১৩. ত্ৰয়োদশ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

চন্দ্ৰহৃদয় নগরে, রণধীর নামে, প্ৰবলপ্ৰতাপ নরপতি ছিলেন। রাজা রণধীরের প্রভাবে, প্ৰজারা চিরকাল নিরুপদ্রবে। বাস করিত। কিয়ৎ দিন পরে, নগরে গুরুতর চৌৰ্যক্রিয়ার আরম্ভ হইল। পৌরেরা, চৌরের উপদ্রবে অতিশয় ব্যতিব্যস্ত হইয়া, সকলে মিলিয়া, নৃপতিসমীপে স্ব স্ব দুঃখের পরিচয় প্ৰদান করিল। রাজা সবিশেষ সমস্ত শ্রবণগোচর করিয়া কহিলেন, যাহা হইয়াছে, তাহারা আর উপায় নাই; অতঃপর যাহাতে না হইতে পায়, সে বিষয়ে সবিশেষ যত্নবান থাকিলাম। এইরূপ আশ্বাস দিয়া, রাজা নগরবাসীদিগকে বিদায় করিলেন; এবং, নূতন নূতন প্রহরী নিযুক্ত করিয়া, তাহাদিগকে সাতিশয় সতর্কতাপূর্বক নগররক্ষার আদেশ দিয়া, স্থানে স্থানে পাঠাইলেন; বলিয়া দিলেন, চোর পাইলে তাহার প্রাণদণ্ড করিবে। প্রহরীরা, সাতিশয় সাবধান হইয়া, নগররক্ষা করিতে লাগিল; তথাপি চৌর্যের কিঞ্চিম্মাত্র নিবৃত্তি হইল না, বরং দিনে দিনে বৃদ্ধিই হইতে লাগিল।

পুরবাসীরা, পুনরায় একত্র হইয়া, রাজার নিকটে গিয়া, আপনি আপনি দুঃখ জানাইলে, তিনি তাহাদিগকে কহিলেন, এক্ষণে তোমরা বিদায় হও; আদ্য রজনীতে, আমি স্বয়ং নগররক্ষার্থে নির্গত হইব। প্রজারা, রাজাজ্ঞা অনুসারে, স্বীয় স্বীয় আলয়ে গমন করিল। রাজাও, সায়ংকাল উপস্থিত হইলে, অসি, চর্ম, ও বর্ম ধারণপূর্বক, একাকী নগররক্ষার্থে নির্গত হইলেন; এবং, কিয়ৎ দূরে গিয়া, এক অপরিচিত ব্যক্তিকে সম্মুখে দেখিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কে, কোথায় যাইতেছ, তোমার বাস কোথায়। সে কহিল, আমি চোর; তুমি কে, কি নিমিত্তে আমার পরিচয় লইতেছ, বল। রাজা ছল করিয়া বলিলেন, আমিও চোর। তখন সে অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া কহিল, আইস, উভয়ে একত্র হইয়া চুরি করিতে যাই। রাজা সন্মত হইলেন।

চোর, রাজাকে সহচর করিয়া, এক ধনাঢ্য গৃহস্থের ভবনে প্রবেশপূর্বক, বহু অর্থ হস্তগত করিল; এবং নগর হইতে নিৰ্গত হইয়া, কিয়ৎ দূরে গিয়া, এক প্রচ্ছন্ন সুরঙ্গ দ্বারা পাতালে প্রবিষ্ট হইল। আপনি আলয়ে উপস্থিত হইয়া, রাজাকে দ্বারদেশে বসিতে আসন দিয়া, সে বাটীর মধ্যে প্ৰবেশ করিল। এই অবকাশে, এক দাসী আসিয়া, কথায় কথায়, রাজার পরিচয় লইল, এবং সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া কহিল, মহারাজ! তুমি কি নিমিত্ত, এই দুর্বৃত্ত দস্যুর আবাসে আসিয়াছ; সে না আসিতে আসিতে, যত দূর পার, পলায়ন কর; নতুবা, সে আসিয়াই তোমার প্রাণসংহার করিবেক। রাজা শুনিয়া সাতিশয় বিষন্ন হইলেন, এবং বলিলেন, আমি পথ জানি না, কিরূপে পলাইব; যদি তুমি কৃপা করিয়া পথ দেখাইয়া দাও, তাহা হইলে এবার আমার প্রাণরক্ষা হয়। তখন সেই দাসী পথপ্ৰদৰ্শন করিলে, রাজা পলাইয়া আপন আলয়ে উপস্থিত হইলেন।

পর দিন, প্রভাত হইবামাত্র, রাজা রণধীর, বহু সৈন্য সামন্ত সমভিব্যবহারে, পূর্বনির্দিষ্ট সুরঙ্গ দ্বারা পাতালে প্রবিষ্ট হইয়া, চোরের ভবনরোধ করিলেন। এক রাক্ষস সেই পাতালস্থ নগবীর, অধিষ্ঠাত্রী দেবতার ন্যায়, রক্ষণাবেক্ষণ করিত। চোর, রাজকীয় অবরোধ হইতে আত্মরক্ষার নিতান্ত অনুপায় দেখিয়া নগররক্ষক রাক্ষসের শরণাপন্ন হইল, এবং নিবেদন করিল, এক রাজা সসৈন্য আসিয়া আমার উপর আক্রমণ করিয়াছে। যদি তুমি এ সময়ে আমার সহায়তা না কর, অদ্যই তোমার নগর হইতে প্ৰস্থান করিব। এই বলিয়া, প্রলোভনস্বরূপ তাহার আহারোপযোগী দ্রব্য উপঢৌকন দিয়া, চোর সম্মুখে কৃতাঞ্জলি দণ্ডায়মান রহিল। আহারসামগ্ৰী উপহার পাইয়া, রাক্ষস সাতিশয় সন্তুষ্ট হইল; এবং, তুমি নিৰ্ভয় হও, কিয়ৎক্ষণমধ্যেই, আমি রাজার সমস্ত সৈন্য উচ্ছিন্ন করিতেছি; এই বলিয়া, তৎক্ষণাৎ তথায় উপস্থিত হইয়া, সৈন্যের অন্তর্গত নর, করী, তুরঙ্গ প্রভৃতি এক এক গ্রাসে উদরস্থ করিতে আরম্ভ করিল। রাজা, রাক্ষসের ভয়ানক আকার ও ক্রিয়া দর্শনে অতিশয় কাতর হইয়া, পলায়ন করিলেন। ফলতঃ, যে পলাইতে পারিল, তাহারই প্ৰাণ বাঁচিল; অবশিষ্ট সমস্ত সৈন্য, সেই দুর্দান্ত রাক্ষসের গ্রাসে পতিত হইয়া, পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল।

রাজা একাকী পলায়ন করিতে লাগিলেন। চোর, রাক্ষসের সহায়তায়, সাহসী ও স্পর্ধাবান হইয়া, তাহার পশ্চাৎ ধাবমান হইল; এবং, ক্ৰমে ক্রমে সন্নিহিত হইয়া, ভর্ৎসনা করিয়া কহিতে লাগিল, অরে কুলাঙ্গার! ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করিয়া, এরূপ কাপুরুষতা প্রদর্শন করিতেছিস; তোরে ধিক! রাজা হইয়া, ভঙ্গ দিয়া, রণক্ষেত্ৰ হইতে পলায়ন করিলে, ইহলোকে অকীর্তি ও পরলোকে নরকপাত হয়। রাজা, তৎকালে নিতান্ত ব্যাকুল ও সৰ্বথা উপায়বিহীন হইয়াও, কেবল কুলাভিমান ও খড়্গ, চৰ্ম সহায় করিয়া, চোরর সম্মুখীন হইলেন।

ঘোরতর সংগ্ৰাম হইতে লাগিল। পরিশেষে, রাজা রণধীর চোরকে পরাজিত করিয়া, বন্ধনপূর্বক রাজধানীতে লইয়া গেলেন, এবং, পর দিন প্ৰাতঃকালে, শূলদানের ব্যবস্থা করিয়া, বধ্যবেশপ্রদানপূর্বক, তাহাকে গর্দভে আরোহণ করাইয়া, নগরের সমস্ত প্রদেশে পরিভ্রমণ করাইতে আদেশ দিলেন। চোর প্রায় সকলেরই সর্বনাশ করিয়াছিল; সুতরাং সকলেই তাহাকে তদাবস্থ দেখিয়া, নিরতিশয় আহ্লাদিত হইয়া, তাহার অশেষপ্রকার তিরস্কার ও রাজার ভূরি ভুরি প্রশংসা করিতে লাগিল।

কিন্তু, ধর্মধ্বজ নামক বণিকের গৃহের নিকটবর্তী হইলে, তাহার কন্যা শোভনা, গবাক্ষদ্বারা দিয়া চোরকে নয়নগোচর করিয়া, একবারে মোহিত হইল; এবং তৎক্ষণাৎ স্বীয় পিতার সমীপবৰ্তিনী হইয়া কহিল, তুমি রাজার নিকটে গিয়া, যেরূপে পার, ঐ চোরকে ছাড়াইয়া আন। বণিক কহিল, যে চোর সমস্ত নগর নির্ধন করিয়াছে; যাহার নিমিত্তে, রাজার সমস্ত সৈন্য উচ্ছিন্ন হইয়াছে; এবং রাজারও নিজের প্রাণসংশয় পর্যন্ত ঘটিয়াছিল; তাহাকে, আমার কথায়, কখনই ছাড়িয়া দিবেন না। শোভনা কহিল, যদি তোমার সর্বস্ব দিলেও, রাজা উহাকে ছাড়িয়া দেন, তাহাও তোমায় করিতে হইবেক। যদি তুমি উহারে না আন, তোমার সমক্ষে আত্মঘাতিনী হইব।

কন্যা ধর্মধ্বজের প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় ছিল; সুতরাং সে, তদীয় নির্বন্ধ উল্লঙ্ঘনে অসমৰ্থ হইয়া, রাজার নিকটে গিয়া আবেদন করিল, মহারাজ! আমার যে কিছু সম্পত্তি আছে, সমস্ত দিতেছি; আপনি, দয়া করিয়া, এই চোরকে ছাড়িয়া দেন। রাজা কহিলেন, এই চোর। আমার ও পৌরবর্গের যৎপরোনাস্তি অপকার করিয়াছে; আমি, কোনও প্রকারে, উহারে ছাড়িয়া দিব না। তখন ধৰ্মধ্বজ, আপনি কন্যার নিকটে গিয়া কহিল, আমি, সর্বস্বদান পর্যন্ত স্বীকারপূর্বক, প্রার্থনা করিলাম; রাজা, কোনও ক্রমে, চোরকে ছাড়িয়া দিতে সম্মত হইলেন না। তখন শোভনা, অভীষ্টসিদ্ধিবিষয়ে নিতান্ত নিরাশ হইয়া, বিষাদসগারে মগ্ন হইল।

এই সময় মধ্যে, রাজপুরুষেরা চোরকে সমস্ত নগর পরিভ্রমণ করাইয়া, পরিশেষে বধ্যভূমিতে আনয়নপূর্বক, শূলস্তম্ভের নিকট দণ্ডায়মান করিল। শোভনার অপরূপ বৃত্তান্ত, তৎক্ষণাৎ নগর মধ্যে প্রচারিত হওয়াতে, অনতিবিলম্বে চোরেরও কর্ণগোচর হইল। তখন সে প্রথমতঃ হাসিতে লাগিল; অনন্তর, হাস্য হইতে বিরত হইয়া, রোদন আরম্ভ করিবামাত্র, রাজপুরুষেরা তাহাকে শূলে আরোহণ করাইল।

বণিককন্যা, চোরের মৃত্যুসংবাদ পাইবামাত্র, সহগমনের উদ্যোগ করিয়া, বধ্যভূমিতে উপস্থিত হইল; এবং, যথানিয়মে চিতা প্রস্তুত হইলে, চোরকে, শূল হইতে অবতীর্ণ করিয়া, গাঢ় আলিঙ্গনপূর্বক, তাহারে লইয়া মৃত্যুশয্যায় শয়ন করিল।

দাহিকেরা অগ্নিপ্রদানে উদ্যত হইল। নিকটে ভগবতী কাত্যায়নী দেবীর মন্দির ছিল। দেবী, তথা হইতে নির্গমনপূর্বক, শ্মশানভূমিতে উপস্থিত হইলেন, এবং কহিলেন। বৎসে! বরপ্রার্থনা কর; তোমার সাহস ও সতীত্ব দর্শনে সবিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছি। শোভনা কহিল, জননি! যদি প্ৰসন্ন হইয়া থাক, এই চোরের জীবনদান কর। দেবী, তথাস্তু বলিয়া, তৎক্ষণাৎ পাতাল হইতে অমৃত আনয়নপূর্বক, চোরর প্রাণদান করিলেন।

ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! চোর, কি নিমিত্তে, প্রথমে হাস্য ও পরে রোদন করিয়াছিল, বল। রাজা কহিলেন, চোর, কন্যার কামনা শুনিয়া, আমার মৃত্যুসময়ে ইহার অনুরাগ সঞ্চার হইল; ভগবানের কি ইচ্ছা, কিছুই বুঝা যায় না; এই আলোচনা করিয়া, প্ৰথমে হাস্য করিয়াছিল; অনন্তর, এই কন্যা, আমার নিমিত্তে, রাজাকে সর্বস্ব দিতে উদ্যত হইয়াছিল; আমি ইহার এমন কি উপকারে আসিতাম; এই অনুশোচনা করিয়া, দুঃখিত হৃদয়ে রোদন করিল।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *