2 of 2

৯৭. জন কিটস (১৭৯৫-১৮২১)

৯৭. জন কিটস (১৭৯৫-১৮২১)

দুশো বছর আগেকার কথা। লন্ডন শহরের প্রাণকেন্দ্রে ছিল একটি আস্তাবল। এমনি একটি আস্তাবলের পরিচালক ছিলেন টমাস কিটস্। নিচে আস্তাবল, উপরে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন টমাস। স্ত্রী আস্তাবলের মালিকের মেয়ে। কাজের প্রয়োজনে টমাসকে যেতে হত মালিকের বাড়িতে। সেখানেই দুজনের দেখা, তারপর প্রেম, একদিন বিবাহ।

বিবাহের এক বছর পর ১৭৯৫ সালের অক্টোবর মাসে টমাসের প্রথম সন্তানের জন্ম হল। যথাসময়ে শিশুর নামকরণ করা হল জন কিটস।

কিটসের জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই জন হল তার দুই ভাই জর্জ আর টমের। তিন ভাইয়ের মধ্যে কিটস্ ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর।

সাত বছর বয়সে তাঁকে এনফিল্ডের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল।

কিটসের তখন নয় বছর বয়স। জীবনে প্রথম আঘাতের মুখোমুখি হলেন। ঘোড়া থেকে পড়ে মারা গেলেন টমাস কিটস।

স্বামীর মৃত্যুর পর কিটসের মা রলিস নামে একজনকে বিয়ে করলেন। কিন্তু অল্পদিনেই দুজনের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরল। এক বছরের মধ্যেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেল। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি এলেন কিটসের মা। কিটস তখন দশ বছরের ছেলে।

১৮১০ সালে মারা গেলেন কিটসের মা। মরবার আগে নিজের অজান্তেই রাজরোগ যক্ষ্মার বীজ দিয়ে গেলেন সন্তানকে।

মায়ের মৃত্যুর পর পিতৃ-মাতৃহীন ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নিলেন মিস্টার এ্যাবি। স্কুলে এলেন কিটস্। দিন-রাত পড়াশুনা নিয়ে থাকেন মাঝে মাঝে মনের খেয়ালে কবিতা লেখেন। ১৫ বছর বয়সে স্কুলের পড়া শেষ হল। কিটসের অভিভাবকের ইচ্ছা কিটস্ ডাক্তারি পড়বেন।

ডাক্তারি পড়বার জন্যে ভর্তি হলো মেডিকেল কলেজে। কিন্তু যাঁর মনের মধ্যে জেগে উঠেছে কবিতার নেশা, হাসপাতালেল ছুরি কাঁচি ঔষধ রুগী তার ভাল লাগবে কেন। সৌভাগ্য সেই সময় তার স্কুলের বন্ধু কাউডেন ক্লার্ক কিটসকে নিয়ে গেলেন সেই সময়কার খ্যাতিমান তরুণ কবি লে হান্টের কাছে।

হান্টের সাথে পরিচয় ১৮১৬ সালে। কিটসের জীবনে এ এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। হান্ট কিটসের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হলেন, তাঁকে আরো কবিতা লেখবার জন্যে উৎসাহিত করলেন। হান্ট একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সেই পত্রিকাতেই কিটসের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হল। এখানে কিটসের পরিচয় হল শেলীর সাথে।

আর ডাক্তারির মোহে নিজেকে বেঁধে রাখতে পারলেন না। অভিভাবকের উপদেশ অগ্রাহ্য করে মেডিকেল কলেজ ছেড়ে দিয়ে স্থির করলেন সাহিত্যকেই জীবনের পেশা হিসাবে গ্রহণ করবেন।

কিটস্ তাঁর দুই ভাইকে নিয়ে লন্ডন ত্যাগ করে এলেন হ্যাঁম্পস্টেডে। এখানে আসবার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হান্টের সঙ্গ পাওয়া।

অল্পদিনের মধ্যে কিটস্ প্রকাশ করলেন তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন। সকলের মনে আশা ছিল এই বই নিশ্চয়ই জনপ্রিয় হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য কিটসের পরিচিত কিছু লোকজন ছাড়া এই বই-এর একটি কপিও বিক্রি হল না।

প্রথম কাব্য সংকলনের ব্যর্থতায় সাময়িক আশাহত হলেন কিটস্ কিন্তু অল্পদিনেই নতুন উৎসাহে শুরু করলেন কাব্য সাধনা। লেখা হল প্রথম দীর্ঘ কবিতা এণ্ডিমিয়ন। (Endumion 1817) এ এক অসাধারণ কবিতা। এই কবিতার প্রথম লাইনের মধ্যেই কিটসের জীবন দর্শন ফুটে উঠেছে–

A Thing of beauty is joy forever.

ইতিপূর্বে কখনো দেশভ্রমণে যাননি কিটস্, তাই বন্ধুর সাথে বেরিয়ে পড়লেন। ভ্রমণ শেষ করে আসতেই দেখলেন তার ভাই টম গুরুতর অসুস্থ।

প্রকাশিত হল তার এণ্ডিমিয়ন ১৮১৭। কিটস আশা করেছিলেন তাঁর এই কবিতা নিশ্চয়ই খ্যাতি পাবে। কিন্তু তৎকালীন দুটি পত্রিকা ব্ল্যাকউড ম্যাগাজিন এবং কোয়াটার্লি রিভিযু তীব্র ভাষায় কিটসের নামে সমালোচনা করল। জঘন্য সে আক্রমণ। এই তীব্র বিদ্বেষপূর্ণ সমালোচনা প্রকৃতপক্ষে কিটসের মানসিক শক্তিতে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল।

একদিকে যখন পত্রিকার সমালোচনায় ভেঙে পড়েছেন কিটস্, সেই সময় এল আরেক আঘাত। ১৮১৮ সালের ১ ডিসেম্বর মারা গেল টম।

এই সময় কিটসের জীবনের এল ফ্যানি ব্রন, সুন্দরী প্রাণোচ্ছল তরুণী। ফ্যানি তার মায়ের সাথে ব্রাউনের বাড়ি ভাড়াটিয়া হয়ে এসেছিল। কয়েক দিনের পরিচয়ে ভাল লেগে গেল দুজনের। কিটস্ ফ্যানিকে বিবাহ করতে চাইলেন। ফ্যানি সম্মত হলেও সংসারর অভিজ্ঞ মিসেস ব্রন তৎক্ষণাৎ কোন সম্মতি দিলেন না। বললেন, আগে কিটস্ স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক তার পর বিয়ে হবে।

কিটস্ স্থির করলেন যেমন করে হোক তাকে অর্থ উপার্জন করতেই হবে। স্বাস্থ্য আগের মত ভাল যাচ্ছিল না। কিন্তু মনের অদম্য শক্তিতে কিটস্ লিখে চললেন একের পর এক কবিতা। প্রকৃতপক্ষে কিটসের জীবনের সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবিতাই এক সময়ে লেখা।

আর্থিক অবস্থাও ভাল যাচ্ছিল না কিটসের। কিটসের শরীর যতই ভেঙে পড়ছিল ততই ফ্যানি তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। তার সাজ-গোজ হাসি অন্য ছেলেদের সাথে মেলামেশা কিটস সহ্য করতে পারতেন না। তার সমস্ত অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত।

তিনি ফিরে এলেন লন্ডনে। একদিন বাইরে বেড়াতে বেরোলেন কিটস। বাড়িতে ফিরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল, সেই সাথে কাশি। এক ঝলক রক্ত উঠে এল মুখ দিয়ে। কিটস্ বললেন, একটি মোমবাতি নিয়ে এস। ব্রাউন মোমবাতি নিয়ে এস। ব্রাউন মোমবাতি নিয়ে আসতেই কিটস্ কিছুক্ষণ রক্তের দিকে চেয়ে বললেন, এই রক্তের রং আমি চিনি, এ রক্ত উঠে এসেছে ধমনী থেকে। এই রক্ত আমার মৃত্যুর শমন।

ডাক্তার এল। সে যুগে যক্ষ্মার কোন চিকিৎসা ছিল না। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে শিরা কেটে কিছুটা রক্ত বার করে দেওয়া হল। কিন্তু তাতে কোন সুফল দেখা গেল না।

তখন তার বয়স মাত্র পঁচিশ। গলার স্বর ভেঙে গিয়েছিল, মাঝে মাঝেই জ্বর হত, গলা দিয়ে রক্ত উঠে আসত, এই সময় তাঁর সৃষ্টির উৎসও ফুরিয়ে আসছিল।

এই সময় প্রকাশিত হল কিটসের তৃতীয় ও শেষ কাব্য সংকলন ১৮২০। এই কবিতাগুচ্ছ কিটসকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের পাশে স্থান দিয়েছে।

এই সংকলনে একদিকে ছিল কিছু বড় কবিতা অন্যদিকে ছোট কবিতা, সনেট। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইসাবেলা। Isabella or the pot of Basil 1818) Hyperion। গ্রীক পূরাণের কাহিনী অবলম্বন করে লেখা দীর্ঘকাব্য।

The Eve of st, Agnes (1818) ইভ অব সেন্ট অ্যাগানিস।

কিটসের আরেকটি বড় কবিতা The Eve of Saint Mark…. এটিও অসমাপ্ত।

এই সব দীর্ঘ কবিতার পাশাপাশি রচিত তাঁর ছোট কবিতা (ode) গুলির মধ্যে ফুটে উঠেছে এক অনন্য সৌন্দর্য।

এই ছোট কবিতাগুলোর মধ্যে আছে। (ode) Ode to a Nightingale, ode on a Grecian Urn, ode to Autumn.

Ode to Autmun- এ মানব জীবনেরই এক রূপক। এখানে জীবন মৃত্যুর স্রোত পাশাপাশি বয়ে চলেছে।

Ode to Autmn-এ এক বিপরীত ধারণা ফুটেছে, এখানে কবি প্রকৃত সৌন্দর্য খুঁজে বেরিয়েছেন।

কবিতা ছাড়া কিটস্ কোন গদ্য লেখার চেষ্টা করেননি। তাঁর কাব্য জীবন ছিল মাত্র ছয় বছর ১৮১৪-১৮১৯। অর্থাৎ ঊনিশ থেকে চব্বিশ বছর বয়স। ১৮২০ সাল। কিটসের দেহ ক্রমশই ভেঙে পড়ছিল। তাঁকে নিয়ে আসা হল ফ্যানিদের বাড়িতে। ইটালিতে যাবার আগে এক মাস তিনি ফ্যানির নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছিলেন।

১৮২০ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর কিটস্ রওনা হলেন ইটালির দিকে। দীর্ঘ সমুদ্র পথ পার হতে ছয় সপ্তাহ লাগল। জাহাজে যেতে যেতে কিটস মুক্ত আকাশের দিকে চেয়ে থাকতেন। চোখে পড়ত ধ্রুবতারা। মনে হত মৃত্যুর পর তিনি ঐ ধ্রুবতারার সাথে একাত্ম হয়ে যাবেন। ধ্রুবতারাকে নিয়ে লিখলেন একটি কবিতা, এটিই কিটসের জীবনের শেষ কবিতা। ২১ অক্টোবর জাহাজ এসে ভিড়ল ইটালি নেপলস্ বন্দরে।

অচেনা অজানা ইটালিতে কোথায় থাকবেন কিছুই স্থির করতে পারেননি কিটস। এমন সময় বন্ধু শেলীর চিঠি পেলেন। শেলী তখন ছিলেন পিসায়। কিন্তু বন্ধুর এই বিপদের দিনে সব কিছু ভুলে তাঁকে আমন্ত্রণ করলেন, তুমি পিসায় চলে এস। আমি তোমাকে সুস্থ করে তুলব।

ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কিটসকে যেতে হল রোমে। কারণ সে সময় ক্ষয়রোগের সবচেয়ে বড় চিকিৎসক ডাক্তার ক্লার্ক থাকতেন রোমে। রোমে ঘর ভাড়া নেয়া হল। শুরু হল কিটসের চিকিৎসা। কিন্তু কোন উপকার পাওয়া গেল না। ক্রমাগত শরীর ভেঙে পড়ছিল। কাশির সাথে রক্তবমি হতে আরম্ভ করল।

২৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ১৯২১ সাল। সমস্ত দিন কেমন আচ্ছন্ন ছিলেন কিটস রাত তখন প্রায় এগারোটা, মাথার পাশে বসেছিল বন্ধু সেভার্ন। আস্তে আস্তে কিস বললেন, “আমাকে তুলে ধর আমার মৃত্যু এগিয়ে এসেছে। আমি শান্তিতে মরতে চাই, তুমি ভয় পেও না- ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, অবশেষে মৃত্যু এল।” সেভার্নের কোলেই চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেন চিরসুন্দরের কবি কিটস।

পরদিন রোমের এক সমাধিক্ষেত্রে তাঁকে সমাধি দেয়া হল।

দু-বছর পরে এই সমাধিক্ষেত্রেই সমাধি দেওয়া হয় আরেক তরুণ কবি শেলীকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *