1 of 2

২৭. ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২)

২৭. ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২)

আজন্ম দারিদ্র পীড়িত কবি হুইটম্যানের জন্ম ১৮১৯ সালের ৩১ মে লং আইল্যণ্ডের ওয়েস্ট হিলে। বাবা ছিলেন ছুতোর। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। লিভস অব গ্রাসের কবি ওয়াল্ট হুটম্যান ছিলেন আমেরিকার নব যুগের নতুন চিন্তার প্রবক্তা। ঊনবিংশ শতকের আমেরিকান সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ। শুধু আমেরিকার নন, আধুনিক বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি।

বাবা ওয়ালটার হুইটম্যান ছিলেন ইংরেজ। সামান্য লেখাপড়া জানতেন। অবসর পেলেই চার্চে গিয়ে ধর্ম-উপদেশ শুনতেন।

যখন ওয়াল্টের চার বছর বয়স, তখন তাঁর বাবা এলেন ব্রুকলীনে। ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে দেওয়া হল ওয়েস্ট হিলে মামার বাড়িতে। কয়েক মাস পর স্কুলে ভর্তি হলেন হুইটম্যান, শহরের চার-দেওয়াল ঘেরা স্কুল।

স্কুলের বাঁধা পড়া ভাল না লাগলেও বই ভাল লাগত। যখন যে বই পেতেন তাই পড়ে ফেলতেন। অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি ছিল তার, যা কিছু একবার পড়তেন তা আর কখনো বিস্মৃত হত না।

পাঁচ বছর পর স্কুলের পাঠ শেষ হল। ছাত্র জীবনেরও পরিসমাপ্তি ঘটল। তখন তাঁর বয়স এগারো। সংসারের আর্থিক অবস্থা ক্রমশই খারাপ হয়ে আসছিল। একটা অফিসে বয়ের কাজ নিতে হল। দুটি বছর সেখানেই কেটে গেল।

তেরো বছর বয়েসে দি লং আইল্যাণ্ড (The long Island) নামে একটি পত্রিকার ছাপাখানায় চাকরি পেলেন। গভীর মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্য করতেন ছাপাখানার প্রতিটি কাজ, পড়তেন পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যা।

কয়েক বছরের মধ্যেই পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ পেলেন। পত্রিকার আর্থিক অবস্থা তখন খারাপ হয়ে আসছিল। তিনি হয়ে উঠেছিলেন একাধারে পত্রিকার প্রকাশক, সম্পাদক, মুদ্রাকর, মেশিনম্যান। তবুও পত্রিকাটিকে চালাতে পারলেন না।… এক বছর পর সব কিছু বিক্রি করে দিলেন। আবার শুরু হল ছন্নছাড়া জীবন।

যখন যেখানে কাজ পেতেন সেখানেই চাকরি করতেন। বেশির ভাগই ছিল পত্র পত্রিকার কাজ। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত লিখে চলতেন গদ্য পদ্য, এর মধ্যে কিছু ছাপাও হয়েছিল।

সাতাশ বছর বয়সে ব্রুকলিনের সবচেয়ে নামী পত্রিকা দৈনিক ঈগল-এ সম্পাদকের চাকরি পেলেন।

হুইটম্যান বিশ্বাস করতেন সমস্ত মানুষই একই সত্তার বিভিন্ন প্রকাশ। সাদা, কালো, পীত সকল মানুষই পরস্পরের ভাই,–তাঁর এই মনের ভাবনাই প্রকাশ পেয়েছিলেন ঈগল পত্রিকায়। অনেকেই তাঁর সাথে একমত হতে পারল না। বাধ্য হয়ে চাকরি ছাড়তে হল। শোনা যায় কোন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। লোকটি দাসপ্রথার সমর্থনে মন্তব্য করেছিল। হুইটম্যান এক লাথিতে তাকে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন। অনিবার্যভাবেই চাকরি হারাতে হল তাঁকে।

নতুন চাকরি পেলেন নিউ অরলিয়েন্সে। জীবনের এই পর্যায়ের অনেক ছবিই অনাবৃত রয়ে গিয়েছে।

নিউ অরলিয়েন্সের রোমাঞ্চকর অধ্যায় একদিকে যেমন এনেছিল আনন্দ, অন্যদিকে বেদনা। তাঁর এই আলোছায়াময় জীবনের কথা অপূর্ব ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন দু-একটি কবিতায়:

Out of the rolling ocean crowd,
Came a drop gently to me,
Whispering I love you, before long I die,
I have travelled a long way merely to look on you, to touch you.
For I could not die till I once looked on you,
Again we wander–we love-we seperate again
Again she holds me by the hand
I must not go
I see her close beside me, with silent lips sad and tremulous.
Return in peace to the occan, my love.
I too am part of the occan, my love.

ত্রিশ বছরে পা দিলেন হুইটম্যান। ক্রমশই তাঁর অন্তরলোকে অনুভব করছিলেন এক পরিবর্তন। নিজেকে প্রকাশ করবার এক তীব্র কামনা খাঁচায় বন্ধ পাখির মত পাখা ঝাঁপটাচ্ছিল। অনুভব করতেন মহৎ এক সৃষ্টির প্রেরণা। নিউ অরলিয়েন্স থেকে ফিরে এলেন ব্রুকলিনে মা-বাবার কাছে। সংসারে অভাব, বাবার সাথে ছুতোর মিস্ত্রির কাজ শুরু করলেন।

দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে চলল তার সাধনা। শিল্পীর হাতে যেমন একটু একটু করে জন্ম নেয় তার মানস প্রতিমা, হুইটম্যান তেমনি রচনা করে চলেন একের পর এক কবিতা।

১৮৫৫ সাল, হুইটম্যান শেষ করলেন তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন; নাম দিলেন লিভস অব গ্রাস (Leaves of grass)। হাতে সামান্য কিছু অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন। সেই

অর্থে এক বন্ধুর ছাপাখানায় ছাপা হল Leaves of grass। এই প্রথম বইতে নিজের নাম লিখলেন ওয়ান্ট হুইটম্যান। প্রথমে ছাপা হল ১০০০ কপি। কবিতা পড়ে কোন প্রকাশকই বই প্রকাশ করবার দায়িত্ব দিল না।

হুইটম্যান তাঁর কবিতার বই আমেরিকার প্রায় সব খ্যাতনামা লোকেদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কেউ মতামত দেওয়া তো দূরের কথা, বই প্রাপ্তির সংবাদটুকু অবধি জানালেন না।

শুধু মাত্র এমার্সন মুগ্ধ হলেন। তাঁর মনে হল আমেরিকার সাহিত্য জগতে এক নতুন ধ্রুবতারার আবির্ভাব হল।

কয়েক মাস পর যখন দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করলেন, বইয়ের সাথে এই চিঠি ছেপে দিলেন। এমার্সনের এই প্রশংসা বহু জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। কিন্তু বইয়ের বিক্রি তেমন বাড়ল না।

এত অপবাদ বিরুদ্ধ সমালোচনা সত্ত্বেও Leaves of grass কালজয়ী গ্রন্থ। এতে ফুটে উঠেছে তার মানব প্রেম।

তাঁর এই মনোভাবের মধ্যে ফুটে উঠেছে আমেরিকান গণতন্ত্রের প্রতিচ্ছায়া। যদিও এই গণতন্ত্র কোন রাজনৈতিক বা সামাজিকতা গণতন্ত্র নয়। এক ধর্মীয় বিশ্বাস-মানুষ এক বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে যার পরিণতিতে এক পূর্ণতা-এই পূর্ণতা কি কবি নিজেও তা জানেন না-তিনি বিশ্বাস করতেন এই পূর্ণতা ব্যর্থ হবার নয়।

“It cannot fail the young man who died and was buried,
Nor the young woman who died and was put by his side,
Nor the little child that pecped in at the door and then drew back and was never seen again. Nor the old man who has lived without purpose and feels it with bitterness worse than gall.”

অন্য একটি কবিতায় জীবনের জয়গান গেয়েছেন–

“Do you weep at the brecity of your life and the intersity of your suf fering?
Weep not child, weep not my darling,
Some thing there is more immortal even then the stars.”

১৮৫৭ সালে Lears of Grass প্রথম প্রকাশিত হয়। তারপর থেকে কবি তাঁর সমস্ত জীবন ধরে এক সংস্কার করেছেন, পরিমার্জনা করেছেন। নতুন কবিতা সংযোজন করেছেন। তার খ্যাতি (সেই সাথে অখ্যাতিও) ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে কিন্তু আর্থিক সাফল্য কোন দিনই পাননি।

১৮৫৭ সালে তিনি “ব্রুকলিন ডেইলি টাইমস” পত্রিকার সম্পাদক হলেন।

কয়েক বছর পত্রিকার চাকরি করলেন, ইতিমধ্যে আমেরিকার ভাগ্যাকাশে নেমে এল এক বিপর্যয়। দাসপ্রথা বিরোধের প্রশ্নে উত্তর আর দক্ষিণের মধ্যে প্রথমে দেখা দিল বিরোধ তারপর শুরু হল গৃহযুদ্ধ।

তাই যুদ্ধ শুরু হবার পর তিনি যুদ্ধে যোগ না দিলেও আহত মানুষদের সেবার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করলেন।

কিন্তু লিভস অব গ্লাসের লেখকের বোধহয় সেবা করবারও অধিকার ছিল না। একদিন হাসপাতালের সেক্রেটারি তার টেবিলের উপর দেখতে পেলেন এক খণ্ড ‘লিভস অব গ্রাস’। জানতে পারলেন লেখকের পরিচয়। এমন একটা অশ্লীল বইয়ের লেখক তার হাসপাতালে কাজ করবে-এ কিছুতেই মেনে নিতে পারল না সেক্রেটারি। পরদিন হুইটম্যান জানতে পারলেন তাঁকে কাজ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

প্রাচ্যের এক মনীষী একবার বলেছিলেন, ঈশ্বর শহরের মানুষের মধ্যে দিয়ে হেঁটে, যান। কিন্তু মানুষ এত অন্ধ যে তাকে দেখতে পায় না।

যথার্থই হুইটম্যানের মহত্ত্বতাকে উপলব্ধি করবার মত তখন কেউ ছিল না। শিক্ষিত ধনী ব্যক্তিরা তাকে উপেক্ষা করেছিল, কারণ তিনি তাদের ভণ্ডামি নোংরামিকে তীব্র ভাষায় কষাঘাত করেছিলেন আর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ক্ষমতা ছিল না তার কবিতার মর্মকে উপলব্ধি করবার।

১৮৬৫ সালে যখন লিঙ্কনকে হত্যা করা হল, বেদনায় ভেঙে পড়েছিলেন কবি। লিঙ্কন তাঁর কাছে ছিলেন স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক। এই মর্মান্তিক বেদনায় তিনি চারটি মর্মস্পর্শী কবিতা রচনা করেন। এমন শোকাবহ কবিতা বিশ্বসাহিত্যে বিরল। এর মধ্যে একটি কবিতা “O Captain my Captain.” যাত্রার শেষ লগ্ন সমাহত, তীরভূমি অদূরে, কিন্তু কাণ্ডারীর দেহ প্রাণহীন। হোয়েন লাইল্যাকস লাস্ট কবিতাটির ফুটে উঠেছে মৃত্যুর বর্ণনা।

All over bouquets of roses
O death! I cover you over with roses and early lilies:

১৮৭৩ সালে কবি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এই সময়ে তিনি থাকতেন ওয়াশিংটনে তার ছোট ভাই জর্জের বাড়িতে।

১৮৯২ সালে বাহাত্তর বছর বয়সে মানুষের প্রিয় কবি হারিয়ে গেলেন তার প্রিয় সূর্যের দেশে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *