৫০. মল্লভূমের রাজধানী বিষ্ণুপুর

৫০

মল্লভূমের রাজধানী বিষ্ণুপুরে শ্মশান দুটি। একটি ব্রীড়াবতী নদীর তীরে সাধারণ প্রজাদের জন্য শ্মশান, অন্যটি রাজপরিবার ও উচ্চবর্গীয় রাজকর্মচারীদের জন্য নির্মিত শ্মশান। দ্বিতীয়টি রাজপ্রাসাদের পিছনে অবস্থিত। আকারে আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও পরিচ্ছন্ন। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে দ্বারকেশ্বর নদী থেকে প্রবাহিত হয়ে আসা একটি খাল। শ্মশানতীরে বাঁধা দু-একটি ডিঙি নৌকো, সেগুলি কালেভদ্রে ব্যবহৃত হয়।

শ্মশানটির তিনদিকে তিনটি চিহ্নিত স্থান। একপ্রান্তে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়, অন্যপ্রান্তে কায়স্থ, বৈদ্য, সদগোপ। একটি ছোট এলাকা সতীদের জন্য। তার সংলগ্ন মন্দিরটিও সতীমাতার। তাতে দুটি কক্ষ। প্রথম কক্ষে সতীমায়ের মূর্তি হিসেবে রয়েছে একটি তেল সিঁদুরে মাখা প্রস্তরখণ্ড। চিতায় ওঠার আগে সতীরা এই প্রস্তরখণ্ডে তেল সিঁদুরের প্রলেপ দিয়ে যান।

সতীমায়ের মন্দিরের দ্বিতীয় কক্ষে সতীকে একবস্ত্রা করা হয়। লালপাড় কাপড় পরানো হয়। পায়ে দেওয়া হয় আলতা। লৌহখাড়ু ও শাঁখা ছাড়া থাকে না কোনও অলংকার। কপালে আঁকা হয় চন্দন, সিঁদুরে লেপে দেওয়া হয় ব্রহ্মতালু। গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয় মালা।

রঘুনাথ যখন শ্মশানে পৌঁছল, তখন শ্মশানঘাটে বেশ ভিড়। বাইরে প্রলয় ঘটে যাচ্ছে যাক, রাজপ্রাঙ্গণের অধিকাংশ এয়োস্ত্রীরাই ভিড় জমিয়েছে। সতীর পায়ের ছাপ মহা পুণ্যের, তা তারা সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে।

শীতলকুমারের দেহ স্নান করিয়ে চিতায় শোয়ানো হয়েছে। অপঘাত মৃত্যুতে এত দ্রুত সৎকারে কিছু বিধিনিষেধ থাকলেও শ্রীব্যাস আচার্য প্রায়শ্চিত্ত করে তা খণ্ডন করেছেন। শীতলকুমারের দেহ শ্বেতবস্ত্রে আবৃত, মুখটুকু অনাবৃত। অনিন্দ্যকান্তি মুখে কোন ক্ষতচিহ্ন নেই, তাই ভারি প্রশান্ত দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেন নিশ্চিন্তে সে ঘুমোচ্ছে।

অদূরে সতীমায়ের মন্দিরে সাজানো হচ্ছে মনোহরাকে। সে সজ্ঞানে নেই, নানাবিধ পানীয়ের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রয়েছে। তার পায়ে আলতা পরিয়ে দিচ্ছে এক কন্যা। এই কাজ বধিলাবাড়ির মেয়ে-বউদের।

শ্রীব্যাস আচার্য সহকারী পণ্ডিতকে বলছিলেন, ‘বেশি বিলম্ব করো না। শুভলগ্ন প্রায় শেষ। ত্রিপাদ দোষ পড়ে যাবে। রাজকুমার পুত্রহীন অবস্থায় পরলোক গমন করেছেন, তাই এক্ষেত্রে পিতাকে মুখাগ্নি করতে হবে।’

‘কিন্তু মহারাজ যে উপস্থিত নেই?’ দ্বিধাগ্রস্ত সহপণ্ডিত বলে ওঠে।

‘তা বলে তো আর সৎকার বন্ধ রাখা যায় না।’ শ্রীব্যাস বলে উঠলেন, ‘সতী হওয়ার ব্যাপার রয়েছে।’

‘তবে উপায়?’

‘উপায় আমি স্থির করে রেখেছি। মাধব মল্ল আসছেন শ্মশানে।’

সহপণ্ডিত হতবাক। যে মাধব মল্লের জন্য আজ মল্লরাজ্যের এই অবস্থা, তিনি কিনা আজ গোপনে রাজধানীতে প্রবেশ করেছেন শুধুমাত্র শীতলকুমারের মুখাগ্নি করবেন বলে?

‘হাঁ করে দেখছিস কী? পিতার অনুপস্থিতিতে পিতার পিতৃব্যও মুখাগ্নি করতে পারেন। নে, দ্রুত প্রস্তুত কর।’

শ্রীব্যাস আচার্য কথা শেষ করতে পারেন না, তার সামনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়ায় রঘুনাথ। তীব্রকণ্ঠে বলে, ‘বউদিদি সতী হবেনা! শাস্ত্রে আছে!’

‘বটে? কোন শাস্ত্রে?’

রঘুনাথ হকচকিয়ে যায়। জীবনে কোনোদিন সে পড়াশুনোয় মন দেয়নি, কোনওদিনও ভাবেনি, শ্লোকগুলো তাকে এত বড় বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে। পবন যে বলল। হ্যাঁ, মনে পড়েছে।

‘নারদীয় পুরাণ। সেখানেই লেখা রয়েছে। বউদিদি অন্তঃসত্ত্বা। সে সতী হতে পারবে না। ঋষি…ঋষি বৃহস্পতিও তা সমর্থন করেছেন।’

শ্রীব্যাস পণ্ডিতের চোখদুটো জ্বলে উঠেই নিভে গেল। গত কয়েকমাসে তাঁর প্রভাব রাজ্যে খর্ব করে দিয়েছেন শ্রীনিবাস আচার্য। মৃন্ময়ী মন্দিরে নরবলি বন্ধ হওয়ার পরে, রাজ্যের যত্রতত্র রাধাগোবিন্দের মন্দির গজিয়ে ওঠার পরে, রাজার ছায়াসঙ্গী হিসেবে শ্রীনিবাস আচার্যকে দেখার পরে শাক্ত শ্রীব্যাসকে লোকে এখন করুণার চোখে দেখে।

আজ বীরহাম্বীরের অস্তক্ষণ আসন্ন! রাজার সঙ্গে যুদ্ধে গিয়ে সেই বৈষ্ণব পণ্ডিতও যে ফিরবে না, তা নিশ্চিত। কালাপাহাড়ের গ্রাস থেকে কেউ কোনদিনও বাঁচেনি।

মাধব মল্ল আশ্বাস দিয়েছেন, নতুন রাজ্যে শ্রীব্যাসই হবেন ধর্মীয় বিষয়ে শেষ কথা। সেই যাত্রাপথে রাজপুত্রের সৎকার ও তার মহিষীর সহমরণের চেয়ে উত্তম আরম্ভ আর কী হতে পারে! মৃত্যুর চেয়ে বড় আর কোনও বিচার নেই, যাতে মানুষ ভয় পেতে পারে। ভয় থেকেই আসে সম্ভ্রম।

রাজ্যের পালাবদলের সময় নিজের পূর্বতন সম্মান ফিরিয়ে আনার জন্য গর্ভবতী মনোহরাকে সতী করতেই হবে। আর এখন শুধু পালাবদল না হওয়া পর্যন্ত অভিনয় করে যেতে হবে। আহা, এই ছোট রাজপুত্রের আয়ুও বড়জোর আর কয়েক ঘণ্টা!

শ্রীব্যাস নিরীহমুখে বললেন, ‘নারদীয় পুরাণ তো অনেক পরের কথা, রঘু! যে তোমার দাদার মৃত্যুর কারণ, যার জন্য আজ আমাদের সোনার রাজ্য ছারখার হয়ে যাচ্ছে, তুমি তার পক্ষ নিচ্ছ শেষমেশ? এও আমাকে দেখতে হল?’

‘মানে?’ রঘুনাথ হকচকিয়ে যায়।

‘মানে স্পষ্ট। তোমার বউদিদির পিতা জীমূতবাহনের প্রতারণার জন্যই রাজ্যের এই অবস্থা।

‘বউদিদির পিতা পাপ করেছেন, বউদিদি তো করেননি!’ রঘুনাথ বলে।

‘তো কী?’ শ্রীব্যাস অম্লানবদনে মিথ্যা বলে যান, ‘তুমি নারদীয় পুরাণ শোনালে, আমি নাহয় তোমায় ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ শোনাই। পিতার পাপের ভার পুত্রকন্যাকেও নিতে হয়। পিতার পাপ জলপ্রপাতের ধারার মতোই এসে পড়ে সন্তানদের স্কন্ধে। আর সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্তের জন্যই মনোহরাকে সতী হতে হবে। বুঝেছ? সরে যাও।

রঘুনাথ থতমত খেয়ে গেল। শাস্ত্র খুঁড়ে তর্ক তো দূর, বিন্দুমাত্র জ্ঞান না থাকায় ও কি বলবে ভেবে পায় না।

কাঁসরঘণ্টা বেজে উঠল। বাজতে থাকে শঙ্খ। দূরে দেখা যায়, আসছেন মাধব মল্ল। শ্রীব্যাস আচার্যের শিষ্যরা উন্মত্তের মতো উল্লাস ধ্বনি করছে।

‘পুড়বে মেয়ে উড়বে ছাই, তবে সে মেয়ের গুণ গাই!’

রঘুনাথ আর্তস্বরে বলে ওঠে, ‘তাহলে হেমনলিনী বেঁচে আছে কী করে? সেও তো বিধবা!’

কিন্তু তার আর্তধ্বনি চাপা পড়ে গেল কাঁসর ও শঙ্খনিনাদে। শীতলকুমারের মৃতদেহের ওপর সাজানো হচ্ছে চন্দন কাঠ। শ্রীব্যাস আদেশ দেন, কিছুটা সাজানোর পরেই যেন মনোহরাকে নিয়ে আসা হয়। দেরি করা যাবে না।

রঘুনাথ পাগলের মতো ছুটে যেতে চায় সতীমন্দিরের দিকে। কিন্তু তাকে দু’দিক থেকে চেপে ধরে রাখে শ্রীব্যাস আচার্যের সহকারী পণ্ডিতরা।

সতীমন্দিরে পুরুষের প্রবেশাধিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ!

রঘুনাথের চোখ দিয়ে অবিরল ঝরতে থাকে অশ্রুধারা। অসহায়তার কান্না!

অদূরেই চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে দাদা। তার মনে পড়ে যায় দাদার শেষ কথা, ‘রঘু, তোর বউদিদিকে দেখিস!’

কী করে দেখবে সে? কী করে এতগুলো পাষণ্ডের হাত থেকে বাঁচাবে বউদিদিকে? ও হাপুসনয়নে কাঁদতে থাকে, ‘দাদা দাদা! তুই ওঠ দাদা!’

ঠিক এই সময় সতীমন্দিরের দিক থেকে ছুটে আসে এক ভৃত্য। বলে, ‘পণ্ডিতমশাই! সতীমা তো নেই!’

‘মানে! ভাঙ খেয়েছিস নাকি?’ শ্রীব্যাস পণ্ডিত চিৎকার করে ওঠেন।

‘সত্যি বলচি পণ্ডিতমশাই! পেত্যয় না হলে গিয়ে দেখুন!’

এবার আর নিষেধ মানে না রঘুনাথ। একঝটকায় হাত ছাড়িয়ে তিরের মতো গিয়ে ঢোকে সতীমন্দিরে। সত্যিই তো, মন্দিরের মধ্যে সতীমায়ের প্রস্তরখণ্ড যেমনটি তেমনটিই রয়েছে, চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে সিঁদুর, আলতা। শুধু মনোহরা উবে গিয়েছে। অদূরে বসে রয়েছে সেই মেয়েটি, যে মনোহরার পায়ে আলতা পরিয়ে দিচ্ছিল! রঘুনাথ মেয়েটিকে চিনতে পারল। সে কমলা, ভাদ্রচন্দ্র বধিলার মেয়ে। পবনের খুড়তুতো বোন।

কমলাকে যতক্ষণে ধর্মের ষাঁড়েরা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছিল, ততক্ষণে পবন মন্দিরের পিছনের দরজা দিয়ে মনোহরাকে নিয়ে ডিঙি নৌকোয় পাড়ি দিয়েছে দূরে। তাকে সাহায্য করেছে তার একসময়ের খেলার সঙ্গী দুই রাখাল বালক।

খাল বরাবর পশ্চিমে গেলেই দ্বারকেশ্বর নদী। পবন বরাবর ভূগোল বড় ভালোবেসে শুনেছে রামেন্দ্রসুন্দর তর্কালংকারের চতুষ্পাঠীতে। সে জানে, দ্বারকেশ্বর নদী ধরে পূর্বদিকে চললে একদিন সে গিয়ে পড়বে গঙ্গায়।

গঙ্গাস্নানে কি নবজন্ম হয়? পবনের জিভ শুকিয়ে আসে, চোখ জ্বালা করে। তবু সে থামে না।

অচৈতন্যা মনোহরাকে একহাতে পরম মমতায় জড়িয়ে রেখে সে প্রাণপণে দাঁড় টেনে যায়।

৫১

ঘটনা! দুর্ঘটনা! হিংসা! লালসা। প্রতিশোধ! যুদ্ধ!

উত্তাল মল্লভুম!

একই সময়ে এর সমান্তরালে আরেকটি রোমহর্ষক ঘটনা সংঘটিত হচ্ছিল মল্লবংশের পরিত্যক্ত রাজধানী প্রদ্যুম্নপুরে।

জগতকুমার শ্বাপদের মতো ওঁত পেতে বসেছিলেন। মাধব মল্লের প্রদ্যুম্নপুর ছেড়ে বিষ্ণুপুর চলে আসার সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটুও দেরি করেননি।

শীতলকুমারের মুখাগ্নি করে মাধব মল্ল যখন তাঁর রক্ষীদের সঙ্গে ফিরে আসছিলেন, অতর্কিতে জগতকুমারের লাঠিয়ালরা তাঁকে রাস্তাতেই বন্দি করল।

অন্যদিকে জগতকুমার নাটকাঞ্চন মৌজার প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসে নিজের লাঠিয়াল বাহিনীকে পাঠিয়ে দিলেন পাঠান সেনাপতির কাছে।

উমাপতি ভোরেই এসে পৌঁছেছিল বিষ্ণুপুর থেকে। প্রদ্যুম্নপুরে গিয়ে তার কাজ কী, সেটা তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে জগতকুমার পাঠালেন প্রদ্যুম্নপুরে। সঙ্গে চারজন লাঠিয়াল।

তিনি নিজে অপেক্ষা করছিলেন গোপালপুর চটির নিকটবর্তী কদম্বঘাটি মদ্যশালার পিছনে। এটিও আসলে একটি সরাইখানা, প্রধানত সুরার লোভে বণিকরা যাতায়াতের পথে এখানে রাত্রিযাপন করে।

মল্লরাজ্যের হিকিম যখন প্রভাতকালে এই সরাইখানার পাশের সংকীর্ণ পথ দিয়ে তাঁর বিশাল বপু নিয়ে দুলকি চালে চলেছিলেন পিছনে তাঁর গোপন বাগানবাড়ির দিকে, তিনি জানে না, সরাইখানার দ্বিতলের ঘর থেকে তাঁর গতিবিধি আরেকজন তীক্ষ্ন চোখে লক্ষ্য করে চলেছে।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সে এখানে লুকিয়ে আছে। কেন যে এই স্বেচ্ছা অজ্ঞাতবাস, তা সে নিজেও সঠিক জানে না। শুধু জানে, একদিকে বাল্যসখার প্রতি বন্ধুকৃত্য, অন্যদিকে এক পরিচিত রাজার আন্তরিকতা, মল্লরাজ্য থেকে পাওয়া অনাবিল ভালোবাসা এই দুইয়ের মাঝে পড়ে সে পিষ্ট হয়ে চলেছে বিবেক দংশনে।

বিষ্ণুপুরের জগতকুমার এই সরাইখানার পিছনে যাচ্ছেন কেন? সে বিস্ময়ের শীর্ষে পৌঁছে যাচ্ছিল।

রুদ্রাক্ষ অবশ্য জানে না এখানে জগতকুমার আসেন সুরার টানে। রাজ্যের হিকিমের প্রকাশ্যে মদ্যশালায় মদ্যপান করাটা ভালো দেখায় না, তাই মদ্যশালার পিছনে এই গোপন কুটীরের ব্যবস্থা।

তবে আজকের আগমনের কারণ সম্পূর্ণ অন্য, অভাবনীয়।

উমাপতি বলেছিল, ‘কর্তা, এখন এই গোলযোগের সময়ে প্রদ্যুম্নপুর না গেলেই কি নয়?’

‘না নয়। চুপ কর। এই দিন, এই মুহূর্তের জন্যই কবে থেকে পথ চেয়ে রয়েছি আমি! ওরে বোকা, সুযোগ বারবার আসে না। চলে যা। জগতকুমার উমাপতির নিষেধাজ্ঞায় কর্ণপাত করেননি।

জগতকুমার নিশ্চিত, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষে তিনিই হতে চলেছেন মল্লভূমের নৃপতি। তখন তাঁর কাজ হবে নিজের অধীনে থাকা সৈন্য ও অন্যান্য অমাত্যদের পরিচালনা করা।

নিজের সীলমোহর দেওয়া পত্র উমাপতির হাত দিয়ে তিনি পাঠালেন প্রদ্যুম্নপুরে। দ্বাররক্ষকরা বিনাবাক্যব্যয়ে তাকে অভিবাদন জানিয়ে দ্বার উন্মুক্ত করে দিল।

প্রদ্যুম্নপুরের তিনটি সুগভীর পরিখা ও হনুমান তোরণ অতিক্রম করে উমাপতি সোজা চলে গেল হেমনলিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। দৌবারিকদের বলে গেল, হিকিম বার্তা পাঠিয়েছেন ভগিনীর জন্যে।

বেচারা দ্বাররক্ষকরা স্বপ্নেও ভাবতে পারল না যে, মল্লবংশের এক রাজপুরুষ নিজের ভগিনীস্থানীয়া কারো অনিষ্ট করবেন।

হেমনলিনীর সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে উমাপতি কোমল স্বরে বলল, ‘রাজ্যে পাঠান সেনা অনুপ্রবেশ করছে। ভীষণ বিপদ! আপনি এখনি চলুন। আপনার পিতা মাধব মল্ল আপনার জন্যে বার্তা পাঠিয়েছেন। এই প্রাসাদ এখন আর নিরাপদ নয়। তিনি আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’

পাঠান সেনাদের বর্বরতার কথা হেমনলিনী বিলক্ষণ জানে। ভীরু হরিণীর মতো সে বলল, ‘বাবামশাই কোথায়?’

‘কদম্বঘাটির কাছে।’

হেমনলিনী অবাক হয়ে বলল, ‘কদম্বঘাটি কেন? বাবামশাই তো বিষ্ণুপুর গিয়েছিলেন!’

উমাপতি বলল, ‘বিষ্ণুপুর ইতিমধ্যেই পাঠান সেনাদলের করায়ত্ব হয়ে গিয়েছে রাজকুমারী! মাধব মল্ল কোনমতে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তিনি আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন কদম্বঘাটিতে।’

হেমনলিনী চমকে উঠল। পিতা যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তা তার কাছে অজানা। সে জানে, মাধব মল্ল বিষ্ণুপুর গিয়েছেন রাজা বীরহাম্বীরকে সাহায্য করতে। রাজবাড়ির শিরোমণি বা মনোহরাকে সে প্রাণাধিক ভালোবাসে। সে বলল, ‘রাজবাড়ির মেয়েরা? তারা কোথায়?’

‘তাঁদের রক্ষা করার জন্য তো ওখানে রাজামশাই ও অন্যান্য কুমাররা রয়েছেন।’ উমাপতি কিঞ্চিত অধৈর্য হয়ে বলল, ‘কিন্তু এই অরক্ষিত দুর্গে আপনি একাকী। যে-কোনও মুহূর্তে সুলতানের সেনারা প্রবেশ করবে। শীঘ্র আমার সঙ্গে চলুন।’

হেমনলিনী কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় কর্কশ স্বরে একটা কাক কাছেপিঠে কোথাও ডেকে উঠল। কাকশাস্ত্রে এমন ডাক চূড়ান্ত অশুভ, হেমনলিনী জানে। যে বিপদের কথা গত কয়েকদিন ধরে ভেবে সে ভয়ে কাঁটা হয়ে রয়েছে, তার পরিণতির কথা ভেবে সে শিউরে উঠল। কালাপাহাড়ের সৈন্যরা লুঠপাট করে থামে না, দুরমুশ করে দেয় লুণ্ঠিত গ্রাম, নগরীর মেয়েদের ইজ্জত। কাক কি সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে?

তেমন কিছু ঘটলে নিজেকেই না-হয় হেমনলিনী শেষ করে দেবে! শত্রুর কাছে ধর্ষিতা হওয়ার চেয়ে অবশ্যই কাম্য আত্মাহুতি দেওয়া। তার কাছে সবসময়েই এক বিশেষ প্রজাতির গাছের শিকড় রাখা থাকে। এই গাছের শিকড় আসলে তীব্র বিষ।

সেটাকে কুলুঙ্গি থেকে বের করে অঞ্চলে বাঁধল হেমনলিনী।

বলল, ‘চলুন।’

৫২

পাঠান সেনাপতি কালাপাহাড় যখন রাজতোরণের সীমান্তে এসে পৌঁছলেন, ততক্ষণে গোটা বিষ্ণুপুর শ্মশানে পরিণত হয়েছে। মুণ্ডমালাঘাট থেকে যে ভয়ানক হত্যালীলা শুরু হয়েছিল, তা অব্যাহত। পাঠান সেনারা কামরূপ ও উৎকল ধ্বংসের পর আরও পাশবিক হয়ে উঠেছে।

মূর্চার পাহাড়ে সেনাপতির শিবিরে আকস্মিক ঢুকে পড়ে ছড়াকারকে হত্যা করা সেই রহস্যময়ী নারীকে গণধর্ষণ করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, রাতভর চলেছে নারকীয় অত্যাচার। সেই অত্যাচারের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন।

অবশেষে প্রত্যুষে সূর্য যখন পূর্বাকাশে সবেমাত্র উদিত হচ্ছেন, সেনাপতির নির্দেশে সকলে যখন প্রস্তুত হচ্ছে শেষ আক্রমণের, এক উপসেনাপতি বলে ওঠে, ‘উস আওরতের কী হবে?’

সকলে তখন শিবিরে সামরিক সাজে সজ্জিত হতে ব্যস্ত। শিবিরের এক কোনায় তখন উপুড় হয়ে পড়েছিল অচৈতন্য মেনকা। প্রায় বিবস্ত্রা। যে কৃষ্ণবর্ণ লইয়া অঙ্গে আচ্ছাদিত করে সে ঢুকেছিল শিবিরে, সেই লইয়ার সামান্য কিছু ভাগ বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে রয়েছে তার নিম্নাঙ্গের ওপর।

ঊর্ধাঙ্গের যে সম্মুখভাগ মাটির সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে, ক্ষতবিক্ষত সেই অংশও। আফগান সেনারা তার গ্রীবা থেকে স্তন, তলপেট থেকে উরু, কোনও কিছুকেই পাশবিক লালসা থেকে বাদ দেয়নি।

একজন উপসেনাপতি সেদিকে একঝলক দৃষ্টিপাত করে বলল, ‘উয়ো আভি তক জিন্দা হ্যায়?’

‘জি।’ আরেকজন প্রত্যুত্তর করে, ‘সাঁস লে রহি হ্যায়।’

‘সাথমে লে চলো। ফির কামমে আয়েগা।’

তেমনই ঠিক হল। কিছু রাজা যেমন প্রমোদবিহারে গেলে সঙ্গে নিতেন বারাঙ্গনাদের, তেমনই সৈন্যরা অচৈতন্য, নগ্ন মেনকাকে ঘোড়ায় তুলে নিল।

তাদের তেজী আফগান অশ্বরা টগবগিয়ে ছুটে চলল রাজধানীর দিকে।

ফৌজের প্রথমে যারা হেঁটে আসছিল, তারা গোলন্দাজ। তারা গড়িয়ে নিয়ে আসছিল বিচিত্রদর্শন চাকাওলা ছোট ছোট কামান। মল্লরাজ্য এমন কামান কখনও দেখেনি। তাদের গোপগ্রামে যে কামানগুলো নির্মিত হয়, সেগুলো প্রকাণ্ড। এই কামানগুলো আকারে তাদের এক চতুর্থাংশ হবে।

মল্লবাসী ভাবছিল, এই কামানগুলো কী আর এমন শক্তিশালী হবে? তারা পরস্পরকে আশ্বস্ত করছিল, না-না। ওইটুকু কামানের গোলা পাঁচ হাতও যাবে না।’

গোলন্দাজদের পিছনে উপসেনাপতিদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে আসছেন স্বয়ং কালাপাহাড়। তিনি আজ হাতিতে সওয়ার। প্রকাণ্ড সেই রণহস্তী। গজকুম্ভে রয়েছে মাহুত। আর হাওদার শীর্ষে প্রকাণ্ড উষ্ণীষ নিয়ে কালাপাহাড়। সর্বাঙ্গে লোহার বর্ম, এক হাতে ভয়ালদর্শন তরোয়াল, অন্যহাতে ঢাল।

কালাপাহাড়ের পিছনে রয়েছে আরও প্রচুর সৈন্য। রয়েছে গোলন্দাজ, তীরন্দাজরাও। উত্তেজনা ও রিরংসায় তারা ফুটছে।

রাজধানীর সীমান্ত অতিক্রম করামাত্র হিন্দু গ্রামগুলো থেকে শঙ্খ ও মুসলমান গ্রামগুলো থেকে দামামা বেজে উঠল। কিন্তু গাছের ওপর বসে থাকা গ্রামবাসীরা যতক্ষণে ধনুকের ছিলায় তীর টেনে ধরল, ততক্ষণে পাঠান সেনারা তাদের ছোট ছোট কামান তাক করে উড়িয়ে দিতে লাগল গাছগুলোকেই।

 গ্রামবাসীদের ধারণা ছিল ভুল। আকারে ক্ষুদ্র হলেও কামানগুলোর নিশানা বহুদূরগামী। এই প্রযুক্তি মল্লরাজ্য দেখেনি। গাছের ওপর থেকে দু-একটা তীর নীচে আসতেই কামানের উপর্যুপরি গোলায় গাছগুলিতে আগুন ধরে গেল। ওপর থেকে চাক ভাঙা মৌমাছির মতো ঝুপঝাপ পড়তে লাগল মানুষ। নিমেষে তাদের কাছে এগিয়ে গেল অশ্বারোহীর দল। তরোয়ালের এক এক কোপে মানুষগুলোকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে লাগল।

পথের দু’পাশে মৃৎকুটীরগুলোয় তখন গৃহবধূদের কান্নার রোল। কেউ জানলার ফাঁক দিয়ে, কেউ খড়ের গাদায় লুকিয়ে কাঁপতে কাঁপতে দেখছে কীভাবে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ছে ঘরের মানুষটা।

তাদের হাত থেকে ছিটকে গেছে শঙ্খ। তারা হাহাকার করছে।

সেনারা লোভী চোখে মৃৎকুটীরগুলোর দিকে দেখলেও তাদের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে হচ্ছে। কারণ, রহিম খাঁয়ের কড়া নির্দেশ, রাজপ্রাসাদ অধিকার না করা পর্যন্ত জেনানাদের দিকে হাত বাড়ানো চলবে না! রাজবাড়ি দখলের পর ফূর্তি বা মন্দির ধ্বংস, সবই চলবে।

কালাপাহাড় নীরবে সব কিছু প্রত্যক্ষ করতে করতে চলেছেন। পথের দুপাশে পড়ে থাকা শত শত মৃতদেহ ও মেয়েদের হাহাকার তাঁকে আবার অবসন্ন ও বিষাদগ্রস্ত করে তুলেছে।

মনের মধ্যে কে যেন বারবার প্রশ্ন তুলছে, ‘এত মানুষ মেরে কার প্রতি প্রতিশোধ নিচ্ছ তুমি? দেবদেবীর মূর্তির প্রতি রাগ জীবন্ত মানুষদের ওপর মেটাচ্ছ কেন? এরা কী দোষ করেছে?’

‘অবশ্যই করেছে। হিন্দু হওয়াই এদের অপরাধ!’ কালাপাহাড় নিজেকে উত্তর দিতে যাচ্ছেন, পারছেন না। নিজের অবচেতনেই বহুযুগ আগের এক গান গুনগুনিয়ে এসে যাচ্ছে তাঁর জিহ্বাগ্রে।

‘মাতঃ শৈলসুতাসপত্নী,

বসুধা শৃঙ্গারহারাবলি,

স্বর্গারোহণ বৈজয়ন্তী!’

মা গঙ্গার উদ্দেশে গীত এই সঙ্গীত বহুকাল আগে তিনি শিখেছিলেন।

কালাপাহাড়ের মনে হল, মা গঙ্গাও তো মূর্তিরূপে পূজিতা হন। তবে কি এবার তিনি গঙ্গা নদীকেই ধ্বংস করে দেবেন?

মহাদেবের মস্তক থেকে উৎপন্ন এই মহা নদীর লোপও কি ঘটবে তাঁর হাতে?

‘কিন্তু এই ধ্বংসলীলার শেষ কোথায়? নদী সভ্যতার বাহক, সভ্যতার ধারক। তাকে শেষ করে তুমি কী পাবে?’ মন তাঁকে প্রশ্ন করে চলে।

কালাপাহাড় স্বগতোক্তি করেন, ‘পাওয়ার জন্য তো কিছু করছি না। মূর্তিতে ঈশ্বর নেই। থাকলে জগন্নাথদেব নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকতেন না। তাঁর ব্রাহ্মণ ভক্তকে তবে তিনি পাণ্ডাদের রোষ থেকে রক্ষা করতেন!’

মনের মধ্য থেকে কে যেন সহসা বলে উঠল,

‘দ্বিভুজ কি চতুর্ভুজ কি দশভুজ বেশ

হেরিয়া ভেবেছ মন, এই কি রূপের শেষ

চিন্তিলে অন্তরে ওরে

দেখিবে কি রূপ ধরে

চিৎরূপে যে ভাতে, সেই এই অনন্ত বিশ্বাকারে।’

কালাপাহাড় কেঁপে উঠলেন। মনের গুপ্ত প্রকোষ্ঠে লুকোনো স্মৃতি কেন বারবার উঠে আসে? কেন বারবার মনে পড়ে যায় বৃন্দাবনের সেই তরুণ শিক্ষকের স্মিতভাষ্য?

‘তুমি যা দ্যাখো, যাদের দ্যাখো, সেগুলো সব মূর্তি, রাজীবলোচন! কিন্তু ভগবানের আবার রূপ কী? তিনি তো বিশ্বরূপ, তাই অরূপ! বিশ্বের ক্ষুদ্র বৃহৎ তুচ্ছ মহান যাই বলো, সবই তাঁর রূপ। তাঁকে তাই নিরাকার বললেই বা আপত্তি কি!’

কালাপাহাড় যন্ত্রণায় কাঁপতে থাকেন।

ঠিক তখনই দেখেন, এক নারী দাঁড়িয়েছে সম্মুখে। সেনাদের দিকে তাকিয়ে দু’হাত দু’পাশে প্রসারিত করে বলছে, ‘দাঁড়াও! দাঁড়াও তোমরা!’

বাহিনী বিস্মিত! ‘কালাপাহাড় আসছে’ শুনলেই যেখানে নারীদের কন্ঠরোধ হয়ে যায়, নিজেদের সম্মান রাখতে তারা কী করবে ভেবে পায় না, সেখানে কে এই দুঃসাহসী নারী, যে পথ রোধ করছে?

নারীর বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ, পৃথুলা গড়ন, বিস্রস্ত পোশাক। বেণী খুলে লুটোচ্ছে সামনের দিকে। সীমন্তে সিঁদুর, কিন্তু তা সম্পূর্ণ ধেবড়ে গিয়েছে।

তার অগ্নিবর্ষী চক্ষুর দিকে চেয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েন কালাপাহাড়! বলে ওঠেন, ‘কে তুমি?’

নারী একটুও স্তিমিত না হয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘আমি এক সামান্য নারী। কিন্তু আপনি কি জানেন, যাকে মূর্চার ঘাটের শিবিরে আপনার সৈন্যরা ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছে, যাকে আপনার এই মিছিলের শেষে ঘোড়ার পিঠে নিয়ে আসা হচ্ছে, সে কে? জানেন, কী তাঁর পরিচয়?’

বিমুঢ় কালাপাহাড়। নির্বাক, স্তম্ভিত।

‘আজ আপনি তামাম বাংলার সেনাপতি!’ নারীটি আরও সামনে এল। তার দু’চোখে ঘৃণা। দক্ষিণ হস্তের তর্জনি তুলে বলল, ‘কিন্তু একদিন আপনি ছিলেন শুধুই ভাদুড়িয়া গ্রামের রাজু। মনে পড়ে যাদের অগ্নিসাক্ষী করে বিবাহ করে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছিলেন, সেই রূপালী ও রূপানীকে?’

কালাপাহাড় মুহূর্তে বেসামাল। বলে উঠলেন, ‘কোথায় তারা? তাদের…তাদের যে আমি অনেক খুঁজেছি গোটা গৌড়বঙ্গে! চর পাঠিয়েছিলাম এই রাঢ়বঙ্গেও। গিয়েছি গ্রামেও। পাইনি।’

‘তাদের কী করে পাবেন সেনাপতি?’ নারী ভ্রূ উত্থিত করে বলল, ‘শ্বশুরালয় থেকে পিত্রালয়, তারা সব জায়গায় আপনার জন্য অপমানিত হয়েছে, লাঞ্ছিত হয়েছে, বিতাড়িত হয়েছে।’

‘তারা কোথায়?’ কালাপাহাড় বলে উঠলেন, ‘এখন কোথায় তারা?’

অন্নদা একেবারে হাতির সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখ উঁচু করে বলে, ‘স্বামী! আপনার প্রথমা স্ত্রী রূপালী দাঁড়িয়ে রয়েছে আপনার সামনেই। আপনারই কৃতকর্মের জন্য তাকে পরিচয় গোপন করে দিনের পর দিন থাকতে হয়েছে।’

কালাপাহাড় বাকরুদ্ধ। কেন এই রমণীর চোখ তাঁর অত চেনা লেগেছিল, এখন বুঝতে পারছেন।

এই কি সেই রূপালী যার সঙ্গে তাঁর ছিল সংসারের প্রথম স্মৃতি? এই কি সেই রূপালী, যে সদ্যতরুণীর প্রতিচ্ছবি তাঁর দৃশ্যপটে ভেসে উঠেছে বারবার?

আচ্ছা, ওর বোন রূপানী? যে এতই ছোট ছিল, ঘুরত কালাপাহাড়ের কোলে চড়ে? কোথায় সে?

অন্নদা পড়ে ফেলে কালাপাহাড়ের মন। জ্বলন্ত চোখে আঙুল তুলে বলে ওঠে, ‘আর যাকে আপনার সেনারা কাল সারারাত চরম অত্যাচার করেছে, সে-ই আমার বোন, আপনার কনিষ্ঠা স্ত্রী রূপানী!’

কালাপাহাড় অমানুষিক জোরে চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘না! না! মিথ্যা কথা!’

অন্নদা চেঁচিয়ে ওঠে, ‘মিথ্যে কথা? সত্যিটা মানতে পারছেন না স্বামী? এতদিন যে লক্ষ লক্ষ মেয়েরা আপনার ফৌজের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই কারুর না কারুর কন্যা, স্ত্রী এমনকী মা! ছিঃ, স্বামী, ধিক।’

কালাপাহাড় অন্নদার চোখে চোখ রাখেন। তাঁর চক্ষু রক্তলালাক্ত। কর্কশকণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘ঝুট, ঝুট। হঠ যাও সামনে থেকে!’

ছুটে আসে রহিম খাঁ। সঙ্গে কয়েকজন সহকারী। দু’দিক থেকে তারা চেপে ধরে মহিলাকে, ‘হঠ যাও!’

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পরিস্থিতি আগের মতো হয়ে যায়। হাওদায় কালাপাহাড় বসে থাকেন পাথরের মতো।

৫৩

ওদিকে প্রদ্যুম্নপুরের পরিত্যক্ত প্রাসাদে সব কিছুই ঘটে চলেছিল হিকিম জগত কুমারের পরিকল্পনামাফিক।

উমাপতি হেমনলিনীকে নিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে নিষ্ক্রান্ত হতেই বিমূঢ় দ্বাররক্ষীরা ছুটে এল। আর তখনই ভোজবাজির মতো মাটি ফুঁড়ে উদয় হল জগতকুমারের সেই চারজন লাঠিয়াল। দ্বাররক্ষীদের অর্ধমৃত করে দিয়ে তারা উমাপতির পিছনে যাত্রা করল।

কয়েক দণ্ডের মধ্যে কদম্বঘাটি মধুশালার পিছনের সেই নিভৃত মৃৎকুটীরে হেমনলিনীকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছল উমাপতি।

‘এখানেই আছেন আপনার পিতা। আপনি কুটিরে যান। আমি এবার আসি।’

হেমনলিনী ভীত মার্জারের মতো ঢুকেই পিতাকে দেখতে পেল।

‘বাবামশাই!’

মাধব মল্ল চমকে উঠলেন। আতঙ্ক এসে জমা হল দৃষ্টিহীন মুখে, ‘মা রে! সেই এসেই পড়লি?’

‘কী বলছেন বাবামশাই? আপনিই তো লোক পাঠিয়েছিলেন!’

মাধব মল্ল বিলাপ করে ওঠেন, ‘আমি পাঠাইনি রে মা, আমি পাঠাইনি! সবই তোর নিয়তি…আর আমার…আমার কর্মফল!’

কিছুই বুঝতে পারে না হেমনলিনী। প্রকাশ্য দিবালোকেও এই নিভৃত কুটীর আলো আঁধারিতে ভরা। চারপাশ এমন ঘন গাছগাছালিতে পরিবৃত, আবছায়া আলো চতুর্দিক। নিঝুম, নিস্তব্ধ। এতদিন বিষ্ণুপুর আর প্রদ্যুম্নপুর ছাড়া গোটা পৃথিবীটাই ছিল হেমনলিনীর কাছে অজানা। ঝোঁকের মাথায় এসে সে কি ভুল করল? পিতার এমন অদ্ভূত ব্যবহার কেন?

হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ। হেমনলিনী শিউরে উঠে দেখল, দরজা দিয়ে ঢুকে এসেছেন বিষ্ণুপুরের হিকিম জগতকুমার।

একি! এই লোকটা এখানে কেন? যতবার বিষ্ণুপুর গিয়েছে হেমনলিনী, এই লোকটার কামুক দৃষ্টিতে বিদ্ধ হয়েছে সে। মনে হয়েছে চোখ দিয়ে যেন সে লেহন করছে হেমনলিনীকে।

জগতকুমার পান চিবোচ্ছিলেন। চিবোতে চিবোতে ধীরেসুস্থে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বৃদ্ধ মাধব মল্লের সামনে এ’সব করার ইচ্ছা তাঁর ছিল না। কিন্তু কিছু করার নেই, এই কুটীরে একটিই মাত্র ঘর। অবশ্য সুবিধা হচ্ছে যে, বৃদ্ধ চোখে তেমন দেখতে পান না!

জগতকুমারকে এগিয়ে আসতে দেখে হেমনলিনী আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু কে শুনবে সেই আর্তস্বর! কুটীরে পাহারা দিচ্ছে জগতকুমারেরই নাটকাঞ্চন মৌজার লাঠিয়ালরা।

হেমনলিনীর পরনের শাটিকা একটানে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন জগতকুমার। তারপর তাকে জাপটে ধরলেন বিপুল শরীর দিয়ে। নিজের দেহভারে হেমনলিনীকে ইচ্ছেমতো পিষ্ট করতে লাগলেন। তাঁর মুখ নিঃসৃত পানের কষে হেমনলিনীর মুখ লোহিতাভ হয়ে উঠল।

বাধা দেওয়া নিষ্ফল! হেমনলিনী অসহ্য যন্ত্রণায় স্তব্ধ। অন্ধ পিতা যাতে শুনতে না পান। সে দাঁতে দাঁত চেপে রইল।

তবে জগত কুমারের সেইসবের বালাই নেই। তিনি যথেচ্ছভাবে রমণসুখের শব্দ করে চলেছিলেন। শত্রুর শেষ রাখায় তিনি বিশ্বাস করেন না। মাধব মল্লকে একটু পরেই হত্যা করা হবে।

অন্ধ মাধব মল্ল দাঁতে দাঁত চেপে বধির হওয়ার ভান করে রইলেন। তাঁর দু’চোখ দিয়ে অবিরাম জল ঝরছিল। নিজের কৃতকর্মের গ্লানিতে, কন্যার সর্বনাশে।

বীভৎস এই দৃশ্যপট স্থায়ী হল কিছু সময়। সম্ভোগশেষে পরিতৃপ্ত জগতকুমার বিস্রস্ত পোশাক ঠিক করতে করতে কুটির থেকে বেরিয়ে এলেন। বেরোবার সময় হেমনলিনীর শাটিকা মাটি থেকে তুলে নিয়ে তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে এলেন। খেয়াল করলেন না, টলতে টলতে উঠে বসে হেমনলিনী খুলছে তার আঁচলের খুঁট। চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে তার আঙুল।

উমাপতি হেমনলিনীকে কুটিরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে লাঠিয়াল মোতায়েন করে গিয়েছিল। জগতকুমার বেরোতেই তারা অভিবাদন জানাল।

জগতকুমার হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘ওদের ধাতস্থ হতে সময় দে। পালাতে তো পারবে না। আমি আসছি।’

কুটিরের পিছনে একটি ক্ষুদ্র জলাশয়। স্বচ্ছ জল টলটল করছে। ছোট-বড় গাছ ও প্রচুর আগাছা।

জগত কুমার থপথপ করে এগিয়ে গেলেন। ভ্যাপসা গরম। শারীরিক পরিশ্রমে শরীর ঘর্মাক্ত। জগত কুমার উবু হয়ে পুকুর থেকে আঁজলা করে জল নিয়ে মুখে-চোখে দিতে গেলেন।

পারলেন না। পিছন থেকে প্রকাণ্ড ছোরা সোজা পিঠে গেঁথে গেল। সেই ধাক্কায় তাঁর বিপুল দেহ পড়ে গেল পুকুরের মধ্যে।

বিকট আর্তনাদ বেরোল জগতকুমারের গলা দিয়ে।

রুদ্রাক্ষ গাছগুলোর আড়ালে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিল। তার নিশানা অব্যর্থ। জগত কুমারের হৃদপিণ্ডে গিয়ে বিঁধেছে ওই ছোরা, প্রাণবায়ু উড়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না।

রুদ্রাক্ষর শরীর রাগে কাঁপছিল। যে হেমনলিনীকে সে দূর থেকে ভালোবেসেছিল, তার এই পরিণতি সে মানতে পারছিল না।

রুদ্রাক্ষের মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হচ্ছিল। এই কয়েকদিনের অজ্ঞাতবাস তাকে যে উপসংহারে পৌঁছে দিতে পারেনি, আজকের এই ঘটনা তাকে সেখানে উপনীত করল। রুদ্রাক্ষ অনুভব করল, তার এই মধ্যযৌবনে এসে উপস্থিত হয়েছে প্রেম! এখনি হেমনলিনীকে নিয়ে এখান থেকে পালাতে হবে, যে করে হোক!

হেমনলিনীর সঙ্গে না-হয় চলেই যাবে এই গ্রামবাংলার কোনও অপরিচিত গ্রামে।

সেখানে কেটে যাবে বাকি জীবন! তাকে ঈশ্বর আবার সুযোগ দিয়েছেন! পাপপূণ্য, ভালোমন্দ, উত্থানপতনের এই জীবনে ক্লান্ত সে।

সম্ভবত শেষ সুযোগ! সেই ঈশ্বর আল্লাহ হোক বা শ্রীকৃষ্ণ, যায় আসে না তার! চায়না সে যুদ্ধের ক্রীড়নক হতে, চায় না মানুষের ঘৃণার সামনে পড়তে, চায় না মখমলের তাকিয়ায় বিলাসবহুল জীবন। এবার শুরু করবে এক শান্তির জীবন। হেমনলিনীর সঙ্গে।

কিন্তু রুদ্রাক্ষ কুটিরে প্রবেশ করতে পারল না।

দু’জন লাঠিয়াল কাছাকাছিই ছিল। তারা মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ল রুদ্রাক্ষর ওপরে। ভীষণ লড়াই হল। একজন লাঠিয়ালের নিষ্ঠুর বর্শা সহসা ফালাফালা করে দিল রুদ্রাক্ষের বুক। অবশ্য দুই লেঠেলকেই ছোরার আঘাতে যমের দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে রুদ্রাক্ষ।

টলতে টলতে রুদ্রাক্ষ গিয়ে দাঁড়াল কুটিরের পৈঠায়। মাথা বেয়ে রক্ত নামছে অঝোরে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।

ও আছড়ে পড়ল কুটিরের মধ্যে। মাথাটা কোনোমতে তুলতে চেষ্টা করল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, একফোঁটা জল না পেলে এখুনি ফেটে যাবে বুক।

তারই মধ্যে আধখোলা চোখে ও দেখতে পেল, মাটিতে পড়ে রয়েছে তার প্রাণের হেমনলিনী। ডান হাতে মুঠো করে ধরা কিছু শিকড়। নগ্ন দেহ তখনও কেঁপে কেঁপে উঠছে। নিষ্প্রাণ মৎস্যের মতো স্তনদুটো দু’পাশে এলিয়ে থাকলেও পা দুটো যন্ত্রণায় ছটফট করে চলেছে।

হেমনলিনী ও রুদ্রাক্ষ, দু’জনেরই প্রাণবায়ু সম্ভবত একইসঙ্গে বেরিয়ে গেল।

নীরব দর্শক হয়ে তখনও প্রস্তরবৎ বসেছিলেন দৃষ্টিহীন রাজকুমার মাধব মল্ল। নিয়তি আর কর্মফলের হাতের পুতুল হয়ে।

৫৪

রহিম খাঁ ডাকে, ‘হুজৌর! প্রাসাদের নজদিক পৌঁছে গেছি!’ ওই যে, মল্লরাজা নিজেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন!’

হস্তীপৃষ্ঠে আসীন কালাপাহাড় চিন্তার জগতে ডুবে ছিলেন। চমকে তাকালেন। তাই তো! প্রবেশপথের বাইরে দশ-বারোজন অমাত্য সহ দাঁড়িয়ে এক তেজস্বী পুরুষ। তাঁর পরনে রাজপোশাক। মাথায় শিরস্ত্রাণ। হাতে তরবারি।

ডান পাশে প্রকাণ্ড বড় এক কামান। কামানের পাশে আদেশের অপেক্ষায় দুই গোলন্দাজ। এই কি বিষ্ণুপুরের সেই বিখ্যাত দলমাদল কামান?

কিছু আগে রহস্যময় নারীর বিলাপ এখনও বেজে চলেছে মনের তন্ত্রীতে। প্রাণপণে মনোযোগ সরিয়ে কালাপাহাড় হিসেব করতে থাকেন, ওই কামানের গোলা কতটা দূরত্ব অতিক্রম করে আঘাত হানতে পারে! এবং তাকে প্রস্তুত করতে যতটা সময় লাগবে, তার মধ্যে ছোট কামানগুলো দিয়ে কি প্রবেশ পথের বাইরে দণ্ডায়মান মানুষগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া সম্ভব? গতিবিদ্যা ও ত্রিকোণমিতির নানা সমীকরণ মনে মনে কষছিলেন তিনি।

ঠিক এই সময়ে রাজার বামপাশে দণ্ডায়মান মুণ্ডিত মস্তক ব্যক্তির দিকে দৃষ্টি পড়ামাত্র কালাপাহাড়ের মেরুদণ্ড দিয়ে হিমস্রোত বয়ে গেল।

এ-কথা সর্বজনবিদিত যে, মহম্মদ ফারমুলী পণ্ডিতদের দু’চক্ষে সহ্য করতে পারেন না! তাঁর মনে হয়, এঁরাই বেদোত্তর যুগে ধীরে ধীরে বেদকে অপভ্রংশের পথে নিয়ে গিয়েছেন, যার জন্য আজ হিন্দু ধর্মের সর্বাঙ্গ দগদগে বিষ স্ফোটকে পূর্ণ।

কিন্তু…কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর মনে একটুও ঘৃণা আসছে না। বড় চেনা লাগছে প্রশান্তদর্শন মানুষটিকে। কে ওই পণ্ডিত?

রহিম খাঁ ফিসফিস করে ওঠে, ‘হুজৌর! গোলা দাগতে বলব?’

রণনীতি অনুযায়ী শত্রুকে প্রথমে প্রস্তাব পাঠাতে হয় সন্ধির জন্য। সন্ধিতে শত্রু অসম্মত হলে তখনই বেজে ওঠে রণভেরী।

কিন্তু সে তো যখন যুদ্ধ হয়! কালাপাহাড় কি আর যুদ্ধ করেন? তিনি করেন ধ্বংস। তীব্র আক্রোশ ও উন্মত্ততায় পূর্ণ সেই ধ্বংসলীলায় কোনও নিয়মনীতিই নেই।

কালাপাহাড় ঝুঁকে পড়েছিলেন সম্মতি দেওয়ার জন্য, কিন্তু তাঁকে স্তম্ভিত করে দিয়ে সেই ওজস্বী পণ্ডিত মন্দ্রকণ্ঠে ডেকে উঠলেন, ‘রাজীবলোচন!’

কালাপাহাড় কেঁপে উঠলেন! এ কি শুনলেন তিনি!

পণ্ডিত আবার বললেন, ‘রাজীবলোচন! তোমাদের একটি গোলাও যদি এদিকে আসে, আমাদের এই দলমাদল কামান কিন্তু তোমাদের সবাইকে গুঁড়িয়ে দেবে। মাকড়া পাথর গলানো এই কামানের তেজ সম্পর্কে তোমার কোনও ধারণা নেই!’

রাজীবলোচন? কালাপাহাড়ের সর্বাঙ্গ জুড়ে শিহরন—বহুবছর, বহুযুগ, বহুজন্ম পরে এই ডাক শুনলেন তিনি! কে ডাকে এই নামে?

এই নাম ধরে ডাকার মতো কেউই তেমন আর ইহজগতে যে অবশিষ্ট নেই!

পণ্ডিত এবার বীরহাম্বীরের খেমা ছেড়ে সামান্য এগিয়ে এলেন। তেজ তাঁর সর্বাঙ্গ দিয়ে ঠিকরে বেরোচ্ছে। গৌরবর্ণ, ঋজু দেহটিতে মনে হচ্ছে কোন জ্যোতির্ময় দিব্যপুরুষ!

কালাপাহাড় কম্পমান কণ্ঠে বললেন, ‘কৌ—কে—কে আপনি?’

ব্রাহ্মণ নির্ভয়ে এগিয়ে আসছেন। সবাই অবাক। ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, নিরস্ত্র। এই পণ্ডিতের মনে কী ভয় নেই?

পণ্ডিত রণহস্তীর মাত্র কয়েক হাত দূরে এসে থামলেন। চারপাশে সূচীভেদ্য নৈঃশব্দ্য। আফগান সেনা থেকে বীরহাম্বীরের অমাত্যবর্গ, সকলে স্তব্ধ। তারা এক অবিশ্বাস্য দৃশ্যের সাক্ষী।

‘কী রাজীবলোচন, আমায় চিনতে পারছ না? ভুলে গেলে আমার কণ্ঠস্বর? নাকি, তোমার এই ছদ্মবেশ আমায় চিনতে চাইছে না?’

কালাপাহাড়ের মুখে কথা সরছে না। হাওদায় বসে কাঁপছেন থরথর করে। তার চোখ এতটাই লাল, মনে হচ্ছে তা ফেটে রক্ত ঝরবে এখুনি।

কী করে কথা বলবেন? তাঁর চোখের সামনে যে ফুটে উঠেছে একটি বহু পুরোনো দৃশ্য। সেই দৃশ্যে এক তরুণ পণ্ডিত কিশোর শিষ্য রাজীবলোচনকে বলছে,

‘ও যে ধরে রে সহস্রবাহু সহস্র প্রহরণ

সহস্র চরণে করে অজস্র বিচরণ

সহস্র বদনে খায়, সহস্র বদনে চায়

সহস্র শ্রবণে শুনে কথা রে।

সহস্রশীর্ষা না হইলে কেবা ওরে অবোধ প্রাণ,

এতই গৌরবে করে সহস্র ধারায় স্নান,

সহস্র ব্রহ্মাণ্ড যারে,

হৃদয়ে ধরিতে নারে

সেই তো বাস করে তোমারও ক্ষুদ্র সহস্রারে।

যিনি বাইরে অনন্তকোটি ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপী বিরাজমান, অনন্তকোটি ব্রহ্মাণ্ডেও যার স্থান হয় না, তিনিই আবার রয়েছেন ক্ষুদ্র জীব হৃদয়ে।’

এ কী রহস্য? এতদিন পর এই অপরূপ ছবি মানসপটে ভেসে উঠছে কেন? কালাপাহাড়ের জিভ শুকিয়ে যাচ্ছে, একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়ছেন তিনি। না। এই কণ্ঠস্বর তিনি পরজন্মেও ভুলবেন না।

পণ্ডিত এবার গেয়ে উঠলেন,

‘ও যে অজ্ঞানে ভুলাতে রে মন, পাতে এমন ইন্দ্রজাল

কভু কালীরূপে করে ধরে করাল করবাল।

কখনও বা বংশী ধরি

ত্রিজগতের মন হরি

আনন্দ কাননে করে লীলা রে।

কভু মহাকালরূপে শ্মশানেতে করে বাস

রাজরাজেশ্বরী কভু মুখে মৃদু মৃদু হাস

যে ভাবে যে জন চায়,

সেইভাবে দেখা পায়

ও যে জ্যোতিরূপে পরব্রহ্ম, শব্দরূপে ওঙ্কারে।’

কালাপাহাড় সজোরে মাথা ঝাঁকাচ্ছেন—নাহ! সব মনে পড়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে, বহুকাল আগের এক কথোপকথন।

‘তুমি যা দ্যাখো, যাদের দ্যাখো, সেগুলো সবই তো মূর্তি, রাজীবলোচন! ভগবানের আবার রূপ কী? তিনি তো বিশ্বরূপ, তাই অরূপ!’

‘তবে কি তিনি নিরাকার পণ্ডিতমশাই?’

‘এই বিশ্বের ক্ষুদ্র বৃহৎ তুচ্ছ মহান যাই বলো, সবই তাঁর রূপ। তাঁকে তাই নিরাকার বললেই বা আপত্তি কি? সব রূপে রূপ মিশাইয়া তুমি আপনি নিরাকার! তিনি মূর্তিতে আছেন, আছেন শূন্যেও।’

কালাপাহাড় শুকনো পাতার মতো কাঁপতে লাগলেন। এত বড় সত্য জানা সত্ত্বেও, কৈশোরে পরমসত্যের উপলব্ধি হওয়া সত্ত্বেও তিনি এ কী করেছেন এতদিন! কার সামনে অস্ত্র ধরে যুদ্ধে উদ্যত তিনি? ছিঃ! ছিঃ!

পাঠান সেনারা বিস্ময়ের চরমে পৌঁছে দেখল, সুলেমান কররাণীর দক্ষিণ হস্ত, সারা দেশে ত্রাস জাগানো দুর্ধর্ষ সেনাপতি মহম্মদ ফারমুলীর চক্ষু দিয়ে অঝোরে ঝরছে জলধারা। আর তিনি সামলাতে পারছেন না নিজেকে! কাঁদতে কাঁদতে নামছেন হাতি থেকে।

মা’কে অনেকক্ষণ পরে দেখলে শিশু যেভাবে অস্থির টলোমলো পায়ে ছুটে যায়, কালাপাহাড়ও সেইভাবে ছুটে যাচ্ছেন ওই হিন্দু পণ্ডিতের দিকে।

কাঁদতে কাঁদতে পণ্ডিতের পায়ে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, ‘পণ্ডিতমশাই! আমি…আমি এ কী করলাম! এত হত্যা, এত ধ্বংস! আমার বিবাহিত স্ত্রী পর্যন্ত ধর্ষিতা হয়েছে আমারই সেনাদলের হাতে, আমারই অঙ্গুলিহেলনে। আমার…আমার যে নরকেও স্থান হবে না পণ্ডিতমশাই!’

শ্রীনিবাস আচার্য পরম স্নেহে টেনে তুললেন তাঁর একসময়ের প্রিয় ছাত্রকে, ‘বাবা তুমি ভুল করেছ! খুব বড় ভুল। ধরাধামে তুমি এসেছিলে প্রতিষ্ঠার জন্য, কিন্তু করে ফেলেছ বিসর্জন!’

‘কিন্তু কেন? কেন করলাম এই ভুল, গুরুদেব?’

শ্রীনিবাস আচার্য বললেন, ‘ক্রোধাৎ ভবতি সম্মোহ! ক্রোধে তোমার মনে মোহ জন্মেছিল। এখন সেই ক্রোধের আগুন নিভেছে, অন্তরে এসেছে বিষাদ। মোহও তাই কেটে যাবে।’

‘প্রভু, আপনি কেন এতদিন দেখা দেননি?’

‘এর আগে দেখা দিলেও যে বিশেষ লাভ হত না রাজীবলোচন!’ শ্রীনিবাস আচার্য বললেন, ‘ক্ষেত্র কর্ষিত না-হলে বীজ বপন করে কি কিছু হয়? তখন তুমি ছিলে ভোগী। এখন সেই ভোগের কাল শেষ হয়েছে। ক্ষেত্র কর্ষিত হয়েছে। ভগবান বলেছেন,

যদা তে মোহকলিলং বুদ্ধির্ব্যতিতরীষ্যতি

তদা গন্তাসি নির্বেদং।

মোহবুদ্ধি গেলে তবেই আসে নির্বেদ। মূর্তির প্রতি তোমার ঘৃণা অদৃশ্য হয়েছে। তুমি বুঝেছ, তুমি মূর্ত, আমি মূর্ত, এই জগত, এই ব্রহ্মাণ্ড, স্থলজল, জীব, উদ্ভিদ, স্থাবর, জঙ্গম, সবই তো মূর্ত। যখন আমরা থাকিনা, তখন তা হল আমাদের অমূর্ত অবস্থা। আর যখন থাকি, তখনই মূর্ত হই। তাই সব রূপ, সব মূর্তিই অমূর্ত হয়। উৎপত্তি ও লয়, লয় ও উৎপত্তি, এই তো বিশ্বরূপের লীলা!’

কালাপাহাড় ভগ্নস্বরে বললেন, ‘তবে এত মূর্তি সম্মুখে থাকতে হিন্দুরা মৃত্তিকা, প্রস্তর বা কাষ্ঠ ইত্যাদি দিয়ে আবার মূর্তি গড়ে কেন?’

বীরহাম্বীর অনেকক্ষণ ধরে শুনছিলেন এক পণ্ডিত ও এক মুসলমান সেনাপতির কথোপকথন। এক প্রাক্তন গুরু ও শিষ্যের আলাপ। মহাপ্রলয়ের শেষে এ যেন এক আশ্চর্য কথামৃত। তিনি এবার বলে উঠেন, ‘মৃৎ ও চিৎ-এ প্রভেদ কী? যা মৃৎ তাই তো চিৎ। যা জড়, তা-ই চৈতন্য। নদী যেমন সম্মুখে থাকলেও নদী পান করা যায় না, ঘটি দিয়ে জল তুলে তৃষ্ণা নিবারণ করতে হয়, তেমনই সাধনার জন্য প্রয়োজন মূর্তি। ভগবান নিজে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, সব রূপেই আবির্ভূত হয়েছেন। তিনিই বংশীধারী, আবার তিনিই ত্রিশূলধারী। তিনিই কালী, তিনিই অন্নপূর্ণা। তৃষ্ণা নিবারণ হওয়া নিয়ে কথা। আপনার যে আকারের ঘটিতে ইচ্ছা, তাতেই না-হয় আপনি জল ভরে পান করবেন!’

কালাপাহাড় স্থির দৃষ্টিতে দেখছেন আঞ্চলিক নৃপতিকে। মল্লরাজ্যের ধর্মপ্রিয়তা, তাঁর অজানা নয়। তিনি বললেন, ‘তাই কি? তবে আমি তো উৎকলে, কামরূপে কত মন্দির-মূর্তি দেখলাম। কই, সেই মূর্তির মধ্যে ঈশ্বরকে পেলাম না!’

‘পাননি—কারণ তখন আপনার হৃদয় নির্মল ছিল না। নির্মল না হলে চিৎ বিভাসিত হবে কী করে? আপনার প্রকৃতি তখন ক্রোধ ও প্রতিহিংসায় পরিপূর্ণ ছিল। অসুরভাবাপন্ন মনে আপনি মৃন্ময়ে চিন্ময় দেখবেন কী করে?’

শ্রীনিবাস আচার্য বললেন, ‘রাজীবলোচন, স্মরণ করো সেই শ্লোক।

অবজানন্তি মাং মূঢ়া মনুধীং তনুমাশ্রিতম

পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম।

মোঘাশা মোঘকর্মাণো মোঘজ্ঞানাবেচতসঃ

রাক্ষসীমাসুরীঞ্চৈব প্রকৃতিং মোহিনীং শ্রিতাঃ।।

যাদের আশা বিফল, কর্ম বিফল, জ্ঞান বিফল, যাদের চিত্ত বিক্ষিপ্ত, সেই সমস্ত অসুর ও রাক্ষস স্বভাবের মূর্খলোকেরা পরমতত্ত্ব না জেনে মানুষদেহধারী ঈশ্বরকে অবজ্ঞা করে।’

কালাপাহাড় অস্থির হয়ে বললেন, ‘তবে আমি যখন দিনের পর দিন অনাহারে জগন্নাথ মন্দিরের বাইরে পড়েছিলাম, তখন তো আমার মনে কোনও পাপ ছিল না, কোনও অবিশ্বাস ছিল না। তাহলে কেন ভগবান আমাকে পথ দেখালেন না?’

‘রাজীবলোচন, সেইসময় তুমি একবারও জগন্নাথকে ভাবোনি যে!’ শ্রীনিবাস আচার্য বললেন, ‘তোমার দেহ ছিল শ্রীক্ষেত্রে, কিন্তু মন যাতায়াত করছিল গৌড়ে ও ভাদুড়িয়ায়। তুমি শাহজাদীর মুখ স্মরণ করছিলে, গ্রামের সেই পণ্ডিতদের প্রতি ক্রোধে উন্মত্ত ছিলে। জগন্নাথ কাকে পথ দেখাবেন? রাজীবলোচনকে? না রাজীবলোচনের মাংসপিণ্ডকে?’

‘আমি মহাপাতকী, প্রভু!’ বিবশকণ্ঠে বললেন কালাপাহাড়, ‘আমার যে-কোনও গতি নেই। নরকেও ঠাঁই নেই!’

আচার্য মহাশয় হাসলেন। বললেন, ‘রাজীবলোচন, তোমার অনুতাপ যখন হয়েছে, গতিও তখনই হয়েছে। অপি চেৎ সুদুরাচারো ভজতে মামনন্যভাক। একমনে তাঁর ভজন করলে অতি দুরাচারও তাঁর চরণে স্থান পায়, রাজীবলোচন! শ্রীক্ষেত্রে মহাপাপীরও স্থান আছে।’

‘কিন্তু কোথায় শ্রীক্ষেত্র, গুরুদেব?’ কালাপাহাড় আকুল হয়ে বললেন, ‘আমি যে নিজে হাতে সেই দারুব্রহ্ম ধ্বংস করেছি!’

শ্রীনিবাস আচার্য স্নেহাদ্র সুরে বললেন, ‘দারুব্রহ্ম ধ্বংস করবে, সেই শক্তি তোমার নেই, রাজীবলোচন! তুমি যা ধ্বংস করেছ, সে তাঁর মৃন্ময়রূপ মাত্র। রাজীবলোচন, তাঁর শরণ নাও, তিনিই তোমাকে মুক্তির আলো দেখাবেন, বাবা! হিন্দু হোক বা মুসলিম, ভালোবাসা, স্নেহ, মায়ামমতাই যে আসল ধর্ম!’

কালাপাহাড় আবেগের চরমসীমায় পৌঁছে গিয়েছিলেন।

এবার তাঁকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন বীরহাম্বীর। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পুত্রের হত্যাকারী এ। কষ্টে তাঁর বুক এখনও ফেটে যাচ্ছে। তবু এত কিছু সত্ত্বেও নিজের পুত্রহন্তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন তিনি।

অনুতাপের চেয়ে বড় শাস্তি আর কিছু নেই। আর ক্ষমা করে যে শান্তি, সেও কিছুতে নেই!

অল্পক্ষণের মধ্যেই দুর্ধর্ষ সেনাপতির অশ্রুতে ভিজে গেল বীরহাম্বীরের কাঁধ। শ্রীনিবাস আচার্য এগিয়ে এসে নিজের বুকে টেনে নিলেন দুজনকেই। মৃদুস্বরে পরম তৃপ্তিতে বললেন, ‘মল্লভূমে আমার কাজ শেষ হল। আহ! কী শান্তি!’

শ্রীনিবাস আচার্যের জাদুস্পর্শে দুই আগ্রাসী শাসক পরিণত হলেন মন্ত্রশান্ত সিদ্ধপুরুষে।

৫৫

সেই কালান্তক যুদ্ধের পর অতিবাহিত হয়েছে বহুবছর। ধরিত্রী এর মধ্যে বহুবার প্রদক্ষিণ করেছেন সূর্যদেবকে। ব্রীড়াবতী, গন্ধেশ্বরী বয়ে চলেছে আপন প্রবাহে। দ্বারকেশ্বর একইভাবে এসে মিশে যাচ্ছে গঙ্গায়। এই সেই দ্বারকেশ্বর, যাতে বিলীন হয়ে গিয়েছিল শীতলকুমারের অস্থি। এই সেই দ্বারকেশ্বর, যা বুকে বয়ে নিয়ে চলেছে রুদ্রাক্ষ-হেমনলিনীর করুণ স্মৃতি।

এই সেই দ্বারকেশ্বর, যা বেয়ে একদিন শূদ্রসন্তান পবন অন্তঃসত্ত্বা মনোহরাকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল অজানার উদ্দেশে!

দ্বারকেশ্বর বেয়ে উত্তরে বহুদূর পথ গেলে তবে আসে সেই পবিত্র বৃন্দাবন ধাম। সনাতন গোস্বামীকে শ্রীচৈতন্য বলেছিলেন, ‘নিজ প্রিয় স্থান আমার মথুরা বৃন্দাবন।’

এই কাহিনির অন্তিম পর্বও সেই পবিত্র বৃন্দাবন ধামেই।

এক প্রভাতে বৃন্দাবনধামের এক কুটীরের সামনে বসে এক বৃদ্ধ অন্য বৃদ্ধকে বলছিলেন, ‘আর বোধহয় বেশিক্ষণ শ্বাস নেই!’

দ্বিতীয় বৃদ্ধ উত্তর দিলেন, ‘তা কেন? মধুসূদন কোবরেজকে এত্তেলা পাঠানো হয়েছে তো শুনলাম! এ’যাত্রা বেঁচে গেলেও যেতে পারে!’

‘রাখো দিকি!’ প্রথম বৃদ্ধ বললেন, ‘বাবা বিশ্বনাথ যখন ডেকে পাঠিয়েছেন, তোমার ওই কোবরেজ এসে কিছুই করতে পারবে না। এমনিতেই তার স্থান হল ষষ্ঠ।’

দ্বিতীয় বৃদ্ধ বললেন, ‘বলো কী হে! মধুসূদন কোবরেজ তো এখন বৃন্দাবনের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক। লোকে বলে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি! সে ষষ্ঠ হতে যাবে কেন?’

‘আহ!’ প্রথম বৃদ্ধ এবার রীতিমতো বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন, ‘চরক সংহিতা কি পড়োনি? সেখানে তো স্পষ্ট বলা আছে,

মালাকারশ্চর্মকারঃ নাপিতো রজকস্তথা।

বৃদ্ধারণ্ডা বিশেষণ কলৌ পঞ্চ চিকিৎসকঃ।।

কলিযুগে চিকিৎসক হচ্ছেন পাঁচজন। বাগানের মালী, কর্মকার, নাপিত, ধোপা এবং পাড়ার বৃদ্ধা বেশ্যা। এরা ছাড়া কেউ আয়ুর্বেদ শাস্ত্র পড়ে চিকিৎসক হলে সে তো ষষ্ঠই হল!’

দ্বিতীয় বৃদ্ধ প্রতিবাদের ভঙ্গিতে কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় কুটীরের সামনে এসে দাঁড়াল মধুসূদন কবিরাজ।

বাস্তবিকই এখন বৃন্দাবনধামের শ্রেষ্ঠ আয়ুর্বেদাচার্য মধুসূদন কবিরাজ। মধুসূদন আশৈশব ছিল অত্যন্ত মেধাবী। নিজের তীক্ষ্ন বুদ্ধির জোরে সে মুখে মুখে এত জটিল আঁক কষতে পারত যে তখন থেকেই বিদ্বানমহলে সে স্নেহের পাত্র। এক আয়ুর্বেদাচার্যের অধীনে চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষার পরে সে-ই এখন বৃন্দাবনের সবচেয়ে বিখ্যাত কবিরাজ। পসারও হয়েছে বিস্তর। লোকে জটিল অসুখ সারাতে তাকেই ডেকে নিয়ে যায়।

কুটিরে রোগশয্যায় শায়িত এক অশীতিপর বৃদ্ধ। বৃদ্ধের রোগজীর্ণ হাত তুলে নিয়ে প্রথমেই ভালো করে নাড়ি দেখল মধুসূদন। তারপর হাতের বালুকাঘড়ি নামিয়ে রাখল রোগীর শিয়রে।

ভৃত্য রামলোচন সাগ্রহে প্রশ্ন করল, ‘কী বুঝলেন বৈদ্যজি? বুড়োবাবা ভালো হয়ে যাবেন তো?’

মধুসূদন একটা নিঃশ্বাস ফেলল। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে রোগীকে একঝলক দেখেই অনেক কিছু অনুমান করা সম্ভব। সে বুঝে গিয়েছে যে এঁকে ফেরানো আর সম্ভব নয়। নাড়ি ক্ষীণ হয়ে আসছে। চোখ খোলা থাকলেও নিষ্প্রভ, চোখের দু’পাশে জলকণা। রোগীর দেহও বয়ঃভারে শীর্ণ হয়েছে, তবে শরীরের কাঠামো বলে দেয় একদা বিশাল শক্তিধর ছিলেন।

কে ইনি?

মধুসূদন কবিরাজ বেশি কৌতূহল দেখাল না। বৃন্দাবন ধামে বাঙালি বিধবা আর মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের অভাব নেই। অনেকেই মৃত্যুর আগে চলে আসে পুণ্যার্জনের আশায়। ইনিও হয়তো তেমনই কেউ। সে বলল, ‘ওই প্রদীপটা নিভিয়ে দাও তো!’

রামলোচন ত্রস্তহাতে প্রদীপটা নিভিয়ে দেওয়ামাত্র মধুসূদন রোগীর ওপর ঝুঁকে পড়ল।

ও বলল, ‘বলছি, প্রদীপ নেভার গন্ধটা পাচ্ছেন?’

বৃদ্ধ অতিকষ্টে বলেন, ‘না!’

সনাতনী চিকিৎসা পদ্ধতিতে এভাবে কয়েকটি লক্ষণের মাধ্যমে রোগীর আয়ুদশা নির্ণয় করা সম্ভব। ঘিয়ের প্রদীপ নেভার গন্ধ যদি কোনও ব্যক্তির নাকে প্রবেশ না করে, তার মানে সেই ব্যক্তি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দেহরক্ষা করতে চলেছে।

উঠে প্রস্থানোদ্যত হয়ে সে ইঙ্গিতে রামলোচনকে বোঝায়, ‘ফেরানো যাবে না গো!’

ছলছল চোখে রামলোচন হাত জোড় করে আকাশের দিকে তাকায়। গান ধরে :

শ্রীকৃষ্ণ গোবিন্দ হরে মুরারি

হে নাথ, নারায়ণ বাসুদেবা।

পিতু মাতু সোয়ামি সখা হমারে

হে নাথ, নারায়ণ বাসুদেবা।

বৃদ্ধ অমনি কোনওমতে দু-হাত জড়ো করে অশ্রুতপ্রায় স্বরে বললেন, ‘হরি বলো!’

রামলোচন উদাত্তস্বরে গাইছিল,

‘…হে নাথ, নারায়ণ বাসুদেবা।

শ্রীকৃষ্ণ গোবিন্দ হরে মুরারি

হে নাথ, নারায়ণ বাসুদেবা।

শ্রীকৃষ্ণ গোবিন্দ হরে মুরারি

হে নাথ, নারায়ণ বাসুদেবা।…’

বৃদ্ধ কম্পমান হাতে ফের তালি দিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললেন, ‘হরি বলো!’

রামলোচনও বলে উঠল, ‘হরি হরি!’

মধুসূদন কবিরাজ বিহ্বল হয়ে দেখছিল।

এমনিতে তার বেশ কঠোর হৃদয়। বহু রোগীকে চোখের সামনেই মরতে দেখেছে, তাদের মধ্যে অনেকেই অল্পবয়েসি। কিন্তু আজ এই বৃদ্ধের কণ্ঠে এমন অমোঘ কিছু ছিল, যা তার মনকে সজল করে তুলল। সে নিজেও বলে উঠল, ‘হরি হরি!’

ইঙ্গিতে একটু জল চাইলেন মানুষটি। রামলোচন সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মাথাটাকে একহাতে আলতো করে তুলে ধরে অন্য হাতের পাত্র থেকে একটু একটু করে জল ঢেলে দিল তাঁর মুখে।

জলপান শেষে তৃপ্ত রামলোচনকে বললেন বৃদ্ধ, ‘কবিরাজকে দক্ষিণা দিয়ে বিদায় জানিও।’ কথা শেষ করেই চোখ বুঁজলেন তিনি।

রামলোচন ডাকল, ‘বৈদ্যজি!’

‘কিছু বলছেন?’

‘জি!’

‘বলুন।’

‘প্রভুর সাধ আছে আপনার সময় এবং বিদ্যার দাম দেওয়ার, কিন্তু সাধ্য নেই। তিনি যে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন মহাপ্রভুর পায়ে! এই অবস্থায় আপনাকে দেওয়ার মতো কাঞ্চনমূল্য এই কুটিরে নেই।’

মধুসূদনের ঘোর কেটে গেল। সে যেন কিঞ্চিৎ আবিষ্ট হয়ে পড়েছিল। দ্রুত মাথা নেড়ে বলল, ‘আমার ওসব কিছুই লাগবে না। চলি।’

‘তা কী করে হয় বৈদ্যজি? একটু দাঁড়ান!’

রামলোচন উঠে গিয়ে ঘরের কোণে রাখা তোরঙ্গ খুলল। তারপর আঁতিপাঁতি করে খুঁজে কী একটা বের করে এনে বলল, ‘আপনার হাতটা একটু বাড়িয়ে দিন, বৈদ্যজি।’

ডান হাত মেলে ধরল মধুসূদন।

মধুসূদনকে বিস্মিত করে সেই হাতের ওপর একখানা অঙ্গুরীয় রাখল রামলোচন।

‘আংটি?’

‘জি!’ রামলোচন মাথা দুলিয়ে বলল, ‘যে সে আংটি নয় বৈদ্যজি। এ হল নীলকান্ত মণি। বুড়োবাবা বলেছিলেন শেষ বৈদ্যকে এই প্রণামী দিতে।’

মধুসূদন বিস্মিতচোখে আংটিটা দেখছিল। খাঁটি সোনায় গড়ন। মধ্যভাগে জ্বলজ্বল করছে এক দ্যুতিময় রত্ন। আংটিটার গায়ে কোনও এক অজানা প্রদেশের রাজমুদ্রাও অঙ্কিত রয়েছে।

নিজের কোঁচড়ে অঙ্গুরীয়খানা বেঁধে নিল নিল মধুসূদন। লক্ষ্মীকে ফিরিয়ে দেওয়ার অর্থ হয় না। মায়ের কাছে সে এই শিক্ষাই পেয়েছে। এখন ফিরে গিয়ে তড়িঘড়ি মা-বাবাকে সাপ্তাহিক গঙ্গাস্নানে নিয়ে যেতে হবে। পিতা আজকাল চোখে ভালো দেখতে পান না।

৫৬

পাঠান সেনাপতি কালাপাহাড় বিধ্বস্ত অবস্থায় যুদ্ধ অসমাপ্ত রেখে ফিরে গিয়েছিলেন তন্দায়। শোনা যায়, তারপর তিনি ত্যাগ করেছিলেন সেনাপতির সমস্ত দায়দায়িত্ব।

তীব্র বেদনাবিদ্ধ ও অনুতপ্ত অবস্থায় এরপর তিনি চলে যান বারাণসীতে। গঙ্গার দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়ে দীর্ঘ দুই যুগ ধরে গায়ত্রীমন্ত্র জপ করেন। শ্রীনিবাস আচার্য তাঁকে বলেছিলেন, তীর্থদর্শনে পাপ দূর হয়। মন তৃপ্ত হয়। দেবতার কৃপালাভ হয়। ভক্তির মধ্যে দিয়েই আসে মুক্তি।

কেউ বলেন, দশ্বাশ্বমেধ ঘাটে ডুব দিয়ে তিনি আর ওঠেননি। সেখানেই ইহলীলা সাঙ্গ হয় তাঁর।

কালাপাহাড় এক ভয়াল ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। কেউ মনে করেন, তিনি ছিলেন আসলে মহাদেবেরই রুদ্ররূপ।

আবার কেউ বলেন, সেখান থেকে কালাপাহাড় চলে গিয়েছিলেন হরিদ্বার। সেখান থেকে হৃষীকেশ। গঙ্গোত্রী। গোমুখ। দিনের পর দিন তিনি হিমালয়ের পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। করেছিলেন সাধুসঙ্গ। প্রতিটি সন্ন্যাসীকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তিনি বলতেন নিজের পাপকৃত্য।

অবশেষে মরুতীর্থ পুষ্করে এক সাধুর উপদেশে তিনি পাড়ি দেন সর্বপাপহর তুষারতীর্থ অমরনাথের উদ্দেশ্যে। শ্রাবণী পূর্ণিমার রাত্রে তিনি সেখানেই মারা যান।

দোর্দণ্ডপ্রতাপ ‘ডাকাতরাজা’ বীরহাম্বীরেরও রাজ্যশাসনের আকাঙ্ক্ষা ঘুচে গিয়েছিল। কয়েকবছরের মধ্যেই জ্যেষ্ঠপুত্র ধাড়ী মল্লকে রাজসিংহাসনে অভিষিক্ত করে চলে যান বৃন্দাবনধামে। বিধাতার করুণ পরিহাস, রাজ্যাভিষেকের কয়েক বছরের মধ্যেই ধাড়ী মল্ল উন্মাদরোগে আক্রান্ত হন।

তখন মল্ল সিংহাসনে আরোহণ করেন বীরহাম্বীরের কনিষ্ঠ পুত্র রঘুনাথ। তাঁর জীবন আরও বৈচিত্রময়, আলো আঁধারিতে ভরা!

মধুসূদন যে ঘাটে পিতা মাতাকে নিয়ে সাপ্তাহিক গঙ্গাস্নানে যায়, তার পাশেই বৃন্দাবন মহাশ্মশান। বৈষ্ণবদের চিতা এখানে প্রজ্জ্বলিত হয়।

আজও কাউকে সৎকার করতে আনা হয়েছে। ধুমধাম করে হরিনাম হচ্ছে। সবে মুখাগ্নি হল। অনেক মানুষ।

মধুসূদনের প্রৌঢ়া মা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আজ কে পুড়ছে গা? এত ভিড়?’

মধুসূদন উঁকি মারে। চেনা মুখ! রামলোচন! একটা ফুটো কলসিতে গঙ্গাজল নিয়ে চিতা প্রদক্ষিণ করছে।

অর্থাৎ সকালে দেখতে যাওয়া সেই বৃদ্ধের পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয়েছে। মধুসূদনের আয়ুর্বেদজ্ঞান অভ্রান্ত ছিল।

সে বলল, ‘এক বুড়ো মানুষ, মা। বঙ্গাল দেশের লোক। আজ সকালে আমিই দেখতে গিয়েছিলাম। অনেক বয়েস। তবে এককালে শাজোয়ান ছিল, চেহারা দেখেই বুঝেছি। রাজাদের মতো। এখন নিঃস্ব। তবে আমায় একটা আংটি দিয়েছিলেন!’

বাবা-মা দুজনেরই আগ্রহ মুহূর্তে বেড়ে গেল। বহু দশক হল বঙ্গাল ছেড়ে এসেছেন, তবু ‘বঙ্গালের লোক’ শুনলে এখনও তাঁদের বুক উদ্বেল হয়ে ওঠে।

মা কিছু বলার আগেই বাবা বলে উঠল, ‘তোকে আংটি দিয়েছেন? কই? দেখা, দেখি।’

‘এই যে।’

মধুসূদন কোঁচড় থেকে বের করে আনে নীলকান্তমণিখচিত সেই অঙ্গুরীয়খানি। দিবালোকে পিতামাতার সামনে তুলে দেখায় সেটি।

মা কেমন যেন কেঁপে ওঠেন। আংটিটা নিয়ে চোখের সামনে এনে দেখতে চেষ্টা করেন। কয়েক মুহূর্ত! তাঁর দেহ মূর্ছিত হয়ে পড়ে যায় গঙ্গার ঘাটে।

হতভম্ব মধুসূদন দ্রুত মা’কে ধরে তুলতে চায়, তার বাবা পবন দাঁড়িয়ে থাকে পাথরের মতো। একসময় শূদ্রসন্তান ছিল সে। তবু চিনতে ভুল করে না মল্লরাজের অঙ্গুরীয়টিকে।

সেইসময় মল্লভূমিতে নীলকান্তমণির আংটির কথা সকলেই জানত! সকলেই বিশ্বাস করত, ওই অঙ্গুরীয়ই সমগ্র মল্লরাজ্যের আশীর্বাদ।

মধুসূদন কবিরাজ মায়ের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে থাকে। ওদিকে প্রায় অন্ধ পবন শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে অদূরের আকাশে মিলিয়ে যেতে থাকা চিতাধূমের দিকে।

পুত্র মধুসূদন তার পিতামাতার ইতিহাস জানে না। জানে না, সে পবনের ঔরসজাত পুত্র নয়। জানে না যে এই সদ্যপ্রয়াত বৃদ্ধের রক্ত বহমান তার শরীরে।

পবনের কণ্ঠনালীতে কী যেন দলা পাকাতে থাকে। তার ইচ্ছা হয় চিৎকার করে কাঁদতে। মনে পড়ে যায় বহুযুগ আগের শীতলদাদাকে। রঘুনাথকে। মল্লভূমের মাঠঘাটকে। দশাবতার খেলাকে।

কী যেন ছিল সেই ছড়াটা? প্রাণপণ চেষ্টাতেও আর মনে করতে পারেনা পবন। মাঝখান দিয়ে কেটে গিয়েছে একটা গোটা জন্ম!

আর ওর সেই খেলার সাথী রঘুনাথ? সে আজ কোথায়? সে কি পিতার মৃত্যুতে আসেনি এখানে? পবনের মনের মধ্যে আলোড়ন চলতে থাকে।

তার হঠাৎ কান্না পায়। খুব কান্না পায়। মনে হয়, সব বাধা অগ্রাহ্য করে গিয়ে বসে অদূরে প্রজ্জ্বলিত সেই চিতার পায়ের কাছে।

ব্যাকুল স্বরে মধুসূদন ডেকে ওঠে, ‘বাবা! বাবা! মা অজ্ঞান হয়ে গেল যে! আমি একটু জল আনি। মুখেচোখে দিতে হবে। তুমি মা’কে নিয়ে বসো।’

অচৈতন্য মনোহরাকে কোলে নিয়ে ঘাটে বসে থাকে পবন। যে বিধবা মনোহরাকে একদিন ভিতু লাজুক শূদ্র যুবক ভালোবেসেছিল, তুলে এনেছিল সাক্ষাৎ অগ্নিদেবের গ্রাস থেকে, সেই মনোহরা এখন পিতৃসম শ্বশুরমশাইয়ের শোকে মুহ্যমান।

পবন পরম আদরে বিলি কাটতে থাকে মনোহরার চুলে। সেদিনের সেই উচ্ছল প্রাণবন্ত মেয়েটা আজ প্রৌঢ়া, ঘন কেশরাজি আজ শিথিল, ধরেছে পাকও।

তবু আজও সে পবনের প্রতিদিনের বাঁচার অনুপ্রেরণাদাত্রী। তারা দুজনে এই ভিনদেশে এসে শূন্য থেকে গড়ে তুলেছে তাদের সাধের সংসার।

মধুসূদন ছুটে যায় গঙ্গা থেকে জল তুলে আনতে। পবন উদাসনয়নে দেখে, নিরন্তর ধারায় বয়ে চলেছে গঙ্গা নদীর জল।

অবশ্য শুধু জল নয়, সময়ও অবিরত চলমান। সময় চলতে থাকে।

আর নিজের হাতে লিখতে থাকে ইতিহাস!

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *