ধাপে ধাপে খুন

ধাপে ধাপে খুন

আজ থেকে প্রায় বাষট্টি বছর আগেকার কথা।

১৯৫৬ সালের ২০ নভেম্বর।

মুম্বাই, তৎকালীন বোম্বাই শহরের গ্র্যান্ট মেডিক্যাল কলেজের শব ব্যবচ্ছেদ ঘর। সিপাই বিদ্রোহেরও আগে প্রতিষ্ঠিত এই খ্যাতনামা ডাক্তারি কলেজে পড়ার সুযোগ পায় শুধুমাত্র অত্যন্ত মেধাবী ছাত্ররাই। বিশাল ভিক্টোরিয়ান গথিক বিল্ডিং, উঁচু উঁচু ছাদ, সুদীর্ঘ করিডর।

আজ টেবিলে এক মধ্যবয়স্কা মহিলার সম্পূর্ণ উলঙ্গ মৃতদেহ শোয়ানো। মহিলা খুব সুন্দরী না হলেও জীবদ্দশায় যে তাঁর মধ্যে একটা নজরকাড়া লাবণ্য ছিল তা এখনও বোঝা যাচ্ছে। মাথার ঘন কোঁকড়া মিশমিশে কালো চুল যেমন—তেমন ভাবে টেনে বাঁধা, মুখখানি ভরাট।

দেখে বোঝা যায় ইনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত ঘরের কোনো গৃহবধূ।

মহিলার নাম ইন্দুমতী পঙ্খে।

যখনকার কথা বলছি, তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে ভারতবর্ষ। মেয়েরা তখনও যথেষ্ট পিছিয়ে। ঘরের মধ্যেই অতিবাহিত হত তাদের জীবন। বন্ধ ঘরের মধ্যে ঘোমটা মাথায় যাদের গোটা জীবন কাটত, ইন্দুমতী তাদেরই একজন হয়ে তাকে যে এইভাবে মৃত্যুর পর মেডিক্যাল কলেজের একরাশ ছাত্রের সামনে আদুর গায়ে শুয়ে থাকতে হবে, তা কি ইন্দুমতী নিজেও ভাবতে পেরেছিল?

তখনও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের সুবিধার্থে মরণোত্তর দেহদানের চল হয়নি। হাসপাতালে কেউ মারা গেলে যথোপযুক্ত নিয়মাচার মেনে তার সৎকার করত আত্মীয় পরিজনেরা। লাশকাটা ঘরের টেবিলে ঠাই হত শুধু বেওয়ারিশ লাশেদেরই।

বেচারি ইন্দুমতী জানতেও পারল না। জীবন্ত অবস্থায় নিজেকে সে সযত্নে আড়ালে রাখত বাইরের লোকের থেকে, তার সেই নশ্বর দেহ আজ চিরে দেখবে একদল ডাক্তারি ছাত্র।

ছাত্রদের মধ্যেও মৃদু গুঞ্জন। বেওয়ারিশ লাশ বলতে তারা এতদিন রাস্তার এককোণে মরে থাকা ভিখারি বা মাতালের দেহই ব্যবচ্ছেদের সুযোগ পেয়েছে, এমন অভিজাত মহিলার দেহ মেলে কোথায়?

যথাসময়ে অ্যানাটমির প্রোফেসর এলেন। রাশভারী ব্রিটিশ অধ্যাপক ডা থমসন। এসেই তাকালেন লাশের দিকে। তাঁর মনে পড়ে গেল, গতকালই এই ডেডবডি জে জে হসপিটালের মর্গ থেকে এসেছে। তিনি একঝলক তাকালেন ছাত্রদের দিকে, ”তোমরা সবাই প্রস্তুত?”

”ইয়েস স্যার!” সমস্বরে বলল ছাত্রের দল।

প্রোফেসর থমসন ইঙ্গিতে পাশে অপেক্ষমান সহকারীকে বললেন ব্যবচ্ছেদের ছুরিটা দিতে। এরা সবে দ্বিতীয় বর্ষ, একদম লিভার, প্যানক্রিয়াস থেকে দেখানো শুরু করবেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে যাবেন ইনটেনস্টাইনের দিকে। স্ত্রীদেহ খুব বেশি পাওয়া যায় না, ইউটেরাস, ওভারির পার্টসগুলো ভালোভাবে দেখাতে হবে।

হাতে গ্লাভস পরে ছুরিটা নিয়ে নাভির উপর থেকে চিরতে গিয়েই তাঁর চোখ পড়ল মহিলার গলার দিকে।

অভিজ্ঞ অধ্যাপকের চোখ। ডা থমসন সাথে সাথে থেমে গেলেন। ছুরি নামিয়ে ঝুঁকে পড়লেন গলার দিকে। একটা স্ক্যালপেল নিয়ে গলাটা চেপে দেখতে লাগলেন পেছনের ঘাড়ের দিকটা।

”কী হয়েছে স্যার?” একজন ছাত্র সাহস করে জিজ্ঞেস করলো।

ডা থমসন ভালো করে বিভিন্ন দিক থেকে দেখছিলেন। একটু বাদে বিড়বিড় করলেন, ”এই বডি কাটা যাবে না।” আরও কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে যেন নিশ্চিত হয়ে পাশ ফিরে তাকালেন ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের দিকে, ”রমেশ, এটা আমি ডিসেক্ট করবো না।”

”কেন স্যার?” রমেশ অবাক। কাল থেকে এই থমসন সাহেবই বলে আসছিলেন, বহুদিন বাদে ফিমেল বডি পাওয়া গেছে, আজ যেন সব ইয়ারের ছাত্রদের ক্লাস পর পর রাখা হয়।

”ভালো করে দ্যাখো।” প্রোফেসর থমসন আঙুল দিয়ে দেখালেন, ”বডির ঘাড়ে আঁচড়ানোর দাগগুলো দেখতে পাচ্ছ?”

কথাটা শুনে শুধু রমেশ নয়, অনেক কৌতূহলী ছাত্রই ঝুঁকে পড়ল ঘাড়ের দিকে। স্যার ঠিকই বলেছেন। ঘাড়ে বেশ কয়েকটা গভীর লম্বা লম্বা দাগ।

”প্রিন্সিপাল স্যার কাল বলেছিলেন জে জে হসপিটালে কেউ ভরতি করে দিয়ে গিয়েছিল, পরে মারা গেছে। এমন দাগ, তবু পোস্ট মর্টেম করেনি কেন ওরা” ভ্রূ কুঁচকে বললেন থমসন সাহেব, ”তুমি প্রিন্সিপালকে জানাও, উনি যেন জে জে হসপিটালের করোনারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এটা পোস্ট মর্টেম করতে হবে। সন্দেহজনক লাগছে।” বলতে বলতে মাথা নেড়ে ল্যাব ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন প্রৌঢ় অধ্যাপক সাহেব।

রমেশ থতমত খেয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর ছুটল প্রিন্সিপালের সেক্রেটারির কাছে।

যেকোনো হাসপাতালের কোনো শবদেহ পোস্ট মর্টেম করা হবে, কোনো শবদেহ চালান করা হবে মেডিক্যাল কলেজে, তার শেষ কথা বলেন করোনার। বিকেলের মধ্যে জে জে হসপিটালের করোনারের কাছে খবর চলে গেল।

করোনার শুনেই চমকে উঠলেন। আরে! এটা তো সেই ডেডবডি, যেটা এসেছিল গোকুলদাস তেজপাল হসপিটাল থেকে। ওদের ওখানে মর্গ নেই, তাইজন্য পাঠানো হয়েছিল এখানে। প্রথমে করোনার নিতে চাননি, কারণ ডেডবডির সঙ্গে মৃত্যুর কারণ জানিয়ে কোনো ডেথ সার্টিফিকেট ছিল না, সর্বোপরি সঙ্গে ছিল বোম্বাই পুলিশের পোস্ট মর্টেম করার অনুরোধ জানিয়ে একখানা চিঠি।

কিন্তু তবু পোস্ট মর্টেম হয়নি। কারণ করোনার যখন গোকুলদাস হাসপাতালে ফোন করে খোঁজ নিয়েছিলেন, ওখানকার রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার, সংক্ষেপে আর এম ও ডাক্তার মুসকার ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছিলেন।

কথাটা মনে পড়তেই করোনার সাহেব তাড়াতাড়ি ডেথ সার্টিফিকেটের পৃষ্ঠাটা উলটে দেখলেন।

এই তো, ডাক্তার মুসকার পরিষ্কার লিখে দিয়েছেন, ”মৃত্যুর কারণ—ডায়াবেটিক কোমা।”

এর মধ্যেই করোনারের কাছে ফোন চলে এল বোম্বে পুলিশের কাছ থেকে, ”নমস্কার স্যার! গ্র্যান্ট মেডিক্যাল কলেজের প্রোফেসর ডা থমসন আমাদের ফোন করে জানিয়েছেন, আপনাদের মর্গ থেকে ওই কলেজে পাঠানো একটা বডি নিয়ে ওঁর সন্দেহ হচ্ছে যে সেটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। আপনারা ময়না তদন্ত করে একটা রিপোর্ট পাঠান তাড়াতাড়ি।”

”কিন্তু।” করোনার বললেন, ”আপনারা তো আগেও ময়না তদন্ত করতে বলেছিলেন কোনো ডেথ সার্টিফিকেট ছিল না বলে। আমি তখন পোস্ট মর্টেমে পাঠাব বলে ফোটোগ্রাফি সেলকে দিয়ে একটা ছবিও তোলালাম, কিন্তু তারপর গোকুলদাস তেজপাল হসপিটালের ডা মুসকার ডেথ সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দিলেন বলে আমি আর …।”

ইংরেজিতে একটা বিখ্যাত প্রবাদ আছে, “Crime Never Pays.”

এক্ষেত্রে সেই প্রবাদটা যেন ভীষণভাবে সত্যি। পরে দেখা গিয়েছিল ইন্দুমতী পঙ্খের ওই ঘাড়ের দাগ আসলে কিছুই নয়, মৃত্যুর পরে কোনো কারণে টানাহ্যাঁচড়ার ফল।

কিন্তু থমসন সাহেবের সেই সন্দেহের ফলে করা সেই পোস্ট মর্টেমই দিনের আলোয় নিয়ে এসেছিল অনেক কিছুকে।

যার ফল ১৯৫৬ সালের বিখ্যাত ‘পুনা বিধবা হত্যা মামলা’।

ধাপে ধাপে অঙ্ক কষে সুচারু হাতে করা হয়েছিল গভীর একটা ষড়যন্ত্র। যার প্রতিটা পর্বে সাহায্য করেছিল অনেকে।

কী সেই ঘটনা? জানতে হলে থমসন সাহেবের সেই লাশকাটা ঘরের দিন থেকে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে পাক্কা সাতদিন আগে।

১৯৫৬ সালের ১৩ নভেম্বর। বোম্বাইয়ের ভিক্টোরিয়া রেলস্টেশন। ভোর পাঁচটা। সবে শীত পড়ছে, এই ভোরের ঠান্ডা আমেজে প্ল্যাটফর্ম চত্বরেই শুয়ে থাকা কুলিরা চাদরে গুটিসুটি হয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছিল, এমন সময় কোনো ট্রেন ঢোকার ভোঁ আওয়াজে তারা দেখতে পেল, স্টেশনে ঢুকছে পুনা প্যাসেঞ্জার।

কুলিদের মধ্যে বিশেষ কোনো হাঁকডাক শোনা গেল না।

কোনো মেল ট্রেন হলে এতক্ষণে হইহই পড়ে যেত। এ অতি সামান্য পুনা প্যাসেঞ্জার। পুনা থেকে বোম্বাই আসার ট্রেন সব দিনে দিনেই। এই একটাই ট্রেন ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে সারা রাত ধরে আসে। যাদের কোনো তাড়া নেই, তারাই আসে এই ট্রেনে।

তখন স্টিম ইঞ্জিনের যুগ, পুনা প্যাসেঞ্জার ট্রেন হুশ হুশ শব্দ করতে করতে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্ট থেকে উদ্ভ্রান্ত ভঙ্গিতে নামলেন একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। পরনে স্যুট টাই, মাথার চুলে রুপোলি পাক ধরেছে, মোটা গোঁফেও কাঁচাপাকা রেখা।

ভদ্রলোক ডাক্তার। হাতে ধরে থাকা স্টেথোস্কোপেই বোঝা যায়।

ডাক্তারবাবু নেমেই দু—একটা কুলির ছুটে আসাকে পাত্তা না—দিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। ফিরে এলেন একটু পরেই। সঙ্গে দু—জন রেলের উর্দি পরা লোক, তারা একটা স্ট্রেচার বয়ে আনছে।

কুলির দল সচকিত হয়ে উঠল। কী ব্যাপার, ট্রেনের মধ্যে কারুর কিছু হল নাকি? তারা কৌতূহলী হয়ে চারপাশে ভিড় করতে লাগল।

হ্যাঁ, তাদের আশঙ্কাই সঠিক।

ট্রেন থেকে স্ট্রেচারে করে নামানো হল এক ভদ্রমহিলাকে। চোখ সম্পূর্ণ বোজা, শরীরে কোনো সাড় নেই।

একটা কুলি আরেকজনের কানে ফিসফিস করল, ”কি ভাই, ট্রেনের মধ্যে টেঁসে গেছে নাকি?”

দ্বিতীয় কুলি বলল, ”কী জানি, মরে গেছে না অজ্ঞান হয়ে গেছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।”

কয়েকজন কুলি এগিয়ে এলেও ডাক্তারবাবু তাদের বিশেষ পাত্তা দিলেন না। রেলকর্মী দু—জনের সহায়তায় বাইরে এসে একটা ট্যাক্সি ডাকলেন।

রেলের স্ট্রেচারবাহক কর্মীরা ট্যাক্সিওয়ালাকে জানলা দিয়ে ঝুঁকে বলল, ”ইনি হঠাৎ রেলগাড়িতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সামনেই সেন্ট জর্জ হসপিটাল। ওখানে নিয়ে যাবেন। সঙ্গে ডাক্তারবাবু আছেন, কোনো অসুবিধা নেই।”

মহিলাকে পেছনের সিটে ধরাধরি করে শুইয়ে দিয়ে ততক্ষণে ডাক্তারবাবু এসে বসেছেন ট্যাক্সির সামনের সিটে। তাঁর সঙ্গে শুধু একটি ছোটো ব্যাগ। আর কোনো মালপত্র নেই। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে তিনি রেলকর্মীদের দিকে হাত নেড়ে ধন্যবাদ জানালেন, তারপর ট্যাক্সিওয়ালাকে বললেন, ”চলিয়ে!”

ট্যাক্সিওয়ালা কিছুটা এগোতেই ডাক্তারবাবু আবার বললেন, ”আপনি গোকুলদাস তেজপাল হসপিটালে চলুন।”

ড্রাইভার বলল, ”কেন? ওটা তো দূর আছে। কাজেই তো সেন্ট জর্জ!”

ডাক্তারবাবু যেন শুনতেই পেলেন না, তিনি ততক্ষণে পেছন ফিরে মহিলাকে ভাল করে দেখছেন।

হসপিটালে পৌঁছে ডাক্তারবাবু দেরি করলেন না, ছুটে গিয়ে ঢুকলেন ‘এমারজেন্সি’ তে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার স্ট্রেচার নিয়ে এসে ভদ্রমহিলাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল।

ডাক্তারবাবুও ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে পিছু পিছু গিয়ে ঢুকলেন সেখানে।

‘এমারজেন্সি’র দায়িত্বে তখন রয়েছেন ডাক্তার উগেল।

ব্যস্তসমস্ত হয়ে এই ডাক্তারবাবু এগিয়ে গেলেন তাঁর দিকে, ”নমস্কার। আমি অনন্ত লাগু, ডা অনন্ত লাগু। পুনায় থাকি, ওখানেই প্র্যাকটিস করি।”

”ও আচ্ছা নমস্কার।” ডা উগেল বললেন, ”এই মহিলা আপনার কেউ…?”

”ইনি আমার বহুদিনের পেশেন্ট, এঁর নাম ইন্দুমতী পঙ্খে। ইনি প্রায়ই অজ্ঞান হয়ে যান। হিস্টিরিয়া আছে আসলে। ওই ব্যাপারেই বোম্বাই নিয়ে আসছিলাম বড়ো স্পেশালিস্ট ডাক্তার দেখাব বলে। এদিকে ট্রেনে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলেন, কিছুতেই জ্ঞান হচ্ছে না আর।” ডা অনন্ত লাগু বললেন।

”আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক আছে। আমরা দেখছি।” ডা উগেল শশব্যস্ত হয়ে পড়লেন। উলটোদিকের লোকটিও ডাক্তার জানতে পারলে ডিউটির ডাক্তাররা আপনা থেকেই তাঁদের বেশ কাছের ভাবতে শুরু করেন। ডা অনন্ত লাগুর জন্য এক কাপ চা আনতে বলে ডা উগেল রোগিণীর ওপর ঝুঁকে পড়লেন।

সেই মহিলা, অর্থাৎ ইন্দুমতী পঙ্খের তখন হাত—পায়ে মাঝে মাঝেই খিঁচুনি ধরছে। ডা উগেল নাড়ি দেখলেন, বেশ দ্রুত।

ডা উগেল এরই মধ্যে খেয়াল করলেন, ভদ্রমহিলাকে একঝলক দেখলে বেশ বনেদি বংশের বধূ বলে মনে হলেও তাঁর গায়ে একফোঁটা অলংকার নেই। নিদেনপক্ষে একগাছা সরু হার কিংবা চুড়ি তো থাকবে, কিচ্ছু নেই। অথচ পরনে বেশ দামি শাড়ি।

ডা উগেল ডা অনন্ত লাগুকে এই নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না, ওপরে ফিমেল ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিলেন ইন্দুমতী পঙ্খেকে। তারপর ডা অনন্ত লাগুকে বললেন, ”ডক্টর, আপনি যেহেতু ওঁকে এখানে নিয়ে এসেছেন, বুঝতেই পারছেন, ওঁর নাম, ঠিকানাটা যদি একটু রেজিস্টারে এন্ট্রি করে দেন …।”

”হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আরে, আমিও তো এককালে ইন্টার্ন ছিলাম সরকারি হাসপাতালে, এত হেসিটেশনের কী আছে?” ডা লাগু তক্ষুনি রেজিস্টারে নাম ঠিকানা লিখে দিলেন,

ইন্দুমতী পঙ্খে

প্রযত্নে ডা অনন্ত চিন্তামন লাগু

২০ বি, শুক্রওয়ার পেঠ, গালা নং ১২

পুনা — ২

ইন্দুমতীকে যখন ওপরতলায় ফিমেল ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হল, তখন ঘড়িতে সবে ছ—টা বাজছে। সারারাতের নাইট ডিউটি শেষে এই ভোরের দিকে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে ফিমেল ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা তরুণী ডাক্তার অনিজার। সে সবে কয়েক মাস হল ডাক্তারি পাশ করেছে, এখনও নাইট ডিউটিতে অতটা সড়গড় হতে পারেনি।

স্ট্রেচারে করে একজন রুগিকে ঢোকানো হচ্ছে দেখে সে দৌড়ে এল।

ডা অনন্ত লাগুও ইন্দুমতীর স্ট্রেচারের পাশে পাশেই এসেছিলেন, তিনি বললেন, ”নমস্কার ম্যাডাম। আমি এঁর পারিবারিক চিকিৎসক, পুনা থেকে আসছি।”

ডা অনন্ত লাগু উগেলকে যা বলেছিলেন, ডা অনিজাকেও তিনি সেটাই বললেন।

অনিজা প্রথমেই উত্তেজক স্টিমুল্যান্ট ইনজেকশন দিলেন, সঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহেরও ব্যবস্থা করলেন। তারপর দিলেন চল্লিশ ইউনিট ইনসুলিন।

ইনসুলিন দেওয়া হয় সুগার অর্থাৎ ডায়াবেটিসের রুগিদের, ডা অনিজা কি ইনসুলিন দেওয়ার আগে ইন্দুমতীর ইউরিন পরীক্ষা করেছিলেন? এই নিয়ে পরে আদালতে বিতর্ক কম হয়নি।

যাইহোক, সেপ্রসঙ্গে পরে আসছি।

এত কিছু করেও তিনঘণ্টা কেটে গেল, তবু ইন্দুমতীর কোনো জ্ঞান ফিরল না।

ডা অনিজা তখন আর আর ঝুঁকি নিলেন না, সিনিয়র ডাক্তার সৈফিকে খবর দিলেন।

ডা সৈফি সব দেখেশুনে বললেন, ”এক কাজ করো, আরো চল্লিশ ইউনিট ইনজেকশন দিয়ে দাও।”

”তিন ঘণ্টা আগেই কিন্তু একবার দিয়েছি, আবার দেব স্যার?” ডা অনিজা প্রশ্ন করলো।

”হ্যাঁ। সঙ্গে কুড়ি সিসি গ্লুকোজ ইনজেকশনও দাও। এ ছাড়া ইন্ট্রা—গ্যাস্ট্রিক গ্লুকোজ ড্রিপ দিয়েও শরীরে গ্লুকোজ ঢোকাও।” ডা সৈফি আদেশ দিলেন।

অতঃপর এইসবই করা হল। ইন্ট্রাভেনাস ইনজেকশন, ইন্ট্রা—গ্যাস্ট্রিক গ্লুকোজ ড্রিপ, এইসব করতে করতে আরও দু—ঘণ্টা কাটল। ইতিমধ্যে ইন্দুমতীর ইউরিন পরীক্ষাও করা হল।

ঘড়িতে এখন বেলা এগারোটা।

এই সময় ফিমেল ওয়ার্ড পরিদর্শনে এলেন ভিজিটিং সার্জেন ডা ভরিয়াবা।

ইন্দুমতীর বেডের কাছে এসে ডা ভরিয়াবা জিজ্ঞাসাসূচক ভঙ্গি করতেই ডা অনিজা বলতে শুরু করল, ”স্যার। এটা ডায়াবেটিক কোমা—র কেস। পেশেন্ট ডায়াবেটিস থেকে কোমায় চলে গেছে। ইউরিনে কি অ্যাসিটোন আছে?”

”না স্যার, অ্যাসিটোন আছে কিনা তো টেস্ট করিনি, সুগার আছে।” ডা অনিজা বলল।

”সুগার আছে তো কী? আগে তো তুমি অ্যাসিটোন আছে কিনা দেখবে, থাকলেও কতটা আছে নোটিস করবে, তারপর তো বলবে ডায়াবেটিক কোমা! নিজে থেকেই ডায়াবেটিক কোমা বলছো কী করে তুমি!” ডা ভরিয়াবা অনিজাকে রীতিমতো বকাঝকা করলেন।

একপাশে তখনও ইন্দুমতীর ইউরিন স্যাম্পল রাখা ছিল। অনিজা ডা ভরিয়াবার তিরস্কার শুনে তক্ষুনি টেস্ট করতে গেল। কিছুক্ষণ পরীক্ষা করে ওর মনে হল, খুব সামান্য পরিমাণে অ্যাসিটোন আছে।

ডা ভরিয়াবা তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর মুখ গম্ভীর হয়ে রয়েছে।

তবে ডা অনিজাকে এরপর আর বকুনি খেতে হল না।

কয়েক মুহূর্ত পরেই ঘড়িতে যখন ঠিক সাড়ে এগারোটা, ইন্দুমতী মারা গেল।

আর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হল এক সরল ধনী বিধবার জীবন। মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকেছিলেন তিনি। যাকে প্রাণপণ বিশ্বাস করে তুলে দিয়েছিলেন নিজের সব কিছু, তার জন্যই যে তাঁর প্রাণবায়ু এভাবে নির্গত হবে, তা বোধ করি ইন্দুমতী কল্পনাও করতে পারেননি। তবে, মৃত্যুর পরে হলেও ইন্দুমতী সুবিচার পেয়েছিলেন।

পাকুড় হত্যা মামলার সঙ্গে এই মামলাও ভারতের ল্যান্ডমার্ক জাজমেন্টে একসারিতে উচ্চরিত হয়, ডাক্তারি বিদ্যা কাজে লাগিয়ে তিলে তিলে খুন করার স্তম্ভিত পদ্ধতির জন্য।

যাইহোক, ইন্দুমতী মারা গেলেও ডা ভরিয়াবা ওয়ার্ড ছেড়ে গেলেন না। অনিজাকে বললেন, ”তুমি ডেডবডির পোস্ট মর্টেম করার ব্যবস্থা করো। আমার মনে হচ্ছে না পেশেন্টের আদৌ ডায়াবেটিক কোমা হয়েছিল।”

কথাটা বলেই ডা ভরিয়াবা আর দাঁড়ালেন না, কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে গেলেন ওয়ার্ড ছেড়ে।

কেউ ভালো করে তাঁকে খেয়াল করলে দেখতে পেত, অবিশ্বাস আর দ্বিধা একসঙ্গে খেলা করছে তাঁর মুখে।

ডা ভরিয়াবার আদেশমতো ডা অনিজা পেশেন্ট ফাইলে লিখে দিল, ”পোস্ট মর্টেম করতে হবে।”

পেশেন্ট ফাইলে রোগীর রোগ নির্ণয়েরও একটা কলাম থাকে, কিন্তু ডা অনিজা সেটাতে কিচ্ছু লিখল না, কলামটা ফাঁকা রেখে দিল।

এই গোটা সময়টা ইন্দুমতীকে যিনি হসপিটালে নিয়ে এসেছিলেন, সেই ডা অনন্ত লাগু কোথায় ছিলেন?

ডা ভারিয়াবা পরে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তিনি যখন ওয়ার্ড পরিদর্শনে আসেন, তখন ওই ব্যক্তিকে দেখতে পাননি। অথচ এটাও তদন্তে প্রমাণিত হয়েছিল, সেইদিন অর্থাৎ ১৯৫৬ সালের ১৪ নভেম্বর ডা অনন্ত লাগু বোম্বাই থেকে পুনা ফেরত চলে গিয়েছিলেন।

ফিরে আসি হসপিটালে।

অনিজা পুরো কেস পেপারটা পাঠিয়ে দিল ওই হাসপাতালের রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার অর্থাৎ আর এম ও ডা মুসকারের কাছে। কোনো লাশকে পোস্ট মর্টেমে পাঠানোর দায়িত্ব আর এম ও—রই।

ডা মুসকারের কাছে যখন ইন্দুমতীর ফাইল পৌঁছল, তখন বাজে প্রায় দুপুর একটা।

ডা মুসকারের কি খুব খিদে পেয়ে গিয়েছিল?

কেননা, তিনি রিপোর্টটা নিয়ে কিছুই করলেন না। পোস্ট মর্টেম পরীক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থাও নিলেন না, বরং অবহেলাভরে কাগজগুলো রেখে দিলেন টেবিলের এক কোণায়।

অনিজা দুটোর সময় খোঁজ নিতে এল, ”স্যার, ইন্দুমতী পঙ্খের ফাইলটা পোস্ট মর্টেমের জন্য প্রসিড করেছেন?”

তখন দুপুর দুটো। লাঞ্চ সেরে ডা মুসকার একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।

জুনিয়র ডাক্তার অনিজার কথা শুনে হালকাভাবে বললেন, ”করব করব। সব করব। আচ্ছা, যে পেশেন্টকে নিয়ে এসেছিল, সে কি আছে এখনও?”

অনিজা কাঁধ ঝাঁকাল, ”বলতে পারব না স্যার। আমি একবারই দেখেছিলাম পেশেন্ট ওয়ার্ডে আসার সময়। তারপরে আর দেখিনি।”

ডা মুসকার আর কিছু বললেন না। হেলেদুলে কিছুক্ষণ গড়িমসি করে ইন্দুমতী পঙ্খের ফাইল উলটে ডা অনন্ত লাগুর ঠিকানা বের করলেন। তারপর নিজের সহকারীকে দিয়ে একটা টেলিগ্রাম করে দিলেন ডা অনন্ত লাগুর লিখে যাওয়া ইন্দুমতীর পুনার ঠিকানায়।

”ইন্দুমতী মারা গেছে। মৃতদেহ সৎকার করতে হবে। দ্রুত উত্তর দিন।”

সেদিনটা পুরো কেটে গেল। কেউ এল না।

পরের দিনও ইন্দুমতীর বডি নিতে ডা অনন্ত লাগু এলেন না। এমনকী ইন্দুমতীর কোনো আত্মীয়স্বজনও এল না।

এই হসপিটালে আবার উপযুক্ত মর্গ নেই। কোনো ডেডবডি সংরক্ষণের প্রয়োজন হলে সেটাকে চালান করতে হয় জে জে হসপিটালের মর্গে।

ডা মুসকার যখন চিন্তাভাবনা করছেন যে, আর তো এভাবে মৃতদেহ ফেলে রাখা যায় না, ঠিক তখনই তাঁর কাছে এসে পৌঁছল একটা চিঠি।

চিঠিটা লিখেছিলেন ডা অনন্ত লাগু নিজে, পুনা থেকে। এই চিঠি পরবর্তীকালে আদালতে বিচারের সময় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

ডা লাগু লিখেছিলেন,

”শ্রীমতী ইন্দুমতী পঙ্খের একমাত্র ভ্রাতা শ্রী গোবিন্দবামন দেশপাণ্ডে থাকেন কলকাতায়। তাঁকে আমি ইতিমধ্যে টেলিগ্রাম করেছি। তিনি কলকাতা থেকে বোম্বাই যাত্রা করবেন আর খুব বেশি হলে দু—দিনের মধ্যেই জি টি হসপিটালে পৌঁছে যাবেন। ধন্যবাদ।”

ডা মুসকার চিঠি পেয়ে বুঝলেন মৃতদেহ আপাতত জে জে হসপিটালের মর্গে পাঠানো ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।

ইতিমধ্যে তাঁর আগে পাঠানো টেলিগ্রামের কোনো উত্তর না—পেয়ে তিনি একটা কাজ করেছিলেন। বোম্বাইয়ের এসপ্ল্যানেড থানায় একটা খবর দিয়ে রেখেছিলেন।

”১৯৫৬ সালের ১৩ নভেম্বর ভোর ছটার সময় ইন্দুমতী পঙ্খে নামক এক বিয়াল্লিশ বছর বয়সের মহিলাকে হিষ্টিরিয়া রোগের চিকিৎসা করার জন্য গোকুলদাস তেজপাল হসপিটালের ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ভরতি করা হয়। ওইদিন বেলা সাড়ে এগারোটায় মহিলা মারা গিয়েছেন। ভরতি করার সময় মহিলার ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল, ইন্দুমতী পঙ্খে, প্রযত্নে ডা অনন্ত চিন্তামন লাগু, ২০ বি, শুক্রওয়ার পেঠ, গালা নং ১২, পুনা — ২। আমরা ওই ঠিকানায় টেলিগ্রাম করেছি, কিন্তু কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। কাজেই, মহিলার দেহ জে জে হসপিটালের মর্গে ট্রান্সফার করা হোক, না হলে ডেডবডি পচে যাবে।”

কোনো মৃতদেহ মর্গে স্থানান্তরিত করতে হলে একটা নিয়মমাফিক ইনফর্ম থানায় করে রাখতে হয়। তাই ডা মুসকারের এই চিঠি। তিনি এই একই চিঠির একটা কপি জে জে হসপিটালের করোনারকেও পাঠিয়ে রেখেছিলেন।

পুলিশ খবর পেয়েই জে জে হসপিটালের করোনারকে জানিয়ে দিল, ”আপনারা দয়া করে গোকুলদাস তেজপাল হসপিটাল থেকে শ্রীমতী ইন্দুমতীর মৃতদেহটা আপনাদের মর্গে অ্যাকসেপ্ট করুন। আর যেহেতু মৃত্যুর কারণ জানিয়ে কোনো ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া নেই, তাই মৃতদেহটির ময়নাতদন্ত অবশ্যই করবেন।”

এরপরের ঘটনাটা আগেই বলেছি। জে জে হসপিটালের করোনারের নির্দেশ পেয়েও ডা মুসকার পোস্ট মর্টেমের জন্য উৎসাহ তো দেখালেনই না, উলটে মৃত্যুর কারণ লিখে দিলেন, ‘ডায়াবেটিক কোমা।’

অতএব, ইন্দুমতী পঙ্খের দেহটি চলে গেল গ্র্যান্ট মেডিক্যাল কলেজের লাশকাটা ঘরে এবং থমসন সাহেবের লাশ ব্যবচ্ছেদের আপত্তিতে পুলিশ করোনারকে জানাল, ”আপনারা এক্ষুনি পোস্ট মর্টেমের ব্যবস্থা করুন। আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সার্জনই পোস্ট মর্টেম করবেন।”

অতঃপর ইন্দুমতী মারা গিয়েছিলেন ১৩ নভেম্বর, তার ঠিক দশদিন পরে ২৩ তারিখ বোম্বাই পুলিশের সার্জেন ডা ঝালা ইন্দুমতীর শরীর চিরে ময়নাতদন্ত করলেন।

পরীক্ষা করে ডা ঝালা দেখলেন ঘাড়ের ওই আঁচড়ানো দাগগুলো মৃত্যুর আগের নয়, মৃত্যুর পরের কোনো দাগ। হয়তো লাশ এদিক—ওদিক করার সময় ডোমেদের হাত লেগেছে। ডা ঝালা পাকস্থলীতে কোনো বিষ পেলেন না। তবু তিনি অন্ত্র পরীক্ষা করার জন্য পাঠিয়ে দিলেন কেমিক্যাল এগজামিনারের কাছে।

কেমিক্যাল এগজামিনারও কোনো বিষের অস্তিত্ব টের পেলেন না। অতএব ডা ঝালা রিপোর্ট দিলেন, ”কোনো বিষ পাওয়া যায়নি। ডায়াবেটিক কোমার কারণে মৃত্যু হলেও হতে পারে।”

এরপর আর কিছুই করার নেই। পুলিশ পরেরদিন ইন্দুমতীর মৃতদেহ হিন্দু রিলিফ সোসাইটিকে পাঠাল। হিন্দু রিলিফ সোসাইটি মৃতদেহটি সৎকার করে ফেলল।

ইন্দুমতী পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

করোনার, থমসন সাহেব সবাই ধীরে ধীরে ভুলে গেলেন ইন্দুমতীর কথা। কারুর মনেও পড়ল না যে, ডা অনন্ত লাগুর কথা অনুযায়ী গোবিন্দবামন দেশপাণ্ডে নামক কেউ কোনোদিনই এল না ইন্দুমতীর খোঁজে।

ভুললেন না শুধু একজন। তিনি বোম্বের এসপ্ল্যানেড থানার ইনস্পেক্টর লক্ষ্মণ সেহগাল। লক্ষ্মণ সেহগালের পুরো ব্যাপারটাই প্রথম থেকে সন্দেহজনক লাগছিল।

একজন অভিজাত পরিবারের মহিলা তাঁর পারিবারিক চিকিৎসকের সঙ্গে পুনা থেকে বোম্বাই এলেন ডাক্তার দেখাতে, তাঁর সারা গায়ে কোনো গয়না নেই, সঙ্গে কোনো টাকাপয়সা নেই কেন?

ডা অনন্ত লাগু সেই যে ভরতি করে দিয়ে চলে গেল, তারপর টেলিগ্রাম পেয়েও এল না কেন? চিঠিতে লিখল, ভাই আসবে, কই, কেউ—ই তো এল না!

হ্যাঁ, এটা ঠিক, পোষ্ট মর্টেমে কিছুই পাওয়া যায়নি, ডাক্তারের সার্টিফিকেটও রয়েছে। কিন্তু গোটা ব্যাপারটাই যেন ঘোর সন্দেহজনক!

লক্ষ্মণ সেহগাল নিজের কাজ করেন, আর সারাদিন খুঁতখুঁতে মনে ঘটনাটা ভাবেন।

ভাগ্যিস কেউ একজন ইন্দুমতীর কথা ভাবছিলেন!

লক্ষ্মণ সেহগাল ভাবতেই পারেননি, তাঁর মনে নিরন্তর খোঁচা দেওয়া এই সন্দেহর জন্যই ধরা পড়বে সাংঘাতিক সুপরিকল্পিত এক অপরাধ, আর এইজন্যই তিনি পরবর্তীকালে ভূষিত হবেন বোম্বাই পুলিশের অন্যতম দক্ষ ইনস্পেক্টর আখ্যায়।

কিছুদিন নিজের মনের মধ্যে সন্দেহগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে লক্ষ্মণ একদিন পুনা পুলিশের কাছে জরুরি তার পাঠালেন।

”পুনার অমুক ঠিকানায় বসবাসকারী ডা অনন্ত লাগুর ব্যাপারে খোঁজখবর চাই। উনি বোম্বাইতে ১৩ নভেম্বর একজন মহিলাকে জি টি হসপিটালে ভরতি করে দিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে মহিলা মারা গিয়েছেন। ডা লাগুর বয়ান ও বিশদ বিবরণ সত্ত্বর চাই।”

জরুরি বার্তা পেয়ে পুনা পুলিশ চটপট দেখা করল ডা লাগুর সঙ্গে।

ডা অনন্ত লাগু তাঁর নিজের লিখে—আসা ঠিকানাতেই ছিলেন। তিনি পুলিশকে বললেন, ”দেখুন স্যার, আমি পুনাতেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করি। ১৩ নভেম্বর সকালে বোম্বাইতে আমার কিছু কাজ ছিল। তা আগের দিন, মানে ১২ তারিখ রাতের ট্রেনে আমি পুনা থেকে চেপেছিলাম।”

”রাতের ট্রেন কেন? দিনে তো হাজার একটা ট্রেনে আছে!” পুনা পুলিশ প্রশ্ন করল।

”বোম্বাইতে আমার কাজটা ছিল একদম সকালে।” ডা লাগু বললেন, ”রাতের ট্রেনে ভিড় কম হয়, সকালে পৌঁছে কাজ সেরে আবার ওইদিন বিকেলের ট্রেন ধরে ফিরে আসতে পারব—এটাই ভেবেছিলাম আর কী!”

”আচ্ছা। তারপর?”

”আমি যে কম্পার্টমেন্টে উঠেছিলাম, সেখানে কয়েকজন মহিলাও ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন মহিলা একটা বেঞ্চিতে গুটিসুটি মেরে শুয়েছিলেন। সারাটা সময় তাঁকে একবারও উঠে বসতে দেখিনি, কিছু খেতেও দেখিনি। সারাটা রাত কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন।

ভোরের দিকে ট্রেন বাইকুল্লা ছেড়ে দেওয়ার পর আমরা সবাই তৈরি হচ্ছিলাম, বোম্বাই আসছে, একটু পরেই নামতে হবে। কিন্তু ওই মহিলা দেখি তখন অকাতরে ঘুমোচ্ছেন। আমি তখন অন্যদের জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা কি কেউ ওঁকে চেনেন? সবাই বললেন যে কেউ চেনেন না, মহিলাটি একাই উঠেছিলেন ট্রেনে। ওঠার পর নাকি একজনকে বলেছিলেন ওঁর নাম ইন্দুমতী পঙ্খে।

এদিকে ভিক্টোরিয়া টারমিনাস স্টেশন এসে গেল, সবাই একে একে নেমে গেল। মহিলাটি তখনও ঘুমোচ্ছেন। দেখেই মনে হচ্ছিল খুব অসুস্থ।” ডা লাগু বললেন, ”স্যার, আমি একজন ডাক্তার। মানুষের সেবা করাই আমার কর্তব্য। আমি তো আর ওভাবে নেমে যেতে পারি না। তখন আমি রেলকর্মীদের গিয়ে ব্যাপারটা বলে স্ট্রেচার এনে ওঁকে গোকুলদাস তেজপাল হসপিটালে পৌঁছে দিলাম। তারপর কাজ সেরে সেদিন বিকেলের গাড়িতে পুনায় ফিরলাম। ওই মহিলা আমার চেনা নয়, কাজেই তাঁর সম্পর্কে আমার কোনো দায়িত্ব নেই। ধন্যবাদ।”

লক্ষ্মণ সেহগাল পুনা পুলিশের রিপোর্ট পেয়েই চমকে উঠলেন। ডা লাগু ইন্দুমতীকে হসপিটালে ভরতি করার সময় যা বলেছিল, আর এখন পুনা পুলিশকে যা বলেছে, দুইয়ের মধ্যে যে বিস্তর পার্থক্য!

লক্ষ্মণ সেহগাল আর কাউকে কিছু বললেন না। চুপচাপ তিনি তদন্ত চালিয়ে যেতে লাগলেন। প্রথমেই তিনি গিয়ে দেখা করলেন সেদিন রাতে নাইটডিউটিতে থাকা ডা উগেলের সঙ্গে। ডা উগেলও বললেন, ডা লাগু বলেছিলেন ইন্দুমতী ওঁর রুগি, বড়ো ডাক্তার দেখাতেই ডা লাগু ওঁকে বোম্বাই এনেছিলেন।

দুনিয়ার তাবড় তাবড় অপরাধ বিজ্ঞানী বলেছেন, যে যত বড়ো বুদ্ধিমান অপরাধীই হোক—না কেন, কিছু—না—কিছু ক্লু সে নিজের অজান্তে ঠিক রেখে দেয়। তদন্তকারীর কাজ হচ্ছে সেই ছাপ খুঁজে বের করা।

এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সত্যি। ১৯৫৬ সালের এই বিখ্যাত হত্যাকাণ্ডের বোম্বাই পর্বের কথা এতক্ষণ বললাম, এবার সমান্তরালে ঘটে যাওয়া অন্য অংশটি বলি। সেটার পটভূমি পুনা। সময় আরও বেশ কয়েক বছর আগেকার।

এই অংশটি যেমনই বিস্ময়ের, তেমনই বেদনার।

১৯২২ সাল।

মাত্র এগারো বছরের বালিকা ইন্দুমতীর বিয়ে হল পুনার ব্যবসায়ী অনন্ত কার্ভের সঙ্গে। অনন্ত কার্ভের এটা দ্বিতীয় বিবাহ; তার প্রথম পক্ষ এক সন্তান রেখে মারা গিয়েছিল। ইন্দুমতীর বাবা—মা তাকে দোজবরে বিয়ে দিলেও ইন্দুমতীর বিবাহজীবন সুখের হয়েছিল।

অনন্ত কার্ভে মানুষ ভালো ছিল, বাড়িতে প্রথম পক্ষের সন্তান বিষ্ণু ছাড়া অন্য কোনো আত্মীয়স্বজনের ঝামেলাও ছিল না।

অনন্ত কার্ভের জমিজায়গা ছিল। পুনার শুক্রাওয়ারে নিজের দোতলা বাড়ি ছাড়াও তার ব্যাবসা ছিল বেশ চালু। সে তার বালিকাবধূকে ভীষণ ভালোবাসত। ভালোবেসে বিয়ের পর নাম পালটে সে ইন্দুমতীর নাম রেখেছিল লক্ষ্মীবাঈ।

আমরা সেইমতো এখন থেকে ইন্দুমতীকে লক্ষ্মীবাই বলেই ডাকব।

অনন্ত কার্ভে ভালোমানুষ হলেও বিচক্ষণ ছিল। ভবিষ্যতের ঝামেলা এড়ানোর জন্য প্রথমেই সে নিজের প্রথম পক্ষের ছেলে বিষ্ণুকে ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে একদম আলাদা ব্যাবসা করে দিয়েছিল। লক্ষ্মীবাঈয়ের নিজের দুটো পুত্রসন্তান হয়েছিল, রামচন্দ্র আর পুরুষোত্তম।

নিজের চালু ব্যাবসা আর শুক্রাওয়ারের দোতলা বাড়িটা অনন্ত কার্ভে উইল করে দিল বড়ো ছেলে রামচন্দ্রকে। কিন্তু উইলে শর্ত রইল, আমৃত্যুলক্ষ্মীবাইয়ের ওই বাড়িতে তিনটে ঘর থাকবে। এ ছাড়াও ব্যাবসার আয় থেকে সে মাসিক পঞ্চাশ টাকা মাসোহারা পাবে।

অনন্ত কার্ভে ব্যাবসার পাশাপাশি সুদের কারবারও করত। ব্যাঙ্ক, পোস্টঅফিসের সব গচ্ছিত অর্থ এবং সুদের কারবারের আয় সে দিল ছোটোছেলে পুরুষোত্তমকে। এ ছাড়া ইতিমধ্যে বিষ্ণুর একটি ছেলে হয়েছিল। প্রথম পক্ষের নাতিকে অনন্ত ছিল দিল কিছু জমি।

স্ত্রী লক্ষ্মীবাঈকে সে জীবদ্দশায় ঢেলে সোনার গয়না গড়িয়ে দিয়েছিল। লক্ষ্মীবাঈয়ের প্রায় ষাট ভরি সোনার গয়না, মুক্তো, এমনকী হীরেও ছিল।

কাজেই, তেইশ বছর সুখী বিবাহিত জীবনযাপনের পর ১৯৪৫ সালে অনন্ত কার্ভে প্লুরিসি রোগে আক্রান্ত হয়ে যখন মারা গেল, তখন লক্ষ্মীবাঈ জলে তো পড়লই না, উলটে স্বামীর করে যাওয়া জীবনবিমা বাবদও অনেকটা টাকা সে পেল। তখন তার বয়স মাত্র চৌত্রিশ বছর।

অনন্ত কার্ভের মারা যাওয়ার আগে অসুস্থ অবস্থায় তাঁর চিকিৎসা করত পাড়ার ডাক্তার অনন্ত চিন্তামন লাগু। অনন্ত লাগুরা দুই ভাই। তার ভাই বি সি লাগুও ছিল ডাক্তার। দুই ভাই একইসঙ্গে শুক্রাওয়ারে ডিসপেনসারি খুলে তাতে প্র্যাকটিস করত।

অনন্ত কার্ভে মারা যাওয়ার পর ডা লাগু আসা তো বন্ধ করলই না, উলটে দেখা গেল, নানা ছলছুতোয় নিজের ডিসপেনসারির চেয়ে বেশি সময় সে কাটাচ্ছে লক্ষ্মীবাঈয়ের বাড়িতে। কখনো লক্ষ্মীবাঈয়ের চিকিৎসার অজুহাতে, কখনো কোনো কারণ ছাড়াই।

চৌত্রিশ বছরের বিধবা লক্ষ্মীবাঈও ভাবল, নিজের বলতে তো কেউ—ই নেই। প্রথম পক্ষের সৎছেলে বিষ্ণু তেমন খোঁজও নেয় না। কোনো বিপদ—আপদ হলে কে দেখবে? তখন তো এই হিতৈষী ডাক্তারবাবুই ভরসা! তার নিজের দুই ছেলেই তো এখনও বালক!

কিন্তু লক্ষ্মীবাঈ ভাবতেও পারেনি, একদিন ওই বালক বড়োছেলে রামচন্দ্রের সঙ্গেই ডা লাগুর ধুন্ধুমার লেগে যাবে!

একদিন রামচন্দ্র স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। মা লক্ষ্মীবাঈ অন্যান্য দিন ছেলের আশপাশে থাকে, এটা—সেটা স্কুলের ব্যাগে গুছিয়ে দেয়, জোর করে আরও দু—গাল বেশি খাওয়ায়। কিন্তু সেদিন খেতে বসে রামচন্দ্র মাকে দেখতে পেল না।

বাড়ির বয়স্ক দাসীকে ও জিজ্ঞাসা করল, ”কী হল, আমার মা কোথায়?”

দাসী বলল, ”মাইজির খুব শরীর খারাপ। উঠতে পারছে না সকাল থেকে। শুয়েই আছে।”

রামচন্দ্র আর পুরুষোত্তম তাদের মাকে খুব ভালোবাসত। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তারা মাকে যেন আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিল।

রামচন্দ্র খাওয়া ছেড়ে উঠে তরতরিয়ে চলে গেল দোতলায় মার ঘরে। বিশাল বাড়ি। সামনে চওড়া দালান, এদিকে ভৃত্যদের বাদ দিলে প্রাণী মাত্র তিনটি।

রামচন্দ্র মার ঘরে ঢুকে বলল, ”কী হয়েছে মা? তোমার কী শরীর খারাপ?”

লক্ষ্মীবাঈ কপালে হাত দিয়ে বিছানায় শুয়েছিল। দুর্বলভাবে বলল, ”হ্যাঁ রে, ভীষণ মাথা ঘুরছে। বুকের ভেতরটাও খুব যন্ত্রণা করছে।”

”তুমি আমাকে এতক্ষণ বলোনি কেন?” পায়ে পায়ে মার বিছানার কাছে এগিয়ে রামচন্দ্র বলল, ”কাল কীসব উপোস করেছিলে সারাদিন, মনে আছে? অনিয়ম করেছ, ওইজন্যই বোধ হয় ভেতরে চাপা অম্বল হয়ে গেছে। সেইজন্য বুকে লাগছে। দাঁড়াও আমি অম্বলের ওষুধটা নিয়ে আসি।”

রামচন্দ্র দ্রুত গতিতে প্রস্থানের উদ্যোগ করতেই পেছন থেকে লক্ষ্মীবাঈ ফস করে ছেলের হাত চেপে ধরল, ”নারে। কাল তো কিছু খাই—ই নি, অম্বল হবে কেন?” তারপর সামান্য থেমে বলল, ”তুই অত চিন্তা করিস না, স্কুলে যা। আর যাওয়ার সময় ডাক্তারকে একবার খবর দিয়ে যা।”

মুহূর্তের মধ্যে মুখ—চোখ বদলে গেল রামচন্দ্রর, রুক্ষভাবে মার থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল সে।

ডা অনন্ত লাগুকে রামচন্দ্র দু—চক্ষে দেখতে পারে না।

যতদিন তার বাবা বেঁচে ছিল, ততদিন ডাক্তার ভিজে বিড়ালের মতো থাকত। বাবাকে সমীহ করে চলত, চিকিৎসা করেই বেরিয়ে যেত।

কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে দিন দিন ওই ডাক্তার যেন ওদের এই বাড়িটাকে নিজের ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলছে। যখন—তখন আসে, এসে ড্রয়িং রুমে বসে পড়ে। এমনকী, মাঝেমধ্যে সটান মার ঘরেও ঢুকে যায়।

বালক রামচন্দ্র মনে মনে ফুঁসতে থাকে। আরেকটা ব্যাপারও খেয়াল করেছে ও, বাবা জীবিত থাকার সময় ডাক্তার মাকে আপনি আজ্ঞে করে কথা বলত, কিন্তু ইদানীং ‘তুমি তুমি’ করে কথা বলে আর মাও তাতে কোনো প্রতিবাদ করে না।

”কী হল?” লক্ষ্মীবাঈ ছেলেকে ধরে ঝাঁকাল, ”হাঁ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবছিস?”

”কিছু না।” ঝাঁঝিয়ে উঠল রামচন্দ্র, ”আমি কাউকে ডাকতে পারব না। আমি ওদিক দিয়ে স্কুল যাব না।” কথাটা বলেই মার উত্তরের অপেক্ষা না করে দুমদুম করে ঘর ছেড়ে চলে গেল রামচন্দ্র।

লক্ষ্মীবাঈ অবাক হয়ে গেল। প্রায় তিন—চারদিন ডা লাগু আসেনি, শরীরটা খুব একটা কিছু না বিগড়োলেও এই সুযোগে লক্ষ্মীবাঈ ভেবেছিল, ডাক্তার এলে একটু গল্পগুজব করবে। আর যাহোক, অনন্ত কার্ভে গত হওয়ার পর থেকে তো ওই ডাক্তারবাবুই বট গাছের মতো আগলে রেখেছেন এত বড়ো বাড়িটাকে।

গচ্ছিত টাকা কোন ব্যাঙ্কে রাখলে বেশি সুদ পাওয়া যাবে, কোথায় বিমা করালে লাভবান হওয়া যাবে, সব ব্যাপারে নিঃস্বার্থভাবে ডাক্তার পরামর্শ দেয়। এমনকী ব্যাঙ্কের চিঠিপত্রও করে দেয়।

ডাক্তার না থাকলে যে লক্ষ্মীবাঈয়ের কী হত! প্রথম পক্ষের ছেলে বিষ্ণু কোনোদিনই সুবিধের নয়, ছোটোভাইগুলোর মাথায় হাত বুলিয়ে নির্ঘাত সব লুটেপুটে নিত।

কিন্তু ডা লাগুর এই অপরিসীম সাহায্য লক্ষ্মীবাঈ যতই বুঝুক না কেন, রামচন্দ্র কিছুতেই বোঝে না। ছোটোছেলে পুরুষোত্তমের এখনও বোঝার বয়স হয়নি, মোটে বারো বছর বয়স তার। কাজেই সে কিছু বলে না। কিন্তু ষোলো বছরের রামচন্দ্র দিনদিন যেন দুর্বিনীত হয়ে উঠছে।

লক্ষ্মীবাঈ কী আর করে, বাড়ির দাসী শান্তাবাঈকে দিয়ে খবর পাঠাল ডাক্তারকে ডেকে আনার জন্য। শান্তাবাঈ বহু পুরোনো দাসী, সে মূক ও বধির। কিন্তু কাজ করে চটপট।

গোলমালটা বাধল দুপুর বেলা।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিনা জানা যায় না, সেদিন রামচন্দ্র অনেক তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরল। দুপুর বেলা নিঝুম একতলা দিয়ে পা টিপেটিপে উঠে সে সোজা চলে গেল মার ঘরে।

সকাল থেকেই তার মেজাজ বিরক্ত হয়ে ছিল, তার ওপর এখন মার ঘরের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে যেন দপ করে জ্বলে উঠল তার অন্তরাত্মা।

ঘরের বিশাল পালঙ্কে শুয়ে আছে লক্ষ্মীবাঈ। তার পোশাক—আশাক বিস্রস্ত। ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনো সেমিজ নেই, শুধু শাড়ির একাংশ আলগোছে চাপা দেওয়া। কোমরের দড়িও আলগা।

ডাক্তার আজ আর চেয়ারে নয়, বসে আছে খাটেই, লক্ষ্মীবাঈয়ের ঠিক পাশে। তার কানে স্টেথোস্কোপ থাকলেও হাতে কিছু নেই, লক্ষ্মীবাঈয়ের পেট টিপে সে কী যেন দেখছে।

রামচন্দ্রের ধৈর্যের সব বাঁধ আজ ভেঙে গেল। সে এতদিন ঠারেঠোরে তার অপছন্দের কথা মাকে ব্যক্ত করলেও তলে তলে ডাক্তার যে এতদূর বেড়েছে, তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।

চিৎকার করে সে বলল, ”কী সব নোংরামি হচ্ছে এখানে?”

ডা লাগু চমকে দরজার দিকে তাকাল। লক্ষ্মীবাঈ ছেলেকে কিছু বলতে যেতেই রামচন্দ্র মাকে থামিয়ে দিল, ”আপনার কোনো চরিত্র নেই? বদলোক একখানা!”

”এসব কী বলছিস তুই রাম! আমার শরীর খারাপ তাই ডাক্তারবাবু …!” লক্ষ্মীবাঈ ভয়ার্ত গলায় বলতে গেল।

”থামো তুমি।” মাকে চেঁচিয়ে চুপ করাল রামচন্দ্র, তারপর ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, ”আপনার মতো দুশ্চরিত্র লম্পট আমি একটাও দেখিনি। সারা পাড়া আপনার স্বভাব জানে। আগে তো রাত দিন খারাপ পাড়ায় গিয়ে পড়ে থাকতেন। সেখানেই আপনার সব রোগিণী থাকত। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে হঠাৎ বড্ড সাহস বেড়েছে, না! আমাকে চেনেন না, আমার নাম রামচন্দ্র কার্ভে, এমন শায়েস্তা করব …!” আরও কিছুক্ষণ চোখা চোখা বাক্য বর্ষণ করে মার দিকে একবার অগ্নিদৃষ্টি হেনে রামচন্দ্র বেরিয়ে গেল।

সেদিন রাতে মাকে স্পষ্টাস্পষ্টি বলল রামচন্দ্র, ”অনেক হয়েছে। আমি তোমাকে একটা কথা পরিষ্কার বলে দিচ্ছি মা, ওই বাজে লোকটা যদি একদিনও বাড়িতে আসে, আমি কিন্তু সেইদিনই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। শহরে হাজার একটা ভালো ভালো ডাক্তার আছে। তোমার চিকিৎসার কোনো ত্রুটি হবে না।”

রামচন্দ্র এমনিতে ছেলে ভালো হলেও রেগে গেলে কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। লক্ষ্মীবাঈ তা জানে বলেই কোনো তর্কে গেল না।

দিনকতক ডাক্তারের নাম আর উচ্চবাচ্যও করলো না।

লক্ষ্মীবাঈকে সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না। একজন চৌত্রিশ বছরের সুন্দরী বিধবা নারী, তার আরেক বার কাউকে বিশ্বাস করা, ভালোবাসাটা কি অপরাধ?

লক্ষ্মীবাঈ কি ডা লাগুকে ভালোবেসেছিল? নাকি তার কাছে ডাক্তার ছিল শুধুই একজন অভিভাবকের ভূমিকায়?

যাইহোক, তারপর লক্ষ্মীবাঈ সত্যিই ডাক্তারকে আসতে বারণ করে দিয়েছিল, ডা লাগু বেশ কয়েক সপ্তাহ এল না।

লক্ষ্মীবাঈ যদিও রামচন্দ্রের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকিকে বিশ্বাস করেনি, অতটা সাহস ওইটুকু ছেলের না হওয়াটাই স্বাভাবিক; তবু সে অশান্তির ভয়ে ডাক্তারের নাম তুলল না বাড়িতে।

এইভাবে কাটল প্রায় দুমাস।

তারপর একদিন সন্ধ্যে বেলা ডা অনন্ত লাগু আবার এল।

সেদিন অনেক কথা জমেছিল, কথা আর ফুরোয় না। ওদিকে রামচন্দ্র তখন বেরিয়েছে কোনো কাজে। লক্ষ্মীবাঈয়ের মনে ভয়ও রয়েছে। সে ক্রমাগত ডাক্তারকে তাগাদা দিলেও ডাক্তার গড়িমসি করতে করতে রাত প্রায় ন—টা বাজিয়ে ফেলল।

ন—টার সময় বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে ডাক্তার, মুখোমুখি তার সঙ্গে দেখা হয় রামচন্দ্রের।

ডাক্তার সৌজন্যবশত সামান্য হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু রামচন্দ্র কোনো সাড়া দিল না। তার মুখ ভীষণ গম্ভীর, পাশ কাটিয়ে চলে গেল সে নিজের ঘরে।

রামচন্দ্র ওই বয়সেই ছিল যেমন জেদি, তেমনই একরোখা।

পরেরদিনই সে বাড়িতে নিজের আলাদা ব্যবস্থা করল। আলাদা মহলে সে থাকে, আলাদা খায়। মার রান্নাঘর, মহলের দিকে সে ভুলেও যায় না। কখনো নিজে রাঁধে, কখনো হোটেল থেকে খাবার আনায়।

লক্ষ্মীবাঈয়ের ভেতরটা ফেটে গেলেও সে রামচন্দ্রকে বেশি ঘাঁটাল না।

এইভাবে কেটে গেল বেশ কয়েক বছর।

১৯৫২ সালে রামচন্দ্র মিলিটারিতে চাকরি পেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। এক বাড়িতে থাকার সুবাদে যেটুকু ছেলেকে চোখের দেখা দেখতে পেত লক্ষ্মীবাঈ সেটুকুও ঘুচে গেল। কনিষ্ঠ পুত্র পুরুষোত্তমকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে লাগল লক্ষ্মীবাঈ। যত দিন যেতে লাগল, সে ডাক্তারের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়তে লাগল।

কিছুদিন বাদে রামচন্দ্র ফিরে এসে নিজে দেখেশুনে বিয়ে করল, করে স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেল বোম্বাইতে। মার সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেক দিনই আলগা হয়ে গেছে; আর ওই বাড়িতে থাকার কোনো মানে হয় না। সে বোম্বাইতে গিয়ে নতুন সংসার পাতল।

মা আর ওই নচ্ছার ডা লাগু যা পারে করুক!

ইতিমধ্যে ঘটে গেল এক মর্মান্তিক ঘটনা।

১৯৫৪ সালে লক্ষ্মীবাঈয়ের কনিষ্ঠ পুত্র পুরুষোত্তম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। কী যে হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারা যাচ্ছিল না। ডা অনন্ত লাগুর পরামর্শমতো লক্ষ্মীবাঈ পুরুষোত্তমকে কোনো হসপিটালেও পাঠাল না। ডা লাগুই বাড়িতে চিকিৎসা করতে লাগল।

অবশেষে ওই ১৯৫৪ সালেরই ১৮ জানুয়ারি পুরুষোত্তম মারা গেল।

পরবর্তীকালে এই বিখ্যাত মামলার দীর্ঘদিন ধরে চলা শুনানিতে যখন একে পর এক ডেকে পাঠানো হত লক্ষ্মীবাঈয়ের পাড়ার প্রতিবেশীদের, তাঁদের বেশিরভাগই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, ডা লাগু নিজেই ধীরে ধীরে স্লো পয়জন করে মেরেছিল পুরুষোত্তমকে।

কিন্তু ডা লাগু কেন এই কাজ করবে? লক্ষ্মীবাঈয়ের ছোটোছেলেকে মেরে তার লাভ কী?

আসছি সেই প্রসঙ্গে।

আগেই বলেছি, ভারতের আইনি ইতিহাসে এই মামলা বিখ্যাত হয়ে আছে—সুপরিকল্পিতভাবে নিজের ডাক্তারি বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে ধাপে ধাপে খুনের জন্য।

অনন্ত কার্ভে মারা গিয়েছিল ১৯৪৫ সালে। তার পরের নয়—বছর ধরে ডা অনন্ত লাগু শুধু একের পর এক ঘুঁটি সাজিয়েছে, পোক্ত করেছে নিজের জায়গা, আর ধীরে ধীরে ভেতর থেকে ফোঁপরা করে দিয়েছে কার্ভে পরিবারকে।

রামচন্দ্র আর প্রথম পক্ষের ছেলে বিষ্ণু অনেক দিন আগেই নিজেদের সম্পত্তি বুঝে নিয়েছিল। পুরুষোত্তম আকস্মিক মারা যাওয়ায় তার ভাগের বিপুল সম্পত্তিও নিয়মমাফিক লক্ষ্মীবাঈয়ের ভাগেই পড়ল।

এইবার সম্পূর্ণ পৃথিবীতে লক্ষ্মীবাঈ একা হয়ে পড়ল। তার পিতৃকুলেও কেউ তেমন বেঁচে ছিল না, ছিল না অন্যান্য আত্মীয়ও।

ডা লাগুর দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি শেষ, সম্পূর্ণ ফাঁকা ময়দানে এইবার সে নামল গোল দিতে।

লক্ষ্মীবাঈয়ের সম্পত্তির সমস্ত দেখাশোনা, ব্যাঙ্কের কাজ করতে লাগল ডা লাগু। সামান্য শিক্ষিত লক্ষ্মীবাঈ কোনোদিনই টাকাপয়সার ব্যাপার বুঝত না। এখন পরম বিশ্বাসে পুরোটা সে ছেড়ে দিল ডাক্তারের হাতে।

লক্ষ্মীবাঈয়ের কাছ থেকে চেক সই করিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা আনা, সেই টাকা বিভিন্ন খাতে পাঠানো, তেজারতি কারবারের খদ্দেরদের থেকে সুদ আদায়, সমস্ত ঝক্কি ডা লাগু সামলাতে লাগল একা হাতে। আগে বিষয়সম্পত্তি দেখভালের জন্য অনন্ত কার্ভের আমল থেকেই একজন ম্যানেজার ছিল।

”শুধু শুধু লোক পুষে খরচ বাড়াবে কেন! আমি তো আছিই!” এই বলে ডাক্তার তাকে ছাড়িয়ে দিল।

মাঝে রামচন্দ্রের ছেলে হতে অনেক মান অভিমানের দ্বিধা কাটিয়ে সে নাতিকে দেখাতে এল লক্ষ্মীবাঈকে। কিন্তু ডাক্তার লাগু তাকে বাড়িতে ঢুকতেই দিল না। ডাক্তার তো আর সেদিনের বিড়াল নেই, এখন সে রীতিমতো বাঘ হয়ে উঠেছে।

যাচ্ছেতাই অপমান করে রামচন্দ্রকে বাড়ির গেট থেকেই সে ফিরিয়ে দিল। আত্মাভিমানী রামচন্দ্রও চলে গেল চিরদিনের মতো। লক্ষ্মীবাঈ ছেলের আগমন জানতেও পারল না।

একদিন ডাক্তার লক্ষ্মীবাঈকে ইনসুলিনের ইনজেকশন দিচ্ছিল। রোজই দেয়। ওহো, বলতে ভুলে গেছি, পুরুষোত্তম মারা যাওয়ার পর থেকেই ডাক্তার লক্ষ্মীবাঈকে নিয়মিত ইনসুলিন ইনজেকশন দিত।

কেন?

লক্ষ্মীবাঈয়ের কি রক্তে চিনি বেড়ে গিয়েছিল? তার কি সুগার, মানে ডায়াবেটিস ধরা পড়েছিল?

তার উত্তর কেউ জানে না। কারণ লক্ষ্মীবাঈয়ের কোনোদিন রক্ত বা ইউরিন পরীক্ষা হয়নি।

সুস্থ মানুষ, যার একটুও ডায়াবেটিস নেই, তাকে দিনের পর দিন কড়া ডোজের ইনসুলিন দিলে কী হয়, তা কি ডা লাগু জানত না?

যাইহোক, ইনজেকশন দেওয়ার পর ডাক্তার দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলল, ”তোমায় নিয়ে বড়ো ভয়!”

”কেন?” লক্ষ্মীবাঈ বলল, ”আপনি তো কাল তাড়াহুড়োয় ইনজেকশন দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু কাল সারাদিন বেশ সতেজ ছিলাম, জানেন! অন্যদিন কেমন যেন ঘুম ঘুম পায়, তেমনটা কিন্তু কাল হয়নি!”

”হবে কী করে?” ডাক্তার গম্ভীর গলায় বলল, ”শান্তাবাঈ কি তোমার আদৌ কোনো খেয়াল রাখে নাকি! ও নিজেই তো বোবা—কালা। তোমার এখন শরীরের যা অবস্থা, সবসময় কোনো ডাক্তারকে রাখা উচিত তোমার পাশে।”

”তা ডাক্তার আবার কোথায় পাব?” লক্ষ্মীবাঈ খানিক ভেবে বলল, ”আপনিই থাকুন তার চেয়ে! আমার নীচের পুরো একতলাটা তো ফাঁকাই পড়ে রয়েছে!”

”তা তো হয় না। এমনি এমনি কেন থাকব আমি?” ডাক্তার গম্ভীর গলায় বলল, ”যদি ন্যায্য ভাড়া নাও, ভেবে দেখতে পারি।”

”আচ্ছা আচ্ছা সে না হয় হবে’খন!” লক্ষ্মীবাঈ মুখ টিপে হেসেছিল, ”তেমন হলে আপনি দেবেন না—হয় আমাকে ভাড়া, শান্তি?”

হায় রে অদৃষ্ট! বেচারি লক্ষ্মীবাঈ জানতেও পারল না, কীভাবে সে দুধ কলা দিয়ে কালসাপকে এবার বাড়িতে সাদর অভ্যর্থনা করে ডেকে নিয়ে এল।

ডাক্তার এবার মনে মনে ভাবল। সব কিছু ঠিকঠাক কমপ্লিট। এবার সময় হয়েছে আসল কার্যসিদ্ধির।

ডাক্তার লক্ষ্মীবাঈয়ের বাড়িতে শিফট করার পর দু’মাস কাটল। ইতিমধ্যে দৈনন্দিন ইনসুলিন বিষের মতো লক্ষ্মীবাঈয়ের অজান্তেই প্রবেশ করে চলেছে তার শরীরে।

মাসদুয়েক পর ডাক্তার একদিন বলল, ”না! আমার দ্বারা আর হচ্ছে না লক্ষ্মী! তোমার শরীর দিন দিন খারাপ হয়ে চলেছে। ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে আমি ওপরওয়ালাকে কী জবাবদিহি করব বলতে পারো?”

সত্যিই লক্ষ্মীবাঈ খুব দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ছিল। অনাবশ্যক ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার জন্য মারণক্ষয় ধরেছিল তার মধ্যে।

সে ক্লান্ত গলায় বলল, ”তাহলে আপনি কী বলেন ডাক্তারবাবু?”

ডা লাগু বলল, ”শোনো। আমি বোম্বাইয়ের মস্ত ডাক্তার ডা সাঠের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। উনি তোমাকে ১৩ নভেম্বর দুপুর তিনটের সময় ওঁর চেম্বারে দেখবেন।”

”বোম্বাই? এখন আবার বোম্বাই যেতে হবে?” লক্ষ্মীবাঈ চমকে উঠে বলল।

”হ্যাঁ তো কী আছে?” ডাক্তার বলল, ”আগের দিন রাতের ট্রেনে উঠব, দিব্যি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যাবে, পরেরদিন ভোরে গিয়ে কোনো হোটেলে ফ্রেশ হয়ে নেবে, তারপর দুপুরে ডাক্তার দেখিয়ে আবার বিকেলের ট্রেনে আমরা ফিরে আসব।”

লক্ষ্মীবাঈ ভগ্নদেহে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিল।

ঘুণাক্ষরেও কি সে ভাবতে পেরেছিল, এই তার শেষ যাওয়া?

পরবর্তীকালে লক্ষ্মীবাঈয়ের সেই মূক ও বধির দাসী শান্তাবাঈয়ের বয়ান কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়েছিল আদালতে। শান্তাবাঈ আকারে ইঙ্গিতে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছিল, ”হুজুর! বোম্বাই যাওয়ার দিন সকাল আর সন্ধ্যে বেলায় ডাক্তারবাবু মাইজিকে দুটো ইনজেকশন দিয়েছিলেন। সেই ইনজেকশন নেওয়ার পরেই দিদিমণি কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান হয়ে যান। পরে আবার কোনোমতে জ্ঞান ফেরে।”

যাইহোক, এরপর কী হল, আগেই বলেছি। ডা লাগু লক্ষ্মীবাঈকে নিয়ে বোম্বাই গেল, কিন্তু লক্ষ্মীবাঈ আর ফিরল না।

ডা লাগু যতক্ষণে পুনা ফিরলেন, ততক্ষণে লক্ষ্মীবাঈয়ের জায়গা হয়েছে লাশকাটা ঘরে।

ডাক্তার ফিরে এসেই পাড়ায় চাউর করে দিল, ”আরে অদ্ভুত ব্যাপার! লক্ষ্মীবাঈকে আমি ডা সাঠের কাছে দেখালাম জানো, দেখিয়ে—টেখিয়ে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলাম আমার একটা স্টেথোস্কোপ কিনতে, এটা আর চলছে না। ওমা, ফিরে এসে দেখি লক্ষ্মীবাঈ ঘরে নেই। হোটেলের ঘর ফাঁকা! এদিকে ট্রেনেরও সময় হয়ে আসছে।”

”সে আবার কী!” পাড়ার বরিষ্ঠ এক প্রতিবেশী অবাক, ”তারপর আপনি কী করলেন ডা লাগু? থানায় গেলেন?”

”আরে থানাতেই তো যাচ্ছিলাম চাচা, হঠাৎ ঘরের দিকে চোখ পড়ল, দেখি লক্ষ্মীবাঈয়ের জিনিসপত্র কিছুই নেই। সব ফাঁকা।” ডা লাগু চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ”তারপর হোটেলের রিসেপশনে জিজ্ঞেস করতেই বলল, ওই রুমের মেমসাব তো এক ভদ্রলোকের সঙ্গে ট্যাক্সি চেপে বেরিয়ে গেলেন!”

”ভদ্রলোক?” প্রতিবেশীরা অবাক, ”লক্ষ্মীবাঈকে আবার কে নিয়ে যাবে?”

পাশ থেকে অন্য এক প্রতিবেশী ফুট কাটল, ”রামচন্দ্র কি? নাকি লক্ষ্মীবাঈয়ের কোনো ভাই—টাই!”

”হ্যাঁ এটা বেড়ে বলেছ। রামচন্দ্র তো বোম্বাইতেই থাকে শুনেছিলাম!”

প্রতিবেশীরা নিজেদের মধ্যে গুনগুন করতে করতে ফিরে গেল। আহা, কাঁচা বয়সের বিধবা, একটা ছেলে মরে গেল, অন্য ছেলেটা এতদিন অভিমানে অভিমানে … এখন যদি ক—টা দিন ছেলের কাছে একটু থেকে আসে, তা তো ভালোই!

কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার! লক্ষ্মীবাঈ আর ফিরল না।

সাতদিন গেল। পনেরো দিন গেল। দু—মাস কেটে গেল। কিন্তু লক্ষ্মীবাঈ ফিরে এল না।

এইবার শুরু হল এই কাহিনির আরেক চমকপ্রদ নাটক।

লক্ষ্মীবাঈ ফিরল না বটে; কিন্তু পাড়ার লোকজন মাঝেমধ্যেই তার চিঠি পেতে লাগল।

প্রথম চিঠি পেল লক্ষ্মীবাঈয়ের বান্ধবী যশোদা বেন, ‘আমি তীর্থে এসেছি। বেশ লাগছে।”

সপ্তাহখানেক পরেই আরেক জন চিঠি পেল, ”এই বেশ ভালো আছি গো। সংসারের কচকচানি নেই, কিছু নেই, কী যে শান্তি …!”

এভাবেই খুচরো খুচরো কিছু চিঠি আসার প্রায় দেড়—দু—মাস পর যে চিঠিটা আরেক বান্ধবী পেল, সেটা পড়ে সবাই হতভম্ব হয়ে গেল।

লক্ষ্মীবাঈ লিখছে, ”গীতা, আমি আর পুনরায় ফিরব না রে। পবন জোশি বলে একজনকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। তাকে বিয়েও করেছি। দু—জনে সংসার পেতেছি রাঠোরিতে, রাঠোরি জয়পুরের কাছে। বিশ্বাস কর গীতা, আমি খুব সুখে আছি। এত সুখ অনেকদিন আমার কপালে আসেনি। আমি আর পুরোনো জীবনে ফিরতে চাই না। তোরা কেউ আমার খোঁজ করিস না। ভালো থাকিস। এই আমার শেষ চিঠি।”

অপরাধবিজ্ঞান বলে, অপরাধী সামান্য হলেও তার নিজের কৃতকার্য দিয়ে লোকের মনে সন্দেহর বীজ বুনে দেয়।

অতি উৎসাহে ডা লাগুও সেটাই করে ফেলেছিল। যে প্রতিবেশীরা লক্ষ্মীবাঈয়ের তীর্থভ্রমণ শুনেও চুপচাপ ছিল, তাদের মন এবার খচখচ করতে লাগল।

হাজার হোক, লক্ষ্মীবাঈ রক্ষণশীল পরিবারের বিধবা, একা সে একজনকে বিয়ে করে ফেলবে? তাও আবার নিজের বাড়িঘর কিছুরই কোনো হিসাব নেবে না?

গোটা ব্যাপারটা যেন ভীষণ রহস্যময়!

ইতিমধ্যে একদিন পাড়ার লোকে দেখল, ডা লাগু বাড়ির সব জিনিসপত্র বোঝাই করে একটা লরি করে কোথায় যাচ্ছে।

”কোথায় চললেন এতকিছু নিয়ে ডা লাগু?” কিষাণ প্যাটেল নামে এক প্রতিবেশী প্রশ্ন করলেন।

”আর বলবেন না, কিষাণজি, যার বিয়ে তার হুঁশ নেই, আর পাড়াপড়শীর ঘুম নেই। ওদিকে লক্ষ্মীবাঈ দিব্যি মনের আনন্দে সংসার করছে, আর আমার ওপর দায় পড়েছে এইসব জিনিসপত্র ওই রাঠোরি গ্রামে পৌঁছে দিতে হবে! কী জ্বালা বলুন দেখি!” ডা লাগু বিরক্তির সুরে বলে।

”তা এখানকার মালপত্র ওখানে পাঠাচ্ছেন, সে নিজে আসছে না কেন?” আরেক জন প্রতিবেশী প্রশ্ন করল।

”লক্ষ্মীবাঈ নাকি পুনার স্মৃতি ভুলতে চায়। তাই আসবে না। এদিকে কাজ বেড়েছে আমার!” ডা লাগু গজগজ করতে করতে প্রস্থান করে।

অদ্ভুতভাবে এর দু—দিন পরেই কিষাণজি চিঠি পেলেন, ”নমস্তে কিষাণজি। আমি ডা লাগুকে আমার জিনিসপত্র সব পাঠানোর দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তিনি এর মধ্যেই পাঠিয়ে দিয়েছেন কিনা কিছু জানেন আপনি? আমি এখনও পাইনি। আর আপনারা প্লিজ কেউ আমার খোঁজ করবেন না। আমি ভালো আছি … সুখে আছি …।”

পাড়ায় এবার সন্দেহ ক্রমশ গুঞ্জনে পরিণত হল। ডা লাগু ইতিমধ্যে লক্ষ্মীবাঈয়ের প্রাসাদোপম বাড়িতে জাঁকিয়ে বসেছে। নিত্যনতুন বিলাসের আসবাবসামগ্রী ঢুকছে তার ঘরে।

পুরোনো বুড়ি দাসী আর শান্তাবাঈয়ের কবেই চাকরি চলে গেছে।

এইভাবে প্রায় দেড়বছর কেটে গেল।

শুক্রাওয়ারে লক্ষ্মীবাঈয়ের পাড়াতেই একজন বিচক্ষণ অধ্যাপক থাকতেন, তাঁর নাম জি ডি ভাবে। সবার পরামর্শে তিনি বোম্বাইয়ের মুখ্যমন্ত্রী (১৯৬০ সালে মহারাষ্ট্র রাজ্য গঠিত হওয়ার আগে পর্যন্ত রাজ্যটার নাম বোম্বাই—ই ছিল)—কে একটা বিস্তারিত চিঠি লিখলেন।

ভদ্র পরিবারের এক বধূ এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবেন, কেউই যেন মেনে নিতে পারছিল না।

কিন্তু সেই চিঠির কোনো জবাব এল না। অতঃপর পাড়ার আরেক জন শুভানুধ্যায়ী ডাক্তার জি এন দাতার ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবার চিঠি লিখলেন।

জি এন দাতার ছিলেন বেশ নামকরা চিকিৎসক। অধ্যাপক ও চিকিৎসক দু—জনেরই চিঠি পেয়ে এবার নড়েচড়ে বসল বোম্বাই সরকার।

তখন বোম্বাইয়ের মুখ্যমন্ত্রী যশবন্তরাও চ্যবন। তিনি পুনার সি আই ডির ডেপুটি সুপারিনটেন্ডেন্ট মি ধোন্দের ওপর দিলেন অনুসন্ধানের ভার।

মি ধোন্দে বোম্বাইয়ের এসপ্ল্যানেড থানার সেই ইনস্পেক্টর লক্ষণ সেহগালেরই মতো কাজের লোক। দুদিনে তিনি বের করে ফেললেন, প্রতিবেশীরা যাকে সন্দেহ করছে, সেই ডা অনন্ত লাগুর কাছেই বোম্বাইয়ে মৃত এক মহিলার খোঁজ করেছিল বোম্বাই পুলিশ। আর সেই রিপোর্ট দিয়েছিল পুনা পুলিশই।

কিন্তু খটকা একটাই। ডা লাগু, নিরুদ্দেশের তারিখ ও ওই মহিলার মৃত্যু সবই মিলে যাচ্ছে। মিলছে না শুধু নাম। বোম্বাইয়ের গোকুলদাস তেজপাল হসপিটালে মৃত মহিলার নাম ইন্দুমতী পঙ্খে, আর এই পুনার নিরুদ্দিষ্ট মহিলার নাম হল লক্ষ্মীবাঈ কার্ভে।

মি ধোন্দে কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছিলেন না। ইন্দুমতী যেদিন যে ট্রেনে ডা লাগুর সঙ্গে বোম্বাই গিয়েছিল, লক্ষ্মীবাই কার্ভেও তো সেদিন সেই ট্রেনে ডা লাগুর সঙ্গে গিয়েছিল।

ইন্দুমতী পঙ্খে যে লক্ষ্মীবাঈয়েরই বিবাহপূর্ববর্তী নাম—সেটা মি ধোন্দে তখনও বুঝে উঠতে পারেননি।

যাই হোক, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর আদেশ, তিনি মাঠে নেমে পড়লেন।

প্রথমেই তিনি দেখা করলেন ডা লাগুর সঙ্গে।

ডা লাগুর ততদিনে বৃহস্পতি তুঙ্গে। ইতিমধ্যেই সে সই জাল করে লক্ষ্মীবাঈয়ের অনেক সম্পত্তি নিজের নামে করে ফেলেছে। এ ছাড়া বোম্বাই যাওয়ার দিনই শারীরিক অসুস্থতার বাহানায় প্রচুর চেক সই করিয়ে রেখেছিল, সেই চেক দিয়েও দেদার টাকা তুলে সেই টাকা জমাচ্ছে সে নিজের অ্যাকাউন্টে। বারবনিতা, নেশাভাঙে খরচ করছে দু—হাতে। কেউ কিছু বলার নেই।

এতদিন পরে একজন পুলিশকর্তা এসে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে—এটা যেন ডা লাগুর ধারণারও অতীত ছিল। সে প্রায় ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। আর এতদিনের বিস্মৃতিতে আগের মতো প্রত্যয়ী স্বরে জবাব দিতে পারল না। মাঝেমধ্যেই খেই হারিয়ে ফেলতে লাগল।

তার জবানবন্দিতে অনেক অসংগতিও ধরা পড়তে লাগল।

ইনস্পেক্টর ধোন্দে পোড় খাওয়া পুলিশ কর্মচারী। তিনি অল্প সময়েই ধরে ফেললেন এই ডা লাগু লোকটা কিছু একটা লোকাচ্ছে।

তিনি বললেন, ”আপাতত আপনি পুনা ছেড়ে কোথাও যাবেন না। একান্ত যেতে হলে লোকাল থানায় জানাবেন।” ধোন্দে সাহেব আর দেরি করলেন না, সেদিনই রওনা দিলেন বোম্বাইয়ের গোকুলদাস তেজপাল হসপিটালের উদ্দেশ্যে।

বোম্বাই গিয়ে সরকারি আদেশে ডেকে পাঠালেন লক্ষ্মীবাঈয়ের সেই মূক বধির দাসী শান্তাবাঈ ও যশোদা বেনের মতো দু—একজন পরিচিতকে।

তাঁর সঙ্গে তদন্তে যোগ দিলেন বোম্বাই এসপ্ল্যানেড থানার সেই ইনস্পেক্টর লক্ষণ সেহগাল।

গোকুলদাস তেজপাল হসপিটালে তখনও চারবছর আগে মারা যাওয়া লক্ষ্মীবাঈয়ের শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ, অন্তর্বাস রাখা ছিল। শান্তাবাঈ সেগুলো দেখামাত্রই শনাক্ত করল।

এই কাহিনির শুরুতেই বলেছি, জে জে হসপিটালের করোনার সাহেব লক্ষ্মীবাঈয়ের মৃতদেহ দাহ করার আগে একটা ছবি তুলিয়ে রেখেছিলেন।

সেই ছবি দেখে মুহূর্তের মধ্যে প্রত্যেকেই বলে উঠল, ”এই তো লক্ষ্মীবাঈ!”

অবশেষে যবনিকা পতন।

১৯৫৮ সালের ১২ই মার্চ, ডঃ অনন্ত চিন্তামন লাগু’কে পুলিশ ইন্দুমতী পঙ্খে ওরফে লক্ষ্মীবাঈ কার্ভেকে হত্যার অপরাধে গ্রেপ্তার করল।

এরপর শুরু হল পুনা শহরের অন্যতম চাঞ্চল্যকর মামলার শুনানি।

যথাসময়ে পুনা দায়রা জজের আদালতে কেস উঠল।

বিচারপতি মাননীয় ভি এ নায়েক, তিনি পরবর্তীকালে বোম্বাই হাইকোর্টের জজও হয়েছিলেন।

লোকের কৌতূহলের অন্ত ছিল না। ডা লাগুকে যখন পুলিশি হেফাজত থেকে আদালতে নিয়ে আসা হত, বাস্তবিক ভিড় ভেঙে পড়ত আদালত প্রাঙ্গণে।

আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল পুত্র রামচন্দ্র, ”ধর্মাবতার! সব দোষ আমার! তখন যদি আমি সাময়িক অভিমানে দূরে না—সরে গিয়ে জোর করে ওই শয়তানটার কবল থেকে মা—কে নিয়ে চলে আসতাম, আজ ও এত বড়ো পাপ করতে পারত না।”

লক্ষ্মীবাঈ ডা লাগুর সঙ্গে বোম্বাই যাত্রা করেছিল ১২ নভেম্বর। তার ঠিক দু—দিন আগে দশ তারিখে বাড়িতে এসেছিলেন লক্ষ্মীবাঈয়ের পুরনো বান্ধবী মিসেস চম্পুটিয়া। তিনি আমেরিকায় থাকতেন, সাক্ষ্য দিতে এখন আবার উড়ে এলেন ভারতে। পরিষ্কার বললেন ”লক্ষ্মীকে আমি শেষ যেদিন দেখেছিলাম, সে দুর্বল ছিল। কিন্তু, মরে যাওয়ার মতো নয়।”

উঠে এল শান্তাবাঈয়ের আকারে ইঙ্গিতে বোঝানো সেই বিস্ফোরক তথ্য, যাওয়ার আগে ডাক্তারবাবু লক্ষ্মীবাঈকে দুটো ইনজেকশন দিয়েছিলেন।

বিচারপতি ভি এ নায়েক ডা লাগুকে প্রশ্ন করলেন, ”আপনি তো মিসেস কার্ভের যাবতীয় চিকিৎসার রেকর্ড রাখতেন। এই দুটো ইঞ্জেকশন দেওয়ার কথা সেই রেকর্ডে নেই কেন?”

উকিল বললেন, ”হুজুর! লক্ষ্মীবাঈ মারা গিয়েছেন ১৩ নভেম্বর। অথচ তারপরেও ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত তাকে যে নিয়মিত চিকিৎসা করে গিয়েছেন, ডা লাগু সেই রেকর্ডও রেখেছেন! তবেই বুঝুন!”

সবই বোঝা গেল। ডা লাগু যে দিনের পর দিন মিথ্যে ইনসুলিন দিয়ে স্লো পয়জন করে লক্ষ্মীবাঈকে মারার পরিকল্পনা করেছিলেন, তাও দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট।

কিন্তু কী সেই দুটো মারাত্মক ইনজেকশন? যা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ল লক্ষ্মীবাঈ?

কেনই—বা ডায়াবেটিক কোমার কোনো প্রমাণ না পেয়েও গোকুলদাস তেজপাল হসপিটালের আর এম ও ডা মুসকার হেলায় লিখে দিয়েছিলেন, ”ডায়াবেটিক কোমার কারণে মৃত্যু?”

উত্তর মিলল অচিরেই। ডা মুসকার যে ডা অনন্ত লাগুর দীর্ঘদিনের বন্ধু! দু—জনে একসঙ্গে ১৯৩৪ সালে পড়েছিলেন পুনার এম পি কলেজে। তখন একসঙ্গেই থাকতেন দু—জনে, একেবারে গলাগলি বন্ধুত্ব!

তরুণী ডাক্তার অনিজা জানালেন, ”আমার সিনিয়র ডা মুসকার। তাঁর নির্দেশেই আমি ডায়াবেটিক কোমার চিকিৎসা শুরু করি। পরে ডা ভরিয়াবা এসে বোঝালে আমি আবার ইউরিন টেস্ট করি, তখন কিছু করার আগেই পেশেন্ট মারা যায়।’

ডা লাগু ছিল ধুরন্ধর ব্যক্তি। সে জানত, মৃত্যুর পর যত দেরি করে পোস্ট মর্টেম করা হবে, ততই শরীর থেকে বিষের প্রমাণ লুপ্ত হতে থাকবে। তাই সে ইচ্ছে করে কাল্পনিক ভাইয়ের আগমনের কথা লিখে ময়না তদন্তে দেরি করিয়েছিল।

লক্ষ্মীবাঈয়ের নাম করে পাঠানো সেইসব রহস্যময় চিঠিগুলোও পাওয়া গেল। মিলিয়ে দেখা গেল, ওই হস্তান্তর আর কারুর নয়—স্বয়ং ডাক্তার লাগুর।

লক্ষ্মীবাঈয়ের একটা মোটা অংশের শেয়ার ছিল বড়ো একটা কোম্পানিতে। সেই শেয়ার নিজের নামে ট্রান্সফার করার জন্য লক্ষ্মীবাঈয়ের সশরীরে হাজির হওয়া ছিল প্রয়োজন। তাই, অন্য এক মহিলাকে লক্ষ্মীবাঈ সাজিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করেছিল ডা লাগু। সেই মহিলাও আদালতে এসে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সত্যি কথাই বলল।

অবশেষে, খেলা শেষ হল। ডা লাগুকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করলেন দায়রা জজ ভি এ নায়েক।

ডা লাগু হাল ছাড়েনি। লক্ষ্মীবাঈয়ের সারল্যের সুযোগ নিয়ে তখন তার টাকার অভাব নেই। সে আপিল করল হাইকোর্টে, সেখানে বিফল হয়ে শেষমেশ সুপ্রিম কোর্টে;

কিন্তু সেখানেও সে হেরে গেল। সুপ্রিম কোর্ট বলল, এক অসহায়া বিধবার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে দিনের পর দিন চক্রান্ত করে যে সাংঘাতিক অপরাধ একজন চিকিৎসক হয়ে সে করেছিল, তার কোনো ক্ষমা হয় না। ক্ষমার অযোগ্য এই অপরাধ!

ভাগ্যের কী পরিহাস! এখানে খুনি একজন ডাক্তার, তাকে সাহায্য করছে আরেক ডাক্তার। আর দু—জন পরিচিত পুলিশ অফিসারের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টায় শান্তি পেল লক্ষ্মীবাঈয়ের আত্মা।

কথায় আছে, Too much cunning overreaches itself! অতিচালাকের গলায় দড়ি! আক্ষরিক অর্থে ডা অনন্ত চিন্তামন লাগুরও সেটাই হল। যে পার্থিব নশ্বর ধনসম্পত্তির জন্য সে এত নীচতার প্রমাণ দিল, তা ভোগ করার আগেই তার জীবনটা শেষ হয়ে গেল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *