২৫. মেসের নাম ব্যাচেলর কোয়ার্টার

২৫

মেসের নাম ব্যাচেলর কোয়ার্টার। সারি সারি কতগুলো খুপরিঘর। সেই ঘরের একটিতে থাকে মইনুল। মইনুল জগন্নাথ কলেজ থেকে পাস করে চাকরি খুঁজছে। এখনো ভালো কিছু জোটেনি। তবে একটি কাপড়ের দোকানে হিসাবরক্ষকের খণ্ডকালীন কাজ করে সে। তাকে যেতে হয় খুব ভোরে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। সেই সন্ধ্যার অপেক্ষায় বসে আছে ফরিদ। তারা বসে আছে মেসের সামনে চাতালের মতো একটি জায়গায়। এর মধ্যে কয়েকবার ভেতরে গিয়ে মইনুলের খবর নিয়ে এসেছে ফরিদ। সে থাকে উত্তর দিকের শেষ ঘরটাতে। ঘরটা এখন তালা মারা। পাশের ঘরের লোকটা জানিয়েছে, মাগরিবের পর পর ফিরবে মইনুল। সেই অবধি ফরিদদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে ফরিদ চাইলে তার ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পারু। ব্যাচেলর এই মেসে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। ফলে ফরিদকেও পারুর সঙ্গে বাইরে বসে থাকতে হলো। এখন দুপুর একটা বাজে। সেই সকাল থেকে তারা বসে আছে। পারুর চোখ-মুখ ফুলে গেছে। রক্তশূন্য, বিবর্ণ চেহারা। সে পেছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে সংজ্ঞাহীনের মতো বসে আছে। ফরিদ দুইবার তাকে খাবার দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কিছুই মুখে নেয়নি পারু। একবার কেবল সামান্য পানি খেয়েছে। তারপর আবার দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে আধশোয়া ভঙ্গিতে বসে পড়েছে। চোখ বন্ধ। ফ্যাকাশে ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। ফরিদ আলতো হাতে বোরকার নেকাবটা তুলে মুখ ঢেকে দিল তার। অন্তত আলো থেকে চোখ জোড়া খানিক রক্ষা পাক।

মইনুলের এই ঠিকানা দিয়েছে দিলারা। শুধু যে ঠিকানাই দিয়েছে তা-ই নয়। সে ফরিদকে চমকে দিয়েছে। ফরিদ ভেবেছিল প্রচণ্ড অপমান-অপদস্থ করে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেবে দিলারা। কিংবা ঘরবন্দি করে আটকে রাখবে। তারপর তুলে দেবে আতাহার মওলানার হাতে। নিজেকে বাঁচাতে এটিই হতে পারত তার জন্য সবচেয়ে সহজ উপায়। দিলারা নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছে এ কথা সত্য। তবে সেই বাঁচার চেষ্টাটা শুধু তার একার নয়। সে চেষ্টা করেছে ফরিদ আর পারুকেও বাঁচাতে। উঁচু গলায় চিৎকার-চেঁচামেচি করে পারু আর ফরিদকে ভর্ৎসনা করেছে সে। অপমানসূচক নানা কথা-বার্তাও বলেছে। তার ঘর ছেড়ে দিতে বলেছে। এসবই সে করেছে খুব আড়ম্বর করে। যাতে বাড়ির আর সকলে শুনতে পায়। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরেই চুপিচুপি ফরিদের কাছে এসে বলেছে, আর এক মুহূর্তও এখানে থেকো না। তোমাদের সামনে বিপদ।

ফরিদ কথা বলতে পারেনি। কেবল ফ্যালফ্যাল করে দিলারার দিকে তাকিয়ে ছিল। খানিক আগেই রুদ্রমূর্তি ধারণ করা সেই দিলারার সঙ্গে এই দিলারার যেন কোনো মিলই নেই। দিলারা বলল, রফিকুলের কাছে ঘটনা সব শুনেছি আমি। তার আগেই অবশ্য অনেককিছুই আন্দাজ করেছিলাম। যা-ই হোক। এখন জরুরি কথা শোনো। আব্বা গেছেন ভুবনডাঙা সালিস করতে। আমি এক শ ভাগ নিশ্চিত, কোনো না কোনোভাবে এই ঘটনা উনি সেইখানে শুনবেনই। না শোনার কোনো কারণই নাই। তো বুঝতে পারছ, এরপর কী ঘটবে?

ফরিদ দিশেহারা ভঙ্গিতে বলল, আমি এখন কী করব ভাবি? আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।

তোমার এখন একটা কাজই করা উচিত। এই মুহূর্তে ওইটাই সবচেয়ে যথার্থ কাজ। কেবল এই একটা কাজই তোমাকে এই সব কিছু থেকে রক্ষা করতে পারে।

কী কাজ? ফরিদ রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় জিজ্ঞেস করল।

পুকুরপাড়ে কাপড় কাঁচার জন্য একটা বড় পাথর রাখা আছে। যাও, গিয়ে ওই পাথরের সঙ্গে বাড়ি মেরে তোমার এই মাথাটা ফাটিয়ে ফেলো। তাতে তুমি মরলেও অন্তত তোমার মাথাভর্তি যে গোবরগুলো আছে সেগুলা বের হবে।

নতুন প্রত্যাশায় উজ্জীবিত ফরিদ যেন মুহূর্তেই ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেল। দিলারা বলল, কোনো কিছু না ভেবে, কোনো বুদ্ধি পরামর্শ না করে, এত বড় একটা সিদ্ধান্ত কেউ নেয়? পারু যদি তোমাকে কিছু বলেও থাকে, তুমি আগে পিছে কিছু ভাববে না? বোঝার চেষ্টা করবে না যে মেয়েটার বয়স কম। সে আবেগের বশবর্তী হয়ে কথাটা বলেছে? কাজটা করতে চাইছে? কিন্তু এরপর মা বাপহারা এই মেয়ের সারা জীবনের দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে। সেই দায়িত্ব। নেয়ার জন্য তুমি প্রস্তুত?

ফরিদ কী জবাব দেবে? সত্যিই তার কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। দিলারা বলল, এটা কি একটা ছেলেখেলা? যে ওজন কাঁধে নিয়েছ, সেই ওজন তুমি বইতে পারবে?

ফরিদ কথা বলল না। তার মনে হলো সত্যি সত্যিই মাত্র এই কদিনেই যেন তার বয়স বেড়ে গেছে। নুজ হয়ে গেছে সে। ক্লান্ত, অসহায়, দিশেহারা লাগছে। দিলারার প্রতিটি কথাই সত্যি। এই কথার বিপরীতে কোনো জুতসই উত্তর তার কাছে নেই। দিলারা বলল, পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ভালোবাসা কি জানো? সন্তানের প্রতি বাবা-মার ভালোবাসা। অথচ সেখান থেকে তুমি তাকে এভাবে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কাল যদি তোমার আর পারুকে ভালো না লাগে? কিংবা তার? তখন কী করবে? যে মা-বাবাকে ছেড়ে সে চলে এলো, তারা কি কোনো অবস্থাতেই একটা মুহূর্তের জন্যও তাকে ভালো না বেসে থাকতে পারবে?

বলে খানিক থামল সে। যেন নিজের ভেতরে জমিয়ে রাখা ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছে। তারপর বলল, তোমাদের সম্পর্কটাকে আমি ছোট করছি না ফরিদ। আমাকে ভুল বুঝো না। কিন্তু একবার পারুর বাবা-মায়ের কথাটা ভাববা তো? নিজেকে তাদের জায়গায় চিন্তা করে দেখো তো?

ফরিদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দিলারা বলল, এখন এসব কথা শুনতে খারাপ লাগছে জানি। কিন্তু একটা সময় আর লাগবে না। তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্যি মনে হবে এটা। সমস্যা হচ্ছে ততদিনে তোমরাও বাবা-মা হয়ে যাবে। বলেই উঠে দাঁঠাল দিলারা। তারপর ফরিদের হাতে একখানা কাগজ দিয়ে বলল, এখানে একটা ঠকানা আছে। মইনুল ভাই, আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু। তুমি তার কাছে যাবে। সে যে খুব ভালো আছে ঢাকায় তা না। তবে কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা সে তোমাদের করে দেবেই। আমি দু লাইন চিঠিও লিখে দিয়েছি।

বলে তাদের বিদায় দিয়েছে দিলারা। সঙ্গে পারুকে একটা বোরকাও দিয়ে দিয়েছে। যাতে চট করে কেউ তাকে চিনে ফেলতে না পারে।

ফরিদ চিঠিটা খুলে দেখেছে। সম্বোধনবিহীন চিঠি। সেখানে লেখা, ফরিদ আর পারুকে আমি আপনার কাছে পাঠালাম। এরা আমার ছোট ভাই-বোনের মতোই। বড় বিপদে পড়ে এরা আপনার কাছে গিয়েছে। জানি, আপনিও ভালো নেই। তারপরও ওদের জন্য যতটুকু সম্ভব করবেন। এই আমার অনুরোধ। আর… আমি ভালো আছি!
–দিলু।

ফরিদ কয়েকবার চিঠিটা উল্টেপাল্টে দেখেছে। খুব সাধারণ, ভাব বিনিময়হীন একটি চিঠি। কোনো আড়ম্বর নেই, সম্বোধন নেই, কুশল জিজ্ঞাসা নেই। তারপরও এই চিঠিটার কোথায় যেন কী একটা লুকানো আছে। কোনো গোপন কথা। গোপন কষ্ট। কিন্তু সেই কষ্টটা কোথাও খুঁজে পেল না সে। তবে আজ প্রায় সারাটা দিন যখন সে পারুকে নিয়ে বসে রইল মইনুলের মেসের সামনে। ঠিক তখন হঠাৎ করেই খুব তুচ্ছ একটি বিষয় তার মনোযোগ কাড়ল। হতে পারে এর হয়তো কোনো তাৎপর্যই নেই। নেহাত অমনোযোগী পত্র লেখকের অসতর্ক কাজ। তারপরও চিঠির ঠিক শেষ বাক্যে আমি… ভালো আছি।-তে দেওয়া তিনটি ডট আর ওই বিস্ময় চিহ্নটা যেন কিছু একটা বলে গেল গোপনে, আড়ালে। ওই চিহ্নটুকুর শীর্ণ বুকে সঙ্গোপনে লুকিয়ে থাকা তীব্র কোনো দুঃখগাখা যেন গভীর দীর্ঘশ্বাস হয়ে ছুঁয়ে গেল ফরিদকে।

.

মইনুল এলো সন্ধ্যার পর পর। ততক্ষণে পারু প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। এই খোলা চত্বরে এভাবে একটা ছেলে আর মেয়েকে সারাদিন বসে থাকতে দেখে অনেকের মনেই নানা প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারত। তবে ফরিদদের ভাগ্য ভালো যে তেমন কেউ ছিল না এখানে। সম্ভবত এই মেসে যারা থাকে, তারা সবাই-ই খুব ভোরে কাজে বের হয়ে যায়। আর রাতে ফেরে। ফলে কৌতূহলী চোখ খুব একটা দেখা গেল না। তবে ফরিদ আর পারুকে এভাবে বসে থাকতে দেখে যে কৌতূহলী চোখে তাকাল, সে মইনুলই। তারা কেউ কাউকে চেনে না। ফলে মইনুল যখন তার মেসের সামনে অনাহুত দুই আগন্তুককে এভাবে বসে থাকতে দেখল, তখন তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। তাকাল ফরিদও। তবে কেউ কোনো কথা বলল না। মইনুল চত্বর পার হয়ে তার ঘরের সামনে গিয়ে চাবি বের করে রুমের দরজা খুলল। আর ঠিক তখনই সামনে গিয়ে দাঁড়াল ফরিদ। তারপর নরম গলায় বলল, আমার নাম ফরিদ। দিলারা ভাবি পাঠিয়েছে।

মইনুল যেন প্রথমে চট করে কথাটা ধরতে পারল না। তবে ঘাড় ঘুরিয়ে ফরিদের দিকে তাকাল সে। তারপর প্রশ্নবোধক চোখে বলল, জি?

ফরিদ তার পকেট থেকে চিঠিটা বের করে মইনুলের হাতে দিল। মইনুল দরজার একপাশের পাল্লা ফাঁক করে হাতের ব্যাগটা ভেতরে ছুঁড়ে দিতে দিতে বলল, কোথা থেকে এসেছেন আপনারা? দিলুর শ্বশুরবাড়ি থেকে?

ফরিদ ওপর নিচ মাথা নাড়ল। ছোট্ট ওই দুই লাইনের চিঠিটা পড়তেই বেশ খানিক্ষণ সময় নিল মইনুল। তারপর চিন্তিত মুখে খানিক উচ্চস্বরেই বলল, ভাই, দেশ থেকে তো এসেছেন, কিন্তু ভাবিরে নিয়ে তো এখানে থাকতে পারবেন না। দেখেন না, মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা এখানে নেই। ওই যে দেখেন, বাইরে লেখা আছে–ব্যাচেলর কোয়ার্টারে মেয়ে মানুষের প্রবেশ নিষেধ।

কথাটা শুনে দমে গেল ফরিদ। সে ভাবেনি এমন রুঢ় ভঙ্গিতে কথাটা বলবে মইনুল। যেহেতু দিলারা ভাবি চিঠি লিখে দিয়েছে, সেহেতু খানিক আতিথিয়েতাপূর্ণ আচরণই আশা করেছিল সে। মইনুল অবশ্য তার হতাশাটা কাটিয়ে দিল পরের কথাতেই। সে গলা নিচু করে বলল, আপনারা আসছেন আর কেউ দেখছে?

পাশের ঘরের ভদ্রলোক দেখেছেন। বলল ফরিদ।

আজিজ ভাই?

নাম তো জানি না। মুখভর্তি দাড়ি। মাথায় লম্বা লম্বা চুল।

ওহ। সমস্যা নেই। ওনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো। কিন্তু অন্য কেউ দেখলে সমস্যা। আপনি এক কাজ করেন, ভাবিরে চুপচাপ নিয়ে আসেন। সাবধান, আশপাশের কেউ যেন না দেখে। দেখলে বিপদ।

এতক্ষণে ঘটনা আঁচ করতে পারল ফরিদ। মইনুল আগের কথাগুলো আসলে কাউকে শোনানোর জন্য বলেছিল। মনে মনে কৃতজ্ঞ বোধ করল সে। তবে তার সেই কৃতজ্ঞতার অনুভূতি খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ছোট্ট খোপের মতো এই ঘরে পাশাপশি দু খানা চৌকি। মাঝখানে সামান্য হাঁটার জায়গা। একটা মাত্র ছোট্ট জানালা পেছন দিকে। এইটুকু এক ঘরে দুজন মানুষ কী করে থাকে, ফরিদ ভেবে পেল না।

তবে সে এরচেয়েও বেশি অবাক হলো টয়লেট আর গোসলখানার কথা শুনে। বাইরে যে সারিবদ্ধ ঘরগুলো রয়েছে, তার শেষ প্রান্তে একখানা কমন টয়লেট। ওই ঘরগুলো পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়। তারচেয়েও বড় কথা, এতগুলো লোকের জন্য ওই একখানা মোটে টয়লেট। ফলে প্রায় সারক্ষণই সেখানে সিরিয়াল লেগে থাকে। আর গোসল করতে যেতে হয় সামনের খোলা চত্বরে। সেখানে একখানা চাপকল রয়েছে। সেই চাপকল চেপে পানি তুলে গোসল করতে হয়। এখানে সবাই পুরুষ মানুষ বলে কারো তেমন অসুবিধা হয় না। খোলা আকাশের নিচে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে তারা গোসল করে। কিন্তু পারুর পক্ষে তো সেটা সম্ভব নয়। এই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল ফরিদ।

মইনুল অবশ্য আপাতত একটা সমাধান বের করল। বলল, এখনো লোকজন কেউ ফেরেনি। আপনি দয়া করে ভাবিকে একটু বাথরুমে নিয়ে যান। আর গোসলটা আজ আর হবে না। তবে আমি বালতি আর গামলায় করে পানি নিয়ে আসছি ঘরে। উনি যতটা সম্ভব হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেবেন।

পারুর অবস্থা তখন মুমূর্ষ প্রায়। ওই অবস্থায়ই তাকে নিয়ে সাবধানে বাইরে গেল ফরিদ। ফিরল বেশ কিছুক্ষণ পর। ততক্ষণে মইনুল ঘরের ভেতর পানির ব্যবস্থা করেছে। সে বলল, ভাবি কাপড়-টাপড় পাল্টে একটু হাত মুখ ধুয়ে নিক। আমি ততক্ষণে খাবারের ব্যবস্থা করি। বলেই বেরিয়ে গেল সে। ফিরল বেশ কিছুক্ষণ পর। তার হাতে খাবারের কতগুলো প্যাকেট। মেঝেতে খবরের কাগজ বিছিয়ে সেগুলো বাড়ল সে। পারুর যেন আর তর সইল না। সে বুভুক্ষের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল। যেন কতদিনের অভুক্ত। খানিক আগে গামলার পানিতে কাপড় ভিজিয়ে শরীর মুছে নিয়েছে সে। ব্যাগ থেকে পাট ভাঙা নতুন কাপড় বের করে পরেছে। এখন খানিক ভালোও লাগছে তার। সমস্যা হচ্ছে রাতে তারা ঘুমাবে কই? তাছাড়া ঘরে যে আরো একজন কেউ থাকে, সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সে ফিরলে তখন কী হবে?

মইনুল অবশ্য তাদের আশ্বস্ত করল। বলল, আমার রুমমেট বাড়িতে গেছে। এইজন্য আপাতত কোনো চিন্তা নাই। আপনারা আরাম করে ঘুমান। তবে রাতে কেউ দরজায় নক করলে খোলার দরকার নাই। আমি পাশের রুমে আজিজ ভাইয়ের সঙ্গে থাকব। তার আগে আমাকে একটু বলেন আপনাদের জন্য আমি কী করতে পারি? বলে একটু থামল সে। তারপর লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, বুঝতেই পারছেন, এখানে আসলে একরাতের বেশি থাকা সম্ভব হবে না।

ফরিদ সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। একই সঙ্গে সে মইনুলের সামর্থ্যের ব্যাপারেও ধারণা পেয়েছে। সে যে তাদের জন্য খুব বেশি কিছু করতে পারবে এমন নয়। তবে অন্তত এই একটি রাতের জন্য হলেও যে সে তাদের আশ্রয় দিয়েছে, এতেই কৃতজ্ঞ ফরিদ। রাতটা কোনোভাবে কেটে গেলেও ভোর হতে না হতেই দরজায় টোকা শোনা গেল। বাইরে মইনুলের কণ্ঠ। সে বলল, আমি না বলা পর্যন্ত আপনারা কেউ কিন্তু বের হবেন না। আগে লোকজন সবাই কাজে বের হয়ে যাক। তখন বের হবেন।

এছাড়া অবশ্য উপায়ও নেই। ফরিদরা ঘর থেকে বের হতে পারল নটার দিকে। ততক্ষণে পুরো মেস সুনসান। মইনুল আজ কাজে যায়নি। সে ফরিদকে বলল, এবার আপনাদের জন্য কী করতে পারি, যদি বলতেন?

ফরিদ যতটা সম্ভব বলল। তবে বেশির ভাগই এড়িয়ে গেল সে। মইনুল বলল, তাহলে তো আপনাদের জন্য একটা থাকার ঘর দেখতে হয়। সমস্যা হচ্ছে একদিনের নোটিশে তো বাড়ি ভাড়া পাওয়া কঠিন।

ফরিদ চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। তবে তাদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করলেন আজিজ মিয়া। বয়সে খানিক বড় বলে মইনুল তাকে খুব মান্যগণ্য করে। ভদ্রলোক দুটো বিয়ে করেছেন। তার এক স্ত্রী থাকেন ঢাকায়। অন্যজন বাড়িতে। বাড়িতে থাকা প্রথম স্ত্রী তার ঢাকার দ্বিতীয় বিয়ের কথা জানেন না। তবে এর ওর কাছে নানা কানাঘুষা শুনে কিছু একটা সন্দেহ করছেন। আর এ কারণেই আজকাল সময়ে-অসময়ে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। স্বামীর সঙ্গে শহরে থাকতে চান। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না। আজিজ মিয়া তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলেছেন, ঢাকায় তিনি যে মেসে থাকেন, সেখানে মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা তো নেই-ই। উপরন্তু প্রবেশ নিষেধ লেখা সাইনবোর্ড পর্যন্ত টানানো। কিন্তু তাঁর স্ত্রী কিছুতেই তাঁকে বিশ্বাস করেন না।

এ কারণেই গত ছয় মাস ধরে এই ব্যাচেলর কোয়ার্টারে মেস ভাড়া নিতে হয়েছে আজিজ মিয়াকে। মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকেন তিনি। বিশেষ করে তাঁর প্রথম স্ত্রী যখন ঢাকায় আসেন তখন। তাঁকে বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি এখানে নিয়ে আসেন। তারপর বাইরে থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, চা-বিস্কুট খাইয়ে বিদায় করে দেন। তার আগে অবশ্যই খুব সতর্কতার সঙ্গে বাইরের সাইনবোর্ডটা দেখান। এই সাইনবোর্ড অবশ্য আজিজ মিয়া নিজ খরচে টানিয়েছেন। এখানে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ–এ কথা সত্য। কিন্তু আজিজ মিয়া আসার আগে এরকম কোনো সাইনবোর্ড এখানে কখনোই ছিল না।

এমন নানা কারণেই আজিজ মিয়ার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব সর্বজনবিদিত। ফলে ঘটনা তাকে খুলে বলল মইনুল। সব শুনে আজিজ মিয়া চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, মেয়ের চেহারা-ছবি কেমন?

মইনুল বলল, আপনি চেহারা-ছবি দিয়ে কী করবেন?

নাহ। আগে দেখতে তো হবে। চেহারা ভালো হলে এক ব্যবস্থা। আর খারাপ হলে এক ব্যবস্থা। একবার তো দেখতেও পারলাম না।

ধুর ভাই। এইসব কথা বাদ দেন। আগে বলেন কিছু করতে পারবেন কি না?

তোমাদের মিয়া এই এক দোষ। সমস্যার কথা বলবা ভালো কথা। কিন্তু এমন সমস্যার কথা বলবা, যার সমাধান আছে। এই সমস্যার কি কোনো সমাধান আছে? ঢাকা শহরে এক দিনের নোটিশে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়?

মইনুল জড়সড় ভঙ্গিতে বলল, আমি জানি আপনি চাইলেই পারবেন আজিজ ভাই। না করবেন না প্লিজ। তারা খুব আশা নিয়ে এসছে। তাদের খুব বিপদ।

আজিজ মিয়া দু আঙুলের ফাঁকে নিচের ঠোঁট চেপে ধরতে ধরতে বললেন, এরপর আবার বলবা নাতো একটা চাকরি জোটাই দেন?

বললে বলব। এখন আগে আপনি থাকার ব্যবস্থা করেন। ফরিদ মরিয়া ভঙ্গিতে বলল। আজিজ মিয়া হতাশ গলায় বললেন, দুই বিয়া করে যে, পাটা পুতায় মরে সে…। বুঝলা মইনুল? আমার এখন সেই দশা। কোনো বউয়ের কাছেই আমার ফুটা পয়সা দাম নাই। দুজনেই সমানতালে ডলে। খালি সন্দেহ আর সন্দেহ। এখন তোমার এই মেহমান দুজনরে নিয়া যে ছোট বউর কাছে যাব। সেই উপায়ও নাই। সে ভাববে এই মেয়ে তার নয়া সতিন। আমার তিন নম্বর বিবি। মিথ্যা নাটক সাজাইয়া ঘরে উঠাইতেছি। পরে সুযোগ বুঝে তারেই খেদাই দেব। এইজন্যই চেহারা দেখতে চাইছি। চেহারা খারাপ হলে বিপদ কম। বউ আর সন্দেহ করবে না। বলে দুষ্টুমির ভঙ্গিতে হাসলেন আজিজ মিয়া।

মইনুল মিনতি করার ভঙ্গিতে বলল, এসব ফাজলামো এখন রাখেন ভাই। তারা আছে নানা বিপদে। মেয়েটা খুবই আপসেট। কারো দিকে তাকায়ও না। কথাও বলে না। তার শরীরও খুব খারাপ। একটু বিশ্রাম নিক। আপনি ভাবিরে একটু ম্যানেজ করেন। মাসের এই কটা মাত্র দিন। এর মধ্যে আমি তাদের জন্য একটা ব্যবস্থা করে ফেলতে পারব।

আজিজ মিয়া তার স্ত্রীকে কিছু একটা বোঝাতে সক্ষম হলেন। তাঁর বাসাতেই পারু আর ফরিদের আপাতত আশ্রয় হলো। ছোট্ট একটা রুম। রুমের সঙ্গে বাথরুম। একটা ছোট্ট জানালা। জানালার বাইরে খানিক খোলা জায়গা। সেখানে একটা পেয়ারা গাছ। গাছে পেয়ারা ধরেছে। মৃদু হাওয়ায় সেই পেয়ারা দুলতে থাকে। পারু অপলক চোখে সেখানে তাকিয়ে থাকে। তার হঠাৎ হঠাৎ মনে হতে থাকে, সে একটা গভীর দুঃস্বপ্ন দেখছে। এই দুঃস্বপ্ন শীঘ্রই কেটে যাবে। সে ঘুম থেকে উঠে দেখবে ভুবনডাঙায় সে তাদের বাড়িতে শুয়ে আছে। বাবা তাকে ডাকছেন, ওই পারু, পারু। পারু মা। ওঠ, ওঠ। কত বেলা হয়েছে দেখেছিস?

পারু উঠবে না। আড়মোড়া ভেঙে আদুরে ভঙ্গিতে পাশ ফিরে শোবে। বাবা তাকে বলবেন, এই বয়সেও এমন বাচ্চাদের মতো করলে হবে? ওঠ, ওঠ। কদিন পরে শ্বশুরবাড়ি যাবি। তখন যদি এত বেলা করে ঘুম থেকে উঠিস, দেখবি শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কত মন্দ কথা শোনাবে।

পারুর চোখে পানি চলে আসে। এই কি তার সেই শ্বশুরবাড়ি? এ সে কোথায়? আর বাবা? বাবা-ই বা কোথায়? মা, চারু, ঠাকুর মা?

.

আজিজ মিয়া পারুকে দেখলেন দ্বিতীয় দিন। দেখেই ভয়ানক চমকে গেলেন তিনি। এই মেয়ে এখানে এলো কী করে! তাঁর শরীরজুড়ে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেল। এই সুযোগ তিনি হেলায় হারাতে চান না!

২৬

মহিতোষের জ্ঞান ফিরল বিকেলের দিকে। কেউ যেন তাঁকে ডাকছে। তবে নাম ধরে না, সে আলতো হাতে তার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলছে, শুনছেন? এই যে শুনছেন?

মহিতোষের মনে হলো অনেক দূরের কোনো এক জগৎ থেকে তিনি হঠাৎ ফিরে আসছেন। অসীম কোনো এক মহাশূন্য কিংবা অতল জলের গভীর থেকে। খুব দ্রুত, অবিশ্বাস্য গতিতে তিনি ফিরে আসছেন। প্রবল চাপে দম নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। ফুসফুস প্রায় বাতাস শূন্য হয়ে যাচ্ছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে যেন জলের গভীর থেকে মাথা তুলে তাকালেন তিনি। আর সঙ্গে সঙ্গেই বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন। দুইবার পিটপিট করে তাকালেন। একজন অল্পবয়সী তরুণী তাঁকে ডাকছে। মহিতোষের মুহূর্তের জন্য মনে হলো, পারু নয় তো? সে কী তবে ট্রেন স্টেশনে তাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছে? কিন্তু পারুর তো তাকে আপনি বলে ডাকার কথা না। মহিতোষ পুরোপুরি চোখ মেলে তাকালেন। মেয়েটি বলল, একটা ব্যাগ হারিয়ে গেছে। এদিকেই কোথা…। আপনি দেখেছেন?

মহিতোষ চট করে ঘুম ভেঙে কথা বলতে পারলেন না। তিনি মেয়েটির দিকে ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটি আবার বলল, ছোট ব্যাগ, টাকা পয়সা কিছু নেই ওতে। কিন্তু জরুরি কিছু কাগজপত্র রয়েছে। আমার ছোটবোনের বোর্ড পরীক্ষার কাগজপত্র। ও চিটাগংয়ে থাকে। আগামী পরশু থেকে পরীক্ষা। ছোট মামা ভোরের ট্রেনে চিটাগং গিয়েছেন। যাওয়ার সময় এখানে হারিয়ে ফেলেছেন। আমি সেই দুপুর থেকে তন্নতন্ন করে পুরো স্টেশন খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও নেই।

মহিতোষ কথা বললেন। কিন্তু তার সেই কথা খুব ম্লান শোনাল। তিনি মৃদু কণ্ঠে বললেন, না গো মা। কোনো ব্যাগ তো আমি দেখিনি। যখন এখানে এলাম, তখনো কোনো ব্যাগ ছিল বলে তো মনে পড়ছে না!

মেয়েটির হঠাৎ কী যে হলো! প্রায় কাঁদো কাঁদো কন্ঠে কথা বলতে শুরু করল সে। তবে মহিতোষ তার কিছুই তেমন বুঝতে পারলেন না। তিনি অনেক কষ্টে উঠে থামের গায়ে হেলান দিয়ে বসলেন। তার শরীরটা প্রচণ্ড খারাপ লাগছে। চারপাশের সবকিছুই কেমন ঘোস্ত এক মানুষের জগৎ বলে মনে হচ্ছে। গায়ে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। মাথাটাও বনবন করে ঘুরছে। পেটের ভেতরের নাড়িভুড়ি সব যেন উন্টে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মেয়েটা আর কথা বলল না। সে ঘুরে চলে যাচ্ছিল। ঠিক এই মুহূর্তে মেয়েটিকে ডাকলেন মহিতোষ, এই মেয়ে।

মেয়েটা শুনেও যেন ঠিক বুঝতে পারছিল না মহিতোষ কাকে ডাকছেন। কিংবা শুনতেই পায়নি। সে ধীরে চলে যাচ্ছিল। মহিতোষ দ্বিতীয়বার ডাকলেন। আগের চেয়ে খানিক উচ্চকিত হবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ডাকটা পুরোপুরি সম্পন্ন করতে পারলেন না তিনি। তার আগেই হড়বড় করে বমি করে ফেললেন। গতরাত থেকে তেমন কিছু খাননি। তারপরও যতটুকু যা ছিল, তা-ই যেন নিংড়ে পেট থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। বিভৎস জান্তব শব্দ শুনে মেয়েটাও ফিরে তাকাল। তবে মহিতোষ তার অসুস্থতা নিয়ে কিছু বললেন না। বরং তার হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ দেখা যাচ্ছে। তিনি সেই ব্যাগটি মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, আমি খেয়াল করিনি। এসেই শুয়ে পড়েছিলাম তো! চাদরের তলায় ব্যাগটি ঢাকা পড়েছিল বোধহয়। এখন বসতে গিয়ে হঠাৎ টের পেলাম। এই যে নাও… তোমার ব্যাগ।

কথাগুলো বলতে খুব কষ্ট হলো মহিতোষের। কয়েকবার বমিও আটকাতে হলো। তবে পুরোপুরি যে পারলেন তাও নয়। মেয়েটি প্রায় ছোঁ মেরে তার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল। তারপর এস্ত ভঙ্গিতে খুলল। কাগজপত্রগুলো সব ঠিকই আছে। তার চোখে মুখে অভাবিত প্রাপ্তির আনন্দ। তবে মহিতোষের দিকে তাকাতেই তার সেই আনন্দ যেন খানিক নিষ্প্রভ হলো। মানুষটাকে এমন লাগছে কেন? লাল টকটকে চোখ। এলোমেলো উস্কোখুস্কো চুল। তবে তিনি যে মোটেই স্টেশনে এভাবে শুয়ে থাকার লোক নন, সেটি বুঝতে কোনো অসুবিধা হলো না তার। সে চট করে বলল, আপনি কি অসুস্থ?

মহিতোষ জবাব দিলেন না। তবে তার পেট গুলিয়ে ওঠা প্রবল ধাক্কাটা সামাল দেয়ার চেষ্টা করলেন। মেয়েটা উদ্বিগ্ন গলায় একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন করল, কী হয়েছে আপনার? কোথায় যাবেন? সঙ্গে কেউ নেই?

মহিতোষ কথা বলতে পারলেন না। তার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে।

.

মেয়েটি ঢাকা মেডিকেলের ইন্টার্নি ডাক্তার। তার নাম তরু। মহিতোষকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিল সে। তাতে অবশ্য খুব একটা লাভ হলো না। সহজেই সুস্থ হলেন না তিনি। প্রচণ্ড জ্বরে রীতিমতো বেহুশ হয়ে রইলেন। তাঁর সেই জ্বর থাকল দীর্ঘদিন। মেয়েটিকে অবশ্য সেদিনের পর আর দেখা গেল না। বোনের পরীক্ষার কাগজপত্র নিয়ে সেই রাতেই তাকে চলে যেতে হলো চট্টগ্রামে। সে ফিরল বেশ কিছুদিন পর। এই পুরোটা সময় একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে রইলেন মহিতোষ। তিনি খানিক সুস্থ বোধ করলেন দিন দশেক পর। ততদিনে মেয়েটা ফিরে এসেছে। সে বলল, আপনি কোথায় যাবেন?

এই প্রশ্নের উত্তর মহিতোষ দিতে পারলেন না। আসলেই তো এখান থেকে কোথায় যাবেন তিনি? যশোর চলে যাবেন? কিন্তু কী করবেন সেখানে গিয়ে? অঞ্জলিরা কি চলে গেছেন? না-কি মহিতোষের ফিরে আসার অপেক্ষা করছেন? তিনি কি তবে তাদের কাছেই ফিরে যাবেন? এই প্রশ্নের উত্তরও মহিতোষ জানেন না। মেয়েটি বলল, আপনি কিছুই বলছেন না। ঢাকায় কেউ নেই আপনার?

মহিতোষ এবার মেয়েটির দিকে চোখ তুলে তাকালেন। তারপর বললেন, আছে।

কে?

আমার মেয়ে।

সে কোথায় থাকে?

জানি না।

জানি না মানে? তাকে তো খবর দিতে হবে। হয়তো সেও এখন আপনার জন্য দুশ্চিন্তা করছে।

কথাটা শুনে বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল মহিতোষের। আসলেই কি পারু তার জন্য দুশ্চিন্তা করছে? এই যে তার যেমন সারাক্ষণ বুক ছটফট করছে, এমনকি পারুও হয়? কান্না পায় বাবার জন্য? চারু, মা, ঠাকুরমার জন্য?

মহিতোষ আর ভাবতে পারেন না। তার বুক ভার হয়ে যায়। তবে এই শহর ছেড়ে তার যেতে ইচ্ছে করে না। কেবলই মনে হয় এই শহরের কোথাও না কোথাও সে রয়ে গেছে। এই যে এই আলো-হাওয়া, এই যে মানুষের ভিড়, কোলাহল, এর কোথাও না কোথাও সে আছে। হয়তো চট করে একদিন তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। তখন কী করবে পারু?

ওই মুহূর্তটার কথা ভাবলেই মহিতোষের চোখ জলে ভরে ওঠে। মনে হয় ওই মুহূর্তটুকুর জন্য তিনি জনম জনম অপেক্ষা করতে পারবেন।

.

সেদিন বিকেলে শরীরটা খানিক সুস্থ লাগছিল। আর তখনই তরু এলো। বলল, আপনাকে এখন হাসপাতাল ছাড়তে হবে। অনেক বলে-কয়ে এতটা দিন আমি। আপনাকে এখানে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন তো আর সম্ভব না। আর আপনি আমাকে ঠিকঠাক কিছু বলছেন না।

মহিতোষ চট করেই কথাটা বললেন, আচ্ছা, ঢাকা শহরে হারিয়ে যাওয়া কাউকে খুঁজতে হলে মানুষ কী করে?

পুলিশের কাছে যায়।

আর?

রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাটে যায়। অথবা হাসপাতাল কিংবা থানায় খবর নেয়।

ঠিক এই কথাটিই যেন জানতে চাইছিলেন মহিতোষ। হাসপাতাল নিয়ে তার অভিজ্ঞতা খুব একটা সমৃদ্ধ নয়। কিন্তু তারপরও মাত্র এই কদিনেই হাসপাতালে দারুণ সব অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। এখানে রোজ কত কত মানুষ যে আসে! তাদের জাত নেই, পাত নেই। বয়স-শ্রেণি নেই। সবাইকেই এখানে কোনো না কোনো সময় আসতেই হয়। আচ্ছা এমন যদি হয় যে পারু বা ফরিদকেও কখনো না কখনো এখানে আসতে হলো? ভাবনটা মাথায় গেঁথে রইল মহিতোষের।

তিনি বললেন, আচ্ছা, এখানে থাকা যায় না?

এখানে কোথায়?

হাসপাতালে।

তরু হাসল, এটা তো আর ঘর-বাড়ি নয় চাচা। এখানে মানুষ অসুস্থ হলে আসে, আর সুস্থ হলে চলে যায়।

যদি সুস্থ না হয়?

কতদিন আর সুস্থ না হয়ে থাকবে?

সারাজীবন।

সারাজীবন তো আর অসুস্থ থাকা যায় না। হয় সুস্থতা, অথবা মৃত্যু।

কেউ কেউ তো দীর্ঘ সময় অসুস্থ হয়ে থাকে। বছরের পর বছর।

অতদিন এই হাসপাতালে এভাবে থাকার সুযোগ নেই চাচা। তবে কেউ যদি ওরকম অসুস্থ হন বা কখনোই সুস্থ না হন, তাহলে হাসপাতাল তো আর তাকে চিরজীবন এখানে রেখে দেবে না? হয় বাড়ি পাঠিয়ে দেবে, না হয় মর্গে।

মর্গে? যেন অবাক হলেন মহিতোষ।

হুম। কারণ সুস্থ না হয়ে তো মানুষ মারা যায়। তাই না?

মহিতোষ এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। তবে বিড়বিড় করে বললেন, কারো যদি এমন কোনো অসুখ হয় যে সে মরেও গেল না, আবার বেঁচেও থাকল না? তখন?

তরু হাসল। লোকটা আসলেই খানিক অদ্ভুত। ঠিক আর দশজনের মতো নয়। কোথায় যেন খানিক আলাদা তিনি। যেন বুকের ভেতর খুব আলগোছে খুব গোপন কিছু একটা লুকিয়ে রাখছেন। সেই গোপন এতটাই আপন যে তা আর কাউকেই বুক খুলে দেখাতে চান না। সে বলল, আপনাকে এত কিছু ভাবতে হবে না। আপনি বলুন কোথায় যাবেন, আমি আপনাকে পৌঁছে দেব।

কিন্তু মহিতোষের মাথা থেকে ওই মর্গের ব্যাপারটা আর গেল না। আচ্ছা যদি এমন হয় যে তিনি আর কখনোই পারুকে খুঁজে পেলেন না। অথচ এই শহরের অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়ালেন। তারপর একদিন হঠাৎ মরে গেলেন। তখন? তখন তার লাশটাও কি অজ্ঞাতনামা লাশ হিসেবে এমন কোনো হাসপাতালের মর্গে পড়ে রইবে? কেউ তাকে দাহও করবে না?

তখন কোথায় থাকবে পারু? ঠিক ওই মুহূর্তে কী করবে? কোনভাবেই কি বাবার মৃত্যু সংবাদটা টের পাবে সে? চারু, অঞ্জলি কিংবা মা? মহিতোষের হঠাৎ মনে হলো তিনি যেন দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছেন। কেমন অন্যরকম। আজকাল অল্পতেই তাঁর চোখে জল চলে আসে। বুক ভার হয়ে যায়। এমন হলে বাকিটা সময় তিনি কী করে কাটাবেন?

পারু এই শহরেই আছে, অন্তত এটুকু তো তিনি জানেন। কিন্তু কোনো না কোনোদিন যদি সত্যি সত্যিই এই শহরের কোথাও না কোথাও পারুর সঙ্গে তাঁর হুট করেই দেখা হয়ে যায়? কিংবা ফরিদের সঙ্গে?

বিষয়টা নিয়ে কত কী যে ভাবলেন মহিতোষ! কত কত স্বপ্ন-সম্ভাবনার কথা। কত কত কল্পনার কথা। কিন্তু সেসবই শেষটায় এসে কেমন ধোঁয়াশা পূর্ণ হয়ে থাকে। সেদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল তার। শরীরটা এখন অনেকটাই ভালো। তরু বলেছে, এবার হাসপাতাল ছাড়তেই হবে। প্রায় মাস হয়ে এলো তিনি এখানে আছেন। এরপর আর কিছুতেই থাকা যাবে না। কিন্তু এখান থেকে বের হয়ে তিনি কোথায় যাবেন?

বিষয়টা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তেই আসতে পারলেন না মহিতোষ। সারাটা দিন ঝিম ধরে বসে রইলেন। তরু এলেও কথা বললেন না। মেয়েটা কত কী যে। জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তার কোনো জবাব দিলেন না মহিতোষ।

অজস্র শঙ্কা-সম্ভাবনার মেঘ ক্রমাগত মাথার ভেতর উড়ে উড়ে যেতে লাগল। রাত তখন কটা মহিতোষ জানেন না। ঘুমানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্তু পারছিলেন না। মাথার ভেতর হিজিবিজি হিজিবিজি অসংখ্য দাগ টেনে দিচ্ছে এলোমেলো ভাবনা। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই হঠাৎ কথাটা মনে পড়ল তার। আর সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ চমকের মতো অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেল শরীরজুড়ে! এই সামান্য জিনিসটা কেন আগে মনে পড়েনি? নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগতে লাগল মহিতোষের। নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তাঁর বুকের ভেতর। চুপসে যাওয়া প্রত্যাশার বেলুনটা যেন আবার উড়তে শুরু করেছে।

.

তরু আজ খানিক দেরি করে হাসপাতালে এলো। এ কদিন মহিতোষকে নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে অনেক কিছু ভাবলেও খুব গুরুত্ব দিয়ে কিছু সেভাবে ভাবেনি সে। কিন্তু গত কয়েকদিন মানুষটার আচার-আচরণ কেমন অস্বাভাবিক লেগেছে তার কাছে। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না। কিছু খাচ্ছেন না। খানিক পরপরই এলোমেলো ছুটে যাচ্ছেন হাসপাতালের বারান্দায়। তারপর উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন নিচে। রোগীদের বেডে বেডেও ঘুরতে দেখা গেছে কয়েকবার। যেন কাউকে খুঁজছেন তিনি। কিন্তু কাকে খুঁজছেন? প্রশ্ন করলেও উত্তর দেন না। বিষয়টা ভাবিয়ে তুলেছে তরুকে। নানা ব্যস্ততা আর ঝামেলা মিলিয়ে মানুষটাকে নিয়ে খুব বেশি কিছু ভাবার ফুরসৎ মেলেনি তার। কিন্তু আজ এই অন্ধকার রাত্রিতে হঠাই। মানুষটার জন্য কেমন মায়া হতে লাগল। মনে হলো, এই বয়সের এমন অসুস্থ একজন মানুষ দিনের পর দিন এভাবে হাসপাতালে পড়ে আছেন, অথচ কেউ কোনো খবর পর্যন্ত নিতে এলো না। অবশ্য তিনিও কাউকে খবর পাঠাতে বলেননি। কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেন না। হেঁয়ালিপূর্ণ কথা বললেন। সেদিন বললেন তার একটি মেয়ে আছে ঢাকায়। কিন্তু সেই মেয়ে সম্পর্কে কিছু জানে না তরু। মহিতোষও বলেন না। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া মানুষ কীভাবে খুঁজে পেতে হয়, এই নিয়ে নানা সময়েই নানা কথা তিনি বলেছেন। মানুষটাকে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শুয়ে থাকতে দেখে তখন তেমন অবাক লাগেনি তরুর। এমন হয়তো অনেকেই থাকেন। কিন্তু আজকাল সেটি নিয়েও খুব ভাবছে সে। ওভাবে ওখানে কেন শুয়েছিলেন তিনি? পোশাকে-আশাকে, কথা-বার্তায় তাঁকে শিক্ষিত, রুচিবান বলেই। মনে হয়েছে। কিন্তু মানুষটার গল্পটা আসলে কী? নিশ্চয়ই এমন কিছু একটা আছে তার, যা তিনি কাউকে বলতে চান না। কিংবা পারেন না। অথচ সারাক্ষণ সেই গল্পটা বুকে বয়ে বেড়ান। শেষ রাতের দিকে খুবই অস্থির লাগতে লাগল তরুর। সে সিদ্ধান্ত নিল, যে করেই হোক, আজ ঘটনাটা জানতেই হবে। মানুষটাকে পৌঁছে দিতে হবে তার ঠিকানায়, প্রিয় মানুষদের কাছে।

ভোরের আলো ফোঁটার আগেই রান্না বসাল সে। আজ নিজ হাতে কিছু বঁধবে। এতগুলো দিন হাসপাতালের ওই বিদ্বাদ একঘেয়ে খাবার ছাড়া আর কিছুই মুখে পড়েনি লোকটার। কেউ দেখতে পর্যন্ত আসেনি। অথচ তার চারপাশে কত কত রোগী। প্রতিদিনই তাদের আপনজনরা কেউ না কেউ দেখতে আসেন। নানা রকম খাবার দিয়ে যান। অথচ তিনি বসে থাকেন একা, নির্বিকার। যেন অসংখ্য মানুষের মাঝেও নিঃসঙ্গ একা মানুষ।

.

তরু হাসপাতালে পৌঁছাল দুপুরের খানিক আগে। ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত এক অস্থিরতা অনুভব করছে সে। যে করেই হোক আজ মানুষটার না বলা সেই গল্পগুলো। সে শুনতে চায়। ঠিক কী কারণে নিজেকে এমন বিচ্ছিন্ন একা এক দ্বীপের মতো সবার থেকে আলাদা করে রেখেছেন তিনি। কীসের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন সঙ্গোপনে। কিন্তু মহিতোষের বেডের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল তরু। বিছানাটা। ফাঁকা। সেখানে কেউ নেই। পাতলা কম্বলটা এলোমেলো পড়ে আছে। ধবধবে বালিশ দু খানা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে দু পাশে। কোথায় গিয়েছেন তিনি? আশপাশে কোথাও? কিংবা বাথরুমে তরু অপেক্ষা করুল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর আশপাশে খুঁজল। এর ওর কাছে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু কেউই কিছু বলতে পারল না। প্রায়। বিকেল অবধি অপেক্ষা করল সে। কিন্তু মহিতোষকে কোথাও পাওয়া গেল না। যেন ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেছেন তিনি।

২৭

আজিজ মিয়া যে ফরিদকে শুধু থাকতেই দিয়েছেন, তা-ই নয়। বরং সঙ্গে কিছু কাজও জুটিয়ে দিলেন। দ্বিতীয় দিন দুপুরেই ফরিদকে ডাকলেন তিনি। বললেন, মইনুল যা বলেছে তাতে এটুকু অন্তত বুঝেছি যে আপনার কাজ দরকার। তাই না?

ফরিদ তার কথা শুনে খুবই খুশি হলো। সে বিগলিত কণ্ঠে বলল, জি ভাই, জি। এমন কিছু হলে খুবই উপকার হয়। তাছাড়া এভাবে আপনার বাড়িতে কতদিন থাকব আমরা?

সেটা কোনো সমস্যা না। আপনার যতদিন ইচ্ছা থাকেন। কোনো সমস্যা নাই। সমস্যা অন্য জায়গায়।

কী সমস্যা? উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করল ফরিদ। আজকাল অল্পতেই বিচলিত হয়ে পড়ে সে।

আমার এক বন্ধুর ছোটখাটো কিছু ব্যবসা আছে। কিন্তু আপনি শিক্ষিত ছেলে। আপনি তো আর যেই সেই কাজ করবেন না।

ফরিদ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সে বলল, আপনি যেকোনো কাজ দিন, আমি করতে পারব।

পারবেন না।

পারব, পারব। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আমার এখন ভালো-মন্দ যাচাই করার মতো অবস্থা নেই?

হুম। তাতো বুঝতে পারছি। তা মশলার আড়তে কাজ করতে পারবেন? সদরঘাটের দিকে তার মশলার কাঁচামালের আড়ত আছে। ওইখানে লঞ্চ-স্টিমারে করে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে হলুদ, মরিচের চালান আসে। সঙ্গে আরো নানা ধরনের মাল-মশলা। সেগুলা বস্তায় করে আনা-নেওয়া করা লাগে। আপনার যে। মাথায় করে বস্তা তুলতে হবে এমন না। তবে আগে-পিছে থাকতে হবে আর কী।

চট করে বিষয়টা বুঝতে পারল না ফরিদ। খানিক যেন হতোদ্যমই হয়ে গেল সে। আজিজ মিয়া বললেন, দিনের বেলা কাজটা একটু কঠিন। তবে রাতের একটা শিফটও আছে। আপনি চাইলে সেইটাও করতে পারেন। তখন লোকজনের প্রেসার কম। হিসাব-নিকাশের কাজটা শুধু করতে হবে।

এটা মোটামুটি পছন্দ হলো ফরিদের। আগে কিছু একটা গুরু তো হোক। তারপর না হয় বাকিটা দেখা যাবে। সে আজিজ মিয়ার কথায় রাজি হয়ে গেল। মনে মনে খুব কৃতজ্ঞও বোধ করল। এই অচেনা অজানা শহরে কে-ই বা কার জন্য এতটুকু করে।

পরদিন সকাল থেকে কাজে লেগে গেল ফরিদ। কিন্তু প্রচণ্ড ঝাল-মশলার ঝাঁঝে প্রাণান্ত পরিশ্রম শেষে যখন সে রাতে ঘরে ফেরে তখন চোখ অবধি বুজতে পারে না। যন্ত্রণায় ছটফট করে। নীরব, নিস্তব্ধ পারু যেন কিছু দেখেও দেখে না। অভিমানী ফরিদ বলেও না কিছু। সে ঘরে ফিরে মেঝেতে বিছানা বিছিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে। পারু শুয়ে থাকে খাটে। তাদের কারো সঙ্গে কোনো কথা হয় না। ফরিদ জানে না, পারু আর কখনো স্বাভাবিক হবে কি না? তার সঙ্গে আবার কখনো আগের মতো কথা বলবে কি না? জীবনের যে অন্ধকার গলিপথে তারা ঢুকে পড়েছে, সেখান থেকে আসলে পিছু ফেরার আর কোনো সুযোগ নেই। বরং সামনে এগিয়ে পথ খুঁজে বের করার যে যুদ্ধ সেটা তাদের করতেই হবে। ফরিদ তা ধীরে ধীরে মেনে নিলেও পারু যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। দিন দিন তাই আরো বেশি খোলস বন্দি হতে থাকে সে। সারাক্ষণ চুপচাপ দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলে না। ফরিদের সঙ্গেও না। এ এক অদ্ভুত জীবন তাদের।

বাইরের পৃথিবীর কাছে যারা পরস্পরের প্রিয়তম মানুষ হিসেবে মূর্ত হয়ে উঠেছে, সেই তারাই আবার চার দেয়ালের ভেতর বিচ্ছিন্ন দুটি দ্বীপ। বিমূর্ত দুজন মানুষ। তারা কেউ কাউকে ছুঁতে পারে না। কাছে যেতে পারে না। অনুভবে স্পর্শও করতে পারে না। কেবল একটা অলঙ্ঘনীয় বিষাদ কিংবা বিভ্রমের প্রাচীর যেন ক্রমশই তাদের মাঝখানে আরো দৃঢ়, আরো বিশাল হতে থাকে।

.

ফরিদ শেষ অবধি রাতের শিফটের কাজটা নিল। সারারাত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নদীপথে কাঁচামাল আসে। সেগুলোর হিসেব-নিকেশ করতে হয় তাকে। দিন দুই কাজ করে খানিক আরমাদায়কই মনে হলো। অন্তত দিনের বেলার ওই ভয়ানক অভিজ্ঞতা থেকে এটা অনেক শ্রেয়। সমস্যাটা হলো পঞ্চম দিন রাত শেষে বাড়ি ফেরার পরে। রাতজাগা ক্লান্ত ফরিদ বারবার কড়া নাড়তে থাকে দরজায়। কিন্তু ভেতর থেকে খোলার কোনো নামই নেই। সে প্রথমে ভেবেছিল পারু হয়তো ঘুমাচ্ছে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পরও যখন দরজা খুলল না পার, তখন ভয় পেয়ে গেল ফরিদ। আজিজ মিয়ার স্ত্রীও আজ বাড়িতে নেই যে তাকে ডাকবে। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি বাবার বাড়ি গিয়েছেন। সুতরাং রাতে একাই থাকতে হয়েছে পারুকে। কোনো অঘটন ঘটেনি তো!

চিন্তিত ফরিদ চিৎকার করে পারুকে ডাকতে লাগল। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে। যে ভয়ানক মানসিক অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে পারু, তাতে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে সে! খুব খারাপ কিছু হয়নি তো তার।

পারু অবশ্য দরজা খুলল তার কিছুক্ষণ পরেই। কিন্তু সেই পারুকে দেখে চমকে উঠল ফরিদ। তার চোখে-মুখে ভয়ানক আতঙ্ক। সন্ত্রস্ত দৃষ্টি। দরজা সামান্য ফাঁক করেই ভীত চোখে এদিক সেদিক তাকাল সে। তারপর আচমকা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ফরিদ বলল, কী হয়েছে পারু? কাঁদছো কেন?

পার কথা বলতে পারল না। তার শীর্ণ শরীরটা থেকে থেকে কাঁপছে। ফরিদ বলল, কী হয়েছে, আমাকে বলো? তুমি কি ভয় পেয়েছ?

পারু এবারও কথা বলল না। ফরিদ তাকে বিছানায় নিয়ে বসাল। তারপর সতর্ক গলায় বলল, কী হয়েছে পারু? কোনো সমস্যা?

ওই লোকটা এসেছিল রাতে। ওই লোকটা। পারু জড়ান গলায় বলল।

কোন লোকটা? আজিজ ভাই? ফরিদ অবাক গলায় বলল।

পারু মাথা নাড়লো, হু।

ফরিদ এতটা অবাক কখনো হয়নি। আজিজ মিয়ার তো রাতে এখানে আসার কথা না! তাঁর স্ত্রী আজ বাসায় নেই। ফলে স্ত্রীর সঙ্গে তাঁরও থাকার কথা শ্বশুরবাড়িতে। ফরিদকে তিনি সেকরমটাই জানিয়েছিলেন। এমনকি গতরাতে পার একা একা বাসায় থাকবে বলে ফরিদ কারখানায়ও যেতে চায়নি। কিন্তু তিনি বলেছিলেন জরুরি কিছু মালের চালান আসবে। ফরিদকে অবশ্যই যেতে হবে। প্রয়োজনে কিছুক্ষণ থেকেই চলে আসবে সে। কিন্তু ফরিদ আসতে পারেনি। রাতে একটার পর অনেকগুলো কাজ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল তাকে। অথচ তখন কী না…।

ফরিদ আর ভাবতে পারল না। লোকটাকে নিয়ে কী যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে তার। সে থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছিল পারু?

সে মাঝরাতে এসে বলল দরজা খুলতে। আপনি নাকি কী খবর পাঠিয়েছেন? আমি দরজার বাইরে থেকেই বলতে বললাম। কিন্তু উনি মানতে চাইলেন না। অনেক রাত পর্যন্ত দরজা ধরে ধাক্কালেন। উল্টাপাল্টা নানা কথা বললেন। চিৎকার চেঁচামেচি করে ভয় দেখালেন। তার গলার স্বরও যেন জড়িয়ে যাচ্ছিল… ভয়ংকর সব কথা বলছিলেন।

কী বলছ তুমি!

হু। পারু এরচেয়ে বেশি আর কিছু বলতে পারল না। তার চোখে মুখে স্পষ্ট আতঙ্ক। সে মাথা নিচু করে রইল। ফরিদ বলল, তোমার কোনো ক্ষতি হয়নি তো পারু।

পারু ডানে বায়ে মাথা নাড়ল। তারপর আচমকা ফরিদের হাত চেপে ধরে বলল, ওই লোকটাকে যেন আগেও কোথায় দেখেছি আমি! কিন্তু মনে করতে পারছি না। আমার ভয় হচ্ছে। খুব ভয় হচ্ছে।

পারুর কথা শুনে খুবই অবাক হলো ফরিদ। সে বলল, ওনাকে তুমি আরো আগে কোথায় দেখবে? কীভাবে দেখবে?

তা জানি না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে লোকটাকে আমি চিনি।

এবার খানিক ভয় পেয়ে গেল ফরিদ। পারুর কোনো মানসিক সমস্যা হচ্ছে না তো? সারাদিন একা একা থাকে। কারো সঙ্গে কথা বলার, মেশার সুযোগ পায় না। সারাক্ষণ একটা তীব্র ভয় তাড়া করে ফেরে। এসব কারণেই কি উল্টাপাল্টা চিন্তা করছে সে?

পারু ভয়ার্ত গলায় বলল, আমি আর এখানে থাকব না, এক মুহূর্তও না। আপনি আমায় অন্য কোথায় নিয়ে যান। যেখানে আপনি সবসময় আমার কাছে থাকবেন। আর কেউ থাকবে না।

প্রথম কথাটুকু শুনে ফরিদ সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল। তবে পারুর বাকি যে কথাটুকু-ওই যে ওই সন্ত্রস্ত দৃষ্টি, ওই যে কম্পিত হাতের মুঠোয় ফরিদের হাতজোড়া শক্ত করে চেপে ধরা, এই প্রত্যেকটা স্পর্শেই যেন ফরিদ হঠাৎ আবিষ্কার করল–পারু যতই তার সঙ্গে কথা না বলুক, অস্পৃশ্য দূরত্ব বজায় রাখুক, কিংবা তুলে রাখুক অলঙ্ঘনীয় বিষাদের প্রাচীর, তারপরও তার কাছে সে এক অতলান্ত নির্ভরতার নাম। একটা মানুষ তার এক জীবনের সকল চেষ্টায়ও হয়তো কারো কাছে এমন নির্ভেজাল নির্ভরতা হয়ে উঠতে পারে না। ফরিদ সেই আরাধ্য নির্ভরতাটুকু অর্জন করতে পেরেছে। নিঃসঙ্কোচ বিশ্বাস হয়ে উঠতে পেরেছে। এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে।

সারাটা রাত পারু ভয় পেয়ে কেঁদেছে। একটা পাতা পড়ার শব্দেও কেঁপে উঠেছে। আর রাতভর অপেক্ষা করেছে ফরিদের জন্য। এই পুরো পৃথিবীতে ভরসা করার মতো এই একটিমাত্র জায়গাই কেবল অবশিষ্ট আছে তার। ভয়ানক বিপদে কেবল এই মানুষটিকেই সে প্রবল নির্ভরতায় স্মরণ করে। এই যে এখন সে পারুর হাত ধরে বসে আছে, তার হাতের মুঠোয় পারুর হাত জোড়া কাঁপছে, এই কম্পনের প্রতিটি স্পন্দনে সে অনুভব করছে নির্ভরতা। যেন সে জানে, এই পৃথিবীর কোনো কিছুর বিনিময়েই এই মানুষটি কখনোই তাকে ছেড়ে যাবে না।

.

ফরিদ সেই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। পরের দুটো দিন গেল ভয়াবহ আতঙ্কে। কিছুতেই ফরিদকে বাড়ি থেকে বের হতে দেবে না পারু। কিন্তু ফরিদকে যেতে হলো। সে তন্নতন্ন করে একখানা ঘর খুঁজল। কিছু কাজও। আজিজ মিয়ার সামান্য অনুগ্রহও আর গ্রহণ করতে চায় না সে। দুর্ভাগ্যের মুহূর্মুহূ আঘাতে পর্যন্ত ফরিদের প্রতি অবশ্য ভাগ্য যেন এবার খানিক সুপ্রসন্ন হলো। দ্বিতীয় দিনেই একখানা এক রুমের ঘর পেয়ে গেল সে। তার সপ্তাহখানেকের মাথায় একটি কাজও। এই কাজটি নিয়ে দারুণ উচছুসিত ফরিদ। একটি ওষুধের দোকানে সহকারীর কাজ। মামা আব্দুল ওহাবের সঙ্গে দীর্ঘ দিন কাজ করার ফলে নিজেকে প্রমাণ করতে তেমন সমস্যা হলো না ফরিদের। জীবন যেন তার অষ্টপ্রহর দহন শেষে খানিক বিরাম দিল তাকে। খানিক প্রশান্তির বর্ষণ ঝরাল। আজিজ মিয়াকে না। জানিয়েই তার বাসা ছেড়ে দিল ফরিদ।

.

পারুর সঙ্গেও আজকাল টুকটাক কথা হয় ফরিদের। তবে সেটা নির্ভর করে পারুর মানসিক অবস্থার ওপর। হয়তো কোনোদিন হঠাৎ করেই সে বলে, আপনি আজ একটু তাড়াতাড়ি আসবেন?

কেন?

দুপুর বেলা আমার খুব ভয় লাগে।

দুপুর বেলা ভয় লাগবে কেন?

তাতো জানি না। কিন্তু খুব ভয় হয়।

কেন?

মনে হয় কেউ একজন আমায় ডাকছেন।

এখানে কে ডাকবে তোমাকে?

বাবা? অবিকল বাবার কণ্ঠস্বর। মনে হয় বাবার শরীরটা খুব খারাপ। কিন্তু তার আশপাশে কেউ নেই। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। এইজন্য আমাকে ডাকছেন।

ফরিদ এই কথার উত্তর দিতে পারে না। সে চুপচাপ পারুর পাশে বসে থাকে। পারু বলে, বাবার যখন জ্বর হতো। আমায় খুব ডাকতেন। চাইতেন আমি যেন তাঁর পাশে সারাক্ষণ বসে থাকি। কপালে জলপট্টি দিয়ে দিই। একটু দূরে গেলেই বলতেন, মা রে কদিন পরে তো এমনিতেই দূরে চলে যাবি। এখন একটু কাছে। থাক না!

ফরিদ কথা বলল না। পারু বলল, বাবা কি কখনো জানত যে আমি এভাবে দূরে চলে যাব? আর কখনো কোনোদিন তার সঙ্গে আমার দেখা হবে না? তার গায়ের একটু গন্ধ নিতে পারব না আমি? একটু জড়িয়ে ধরতে পারব না?

ফরিদ আলতো করে পারুর হাতটা ধরল। পারু বলল, আমার কী মনে হয় জানেন?

কী?

বাবা এই শহরের কোথাও না কোথাও আছেন। আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, মনে মনে ডাকছেন। আর আমি সেই ডাকটাই শুনতে পাই। খানিক একা থাকলেই মনে হয় ওই তো বাবা আমাকে ডাকলেন। স্পষ্ট ডাক। আমি বারবার চমকে উঠি। কী যে কষ্ট হয় তখন।

পারু কাঁদছে না। তবে তার চোখ ছলছল। গলা ভেজা। ফরিদ অস্ফুটে ডাকল, পারু!

পারু হঠাৎ তার হাতে রাখা ফরিদের হাতখানা শক্ত করে মুঠোবন্দি করল। তারপর বলল, জীবনটা এমন কেন হয়ে গেল বলতে পারেন?

এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে ফরিদ? সেই সারাটা দিন কেমন থম মেরে রইল সে। এই জীবনে পারু আর কখনোই পুরোপুরি আনন্দিত হতে পারবে না। হাসতে পারবে না। হৈ-হুঁল্লোড় করতে পারবে না। সারাক্ষণই তার বুকের ভেতর একটা সূক্ষ্ম অথচ তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো বিধে রইবে এই যন্ত্রণা। জীবনের শেষ দিন অবধি। এমন ভয়াল যন্ত্রণা বুকে পুষে একটা জীবন বয়ে বেড়ানো কী অসহনীয় দুর্ভাগ্যের!

.

গ্রামের চেয়ে শহরে শীত খানিকটা কম। তারপরও শেষরাতের দিকে যেন আঁকিয়ে বসে ঠাণ্ডা। ফরিদ মেঝেতে ঘুমায় বলে কষ্টটা বেশিই হয় তার। এ বাসার জন্য যতটা সম্ভব কম দামে কিছু ব্যবহার্য জিনিসপত্র কিনেছে তারা। তার মধ্যে একটা ছোট্ট চৌকিও রয়েছে। সেখানে পারু ঘুমায়। ফরিদ মেঝেতেই। কিন্তু সেখানে বিছানোর মতো কিছু কেনার পয়সা এখনো জোটেনি তার। ফলে ওষুধের বড় খালি কার্টনগুলো দোকান থেকে নিয়ে এসেছে সে। কিছু বিছিয়ে দিয়েছে পারুকে। আর কিছু মেঝেতে বিছিয়ে নিয়েছে সে। তারপরও রাত বাড়তেই যেন সিমেন্টের মেঝে থেকে হুহু করে হাড় কাঁপানো হিম উঠে আসতে থাকে। মোটা একখানা কম্বল অবধি কিনতে পারেনি ফরিদ। এই নিয়ে পারুও কখনো কিছু বলেনি। বিষয়টা মাঝে মাঝে খুব কষ্ট দেয় তাকে। একটু সহানুভূতিও কি সে পেতে পারে না পারুর কাছ থেকে দুটো ভালো কথা? খানিক যত্ন? ভুল যদি কিছু হয়ে থাকে, তাতো সে একা করেনি। এই অপরিণমদর্শী যাত্রা যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তবে সেখানে তারা দুজনই সমান দোষী। তাহলে পারু কেন সবসময় তাকে এভাবে উপেক্ষা করে? কেন ফরিদের নিজেকেই কেবল অপরাধী মনে হতে থাকে!

.

সেদিন শেষ রাতে অবশ্য একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। দিনভর মেঘলা হয়েছিল আকাশ। সাধারণত বছরের এই সময়ে বৃষ্টি হয় না। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যার পর হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। ফরিদের ফিরতেও দেরি হলো খানিক। পারু জানালার কাছে বসে ছিল। বৃষ্টির সঙ্গে একটা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ধেয়ে আসতে লাগল উত্তর দিক থেকে। ফরিদ যখন ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল, তখন রাত নটা। থরথর করে কাঁপছে সে। তার সারা শরীর ভেজা। গায়ের সোয়েটারটাও শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। পারু তাকে শুকনো তোয়ালেটা এগিয়ে দিল। তবে কথা বলল না। সারাদিন মন ভার হয়েছিল তার। ফরিদও অবশ্য আজ কোনো কথা বলল না। এমনিতে রোজ কাজ থেকে ফিরে সে পারুর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। দোকানের কথা ও কাজের কথা। কোন ক্রেতার সঙ্গে মজার কী ঘটেছে, সেসব কথাও। সে আসলে পারুকে সহজ করার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। পারু যেন কঠিন বিশাল এক পাথর। তাকে ভাঙা যায় না। গড়া যায় না। সে যেমন তেমনই। নীরব, নিথর। অনড়, অবিচল। তাকে কঠিন কিংবা আলতো ছোঁয়ায় স্পন্দিতও করা যায় না।

.

ফরিদ বাথরুম থেকে এসে শুয়ে পড়ল। কিছু খেল না অবধি। শরীরটা খারাপ লাগছে তার। ঠাণ্ডাটাও জাঁকিয়ে পড়েছে বেশ। মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভেঙে গেল ফরিদের। কিছু একটা অস্বস্তি দিচ্ছে তাকে। সে চট করে চোখ মেলে তাকাল। ভেন্টিলেটর দিয়ে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের সামান্য আলোর আভা এসে পড়েছে ঘরে। সেই আভায় পারুকে দেখতে পেল সে। চুপচাপ তার পাশে বসে আছে। কোনো কথা নেই। শব্দ নেই। কেবল বসে আছে একা। যেন এই আবছা অন্ধকারের সঙ্গে সেও অকপট আলস্যে লেপ্টে আছে। ফরিদ ভয় পেয়ে উঠে বসল। এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। সে বলল, কী হয়েছে পারু? কোনো সমস্যা?

পারু বলল, হু।

কী সমস্যা?

বুঝতে পারছি না।

কী বুঝতে পারছ না?

সমস্যা।

ফরিদ তার কথা শুনে বিভ্রান্ত হয়ে গেল। সে বলল, কী হয়েছে তোমার?

কিছু হয়নি তো!

বলো আমাকে? নরম গলায় বলল ফরিদ।

কী বলব?

কী হয়েছে?

বুঝতে পারছি না তো।

একটা তেরছা আলো এসে পড়েছে পারুর মুখে। ওই আলোটুকুতে এই আবছা অন্ধকারেও পারুকে যে কী মায়াময় লাগছে! মনে হচ্ছে শিল্পীর তুলিতে আঁকা বিষণ্ণ সুন্দর কোনো ছবি। পারু হঠাৎ বলল, আমি মানুষটা খুব খারাপ, তাই না?

তুমি খারাপ কেন হবে?

তা জানি না। তবে আমি খারাপ তা জানি।

তুমি মোটেও খারাপ না।

উহু, আমি খারাপ। না হলে ওভাবে সবাইকে ছেড়ে আমি এক মুহূর্তে চলে আসতে পারতাম না। আর এসেছিই যখন, তখন এমন করে আপনাকে কষ্টও দিতে পারতাম না। সবকিছু মেনে নিতে পারতাম। কিন্তু আমি কিছুই পারছি না। অনেক চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না। অথচ আমি জানি, আমার জন্য আপনার খুব কষ্ট হয়। খুব। আমি সবাইকে কেবল কষ্টই দিই। কাউকে একটু ভালো রাখতে পারি না।

পারুর গলা ভার। তবে সে থামলেও কথা বলল না ফরিদ। যেন তার বুকের ভেতর জমে থাকা অভিমানের বিশাল হিমবাহটা আরো ভারী হচ্ছে। খানিক উত্তাপের অপেক্ষায় হাঁসফাস করছে। ওটুকু পেলেই গলতে শুরু করবে। কিন্তু পৃথিবীতে ওই উত্তাপটুকু যার কাছে আছে সেই পারু তা লুকিয়ে রেখেছে তার অতলান্ত বিষাদ আর কান্নার আড়ালে। সেটুকু পাবে কী করে ফরিদ?

পারু বলল, আমাকে সবাই এত ভালোবাসে…। এই যে মা, বাবা, চারু, ঠাকুরমা। এই যে আপনি…। অথচ আমি? আমি বিনিময়ে কষ্ট ছাড়া আর কাউকে কিছু দিতে পারি না। আমি খুব খারাপ। বলে হঠাৎ কাঁদতে লাগল সে। ওই বাইরের ল্যাম্পপোস্ট নিংড়ে আসা একচিলতে আলোর আভায় তার চোখের কোল গড়িয়ে ঝরে পড়তে থাকা অশ্রুবিন্দুকে হঠাৎ কেমন অপার্থিব মনে হতে লাগল ফরিদের। সে আঙুল বাড়িয়ে পারুর চোখের কোলে উপচে ওঠা জলের ওই প্রস্রবণটুকু ছুঁয়ে দিল। তারপর বলল, এই যে তুমি এমন করে ভালোবাসতে পারো!

কই? আমি ভালোবাসতে পারি না তো!

উহু, পারো। এই যে কাউকে ভালোবাসতে পারো না ভেবে, কষ্ট দিচ্ছো ভেবে মাঝরাত্তিরে একা একা অন্ধকারে কাঁদছে, পৃথিবীতে এরচেয়ে শুদ্ধতম অনুভূতি আর কী আছে পারু? এরচেয়ে শুদ্ধ আর কিছু নেই।

আমার খুব কষ্ট হয়। আমি এমন কেন?

ফরিদ এই প্রশ্নের জবাব দিল না। তবে সে আচমকা বলল, আমি কি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি পারু?

পার কথা বলল না। তবে সে আলগোছে ফরিদের বুকের কাছে সরে এলো। তারপর ঢুকে গেল তার বুকের ভেতর। ফরিদের হঠাৎ মনে হলো এক জোড়া উষ্ণ কবুতরের আশ্চর্য কোমল স্পর্শে তার শরীর সেই আরাধ্য উত্তাপটুকু পেতে শুরু করেছে। যে উত্তাপে গলে ধসে যেতে থাকল তার বুকে জমা অভিমানের সুকঠিন হিমবাহ। সে হাত বাড়িয়ে পারুকে জড়িয়ে ধরল। তারপর ডাকল, পারু?

পারু তার ডাকে সাড়া দিল না। তবে সে ফিসফিস করে বলল, আপনি আমায় কখনো ছেড়ে যাবেন নাতো? কোনোদিন না?

ফরিদ বলল, কখনোই না।

আপনি ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই।

ফরিদ কথা বলল না। তবে শক্ত করে তার বুকের সঙ্গে চেপে ধরে রাখল পারুকে। পারু বলল, আমার সারাক্ষণ কেবল ভয় হয়। খুব ভয় হয়।

কীসের ভয়?

আমি যদি কখনো আপনাকেও হারিয়ে ফেলি?

ধুর বোকা। আমাকে কেন হারাবে?

আমি জানি না। কিন্তু আমার সারাক্ষণ কেবল ভয় হতে থাকে।

ফরিদ পারুকে আলিঙ্গন মুক্ত করে মুখোমুখি বসাল। তারপর বলল, হারিয়ে যাওয়ার জন্য কি এতকিছু করেছি আমরা? এভাবে সবকিছু ছেড়ে পথে নেমেছি?

কিন্তু ভয় হয় যে!

উহু। একটা মানুষ কি সারাজীবন শুধু হারাবেই? কিছুই পাবে না?

পারু জবাব দিল না। ফরিদ বলল, যা হারানোর, তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু হারিয়েছি আমরা। এবার পাওয়ার পালা।

আর কী পাওয়ার আছে?

তোমার কি পাওয়ার আছে আমি জানি না। তবে আমার অনেক কিছু পাওয়ার আছে।

কী?

তোমাকে।

এই কথায় চুপ করে রইল পারু। ফরিদ বলল, আমার কী হয়েছে জানো?

কী?

তোমাকে পুরোপুরি পেতে গিয়ে যেটুকু পাওয়া ছিল তাও হারিয়ে ফেললাম।

বুঝিনি। পারু জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলল।

ভুবনডাঙার সেই লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলার দিনগুলোতে তোমাকে একটু হলেও পেয়েছি বলে ভাবতাম। অথচ এখন মনে হয়, পুরোপুরি পেতে গিয়ে ওই যেটুকু পেয়েছি বলে ভাবতাম, সেটুকুও বোধহয় হারিয়ে ফেলেছি।

ফরিদের কষ্টটা যে পারু বোঝে না, তা নয়। কিন্তু কী করবে সে? কোনোভাবেই নিজেকে বোঝাতে পারে না। সারাক্ষণ মাথার ভেতর অসংখ্য ভাবনা কিলবিল করতে থাকে। বুকের ভেতর দংশাতে থাকে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা। ওই বিষাক্ত ছোবল থেকে মুক্তি না পেলে কী করে সে আবার আগের মতো হবে? তবে একদম প্রথম দিকে ফরিদের প্রতি যে অনাসক্তিটা তার তৈরি হয়েছিল, তা যেন আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। বিষয়টা টের পায় পারু। প্রায় রাতেই ঘুমন্ত ফরিদের মুখের দিকে চুপিচুপি তাকিয়ে থাকে সে। সারাদিন পরিশ্রম করে রাতে এসে বেঘোরে ঘুমায় ফরিদ। তখন কী নিষ্পাপ আর শান্ত লাগে তাকে। হাত দুখানা বুকের কাছে ভাঁজ করে জড়সড় হয়ে ঘুমিয়ে থাকে। পারুর তখন মাঝে মাঝে খুব ডাকতে ইচ্ছে হয় তাকে। তারপর গল্প করতে ইচ্ছে হয় রাত জেগে। কিন্তু সে কিছুই বলে না। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে কেবল। আচ্ছা, ফরিদ কি টের পায়? পারু জানে না। তবে সে চায়ও না ফরিদ জানুক। বরং সে জানলে খুব লজ্জা পাবে পারু। আজকাল তার আরো একটা ইচ্ছা হয়। খুব গোপন একটা ইচ্ছা।

কিন্তু কথাটা কখনোই ফরিদকে বলতে পারবে না সে।

২৮

শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়েছেন অঞ্জলি। না ছেড়ে অবশ্য উপায়ও ছিল না। অরবিন্দু বাবুর ছেলে-বউ, মেয়ে-জামাইরা প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। বিরক্ত হলেও প্রথম প্রথম সামনাসামনি কিছু বলত না তারা। তবে আড়ালে-আবডালে অরবিন্দু বাবুকে নানা কথা শোনাত। সেই রাখঢাক অবশ্য কমতে শুরু করল মহিতোষের চিঠি পাওয়ার পর থেকে। অরবিন্দু বাবু চিঠিটা এনে অঞ্জলিকে দিয়ে বললেন, মহিতোষ পাঠিয়েছে।

চিঠি? ভারি অবাক হলেন অঞ্জলি। চিঠি কেন? উনি কই?

ও আসেনি।

আসেননি মানে? কোথায় গেছেন? উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন অঞ্জলি।

পারুকে খুঁজতে বেরিয়েছে মহিতোষ।

কোথায়?

ঢাকায়।

ঢাকায়! শুনে আঁতকে উঠেছিলেন অঞ্জলি।

উনি ফিরবেন কবে?

তাতো জানি না। বলেছে পারুকে না পাওয়া পর্যন্ত সে ফিরবে না।

অঞ্জলি যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি চিঠিটা খুললেন। অরবিন্দু বাবু যা বলেছেন, সংক্ষেপে তা-ই লেখা চিঠিতে। বাড়তি যেটুকু লেখা, তা হলো। মহিতোষের ফিরতে দেরি হলে যেন তারা ওপারে চলে যায়। এ বাড়িতে থাকার নানাবিধ সমস্যা। তাছাড়া কতদিন আর এভাবে অনিশ্চিত অবস্থায় এখানে পড়ে থাকবে তারা? তারচেয়ে ওপারে চলে যাওয়াই ভালো। সময়-সুযোগ বুঝে মহিতোষও চলে আসবেন। বিষয়টা অরবিন্দু বাবুর বাড়ির আর সবার মধ্যে। জানাজানি হতে সময় লাগল না। তবে অঞ্জলি নিজের সিদ্ধান্তে অটল। তিনি কিছুতেই মহিতোষ ও পারুকে ছাড়া কোথাও যাবেন না। প্রয়োজনে মহিতোষের ফেরা অবধি অপেক্ষা করবেন। তা যতদিনই লাগে লাগুক। কিন্তু দিন কয়েক যেতে না যেতেই বাড়ির পরিস্থিতি পাল্টাতে লাগল। সেদিন অরবিন্দু বাবুর ছেলের বউ মালা এসে বলল, বৌদি, ও ঘরটা তো একটু ছেড়ে দিতে হবে?

অঞ্জলি যেন বুঝলেন না। বললেন, কোন ঘর?

ওই যে বড় মাসী যে ঘরখানাতে থাকেন।

অঞ্জলি ভারি অবাক হলেন। ছায়ারাণী যে ঘরে থাকেন, সে ঘরটা ছেড়ে দিতে বলছে মালা! তিনি বললেন, মা যদি ওই ঘর ছেড়ে দেন তো, উনি থাকবেন কোথায়?

আপনাদের এখানে থাকবেন।

এইটুকু ঘরে তিনজন মানুষ থাকা সম্ভব? তাছাড়া মায়ের হো বারবার বাথরুমেও যেতে হয়। এঘরে তো বাথরুম নেই। আর উনি অন্য কারো সঙ্গে থাকতেও পারেন না।

আমরা গরিব লোক বৌদি। আপনাদের মতো অত বড়লোকি চাল কি আর আমাদের এখানে সাজে?

অঞ্জলির মুখের ওপর কথাটা বলে ফেলল মালা। অনেকটা সময় যেন বিশ্বাসই হলো না অঞ্জলির। কিছু বলতেও পারলেন না তিনি। তবে ঘটনার সেই শুরু। মাঝখানে একদিন মালা এসে বলল, অত রাত অবধি আলো জ্বালিয়ে রাখবেন না বৌদি। জানেন তো অনেক খরচ-খরচার ব্যাপার। আমাদের নানা হিসেব-নিকেশ করে চলতে হয়। এ বাড়িতে অঢেল তো কিছু নেই।

এরপর থেকে রাখঢাকটা বলতে গেলে উঠেই গেল। অঞ্জলি অরবিন্দু বাবুকে বলেও ছিলেন যে তাদের এখানে খরচাপাতি যা লাগে, তা তাদের পয়সা থেকেই যেন অরবিন্দু বাবু খরচ করেন। তবে তাতেও পরিস্থিতি পাল্টাল না। বরং আরো খারাপ হতে লাগল। এ কথা-সে কথা কানে আসতে লাগল যখন তখন। বিষয়টা অঞ্জলির জন্য অপমানজনক যেমন, তেমনি অসহনীয়ও।

দিন কয়েক বাদে এক সন্ধ্যায় চারু বাড়ির সামনের খোলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছিল। পাড়ার কোন এক ছেলে তাকে দেখে শিষ বাজাল। বিষয়টা পছন্দ হলো না চারুর। সে ছেলেটাকে ডেকে আচ্ছা করে দু কথা শুনিয়ে দিল। ছেলেটাও দমবার পাত্র নয়। সে মুখের ওপর খুবই অশ্লীল গাল বকল তাকে। চারু এ ধরনের কথা শুনতে অভ্যস্ত নয়। হাতের কাছে থাকা এক টুকরো ইট কুড়িয়ে নিয়ে সে প্রায় ছেলেটাকে মারতে উদ্যত হলো। কিন্তু পারল না। উপস্থিত কয়েকজন মিলে তাকে থামাল। তারপর বিষয়টা মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল। তবে ঘটনা তাতে মিটল না। বরং তার রেশ গড়াল বহুদূর অবধি। ছেলেটা প্রায়ই উত্ত্যক্ত করতে লাগল তাকে। চাকও ছেড়ে কথা কইবার মেয়ে না। কয়েকবার তেড়ে গেল সে। এক রাতে হঠাৎ অঞ্জলিদের ঘরের কাচের জানালা বিকট শব্দে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। ইট মেরে কেউ জানালা ভেঙে দিয়েছে। রাত দুপুরের এই ঘটনায় পুরো বাড়ি জেগে উঠল। সকলের চোখে মুখেই তীব্র আতঙ্ক। তবে সেই তীব্র আতঙ্কের জের টানতে হলো অঞ্জলিকেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল এলাকার একটা বখাটে ছেলের দল চারুর পিছু লেগেছে। চারু নিজ থেকে তাদের সঙ্গে লাগতে গিয়েই বিপদ ডেকে এনেছে বাড়ির ওপর। বিষয়টা এ বাড়ির সবার জন্যই যেন ভয়ের হয়ে উঠল। কিংবা যতটা না ভয়ের হলো, তারচেয়েও বেশি প্রকটভাবে সেটিকে সামনে নিয়ে আসা হলো। এই নিয়ে অরবিন্দু বাবুর বড় ছেলে সবার সামনে বলেই ফেলল, আসলে কী বৌদি, বুঝতেই তো পারছেন, এখানে আমাদের অনেক হিসেব-নিকেশ করেই থাকতে হয়। এখন আপনাদের কারণে যদি আমাদের নির্ঝঞ্ঝাট জীবনে ঝামেলা চলে আসে, তাহলে তো বিপদ।

অঞ্জলি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে সে বলল, ওই ছেলেগুলো ভালো না। কখন কী হয়ে যায়, বলা তো যায় না। ধরুন আমাদের কোনো বিপদ-আপদ হলে আমরা না হয় সামলে নিলাম। কিন্তু চারুর যদি কোনো ক্ষতি ওরা করে ফেলে, তাহলে আপনি সামলাবেন কী করে? আমাদেরও তো সেই শক্তি নেই যে কিছু করব। তাছাড়া, বড় বোন যখন ওরকম একটা কাজ করতে পেরেছে, ছোটোটাকে আর বিশ্বাস কী? কখন কার সঙ্গে পালিয়ে ভাগবে, তার তো আর ঠিক নেই, না? ছেলেগুলো তো আর এমনি এমনিই তার পিছে লাগেনি। তারও নিশ্চয়ই ভেতরে ভেতরে কোনো ঘটনা আছে। কথায় আছে না, আগের হাল যেদিকে যায়, পিছের হালও সেদিকেই যায়!

অঞ্জলি হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন। এ বাড়ির কেউ তার মুখের সামনে এমন কথা বলতে পারে, এ তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি। অরবিন্দু বাবুর বয়স হয়েছে। চাইলেও তিনি আর এ বাড়িতে খুব একটা কিছু বলতে পারেন না। তবে ছেলে বৌদের এমন আচরণে মনে মনে খুব কষ্ট পান তিনি। আর সে কারণেই কী না কে জানে, সেদিন অঞ্জলিকে ডেকে তিনি বললেন, তুমি মন খারাপ করো না বৌ মা। সকলের সব দিন তো আর সমান যায় না। তোমাদেরও এই বিপদ একদিন কেটে যাবে।

তা যাবে। কিন্তু…।

আমি বুঝতে পারছি মা। কিন্তু কী করব বলো? সব মানুষেরই সময় ফুরায়। আমারও ফুরিয়েছে। এখনো দুটো পয়সা রোজগার করতে পারি বলে হয়তো তারা একদম ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে না। কিন্তু ওটুকুও যখন থাকবে না, তখন কী হবে, সেটা ভেবে খুব দুশ্চিন্তা হয়।

অঞ্জলি মানুষটার অবস্থা বুঝতে পারেন। যে কদিন এ বাড়িতে তিনি থাকছেন, তাতে ধীরে ধীরে অনেক কিছুই উন্মোচিত হয়েছে। অরবিন্দু বাবুর স্ত্রীও দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী। ফলে তাঁর দেখা-শোনার ভার নিয়েও ছেলে-মেয়েদের মধ্যে নানা ভাগাভাগি। সেসব সামলাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন তিনি। এরমধ্যে অঞ্জলিদের দায়িত্ব নিতে গিয়ে যেন ন্যুজ হয়ে গেছেন। তিনি বললেন, এখানে তোমাদের নানা কথা শুনতে হবে। মান-অপমান সইতে হবে। আমিও কিছু করতে পারব না। তারচেয়ে বরং তুমি ওপারেই চলে যাও। একই তো কথা। এই সামান্য পথ। এপার আর ওপার! এই বিদেশ তো আর বিলেত-আমেরিকা নয়। আমার আর এভাবে তোমাদের অপমান দেখতে ভালো লাগে না মা। আমায় ভুল বুঝো না। আর মহিতোষ আসা মাত্রই তাকে আমি পাঠিয়ে দেব।

অঞ্জলি তাঁকে ভুল বোঝেনও নি। তবে তিনি যেতেও চাইছিলেন না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবন তাঁকে রূঢ় বাস্তবতার নানা পাঠ শেখাতে লাগল। মাসখানেকের মাথায় সেই পাঠই তাকে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য করল। একদিন অরবিন্দু বাবুকে ডেকে তিনি বললেন, আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করেন মেসো।

অরবিন্দু কথা বললেন না। তিনি তাদের যাওয়ার গোছগাছ করতে লাগলেন। আর এই প্রতিটি মুহূর্ত অঞ্জলির বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হতে লাগল। ওই যে সীমানার ওই কাঁটাতারটুকু পেরুলেই অন্য এক দেশ। অথচ সেই একই আকাশ, একই মাটি। একই মানুষ, ভাষা, ফসলের মাঠ। তারপরও তার বুকের ভেতরটা কেমন চিনচিনে এক ব্যথায় সারাক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে রইল।

এই যে অরবিন্দু বাবু, তাঁদের এত কাছের মানুষ। তাঁর বাড়িতেও এই কটা মাত্র দিনেই নিজেদের কেমন অনাহুত মনে হতে লাগল। যেন অন্যের অনুকম্পা ভিক্ষা করে আশ্রিত হয়ে ছিলেন তারা। সেটা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে তার ছেলেমেয়েরা। নিজের দেশে থেকেও কেবল নিজের একখানা ঘর, একখানা বাড়ির অভাবে নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে বাঁচার যে যন্ত্রণা তা যেন শিরায় শিরায় উপলব্ধি করতে পেরেছেন।

অথচ এবার তাদের সত্যি সত্যিই পরবাসী হতে হবে। অন্য এক দেশে, অন্য এক পরিচয়ে। কী হবে সেখানে? ভাবতেই কেমন অবশ অবশ অনুভূতি হয় অঞ্জলির। মনে হয়, যদি এই মুহূর্তে কোনো এক অলৌকিক উপায়ে আবার ভুবনডাঙা ফিরে যেতে পারতেন তিনি? গিয়ে দেখতেন সবকিছু ঠিক আগের মতোই। আছে। সেই কলতলা, বাঁশঝাড়, সুপারিগাছের সারি আর টুপটাপ শিশিরের শব্দে আচ্ছন্ন রাত প্রহরের ঘর।

আচ্ছা, কেমন আছে ভুবনডাঙা? তাদের ওই ঘরখানা? ওই উঠোন? উঠোনের পাশে শিউলি ফুলের গাছ। টলটলা জলের স্বচ্ছ পুকুর? কালু কেমন আছে মফিজুলের কাছে? তার কি তাদের কথা মনে পড়ে?

.

অঞ্জলি আর কিছু ভাবতে পারেন না। তারপরও সারাক্ষণ মহিতোষ চোখের সামনে এসে দাঁড়ান। পারু এসে দম বন্ধ করে দেয়। ভগবান তার জন্য এ কী জীবন নির্ধারণ করে দিলেন? এ জীবনের চেয়ে মৃত্যু অনেক শ্রেয়। সেই মৃত্যুর মতো জীবন সঙ্গে করেই এক ভোরে তাঁরা সীমানা পেরোলেন। দেশ ছেড়ে হয়ে গেলেন পরবাসী। সেখানে তাদের অপেক্ষায় ছিলেন মহিতোষের বড়দা আর অঞ্জলির মামা। তাঁরা গভীর ভালোবাসায় তাদের বরণ করে নিলেন। আদর-যত্নের কমতি রাখলেন না। কিন্তু তার কিছুই যেন স্পর্শ করতে পারল না অঞ্জলিকে। তিনি ঝিম ধরা দুপুরের মতো নিস্পন্দ হয়ে রইলেন। ছায়ারাণীও। চারু অবশ্য এখানে এসে সমবয়সী নতুন ভাই বোনদের সঙ্গ পেয়ে যেন খানিক চনমনে হয়ে উঠল। তারপরও রোজ রাতে সে যখন মায়ের কাছে ঘুমাতে আসে। তখন ফিসফিস করে বলে, মা।

হুম।

তোমার কি মনে হয়, বাবা দিদিকে খুঁজে পাবে?

জানি না।

যদি কখনো না পায়?

পাবে না কেন?

ধরো, যদি না পায়?

অঞ্জলি জবাব দেন না। চারু মায়ের আরো কাছে সরে আসে। তারপর নরম গলায় বলে, আমার খুব ভয় হয় মা। মন কেমন করে।

কেন?

চারু সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে। শীতের রাতে বাইরে টুপটাপ শিশির ঝরার শব্দ শুনতে পায় সে। ওই শব্দ যেন বুকের গহিন খুঁড়ে তুলে আনতে চায় কত শত স্মৃতির ভাড়ার। সেই স্মৃতিতে পারুদি ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায় না চারু। পাবেই বা কেমন করে? তার শৈশব-কৈশোরের পুরোটা জুড়েই তো কেবল ওই পারুদি। সে-ই তার বন্ধু, সে-ই তার বড় বোন। তার জীবনে পারুদি ছাড়া আর কী আছে? কিন্তু সেই পারুদি তাকে ছেড়ে অমন করে কীভাবে চলে গেল? সে হলে কি পারত? কখনোই না।

চারুর খুব অভিমান হতে থাকে। রাগও। তবে ওই রাগটা বেশিক্ষণ থাকে না। ধীরে ধীরে কপুরের মতো হাওয়ায় মিশে যেতে থাকে। তারপর জেগে ওঠে তীব্র অভিমান। সেই অভিমান কষ্ট হয়ে দলা পাকিয়ে উঠতে থাকে গলার কাছে। তার তখন কেমন কান্না কান্না লাগে। তবে সে কারো সামনে কাঁদে না। কারণ মায়ের কষ্টটা সে বুঝতে পারে। আর পারে বলেই সে কাঁদে একা একা, গোপনে। তবে আজ সে তার ভয়ের কথাটা আর মাকে না জিজ্ঞেস করে পারল না। বলল, মা।

হুম।

বলো না, বাবা যদি পারুদিকে আর কখনোই খুঁজে না পায়?

জানি না।

বলো না। তাহলে কি বাবাও আর ফিরে আসবে না? পারুদির মতো বাবাও কি তবে হারিয়ে গেল?

অঞ্জলি জবাব দিলেন না। তবে চারুর এই শঙ্কাটা আজকাল তার বুকেও ভয়। ছড়ায়। সত্যি সত্যিই কি মহিতোষকেও তারা চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেললেন? এমন হওয়ার কথা নয়। মহিতোষ দায়িত্বশীল মানুষ। তিনি নিশ্চয়ই এমন কিছু করবেন না, যা সারাজীবনের জন্য কাউকে শূন্য করে দেবে? নিশ্চয়ই তিনি ফিরে আসবেন। নিশ্চয়ই পারুকে নিয়েই ফিরবেন?

চারু বলল, আচ্ছা মা, এমন কি হতে পারে যে বাবাও আর কখনো ফিরল? পারুদি আর বাবাকে আমরা চিরজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম। বাকিটা জীবন কেবল রয়ে গেলাম তুমি আর আমি? ঠাকুমা তো আর বেশি দিন বাঁচবে না। কিন্তু মা, বাবা আর পারুদিকে ছাড়া বাকিটা জীবন আমরা কী করে থাকব।

অঞ্জলি কথা বললেন না। তবে চারুর দিকে ঘুরে শুলেন তিনি। তারপর দু হাতে তার মাথাটা চেপে ধরলেন বুকের সঙ্গে। তারপর ফিসফিস করে বললেন, ভগবান অত নিষ্ঠুর না রে মা। ভগবানের অনেক দয়া। অনেক দয়া তার। দেখবি তিনি সব ঠিক করে দেবেন। একদম আগের মতো সব।

আমরা কি তাহলে আবার আগের মতো ভুবনডাঙায় ফিরে যেতে পারব মা? আমাদের বাড়িতে? আবার আমি আর চারুদি পুকুর ঘাটে বসে হিজল ফুলে ছাওয়া জলের ভেতর ঢিল ছুঁড়তে পারব মা? যদি ভগবান সব ঠিক করে দেন, তাহলে আবার আমরা…।

অঞ্জলি হঠাৎ চারুর মুখের সামনে তার হাত এনে মুখটা বন্ধ করে দিলেন। তিনি কাঁদছেন। তার সেই কান্না চারুকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সে মায়ের বুকের গভীর থেকে উঠে আসা প্রবল যন্ত্রণার কম্পন টের পাচ্ছে। সেই কম্পন তাকেও সমূলে নাড়িয়ে দিচ্ছে। পারু হারিয়ে যাওয়ার পর মা আর বাবাকে দেখে চারু নিজের কাছেই নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে আর কখনো কোনোদিন তাদের সামনে কাঁদবে না। মায়ের সামনে তো নয়ই। কিন্তু আজ এই অন্ধকার গভীর রাত্রিতে, সুনসান হিম। শীতল ঘরের বুকের ভেতর মায়ের কান্না ক্লান্ত শরীরের ওমে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা চারু হঠাৎ কাঁদল। সেই কান্না নিঃশব্দ। কিন্তু তার চোখের কোল গড়িয়ে ঝরে পড়া অঝোর জলে যেন লেখা হতে লাগল–জগতে নিঃশব্দ কান্নার চেয়ে বায় কিছু নেই। নিঃশব্দ যন্ত্রণার চেয়ে তীব্র কিছু নেই।

২৯

পারুর ঘুম ভাঙল খানিক দেরি করে। সে উঠে দেখল ফরিদ নেই। তবে তার বিছানার কাছে ভাজ করা একটুকরো কাগজ পড়ে আছে। আলস্যে কাগজটা আর দেখা হলো না। হয়তো ফরিদের দরকারি কোনো কিছু। সে সেটা বালিশের তলায়। রেখে দিল। কিন্তু ঠিক দুপুরের দিকে, যখন চারপাশ সুনসান। একটা অদ্ভুত নিস্তরঙ্গ অনুভব হাওয়ায়, ঠিক তখন তার বাড়ির কথা খুব মনে পড়তে লাগল। রোজই পড়ে। বাবা-মায়ের কথাও। তখন খুব কান্না পায়। গলার কাছে কিছু একটা যেন। দলা পাকিয়ে থাকে। আজও তেমন হলো। পারু জানালাটা খুলে চুপচাপ বসে রইল। তার চোখের সামনে সারি সারি মেঘের মতো ভেসে যেতে থাকল শৈশব কৈশোরের অসংখ্য স্মৃতি। সেই সব স্মৃতি বুকের গভীরে এমন প্রগাঢ় অনুভূতির। আখরে লেখা আছে যে আরো কয়েক জন্মেও সে তা ভুলতে পারবে না। ওই স্মৃতিগুলো এমন কেন? সারাক্ষণ নিজের পৃথিবীটা ওলট-পালট করে রাখে। মুহূর্তের জন্য স্বস্তি দেয় না। আবার ভুলে যেতে চাইলেও পারা যায় না।

সন্ধ্যার বিষণ্ণ অন্ধকার নেমে এলো চারিদিকে। এই সময়টাতে পারুর খুব একা একা লাগে। খুব নিঃসঙ্গ। এই নিঃসঙ্গতা কাটাতে পারে, এমন কি কেউ আছে? পারুর মনে হলো নেই। কেবল ভুবনডাঙার ওই আয়নার মতো ঝকঝকে নিকানো উঠোন, তার পাশে স্বচ্ছ জলের পুকুর আর শানবাঁধানো ঘাট। এ ছাড়া তার এই নিঃসঙ্গতা কাটাতে পারে এমন আর কেউ নেই। আচ্ছা, তাহলে কি এই একটা জীবন তাকে কাটিয়ে দিতে হবে এই আশ্চর্য নিঃসঙ্গতা বুকে পুষেই! কথাটা ভাবতেই কেমন দম বন্ধ লাগতে লাগল পারুর। সে মাথার কাছ থেকে বালিশটা টেনে নিয়ে কোলের ওপর রাখল। আর ঠিক তখনই ভাঁজ করে রাখা সেই কাগজের টুকরোটা আবার বেরিয়ে এলো চোখের সামনে। কী মনে করে এবার আর সেটা সরিয়ে রাখল না। বরং সন্ধ্যার ওই আধো আলো-আধো অন্ধকারে কাগজটা খুলল। তারপর চমকে উঠল। ফরিদ তার জন্যই চিরকুটটা লিখে রেখে গেছে। সেখানে কী সুন্দর হাতের লেখায় লেখা

পারু,
এমন বিষণ্ণ দিন শেষে
 যদি খানিক আঁধার এসে,
ভীষণ আপন হয়ে বসে
তোমার আঙুলগুলোর ফাঁকে?
তখন আমার আঙুল ছাড়া
তুমি খুজবে কোথায় কাকে?

পার কথাগুলো পড়ল। একবার, দুবার, তিনবার। তারপর বারবার। এত সুন্দর কেন কথাগুলো? এই যে সারাটা দিন সে মন খারাপ করে বসেছিল। এই যে সন্ধ্যার বিষণ্ণ অন্ধকার। ওই যে দূরে কোথাও সূর্য ডুবছে। এসবই মুহূর্তেই তার কাছে কেমন অন্যরকম মনে হতে লাগল। মনে হলো এই একটা মানুষ তো তার আছে। তার নিজের মানুষ। যেই মানুষটা তার জন্য জীবনের আর সব ফেলে রেখে পথে নেমেছে। এই মানুষটা এমন অন্ধকারে, এমন মন খারাপের সন্ধ্যায়, এমন অজস্র অব্যক্ত যন্ত্রণার দংশনে নীল হয়ে থাকা তার পাশে এসে আলগোছে বসতে জানে। তারপর তার ওই আঙুলগুলোর ফাঁকে যে নিঃশব্দ নিঃসঙ্গতা আছে, সেই নিঃসঙ্গতাটুকু তাড়িয়ে দিতে পারে। ছুঁয়ে দিতে পারে পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে নির্ভেজাল অনুভবে। এ-ই বা কম কীসে?

সেই সন্ধ্যায় পার হঠাৎ আয়নার সামনে দাঁড়াল। তারপর যত্ন করে কাজল পরল চোখে। যদিও খুব লজ্জা লাগছিল তার। কী ভাববে ফরিদ?

ফরিদ এলো রাত ৯টার দিকে। কিন্তু দরজায় শব্দ করতেই পার যেন কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। ইশ, ফরিদ যদি তাকে এভাবে দেখে কিছু ভাবে! সে হঠাৎ ওড়নার খুঁটে চোখের কাজলটুকু মুছতে লাগল। কিন্তু ফরিদ ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছিল। পারু তাড়াহুড়ো করে যতটুকু সম্ভব কাজল তুলে ফেলল। তারপর দরজা খুলে দিল।

ফরিদ তাকাতেই কেমন অচেনা এক লজ্জায় গুটিয়ে গেল সে। বিষয়টা চোখে এড়াল না ফরিদের। পারুর চোখের কোণে তখনো খানিক কাজল লেপ্টে আছে।

সেই রাতে তাদের আর খুব একটা কথা হলো না। তবে পরদিন ভোরে ঘুম ভেঙে আবারও একটা চিরকুট পেলো পারু। সেখানে লেখা–

শোনো কাজল চোখের মেয়ে, আমি তোমার হবো ঠিক,
তুমি ভীষণ অকূল পাথার, আমি একরোখা নাবিক।

ওইটুকু দু লাইনের এক লেখা। কিন্তু ওই লেখাটুকুই পারুর মনজুড়ে কেমন সুবাস ছড়াতে লাগল। মনে হতে লাগল, এই এত কিছুর পরও তার সঙ্গে এই মানুষটা আছে। হয়তো জীবনের এই ঝাবিক্ষুব্ধ পথের পুরোটা জুড়েই সে অদ্ভুত এক হাহাকারের চোরাবালিতে ডুবে যেতে থাকবে। কিন্তু এই মানুষটা ঠিকই তার হাত দুটো শক্ত করে ধরে রাখবে। কখনোই ডুবে যেতে দেবে না পুরোপুরি।

ফরিদের এই চিরকুট লেখা চলতেই থাকল। রোজ ঘুম থেকে উঠে পারু অবচেতনেই তার বালিশের কাছটাতে হাত বোলায়। আর একটা করে চিরকুট তার নিঃসঙ্গ একাকীত্বের দিনটাকে কেমন আলো ঝলমলে করে রাখে। সেদিন সে পড়ল–

তোমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে–
একটা দোয়েল একটা চড়ুই পাখি
খানিকটা পথ উড়েই এলো, কুড়িয়ে নিল খানিক বিষাদ জমা।
তোমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে–
শিমুল ফুলের একটা নবীন কুঁড়ি
পড়ল ঝরে অকাতরে, উতল হাওয়ার বুকের ভেতর কে সে প্রিয়তমা।
তোমার জন্য অপেক্ষাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে–
মেঘ বলেছে খানিক আঁধার ঢেলেও
বৃষ্টি নামুক আর কিছুক্ষণ পরে।
তোমার জন্য অঝর চোখের জলে, একটা জনম কাটিয়ে দিলাম বলে–
এই পৃথিবী হাজার বছর ধরে
নদীর নামে নারীর কথা বলে।

পারু সেই সারাটা দিন তন্ময় হয়ে রইল। কতবার যে পড়ল কথাগুলো। মনে হলো এমন করে কেউ যদি কারো জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে, তবে তাকে ভালো না বেসে পারা যায়? যায় না। পারুও পারল না। সেদিন মাঝরাতে সে আচমকা ফরিদকে ডাকল, শুনছেন?

হু। ফরিদ জবাব দিল ।

আমার না ঘুম পাচ্ছে না।

কেন? শরীর খারাপ লাগছে?

উহু।

তাহলে?

পারু জবাব দিল না। ফরিদ বলল, মন খারাপ?

হু।

বাড়ির কথা মনে পড়ছে?

আমার তো আর বাড়ি নেই।

আছে।

কোথায়?

কল্পনায়।

কল্পনায় কারো বাড়ি থাকে?

হু।

কীভাবে?

আমাদের কল্পনায় যা যা থাকে, তা শুধুই আমাদের। অন্য কারো নয়। সারাজীবন ভুবনডাঙা আর ওই বাড়িটা তোমার কল্পনায় থেকে যাবে। ওখান থেকে তো আর কেউ তাকে কেড়ে নিতে পারবে না!

কথাটা খুব পছন্দ হলো পারুর। ঠিকইতো। তার বুকের ভেতর ভুবনডাঙার যে স্মৃতি, যে ছবি সে আলগোছে যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে, তা তার কাছে থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আজ থেকে অনেক অনেক বছর পরেও, যখন সে বুড়ো হয়ে যাবে–তখনো ভুবনডাঙার ওই বাড়ি, ওই উঠোন, ঝাকড়া আমগাছ, ওই শিউলিতলা সবই অমন একইরকম থেকে যাবে। তাদের বয়স বাড়বে না। তারা কখনো জীর্ণ, পুরনো হবে না। সে চাইলেই তার কল্পনায় যখন তখন ওই উঠানে ঘুরে বেড়াতে পারবে। তার সেই আটপৌরে ঘ্রাণ মাখা পুরনো খাটের এলোমেলো আদুরে বিছানাটায় ঘুমুতে পারবে। কার সাধ্য আছে তার থেকে সেসব কেড়ে নেয়?

ফরিদ আবার বলল, বাড়ির জন্য খুব মন কেমন করছে?

উহু।

তাহলে?

এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে পারু? এই ছোট্ট অন্ধকার ঘরটিতে তারা দুজন মাত্র মানুষ। এইটুকু দূরত্বে শুয়ে আছে। তারপরও কেউ যেন কাউকে ছুঁতে পারছে না পুরোপুরি। কোথায় যেন একটা অনতিক্রম্য সঙ্কোচের দেয়াল মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা, তারা কেউ কি কখনো ওই দেয়ালটা অতিক্রম করতে পারবে না?

পারু আচমকা বলল, আপনার জন্য। বলেই প্রবল লজ্জায় যেন নিজের ভেতর গুটিয়ে গেল সে। এই যে অন্ধকার, এই অন্ধকারের আড়ালটুকু না থাকলে সে মুখ দেখা তো কী করে ফরিদকে!

ফরিদ ধীরে উঠে বসল। তারপর চুপচাপ তাকিয়ে রইল পারুর দিকে। কিন্তু তার মুখটা দেখা যাচ্ছে না। তারপরও সে তাকিয়ে রইল। পারু বলল, আপনি আমায় খুব খারাপ ভাবছেন, না?

হু। বলল ফরিদ।

অনেক খারাপ?

অনেক।

পারু আর কথা বলল না। ফরিদ বলল, খারাপ মানুষের তো শাস্তি পেতে হয়। জানো?

হু।

কী জানো?

পারু জবাব দিল না। চুপচাপ অন্ধকারের ভেতর নিবিষ্ট হয়ে রইল। ফরিদ বলল, আমি কি তোমাকে সেই শাস্তিটা দিতে পারি?

কী শাস্তি? মৃদু কণ্ঠে বলল পারু।

এই যে আমায় এত অচ্ছুৎ ভাবো। সেই অদ্ভুত মানুষটা যদি খানিক তোমার পাশে এসে বসে, সেটা তোমার জন্য শাস্তি নয়?

পারু কথা বলল না। তবে ফরিদ তার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর পারুর পাশে তার গা ঘেঁষে বসল। পারু অবশ্য দেয়ালের দিকে খানিক সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিল। ফরিদ বলল, আমার জন্যও তোমার মন কেমন করে?

হু।

কী রকম মন কেমন করে? তাতো জানি না।

না জানলে হবে?

আপনি এই যে সারাদিন বাড়ি থাকেন না, আমি একা একা থাকি, আমার খুব কষ্ট হয়।

কেমন কষ্ট?

কষ্টের কি আবার রকম হয়?

হয়।

আমি অতকিছু বুঝি না।

তাহলে কী বোঝো?

পারু এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল না। তবে তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে মানুষটা তাকে একটু জড়িয়ে ধরুক। তার চুলের ভেতর খানিক নাক ডুবিয়ে সুবাস শুষে নিতে থাকুক। কিন্তু সেকথা সে বলবে কী করে! এ কি বলা যায়? কখনোই না। ফরিদ হঠাৎ আলতো করে পারুর গালে আঙুল ছোঁয়াল। কেঁপে উঠল পারু। ফরিদ। বলল, ভয় হচ্ছে?

উহু।

তাহলে?

জানি না।

এত না জানলে হয়?

হয়।

কীভাবে?

আমার সব না জানাগুলো আপনি জেনে নেবেন।

নেবো?

হু।

ফরিদ পারুর পাশে ফাঁকা জায়গাটুকুতে গা এলিয়ে দিল। সেখানে একটামাত্র বালিশ। সেই বালিশে এলোমেলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পারুর চুল। ফরিদ সেই চুলের ভেতর নাক ডুবিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,

যেথায় তোমার গন্ধে ব্যাকুল হাওয়া,
তোমায় পাওয়ার তেষ্টা কেবল চাওয়া,
সেথায় আমার বাস।
তোমার এমন সুবাস মাখা ছোঁয়ায়
ভাসে আমার দীর্ঘ-দীর্ঘশ্বাস।
পারু ফিসফিস করে বলল, দীর্ঘশ্বাস কেন?
ফরিদ ঘোরলাগা গলায় বলল, কারণ–
তুমি মানেই নির্বাসিত আমি,
নিদাঘ সময় দীর্ঘ বরষ-মাস।

পারু হাত বাড়িয়ে ফরিদকে টেনে নিল বালিশে। তারপর বলল, আপনি নির্বাসিত থাকতে চাইলে আমি কী করব?

ফরিদ ততক্ষণে পারুর ঘাড়ের কাছে নাক ঘষছে। সে কেমন সম্মোহিত গলায় কবিতার শেষটুকু পড়ল,

যেথায় তোমার সুবাস মাখা নদী
যেথায় তোমার তেষ্টা নিরবধি
সেথায় আমার অবাক মিশে যাওয়া।
এই জনমের জন্ম-মৃত্যু জানে–
আমি মানেই সকল প্রার্থনায়
তুমিই এবং সবটা তোমায় চাওয়া…।

তার সেই কণ্ঠে কী ছিল কে জানে! পারু আচমকা ফরিদের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। তারপর গাঢ় গলায় বলল, আপনি এমন কেন? ফরিদ কী বলবে জানে না। তবে কিছু বলতে চাইলেও আর বলা হলো না তার। সে ক্রমশই ডুবে যেতে থাকল আশ্চর্য এক সম্মোহনের অসীম অতল জলে। সেখানে পৃথিবীর আদি ও অকৃত্রিম প্রেমের ভাষায় লেখা হতে থাকল জীবন ও জগতের এক অলৌকিক মহাকাব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *