2 of 2

৭৭. এন্টনি লরেন্ট ল্যাভোশিঁয়ে (১৭৪৩-১৭৯৪)

৭৭. এন্টনি লরেন্ট ল্যাভোশিঁয়ে (১৭৪৩-১৭৯৪)

১৭৪৩ সালের ২৬ আগস্ট ফ্রান্সের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ল্যাভোশিঁয়ে। পিতা ছিলেন পার্লামেন্টের এটর্নি। তাঁর পূর্বপুরুষেরা অবশ্য ছিলেন রাজপরিবারের ঘোড়াশালার কর্মচারী। নিজের চেষ্টায় পরিশ্রমে ল্যাভের্শিয়ের পিতা নিজেকে প্যারিসের সম্ভ্রান্ত মহলে প্রতিষ্ঠিত করেন।

পিতার ইচ্ছা ছিল তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে আইনের ব্যবসায়যুক্ত হবে। এগারো বছর বয়েসে তাকে শিক্ষায়তনে ভর্তি করে দেওয়া হল। জন্ম থেকেই ল্যাভোশিঁয়ে অন্যসব বিষয়ের মধ্যে বিজ্ঞানই ল্যাভোশিঁয়েকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করত। স্কুলজীবন শেষ করে কলেজে ভর্তি হলেন ল্যাভোশিঁয়ে। এখানে তাঁর শিক্ষক ছিলেন প্রখ্যাত অঙ্কবিদ ও জ্যোতির্বিদ নিকোলাস লুইস। অল্পদিনেই দুজনে দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। গুরু-শিষ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। নিকোলাস আবহবিদ্যার প্রতি ল্যাভোশিঁয়েকে আকৃষ্ট করে তোলেন। তারই ফলে সমস্ত জীবন আহতবিদ্যার প্রতি ল্যাভোশিঁয়ের ছিল গভীর অনুরাগ।

এই সময় পিতার ইচ্ছা অনুসারে ল্যাভোশিঁয়ে আইনের ক্লাসে ভর্তি হলেন। আইনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও আইনের প্রতি তাঁর সামান্যতম আকর্ষণ ছিল না। দিন-রাতের অধিকাংশ সময় তাঁর কেটে যেত বিজ্ঞানচর্চায়। বাড়িতেই ছোট একটি গবেষণার গড়ে তুলেছিলেন তিনি। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে গবেষণাতেই ডুবে থাকতেন ল্যাভোশিঁয়ে। এই সময় (১৭৬৪ সালে। তিনি ফরাসী বিজ্ঞান একাডেমিতে প্রথম তার বিজ্ঞান বিষয়ক রজনা পড়লেন। তাতে মৌলিক কোন তথ্য না থাকলেও তার প্রচেষ্টার সকলেই প্রশংসা করল। পরের বছর ফরাসী এ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হল। রচনার বিষয় ছিল “পথে কিভাবে আলো দেওয়া সম্ভব এবং তার সমস্যা”। সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করলেন ল্যাভোশিঁয়ে। অনেক জ্ঞাণীগুণী মানুষের সাথে পরিচয় হল ল্যাভোশিঁয়ের। এদের মধ্যে ছিলেন ভূতত্ত্ববিদ জিন গুটার্ড। গুটার্ড সেই সময় ফরাসী দেশের ভূতত্ত্ব বিষয়ক মানচিত্র তৈরির কাজে তার সঙ্গী হবার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। এই কাজের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করতে হবে জেনে সানন্দে নিজের সম্মতি জানালেন ল্যাভোশিঁয়ের। ১৭৬৭ সালে মানচিত্র তৈরির কাজে বেরিয়ে পড়লেন ল্যাভোশিঁয়ে। কাছে আছে মাত্র পঞ্চাশ লুইস। সঙ্গী বলতে একটি ঘোড়া, চাকর জোফেস আর প্রৌঢ় বিজ্ঞানী গুটার্ড। দুজনের মনেই অদম্য সাহস আর অজানাকে জানবার তীব্র কৌতূহল। নির্জন প্রান্তর পাহাড় নদী পথ ধরে দুজনে ঘুরে বেড়ালেন ফ্রান্সের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। প্রকৃতির অপরূপ রূপ দেখেই শুধু মুগ্ধ হন না ল্যাভোশিঁয়ে, তার অপার রহস্য তার মনকে নাড়া দিয়ে যায়।

প্রতিদিন সকালে উঠে থার্মোমিটার ব্যারোমিটার দেখা। তারপর মাটির রং, তার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা। যেখানে রয়েছে খনিজ সম্পদ তার সম্ভাব্য পরিমাণ বিস্তৃতি নিরূপণ করা, নদীর গতিপথ হ্রদ ঝর্ণার অবস্থায়, বিভিন্ন ধরনের গাছপালা তাদের বর্ণনা। নিখুঁতভাবে খাতার পাতায় লিখে রাখতে হয়। কয়েক মাস বিস্তৃত পর্যবেক্ষণের পর তাঁরা ফিরে এলেন প্যারিসে। এই দেশভ্রমণের ফলে একদিকে ল্যাভার্শিয়ের মধ্যে গড়ে উঠল নতুন জীবন দর্শন, বিশ্বপ্রকৃতিকে আরো গভীর ব্যাপকভাবে চেনবার ক্ষমতা, অন্যদিকে কঠোর পরিশ্রমের ক্ষমতা।

প্যারিসে ফিরে এসে স্থির করলেন আইন নয়, বিজ্ঞানই হবে তাঁর জীবনসাথী। কিছুটা আশাহীন ভাবেই ফরাসী বিজ্ঞান এ্যাকাডেমিতে সদস্য হবার জন্য আবেদন করলেন। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবেই একদিন জানতে পারলেন তাকে বিজ্ঞান এ্যাকাডেমির সভ্য হিসাবে জানতে পারলেন তাঁকে বিজ্ঞান এ্যাকাডেমির সভ্য হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছে। তখন তার বয়েস মাত্র পঁচিশ। এক তরুণের পক্ষে এ অভাবনীয় গৌরব। শুরু হল তাঁর গবেষণা, এ্যাকাডেমির প্রত্যেক সদস্যকেই নিয়মিত গবেষণাপত্র জমা দিতে হত। গবেষণার বিষয় ছিল যেমন বিচিত্র তেমনি ব্যাপক। জীবদেহের উপর চুম্বকত্বরে প্রভাব, অভিকর্ষ, জল সরবরাহ, রঙের তত্ত্ব, বাকাকপির বীজ থেকে তেল নিষ্কাষণ, চিনি তৈরি, কয়লা থেকে পিচ তৈরি করা, কীটপতঙ্গের শ্বাস-প্রশ্বাস। এই বিচিত্র ধরনের গবেষণা করে যখন অন্যেরা সমস্ত দিন সামান্যতম সময় পেতেন না, ল্যাভোশিঁয়ে অন্য সকলের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেও একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হলেন। প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল “Ferme”। এদের কাজ ছিল সরকারকে হিসাব মত রাজস্ব জমা দেওয়া। বিনিময়ে তারা চাষীদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন। খাজনার পরিমাণ রাজস্বের চেয়ে যত বেশি হত ততই “Ferme” এর লাভ।

ল্যাভোশিঁয়ে বুঝতে পারছিলেন গবেষণার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। তাই তিনি খাজনা সংগ্রহের চাকরি নিলেন। যে বিজ্ঞানের সাধনার জন্য তিনি অর্থ উপার্জন করতে চেয়েছিলেন সেই অর্থই একদিন তার মৃত্যুর কারণ হল।

Ferme-তে দু বছর চাকরি করবার পর ল্যাভেশিয়ে তাঁর এক উচ্চপদস্থ মনিবের সুনজরে পড়ে গেলেন। তার একমাত্র মেয়ে মেরী এ্যানির সাথে ল্যাভোশিঁয়ের বিবাহ দিলেন। মেরী তখন মাত্র চোদ্দ বছরের বালিকা। পরবর্তী জীবনে মেরী হয়ে উঠেছিলেন ল্যাভোশিঁয়ের যোগ্য সঙ্গিনী। তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণা কাজে নানাভাবে সাহায্য করতেন। বিভিন্ন ইংরাজি প্রবন্ধ ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করে দিতেন। ল্যাবরেটারির কাজের বিভিন্ন সাজসরঞ্জাম গুছিয়ে দিতেন। কখনো নোট তৈরি করতে সাহায্য করতেন। শ্বশুরের সাহায্যে চাকরিতে ক্রমশ উন্নতি করছিলেন ল্যাভোশিঁয়ে। কাজের চাপ বাড়া সত্ত্বেও বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য তার সময় নির্দিষ্ট ছিল সকাল ছটা থেকে নটা পর্যন্ত, সন্ধ্যেবেলায় সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত।

গবেষণা কাজের জন্য বিরাট একটি ল্যাবরেটারি তৈরি করলেন। বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করলেন সর্বাধুনিক সব যন্ত্রপাতি। কিছু দক্ষ সহযোগীকে নিযুক্ত করলেন। গবেষণার জন্য তার মত তরুণ বিজ্ঞানীদের কাছে ল্যাবরেটারির জন্য যে বিরাট পরিমাণ অর্থ ব্যয় হত, সবটাই দিতেন ল্যাভেশিয়ে, প্রকৃতপক্ষে তার আয়ের প্রায় সবটুকুই এখানে ব্যয় করতেন। ব্যয় বাহুল্যের জন্য তাঁকে নিয়ে লোকে কৌতুক করত, বলত, ‘অর্থ খরচের পরীক্ষাগার। এই অর্থ খরচের গবেষণাগার থেকেই একদিন জন্ম নিল এক বিজ্ঞান যা পৃথিবীর জ্ঞানের জগতে নতুন আলোক শিখা জ্বালিয়ে দিল। অ্যালকেমির কুয়াশাচ্ছন্ন জগতে আবির্ভূত হল আধুনিক রসায়ন বিজ্ঞান।

ল্যাভোশিঁয়ে যখন গবেষণা আরম্ভ করেছিলেন তখন রসায়ন মধ্যযুগীর এক বিচিত্র চিন্তাভাবনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। রসায়নকে বিবেচনা করা হত শুধুমাত্র চিকিৎসার সহায়ক হিসাবে। লন্ডন গেজেটে প্রকাশিত একটি বিবরণ থেকে জানা যায় মিসেস স্টীফেন নামে এক ব্রিটিশ রসায়নবিদ একটি ঔষধ তৈরি করেছেন যা দিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পেটের পাথুরী সারানো সম্ভব হয়েছে। ঔষধটি তৈরি হয়েছে ডিমের খোলা, গুগলি, সাবানের দলা, আগুনে পুড়িয়ে নেওয়া, শাক, আর মধু একসাথে মিশিয়ে। এই বিচিত্র ঔষধ তৈরির জন্য মিসেস স্টীফেন পাঁচ হাজার পাউন্ড পুরস্কার পেয়েছিলেন।

অন্য আর একজন রসায়নবিদ পরীক্ষা করে সর্বসমক্ষে দেখালেন একটি বস্তুকে অন্য আর একটি বস্তুতে রূপান্তরিত করা যায়। একটি পাত্রে জল নিয়ে ফুটাতে আরম্ভ করা হল। পাত্রের মুখ যথাসম্ভব ঢেকে দেওয়া হল। সমস্ত জল বাষ্প হয়ে বার হবার পর দেখা গেল পাত্রের মধ্যে খানিকটা মাটির মত গুড়ো পড়ে রয়েছে। রসায়নবিদ বললেন, এর থেকেই প্রমাণ হচ্ছে জল থেকে সৃষ্টি হয় মাটি।

এই ঘটনাই প্রথম ল্যাভোশিঁয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। প্রকৃতপক্ষে এর সূত্রপাত যখণ তিনি গুটার্ড-এর সাথে মানচিত্র তৈরির কাজে দেশভ্রমণ করছিলেন। তিনি ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন জলের ঘনত্ব, তার প্রকৃতি। তাঁর মনে সন্দেহ দেখা দিল সত্যিই কি জলের অবশিষ্ট অংশ মাটি না পাত্রের ভগ্নাবশেষ? শুধুমাত্র অনুমানের উপর নির্ভর করে কোন কিছুই বিশ্বাস করতে চাননি ল্যাভোশিঁয়ে। তিনি যুক্তি প্রমাণ পরীক্ষার সাহায্যে সত্যকে নিরূপণ করতে চাইলেন।

নানাভাবে পরীক্ষার পর তিনি সিদ্ধান্তে এলেন জল ফোঁটাবার পর যে গুড়ো পদার্থটুকু পাত্রের মধ্যে পড়ে থাকে তা মাটি নয়, পাত্রের ক্ষয়ে যাওয়া অংশ। তিনি জল পুরোপুরি বাষ্পীভূত হওয়ার পর ওজন করে দেখা গেল পাত্রের ওজন কমে গিয়েছে। যেটুকু ওজন কমেছে তা হচ্ছে গুঁড়ো পদার্থের সমান ওজন। এর থেকেই সিদ্ধান্তে এলেন ল্যাভোশিঁয়ে জল ফোঁটাবার জন্যেই পাত্রের ক্ষয় হচ্ছে। জল থেকে মাটি সৃষ্টি হচ্ছে না।

এই নিরূপিত সত্য এ্যালকেমি সম্বন্ধে বহু যুগের প্রচলিত বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করল।

ল্যাভোশিঁয়ে এখানেই থেমে গেলেন না। তিনি বললেন, জলই পরিবর্তিত হয়ে জন্ম দেয় গাছের এই ধারণা ভ্রান্ত। গাছ বিভিন্ন পদার্থের সংমিশ্রণ। এই সমস্ত পদার্থ গাছ। গ্রহণ করে মাটি থেকে, জল থেকে, বাতাস থেকে।

এই প্রতিটি উপাদানই বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। ল্যাভোশিঁয়ে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হলেন বাতাসের উপাদান নিয়ে। তখনো পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল বিভিন্ন ধরনের বাতাস আছে। ল্যাভোশিঁয়ে প্রথম বললেন, বাতাসের দুটি উপাদনি। একটি শ্বাসযোগ্য অপরটি বিষাক্ত। যেটি শ্বাসযোগ্য তার নাম দিলেন অক্সিজেন গ্রীক শব্দ “অক্সিস”, এর অর্থ অ্যাসিড এবং “জেনান”, এর অর্থ উৎপাদন করা। শুধু অক্সিজেন নয়, রসায়ন শাস্ত্রের ব্যবহৃত একাধিক শব্দের সংজ্ঞা নিরূপণ করলেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁরই আন্তরিক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠল আধুনিক রসায়ন শাস্ত্রের ভিত্তিমূল। আধুনিক রসায়নের জনক ল্যাভোশিঁয়ের আরেকটি মহৎ কীর্তি রসায়নের জন্য অভিধান তৈরি করা। তাঁর উদ্ভাসিত বহু শব্দ আজও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই ব্যবহৃত হচ্ছে।

ল্যাভোশিঁয়ে তাঁর এই বৈজ্ঞানিক গবেষণামূলক কাজকর্ম বিভিন্ন ধরনের সরকারী বেসরকারী কাজের মধ্যেই চালিয়ে যেতেন। তবে Ferme কোম্পানির খাজনা আদায় করবার জন্যই তাঁকে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করতে হত। এছাড়াও ফরাসী বিজ্ঞান এ্যাকাডেমির সদস্য হিসাবে তাকে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের গবেষণাপত্র জমা দিতে হত।

পরিশ্রম করবার ক্ষমতা, অধ্যবসায়, নিষ্ঠা, মৌলিক সৃষ্টির জন্য ল্যাভোশিঁয়ের নাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সরকারী তরফেও কোন বৈজ্ঞানিক বিষয়ক সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধানের ভার দেওয়া হত ল্যাভোশিঁয়ের উপর।

সেই সময় একটি বেসরকারী সংস্থা বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র কামানের গোলা-বারুদ তৈরি কর ফরাসী সরকারের কাছে বিক্রি করত। কিন্তু ক্রমশই তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের গুণমান খারাপ হচ্ছিল। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব বিবেচনা করে সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ফ্রান্সের সম্রাট দেশের বিজ্ঞান এ্যাকাডেমিকে অভিমত দেবার জন্য আহ্বান করলেন। বিজ্ঞান এ্যাকাডেমি চারজনের একটি কমিটি তৈরি করলেন। তার প্রধান হলেন ল্যাভোশিঁয়ে। তাঁদের উপর ভার দেওয়া হল কিভাবে সামরিক প্রয়োজনে উৎপাদিত দ্রব্যের পরিমাণ বাড়ানো যায় এবং কিভাবে তার গুণমান বৃদ্ধি করা সম্ভব সেই বিষয়ে এ এক সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ। কিন্তু দেশের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে সানন্দে নতুন কার্যভার গ্রহণ করলেন। শুরু হল তার নিরন্তর প্রচেষ্টা, কিভাবে সামরিক প্রয়োজনে গোলা বারুদের উন্নতি করা যায়।

এই দায়িত্বভার তাঁর জীবনে বিরাট এক আশীর্বাদ হয়ে এল। গবেষণার প্রয়োজনে তাঁকে চাহিদা মত গবেষণার সাজ-সরঞ্জাম। সামরিক বাহিনীর কাজের সাথে দীর্ঘ সতেরো বছর (১৭৭৫–১৭৯২) তিনি যুক্ত ছিলেন। তিনি গোলা-বারুদের ব্যবহারিক কার্যকারিতা বহুগুণ বৃদ্ধি করেন। এবং উৎপাদন ব্যবস্থাকেও আরো সহজ করে তোলেন। এবং উৎপাদন ব্যবস্থাকেও আরো সহজ করে তোলেন। এর ফলে শুধু ফরাসী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি হয় তাই নয়, আয়ও বৃদ্ধি পায়।

সামরিক কাজকর্মের মধ্যেও তিনি তাঁর নিজস্ব গবেষণা সংক্রান্ত কাজকর্ম বন্ধ করেননি। দিনের বেলায় চলত সামরিক কাজের প্রস্তুতি। রাতের বেলায় তিনি লিখতেন বৈজ্ঞানিক হিসাবে তার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, গবেষণার নানা বিষয়, বিভিন্ন তথ্য, বিবরণ। দীর্ঘ তিন বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করবার পর তিনি প্রকাশ করলেন তার যুগান্তকারী রচনা “Elementary Treatise of Chemistry” (1789)! এই বইয়ের কোথাও তিনি একটি অজানা তথ্যকে যুক্ত করেননি। শুধুমাত্র যা তার পরীক্ষার দ্বারা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে তাকেই গ্রহণ করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে এই বই আধুনিক রসায়ন বিজ্ঞানের নতুন দিগন্তকে উন্মোচিত করল। কিন্তু একদল প্রাচীনপন্থী মানুষ মুখর হয়ে উঠল এর বিরুদ্ধে, “এই বই-এর সমস্তই অবাস্তব ধারণার উপর গড়ে উঠেছে। যা কিছু নতুন তাই সত্য নয়। আবার যা কিছু সত্য তাই নতুন নয়।” ল্যাভোশিঁয়ের বিরুদ্ধবাদীদের সরব চিৎকারের জবাব দিতে এগিয়ে এলেন বিজ্ঞান এ্যাকাডেমির সদস্যরা। রসায়ন বিজ্ঞানের কুয়াশাচ্ছন্ন জগতে যে আলো ল্যাভোশিঁয়ে জ্বালালেন তার জয়গানে সকলে মুখর হয়ে উঠলেন।

এক চিঠিতে ল্যাভোশিঁয়ে লিখেছেন, আমি খুবই আনন্দিত। আমার নতুন তত্ত্ব পণ্ডিত মহলে এক ঝড় তুলেছে।

এরই মধ্যে ল্যাভোশিঁয়ে আরো একটি যুগান্তকারী তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন। নির্দিষ্ট অনুপাতে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন-এর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তার মধ্যে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ চালনা রলেন জল।

ল্যাভোশিঁয়ে যখন তার নতুন নতুন তত্ত্বের মাধ্যমে মানুষের চিন্তাজগতে বিপ্লব সৃষ্টি করে চলেছেন, তখন সমগ্র ফ্রান্স জুড়ে চলেছে আরেক বিপ্লব। ফরাসী বিপ্লব। দেশের শাসনভার গ্রহণ করেছে বিপ্লবী ট্রাইবুন্যাল। তৈরি হয়েছে বিপ্লবী আইন। যারা বিপ্লবের বিরোধী, যারা পুরনো রাজতন্ত্রের সমর্থক বা কোনভাবে তার সঙ্গে জড়িত তাদের সকলকে গিলোটিন নামে এক যন্ত্রে শিরোচ্ছেদ করা হত। এইভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা পড়ত। সমস্ত দেশ জুড়ে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হল।

প্রকৃতপক্ষে ল্যাভোশিঁয়ে এই রাজনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন। গবেষণার কাজের মধ্যেই তিনি দিনরাত ডুবে থাকতেন। তবুও তিনি বিপ্লবী শাসকদের হাত থেকে রেহাই পেলেন না। একদিন (১৭৯১ সালের ৭ই জানুয়ারি) বিপ্লবী দলের সংবাদপত্রে তার সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ ছাপা হল। এক বিপ্লবী নেতা চেয়েছিলেন ল্যাভোশিঁয়েকে সরিয়ে নিজেই বিজ্ঞানের জগতে বিখ্যাত হবেন। সরাসরি ল্যাভোশিঁয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগে আনলেন।

“ল্যাভোশিঁয়ের রাজতন্ত্রের সমর্থক, প্রতারক, ঠক, চোরদের শিরোমনি। অসৎ উপায়ে লক্ষ লক্ষ মুদ্রা উপার্জন করে এখন প্যারিসের শাসনকর্তা হতে চাইছে! একে অফিসে পাঠানো নয়, প্রকাশ্য রাজপথের ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে রাখাই আমাদের কর্তব্য। ল্যাভোশিঁয়ে এই সমালোচনা সামান্যতম ভ্রূক্ষেপ করলেন না। কিন্তু পত্রিকার তরফে একের পর এক অভিযোগে উঠতে থাকে।

এরই মধ্যে বিপ্লবী নেতা আরো নেতার সমর্থনে ফরাসী বিজ্ঞান এ্যাকাডেমিকে। নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। ল্যাভোশিঁয়ে তখন এ্যাকাডেমির প্রধান। তিনি এর প্রতিবাদ করলেন। এতদিন এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল বিপ্লবী নেতা। বিপ্লবী পরিষদের আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর অপরাধে বন্দী করা হল ল্যাভোশিঁয়েকে।

কিন্তু অভিযোগহ বাড়ি খানাতল্লাসী করা হল। তাঁর সমস্ত কিছু আটক করা হল। গবেষণার কাগজপত্র ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছুই পাওয়া গেল না। তবুও তাকে মুক্তি দেওয়া হল না।

কারাগারে বন্দী থেকেও মনের সাহস হারালেন না ল্যাভোশিঁয়ে। তিনি জানতেন তাঁর সামনে নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানি। অথচ তার এক আত্মীয়কে চিঠিতে লিখিছেন, “আমি দীর্ঘ সুখী জীবন পেয়েছি। এখন বার্ধক্যের ভারে ক্লান্ত। পেছনে ফেলে এসেছি কিছু জ্ঞান, সামান্য কিছু গৌরব। এর বেশি পৃথিবীর মানুষ আর কি আশা করতে পারে?”

শুরু হল বিচারের মিথ্যা প্রহসন। প্রধান সাক্ষী ল্যাভোশিঁয়েরই এক কর্মচারী যাকে চুরির অপরাধে বরখাস্ত করা হয়েছিল। ল্যাভোশিঁয়ের উকিল তার বৈজ্ঞানিক গবেষণার কথা উল্লেখ করতেই প্রতিপক্ষের তরফে জবাব এল, “বিপ্লব বিজ্ঞানকে চায় না, তার প্রয়োজন ন্যায়ের।”

অবশেষে সেই বিচিত্র বিচার শেষ হল। সবচেয়ে বিচিত্র তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ, “বিদেশী ও দেশের শত্রুদের সাথে ষঢ়যন্ত্র করার অভিযোগে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল।”

মৃত্যুর আগে যেন চিঠিতে তিনি স্ত্রীকে লিখেছেন, তোমার স্বাস্থ্যের যত্ন নিও প্রিয়তমা, দুঃখ করো না, আমি আমার কাজ শেষ করেছি, তার জন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিও।

১৭৯৪ সালের মে মাসের কোন এক সকালে তাঁকে গিলোটিনে হত্যা করা হল।

তাঁর মৃত্যুর পর বিজ্ঞানী লরেঞ্জ বলেছিলেন, “শুধু একটি মুহূর্ত লেগেছিল তাঁর মাথাটি কাটতে। তেমন আর একটি মাথা পেতে হয়ত আমাদের আরো একশো বছর অপেক্ষা করতে হবে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *