1 of 2

৪২. ভাস্করাচার্য (১১১৪-১১৮৫)

৪২. ভাস্করাচার্য (১১১৪-১১৮৫)

প্রায় ৮৫০ বছর আগেকার কথা। দক্ষিণ ভারতের বিজ্জবিড় নামে এক নগরে বসে করতেন এক ব্রাহ্মণ। নাম ভাস্করাচার্য। অঙ্ক এবং জ্যোতিষ দুটি বিষয়েই ছিল তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য। নগরের সীমানা ছাড়িয়ে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দূর দেশে। দেশের রাজা মহারাজা থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করত। এত সম্মান খ্যাতি তবুও মনে সুখ ছিল না। ভাস্করাচার্যের। তার একমাত্র সন্তান। লীলাবতী রূপে সরস্বতী গুণে লক্ষ্মী। শান্ত ধীর, অসাধারণ মেধাবী। মুখে মুখে পিতার কাছ থেকে শাস্ত্রের নানান পাঠ নিয়েছে। এমন গুণবতী, রূপবতী কন্যা তবুও ভাস্করাচার্য নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় কষ্ট পান। জন্ম সময়ে তিনি কন্যার ভাগ্য গণনা করে কোষ্ঠী প্রস্তুত করেছেন। তাতে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে কন্যার বৈধব্যযোগ। এ কথা তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না। এতদিন ভুলেই ছিলেন। কিন্তু এখন যে কন্যা বিবাহযোগ্য হয়ে উঠেছে। প্রতিবেশীরা মেয়ের বিবাহের কথা বলছে। অনেকেই লীলাবতাঁকে বিবাহ করতে চায়। দিবারাত্র ভাবতে থাকেন ভাস্করাচার্য। কার সাথে তার কন্যার বিবাহ দেবেন? জেনেশুনে একটি ছেলের জীবন নষ্ট করবেন! এক সময় তার মনে হল গণনায় কোন ভুল হয়নি তো? আরো কয়েকজন গণৎকারকে দিয়ে নতুন করে গণনা করালেন। সকলেই একমত, এই কন্যার বিবাহ দেওয়া উচিত নয়। বিবাহের অল্প দিনের মধ্যেই এর স্বামীর মৃত্যু হবে। কিন্তু এর কি কোন প্রতিকার নেই? ভাবতে থাকেন ভাস্করাচার্য। সমস্ত পুঁথিপত্র নিয়ে বসলেন। কয়েক দিন ধরে অবিশ্রান্ত গণনা করার পর একটি মাত্র শুভক্ষণ পেলেন। ঐ শুভক্ষণে বিবাহ হলেই একমাত্র কন্যার বৈধব্যযোগ রোধ করা সম্ভব। কন্যার উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পেতে দেরি হল না। বিবাহের প্রস্তুতি আরম্ভ হল।

বিবাহের শুভদিন এসে গেল। সকাল থেকে ভাস্করাচার্য উদ্বিগ্ন, সেই শুভক্ষণ যেন পার না হয়ে যায়। সময় নির্ধারণ করবার জন্য বালু ঘড়ি বসানো হয়েছে কক্ষের একদিকে। বারংবার ভাস্করাচার্য নিজে এসে সময় দেখছেন।

সেই যুগে সময় নির্ধারণের জন্য বালু ঘড়ি ব্যবহার হত। বালু ঘড়িতে দুটি কাঁচের পাত্র উপর-নিচ করে বসান হত। দুটি পাত্রেই একটি করে ছোট ফুটো ছিল। একটি পাত্রে বালি ভর্তি থাকত। তার থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে বালি ঝরে পড়ত। নির্দিষ্ট সময়ে পাত্রটি খালি হলে তা আবার উলটো করে দেওয়া হত। আর তার থেকে সময় নির্ধারণ করা হত।

বালু ঘড়ি ও লীলাবতী প্রকৃত ব্যাপারটি জানত না। বারংবার কৌতূহলী হয়ে বালু ঘড়ির দিকে গিয়ে দেখছিল। এদিকে পুরোহিত অপেক্ষা করে থাকেন। সময় পার হয়ে যায়। লগ্ন যে আর হয় না। অধৈর্য হয়ে বালু ঘড়ি ভাল করে দেখতেই আর্তনাদ করে উঠলেন ভাস্করাচার্য। লীলাবতী যখন বালু ঘড়ির উপর ঝুঁকে পড়ে সময় দেখছিল তখন তার অজান্তে গলার হার থেকে একটি মুক্তো খসে পড়ে বালি পড়ার ছিদ্রটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই কখন যে বিয়ের লগ্ন পার হয়ে গিয়েছিল কেউ জানতে পারেনি।

দুঃখে ভেঙে পড়লেন ভাস্করাচার্য। কন্যার বিবাহ হল। বিধির বিধান খণ্ডন করে মানুষের সাধ্য কি! অল্পদিনের মধ্যেই স্বামীকে হারিয়ে পিতার কাছে ফিরে এলেন লীলাবতী। কন্যার জীবনের সব আনন্দ সুখ চিরদিনের জন্য মুছে গেল। তাঁর জীবনের দুঃখ ভোলবার জন্য ভাস্করচার্য কন্যাকে বিদ্যাশিক্ষা দিতে আরম্ভ করলেন। আর সেই জন্য রচনা করলেন গণিত শাস্ত্রের বিশাল এক গ্রন্থ সিদ্ধান্ত শিরোমণি–এই গ্রন্থের মোট চারটি খণ্ড। প্রথম খণ্ডের নাম লীলাবতী-এতে সাধারণ গণিত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লীলাবতী পৃথিবীর আদিমতম গণিতের গ্রন্থ। প্রাচীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা।

আনুমানিক ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে সিদ্ধান্ত শিরোমণি রচিত হয়েছিল। তখন ভাস্করাচার্যের বয়স মাত্র ৩৬। ইউরোপে প্রথম গণিতের বই প্রকাশিত হয়েছিল ১২০২ খ্রিস্টাব্দে। লিওনার্দ দ্য পিসা নামে এক পণ্ডিত এই বই রচনা করেছিলেন।

আনুমানিক ১১১৪ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের বিজ্জবিড় গ্রামে ভাস্করাচার্যের জন্ম হয়। তাঁর জীবন কাহিনী সম্বন্ধে যতটুকু জানা যায় তার কতটুকু সত্য কতটুকু কল্পনা তা বিচার করা কঠিন। তবে সাম্প্রতিক কালে বোম্বাই-এর অন্তগর্ত চালিসও নামে একটি স্থান থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি পুরনো মন্দিরের শিলালিপি থেকে জানা যায় ভাস্করাচার্যের পিতার নাম ছিল মহেশ দৈবজ্ঞ; তাঁর পিতার নাম মনোরথ; তাঁর ঊর্ধ্বতন পুরুষদের নাম যথাক্রমে প্রভাকর, গোবিন্দ, ভাস্করভট্ট এবং ত্রিবিক্রম। ভাস্করাচার্যের দুই পুত্রের নাম জানা যায়-লক্ষ্মীধর ও চঙ্গদেব। এঁরা সকলেই ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ। পাণ্ডিত্যের জন্য তারা ছিলেন সকলের শ্রদ্ধেয়। শিলালিপিতে প্রত্যেকের সম্বন্ধেই রয়েছে প্রশস্তি। তবে ভাস্করাচার্যের প্রশংসায় মুখরিত হয়ে উঠেছে লিপিকার। তাকে বলা হয়েছে ভট্ট পারদর্শী তিনি সাংখ্য, তন্ত্র, বেদে মহাপণ্ডিত। তাঁর তুল্য জ্ঞান আর কারো নেই। কাব্যে, কবিতায়, ছন্দে, অতুলনীয়। গণিতে শিবের মতই তিনি মহাজ্ঞানী, তার চরণে প্রণাম জানাই।

এ লিপিতে কোথাও লীলাবতীর উল্লেখ নেই। তাহলে লীলাবতীর অস্তিত্ব কি শুধুই কাল্পনিক! এ বিষয়ে নানা রকম মত আছে। অনেকের ধারণা লীলাবতী ছিলেন ভাস্করাচার্যের কন্যা। তিনি অত্যন্ত বিদূষী ছিলেন। লীলাবতী অংশটি তাঁরই রচিত। ভাস্করাচার্য সমগ্র সিদ্ধান্ত শিরোমণি গ্রন্থটি কন্যাকে উৎসর্গ করেছিলেন। কেউ বলেল লীলাবতী নামে কোন নারীরই অস্তিত্ব নেই। কারণ এই বইটির বিভিন্ন শ্লোকে কোথাও সখে, কোথাও প্রিয়ে, চঞ্চলা ইত্যাদি সম্বোধন করেছেন। কন্যাকে কেউই প্রিয়ে বা সখে বলে সম্বোধন করে না। সম্ভবত ভাস্করাচার্য জ্ঞানের দেবী সরস্বতাঁকেই বিভিন্ন সম্বোধনে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করেছেন।

লীলাবতী প্রসঙ্গে যতই বিতর্ক থাক, মূল পুস্তকখানি নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। এর প্রথম খণ্ড লীলাবতীতে সাধারণ গণিত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এর প্রথমে রয়েছে গণেশ বন্দনা আর মঙ্গলাচারণ। লীলাবতীতে মোট ২৭৮টি শ্লোক আছে। এতে সরল গণিতের বিভিন্ন পদ্ধতি সহজভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সাধারণ যোগ, ঘনমূল, অনুপাত, সমানুপাত, বিপরীত ক্রিয়া, সুদকষা, ভগ্নাংশ, লাভক্ষতি।

গণিত ছাড়াও লীলাবতীতে জ্যামিতি নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। এতে আছে। ত্রিভুজ চতুর্ভুজ ট্রাপিজিয়ম বৃত্ত। প্রতিটি বিষয়েই তাঁর আলোচনা মোটামুটি নির্ভুল। লীলাবতী থেকে একটি অঙ্কের উল্লেখ করা হল। “একজন ব্যক্তি কিছু অর্থ নিয়ে তীর্থযাত্রা করেছিল। তাঁর মোট সঞ্চিত অর্থের অর্ধেক প্রয়োগে ব্যয় করল। অবশিষ্ট অর্থের দুই নবমাংশ কাশীতে ব্যয় করল। পথখরচ বাবদ তার ব্যয় হল অবশিষ্টের এক চতুর্থাংশ। অবশিষ্টের ছয় দশমাংশ ব্যয় হল গাঁজাতে। তীর্থযাত্রীর হাতে অবশিষ্ট রইল মাত্র ৬৩টি মুদ্রা।” ভাস্করাচার্য প্রশ্ন রেখেছেন তীর্থযাত্রীটি কত মুদ্রা নিয়ে পথে বার হয়েছিল।

প্রায় ৯৫০ বছর আগে রচিত অঙ্কটির সমরূপ অঙ্ক বর্তমান কালের স্কুলের ছাত্ররাও করে থাকে সিদ্ধান্ত শিরোমণির অন্তর্ভুক্ত হলেও লীলাবতী গ্রন্থটি স্বতন্ত্র পুস্তকের মর্যাদা পেয়েছিল। এবং এটি বহুল প্রচলিত ছিল।

দ্বিতীয় খণ্ড বীজগণিত। এতে মূলত সমীকরণ ও দ্বিঘাত সমীকরণের তত্ত্বগুলো নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে তবে ভাস্করাচার্য এই তত্ত্বগুলোর উদ্ভাবক নন। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীধরাচার্য প্রথম দ্বি সমীকরণ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তাঁর গ্রন্থটির নাম ছিল গণিতাসার। এতে বীজগণিত পাটিগণিতের বহু নিয়ম আলোচিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য–ভগ্নাংশ, সুদ নির্ণয়, দ্বিঘাত সমীকরণ, বর্গমূল, ঘনমূল প্রভৃতি।

আর্যভট্ট, শ্রীধরাচার্য, ব্রহ্মগুপ্ত প্রভৃতি পণ্ডিতেরা বীজগণিতের যে সূত্রপাত করেন, ভাস্করাচার্য তাকেই বিস্তৃত করেন। সিদ্ধান্ত শিরোমণিতে গণিত শাস্ত্রকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক ভাগে জ্ঞান রাশি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। একে বলা হয়েছে অঙ্ক গণিত। দ্বিতীয় বিভাগে অজ্ঞাত রাশি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এটির নাম দেওয়া হয়েছে বীজগণিত।

বর্তমান কালে অজ্ঞাত রাশি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যেমন a, b, x, অথবা ১, ২ বা অন্য কোন সংখ্যা অজ্ঞাত রাশির পরিবর্তে ধরা হয় তেমনই ভাস্করাচার্য অজ্ঞাত রাশিদের চিহ্নিত করবার জন্য বিভিন্ন রং যেমন সাদা, কালো, নীল, হলুদ, উল্লেখ করেছেন। কোথাও বিভিন্ন রত্নের নাম হীরা, মণি, মুক্ত মাণিক্য ব্যবহার করেছেন।

সিদ্ধান্ত শিরোমণির তৃতীয় খণ্ড গোলধ্যায় এবং চতুর্থ খণ্ড গণিতাধ্যায়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে মৌলিক গবেষণার ফলাফল আলোচনা করেছেন। এতে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, চন্দ্রের দ্রাঘিমা, নির্ণয়, পৃথিবীর গোলাকার আকৃতির প্রমাণ দিয়েছেন।

বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয় নিউটনের আবিষ্কারের অন্তত পাঁচশো বছর আগে পূর্বসূরীদের কোন সাহায্য ছাড়াই তিনি নির্ভুল সত্যে উপনিত হয়েছেন যে পৃথিবী শূন্যে ভাসমান। অথচ সুদীর্ঘ কাল পর্যন্ত পৃথিবীর সব দেশের মানুষের ধারণা ছিল পৃথিবী কোন একটি আধারের উপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে আটটি বিশাল হাতি এই পৃথিবীকে ধরে রেখেছে। আবার এ হাতিগুলো রয়েছে বিশাল এক কচ্ছপের উপর। কচ্ছপটি সমুদ্রে ভাসছে। আবার কোন কোন পুরাণে বলা হয়েছে এক অনন্তনাগ তার ফণার উপর ধরে রেখেছে পৃথিবীকে। যদি কোন কারণে সাপ মাথা নাড়ায় তখনই ভূমিকম্প হয়।

ভাস্করাচার্য এই অলীক কল্পনার জগতে প্রথম নিয়ে এলেন বৈজ্ঞানিক যুকি। গোলাধ্যায়ের তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি বলেছেন–

“নানা ধারঃ স্ব শক্তৈব বিয়তি নিয়তাং তিষ্ঠতীহাস্য পৃষ্ঠে।”

এর অর্থ–কল্পনা করে নাও পৃথিবী মহাসমুদ্রে ভাসমান। পৃথিবীর কোন আধার নেই। এর চারদিকে রয়েছে আকাশ।

সেই যুগে মানুষের ধারণা ছিল পৃথিবী চ্যাপ্টা থালার মত। আর্যভট্ট প্রথম বলেছিলেন পৃথিবীর আকার কদম ফুলের মত গোল কিন্তু তার সপক্ষে যুক্তিনিষ্ঠ কোন প্রমাণ দিতে পারেননি। ভাস্করাচার্যই প্রথম বললেন পৃথিবী গোল।

“সমো যতঃ স্যাৎ পরিধে শতাংশ
পৃথ্বী চ পৃথ্বী নিতরাং তনীয়ান।
নরশ্চ তৎ পৃষ্ঠ গতস্য কৃৎস্না
সমেব তস্য প্রতিভাত্যতঃ সা!”

ভাস্করাচার্য নিজেই প্রশ্ন করেছেন পৃথিবী যদি গোল হয় তবে আমরা তাকে সমতল দেখি কেন? সহজ সরল যুক্তিনিষ্ঠভাবে নিয়েই এর উত্তর দিয়েছেন। বিরাট একটি বৃত্তের পরিধির একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ যদি লক্ষ্য করা যায় তবে তাকে সমান বলেই মনে হবে, তেমনি পৃথিবীর আয়তন এত বিরাট যে মানুষ খালি চোখে যা দেখে তা পৃথিবীর অতি ক্ষুদ্রতম একটি অংশ; তাই মনে হয় সমতল।

নিউটনের বহু আগেই ভাস্করাচার্য মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি অবশ্য মাধ্যাকর্ষণ কথাটি ব্যবহার না করে আকর্ষণ কথাটি ব্যবহার করেছেন।

“আকৃষ্টি শক্তিশ্চ মহী তয়া
যঘুস্থং গুরু বাড়িমুখং স্বশ্যা।
আকৃষ্যতে তৎপততীব ভাতি
সমে সমান্তার পত ত্বীয়ং খে।।”

ভাস্করাচার্য বলেছেন পৃথিবীর এক আকর্ষণী বল আছে। তাই কোন বস্তু উৎক্ষিপ্ত হলে এই আকর্ষণী শক্তির দ্বারাই তা পুনরায় ভূমিতে পতিত হয়।

নিউটন এই মধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কার করে জগৎ বিখ্যাত হলেন অথচ তার কত পূর্বে ভাস্করাচার্য তা আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু বিশ্বের কাছে তিনি অপরিচিত অজ্ঞাত রয়ে গেলেন। এ্যারিস্টটল, প্লেটো, পিথাগোরাস, টলেমি, ইউরোপের মানুষের কাছে যে শ্রদ্ধার আসন পেয়েছিলেন, ভাস্করাচার্য তার থেকে বঞ্চিত হলেন। এর কারণ ভারতে বিজ্ঞানচর্চার অভাব। আর্যভট্ট, ভাস্করাচার্য প্রভৃতি বিজ্ঞানী যে বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত করেছিলেন, পরবর্তী প্রজন্মের মানুষেরা কেউই তা ধরে রাখতে পারেনি। বিজ্ঞানকে বিসর্জন দিয়ে ধর্মের কূটকচালিতেই নিজেদের মত্ত রেখেছিলেন।

তবে সিদ্ধান্ত শিরোমণি গ্রন্থখানি এক সময় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। বিভিন্ন ভাষায় এটির অনুবাদ হয়েছিল, সম্ভবত এটি ফার্সী ভাষায় অনুবাদ হয়ে আরব দেশে গিয়েছিল। মধ্যযুগে শুধু ভারতবর্ষ নয়, সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞ।

ভাস্করাচার্যের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে যতটুকু জানা যায় তাতে অনুমান তিনি মহারাষ্ট্রর সহাদ্রি পর্বতমালার নিকটস্থ নগর বিজ্জবিড় বা বিজুড়বিড়-এ জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে এই নগরের নাম হয় বিজাপুর।

ভাস্করাচার্যের পিতা মহেশ্বর দৈবজ্ঞ ছিলেন পণ্ডিত। জ্যোতির্বিদ্যা, ধর্মশাস্ত্রে তিনি ছিলেন খুবই পারদর্শী। তাঁদের বংশ বিদ্যাচর্চা ও পাণ্ডিত্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। তাঁরা সকলেই ছিলেন বিনয়ী, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবান।

ভাস্করাচার্যের শিক্ষা শুরু হয় তাঁর পিতার কাছে। বংশানুক্রমিক সাধনার পূর্ণ পরিণতি ঘটেছে তার মধ্যে। তাঁর সময়ে উজ্জয়িনী ছিল শিক্ষা-সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান। পরিণত বয়সে উজ্জয়িনী ছিল তাঁর প্রধান কর্মক্ষেত্র। তাঁর দুই পুত্রই ছিলেন বেদজ্ঞ পণ্ডিত।

ভাস্করাচার্য ছিলেন সাহসী, সংস্কারমুক্ত, উদার মনের মানুষ। মধ্যযুগে যখন ভারতবর্ষের মানুষ ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনার জগতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিল, সেই যুগের বুকের উপর দাঁড়িয়ে তিনি সমস্ত ভ্রান্ত ধারণাকে ছিন্নভিন্ন করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এর মধ্যে দিয়ে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি যখন অন্যের মতকে খণ্ডন করেছেন তখন প্রতিপক্ষের কাছে মার্জনা চেয়ে নিতে দ্বিধা করেননি। ভাস্করাচার্যের মধ্যে ছিল সাহস, সত্যকে প্রকাশ করবার দৃঢ়তা, সেই সাথে উদারতা।

ভাস্করাচার্য প্রায় ৭১ বছর জীবিত ছিলেন। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তিনি করণকুল নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থখানি তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে সমৃদ্ধ।

ভারতবর্ষের মানুষ যদি এ মহাবিজ্ঞানী পথকে অনুসরণ করত তবে ভারত আজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন পেত। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা সব কিছু থেকেও সব কিছু হারিয়েছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *