নৃশংস হত্যা

নৃশংস হত্যা

ডাক্তার জৈন ওই ভয়ংকর দৃশ্যটার বর্ণনা দিতে গিয়ে থরথর করে কাঁপছিলেন, ”ইনস্পেক্টর, আপনি বিশ্বাস করবেন না, আমার শরীর ভয়ে বরফ হয়ে গিয়েছিল। আ—আমি দেখলাম, আমার স্ত্রী বিদ্যা নর্দমার মধ্যে পড়ে রয়েছে, ওর গোটা শরীরটা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল কোনো হিংস্র জন্তু যেন তার ধারালো নখের আঘাতে তার গোটা মুখটা ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে, এছাড়াও সারা দেহে আঘাত!”

”তারপর?” দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের দুঁদে ইনস্পেক্টর ফকির চাঁদ প্রশ্ন করলেন।

”তারপর, আমি ভয়ে এমন চিৎকার করে উঠি, বাড়ি থেকে আমার চাকর—খানসামারা ছুটে আসে, ওরাও ওই দৃশ্য দেখে ভয়ে আঁতকে ওঠে। আমার ম্যানেজার সুখলাল, সে বলে মেমসায়েব হয়তো এখনও বেঁচে আছেন!”

”আপনি থাকতে সুখলাল কেন? আর সুখলাল কী করে বুঝল আপনার স্ত্রী বেঁচে ছিলেন?”

”সুখলাল শখে কোবরেজি করে, নাড়ির জ্ঞান আছে ওর।” ডাক্তার জৈন লাল চোখে তাকালেন, ”আমার তখন কাণ্ডজ্ঞান নেই ইনস্পেক্টর!”

”আচ্ছা। তারপর?”

ডা জৈন ক্লান্ত চোখে বললেন, ”তারপর আমি আর দেরি করিনি। সবাই ধরাধরি করে বিদ্যাকে গাড়িতে তুলে দিল, আমি ওকে নিয়ে বাহাদুর শাহ জাফর মার্গে ডা এস কে সেনের নার্সিং হোমে নিয়ে চলে গেলাম। কিন্তু ডাক্তার সেন দেখেই বললেন ও আর নেই।” ডা জৈন একটা চাপা নিশ্বাস ফেললেন।

ঘটনাটা বর্ণনা করতে গিয়ে দুঃখে কষ্টে তাঁর গলা প্রায় বুজে এল।

ইনস্পেক্টর ফকির চাঁদ সামান্য ভ্রূ কুঁচকোলেন। তাঁর মনে অনেক প্রশ্ন বুদবুদ কেটে উঠছিল, অন্য কেউ হলে তিনি মিসাইলের মতো প্রশ্ন ছুঁড়তেন, কিন্তু হাই প্রোফাইল মানুষ এই ডা জৈন, দুমদাম প্রশ্ন করা যায় না।

ডাক্তার এন এস জৈন খোদ ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির চক্ষুবিশেষজ্ঞ, বর্তমানে দেশের সেরা চোখের ডাক্তার। সম্প্রতি পদ্মশ্রী খেতাবও পেয়েছেন। ডা জৈন নাকি ধন্বন্তরি, তিনি অন্ধ মানুষকেও দৃষ্টিদান করতে পারেন।

ফকির চাঁদ কিছু—একটা ভাবতে ভাবতে ঘড়ির দিকে তাকালেন, ঘড়িতে রাত দশটা। খুনটা হয়েছে আন্দাজ সন্ধ্যে সাতটা পনেরোর সময়। ইনস্পেক্টর আবার ডাক্তারের দিকে ফিরলেন। ডা জৈনকে এখন পরিস্থিতির আকস্মিকতায় বিধ্বস্ত দেখালেও একঝলক তাকালেই বোঝা যায় তিনি আদ্যন্ত সুপুরুষ, এবং ততটাই শৌখিন মানুষ। পরনের স্যুট, প্যান্ট, টাই থেকে শুরু করে কবজিতে বাঁধা ঘড়ি, কোনোটাই এদেশের নয়।

এখন অবশ্য সেই বিদেশি জামাতে রক্তের দাগ শুকিয়ে রয়েছে।

ফকির চাঁদ বললেন, ”আপনার বাড়ি আর চেম্বার দুটোই তো ডিফেন্স কলোনিতে, ওখান থেকে বাহাদুর শাহ জাফর মার্গ তো অনেক দূর; অন্তত দশ কিলোমিটার। অতদূরে না—গিয়ে কাছাকাছি কোথাও নিয়ে গেলেন না কেন? আর পুলিশেই বা খবর দিলেন না কেন?” কথাটা বলে তিনি সামনে রাখা জলের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলেন ডাক্তারের দিকে, ”নিন, জল খান।”

ডা জৈন ঢকঢক করে জলটা খেলেন, ”ডা এস কে সেন আমার বন্ধু; ওই বিপদে মাথা ঠিক কাজ করছিল না, তাই ওঁরা কথাই প্রথমে মনে পড়েছিল। তারপর ডা সেনই ওখান থেকে পুলিশে ফোন করে খবর দেন।”

আধঘণ্টা পর …

ডা জৈন যে চেয়ারে বসেছিলেন, এখন সেখানে বসে আছেন ডা এস কে সেন। তাঁর মুখচোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি রীতিমতো ক্ষুব্ধ।

”কী হল, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ রেগে আছেন?” ইনস্পেক্টর ফকির চাঁদ নতুন আনা জলের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলেন এই ডাক্তারের দিকে।

”না, আপনিই বলুন ইনস্পেক্টর, ডা জৈন এত বড়ো ডাক্তার হয়ে কী করে এই ভুলটা করলেন, আমাকেই বা কেন খামোখা জড়ালেন! বডি আমার নার্সিং হোমে নিয়ে আসার অনেক আগেই ওঁর স্ত্রী মারা গিয়েছেন; সেখানে পুলিশে খবর না—দিয়ে, দুম করে আমার কাছে নিয়ে এসে আমাকে জড়ানোর কোনো মানে হয়! একে আমার নার্সিং হোম নতুন, তার ওপর এই কেলেঙ্কারি।” ডা এস কে সেন বিরক্তকণ্ঠে বললেন, ”আবার আমাকে বার বার বারণ করছিলেন যাতে পুলিশে ফোন না—করি। চিন্তা করুন, ওঁর মতো মানুষের এই ভয় মানায়!”

ফকির চাঁদ মন দিয়ে শুনছিলেন, ”ডা জৈন কী বলেছিলেন আপনাকে?”

”উনি বললেন, আজ সন্ধ্যে বেলা এক আত্মীয়র বাড়ি ওঁদের দু—জনের নিমন্ত্রণ ছিল, ডিফেন্স কলোনিতেই। উনি চেম্বার থেকে ফিরে স্ত্রীকে তৈরি হতে বলে স্টাডিরুমে একটা দরকারি চিঠি দ্রুত লিখছিলেন। এইসময় তাঁর মনে হল পাশ দিয়ে যেন বিদ্যা চলে গেলেন বাইরে। তার ঠিক পরেই তিনি একটা নারীকণ্ঠের তীব্র আর্তনাদ শুনতে পেয়ে বাইরে যান, গিয়ে দেখেন, দুটো লোক দূরে পালিয়ে যাচ্ছে।”

পাশ থেকে সাব—ইনস্পেক্টর উদয় চোপড়া চোখ বড়ো বড়ো করে বলতে যাচ্ছিল, ”স্যার, এ তো পুরো অন্য স্টেটমেন্ট …!”, ফকির চাঁদ সঙ্গেসঙ্গে উদয়কে থামিয়ে দিলেন।

১৯৭৩ সালের ৪ ডিসেম্বর দিল্লির অভিজাত এলাকা ডিফেন্স কলোনিতে বিখ্যাত ডাক্তার নরেন্দ্র সিং জৈনের স্ত্রী বিদ্যা জৈনের নৃশংস হত্যা সেইসময় সারা দেশে ঝড় তুলে দিয়েছিল। বিদ্যার শরীরে মোট চোদ্দোটা ধারালো ছুরির আঘাত পাওয়া গিয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছিল অপরাধী তীব্র আক্রোশে ফালাফালা করেছে তাঁকে।

একজন অভিজাত উচ্চবর্গের গৃহবধূর প্রতি কার এমন আক্রোশ থাকতে পারে?

তা জানতে হলে আগে জানতে হবে ১৯৭৩ সালের কুখ্যাত বিদ্যা জৈন হত্যা মামলার নেপথ্যকাহিনি।

আগেই বলেছি, ডা নরেন্দ্র সিং জৈন দেশখ্যাত চক্ষুবিশারদ ছিলেন। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা, তখনই প্রায় এক লক্ষ টাকা রোজগার করতেন মাসে। স্বয়ং রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত চিকিৎসক হওয়ায় মান্যগণ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে ছিল নিয়মিত ওঠা—বসা। এ ছাড়াও স্থাবর—অস্থাবর মিলিয়ে অগাধ সম্পত্তি। বয়স পঞ্চাশের ওপরে, বড়ো ছেলে ইতিমধ্যেই ডাক্তারি পাশ করে হাসপাতালে ঢুকেছে, ছোটো ছেলে ডাক্তারি পড়ছে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যস্ত জীবনে নারীর প্রতি ছিল ডা জৈনের ভীষণ দুর্বলতা। প্রায়ই তাঁকে বিভিন্ন মহিলা বা কলগার্লের সঙ্গে ক্লাবে, সিনেমায়, রেস্তরাঁয়, এমনকী হোটেলে রাত কাটাতেও দেখা যেত।

এত স্বনামধন্য ডাক্তারের এমন চরিত্রের জন্য বন্ধুত্বস্থানীয় অনেকেই তাঁকে সাবধান করতেন, কিন্তু স্বভাব তো অত সহজে পালটায় না।

যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময়ে ডাক্তারের রক্ষিতা ছিল চন্দ্রেশ শর্মা। ঘটনায় ঢোকার আগে চন্দ্রেশ সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া প্রয়োজন।

আমরা যতই লিঙ্গসাম্যের ধ্বজা ওড়াই না কেন, অস্বীকার করে লাভ নেই, কিছু কিছু মহিলা আজও আছেন, যাঁরা নিজেদের গুণে, নিজেদের ধীশক্তিতে নয়—রূপ যৌবনকে মই হিসেবে কাজে লাগিয়ে উপরে উঠতে চান, আর বিত্ত বিলাসের লোভে যে—কোনো পুরুষের অঙ্কশায়িনী হতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। যুগে যুগে এই ধরণের রমণীর আবির্ভাব হয়েছে, এবং চন্দ্রেশ শর্মা তেমনই একজন।

দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, অল্পবয়সে তার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল সাধারণ সওদাগিরি অফিসে কাজ করা এক কেরানির সঙ্গে। চন্দ্রেশ তার স্বামীকে সহ্য করতে পারত না, বার বারই তার মনে হত, এই আটপৌরে জীবন তার জন্য নয়। সে জন্মেছে অনেক বড়ো কিছু হওয়ার জন্য।

ঈশ্বর বোধ হয় চন্দ্রেশের ডাক শুনেছিলেন, বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই চন্দ্রেশের স্বামী অল্প ভুগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।

চন্দ্রেশ জলে পড়ল বটে, তার শ্বশুরবাড়ি বাপের বাড়ি দুই তরফই গরিব; তবু মনে মনে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তার মধ্যে যা—কিছুই থাকুক বা না থাকুক, ছলা কলা করে পুরুষদের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার চাপল্য ছিল যথেষ্ট। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই সে বেশ অর্থবান একটা পুরুষ পেয়ে গেল। হোক মধ্যবয়স্ক, আর্মির মস্ত অফিসার, পয়সা অঢেল। চন্দ্রেশ আর দু—বার ভাবল না। আগের পক্ষে তার একটা ছেলেও হয়েছিল, আর্মি অফিসার তার সেই ছেলের দায়িত্ব নিতেও রাজি হয়ে গেলেন। চন্দ্রেশ সানন্দে ঝুলে পড়ল তাঁর গলায়।

বিয়ের পর কয়েক মাস ভালোই কাটল। তারপর একদিন দিল্লিতেই এক পার্টিতে ঘটনাচক্রে দেখা চন্দ্রেশের সঙ্গে আলাপ হল ডা জৈনের।

তখন চন্দ্রেশের বয়স ছাব্বিশ বছর, তাকে দেখতে যে অপরূপ সুন্দরী তা নয়, কিন্তু তার চটক আর যৌন আবেদন এমনই মন মাতাল করা যে, ডা জৈন সেই ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলেন না। চন্দ্রেশ একদিন ছল করে ডা জৈনের চেম্বারে চোখ দেখাতে এল।

দু—জনই একইধরনের, ডা জৈন বেশিদিন কোনো রক্ষিতার প্রতি অনুরক্ত থাকতে পারেন না, ওদিকে চন্দ্রেশ সেই আর্মি অফিসারের চেয়েও বড়ো শিকার পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে পড়ল।

পরকীয়ার আকর্ষণ বড়ো সাংঘাতিক। শুরু হল অসমবয়সি দু—জনের দামাল প্রেম। ক্রমশ পার্টি, হোটেলের ঘর পেরিয়ে তা পৌঁছোল দূরদূরান্ত ভ্রমণে।

ডা জৈনের স্ত্রী বিদ্যা অনেক দিন আগেই হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, জোর করে আর যাই হোক বিশ্বস্ততা পাওয়া যায় না।

কিন্তু চন্দ্রেশের স্বামীর কানে খবরটা উঠতে খুব বেশি দেরি হল না। শুরু হল তীব্র দাম্পত্যকলহ। অবশেষে একদিন দু—জনের ডিভোর্স হয়ে গেল।

চন্দ্রেশ বিশেষ বিব্রত হল না। তার এখন পাখির চোখ ডা জৈনের প্রভূত বিত্তের ওপর, আর্মি ক্যাপ্টেনের সম্পত্তি সেখানে নেহাতই তুচ্ছ!

একদিন ডা জৈন তৈরি হচ্ছেন, তিনি বোম্বাই যাবেন, চোখের ওপর এক সেমিনারে বক্তৃতা দিতে, চন্দ্রেশ মুখ ভার করল, ”তুমি খালি একাই যাও, আমাকে নিতে হবে না!”

ডা জৈনও চাইছিলেন চন্দ্রেশকে নিয়ে যেতে, কিন্তু মুশকিলটা হল তাঁর স্ত্রী বিদ্যার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বোম্বাইয়ে থাকেন। হোটেলে দেখা করতে এলে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড হবে। যতই যাই হোক, আইনত বিদ্যা আর তিনি এখনও স্বামী—স্ত্রী। অথচ চন্দ্রেশের তীব্র শারীরিক মোহও অগ্রাহ্য করা দুঃসহ।

হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি এল, ”চন্দ্রা, তোমাকে এই মুহূর্ত থেকে আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি নিযুক্ত করলাম। আমি সেমিনারের অরগানাইজারদের বলে দিচ্ছি, তারা তোমারও বন্দোবস্ত করবে। আমি তোমাকে উপযুক্ত মাইনেও দেব।”

শেষ বাধাটুকুও ঘুচে গেল, চন্দ্রেশ ছুটে এসে ডা জৈনের বুকে মাথা রাখল।

ফিরে আসি খুনের তদন্তে।

ইনস্পেক্টর ফকির চাঁদ তদন্তে নেমেই ডাক্তার আর চন্দ্রেশের গুপ্ত প্রণয়ের কথা বেশ দ্রুত জেনে গেলেন। মানুষের মধ্যে তখন গুঞ্জন চলছে, একজন নিরীহ গৃহবধূর প্রতি কার এমন আক্রোশ থাকতে পারে?

ইনস্পেক্টর ফকির চাঁদ ফিঙ্গার প্রিন্ট এক্সপার্ট, ফরেনসিক, পুলিশ কুকুর, সিভিল ড্রেসের টিম—একেবারে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এত বড় বাড়ির ব্যাপার বলে কথা, রাজনৈতিক মহল থেকেও প্রশ্ন উঠছে অহরহ।

তদন্তে নেমেই ফকির চাঁদের তিনটে খটকা লেগেছিল।

এক, অনুষ্ঠানবাড়িতে যাওয়ার জন্য সুসজ্জিতা বিদ্যা জৈনের গায়ে বহুমূল্য অলংকার ছিল, খুনি দুষ্কৃতিরা গয়না ছোঁয়নি, তার মানে ডাকাতি তাদের উদ্দেশ্য ছিল না।

দুই, ডা জৈন তাঁর বন্ধু ডা সেনকে বলেছিলেন তিনি চিঠি লিখছিলেন। এইসময় বাইরে থেকে বিদ্যার আর্তনাদ শোনেন, গিয়ে দেখেন একটা গাড়ি চলে যাচ্ছে। অথচ পুলিশের কাছে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তিনি আর বিদ্যা একসঙ্গে বেরিয়ে গাড়ির সামনে অপেক্ষা করছিলেন, এমন সময় দেখেন খুনিরা বিদ্যাকে রক্তাক্ত করে নর্দমায় ফেলে দুটো লোক পালাচ্ছে।

এই অসংগতি কেন?

তিন, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এটা পূর্ব—পরিকল্পিত হত্যা, তাহলে হত্যাকারীরা ডা জৈনকে স্পর্শও করল না কেন?

ফকির চাঁদ আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করলেন, ডা জৈন বিদ্যা খুনের মাত্র কয়েক দিন আগে ব্যাঙ্ক থেকে দশ হাজার টাকা তুলেছিলেন। তখনকার দিনে দশ হাজার টাকা নেহাত কম টাকা ছিল না। উনি জিজ্ঞেস করলেন, ”ডা জৈন, আপনি এই টাকা তুলেছিলেন কেন?”

ডা জৈন আমতা আমতা করে বললেন, ”ওই একটা ডোনেশন ফান্ডে টাকা দিয়েছিলাম।”

ফকির চাঁদ আরও অবাক হয়ে বললেন, ”ক্যাশে? কোন সংস্থায়?”

ডা জৈন ঠিকঠাক কিছু বলতে পারলেন না।

আরও বেশ কিছুদিন অনুসন্ধান চালিয়ে ফকির চাঁদ সাতজনকে গ্রেফতার করলেন। ডঃ নরেন্দ্র জৈন, তাঁর সেক্রেটারি চন্দ্রেশ শর্মা, চন্দ্রেশের পাতানো ভাই আর্মির হাবিলদার রাকেশ কৌশিক, দু—জন ভাড়াটে খুনি উজাগর সিং ও কর্তার সিং, তাদের সহকারী কল্যাণ গুপ্তা ও ভগীরথ, আর রামজিলাল নামে এক ট্যাক্সি ড্রাইভার।

ভাড়াটে খুনিদের ম্যারাথন জেরার পর বেরোল চমকপ্রদ তথ্য।

সামাজিক কলঙ্ক বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, ডা নরেন্দ্র জৈন বিদ্যাকে ডিভোর্স দিতে চাননি। এদিকে চন্দ্রেশের বারংবার বিয়ের জন্য তাগাদায় বাধ্য হয়ে ঠিক করেন, দু—জনে মিলে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবেন নির্দোষ বিদ্যাকে।

সেইমতো ছকা হয় পরিকল্পনা। বিদ্যা জৈন খুন হন ডিসেম্বরের চার তারিখে, কিন্তু তাঁকে মারার প্ল্যান শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাস থেকেই।

আর এই হত্যাকাণ্ড এতটাই জটিল এবং নৃশংস ছিল, যে সেটা আজও দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। বিদ্যা জৈন হত্যার খবর পড়ে মানুষ যতটা বিস্মিত হয়েছিল, তার চেয়েও বেশি চমকে উঠল, ”স্ত্রী বিদ্যা জৈনকে হত্যার সন্দেহে গ্রেফতার ডাক্তার নরেন্দ্র জৈন” শীর্ষক খবর পড়ে।

এতবড়ো মানুষ, দেশজোড়া নাম যার, সেই ডাক্তার খুনের দায়ে অভিযুক্ত?

ঠিক তিন মাস পরে ১৯৭৪ সালের ৪ মার্চ, প্রথম কেস উঠল দিল্লির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। কেস চলেছিল পাঁচ—শো দিন ধরে। ফকির চাঁদ প্রায় দেড়শো সাক্ষী জোগাড় করেছিলেন।

আগেই বলেছি, চন্দ্রেশ ছিল সুখের পায়রা। সে বুঝেছিল, ফেঁসে যখন একবার গেছে, শাস্তিতে জর্জরিত ডা জৈনের সাথে থেকে আর লাভ নেই। সে বলল, ”ধর্মাবতার! পুরো টাকাটাই জুগিয়েছিলেন ডাক্তারসাহেব। আমি কিছু জানি না।”

৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যে ৭ টা ১৫ তে ডা জৈন বাড়ি ফিরেছিলেন, তার তিন ঘণ্টার আগে ঘটে যাওয়া গল্প এবার আমরা একটু জেনে নিই। চন্দ্রেশের অজস্র পাতানো ভাই ছিল, সুবিধা অসুবিধায় ছলা কলায় ভুলিয়ে সে তাদের কাজে লাগাত। তেমনই একজন ছিল হাবিলদার রাকেশ কৌশিক।

চন্দ্রেশ রাকেশ কৌশিককে বলেছিল, ”ডাক্তারের বউকে এবার সরাতেই হবে। না—হলে আমার আর কোনো আশা নেই। তুমি গুন্ডা জোগাড় করে দাও। ভালো কমিশন পাবে।”

সেইদিন বিকেল সাড়ে চারটের সময় দিল্লির জমজমাট অঞ্চল চাঁদনি চকের ‘নিউ ভিগ’ রেস্তরাঁয় সবাই মিলে বসে খুনের ছক কষা হল। হাবিলদার রাকেশ কৌশিক তার চেনা ট্যাক্সি ড্রাইভার রামজিলাল আর পেশাদার খুনিগুলোকে নিয়ে এসেছিল।

উজাগর সিং আর কর্তার সিং—এর কাছে মানুষ খুন জলভাত। টাকার জন্য তারা সব করতে পারে।

কর্তার সিং বলল, ”এত বড়ো ঘরের ব্যাপার, ফেঁসে যাওয়ার চান্স অনেক বেশি। পঁচিশ হাজার টাকা লাগবে, ওর থেকে কমে হবে না।”

ডা জৈন মুখে কোনো কথা না—বলে ছোট্ট নড করে বুঝিয়ে দিলেন টাকাটা কোনো ব্যাপার নয়। দশ হাজার টাকা তুলেই রেখেছিলেন দিনদুয়েক আগে। বিনাবাক্যবয়ে অ্যাডভান্স করে দিলেন, ”বাকি পনেরো হাজার কাজ হাসিল হওয়ার পরেই পেয়ে যাবে। শুধু সাবধানে যেন হয়, খেয়াল রেখো। সব ঠিকমতো মিটলে বখশিশও পাবে।”

দুই যমদূত বড়োবড়ো দাঁত বের করে হাসল, ”কী যে বলেন স্যার! উজাগর সিং কর্তার সিং কোনো কাঁচা কাজ করে না, এমনভাবে সাল্টে দেব, পুলিশের বাপের সাধ্যি নেই কিছু বুঝতে পারে। ওসব নিয়ে আপনি একদম চাপ নেবেন না!”

ডা জৈন বেরিয়ে যেতে চন্দ্রেশ মুখ খুলল, ”আমি আর ডাক্তারবাবু সাড়ে ছ—টা নাগাদ পৌঁছোব। তৈরি থেকো।”

ওদিকে ট্যাক্সিচালক রামজি ভগীরথ আর কল্যাণকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সন্ধ্যে ছ—টা থেকে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ডা জৈনের বাড়ির পিছন দিকে।

রাকেশ কৌশিক সিং ভাইদের নিয়ে বেরিয়ে গেল কনট প্লেস, সেখান থেকে এসে ডা জৈনের বাড়ি থেকে নব্বই মিটার দূরে অপেক্ষা করতে লাগল।

ডা জৈন যখন প্ল্যানমাফিক বিদ্যাকে নিয়ে বাইরে এলেন, অন্ধকারে নির্মমভাবে বিদ্যাকে আক্রমণ করল দুই ভাড়াটে খুনি উজাগর সিং আর কর্তার সিং।

একটু দূরে তখন অন্য গাড়িতে বসে যবনিকা পতনের অপেক্ষা করছিল চন্দ্রেশ। সে—ই দূর থেকে গুন্ডাদুটোকে ইশারা করেছিল।

উজাগর সিং আর কর্তার সিং ধারালো ছোরা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিদ্যা জৈনের ওপর। মহিলা আচমকা আক্রমণে চিৎকার করতে লাগলেন, কিন্তু নির্জন রাস্তায় সেই করুণ আর্তনাদ বেশিদূর পৌঁছোল না, তার আগেই মুখে উপর্যুপরি আঘাতে নিস্তেজ হয়ে পড়লেন ডা জৈনের স্ত্রী।

এই পুরো সময়টা অদূরে দাঁড়িয়ে ডা জৈন চুপচাপ দেখছিলেন। একটা চুরুট ধরিয়ে স্থিরভাবে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি, যতক্ষণ—না বিদ্যার শেষনিশ্বাস নির্গত হয়।

স্বামীকে ঠুঁটো জগন্নাথের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিদ্যার চোখদুটো আতঙ্কে, দুঃখে বড়োবড়ো হয়ে এল, তারপর আস্তে আস্তে বুজে গেল, চিরকালের মতো।

গুন্ডাদুটো যখন নিশ্চিত হল যে মিসেস জৈনের দেহে আর প্রাণ নেই, রক্তে ভেসে যাওয়া ক্ষতবিক্ষত শরীরটাকে তারা পাশের নালায় ফেলে দিল। একটু দূরেই চন্দ্রেশ রামজিলালের ট্যাক্সি নিয়ে অপেক্ষা করছিল, সেই গাড়িতে করে চলে গেল তারা।

গাড়ি বেশ কিছুটা চলে যাওয়ার পর নিখুঁতভাবে চিৎকার করে উঠেছিলেন ডা জৈন, বাড়ি থেকে তখন ভৃত্য ঠাকুর রাম সিং আর তার বউ কিরণবাঈ বেরিয়ে এসেছিল। তাদেরই সামনে হাউমাউ করে নাটক করতে শুরু করেছিলেন ডা জৈন।

কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডেডবডি নিয়ে ডা জৈন রওনা দিয়েছিলেন ডা সেনের নার্সিং হোমে।

এই মামলায় আসামির মামলা প্রভাবিত করার সম্ভাবনা ছিল প্রচুর। ডা জৈন রাষ্ট্রপতির চিকিৎসক ছিলেন। আবার উলটোদিকে বিদ্যা জৈনের দাদা বীরেন্দ্র সিং ও ছিলেন আর্মির মেজর জেনারেল, তৎকালীন দিল্লির অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি, দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নরের ঘনিষ্ঠ।

দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর নির্দেশ দিয়েছিলেন ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করার। আসামিরা কোনোমতেই যেন নিষ্কৃতি না—পায়।

ফকির চাঁদের প্রখর পরিশ্রমে জাল ক্রমশ গুটিয়ে এল। লোদি রোডে দয়াল সিং কলেজের কাছে রাস্তার ধারে সামান্য দূরত্বের ব্যবধানে ছোরা দুটো পাওয়া গেল। সেই ছোরা দুটোর গায়ে রক্ত লেগেছিল। সেই রক্তের সঙ্গে কর্তার এবং উজাগর সিং এর জামায় লেগে থাকা রক্ত এবং বিদ্যা জৈনের রক্ত পরীক্ষা করে ফরেনসিক এক্সপার্টরা রিপোর্ট দিলেন, ”জামার রক্ত এবং ছোরার—দুটোই একই ব্যক্তির।”

এইসময় ড্রাইভার রামজিলাল পুলিশকে বলল, ”হুজুর! আমি রাজসাক্ষী হতে চাই। আমি তো খুন করিনি, শুধু গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে রাজসাক্ষী করুন স্যার!”

রামজিলাল রাজসাক্ষী হওয়ায় পুলিশের কাজ অনেক সহজ হয়ে গেল। রামজিলাল অকুস্থলে গিয়ে দেখিয়ে দিল কীভাবে কোন জায়গায় গাড়ি নিয়ে তারা দাঁড়িয়েছিল, কখন এসেছিল।

অবশেষে পাঁচ—শো দিন কেস করার পর দিল্লি ট্রায়াল কোর্ট রায় দিলেন ১৯৭৫ সালের ৬ জুলাই। দু—শো পৃষ্ঠাব্যাপী রায়।

প্রত্যেক আসামির জন্য আলাদা আলাদা শাস্তি।

প্রথমেই অস্ত্র আইনের ২৭ নম্বর সেকশন অনুযায়ী নিজেদের কাছে অবৈধ অস্ত্র রাখার দায় অভিযুক্ত করা হল উজাগর সিং আর কর্তার সিংকে।

ডা নরেন্দ্র জৈন, চন্দ্রেশ শর্মা, রাকেশ কৌশিক, ভগীরথ এবং কল্যাণ গুপ্তাকে বিদ্যা জৈনকে ষড়যন্ত্র করে হত্যার অপরাধে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২০ নম্বর সেকশনে অভিযুক্ত করা হল।

চন্দ্রেশের আইনজীবী ছিলেন এ এন মুল্লা এবং ডা জৈনের আইনজীবী ছিলেন বি বি লাল। দুই আইনজীবীই প্রাণপণ লড়লেন।

”মাই লর্ড! একথা সত্য যে, আমার ক্লায়েন্ট শ্রীমতী চন্দ্রেশ শর্মার সঙ্গে ডা নরেন্দ্র জৈনের একটি অবৈধ সম্পর্ক ছিল, ডাক্তার শ্রীমতী চন্দ্রেশকে প্রচুর টাকা দিতেন, কিন্তু নিজের স্ত্রীকে খুন করে ওঁদের কী লাভ? উনি তো ডিভোর্সই দিতে পারতেন! তা ছাড়া বিদ্যা জৈনের নিজের চরিত্রও ভালো ছিল না, তিনি বহু পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেন।”

”মিথ্যে কথা!” বলে উঠলেন আর্মি জেনারেল বীরেন্দ্র সিং, বিদ্যার দাদা, ”নিজের ক্লায়েনকে জেতানোর জন্য একজন নির্দোষ মহিলার চরিত্রে দাগ লাগাতে লজ্জা করে না আপনাদের?”

আশ্রমচক থেকে এক জ্যোতিষীকে ধরে আনা হয়েছিল। সেই জ্যোতিষী চন্দ্রেশকে দেখে সনাক্ত করল, ”এই মহিলা আমার কাছে গিয়েছিল, বলেছিল ও যাকে ভালোবাসে, সে বিবাহিত, বয়স বাহান্ন—তিপ্পান্ন, নামের আদ্যক্ষর ‘এন’, ওঁর সাথে কি বিয়ে হবে?”

চন্দ্রেশের উকিল মুল্লা বললেন, ”তা ছাড়া ওদের সম্পর্ক ১৯৬৭ সাল থেকে, ছ—বছরে চন্দ্রেশ কখনো ক্ষতিকর কিছু করেননি ডা জৈনের স্ত্রীর বিরুদ্ধে, হঠাৎ এখন কেন করবেন?”

কিন্তু চন্দ্রেশের এক ঘনিষ্ঠ পরিচিত সাক্ষ্য দিল, ”৪ ডিসেম্বর রাতে চন্দ্রেশ আমাকে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল আপদ বিদায় হয়েছে। আমি চেপে ধরতে আর কিছু উত্তর পাইনি।”

আসলে কখন কার মাথায় দুষ্ট আত্মা ভর করে, তা কি হিসাব করে বলা যায়? লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। চন্দ্রেশ ডা জৈনের থেকে প্রচুর টাকা নিয়মিত পেয়েও সন্তুষ্ট হচ্ছিল না; সে হাত বাড়িয়েছিল সামাজিক মর্যাদার দিকে।

বিদ্যা জৈন নরম ভালোমানুষ ছিলেন, কিন্তু অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত বুদ্ধিমতীও তো ছিলেন। স্বামীর এই গুণের কথা কি তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি?

ডা জৈনের প্রতিবেশিনী শ্রীমতী শীলা খান্না আদালতে বললেন, ”আমাকে বিদ্যা বলেছিল, ইদানীং প্রায়ই সেক্রেটারি চন্দ্রেশকে ডিনারে নিমন্ত্রণ করত ওঁর স্বামী। আর চন্দ্রেশ এমন হাবভাব করত যেন ও—ই বাড়ির কর্ত্রী। মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে বিদ্যা চন্দ্রেশকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেন।”

সেক্রেটারি হিসেবে চন্দ্রেশের মাইনে ছিল মাসিক তিন—শো টাকা, অথচ ১৯৬৮ সালের ২৫ নভেম্বরে দেওয়া ডা জৈনের একটা চেকে দেখা যাচ্ছে তিনি মাইনেবাবদ চন্দ্রেশকে দিয়েছেন আট হাজার চার—শো টাকা, যা চন্দ্রেশের আঠাশ মাসের মাইনের সমান। এইরকম বিপুল অঙ্কের টাকা উনি চন্দ্রেশকে দিতেন প্রায় প্রতিমাসেই।

সংবাদপত্রে আলোড়ন ফেলা বিদ্যা জৈন হত্যা মামলার রিপোর্ট। বাঁ—দিকে চাদরের আড়ালে অবগুণ্ঠিতা চন্দ্রেশ শর্মা, ডানদিকে উপরে ডা নরেন্দ্র জৈন, ডানদিকে নীচে শ্রীমতী বিদ্যা জৈন।

প্রত্যেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হল। ছাড়া পেল একমাত্র ট্যাক্সি ড্রাইভার রামজিলাল।

আসামিপক্ষ প্রবল বিত্তশালী, তারা আপিল করল উচ্চ আদালতে। মজার বিষয় হল, উচ্চ আদালতে কর্তার এবং উজাগর সিং—এর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বেড়ে গিয়ে হল মৃত্যুদণ্ড। বাকিদের যাবজ্জীবন বহাল রইল।

উচ্চ আদালতের বিচারক রায় ঘোষণা করে বললেন, ”এক নিরপরাধ গৃহবধূকে এমন নির্মমভাবে যারা হত্যা করে, তাদের প্রতি আদালত কোনোভাবেই নরম হবে না।”

১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ফাঁসিকাঠে ঝুলে পড়ল উজাগর সিং এবং কর্তার সিং। আর নিজের সম্মান, প্রতিপত্তি ভূলুণ্ঠিত করে যাবজ্জীবনের জন্য কারাগারের অন্তরালে ঢুকলেন ডা নরেন্দ্র সিংহ জৈন, সঙ্গে অন্যরাও।

এই মামলা অনেক দিন থেকে উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে, প্রথমত সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স—এর ওপর এতজন অপরাধীর শাস্তি ধার্য করা হয়েছিল সেই প্রথম। আসামি পক্ষের উকিলেরা প্রাকারান্তরে ডা জৈন এবং চন্দ্রেশের অবৈধ প্রেম মেনে নিয়েছিলেন, সেটাও আশ্চর্যের। কারণ এমন কোনো কিছু যা আসামিকে কলঙ্কিত করছে, তা সাধারণত তার উকিল মানতে চান না।

দ্বিতীয়ত, দণ্ডবিধি অনুযায়ী মূল হত্যাকারী এবং হত্যার ষড়যন্ত্রকারীরা আইনের চোখে সমান দোষী, কিন্তু এক্ষেত্রে উজাগর এবং কর্তার সিং ফাঁসির আদেশ পেলেও ডা জৈন বা অন্যান্যদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

শাস্তির ক্ষেত্রেও এই বৈষম্য কি প্রভাবশালী আসামিদের জন্যই? উজাগর সিং, কর্তার সিং ভাড়াটে খুনি, টাকার বিনিময়ে অপরাধ করেছে, তাদের পেছনে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি নেই।

কিন্তু যারা এক নির্দোষ প্রাণকে শেষ করতে এমন ঘৃণ্য ছক কষল, তারা যে সমাজের মান্যগণ্য ব্যক্তি। বিদ্যা জৈনের স্বামীই তো আসল আসামি!

মনে পড়ে যায় সেই বিখ্যাত প্রবচন, “Poor went to the gallows but the affluent survived!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *