2 of 2

৮০. হেনরিক ইবসেন (১৮২৮-১৯০৬)

৮০. হেনরিক ইবসেন (১৮২৮-১৯০৬)

শেকসপীয়ারের পর ইউরোপের নাট্যজগতে সবচেয়ে প্রভাব যিনি বিস্তার করেছিলেন, তাঁর নাম হেনরিক ইবসেন। নরওয়ের স্কিন শহরে তাঁর জন্ম (২০ মার্চ ১৮২৮)। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। পারিবারিক সূত্রে তাদের মধ্যে ডাচ জার্মান স্কট জাতির সংমিশ্রণ ঘটেছিল। যখন ইবসেন নিতান্তই বালক সেই সময় তাঁর বাবা ব্যবসায়ে সর্বস্বান্ত হন। সুখের সংসারে নেমে আসে চরম দারিদ্র। নিদারুণ আর্থিক অনটনের মধ্যেই শুরু হল হেনরিক ইবসেনের শৈশব। ছেলেবেলা থেকেই সমাজের নির্মম বাস্তবতাকে জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি।

তাঁর স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবার, নিদারুণ অভাবের জন্য প্রাথমিক স্কুলের গর্তটুকুও শেষ করতে পারলেন না। এই সময় তারা স্কিন শহর ত্যাগ করে এলেন ডেনস্টপে। ষোল বছর বয়সে এক ঔষধের কারখানায় কাজ পেলেন। এখানকার পরিবেশ ছিল এক কিশোরের পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। তবুও তারই মধ্যে ছটি বছর তিনি এখানে অতিবাহিত করেন। এখানকার জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে তাঁর মানসিকতাকে গড়ে তুলতে খুবই সাহায্য করেছিল। এখানে কাজ করবার সময়েই তিনি দেখেছিলেন সমাজের অভিজাত শ্রেণীর কদর্য রূপ। দরিদ্র মানুষদের প্রতি তাদের কি নিদারুণ অবজ্ঞা আর ঘৃণা! এই ঘটনা থেকেই তাঁর মনের মধ্যে জেগে উঠতে থাকে সমাজের প্রতি তীব্র ক্ষোভ আর ঘৃণা, এবং মাঝে মাঝেই তাঁর আচরণের মধ্যে এই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটত।

যখন তিনি ঔষধ কারখানাতে কাজ করতেন তখনই প্রথম তিনি সাহিত্যের দিকে আকৃষ্ট হন। কাজের অবসরে যখনই সময় পেতেন নানান বিষয়ের বই নিয়ে পড়তেন, সাহিত্যচর্চা করতেন। প্রথম কবিতা রচিত হয় যখন তার ১৯ বছর বয়সে। স্থানীয় একটি পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতা রচনার সাথে সাথে রাজনীতির প্রতিও আকৃষ্ট হয়ে ওঠেন। পরবর্তী দু বছরের মধ্যে তাঁর বেশ কিছু কবিতা প্রকাশিত হল। কবি হিসাবে জনগণের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

ইতিমধ্যে কিছু অর্থ সঞ্চয় করে ঔষধ কারখানার চাকরি ছেড়ে দিলেন। আসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পড়াশুনা আরম্ভ করলেন। ২২ বছরে তিনি ভর্তি হলেন আসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক সংকীর্ণ পরিবেশ থেকে এলেন এক উন্মুক্ত জগতে। এখানে তিনি পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন। গ্রীক নাট্যকারদের নাটক পড়ে তার মনের মধ্যে ধীরে ধীরে নাটক লেখার রচনা করেন Cataline. বন্ধুবান্ধবদের সহযোগিতায় তা প্রকাশিত হল। এর অল্পদিনের মধ্যেই রচনা করলেন The Viking’s Tomb নাটকটি মঞ্চস্থ হল কিন্তু তা কয়েকদিনের বেশি চলল না।

সাহিত্য সাধনায় এত বেশি মনোযোগি হয়ে ওঠেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেন। বাধ্য হয়ে একটি পত্রিকায় কয়েক মাসের জন্য সাংবাদিকের চাকরি নিলেন। নাটকের প্রতি তাঁর ছিল স্বভাবসিদ্ধ আকর্ষণ। সাংবাদিক হিসাবে কাজ করবার সময়েই নাট্যজগতের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৮৫১ সালে ওল বুল নামে একজন বিখ্যাত বেহালাবাদক বার্গেন শহরে একটি রঙ্গমঞ্চ স্থাপন করলেন। তিনি ইনসেনকে এখানে মঞ্চসজ্জা ও কবিতা রচনার জন্য নিযুক্ত করলেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর ইবনেস বার্গেন রঙ্গমঞ্চের সাথে যুক্ত ছিলেন। এই সময় শুধু যে তাঁর রচিত কয়েকটি নাটক এখানে মঞ্চস্থ করতে পেরেছিলেন তাই নয়, ইউরোপের বিভিন্ন নাট্যকারদের নাটকের সাথেও পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাছাড়া নাটক দর্শক রঙ্গমঞ্চ সম্বন্ধেও বিস্তৃত ধারণা হয়। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে তাকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছিল। এক বছর পর ১৮৫২ সালে ইবসেনকে দেশ-বিদেশের নাট্যকলার সাথে পরিচিত হবার জন্য বার্গের থিয়েটারের তরফ থেকে একটি বৃত্তি মঞ্জুর করা হল। ইবসেন প্রথমে গেলেন ডেনমার্কে তার পর জার্মানী। জার্মানীতে থাকার সময় তিনি লিখলেন মিড সামার ইভ (Mid summer Eve) নামে একটি নাটক। পরের বছর এই নাটকটি মঞ্চস্থ হল। এই সময় আরো কয়েকটি নাটক লিখেছিলেন। এই সব নাটকগুলোর মধ্যে তার ধারাবাহিক উন্নতির চিহ্ন লক্ষ্য করা গেলেও প্রতিভার কোন পরিচয় প্রকাশ পায়নি। তাছাড়া কোন নাটকই মঞ্চে সফল হয়নি।

বাৰ্গেনের রঙ্গমঞ্চটি দর্শকের অভাব বন্ধ হয়ে গেল। অন্য সকলের মত ইবসেনকেও চাকরি হারাতে হল। সংসারে তখন আর ইবসেন একা নন, সাথে সদ্য বিবাহিতা পত্নী সুসালা থোরসেন। সুসালার বাবা ছিলেন নরওয়ের একজন প্রেম পরিণয়। সুসালা সমস্ত জীবন ছিলেন ইবসেনের যোগ্য সঙ্গিনী।

চাকরি হারিয়ে নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়লেন ইবসেন। অভাব আর দারিদ্র্য দীর্ঘ দিন পর্যন্ত ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী। এক বছর পর ক্রিস্টিয়ানিয়া নরওয়েজিয়ান থিয়েটারের ম্যানেজারের চাকরি পেলেন।

পঁয়ত্রিশ বছর বয়েস পর্যন্ত তিনি প্রায় ৮টি নাটক লিখেছিলেন। এই নাটকগুলোর মধ্যে বিছিন্নভাবে কিছু শিল্পকর্ম থাকলেও কোন মৌলিকত্ব বা পরিণত শিল্পসৃষ্টির প্রকাশ ছিল না। এর মধ্যে একটি নাটক Lover’s Comedy কিছু কিছু নাট্যমোদীর ভাল লাগলেও তার থেকে অর্থ উপার্জন করতে পারেননি।

এর পরের নাটকে The Pretenders (১৮৬৪) প্রথম তাঁর প্রতিভার চিহ্ন ফুটে উঠল, মাঝখানে কিছুদিন কাব্য নাটকের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। এই নাটকে পুনরায় গদ্য ভাষা ব্যবহার করতে আরম্ভ করলেন। এয়োদশ শতাব্দীতে নরওয়ের গৃহযুদ্ধের কাহিনী অবলম্বন করে এই নাটক লেখা হয়েছিল।

নরওয়েজিয়ান থিয়েটারের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়ে আসছিল। চাকরি ছাড়তে বাধ্য হলেন ইবসেন। নরওয়ের পরিবেশ আর ভাল লাগছিল না ইবসেনের। তাঁর মনে হল এখানকার মানুষ নাটকের মর্মকে উপলব্ধি করতে পারছে না। সরকারী তরফে কিছু অর্থ সাহায্য পেলেন। স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। প্রথমে গেলেন ডেনমার্ক, সেখান থেকে জার্মানি তারপর ইতালির রোম।

রোমের শিল্প-সাহিত্যের পরিমণ্ডল ইবসেনকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করছিল। এখানেই রচিত হল তাঁর প্রথম সার্থক নাটক ব্রানদ (Brand) এটি বিয়োগান্ত নাটক। এই নাটকে নরওয়ের সমাজ জীবনের মূল্যবোধের অভাবকে তুলে ধরেছেন। এরপরেই লিখলেন পীয়েরয়িনত (Peer Gynt} এই দুটি নাটক ইবসেনকে খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা এনে দিল। কিছু পরিমাণে আর্থিক স্বচ্ছন্দ্য এনে দিল।

তিনি একের পর এক রচনা করে চললেন তাঁর নাকট। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য The League of youth (1869), Pillars of Society (1877) এই পর্যায়ের নাটকগুলোর মধ্যে অলংকার ভূষিত রোমান্টিকতার প্রভাব বেশি। যে ইবসেনের লেখনী সমাজের সব অবক্ষয়কে ছিন্নভিন্ন করে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিল, জীবনের মধ্য-পর্ব পর্যন্ত তার কোন প্রকাশ দেখা যায়নি। তাঁর Pillars of the Society কে প্রথম বাস্তববাদী রচনা হিসাবে অভিহিত করা যায়। ইবসেন বিশ্বাস করতেন সমগ্র বিশ্বের শুভবোধ একসঙ্গে জাগ্রত করা সম্ভব নয়, কিন্তু ব্যক্তিগত উন্নতি করা সম্ভব। প্রত্যেকটি মানুষ নিজেই তার নৈতিক চিকিৎসা করতে পারে। প্রত্যেকটি নারী-পুরুষ নিজেই নিজেকে শিক্ষা দেবে।

এই নাটকে তিনি দেখিয়েছেন একটি ছোট শহরের দুর্নীতিগ্রস্থ মানুষের ছবি। এদের প্রতি তার তীব্র ঘৃণা ফুটে উঠেছে। এখানে সমাজের উপরতলার কিছু মানুষ যাদের মধ্যে আছে বিশালদেহি ধর্মযাজক, প্রবঞ্চক ব্যবসায়ী, অসৎ শাসক আর এদের প্রতিই রয়েছে সমাজের সকলের আনুগত্য। এই মানুষেরাই যেন রাষ্ট্রের প্রতিরূপ।

প্রকৃতপক্ষে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত বলা যেতে পারে ইবসেনের নাট্য সাহিত্যের পরীক্ষা নিরীক্ষা পর্ব। ১৮৭৭ থেকে ১৮৯০ এই সময়ে রচিত নাটকগুলোর মধ্যেই ইবসেনের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে এবং এই সময়ে লেখা নাটকগুলো তাঁকে শেকস্পীয়র বার্নার্ড শ পিরেনদেল্লোর সাথে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নাট্যকারদের পাশে সমমর্যাদা দিয়েছে। এই নাটক একদিকে যেমন তাকে বিশ্বখ্যাতি দিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি সমসাময়িক সমাজে চরম নিন্দিত করেছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সমাজে ছিল পুরুষের শাসন। নারীর অবস্থা ছিল শোচনীয়। সব কিছুতেই তাদের পুরুষের শাসন মেনে চলতে হত। আদালতে নারীর কোন অধিকার ছিল না। বিবাহের পর নারীর সব কিছুর স্বামীর সম্পত্তি বলে অভিহিত হত। স্বামীর ইচ্ছ-অনিচ্ছাকেই মেনে চলত স্ত্রীরা। নারীজাতির এই শোচনীয় দশা ইবসেনকে বিচলিত করে তুলেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন নারীর আত্মমর্যাদার অধিকার। সমাজে তাদেরও পুরুষের মতই মর্যাদা আছে।

নারীর অধিকারের স্বপক্ষে লিখলেন তার যুগান্তকারী নাটক A Doll’s house (পুতুল ঘর) নোরা ও হেলমার স্বামী-স্ত্রী। হেলমার অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তার স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য ইতালি নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল কিন্তু কারোর কাছেই টাকা ছিল না। নোরা বাবার সই জাল করে টাকা জোগাড় করল। কিন্তু সে কথা গোপন করে হেলমারকে বলেছিল তার (নোরার) বাবা মারা যাবার আগে সে টাকা নিয়েছিল। নোরা ভেবেছিল অল্প অল্প করে নেই টাকা শোধ করে দেবে।

তারপর তিন বছর কেটে গিয়েছে। এই টাকা শোক করতে পারেনি নোরা। ঘটনাচক্রে সবকিছু স্বামী জানতে পারে। স্ত্রীকে অভিযুক্ত করে।

ইবসেনের মনে হয়েছে প্রয়োজনে নারীও মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে। কারণ ন্যায় অন্যায় সৎ-অসৎ এর বিচার করবার কোন মাপকাঠি নেই। অবস্থার সাথে সত্য-মিথ্যা পরিবর্তনশীল। তাই অসুস্থ স্বামীকে সুস্থ করে তোলবার জন্যে বৃদ্ধ পিতাকে আর বিব্রত করতে চায়নি। হাতনোটে পিতার সই জাল করে টাকা তুলেছিল। আইন একে অপরাধ বললেও ইবসেনের নৈতিক সমর্থন রয়েছে নোরার প্রতি। কারণ তার উদ্দেশ্য ছিল মহৎ, প্রয়োজনের সময়ে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সমর্পণ না করে কিছু করবার জন্যে চেষ্টা করেছে, কিন্তু প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় হেলমারের কাছে এই ঘটনা মনে হয়েছে অপরাধ। নোরা তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করে এক প্রশ্ন করেছে, এক কন্যার কি অধিকার নেই এক মৃত্যুপথযাত্রী পিতাকে রক্ষা করা…অথবা কোন স্ত্রীর কি অধিকার নেই তাঁর স্বামীর জীবন রক্ষা করা?

নোরার এই কথার মধ্যে দিয়েই নারীর অধিকার প্রথম ধ্বনিত হয়ে উঠেছে।

কিন্তু হেলমারের কাছে নোরার একমাত্র পরিচয় সে স্ত্রী এবং মা। এর বাইরে স্বতন্ত্র কোন অধিকার নেই।

নোরা বুঝতে পারে স্বামীর চোখে সে একটি পুতুল মাত্র, তার কোন স্বতন্ত্র সত্তা নেই। তাদের বিবাহিত সম্পর্ক ভালবাসা শ্রদ্ধার উপর দাঁড়িয়ে নেই। তাই নোরার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে ওঠে, “আমি বিশ্বাস করি আমিও একজন মানুষ–তোমারই মত আমারও স্বাধীন সত্ত্বা আছে। এবং যে কোন মূল্যেই আমার সেই স্বতন্ত্র সত্তাকে রক্ষা করব।”

পুরুষশাসিত সমাজে হেলমার নোরার এই মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে মেনে নিতে পারে না। সে বলে ওঠে, নোরার এই আচরণ সমাজের প্রচলিত নিয়মবিরুদ্ধ। নোরা সমাজের নিয়মকেই ভাঙতে চায়। কিন্তু নোরার প্রতিবাদী সত্তা জানতে চায় সমাজ না তার আচরণ- কে সত্য? সে স্বামী সংসার ছেড়ে মুক্ত পৃথিবীর বুকে বেরিয়ে পড়ে, এক আশ্চর্য সুন্দর মুক্ত পৃথিবীর আশায়।

সম্ভবত নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তি ও ব্যক্তিস্বতন্ত্রবাদের ক্ষেত্রে এই নাটক যে সুদূর প্রসারী ভূমিকা নিয়েছিল, বিশ্বসাহিত্যে তার কোন তুলনা নেই। ডলস হাউস শুধু ইবসেনের নয়, বিশ্বসাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ নাটক।

ডলস হাউসের পর রচনা করলেন তার আর একটি বিশ্ববিখ্যাত নাটক Ghosts (1881)। এই নাটকটির নায়িকা মিসেস আলভিংক। তিনি বধূ আবার জননী। তারই জীবনের বিয়োগান্ত কাহিনীর মধ্যে ইবসেন সমাজের বিকৃতি রূপকে নির্মমভাবে উন্মোচন করেছেন। সেই যুগের পটভূমিকায় তিনি হয়ে উঠেছেন দুঃসাহসিক। পুত্র অসওয়াল্ড উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছে পিতার যৌন ব্যাধি। তাঁর মা মিসেস আলভিংকে দেখতে হচ্ছে পুত্রের অমানুষিক যন্ত্রণা। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, যে স্বামী অন্যায় করে, পাপ করে, তাকে ছেড়ে যাওয়া কি অন্যায়? তাকে উত্তর শুনতে হয়, স্বামীর পাপ-পুণ্যের বিচার করবার কোন অধিকার নেই স্ত্রীর। স্বামী যাই করুক না কেন স্ত্রীকে সংসারের দায়-দায়িত্ব পালন করতে হবে, সন্তান পালন করতে হবে।

কিন্তু মিসেস আলভিং তা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। তাঁর কাছে এ নারীত্বের অপমান। সমাজের প্রচলিত আইন-কানুনের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ ফেটে পড়ে, “আইন আর নিয়ম এরাই সমাজের সব সমস্যার কারণ,” নোরার মত তার কণ্ঠেও ধ্বনিত হয় I must somehow free myself.

A Doll’s house আর Ghosts নাটক দুটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে সমাজের বুকে যেন ঝড় বয়ে গেল। বিভিন্ন সংবাদপত্রে কুৎসিত ভাষায় ইবসেনের বিরুদ্ধে প্রচার আরম্ভ হল। বলা হল, বিবাহের সুপবিত্র বন্ধনকে অস্বীকার করে ইবসেন সমাজের বুকে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। বহু দেশে এই নাটক নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছিল। এমনকি জনগণ ইবসেনকে আক্রমণ করতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু নির্ভীক সৈনিকের নিজের লেখনী থেকে সামান্যতম বিচ্যুত হননি ইবসেন। তিনি জানাতেন সমাজের ক্ষত দূষিত জঞ্জাল দূর করতে গেলে আঘাত আসবেই।

সমাজের তথাকথিত উঁচুতলার মানুষদের মুখোশ খুলে দেবার জন্য এইবার লিখলেন “An Enemy of the People” (1882)। আগের দুটি নাটকে ছিল বিবাহ, নারী স্বাধীনতা–এইবার দেখালেন সমাজ কল্যাণের নামে ক্ষমতাবান মানুষেরা কি করে অন্যকে শোষণ করে, সমাজকে দূষিত করে।

শহরের স্নানাগারে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ স্নান করে। কিন্তু বাইরে থেকে দূষিত জল এসে স্নানাগারের জলকে স্বাস্থ্যের পক্ষে অযোগ্য করে তুলেছে। ডাক্তার স্টকম্যান চান এই স্নানাগার বন্ধ করে তাকে সংস্কার করা হোক। স্নানাগার বন্ধ হওয়ার অর্থই তা থেকে অর্থ উপার্জন বন্ধ হওয়া। তাই নগরের চেয়ারম্যান, মেয়র, পুলিশ প্রধান অর্থের অভাব দেখিয়ে সংস্কারের কাজ করতে অস্বীকার করেন। ডাক্তার জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে সমস্ত বিষয়টি জনগণের কাছে প্রকাশ করতে চাইলে কমিটির পক্ষ থেকে তাঁকে বাধা দেওয়া হল। বলা হল, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রকাশ করার তাঁর কোন অধিকার নেই। কিন্তু ডাক্তার এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। তাঁকে চাকরি থেকে বিতাড়ন করা হল। সংবাদপত্রের মালিকেরা স্নানাগার কর্তৃপক্ষের সাথে যোগ দিল।

ডাঃ স্টকম্যান একা, তাঁর কন্যাকে স্কুল শিক্ষিকা পদ থেকে ছাঁটাই করা হল। চারদিকে প্রতিকূলতা, ডাক্তারকে বলা হল সমাজের শত্ৰু। কিন্তু সত্যের স্বপক্ষে দাঁড়াতে ভীত হলেন না ডাক্তার। তিনি জানতেন তাঁকে একাই সংগ্রাম করতে হবে “The strongest man in the world is the man who stands most alone.”

এই নাটকের মধ্যে দিয়ে ইবসেন দেখালেন মালিকপক্ষ নিজেদের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবার জন্য কোন ন্যায় নীতিকেই মানে না। নিজেদের কর্মচারীদের উপর নির্যাতন করতেও তাদের সামান্যতম বিবেক বাধে না। এরই পাশাপাশি দেখালেন সংবাদপত্রগুলোর নিলজ্জ ভণ্ডামি। অর্থের জন্য মিথ্যা অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে এতটুকু বাধে না। সমাজের এই শ্রেণী বৈষম্য, এই অন্যায় অবিচারের কাহিনী ফুটিয়ে তুলে প্রশ্ন রেখেছেন সমাজের প্রকৃত শত্রু কে?

সত্যজিৎ রায় এই কাহিনী অবলম্বন করে তৈরি করেছিলেন তাঁর একটি ছবি “গণশত্রু”। এই ছবি দেখে প্রখ্যাত ইংরেজ সাংবাদিক মন্তব্য করেছিলেন একশো বছর পরেও ইবসেনের এ্যান এনিমি অব দি পিপল এর প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে যায়নি।

An Enemey of the People-র স্টকম্যান যেন ইবসেনেরই প্রতিরূপ, যিনি ছিলেন আপসহীন সংগ্রামী। তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজের অন্যায়ের সাথে কোন সমঝোতা নেই। প্রতিবাদ ও সত্যের পথেই আদর্শ সমাজ গড়ে তোলা যায়। তার এই আদর্শের প্রতিফলন দেখতে পাই ডেনমার্কের সাথে রাশিয়ার যুদ্ধের সময়। নরওয়ে প্রথমে ডেনমার্কের সাথে যুক্ত ছিল। ১৮১৪ সালে ডেনমার্কের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে সুইডেনের সাথে যুক্ত হয়। রাশিয়া ডেনমার্ক আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। ইবসেন ডেনমার্কের সহায়তার জন্য নরওয়ে ও সুইডেনের কাছে আবেদন জানালেন, কিন্তু তার আবেদনে নরওয়ে সুইডেন কেউ সাড়া দিল না। তার নীরব দর্শক হয়ে রইল। স্বদেশবাসীর এই আচরণের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ ফেটে পড়েছিল Brand নাটকটিতে।

ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোনদিন রাজনৈতিক আন্দোলন বা দলের সঙ্গে যুক্ত হননি। কিন্তু মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলা পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের বিরুদ্ধে তাঁর কলম ক্ষুরধার হয়ে উঠেছে। নির্মমভাবে তিনি ব্যক্তিগত জীবনের মিথ্যাচার, ভণ্ডামি, পারিবারিক জীবনের কলুষতা, মালিক শ্রেণীর হাতে শোষণ লাঞ্ছনাকে লুটিয়ে তুলেছেন তাঁর সাহিত্যের পাতায় পাতায়। এরই মধ্যে দিয়ে তিনি নরওয়েরর মানুষের চেতনাকে জাগ্রত করতে চেয়েছেন।

ইবসেন জীবনের প্রথম পর্যায়ে ছিলেন রোমান্টিক, তারপর হলেন বাস্তববাদী। ১৮৮৪ সালে নাটকে দেখা গেল পরিবর্তন, এই সময়ে লেখা নাটকগুলো প্রধানত প্রতীকধর্মী–The Wild Duck (1889), The lady from the sea (1888), এই নাটকগুলোর মধ্যে লক্ষ্য করা যায় সমসাময়িক জীবনের সমস্যা থেকে সরে গিয়ে সচেষ্ট হয়েছেন মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে। তাঁর Hedda Gables একটি অসাধারণ নাটক। নোরার পরে হেডড়া সবচেয়ে বিখ্যাত নারী চরিত্র। তাকে সমালোচকরা লেডি ম্যাকবেথের সাথে তুলনা করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে হেড়া ঘৃণিত, দুশ্চরিত্র এক নারী। তবুও লেখক সেই পঙ্কের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন পদ্মকে। হেড্ডার সৌন্দর্য বোধ, তার সাহস লেখককে মুগ্ধ করেছে তার মধ্যেকার সব হীনতা, কর্মদর্যতা, প্রতারণার অন্তরালে জীবনের সব বাধাকে অতিক্রম করে মুক্তি পাওয়ার যে তীব্র কামনা, যে দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা, তার মধ্যে দেখা যায় তার কোন তুলনা হয় না। এখানেই তাঁর মহত্ত্বতা।

তবে এই সব নাটকগুলোতে তাঁর ব্যক্তিগত শিল্প চিন্তা বিশ্লেষণ এত প্রাধান্য পেয়েছে যে নাটকগুলোর গতিস্বতন্ত্রতা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাহত হয়েছে।

এরপরে লেখেন The Master Builder (1892), When we dead awaken (1899)। ইউরোপে যে নারী জাগরণের ঢেউ উঠেছিল, তারই জয়ধ্বনি শোনা যায় শেষের নাটকটিতে।

ইবসেন তাঁর জীবিতকালেই ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসাবে সম্মান পেয়েছেন। ১৮৮০ থেকে ১৯২০–এই দীর্ঘ চল্লিশ বছর ইউরোপের রঙ্গমঞ্চে ইবসেনের প্রাধান্য ছিল সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে তার নাটক। ইউরোপে প্রথম তাঁর নাটকের সার্থক মূল্যায়ন করেছিলেন বার্নার্ড শ।

তিনি শুধু যে নাটকের মধ্যে দিয়ে সামাজিক আন্দোলন স্থাপন করেছেন তাই নয়, তিনি নাটকের আঙ্গিকের ক্ষেত্রেও নিয়ে এসেছেন নতুন যুগ। চিরাচরিত রীতিকে বর্জন করে নাটকের গঠনশৈলীকে সহজ-সরল করেছেন। নাটকে তিনি রোমান্টিকতা বর্জন করে ন্যাচারলিজম বা বাস্তবদের প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। বিংশ শতাব্দীর নাট্যকারদের উপর তাঁর প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি।

জীবিতকালে প্রচুর পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু পুরস্কারের কোন মোহ ছিল না ইবসেনের। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাঁর লেখালেখি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯০০ সালে অসুস্থ হয়ে পড়লেন, বিশেষ হাঁটা-চলা করতে পারতেন না। ধীরে ধীরে তার স্মৃতিভ্রংশ হতে থাকে। ১৯০৩ সালে একেবারেই পঙ্গু হয়ে যান। ১৯০৬ সালের ২৩শে মে বেলা আড়াইটের সময় তাঁর জীবন দীপশিখা চিরদিনের মত নিভে গেল।

তাঁর উদ্দেশ্য শ্রদ্ধা জানিয়ে সমালোচক এম, ব্লক বলেছিলেন, Modern Drama begins with Ibsen-যথার্থই তিনি আধুনিক নাটকের জনক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *