মৃত্যুমেডেল

মৃত্যুমেডেল

প্রভাত কুমার আগরওয়াল দরদর করে ঘামছিলেন। কলকাতা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত অন্যতম অভিজাত নার্সিং হোম বেলভিউয়ের অপারেশন থিয়েটারের বাইরের লম্বা শীততাপনিয়ন্ত্রিত করিডরে বসে কারুর পক্ষে ঘামা সম্ভব নয়। তার ওপর সময়টা শরৎকাল। ঝকঝকে আকাশ, সুন্দর আবহাওয়া।

১৯৭৮ সালের অক্টোবর মাসের কলকাতা।

মি. আগরওয়ালের খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। তাতে টেনশনটা একটু হলেও কমতো। কিন্তু হাসপাতালের মধ্যে দাঁড়িয়ে সেইটা সম্ভব নয়। ঘড়িতে সকাল সাড়ে এগারোটা। যে কোনো সময় ওটি’র বাইরের লাল আলোটা নিভে যেতে পারে। তাই বাইরে বেরনোরও প্রশ্ন নেই।

তিনি ফ্যাকাসে হেসে পাশে বসে থাকা ভদ্রমহিলাকে বললেন, ‘এত দেরি কেন হচ্ছে বলুন তো, মিসেস মুখার্জি?’

মিসেস মুখোপাধ্যায় হাসলেন। বললেন, ‘আপনি টেনশন করবেন না প্রভাতবাবু। উনিও তো কাল সারারাত একফোঁটা ঘুমোননি। ব্যালকনিতে বসে অন্তত চল্লিশখানা সিগারেট খেয়েছেন। বারবার বলেছেন, নমিতা, সব ভালোমতো মিটবে তো? আপনি দেখবেন, সব ভালোই হবে। আপনার বুঝি খুব স্মোক করতে ইচ্ছে করছে? আপনার বারবার পকেটে হাত দেওয়া দেখে বুঝতে পারছি।’

প্রভাত আগরওয়াল একটু লজ্জা পেলেন, ‘নানা! সে’রকম কিছু না। আসলে কি জানেন মিসেস মুখার্জি, গত পনেরোটা বছর যে প্রচণ্ড দুঃখ, অবসাদ, হতাশায় কেটেছে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া মানে নতুন একটা জন্ম। এত সুখ যে আমার কপালে সত্যিই আসবে, তা বিশ্বাস করতে পারছি না।’

এবার নমিতা মুখোপাধ্যায়ের গলার কাছটা দলা পাকিয়ে উঠল। তিনি বলতে চাইলেন, জানি প্রভাতবাবু। সন্তান না থাকার কষ্ট আমি বুঝি। গত আঠেরো বছর ধরে এই পাথরই তো বুকে চেপে রেখেছি। তাই তো আপনাদের সঙ্গে এই কয়েকমাসে মিলেমিশে আপনার জন হয়ে উঠেছি। গর্ভে না ধরেও অনুভব করতে চেয়েছি একটি মানবশিশুর আগমনকে!

কিন্তু নমিতা এ’সব বলতে পারলেন না। বলতে পারলেন না, যে সাতসকালে স্কুল কামাই করে তিনি যে এই বেলভিউতে এসে বসে রয়েছেন, তা এক অব্যক্ত অনুভূতির জন্য।

যে অনুভূতিতে তিনি তাঁর পাহাড়ের মতো বিশাল অথচ শিশুর মতো সরল স্বামীর প্রতিটি ‘হ্যাঁ’তে ‘হ্যাঁ’ করে এসেছেন। যে অনুভূতিতে স্বামীর ভুলোমন, আত্মভোলা প্রকৃতিকে লালন করেছেন এতগুলো বছর ধরে!

আজ যখন নমিতা পিছনে তাকান, ভাবেন, জীবনটাকে তিনি আর পাঁচজনের মতো সরলরৈখিক পথে কেন বাঁধলেন না? কেন একজন ‘অন্যরকম’ মানুষের সঙ্গে জীবন কাটানোর চ্যালেঞ্জ নিলেন?

পরক্ষণেই চমকে ওঠেন। এসব কী ভাবছেন তিনি! তাঁর অবোধ স্বামীটি এমনিতেই সংসারজ্ঞানশূন্য। তিনিও হাত ছেড়ে দিলে কে দেখত ওঁকে?

হাসপাতালের করিডরে চুপচাপ নিজের ডাক্তার স্বামীর রোগিণীর পরিবারের পাশে বসে থাকতে থাকতে নমিতা কখন যেন চলে যান আঠেরো বছর আগের সেই দিনটাতে।

১৯৬০ সাল। দিনটা ছিল পঁচিশে বৈশাখ। অত্যন্ত প্রতিভাবান ঝকঝকে তরুণ চিকিৎসক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেদিন ছিল নমিতার বিয়ে। পাত্র সুদর্শন, নম্র ভদ্র। পাত্রের বাবা ড. সত্যেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় হাজারিবাগের সম্ভ্রান্ত ডাক্তার। বনেদি পরিবার, খোদ কৃত্তিবাস ওঝার বংশধর। পরিবারের সকলেই বিদ্যা বুদ্ধি সৌজন্যে একে অন্যকে টেক্কা দেন।

পাত্র সুভাষ তো এইবয়সেই স্কলার। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে গোল্ড মেডেল ও হেমাঙ্গিনী স্কলারশিপ নিয়ে ডাক্তারি পাশ করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিখ্যাত অধ্যাপক ড. সচ্চিদানন্দ ব্যানার্জির তত্ত্বাবধানে পি এইচ ডি করেছে সে। গবেষণার বিষয়ও বেশ জটিল। ‘Biochemical changes in normal and abnormal pregnancy.’

বিয়ের পরই স্ত্রীকে নিয়ে সে পাড়ি দেবে ব্রিটেনের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলম্বো প্ল্যান স্কলারশিপের অধীনে আরও একটি বিষয়ের ওপর ডক্টরেট করার জন্য।

নমিতার বাবা-মা এত ভালো সম্বন্ধটি পেয়ে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য তাঁদের মেয়ে নমিতাও কম নয়। সেও ইতিমধ্যে লন্ডনের ঐতিহ্যবাহী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছে।

একেই বলে রাজযোটক!

তাই হল। বিয়ের পর দুজনে একসঙ্গে পাড়ি দিলেন লন্ডন। পড়ার সূত্রে দুজন দু-জায়গায় থাকতে শুরু করলেন বটে, কিন্তু নমিতা ছুটি পেলেই স্বামীর কাছে চলে আসেন। আনকোরা হাতে নতুন সংসার সাজান। রান্নাবান্না করেন। এরমধ্যেই তিনি বুঝে গিয়েছেন, তাঁর স্বামীটি একেবারে আত্মভোলা প্রকৃতির। গবেষণাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। মাঝেমধ্যে ভালো বই পড়া বা কোনো চিত্রগ্যালারিতে গিয়ে নিবিষ্টচিত্তে ছবি দেখা ছাড়া তাঁর কোনো শখ নেই।

নাহলে বিয়ের পরপরই কেউ স্ত্রীকে স্পষ্ট বলতে পারেন অমন একটি সাংঘাতিক কথা?

‘নমিতা, আমি কিন্তু চাইনা, আমাদের কোনো সন্তান হোক! আমার … আমার গবেষণার কাজের বড় ক্ষতি হবে তাতে, মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটবে। বিশ্বাস করো, এইজন্যই আমি বিয়ে করতে চাইনি। তোমাকে আমি বিয়ের আগে বোঝাতেও চেয়েছিলাম!’

না। সাময়িক মন খারাপ হলেও স্বামীর কথা শুনে নমিতার মাথায় সেদিন আকাশ ভেঙে পড়েনি। ‘মা’ ডাক শোনার যে সুপ্ত ইচ্ছা প্রতিটি মেয়ের অন্তরে থাকে, তাকে ধামাচাপা দিয়ে অন্য আঙ্গিকে বিষয়টা দেখেছিলেন সেদিন নমিতা।

সত্যিই তো, তাঁর স্বামীর গবেষণাক্ষেত্রটি যে বড় জটিল। হাজার হাজার সন্তানহীন দম্পতিকে আনন্দের আলো দেখাবার প্রতিজ্ঞা করেছেন তিনি। অসংখ্য মেয়েকে ‘বন্ধ্যা’ অপবাদ থেকে মুক্তি দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন তিনি।

এতবড় একটা ভালো কাজের জন্য প্রয়োজন নিরন্তর নিরলস সাধনা। তার মধ্যে নিজের ‘মা’ ডাক শোনা, নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ দেখা?

ছি ছি! সে যে বড় সংক্ষিপ্ত মনের পরিচয়।

নমিতা গুটিয়ে গিয়েছিলেন। শান্ত বনস্পতির মতো নিজের ছায়ায় আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁর কর্মব্যস্ত স্বামীটিকে। বলেছিলেন, ‘বেশ তো! তুমি যখন চাওনা, তখন হবেনা। তুমি তোমার কাজটা ভালো করে করো। সংসারের ব্যাপারে কিচ্ছু তোমায় ভাবতে হবেনা। বুঝেছ?’

সেই শুরু। তারপর সুভাষ ক্রমেই ডুব দিয়েছেন নিজের উপাসনায়, আর নমিতা একা হাতে সামলেছেন বাকি সবকিছু।

পড়া শেষে দুজনে দেশে ফিরে এসেছিলেন ১৯৬৭-তে। ওদেশে সুভাষের মতো প্রতিভাবান চিকিৎসকের সামনে তখন প্রচুর লোভনীয় চাকরির অফার। আসছে অন্য দেশ থেকেও সোনালি কেরিয়ার গড়ার প্রস্তাব। অধ্যাপক জন এ লোরেনের সঙ্গে মিলে তাঁর হরমোন সংক্রান্ত গবেষণার খবর ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে।

কিন্তু তাঁর স্বামীর এক কথা, ‘নিজের দেশে না ফিরলে কাজ করে তৃপ্তিটা কী? পৃথিবীর আর কোন দেশে সন্তান না হলে শুধুমাত্র মেয়েদেরই দোষের ভাগীদার করা হয় বলো তো? না না, ফিরতে আমাকে হবেই, নমিতা! তুমি যেন বাধা দিও না।’

ততদিনে মানুষটাকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন, বাধা কোন কাজেই দিতে পারেননি নমিতা। দেশে ফিরে ঢুকেছিলেন শিক্ষকতায়।

আর তাঁর স্বামী বিখ্যাত কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে যোগ দিয়েছিলেন ফিজিওলজির অধ্যাপক হিসেবে। হাসপাতাল চত্বরেই পেয়েছিলেন দোতলা কোয়ার্টার। নমিতা দোতলায় সাজিয়েছিলেন দুজনের ছোট্ট সংসার, আর তাঁর স্বামী সুভাষ গোটা একতলা জুড়ে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর সাধের ‘Animal House’। বিভিন্ন প্রজাতির ইঁদুর থেকে বাঁদর, কী নেই সেখানে! অধ্যাপনাশেষে বাড়ি ফিরে তাঁর স্বামী সারাদিন বুঁদ হয়ে থাকতেন তাঁর সেই ‘Animal House’ গবেষণাগারে। হরমোন ও প্রজননের নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন তিনি। কখনো ওপরে খেতে আসতে ভুলে যান, নমিতা গিয়ে শুকনো কিছু খাবার দিয়ে আসেন, কখনো আবার কাজ করতে করতেই সেখানেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।

বরাবরই তাঁর স্বামী ড. সুভাষ মুখোপাধ্যায় অদ্ভুত সমস্ত বিষয় নিয়ে গবেষণা করতেন। কলকাতার নানা ডাক্তাররা সুভাষের কাছে এমন সব রোগীদের রেফার করতেন, যাদের Reproductive Abnormality অর্থাৎ জন্মগত জননসমস্যা রয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই উভলিঙ্গ, অর্থাৎ bisexual. পুরুষ ও নারী দু-ধরনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গই বিদ্যমান তাদের শরীরে।

মায়েরা যখন এইরকম সন্তানদের সুভাষের কাছে নিয়ে আসতেন, সুভাষ তখন প্রশ্ন করতেন, ‘মা, তোমার সন্তানকে তুমি কীভাবে দেখতে চাও? ছেলে না মেয়ে?’

মা হয়তো বললেন, ‘মেয়ে।’

সুভাষ বলতেন, ‘বেশ, তাই হবে।’

নমিতা অবাকচোখে দেখতেন, তাঁর স্বামী কখনো সার্জারি, কখনো হরমোন প্রয়োগ করে অনেকটাই স্বাভাবিক স্রোতে ফিরিয়ে দিচ্ছেন সেইসব ছেলেমেয়েকে। সুভাষকে গবেষণায় সাহায্য করতেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ ড. সরোজকান্তি ভট্টাচার্য এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রধান ড. সুনীত মুখোপাধ্যায়। দুজনেই ধীরে ধীরে নমিতার পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছেন।

এছাড়াও Polycystic Ovarian Disease, নানারকম Gynecological সমস্যা নিয়ে সুভাষ দিবারাত্র বুঁদ হয়ে থাকতেন। Infertility বা বন্ধ্যাত্বকে তিনি অভিধান থেকে মুছে দেবেন, এমনই বোধহয় শপথ করেছিলেন। কলকাতা থেকে সুদূর প্যারিস, যেখানে যখন কোনো কনফারেন্সে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছেন, খোলা মনে ব্যক্ত করেছেন তাঁর এই প্রতিজ্ঞার কথা।

আর সেই প্রতিজ্ঞা রাখতে গিয়েই বোধ হয় তাঁর সরল সাধাসিধা স্বামীটিকে এত অপমান, এত বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে। তাঁর স্বামীর গবেষণা নিয়ে হাসিঠাট্টার ফোয়ারা ছুটেছে নানা মহলে।

‘ইঁদুরের ওপর টেস্টোস্টেরন হরমোন প্রয়োগ করে ইনফার্টিলিটি কমানোর চেষ্টা করছে! সুভাষ কি শেষে পাগল হয়ে গেল নাকি?’

কিছুটা অজ্ঞানতায়, কিছুটা ঈর্ষায় সুভাষকে ইচ্ছাকৃত ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়েছে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে, যেখানে একটা আধুনিক ল্যাব পর্যন্ত নেই। সুভাষের গবেষণার মানের পরিকাঠামো তো দূরের কথা।

তবু তাঁর স্বামী মাথা নোয়াননি। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হয়েও দাঁতে দাঁত চেপে পড়িয়েছেন বাঁকুড়ায়, তারপর শনি-রবিবারে ছুটতে ছুটতে এসেছেন কলকাতায়, দিনরাত জেগে চালিয়েছেন নিজের গবেষণা। এভাবেই কেটেছে শেষ দু-বছর।

ভাবতে ভাবতে নমিতার চোখ জলে ভরে আসে। এই যে তাঁর পাশে বসে সন্তানের আগমনপ্রতীক্ষা করছেন প্রভাস আগরওয়াল, তিনি ও তাঁর স্ত্রী বেলা আগরওয়াল সুভাষের কাছে এসেছিলেন চারবছর আগে। বেলা আগরওয়ালের ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লকড থাকায় তাঁর পক্ষে সন্তানধারণ ছিল অসম্ভব। বিত্তশালী দম্পতি, পনেরোবছর ধরে তাঁরা ঘুরেছেন দেশবিদেশের নানা ডাক্তারের কাছে। জ্যোতিষীরাও বাদ যায়নি। কিন্তু কেউই আশার আলো দেখাতে পারেননি।

সুভাষ কিন্তু তাদের ফেরাননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি চেষ্টা করব। কিন্তু যতক্ষণ না হচ্ছে, আমি কিছু বলব না।’

তারপর সেই চেষ্টা চলেছে চারবছর ধরে। অবশেষে আজ উপস্থিত হয়েছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।

হঠাৎ প্রচণ্ড এক চিৎকারে নমিতার চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে তিনি ফিরে আসেন বাস্তবে। দেখেন, করিডরে জড়ো হয়েছে বেশ কিছু নার্স ও ডাক্তার।

নমিতা চমকে ওঠেন। ওটির ওপরের আলো কখন নিভে গেছে। পরনে সার্জনের পোশাক পরে থিয়েটার থেকে একে বেরিয়ে আসছেন সুভাষ ও তাঁর দুই সহযোগী সরোজকান্তি ও সুনীত।

সুভাষের কোলে ওইটুকু যে শিশুটা, কে ও? একরত্তি শরীরে চোখ পিটপিট করে দেখছে চারপাশ? ঘ্রাণ নিচ্ছে নতুন পৃথিবীর?

নমিতার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। দেখেন, প্রভাস আগরওয়াল পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছেন সুভাষের দিকে। সুভাষ উঁচু করে দেখাচ্ছেন সেই মানবশিশুটিকে। হাসিমুখে বলছেন, ‘কনগ্রাচুলেশনস মিঃ আগরওয়াল! আপনার একটি ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। মা মেয়ে দুজনেই সুস্থ রয়েছে।’

আবেগে গলা কাঁপছে সুভাষের।

প্রভাত আগরওয়াল কেমন যেন স্থবির হয়ে গেলেন কথাটা শুনে। দীর্ঘপথ হেঁটে আসা তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো তিনি তাকালেন শিশুটির দিকে।

ডাক্তারবাবুর কথাটা হৃদয়ঙ্গম করামাত্র তাঁর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পড়ছে অশ্রুধারা। আবেগের শীর্ষে পৌঁছে যেতে যেতে ভাঙা গলায় বলছেন, ‘কী করে আপনার এই ঋণ আমি শোধ করবো, ড. মুখার্জি? আপনি … আপনি আমায় নতুন জীবন দিলেন ডাক্তার!’

নমিতা দেখছেন, সুভাষের কানে যেন কথাটা পৌঁছচ্ছেই না কথাটা। তিনি কাঁপা কাঁপা স্বরে বলছেন, ‘আজ তো দুর্গাপঞ্চমী। দুর্গাপুজোর আগে আপনার বাড়িতে মা-ই এসেছেন। আপনারা যে নামই দিন, আমি কিন্তু ওকে দুগগা বলেই ডাকব! ঠিক আছে তো, মিঃ আগরওয়াল? মিষ্টি কোথায়?’

এতক্ষণে আপনারা সকলেই বোধহয় বুঝতে পারছেন, হারিয়ে যাওয়া খুনিরা-র সিরিজের তৃতীয় পর্বের প্রথম কাহিনীতে আমি কোনো হৃদয়বিদারক কাহিনী লিপিবদ্ধ করতে বসেছি।

হ্যাঁ, প্রথমেই নতমস্তকে স্বীকার করি, এই মর্মন্তুদ কাহিনীতে নেই কোনো হাড়হিম করা খুনের বিবরণ। কিন্তু দিনের পর দিন কাউকে যদি বাধ্য করা হয় জীবনের সমাপ্তি ঘটে? যদি অপমানের সাগরে ডুবিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে?

তবে কি সেই আত্মহত্যা ‘খুন’ নয়?

কিন্তু ‘খুন’ যদি নাই হবে, কেন এই কাহিনীর তথ্যসংগ্রহ করতে গিয়ে যত জেনেছি, তত নিমজ্জিত হয়েছি লজ্জায়। কেন মুখ লুকিয়েছি আয়নার সামনে? কেন লিখতে লিখতে ডুবে গেছি প্রচণ্ড হতাশায়, দুঃখে?

হ্যাঁ, এই কাহিনী বাঙালীর প্রচণ্ড ঈর্ষার ইতিহাস। এই কাহিনী চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, বাঙালির ‘কাঁকড়া’ মানসিকতা।

Crab syndrome জানেন তো?

‘আমি উঠতে পারব না, তাই কাউকে উঠতেও দেব না।’

এই কাঁকড়া-মানসিকতার ই শিকার হয়েছিলেন ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

যিনি হতে পারতেন স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম নোবেলজয়ী বাঙালি, যিনি হতে পারতেন আমাদের সকলের গর্বের কারণ, তিনি তাঁর সাধের দুর্গার জন্মের তিনবছরের মাথায় এক বৃষ্টিভেজা দিনে নিজের সাদার্ন অ্যাভিনিয়ের পাঁচতলার ফ্ল্যাটের সিলিং থেকে সটান ঝুলে পড়েছিলেন। স্ত্রী নমিতা স্কুল থেকে এসে আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর গুণী স্বামীটির ঝুলন্ত মৃতদেহ।

তারিখটা ছিল ১৯শে জুন। সাল ১৯৮১।

ছোট্ট সুইসাইড নোটে লিখে গিয়েছিলেন একটি মাত্র বাক্য।

‘I can’t wait everyday for a heart attack to kill me!’

কবে হার্ট অ্যাটাকে আমার মৃত্যু হব, সেই প্রতীক্ষায় আমি দিন কাটাতে পারব না!

যে ঝকঝকে তরুণ দেশের মাটিতে বসে গবেষণা করবেন বলে ছেড়ে এসেছিলেন প্রথম বিশ্বের চোখধাঁধানো অফার, তাঁকে কেন চলে যেতে হল এইভাবে? যখন আলোড়নফেলা আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশেবিদেশে সম্মানে সংবর্ধনায় তাঁর ডুবে থাকার কথা, তখন কেন এভাবে নিভৃতকোণে প্রতিদিন রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছিল তাঁকে?

আসুন, জেনে নিই। জেনে বিনম্র লজ্জায় স্মরণ করি সেই কাজপাগল নির্লোভ বিজ্ঞানীকে।

প্রজননতন্ত্রের নানাক্ষেত্রে ড. সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা থাকলেও তাঁর কাজের আসল ক্ষেত্র ছিল কৃত্রিম গর্ভধারণ। আজকের বিজ্ঞান পরিভাষায় যাকে বলা হয় In Vitro Fertilization (IVF)।

কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রথমেই একটি দোষ করেছিলেন। সেই দোষ ক্ষমার অযোগ্য। সময়ের চেয়ে অনেক অনেক আগে জন্মানোর সেই ভয়ংকর ‘কালানৌচিত্য’ দোষে অকালে ঝরে যেতে হয়েছিল গ্যালিলিওর মতো বিজ্ঞানীকেও।

১৬৩৩ সালের ইটালিতে ভীষণ অপরাধ করেছিলেন গ্যালিলিও। বাইবেলের উলটোপথে হেঁটে দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন, পৃথিবীকে কেন্দ্রে রেখে সূর্য, চন্দ্র বা গ্রহ নক্ষত্ররা মোটেই আবর্তিত হয়না। পৃথিবী হল সৌরজগতে সূর্যকে ঘিরে প্রদক্ষিণরত একটি গ্রহ মাত্র।

বাইবেলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা? চরম অত্যাচার। বন্দিদশা। অপমান। তবু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেই মহাবিজ্ঞানী সত্য প্রতিষ্ঠার দাবিতে মাথা নত করেননি, এই নশ্বর জীবনকে তাচ্ছিল্যভরে উৎসর্গ করে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন।

আর তার সাড়ে তিনশো বছর পর সেই একই পথে হেঁটেছিলেন আরেকজন বিজ্ঞানসাধক সুভাষও।

ড. সুভাষ মুখোপাধ্যায় যখন টেস্ট টিউব বেবির উদ্ভাবন করেছিলেন, সত্তরের দশকের কলকাতা তখন পুরুষত্বহীনতা, low sperm count– ovulation– blocked Fallopian Tube, এসব সম্পর্কে প্রায় অন্ধকারে। বন্ধ্যাত্ব মানেই সহজে তখন দেগে দেওয়া যায় মেয়েদের। ‘বাঁজা’ অপবাদে মুখ বুজে দিন কাটে তাদের। এই বিষয়ে ছেলেদেরও যে কোনো দোষ থাকতে পারে, তা সমাজের কল্পনার বাইরে।

আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে ড. সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের হাতে ছিল না তেমন কোনো অত্যাধুনিক যন্ত্র বা পরিকাঠামোও। তবু তিনি এগিয়েছিলেন আশ্চর্যভাবে।

প্রথমেই তিনি Human Menopausal Gonadotropin ইঞ্জেকশন দিয়ে প্রভাত আগরওয়ালের স্ত্রী বেলা আগরওয়ালের ovary stimulate করেছিলেন। এই পদ্ধতিকে বলা হয় superovulation। ঋতুচক্রের তিন থেকে ন-দিনে একদিন অন্তর চলে এই HMG. তারপর এগারোতম দিনে দেওয়া হয় Human Chorionic Gonadotropin হরমোন ইনজেকশন। এর ফলে একসঙ্গে অনেকগুলি ডিম্বাণু একই ঋতুচক্রে পাওয়া যায়। এতে সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেশি। কারণ, একটি ডিম্বাণু যদি কোনো কারণে নিষিক্ত নাও হয়, অন্যগুলির সম্ভাবনা থাকবে। প্রসঙ্গত বলি, তার প্রায় পাঁচবছর পর আমেরিকার ভার্জিনিয়ার গবেষক হাওয়ার্ড জোনস নানা পত্রপত্রিকায় দাবি করেছিলেন, তিনিই বিশ্বে প্রথম HMG ব্যবহার করেছেন। ততদিনে সুভাষ আর ইহলোকে নেই।

তারপর তিনি কয়েক মিনিটের একটি অপারেশন যাকে বলা হয় কল্পোটমি, তার সাহায্যে ওভারি থেকে ফ্ল্যুইড সমেত পাঁচটি ডিম্বাণু সংগ্রহ করেছিলেন। সেইসময়েই বিদেশে ড. স্টেপটো ও ড. এডওয়ার্ডস এই গবেষণায় ল্যাপারোস্কোপির ব্যবহার করেছিলেন। অর্থাৎ ডিম্বাণু সংগ্রহ করতে পেটের ওপর ফুটো করে সুচ ও সিরিঞ্জের মাধ্যমে ডিম্বাণু নিষ্কাশন করা হয়েছিল। কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায় বিশ্বে সর্বপ্রথম Transvaginal Colpotomy ব্যবহার করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি যোনিপথে ডিম্বাণু নিষ্কাশন করেছিলেন, যেটি অনেক বেশি সহজ ও ব্যয়সাধ্য। গোটা বিশ্বে এখন এই পদ্ধতিই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই পদ্ধতিও পরে আবিষ্কারের দাবি করেছেন বিজ্ঞানী গ্লেইচার।

এরপর সুভাষ ডিম্বাণুটিকে নিষিক্ত করে তিপ্পান্নদিন অতি-হিমায়িত তাপমাত্রায় cryopreservation করেন। সহযোগী ড. সুনীত মুখোপাধ্যায় নিজে ক্রায়োবায়োজিস্ট। সুভাষ মুখোপাধ্যায় ৫৩ দিন সেই মানবভ্রূণটিকে তরল নাইট্রোজেন ফ্লাক্সে সংরক্ষিত করে তাকে আবার স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এনে মাতৃজঠরে প্রবেশ করালেন। সেটা ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাস।

এর ঠিক নয়মাস পর বেলা আগরওয়াল জন্ম দেন ভারতের প্রথম নলজাতক শিশু ‘দুর্গা’র।

কী ভাবছেন, ইতিহাস রচিত হল? হইহই পড়ে গেল চারদিকে? ভুল। হইচই শুরু হল ঠিকই, কিন্তু তা ছেয়ে গেল অজ্ঞানতাজনিত ঈর্ষাপরবশ বিদ্রূপ আর শ্লেষে।

খবরটা পাঁচকান হওয়ামাত্র দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল গোটা শহরে। সারা কলকাতা জেনে গেল ‘একটা নলের মধ্যে তৈরি হয়েছে বাচ্চা।’

অ্যাঁ! সে আবার হয় নাকি! সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের হুড়োহুড়ি পড়ে গেল বেলভিউয়ের বাইরে, দূরদর্শন রাতারাতি আয়োজন করে ফেললো অনুষ্ঠানের। সাধারণ মানুষ তো বটেই, ছোটবড় ডাক্তাররাও হতভম্ব হয়ে গেলেন।

কী কাণ্ড! একি সত্যি নাকি? গাঁজাখুরির একটা সীমা হয়।

ডাক্তারদের যে ক্ষমতালোভী গোষ্ঠীটি আগে থেকেই জানতেন সুভাষের এইসব ‘অদ্ভুত’ কার্যকলাপ, যারা আগে থেকেই নানা শূলবাক্যে সুভাষকে বিদ্ধ করে তৃপ্ত করতেন নিজেদের অক্ষমতা, যাদের যোগসাজশে সুভাষকে আগেই নির্বাসিত হতে হয়েছিল বাঁকুড়ায়, তাঁরা এবার প্রকাশ্যে নখদাঁত বের করতে শুরু করলেন।

জালিয়াতি, বোগাস, অসম্ভব, নোংরামি ইত্যাদি নানা বিশেষণে তাঁরা ভূষিত করতে শুরু করলেন উজ্জ্বলতম সতীর্থটিকে।

ওদিকে সংবাদমাধ্যম ঝড় তুলে দিয়েছে গোটা শহরে। মানুষের কৌতূহলের পারদ চড়ছে চরচরিয়ে। রাজ্যসরকার তড়িঘড়ি চেয়ে পাঠাল বিস্তারিত রিপোর্ট।

দুর্গার জন্মের ষোলোদিনের মাথায় সুভাষ এবং তাঁর টিম গোটা পরীক্ষাটির experimental procedure লিখে জমা দিলেন রাজ্যসরকারের Directorate of Heath Services-এ।

এবং এরপরেই শুরু হল সেই ন্যক্কারজনক খেলা। যে খেলার শুরু দু-বছর আগে হয়েছিল সুভাষকে বাঁকুড়ায় পাঠিয়ে, সেই খেলারই শেষ দান শুরু হল এবার।

সুভাষের রিপোর্ট পেয়ে সরকারের তরফে একটি এনকোয়ারি কমিটি গঠন করা হল।

কে কে ছিলেন কমিটির সদস্য হিসেবে?

এক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিও ফিজিক্স ও ইলেক্ট্রনিকসের অধ্যাপক ড. মৃণালকান্তি দাশগুপ্ত।

দুই, সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের অধ্যাপক ড. কে এন কুণ্ডু।

তিন, স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ ড. জে সি চ্যাটার্জি।

চার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোফিজিওলজির অধ্যাপক ড. অজিত মাইতি।

পাঁচ, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ডঃ অচিন্ত্য মুখার্জি।

আপনি কী ভাবছেন তা আমি জানি। ফিজিক্স কোথা থেকে আসছে? হ্যাঁ, পদার্থবিদ্যায় প্রয়োগ থাকলেও এত লোক কেন?

যেখানে ড. সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণার নানা ধাপে বিভিন্নরকম রাসায়নিকের ব্যবহার হয়েছিল, সেখানে গোটা কমিটিতে নেই কোনো রসায়নবিদ! নেই কোনো Obstetrician বা প্রসূতিবিদ। অতি হিমায়ন পদ্ধতির বিশেষজ্ঞ ক্রায়োবায়োলজিস্ট বা কোনো ইনফার্টিলিটি স্পেশালিস্ট তো দূরের কথা!

কমিটির সদস্যদের রিপ্রোডাক্টিভ মেডিসিন সম্পর্কে ছিল না কোনো অত্যাধুনিক জ্ঞান। নাতিদীর্ঘ মূল্যায়নের পরই বেরল কমিটির রায়।

‘This is ridiculous and absurd!’

কমিটি সুভাষের আবিষ্কারকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করা মাত্র রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ও অন্যান্যরা। সুভাষকে ডেকে পাঠানো হল Bengal Obstetrics & Gynecological Society তে।

নমিতা এই প্রথম বাধা দিলেন স্বামীকে, ‘কী দরকার যাওয়ার? ওই রিপোর্টের মতো এখানেও তোমায় হেনস্থাই করবে, দেখো!’

সুভাষ ম্লানমুখে বললেন, ‘নাগো। না গেলে ভাববে আমি বুঝি উত্তর দিতে ভয় পাচ্ছি। যাব না কেন? যে কোনো প্রশ্নের আমি ক্ল্যারিফিকেশন দিতে প্রস্তুত।’

কিন্তু ‘প্রশ্ন’ এলে তবে তো তার উত্তর! বিদ্রূপ, টিটকিরি, অপমানের কি কোনো উত্তর হয়? না সুভাষের মতো অতিভদ্র মানুষ সেসবের উত্তর দিতে পারেন!

আমার পরিচিত প্রখ্যাত চিকিৎসক ড. অনিরুদ্ধ বোস সেই সময় ডাক্তারির ছাত্র। উপস্থিত ছিলেন সেই প্রকাশ্য সভায়। তিনি আমাকে বলেছিলেন তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।

‘আমার মাস্টারমশাইদের অসভ্যতা দেখে সেদিন থমকে গিয়েছিলাম! সকলেই নামী ডাক্তার। বিশেষ করে দুই গায়নোকলজিস্ট, আমার স্যার ড. নগেন রায়চৌধুরী ও ড. তরুণ ব্যানার্জি। নগেন রায়চৌধুরীর একটা বিদ্রূপ এখনো মনে পড়ে।

‘You mean to say all these were done in your South Calcutta Flat?’

হাসি ঠাট্টা টিটকিরির মাঝে চরিত্র তুলে অপবাদের মধ্যেই ড. তরুণ ব্যানার্জি বললেন, ‘We’re giving you 15 minutes to prove your crap!’

ড. সুভাষ মুখোপাধ্যায় শক্তমুখে বললেন, ‘You’ve invited me to talk of my work, Sir! You can’t dictate any time limit to prove my work!’

কিন্তু কে শোনে সে’সব কথা? ডাক্তাররা তখন পরিণত হয়েছেন রাস্তার চায়ের দোকানে আড্ডা মারা কিছু অসভ্য মানুষে, সুভাষের বংশ তুলে গালিগালাজ থেকে শুরু করে অশ্লীল ইঙ্গিত, সবই চলছে।

স্বভাবমার্জিত সুভাষ আর কিছু বলতে পারলেন না। ভগ্নহৃদয়ে টলতে টলতে বাড়ি ফিরে এলেন। ওদিকে বাঁকুড়ায় জয়েন করতেই হবে। নাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে আসছে শোকজ করার হুমকি।

‘অনেক অন্যায় সহ্য করেছি, নমিতা! কিন্তু এইভাবে প্রকাশ্যে আমাকে কেউ অপমান করেনি! তুমি তো জানো, দুর্গাকে আমি কিভাবে পৃথিবীতে এনেছি?’

নমিতা তখন সদ্য ফিরেছেন আগরওয়ালদের বাড়ি থেকে। দুর্গা পৃথিবীতে আসার পর থেকে তিনিও যেন একটি মেয়ে পেয়েছেন। জন্ম না দিয়েও অনুভব করছেন নাড়ির টান। তাই ফাঁক পেলেই চলে যান প্রভাস আগরওয়ালের বাড়ি। ওঁরাও বড় ভালোবাসেন এই ডাক্তারপত্নীটিকে। আগরওয়ালরা কৃষ্ণভক্ত, মেয়ের খাতায়কলমে নাম রাখা হয়েছে, ‘কানুপ্রিয়া’।

কিন্তু নমিতার কাছে ও শুধু দুর্গা।

নমিতা স্বামীর কষ্ট বুঝতে পারেন। যে মানুষটি গবেষণার জন্য নিজে ‘বাবা’ ডাক শুনতে চাননি, তিনি যখন এত বড় যুগান্তকারী কাজ করেও অপমানিত লাঞ্ছিত হন, তখন সেই কষ্ট বর্ণনাতীত।

তিনি তবু বললেন, ‘এত ভেঙে পড়োনা। দেশ স্বীকৃতি দিচ্ছেনা তো কি, জাপান সরকার তো তোমাদের ইতিমধ্যেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। একমাস সরকারি খরচে ওঁদের Kyoto বিশ্ববিদ্যালয়ে কোলাবরেশনে কাজ করার জন্য।’

সত্যিই তো তাই! ক্রমাগত বিদেশ থেকে আসতে থাকছে কনফারেন্সের আমন্ত্রণ। জার্মানি থেকেও চিঠি এসেছে। তাঁরা সকলে শুনতে চান এই অভূতপূর্ব আবিষ্কারের ইতিবৃত্ত।

সুভাষ ঘন অন্ধকারের মধ্যেও দেখতে পেলেন ক্ষীণ আশার আলো। ফিরে গেলেন বাঁকুড়ায়। কাজশেষে বাড়ি ফিরে আরো গুছিয়ে তৈরি করতে লাগলেন তাঁদের গবেষণার রিপোর্ট। না, বিদেশের বক্তৃতায় তিনি কোনো ফাঁক রাখবেন না। দেশবিদেশে তিনি এর আগে বহু সেমিনারে অংশ নিয়েছেন, critical pregnancy, hormonal disbalance, testicular feminization এইসব জটিল বিষয় নিয়ে তাঁর প্রচুর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিকক্ষেত্রে তিনি এমনিতেই যথেষ্ট সম্মানীয় নাম।

কিন্তু একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে দ্বিতীয় আঘাত এল কিছুদিনের মধ্যেই। সুভাষ যাবেন কী করে? সরকার যে কিছুতেই সুভাষের পাসপোর্ট রিনিউ করতে দিচ্ছে না। বারবার আটকে দেওয়া হচ্ছে সুভাষের পাসপোর্ট ও ভিসা।

সুভাষ, সুনীত ও সরোজকান্তি হন্যে হয়ে চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁরা বিদেশে যাওয়ার ছাড়পত্র পেলেন না। বাঁকুড়ায় কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে কলকাতায় পরিচিতমহল, সুভাষকে নিয়ে ব্যঙ্গ্যোক্তি, বক্রোক্তি বাড়তে লাগল। কারুর ধারণাই নেই যে কাজ সম্পর্কে, সেই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র যুক্তিবোধ নিয়ে ভাবার চেষ্টা না করে চলতে লাগল উপহাস। প্রথমে আড়ালে, তারপর সামনাসামনি।

বিধ্বস্ত সুভাষের হার্ট অ্যাটাক হল ১৯৮০-এর মে মাসে। বাঁকুড়া থেকে তাঁকে ট্রান্সফার করা হল আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে।

এরপরেও সুভাষ আবেদন জানালেন, তাঁকে যদি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ বা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে দেওয়া যায়। কারণ ওই দুটি কলেজে ফিজিওলজি ডিপার্টমেন্ট একতলায়। হার্ট অ্যাটাকের পর তাঁর সিঁড়ি ভাঙা একেবারে বারণ।

কিন্তু কর্ণপাত করা হল না তাঁর কথায়। আর জি কর হাসপাতালে তিনতলায় ফিজিওলজি ডিপার্টমেন্ট, লিফটও নেই। সুভাষকে রোজ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হত।

ভাবতে বিস্ময় লাগে, যে আমরা বাস করি শিক্ষিত সমাজে। যেখানে একজন বিশ্বনন্দিত বৈজ্ঞানিককে তাঁর আবিষ্কারের জন্য এতটা লাঞ্ছিত হতে হয়। বিদেশে ড. এডওয়ার্ড এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন অজস্র সম্মাননা ও মেডেল।

আর সুভাষ কী পেলেন? মৃত্যুমেডেল!

২০০২ সালে প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক ড. পুষ্প ভার্গব এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘কী করে ভারতীয়রা নোবেল পাবে যদি তাঁকে নিজের দেশেই না স্বীকৃতি দেওয়া হয়? Our system suppresses cream and pushes up second rate scientists.’

কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতেছিল আরেকটি অফিস অর্ডার। ড. সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে হঠাৎ ট্রান্সফার করা হল রিজিওনাল ইন্সটিটিউট অফ অপথ্যালমোলজিতে।

মেডিকেল কলেজের চক্ষুরোগকেন্দ্র।

সুভাষ কী বলবেন ভেবে পাননি! বুঝতে পারেননি চোখের গবেষণাগারে তিনি কীভাবে কাজ চালাবেন? কী কাজই বা করবেন সেখানে?

তাঁর সামনের দরজাগুলো একে একে সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

তাই ১৯৮১ সালের ১৯ জুন তিনি সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে নিজের ফ্ল্যাটে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

সতীর্থ চিকিৎসকদের অপমান, লাঞ্ছনা, আঘাত তিনি মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু চোখের ডিপার্টমেন্টে গিয়ে নিজের গবেষণা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়াকে মেনে নিতে পারেননি এই কর্মযোগী মানুষটি।

বন্ধুদের কথায় ‘Exceptionally Extraordinary’ সুভাষ মাত্র পঞ্চাশেই শেষ করে দিয়েছিলেন নিজেকে।

অথচ সুভাষ কিন্তু নাম যশ খ্যাতি কিছুই চাননি। শুধু কাজ করতে চেয়েছিলেন নিজের আনন্দে। কিন্তু তাঁর হাতদুটোকেও কেটে নেওয়া হয়েছিল।

এরপর কেটে গেছে বহুবছর। তাঁর কাজের আটবছর পর ড. টি সি আনন্দ তৈরি করেন দেশের দ্বিতীয় টেস্ট টিউব বেবি ‘হর্ষ’কে। কর্মসূত্রে ১৯৯৭ সালে কলকাতায় এসে সুভাষের কাজ দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে যান। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সমস্ত গবেষণাপত্র খুঁটিয়ে দেখে তিনি নির্দ্বিধায় বলেন, ‘আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। ড. মুখোপাধ্যায়ই এই পথে পথিকৃৎ।’

ড. টি সি আনন্দ তারপর থেকে যেখানে গিয়েছেন, অকুণ্ঠে প্রচার করেছেন পূর্বসূরি এই বাঙালি বৈজ্ঞানিকের কীর্তির কথা। বলেছেন, বিশ্বের প্রতিটি IVF clinic এখন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের দেখানো পদ্ধতি ব্যবহার করে।

 হায়! তবু স্বজাতি বোঝেনি এই সোনার ছেলের কথা। আজ যার জন্য হাজার হাজার দম্পতির মুখে হাসি ফুটছে, তাকে ছুঁড়ে ফেলেছে নির্মমভাবে।

দুর্গা ওরফে কানুপ্রিয়া আগরওয়াল এখন চল্লিশ পেরিয়েছে। সে ব্যস্ত কর্পোরেট লেডি, একই সঙ্গে সন্তানের জননী।

নমিতা মুখোপাধ্যায় মারা গিয়েছেন ২০১৩ সালে। নিঃসন্তান নমিতার শেষ জীবন কেটেছিল বড় অসহায়ভাবে।

কিছুদিন আগে Indian Statistical Institute ড. সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে ভূষিত করেছে মরণোত্তর সাম্মানিক DSC ডিগ্রিতে।

কিন্তু তাতে কী? সাধারণ বাঙালি কতটুকু মনে রেখেছে এই কাজপাগল অনন্যসাধারণ প্রতিভাবান বিজ্ঞানীটিকে?

২০০৫ সালে কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির সামনের রাস্তা লেক ভিউ রোডকে তাঁর নামে নামাঙ্কিত করার আবেদন করেন কলকাতা পুরসভায়।

প্রাথমিকভাবে সেই আশ্বাস দেওয়া হলেও নাম পালটে হয়ে যায় ‘অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় সরণি।’

আবেদনকারীরা পুরসভার এক আধিকারিককে গিয়ে প্রশ্ন করতে তিনি বলেন, ‘অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম সবাই জানে। গায়ক ছিলেন। সুভাষ মুখার্জির নাম কে শুনেছে?’

কাঁকড়ারা কি এতটাও আত্মবিস্মৃত, এতটাও ঈর্ষাপরায়ণ, এতটাও আত্মঘাতী হয়?

বিশ্বাস হয়না!

সহায়ক তথ্যপঞ্জী :

১। ড. সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও ড. উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, দোয়েল দত্ত।

২। Architect of India’s first test tube baby– Dr. Subhas Mukherjee, Dr Sunit Mukherjee & Dr S.C. Lodh

৩। সুভাষ-নমিতা-সুনীতের উপকথা, ড. সুনীত মুখোপাধ্যায়

৪। ছবি : অন্তর্জাল ও উপরোক্ত গ্রন্থাবলী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *