1 of 2

৩৭. বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৬-১৭৯০)

৩৭. বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৬-১৭৯০)

আমেরিকার ইতিহাসে যদি বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী কোন পুরুষের নাম করতে হয় যিনি একাধারে ছিলেন মুদ্রাকর, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রের সংবিধানে রচয়িতা, বিজ্ঞানী, আবিষ্কারক, যার সম্বন্ধে দেশবাসী শ্রদ্ধা অবনত চিত্তে বলেছিল আমাদের হিতৈষী মহাজ্ঞানী পিতা সেই মানুষটির নাম বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। শুধু আমেরিকার নন, সমগ্র মানব জাতির তিনি হিতৈষী বন্ধু। এই মহাজ্ঞানী কর্মযোগীর জন্য আমেরিকার বোস্টন শহরে।

১৭০৬ সালের জানুয়ারি মাসে। তার বাবা ধর্মীয় কারণে ইংল্যাণ্ড ত্যাগ করে আমেরিকায় গিয়ে বসবাস আরম্ভ করেন। বেঞ্জামিন জন্মের আগে তার মা চোদ্দটি সন্তানের জন্ম দেন। তাঁর বাবা অতিকষ্টে এই বিরাট সংসার প্রতিপালন করতেন। ছেলেবেলায় বেঞ্জামিন কোনদিনই আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখেননি।

যখন তার আট বছর বয়স, বাবা তাকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। কয়েক বছর স্কুলের খরচ মেটালেও শেষ পর্যন্ত আর পারলেন না। বেঞ্জামিনকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে নিজের সাবান তৈরির কারখানায় ঢুকিয়ে দিলেন।

কিন্তু এই কাজে কিছুতেই মন বসল না বেঞ্জামিনের। ব্যবসার প্রতি কোনদিন তাঁর কোন আকর্ষণ ছিল না। তার আগ্রহ ছিল সমুদ্রে ভেসে বেড়াবার।

কিন্তু ছেলের এই দুরন্তপনা বাবার ভাল লাগল না। সাবানের কারখানার কাজে ছেলের মন নেই দেখে তিনি ঠিক করলেন তাকে অন্য কোন কাজে ঢুকিয়ে দেবেন।

বেঞ্জামিনের তখন বারো বছর বয়স। বোস্টনের এক ছাপাখানায় শিক্ষানবিস হিসাবে কাজ শুরু করলেন। এই ছাপাখানার দেখাশুনার ভার ছিল তাঁর ভাইয়ের উপর।

ভাইয়ের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। ঠিক করলেন ফিলাডেলফিয়া শহরে গিয়ে স্বাধীনভাবে ছাপাখানার ব্যবসা শুরু করবেন।

বেঞ্জামিন নিউইয়র্ক ঘুরে ফিলাডেলফিয়া শহরে এসে পৌঁছলেন। অচেনা অজানা শহর, হাতে সামান্য কিছু পয়সা। পোশাকের অবস্থা ভাল নয়, কয়েক দিন ভাল করে খাওয়া হয়নি। ঘুরতে ঘুরতে একটা রুটির দোকানে এসে তিন পেনি দিয়ে রুটি কিনলেন।

চালচুলোহীন হাভাতে বেঞ্জামিন অল্পদিনেই নিজের বুদ্ধি আর পরিশ্রমে ছাপার কাজ শুরু করলেন। এই কাজের ফাঁকে নিয়মিত নানান বিষয়ের বই পড়তেন। এক একদিন সমস্ত রাত কেটে যেত বই-এর মধ্যে।

ফিলাডেলফিয়া শহরে দু বছর কেটে গেল। এই সময় ইংল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। লন্ডনে এসে একটি বড় ছাপাখানায় কাজ পেলেন, দীর্ঘ দু বছর তিনি লন্ডন শহরে ছিলেন।

লন্ডনে প্রবাস জীবনে বেঞ্জামিনের জীবনে ঘটেছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যখন তিনি ফিলাডেলফিয়াতে ছিলেন তখন ঘটনাচক্রে একদিন পরিচয় হয় মিস রীডের সাথে। মিস রীড তখন সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণা এক তরুণী। এই পরিচয় প্রেমে রূপান্তরিত হতে দীর্ঘ সময় লাগেনি। কিন্তু তখন একটি মেয়ের ভার গ্রহণ করবার মত আর্থিক সামর্থ্য ছিল না, তাই প্রেম পরিণয়ে পরিণত হতে পারেনি। এই সময় ইংল্যান্ডে যাওয়ার ডাক এল।

বেঞ্জামিনের প্রত্যাবর্তনের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে বিয়ে করলেন মিস রীড।

দু বছর ইংল্যান্ডের থাকার পর ১৭২৬ সালে বেঞ্জামিন ফিরে এলেন ফিলাডেলফিয়া শহরে। একজন ধনী ব্যক্তির সাহায্যে অল্পদিনের মধ্যেই গড়ে তুললেন বিরাট এক ছাপাখানা। কঠোর পরিশ্রম আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সাহায্যে তার ব্যবসা অল্পদিনেই শ্রীবৃদ্ধি ঘটল। আশাতীত অর্থ উপার্জন করতে আরম্ভ করলেন।

সেই সময় পেনসেলভেনিয়া গেজেট” নামে একটি পত্রিকা ফিলাডেলফিয়া শহর থেকে প্রকাশিত হত। তিনি সেই পত্রিকাটি কিনে নিয়ে তাঁর স্বত্বাধিকারী হলেন। এই পত্রিকা প্রকাশনা কাজের সাথে সাথে নিয়মিতভাবে এতে লেখালেখি করতেন।

এ সময় ভাগ্যদেবীর প্রসন্নতায় আবার মিস রীডের সাথে দেখা হল বেঞ্জামিনের। বিবাহের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিধবা হয়েছিলেন মিস রীড। তার বেদনায় নিঃসঙ্গ জীবনকে ভরিয়ে দিতে এগিয়ে এলেন বেঞ্জামিন। ১৭৩০ সালে দুজনের বিবাহ হল। এই বিবাহ দুজনের জীবনেই এনে দিয়েছিল পরিপূর্ণ সুখ আর শান্তি। ১৭৭৩ সালে মৃত্যু পর্যন্ত মিসেস রীড ছিলেন বেঞ্জামিনের সুযোগ্য স্ত্রী।

১৭৩৩ সাল নাগাদ পুওর রিচার্ডস আলমানাক নামে একটি ধারাবাহিক প্রকাশ করলেন। এ রচনা অল্পদিনেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল।

ধনী ও খ্যাতিমান ব্যক্তি হিসাবে বেঞ্জামিন ক্রমশই ফিলডেলফিয়া শহরে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। অর্থ উপার্জনের সাথে সাথে সমাজসংস্কারমূলক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বেঞ্জামিন। ইতিমধ্যে তিনি ফিলাডেলফিয়া শহরে একটি সংস্থা স্থাপন করেছিলেন। নাম “ডুণ্টো”। এর উদ্দেশ্য ছিল সমাজের উন্নতিতে পারস্পরিক সহায়তা।

এ সংস্থায় তিনি যেসব প্রবন্ধ পাঠ করতেন সেই অনুসারে নানান সমাজসংস্কার মূলক কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। সমাজের প্রতি সমস্যার প্রতি তাঁর ছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। “ তিনি দেখেছিলেন দেশে উপযুক্ত গ্রন্থাগারের অভাব। অধিকাংশ মানুষই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অর্থের অভাবে বই কিনতে পারে না। সর্বত্র লাইব্রেরী স্থাপন করাও ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। তাই ১৭৩০ সালে তিনি স্থাপন করলেন ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী। আমেরিকায় এই ধরনের লাইব্রেরী এই প্রথম। এর জনপ্রিয়তা দেখে অল্পদিনেই আরো অনেক ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী গড়ে ওঠে।

১৭৩৭ সালে তিনি আমেরিকাতে প্রথম স্থাপন করলেন বীমা কোম্পানি। এ কোম্পানির কাজ ছিল আগুনে পুড়ে যাওয়া সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ দেওয়া।

১৭৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন ফিলাডেলফিয়া এ্যাকাডেমি। এ এ্যাকাডেমি তার জীবন কালেই পরিণত হয়েছিল ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বেঞ্জামিনের দৃষ্টিভঙ্গি যে কতখানি ব্যাপ্ত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় হাসপাতাল নির্মাণের কাজে। ডাক্তার না হয়েও তিনি অনুভব করেছিলেন হাসপাতাল নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা। তাঁর বন্ধু ডাক্তার বন্ডকে পরামর্শ দিলেন হাসপাতাল তৈরির কাজে হাত দিতে।

বেঞ্জামিনের আন্তরিক সহযোগিতায়, ডাক্তার বন্ডের প্রচেষ্টায় ১৭৫১ সালে আমেরিকায় গড়ে উঠল প্রথম হাসপাতাল।

এসব বহুমুখী কাজের মাধ্যমে বেঞ্জামিন হয়ে উঠেছিলেন আমেরিকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষ।

১৭৪০/৪১ সাল নাগাদ তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণা কাজকর্ম শুরু করেন। আবিষ্কারক হিসাবে তার প্রথম উদ্ভাবন খোলা উনুন (Open stove)। এই উনুন অল্পদিনেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে বিদ্যুৎ শক্তির প্রতি আগ্রহ ছিল সব চেয়ে বেশি। একদিন আকাশে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে আকাশের বিদ্যুৎ চমক দেখে প্রথম অনুভব করলেন আকাশের বিদ্যুৎ আর কিছুই নয়, বিদ্যুৎ এক ধরনের ইলেকট্রিসিটি। ইতিপূর্বে মানুষের ধারণা ছিল আকাশে যে বিদ্যুৎ জমকায় তা দেবরাজ ডিউসের হাতের অস্ত্র। যখন তিনি মানুষকে ধ্বংস করতে চান তখনই তার এই অস্ত্র প্রয়োগ করেন। তাই আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে মানুষ ভীত স্বন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত, পূজা-অর্চনা করত। ফ্রাঙ্কলিন সেই ভ্রান্ত ধারণাকে চিরদিনের জন্যে মুছে দিলেন। তখন লিডেন জার উদ্ভাবিত হয়েছে। এই যন্ত্রের সহায্যে দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবার পর তিনি প্রমাণ করলেন বৈদ্যুতিক শক্তি দু ধরনের। একটিকে বলে নেগেটিভ, অন্যটিকে বলে পজেটিভ। তাঁর আবিষ্কৃত এই নতুন তত্ত্ব বৈদ্যুতিক গবেষণার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী সংযোজন।

আধুনিক কালে আমরা যে টিউব লাইট দেখি তা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈদ্যুতিক শক্তি সংক্রান্ত এইসব আবিষ্কার এই সব আবিষ্কারের গবেষণাপত্র তিনি প্রথম পেশ করেন লন্ডনের রয়াল সোসাইটিতে। তার পর থেকেই তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

ইংল্যান্ডে থাকাকালীন সময়ে সমুদ্রস্রোতে, তার গতি, প্রকৃতি সম্বন্ধে কয়েকটি গবেষণাপত্র রয়াল সোসাইটিতে জমা দেন। এছাড়া তিনিই প্রথম বাইফোকাল লেন্সের ব্যবহার শুরু করেন।

তার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং এই সম্পর্কিত বিভিন্ন রচনা অল্পদিনেই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিজ্ঞানী মহলে সাড়া জাগাল। এই সমস্ত দেশের বিজ্ঞানীরা তাকে বিপুলভাবে সম্মান জানাল। ইংল্যান্ডের রয়াল সোসাইটি তাঁকে তাদের সদস্য হিসাবে নির্বাচিত করল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টর উপাধিতে ভূষিত করল।

ইতিমধ্যে তিনি হয়ে উঠেছিলেন পেনসিলভেনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি। জনগণের তরফ থেকে তাকে সংসদ নির্বাচিত করা হল (১৭৫০)। এই সময় থেকে তিনি ক্রমশই রাজনৈতিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়লেন। তিনি চেয়েছিলেন আমেরিকার সমৃদ্ধি, শ্রীবৃদ্ধি।

তার এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বিচক্ষণতার জন্য তিনি আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যের তরফ থেকে প্রতিনিধি হিসাবে একাধিকবার ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড গিয়েছেন। যেখানেই তিনি গিয়েছেন সেখানেই পেয়েছেন অভূতপূর্ব সম্মান আর সম্বর্ধনা।

এদিকে সমস্ত দেশ জুড়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আমেরিকার অধিবাসীদের মনে ক্ষোভ জমে উঠতে থাকে। আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দিল। ১৭৭৫ সালের ১৯শে এপ্রিল আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভ হল।

পরের মাসেই ফিলাডেলফিয়া শহরে আমেরিকান কংগ্রেসের অধিবেশন বসল। এখানেই জর্জ ওয়াশিংটনকে আমেরিকান বাহিনীর প্রধান হিসাবে নির্বাচিত করা হল। দেশের এই স্বাধীনতা যুদ্ধে অসাধারণ সাংগঠনিক প্রতিভা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বেঞ্জামিন। তাঁকে আমেরিকার প্রতিনিধি হিসাবে পাঠানো হল ফ্রান্সে। তিনি অল্পদিনেই ফ্রান্সের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য অস্ত্র ও সৈন্য সংগ্রহ করলেন।

১৭৮৩ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর তিনি দেশের উন্নয়নের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তাঁকে পেনসিলভেনিয়ার শাসন পরিষদের সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত করা হল।

নতুন আমেরিকা গড়ে উঠবার পর নতুন শাসনতন্ত্র রচনার প্রয়োজন দেখা দিল। ডাক পড়ল বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের। তিনি আরো কয়েকজনের সহযোগিতায় রচনা করলেন আমেরিকা সংবিধান। এই সংবিধানের মধ্যে দিয়ে তিনি আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করলেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল একাশি। এই বয়সেও তিনি ছিলেন তরুণদের মতই উদ্যমী কর্মঠ।

সকল মানুষের প্রতি ছিল তাঁর আন্তরিক ভালবাসা। জীবনের অন্তিম পর্যায়ে এসে নিগ্রো দাসদের দুরবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। তাই দাসপ্রথা বিলোপের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি যে কাজের সূত্রপাত করেন, উত্তরকালে লিঙ্কন তা সমাপ্ত করেন।

১৭৯০ সালে সামান্য রোগভোগের পর তার মৃত্যু হয়।

বিজ্ঞান, দর্শন রাজনীতি, অর্থনীতি-সর্বক্ষেত্রেই অসংখ্য রচনার মধ্যে দিয়ে নিজের অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। সমস্ত জীবন সেই লক্ষ্যপথেই অগ্রসর হয়েছেন– তাই তার সম্বন্ধে এমাসন বলেছেন, তিনি ছিলেন মানবজাতির সবচেয়ে হিতৈষী বন্ধু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *