2 of 2

৭২. উইলিয়াম হার্ভে (১৫৭৮-১৬৫৭)

৭২. উইলিয়াম হার্ভে (১৫৭৮-১৬৫৭)

শরীরে রক্ত সঞ্চালন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্ভে। পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা ছিল মানুষের। সেই ভুল ধারণা নিয়েই এতকাল মানুষের চিকিৎসা করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক উইলিয়াম হার্ভে দীর্ঘ ন’বছর ধরে গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ১৬২৮ সালে একটি বাহাত্তর পৃষ্ঠার বই বার করেন। এই ছোট বইটার মধ্যে তিনি তুলে ধরেছেন শরীরের জটিল সমস্যাগুলো।

১৫৭৫ সালে ১লা এপ্রিল ফোকস্টোনে উইলিয়াম হার্ভের জন্ম হয়। তাঁর পিতা ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন। উইলিয়াম প্রথমে কিংস স্কুলে ওপরে কেমব্রিজে পড়াশুনা করেন। ১৫৯৭ সালে তিনি পাদুয়ায় পড়তে আসেন। এই পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্যাব্রিমিয়াসের কাছ থেকে তিনি অনেক কিছু শিক্ষালাভ করেন। যা পরবর্তীকালে তার আবিষ্কারে সাহায্য করে। বিজ্ঞানী ফ্যাব্রিমিয়াসই বলেন যে মানুষের শরীরে শিরার মধ্যে ভালভ বা কপাটক আছে। এই ভালভ বা কপাটকের কি কাজ তিনি বুঝতে পারেননি। তাই রক্ত সঞ্চালনের ব্যাখ্যা অসমাপ্তই রয়ে গেল। হার্ভে তা পরীক্ষার দ্বারা দেখালেন যে এই ভাল্ভ বা কপাটকই হৃৎপিন্ডে অন্য যে কোন দিক থেকে রক্তের প্রবাহকে বাধা দেয়। তিনিই রক্ত সঞ্চালনের গুরুত্ব বিষয় আবিষ্কার করলেন।

পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অফ মেডিসিন ডিগ্রী নিয়ে তিনি লন্ডনে ফিরে আসেন। ১৬০৯ সালে তিনি বার্থোলোমিউ হাসপাতালে চিকিৎসক হিসাবে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি রোগীদের পরীক্ষা করে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেন ও এই সিদ্ধান্তে এলেন যে মানুষের শরীরে রক্ত সঞ্চালন সম্পর্কে এতদিন যা ধারণা ছিল তা সবই ভুল। তবে পুরনো তথ্যের ভুলটা কোথায়–সেটা জানার জন্যে তিনি বছরের পর বছর যা পেয়েছেন তাকেই কাটাকুটি করে দেখেছেন। সব জন্তু-জানোয়ার, পাখি, ব্যাঙ, সাপ, ইঁদুর সবই তিনি কাটাকুটি করেছেন ও তার সাথে পরীক্ষাও করেছেন।

মানুষের শরীরে যে হৃৎপিন্ড আছে তাতে চারটে প্রকোষ্ঠ। ডানদিকে ও বাঁদিকে আছে হৃৎকোষ বা অলিন্দ। তাছাড়া ডানদিকে ও বাদিকে রয়েছে হৃৎপিন্ডের রন্ধ্র। সোজাসুজি হৃৎপিন্ডকে ভাগ করে রয়েছে সেপটাস বা পর্দা। আগে রক্ত সঞ্চালনের সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকদের যে ভুল ধারণা ছিল তা হচ্ছে যুকৎ থেকে রক্ত তৈরি হয় এবং রক্ত দুই ধরনের। প্রথম রকমের রক্ত হল হৃৎপিন্ডের দক্ষিণ নিলয় থেকে রক্ত উৎপত্তি হয়ে শিরার মাধ্যমে সঞ্চালিত হয়। আর এক প্রকার বাম নিলয় থেকে উৎপত্তি হয়ে ধমনীর মাধ্যমে শরীরে প্রবাহিত হয়। পরে বিজ্ঞানী মাইকেল সেভেটাস ফুসফুসীয় সংবহনের প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর এই ব্যাখ্যা ধর্মবিরুদ্ধ বলে তাকে পুড়িয়ে মারা হয় ও তার লেখা বইটিকেও নষ্ট করে ফেলে।

এখন তো অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে শোণিত সংবহন পরীক্ষা করা যায়। কিন্তু চারশ বছর আগে এটা খুবই কঠিন কাজ ছিল। তখন তো অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছিল না। ফ্যাব্রিসিয়াসের কাছ থেকে হার্ভে জেনেছিলেন শিরায় কপাটক আছে। এই কপাটকের মানেই হল রক্ত একমাত্র শিরার ভেতর দিয়ে একদিকে প্রবাহিত হতে পারে। কিন্তু কোন দিকে রক্ত প্রবাহিত হয় সেকথা তিনি বলতে পারেন নি। হার্ভে দেখলেন এই রক্ত প্রবাহ হয় হৃৎপিন্ডের দিকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রক্ত কোথা থেকে আসছে? পাকস্থলী বা যকৃত থেকে রক্ত আসছে এই আগে ধারণা ছিল, কিন্তু উইলিয়াম হার্ভে তা পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণ করেন যে রক্ত মোটেই দু’রকমের নয়। একই রকমের রক্ত শিরা ও ধমনীতে প্রবাহিত হয়। রক্ত শুধু হৃৎপিন্ডের মধ্যেই নয় শরীরের সব জায়গায় এবং সবসময় একই দিকে প্রবাহিত হয়। হৃৎপিন্ড থেকে যে রক্ত পাম্পের মত প্রতিক্রিয়ায় বেরিয়ে আসে, বৃত্তাকারে তা শরীরে প্রবাহিত হয় এবং আবার তার সূত্রে ফিরে আসে। শোণিত সংবহন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া মানেই মৃত্যু হওয়া। হৃৎপিন্ড এ কাজ করে রক্তবাহী নালীর সাহায্যে।

উইলিয়াম হার্ভে তাঁর আবিষ্কারের কথা প্রকাশ করতে চাননি। ১৬১৫ সালে বই প্রকাশের বার বছর আগে রয়্যাল কলেজে বক্তৃতা দেবার সময় তাঁর আবিষ্কারের কথা উল্লেখ করেন। তখন কেউই পাত্তা দেয়নি। ১৬২৮ সালে তাঁর গবেষণা প্রায় বন্ধ হবার পর চিকিৎসা মহলে বিরাট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সেইসময় তাঁর গবেষণা প্রায় বন্ধ হবার মুখে। হার্ভের বিরোধীরা অনেক পরীক্ষা করেও হার্ভের আবিষ্কারকে নিয়ে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারল না। তাঁরা দেখলেন হার্ভের কথাই ঠিক ও অভ্রান্ত। তাঁর আবিষ্কারে ডাক্তারদের চিকিৎসাও ভাল হতে থকে। এতে ডাক্তারদের প্র্যাকটিস বেড়ে গেল। যার ফলে হার্ভের খ্যাতি ও যশ বেড়ে গেল। তিনি প্রথম চার্লসের চিকিৎসক নিযুক্ত হন। প্রথম চার্লস হার্ভের আবিষ্কারে খুব খুশী হন। তিনি তাকে গবেষণার জন্য সব ব্যবস্থা করে দিলেন। হার্ভে রাজাকে তাঁর বই উৎসর্গ করলেন, এই বলে যে শরীরের কাছে হৃৎপিন্ডের যে স্থান, রাজত্বের কাছেও রাজার সেই স্থান। তিনি খুব রাজার ভক্ত ছিলেন। এরপর লাগল গৃহযুদ্ধ। রাজার সাথে হার্ভে ত্যাগ করলেন লন্ডন। প্রচন্ড যুদ্ধের মধ্যেও তিনি গবেষণা করে যান। তিনি রাজার সঙ্গে অক্সফোর্ড সফরে যান। রাজপরিবারের প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল বলে তাঁর বার্থোলোমিউ হাসপাতালের চাকরিটাও চলে যায়। অক্সফোর্ড ছেড়ে তিনি চলে আসেন লন্ডনে। তিনি খুব ভুগছিলেন গেঁটেবাতের যন্ত্রণায়। ঠান্ডা পানিতে পা ডুবিয়ে তিনি সারাটা দিন কাটাতেন। তখন তাঁর বয়স ছিল আটষট্টি।

হার্ভের আবিষ্কার ইউরোপের সর্বত্র স্বীকৃত হয়েছে। ১৬৫৪ সালে রয়্যাল কলেজ তাঁকে সভাপতির পদে বসিয়ে সম্মান দেন। কিন্তু তিনি তার গ্রহণ করেন নি। কারণ বয়স বেশি ও শারীরিক অসুস্থতা। ১৬৫৭ সালে তিনি সম্পূর্ণভাবে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এবং কথা বলার ক্ষমতাও ছিল না। হার্ভে নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তাঁর স্ত্রী মারা যান। স্ত্রী মারা যাবার পর তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি রয়্যাল কলেজকে দান করে দেন। যাতে চিকিৎসকরা গবেষণা করে নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করতে পারে। ১৮৮৩ সালে কলেজের ফেলোরা হার্ভের যাবতীয় স্মৃতি সরিয়ে সংরক্ষণ করেন হেম্পস্টেড গির্জার মার্বেল পাথরে তৈরী হার্ভে স্মৃতিকক্ষে। উইলিয়াম হার্ভের আবিষ্কার চিকিৎসা জগতে এক অমর কীর্তি। ১৬৫৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তি এক ভাইপোকে দিতে না দিতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *