লকার নম্বর তেত্রিশ

লকার নম্বর তেত্রিশ

এক

গণ্ডগোলটা যখন বীথিকা টের পেল তখন ঘড়িতে ঠিক সাড়ে এগারোটা৷ আর টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নামতে শুরু করল৷

এমনিতেই মাসের প্রথম বলে ব্যাঙ্কে সাতসকালেই মারাত্মক ভিড়, তার ওপর আজ রাজ্য সরকারের পেনশন ঢুকেছে, আর ষ্টেট, সেন্ট্রাল, রেল মিলিয়ে এই ব্র্যাঞ্চে প্রায় সাড়ে সাতশো পেনশন অ্যাকাউন্ট, ফলে সকাল থেকে উত্তরপাড়া স্টেশনের গায়ে এই ব্যাঙ্কে প্রায় পা রাখার জায়গা নেই৷

সকাল প্রায় সাতটা-সাড়ে সাতটা থেকে বয়স্ক মানুষজন ভিড় করতে শুরু করেছেন বাইরের প্রেমিসে, ব্যাংকের লোক এসে দরজা খোলার সাথে সাথে কে এসে চেক জমা দিয়ে আগে টোকেন নেবে, তাই নিয়ে এদের অদ্ভুত এক প্রতিযোগিতা৷ প্রতি মাসেই এই এক ছবি৷ দশটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে টোকেন নিয়েই দাঁড়িয়ে পড়বে সবাই, তারপর চলবে ঘন্টা দেড়-দুই করে গল্প৷

প্রথম প্রথম বীথিকা খুব অবাক হয়ে যেতো৷ এরা সবাই কেন এত সকালেই এসে ভিড় করে? নিজেদেরও দেরি, ব্যাঙ্কেও ভিড়৷ একজন অতিবৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গে বেশ ভাল আলাপ হয়েছিল তখন, তাকেই এই প্রশ্নটা করেছিল ও, ‘‘আচ্ছা, আপনি আজকেই আসেন কেন? তার ওপর এত সকালে? ভিড় ভাট্টা, এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা! তার চেয়ে খেয়েদেয়ে দুপুরে আসতে পারেন, তখন তো একদমই ফাঁকা হয়ে যায়! কিংবা কাল পরশুও আসতে পারেন৷’’

ভদ্রলোক ভারী সজ্জন প্রকৃতির, ফর্সা লম্বা শান্ত সৌম্য চেহারা, এককালে যে সুপুরুষ ছিলেন বোঝা যায়৷ উত্তর না দিয়ে অশক্ত কাঁপা কাঁপা হাতে লাঠিটা চেপে ধরে উনি ওর দিকে চেয়ে শুধু মিটিমিটি হেসেছিলেন৷

বীথিকা হাল ছাড়েনি, এমনিতেই হেড অফিস থেকে ঘন ঘন সার্কুলার আসছে কাস্টমারদের এ টি এম, নেট ব্যাঙ্কিং এর দিকে উৎসাহিত করার জন্য, ও বোঝানোর ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘‘তাছাড়া, আপনি তো এ টি এম থেকেও তুলতে পারেন, এতদূর আসতেও হবে না, আবার এতগুলো টাকা নিয়ে ফিরতেও হবে না৷ যখন দরকার তখন অল্প অল্প করে তুলবেন৷ শিখিয়ে দেব আপনাকে?’’

ভদ্রলোক তখন স্মিতমুখে মাথা নেড়েছিলেন, ‘‘মা, বাইশ বছর হল রিটায়ার করেছি৷ এই বাইশটা বছরের প্রতিটা মাসের এই একটা দিন এই সময়ে আসি, গল্পগুজব করি৷ প্রথমে দলের মধ্যে আমি ছিলাম জুনিয়র, সদ্য রিটায়ার করেছিলাম৷ তারপর সেই গ্রুপের সিনিয়ররা আস্তে আস্তে চলে যেতে লাগল৷ প্রতিমাসেই এসে দেখতাম সেই দাদাদের একজন দু’জন নেই৷ তাদের বাড়িও চিনতাম না, বাড়িতে কে কে ছিলেন তাও জানতাম না, বড়জোর নামটুকু হয়ত জানা ছিল৷ তবু মাসের ওই একটা দিনের কয়েক ঘণ্টা যেন আমরা একটা বড় পরিবারের সদস্য হয়ে উঠতাম সবাই৷’’ ভদ্রলোক একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘‘এখন সেই দলে আমি সিনিয়র হয়েছি৷ প্রতি মাসে আসার আগে বুকটা কেমন করে, গিয়ে সবাইকে দেখতে পাব তো? কিংবা পরের মাসে আবার আসতে পারব তো? চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, হাত পা কাঁপে ! বাড়ির লোক বারণ করে, বলে কেন তুমি যাচ্ছ? পড়ে টরে যাবে৷ নাতি বলে আমি গিয়ে নিয়ে আসছি দাদু! তবু কারুর কথা শুনিনা, লাঠি নিয়ে টুকটুক করতে করতে আসি, ব্যাঙ্কের সামনে এসে চেনা মানুষগুলোকে না দেখতে পেলেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে!’’ ভদ্রলোকের বলিরেখায় ভরা গালে চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে কখন, ‘‘তারপর সবাইকে দেখে মনের মধ্যে যে শান্তিটা হয়, আপনাদের এ টি এম কি এই আনন্দটা আমায় দিতে পারবে মা?’’

বীথিকা হতভম্ব হয়ে চুপ করে গিয়েছিল, আর কিচ্ছু বলতে পারেনি৷

ভদ্রলোক যেতে উদ্যত হয়েও ফিরে তাকিয়েছিলেন, ‘‘তার ওপর আপনাদের সঙ্গে দেখা হয় এলে, সেটাও তো ভাল লাগে৷ পরের মাসে হয়ত আর নাও আসতে পারি! কখন ডাক আসে তো বলা যায় না!’’

বীথিকা এমনিতেই নরম মনের মেয়ে, মানসিক চাপ নিতে পারেনা বেশি, তার ওপর এইরকম কথা শুনে ওর বুকের ভেতরটাও কেমন করে উঠেছিল, নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে ও কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে চেয়ে কাজে মন দিয়েছিল৷

তারপর থেকে বীথিকা এদের কাউকে কখনো আর কিছু বলেনি৷

প্রচুর ভিড়ের মধ্যে নিজের কেবিনে বসে ও প্রায় উল্কার গতিতে চেক পাস করছিল আজ৷ প্রোবেশনারি অফিসার হিসেবে জয়েন করে এখনো এক বছরও হয়নি, এর মধ্যেই ও অপারেশনস ডিপার্টমেন্টের বেশ কাজকর্ম শিখে ফেলেছে৷ উত্তরপাড়া স্টেশনের ওইদিকে, মানে গঙ্গার দিকে অনেক ব্যাঙ্ক থাকলেও, এই মাখলার দিকে খুব একটা রাস্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলোর ব্র্যাঞ্চ খোলেনি এখনো, ফলে এই ব্যাঙ্কটার ওপর বেশ চাপ পড়ে যায়৷ আশপাশের প্রায় দশ বারো কিলোমিটারের কাস্টমার তো আছেই, এছাড়া একটু দূরেই দিল্লী রোড, সেখানে কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে, সেখানকার লেবারদের জব কার্ড, একশো দিনের কাজ এ’সব ঝক্কিও আছে প্রচুর৷

আর এখন মোদি সরকার আসার পরে তো আজ আধার, কাল ডিমানিটাইজেশন, ব্যাঙ্কে ঝামেলা লেগেই আছে৷

তবে বীথিকা কুইক সার্ভিস দেয়৷ হাতের স্পীড একটুও না কমিয়ে কিভাবে সই, ছবি সব ভেরিফাই করে চেক পাস করতে হয়, সেই কৌশল ওর এখন করায়ত্ব, ফলে আজও হু হু করে পেমেন্ট হচ্ছিল৷

এমন সময় সেই ঘটনাটা ঘটল৷

সাবস্টাফ ধীরাজ ব্যস্ত পায়ে ওর কেবিনে ঢুকলো, ‘‘ম্যাডাম, ম্যানেজার স্যার আপনাকে ডাকছেন৷’’

বীথিকা ভ্রূ কুঁচকোল৷ এই সময়ে খুব দরকার না হলে কেউ ওকে ডাকবে না৷ এখন পেমেন্টের কেমন রাশ, সবাই জানে৷ তবু হাতে ধরা শেষ চেকটায় সই মিলিয়ে নিয়েই পাস করে ও উঠে দাঁড়ালো৷

তড়িৎ গতিতে ম্যানেজারের কেবিনে ঢুকতেই ও একটু অবাক হয়ে গেল৷ ও বাইরের কেবিনে বসে পেমেন্ট সামলাচ্ছিল বলে বুঝতেই পারেনি, ম্যানেজারের কেবিনে লকার অফিসার শুভাশিসদা আর ক্রেডিট ডিপার্টমেন্টের সৌমিতও দাঁড়িয়ে রয়েছে গম্ভীরভাবে৷

ওদের ব্র্যাঞ্চে ম্যানেজার ছাড়া ওরা এই তিনজনই অফিসার৷ বাকি সব ক্লার্ক বা সাবস্টাফ৷ তারা সবাই বয়স্ক, সবারই প্রায় রিটায়ার করতে বড়জোর বছরপাঁচেক মত বাকি৷

ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার অশোক ভগত অবাঙ্গালী, কিন্তু বাংলা বলেন ভালই৷ ওকে ঢুকতে দেখেই স্যার বলে উঠলেন, ‘‘ওই তো বীথিকা!’’

বীথিকা বলল, ‘‘কি হয়েছে স্যার? প্রচুর চেক জমে আছে … !’’

অশোক স্যার হাত তুললেন, ‘‘ওসব পরে হবে৷’’ ধীরাজের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘কিছুক্ষণ একটু ম্যানেজ করতে বলোতো বাইরে৷ বীথিকা তুমি এখানে এসে বসো৷’’ তারপর ওর দিকে ঝুঁকে পড়লেন, ‘‘সকালে একটা মহিলাকে নিয়ে তুমি লকারে গিয়েছিলে? লকার নম্বর তেত্রিশ?’’

বীথিকা অবাক হয়ে বসতে বসতে বলল, ‘‘হ্যাঁ৷ একদম দশটার সময়েই তো এসেছিল, তখনো শুভাশিসদা আসেনি, আর তারপর পেমেন্ট শুরু হয়ে যাবে বলে আমি শুভাশিসদার ডেস্ক থেকে চাবিটা নিয়ে … মানে, আগেও তো শুভাশিসদা না এলে আমি …!’’

অশোক স্যার বললেন, ‘‘আরে সে ঠিক আছে৷ কিন্তু মহিলাটার সঙ্গে কি ছিল কিছু খেয়াল করেছিলে কি?’’

বীথিকা এবার আমতা আমতা করতে শুরু করল, ‘‘না সে’রকম তো ঠিক মানে আমি …!’’

এবার শুভাশিসদা কথা বলল, ‘‘যখন মহিলাটা সই করেছিল, তুই মিলিয়ে ছিলি লকার রেজিস্টারের সাথে?’’

বীথিকা এবার ঢোঁক গিলল৷ লকারের নিয়ম হল একটা চাবি ব্যাঙ্কে থাকে, আরেকটা চাবি কাস্টমারের কাছে৷ কাস্টমার লকার খুলতে এলে আগে লকার অফিসারকে রেজিস্টারে তার ছবি আর সই মেলাতে হয়, তারপর গিয়ে লকার খুলতে হয়, কাস্টমার ছাড়া অন্য কেউ তার চাবি নিয়ে এলেও লকারে যাওয়ার কোনো পারমিশন নেই৷ লকার অফিসার গিয়ে তার চাবি দিয়ে একটা প্যাঁচ ঘুরিয়ে বাইরে চলে আসে, তারপর কাস্টমারকে নিজের চাবি দিয়ে খুলতে হয়৷ কাস্টমার যখন লকারে থাকবে, তখন অন্য কাস্টমার তো দূর, ব্যাঙ্কের স্টাফদেরও ভেতরে যাওয়ার নিয়ম নেই৷ কাজেই লকারের ভেতর কে কি করছে কেউ জানতে পারেনা, কাস্টমার প্রাইভেসির জন্য সেখানে ক্যামেরাও লাগানো যায়না৷ কাজ মিটে গেলে কাস্টমার যাওয়ার আগে লকার অফিসারের কাছে গিয়ে রেজিস্টারে সই করে বেরিয়ে যায়৷

কিন্তু এ’সব নিয়মই খাতায় কলমে৷ এমনিতে তো এত ভিড় থাকে, সবার সই ছবি অত মেলানো সম্ভব হয়না, তাছাড়া তিনশো লকারের মধ্যে সবারই মোটামুটি মুখ চেনা, এলেই গিয়ে খুলে দেওয়া হয়৷ ফেরার সময়ে যে সই করার কথা, সেটাও একেবারেই করে কাস্টমার অনেকসময় ভেতরে ঢুকে পড়ে, ফেরার সময়ে শুধু মৌখিক বলে যায়৷

বীথিকার মনে পড়ল, ওই মহিলা যাওয়ার সময় ওকে জানিয়ে যায়নি, ওরও এত ব্যস্ততায় আর মনে ছিল না, তার পরেই পেনশন পেমেন্ট শুরু হয়ে গিয়েছিল৷

ও বলল, ‘‘না দেখিনি৷ কেন কি হয়েছে স্যার?’’

মিনিট দুয়েক পর পুরো ঘটনাটা শুনে ওর হাত পা কাঁপতে শুরু করল৷ এতো সাংঘাতিক ব্যাপার! ওর চাকরিটা থাকবে তো?

আধ ঘন্টা আগে নাকি ম্যানেজারের চেম্বারে একটা ফোন এসেছিল৷ এক ভদ্রমহিলা ফোন করে জানিয়েছেন তার বাড়ির কাজের মেয়েটা আজ ভোর থেকে নিখোঁজ, সঙ্গে কি কি নিয়ে গেছে তা না বললেও লকারের চাবিটা যে আলমারি থেকে হাওয়া সেটাই বলেছেন উদ্বিগ্ন গলায়৷ এইরকম কোনো অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গে তার লকারটাকে সিজ করে দেওয়া হয়, তারপর মোটা টাকা ফাইন হিসেবে নিয়ে ডুপ্লিকেট চাবি ইস্যু করা হয়৷ শুভাশিসদা তাই ওনাকে বলেছিল লিখিত ভাবে জানাতে, কিন্তু তারপরই গিয়ে রেজিস্টারে আবিষ্কার করেছে যে আজ সকালেই ওনার লকার ইউজ করা হয়েছে, আর সেটা বীথিকার অথরাইজেশনে৷ আর বেরনোর সময় কোনো সইও নেই৷

ভদ্রমহিলা আর তার স্বামী একটু পরেই ব্যাঙ্কে আসছেন লিখিত ভাবে চুরি যাওয়ার ব্যাপারটা জানাতে৷ তাদের যদিও এখনো জানানো হয়নি এই ব্যাপারটা৷

অশোক স্যার একটু চুপ করে থেকে বীথিকার দিকে তাকালেন, ‘‘আজ সকালে ওই মহিলা যখন সই করেছিল, তার পাশে তোমার ভেরিফাই করা সই রয়েছে, সুতরাং বুঝতেই পারছ,’’ স্যার চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন, ‘‘তোমাকেই পুরো ব্যাপারটার জন্য রেসপনসিবল করা হবে৷’’

বীথিকা ভয়ে আতঙ্কে কাঁপতে শুরু করেছিল, ‘‘স্যার, অত ভিড়ের মধ্যে তখন তো …!’’

অশোক স্যার সমব্যাথী গলায় বললেন, ‘‘বীথিকা, সবই আমরা বুঝতে পারছি৷ কিন্তু হায়ার অথরিটি তো কিচ্ছু শুনবে না, না ! তুমি তো নতুন ঢুকেছ, এর মধ্যেই এরকম হল বলে বাজে লাগছে, কিন্তু জানো তো, ব্যাঙ্কের অফিসারের চাকরি হচ্ছে সরু তারের উপর দিয়ে হাঁটার মত৷ এমনিতে তুমি যতই ব্যাঙ্কের জন্য প্রাণপাত করে ফ্যালো, লোন রিকভারি করতে গিয়ে গালাগালি খাও, কি যান লড়িয়ে দিয়ে টার্গেট অ্যাচিভ করো, একটা কিছু যদি কাজের চাপে ভুলবশতও এদিক ওদিক হয়, হেড অফিস সঙ্গে সঙ্গে তোমার পেছনে পড়ে যাবে, কোনো কথাই তখন শুনবে না, সার্কুলার অনুযায়ী এটা করা নিয়ম, ওটা করা নিয়ম এইসব বলবে৷ আরে সার্কুলার অনুযায়ী সব করতে গেলে যে রাত দুটোতেও আমরা অফিস থেকে বেরোতে পারব না সেটা আর কে বুঝবে!’’

শুভাশিসদা বলল, ‘‘স্যার, এখন প্রায় বারোটা বাজে৷ সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আমরা যদি বের করে পারি ওই মহিলা কখন ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়েছিল, সেটা দিয়ে থানায় খবর দিলে ওরা তো খুঁজে বের করতে পারবে?’’

অশোক স্যার চিন্তিতমুখে মাথা নাড়লেন, ‘‘আমরা এইরকম নিজে থেকে তো কোনো ইনভেস্টিগেশান ইনিসিয়েট করতে পারি না, না! এখন দেখা যাক, কাস্টমার নিজে কি বলেন, গোদরেজ কোম্পানিতে ফোন করতে হবে, গোদরেজ একটা অ্যামাউন্ট চার্জ করবে, তারপর ডুপ্লিকেট চাবি ইস্যু করবে, সেই খরচটা কাস্টমারকেই দিতে হবে৷’’ অশোক স্যার একটা বড় নিঃশ্বাস ফেললেন, ‘‘আমি যতটা সম্ভব বীথিকাকে বাঁচানোর চেষ্টা করব৷ তোমরা চিন্তা কোরো না৷’’

বীথিকার চোখ দিয়ে জল পড়ছিলো কি হবে ভেবে৷ একটা গরম রক্ত যেন আস্তে আস্তে ওর সবকটা শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে যাচ্ছিলো, প্রবল টেনশনে ওর মাথা আর কাজ করছিল না৷ অনেক কষ্টে, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে পড়াশুনো চালিয়ে এই চাকরির পরীক্ষায় ও পাশ করেছিল, আর পাঁচজনের মত চাকরি ওর কাছে বিলাসিতা নয়৷ বাবা ছোটবেলাতেই মারা গেছেন, তেমন কিছুই বলতে গেলে রেখে যেতে পারেননি৷ ভাই এখনো পড়ছে৷ মায়ের সংগ্রাম অনেক দিন ধরেই শুরু হয়েছে, তবু ওরা দু’ভাইবোনই পড়াশুনোয় ভাল ছিল বলে এখন ওদের সংসারটা মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে৷ কিন্তু এবার কি হবে? ওর কি চাকরিটা চলে যাবে?

আচ্ছা প্রোবেশন পিরিয়ড বলে কি কোনো ছাড় দেওয়া হবে না ওকে?

কিন্তু এটা তো জেনেবুঝে ফ্রড নয়! এটা একটা মিসটেক৷ কথায় বলে সরকারী চাকরি কোনো ক্রাইম না করলে যায় না, তবে?

অশোকস্যারকে বলতেই তিনি বললেন, ‘‘তোমার দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকে হাইলাইট করে অনেক কিছুই করতে পারে৷ শো কজ করতে পারে হেড অফিস, বাজে জায়গায় ট্রান্সফারও করতে পারে, কিংবা ইনক্রিমেন্টেও ঝামেলা করতে পারে৷ আবার প্রোবেশন পিরিয়ড বাড়িয়ে দিতে পারে৷ আরে এত চাপ নিও না৷ আমি তো আছি, দেখছি কি করা যায়৷’’

সৌমিতের কথায় হঠাৎ বীথিকা মুখ তুলে তাকালো, ‘‘দ্যাখ তো বীথিকা, এই মহিলা তো?’’

বীথিকা দেখলো, ম্যানেজারের পাশে রাখা সিসিটিভি মনিটরে ততক্ষণে সকাল দশটায় পিছিয়ে গেছে সৌমিত৷ ও উঠে এগিয়ে গেল মনিটরের দিকে৷

ঐ তো, লাল রঙের জংলা ছাপ শাড়ি পরা মহিলা ব্যাঙ্কের গেট দিয়ে ঢুকছে, তখন ব্যস্ততায় বীথিকা খেয়াল করেনি, এখন দেখল, মহিলার মুখে কেমন একটা ভয় ভয় ভাব, চারপাশে কেমন একটা উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, ডান কাঁধে একটা ঢাউস প্যারাশ্যুট কাপড়ের সস্তা ব্যাগ৷ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সামনে পাসবুক প্রিন্টারের সামনে বসে থাকা গণেশদা’কে কিছু বলল, গণেশদা মাথা নাড়ালো দু’পাশে৷ মহিলা আকুল হয়ে আরো কি সব বলছে, তখন গণেশদা আঙুল দেখিয়ে বীথিকার কেবিনের দিকে দেখালো৷ ক্যামেরাটা ঝাপসা হওয়ায় মুখটা অত ভাল দেখা যাচ্ছে না, তবে ঘোলাটে ক্লান্ত চোখটা বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট৷

অশোক স্যারও দেখছিলেন, ‘‘বীথিকা, মহিলাকে দেখেই মনে হচ্ছে ব্যাঙ্কে আসা এর অভ্যেস নেই৷ তুমি কি করে যে ছবি সই না মিলিয়েই লকারে নিয়ে চলে গেলে!’’

বীথিকা মৃদু স্বরে বলল, ‘‘লকারের চাবি তো রয়েছে সঙ্গে, লকার নম্বরও ঠিক বলল … !’’

‘‘তো কি?’’ অশোক স্যার রীতিমত বিরক্ত, ‘‘লকারের চাবি তো চুরি করতেই পারে কেউ, আর অনেকদিন ধরে বাড়িতে কাজ করলে লকার নম্বর জানাও বিচিত্র কিছু নয়! এত ক্যাজুয়াল হলে হয়?’’

অশোক স্যারের কথা শেষ হল না, কেবিনের বাইরের পর্দা সরিয়ে একটা গোল ফর্সা মুখ দেখা গেল, ‘‘আসব স্যার? আ-আমিই ঊর্মিলা বসু৷’’

অশোক স্যার অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় সঙ্গে সঙ্গে ডান হাত দিয়ে সিসি মনিটরটাকে অফ করে দিয়ে বললেন, ‘‘হ্যাঁ আসুন৷’’

ভদ্রমহিলা হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকলেন, পেছন পেছন একজন ভদ্রলোক, একটু গোবেচারা ধরণের৷ ভদ্রমহিলার বয়স পঞ্চাশের ওপরেই হবে, বেশ মোটা, মেহেন্দি করা লালচে খয়েরি চুল চুড়ো করে খোঁপা করা, চেহারায় বেশ উগ্র মেক আপ, এই ভ্যাপসা গরমেও মুখের লাল লিপস্টিক, চোখের উপরে মোটা করে কাজল চোখ এড়ালো না বীথিকার৷

সামনের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন মহিলা, সঙ্গে সঙ্গে পারফিউমের উগ্র গন্ধ যেন নাকে এসে ঝাপটা দিল, হঠাৎ গা টা গুলিয়ে উঠল ওর৷

তার মধ্যেও এই মহিলাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগল ওর৷ বিশেষ করে ওই কাজল দিয়ে আঁকা ধনুকের মত কৃত্রিম ভ্রূ’টা৷

‘‘নমস্কার স্যার, আমি-ই ঊর্মিলা বসু৷ আমার এখানে লকার আছে, তেত্রিশ নম্বর৷ আপনাকে একটু আগে ফোন করেছিলাম না যে আমার চাবিটা খোয়া গেছে?’’

‘‘হ্যাঁ৷ এতটা ইররেসপন্সিবল কি করে হন যে এরকম জিনিষ হারিয়ে যায়? জানেন এর জন্য আপনাকে কত টাকা দিতে হবে?’’ একটু চড়া গলায় প্রথমেই ভড়কে দিয়ে একটা চাল চাললেন অশোক স্যার৷

‘‘না না!’’ ভদ্রমহিলা আঁতকে উঠলেন, ‘‘আমি সব জিনিষ খুব সাবধানে রাখি স্যার! আর লকারে তো আমার সর্বস্ব রয়েছে, সেটার চাবি যত্নে রাখবো না?’’

‘‘তাহলে হারালো কি করে?’’ অশোক স্যার প্রায় ধমকে উঠলেন৷

‘‘আসলে স্যার’’ মহিলার মুখ প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে এল, ‘‘মিনু, মানে আমার বাড়িতে থাকা খাওয়া কাজের মেয়েটা আজ সকালে উঠে দেখছি হঠাৎ পালিয়েছে, তারপর সব ঠিক আছে কিনা খুঁজতে গিয়েই দেখি আলমারিতে এটা নেই!’’

‘‘থানায় ডায়রি করেছেন?’’

‘‘হ্যাঁ, থানা থেকেই তো আসছি এখানে৷’’ ভদ্রমহিলার চোখ ছলছল করছে, ‘‘আমি অ্যাপ্লিকেশনও লিখে নিয়ে এসেছি, আমার লকারটা কেউ চাবি নিয়ে এলে খুলতে দেবেন না যেন স্যার! আমার সবকিছু আছে ওতে৷’’

‘‘আচ্ছা বুঝলাম,’’ অশোক স্যার বুঝতেই দিলেন না কিছু, ‘‘আপাতত থানার এফ আই আরের কপিটাও জমা দিন, আমরা গোদরেজে জানিয়েছি, মোটামুটি ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা চার্জ করা হবে আপনার থেকে, তারপর ডুপ্লিকেট চাবি ইস্যু করা হবে৷’’

‘‘অ্যাঁ !’’ ভদ্রমহিলার মুখ নিমেষে সাদা, ‘‘এত টাকা! কে-কেন?’’

‘‘আপনি লকারের চাবি হারিয়ে ফেলবেন আর আপনাকে পেনাল্টি দিতে হবে না?’’

ভদ্রমহিলার স্বামী এতক্ষণ পাশে চুপচাপ বসেছিলেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে ঊর্মিলা বসু কি আলোচনা করলেন, তারপর বললেন, ‘‘আচ্ছা, সে ঠিক আছে, কিন্তু স্যার, লকারটা অন্য কেউ চাবি নিয়ে এলে অ্যাকসেস করতে পারবে না তো?’’ মহিলার অভিব্যক্তিতে ডুবে যেতে যেতেও খড়কুটো ধরে বাঁচতে চাওয়ার আশা৷

অশোক স্যার এইবার একঝলক বীথিকার দিকে তাকালেন, তারপর নরম গলায় বোমাটা ফাটালেন, ‘‘ম্যাডাম, আজ সকালে আপনার চাবি নিয়ে একজন এসেছিলেন, এবং চাবি থাকায় আমরা তাঁকে লকারটা অ্যাকসেস করতে দিতে বাধ্য হয়েছি৷’’

ঊর্মিলা বসু প্রথমে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড, তারপর হিষ্টিরিয়া রুগীর মত কেমন ছটফটিয়ে উঠেই চেয়ারে এলিয়ে পড়লেন, ‘‘আমার আশি ভরি গয়না!’’

দুই

পরেরদিন সকালে ব্র্যাঞ্চে যখন থানা থেকে তরুণ পুলিশ অফিসারটি দুজন কনস্টেবল সঙ্গে করে এলেন, তখন বীথিকা মনমরা হয়ে অশোকস্যারের কেবিনে বসেছিল৷ যদিও অফিসে এসেই ও নিজের কেবিনে বসতে গিয়েছিল, কিন্তু অশোক স্যারের নির্দেশে ওকে আর কাজ করতে দেওয়া হয়নি৷

গণেশদা বলেছিল, ‘‘একে মনের এই অবস্থা তোমার, কাল রাতে নিশ্চয়ই ঘুম হয়নি৷ তার ওপর এখন কাজ করতে গিয়ে কাজে ভুল করে যদি আরো ঝামেলায় পড়ে যাও? এমনিতেই পুলিশ টুলিশ আসবে, তোমাকে বারবার ডাকবে, তার চেয়ে ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে বসে থাকো, আমরা সামলে নেবো৷’’

বীথিকা আর দ্বিরুক্তি করেনি৷ কাল বাড়িতে গিয়ে অবধি ঘুম তো দূর, কিচ্ছু মুখে কাটতে পারেনি ও, কাউকে কিছু জানাতেও পারেনি৷ মা দু’বার জিজ্ঞাসা করেছে যে কি হয়েছে, ও এড়িয়ে গেছে৷ কি হবে এসব বলে! ও নিজে তো চাপে রয়েইছে, মাঝখান থেকে বাড়িতেও চাপ দেওয়া৷

সকালে শুকনো মুখে অফিসে এসেই ও প্রথমে লকারে গিয়েছিল৷ মোট তিনশোটা লকার৷ তিনটে আলমারি, প্রতিটায় একশোটা করে লকারের খোপ৷ তেত্রিশ নম্বর লকারটার বাইরে হাত বুলিয়েছিল বীথিকা বেশ কিছুক্ষণ ধরে, আকুল মনে ঠাকুরকে ডেকেছিল, ‘‘ঠাকুর, জ্ঞানত কারুর কোনো ক্ষতি করিনি৷ আমাকে বাঁচাও ঠাকুর, সংসারটা আমাদের ভেসে যাবে নাহলে!’’

পুলিশ যখন এলো, তখন ও চুপচাপ অশোকস্যারের কেবিনে স্যারের উল্টোদিকে বসেছিল৷

পুলিশ অফিসারটি অবশ্য বেশ ভদ্র৷ নাম অরণ্য মজুমদার৷ বয়স সাতাশ, আঠাশ হবে, সুঠাম ঋজু চেহারা৷ সব শুনে টুনে লকার রেজিস্টারের পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, ‘‘দেখুন ঊর্মিলা বসু যে ডায়রি করেছেন সেই ভিত্তিতে লকারটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওপেন করতে হবে, কারণ ওনার বাড়ি থেকে কিছুই তেমন খোয়া যায়নি৷’’

অশোক স্যার বললেন, ‘‘হ্যাঁ স্যার, আমরা রিকুইজিশান কালই পাঠিয়ে দিয়েছি৷ আজ কাল করেই গোদরেজ থেকে লোক এসে পড়বে৷ আচ্ছা ওই মহিলাকে ধরতে পারলেন কি?’’

অরণ্য মাথা নাড়লেন, ‘‘আমি কাল গিয়েছিলাম৷ ঊর্মিলা বসুর কথা অনুযায়ী মিনু বলে কাজের মহিলাটা থাকে সুন্দরবনের দিকে, নামখানার কাছের একটা গ্রামে৷ ডিটেইলস উনিও জানেননা, ওনার আগের কাজের লোক নাকি ছেড়ে দেওয়ার সময় একে ঠিক করে দিয়ে গিয়েছিল৷’’

অশোক স্যার একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘‘আচ্ছা, লকার খুলে যদি কিছু গণ্ডগোল দেখতে পান, তাহলে কি করণীয়?’’

অরণ্য বললেন, ‘‘এমনিতে তো ব্যাঙ্কের কোনো দায়িত্ব নেই লকারের জিনিষের ওপর, কিন্তু যেহেতু এক্ষেত্রে লকার মালিক নিজে আসেনি অথচ তবু ব্যাঙ্ক খুলতে পারমিশন দিয়েছে, আর সইও ম্যাচ করছে না, ঊর্মিলা বসুর কমপ্লেন অনুযায়ী প্রথমেই সেই ব্যাঙ্ক অফিসারকে আমাদের ইন্টারোগেট করতে হবে৷’’ ভদ্রলোক শব্দ করে লকার রেজিস্টারটা বন্ধ করলেন, ‘‘ভাল কথা, যিনি ওই মহিলাকে নিয়ে লকারে গিয়েছিলেন তাঁকে একটু যদি পাঠিয়ে দেন৷’’

বীথিকা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল৷ নার্ভাসনেস, টেনশন সব কিছু চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলে কেমন যেন অভিব্যক্তিহীন হয়ে পড়ে মানুষ৷ ওরও যেন সেটাই হয়েছে৷ আর কিছু ওর মনে হচ্ছিল না, অশোকস্যার ওকে কিছু বলার আগেই ও ক্লান্তভাবে বলল, ‘‘আমি৷ আমি নিয়ে গিয়েছিলাম ভেতরে৷’’

অরণ্য এবার ওর দিকে তাকালেন, ‘‘আচ্ছা৷ আপনার নাম?’’

‘‘বীথিকা৷ বীথিকা চ্যাটার্জি৷’’

অরণ্য বললেন, ‘‘বেশ৷ ম্যাডাম এই ব্র্যাঞ্চের লকার যখন আপনি দেখেন, কোনো কাস্টমার এলে তিনি জেনুইন কিনা সেটা ভেরিফাই করে নেন না?’’

বীথিকা ঠোঁট কামড়াল৷ পুলিশ আসার আগে অশোক স্যার পইপই করে শিখিয়ে দিয়েছেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা কথাও না বলতে৷ যতটুকু প্রশ্ন, ঠিক ততটুকু জবাব, এর বাইরে কিছু বললেই সেইখান থেকে প্রশ্ন তুলে জেরায় জেরায় জেরবার করতে পারে ওকে৷

বীথিকা দেখল, লকার রেজিস্টারের উপর লেখা লকার অফিসারের নামটা আড়চোখে দেখে অরণ্য প্রশ্নটা ছুঁড়লেন৷ ও বলল, ‘‘আমি তো লকার দেখি না৷ লকার দেখেন শুভাশিস মৈত্র৷ সেদিন তখনো শুভাশিসদা আসেননি তাই আমি … আর ভেরিফাই অত ব্যস্ততায় করার সময় পাইনি৷’’

অরণ্য মাথা নাড়লেন, পাশেই চলতে থাকা সেদিনের ফুটেজে মহিলাটিকে ভাল করে লক্ষ্য করছিলেন তিনি, মহিলার মুখ ভাল বোঝা না গেলেও সঙ্গের ব্যাগটা ভালই দেখা যাচ্ছিলো, ‘‘এত বড় ব্যাগ নিয়ে কেউ লকারে ঢুকতে পারে? মানে যদিও আমি ব্যাঙ্কের গাইডলাইনস জানিনা, তবু, আপনার সন্দেহ হল না?’’

বীথিকা বলল, ‘‘আমি মানে ঠিক … অতটা … সেদিন আমাদের পেনশনের পেমেন্ট ছিল সেইজন্য এত তাড়াহুড়ো…!’’

অরণ্য কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, অশোক স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘স্যার, আপনার এই স্টাফকে একটু আমাদের সঙ্গে ঊর্মিলা বসুর বাড়িতে যেতে হবে৷ বুঝতেই পারছেন, যেহেতু ওই মহিলাকে উনিই একমাত্র দেখেছেন, আর সিসিটিভি ফুটেজও তেমন ক্লিয়ার নয়, কাজেই ওনাকে একবার স্পটে নিয়ে যেতে হবে৷ এইটুকু কো-অপারেশন আশা করি আপনার থেকে …!’’

‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই!’’ অশোক স্যার মাথা নেড়েই বীথিকার দিকে তাকালেন, ‘‘বীথিকা তুমি এনাদের সঙ্গে একটু যাও৷’’

বীথিকা একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল৷ দুশ্চিন্তায়, আশঙ্কায় এই একদিনেই ওর মুখে একটা কালো ছোপ পড়েছে৷ অরণ্য গাড়িতে উঠে সেটা লক্ষ্য করে হাসলেন, ‘‘ম্যাডাম, আপনি মনে হচ্ছে খুব চাপে আছেন৷’’

‘‘আসলে,’’ বীথিকা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘‘হেড অফিস থেকে কি শো কজ করবে সেটা নিয়ে ভাবছি৷ নতুন জয়েন করেছি, তারপর আমার ফ্যামিলি আমার ওপর অনেকটাই ডিপেন্ডেন্ট৷’’ শেষের দিকে ওর গলাটা প্রায় বুজে এল৷ খুব কষ্ট হচ্ছিল৷ জীবনে এই প্রথম পুলিশের গাড়িতে উঠল, রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যতটা সম্ভব ওড়নায় মুখটা ঢেলে ফেলল বীথিকা, যদি চেনাপরিচিত কেউ দেখে ফ্যালে? সত্যি মিথ্যে না জেনেই কুৎসা রটাতে তো মানুষের জুড়ি নেই!

অরণ্য সায় দিলেন, ‘‘এই তো হয়, পাবলিক সার্ভিসে আপনি যতই খাটুন, একটা ভুল হোক, ওমনি সবাই আপনার পেছনে পড়ে যাবে৷ তবে,’’ অরণ্য আবার বীথিকার দিকে তাকালো, ‘‘এমনিতেই আমার কাছে কিছু ইনফরমেশন এসেছে যেটা থেকে আমার মনে হচ্ছে মিনু নেহাত ছিঁচকে চোর নয়৷ এখন ওখানে গিয়ে দেখা যাক৷’’

তিন

মিনিট কুড়ি পরে ঊর্মিলা বসুর বাড়িতে পৌঁছে বীথিকা একটু অবাক হয়ে গেল৷ উত্তরপাড়ার এই জায়গাটা এমনিতে ওর খুব প্রিয়, এই অঞ্চলের সব বাড়িই একদম গঙ্গার ধারে৷ এখান থেকে গঙ্গার দিকে মুখ করে তাকালেই ওপারের দক্ষিণেশ্বর মন্দির চোখে পড়ে, সেখান থেকে সন্ধ্যেবেলা ভেসে আসা আরতির ঘন্টা, ডানপাশে ব্যস্ত বালি ব্রিজ, সামনে সুবিশাল গঙ্গার উপর ইতস্তত নৌকো ভেসে চলা, এসব দেখলে মনটা খুব ভাল হয়ে যায়৷ ওর খুব ইচ্ছে ছিল এইরকম কোথাও একটা বাড়ি বানাবে, চাকরিটা পাওয়ার পর সেই স্বপ্নের জাল বুনতেও শুরু করেছিল মনে মনে, কিন্তু এখন তো সবই মনে হচ্ছে শেষ হয়ে গেল৷

ঊর্মিলা বসুর বাড়িটা বেশ বড় দোতলা৷ এই চত্বরটায় এখন প্রচুর ফ্ল্যাট ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে, তার মাঝে এই পুরনো আমলের বাড়িটা বেশ আলাদা করে চোখে পড়ে৷ বাড়িটার সামনেটা একটেরে বাগান, তাতে বেশ বড় বড় কয়েকটা গাছ বাড়ির সামনের দিকটাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে৷ বাড়িটার একটা বৈশিষ্ট্য হল, গাছগুলোর জন্যই হোক বা প্যাটার্নটার জন্য, কেমন একটা দুর্গের মত দেখতে, একঝলক তাকালে মনে হয়, ভেতরে কি হচ্ছে, কারা রয়েছে বাইরে থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই৷

 কিন্তু বীথিকার অবাক হওয়ার কারণ সেটা নয়৷ ওর একটু আশ্চর্য লাগল কারণ বাড়িটায় পা দিয়েই ও বুঝল এই বাড়িতে ও আগেও একবার এসেছে৷ স্কুলে পড়তে, বন্ধু সুনয়নার সঙ্গে৷ সুনয়নার এটা পিসির বাড়ি৷ সেই কারণেই কি ব্যাঙ্কে ওই ঊর্মিলা বসুকে অত চেনাচেনা লাগছিল?

অত দিন আগে কারুর বাড়ি আসলে সেটা মনে থাকার কথা নয়, কিন্তু বিশেষ একটা কারণে সেটা বীথিকা ভোলেনি৷ ভদ্রমহিলা সেদিন অকারণেই দুর্ব্যবহার করেছিলেন ওদের সাথে, তাতে ওর যতটা না খারাপ লেগেছিল, তার চেয়েও বেশি অপ্রস্তুত হয়েছিল সুনয়না৷ ওর এখনো স্পষ্ট মনে আছে, ভদ্রমহিলা ওদের একবারও বসতে পর্যন্ত বলেননি৷ আর সেদিনও এইরকম কাজল দিয়েই ভ্রূ আঁকা ছিল ওনার৷

‘‘আমার পিসি না এইরকমই, কিছু মনে করিস না প্লিজ! আসলে দাদা এত জ্বালায়, ওকে নিয়ে জেরবার হতে হতে পিসি এরকম হয়ে গেছে রে৷’’ সুনয়নার কথাগুলো আজও মনে আছে ওর৷

দরজা খুললেন ঊর্মিলা বসু নিজেই৷ একতলায় কাউকে চোখে পড়ল না, সিঁড়ি বেয়ে উঠে ড্রয়িং রুমে পৌঁছতে ভদ্রমহিলার স্বামীকে সোফায় বসে থাকতে দেখলো ওরা৷ মোটামুটি গোছানো আসবাবপত্র, ততক্ষণে ঊর্মিলার মুখে চোখে কালকের দুঃখ ভাবটা কেটে গিয়ে কেমন একটা বিরক্তি আর অসন্তাোষ ফুটে উঠেছে, ‘‘স্যার, আপনাদের কালও বললাম আমরা বারবার কমপ্লেন করা সত্বেও ব্যাঙ্ক এখনো লকারটা খুলতে পারল না৷ আমরা এখনো বুঝতে পারছি না কি কি খোয়া গেছে ওখান থেকে৷ ওই ম্যানেজারও কিছু করছে না, আপনারাও কিছু করছেন না৷ এটা কি ধরণের সিস্টেম বলুন তো?’’ ঊর্মিলা স্পষ্টতই বিরক্ত৷

অরণ্য হাত নেড়ে ওঁকে থামালেন, ‘‘আমরা সব দেখছি ম্যাডাম৷ আগে আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিন৷’’

ঊর্মিলা বিরক্ত মুখেই বললেন, ‘‘বলুন৷’’

‘‘আপনারা এখানে কতদিন আছেন?’’

‘‘এটা এখন জিগ্যেস করার কি মানে?’’ ঊর্মিলার মুখটা বেঁকে গেল, ‘‘আমি বিয়ে হয়ে এসে ইস্তক আছি৷ এই বাড়িটা তৈরি করেছিলেন আমার শ্বশুরমশাইয়ের বাবা৷’’

অরণ্য ঊর্মিলার স্বামীর দিকে তাকালেন, ‘‘আপনি কি করেন?’’

কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা কিছুটা নিজেদের ব্যক্তিত্বের অভাবে, আর কিছুটা পারিপার্শ্বিকের চাপে কেমন জবুথবু হয়ে যান৷ এই ভদ্রলোককে দেখেও বীথিকার সেটাই মনে হল৷ ভদ্রলোক কেমন আড়ষ্ট হয়ে বললেন, ‘‘আমি … আমি রেলে চাকরি করতাম৷ দু’বছর আগে রিটায়ার করেছি৷’’

অরণ্য জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আপনাদের ছেলেমেয়ে?’’

ঊর্মিলা বললেন, ‘‘আমাদের একটাই ছেলে৷ সে ইঞ্জিনিয়ার৷’’

‘‘কোথায় তিনি এখন?’’

‘‘অফিসের কাজে দিল্লী গেছে৷’’ বলেই মহিলা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘‘আমি বুঝতে পারছি না মিনু চুরি করে পালিয়েছে, আপনারা ওকে খোঁজার চেষ্টা না করে এইসব আলতু ফালতু প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করছেন কেন?’’

‘‘কোনটা আলতু ফালতু আর কোনটা দরকারি সেটা বোঝবার ভারটা আমার ওপরেই না হয় ছেড়ে দিন মিসেস বাসু৷’’ অরণ্য ঊর্মিলার চেয়েও কড়া গলায় ধমকে উঠলেন, ‘‘আপনাকে যেগুলো জিজ্ঞাসা করছি ঠিকঠাক আনসার দিন, নাহলে কিন্তু তদন্তে অসহযোগিতার জন্য স্টেপ নিতে আমি বাধ্য হব৷’’

ঊর্মিলা বসু মুহূর্তেই গুটিয়ে গেলেন, ‘‘না না বলুন৷’’

অরণ্য কড়া গলাতেই বললেন, ‘‘বছর দুয়েক আগে আপনাদের বাড়িতে থানা থেকে পুলিশ এসেছিল, আপনার ছেলেকে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল, পরে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ কেন?’’

ঊর্মিলা এবার প্রচণ্ড ভড়কে গেলেন, আমতা আমতা করে বললেন, ‘‘ওটা … ওটা আমার ছেলেকে কয়েকটা বাজে ছেলে ফাঁসিয়ে দিয়েছিল … বাবুর কোনো দোষই ছিল না … !’’

‘‘বাড়িতে কোকেন স্টোর করে রেখেছিল আপনার ছেলে, সাপ্লাইও করতো, সেইজন্য তো?’’ অরণ্য মহিলার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলেন৷

ঊর্মিলা বসু এবার ভাঙ্গা গলায় উত্তর দিলেন, ‘‘ওকে ফাঁসানো হয়েছিল৷ কয়েকটা বন্ধু বাড়িতে এসে লুকিয়ে রেখে ওর ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছিল৷’’

‘‘বুঝেছি৷’’ অরণ্য উঠে হেঁটে হেঁটে ঘরের চারদিক দেখছিলেন, ‘‘এবার বলুন, মিনু বলে যে মেয়েটা আপনার বাড়িতে কাজ করত, তাকে পেলেন কোথা থেকে? আসার পর থানায় আইডি কার্ড ছবি জমা দিয়েছিলেন?’’

মহিলার তেজ এখন সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেছে৷ ফ্যাসফেসে গলায় বলতে লাগলেন, ‘‘না৷ আসলে আমার বাড়িতে মানদা বলে একজন কাজ করত, অনেক বছর ধরে৷ সে হঠাৎ শরীর খারাপ হওয়ায় কাজ ছেড়ে দেয়, তখনই মিনুকে ঠিক করে দিয়েছিল৷ মিনু ওর গ্রামেরই মেয়ে, গোসাবায় বাড়ি৷ বাবা মা ছিল না, মামার বাড়িতে মানুষ, আমার এখানে এসেছিল দু’বছর আগে৷’’

‘‘কত টাকা মাইনে দিতেন?’’

‘‘দু’বেলা খাওয়া থাকা ছাড়া দু’হাজার টাকা দিতাম৷’’ ঊর্মিলার গলায় যেন প্রচ্ছন্ন অহংকার ঝরে পড়ল৷

অরণ্য বললেন, ‘‘এমনিতে কেমন মেয়ে ছিল মিনু? পাড়ার লোকেদের সাথে মেলামেশা করতো?’’

ঊর্মিলার মুখে আবার বিরক্তি ফুটে উঠলেও তিনি গলাটা শান্ত রাখলেন, ‘‘কাজের মেয়ে, বাইরের লোকের সাথে বেশি মেলামেশা করতে যাবে কেন? বাড়িতেই থাকতো৷’’

অরণ্য বললেন, ‘‘কোনো ছবি আছে আপনার কাছে মিনুর?’’

ঊর্মিলা একটু চিন্তা করলেন, ‘‘ও আসার পরে পরেই আমার বোনের বাড়ির একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, ওকেও নিয়ে গেছিলাম সেখানে৷’’ ভদ্রমহিলা দেখা গেল বেশ মডার্নও, ফোনে খুঁজে খুঁজে বের করে এগিয়ে দিলেন একটা ছবি, ‘‘এই যে ডানপাশের মেয়েটা৷’’

অরণ্য দেখে বীথিকার দিকে এগিয়ে দিলেন, ‘‘দেখুন তো, চিনতে পারছেন কিনা৷’’

বীথিকা দেখল কালকের মহিলাটাই বটে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন এটা বহু যুগ আগের ছবি৷ ছবিতে সে একজন রোগা গড়নের মেয়ে, শ্যামলা রঙ, কিন্তু মুখটা বেশ লাবণ্যে ঢাকা, চেহারায় একটা মিষ্টি লালিত্য আছে৷ কিন্তু কালকে যতটুকু বীথিকা দেখেছিল, একটা শ্রীহীন ভগ্ন পরিশ্রান্ত চেহারাই ওর মনে পড়ল৷

এই বছরখানেকের মধ্যেই এতটা চেহারার পরিবর্তন?

বীথিকা মুখে কিছু বলল না, ইশারায় সন্মতি জানালো৷

অরণ্য আবার ঊর্মিলার দিকে তাকালেন, ‘‘আপনি কাল সকালে থানায় ডায়রি করতে গিয়েছিলেন৷ কখন বুঝতে পারলেন যে লকারের চাবিটা নেই?’’

ঊর্মিলা বসু বললেন, ‘‘কাল ভোর থেকেই মিনুকে পাচ্ছিলাম না৷ আগের দিন রাতে ঠিকই ছিল৷ খাওয়াদাওয়া করে রান্নাঘর মুছে শুতে চলে গিয়েছিল৷ সকালে উঠে দেখি নেই৷’’

‘‘একটা মানুষ বাড়ি থেকে জলজ্যান্ত উবে গেছে দেখেও আপনার অন্য কিছু না ভেবে ব্যাঙ্কের লকারের চাবির কথাই মনে পড়ল কেন?’’

ঊর্মিলা বসু বললেন, ‘‘আমার একটা বিয়েবাড়ি ছিল কাল রাতে৷ সেইজন্য ব্যাঙ্কে এমনিই যেতাম গয়না আনতে৷ মিনুকে খোঁজার সাথে সাথে আলমারিও খুলেছিলাম৷ তখনই দেখলাম চাবিটা নেই৷’’

অরণ্য মাথা নাড়লেন, ‘‘বুঝলাম৷ আচ্ছা, আপনার বাড়ি থেকে আর কি কি চুরি গেছে?’’

‘‘আর সে’রকম কিছু এখনো তো বুঝতে পারিনি৷’’

‘‘আপনি লকারের চাবি কোথায় রাখতেন?’’

‘‘আমার আলমারিতে৷’’

‘‘আলমারির চাবি কোথায় রাখতেন?’’

‘‘আমাদের শোবার ঘরের বিছানার তোষকের নীচে৷ মিনু জানতো সেটা৷ কিন্তু কোনোদিনও হাতটান জাতীয় কিছু তো দেখিনি, হঠাৎ যে এই দুর্বুদ্ধি হবে সেটা কি করে বুঝবো বলুন৷’’

‘‘আলমারিতে যেখানে লকারের চাবিটা ছিল, সেখানে টাকাপয়সা, গয়না কিছু ছিল কি?’’

ঊর্মিলা বসু কিছু বলার আগেই ওনার স্বামী এতক্ষণ পরে কথা বলে উঠলেন, ‘‘হ্যাঁ, হাজার পাঁচেক টাকা সংসারের জন্য রাখা ছিল, ঊর্মির ছোট একজোড়া কানের দুল আর একটা নাকছাবিও ছিল৷ সেগুলো সব ঠিকঠাকই রয়েছে৷ এমনকি মিনুর ছ’মাসের মাইনেটাও তো নিয়ে যায়নি৷’’

বীথিকা লক্ষ্য করল ভদ্রলোক বলা মাত্র ঊর্মিলা বসু প্রায় ভস্ম করে দেওয়ার ভঙ্গীতে স্বামীর দিকে তাকালেন, ‘‘আহ! তুমি থাম না৷ আমি তো কথা বলছি, নাকি?’’

ভদ্রলোক সাথে সাথে গুটিয়ে গেলেন৷

অরণ্য সেটা লক্ষ্য করে বললেন, ‘‘মিনু থাকতো কোথায়?’’

ঊর্মিলা বললেন, ‘‘একতলায়৷’’

‘‘চলুন ঘরটা দেখে আসি৷’’ অরণ্য ঘর ছেড়ে সিঁড়ির দিকে যেতে উদ্যত হলেন৷

সিঁড়ি দিয়ে নেমে ডানপাশে একটা ছোট বাথরুম, তার পাশেই মিনুর ঘর৷ কিন্তু সেখানে গিয়ে তেমন কিছুই পাওয়া গেল না৷ খুব পরিপাটি করে গোছানো ঘর, একপাশে একটা আলনায় গোটাকয়েক সালোয়ার কামিজ, একটা মলিন শাড়ি আর টুকিটাকি কিছু মেয়েলি জিনিষ৷ ঘরের একপাশের বিছানা টানটান করে পাতা৷ দেখে মনে হচ্ছে বিছানাটা গোছাবার পর সেখানে কেউ শোয়নি৷

অরণ্য বললেন, ‘‘মিনু উধাও হওয়ার পর আপনারা এই ঘরে এসেছিলেন?’’

‘‘এমনি এসে উঁকি মেরেছিলাম একবার’’ ঊর্মিলা বসু বললেন, ‘‘ভেতরে ঢুকিনি৷’’

চার

ঊর্মিলা বসুর বাড়ি থেকে বেরিয়েই অরণ্য ইতস্তত এগিয়ে গেলেন পাশে চায়ের দোকানটার দিকে৷ চায়ের দোকানে দোকানদার ছাড়াও দু’তিনজন বসেছিল৷ সবার মুখেই একটা অস্পষ্ট ভয়ের ছায়া পুলিশের জিপ দেখে ফুটে উঠল৷

কিন্তু অরণ্য যে আর পাঁচজন পুলিশের মত নন, সেটা বোধ হয় তিনি প্রথমেই বুঝিয়ে দিতে চান৷

অরণ্য প্রথমে গিয়ে স্মিত মুখে হাসলেন, দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘নমস্কার, আমি উত্তরপাড়া থানা থেকে আসছি৷ কয়েকটা ব্যাপারে একটু জানার ছিল আপনার থেকে৷’’

দোকানদার মানুষটা ভালই, বয়স চল্লিশ বিয়াল্লিশ৷ অরণ্যর পাশে বীথিকাকে দেখে তাকেও কোনো কেউকেটা ভেবে বেশ সমীহ করে বসালো বেঞ্চে, কাঁধের গামছা দিয়ে ঝেড়ে দিল জায়গাটা৷ ‘‘নিশ্চয়ই স্যার, বসেন এখানে, আমার নাম পরেশ৷ কি জানতে চান বলেন?’’

অরণ্য বললেন, ‘‘আপনার এখানে কতদিনের দোকান?’’

পরেশ বলে লোকটা মাথা চুলকোল, ‘‘তা প্রায় পনেরো বচ্ছর তো হবেই স্যার৷ আগে গুমটি ছিল হিন্দমোটর কারখানার সামনে, তারপর গণ্ডগোল শুরু হতে এইখানে নিজে দোকান দিয়েছি৷’’

অরণ্য বেশি সময় নষ্ট না করে সোজাসুজি প্রশ্নে চলে গেলেন, ‘‘আচ্ছা পরেশবাবু, ওই যে গোলাপি বাড়িটা দেখছেন, ওদের আপনি নিশ্চয়ই চেনেন৷’’

পরেশ লম্বা মাথা নেড়ে সসপ্যানে বোধ হয় অরণ্যদের জন্যই চা বানানোর আয়োজন করতে লাগলো, ‘‘আজ্ঞে এইখানে দোকান, আর ওনাদের চিনবো না? মলয়বাবু তো আগে রোজ অফিস ফেরতা আমার কাছে দু’দন্ড বসে চা খেয়ে যেতেন৷’’

অরণ্য বললেন, ‘‘মলয়বাবু মানে ওই বাড়ির মালিক ভদ্রলোকের কথা বলছেন?’’

‘‘আজ্ঞে৷’’ পরেশ মনে হয় ওদের খাতিরে স্পেশাল চা বানাচ্ছে, মুহূর্তে এলাচের গন্ধে জায়গাটা ম-ম করতে লাগলো৷

‘‘ওদের বাড়িতে একটা খাওয়া পড়া কাজের মেয়ে থাকতো, মিনু নাম৷ তাকে পাওয়া যাচ্ছে না৷ চিনতেন তাকে?’’

‘‘ওমা চিনবুনি?’’ পরেশ বড় একটা হাতা দিয়ে মাংস কষার মত পুরো চা’টাকে নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘‘আগে তো এইখান দিয়েই বাজার যেতো, আমার এখানে দাঁড়াত, টুকটাক কথা বলতো৷ বেশ ভাল, শান্ত মেয়ে৷ হঠাৎ কোথায় যে চলে গেল কে জানে!’’

অরণ্য এবার বেশ অবাক, মিনুর পালানোর খবর তার মানে এর মধ্যেই এরা সবাই জেনে গেছে৷ ‘‘আপনি জানেন মিনু পালিয়েছে?’’

‘‘পালাবে কেন?’’ পরেশ ভ্রূ কুঁচকে চোখ পিটপিট করলো, ‘‘মলয়বাবুর বৌ যে বলেছিল ওরা ছাড়িয়ে দিয়েছে?’’

অরণ্য বীথিকার দিকে আড়চোখে চাইলেন, তারপর বললেন, ‘‘কবে বলেছে এটা আপনাকে?’’

পরেশ সসপ্যান থেকে চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল, ‘‘পুজোর পরে পরেই তো বলেছিল৷ তা প্রায় ন-দশ মাস তো হবেই৷’’

‘‘মানে?’’ অরণ্য রীতিমত কনফিউজড, ‘‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন মিনুকে আপনি শেষ দেখেছিলেন দশ মাস আগে?’’

‘‘হ্যাঁ৷’’ পরেশ দুটো কাপ এগিয়ে ধরল ওদের দিকে, ‘‘মিনু তো অনেকদিন হল চলে গেছে ওদের বাড়ি থেকে৷ আর যাবেনা-ই বা কেন!’’ পরেশ গলার স্বর নিচু করলো, ‘‘মলয়বাবুর বৌ যতই বলুক ছাড়িয়ে দিয়েছে, আসলে নিশ্চয়ই মেয়েটা নিজেই চলে গেছে৷ ছেলেটা যা বজ্জাত স্যার! পাড়ার মেয়েদের কম জ্বালিয়েছে? আরো অনেক গুণ আছে৷ ও’বাড়িতে অল্পবয়সী সোমত্থ মেয়ে কখনো টিকতে পারে নাকি?’’

অরণ্য চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘‘হুম৷ কি করে ছেলেটা? ইঞ্জিনিয়ার নাকি?’’

‘‘এহহ!’’ পরেশ মুখ বেঁকালো, ‘‘ঘোড়ার ডিম৷ কিচ্ছু করেনা, কলেজে পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে দিয়েছিল৷ একবার তো থানায় ধরেও নিয়ে গিয়েছিল৷’’

‘‘আচ্ছা, তারপর ওদের বাড়িতে নতুন কোন কাজের লোক এসেছে জানেন আপনি?’’

পরেশ এবার জোরে জোরে মাথা নাড়ল, ‘‘তারপর আর কেউ আসেনি স্যার৷’’

‘‘আপনি শিওর?’’

পরেশ এবার হাসল, ‘‘এত কাছে দিনরাত বসে আছি, আর কেউ এলে টের পাবুনি? আর তাছাড়া মিনু থাকতো ওদের তেতলার ছাদের চিলেকোঠায়, প্রায়ই দেখতাম ছাদে কাপড় মেলছে বা জানলায় বসে আছে৷ আর তাছাড়া গলার আওয়াজটাও তো পাব৷ তবে’’ পরেশ বিস্কুট এগিয়ে ধরল এবার, ‘‘ইদানিং কালে তো যা ষাঁড়ের মত গান চালায় সন্ধ্যে থেকে, কেউ কিছু শুনতেই পায়না৷ এই নিয়ে পাড়ার ক্লাব থেকে দু’বার বারণ করা হয়েছে, ওই বদ ছেলে কারুর কথা শোনে নাকি! মা’টার আশকারাতে আরো উচ্ছন্নে গেছে স্যার!’’

গাড়িতে উঠে অরণ্য বললেন, ‘‘কেসটা বুঝলেন? পাড়ায় জানে যে মিনু বছরখানেক আগেই চলে গেছে৷’’

কনস্টেবলদুটো আগেই গাড়িতে এসে বসেছিল৷ গাড়ি স্টার্ট হতে বীথিকা বলল, ‘‘না, হয়ত এই দোকানদারটা জানেনা, অন্যরা জানে৷’’

‘‘উঁহু! পাড়ার মধ্যে চায়ের দোকান, সে হচ্ছে পাড়ার গেজেট, সব খবরই জানবে৷’’ অরণ্য মাথা নাড়লেন, ‘‘এতো আরো কমপ্লিকেটেড হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা৷ তার মানে কি কাল মিনুর বাড়ি থেকে পালানোটা পুরো বানানো?’’

বীথিকা বলল, ‘‘আরেকটা জিনিষ লক্ষ্য করলেন? লোকটা বলল মিনু থাকতো নাকি চিলেকোঠায়৷ অথচ ঊর্মিলা বসু আমাদের একতলায় নিয়ে গেল৷’’

‘‘হুম, সেটাও দেখলাম৷ মহিলাকে যতটা ঘোড়েল ভেবেছিলাম, তার চেয়েও দেখছি ঘাগু৷’’ ‘‘অরণ্য নিজের মনেই স্বগতোক্তি করলেন, ‘‘আলমারি থেকে টাকা পয়সা, গয়নাগাটি কিছু নিল না, এমনকি নিজের মাইনেও রেখে গেল, অথচ শুধু লকারের চাবিটা নিল, এটাই অদ্ভুত লাগছে৷ যতক্ষণ না লকারটা ওপেন করা যাচ্ছে …!’’ চিন্তিত মুখে কথাগুলো বলেই বীথিকার দিকে তাকালেন অরণ্য, ‘‘চলুন আপনাকে আপনার অফিসে পৌঁছে দিই৷’’

বীথিকা এবার একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, ‘‘বলছি এই বাড়িটায় আমি অনেক ছোটবেলায় একবার এসেছিলাম৷ আমার এক বন্ধুর সঙ্গে৷ ঊর্মিলা বসু ওর পিসি৷ এদিকে একটা কোচিং এ পড়তে এসেছিলাম, সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, তাই মাঝরাস্তায় ঢুকতে হয়েছিল৷ আধঘন্টা মত ছিলাম৷’’ কথাটা বলে ও ঠোঁটটা কামড়ে ধরল, ‘‘ওই ভদ্রমহিলা খুব একটা ভাল নয়৷ ব্যবহার খুব খারাপ৷’’

‘‘হুম, সে তো বোঝাই যাচ্ছে৷’’ অরণ্য বললেন, ‘‘অদ্ভুত ব্যাপার হল মিনুকে এতদিন কেউ দেখেনি৷ তার মানে কি ও রিসেন্টলি আবার এখানে এসেছিল?’’ অরণ্যর কথা শেষ হল না, ফোন বেজে উঠল, ‘‘হ্যালো?’’

‘‘আচ্ছা, তাই? ভেরি গুড! আমি এখুনি আসছি৷’’ ফোনটা রেখেই সঙ্গের কনস্টেবলকে অরণ্য নির্দেশ দিলেন, ‘‘সুবল, তুমি এক্ষুনি নেমে চলে যাও ঊর্মিলা বসুর বাড়িতে৷ গিয়ে বলো, ব্যাঙ্কে ডুপ্লিকেট চাবি এসে গেছে৷ উনি যেন এক্ষুনি চলে আসেন৷’’

বীথিকা বলল, ‘‘লকারটা খোলা হবে তাহলে এখন?’’

‘‘হ্যাঁ৷ আপনাদের ব্যাঙ্কে গোদরেজ থেকে লোক এসে গেছে৷’’ অরণ্যকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল৷

সারাটা রাস্তা আর কোনো কথা হল না৷ বীথিকার বুকের ভেতরে গুম গুম শব্দ হচ্ছিল৷ কাল থেকে মানসিক চাপ, অনিদ্রা, না খাওয়া, সবকিছু একসাথে হয়ে ওর স্নায়ু এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ছিল, ওর মনে হল যে কোনো মুহূর্তে ও অজ্ঞান হয়ে যাবে৷ যদি লকার থেকে ওই আশি ভরি গয়নাই হাপিশ হয়ে যায়? ওই ঊর্মিলা বসু তো ঠারেঠোরে বুঝিয়েই দিয়েছেন ব্যাঙ্কের বিরূদ্ধে অভিযোগ করাটা শুধু সময়ের অপেক্ষা৷

কি হবে বীথিকার? চাকরি যে যাবে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু চুরিতে পরোক্ষভাবে মদত দেওয়ার অভিযোগে কি জেল হয়ে যাবে? যদি বলে মিনু ওর চেনা, তাই বীথিকা ওকে খুলতে দিয়েছে?

ও চোখ বুজে ফেলল৷

‘‘আরে আপনি এত চাপ নেবেন না৷ আপনাকে দেখে তো আমারই ভয় করছে৷’’ ওর অবস্থা দেখে অরণ্য বললেন, ‘‘আমার অনুমান যদি ঠিক হয় লকার থেকে গয়না খোয়া যাবে না, চুরি করা মিনুর উদ্দেশ্য হলে ও আলমারির ওই গয়না বা টাকাগুলোও ছাড়তো না৷ অন্য কিছু একটা গণ্ডগোল আছে৷’’

বীথিকা কি একটা বলতে গেল, অরণ্য থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘আচ্ছা, আমি কিন্তু একবার থানা ঘুরে যাবো ব্যাঙ্কে, কেমন?’’

বীথিকা মাথা নাড়ল৷

বীথিকা কাছাকাছি থাকলেও এর আগে ওর কোনোদিনও থানায় আসার প্রয়োজন পড়েনি৷

পুলিশের জিপ থেকে অরণ্যর সঙ্গে নামার সঙ্গে সঙ্গে বাইরের ভিড়ের অনেকগুলো কৌতূহলী চোখ যেন ওর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷

বীথিকার প্রচণ্ড একটা অস্বস্তি হচ্ছিল, আচ্ছা এরা সবাই কি বীথিকাকে ক্রিমিন্যাল ভাবছে?

তবে অরণ্য ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ভিড় ঠেলে এগোনোর সময় ওকে বেশ গার্ড করে নিয়ে যেতে লাগলেন, বারবার ‘‘আসুন ম্যাডাম৷’’ বলছিলেন যাতে বীথিকার অস্বস্তিটা একটু কমে৷

তাতে কাজ হল৷ লোকগুলোর চোখেমুখে কৌতূহল সরে গিয়ে একটা সমীহের ভাব জেগে উঠল৷ খোদ ওসিসায়েব নিজে এরকম খাতির করে নিয়ে যাচ্ছেন মানে বীথিকা নিশ্চয়ই বড় কেউ হবে৷

চেম্বারে ঢুকতেই অন্য একজন স্টাফ এগিয়ে এলেন, ‘‘স্যার, সাউথের সব স্টেশনেই অ্যালার্ট দেওয়া আছে, এখনো অবধি মিনু বলে মেয়েটাকে ধরা যায়নি৷ আর, ওই ভদ্রমহিলার ছেলে গতকাল সকালে হাওড়া স্টেশন থেকে পূর্বা এক্সপ্রেস ধরেছিল, রাত আটটা নাগাদ নেমে গেছে মুঘল সরাইতে৷’’

অরণ্য মাথা নাড়লেন, ‘‘ হুম৷ তারপর?’’

‘‘তারপর এখনো আপডেট আসেনি স্যার৷’’

অরণ্য টেবিলে রাখা ফাইলগুলোয় ঝড়ের গতিতে সই করছিলেন, ‘‘ঠিক আছে৷ খবর এলেই আমাকে জানাবে৷ ইউ পি পুলিশকে বলে দাও খোঁজ পেলেই যেন অ্যারেস্ট করে৷ আমি বেরোচ্ছি৷’’

গাড়িতে উঠে বীথিকা জিজ্ঞেস করল, ‘‘ওই মহিলা যে বলল ওর ছেলে দিল্লী গেছে?’’

অরণ্য হাসলেন, বীথিকা লক্ষ্য করল হাসলে অরণ্যকে বেশ বাচ্চা বাচ্চা লাগে৷ ‘‘ওটা কি আপনি সত্যি ভেবেছিলেন নাকি? মহিলা সেয়ানা হলেও বোকামি করেছে অনেক, নাহলে পুলিশকে এইসব বোকা বোকা মিথ্যে বলে কেউ!’’

পাঁচ

ব্যাঙ্কে ওরা যখন পৌঁছল, ততক্ষণে ঊর্মিলা বসু তাঁর স্বামীকে নিয়ে উপস্থিত হয়ে গেছেন৷ ব্যাঙ্কের ভল্টে গোদরেজ কোম্পানির লোক, অশোক স্যার, শুভাশিসদা, সৌমিত ছাড়াও ব্যাঙ্কের অন্যান্য স্টাফেরাও সব ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিলেন৷

কিন্তু অরণ্য ঢুকেই সবাইকে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন৷ ভল্টে রইলেন শুধু অশোক স্যার, বীথিকা, দুজন কনস্টেবল, লকার অফিসার শুভাশিসদা আর গোদরেজের লোকটা৷ এছাড়া ঊর্মিলা বসু আর তাঁর স্বামী৷

ম্যানেজার সঙ্গে অফিশিয়াল সইসাবুদ মিটে যেতে কোম্পানির লোকটা বলল, ‘‘তাহলে স্যার, খুলি?’’

অরণ্য মাথা নাড়লেন, ‘‘হ্যাঁ খুলুন৷’’

একেই হাওয়া বাতাস ঢোকেনা বলে ভল্টটায় একটা ভ্যাপসা গন্ধ, তার ওপর একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় সবার মুখ যেন থমথম করছে৷

ঊর্মিলা বসু থেকে থেকেই ফুঁপিয়ে উঠছিলেন, ‘‘আমার অত গয়না … !’’

ওর স্বামী মৃদু গলায় স্ত্রীকে মানানোর চেষ্টা করছিলেন৷

ব্যাঙ্কে থাকা মাস্টার কি দিয়ে শুভাশিসদা প্রথমে এক প্যাঁচ ঘোরানোর পর গোদরেজের লোক এগিয়ে এসে তার ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে আরেক প্যাঁচ ঘোরাল৷

মৃদু একটা শব্দ করে লকার নম্বর তেত্রিশ খুলে গেল৷

ঊর্মিলা বসু যেন কোহিনুর হীরে খুঁজতে যাচ্ছেন এইরকম ভঙ্গীতে উঁকি মারতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু একজন কনস্টেবল তাকে সরিয়ে দিল, ‘‘আপনি সরে দাঁড়ান৷’’

প্রথমে কিছু দেখা গেল না, নিকষ কালো অন্ধকার৷ বীথিকাদের ব্যাঙ্কের লকারগুলো প্রস্থে পাঁচ ইঞ্চি মত হলেও দৈর্ঘ্যে প্রায় ফুটতিনেক, পুরো হাতটাই প্রায় ঢুকে যায় ভেতরে৷

অরণ্য এগিয়ে গেলেন৷ লকারের খোলা মুখটার সামনে গিয়ে হাত ঢোকালেন ভেতরে৷

কয়েক সেকেন্ড পরে যেটা বের করে আনলেন সেটা একটা সাদা রঙের পুঁটলি৷ আয়তনে প্রায় ইঞ্চি দশেক হবে৷ ছোটখাটো একটা পাশবালিশের মত আকৃতি৷

জিনিষটা বের করার সঙ্গে সঙ্গে একটা কেমন বিচ্ছিরি গন্ধ যেন নাকে এসে ঝাপটা মারল সবার৷

ঊর্মিলা প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাবেন, এমন ভাবে বললেন, ‘‘এটা কি? আ-আমার গয়নার কৌটো কোথায়?’’ শেষের দিকে ওনার গলাটা যেন কেঁপে উঠল৷

অরণ্য পুঁটলিটা খুলে আঁতকে উঠলেন৷

ভল্টরুমে বাইরের আলো না ঢোকায়, দুটো টিউবলাইট ফিট করা আছে৷ সেইদুটোর আলো লম্বভাবে এসে প্রতিফলিত হচ্ছে সারা ঘরে৷ একটা ছোট পেডেস্ট্রাল ফ্যান রয়েছে একপাশে, কিন্তু সে তার ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে ভ্যাপসা দুর্গন্ধটাকে কাটাতে পারছেনা৷

টিউবলাইটের আলোয় সবাই কম্পিতমুখে দেখল, পুঁটলিটার মধ্যে রয়েছে একটা বাচ্চা৷

সদ্যোজাত৷ মৃত৷ রক্তশুন্য ফ্যাকাশে৷

নাড়িছেঁড়া রক্ত তখনো শুকিয়ে কালচে হয়ে রয়েছে পেটের কাছটায়৷

বীথিকার নিঃশ্বাস প্রায় আটকে গিয়েছিল৷ ধপ করে একটা শব্দ হতেই ও দেখল ভয়ে আতঙ্কে ঊর্মিলা বসু পড়ে গেছেন মাটিতে৷

বীথিকার মাথা যেন কাজ করা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে দিচ্ছিল ধীরে ধীরে৷ রক্তের চাপ এতটাই বেড়ে গেছে, মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে ফেটে ছলকে পড়বে বাইরে৷

বাচ্চাটার চোখদুটো সম্পূর্ণ বোজা৷ বীথিকার অনভিজ্ঞ চোখ বলল এর বয়স কয়েক ঘন্টার বেশি হতেই পারে না৷

মায়ের শরীর থেকে সে যখন বেরিয়েছিল, তখন কি প্রাণ ছিল ওইটুকু দেহে? নাকি পৃথিবীর আলো এক মুহূর্তের জন্যও দেখার ভাগ্য হয়নি তার!

অরণ্য অস্ফুটে বললেন, ‘‘বডিতে রাইগার মর্টিস শুরু হয়ে গেছে৷’’ একটা গভীর শ্বাস ছেড়ে তিনি বীথিকার দিকে তাকালেন, ‘‘মেয়েটাকে কেন গত কয়েকমাস বাইরে দেখতে পাওয়া যায়নি এবার বুঝতে পারলেন ম্যাডাম?’’

বীথিকা তখনো বিস্ফারিত চোখে তাকিয়েছিল পুঁটলিটার দিকে৷

অরণ্য বললেন, ‘‘নিজের ছেলের কুকীর্তি ঢাকতে মেয়েটাকে বন্দি করে রেখে দেওয়া হয়েছিল৷ বেচারিকে বাড়িতেই মনে হয় প্রসব করানো হয়েছিল৷’’

ঠিক এইসময়েই ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢুকল থানার সেই সুবল নামের পুলিশটা, ‘‘মেয়েটার খোঁজ পাওয়া গেছে৷ নৈহাটির দিকে গঙ্গায় ভেসে উঠেছে বডিটা৷ সুইসাইড কেস স্যার৷ কাল বেলার দিকে কয়েকজন ঝাঁপ দিতে দেখেছিল৷ জল পুলিশ বলে একটু দেরি হল৷ এখান থেকেই যাবেন তো?’’

‘‘মিনু আর নেই?’’ একটা আর্ত চিৎকার শুনে ওরা চমকে তাকিয়ে দেখল ঊর্মিলা বসুর স্বামী থরথর করে কাঁপছেন, চোখে জল, ‘‘আমি বারণ করেছিলাম ঊর্মিকে, এভাবে ছেলের পাপ ঢাকতে যেয়ো না৷’’ কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে বয়স্ক মানুষটার শরীর, ‘‘কম কষ্ট দিয়েছে মেয়েটাকে? পাঁচ মাস হয়ে গিয়েছিল, লুকিয়েও অ্যাবরশান করাতে পারেনি, তাই সারাদিন না খাইয়ে রোজ রোজ ভারী জলের বালতি দুহাতে ধরিয়ে লাফ দিতে বাধ্য করাতো৷ আমি কত বারণ করেছি, শোনেনি! ওষুধ, জড়িবুটি, শেকড়বাকড়!’’

অরণ্য কড়া গলায় বললেন, ‘‘আপনি জেনেও থানায় জানাননি কেন? বাচ্চাটা কি বাড়িতেই জন্মেছে?’’

ভদ্রলোকের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছিল, ‘‘হ্যাঁ৷ জন্মানোর আগেই মরে গিয়েছিল বাচ্চাটা৷’’ কথাটা বলেই তিনি হাউমাউ করে ঊর্মিলা বসুর জ্ঞান ফেরাতে চেষ্টা করলেন, অজ্ঞান স্ত্রীর গায়ে জোরে জোরে ঠেলা দিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘‘দেখলে ঊর্মি? দেখলে? সারাক্ষণ মেয়েটাকে কত কষ্ট দিতে, বাবুকে বাঁচাতে এত লুকোছাপা করলে, দেখলে মিনু কেমন তোমার সর্বস্ব রাখার জায়গাতেই ওরও সর্বস্বটুকু রেখে দিয়ে চলে গেল? তখনই বলেছিলাম দড়ি এতজোরে টেনো না, ছিঁড়ে যাবে৷’’ কাঁদতে কাঁদতে ভদ্রলোক থেবড়ে বসে পড়লেন মাটিতে৷

অরণ্য আর দেরি করলেন না, ‘‘এই, এদের দুজনকে অ্যারেস্ট করো শিগগির, আর ছেলেটার খোঁজ লাগাও যে করে হোক!’’

বীথিকার বারবার চোখ চলে যাচ্ছিলো মৃত ছোট্ট একরত্তি দেহটার দিকে, অবসন্ন শরীরে মনে হচ্ছিল ও টলে পড়ে যাবে এখুনি৷

তার মধ্যেই গোদরেজের লোকটা একটা স্টিলের কৌটো নিয়ে এগিয়ে এল অরণ্যর দিকে, ‘‘এটাও ছিল স্যার লকারটায়!’’

অরণ্য কৌটোটা খুলেই বিড়বিড় করলেন, ‘‘গয়নার বাক্সটা তাহলে হাতও দেয়নি মিনু! আর দিয়েই বা কি করতো!’’

সুবল যেতে গিয়েও ফিরে তাকালো, ‘‘শালা কে ভদ্দরলোক আর কে ছোটলোক!’’

************

মাস তিনেক বাদে দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গার ঘাটে যখন অরণ্য তাঁর বিশাল বাইকটা নিয়ে এলেন, বীথিকা তখন উদাস চোখে গঙ্গায় সূর্যাস্ত দেখছিল৷ এপার থেকে ও দেখতে পাচ্ছিল কেমন ভাবে ওপাড়ে ঊর্মিলা বসুদের বিশাল বাড়িটার পেছনে আস্তে আস্তে চাপা পড়ে যাচ্ছে কমলা রঙের সূর্যটা৷

ওর হঠাৎ মনে হল, অস্ত যাওয়া সূর্যের মতই দুটো তরতাজা প্রাণকে ঊর্মিলা বসু আর তার ছেলে শেষ করে দিয়েছে৷

এতদিন পরেও ওর চোখটা আবার ছলছল করে উঠল ওর অপরিচিতা সেই মিনু বলে মেয়েটার জন্য৷ সেই শয়তান ছেলেটাকে কয়েকদিনের মধ্যেই পুলিশ ধরে ফেলেছিল৷ ওদের বাড়ির পেছনের ঘরে মিনুর প্রসবরক্তের দাগ তখনো পুরোপুরি মিলোয়নি৷

সবই আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়েছিল৷ মিনু প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েছে বুঝতে পেরে ঊর্মিলা বসু প্রথমে অনেক চেষ্টা করেছিলেন যাতে ওর মিসক্যারেজ হয়ে যায়৷ তারপর কিছুতেই কিছু না হতে পেছনের ঘরটায় শেষ কয়েকমাস পুরোপুরি গৃহবন্দি করে রেখে দিয়েছিলেন মেয়েটাকে৷ পাড়ার লোকেরাও যাতে ওর অস্তিত্ব টের না পায়, সেইজন্যই চলত তারস্বরে গান৷ তারপর সেদিন রাতে সেই ঘরেই প্রসব করানো হয়৷ পুলিশের ধারণা, মৃত বাচ্চা দেখে ঊর্মিলা বসু আর তার ছেলে প্ল্যান করেছিল পরের দিন সকাল হলেই কিছু একটা করবে, কিন্তু তার মধ্যেই ভোরে মিনু কোনোভাবে বেরিয়ে পড়ে বাড়িটা থেকে৷

বীথিকা শুধু ভাবে, কয়েকটা শয়তানের জন্য মিনু নিজের জীবনটা কেন শেষ করে দিল! পালালোই যখন, থানায় গিয়ে খুলে বলতে পারতো সব৷ পরক্ষণেই এটাও মনে হয়, এ দেশে টাকার জোর যার, আইনও তারই৷ মিনু একা গরীব মেয়ে, ও গিয়ে থানায় বললে কিছুই হতনা৷ তাই এভাবেই মেয়েটা ঊর্মিলা বসুর বংশধরকে ঊর্মিলা বসুরই মহামূল্যবান সম্পত্তির মধ্যে রেখে দিয়ে নিজেকে শেষ করে দিয়েও অপরাধীদের ধরিয়ে দিয়ে গেল৷

মা হয়ে নিজের সন্তানের প্রতি কয়েকমাস ধরে হয়ে চলা লাঞ্ছনা সে আর সহ্য করতে পারেনি৷

বীথিকার এখনো অবাক লাগে, ঊর্মিলা বসু একজন মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সঙ্গে এইরকম করতে পারল?

অরণ্যকে ও রোজ এই নিয়ে অনুযোগ করে, ওদের যেন চরম শাস্তি হয়৷

অরণ্য বাইকটা পার্ক করিয়ে সোজা হেঁটে এলেন৷ সেই ঘটনার পর থেকে দুজনের ফোনে নিয়মিত কথা হলেও এইভাবে দেখা এই প্রথম৷ তবে, এই কয়েকমাসে ওরা নিজেদের অনেকটা কাছাকাছি এসে গিয়েছে৷

অরণ্য যদিও আজ পুলিশি পোশাক পড়ে আসেননি, তবু তাঁর হাঁটাচলার মধ্যে এমন একটা দৃপ্ত ভঙ্গি আছে যে সবার মধ্যে আলাদা করে চোখে পড়ে৷ বীথিকার পাশে বসে পড়ে অরণ্য বললেন, ‘‘আজ চার্জশিট ফাইল করে এলাম৷ ছ’টা কেস দিয়েছি ইনক্লুডিং তিনশো দুই৷ ছেলেটা একটা চিজ, জেলের লপসি খেয়েও এখনো তড়পে যাচ্ছে জানো!’’

বীথিকা চোখ সরিয়ে অরণ্যর দিকে তাকালো, কমলা রঙের উজ্জ্বল টিশার্টে আর সবুজ নরম দাড়িতে আজ অরণ্যকে ঠিক একটা কলেজ পড়ুয়া মনে হচ্ছে৷

বীথিকার দৃষ্টিতে নিঃসঙ্কোচ কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠল৷

অরণ্য যখন আছে, মিনু বিচার পাবেই৷

সূর্যাস্তকে সাক্ষী রেখে প্রবল ভরসায় ও অরণ্যর হাতটা জড়িয়ে ধরল৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *