কুমারটুলির রাজাবাবু

কুমারটুলির রাজাবাবু

দুটো প্রমাণিত খুন, কুড়িটা অপ্রমাণিত খুন। পঁচাত্তরটা চুরি-ডাকাতি-রাহাজানির মামলা। অগণিতবার ব্রিটিশ পুলিশকে ধোঁকা দিয়ে পালানো। হাসতে হাসতে শত্রুর বুকে ছুরি বসিয়ে সযত্নে তার মুণ্ডু কেটে নেওয়া।

অন্যদিকে পিতৃহীন কন্যার বিবাহের আয়োজন। অসহায় বিধবার অন্নসংস্থান। পতিতা পল্লির মেয়েদের ত্রাতা হয়ে দাঁড়ানো। অনাথ আশ্রমের পৃষ্ঠপোষক।

এই হল প্রায় এক-শো বছর আগে গোটা উত্তর কলকাতার ত্রাস হয়ে কয়েক দশক রাজত্ব করা সাড়াজাগানো খাঁদা গুন্ডার অতিসংক্ষিপ্ত পরিচয়।

যার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দ্বৈত সত্তার সম্পর্কে জানতে পেরে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টও বিস্মিত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, এমন দাগি অপরাধী, অথচ এমন অদ্ভুত নরম মন, কীভাবে সম্ভব! এ যে রবিনহুড!

না, সে বিদেশি রবিনহুড নয়, সে ‘রাজা অফ কুমারটুলি।’

তা ‘সাবেক কলকাতার রবিনহুড’ ই বলুন বা ‘রাজা অফ কুমারটুলি, এই খাঁদা গুন্ডার রোমহর্ষক কাহিনি জানতে গেলে আমাদের পৌঁছে যেতে প্রাকস্বাধীনতা যুগে।

সময়টা ১৯৩৬। ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসনের প্রায় শেষ সময় উপস্থিত। গোটা ভারতবর্ষ তখন ধীরে ধীরে প্রস্তুত হছে আসন্ন স্বাধীনতার জন্য। কিছুদিন আগেই লখনৌ শহরে অনুষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ঊনপঞ্চাশতম অধিবেশন। অধিবেশনের প্রেসিডেন্ট পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু সেখানে নস্যাৎ করে দিয়েছেন ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন, কারণ সেই আইন তৈরি হয়েছে ভারতীয় জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে।

সুভাষচন্দ্র বসু তখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দলবদ্ধভাবে লড়ার জন্য চষে বেড়াচ্ছেন ইউরোপে, দেখা করছে বেনিতো মুসোলিনির মতো নেতাদের সঙ্গে।

অন্যদিকে হুগলি নদীর ওপর অস্থায়ী পন্টুন ব্রিজ খুলে ফেলা হয়েছে। নিলামে ব্রেইথওয়েট, বার্ন ও জেশপ কোম্পানি বরাত পেয়ে নদীর ওপর বানাচ্ছে সুবিশাল ক্যান্টিলিভার সাসপেনশন ব্রিজ, আজকের ‘হাওড়া ব্রিজ’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতীর আর্থিক সংকট মোচনের জন্য নৃত্যনাট্যের দল নিয়ে নিজে যাচ্ছেন এলাহাবাদ, লখনৌ, দিল্লি শহরে। অশক্ত শরীরে অর্থের জন্য কবিগুরুর এই পরিশ্রমে ব্যথিত হয়ে সেই অর্থের জোগাড় করে দিচ্ছেন মহাত্মা গান্ধী স্বয়ং।

এইরকম সময় ৫ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা কুমারটুলির পেছনে বলরাম মজুমদার স্ট্রিটে বেশ শোরগোল পড়ে গেল। পথচারীরা তো ছিলই, স্থানীয় বাসিন্দারাও ছুটে এল। দুর্গাপুজোর আর মাত্র কয়েকদিন দেরি, কুমারটুলিতে সারাদিনই সাজো সাজো রব। কিছু কারিগরও কাজ ফেলে এদিকে ছুটে এল, ঘটনাটা কী, তা দেখতে।

ঘটনা না বলে দুর্ঘটনা বলাই যুক্তিযুক্ত।

তখন প্রতিটি বড়ো রাস্তার পেছন দিয়েই থাকত মেথরদের যাতায়াতের জন্য মেথর গলি।

বলরাম মজুমদার স্ট্রিটেরও দোতলা, তিনতলা বাড়িগুলোর পেছন দিয়ে চলে যাওয়া সরু মেথর গলিতে প্রতিদিনের মতো কলকাতা কর্পোরেশনের মেথর মোহন ভোরবেলা ঢুকেছিল ময়লা পরিষ্কার করতে। ঢুকে দেখে, একটা বাড়ির পেছনের দেওয়ালের গর্তে ঢোকানো রয়েছে একটা আস্ত লাশ।

সেই লাশের মুণ্ডু নেই, কাঁধের ওপর থেকে মুণ্ডুটাকে কেউ যেন বেশ যত্নের সঙ্গে চেঁছেপুঁছে কেটে নিয়েছে। ছোপ ছোপ রক্তে ভরে রয়েছে চারদিক। বোঝাই যাচ্ছে মৃত্যুর আগে তাকে নিদারুণ কষ্টভোগ করতে হয়েছে। ধড়ের যেখান থেকে মুণ্ডুটাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, সেখান থেকে ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে গোটা দেওয়ালটা।

সাতসকালবেলা এমন দৃশ্য দেখে ঝাঁটা-বালতি হাতে মোহনের হাত-পা অবশ হয়ে এল। এত সরু এই গলি, ঠিক মতো দিনের আলো ঢোকে না বললেই চলে, তার মধ্যে গলির দু-পাশেই উঁচু-উঁচু বাড়ির পশ্চাদ্দেশ। চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে ফেললেও কেউ শুনতে পাবে না।

মোহন পড়ি কি মরি করে ছুটে বেরিয়ে এল সেই গলি থেকে, বলরাম মজুমদার স্ট্রিটে পা দিয়েই চিৎকার করতে লাগল, ”খু-খুন! খুন হয়েছে। কে আছ, শিগগিরই এদিকে এসো!’

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ছোটোখাটো একটা ভিড় জমে গেল। চায়ের দোকানি থেকে শুরু করে কুমারটুলির শিল্পী, কেউই বাদ নেই সেই ভিড়ে। সবার চোখ বড়োবড়ো, মুখে এক কথা, ‘আহা গো, কী বীভৎসভাবে খুন করেছে লোকটাকে!’

মোহনের কাঁপুনি তখনও কাটেনি। হঠাৎ করে এমন মুণ্ডুহীন লাশ আবিষ্কার করে সে যে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে, তা বোঝা যাচ্ছিল। দিশেহারা হয়ে সে ছুটোছুটি করছিল গলির সামনে।

এমন সময় কলকাতা কর্পোরেশনের ওভারসিয়ার বিনয় কুমার রায় সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি এইসময় রোজই এই চত্বরের প্রতিটা মেথরগলি টহল দেন। কর্পোরেশনের মেথররা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা, সেটা দেখভাল করাই তাঁর কাজ।

বিনয়বাবুকে দেখামাত্র মোহন ছুটে গিয়ে তাকে সব খুলে বলল, তারপর গলির মধ্যে নিয়ে গিয়ে দেখাল সেই হাড় হিম করা দৃশ্য। বিনয়বাবু বিচলিত হয়ে পড়লেও বিচারবুদ্ধি হারালেন না। চারপাশে প্রচুর লোক নিশ্চেষ্টভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুলতানি করলেও তিনি হাঁটা লাগালেন নিকটবর্তী শ্যামপুকুর থানার দিকে। তাঁরই অধস্তন মেথর প্রথম দেখেছে লাশ, তাই তাঁর দায়িত্ব থেকেই যায়। তাছাড়া শ্যামপুকুর থানায় এখন তাঁর পরিচিত অফিসার পঞ্চাননবাবু আছেন।

শ্যামপুকুর থানায় গিয়ে সব জানানো মাত্র পঞ্চানন ঘোষাল ও ইনস্পেক্টর সুনীল কুমার রায় বেশ কয়েকজন কনস্টেবল ও হাবিলদার সহ ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দিলেন।

সেখানে পৌঁছে অকুস্থল ভালো করে পরিদর্শন করে ওঁরা বিস্মিত হয়ে গেলেন।

ইনস্পেকটর সুনীল রায় বললেন, ‘কী নৃশংসভাবে মেরেছে দেখেছেন ঘোষালবাবু? প্রচণ্ড আক্রোশ না থাকলে এইভাবে হত্যা করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ধড় থেকে মুণ্ডু কেটে নেওয়ার জায়গাটা দেখুন। আমার মনে হয় হত্যাকারী পাকা অপরাধী।’

পঞ্চানন ঘোষাল তখন ভালো করে মেথরগলিটা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সরু গলিটা বাড়িগুলোর পেছন দিক দিয়ে এগিয়ে বহুদূর চলে গিয়েছে, কিন্তু দু-পাশে পেল্লাই সব বাড়ি থাকলেও একটা বাড়িরও কোনো দরজা এই গলিতে নেই। অর্থাৎ, কোনো বাড়ি থেকে এই গলিতে সরাসরি আসা সম্ভব নয়। তিনি মোহনকে বললেন, ‘এই গলিটা কদ্দূর গেছে?’

মোহন নামের মেথরটি তখন ভয়ার্ত মুখে পাশে দাঁড়িয়েছিল। পুলিশের প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘আজ্ঞে হুজুর, এ-গলি গিয়ে মিশেছে সেই শোভাবাজার স্ট্রিটে।’

পঞ্চানন ঘোষাল উত্তর শুনে আবার মৃতদেহের দিকে নজর দিলেন। যে বাড়ির পেছনে এই ভীষণ কাণ্ড ঘটেছে, সেই বাড়িটি অতিকায় ও সুপ্রাচীন, বহুবছর মেরামতির অভাবে বাড়ির এই পেছন দিকটিতে বাসা বেঁধেছে বট ও অশ্বত্থ গাছ, তাদের ঝুরি সাপের মতো এঁকে বেঁকে প্রসারিত হয়েছে গোটা বাড়িতে, মাঝে মাঝেই দেওয়াল ফাটিয়ে প্রবেশ করেছে ভেতরে।

যে গর্তের মধ্যে মুণ্ডহীন লাশটা ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে, সেটারও উৎপত্তি ওই বট অশ্বত্থের দাক্ষিণ্যেই।

একটা ব্যাপারে সুনীল কুমার রায় ও পঞ্চানন ঘোষাল, দুই পুলিশকর্তাই নিঃসন্দেহ হলেন, মাটি থেকে প্রায় চার ফুট উঁচুতে ওই গর্তটার মধ্যে যেভাবে লাশটা ঢোকানো হয়েছে, তা একা কারুর সাধ্য নয়। হত্যাকারী একজন নয়, একাধিক।

কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর পেয়ে পুলিশের ফটোগ্রাফার, ফিঙ্গার প্রিন্ট এক্সপার্ট আর প্ল্যানমেকার এসে পড়লেন। ওই গর্তের মধ্যে থাকা অবস্থাতেই মৃতদেহের প্ল্যান এঁকে ফেলা হল, কিন্তু গলিটি এতই সরু, আর আলো এতই অপ্রতুল যে ফটোগ্রাফার কিছুতেই একটা ভালো ফটো তুলতে পারলেন না।

তারও ব্যবস্থা হল। কুমারটুলির বিখ্যাত মৃৎশিল্পী গোপেশ্বর পালের ভাইপো মণি অন্য অনেকের সঙ্গে এসে কৌতূহলী হয়ে দেখছিল পুলিশি কাজকর্ম। আলোর অভাবে ফটো তোলার অসুবিধার কথা শুনে সে তার কাকাকে ডেকে নিয়ে এল। কাকা-ভাইপো মিলে মৃতদেহ ও তার পারিপার্শ্বিকের একটি নিপুণ স্কেচ এঁকে পুলিশের হাতে তুলে দিল।

এর মধ্যে গোটা শহরে এই হত্যাকাণ্ডের কথা রটে গেছে। যাদের আত্মীয় বা কোনো পরিজন কিছুদিন ধরে নিখোঁজ রয়েছে, তারা দলে দলে আসতে শুরু করেছে, যদি এই মৃতদেহ তারা শনাক্ত করতে পারে। কিন্তু একে তো ক্ষতবিক্ষত, তায় মুণ্ডহীন। কেউই লাশটাকে চিনতে পারল না।

সৌভাগ্যক্রমে যে দু-জন তরুণ পুলিশ অফিসার এই হত্যাকাণ্ডের প্রথম থেকেই জড়িয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা দু-জনেই ছিলেন কলকাতা পুলিশের সম্পদ। পঞ্চানন ঘোষালের নাম তো অত্যন্ত সুবিদিত, পরবর্তীকালে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি আই জি হয়েছিলেন এবং গোটা কেরিয়ারে তিনি প্রচুর তাবড় তাবড় অপরাধী ধরেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয়, যিনি অপরাধী মনস্তত্বের ওপর ডক্টরেট করেছিলেন। এছাড়াও সাহিত্যে ছিল তাঁর দারুণ দখল। লিখেছেন একাধিক বই, যেতেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যসভাতেও।

অন্যদিকে সুনীল কুমার রায়ের ষষ্ঠেন্দ্রিয় ছিল আশ্চর্যরকমের। কোনো মৃতদেহকে ভালো করে পরীক্ষা করে তিনি তাকে খুন করার সঠিক সময় থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছু বিশদে বলে দিতে পারতেন।

এক্ষেত্রেও তাই হল। পুলিশের ডাক্তার এসে পরীক্ষা করার আগেই সুনীলবাবু মৃতদেহের কাঠিন্য ও রক্তের জমাট বাঁধা পরীক্ষা করে বললেন, ‘পঞ্চাননবাবু, একে মারা হয়েছে প্রায় দশঘণ্টা আগে, অর্থাৎ গতকাল রাত ন-টা নাগাদ।’

মৃতদেহকে রাস্তার ওপর শোয়ানো ছিল। পঞ্চাননবাবু সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘লোকটার বয়স তো দেখে সাতাশ আটাশ মনে হচ্ছে, গলায় পৈতে রয়েছে। বাঙালি হতে পারে, আবার মাদ্রাজি, উড়িয়া কিংবা বিহারী ব্রাহ্মণও হতে পারে। কিভাবে খোঁজ পাব এর?’

সুনীল রায় পা মুড়ে বসে ভালো করে দেখছিলেন গোটা দেহটাকে। বললেন, ‘দেখুন, বুকে আর গোটা শরীরে প্রচুর লোম। বাঁ-হাতের নীচে দেখুন একটা উল্কি আঁকা রয়েছে। বেলফুলের। পরেশ, তুমি হাত আর পায়ের প্রতিটা আঙুলের ছাপ নাও তো। দেখো, সেগুলো আমাদের কোনো রেকর্ডের সঙ্গে মেলে কিনা।’

পরেশ বলে ফিঙ্গার প্রিন্ট এক্সপার্টটি তাড়াতাড়ি নিজের কাজ করতে উদ্যত হল। অনেকসময় খুন হওয়া ব্যক্তিটিও কোনো দাগি অপরাধী হয়, পুলিশের কাছে থাকা তার পুরনো আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলে গেলে খোঁজ পাওয়া যায়।

যাইহোক, সব কাজ মিটতে মিটতে বেলা হয়ে গেল। কিন্তু মৃতদেহের কোনো পরিচয় পাওয়া গেল না। আশপাশের বাড়ির বাসিন্দাদেরও জিজ্ঞেস করা হল, কেউই কোনো সদুত্তর দিতে পারল না। অতঃপর লাশটাকে পোস্ট মর্টেমের জন্য পাঠিয়ে পঞ্চানন ঘোষাল আর সুনীল রায় শ্যামপুকুর থানায় ফিরে গেলেন।

কিন্তু সেখানে ফিরেও তাঁরা শান্ত হতে পারলেন না। কলকাতা শহরের বুকে এমন বীভৎসভাবে খুন করার স্পর্ধা কার হল, আর খুন হওয়া লোকটাই বা কে, এই চিন্তাতেই তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

সব থানারই কিছু ইনফরমার থাকে। কিন্তু তারাও এসে বর্ণনা শুনে খুন হওয়া লোকটিকে চিনতে পারল না। অবশেষে গভীর রাতে পোস্ট মর্টেমে রিপোর্ট এল। সুনীলবাবুর কথাই ঠিক। পোস্ট মর্টেমেও লেখা আছে, মৃতদেহের বয়স ছিল সাতাশ আটাশ, গতকাল রাতে আটটা কি ন-টা নাগাদ তাকে খুন করা হয়েছে। প্রথমে তাকে ছুরি দিয়ে বারবার আঘাত করা হয়। সে মুমূর্ষু হয়ে পড়লে জ্যান্ত অবস্থাতেই মুণ্ডুটা কেটে নেওয়া হয়।

রিপোর্ট পাওয়ার পর পঞ্চানন আর সুনীল, দুই তরুণ পুলিশ অফিসার জোর তল্লাশি শুরু করে দিলেন।

মৃত ব্যক্তিটি কি আশপাশের এলাকার কোনো ধনী বাড়ির রাঁধুনি ব্রাহ্মণ ছিল? নাকি কোনো দুষ্কৃতির সহচর ছিল, অপরাধ ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখাতে খুন হয়ে তাকে?

নাকি এ নিজেই এক ধনী ব্যক্তি? সম্পত্তির লোভে একে খুন করেছে অন্য অংশীদারেরা?

কিন্তু হত্যাকারী খুন করার পর দুই পায়ের শিরা পর্যন্ত কেটে রেখে গেছে। প্রচণ্ড ঘৃণা বা হিংসা না হলে এতটা নির্মমভাবে খুন করা যায় না। তবে কি প্রেমঘটিত কিছু?

নাকি কোনো নারীর প্রেমে পড়ার অপরাধে প্রতিশোধ নিয়েছে নারীর আর এক প্রণয়ী?

নাকি এ নেহাতই এক লম্পট যুবক? ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে কলকাতার বিখ্যাত যৌনপল্লি সোনাগাছি। সেখানে মহিলাঘটিত কোনো গণ্ডগোলে কি এই হাল হয়েছে তার?

এরকম নানা সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হতে লাগল। কিন্তু কিছুতেই কোনো দিশা পাওয়া গেল না। তবু দু-জনে হাল ছাড়লেন না। আশপাশের গোটা অঞ্চলে নিয়মিত তদন্ত চালাতে লাগলেন তাঁরা।

অবশেষে একদিন একটু হলেও আলোর সন্ধান মিলল। একদিন পঞ্চাননবাবু ঠনঠনে, মীর্জাপুর হয়ে খোঁজ চালাতে চালাতে চিতপুরে এসেছেন, এমন সময় একটা লোক এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আজ্ঞে স্যার, আমি পাগলাকে চিনতাম!’

‘কে পাগলা?’ পঞ্চাননবাবু ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন লোকটার দিকে, ‘তুমি কে? কী নাম তোমার?’

‘আজ্ঞে, আমার নাম অম্বিকা।’ লোকটা মাথা চুলকে বলল, ‘যে লোকটার কথা জিজ্ঞেস করচিলেন না, ওর নাম পাগলা। আমি ওকে চিনতাম। যেদিন পাগলার লাশ পাওয়া গেল, তার আগেরদিন রাতেও ওর সঙ্গে কথা কয়েচি।’

পঞ্চাননবাবু তড়িঘড়ি অম্বিকাকে থানায় নিয়ে এলেন। বেচারা প্রথমদিনই বলরাম মজুমদার স্ট্রিটে ঘুরঘুর করছিল, কিন্তু ‘পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা’ এই প্রবাদ স্মরণ করে ভয়ে কিছু বলে উঠতে পারেনি। এখন ব্যাপারটা মোটামুটি থিতিয়ে যেতে মনে অনেক সাহস সঞ্চয় করে বলতে এসেছে।

ইতিহাসে এই ঘটনা কুখ্যাত হয়ে আছে ‘পাগলা হত্যা মামলা’ নামে। ‘পাগলা হত্যা মামলা’র প্রেক্ষিতেই ধরা পড়ে তৎকালীন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দুর্ধর্ষ ডাকাত সর্দার খাঁদা গুন্ডা। সোনাগাছির এক সামান্য দালাল অম্বিকা সেদিন সাহস করে বলতে না এলে হয়তো চিরকাল অধরাই থেকে যেত সেই দুর্দান্ত গুন্ডা।

অম্বিকা কম্পিতস্বরে বলল, ‘পাগলার ভালো নাম অতুলবাবু। সে আমাদের এলাকার গানের মাস্টার। তবলাতেও সঙ্গত করে। সোনাগাছির অনেক মেয়েই পাগলার কাছে গান শিখত। ৪ সেপ্টেম্বর বিকেলবেলা আমি বাড়ি ফিরচিলাম। তখন সোনাগাছিরই মণীন্দ্রবাবুর রোয়াকে বসে পাগলা মণীন্দ্রবাবুর সঙ্গে গল্প করচিল। আমিও কথা বলতে সেখানে দু-দন্ড দাঁড়িয়েচিলুম।’

‘মণীন্দ্রবাবু কে? তোর মতো কোনো দালাল নাকি কোনো মেয়ের বাঁধা বাবু?’ বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন পঞ্চানন ঘোষাল।

‘আজ্ঞে না না।’ জিভ কাটল অম্বিকা, ‘মণীন্দ্রবাবু ওই পাড়ায় থাকেন বটে, কিন্তু তিনি ভদ্দরলোক হুজুর। পালোয়ানও বটে, তাঁর ব্যায়ামের দল আছে। পাড়ার কোনো বিপদ-আপদেও তিনি রক্ষে করেন।’

‘আচ্ছা। তারপর?’

‘এমন সময় কয়েকটা গুন্ডাপ্রকৃতির লোক এসে পাগলাকে ঘিরে ধরে ধমকাতে শুরু করল। তাদের মধ্যে যে নেতাগোছের, সে পাগলার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল, আমার নাম খোকা, নাম নিশ্চয়ই শুনেচিস। তোকে শুধু খুনই করব না, নাকও কেটে নেব। পাগলা ভয়ে কাঁপচিল, লোকটার পা জড়িয়ে বলল, আমায় এবারের মতো মাফ করুন। আমি জীবনেও আর ওই মেয়ের ধারেকাছে যাব না, মা কালীর নামে শপথ করে বলচি।” অম্বিকা কথা শেষ করে দম নিল।

‘তারপর?’

‘তারপর মণীন্দ্রবাবুও বারবার পাগলাকে এবারের মতো ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন। তখন ওই গুন্ডার দল ওকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। পাগলা তখন ভয়ে কথা বলতে পারচিল না। মনীন্দ্রবাবু ওকে অনেক সাহস জোগালেন, তারপর আমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসতে বললেন। আমি আর পাগলা দু-জন মিলে সবেমাত্র গরাণহাটা স্ট্রিটের দিকে কিছুদূর এগিয়েচি, চারপাশ এট্টু অন্ধকারমত হয়ে এসেচে, এমন সময় একটা বাড়ির রোয়াক থেকে সেই ‘খোকা’ আর একটা ফর্সা মতো লোক পাগলার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। খোকা পাগলার টুঁটি টিপে ধরে দ্বিতীয় লোকটাকে বলল, ‘শিগগির একটা ট্যাক্সি ডেকে আন।’

পঞ্চাননবাবু লক্ষ্য করছিলেন বেশ কয়েকদিন কেটে গিয়েছে, তবুও অম্বিকার অভিজ্ঞতাটা বর্ণনা করতে করতে মুখ-চোখ কেঁপে কেঁপে উঠছে। তিনি বললেন, ‘তারপর কি হল?’

‘পাগলাকে যখন ওইভাবে ধরেছে, তখন আমি ভয়ে ওখান থেকে কেটে পড়লাম। ফর্সা লোকটা আমাকে আটকাতে চাইলেও খোকা লোকটা আমাকে অত গুরুত্ব দিল না। আমি ছুটতে ছুটতে মণীন্দ্রবাবুর কাছে বলতে গেলাম পুরো ঘটনাটা। বলে যখন আবার ওইপথে ফিরচি, তখন দেখি খোকা আর ওই লোকটার সঙ্গে আরও দু-তিনটে গুন্ডা জড়ো হয়েছে। সবাই মিলে বেচারা পাগলাকে একটা ট্যাক্সিতে চাপিয়ে নিয়ে গরাণহাটা স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে যাচ্চে।’

‘ট্যাক্সির নম্বর মনে আছে?’ দূরের টেবিল থেকে সুনীল রায় প্রশ্ন ছুঁড়লেন।

অম্বিকা বলে দালালটার বোধ হয় কথায় কথায় জিভ কাটা একটা মুদ্রাদোষ। এবারেও সে জিভের প্রায় আধখানা বের করে বলল, ‘আজ্ঞে না স্যার। তালেগোলে মাতাটা একদম গুইলে গেচল, নম্বরের কতা মনেই ছিল না।’

যাক, অন্ধকারে ক্ষীণ হলেও তবু একটা আলোর দিশা পাওয়া গেল। এবার ওই মণীন্দ্রবাবু নামক লোকটিকে জেরা করতে হবে। পঞ্চাননবাবু মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে প্রথম প্রশ্নে ফিরে এলেন, ‘আচ্ছা, এই যে পাগলা বলে যাকে ডাকছিস, তার নাম তো বলছিস অতুলবাবু। এই অতুলবাবু সম্বন্ধে আর কী কী জানিস তুই?’

অম্বিকা বলল, ‘আজ্ঞে স্যার, ওই যে বললুম, অতুলবাবু আমাদের পাড়ার মেয়েদের গানের সঙ্গে তবলা বাজাত। গানটান-ও শেখাত। সরল সাধাসিধা লোক ছিল, কোনো গোলমালে কখনও জড়াতে দেখিনি।’

পঞ্চাননবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ”সেদিন কী করে বুঝলি, যে ওই লাশটা ওই অতুলবাবুরই? মুণ্ডু তো ছিল না।’

‘মুণ্ডু না থাকলেই বা, পাগলা যে খুব মদ খেত স্যার। প্রায়ই মাতাল হয়ে সোনাগাছির রাস্তার ধারের নর্দমাগুলোয় পড়ে থাকত আদুর গায়ে। আর ওর গায়ে যা লোম, তার ওপর হাতে বেলফুলের উল্কি, ও আমি দেখেই চিনেচি। সোনাগাছির সব মেয়েরাও চিনবে দেখলে।’ অম্বিকা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিল।

এরপর আর বসে থাকার কোনো মানে হয় না। পঞ্চানন ঘোষাল আর সুনীল রায় অম্বিকাকে ছেড়ে দিলেন, তারপর বেরিয়ে পড়লেন সোনাগাছির উদ্দেশ্যে। মণীন্দ্র পালের সঙ্গে কথা বলা খুবই দরকার।

অম্বিকা আগেই জানিয়েছিল, মণীন্দ্র পাল সোনাগাছি অঞ্চলের এক ব্যায়ামবীর। তার নিজস্ব আখড়াও রয়েছে সেখানে। তাই তাঁকে খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হল না। অম্বিকা যা বলেছিল, মণীন্দ্র পালও সেটাই বললেন।

তবে কিছু অতিরিক্ত কথা জানা গেল। মণীন্দ্র পাল বললেন, ‘খোকা বলে গুন্ডাটা পাগলাকে যখন শাসাচ্ছিল, আমি তখন নিরস্ত করছিলাম। বলছিলাম, ‘এবারকার মতো ওকে ছেড়ে দিন, ও আর ওই ভুল করবে না।’ তখন খোকা লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভুল করবে না? কাল রাতেও ও মলিনার ঘরে গিয়েছিল।’ আমি তখন বললাম, ‘আচ্ছা, আর কোনোদিনও যাবে না, এবারকার মতো ওকে মাফ করুন।’

মনীন্দ্র পাল একটু থেমে বললেন, ‘এ-তল্লাটে প্রায় সবাই আমায় মান্যিগন্যি করে। আমার কথায় ঠান্ডা হয়ে তখনকার মতো খোকা চলে গিয়েছিল। কিন্তু তার একটু পরেই অম্বিকা এসে খবর দিয়েছিল, ওরা নাকি আবার পাগলাকে ধরেছিল।’

ইনস্পেকটর সুনীল রায় বললেন, ‘এই পাগলা অর্থাৎ অতুলবাবু কি কারুর প্রেমে পড়েছিল? আপনি জানেন কিছু?’

মণীন্দ্র পাল মাথা নাড়লেন, ‘অতুল ছেলেটা ভালো বংশের ছেলে ছিল। ওর বাড়ি ছিল যশোরে। ওখানে ওর ভাই নাকি ডাক্তার। কিন্তু অতুল কচিবয়সে বখে যায়, গানবাজনার চক্করে চলে আসে এই তল্লাটে। আপনভোলা লোক ছিল, তবলা নিয়ে থাকত, তাই লোকে ওকে পাগলা নাম দিয়েছিল। তবে চারিত্রিক গোলমাল কখনও কিছু দেখিনি। আসলে এ-পাড়ার মেয়েরা বেবুশ্যে হলেও গানের মাস্টারকে গুরু মানে, তাই গুরুর সাথে এরা বেচাল কিছু করে না। পাগলা ভোলাভালা আমুদে লোক ছিল, মেয়েরা ওকে সবাই ভালবাসত।’

‘আর ওই যে মলিনার নাম করলেন, সে কি এই পাড়ারই কোনো মেয়ে?’

‘হ্যাঁ। মলিনা এ-পাড়ারই এক বেশ্যা। সম্প্রতি সিনেমাতেও নেমেছে। ওর বাড়ি ইমামবক্স থানাদার লেনে।’ মণীন্দ্রবাবু একটু থেমে মাথা নাড়লেন, ‘হতে পারে, পাগলা হয়তো ওর প্রেমে পড়েছিল। তাতে আমি কোনো অন্যায় দেখি না।’

‘এই যে খোকা বলে গুন্ডাটা, একে কি আপনি চিনতেন আগে থেকে?’ পঞ্চাননবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

”চিনি বলতে এইটুকুই জানি যে খোকা একটা দাগি জেলপালানো গুন্ডা। পুলিশের নজর এড়িয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এই পাড়াতে রাতবিরেতে তার ভালোই যাতায়াত আছে।’

‘কার ঘরে যাতায়াত আছে বলতে পারবেন?’

‘দেখুন, এখানকার মেয়েদের ঘরের খবর আমি রাখি না।’ মণীন্দ্র পাল এবার হাসলেন, ‘তবে আমার আখড়ার ছেলেরা বা আমি নিজে যতটা সম্ভব এখানকার মেয়েদের সাহায্য করি। অনেক বাজে লোক পয়সা দিতে চায় না বা অন্যরকম জুলুম করে, তখন আমরা গিয়ে তাদের শায়েস্তা করি। এইজন্য আমাকে সবাই এখানে বেশ সমীহ করে চলে। তাদের মুখেই শুনেছিলাম পাগলা নাকি ট্যাক্সিতে ওঠার আগে একবার আশ্রয় চেয়েছিল ‘নাকি-বীণা’র বাড়িতে। কিন্তু খোকার ভয়ে নাকি-বীণা তাকে আশ্রয় দেয়নি, উলটে চাকর দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এখনও অবশ্য ও পুলিশের ভয়ে এসব নাও স্বীকার করতে পারে।’

‘নাকি-বীণা কে?’

‘এখানকারই একটা মেয়ে। বীণা নাম। কিন্তু তার নাকটা খুব টিকলো, তাই তাকে ‘নাকি-বীণা’ নামে ডাকা হয়।’ মণীন্দ্রবাবু সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন পরবর্তী প্রশ্নটা কী হতে চলেছে, তাই আগে থেকেই বলে দিলেন, ‘ঠিকানা ২ নম্বর নীলমণি স্ট্রিট।’

দুই পুলিশ অফিসার পরামর্শ করতে করতে থানায় ফিরলেন। তদন্তে দুটো মেয়ের নাম উঠে আসছে যারা এই ‘খোকা’ নামক গুন্ডাকে চেনে। মলিনা আর নাকি-বীণা। মলিনার সঙ্গে পাগলার ঘনিষ্ঠতায় খোকা পাগলাকে শাসাচ্ছিল। অন্যদিকে পাগলা খোকার হাত থেকে বাঁচতে ঠাই পেতে চেয়েছিল নাকি-বীণার কাছে।

ঠিক হল, আগে এই দু-জনকে জেরা করতে হবে। তাও কৌশলে।

পরেরদিন থানায় এসে সুনীল রায় চিন্তিতমুখে বললেন, ‘খোকা যদি জেলপালানো গুন্ডা হয়, তবে তো আমাদের কাছে রেকর্ড থাকবেই তার। কিন্তু কাল খবর নিলাম, এরকম কোনো নাম তো পুলিশি রেকর্ডে পাওয়া যায়নি পঞ্চাননবাবু!’

পঞ্চানন ঘোষাল বললেন, ‘এও হতে পারে, খোকা অন্য নামে জেল খেটেছে।’

‘হ্যাঁ। তা পারে।’ মাথা নাড়লেন সুনীল রায়, ‘সেইজন্য আগে ওই মেয়ে দুটোকে আমাদের জেরা করা দরকার।’

দুই নম্বর নীলমণি স্ট্রিটের বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালে প্রথমেই থ হয়ে যেতে হয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, রূপোপজীবিকার বাড়বাড়ন্তের ফলে সোনাগাছি অঞ্চলে বড়ো বাড়ির অভাব নেই। বরং যেকোনো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলে দু-পাশেই বড়ো বড়ো দোতলা তিনতলা বাড়ি চোখে পড়বে।

কিন্তু এই বাড়িটা যেন আয়তনে, রঙে, কায়দায় সবাইকেই টেক্কা দেয়। লাল রঙের ওপর সবুজ রঙের সূক্ষ্ম গ্রিলের কারুকার্য, বাইরের রোয়াকটা পর্যন্ত দামি মার্বেল পাথরে বাঁধানো। একপাশ দিয়ে চলে গিয়েছে গাড়ি বারান্দা। সেখানে দাঁড় করানো রয়েছে দুধসাদা একটা ফিটন।

দোতলার বারান্দায় দুলছে নানারকমের ছোটো-বড়ো পাখির খাঁচা। তার মধ্যে বসে কিচিরমিচির করে চলেছে দেশ বিদেশের নানারকমের পাখি। গোটা বারান্দাটাই অবশ্য জালি কাটা ডিজাইন করা।

বোঝাই যাচ্ছে নাকি-বীণার উপার্জন রীতিমতো ঈর্ষণীয়।

একটু মনোযোগ দিয়ে কান পাতলে শোনা যায়, ওপরের তলা থেকে ভেসে আসছে একটা সুরেলা মহিলা কণ্ঠ,

যদি চলিলে মুরারেই, ত্যেজে ব্রজপুরী

ব্রজনারী কোথা রেখে যাও।

জীবন উপায় বলে দাও।

ইনস্পেকটর সুনীল রায় আবার সংগীতের পরম ভক্ত। তিনি চোখ বুজে গানটা শুনতে শুনতে বললেন, ‘আহা! খাসা গাইছে। কার গান বলুন তো পঞ্চাননবাবু?’

‘বলতে পারব না।’ পঞ্চাননবাবু স্মিত কণ্ঠে বললেন, ‘এই ব্যাপারে আমি নিতান্তই অজ্ঞ সুনীলবাবু!’

‘হরু ঠাকুর। হরু ঠাকুরের বিখ্যাত কবিগান।’

পঞ্চাননবাবু বললেন, ‘তিনি আবার কে! আপনি তো জানেনই, এইসব গানবাজনার ব্যাপারে আমি একেবারেই অজ্ঞ।’

সুনীলবাবু আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘সেকি মশাই। হরু ঠাকুরের নাম শোনেননি? হরেকৃষ্ণ দীঘাড়ী। নামকরা কবিয়াল ছিলেন। তাঁর এমন অনেক কবিগান আছে।’

‘অ!’

‘আহা!’ সুনীল চোখ বুজে ফেললেন, ‘হতে পারে বেশ্যা, কিন্তু বড়ো দরদ দিয়ে গাইছে গো মেয়েটা।’

‘তা দরদ দেখার জন্য ভেতরে যাবেন, নাকি এখান থেকেই শুনবেন?’

পঞ্চাননবাবুর রসিকতায় এবার সামান্য লজ্জিত হয়ে সুনীল পা বাড়ালেন ভেতরের দিকে।

বাইরের রাস্তায় তখন অনেক বাবু হেঁটে চলেছেন। তাঁরা কেউ হয়তো উকিল, কেউ অধ্যাপক, কেউ লেখক, কিন্তু এই পাড়ায় তাঁদের একটাই পরিচয়। তাঁরা খদ্দের।

১৮৮৫ সালে প্রিয়নাথ পালিত তাঁর ‘টাইটেল দর্পণ’-এ এঁদের নিয়েই লিখেছিলেন —

বেশ্যাবাড়ী ছড়ি ঘড়ি বিকেলে ফিটন গাড়ি
দিবানিশি ভাস লাল জলে
 গান বাদ্য কর সার মাছ ধর রবিবার
চুল কাট অ্যালবার্ট ফ্যাসনে
 বড়লোক বলি তবে ঘুচিবে সুখ্যাতি সবে
সার কথা দীনবন্ধু ভণে।

সুনীল আর পঞ্চাননও আজ সেভাবেই সেজে এসেছেন। দু-জনেরই পরনে শান্তিপুরী ধুতি আর পাঞ্জাবি। গায়ে বেশ করে আতর ঢেলেছেন দু-জনে, ধুতির কোঁচা টেনে নিয়ে ধরে আছেন এক হাতের মুঠোয়। চুলে সুগন্ধি তেলের গন্ধ ভুরভুর করছে, মুখে রয়েছে এক খিলি করে পান। হাতে ধরা একখানা করে ছড়ি।

গাড়িবারান্দায় এসে দাঁড়ানো মাত্রই দুটো ভৃত্য গামছা কাঁধে ছুটে এল, ‘আসুন বাবুরা, এদিকে আসেন আজ্ঞে …।’

কিছু না বলতেই দু-জনকে ভৃত্য দুটো নিয়ে চলে এল একতলার এক বিশাল বৈঠকখানায়। বৈঠকখানা না বলে অবশ্য গান-বাজনা জলসার ঘর বলাই ভালো। গোটা ঘরেতেই মোটা মোটা গদি পাতা, আর কোণেতে তানপুরা, তবলা রাখা। সুনীল আর পঞ্চানন বসতে না বসতে একজন ভৃত্য লম্বা দুটো গ্লাসে করে ঠান্ডা ঘোলের শরবত নিয়ে এল, ‘এই নিন, খেয়ে প্রাণটা এট্টু জুড়িয়ে নিন…।’

সুনীল আর পঞ্চানন কথা না বাড়িয়ে শরবৎটা খেয়ে নিলেন, তারপর মুখ মুছে পঞ্চানন বললেন, ‘আমরা আসছি অনেক দূর … সেই বর্ধমান থেকে। এটাই কি নাকি-বীণার বাড়ি?’

‘হ্যাঁবাবু।’ ভৃত্য বলল, ‘আপনারা সেই বর্ধমান থেকে আসচেন?’

‘হ্যাঁ। তোমার মালকিনের এত সুনাম শুনি যে থাকতে পারলুম না। ওখান থেকে ছুটে এলুম!’ পঞ্চাননবাবু বেমালুম বলে চললেন, ‘তা দেখা হবে তো উনার সাথে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁবাবু। আপনারা অ্যাত দূর থেকে এয়েচেন, আর দ্যাকা হবে না তা কি হয়?’ ভৃত্য বিগলিতকণ্ঠে বলল, ‘তবে কিনা, এখন তো জমিদারবাবু এয়েচেন, এট্টু বসতে হবে আজ্ঞে!’

‘সে ঠিক আছে। তুমি এক কাজ করো দিকি, এই নাও, দুটো পান সেজে নিয়ে এসো। বাকিটা তোমার বখশিশ।’ সুনীলবাবু দশটা টাকা ভৃত্যের হাতে দিয়ে চারদিক জরিপ করতে করতে বললেন, ‘গেল হপ্তায় এ-বাড়িতে কারা নাকি এসে পাগলা মাস্টারকে ধরে নিয়ে গ্যাছে?’

দুটো পানের দাম বড়োজোর চার চার আনা। তার জন্য দশ টাকার একটা কড়কড়ে নোট পেয়ে ভৃত্যটির মুখ-চোখ পালটে গিয়েছিল, পাশে পড়ে থাকা হাতপাখাটা টেনে নিয়ে জোরে জোরে বাতাস করতে শুরু করেছিল দুই বাবুকে, কিন্তু সুনীলবাবুর শেষ প্রশ্নে একটু অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি কি করে জানলেন সে-কতা বাবু?’

‘আরে, আমরা তোমার মালকিনের কাছে এই প্রথমবার আসছি বলে কি সোনাগাছিতেও নতুন আসছি নাকি হে!’ সুনীলবাবু বললেন, ‘ফি হপ্তাতেই তো আসি। ও-পাড়ার বাসন্তীর কাছে। হিংসুটে মেয়েমানুষ যেমন হয়, অ্যাদ্দিন নাকি-বীণার নামই বাসন্তী বলেনি, পাছে খদ্দের এদিকে চলে আসে। সেদিনই এই কথা বলতে বলতে বলে ফেলল। সত্যি নাকি?’

‘আর বলবেন না বাবু!’ ভৃত্য চোখ বড়োবড়ো করে ফেলল, ‘সে কি কাণ্ড! সেদিন সন্ধেবেলা আমি তেতলার রসুইঘরে রাঁধছি, এমন সময় নীচে খুব শোরগোল। ছুটে নেমে এসে দেখি, তবলা বাজানো পাগলা মাস্টার আমাদের দিদিমণির পা জড়িয়ে ধরে চেঁচাচ্ছে, বলছে, ‘ওরে বীণা, আমাকে বাঁচা! ওরা আমাকে কেটে ফেলবে।’ ওদিকে আট-ন-টা ষণ্ডা চেহারার লোক ঘরে ঢুকে পড়েচে, তারা ভীষণ চোখে তাকিয়ে আচে পাগলা মাস্টারের দিকে।’

‘পাগলা মাস্টার এ-বড়িতে প্রায়ই আসত বুঝি?’ পঞ্চানন বললেন, ‘ওই বাসন্তীর কাছেও যেত দেখতুম।’

‘সে তো দেখবেনই, বেবুশ্যেপাড়ার সব বাড়িতেই তো পাগলা মাস্টার তবলা বাজাত।’ ভৃত্য বলল, ‘এট্টু বেশি বকত বটে, কিন্তু মাস্টার লোক ভালো ছিল। টাকার খাঁই ছিল না, যে যা দিত, তাতেই খুশী হয়ে যেত। আমাদের দিদিমণিকে খুব ভালও বাসত। কিন্তু, সেদিন দিদিমণি মোটেই মাস্টারকে বাঁচালেন না। উলটে একভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন, গুন্ডাগুলো এসে মাস্টারকে টেনে হিঁচড়ে বাড়ির সামনে দাঁড়ানো একটা ট্যাক্সিতে উঠিয়ে চলে গেল।’ ভৃত্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ”তারপরেই তো শুনি পাগলা মাস্টার খুন হয়েচে।’

‘কার সঙ্গে অ্যাত পেয়ারের কথা কইচিস বিশে?’ বলতে বলতে ঘরে প্রবেশ করল চব্বিশ পঁচিশ বছরের এক তরুণী। বেশ সুন্দরী ও তন্বী। তার উন্নত নাক দেখে একনজরে বলে দেওয়া যায়, সে-ই প্রখ্যাত নাকি-বীণা।

বীণা ভ্রূ কুঞ্চিত করে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই সুনীলবাবু উঠে গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘নমস্কার। শ্যামপুকুর থানা থেকে আসছি। গানের মাস্টার অতুল ঘোষ খুন হয়েছে শুনেছ নিশ্চয়ই? ৪ সেপ্টেম্বর রাতে সে তোমার কাছে আশ্রয় নিতে এসেছিল, তাই তো? তুমি আশ্রয় দাওনি কেন?’

বিশে নামক ভৃত্যটি সুনীলবাবুদের এই পরিচয় শুনে ভয়ার্ত চোখে মালকিনের দিকে তাকাল। সে সম্ভবত কল্পনাও করতে পারেনি, বাবুদের ছদ্মবেশে পুলিশ এ-বাড়িতে হানা দিতে পারে।

বীণা চমকাল, কিন্তু ভড়কে গেল না। সে সাতঘাটের জল খাওয়া মেয়ে, কিছুটা ঘরে প্রবেশ করার সময় শুনতে পাওয়া বিশের বক্তব্য আর বাকিটা নিজস্ব বুদ্ধিমত্তায় সে বুঝে ফেলল, ভৃত্যের অত্যুৎসাহে তার এখন আর কিছুই লুকনোর জো নেই।

সে শান্তগলায় বলল, ‘কী করে আশ্রয় দেব বলুন? খোকাবাবুকে চটিয়ে এই পাড়ায় কেউ রাত্রিবাস করতে পেরেচে? না কারুর সেই সাহস আচে? মাস্টারকে আমার ঘরে থাকতে দিলে সেদিন রাতেই খোকাবাবু আমার গলা কেটে রেকে যেতেন। তকন কি আপনারা এসে পাহারা দিতেন?’

পঞ্চানন বললেন, ‘কোথায় থাকে খোকাবাবু?’

‘তিনি কি একজায়গায় থাকার মানুষ যে আমি জানব তিনি কোতায় থাকেন? মাঝে মাঝে এদিকে আসেন, মলিনার ঘরে থাকেন, আবার ফুড়ুৎ করে চলে যান। মলিনা আবার অ্যাক্টো করচে এখন, বাড়ি থাকে না সবসময়, তাই খোকাবাবুও আসা কমিয়ে দিয়েচেন শুনেচি।’ বীণা এক নিশ্বাসে বলে গেল।

এরপর আর সময় নষ্ট করলে এখান থেকেই মলিনার কাছে সাবধান হওয়ার খবর চলে যেতে পারে।

সোনাগাছি এক বিচিত্র জায়গা। সন্ধ্যে হলেই এখানকার চেহারা পালটে যায়। তখন রাস্তায় পিঁপড়ের মতো থিকথিক করতে থাকে দালাল, খদ্দের আর বারাঙ্গনা মেয়েরা।

কলকাতার বৃহত্তম গণিকাপল্লির নাম সোনাগাছি হলেও শুধু সোনাগাছি অঞ্চলেই গণিকাদের বাস সীমাবদ্ধ ছিল না। সোনাগাছি, নাথের বাগান, রামবাগান, বাগবাজার, জোড়াবাগান, শেঠবাগান, গরাণহাটা, চোরবাগান, তালতলা, কলুটোলা, জানবাজার, টেরিটিবাজার, ইময়ামবাড়ি লেন ইত্যাদি স্থানে হাজার হাজার গণিকার বাস ছিল সেইসময়। অন্যান্য অঞ্চলের বারবনিতাদের তুলনায় ছলাকলা ও পারদর্শিতায় তারা ছিল অনেক এগিয়ে। তাদের নিয়ে রয়েছে বাউল গানও —

কলিকাতার বেশ্যাদের লীলা অতি চমৎকার
মায়া বোঝে সাধ্য কার
হাটখোলায় আছে যারা বলি তাদের ধারা
কাপড় পরে রাস্তার ধারে নেয় বাহার তারা।
আবার সোনাগাছি থাকে যারা কশায়ের মতো ব্যাভার।
তাইতে বলছে হরি বিনয় করি বেড়াও হয়ে হুঁশিয়ার।

এমন চতুর যে গণিকারা, তাদেরকে জেরা করার সময় সামান্য অন্যমনস্কতা বা দেরিতে অনেক বড়ো ভুল হয়ে যেতে পারে। তাই নাকি-বীণার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যত দ্রুত সম্ভব সুনীল আর পঞ্চানন পৌঁছলেন ৩২ নম্বর ইমামবক্স থানাদার লেনে মলিনার বাড়ি।

কিন্তু মলিনাসুন্দরীকে তার বাড়িতে পাওয়া গেল না। শুধু তাই নয়, তার বাড়ির প্রতিটা ভৃত্য পর্যন্ত ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে ছিল। কোনো কারণে তাদের সবাইকে এমনভাবে ভয় দেখিয়ে রাখা আছে, যে পুলিশের হাজার জেরাতেও তাদের কাছ থেকে বিশেষ কিছু জানা গেল না।

এমন যখন অবস্থা, পাঁচু বলে পুলিশের একজন ইনফরমার, যে এই পাড়াতেই থাকে, ছুটে এসে পঞ্চাননবাবুর কানে কানে বলল, ‘হুজুর, এখানে চাকরবাকরদের সঙ্গে বেশি সময় নষ্ট করবেন নাকো! মলিনার মা ওদিকে বাড়ির খিড়কি দিয়ে মেয়ের কাছে পোঁটলা-পুটলি বেঁধে পালাচ্ছে।’

শোনামাত্র সুনীল ও পঞ্চানন কনস্টেবলদের নিয়ে ছুটলেন বাড়ির পেছনদিকে। পাঁচুর সংবাদ একেবারে সঠিক। আর একটু দেরি হলেই মহিলা পগারপার হয়ে যেত। কিন্তু কনস্টেবলরা গিয়ে তাকে এমনভাবে চারদিক থেকে ঘিরে ধরল, সে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়ল।

পঞ্চানন ঘোষাল এগিয়ে এলেন। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এই মহিলা দাগি অপরাধী নয়। এই ধরনের মানুষ গোপনে কাজ করতে গেলেই এমনিতেই ভড়কে থাকে। পুলিশের কাজ হল সেই ভড়কে যাওয়াকে কাজে লাগিয়ে কথা বের করা।

পঞ্চানন ঘোষাল বেশ উঁচু গলায় বললেন, ‘মলিনাদেবীর গয়নাগাটি নিয়ে পালানো হচ্ছে, অ্যাঁ? অ্যাই, একে গ্রেফতার করো, শিগগির। জেলে গিয়ে দু-ঘা দিলেই টের পাবে।’

প্রৌঢ়া মহিলার মুখ এই কথা শুনে সাদা হয়ে গেল। সে চেঁচিয়ে মেচিয়ে কান্না জুড়ে দিল, ‘ওমা, একী কতা কইচেন আপনারা। মলিনা আমার নিজের মেয়্যা, আমি কিনা তার গয়নাগাটি, কাপড়চোপড় তার কাছে পৌঁছে দিতে যাচ্চি, আর আপনারা আমাকে চোর ঠাউরালেন? হায় হায় এ কি কতা গা!’

পঞ্চানন ঘোষাল একইরকম কড়া গলায় বললেন, ‘মলিনা তোমার নিজের মেয়ে? মিথ্যে কথা বলার জায়গা পাওনি?’

মহিলা এবার ভয়ে কাঁপতে শুরু করল, ‘না, নিজের মেয়্যা নয়, কিন্তু আমিই তো ওকে ছোটো থেকে মানুষ করেচি, তারপর হাত ধরে এই ব্যবসায় নামিয়েচি, নাকি? এই সরোজিনী দাসী না থাকলে একানে এত তাড়াতাড়ি ও জেঁকে বসতে পারত? নর্দমার ধারে পড়েচিল, কে ওকে কুড়িয়ে এনেচিল শুনি? পেটে নাই বা ধরলাম, মলিনার মা আমি ছাড়া কেউ নয়।’

‘আচ্ছা।’ পঞ্চানন ঘোষাল এবার কিছুটা নরম হলেন, ‘তা তোমার মেয়ে রয়েছে কোথায়? আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারবে?’

সরোজিনী বলল, ‘কেন পারব না? আমি উত্তরপাড়ায় যে বাড়িতে ভাড়া থাকি, মেয়্যা আজ ক-দিন হল ওকানেই রয়েচে। আমাকে আজ সকালে বলল, যাও তো মা, গিয়ে আমার সব নিয়ে এসো। তাই তো আমি এলুম গো।’

পঞ্চানন আর সুনীল দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। সুনীল কনস্টেবলদের নিয়ে ফেরত চলে গেলেন থানায়, সেখানে এই ‘খোকাগুন্ডা’টির আসল নাম বের করা খুবই জরুরি।

অন্যদিকে সরোজিনীকে নিয়ে পঞ্চানন গাড়িতে রওনা দিলেন উত্তরপাড়ায়।

যেতে যেতে সরোজিনীর কাছ থেকে গল্পচ্ছলে আরও কিছু তথ্য বের করা গেল। মেয়ের এখন বাঁধা বাবু কে তা সে জানে না, তবে একটা লোক মেয়েকে উত্তরপাড়ায় তার কাছে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল, তাকে দেখলেই সরোজিনী চিনতে পারবে। তার ধারণা মলিনার বাবুটি বেশ ধনী কারণ গত কয়েক মাস হল মলিনা তার মায়ের হাতখরচ বেশ অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে।

পঞ্চানন জিজ্ঞেস করলেন, ‘পাগলা বলে কাউকে চেনো তুমি?’

সরোজিনী বলল, ‘ওই গানের মাস্টার তো? চিনব না? যকনই একানে আসি, তকনই দেখি তো সে তবলা বাজাচ্চে। আহা, খাসা হাত ছেলেটার। তবে এই ক-দিন দেকিনি আসতে!’

উত্তরপাড়ার বাড়িতে পৌঁছতে খুব বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। মলিনা নামক চলচ্চিত্রের অভিনেত্রীটি যে শুধু বাড়িতেই ছিল তাই নয়, একেবারে সদর দালানে পা ছড়িয়ে বসে সে কিছু চিন্তা করছিল।

মলিনাসুন্দরী দাসী প্রকৃত সুন্দরী। কাঁচা হলুদের মতো তার গায়ের রং, চোখদুটো টানা, ভ্রু-দুটো ধনুকের মতো বাঁকানো। দোহারা গড়ন, গড়পড়তা বাঙ্গালি মেয়েদের তুলনায় উচ্চতাও তার অনেকটা বেশি। এক পা মাটিতে বেঁকিয়ে রেখে অন্য পা হাঁটু পর্যন্ত মুড়ে বসে সে নিজের মনে গান গাইছিল,

সই লো, ভাতারে সুখ হল না
গলা ধরে গলিয়ে দিবি দেখিয়ে রসের গলি
কত ব্যাটা গুণ গেয়ে বেড়াবে গলি গলি …।

গান গাইতে গাইতে দরজার দিকে তাকিয়ে সে চমকে উঠল। সরোজিনীর সঙ্গে বাবুর বেশে পঞ্চানন ঘোষালকে ঢুকতে দেখে সে প্রথমে কিছু বুঝতে পারল না। তারপর খনখনে ভাষায় চিৎকার করে উঠল, ‘মা তুমি সোনাগাছি থেকে বাবু ধরে নিয়ে এলে একানে? তোমার কি মাতা খারাপ হয়েছে নাকি গা? খোকাবাবু এসে পড়লে আমাকে কেটে ফেলবে এক্কেরে …!’

পঞ্চানন ঘোষাল সরোজিনীকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না। তার আগেই এগিয়ে এসে নিজের পরিচয়পত্র উঁচু করে তুলে ধরে বললেন, ‘মলিনা, আমি লালবাজার থেকে আসছি, পুলিশের লোক। খোকাবাবু সম্পর্কে তোমার থেকে কিছু জানতে চাই। সত্যি কথা বলবে, নাহলে তোমারই কপালে দুর্ভোগ আছে।’

‘পুলিশ!’ মলিনার মুখটা পার্চমেন্ট কাগজের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ও তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ক-কি বলুন?’

‘খোকাবাবু কে? তোমার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক?’ পঞ্চানন একটুও না থেমে কড়া গলায় প্রশ্ন করলেন।

মলিনা একটু থেমে বলল, ‘তিনি আমার বাবু। মাস ছয়েক হল তিনি আমাকে বাঁধা রেকেচেন।’

‘কি করেন খোকাবাবু?’ পঞ্চানন জিজ্ঞেস করলেন।

মলিনা দু-পাশে মাথা নাড়ল, ‘তা তো জানিনা। মাঝে মাঝে আসেন, আবার উধাও হয়ে যান। তিনি নিজে থেকে কোনোদিন কিচু বলেননি, আমিও শুধোইনি। আগে রোজ গতর খাটিয়ে গোটা মাসে যা পেতাম, উনি তা একাই আমাকে দিচ্চেন, তার ওপর আদ্দেক দিন আসেন না। আমি এতেই খুশী। কী করেন, কোতায় থাকেন, অত জেনে আমি কী করবো?’

পঞ্চাননবাবু ভ্রূ কুঁচকলেন। মলিনা কিছু লুকোছে কিনা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে যতক্ষণ সম্ভব কথা চালিয়ে যেতে হবে। একটু বেচাল হলেই মিথ্যেটা ধরতে পারা যাবে।

তিনি বললেন, ‘খোকাবাবু তোমায় কত টাকা করে দেন?’

‘বারো-শো টাকা।’ টাকার অঙ্কটা বলার সময় মলিনার গলা দিয়ে প্রচ্ছন্ন অহংকার ঝরে পড়ল, ‘অ্যাক্টোতেও সারাদিন খেটে দিনে পনেরো টাকার বেশি দেয় না। সেখানে বাড়ি বসে বসে চল্লিশ টাকা রোজ পাই। খোকাবাবুর মতো লোক হয়না হুজুর!’

‘সে বুঝতেই পারছি। আর পাগলা মাস্টার?’

মলিনার চোখ দুটো কেমন যেন চমকে উঠল, স্পষ্ট লক্ষ্য করলেন পঞ্চানন।

দ্রুত নিজেকে সামলাতে সামলাতে মলিনা বলল, ‘গানের মাস্টার অতুলবাবুর কতা বলচেন আপনি? সে তো ভালোই, আমার গানের সাথে তবলা বাজাত। এর বেশি আমি কী বলব!’

পঞ্চাননবাবুর কী মনে হল, হঠাৎ বললেন, ‘তুমি কি জানো, তোমার খোকাবাবু পাগলাকে খুন করে পালিয়েছে?’

এই কথাটা বলা মাত্র মলিনা চমকে তাকালো পঞ্চাননবাবুর দিকে। তার চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে গেছে। অবিশ্বাসে ঠোঁটদুটো কাঁপছে তিরতির করে। কোনোমতে সে বলতে পারল, ‘কি বলচেন! পাগলা মাস্টার খুন হয়েচে?’

তারপরই সে অস্ফুট আর্তনাদ করে পড়ে গেল মাটিতে। সরোজিনি ছুটে এল, ‘ওমা, ওকি হল গা, কি হল মলু, মাতা ঘুরচে?’

পঞ্চাননবাবু ভ্রূ কুঁচকলেন। পাগলার খুন হওয়ার কথা শুনে মলিনার অজ্ঞান হয়ে যাওয়াটা একটু আশ্চর্যের।

মনে রাখতে হবে, মলিনাসুন্দরী ছিল সোনাগাছির ঘাগি বেশ্যা আর সেই সময় পতিতা পল্লীর মেয়েদের কাছে খুন-জখম, রাহাজানি এগুলো বেশ স্বাভাবিক ব্যাপার।

এই পঞ্চানন ঘোষালই পরবর্তীক্ষেত্রে লিখেছিলেন, ‘অপরাধীদের সহিত বেশ্যাদের সম্বন্ধ চিরন্তন ও শাশ্বত যুগের। বেশ্যা ভিন্ন প্রকৃত অপরাধীদের একদিনও চলেনা। অভ্যাস-অপরাধীরা সাধারণত অভ্যাস-বেশ্যার সহিত এবং স্বভাব-অপরাধীরা সাধারণত স্বভাব-বেশ্যাদের সহিত বাস করে। এই শেষোক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে নৈতিক এবং দৈহিক অসাড়তা অত্যধিকরূপে পরিদৃষ্ট হয়।’

পুরোনোদিনের ‘সমাচার দর্পণ’, ‘বেঙ্গল গেজেট’, ‘সম্বাদ ভাস্কর’ ইত্যাদি পত্রিকা ঘাঁটলে বোঝা যায়, সে সময়ে সোনাগাছিতে হত্যা ছিল প্রায় দৈনন্দিন ব্যাপার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রেমঘটিত ঈর্ষায় খুন হত বেশ্যারা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, হত্যাকারীর শাস্তি হওয়া তো দূর, সাধারণ মানুষের সহানুভূতি পর্যন্ত পায়নি খুন হওয়া মেয়েগুলো।

এই প্রসঙ্গে অখিলচন্দ্র দত্ত লিখেছিলেন, ‘সোনাগাছির এক পতিতাকে খুন করে ধরা পড়ার পর অপরাধী লোকটি ভয় পাওয়া তো দূর, ডেপুটি পুলিশ কমিশনার ল্যাম্বার্ট সাহেবের সঙ্গে রঙ্গ করতে করতে থানায় যাচ্ছে:

হতভাগ্য আসামির হাতকড়া হাতে
রয়েছে উড়ানি গায় দেখেছি সাক্ষাতে।
 কৃষ্ণবর্ণ কলেবর দোহারা শরীর
মুখেতে দু-চারি দাগ আছয়ে গুটির
 বয়স বছর ত্রিশ হয় অনুমান
ল্যাম্বার্টের সঙ্গে রঙ্গে করিছে পয়ান।

এইরকম যখন অবস্থা, তখন মলিনাসুন্দরীর মতো বেশ্যার পক্ষে কেউ খুন হয়েছে শুনে এতটা ভেঙে পড়াটা কিছুটা অস্বাভাবিক ছিল বৈকি।

কিছুক্ষণ জলের ছিটে দেওয়ার পর মলিনার জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান আসতেই সে থেবড়ে বসে পড়ল মাটিতে। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে তার চোখমুখ। তার সুন্দর পানপাতার মতো মুখটা দু-হাতে ঢেকে থরথর করে কেঁপে উঠছে সে।

পঞ্চাননবাবু তো বটেই, তার মা সরোজিনীও কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সরোজিনী দু-একবার বলতে গেল, ‘পাগলা মরেচে তো এমন করে কাঁদচিস কেন লা! হ্যাঁ, লোকটা মন্দ ছিল না, কিন্তু তারজন্য অ্যাত চোকের জল ফেলার কি আচে, আমি তো বুঝচি না বাপু!’

মলিনা তার মায়ের কথার কোনো উত্তর দিল না। বেশ কিছুক্ষণ পর মুখ থেকে দু-হাত সরাল সে। তার চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। ধরা গলায় সে বলল, ‘আপনি খোকাবাবুকে খুঁজে বের করুন হুজুর। ও যেন কিচুতেই পালাতে না পারে। পাগলার মতো মানুষকে যে মারে, তার যেন নরকে ঠাই হয়!’

মলিনা একটু আগেই বলছিল, খোকাবাবুর মতো মানুষ হয়না, আবার এখনই তার সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলছে।

এইজন্যই বলে, স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যা! মনে মনে ভাবলেন পঞ্চানন।

মুখে বললেন, ‘শান্ত হও মলিনা। আগে তুমি যা জানো, আমাকে সব খুলে বল।’ তারপর একটু গলা নামিয়ে নরম গলায় বললেন, ‘খোকাবাবু বুঝি পাগলার সঙ্গে তোমার মেলামেশা পছন্দ করতেন না?’

নরম কথায় কাজ হল। মলিনা এবার কান্নায় ভেঙে পড়ে বলতে শুরু করল, ‘আমি যে বেবুশ্যে, আমার আবার নিজের পচন্দের দাম কি? খোকাবাবুর রাঁড় চিলাম হুজুর! নিজের রাঁড় অন্যের সাথে মেলামেশা করবে, সেটা কেউ দেকতে পারে? কিন্তু আমার পাগলা তেমন ছিল না বিশ্বেস করুন। কোনোদিনও ও খোকাবাবুর সামনে তো দূর, আর কারুর সামনেও বেচাল কিচু করেনি। শুদু সে আমায় বড়ো ভালবাসত!’

‘পাগলা খুন হয় ৪ সেপ্টেম্বর রাতে। তারপর খোকাবাবু তোমার কাছে কি এসেছিল?’

মলিনা এবার একটু শান্ত হয়ে বলল, ‘খোকাবাবু ৫ তারিখ ভোরবেলা হঠাৎ আমার ইমামবক্স থানাদার লেনের বাড়িতে হাজির হয়েচিলেন। এসেই আমাকে বললেন, মলু, তৈরি হয়ে নে। আমি বললাম, তৈরি হব মানে? কোতায় যাব? খোকাবাবু বললেন উনি দু-মাসের জন্য বিদেশে যাবেন। আমি বললুম, তা আপনি যাবেন তো আমার কি, আমায় তো নিয়ে যাবেন না, আমি তৈরি হব ক্যান? তকন উনি চোখ পাকিয়ে বললেন, এহ, খুব শখ মাগির, না? আমি থাকব না, আর তুই মক্ষীরানি হয়ে সোনাগাছিতেই বসে থাকবি অন্য বাবু ধরার জন্য? ওসব হবে না, শিগগিরই বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে নে, তোকে তোর মা-র কাচে রেকে আমি ওকান থেকেই চলে যাব।’ মলিনা একটা লম্বা নিশ্বাস নিল, ‘একানে এসে আমাকে রেকেই খোকাবাবু চলে গ্যাচেন। সেই যে গ্যাচেন, আর এ-মুখো হননি কো! অ্যাতোদিন কোনো সন্দ হয়নি, কিন্তু অ্যাকন বুজচি, পাগলা খুন হয়েচে, সেটা যাতে আমি জানতে না পারি, সেইজন্যই আমাকে একানে রেকে গ্যাচে।’

পঞ্চাননবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তার সঙ্গে তখন কেউ ছিল?’

মলিনা শাড়ির আঁচল পাকাতে পাকাতে বলল, ‘না। তকন ছিল না। কিন্তু তার আগের দিন ছিল।’

‘আগের দিন মানে? যেদিন পাগলা খুন হয়, সেদিনও খোকা তোমার কাছে এসেছিল?’ পঞ্চানন আশ্চর্য হয়ে বললেন।

‘হ্যাঁ।’ মলিনা একটু ভেবে বলল, ‘চার তারিখ রাতের বেলা ঘরে বসে রেওয়াজ করছিলাম। এমন সময় কালী এল। কালী খোকাবাবুর সাকরেদ। ওকে আগেও খোকাবাবুর পেছন পেছন ঘুরতে দেকেচি। কালী আমাকে ওর সাথে যেতে বলল। খোকাবাবুর নাকি তেমনই হুকুম। আমি অগ্রাহ্যি করলুম না, খোকাবাবু আমাকে মাসে মাসে অ্যাতোগুলো করে টাকা দিচ্চেন, তিনি জাহান্নামে যেতে বললে আমি সেকেনেও যাব। তো, তাড়াতাড়ি সেজেগুজে নিয়ে কালীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লুম। ওমা! কালী দেকি আমাকে এ-গলি ও-গলি ঘুরিয়ে টুরিয়ে নিয়ে হাজির করল আমাদের সোনাগাছিরই ঊষা বলে একটা মেয়ের বাড়িতে। সে মেয়ে নেহাতই ফচকে, কিচুদিন হল এট্টু নাম করে বাড়িটা কিনেচে। আমি তো অবাক, রাগও হচ্চে, আমি হলেম গিয়ে ইমামবক্স লেনের মলিনা, বড়ো বড়ো রাজাউজির ডাকলে যাইনে, তারা এসে আমার পায়ে হত্যে দেয়। সেকেনে নিজে থেকে একটা দু-দিনের মেয়েছেলের বাড়িতে গিয়ে ওঠা আমার অপমান বই কী! যাইহোক, কী আর করব। চুপচাপ বসে আচি, অ্যামন সময় খোকাবাবু তাঁর বন্ধু কেষ্টবাবুকে নিয়ে হাজির হলেন।”

‘তখন কটা বাজে?’ পঞ্চানন প্রশ্ন করলেন মাঝপথে।

‘তা ধরুন দশটা।’ মলিনা হিসেব করে বলল, ‘তার এট্টু আগেই আরমানী গির্জের ঢং ঢং শুনতে পেয়েচিলাম।’

‘আচ্ছা।’ পঞ্চাননবাবু মনে মনে মলিনার স্মরণশক্তির তারিফ না করে পারলেন না। মেয়েটা হয়তো এত কিছু তাকে কখনোই বলত না, কিন্তু পাগলার মৃত্যু ওকে উত্তেজিত করে তুলেছে। দেহপসারিণী হলেও পাগলাকে মলিনা খুবই ভালোবাসত, তা বোঝা যাচ্ছে।

তিনি বললেন, ‘তারপর?’

‘তকন আমি দেকি, খোকাবাবুর নীল রঙের জামার ওপর একানে-ওকানে লাল ছোপ লেগে। আমি জিজ্ঞেস করলে খোকাবাবু ওগুলো পানের পিচ বলে কতা ঘুরিয়ে দিয়েচিল। তকনও বুজিনি ওগুলো আমার পাগলার রক্ত হুজুর!” মলিনা ডুকরে কেঁদে উঠল, ”তারপর কেষ্টবাবুকে নিয়ে উনি বেরিয়ে গেলেন। এলেন যকন, তকন প্রায় রাত দেড়টা-দুটো বাজে। তকন দেকি, খোকাবাবু ওই মাঝরাতে চান করেচে, করে মাতায় গন্দ-তেল দিয়েচে হুজুর। ছোপলাগা নীল জামাটাও পালটে ফেলেচে, পরেচে একটা নতুন পাটভাঙা জামা, ছাই রঙের।’

‘তখন কি ওর সঙ্গে কেষ্ট এসেছিল?’ পঞ্চানন জিজ্ঞাসা করলেন।

মলিনা মাথা নাড়ল, ‘নানা। তকন এসেচিল ভূপেনবাবু। যার বাড়িতে তকন বসেচিলুম, সেই ঊষারই বাঁধা বাবু তিনি। তারপর সারারাত মদ খাওয়া আর হইহুল্লোড় হল। ভোর হতে খোকাবাবু আমাকে বাড়ি নিয়ে এসে বললেন, তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরিয়েচে, অ্যাকন কিচুদিন তিনি গা-ঢাকা দিয়ে থাকবেন, তারপরই আমায় একানে রেকে গেলেন। তকন অ্যামন তাড়াহুড়োয় এসেচিলাম, আদ্দেক জিনিষই আনা হয়নি, তাই মা’কে পাঠিয়েচিলুম সেগুলো আনতে। কদ্দিন একানে থাকতে ওনার হুকুম হবে, তার তো ঠিক নেই।’

কলকাতা থেকে এতদূর উত্তরপাড়া ট্যাক্সি উজিয়ে আসতে হল বটে, কিন্তু আসাটা যে এতদূর সার্থক হবে, তা পঞ্চাননবাবু কল্পনাও করতে পারেননি। তিনি দেরি না করে যে ট্যাক্সিতে উত্তরপাড়া গিয়েছিলেন, সেই ট্যাক্সিতেই মলিনাকে নিয়ে কলকাতা ফিরে এলেন।

গোটা রাস্তা মলিনা একটা কথাও বলল না। কেবল মাঝে মাঝে নিজের মনেই বিড়বিড় করছিল আর ফুঁপিয়ে উঠছিল।

সোনাগাছিতে ঢোকার আগে শ্যামপুকুর থানা থেকে গাড়িতে উঠলেন ইনস্পেকটর সুনীলবাবু আর তিনজন কনস্টেবল।

মলিনা ঊষার বাড়ি চিনিয়ে দেওয়ামাত্র সবাই মিলে ঢুকে পড়লেন সেখানে। ভাগ্যক্রমে ঊষার বাবু ভূপেন তখন ঘরেই ছিল। বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ, পরনে ধপধপে ধুতি পাঞ্জাবি। সে নিতান্তই গোবেচারা লোক, তাকে তৎক্ষণাৎ গ্রেপ্তার করা হল, কিন্তু মলিনার চেয়ে বেশি কিছু তথ্য প্রথমে তার কাছ থেকে পাওয়া গেল না। ঊষা বাধা দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে তাকে চুপ করানো হল।

ভূপেন খালি হাউমাউ করে বলতে লাগল, ‘আমায় মাপ করুন স্যার আমি ভদ্দরলোক। পাটের দালালী করে খাই। দর্মাহাটা স্ট্রিটের পেছনে আমার বাড়ি, সেকেনে আমার বউ, ছেলেপুলে সব আছে।’

‘বটে? বউ আছে তো এখানে কী করছিস?’ সুনীলবাবু চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

ভূপেন অধোবদন হয়ে বলল, ‘আজ্ঞে, পাটের ব্যবসায় ভালো লাভ হচ্চিল, লোকে বলল বাঁধা মেয়েমানুষ না রাখলে ভদ্দর সমাজে জায়গা হবে না। তাই মাসে মাসে চার-শো টাকা করে গুণে রাঁড় পোষা স্যার! নাহলে আমি ভালো লোক, এট্টু বিড়ি আর মদ ছাড়া তেমন কোন নেশা নেই।’

ঊষা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, সে অমনি এসে তার বাঁধা বাবুকে জড়িয়ে বলল, ‘ওকে ছেড়ে দিন হুজুর! বাবু আমার দেবতুল্যি!’

ভূপেনের মতো চরিত্র সেকালের কলকাতায় বিরল ছিল না। রাম বসু লিখেছিলেন,

ঘরের ধন ফেলে প্রাণ
 পরের ধনকে আগলে বেড়াও
নাহি জানো ঘর বাসা
কি বসন্ত, কি বরষা
সতীরে করো নিরাশা
 অসতীর আশা পুরাও।

বাস্তবিকই সেইসময় ভূপেনের মতো লোকে কলকাতা ছেয়ে গিয়েছিল, যারা নিজের ঘর উচ্ছন্নে গেলেও দৃকপাত না করে পতিতা পল্লিতে পয়সা ওড়াত।

তাই বিস্মিত না হয়ে পঞ্চাননবাবু আসল প্রসঙ্গে চলে গেলেন, খোকাবাবুর সঙ্গে তোমার কী করে পরিচয় হয়েছিল?

ভূপেন চোখ মুছে বলল, ‘আজ্ঞে আমি মাঝেমধ্যেই এখানেই কিচুদিন করে থেকে যাই। ঘরের দিনরাত্রির অভাব অভিযোগ আর ভালো লাগে না। ঊষার কাছে এসে এট্টু শান্তি পাই। তো, এই পাড়াতেই খোকাবাবু আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। কেষ্ট, গোপী, সুবল, কালী। সন্ধের দিকে ঘরে থাকতে ভাল্লাগতো না, তখন কাছের ওই ব্ল্যাক স্কোয়্যারে এদের সঙ্গে আড্ডা মারতুম। কিন্তু মাইরি বলচি স্যার, ওরা কে, ওদের ধান্দা কি আমি কিচ্চু জানতুম না। ব্ল্যাক স্কোয়্যারে আড্ডা হত, তারপর দু-একদিন একেনে এসে ভালমন্দ খেয়ে গিয়েচে।

‘চার তারিখ রাতে খোকা যখন মলিনাকে নিয়ে এখানে আসে, তুমি ছিলে তখন?’ পঞ্চাননবাবু প্রশ্ন করলেন।

‘চার তারিখ?’ ভুপেন মাথা চুলকোতে লাগল।

মলিনা খনখনে গলায় বলল, ‘ক্যান, যেদিন আমি এয়েচিলুম একেনে, সেদিনই তো চার তারিখ ছিল। ভুলে খেয়ে নিলেন নাকি সব?’

ভূপেন বলল, ‘ওহ। আসলে তারিখ কি করে মনে থাকবে স্যার, এ-পাড়ায় এলে ঊষা আর লাল জল ছাড়া সবই ভুলে যাই। তবে হ্যাঁ, তার আগের দিন রাতে হাওড়ার ঘাটে হবুনাথ গুন্ডা ধরা পড়েচিল, খুব হল্লা হচ্চিল, এটুকু মনে আচে।’

পঞ্চানন মনে মনে চিন্তা করলেন। ভূপেন মিথ্যে বলছে না। ৩রা সেপ্টেম্বর অনেক চেষ্টার পর হাওড়ার কুখ্যাত হবুনাথ গুন্ডাকে পুলিশ ধরেছিল, এ-কথা সত্যি। গোটা শহরে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল।

ভূপেন বলল, ‘সেদিন আমরা ব্ল্যাক স্কোয়্যার মাঠে বসে মদ খেয়েচিলুম অনেক রাত অবধি। তারপর আমি ওকানেই ঘুমিয়ে পড়েচিলুম। ঘুম ভেঙে এ-বাড়ি এসে দেকি খোকা, কালী, কেষ্ট আর এই দুটো মেয়েছেলে বসে বসে জটলা করছে।’

দু-জনে চিন্তিতমুখে থানায় ফিরতে না ফিরতে একটা অদ্ভুত কাণ্ড হল।

শ্যামপুকুর থানার সাব ইনস্পেক্টর অচিন্ত্য সান্যালকে লালবাজারে খোকাবাবুর ব্যাপারে খবর আনতে পাঠানো হয়েছিল, তিনি জানালেন, ‘স্যার! খোকা নামের কারুর রেকর্ডস পাওয়া যায়নি। কিন্তু ৫ তারিখ ইমামবক্স লেনের পাশের একটা কানাগলিতে একটা মাতাল শুয়ে শুয়ে চেঁচাচ্ছিল, তাকে বটতলা থানার পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে। তার নাম গোপী। সে বলেছে …।’

সুনীল রায় থানায় ঢুকেই আঁতিপাঁতি করে পুরনো রেজিস্টার খুঁজছিলেন, যদি এই থানার কোন রেকর্ডে কিছু পাওয়া যায়, অচিন্ত্যের কথার মাঝে তিনি বললেন, ‘ওসব ছেঁদো মাতালদের কথা ছাড়ো অচিন্ত্য! তোমাকে বললাম না খোকাবাবু বলে একজন দাগি…।’

সুনীলবাবুকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে পঞ্চানন ঘোষাল বললেন, ‘না না, দাঁড়ান সুনীলবাবু, অচিন্ত্য যার কথা বলছে, সে খোকাবাবুর সাকরেদ গোপী নয় তো? ইমামবক্স লেনের পাশেই পড়েছিল বলছে!’

অচিন্ত্য সান্যাল বললেন, ‘স্যার, এই গোপী মাতাল অবস্থায় বলেছে, সে খাঁদাগুণ্ডার চেলা। কারুর সাধ্য নেই তাকে আটকে রাখতে পারে।’

পঞ্চানন ও সুনীল দু-জনেই চমকে উঠলেন, ‘কোন খাঁদা? সেই জেলপালানো দুর্ধর্ষ গুন্ডা খাঁদা?’

সোনাগাছি থেকে ফিরে আসার সময় মলিনাকে তার নিজের বাড়িতেই রেখে আসা হয়েছিল। খোকাবাবু যদি আবার তাঁর প্রেয়সীর কাছে রাতের অন্ধকারে ফিরে আসেন, তাই দুটো সাদা পোশাকের পুলিশ মোতায়েন কড়া হয়েছিল মলিনার বাড়ির সামনে।

এদিকে ভূপেনকে থানায় নিয়ে এসে লক-আপে আটকে রাখা হয়েছিল। ভূপেন গোপীকে দেখলেই চিনতে পারবে। পঞ্চাননবাবু আর সুনীলবাবু তাই ভূপেনকে নিয়ে ছুটলেন বটতলা থানায়।

গাড়িতে যেতে যেতে দু’জনেই উত্তেজনায় ফেটে পড়ছেন। সুনীল রায় বললেন, ‘সেই ডেঞ্জারাস খাঁদা গুন্ডা! সে-ই যদি খোকাবাবু হয়ে মলিনার কাছে সে থাকে, তা হলে এই পাগলা খুন তার কাছে কোনো ব্যাপারই নয়, তাই না পঞ্চাননবাবু?’

‘সে তো বটেই!’ পঞ্চানন সায় দিয়ে বললেন, ‘খাঁদার নামে সত্তরের ওপর ডাকাতি আর খুনের মামলা ঝুলছে। ধুকুড়িবাগানের মিত্তিরদের বাড়ি সারারাত ধরে সে যে বীভৎস তাণ্ডব চালিয়ে সর্বস্ব লুটে নিয়ে গিয়েছিল, তার কাছে পাগলার মতো নিরীহ গানের মাস্টারকে খুন করা কোনো ব্যাপার নাকি? প্রথম থেকেই খুনের ধরণ, মুণ্ডু কাটার কায়দা দেখে বুঝতে পারছিলাম যে খুনী নভিশ কেউ নয়। কিন্তু সে যে খাঁদা তা আমার মাথাতেও আসেনি সুনীলবাবু!’

পঞ্চানন ঘোষাল আর সুনীল রায় যতক্ষণ ভূপেনকে নিয়ে গাড়িতে বটতলা থানার দিকে চলেছেন, তার মধ্যে খাঁদা গুন্ডার ইতিহাস সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কলকাতায় দ্রব্যমূল্য যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তেমনই অসামাজিক কাজকর্মও উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছিল। ১৯২৩ সালে চার্লস টেগার্ট কলকাতার ১২ তম পুলিশ কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই এইসমস্ত দুষ্কৃতিদের কঠোর হাতে দমন করার সংকল্প করেন। তখনই পাশ হয় Bengal Goondas Act, 1923.

এই আইনবলে সরকার কোন অপরাধীকে ‘গুন্ডা’ হিসেবে ডিক্লেয়ার করলে তাকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য গোটা বাংলা প্রদেশ থেকে নির্বাসিত করে রাখা যেত। অবৈধভাবে কোন গুন্ডা বাংলায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলেই তার হাজতবাস ছিল অবধারিত। যদিও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গুন্ডা হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে এই আইনের অপব্যবহার হয়েছিল অনেকবার, তবু এই আইনের জন্য কিছুটা হলেও কলকাতা শহরে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য একটু হলেও কমেছিল।

ওই সময়ের উত্তর কলকাতায় যে সবচেয়ে কুখ্যাত অপরাধীর নাম পুলিশি রেকর্ডে বারে বারে উঠে আসে, তার নাম খাঁদা গুন্ডা।

পাগলা হত্যাকাণ্ডের অনেক আগে থেকেই সে পুলিশি খাতায় নাম তুলে ফেলেছে বহু ধনী বাড়িতে ডাকাতির অভিযোগে। একবার মাত্র ছোটো একটা চুরির মামলায় সে সামান্য কয়েকদিন জেল খেটেছিল, কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাকে ছেড়ে দিতে হয়। তারপর থেকে কোনো সময়েই পুলিশ আর তাকে ধরতে পারেনি। তার বুদ্ধি, সাহস ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল প্রচণ্ড। সে নিয়মিত নিজের দলবল পালটে ফেলত। তার সম্পর্কে অনেক অদ্ভুত খবরও পুলিশের কানে আসত। যেমন অমুক বাড়িতে ডাকাতি করে ফিরে সেদিন রাতেই সে অমুক সহায়সম্বলহীন বিধবার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ভার নিয়েছে। কিংবা ওলাওঠায় কোন পাড়া উজাড় হয়ে গেলে অনাথ শিশুদের পালন করতে শুরু করেছে। সোনাগাছিতে কোন মেয়েকে রাত কাটানোর পর তার প্রাপ্য না দিয়ে সরে পড়ার চেষ্টা অনেকেই করত, তখন খাঁদা গুন্ডা গিয়ে নাকি পিস্তল উঁচিয়ে পাওনাগণ্ডা আদায় করেছে।

এইসব নানা কারণে নিম্নবিত্ত পাড়ায় ও পতিতাপল্লীতে খাঁদা গুন্ডা ছিল খুব জনপ্রিয়। তাই অনেকেই তার খবর জানলেও পুলিশকে বলত না।

খুব স্বাভাবিকভাবেই সরকারের গুন্ডা তালিকায় তার নাম বেশ ওপরের দিকে ছিল, এবং গুন্ডা আইন বলবত হতেই তার নাম ‘গুন্ডা’ তালিকায় ঢুকে গেল। এর ফলে পুলিশের একটা লাভ হল। এরপর খাঁদা গুন্ডাকে দেখতে পেলেই বাংলায় অনুপ্রবেশের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে, নতুন করে কোনো মামলা দাখিল করতে হবে না।

কিন্তু খাঁদা গুন্ডাকে সশরীরে ধরতে পারা যে কত অসম্ভব কাজ, তা কলকাতা পুলিশ অচিরেই টের পেল।

১৯৩৪ সালে দেওয়াদত তিওয়ারি নামে পুলিশের একজন জমাদার হঠাৎ করেই তাকে শহরের এক গলিতে দেখতে পেয়ে যায়। পুরোনো এক মামলার সুবাদে খাঁদা গুন্ডার মুখটা তার পরিচিত ছিল। গুন্ডা আইনে বাংলায় তার প্রবেশ নিষেধ জেনেও খাঁদা রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, এটা উপলব্ধি করামাত্র জমাদার তিওয়ারি তাকে অনুসরণ করতে শুরু করে।

খাঁদার ষষ্ঠেন্দ্রিয় ছিল বিড়ালের চেয়েও প্রখর, সে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়, একসময় ছুটতে শুরু করে। বাধ্য হয়ে জমাদার দেওয়াদত তিওয়ারি তাকে ছুটে ধরতে যেতেই খাঁদা কিছুক্ষণ তাকে এ-গলি ও-গলি খেলিয়ে হঠাৎ এক গলির আড়াল থেকে শিকারি বাঘের মতো ছুরি মেরে উধাও হয়ে যায়। রক্তাক্ত জমাদার অচৈতন্য হয়ে পড়ে যায় রাস্তায়।

এর ফলে জমাদার তিওয়ারি সাহসিকতার জন্য পুলিশের পদক পেল বটে, কিন্তু খাঁদা অধরাই রয়ে গেল। শুধু তাই নয়, সে যেন কলকাতার বুক থেকে কর্পূরের মতো উবে গেল। নানারকম অপরাধ ঘটে, পুলিশের মনে সন্দেহ হয় যে এও হয়তো সেই খাঁদা গুন্ডারই কাজ, কিন্তু তার কোন হদিশ পাওয়া যায় না।

এইভাবে প্রায় বছরখানেক চলার পর ১৯৩৫ সালের মাঝামাঝি আবার খাঁদা গুন্ডার খোঁজ পাওয়া গেল। এবার আর খোলা রাস্তায় নয়, খোঁজ আনল পুলিশের ইনফরমার শিউচরণ। তাও আবার পঞ্চানন ঘোষালেরই কাছে।

প্রথম জীবনে শিউচরণ ছিল একজন চোর, কিন্তু ক্রমাগত জেল খাটতে খাটতে আর পুলিশের হাত থেকে লুকোতে লুকোতে তিতিবিরক্ত হয়ে সে পরবর্তী জীবনে পুলিশের ইনফরমারের কাজ করত। এ-জন্য সে টাকাও পেত।

সে-ই এসে পঞ্চানন ঘোষালকে বলল, ‘স্যার! এবার একদম পাক্কা খবর। খাঁদা যে বহাল তবিয়তে কলকাতায় রয়েছে শুধু তাই নয়, কৃপানাথ লেনে একখানা ভদ্দরবাড়িও ভাড়া নিয়েচে ছদ্মনামে।’

‘সত্যি? এই খবর ঠিক হলে তুমি মোটা ইনাম পাবে শিউচরণ।’ পঞ্চানন ঘোষাল উল্লসিত হয়ে বলেছিলেন।

শিউচরণ কাঁচুমাচু মুখে বলেছিল, ‘সে আপনি যত ইনামই দিন স্যার, আমি কিন্তু দূর থেকে বাড়িটা দেকিয়ে দিয়ে চলে আসব। আপনি তারপর আপনার দলবল নিয়ে যা ইচ্ছে করবেন। আমি দেকিয়ে দিয়েচি জানলে খাঁদাবাবু আমাকে জ্যান্ত পুঁতে দেবে স্যার!’

কিন্তু শিউচরণ যতই চেষ্টা করুক নিজেকে বাঁচানোর, অদৃষ্টের বিধান আটকায় কে! শিউচরণ বাড়িটা পঞ্চানন ঘোষালকে দূর থেকেই দেখিয়ে দিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ঠিক সেইসময় বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিল খাঁদা নিজে।

শিউচরণ আগে চোর ছিল আর এখন পুলিশের ইনফরমার হয়েছে, তা খাঁদা ভালোমতোই জানত। পুলিশ অফিসার পঞ্চানন ঘোষালের পাশে শিউচরণকে দেখতে পেয়ে ও যা বোঝার বুঝে ফেললো। পঞ্চানন ঘোষাল তাঁর লুকিয়ে থাকা দল নিয়ে দৌড়ে গিয়েও তাকে ধরতে পারলেন না। খাঁদা গুন্ডার সঙ্গে ছিল একটা সাইকেল, তাতে চড়ে চোখের নিমেষে উধাও হয়ে গেল।

আর ঠিক তার পরের দিনই কুমারটুলির একটা বাড়ির সামনের খোলা রোয়াকে পাওয়া গেল শিউচরণের মৃতদেহ। তার বুকের মধ্যে একটা লম্বা ছুরি আমূল বসানো। কারুর বুঝতে বাকি রইল না, এটা কার কাজ।

‘শিউচরণ হত্যা মামলা’ শুরু হল। কিন্তু শিউচরণের ভয়ংকর পরিণতি দেখে গোটা তল্লাটের কেউই কিছু জানলেও বলতে সাহস পেল না।

শুধু বরেনবাবু নামে একজন ভদ্রলোক থানায় এসে জানিয়েছিলেন, তাদের পাড়ায় বিধু বলে একজন আছে, সে নাকি সেদিন রাত দশটা নাগাদ কুমারটুলির একটা মিষ্টির দোকানে বসে পুরী খাচ্ছিল। শিউচরণ তার পাশে বসে টুকটাক কথা বলছিল আর জিলিপি খাচ্ছিল। এমন সময় খাঁদা গুন্ডা এসে সবার সামনেই তখন শিউচরণের বুকে ছুরি বিঁধিয়ে দিয়েছিল। দোকানদার আর বিধু দু-জনেই খাঁদার চেনা, তাই খাঁদা তাদের কিছু করেনি।

পুলিশ জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় সেই বিধু? তার বাড়ি নিয়ে চলুন তো!’

কিন্তু বিধু নামক ব্যক্তি বোধ হয় কোনোভাবে টের পেয়েছিল যে, বরেনবাবু থানায় গিয়েছেন, সে কোথায় যে সরে পড়ল, তার পর কয়েক মাস ধরে খুঁজেও পুলিশ তার টিকিটি পেল না।

সাক্ষী ও উৎসাহের অভাবে তারপর ধীরে ধীরে ‘শিউচরণ হত্যা মামলা’ মাটির তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল।

এরপর আরও একবার খাঁদা গুন্ডা তার নিজের খেল দেখিয়েছিল। কুমারটুলির এক নামকরা জমিদারবাড়ি থেকে হাজার হাজার টাকার গয়না চুরি করে পালিয়েছিল সে। সঙ্গে হাতিয়েছিল গুলি ভরতি রিভলভার। এই ডাকাতির মামলা চলার সময় কলকাতা পুলিশের এক অসমসাহসী তরুণ অফিসার হঠাৎ তাকে মাঝগঙ্গায় নৌকোয় দেখতে পেয়ে যান। দু-জনেই এক নৌকোয় পার হচ্ছিলেন। পুলিশ অফিসারটি একা থাকলেও সাহস করে চেপে ধরেছিলেন খাঁদা গুন্ডাকে।

কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে খাঁদা তাকে নৌকো থেকে ছুঁড়ে ফেলে মাঝগঙ্গায়, তারপর নিজে ঝাঁপ দিয়ে উল্কার গতিতে সাঁতার কেটে গঙ্গা পেরিয়ে ওপারে উঠে পালায়।

তো বোঝাই যাচ্ছে, এমন ভীষণ অপরাধী কতটা আলোড়ন ফেলতে পারে শহরে।

এক ঘণ্টা আগে পর্যন্ত যেটা ছিল শুধুই মামুলি একটা বেশ্যাপাড়ার খুনের মামলা, সেটাই খাঁদার নাম উঠতে হয়ে উঠল হেভিওয়েট কেস। লালবাজার থেকে বড় বড় পুলিশ কর্তারা খোঁজ নিতে লাগলেন। বহুদিন পরে খাঁদা গুণ্ডার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। এবার তাকে ধরতে প্রয়োজন পড়লে গোটা লালবাজার ঝাঁপিয়ে পড়বে।

থানায় পৌঁছে গোপীকে শনাক্ত করতে ভূপেনের কোনো অসুবিধা হল না। কিন্তু তাকে নরম গরম অনেকরকম ভাবে জেরা করেও খাঁদা এখন কোথায়, তা সম্পর্কে কোনো কথা খুঁজে বের করা গেল না। এদিকে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অতি নগণ্য, মাতাল অবস্থায় রাস্তায় চেঁচাচ্ছিল সে। একটু পরেই তাকে ছেড়ে দিতে হবে।

তখন পঞ্চাননবাবু বললেন, ‘এক কাজ করা যাক। কোনো অপরাধীকে খুঁজে বের করতে গেলে আগে তার ভালোবাসার মানুষটিকে খুঁজে বের করতে হয়। খাঁদা মোটা টাকা দিয়ে মলিনাকে বাঁধা রেখেছিল, অথচ মলিনা কিনা পাগলাকে ভালবেসে ফেলেছিল। সেই রাগটাই খুব সম্ভবত খাঁদার পাগলাকে খুন করার মোটিভ। যেভাবে মুণ্ডুটাকে সে কেটেছিল, তাতে তার ভেতরের আক্রোশটাই ফুটে উঠেছে। আমার মনে হয়, মলিনার বাড়িতে আমাদের সারাক্ষণ নজর রাখা উচিৎ।’

‘নজর রাখা হচ্ছে তো।’ এক তরুণ এস আই বলল, ‘ইমামবক্স লেনে মলিনাসুন্দরী বলে মেয়েটার বাড়িতে সাদা পোশাকে দুজন কনস্টেবল রাখা তো হয়েছে স্যার!’

‘হ্যাঁ, সে জানি।’ পঞ্চাননবাবু সায় দিলেন, ‘কিন্তু খাঁদা তার রক্ষিতার কাছে এলে গভীর রাতেই আসবে। সিভিল ড্রেসে যারা আছে থাকুক, আজ রাত থেকে আমি মলিনার বাড়ির কাছে লুকিয়ে থাকবো। সঙ্গে দুজন কনস্টেবল পেলেই চলবে। তেমন বুঝলেই ঢুকে পড়ব ওই বাড়িতে।’

সুনীল রায় বাধা দিয়ে বললেন, ‘এটা কি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না পঞ্চাননবাবু? আপনি একা ওইভাবে ওখানে মাত্র দু-জনকে নিয়ে থাকবেন? খাঁদা তো দেখছেন কেমন ডেঞ্জারাস। তার চেয়ে মলিনার বাড়ির কনস্টেবলরা থানায় খবর দিলে গোটা ফোর্স নিয়ে গেলে হতনা?’

‘না।’ পঞ্চাননবাবু মাথা নাড়লেন, ‘ওইভাবে খাঁদাকে ধরা সম্ভব নয় সুনীলবাবু। ওর বিরুদ্ধে দুটো মামলার ইনভেস্টিগেশন অফিসার ছিলাম আমি। আপনার ধারণা নেই ও কী প্রচণ্ড বুদ্ধিমান। ওখান থেকে থানায় খবর আসতে আসতে পাখি উড়ে যাবে। চিন্তার কিছু নেই, খাঁদার সঙ্গে আগেও আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। আমিই যাব।’

সেইমতো সেদিন রাত থেকে পঞ্চাননবাবু দুজন পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে ইমামবক্স লেনে মলিনার বাড়ির পাশেই একটা গলিতে লুকিয়ে থাকতে শুরু করলেন। আর এই ব্যাপারে মলিনাকে কিছু জানালেন না। তাঁর এই পরিকল্পনার পেছনে অনেক হিসেব ছিল। মলিনার কাছ থেকে যা শুনেছেন, তাতে খাঁদাকে মলিনার প্রতি বেশ possessive বলেই মনে হয়েছিল তাঁর। নিজে পালিয়ে যাচ্ছে বলে সে মলিনাকে উত্তরপাড়ায় রেখে দিয়ে এসেছিল। সেখানে মলিনা আবার এখানে ফিরে এসে সোনাগাছির কেন্দ্রবিন্দুতে একা বাড়িতে রয়েছে, প্রকাশ্যে না হোক, লুকিয়ে খাঁদা একবার না একবার আসবেই তার রক্ষিতাকে দেখতে।

দ্বিতীয় দিনেই পঞ্চাননবাবুর পরিকল্পনা সফল হল। নিশুতি রাত হলেও সোনাগাছির রাস্তা বলে ইমামবক্স লেনে তখন লোকচলাচল ছিল ভালোই। মাঝেমধ্যেই কোনো মাতাল টলতে টলতে এগোচ্ছে, দূরের খোলার ঘরগুলোর সামনে গরীব মেয়েগুলো দাঁড়িয়ে আছে, রিকশাওয়ালা, ভিস্তিওয়ালারা ঢুকছে তাদের ঘরে। চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসছে। রাস্তার এপারে মলিনার মতো খানদানী বেশ্যাদের বাড়ি। পঞ্চানন যে গলিতে লুকিয়ে রয়েছেন, তার পাশের দোতলা বাড়ি থেকে ভেসে আসছে বাজনা সহযোগে সুরেলা কণ্ঠে গান —

‘বাঁকা সিতে ছড়ি হাতে বাবু এসেছে
 হেসে কাছে বসেছে।
কামিজ আঁটা সোনার বোতাম
 চেনের কি বাহার,
রুমালে উড়ছে লেভেনডার
গলায় বেলের কুড়ির হার
গলা ধরে সোহাগ করে
নইলে কি মন রসেছে …’

গানের সঙ্গে মাঝে মাঝেই করতালি, তবলার সঙ্গত চলছে। শুনতে শুনতে পঞ্চানন যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন। তখন রাত প্রায় দুটো।

এমন সময় মলিনার বাড়ির দোতলার ঘর থেকে পরিত্রাহি আর্তনাদ শোনা গেল, ‘বাঁচাও আমায়, কে আছ বাঁচাও …!’ কণ্ঠস্বর মলিনার।

আর সেই চিৎকার শোনামাত্র সামনের রাস্তায় কেমন ছুটোছুটি লেগে গেল। পথচলতি সবার মুখে ভয়ের ছোপ, মুখে একটাই নাম, ‘খোকা ফিরে এসেচে, খোকা!’

বটতলা থানার সেকেন্ড অফিসার আসিরুল হক এইসময় টহল দিতে এসেছিলেন ওই রাস্তায়, একদিক থেকে তিনি, অন্যদিক থেকে পঞ্চানন ঘোষাল ছুটে এলেন মলিনার বাড়ির সামনে। কিন্তু কিছুই করা গেল না। মলিনার বাড়ির দোতলার কার্নিশ থেকে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা লোক, তার হাতে পিস্তল। রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়েই সে এদিক-ওদিক এলোপাথাড়ি গুলি করতে শুরু করল।

পঞ্চানন ঘোষালও সাথে সাথে তার রিভলভার বের করলেন। কিন্তু ততক্ষণে মলিনার বাড়ির সামনে এত লোক জড়ো হয়ে গেছে, যে সেই ভিড় বাঁচিয়ে গুলি করতে করতে খাঁদা পাশের একটা সরু গলি দিয়ে উধাও হয়ে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বটতলা ত্থানার ওসি যতীন্দ্র মুখার্জি দলবল নিয়ে এসে পৌঁছলেন। শ্যামপুকুর থানা থেকে এলেন সুনীল রায়ও। সবাই মিলে আশপাশের প্রতিটা বাড়ি, বড়ো গলি, মেথর গলি তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেলা হল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না।

খাঁদা যেন নিমেষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

মলিনা নিজের ঘরে বসে ভয়ে কাঁপছিল। তার পাশে পড়ে রয়েছে একটা ক্লোরোফর্মের শিশি আর শক্ত মোটা দড়ি। খাঁদা সম্ভবত আগে থেকেই আন্দাজ করেছিল, মলিনা এবার আর সহজে তার সঙ্গে যেতে রাজি হবে না। কিন্তু রক্ষণশীল প্রেমিকের মতোই সে ঠিক করেছিল মলিনা নিজে না যেতে চাইলেও তাকে অজ্ঞান করে তার দেহটা দড়ি দিয়ে নীচের গলিতে নামিয়ে দেবে। সেই ভেবেই নীচে সাকরেদ সুবল আর কালীকে দাঁড় করিয়ে রেখে সে পাইপ বেয়ে উঠেছিল মলিনার বাড়ির বারান্দায়। সুবল আর কালি অপেক্ষা করছিল, দেহ ওপর থেকে নামিয়ে দিলেই তারা তক্ষুনি অজ্ঞান মলিনাকে নিয়ে তুলে দেবে ট্যাক্সিতে। তারপর খাঁদা এসে মলিনাকে নিয়ে পালাবে।

কিন্তু যেমন ভাবা তেমন হল না। মলিনা যে অমন চিৎকার শুরু করবে তা খাঁদা বুঝতে পারেনি। মলিনার চিৎকার শুনে নীচ থেকে সাদা পোশাকের পুলিশদুটো ছুটে এসে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। বাধ্য হয়ে খাঁদা মলিনাকে ছেড়েই নীচে লাফিয়ে পালিয়ে গেল।

খাঁদা যে ক্লোরোফর্মের শিশিটা হাতে করে এসেছিল, সেটা সতর্কতার সঙ্গে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে নেওয়া হল। ওতে খাঁদার হাতের ছাপ পাওয়া যাবে।

পঞ্চাননবাবু মলিনাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমায় তোমার খোকাবাবু মাসে বারোশো টাকা দেয়, তবু তুমি তার সঙ্গে গেলে না কেন? পাগলাকে খুন করেছে সেই রাগে?’

এর উত্তরে মলিনা বলেছিল, ‘সেটা তো আছেই। তবে, তার চেয়েও বড়ো হল গেলে আমি আমার স্বাধীনতাটুকু হারিয়ে ফেলতাম হুজুর। আমরা এই খারাপ মেয়েরা সংসার পাইনে, সোয়ামির সোহাগ পাইনে, দুনিয়াসুদ্ধু লোক আমাদের নিচু নজরে দ্যাকে ঠিকই, কিন্তু একটা দিকে আমরা ভদ্দরঘরের মেয়েদের চেয়ে এগিয়ে। আমরা নিজেদের খুশিমতো থাকতে পারি, খেতে পারি, পরতে পারি। এটা হারাতে চাইনা হুজুর, সে যে যত টাকাই দিক না ক্যান!’

গোপীকে জেরা করে একটা চমকপ্রদ তথ্য অনেক কষ্টে উদ্ধার করা গেল। শিউচরণ যে বাড়িটা পঞ্চাননবাবুকে বছরখানেক আগে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, সেই কৃপানাথ লেনেরই ১০ নম্বর বাড়ির পেছনের গলির এক বস্তিতে খাঁদার আত্মীয়স্বজন নাকি বাস করে, খাঁদাও মাঝেমধ্যেই এখন সেখানে আসে।

পঞ্চাননবাবু আর দেরি করলেন না, গোটা বাহিনী নিয়ে হানা দিলেন বস্তির সেই বাড়িতে। সেখানে খুপড়ির মতো দুটো মাটির ঘর।

আশপাশের বাড়িতে যারা বাস করে তারা সবাই গৃহস্থবেশী বেশ্যা। এই সমস্ত মেয়েরা দিনে পরিচারিকার কাজ করে, রাতে বেশ্যাবৃত্তি।

পঞ্চাননবাবুর কাছে আগেই খবর ছিল, বেশ্যামহলে খাঁদা পরোপকারী বলে পরিচিত, অনেক পাওনাগণ্ডার গোলমালে সে এদের রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়ায়। তাই সোনাগাছির বেশ্যারা খাঁদার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে মুখ খোলেনা।

কিন্তু এরা তো ঘাগি বেশ্যা নয়, এরা কিছু বললেও বলতে পারে।

কিন্তু না। খাঁদা গুন্ডা এদের কাছে একটা মূর্তিমান আতঙ্ক। তার নাম শুনেই অর্ধেক মেয়ে ভয়ে কাঁদতে শুরু করল।

তবু অনেক চেষ্টায় দু-একজন কাঁপতে কাঁপতে চুপিসাড়ে বলল, ওই দুটো ঘরের একটায় থাকে খাঁদা নিজে, অন্যটায় দুজন প্রাপ্তবয়স্ক লোক তারা নাকি সম্পর্কে খাঁদার বাবা ও কাকা। সত্যাসত্য তারা জানেনা।

খাঁদার ঘরের এককোণে রক্তমাখা ধুতি, পাঞ্জাবি, অন্তর্বাস পাওয়া গেল। পঞ্চাননবাবু লক্ষ্য করলেন প্রতিটার কণায় ইংরেজি ‘S’ অক্ষর সুতো দিয়ে লেখা রয়েছে।

ভ্রূ কুঁচকে তিনি সুনীল রায়কে বললেন, ‘খাঁদার আসল নাম কি সেটা আমরা এখনো জানিনা, তাই না সুনীলবাবু?’

সুনীলবাবুর গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় আগেই দেওয়া হয়েছে। তিনি তখন উবু হয়ে বসে ঘরের মাটি পরীক্ষা করছিলেন। নিচু গলায় বললেন, ‘এই মাটি আগে খোঁড়া হয়েছে পঞ্চাননবাবু। খাঁদা কি মাটির তলায় পাগলার মুণ্ডুটা লুকিয়ে রেখেছে?’

সঙ্গে সঙ্গে গোটা ঘরের মেঝে খুঁড়ে ফেললো কনস্টেবলরা। না, পাগলার কাটা মুণ্ডু পাওয়া গেল না, কিন্তু পাওয়া গেল অসংখ্য হিরেজহরত, বহুমূল্য গয়নাগাটি ও মনিমুক্তো। পাওয়া গেল একটা বাক্স। তার মধ্যে শয়ে শয়ে হাজার টাকা ও একশো টাকার নোট। সব মিলিয়ে ত্রিশ হাজার টাকারও বেশি সম্পত্তি মাটির নীচে লুকিয়ে রেখেছিল খাঁদা।

আর আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে ত্রিশ হাজার টাকা যে কতটা দামি ছিল, তা সহজেই অনুমেয়।

আশপাশের লোকেদের ভিড় উপচে পড়ল সেখানে কৌতূহলে, বিস্ময়ে। বাধ্য হয়ে সেখানে দু-জন পুলিশকে বসিয়ে রাখা হল।

এর মধ্যে একজন তিলক কাটা বুড়ি ফিসফিস করে বলল, চার তারিখ রাতে সাড়ে বারোটা নাগাদ খাঁদা হাতে একটা ধারালো ছুরি নিয়ে ফিরে এসেছিল ঘরে। তারপর সারারাত ধরে জামাকাপড় কেচেছিল কুয়োতলায়।

পঞ্চাননবাবু জানতে চাইলেন, ‘খাঁদা নিজের জামায় ‘এস’ লিখে রাখত?’

তিলক কাটা বুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অল্পবয়সি মেয়ে মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, ওনার শখ ছিল ওটাই।’ তারপর সে একটু থেমে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘সেদিন জোছনারাত ছিল। খাঁদাবাবু এসে পড়তে আমরা সবাই খদ্দের না ধরে ভয়ে ঘরে ফিরে আসচিলাম। তকনই আমি উঁকি দিয়ে দেকেচিলাম, খাঁদাবাবু যে বালতিতে কাপড় কাচছিলেন, সেটার জল টকটকে লাল হয়ে উঠেচিল, মা কালীর দিব্যি বাবু!’

খাঁদার ঘরে রক্তমাখা জামাকাপড়ের পাশেই একটা ধোপাবাড়ির স্লিপ পাওয়া গেল। ধোপাবাড়িতে জামাকাপড় কাচতে দিয়ে এলে এইধরণের স্লিপ হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়, সেই স্লিপ দেখিয়ে আবার জামা ফেরত আনতে হয়।

স্লিপটি মানিকতলা স্ট্রিটের মাথুরাম ধোপার ভাটিখানার। তাতে লেখা রয়েছে, ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৬ তারিখে সেখানে কিছু কাচতে দিয়ে আসা হয়েছে।

সুনীল খাঁদার সেই ঘরে অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে লাগলেন, আর পঞ্চানন দ্রুত সেই ভাটিখানায় গিয়ে পৌঁছলেন এবং সেই স্লিপ দেখালেন। স্লিপ দেখিয়ে যে জামাকাপড়গুলো তিনি উদ্ধার করলেন, সেগুলোরও প্রান্তে ‘S’ খোদাই করা ও কাচার পরেও সেগুলোর থেকে শুকনো রক্ত পুরোপুরি ওঠেনি, খয়েরি হয়ে রয়েছে।

ওদিকে সুনীল রায় ততক্ষণে কৃপানাথ লেনের সেই বস্তিতেই একজন প্রত্যক্ষদর্শীকে খুঁজে বের করেছেন।

লোকটির নাম দেবেন।

‘পাগলা হত্যা মামলা’য় এই দেবেনের সাক্ষ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে।

দেবেন বলে, ৪ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ সে খাঁদাবাবুর বাড়ির বাইরের রোয়াকে বসে বিড়ি খাচ্ছিল। সেইসময় সে খাঁদাকে খালি পায়ে আসতে দেখে। খাঁদার পায়ে কোনো জুতো ছিলনা, পরনে ছিল নীল রঙের জামা আর সাদা রঙের ধুতি। তার পেছনে তার চ্যালা কেষ্টও ছিল।

দেবেন খাঁদা কে দেখামাত্র চমকে ওঠে, কারণ খাঁদার ধুতি আর শার্টে ছোপ ছোপ রক্ত লেগে ছিল। তাছাড়া খাঁদার হাতে ছিল একটা মস্ত ধারালো ছুরি। দেবেনকে দেখে কেষ্ট বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে লাগল যাতে দেবেন ভেতরে ঢুকতে না পারে। আর খাঁদা ভেতরে ঢুকে গেল।

যখন বেরিয়ে এল, তখন খাঁদার পরনে ছাই রঙা শার্ট, মাথার চুল ভিজে। বোঝাই যাচ্ছে এই মাঝরাতে সে স্নান করেছে। তার সঙ্গে গায়ে মেখেছে প্রচুর আতর। দেবেন হাঁ করে দেখছে দেখে খাঁদা ওর কাছে এগিয়ে এসে পকেট থেকে একটা রিভলভার বের করে শাসিয়েছিল, তারপর শিস দিতে দিতে কেষ্টর সঙ্গে শোভাবাজার স্ট্রিটের দিকে চলে গিয়েছিল।

দেবেন আরও আশ্চর্য কিছু কথা বলল, ‘খাঁদা আমার ছোটোবেলার বন্ধু স্যার! আমি, খাঁদা, কেষ্ট আর হরিপদ একসঙ্গে ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়তাম।’

‘বোঝ!’ সুনীল রায় বিড়বিড় করলেন, ‘যে স্কুলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন, সেই স্কুলে খাঁদা গুন্ডাও পড়েছে।’

দেবেন বলল, ”উঁচু ক্লাসে ওঠার পর আমরা সবাই-ই অভাবে স্কুল ছেড়ে দিই বটে, কিন্তু কেষ্ট আর খাঁদা পুরোপুরি বয়ে যায়। আমি আর হরিপদ এখন এই পাড়াতেই থাকি, ব্যবসা করি, কিন্তু খাঁদা আর কেষ্টর সঙ্গে আমাদের সেই বন্ধুত্ব তো ছাড়, ঠিকমতো কথাও নেই। এখন খাঁদা এমন ভীষণ হয়ে উঠেছে, যে ওর ভয়ে পাড়ায় বাস করাই দিন দিন দুরূহ হয়ে উঠেছে।”

দেবেনের কথা শুনে পঞ্চানন যোগাযোগ করলেন খাঁদার বাল্যবন্ধু পাড়ায় বসবাসকারী ব্যবসায়ী হরিপদ সরকারের সঙ্গে। তাঁর স্বচ্ছল অবস্থা, ব্যবসাও প্রকাণ্ড। বোঝাই যাচ্ছে, হরিপদ দেবেনের চেয়েও বেশি জীবনে সাফল্য অর্জন করেছেন। তিনি বললেন, ‘দেখুন সাহেব, খাঁদা আমার ছোটোবেলার বন্ধু এ-কথা বলতে লজ্জা করে। এ-পাড়ার সকলের জীবন সে ওষ্ঠাগত করে তুলেছে। কিন্তু সকলেরই প্রাণের ভয় রয়েছে, তাই সাহস করে কিছু করে উঠতে পারছে না। আপনারা যদি আমার নিরাপত্তার জন্য সারাক্ষণের সশস্ত্র সিপাই মোতায়েন করেন, আমি আপনাদের সাহায্য করতে রাজি আছি।’

তাই হল। হরিপদবাবু খাঁদাকে ভালো করে চেনেন, পুলিশের সঙ্গে তিনিও মাঝে মধ্যে বেরতে লাগলেন তদন্তে।

দিনদশেক এইভাবে কাটার পর একজন লোক সন্ধ্যেবেলা থানায় খবর দিল, বলরাম মজুমদার স্ট্রিটের পেছনের যে মেথর গলিতে পাগলার মুণ্ডুহীন দেহ পাওয়া গিয়েছিল। সেই গলি থেকে খাঁদাকে বেরিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে।

হরিপদবাবু সেদিন আসেননি। এই খবর শোনামাত্র একলরি সশস্ত্র সিপাই নিয়ে পঞ্চানন আর সুনীল ছুটলেন সেখানে।

সেখানে গিয়ে শোনা গেল খাঁদা তাঁর খুনের জায়গাটা আরেকবার দেখতে এসেছিল, তার সঙ্গে তার কৃপানাথ লেনের বাড়িতে গিয়ে সেই তিলককাটা বুড়ি ও আরও অন্যান্য সাক্ষীদের আসন্ন ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কে শাসিয়ে গিয়েছে। গোটা পুলিশ বাহিনী সংলগ্ন প্রতিটা রাস্তা, গলি, বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল। কিন্তু খাঁদাকে কোথাও পাওয়া গেল না।

খুঁজতে খুঁজতে রাত গড়িয়ে ভোর হয়ে গেল। সবাই যখন ক্লান্ত বিধ্বস্ত, তখন আবার খবর এল, খাঁদা এরমধ্যেই হাওড়ার একটি বস্তিতে পৌঁছে গিয়েছে। পঞ্চানন আর সুনীল ক্লান্ত থাকলেও সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন হাওড়ায়।

বস্তির সেই ঘর ভেঙে তাঁরা যখন ঢুকলেন, তখন খাটিয়ায় একটা লোক শুয়ে ছিল। তাকে দেখে একজন কনস্টেবল, যে কিনা আগের এক মামলায় খাঁদাকে দেখেছিল, চিৎকার করে উঠল, ‘স্যার, ওই! ওই তো খাঁদা!’

শোনামাত্র সুনীল আর পঞ্চানন বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। খাঁদার হিংস্রতা ও চাতুর্যের কথা সবার জানা, সকলেই ভাবল এবার একটা মারাত্মক রক্তারক্তি ঘটবে।

কিন্তু কিছুই হল না। খাটিয়ায় শুয়ে থাকা খাঁদা গুন্ডা নির্বিবাদে ধরা দিল পুলিশের কাছে। তাকে নিয়ে যাওয়া হল শ্যামপুকুর থানায়।

আশাতীত এই সাফল্যে গোটা পুলিশ মহলে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ল। আশপাশের সমস্ত থানার অফিসাররা এসে গেলেন। সবার মুখেই এক কথা, ‘ধন্য পঞ্চাননবাবু ! ধন্য সুনীলবাবু! আপনাদের জন্যই আজ খাঁদা ধরা পড়ল!’

সবাই উল্লাস করলেও পঞ্চাননবাবু ঠিক তৃপ্ত হতে পারছিলেন না। খাঁদা গুন্ডা যে এমন বিনা প্রতিবাদে, বিনাযুদ্ধে ধরা দেবে, এটা যেন ঠিক স্বাভাবিক নয়।

সমস্ত পুলিশরা যখন টেবিলে সুনীলবাবুকে ঘিরে ধরে গোটা অভিযানের কাহিনি শুনছেন, পঞ্চানন তখন পুলিশ গেজেটে খাঁদা গুন্ডার বিবরণ খুঁজে চলেছেন।

এই তো! এই তো পেয়েছেন। গেজেটের এক পাতায় খাঁদার বিবরণ পেয়ে পঞ্চানন সোৎসাহে পড়তে শুরু করলেন।

খাঁদা গুন্ডা। বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ। উচ্চতা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। গায়ের রং গৌরবর্ণ, লম্বা চওড়া দোহারা চেহারা। বাঁ-হাতে রয়েছে একটি উল্কি, তাতে নারকেল গাছে জড়ানো সাপের ছবি আঁকা। ডান হাতে রয়েছে দুটি উল্কি। একটি গোলাপফুল। আর তার নীচে লেখা ‘প্রাণের খাঁদা’।

পঞ্চানন সহকর্মীদের কলরোলের মাঝে উঠে গিয়ে লক-আপে থাকা খাঁদা গুন্ডাকে পরীক্ষা করলেন। নাহ, সবই মিলে যাচ্ছে। উল্কি, গায়ের রং সবই যথাযথ। পুলিশ গেজেটে খাঁদার একটা অস্পষ্ট ছবি রয়েছে, মিলে যাচ্ছে তার সঙ্গেও।

দ্বিধাবিভক্ত মনে পঞ্চানন লক-আপ ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন, এমন সময় দেখতে পেলেন থানার দরজা দিয়ে হরিপদবাবু ঢুকছেন। তিনি আজ দলে ছিলেন না, কোন কাজে ব্যস্ত ছিলেন। খাঁদা গুন্ডা ধরা পড়েছে জেনে তিনি শনাক্ত করতে এসেছেন।

পঞ্চানন হরিপদবাবুকে নিয়ে লক-আপে গেলেন, খাঁদা গুন্ডার বাল্যবন্ধু এসেছে জেনে অন্যান্য পুলিশরাও কৌতূহলে এগিয়ে গেলেন লক-আপের দিকে।

লক-আপের লোকটিকে দেখামাত্র হরিপদবাবু প্রথমে সভয়ে দু-পা পিছিয়ে এলেন। খাঁদা গুন্ডার তাণ্ডব এমনই ভয়ংকর, যে তার ছেলেবেলার বন্ধু পর্যন্ত ভয় পায়।

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বটতলা থানার সেকেন্ড অফিসার আসিরুল হক। তিনি মজা করে বলেন, ‘কী মশাই? বন্ধুকে দেখে এত ভয়?’

সবাই হাসতে লাগল।

‘বন্ধুর নাম যখন খাঁদা তখন ভয় তো হবেই স্যার!’ হরিপদবাবু তীক্ষ্নদৃষ্টিতে লক আপের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিন্তু এখন ভয় পাচ্ছি না। কারণ এই লোকটা খাঁদা নয়।’

‘অ্যাঁ! কি বলেন মশাই!’ মুহূর্তে থানার পরিবেশ পালটে গেল। সবাই হুড়মুড়িয়ে চলে এল লক আপের সামনে, ‘এই লোকটা খাঁদা নয়?’

‘না। তবে এ খাঁদার ঘনিষ্ঠ বটে। এ হল সুধীর, খাঁদার ডুপ্লিকেট। খাঁদার সঙ্গে চেহারায়, হাঁটাচলায়, সবেতেই এই সুধীরের খুব মিল। মুখের আদলও মেলে, যদিও খাঁদার মুখ একটু আলাদা। পুলিশের চোখে ধোঁকা দেবার জন্য খাঁদা একে ব্যবহার করে।’ হরিপদবাবু বললেন, ‘এ সত্যিকারের খাঁদা গুন্ডা হলে এতক্ষণে আপনাদের মধ্যে অন্তত দুজন এরমধ্যেই লাশ হয়ে যেতেন।’

পঞ্চাননবাবু এবার এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমার মনে তখন থেকে খটকা লাগছিল হরিপদবাবু! খাঁদা এত সহজে ধরা দেবে, সেটা ঠিক মানা যাচ্ছিল না।’

হরিপদবাবু বললেন, ‘খাঁদাকে খুঁজে পাওয়া এত সহজ নয় স্যার। যতদিন সে আমাদের সঙ্গে ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়ত, লেখাপড়া থেকে শুরু খেলাধুলো, সবেতেই ফার্স প্রাইজ বাঁধা ছিল তার। যেমন বুদ্ধি, তেমনই সাহস।’

‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারির মত নামী স্কুলের ফার্স বয় ছিল খাঁদা?’ বটতলা থানার যতীন মুখার্জি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘সে এমন দাগি গুন্ডা হল কী করে?’

হরিপদবাবু বললেন, ‘খাঁদার মধ্যে বরাবরই যেটা ছিল, সেটা হল অবিশ্বাস্য ধরণের সাহস। যে সাহসের ফলে অনেকসময় সে ভালো-মন্দ নানারকম দলে ভিড়ে যেত। স্কুলে থাকতেই খাঁদা কেষ্ট, গোপী ও আরো কয়েক জনকে নিয়ে একটা দল খোলে। প্রথমদিকে সেই দলের উদ্দেশ্য ছিল দেশোদ্ধার, বড়োলোকের অর্থ হাতিয়ে গরিবদের মধ্যে দান। কিন্তু নানারকম বেনোজল ঢুকতে শুরু করায় কিছুদিনের মধ্যেই ওদের দলটা একটা সাধারণ ডাকাতদলে পরিণত হয়। খাঁদার ডাকাতদল অন্তত ত্রিশটি খুন করেছে বলে আমাদের পাড়ার সকলেরই ধারনা।’

‘এখন কতজন আছে খাঁদার দলে?’ সুনীল রায় প্রশ্ন করলেন।

হরিপদবাবু বললেন, ‘অন্তত সত্তর থেকে আশিজন। এরা শুধু ধনীবাড়িতে ডাকাতিই যে করে, তা কিন্তু নয়, বাংলা, বিহার উড়িষ্যার রেলপথেও প্রচুর লুঠপাট চালায়। এরা এতটাই নির্মম, পথে কেউ সামান্য বাধাটুকু হয়ে দাড়ালেও তাকে নির্বিচারে হত্যা করে এরা।’

সবাই স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। পঞ্চাননবাবু বললেন, ‘আচ্ছা হরিপদবাবু, খাঁদা তাহলে থাকে কোথায়? আমরা তো তার কৃপানাথ লেনের বাড়ি থেকে শুরু করে তার রক্ষিতা মলিনার বাড়ি কিচ্ছুই বাদ দিচ্ছি না। তবুও তো তাকে পাচ্ছি না!’

হরিপদবাবু এবার মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘খাঁদা এক আশ্চর্য চরিত্র স্যার। সে সমাজের উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত দুই ক্ষেত্রেই বিচরণ করে। মাঝে মাঝেই সে এই সোনাগাছি ছেড়ে উধাও হয়ে যায়। তার সাম্রাজ্যের ভার তখন সে দিয়ে যায় কেষ্ট আর গোপীর হাতে। নিজেকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলে স্যুটেড বুটেড হয়ে সে তখন বাস করতে থাকে সমাজের একেবারে উচ্চবিত্ত সমাজে। আমি এও শুনেছি, শহরের নামকরা ক্লাবের সদস্য হয়ে বিলাতি স্যুট আর মুখে পাইপ নিয়ে সে তখন গলফ খেলে নামিদামি শিল্পপতির সঙ্গে, কিংবা বক্তৃতা রাখে বড়ো কোনো পার্টি বা মিটিং-এ। আপনারা যখন তাকে এখানে হন্যে হয়ে খুঁজছেন, সে তখন হয়তো কোনো বড়ো ক্লাবে টেনিস খেলছে।’

‘কি বলছেন?’ সুনীল রায় চমকে উঠে বললেন, ‘এ যে Dual personality মশাই!’

হরিপদবাবু বললেন, ‘শুধু তাই নয়। কলকাতা হাইকোর্টের এক জজের একমাত্র বিদুষী কন্যা নীলার সঙ্গে সে এমন মেলামেশা শুরু করেছিল যে নীলার বাবা খাঁদার পরিচয় না জেনেই তার কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে জামাই করতে উৎসাহী হয়ে পড়েছিলেন! খাঁদা বেগতিক দেখে তখন সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়। এইভাবে কিছুদিন কাটানোর পর সে আবার ছেঁড়া লুঙ্গি আর গেঞ্জি গলিয়ে চলে আসে এ-পাড়ায়, বেশ্যা আর চোরডাকাতদের সঙ্গে বাস করতে থাকে নোংরা বস্তিতে।’

পঞ্চাননবাবু ভ্রূ তুলে সুনীল রায়ের দিকে তাকালেন। বাকি সমস্ত পুলিশরাও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে শুরু করেছে। এ কী মানুষ না অপদেবতা? যত দিন যাচ্ছে, খাঁদাকে পাকড়াও করাটা অসম্ভব বোধ হতে শুরু করেছে সবার কাছে।

পঞ্চাননবাবু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা এই সুধীর নামক খাঁদার ডুপ্লিকেট লোকটা, একে আপনি চিনলেন কীভাবে?’

‘একদিন ব্ল্যাক স্কোয়্যারে দু-জনকে পাশাপাশি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন খাঁদার কোনো কারণে মেজাজ সুপ্রসন্ন ছিল। আমার বিস্ময় দেখে সে নিজেই আমাকে গর্ব করে বলেছিল, কীভাবে সুধীরকে সে হঠাৎ খুঁজে পেয়ে পুলিশের কাছে ধোঁকা দেওয়ার কাজ করাচ্ছে। প্রথমে সুধীরের গায়ে খাঁদার মতো ওইসব উল্কি ছিল না। খাঁদা সেগুলো আঁকিয়েছে। তারপর সুধীর খাঁদার হয়ে জেলও খেটেছে।’ হরিপদবাবু বললেন।

‘অ্যাঁ! মানে খাঁদা কখনও জেলে থাকেইনি?’

‘আজ্ঞে না। আপনাদের পুলিশি গেজেটে যার ছবি, বর্ণনা রয়েছে, সে আসলে সুধীর। খাঁদা নয়।’ হরিপদবাবু মৃদু হেসে বললেন।

এরপর কেটে গিয়েছে বেশ কিছুদিন। কলকাতা পুলিশ তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে খাঁদা গুন্ডার সন্ধানে। গোটা সোনাগাছি কুমারটুলি এলাকায় মাছির মতো ছড়িয়ে দিয়েছে অজস্র ইনফরমার। সেই ইনফরমারেরা কখনও খবর এনেছে, আজ রাতে খাঁদা দশটা পতিতার মেয়ের বিবাহের আয়োজন করেছে, কখনও খবর এনেছে অমুক বারাঙ্গনার ন্যায্য পাওনার জন্য তার খদ্দেরের মুখ ভরা রাস্তায় ঘুষি মেরে ফাটিয়ে দিয়েছে।

প্রতিটা সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছে পুলিশ। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। খাঁদাকে ধরা যায়নি। সেও পুলিশের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে কখও ছদ্মবেশ, কখনও আরও বিচিত্র সব পন্থা অবলম্বন করে সরে পড়েছে।

খাঁদা মাঝে মাঝেই কোনো এক অমোঘ টানে ঢুঁ মেরেছে বলরাম মজুমদার স্ট্রিটের সেই মেথর গলিতে। খবর পাওয়ামাত্র পুলিশ গিয়েছে। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি।

পঞ্চানন আর সুনীল নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে ছেড়ে দিয়েছেন খাঁদার ডামি সুধীরকে। পরবর্তীকালে খাঁদা ধরা পড়লে এই নির্দোষ সুধীরকে কেন জেলে আটকে রাখা হয়েছিল, তা নিয়ে আদালত প্রশ্ন করতে পারে। তাই এই সিদ্ধান্ত।

ততদিনে কলকাতা পুলিশের অনেক অফিসারই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, খাঁদা নির্ঘাত ভোজবাজি জানে। নাহলে পরপর এতরকমভাবে কারুর পক্ষে পালানো সম্ভব নয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা ভয়ে কাঁটা হয়ে গেলেও প্রথম প্রথম খাঁদা গুন্ডাকে দেখতে পেলে যে কোনোভাবেই হোক থানায় খবর পাঠাত। কিন্তু পর পর পুলিশের ব্যর্থতায় তারাও বিশ্বাস করতে শুরু করল, খাঁদা নির্ঘাত মানুষ নয়। অপদেবতা জাতীয় কিছু। কুসংস্কার তো মনে গেঁথে ছিলই, তার সঙ্গে এবার জেঁকে বসল আতঙ্ক। ভয়ে তারা এরপর থেকে খাঁদাকে রাতের অন্ধকারে কোনো গলিতে দেখলেও চুপ করে থাকত।

এইভাবে বেশ কিছুদিন কাটার পর একটা সাংঘাতিক কাণ্ড হল। সেদিন রাতে পঞ্চাননবাবু শ্যামপুকুর থানাতেই ছিলেন, রাউন্ড দিতে যাবেন বলে তৈরি হচ্ছেন। সেইকালে সব থানার নিজস্ব গাড়ি থাকত না। অফিসাররা কখনও ট্যাক্সি, কখনও রিকশাতে ডিউটি করতেন। পঞ্চাননবাবু প্রস্তুত হয়ে থানার এক সিপাইকে বললেন, ‘অ্যাই রামলাল, একটা রিকশা ডাকতো! একটা রাউন্ড দিয়ে আসি।’

রামলাল রিকশা ডাকতে গেল আর সেই মুহূর্তে দরজা দিয়ে ঢুকলেন আইনজীবী গোপাল ব্যানার্জি। গোপাল ব্যানার্জি ব্যাঙ্কশাল কোর্টের উকিল। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটা ছিনতাইয়ের মামলায় তিনি আসামি পক্ষের হয়ে লড়ছেন, এখন থানায় এসেছেন আসামীর জামিনের জন্য আবেদন করতে।

পঞ্চাননবাবু গোপাল ব্যানার্জিকে দেখেই কিঞ্চিৎ রুষ্ট হলেন। এই মামলার যা ধরন, তাতে আসামির জামিন পাওয়া যায়না। কিন্তু গোপাল ব্যানার্জি আইনের লোক হয়েও তা মানতে চাইছেন না, গত কয়েকদিন ধরে বারবার এসে বিরক্ত করছেন। তিনি বললেন, ‘কি ব্যাপার ব্যানার্জিবাবু?’

গোপাল ব্যানার্জি মিষ্টি করে হাসলেন, ‘আর কি ব্যাপার স্যার, ওই যে আমার ক্লায়েন্টের বেল নিয়ে …।’

পঞ্চাননবাবু বললেন, ‘আপনাকে তো কতবার করে বলছি যে এই কেসে বেল পাওয়া যায় না। আপনি নিজে উকিল আপনি তো সেটা ভালোমতোই জানেন। তবু কেন একই কথা বলছেন বলুন তো?’

দু-জনের মধ্যে কথোপকথন হতে হতে বেশ অনেকক্ষণ গড়িয়ে গেল। গোপালবাবুও ছাড়বেন না, পঞ্চাননবাবুও আইনের বাইরে কিছু করবেন না। এর মধ্যে সিপাই রামলাল এসে দু-বার ডেকে গেছে, ‘বাবু, রিকশা এসে দাঁড়িয়ে আছে!’

কিন্তু তর্কাতর্কিতে রাত প্রায় একটা বেজে গেল। পঞ্চাননবাবু রাউন্ডে যাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে বিরক্ত মুখে চেয়ারে এসে বসে পড়লেন। আর গোপাল বাঁড়ুজ্জে জামিন পাওয়া অসম্ভব বুঝে গজগজ করে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। পঞ্চাননবাবুর রাউন্ডের জন্য যে রিকশাটি আনা হয়েছিল, তাতে চেপে প্রস্থান করলেন।

এর ঠিক আধঘণ্টা পরে হাউমাউ করতে করতে আবার থানায় ঢুকলেন গোপাল বাঁড়ুজ্জে। পঞ্চানন তখন রেজিস্টারে কিছু লিখছিলেন। মুখ তুলে দেখলেন, ফর্সা গোপাল বাঁড়ুজ্জের মুখটা টকটকে লাল হয়ে গেছে, বুকটা ওঠানামা করছে হাপরের মতো। হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি বললেন, ‘প-পঞ্চাননবাবু! আপনি … আপনি আজ বরাতজোরে বেঁচে গিয়েছেন!’

পঞ্চাননবাবু বুঝতে পারলেন কিছু একটা ঘটেছে। তিনি দ্রুত উঠে গোপাল বাঁড়ুজ্জেকে হাত ধরে চেয়ারে বসালেন, এক গ্লাস জল দিলেন। তারপর ক্রমাগত পিঠে হাত বোলাতে লাগলেন, ‘শান্ত হোন গোপালবাবু … জলটা খেয়ে ফেলুন … জোরে জোরে শ্বাস নিন।’

মিনিটপাঁচেক পর গোপাল বাঁড়ুজ্জে একটু সামলে উঠলেন। ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, ‘আপনি আজ খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছেন স্যার! আপনার জন্য যে রিকশাটা আনা ছিল, আমি তাতে উঠে বাড়ি যাচ্ছিলাম। রিকশাওয়ালা মাথায় কাপড় জড়িয়েছিল, সে-ও আমাকে দেখেনি, আমিও তাকে খেয়াল করিনি। শ্যামবাজারের রাস্তা ধরে কিছুদূর যাওয়ার পর আমি যেই আমার বাড়ির গলিতে বেঁকতে বলেছি, অমনি সে পেছন ফিরে আমার দিকে বেশ অবাকচোখে তাকাল। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। বাড়িতে পৌঁছে রিকশা থেকে নেমে আমি যেই ভাড়ার পয়সা দিতে যাচ্ছি, অমনি সে মাথা নেড়ে বলল, ‘ভাড়া লাগবে না গোপালবাবু। ভালো করে আমাকে দেখে নিন। আমিই হলাম খাঁদা। পুলিশ অফিসার পঞ্চানন ঘোষালকে গিয়ে বলে দেবেন আজ তাঁর বদলে আপনি রিকশায় উঠেছিলেন বলে তিনি বেঁচে গেলেন। তবে চিন্তা নেই, খুব শীগগিরই তিনি ওপরে যাবেন। হা হা হা হা!’ এই বলে হাসতে হাসতে সে রিকশা নিয়ে চলে গেল।” গোপালবাবুর গলাটা কাঁপছিল বলতে বলতে।

গোপালবাবুর মুখে ঘটনাটা শুনে থানার সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পঞ্চানন ঘোষাল খাঁদার একাধিক মামলায় সক্রিয়ভাবে ইনভেস্টিগেট করেছেন, সুধীরকে ধরা থেকে শুরু করে মলিনাকে উত্তরপাড়া থেকে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ, সেদিন রাতে মলিনাকে অজ্ঞান করে খাঁদার নিয়ে পালানোর চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেওয়া, পঞ্চাননবাবু সবেতেই বড় ভূমিকা নিয়েছেন।

তাই খাঁদার এখন সমস্ত আক্রোশ এসে জমা হয়েছে পঞ্চাননবাবুর ওপরে।

সুনীল রায় বললেন, ‘আমার মনে হয়, আপনি এখন কিছুদিন ছুটিতে থাকুন পঞ্চাননবাবু!’

‘ধুস!’ উড়িয়ে দিয়ে বললেন পঞ্চাননবাবু, ”পুলিশের চাকরি করতে এসে অত ভয় পেলে চলে নাকি মশাই? দেখা যাক না খাঁদার দৌড় কতটা!”

এর পরেরদিনই আর একজন ইনফরমার খবর আনল, পঞ্চাননবাবু যে পুলিশ কোয়ার্টারে থাকেন, তার জানলা দিয়ে ঢুকে খাঁদা তাঁকে খুন করার ষড়যন্ত্র করেছে। এই খবর কলকাতা পুলিশের উত্তর সেকশনের ডেপুটি কমিশনার মি নর্টন জোন্সের কাছে পৌঁছলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে অর্ডার দিলেন, এক্ষুনি যেন ওই কোয়ার্টারের সব জানলা তারের জাল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।

এইভাবে একটা একটা করে দিন কাটতে লাগলো। গোটা টিম খাঁদা গুন্ডাকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। কারণ খাঁদাকে না ধরলে সে একে একে সবাইকে খুন করবে।

শেষে এমন অবস্থা এল পঞ্চাননবাবু থেকে শুরু অন্যান্য অফিসাররা খাঁদার খোঁজে বেরোনোর সময় জামার তলায় লোহার জ্যাকেট পরতে লাগলেন। মাথায় পরতে শুরু করলেন লোহার হেলমেট, সবসময় সঙ্গে রাখতে আরম্ভ করলেন লোডেড রিভলভার।

জ্যাকেট, হেলমেট এইসব বিশেষ সাজসরঞ্জাম লালবাজারের হেড কোয়ার্টারে রাখা থাকত সশস্ত্র বিপ্লবীদের বাড়িতে রেইড করার জন্য। এই মামলার জন্য স্পেশাল অর্ডারে সেগুলো আনানো হয়েছিল।

 এইভাবে আরও পনেরোদিন কাটল। আবার একটা কাণ্ড হল।

সেদিন থানায় বসে সুনীল রায় আর পঞ্চানন ঘোষাল নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলেন।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পঞ্চানন বললেন, ‘একটা ব্যাপার ভেবে দেখুন সুনীলবাবু, আমরা এই যে হন্যে হয়ে খাঁদা, গোপী আর কেষ্টকে খুঁজছি, আমরা কেউ কিন্তু এদের মুখটা ভালো করে চিনিনা। অথচ এরা আমাদের চেনে। এটাই এই মামলার সবচেয়ে ডেঞ্জারাস ব্যাপার।’

‘ঠিকই বলেছেন। আর তাছাড়া খাঁদা গুন্ডার জন্য অন্য সব কেস মাথায় উঠেছে। রুটিন কাজগুলো হচ্ছে না থানার। কতদিন যে এরকম চলবে!’ সুনীলবাবু কথাটা শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে যাবেন, এমন সময় থানার দরজা দিয়ে ঢুকল পুঁটিরাম।

পুঁটিরাম খুবই বিশ্বস্ত একজন ইনফরমার। অতীতে সে যখন চোর ছিল, তখন হাতসাফাইকে সে এমন শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে খোদ বটতলা থানার ওসির পকেট থেকে মানিব্যাগ তুলে নিয়েছিল।

এহেন পুঁটিরাম পুলিশের ইনফরমার হিসেবেও খুবই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। ইদানীংকালে তাকে সব কাজ বাদ দিয়ে শুধু খাঁদার খোঁজ লাগানোর জন্যই বলে রাখা হয়েছিল। তাই তাকে থানায় ঢুকতে দেখে দু-জনেই আগ্রহের সঙ্গে তাকালেন।

পুঁটিরাম বলল, ‘স্যার! খাঁদা এয়েচে আবার। এখুনি চলুন! একদম পাক্কা খবর।’

পঞ্চানন আর সুনীল তৈরি হয়ে বেরোতে বেরোতে বললেন, ‘কোথায়? ইমামবক্স লেনে মলিনার কাছে?’

‘না স্যার!’ পুঁটিরাম মাথা নাড়ল, ‘চিতপুর রোডে কমলা বলে একটা নামকরা মেয়ে আচে। অল্পদিনেই অনেক টাকা করেচে, তেতলা বাড়িও হাঁকিয়েচে। সেই বাড়ির তেতলায় এ-তল্লাটের অনেক মাগি মিলে আজ খাঁদাকে সম্বর্ধনা দিচ্চে! সঙ্গে গান-বাজনা, খানাপিনা অনেক কিচু হচ্চে। আমি খবর পেয়েই ছুটে এয়েচি।’

খাঁদাকে সম্বর্ধনা! তাও আবার নাকের ডগায় চিতপুর রোডে? পঞ্চানন আর সুনীল দুজনেই হতভম্ব হয়ে গেলেন। খাঁদা খুব ভালো করে জানে তাকে ধরার জন্য পুলিশ এই অঞ্চলের এক ইঞ্চি মাটিও বাদ দিচ্ছে না, সেখানে আজ সে নিশ্চিন্ত মনে এসেছে সম্বর্ধনা নিতে আর গান শুনতে?

এতটা দুঃসাহস কারুর হতে পারে?

যাইহোক, কমলা দাসীর তিনতলা বাড়িতে রুদ্ধশ্বাসে পৌঁছে পঞ্চানন আর সুনীল দেখলেন তিনতলার ঘরের দরজা বন্ধ, ভেতর থেকে ভেসে আসছে গানের আওয়াজ আর ঘুঙুরের শব্দ। পঞ্চাননের নির্দেশ পেয়ে একটুও কালবিলম্ব না করে কয়েকজন কনস্টেবল ক্রমাগত লাথি মেরে দরজাটাকে ভেঙে ফেললো।

দরজা ভেঙে পড়ামাত্র পঞ্চানন আর সুনীল রিভলভার উঁচিয়ে ভেতরে ঢুকলেন, সঙ্গে ঢুকলেন খাঁদার বন্ধু হরিপদবাবু।

সকলে মিলে সভয়ে দেখলেন একটা লোক খোলা জানলা দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ল। হরিপদবাবু চিৎকার উঠলেন, ‘ওই! ওই তো খাঁদা! গুলি করুন, এক্ষুনি গুলি করুন স্যার!’

কিন্তু গুলি করার আগেই সেই লোক জানলা থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।

সম্বর্ধনা সভা তখন ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। চার পাঁচটা চুলে বেলফুলের মালার জড়ানো রঙচঙে পোশাক পরা মেয়ে ছোটাছুটি শুরু করেছে, কেউ কেউ কান্নাও জুড়ে দিয়েছে।

পঞ্চানন সেসব মেয়েদের টপকে জানলার দিকে যাচ্ছিলেন, সুনীল রায় বাধা দিয়ে বললেন, ‘ওদিকে গিয়ে লাভ নেই। খাঁদাকে আর জ্যান্ত ধরা গেল না, এটাই যা আফশোস পঞ্চাননবাবু। ব্যাটা উত্তেজনার বশে তিনতলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে দিল। ইশ! চলুন, ওর বডিটা আগে গিয়ে দেখি ভালো করে।’

সবাই মিলে নীচের রাস্তায় এসে পৌছতেই হাঁ হয়ে গেল। সেখানে খাঁদার মৃতদেহ তো দূর, একফোঁটা রক্তও পড়ে নেই।

পাশেই একটা খোলা পানের গুমটিতে বসে একটা পানওয়ালা ঠকঠক করে কাঁপছিল। পঞ্চাননবাবুরা তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে দেখলেন, তার দুই গালে টকটকে লাল পাঁচ আঙুলের ছাপ।

‘ওপর থেকে একটা লোক দেকলাম ওপর থেকে কিচুটা পাইপ বেয়ে নামল, তারপর ভল্ট খেতে খেতে নামচিল। আমি ভাবলাম পড়েই মরে যাবে, তাই দোকান থেকে বেরিয়ে এগোতে যাচ্চি, এমন সময় লোকটা ফুটপাথের ওপর আছড়ে পড়ল, কিন্তু তারপরই উঠে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজের হাত-পা গুলো টেনে টেনে সোজা করল, তারপর আমার কাচে এসে জোরে একটা চড় কষিয়ে বলল, এখুনি একটা সিগারেট দে। আ-আমি তো দেখেই খাঁদাবাবুকে চিনেচি আর ভয়ে কাঁপতে লেগেচি। খাঁদাবাবু নিঘঘাত ভূতপ্রেত, নাহলে অত ওপর থেকে পড়ে কেউ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াতে পারে? সিগারেট দিতেই খাঁদাবাবু আমার আরেক গালে চড় কষিয়ে বলে, দেশলাই দে। সেটাও দেওয়ামাত্র সিগারেটটা ধরিয়ে জোরে একটা টান দিল, তারপর দোকানের গায়ে দাঁড় করানো আমার সাইকেলটায় চড়ে গান গাইতে গাইতে চলে গেল।’ পানওয়ালা বলতে বলতে হাপুসনয়নে কাঁদছিল।

সেদিনও গোটা তল্লাট চষে ফেলা হল। যেসব মেয়েরা তাদের খদ্দেরের সঙ্গে বন্ধ ঘরে ব্যস্ত ছিল, তাদেরও জোর করে দরজা খুলিয়ে ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজা হল।

 কিন্তু না। খাঁদা আবারও পুলিশকে কাঁচকলা দেখিয়ে পালিয়ে গেল। যার বাড়িতে জলসা বসেছিল, সেই কমলা দাসী ও অন্য আরো কয়েকটা মেয়েকে পাকড়াও করা হল, কিন্তু তাদের কাছ থেকে কিছুই কথা আদায় করা গেল না।

খাঁদার আবার খোঁজ পাওয়া গেল সপ্তাহদুয়েক পর। আর এবারের খোঁজটি এতই অবিশ্বাস্য যে মনকে অনেকরকমভাবে বুঝিয়েও পঞ্চানন আর সুনীল কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলেন না।

যে খোঁজ এনেছিল, তার নাম ছকু। ছকু জোর দিয়ে বলল, ‘আমি যা বলচি তা যদি মিথ্যে হয়, আমার কান কেটে নেবেন স্যার। ছকু সর্দার ভুল খপর দেয় না। একদম হক কতা বলচি, খাঁদাবাবু রয়েচেন শান্তিনিকেতনে। সেখানে মান্যিগন্যিদের জন্য যে থাকার জায়গা, সেকেনেই তিনি রয়েচেন, আশ্রমে ঘুরে বেড়াচ্চেন।’

 পঞ্চাননবাবু হতবাক হয়ে সুনীলবাবুর দিকে তাকান। সুনীলবাবুও তাই। এ’কি বিশ্বাসযোগ্য? শান্তিনিকেতনে ভি আই পি-দের জন্য নির্ধারিত যে গেস্টহাউজ, সেখানে রয়েছে খাঁদা?

দুজনের কেউই বিষয়টা হৃদয়ঙ্গম করতে না পারলেও পাশে বসে থাকা হরিপদ সরকার মাথা নাড়লেন, ‘খাঁদার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। আগেই আপনাদের বলেছি, সমাজের অনেক উঁচুমহলে তার যাতায়াত আছে।’

অতএব এবার শান্তিনিকেতন অভিযান। এবারেও পঞ্চাননবাবু স্থির করলেন, তিনিই যাবেন।

কিন্তু যাত্রাশুরুর আগের দিন ডেপুটি কমিশনার মি নর্টন জোন্সের আদেশ এল, ‘শান্তিনিকেতন আশ্রমের পরিবেশ যেন কোনোভাবেই লঙ্ঘন না হয়। স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এখন আশ্রমে উপস্থিত রয়েছেন। খাঁদা গুন্ডাকে পেলেও তাকে যেন কৌশলে আশ্রম চৌহদ্দির বাইরে নিয়ে এসে গ্রেপ্তার করা হয়। কোনোরকম গোলাগুলিও আশ্রমের মধ্যে যেন না করা হয়।’

পঞ্চানন পড়লেন বেজায় ফ্যাসাদে। খাঁদার মতো দুর্দমনীয় গুন্ডাকে ধরতে পারাটাই একটা কঠিন কাজ, তার ওপর তাকে তাড়া করে আশ্রম ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে এসে গ্রেপ্তার করাটা মোটেও সহজ নয়।

তার ওপর তাঁর মনটা একটু খারাপও হয়ে গিয়েছিল। তিনি অবসরে সাহিত্যচর্চা করতেন, কিছু পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপাও হয়েছিল। বহুদিন ধরে তাঁর মনে সুপ্ত বাসনা ছিল, শান্তিনিকেতনে গিয়ে কবিগুরুর পায়ের ধুলো নেওয়ার।

এই প্রথমবার তিনি শান্তিনিকেতন যাচ্ছেন, কিন্তু পরিস্থিতির চাপে এবার আর কিছুতেই তা সম্ভব নয়।

পঞ্চানন ভারাক্রান্ত মনে কলকাতা ছাড়লেন বটে, কিন্তু চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখলেন না। খাঁদার বাল্যবন্ধু হরিপদবাবুকে সঙ্গে নিয়ে বোলপুর পৌঁছে তিনি উঠলেন শান্তিনিকেতনের সাধারণ অতিথিভবনে। নিজেদের পরিচয় দিলেন সাধারণ পর্যটক হিসেবে।

তারপর চষে ফেলতে শুরু করলেন গোটা এলাকা। ব্যস্ততা এতটাই বাড়ল যে আশ্রম ঘুরে দেখার সময়টুকু পর্যন্ত পেলেন না।

পরিশ্রমের ফল মিলল। তিনদিনের মাথায় উত্তরায়ণের সামনের রাস্তায় ধোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরে একটা ঝোলা কাঁধে বই হাতে খাঁদাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। কিন্তু কাছাকাছি যেতে না যেতেই পাখি ফুড়ুৎ। খাঁদা যেন শূন্যে বিলীন হয়ে গেল।

অতঃপর শান্তিনিকেতন, বোলপুর, শ্রীনিকেতন তোলপাড় করে ফেললেও আর খুঁজে পাওয়া গেল না খাঁদাকে।

বিফলমনোরথ হয়ে কলকাতা ফিরলেন পঞ্চানন ঘোষাল। কিন্তু মাঝপথে হাল ছেড়ে দেওয়া তাঁর রক্তে ছিল না। হতাশ হয়ে পড়ার পরিবর্তে তিনি আরো উদ্যম নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে লাগলেন। খাঁদা গুন্ডার এই কেসকে থেকে আরও একবার খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন তিনি।

আর তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, খাঁদার রক্ষিতা মলিনাসুন্দরীর বাড়িতে তখনও যে দু-জন পুলিশ মোতায়েন করা ছিল, তাদের তুলে নেবেন। বদলে বাড়ির কাছাকাছি রাখবেন একজন সাদা পোশাকের পুলিশকে।

এবার খাঁদা ফাঁদে পা দিল। যে মলিনার জন্য সে পাগলাকে খুন করে মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলেছিল, সেই মলিনাকে দেখতে না পেয়ে সে অস্থির হয়ে উঠছিল। পুলিশি প্রহরা উঠে যেতেই ডানহাত কৃষ্ণলাল ওরফে কেষ্টকে পাঠাল মলিনার খবর নিতে।

আর এইভাবেই ১৯৩৬ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর কেষ্ট পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হল। পাগলা হত্যা মামলার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ও খাঁদার অনুসন্ধানকাজে লিপ্ত প্রতিটা থানায় সাজো সাজো রব পড়ে গেল।

খাঁদার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল অপরাধ, কিন্তু কেষ্টর তা নয়। সে ছিল উচ্চবংশজাত ব্রাহ্মণসন্তান, কৈশোরে কুসঙ্গে ভিড়ে সে এমন হয়ে গিয়েছিল।

খাঁদার যেমন নিজের কৃতকর্ম নিয়ে অহংকার ছিল, নিজের এই পরিচয়ে সে গর্বিত হত, কেষ্ট আবার সম্পূর্ণ বিপরীত, সে থেকে থেকেই অনুশোচনায় দগ্ধ হত। তার তখন মনে হত, সে বংশের কুলাঙ্গার।

পঞ্চানন ঘোষাল কোনো সাধারণ পুলিশ অফিসার ছিলেন না, তিনি অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব খুঁটিয়ে বুঝতে পারতেন এবং পরবর্তীকালে এই নিয়ে তিনি বিস্তর গবেষণাও করেছেন। বস্তুত তিনিই ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম অপরাধবিজ্ঞানী।

অন্য পুলিশরা থার্ড ডিগ্রির কথা বললেও কেষ্টর মনের এই দিকটার হদিশ পেয়ে পঞ্চানন তাকে জেরা করার স্টাইল বদলে ফেললেন। কড়া প্রশ্নোত্তর বা ধোলাইয়ের বদলে তার সঙ্গে অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করলেন। থানাতেই লুচি তরকারি রসগোল্লা খাইয়ে তাকে চমৎকার বিছানায় শোয়ানোর ব্যবস্থা হল।

কেষ্ট জানত, বহুদিন ধরে খাঁদাকে আর তাকে পুলিশ গোরু খোঁজা খুঁজছে। ধরা পরে যেতে যে কপালে প্রচুর অত্যাচার অপেক্ষা করছে, তা তার কাছে ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু এমন আশ্চর্য ব্যবহার পেয়ে সে বিস্মিত হয়ে গেল।

পঞ্চানন নরম গলায় বললেন, ‘কৃষ্ণলাল, নিয়তির ফেরে তুমি এই দলে ভিড়েছিল ঠিকই, কিন্তু তুমি যে কত বড়ো বংশের ছেলে, তা আমি জানি। তুমি আমার সব কিছু খুলে বলো আর নাই বলো, আমি জোর করবো না।’ তারপর পাশে দাঁড়ানো সিপাইকে পূর্বপরিকল্পনামত তিরস্কার করে বললেন, ‘একী! একে হাতকড়া পরিয়ে রেখেছ কেন? শীগগিরই খুলে দাও!’

মানুষ প্রচণ্ড পরিমাণে খেয়ে ফেললে মস্তিষ্কের রক্ত উদরকে নিয়ন্ত্রণের জন্য উদরে নেমে আসে, ফলে মস্তিষ্কে রক্ত হ্রাস পায়, মস্তিষ্কের শক্তিও কমে যায়, মানুষের প্রতিরোধ শক্তিও তার সঙ্গে কমতে থাকে। এই অবস্থায় মানুষের মন expressive হয়ে ওঠে। পঞ্চানন এগুলো জানতেন বলেই কেষ্টকে ভরপেট খাইয়ে ছিলেন।

কেষ্ট উপর্যুপরি বিস্মিত হয়ে উঠছিল। উত্তম-মধ্যম মারের বদলে তার কপালে জামাই আদর জুটছে! কিন্তু কেন?

পঞ্চানন এবার সিপাইকে হুকুম করলেন, ‘দোতলায় আমার কোয়ার্টার থেকে আমার আরামকেদারাটা নিয়ে এসো।’

আরামকেদারায় কেষ্টকে শোয়ানোর পেছনেও একটা কারণ ছিল। আরামকেদারায় শুলে স্নায়ু শিথিল হয়ে পড়ে, যুক্তি তর্কের ক্ষমতা কমে যায়, বিচারবোধও হ্রাস পায়।

সবরকম ব্যবস্থাপনা করে রাত দশটা নাগাদ পঞ্চানন ঘোষাল কেষ্টর পাশে বসে তার সঙ্গে অত্যন্ত আপনজনের মতো গল্প করা শুরু করলেন। কেষ্টর ছোটোবেলার কথা, মা-বাবা ভাই-বোন, এইসব নিয়ে কথা বললে বলতে অত্যন্ত কৌশলে ঢুকে পড়লেন আসল প্রসঙ্গে।

আগেই বলেছি, কেষ্ট খাঁদার মতো ধুরন্ধর জাত অপরাধী ছিল না, এই পুলিশ অফিসারটির কাছ থেকে এমন সহৃদয় ব্যবহার পেয়ে ভরা পেটে আরামে শুয়ে সে অসতর্ক হয়ে অনেক কিছু বলে ফেললো।

‘খাঁদা খুব হিংস্র স্যার, একবার যদি কাউকে মারবে মনে করে, তাকে কিছুতেই রেহাই দেয় না। এই ধরুন না, পাগলা মাস্টারের কথা। পাগলা যে মলিনাকে ভালোবাসত, তা খাঁদা বিলক্ষণ জানত, অত গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু একদিন রাতে সে মলিনার ঘরে পাগলাকে দেখতে পেয়ে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে পাগলাকে চড়থাপ্পড় মেরে বসল। পাগলাটাও ছিল বোকা, কিছুই করার মুরোদ নেই, যাওয়ার আগে বলে গেল, জেল থেকে পালিয়ে বেড়াচ্চ, আর আমাকে মারা হচ্চে? দাঁড়াও না, পুলিশে খবর করচি, কোমরে দড়ি দিয়ে নিয়ে যাবে। এই কথাটা পাগলা নেহাতই কথার কথা বলেছিল, সে পুলিশে খবর দেয়নি তা আমরা ভালোমতোই জানতাম। কিন্তু সেইসময় বারদুয়েক মলিনার বাড়িতে বটতলা থানার পুলিশ হানা দিল। আর খাঁদা সন্দেহ করল নির্ঘাত পাগলা গিয়ে নালিশ করেছে। তখনই সে ঠিক করল, পাগলাকে মারবে।

৪ তারিখ রাতে গরাণহাটা স্ট্রিট থেকে পাগলাকে একটা ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে আমরা পৌঁছেছিলাম গঙ্গার ঘাটে। আসার পথে পাগলার চিৎকারে সত্য গোয়ালা আর হারু গোঁসাই দেখেছিল আমাদের। গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে খাঁদা পাগলাকে হুকুম দিল স্নান করে আসতে। পাগলা তাই করল। সেইসময় সেখানে গঙ্গা সাঁতরে উপস্থিত হয়েছিল গৌড়িয়া। গৌড়িয়া হল ‘খাউ’ অর্থাৎ কিনা চোরাই মাল বেচাকেনা করে। সে প্রথমে আমাদের সঙ্গে দাঁড়াল, কিন্তু যখন দেখল এ খুনখারাপির ব্যাপার, তখন সরে পড়ল। তাতে খাঁদা রেগেও গিয়েছিল। যাইহোক, গঙ্গাস্নানের পর খাঁদা তাকে নিয়ে গেল কাছের কালভৈরব শিবমন্দিরে। সেখানে পাগলাকে বলল নমস্কার করে চরণামৃত খেয়ে আসতে। পাগলা তাই করল। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হল কুমারটুলির বলরাম মজুমদার স্ট্রিটের পেছনের মেথর গলিতে। সেখানে গিয়েই খাঁদা তার ছুরি বের করল। সেখানা তার শখের ছুরি, হাতির দাঁত দিয়ে বাঁটটা বাঁধানো। ওই ছুরি দিয়ে খাঁদা অনেক কাজ করেছে। খাঁদা পাগলাকে বলল, তোর কিচু শেষ ইচ্ছে আচে? পাগলা এমন হাঁদা, এত কিছুর পরেও বলে কি, হ্যাঁ। আমি একবার মলিনাকে দেকতে চাই। এই শুনে খাঁদা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ওর টুঁটি টিপে ধরল। তারপর ছুরিটা নিয়ে পরপর তিনবার পাগলার বুকে বসিয়ে দিল।’

‘খাঁদা অ্যানাটমি নিয়ে অনেক পড়াশুনো করেছে, সেই বিষয়ে তার জ্ঞানও প্রচুর। তাই সে এমনভাবে মানুষের বুকে ছুরি বসায় যে তার আর বাঁচার সম্ভাবনাই থাকে না। তারপর খাঁদা আর আমি যাই খাঁদার কৃপানাথ বোস লেনের বাড়িতে। সেখানে দেবেনের সঙ্গে দেখা হয়। খাঁদা সেখানে স্নান করে রক্তমাখা জামাকাপড়গুলো ছেড়ে ফেলে। কিন্তু তারপর আবার তার কী খেয়াল হয় কে জানে, আমাকে নিয়ে আবার যায় সেই মেথর গলিতে। গিয়ে পাগলার গোড়ালির শিরাদুটো কেটে দেয়। মুণ্ডুটাও এক কোপে ধড় থেকে আলাদা করে দেয়।

‘তারপর আমরা কাটা মুণ্ডুটা একটা চটের বস্তায় নিয়ে চলে যাই গঙ্গার ধারে। সেখানে খাঁদা মুণ্ডু সমেত বস্তাটা জলে ফেলে দেয়। একটা লোক আমাদের ফেলতে দেখে বলে, কি ফেললেন? খাঁদা বলে, মরা বিড়াল।’

 পঞ্চানন, সুনীল ও থানার অন্যরা হতবাক হয়ে শুনছিলেন কেষ্টর আপন খেয়ালে বলে যাওয়া কথাগুলো। পঞ্চাননবাবুর থেরাপি যে এমন কাজ দেবে, কেউ ধারণাই করতে পারেনি।

কেষ্ট থামলে পঞ্চাননবাবু সহানুভূতির সঙ্গে বললেন, ‘তোমার মতো ভালোমানুষকে ভাগ্যের দোষে খাঁদার এই সব নিষ্ঠুরতা সহ্য করতে হয়েছে দেখে খুব খারাপ লাগছে ভাই। যে পাগলার মতো নিরীহ লোককে এইভাবে মারতে পারে, সে সোনাগাছির গুন্ডা হয়ে না জানি ওখানকার কত মেয়ের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে।’

‘না স্যার!’ কেষ্ট বলল, ‘এই একটা ব্যাপারে খাঁদা শুধু নিজে নয়, আমাদের ওপরেও কড়া। সোনাগাছি, রামবাগান, নাথের বাগান, ইমামবাড়ি লেন, চাঁপাতলা এইসব এলাকায় যে হাজার হাজার পতিতা মেয়ে বাস করে, তাদেরকে বুক দিয়ে আগলায় খাঁদা। ও সবসময়ে আমাদের বলে, ওদের ওপর কোন অত্যাচার করিসনি। পৃথিবীতে ওরাই আমাদের একমাত্র বন্ধু। পুলিশের দল কুকুরের মতো যখন আমাদের পল্লি থেকে পল্লিতে খেদিয়ে নিয়ে বেড়ায়, তখন একমাত্র ওরাই আমাদের সাহায্য করে। ওরা আমাদের আশ্রয় দেয়, আহার্য ও পানীয় দেয়, আর দেয় একজন সাময়িক পত্নী।’

‘বুঝলাম।’ পঞ্চাননবাবু একটু থেমে বললেন, ‘আচ্ছা, খাঁদা এখন কোথায়?’

 ‘সে তো এখন দেওঘরে স্যার!’ কেষ্ট দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে উদাসচোখে বলল।

‘দেওঘরে?’ সবাই বিস্মিত। এখানে খাঁদার খোঁজে সারাক্ষণ তল্লাশি চলছে, আর সে সুদূর দেওঘরে গিয়ে বসে আছে?

‘হ্যাঁ স্যার।’ কেষ্ট বলল, ‘দেওঘরে খাঁদা বিশাল এক রাজপ্রাসাদ ভাড়া নিয়েছে। নিজের পরিচয় দিয়েছে ‘রাজা অফ কুমারটুলি’ বলে। সেখানে সে অনেক চাকরবাকর রেখে প্রচণ্ড বিলাসিতার মধ্যে বাস করছে। রোজ ভিখারিদের দানধ্যান করে, প্রায়ই শহরের বড়ো বড়ো লোকেদের নিমন্ত্রণ করে নৈশভোজে। সরকারি অফিসাররাও গিয়ে সেখানে আড্ডা জমান। ঢালাও খানাপিনা চলে। সেখানে অল্পদিনেই তার প্রচুর খ্যাতি হয়েছে। আমিও সেখানেই ছিলাম তার দেওয়ান হয়ে। কিন্তু খাঁদার শখ হয়েছিল, সে তার রানি অর্থাৎ মলিনাকেও নিয়ে যাবে দেওঘরের প্রাসাদে। তাই আনতে এসেছিলাম। কিন্তু আপনাদের হাতে ধরা পড়ে গেলাম। পঞ্চাননবাবু, আপনি যেন সেখানে যাবেন না। আপনার ওপর খাঁদার খুব রাগ, গেলে আপনার হাল ও পাগলার মতোই করে ছাড়বে।’

কেষ্টর কথা শুনতে শুনতে রাত কেটে ভোর হয়ে এসেছে। কেষ্ট কখন কথা বলতে বলতে আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়েও পড়েছে।

পঞ্চানন, সুনীল আর বাকিরা পাশের ঘরে এসে থ’ হয়ে বসে পড়লেন। কেষ্ট যা বলল, তা যেন বিশ্বাসের অতীত।

সুনীল বললেন, ‘মাই গুডনেস! রাজা অফ কুমারটুলি? এই খাঁদা নামক লোকটি আর কত খেল দেখাবে পঞ্চাননবাবু?’

পঞ্চাননবাবু কী চিন্তা করছিলেন, সুনীল রায়ের কথার উত্তর না দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক সিপাইকে বললেন, ‘মধু, তুমি গিয়ে কেষ্টর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দাও, তারপর তাকে গারদে পুরে ফেল। সে এতক্ষণ অনেককিছু আমাদের বলে ফেলেছে। সকাল হয়ে আসছে। যেকোনো মুহূর্তে সে বুঝতে পারবে কত বড়ো ভুল করে ফেলেছে। তখন তাকে সামলানো কঠিন হবে।’

পঞ্চাননবাবুর কথাই ঠিক। গারদে পোরার কিছুক্ষণের মধ্যে কেষ্ট চিৎকার করে গালাগাল দিতে শুরু করল। কায়দা করে, ভুলিয়ে ভালিয়ে কেমনভাবে তার কাছ থেকে সব কথা বের করে নেওয়া হয়েছে, সে যে খাঁদার প্রতি কতবড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেলেছে, তা বলতে বলতে সে দেওয়ালে মাথা ঠুকছিল।

তার রকমসকম দেখে ইনস্পেক্টর সুনীল রায় তাকে থানায় রাখতে সাহস পেলেন না, জেলে পাঠিয়ে দিলেন।

অবশেষে এল রাবণ বধের পালা। আর সেই ভার একাই নিজের কাঁধে তুলে নিলেন অসমসাহসী অফিসার কলকাতা পুলিশের গর্ব পঞ্চানন ঘোষাল। সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পরিবারপরিজন, সকলের ভয়, উৎকণ্ঠা, নিষেধ উপেক্ষা করে রওনা দিলেন দেওঘরের উদ্দেশ্যে।

সঙ্গে পুলিশ ফোর্স নেওয়া গেল না, কারণ তাতে খাঁদা খবর পেয়ে যেতে পারে।

অনেক অনুরোধ উপরোধের পর পরবর্তী ছ-মাস অষ্টপ্রহর পুলিশি প্রহরার পরিবর্তে তাঁর সঙ্গে যেতে রাজি হল খাঁদার বাল্যবন্ধু হরিপদ সরকার। দেবেনকেও বলা হয়েছিল। কিন্তু সে সদ্য বিয়ে করেছে, স্ত্রীর বিধবা হবার আশঙ্কায় কিছুতেই যেতে সম্মত হল না।

হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে গেলে খাঁদার দলের অন্যান্যরা টের পেয়ে যেতে পারে, তাই পঞ্চাননবাবু আর হরিপদবাবু একটা গাড়ি ভাড়া করে সোজা চলে গেলেন নৈহাটি, তারপর সেখান থেকে ব্রিজ পার হয়ে জি টি রোড ধরে পৌঁছলেন আসানসোল। আসানসোল থেকে উঠলেন দেওঘরের ট্রেনে।

পঞ্চানন ঘোষালের মাথায় পেশোয়ারি টুপি, পরনে সিল্কের চোগা কামিজ, চোখে সুর্মা। দেখলে কেউ চিনতে পারা তো দূর, বাঙালিও ভাববে না। বাইরে অহরহ চুরুট খেলেও ভেতরে তাঁর মনে প্রবল উত্তেজনা, সারাটা রাত বার্থে শুয়ে ছটফট করলেন।

ট্রেন দেওঘর পৌঁছল পরেরদিন ভোরবেলা। স্টেশনে নেমেই শহরে ঢুকে পঞ্চাননবাবু একটা ঘর ভাড়া করলেন, সেখানে হরিপদ সরকারকে রেখে ছদ্মবেশ খুলে ফেলে বেরিয়ে পড়লেন কাজে। প্রতিটা মুহূর্ত এখন অমূল্য। কেষ্ট পুলিশের জিম্মায় থাকলেও খাঁদার অনেক সাঙ্গোপাঙ্গ গোটা কলকাতায় ছড়িয়ে আছে, যেকোনো মুহূর্তে এখানে খবর চলে আসতে পারে। তখন সব প্রচেষ্টাই জলে যাবে।

পঞ্চাননবাবু একটা রিকশায় উঠে বললেন, ‘বিলাসী টাউন চলো।’

কেষ্ট ক্ষণিকের দুর্বলতায় বলেছিল খাঁদা বিলাসী টাউনে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। পঞ্চাননবাবু আগেও দেওঘর এসেছেন, সেই সূত্রে জানেন, বিলাসী টাউন হল দেওঘরের সবচেয়ে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন এলাকা। ফাঁকা ফাঁকা রাতা, দু-পাশে আকাশ ঢাকা লম্বা লম্বা গাছ, দু-পাশে ছবির মতো চোখ জুড়নো বাংলো। মূলত ধনী ব্যক্তিরাই সেখানে থাকেন।

বিলাসী টাউনে পৌঁছে রিকশা থেকে নামতে না নামতেই বৃষ্টি শুরু হল। পঞ্চাননবাবুর সঙ্গে ছাতা নেই, বৃষ্টিতে ভেজার হাত থেকে বাঁচতে তিনি তড়িঘড়ি আশ্রয় নিলেন একটা সুবিশাল প্রাসাদোপম অট্টালিকার গেটে।

গেটটা অত্যন্ত সুন্দর ও ওপরে ছাউনি দেওয়া। গেটের ভেতরদিকে তাকালে লাল সুরকি আর মোরাম বিছোনো লন দেখা যায়। সেই লন গিয়ে মিশেছে প্রায় দুশো মিটার দূরের প্রকাণ্ড বাংলোটায়।

পঞ্চাননবাবু গেটে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাঁর মতো আরও কয়েকজন সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মধ্যে একজন স্থানীয় স্কুলশিক্ষক। বাঙালি। নাম রামকৃষ্ণ বটব্যাল। পঞ্চানন নিজের পরিচয় দিয়েছেন ট্যুরিস্ট হিসেবে। বলেছেন কলকাতায় এক সওদাগরী অফিসের কেরানি তিনি। পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন। এখন একা রাস্তায় বেরিয়ে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছেন।

রামকৃষ্ণবাবুরা তিন পুরুষ ধরে দেওঘরে। তাই নিয়ে নানা গল্প জুড়ে দিলেন। তাঁর ঠাকুরদা কবে কীভাবে হুগলির এক গ্রাম থেকে দেওঘরে এসে চাকরি পেয়েছিলেন, জমি কিনেছিলেন, এখন ব্যস্ততায় দেশের বাড়ি যাওয়াই হয়না ইত্যাদি।

পঞ্চানন শুনতে শুনতে একসময় চারপাশ দেখে নিয়ে অত্যন্ত সতর্কভাবে নীচুগলায় প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা মাস্টারমশাই, এসে থেকে শুনছি এক বাঙ্গালী রাজাবাবু নাকি এখন এসেছেন বিলাসী টাউনে? আপনি জানেন কিছু?’

রামকৃষ্ণবাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘ওমা! আপনি জানেন না? কুমারটুলির রাজাবাবু খোদ এখন এখানে রয়েছেন তো! আহা কী দয়ামায়া তাঁর, কী বলব আপনাকে। রোজ দু-বেলা কত লোক যে পাত পেড়ে খাচ্ছে। এছাড়া পোশাক-আশাক বিতরণ তো আছেই।’

‘কোন বাড়িটায় রয়েছেন তিনি?’ পঞ্চাননবাবু মিহিগলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘জানেন আপনি?’

মাস্টারমশাই এবার হেসে ফেললেন, ‘আপনি রাজাবাবুর বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছেন উনি কোথায় থাকেন? এটাই তো রাজাবাবুর বাড়ি!’

পঞ্চাননবাবুর হৃদপিণ্ডের রক্ত ছলকে উঠল, তিনি প্রচণ্ড বিস্ময়ে পেছন দিকে তাকালেন। এতক্ষণ লক্ষ্য করেননি, এবার তাঁর চোখে পড়ল, গেটের বাঁ-পাশে একটা নেমপ্লেট সাঁটা। তাতে ইংরেজি হরফে বড়োবড়ো করে লেখা, ‘Raja of Coomartoli’.

মাস্টারমশাই বলে চলেছিলেন, ‘আর একটু দাঁড়ান, দশটা বাজলেই রাজাবাবু তাঁর গাড়ি চড়ে বেরোবেন। রাস্তার দু-পাশে যারা দাঁড়িয়ে থাকে, তাঁদের উনি টাকা বিলোতে বিলোতে যান। বড্ড দয়ার শরীর যে!’

পঞ্চাননবাবু স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছিলেন। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! তিনি এত অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার হয়েও কল্পনাই করতে পারেননি যে তিনি সাক্ষাৎ সিংহের মুখের সামনে এসে পড়েছেন।

এই রাজকীয় প্রাসাদ ভাড়া করে খাঁদা থাকছে? তাও আবার কুমারটুলির রাজা পরিচয়ে? এখানকার স্থানীয়রা তো বটেই, প্রবাসী বাঙালিরাও ভেবে নিয়েছে কুমারটুলি বোধ হয় কলকাতার একটা জেলা। সেখানকার রাজা মানে বিশাল হোমরাচোমরা কেউ!

পঞ্চাননবাবু রামকৃষ্ণ বটব্যালের থেকে বিদায় নিয়ে হনহন করে হাঁটতে শুরু করলেন।

রামকৃষ্ণবাবু হাঁকতে লাগলেন, ‘ও মশাই, আরে বৃষ্টিটা কমুক, কোথায় চললেন?’

পঞ্চাননবাবু কর্ণপাত করলেন না। ভিজতে ভিজতে লম্বা পা ফেলে চললেন থানার দিকে। তাঁর মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। এই মূর্তিমান শয়তানকে তিনি কী করে ধরবেন?

সৌভাগ্যক্রমে এখানকার থানার ওসিও বাঙালি। নাম সুরেশবাবু। তিনি তো দেখেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন, ‘আরে কাল থেকে শুনছি কোনো একটা ইনভেস্টিগেশনে কলকাতা থেকে একজন অফিসার আসছেন। কী হয়েছে বলুন তো? আমার বিলাসী টাউন কিন্তু খুব শান্তির জায়গা!’

পঞ্চাননবাবু হাসলেন কিন্তু কিছু বললেন না। সুরেশবাবু ওসি হলেও তাঁর সঙ্গে ‘কুমারটুলির রাজা’র কতটা ঘনিষ্ঠতা তিনি জানেন না। খাঁদা এখানে যে হারে সরকারি লোকেদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ায়, এই সুরেশবাবুকেও নিমন্ত্রণ করা অসম্ভব তো নয়ই, বরং খুবই সম্ভব। তিনি মুখে বললেন, ‘কুমারটুলি এলাকার একজন খুনি এদিকে পালিয়ে এসেছে। তারই সন্ধানে আছি।’

‘ওহ আচ্ছা তাই?’ সুরেশবাবু বললেন, ‘কুমারটুলির রাজাবাহাদুর তো স্বয়ং এখানে উপস্থিত আছেন। তিনি যদিও ভীষণ অহংকারী, দেওঘরের বড়ো বড়ো লোকেদের সঙ্গে ওঠাবসা করেন, আমার মতো ছোটো থানার দারোগাকে পাত্তাই দেন না। দু-দিন তো ওপরমহলের আদেশে আমাকে ওঁর বাড়ির গেটে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থাও করতে হয়েছিল। তা ওঁর লোকজনের কাছে গোপনে খবর নেব?’

‘না না কাউকে বলতে হবে না।’ পঞ্চাননবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, ‘আপনি শুধু আমায় যখন প্রয়োজন লোক দিয়ে সাহায্য করবেন।’

‘আরে সে আর বলতে!’ সুরেশবাবু হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিলেন, ‘অবশ্যই। আমার তরফ থেকে সবরকম সহযোগিতা পাবেন।’

পঞ্চাননবাবু থানা থেকে বেরিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। খাঁদা এখানকার লোকজনকে এমন মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে, চারপাশে কাউকেই বিশ্বাস করা যাচ্ছে না।

অনেক ভেবেচিন্তে তিনি রওনা দিলেন তাঁরই এক আত্মীয় রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। তিনি এখানকার বেশ বড়োমাপের মানুষ, দেওঘর কোর্টের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। একমাত্র তাঁকেই নির্দ্বিধায় সব খুলে বলা যায়। হরিপদ সরকার সঙ্গে না এলে তিনি তাঁর বাড়িতেই উঠতেন।

রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সব শুনে চমকে উঠলেন, ‘বল কি পঞ্চানন! কুমারটুলির রাজাসাহেব তো আমাকেও নিমন্ত্রণ করেছিল। কিন্তু আমি যাইনি।’

পঞ্চানন বললেন, ‘বুঝতেই তো পারছেন রবীনদা, কী সাংঘাতিক লোক। এদিকে এখানে সবার কাছে এমন মুখোশ পরে রয়েছে, আমি কাউকে ভরসা করে বলতেও পারছি না। কীভাবে গ্রেপ্তার করা যায় বলুন তো?’

‘এক কাজ করো।’ রবীন্দ্রনাথবাবু চিন্তা করে বললেন, ‘তুমি এখানে স্নানখাওয়া সেরে ফেলো, আমি ততক্ষণে এস ডি ও সাহেবকে গিয়ে সব জানাচ্ছি। এখানকার হেড কোয়ার্টার হল দুমকা শহরে। এস ডি ও-কে বলে দুমকা থেকে পুলিশ ফোর্স আনাব।’

পঞ্চানন বললেন, ‘সেই ভালো। ফোর্স এলে গভীর রাতে ওই বাংলো ভেঙে ঢুকে খাঁদাকে অ্যারেস্ট করবো। আপনি চলে যান রবীনদা।’

রবীন্দ্রনাথবাবু তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতেই পঞ্চানন পকেট থেকে রিভলভার করে বউদির হেফাজতে রাখলেন। তারপর এ-বাড়ির আর্দালিকে দিয়ে হরিপদ সরকারকে খবর পাঠালেন, সে যেন এখুনি এখানে চলে আসে। তারপর স্নান করে নিলেন।

বউদি বললেন, ‘তোমাকে খেতে দিয়ে দিই পঞ্চানন?’

‘না বউদি, রবিনদা আসুক, একসাথেই খাব’খন।’ পঞ্চানন বাইরে বেরোতে বেরোতে বললেন, ‘আপনাদের এদিকটা ভারী সুন্দর। একটু হেঁটে আসছি বউদি।’

পঞ্চানন বেরিয়ে ইতস্তত হাঁটছিলেন। ছোটোনাগপুর মালভূমির ওপর ইতস্তত ছড়ানো আর ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে এই দেওঘর শহর যেমন সুন্দর, এর জলহাওয়াও তেমনই উত্তম।

পঞ্চানন ঠিক করলেন, এসেছেন যখন, সময় পেলে বৈদ্যনাথের মন্দির দর্শন করে যাবেন। বাড়ির লোকের জন্য প্রসাদও নিয়ে নেবেন।

তবে সময় পাবেন কিনা সেটাই হল প্রশ্ন। সত্যি বলতে কী, খাঁদা যে এইভাবে এখানে ওর প্রভাব বিস্তার করে রাখবে, তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি।

ট্রেনে আসার সময় হরিপদ সরকার অদ্ভুত সব কথা বলছিল। খাঁদা নাকি প্রতি মাসে কলকাতায় অন্তত পঞ্চাশটা দরিদ্র পরিবারকে মাসোহারা দিয়ে থাকে। বীরভূমের তিন-চারটে অনাথ আশ্রমেও তার মোটা অনুদান মাসের প্রথমেই পৌঁছে যায়। খাঁদা যখন সমাজে উচ্চমহলে ওঠাবসা করে, সেখানেও তার প্রভাব সাংঘাতিক থাকে।

কলকাতা হাইকোর্টের এক ডাকসাইটে ব্যারিস্টার ও তাঁর স্ত্রী-র সঙ্গে ক্লাবে ঠাট্টা রসিকতা করতে করতে খাঁদা নাকি একবার প্রস্তাব দিয়েছিল, ব্যারিস্টারের স্ত্রী যদি হাতের সামনের দিকে প্রকাশ্যভাবে ‘প্রাণের খাঁদা’ লেখাটা উল্কি করাতে পারেন, তবে খাঁদা ওই দম্পতিকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবে। আর বিস্ময়করভাবে সেই দম্পতি তাতে সম্মত হয়েছিলেন, ব্যারিস্টার পত্নীর হাতে এখনো ‘প্রাণের খাঁদা’ জ্বলজ্বল করে।

সত্যি! বিচিত্র মনুষ্যপ্রকৃতি! একদিকে নৃশংস হত্যাকারী, অন্যদিকে দরিদ্রের ত্রাতা, মুড়িমুড়কির মতো পয়সা ছড়ানো।

পঞ্চানন এইরকম নানা কথা ভাবতে ভাবতে আনমনে হেঁটে চলেছিলেন, এমনসময় সামনের দিকে চোখ পড়তেই তাঁর শরীর দিয়ে কয়েক-শো ভোল্টের ইলেকট্রিক বয়ে গেল।

তার হাঁটার রাস্তায় পনেরো কুড়ি হাত দূরেই একটা লন্ড্রির দোকান। সেই লন্ড্রির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘রাজা অফ কুমারটুলি’ খাঁদা স্বয়ং!

তার পরনে সবুজ রঙের একটা দামি সিল্কের পাঞ্জাবি। মাথা অনাবৃত, রেশমি চুল হাওয়ায় উড়ছে পতপত করে। চোখে প্রচ্ছন্ন অহমিকা আর কৌতুকের ছাপ।

পঞ্চান্ন ভালো করে দেখে নিশ্চিত হলেন। হ্যাঁ, এ সেই ডামি সুধীর নয়, প্রকৃতই খাঁদা।

পঞ্চানন যে মুহূর্তে খাঁদাকে দেখতে পেলেন, খাঁদাও সেই মুহূর্তে পঞ্চাননকে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য কেমন স্থবির হয়ে গেল। তারপর সোজা হেঁটে এসে পঞ্চাননের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের পাঞ্জাবির ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল।

পঞ্চাননবাবুও তখুনি স্বভাবগত দ্রুততায় ডান পকেটে হাত ঢোকালেন। কিন্তু পকেট ফাঁকা। তক্ষুনি তাঁর মনে হল, পিস্তলটা তিনি রবীনদার স্ত্রী-র কাছে রেখে এসেছেন। তাঁর শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত বয়ে গেল।

এমন বিপদসংকুল অবস্থায় পঞ্চানন এর আগে কখনো পড়েননি। তবু অকল্পনীয় মনের জোরে তিনি খাঁদার চোখে চোখ রেখে ভান করতে লাগলেন যে তাঁর পকেটেও পিস্তল রয়েছে, চাইলেই তিনি তা বের করে গুলি করতে পারেন।

খাঁদা মিটিমিটি হেসে বলল, ‘আরে কলকাতা পুলিশের গর্ব পঞ্চাননবাবু যে! কেমন আছেন?’

পঞ্চাননবাবু উত্তর দিলেন না। এমন নিরস্ত্রভাবে শত্রুর সম্মুখীন তিনি কখন হননি। তবুও তিনি খাঁদার চোখ থেকে চোখ সরালেন না।

খাঁদা বলল, ‘দেখুন, আপনার পকেটে যেমন আগ্নেয়াস্ত্র আছে, আমার পকেটেও আছে। আপনি মারলে আমি মারব, আমি মারলেও আপনি। এইভাবে আমরা দু-জনেই মরে যাব। তারচেয়ে বরং এক কাজ করা যাক। আমরা দু-জনেই চুপচাপ সরে পড়ি। সবাই জানবে আমাদের দেখাই হয়নি। এতে দু-জনেরই সুনাম অক্ষুন্ন থাকবে। কি বলেন?”

পঞ্চাননবাবু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ তাঁর কেমন সন্দেহ হল। খাঁদার কেস হিষ্ট্রি বলে সে শত্রুকে সামনে পেলে কোনো কথা বাড়ায় না, প্রথমেই তাকে শেষ করে। এক্ষেত্রে খাঁদা কথা বাড়াচ্ছে মানে নির্ঘাত তার কাছেও কোনো অস্ত্র নেই।

পঞ্চাননবাবু একটা মারাত্মক ঝুঁকি নিলেন। সোজা এগিয়ে যেতে লাগলেন খাঁদার দিকে।

খাঁদা থমকে গেল। তারপর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, ‘খবরদার! আর এক পা-ও এগোবেন না। আমি কিন্তু এখুনি গুলি করব পঞ্চাননবাবু!’

পঞ্চাননবাবু তাতে কর্ণপাত করলেন না, সোজা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন খাঁদার ওপর।

শুরু হল প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি। পঞ্চাননবাবুর আন্দাজ সঠিক, খাঁদাও তাঁরই মত নিরস্ত্র। আর বন্দুক-ছুরি চালিয়ে চালিয়ে মারামারিতে সে বুঝি একটু অনভ্যস্তও।

দু-জনের মধ্যে মারামারি চলতে লাগল। খাঁদা ঠেলে পঞ্চাননবাবুকে রাস্তার পাশের নর্দমায় ফেলে দিল। পঞ্চাননবাবুও তার পা ধরে টেনে আনলেন নর্দমায়।

এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলল। আশ্চর্যজনকভাবে রাস্তায় কোনো লোক নেই। দূর দিয়ে যদিওবা কোনো লোক যাতায়াত করছে, তারা এদিকে গণ্ডগোল হচ্ছে দেখে নিজেদের বাঁচাতেই ব্যস্ত।

এইভাবে চলতে চলতে হঠাৎ সেখানে টহল দিতে দিতে এসে পড়ল দু-জন সিপাই।

কিন্তু পঞ্চাননবাবুর স্বস্তিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণ করে তাদের মধ্যে একজন সিপাই ছুটে এসে পঞ্চাননবাবুকে মারতে শুরু করল, ‘আরে বদমাশ! রাজাবাবুকো পিটল হো?’

সৌভাগ্যক্রমে অন্য সিপাই থানায় একটু আগেই দারোগা সুরেশবাবুর সঙ্গে পঞ্চাননবাবুকে কথা বলতে দেখেছিল। সে কিছু গোলমাল আঁচ করে দৌড়ে ছুটল কোর্টের মধ্যে থাকা পুলিশকে খবর দিতে।

অন্যদিকে সুরেশবাবু তাঁর জমাদার দিলওয়ার খানকে নিয়ে তখন কিছু প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ ব্যানার্জির কোয়ার্টারে আসছিলেন পঞ্চাননবাবুর সঙ্গে কথা বলতে। পঞ্চাননবাবুকে ওই অবস্থায় দেখে তিনি তৎক্ষণাৎ পুরোটা বুঝে ফেললেন।

একদিকে তিনি, অন্যদিকে তাঁর জমাদার দিলওয়ার খান এসে চেপে ধরল খাঁদাকে। পঞ্চাননবাবু প্রায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন, কোনোমতে রক্ষা পেলেন।

অতএব উত্তর কলকাতার ত্রাস, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা জুড়ে রেলডাকাতি চালানো দুর্দান্ত খাঁদা গুন্ডা ধরা পড়ল।

খাঁদা যখন বুঝল সে সত্যিই পুলিশের জালে আটকে পড়েছে, তখন সে আর কোনোরকম প্রতিরোধ না করে হা হা করে এমন জোরে হাসতে লাগল, সবাই অবাক হয়ে গেল।

তারপরই সে নাটকীয় ভঙ্গিতে ডানহাত বাড়িয়ে দিল, ‘কনগ্রাচুলেশনস পঞ্চাননবাবু! ধন্য আপনার ভাগ্য! জীবনে এই প্রথম রাস্তায় অস্ত্র ছাড়া বের হয়ে পড়েছিলাম বলে আপনি আজ বেঁচে গেলেন। নাহলে খাঁদার সামনে আজ পর্যন্ত তার কোনো শত্রু সাড়ে তেরো সেকেন্ডের বেশি দাঁড়াতে পারেনি। কী করব বলুন, সাতসকালে উঠে ছুরি আর পিস্তল ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে স্নান করতে যাব, দেখি তখনো ধোপা কাপড় দিয়ে যায়নি। এত রাগ হল কী বলব! রেগেমেগে কাউকে ডাকলুম না! একাই বেরিয়ে চলে এলাম এই দোকানে। তাই আপনি রক্ষা পেলেন। হা হা হা!’

সুরেশবাবু ততক্ষণে থানা থেকে হাতকড়া আর দড়ি আনিয়েছেন। সঙ্গে এসে পড়েছেন আমার আত্মীয় রবীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, লোকলস্কর নিয়ে এস ডি ও সাহেব, মধুপুর থানার দারোগা ব্যানার্জিবাবু, ডি এস পি বসিরুদ্দিন খান সাহেব।

খাঁদা কোমরে দড়ি নিয়েই কৌতুকভরা চোখে আমার দিকে তাকাল, ‘আপনি নিশ্চিত তো পঞ্চাননবাবু? আমিই খাঁদা? ভালো করে দেখুন। আমি ডুপ্লিকেট খাঁদা মানে সুধীর নই তো? যাকে আপনারা জেলে পুরেছিলেন? তাহলে কিন্তু আপনার প্রমোশন হবে না। হা হা!’

হরিপদবাবু ততক্ষণে এসে পড়েছেন। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই। এই মুখ, এই চাউনি, সবচেয়ে বড়ো কথা এই হাসি খাঁদা ছাড়া কারুর হতে পারেনা।’

খাঁদার হাসিমুখ মুহূর্তে বদলে গেল, ‘পঞ্চাননবাবু তাঁর ডিউটি করেছেন, কিন্তু তোকে আমি ছাড়ব না শালা। বেরোই, তারপর তোর হবে হরিপদ!’

বিলাসী টাউনের কুমারটুলির রাজার বাড়ি থেকে পাওয়া গেল খাঁদার সেই হাতির দাঁত দিয়ে বাঁধানো শৌখিন ছুরি, জমিদারবাড়ি থেকে চুরি করা পিস্তল, প্রায় এগারো বারোটা বহুমূল্য হিরের গয়না, সতেরো হাজার টাকা।

থানায় এসে খাঁদাকে পঞ্চাননবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি যে পাগলার মতো একটা নির্দোষ মানুষকে ওইভাবে মারলে, অনুতাপ হল না?’

‘কেন অনুতাপ হবে?’ ভ্রূ অনেকটা ওপরে তুলে বলল খাঁদা, ‘আপনারা একটা মশা মারলে অনুতাপ করেন? মশা আপনাকে কামড়ায়, আপনি মেরে দেন। পাগলা আমার পেছনে লাগতে এসেছিল, মেরে দিয়েছি। এই পৃথিবীতে শুধু শক্তিমানদেরই বাঁচার অধিকার রয়েছে। কেন চার্লস ডারউইন পড়েননি? Survival of the fittest থিয়োরি তো তাই বলছে।’

পাশ থেকে সুরেশবাবু বললেন, ‘আপনার … ইয়ে তোমার কি ভগবানেও ভয় নেই? এত পাপ করে কি সেখানে গিয়ে ছাড়া পাওয়া যাবে?’

‘ভগবান?’ খাঁদা এবার আরো জোরে হাসল, ‘পৃথিবীতে আর যা কিছুই থাকুক না কেন, তিনটে জিনিস একদম ফালতু, বুঝলেন দারোগাবাবু? ভূত, ভগবান আর প্রেম। বিশ্বাস করুন, জীবন এই জন্মেই শুরু, এই জন্মেই শেষ, কোনো ভূত নেই, কোনো ভবিষ্যৎও নেই। আর প্রেম? সে তো সবচেয়ে বেকার। নাহলে মলিনা ওই অপদার্থ তবলচিটাকে ভালোবাসতে যায়?’

‘ভূত ভবিষ্যৎ না থাকুক, ইহকাল তো আছে। এত কিছুর জন্য এবার তো তোমার ফাঁসি হবে।’ সুরেশবাবু আবার বললেন।

‘হবে হবে।’ খাঁদা হাত উলটে বলল, ‘মরতে আমি ভয় পাই নাকি? আমার জীবনে কোন আফশোস নেই দারোগাবাবু। যখন যা মন চেয়েছে করেছি, প্রতিটা মুহূর্ত তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছি। আপনাদের মতো পরকালের ভয়ে দমিয়ে রাখিনি ইচ্ছেগুলোকে। হ্যাঁ, একটাই শুধু দুঃখ আছে বলতে পারেন।’

‘কী?’

‘মাঝে মাঝে তো এইসব খারাপ কাজ ভালো লাগত না, তখন সব ছেড়ে চলে যেতাম ভদ্রলোকেদের মাঝে। সেইরকমই সময়ে চন্দননগরে একটা বিয়ে করে ফেলেছি। তাকে আমি পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে রেখেছি, বলেছি আমি মরে গেলে তুমি যেন শোকপালন করো না, ফুর্তি করো, জীবনটাকে উপভোগ করো। কিন্তু আমার কি ভয় জানেন? আমার ফাঁসি হলে সে ওসব কিছুই করবে না, বিধবাদের মতো নিরামিষ খাবে আর একাদশী করবে।’ খাঁদার চোখ দুটো কেমন যেন চিকচিক করে উঠল, ‘আর খারাপ লাগবে কয়েকটা পরিবারের কথা ভেবে। তাদের সংসার আমিই চালাই কিনা! যাক সে-কথা!’

দেওঘর ছাড়ার আগে পঞ্চাননবাবু শ্যামপুকুর থানায় ইনস্পেকটর সুনীল রায়কে একটা টেলিগ্রাম করে দিলেন।

‘KHANDA ARRESTED — NO CASUALTY.’

গত কয়েক দশক ধরে কলকাতা শহরে খাঁদা গুন্ডা একজন বিভীষিকা হয়ে উঠেছিল। রাতবিরেতে মানুষ ঘর ছেড়ে বেরোতে ভয় পেত, মেয়ের বিয়ের আগের দিন ধনী পিতার বুক কম্পমান হত, এই বুঝি খাঁদা তাঁর দলবল নিয়ে এসে সব সোনাদানা লুঠ করে নিয়ে গেল। তা ছাড়া খুন-জখমের ভয় তো ছিলই।

তাই public enemy নামে কুখ্যাত খাঁদা গুন্ডাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসার সংবাদ পেয়ে থানায় ভিড় করলেন বহু নাগরিক। তাঁদের মধ্যে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রয়েছেন কবি, চিত্রকার, শিল্পীরাও। তাঁরা প্রত্যেকে জয়ধ্বনি করলেন পঞ্চানন ঘোষালের, সমগ্র কলকাতা পুলিশের।

তদন্তের জাল গুটিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হল। কৃপানাথ বসু লেনের বাড়ি ও দেওঘরের প্রাসাদ থেকে উদ্ধার করা হল হাজার হাজার টাকা ও কয়েক লক্ষ টাকার গয়না। গয়নাগুলো সবই কলকাতার নানা ধনী বাড়ি থেকে চুরি করা। গয়নার মালিক শনাক্তকরণের জন্য পুলিশের তরফ থেকে আয়োজন করা হল প্রদর্শনীর।

খুঁজে বের করা হল সেই কয়েকটি দরিদ্র পরিবারকে যারা বেঁচেছিল খাঁদার আর্থিক সাহায্যে। তাদের কাছে সে সাক্ষাৎ ভগবান, খাঁদাবাবুর শাস্তি হবে শুনে তাঁরা কাঁদতে লাগল হাউহাউ করে।

গঙ্গায় পাগলাকে নিয়ে যাওয়ার সময় গৌড়িয়া নামে যে খাউ মাঝপথে পালিয়েছিল, তাকে পাওয়া গেল শেওড়াফুলিতে তার রক্ষিতার বাড়িতে। গৌড়িয়া পুলিশকে বলল, পালিয়ে যাওয়ার অপরাধে দেওঘর যাওয়ার আগেই খাঁদা তাকে শেওড়াফুলি গিয়ে মারধর করে এসেছিল।

সব মিলিয়ে মোট ৭৫ টি চুরি-ডাকাতির মামলা রুজু করা হল খাঁদা গুন্ডার বিরুদ্ধে। সঙ্গে পাগলা ও শিউচরণ দুটি খুনের মামলা। যদিও খাঁদা পঞ্চাননবাবুকে হাসতে হাসতে বলেছে, আরও অন্তত কুড়িটা খুন সে করেছে, কিন্তু সেগুলোর কোনো তথ্য এখন আর সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।

কলকাতা কাঁপিয়ে দেওয়া খাঁদা গুন্ডার কেস অবশেষে উঠল আদালতে। বিচারক ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট আই এস মুখোপাধ্যায়। স্ট্যান্ডিং কাউন্সেল ছিলেন এম এম বসু, সলিসিটর এস চৌধুরী।

মহামান্য আদালত পঁচাত্তরটি অপরাধের প্রতিটির জন্য এক বছর করে মোট পঁচাত্তর বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিল খাঁদাকে। খাঁদা জেলে কয়েদ হল।

তারপর শুরু হল খুনের মামলার বিচার। হেভিওয়েট এই মামলার চার্জশিটের ওজনই ছিল সাত সের। সাক্ষ্যদান করেছিল ৬১ জন সাক্ষী। exhibit ছিল ১৩৫ টি। একত্রিশ দিন ধরে শুনানি চলল। অবশেষে জজ সাহেব মি খন্দকার দুটি খুনের জন্য খাঁদাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলেন।

শোনা যায়, এজলাসে দাঁড়িয়ে নিজের ফাঁসির রায় শোনার পর খাঁদা প্রথমে অভিবাদন জানায় বিচারক মি খোন্দকার ও জুরিদের। তারপর হাসিমুখে পুলিশি প্রহরায় ফিরে যায় হাজতে। একজন ডিফেন্স কাউন্সেলর তার সঙ্গে তখন দেখা করতে গেলে সে বলে, ‘আমি তো বেশিদিন আর এই পৃথিবীতে নেই, শিগগিরই আমার ফাঁসি হবে। আপনি একবার পঞ্চানন বাবুকে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতে বলবেন? খুব দরকার।’

পঞ্চাননবাবু গিয়েছিলেন সমানে সমানে টক্কর দেওয়া তাঁর এই মহাশত্রুর সঙ্গে জেলে দেখা করতে। কিন্তু সেদিন খাঁদা কোনো কারণে খুব মনমরা ছিল। বলেছিল, ‘আপনি দয়া করে আরেকদিন আসতে পারবেন ঘোষালমশাই? আমার আজ মেজাজ একদম ভালো নেই।’

কিন্তু তারপর আর পঞ্চাননবাবু সময় বের করে উঠতে পারেননি। ১৯৩৭ সালের ৩১ জুলাই সকাল ছ-টার সময় স্নান করানো হয় খাঁদাকে। সে নিজেই তারপর পরিষ্কার জামা পরে সারা গায়ে সুগন্ধী মাখে। তারপর পাশের সিপাইকে বলে, ‘আমাকে কিছু ফুল এনে দিতে পার?’

ফুল এনে দেওয়া হলে সে নিজেই তা দিয়ে মালা গাঁথে, তারপর সেই মালা গলায় পরে নিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বলে, ‘হ্যাঁ, এইবার নিয়ে চল আমায়!’

ফাঁসি মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন আলিপুর থানার ওসি হেমন্ত গুপ্ত। তাঁকে ফাঁসি মঞ্চে ওঠার আগে খাঁদা বলে, ‘আচ্ছা ঘোষালমশাই কেমন আছেন জানেন? শ্যামপুকুর থানার পঞ্চানন ঘোষাল?’

হেমন্ত গুপ্ত আড়ষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘ভাল আছেন।’

খাঁদা হেসে বলেছিল, ‘আপনি ওঁকে বলবেন, কুমারটুলির রাজা খাঁদা তাঁর কথা মনে রাখবে। যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে, তখনও।’

খাঁদা গুন্ডা আজ আর নেই। ইতিহাসের অমোঘ গহ্বরে লীন হয়ে গেছে হাড় কাঁপিয়ে দেওয়া তাঁর সমস্ত কৃতকর্ম। মানুষ ভুলে গিয়েছে তাকে।

ভুলে গিয়েছে অদ্ভুত এক দ্বৈতচরিত্রের মানুষকে, যে সমানতালে অপরাধ, সমাজসেবা দুই-ই করেছে, একইসঙ্গে সমাজের সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই স্তরে জীবনযাপন করেছে অবলীলায়।

তবে খাঁদা না থাকলেও যে গলিতে সে খুন করেছিল পাগলাকে, বলরাম মজুমদার স্ট্রিটের পেছনের মেথরগলিটা আজও আছে। তার নাম এখন গলাকাটা গলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *