রাজকন্যা সত্যবতী

রাজকন্যা সত্যবতী

ডিসেম্বর মাসের প্রথমদিকে অফিসের একটি বিশেষ কাজে যেতে হয়েছিল বর্ধমান। তখনো জাঁকিয়ে শীত পড়েনি, দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি হু হু করে ছুটে চলার সময় কনকনে বাতাস তখনো হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছিল না, বরং আমেজটা বেশ ভালোই লাগছিল। ডানকুনি পেরিয়ে কিছুদূর গেলেই চারপাশের দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যায়, সবুজের পর সবুজ ক্ষেত, কাকতাড়ুয়া আর আকাশে পাখিদের উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে অজান্তেই মন ভালো হয়ে আসে।

বর্ধমান সদরে কাজ মিটতে মিটতে দুপুর আড়াইটে বেজে গেল। মধ্যাহ্নভোজ বেশ আড়ম্বরে সদর অফিসেই হয়ে গিয়েছে, তাই ফুরফুরে মেজাজে আমার চালক দেবরাজকে বললাম, ‘চলো, এলাম যখন, শহরটা একটু ঘুরে যাই।’

বর্ধমানে আমার শ্বশুরবাড়ি, কিন্তু তা শহরে নয়, শক্তিগড়ের কাছে। তাই সেখানে বছরে তিন-চারবার গেলেও টাউনে সেভাবে আসা হয়না। তা এলামই যখন, কার্জন গেটের সামনে রামপ্রসাদের লস্যি না খেয়ে চলে যাওয়া হল ক্ষমার অযোগ্য পাপ। আর সেই পাপ করতে আমি একেবারেই রাজি নই।

তা এক গ্লাস করে ঘন সর ভাসতে থাকা বাদামলস্যি খেয়ে মহাপুণ্য করার পর দেবরাজ বলল, ‘এবার কোথায় যাব, ম্যাডাম? গোলাপবাগের দিকে? কৃষ্ণসায়র?’

‘কৃষ্ণসায়র?’ অন্যমনস্ক গলায় উত্তর দিলাম আমি, ‘তাই চলো!’

মনটা হঠাৎই কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল, এক হৃদয়বিদারক কাহিনীর কথা।

যে কাহিনী বেদনার তো বটেই, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি গর্বের।

কৃষ্ণসায়র। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে খনন করা এক বিরাট দীঘি অর্থাৎ ‘সায়র’, আজও যা কানায় কানায় ভরতি। আজও অচেনা অজানা পাখিরা রোদ পোহায় সেই প্রকাণ্ড সরোবরের তীরে।

আজও যার কালো মিশমিশে জলে নিবিষ্ট মনে খেয়াল করলে হয়ত দেখা যায়, নিশ্বাস ফেলছে প্রাচীন কোনো প্রতিবিম্ব! সেই নিশ্বাসে নেই কোনো আক্ষেপ, বরং মিশে রয়েছে সফল প্রতিশোধের তৃপ্তি!

কৃষ্ণসায়র বানিয়েছিলেন রাজা কৃষ্ণরাম রায়। তাঁর কথায় আসার আগে সংক্ষেপে তাঁর বংশপরিচয় দেওয়া একান্তই প্রয়োজন।

বহুবছর আগে সুদূর লাহোর থেকে এক ক্ষত্রিয় রাজপুরুষ এসেছিলেন পুরীধামে তীর্থ করতে। তিনি কাপুর বংশীয়, নাম সঙ্গম রায় কাপুর। তীর্থ সেরে যখন ফিরে যাচ্ছেন স্বদেশে, বর্ধমানের কাছাকাছি একটি সবুজ শ্যামল গ্রাম তাঁর ভারী মনে ধরে গেল। গ্রামটির নাম বৈকুন্ঠপুর। সঙ্গম রায় কাপুর নিজের পাইক বরকন্দাজদের বললেন, ‘কী সুন্দর গ্রাম দেখেছ? এখানে কিছুদিন থেকে যাই, চলো!’

তা সেই যে তিনি থাকতে শুরু করলেন, আর গেলেন না। রুক্ষ লাহোরের থেকে সহজ সরল গ্রামবাংলা তাঁর বেশি প্রিয় হয়ে উঠল, সেখানেই বসতবাড়ি বানিয়ে সঙ্গম থাকতে শুরু করলেন। আরম্ভ করলেন ব্যবসা। এক পুরুষেই করে ফেললেন প্রচুর ধনসম্পত্তি।

তাঁরই কয়েক প্রজন্ম পরের উত্তরপুরুষ কৃষ্ণরাম রায়। তিনি উদ্যোগী পুরুষ। বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে ফরমান নিয়ে এসে তিনি হয়ে বসলেন ওই অঞ্চলের জমিদার। উপাধি পেলেন চৌধুরী। খেতাব পেলেন রাজা। প্রজাদের ভারী জলকষ্ট, তাই প্রায় তেত্রিশ একর জমির ওপরে তৈরি করালেন আজকের এই ‘কৃষ্ণসায়র’।

দেবরাজ বলল, ‘এবার কি ফিরে যাব, ম্যাডাম?’

ওর ডাকে বাস্তবে ফিরে এলাম আমি, সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললাম, ‘না। তুমি এই রাস্তা দিয়ে সোজা চলো তো। কাঞ্চননগর চলো। দেখবে একটা বড় তোরণ পড়বে। তার নাম বারোদুয়ারি। ওটা দেখে ফিরব না হয়!’

দেবরাজ আমার হঠাৎ হঠাৎ পাগলামির সঙ্গে বেশ অভ্যস্ত, তবু মিনমিন করে বলল, ‘এই যে বললেন ম্যাডাম, কাজ হয়ে গেলেই তাড়াতাড়ি ফিরবেন, এখান থেকে আবার ওদিকে গেলে তো বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।’

দেবরাজ কীসব বিড়বিড় করে চলছিল, আমি ওর কথায় কর্ণপাত করলাম না। ততক্ষণে আমার মন ছুটে চলে গিয়েছে অনেক অতীতে, সেই ১৬৯৫ সালে। যে সময়কাল সাক্ষী এক অগ্নিকন্যার।

যে মুখ বুজে সহ্য করেনি অন্যায়, বরং তীব্র প্রতিহিংসায় ধ্বংস করেছে শত্রুকে। ‘খুনি’ তকমা মাথায় নিয়েও তাই সে আজও ইতিহাসে অমলিন।

বর্ধমানের রাজা কৃষ্ণরাম রায় তখন সিংহাসনে আসীন। সুখে সমৃদ্ধিতে যখন রাজ্য কানায় কানায় ভরে উঠছে, ঠিক সেইসময়ে আচমকা চেতুয়া বরদার জমিদার শোভা সিংহ আক্রমণ করল বর্ধমান রাজ্য। তখন মুঘল —আফগান সংঘর্ষ চরমে, মুঘল-অনুগত রাজ্য বর্ধমানকে শায়েস্তা করতে শোভা সিংহ ধরল রহিম খাঁ নামে এক আফগান সর্দারের হাত।

শোভা সিংহ ও আফগান সর্দারের যৌথ আক্রমণের সংবাদ পাওয়ামাত্র নিজের সেনাদলকে পরিচালনা করে যুদ্ধক্ষেত্রে রওনা দিলেন রাজা কৃষ্ণ রায়। তিনি নিজে সুশাসক তো বটেই, সঙ্গে সুযোদ্ধাও। সঙ্গে গেলেন পুত্র অম্বর রায়ও।

এই সত্যকাহিনীর রুদ্ধশ্বাস মোড়ে অবতীর্ণ হওয়ার আগে একটু শোভা সিংহ কে, তা বলি। মেদিনীপুর জেলার একেবারে পূর্বপ্রান্তে রূপনারায়ণ নদী। তারই পশ্চিমে চেতুয়া ও বরদা—দুই পরগণার রাজা ছিল শোভা সিংহ। ইতিহাস তাকে মনে রেখেছে এক দুঃসাহসী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও হিংস্র শাসক হিসেবে। মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব যখন দাক্ষিণাত্যে, সেই সুযোগে শোভা সিংহ বিদ্রোহ ঘোষণা করল মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে। এবং তার প্রথম নজর পড়ল বর্ধমানের দিকে।

রাজা কৃষ্ণ রায় যুদ্ধে বেরনোর আগে প্রথামতো অন্দরমহলে এলেন। রানী কূলমন্দিরে পুজো সেরে অপেক্ষা করছিলেন। স্বামী ও পুত্রের মাথায় প্রসাদী পুষ্প ঠেকালেন, কপালে এঁকে দিলেন রক্ততিলক। মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘জয়ী হয়ে ফিরে এসো।’

‘অম্বর, তুমি একটু বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করো।’ রাজা কৃষ্ণ রায় তাকালেন পুত্রের দিকে।

অম্বর বাধ্য সন্তান, প্রণাম সেরে তক্ষুনি প্রস্থান করলেন।

কৃষ্ণ রায় তাঁর মহিষীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন, মৃদু আলিঙ্গনে কাছে টানলেন প্রিয়তমাকে। রানী বাধা দিলেন না। তাঁর স্বামী দক্ষ যোদ্ধা, এর আগে বহু সমরশেষে ফিরে এসেছেন প্রশস্ত হাসি নিয়ে, এবারেও তাই আসবেন। তিনি স্বামীর বুকে মাথা রাখলেন। বললেন, ‘সেনাপতিমশাই কি বেরিয়ে গিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ। এবার আমাদেরও যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ কৃষ্ণ রায় এবার একটা ভারী অদ্ভুত কথা বললেন, ‘রানী, এই পাত্রটা রাখো নিজের কাছে।’

‘কী এটা?’ স্বামীর হাতে একটি রৌপ্য পাত্র দেখে বিস্মিত হলেন রানী।

‘ঈশ্বরের প্রসাদ।’ সামান্য কম্পিত কণ্ঠে বললেন রাজা কৃষ্ণ রায়, ‘শোভা সিংহ বড় দুর্ধর্ষ। তার চেয়েও বড় কথা, তার চরিত্রে নৈতিকতা বা মূল্যবোধ বলে কিছু নেই। আমি আর অম্বর যদি মরে যাই, তোমরা এটা খেয়ো, কেমন?’

রানী যা বোঝার পলকে বুঝে গেলেন। মধ্যযুগের রাজস্থানের রমণীদের জহরব্রতর মতো স্বেচ্ছামৃত্যুবরণ এখানেও প্রচলিত। শত্রুর কাছে ধর্ষিতা লাঞ্ছিতা হওয়ার চেয়ে আত্মহত্যা বহুগুণে শ্রেয়। তিনি বিনাবাক্যবয়ে মাথা নাড়লেন, তারপর স্বামীর পদধূলি নিয়ে চোখের জলে তাঁকে বিদায় জানালেন।

রণভেরী বেজে উঠল। অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে বাজতে লাগল শঙ্খ। সগৌরবে দৃপ্তভঙ্গিতে রাজা ও রাজপুত্র যখন যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছলেন, ততক্ষণে রানী রাজবাড়ির মন্দিরে গিয়ে পূজায় বসেছেন।

দাসীদের বাদ দিলে অন্তরমহলে মহিলা মাত্র চারজন। রানীমা নিজে, তাঁর দুই কন্যা ও পুত্রবধূ। রানীমা ছাড়া বাকি তিনজন নিজ নিজ মহলে থাকলেও গোটা রাজপ্রাসাদে থমথম করতে লাগল এক অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা।

‘কিচ্ছু হবেনা!’ ইষ্টনাম জপ করতে করতে নিজের মনকেই প্রবোধ দিলেন রানীমা, ‘সকলে ঠিক ফিরে আসবেন। আমার সিঁদুর, বউমার সিঁদুরের জোর এত কম নয়!’

সময় কাটতে থাকে। সূর্যদেব ক্রমশ ঢলতে থাকেন পশ্চিমে। গোধূলিবেলায় যখন রক্তিমাভায় ভরে উঠেছে আকাশ, দূরের গ্রামের কৃষকরা ক্লান্ত পায়ে ফিরছে গ্রামে, পাখিরা উড়ছে বাসার দিকে, তখনই এল নিদারুণ দুঃসংবাদ।

রানীমার খাস পরিচারিকা ফুল্লরা উদ্ভ্রান্তচোখে ছুটতে ছুটতে এল মন্দিরে। তার চোখ রক্তাভ, ঠোঁট কাঁপছে থরথর করে।

‘কীরে? কী হয়েছে?’ রানীমা চমকে উঠলেন।

ফুল্লরা চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই তার গলা দিয়ে একটি শব্দও বেরোচ্ছে না। শুধু নিরন্তর অশ্রু ঝরে পড়ছে চোখ দিয়ে। রানীমার পায়ের কাছে ঝাঁপিয়ে পড়ে আছারিপিছারি খেয়ে কাঁদতে লাগল সে।

পলকে যা বোঝার বুঝে গেলেন রানীমা।

তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ হয়নি। যুদ্ধে জয় হয়েছে প্রতিপক্ষের। রাজা ও রাজপুত্র দুজনেই যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করতে করতে বীরের মতো প্রাণ দিয়েছেন। শোভা সিংহ ও রহিম খাঁ তীব্র উল্লাসে ছুটে আসছে রাজপ্রাসাদ দখল করতে।

যে কোনো মুহূর্তে শোনা যেতে পারে সেই বিজয়ী সেনাদলের নিষ্ঠুর পদধ্বনি।

চারপাশের ক্রন্দনরোলের মাঝে রানীমা যেন এতটুকু টলে গেলেন না। শুধু গভীরচোখে তাকালেন কূলদেবতার দিকে, তারপর পূজা অসমাপ্ত রেখেই বেরিয়ে এলেন মন্দির থেকে। ধীর মন্দ্র পায়ে মন্দির থেকে হেঁটে এলেন নিজের মহলে। তারপর ডেকে পাঠালেন পুত্রবধূ ও কন্যাদের।

বুকের ভেতর কী যেন চৌচির হয়ে যাচ্ছে, একমুহূর্তে স্বামী ও পুত্রকে হারিয়ে ফেলার যে কি অমানুষিক কষ্ট, তা যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করতে পারছেন তিনি। মনে হচ্ছে, হৃদয় নিংড়ে তীব্র বিলাপে শেষ ক্রন্দনটুকু বের করতে পারলে বুঝি একটু শান্তি হয়।

কিন্তু সেই সময় বা সুযোগ কোনোটাই নেই। সান্ধ্যপ্রদীপের আলোয় রানীমা যেন এখন পরিণত হয়েছেন লৌহমানবীতে।

দুই কন্যা ও পুত্রবধূ উপস্থিত হওয়ামাত্র তাঁদের সংক্ষেপে দিলেন এই নিদারুণ সংবাদ। শোক উপলব্ধি করার জন্য যতটুকু সময় লাগে, তার আগেই রানীমা বাড়িয়ে ধরলেন রাজার দিয়ে যাওয়া সেই রৌপ্য পাত্র।

‘নে তোরা। তোরা আগে খা। তোদের বাঁচাতে পেরেছি না জেনে যে মরতেও পারব না! একেবারে শেষে আমি খাব।’

দুই কন্যা ও পুত্রবধূ, সকলেই তরুণী। মুহূর্তে তারা বুঝে ফেলল, মায়ের হাতে বা শাশুড়িমায়ের হাতে ওটা কী।

প্রথমে এগিয়ে এল জ্যেষ্ঠা কন্যা। সে অষ্টাদশী, সুযোগ্য পাত্রের সঙ্গে তার বিবাহ ইতিমধ্যেই নির্ধারিত হয়ে রয়েছে। শান্ত ধীর স্থির লয়ে এসে কোনো কথা না বলে সে মায়ের হাতের পাত্র থেকে তুলে নিল সেই বিষ। মৃত পিতার উদ্দেশ্যে বোধহয় করজোড়ে প্রণাম করল, তারপর মুখে ঢেলে দিল সবটুকু। অস্ফুটে বলল, ‘এলাম মা!’

কয়েক মুহূর্তমাত্র। সেই বিষের তীব্রতা এতটাই যে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেনা উঠতে লাগল তার মুখ দিয়ে। যে সুন্দর দেহে কিছুদিন পরে ওঠার কথা ছিল বিবাহপোশাক, সেই দেহ কয়েকবার মাত্র ঘরের মেঝেতে ছটফটিয়ে নিশ্চল হয়ে গেল।

রানীমার অশ্রুগ্রন্থি যেন আজ বিস্মৃত হয়েছে সীমানা, অবিরাম গতিতে ঝরে চলেছে জল। মৃতা কন্যার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন তিনি। আর সেই মুহূর্তেই শুনতে পেলেন এক বিকট শব্দ।

ছুটে এল এক পরিচারিকা, ‘মা! ওরা চলে এসেছে! সিংহদরজা এদিক থেকে বন্ধ বলে নির্দয়ভাবে ভেঙে ফেলছে। কী হবে মা?’

রানীমা যেন প্রস্তরপ্রতিমা, শুনতেই পেলেন না কিছু। পরিচারিকাকে প্রস্থানের আদেশ দিয়ে দ্বার রুদ্ধ করলেন। তারপর সস্নেহে কাছে ডাকলেন পুত্রবধূকে, জড়িয়ে ধরে তার কপালে করলেন চুম্বন। তারপর তারও মুখে তুলে দিলেন সেই তীব্র হলাহল। পুত্রবধূ তার প্রিয় শ্মশ্রুমাতাকে জড়িয়ে ধরে ধীরে ধীরে স্থির হয়ে গেল। তারপর তারও নিঃস্পন্দ দেহটা আছড়ে পড়ল মাটিতে।

রানীমার বুকে এসে বিঁধল আরও একটি শেল। কিন্তু সময় একেবারেই নেই। সিঁড়িতে হচ্ছে দুপদাপ শব্দ। শোভা সিংহের সৈন্যরা গড়দরজা ভেঙে ফেলেছে, এখন তরবারি শাণিয়ে ছুটে আসছে অন্দরমহলের দিকে। তারা উত্তেজনায় উল্লাসে এখন পশুপ্রায়।

যুদ্ধ শেষে পরাজিত রাজার অন্দরমহলের রমণীরা, যে রাজঅন্তঃপুরচারিণীরা থাকেন অসূর্যম্পশ্যা, যাদের আভিজাত্য ও সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য তাদের কোনোদিনই হতনা, তাদের প্রকাশ্যে বিবস্ত্রা করে একের পর এক ধর্ষণের যে কি পৈশাচিক তৃপ্তি, তা অবর্ণনীয়।

রানীমা এবার তাকালেন প্রাণাধিক প্রিয় ছোট মেয়ের দিকে। তাঁর মনে পড়ল, এই ছোট মেয়ে ছিল তাঁর স্বামীর সবচেয়ে আদরণীয়া। রূপে, ব্যক্তিত্বে, গুণে সবেতেই এই কনিষ্ঠা কন্যা রাজপরিবারে সর্বশ্রেষ্ঠ। কন্যার প্রতি অন্ধ স্নেহের আতিশয্যে মেয়েকে পুরুষোচিত কত কী যে শেখাতেন রাজা কৃষ্ণ রায়, আর সেসব নিয়ে রানীমা নিজে যে কত অসন্তোষ প্রকাশ করতেন, এসব মনে করে তাঁর বুক থেকে আবার একদলা কান্না গলা বেয়ে উঠে এল।

মাত্র কয়েক প্রহরে তাঁর জীবন, তাঁর সোনার সংসার ধ্বংস হয়ে গেল।

অমানুষিক মনের জোরে আবেগ সংবরণ করে রানীমা বললেন, ‘এবার তুই আয় মা। আর দেরি করিস না! ওরা এখুনি ঢুকে পড়বে ঘরে!’

রাজকন্যা সত্যবতী এগিয়ে এল। সে ষোড়শী, অপূর্ব সুন্দরী। নিজের চোখের সামনে দিদি ও বউদিদিকে সে মরে যেতে দেখেছে। শক্তমুখে এগিয়ে এসে সে নীরবে মায়ের হাত থেকে বিষটুকু নিল।

রুদ্ধ দরজায় শুরু হয়েছে কর্কশ আঘাত। শোভাসিংহের সেনারা আর ধৈর্য ধরতে পারছেনা, নিজেদের অস্ত্র দিয়ে ভাঙছে অন্দরমহলের দরজা। ভৃত্যদের চিৎকার, ক্রন্দন, অনুনয় বিনয়ে কান পাতা দায়।

রানীমা নিজেও হাতে নিয়েছেন বিষ, কিন্তু সত্যবতী যে খাচ্ছে না। সে তো বিষটুকু লুকিয়ে রাখছে নিজের পোশাকের আড়ালে!

সন্ত্রস্তা রানীমা বললেন, ‘লুকোচ্ছিস কেন? আর যে সময় নেই। মুখে দে মা! শিগগীর মুখে দে।’

‘না।’ তেজী হরিণীর মতো এবার ফুঁসে উঠল সত্যবতী, ‘আমি বিষ খাব না।’

‘সেকি!’ দরজা ভাঙার প্রচণ্ড শব্দের মধ্যে স্তম্ভিত রানীমা বললেন, ‘তুই বাচ্চা মেয়ে … বুঝতে পারছিস না … এখুনি নিজেদের শেষ না করলে ওরা … ওরা এসে অসম্মানের চূড়ান্ত করবে। ইজ্জত তো নেবেই, সে যে কি অপমান, অত্যাচার তার চেয়ে মৃত্যু অনেক শ্রেয়, মা! তোর বাবাও তাই আদেশ দিয়ে গিয়েছেন।’

‘আমি মানিনা এই আদেশ।’ অনমনীয় ভঙ্গিতে বলল সত্যবতী, ‘আমি জানি, বাবা আমাকে আশৈশব শিক্ষা দিয়েছেন, শত্রুর চোখে চোখ রেখে লড়াই করার। প্রতিশোধ নেওয়ার। আমি ভিতু নই, মা! তুমি চলে যাও। আমি … আমি এতগুলো প্রাণের বদলা নিয়ে না হয় আসছি তোমার কাছে?’

মেয়ের এই জেদের সঙ্গে রানীমা পরিচিত, তাই তর্ক বৃথা বুঝে তিনি কাঁদতে কাঁদতে মুখে বিষ দিলেন।

ছটফট করতে করতে যখন তিনি এলিয়ে পড়ছেন মাটিতে, ঠিক তখনই দরজা ভেঙে ঢুকল শোভা সিংহের সৈন্যরা।

এক লহমায় তারা বুঝে ফেলল, কী ঘটেছে। সঙ্গে তারা হতভম্ব হয়ে এও দেখল, তিনটি তরতাজা মৃতদেহের পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক পরমাসুন্দরী, অনবগুণ্ঠিতা এবং সুসজ্জিতা।

তারা এগিয়ে আসার আগেই সত্যবতী চিৎকার করে বলল, ‘খবরদার! কেউ স্পর্শ করবে না আমায়! আমি রাজকন্যা সত্যবতী!’

ঘরের বাইরে চলছে অবিচারে হত্যালীলা। রাজপ্রাসাদের কর্মচারীরা লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে। সেনারা উন্মত্ত পশুর মতো সত্যবতীর দিকে এগিয়ে আসছিল, কিন্তু নামটা শুনে তারা থমকে গেল। তাদের সেনাপতি বারংবার মনে করিয়ে দিয়েছে, বর্ধমানের ছোট রাজকন্যা সত্যবতীকে জীবন্ত বন্দী করা সম্ভব হলে তাঁর যেন কোনোরকম অসম্মান না করা হয়।

কারণ তাকে ভোগ করার প্রথম অধিকার একমাত্র শোভা সিংহের নিজের!

আড়ালে আবডালে সব সেনারাই শুনেছে, তাদের রাজা শোভা সিংহের বর্ধমান আক্রমণের পরোক্ষ কারণ হল রাজকুমারী সত্যবতী। সত্যবতী মাত্র ষোড়শী হলে কী হবে, এর মধ্যেই তার রূপের খ্যাতি দামোদর পেরিয়ে নানা নদী ঘুরে মিশেছে রূপনারায়ণে।

তবে অতিরঞ্জন নয় সেই খ্যাতি, প্রত্যেক সেনা মনে মনে স্বীকার করে। কি অনুপম সুন্দর মুখশ্রী, তেমনই তন্বী দেহ, উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ। আয়ত চোখদুটোর ওপরের স্থানে ঈশ্বর যেন স্বহস্তে অঙ্কন করেছেন দুটি বাঁকানো ভ্রূ। ঈষৎ স্ফীত ঠোঁটদুটো দেখলেই যেন আগুন জ্বলে ওঠে বুকে!

কিন্তু রাজ আদেশ! কী আর করা যাবে, তারা সসম্মানে বন্দি করল রাজকন্যাকে।

পিতৃ আজ্ঞা, মাতৃ অনুরোধ উপেক্ষা করে অমান্য করে স্বেচ্ছায় ধরা দিল সত্যবতী। একপ্রহরের মধ্যেই গোটা প্রাসাদের দখল নিল শোভা সিংহ ও রহিম খাঁ-র বাহিনী। এত বড় রাজ্যজয়ের উল্লাসে মেহফিল বসল নাচঘরে। যে নাচনিবাঈ আগেরদিন এসে রাজা কৃষ্ণ রায়ের মজলিশ মাতিয়েছে, তাকেই এত্তেলা পাঠানো হল শোভা সিংহের সামনে নাচার জন্য।

সত্যবতীর বন্দিনী হওয়ার খবরে সকলেই উত্তেজিত। আফগান সর্দার রহিম খাঁ গলায় দু-পাত্তর ঢেলে বলল, ‘মুঝে ভি চাহিয়ে! সির্ফ এক রাতকে লিয়ে!’

‘ওটি হবে না ভাই!’ শোভা সিংহ ইতিমধ্যে পাঁড় মাতাল হয়ে গেলেও জ্ঞান হারায়নি, ‘তোমাকে আগেই বলেছিলাম। চাইলে গোটা তহবিল নিয়ে নাও। চাইনা আমার বখরা। কিন্তু আজ রাজকুমারীর ভাগ হবে না খাঁ ভাই! পরে না হয় পুষিয়ে নিও!’

তথাস্তু। রহিম খাঁ বিনাবাক্যবয়ে মেনে নিল প্রস্তাব।

রাত্রি যখন মধ্যযাম, আকণ্ঠ মদ্যপান করে শোভা সিংহ গিয়ে ঢুকল ঘরে। অষ্টপ্রহর আগেও যা ছিল রাজা কৃষ্ণ রায় ও তাঁর পত্নীর শয়নকক্ষ, সেখানেই এখন তাঁদের প্রাণাধিক প্রিয় অক্ষতযোনি তনয়াকে সম্ভোগ করবে সে!

আহ! ভাবতেই শিহরণ লাগছে তার শরীরে! হ্যাঁ, এটা ঠিক, অন্য জায়গায় হলেও বিছানায় শুখা জোরজবরদস্তি করা পছন্দ করে না শোভা সিংহ। একটু মিঠা বুলি, সোহাগের কথা, আসল কাজের আগে এসব তার মনপসন্দ। কিন্তু যে মেয়ে কয়েকপ্রহর আগে বাপ-মা-ভাই-বোন সবাইকে হারিয়েছে, তার থেকে এতটাও আশা করে না সে। শালির কাছে ইজ্জতের চেয়ে নিজের জিন্দেগী বড়, তাই অন্যদের মতো আত্মহত্যা করেনি। তো এমন বেশরম লেড়কির সাথে কোনো প্যায়ারি বাত নয়, স্রেফ ইজ্জৎ লোটাই হবে তার উচিত কাজ।

শোভা সিংহ ঘরে প্রবেশ করে ঘোলাটে চোখে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করল। ওই তো, প্রকাণ্ড পালঙ্কের একেবারে কোণে ম্লান মুখে নতমস্তকে দণ্ডায়মান বর্ধমানের রাজকন্যা।

আহ, কী সুরত! যেন স্বর্গের উর্বশী নেমে এসেছে মর্ত্যে! ঘন কেশরাশি কোমর বেয়ে নেমেছে, আঁকানো বাঁকানো লতার মতো এসে লুটোচ্ছে সামনের দিকে, ছলছলে চোখগুলোয় যেন স্পষ্ট মদির আহ্বান!

শোভা সিংহের চোখ জুড়িয়ে গেল। দ্রুত হাতে কপাট বন্ধ করে মুহূর্তের মধ্যে এসে জড়িয়ে ধরল সত্যবতীকে।

কেউ বেশ বিচক্ষণ, এই ঘরে খুব ম্লান একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। সেই আধো আলো আধো অন্ধকারে সত্যবতীকে যেন মনে হচ্ছে না কোনো রক্তমাংসের মানবী! স্বর্গের অপ্সরার মতোই কুহকিনী রহস্যময়ী লাগছে তাকে!

শোভা সিংহের উত্তেজনার পারদ দ্রুত চড়তে থাকে। তীব্র পেষণে সে নিষ্পেষিত করতে থাকে সত্যবতীকে। নিজের কর্কশ ঠোঁট হিংস্র শ্বাপদের মতো চেপে ধরে সত্যবতীর ঠোঁটের ওপর। প্রচণ্ড চুম্বনে যেন খুবলে নেবে সে নরম মাংস!

সত্যবতীর চোখ উপচে জল এলেও সে বাধা দেয়না। দাঁড়িয়ে থাকে একভাবে। তার চোখ খোলা থাকলেও সে যেন দেখছেনা কিছুই!

কোনোরকম বাধা না পাওয়ায় শোভা সিংহের পুলক আরও বেড়ে যায়। চুপচাপ আদর খাচ্ছে, এ তো আজিব অঊরত!

সত্যবতীর পরনে রয়েছে দেহের সঙ্গে আঁটসাঁট হয়ে বসে থাকা চুড়িদার চুস্ত। উত্তর পশ্চিম ভারতের এই পোশাকই তখনকার দিনের অধিকাংশ সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবারের মেয়েরা পরিধান করতেন। এতটাই টানটান যে এই পোশাক টেনেও খোলা যায় না, ছিঁড়েও খোলা যায়না।

তবু অতিকষ্টে শোভা সিংহ ছিঁড়তে পারে সত্যবতীর বক্ষাবরণ। টেনে খুলে ফেলতে চায় ভেতরের অধোবাস। কিন্তু পারে না। কামুক নির্লজ্জ এক পশুর মতো তারপর সে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তীব্র দংশনে তাধোবাসের ওপর দিয়েই নিষ্পেষণে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে সত্যবতীর ঊর্ধ্বাঙ্গ। দ্রুতগতিতে চড়তে থাকে তার উত্তেজনার পারদ।

কিন্তু ওই পর্যন্তই। নিজের শরীরের সব শক্তি একত্র করেও সে টেনে ছিঁড়তে পারে না সত্যবতীর চুস্ত বা পাজামা। তা এতটাই লেপ্টে রয়েছে দেহের সঙ্গে, যে আলাদা করে টান মারা অসম্ভব। প্রদীপের টিমটিমে আলোয় চেষ্টা করতে করতে শোভা সিংহ ঘেমে ওঠে।

এই শালির দিমাগ খারাপ নাকি? এত কিছুতেও পাথর মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে?

শোভা সিংহ সত্যবতীর চুলের মুঠি ধরে গর্জে ওঠে, ‘খুল!’

কিন্তু সত্যবতী যেন শুনতেই পায় না শোভা সিংহ তাকে পাজামার গিঁট খুলতে বলছে। সে যেন বধির হয়ে গিয়েছে, একভাবে চেয়ে রয়েছে দূরের দেওয়ালের দিকে।

গতরাতেও এই দেওয়ালে ঠেস দিয়ে সে বাবা-মা’র সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করে গিয়েছে, সে কি এখন সেই কথাই ভাবছে?

রাগে শোভা সিংহের ইচ্ছে হয় টেনে এক থাপ্পড় কষাতে, কিন্তু তাতে উত্তেজনার দফারফা হয়ে যাবে! এই রিরংসা, অপূর্ব কামানুভূতিও অদৃশ্য হয়ে যাবে পলকে।

উপায়ান্তর না দেখে সে হাঁটুগেড়ে বসে। চোখ কুঁচকে চেষ্টা করে সত্যবতীর পাজামার দড়ির ফাঁস খুলতে।

অবশেষে … অবশেষে উপস্থিত হয় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! এতক্ষণের পাষাণপ্রতিমা সত্যবতী যেন হঠাৎই হাজার বছরের ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে। শোভা সিংহ যখন ধীরে ধীরে দড়ির ফাঁস খুলতে ব্যস্ত, অতি সন্তর্পণে সে তখন নিজের ডান হাত ঢোকায় বুকের ভেতরে। বুকের অধোবাসের গোপনে লুকনো রয়েছে অত্যন্ত ছোট কিন্তু তেমনই ধারালো একটা ছুরি।

বাবা এক জন্মদিনে এই অস্ত্র তাকে উপহার দিয়েছিলেন। সেই বাবা-ই হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন ছুরিচালনা। বাবা-ই শিখিয়েছিলেন মানুষের ঘাড়ের কোন স্থানে আচমকা গভীর ছুরিকাঘাতে মৃত্যু অনিবার্য।

আর সেই বাবার-ই খুনি যখন পাজামার ফাঁস খুলতে মগ্ন, তার ঘাড়ের সেই বিশেষ স্থানে সত্যবতী আমূল বিদ্ধ করে দেয় ছুরিটাকে।

তার সারা শরীর কাঁপছে উত্তেজনায়। ঠোঁট দুটো থরথর করছে।

চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পড়ছে জল। যে প্রচণ্ড শোক এতক্ষণ ধরে সে সঞ্চয় করে রেখেছিল নিজের মধ্যে, তা এখন গলে গলে পড়ছে অশ্রু হয়ে।

বাইরের প্রহরীরা চমকে ওঠে। পুরুষালী কণ্ঠের এই বিকট আর্তনাদ কার? এ তো প্রত্যাশিত নারীকণ্ঠের শীৎকার নয়!

তারা হাঁকাহাঁকি শুরু করে, ‘হুজৌর! হুজৌর! ক্যা হুয়া!’

উত্তর নেই।

রুদ্ধদ্বার ভেঙে তারা যখন রাজকক্ষে প্রবেশ করল, ততক্ষণে সত্যবতী মুখে পুরে দিয়েছে মায়ের দেওয়া সেই প্রসাদ। বর্ধমানজয়ী দুর্ধর্ষ শোভা সিংহের নিষ্প্রাণ দেহের পাশেই বসে রয়েছে তার নিঃস্পন্দ শরীরটা।

চোখদুটো খোলা। যেন বলে চলেছে অনেক কিছু।

আমি মা-দিদি-বউদিদির মতো মুখ বুজে চলে যাব কেন? হ্যাঁ, যাব। তবে উপযুক্ত প্রতিশোধ নিয়ে পিতৃহন্তাকে শেষ করে!

দেবরাজ আবার ডাকে, ‘সন্ধে গাঢ় হয়ে এল ম্যাডাম! বাড়ি ফিরবেন না?’

আমি বর্তমানে ফিরে আসি। চোখ তুলে দেখি, আমরা দাঁড়িয়ে আছি বারোদুয়ারির সামনে। শোভা সিংহ বর্ধমান দখল করলেও সেই রাতেই তাকে খুন করে রাজকুমারী সত্যবতী। ফলে পরে আবার বর্ধমানের সিংহাসনে বসেন রাজা কৃষ্ণ রায়েরই উত্তরপুরুষ রাজা কীর্তিচাঁদ। জয়ের স্মারক হিসেবে নির্মাণ করেন এই বারোদুয়ারি।

সত্যবতী খুনি বটে। সম্ভবত বাংলার প্রাচীনতম মহিলা হত্যাকারী। কিন্তু এমন খুনি আসুক বারেবারে। তখনকার রাজঅন্তঃপুরচারিণী হোক বা সাধারণ মেয়ে, কারুরই নাম জানা যেত না। অমুকের স্ত্রী, তমুকের মহিষী, তমুকের কন্যা নামেই ইতিহাসে ঘুমিয়ে আছেন তাঁরা।

কিন্তু একমাত্র রাজকুমারী সত্যবতী তাঁর আপন নামে আপন যোগ্যতায় ভাস্বর হয়ে রয়েছেন! তিনি আলাউদ্দিন খলজির ভয়ে রানী পদ্মাবতীর মতো শুধুই নিজেকে শেষ করেননি, নিজের প্রাণ দিয়ে তিনি নিয়ে গিয়েছেন আত্মীয় বিয়োগের প্রতিশোধ।

তাই তাঁর শৌর্য বা বীরত্ব অনেক অনেক বেশি।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। বাড়িতে আমার আঠেরো মাসের পুত্র প্রতীক্ষায় রয়েছে। ভাঙা গলায় বলি, ‘হ্যাঁ। বাড়ি চলো এবার!’

পেছনে নিশ্বাস ফেলেন সত্যবতী। দাঁড়িয়ে থাকে বারোদুয়ারি। এক হত্যার প্রতিশোধগাথা বুকে চেপে রেখে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *