১০. পারুদের বাড়ির সামনে

১০

ফরিদের শরীর এখন অনেকটাই ভালো। গত তিন দিন ধরে সে আবার ফার্মেসিতে আসছে। আজ অবশ্য একটু দেরি হয়েছে। এই দেরির কারণ আছমা। আছমাকে তার খালাবাড়িতে নামিয়ে দিতে হয়েছে। সে এই পুরোটা সময় সাইকেলের পেছনের সিটে শক্ত হয়ে বসে ছিল। পারুদের বাড়ির সামনে আসতেই সে জিজ্ঞেস করেছিল, ফরিদ ভাই, সেইদিন তুমি পারু বুর সঙ্গে কথা বলো নাই কেন?

কী কথা বলব?

কেউ একজন বাড়িতে এলে ভালো-মন্দ বলতে হয় না?

আমি তো মন্দ বলতে জানি না।

তাইলে ভালোটাই বলতে!

আমার ভালো আরেকজনের তো ভালো নাও লাগতে পারে।

তোমার সঙ্গে পারু বুর কী হয়েছে?

কী হবে?

কিছু একটা তো হয়েছেই!

ফরিদ হাসার চেষ্টা করে, কী?

ঝগড়া?

ঝগড়া হতে হলে ভাব থাকতে হয়।

তোমাদের তো ভাব আছেই।

উহু, নাই।

কেন?

কারণ সে হিন্দু। আর আমি মুসলমান।

এই কথায় আছমা চুপ করে যায়। ফরিদ আর পারুর ব্যাপার নিয়ে নানা কিছু জানে সে। বিভিন্ন সময় ফরিদের ঘর গোছাতে গিয়ে কত কিছু যে পেয়েছে। তবে সেসব কিছুই সরায়নি সে। কাউকে বলেওনি। এমনকি মাকেও না। মা শুনলে খুব যন্ত্রণা করবে। আর অন্য কেউ শুনলে তো লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যাবে। এমনিতেই গাঁয়ে পারুদের নানা যন্ত্রণা পোহাতে হয়। তার মধ্যে এমন ঘটনা রটলে তুলকালাম হয়ে যাবে। তাছাড়া ফরিদের ওপরেও চতুর্মুখী বিপদ ঘনিয়ে আসবে। ফলে বিষয়টা চেপে গেল আছমা। এই চেপে যাওয়াতে যে তার কষ্ট হয়নি তা নয়। বরং রাতের পর রাত কেঁদেছে সে। মা জিজ্ঞেস করলে বলত আজকাল সময়ে অসময়ে খুব পেট ব্যথা হয় তার। এজন্য রহিম ফকিরের বাড়ি থেকে বিভিন্ন সময়ে মা তাকে পানি পড়া এনেও খাইয়েছে। নুরুন্নাহারের ধারণা রহিম ফকির সব সমস্যার সমাধান করতে পারে। আছমারও যে মাঝে মাঝে তেমন মনে হয়নি তা নয়। তারও মনে হয়েছে। আর মনে হয়েছে বলেই সে একবার গোপনে রহিম ফকিরকে বলেছিল, তাকে একটা তাবিজ দিতে। যেন সেই তাবিজ পরলে তার মনের ইচ্ছে পূরণ হয়। রহিম ফকির দিয়েছিল। তবে তাতে খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হয়নি। আছমার। তার প্রতি ফরিদের আলাদা কোনো আসক্তি তৈরি হয়নি। বরং আরো যেন খানিক খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল। আছমার ধারণা, তাবিজ অন্যভাবে কাজ করেছিল। ফরিদ আর পারুর মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি করেছিল। তবে সেই দূরত্ব তার কোনো কাজে লাগেনি। বরং ফরিদকে তার থেকে আরো দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।

সাইকেলের পেছনে বসে আছমার হঠাৎ মনে হলো, ঝগড়া হতে হলে যেমন ভাব-ভালোবাসা থাকতে হয়। তেমনি দূরে সরে যেতে হলেও আগে কাছে আসতে হয়। সে তো কখনো ফরিদের কাছেই আসতে পারেনি। তাহলে দূরে সরে যাবে কী করে! এই উপলব্ধিটুকু খুব কষ্ট দেয় তাকে। ফরিদ মানুষটা যেন কেমন। ঠিক আর দশটা ছেলের মতো নয়। খানিক চুপচাপ আর গম্ভীর। সারাক্ষণ বইপত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মাঝেমধ্যে এমন এমন সব কথা বলে যে তার কিছুই বোঝে না আছমা। বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আর তখন খুব মন খারাপ হয় তার। মনে হয়, সে যদি ফরিদের ওই কথাগুলো বুঝতে পারত। ওরকম গল্প, উপন্যাস পড়তে পারত। তাহলে বোধহয় ফরিদ তাকে ভালোবাসত। কিংবা খানিক অন্য চোখে দেখত। কিন্তু তার পড়াশোনাই ভালো লাগে না। ফি বছরের পরীক্ষায় অনেক বিষয়ে অকৃতকার্য হয় সে। ফলে একই ক্লাসে বারবার আটকে থাকতে হয়। এটা নিয়েও ফরিদ তার ওপর খুব বিরক্ত। মাঝে মাঝে বলেও, আছমার মাথায় কিছু নেই। যা আছে তার নাম গোবর। এই মাথা নিয়ে আর যাই হোক, পড়াশোনা সম্ভব নয়।

আছমা সেই থেকে জানে, ফরিদের মতো কারো ভালোবাসা পেতে হলে যা থাকতে হয়, তা তার নেই। কষ্ট হলেও এটা মেনে নিয়েছে সে। তবে প্রথম যেদিন সে জানল যে ফরিদের সঙ্গে পারুর অন্যরকম কিছু একটা রয়েছে। সেদিন খুব কেঁদেছিল। দিনকয়েক একা একা কতকিছু যে ভেবেছিল! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দীর্ঘ সময় দেখেছিল। এমন নয় যে পারুর চেয়ে বয়সে খুব বেশি একটা ছোট সে। কিংবা দেখতে মন্দ। বরং পারুর চেয়ে তার গায়ের রং উজ্জ্বল। খানিক লম্বাও বোধহয়। এই নিয়ে চাপা একটা অহংকারও তার ছিল। কিন্তু পারু আর ফরিদের ওই সম্পর্কটার কথা জানার পর থেকে মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিল সে। সেই প্রথম সে বুঝেছিল, ভালোবাসার জন্য আলাদা কোনো রূপ বা গুণের প্রয়োজন পড়ে না। ভালোবাসার জন্য কেবল প্রয়োজন হয় ভালোবাসারই। ওটা তার জন্য ফরিদের নেই। পারুর জন্য আছে। এটাই একমাত্র সত্য।

.

আছমাকে পৌঁছে দিয়ে ফার্মেসিতে ফিরতে ফিরতে বিকেল প্রায় মরে এলো। সাইকেলটা রেখে নদীর ঘাটে হাত-মুখ ধুতে গেল ফরিদ। শীতের এই সময়টায় বৃষ্টির অভাবে পথ-ঘাটে খুব ধুলো উড়তে থাকে। সেই ধুলো প্রায় আচ্ছাদিত করে ফেলেছে তাকে। ফরিদ তার ধূসরিত মুখখানা ধুতে গিয়ে আবিষ্কার করুল হাতে মুখে কালি লেগে আছে। পথে দুইবার চেইন পড়ে গিয়েছিল সাইকেলের। সেই চেইন তুলতে গিয়েই এই অবস্থা। বিরক্ত ফরিদ তড়িঘড়ি করে সরু গাছের ঘাট বেয়ে উঠতে গিয়ে আচমকা পা হড়কে পড়ে গেল। প্যান্টের নিচের দিকে ছিঁড়েও গেল খানিকটা। কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। আজ সারাদিনই একটার পর একটা অঘটন ঘটছে। সকাল থেকে কেন যেন খুব অস্থিরও হয়ে আছে সে। কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। ফরিদ জানে না কেন, পারুদের বাড়ির সামনে দিয়ে আসার সময় আড় চোখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল সে। ঘরের দরজার সামনে দু খানা চেয়ার পাতা। বাশের আড়ায় নানা রঙের কাপড় শুকাতে দেয়া। হাঁস-মুরগিগুলোও খুঁটে খুঁটে খাবার খাচ্ছে উঠানে। ঘরের দরজা জানালাগুলোও হাট করে খোলা। সবকিছুই স্বাভাবিক। কিংবা অতি স্বাভাবিক। ওই অতি স্বাভাবিকতাটাই যেন ফরিদকে কেমন অস্বস্তি দিতে লাগল। মনে হলো, ইচ্ছে করেই যেন বাড়ির লোকজন তাদের সরব উপস্থিতি প্রমাণের চেষ্টা করছে। না হলে এর আগে কখনো পারুদের বাড়ির দরজা-জানালা ওভাবে খোলা দেখেনি সে। ওরকম আড়াভর্তি অত কাপড়-চোপড়ও না। এই প্রায় সন্ধ্যাবেলা উঠানের মাঝখানে হাঁস-মুরগিকে ওভাবে খাবার দেয়ারও কথা নয়। কে জানে, হয়তো একটু বেশিই ভাবছে সে। কিন্তু তারপরও ভেতরে ভেতরে যে অস্বস্তির কাটাটা একটু একটু করে বিধে যাচ্ছে, তাকে অস্বীকারও করতে পারল না সে।

ভেজা পোশাকে আর দোকানে ঢুকল না ফরিদ। সাইকেলটা টেনে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। পারুদের বাড়ি অতিক্রম করার সময়ও প্রায় একই দৃশ্য দেখল সে। তবে এখন হারিকেনের আলোও যুক্ত হয়েছে। দরজা-জানালা দিয়ে আলো এসে পড়েছে উঠানে। সেই আলো যেন অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশিই উজ্জ্বল। যেন এ বাড়িতে কোনো উৎসব চলছে। আচ্ছা, এমন নয়তো যে পারুরা কিছু আড়াল করতে চাইছে। কিংবা কিছু হচ্ছে ও বাড়িতে? কিন্তু কী হতে পারে?

অনেক ভেবেও এর উত্তর পেল না ফরিদ। তবে রাজ্যের প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা মাথায় নিয়েই সে বাড়ি ফিরল। আর ফিরতে ফিরতে যেই প্রশ্নটা সবচেয়ে বেশিবার তার মাথায় এলো, তা হলো–পার কি চলে যাওয়ার আগে একবারের জন্যও তার সঙ্গে দেখা করবে না? কথা বলবে না? শেষবারের মতোও না?

সে সাইকেলটা উঠানে রেখে ঘরে ঢুকল। তারপর কাপড় পাল্টে বেরিয়ে এলো বাইরে। রাতে রান্নাঘরে তুলে রাখতে হয় সাইকেল! আজকাল চোরের উপদ্রব খুব বেড়েছে। বাইরে যা পায়, তা-ই নিয়ে যায়। ফরিদ তাই সাইকেলটা রান্নাঘরে তুলে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে তালা মেরে রাখল। তারপর নেমে এলো উঠানে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই রিংকুকে দেখল সে। ছুটে এসে রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে হাপাতে লাগল রিংকু। ফরিদের বুকটা হঠাৎ ধক করে উঠল, কোনো বিপদ নয় তো?

রিংকু চট করে তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। তারপর বলল, পারুদি দিয়েছে। খুবই জরুরি। বলেছিল আরো আগে তোমাকে দিতে। কিন্তু বাজারে গিয়ে দেখি তোমার দোকান বন্ধ। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে খানিক দম নিল রিংকু। তারপর বলল, সেই বাজার থেকে আবার ছুটতে ছুটতে এইখানে এলাম।

ফরিদ ছো মেরে রিংকুর হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে নিল। এর আগেও একবার রিংকুকে দিয়ে এভাবে চিঠি লিখে পাঠিয়েছিল পারু। সেই চিঠিতে অভিমানের কথা ছিল। কিন্তু আজ কী আছে? ফরিদ চিঠিটা পড়ল। মাত্র কয়েক লাইনের ছোট্ট এক চিঠি। কিন্তু সেই চিঠি পড়ে তার গা শিউরে উঠল।

.

পারু যখন রতনপুর স্টেশনে নামল, তখন রাত প্রায় বারোটা। এখানে মিনিট পাঁচেকের জন্য ট্রেন থামে। ওইটুকু সময়ের জন্য তাকে নামতে হবে। ওইটুকু সময়ের মধ্যে তাকে আরো একবার ভাবতে হবে জীবনের সকল হিসেব-নিকেশ। ভুল-শুদ্ধ। যুক্তি-আবেগ। ওই শেষ মুহূর্তটুকুতেও তাকে আরো একবার জীবনে অবিশ্বাস্য ভয়ংকর সব সমীকরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধ করতে হবে নিজের সঙ্গেও। তবে অঞ্জলি যখন আঁচলে মুখ ঢেকে ঘুমিয়ে আছেন, চারু যখন জানালার সঙ্গে গাল চেপে ধরে নিঃসাড়ে শুয়ে আছে, তখনো তার মনে হয়নি এই শেষবারের মতো সে তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে। বরং তখনো তার মনে হচ্ছিল, রাত পোহালেই আবার সবার সঙ্গে তার আগের মতোই দেখা হবে, কথা হবে। হাসি, আড্ডা, গল্প হবে। সে নামার সময় পাশের কম্পার্টমেন্ট হয়ে নামল। দূর থেকে বাবা আর ঠাকুরমাকেও এক পলক দেখে নিল। আর তখনো তার স্পষ্ট মনে হলো, এই যে সে বাবা-মা, চারু, ঠাকুরমাকে ছেড়ে অচেনা এক স্টেশনে উধাও হয়ে যাচ্ছে, এ বুঝি বাস্তব নয়। এ এক স্বপ্ন।

ভোর হতেই সে জেগে উঠবে ভুবনডাঙার ওই চিরচেনা ঘরে। চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পাবে রোজকার চেনা সব দৃশ্য। ঘরের জানালা, দরজার ফাঁকে আলস্যে ঝুলে থাকা খিল, চৌকাঠের ফাঁকে সূর্যের ফালি ফালি রোদ, উঠোনে সন্তর্পণে হেঁটে যাওয়া লাল ঝুঁটির মোরগ। সবই আবার আগের মতোই দেখতে পাবে সে। কিন্তু পারু তখনো জানে না, সময় কি অদ্ভুত আবেশে, মোহে, সম্মোহনে মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাখে? আর রাখে বলেই মানুষ কখনো তার বর্তমানকে পড়তে পারে না। সে পড়তে পারে অতীতকে। অতীতের ভুল, শুদ্ধ সে অকপটে নির্ণয় করতে পারে। কিন্তু বর্তমান রয়ে যায় চির অপাঠ্য। আর তাকে পড়তে হলে সময়ের বাহনে চড়ে মানুষকে যেতে হয় ভবিষ্যতে। সে তখন অতীতের বুক খুঁড়ে তুলে আনতে থাকে জীবনের যোগফল।

.

রতনপুর স্টেশনটা ছোটো। চারদিকে সুনসান নীরবতা। গাঢ় অন্ধকারে দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে দুই পাশের বড় বড় গাছগুলো চোখে পড়েছে পারুর। এক পাশে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান। তারপাশেই টিকিট ঘর। সেখানে কিছু লোক বসে আছে। টিমটিম করে জ্বলছে হলদে মরা আলো। দূরে কতগুলো কুকুর চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার পরেই আচমকা শেষ হয়ে গেছে প্ল্যাটফর্ম। সেখান থেকে শুরু হয়েছে রুক্ষ্ম মাটির পায়ে হাঁটা পথ। পথের দু ধারে লালচে রুগ্ন ঘাস। হেমন্তের শিশির ভেজা নেতানো ঘাসগুলোর শরীরে লেপ্টে আছে ল্যাম্পপোস্টের মরা আলো। পারু দীর্ঘসময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিল চারপাশটা। আর তাতেই পুরো স্টেশনটাকে কেমন শোকবিহ্বল বাড়ির মতো মনে হলো তার। যেন কিছুক্ষণ আগেই প্রিয় কারো মৃত্যু সংবাদ এসেছে এখানে। ফলে শোকস্তব্ধ হয়ে গেছে পুরো বাড়ি। কিন্তু আশপাশে কোথাও ফরিদকে দেখতে পেল না সে।

আজ সকাল থেকেই ভয়ানক অস্থির লাগছিল পারুর। যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল অজানা কোনো আতঙ্কে। সেই আতঙ্ক যে ফরিদকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার, তা সে বুঝতে পেরেছে অনেক পরে। যখন বিকেল মিইয়ে গিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে ভুবনডাঙার ওই বাড়িতে, ঠিক সেই মুহূর্তে। হঠাৎই তার মনে হলো, ফরিদকে এভাবে ফেলে রেখে কোথাও যেতে পারবে না সে। কোথাও না। তারপর কী যে হলো! পারু তার কিছুই জানে না। কেবল প্রচণ্ড ঝার মতো কিছু একটা আছড়ে পড়তে লাগল তার বুকের ভেতর। ভেঙে নিতে লাগল এপার ওপার। কেবল ওটুকুই টের পেল সে। তারপর পাগলের মতো ছুটে গেল রিংকুদের বাড়িতে। তার হাতেই ছোট্ট একটা চিরকুট লিখে পাঠাল ফরিদের কাছে। রিংকু ফিরে এসে জানাল, সে ঠিকঠাক চিরকুটটা ফরিদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। ফরিদ ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়েছে, আমি থাকব।

কিন্তু কোথায় ফরিদ? হেঁটে স্টেশন থেকে বাইরে বেরুবার গেটের কাছে এলো পারু। এদিকটাও খানিক দেখে নিতে চায় সে। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। যাত্রীরাও একে একে স্টেশন ছাড়তে শুরু করেছে। বাইরে লাল ইটের সরু রাস্তা। সেখানে কখানা রিকশা-ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ধীরে ধীরে যাত্রী নিয়ে চলে যেতে লাগল সেগুলোও। পারু কি তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই একা হয়ে যাবে এখানে? ঝট করে পেছন ফিরে তাকাল সে। আর তখুনি মনে হলো, কাজটা একদম ঠিক হয়নি। এই অচেনা-অজানা স্টেশনে এভাবে একা এই মধ্যরাতে এখন কী করবে সে?

.

গেটের কাছে খানিক অন্ধকার। সেখানে পুরনো চটের বস্তার ভেতর কাউকে নড়াচড়া করতে দেখল পারু। রুক্ষ্ম লম্বা চুল দেখে মেয়ে মানুষ বলেই মনে হলো তার। সে পাশে গিয়ে বসল। সব ট্রেন স্টেশনেই এমন ছিন্নমূল মানুষ দেখা যায়। হঠাৎ বস্তার ভেতর থেকে মুখ বের করে তাকাল ভাঁজ পড়া মুখের বিবর্ণ এক বৃদ্ধা। তারপর খক শব্দে মুখভর্তি করে কয়েকবার থুতু ফেলল সে। তবে কথা বলল না। টুপ করে আবার বস্তার ভেতর ঢুকে গেল। খোলা স্টেশনে একটা কনকনে হিমেল হাওয়া বইছে। সেই হাওয়ায় পারুর খুব শীত লাগতে লাগল। তার হাতে একটা ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। একটা চাদরও হয়তো আছে। কিন্তু চাদরটা আর বের করতে ইচ্ছে হলো না তার। বুকের কাছে দুই হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে জড়সড় হয়ে বসে রইল সে। কটা বাজে এখন? পারুর কাছে ঘড়ি নেই। স্টেশনের টিকিটঘরে আলো জ্বলছে। সেখানে গেলে হয়তো সময়টা জানা যেত। কিন্তু পারুর অবচেতন মন তাকে সতর্ক করে দিল, যতটা সম্ভব নিজের উপস্থিতিটাকে অপ্রকাশিত রাখাই তার জন্য মঙ্গল। ওখানে কতগুলো লোককে বসে থাকতে দেখেছে সে। স্টেশনে নানা কিসিমের মানুষ থাকে। তাদের কে ভালো, কে মন্দ, বোঝা বড় মুশকিল। সুতরাং নিজেকে আর প্রকাশ করতে চায় না সে।

রাত বাড়তে থাকল। বাড়তে থাকল নির্জনতাও। টিকিটঘরের আলোটা নিভে গেল। যে দু-চারজন মানুষ এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তারাও চলে গেল ধীরে ধীরে। চায়ের দোকানটাও বন্ধ হয়ে গেল। সবাই তাহলে চলে যাচ্ছে? রাতে আর কোনো ট্রেন নেই এই স্টেশনে?

পারু অবশ্য এতে খুশিই হলো। ফরিদ নিশ্চয়ই কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। তার আগের সময়টুকু নিঝঞ্ঝাটে কাটিয়ে দিতে পারাটাই তার লক্ষ্য। মানুষগুলো চলে গেলে ভাঙা ওয়েটিং রুমটাতে গিয়েও কিছুক্ষণ বসতে পারবে সে। তা ছাড়া এমন স্টেশনে এই সুনসান মধ্যরাতে অচেনা কেউ থাকার চেয়ে না থাকাই বরং ভালো। পারুর ইচ্ছে অবশ্য পূরণ হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো স্টেশন ফাঁকা হয়ে গেল। সে এবং বস্তাবন্দি এই পাগলিটি ছাড়া আর কোথাও কাউকে দেখা গেল না। পারু সাবধানে ব্যাগের ভেতর থেকে চাদরটা বের করল। শীত আরো বাড়ছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে চাদরটা ভালোভাবে জড়িয়ে বসে রইল সে।

ফরিদকে যে সময়ে খবরটা দিয়েছে পারু, তাতে আরো আগেই এখানে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল তার। অনেক হিসেব-নিকেশ করেই এটা ঠিক করেছিল পারু। সে জানে, চাইলেই ফরিদের সঙ্গে ভুবনডাঙায় থেকে যেতে পারবে না সে। বা অন্য কোনোভাবেও না। বরং এটাই ছিল একমাত্র পথ। সবচেয়ে নিরাপদ উপায়। কিন্তু ফরিদ এখনো আসেনি কেন?

.

পারুর হঠাৎই মনে হলো, ফরিদ যদি কোনো কারণে না আসে? তাহলে কী করবে সে? কোথায় যাবে? ট্রেন থেকে নামার আগে চারুর ব্যাগে ছোট্ট একটা চিরকুট লিখে রেখে এসেছে সে। যাতে বাবা-মা অন্তত জানেন, সে হারিয়ে যায়নি। গিয়েছে নিজের ইচ্ছেয়। আচ্ছা,–বাবা যখন দেখবেন, সে নেই, তখন কী করবেন তারা? প্রথম হয়তো বুঝতেই পারবেন না। ভাববেন বাথরুমে গিয়েছে। কিংবা অন্য কম্পার্টমেন্টে বাবার কাছে। হয়তো বুঝতে বুঝতে ভোর হয়ে যাবে। ততক্ষণে যশোরে পৌঁছে যাবেন তাঁরা। কিন্তু তারপর? তারপর কী হবে?

এই তারপরের টুকু যেমন ভাবতে চায় না পারু, তেমনি ভাবতে চায় না ফরিদ না এলে কী হবে সেটুকুও! কারণ এরপর আর কিছু নেই তার জন্য। তবে পারুর দৃঢ় বিশ্বাস, ফরিদ আসবেই। যে করেই হোক সে আসবে। এই বিশ্বাস তার আছে। সে তো চট করে ফরিদকে ভালোবাসেনি! আগে মানুষটাকে অনুভব করেছে। তারপর বুঝতে চেষ্টা করেছে। এই অনুভব আর বোঝাবুঝি তাকে পৌঁছে দিয়েছে সিদ্ধান্তে। নাহলে তাদের এই অসম্ভব সম্পর্কটা কখনোই হতো না। এ তো সহজ কোনো বিষয় নয়। বরং পৃথিবীর আর সব সম্পর্কের চেয়ে কঠিন, জটিল এই সম্পর্ক। এখানে ওই বিশ্বাসটুকুই যদি না থাকত তাহলে ভালোবাসা যেত না!

.

এমন নিথর, নিষ্প্রাণ রাত আর কখনো দেখেনি পারু। সে চুপচাপ তার ভাঁজ করা হাতের ওপর গাল চেপে ধরে বসে রইল। তার চোখের সামনে, কল্পনায় কতকিছু যে ভেসে যেতে লাগল! অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, এই এতকিছুর পরও পারুর কেন যেন মনে হচ্ছে তার অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। যেন কোনো কিছুই আর স্পর্শ করতে পারছে না তাকে। না হলে বাবা-মায়ের জন্য যতটা খারাপ লাগার কথা। ছিল, ঠিক ততটা খারাপ যেন তার লাগছে না। কিংবা সে হয়তো টেরই পাচ্ছে না কিছু। এমনকি ফরিদের জন্য যতটা দুশ্চিন্তা তার হওয়ার কথা ছিল, তাও হচ্ছে না। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হচ্ছে, এই যে এই নির্জন রাতে অচেনা-অজানা এক স্টেশনে সে এভাবে একা বসে আছে, এই বিষয়টাও তাকে কেন যেন ঠিক অতটা ভীত করতে পারছে না। বরং কেমন একটা স্বপ্ন স্বপ্ন অনুভব। যেন এসবই স্বপ্ন। অলীক কল্পনা। যদি সত্যি সত্যিই ভয়ংকর কিছু সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন হয়তো স্বপ্নটাও সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে যাবে!

.

পারুর স্বপ্ন অবশ্য ভাঙে না। বরং ভয়ংকর হতে থাকে। হঠাৎ করেই উৎকট গন্ধটা টের পায় সে। প্রথম বেশ কিছুক্ষণ অবশ্য বুঝতে পারে না গন্ধটা কীসের! কিন্তু তারপরই স্নায়ু টানটান হয়ে যায় তার, আশপাশে কেউ গাঁজা খাচ্ছে! গাঁজার তীব্র গন্ধে শরীর গুলিয়ে ওঠে। তবে তার চেয়েও বেশি কেঁপে ওঠে ভয়ে। তীব্র ভয় গ্রাস করে নিতে থাকে তাকে। রাতদুপুরে এমন স্টেশনে ঠিক কোন মানুষগুলো গাঁজা খায় পারু জানে! এরা দলবেঁধে নেশা-ভাং, চুরি-ছিনতাই করে। অরক্ষিত মেয়ে মানুষ পেলে মুহূর্তেই নখর বাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

চাদরটা টেনেটুনে নিজেকে আরো ঢেকে নেয় পারু। যাতে অন্ধকারে তাকে ঠিকঠাক ঠাহর করা না যায়। এখন কটা বাজে রাত? ফরিদ কেন আসে না? কোনো সমস্যা হয়নি তো তার? পারু মাথা ঢেকে দুই হাঁটুর মাঝখানে মুখ লুকিয়ে বসে থাকে। যেন এভাবে লুকিয়ে থাকলে আর কেউ তাকে দেখতে পাবে না।

কতক্ষণ এভাবে বসেছিল পারু জানে না। খানিক তন্দ্রার মতো লেগে এসেছিল তার। ঠিক সেই মুহূর্তেই কথাটা শুনল সে। তরল, জড়ানো গলায় কেউ একজন বলল, আরেহ, পাগলির লগে আইজ তো দেখি পাগলা আইসাও জুটছে।

পারু নড়ল না। তবে খানিক দূর থেকে ভেসে আসা আরেকজনের কণ্ঠ শুনতে পেল সে, পাগলা কেডা?

আইসা দেখ এইখানে। টুলু পাগলির পাশে কে যেন চাদর মুড়া দিয়া বইসা আছে?

পেছনের লোকটা ততক্ষণে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পারু চাদরের ভেতর থেকে তাদের দেখতে না পেলেও ঘটনা অনুমান করতে পারছে। লোকটা বিচ্ছিরি শব্দে হাসল। তারপর বলল, পুরান পাগলের ভাত নাই, নতুন পাগলের আমদানি। মালডা কেডা, দেখত?

পারু কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝটকা টানে তার গায়ের চাদরটা কেড়ে নিল একজন। আচমকা ঠাণ্ডা হাওয়ায় কেঁপে উঠল সে। ল্যাম্পপোস্টের ওই মৃদু আলোটুকুও যেন চোখে কটকট করে বিধতে লাগল। আধবোজা চোখে কোনোমতে তাকাল পারু। কিন্তু ততক্ষণে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে লোক দুজন। বেশ কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না তারা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর খুব সাবধানি কণ্ঠে বলল, কে আপনে?

পারু জবাব দিল না। চুপচাপ বসে রইল। প্রথম জন বলল, এইখানে কী? লগে আর কে আছে?

এত রাতে এই নিভৃত, জনশূন্য স্টেশনে পারুর মতো এমন কোনো তরুণীকে দেখার কথা তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। ফলে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেছে দুজনই। তবে সেই দ্বিধা ঝেড়ে ফেলতেও খুব একটা সময় লাগল না তাদের। দ্বিতীয় লোকটি বলল, আপনে একলা?

পারু এবারও জবাব দিল না। লোক দুজন পরস্পর চোখাচোখি করল। তারপর বলল, ঘটনা কী? অন্য কোনো ধান্দা?

পারু এবার তাকাল। তারপর বলল, আমার সঙ্গে লোক আছে।

তাই না-কি?

লোক দুজন হাসল। পারু বলল, হুম।

কই সে?

এই তো এখুনি চলে আসবে।

গেছে কই?

পারু খানিক চুপ করে থেকে বলল, আমাকে স্টেশন থেকে তার নিতে আসার কথা ছিল। কিন্তু একটু দেরি হচ্ছে… এতক্ষণে কাছাকাছি চলে এসেছে।

ওওও…। বলে আবারও চোখাচোখি করল তারা। তারপর বলল, তাইলে আর কী? একলা একলা আর কতক্ষণ এইখানে বইসা থাকবেন? আমাগো লগে লন, ওই পাশে সোন্দর বসার জায়গা আছে।

অন্য জন চোখ টিপল, চাইলে শোয়াও যাইব।

পারু উঠল না। সে শক্ত ভঙ্গিতে বসে রইল। প্রথম জন আচমকা বলল, কী হইলো? ওঠেন, ওঠেন। এই ঠাণ্ডার মইধ্যে আর কতক্ষণ বইসা থাকবেন?

পারু বুঝতে পারছে তার সামনে ভয়ংকর বিপদ। কিন্তু এই বিপদ থেকে সে কী করে মুক্তি পাবে, তা জানে না। দ্বিতীয় লোকটা হঠাৎ বলল, কী হইল? আপনে হাঁটতে পারেন না?

পারু তবুও নড়ল না। লোকটা আচমকা বল, কী? কোলে তুইলা নিতে হইব নি?

পারু একবার পাশের চটের বস্তাটার দিকে তাকাল। পাগলিটা কি তাকে কোনোভাবে সাহায্য করবে? কিছু বলবে সে? এ যেন গভীর সমুদ্রে ডুবে যেতে থাকা কোনো মানুষের খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকবার আশা। পাগলিটা অবশ্য বলল। সে হঠাৎ মাথা তুলে বলল, নয়া বউরে কোলে কইরাই নিতে হয়। হা হা হা। নয়া বউ। নয়া বউ।

পারু তার হাসি শুনে শিউরে উঠল। সে কখনো ভাবতেও পারেনি, কোনো মানুষের হাসি এমন ক্রুর হতে পারে। এদিকে-সেদিক তাকাল সে। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। কেবল দূরে প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় কতগুলো কুকুর অলস ভঙ্গিতে বসে আছে। সেদিকে তাকিয়ে পারুর আচমকা চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করল। এ সে কী করেছে! তার হঠাই কেন যেন মনে হলো, ফরিদ আর আসবে না। সেও বড় ধরনের কোনো বিপদে পড়েছে। সেই বিপদ তাকে আটকে রাখবে পারুর জীবনের কুসতিতম ঘটনা অবধি। জঘন্যতম মৃত্যু অবধি।

১১

পারুর চিঠি পাওয়ার পর থেকে থমকে আছে ফরিদ। তার মাথা কাজ করছে না। গত কয়েকটা মাস প্রায় সারাক্ষণই সে পারুর চলে যাওয়া নিয়ে ভেবেছে। নানা চিন্তা-ভাবনা করেছে। কিন্তু পারু যে এমন কিছু করতে পারে এটা সে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। কিন্তু এখন সে কী করবে? বেঁকের মাথায় কিছু না ভেবেই পারুর চিঠির জবাবও সে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেই চিঠিতে লিখেছে, স্টেশনে থাকবে সে। যে করেই হোক ট্রেন রতনপুর স্টেশনে পৌঁছানোর আগে সেখানে পৌঁছে যাবে! কিন্তু তারপর? তারপর কী হবে? পারুকে নিয়ে কোথায় যাবে ফরিদ?

ভুবনডাঙার দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে তার। এই গাঁয়ে আর কোনোদিন ফিরতে পারবে না সে। যেতে পারবে না অন্য কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িও। পারুও না। পুরো পৃথিবীতে একা হয়ে যাবে তারা দুজন মানুষ। ফরিদের হঠাৎ খুব দিশেহারা লাগতে লাগল। মনে হলো, এরচেয়ে পারুর চলে যাওয়াই বোধহয় ভালো ছিল। অন্তত তার স্মৃতি বুকে পুষে একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারত সে।

কিন্তু এখন কী করবে? পারুকে কি তবে বারণ করে দেবে? হাতে সময় আছে, চাইলে নিজে সাইকেল চালিয়েও পারুদের বাড়ি চলে যেতে পারে ফরিদ। তারপর সরাসরিই কথাটা বলতে পারে পারুকে। ফরিদ রান্নাঘর থেকে সাইকেলটা বের করল। তার হাতের ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা সাতটা। ভুবনডাঙা থেকে তাকে প্রথমে যেতে হবে থানা শহরে। সেখান থেকে জেলা। তারপর তাকে বাসে যেতে হবে রতনপুর। কম করে হলেও তিন-চার ঘণ্টার যাত্রা। এখন রওয়ানা দিলে রাত বারোটার আগেই সে রতনপুর স্টেশনে পৌঁছে যেতে পারবে। ফরিদ এটা নিশ্চিত। কিন্তু তার আগে তাকে কিছু কাজ করতে হবে।

যে মেয়েটা তার জন্য এতবড় ঝুঁকি নিতে পারে, নিজের পুরো জীবনটাকে এমন ভয়ংকর অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিতে পারে, সেই মেয়েকে নিয়ে সে অথৈ পাথারে ডুবে মরতে পারে না। তাকে কোনো একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। যাতে রতনপুর স্টেশন থেকে বের হয়ে অনিশ্চিত কোনো গন্তব্যে তাদের ছুটতে না হয়।

ফরিদ প্রথমেই গেল বাজারে। ফার্মেসির ক্যাশবাক্সে টাকা-পয়সা যা ছিল তা পকেটস্থ করে মামা আব্দুল ওহাবকে একটা চিঠি লিখে রাখল সে। তারপর বেরিয়ে পড়ল সাইকেল নিয়ে। ভুবনডাঙা স্টেশন তখনো ফাঁকা। লোকজন তেমন নেই। সেখানে এসে খানিক দাঁড়াল ফরিদ। তারপর নিজের আশু কর্তব্য ঠিক করে নিল। পোস্ট অফিসের সঙ্গে সাইকেলটা তালা মেরে হেঁটে রেললাইন পার হয়ে এলো। এপাশ থেকে টেম্পো যায় থানা শহর অবধি। কিন্তু ফরিদের ভাগ্য খারাপ। আজ কোনো যানবাহন নেই। এই কনকনে ঠাণ্ডায় সন্ধ্যার পর ঘর থেকেই বেরুতে চায় না কেউ। ফলে যাত্রী না পেয়ে চালকরা সব বাড়ি ফিরে গেছে। খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল ফরিদ। কিন্তু সে জানে, যে করেই হোক ঠিক সময়ে রতনপুর স্টেশনে তাকে পৌঁছাতেই হবে। তার আগে পারুর জন্য একটা থাকার জায়গার বন্দোবস্তও তাকে করতে হবে। সেজন্যই সে আগে যাবে তার বন্ধু রফিকুলের বাসায়। থানা শহরের বড় মসজিদটার পেছনেই রফিকুলদের বাড়ি। সেখানে পৌঁছে যেতে পারলে রতনপুর পৌঁছানোর একটা ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। ফরিদ আর সময় নষ্ট করল না। রেললাইন পেরিয়ে আবার চলে এলো এপাশে। তারপর সাইকেল নিয়েই রওয়ানা হয়ে গেল থানা শহরের উদ্দেশে।

রফিকুলদের বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় নটা। সাইকেল চালিয়ে এতটা পথ আসার ফলে সময় লেগেছে বেশি। প্রচণ্ড পরিশ্রমও হয়েছে। ঘেমে নেয়ে। একাকার হয়ে গেছে ফরিদ। শরীরটাও যেন ভেঙে পড়তে চাইছে। কিন্তু এসব নিয়ে এখন একদমই ভাবছে না সে। তার একমাত্র চিন্তা সঠিক সময়ে রতনপুর পৌঁছানো নিয়ে। তবে ঘটনা শুনে থম মেরে গেল রফিকুল। সে বলল, এখন তুই কী করবি?

রতনপুর যাব।

এই রাতে?

ফরিদ রফিকুলের কথায় খুবই বিরক্ত হলো। সে বলল, তুই গাধার মতো কথা বলছিস কেন?

আমি গাধার মতো কথা বলছি?

না। তুই কথা বলছিস অমানুষের মতো।

কী? রফিকুলের কণ্ঠে উম্মা।

একটা মেয়ে এই রাতে তার পরিবার-পরিজন সব ছেড়ে আমার জন্য অচেনা অজানা এক স্টেশনে অপেক্ষা করবে। আর তুই বলছিস আমি এত রাতে রতনপুর যাব কী না?

ফরিদ আর কথা বাড়াল না। রফিকুলকে কিছু বলারও সুযোগ দিল না। সে হনহন করে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো। ফরিদ অবশ্য রফিকুলদের ঘরে। ঢোকেনি। সীমানাপ্রাচীরের ভেতর গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলেছে। সে চায় না এখনই তাকে এ বাড়ির কেউ দেখুক।

রফিকুল জানে, কথাটা সে ঠিক বলেনি। কিন্তু ফরিদ যে সমস্যার মধ্যে ঢুকছে, তা নিয়ে সে চিন্তিত। কোনোভাবে যদি এই ঘটনা চাউর হয়ে যায়, তবে তা তার জন্যও বিপদ ডেকে আনবে। তার ওপর ফরিদ বলছে পারুকে নিয়ে এসে সে কয়েকদিনের জন্য তাদের বাড়িতেই উঠবে। এটাও ভয়ানক বিপদের কথা। বাবা মাকে কী বলবে রফিকুল? কিংবা আশপাশের মানুষদের? এ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান প্রেম-বিয়ে ভয়ানক অপরাধ। কেউ কিছু জানলে তাদের ওপরও অকল্পনীয় দুর্যোগ নেমে আসবে।

ফরিদ রাগ করে বেরিয়ে গেলেও তাকে একা ছাড়ল না রফিকুল। বরং বন্ধুর সঙ্গে জেলা শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো সেও। রাত তখন প্রায় সাড়ে ৯টা। এখান থেকে জেলা শহর পৌঁছাতে কম করে হলেও ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যাবে তাদের। তারপর ধরতে হবে রতনপুরের বাস। কিন্তু রফিকুলের তীব্র আশঙ্কা, এত । রাতে তারা রতনপুরের কোনো বাস নাও পেতে পারে। আর সেটি হলে দুর্ভোগের আর অন্ত থাকবে না।

তবে তাদের ভাগ্য ভালো। তারা যখন ভ্যানগাড়ি থেকে জেলা শহরের বাসস্ট্যান্ডে নামল, তখন শেষ বাসটা ছেড়ে যাচ্ছিল রতনপুরের উদ্দেশ্যে। আর মিনিট পাঁচেক দেরি হলেও বাসটা ধরতে পারত না তারা। বাসে উঠে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ফরিদ। প্রবল দুশ্চিন্তায় প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার। এত রাতে ট্রেন থেকে ওভাবে নেমে পারু যদি তাকে না পেত, তাহলে কী করত? বিষয়টা ভাবতে পারে না ফরিদ। সে এখন পারুকে কেবল একবার দেখতে চায়। জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চায়। আর বুকের ভেতর কবুতরের পালকের মতো পারুর ওই স্পর্শটুকু অনুভব করতে চায়। তারপর যা হবার হবে।

রফিকুল বলল, আমাদের হয়তো আধাঘণ্টা দেরি হতে পারে। সাড়ে বারোটা বেজে যাবে পৌঁছাতে পৌঁছাতে।

ফরিদ বলল, ওটুকুতে সমস্যা নেই। এরচেয়ে বেশি হলে সমস্যা। তা ছাড়া ট্রেনও তো লেট করে। করে না?

তা করে।

আরেকটা কথা।

কী? রফিকুল তাকাল।

ভেবেছিস কিছু?

কী ভাবব?

পারুকে নিয়ে তোদের বাড়িতে যে কটা দিন থাকতে চাই?

রফিকুল সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না। তবে দীর্ঘসময় পর সে বলল, সেটাই ভাবছি। কিন্তু কোনো সমাধান পাচ্ছি না। কী বলে ওকে বাড়িতে নেব, বল? আব্বা আর মাকে তো চিনিস। তাদের কী বলব? তোর আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধব তো বলা যাবে না! বাড়িতে এটা মানবে না।

আমি ভেবে রেখেছি কী বলব?

কী?

বউ। বউ? অবাক গলায় বলল রফিকুল।

হুম। পারু আমার বউ। আমরা তোদের বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এসেছি। এ ছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই। অন্য যা কিছুই বলিস না কেন, একটা না একটা ঝামেলা হবেই। এটাই সবচেয়ে নিরাপদ।

কিন্তু…।

ফরিদ রফিকুলকে থামিয়ে দিয়ে বলল, বলবি নতুন বউ নিয়ে তোদের বাসায় বেড়াতে এসেছি। দিন কয়েক থাকব। তারপর চলে যাব। বলে একটু থামল সে। তারপর বলল, এর মধ্যে আমি অন্য কোনো একটা ব্যবস্থা করে ফেলব।

অন্য কী ব্যবস্থা করবি?

সেটা এখনো জানি না। তবে তুই নিশ্চিন্ত থাক, সারা জীবন তোর ঘাড়ে বসে থাকব না। দু-চারদিনের মধ্যেই তোর ঘাড় থেকে নেমে যাব।

রফিকুল আর কথা বাড়াল । তবে তার দুশ্চিন্তা হচ্ছে খুব। যদিও ফরিদের বুদ্ধিটা ভালো। কেবল তার বউ বললেই হয়তো বাবা-মাকে মানানো যাবে। অন্য যা-ই বলা হোক না কেন, কোনো না কোনো সমস্যা তারা করবেই। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে পারু কতটা মানিয়ে নিতে পারবে? আর এরপর কী করবে ফরিদ? কোথায় যাবে?

বিষয়টা নিয়ে ফরিদও যে ভাবছে না, তা নয়। বরং এই নিয়েই তার দুশ্চিন্তা সবচেয়ে বেশি। এমন হুট করে সব হয়ে গেল যেকোনো কিছুই আর ভাবতে পারছে না সে। তবে ফরিদের সেই ভাবনায় তীব্র আতঙ্ক যুক্ত করল বাসটা। হঠাই যেন কাশির রোগীর মতো খুক খুক করে কাশতে লাগল। তারপর চলতে লাগল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। খানিকটা পথ গিয়ে থেমে গেল পুরোপুরি। প্রথমে কিছুক্ষণ ঘটনা বুঝতে পারল না ফরিদ। তবে বাসের ড্রাইভার যখন বলল যে এই বাস আর যাবে না, তখন আকাশ ভেঙে পড়ল তার মাথায়। সে সিট ছেড়ে উঠে গিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে বচসাও করল। কিন্তু তাতে লাভ হলো না। এত রাতে এই রাস্তার মাঝখানেই নেমে যেতে হবে তাদের। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বাস আর সামনে যাবে না। ভোরে মেকানিক এসে বাস ঠিক করবে, তারপর এই বাস পৌঁছাবে গন্তব্যে।

ফরিদের মনে হচ্ছে সে পাগল হয়ে যাবে। কিংবা দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। এখন কী করবে সে? সুনসান রাস্তায় আর কোনো গাড়ি-ঘোড়া নেই। একটা মানুষ পর্যন্ত নেই। কীভাবে সে রতনপুর পৌঁছাবে? ঘড়ির দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল ফরিদ। রাত প্রায় এগারোটা। আর মাত্র ঘণ্টাখানে সময়। এর মধ্যে সে রতনপুর পৌঁছাবে কী করে? আর সে যদি না পৌঁছাতে পারে, তাহলে কী করবে পারু?

.

ফরিদের মাথা দপদপ করছে। বুক শুকিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে প্রবল উল্কণ্ঠা তাকে অবশ করে ফেলবে। ঘড়ির কাঁটা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। আরো কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইল তারা। তারপর হঠাৎ একটা অদ্ভুত কাজ করল ফরিদ। পরনের জামাটা খুলে কোমরে বেঁধে নিল। এই গভীর শীতের রাত্রিতে তার এই কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গেল রফিকুল। তবে কিছু বলল না সে। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। ফরিদ ততক্ষণে দৌড়াতে শুরু করেছে। সে জানে, এভাবে কিছুতেই রতনপুর পৌঁছাতে পারবে না সে। অতটা শক্তি তার নেই। কিন্তু তারপরও তার এই অর্বাচীন পাগলামি দেখে কেন যেন বিহ্বল হয়ে গেল রফিকুল। সেও ধীর পায়ে ফরিদের পেছন পেছন ছুটতে লাগল।

.

পারু দাঁড়িয়ে আছে ভাঙা রুমটার সামনে। তার মুখোমুখি দাঁড়ানো লোক দুটোর মুখ থেকে ভক ভক করে উৎকট গন্ধ বেরুচ্ছে। কিন্তু পারুর যেন সেসবে কোনো বিকার নেই। সে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের কোল ভিজে যাচ্ছে জলে। লোকটা বলল, তোমার ভাড়া কত?

পার কথা বলছে না। কাঁদছে সে। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। লোকটা বলল, কও কও, রেট কও তোমার?

তার কথা শেষ হতেই অন্যজন বলল, আমাগো কাছে কিন্তু বেশি টাকা-পয়সা নাই। অল্প আছে। অল্প পয়সায় কাম দিবা না?

পার হঠাৎ হাতজোড় করে বলল, আমাকে আপনারা ছেড়ে দিন। আমি আপনাদের পায়ে পড়ি, আমাকে ছেড়ে দিন।

প্রথম লোকটা হাসল। তারপর বলল, আমরা লোক খারাপ। এইজন্য খারাপ লোক দেখলেই আমরা চিনি। তুমি যে খারাপ মাইয়া লোক না, এইটা বুঝছি। আবার এইটাও বুঝি, আমাগো শখ-আহ্লাদও তত আছে। আছে না? কী কস?

দ্বিতীয় লোকটি ফে ফে করে হাসল, শখের ভোলা আশি টাকা। তয় অত পয়সা আমাগো নাই। তারপরও আইজ রাইতের জন্য তোমার রেট কত, কও? দেখি, দুজনের কাছে হইবো কী না? বিনা পয়সায় কিছু করব না আমরা। কী বলিস ছি?

লোকটা তার সহযোগীর দিকে তাকাল। তার নাম ছিরু। ছিরুও হাসল। বলল, ফাওই তো পাইতেছি। জিনিস তো এখন আমাগো। তাইলে টাকা দিয়া খামু কেন?

লোকটা আবারও খিক খিক করে হাসল। তারপর বলল, জোর করা জিনিসে মজা নাই। টাকা দিলে যদি আপসে কাম হয়, ওইটা হইলো মজা। এখন সে রাজি হইলেই হয়।

ছিরু সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, তাছাড়া জোর-জবরদপ্তি করলে জখম টখমও হয়। কাটা-ছিড়া লাগে। ব্যথা পাইব মাইয়া। এইগুলা চাও? তার চাইতে আপসেই ভালো না?

পারুর মনে হচ্ছে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এইসব কুৎসিত জঘন্য কথা আর নিতে পারছে না সে। অসহনীয় যন্ত্রণায় যেন বুকের ভেতর থেকে কলজেটা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে। সে প্রায় জান্তব চিল্কারের মতো কাঁদতে লাগল। তারপর দুই হাত জড়ো করে আচমকা মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে ছিরুর পা জড়িয়ে ধরল। বলল, আপনি আমার বাবা। আমার বাবা আপনি। আপনি আমাকে বাঁচান। আমি আপনার মেয়ের মতো। আমার এই ক্ষতিটা আপনি করবেন না…। পারুর কথার কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তার গলা জড়িয়ে আসছে। ছি হঠাৎ বিড়িটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর খপ করে পারুর চুল ধরে ফেলল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল পারু। সঙ্গে সঙ্গেই অন্য লোকটা বলল, আরেহ, করস কী? করস কী? এমন সোনার পুতলা মাইয়া এর আগে কোনোদিন দেখছোস? এতদিন যেইগুলা দেখছস, ওইগুলা আছিলো পাখর, আর এইটা হইলো গিয়া মোম। অত জোরে ধরিস না, গইলা যাইব।

হিরু অবশ্য ছাড়ল না। সে পারুর চুল ধরে টেনে দাঁড় করাল। তারপর ধাক্কা দিয়ে ভাঙা ঘরটার ভেতর ঢুকিয়ে দিল। তার চোখে-মুখে পাশবিক উল্লাস। সঙ্গের লোকটা বলল, তোর অবস্থা তো ভালো না ছিরু। চোখে দেহি রক্ত আইসা পড়ছে। যাহ, আইজ তুইই আগে যা।

ছিরু ভেতরে ঢুকল। জায়গাটা অন্ধকার হলেও সামান্য আলোর আভা রয়েছে। সেই আভায় সে পারুকে এক পাশে ঠেলে দিল। তারপর বলল, জোর জবরদস্তি করলে কিন্তু লাভ নাই। লস। আপোষে করলে দুইজনেরই ভালো। এহন সিদ্ধান্ত তোমার। দুই চাইরড়া খুন করনের ঘটনাও আমাগো আছে। দুই মিনিট সময়, কী করবা ভাবো। আমি একটা বিড়ি ধরাইলাম। বিড়ি শেষ করন পর্যন্ত টাইম।

বলেই থক করে একদলা থুতু ফেলল ছিরু। তারপর পকেট থেকে বিড়ি বের করে দু হাতের তালুতে ঘসে সোজা করার চেষ্টা করতে লাগল। এতক্ষণের ধস্তাধস্তিতে সম্ভবত ভাঁজ হয়ে গেছে বিড়িটা। পারু প্রায় দেয়ালের সঙ্গে মিশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রিলবিহীন খোলা জানালাটা সেখানে। বাইরে সেই হলদে মরা আলোর রাত। সুনসান স্তব্ধতা। গা হিম হয়ে আসা কনকনে হাওয়া। দূরে ল্যাম্পপোস্টের নিচে কতগুলো কুকুর। তারা অলস ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। আর কোথাও কেউ নেই। কেবল বুকের ভেতর ওই ঢিবঢিব শব্দটা ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না পারু। তার আচমকা চিৎকার করে বাবাকে ডাকতে ইচ্ছে করল। মাকেও। আচ্ছা, এমন যদি হতো যে, এই পুরো বিষয়টাই কেবল ভয়াল এক দুঃস্বপ্ন হয়ে যেত। সে চোখ খোলা মাত্রই দেখত, মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে সে! এমন কত হয়েছে তার। ছোটবেলায় খুব অসুখ করত পারুর। বিশেষ করে জ্বরটা যেন লেগেই থাকত। আর তখন ঘুমের ভেতর ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখত সে। তবে অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, স্বপ্নটা যখন একদম চূড়ান্ত পর্যায়ের আতঙ্কের হয়ে যেত, যখন প্রচণ্ড ভয়ে দম আটকে আসত, ঠিক সেই মুহূর্তে স্বপ্নের ভেতরই কে যেন তাকে মনে করিয়ে দিত, এটা সত্যি নয়। এটা স্বপ্ন। সে যেন বারবার বলতে থাকত, তুমি ভয় পেয়ো না। এটা সত্যি নয়। এটা একটা স্বপ্ন। তুমি চোখ মেলে দেখ। এখুনি ঘুম ভাঙো। দেখ, কোথাও কোনো বিপদ নেই তোমার। তুমি শুয়ে আছ তোমার মায়ের কাছে। নিরাপদে।

পারু হঠাৎ চিৎকার করে কাঁদতে লাগল, মা… মা… মা… ও মা… মাগো…।

ছিরু সিগারেটটা দু হাতের ফাঁকে রোল করে দিয়াশলাই খুঁজতে লাগল। কিন্তু বুক পকেটে দিয়াশলাইটা নেই। সে পারুর কান্না শুনে আড়চোখে একবার তাকাল। তার ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি। যেন বিষয়টা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে। সে। জিভ দিয়ে বারকয়েক ঠোঁট ভিজিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর লুঙ্গির কেঁচড়েও খুঁজল। কিন্তু পেল না। পারু তখনো চিৎকার করে কাঁদছে, ও মা… মাগো…ও বাবা, বাবা…।

অসংলগ্ন এক মানুষের মতো কতকিছু বলে যাচ্ছে সে। প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ছে তার শরীর। ছিরুর শক্ত হাতের স্পর্শটা তখুনি টের পেল পারু। তার কাঁধ খামচে ধরেছে গা ঘিনঘিনে লোকটা। তারপর হ্যাঁচকা টানে তার দিকে ফেরাল। বলল, এইসব ভাল্লাগতেছে না। কান্দন বন্ধ। মাথায় কিন্তু রাগ উইঠা যাইতেছে।

পারু কথা বলল না। মুখ তুলে তাকালও না। বরং আরো খানিকটা পিছিয়ে যেন দেয়ালের ভেতর মিশে যেতে চাইল সে। ছিরু হঠাৎ ঘরের বাইরে থাকা তার সঙ্গীকে ডাকল। চিৎকার করে দিয়াশলাই দিয়ে যেতে বলল। লোকটা অবশ্য তার কথা শুনল না। বরং উত্তরে অশ্লীল ভঙ্গিতে বলল, আগে আগে মজা নিবা তুমি, আবার ম্যাচও দিয়াসবো আমি? তাতো হইবো না। এহন একটু কষ্ট করো। এইখানে আইস্যা ম্যাচ নিয়া যাও।

ছি গজগজ করতে করতে দিয়াশলাই আনতে বাইরে গেল। তারপর বিড়ি ধরাল। বিড়িটা নিয়ে অবশ্য ফিরতে পারল না সে। তার আগেই তার সঙ্গী বলল, কয়ডা টান দিয়া আমারে দিয়া যা। আমার কাছে বিড়ি নাই। বাইরে কী ঠাণ্ডা দেখছোস? আর তুই তো ভেতরে গরম হবি। আমি কাঁপমু একলা একলা। দে বিড়িডা। হা হা হা।

বিরক্ত ছিরু দ্রুত কয়েকটা টান দিয়ে বিড়িটা তাকে দিল। তারপর শশব্যস্ত ভঙ্গিতে ছুটে এল ঘরে। কিন্তু ঘরে ঢুকেই স্তম্ভিত হয়ে গেল সে!

.

ঘন্টা দুয়েকের মতো পায়ে হেঁটেছে ফরিদ আর রফিকুল। প্রথম দিকে অবশ্য দৌড়ানোর চেষ্টাও তারা করেছিল। কিন্তু অতটা নিতে পারেনি শরীর। দম ফুরিয়ে এসেছে। ফলে ধীরে ধীরে কমেছে গতিও। ফরিদ অবশ্য শেষ বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করেছে। যতটা সম্ভব মনের জোরে ছুটতে চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু লাভ হয়নি। এ এক অসম্ভব চিন্তা। রতনপুর তো পায়ে হাঁটা দূরত্বের পথ নয়। তার ওপর অনভ্যস্ত শরীর। মানসিক দুশ্চিন্তা। অন্ধকার রাত। সব মিলিয়ে ক্রমেই শ্লথ হয়েছে গতি। পায়ের তালুতে উঁকি দিয়েছে ফোঁসকা। দরদর করে ঘাম ঝরছে শরীর বেয়ে। চারদিকে একটানা ঝিঁঝি পোকার ডাক। টুপটাপ করে শিশির ঝরে পড়ছে মাথার ওপর। রাস্তার দুই ধারে বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ। সেখানেও জমাটবাঁধা অন্ধকার। দূর কোথাও থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। এ যেন এক অচিনপুর। তারা দুজন সেখানে অচেনা আগন্তুক।

রফিকুল আচমকা বলল, আমি আর পারব না ফরিদ। আমার পা আর চলছে না।

ফরিদ একবার পেছন ফিরে তাকাল। তারপর বলল, আরেকটু চেষ্টা কর। একবার ভাব মেয়েটার কথা! একবার ভেবে দেখ কী পরিস্থিতির মধ্যে সে আছে!

আমি সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু শরীর না টানলে কী করব বল? আর এটা কি সম্ভব?

আমি জানি না রফিক। আমার মাথা কাজ করছে না। মনে হচ্ছে এই পথ আর কোনোদিন শেষ হবে না। পারুর সঙ্গে আমার আর দেখাও হবে না! কোনোদিন না। ফরিদ কাঁদছে।

রফিকুল এগিয়ে এসে বন্ধুর কাঁধে হাত রাখল। তারপর বলল, তুই এমন করিস না। দেখিস কিচ্ছু হবে না। পারুর কোনো ক্ষতিই হবে না!

তুই সত্যি বলছিস তো? যেন রফিকের কথায় আশ্বস্ত হতে চাইল ফরিদ।

রফিকুল তার কাঁধে হাত রেখে বলল, এমনও তো হতে পারে যে পারু শেষ পর্যন্ত ট্রেন থেকে নামেইনি? তুই শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছিস!

ফরিদ এক ঝটকায় তার কাঁধ থেকে রফিকুলের হাতটা সরিয়ে দিল। তারপর বলল  তোর যেতে ইচ্ছে না করলে দরকার নেই। কিন্তু পারুর সম্বন্ধে এমন কিছু বলিস না, যেটা…।

ফরিদের কথা শেষ করতে দিল না রফিকুল। তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আরে বোকা, আমি সেটা বলছি না। সে যে ইচ্ছে করে নামবে না, তা তো নয়। এমনও তো হতে পারে যে সে শেষ পর্যন্ত নামতেই পারল না। নামার সুযোগই হয়তো পায়নি!

রফিকুল কথা ঘোরালেও বিষয়টা মাথায় গেঁথে রইল ফরিদের। আচ্ছা, সত্যি সত্যিই যদি পারু ট্রেন থেকে না নামে? বা নামতে না পারে? তাহলে কী করবে সে? কী করে বুঝবে যে পারু কই? এখন ট্রেন স্টেশনে গিয়ে যদি তাকে না পায় ফরিদ, তাহলে কী ভাববে সে? পারু নামেনি? না-কি কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে তার? পারুর সঙ্গে যোগাযোগ করার আর কোনো উপায়ও তো তার জানা নেই।

বিষয়টা রীতিমতো এলোমেলো করে দিল ফরিদকে। আসলেই তো, রতনপুর স্টেশনে গিয়ে যদি সে পারুকে না পায়, তাহলে কী সিদ্ধান্ত নেবে সে?

.

তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে দুজনেরই। কিন্তু আশপাশে কোথাও কোনো আলো চোখে পড়ছে না। ঘর-বাড়িও না। তা ছাড়া এই রাতে গিয়ে কাউকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে পানি খাওয়ার কথাও বলা যায় না। বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এমনিতেই এসব অঞ্চলে ইদানীং খুব চুরি-ডাকাতি হয়। ফলে সন্দেহভাজন হিসেবে বিরূপ কোনো পরিস্থিতির শিকার হওয়াটাও অসম্ভব নয়। মাথার ওপর তারা ভরা আকাশ। সামনে ধোয়ার মতো কুয়াশা। গালে এসে বরফের কুচির মতো আছড়ে পড়ছে। অথচ তারপরও তারা দুজন ঘামছে। রফিকুল আচমকা রাস্তার পাশে বসে পড়ল। তারপর বলল, আমাকে মেরে ফেললেও আমি আর এক পাও এগুতে পারব ফরিদ।

ফরিদ নিজেও আর পারছে না। তার শরীরও হাল ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগেই। কেবল মনের জোরেই এখনো হেঁটে চলছে সে। ভয়ানক শঙ্কা আর তীব্র দুশ্চিন্তা তাকে তাড়া করে ফিরছে। কিন্তু সেই শক্তিতে আর কতক্ষণ চলবে শরীর? হাঁটতে গেলেই জ্বালা করে উঠছে পায়ের তালু। যেন দগদগে ঘা জেগে উঠছে সেখানে। ব্যথায় টনটন করছে হাঁটু। খানিক হেঁটে গেলেও আবার ফিরে এলো ফরিদ। তারপর ধপ করে বসে পড়ল রফিকুলের পাশে।

.

পারু কাঁদছে। তার কান্নার শব্দে সচকিত হয়ে উঠেছে কুকুরগুলো। মাঝরাত্রির এই অনাকাঙ্ক্ষিত উপদ্রবে তারা যারপরনাই বিরক্ত। প্রথমে বিকট শব্দে সমস্বরে চিৎকার শুরু করেছিল তারা। তাদের সেই চিৎকারে মাঝ রাত্রির এই জম-জমাট নীরবতা যেন কাচের দেয়ালের মতো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে চারধারে। পারু ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে প্ল্যাটফর্মের শক্ত মেঝেতে। সে মোটেই এতটা সাহসী নয়। বরং খানিক ভীতুই বলা চলে। তারপরও ছিরু যখন বিড়ি ধরানোর জন্য ঘরের বাইরে গেল, ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ কী যে হলো তার কিছু না ভেবেই লাফ দিয়ে গিলবিহীন জানালাটার ওপর উঠে বসল সে। তারপর লাফিয়ে পড়ল খোলা প্ল্যাটফর্মে। তার পতনের ওই শব্দটুকু ছিরুর কান পর্যন্ত গিয়েছিল কী না, পারু জানে না। সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করেছিল সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু কোথায় যাবে সে? এই প্ল্যাটফর্মের বাইরে আর কোনো কিছুই তার চেনা নেই। তারপরও সে ছুটল। উদ্দেশ্যহীন। যদিও ছিরুর চিৎকার ততক্ষণে শোনা যাচ্ছিল। পারুকে দেখতে না পেয়ে যেন উন্মাদ হয়ে গেছে সে।

পারু অবশ্য বেশিদূর যেতে পারল না। আতঙ্কে অবশ হয়ে আসছিল তার শরীর। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ওরা তাকে ধরে ফেলল! এই বুঝি আছড়ে ফেলল মাটিতে। সেই ভয় থেকেই কী না কে জানে, আচমকা হোঁচট খেয়ে ছিটকে পড়ল সে। শক্ত কংক্রিটের মেঝেতে গড়িয়ে গেল খানিকটা। সেখানে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েছিল কুকুরগুলো। তাদের মাঝরাতের নিরুপদ্রব ঘুমে হঠাৎ এমন বজ্রাঘাতে একযোগে খেঁকিয়ে উঠল তারা। তারপর ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এলো পারুর দিকে। পারু অবশ্য নড়ল না। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টাও করল না। এমন কি ছুটে পালাতেও চাইল না। সে যেমন ছিল, তেমনই বসে রইল। এক অসহায়, নিঃস্ব মানুষ। তার হাতের কনুই বেয়ে দরদর করে রক্ত ঝরছে। ঠোঁটের কোণে রক্তের দাগ। চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। এলোমেলো চুলে টেকে আছে মুখ। এই মাঝরাত্রির নির্জন ট্রেন স্টেশনের স্থবির ল্যাম্পপোস্টের হলুদ বিবর্ণ আলোটুকু যেন তাকে আরো বিবর্ণ, আরো একা, আরো অসহায় এক মানুষের প্রতিচ্ছবি করে তুলল।

পারু ভেবেছিল সে উঠে আবার ছুটতে শুরু করবে। প্ল্যাটফর্মের একদম শেষ প্রান্তে আধশোয়া হয়ে বসে আছে সে। এখান থেকেই শুরু হয়েছে পায়ে হাঁটা সরু পথ। সামনে গভীর অন্ধকার। একপাশে ট্রেন লাইন। অন্য পাশে ঘন জঙ্গল। পারু বুঝতে পারছে না সে এখন কী করবে? ওই অন্ধকারে ছুটে গেলে এক কদমও এগোতে পারবে না সে। এখানে কিছুই তার চেনা নেই।

আর ফরিদ যদি ফিরে এসে তাকে না পায়?

.

দূরে ছিরু আর তার সঙ্গীকে ছুটে আসতে দেখা যাচ্ছে। তাদের দীর্ঘ ছায়া পড়েছে পাশের দেয়ালে। সেই ছায়াও তাদের সঙ্গে সঙ্গেই ছুটছে। যেন ভয়াল একজোড়া দানব তাকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে। পারুর শরীরে আর এক ফোঁটা শক্তিও অবশিষ্ট নেই। দুইবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টাও করল সে। কিন্তু পারল না। হাল ছেড়ে দেয়া পারু চিৎকার করতে গিয়েও আচমকা থেমে গেল। যেন সে জানে, এখানে তার চিৎকার শোনার মতো কেউ নেই। না স্রষ্টা। না তার মা, বাবা কিংবা অন্য কেউ। সে কেবল বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল ছুটে আসা ভয়াল দানব দুটোর দিকে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা তাকে ধরে ফেলবে। তারপর খুবলে খাবে। মাংসাশী পিশাচের মতো। তীব্র আতঙ্কে হঠাৎ চোখ বন্ধ করে ফেলল পারু। তার গ্রীবা বেয়ে ঘাম নামছে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে মাকে ডাকতে লাগল সে। বাবাকেও। কিন্তু অমন ঘুমের ঘোরে, অন্ধকারে যে বাবা-মাকে ছেড়ে সে চলে এসেছিল নিশাচর এক ট্রেনে, তারা তার ডাক শুনবে কেন? তারা তখন হারিয়ে গেছে বহুদূরের আজন্ম অচেনা নিরুদ্দেশ এক পথে, সেই পথ থেকে পারুর ডাক তারা কী করে শুনবে?

.

জগতে সকল ঘটনারই ব্যাখ্যা থাকে। কিংবা মানুষ তার যুক্তি, তর্ক, সমীকরণে সেসবের নানা ব্যাখ্যা দাঁড় করায়। কিন্তু তারপরও তীব্র অন্ধকার কিংবা আলোর ওপার রয়ে যায় অজানাই। গাঢ় অন্ধকার যেমন মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাখে, কিছুই দেখতে দেয় না, তেমনি তীব্র আলোও চোখ ঝলসে দেয় মানুষের। করে ফেলে দৃষ্টিহীন। ফলে ওই তীব্র আলো আর অন্ধকারের ওপারটা আর দেখা হয় না মানুষের। সেই রাতে পারুর জীবনে তেমনই এক আলো-অন্ধকারের গল্প লেখা হয়ে গেল। যার ওপারটা আর কখনোই জানা হয়নি তার। এ যেন এক অব্যাখ্যেয় অদ্ভুত ঘটনার আঁচড় এঁকে দিয়ে গেল অসীম রহস্যময় কোনো অস্তিত্ব। এই জীবনে যার কোনো ব্যখ্যা আর কখনোই পাওয়া হয়নি তার। তবে পারু জানে, সবকিছু জানতে নেই। কিছু কিছু অজানাতেই ভালো। অলখেই প্রতিভাত হয় অসীমের অস্তিত্ব।

.

কুকুরগুলো এক নাগাড়ে তারস্বরে চিৎকার করে যাচ্ছে। তাদের সেই চিৎকার গা হিম করা ভয়ংকর। পারু অবশ্য সেসব শুনেও চোখ মেলল না। অসাড় হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল তার জীবনের সবচেয়ে কদর্য ঘটনাটির জন্য। কিন্তু দীর্ঘ সময় পরও যখন সে ছিরু আর তার সঙ্গীর কোনো উপস্থিতি টের পেল না, তখন হঠাৎ চোখ মেলে তাকাল। আর তারপরই হতভম্ব হয়ে গেল সে। তার চারপাশে ক্রমাগত বৃত্তাকারে ঘুরছে কুকুরগুলো। অনবরত ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে। তাদের থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে লোক দুজন। তারা বেশ কয়েকবার কাছে আসার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু লাভ হয়নি। সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র চিৎকারে তেড়ে গিয়েছে কুকুরগুলো। হতবিহ্বল পারু স্থির তাকিয়ে রইল। খানিক আগের নিরীহ, নির্বিরোধী কুকুরগুলো কী করে হঠাৎ এমন হয়ে গেল! ভয়াল দাঁতের ফাঁকে লকলকে জিভ বের করে মুহূর্তেই তারা হয়ে উঠেছে ভয়ংকর হিংস্র, নৃশংস। তাদের মুখের কোষ বেয়ে লালা ঝরে পড়ছে। ছিরু আর তার সঙ্গী একই সঙ্গে হতাশ ও ভীত চোখে তাকিয়ে আছে। যেন কিছুতেই এই অনভিপ্রেত অতিথিদের উপস্থিতি তারা মেনে নিতে পারছে না। বরং তাদের এমন অকস্মাৎ ভয়াল রূপ ছিরুদের চোখে-মুখে এঁকে দিয়েছে তীব্র আতঙ্ক।

পারু অবশ্য নড়লো না। ওভাবেই বসে রইল। তার অবিন্যস্ত চুলগুলো মুখের অর্ধেক ঢেকে দিয়েছে। সেখানে জমাটবাঁধা অন্ধকার। ঠোঁটের বাঁ পাশে গড়িয়ে পড়া রক্তের দাগ। তার জলে ভেজা চোখ জোড়া বন্ধ। ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় কতগুলো হিংস্র কুকুর তার চারপাশে ঘুরছে। দূরে তাদের দীর্ঘ ছায়া পড়েছে। কুকুরগুলোর মাঝখানে ঠায় বসে আছে পারু। হিম হাওয়ায় তার গায়ের চাদর, চুলের একাংশ উড়ছে। ওই নির্জন রাতের আলো-আঁধারিতে দৃশ্যটা বড় গা ছমছমে। বড় অস্বাভাবিক। অতিপ্রাকৃতিক।

তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পারু কতক্ষণ এভাবে বসে ছিল সে জানে না। তবে দূর কোনো মসজিদ থেকে তখন ভেসে আসছে ফজরের আজান। একটা-দুটা পাখি ডাকতে শুরু করেছে আশপাশে। কাছেই কোথাও জেগে উঠতে শুরু করছে রাস্তা-ঘাট। রিকশা-ভ্যান চলতে শুরু করেছে। ভোরের নিস্তব্ধতায় তাদের টুংটাং শব্দ খুব কানে লাগছে। ধীরে ধীরে কোলাহল বাড়ছে। পারু সেই কোলাহলে আচমকা চোখ মেলে তাকাল। আর তারপর চমকে উঠল। তার চারপাশে চুপচাপ শুয়ে আছে কুকুরগুলো। যেন রাস্তার পাশে পড়ে থাকা কতগুলো শান্ত, নিরীহ, রুগ্ন নেড়ি কুকুর। কিন্তু রাতের ভয়াল ওই লোক দুটোকে আর কোথাও দেখতে পেল না সে। হয়তো কোনো এক ফাঁকে সটকে পড়েছে তারা। তবে তার সামনে তখন দাঁড়িয়ে আছে অন্য দুজন লোক। তাদের একজনকেও চেনে না পারু। অবশ্য সবকিছুই অচেনা লাগছে তার কাছে। এ যেন নতুন এক জীবন। এই জীবন ও জগতের কিছুই যেন এর আগে কখনো দেখেনি সে।

পারু ঘোর লাগা বিভ্রান্ত চোখে মানুষ দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারাও তাকিয়ে আছে নিষ্পলক। সেখানে একই সঙ্গে আনন্দ, দুঃখ, ক্লান্তি, বিস্ময়, বিভ্রম। তাদের একজন হঠাৎ ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতো এগিয়ে এলো। তারপর পারুর হাত ধরে ওঠাল। মানুষটা কাঁপা গলায় ডাকল, পারু!

পারু তাকাল। তার চোখ শূন্য। নির্বাক।

লোকটা আবার বলল, আমি এসেছি, পার। আমি এসেছি। তোমার আর কোনো ভয় নেই। পারু…।

পারুর হঠাৎ কী যে হলো! সে আকাশ ভেঙে নেমে আসা বৃষ্টির মতো আচমকা নেমে এলো ফরিদের বুকে।

১২

রফিকুলের বাবা আতাহার মওলানা আগে দর্শনা চিনিকলের কাছে একটি মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। এখন অবসরে। তবে দিনের বেশির ভাগ সময়েই সামাজিক নানা কর্মকাণ্ডে তিনি ব্যস্ত থাকেন। এলাকার মসজিদের সভাপতির দায়িত্বটাও তাঁর কাঁধে। নামাজও পড়ান। এলাকায় সালিস ব্যবস্থা হলে লোকে তাকে ডাকে। ফলে বাড়িতে খুব একটা থাকা হয় না। আর যতক্ষণ থাকেন, চুপচাপ গম্ভীর। খুব একটা কথা হয় না কারো সঙ্গে। রফিকুলের মাও তেমন প্রগলভ নন। বেশির ভাগ সময়ই বাতের ব্যথায় কাবু হয়ে থাকেন। তার দুই মেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। সে থাকে শ্বশুরবাড়ি। ছোটো মেয়ে রোকেয়া ক্লাস টেনে পড়ে। এই মেয়ের সঙ্গেই তার যেটুকু কথা হয়। বাকি সময় নিজের মতোই একা একা থাকেন তিনি। রফিকুলের বড় একটি ভাইও রয়েছে। তার নাম শফিকুল। রেলওয়ের চাকরিসূত্রে তিনি খুলনা থাকেন। তাঁর স্ত্রীর নাম দিলারা। সে বয়সে রোকেয়ার চেয়ে বছর তিনেকের বড়। বাড়িতেই থাকে। তবে সদ্য বিবাহিতা দিলারা এখনো তার আচরণ থেকে কিশোরীসুলভ চপলতা দূর করতে পারেনি। আর এ কারণে প্রায়ই তাকে শাশুড়ির বকাঝকা শুনতে হয়। তবে তাতে খুব একটা বদলায়নি সে।

রাতে যে রফিকুল ঘরে ছিল না, এটা প্রথম তার চোখেই এসেছে। আজ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়েছে। বাইরে ঘন কুয়াশা। সহসা সূর্যের দেখা মিলবে বলেও মনে হচ্ছে না। রোকেয়া লেপের তলায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। দিলারা তার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, আব্বা জানলে তো তুলকালাম ঘটে যাবে!

কেন? কী হয়েছে? লেপের তলা থেকে মুখ বের করে বলল রোকেয়া। তার কণ্ঠে উৎকণ্ঠা। সে নিশ্চিত, রফিকুল কিছু একটা ঘটিয়েছে।

দিলারা বলল, রফিকুল তো রাত থেকে ঘরে নাই!

কী বলো ভাবি? কই গেছে সে? এবার উঠে বসল রোকেয়া। এ বাড়িতে অনুমতি ছাড়া রাতে কারো বাড়ির বাইরে থাকা আতাহার মওলানার পছন্দ না।

তাতো জানি না। আমাকে কিছু বলে যায়নি।

রোকেয়া বলল, আব্বা জিজ্ঞেস করে নাই?

নাহ। আব্বা কাল রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেছিলেন।

তাহলে আর সমস্যা কী? এখন তো দিন। দিনের বেলায় তো আর সমস্যা নাই। রাতেরটা না জানলেই হবে।

কিন্তু রাতে আম্মার জন্য ওষুধ আনতে টাকা দিছিলেন আব্বা, সেই টাকা নিয়েই বের হয়ে গিয়েছিল রফিকুল। তারপর তো আর খবর নাই। এখন ওষুধ চাইলে কী বলব?

এই কথায় চিন্তিত হয়ে পড়ল রোকেয়াও। তবে তাদের বেশিক্ষণ চিন্তিত থাকতে হলো না। রফিকুল ফিরল তার ঘণ্টা দুয়েক বাদেই। তখনো রোদ ওঠেনি। ঘন কুয়াশার বিষণ্ণ দিন। আকাশও যেন থম মেরে আছে। সূর্যের দেখা নেই কোথাও। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। সেই ঠাণ্ডায় জবুথবু রফিকুলকে দেখে থমকে গেল দিলারা। যেন এক রাতেই কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে সে। লাল টকটকে চোখ। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মুখ। দিলারা অবশ্য মুখ টিপে হাসল, কী ব্যাপার? এই অবস্থা কেন? রাত-বিরাত কই ছিলেন আপনি?

রফিকুল জবাব দিল না। তবে হাতের ইশারায় তাকে নিজের ঘরে ডাকল। তারপর বলল, একটা বিপদ হয়ে গেছে ভাবি।

কী বিপদ? বিশেষ কোনো ঘটনা আছে নাকি দেবর সাহেব? বলে ভ্রু নাচাল সে।

রফিকুল অবশ্য ভাবির টিপ্পনী গায়ে মাখল না। সে বলল, হুম। তবে বিপদটা আমার না।

কার তাহলে?

ফরিদের।

ফরিদকে এ বাড়ির সবাই-ই চেনে। দিলারার বিয়েতেও সে এসেছিল। তবে এরপর বেশ কিছুদিন আর তাকে দেখেনি দিলারা। সে বলল, কী হয়েছে?

ফরিদ বিয়ে করছে।

বিয়ে করেছে? যেন অবাক হলো দিলারা। এতে বিপদের কী হলো?

আছে ভাবি। সে বিয়ে করেছে লুকিয়ে।

শুনে হাসল দিলারা, ভালো কাজ করছে। নাহলে তোমার ভাইয়ের মতো বুড়ো বয়সে বিয়ে করতে হতো। শেখো শেখো। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে না শিখে বন্ধুর কাছ থেকে শেখো।

ভাবি! অধৈর্য গলায় বলল রফিকুল। তুমি বুঝতে পারছে না। সে মেয়েটাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে।

মানে কী?

হ্যাঁ।

এখন কই তারা?

আমাদের বাড়ির সামনে।

কী বলছো তুমি? নতুন বউ নিয়ে সরাসরি এখানে চলে এসেছে?

হুম।

আব্বা শুনলে কী হবে কিছু বুঝতে পারছো?

পারছি ভাবি। এজন্যই তো আগে তোমার কাছে এসেছি।

আমার কাছে? আমি কী করব?

করলে তোমাকেই কিছু একটা করতে হবে। ওরা এখন কই যাবে বলো? আর তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। কয়েকটা দিন এখানে থেকেই চলে যাবে ওরা।

এবার থমকাল দিলারা। এতক্ষণ বিষয়টা তার কাছে যতটা মজার মনে হয়েছিল, এখন আর তা মনে হচ্ছে না। সে বুঝতে পারছে, রফিকুল পুরো বিষয়টা তাকেই সামলাতে বলছে। কিন্তু কী করবে সে?

রফিকুল বলল, তুমি না বলো না ভাবি। আমি তোমার পায়ে ধরি, একটা না একটা ব্যবস্থা তোমাকে করতেই হবে।

দিলারা অসহায় ভঙ্গিতে বলল, আমি কী ব্যবস্থা করব? আমি এই বাড়ির নতুন বউ। মাত্র কয় মাস হলো এসেছি। এখনই যদি কোনো ঝামেলা পাকিয়ে ফেলি, অবস্থাটা কী হবে তুমি বুঝতে পারছো? আর আব্বাকে তো তুমি চেনোই। চেনো না?

আমি সবই জানি। কিন্তু আর কোনো উপায় নাই ভাবি। এই ছেলে-মেয়ে দুটা এখন কই যাবে বলো? আমি যদি এমন কিছু করতাম, তুমি একটা না একটা ব্যবস্থা করতে না?

দিলারা রফিকুলের কথার জবাব দিল না। তবে চুপ করে রইল। তারপর বলল, আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। কী বলে এইখানে আনব? কয়দিনের জন্য আনব? আব্বা-আম্মা কী মানবে?

দিলারা যে এমন প্রশ্ন করবে, তা রফিকুল জানত। জানত ফরিদও। আর সে কারণেই এমন পরিস্থিতিতে কী বলতে হবে তাও তারা আলোচনা করেই ঠিক করে রেখেছে। ঠিক করে রেখেছে, কাকে কতটুকু কী বলতে হবে তাও। পারুর ধর্মীয় পরিচয়টাও যে সর্বোচ্চ সতর্কতায় গোপন রাখতে হবে তাও তারা জানে। এটিই এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক। রফিকুল সতর্ক ভঙ্গিতে বলল, এক কাজ করলে কেমন হয় ভাবি?

কী কাজ?

ধরো, ফরিদ এমন ভাবে আমাদের বাড়িতে এলো যে সে তার নতুন বউ নিয়ে বেড়াতে এসেছে। আমার বন্ধু তার নতুন বউ নিয়ে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতে পারে না?

হুম। গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল দিলারা। তা পারে।

তাহলে সেভাবেই এলো।

কিন্তু এই সাত সকালে? এত সকালে কেউ কারো বাড়িতে বেড়াতে আসে?

তাও তো কথা! চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রফিকুল।

তাছাড়া নতুন বউ নিয়ে কেউ কারো বাড়িতে এলে আগেভাগে তো খবর দিয়ে আসবে তাই না? তাদের জন্য তো একটু আলাদা আয়োজনের ব্যাপার থাকে। এভাবে বলা নেই-কওয়া নেই, এসে হাজির? সেটা বিশ্বাসযোগ্য হবে?

হুম। বলে কী ভাবল রফিকুল। তারপর বলল, এক কাজ করলে কেমন হয়, তুমি একটু ফরিদের সঙ্গে কথা বলে দেখবে?

দিলারা স্পষ্ট বুঝতে পারছে, এই ঝামেলা শেষ পর্যন্ত তাকেই সামলাতে হবে। ফলে পিছিয়ে গিয়ে লাভ নেই। বরং আরো বড় কোনো ঝামেলা তৈরি হওয়ার আগেই মুখোমুখি হওয়া ভালো। তার ওপর একটু কৌতূহলও হচ্ছে তার। সে সতর্ক ভঙ্গিতে ঘরের ভেতরটা দেখে এসে বলল, আম্মা নামাজ পড়ে আবার ঘুমাচ্ছেন। রোকেয়াও। আব্বাও বাড়িতে নাই। চলো, এই ফাঁকে ফরিদের সঙ্গে কথা বলে আসি।

ফরিদ আর পারু বসে আছে একটা বন্ধ চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চিতে। তাদের দুজনকে দেখে রীতিমতো আঁতকে উঠল দিলারা। বলল, এ কী অবস্থা এদের?

ফরিদ আর পারু জড়সড় ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। রফিকুল তার দৃষ্টি নিচু করে ফেলল। দিলারা বলল, এই অবস্থায় এরা নতুন জামাই-বউ হিসেবে বেড়াতে আসবে? এটা কেউ বিশ্বাস করবে? বলেই পারুর কাছে গেল সে। তারপর আলতো হাতে তার চিবুক তুলে ধরে বলল, কী হয়েছে এই মেয়ের? কে মেরেছে তাকে? তার ঠোঁট কাটা, কপালে দাগ। চুল, চেহারা, জামা-কাপড়ের এ কী অবস্থা?

ফরিদ হঠাৎ হাত জোড় করে মিনতির ভঙ্গিতে বলল, অনেক ঘটনা আছে ভাবি। আপনাকে আমি সব ঘটনা খুলে বলব। তার আগে ওকে একটু থাকার ব্যবস্থা করে দেন। একটু খাবার আর বিশ্রাম, না হলে মরে যাবে ও।

এতক্ষণে যেন ঘটনার সত্যিকারের ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারল দিলারা। ফরিদের অবস্থাও শোচনীয়। তাকে দেখতে লাগছে ঝড়ে বিধ্বস্ত গাছের মতো। যেন যেকোনো সময় উপড়ে পড়বে। আর পারুর দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। যেন কোনোভাবে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে সে। কিন্তু বিষয়টা সন্দিগ্ধও করে তুলল তাকে। এ বাড়িতে নতুন বউ সে। ফলে এখনই বড়সড় কোনো ঝামেলা পাকিয়ে ফেললে আর রক্ষা নেই। এমনও তো হতে পারে যে ফরিদদের জন্য তাদের সবারই বড় ধরনের কোনো বিপদে পড়তে হলো? তবে তাকে আশ্বস্ত করল রফিকুল। সে বলল, তেমন কোনো ঝামেলা হবে না ভাবি। তা ছাড়া ওরা এখন বিয়ে করা স্বামী খ্রী। এখানে কয়েকটা দিন থেকেই ওরা চলে যাবে।

ফরিদ প্রায় কেঁদে ফেলার-ভঙ্গিতে হাত চেপে ধরল দিলারার। দিলারা গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, আগে এই মেয়েকে গোসল টোসল করিয়ে পরিষ্কার করাতে হবে। এর চুল ধুতে হবে। সাজ-গোজ করিয়ে নতুন শাড়ি পরাতে হবে। নতুন বউ কখনো এভাবে কারো বাড়িতে যায়? তোমাদের মাথায় কি বুদ্ধিসুদ্ধি বলতে কিছু নেই।

দিলারার গলায় বিরক্তি। তবে তার কথা শুনে এখন রফিকুল এবং ফরিদেরও তা মনে হচ্ছে! দিলারা অবশ্য একটা সমাধান বের করুল। সে বাড়িতে গিয়ে তার অব্যবহৃত নতুন কয়খানা শাড়ি নিয়ে এলো। বিয়েতে রাজ্যের শাড়ি উপহার পেয়েছিল সে। তার বেশির ভাগই পরা হয়নি। দেখানোও হয়নি কাউকে। বাড়িতে তখনো কারো সাড়া-শব্দ নেই। মা আর রোকেয়া লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। ঘন কুয়াশা আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কারণে সুনসান চারপাশ। রাস্তা-ঘাটেও কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। যেন এই প্রবল হিমভোরে ঘর থেকে বের হতে চাইছে না কেউই। দোকানের পেছন দিকটা আরো নির্জন। খানিক ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়ালও রয়েছে। পারুকে সেখানে নিয়ে গেল দিলারা। ফরিদ আর রফিকুলকে বলল রাস্তায় নজর রাখতে। কেউ এলেই যেন তাকে জানানো হয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পারুকে শাড়ি পরিয়ে ফিরল দিলারা। লম্বা করে ঘোমটা টেনে দেওয়া হয়েছে তার মুখে, যাতে চট করে কিছু বোঝা না যায়।

দিলারা বলল, ওর নাম কী?

ফরিদ চট করে বলল, পারু। সে আগেই ভেবে রেখেছে, পারুর আল নামটাই সে বলবে। কারণ এই নাম শুনে হিন্দু-মুসলিম আলাদা করার উপায় নেই।

আমি ওকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। বলব, তোমরা ভোরের ট্রেনে ঢাকা থেকে এসেছে। এইজন্যই এত সকাল সকাল এসে পৌঁছেছে। আর স্টেশন থেকে আসার পথে ভ্যানগাড়ি উল্টে দুর্ঘটনা ঘটেছে। ঠিক আছে? এজন্যই ওর এখানে ওখানে। কেটে গেছে।

দিলারার কথা শুনে খানিক আশ্বস্ত হলো ফরিদ। সে বলল, চলেন তাহলে ভাবি।

উহু। বলে ফরিদকে নিবৃত করল দিলারা। তারপর বলল, তোমরা দুজন এখুনি বাজারে চলে যাও। দোকান খোলা মাত্র পারুর জন্য এই জিনিসগুলো কিনে আনবে। বলেই ফরিদের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল সে। সেখানে নানা জিনিসপত্রের ফর্দ। তারপর বলল, সঙ্গে একটা বড়সড় ব্যাগও কিনবে। ভুল হয় না যেন! ঢাকা থেকে নতুন বউ নিয়ে এক কাপড়ে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছো? এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে?

দিলারার কথা যুক্তিসংগত। ফরিদ আর রফিকুল চলে গেল বাজারে। তবে পারুকে নিয়ে নির্বিঘ্নেই ঘরে ফিরল দিলারা। তখনো কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। ফলে চট করে কোনো ঝামেলার মুখোমুখি হতে হলো না তাকে। ঘরে ঢুকেই পারুকে গোসল করতে পাঠাল সে। তারপর নিজের হাতে যতটা সম্ভব সাজিয়ে গুছিয়ে দিল। তারপর ভাত খেতে বসাল। এই পুরোটা সময় একটা কথাও বলেনি পারু। দিলারা মাঝেমধ্যে টুকটাক এটা সেটা জিজ্ঞেস করেছিল তাকে। কিন্তু পারু তার জবাব দেয়নি। দিলারা অবশ্য এতে মন খারাপ করেনি। বরং তার মনে হয়েছে, মেয়েটা ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। কোনো কারণে মানসিকভাবে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে। ফলে সহসাই স্বাভাবিক হতে পারছে না। আরো খানিকটা সময় তাকে দিতে হবে। ভাত খাওয়া শেষে পারুকে নিজের ঘরে এনে শুইয়ে দিল দিলারা। খানিক বিশ্রাম করে নিতে বলল। পারু অবশ্য বিছানায় গা এলাতেই তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

.

তার ঘুম ভাঙল বিকেলে। ততক্ষণে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করল প্রচণ্ড ব্যথায় আড়ষ্ট হয়ে আছে শরীর। দিলারা অবশ্য ঘরেই ছিল। সে বলল, শরীর খারাপ লাগছে?

পারু সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না। কয়েকবার এদিক-সেদিক তাকল। যেন বোঝার চেষ্টা করল, কোথায় আছে সে? এই ঘর, এই বিছানা, ঘরের সাজ সজ্জা কিছুই তার চেনা নয়। অপরিচিত, অনভ্যস্ত পরিবেশ। কিন্তু এখানে সে এলো কী করে? বিষয়টা চট করে মাথায় ঢুকল না তার। বেশখানিকটা সময় লাগল বুঝতে। প্রচণ্ড ব্যথায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। ভাঁজ করা দুই হাঁটুর ওপর মাথা চেপে ধরে দীর্ঘ সময় বসে রইল সে। একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকল গত কয়েকদিনের ঘটনা। আর ক্রমশই নিজেকে অসহায়, বিভ্রান্ত, নিঃস্ব এক মানুষ মনে। হতে লাগল তার। সত্যি সত্যিই এতসব করেছে সে? যেন ঘরগ্রস্ত এক মানুষ ঘোর কেটে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারছে। কিন্তু সেই আবিষ্কার তাকে আরো বেশি আড়ষ্ট, ভীত, অপাঙক্তেয় করে তুলছে।

দিলারা বলল, খুব খারাপ লাগছে?

পারু ওপর নিচ মাথা নাড়ল। দিলারা বলল, হাত-মুখ ধুয়ে এসে কিছু খেয়ে নাও, ভালো লাগবে।

পারু আলতো হাতে গায়ে জড়িয়ে থাকা কম্বলটা সরাল। তারপর উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করল তার মাথা ঘুরছে। সে এক হাতে শক্ত করে জানালার গ্রিলটা ধরল। দিলারা বলল, কী হয়েছে? তার কণ্ঠে শঙ্কা।

পার কথা বলল না। চোখ বন্ধ করে আবার বসে রইল। যেন ধাতস্ত হওয়ার চেষ্টা করছে সে। দিলার ছুটে এসে পারুর হাত ধরল। আর তখনই টের পেল, পারুর গায়ে জ্বর। সে তার ঘাড়ে, কপালে হাত রেখেও বোঝার চেষ্টা করল। গা পুড়ে যাচ্ছে। দিলারা বলল, তুমি শুয়ে থাকো। উঠো না। দেখি কী করা যায়?

পারু আবার শুয়ে পড়ল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই আবারও তলিয়ে গেল ঘুমে।

.

খবর শুনে অস্থির হয়ে উঠল ফরিদ। দিলারা বলল, এত অস্থির হয়ো না। দেখছি কী করা যায়।

সে রফিকুলকে পাঠাল ডাক্তার ডেকে আনতে। বাড়িতে ততক্ষণে ফরিদদের আসার কথা সবাই জেনে গেছে। রফিকুল আর দিলারা যতটা সম্ভব সবাইকে বুঝিয়ে বলেছে। ফরিদ আসলে রফিকুলকে চমকে দিতে চেয়েছিল। এ কারণেই আগেভাগে তার আসার কথা কাউকে কিছু জানায়নি। নতুন বউ নিয়ে সরাসরি চলে এসেছে। কিন্তু পথে ভ্যান দুর্ঘটনাটা তাদের এই আনন্দ ভ্রমণটাকে বিষাদে পরিণত করেছে। রফিকুলের মা নাজমা বেগম অবশ্য বিষয়টা নিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তিনি যতটা সম্ভব ফরিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন। খোঁজখবর নিলেন। তবে রোকেয়া খুবই কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। সে বারবার ভাবির কাছে নানা প্রশ্ন করেছে। এটা-সেটা জানতে চেয়েছে। বউ কেমন সেটা দেখতে চেয়েছে। দিলারা বলেছে, এমন তো নয় যে তারা আজই চলে যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন থাকবে এখানে। সুতরাং এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। ধীরে সুস্থে সবই জানতে পারবে সে।

এই কথা বলার অবশ্য কারণও রয়েছে। এতে করে দিলারা ইঙ্গিতে জানিয়ে দিতে পারল যে ফরিদরা এখানে বেশ কিছুদিন থাকবে। কথাটা সে সরাসরি শ্বশুর শাশুড়িকে বলার সাহস পাচ্ছিল না। এখন রোকেয়ার মাধ্যমে নিশ্চয়ই তারা জানতে পারবে। আতাহার মওলানাও অবশ্য তেমন কিছু বললেন না। তিনি সদা গম্ভীর মানুষ। সন্ধ্যায় সব শুনে বললেন, হঠাৎ করে এই ঠাণ্ডার মধ্যে এসে পড়ার কারণেই মনে হয় জ্বর-টর এসেছে। ঠিক হয়ে যাবে। নতুন বউ নিয়ে এসেছে, আদর-আপ্যায়ন করো।

তিনি বউ দেখতেও চাইলেন না। মাগরিবের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় কেবল ফরিদকে বললেন, আর যা-ই করো, নামাজ-রোজাটা ঠিক রাখো বাবা। দিন শেষে এটাই শুধু কাজে লাগবে।

ফরিদ জবাব দিল না। তবে বিগলিত হাসল। রাতে ডাক্তার নিয়ে এলো রফিকুল। ডাক্তার অবশ্য দেখে বিশেষ কিছু খুঁজে পেলেন না। তিনি স্বাভাবিক জ্বর, গা ব্যথার ওষুধ দিলেন। আর এই ঠাণ্ডার মধ্যে বাইরে বাইরে না ঘুরে যতটা সম্ভব ঘরে বিশ্রাম নিতে বললেন। সন্ধ্যার পর পারুকে ঘুম থেকে তুলে সামান্য কিছু খাইয়ে দিল দিলারা। তবে তখনো তাকে স্বাভাবিক মনে হলো না। যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে সে। চারপাশের মানুষ, পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে যেন স্পষ্ট কোনো ধারণাই নেই তার।

ভেতরে ভেতরে দুশ্চিন্তা হলেও খানিক স্বস্তিও অনুভব করছে ফরিদ। যে ভয়াবহ বিপদ থেকে পারু রক্ষা পেয়েছে, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। বিষয়টা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে তার। এখানে আসার পর থেকে পারুর সঙ্গে খুব একটা কথা বলারও সুযোগ পায়নি সে। দু-একবার যা দেখা হয়েছে, তাতে এটা সেটা জিজ্ঞেসও করেছিল ফরিদ। কিন্তু তার উত্তর দেয়নি পারু। তাকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। অসুস্থও। যেন মৃয় ফ্যাকাশে, বিবর্ণ এক মানুষ।

তবে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল ফরিদের সঙ্গে। বিষয়টা স্বাভাবিক হলেও তার জন্য খুবই অস্বস্তিকর। সে রফিকুলের ঘরে শোয়র প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এই সময়ে দিলারা এলো। বলল, যাও, সারাদিন তো বউয়ের সঙ্গে কথা বলারও সুযোগ পাওনি। এখন যাও। দেখো যদি রাতভর জাগিয়ে রাখতে পারো। বলে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসলো দিলারা।

ফরিদ থতমত খাওয়া গলায় বলল, কই যাব?

আমার ঘরে।

আপনার ঘরে কেন?

আমার ঘরে কেন মানে? অবাক কণ্ঠে বলল দিলারা। তোমাদের থাকার জন্য আমার ঘরটা ঠিক করা হয়েছে। আমি এ কয়দিন রোকেয়ার সঙ্গে থাকব।

না মানে…। ফরিদ ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছিলো না কী বলবে! এত কিছু চিন্তা করলেও এই বিষয়টা তার একদমই মাথায় ছিল না যে পারুর সঙ্গে রাতে তার একই ঘরে থাকতে হবে। সে মিনমিনে গলায় বলল, আপনার আর কষ্ট করে রোকেয়ার সঙ্গে থাকতে হবে কেন? আপনি পারুর সঙ্গেই থাকেন। আমি রফিকুলের সঙ্গে এ ঘরেই থাকছি। আমার কোনো সমস্যা হবে না।

দিলারা চোখ টিপে বলল, কেন? লজ্জা করছে? পালিয়ে বিয়ে করতে পেরেছো, আর এখন সবার সামনে বউয়ের সঙ্গে এক ঘরে থাকতে লজ্জা করছে? আহা রে পুরুষ…। বলে আফসোসের ভঙ্গিতে শব্দ করল সে। তারপর বলল, এত লজ্জা-শরমের কিছু নেই। এ বাড়িতে যারা আছে, তারা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক। তারা জানে, বিয়ের পর জামাই-বউ একসঙ্গে ঘুমায়। সঙ্গে আরো অনেক কিছুই করে…। বলে চোখ টিপল দিলারা ।

ফরিদ কী করবে বুঝতে পারছে না। সে খুবই অপ্রতিভ বোধ করছে। লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছে না। দিলারা যে এমন অশোভন ইঙ্গিত করতে পারে, এমন অশালীন কথা বলতে পারে, এটা সে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। দিলারা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই বলল, তুমি কিন্তু আমার দেবর। দেবরদের ভাবির সামনে এত লজ্জা পেলে হয় না ফরিদ মিয়া। যাও যাও। বউ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

ফরিদ বলল, ভাবি, ও তো অসুস্থ। এই রাত বিরাতে কখন কী লেগে বসে বলা তো যায় না। আপনিই ওর সঙ্গে থাকেন।

ধুর! এটা কী ধরনের কথা? জামাই-বউ আলাদা থাকতে হয় না। এতে মায়া মহব্বত কমে যায়। এই বয়সে তো আরো না। যাও যাও।

আপনি ঝছেন না ভাবি। রাত-বিরাত ওর কিছু দরকার হলে? আমি তো একটা ছেলেমানুষ, মেয়েদের তো অনেক ধরনের সমস্যা…। কথাটা বলতে গিয়েই ফরিদ বুঝল, ৫ ঠিক জায়গায় ঠিক কথাটা বলেনি। মেয়েমানুষ হলেও এখানে তো তার স্ত্রী হিসেবেই পারুর পরিচয়। ফলে সে এসব বলে আসলে পার পাবে না। বরং সমস্যা আরো ঘনীভূত হবে। সন্দেহ বাড়বে। খ্রীর যেকোনো গোপন ব্যাপার, যেকোনো সমস্যা তো তার স্বামীই সবার আগে জানবে। এখানে তো আড়ালের কিছু নেই। বরং এটাই সবচেয়ে সহজ-স্বাভাবিক ঘটনা। হতচকিত ফরিদ তার করণীয় নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারল না। বরং প্রচণ্ড দ্বিধা ও শঙ্কায় ভুগতে লাগল। এ অবস্থায় এখানে পারুর সঙ্গে সে কিছুতেই একঘরে থাকতে পারবে না।

ফরিদকে অবশ্য রক্ষা করল পারুই। ঘরের সব ঠিকঠাক করে দিয়ে মশারি টানাচ্ছিল দিলারা। পারু তখন জেগে আছে। তার বুক অবধি লাল কম্বলে ঢাকা। দিলারা বলল, এখন একটু ভালো লাগছে?

একটু।

জ্বর কমেছে?

হুম।

ব্যথা?

ব্যথাও।

আচ্ছা। রাতে আরো ভালো লাগবে।

কিন্তু বাকি রাত তো জেগে থাকতে হবে।

দিলারা ঝট করে তাকাল, তাই? বলে ঐ নাচিয়ে হাসল সে। এই শরীরেও এত শখ?

পারু তার ইশারা বুঝল না। সে বলল, আসলে সারাদিন এত ঘুমালাম, আর মনে হয় ঘুম হবে না। পারুর গলায় ক্লান্তি থাকলেও খানিক ভালো বোধ করছে সে। দিলারা হাসল, থাক, রাতে আর ঘুমাতে হবে না।

কেন?

পতিদেব আসছেন। এমন ঠাণ্ডার রাতে পতিদেবকে ঘুমিয়ে পড়তে দিলে জগজুড়ে স্ত্রী জাতির মান-সম্মান বলতে আর কিছু বাকি থাকবে না।

মানে? যেন আকাশ থেকে পড়ল পারু। পতিদেব কে?

পতিদেব কে মানে কী? মশারি টানানো শেষে বিছানার চারপাশে গুঁজে দিতে দিতে বলল দিলারা, এইটুকু জ্বরেই পতিদেবের নাম পরিচয়ও ভুলে গেছো? ফরিদ আসছে। সারাদিন তো ওকে পাইনি। রাতে যতটা সম্ভব পেয়ে নিও। বুঝলে? এই সব রাত কিন্তু পরে আর পাবে না। তখন আফসোস হবে। সময় গেলে সাধন হয় না। হা হা হা।

পারু এতক্ষণে ঘটনা আঁচ করতে পারল। আর সঙ্গে সঙ্গেই চমকে উঠল সে। ফরিদ আজ ভোরে রতনপুর থেকে ফেরার পথেই তাকে আবছা ধারণা দিয়েছিল এখানে কোথায়, কীভাবে থাকবে তারা। বিষয়টা মাথা থেকে চলেই গিয়েছিল তার। কিন্তু তাই বলে ফরিদের সঙ্গে একঘরে এক বিছানায় থাকতে হবে তাকে? বিষয়টা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারল না পারু। সে বলল, আজ আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন

আমি?

হুম।

কেন?

আমার না কিছু ভালো লাগছে না। কেমন ভয় ভয় লাগছে। আপনি থাকলে ভালো লাগবে।

পারুর কথায় কিছু একটা ছিল। দিলারা বলল, কিন্তু সেটা কি ঠিক হবে? নতুন বউয়ের কিন্তু জামাই ছাড়া থাকা ঠিক না।

পার কথা বলল না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার সেই দৃষ্টিতে মিনতি। ভয়। অনিশ্চয়তা। কিংবা আরো কিছু। দিলারা বলল, কিন্তু পতিদেব নিজেকে বঞ্চিত ভাববে না তো? পরে যদি কখনো এই নিয়ে আমাকে কথা শোনায়? তার কণ্ঠে দুষ্টুমি।

পারু এবারও কথা বলল না। তবে তার সেই না বলা কথাতেও যেন কী ছিল। দিলারা আর ঘাটাল না তাকে। সে ফরিদকে বলল, পারুর শরীরটা তো তেমন ভালো না। ও চাইছে, আমি ওর সঙ্গে থাকি রাতে।

এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। ফরিদ উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, সেটাই ভালো, সেটাই ভালো। কিছু লাগলে আমাকে ডাক দেবেন ভাবি। আমি জেগেই আছি।

দিলারা ভ্রুকুটি করে বলল, আমি তো আর পুরুষ মানুষ না যে মেয়ে লোকের সঙ্গে হঠাৎ রাত-বিরাতে থাকতে আমার বিশেষ কিছু লাগবে।

ফরিদ লজ্জায় নিজের ভেতর গুটিয়ে গেল যেন। তবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলোও সে। দিলারা যেমন একগুয়ে মানুষ, তাতে আজকের এই ঘটনায় মুক্তি পাবে বলে ভাবেনি সে। কী করবে তাও ভেবে পাচ্ছিল না। কিন্তু ভাগ্যের এমন অনাকাক্ষিত সহায়তায় যারপরনাই আপুত ও কৃতজ্ঞ বোধ করতে লাগল ফরিদ।

.

অবশ্য ভাগ্য তাকে ঠিক কতক্ষণ এমন সাহায্য করবে এই নিয়ে দুশ্চিন্তাও হচ্ছিল তার। রাতে ঘুমানোর আগে রফিকুলকে সেটা বললও, শুনেছিস, আজ কী হয়েছে?

কী?

দিলারা ভাবি বলছিল আমাকে পারুর সঙ্গে ওই ঘরে থাকতে।

তাই নাকি! একটু যেন চমকাল রফিকুল। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনা বুঝে ফেলল সে। তারপর হেসে বলল, পড়েছে মোঘলের হাতে, খানা খেতে হবে সঙ্গে। বিয়ে যখন করেছিস, তখন আর আলাদা ঘরে থাকবি কী করে? লোকে এই নিয়ে কথা বলবে না?

ধুর। তুই বুঝতে পারছিস না সমস্যা?

আমি না হয় বুঝতে পারলাম। কিন্তু তাতে লাভ কী? অন্যদের বুঝতে হবে না?

হুম। গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল ফরিদ। বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত সে। আজ না হয় কোনোভাবে এড়ানো গেছে। কিন্তু কাল বা পরশু কী করবে সে? প্রসঙ্গটা তুলল রফিকুলও। বলল, কাল কী করবি?

সেটাই ভাবছি।

কী আর করা। আজ হোক, কাল হোক, বিয়ে তো করবিই। দুদিন আগে আর পরে। নাকি?

হুম। কিন্তু তাই বলে এখুনি…। তা ছাড়া পারুর মানসিক অবস্থাটা একবার ভেবে দেখেছিস?

ওটা আসলে যতই ভাবিস, কোনো লাভ নেই।

কেন?

কারণ একজনের মানসিক অবস্থা কখনোই অন্যজন পুরোপুরি বুঝতে পারে ্না। ও যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে বা যাচ্ছে, সেটা কি কোনোভাবেই অন্য। কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব?

সম্ভব না হোক। কিন্তু তাই বলে চেষ্টাও করব না?

হুম। করবি। আর সেজন্যই তোর এখন ওকে বেশি বেশি সময় দেয়া দরকার।

কিন্তু এখানে সবাই আছে। আর আজ কী পরিস্থিতি হলো, দেখলিই তো! এখন এত মানুষের মধ্যে আলাদা করে কথা বলতে, সময় দিতে কেমন লাগে না?

কেমন লাগে? লজ্জা? বলে হাসল রফিকুল।

ঠিক তা না। আশপাশে সবাই তো আছে তাই না?

হুম। তা আছে। আর এই জন্যই তোর উচিত এই আলাদা থাকার সুযোগটা কাজে লাগানো।

মানে?

মানে রাতে একসঙ্গে থাকা! বলে আবারও হাসল রফিকুল।

ফরিদ এবার সত্যি সত্যি রেগে গেল, বুঝলাম না। তোদর সবার মাথায় কেন ওই এক জিনিস, হ্যাঁ? এখানে তো আমরা মজা করতে আসিনি, না? ওসবের অনেক সময় পাওয়া যাবে।

একসঙ্গে থাকলেই যে ওসব করতে হবে, তা তো না। তা ছাড়া, বাড়ির আর সবার কথাটাও মাথায় রাখিস। কেউ সন্দেহ করে এমন কিছু করিস না। আর দিলারা ভাবি কিন্তু খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। যা-ই করবি, খবরদার। খুব সাবধান।

রফিকুলের কথায় ফরিদ চুপ করে গেল। আসলেই, রফিকুল তো ভুল কিছু বলেনি। এ বাড়ির সবাই জানে তারা নবদম্পতি। আর কোনো নবদম্পতিই রাতে আলাদা ঘরে থাকে না। বিষয়টা দৃষ্টিকটু। তা ছাড়া দিলারা তো দেখেছেই, তারা । কী অবস্থায় এখানে এসেছে। এখনো তাকে পেছনের ঘটনা কিছু বলা হয়নি। ফরিদ যদিও কিছু গল্প ভেবে রেখেছে। সময় সুযোগ বুঝে দিলারাকে বলবে সে। কিন্তু এরপর কী করবে? পারুকে নিয়ে এই অবস্থায় কোথায় যাবে সে?

ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে ফরিদের। গতকালের ঘটনায় তার ওপর দিয়েও কম কিছু যায়নি। দীর্ঘ পথ পায়ে হাঁটার পর শেষ রাতের দিকে হঠাৎই পাটবোঝাই এক ট্রাক পেয়ে গিয়েছিল তারা। সেই ট্রাকে চড়েই গিয়েছিল রতনপুর। ওই ট্রাক না পেলে কী হতো কে জানে! শরীরটা ভেঙে পড়তে চাইলেও তীব্র দুশ্চিন্তায় চোখের পাতা এক করতে পারছে না সে। ভাবনার এক অতল সমুদ্রে যেন ক্রমশই ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু কোথাও উত্তরণের কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না।

মামা নিশ্চয়ই এতক্ষণে তার চিঠি পেয়ে গেছেন। এরপর আর কখনো ভুবনডাঙা ফিরতে পারবে না সে। আর পারুর মা-বাবা? কী করছে তারা এখন? কখন টের পেয়েছে যে পারু নেই?

ফরিদের মাথা কাজ করছে না। প্রচণ্ড ক্লান্তির কারণেই ঘুমিয়ে গেল সে। কিন্তু সারাটা রাত ভয়ংকর সব দুঃস্বপ্ন দেখল। পারুর জন্যও দুশ্চিন্তা হতে লাগল খুব। কী করছে মেয়েটা? কী ভাবছে? এই মুহূর্তে তার পাশে থাকাটা খুব দরকার তার। তাকে বুঝিয়ে দেয়া দরকার যে নিরাপদ জাহাজ থেকে উথালপাথাল ঝাবিক্ষুব্ধ এক সমুদ্রে সে নেমে পড়েছে, সেই সমুদ্রে সে একা নয়। যে মানুষটার জন্য এমন ভয়ংকর সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে, সেই মানুষটা তার সঙ্গেই আছে। শেষ মুহূর্ত অবধি আছে।

১৩

মহিতোষরা চলে যাওয়ার রাতেই ঘটনা জানতে পারলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তিনি খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। সেদিনও উঠেছেন। তখনো ভোরের আলো ঠিকঠাক ফোটেনি। ঘরের দরজা খুলে বাইরে বের হয়েছেন। উঠানে দাঁড়িয়ে হাই তুলে খানিক আড়মোড়া ভাঙার চেষ্টা করলেন। গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিলেন শরীরে। হাত-মুখ ধুতে পুকুরপাড়ে যাবেন। তবে এই শীতের ভোরে পুকুরের পানি থাকে বরফের মতো ঠাণ্ডা। খানিক গরম পানি হলে ভালো হতো। সমস্যা হচ্ছে এই সময়ে গরম পানি পাবেন কোথায়! তবে নলকূপটা অনেকক্ষণ চাপলে খানিক গরম পানি পাওয়া যায়। তিনি নলকূপের দিকে যাবেন বলে মনস্থির করলেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন তিনি। উঠানের এক কোণে সাদা জামা পরা কে যেন দাঁড়িয়ে আছে! এই অসময়ে কে ওখানে? জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া খুব বেশি সময় নিলেন না ভাবার। চট করে ঘরে ঢুকে গেলেন। তারপর সাবধানে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

তার শত্রুর অভাব নেই। নানাভাবে তিনি শত্রু তৈরি করেছেন। তবে কৌশলী আর ধুরন্ধর মানুষ বলেই এখনো টিকে আছেন। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করার পরও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বহালতবিয়তে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। সমস্যা হচ্ছে, এসব করতে গিয়ে মিত্র যেমন বানিয়েছেন, তেমনি শত্রুও কম বানাননি। তা ছাড়া নিজের মনে যেমন সারাক্ষণ অন্যের অনিষ্ট চিন্তা করেন, তেমনি আতঙ্কে থাকেন যে অন্যরাও বোধহয় সারাক্ষণ তার ক্ষতি করার চেষ্টায় থাকে। তিনি আলগোছে জানালার ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখলেন অন্ধকারেই সাদা অবয়বটা তার দিকে এগিয়ে আসছে। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল তাঁর। কী ওটা? মানুষ না অন্য কিছু? ভয়ে জড়সড় জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বিড়বিড় করে দোয়া দরুদ পড়তে থাকলেন। এই মুহূর্তে এছাহাকের গলাটা শুনতে পেলেন তিনি, ভূইয়া সাব, আমি এছাহাক। এছাহাক আমি।

এছাহাকের গলা শুনে আরো ভড়কে গেলেন তিনি। এই অসময়ে এছাহাক কেন তার বাড়িতে? কোনো অশুভ সংবাদ নয় তো? কিন্তু কী অশুভ সংবাদ হতে পারে, তা তিনি ভেবে পেলেন না। তা ছাড়া, এছাহাক তাঁর নিজের লোক হলেও তিনি আসলে জগতে কাউকেই বিশ্বাস করেন না। জীবনভর অন্যের বিশ্বাস ভেঙেছেন তিনি। ফলে এখন সারাক্ষণ মনে হয়, অন্যরাও বোধহয় তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। তিনি ভীত গলায় বললেন, এই সময়ে এইখানে কী এছাহাক?

দরজাটা খোলেন। জরুরি কথা আছে।

দরজা খোলা যাবে না। যা বলার ওখান থেকেই বল।

সর্বনাশ হয়ে গেছে ভূঁইয়া সাব।

কী সর্বনাশ?

পাখি তো উড়ে গেছে।

এই শেষ রাতে এমন হেঁয়ালি মার্কা কথা একদমই পছন্দ হলো না জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি এখন যাও এছাহাক। আমি একটু পরই আড়তে যাব। সেইখানে আসো। সব শুনব।

তখন শুনলে তো হবে না। শুনতে হবে এখন। যদি এখনো কোনো ব্যবস্থা করা যায়।

কী ব্যবস্থা? কী হয়েছে?

মহিতোষ মাস্টার নাই। সে বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে গেছে!

বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে গেছে মানে? কই গেছেঃ জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কণ্ঠে দ্বিধা।

তাতো জানি না।

মানে কী? কী বলো তুমি? তাঁর না দলিল-পর্চা আনতে যশোর যাওয়ার কথা ছিল?

সে আমারে ফাঁকি দিছে ভূঁইয়া সাব। বিরাট বড় ফাঁকি দিছে। সে যে তলে তলে এত বড় হারামি, সেইটা তো বুঝি নাই।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এবার আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। তিনি ঝট করে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তারপর বললেন, ঘটনা কী? খুলে বলো।

এছাহাক ঘটনা খুলে বলল। সে মহিতোষ মাস্টারকে ট্রেনে বিদায় দিয়ে আর দেরি করেনি। সেখান থেকে প্রথমে বাড়ি গেল। হাত-মুখ ধুয়ে রাতের খাবার খেল। তারপর নতুন ধোয়া পাঞ্জাবিটা পরে খানিক সুগন্ধি আতরও ছিটিয়ে নিল গায়ে। তারপর একটা পাঁচ ব্যাটারির বড় টর্চলাইট হাতে ঘর থেকে বের হলো। তার মনটা তখন ফুরফুরে। উলের মাফলারে গলা, মুখ পেঁচিয়ে গুন গুন করে গানও ধরল সে। তার সব অপকর্মের সঙ্গী মতি মিয়াকেও সঙ্গে নিয়ে নিল। কিন্তু মহিতোষের বাড়ির উঠানে এসে হঠাৎ দমে গেল সে। মনে মনে প্রমাদ গুনল। এই এতরাতেও মহিতোষের ঘরের সবগুলো দরজা-জানালা হাট করে খোলা। বাইরে বাঁশের আড়ায় কাপড় ঝোলানো। মৃদু হাওয়ায় কাপড়গুলো দুলছে। দু খানা চেয়ার দরজার সামনে। তার একখানার হাতলে গামছা রাখা। যেন এই মাত্র কেউ রেখে গেছে। ঘরের ভেতর হারিকেন জ্বলছে। তারপাশে একখানা কেরোসিনের কুপিও। তাতে আলো জ্বলছে। তবে দীর্ঘসময় ধরে জ্বলছে বলে আলো ক্রমশই স্তিমিত হয়ে এসেছে। এছাহাকের মনে আচমকা কু-ডাক ডাকতে লাগল। এই এতরাতে কী হচ্ছে এখানে? যেন আয়োজন করে জানানোর চেষ্টা চলছে, এই বাড়িতে আজ বিশেষ কোনো উৎসব। যেন এখানে আজ কেউ ঘুমায়নি। সবাই সরব, নির্ঘুম, মুখর।

তার উষ্ণ শরীর হঠাৎ শীতল হয়ে এলো। কয়েকবার পারুকে নাম ধরে ডাকল সে। অঞ্জলিকেও। কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে কেউ কোনো সাড়া দিল না। ভীত, উদ্বিগ্ন এছাহাক মতি মিয়ার চোখের দিকে তাকাল। তার চোখেও সতর্ক দৃষ্টি। ইশারায় তাকে কিছু বোঝাল সে। তারপর সাবধানে পা বাড়াল ঘরের দিকে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে ঘরে কেউ নেই। মহিতোষ তাকে বোকা বানিয়েছে।

পরের বেশ খানিকটা সময় হতবুদ্ধির মতো ঘরটা তন্নতন্ন করে খুঁজল এছাহাক আর মতি মিয়া। কিন্তু বাইরে থেকে দেখা ভর ভরন্ত ঘরখানা যে ভেতরে এমন শূন্য হয়েছিল, তা কে জানত? দু খানা চৌকি, পুরনো কাপড়-চোপড়, হাঁড়ি-পাতিল আর কিছু ভাঙাচোরা আসবাব ছাড়া কোথাও কিছু নেই। কবে থেকে চুপি চুপি সব সরিয়েছে মহিতোষ? আজ রাতের ট্রেনে তারা সবাই তাহলে একসঙ্গেই ভুবনডাঙা ছেড়েছে? সে নিজে যে ট্রেনে তুলে দিয়ে এসেছিল মহিতোষ আর তার মাকে, সেই একই ট্রেনে? চোখের সামনে এই সব কিছু ঘটেছে অথচ তার কিছুই সে দেখতে পায়নি। এছাহাকের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, তার মতো ধূর্ত, ধুরন্ধর এক মানুষকে ওই আপাতদৃষ্টিতে সহজ-সরল মহিতোষ মাস্টার এমন করে ঠকিয়েছে! হতভম্ব এছাহাক অন্ধকার ঘরের প্রতিটি কোণে আলো জ্বালিয়ে দেখল। কোথাও কেউ নেই। যেন শূন্য, পরিত্যক্ত এক পোড়া বাড়ি। কী অদ্ভুত, খানিক আগেই সরব সরগরম মনে হওয়া বাড়িটা মুহূর্তেই যেন হয়ে গেছে প্রাণহীন, জরাজীর্ণ। কেবল মানুষ থাকে বলেই একখানা কাঠের কাঠামো ঘর হয়ে ওঠে। আর মানুষ না থাকলে সেই মায়াময় ঘরখানা মুহূর্তেই হয়ে যায় বিরান প্রান্তর!

এছাহাকের বুঝতে একটু সময়ই লাগল যে মহিষেরা এ বাড়ি ছেড়ে রাতের অন্ধকারে চিরতরে চলে গেছে। কারণ, সে কিছুতেই কোনো যুক্তিতেই হিসেব মেলাতে পারছিল না যে এই বিশাল বাড়ি, জমি-জমা, পুকুর, ঘর এসব ছেড়ে তারা গোপনে রাতের অন্ধকারে এভাবে পালিয়ে গেল? যাওয়ার আগে সবকিছুর একটা বন্দোবস্ত তো করে যাওয়ার কথা! তা সে দশ টাকা হোক, আর পাঁচ টাকা। একদম বিনা হিসেবে সবকিছু এভাবে ফেলে রেখে যাওয়ার তো কথা না! বিষয়টা কোনোভাবেই এছাহাকের মাথায় ঢুকল না। না-কি এর আড়ালে অন্য কোনো ঘটনা আছে? কিন্তু কী সেই ঘটনা? এছাহাক অনুমান করতে পারল না। তবে সে নিশ্চিত, এ গাঁয়ে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া ছাড়া এই মুহূর্তে এই এত এত জমি কেনার সামর্থ্য আর কারো নেই। নেই সাহসও। সকলেই জানে, এই জমির ওপর শকুনের নজর পড়েছে। তাছাড়া সে নিজেও চারদিকে সতর্ক নজর রেখেছিল। তাহলে?

এছাহাক দীর্ঘসময় শূন্য বাড়ির নির্জন, নিস্তব্ধ উঠানের মাঝখানে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল। তার মাথা কাজ করছে না। একটার পর একটা বিড়ি ধরিয়েও চিন্তার গুমোট হয়ে থাকা ঘরের কোনো দরজা-জানালাই সে খুলতে পারল না। তবে সব দেখে-শুনে মতি মিয়া তাকে তাৎক্ষণিক জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দিল। ঘটনা এখুনি না জানালে সমূহ বিপদ। কথাটা এছাহাকও যে ভাবেনি তা নয়। সমস্যা হচ্ছে এই এতরাতে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে এই খবর সে কীভাবে দেবে?

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়েছিল সে। কিন্তু ডাকতে সাহস হয়নি। এখন অবশ্য হড়বড় করে সব ঘটনা খুলে বলল। শুনে স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ফজরের আজান হলেও ওজু করতে যাওয়ার আর কোনো আগ্রহ দেখা গেল না তার মধ্যে। এছাহাক জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া হঠাৎ চিৎকার করে বললেন, লোকজন খবর দে। এক্ষণ।

এছাহাক লোকজন খবর দিল। শীতের সকালে চারদিকটা গুমোট অন্ধকারে ছেয়ে আছে। প্রায় দশ-বারোজনের দলটা যখন মহিতোষের বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়াল তখন তার ঘরের খোলা দরজায় আয়েশি ভঙ্গিতে দুটো কুকুরকে শুয়ে থাকতে দেখা গেল। যেন এই বাড়ি, এই ঘর তাদের অভয়াশ্রম। মানুষের দখলদারিত্বের কারণেই এতদিন তাদের এমন অনায়াস পরিভ্রমণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু আজ এই ভোরে তারাও যেন জেনে গেছে, এই বাড়ির মালিকানা এখন অনিশ্চিত, দোদুল্যমান। এখানে এখন শক্তি আর দখলদারিত্বের খেলা চলবে। ফলে। তারাও তাদের এই এতদিনকার আক্ষেপ খানিক মিটিয়ে নিতে চাইছে। খানিক দাবি আদায় করে নিতে চাইছে। ঘরের এ দুয়ার থেকে ও দুয়ার অবধি হেলেদুলে আয়েশি ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়াল তারা। তারপর কর্তৃত্বপূর্ণ অভ্যস্ত ভঙ্গিতে। মেঝের একপাশে পড়ে থাকা আধ-খাওয়া ভাত-তরকারির হাড়িগুলোতে মুখ ডুবিয়ে স্বাদ পরখ করে নিতে চাইল। নাক কুঁচকে ঘ্রাণ নিতে চাইল । কয়েকবার জিভ বের করে চেটে দিল। তবে তাদের দুজনের কারোই যেন বেশিক্ষণ এসব মনঃপূত হলো না। যেন এই উচ্ছিষ্ট ভোগের দিন তাদের ফুরিয়েছে। এই গৃহ ও গৃহস্থের অবিসংবাদিত স্বত্ব এখন তাদের। এই অন্দর ও আহারের কর্তা এখন তারা। ফলে তাড়াহুড়োর কিছু নেই। বরং সময় নিয়ে এসব তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা যাবে। ফলে কপালকুঞ্চিত অবহেলায় মুখ ফিরিয়ে নিল তারা। তারপর দুই দরজার পথ রোধ করে ঠাণ্ডা কনকনে মেঝেতে শরীর এলিয়ে শুয়ে রইল।

খানিক বাদে কেউ একজন হুসহাস শব্দে তাদের গৃহচ্যুত করতে চাইল। কিন্তু বহু প্রতীক্ষিত এই স্বত্ব যেন কিছুতেই ত্যাগ করতে চাইছিল না তারা। ফলে দুজন লোককে তেড়ে আসতে হলো। তাদের হাতে লাঠি। সেই লাঠির আঘাতে ব্যথিত, বিস্মিত কুকুরগুলো তীব্র চিঙ্কারে প্রতিবাদ করতে চাইল। কিন্তু লাভ হলো না। ভোরের নির্জনতা ভাঙা ঘেউ ঘেউ শব্দে তারা তাদের ক্ষণস্থায়ী আবাস ত্যাগ করতে বাধ্য হলো। কে জানে, মহিতোষ মাস্টার এই দৃশ্য দেখলে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন কী না! কারণ শেষবারের মতো এই বসতভিটা ছেড়ে যখন তিনি রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেলেন, তখনো প্রতিবাদ করার সাহস সঞ্চয় করতে পারেননি। ওই কুকুরগুলোর মতো চিৎকার করে নিজের অক্ষমতা, কান্না, যন্ত্রণা কিংবা অধিকারটুকুও প্রকাশ করতে পারেননি।

.

সব দেখে শুনে মনে মনে সতর্ক হয়ে উঠলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। মহিতোষ মাস্টার তার এই বিশাল বাড়ি-ঘর, জমি-জমা কোনো কারণ ছাড়াই এভাবে ফেলে রেখে গেছেন, এটা তার বিশ্বাস হচ্ছে না। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো না কোনো ঘটনা আছে। কিন্তু সেই ঘটনা কী? আপাতদৃষ্টিতে সবকিছু সহজ-শান্ত মনে হচ্ছে। কিন্তু এই জনমানবহীন, শ্মশানের মতো নিষ্প্রাণ বাড়ির আড়ালে অন্য কোনো ঘটনা না থেকেই পারে না। এবং জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া অনুমান করছেন, সেই ঘটনা তার জন্য সুখকর কিছু নয়।

মহিতোষ মাস্টার দিনের পর দিন মুখ বুজে তার সকল অত্যাচার সহ্য করেছেন। রাতের আঁধারে চুপিচুপি পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু যাওয়ার আগে ঠিক কী খেলাটা খেলে গেছেন তিনি? অনেক ভেবেও জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া সেই চালটি ধরতে পারলেন না। এই না ধরতে পারাটা তার ভেতরে তীব্র এক অস্বস্তির পাহাড় গেড়ে দিল। তবে ধূর্ত জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এটিও জানেন, বিলম্ব মানেই বিভ্রাট। ফলে তিনি সেদিনই মহিতোষের ঘর-বাড়ি দখল নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এছাহাককে পাঠালেন ভূমি অফিসের তহশিলদারের কাছে। যত দ্রুত সম্ভব এই জমির কিছু প্রাথমিক কাগজপত্র তিনি নিজের নামে তৈরি করতে চান। আশপাশের মানুষ, এলাকাবাসীর কাছে যেন প্রমাণ করা যায় যে যাওয়ার আগে মহিতোষ মাস্টার তার বসতভিটাসহ বাড়ি-ঘর, ফসলিজমি সব বিক্রি করে দিয়ে গেছেন। পরে সময়-সুযোগ বুঝে পাকা কাগজপত্র তৈরি করে ফেলা যাবে। তবে এখন এই মুহূর্তে যেটি জরুরি, সেটি হচ্ছে এই সবকিছুর দখল নিশ্চিত করা।

১৪

রাতে ভালো ঘুম না হলেও খুব ভোরেই উঠে পড়তে হলো ফরিদের। রফিকুলের বাবা আতাহার মওলানা ফজরের আজানের আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন। কারণ তিনি নিজে মসজিদে গিয়ে আজান দেন। তবে এই যাওয়ার আগে ঘরের সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন তিনি। আজও তুললেন। রফিকুল অবশ্য বাবার ডাকে সাড়া দিয়ে উষ্ণ কম্বলের ওম ছেড়ে বের হলো না। সে ফিসফিস করে ফরিদকে বলল, তাড়াতাড়ি ওঠ। না হলে আব্বা কিন্তু ডেকে ডেকে পাড়া মাথায় তুলবে।

ফরিদ বলল, তুই উঠবি না?

উঠব, উঠব। আগে তুই ওঠ। তুই এ বাড়ির মেহমান না? গুরুজনের প্রতি তোর একটা সম্মান-ভক্তির ব্যাপার আছে না?

ফরিদ কথা বলল না। চুপ করে কম্বলের ভেতর গুটিশুটি মেরে শুয়ে রইল। রফিকুল তাকে ধাক্কা মেরে বলল, ওঠ, ওঠ। আব্বাকে খুশি রাখা কিন্তু তোর জন্য খুব জরুরি।

রফিকুলের কথা সত্য। ফরিদ এখনো জানে না, এ বাড়িতে ঠিক কতদিন তাকে থাকতে হবে! তবে যত দিনই সে থাকুক না কেন, কোনোভাবেই আতাহার মওলানার বিরাগভাজন হওয়া যাবে না। সে বিছানা ছেড়ে উঠল। কাঁপতে কাঁপতে কনকনে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ওজু করল। আতাহার মওলানা আজান দিয়ে আবার বাড়িতে এলেন। খানিক পরেই নামাজ শুরু হবে। তিনি জানেন, এই শীতের ভোরে একবার ডাকলে কেউ ঘুম থেকে উঠতে চায় না। বারবার ডাকতে হয়। ফলে তিনি জামাত শুরুর আগেই আরেক দফা ডাকতে এলেন। বাড়ির সঙ্গেই মসজিদ হওয়ায় এই সুবিধা হয়েছে। দরজার কাছে দাঁড়িয়েই তিনি উঁচু গলায় বলতে শুরু করলেন, কোনো মোসলমানের ঘর মনে হয় এটারে? মনে হয়? ঘরে অত বড় এক পোলা, সে নিজে গিয়া মসজিদে আজান দেবে। তা না। ঘুমের ভান ধরে শুয়ে থাকবে। হাজারবার ডাকলেও সাড়া দেবে না। এটা কোনো কথা? মোসলমানের ঘরে ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে সবাই নামাজের জন্য উঠে যাবে। আর এরা এখনো কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমায়! আরে, এই শান্তি শান্তি না। আসল শান্তি মরণের পর। শান্তিও। এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করার শাস্তি তোরা জানস না?

আতাহার মওলানা হয়তো আরো কিছু বলতেন। কিন্তু তার আগেই দরজার সামনে দাঁড়ানো ফরিদকে দেখে তিনি থেমে গেলেন। একই সঙ্গে অবাকও পরিতৃপ্ত বোধ করলেন। ফরিদের মাথায় টুপি। তার সদ্য ঘুম ভাঙা মুখে তখনো ওজুর ফোঁটা ফোঁটা পানি লেগে আছে। দেখতে লাগছে শান্ত, স্নিগ্ধ। তিনি খানিক তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বললেন, আসো বাবা, আসো। মানুষ বলে সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। কিন্তু আমার রফিকুলের ঘটনা তো দেখি উল্টা। সে তোমার মতো ছেলের সঙ্গে থেকেও কিছু শিখতে পারল না। আহারে। এইজন্যই কথায় আছে–যার হয়, তার নয়তেই হয়। আর যার হয় না, তার নব্বইতেও হয় না। আলেমের ঘরে সে জালেম হইছে।

ফরিদ কিছু বলল না। তবে আতাহার মওলানার রাগের উত্তপ্ত আগুনে যে খানিক শীতল পানি পড়েছে তা সে বেশ আঁচ করতে পেরেছে। তিনি আরো দুইবার রফিকুলকে ডাকলেন। ডাকলেন রোকেয়া এবং দিলারাকেও। তার স্ত্রী নাজমা বেগমের শরীর খারাপ বলে আর তাঁকে ডাকাডাকি করলেন না। তবে নিজের পুত্রকে নিয়ে খুব উষ্ম প্রকাশ করলেন। নামাজ শেষে ফরিদকে নিয়ে খানিক হাঁটতেও বের হলেন তিনি। নিজের জমি-জমা দেখালেন। যেসব সমাজকল্যাণমূলক কাজ তিনি করছেন, সেগুলোর বিশদ বিবরণও দিলেন। ফরিদ অবশ্য এই ঠাণ্ডায় আর বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে চাইছিল না। কিন্তু উপায় নেই। মনোযোগী শ্রোতার ভান ধরে সব শুনতে হলো তাকে। আতাহার মওলানা বললেন, আরেকটা কথা বাবা। যদি কিছু মনে না করো, তাহলে বলতে চাই। আমি তো তোমার বাবার মতোই… এইজন্যই বলছি…।

জি চাচাজি, জি। অবশ্যই বলবেন।

না… মানে… হয়েছে কী, নিজের সন্তান ঠিক না করে তো অন্যের সন্তান ঠিক করা যায় না। তারপরও বলি, যেহেতু রফিকুল তোমার বন্ধু। ওকে একটু বুঝিয়ো। এই বয়সে যদি ঠিক কাজটা না করা যায়, তাহলে বাকি জীবনে যত কাজই করুক

কেন, তা আর ঠিকঠাক হয় না। তুমি তো এখন বিয়ে-শাদি করছো। ওর ও তো করতে হবে। হবে না?

জি চাচাজি।

এখন বিয়ে করাটাই তো আর শেষ কথা না। দায়িত্ব নিতে পারাটা হলো আসল। তাই না?

জি।

এই যে ধরো তুমি বিয়ে করছে। এখন তোমার অনেক দায়িত্ব বাড়ছে না?

জি।

এখন সেই সব দায়িত্ব তোমার ঠিকঠাক পালন করতে হবে। সেগুলো পারলেই তুমি স্বামী হিসেবে সফল। প্রত্যেক পুরুষ মানুষের এটা দায়িত্ব। স্ত্রীর যেমন স্বামীর প্রতি দায়িত্ব আছে, তেমনি স্বামীরও তো স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব আছে? আছে না?

জি।

স্বামীর দায়িত্ব হলো আরো বেশি। সে অনেকটা গার্জিয়ানের মতো। বুঝলা? স্ত্রীর ভালো-মন্দ দেখা তার দায়িত্ব।

ফরিদ মাথা নাড়ল। আতাহার মওলানা বললেন, তোমার এখন প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব হলো তোমার স্ত্রীকে ধর্ম-কর্ম, আদব-কায়দা শেখানো। না… মানে… সে যে এসব জানে না, তা তো না। তার বাবা-মাতো তাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে। তারপরও, মেয়েরা বাপের বাড়ি থাকে আদরে-আহ্লাদে। বোঝোই তো, সেইখানে ঠিকভাবে চাইলেও সবকিছু শিখানো যায় না। এইজন্য স্বামীর কিন্তু অনেক দায়িত্ব, বুঝলা?

জি।

কাল রাতে দেখলাম তোমার স্ত্রী বসে আছে। তার মাথায় কাপড় নাই। গায়ের ওড়নার ঠিক নাই। এই ঘরে তুমি ছাড়াও কিন্তু আরো পুরুষ মানুষ আছে। আছে না?

জি।

তাহলে? সে হয়তো ছোট মানুষ, অত কিছু খেয়াল করে নাই। কিন্তু তোমার দায়িত্ব, এইসব শিখাই দেওয়া। ভালো-মন্দ বোঝানো । তারপর নামাজটাও তো পড়তে হবে। হবে না?

ফরিদ জি বলতে গিয়েও থমকে গেল। এই প্রথম তার মনে হলো, এ বাড়িতে পারুকে নিয়ে থাকতে হলে তাকে এমন আরো অসংখ্য বিষয়ের মুখোমুখি হতে হবে, যা সে আগে কখনো চিন্তাই করেনি। সে বিড়বিড় করে বলল, আসলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেল তো। এইজন্য এসব খেয়াল ছিল না চাচাজি।

না না। সেটা ঠিক আছে। মানুষের রোগ-বালাই হলে সাত খুন মাফ। কিন্তু বাবা নামাজটা কিন্তু পড়তেই হবে। ওতে কিন্তু কোনো মাফ নাই। এখন না পড়লেও পরে কাজা পড়তে হবে। তা ছাড়া, সে তো নামাজ না পড়ার মতো অসুস্থ না। এটা একটু বুঝাই বলবা। ঠিক আছে? এটা তোমার দায়িত্ব।

জি জি।

এই যে তুমি আমার সঙ্গে নামাজে আসছে, আমি যে কী খুশি হয়েছি, তোমাকে বোঝাতে পারব না বাবা। বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আতাহার মওলানা। তারপর বললেন, অথচ দেখো, নিজের ছেলাটারে কোনোভাবেই মানুষ বানাতে পারলাম না।

ফরিদ কথা বলল না। তার মাথায় বিষয়টা ঢুকে গেছে। খানিক বাদেই দিনের আলো ফুটবে। তারপর সময় গড়ালেই দুপুর। জোহরের নামাজ। তখন? তখন কী করবে পারু? নিশ্চুপ ফরিদ ভেতরে ভেতরে খুবই উদ্বিগ্ন বোধ করছে। তা ছাড়া মুলমান ঘরের রীতিনীতি অনেক কিছুই পারুর জানার কথা নয়। যদি কোনোভাবে সেসব দিলারা টের পেয়ে যায়, তাহলে ভয়ানক কাণ্ড ঘটে যাবে। পরিস্থিতি যতটা সহজ সে ভেবেছিল, আদতে তত সহজ নয়। বরং খুবই ভয়ংকর এক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সে। সামনে আরো কী কী অপেক্ষা করছে কে জানে?

আতাহার মওলানা বললেন, তুমি বাড়ি যাও। আমি দেখি নদীর ঘাটে গিয়ে। তোমাদের জন্য কিছু মাছ-টাছ আনতে পারি কী না? নদীর ফ্রেশ মাছ। শীতের দিনে নদীর আইড় মাছ আর বেগুন-টমেটোর তরকারি জিভে লেগে থাকে, বুঝলা?

জি চাচাজি!

.

ফরিদ বাড়ি এসে দেখে রফিকুল কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। তবে দিলারা ঘুম থেকে উঠে গেছে। সে বলল, পারু তো এখনো ওঠে নাই। তোমারে একা কি নাশতা বানিয়ে দেব?

ফরিদ বলল, না না। আগে ও উঠুক। তারপর একসঙ্গে খাব।

আহা, বউয়ের জন্য এত দরদ। আর একসঙ্গে ঘুমাইতে শরম, না? সে টিপ্পনী কাটল।

ওর শরীর এখন কেমন? ফরিদ কথা ঘোরাল।

রাতে তো আর জ্বর আসে নাই। তবে ঘুমের মধ্যে বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বলে একটু থামল দিলারা। তারপর বলল, তুমি কিন্তু আমার কাছে এখনো ঘটনা খুলে বলো নাই। তোমাদের ঘটনা আসলে কী?

বলব ভাবি। সবই বলব। আগে ও একটু সুস্থ হোক।

তুমি দূরে দূরে থাকলে তো সুস্থ হবে না। কাছে কাছে থাকতে হবে।

ফরিদও অবশ্য বিষয়টা ভেবেছে। বিশেষ করে আজ আতাহার মওলানা কথাগুলো শোনার পর থেকে সে শঙ্কিত বোধ করছে। পারুর কোনো অসাবধানতায় হঠাৎ যদি কেউ টের পেয়ে যায় যে তারা স্বামী-স্ত্রী নয়? এমনকি সে অন্য ধর্মের একটা মেয়ে? ফরিদ তাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে? ভাবলেই গা শিউরে ওঠে ফরিদের। সবচেয়ে ভালো হয় সে যদি পারুর কাছাকাছি থাকতে পারে। অন্যদের চেয়ে যতটা সম্ভব তাকে আলাদা করে রাখা যায়। কিন্তু তার মানসিক অবস্থাই তো ফরিদ জানে না। কিংবা যদি এমন হয় যে এই অবস্থায় ফরিদের সঙ্গে এক ঘরে থাকতে রাজি না হয় পারু?

এমন নানাবিধ চিন্তা নিয়েই শুয়ে রইল ফরিদ। পারুর ঘুম ভাঙল বেলা করে। তার জ্বর কমলেও সারা গায়ে ব্যথা। খানিক কাশিও। দিলারা অবশ্য তার যত্নের কমতি করল না। ফরিদের সঙ্গে পারুর দেখা হলো খাবার টেবিলে। পারুকে খুব রোগা আর ফ্যাকাশে লাগছে। খাবার টেবিলে সে চুপচাপ খেলো। কারো সঙ্গে কথা বলল না। ফরিদ কয়েকবার চেষ্টা করল। তবে তাতে সাড়া দিল না পারু। ফরিদ বলল, খুব খারাপ লাগছে?

পারু ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়াল। ফরিদ বলল, রাতে ঘুম হয়েছে?

হুম।

জ্বর এসেছিল আর?

উহু।

খুব মন খারাপ লাগছে?

এই কথায় পারু উত্তর দিল না। তবে তার খাবারের প্লেটে দু ফোঁটা চোখের জল টুপটাপ ঝরে পড়ল।

এদিক-সেদিক তাকিয়ে ফরিদ হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, এখানে যে কটা দিন আছি। আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে। তুমি কি বুঝতে পারছো?

পারু এবারও জবাব দিল না। ফরিদ গলায় খানিকটা জোর ঢেলে বলল, আমি জানি তুমি কীসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের তো এখান থেকে আর পেছনে যাওয়ার সুযোগ নেই পারু। যেভাবেই হোক সামনেই যেতে হবে। আর সেজন্য আমাদের শক্ত হতে হবে। হবে না?

পারু চুপ করেই রইল। ফরিদ হাত বাড়িয়ে পারুর হাতটা ধরল। তারপর বলল, আমি জানি না আমি তোমার জন্য কী করতে পারব। কিন্তু আমার জন্য তুমি যা করেছে, আমি তা কোনোদিন ভুলব না। এ জীবনে কখনো তোমাকে আমি একা থাকতে দেব না পারু। এক মুহূর্তও না। পারু কাঁদছে। নিঃশব্দ কান্না। তবে তার শরীর কাঁপছে। সে আচমকা তার হাতের মুঠোয় ফরিদের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *