খুন হলেন এলেন রায়

খুন হলেন এলেন রায়

আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে আমরা সকলেই চিনি, তাই না? যাঁরা নামে চেনেন না, তাঁরা নিশ্চয়ই হাল—আমলের টি—শার্টে চে—র ঝাঁকড়াচুলো ছবির সাথে পরিচিত।

আর্জেন্টিনার তরুণ চে গুয়েভারাকে বলা হয় বিংশ শতকের সবচেয়ে আলোড়ন ফেলা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের মধ্যে অন্যতম। ধনীদরিদ্রের ব্যবধান মুছে দেওয়ার জন্য যে অননুকরণীয় সংগ্রাম তিনি কিউবা, কঙ্গো, বলিভিয়ার মতো দেশগুলোতে চালিয়েছিলেন, সেই সংগ্রাম ও আদর্শ এখনও সমাজতত্ত্বের শিক্ষার্থীদের অবশ্যপাঠ।

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, আমরা চে গুয়েভারাকে নিয়ে এত মাতামাতি করি, অথচ এই চে—র মতোই একজন কিংবদন্তী বিপ্লবী জন্মেছিলেন আমাদের এই বঙ্গভূমিতে। তিনি কিন্তু আমাদের মধ্যে আজ বিস্মৃতপ্রায়।

হ্যাঁ, আমি এম এন রায় অর্থাৎ মানবেন্দ্রনাথ রায়ের কথা বলছি।

মানবেন্দ্রনাথ রায় জন্মেছিলেন এখানেই, কিন্তু পরে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সুদূর মেক্সিকোতে। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া, সংক্ষেপে সি পি আই এবং কমিউনিস্ট পার্টি অফ মেক্সিকো। পর পর দু—টি বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন ও উত্তাল জাতীয়তাবাদী বিপ্লবিদের ভিড়ে এই মানুষটি উজ্জ্বল হয়ে আছেন তাঁর আপন ঐশ্বর্যে।

১৯০৫—এর বঙ্গভঙ্গ থেকে শুরু করে অনুশীলন সমিতি বা বাঘা যতীনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তিনি লড়েছিলেন। পরে জার্মান শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারত থেকে ব্রিটিশ রাজ উচ্ছেদ এবং তারও পরে কমিউনিজমে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। বিয়েও করেন এক জার্মান মহিলাকে, তাঁর নাম এলেন রায়।

মানবেন্দ্রনাথ রায় আমাদের আলোচ্য বিষয় নন। আমাদের আলোচ্য বিষয়বস্তু তাঁর স্ত্রী এলেন।

এলেনও যে—সে মহিলা নন; তিনি একসময় ছিলেন ‘র‍্যাডিক্যালি হিউম্যানিস্ট’ পত্রিকার সম্পাদিকা। তখন তিনি এলেন গটসচক। চাঁছাছোলা ভাষায় চীনের রাজ্যবিস্তারের স্পৃহার সমালোচনা করতেন। এ ছাড়া এম এন রায়ের মতোই তাঁর বক্তব্যও ছিল দেশের প্রথম সারির নেতাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মানবেন্দ্রনাথ রায় শেষ বয়সটায় সস্ত্রীক থাকতেন দেরাদুনে। দেরাদুনে তেরো নম্বর মোহিনী রোডের রোশনবাগ বাংলোয় থাকতেন তাঁরা। ১৯৫২ সালের জুনে তাঁরা বেড়াতে যান মুসৌরিতে। সেখানে এক বিকেলে বেড়ানোর সময় মানবেন্দ্রনাথ পা পিছলে খাদ বেয়ে পঞ্চাশ ফুট নীচে পড়ে যান। কয়েকটা হাড় ভেঙে যায়। সেইসময় শয্যাশায়ী থাকতে থাকতে তিনি সেরিব্রাল থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হন। সেই অবস্থাতেই অবশেষে ১৯৫৪ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি মারা যান।

মানবেন্দ্রনাথ রায়ের এইভাবে মৃত্যুতে দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। কিন্তু কেউ তখন ভাবতেও পারেনি, এর কয়েক বছর পরেই তাঁর স্ত্রী এলেন রায়েরও মৃত্যু হবে আরও কয়েকগুণ বেশি শোচনীয়ভাবে।

সেই ঘটনা জানতে হলে চলে যেতে হবে ১৯৬০ সালের এক শীতের সকালে।

তারিখটা ছিল ১৪ ডিসেম্বর।

দেরাদুনের তেরো নম্বর মোহিনী রোডের রোশনবাগ বাংলোয় ঝলমল করছে মরশুমি ফুল। ঠান্ডা ঘাসের ওপর শিশিরের পরশ যেন স্নিগ্ধ আমেজ এনে দিয়েছে পাহাড়ের কোলের এই বাগানবাড়িতে।

সকাল সবে সওয়া সাতটা। নান্নি ঝাড়ুদারনি রোজকার মতো এসেছে বাড়ি ঝাঁট দিয়ে সাফসুতরো করতে। মেমসাহেব নিজে অনেক ভোরে উঠে পড়েন আর অপরিচ্ছন্নতা একদম পছন্দ করেন না। কাজেই নান্নিকেও তাড়াতাড়ি চলে আসতে হয়। আর প্রতিদিন গেট ঠেলে ঢুকেই ও দেখতে পায় মেমসাহেব লম্বা গাউন পরে, গায়ে একটা কার্ডিগান জড়িয়ে দেখভাল করছেন বাগানের ফুলগুলোকে।

রোশনবাগ বাড়িটাই ভীষণ সুন্দর। চারপাশে বাগান, মাঝখানে ইউরোপিয়ান স্টাইলের একটেরে বাংলো। ঠিক যেমনটা ক্যালেন্ডারে পাহাড়ি শহরগুলোয় দেখা যায়। রোশনবাগের পেছনেই পাহাড় দেখা যায়। পরিষ্কার দিনে মেমসাহেব যখন ছাদে হেঁটে বেড়ান, নান্নির মনে হয় যেন মেমসাহেব মেঘের ওপর হাঁটছেন।

আর এই যে চমৎকার বাগান, এত সব ফুল, ফলের গাছ, তরিতরকারি—সবই তো মেমসাহেবের নিজের হাতে তৈরি।

আহা গো, নান্নি মেমসাহেবের দুঃখ বুঝতে পারে। সেই কোন দূরের দেশ থেকে এসেছিল স্বামীর হাত ধরে, সেও কেমন অকালে চলে গেল। এদিকে কোনো ছেলেপুলেও নেই। এই দুনিয়ায় মেমসাহেব সত্যিই যেন বড়ো একা!

গেট খুলে সবুজ ঘাসের লন দিয়ে হেঁটে মূল বাড়িতে প্রবেশ করতে হয়। লনের দু—পাশে মনোরম বাগান। সেখানেই রোজ গাছের পরিচর্যা করেন মিসেস এলেন রায়।

কিন্তু নান্নি সেদিন সকালে বাগানে কাউকে দেখতে পেল না।

কী ব্যাপার? মেমসাহেব কি আজ এখনও ওঠেননি? আজ অবধি নান্নি আসার পর ওঁকে বাগানে না থাকতে দেখেনি; তবে কি শরীর—টরির খারাপ হল?

নান্নি তড়িৎ পায়ে এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে। মেমসাহেবের ঘর ভেতর থেকে বন্ধ। সারা রোশনবাগ বাংলোয় মেমসাহেব একাই থাকেন, নান্নি আসে দিনে দু—বার, আর সারাদিন থাকে বাবুর্চি পরশন লাল। সেও রাতে রান্নাবান্না সেরে চলে যায় তার নিজের ঘরে।

নান্নি একটু দোনোমনা করে আর কিছু না—ভেবে ঝাঁট দিতে শুর করে। কিন্তু ব্যালকনি পেরিয়ে মেমসাহেবের ঘরের দরজার কাছে যেতেই ও চমকে ওঠে।

একী! বন্ধ দরজার নীচ দিয়ে গড়িয়ে এদিকে এসেছে রক্ত। সরু হলেও শোণিতধারা যে একাধিক!

এরই মধ্যে পরশন লাল এসে পড়েছে। দেখেশুনে তারও চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেছে। উদ্ভ্রান্তের মতো সে ক—বার দরজায় ধাক্কা দিল, ”মেমসাব! মেমসাব!”

কোনো সাড়া নেই।

পরশন কী করবে বুঝে উঠতে না—পেরে নান্নিকে বলল, ”কী করব? থানায় চলে যাব?”

”না না, প্রথমেই থানায় যাবে কি—আগে পাড়ার লোকেদের না হয়—!” বলতে বলতেই নান্নির হঠাৎ মনে পড়ে যায়, সে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে ”উলটোদিকের বাড়িতে একজন বড়ো পুলিশকর্তা থাকেন না? তাঁকে খবর দাও না একবার! আমি বরং মেমসাহেবের বন্ধুদের ডেকে আনি। নির্ঘাত কাল রাতে ডাকাত পড়েছিল, হে ভগবান!” হাউমাউ করতে করতে নান্নি ছোটে বাইরের দিকে।

পরশন মাথা চুলকোল। কথাটা নান্নি মন্দ বলেনি। উলটোদিকের বাড়িতে থাকেন এক বাঙালিবাবু, নাম ডি ডি সান্যাল। তিনি পুলিশ নন, তবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ছিলেন। কিছুদিন হল রিটায়ার করে এই দেরাদুনেই বাড়ি করেছেন। ওঁর বড়ো বড়ো সব পুলিশকর্তার সঙ্গে ওঠা—বসা, তাই ওঁকে খবর দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

ডি ডি সান্যাল জাঁদরেল মেজাজের এক্স—মিলিটারিম্যান। রোশনবাগে এসে দেখেশুনে একটুও দেরি করলেন না, খবর পাঠালেন দালানওয়ালা থানায়।

ইতিমধ্যে এলেন রায়ের দুই বান্ধবী এসে পড়েছেন অকুস্থলে। দু—জনেই অত্যন্ত সম্ভ্রান্তবংশীয়া রাজপরিবারের সদস্যা—একজন হলেন রানি সংগিতাকুমারী, অন্যজন রানি লেভাং মঞ্জিরি।

তখন উচ্চবিত্ত দেশীয় রাজপরিবারগুলোর শৈলশহরে গিয়ে বসবাস করা ছিল খুব সাধারণ ব্যাপার। এঁরা নিজেদের এলিট বৃত্তের মধ্যে জীবন কাটাতেন সেখানে।

পুলিশ আসতে রানি লেভাং মঞ্জিরি উদ্ভ্রান্তের মতো বললেন, ”আমি তো …আমি তো কাল রাতেই এখান থেকে ওদের সঙ্গে ডিনার করে গেলাম! শি ওয়্যাজ পারফেক্টলি ফাইন দেন!”

”কোনো স্ট্রোক—ফোক …!” রানি সংগীতাকুমারী অস্ফুটে বললেন।

পুলিশ ইনস্পেক্টর আর এস শর্মা ততক্ষণে দরজা ভেঙে লোকজন নিয়ে ঢুকে পড়েছেন। সামনেই ড্রয়িং রুম।

এলেন রায় নিজে অত্যন্ত পরিশীলিত ছিলেন। তাঁর ঘরদোর সবসময় ঝকঝক করত। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে গোটা ড্রয়িং রুমের ওপর দিয়ে একটা বিশাল ঝড় বয়ে গেছে।

সমস্ত দামি আসবাবপত্র ওলটপালট হয়ে রয়েছে। একদিকে ট্রাঙ্ক হাঁ মুখ করে খোলা। একটা চেয়ারে জানলার ভারি পর্দা ছিঁড়ে রাখা হয়েছে। সেই পর্দা আবার পোড়া, অজস্র কাগজপত্র, বইয়ে বিস্রস্ত অবস্থায় ছড়ানো রয়েছে চারপাশে।

ড্রয়িং রুম পেরিয়েই বাথরুম। সেটার দরজা খোলা, এবং আলো জ্বলছে।

বাথরুম পেরোতেই সকলে দেখতে পেল এলেন রায়কে। দরজার সামনেই এলেন চিত হয়ে পড়ে আছেন কার্পেটের ওপর। গায়ে একটা চাদর এলোমেলোভাবে ঢাকা দেওয়া। মাথাটা পুরোপুরি থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। তাঁর মুখে টেবিলক্লথের কিছুটা অংশ ঠুসে ঢোকানো। চারপাশে রক্তের বন্যা বইছে যেন! সবমিলিয়ে এক সাংঘাতিক দৃশ্য!

”ওহ মাই গড!” দুই বান্ধবীই এলেনের অমন ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখে প্রায় মূর্ছিত হয়ে পড়লেন।

ইনস্পেক্টর আর এস শর্মা বিচলিত হয়ে পড়লেও নিজের কর্তব্য ভুললেন না। এলেন রায় আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। তার ওপর তিনি ভারত ও আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক ছিলেন। দেশের ওপরমহল তো বটেই, মার্কিন দূতাবাসও মৃত্যুর সঠিক তদন্তের জন্য চাপ দেবে, আর পুরোটাই সহ্য করতে হবে তাঁকে। তাই প্রাথমিক পর্যবেক্ষণটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমেই তিনি এলেন রায়ের মুখে গুঁজে দেওয়া টেবিলক্লথটা সরিয়ে দিলেন। যে চাদরটা তাঁর দেহের ওপর এলোমেলোভাবে ছড়ানো ছিল, সেই চাদরটাও সরিয়ে পাঠিয়ে দিলেন পরীক্ষার জন্য। কার্পেটে পায়ের ছাপ স্পষ্ট। আর এস শর্মার নির্দেশে কনস্টেবলরা সেই ছাপের মাপ নিয়ে নিল।

আর এস শর্মা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। মিসেস রায়ের মাথার চুল চাপ চাপ জমাট রক্তে ডেলা পাকিয়ে রয়েছে। তাঁর পরনে রাতপোশাকের ওপর ভেলভেটের ড্রেসিং গাউন জড়ানো। মহিলারা এই গাউন শোওয়ার সময় খুলে রেখে শুধু রাতপোশাক পরে শুতে যান। এলেনের পায়ে জুতো মোজাও পরা রয়েছে। এর একটাই অর্থ হয়—খুন হওয়ার আগে পর্যন্ত এলেন শুতে যাননি।

ইনস্পেক্টর শর্মা হঠাৎ পেছনে ঘুরে তাকালেন এলেনের দুই বান্ধবীর দিকে, ”ম্যাডাম, আপনাদের মধ্যে কে যেন একটু আগে বলছিলেন কাল রাতে এখানে ডিনার করতে এসেছিলেন?”

”হ্যাঁ আমি!” রানি লেভাং মঞ্জিরি বললেন।

”আপনি যেন বললেন, কাল রাতেই এখান থেকে ওদের সঙ্গে ডিনার করে গেছেন। ওদের সঙ্গে বলতে এলেন ম্যাডাম আর কে? ম্যাডাম তো এখানে একাই থাকতেন!” ইনস্পেক্টর শর্মা জিজ্ঞেস করলেন।

”আমি, এলেন আর অটো যোসেফ ছিলাম কাল।”

”অটো যোসেফ কে?”

”একজন জার্মান যুবক। এক সপ্তাহ আগে দেরাদুনে এসেছিল এলেনের কাছে। এই বাড়িতেই গেস্ট রুমে থাকত ও।”

অল্পক্ষণ থেমে রানি লে ভাং মঞ্জিরি আবার বলতে শুরু করলেন, ”কাল বিকেলে কাছের ওয়েলান স্কুলের প্রতিষ্ঠাদিবসে আমি আর এলেন নিমন্ত্রিত ছিলাম। স্কুলের ওই অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আমি, এলেন আর যোসেফ ডিনার খাই এখানে। তারপর যোসেফ গেস্ট রুমে চলে যায়। আমরা দু—জন গল্প করছিলাম।”

”এক মিনিট।” ইনস্পেক্টর শর্মা বাধা দিলেন, ”বাবুর্চি পরশন লাল তখন ছিল?”

”না, ও তো সাড়ে ন—টা নাগাদই বাড়ি চলে গিয়েছিল। আমি যখন বেরোই, তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। এলেন আমাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য গেট অবধি গিয়েছিল।”

”তখন মিসেস রায়ের কথাবার্তায় কোনো দুশ্চিন্তা লক্ষ করেছিলেন?”

রানি মাথা নাড়লেন, ”একেবারেই না। দিব্যি খোশমেজাজে ছিল এলেন। অন্ধকারেও বাগানে কোন ফুল ফুটেছে তা আমায় টর্চ জ্বেলে দেখাচ্ছিল।”

”মিসেস রায়ের হাতে তখন টর্চ ছিল? আর কী ছিল?” ইনস্পেক্টর শর্মা জিজ্ঞেস করলেন।

”এক হাতে টর্চ অন্য হাতে লাঠি। পাহাড়ি জায়গায় একা থাকত তো, এলেন যেখানেই রাতে বেরত, এইদুটো নিয়ে বেরত।”

ইনস্পেক্টর শর্মা পরশন লাল আর নান্নিকে এরপর আরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে গোটা বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। সব দেখে তিনি মোটামুটি নিঃসন্দেহ হলেন, খুনি বাথরুমের জানলা দিয়েই ভেতরে ঢুকেছিল। কারণ, শীতের রাতে বাথরুমের অতবড়ো জানলাটা খোলা ছিল আর জানলার নীচেই বাথরুমে পায়ের ছাপও স্পষ্ট। সেগুলো সব কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের জন্য পাঠানো হল।

আশ্চর্যের ব্যাপার, অটো যোসেফের কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। গেস্ট রুম সম্পূর্ণ ফাঁকা, বিছানার চাদর পরিপাটি করে ভাঁজ করা। কোথাও যোসেফের কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। গেস্ট রুম সম্পূর্ণ ফাঁকা, বিছানার চাদর পরিপাটি করে ভাঁজ করা। কোথাও যোসেফের কোনো চিহ্ন নেই। যে ছেলেটা আগের দিন বাড়ির গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে ডিনার খেয়েছে, সে সকালে কোথায় চলে যেতে পারে?

এলেন রায়ের হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়তেই গোটা দেশে আলোড়নের সৃষ্টি হল। অনেকেই এই মৃত্যুকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে সন্দেহ করতে শুরু করল।

দেরাদুনের ভ্যানগার্ড সাপ্তাহিক পত্রিকা লিখল—মিসেস এলেন রায় প্রথম জীবনে জার্মানিতে থাকার সময় অনেকেই সন্দেহ করে থাকেন যে তিনি প্রথমে ট্রটস্কির দলভুক্ত ছিলেন। পরে দলত্যাগ করে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। আমরা জানি, ট্রটস্কিকে হত্যা করার জন্য একজন যুবককে মেক্সিকোতে পাঠানো হয়েছিল। ঠিক এইভাবেই যদি আমরা ভাবি এই হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া অটো যোসেফকেও জার্মানি থেকে পাঠানো হয়েছিল এলেন কে হত্যার জন্য—সেটা খুব অলীক কিছু হবে কি?

কথাটা নেহাত ফ্যালনা নয়। তা ছাড়া মাস কয়েক আগেই দুটো ব্যাপার ঘটেছিল। দেরাদুনের সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অফিসে পর পর দু—বার হঠাৎ আগুন লেগে যায় এবং তাতে হিমালয়ের সীমান্ত এলাকার ক—টা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাপ ভস্মীভূত হয়ে যায়। তখন প্রকাশ্যে লিখেছিলেন যে, এই অগ্নিকাণ্ড উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ইচ্ছে করে ওই নথিগুলো নষ্ট করা হয়েছে।

শুধু কাগজে লিখেই এলেন হাল ছাড়েননি, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও যোগাযোগ করে বলেছিলেন যে এই ব্যাপারে তিনি কিছু প্রমাণ দাখিল করতে চান। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক তাঁকে নিরস্ত করা হয়েছিল।

পরের ঘটনাটা ঘটেছিল তার কিছুদিন পরেই। এলেনের বাংলো রোশনবাগে হঠাৎ চুরি হয়েছিল, যে চুরিতে মূল্যবান জিনিসপত্রের চেয়ে বেশি খোয়া গিয়েছিল কাগজপত্র।

অনেকেই তারপর থেকে সন্দেহ করেন যে, এলেনের কাছে নিশ্চয়ই এমন কোনো স্পর্শকাতর নথিপত্র রয়েছে; যা চীনের এজেন্ট বা অন্য কোনো দল সরানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।

যাইহোক, এইসব নিয়ে জল্পনাকল্পনা তুঙ্গে উঠলেও আসল খুনির কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলে দিল্লি আর লখনউ থেকে একদল দক্ষ ডিটেকটিভ এল দেরাদুনে।

তাঁরা তন্নতন্ন করে সারা বাড়ি, বাগান তল্লাশি করতে শুরু করল।

এইবার পাওয়া গেল দুটো গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী। লাশের অনতিদূরেই একটা বাঁশের লাঠি পড়েছিল। আর কার্পেটের ভাঁজে আটকে ছিল একটা হামানদিস্তার কিছু থেঁতো করা হয়। ডাণ্ডাটার নীচে রক্ত জমাট বেঁধে শুকিয়ে ছিল।

গোয়েন্দার দল অনুমান করলেন, এই হামানদিস্তার ডাণ্ডা দিয়েই এলেনের মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়েছিল। এরমধ্যেই পোস্টমর্টেমে জানা গেছে, মাথার চার জায়গায় ভোঁতা কিছু দিয়ে জোরে আঘাত করা হয়েছিল, দুটো জায়গায় ঘিলু প্রায় বেরিয়ে এসেছিল। আর বুকের পাঁজরও কয়েক টুকরো হয়ে গিয়েছিল।

এত বিদুষী একজন মহিলার কী নৃশংসভাবেই না মৃত্যু হল!

গোয়েন্দারা সব দেখেশুনে মোটামুটি একটা আইডিয়া দাঁড় করালেন। ইতিমধ্যে কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের রিপোর্ট এসে গিয়েছে। সেই রিপোর্টে বাথরুমের বাইরে, জানলার নীচে গোড়ালি ও বাঁ—পায়ের বুড়ো আঙুলের ছাপ, কমোডের ওপর পায়ের ছাপ এবং বাথরুমের মেঝেতে পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ইনস্পেক্টর শর্মার অনুমান সঠিক। খুনি বাথরুমের জানলা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল। ঢুকে ড্রয়িং রুমে লুকিয়ে ছিল।

রাত সাড়ে এগরোটা নাগাদ এলেন রানি লেভাং মঞ্জিরিকে বিদায় জানাতে গেট পর্যন্ত গিয়েছিলেন। বাড়িতে ফিরে তিনি হয়তো খুনির ছায়া দেখতে পান, এবং চিৎকার করতে যেতেই খুনি তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হামানদিস্তার ওই ডাণ্ডা দিয়ে মাথায় সজোরে আঘাত করে।

মাথায় আঘাত পেয়ে এলেন মাটিতে পড়ে যান। তখন তাঁর পা ধরে ভেতরে টেনে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সম্ভবত এই টেনে নিয়ে যাওয়ার সময়েই হামানদিস্তার ডাণ্ডাটা কার্পেটে পড়ে ভাঁজের মধ্যে ঢুকে যায়।

হত্যাকাণ্ড সমাধা হলে আততায়ী ঘুরে বেড়াতে থাকে ড্রেসিং রুম, স্টোর রুম, বেডরুম অবশেষে বাথরুমে। বাথরুমে প্রচুর সাবানের রক্তমাখা ফেনা ও জল পড়েছিল, যা থেকে বোঝা যায় সে সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছিল।

এলেন ছিলেন দীর্ঘাঙ্গী। তাঁর বাথরুমের আয়নাটাকে নীচে বেঁকানো হয়েছিল। সেই আয়নাতেও খুনির আঙুলের ছাপ পড়েছিল। এথেকে বোঝা গেল খুনি যেই হোক, সে বেঁটে ছিল।

বাথরুমে হাত মুখ ধুয়ে সে চলে গিয়েছিল ড্রয়িং রুমে। আগেই বেডরুমে এলেনের বালিশের তলা থেকে সে চাবি বের করে নিয়েছিল। বেডরুমের বিছানার চাদরেও ছিটে ছিটে রক্ত লেগেছিল।

এলেনের যে স্টিলের আলমারিতে মূল্যবান কাগজপত্র ছিল, তাঁর হ্যান্ডেল বা গায়ে কোনো আঙুলের ছাপ পাওয়া গেল না। অথচ টাকা রাখার আলমারি, টেবিলের ড্রয়ার, হ্যান্ডব্যাগ —সর্বত্র সেই জলমিশ্রিত রক্তের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল।

গোয়েন্দারা একটা ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলেন। খুনি কোনো রাজনৈতিক কারণে খুন করেনি। তার উদ্দেশ্য ছিল টাকাপয়সা বা অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য হাতানো। কারণ এলেনের একটা ব্যাগে যত টাকা ছিল, খুনি সব নিয়েছিল; কিন্তু সেই ব্যাগেই ক—টা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হবে এমন গোপন চিঠি ছিল, সেগুলোয় খুনি হাতও দেয়নি।

আর একটা চাঞ্চল্যকর হদিশ মিলল। ড্রয়িং রুমে মল্ট হুইস্কির বোতলে এবং কাচের গ্লাসে দু—ধরনের রক্তের ছাপ পাওয়া গেল।

”স্যার, তার মানে কি দু—জন ছিল?” জুনিয়র ইনভেস্টিগেশন অফিসার ময়াঙ্ক পাণ্ডে চিন্তিতভাবে জিজ্ঞেস করল সিনিয়র মি খান্নাকে।

”সেটাই মনে হচ্ছে।” মি খান্না বললেন, ”একজন প্রত্যক্ষ খুনটা করেছে, অন্যজন পাশে থেকে মদত জুগিয়েছে।”

”আচ্ছা স্যার, এমনটা কি হতে পারে যে, ওই যে অটো যোসেফ নামের জার্মান যুবক অতিথি হয়ে এখানে ছিল, সে পাশে থেকে মদত জুগিয়েছে, আর অন্য একজন খুন করেছে?”

”তাই যদি হয়, তবে খুনিকে বাথরুম টপকে ভেতরে আসতে হল কেন? অটো যোসেফই তো দরজা খুলে দিতে পারত!” মি খান্না যুক্তি দিলেন, ”অবশ্য সেক্ষেত্রে মিসেস রায় টের পেয়ে যেতেন।”

কিন্তু এর ঠিক পরেরদিন এমন একটা ব্যাপার ঘটল যে পুলিশ এবং গোয়েন্দাদের সব তদন্ত একেবারে তালগোল পাকিয়ে গেল।

রোশনবাগ বাংলোয় এসে হাজির হল স্বয়ং অটো যোসেফ। সে ১৪ ডিসেম্বর ভোরে বেরিয়ে চলে গিয়েছিল হরিদ্বার। আগের দিন রাতে এলেন রায়কে সে বিদায় জানিয়ে রেখেছিল। এতদিন ধরে হরিদ্বার, রুদ্রপ্রয়াগ, দেবপ্রয়াগ—সহ আরও অনেক স্থান ঘুরে দিল্লি ফেরত যাওয়ার আগে সে শেষবারের জন্য দেখা করতে এসেছে এলেন রায়ের সাথে।

পুলিশ সব ভেরিফাই করে বুঝল অটো যোসেফ সত্যি কথাই বলছে। সে সত্যিই ওইসব জায়গায় যে গিয়েছিল, থেকেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গেল। সবচেয়ে বড়োকথা, অটো যোসেফের আঙুলের ছাপের সাথে ওই দুটো ছাপের কোনো মিলই নেই।

ওদিকে মার্কিন দূতাবাস ক্রমশ চাপ বাড়াতে শুরু করেছে। এত নামি একজন মহিলা খুন হলেন, অথচ পুলিশ কোনো কিনারা করতে পারছে না—এ কেমন কথা?

এইরকম যখন অবস্থা, সিনিয়র ইনভেস্টিগেশন অফিসার মি খান্না হঠাৎ একটা ফোন পেলেন উত্তরপ্রদেশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের অফিসার আতর সিং—এঁর কাছ থেকে। প্রসঙ্গত যেসময়ের কথা বলছি, সেইসময় দেরাদুন শহর ছিল উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের অন্তর্গত।

আতর সিং বললেন, ”স্যার, দু—নম্বর মোতি রোডের একটা ছেলে কাল রোল্ডগোল্ডের সুইস রিস্টওয়াচ বিক্রি করতে গিয়েছিল সদরবাজারে। ঘড়ির নম্বর ৩২৬৬৮৯৬। মিসেস রায়ের ফাইলে এই ঘড়িটার নিখোঁজের বিবরণ ছিল না?”

মি খান্না এমন অযাচিত সংবাদে হাতে যেন চাঁদ পেলেন। তিনি একটুও দেরি করলেন না। ময়াঙ্ক—সহ সমস্ত সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন। কী মনে হল, সঙ্গে নিলেন এলেন রায়ের দীর্ঘদিনের বাবুর্চি পরশন লালকেও।

আতর সিং—এর সাথে দু—নম্বর মোতি রোডের বাড়িতে সবাই যখন পৌঁছোলেন, তখন বিকেল প্রায় পাঁচটা। বাড়ির সামনের রোয়াকে এক বৃদ্ধ বসে শীতের রোদ পোহাচ্ছিল।

পরশন লাল তাকে দেখেই চমকে উঠল, ”আরে! এ—তো রামপ্রসাদ! এর বাড়ি এদিকেই শুনেছিলাম অবশ্য।”

”তুমি কি ওই বুড়োর কথা বলছ?” ইনস্পেক্টর আতর সিং জিজ্ঞেস করলেন, ”ওরই তো বাড়ি এটা। যে ছেলেটা ঘড়ি বিক্রি করতে গিয়েছিল সে এর মেয়ের দিকের নাতি হয়।”

”রাম রাম!” পরশন লাল চোখ বড়ো বড়ো করে মি খান্নার দিকে তাকাল, ”এই রামপ্রসাদ তো সাহেবের গাড়ি চালাত হুজুর!”

”সাহেব মানে কি তুমি এম এন রায়ের কথা বলছ?”

”জি হুজুর। সাহেব মারা যাওয়ার পর মেমসাহেবেরও গাড়ি চালাত। বছর কয়েক আগে বয়স হয়ে গিয়েছিল বলে ছেড়ে দিয়েছিল চাকরি।”

মি খান্না বুঝতে পারছিলেন জট ক্রমশ খুলতে শুরু করেছে। যদিও বৃদ্ধ রামপ্রসাদ নাতির কীর্তিকলাপের বিন্দুবিসর্গও জানত না, কিন্তু তার নাতি বসন্তকুমারকে বাড়ির সামনের রোয়াকে ঘা কতক দিতেই সে হাউমাউ করে সব স্বীকার করে ফেলল।

বসন্তকুমারের বয়স মেরেকেটে সতেরো বছর। ম্যাট্রিকে বার কয়েক ঘায়েল হয়ে পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছে। বেঁটে, ফর্সা, ছিপছিপে চেহারা। পুলিশের ম্যারাথন জেরায় সে বেশিক্ষণ যুঝতে পারল না, বের করে দিল সেই ঘাতক হামানদিস্তার নীচের পাতটি।

পুলিশ বসন্তকে গ্রেফতার তো করলই, সঙ্গে তার নখ কেটে ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হল।

অবশেষে ৭ ফেব্রুয়ারি ম্যাজিস্ট্রেট পি সি ভাণ্ডারীর সামনে বসন্তকুমারকে হাজির করানো হল। সেখানে বসন্তকুমার প্রায় আঠাশ পৃষ্ঠার দীর্ঘ স্বীকারোক্তি করল।

বলল, ”হুজুর! আ—আমি একা একাজ করিনি। আমি আর সুরেশ ক্ষেত্রী দু—জনে ছিলাম!”

ম্যাজিস্ট্রেটের উপর্যুপরি জেরায় বসন্ত বলতে লাগল, সে আর সুরেশ দুজনেই ছিল দেরাদুনের ডি এ ভি ইন্টারকলেজের ছাত্র। সমবয়সি নয়, সুরেশ বছর দুয়েকের বড়ো, কিন্তু ইয়ারদোস্তি একদম গলায় গলায়। বসন্ত পড়াশুনো আগেই ছেড়ে দিয়েছিল, এলেন রায়ের বাংলোর একটু দূরে চার নম্বর মোহিনী রোডে সে চৌকিদারের চাকরি করত। আর সুরেশ তখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু ফিজ দিতে না পারায় তার নাম কেটে দেওয়া হয়।

এলেন রায়কে হত্যার পাঁচদিন আগে সুরেশ তাকে বলে কলেজের তিরিশ টাকা মাইনে সে মদ খেয়ে উড়িয়ে দিয়েছে, আর সেটা তার মান জানতে পেরে গেছে। কাজেই সে ভয়ে বাড়িও ফিরতে পারছে না, কলেজও যেতে পারছে না। বসন্ত যদি তিরিশ টাকা জোগাড় করে দিতে পারে, তবে সে বাড়ি ফিরতে পারে।

বসন্ত বলেছিল, ”এক—দু—টাকা হলে তবু কথা ছিল। তিরিশ টাকা আমি কোথায় পাব?”

তখন সুরেশই প্রস্তাব দিয়েছিল, ”চল, চুরি করি।”

তা চুরি করব বললেই তো করা যায় না, মোহিনী রোডের অধিকাংশ বাড়িই অভিজাত পরিবারের। সব বাড়িতেই উত্তম সিকিউরিটির ব্যবস্থা। সুরেশ বলেছিল, ”আমাদের নেহরুগ্রামে একটা বুড়ি আছে, একা থাকে। চল সেখানে চুরি করব।”

”নেহরুগ্রাম তো অনেক দূর! রাতে অতদূর গেলে বাড়ি ফিরব কী করে! বাড়ি না ফিরলে দাদু আমায় বকবে!” বসন্ত বলেছিল।

”তবে?” সুরেশ বলেছিল, ”কোথায় করব তাহলে?”

দু—জনে তখন বসেছিল রোশনবাগের সামনের কালভার্টে। বসন্ত হঠাৎ বলে উঠেছিল, ”এক কাজ করলে হয়। রোশনবাগে চুরি করবি? আমার দাদু তো এই বাড়িতে গাড়ি চালাত, আমি ছোটোবেলায় অনেকবার এসেছি, কোথায় কোন ঘর সব জানি। তার ওপর ওই বুড়ি মেম রাতে একাই থাকে!”

ইতিমধ্যে সুরেশকে খুঁজে পেতে পুলিশ হন্যে হয়ে ঘুরছে। খুনের পরই সে নেপাল পালিয়েছে। তাকে গ্রেফতার করার জন্য একজন পুলিশ অফিসার ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র নিয়ে কাঠমান্ডু চলে গেলেন।

কাঠমান্ডুতে ভারতীয় দূতাবাস ও নেপাল পুলিশের সাহায্যে সুনধারা বাসস্টপের কাছে সুরেশকে গ্রেফতার করা হল। তার কাছেও পাওয়া গেল মিসেস এলেন রায়ের একাধিক দামি হাতঘড়ি।

এর মধ্যেই ল্যাবরেটরির রিপোর্ট এসেছে। বসন্তের পায়ের ছাপের সঙ্গে রোশনবাগে পাওয়া ছাপ হুবহু মিলে গেছে। এ ছাড়া বসন্তের নখেও যে রক্তের নমুনা পাওয়া গিয়েছে, তা মিলে গেছে মিসেস রায়ের রক্তের সাথে।

অতএব, আর কোনো সন্দেহই নেই, ১৯৬১ সালের মে মাসে দুই অকালপক্ক কীর্তিমানকে দায়রা আদালতে হাজির করানো হল ও চার্জশিট পেশ করা হল।

সেপ্টেম্বর মাসে শুনানি আরম্ভ হল। বিচারপতি ছিলেন ওঙ্কার সিং। বিচারের সময় আদালত চত্বর জনতার ভিড়ে ভেঙে পড়ত। সকলেই দুই কিশোরের নিষ্ঠুরতায় আশ্চর্য, সামান্য তিরিশ টাকার জন্য কলেজের দুটো ছেলে এত বড়ো একজন মহিলাকে খুন করল? ছি ছি!

সবচেয়ে বড়ো কথা, দু—জনের কারুর অভিব্যক্তিতেই অনুশোচনার লেশমাত্র নেই। দুজনেই নির্বিকার। বসন্ত এখন সব দোষই সুরেশের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করছে, আর সুরেশও তাই।

তদন্তে প্রকাশ পেল, তারা খুনের পরেরদিন রিয়েল কাফে ইউনিক রেস্টুরেন্টে ও ফিল্মিস্তান সিনেমায় দেদার টাকা উড়িয়েছে, মদ খেয়েছে, ফুর্তি করেছে।

এই মামলায় চুয়ান্ন জনের সাক্ষ্য গৃহীত হয়েছিল এবং ১৯১টি স্পেসিমেন নথিভুক্ত করা হয়েছিল। ফিল্মিস্তান সিনেমার এক কর্মী সাক্ষ্য দিলেন তিনি টিকিট কাটার সময় বসন্তের কাছে চার—শো টাকা দেখেছিলেন। আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে টাকাটা একেবারেই কম ছিল না।

হতভাগ্যা এলেন যখন অটো যোসেফ আর রানি লেভাং মঞ্জিরির সাথে ডিনার করছিলেন, তখনই বসন্ত আর সুরেশ জুতো খুলে পেছনের তারের বেড়া পার হয়ে ঢুকেছিল রোশনবাগে। বাংলোর পেছনদিকের বারান্দার ধারে বাথরুম, সেই বাথরুমের জানলা দিয়ে প্রথমে বসন্ত ঢুকেছিল, তারপর সুরেশ। কিন্তু বাথরুমের দরজা বন্ধ থাকায় বিশেষ সুবিধা হল না। তখন তারা আবার বেরিয়ে এসে পেছনের বারান্দার একটা অন্ধকার কোণে অপেক্ষা করতে লাগল।

একে একে অটো যোসেফ বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন দূরের গেস্ট রুমে। গেস্ট রুমটা ছিল মূল বাংলো থেকে একটু দূরে, বাগান পেরিয়ে। এলেন রানি লেভাং মঞ্জিরিকে বিদায় জানাতে গেলেন গেটে।

ফিরে এসে যেই তিনি দরজা বন্ধ করে ভেতরে ঢুকেছেন, অমনি বসন্ত সামনের বারান্দায় গিয়ে পরিকল্পনামতো হাঁকতে লাগল, ”টেলিগ্রাম মেমসাব! টেলিগ্রাম! জলদি আইয়ে!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *