রাজনীতি

রাজনীতি (প্রবন্ধ) – গোলাম মোস্তফা

মুসলিম জাহানের শাসনতন্ত্র

পাকিস্তানের নূতন শাসনতন্ত্র ঘোষণা করা হইয়াছে। দেশবাসী এর গঠন-প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল।

এই নূতন পরিবর্তনের মূলে দাঁড়িয়ে মুসলিম জাহানের কোন্ রাষ্ট্রে কিরূপ শাসন পদ্ধতি বিদ্যমান রয়েছে, তার একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় উপভোগ্য হতে পারে। সব দেশের পূর্ণ পরিচয় এক প্রবন্ধে দেওয়া অসম্ভব। নিয়ে আমি তাই তুরস্ক, মিসর, আফগানিস্তান, ইরান এবং ইরাকের শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে কিছুটা আভাস দিচ্ছি।

তুরস্ক: তুরস্ক একটি রিপাবলিক। বহু বিচিত্র এর রাজনৈতিক ইতিহাস। তুর্কীজাতি সাম্রাজ্য জয় করেছে, স্থাপন করেছে, শাসন করেছে, আবার তেমনি হারিয়েছে। তবু এরা মরেনি, টিকেই আছে। অদ্ভুত এদের প্রাণশক্তি ও মনোবল।

১৯২২ খৃষ্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত তুরস্কে রাজতন্ত্র (Monarchy) প্রচলিত ছিল। সুলতান আবদুল মজিদ যখন তুরস্কের খলিফা, তখন তার হাতেই সর্বপ্রথম (১৮৫৬) কিছুটা নিয়মতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রবর্তিত হয়। অতঃপর ইউরোপীয় শক্তিপুঞ্জের চাপে পড়ে সুলতান আবদুল হামিদ (১৮৭৬) একটাconstitution ঘোষণা করেন। তাতে স্থানীয় খৃষ্টানরা স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। কিন্তু ১৮৭৮ সালে সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ পুনরায় রাজতন্ত্রের প্রবর্তন করেন। এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ নব্য তুর্কীদলের আবির্ভাব হয় এবং ১৯০৫ সালের পূর্বের (১৮৭৬ সালের) শাসনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তবে তাতে কতিপয় ধারার পরিবর্তন ও সংযোজন সাধিত হয়েছিল। ১৯০৮ সালে সুলতান আবদুল হামিদ সিংহাসনচ্যুত হন। সেই সঙ্গে খেলাফতেরও অবসান ঘটে।

তারপরই আসে প্রথম মহাসমর, ১৯১৪ খৃষ্টাব্দে। তুরস্ক জার্মানীর সঙ্গে যোগ দিয়ে ত্রি-শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু জার্মানীর পরাজয়ের সাথে তারও পরাজয় ঘটে। এতে নব্য তুর্কীদলের প্রভাব তিরোহিত হয়। তুর্কীবীর কামাল-পাশার অধীনে নূতন জাগরণ দেখা দেয়। ১৯২২ খৃষ্টাব্দে তুরস্ককে রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়। মুস্তফা কামাল পাশা প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তখন থেকে তুরস্ক ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র (secular state) রূপে পরিগণিত হয়।

তুরস্কের রাষ্ট্রভাষা তুক। এর সার্বভৌমিকতা (sovereignty জাতির হাতে ন্যস্ত (sovereignty belongs to the nation)। The Grand National Assembly-ই হচ্ছে তুরস্কের সর্বময় কর্তা। এই এসেমরি সমগ্ৰ তুকী জাতির প্রতিনিধিত্ব করে। প্রতি চার বছর অন্তর এই এসেমব্লির নির্বাচন হয়।

তুরস্কে ব্যক্তি-স্বাধীনতার ব্যাখ্যা হচ্ছে—”Liberty consists any action which is not deterimental to others” অর্থাৎ যে-কোনো ব্যক্তি স্বাধীনভাবে যে-কোনো কাজ করতে পারে যদি তা অপরের ক্ষতির কারণ না হয়।

তুরস্কে ধর্ম-স্বাধীনতা আছে, তবে অপর ধর্মের প্রতি তা যেন আক্রমণাত্মক না হয়।

তুরস্কে প্রাইমারী শিক্ষা ছেলে-মেয়েদের জন্যে বাধ্যতামূলক এবং পাবলিক স্কুলসমূহে তা অবৈতনিক।

মিসর : মিসর পূর্বে তুর্কীর অধীনে ছিল। খেদিব তখন দেশ শাসন করতেন। বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণের ফলে ১৮৭৯ সালে মিসর গ্রেট বৃটেন ও ফ্রান্সের সম্মিলিত শাসনাধীনে আসে। ১৮৮২ সালে জাতীয় নেতা আরাবী পাশা বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

১৯১৪ খৃষ্টাব্দে বৃটেন মিসরকে আশ্রিত রাজ্য (protectorate) বলে ঘোষণা করে। অতঃপর জগলুল পাশার নেতৃত্বে মিসরে গণ-আন্দোলন শুরু হয়। ফলে ১৯২২ সালে বৃটিশ সরকার মিসরকে স্বাধীনতা দান করেন। ১লা মার্চ, ১৯২৩ খৃষ্টাব্দে বাদশা ফুয়াদ মিসরের স্বাধীন নরপতিরূপে স্বীকৃতি লাভ করেন। একমাস পরেই মিসরের বর্তমান শাসনতন্ত্র বিঘোষিত হয়।

রাজাই ছিলেন এতদিন মিসরের প্রধান কর্মকর্তা। কিন্তু মিসর আর এখন রাজতন্ত্র নয়। জেনারেল জামাল আব্দুল নাসের রাজন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে মিসরে স্থাপন করেছেন ডিক্টেটরশীপ।

আফগানিস্তান : আফগানিস্তান রাজতন্ত্র। ইংরাজীতে যাকে বলে “benevolent despotism”-এখানে তাই। আমীরই সর্বেসর্বা। রাশিয়া এবং ভারতের মধ্যবর্তী বলে একে নিয়ে চিরদিনই ইউরোপীয় শক্তিপুঞ্জ অনেক খেলা খেলতে চেয়েছে এবং এখনও সে খেলার অবসান ঘটেনি। আফগানিস্তানকে বৃটিশ আপন কুক্ষিগত করে রাখবার বহু চেষ্টা-ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু আফগান জাতিও শক্ত চীজ। সহজে কারো হাতে সে ধরা দেয়নি। অনেক ভাগ্যবিড়ম্বনার পর ১৯১৯ খৃষ্টাব্দে আফগানিস্তান বৃটেন ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির চক্রান্ত থেকে মুক্ত হয়, এবং ১৯২১ সালে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯২৩ সালে বিচক্ষণ-প্রগতিশীল বাদশাহ আমানুল্লা আফগানিস্তানের জন্যে একটি নূতন শাসনতন্ত্র কায়েম করেন।

এরপর আফগানিস্তানে দ্রুত রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে। ইতিহাস পাঠক তা জানেন।

আফগানিস্তানকে বলা যায় ধর্মমিশ্রিত স্বেচ্ছাতন্ত্র (Government is autocracy diluted with theoeracy)। বাদশাকে হানাফী জামাতভুক্ত হতেই হবে। দেশের শাসনভার গ্রহণের পূর্বে তাকে পার্লিয়ামেন্টের সম্মুখে শপথপরে এই বলে স্বাক্ষর করতে হয় এবং ঘোষণা করতে হয় যে, তিনি শরিয়ৎ মোতাবেক দেশ শাসন করবেন এবং দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করবেন।

কেবলমাত্র আফগানিস্তানের মুসলিম প্রজারাই মন্ত্রী হবার অধিকরী। আফগান পার্সিয়ামেন্টে দুটি স্থায়ী পরিষদ (Houses) আছেঃ উচ্চ এবং নিম্ন। তৃতীয় একটি পরিষদও আছে-তার নাম জির্গা Jirga)। প্রত্যেক চার বৎসরে জির্গার এক একটি অধিবেশন হয়। এই জিৰ্গায় সমস্ত উপজাতিদের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন। বাদশাহ নিজে সভাপতিত্ব করেন।

ইরান : ১৯০৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ইরানে অবিমিশ্র রাজতন্ত্রই বিদ্যমান ছিল। শাহিনশাহ্-ই ছিলেন ইরানের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। কিন্তু ধীরে ধীরে শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন ঘটে এবং সুখের বিষয়, তা রক্তহীন বিপ্লবের মধ্য দিয়েই ঘটে।

১৯২৪ খৃষ্টাব্দে ইরানে রিপাবলিক শাসন আসন্ন হয়ে আসে। কিন্তু নানা কারণে উলেমা সম্প্রদায়ের সঙ্গে রেজা শাহের মতবিরোধ ঘটে; ফলে রিপাবলিক শাসন তো প্রতিষ্ঠিত হয়ই না, উল্টা রেজা শাহেব কাছ থেকে উলেমারা এই ঘোষণাই আদায় করে নেন যে, রিপাবলিক শাসন শিয়া মতের সম্পূর্ণ বিরোধী। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯২৫ সালের ১২ই ডিসেম্বর তারিখে ইরানের জাতীয় পরিষদ (Iranian National Assembly) রেজা শাহকে পুরুষানুক্রমিকভাবে রাজা বলে ঘোষণা করে। রেজা শাহ্ পাহলবী ছিলেন সত্যই ইরানের ত্রাণকর্তা। কিন্তু ১৯৪১ সালে আবার বিপর্যয় দেখা দেয়। বহু ঘাত-প্রতিঘাতের ফলে ১৯৪৩ সালে আমেরিকা, বৃটেন এবং সোভিয়েত রাশিয়া বিখ্যাত Tehran Declartion-এ ইরানের স্বাধীনতা স্বীকার করে।

১৯০৬-৭ সালে ইরানী শাসনতন্ত্র প্রবর্তিত হয়। গণতন্ত্র এবং ধর্মতন্ত্রের এ এক সংমিশ্রণ।

ইরানে সর্বপ্রকার প্রকাশনাই (Publications) স্বাধীন। যদি কোনো মুদ্রিত পুস্তকে বা অন্য কোনো কিছুতে আপত্তিকর কিছু প্রকাশিত হয়, তখন প্রেস আইন অনুসারে লেখক অথবা প্রকাশককে তার জন্য দায়ী করা হয়। লেখক যদি দেশবাসী ও সুপরিচিত হন, তখন শুধু তাকেই অভিযুক্ত করা হয়-প্রকাশককে নয়। লেখককে না পাওয়া গেলে তখন প্রকাশককে দায়ী করা হয়।

ইরাক : ইরাক (মেসোপোটেমিয়া) পূর্বে তুর্কী সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। কিন্তু বৃটিশদের চক্রান্তে প্রথম মহাযুদ্ধের শেষভাগে (১৯১৭) ইরাক তুরস্ক থেকে স্বতন্ত্র হয়ে যায়। General Mande-এর অধীনে একদল বৃটিশ সৈন্য ইরাক দখল করে এবং ইরাককে আশ্রিত রাজ্য বলে ঘোষণা করে। কিন্তু ইরাকে স্বাধীনতার আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯২০ খৃষ্টাব্দে Sir Percy (মেসোপোটেমিয়ার তৎকালীন বৃটিশ হাই কমিশনার) সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে আরব মন্ত্রীদের দ্বারা গঠিত একটি কাউন্সিল প্রবর্তিত করেন। এরপর মক্কার রাজা হুসেনের পুত্র ফয়সলকে ইরাকের আমীর পদে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। বলা বাহুল্য, এই হুসেন তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার সময় বৃটিশ পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। ১৯২১ সালে Sir Percy আমীর ফয়সলকে ইরাকের রাজা বলে ঘোষণা করেন। তারপর ঘটনার স্বাভাবিক গতিতে ইরাক বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়। ১৯৩১ সালে ইরাকে ম্যান্ডেটরী (Mandatory) শাসনের অবসান ঘটে এবং তার ফলে ইরাক স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্রে (Sovereign stste) পরিণত হয়।

ইরাক তাই রাজতন্ত্র।[১] এর সার্বভৌমিকতা (Sovereignty) ইরাকবাসীর হাতে (The sovereixgty of the constitutional kingdom of Iraq resides in the people)। দেশবাসী এই ক্ষমতা আমানত (Trust) স্বরূপ তাদের রাজার হাতে অর্পণ করেছেন।

[১. ইরাক এখন আর রাজতন্ত্র নয়। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে জেনারেল করিম কাসেম ক্ষমতা দখল করেন। ইরাক প্রজাতন্ত্রের রূপ নেয়। প্রকৃতপক্ষে সেখানে ডিক্টেটরী শাসনই প্রবর্তিত হয়েছিল। ১৯৬৩ সালে অপর একটি অভ্যুত্থানের দ্বারা ফিল্ড মার্শাল আব্দুস মালাম আরিফ ক্ষমতা দখল করেন। তার মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা আবদুর রহমান আরিফ ইরাক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। লেখাটি ১৯৬২ সালে রচিত, ফলে বর্তমানে এসব ছেলের খোলনলচে প্রায় সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গেছে।–সম্পাদক]

ইরাকের শাসতন্ত্রে নাগরিক অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে। সর্বপ্রকার নাগরিকই সমঅধিকার ভোগ করতে পারে।

বাক-স্বাধীনতাও ইরাক-শাসনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। যে কেউ যখন খুশী অবাধে যার-তার সঙ্গে মেলামেশা করতে পারে। তবে আইনের খেলাফ কিছু হলে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে।

ইরাকের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। অন্যান্য ধর্মমতাবলম্বীরাও স্বাধীনভাবে তাদের ধর্মচর্চা করতে পারে।

রাজা দেশ শাসন করেন, আবার সৈন্যদের প্রধান সেনাপতিও তিনি। শাসনকার্য পরিচালনার জন্যে তার একটি মন্ত্রীসভা (Council of ministers) আছে। প্রয়োজন হলে রাজা সামরিক আইন জারি করতে পারেন।

মুসলিম রাষ্ট্রগুলির শাসন-পদ্ধতি সম্বন্ধে এই হলো মোটামুটি পরিচয়। বলাবাহুল্য, এ পরিচয় অতি আধুনিক (uptodate) নয়। মধ্যপ্রাচ্যে রাজনীতি ও শাসনতন্ত্রের এত দ্রুত পরিবর্তন হয় যে, কোনো বিষয় স্থির নিশ্চিতরূপে বলা কঠিন।

[“Selected Constitutions of the world” থেকে সংগৃহীত।]

পাক জমহুরিয়াত

মার্চ, ১৯৬২

নয়া শাসনতন্ত্রের ইসলামী রূপ

নূতন শাসনতন্ত্র প্রবর্তিত হবার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানে এক নূতন সম্ভাবনার যুগ সূচিত হবে।

আমি রাজনীতির ছাত্র নই। কাজেই রাষ্ট্রদর্শনের আলোকে এর দোষগুণ বিচার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সে চেষ্টা আমি করবো না। রাজনীতি থেকে দূরে দাঁড়িয়ে একজন সাধারণ মুসলিম নাগরিক হিসেবে এই নূতন রাষ্ট্রবিধান আমার মনে কী প্রতিক্রিয়া জাগিয়েছে, তাই আমি বলবো।

এই শাসনতন্ত্রের সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য ও আকর্ষণ হচ্ছে এর ইসলামী রূপ। যদিও শাসন-বিধানের কোথাও পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র বলে উল্লেখ করা হয়নি, শুধু বলা হয়েছে “Republic of Pakistan”,তবু এই শাসনতন্ত্রের মধ্য দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের রূপই ফুটে বেরিয়েছে। ইসলামের চমৎকারিত্ব তো সেইখানেই। নাম না বললেও আপন মহিমায় সে পরিচিত হয়।

তবু ইসলামী রাষ্ট্রের যে আদর্শ আমাদের মনে জেগে আছে, তার সঙ্গে পাকিস্তানকে একবার মিলিয়ে দেখতে চাই। কিন্তু তা করতে হলে ইসলামী রাষ্ট্রের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে একটা পূর্ব-ধারণার প্রয়োজন। নিম্নে এর বিশেষ বিশেষ লক্ষণগুলি দেওয়া হলো :

ইসলামী রাষ্ট্রের স্বরূপ

(১) সার্বভৌমিকতা একমাত্র আল্লাহর (Sovereignty belongs to Allah alone) এ নীতি মানতে হবে;

(২) শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহর প্রদত্ত আমানত (Sacred turst) বলে গ্রহণ করতে হবে;

(৩) আল্লাহ্ ও রসুলের নির্দেশ অনুযায়ী (অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক) আইন প্রণয়ন করতে হবে;

(৪) কুরআন-হাদিসের বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করা চলবে না;

(৫) জাতিধর্ম নির্বিশেষে সব নাগরিককে সমান অধিকার দিতে হবে;

(৬) সব নাগরিককে ধর্ম-স্বাধীনতা, কর্ম-স্বাধীনতা ও বাক-স্বাধীনতা দিতে হবে;

(৭) কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করা চলবে না;

(৮) নারী জাতির ন্যায্য অধিকার দিতে হবে;

(৯) সামাজিক সাম্য ও ন্যায়নীতির প্রতিষ্ঠা করতে হবে;

(১০) মুসলমানদের জন্য ইসলামী জীবন ও ইসলামী সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে হবে;

(১১) আইনের চোখে সবাই সমান–এই নীতি মানতে হবে;

(১২) প্রত্যেক অসমর্থ নাগরিকের মৌলিক অভাব (basic needs) পূরণ করতে হবে;

(১৩) রাষ্ট্রকে জনকল্যাণ প্রয়াসী (Welfare stste) করে গড়ে তুলতে হবে;

(১৪) আন্তর্জাতিক মৈত্রী ও মিলন প্রতিষ্ঠা করতে হবে;

(১৫) নূতন কোনো সমস্যার উদয় হলে ইজমা, কিয়াস, ইসতিহাদ ইত্যাদি দ্বারা তার সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে।

-(দেখুনঃ মওদূদীর Islamic Law and Constitution)

এইগুলিই হলো ইসলামী রাষ্ট্রের সংক্ষিপ্ত পরিচয়।

ইসলামী রাষ্ট্রের আলোকে পাকিস্তান

এই আলোকে পাকিস্তানের নয়া শাসনতন্ত্রকে একবার পরীক্ষা করা যাক–

শাসনতন্ত্রের সর্বপ্রথম প্রস্তাবনাতেই আল্লাহর সার্বভৌমিকতা এবং তাঁর আমানতের কথা মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে?

Whereas sovereignty over the entire universe is Almighty Allah alone, and the authority exercisable by the people is a sacred trust;

“And—Pakistan should be a democratic state based on Islamic principles of social justice”.

তারপর বলা হয়েছে :

“কোনো আইনই ইসলামের মূলনীতিসমূহের বিরোধী হবে না।”

(No law should be repugnant to Islam)

“সমস্ত নাগরিককে আইনের চোখে সমান জ্ঞান করা হবে এবং সবাইকে সমানভাবে আইনের আশ্রয় (protection) দেওয়া হবে,

“কোন নাগরিকের বাক-স্বাধীনতাকে (বিনা কারণে) ক্ষুণ্ণ করা হবে না;

“(বিনা কারণে) পরস্পরের মেলামেশার অধিকার হরণ করা হবে না;

“কর্মে, গতিবিধিতে এবং ধর্মাচরণে প্রত্যেকের স্বাধীনতা থাকবে;

“অমুসলমান ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহের অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকবে এবং তাদের উন্নয়নের জন্যে বিশেষ সুযোগ ও সাহায্য দেওয়া হবে;

“মুসমানদের জীবনযাত্রা পদ্ধতি ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে যাতে ইসলামানুসারী হয় সে ব্যবস্থা করা হবে;

“কুরআন ও ইসলামিয়াত শিক্ষা মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হবে;

“অসমর্থ নাগরিকদের মৌলিক অভাব (যথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা) পূরণ করা হবে;

“সুদ (রিবা), মাদকদ্রব্য ও অন্যান্য নিষিদ্ধ বস্তু সমাজ থেকে দূরীকরণের ব্যবস্থা করা হবে;

“মুসলিম জাহানের সংহতি এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও মিলন সুদৃঢ় করা হবে;

“প্রাথমিক শিক্ষা আবশ্যিক ও অবৈতনিক হবে;

“জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে জনকল্যাণের জন্য সর্বপ্রকার উপায় অবলম্বণ করা হবে।”

এইরূপ ছোটখাটো আরও অনেক ব্যবস্থা রয়েছে-যা থেকে সত্যই মনে হবে কি ইসলামের দিক থেকে, কি মানবতার দিক থেকে-এই শাসনতন্ত্র সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য হয়েছে। ইসলামী আদর্শ সম্পূর্ণ বজায় রেখে, অথচ বর্তমান যুগের সমস্ত চাহিদা মিটিয়ে এমন একটা অভিনব শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা সহজ কথা নয়।

অন্যান্য বৈশিষ্ট্য

শাসনতন্ত্রে Presidential form of Government গ্রহণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রের একজন প্রেসিডেন্ট থাকবেন, তিনি অবশ্য মুসলমান হবেন। তিনি রাষ্ট্রপ্রধানও হবেন (Head of the state) আবার সৈন্য বাহিনীরও তিনি প্রধান সেনাপতি হবেন। এই ব্যবস্থাও সম্পূর্ণ ইসলামানুমোদিত হয়েছে বলে আমি মনে করি। খোলাফায়ে রাশেদীনও এই ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন। হযরত ওমর ‘আমীরুল মুমেনীন’ও ছিলেন, সিপাহসালারও (Commander-in-chief) ছিলেন। রাষ্ট্রপ্রধানের এই দ্বৈত-রূপ তাই আমাদের কাছে নূতন নয়; ইসলামের মূলনীতির সঙ্গে এ ব্যবস্থা অন্তর্বিজড়িত। দুইকে নিয়েই ইসলামের কারবার। দুই বিপরীতের মধ্যে সে আনে সমন্বয়। দীন ও দুনিয়া, ইহকাল ও পরকাল, জড় ও চৈতন্য; ধর্ম ও কর্ম, কুরআন ও তলোয়ার, স্রষ্টা ও সৃষ্টি ইসলামে একসাথে বাধা। দুই প্রান্তের মাঝখান দিয়ে পাতা আছে তার সিরাতুল মুস্তাকিম; কাজেই যারা একই ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সেনাপতিরূপে দেখতে নারাজ তাদের ইসলামী রাষ্ট্র দাবী করবার কোনো অধিকার আছে বলে আমি মনে করি না।

ইসলামী গণতন্ত্র

ইসলাম গণতন্ত্রের প্রয়াসী সন্দেহ নেই, কিন্তু পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের অন্ধ অনুকরণ সে সমর্থন করে না। গণভোট তার কাম্য নয়। প্রতিটি মানুষের কাছে ভোট নেবার প্রথা ইউরোপ আমাদের শিখিয়েছে। তাদের সেটা দরকার, কিন্তু আমাদের নয়। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র (Secular State; সেখানকার রাষ্ট্রদর্শনও স্বতন্ত্র। সার্বভৌমিক ক্ষমতা নিয়েও তাদের সঙ্গে আমাদের দারুণ প্রভেদ। তারা বলে দেশের চরম শাসনক্ষমতা হচ্ছে দেশবাসীর (Sovereignty belongs to the people)। কাজেই কোনো জননেতাকে নির্বাচিত হতে হলে তাদের প্রতিটি দেশবাসীর মত ভোট গ্রহণ করতেই হয়। তাই তারা গণভোটের প্রবর্তন করেছে। কিন্তু ইসলামের মূলণীতি তো তা নয়। ইসলামের সার্বভৌমিকতা একমাত্র আল্লাহর। ভোটে জিতে গেলেই যে সে যোগ্য নেতা বা যোগ্য শাসক হলো তা নয়; আল্লাহর রাজ্য আল্লাহর আইন কানুন দ্বারা সে পরিচালনা করছে কিনা, তাই দেখে হবে তার বিচার। ইসলাম তাই বিশেষ কোনো তন্ত্র বা ইজমের অন্ধ উপাসক নয়। গণভোটের চেয়ে তার কাছে যোগ্যতার মূল্য বেশী। ইসলামে তাই যোগ্য ব্যক্তির মনোনয়নের স্থান আছে। মনোনয়ন যদি জনসাধারণ দ্বারা সমর্থিত হয়, তবে তাও এক হিসাবে নির্বাচন বলে গণ্য হবে। এই নীতিই রাসূলুল্লাহর অভিপ্রেত ছিল। মৃত্যুকালে তিনি হযরত আবুবকরকে খলিফা মনোনীত করবার ইঙ্গিত রেখে গিয়েছিলেন। হযরত আবুবকরও হযরত ওমরকে মনোনীত করে গিয়েছিলেন। সেই ওমরই ছিলেন সমগ্র ইসলাম জাহানের আদর্শ খলিফা। হযরত ওমর কাকেও মনোনয়ন দিয়ে যাননি। তিনি মজলিস-ই-শোরার হাতে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের ভার দিয়ে গিয়েছিলেন। তদনুসারে হযরত ওসমান তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হয়েছিলেন। দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয় নির্বাচন প্রথা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইসলামের ঘর ভাঙার পর্বও শুরু হলো। এই ছিদ্রপথ দিয়েই ইসলামে রাজতন্ত্র (monarchy) অনুপ্রবেশ করে এবং হযরত আলির সময়েই ইসলামের স্বর্ণযুগের অবসান ঘটে।

বস্তুতঃ গণতন্ত্র হলেই যে কল্যাণ হলো, এমন কোনো কথা নেই। বর্তমান গণতন্ত্র মেজরিটির শাসন নয়, নানা দলে বিভক্ত জনগণের একটির শাসন মাত্র। ইকবাল তাই বর্তমান গণতন্ত্রের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন না। তিনি বলেছেনঃ এই গণতন্ত্রে মানুষের মাথা শুধু গণনাই করা হয়, ওজন করা হয় না। আরও বলেছেন; দুশ গাধার মগজ একত্র করলেও একটা মানুষের মগজ (চিন্তা) তৈরি করা যায় না (আজ মগজে দোস খর ফিরে ইনসানী না মীআয়ে)। কাজেই গণতন্ত্রের প্রতি অহেতুক মোহ যেন আমাদের না থাকে। নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রই (Controlled democracy) আমাদের কাম্য। নূতন শাসনতন্ত্রে সেই বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান।

নয়া শাসনতন্ত্রের ইসলামী রূপ

অনেকে বলতে পারেন, কাজে ইসলামী হলে তবেই তো একটা রাষ্ট্র ইসলামী হবে। পাকিস্তানে বহু অনৈসলামিক বিধি-ব্যবস্থা ও ক্রিয়াকলাপ এখনও বিদ্যমান। কি করে তবে একে ইসলামী রাষ্ট্র বলা যায়।

এ এক বিকৃত ধারণা। কাজ বা ফল দেখেই যদি কোনো বস্তুর নামকরণ হয়, তবে রাষ্ট্র ও সমাজ তো দূরের কথা, ক’জন মুসলমান ধোপে টিকবে-কার্যকলাপ দেখে কি প্রত্যেক মুসলমানের নামকরণ করা হয়েছে? মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেই একটা শিশুও মুসলমান বলেই গণ্য হয়। বড় হলেই সে নামাজ, রোজা ও শরিয়তের অন্যান্য হুকুম-আহকাম পালন করবে কিনা, তা না দেখেই আদমশুমারীর পাতায় তার নাম লিখে দেওয়া হয় যে সে মুসলমান। কার্যতও দেখা যায়, বহু মুসলামানই নামাজ রোজা করে না অথচ মুসলমানদের তালিকা থেকে তাদের নাম কেউ কেটে দেয় না-এমন কি মোল্লা মৌলবীরাও না। এটা কিছু অন্যায় নয়, বরং এইটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতির রাজ্যে এই নীতিই অনুসৃত হয়। পণ্ডিতেরা যদিও বলেন, “A tree is known by its fruit”, তবু ফল ধরার আগেই কিন্তু গাছের পরিচয় হয়ে যায়। আমের চারার কলম দেখেই বলে দেওয়া যায় সেটা আমের গাছ। সেই রকম কলার পেয়া কলা না দেখিয়েই আমাদের কাছ থেকে কলাগাছের স্বীকৃতি আদায় করে নেয়।

এরূপ কেন হয়?

এর কারণ এই যে, প্রকৃতি, পরিবেশ ও অভিজ্ঞতা আমাদের জ্ঞানকে সহজ করে দেয়। অনেক কিছুই বুঝবার আগেই আমরা বুঝি। আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি অত চুলচেরা হিসাব পছন্দ করেনা। কোনো ব্যতিক্রম বা ত্রুটি থাকলে সে তা উপেক্ষা করে যায়। এই হলো প্রকৃতির নিয়ম।

ব্যক্তিগত জীবনে, সমাজ জীবনে এবং প্রকৃতিতে যখন এই নীতি ক্রিয়া করছে, তখন ইসলামী রাষ্ট্রের বেলায় তা কেন চলবে না? ব্যক্তি যদি ইসলামী হয়, সমাজ যদি ইসলামী হয়, তবে তাদের দ্বারা রচিত রাষ্ট্রও ইসলামী হতে বাধ্য; কেননা ইসলামী রাষ্ট্রের উপর যে যে বিধান প্রযোজ্য, ব্যক্তি এবং সমাজের উপরেও ঠিক সেই সেই বিধানই প্রযোজ্য। কাজেই প্রথম দুটো স্তর ইসলামী বলে সার্টিফিকেট পেলে উচ্চতর স্তরটি আপনা আপনি ইসলামী খেতাব পাবার অধিকারী হয়: কেননা রাষ্ট্র হচ্ছে সমাজেরই উচ্চতম স্তর- The highest organisation of society is the state”- Dr. Khalifa A. Hakim!

সুদ, মাদক দ্রব্য ও অন্যান্য নিষিদ্ধ বস্তুর দূরীকরণ সম্বন্ধে বলা যায় এই সব সমস্যার সমাধান কোনোদিন রাতারাতি সম্ভব হয় না। ধীরে ধীরে এর মূলোৎপাটন করতে হয়। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ ঠিক এই পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন। আন্তর্জাতিক জটিলতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিধর্মীদিগের প্রভাব ও প্রয়োজন ইত্যাদি অনেক সমস্যা এর সঙ্গে জড়িত আছে। কাজেই এই ধরনের সংস্কার কিছুটা ক্রমিক ও সময় সাপেক্ষ। মাওলানা মওদূদীর মতো কঠোর শাসনতান্ত্রিকও একথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন : “It is inevitable that the required reform should be gradual and the changes in the laws should be effected in such a manner as to balance favourably the change in the moral educational, social, cultural and political life of the nation.”

-(Islamic Law and constitution).

অনেকের ধারণা ইসলামী রাষ্ট্রের মানে হচ্ছে এমন একটা রাষ্ট্র যা স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং যেখানে ঘটেছে শরীয়তের পূর্ণ রূপায়ণ। কিন্তু এ ধারণা ভুল। ইসলামী রাষ্ট্র কোনেদিন আকাশ থেকে মাটিতে পড়বে না-একে গড়ে নিতে হবে। ফলের আশায় আমরা যেমন গাছ লাগাই এবং অনেক দিন পরে তার ফল খাই–এও তাই। পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র বললে বুঝতে হবে–আমাদের ধ্যানের পাকিস্তানকে লাভ করবার একটি প্রক্রিয়া (process) মাত্র আমরা লাভ করেছি। Cantwel Smith চমৎকার ভাবেই বলেছেন : “To achieve an islamic state was to attain not a form, but a process.’’ইসলামী শাসনতন্ত্রকেও এই আলোকেই দেখতে হবে। খুঁটিনাটি দোষত্রুটি বিচারের সময় এ নয়-মূল নীতি ও কাঠামো ঠিক রেখে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। ডক্টর খলীফা আবদুল হাকিমও এই কথা বলেন “The Islamic State shall follow a prescribed model in broad outlines; it is a system, but is an open ant not a close system.”–(Islamic Ideology)

ইসলামী রাষ্ট্র ঠিক ধর্মরাষ্ট্র (Theocracy) নয়; আধুনিক ও প্রগতিশীল হতে এর কোথাও বাধা নেই। ইজমা, কিয়াস ও ইসতিহাদ দ্বারা একে অনায়াসে যুগোপযোগী করে নেওয়া যায়। বর্তমানে শাসনতন্ত্রেও এ বিধান প্রয়োগ করা হয়েছে।

“Electoral college” দ্বারা নির্বাচন সম্পন্ন করার বিধান ও ইসলামের অনুসারী হয়েছে। গণভোট একে তো আমাদের আদর্শের বিরোধী, তার উপর এ প্রথা অনাবশ্যকভাবে ব্যয়বহুল। এক একটা ইলেকশনে সরকারের কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় হয়। এই অহেতুক অপব্যয়ের কোনো মানে হয় না। এ অর্থ অন্য কোন মহৎ কাজে অনায়াসে ব্যয় করা যেতে পারে। প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কাজ করবার তাকিদ তো কুরআনেরই নির্দেশ। আল্লাহতা’লা কুরআন শরীফে বলেছেন : “আতিউল্লাহ ওয়া আতিউর রসুলা ও ওয়া উলিল আরে মিন কুম।”

অর্থাৎ-আল্লাকে মাননা, রসুলকে মানো এবং কওমের নেতাদিগকে মানো।

কাজেই যে কোনো দিক দিয়ে বিচার করলেই দেখা যাবে আইয়ুব প্রবর্তিত এই নয়া শাসনতন্ত্র ইসলামের মূলনীতি ও আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে; কার্যগতভাবে না পেলেও আদর্শগতভাবে আমরা ইসলামী রাষ্ট্র লাভ করেছি। আর আমরা যখন ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ্য সামনে রেখেই পা বাড়িয়েছি, তখন এই অবস্থাতেও আমরা পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র বলতে পারি। Cantwell Smith-এর আরেকটি মন্তব্যও এখানে উদ্ধারযোগ্য?

“A state is Islamic in actuality if it aims at becming Islamic ideally. – (Isamic in Modern History)

অর্থাৎ-ধ্যান ধারণার ইসলামী হলেই একটা রাষ্ট্রকেও কার্যতঃ ইসলামী রাষ্ট্র বলা যায়।

আদর্শ রাষ্ট্র (Ideal state) স্থাপনের জন্য প্লেটোর সময় থেকে আজ পর্যন্ত চিন্তা ও চেষ্টার বিরাম নেই। হাজার হাজার বছর ধরে এর সন্ধানে মানুষ ঘুরে মরেছে।

Socialism, Marxism, Fascism, League of Nations, UNO ইত্যাদি কতো মতবাদ, কতো সংস্থাই না স্থাপিত হয়েছে; কিন্তু আদর্শ রাষ্ট্র কেউ আনতে পারেনি। তার একটা বড় কারণ হচ্ছে এই যে, শাসনকার্যের মূলমন্ত্র মানুষ ভুলে গেছে। আদান-প্রদানের মনোভাবই হবে সব শাসনের ভিত্তিমূল। শাসিতের উপর শাসকের শাসন দণ্ড চালাবার দিন চলে গেছে। এখন হবে সমানের উপর সমানের শাসন (“Rule of the equals over the equlas”)—অর্থাৎ শাসক এবং শাসিত উভয়কে দেশের কাজে হাত মিলাতে হবে। কুরআন শরীফে এইরূপ শাসনেরই ইঙ্গিত আছে। আল্লাহ্ বার বার তার ‘ওয়াদার’ (covenant) কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেনঃ “তোমরা তোমাদের ওয়াদা পালন করো, আমিও করবো।” এর থেকেই Roussear তার “Social contract”-এর থিওরী গ্রহণ করেছিলেন। আইয়ূব-প্রবর্তিত নয়া শাসনতন্ত্রে এই আদান-প্রদানের ভঙ্গী বিদ্যমান। কাজেই এ শাসন কুরআনের নির্দেশিত পথ ধরেই চলেছে বলে আমি মনে করি।

এক নূতন যুগের প্রবেশ দুয়ারে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি। ইসলামের সোনালী যুগের স্বপ্ন আবার আমাদের চোখে ঘনিয়েছে। আবার তার নূতন জয়যাত্রা শুরু হবে এবং সেই অভিযানে পাকিস্তান প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।

নয়া শাসনতন্ত্রকে তাই জানাই আমার আন্তরিক মুবারকবাদ।

আজাদ

মার্চ, ১৯৬২

জিন্নাহ্ হইতে কায়েদ-ই-আযম

শিশুর পিতা যেমন শিশুর অন্তরেই ঘুমাইয়া থাকে, মিঃ জিন্নাহর ভিতরে তেমনি ঘুমাইয়া ছিলেন আমাদের মহান নেতা-কায়েদ-ই-আযম। যে নির্ভীকতা, তেজস্বীতা, স্পষ্টবাদিতা, সততা ও সৎসাহস কায়েদ-ই-আযমের চরিত্রে আমরা লক্ষ্য করি সেসব গুণ মিঃ জিন্নাহর মধ্যেই রূপলাভ করিতেছিল। বস্তুতঃ মিঃ জিন্নাহ্ কায়েদ-ই-আযমেরই পূর্ব অধ্যায়। এই অধ্যায় পাঠ করিলেই বুঝা যাইবে-ভবিষ্যতের কায়েদ-ই-আযম কিভাবে ধীরে ধীরে মিঃ জিন্নাহর মধ্যে সঞ্চারিত হইতেছিলেন।

কায়েদ-ই-আযম তো একদিনে হয় না। কতো দীর্ঘ দিনের তপস্যায় লালা পুলের অন্তর-মূর্তি বিকশিত হয়। কায়েদ-ই-আযমে পৌঁছিতে মিঃ জিন্নাহকেও সেইরূপ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করিতে হইয়াছিল।

মার্বেল খেলার গলিতে কায়েদ-ই-আযমকে সর্ব প্রথম আমরা লক্ষ্য করি। ছেলেরা। ধূলায় মার্বেল খেলিতেছে। বালক জিন্নাহ্ বলিলেন- বন্ধুরা- শোনো। মার্বেল খেলা ভালো নয়। এ অতি নোংরা খেলা। হাত-পা, মুখে-চোখে ধূলা-বালি লাগে। আর বসে বসে বুড়োদের মতো খেলতে হয়। তার চেয়ে এসো আমরা ক্রিকেট খেলি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বীরের মতো খেলবো। গায়ে-হাতে ধূলা লাগবে না। পরিচ্ছন্ন সেই খেলা। মার্বেল খেলার চেয়ে ক্রিকেট খেলা শতগুণে ভালো। তাই নয় কি? কথাগুলির মধ্যে সেদিন আমরা কিশোর কায়েদের কথাই শুনিতে পাই নাই কি?

তরুণ ব্যারিষ্টার মিঃ জিন্নাহ। বোম্বে হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করিতেই তার খ্যাতি চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। অতবড় হাইকোর্টে একমাত্র সার্থক মুসলিম ব্যারিষ্টার-তাও বয়সে নবীন। কিন্তু তবু তাঁর কী বলিষ্ঠ মনোবল। বিচারপতির সামনে তিনি যখন সওয়াল-জবাব করেন, তখন তার ব্যক্তিত্বে ফুটিয়া উঠিত এক অপূর্ব দৃঢ়তা ও আত্মমর্যাদাবোধ। একবার এক জজ সাহেব জিন্নাহর কথা শুনিতে না পাইয়া বলিয়া ফেলিলেন-মিঃ জিন্নাহ্, আপনার কথা আমরা শুনিতে পাইতেছি না, একটু জোরে বলুন। (we can’t hear you, Mr. Jinnah, speak up) ইহাতে মিঃ জিন্নাহ্ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, আমি ব্যারিষ্টার, অভিনেতা নই। জজ সাহেব একটু দমিয়া গেলেন। কিন্তু জিন্নাহর কণ্ঠস্বর কিছুমাত্র উন্নীত হইল না দেখিয়া পুনরায় তিনি বলিতে বাধ্য হইলেন? Mr. Jinnah, I must ask you speak louder. মিঃ জিন্নাহ এবার উত্তর দিলেন : মিঃ লর্ড, যদি আপনি আপনার সম্মুখের স্তূপীকৃত পুস্তকগুলি সরাইয়া দেন, তবেই আপনি আমার কথা শুনিতে পাইবেন।

জজ সাহেব নিরুত্তর।

একবার একটি মামলার নথিপত্র লইয়া এক মক্কেল আসিলেন জিন্নাহর নিকটে। উদ্দেশ্য তিনি তাহাকে সেই মামলায় ব্যারিষ্টার নিয়োগ করিবেন। মক্কেল জিজ্ঞাসা করিলেন : আপনার ফি কতো?

মিঃ জিন্নাহ বলিলেন : দৈনিক পাঁচশত টাকা।

মক্কেলের আশঙ্কা হইল তাহার মামলাটি দীর্ঘদিন স্থায়ী হইবে, কাজেই দৈনিক হিসাবে ফি দিতে গেলে তাহার অনেক টাকা লাগিবে। তিনি তাই বলিলেন, আমার কাছে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা আছে। দয়া করিয়া এই টাকাটাই আপনার গোটা ফি বাবদ গ্রহণ করিবেন কি?

মিঃ জিন্নাহ পাঁচ হাজার টাকা রাখিয়া দিলেন বটে, কিন্তু ওরূপ চুক্তিতে রাজী হইলেন না। বলিলেন, দৈনিক হিসাবেই আমি ফি গ্রহণ করিব। মাত্র তিনদিন শুনানীর পরই মিঃ জিন্নাহু সেই মামলায় জয়লাভ করিলেন। তিনি তখন উক্ত পাঁচ হাজার টাকা হইতে তিন দিনের ফি বাবদ দেড় হাজার টাকা কাটিয়া রাখিয়া বাকী সাড়ে তিন হাজার টাকা মক্কেলকে ফেরৎ দিলেন। মক্কেল বিস্মিত হইয়া গেলেন।

একবার এক মক্কেল মিঃ জিন্নাহ্র কার্যে সন্তুষ্ট হইয়া তাহাকে তাহার ধার্যকৃত ফির উপরেও একটা মোটা টাকা পুরস্কারস্বরূপ পাঠাইয়া দিলেন। জিন্নাহ্ সে টাকা গ্রহণ করেন নাই। একটা চিঠি লিখিয়া তিনি টাকাটা ফেরৎ পাঠাইলেন। চিঠিতে এইরূপ লেখা ছিল? আপনি আমাকে দিয়াছেন সর্বমোট—–টাকা, তন্মধ্যে আমার ফি বাবদ পাওনা—-টাকা। বাদবাকী——টাকা ফেরত পাঠাইলাম।

মিঃ জিন্নাহর বিবাহ ব্যাপারের মধ্যেও একই দৃঢ়তা, চরিত্রবল ও সৎসাহসের পরিচয় পাওয়া যায়। বোম্বের বিখ্যাত পাশী নেতা স্যার দীনশা পেটিটের পরমা সুন্দরী কন্যা রতনবাঈকে তিনি বিবাহ করেন। এই বিবাহে কন্যার পিতার আদৌ সম্মতি ছিল না। তিনি যখন শুনিলেন রতনবাই গোপনে গোপনে জিন্নাহর সহিত বাগদত্তা (betrothed) হইয়া আছেন তখন তিনি ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন। রতনবাঈয়ের বয়স তখন মাত্র ১৭ বৎসর। তিনি তাই আইনের আশ্রয় লইয়া কন্যার এই বিবাহ বন্ধ করিতে উদ্যত হইলেন। কারণ আইন অনুসারে ১৮ বৎসর বয়স না হইলে স্বমতে বিবাহ করা যায় না। মিঃ জিন্নাহ ও রতনবাঈয়ের উপর তাই কোর্ট হইতে ইনজাংশন জারী হইল। ইনজাংশন জারী হওয়ার পর মিঃ জিন্নাহ রতনবাঈকে নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে উপদেশ দিলেন এবং নিজেও সে অনুসারে চলিলেন। নির্দিষ্ট দিন আসিলে দেখা গেল, স্যার দিনশা পেটিটের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। যে আইনের তিনি আশ্রয় লইয়াছিলেন, তাহারই বলে উভয়ে উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছেন। সুতরাং ১৯১৮ খৃষ্টাব্দের ১৯শে এপ্রিল তারিখের Statesman পত্রিকায় স্যার দীনশা এই মর্মে ঘোষণা দিতে বাধ্য হইলেন?

“Miss Rattanbai only daughter of Sir Dinshaw Petit, yesterday underwent conversion to Islam and is today to be married to the Hon. Mr. M. A. Jinnah.”

বলা বাহুল্য এই ব্যাপারেও মিঃ জিন্নাহর চরিত্র-মাধুর্য ও মনোবল উজ্জ্বল হইয়া প্রকাশ পাইতেছে। তাঁর প্রেমও মর্যাদাপূর্ণ। কোথাও কোনো বাড়াবাড়ি নাই। অশোভনতা নাই-সংযম ও শালীনতা দ্বারা সে প্রেম নিয়ন্ত্রিত। অতবড় পাশী সম্প্রদায়ের নেতা স্যার দীনশা পেটিটকেই তরুণ জিন্নাহর নিকট নতিস্বীকার করিতে হইয়াছে। জাতীয় মর্যাদাকে কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ না করিয়া সম্ভ্রমের সঙ্গেই তিনি রতনবাঈকে লাভ করিয়াছিলেন। রতনবাঈও জিন্নাহর মধ্যে এমন কিছু গৌরবজনক সম্পদ দেখিতে পাইয়াছিলেন যে, শত বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করিয়াও তিনি তাঁহাকে পতিত্বে বরণ করিয়াছিলেন। সাবালিগা না হওয়া পর্যন্ত অত্যন্ত নিষ্ঠার সহিত তিনি অপেক্ষা করিতেছিলেন। এরূপ অবস্থায় সচরাচর মেয়েদের মতি পরিবর্তন ঘটাইবার নানা প্রকার চেষ্টা করা হইয়া থাকে। অনেক সময় তাহাতে ফলও হয়। কিন্তু রতনবাঈয়ের উপর সব চেষ্টা, সব কৌশল ব্যর্থ হইয়া ফিরিয়া গেল। পরম বিশ্বস্ততার সহিত তিনি তাহার প্রতিজ্ঞা পালন করিলেন।

ব্যাপারটি ভাবিবার মতো। একে তো ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, তাহাতে যে-সে পিতা নন, ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা স্যার দীনশা পেটিট—অগাধ ধন-সম্পত্তির মালিক, রতনবাঈ তাহার একমাত্র সন্তান। সেই কন্যাকে পিতা যখন আইন দ্বারা মিঃ জিন্নাহর সহিত বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হইবার পথে বাধা দান করিলেন, তখন এ বিবাহের সম্ভাবনা শুধুমাত্র একটা ক্ষীণ আশার সূত্রে দুলিতে লাগিল। জিন্নাহ ইচ্ছা করিলে হয়তো অন্য উপায়ে রতনবাঈকে লাভ করিতে পারিতেন, কিন্তু সেপথে তিনি যান নাই। রতনবাঈয়ের আন্তরিকতার উপর নির্ক্স করিয়া তিনি তাঁহাকে স্বাধীনতা দিলেন এবং নিজে নিজের শপথে অটল থাকিয়া প্রহর গুণিতে লাগিলেন। প্রেম অন্ধ বলিয়া শোনা যায়। কিন্তু জিন্নাহর প্রেম ছিল প্রজ্ঞার আলোকে সমুজ্জ্বল।

বিবাহের কিছুদিন পরেই যে কাণ্ডটি ঘটে, তাহা আরও অপরূপ। জিন্নাহর নির্ভীকতার সে এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। সেই সময় বোম্বের গভর্ণর ছিলেন লর্ড উইলিংডন। জিন্নাহর সহিত গভর্নরের যথেষ্ট বন্ধুত্ব ছিল। গভর্নর ও গভর্নর-পত্নী নব দম্পতিকে তাই এক প্রীতিভোজে নিজ বাড়ীতে নিমন্ত্রণ করেন। তখন ছিল শীতকাল। সুসজ্জিত ডাইনিং হলে বহু নিমন্ত্রিত গণ্যমান্য ব্যক্তির সমাবেশ হইয়াছে। এমন সময় মিঃ জিন্নাহ্ সস্ত্রীক সেই হলে প্রবেশ করিলেন। গভর্নর গভর্নর-পত্নী আন্তরিকতার সঙ্গে তাহাদিগকে অভ্যর্থনা জানাইলেন। নির্দিষ্ট আসনে গিয়া উভয়ে উপবেশন করিলেন। রতনবাঈ সেদিন একটা খাটো জ্বলের গাউন পরিয়া গিয়াছিলেন। গভর্নর-পত্নী তাহা লক্ষ্য করিলেন। তিনি ভাবিলেন খাটো পোষাকের দরুন মিসেস্ জিন্নাহ শরীরের নীচের অংশে শীত অনুভব করিতেছেন। তাড়াতাড়ি তিনি একজন এডিকংকে ডাকিয়া একটা শাল আনাইয়া তাহাকে দিলেন। ইহাতে মিঃ জিন্নাহর অনুভূতি আহত হইল। তিনি সৃমনি বলিয়া উঠিলেন : মিসেস জিন্নাহ যদি শীত বোধ করেন, তবে তিনি নিজেই বলিবেন এবং নিজেই শীতবস্ত্র চাহিয়া লইবেন। এই বলিয়াই মিসেস্ জিন্নাহকে লইয়া হল হইতে বাহির হইয়া গেলেন। সেই যে গেলেন, তারপর আর কোনোদিন তিনি গরের বাড়ীতে যান নাই।

মনে হয় না কি, এই সব ঘটনার মধ্যে ভবিষ্যতের নির্ভীক ও স্পষ্টবাক কায়েদ-ই আযমই উপস্থিত ছিলেন।

মাহে-নও

ডিসেম্বর, ১৯৬৩

নয়া জিন্দেগীর আহ্বান

পাকিস্তানের নূতন শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক নূতন অধ্যায় সূচিত হবে।

বৃটিশ আমল থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত পাশ্চাত্য শাসনতন্ত্র দ্বারাই আমাদের দেশ শাসিত হয়ে এসেছে। পাশ্চাত্য প্যাটানেইর পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রই ছিল এতদিন আমাদের রাষ্ট্রীয় আদর্শ। শুধু পাক-ভারত উপমহাদেশেই নয়, বর্তমান জগতের প্রায় সর্বত্রই এই শাসন প্রথারই প্রচলন দেখা যায়। সেই গণভোট, সেই আইন-পরিষদ, সেই পার্লামেন্ট, সেই মেম্বর, সেই মন্ত্রী-সমস্তই ইউরোপীয় প্যাটার্নের। এমন কি মুসলিম জাহানের সর্বত্রই এই আদর্শে শাসনতন্ত্র রচিত হচ্ছে। আযাদী লাভের পরও পাক-ভারতে বৃটিশ নীতিতেই দেশ শাসিত হচ্ছে। এমন কি ভারতে আজ পর্যন্ত পালিয়ামেন্টারী প্রধাই চালু রয়েছে। কোনো মৌলিক পরিবর্তন সেখানে আসেনি।

সারা জগত যখন পাশ্চাত্য-শাসনতন্ত্রের মোহে মুগ্ধ হয়ে তার অন্ধ-অনুকরণ করছে, তখন একমাত্র পাকিস্তান থেকেই সর্বপ্রথম এর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ এলো। ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে যখন বিপ্লবী সরকার পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করলেন, তখন থেকেই আমরা এক নতুন পথে চলছি। এ পথ আগের সেই চলা পথ নয়; এর লক্ষ্য-আদর্শ নূতন, ধ্যান-ধারণা নূতন-যাত্রীরাও নূতন, রাহুগীরও নূতন। প্রেসিডেন্ট ফিন্ড-মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ূব খান এই নূতন পথের দিশারী।

সমগ্র জগত একদিকে-পাকিস্তান একদিকে। স্বাবলম্বনের এমন দুর্জয় প্রতিজ্ঞা খুব কম দেখা যায়। বাইরের জগতে কতো দ, কতত প্রলোভন; কতো ভয়ভীতি; কতো আকর্ষণ; সব তুচ্ছ করে আপন ঐতিহ্যে ফিরে আসবার এই শপথ নিশ্চয়ই আমাদের নূতন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। এত বড় সুঃসাহস একমাত্র ইসলামের সেই সোনালী যুগেই দেখেছি। মুষ্টিমেয় আরব-বীর যে মনোবলে বিহর্বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল, যে গভীর আত্ম-প্রত্যয়ে নূতন পথে জয়যাত্রা করেছিল, দীর্ঘদিন পরে আবার তার প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। এই নূতন বিপ্লব কতখানি সার্থক হয়েছে, কোথায় এর দোষত্রুটি আছে–আমি আজ তার বিচার করবো না। দোষত্রুটি তো থাকতেই পারে। আর প্রত্যেক নবগঠিত শাসনতন্ত্রে তা থাকেই। এতবড় যে British constitution, তাও একদিনে গড়ে ওঠেনি। হাজার বছরের ঘাত-প্রতিঘাতে এই “unwitten constitution” গড়ে উঠেছে। কাজেই সে বিচার আজ নয়। আজ শুধু শুরিয়া–আজ শুধু মুবারকবাদ, যেহেতু বিদেশী শাসনতন্ত্র থেকে আজ আমরা প্রকৃত মুক্তি লাভ করেছি। পাকিস্তানে পাশ্চাত্য প্যাটার্নের Parliamentary Democracy-র আজ অবসান ঘোষিত হচ্ছে আর তার যায়গায় কায়েম হচ্ছে আমাদের নিজস্ব গণতন্ত্র–পা জহুরিয়াত। এটা আমাদের এক বিরাট মনের আযাদী। এর মধ্যে আছে আমাদের মুক্তির আনন্দ আর সৃষ্টির উল্লাস। Boala facos 21691699 : “The slave imitates, the freeman creates.” কাজেই, এই নূতন পাক-গণতন্ত্র নিশ্চয়ই অভিনন্দনযোগ্য।

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব নূতন শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে পরিচয় দিতে গিয়ে কয়েকটি মূল্যবান কথা বলেছেন :

“It is sometimes said that no matter how good a system, it won’t work unless there are men to work it. This is partially true; but what is wholly true is this : That it is far more difficut to change a bad system than to change bad men. So, don’t let us have a weak system because of the fear that we may not find suitable men to run it.’

-“অর্থাৎ, সময় সময় বলা হয় যে, একটা নিয়মতন্ত্র যতই ভালো হোক না কেন, উপযুক্ত লোক না পেলে তা কিছুতেই কার্যকরী হয় না। একথা আংশিকভাবে সত্য, কিন্তু পুরোপুরি সত্য হচ্ছে এইঃ মন্দ লোককে পরিবর্তন করা যতো কঠিন, মন্দ পদ্ধতি পরিবর্তন করা তার চেয়ে অনেক বেশী কঠিন। অতএব উপযুক্ত লোক পাওয়া যাবে না-এই আশঙ্কায় একটা দুর্বল নিয়মতন্ত্র যেন আমরা প্রবর্তন না করি। এ হবে একটা নিরাশার যুক্তি এবং এর কাছে আমাদের কিছুতেই আত্মসর্পণ করা উচিত নয়।”

অতি সত্য কথা। ভালো লোক না পেলে যতো ভালো শাসনতন্ত্রই হোক না কেন, কার্যকরী হয় না। কিন্তু তাই বলে শাসনতন্ত্রকে তো আর দুর্বল করে গড়া যায় না। শাসনতন্ত্র যাতে আদর্শ হয়, সেই দিকে আগে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। তারপর ভালো লোক খুঁজতে হবে,-তৈরি করে নিতে হবে।

প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের আর একটি কথাও অত্যন্ত মূল্যবান। জনসাধারণের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন :

“It would be the height of stupidity if they reinforce the system that had failed. They should adopt a system which could give their country satbility. The parliamentary system could work only in countries where political parties were stable and by commanding an overwhelming majority, could give their country a stanle government.”

-“অর্থাৎ, যে পদ্ধতি ব্যর্থ হচ্ছে, তা পুনঃপ্রবর্তন করা তাদের পক্ষে হবে চরম মূর্খতা। এমন একটা পদ্ধতি তাদের গ্রহণ করা উচিত যা তাদের দেশকে স্থায়িত্ব দান করবে। পার্লামেন্টারী পদ্ধতি কেবল সেই সব দেশেই চলতে পারে যে-সব দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর স্থায়িত্ব আছে এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতার দরুন তারা দেশে স্থায়ী সরকার গঠন করতে পারে।”

এ কথা সত্যই আজ আমাদের ভেবে দেখবার সময় এসেছে যে, আমরা পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের উপযোগী কি-না। পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র ঐসব দেশেই সার্থক হতে পারে যেখানে স্থায়ী রাজনৈতিক দল আছে এবং প্রচুর সংখ্যাধিক্য (majority) দ্বারা যেখানে দলগত স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশ তো তা নয়। এখানে ব্যাঙের ছাতার মতো নূতন নূতন দল গজায়; দল নিয়ে শুধু দলাদলি, মারামারি, রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে। সুই রাজনৈতিক কোনো মতবাদ বা রাষ্ট্রদর্শন এখানে গড়ে ওঠেনি; ব্যক্তিগত এবং দলগত স্বার্থের জন্যই এখানে দল গঠন করা হয়। এ অবস্থায় পাশ্চাত্য শাসনতন্ত্রকে হুবহু এখানে নকল করতে গেলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। দেশের নাড়ির সঙ্গে যোগ রেখে, আলো-বাতাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে, জাতীয় ঐতিহ্যের দাবী মিটিয়ে এখানকার শাসনতন্ত্র রচনা করতে হবে। কাজেই, আদর্শের দিক দিয়ে এবং যৌক্তিকতার দিক দিয়ে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র যে মূলতঃ অন্য দেশের শাসনতন্ত্র অপেক্ষা খানিকটা স্বতন্ত্র হবেই- এ কথা স্বতঃসিদ্ধ। আরও একটি বিশেষ কথা এইঃ দল যেখানে বেশী, গণতন্ত্র সেখানে অচল। গণতন্ত্রের গোড়ার কথা হলো সংখ্যাধিক্যের শাসন (rule of the majority)। কিন্তু যে দেশ বহু দলে বিভক্ত, সে দেশের ভোটাভুটিতে মেজররিটিই বা কারা, আর মাইনরিটিই বা কারা বুঝা কঠিন। সে প্রশ্ন অবান্তরও বটে। ধরুন, একটি কেন্দ্রে ১০,০০০ ভোটার; সেখানে ১০টি রাজনৈতিক দল থেকে ১০জন প্রাথী। ভোট ভাগাভাগি হয়ে একজন প্রার্থী মাত্র ১,৫০০ (কিংবা তার কিছু বেশী-কম) ভোট পেয়েই ইলেকশনে জয়লাভ করতে পারে। কিন্তু গোটা ভোটদাতাদের তুলনায় ১,৫০০ তো সামান্য একটা মাইনরিটি মাত্র। অথচ দলের আধিক্য বশতঃ তারাই সেখানে মেজরিটি! এর নাম কি গণতন্ত্র?

মাথা-গুনতির এই গণতন্ত্র ইসলাম সমর্থনও করে না। এ গণতন্ত্র শুধু secular state-এর জন্যই উপযোগী। পাশ্চাত্য গণতন্ত্রে প্রতিটি মানুষকে ভোটাধিকার দেওয়া হয়, তার কারণ আছে। সেখানকার রাষ্ট্রদর্শনের মূল নীতিই হলো? “sovereignty belongs to the people.” অর্থাৎ সার্বভৌমিক ক্ষমতা গণ-মানুষের হাতে। সেইজন্য কোনো মেম্বর বা প্রেসিডেন্টকে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে চূড়ান্ত সমর্থন চাইতে হয় গণ-মানুষের কাছে। কিন্তু ইসলামের রাষ্ট্রনীতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ইসলামের সার্বভৌমিকতা মানুষের হাতে নয়–আল্লাহর হাতে। ইসলাম বলে? “Sovereignty belongs to Allah.” কাজেই পাকিস্তানকে আমরা ইসলামী স্টেটও করতে চাইব, আবার secular state এরও আইন-কানুন মেনে চলবো-এ কোনো যুক্তি নয়।

ইসলামী রাষ্ট্র এখন গঠনের মুখে। এর জন্য কোনো বিধিবদ্ধ আইন-কানুন নেই। একে এখন সুষ্ঠভাবে আমাদের গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু এ কাজ সহজ নয়। কোনো দেশের কোনো শাসনতন্ত্রই একদিনে নিখুঁত হয়নি। Ideal state বা আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন আজকার নয়, প্লেটো-এরিস্টটলের সময় থেকেই এই ধ্যান মানুষের মনে জেগে আছে। এরপর মধ্যযুগে Locke, Hume, Hobbs, Roussseau, Voltaire প্রভৃতি বহু রাজনৈতিক দার্শনিক এ ভিষয়ে বহু আলোকপাত করেছেন। অবশেষে উনবিংশ শতাব্দীতে কালমার্টের হাতে রাষ্ট্রদর্শনের এক নবরূপায়ণ ঘটেছে। কিন্তু এখানেও এর শেষ হয়নি। বর্তমান যুগেও Harold Laski, Bertrand Russel, Bernard Shaw সমুখ অসংখ্য লেখক রাজনৈতিক দর্শনের উপর বহু গ্রন্থ লিখেছেন। সর্বশেষ প্রচেষ্টা United Nations Organisation (UNO-তে এসে পৌঁছেছে। আদর্শ সুন্দর কোনো রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা এখানেও যে সার্থক হয়ে ওঠেনি, একথা সকলেই জানেন।

অবস্থা যখন এই, তখন নবগঠিত পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র যে নিখুঁত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে, সে আশা করা যায় না। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সাথে সাথে এরও উন্নতি ও পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী! দেশবাসীর এখন উচিত এই নৃতন প্রচেষ্টাকে সর্বপ্রকারে সার্থক করে গড়ে তুলতে সাহায্য করা। চিন্তাশীল উলেমা, রাজনীতিক, কবি-সাহিত্যিক, কর্ম, ছাত্র প্রত্যেকেরই সাহায্যের প্রয়োজন আছে। তারা এগিয়ে আসুন এবং সুন্দর, সুখী ও স্থিতিশীল পাকিস্তান গড়ে তুলবার গৌরবময় ভূমিকায় অংশ গ্রহণ করুন।

মাহেনও

মার্চ, ১৯৬২

আমরা কেন স্বতন্ত্র নির্বাচন চাই

স্বতন্ত্র নির্বাচনের স্বপক্ষে অনেক যুক্তি-প্রমাণ দেওয়া হইয়াছে। পাকিস্তানের বর্তমান শাসন-ব্যবস্থায় যুক্ত-নির্বাচন প্রবর্তিত হইলে মুসলমানদের কী কী ক্ষতি হইতে পারে এবং কেমন করিয়া কোন পথ দিয়া সেই ক্ষতি আসিতে পারে দূরদর্শী রাজনৈতিক চিন্তাবিদেরা তাহা বিশ্লেষণ করিয়া দেখাইয়াছেন। আমি সেই দিক দিয়া আজ কোনো কথা বলিব না। আমাদের জাতীয় লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও আদর্শের দিক দিয়াই আজ এ বিষয়ের উপর কিছুটা আলোকপাত করিব।

একথা সকলেই জানেনঃ টু-নেশন থিওরীর উপরেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। এই নীতির প্রবর্তক কায়েদ-ই-আযম কিন্তু কায়েদ-ই-আযম নিজে এ-নীতি উদ্ভাবন করেন নাই। চৌদ্দশত বৎসর পূর্বেই এ নীতি জগতে বিঘোষিত হইয়াছে। দ্বিজাতিত্বের ভিত্তির উপরেই ইসলামিক সমাজ ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা গড়িয়া উঠিয়াছে। উহা আল্লারই বিধান। কুরআন উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছে : “ইন্নামাল মুমিনুনা ইখওয়াতুন” (মুসলমানেরা এক জাতি)-এই কথা বলিলে স্বাভাবিক ভাবেই দুই জাতির কথা আসিয়া পড়ে। মুসলমানেরা যদি এক জাতি হয়, তবে অবশিষ্ট যাবতীয় অ-মুসলমানেরাও আরেক জাতি হইয়া দাঁড়ায়। ইহার উপরেও রাসূলুল্লাহ বলিয়াছেনঃ “আল-কুফরো মিল্লাতাও ওয়হেদা” (অবিশ্বাসীরা এক জাতি)। তাহা হইলে কুরআন ও হাদিস উভয়ের দ্বারাই দ্বি-জাতিততু স্বীকৃত ও প্রতিপন্ন হইতেছে।

ইহাই হইল দ্বি-জাতিতত্বের গোড়ার কথা। যাহারা মনে করেন কায়েদ-ই-আযম গোঁড়ামী করিয়া সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বশে ভারতের হিন্দু-মুসলমানকে দুই স্বতন্ত্র জাতিতে বিভক্ত করিয়া গিয়াছেন, তাহারা ভ্রান্ত। টু-নেশন-থিওরী কায়েদ-ই-আযমের মনগড়া রাজনৈতিক মতবাদ নয়, ইসলামের গভীর সত্যের এ বাস্তব উপলব্ধি।

এখন, কথা হইতেছে, মুসলমানদিগকে আল্লাহ স্বতন্ত্র জাতি রূপে কেন ঘোষণা করিলেন। ইহারও কারণ আছে। কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদ-বুদ্ধি বা জাতি-বিদ্বেষের কথা এর মধ্যে নাই। বৃহত্তর মানবকল্যাণের জন্যই মুসলমানদিগকে পৃথক বা স্বতন্ত্র জাতি রূপে চিহ্নিত করা হইয়াছে।

তওরাত, যবুর এবং বাইবেল যাহারা পড়িয়াছেন, তাহারা একটা কথার সহিত নিশ্চয়ই পরিচিত হইয়াছেন। সে কথাটি হইতেছেঃ “covenant” অর্থাৎ চুক্তি বা একরারনামা। কুরআন শরীফেও বহু স্থানে এ কথার উল্লেখ আছে। আল্লাহ্ ইহুদী ও খৃষ্টান জাতির সঙ্গে বারে বারে চুক্তি-সম্পাদন করিয়াছেন। চুক্তিতে এইরূপ বলা হইয়াছে যে, ইহুদীরা ও খৃষ্টানেরা যদি আল্লাহকে প্রভু বলিয়া মানে এবং তাহার বিধান অনুযায়ী চলে, তবে আল্লাহও তাহাদের উপর নানা অনুগ্রহ বর্ষণ করিবেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বারে বারে ওয়াদা করিয়াও ইহুদী ও খৃষ্টানেরা সে ওয়াদা রক্ষা করে নাই। (দেখুন : সুরা মারদার ১২-১৪ আয়াত) আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, তার হুকুমাত (হুকুমাতে ইলাহিয়া) জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। পাদ্রীদের মুখেও এই “Kingdom of God” বা “Kingdom of Heaven” এর কথা শোনা যায়। কিন্তু আল্লাহ্ পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছেন ইহুদী বা নাসারাদের হাতে আল্লাহর রাজ্য দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় নাই বা হইবার আশা নাই। আল্লাহর শর্ত এমন কিছু কঠিনও নয়। আল্লাহর একত্ব ও প্রভুত্ব স্বীকার এবং মানুষকে সমঅধিকার দান-এই সহজ স্বীকৃতির উপরেই ‘স্বর্গরাজ্য’ কায়েম হইতে পারিত। কিন্তু বনি-ইসরাঈল গোষ্ঠী দুইটি শর্তের একটিও পালন করে নাই। আল্লাহকে তাহারা অস্বীকার করিয়াছে, আল্লাহর নবীদিগকে হত্যা করিয়াছে, আল্লাহর বাণীকে বিকৃত করিয়াছে, পক্ষান্তরে মানুষের উপরেও তাহারা অকথ্য জুলুম করিয়াছে এবং পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ ও পার্থক্যের দেওয়াল তুলিয়া দিয়াছে। খোদাদ্রোহিতা এবং মানব-বিদ্বেষ তাহাদের রক্তে মিশিয়া আছে। এই মনোভাব লইয়া কেহই কোনোদিন জগতে কোনো আদর্শ-ভিত্তিক রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিতে পারে না। মুনাফেকী ও শঠতা কোনোদিন জয়যুক্ত হয় না। বলা বাহুল্য, ইহুদী ও খৃষ্টান-জগতের কোনো রাষ্ট্র বা সমাজ-ব্যবস্থাই তাই কোনো কালেই সফল হয় নাই। মানবজাতির কোনো কল্যাণই তাহারা সাধন করিতে পারে নাই। প্রাচীন গ্রীসে সক্রেটিস ও প্লেটো “Ideal state” বা আদর্শ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন; সেই হইতে আরম্ভ করিয়া মধ্যযুগে রুশো, ভল্টিয়ার, ল, হিউম প্রমুখের সমাজ-তন্ত্রবাদ, পরবর্তী কালের ফ্যাসিবাদ ও সমূহবাদ (কমিউনিজম) এবং অতি আধুনিক যুগের লীগ অব-নেশনস ও ইউ-এন-ও প্রতিষ্ঠান-সবকিছুর ইতিহাসই ব্যর্থতা ও ধোকাবাজির ইতিহাস। জগতে আজ পর্যন্ত ইহারা স্বর্গরাজ্য স্থাপন করিতে পারে নাই, পারিবেও না।

বনি-ইসরাইল শাখা ব্যর্থ হইয়াছে। কিন্তু বাকী আছে বনি-ইসমাইল শাখা। হযরত ইব্রাহিম এবং ইসমাইলের সঙ্গেও আল্লাহ চুক্তি সম্পাদন করিয়াছিলেন এবং সে চুক্তি এখনও বলবত আছে। আল্লাহর হুকুমাত প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর-খলিফা (Vicegerent) দুনিয়ায় অবতীর্ণ হইয়াছে, সে হুকুমাতের বিধিবদ্ধ আইন-কানুন (আল কুরআন) জারি হইয়াছে, সে স্বর্গরাজ্যের রাজধানীও (মক্কা) সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানবতা তাই ব্যাকুল আগ্রহে এই স্বর্গরাজ্যের প্রতি চাহিদা আছে। এই শাসনতন্ত্রেই বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত মানুষ তার হারানো অধিকার ফিরিয়া পাইবে। নূতন নূতন মতবাদে মানুষের মন এখন বিরক্ত ও ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে, ইসলামী রাষ্ট্রের কাছে তাই তাহারা শান্তির আশা করিতেছে।

পাকিস্তান এই ধ্যান-ধারণা ও আশা-আকাখারই প্রতীক। আজ তাই পাকিস্তানকে “ইসলামিক রিপাবলিক” বলিতে আমাদের কোনো লজ্জা নাই, সংকোচ নাই। জগত জোড়া নিরাশার মধ্যে কপালে লেবেল আঁটিয়াই পাকিস্তান আজ ইসলামী রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। মোহামেডান স্পোটিং’-এর মতো তাজমহলের মতো আপন শ্রেষ্ঠত্ব ও চমত্তারিত্ব দিয়াই প্রকাশ্য প্রতিযোগিতায় সে আজ বহির্বিশ্বের শ্রদ্ধা কুড়াইবে।

মুসলমান তাই স্বতন্ত্র একটি জাতি। এই স্বাতন্ত্রের অর্থ সংকীর্ণতা নয়, এটা তার বৈশিষ্ট্যের পরিচয়। অপর সকলের দ্বারা যাহা সম্ভব হয় নাই, মুসলমানের দ্বারা তাহা সম্ভব হইবে-এই জন্যই সকলের মধ্য হইতে তাহাকে পৃথক করিয়া আনা হইয়াছে। মুসলমানকে এই স্বতন্ত্র রূপ কেন দেওয়া হইয়াছে, সে সম্বন্ধে আল্লাহ কুরআন-শরীফে কি বলিতেছেন দেখুন :

“ওয়া ফাযা-লিকা জা-আনা-কুম উম্মাতাও ওয়াসাতা”——–

অর্থাৎ : আমি তোমাদিগকে মহান জাতিরূপে গড়িয়া তুলিয়াছি, যাহাতে তোমরা আমার বাণী অপর সকলের নিকট পৌঁছাইয়া দিতে পারো”… (২: ১৪৩)

অন্যত্র বলিতেছেন:

“কুনতুম্ খায়রা-উম্মাতি উখরিজাত লিন্নাসে তা”মুরুনা বিল মারুফে”….

অর্থাৎ : মানব কল্যাণের দিক্ দিয়া তোমাদিগকেই আমি শ্রেষ্ঠ জাতি বলিয়া নির্ধারিত করিয়াছি; যাহা ভালো তাহাই তোমরা সকলকে করিতে নির্দেশ দিবে, যাহা মন্দ তাহা করিতে নিষেধ করিবে এবং আল্লাহতে বিশ্বাস রাখিবে।….(৩: ১০১)

মুসলমানেরা যে কেন স্বতন্ত্র জাতি, এইখানে তাহার সন্ধান মিলিবে। একটা বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্যই তাহাদিগকে স্বতন্ত্র হইতে হইয়াছে। বলাবাহুল্য, এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই তাহাদের তাহজিব-তমদুনও স্বতন্ত্র হইয়াছে। কাজেই কায়েদ-ই-আযম যে বলিয়া গিয়াছেনঃ “আমরা স্বতন্ত্র একটি জাতি এবং আমাদের কালচারও স্বতন্ত্র”- এ কথা অতি সত্য।

আজ জগত ভৌগলিক স্বাদেশিকতার আদর্শে অভিশপ্ত হইয়া আছে। যে যেখানে জন্মগ্রহণ করিয়াছে সে শুধু সেখানকার কথাই ভাবিতেছে। দেশ-প্রাচীরের বাইরে যেসব মানুষ আছে, তাহাদিগকে সে আর ভাই বলিয়া কাছে ডাকিতে পারিতেছে না। ভৌগলিক সংলগ্নতা (Geographical contignity) না থাকিলে এক-ধর্মাবলম্বীদিগকেও একই জাতি বা স্টেট বলিয়া স্বীকার করা সম্ভব হইতেছে না। ইউরোপীয় রাষ্ট্র-দর্শন তাই মানব জাতিকে শতধা খণ্ডিত করিয়া ফেলিয়াছে। ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থের সংঘাতে পৃথিবীর আকাশ-বাতাস আজ মুখরিত। একমাত্র ইসলামই আজ প্রচলিত রাষ্ট্র-দর্শন ও সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নূতন আদর্শ তুলিয়া ধরিয়াছে। দেড়হাজার মাইল দূরবর্তী দুইটি দেশ লইয়াও যে একটি রাষ্ট্র বা জাতি গঠিত হইতে পারে, পূর্ব ও পশ্চিমকে যে এক নিশানের তলে মিলানো যাইতে পারে-ইসলামই তাহা জগতকে দেখাইয়াছে। এক নূতন রাষ্ট্র দর্শনের পরীক্ষা বা experiment চলিয়াছে পাকিস্তানে। এ আদর্শ সফল ও কার্যকরী হইলে ইহা বহির্বিশ্বের দিকে দিকে বিস্তৃত হইয়া যাইবে। কালে কালে এই পাকিস্তানের আদর্শেই একটা বিশ্ব-গভর্নমেন্ট (Global Government) স্থাপিত হইবে এবং প্রত্যেক জাতির ন্যায্য অধিকারই সেখানে স্বীকৃত হইবে। এক-পৃথিবীর (One world)-এর স্বপ্ন আজ আমাদের চোখে ঘনাইয়া আসিয়াছে। সেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপদান করাই হইবে পাকিস্তানের অনাগত দিনের প্রধান ভূমিকা; কারণ তাহার সামনে আছে এক পৃথিবী ও এক মানব জাতির আদর্শ :

“কানান্নাসা উম্মাতাঁও ওয়াহেদা”

অর্থাৎ : সমগ্র মানবমণ্ডলী এক জাতি।

এই নূতন চিন্তা ও নূতন আদর্শের সূত্র ধরিয়া বহু সংঘর্ষের পর আমরা পাকিস্তান লাভ করিয়াছি। নিতান্ত দুঃখের বিষয় কায়েদ-ই-আযমের মৃত্যুর কয়েক বৎসর পরই আমাদের মধ্যে একদল লোক সেই পুরাতন পদ্ধতি ও আদর্শের মধ্যে ফিরিয়া যাইতে চাহিতেছে। সুদূর ভবিষ্যতের চিন্তা না করিয়া, নিজেদের গুরু দায়িত্বের কথা না ভাবিয়া, বৃহত্তর মানবকল্যাণের প্রতি লক্ষ্য না রাখিয়া অন্ধ আবেগে অথবা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য তাহারা যুক্ত-নির্বাচন চাহিতেছে। যুক্ত-নির্বাচন-নীতি গ্রহণ করিলে যে পাকিস্তানের মূল নীতিরই বিরোধিতা করা হয়, পাকিস্তানের মূলনীতি অস্বীকার করিলে যে পাকিস্তানকে টিকাইয়া রাখিবার আর কোনো যৌক্তিকতা থাকে না এবং পাকিস্তান গেলে যে সেই সঙ্গে আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের প্রদত্ত বিধানকেও মিটাইয়া দেওয়া হয়, একথা বলিয়া বুঝাইবার . প্রয়োজন রাখে না। ইহা দ্বারা শুধু যে পাকিস্তানই ধ্বংস হইবে তাহা নহে, সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব মানুষের এক চরম দুর্দিনও ঘনাইয়া আসিবে।

পাকিস্তান আজ ইসলামী রাষ্ট্র। এর লক্ষ্য ও আদর্শের রূপদানের জন্য তাই চাই আমরা একদল যোগ্য মুসলমান। বিরুদ্ধ ধ্যান-ধারণা ও ভিন্ন আদর্শের পূজারীদের সহযোগিতায় এ-রাষ্ট্র চালাইতে গেলে গণমানুষের মুক্তির পথ অনির্দিষ্ট কালের জন্য রুদ্ধ হইয়া যাইবে।

ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র (secular state) ভারতে যুক্ত-নির্বাচন প্রথার ফলাফল আমরা লক্ষ্য করিতেছি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সেখানে লাগিয়াই আছে, মুসলিমদিগের শুদ্ধিকরণ সেখানে অবাধে চলিতেছে, বহুভাবে মুসলমানেরা সেখানে নির্যাতিত হইতেছে। ঠিক তাহারই পাশে ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্বিঘ্নে তাহাদের ধর্ম-কর্ম পালন করিতেছেন। এই শান্তি ও নিরাপত্তাই হইবে আমাদের লক্ষ্য। যুক্ত-নির্বাচন দ্বারা যদি অশান্তির আগুন জ্বলে, তবে সে যুক্ত-নির্বাচন দিয়া আমরা কি করিব?

আজ এই কঠিন জাতীয় দুর্দিনে দলনির্বিশেষে সমস্ত মুসলমানকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাইঃ তাঁহারা এই ব্যাপারে একমত হউন। মানুষকে তাহার ন্যায্য অধিকার দিবার জন্য পাকিস্তান এক নূতন রাষ্ট্রতন্ত্র গঠন করিয়া জগতকে চ্যালেঞ্জ দিয়াছে। ইহা কোনো সাম্প্রদায়িক অভিযান নয়; মানবতার মুক্তির অভিযান। কে আছো যুবক, কে আছো তরুণ, কে আছে আদর্শবাদী, কে আছো স্বাপ্নিক কায়েদ-ই-আযমের মতো স্বতন্ত্র হইবার দুর্জয় সৎসাহস ও গভীর আত্মপ্রত্যয় লইয়া সামনে আসিয়া দাঁড়াও। নূতন পৃথিবী তোমাদের মুখের দিকে চাহিয়া আছে।

শান্তিনগর, ঢাকা

মার্ক-ইজম্ কি বাঁচিয়া আছে?

কোনো একজন সুরসিক লেখক বলিয়াছেন : “All isms have become wasms” (অর্থাৎ সমস্ত ইজই এখন বাসি হইয়া গিয়াছে) মার্ক-ইজম সম্বন্ধেও কি তাই?

কমিউনিজমের বুনিয়াদ হইল মার্কস্-ই। কমিউনিজমের যুক্তি, দর্শন ও অঙ্গীকার সমস্তই মার্কসের। কমিউনিস্ কেন আসিবে, কেমন করিয়া পুঁজিবাদের পতন হইবে, কমিউনিজম প্রবর্তিত হইলে মানুষের কি কি সুখ-সুবিধা ঘটিবে, ইত্যাদি বিষয় সম্বন্ধে মার্ক বহু যুক্তি-প্রমাণ ও ভবিষ্যৎবাণী রাখিয়া গিয়াছেন। সেই সব প্রমাণ ও অঙ্গীকারে বিশ্বাস করিয়াই রাশিয়ার বলশেভিকরা নিজ দেশে কমিউনিজমের প্রতিষ্ঠা করে। আজ ত্রিশ বৎসরেরও উকাল হইতে রাশিয়ায় কমিউনিজ চলিতেছে। মার্কসের সমস্ত থিওরী সেখানে পরিলক্ষিত হইয়াছে। কাজেই আমরা এখন দেখিতে চাই : মার্কসের মতবাদ ধোপে টিকিয়া গিয়াছে কি না; অন্য কথায় মার্কস্বাদ এখনও বাঁচিয়া আছে কি না।

(১) মার্কস্ চাহিয়াছিলেন ঈশ্বরহীন ধর্মহীন ও শ্রেণীহীন সমাজ। ধর্মকে তিনি আফিম (oplum of the people) বলিয়া নির্বাসন দিয়াছিলেন। কিন্তু মার্কসের এই আশা সফল হয় নাই। ধর্মভাব মানুষের মনের সহজাত একটি বৃত্তি। সেই স্বভাবধর্মের বিরুদ্ধতা করিয়া মানুষ বেশীদিন টিকিয়া থাকিতে পারে না; একটা প্রতিক্রিয়া আপনা আপনিই দেখা দেয়। সোভিয়েট রাশিয়াতেও তাহাই ঘটিয়াছে। নির্বাসিত ধর্ম দিনে দিনে আবার ফিরিয়া আসিতেছে; গীর্জাতে আবার লোকেরা যাওয়া-আসা করিতেছে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলির তো কথাই নাই। সোভিয়েট রাশিয়া হইতে সহস্র মুসলমান এখনো প্রতি বৎসর মক্কা-শরীফে হজ করিতে যায়। সোভিয়েট রাশিয়া এই জন্যই ধর্ম সম্বন্ধে তাহাদের নীতির পরিবর্তন করিয়াছে; এখন সে অনেকটা ধর্মের স্বাধীনতা দিয়াছে। ধর্ম এখন সেখানে একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার।

অপর দিক দিয়াও মার্কসের এই অধর্মের অভিযান সফল হয় নাই। এক ধর্মকে তাড়াইতে গিয়া আর এক ধর্মের ভূত আসিয়া কমিউনিস্টদের ঘাড়ে চাপিয়াছে। কমিউনিস্টদের নিকট এখন মার্কই হইতেছেন ঈশ্বর এবং মার্কসবাদ বা কমিউনিজমই হইয়াছে তাহাদের ধর্ম। মার্কসের ক্যাপিটালকে (Das Kapital) কমিউনিস্টরা একটা প্রেরণাপূর্ণ, অবতীর্ণ ও অব্যর্থ গ্রন্থ (“revealed, inspired and infallible”) বলিয়া মনে করে এবং এই জন্যই ক্যাপিটাল’কে শ্রমিকদিগের বাইৰেল’ বলা হয়। খৃষ্ট ধর্মের অন্যান্য ক্রিয়াকলাপ ও অনুষ্ঠানের সহিতও এই নূতন ধর্মের অবিকল মিল আছে। খৃষ্টধর্মে অবিশ্বাসীদিগকে যেমন পুড়াইয়া মারিবার ব্যবস্থা (inguisition) ছিল, কমিউনিজমে অবিশ্বাসীদিগকেও তেমনি ভাবে হত্যা করা হইয়াছে। iljin নামক জনৈক লেখকের “The world on the Brink of the Abyss” গ্রন্থ হইতে জানা যায়? কমিউনিজমকে স্বীকার না করার অপরাধে অথবা কমিউনিজম-বিরোধী কোনো কাজে লিপ্ত থাকিবার কোনোরূপ সত্য বা অমূলক সন্দেহে বলশেভিকরা মোট ১,৮৬০,০০০ লোককে হত্যা করিয়াছে, তন্মধ্যে ২৮ জন বিশপ, ১২০০ জন পাদ্রী, ৬০০০ জন শিক্ষক, ৬৮০০ জন ডাক্তার, ১১২০০০ জন শ্রমিক এবং ৮১৫,০০০ জন কৃষক (Economics of Islam : P.80)। খৃষ্টানদের যেমন Rome, কমিউনিস্টদের তেমনই Kremlin. এইরূপে খৃষ্ট ধর্মের যাবতীয় ভূতই এখন কমিউনিস্টদের ঘাড়ে চাপিয়া ধর্মকে তাড়াইবার অপচেষ্টার প্রতিশোধ লইতেছে! স্বভাবের নিকট মার্কসবাদ এইরূপে পরাজিত হইয়াছে।

(২) পুঁজিবাদকে তুলিয়া দিয়া দেশে পূর্ণ সাম্যবাদ স্থাপন করাই ছিল কমিউনিজমের প্রধান অঙ্গীকার। উহার মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের সমস্ত শিল্পকে জাতীয়করণ (Nationalized) করিয়া দেশবাসীর অর্থ-বৈষম্যকে দূর করা এবং সর্বপ্রকার শ্রেণী বিভাগ তুলিয়া দিয়া সকলকেই সমঅধিকার দান করা। স্টেট (State) অথবা ডিক্টেটরশিপ (Dictatorship) প্রতিষ্ঠাও কমিউনিজমের আসল উদ্দেশ্য ছিল না। সর্ব সাধারণই হইবে দেশের মালিক, ডিক্টেটর নয়, স্টেটও নয়- ইহই ছিল তাহাৰ আদিম পরিকল্পনা। তবে যেহেতু এই চরম সাম্য রাতারাতি আনা যায় না, তাই সাময়িক ব্যবস্থা হিসাবেই ডিক্টেটর ও স্টেটের প্রয়োজন হইয়াছিল। কথা ছিলঃ লোকেরা যখন সাম্যবাদের আদর্শ পুরাপুরি গ্রহণ করিতে পারিবে তখন এই ডিক্টেটরশিপ এবং স্টেট-দুইই উড়িয়া যাইবে (The state will wither away”-Lenin)। আবার একথাও ছিল যে, ডিক্টেটর যিনি হইবেন, তিনি জনসাধারণের প্রতিনিধি রূপেই দেশ শাসন করিবেন-স্বাধীন ভাবে বা স্বেচ্ছাচারীরূপে নয়। পূর্ণ সাম্য প্রতিষ্ঠিত হইলে সাম্যনীতিও পরিবর্তিত হইবে। এখন যেমন যোগ্যতা অনুসারে প্রত্যেকের মজুরী বা ব্যয়-বরাদ্দ করা হয়, তখন আর স্রূেপ হইবে না। তখন যাহার যাহা প্রয়োজন হইবে, সে তাহাই পাইবে। (From each according to his capacity to his need” ইহাই হইবে চরম সাম্যের মূলমন্ত্র।

কিন্তু এই ৩০ বৎসরের সাধনার পর আমরা সোভিয়েট রাশিয়ায় কি দেখিতেছি? স্টেট বা ডিক্টেটরশিপ কি ধীরে ধীরে উঠিয়া যাইবার অবস্থায় আসিয়াছে? প্রয়োজন অনুযায়ী সবই পাইব–এমন অবস্থা কি সম্ভব হইয়াছে? কখনোই না। বরং উল্টা ফলই ফলিয়াছে। স্টেট উঠিয়া যাওয়া তো দূরের কথা, ডিক্টেটরই এখন সর্বেসর্বা। ডিক্টেটরের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া তো দূরের কথা, ডিক্টেটরই এখন সর্বময় কর্তা। লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিন সেই যে রাশিয়ার ভাগ্য-বিধাতা হইয়াছেন, আর সেখান হইতে তাহার সরিবার কোনো মতলব নাই।

সাম্যবাদের মূলনীতি ছিলঃ Power must not be concentrated in the hands of an individual” (অর্থাৎ এক হাতে কিছুতেই যেন শক্তি কেন্দ্রীভূত না হয়), কিন্তু স্ট্যালিন সমস্ত শক্তি নিজের হাতে লইয়া এই নীতির মর্যাদা রক্ষা করিতেছেন। ডিক্টেটর পদ হইতে তাহাকে হটায়, এমন শক্তিমান পুরুষ আজ সোভিয়েট রাশিয়ায় নাই।[১]

[১. রাশিয়ায় এখন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছে। আলেক্সি কেসিপিন বর্তমানে রাশিয়ার এখান; কিন্তু তিনি পার্টিপ্রধান নন।]

রাশিয়ায় প্রেরিত আমেরিকার ভূতপূর্ব রাজদূত Joseph E. Davies তাহার Mission to Moscow নামক পুস্তকে লিখিয়াছেন।

“The Government is a Dictatorship, not of the proletariat, as professed, but over the proletariat. It is completely dominated bu one man.”

অর্থাৎ : সোভিয়েট রাশিয়া ডিক্টেটরশিপ প্রচলিত; ডিক্টেটর এখন আর পূর্ব প্রতিশ্রুত শ্রমিক সাধারণের ডিক্টেটর নহেন, এখন তিনি শ্রমিক সাধারণের উপরে ডিক্টেটর। এটা সম্পূর্ণরূপে একজন লোকের কর্তৃত্বাধীন।

বস্তুত, সোভিয়েট রাশিয়াকে এখন আর সাম্যবাদী বলা চলে না। নামে না হইলেও, কাজে এখন সে পুরাদস্তুর সম্রাজ্যবাদী বাফ্যাসিবাদী। সোভিয়েট রাশিয়া এখন প্রকৃতপক্ষে Britsh Commonwealth-এরই অনুরূপ। অথবা ইহাকে সম্পূর্ণ এক নূতন ধরনের রাষ্ট্র আদর্শও বলা যায়। Mr. Masani ঠিকই বলিয়াছেন?

“Actually a third variety of State is not only possible, but is already coming to existence, and one of the countries where you can see it to-day is Russia.”-Socialism Re-considered : P. 28.

(৩) কমিউনিস্টদের প্রস্তাবনা ছিল শুধু রাশিয়াতে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত করিয়াই তাহারা সন্তুষ্ট থাকিবে না, অন্যান্য দেশেও তাহারা নিজেদের মতবাদকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিবে এবং ইহার জন্য প্রয়োজন হইলে তাহারা বিপ্লব ও রক্তপাতও ঘটাইবে। এই উদ্দেশ্যের বশবর্তী হইয়াই তাহারা মস্কোতে Communist International বা Comintem স্থাপন করিয়া রাখিয়াছিল। ইহা একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন বিশেষ।

এই কমিনটার্ণ ছিল অন্যান্য নন্-কমিউনিস্ট দেশের পক্ষে মস্তবড় এক বিভীষিকা। আশ্চর্যের বিষয়, গত ১৯৪৩ খৃষ্টাব্দের শেষ ভাগে স্ট্যালিন এই comintem ভাঙ্গিয়া দিয়াছেন। ফলে জোর রিয়া ভিন্ন দেশে কমিউনিজম চালাইবার সিদ্ধান্ত পরিত্যক্ত হইয়াছে। Comintern-এর পরিবর্তে এখন Cominforn স্থাপিত হইয়াছে। ইহা আত্মগঠনমূলক, আক্রমণমূলক নয়। সাম্রাজ্যবাদী অন্যান্য শক্তির সহিত মৈত্রী স্থাপন না করিলে সোভিয়েট রাশিয়ার চলে না; তাই বাধ্য হইয়া সে তাহার মূলনীতি পরিত্যগ করিয়াছে। সাম্রাজ্যবাদের সহিত এইখানে কমিউনিজমের আপোষ হইয়াছে।

(৪) মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (historical materialism)-ও বাস্তবশুন্য নিছক কল্পনা। মাকস্ বলেনঃ জগতের ইতিহাস শ্রেণী সংঘর্ষেরই ইতিহাস। (“The history of all hitherto existing societies is the history of class struggles.”) আযাদ ও গোলামে, ধনিক ও শ্রমিকে, জালিম ও মজলুমে-যুগে যুগে চলিয়াছে অবিশ্রান্ত সংঘর্ষ (uninterrupted struggle) তারই ফলে দেশে দেশে রচিত হইতেছে ইতিহাস। কিন্তু মার্কসের এই থিওরি জগতের ইতিহাস সমর্থন করে কি? নিশ্চয়ই না। দাস-মুক্তির ইতিহাসের কথাই ভাবুন। মার্কসের থিওরি অনুসারে যুগে যুগে দাসেরা করিয়াছে মনিবদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং তাহারই ফলে লাভ করিয়াছে তাহারা আযাদী। কিন্তু ঐকথা একেবারে মিথ্যা। দাসেরা যুদ্ধ করিয়া নিজেদের মুক্তি আনে নাই। মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা) এবং লিঙ্কন প্রমুখ উদারমনা মহদ্ব্যক্তিদের চেষ্টাতেই দাসমুক্তি আসিয়াছে।

আলেকজাণ্ডার যখন পারস্য আক্রমণ করেন, তখন তাহার সঙ্গে ছিল লক্ষ লক্ষ ক্রীতদাস। আবার পারস্য সম্রাট দরিয়াসের অধীনেও ছিল অগণিত ক্রীতদাস। কিন্তু যখন উভয় পক্ষে যুদ্ধ আরম্ভ হইল তখন আলেকজান্ডারের দাসগণ দরিয়াসের দাসদের সঙ্গে মিলিয়া সম্রাটদ্বয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিল কি? বরং তার উল্টা! আলেকজাণ্ডারের ক্রীতদাসেরা স্বীয় প্রভুর স্বপক্ষে দাঁড়াইয়া দরিয়াসের ক্রীতদাসদের বিরুদ্ধে লড়াই করিল। দরিয়াসের ক্রীতদাসেরাও সেইরূপ স্বদেশের কল্যাণ কামনায় নিজ প্রভুর স্বপক্ষে দাঁড়াইয়া আলেকজাণ্ডারের ক্রীতদাসদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিল। কোথায় রহিল তবে শ্রেণী-সংঘর্ষ?

ভারতের ইতিহাস আলোচনা করিলেও দেখা যায়। এখানে শ্রেণী সংঘর্ষের কোনো কথাই নাই। শূদ্রেরা কবে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে লড়িয়াছে? Prof. Bri Narain তাই Poos afetiga : “If all history is class struggle, India has no history at all” অর্থাৎ : সমস্ত ইতিহাসই যদি শ্রেণী-সংঘর্ষের ইতিহাস হয়, তবে ভারতের কোনো ইতিহাসই নাই।

বিগত দুইটি মহাযুদ্ধের পানে তাকান। কোন্ শ্রেণী-সংঘর্ষের ফলে এই দুইটি মহাযুদ্ধ সংঘটিত হইল? পুঁজিবাদী আমেরিকা সাম্যবাদী সোভিয়ট রাশিয়ার সহিত যোগ দিয়া জার্মানীর বিরুদ্ধে কেন যুদ্ধ করিল? তুর্কী কেন জার্মানীর স্বপক্ষে যোগ দিল?

হালাকু খা কেন বাগদাদ ধ্বংস করিল? মুসমানদিগের অধঃপতন কেন হইল, আবার কেনই বা দিকে দিকে ইসলামের লাল মশাল জ্বলিয়া উঠিল? পাকিস্তান কেন আসিল? কোন শ্রেণী-সংঘর্ষের ফলে এতগুলি কাণ্ড ঘটিল। মার্কসের থিওরী এই সব ঐতিহাসিক ঘটনার একটিরও কোনো ব্যাখ্যা করিতে পারে না।

(৫) “workers of the world, unite” (জগতের শ্রমিকদল এক হও)-ইহাই ছিল মার্কসের বাণী। এ বাণীও সফল হয় নাই। ইংলণ্ডের শ্রমিকদল জার্মানী, রাশিয়া এবং আমেরিকার শ্রমিকদলের সহিত মিলিত হইয়া সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংসের জন্য কোথাও যুদ্ধ করিয়াছে কি? না। যুদ্ধ বাধিলেই দেখা যায়, প্রত্যেক দেশের শ্রমিকদল তাহাদের নিজেদের দেশের রক্ষাকল্পে অপর দেশের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ইংলণ্ডের বা আমেরিকার শ্রমিকদল জানে, ইংলণ্ড বা আমেরিকা ধ্বংস হইলে তাহাদের রুজি-রোজগার ও সুখ-সুবিধা মারা যাইবে।

(৬) মার্কস গোড়াতে অনেকগুলি ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন:

“Abolish slavery and you will have wiped America off the map of nations.” অর্থাৎ : দাসপ্রথা তুলিয়া দিলে ম্যাপে আমেরিকার অস্তিত্বই থাকিবে না। আমেরিকায় দাসপ্রথা তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু কই, আমেরিকা তো নিশ্চিহ্ন হইয়া যায় নাই! বরং সে এখন পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র।

(৭) মার্কসের অর্থনৈতিক থিওরিও ব্যর্থ হইয়াছে। তিনি চাহিয়াছিলেন মুদ্রাহীন অর্থনীতি (moneyless economy)। অর্থাৎ আজকাল যে অর্থ দ্বারাই সমস্ত জিনিসের লেন-দেন চলে, মার্কস্ এ প্রথা তুলিয়া দিতে চাহিয়াছিলেন। কুলি, মজুর, উকিল, ব্যারিস্টার যোগ্যতা অনুসারে কাজ করিয়া যাইবে, তার বিনিময়ে তাহারা বেতন পাইবে না, পাইবে তাহাদের যাবতীয় অভাবের জিনিসপত্র। কৃষক জমি চাষ করিয়া ফসল ফলাইয়া স্টেটকে দিল, স্টেট তাহার ভাত-কাপড় সরবরাহ করিল। আদিম যুগে যেরূপ পরস্পরের মধ্যে দ্রব্য-বিনিময় হইত, মার্কসের মনেও ছিল সেই পরিকল্পনা। মুদ্রা প্রথা তিনি এই জন্য তুলিয়া দিতে চাহিয়াছিলেন যে, উহা পুঁজিবাদেরই বাহন এবং সাম্যবাদের ঘোর পরিপন্থী। কিন্তু মার্কসের এ আশা সফল হয় নাই। ১৯২০ খৃষ্টাব্দে লেনিন মুদ্রা বিনিময় প্রথা তুলিয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু উহাতে নানা প্রকার অসুবিধা ঘটায় বাধ্য হইয়া তিনি আবার মুদ্রা-প্রথারই প্রচলন করেন। বিতাড়িত রুবল (ruble) আবার ফিরিয়া আসিয়া নিজের স্থান দখল করিয়াছে। পুঁজিবাদের প্রধান বাহন মুদ্রাশক্তির নিকট কমিউনিজম এইখানে হারিয়া গিয়াছে।

(৮) দেশের কর্মশক্তি বাড়াইবার জন্য মার্কস্ যে ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, তাহাও কার্যকরী হয় নাই। কার্যে দক্ষতা ও আন্তরিকতা দেখাইলে কর্মচারীর পদোন্নতি হয় ও বেতন বাড়ে, ইহাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু মার্ক এরূপ তারতম্য পছন্দ করেন নাই। বেতনের হারের সমতাই ছিল তাহার কাম্য। যাহাকে যেখানে যে কাজে লাগান যাইবে, সে সেই কাজই দক্ষতার সহিত করিবে; ব্যক্তিগত পদোন্নতি বা স্বার্থের কথা না ভাবিয়া তাহারা ভাবিবে দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা, সমষ্টিগত কল্যাণের কথা- ইহাই ছিল মার্কসের নির্দেশ। কিন্তু সোভিয়েট রাশিয়ায় এ ব্যবস্থা বিফল হইয়াছে। ভালো কাজ করিলে পদোন্নতি হইবে বা বেতন বাড়িবে অথবা যে যতো উৎপন্ন করিবে সে ততোই বেশী অর্থ পাইবো–এরূপ দৃঢ় বিশ্বাস এবং প্রেরণা না থাকিলে কোনো কাজই সুসম্পন্ন হইতে পারে না। সমষ্টিগত কল্যাণ-বোধ কর্মীকে যতোটা না কর্মে উদ্বুদ্ধ করে, তার চেয়ে বেশী করে ব্যক্তিগত কল্যাণ-বোধ। এই সত্য সোভিয়েট রাশিয়া হাতে কলমে ঠেকিয়া উপলব্ধি করিয়াছে। সোভিয়েট রাশিয়ায় এখন আর বেতনের হারের সমতার কোনো কথা নাই। ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে লেনিন ঘোষণা করিয়াছিলেন : The salaries of the highest official should not exceed the average salary of a good worker. অর্থাৎ রাজ্যের সর্বোচ্চ কর্মচারীর বেতন একজন ভালো শ্রমিকের বেতন অপেক্ষা বেশী হইবে না। তিনি এই নির্দেশও দিয়াছিলেন যে, কোনো উচ্চ পদস্থ কর্মচারীর বেতন ৫০০ রুবলের বেশী হইবে না। কিন্তু স্ট্যালিনের হাতে আসিয়া এই নির্দেশ এখন কোথায় গিয়া নামিয়াছে, রাশিয়ার বর্তমান বেতন ও আয়ের হার লক্ষ্য করিলেই পাঠক তাহা পরিষ্কার বুঝিতে পারিবেন :

কর্মীর পরিচয় — বেতনের নিম্নতম এবং উচ্চতম হার

(১) সাধারণ শ্রমিক—————- ৮০-৪০০ রুবল

(২) ক্ষুদ্র কর্মচারী———-৮০-৩০৯ রুবল

(৩) উচ্চপদস্থ কর্মচারী————–১৫০০-১০,০০০ রুবল

(বিচারক, বিশেষজ্ঞ, প্রফেসর, হাকিম ইত্যাদি)

কর্মীর পরিচয় বেতনের নিম্নতম এবং উচ্চতম হার

(৪) সাধারণ শ্রমিকদের পেনসন———-৫৫-৫৮০ রুবল

(অন্য কোনো সুবিধা নাই)

(৫) উচ্চ কর্মচারীদের অথবা————২৫-১০০০ রুবল

তাহাদের বিধবা ও সন্তান (ইহার সহিত বাসগৃহ, ছেলেদের মেয়েদের স্কলারশিপ ইত্যাদি সুবিধা আছে)

কমরেড ইভন (Comrade Yvon) নামক একজন ফরাসী কমিউনিস্ট বলেনঃ বর্তমানে রাশিয়ার আয়ের হার ২৫ রুবল হইতে ৩০,০০০ রুবল (অর্থাৎ : ৫ টাকা হইতে ৬০০০ টাকা)। একজন ইঞ্জিনিয়ার বা বিশেষজ্ঞ একজন শ্রমিক অপেক্ষা গড়ে প্রায় ১০০০ গুণ বেশী বেতন পায়। শ্রমিকদের মধ্যেও যাহারা কর্মদক্ষ (stakhnovist), তাহারা সাধারণ শ্রমিক অপেক্ষা ৫/৬ গুণ বেশী বেতন পায়। G. P. U. গুপ্ত-পুলিশের বেতন ও সুখ-সুবিধা অন্যান্য সকলের অপেক্ষা বেশী।

এই হারের সহিত ইংলণ্ড ও আমেরিকার বেতনের হার তুলনা করিলে দেখা যাইবে? ইংলণ্ড ও আমেরিকা পুঁজিবাদী হইয়াও যে-হারে বেতন দেয়, সোভিয়েট রাশিয়া কমিউনিস্ট সাজিয়াও তদপেক্ষা নিকৃষ্ট হারে বেতন দেয়। আমরা দুই একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি।

ফ্যাক্টরীর নাম — বেতনের হার

Chili Copper Company—— 1:41

Curtis Publishing Co.—— 1:51

Consolidated Oli Co.—— 1:82

অতএব দেখা যাইতেছে, সোভিয়েট রাশিয়ার শ্রমিকেরা যে ইংলণ্ড ও আমেরিকার শ্রমিকদের অপেক্ষা সুখে আছে, তাহা নয়। বরং শ্রমিকদের অবস্থা অন্যান্য দেশের তুলনায় আরো শোচনীয়। Prof. Brj Narain তাঁহার “Marxism is dead” নামক বিখ্যাত পুস্তকে অকাট্যরূপে প্রমাণ করিয়া দেখাইতেছেন যে, সোভিয়েট রাশিয়ার শ্রমিকদের বেতনের হার এমন কি বোম্বাই এবং লাহোরের মিল-মজুরদের বেতনের হার অপেক্ষাও কম। তাহা হইলে পরিষ্কার দেখা যাইতেছে যে, সোভিয়েট রাশিয়ার বেতনের সমতা রক্ষা করা তো দূরের কথা, বেতনের তারতম্য সেখানে অন্যান্য দেশ হইতে আরো বেশী।

সোভিয়েট রাশিয়ার রেল, স্টীমার এবং সিনেমাতে অন্যান্য দেশের মতই ১ম শ্রেণী, ২য় শ্রেণী, ৩য় শ্রেণী-এইরূপ শ্রেণীবিভাগ রহিয়াছে।

অতএব স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, সোভিয়েট রাশিয়ায় কোনো শ্রেণীহীন সমাজ গঠিত হয় নাই-হইবেও না। কাজেই বলা যায়, মার্কসের একটি প্রধান নীতি এবং অঙ্গীকার এইখানে একেবারে ব্যর্থ হইয়াছে।

(৯) পুজিবাদ এবং সেই সঙ্গে শোষণ (exploitation)-এর সমস্ত পথ বন্ধ করিয়া দেওয়াই ছিল কমিনিউজমের প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু সে আশাও সফল হয় নাই। সোভিয়েট রাশিয়াতে বহু স্টেট ব্যাঙ্ক রহিয়াছে। সেখানে ব্যক্তিগত ভাবেই লোকেরা টাকা জমা রাখে। লোকগুলিকে প্রলুব্ধ করিবার জন্য ব্যাঙ্কগুলি উচ্চ হারে সুদ দেয়। সোভিয়েট রাশিয়ায় এখন যারা যতো খুশী রোজগার করিতে পারে; কিন্তু স্টেট বণ্ড (State Bond) ক্রয় করা ছাড়া অন্য উপায়ে তাহারা সে টাকা খাটাইতে পারে না। স্টেট ব্যাঙ্কগুলির সুদও খুব বেশী : শতকরা ৮। সেভিংস ব্যাঙ্কের প্রচলনও সেখানে যথেষ্ট আছে।

১৯৩৫ খৃষ্টাব্দে সোভিয়েট রাশিয়ায় মোট ৪৩,০০০০০ সেভিংস ব্যাঙ্ক ছিল। সেভিংস ব্যাঙ্কও খুব উচ্চ হারে সুদ দেয় শতকরা ৮ হইতে ১০। তাহা হইলে পুঁজিবাদে আর কমিউনিজমে বিশেষ তফাৎ রহিল কোথায়? এইভাবে বিনা পরিশ্রমে আয় বৃদ্ধি করাও তো exploitation! এই জন্যই একজন লেখক সোভিয়েট রাশিয়ার এই বিপ্লবকে “Revolution without, no change within” অর্থাৎ বাহিরে বিপ্লব, ভিতরে কিছুই না-এই বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন। Islam and Socialism-By Mirza Md. Hossain P. 124.)

এই ধরনের বহু দৃষ্টান্তই দেওয়া যাইতে পারে। আশা করি, পাঠক ইহা হইতেই বুঝিতে পারিতেছেনঃ মার্ক স্বাদ আর এখন ‘Ism’ নাই, ‘Wasm’-এ-ই পরিণত হইয়াছে।

নাহার

ভাদ্র ১৩৬-১৯৪৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *