০১. হেমন্তের বিষণ্ণ সন্ধ্যা

স্মৃতিগন্ধা – সাদাত হোসাইন
প্রকাশকাল : একুশে বইমেলা ২০২১

উৎসর্গ

আমার তেইশ মাস বয়সের কন্যা
সারিনা সাদাত নোরা
প্রার্থনা করি, একজন সত্যিকারের মানুষ হয়ে
বেড়ে ওঠো…

এই উপন্যাসের মহিতোষ মাস্টারের চরিত্রটি লিখতে গিয়ে বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছিল জলে। মনে হচ্ছিল, এর আগে কখনো কোনোদিন কোনো বাবা-কে এভাবে অনুভব করিনি। এই যে হঠাৎ বাবা হয়ে উঠলাম, এ তো তোর জন্যই! না হলে কী করে বুঝতাম, জগতের সব বাবা ঠিক আমার মতোই। এরা সত্যিকারের বাবা হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্ত অবধিও বুঝতে পারে না, এতটা বছর নিজের অজান্তেই কী করে এমন আশ্চর্য অনুভূতির অথই সমুদ্র সঙ্গোপনে বুকে বয়ে বেড়ায়!

ভূমিকা

প্রায় বছর তিরিশেক আগে আমাদের গাঁয়েরই এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গিয়ে বসবাস শুরু করেন আমার বাবা। কিন্তু ওইটুকু স্থানচ্যুতিই যেন নানাভাবে একধরনের অনাহুত আগন্তুক অনুভূতি দিতে থাকে আমাদের। চারপাশের নানা আবহ-আচরণ যেন প্রতিষ্ঠিত করতে থাকে, তোমাদের বাড়ি তো এখানে নয়, ওইখানে… ওই যে ফেলে এসেছো… গাঁয়ের ওই প্রান্তে…।

নিজের শৈশব-কৈশোরের তীব্রতম অনুভূতিতে বুকের ভেতর ওই জল-হাওয়া-মাটি শুষে নিয়ে নিজের শিকড় প্রোথিত করে, ওইটুকু অবজ্ঞা মেনে নেয়ার অভ্যেস রপ্ত করেই আমরা ওই মাটিকে নিজের করে ভালোবেসেছি, বেড়ে উঠেছি। তবে সেই বেড়ে ওঠায় নানা ভাবনা, সংবেদনশীলতাও তৈরি হয়েছে। হয়তো এ কারণেই দেশত্যাগের মতো একটি বিষয় চেতনে-অবচেতনে আমাকে সারাক্ষণ নাড়া দেয়। সেই ভাবনা থেকেই দেশভাগ নিয়ে লেখার ইচ্ছে বহুদিনের। কিন্তু পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাবে সেটা এখনো হয়ে ওঠেনি। স্মৃতিগন্ধাও দেশভাগ নিয়ে লেখা নয়। তবে উপন্যাসের প্লটটি মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের একটি সময়ের। ছেয়াত্তর-সাতাত্তর সাল। শিকড় উপড়ে যাওয়া মানুষের বেদনার গল্পই হয়তো আমি লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই উপন্যাস আর সেই গল্পের থাকেনি। হয়ে উঠেছে অন্য এক ভালোবাসার গল্প। সেখানে পিতা হয়ে উঠেছেন অন্য এক দেশ। যে দেশ আকুল হয়ে খুঁজে বেড়াতে থাকে তার সন্তানকে।

কে জানে, হয়তো দেশও এমন করেই খুঁজে বেড়ায়, অপেক্ষায় থাকে তার সন্তানদের! কেবল তার ছুটে বেড়ানোর ক্ষমতা থাকে না বলে তা দেখা যায় না চোখে। কিন্তু দূর কোনো দেশে হারিয়ে যাওয়া তার পরবাসী সন্তান হয়তো ঠিকই টের পায়, মা তাকে ডাকছে!

সেই ডাক নিঃশব্দ রাত্রির একাকী প্রহরে সঙ্গোপনে কান্না হয়ে ঝরে পড়ে।

সাদাত হোসাইন
১৪.০৩.২০২১
শ্যামলী

জানি যাচ্ছি, ফেলে সন্ধ্যা,
সাথে তোমাকেও, স্মৃতিগন্ধা!

–সাদাত হোসাইন

হেমন্তের বিষণ্ণ সন্ধ্যা।

খানিক আগেই ভুবনডাঙা স্টেশন ছেড়ে সাইরেন বাজিয়ে চলে গেছে সন্ধ্যার ট্রেন। তারপর থেকে অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য। সুনসান নীরবতা। একটা হলুদ পাতা হঠাৎ উড়ে এসে পায়ের কাছে পড়তেই পারু স্নান চোখে তাকায়। কী রুক্ষ্ম, প্রাণহীন চারপাশ! যেন ক্রমশই নেমে আসছে মৃত্যু। গাঢ় অন্ধকার। মুখভার থমথমে আকাশও মিশে গেছে দূরে কোথাও। কিন্তু পারুর খুব ইচ্ছে হয়, ওই আকাশটাকে টুপ করে বুকের ভেতর লুকিয়ে ফেলতে। এমন আকাশ কি আর কোথাও আছে? এমন মন কেমনের সন্ধ্যা? ওই যে দূরের গ্রাম, শুকনো খড়ের মাঠ, ভেজা ঘাসের মেঠোপথ? ওই যে নরেন দাদুর ফোকলা দাঁতের হাসি? ভুবনডাঙা নদী? এই যে সে বসে আছে পুকুরপারে, ওই যে সামনে শান বাঁধানো ঘাট, স্বচ্ছ জলের আয়না, তুলসি তলার মায়া, বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ, এমন কি আর কোথাও কিছু আছে?

পারু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও লুকায়। মানুষ হওয়ার এই এক যন্ত্রণা। জীবনভর কেবল লুকাতে হয়! মিহি কুয়াশার ভেতর থেকে গায়ে এসে বেঁধে সূচের ফলার মতো তীক্ষ্ণ হিমেল হাওয়া। জড়সড় চারু ডাকে, দিদি।

হুম? সাড়া দেয় পারু।

এসব ছেড়ে যেতে তোর ভালো লাগবে?

কই যাব?

কেন? তুই শুনিসনি?

কী?

বাবা যে বলল আমাদের জমিগুলো বিক্রির একটা ব্যবস্থা করতে পারলেই আমরা কলকাতা চলে যাব! ভুবনডাঙার ট্রেন ধরে বর্ডার পর্যন্ত। তারপর সীমানা পার হলেই ভারত। আমরা আর কখনো ফিরে আসব না দিদি?

পারু ছোট বোনের দিকে তাকায়। চারুর বয়স চৌদ্দ। তার থেকে বছর চারেকের ছোট। মাথাভর্তি চুল। মা চুপচুপে তেল দিয়ে বেণি করে দিয়েছে চুলে। সে তাকিয়ে আছে ফ্যাকাশে চোখে। পারুর হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, এই বয়সের স্মৃতি কতটা গম্ভীর হয়? আজ থেকে কুড়ি বছর পর কি আজকের এই সন্ধ্যার কথা চারুর মনে থাকবে? কিংবা তার?

নাহ। পার ফোঁস করে লুকানো দীর্ঘশ্বাসটা ফেলে। আমরা আর কখনোই ফিরে আসব না।

কখনোই না?

উহু। বলেই উঠে দাঁড়ায় পার। তুলসীগাছের তলায় সন্ধ্যা আরতি দিচ্ছেন মা। তার পাশেই ঠাকুরঘর। ওই যে বাঁশের কঞ্চি কেটে বানানো ঠাকুরমার লাঠিটা ওখানে। তার পাশে কাঠের খড়ম। দরজার কাছে জলচৌকি। ঘরের টিনের চালের ওপর ডালপালা ছড়ানো আমগাছ। গোয়ালঘর থেকে গলগল করে ধূপের গন্ধ বেরুচ্ছে। সন্ধ্যা হলেই মশা তাড়াতে ধূপ জ্বেলে দেন মা। কালো রঙের বড় গাইটা কেমন অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। তার চোখ কি ভেজা?

পারু জানে না। তবে সে দু পা এগিয়ে গাইটার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। হাত বোলাতে থাকে পিঠে। বাবা খদ্দের খুঁজছেন। ভালো দাম পেলেই বেচে দেবেন। তারপর? কোথায় চলে যাবে কালু আর কখনো দেখা হবে না তাদের? পারুর আচমকা কী যে হয়! সে দুই হাতে গাইটাকে জড়িয়ে ধরে। গাল ঘসতে থাকে পিঠে। এত কান্না পাচ্ছে কেন তার কে জানে! এই সবকিছু ছেড়ে সে কোথায় যাবে? কীভাবে যাবে?

.

বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হলো মহিতোষের। তাঁর পায়ের আওয়াজ পেতেই ছায়ারাণী হাঁক ছাড়লেন, কে ওইখানেঃ মহি নি?

হ্যাঁ মা।

রাইত কয় ঘড়ি হইছে, সেই খেয়াল আছে? এখন বাড়ি ফেরনের টাইম?

একটু দেরি হয়ে গেল মা।

দিন-কাল ভালো না। এত রাইত করে বাড়ি ফিরিস না।

মহিতোষ জানেন, দিনকাল ভালো না। তবে ভালো হলেও লাভ নেই। মায়ের এই দুশ্চিন্তা কখনোই যাবে না। সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফেরা ছায়ারাণীর পছন্দ না। এটা সে সেই এতটুকু বয়স থেকে দেখে এসেছে। উঠানের পাশে কলতলা। মহিতোষ সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। অঞ্জলি কেরোসিনের কুপি আর গামছা নিয়ে এলেন। মহিতোষ বললেন, পারু আর চারু ঘুমিয়েছে?

তা জানি না। তবে শুয়েছে।

না ঘুমালে শোবে ক্যান?

কে জানে! অঞ্জলির কণ্ঠে বিরক্তি। সারাক্ষণ দুজনে কী গুটুর গুটুর করে কে জানে!

মহিতোষ হাসেন, দুই বোনে খাতির থাকা ভালো। বলে হাতে-মুখে জল ছেটান তিনি। গড়গড় করে কয়েকবার মুখ কুলকুচি করেন। তারপর মাথায় মুখে শেষবারের মতো জলের ছিটা দিয়ে অঞ্জলির হাত থেকে গামছা নেন। অঞ্জলি বলেন, জমি বেচার কোনো বন্দোবস্ত হলো?

মহিতোষ সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন না। সময় নিয়ে হাত মুখ মুছলেন। তারপর বললেন, লোকে যা মাগনা পাওয়ার আশা করে, তা কি আর টাকা দিয়ে কিনতে চায়?

মাগনা পাওয়া যাবে ক্যান?

এই প্রশ্নের জবাব দেন না মহিতোষ। অন্ধকারে আকাশের দিকে তাকান তিনি। ঘরের পুবদিকে ঘন বাঁশঝাড়। সেখানে চারদিক থেকে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে নুয়ে এসে মাথার ওপরের আকাশটাকে ঢেকে দিয়েছে বাঁশঝাড়টা। এই দৃশ্য তাঁর কতকালের চেনা! অথচ এই সব ছেড়ে চলে যেতে হবে? মানুষ যেখানে জন্মায়, সেখানে কেন গাছের মতো শিকড় গজিয়ে ফেলে? শুষে নিতে থাকে আলো, জল, হাওয়া। তারপর কেন আবার তাকে সেই শিকড় উপড়ে নিয়ে চলে যেতে হয় অন্য কোথাও? ক্রমাগত শুকিয়ে যেতে হয় ভেতরে-বাইরে। শিকড় উপড়ানো মৃত গাছের মতোই। রাতে খেতে বসে তিনি বললেন, বড়দা কলিকাতা থেকে চিঠি দিয়েছে।

কী লিখেছে? অঞ্জলির কণ্ঠে উত্তষ্ঠা।

ভালো কিছু না। পাঁচ-ছ বছর তো হলো ওপারে গেল। কিন্তু এখনো কিছুই গোছাতে পারেন নাই। বলেছেন, দেশে তাঁর ভাগের জমি-জমা যা ছিল, তার একটা ব্যবস্থা যেন করে যাই আমি। কিছু টাকা-পয়সা পেলে খুব উপকার হবে…।

আমাদের জমিগুলাইতো বেচতে পারছেন না। তারটা কেমনে বেচবেন?

মহিতোষ জবাব দেন না। চুপচাপ ভাত খেতে থাকেন। কুপির আলোয় দেয়ালে তাঁর দীর্ঘ ছায়া পড়েছে। খানিক ঝুঁকে ভাতের গ্রাস মুখে তোলার সঙ্গে সঙ্গে ছায়াটাও ঝুঁকছে। ওই ছায়ার দিকে তাকিয়ে অঞ্জলির কেমন অস্বস্তি হতে থাকে। খুব অসহায় আর ন্যুজ লাগছে মানুষটাকে। যেন জীবনের ভার বইতে বইতে ক্লান্ত। বছর পাঁচ-ছয় আগে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো, তখন কত কত মানুষ দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু মহিতোষ যাননি। বাপের দেশের মাটি ছেড়ে কোথায় যাবেন তিনি? এই গ্রাম, এই ঘর-বাড়ি, ফসলের মাঠ, মাটি ও মানুষ সবই তার হাতের তালুর মতো চেনা। মায়ের মতো মায়াময়। এসব ছেড়ে কেন যাবেন? কিন্তু সময় বদলায়। বদলায় চারপাশের মানুষও। যাকে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, জলের মতো স্বচ্ছ-সহজ ভেবে দিনের পর দিন নির্ভরতায় পথ চলেছেন, সেই মানুষটাও আচমকা কেমন অন্যরকম হয়ে উঠতে লাগল। সবাই যে এমন, তা নয়। বরং বেশির ভাগই সহজ-সরল, আত্মীয়সম প্রতিবেশী। কিন্তু তারা বড় নিরীহ, নির্ঝঞ্ঝাট। ফলে নরম ঘাসের মতো তাদের পায়ের তলায় পিষে ভয়াল আদল নিয়ে বেড়ে উঠেছে কিছু দানবীয় মানুষ। তাদের ছায়া ক্রমশই বিস্তৃত হচ্ছে। এই পরিবর্তনটা অনেক দিন ধরেই টের পাচ্ছিলেন মহিতোষ। তারপরও মন সায় দিচ্ছিল না তার। বলতে গেলে মাটি কামড়েই পড়েছিলেন। এ তার বাপ-দাদার ভিটে। এখানেই তার নাড়িপোঁতা। এ ছেড়ে কোথায় যাবেন তিনি।

কিন্তু গত বছরের বন্যা আর নদীভাঙনে স্কুলটাও বিলীন হয়ে গেল নদীতে। তার ওপর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শুরু হলো নানা রাজনৈতিক সংকটও। সেসব সংকটে হঠাই কেমন গুমোট হয়ে গেল চারপাশ। কালবোশেখী ঝড়ের আগে যেমন হয়।

.

মহিতোষের বড় ভাই পরিতোষ খানিক ভীতু প্রকৃতির। যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সীমানা পেরিয়ে ওপারে চলে গিয়েছিলেন। এতকিছু আর ভাবেননি তখন। কিন্তু সীমান্তের ওপারে যে নিরাপদ জীবনের ভাবনায় তখন আচ্ছন্ন ছিলেন, সেই ঘোরও কাটতে লাগল ধীরে ধীরে। বুঝতে পারলেন, একবার যে গৃহত্যাগ করে তার আর কোথাও কখনো ঘর হয় না। পথের ধারের সরাইখানায় হয়তো বছরের পর বছর থাকা যায়, কিন্তু সেখানে কখনো ঘরের মায়া থাকে না। এ যেন মায়ের কোল ছেড়ে পাথুরে পৃথিবীতে নামার মতোই। বুকের ভেতর খানিক স্পর্শের জন্য, মায়ার জন্য, চেনা ঘ্রাণের জন্য ছটফট করতে থাকে। অন্য কোথাও হয়তো অন্য কোনো মমতাময়ী নারী থাকে। আশ্রয় ও ভালোবাসাও থাকে। কিন্তু মা?

.

মা ছাড়া আর কোথায় মেলে মায়ের স্নেহ?

মহিতোষ ভাত খেয়ে উঠতে উঠতে বলেন, পারু আর চারুর দিকে খেয়াল রেখো। বেলা-অবেলায় এদিক-সেদিক না যাওয়াই ভালো।

অঞ্জলি কথা বলেন না। তবে মহিতোষের দুশ্চিন্তা তিনি বুঝতে পারেন। রাতে ঘুমাতে গিয়ে মহিতোষ বললেন, মনে হয় না জমি-জমা ঠিকঠাক মতো বেচতে পারব। আর পারলেও দাম পাব দশ ভাগের এক ভাগ। সবাই ভাবছে আজ হোক, কাল হোক, দেশ তো ছাড়বোই। তখন উড়ে এসে জুড়ে বসবে। শুধু শুধু টাকা পয়সা দিয়ে কিনে কী লাভ?

.

টিনের চালে টুপটাপ শিশিরের শব্দ হয়। একটা পা, ছোট ডাল, একটা নিশাচর পাখির ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ রাতের এই নীরবতার বুকে সুই-সুতোর মতো দুঃখ গেঁথে দিতে থাকে।

.

কাক ভোরে ঘুম ভাঙে পারুর। সে ফিসফিস করে চারুকে ডাকে, এই, ওঠ। ওঠ।

চারু ঘুম ঘুম গলায় বলে, আরেকটু ঘুমাই না দিদি।

আর কত ঘুমাবি? ওঠ।

চারু অবশ্য ওঠে না। সে কথা টেনে নিয়ে নিজেকে আরো জড়িয়ে নেয়। ভোরের এই হিম হিম অনুভবে কাঁথার ওই ওমটুকু যেন তাকে আরামে অবশ করে দেয়। গাছের পাতার ফাঁক গলে ভোরের সোনালি আলোর প্রথম আভাটুকু তখন কেকল উঁকি দিতে শুরু করেছে। পারু হাত বাড়িয়ে সেই আলোটুকু হাতে মেখে নেয়। গরম চায়ের পেয়ালা থেকে ভেসে আসা ধোয়ার মতো পাতলা কুয়াশা ভাসতে থাকে সেই আলোর ভেতর। সে পা টিপে টিপে বাড়ির উঠোনটা পেরোয়। তার ওপাশে ধানক্ষেত। ধানক্ষেতের পাশেই খোলা চাতাল। মা গোবর আর মাটি দিয়ে লেপে চকচকে করে রেখেছে চাতালটা। শীতের ভোরে যখন আরো খানিকটা আলো ফুটবে, ওম ছড়াবে সূর্য, তখন এখানে এসে সবাই রোদ পোহাতে পোহাতে ভাত খেতে বসবে। রাতের বেঁচে যাওয়া কড়কড়ে ঠাণ্ডা ভাত। বেগুন, আলু, টমেটোর সঙ্গে ছোট মাছের ঠাণ্ডা-জমাট ঝোল-তরকারি। তারপর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন মা। গাছ-গাছালির জন্য বাড়ির উঠানে তেমন রোদ পড়তে পারে না। ফলে ফসল শুকানো থেকে শুরু করে রোদ লাগে এমন সব কাজ এখানেই করতে হয়। দিন সূর্য এখানে দাপিয়ে বেড়ায়। আরামদায়ক ওমে বুক পেতে রাখে মাটি। বাশের আড়ায় লেপ, তোশক শুকাতে দেন মা। যাতে আরাম করে ঘুমানো যায় রাতে। দুপুরের দিকে বড় পাতিলে করে কলতলা থেকে জল এনে এখানে রোদে রাখা হয়। সেই জল গরম হতে থাকে। ঠাকুরমাকে তখন জলচৌকিতে দাঁড় করিয়ে স্নান করিয়ে দেন মা। ড্যাবড্যাব করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে পারু আর চারু।

ছায়ারাণী অবশ্য কোনো গলায় বলেন, আমি চান করতেছি, আর তোরা দুইটা অমনে চাইয়া থাকস ক্যান?

পারু দাঁত বের করে হাসে, তোমার রূপ-যৌবন দেখি ঠাকুমা।

আমার রূপ-যৌবন দেখন লাগব না। নিজেদের রূপ-যৌবন দেখানোর নাগরের

তুমি কি ছোট থেকেই এমন জোয়ান ছিলা? পারুচোখ টিপে বলে, না হলে ঠাকুরদা ক্যান অত অল্প বয়সের তোমাকে দেখে পাগল হলো!

তোর এই বয়সে আমি দুই পোলা, এক মাইয়ার মা হইছি। আর তোগো বোহেই তো এখনো ঠিকঠাক মাংস জমে নাই। পোলাপান হইলে খাওয়াবি কী?

ছায়ারাণীর মুখ বড় নির্লজ্জ। ঠোঁটকাটা। এমন আচমকা কথা বলায় তাঁর জুড়ি নেই। কথাগুলো মনে হতেই পারু একা একা হাসে। মন খারাপও হয়। এই যে এমন সোনালি আলো, ওই যে দূরের মাঠ, শিশির ভেজা ঘাস, ঠাকুরমার সঙ্গে এই এখানে এত এত খুনসুটি, এসবকিছুই কেবল স্মৃতি হয়ে যাবে? আর কখনো এখানে ফিরে আসা হবে না তাদের এখানে অন্য কেউ থাকবে? অন্য কারো গল্প জমা হতে থাকবে? আর তাদের স্মৃতির ভাড়ার নিয়ে তারা চলে যাবে অন্য অজানা কোথাও?

.

চাতালের ডান দিকটায় তাকাতেই মন ভালো হয়ে গেল পারুর। হেমন্তের রাতই মূলত শীত নিয়ে আসে ভুবনডাঙায়। সারা রাত টুপটাপ ঝরে পড়তে থাকে শিশির। নেমে আসতে থাকে কুয়াশা। তারপর ভেজা মাটি, ঘাস আর ফুল। চাতালের ওই দিকটা শিউলি ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। পারু ছুটে গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসে। মুক্তোর মতো শিশির জমে আছে শুভ্র ফুলের পাপড়িতে। সে আঙুলের ডগায় ছুঁয়ে দেয়। অদ্ভুত এক শিহরণে গা শিরশির করে ওঠে। ওড়না মেলে ফুল কুড়াতে থাকে সে। আর গুনগুন করে গাইতে থাকে।

তুমি এমন করে কুড়িয়ে নিয়ে আমায়, এমন ঝরা ফুলের মতো,
আমি তোমার ছোঁয়ায় বাঁচবো নতুন করে, ভুলবো ভুলের ক্ষত।

.

সাইকেলের টুংটাং শব্দটা ঠিক সেই মুহূর্তেই কানে এলো পারুর। মাটির উঁচু রাস্তা থেকে ক্ষেতের আইলঘেঁষা সরু মেঠোপথ ধরে নেমে আসছে ফরিদ। তার পরনে লুঙ্গি। গায়ে হাফহাতা শার্ট। শার্টের ওপর আড়াআড়ি চাদর জড়ানো। তবে সাইকেল চালাতে গিয়ে চাদরটা সরে গিয়ে বুকের খানিকটা উন্মুক্ত হয়ে আছে। ভোরের হিমেল হাওয়ায় চোখ-মুখ আড়ষ্ট। এত ভোরে এখানে এভাবে ফরিদকে দেখে ভড়কে গেল পারু। সে চকিতে উঠে দাঁড়াল। তারপর এস্ত পায়ে হাঁটতে লাগল বাড়ির দিকে। ফরিদ ডাকল, পারু।

পারু খানিক থমকাল। তবে থামল না। ফরিদ আবার ডাকল, পারু, শোন । এই পারু।

পারু এবারও থামল না। হাঁটতেই থাকল। তবে ফরিদ হাওয়ার মতো উড়ে এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়াল। তারপর শক্ত গলায় বলল, ডাকছি, শুনছো না?

পারু প্রায় ফিসফিস করে বলল, পথ ছাড়েন। কেউ দেখে ফেললে খুব খারাপ হয়ে যাবে।

হোক। আমার তাতে কিছু যায় আসে না।

আমার যায় আসে। বাবা দেখলে খুন করে ফেলবে আমাকে।

কিন্তু কী করব আমি? তুমি কিছুই বলছে না!

বলেছি তো, আমি জানাব।

রোজ বলছো জানাব। কিন্তু কখনোই কিছু জানাও না!

ইচ্ছে করে যে জানাই না, তা তো নয়। আপনি বোঝেন না?

ফরিদ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কী জানি! আজকাল আর তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছা কিছুই বুঝতে পারি না। এই মনে হয় সব ঠিকঠাক। তুমি ঠিক আগের মতোই আছে। আবার পরক্ষণেই মনে হয় তোমাকে চিনি না আমি।

পারু জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে। সে নিজেও কি আজকাল নিজেকে ঠিকঠাক চেনে? কীভাবে চিনবে? তার চারপাশের পৃথিবীটা যে ক্রমশই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। এই পৃথিবীতে সে একা নয়। তার বাবা আছেন, মা আছেন। ঠাকুরমা, চারু আছে। আছে আরো কতকিছু! এখানে সে ফরিদকে নিয়ে কীভাবে ভাববে? কী ভাববে?

ফরিদ খানিক চুপ করে থেকে নরম গলায় বলল, তোমরা সত্যি সত্যিই চলে যাচ্ছো, পারু?

হুম। ফরিদ সবই জানে। পারু তাকে বলেছে। কিন্তু তারপরও তার কিছুতেই কিছু বিশ্বাস হতে চায় না। মনে হয়, এটা সত্যি নয়। পারু হঠাৎ করেই ফিক করে হেসে ফেলবে। তারপর ঝলমলে গলায় বলবে, পুরুষ মানুষের এত অল্পতেই ভয় পেলে চলে?

এটা এত অল্প?

অল্প নয়?

উহু।

তাহলে?

এটা আমার জীবনের চেয়েও বড়।

জীবনের চেয়েও বড় কী জানেন?

কী?

বাবা বলেন জীবনের চেয়ে বড় হলো মৃত্যু। আমার চলে যাওয়া কি তবে আপনার কাছে মৃত্যুর মতো?

এই কথায় ফরিদ চুপ করে থাকল। আসলেই তো, পারু ছাড়া তার জীবনের আর অর্থ কী! সেই জীবন তো মৃত্যুরই মতো।

.

ফরিদ দীর্ঘ নীরবতার পর আবারও ডাকল,

পারু?

হুম।

সত্যিই চলে যাবে? আর কখনো কোনোদিন ফিরবে না?

উহু।

তাহলে?

তাহলে কী?

তাহলে আমি কী করব?

এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। ফরিদ মুসলমান একটা মেয়ে দেখে বিয়ে-টিয়ে করে সংসারি হবে। পারু চলে যাবে কলকাতা। সেখানে তার হিন্দু কোনো ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাবে। এই যে এত জটিলতা, এত দুশ্চিন্তা, সমীকরণ এর কিছুই তখন আর থাকবে না। হয়তো কখনো কখনো মাঝরাত্তিরে তাদের পরস্পরের কথা মনে পড়বে। তারপর মন খারাপ হবে। তাদের কিছু মিষ্টি স্মৃতি আছে। সেই স্মৃতিগুলো বুকের ভেতর সুবাস ছড়াবে। হয়তো কান্না জমবে চোখে। আবার শুকিয়ে যাবে। ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে তারা যন্ত্রণা আড়াল করে হাসিমুখে মিশে যাবে জীবনের চোরাস্রোতে।

বর্ষায় টইটম্বুর যে ভুবনডাঙা নদী, তা এই হেমন্তে শান্ত, চুপচাপ। কোথাও কোথাও হাঁটু অবধি জল দেখা যায়। দুই ধারে জেগে ওঠা বালিয়াড়িও হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে। দিনভর যাত্রী পারাপারে এপার-ওপার ছোটাছুটি করে খেয়ানৌকা। সেই খেয়াঘাটের গা ঘেঁষেই জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার চাল-ডালের মস্ত আড়ত। মহিতোষ। সেখানে বসে আছেন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার ক্যাশবাক্সের ওপর চায়ের কাপ। তিনি কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, এই দেশে কি আপনি খারাপ আছেন নাকি মাস্টার মশাই?

না না। খারাপ থাকব কেন? আর পরের দেশে ভালো থাকার চেয়ে নিজের দেশে খারাপ থাকাও ভালো।

তাহলে পরের দেশে কেন যাইতে চাইতেছেন?

আসলে বড় দাদা চলে গেলেন সেই যুদ্ধের শুরুতেই। বড়দিরও তো বিয়েই। হলো ওখানে। আত্মীয়-স্বজন যা ছিল, তারাও সব একে একে চলে গেল। আমি এখন এখানে একদম একা!

একা কই হ্যাঁ? আমরা কি সব মরে গেছি না কি? আমরা আত্মীয়-স্বজন না? জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া চা শেষ করে বিড়ি ধরালেন। তারপর মুখ ভর্তি করে গলগল করে ধোয়া ছাড়লেন। তাঁর বয়স পঞ্চাশের মতো। শক্ত-সামর্থ্য মানুষ তিনি। ইদানীং ব্যবসার অবস্থা ভালো বলে তার আচার-আচরণেও পরিবর্তন এসেছে। আগে চা বিড়ি খেতেন না। আজকাল খাচ্ছেন। আড়তের সামনে তিন দিক থেকে বসার বেঞ্চি পেতেছেন। লোকে সেখানে বসে গল্প আড্ডা জমায়। পান, বিড়ি খায়। সারাক্ষণ একটা গমগমে ভাব লেগে থাকে। বিষয়টি বেশ উপভোগ করেন জাহাঙ্গীর ভূইয়া।

মহিতোষ বললেন, তা আছেন। আপনারা আছেন বলেই তো এতদিনেও কখনো নিজেকে একা মনে হয়নি।

এইটাই আসল কথা। সম্পর্ক শুধু রক্তেরই না। মনেরও। মনের সম্পর্কই আসল, বুঝলেন মাস্টার মশাই।

মহিতোষ মাথা নাড়লেন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বিড়িতে শেষ টান দিয়ে ফিল্টারটা নেভাতে নেভাতে বললেন, তা জমি-জমা যে বেচবেন, কাস্টোমারের কী অবস্থা?

সেইভাবে এখনো পাই নাই। দু-একজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু তারা দাম যা বলছেন, তাতে তো এখন মনে হয় যে জমির চেয়ে জলের দামও বেশি।

তা পানির দাম কি কম নাকি? জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া হাসতে হাসতে বললেন, দুনিয়ায় পানিই সবচেয়ে দামি জানিস। পানির অপর নাম হইলো জীবন। এখন জীবনের চাইতে বেশি দামি আর কী? আছে না-কি কিছু রে কামাল? তুই তো শিক্ষিত মানুষ, শহরে থাকিস, তুইই বল? বলেই আড়তের পেছন দিকে তাকালেন তিনি। সেখানে ছোটখাটো একজন মানুষ বসা। শক্ত-সামর্থ্য। চট করে দেখে তার বয়স বোঝা যায় না। ক্লিন শেভড মুখ। তবে একটা বিষয় খুব অবাক করার মতো। এই প্রচন্ড ঠান্ডায়ও লোকটার মাথা কামানো। যেন চকচকে একটি বৃহদাকার মার্বেল বানো ঘাড়ের ওপর। লোকটাকে এতক্ষণ চোখে পড়েনি মহিতোষের। এদিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল সে। তারপর বলল, ভুল বলেননি দুলাভাই। কথা সত্য। পানির চেয়ে দামি কিছু নাই।

মহিতোষও হাসলেন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, আমার শালা। ঢাকায় থাকে। গ্রামে আসছে শীতের রস-পিঠা খাইতে।

মহিতোষ তাকিয়ে আদাব দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। কামালও স্মিত হেসে জবাব দিল। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, ওর কাছেই শুনলাম। ঢাকায় তো পরিস্থিতি ভালো না। দেখেন না, আজ একজন সরকারে আসে তো, কাল আরেকজন। কোনো প্ল্যান-পরিকল্পনার ঠিক আছে? নাই। স্থিরতা নাই কোনো কিছুতে। এত বড় একটা দুর্ঘটনার পর দেশ এখন টালমাটাল। এই অবস্থায় সবার মনেই চাপা আতঙ্ক। কী জানি, কী হয়! তারওপর পাঁচ-ছয় বছরও তো ঠিকঠাক যেতে পারল না দেশটা স্বাধীন হলো। পাকিস্তানিরা তো দেশটা চুষে ছোবড়া বানাই ফেলছে। দেশের রাজনীতির অবস্থাও তো করুণ! এই অবস্থায় মানুষ আছে আতঙ্কে। জমি কেনার কথা চিন্তা করবে কীভাবে?

হ্যাঁ, সেটা জেনেই আপনার কাছে আসা ভূঁইয়া সাব। এই দুর্দিনের বাজারে একমাত্র আপনিই যা ভালো আছেন। শুনেছি লোকজনকে সাহায্য-সহযোগিতাও করেন।

আরে, ও এমন কিছু না। আল্লাহ সামর্থ্য যখন দিছেন, কিছু তো করতেই হবে। তারপরও দেখেন না, মানুষ কত আজেবাজে কথা বলে। আমি না কি রিলিফের মাল চুরি করে আড়তে ঢুকাই। আঙুল ফুলে কলাগাছ…। আসলে কি জানেন, কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না। মানুষ আপনার ওপরে ওঠাটাই দেখবে, কিন্তু ওপরে ওঠতে গিয়ে যে আপনার কী পরিশ্রমটা হচ্ছে, সেটা আর কেউ দেখবে না।

মহিতোষ কথা বললেন না। স্নান হাসলেন কেবল। এছাহাক বেপারি আড়তের দরজার কাছে দাঁড়ানো। দেখতে বয়স্ক মনে হলেও জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার চেয়ে বয়সে ছোট সে। শুকনো টিনটিনে লোক। থুতনির কাছে চিকন দাড়ির গোছা। পানের পিক লেগে আছে পরনের কোঁচকানো পাঞ্জাবিতে। তাকে হাতের ইশারায় ডাকলেন জাহাঙ্গীর। বললেন, কী মিয়া? এত বড় জমির দালাল তুমি আর একটা ভালো দাম দেখে মাস্টার মশাইয়ের জমি বেচে দিতে পারতেছে না?

এছাহাক গম্ভীর মুখে বল, সে যা দাম চায়, ওই দামে কি এই বাজারে জমি বেচা যায়? মানুষের পেটে নাই ভাত, ক্ষেতে হয় না ফসল। দেশে তো দুর্ভিক্ষ আসলো বলে। এর মধ্যে কেউ ওই দামে জমি কিনব?

তা অবশ্য কথা খারাপ বলো নাই। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া হাসলেন। তার আঙুলের ডগায় চুন। তিনি সেই চুন জিভের আগায় দিতে দিতে বললেন, কী করবেন কন মাস্টার মশাই। বোঝেনই তো, যুদ্ধ শেষ হইলো মাত্র কয় বছর। দেশটা তো ঠিক মতো দাঁড়াইতেই পারল না। যা-ও দাঁড়াইতে পারত, তাও একটার পর একটা দুর্ঘটনা। এখন তো সবাই ইয়া নফসি, ইয়া নফসি। জমি-জিরাত কে কেনবে কন?

মহিতোষ সবই বোঝেন। কিন্তু কী করবেন তিনি? এতগুলো জমি অমন জলের দরে ছেড়ে দেবেন? এই সোনার জমি? বাপ-দাদার ভিটে? তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ভূইয়া সাব, বিপদে-আপদে তো আপন মানুষরাই এগিয়ে আসে, তাই না? আর এই গাঁয়ে আমার আপন বলতে তো আপনারাই। আপনি একটু সহযোগিতা না করলে একদম অথৈ সাগরে পড়ে যাব।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া হাত বাড়িয়ে মহিতোষের হাত ধরলেন। তারপর বললেন, আমি গরিব মানুষ। যা আছে, তাই নিয়াই সন্তুষ্ট। এত জমি-জমা, ধন-সম্পত্তির খায়েশ আমার কোনো কালেই ছিল না। শুধু শুধু এত জমি দিয়া আমি কী করব কন?

মহিতোষ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই জাহাঙ্গীর ভূইয়া বললেন, আচ্ছা, এত চিন্তা কইরেন না। আমি যখন আছি, ব্যবস্থা একটা হবেই। আগে আশপাশে আরো দশজন কাস্টোমার দেখেন। ভালো দাম না পেলে তখন আমার কাছে আইসেন। কী করব বলেন, মনটা কিছুতেই মানে না। যখন শুনি চোখের সামনে আর আপনেদের দেখব না, তখন বুকটা খাঁ খা করে।

জাহাঙ্গীর ভূইয়ার চোখ প্রায় ছলছল। গলা ভার। মহিতোষ আড়ত থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে গেলেন না। নদীর ধারে চুপচাপ বসে রইলেন। এই যে নদী, ওই যে নদীর ওপার শামুকভাঙ্গার বিল, তার ওপারে নাখালপাড়ার মাঠ। মাঠের পাশে। হরিদাশপুর কলেজ। তার ওপারেও কত কিছু!

মহিতোষ জানেন, এসবই তার বুক পকেটে গভীর যত্নে ভাঁজ করে রাখা। এসবই তার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের মায়াবন। আর কিছুদিন বাদে, যখন তিনি দূরে কোথাও, অন্যকোনো দেশে, কোনো এক খুপরি টিনের ঘরে পরবাসী এক মানুষ হয়ে ঝিম ধরা দুপুর কিংবা মন খারাপের রাতে একা একা বসে থাকবেন, তখন বুক পকেট থেকে আলগোছে তাদের বের করে আনবেন। তারপর ভাজ খুলে ঘ্রাণ নেবেন। স্মৃতির ঘ্রাণ। প্রীতির ঘ্রাণ। মায়াময় মাটি, মানুষ আর বাংলাদেশের ঘ্রাণ।

.

রাতে অঞ্জলি বললেন, জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া কী বলল?

বলল যতটা সম্ভব দেখবে।

কী দেখবে আমার জানা আছে। ছিল আস্ত রাজাকার, আর যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই একদম ভোল পাল্টে গরিবের বন্ধু সেজে বসে আছে। এখন তো কথায় কথায় যুদ্ধের কথা বলে, দেশের কথা বলে। আবার শুনলাম সরকারি কী এক গ্রাম কমিটিতেও না-কি ঢুকে পড়ছে?

আস্তে! ফিসফিসিয়ে বললেন মহিতোষ। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ করা যায়?

আমাদের সবটাই জল, সবটাতেই কুমির। অঞ্জলি মুখ ঝামটা মেরে বললেন।

শোনো।

হুম।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া কোনোভাবেই এই জমি বেচতে দেবে না। কারো কাছেই না। যার কাছেই জমি বেচতে যাই, সে-ই বলে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া না-কি বলে রেখেছে এই জমি সে কিনবে। বায়না করে রেখেছে। আর কেউ যেন এই জমির দিকে না তাকায়। অথচ তার কাছে গেলে এমন ভাব করে যেন কিছুই জানে না।

শেষ পর্যন্ত না খালি হাতেই সব রেখে বিদায় নিতে হয়।

মহিতোষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সেটাই সে চাইছে। আর এই কারণেই আমি বারবার তার কাছেই যাই। যাতে কোনোভাবে তার মনটা নরম করতে পারি।

সে নরম হওয়ার মানুষ?

মহিতোষ এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। কম যন্ত্রণায় তিনি এই বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে পরবাসী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেননি। তাঁর ঘরে দুটো অল্পবয়সী মেয়ে আছে। অঞ্জলির বয়সও বেশি নয়। তার ওপর রাত বিরাতে টিনের চালে ঢিল পড়ে। আউশ ধানের সময় হঠাৎ আগুন লেগে গেল ক্ষেতে। ক্ষেতভর্তি পাকা ধান পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এমন আরো কত কী! গাঁয়ের লোকেরা যে সবাই এমন, তা নয়। বরং বেশির ভাগের সঙ্গেই তাদের সম্প্রীতির সম্পর্ক। কিন্তু তারা শান্তশিষ্ট, নির্বিরোধী মানুষ। কারো সাতে-পাঁচে নেই। এই এতটা বছর তারা পাশাপাশি একে অন্যের সুখে-দুঃখে হাত ধরাধরি করে জীবন কটিয়েছেন। কখনো নিজেকে আলাদা ধর্মের কিংবা পরিচয়ের মানুষ মনে হয়নি।

অঞ্জলি বললেন, গাইটা বেচার কিছু হলো?

গাই যেকোনো সময়ই বেচা যাবে। এটা নিয়ে ঝামেলা হবে না। আসল চিন্তা জমি।

কী মনে হয়? জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া কিনলে কত টাকা দেবে?

সে তো :ধু সেজে বসে আছে। মুখ ফুটে কিছুই বলছে না। যেন এই জমি জমার মতো ফালতু বিষয়ের প্রতি তার কোনো আগ্রহই নেই।

এক কাজ করলে কেমন হয়?

কী কাজ?

খাঁ সাহেবের কাছে গেলে কেমন হয়?

উত্তরপাড়ার আশরাফ খাঁ?

হুম।

লাভ হবে বলে মনে হয় না। কথায় আছে না, সব রসুনের গোড়া এক! তারপরও একবার গিয়ে দেখেন। সে তো আর এই গাঁয়ের লোক না।

ওটাও একটা সমস্যা। বিষয়টা জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া ভালোভাবে নেবে? ঘোড়া ডিঙেয়ে ঘাস খাওয়ার মতো হয়ে যাবে না ব্যাপারটা?

এটা অবশ্য ভুল বলেননি মহিতোষ। অঞ্জলিও তা বোঝেন। আশরাফ খাঁ পাশের গাঁয়ের লোক। তার বাবা শত বিঘা জমির মালিক ছিলেন বলে শোনা যায়। তবে সেই জমির বেশির ভাগই ধীরে ধীরে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বাকি জমি নিয়েও সৎ ভাইদের সঙ্গে মামলা-মোকাদ্দমা চলছে। দীর্ঘদিন থেকেই নানারকম বিরোধ লেগেই আছে। ফলে এই মুহূর্তে তিনি আর জমি-জমা কেনার প্রতি আগ্রহ দেখাবেন বলে মনে হয় না। তা ছাড়া জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার শকুনের চোখ যে এখানে পড়েছে, তা দশ গ্রামের সবাই জানে। ফলে শুধু শুধু আর ঝামেলা করতে কে। আসবে এখানে?

.

মহিতোষ ঘুমানোর আগে মেয়েদের দেখতে এলেন। দুই বোন জড়াজড়ি করে। ঘুমাচ্ছে। চোখের পলকে যেন বড় হয়ে গেছে পারু আর চারু। এই সেদিনও তিনি। যখন সাইকেল নিয়ে উঠান পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে যেতেন, তখন ঘরের দাওয়ায়। বসে খ্যাখ্যান করে কাঁদত পার। অথচ ছোট চারুও এখন কত বড় হয়ে গেছে! মহিতোষ দুই মেয়ের কপালে চুমু খেলেন। এই মেয়েগুলোকে তিনি একটু অন্যরকম করে বড় করার চেষ্টা করেছেন। গাঁয়ের আর আট-দশজনের মতো স্রোতে ভেসে যেতে দেননি। আলাদা আদব-লেহাজ শিখিয়েছেন। সুন্দর করে কথা বলতে শিখিয়েছেন। যেন গাঁয়ে থেকেও খানিক শহুরে হয়ে বেড়ে উঠেছিল ওরা। কত কত স্বপ্ন যে তাঁর ছিল। মহিতোষ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে টিনের চালে প্রথম ঢিলটা পড়ল। তারপর দ্বিতীয় দিল। তারপর একনাগাড়ে অনেকগুলো। বৃষ্টির মতো পড়তেই থাকল। ভেতর ঘর থেকে ছায়ারাণী খনখনে গলায় বললেন, কে ওইখানে? কার এত বড় কইলজা, আমার ঘরে ঢিল ছোড়ে। ওই, সাহস থাকে তো সামনে আয়।

বাইরে খ্যাকখ্যাক করা হাসির শব্দ শোনা যায়। কে যেন পারুর নাম ধরে ডাকে, ও পারু, ঘুমাইছোনি? একলা একলা ঘুমাইলে হইবো? আসো, বাইরে আসো।

পারু আর চারু ধড়ফড় করে উঠে বসে। মহিতোষ অন্ধকারে দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকেন। তাদের বুকের ভেতর পাড় ভাঙার শব্দ শোনা যায়। সেই শব্দ তারা ছাড়া আর কেউ শুনতে পায় না।

পারু আর চারুর বাড়ির বাইরে যেতে মানা। তারা দুই বোন তাই উঠান পেরিয়ে পুকুর, পুকুর পেরিয়ে চাতাল, চাতালের পাশে একচিলতে মাঠ, এইটুকুতেই ঘুরে বেড়ায়। এতে যে তাদের খুব খারাপ লাগে তা নয়। বরং আনন্দই হয়। এখন অখণ্ড অবসর। বাড়ির প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গেও তাই ঘুরে ঘুরে সখ্য পাতানো যায়। এ যেন চিরতরে দূরে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো খানিক কাছে আসা। চারু অবশ্য মাঝে মাঝে আচমকা প্রশ্ন করে, আচ্ছা দিদি, ফরিদ দাদার জন্য তোর খারাপ লাগবে না?

তার জন্য কেন খারাপ লাগবে?

আমার কাছে আর লুকাস না দিদি। আমি সব জানি।

কী জানিস তুই?

সব। তুই কি ভাবিস আমি সত্যি সত্যিই রোজ রাতে ওভাবে অচেতন হয়ে ঘুমাই?

কী করিস তাহলে?

ফরিদ দাদা যখন অনেক রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে জানালার বাইরে এসে দোয়েল পাখির মতো শিস দেয়, তখুনি আমার ঘুম ভেঙে যায়। তারপরও আমি চোখ বন্ধ করে থাকি। আর তুই তখন চুপিচুপি উঠে আমাকে ধাক্কা দিয়ে দেখিস আমি জেগে আছি কী না? মাঝে মাঝে ডাকিসও, এই চারু ওঠ, ওঠ, বাথরুম করবি না? আমি তখন ইচ্ছে করেই ঘুমের ভান ধরে থাকি। হা হা হা। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায় চারু। পারু কঠিন চোখে বোনের দিকে তাকায়। অমন সহজ-সরল চেহারার আড়ালে যে এমন হাড়-বজ্জাত মেয়ে লুকিয়ে আছে, কে জানত!

চারু বলে, তারপর তুই যখন নিশ্চিন্ত হোস যে আমি গভীর ঘুমে। তখন তুইও একটা সংকেত দিস। আর ফরিদ দাদা তখন পা টিপেটিপে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। তারপর শুরু হয় তোদের ফিসফিসানি। আচ্ছা, ওভাবে বেড়ার এপার আর ওপার থেকে অমন ফিসফিস করে কথা বললে কিছু শোনা যায়?

পারু এবার ধমকায়, খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু চারু।

কীসের আর বাড়াবাড়ি হলো? এত নিচু স্বরে কথা বলিস তোরা যে অত কাছে শুয়ে থেকেও কিছু শুনতে পাই না আমি। আর বেড়ার ওপাশ থেকে তোরা কী করে যে একজন আরেকজনের কথা শুনিস, কে জানে!

পারু আলতো হাতে চারুর মাথায় চাটি মারে, সত্যিই কিন্তু তোর খুব বাড় বেড়েছে।

বাড় বাড়লে তো কবেই মাকে বলে দিতাম। দিয়েছি কখনো?

এই কথায় সতর্ক হয় পারু। আসলেই তো, চারু যা বলছে তার একরত্তিও মিথ্যে নয়। আর সে চাইলে এতদিনে মাকেও বলে দিতে পারত। যেহেতু বলেনি, সেহেতু তাকে নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। পারু বলে, মাকে সত্যি কিছু বলিসনি তো?

ভগবানের দিব্যি।

পারু এবার নিশ্চিন্ত হয়। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তবে সে তো অনেক আগের কথা। গত ক মাসে আর ওরকম শুনেছিস?

নাহ। তা শুনিনি। স্বীকার করে চারু। কিন্তু তোর ভয় করল না দিদি?

কীসের ভয়?

তুই হিন্দু হয়ে মুসলমান ছেলের সঙ্গে প্রেম করলি?

ভুল করেছিলাম।

এখন শুধরে নিয়েছিস?

হুম।

এত সহজে?

কী এত সহজে?

কাউকে ভালোবেসে ভুল করলে এত সহজে শুধরে নেয়া যায়?

চারুর কথা শুনে চমকে ওঠে পারু। সে ঝট করে বোনের বাহু ধরে নিজের দিকে ফেরায়। তারপর বলে, তোর বয়স কত হলো বলত?

কেন? চারু হাসে।

তোর এই বয়সে আমি ঠিক করে কথাই বলতে পারতাম না। আর তুই তো পেকে টনটন করছিস!

মাও কিন্তু তোকে এই একই কথা বলেতোর বয়সে না-কি মা কথা বলতে গেলে তোতলাতো। বড়রা সবসময় ছোটদের একটু বেশিই ছোট ভাবে, বুঝলি?

পারু সত্যি সত্যিই অবাক হয়েছে। তার ঠিক চোখের সামনে থেকেও চারু যে কখন এত বড় হয়ে গেছে তা যেন সে খেয়ালই করেনি।

চারু বলল, তোর খুব কষ্ট হবে, তাই না দিদি?

কেন?

এই যে ফরিদ দাদাকে রেখে চলে যেতে হবে?

বলেছি-ই তো ওটা ভুল ছিল।

সে তো আমাদের চলে যেতে হচ্ছে বলে। যদি চলে যেতে না হতো তাহলেও ভুল বলতি?

এই কথার উত্তর খুঁজে পায় না পারু। ফরিদের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কেমন অদ্ভুত! কখন কোন অগোচরে তারা পরস্পরকে ভালোবাসল, তা যেন টেরই পায়নি কেউ। ফরিদ তার চেয়ে বয়সে বছর পাঁচেকের বড়। সে যখন ক্লাস নাইনে উঠল, ফরিদ তখন হরিদাশপুর কলেজও পাস করে ফেলেছে। ওই কলেজে পড়েছিলেন মহিতোষও। ফলে ফরিদকে খানিক আলাদা স্নেহই করতেন তিনি। তখন তার স্কুলটাও খুব জমজমাট। পারুকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে রোজ স্কুলে যেতেন মহিতোষ। সমস্যা হলো স্কুলের অঙ্ক শিক্ষক বদরুল আলম হঠাৎ কালাজ্বরে দীর্ঘদিনের জন্য শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। ফরিদটা অঙ্কে খুব ভালো। তো মহিতোষ তাকে একদিন বললেন, স্কুলের ছেলেমেয়েদের খানিক সময় দিতে। পারু জানে না কেন, ফরিদ তাকে খানিক আলাদা করেই সময় দিতে চাইত। বাবা তাকে পছন্দ করেন এটা পারু জানে। কিন্তু সে এও জানে, এই পছন্দ অপছন্দে পরিণত হতে সময় লাগবে না। ফলে নিজেকে যতটা সম্ভব গুটিয়েই রাখত সে। কিন্তু একদিন বাড়ি এসে খাতা খুলতেই চিরকুটটা চোখে পড়ল তার। ফরিদ গোটাগোটা অক্ষরে লিখেছে–

কোথাও একটা পোস্টবক্স নেই
অথচ বুকের ভেতর চিঠি জমে জমে মেঘের মিনার,
কোথাও একটা ঠিকানা নেই
অথচ নীল খাম জমে জমে ভেসে যায় বুকের কিনার।

.

ফরিদ খুব পড়াশোনা করা ছেলে। রাজ্যের বই-পত্র পড়ে সে। গল্প-কবিতাও লেখে। ভারী ভারী কথা বলে। পারুও পড়াশোনায় ভালো। তবে ক্লাসের পাঠ্যবইয়ে খুব অনীহা তার। গল্প-কবিতা ভালো লাগলেও ক্লাসের বই একদম ভালো লাগে না। বরং চোখভর্তি কাজল দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে। পায়ে আলতা মেখে রাঙা পা জোড়া রোদে মেলে ধরতে আনন্দ হয়। মায়ের পাটভাঙা শাড়ি পরে খানিক পুকুরপাড়ের হাওয়ায় আঁচল মেলে ধরতে ইচ্ছে হয়। ফরিদের ওই চিরকুটের দুই লাইনের কঠিন কথা অবশ্য তার মাথায় ঢুকল না। সে জিজ্ঞেসও করল না কিছু। পরদিন ঠিকঠিক ক্লাস শেষে আর সব ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে সেও ফরিদের কাছে পড়তে গেল। ফরিদ অঙ্কও শেখাল। তারপর বাড়ি ফিরে এলো পারু। তার পরদিন। তার পরদিনও। ফরিদও আর কিছু জানতে চাইল না। পারুও বলল না কিছু।

তবে পারু যখন রাতে একা একা কেরোসিনের কুপির আলোয় অঙ্ক খাতাটা খুলত, তখন সেখান থেকে ভাঁজ করা ওই দুই লাইনের চিরকুটটা যেন আপনা আপনিই টুপ করে তার সামনে এসে বুক মেলে দাঁড়াত। যেন বলত, আমায় পড়। পাঠ করো। পারু তখন আপন মনে বিড়বিড় করে লাইন দুটো পড়ে তার অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করত। কিন্তু তার অগম্য চিন্তায় সেসব নিষ্ফল চেষ্টা হিসেবেই রয়ে যেত।

সপ্তাহখানেক বাদে অবশ্য একদিন ফরিদ তাদের বাড়িতে এলো। তাকে নিয়ে এসেছিলেন মহিতোষ নিজে। তিনি পারুকে বললেন, সামনেই তো ফাইনাল পরীক্ষা। কিন্তু তোর অঙ্কের যা অবস্থা, তাতে তো শূন্য পাওয়াও কঠিন হয়ে যাবে দেখছি! তারচেয়ে ফরিদটা না হয় মাঝেমধ্যে এসে একটু দেখিয়ে দিয়ে যাক তোকে? সঙ্গে চারুকেও একটু পড়াল।

পার আপত্তি করেনি। তার সঙ্গে ফরিদের সেই কথা বলার শুরু। তবে বলার চেয়ে পারু বেশির ভাগ সময় কেবল শুনতোই। ফরিদ কী সুন্দর করে কথা বলে! কত কিছু যে জানে সে। পারু সেসব না শুনলেও শোনার ভান করত। ফরিদ যখন অমন হাত নেড়ে নেড়ে চোখে-মুখে রাজ্যের উচ্ছ্বাস নিয়ে কথা বলত, তখন তাকে দেখতে যে কী ভালো লাগত পারুর। সে চোখ ফেরাতে পারত না। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকত নির্নিমেষ।

ঠিক এমনই একদিন ফরিদ আচমকা তার কথা থামিয়ে গম্ভীর মুখে বলল, তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছিলাম, পাওনি?

চিঠি? পারু যেন জানেই না এমন ভঙ্গিতে বলল।

হুম।

উহু।

সত্যি পাওনি? ভারি অবাক হলো ফরিদ।

নাহ।

ফরিদকে এবার খুব বিচলিত মনে হলো। সে বলল, দুই লাইনের একটা কবিতা লেখা ছিল।

কবিতা?

হুম।

আপনি যে বললেন চিঠি? কবিতা কী করে চিঠি হয়?

হয় না?

উহু।

চিঠি হতে হলে তবে কী কী থাকতে হয়?

চিঠিতে সম্বোধন থাকে, কুশল বিনিময়, পরুসমাচার, মধ্যভাগ, শেষ ভাগ, ইতি, এসব থাকে। আমরা বাংলা ব্যকরণ বইতে পড়েছি। কিন্তু দুই লাইনের কবিতার চিঠির কথা তো কখনো শুনিনি!

তার কথা শুনে হেসে ফেলেছিল ফরিদ। সে বলল, তুমি চিঠি লিখতে পারো?

উহু।

কখনো লেখোনি?

একবার মাত্র।

কাকে?

আমার বড় মামা থাকেন কলকাতায়। তাকে লিখেছিলাম। বাবা শিখিয়ে দিয়েছিলেন যে সম্বোধনে শ্রীচরণেষু লিখতে হয়। কিন্তু ওইটুকুতেই দুটো বানান ভুল করে ফেলেছিলাম আমি।

পুরো চিঠির অবস্থা তাহলে কী ছিল?

পারু ম্লান মুখে বলল, সেটাই। এই নিয়ে খুব রেগে গিয়েছিলেন মামা। তিন পাতার ফিরতি চিঠি পাঠিয়ে আমাকে জানিয়েছিলেন যে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

ফরিদ ইচ্ছে করেই গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, তো অন্ধকার থাকলে তো সেখানে আলো জ্বালাতে হয়, তাই না?

হ্যাঁ হয়।

তো আলো কীভাবে জ্বালাতে হয়, জানো?

জানি।

কীভাবে?

বিয়ে করে ফেলতে হয়। বলেই মুখ টিপে হাসল পারু।

যেন আকাশ থেকে পড়েছে, এমন ভঙ্গিতে ফরিদ বলল, বিয়ে করে ফেলতে হয়?

হুম। পারু হাসি থামাতে পারছে না। ঠাকুমা বলেন মেয়েদের সত্যিকারের আলো হলো তাদের স্বামী। স্বামী যদি বিদ্যা-বুদ্ধিতে আলোকিত হয়, তাহলেই মেয়েরা আলোকিত হবে।

ফরিদ পারুর চিন্তা ও কথায় যারপরনাই হতাশ হলো। কিন্তু এই মেয়েটা যেন কেমন। তার চোখভর্তি মায়া। সে তাকালেই বুকের ভেতর অদৃশ্য তীরের ফলা এসে বিধতে থাকে। সেই ফলায় সম্ভবত বিশেষ কোনো বিষ মাখানো থাকে। ওই বিষের যন্ত্রণার আর উপশম মেলে না।

.

তবে কিছু দিনের মধ্যেই ফরিদ বুঝল, পারু তার সঙ্গে কারণে-অকারণে হেঁয়ালি করে। বোকা বানিয়ে আনন্দ পায়। অন্য কেউ এমন করলে কেমন লাগত ফরিদ তা জানে না, তবে পারু যে তার সঙ্গে ইচ্ছে করেই এমন করে, এটা তাকে খুব আনন্দ দিতে লাগল। তার মানে পারু তাকে আর আট-দশজনের চেয়ে আলাদা করেই দেখে। একদিন সাহস করেই কথাটা জিজ্ঞেস করে ফেলল ফরিদ, একটা প্রশ্ন করি?

কঠিন কোনো পড়া? পারু আঁতকে ওঠা গলায় বলল, গতরাতে খুব মাথা ব্যথা ছিল। কিছু পড়তে পারিনি।

ফরিদ হাসল, উহু। পড়া না।

তাহলে? নিমেষেই ঝলমল করে উঠল পারুর মুখ।

ব্যক্তিগত প্রশ্ন।

ব্যক্তিগত কী প্রশ্ন?

এই ধর তোমার আর আমার কোনো ব্যাপার। যা অন্য আর কেউ জানতে পারবে না।

জানলে কী হবে?

আমার আর এ বাড়িতে আসা হবে না।

তাই? উচ্ছ্বসিত গলায় বলল পারু। সত্যি তাহলে আপনার আর এ বাড়িতে আসা হবে না?

উহু।

তাহলে তো ভালোই হবে।

ভালোই হবে? বিমর্ষ কণ্ঠে বলল ফরিদ। হুট করে মন খারাপ হয়ে গেল তার।

হ্যাঁ। আমার রোজ রোজ এমন খটোমটো পড়াশোনা আর ভালো লাগে না।

ফরিদ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। অন্তত তার কারণে নয়। পড়াশোনার কারণেই এমন অনীহা পারুর। সে চট করে বলল, আমাকে তোমার কেমন লাগে পারু?

কঠিন কঠিন কবিতার লাইন ছাড়া ভালোই লাগে।

তুমি কবিতার কঠিন লাইন কোথায় পেলে?

এই যে আপনি আমার খাতার ভেতর লিখে দিয়েছিলেন? পারু চিরকুটটা বের করে দেখায়। ফরিদ ভীষণ অবাক হয়ে বলে, সেদিন যে বললে চিঠিটা তুমি পাওনি?

চিঠি তো আসলেই পাইনি। এটা কি চিঠি? ফরিদ হাসল, আচ্ছা, এটা চিঠি না। কবিতা। কিন্তু কবিতাটা কি তুমি বুঝেছ?

নাহ।

বুঝতে চাও?

হুম।

ফরিদ খানিক কী ভাবল। তারপর বলল, একটা মানুষ তার বুকে লুকানো খুব গোপন কিছু বিশেষ একজনকে বলতে চায়। কিন্তু সেই কথাটা সে যাকে বলতে চায়, তাকে বলতে পারে না। অথচ রোজ সেই কথাগুলো একটু একটু করে তার বুকের ভেতর জমতেই থাকে। জমতে জমতে বুকের আনাচ-কানাচ পরিপূর্ণ হয়ে যায়। ওই ভারটাও আর বইতে পারে না সে। বলতে না পেরে খুব কষ্ট হয়।

পারু কী বুঝল কে জানে! কিংবা আসলেই কিছু বুঝল কি না, তাও বোঝা গেল না। তবে সে স্নান গলায় বলল, আপনি এত কঠিন করে কেন কথা বলেন? আমি যে বুঝতে পারি না। আমার খুব ইচ্ছে হয়, আমি আপনার সব কথা বুঝব। সব কথা।

ওইটুকু এক কথায় ফরিদের সব শঙ্কা ও সঙ্কোচ, দ্বিধা ও দুঃখ দূর হয়ে গেল। তবে পারু তখনো জড়সড় হয়েই ছিল। সে জানত, এটা অসম্ভব এক সম্পর্ক। কিন্তু বয়স আর যুক্তিহীন আবেগ তাকে ডুবিয়ে দিল। সে জানেই না, কখন কোন অগোচরে আলগোছে সে বুঁদ হয়ে গেল ফরিদের গভীর অতলে।

.

চারু বলল, কী ভাবছিস দিদি? কথা বলছিস না কেন?

হুম? যেন হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেল এমন ভঙ্গিতে বলল পারু। কী বলব?

তোর খুব কষ্ট হবে, না?

হবেই তো! এই যে সবকিছু ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আর কখনো আসতে পারব কী না, জানি না। কষ্ট হবে না? ঠাকুমা কে দেখেছিস? বাবাকে? সারাক্ষণ কেমন মন মরা হয়ে থাকে? ঠাকুমা তো সারারাত এক ফোঁটা ঘুমায় না। একা একা কাঁদে। সেদিন দেখি জামগাছটা জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কোঁচকানো গালটা গাছের সঙ্গে লাগানো। চোখ বেয়ে দরদর করে পানি পড়ছে। ওই গাছটা না-কি ঠাকুমার বাবা এ বাড়িতে এসে লাগিয়েছিল। ঠাকুমার বিয়ে হয়েছিলো ৯ বছর বয়সে। সেই সময় এ বাড়িতে এসে লাগিয়েছিল। বলতে বলতে পারুর গলা ভার হয়ে এলো। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। সে চারুকে লুকিয়ে ওড়নার খুঁটে চোখ মুছল। চারু আচমকা বোনকে জড়িয়ে ধরল। তারপর ফিসফিস করে বলল, তোর খুব কষ্ট হচ্ছে, তাই না দিদি?

পার কথা বলল না। তবে চারুর জড়িয়ে রাখা হাতের ভেতর তার শরীরটা হঠাৎ কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। চারুর আচমকা মনে হলো, একটা গাছের জন্য, একটা ঘরের জন্য, এক টুকরো মাটির জন্য যেখানে এত মায়া মানুষের, সেখানে প্রিয়তম মানুষের জন্য কত মায়া সে পুষে রাখে বুকে? আর সেই মানুষটাকে যদি ছেড়ে যেতে হয়ে জনম জনমের জন্য, তাহলে?

তাহলে সেই কষ্টের কি আর সীমা-পরিসীমা থাকে?

মহিতোষ খুব ভোরে ভুবনডাঙা বাজারে এসেছেন। তাঁর হাতে ব্যাগ আর জগ। আজ বিশেষ একটা উদ্দেশ্যে তিনি বাজারে এসেছেন। উত্তরপাড়া থেকে মফিজুল গোয়ালা কলসভর্তি দুধ নিয়ে প্রায়ই ভুবনডাঙা আসে। আজও এসেছে। মহিতোষ এসেছেন তার সঙ্গে গোপন কিছু কথা বলতে। মফিজুল গোয়ালার পিতলের কলসের ভেতর খেজুর পাতা গোঁজা। গাঁয়ের এবড়োখেবড়ো মেঠো পথে দুধভর্তি কলস মাথায় হাঁটতে গেলে হাঁটার তালে তালে কম্পন তৈরি হয়। দুধ ছলকে ওঠে। কিন্তু ভেতরে খেজুর পাতা গুঁজে দিলে সেই পাতার ভেতর কলসভর্তি দুধ খলবল করে। কিন্তু ছলকে উঠতে পারে না আর। ভোরের সোনালি রোদ এসে তেরছাভাবে পড়েছে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার আড়তের নতুন টিনের চালে। সেদিকে তাকিয়ে প্রায় চোখ ঝলসে যাওয়া জোগাড় হলো মহিতোষের। তিনি কপালের ওপর ডান হাতখানা তুলে সামনে এগুতে লাগলেন। এই মুহূর্তে এছাহাকের সঙ্গে দেখা। এছাহাক বলল, মাস্টার মশাই জগ লইয়া কই যান?

সেরখানেক দুধ কিনব।

কেন? আপনের না গাই আছে? দুধ দেয় না গাইতে?

তা দেয়। কিন্তু আজকাল আর দুধ পাচ্ছি না তেমন। সকালে উঠে দেখি গাইর ওলান চিমসানো। দুধ নাই।

রাইতে কেউ দুধ দোয়াইয়া নিয়া গেছেনি?

তাতো জানি না।

দেখেন সাপের নজর পড়ছেনি। অনেক সাপ কিন্তু রাইত-বিরাইতে জঙ্গল থেকে আইসা গরুর দুই পায়ে প্যাঁচ দিয়া ওলান থেইকা দুধ চুইসা খায়।

মহিতোষ হাসেন। জবাব দেন না। এছাহাক বলে, বিশ্বাস না হইলে ওলান চেক কইরা দেইখেন। সাপের দাঁতের দাগও লাইগা থাকে।

আচ্ছা। দেখব নে। বলে পাশ কাটান মহিতোষ। মফিজুল গোয়ালাও অবশ্য তাকে দেখে অবাক হয়। সে বলে, কী ব্যাপার মাস্টার মশাই, আপনের না গাই আছে?

তা আছে। তবে শুনলাম তোমার গাইর দুধ না-কি খুব মিষ্টি।

মফিজুল গোয়ালা কখনো দুধে পানি মিশায় না। মিষ্টি না হইয়া যাইব কই?

মহিতোষ দুধ কেনেন। বড় সিলভারের গ্লাসে দুধ মেপে দিতে দিতে মফিজুল বলে, আপনে না-কি দ্যাশ ছাড়তেছেন? এইটা কেন করতেছেন মাস্টার মশাই?

এখনো তো ছাড়ি নাই।

কিন্তু ছাড়বেন তো?

দেখি। আসলে আমার শ্বশুরবাড়ি তো ওই পারেই। এই পারে দাদা-দিদি ছিল। দিদির তো বিয়েও হয়ে গেল ওইখানে। দাদাও নেই। বোঝোই তো, সবাইরে দেখতে মন কেমন করে!

তা অবশ্য ঠিক কথা। আপনা মানুষ না থাকলে সব খাঁ খাঁ করে।

তা খাঁ সাহেবের কী খবর?

আশরাফ খাঁ?

হুম।

মন মেজাজ ভালো না। চারদিকে খারাপ সংবাদ। তার মধ্যে সৎ ভাইরা উইঠা পইড়া লাগছে। এর মধ্যে মন ভালো থাকে?

তা অবশ্য ঠিক। আমার একটু তার সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার।

তা গেলেই তো হয়। খাঁ সাহেব বেশির ভাগ সময় দহলিজ ঘরেই থাকেন।

তারপরও। তুমি একটু তারে খবরটা দিও যে আমি একদিন আসতে চাই।

মফিজুল কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই তাকে চোখ টিপে থামতে ইশারা করলেন মহিতোষ। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া যে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন তা হঠাৎই খেয়াল করেছেন তিনি। ঘুরে বললেন, কী খবর ভূঁইয়া সাব?

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তবে মফিজুলকে বললেন, তোর গাই কয়টা?

এই আল্লাহর ইচ্ছায় দুইটা গাই।

দুইটা গাইতে দুধ হয় কয় সের?

তা সাত আট সের হয়।

এই সময়ে ক্ষেতে নাই ঘাস। গরুরে কী এমন জিনিস খাওয়াস যে এত দুধ হয়?

মফিজুল হাসে, আমি দুধে পানি দিই না ভূঁইয়া সাব।

আমি কি বলছি তুই দুধে পানি দিস? আগ বাড়াইয়া কথা বলিস কেন? না-কি চোরের মনে পুলিশ-পুলিশ, অ্যাঁ? মফিজুল কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া মহিতোষের দিকে ফিরলেন। তারপর বললেন, তা কয় সের দুধ কিনলেন? শুনলাম আপনের গাইর দুধ না-কি কারা অন্ধকারে দোয়াই নিয়া যায়?

এইটা কি মগের মুলুক না-কি? আপনে এই ঘটনা আমারে জানাবেন না?

মহিতোষ নমনীয় ভঙ্গিতে হাসলেন, আমি তো আর কাউরে দেখি নাই। না দেখে আন্দাজে কীভাবে বলি?

সব তো আর চোখে দেখন যায় না। কিছু জিনিস অনুমানেও বোঝা যায়। যায় না?

তা যায়।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াও দুধ কিনলেন। তারপর বললেন, আপনেরে তো বলেছিই, যেকোনো দরকারে আমারে জানাবেন। সঙ্কোচ করবেন না। আমি তো আর দূরের কেউ না।

জি জি। জানাব।

আর জমির গাহেক পাইলেন?

সবাই শুধু আপনার কথাই বলে। বলে যে এই বাজারে জমি কেনার ক্ষমতা কার আছে? এক যদি কেউ পারে, তবে সে ভূঁইয়া সাবই।

মানুষ যে আমারে কী ভাবে কে জানে! বলে মৃদু হাসলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তারপর বললেন, এক কাজ করেন, জমির দলিল পর্চা নিয়া একদিন আসেন। দেখি কতটুকু কী জমি আছে! আর জানেনই তো, আজকাল জমি কেনাও এক ফ্যাসাদ। সব জমিতেই তো কোনো না কোনো ঝামেলা থাকে। নিষ্কণ্টক বলতে তো কোনো জমি নাই। টাকা দিয়া জমি কিনব, তারপর বছরের পর বছর মামলা মোকাদ্দমায় জীবন শেষ।

মহিতোষ ম্লান হাসলেন। তবে কথা বললেন না।

.

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার ক্যাশ বাক্সের ওপর নানা কাগজপত্র বিছানো। এছাহাক উবু হয়ে গভীর মনোযোগে সেসব দেখছে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, আবহাওয়া কেমন রে এছাহাক?

ভালো।

কেমন ভালো?

আপনে যেই দাম বলবেন, সেই দামেই জমি বেচতে বাধ্য হইবো মহিতোষ মাস্টার।

আমি কিন্তু তারে জোর-জুলুম করব না। সে নিজের ইচ্ছায় আমার মন মতো দামে জমি বেইচা যাইব, এই ব্যবস্থা করতে হবে।

নিজে আইসাই বেচবে। ব্যবস্থা আমি করব। আপনি চিন্তা করবেন না। এলাকায় যে-ই জমি বেচুক বা কিনুক, আমার কাছেই তো সবার আগে আসতে হবে, না কি? এত বছর ধইরা জমির দালালি করি, আর আমার অগোচরে কেউ জমি বেচবে বা কিনবে, এইটা তো হবে না। আর যে-ই আমার কাছে আসে, জমির খোঁজখবর নেয়, আমি স্পষ্ট বলে দিই যে ভূঁইয়া সাব তো এই জমি বায়না। করছে। এক জমি কয়জনে কিনবেন? বলে পানের পিক ফেলল এছাহাক। তারপর বলল, শোনেন, এই জমি সে আপনে ছাড়া আর কারো কাছেই কোনোদিন বেচতে পারব না। বেচতে যাইতেই পারব না। আপনে নিশ্চিন্তে থাকেন। আমি তো আছি।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এটা জানেন। আর জানেন বলেই তিনি নিশ্চিন্ত। কম করে হলেও পঁচিশ বিঘা জমি হবে মহিতোষের। সঙ্গে তার ভাই পরিতোষেরও কিছু জমি। দেশ ছাড়ার তাড়াহুড়ায় তখন সব জমি সে বিক্রি করে যেতে পারেনি। এর বাইরে ভিটা-বাড়ির হিসেব আলাদা। শানবাঁধানো ঘাটসহ পুকুর। পেছনে বিশাল বাগান। ফলদ গাছগাছালি। এক কথায় সোনার খনি। এই সোনার খনির দিকে বহুদিনের নজর তার। আর মাত্র কটা দিন। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর বড়ই যন্ত্রণার। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, তবে একটা কথা?

কী কথা?

মহিতোষের মতিগতি কিন্তু ভালো না।

কী মতিগতি?

আইজ সকালে দেখলাম সে উত্তর পাড়ার মফিজুলের সঙ্গে কী ফিসফিস করতেছে। আমি আড়তে বসা ছিলাম। তার হাবভাবে কেন জানি আমার সন্দেহ ঠেকল। তার তো বাড়িতে গাই আছে, তারপরও তার দুধের এত দরকার যে বাজার থেইকা কিনতে হইবো? তাও আবার আর কারো কাছের থেকে না। একদম উত্তরপাড়ার মফিজুলের কাছ থিকাই?

আমার সঙ্গেও তো দেখা হইলো। বলল যে কারা যেন রাইতে গাই দোয়াই নেয়।

কী জানি! আমি পরে আড়ত থিকা উঠে গেলাম। গিয়ে শুনতেছি, সে উত্তরপাড়ায় জানি কার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

কী বলেন?

হুম। আচমকা আমারে দেইখা চুপ হয়ে গেল। তুই বিষয়টা দেখিস। আমার কিন্তু নানান দিকে নানান শত্রু আছে। এইদিকে ওইদিকে প্রচুর মানুষ একটা মাত্র সুযোগের অপেক্ষায় আছে। এরা কেউ কিন্তু সুবিধার না। কোনদিক দিয়ে আবার কোন ঝামেলা বাধায় কে জানে!

এছাহাক চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, হুম। আপনে চিন্তা নিয়েন না। বিষয়টা আমি দেখতেছি।

.

এছাহাক মহিতোষের বাড়িতে এলো পরদিন দুপুরে। সে সরাসরিই বলল, জমি বেচনের মতো পাইছেন কাউরে?

মহিতোষ স্নান গলায় বললেন, তুমি এই এলাকার সবকিছু জানো। সবার জমি-জমা কেনা-বেচার মধ্যস্থতা করো। তুমি না পেলে আমি কীভাবে পাব?

আসলে কী, আপনের দাম কমাইতে হবে। দাম না কমাইলে এই বাজারে এত জমি বেচতে পারবেন না!

আর কত দাম কমাব? এর চেয়ে কম দামে আর কোথাও এই জমি কেউ পাবে? তাও আবার বসতভিটাসহ?

মহিতোষ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই এছাহাক বলল, শুনলাম আপনে না-কি উত্তরপাড়ায় কার সঙ্গে দেখা করতে যাইবেন? এইটা একটা ভালো বুদ্ধি। যদিও এখন কারো অবস্থাই খুব একটা ভালো না। আশরাফ খাঁর কথা শুনছি সৎ ভাইগো সঙ্গেই নানা মামলা-মোকদ্দমা শুরু হইছে। জলিল খাঁর অবস্থাও সুবিধার না। মোতাহার তালুকদার তো ঘরেই পড়া। এর মধ্যে তারা কেউ এত দূরের এই জমি কিনবো বলে তো মনে হয় না!

এই অবেলায় এছাহাকের এভাবে বাড়ি আসার উদ্দেশ্য অবশেষে পরিষ্কার হলো মহিতোষের কাছে। ঘটনা তাহলে তার কান অবধিও পৌঁছে গেছে? এখন অবশ্য লুকিয়েও আর লাভ নেই। তিনি হাসি হাসি মুখে বললেন, বিষয়টা নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলব ভাবছিলাম। তার আগেই তুমি এসেছো, ভালো হয়েছে। ভূঁইয়া সাব তো সেদিন বললেনই, কিছু ভালো কাস্টোমার খুঁজে দেখতে। এখন খাঁ সাব ছাড়া তো আর কাউরে দেখছি না।

না…। তা ঠিক আছে। চিবিয়ে চিবিয়ে কথাটা বলল এছাহাক। তারপর বলল, তা যাইবেন যখন, আমিই আপনারে নিয়া যাব। খাঁ সাবের সঙ্গে আমারও তো ভালো চিন-পরিচয় আছে। কবে যাইবেন জানাইয়েন।

আচ্ছা। হাসি মুখে বললেন মহিতোষ। তবে এছাহাক চলে গেলেও তার বুকের ভেতর থেকে দমবন্ধ অনুভবটা আর দূর হলো না। বরং বাড়তে লাগল। আশরাফ খাঁর সঙ্গে দেখা করলেও এখন আর লাভ হবে বলে মনে হয় না। কারণ তার সঙ্গে থাকবে এছাহাক। আর কে না জানে এছাহাক জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার খাস লোক। সে কোনোভাবেই এই জমি অন্য কারো কাছে বেচতে দেবে না। নিশ্চয়ই আশরাফ খাঁকে এমন কোনো ইঙ্গিতই সে দেবে। ফলে এক গাঁ থেকে আরেক গাঁয়ে এসে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার প্রত্যাশিত জমি কিনে শুধু শুধু ঝামেলায় জড়াতে চাইবেন না অন্য কেউই। তা সে আশরাফ খাঁ হোক, বা জলিল খাঁ। মোতাহার তালুকদার অবশ্য এখন একভাবে হিসেবের বাইরেই। তারপরও আশরাফ খাঁর কাছে যাবেন মহিতোষ। একবার শেষ চেষ্টাটা করে দেখতে চান তিনি।

.

পরের শুক্রবার জুমার নামাজের ঘন্টাখানেক পরে খাঁ বাড়ির দহলিজ ঘরে পৌঁছালেন মহিতোষ। তাঁর সঙ্গে এছাহাক। আশরাফ খাঁ বসে আছেন চেয়ারে। তার পায়ের কাছে জলচৌকি রাখা। তিনি সেই জল চৌকিতে পা রেখে বসেছেন। আশরাফ খাঁ বয়সে যতটা না বৃদ্ধ, তার চেয়েও বেশি বৃদ্ধ তাকে দেখে মনে হয়। নানা কারণে শরীরটা ভেঙে পড়েছে। গত কিছুদিন ধরে কোমরে খুব ব্যথা। উঠতে বসতে ভারি কষ্ট হয়। ইদানীং তা পায়ে এসে পৌঁছেছে। নামাজের সময় ইশারায় নামাজ পড়তে হয়। বসতে হয় উঁচু কিছুতে পা রেখে। তার পরনে গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা জোব্বা। মাথায় টুপি। মুখে দাড়ি। তিনি মহিতোষের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি আছি নানা ঝামেলায়। এর মধ্যে নতুন কোনো ঝামেলা আর মাথায় নিতে চাই না। এই জমি-জমা এমন এক জিনিস, ভাইয়ে-ভাইয়ে সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়। মামলা-মোকাদ্দমা, খুনাখুনি শুরু হয়। এইগুলার মধ্যে আমি আর যেতে চাই না। মহিতোষ নরম গলায় বললেন, এই জমিতে কোনো ঝামেলা নাই খাঁ সাব। আমার পৈতৃক সম্পত্তি। কোনো উত্তরাধিকারও নাই যে পরে ঝামেলা করবে। তা ছাড়া আমি একদম নামমাত্র মূল্যে ছেড়ে দিচ্ছি। বসতভিটাসহ। পুকুর আছে, বাড়ি আছে, বাগান আছে। বলতে বলতে যেন গলা খানিক ভার হয়ে এলো মহিতোষের।

তা ভুবনডাঙায় এই জমি কেনার মতো কেউ নাই? এতদূর আমার কাছে কেন আসছেন মাস্টার?

বলে সামান্য থামলেন আশরাফ খাঁ। তারপর বললেন, এই যে এছাহাক আসছে, ও-ই তো জমি বেইচা দিতে পারে। এই, তুই জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ারে বললেই তো পারস?

এছাহাক শুষ্ক কণ্ঠে বলল, সে তো কিনতেই চায়। কিন্তু মাস্টার মশাইর তাতে পোষায় না। তার বেশি দাম লাগব জমির। এই বাজারে অত দাম দিয়া জমি কে কিনব?

তাও কিন্তু কথা মাস্টার। আপনে এখন জমির দাম বেশি পাইবেন না। তা জাহাঙ্গীর কত বলে?

মহিতোষ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই এছাহাক জমির বিঘা প্রতি একটি কাল্পনিক দাম বলে ফেলল। যা বর্তমান বাজার বিবেচনায় মোটেই ফেলনা কিছু নয়। বরং সন্তোষজনক। এছাহাকের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন মহিতোষ। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া কেন, কেউই তাকে কখনো এই জমির এত দাম বলেনি! কিন্তু এছাহাকের সামনে বসে এই কথার বিপরীতে কিছু বলতেও সাহস পাচ্ছেন না তিনি। দাম শুনে আশরাফ খাঁও খুবই অবাক হলেন। তিনি বললেন, দেশের অবস্থা তো জানেনই। এই পরিস্থিতিতে এত দাম দিয়া যদি কেউ জমি কিনতে চায়, তাইলে আপনের অবশ্যই বেইচা দেওয়া উচিত মাস্টার। এরপর আর কথা থাকে না।

মহিতোষ শেষ চেষ্টাটা চালালেন, আসলে ভূঁইয়া সাব বলছিলেন যে উনি এখন জমি-জমা কিনবেন না। এতটাকা এই মুহূর্তে ওনার কাছে নেই। কিনলেও দেরি হবে। কিন্তু আমার এখনই দরকার। ইমার্জেন্সি। এইজন্যই আপনার কাছে আসা। আসলে খাঁ সা, এত দামও আমার চাই না। এর অর্ধেক দামেও আমি জমি দিয়ে দেব। আপনি একটু দেখেন। খুব উপকার হয় আমার! মহিতোষের কণ্ঠে মিনতি।

আশরাফ খাঁ সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবলেন। তারপর বললেন, অত দাম রাইখা এত কম দামে কেউ জমি বেচে? যদি সে বোকা না হয়? কী বলিস এছাহাক?

সেইটাই। আপনে চিন্তা নিয়েন না খাঁ সাব। আমি জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ারে বইলা আগেই টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করব।

তাইলে তো ভালোই। বলে মহিতোষের দিকে তাকালেন আশরাফ খাঁ। বললেন, অত টাকা দিয়ে জমি কেনার অবস্থা আমার নাই। এখন যদি জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া নগদ টাকা দিতে না পারে, আর আপনের ইমার্জেন্সি টাকা দরকার হয়, তাইলে আমি জমি কিনতে পারি। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে আপনে দাম পাইবেন কম। সে যেই দাম বলছে, তার তিন ভাগের এক ভাগ দাম দিতে আমি রাজি আছি। এখন আপনে হিসাব-নিকাশ কইরা দেখেন মাস্টার। সিদ্ধান্ত আপনের। এর বেশি কিছু আর আমার বলার নাই।

মহিতোষ বড় আশা করে এসেছিলেন। ভেবেছিলেন অন্যরা জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে ভয় পেলেও আশরাফ খাঁ অন্তত পাবেন না। আগের সেই শক্তি-সামর্থ্য তার না থাকলেও এখনো লোকে তাকে মান্যগণ্য করে। কিন্তু তিনিও যে জমির এত কম দাম বলবেন, এটি মহিতোষ আশা করেননি। প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়েই তিনি খাঁ বাড়ি থেকে বের হলেন। গহিন অন্ধকারে প্রত্যাশার যে আলোটুকু টিমটিম করে জ্বলছিলো, তাও যেন দপ করে নিভে গেল। দহলিজ ঘর থেকে বের হতেই সুপারি বাগান। বাগান পেরোতেই মূল রাস্তা। তারা যখন সেই রাস্তায় এসে দাঁড়াল, তখন কেবল আসরের আজান হয়েছে। মহিতোষের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল এছাহাককে কিছু বলতে। কিন্তু কী বলবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তারপরও যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত করেই তিনি বললেন, তুমি যে বললে ভূঁইয়া সাব ওই দামে জমি। কিনতে চেয়েছেন, কখন চেয়েছেন? শুধু শুধু মিথ্যা কথাটা কেন বললে?

এছাহাক বিগলিত ভঙ্গিতে হেসে বলল, ও মাস্টার সাব। আপনারে বলতে ভুলে গেছিলাম। গতকাইলই ভূঁইয়া সাব আমারে বলল, আপনে যদি বছর দুই অপেক্ষা করতে পারেন, তাইলে উনি ওই দামেই জমি কিনবেন। কারণ পরের বছর চেয়ারম্যান ইলেকশনে উনিই জিতবেন। তখন তো টাকা-পয়সা হাতে আসব, বুঝলেন না?

অতদিন আমি কীভাবে অপেক্ষা করব?

সেইটা আপনার বিবেচনা।

মহিতোষ কথা বললেন না। কিছুদূর হেঁটে এসে এছাহাক হঠাৎ বলল, আপনে তাইলে বাড়ি যান মাস্টার সাব, আমার একটু বড় বু জানের বাড়ি যাইতে হইবো। মোল্লাকান্দি। আমি এই ক্ষেতের আইল ধইরা আড়াআড়ি নাইমা যাব। আপনে একা যাইতে পারবেন না?

পারব না কেন? এখনো তো বেলা আছে। বলেই হাঁটা ধরলেন মহিতোষ। এছাহাক ক্ষেতের আইল ধরে নেমে হাঁটতে শুরু করল। তবে সে চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন মহিতোষ। তারপর কী মনে করে আবার পেছন দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে কিছুতেই ওই জমি ভোগ করতে দেবেন না তিনি। প্রয়োজন হলে আশরাফ খাঁকে বিনামূল্যে সব লিখে দিয়ে যাবেন। তাও জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে নয়। লোকটা তার হাড় জ্বালিয়ে কালো করে ফেলেছে। নিজের ক্ষতি করে হলেও এই শোধটুকু তিনি নেবেন। মহিতোষ আবার হেঁটে এসে যখন খ বাড়ির মসজিদের সামনে দাঁড়ালেন, তখন আসরের নামাজ শেষে আশরাফ খাঁ লাঠিতে ভর দিয়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসছেন। তাকে দেখে বললেন, কী ব্যাপার মাস্টার, এখনো যান নাই?

আপনার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে খাঁ সাব।

কী কথা?

আপনি যেই দাম বলছেন, ওই দামেই আমি জমি বেচব।

কী বলেন আপনি? ভেবে বুঝে বলতেছেন তো?

জি, ভেবেই বলছি। আপনি দাম না দিলেও বেচব। তবে একটা কথা।

কী কথা?

এই কথা আপনি আর কারো কাছে এখন বলবেন না। যেদিন আমি আপনারে জমি লিখে দিয়ে ভুবনডাঙা ছেড়ে চলে যাব, সেই দিন আপনি এই কথা বলবেন। এটা আমার অনুরোধ।

আশরাফ খাঁ কথা বললেন না। তিনি বুঝতে পেরেছেন মহিতোষ বড়সড় কোনো বিপদে পড়েছেন। তবে এটা তার জন্য একটা সুযোগ। এই সুযোগ তিনি। হেলায় হারাতে চান না। তিনি মহিতোষের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। বললেন, আচ্ছা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *