1 of 2

২৯. আলেকজান্ডার দি গ্রেট (৩৫৬ খ্রিস্ট পূর্ব-৩২৩ খ্রিস্ট পূর্ব)

২৯. আলেকজান্ডার দি গ্রেট (৩৫৬ খ্রিস্ট পূর্ব-৩২৩ খ্রিস্ট পূর্ব)

খ্রিস্ট পূর্ব চারশো বছর আগেকার কথা। গ্রীসদেশ তখন অসংখ্য ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। এমন একটি রাষ্ট্রের অধিপতি ছিলেন ফিলিপ। ফিলিপ ছিলেন বীর, সাহসী, রণকুশলী। সিংহাসন অধিকার করবার অল্প দিনের মধ্যেই গড়ে তুললেন সুদক্ষ এক সৈন্যবাহিনী। ফিলিপের পুত্রই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে বীর আলেকজান্ডার।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬ সালে আলেকজান্ডারের জন্ম। আলেকজান্ডারের মা ছিলেন কিছুটা অস্বাভাবিক প্রকৃতির। সম্রাট ফিলিপকে কোন দিনই প্রসন্নভাবে গ্রহণ করতে পারেননি।

ছেলেবেলা থেকেই আলেকজান্ডারের দেহ ছিল সুগঠিত। বাদামী চুল, হালকা রং। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় ছিল-আলেকজান্ডারের শরীর থেকে সব সময় একটা অপূর্ব সুগন্ধ বার হত। সমকালীন অনেকেই এই সুগন্ধের কথা উল্লেখ করেছেন।

যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকলেও পুত্রের শিক্ষার দিকে ফিলিপের ছিল তীক্ষ্ণ নজর। আলেকজান্ডারের প্রথম শিক্ষক ছিলেন লিওনিদোস নামে অলিম্পিয়াসের এক আত্মীয়। আলেকজান্ডার ছিলেন যেমন অশান্ত তেমনি জেদী আর একরোখা। শিশু আলেকজান্ডারকে পড়াশুনায় মনোযোগী করতে প্রচণ্ড বেগ পেতে হত লিওনিদোসকে। কিন্তু তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন আলেকজান্ডার। লিওনিদোসের কাছে শিখতেন অঙ্ক, ইতিহাসের বিভিন্ন কাহিনী, অশ্বরোহণ, তীরন্দাজী।

কিশোর বয়েস থেকেই তার মধ্যে ফুটে উঠেছিল বীরোচিত সাহস। এই সাহসের সাথে সংমিশ্রণ ঘটেছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধির। একদিন একজন ব্যবসায়ী একটি ঘোড়া বিক্রি করেছিল ফিলিপের কাছে। এমন সুন্দর ঘোড়া সচরাচর দেখা যায় না। ফিলিপের লোকজন ঘোড়াটিকে মাঠে নিয়ে যেতেই হিংস্র হয়ে উঠল। যতবারই লোকেরা তার পিঠের উপরে উঠতে চেষ্টা করে, ততবারই তাদের আঘাত করে দূরে ছিটকে ফেলে দেয়। শেষ আর কেউই ঘোড়ার পিঠে উঠতে সাহস পেল না। কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন ফিলিপ আর আলেকজান্ডার। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন নিজের ছায়া দেখে ভয় পাচ্ছে। ঘোড়াটি। তাই ঘোড়ার পাশে গিয়ে আস্তে আস্তে তার মুখটা সূর্যের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। তারপর ঘোড়াটিকে আদর করতে করতে একলাফে পিঠের উপর উঠে পড়লেন। উপস্থিত সকলেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। যদি ঐ ঘোড়া আলেকজান্ডারকে আহত করে। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে এলেন আলেকজান্ডার। ঘোড়া থেকে নেমে ফিলিপের সামনে আসতেই পুত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ফিলিপ। বললেন, তোমাকে এইভাবে নতুন রাজ্য জয় করতে হবে। তোমার তুলনায় ম্যাসিডন খুবই ছোট।

ফিলিপ অনুভব করতে পারলেন তাঁর ছেলে অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। এখন শুধু প্রয়োজন প্রকৃত শিক্ষার এবং সে ভার আলেকজান্ডারের জন্মের সময়েই সমর্পণ করেছেন মহাজ্ঞানী অ্যারিস্টটলের উপর। অ্যারিস্টটল ফিলিপের আমন্ত্রণে ম্যাসিডনে এলেন।

দীর্ঘ তিন বছর ধরে অ্যারিস্টটলের কাছে শিক্ষালাভ করেছিলেন আলেকজান্ডার। পরবর্তীকালে অনেক ঐতিহাসিকের অভিমত, নিজেকে বিশ্ববিজয়ী হিসাবে গড়ে তোলার শিক্ষা আলেকজান্ডার পেয়েছিলেন অ্যারিস্টটলের কাছে।

আমৃত্যু গুরুকে গভীর সম্মান করতেন আলেকডান্ডার। তাঁর গবেষণার সমস্ত দায়িত্বভার নিজেই গ্রহণ করেছিলেন। নিজের গুরুর প্রতি সম্মান জানাতে গিয়ে আলেকজান্ডার বললেন, এই জীবন পেয়েছি পিতার কাছে। কিন্তু সেই জীবনকে কি করে আরো সুন্দর করে তোলা যায়, সেই শিক্ষা পেয়েছি গুরুর কাছে।

আলেকজান্ডারের বয়স যখন মোল, ফিলিপ বাইজানটাইন অভিযানে বার হলেন। পুত্রের উপর রাজ্যের সমস্ত ভার অর্পণ করলেন। ফিলিপের অনুপস্থিতিতে কিছু অধিনস্থ অঞ্চলের নেতারা বিদ্রোহ ঘোষণা করল। কিশোর আলেকজান্ডার নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে রইলেন না। বীরদর্পে সৈন্যবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শুধু বিদ্রোহীদের পরাজিত করলেন। না, তাদের বন্দী করে নিয়ে এলেন ম্যাসিডনে।

এই যুদ্ধজয়ে অনুপ্রাণিত আলেকজান্ডার সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগিয়ে চললেন। প্রথম যে দেশ জয় করলেন, নিজের নামে সেই দেশের নাম রাখলেন আলেকজান্ডা পোলিস।

পিতা-পুত্রের মধ্যেকার সম্পর্ক ক্রমশই খারাপ হতে থাকে। এর পেছনে মায়ের প্ররোচনাও ছিল যথেষ্ট। আলেকজান্ডারের যখন কুড়ি বছর বয়স, ফিলিপ আততায়ীর হাতে নিহত হলেন। এর পেছনে রানী অলিম্পিয়াসেরও হাত ছিল। ফিলিপ নিহত হতেই সিংহাসন অধিকার করলেন আলেকজান্ডার। প্রথমেই হত্যা করা হল নতুন রানীর কন্যাকে, নতুন রানীকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করলেন রানী অলিম্পিয়াস। যাতে ভবিষ্যতে কেউ তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে।

এই সময় ম্যাসিডনের চতুর্দিকে শক্ররাষ্ট্র। ফিলিপের হত্যার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন অধিনস্থ রাষ্ট্র স্বাধীনতা ঘোষণা করল। ম্যাসিডনের নেতৃস্থানীয় সকলেই আলেকজান্ডারকে পরামর্শ দিল প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্র সম্পর্ক স্থাপন করতে।

কিন্তু এই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করলেন আলেকজান্ডার। সুসংহত সামরিক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুদের উপর। প্রথমে আক্রমণ করলেন থেবেস। তাদের সমস্ত বাধা চূর্ণ বিচূর্ণ করে শহর দখল করলেন, যাতে তার শক্তি সম্বন্ধে সমস্ত গ্রীসের মানুষ সচেতন হয়ে ওঠে। তাই শুধু নগর ধ্বংস করে নিবৃত্ত হলেন না, ছয় হাজার লোককে হত্যা করা হল এবং ত্রিশ হাজার লোককে দাস হিসাবে বিক্রি করা হল।

এবার থেবেস থেকে আলেকজান্ডার এগিয়ে চললেন দক্ষিণের দিকে। প্রথমে কিছু রাষ্ট্র বাধা দিলেও একে একে সমস্ত দেশই তার অধীনতা স্বীকার করে তাঁকে নেতা হিসাবে মেনে নিল।

অবশেষে তিনি এলেন কর্নিথে। এখানে সমস্ত গ্রীক রাষ্ট্র সম্মিলিতভাবে তাঁকে প্রধান হিসাবে নির্বাচিত করল এবং এশিয়া অভিযানের সমস্ত দায়িত্বভার অর্পণ করা হল।

যখন আলেকজান্ডার কর্নিথে ছিলেন, দেশের সমস্ত জ্ঞানীগুণী মানুষেরা নিয়মিত তাকে অভিনন্দন জানাতে আসত। কিন্তু আলেকজান্ডার মহাজ্ঞানী ডায়োজেনিসের সাথে সাক্ষাতের জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছিলেন। তিনি আলেকজান্ডারের কাছে গেলেন না। শেষে আলেকজান্ডার নিজেই গেলেন তাঁর কাছে।

বাড়ির সামনে একটি খোলা জায়গায় শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিলেন বৃদ্ধ দার্শনিক। আলেকজান্ডার তার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আপনি কি আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করেন?

ডায়োজেনিস শান্ত স্বরে বললেন, “আপনি আমার আর সূর্যের মাঝে আড়াল করে দাঁড়াবেন না, এবং বেশি আর কিছু প্রার্থনা করি না।”

সামান্যতম ক্রুদ্ধ হলেন না আলেকজান্ডার। বৃদ্ধ দার্শনিকের নিলোর্ভ স্পষ্ট উত্তর শুনে শ্রদ্ধায় বলে উঠলেন, আমি যদি আলেকজান্ডার না হতাম তাহলে ডায়োজেনিস হতে চাইতাম।

আলেকজান্ডার জানতেন উপযুক্ত প্রস্তুতি ছাড়া কোন যুদ্ধজয় অসম্ভব। শুরু হল তাঁর যুদ্ধের প্রস্তুতি। অল্পদিনের মধ্যেই গড়ে তুললেন সুদক্ষ বিশাল এক সৈন্যবাহিনী। তার মধ্যে ছিল ত্রিশ হাজার পদাতিক, চার হাজার অশ্বারোহী। তাঁর প্রথম লক্ষ্য ছিল পারস্য অভিযান। পারস্য দখলের পর তার লক্ষ্য এশিয়া। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৪ সালে বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন।

প্রথমে আলেকজান্ডার এলেন হেলসম্পটে। এখানে বয়ে চলেছে Granicus নদী। নদীর ওপারে পারস্য সম্রাটের বিশাল সৈন্যবাহিনী।

দুই পক্ষে শুরু হল মরণপণ লড়াই। ক্রমশই দারিয়ুসের বাহিনী বিধ্বস্ত হতে থাকে। তাদের পক্ষে প্রায় ২৫০০০ হাজার সৈনিক মারা পড়ল। প্রাণ বাঁচাতে দারিয়ুস তার পরিবারের সকলকে ফেলে রেখে পালিয়ে গেলেন।

এই বার আলেকজান্ডার এশিয়ামাইনর অভিমুখে অভিযান শুরু করলেন-ক্রমাগত যুদ্ধ জয়ে এক অপরাজের মনোভাব গড়ে উঠল তার মধ্যে। পৃথিবীর কোন কিছুতেই তাঁর ভয় নেই। ধ্বংসের জন্যেই যেন তার আবির্ভাব।

যা অসম্ভব অন্যরা যা দেখে পিছিয়ে যায় তিনি তাকে সম্ভব করে তুলতেন। যেখানে দুরন্ত নদী তার পথে বাধার সৃষ্টি করত, সকলে বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত, সুকৌশলে সেই নদী পার হয়ে যেতেন আলেকজান্ডার। যখন বিশাল পাহাড় তার পথে অবরোধ করে দাঁড়াত তিনি অসীম সাহসে সেই পাহাড় অতিক্রম করে শত্রু সৈন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন।

দ্রুততাই একবার তাঁকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। সেই সময় দারিয়ুস ছিলেন সমগ্র পশ্চিম এশিয়া, মিশর ও পারস্যের অধিপতি। একটি যুদ্ধে পরাজিত হলেও

অন্য জায়গায় গিয়ে তিনি অন্য সৈন্যদল নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।

আলেকজান্ডারও তখন যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। মরুভূমির মত রুক্ষ প্রান্তরের বুকে ঘোড়া ছুটিয়ে এলেন Cydnus নদীর কূলে। এই নদীর পানি ছিল ভীষণ ঠাণ্ডা। সমস্ত দিনের রৌদ্রতাপে আলেকজান্ডারের শরীর এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব না করে তিনি নদীর পানিতে গোসল করলেন এবং পরদিনই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

কয়েক দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠলেন।

এইবার শুরু হল আলেকজান্ডারের বৃহত্তম অভিযান। সেই সময় দাবিয়ুস ছিলেন পৃথিবীর বৃহত্তম সাম্রাজ্যের অধিপতি। তার সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় দশ লক্ষ। অপরদিকে আলেকজান্ডারে সৈন্য সংখ্যা দু লক্ষের বেশি হল না।

আরবেলায় রণক্ষেত্রে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হল। দারিয়ুসের সৈন্যদের মধ্যে ছিল সংহতির অভাব। তাছাড়া দারিয়ুস নিজেও রণকুশলী ছিলেন না। সম্পূর্ণ পরাজিত হলেন দারিয়ুস। এইবারও প্রাণভয়ে স্ত্রী কন্যাদের রেখে পালিয়ে গেলেন।

আলেকজান্ডার পারস্যের রাজধানী পার্সেপোলিশ দখল করলেন। সেই সময় পার্সেপোলিশ ছিল পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ নগর। যুগ যুগ ধরে পারস্য সম্রাটেরা বিভিন্ন দেশ থেকে সম্পদ আহরণ করে এখানে সঞ্চিত করে রেখেছিল। সব সম্পদ অধিকার করলেন আলেকজান্ডার। রাজপ্রাসাদের সকলকে বন্দী করা হল। দারিয়ুসের মা, স্ত্রী, দুই কন্যাকে বন্দী করে আনা হল আলেকজান্ডারের সামনে। তারা সকলেই মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আলেকজান্ডার তাদের সসম্মানে মুক্তি দিয়ে প্রাসাদে ফিরিয়ে দিলেন।

পারস্য অভিযানের পর তিনি সিরিয়া অভিযান শুরু করলেন। সমুদ্র-বেষ্টিত শহর দখল করবার সময় অসাধারণ সামরিক কৌশলের পরিচয় দেন। সৈন্য পারাপার করবার জন্য সমুদ্রের উপর তিনি দীর্ঘ সেতু নির্মাণ করলেন। সিরিয়ার সৈন্যবাহিনী ছিল খুবই শক্তিশালী। এক প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী মরণপণ সংগ্রামের পর জয়ী হলেন আলেকজান্ডার। সিরিয়া দখল করবার পর দখল করলেন প্যালেস্টাইন, তারপর মিশর। মিশরে নিজের নামে স্থাপন করলেন নতুন নগর আলেকজান্দ্রিয়া।

খ্রিস্টপূর্ব ৩২৮ সালের মধ্যে সমগ্র পারস্য সাম্রাজ্য তাঁর অধিকারে এল।

৩২৭ খ্রিস্টপূর্বে আলেকজান্ডার সৈন্যবাহিনী নিয়ে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ভারতবর্ষে প্রবেশ করলেন। সেই সময় ভারতবর্ষে ছিল অসংখ্য ছোট বড় রাষ্ট্র। কারোর সাথেই কারোর সদ্ভাব ছিল না। প্রত্যেকেই পরস্পরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হত।

তক্ষশীলার রাজা অম্ভি প্রতিবেশী রাজা পুরু শক্তি খর্ব করবার জন্য আলেকজান্ডারের বন্ধুত্ব চেয়ে তাঁর কাছে দূত পাঠালেন।

দীর্ঘ এক মাস চলবার পর নিহত হলেন রাজা অষ্টক। গ্রীক সৈন্যরা পুষ্কলাবতী নগর দখল করে নিল।

প্রতিবেশী সমস্ত রাজাই আলেকজান্ডারে বশ্যতা স্বীকার করে নিল। শুধু একজন আলেকজান্ডারের বশ্যতা স্বীকার করতে অস্বীকার করলেন, তিনি রাজা পুরু।

আলেকজান্ডার সরাসরি শত্রুসৈন্যের মুখোমুখি হতে চাইলেন না। তিনি গোপনে অন্য পথ দিয়ে নদী পা হয়ে পুরুকে আক্রমণ করলেন। পুরু ও তার সৈন্যবাহিনী অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করলেও আলেকজান্ডারের রণনিপুণ বাহিনীর কাছে পরাজয় বরণ করতে হল। আহত পুরু বন্দী হলেন। তাঁকে নিয়ে আসা হল আলেকজান্ডারের কাছে। তিনি শৃঙ্খলিত পুরুকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি আমার কাছে কি রকম ব্যবহার আশা করেন? পুরু জবাব দিলেন, একজন রাজা অন্য রাজার সঙ্গে যে ব্যবহার আশা করেন, আমিও সেই ব্যবহার আশা করি।

পুরুর বীরত্ব, তাঁর নির্ভীক উত্তর শুনে এতখানি মুগ্ধ হলেন আলেকজান্ডার, তাঁকে মুক্তিদিয়ে শুধু তাঁর রাজ্যই ফিরিয়ে দিলেন না, বন্ধুত্ব স্থাপন করে আরো কিছু অঞ্চল উপহার দিলেন।

আলেকজান্ডারের ইচ্ছা ছিল আরো পূর্বে মগধ আক্রমণ করবেন। কিন্তু তাঁর সৈন্যবাহিনী আর অগ্রসর হতে চাইল না। দীর্ঘ কয়েক বছর তারা মাতৃভূমি ত্যাগ করে এসেছিল। আত্মীয় বন্ধু পরিজনের বিরহ তাদের মনকে উদাসী করে তুলেছিল। এছাড়া দীর্ঘ পথশ্রমে যুদ্ধের পর যুদ্ধে সকলেই ক্লান্ত। অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বদেশের পথে প্রত্যাবর্তন করলেন আলেকজান্ডার। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আলেকজান্ডার এসে পৌঁছলেন ব্যাবিলনে।

ব্যাবিলনে এসে কয়েক মাস বিশ্রাম নিয়ে স্থির করলেন আরবের কিছু অঞ্চল জয় করে উত্তর আফ্রিকা জয় করবেন। কিন্তু ২রা জুন খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩, গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন আলেকডান্ডার। এগারো দিন পর মারা গেলেন আলেকজান্ডার। তখন দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা নেমেছিল।

আলেকজান্ডার মাত্র ৩৩ বছর বেঁচেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং সেই বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যের অধিশ্বর হতে। তার মনের অতিমানবীয় এই ইচ্ছাকে পূর্ণ করবার জন্য তিনি তাঁর স্বল্পকালীন জীবনের অর্ধেককেই প্রায় অতিবাহিত করেছেন যুদ্ধেক্ষেত্রে। তার বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য ঐতিহাসিকরা তাঁকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতির আসনে বসিয়েছেন। তাঁকে ‘আলেকজান্ডার দি গ্রেট’ এই নামে অভিহিত করা হয়েছে।

নিরপেক্ষ বিচারে কি আলেকজান্ডারকে শ্রেষ্ঠ মহৎ নৃপতি হিসাবে ব্যাখ্যা দেওয়া যায়? এই প্রসঙ্গে একজন প্রখ্যাত জীবনীকার লিখেছেন, অনেকে তাঁকে মানব জীবনের যা কিছু শ্রেষ্ঠ গুণ-মহত্ত্বতা, বীরত্বের এক প্রতিভু বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি নগর স্থাপন করেছেন, অসভ্য জাতিকে সভ্য করেছেন, পথঘাট নির্মাণ করেছেন, দেশে দেশে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আলেকজান্ডার সভ্যতা সংস্কৃতি সম্বন্ধে উৎসাহী ছিলেন না। নিজের খ্যাতি গৌরব প্রভুত্ব ছাড়া কোন বিষয়েই তাঁর কোন আগ্রহ ছিল না। এক পৈশাচিক উন্মাদনায় তিনি শুধু চেয়েছিলেন পথিবীকে পদানত করতে। তিনি যা কিছু করেছিলেন, সব কিছুই শুধুমাত্র নিজের গৌরবের জন্য, মানব কল্যাণের জন্য নয়। তিনি যে ক’টি নগর স্থাপন করেছিলেন, তার চেয়ে বেশি নগর গ্রাম জনপদকে ধ্বংস করেছিলেন। হাজার হাজার মানুষকে শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছা চরিতার্থতার জন্য হত্যা করেছিলেন।

সুপ্রাচীন মহান গ্রীক সভ্যতার একটি মাত্র বাণীকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন দেশে দেশে। সে বাণী ধ্বংসের আর মৃত্যুর। শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রচারের ব্যাপারে তার সামান্যতম আগ্রহ ছিল না।

তার তৈরি করা পথে পরবর্তীকালে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল বলে অনেকে তাঁর দূরদর্শিতার প্রশংসা করেন। কিন্তু এই পথ তিনি তৈরি করেছিলেন সৃভ্যতাকে ধ্বংসের কাজ তরান্বিত করতে।

প্রকৃতপক্ষে তাঁর নাম চিরদিন ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে সভ্যতার অগ্রদূত হিসাবে নয়-ধ্বংস, ঝঞ্ঝা, হত্যা, মৃত্যুর পথপ্রদর্শক হিসাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *