1 of 2

১৩. ইমাম গাজ্জালী (রঃ) (১০৫৮–১১১১ খ্রি:)

১৩. ইমাম গাজ্জালী (রঃ) (১০৫৮–১১১১ খ্রি:)

আল্লাহ রাব্দুল আ’লামীন পথহারা মানুষদের সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার জন্যে এবং পৃথিবীর বুক থেকে সকল অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অন্যায়, অসত্য, শোষণ, জুলুম, অবিচার, ব্যভিচার, শিরক, কুফর, কুসংস্কার এবং মানব রচিত মতবাদ ও মতাদর্শের মূলোৎপাটন করে আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা তথা খিলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে লক্ষাধিক নবী রাসূল। তাঁর পরে পৃথিবীতে আর কোন নবী বা রাসূলের আবির্ভাব ঘটবে না। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে আল্লাহ পাক নবুয়্যতের দরজাকে বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে এ কথা অসত্য নয় যে, প্রত্যেক যুগেই পথহারা মানুষদের সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার জন্যে ঐশী জ্ঞানে সমৃদ্ধ এক বা একাধিক মনীষীর আবির্ভাব ঘটবে এ ধরাতে। তারা নবী কিংবা রাসূল হিসেবে আবির্ভূত হবেন না; কিংবা নতুন কোন মত বা মতাদর্শও প্রচার করবেন না। বরং তারা বিশ্বনবী (সাঃ) এর নির্দেশিত পথে এবং তাঁরই আদর্শের দিকে আহবান করবেন মানব জাতিকে। তাদের চরিত্র ও স্বভাব হবে মার্জিত, আকর্ষণীয় ও অনুপম। তাঁরা দুনিয়াকে ভোগ বিলাসের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে মনে করবেন না। তাদের চরিত্র, স্বভাব ও সাধারণ জীবন যাত্রা দেখে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ ফিরে আসবে সত্য ন্যায়ের পথে। ইমাম গাজ্জালী (রঃ) ছিলেন তাঁদেরই একজন।

একাদশ শতাব্দীতে মানুষ অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুফর, শিরক, বিদআত, কুসংস্কার ও নানাবিদ পাপ কাজে লিপ্ত হতে শুরু করেছিল, অপরদিকে শিক্ষিত যুব সমাজ এরিস্টটল, প্লেটো এবং পাশ্চাত্যের অন্যান্য অমুসলিম দার্শনিকদের ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে ইসলামের সত্য পথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল, তখন পৃথিবীতে সত্যের আলোক বর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হন মুজাদ্দিদ ইমাম গাজ্জালী (রঃ)। তিনি ১০৫৮ খ্রিস্টাব্দে ইরানের খোরাসান প্রদেশের অন্তর্গত তুস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল এ ইরানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন শেখ সাদী (রঃ) মহাকবি ফেরদৌসী (রঃ), আল্লামা হাফিজ (রঃ), আল্লামা রুমী (রঃ), এর মত বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম মনীষীগণ।

ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর প্রকৃত না আবু হামেদ মোহাম্মদ গাজ্জালী। কিন্তু তিনি ইমাম গাজ্জাল নামেই খ্যাত। গুজ্জাল শব্দের অর্থ হচ্ছে সূতা কাটা। এটা তার বংশগত উপাধি। কারো মতে তাঁর পিতা মোহাম্মদ কিংবা পূর্ব পুরুষগণ সম্ভবত সূতার ব্যবসা করতেন। তাই উপাধি হয়েছে গাজ্জালী।

তাঁর পিতা ছিলেন দরিদ্র এবং শৈশবেই তিনি তাঁর পিতাকে হারান। পিতার মৃত্যুতে তিনি নিদারুণ অসহায় অবস্থায় পড়েন কিন্তু সাহস হারাননি। জ্ঞান লাভের প্রতি ছিল তার খুব আগ্রহ। তৎকালীন যুগের বিখ্যাত আলেম হযরত আহমদ ইবনে মুহাম্মদ বারকানী এবং হযরত আবু নসর ইসমাইলের নিকট তিনি কোরআন, হাদিস, ফিকাহ ও বিবিধ বিষয়ে অস্বাভাবিক জ্ঞান লাভ করেন। কিন্তু এতে তিনি তৃপ্তি বোধ করলেন না। জ্ঞান অন্বেষণের জন্যে পাগলের ন্যায় ছুটে যান নিশাপুরের নিযামিয়া মাদ্রাসায়। তৎকালীন যুগে নিশাপুর ছিল ইসলামী জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যে সমৃদ্ধ ও উন্নত। এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সর্ব প্রথম ও পৃথিবীর বৃহৎ নিযামিয়া মাদ্রাসা। সেখানে তিনি উক্ত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আবদুল মালিক (রঃ) নিকট ইসলামী দর্শন, আইন ও বিবিধ বিষয়ে জান অর্জন করেন।

আবদুল মালিক (রঃ) এর মৃত্যুর পর তিনি চলে আসেন বাগদাদে। এখানে এসে তিনি একটি মাদ্রাসায় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং বিভিন্ন জটিল বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। জ্ঞান বিজ্ঞান ও দর্শনে তাঁর সুখ্যাতি আস্তে আস্তে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। অপরদিকে তিনি আল্লাহকে পাবার জন্যে এবং আল্লাহর সৃষ্টির রহস্যের সন্ধানে ধন– সম্পদ ও ঘর-বাড়ির মায়া মমতা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন অজানা এক পথে৷ প্রায় দশটি বছর দরবেশের বেশে ঘুরে বেড়ান দেশ থেকে দেশান্ত। আল্লাহর ইবাদত, ধ্যান মগ্ন, শিক্ষাদান ও জ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেন দিন রাত। জেরুজালেম হয়ে চলে যান মদীনায়। বিশ্বনবীর রওজা মোবারক জিয়ারত শেষে চলে আসেন মক্কায়। হজ্জব্রত পালন করেন। এরপর চরে যান আলেকজান্দ্রিয়ায়। সেখানে কিছু দিন অবস্থান করে আবার ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে।

ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর আধ্যাত্মিক জ্ঞান ছিল অত্যন্ত গভীর। আল্লাহর স্বরূপ ও সৃষ্টির রহস্য তিনি অত্যন্ত নিবিড় ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর মতে আত্মা ও সৃষ্টির রহস্য এবং আল্লাহর অস্তিত্ব বৈজ্ঞানিক যুক্তি তর্কে মীমাংসা করার বিষয় নয়; বরং এরূপ চেষ্টা করাও অন্যায়। আল্লাহর অস্তিত্ব ও সৃষ্টির রহস্য অনুভূতির বিষয়। পরম সত্য ও অনন্তকে যুক্তি দিয়ে বুঝার কোন অবকাশ নেই। তাঁর মতে যুক্তি দিয়ে আপেক্ষিকতা বুঝা যায় মাত্র। তিনি সকল প্রশ্নে মীমাংসা করেছেন কোরআন, হাদিস ও তারই ভিত্তিতে নিজের বিবেক বুদ্ধির সাহায্যে। আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ধর্মের প্রতি তাঁর আস্থা ছিল পর্বতের ন্যায় অটল ও সুদৃঢ়। ধর্ম ও দর্শনে তাঁর ছিল প্রভূত জ্ঞান। ধর্ম ও যুক্তির নিজ নিজ বলয় তিনি নির্ধারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, “আত্মা কখনো ধ্বংস হয় না কিন্তু দেহ ধ্বংস হয়। আত্মা মৃত্যুর পর জীবিত থাকে। হৃদপিণ্ডের সাথে আত্মার কোন সম্পর্ক নেই হৃদপিণ্ড একটি মাংসপিণ্ড মাত্র, মৃত্যুর পরও দেহে এর অস্তিত্ব থাকে। কিন্তু আত্মা মৃত দেহে অবশিষ্ট থাকে না। মৃত্যুর পর আত্মার পরিপূর্ণ উৎকর্ষ ও মুক্তি সম্ভবপর হয়ে থাকে।” তিনি ইসলামী জান, বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যে ইসলামের পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছেন। তিনি ছিলেন ধর্ম, আদর্শ ও সুফিবাদের মূর্তিমান প্রতীক। তিনি অন্ধ বিশ্বাসের উপর যুক্তিকে প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু যা চিরন্তন সত্য ও বাস্তব সেখানে তিনি যুক্তিকে প্রাধান্য দিতেন না বরং সেক্ষেত্রে ভক্তি ও অনুভূতিকেই প্রাধান্য দিতেন।

অংকশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে ছিল তাঁর বিশেষ আগ্রহ। এ সম্পর্কে তাঁর বিশেষ বিষয় ছিল ম্যাজিক স্কোয়ার। সাবিত ইবনে কোরা ও ইমাম গাজ্জালী (রঃ) ব্যতীত ম্যাজিক স্কোয়ার মুসলিম বৈজ্ঞানিকদের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পারেনি। তিনি নক্ষত্রাদির গতি ও প্রকৃতি সম্বন্ধে ২টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সম্ভবত তাঁর এ গ্রন্থ দু’টি আক প্রায় বিলুপ্তি। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে তিনি প্রায় চার সহস্রাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থই ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ শতাব্দিতে ইউরোপ অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করে। তাঁর প্রণীত গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে–(১) ইহিল –উল–উলুমুদ দীন, (২) কিমিয়াতে সা’দাত–এ গ্রন্থটি ক্লড ফিল্ড The Alchemy of happiness নাম দিয়ে ইংরেজি ভাষার অনুবাদ করেন। এ গ্রন্থটি ‘সৌভাগ্যের পরশ মণি’ নামে বাংলা ভাষায়ও অনূদিত ও বহুল প্রচারিত হয়ে আছে, (৩) কিতাবুল মনফিলিন আদ দালাল–এ গ্রন্থটি The liberation Fromerror নাম দিয়ে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, (৪) কিতাবুত তাকাফাতুল কালাসিফা এ গ্রন্থটি ক্লড ফিল্ড The Internal Contradiction of philos ophy নাম দিয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করছেন, (৫) মিশকাতুল আনোয়ার, (৬) ইয়াকুত্তাবলিগ, (৭) মনখুল প্রভৃতি গ্রন্থ সমগ্র ইউরোপে সমাদ্রিত হয় এবং আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ মহামনীষী ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ইসলামের এক নব জাগরণ ঘটিয়েছিলেন।

তিনি ১১১১ খ্রিস্টাব্দে সুস্থ অবস্থায় এ নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান; যাকে পাবার জন্যে, যার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে, যার স্বরূপ উপলব্ধি করার জন্যে সারাটা জীবন ঘরবাড়ি ছেড়ে ঘুরে ফিরেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। মৃত্যুর দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে তিনি ফজরের নামাজ আদায় করেন। তারপর নিজ হাতে তৈরি করা কাফনের কাপড়খানা বের করে বলেন, “হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমি তো রহমান এবং রাহিম। হে আল্লাহ, একমাত্র তোমাকে পাবার জন্যে এবং তোমার স্বরূপ বুঝার জন্যেই আমি সকল আরাম আয়েশ ত্যাগ করে ঘুরে ফিরেছি বছরের পর বছর এবং এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তরে। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।” এরপর তিনি কাফনের কাপড় পরিধান করেন এবং পা’দুখানা সোজা করে শুয়ে পড়েন এবং শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১১১১ খ্রিস্টাব্দে। বিশ্ব বিখ্যাত এ মনীষী চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন মুসলিম জাহানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *