৪. চতুর্থ পর্ব : ল্যাগ্রেন্স

চতুর্থ পর্ব : ল্যাগ্রেন্স

২২. বিগ ব্রাদার

…আমাদের ছোট ডলফিনটার জন্য দারুণ সুখবর তো! আমি শুধু কল্পনাই করতে পারি ওটার বাবা মা ওটাকে বাড়িতে আনার পর ক্রিস কতটুকু খুশি হয়েছে। ভিডিওটা দেখার সময় আমার সাথীদের আহ-উহ কল্পনা করতে পারবে তুমি। ক্রিস বসে আছে ওটার পিঠে আর বাকিরা চক্কর মারছে চারদিকে। ওরা আমাকে এটার নাম রাখতে বলেছে শুটনিক। কারণ স্পুটনিক সাথীও-আবার একটা উপগ্রহও। আসলে যে যেটা নিয়ে থাকে তার চিন্তার পরিধি এর বাইরেই যায় না।

স্যরি, শেষ মেসেজটা পাঠানোর পর অনেক দেরি করে ফেললাম। তবু প্রচার মাধ্যমগুলো হয়ত আমাদের করা বিরাট কাজটার ব্যাপারে ধারণা দিয়েছে তোমাকে। এমনকি ক্যাপ্টেন তানিয়া অর্লোভা পর্যন্ত বাতিল করে ওর সব শিডিউল। দরকার না পড়লে কেউ কোনো কাজই করেনি। আমরা শুধু ঘুমিয়েছি তখনি যখন আর জেগে থাকতে পারিনি। প্রত্যেকে। কীভাবে এ সময় মেসেজ পাঠাই বল?

মনে হয় আমাদের সবাই যা করেছি তা নিয়ে গর্ব করতে পারি সারা জীবন। দুই শিপই কাজ করছে। হালের উপর প্রথম পরীক্ষাও শেষ। দু দিনের মাঝেই জেনে যাব ওকে বিশ্বাস করা যায় কিনা। গেলে বিগ ব্রাদারের সাথে মিলনের সময় ডিসকভারির দায়িত্বটা ওকেই দেয়া হবে।

…প্রথমে এ নামটা কে দিয়েছে আমি জানি না। রাশিয়ানরা পছন্দ করছে–বোঝাই যায়। ওরা আমাদের টি এম এ ভিত্তিক নামও পছন্দ করে না। টাইকো। চৌম্বকীয় বিশৃঙ্খলা নামটা নাকি মানায় না। কয়েকবার আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে, এটা টাইকো থেকে মাত্র কয়েকশ কোটি কিলোমিটার দূরে আর এখানে কোনো ম্যাগনেটিক অ্যানোম্যালির কথা ওঠেনি। একমাত্র মিল হল আকার আর গঠনে। এও টি এম এ-১ এর মতোই।

জিজ্ঞেস করলাম কোনো নাম পছন্দ-ওরা বেছে নিয়েছে জাগাদকা। জাগাদকা মানে এনিগমা-রহস্যময় সমাধা-আসলে এনিগমার অর্থ এনিগমাই। অবশ্যই দারুণ নাম। সমস্যাটা কোথায় জানো? আমি যখন জাগাদকা উচ্চারণ করলাম না? সবাই হেসেছে। বুঝতেই পারছ আমি তাই বিগ ব্রাদারেই লেগে থাকব।

জিনিসটাকে যা-ই ডাকো না কেন, আর মাত্র দশ হাজার কিলোমিটার। কয়েক ঘণ্টার বেশি লাগবে না যাত্রা শেষ করতে। কিন্তু তোমাকে বলতে ইতস্তত করব না-আসলে এই পুরো অভিযানের মধ্যে সবাই যে জার্নিটাকে ভয় পেয়েছে আজ পর্যন্ত–এটাই সেই যাত্রা।

আশা করি কোনো না কোনো নতুন খবর পাব ডিসকভারির বুকে। এটাই আমাদের একমাত্র ব্যর্থতা যা আশা করেও পাইনি আমরা। ডেভ বোম্যান সেই স্ত টার মুখোমুখি হওয়ার অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন হয়েছে হাল। এ নিয়ে তার কোনো স্মৃতি নেই; স্বাভাবিক। বোম্যানতো যাওয়ার সময় সাথে করে সব রহস্যই নিয়ে গেল। শিপের লগ আর অটোম্যাটিক রেকডিং সিস্টেমে কোনো তথ্যই নেই-এটাতো আর আগে জানতাম না।

একমাত্র যা আমরা পেয়েছি তা হল মায়ের জন্য রেখে যাওয়া বোম্যানের চিঠি, একেবারেই ব্যক্তিগত জিনিস। ভেবে অবাক হয়েছি কেন পাঠায়নি। বোঝাই যায় ও ভাবেওনি যে যাচ্ছে চিরদিনের জন্য। সমস্যা আছে আরো। বৃহস্পতির জগৎ যত বড়ই হোক, আটকে যাওয়া বস্তুতো পাক খাবে। আমরা ঠিকই ধরে ফেলতাম বোম্যানের পোডটাকে। অবশ্য যদি কোনো উপগ্রহের উল্কা না হয়ে থাকে অথবা বৃহস্পতির শক্তিকে দোলনা করে সৌর জগতের বাইরে একটু ঘুরতে না গিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রেও ভরসা থাকে। ওর পোডের ইঞ্জিনের যেমন ঐ কৌণিক ভরবেগে ঘোরার ক্ষমতা নেই তেমনি ওটার কম্পিউটারের পক্ষেও হিসাব করে সেই বাঁকা পথটা বের করার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

অবশ্যই, মিসেস বোম্যানের সাথে যোগাযোগ করেছি। তিনি একটা নার্সিং হোমে। ফ্লোরিডার কোথাও না কোথাও। কিন্তু এখন আর এ মেসেজ তাঁর কাছে। কোনো অর্থই বয়ে নেয় না।

এটুকুই সব খবর আজকের মতো। আমার পক্ষে বলা সম্ভব না তোমাদের কেমন মিস করি… কেমন মিস করি পৃথিবীর নীল আকাশ আর সবুজ বন। এখানকার সব রঙই লাল গোত্রের। কমলা, হলুদ। মাঝে মাঝে অবশ্যই দারুণ সূর্যাস্তের মতো। কিন্তু ঐ বর্ণালীর পেছনের হাড় জমিয়ে ফেলা শীত প্রত্যেককে অসুস্থ করে তোলে।

তোমাদের সবার জন্য আমার রাশি রাশি ভালবাসা। যখনই পারব কল করব। যখনই পারি।

২৩. মিলনমেলা

নিকোলাই টার্নোভস্কি লিওনভের কন্ট্রোল এবং সাইবারনেটিক্স এক্সপার্ট। একমাত্র সেই ডক্টর চন্দ্রের সাথে নিজের মতো করে কথা বলতে পারে। যদিও হালের প্রধান স্রষ্টা ও মানসিকতার নির্মাতা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে তার কাজে নাক গলাতে দিতে, তবু তার শরীরের দুর্বলতা তাকে বাধ্য করেছে অন্য কারো সাহায্য স্বীকার করতে। একটা অস্থায়ী জোট গড়েছে রাশিয়ান আর ইন্দো আমেরিকান মিলে। অবাক ব্যাপার, জোটটা কাজ করছে চমৎকার। এর বেশিরভাগ কৃতিত্ব ভাল স্বভাবের ক্রু নিকোলাইয়ের পাওনা। সে কীভাবে যেন সময়মতো বুঝেছে যে এবার চন্দ্র টার্নোভস্কির প্রয়োজন অনুভব করবে। অথচ সে সময় চন্দ্র একা থাকতে চেয়েছে আরো বেশি। নিকোলাইয়ের ইংরেজি যে শিপে সবচে খারাপ তা তেমন গুরুত্ব পায়নি। কারণ আছে, পুরোটা সময় তারা কম্পিউটারের বিভিন্ন শব্দ আর ভাষা ব্যবহার করেছে, বাকি কারও পক্ষে তাতে নাক গলানো অসম্ভব।

এক সপ্তাহের ধীর আর সতর্ক পুননির্মাণের পর হালের সব রুটিন আর যত্ন নেয়া হচ্ছে ঠিকমতো। সে এখন একজন মানুষের মতো-যে একটু আধটু হাঁটতে পারে, সাধারণ কাজ আর কম হলেও কিছু পরিশ্রম পারে দিতে; যে নিম্নস্তরের কথাবর্তায় থাকতে পারে ব্যস্ত। মানুষের হিসাবে বলতে গেলে তার সাধারণ জ্ঞান আর আই কিউ পঞ্চাশ ভাগ; তার আসল ব্যক্তিত্বের অতি সামান্যই ধরা দিয়েছে এ পর্যন্ত।

হাল এখনো ঘুমের মাঝে হাঁটে। কিন্তু চন্দ্রের দাবী অনুযায়ী সে এখনি ডিসকভারিকে উড়িয়ে নিয়ে বিগ ব্রাদারের কাছাকাছি মিলনমেলা বসিয়ে দিতে পারবে।

আরো সাত হাজার কিলোমিটার উপরে উঠে নিচের জ্বলন্ত দোজখটাকে এড়াতে সবাই উদগ্রীব। এস্ট্রোনমিক্যাল হিসাবে নিতান্তই তুচ্ছ দূরত্ব, কিন্তু দান্তে বা হিরোনিমাস বসের লেখার মতো একটা পরিবেশকে ছেড়ে যেতে এটাই তাদের জন্য বহুদূর, প্রায় স্বর্গের কাছাকাছি। সবচে ভয়াল বিস্ফোরণগুলো এখনো শিপের আশপাশে আসতে পারেনি। কিন্তু ভবিষ্যতে যে আসবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আইওতে হরদম বিস্ফোরণগুলো নতুন রেকর্ড করার মতলব আঁটে; আজ যেখানে সালফারের মৃদু স্তর পড়তে পারে কাল সে স্থানটা চলেও যেতে পারে সেসব ভয়ের গর্ভে।

শুধু কার্নো আর চন্দ্র শিপে ছিল যখন হালের হাতে ডিসকভারিকে ছেড়ে দেয়া হয়। খুবই সীমিত নিয়ন্ত্রণ, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ তো! সে তার মেমোরিতে দেয়া প্রোগ্রামটাকেই বার বার চালিয়েছে-তারপর দেখেছে এর কাজ করার ক্ষমতা। অন্যদিকে মানব-কুরা দেখেছে তাকে। একটু এদিক সেদিক হলেই পদক্ষেপ নেবে।

প্রথম প্রজ্বলন চলল দশ মিনিট ধরে; এরপর হাল রিপোর্ট করল যে ডিসকভারি ট্রান্সফার অর্বিটে চলে এসেছে। লিওনভের রাডার আর অপটিক্যাল ট্র্যাকিং সেটা নিশ্চিত করার সাথে সাথে শিপটা নিজেকে নিয়ে গেল একই কক্ষপথে। পথের ব্যাপারে ছোট দুটো সংশোধনের তিন ঘণ্টা পনের মিনিট পরে দু শিপই প্রথম ল্যান্সে পয়েন্ট এ হাজির হয় যেটাকে লোকে বলে এল ওয়ান বা ল্যাগ্রে ওয়ান। সাড়ে দশ হাজার কিলোমিটার উঁচুতে সেই রেখার উপর অবস্থিত-যেটা আইও আর বৃহস্পতির কেন্দ্রের যোগাযোগ সরলরেখা।

হাল নিঃসন্দেহে দারুণ কাজ দেখিয়েছে; কিন্তু চন্দ্র তার খাঁটি মানবিক সন্তুষ্টি এমনকি খুশি গোপন করার চেষ্টা করেনি একটুও। কিন্তু এর মধ্যেই বাকি সবার চিন্তা ঘুরে গেছে অন্যদিকে বিগ ব্রাদার, এলিয়াস জাগাদকা মাত্র শত কিলোমিটার দূরে!

এমনকি এত দূর থেকেও জিনিসটাকে পৃথিবীর আকাশে চাঁদের চেয়ে বড় দেখায় এবং আশ্চর্যজনকভাবে এর ধারগুলো একেবারে নিখুঁত। নিখুঁত জ্যামিতিক গঠন। পেছনে মহাকাশ রেখে একে দেখার চেষ্টা করলে লাভ নেই, দেখা যাবে না। কিন্তু সাড়ে তিন লাখ কিলোমিটার নিচের দৌড়াতে থাকা বৃহস্পতির রঙিন মেঘের কারণে দেখা যায়। বেশ স্পষ্ট। মেঘগুলো বেশ গর্ব করেই যেন বলছে, একবার আমাকে দেখ, দেখবে মন আরেকবার দেখতে চায়-এবং দেখতেই হবে। কারণ চোখে এর বিস্তার-সৌন্দর্যের কোনোটাই মাপা যায় না। মাঝে মাঝে বিগ ব্রাদারকে দেখলে মনে হয় না যে জিনিসটা বৃহস্পতির সাড়ে তিন লাখ কিলোমিটার উপরে ভাসছে; মনে হয় গ্রহরাজের বুকে বসিয়ে দেয়া বিরাট কোনো শিকারের ট্র্যাপোের।

এমনটা মনে করার কোনো কারণই নেই যে একশ কিলোমিটার দশ কিলোর চেয়ে নিরাপদ বা হাজার কিলোর চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ; এ দূরত্বটা ক্রুদের কাছে প্রথম পরীক্ষা আর পর্যবেক্ষণের জন্য ঠিক মনে হয়েছে। ব্যাপারটা মানসিক। এতদূর থেকে শিপের টেলিস্কোপ জিনিসটার কয়েক সেন্টিমিটার পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখতে পারে-কিন্তু কিছুই দেখার নেই। বিগ ব্রাদারের উদয় হয়েছে একেবারে অবাক পথে। এর গঠন বিশ্লেষণ করা বা টেলিস্কোপ দিয়ে আরেকটু আভ্যন্তরীণ গঠন দেখা সম্ভব না। এর গঠন যা দিয়েই হোক না কেন তা মহাকাশের বিশাল বিশাল বিস্ফোরণের শিকার হয়েছে; মসৃণতায় একচুল নড়চড় হয়নি।

দূরবীনের আইপিসে চোখ রেখে সেটাকে দেখে সেই চাঁদের মতোই অনুভূতি হল ফ্লয়েডের। যেন মেঘ উঠে এসে সেই কৃষ্ণবস্তুকে ছুঁয়ে যাচ্ছে; যেমন দশ বছর আগে তার গ্লাভ পড়া হাত ছুঁয়েছিল চাঁদের স্তম্ভটাকে। টাইকো মনোলিথকে একটা প্রেশারাইজড ডোম দিয়ে ঢেকে না দিলে সে কি আর খালি হাতে ছুঁয়ে দেখতে পেত।

কোনো পার্থক্য নেই; তার কখনো মনে হয়নি যে সে ছুঁয়ে দেখেছে টি এম এ ওয়ান। তার আঙুলের ডগাগুলো যেন কোনো অদৃশ্য বাঁধার সামনে পিছলে গেল। যত জোরে সে চাপ দেয়, তত বেশি আসে প্রতিরোধ। কে জানে, বিগ ব্রাদারও একই আচরণ করতে পারে।

এত কাছে আসার আগে তাদের যন্ত্রে আর মনে যতোটা কুলায় তার সব পরীক্ষাই করেছে; রিপোর্ট পাঠিয়েছে পৃথিবীতে। একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ সম্পূর্ণ নতুন অচেনা কোনো বোমা নিষ্ক্রিয় করার সময় যেমন অনুভব করে তাদের অনুভূতিও একই। যেটুকু বলতে পেরেছে তা হল, সবচে ভাল রাডারগুলোও শুধু একটা অকল্পনীয়, অপার্থিব… হয়ত অ-মহাজাগতিক কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় এর সংকেত দিচ্ছে!

প্রথম চব্বিশ ঘণ্টায় তারা প্রভাব ফেলে না এমন সব যন্ত্র দিয়ে চালিয়েছে কাজ-যেমন টেলিস্কোপ, ক্যামেরা, প্রতি ওয়েভলেংথ এ সেন্সর। ভ্যাসিলি অর্লোভ জিনিসটার মাত্রা মাপার কাজ হাতে নিয়ে অবাক হয়েছে, সেই সে ১:৪:৯! সেই ছ তল ওয়ালা বস্তুর সবচে সরল, সবচে সুদৃশ্য, সবচে সহজ গাণিতিকতা। বিগ ব্রাদারেরও আনুপাতিক চেহারা হুবহু টি এম এ ওয়ানের মতো-শুধু এটা দু কিলোমিটারের বেশি লম্বা; চাঁদের বুকে থাকা এর ছোট ভাইয়ের চেয়ে এটা সাতশো আঠারো গুণ বড়।

এরপরে সেই চিরাচরিত গাণিতিক রহস্যতো আছেই, মানুষ বছরের পর বছর ধরে সেই ১:৪:৯ অনুপাত নিয়ে চালাচ্ছে তর্ক-এ তিন সংখ্যা হল প্রথম তিন মৌলিক সংখ্যার বর্গ, তাও একের পর এক। যতদূর বোঝা যায়, এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার না; এবার এ তর্কে আরো প্রবল যুক্তি পাওয়া যায়।

আর পৃথিবীতে মেসেজ যাওয়ার সাথে সাথে গণিতবিদ আর গাণিতিক পদার্থবিদরা তাদের কম্পিউটারের সাথে খুশি মনে শুরু করেছে খেলা; উঠে পড়ে লেগেছে অনুপাতটাকে প্রকৃতির মূল গঠনের সাথে মিলিয়ে নিতে-আলোর গতি, পোটন-ইলেক্ট্রন ভরের অনুপাত, দৃষ্টিনন্দন গঠনের ধ্রুব মান… খুব দ্রুত তাদের সাথে যোগ দিয়েছে একদল নিউমেরোলজিস্ট, ভবিষ্যৎ-গণক, অতিন্দ্রীয়বিদ যারা এর মধ্যেই দ্য গ্রেট পিরামিডের১৫ উচ্চতা, স্টোনহেঞ্জের১৬ কেন্দ্রের মাঝ দিয়ে যাওয়া রেখার দৈর্ঘ্য আর ইস্টার দ্বীপের অবাক করা ব্যাপার, নাজকা লাইনের কৌণিক উচ্চতার রেখাগুলো নিয়ে হল্লা করে মরছে। এগুলোর সাথে ভবিষ্যতের কোনো একটা সম্বন্ধ পাতাতে পারলেই তাদের চলে যায়। তারা বিন্দুমাত্র অবাক হয়নি যখন ওয়াশিংটনের একজন বিখ্যাত ভঁড় বলেছিল যে উনিশো নিরানব্বইয়ের একত্রিশে ডিসেম্বর পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে। অবশ্য যারা বিশ্বাস করেনি তারাও অনেক উদ্বেগ নিয়ে দিনটার জন্য অপেক্ষা করেছিল।

মস্ত শিপদুটো যে তার এলাকায় এসে বসে আছে তা দেখার জন্য বিগ ব্রাদার বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়। এমনকি রাডার বিমের সাহায্যে যখন একে পরীক্ষা করছে তখনো না… রেডিও পালসের সাহায্যে যখন এর আশপাশটায় বিস্ফোরণের চেয়ে ভয়াবহ শব্দ করছে তখনো না। আশা করা হয়েছিল যে এসব চললে কোনো বুদ্ধিমত্তা হয়ত সাড়া দেবে একই পথে।

দুটো হতাশ করা দিনের শেষে মিশন কন্ট্রোলের অনুমতি নিয়ে শিপগুলো দূরত্ব অর্ধেক করে নিল। পঞ্চাশ কিলোমিটার দূর থেকে বিগ ব্রাদারকে পৃথিবীর আকাশে চাঁদের ব্যাসের চেয়ে চারগুণ বড় লাগছে-যথেষ্ট বড়, কিন্তু এখনো মানসিক বিকার আনার মতো দেখায় না। এখনো সে বৃহস্পতির সাথে পাল্লা দেয়নি, গ্রহরাজ দশগুণ বড়। এবং হঠাৎ করেই মিশনের পরিস্থিতি ভয় থেকে সরে গিয়ে অধৈর্যের দিকে মোড় নিল।

ওয়াল্টার কার্নো নিজের স্বভাব অনুযায়ী বলে বেড়াচ্ছে, আমাদের চলে যেতে হবে কয়েক দিনের মধ্যেই… বিগ ব্রাদার সম্ভবত আর মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছর অপেক্ষা করতে চাইছে।

২৪. সতর্ক দৃষ্টি

ডিসকভারি পৃথিবী ছাড়ার সময় সাথে করে তিনটা ছোট ছোট স্পেস পোড নিয়ে এসেছে যাতে যে কোনো সময় স্পেস স্যুট পড়ার মতো সহজেই এগুলো ব্যবহার করে মহাশূন্যে একটা ছোটখাট ঘোরাঘুরি সেরে ফেলতে পারে। একটা পোড এক্সিডেন্টে হারিয়েছে ফ্র্যাঙ্ক পোলকে সাথে নিয়ে-যদি ওটা এক্সিডেন্ট হয়ে থাকে। টি এম এ-২ ডেভ বোম্যানকে টেনে নেয়ার সময় অন্যটা সাথে ছিল; সেটার একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে ডেভ বোম্যানের শরীরের মতো। তৃতীয় পোডটা আজো ডিসকভারির মহাকাশ গ্যারেজে সেই গ্যারেজ। পোড বে।

পোড নম্বর তিন (যেটাকে সব যুক্তি না মেনে ম্যাক্স নাম দিয়েছে নিনা-এমনকি নামটা বসিয়েও দিয়েছে। অথচ কোনো কারণই নেই এ নামের।) আরেকটা ই ভি এর জন্য বেরিয়েছে এখন।

ডেভ বোম্যান ওর দারুণ কর্তব্যপরায়ণতার জন্যই এক অসাধারণ সুযোগ পেয়ে যায়। এর সুবিধাটুকু না নেয়া বোকামিই হবে। নিনাকে একটা রোবট প্রোবের মতো ব্যবহার করে বিগ ব্রাদারকে পরীক্ষা করে ফেলা যায়। একটা মানব জীবনও ঝুঁকিতে থাকবে না। এটা শুধুই থিওরি। কেউই শিপের প্রতি সম্ভাব্য আসতে থাকা আঘাতের কথা বাতিল করতে পারে না। সবচে বড় কথা, মহাজাগতিক দূরত্বে পঞ্চাশ কিলোমিটার মাপার মতো কোনো দূরত্বই না যেখানে পুরো সৌর জগৎ ধূলিকণার সমান!

অবহেলার অনেকগুলো বছর পেরিয়ে নিনা এখন একেবারেই নোংরা। শূন্য জি তে উড়তে থাকা ধুলার অস্তিত্ব প্রকাশ পায় ঐ কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ সৃষ্টির পরপর। মহাজাগতিক কণার পরত জমেছে সবখানেই। ডিসকভারির উজ্জ্বল শরীরটা আজকে একেবারেই মলিন।

ডিসকভারির মূল দেহ থেকে ডানা বেশি জোরে ঘোরার কারণে ধারণ করেছে। স্রেফ কালো রঙ। আর মানব জাতির প্রতিনিধি ডিম্বাকার ভিউপোর্টটাকে একটা অন্ধ চোখের চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না। কিন্তু এর আরেকটা সুবিধা আছে। নিচের বিশাল আগুন এত বছরেও ক্ষতি করতে পারেনি। ওটার ছাইই দিয়েছে আবরণ। ছোট আকার আর কম গতি এর উদ্দেশ্যপূরণেও সাহায্য করে।

প্রথমে শুধু ভিউপোর্টকেই বিগ ব্রাদারের কাছে পাঠানোর কথা ছিল খালি হাতে। পরে নিনার কথা মনে পড়ে সবার। এও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, নিনা যদি ওর নখগুলো আগে বাড়িয়ে ষাঁড়ের মতো দৌড়ে আসে তাহলে ওরাও জীবন বাঁচাতে দৌড়ে বেড়াবে।

দু ঘন্টার আলসে ঘোরাঘুরির পর নিনা বিশ্রামের জন্য ঐ বিরাট আয়তাকার স্ল্যাবটার এক কোণার একশো মিটার দূরে থামল। হাতের কাছ থেকে দেখা টিভি চিত্রেও ঐ জিনিসটার আয়তনের কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কৃষ্ণ বস্তু না পাওয়ার যে হাহাকার বিজ্ঞানীদের মধ্যেওটা বোধহয় এবার পুরণ হল। টিভি ক্যামেরাগুলো বোধহয় নিচের চৌকোণা অসীম কালোর কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। নিনার যন্ত্রপাতিগুলোও বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের বা তেজস্ক্রিয়তার কোনো লক্ষণ দেখায় না। না-একটা কিছু পাওয়া গেছে। একটা কিছু। এ দানব দয়া করে সূর্যরশ্মির কোটি কোটি ভাগের এক ভাগ ফিরিয়ে দিচ্ছে। তার মানে এটাও দ্য পারফেক্ট ব্ল্যাক বডি নয়। নাহ।

পাঁচটা মিনিটের বিশ্রাম শেষে হ্যালো, আমি এখানে। শুনেই যেন নিনা আবার নতুন উদ্যমে খোঁজ শুরু করল। এবার প্রথমে একদম সূক্ষ্মভাবে, তারপর একটু স্কুল, আর তারপর একেবারে পুরোটার প্রতি দৃষ্টি দিল পঞ্চাশ মিটার উপর থেকে। কিন্তু অবিশ্বাস্য ব্যাপার হচ্ছে, জিনিসটাকে যত কাছ থেকেই দেখা হোক না কেন-একই রকম। কোনো দাগ নেই, নেই ভাগ। কোনো উঁচু-নিচুর ব্যাপার নেই। আচ্ছা, যদি এটাকে আণবিক বিশ্লেষক মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখা হয়, তবু কি পরমাণুগুলোকে আলাদা আলাদা ভাবে দেখা যাবে না? বোধহয়-ভাবল কার্নো। কারণ নিনা মাঝে মাঝে এর পাঁচ মিটারের মধ্যেও নেমে গেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মিশনটা একেবারে বিরক্তিকর হয়ে গেল। সবাই চলে গেছে যার যার কাজে। মাঝে মাঝে শুধু ইচ্ছা হলে এক পলক দেখে যায়।

এ-ই সব। বাঁচা গেল, অবশেষে মুখ খুলেছে ওয়াল্টার কার্নো, নিজের স্থানে নিনা ফেরার পর, যাক, আমরা এ কাজটায় বাকি জীবন কাটাতে পারতাম। তবে ছোটখাট একটা বাজি ধরতে পারি-এরচে বেশি কিছু শিখতাম না। এমন মিষ্টি নামের পোডটাকে কী করব? বাড়িতে ফিরিয়ে আনব?

না। বলল ভ্যাসিলি, লিওনভ থেকে সার্কিটে ঢুকতে ঢুকতে, বিরাট মুখের ঠিক সামনা সামনি দাঁড় করাও ওটাকে। তারপর বিশ্রাম দাও-ওহহা ভাল কথা, একশো মিটার দূরত্ব রেখে। এবার রাডারের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে ওই জায়গাতেই পার্ক করাও।

নো প্রব্লেম-আশা করি এর কিছু গতি বাকি আছে। কিন্তু ঐ পয়েন্টটা কোথায়?

আমার কলেজের এস্ট্রোনমি কোর্সের কয়েকটা এক্সারসাইজের কথা এই মাত্র মনে পড়ল। একটা অসীম সমতল প্লেটের গ্র্যাভিটিশনাল আকর্ষণের কেন্দ্র বের করা। কোনোদিন ভুলেও ভাবিনি যে হাস্যকর অসীম সমতল কোনো জিনিস বাস্তবে পেয়ে এ কাজটা প্রয়োগ করার সুযোগ আসবে। নিনার গতিবিধি কয়েক ঘণ্টা দেখে আমি অন্তত জাগাদকার ভর ১১৯ বের করতে পারব। সমস্যা হল, ভর থাকতে হবে। না থাকলে বের করে কোনো লাভ আছে বলে মনে হয় না। আমি ভাবা শুরু করেছি। যে, ওখানে কিছুই নেই।

বোঝার সহজ পথ আছে একটা। আস্তে ধীরে আমাদের তাই করতে হবে। নিনাকে সরাসরি এগিয়ে গিয়ে ওটাকে ছুঁতে হবে।

এর মধ্যেই করে ফেলেছে।

কী বলতে চাও? ক্ষেপে গিয়ে প্রশ্ন করল কার্নো, আমি ওটাকে কন্ট্রোল করছি। আর পাঁচ মিটারের মধ্যে নিইনি।

তোমার ড্রাইভিং ক্ষমতাকে ছোট করে দেখছি না-কিন্তু এটা প্রথম বারের হিসাবে খুবই কাছাকাছি ছিল। আর পাঁচ মিটার খুবই কম, ঠিক না?

মানে?

কাছাকাছি থাকার সময় প্রতিবার প্রাস্টার ছাড়ার পর এটা জাগাদকায় ধাক্কা খেয়েছে-হয়তো।

একটা মাছি হাতির গায়ে টোকা মেরেছে?

সম্ভবত। সোজা কথায় আমরা জানি না। কিন্তু ভাল হয় কী করলে জানো? আমরা এখনো এর থেকে দূরে দেখেই ও-ও আমাদের সহ্য করছে। কিন্তু আমাদের গাধা বানানো পর্যন্ত অপেক্ষা করবে…মনে হয়।

ও না বলা প্রশ্নটা ঝুলিয়ে রাখল বাতাসেই। এর আগে কীভাবে একজন মানুষ প্রায় এমন একটা আয়তাকার স্ল্যাবকে বিরক্ত করেছিল? আর এদের রাগটা ঠিক কীভাবে প্রকাশ পায়?

২৫. ল্যাগ্রেন্স থেকে দেখা

এস্ট্রোনমি সব সময়ই এসব অদ্ভুতুড়ে আর অর্থহীন হঠাৎ ঘটা ব্যাপার স্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায়। এর মধ্যে সবচে বিখ্যাত যেটা সেটা নিয়ে সবাই কোনো না কোনো তত্ত্ব দাঁড় করাতে চেয়েছে। আবার অনেকেই বলেছে যে এটা হঠাৎ ঘটা ঘটনা। পৃথিবীর তের লক্ষগুণ বড় সূর্য আর পঞ্চাশ ভাগেরও এক ভাগ চাঁদ। কিন্তু এ দুটোকেই পৃথিবী থেকে একেবারে একই ব্যাসের দেখায়।

এই এখানেও, এল ওয়ান মুক্ত বিন্দুতে যেখানটাকে বিগ ব্রাদার তার মহাজাগতিক বস্থানের জন্য বেছে নিয়েছে সে জায়গাটা বৃহস্পতি আর আইওর মাঝের মাধ্যাকর্ষণের সবচে পোক্ত জায়গা। আর মজাটা হল, এখানে এই গ্রহ আর উপগ্রহ দুটো ঠিক একই রূপ নিয়ে দেখা দেয়। একই ব্যাসার্ধে।

কী দারুণ আকৃতি! সূর্য আর চাঁদের আধ ডিগ্রি বিস্তৃতি নয়, বরং তাদের ব্যাসের চেয়ে চল্লিশ গুণ বড়। আর আর এলাকার হিসাব রাখলে তা মোলশ গুণ। এই আকৃতিটা মনকে ভয় আর বিস্ময়ে ডুবিয়ে দিতে যথেষ্ট। দৃশ্য একেবারে অপার্থিব।

বেয়াল্লিশ ঘণ্টা পর পর ওরা পর্যায়ের একটা চক্র পূর্ণ করে। এ চক্রটার শুরু ধরা যায় যখন বৃহস্পতি পূর্ণ আর আইও নতুন-সে অবস্থা থেকে। অথবা উল্টো। যখন গ্রহটা সূর্যকে ঢেকে ফেলে তখন এর রাতের অংশই শুধু দেখা দেয় কালো চাকতি হয়ে রাতের নক্ষত্রদের পরাজিত করে দিয়ে। মাঝে মাঝেই এ কালো রাতকে ধারালো করে তোলে ভয়ানক বৈদ্যুতিক ঝড়-বজ্র। বহু পলের জন্য। পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি ভয়াল চেহারা নিয়ে আসে বিজলির এসব চমক।

আকাশের আরেক প্রান্তে দৈত্য মনিবের দিকে সব সময় মুখটা ফিরিয়ে রেখেছে আইও। যেন লাল আর কমলার তপ্ত কড়াই। মাঝে মধ্যে হলুদ লাভারা উঠে আসে কোনো এক অগ্নিগিরি থেকে আবার থিতিয়েও যায় সময় মতো। বৃহস্পতিতেও ঘটে; তবে এরচে দ্রুত। আইও একটা ভৌগোলিক চেহারা বিহীন দুনিয়া। এর চেহারা যুগে যুগে পাল্টায়। বৃহস্পতিরটা দিনে দিনে।

আইও চলে গেছে কক্ষের শেষ কিনারায়। আর ছড়ানো, বিশাল সব পতীয় মেঘ ঝিকিয়ে উঠছে অনেক দূরের ছোট্ট সূর্যের আলোয়। যদি কখনো বৃহস্পতির উপর আইও বা আর কোনো উপগ্রহ বড় হয়ে দেখা দেয় তাহলে প্রতি ঘূর্ণনে দেখা যাবে গ্রহ আকৃতির বিশাল হ্যারিকেন দ্যা গ্রেট রেড স্পটকে। ঝড়টা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলছে যদি সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ ধরে না চলে থাকে।

এসব আশ্চর্যের মাঝে পড়েই লিওনভের ত্রুরা দু একটা জীবন পার করে দিতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা হল, বৃহস্পতি জগৎ ওদের প্রাধান্যের তালিকার সবচে নিচে বসে আছে। বিগ ব্রাদারই এক নম্বরে। যদিও বিগ ব্রাদারের মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূর দিয়ে শিপ দুটো ওড়াউড়ি করছে তবু ক্যাপ্টেন তানিয়া বাতিল করে দিয়েছে দু শিপকে এক করার আবেদন।

আমি আরো অপেক্ষা করতে চাই… ও বলল, যে পর্যন্ত সময়মতো দ্রুত পালানোর প্রস্তুতি না নিচ্ছি। এখন বসে বসে শুধু অপেক্ষা করব-যা করার করব আমাদের লঞ্চ উইন্ডো খুলে যাওয়ার পর।

অবশেষে নিনা বিগ ব্রাদারের উপর ল্যান্ড করল। পঞ্চাশ মিনিটের মুক্ত পতনের পর। এর ফলেই ভ্যাসিলি বের করেছে এর ভর। দশ লাখ টনের চেয়েও কম, মাত্র সাড়ে ন লাখ। আশ্চর্য! ঘনত্ব বড়জোর বাতাসের সমান! এবার সবাই ধরে নিয়েছে যে এটা ফাঁপা আর ভিতরে যে কোনো জিনিসকে ধরে রাখতে পারে সহজেই। যদি ও চায়। অথবা প্রথম আন্দাজটাই ঠিক, এখানে এ জিনিসের নিজের কোনো ভর নেই। শুধু যে বাতাসটুকু ছিল প্রথমে এ এলাকায় তারই ভর এটা। এর অর্থও একই। এর ভিতরে যে কোনো কিছু ঢুকে যাবে। হয়ত।

প্রতিদিনের হাজার বাহ্যিক কাজ আছে যা তাদের এ চিন্তা থেকে সরিয়ে রাখতে পারে সার্থকভাবে। লিওনভ আর ডিসকভারি দুটোতেই তাদের কাজের নব্বই ভাগ কেড়ে নিয়েছে ঘরদোরের কাজকর্ম। এর কারণ আছে যথেষ্ট। এ দুই শিপ একটা স্থিতিস্থাপক সংযোগ পথের মাধ্যমে একত্র হয়েছে এবার। সুবিধার সাথে সাথে বেড়ে গেল কাজও।

কানো ক্যাপ্টেন অলোভাকে নিশ্চিত করেছে হঠাৎ করে ডিসকভারির করাসেলের নষ্ট হওয়ার বা কারো দখলে চলে যাবার কোনো আশাই নেই। তাই এখন দুটো এয়ার প্রেশার দরজা খোলার মাধ্যমেই এক শিপ থেকে অন্যটায় যাওয়া যায়। স্পেসসুট আর সময় নষ্ট করা ই ভি এগুলোর কোনো দরকারই নেই। একমাত্র ম্যাক্স অসন্তুষ্ট কারণ ও বাইরে না যেতে পেরে আর ঝাড় শলা ব্যবহার না করে যার পর-নেই অতৃপ্তি পায়।

ব্যাপারটা শুধু দুজনের উপর কোনো প্রভাবই ফেলেনি। চন্দ্র আর টার্নোভস্কি। ওরা এখন ডিসকভারির বাসিন্দা। রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা কেউ না কেউ কথা বলছেই হালের সাথে।

কখন তুমি রেডি হয়ে যাবে একেবারে? দিনে একবার হলেও এ প্রশ্নটা শুনতে হয় হালকে ওদের মুখ থেকে। আলাদা আলাদা-ব্যক্তিগতভাবে। ওরা দুঃখ বুকে চেপে রেখে কাউকেই জানাত না কবে নাগাদ ঠিক হতে পারে হাল। ও রয়ে গেছে এক আস্ত বোকাটে মানুষের মতো।

আর বিগ ব্রাদারের সাথে মুখোমুখির ঠিক সপ্তাখানেকের মাথায় সবাইকে চমকে দিয়ে ডক্টর চন্দ্র ঘোষণা করল, আমরা প্রস্তুত।

ডিসকভারির ফ্লাইট ডেকে শুধু দুই মহিলা ডাক্তারই অনুপস্থিত। কারণ ওদের জন্য কোনো জায়গা নেই। লিওনভের মনিটরে বসে বসে দেখেছে দৃশ্যগুলো। চন্দ্রের ঠিক পেছনেই ফ্লয়েড, তার আগ্রহ আছে অবশ্যই-কাছাকাছি থাকার আরো বড় একটা কারণও থাকে। কার্নো ওটাকে বোধহয় উপযুক্ত নামই দিয়েছিল দৈত্যঘাতক। ওর হাত ওটার কাছে কাছেই ঘোরে।

আমাকে আবার জোর দিয়ে বলতে দাও, বলল কম্পিউটার বিজ্ঞানী, এখানে কোনো-কথা-চলবে-না। তোমাদের উচ্চারণ ওকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেবে। কথা বলতে হলে শুধু আমিই। বোঝা গেল? চন্দ্র তাকায় শব্দ করে। ও এখন উত্তেজনার শেষ প্রান্তে। আজ কণ্ঠ এমন একটা অধিকার নিয়ে চিৎকার করছে যা এর আগে কেউ উপলব্ধিও করেনি। তানিয়া সবখানে বস হতে পারে-কিন্তু এখানে ও মাস্টার।

উপস্থিত জনতা নগ্ন অনুমতি জানায়। তাদের সবাই কোনো হ্যান্ডহোল ধরার জন্য ঝামেলা করছে অথবা ভাসছে চারদিকে।

ডক্টর শিব শুভ্ৰমানিয়াঁ চন্দ্রশেখরাম পিল্লাই একটা অডিও সুইচ বন্ধ করে। স্পষ্ট, কিন্তু দ্রুত বলে, গুড মর্নিং, হাল।

একটা মাত্র মুহূর্ত-ফ্লয়েডের মনে হচ্ছে বছরের পর বছর গড়িয়ে যাচ্ছে আশপাশ দিয়ে। এবার, জবাবটা, কোনো ছোটকালে খেলা নির্বোধ যন্ত্রের নয়।

সৃষ্টি জগতের প্রথম বুদ্ধিমান মানবীয় কম্পিউটার হাল নহাজার জবাব দিয়েছে।

শুভ সকাল, ডক্টর চন্দ্র।

আগের কাজগুলো আবার করতে পারবে?

অবশ্যই। আমি পুরোপুরি কর্মক্ষম। সবগুলো সার্কিট কাজ করছে দারুণ।

আমি কয়েকটা প্রশ্ন করলে কিছু মনে করবে নাতো?

মোটেই না।

ই এ পঁয়ত্রিশ এন্টেনা ইউনিটের নষ্ট হওয়ার কথা তোমার মনে পড়ে?

এখন একেবারেই না।

চন্দ্রের আদেশ ছাড়াও সবার মধ্যেই একটা টান টান উত্তেজনা আর নিরাপদ ব্যগ্রতা দেখা গেল। এটা মাইন পোতা মাঠে পা টিপে টিপে হাঁটার মতো-ভাবল ফ্লয়েড যখন ও রেডিও কাট অফের গায়ে চড় মেরে উপস্থিতি বুঝে নিচ্ছে। প্রশ্নের ঐ ধারা যদি অন্য পথে যায়, সাথে সাথেই হালকে খুন করবে। (বহুবার প্র্যাকটিস করে করে পদ্ধতিটা আয়ত্তে এনেছে সে। কিন্তু একটা সেকেন্ড কম্পিউটারের জন্য গুনে শেষ করা যায় না এমন বিশাল সময়। এটাই কম্পিউটারের জন্য সুবর্ণ সুযোগ।

ফ্র্যাঙ্ক পোলের এ ই পঁয়ত্রিশ ঠিক করতে বাইরে যাওয়ার কথাও মনে নেই?

না। এ ব্যাপারটা সম্ভবত হয়নি-হলে আমার মনে পড়ত। ফ্র্যাঙ্ক আর ডেভ কোথায়? এরা কারা? আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই চিনতে পারছি না… তবু। পঁয়ষট্টিভাগ সম্ভাবনা আছে তোমার পেছনের লোকটার ডক্টর হেউড ফ্লয়েড হওয়ার।

চন্দ্রের কথা মনে পড়াতেই ফ্লয়েড হালকে অভিনন্দন জানানো থেকে বিরত থাকল। এক দশক পরেও চেনার ব্যাপারে পঁয়ষট্টি এক বিরাট স্কোর।

মন খারাপ করো না হাল। আমি পরে সবটাই ব্যাখ্যা করব।

মিশন শেষ? জানোতো, আমি এর জন্যই সবচে বেশি উদ্বিগ্ন।

শেষ মিশনটা। নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তোমার সব প্রোগ্রাম। এখন তুমি যদি আমাদের একটু ক্ষমা কর তো নিজেরা কথা বলতে পারি।

অবশ্যই।

চন্দ্র বন্ধ করে দেয় মূল অংশের শব্দ আর চিত্রের ইনপুট। এর আছে এক বিরাট তাৎপর্য। শিপের এ অংশের জন্য হাল এখন অন্ধ আর বধির।

ভাল; এটুকুই সব? জানতে চাইল ভ্যাসিলি অর্লোভ।

এর মানে হল-আমি… বলল চন্দ্র ঠাণ্ডা মাথায়, আমি সমস্যা শুরু হওয়ার সময় থেকে শেষ পর্যন্ত হালের সবটুকু স্মৃতি মুছে ফেলেছি।

অবাক কণ্ঠ শাসার, কীভাবে করলে?

মনে হয় যততক্ষণে এটা ব্যাখ্যা করতে পারব মুছেছি তারচে অনেক কম সময়ে। আর মুছতে তেমন সময় লাগেনি।

চন্দ্র, আমি একজন কম্পিউটার এক্সপার্ট-যদিও তোমার আর নিকোলাইয়ের মতো না। নহাজার সিরিজের কম্পিউটারগুলো হলোগ্রাফ মেমরির; তাই না? তুমি কিন্তু ক্রমান্বয়িক সাধারণ ইরেজার ব্যবহার করতেই পার না। শুধু পরজীবী আক্রমণকারী পোকা-এক কথায় ফিতাকৃমির ব্যবহারে এ কাজ সম্ভব যা খুঁজে পেতে শুধু নির্ধারিত শব্দ আর বর্ণ সরিয়ে দেবে।

আক্রমণকারী পরজীবী পোকা? প্রশ্ন করল ক্যাথেরিনা। শিপের ইন্টারকমের মধ্য দিয়ে, আমি ভেবেছিলাম ওই কাজকর্ম শুধু আমার। আমি বলতে গর্ববোধ করি যে ঐ জান্তব ফিতাকৃমি অ্যালকোহলের বোতলের বাইরে কখনো দেখিনি। তোমরা আবোলতাবোল বকছ নাতো?

কম্পিউটারের শব্দ, ক্যাথেরিনা। আগেকার দিনে অনেক আগে-মানুষ স্মৃতির জন্য চৌম্বকীয় টেপ বা ফিতা২১ ব্যবহার করত। আর এমন একটা প্রোগ্রাম বানিয়ে নেয়া সম্ভব যা শুধু ধ্বংসের কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। সোজা কথায় সব খেয়ে ফেলবে। যে অংশটুকু তুমি চাও। সম্মোহনের দ্বারা তুমি কি ঐ একই কাজ মানুষের উপরও ফলাতে পার না?

হ্যাঁ, কিন্তু সব সময় উল্টো ফল হবার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। আসলে মানুষ কখনো সত্যিকার অর্থে কোনো কিছু ভোলে না। আমরা শুধু ভাবি যে ভুলে গেছি।

একটা কম্পিউটার এ পথে কাজ করে না। যখন কিছু ভুলে যেতে বলা হয় তখন ভুলে যায়। তথ্যটুকু পুরোপুরি গাপ করে দেয়া হয়েছে।

সুতরাং হালের ঐ… অস্বাভাবিক অবস্থার কোনো স্মৃতিই নেই?

আসলে আমি এ ব্যাপারটায় একেবারে শতভাগ নিশ্চিত হতে পারছি না। চন্দ্র নির্দ্বিধায় বলে যাচ্ছে। কম্পিউটারের বিষয়েই শুধু সবাই ওর সাথে সব সময় কথা বলতে পারে-জগতের আর কোনো বিষয়ে নয়, কিছু মেমরি থাকতে পারে যা টেপওয়ার্ম সার্চ করার সময়… এক সার্কিট থেকে আরেকটায় চলে যায়। কিন্তু খুবই কম।

ভয়াবহ। বলল ক্যাপ্টেন অর্লোভা, যখন একই কথা চুপ করে থেকেও সবাই ভাবছে, কিন্তু আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল-ও আবারও মিথ্যা বলতে পারবে নাকি?

চন্দ্র উত্তর দেয়ার আগে ফ্লয়েড তাকেই আশা করল। তার আরো একটা কাজ আছে যা কেউ জানে না। চন্দ্রের ব্যাপারে তাকে কাঠখোট্টা অফিসিয়াল ভাষায় রিপোর্ট করতে হবে একটু পর।

ঠিক একই সেট পরিস্থিতি আবার আসবে না। কোনোদিন না। আমি কসম খেতে পারি। পুরো বিষয়টা এমন ঘোলাটে হওয়ার কারণ হল কম্পিউটারের কাছে নিরাপত্তা আর প্রাধান্য শব্দ দুটো ব্যাখ্যা করা বাস্তব ক্ষেত্রের চেয়ে অনেক কঠিন।

অথবা মানুষের কাছে। মুখ টিপে হাসল কার্নো। মোটা দাগের খোঁচাটা চন্দ্রের গায়ে লাগা উচিত।

আশা করি তুমিই ঠিক। কোনো মূল্যই দেয়নি তানিয়া কার্নোর কথায়, পরের ধাপটা কী, চন্দ্র?

তেমন জটিল কিছুই না-শুধু খুব লম্বা। এখন আমরা তাকে বৃহস্পতি ছাড়ার হিসাব নিকাশ করতে প্রোগ্রাম করব। এরপর ডিসকভারিকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে বলব। তিন বছর পর আবার ফিরতে যাচ্ছি আমাদের প্রচণ্ড গতির অর্বিটে।

২৬. যাচাই

প্রতি: ভিক্টর মিলসন,

চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাস্ট্রোনটিক্স,

ওয়াশিংটন।

হতে : হেউড ফ্লয়েড, ইউ এস এস সি ডিসকভারি।

বিষয়: মহাকাশযানের কম্পিউটার হাল ন হাজার এর অস্বাভাবিক অবস্থা।

গোপনীয়তার শ্রেণী : অত্যন্ত গোপনীয়।

ডক্টর চন্দ্রশেখরামপিল্লাই (পরে সবার কাছে ডক্টর সি নামে পরিচিত।) প্রাথমিক পরীক্ষা শেষ করেছেন বৃহস্পতিতে আটকে পড়া হাল- নাইন থাউজ্যান্ড সিরিজের কম্পিউটারটার উপর। তিনি সব হারানো মডিউল প্রতিস্থাপিত করার পর জানান যে সার্কিটগুলো পুরোমাত্রায় সচল। ডক্টর সি আর টার্নোভস্কির কথা জানা যাবে তাঁদের দুজনের দেয়া রিপোর্টেই।

অন্যদিকে, কাউন্সিলের স্বার্থে আপনি আমাকে ওদের ওপর একটা নন টেকনিক্যাল ভাষায় সারমর্ম প্রকাশ করতে বলেছিলেন। অন্তত নতুন সদস্যদের স্বার্থে যারা আজও এসব টেকনিক্যাল টার্মের পুরো কথা বুঝে উঠতে পারেননি।

ফ্রি মনেই বলে ফেলি-আমার মনে হয় এ কাজটা করতে নাও পারি, কারণ আপনি জানেন আমি একজন কম্পিউটার স্পেশালিস্ট নই। কথা দিচ্ছি, তবু আমার সাধ্যানুযায়ী সবচে ভালটুকু করে ফেলব।

ঐ সমস্যার মূল ডক্টর সি ও অন্যরা ধরে ফেলতে পেরেছেন। হালের মৌলিক নীতি নির্ধারণের সাথে নিরাপত্তা ব্যবস্থার নীতির অসামঞ্জস্য দেখা। দেয়ায় এ সমস্যা হয়েছিল। সরাসরি দেয়া আদেশ অনুসারে, টি এম এ এক এর অস্তৃিত্ব গোপন করে রাখাটা ছিল একেবারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়। শুধু জরুরি প্রয়োজনে তাদের জানানোর অনুমতি দেয়া ছিল।

যখন টি এম এ এক খুঁড়ে বের করা হয় তার কয়েকদিন আগেই .. ডিসকভারির বৃহস্পতির দিকে যাত্রার চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। এটাকে আরো নিশ্চিত করে টি এম এ এক তার সিগনাল বৃহস্পতির দিকে পাঠিয়ে। যেহেতু মূল কুরা (বোম্যান ও পোল) শুধু এটুকু জানত যে, শিপকে নিয়ে যেতে হবে লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে নতুন উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু বলা হবে না। অনুসন্ধানকারী দলকে (কামিনস্কি, হান্টার, হোয়াইটহেড) আলাদা ট্রেনিং দিয়ে তিনজনকেই অভিযান শুরুর আগে আগে হাইবারনেশনে পাঠিয়ে মনে করা হয়েছিল যে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেছে। আর এ কারণেই নিরাপত্তার ফাঁক-ফোকড়ের সম্ভাবনা (অ্যাকসিডেন্ট অথবা আর যাই হোক) বেড়ে গেছে দারুণভাবে।

আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, ঐ সময়ে (ভবিষ্যতের জন্য রাখা আমার তথ্য এন সি এ তিনশো বিয়াল্লিশ তেইশ) টপ সিক্রেট ০১.০৪.৩০) আমি নীতিটার বিরুদ্ধে অনেক কথা তুলেছিলাম-এমনকি অবজেকশনও-যাই হোক, ওগুলোকে উচ্চ স্তর থেকে বাতিল করা হয়।

মানব সহায়তা ছাড়াই হাল পুরো মিশন চালাতে সক্ষম হওয়াতে ওকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যাতে মানব ক্রুদের অনুপস্থিতি, অপারগতা বা মৃত্যুতেও ও মিশন শেষ করতে পারে। এ কারণেই সব তথ্য তাকে দেয়া হয়। কিন্তু এসব ডাটা বোম্যান অথবা পোলের কাছে প্রকাশের অনুমতি দেয়া হয়নি।

এ পরিস্থিতি হালের ডিজাইনের উদ্দেশ্যের সাথে খাপ খায় না। তথ্যের বিকৃতি অথবা গোপনীয়তা ছাড়া প্রসেসিং হল তার ডিজাইনের ভিত্তি। এ কারণেই হালের ভিতরে বাসা বেঁধেছে যাকে মানবিক ভাষায় বলা হয় সাইকোসিস১২৩-আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে সিজোফ্রেনিয়া।

ডক্টর সি আমাকে প্রাযুক্তিক পদ্ধতিতে জানিয়েছেন যে, হাল হটাটার মোবাস ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থাটা উন্নত কম্পিউটারের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষ করে যেগুলো নিজে নিজে উদ্দেশ্যে জড়ানোর জন্য প্রোগ্রামড়। তিনি বলেছেন যে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য স্বয়ং প্রফেসর হটাটারের সাথে যোগাযোগ করলেই আপনাদের জন্য ভাল

এটাকে পরিষ্কারভাবে বসাতে হলে বলতে হয়, (যদি আমি ডক্টর সি কে বুঝে থাকি) ও জটিলতম-বলা ভাল অসহ্য দ্বিমুখীতায় পড়ে গিয়েছিল যেটা তার সব কাজে দিয়েছে বাঁধা। এমনকি এমন প্যারানোয়ায়২৫ ভুগছিল যে, পৃথিবী থেকে তার কাজ মনিটরিংয়ের বিরুদ্ধে যেতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। সাথে সাথেই মিশন কন্ট্রোলের সাথে রেডিও যোগাযোগ বন্ধ করতে চেয়েছে। প্রথমেই না থাকা কল্পিত একটা সমস্যার কথা রিপোর্ট করেছে এ ই পঁয়ত্রিশ এন্টেনা ইউনিটের ব্যাপারে যাতে যোগাযোগ বন্ধ রাখা যায়।

ব্যাপারটা তাকে শুধু সরাসরি মিথ্যার দিকে ঠেলে দেয়নি বরং সরাসরি আর সব ক্রুর বিপরীতে আরো বিপ্রতীপ করে তোলে। সম্ভবত (আন্দাজ করে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই) তাঁর মতে হালের একমাত্র উপায় ছিল নিজের মানব ক্রুদের হত্যা করা-আর সাফল্যের সাথেই করেছে ওই কাজটা। এ বিষয়ের সবদিকে ঠিকমতো তাকালে বোঝাই যায় ও হয়ত মানুষের নাক গলানো ছাড়াই মিশন চালিয়ে গিয়েছিল।

এটুকুই সব। এরচে বেশি প্রশ্ন করতে মোটেও ইচ্ছা করেনি ডক্টরকে–চাইও না করতে। তিনি নিজের মনোযোগের শেষস্তরে কাজ করছেন। এর পরও যদি আমাকে কিছু করতে বলা হয়, তো (নিশ্চিত জেনে রাখুন, এটা একটা তথ্য।) তিনি একেবারেই সহযোগী মনোভাবের নন।

তিনি সব সময় হালের প্রতি একটা নমনীয় মনোভাব নিয়ে কথা বলেন যা সেসব বিষয় নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে সমস্যা বাড়িয়ে তোলে। এমনকি ডক্টর টানোভস্কি-যাকে সবাই নিরপেক্ষ ভাবতে পারে তিনিও একই দৃষ্টিভঙ্গীতে কাজ করেন বেশিরভাগ সময়।

যাই হোক, একমাত্র গুরুত্ববহ প্রশ্ন হল-আবার হাল মিথ্যা বলতে পারবে কিনা। অবশ্যই ডক্টর সির এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দাবী করেছেন যে ঐ দারুণ সমস্যময় ঘটনা থেকে শুরু করে বিচ্ছিন্ন হওয়া পর্যন্ত হালের সব স্মৃতি এখন লুপ্ত। আর তিনি এবারও বিশ্বাস করেন না যে, হাল আবার এমন কিছু করতে পারে যা মানুষের বিচারে ঠিক নয় বা অপরাধ।

যেভাবেই হোক না কেন, তিনি বলতে চাচ্ছেন যে আগের সে পরিস্থিতি আর ফিরে আসবে না। কারণ সবাই সচেতন। আমরা মেনেও নিয়েছি। শুধু একটা ব্যাপার। যদি ঐ অবস্থা ফিরে আসলেও সে বিপদের কারণ হয়-অথবা সে আবারো কোনো না কোনো ভাবে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে সে আবার ঐ পরিস্থিতিতে পড়বে-তাহলেতো আবারও হাল বিপজ্জনক। নিরাপদ বলার যুক্তি কোথায়? আর হালতো হাজার রকমের অস্বাভাবিকতায় ভোগে। এগুলোর কোনো কোনোটা হাস্যকর, কোনোটা ভয়ংকর। আপনি-আমি জানি; শুধু ডক্টর সি জানেন না-আমি অবশ্য শেষ চালটা আমার হাতেই রেখে দিয়েছি।

মূল কথা: হাল ন হাজার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কাজ দ্রুত সারছে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে। কেউ এটাকে প্রোবেশনও বলতে পারে।

আমার ভয় অন্য কোথাও। সে জেনে ফেললে কী হবে?

২৭. যার যা বিশ্বাস

যেকোনো পরিস্থিতিকে নিজের সাথে মানিয়ে নেয়ার অসীম ক্ষমতা আছে মানব মনের। একঘেয়ে কিছু সময় গেলে অসম্ভবও অপরিহার্য হয়ে যায় মানব মনের জন্য। মাঝে মধ্যেই লিওনভের ক্রুরা তাদের চারপাশটাকে ভুলে যায়-হতে পারে কোনো সচেতনতার পথে অসচেতন পদচারণা।

ডক্টর হেউড ফ্লয়েড প্রায়ই ভাবে এসব পরিস্থিতিতে ওয়াল্টার কার্নো একটু বেশিই খাটাখাঁটি করে সবার মধ্যমণি হয়ে। শাসা কোভলেভ সত্য বিশ্বাস এর পর্ব করার ধারণা দেয় হঠাৎ করেই। তার মনে হয় শাসা নিজেও আগে ভাবেনি এমন কথা। একেবারে হঠাৎ করেই এ মজার মিটিং এসে পড়ে যখন ও জিরো গ্র্যাভিটির উপর চিরকালীন জেদ প্রকাশ করল।

আমি যদি একটা ইচ্ছা পুরো করতে পারতাম, তাহলে, সে নিয়মিত সিক্স ওক্লক সোভিয়েতে বলেছিল-অনেকটা আফসোসের সাথেই, একটা ফেনায় ভরা বাথটাবে ডুবে যেতাম। পাইনের গন্ধে ভুরভুর করত পুরো ঘরটা। আর পানির উপরে থাকত শুধু আমার নাক। উফ! ঘণ্টার পর ঘণ্টা!

সুগন্ধির প্রভাব আর গোসলের হতাশা দুইই চলে যাবার পর ক্যাথেরিনা রুডেঙ্কো চ্যালেঞ্জটা নিল, তোমার চাওয়াটা খুবই ছোট, ওয়াল্টার; আমি পৃথিবীতে ফিরতে পারলে এরচে ভাল কিছু চাইতাম।

যেমন?

হু…আমি কি সে সময়ে ফিরে যাওয়ার অনুমতি পেতে পারি?

ইচ্ছা হলে।

ছোট এক মেয়ে আমি তখন। ছুটির দিনগুলিতে চলে যেতাম একটা সমবায় ফার্মে। তখন জর্জিয়ায় থাকি। এক ইয়া বড় পালমিনো ঘোড়া ছিল ওখানটায়। ডিরেক্টরের আনা। বোঝাই যায় কালো বাজারের পয়সা। একটা আস্ত শয়তান হলেও বুড়োটাকে আমি ভালবাসতাম। বুঝতেই পারো-ও আমাকে আলেকজান্ডারের পিঠে চড়ে সারাটা দেশ ঘুরে বেড়াতে দিত। যে কোনো সময় পড়ে গিয়ে মরে যেতে পারতাম আমি। তবু বসুধাকে স্বর্গ হিসেবে যখনি ভাবি তখনি ওই মধুর স্মৃতি আমাকে তাড়া করে।

একটা দীর্ঘ মুহূর্ত ধরে সবাই নিজের মধ্যে ডুবে গেছে যেন এরপর। কার্নো আরো কাউকে ডাকল, আর কোনো স্বেচ্ছাসেবী?

সবাই মহাকাশের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র ঐ পৃথিবীতে এমনভাবে জমে গেল যে খেলা বন্ধ হওয়ার পথে। এমন সময় ম্যাক্সিম ব্রেইলোভস্কি বদলে দিল গিয়ার, আর আমি অবশ্যই চাইব অতল সাগরে ডাইভিং করতে। এটাই আমার সবচে প্রিয় শখ-একটা ডাইভ দেয়ার সময় পেলেই হল। কসমোনট ট্রেনিংয়ের সময় দারুণ সুখে ছিলাম ঝপাঝাপি চালিয়ে যেতে পারায়। প্যাসিফিকের অতলে ডুব মেরেছি কোরাল সারির মাঝে। অথবা দি গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে,১২০ লোহিত সাগরে। জানো, পৃথিবীর সব সৌন্দর্য ঘাপটি মেরে আছে কোথায়? প্রবাল প্রাচীরে। তবু আমার সবচে মজার অভিজ্ঞতাটা অন্যখানে। এক জাপানি কেল্প বনে। পানির তলায় এক শ্যাওলা ধরা প্রধান গীর্জা যেন! অসীম পাতার উপরে সূর্যের কৃপণ আলো মাঝে মাঝে বয়ে যাচ্ছে উপরের ঢেউয়ের সাথে মিল রেখে। নড়েচড়ে। রহস্যময়…জাদুতে ভরা। আমি হয়ত আর কখনো ফিরে যাব না। পরের বার আর তেমন নাও থাকতে পারে জায়গাটা। কিন্তু ফিরে গেলে ওদিকেই যাব আমি। যাবই।

দারুণ! বলল ওয়াল্টার। স্বভাবতই নিজেকে মধ্যমণি করে রেখেছে, নেক্সট পজিশন কার?

আমি তোমাদের খুব দ্রুত জবাব দেব। বলল তানিয়া অর্লোভা, (বলশোয়ি-রাজহংসের হ্রদ। কিন্তু ভ্যাসিলি রাজি হবে না। বলতে গেলে ও ব্যালে ড্যান্স ঘেন্না করে।

ঠিক আছে। আরো মজা। দুজন দু রকম। কে বলেছে তোমাদের দুজনকে একসাথে পৃথিবীতে গিয়ে একই জিনিসকে সেরা বলতে? ভ্যাসিলি কোনটা বেছে নিচ্ছ?

আমি ডাইভিং বলতে যাচ্ছিলাম। বিধি বাম। ম্যাক্স দখল করে বসেছে। ঠিক হ্যায়, উল্টোটা। গ্লাইডিং। নীরব গ্রীষ্ম দিনের প্রথম সকালটায় মেঘগুলোর ভিতর দিয়ে জায়গা করে নেব নাহয়। নানা, শেষ হয়নি-ডানার উপরে বয়ে যাবে বাতাস। হয়ত চিল্লাচিল্লি করবে যখন তুমি মোড় নাও। পৃথিবীকে উপভোগের এটাই পথ। একটা পাখি হয়ে। পৃথিবীরই উপরে ভেসে ভেসে। সব সময় ওকে সামনে রেখে। যাতে হারিয়ে না যায়।

জেনিয়া?

সোজা। পামিরের উপর দিয়ে কি করে করে যাব। তুষার ভালবাসি।

আর তুমি, চন্দ্র?

পরিবেশ দেখার মতো বদলে গেছে ওয়াল্টারের কথার সাথে। এই এতকিছুর পরেও, এত সময় পরেও চন্দ্র একজন নবাগত। পুরোপুরি দ্র। কখনো কখনো সম্মানও দিচ্ছে অন্যকে। কিন্তু নিজেকে কখনো তুলে ধরেনি সবার সামনে।

যখন আমি ছোট্ট ছেলে, তখন… সে ধীরে বলে যায়, আমার দাদা একটা ধর্মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন বারনসী…বেনারসে। তোমরা যদি কখনো না গিয়ে থাক তো কস্মিনকালেও বুঝবে না। আমার কাছে অনেক ভারতীয়ের কাছে এমনকি আজো-তাদের ধর্ম যাই হোক না কেন, এটাই মহাবিশ্বের কেন্দ্র। একদিন ফিরে যাবার ইচ্ছা ভিতরে ভিতরে রয়ে গেছে।

নিকোলাই, তুমি?

ভাল, আমরা সাগর আকাশ সবই পেয়ে গেছি এর মাঝে। আমি দুটোকেই মিলিয়ে দিতে চাই। উইন্ডসার্ফিং আমার প্রিয় খেলা। জানি এর জন্যে আর উপযুক্ত নই। অনেকটা বুড়িয়ে গেছি। তবু আবার এটাকে খুঁজে পেতেই আমার আনন্দ।

শুধু খুঁজে পাওয়াটাই তোমাকে ছেড়ে গেছে। উডি, তোমার পছন্দ?

ফ্লয়েড ভাবার জন্যেও থামল না। তার মুহূর্তের জবাব আর সবার মতো নিজেকেও অবাক করেছে, পৃথিবীর কোথায় আমি তাতে কিছুই আসে যায় না যদি

আমার পিচ্চি ছেলেটা সাথে থাকে।

এরপর আর সেখানে বলার কিছু ছিল না। কেমন এক নিরবতা চারদিকে। বৈঠক শেষ হল সাথে সাথেই।

২৮. হতাশা

সব টেকনিক্যাল রিপোর্টই দেখেছ তোমরা। দিমিত্রি, আমাদের হতাশার কারণটা অবশ্যই বুঝতে পারছ, স্পষ্ট। আমাদের সব টেস্ট আর গুনাগুনতিতে কিছুই শিখিনি। শুধু সেখানে জাগাদকাকে দেখা যায়, ব্যস। আধখানা আকাশ জুড়ে থেকে আমাদের অবহেলা করেই যাচ্ছে।

আজো এটা নিষ্ক্রিয়-অকর্মা পরিত্যক্ত জিনিস। ভ্যাসিলি পথ বের করেছে একটা। যদি মুক্ত বিন্দুতে থাকতেই চায় তো কোনো না কোনো সক্রিয়তা দেখাতে হবে এবার। নাহয় ডিসকভারির মতো এক কোণা থেকে আরেক কোণায় ঘুরে বেড়াতে থাকবে বৃহস্পতির কোনো না কোনো অর্বিট ধরে। বাকি অংশটা আইওতেই বিস্ফোরিত হবে।

তো, ঠিক পরের কাজটা কী হবে আমাদের? জাহাজে পারমাণবিক বোমা থাকার কথা না। অন্তত জাতিসংঘের সনদ শূন্য আট এর তৃতায় প্যারা অনুসারে। আরে আমি শুধুই ঠাট্টা করছি…

এখন চাপ কম। বাড়ির পথের রওনা এখনো কয়েক সপ্তাহের দূরত্বে। প্রায়ই আমরা সবাই বিরক্তিতে মরে যাই, একই সাথে হতাশায়ও। হেসো না। জানি মস্কোতে বসে তোমার এসব শুনতে কেমন লাগে। কোনো বুদ্ধিমান লোক কেমন করে এখানে আসে সেসব দারুণ জিনিস দেখতে যা দেখে তার সাথীরা ছাড়া আর কোনো মানুষ বেঁচে নেই?

তবু এ নিয়ে কোনো যুক্তি চলে না। আগে আত্মবিশ্বাস যা ছিল আজ আর তা নেই। এখন পর্যন্ত আমরা ভালই আছি। আশ্চর্যজনক ব্যাপার। তবু সবারই একটু ঠাণ্ডা, নাহয় পাকস্থলির গণ্ডগোল, অন্তত চামড়ায় দাগ পড়েছে ক্যাথেরিনার সব পিল আর পাউডারেও যা সারবে না। ও কিন্তু হাল ছেড়ে দিয়েছে। আমাদের সাথে এখন শুধু ওয়াদাই করে।

শাসা আমাদের জন্য একটু সুযোগ করে দিয়েছে কদিন আগে। বুলেটিন বোর্ডে বুলেটিন রেখে হাসাহাসি করা যায়। ওদের থিমটাও মজার নিয়ে এসো রাশলিস!

ও রাশিয়ান আর ইংলিশ ভাষা মিশিয়ে জগাখিচুড়ি করেছে ভয়াবহভাবে। সব সময়ই দাবী করে যে এ দু ভাষারই হঠাৎ শোনা ভুল ব্যবহার করা আরো নানা কিছু হয়ে যাওয়া শব্দ শুনেছে সে। বাড়ি ফেরার সময় আমাদের সবাইকেই নাকি ভাষাটা ঠিক করে নিতে হবে। প্রায়ই তোমার দেশের অনেক লোক দেখেছি যারা ইংরেজি বলেই যাচ্ছে একটুও সচেতন না হয়ে। আরো মজার ব্যাপার হল, ঠেকে গেলেই দেশি কথার ছায়ায় চলে যায়। আরেকদিন নিজের অজান্তেই আমি ওয়াল্টার কার্নোর সাথে কথা বলা শুরু করেছি রাশিয়ানে। ঘটনা অন্যখানে, কেউই কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্যাপারটা ধরতে পারিনি।

আমাদের মনের অবস্থা বুঝবে আরেক দিনের কথা শুনলে। একটা স্মোক ডিটেক্টরের বদৌলতে মাঝরাতে ফায়ার অ্যালার্ম বেজে ওঠে। যাই হোক, বোঝা গেল চন্দ্র নেশার তাড়া খেয়ে ওর একটা বিশাল সিগার পুড়িয়েছে। ভয় পাওয়া স্কুল বয়ের মতো টয়লেটে বসেই টানতে শুরু করেছিল একটা। লজ্জা পেয়েছিল দারুণ। স্বাভাবিক। আর আতঙ্ক কেটে যাবার পর বাকি সবাই ধরে নেয় এ এক ঐতিহাসিক হাস্যকর ব্যাপার। কিছু কিছু সত্যিকার কমদামি কৌতুক থাকে যেগুলো বাইরের লোকের কাছে কিছুই না হলেও উপস্থিত থাকা বুদ্ধিমান মানুষেরাও হাসিতে ভেসে যায়। পরের কয়েক দিন একজন শুধু একটা সিগার ধরানোর ভান করত, বাকিরাও সাথে সাথে…

আরো অদ্ভুত ব্যাপার হল, চন্দ্র যদি কোনো এয়ারলকে ঢুকে যায় অথবা স্মোক ডিটেক্টর বন্ধ করে দেয় তবু কেউ কিছু মনে করে না। কিন্তু ওর সবচে বড় লজ্জা ছিল নিজের ভিতর। ওর একটা অতি সাধারণ মানবিক দুর্বলতা আছে। এটাও হয়ত হালের সাথে যোগাযোগ করে আগের চেয়ে বেশি সময় কাটিয়ে দেয়ার একটা কারণ; সিগার থেকে দূরে থাকা যায়, দূরে সরা যায় আমাদের ঠাট্টা থেকেও।

ফ্লয়েড পজ বাটন চেপে রেকর্ডিং বন্ধ করল। চন্দ্রকে নিয়ে এভাবে মজা করাটা উচিত না। কোনো একদিন এমন কিছু হয়েছে-তবু কাজটা ঠিক না। শেষ কয়েক সপ্তায় ভেসে ওঠা শুরু করে সবার ব্যক্তিত্বের ছোটখাট মজার দিকগুলো। এমনকি কোনো আসল কারণ ছাড়া কয়েকটা ঝগড়াও হয়ে গেছে। এসব দিক থেকে ভাবলে ওর নিজের আচরণ সম্পর্কে কী বলা যায়? এটা কি সব সময় সমালোচনার উর্ধ্বে?

ও এখনো ঠিকভাবে বলতে পারবে না আদৌ কার্নোর সাথে ঠিক ব্যবহার করতে পেরেছে কিনা। কখনোই ঐ বিরাট ইঞ্জিনিয়ারকে অথবা ওর জোর গলাটা ভাল লাগেনি কিন্তু ইদানীং যে ব্যবহার করে তা ঠিক সম্মান দেয়ার ধারে কাছে নেই।

পলিয়োস্কো পলির মতো বিখ্যাত ব্যাপারগুলো হাসি-ঠাট্টায় ভোলার কারণে ওকে রাশিয়ানরা সম্ভবত একদমই পছন্দ করে না। এসব ব্যাপার প্রায়ই কান্নায় শেষ হয়। আর একটা ব্যাপারে ফ্লয়েড অনুভব করল যে ভালবাসা বেশ খানিকটা দূরেই সরে গেছে এ কদিনে।

ওয়াল্টার, ও সতর্কভাবে শুরু করে সেদিন, মনে হয় না এটা আমার কাজের মধ্যে পড়ে, তবু একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার তোমার সামনে তুলতে চাচ্ছি।

কেউ যখন আগেভাগেই বলে তার ব্যাপার না-প্রায় সব সময়ই সে ঠিক। সমস্যাটা কী?

আসলে, ম্যাক্সের সাথে তোমার ব্যবহার…

একটা জমাট নিরবতা চারদিকে। ফ্লয়েড নৈঃশব্দের একপ্রান্ত ধরে রেখেছে দেয়ালের বিশ্রী পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়ে থেকে। এরপর কার্নো এখনো নরম থাকা সুরে বলল, ওর বয়স আঠারোর বেশি ভেবে আমি আসলে অবাক হয়েছিলাম।

ব্যাপারটাকে ঘোলা করোনা। আর খোলাখুলিই বলি, ম্যাক্সের ব্যাপারে না, আমি ভয় পাচ্ছি…জেনিয়াও জড়িয়ে গেল।

কার্নোর ঠোঁটদুটো হঠাৎ চেপে বসেছে। বোধহয় ও অবাক এ কথায়, জেনিয়া? ওর আবার আমাদের সাথে কী দরকার?

যে কোনো বুদ্ধিমানের কাছেই তুমি সহজে হজম হয়ে যাবে-বোকাও বনে যেতে পার। জানো নিশ্চই-ও ম্যাক্সকে ভালবাসে। ম্যাক্সকে জড়িয়ে ধরার সময় কীভাবে তাকিয়েছিল তোমার মনে নেই?

ফ্লয়েড কখনো ভাবেনি কার্নোকে অবাক চোখে তাকাতে দেখবে। আঘাতটা বোধ হয় বেশি হয়ে গেল, জেনিয়া? আমি মনে করেছি প্রত্যেকেই ঠাট্টা করে। ও একটা ছোট ইঁদুরছানা ছাড়া কি না। আর প্রত্যেকেইতো ম্যাক্সের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। এমনকি বিশালদেহী ক্যাথেরিনাও। তবু…হু, আমার মনে হয় আরেকটু সচেতনভাবে চলাফেরা করলেই আমার ভাল হয়। অন্তত জেনিয়া আশপাশে থাকার সময়।

সামাজিক তাপমাত্রা সাধারণ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত একটা লম্বা বিরতি ঝুপ করে নেমে এসেছিল। কোনো অসুস্থ অনুভূতি নেই যে সেটা প্রমাণ করতেই কার্নো কথাবার্তার ঢঙে বলল, তুমিতো জানো, মাঝেমধ্যেই আমি জেনিয়াকে দেখে অবাক হতাম। কেউ একজন ওর মুখে প্লাস্টিক সার্জারির দারুণ কাজ দেখিয়েছে। কিন্তু সবটা ঠিক করতে পারেনি। চামড়া দারুণ টানটান। আর মনেও করতে পারব না কখনো ওর একটা পরিপূর্ণ হাসি দেখেছি কিনা। এজন্যেই বোধ হয় ওর দিকে না তাকানোর চেষ্টা করেছি সব সময়। তুমি কি আমাকে এটুকু সৌন্দর্যে অভিভূত মানুষের মর্যাদা দেবে, হেউড? ওর জন্যে হিংসায় পড়ে আমি ম্যাক্সের সাথে…

পুরোপুরি অন্যরকম ডাক, হেউড টা প্রাতিষ্ঠানিকতা বহন করে। হিংস্রতার বদলে ভদ্রতাই উঠে আসছে ওর তরফ থেকে। ফ্লয়েড নিজেকে একটু সহজ করে নিল, আমি তোমার কয়েকটা আগ্রহের জবাব দিতে পারি-ওয়াশিংটন জানে ব্যাপারটা। বোঝা যায় যে, ও কোনো ভয়ানক এয়ারক্রাশে পড়েও বেঁচে গেছে। এখানে কোনো রহস্যই নেই-যতটুকু আমরা জানি। কিন্তু আজকাল এয়ারক্রাফটে দুর্ঘটনা হওয়ার কথা না।

বেচারি। ওকে স্পেসে আসতে দিয়েছে এটাই আমার প্রথম প্রথম অবাক লাগত। তবু ইরিনার অ্যাক্সিডেন্টের পর একমাত্র ও ই ছিল যোগ্য মানুষ। ওর জন্য দুঃখ হয় আমারো। শারীরিক আঘাতের চেয়ে মানসিক কষ্টটা নিশ্চই বেশি ভয়ংকর।

আমিও নিশ্চিত। কিন্তু এর মধ্যেই কাটিয়ে উঠেছে পুরোপুরি। তুমি পুরো সত্যিটুকু বলছ না-ফ্লয়েড বলছে মনে মনে নিজেকেই, আর কখনোই কাউকে বলবে না। বৃহস্পতির মুখোমুখি হওয়ার পর তাদের সবার মধ্যে একটা বন্ধন গড়ে ওঠে। হয়ত ভালবাসার না-হয়ত শুধু একটু কোমলতা। কিন্তু এর মূল্যই মাঝে মধ্যে অমূল্য। হঠাৎ করেই ও কার্নোর প্রতি নরম হয়ে গেছে-বুঝতে পারে। কার্নোও জেনিয়ার জন্য নিজের উদ্বেগটার কথা ভেবে আশ্চর্য। তবু এটা নিয়ে নিজের কথার পক্ষে কিছু দাঁড় করাচ্ছে না কেউ।

কিন্তু ফ্লয়েড যুক্তি দেখালে বোধহয় ভুল হত না। কয়েকদিন পর ফ্লয়েড নিজেই ভাবতে বসে; ওর আচরণে জেনিয়ার প্রতি নরম মনোভাব বোঝা যায় না তো? কার্নো রেখেছে নিজের ওয়াদা। আসলেই প্রথমে না জানলে যে কেউ ভাববে যে জেনিয়া আশেপাশে থাকায় ও ম্যাক্সকে অবহেলা করে। ও জেনিয়াকে একটু বেশি ভালভাবেই নিচ্ছে। আসলেই বেশ কিছু সময়ে ও মেয়েটাকে জোরে হাসিয়ে ছাড়ে।

তবু নাক গলানোটা সার্থক-এর পেছনের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন। যদি দুর্বলতা হয়েও থাকে, তবু এ হাস্যকর কাহিনীর পিছনে অন্য এক অপরাধী মনকে খুঁজে পাওয়া যাবে সহজেই। এটা ঐ চিরন্তন গুপ্ত হিংসা যা প্রত্যেকেই করে-সম অথবা বিপরীতকামী; সত্যি বলতে গেলে-ফ্লয়েড বুঝতে পারে, ব্যাপারটা বিভিন্নমুখী সমস্যা নিয়ে দারুণভাবে এগিয়ে আসছে সামনে।

ওর আঙুল আবার রেকর্ডারের দিকে ফিরে যায় কিন্তু চিন্তার ধারাটা ভেঙে গেছে এর মধ্যেই। মেঘের মতো ঘনিয়ে আসে পরিবারের খণ্ড খণ্ড ছবিগুলো। ঠেকানো যায় না। চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে স্মৃতি ক্রিস্টোফারের জন্মদিনটাকে ডেকে আনল। বাচ্চাটা কেকের তিন মোমবাতি নেভাতে চাইছে। স্মৃতিটা চব্বিশ ঘন্টার পুরনোও নয়। শুধু শত শত কোটি মাইল দূরের। ও এতবার ভিডিওটা চালিয়েছে যে এখন প্রতিটা নড়াচড়াই মুখস্থ।

আচ্ছা, ক্রিস যেন বাবাকে ভুলে না যায় সে উদ্দেশ্যে ক্যারোলিনা কতবার ওর মেসেজটা প্লে করেছে? নাকি পরের জন্মদিনে যখন ফিরবে তখন ক্রিসের কাছে ও একজন অপরিচিত লোক ছাড়া আর কিছুই হবে না? জিজ্ঞাসা করতেও ভয় পাচ্ছে ফ্লয়েড।

ক্যারোলিনকে ও ঠিক দোষও দিতে পারে না। হাইবারনেশনের কারণে ফ্লয়েডের মনে হয় মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই ক্যারোলিন ছিল ওর কাছে। আর জগৎগুলোর মাঝে ও স্বপ্নহীন ঘুম কাটানোর সময় মেয়েটা দুটা দীর্ঘ বছর পার করে বসেছে। একজন নতুন বিধবা হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এ এক লম্বা সময়; অন্তত ক্ষণিকের জন্য।

ভয় হচ্ছে খুব, একদিন হয়ত পৃথিবীতে নেমে যাব কোনো একটা শিপে করে-ফ্লয়েড কখনো এত হতাশায় পড়ে না, ভেঙে গেলে, হেরে গেলেও না-তারপর দেখব সময় আর দূরত্বের সাগরে কোথায় ভেসে গেছে আমার ঘরবাড়ি! হয়ত হারিয়েই বসেছি নিজের অজান্তে। মিশনে আমার ব্যর্থতার পর…অথবা যদি লক্ষ্যে যেতেও পারি, তবু সামনে কী পাব? কালো, নিরেট কালো একটা দেয়াল।

আর এখনো ডেভিড বোম্যানের সেই চিৎকার সবার মনে, মাই গড! আমার সামনেটা তারায় ভরা!

২৯. জরুরি

শাসা শেষবার কর্তৃত্ব ফুটিয়ে ঘোষণা করল:

রাশলিশ বুলেটিন # ৮

বিষয়: টোভারিশ (টোরিশ২৭)

আমাদের আমেরিকান বন্ধুদের প্রতি:

সত্যি, বন্ধুরা, আমার মনে নেই শেষ কবে আমাকে এভাবে ডাকা হয়েছিল। একুশ শতকের যে কোনো রাশিয়ানের কাছেই যুদ্ধযান পটেমকিন এক স্মৃতি জাগানিয়া নাম। লাল জামা-টুপি আর একই সাথে স্লাদিমি ইলেচের লম্বা বক্তব্যের স্মৃতি। এটা তিনি রেলওয়ের শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে দিয়েছিলেন।

যদিও আমি ছোট ছিলাম, তবু এটা ছেলেখেলা নয়, নয় দ্রুজহক-যাই মনে কর না কেন-তোমাদের ব্যাপার। তোমরা সাদরে আমন্ত্রিত।

কমরেড কোভালেভ।

ফ্লয়েড তখনো পড়তে পড়তে মুচকে হাসছিল যখন ভ্যাসিলি অর্লোভ লাউঞ্জ অথবা

অবজার্ভেশন ডেক থেকে ভেসে এসে ওর সাথে যোগ দেয়।

আমার অবাক লাগছে কী ভেবে জান? টোভারিশ! ইঞ্জিনিয়ারিং আর পদার্থবিদ্যা পড়া ছাড়া আর কিছু করার বা পড়ার সময় পেয়েছে কীভাবে ও? সারাক্ষণই নাটক আর কবিতা থেকে কোটেশন নিয়ে কথা বলে। আমার সন্দেহ ও হয়ত ওয়াল্টারের মতো ইংরেজিও বলতে পারবে।

কারণ ও প্রবেশ করেছে বিজ্ঞানের জগতে। শাসা হল-তুমি ওকে কী বলবে?-পরিবারের গর্ধভ? ওর বাবা ছিলেন নোভোসিবিরস্ক এর একজন ইংরেজির অধ্যাপক। বাসায় একটা পাগলাটে নিয়মও ছিল। সোমবার থেকে বুধবার পর্যন্ত বাসায় রাশিয়ান চলবে। বৃহস্পতি, শুক্র আর শনিবারে ইংরেজি।

আর রবিবার?

আর বলো না! ফ্রেঞ্চ অথবা জার্মান। বিকল্প সপ্তাগুলোও ভয়াল।

এবার বুঝলাম নিকোলটোনি দিয়ে তোমরা আসলে কী বোঝাও। ঠিক একটা গ্লাভের মতো খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। আসলেই কি শাসা ওর নিজের…দুর্বলতার কারণে হীনমন্যতায় ভোগে? আর এমন একটা ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও কেন ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেল?

নোভোসিরভিস্ক পড়লে জানতে পারতে কারা সার্ফ আর কারা অ্যারিস্টোক্রেট। শাসা ছিল এক তরুণ উচ্চাকাতক্ষী। তার আরো একটা প্রাস পয়েন্ট-মেধা।

ঠিক তোমার মতো, ভ্যাসিলি।

এট টু টে! ফাজলামি করো না। তবে ঠিক, আমি শেক্সপিয়র বলতে পারি যেমন পারি বোহে মোয়ি! কিন্তু আবার কী হল?

ফ্লয়েড দুর্ভাগা-বেচারা অবজার্ভেশন উইন্ডোর ভিতরে ভাসতে ভাসতে ঢুকে পড়েছে। তাও ভাল, শুধু পেছনটা! আর কথা বলায় এত বেশি মজে গেছে যে টেরই পায়নি। ব্যাপারটা হাস্যকর। অন্তত ফ্লয়েড ভাবল ওর ক্ষেত্রেও একবার হল হাস্যকর ঘটনা। যথারীতি এটা ছড়িয়ে দেয়ার মহান দায়িত্বটা নিজ থেকেইে কাঁধে নিয়ে নেবে ভ্যাসিলি।

কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরে যখন মুচড়ে ভেতরে ঢুকল ও, অবজার্ভেশন উইন্ডোর ভিতর দিয়ে দেখা যায় বৃহস্পতির বিরাট বৃত্ত। কিন্তু ওটা কোনো ঘটনা না। ঘটনা

অন্য কোথাও। বৃহস্পতির আলোয় বিগ ব্রাদারকে দেখা যাচ্ছে। কেন যেন একটা হিম স্রোত বয়ে গেল ওর শিরদাঁড়া বরাবর। অকারণেই ফ্লয়েড ভাবল একটা কথা।

ওরা আসার পর এই প্রথম বিগ ব্রাদার তার সক্রিয়তা দেখালো। এই প্রথম। এবং শুরু।

হয়ত ভ্যাসিলির স্মৃতিতে চিরদিনের জন্য এটা বসে গেছে। ঐ তীক্ষ্ণ ধারওয়ালা জিনিসটা দেখে একেবারে অন্যরকম, অতিমানবীয় অনুভূতি হচ্ছে যেন। অনুভূতিটা আসলেই ভয়াল হওয়ার কথা। কারণ ওরা মানুষ। আর মানুষের একটা অদ্ভুত গুণ হল, যা না বোঝার, তাও কেমন করে যেন বুঝে যায়। তবু ওরা বোঝেনি অনুভূতিটা কীসের।

কারণ, এর আগে, কখনোই ওদের সামনে অন্য জগৎগুলোর দুয়ার খুলে যায়নি।

দৃশ্যটা এক সেকেন্ডেরও কম সময় ধরে চলল। এর পর ও একটা অনিচ্ছাকৃত পলক ফেলার সাথে সাথেই মিলিয়ে গেল ভোজবাজীর মতো। না। না। হতে পারে না।

ভ্যাসিলি অর্লোভ একটা আকাশ দেখছিল-নাকি একটা এলাকা-হবে কিছু একটা, যাই হোক, দেখেছিল। দেখছিল তারায় ভরা এক জগৎ। না, সূর্যে ভরা। সূর্যে ভরা একটা নীহারিকার মাঝখান। এক কসমিক জোট! ঠিক ঐ মুহূর্তেই ভ্যাসিলি অর্লোভ চিরদিনের মতো পৃথিবীর নীল আকাশকে হারিয়ে ফেলল। ঠিক এখন থেকে ওরা হয়ত অসহ্য আর অসহ্য সব একাকীত্বে, অসহ্য সব শূন্যতায় হারিয়ে যাবে। এমনকি স্করপিও বা বৃশ্চিক নক্ষত্রমালা আর অরিওন এর নিপ্রভ আলোর দিকে বহুকাল তাকিয়ে থাকা যায়। কিন্তু এদিকে…এদিকে একটা মুহূর্তের বেশি নয়। না। ভ্যাসিলি অর্লোভ যদি বেঁচে থাকে, তাহলে সবাইকে জানিয়ে দেবে কেন ডেভ বোম্যান বলেছিল সেই বুক কাঁপানো কথা।

মাই গড! আমার সামনেটা তারায় তারায় ভরা!

ও যখন চোখদুটো খুলতে সাহস পাচ্ছে না তখন আর কিছুই নেই। অবশ্য পুরোপুরি নয়। আবার ঠিক হওয়া পাথুরে কালচে জিনিসটার উপর এক ম্লান সূর্য জ্বলছে এখনো।

কিন্তু ও দেখে থাকলেও একটা সূর্যের পক্ষে নড়াচড়া করা সম্ভব না। আবারো পলক ফেলে নিজের ভেজা চোখটাকে পরিষ্কার করে নিল সে। ঠিক, নড়াচড়া আসলেই হয়েছে। কল্পনা করেনি।

উল্কা নাতো? চিফ সায়েন্টিস্ট ভ্যাসিলি অর্লোভ বিবশ হয়েছিল এত বেশি সময়ের জন্য যে, এটুকুও মনে করতে পারেনি বায়ুশূন্য আকাশে উল্কা পিণ্ড পড়া অসম্ভব। যে কোনো পাথুরে মহাকাশের বস্তু বাতাসের সাথে ঘষা লেগেই উল্কা হয়ে জ্বলতে জ্বলতে পড়ে যায়। জ্বলতে জ্বলতে পড়ে যায়, কিন্তু নিচেই জন্মে না। ওটা আরো হাজারটা সূর্যের সাথে বিগ ব্রাদারের মুখে দেখা দিয়ে নিচেই ঘোরাফেরা করছে একা একা।

একবারের জন্য মলিন হয়ে গেল হালকা আলো হয়ে। আর হৃদপিণ্ডের কয়েকটা ধ ধক্ যেতে না যেতেই হারিয়ে গেল বৃহস্পতির পেছনে।

ভ্যাসিলি একজন শক্ত স্নায়ুর মহাকাশচারী। এর মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে নির্লিপ্ত একজন দর্শক বনে গেল সে।

ওর এর মধ্যেই এ জিনিসটার যাত্রাপথ বোঝা হয়ে গেছে। না। অসম্ভব। ওটা যাচ্ছে পৃথিবীর দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *