০৫. পঞ্চম উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

ধারা নগরে, মহাবল নামে, মহাবল পরাক্রান্ত নরপতি ছিলেন। তাঁহার দূতের নাম হরিদাস। ঐ দূতের, মহাদেবী নামে, এক পরম সুন্দরী কন্যা ছিল। কালক্রমে, কন্যা যৌবনসীমায় উপনীত হইলে, হরিদাস মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল, কন্যা বিবাহযোগ্য হইল; অতঃপর, বর অন্বেষণ করিয়া, উহার বিবাহ সংস্কার সম্পন্ন করা উচিত। অনন্তর, পরিবারের মধ্যে, মহাদেবীর বিবাহের কথার আন্দোলন হইতে আরম্ভ হইলে, সে, এক দিন, আপনি পিতার নিকট নিবেদন করিল, পিতঃ! যে ব্যক্তির সহিত আমার বিবাহ দিবেন, তিনি যেন সৰ্বগুণে অলঙ্কত হন। হরিদাস, কন্যার এই প্রশংসনীয় প্রার্থনা শ্রবণে সন্তুষ্ট হইয়া, উপযুক্ত পাত্রের অনুসন্ধান করিতে লাগিল।

এক দিন, রাজা মহাবল হরিদাসকে কহিলেন, হরিদাস। দক্ষিণদেশে হরিশ্চন্দ্ৰ নামে রাজা আছেন। তিনি আমার পরম বন্ধু। বহু দিন অবধি, তাঁহার শারীরিক ও বৈষয়িক কোনও সংবাদ না পাইয়া, বড় উৎকণ্ঠিত হইয়াছি। অতএব, তুমি তথায় গিয়া, আমার কুশলসংবাদ দিয়া, ত্বরায় তাহার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলসংবাদ লইয়া আইস। হরিদাস, রাজকীয় আদেশ অনুসারে, কতিপয় দিবসের মধ্যে, রাজা হরিশ্চন্দ্রের রাজধানীতে উপস্থিত হইয়া, তাহার নিকট নিজ প্রভুর সন্দেশ জানাইল। হরিশ্চন্দ্ৰ, দূতমুখে মিত্রের মঙ্গলবাতাঁ প্রাপ্ত হইয়া, আনন্দসাগরে মগ্ন হইলেন; এবং সমুচিত পুরস্কার প্রদানপূর্বক, হরিদাসকে, কতিপয় দিবস, তথায় অবস্থিতি করিতে অনুরোধ করিলেন।

এক দিবস, রাজা হরিশ্চন্দ্ৰ সভামধ্যে হরিদাসকে জিজ্ঞাসা করিলেন, হরিদাস। তুমি কি বোধ কর, কলিযুগের আরম্ভ হইয়াছে কিনা। তখন সে কৃতাঞ্জলি হইয়া কহিল, হাঁ মহারাজ! কলিকাল উপস্থিত হইয়াছে। তাহার অধিকারপ্রভাবেই, সংসারে মিথ্যাপ্ৰপঞ্চ প্রবল হইয়া উঠিতেছে; সত্যের হ্রাস হইতেছে; পৃথিবী অল্প ফল দিতেছেন; লোক মুখে মিষ্ট বাক্য ব্যবহার করে, কিন্তু অন্তরে সম্পূর্ণ কপটতা; রাজারা, প্রজার সুখসমৃদ্ধির প্রতি দৃষ্টি না রাখিয়া, কেবল কোষ পরিপূরণে যত্নবান হইয়াছেন; ব্ৰাহ্মণের সৎকর্মের অনুষ্ঠানে বিসর্জন দিয়াছেন, এবং যৎপরোনাস্তি লোভী হইয়াছেন; স্ত্রীলোক লজ্জায় এককালে জলাঞ্জলি দিয়াছে, এবং সর্ব বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করিয়াছে; পুত্র পরম গুরু পিতামাতার শুশ্রূষায় ও আজ্ঞা প্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হইয়াছে; ভ্রাতা ভ্রাতার প্রতি সৰ্বতোভাবে স্নেহশূন্য দৃষ্ট হইতেছে; মিত্ৰতা নিবন্ধন অকৃত্রিমপ্রণয়সম্বলিত সরল ব্যবহার আর দৃষ্টিগোচর হয় না; নিত্য, নৈমিত্তিক প্রভৃতি শাস্ত্রোক্ত কর্মে কাহারও আস্থা দেখিতে পাওয়া যায় না; পামরেরা, বুদ্ধি ও বিদ্যার অহঙ্কারে, প্রতিকূল তর্ক দ্বারা, ধৰ্মমূল সনাতন বেদশাস্ত্রের বিপ্লাবনে উদ্যত হইয়াছে। মহারাজ! ইত্যাদি নানা প্রকারে কেবল ধর্মের তিরোভাব ও অধর্মের প্রাদুর্ভাব সর্বত্র নেত্রগোচর হইতেছে। রাজা শুনিয়া, সন্তুষ্ট হইয়া, হরিদাসের সবিশেষ প্ৰশংসা করিলেন।

সভা ভঙ্গান্তে, রাজা অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। হরিদাস, আপন অবস্থিতিস্থানে উপস্থিত হইয়া, এক অপরিচিত ব্ৰাহ্মণতনয়কে উপবিষ্ট দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কে, কি নিমিত্তে আসিয়াছ। সে কহিল, আমি তোমার নিকটে কিছু প্রার্থনা করিতে আসিয়াছি। হরিদাস কহিল, কি প্রার্থনা, বল; আমার সামর্থ্য হয়, সম্পন্ন করিব। সে কহিল, তোমার এক পরম সুন্দরী গুণবতী কন্যা আছে; আমার সহিত তাহার বিবাহ দাও। হরিদাস কহিল, আমি, কন্যার প্রার্থনা অনুসারে, প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছি, যে ব্যক্তি সমস্ত বিদ্যায় পারদর্শী ও অসাধারণগুণসম্পন্ন হইবেক, তাহাকে কন্যাদান করিব। সে কহিল, আমি, বাল্যকাল অবধি, পরম যত্নে, নানা বিদ্যায় নিপুণ হইয়াছি; আর, আমার এক অসাধারণ গুণ এই যে, এক অদ্ভুত রথ নিৰ্মাণ করিয়াছি; তাহাতে আরোহণ করিলে, এক দণ্ডে, বর্ষগম্য দেশে উপস্থিত হওয়া যায়।

হরিদাস শুনিয়া সন্তুষ্ট হইল; এবং, কন্যাদানে সম্মত হইয়া কহিল, কল্য প্ৰাতঃকালে, তুমি রথ লইয়া আমার নিকটে আসিবে। এই বলিয়া, ব্ৰাহ্মণতনয়কে বিদায় দিয়া, হরিদাস স্নান, আহ্নিক, ও ভোজন করিল; এবং, অপরাহ্নে, রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, বিদায় লইয়া, স্বদেশ প্ৰতিগমনের নিমিত্ত প্ৰস্তুত হইয়া রহিল।

পর দিন, প্ৰভাত হইবামাত্র, ব্ৰাহ্মণতনয় হরিদাসের নিকটে উপস্থিত হইলে, উভয়ে, রথে আরোহণ করিয়া, স্বল্প সময় মধ্যে, ধারানগরে উপস্থিত হইল। হরিদাসের প্রত্যাগমনের পূর্বে, তদীয় পত্নী ও পুত্র, পৃথক পৃথক, এক এক ব্ৰাহ্মণতনয়ের নিকট অঙ্গীকার করিয়াছিল, মহাদেবীর সহিত বিবাহ দিব; তাঁহাতে কেবল হরিদাসের গৃহপ্ৰত্যাগমনপ্রতীক্ষা প্রতিবন্ধক ছিল। এক্ষণে, সেই পূর্বাশ্বাসিত বরেরা, হরিদাসকে গৃহাগত শুনিয়া, বিবাহের নিমিত্ত, তদীয় আলয়ে উপস্থিত হইল।

এইরূপে তিন বর একত্র হইলে, হরিদাস, অতিশয়, ব্যাকুল হইয়া, মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিল, তিন জনে তিন জনের নিকট অঙ্গীকার করিয়াছি; তিন জনেই বিদ্যাবান ও অসাধারণগুণসম্পন্ন, কাহাকেই নিরাশ করি। অনন্তর, সে তাহাদিগকে কহিল, অদ্য তোমরা আমার আলয়ে অবস্থিতি করা; আমি, পুত্র ও গৃহিণীর সহিত পরামর্শ করিয়া, কর্তব্য স্থির করিব। তাহারা, সন্মত হইয়া, সে দিন, হরিদাসের আবাসে অবস্থিতি করিল। দৈববিড়ম্বনায়, সেই রজনীতে, বিন্ধ্যাচলবাসী এক রাক্ষস আসিয়া, হরিদাসের কন্যাকে হস্তগত করিয়া, প্ৰস্থান করিল।

গৃহজন প্ৰভাতে গাত্ৰোখান করিয়া দেখিল, মহাদেবী গৃহে নাই। তখন সকলে, একত্র হইয়া, নানাপ্রকার কল্পনা করিতে লাগিল। বিবাহাৰ্থী ব্ৰাহ্মণকুমারেরাও, ভাবিনী ভাৰ্যার আদর্শনবাতাঁ শ্ৰবণগোচর করিয়া, ম্লান বদনে তথায় উপস্থিত হইল। তন্মধ্যে এক ব্যক্তি, সমাধিবলে, ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান, সমুদয় প্রত্যক্ষবৎ দেখিত। সে হরিদাসকে কহিল, মহাশয়! উৎকণ্ঠিত হইবেন না। আমি দেখিতেছি, এক রাক্ষস, আপনকার কন্যার রূপলাবণ্যে মোহিত হইয়া, তাহাকে লইয়া গিয়া, বিন্ধ্য পৰ্বতে রাখিয়াছে; যদি তথা হইতে প্ৰত্যাহরণ করিবার কোনও উপায় থাকে, চেষ্টা দেখুন। দ্বিতীয় কহিল, আমি শব্দবেধী শর দ্বারা, বিপক্ষের প্রাণসংহার করিতে পারি; অতএব, কোনও উপায়ে তথায় উপস্থিত হইতে পারিলে, রাক্ষসেরা প্ৰাণবিনাশ ও কন্যার উদ্ধারসাধন করিতে পারিব। তখন তৃতীয় কহিল, আমার এই রথে আরোহণ করিয়া প্ৰস্থান কর, অবিলম্বে তথায় উপস্থিত হইতে পরিবে।

অনন্তর, সে, ঐ রথে আরোহণপূর্বক, বিন্ধাচলে উপস্থিত হইল; এবং, শব্দবেধী শর দ্বারা ক্ৰব্যাদের প্রাণসংহার করিয়া, মহাদেবী সমভিব্যাহারে, অবিলম্বে ধারানগরে প্রত্যাগমন করিল। অনন্তর, তিন বর, পরস্পর বিবাদ করিয়া, কহিতে লাগিল, আমিই ইহার পাণিগ্রহণে অধিকারী; আমি না হইলে, ইহার উদ্ধার হইবার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। হরিদাস, তদীয় বাদানুবাদ শ্রবণে কর্তব্যাবধারণে বিমূঢ় ও যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হইল।

এইরূপে উপাখ্যানের সমাপন করিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! এই তিনের মধ্যে কোন ব্যক্তি মহাদেবীর পাণিগ্রহণে অধিকারী হইতে পারে। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, যে ব্যক্তি রাক্ষসের প্ৰাণসংহার করিয়া, মহাদেবীর প্রত্যানয়ন করিয়াছে। বেতাল কহিল, তিন জনেই সমান বিদ্বান; এবং, তিন জনই, প্ৰত্যানয়নবিষয়ে, সমান সাহায্য করিয়াছে; তবে কি জন্য, অন্য কাহারও না হইয়া, এই কন্যা প্ৰত্যাহতাঁরই প্ৰণয়িনী হইবেক। রাজা কহিলেন, তিন জনই অসাধারণ গুণপ্রকাশ করিয়াছে, যথার্থ বটে; কিন্তু সূক্ষ্ম বিবেচনা করিলে, প্রত্যাহতাঁর গুণেই, প্রকৃত কার্য নিম্পন্ন হইয়াছে; অতএব, তাহারই প্রাধান্য যুক্তিযুক্ত বোধ হইতেছে।

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *