৩. তৃতীয় পর্ব : ডিসকভারি

তৃতীয় পর্ব : ডিসকভারি

১২. বৃহস্পতির সীমান্তে

শিপ অবশেষে যাত্রা শুরু করে বৃহস্পতির দিকে। অনেক আগেই মহাকর্ষের Trনিরপেক্ষ অঞ্চল পেছনে পড়ে গেছে। সেখানে ছোট চারটা চাঁদ-সাইনোপ, প্যাসিফা, অ্যানাংক, ও ক্যারমে টলমল করছিল তাদের নিম্নমুখী বন্য ও অদ্ভুত কক্ষপথে। নিঃসন্দেহে অ্যাস্টরয়েড গ্রহাণুপুঞ্জের গ্রহাণু এগুলো। গ্রহরাজ ক্ষমতা খাঁটিয়ে দখল নিয়েছে কোনো এক কালে। আকৃতি অস্বাভাবিক। সবচে বড়টাও আড়াআড়িভাবে মাত্র ত্রিশ কিলোমিটার। চারটাই এবড়োথেবড়ো; ধারালো পাথরের টুকরা। আদতে এরা গ্রহ-নৃতত্ত্ববিদদের ছাড়া আর কাউকে আকৃষ্ট করতে পারে না। তাদের আনুগত্য সূর্য আর বৃহস্পতির মাঝে টলায়মান। একদিন সর্বগ্রাসী সূর্য হয়ত পুরোপুরি দখল করে নেবে এগুলোকে আর সব গ্রহের মতো শুধু নিজের প্ৰজা করে রাখবে।

কিন্তু বৃহস্পতি দ্বিতীয় স্তরের চার উপগ্রহকে ঠিকই নিজের কজায় রাখবে যেগুলো প্রথম চারটার অর্ধেক দূরত্বে দোলায়মান। ইলোরা, লিসিথিয়া, হিমালিয়া ও লিডা সুন্দরভাবেই একে অন্যের কাছাকাছি এবং একই দূরত্বে আবর্তন করছে। মানুষ মনে করে যে, এ চার বোন এক সময় এক ছিল। তাই হয়ে থাকলে মূল দেহটা অন্তত শত কিলোমিটার বিস্তৃত হওয়ার কথা। শুধু ক্যারমে ও লিডা এত কাছে এসেছে যাতে নগ্ন চোখে তাদের একটা চাকতির মতো দেখা সম্ভব। তারা পুরনো বন্ধুর মতো আজো একে অন্যের সাথে মিলে মিশে থাকে।

দীর্ঘতম সাগর অভিযানের পর বৃহস্পতি দ্বীপপুঞ্জের জলসীমায় এই তাদের প্রথম প্রবেশ। শেষের ঘণ্টাগুলো উড়ে পালালো; পুরো অভিযানের জটিলতম স্তর সামনে। বৃহস্পতির অ্যাটমোস্ফিয়ারে প্রবেশ করার মতো জটিল কাজ করতে হবে। এর মধ্যেই বৃহস্পতি পৃথিবীর আকাশের চাঁদের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়। ভিতরের দিকের দৈত্য-উপগ্রহগুলিকে স্পষ্ট দেখা যায় গ্রহরাজের চারপাশে ঘুরতে। তাদের সবাইকে চাকতির মতো দেখায় এমনকি প্রত্যেকে নিজস্ব রঙও প্রকাশ করে যদিও এখনো তারা ঘুরে বেড়ায় দেখা না যাওয়ার মতো দূরত্বে। তাদের মহাজাগতিক ব্যালে নাচ চলছে ভাগ্যপতির পেছনে লুকিয়ে পড়া আর সূর্যের আলোয় বেরিয়ে আসার মাধ্যমে। নাচের সঙ্গী নিজ নিজ ছায়া। এবং এটাই সৃষ্টি জগতের জন্য সেই বুক কাঁপানো চিরন্তন ও স্থায়ী দৃশ্য। এটাই সেই সৃষ্টি, যা চারশো বছর আগে গ্যালিলিও একপলক দেখার পর থেকে আজ পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখে আসছেন। কিন্তু লিওনভের কুরাই একমাত্র জীবিত নর-নারীর দল যারা এ গ্রহকে নগ্ন চোখে দেখেছে। কথাটাকে কি অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? গ্রহরাজ তাকে খোলা চোখে দেখে নেয়ার স্পর্ধা দেখানো কোনো তুচ্ছ মানুষের জীবনই বাঁচিয়ে রাখেন না!

অসীম দাবাখেলা বন্ধ হয় শেষে। ডিউটির বাইরের ঘন্টাগুলো টেলিস্কোপে চোখ রেখে কেটে যায়। অথবা উৎসুক কথোপকথনের ফোয়ারা ছোটায় কুরা। কেউ কেউ মিউজিক শুনে সময় কাটায়। কিন্তু সবার স্থির দৃষ্টি বাইরের অভূতপূর্ব দৃশ্যে। অন্তত শিপে ঠাট্টা চালানোর একটা উপায় পাওয়া গেল, সবাই যখন অবাক চোখে বৃহস্পতির দিকে তাকিয়ে তখন ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কি আর জেনিয়া মার্শেঙ্কো হঠাৎ হাওয়া হয়ে যায় সবার মাঝ থেকে। এজন্য হাল্কা হাসিঠাট্টাও হয়। বেচারারা এত ছোট শিপে নিজেদের মতো করে মিশতে পারে না।

ফ্লয়েড ভাবল, কী অদ্ভুত জুটি! সুদর্শন ম্যাক্স লম্বা, চওড়া, স্বর্ণাভ চুলের অধিকারী একজন চ্যাম্পিয়ন ব্যায়ামবীর। ও দুহাজারের অলিম্পিক ফাইনালে গিয়েছিল। বয়স ত্রিশে পড়লেও ভাবভঙ্গি বাচ্চা ছেলের মতো। এই সব না; উজ্জ্বল ইঞ্জিনিয়ারিং রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও সে প্রায়ই ফ্লয়েডকে নিজের লোকের মতো অস্বাভাবিকভাবে আঘাত করে তেমন আপন লোকের মতো যারা কথা বলার ক্ষেত্রে আমুদে, কিন্তু বেশি সময়ের জন্য নয়। নিজের সর্বস্বীকৃত পটুতার ক্ষেত্রের বাইরেও সে ব্যস্ত থাকে, কিন্তু গভীরভাবে নয়।

ঊনত্রিশ বছরের জেনিয়া শিপের সবচে কমবয়েসী কু। এখনো রহস্যময়। কেউ তার দুর্বলতার কথা তোলার আগ পর্যন্ত ফ্লয়েড কখনো প্রসঙ্গটা তোলে না। ফ্লয়েডের ওয়াশিংটনের সোর্স তাকে এ নিয়ে কিছু জানাতে পারেনি। বোঝাই যায় সে কোনো ভয়ংকর দুর্ঘটনায় পড়েছিল। গাড়ির দুর্ঘটনাই হবে। এরচে অস্বাভাবিক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম। সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে জনপ্রিয় লোকগাঁথার এটা একটা অংশ যে সে এক গোপন স্পেস মিশনে ছিল। এ আশা বাদ দেয়া যায়। গ্লোবাল ট্র্যাকিং নেটওয়ার্ককে ধন্যবাদ, এ ধরনের ঘটনা অর্ধশতাব্দী যাবৎ অসম্ভব। জি টি এন তা ধরবেই। প্রকট শারীরিক ও মানসিক ক্ষত থাকা সত্ত্বেও জেনিয়া খেলেছে আরো কয়েকটা খেলা। সে শেষ মুহূর্তের প্রতিস্থাপিত যাত্রী-সবাই জানে।

ইরিনা ইউকোনিনার খাদ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ এবং মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়ার কথা। কিন্তু চলে এল সে। একটা হ্যাং গ্লাইডার ইউকোনিনার অনেকগুলো হাড় ভেঙে দেয়।

প্রতিদিন জিএমটি৬৭ আঠারোতম ঘণ্টায় সাতজন ক্রু এবং একজন যাত্রী ছোট্ট কমনরুমে একত্র হত। কমনরুমটাই গ্যালি ও স্লিপিং কোয়র্টারগুলোকে ফ্লাইট ডেক থেকে আলাদা করে। বৃত্তাকার টেবিলটা আটজনের গাদাগাদি করে বসার জন্য যথেষ্ট। চন্দ্র আর কার্নো জেগে উঠলে প্রত্যেককে এখানে জায়গা দেয়াটা হবে সমস্যা। অন্য কোথাও বসানো হতে পারে দু সিট।

সিক্স ও ক্লক সোভিয়েত নাম দেয়া হয়েছে এর। প্রতিদিনের গোল টেবিল কনফারেন্স বলা হয় অনুষ্ঠানটাকে। সাধারণত দশ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না। শিপের নিয়ম, কমান্ড আর মানবিকতা বজায় রাখতে বিরাট ভূমিকা রাখে। অভিযোগ, পরামর্শ, সমালোচনা এবং উন্নয়ন প্রতিবেদনের সবই উত্থাপিত হতে পারে ক্যাপ্টেন যদি ভেটো না দেয়। ভেটোর মতো বাজে জিনিসের চর্চা হয় খুবই কম।

আজকের মেনুতে একটা পরিবর্তন আনার আবেদন করা হয়েছে। টেবিলে আলোচ্য বিষয়ের বাইরে জটিল ব্যাপারগুলো আলোচনার জন্যই এ আবেদন। পৃথিবীর সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগের জন্য আরো সময় দেয়ার প্রস্তাব উঠেছে। মহাকাশে ছড়িয়ে আছে প্রচুর আমেরিকান সৈন্যদল। সৈনিকদের সাথে চলচ্চিত্র প্রোগ্রাম, সংবাদ আদান-প্রদান আর গল্পগুজব করার ব্যাপারেও কথা ওঠে।

ব্যাপার-স্যাপারে পরিবর্তন আসতে পারে, ফ্লয়েড তার সহকর্মীদের বলল কার্নো আর চন্দ্র হাইবারনেশন থেকে উঠে এলে। সে তার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপারে বলল না যে, কার্নো জাহাজের অন্য সবার চেয়ে বেশি চেঁচামেচি করতে ও কথা বলতে পারে।

ঘুমানো ছাড়া ফ্লয়েডের বেশির ভাগ সময়ই কাটত কমনরুমে। কিছুটা একারণে-ছোট হলেও এটা অনেক খোলামেলা; অন্তত তার ছোট্ট চৌকোণা ঘর থেকে বড়। সুন্দরভাবে সাজানো। সমস্ত সমতলই ছবি দিয়ে ভরা। সুন্দর ভূমি, সামুদ্রিক ছবি, খেলার ওয়ালপেপার, জনপ্রিয় চলচ্চিত্র তারকা আর পৃথিবীর আর সব সুন্দরের ছবি দিয়ে সাজানো এ ঘরটা।

ঘরের একদিকে ঝুলছে লিওনভের ছবি। ১৯৬৫ সালে তার নিয়ার দ্য মুন স্টাডিটা করা হয়েছিল যখন তিনি একজন তরুণ লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে ভস্কট দু কে ফেলে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যানবিহীন সংক্ষিপ্ত মহাকাশ অভিযান করেন।

স্পষ্ট বোঝা যায় যে মেধাবী অপেশাদার লোক একজন পেশাদারের চেয়ে ভাল কাজ করে। চাঁদের জ্বালামুখময় প্রান্তর, সুন্দর সাইনাস ইরিডিয়াম ও বে অফ রেইনবো দেখে ব্যাপারটা চোখে পড়ে। চাঁদের খাড়া উপরে দানবীয় উজ্জ্বলতায় জ্বলছিল পৃথিবী। নতুন চাঁদের মতো দেখায় এ গ্রহ। বসুধা রাতের দিকের বাকি আঁধার অংশটুকুকে আঁকড়ে আছে। এছাড়াও করোনার আলোক প্রবাহ মহাশূন্যে লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার দূরে পৌঁছে যাচ্ছে সূর্যের আশীর্বাদ হিসেবে। দারুণ লড়াকু কম্পোজিশন। ভবিষ্যতের এক ক্ষণিক আলোও যেন পড়ছে যা তখন থেকেই তিন বছর পরে সত্যি হয়ে যায়।

অ্যাপোলো আটের উড্ডয়নে এন্ডার্স, বর্মণ ও লভেল রাজকীয় দৃশ্যটা খালি চোখে দেখেছিল ক্রিসমাস ডে উদযাপন করার সময় দূরে পৃথিবীর উদয় হচ্ছে তখন। তারা ছিল চাঁদের বুকে। উনিশো আটষট্টিতে।

হেউড ফ্লয়েড এ চিত্রটাকে খুব উঁচু দরের কাজ মনে করে। কিন্তু ছবিটার ব্যাপারে তার ধারণা ছিল মিশ্র। সে ভুলতে পারল না যে পেইন্টিংটা শিপের আর সবার চেয়ে বয়সে বড়। ব্যতিক্রম মাত্র একজন। যখন অ্যালেক্সি লিওনভ এটা আঁকেন, ফ্লয়েড ছিল ন বছরের এক ছেলে।

১৩. গ্যালিলিওর ভুবনগুলো

এমনকি এখনো, প্রথম ভয়েজারের উড়ে যাবার তিন দশকেরও পরে কেউ আসলে বুঝতে পারেনি কেন ঐ চার দৈত্য-চাঁদ একে অন্যের সাথে এত দূরত্ব বজায় রেখে চলে। তাদের সবাই প্রায় একই আকৃতির এবং সৌর জগতের একই অংশে অবস্থিত-তবু পুরোপুরি আলাদা প্রকৃতির। ঠিক যেমন হয় ভিন্ন জন্ম নেয়া চার বাচ্চার বেলায়।

ক্যালিস্টো সবচে বাইরের উপগ্রহ। শুধু ওটাই প্রত্যাশা মাফিক সাজানো। লিওনভ এটাকে মাত্র লাখখানেক কিলোমিটার দূরে রেখে এগিয়ে যায়। এর অসীম জ্বালামুখের মধ্যে বড়গুলো দেখা যাচ্ছিল একেবারে খালি চোখেই। টেলিস্কোপের মধ্য দিয়ে উপগ্রহটাকে বিশাল কাঁচের গোলক মনে হয়। কাঁচের বলটা যেন শক্তিশালী রাইফেলের গুলিতে একেবারে ঝাঁঝড়া। যেন টার্গেট প্র্যাকটিস করা হয়েছে ঘুরতে থাকা গোলায়। সব আকারের জ্বালামুখে ভরা; একেবারে দৃষ্টি সীমার শেষপ্রান্ত পর্যন্ত। কেউ একবার বলেছিল চাঁদকে যতোটা না পৃথিবীর চাঁদের মতো দেখায় তার চেয়ে বেশি দেখায় ক্যালিস্টোকে।

অবাক করা কোনো কথা না। অ্যাস্টরয়েড বেল্টের এক প্রান্তে বসে যে কেউ নিজের অন্য প্রান্তের একটা জগৎ এখানে আশা করতেই পারে। কিন্তু এ অশটায় শুধুই আঘাত করে সেই ধ্বংসাবশেষ যেটাকে সৌর জগতের সৃষ্টি থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। অ্যাস্টরয়েড বেল্ট।

পরের উপগ্রহ গ্যানিমিডের চেহারা পুরোপুরি অন্যরকম। পেছনেরটার জ্বালামুখময় বিশাল প্রভাব এর উপর পড়ার কথা, তবু এর জ্বালামুখের বেশিরভাগই যেন চাষ করা-অদ্ভুত হলেও এ কথাটাই খাটে। গ্যানিমিডের বিস্তৃত অঞ্চল পিঠের মতো সমতলে ঢাকা। আবার কিছুটা মহাজাগতিক লাঙলে চষা জমি যেন। যেন কোনো বিরাট চাষী এ দৈত্যাকার চিরুনিচেরা পথ চষেছে কোন্ কালে। সেখানে হালকা রঙা বিচিত্র বর্ণের গর্ত, যেন স্ল্যাগ শামুক অর্ধশত কিলোমিটার দীর্ঘ পথটা বানিয়েছিল দুলকি চালে চলতে চলতে। সবচেয়ে রহস্যময় দাগগুলো লম্বা একেবেঁকে যাওয়া ভোরার দল-ডজন ডজন সমান্তরাল রেখা।

নিকোলাই টার্নোভস্কি বলে, এ লাইনগুলো অবশ্যই কোনো মাতাল অভিযাত্রী দলের বানানো বহু লেনওয়ালা সুপার হাইওয়ে।

সে দাবী করে টেলিস্কোপে দেখেছে ওভারসীজ এমনকি তার চোখে পড়ে লেন পৃথককারী পাতলা গাছের সারি।

মানব জ্ঞান ভাণ্ডার থেকে লিওনভ কয়েক ট্রিলিয়ন বিট তথ্য যোগাড় করেছে গ্যানিমিড সম্পর্কে। ইউরোপার কক্ষপথ পেরুবার আগেই এ ডাটা যোগাড় করে স্পেসশিপটা। ইউরোপা-সেই বরফ বাঁধানো দুনিয়া তার দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আর সবগুলো লাশ নিয়ে বৃহস্পতির অন্যপাশে থাকলেও কারো মন থেকেই দূরে নয়।

পৃথিবীতে খবর যাওয়ার সাথে সাথেই ডক্টর চ্যাং একজন জাতীয় বীরের সম্মান পান আর তার দেশের মানুষ স্বাভাবিক হতবুদ্ধি অবস্থায় পাঠায় অসংখ্য শোকবার্তা। একটা পাঠানো হয়েছিল লিওনভের ক্রুদের নামে। শিপে থাকার সময় সবার মানসিক অবস্থাই টলায়মান-প্ৰশংসা, দুঃখ আর মুক্তির মিশ্রণ চারদিকে। সব নভোচারী নিজেদের জাতীয় পরিচয়ের ব্যাপারে অবচেতন থেকে নিজেকে মহাশূন্যের নাগরিক মনে করে। একটা সাধারণ বন্ধনও অনুভব করে নিজেদের মধ্যে। তবু লিওনভের যাত্রীরা বিজয় বা দুঃখে অংশ নেয়নি তেমনভাবে কারণ চৈনিক

অভিযাত্রীদলের দেখা হয়েছিল দুর্ঘটনার সাথে। এর মধ্যে একটা নীরব সচেতনতাও ছিল কারণ তাদের জাতি এমন তাড়াহুড়ো করতে চায়নি।

ইউরোপায় হঠাৎ জীবন আবিষ্কার এ পরিস্থিতিতে যোগ করে এক নতুন মাত্রা। এরই মাঝে হয়ত সেই নতুন মাত্রা ব্যাপকভাবে প্রবেশ করেছে পৃথিবী এমনকি লিওনভেও। কিছু এক্সোবায়োলজিস্ট চিৎকার করে উঠেছেন, আমি আপনাদের তাই বলেছিলাম! সাথে সাথে এটাও বলেন যে, ব্যাপারটা আসলে তত বড় চমক নয়। যতটুকু পেছনে তাকানো সম্ভব-উনিশো সত্তুরের দিকে রিসার্চ ডুবোজাহাজগুলো অদ্ভুত সামুদ্রিক প্রাণীর একত্রিশটা কলোনি পেয়েছিল যেগুলো প্রতিকূল পরিবেশেও গঠনের দিক দিয়ে উন্নত। তাদের পরিবেশটা যেকোনো জীবনের জন্য দারুণ বিরূপ। প্রশান্ত মহাসাগরের তলায় অগ্নিগিরির আশপাশে বা ভিতরে গভীর খাদে সেগুলোর বাসা। সেখানে আগুন-ঝর্না প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে বেরিয়ে এসে অতল সাগরের পানিকে অসম্ভব গরম করে তোলে। সাগর তলের মরুভূমিতে মরুদ্যান সৃষ্টি করেছে। প্রাণীগুলো!

যা একবার পৃথিবীতে ঘটতে পারে, তা লক্ষ লক্ষ বার মহাবিশ্বে ঘটেছে বলে আশা করা যায়।

বিজ্ঞানীদের বিশ্বাসের এক অটল অবিচল সিংহাসন এই এক কথা।

পানি অথবা নিদেনপক্ষে বরফ পাওয়া যায় বৃহস্পতির সব চাঁদে। আর আইওতে– অবিরাম গর্জাতে থাকা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত চলে সব সময়। তাই পাশের এ বিশ্বে কম ভয়াল অবস্থা আশা করাটা যৌক্তিক। এ দু ব্যাপার এক করে ইউরোপা বানায় জীবন সুধা। পানি আর আগ্নেয়গিরির সহায়তায় জীবন শুধু সম্ভবই নয়-অপরিহার্য। প্রকৃতির আর সব বিস্ময় বেরিয়ে আসে এ গ্রহের পরিবেশের সবটুকু লুকানো অংশ মিলিয়ে দেখলে।

এখনো ঐ সমাধান আরেক প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে যা লিওনভের মিশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জীবন পাওয়া যায় বৃহস্পতির চাঁদে। এগুলোর কি কোনো সম্পর্ক থাকার কথা টাইকো একশিলাস্তম্ভের সাথে? কোনো সম্পর্ক আছে আইওর কাছের কক্ষপথের জিনিসটার সাথে? ওটাওতো কোনো না কোনো প্রাণীর সৃষ্টি।

সিক্স ও ক্লক সোভিয়েত সভায় ঐ রহস্যময় জিনিসটা বিতর্কের এক প্রিয় বিষয়। সবাই এটুকু বোঝে যে ডক্টর চ্যাংয়ের দেখা জীবটা কোনো উঁচু স্তরের বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ রাখতে পারেনি; যদি এটার আচরণ সম্পর্কে তাঁর কথা ঠিক হয়। কোনো প্রাণীই নিজের সহজাত প্রকৃতির কারণে নিজেকে বিপন্ন হতে দিতে পারে না। এমনকি কারণ থাকলেও জীবনের ঝুঁকি নেয় না কখনো। ওটার বুদ্ধি কি উইপোকার চেয়ে বেশি? বাতির দিকে পতঙ্গের মতোই নিজের জীবন নষ্ট করে এগোয়।

ভ্যাসিলি অর্লোভ দ্রুত আরেক বিপরীত উদাহরণও টানে যা এ যুক্তিকে দেয় দুর্বল করে, এমনকি খণ্ডনও করে, আর ডলফিনদের দিকে একবার তাকাও, সে বলে যায়, আমরা তাদের বুদ্ধিমান বলি, কিন্তু কীভাবে তারাই মাঝেমধ্যে নিজেদেরকে দল বেঁধে খুন করে? করে আত্মহত্যা! এও এক কারণ। বোকামির চেয়ে কারণটাই বড় হয়ে দেখা দিলে বুদ্ধিমান প্রাণী জীবনের ঝুঁকি নিবেই। মানুষ সব কালেই যুদ্ধ করে। সুইসাইড স্কোয়াডও থাকে।

ডলফিনদের কাছে যাওয়ার কোনো কারণ দেখি না, নাক গলালো ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কি, আমার ক্লাশের দারুণ মেধাবীদের মধ্যে একজন ইঞ্জিনিয়ার কোনো এক স্বর্ণকেশী কাইভের প্রেমে পড়ার পর শেষবার যখন তার কথা শুনি তখন সে কাজ করত একটা গ্যারেজে। অথচ ও স্পেস স্টেশনের ডিজাইন করার কারণে স্বর্ণপদক পেয়েছিল। মেধার কী অপচয়!

আসলেই, মন সব নষ্টের গোড়া। যে প্রাণীর আবেগ থাকে সে প্রাণী বুঝেশুনে বোকামি করবেই।

যদি ডক্টর চ্যাংয়ের ঐ ইউরোপান বুদ্ধিমান হয়েও থাকে, অবশ্যই উচ্চ স্তরের কোনো প্রাণী না। আবার বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের জীববিদ্যা পৃথিবীর নমুনা আর উদাহরণের উপর নির্ভর করে না। তাই বিচারও করা যায় না এক হিসাব মাথায় রেখে।

অতি উন্নত প্রাণিকুল সামুদ্রিক হতে পারে না এমন কথা উঠেছে সবসময়। পৃথিবীকেন্দ্রীক প্রমাণও পাওয়া যায়। উন্নত প্রাণী সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন সমস্যায় ভরা প্রতিকূল পরিবেশ। কিন্তু সমুদ্র ততোটা চ্যালেঞ্জিং কোনো পরিবেশ নয়। পরিবেশটা আরামের। নেই কোনো পরিবর্তন। সর্বোপরি, কীভাবে একটা জলজ সৃষ্টি উন্নয়ন করবে আগুন ছাড়া? অন্তত প্রকৌশল বিদ্যার ক্ষেত্রে? আর প্রকৌশলের ধাপ বন্ধ থাকলে সভ্যতার আর সব দরোজাও তালা দেয়া থেকে যায়।

এখনো অবশ্য সভ্যতার পক্ষে যুক্তি থাকে, মানব সভ্যতা যে রাস্তায় চলেছে তাই হয়ত একমাত্র পথ না। মানুষের সর্বকালের সমস্যা হচ্ছে নিজেকে দিয়ে অন্যের বিচার করা। আরেক রহস্যঘেরা জগতের সম্পূর্ণ সভ্যতাটাই জলের নিচে থাকতে পারে। সৃষ্টিজগতের বাকি সবগুলোই হয়ত তেমন।

একটা ব্যাপার অস্বাভাবিক। কোনো মহাজাগতিক ভয়াবহ সৃষ্টি ইউরোপায় উঠে থাকতে পারে কিন্তু ভুলের কোনো চিহ্ন না রেখে চলে যাওয়াটাই রহস্যময়। নিজের অস্তিত্বের সামান্যতম নিদর্শন না রেখে ঐ সৃষ্টিটা চলে গেল বিশাল গড়ন, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, পাম্প বা আর সব মানব সৃষ্ট জিনিসপত্র স্রেফ ধ্বংস করে দিয়ে। কিন্তু ইউরোপায় এক মেরু থেকে আরেক মেরুতে শুধুই সমতল কঠিন বরফ আর কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রুক্ষ নগ্ন পাথর ছাড়া কিছুই দেখা যায়নি।

লিওনভ যখন প্রচণ্ড গতিতে আইও এবং ছোট্ট মিমাসের কক্ষপথগুলো ছাড়িয়ে গেল তখন আলোচনা এমনকি এগুলোর সম্পর্কে অনুমানেরও সময় ছিল না। সবাই ব্যস্ত রাজকীয় এলাকার ওজন বেড়ে যাওয়ার ছোট সমস্যাটার ব্যাপারে। বৃহস্পতির টান যে অসম্ভব! ঘণ্টা কয়েক পরে আসবে মুক্ত পতন। বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের আগেই সব আলগা জিনিসপত্র নিরাপদে রাখাটা জরুরি। মুহূর্তের মধ্যে মন্দনের কারণে টেনে চলাটা শুরু হয়। এজন্য হয়ত বড়জোড় টু জির মতো তীব্র ওজন বোঝা যাবে।

ফ্লয়েডের ভাগ্য ভালই; সে একাই পেয়েছে আসতে থাকা গ্রহের অপার্থিব দৃশ্যের প্রশংসা করার সময়-সুযোগ। এরই মধ্যে আকাশের অর্ধেকটা গ্রহরাজের দখলে। একে মাপার মতো কোনো নিক্তি নেই। বিবশ মনের পক্ষে প্রকৃত আকারটা ধরে রাখারও উপায় নেই কোনো। তার নিজেকেই বারবার বলতে হচ্ছে যে অর্ধশত ধরণীও এ গোলার্ধকে ভরে দিতে পারবে না যা তার দিকে এগিয়ে আসছে নিয়তির মতো।

পৃথিবীর সবচে দামি সূর্যাস্তের মতো দেখায় ভাগ্যপতির মেঘমালা; এত দ্রুত ছুটে বেড়ায় যে দারুণ নড়াচড়া দেখা যায় বড়জোর দশ মিনিট; তারপরই হারিয়ে যায় ওপাড়ে। দানবীয় ঘূর্ণিগুলো থেকে থেকে জন্ম দিচ্ছে ডজন ডজন ছোট ঝড়। অথবা আরো বড় বড় দল। এ দল আর মেঘ ঘিরে থাকে দানো গ্রহকে। ঢেউ খেলিয়ে চলে যায় ধোয়ার চক্রের মতো। সাদা গ্যাসের শিখা মাঝে মাঝে গভীর থেকে উষ্ণ প্রস্রবনের মতো উথলে ওঠে আবার বৃহস্পতির ভয়ানক পাক খাওয়া ঝড়ে সরে যায় দূর থেকে দূরে। সাদা চিহ্নগুলো সবচে অদ্ভুত, দেখতে নেকলেসের গায়ে সাজানো মণিমুক্তার মতো। অবাধ বাতাসের সাথে শুয়ে আছে বৃহস্পতির মাঝামাঝি.অক্ষাংশ জুড়ে।

দ্বীপরাজ্যের রাজধানীর শহরতলীতে ঢোকার আগের কয়েক ঘণ্টায় ফ্লয়েড ক্যাপ্টেন আর নেভিগেটদের দেখল খুব কমই। অর্লোভরা ব্রিজ ছেড়ে যায় না কারণ তাদের কাজটা খুব কঠিন। বৃহস্পতির এলাকায় অনেক অনেক অর্বিট। ওরা তাই আসতে থাকা কক্ষপথকে পরীক্ষা করছে আর মিনিটে মিনিটেই বদলে দিচ্ছে লিওনভের পথ। এ মুহূর্তে শিপের রাস্তা খুব জটিল। এখনি বাইরের বায়ুমণ্ডলে ঢুকবে; যদি স্পিড অনেক বাড়ে তাহলে ফ্রিকশনাল ব্রেক করাটা অসম্ভব হতে পারে। এমনকি, উপরের দিকে উঠে পড়লে বৃহস্পতি-অর্বিটের আকর্ষণ কাজে লাগিয়ে দোলনার মতো শিপটা হারিয়ে যাবে সৌরজগতের বাইরে। ঐ শূন্যতা থেকে লিওনভকে উদ্ধার করাটা অসম্ভবই শুধু না, পথের আশা হবে অলীক কল্পনা। আবার যদি অনেক নিচু হয়ে যায়-পড়তে থাকে বরাবর বৃহস্পতির দিকে তাহলে অ্যাটমোস্ফিয়ারের কণার সাথে অতি গতিতে সরাসরি ঘর্ষণের কারণে স্রেফ পুড়ে যাবে এক উল্কাপিন্ডের মতো। এ দুই ভয়াল শেষ সীমার মাঝের ছোট্ট অঞ্চলে থাকতে পারলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে খুব অল্প।

চীনারা আগেই প্রমাণ করেছে যে অ্যারোব্রেকিং করা সম্ভব। কিন্তু সব সময় দু একটা ভুলের সুযোগ থেকে যায়। তাই ফ্লয়েড একটুও আমল দেয়নি সার্জন কমান্ডারের কথায়। সার্জন কমান্ডার রুডেস্কো যোগাযোগের এক ঘণ্টা আগে প্রশংসা করেছিল, উডি, আশা করা শুরু করলাম যে অবশেষে ধরা দিচ্ছে সেই বিজয়।

১৪. মুখোমুখি

…নান্টাকেট হাউসের বন্ধকের কাগজপত্র এম মার্ক করে ফাইলের মধ্যে নিয়ে লাইব্রেরীতে রাখতে হবে।

ঠিক আছে, আমার মনে হয় এটুকুই আমাদের আলোচনা। কয়েক ঘণ্টা ধরে মনে পড়ছে একটা ছবির কথা। আমি এক ছোট্ট ছেলের ছবি পেয়েছিলাম ভিক্টোরিয়ান আর্টের ছেঁড়া ভলিউমে। কমসে কম দেড়শো বছরের পুরনো। সাদাকালো নাকি রঙিন তা খেয়াল নেই। কিন্তু কখনোই ঐ ছোট্টটাকে ভুলব না–হাসবে না কিন্তু শুনে… ছবিটাকে দি লাস্ট মেসেজ হোম নামে ডাকত লোকে। আমাদের দাদার দাদারা পছন্দ করতেন ঐ ধরনের আবেগিক মেলোড্রামা।

চিত্রটায় হ্যারিকেনের মুখে পড়া এক জাহাজ দেখা যায়। পালগুলো ফোলা। ডেকে পানি আর পানি। পেছনে ক্রুরা জাহাজকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করছে আর সামনের দিকে এক তরুণ নাবিক হাতে কাগজ নিয়ে লিখছে একটা নোট। তার পাশেই রাখা আছে খালি বোতল। তার বিশ্বাস, এ ছিপিবন্ধ বোতল নোটটাকে নিয়ে কোনো এক সবুজ মাটির বুকে আছড়ে পড়বে কোনো একদিন।

তখন আমি ছিলাম একটা বিচ্ছু, ভেবেছি চিঠি লেখা বাদ দিয়ে তার উচিত ছিল সহযোগীদের সাহায্য করা। একইভাবে এটা আমার উপরেও এসে পড়তে পারে তাতো ভাবিনি কোনোদিন! ভাবিনি আমিই ঐ নাবিক।

অবশ্যই-আমি শিওর তুমি মেসেজটা পাবে। কিন্তু আমিতো লিওনভে কোনো সহযোগিতাই করতে পারব না। আসলে আমাকে ঐ কাজ থেকে দূরে থাকার জন্য খুব ভদ্রভাবেই বলা হয়েছে। আমি এ কথাটা বলার সময় আমার বিবেক পুরোপুরি সচেতন।

এখন মেসেজটা ব্রিজে পাঠাব। কারণ পনের মিনিটের মধ্যে সম্প্রচার শেষ হবে। বড় ডিশটা নামিয়ে বন্দী করব হ্যাঁচের ভেতরে। স্পেসশিপের সাথে সুন্দর মিল আছে তোমার! বৃহস্পতি ঠিক এ মুহূর্তে ভরে ফেলছে আকাশটাকে। সেটা আর বর্ণনা করার চেষ্টা করব না। সৌন্দর্যটা বেশিক্ষণ দেখবও না-কয়েক মিনিটের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শাটার।

যাই হোক, ক্যামেরাগুলো এরচে অনেক ভাল দেখতে পারে। বিদায় প্রিয়তমা। …..: তোমাদের সবার জন্য অনেক অনেক ভালবাসা। বিশেষ করে ক্রিসের জন্য। যখন এটা পাবে, ততোক্ষণে এগিয়ে গিয়ে চলাটা শেষ হবে; তা সোজা পথে হোক আর উল্টো। মনে রেখ, আমাদের সবার খাতিরে আমি চেষ্টা করেছি যথাসাধ্য। বিদায়।

অডিও চিপ সরিয়ে ফ্লয়েড ভেসে চলল কম্যুনিকেশন সেন্টার থেকে বেরিয়ে। তারপর চিপটা শাসা কোভালভের হাতে দিয়ে দিল, প্লিজ, মেসেজটা যেন ডিশ নামানোর আগেই পাঠানো হয়। পাঠিয়েই জানিয়ে দিও আমাকে।

চিন্তা করো না। শাসা জবাব দিল, আমি এখনো সব চ্যানেলে চেষ্টা করছি। হাতে জলজ্যান্ত দশ মিনিট বাকি।

আবার যদি দেখা হয়-আমরা তো হাসব। যদি তা নাই হয়, কেন এ বিদায় এত সুন্দর করে হল?, কথাটা বলার আগে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ফ্লয়েড। বলা শেষ করেই একচোখ একটু পিটপিট করল।

শেক্সপিয়র-ঠিক?

অবশ্যই; ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াসের কথা। যুদ্ধের আগে। শাসা, দেখা হবে তোমার সাথে।

তানিয়া আর ভ্যাসিলি নিজেদের কাজে এত বেশি মনোযোগী ছিল যে ফ্লয়েডের দিকে তারা সেভাবে খেয়ালও করল না। সে সবকিছু ছেড়ে সেঁধিয়ে গেল নিজের সেই ছোট্ট কেবিনেই। সবার কাছ থেকেই বিদায় নেয়া হল। এখন অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তার স্লিপিং ব্যাগ প্রস্তুত। আবার মহাকর্ষ শুরু হলে স্লিপিং ব্যাগে ঢোকার মতো একমাত্র লোক সে।

অ্যান্টেনাগুলো… ইন্টারকম স্পিকার বলে উঠল, আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রথম অভিকর্ষ অনুভব করব, আশা করি। সবকিছুই নরমাল।

এ শব্দটাই আমি সবচে কম ব্যবহার করি, বলল ফ্লয়েড। নিজেকেই, আমার মনে হয় তোমরা নরমাল শব্দটা বলেছ ভুল করে, হয়ত বলতে চাইছ নোমিনাল বা নামমাত্র।

হঠাৎ করেই নিজের চিন্তা থামিয়ে দিল ফ্লয়েড। দরজায় জোর শব্দ হচ্ছে। প্রশ্ন করল, কটো টম?

মনে হল জেনিয়া এসেছে।

আমি ভিতরে এলে কি তুমি কিছু মনে করবে? জিজ্ঞাসাটা ন্যাকা সুরের। অবশ্যই ছোট্ট মেয়ের কণ্ঠে; ব্যাপারটা ফ্লয়েড বুঝতে পারে ভয়ার্ত মনে।

অবশ্যই কিছু মনে করব না। তুমি নিজের কিউবিকলের বাইরে কেন? এলাকায় ঢুকতে আর পাঁচ মিনিটও বাকি নেই। প্রশ্নটা করলেও নিজের বোকামীর ব্যাপারে সচেতন ছিল ফ্লয়েড। জবাবটা এত বেশি অদরকারি যে জেনিয়া তা দেয়ার কোনো চেষ্টাই করেনি।

কিন্তু জেনিয়াই সর্বশেষ মানুষ যাকে ফ্লয়েড হয়ত আশা করে থাকবে। তার প্রতি জেনিয়ার আচরণ সব সময়েই নস্ত্র কিন্তু দৃঢ়তাও ঠিক থাকত। এমনকি সমস্ত ক্রুর মধ্যে একমাত্র ও-ই ফ্লয়েডকে ডক্টর ফ্লয়েড নামে ডাকতে পছন্দ করে। ঠিক এখনো, দুর্দশার মুহূর্তে সে একটু আয়েশ আর সঙ্গই হয়ত আশা করে এখানটায়।

জেনিয়া, মাই ডিয়ার সে বিকৃত সুরে বলল, তোমাকে স্বাগতম, কিন্তু আমার থাকার জায়গাটা খুব ছোট। এটাকে কেউ ইচ্ছা করলে স্পার্টা নগরীর মতোও বলতে পারে।

মেয়েটা কোনোমতে একটা ফ্যাকাশে হাসি দিয়ে কোনো কথা না বলেই ঘরে ঢুকল ভেসে ভেসে। আর প্রথমবারের মতো ফ্লয়েড দেখতে পেল ও শুধু নার্ভাস না, রীতিমতো আতঙ্কিত। এতক্ষণে বুঝতে পারছে কেন মেয়েটা এসেছে তার কাছে। এ অবস্থায় নিজের সহযোগীদের কাছে যেতে লজ্জা পাচ্ছিল বলেই ভেসে বেড়াচ্ছে। একটু সমর্থনের আশায়।

ও হঠাৎ ঢুকে যাওয়ায় অবশ্যই ফ্লয়েডের রাগ ওঠার কথা। জেনিয়ার অসহায়ত্ব বুঝতে পেরেই রাগটা মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। বাড়ি থেকে অকল্পনীয় দূরে থাকা একা একজন মানুষ এমন কোথাও ঢুকবে একটু পর যেখান থেকে কেউ বেঁচে ফেরেনি। এবং সেই ঢোকারও কোনো নিশ্চয়তা নেই, কেউ জানে না তারা অসীম স্পেসে হারিয়ে যাবে নাকি জ্বলে ছাই হবে বৃহস্পতির দিকে পড়তে পড়তে। এত বিরক্ত হয়নি ফ্লয়েড যার ফলে তার এটুকু বোঝার ক্ষমতা কমে যাবে। জেনিয়া ঠিক অপরূপা না হলেও আকর্ষণীয়। কিন্তু তার অর্ধেক বয়েসী কোনো মেয়ের ক্ষেত্রে এসব কোনো ব্যাপার না। এটাই হয়েছিল; সে ভাবতে বসেছিল ঐরকম কিছুই। ফ্লয়েড একটু আড়ষ্ট।

জেনিয়া অবশ্যই বুঝতে পারে সব। কোকুনে পাশাপাশি শুয়ে থাকার সময় মেয়েটা উৎসাহ অনুৎসাহের কোনোটাই দেয় না। তাদের দুজনের জন্য মোটামুটি স্থান থাকলেও ফ্লয়েড জায়গা নিয়ে হিসাব নিকাশ শুরু করে দিয়েছিল। তার সবচে ভয়ের হিসাবটাও মাথায় আসে, যদি সর্বোচ্চ অভিকর্ষ পরিকল্পনার চেয়ে একটুও বেশি হয়…সহ্য ক্ষমতার চেয়ে বেশি হলে? তারা মারা যেতে পারে সাথে সাথে…

দুজনের দূরত্বটা মোটামুটি ভদ্র, হঠাৎ এ পরিস্থিতিতে পড়ায় লজ্জার কিছু নেই। মনের অবস্থার সাথে কামনার কোনো মিলই নেই এখন; কোন ফাঁকে তাদের আলিঙ্গন এত কাছাকাছি এসেছে টেরও পায়নি কেউ। ফ্লয়েড জানে না এতে দুঃখ পেতে হবে নাকি সুখ।

এখন আর অন্য চিন্তার সময় নেই। অনেক অনেক দূর থেকে ভেসে এল মৃদু শব্দের প্রথম ফিসফিসানি; যেন কোনো অশান্ত আত্মার হাহাকার। একই মুহূর্তে শিপ বেশ স্পষ্টভাবে ঝাঁকি খায়; এপাশ ওপাশ দুলতে থাকে কোকুন। প্রথমবারের মতো তারা আকর্ষণ টের পায়। কোকুন আঁকড়ে রেখেছে তাদের। বহু সপ্তাহের ওজনহীনতার পর ফিরে আসছে গ্র্যাভিটি।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেই হালকা ফিসফিস পরিণত হয় এক নিয়মিত উঁচু শব্দে। এবার কোকুনটার অবস্থা ঠেসে ভরা নেটের ঝুলন্ত বিছানার মতো। ব্যাপারটা ভাল হচ্ছে না…ভাবল ফ্লয়েড। এখনি শ্বাস নেয়া কষ্টকর। তার শ্বাস নেয়ার কষ্ট গ্র্যাভিটির জন্য নয়, জেনিয়া তাকে আঁকড়ে ধরেছে-যেভাবে ডুবন্ত মানুষ আঁকড়ে থাকে সামান্য খড়কুটোকে। সে মেয়েটাকে সরিয়ে দিল যতটা ভদ্রভাবে পারা যায়।

সবই ঠিকঠাক চলবে-জেনিয়া। জিয়াংপেরে থাকলে আমরাও পারব…রিল্যাক্স, ভয় পাবার কিছু নেই। এমন পরিবেশে নরম সুরে কথা বলা যথেষ্ট কঠিন, তবু সে শিওর না এত কান ফাটানো গর্জনের মাঝে জেনিয়া কথাটুকু শুনেছে কিনা।

তাপে তাপে উবে যাওয়া হাইড্রোজেনের চিৎকার বাড়ছেই। ভাগ্য ভাল, এখন আর সে তাকে চেপে ধরে রাখছে না। সুযোগ পেয়ে ফ্লয়েড ভাল মতো দম নিয়ে নেয়।

তাকে এ অবস্থায় দেখলে ক্যারোলিন কী ভাবত? কখনো সুযোগ পেলে সে কি এ সময়ের কথাটা স্ত্রীকে বলবে? শুনলে মেয়েটা তার কথা মানবে কিনা কে জানে!

এমন এক মুহূর্তে পৃথিবীর বন্ধনকে অনেক অনেক হাল্কা মনে হয়।

নড়া অসম্ভব। কথাও বলা যায় না। কিন্তু এরিমধ্যে সে ওজনের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সাথে তাল মিলিয়ে নিয়েছে–ওজন কখনোই তার কাছে কঠিন মনে হয় না; শুধু এখন ডান হাতটায় চাপ বাড়ছেই বাড়ছে। অসহ্য। বহু কষ্টে হাতটাকে উদ্ধার করে জেনিয়ার কাছ থেকে; কাজটা করেই কেমন অপরাধবোধে ছেয়ে যায় মন। হাতের রক্ত চলাচল ফিরে পেতেই তার মনে পড়ে কমপক্ষে এক ডজন অ্যাস্ট্রোনট আর কসমোনটের বিখ্যাত উক্তিটা, জিরো গ্র্যাভিটি সেক্সের আনন্দ আর সমস্যা দুইই খুব বেশি।

কীভাবে বাকি ক্রুরা চলছে কে জানে! একই সাথে তার হিংসাও হয় চন্দ্র আর কার্নোকে, পুরো পথটাই ঘুমিয়ে কাটালো ওরা-দুশ্চিন্তা আর মানসিক চাপ পরের কথা, ঘুমিয়েছে যে তাই টের পায় না। বৃহস্পতির আকাশে লিওনভ যদি একটা উল্কা হয়ে ঝরে পড়ে তবু তারা কোনোদিন জানতে পারবে না। হঠাৎ হিংসাটা কেটে গেল, তারা জীবনের এক বিরাট অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হল আজ।

তানিয়া ইন্টারকমে কথা বললেও গর্জনের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে তার শান্ত আর খুবই স্বাভাবিক কথাবার্তা। কথা এতই শান্ত যেন কোনো রুটিন এনাউন্সমেন্ট চলছে। ফ্লয়েড হাতঘড়ির দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে নেয়, অবাক ব্যাপার! পেরিয়ে গেছে অর্ধেক পথ। ঠিক এ মুহূর্তে লিওনভ বৃহস্পতির সবচে কাছাকাছি। শুধু এক্সপান্ডেবল অটোমেটিক প্রোবগুলো বৃহস্পতির আকাশের আরো ভিতরে ঢুকে যাবে।

অর্ধেক পথ শেষ, জেনিয়া। চিৎকার করে ওঠে সে, এবার বেরিয়ে যাব। কে জানে, মেয়েটা শুনেছে কিনা। তার চোখগুলো একেবারে বন্ধ, একটু হাসল শুধু।

বোঝাই যায় শিপ দুলছে কোনো উন্মাদ সাগরে ছোট্ট নৌকার মতো। এমন হবার কথা? ভয় পায় ফ্লয়েড। জেনিয়াকে নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ পেয়ে সে যথেষ্ট খুশি; নিজের ভয়কে অনেক দূরে সরিয়ে দেয়া গেল। এ চিন্তাটা সরিয়ে দেয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সে দেয়ালগুলোকে চেরির মতো আগুন রঙা হয়ে যেতে দেখল, কুঁকড়ে আসছে তার দিকে। এডগার অ্যালান পোর সেই দুঃস্বপ্ন ফ্যান্টাসি, দ্য পিট অ্যান্ড দ্য পেন্ডুলাম এর মতো যেটার কথা সে ভুলে ছিল গত ত্রিশ বছর…

কিন্তু এমন কিছু কখনোই হবে না। হিট শিল্ড ব্যর্থ হলে সাথে সাথেই শিপ দুমড়ে যাবে। সামনের গ্যাস স্তর পৃথিবীর মতো নয়, বৃহস্পতির বায়ুস্তর যেন শক্ত দেয়াল। কোনো ব্যথা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। স্নায়ুতন্ত্র এ অনুভূতি বহন করার আগেই ছাই হয়ে যাবে। সে সান্ত্বনার আরো অনেক শব্দ খুঁজে পায়, কিন্তু চিন্তাটা তাড়ানো অসম্ভব।

উত্তেজনা থিতিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। তানিয়া আরেকটা ঘোষণা দেয় এবার (সব শেষ হলে সে নিশ্চই এ ঘোষণার জন্য ক্যাপ্টেনকে দেখে নেবে।) এবার সময় যেন আরো আরো ধীর; এক সময় ঘড়ির দিকে তাকানো বন্ধ করে দেয়। এ ঘড়িকে আর বিশ্বাস করা যায় না। ডিজিট এত আস্তে আস্তে পরিবর্তন হচ্ছে যেন সে স্পষ্ট নিজেকে কোনো আইনস্টাইনীয় সময় দীর্ঘায়নের ফাঁদে দেখতে পায়।

এরপর আরো অবাক করা কিছু হয়। প্রথমে একটু মজা পেলেও রেগে যায় ধীরে ধীরে। জেনিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে-তার হাতে না হোক, একেবারে হাতের পাশে।

এই স্বাভাবিক। এত চাপ আর উত্তেজনা মেয়েটাকে নিশ্চই ক্লান্ত করে তুলেছে-কিন্তু শরীরের সৌন্দর্য তাকে ফ্লয়েডের রাগের হাত থেকে বাঁচায়। হঠাৎ ফ্লয়েড নিজেও ঝিমাতে শুরু করে শারীরিক আনন্দের পর যে অবসাদ আসে তার কারণে, যেন সেও এই মুখোমুখির জন্যে ডুবে গেছে অনেকটা। তাকে জেগে থাকতেই হবে…

…আর সে পড়ে যাচ্ছে… পড়ছে… পড়ছে… সব শেষ। শিপ ফিরে এসেছে মহাকাশে; যেখানে তার থাকার কথা। আর মাধ্যাকর্ষণ নেই। আলাদা হয়ে ভেসে বেড়ায় সে আর জেনিয়া।

তারা হয়ত আর কক্ষনো এত কাছে আসবে না কিন্তু সারা জীবন একে অন্যের প্রতি অন্যরকম এক কোমলতা নিয়ে চলবে যা আর কারো সাথে শেয়ার করা অসম্ভব।

১৫. দৈত্য থেকে দূরে

জেনিয়ার মাত্র কয়েক মিনিট পরে ফ্লয়েড অবজার্ভেশন ডেকে পৌঁছল। বৃহস্পতি এর মধ্যেই সরে গেছে অনেক দূরে। যা দেখেছে সে সময় না, তা অবশ্যই কোনো বিভ্ৰম-চোখের প্রমাণ নয়। বৃহস্পতির অ্যাটমোস্ফিয়ার থেকে তারা দূরে। কিন্তু এখনো গ্রহটা অর্ধাকাশ জুড়ে রয়েছে।

এখন তারা গ্রহরাজের হাতে বন্দী। শেষের জ্বলন্ত ঘণ্টাগুলোয় ভালমতো চিন্তা ভাবনা করেই জলাঞ্জলি দিয়েছে বাড়তি গতি। এ গতিটা সৌরজগতের ঠিক বাইরে অনন্ত নক্ষত্রবীথির মাঝে নিয়ে ফেলতে পারত। এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে এক উপবৃত্তাকার পথে। এক পরিচিত হোম্যান কক্ষপথ। হয়ত তাদের উপরদিকে সাড়ে তিন লাখ কিলোমিটার পিছিয়ে নিতে পারে। সেটা বৃহস্পতি আর আইওর মাঝামাঝি অর্বিট। তা করতে না পারলে ভাল। না করলে আবার মোটরগুলো জ্বালাতে হবে। লিওনভ ঘুরে বেরিয়ে যাবে এবং মরণের সেই দুই সীমার মুখোমুখি হবে আবার। বারবার কষ্ট করে বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে ঢুকবে, বেরিয়ে যাবে প্রতি উনিশ ঘণ্টা অন্তর অন্তর। এ অর্বিটটা বৃহস্পতির চাঁদগুলোর কাছাকাছি যেতে পারে তবে খুব বেশিক্ষণের জন্য নয়। যতবার যানটা অ্যাটমোস্ফিয়ারে ঘোরাঘুরি করবে ততোবারই হয়ত এর উচ্চতা যাবে কমে, যে পর্যন্তসর্পিল আর ছোট হতে থাকা পথটা ধ্বংসের দিকে না গড়ায়।

ফ্লয়েড আসলে কখনোই ভদকায় মজা পায়নি, কিন্তু নিজের পছন্দ-অপছন্দ না দেখিয়েই আর সবার সাথে যোগ দিয়েছিল বিজয় ড্রিংক পার্টিতে। স্বাস্থ্য কামনা করা হয়েছিল শিপের ডিজাইনারদের আর সবাই ধন্যবাদ দিয়েছিল স্যার আইজ্যাক নিউটনকে। তখন তানিয়া তার বোতলটা কাপ বোর্ডে ফেরত দেয় কারণ আরো অনেক অনেক কাজ বাকি।

সবাই ভেবেছে এমন হতে পারে, তবু বিচ্ছিন্নতার ধাক্কাটায় যেন সবাই হঠাৎ আঘাতের বিস্ফোরণের পরের ছাইয়ে ঢাকা পড়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত পরেই এক বিশাল জ্বলন্ত চাকতি ভেসে উঠল চোখের সামনে। একপাশ থেকে অন্যপাশে ঘুরতে ঘুরতে দ্রুত শিপ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সাথে সাথেই শুরু হল মাতাল কথাবার্তা।

দেখ! চিৎকার করে উঠল ম্যাক্স, ফ্লাইং সসার! একটা ক্যামেরা হবে?

এরপর যে হাসিটা বয়ে গেল,সেটার আছে আলাদা ঐতিহাসিক তাৎপর্য। মানসিক মুক্তি আনে এমন হাসি। কিন্তু হাসিটায় বাধা দেয় ক্যাপ্টেনের সিরিয়াস। মনোভাব, বিদায় বিশ্বস্ত হিট শিল্ড, দারুণ কাজ করলে তুমি।

কিন্তু কী আশ্চর্য! বলল শাসা, ওজন হবে কমসে কম দু টন। জিনিসটা না থাকলে বাড়তি কিছুই বহন করতে পারব না।

ওটা ভাল রাশিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং হয়ে থাকলে, বলল ফ্লয়েড, আমিই এর জন্য যথেষ্ট। কয়েক টনকে অনেক বড় মনে করা এক মিলিগ্রামকে সামান্য ভাবার চেয়ে অনেক ভাল।

সবাই তার মহৎ মনোভাবকে বাহবা দেয়। আলাদা হয়ে যাওয়া শিল্ডটা হলুদাভ হয়ে লাল আর সবশেষ হয় চারদিকের মহাশূন্যের মতো কালো রঙা। মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়েই হারিয়ে গেল; কোনো নক্ষত্রের আলো ঠিকমতো শিপে পড়লে জিনিসটা দেখাই যেত না।

প্রাথমিক অর্বিট চেক কমপ্লিট। বলল ভ্যাসিলি, আমাদের ডানদিকের ভেক্টরের দিকে প্রতি সেকেন্ডে দশ মিটার যাচ্ছি। প্রথম চেষ্টায় খারাপ না।

সাথে সাথে একটু স্বস্তির আভাস খেলে গেল সবার মনে। কয়েক মিনিট পরে ভ্যাসিলি আরো একটা ঘোষণা দেয়, যাত্রাপথ পরিবর্তনের চেষ্টার ধরন পাল্টাচ্ছি। প্রতি সেকেন্ডে ডেল্টা ভি ছ মিটার। এক মিনিটের মধ্যে বিশ সেকেন্ডের প্রজ্বলন শুরু হবে।

বৃহস্পতি এত কাছে যে এর কক্ষপথ ধরে ঘোরার কথাও বিশ্বাস হয় না। মেঘের সাগর থেকে বেরিয়ে এলে একটা এয়ারক্রাফট থেকে পৃথিবীকে যেমন দেখায় তেমন লাগছে বৃহস্পতিকে। এত বিশালতায় পরিমাপের কোনো হিসাব থাকে না। যেন কোনো পার্থিব সূর্যাস্তের সময় তারা পৃথিবীর আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। নিচের গোলাপী আর লালের লালিমা যেন অতি পরিচিত।

এক ধরনের মোহ; আসলে পার্থিব কিছুর সাথেই এর তুলনা চলে না। রঙটা বৃহস্পতির অংশ। পৃথিবীর গোধূলী লালিমা সূর্য থেকে ধার করা। নিচের গ্যাসগুলো পরিচিত হয়েও অপার্থিব। ভাসছে মিথেন, অ্যামোনিয়া, আর ডাইনীর ক্রুর মতো হাইড্রোকার্বনের মেঘ। কোনো মুক্ত অক্সিজেনের দেখা নেই; মুক্ত শ্বাসের নেই উপায়।

মেঘেরা উঁচু থেকে উঁচুতে সারি সারি বিন্যস্ত। সাধারণত সমান্তরালে থাকে, মাঝে মধ্যে ঘূর্ণিগুলো বিরক্ত করছে মেঘ-সারিকে। এখানে সেখানে উজ্জ্বল গ্যাস উপরে উঠে আসায় সুন্দর লাইনগুলো হয় এলোমেলো। ফ্লয়েড একটা বিরাট ঘূর্ণির কালো প্রান্তের দেখা পেয়েছে, এত নিচে নেমে গেছে ওটা-মেপে শেষ করা যাবে না।

এবার সে গ্রেট রেড স্পটের খোঁজ শুরু করল, সাথে সাথেই নিজেকে একটু বোকাও ভেবে নিল। নিচে যতটুকু দেখা যায়, তার পুরোটা হয়ত গ্রেট রেড স্পটের শতভাগের কয়েকভাগ। কেউ যদি ছোট একটা প্লেন নিয়ে ক্যানসাসের উপর উড়তে উড়তে আমেরিকার ম্যাপটা দেখতে চায়, তাকে বোকা না বলে কী বলা যায়!

সংশোধন শেষ। এবার আমরা আইও আর বহস্পতির মাঝামাঝি একটা স্থির অর্বিটে। এসেছি অষ্টম ঘণ্টার পঞ্চান্ন মিনিটে।

বৃহস্পতি থেকে ন ঘণ্টারও কম সময়ে সরে এলাম, এবার অপেক্ষা করতে হবে যার জন্য আসা। ভাবল ফ্লয়েড। আমরা দৈত্য থেকে দূরে চলে এসেছি-কিন্তু সে কোনো একটা বিপদ পেতে বসে আছে আমাদের জন্য, এবার প্রস্তুত হতে হবে। সামনের সবটা এখনো শুধুই রহস্য।

একবার যেহেতু চ্যলেঞ্জটা পেরিয়ে এসেছি, আরো একবার বৃহস্পতির দিকে যেতে হবেই। ঘরে ফিরতে হলে বৃহস্পতির আকর্ষণ শক্তি দরকার।

১৬. প্রাইভেট লাইনে আলাপ

হ্যালো, দিমিত্রি। উডি বলছি, পনের সেকেন্ডের মধ্যে কি-টু চাপব…হ্যালো, দিমিত্রি-কি-থ্রি আর কি-ফোর তৈরি কর, কিউব করে বর্গমূল দাও, পাইয়ের বর্গ যোগ করে সমষ্টিকে কি-ফাইভ হিসেবে ব্যবহার কর। তোমাদের কম্পিউটার যদি আমাদেরগুলো থেকে লাখো গুণ দ্রুত কাজ করে, তাহলে এ ম্যাসেজ কেউ ভাঙলে ভাঙতেও পারে। আমি জানি, তোমাদেরগুলো লক্ষগুণ শক্তিশালী নয়। আমরাও এটা ভাঙতে পারব না। মনে হয় কিছু ব্যাখ্যা দেবে-এ কাজে তুমি খুব দক্ষ।

যাই হোক, আমার দারুণ একজন সোর্স আছে। সে বলেছে বুড়ো আন্দ্রে এবারও রিজাইন করতে পারেনি। তোমার কর্মকর্তাদের দল আর সবার মতোই ব্যর্থ। এবারও তাকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে হচ্ছে। আমার মাথাটার প্রশংসা করতে হয়, আজো এটা একাডেমিকে ঠিকমতো সেবা দেয়। আমি জানি, বুড়ো নব্বইয়ের উপরে-আর দিনে দিনে হচ্ছে আরো অথর্ব। স্যরি, তাকে সরানোর কাজে আমার কোনো সাহায্যই পাবে না, যদিও আমি বুড়ো বিজ্ঞানীদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার কাজে পৃথিবীর… ধ্যাৎ… সৌর জগতে সবচে বেশি দক্ষ।

বিশ্বাস হয়, এখনো আমি একটু একটু মাতাল? মনে হল এবার একটা ছোটখাটো পার্টি দিয়ে দেয়া যায়, কারণ এক সময় না এক সময় আমরা সার্থকভাবেই মিল… মিশ… ধ্যাৎ… মিলেছি বৃহস্পতির সাথে। এছাড়াও আমরা নতুন দুজন সদস্য পেয়েছি শিপে। চন্দ্র অ্যালকোহল পছন্দ করে না-এটা নাকি মানুষকে অতিমাত্রায় মানবিক করে ফেলে-কিন্তু ওয়াল্টার কার্নো সেটা কড়ায় গণ্ডায় পুষিয়ে দিচ্ছে। একমাত্র তানিয়াই কঠিন। সে কিছুতেই মাতাল হবে না-অ্যালকোহল নিক, না নিক… এমনটাইতো আশা করো ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে, না?

প্রিয় আমেরিকানরা-আমি কথা বলছি রাজনীতিকের মতো। ঈশ্বর সাহায্য করেছেন আমাকে-ভালয় ভালয় বেরিয়ে এসেছি হাইবারনেশন থেকে, তারপর বৃহস্পতির টান থেকেও। দুজনেই আছি কাজে নামার ধান্ধায়। আমাদের সবাইকে তাড়াহুড়ো করতে হবে। শুধু সময় যাচ্ছে না-ডিসকভারির অবস্থাও মনে হয় খারাপ। নিখুঁত সাদা শরীরটা হলদেটে হয়ে গেছে দেখে আমার বিশ্বাসই হতে চায়নি।

অবশ্যই দোষটা আইওর। শিপ বাঁকা পথে চাঁদটার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে নেমেছে তিন হাজার কিলোমিটার। আর প্রতিদিনই সেখানে দু-চারটা জ্বালামুখ কয়েক মেগাটন সালফার উগরে দেয় আকাশের দিকে। তোমরা অবশ্যই ছবি দেখেছ, কিন্তু এর উপর ঝুলে থাকা যে কতটা মানসিক চাপের ব্যাপার সেটা কল্পনাও করতে পারবে না। আমি ফিরে আসতে পারলেই বাঁচি, অথচ অপেক্ষা করছি এরচে রহস্যময় কিছু একটার জন্য। হয়ত জিনিসটা আইওর চেয়ে অনেক বেশি ভয়াল, কে জানে?

ছ নম্বর বিস্ফোরণের সময় আমি উড়েছিলাম কিলাওয়ার উপর, সেটাও ভয়ংকর, কিন্তু এর সাথে কোনো… কোনো দিক দিয়েই তুলনা করা যায় না। এখন আমরা রাতের আকশের উপর। রাতটাই মাটি। একটু দেখলেই অনেক ভাবার উপাদান পেয়ে যাবে। আমি যেমন দোযখে যাওয়ার ভয় পাই এটা দেখতে ঠিক তেমন…

অনেক সালফার লেকই আলো দেয়ার মতো গরম, কিন্তু আলোেটা আসে মূলত বিদ্যুৎ চমক থেকে। কয়েক মিনিট পর পরই মনে হয় উপগ্রহটা ফেটে পড়বে। যেন একটা দানবীয় ফটোফ্ল্যাশ এর উপর দিয়ে চলে যায়। উদাহরণটা খারাপ হল না, কী বল? আইও আর বৃহস্পতির সংযোগ হল বিরাট ফ্লাক্স টিউব। সেটা দিয়ে প্রতি মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ অ্যাম্পিয়ার বিদ্যুৎ বয়ে যায়। যখন তখন সেখানে কিছু না কিছু দুর্ঘটনা ঘটছেই। এরপর হঠাৎ সৌরজগতের সবচে বড় বিদ্যুৎ চমকের আলো দেখেই আমাদের সার্কিট ব্রেকারের অর্ধেক লজ্জা পেয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে।

ঠিক এখনো একটা বিস্ফোরণ হল, বিরাট এক মেঘ আসছে আমাদের দিকে, সূর্যালোকের সিঁড়ি বেয়ে। কবে যেন ধরেই ফেলে। অবশ্য ভয় নেই, এত উপরে উঠে ধরে ফেললেও আর তেমন ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু এই বিস্ফোরণের ক্ষুধার্ত মহাকাশের দানব-আমাদের না খেতে পারলে তার শান্তি নেই।

এখানে এসেই আমার মনে হল আইও কিছু একটা মনে করিয়ে দিতে চায়। দু দিন কাজ করেছি এ নিয়ে। শেষে মিশন আর্কাইভের সাহায্য নিতে হল-শিপের লাইব্রেরি কোনো কাজেই লাগেনি। মনে আছে, কীভাবে দ্য লর্ডস অব দ্য রিংস এর সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম দিমিত্রি? আমরা তখন ছোট, অক্সফোর্ড কনফারেন্সে ছিলাম। এই আইও হচ্ছে সেই মোরভোর, তৃতীয় অধ্যায়ে দেখ। সেখানে একটা প্যারায় লেখা, …গলা পাথরের নদী হয়ত তাদের পথ হবে… যে পর্যন্ত তারা শান্ত না হয়, মরা ড্রাগনের মতো কুঁচকে শুয়ে না পড়ে ব্যথায় ভরা বসুন্ধরায়। এ হল খাঁটি উদাহরণ। কীভাবে টোকেন পঁচিশ বছর আগেই আইওর খবর জানতো কে জানে! এটা প্রকৃতিকে নকল করে লেখা উপন্যাস হওয়ার কথা।

যাক, আমাদের সেখানে ল্যান্ড করতে হচ্ছে না। আমাদের চীনা সহকর্মীরা এমন করতে চাইলেও আমি তা ভাবতে পারি না। একদিন সম্ভব হতে পারে। কিছু কিছু এলাকা একেবারেই শান্ত দেখায়, সালফারের জোয়ার সেখানে কম।

কদিন আগে কে বিশ্বাস করতে পারত যে আমরা বৃহস্পতি ছাড়িয়ে ওপাশের কক্ষপথে এসে পৌঁছব সবচে বড় গ্রহকে হেলা করে! এবার আমরা তাই করছি। না বৃহস্পতি, না আইও, আর না ডিসকভারি। আমরা খুঁজছি সেই… আর্টিফ্যাক্টটা। কোনো এক সভ্য প্রাণীর বানানো কৃত্রিম একটা জিনিস, প্রাকৃতিক নয়। চাঁদেরটা নয়, বৃহস্পতিরটা।

ওটা এখনো দশ হাজার কিলোমিটার উপরে, মুক্ত এলাকায়। কিন্তু যখনি টেলিস্কোপ দিয়ে তাকাই, মনে হয় একেবারেই মসৃণ। যত কাছেই জুম করি না কেন, একই রকম মসৃণ-চোখে দেখে শেষ করা যায় না। দু কিলোমিটার লম্বা, যদি কঠিন হয়ে থাকে তো ওজন হবে শত শত কোটি টন।

আসলেই পুরোটা খাঁটি? এ থেকে কোনো রাডার প্রতিদ্বন্দ্বী হয় না। যখন আমাদের দিকে ফিরে থাকে তখনো না। আমাদের চোখে এটা তিন লাখ কিলোমিটার নিচের বৃহস্পতির মেঘের রাজ্যে বসিয়ে দেয়া কালো এক শ্লেট।

আকারের অনুপাতটা বাদ দিলে হুবহু সেই চাঁদের মনোলিথই যেন।

কালকে আমরা ডিসকভারিতে যাচ্ছি। তাই জানি না আবার কখন সময়-সুযোগ হবে কথা বলার। কিন্তু পুরোনো বন্ধু, শেষ করার আগে আরো একটা কথা বলার থাকে।

ক্যারোলিনের ব্যাপারে কিছু কথা… সে কখনোই বুঝতে চায়নি কেন পৃথিবী ছাড়তে হচ্ছে আমাকে। এ একটা ব্যাপারে ভয় পাই, ও হয়ত কখনোই আমাকে ক্ষমা করবে না। কোনো কোনো মেয়ে মনে করে ভালবাসাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না-বরং শুধু ভালবাসাই সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। হয়ত তারাই ঠিক… যেই ঠিক হোক, এখন আর এসব যুক্তি দেখানোর মানে নেই।

সুযোগ পেলেই ওকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করো। ও মেনইল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার কথা বলে। মাঝে মাঝে ভয় হয় ও যদি… তুমি যদি ওর কাছাকাছি না

যেতে পার তো ছেলেটাকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করো। আমি যতোটা বলি, তারচে অনেক বেশি মিস করি ক্রিসকে।

ও আংকল দিমিত্রিকে বিশ্বাস করবে-যদি তুমি বল যে বাবা আজও ওকে একই রকম ভালবাসে এবং সুযোগ পেলেই যত তাড়াতাড়ি পারে চলে আসবে।

১৭. ডিসকভারিতে

সবচে বেশি সুবিধার সময়েও কোনো পরিত্যক্ত অকেজো স্পেসশিপকে কজা করা চাট্টিখানি কথা না। আসলে কাজটা সোজা-সাপ্টা বিপজ্জনক।

ওয়াল্টার কার্নো জানে, এ-ই পরম সত্য; কিন্তু নিজের ভিতরে ব্যাপারটা আগে এভাবে অনুভব করেনি শতমিটার লম্বা ডিসকভারিকে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরতে দেখে যেভাবে বুঝতে পারছে-তারা অবশ্য এখন নিরাপদ দূরত্বে। কয়েক বছর আগের সংঘর্ষে ডিসকভারির সামনের গোল অংশটার ঘোরা বন্ধ হয়ে যায়, যেটাকে লোকজন করোসেল বলে। এর ফল হল ভয়ংকর। আগে করোসেলকে ঘুরতে হত নিজের অক্ষে, ফলে ডিসকভারির সামনের অংশে অভিকর্ষ থাকত কিছুটা, সে ঘোরাটা পরিবর্তিত হয়ে এখন সারা ডিসকভারিই ঘোরে! কোনো এক ড্রাম বাদকের ছুঁড়ে দেয়া কাঠির মতো শিপটা নিজের অর্বিটে ঘুরছে ধীরে ধীরে।

প্রথম সমস্যা হল সেই ঘোরাটাকে বন্ধ করা। মরার ঘূর্ণন ডিসকভারিকে শুধু নিয়ন্ত্রণের বাইরেই নিয়ে যায়নি, বরং করেছে অগম্য। ম্যাক্স ব্ৰেইলোভস্কির সাথে স্যুট পরে নিয়ে কানোর নিজেকে খুব অযোগ্য মনে হল, এটা তার কাজ না। সে এর মধ্যেই মুখ আঁধার করে ব্যাখ্যা করেছে, আমি একজন স্পেস ইঞ্জিনিয়ার, স্পেস মাংকি নই যে লাফালাফি করে শিপ পার হব।

কিন্তু করতেই হবে কাজটা। আর একমাত্র তারই সে দক্ষতা আছে যা দিয়ে ডিসকভারিকে আইওর গ্রাস থেকে রক্ষা করা যায়। ম্যাক্স বা তার সহকর্মীরা অপরিচিত সার্কিট ডায়াগ্রাম নিয়ে কাজ করে, তারা আরো প্যাঁচ লাগাবে। কাজ করতে গেলে জ্বালানি ঠিক করে সব নির্ধারণ করে একে পথে নিয়ে আসতে এত সময় লাগবে যে ততোক্ষণে ডিসকভারি আইওর মুখেও পড়ে যেতে পারে।

হেলমেট মাথায় নেয়ার সময় ম্যাক্স প্রশ্ন করল, তুমি ভয় পাওনি, ঠিক?

আমার স্যুট নষ্ট করার মতো ভয় পাইনি। এটাকে হিসাবের বাইরে রাখলে… পেয়েছি।

ম্যাক্স মুখ বাঁকিয়ে হাসি দিল, আমার বলা দরকার, এটুকু ভয় এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয়। নাহলে তোমার মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠত। এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তোমাকেও একটা দিব। কী যেন নাম দিয়েছ ওগুলোর?

ঝড়র কাঠি। ক্ৰমস্টিক। কারণ ডাইনীরা এগুলোতে চড়েই উড়ে বেড়ায়।

ও, হ্যাঁ–ব্যবহার করেছ কখনো?

চেষ্টা করেছিলাম একবার, কিন্তু আমারটা চলে যায় দূরে। সবার চোখে ব্যাপারটা মজার; শুধু আমার চোখগুলো ছাড়া।

সব পেশার জন্য ঠিক করা থাকে কিছু জিনিস-খালাসীদের হুক, কুমারের চাকতি, মিস্ত্রির খুন্তির মতো যন্ত্র, ভূতত্ত্ববিদের হাতুড়ি… যেসব মানুষ জিরো গ্র্যাভিটিতে নির্মাণকাজ করে তাদের অতি দরকারি এক যন্ত্র এই ক্ৰমস্টিক, এর উন্নয়ন হয়েছে এজন্যই। খুবই সরল যন্ত্র; এক মিটার লম্বা ফাঁপা টিউবের একপ্রান্তে পা-দানি আর অন্যপ্রান্তে টানা যায় এমন এক বাকানো ফাঁদের মতো অংশ। এক বাটনের চাপেই এর দৈর্ঘ্য পাঁচ-ছ গুণ হতে পারে। ভিতরে কম্পন শুষে নেয়ার অংশ আছে, তাই একজন দক্ষ কর্মী এ দিয়ে ভালই কাজ করতে পারবে। পা-দানিটাও প্রয়োজনে হুক হয়ে যেতে পারে। পরে আরো হাজারবার হাজারো পরিবর্তন আর ডিজাইন আনা হয়েছে, কিন্তু এ হল বেসিক ডিজাইন। ব্যবহার দেখতে খুবই সহজ, কাজে ততটা সহজ নয়।

এয়ারলক পাম্পের বাতাসের চাপ সমান করার কাজ শেষ হয়ে এক্সিট লেখা চলে এসেছে; দরজাগুলো খুলে গেলে তারা আস্তে ভেসে বেরিয়ে গেল বাইরের বিশাল শূন্যতায়।

দুশ মিটার দূরে ডিসকভারি ঘুরছে উইন্ডমিলের মতো, আইওর অর্বিটে তাদের পিছন পিছন আসছে এগিয়ে। আইওর দখলে আধখানা আকাশ, পেছনের বৃহস্পতিও দেখা যায় না। এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তাদের নিজেদের বাঁচাতে হবে আইও আর বৃহস্পতির মাঝে বয়ে যাওয়া ফ্লাক্স টিউবের হাত থেকে সেটা করতে হলে দু গ্রহের সংযোগে থাকা চলবে না। এত কিছুর পরেও তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা অত্যন্ত বেশি। আরেক আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য পনের মিনিট সময়ও হাতে নেই।

সময়মতো কানোর স্যুটে সমস্যা দেখা দিল, পৃথিবী ছাড়ার সময় এটা আমার গায়ে ঠিকমতো লেগেছে। সে বলল আফসোসের সুরে, কিন্তু এখন আমার অবস্থা বাদামের খোসার ভিতর বাদামের মতো।

স্বাভাবিক, ওয়াল্টার। রেডিও সার্কিটে নাক গলিয়ে বলল সার্জন কমান্ডার রুডেঙ্কা, হাইবারনেশনে দশ কেজি ওজন কমে, তোমার জন্য ভালই হত কিন্তু এরি মধ্যে ফিরে এসেছে তিন কিলো।

সুন্দর একটা জবাব খুঁজে পাওয়ার আগেই সে নিজের শরীরটাকে শিপের বাইরে ভেসে যেতে দেখল।

রিল্যাক্স কর, ওয়াল্টার। বলল ব্রেইলোভস্কি, ঘুরতে শুরু করলেও জেট গ্লাস্টার অন করো না, দেখা যাক কী করতে পারি।

কার্নো কমবয়েসি ছেলেটার ব্যাকপ্যাক থেকে আসা হালকা ধোয়া দেখতে পাচ্ছে, সেটার ছোট্ট জেট ইঞ্জিনই তাদের নিয়ে যাচ্ছে ডিসকভারির দিকে। প্রত্যেক ছোট ধোয়া-কুণ্ডলীর সাথে সাথেই দুই শিপের মাঝের দড়ি ধরে আরো এগিয়ে যায় ওরা। একটা ইয়ো-ইয়ো যেমন পৃথিবীর বুকে ওঠানামা করে, সেভাবেই ঝুলতে ঝুলতে এগুচ্ছে সামনে।

পরিত্যক্ত শিপটার দিকে যাওয়ার আর কোনো নিরাপদ উপায় নেই। ডিসকভারি যে অক্ষ ধরে ঘোরে সেটার কাছাকাছি পৌঁছতে হবে। ডিসকভারির ঘূর্ণন কেন্দ্র প্রায় শিপটার মাঝামাঝি, মূল অ্যান্টেনা কমপ্লেক্সে। ব্রেইলোভস্কি এ পথ ধরেই যাচ্ছে সরাসরি-তার কাঁধে ভীত অংশীদার। কার্নো নিজেকেই প্রশ্ন করে, দুজনকেই কীভাবে থামাব একসাথে?

এখন তাদের সামনের আকাশে বোকার মতো ঘুরছে ডিসকভারি, দেখতে অনেকটা যেন ডাম্বেল। যদিও এটার এক একটা ঘূর্ণন শেষ করতে কয়েক মিনিট সময় নেয়, তবু প্রান্তের দিক বেশ জোরেই ঘুরন্ত। ওয়াল্টার কার্নো সেগুলো উপেক্ষা করে সামনের অনড় জায়গাটুকুর দিকে তাকালো।

আমি সামনের ঐদিকটা টার্গেট করে যাচ্ছি। বলল ব্রেইলোভস্কি, সাহায্যের চেষ্টা করো না আর সামনে যাই হোক অবাক হওয়ার দরকার নেই।

আচ্ছা, ও যাই হোক দিয়ে কী বোঝাতে চায়? নিজেকেই জিজ্ঞেস করল কার্নো। এর মধ্যেই অবাক না হওয়ার জন্য মনকে প্রস্তুত করে নিয়েছে খানিকটা।

পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই সব ঘটে গেল। ব্রেইলোভস্কি ক্ৰমস্টিক ট্রিগার টিপে দিয়ে চার মিটার দূরে শিপের সাথে যোগাযোগ করে একদিকে, অন্যদিকে ক্ৰমস্টিক ভেঙে যাওয়া শুরু করে। শক এবজর্ভিং অংশ ব্রেইলোভস্কির সাধারণ ভরবেগ সামলে নেবে সহজেই। কিন্তু কার্নো আশা করেছিল তাকেও অ্যান্টেনা মাউন্টের দিকে নিয়ে যাবে; এখানেই সমস্যা। জিনিসটা আবারো দ্রুত প্রসারিত হয়ে রাশিয়ানের ভরবেগ সামলে নিল, কিন্তু দুজন থাকায় ম্যাক্স ঠিকই ডিসকভারির গায়ে ধাক্কা খেয়ে একই গতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। কার্নোর পাশ দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে আবার মহাশূণ্যে পড়ে ছিটকে। ভয় পাওয়া আমেরিকানের হাতে শুধু একটা চিকণ হাসি দেয়ার সময় ছিল যখন ম্যাক্স তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। বেচারা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সব সময়।

ধরে রাখা লাইনে দ্রুত একটু ঝাঁকি উঠেই বড়সড় ঢেউ আসে। বিপরীত গতি প্রায় শেষ; আপাতত তারা ডিসকভারির সাপেক্ষে অনড়। কার্নো কোনোমতে সামনের হাতলে পৌঁছতে পেরেই দুজনকে টেনে আনল ভিতরের দিকে।

কখনো রাশিয়ান রোলেট খেলার চেষ্টা করেছ? সে প্রশ্ন করে দম ফিরে পেয়েই।

না-এটা আবার কী?

সময় পেলে অবশ্যই শিখিয়ে দেব। খেলাটা এ কাজের মতোই। বিরক্তি আনতে কোনো জুড়ি নেই।

আশা করি ওয়াল্টার তুমি ম্যাক্সকে কোনো ভয়ংকর কাজ করতে বলবে না, ঠিক? ডক্টর ডেস্কো এমনভাবে কথাটা বলল যেন সে সত্যি সত্যি আঘাত পেয়েছে। কার্নো মনে মনে ঠিক করে ফেলে, জবাব না দেয়াই নিরাপদ; প্রায়ই রাশিয়ানরা তার অদ্ভুত রসিকতা বুঝতেই পারে না। তুমিতো আমাকে প্রায় বোকা বানিয়ে ছেড়েছিলে… সে এত আস্তে আস্তে বলল যাতে মেয়েটা শুনতে না পায়।

এর মধ্যেই তারা বাইরে দিয়ে পৌঁছে গেছে ঘুরতে থাকা শিপের কেন্দ্রে সে আর এটার ঘূর্ণনের ব্যাপারে চিন্তা করে না-বিশেষত তার দৃষ্টি ধাতব প্লেটগুলোর উপরে পড়ার পর। সামনের মইটা অনেক বড়, ডিসকভারির মূল গঠন যে লম্বা শরীর-মই চলে গেছে সেটার বাইরে দিয়ে। গোল কমান্ড মডিউল আর এর পেছনের অংশটা মনে হচ্ছে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে; যদিও সে ভালমতোই জানে যে সে দূরত্বটা মাত্র পঞ্চাশ মিটার।

আমিই আগে যাচ্ছি। দুজনের দড়িকে পেঁচিয়ে নিতে নিতে বলল ব্ৰেইলোভস্কি, মনে রেখ, পাহাড়ের নিচু ঢাল ধরে নামার মতো হবে। কোনো চিন্তা নেই, এক হাতেই ধরে রাখতে পারবে নিজেকে। এমনকি একদম নিচেও মাধ্যাকর্ষণ দশভাগের একভাগ। এ কাজটাই হল… যেটাকে তুমি বল একদম সহজ, চিকেনশিট-মুরগির ইয়ে…

মনে হয় তুমি চিকেনফিডের কথা বলছ। যদি তোমার কাছে বিষ্ঠা আর খাবার একও হয়, তবু আমিই আগে যাব। উল্টোদিক উপরে দিয়ে মই বেয়ে নামতে পছন্দ করি না; তা অভিকর্ষ যত কমই হোক না কেন।

এর দরকার ছিল, কার্নো জানে। তার এই প্রায় দ্র ঠাট্টার জোরে সে অনেক ক্ষেত্রেই জিতে যায়। নাহলে হয়ত উপেক্ষা করা হতো। তাছাড়া এ ব্যাপারটা পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে অনেক কমিয়ে দেয়। বাড়ি থেকে শতকোটি কিলোমিটার দূরে; ঢুকছে মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে সবচে বিখ্যাত পরিত্যক্ত দেহের ভিতরে, যেটা দেখেছে তার সব কুকে একে একে শেষ হয়ে যেতে। একে একবার এক সাংবাদিক বলেছিল স্বর্গের দরজা; তবে পাপীরাও এ দরজা ধরে নরকে যেতে পারবে-তুলনাটা মোটেও খারাপ নয়। এসব ছাড়াও পরিবেশকে আরো মজাদার করার ব্যবস্থা আছে, নিচের দুঃস্বপ্নের মতো আধ আকাশ ভরা চাঁদটাকে মন থেকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করলেও বেহায়ার মতো সে বাদ পড়ে না। যতবার কার্নো ডিসকভারির মই-হাতলে হাত দেয়, ততবার সালফারের ধুলোয় ভরে ওঠে গ্লাভস।

অবশ্যই ব্রেইলোভস্কির কথা ঠিক, এ শিপের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘোরার জন্যে যে অভিকর্ষ তৈরি হয় তাকে সহজে মোকাবিলা করা যাবে। এটা ব্যবহার করে উল্টো কার্নোর সুবিধা হচ্ছে, পাওয়া যাচ্ছে দিকনির্দেশ।

তখন হঠাৎ করেই তারা সেই বিরাট গোলকের বাইরের অংশে চলে গেল যেটাকে বলা হয় ডিসকভারির কন্ট্রোল ও লাইফ সাপোর্ট মডিউল। মাত্র কয়েক মিটার দূরেই সেই ঐতিহাসিক ইমার্জেন্সি হ্যাঁচ।

আশা করি ভিতরে যেতে পারব। বলল ব্রেইলোভস্কি, সারাপথ কষ্ট করে এসে হ্যাঁচ লক করা পেলে ব্যাপারটা খুব করুণ হবে, তাই না?

সে এয়ারলক স্ট্যাটাস লেখার উপরের সালফার আবরণ সরিয়ে হতাশ হল।

মরা, অবশ্যই। দশটা বছর… আমি কি ম্যানুয়ালি কন্ট্রোল করার চেষ্টা করব?

করলে ক্ষতি নেই-তবে লাভও নেই।

তোমার কথাই ঠিক, আচ্ছা… ম্যানুয়ালি যাচ্ছি…

বাঁকাচোরা দেয়ালের চুলের মতো চিকণ রেখাটাকে বড় হতে দেখা এবং তা থেকে হাল্কা ধোয়ার স্পেসে বেরিয়ে যেতে দেখাটা ভয়ংকর। সাথে একটা ছোট কাগজের টুকরোও হারিয়ে গেল মহাকাশে। কোনো মেসেজ নাকি? তারা কোনোকালেই জানবে না। জিনিসটা একইভাবে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে গেল তারার মেলার ওপাশে।

ব্রেইলোভস্কি অনেকক্ষণ ধরে ম্যানুয়াল কন্ট্রোলটা ঘোরাচ্ছে। কালো, রাগী চেহারার পথটা এক সময় গেল খুলে। কার্নো আশা করেছিল অন্তত ইমার্জেন্সি লাইটগুলো এখনো কাজ করছে, কিন্তু তেমন ভাগ্য নেই তার।

তুমিই এবার বস, ওয়াল্টার। আমেরিকান এলাকায় স্বাগতম।

ভিতরে ঢুকে পরিবেশটা তেমন স্বাগত মনে হচ্ছে না। অন্তত তার হেলমেটের আলো চারপাশে পড়ার পর এমন কথা মনে হতেই পারে। যতটুকু মনে পড়ে তার, সবতো ঠিকই আছে। এরচে বেশি কী আশা করেছিলাম আমি? রেগে নিজেকেই প্রশ্ন করল সে।

ম্যানুয়ালি দরজাটা বন্ধ করতে সময় লাগল আরো বেশি, কিন্তু আর কোনো বিকল্প নেই পাওয়ার ফিরে আসার আগ পর্যন্ত। বন্ধ করে দেয়ার আগের মুহূর্তে কার্নো বাইরে তাকানোর একটু ঝুঁকি নিল।

বিষুবরেখার কাছাকাছি একটা দোলায়মান নীল সমুদ্র দেখা যায়, নাকি হ্রদ? সে নিশ্চিত, এটা কয়েক ঘণ্টা আগেও সেখানে ছিল না। উজ্জ্বল হলুদ আলো হল সোডিয়ামের গলিত রূপের বহিঃপ্রকাশ। আলোটা দেখা যায় হ্রদের আশপাশে। আর রাতের পুরো আকাশ প্লাজমা ডিসচার্জে ভরা। প্লাজমার ভৌতিক নিঃসরণ এ উপগ্রহের এক নিয়মিত ছবি।

ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্নের উপাদান এটা। এ-ও যেন যথেষ্ট নয়, এর পরও এক পাগলাটে শিল্পীর পরাবাস্তবতার আরো বহু আঁচড় পড়েছে এর উপর। সরাসরি আগুনের উৎসগুলো থেকে উঠে এসে অদ্ভুত জ্বলন্ত উপগ্রহের আগুন-গোলাগুলো যেন শেষ হয়ে যাওয়া কোনো বুলফাইটারের চোখ, যে মৃত্যু দেখছে সামনে। আর সেই মৃত্যু হল চিকণ হয়ে যাওয়া চাঁদটার দেহ, যেন পাগলা ষাড়ের প্রকাণ্ড শিং।

চিকণ চাঁদের মতো উঠে আসছে বৃহস্পতি। এর অর্বিটে একই পথে চলতে থাকা ডিসকভারি আর লিওনভকে যেন সে স্বাগত জানাবে।

১৮. উদ্ধার অভিযান

অদ্ভুতভাবে ভূমিকা উল্টে গেছে পেছনের হ্যাঁচটা বন্ধ হওয়ার পরই। তৃপ্তি লাগছে কার্নোর। ও এখন নিজের বাড়িতেই। আর ঠিক উল্টোটাই যেন খাটে ব্ৰেইলোভস্কির বেলায়। ডিসকভারির ভিতরের পিচ-কালো করিড়োর আর টানেলের গোলক ধাঁধা তাকে স্বস্তি দিচ্ছে না মোটেও। ম্যাক্স-এ শিপ সম্পর্কে যা জানে তা শুধুই ডিজাইন ড্রয়িং দেখে দেখে। আর কার্নো ডিসকভারির এখনো জন্ম না নেয়া জমজের উপর মাসের পর মাস এত্তো কাজ করেছে যে চোখ বাঁধা অবস্থায় অলিগলি ছুঁড়ে বেড়াতে পারবে-বেশ আরামেই।

কাজ এগুনো খুবই কঠিন। এ অংশটা তৈরিই হয়েছে জিরো গ্র্যাভিটির জন্য। আর অনিয়ন্ত্রিত পাকচক্র এটাকে উপহার দিয়েছে কৃত্রিম অভিকর্ষ। তাও ভাল-কিন্তু গতিটা সব সময়ই আরো বেশি অসুবিধা গড়ে দিচ্ছে কাজের জন্য।

আমাদের প্রথমে যা করণীয়, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল কার্নো, একটা হ্যান্ডহোল্ড ধরার আগে কয়েক মিটার পিছলে গিয়ে, এ মরার বনবনানি থামানো… কিন্তু ইঞ্জিন ছাড়া কোনোকালেও সম্ভব না। আল্লা আল্লা করে শুধু এটুকুই আশা করি যে, ডেভ বোম্যান স্পেসশিপটাকে এতিম করে যাওয়ার আগে যন্ত্রপাতির প্রতি একটু হলেও দয়া দেখিয়েছে।

ও শিপকে মরুভূমি করে চলে গেছে-তুমি শিওর? তার ফিরে আসার ইচ্ছা ছিল হয়ত।

হতে পারে। মনে হয় না কোনোকালে আমরা জানতেও পারব। ও নিজেও যদি নিজের ভিতরটা জানত… সেটাকেও বড় করে দেখা যায়।

ওরা এরই মধ্যে পোড বে তে চলে এসেছে। এটা ডিসকভারির স্পেস গ্যারেজ। সাধারণত এখানে তিনটা আয়তাকার মডিউল থাকে। প্রতিটায় চড়তে পারে মাত্র একজন। স্পেসশিপের বাইরের টুকটাক কাজেই বেশি ব্যবহার করা হয় এগুলোকে। শুধু তৃতীয় পোডটা বাকি। প্রথম খোসাটা ফ্র্যাঙ্ক পোলের রহস্যময় অ্যাক্সিডেন্টে খোয়া গেল। দু নম্বরটা আছে ডেভ বোম্যানের সাথেও যেখানেই থাক না কেন গত দশ বছর ধরে।

পোড বে টায় দুটা বাড়তি স্পেস স্যুটও দেখা যায়। হেলমেট ছাড়া এগুলোকে ভাল দেখাচ্ছে না। মুণ্ডু কাটা এক জোড়া ঝুলন্ত লাশ। আন্দাজ করতে কষ্ট হয় না–এগুলো দশ বছর ধরে দুজনের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রতীক্ষা তাদের জন্য যারা হাজার বছরেও ফিরে আসবে না। ব্ৰেইলোভস্কির স্যুটটা হয়ত ওদের দুরবস্থা দেখে কাজ বন্ধ করে দেবে।

কার্নোর রসজ্ঞান-বলা ভাল কোনো কোনো ক্ষেত্রে দায়িত্বজ্ঞানহীন রসজ্ঞান এ মুহূর্তে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অবশ্য এটা দুঃখজনক হলেও অবাক করা ব্যাপার না।

ম্যাক্স, ও একটা ভয়াল সিরিয়াস সুরে বলল, প্লিজ স্পেসশিপের বিড়ালের পেছনে দৌড়াতে যেও না।৯৭।

কয়েক মিলিসেকেন্ডের জন্য ব্রেইলোভস্কি অতলে পড়ে গেল। খুব একটা সহজ না হয়েই বলল, আশা করি তুমি ওটা বোঝাওনি… সাথে সাথেই সংযত করল নিজেকে। এখন দুর্বলতা প্রকাশের সময় না। আবার বলল, যে আমাদের লাইব্রেরিতে ঐ ছায়াছবিটা রেখেছে তাকে দেখে নেব।

সম্ভবত ক্যাথেরিনা। প্রত্যেকের সাইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স পরীক্ষার জন্য। যাই হোক, গত সপ্তায় ছবিটা দেখার সময় তুমি ঘর ফাটিয়ে হেসেছিলে।

ব্রেইলোভস্কি একদম চুপসে গেল-কার্নো ভুল কিছু বলেনি। সে সময়টা নিজের স্পেসশিপ লিওনভে উষ্ণ আর আলোয় ভরা পরিবেশে ও কাটিয়েছে বন্ধুদের মাঝে-কোনো পিচ কালো বরফ হয়ে যাওয়া স্পেসশিপে নয়। যেভাবেই বলা হোক না কেন, এ শিপটা ভূতে পাওয়া। একবার যেহেতু এলিয়েন পশু দেখা দিয়েছে বৃহস্পতির কোথাও-আর ভয় না পাবার যুক্তি খোঁজার দরকার নেই। এখন কোনো এক অপ্রতিরোধ্য এলিয়েন জন্তুর কল্পনা করা একেবারে সহজ যে আঁধার করিডোরগুলো বেয়ে চলেছে এমন কিছু পাওয়ার আশায় যা হয়ত সে দশ বছর ধরে খাচ্ছে না। আঁধার খুব ভয়াবহ। কোনো মানুষের সাহস মাপার শ্রেষ্ঠ নিক্তি হতে পারে ডিসকভারি। বাসা থেকে শত শত কোটি মাইল দূরে, শিকারী এলিয়েনের এলাকায় দশ বছরের রহস্যঘেরা আর আইওর সালফার ধুলায় বোঝাই এক শিপ যা শুধু অন্ধকারে ভরা, যার পাঁচ সদস্যই তিনটা আচমকা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিল। সেই স্পেস ক্রুদের লাশ যে নেই তাই বা কে জানে?

এর পুরোটাই তোমার দোষ-দাদী (হয়ত তুমি আজ সাইবেরিয়ান তুন্দ্রা অঞ্চলে তোমার ভালবাসা মাখা কঙ্কাল নিয়ে শুয়ে আছ।)-আশা করি আমার মনটাকে সারা জীবনের জন্য ঐসব ভয়াল রূপকথায় ভরে দাওনি। আজও চোখদুটো বন্ধ করলে সেই বাবা যোগীকে দেখি যে সবুজ বনের মাঝে থাকা তার ছোট্ট কুঁড়ের ভেতর থেকে মাংস ছাড়া মুরগীর পাগুলো পরিষ্কার করছে…

যথেষ্ট হয়েছে। আমি একজন মেধাবী তরুণ ইঞ্জিনিয়ার যে রাশিয়ার সবচে গুরুত্ববহ মহাকাশ মিশনে সবচে বড় চ্যালেঞ্জ সাফল্যের সাথে মোকাবিলা করবে। আমি যে প্রায়ই ভয় পাওয়া এক ছোট ছেলে তা কস্মিনকালেও আমেরিকান বন্ধুকে জানাতে চাই না…

ডিসকভারি এবার আলোর দিকে। ভেতরে সেই একই অন্ধকার। শব্দটা ভয় কাটাতে মোটেও সাহায্য করল না-বরং আরো বাড়িয়ে দিল। অনেক শব্দ। সেগুলো এত ক্ষীণ যে স্পেস স্যুটের আওয়াজ ছাপিয়ে অভিজ্ঞ একজন অ্যাস্ট্রোনট ছাড়া আর কেউ ধরতে পারবে না। কিন্তু ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কি মৃত্যুপুরীর নিরবতায় কাজ করে করে একজন অভ্যস্ত মানুষ। শব্দগুলো উল্টো পথে স্নায়ুতে আঘাত করছে যদিও ও ভালমতোই জানে যে এটাই নিয়ম, হঠাৎ করে আলোতে গেলে ছোটখাট ক্যাচক্যাচ এমনকি বিস্ফোরণের শব্দও হতে পারে। কারণ শিপটি এক কয়লা আগুনের গোলার উপরে রোস্ট করতে থাকা কোনো প্রাণীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে গত দশ বছর। এটা বৃহস্পতীয় এলাকা, তাই যখন ডিসকভারি গ্রহরাজের পেছনে থাকে-তখন অকল্পনীয় ঠাণ্ডা। যখনি সূর্যের দেখা পাবে, তখন বরফের আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে সৌর জগতের আলোক দেবের কাছেতো অভিযোগ জানাবেই। আলো আর আঁধারের মাঝে এখানে সব সময়ই বড় ব্যবধান।

মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো এবার তার স্পেসস্যুটও সমস্যা শুরু করে। এখন ব্রেইলোভস্কি উভয় সংকটে। স্যুটের জয়েন্টের উপর কাজ করা সব শক্তি বদলে গেছে ভয়ংকরভাবে। এমনকি সে আর নিজের মনের গতিবিধি ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। আমি এক আনাড়ী-মাত্র নিজের ট্রেনিং শুরু করতে বসেছি… সে রেগে গিয়ে নিজেকেই বলতে লাগল। কোনো ঘটনা এ অবস্থাটা ভেঙে দেবে। এখনি…

ওয়াল্টার, চল এটমোস্ফিয়ার পরীক্ষা করে দেখি।

চাপ ঠিক আছে। তাপমাত্রা…কমই। শূন্য থেকে একশো পাঁচ ডিগ্রি কম।

দারুণ! রাশিয়ান আবহাওয়ার মতোই। আঁটসাট। যেভাবেই হোক, আমার স্পেসস্যুটের ভিতরের বাতাস ঠান্ডাটাকে দূরে সরিয়ে রাখবে।

আমরা এগিয়ে যাব। কিন্তু তার আগে আমার লাইটটা তোমার চেহারায় বুলিয়ে নিই। তুমি নীল হয়ে যেতে নিলে যেন বুঝতে পারি। কথা বলতে থাক।

ব্রেইলোভস্কি ওর ভিজর আনলক করে মুখের সামনের প্লেটটা সরিয়ে দিল। কয়েকটা বরফ শীতল আঙুল ওর গালে আদর বুলিয়ে দিলে ও লাফিয়ে ওঠে ভয়ানকভাবে। ঠিক ফিঞ্চের মতো-যেগুলো দানা খুঁটে খাওয়ার সময় মানুষ দেখলে লাফায়। এরপর একটা গভীর শ্বাস নিল-ভয় থেকে বেঁচে যাওয়ার শ্বাস।

ঠাণ্ডা… কিন্তু আমার লাংস এখনো জমে যাচ্ছে না। একটা মজার গন্ধ পাচ্ছি। পুরনো, একেবারে পুরোনোই মনে হচ্ছে, যেন কিছু একটা… ওহ! না! আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে হঠাই ব্ৰেইলোভস্কি ফেসপ্লেট নামিয়ে ফেলল।

কী ব্যাপার, ম্যাক্স? এই প্রথম ব্যগ্র মনোভাব নিয়ে প্রশ্নটা করল কার্নো। কোনো জবাব নেই ব্রেইলোভস্কির পক্ষ থেকে। দেখে বোঝাই যায় নিজেকে ফিরে পেতেই ব্যস্ত রাশিয়ান ইঞ্জিনিয়ার। আসলে ওকে দেখে মনে হচ্ছে ঐ চিরকালীন ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হবে এবার। অন্তত স্পেসসুটের জন্য আসলেই সব সময় ভয়াবহ। বমি করেই বসবে হয়ত।

দীর্ঘ নিরবতা। এরপর কার্নো ভরসা দেয়ার সুরে বলল, আমিই যাচ্ছি ভিতরে। সত্যি, আমি নিশ্চিত তুমি কোনো না কোনো ভুল করেছ। সবাই জানে, পোল হারিয়ে গেছে মহাশূন্যে। বোম্যান রিপোর্ট করেছে যে ও… আর সবাইকে বাইরে ফেলে দিয়েছে যারা মরেছিল হাইবারনেশনে থাকতেই। ডেভিড একজন মহাকাশযান অধিনায়ক আমরা ধরেই নিতে পারি কথাটা ঠিক। আর তার স্পেসস্যুটটাতো আমরা পোড বে তেই পেলাম। এখানে কেউ থাকতে পারে না। স্থানটা ভয়ানক ঠাণ্ডা। আরো কিছু বলে বসল নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা ভুলে গিয়ে, ঠাণ্ডাটা লাশকাটা ঘরের চেয়েও বেশি…

কিন্তু ধর। যেভাবেই হোক… অসুস্থ সুরে ফিসফিস করছে ব্ৰেইলোভক্তি, শুধু ধর যে বোম্যান শেষবারের মতো ফিরে এসেছে শিপে…আর মারা পড়েছে এখানেই।

কার্নো আস্তে করে তার ফেসপ্লেটটা তুলে ফেলার আগে একটা বিরাট নৈঃশব্দভরা সময় বয়ে যায় ডিসকভারিতে। এ সময়টায় ব্ৰেইলোভস্কি ওর দিকে তাকায়নি। যদি আর কারো ছায়া দেখা যায়-এ মানসিক অবস্থায় সেটা বিশ্বাস করে হার্টফেল করে মরে যেতে ও বোধহয় একটুও দেরি করবে না।

জমে যেতে থাকা লাংসের ভিতরে বাতাস ঢোকায় চেহারা কোঁচকায় কার্নো। এরপর নাক কুঁচকে ফেলল ঘৃণায়, এবার বুঝলাম কী বলতে চাও। কিন্তু তোমার চিন্তাকে তোমার নিজের সাথে দৌড়ে পালাতে দিচ্ছ কেন? আমি দশ বনাম এক রেটে বাজি ধরতে রাজি। গন্ধটা গ্যালি থেকে আসছে। সম্ভবত শিপ জমে যাওয়ার আগেই নষ্ট হয়ে গেছে কিছু মাংস। বোঝাই যায় বোম্যান কর্তা হিসেবে যথেষ্ট ব্যস্ত ছিল। গন্ধটা পরিচিত কেন জানেন? শুনলে হাসবে, অনেক ব্যাচেলরের অ্যাপার্টমেন্ট চিনি যেগুলো থেকে হুবহু এ গন্ধ আসে।

হয়ত তোমার কথাই ঠিক। আশা করি। তেমনি আশা করি…

অবশ্যই আমি ঠিক। আর যদি ঠিক না হই…আরে বাপ, পচা লাশ আর মাংসের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? আমাদের করার মতো কিছু কাজ আছে, ম্যাক্স। যদি ডেভ বোম্যান এখনো এখানে থেকেই থাকে, সেটা বিরাট সুবিধার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে পুরো মিশনের জন্য। আর এ নিয়ে মাথা ঘামানো আমাদের ডিপার্টমেন্টের কাজ না–ঠিক, ক্যাথেরিনা?

সার্জন কমান্ডারের কাছ থেকে কোনো উত্তরই এল না। ওরা শিপের এত ভিতরে চলে গেছে যে, রেডিও কাজ করার রেঞ্জ শেষ। আসলেই তারা শুধু তাদের কাজই করবে। জীববিদ্যা বিভাগের কাজের সাথে প্রকৌশলের তেমন কোনো মিল নেই। আস্তে আস্তে ব্রেইলোভস্কি সাহস ফিরে পায়।

ওয়াল্টারের সাথে কাজের সুযোগ পাওয়াটা ওর জন্যে বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার প্রায়ই নরম আর বন্ধুসুলভ আচরণ করে। ও পুরোপুরি যোগ্য-আবার দরকার পড়লে পেরেকের মতো কঠিন যা মোটের উপর প্রায় সবকিছু ভেদ করে যায়।

এ দলটা মন্দ না। হয়ত একত্রে ওরা ডিসকভারিকে জীবনে ফিরিয়ে নিতে পারবে, হয়ত পৃথিবীতেও।

১৯. অপারেশন উইন্ডমিল

ডিসকভারি চিরন্তন ক্রিসমাস ট্রির মতো জ্বলে উঠলে ভিতর-বাইরের লাইটগুলো এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ভাসিয়ে দিল আলোয়-লিওনভ থেকে আনন্দের ঢেউ যেন শূন্যের ভিতর দিয়ে এগিয়ে এসে ভরিয়ে দিল পুনর্জন্ম লাভ করা শিপটাকে। সেই আনন্দ ঢেউই হঠাৎ পরিণত হয় আফসোসে। আবার লাইট উধাও।

আধঘণ্টা সব চুপচাপ। ডিসকভারির অবজার্ভেশন উইন্ডোগুলোতে এলার্মের হালকা আলো খেলতে শুরু করে কয়েক মিনিট পর। কার্নো আর ব্রেইলোভস্কি ভিতরে ঘোরাঘুরি করছে-দেখল সবাই। সালফারের হালকা পরতের জন্য ওদের আবছা দেখায়।

হ্যালো…ম্যাক্স, ওয়াল্টার, আমাদের কথা শুনছ? তানিয়া অর্লোভা ডাকল ওদের।

সাথে সাথেই মূর্তি দুটো ঘুরে দাঁড়ায়। নাহ্, শুধু নিজেদের সাথে কথা বলার জন্যই। ডিসকভারির একেক কোণে একেক সময় নানা ধরনের আলো জ্বলে ওঠে। লিওনভ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। পোড বের একটা দরজা ধীরে খুলে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেল দ্রুত। বড় অ্যান্টেনাটা আড়মোড়া ভেঙে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দশ ডিগ্রি।

হ্যালো, লিওনভ, অবশেষে কার্নোর কণ্ঠ, স্যরি। তোমাদের অপেক্ষায় রাখলাম অনেকক্ষণ। কী করি বল? খুব ব্যস্ত ছিলাম আমরা।

যা দেখেছি তার উপর হিসেব করতে হয়েছে খুব দ্রুত। ডিসকভারি নিয়ে আমাদের ভয়টা ভুল। আশঙ্কার চেয়ে অনেক অনেক ভাল আছে শিপটা। হালের ক্ষতি হিসাবে না ধরলেও চলে। বায়ুচাপ স্বাভাবিকের পঁচাশি ভাগ। ভালভাবেই দম নেয়া যায়-একটা সমস্যা ছাড়া। আমাদেরকে শিপে একটা বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। চারদিকে স্বর্গীয় দুর্গন্ধ।

সবচে ভাল খবরটা হয়ত জান-পাওয়ার সিস্টেম একেবারে ঠিক। প্রধান রিয়্যাক্টর* মোটামুটি, ব্যাটারিগুলোর আকার আকৃতি খারাপ না। সব সার্কিট ব্রেকার খোলা-হয়ত ডেভ বোম্যান শিপ ছাড়ার আগে ওগুলোকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করেছিল-সুতরাং গুরুত্বপূর্ণ সব যন্ত্রপাতিই নিরাপদে আছে।

কিন্তু শিপকে আবার জীবন দেয়ার সময়ের মধ্যে এগুলোকে সম্পূর্ণ পরীক্ষা করাটা কঠিন হবে আমাদের জন্য।

কতক্ষণ লাগতে পারে? অন্তত লাইফ সাপোর্টগুলো আর ড্রাইভিং জিনিসপত্র ঠিকঠাক করতে? প্রশ্ন করল লিওনভ।

বলা কঠিন, ক্যাপ্টেন। ক্র্যাশ করার আগে হাতে আছে কদ্দিন?

কমপক্ষে এক হপ্তা নেবে চাঁদটার দিকে নেমে যেতে। তুমিতো জানই কীভাবে হিসাবটা ওঠানামা করে।

যাই হোক, যদি কোনো হঠাৎ টানে আমরা নেমে না যাই, আশা করি ডিসকভারিকে একটা নিরাপদ অর্বিটে টেনে নিতে পারব এই দোজখের দরজা থেকে।

কতদিন দরকার?

ও, বলিনি? সপ্তাখানেক।

কিছু দরকার?

না, ম্যাক্স আর আমি বেশ ভালভাবে কাজ করতে পারি। আবার একটা চক্কর মারব এখুনি। পুরো ব্যাপারটা আরেকবার খতিয়ে দেখে নিতে হয় যে…আমার এখন একটাই চাওয়া। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মহাকাশরথটাকে সচল করে তোলা।

ভুল হলে মাফ করো, ওয়াল্টার, কাজটা কি প্রয়োজনীয়? গ্র্যাভিটি মোটামুটি আরামদায়ক বলা যায়। কিন্তু আমরা কোনো অভিকর্ষ ছাড়াই সমাধান করেছি বহু সমস্যার।

আমি গ্র্যাভিটির নিকুচিও করি না। অবশ্য আকর্ষণটা চলাচলে সাহায্য করছে। বলা যায়। পুরো চক্রটাকে আবার চালিয়ে দিতে পারলে ডিসকভারির স্পিন বাঁধা পড়ে যাবে। এমনকি ঘোরাঘুরি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। ফলে এয়ারলকগুলো জুড়ে দিয়ে ই ভি এ বাদ দিতে পারব সহজেই। কাজ করাটা শতগুণ সহজ হয়ে যাবে।

ভাল আইডিয়া, ওয়াল্টার, কিন্তু তুমি কিছুতেই আমার শিপের সাথে ঐ কী বলে ইংরেজিতে… উইন্ডমিলকে মিলিয়ে ফেলতে যেও না। ধর কোনো একটা গণ্ডগোল হল আর ঐ অর্বিট চক্রটায়ও কোনো বিপদ এল নেমে…পরে কাজটা আমাদের সবাইকে কাঁদাবে।

মানলাম। আমরা ব্রিজের কাছে আসার আগে পেরুনোর চেষ্টা করব না। তাড়াতাড়িই যোগাযোগ করতে যাচ্ছি লিওনভের সাথে।

.

পরের দুদিন কেউ তেমন বিশ্রাম পায়নি। সময়টা কেটে যাবার পর কার্নো আর ব্রেইলোভস্কি ঘুমিয়ে পড়ে নিজেদের স্যুটেই। কিন্তু তার আগেই চষে ফেলেছে ডিসকভারি। মন খারাপের কিছুই পায়নি।

দেশ দুটোর স্পেস এজেন্সি আর স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রাথমিক রিপোর্টের পর স্বস্তি র নিঃশ্বাস ফেলল। ঠিক হওয়ার ফলেই মার্কিন সংস্থাগুলো তাদের পুরনো রাজনৈতিক চাল চালতে পেরেছে… ডিসকভারি কোনো কালেই পরিত্যক্ত ছিল না, বরং, সাময়িকভাবে অকার্যক্ষমকৃত যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ যান। আর এখনি শুরু হতে যাচ্ছে সেটার রিকন্ডিশনিংয়ের কাজ।

পাওয়ার নিয়ে সমস্যা নেই। পরের সমস্যাটা হল বাতাস। কারণ সব হাউজ ক্লিনিং যন্ত্রপাতিই ফেল মেরেছে এই মরার গন্ধটাকে সরানোর কাজে। কার্নোর কথাই ঠিক। গলিত খাবার। যখন রেফ্রিজারেশন সিস্টেম কিছু করতে পারেনি তখনই এগুলো পচতে থাকে। মহাকাশযানে জীবাণু কম বলে আস্তে-ধীরে গলেছে, তার উপর বিশাল ফ্রিজ থেকে একটু একটু করে গন্ধ বেরিয়ে এসেছে দেখে স্থায়িত্বও বেশি। কার্নোর কাছে অবশ্য এ ব্যাপারটাকে মোটেও বিরক্তিকর মনে হয়নি। বরং রোমান্টিক।

আমার শুধু চোখটা বন্ধ করতে হবে, সে বর্ণনা করছে, আর মনে হয় যেন অনেক আগেকার তিমি শিকারী কোনো জাহাজে চলে এসেছি। তুমি কি বাসী তিমির আসল গন্ধটা সম্পর্কে জানো, অথবা সারারাত শিকারের পর জাহাজ একদিন পরিষ্কার না করলে যে গন্ধ আসবে চেন সেটা?

ডিসকভারিতে একটা ভ্রমণ শেষ করে সবাই মেনে নিয়েছে যে এখানটাকে বুঝে নিতে খুব কম কল্পনাশক্তির প্রয়োজন। শিপের গুমোট বাতাসের সমস্যার সমাধান হয় বেশ ভালভাবে-অন্তত ম্যানেজ করে নেয়ার মতো অবস্থায় এখন ডিসকভারি। ভাগ্য ভাল যে এখনো রিজার্ভার ট্যাঙ্কে প্রচুর বাতাস পাওয়া যাচ্ছে। বড় সুসংবাদের একটা হল, প্রপেলারের নব্বইভাগ কার্যক্ষম। হাইড্রোজেনের বদলে এমোনিয়া বেছে নেয়ার পরও প্লাজমা ড্রাইভ ভালই কাজ করছে।

হয়ত কয়েক বছরের মধ্যে হাইড্রোজেনের বেশিরভাগ উবে গেছে প্রতিরোধ ব্যবস্থা আর বাইরের ভয়াল ঠাণ্ডা থাকা সত্ত্বেও। কিন্তু এমোনিয়ার সবটাই তরল। আর সেটুকুই পৃথিবীর কোনো এক নিরাপদ অর্বিটে নির্বিঘ্নে ফিরিয়ে নিতে যথেষ্ট-নিদেনপক্ষে রূপালী চাঁদের চারদিকে।

সম্ভবত ডিসকভারির প্রপেলারের মতো বনবনানিই শিপটাকে কজা করার পথে সবচে বড় বাঁধা। শাসা কোভলেভ কার্নো আর ব্রেইলোভস্কিকে তুলনা করল ডন কুইক্সোট আর শ্যাঙ্কো পাঞ্জার সাথে। তাদের উইন্ডমিল কজার কসরৎ সার্থক হবে এমন আশার কথাও শোনালো সবাইকে।

অবশেষে পরীক্ষার জন্য অনেকগুলো বিরতি নিয়ে ওরা শক্তি দিল করোসেলকে। বিশাল ড্রামটা দীর্ঘ দশ বছর পর নড়াচড়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। ডিসকভারি স্টার্ট করার জন্য খুব জটিল এক ধারা পেরিয়ে এসেছে তারা। আস্তে আস্তে প্রান্ত থেকে প্রান্তে ঘোরাটা বন্ধ হয়। এবার স্পিনিংয়ের শেষ চিহ্নটাও এটিচ্যুড কন্ট্রোল জেটের কারণে গায়েব হয়ে গেছে। ঘূর্ণন গতিহীনভাবে পাশাপাশি চলার আগ পর্যন্ত বেঁটেখাট লিওনভকে তাড়া করে বেরিয়েছে ডিসকভারি-লম্বা আকারের এক রহস্যময় স্পেসশিপ।

এখন একটা থেকে আরেকটায় যাতায়াত একদম সোজা। কিন্তু ক্যাপ্টেন অর্লোভা এখনো সরাসরি কোনো সংযোগ গড়তে দিতে রাজি নয়। প্রত্যেকেই তার সাথে একমত। কারণ ছোট দৈত্য আইও এগিয়ে এসেছে আরো। তাদের হয়ত এখনি এ যানটাকে ছেড়ে দিতে হবে। ছাড়তে হতে পারে স্পেসশিপ ডিসকভারি-যেটাকে বশ মানাতে ওরা এত কষ্ট করল।

তারা এখন ডিসকভারির অর্বিট ক্ষয়ের কারণ জানে, কিন্তু কোনো কাজেই আসবে না তথ্যটা। যতবার শিপটা বৃহস্পতি আর আইওর মাঝামাঝি এসেছে, ততবার এ দু দানোর অদৃশ্য প্রবাহ নলের কারণে সরে গেছে একদিকে। বিশ্ব থেকে বিশ্বে বয়ে চলা বিদ্যুতের এ মহানদী জাহাজকে একের পর এক আঘাতে আঘাতে ঠেলে দিয়েছে আইও নরকের দিকে। প্রতিবার।

প্রভাবের শেষ মুহূর্ত রুখে দেয়ার আর কোনো উপায় নেই। বৃহস্পতির একান্ত নিজের এক নিয়ম চলে এ এলাকায়। সেই অপ্রতিরোধ্য নিয়মের জন্যই চওড়া প্রবাহটা এতে প্রভাব ফেলবে। আইওর চারদিকের ভয়াবহ মেরুজ্যোতি-ঝড়ের সাথে সাথে মাঝে মাঝেই তাদের চমকে দেয়া চমক দেখা দেয়। তখুনি আমেরিকান যানটা অনেক কিলোমিটার নিচে নেমে যায় আর নিজের তাপ ঠিক রাখার সিস্টেম চালু হওয়ার আগেই দারুণ তাপদাহ জ্বালিয়ে দিতে চায় ডিসকভারিকে। কোনো কোনো সময় সেই বিদ্যুৎ নদী থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থাকার কারণে এ শিপ শুধু উত্তপ্ত হয়।

এ ব্যাখ্যা পাবার আগে হঠাৎ তাপ বাড়ার ঘটনা সবার কাছেই রহস্যময় লাগত। যে কোনো ধরনের ব্রেকিংই তাপ উৎপাদন করে। এখন আর সেই দুর্গন্ধ অবাক করে না। কারণ এ শিপ শুধু জমে ছিল না। কিছুক্ষণ জমাট ছিল, আর কিছুক্ষণ সেদ্ধ। এ কারণেই গন্ধটা বাড়াবাড়ি রকমের বেশি সময় ধরে জমে আছে ডিসকভারিতে।

আইওর আতঙ্ক জাগানিয়া চিত্র যে কোনো মেডিক্যাল টেক্সট বুকের রক্তাক্ত আর বীভৎস ছবিগুলোর চেয়েও দমবন্ধ করা। এখন সে ভূমি মাত্র পাঁচশ কিলোমিটার দূরে। একটা-মাত্র একটা রাজকীয় উদগীরণ দরকার ডিসকভারিকে ছাইয়ের সাথে মিশিয়ে নিতে। লিওনভ যথাযথ সম্মান দেখিয়ে ঝুলে আছে অনেক দূরে। কানো বেপরোয়া হয়ে উঠল। মূল ড্রাইভটা চালাবে।

কোন কিছুই দেখা গেল না। পুরনো দিনের রাসায়নিক রকেটের মতো কোনো আগুনে লেজ নেই এখন ডিসকভারির পেছনে। কিন্তু ধীরে সরে যাচ্ছে লিওনভও।

কয়েক ঘণ্টা পরে। বহু ভদ্র কসরতের পর দুজনেই নিজেদের হাজার কিলোমিটার উপরে তুলে ফেলতে পেরেছে। এখন ছোটখাট একটা বিশ্রাম নেয়া যায়। আলোচনাও করা যায় মিশনের পরের অংশ নিয়ে।

তুমি একটা প্রায় অসম্ভব কাজ করেছ, ওয়াল্টার… বলল সার্জন কমান্ডার রুডেঙ্কা তার সিলিন্ডারের মতো হাত দুটি ক্লান্ত কার্নোর কাঁধে রেখে, আমরা সবাই তোমার জন্য গর্বিত। খুব ভদ্রভাবেই ও কার্নোর নাকের নিচে একটা ছোট ক্যাপসুল ভেঙে ফেলল কথা শেষ করে।

এরপর কার্নো বিরক্ত আর একই সাথে ক্ষুধার্ত। কারণ গত চব্বিশ ঘণ্টা ও ক্যাপসুলের ফজিলতে ঘুমিয়েছে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে।

২০. মাথার উপর খড়গ

এটা কী? ঠাণ্ডা অতৃপ্তির সাথে ছোট মেশিনটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করল কার্নো, ইঁদুরের জন্য খড়গ?

বর্ণনাটা খারাপ না-কিন্তু আমি আরো বড় খেলুড়ের হাতে পড়ে গেছি, বিড়াল নয়। ফ্লয়েড ডিসপ্লে স্ক্রিনে একটা জ্বলন্ত অ্যারো দেখালো যেটা এখন এক জটিল সার্কিটের নকশা দেখাচ্ছে।

লাইনটা দেখেছ?

হু, মূল পাওয়ার সাপ্লাই-ঠিক?

ঠিক এখান দিয়েই পাওয়ার সাপ্লাই কর্ড হালের সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিটে°২ ঢোকে। এই ছোট মেশিনটা আমি এখানে ঢোকাতে চাচ্ছি। একেবারে সব তারের হিবিজিবিতে। পেল্লায় সার্চ ছাড়া পাওয়া যাবে না।

আচ্ছা, আচ্ছা! রিমোট কন্ট্রোল্ড ডিভাইস! যখন খুশি হালের মূল পাওয়ার সাপ্লাইটা টেনে তুলতে পারবে, তাইতো? দারুণ! একটা ননকন্ডাক্টরে তৈরি ব্লেড; বিপদের সময় হালের মাথার উপর খড়গ হয়ে নেমে আসতে পারে। এসব খেলনা বানায় কে? সি আই এ?।

নেভার মাইন্ড। এ লাল ক্যালকুলেটরের কন্ট্রোল সব সময় আমার হাতে। আমার অফিসের ডেস্কে সর্বক্ষণ একটা পড়ে থাকে। সহজ হিসাব, তবু না জানলে কেউ টিপেটুপে কমান্ড দিতে পারবে না। গাণিতিক তো! পাসওয়ার্ড হিসেবে নয়ে ন দিই, তারপর স্কয়ার রুট। শেষে এন্টার। ব্যস। সমস্যাটা কী জানো? এটার রেঞ্জ নিশ্চিত করে বলতে পারব না। একবার টেস্ট করতে হয়। চিন্তার কিছু নেই। যে পর্যন্ত লিওনভ আর ডিসকভারি দু-চার কিলোমিটারের মধ্যে আছে, হাল ব্যাটাকে আবার চালাতে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ দেখি না।

কাকে তুমি এ… জিনিস সম্পর্কে বলতে চাচ্ছ?

কার্নো আলগা মুখে উল্টোপাল্টা কিছু শব্দ বলে বসতে যাচ্ছিল, ফ্লয়েড অনেক সিনিয়র। সামলে নিয়েছে।

সময় মতো করেছ প্রশ্নটা। তোমাকে কেউ বোকা ভাবলে ভুল করবে। যদিও সব সময় বোকার মতোই ঠাট্টা মশকরায় ডুবে থাক… আমি মাত্র একজনের কাছ থেকেই লুকাব। ডক্টর চন্দ্র।

আমার আন্দাজকেও যদি কেউ ছোট করে-ভুল করবে, তাই না? চোখ মটকায় কার্নো।

কিন্তু যত কম লোক জানবে, আলোচনা হবে ততই কম। এটা যে আছে তা তানিয়াকে বলব, আর বিশেষ দরকার পড়লে ওকে তুমি বুঝিয়ে দেবে কীভাবে অপারেট করতে হয়।

কোন ধরনের বিশেষ দরকার? কার্নোর সচেতন দৃষ্টি ফ্লয়েড টের পাবেই।

প্রশ্নটা কি খুব একটা বুদ্ধির পরিচায়ক, ওয়াল্টার? আমি যদি জানতামই কীরকম বিপদ আসবে, মরার জিনিসটা সাথে করে নিয়েই আসতাম না।

ধরে নিচ্ছি তুমিই ঠিক। কখন তোমার পেটেন্ট করা এই হালের মরণটাকে বসাতে চাচ্ছ? মানে বসানোর কাজটা আমাকে দিতে চাচ্ছ?

কত তাড়াতাড়ি তুমি বসাতে পারছ? সম্ভবত আজ রাতেই। চন্দ্রকেতো অবশ্যই সে সময় ঘুমিয়ে থাকতে হবে, ঠিক না? বোঝাই যায় ফ্লয়েড চন্দ্রের ব্যাপারে মোটেও বিশ্বাস করে না। কারণও আছে; কেউ নিজের সন্তানকে খুনী বলে মানতে পারে না। কখনোই না।

আবোল-তাবোল বকছ কেন! আমার বিশ্বাস সে কখনোই ঘুমায় না। অসুস্থ সন্তানের সেবা করতে থাকা মা কখনো ঘুমায় নাকি?

ছেলেটা ভয়ংকর। এর থেকে দূরে থাকতে হবে। হয় ও আমার চিন্তা বুঝে ফেলে, নাহয় আমার মতোই চিন্তা করে। দুটোই ভয়াল। ভেবে বলল ফ্লয়েড, যাই হোক, ও লিওনভের দিকে আসে দু একবার। খাওয়ার দরকার পড়লে।

আমি তোমাকে একটা সংবাদ দিতে পারি। সু নাকি কু তা তোমার ব্যাপার। শেষবার যাওয়ার সময় পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে গেছে চন্দ্র। বলতো পোটলায় কী?

বিষিয়ে গেছে ফ্লয়েড, এমন চেহারা নিয়ে জবাব দিল, খাবার?

এই প্রথম কার্নোর মনে হল খাবারের মতো বিষাক্ত জিনিস সৃষ্টি জগতে নেই। হাসিও পেল, বাহ্! তোমার আন্দাজও তো কম যায় না! ভাতটুকু হপ্তাখানেক চালাবে ওকে।

সেক্ষেত্রে আমাকে ক্যাথেরিনার ভুবনখ্যাত তকমাগুলোর একটা ব্যবহার করতেই হচ্ছে। এক ড্রপে বাজীমাৎ! ওগুলো তোমার উপর ভাল তেলেসমাতিই ফলিয়েছে, একাধারে চব্বিশ ঘণ্টা কাৎ… নাকি?

এরপর কার্নো শুরু করল চন্দ্রকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা, অন্তত ফ্লয়েড তাই মনে করেছে, যদিও তার ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত হতে পারবে না-ও সব সময়ই একটা কঠিন মুখে তরল তরল কথা বলে স্বর্গীয় সুখ পায়। রাশিয়ানরা ব্যাপারটা পুরোপুরি সামলে নেয়ার পর পরিস্থিতি এত করুণ হয়েছে যে কার্নোর চরম সিরিয়াস মুহূর্তের কথায়ও খিল ধরে যায় ওদের পেটে।

আর কার্নো-ওকে কেউ কি কখনো হাসতে দেখেছে? একবার ফ্লয়েড দেখেছিল, যখন ওরা বসুন্ধরাকে বিদায় জানাচ্ছে উপরে উঠতে উঠতে। সেটা হাসি নাকি কান্না কে জানে! অনেকেই ব্যাপারটা সহ্য করতে পারে না-এ ভুবনে ফিরে আসার আশা করতে পারে না কেউই পুরোপুরি। ডুবে যায় অ্যালকোহলে। আগে মহাকাশ যাত্রায় মদ জাতীয় তরল ছিল নিষিদ্ধ। পরে পৃথিবী ছাড়ার সময়টার স্মৃতি পুরো অভিযান ধরে কুকে কুরে কুরে খায় দেখে কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বেই প্রাচীনতম ফ্রেঞ্চ শ্যাম্পেন বিলিয়ে থাকে। কার্নো হেসেছিল ঐ সময়। অবশ্যই এর পুরো প্রভাবক ছিল সবচে দুর্লভ উত্তেজক পানীয়।

ফ্লয়েড ঐ হাসির আশঙ্কা করেছে এন্ড অব ডিসকভারি অর্বিট পার্টিতে। ডিসকভারির সাথে লিওনভের চুড়ান্ত মিলনের পর। তখন কার্নো পান করেছিল যথেষ্ট। তারপরও ক্যাপ্টেন অর্লোভা যেমন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে-ওও ঠিক তেম্নি। আচ্ছা, ক্যাপ্টেন অর্লোভা সহজে এক ফোঁটা মদ ছোঁয় না–এর কারণ কি ব্যক্তিগত, নাকি কোনো ক্যাপ্টেনই ছোঁয় না? এটা কি কোনো মহাকাশ রুল, যা ক্যাপ্টেন হওয়ার পর আরো হাজারো গোপন রুলের সাথে জানা যাবে? মরুকগে। ফ্লয়েডের স্পেস ক্যাপ্টেন কেন, আর জীবনে স্পেস কিং হওয়ারও কোনো ইচ্ছা নেই।

এই কার্নো ছেলেটা একটা জিনিসই সিরিয়াসলি নেয়। তার কাজ। যখন পৃথিবীর অর্বিট ছেড়ে আসে ওরা, কার্নো একজন যাত্রী যে মাতাল হওয়ার অধিকার রাখে। আর আজকে ও একজন ক্রু, তাই মাতাল হওয়া চলে না। নাহ্। এ ছেলে যথেষ্ট জটিল। মহাকাশ অভিযাত্রী বাছাইয়ে কখনো স্পেস সংস্থা ভুল করে না।

২১. পুনরুত্থান

আমরা-বলছে ফ্লয়েড নিজেকেই-জাগিয়ে তুলতে যাচ্ছি এক ঘুমন্ত দৈত্যকে। হাল আমাদের উপস্থিতি দেখে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে এত বছর পর? অতীতের সব কথা মনে করতে পারবে তো? আর সবচে বড় কথা, ওর মনোভাব বন্ধুর মতো হবে, নাকি থাকবে শক্রতা?

সে এখন ডক্টর চন্দ্রের পেছনে ভেসে বেড়াচ্ছে। ভাল দিকটা হল, ডিসকভারি এখন এতই স্বয়ং সম্পূর্ণ যে তুলতে পেরেছে জিরো গ্র্যাভিটি। তার মন এখন কয়েক ঘন্টা আগে বসানো কাট অফ সুইচ থেকে অনেক অনেক দূরে। হাতের কয়েক সেন্টিমিটার দূরেই রেডিও সেটটা। এটা আনায় নিজেকেই খুব বোকা মনে হচ্ছে। এখন হাল সারা ডিসকভারির সব অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন। ও যদি আবার জেগেও ওঠে, হবে স্নায়ুতন্ত্র থাকা সত্ত্বেও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছাড়া মাথার মতো। বড়জোর যোগাযোগ করতে পারবে, প্রভাব ফেলবে না কোনো।

কার্নো জিনিসটা বসানোর সময় বলেছিল, ও বড়জোর ইনিয়ে বিনিয়ে আমাদের কাছে ওয়াদা করতে পারে, আর কক্ষনো করব না। কানে ধরলাম। এরচে বেশি কিছুই না।

আমি প্রথম পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত, ক্যাপ্টেন। বলল চন্দ্র, এবার কথায় মহাকাশ রিপোর্টের ভঙ্গী, সব হারিয়ে যাওয়া মডিউল এনে জোড়া দেয়া হয়েছে। আমি ডায়াগনস্টিক প্রোগ্রাম চালিয়েছি সব সার্কিটে। সব কিছুই একেবারে স্বাভাবিক,

অন্তত এখন।

ক্যাপ্টেন অর্লোভা একবার তাকায় ফ্লয়েডের দিকে। জবাবে ফ্লয়েড একবার নড করল মাথা নিচু করে। চন্দ্রের অনুরোধের কারণে প্রথম চলার সময় মাত্র তিনজন উপস্থিত ডিসকভারিতে; প্রথম স্টার্টিং জটিল-এ উসিলায়। এটাও বোঝা যাচ্ছে এ তিনজনও ঠিক স্বাগত নয় চন্দ্রের দ্বারা।

ভাল, ডক্টর চন্দ্র। সে নিয়ম কানুনের ব্যাপারে সচেতন, তবু দ্রুত যোগ করল, ডক্টর ফ্লয়েড তার অনুমোদন জানিয়েছে। আমার নিজের পক্ষ থেকেও কোনো আপত্তি নেই।

আমার আসলে ব্যাখ্যা করা উচিত। বলল চন্দ্র, তার স্বভাবসুলভ অননুমোদনের সুরে।

ওর ভয়েস রিকগনিশন৫ আর স্পিচ সিন্থেসিস সেন্টারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। আবার আমাদেরকে কাজ করতে হবে। ওকে কথা বলা শিখাতে হবে। আমাদের সৌভাগ্য যে ও মানুষের চেয়ে কয়েক লাখ গুণ দ্রুত শেখে।

বিজ্ঞানীর আঙুলগুলো নেচে বেড়ায় কি-বোর্ডের উপর ডজনখানেক শব্দ টাইপ করার সময়। একই সাথে পাইকারি হারে পরীক্ষাও করা হচ্ছে প্রতিটা শব্দ; স্ক্রিনে ওঠার সাথে সাথেই। বিকৃত প্রতিধ্বনির মতো কথাগুলো স্পিকার থেকে ভেসে আসছে। প্রাণহীন। আসলে এ শব্দ থেকেই বোঝা যায় যেখান থেকে আসছে সেখানটায় কোনো বুদ্ধিমত্তা কাজ করে না। একেবারেই যান্ত্রিক। এ সেই হাল নয়-ভাবল ফ্লয়েড। আমার ছোটকালে দেখা প্রাথমিক কথা বলা যন্ত্রের চেয়ে বেশি আবেগ নেই এসব কথায়।

ডক্টর চন্দ্র রিপিট বাটন টিপল। আবার সেই শব্দের সিরিজ আবৃত্তি করল হাল। তোতা পাখির মতো। এর মধ্যেই দেখার মতো উন্নতি হচ্ছে যদিও এখনো কণ্ঠটাকে মানব প্রজাতির কারো সাথে গুলিয়ে ফেলেনি কেউ-তবু তোতার মুখে আবেগ ফুটছে মনে হয়।

আমার দেয়া শব্দগুলো ইংরেজির মূল ফোনিমির ১০ সবটাই বহন করে। দশ বারের বার ওর উচ্চারণ গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু আমার কাছে এমন কোনো যন্ত্র নেই যা আসলেই দারুণ কোনো থেরাপি চালাতে পারবে ওর শেখার পথে।

থেরাপি? ধরে বসেছে ফ্লয়েড, তুমি বলতে চাও যে ওটার-যাই হোক, ব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত, যাকে বলে অ্যাবনরমাল?

না! জায়গামতো লেগেছে চন্দ্রের। চিৎকার করল কম্পিউটার বিজ্ঞানী, লজিক সার্কিটগুলো আছে সবচে ভাল। শুধু ভয়েস আউটপুট একটু সমস্যায় পড়েছে হয়ত। উন্নতি হবে তাড়াতাড়ি। ভুল ইন্টারপ্রিটেশন ১০৮ এড়াতে হলে মনিটরের প্রত্যেকটা শব্দ চেক কর। আর যখন কথা বলবে, একেবারে সাবধানে। শুদ্ধভাবে।

ফ্লয়েড একটা মিষ্টি হাসি দিল অর্লোভার দিকে তাকিয়ে। এরপর এল আসল প্রশ্ন, এর চারপাশে রাশিয়ান উচ্চারণ। এ ব্যাপারে কী করবে?

আমি জানি ক্যাপ্টেন অর্লোভা আর ডক্টর কোভলেভ কোনো সমস্যা নয়। অন্যদের বেলায়-ঠিক আছে, আমরা আলাদা আলাদা পরীক্ষা করব। যে কেউ-যে উৎরে যেতে পারবে না-অবশ্যই কষ্ট করে কি-বোর্ড ব্যবহার করতে হবে তাকে।

গাছে কাঁঠাল রেখেই আঠা লাগার ভয়ে গোঁফ তেলতেলা করে লাভ নেই। এ মুহূর্তে তুমিই হালের সাথে যোগাযোগের জন্য একমাত্র উপযুক্ত মানুষ ডিসকভারি আর লিওনভের মধ্যে। আমার প্রস্তাবে রাজি, ক্যাপ্টেন?

অবশ্যই।

একটা সংক্ষিপ্ততম নড় বুঝিয়ে দিতে চায় যে, ডক্টর চন্দ্র শেখরাম পিল্লাই তাদের কথা শুনে বুঝতে পারছে। ওর আঙুলগুলো এখনো সমানতালে উড়ে যাচ্ছে কি বোর্ডের উপর। শব্দের কলামগুলো এত দ্রুত উঠছে মনিটরে যে কোনো মানুষই হয়ত পড়ে ফেলতে পারবে না সহজে। সম্ভবত চন্দ্র একটা সদা জাগ্রত বিরাট মুখস্থবিদ্যা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে। নাহলে এগুলো মনে রাখার আর এক মুহূর্তে বের করে আনার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ফ্লয়েড মনে মনে বলল, এ লোকটাও তার নিজের ক্ষেত্রে যোগ্যতম। যত অসভ্যই হোক-পৃথিবীর ইতিহাসে সফলতম কম্পিউটার বিজ্ঞানী, যে একটা বুদ্ধিমান কম্পিউটারের জন্ম দিয়েছিল আজ থেকে তের বছর আগেই।

চন্দ্ৰ আরেকবার সবার উপস্থিতি স্বীকার করল-এবার আরো অভদ্রভাবে। কিছুক্ষণের জন্য নিজের হাতটা বন্ধ রেখে ওদের দিকে তাকালো সে। অর্লোভা আর ফ্লয়েড সাথে সাথেই তাকে তার রহস্যময় ভালবাসার কাছে ছেড়ে দিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে। একটা পুরোপুরি ইতস্তত নড়াচড়ার সাথে ও আগের দ্রুততায় লকিং বারের এক নিঃসঙ্গ কি-তে চাপ দিল।

কোনো বোঝার মতো বিরতি না দিয়েই এবার আবেগের সাথে ভিতর থেকে একটা কথার ধারা বেরিয়ে আসে, এখন আর মানব কণ্ঠের বিকৃত উচ্চারণ নেই। একজন কথা বলছে, তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে, তার সচেতনতা দিয়ে, নিজস্ব সচেতনতা-যদিও প্রাথমিক পর্যায় ছেড়ে এল মাত্র।

গুড মর্নিং, ডক্টর চন্দ্র। হাল বলছি-প্রথম শিক্ষার জন্য আমি প্রস্তুত।

আহত নিরবতা ভর করেছে পুরো ঘরে। এ অপার্থিব মৌনতার প্রতি সম্মান জানাতেই হয়ত দুজন দর্শক ডেক ছেড়ে গেল সাথে সাথে।

ফ্লয়েড কখনো বিশ্বাস নাও করতে পারে যে বিংশ আর একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের উজ্জ্বলতম কম্পিউটার বিজ্ঞানী ডক্টর চন্দ্র কাঁদছিল তখন। হাউমাউ করে কাঁদছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *