1 of 2

৪৩. পার্সি বিশী শেলী (১৭৯২-১৮২২)

৪৩. পার্সি বিশী শেলী (১৭৯২-১৮২২)

১৭৯২ সালের ৪ আগস্ট ইংলন্ডের সাজেক্সের অন্তর্গত ওয়াহহ্যামে শেলীর জন্ম। টিমথি শেলীর প্রথম পুত্র পার্সি বিশী শেলীর ছেলেবেলাকার স্মৃতিমধুর ছিল না। ছেলেবেলা থেকে পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। তিনি। শেলীর জগৎ ছিল স্বপ্নের এবং কল্পনার। প্রাথমিক স্কুলের পাঠ শেষ করে তিনি ভর্তি হলেন লন্ডনের সবচে নামী স্কুল ইটনে। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে ইটন ছাড়তে হল কারণ এক সহপাঠীর হাতে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছিলেন তিনি।

শেলী ছিলেন অসাধারণ সুন্দর। দশ বছর বয়সে তাকে ‘সিয়ন এ্যাকাডেমি’র আবাসিক স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। আঠারো বছর বয়সে তিনি ভর্তি হলেন অক্সফোর্ডের কলেজে। ইতিমধ্যে তাঁর রোমান্টিক কবি কল্পনায় শুরু হয়েছে কাব্য রচনা। ১৮১১ সালে শেলী লিখলেন The necessity of Atheism। এই প্রবন্ধ লেখার অপরাধে তাকে কলেজ ছাড়তে হয়। এর বিরুদ্ধে শেলীর বন্ধু প্রতিবাদ জানালে তাকেও কলেক থেকে বহিষ্কার করা হয়। দুই বন্ধু কলেজ ছেড়ে লন্ডনের পোলক স্ট্রীটের এক বাড়িতে এলেন। তাঁর এই দুর্দিনে এগিয়ে এলেন তার ছোট বোন। নিজের সঞ্চয় থেকে ভাইকে নিয়মিত অর্থ সাহায্য করতে শুরু করলেন। এই অর্থ তিনি পাঠাতেন তার এক বান্ধবী হ্যারিয়েট ওয়েস্ট ব্রোকের সাহায্যে। এই পরিচয়ের সূত্র থেকেই হ্যারিয়েটের সাথে সম্পর্কে গড়ে শেলীর। সে বছরেই দুজনের বিয়ে হয়ে যায়। এ বিবাহে ভালবাসার চেয়ে বেশি ছিল সহানুভূতি। বিয়ের পর দুজনে গেলেন আয়ারল্যান্ড।

শেলীর বয়স তখন উনিশ। তিনি আয়াল্যান্ডের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখে খুশী হন। এরপর ফিরে আসেন লন্ডনে। বিয়ের পর দুটি বছর তারা এক সাথে সুখে শান্তিতে কাটিয়েছেন। ১৮১২ সালে শেলী রচনা করলেন, “Queen Mab”। এক দীর্ঘ কবিতা। মধ্যে অপরিণতির ছাপ থাকতে একজন মহৎ কবির আগমন ধ্বনি এতে উচ্চারিত হয়েছে।

১৮১৩ সালে হ্যারিয়েট একটি কন্যার জন্ম দিল। কুইন মবের নায়িকার নাম অনুসারে তাঁর নাম রাখা হল ইয়ানথি। এর কিছু দিন পর সরকারি আইনের নিয়ম অনুসারে হ্যারিয়েটকে পুনরায় বিবাহ করতে হল।

এই বিবাহের পর থেকেই শেলীর জীবনে নেমে এল এক মানসিক অস্থিরতা।

সংসারের এই অশান্তির মধ্যে শেলীর পরিচয় হল দার্শনিক গডউইনের সাথে। গডউইনের Political Justice বইটি শেলীর মনকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। গডউইনের সাথে প্রথমে চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল। তার পর দুজনের পরিচয় হল।

গডউইনের সাথে ছিল তাঁর প্রথম পক্ষের সতেরো বছর বয়সী সুন্দরী কন্যা মেরি।

শেলীর সাথে গড়ে উঠল তার গোপন প্রণয়। এবং ক্রমশই হ্যারিয়েটের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে আরম্ভ করলেন শেলী।

পুত্র সন্তান জন্মের দু বছর পর হ্যারিয়েট আত্মহত্যা করেন। শেলীর জীবনে তখন তাঁর কোন ভূমিকা ছিল না।

১৮১৫ সালে লিখলেন এ্যালাস্টার “Alastor”। অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা এক কাব্য। এটি একটি আত্মজীবনীমূলক রচনা।

Alastor or the Spirit of Solitude প্রকাশের দু মাস পর শেলী জেনিভায় গেলেন। সাথে মেরি ও কবি বায়রনের প্রেমিকা জেনি। তারা জেনেভায় পৌঁছবার অল্পদিনের মধ্যেই বায়রন এলেন সেখানে। দেখা হল দই কবির।

আগস্ট মাসে শেলী ফিরে এলেন ইংল্যন্ডে এসে পরিচয় হল কবি লে হান্টের সাথে। হান্ট ছিলেন তৎকালীন কবিদের প্রধান উৎসাহদাতা।

শেলী মেরিকে বিয়ে করলেন। এর পর শেলী হাত দিলে প্রমিথিয়াস আনবাউন্ড (Prometheus Unbound) রচনার কাছে। এর মধ্যে নাটক এবং গীতিকবিতার এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ ঘটেছে।

১৮১৮ সালের মার্চ মাসে শেলী রওনা হলেন ইটালির পথে। সাথে মেরি, জেনি, তাদের ছেলেমেয়ে। এই সময়েই রচিত হয় তার জীবনের সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবিতা।

শেলীর জীবনের শেষ চারটি বছর অতিক্রান্ত হয় ইটালিতে। এই সময়টুকুই তাঁর জীবনের মহত্তম সৃষ্টির কাল।

ইটালিতে এসে শেলী কোন স্থায়ী বাসা বাঁধেননি। তাঁর মনে হল তিনি সমগ্র ইটালি পরিভ্রমণ করবেন। বর্তমানের জগতে থেকে ফিরে যাবেন অতীতের জগতে। এখানেই পরিচয় হল এক অধ্যাপকের সাথে, তিনিও যোগ দিলেন তাদের মজলিসে।

একদিন কথা প্রসঙ্গে অধ্যাপক বললেন ফ্লোরেন্সের এক কাউন্টেই দুই কন্যা সৎ মায়ের তাড়নায় বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে এক আশ্রমে। দুজনেই সুন্দরী রূপসী।

কয়েকদিন পর শেলী অধ্যাপককে সাথে নিয়ে সেই তরুণীদের সাথে সাক্ষাতের জন্য যাত্রা করলেন। যখন দুজনে আশ্রমে এসে পৌঁছলেন, বড় বোন এমিলিয়া বাগানে দাঁড়িয়েছিল। শেলীর মনে হল কোন ভাস্কর যেন খোদাই করে তাঁর নারী রূপ সৃষ্টি করেছে। প্রথম পরিচয়ে দুজনেই দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হলেন।

শেলী গৃহে এলেন, তখন তাঁর সমস্ত মন জুড়ে শুধু এমিলিয়া। শেলীর জীবনের এই নতুন নারীকে মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না মেরি। তবুও কখনো নিজের অন্তরের ব্যথাকে প্রকাশ করেননি।

শেলী এমিলিয়ার প্রেম দীর্ঘদিন স্থানী ছিল না। একদিন শেলী পত্র পেলেন, এমিলিয়ার বাবা তার বিবাহ স্থির করে ফেলেছেন…।

শেলী ব্যথিত হলেন কিন্তু সৃষ্টির উন্মাদনায় তখন তিনি ক্রমশই সৃষ্টির গভীরে ডুব দিচ্ছিলেন।

সাংসারিক সমস্যা থেকে ক্রমশই দূরে সরে যেতে চাইছিলেন শেলী। এমন সময় অপ্রত্যাশিত এক আঘাত নেমে এল তার উপর। মেরির প্রথম সন্তান জন্মের কয়েক সপ্তাহ পরেই মারা গেল। এর পর শেলীর আরো দুটি সন্তান হয়। দুটি সন্তানই অকালে মৃত্যু বরণ করেছিল।

এ বেদনা থেকে নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে সৃষ্টির সাধনায় ক্রমশই ডুব দিলেন। তিনি নিজেই লিখেছেন, “আমি বেদনার মধ্যে যা পেয়েছি, কবিতার মধ্যে তাকেই প্রকাশ করেছি।”

তার অনুভূতিবোধ থেকে জন্ম নিতে থাকে একের পর এক কবিতা। Ode tothe west wind, The cloud, The skylark, Song to prosperine, The Indian serenade, Music, When soft vioces die, On a Faded violet, To night। এর এক একটি কবিতা যেন সৌন্দর্যে, বর্ণচ্ছটায় এক একটি হীরক দ্যুতি।

যখন তিনি সৃষ্টির উল্লাসে মেতে উঠেছেন, এমন সময় দুঃসংবাদ এল বন্ধু কবি কিটস্ মারা গিয়েছেন। চিকিৎসার জন্য ইটালিতে এসেছিলেন কিটস্ শোকাহত কবি কিটসের এই প্রয়াণে রচনা করলেন, Adonais-এমন মর্মস্পর্শী কবিতা শুধু ইংরাজি সাহিত্যে নয়, বিশ্বসাহিত্যে কম লেখা হয়েছে।

….He lives, he walks-it is death is dead, not he;
Mourn not for Adonais-Thou young Dawn, Turn all thy
dew to splendour for from three
The spirit thou lamentest is not gone.
Ye caverns and ye forests cease to moan!

শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পাবার জন্য ১৮২২ সালে শেলী এবং বন্ধু উইলিয়ম স্পেজিয়া উপসাগরের তীরে একটি বাড়ি ভাড়া নিলেন। শেলী সমুদ্র ভালবাসতেন কিন্তু সাঁতার জানতেন না।

জুন মাসে শেলী সংবাদ পেলেন কবি লে হান্ট ইংল্যান্ড থেকে ইটালিতে এসেছেন। হান্টের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিলেন শেলী। বন্ধু উইলিয়ামকে সাথে নিয়ে লেগহনে গেলেন হান্টের সাথে দেখা করবার জন্য।

কয়েকদিন হান্টের সাথে কাটিয়ে ১৮২২ সালের ৮ জুলাই কবি উইলিয়ামকে সাথে নিয়ে এলেন লেগহর্নে। তারা নৌকায় উঠতেই জেলেরা বারণ করল।

জেলেদের কথায় কান দিলেন না দুই বন্ধু। নৌকা নিয়ে ভেসে চললেন। কয়েক মাইল যেতেই আচমকা ঝড় উঠল। ঘন মেঘে চারদিক ছেয়ে গেল। কুড়ি মিনিটের মধ্যেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল। কিন্তু শেলীর নৌকা খুঁজে পাওয়া গেল না।

দশ দিন পর রেগগিয়োর সমুদ্রের তীরে জেলেরা একটি মৃতদেহ খুঁজে পেল। তাঁর জামার এক পকেটে কবি কিটসের কবিতার কপি, অন্য পকেটে সফোক্লিসের নাটক। বন্ধুরা এসে শনাক্ত করল শেলীর দেহ।

সমুদ্র ভালবাসতেন শেলী। তাই সমুদ্রতীরেই তাঁর চিতায় আগুন জ্বালান হল। তখন শেলীর বয়স মাত্র ত্রিশ।

শেলীর মূল পরিচয় বিপ্লবী আদর্শবাদের কবি হিসাবে। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ তাঁর চেতনা মন জগৎতে এক নতুন প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাই তিনি ফরাসি বিপ্লবের আদর্শকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন। সে যুগের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে তাঁর অন্তর বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। তার প্রকাশ দেখা যায় The Revolt of Islam promethous Unbound-এ। শেলীর প্রমিথিয়াস চিরস্বাধীন। জিউসের পতনেই তাঁর মুক্তি।

শেলী এক কল্পনার মধ্যে খুঁজে ফিরেছেন এক আদর্শ জগৎকে, তাই তিনি সন্ধান করেছেন অনাগত যুদকে। যেখানে থাকবে প্রেম, সৌন্দর্য স্বাধীনতা। তিনি দেখতে পান পৃথিবীর মানুষ সেই পথে এগিয়ে চলেছে। একদিন সব অন্ধকার দূর হবে। পশ্চিমে বাতাস সব মলিনতা দূর করে দেবে…তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা Ode to the west wind-এ লিখেছেন, এক প্রলয়ঙ্করী ঝড় এসেছে পশ্চিমা বাতাসের রূপ ধরে। সে যেন ধ্বংসের মূর্তি। সে মিলনতাকে ধ্বংস করে কিন্তু যাবার সময় সৃষ্টি করে নব জীবনের সূচনা। তাই সে ভয়ঙ্কর হলেও সুন্দর, ভীষণ হলেও মধুর, ধ্বংস করলেও প্রতিশ্রুতিবান।

ঋতুকাব্য হিসাবে The west wind যেমন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি কবিতা, তেমনি তাঁর আর একটি অসাধারণ কবিতা The cloud. ভেসে চলা মেঘের বর্ণনায় কবি যেন শিল্পী হয়ে উঠেছেন। রঙের তুলি দিয়ে ছকি এঁকেছেন এখানে।

স্কাইলাক পাখির ডানায় ভর দিয়ে কবি সমস্ত মলিনতা, জীবনের সব অন্ধকার, সব কলুষতা থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখছেন। তাই কবি লিখেছেন–

The trumpet of a prophecy! O wind,
If winter comes, can spring be far behind?

“শীত যদি আসে, বসন্ত কি দূরে থাকতে পারে?” এই বিশ্বাসই শেলীকে এক মহত্তর কবির স্তরে স্থান দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *