না – ১০

১০

ভালো ঘুম হয়নি রাতে। অফিস বন্ধ আজ। বেলা করে ঘুমানো যেত। গাঢ় ঘুম এল না রুবার চোখে। বিছানা থেকে নেমে মশারি খুলে ভাজ করে রাখল বেডের তলে। বাথরুমে যাওয়ার দরকার। তাড়া থাকলেও সাড়া নেই তেমন। শরীর গুটিয়ে জানালার দিকে মুখ করে আবার শোয় ও।

কিছুদিন আকাশ গোমড়া ছিল, বর্ষার কালো ছাঁট ছিল আকাশে। গোমড়া কালো বর্ষার আকাশকে দূরে ঠেলে দিয়েছে নীল আকাশের বুকে ঘাপটি মেরে বসে থাকা সাদা মেঘের ছোট ছোট পাহাড়। মেঘ-পাহাড় উড়ে যাচ্ছে না, বসে আছে আকাশের নীল চাদরের বুকে। খাটে শুয়ে রুবা দেখছে প্রকৃতির অপরূপ ঢেউ। নীল আর সাদার গোপন মিলনে ছেয়ে গেছে দরের দষ্টিরেখা। নীল আর সাদা শরতের রং। শরৎ কি চলে এসেছে? মনে প্রশ্ন আসার সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে শুয়ে, পেটটা জেঁকের মতো বাঁকিয়ে মাথাটা সামান্য টেনে জানালার গ্রিলের কাছে চলে আসে রুবা। পাশের বাড়ির পরেই আছে একটা গোছানো বাড়ি। বাড়ির গেটের বাঁ পাশে রয়েছে এক টুকরো জায়গা। ওই দিকে চোখ যায় ওর। জায়গাটাতে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একঝাড় দোলনচাঁপা গাছ। মনে হচ্ছে, সাদা শাড়ি পরে এদিকে তাকিয়ে হাসছে দোলনচাঁপা-পড়শি হিসেবে রুবা দেখছে দোলনচাঁপার শুভ্রতা, পাচ্ছে মায়াবী এক গন্ধ। গন্ধহীন নীল অপরাজিতার এক রূপ আর গন্ধময় দোলনচাঁপার অন্য রূপ। অপরূপের এ প্রকৃতিতে সামনের বাড়ির দেয়ালে দেহের সব নীল উজাড় করে একাকী ফুটে আছে নীল অপরাজিতা। একাকিত্বের কষ্টের সঙ্গে কি প্রতিযোগিতা করছে, নাকি আকাশের নীলের সঙ্গে মেশার টানে নীল হয়ে ফুটে থাকে এই ফুল?

নীল রং রুবার মনে জাগিয়ে তোলে জমাট কষ্ট, নীল হাহাকার। আবার তাকাল ও দোলনচাঁপার দিকে। সাদা আর নীল ফুল দুটি হচ্ছে শরতের রাজজুটি। রাজজুটির সাদা রং নীলের মধ্যে ঢেলে দিয়েছে আবার স্বচ্ছতার পরশ। নিজের মনের পুরো স্বচ্ছতা নিয়ে হেসে ওঠে, টের পায় রুবা। টের পেয়ে উঠে বসে। পা বাড়াল বাথরুমের দিকে। একবার ও দেখে নেয় দুই রুমমেটকে। দুটি সরল কিশোরী মশারির মধ্যে গুটি মেরে শুয়ে আছে। ঘুমাচ্ছে। মনে হচ্ছে শীতের ছোঁয়ায় নয়, ঘুমের মধ্যে তারা কুঁকড়ে আছে ভয়ে। ওদের দিকে তাকিয়ে মায়া লাগছে। ভয়ও জাগছে। মায়া ও ভয়ের অনুভূতি নিয়ে এগিয়ে যায় ও প্রকৃতির ডাকে।

বাথরুমের লুকিং গ্লাসে চেহারা দেখে চমকে ওঠে রুবা। এক দিনে কেমন ঠেসে গেছে, বয়স বেড়ে গেছে, শুষ্ক লাগছে মুখ। নিজেকে দেখে অসহায় লাগছে। শ্বাস ছাড়ল বড় করে। মন হালকা হচ্ছে না তবুও। মনে চাপ নিয়ে ফিরে আসে আবার রুমে।

সানিয়া কোলবালিশটাকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। ঝুলে আছে মণির মশারি। বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে মশার ঝাঁক ভেতরে। ঘুম ভাঙছে না তবুও। সারা রাত ঘুমোয়নি ওরা। শেষ রাতের দিকে ঘুম এসেছে। এজন্য এই বেহাল দশা। মায়া লাগছে দেখে ওদের।

রুমে ফিরে মুঠোফোন হাতে নেয় রুবা। প্রথমে ভেবেছিল ছোট বোন আনিকাকে এসএমএস দেবে। মত বদলিয়ে এসএমএস করে রবিনকে। এসএমএস ডেলিভারির কোনো সংকেত না পেয়ে কল করল রুবা। কল কানেক্ট হচ্ছে না। রবিনের ফোন এখনো বন্ধ। বন্ধের দিনটা রবিনের সঙ্গে কাটাতে চেয়েছিল। কখন ঘুম থেকে উঠবে সে, কখন কল করবে, কে জানে। মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি আসে। কল মি লিখে মেসেজটি পাঠিয়ে দেয় রুবা। তারপর কল করে আনিকাকে। এনগেজড টোন আসছে। বিষয়টা কী? ওর সেলফোন এনগেজড পাওয়া যায় কেন সব সময়! তবে কি কোনো বন্ধু জুটেছে? সব সময় কথা বলে! বন্ধের দিন আজ। হয় ঘুমাবে, নয় পড়বে। স্টুডেন্ট মানে পড়াশোনা। পড়াশোনায় কি তবে মন নেই আনিকার? রেজাল্ট কেমন করছে কে জানে। কথা প্রসঙ্গে বিষয়টা এলে এড়িয়ে যায় সে। এবার গেলে স্কুলে গিয়ে খোঁজ নেবে। আবার কল করে আনিকাকে। না। ফ্রি হয়নি লাইন। ওকেও মেসেজ পাঠায়–কল মি।

দুটো মেসেজ পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে উত্তর পাওয়ার জন্য। নিজের টেবিলের দিকে মনোযোগ দেয়। টেবিলটা গোছাতে গিয়ে দেখতে পায় পুরোনো একটা হেলথ ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে পড়তে লাগল ও। ব্রেকিং ব্যাড নিউজ কলামটি পড়ে চমকে ওঠে মন। ব্যাড নিউজ এখন চেপে বসেছে তিন রুমমেটের জীবনে। নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত ঘটনাটি। অন্যদের কাছে ব্রেক করা উচিত নয় আগ বাড়িয়ে–সমস্যা এলে মোকাবিলা করা যাবে, ভেবে সমস্যার আপাত সমাধান বের করে অলীক সান্ত্বনা খুঁজতে থাকে ও। অন্য রুমমেট সিমি পলাতক। বিষয়টা সহজে মিটমাট হবে বলে মনে হচ্ছে না। কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়, শঙ্কার বিষয়টি মোটেই উবে যায় না মাথা থেকে। পলাতক সেজে কেবল নিজেকে আড়াল করেনি সিমি, একই সঙ্গে নিজেদের মনোজগৎ থেকে পলাতক বানিয়েছে অন্য রুমমেটদেরও। এই বোধটুকু কাজ করেনি সিমির মনে। এত বোকা ছিল না সে কখনো। বোকা সেজেছে, নাকি হয়েছে অতি চালাক? অতি চালাকের গলায় দড়ি! হ্যাঁ। দড়ির গিঁট লেগেছে সিমির পায়ে। এই গিট গলাতেও জড়াতে পারে। এ দডি বাঁধতে পারে কোমলমতি তিন রুমমেটকেও, ভাবেনি সে। ডুবে গেছে।

মুঠোফোন বেজে উঠেছে। রিংটোনের শব্দ শুনে মোচড় দিয়ে শোয় মণি। সানিয়াও এক পাক ঘুরে খাটের কিনারে চলে আসে। রিংটোনে দুই রুমমেটের ঘুম ভাঙুক, চায় না রুবা। থমকে যায় অ্যাটেন্ড করতে গিয়ে। অচেনা নম্বর থেকে কল এসেছে। ধরবে কি না, দ্বিধায় পড়ে চট করে কেটে দেয় লাইন। রুমের বাইরে চলে আসে। বুঝতে পারে আবার আসবে কল। হ্যাঁ। কল হচ্ছে। এবার নাম ভেসে উঠেছে-সিমির আব্বু। মানে সিমির বাবা ফোন করেছে। বুকে দ্রিম করে আঘাত করে জীবনের কঠিনতম বাজ। গতকাল থেকে সিমি নেই রুমে। রুমমেট হিসেবে বিষয়টি জানানো উচিত ছিল ওদের বাসায়। এটা হওয়া উচিত রুমমেটের একটি অলিখিত দায়িত্ব। দায়িত্বটি পালন করেনি, মনে পড়েনি সে কথা। দায়িত্বে কি গাফিলতি করেছে ও? কল অ্যাটেন্ড করে বলে, স্লামুয়ালাইকুম!

রুবা বলছ? নরম কণ্ঠে ভদ্র প্রশ্ন।

জি। আংকেল। রুবা বলছি।

সিমির বাবা বলছি আমি।

জি আংকেল। বুঝতে পারছি। আপনার নাম্বার সেভ করা আছে আমার ফোনবুকে।

সিমির কী হয়েছে, মা? কাঁদো কাঁদো গলায় প্রশ্ন করেন তিনি।

আংকেল সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক কথা শুনেছে রুবা। অনেক নির্মম আচরণ করেছেন তিনি সিমির সঙ্গে। সিমির চেয়েও কমবয়সি সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করেছেন, এর চেয়ে কঠিন ঘটনা কী হতে পারে একটি মেয়ের জীবনে। বাবার বেপরোয়া এ ভুল ক্ষুব্ধ করেছে মেয়েকে। ক্ষুব্ধ হয়ে ভুল পথের দিকে পা বাড়াতে উসকে দিয়েছে বাবার ভুল। মেয়ের শুদ্ধ পথে চলার পথটা জটিল করেছে। কুটিল পথে পা বাড়িয়েছে সিমি। বাড়ানো পা ফাঁদে পড়েছে। অজান্তে এ ভুলই কি ফাঁদের দিকে ঠেলে দিয়েছে সিমিকে? উড়িয়ে দেওয়া যায় না ভাবনাটা। নিজের ভেতর হতাশা থাকলে, কষ্ট থাকলে ভুল পথে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সেই জন্য কি ও নিজেকে ঠেকাতে পারেনি? অবশ্যম্ভাবী খারাপ পথের দিকে নিজের অজান্তে ছুটে গেছে সিমি? এমন বেপরোয়া ছিল না সে। মেধাবী সিমি, নিজেকে গড়ে তোলার জন্য এসেছিল ঢাকায়। এ মুহূর্তে পুরুষ কণ্ঠে বাবা-ব্যক্তিত্বের কোমল রূপটি ধরা পড়ছে। নির্মমতার কোনো চিহ্ন নেই তাঁর গলায়। পিতৃসত্তার কাছে পরাজিত এখন বাবার পুরুষসত্তা?

কোনো উত্তর না পেয়ে সিমির বাবা আবার বলেন, চুপ করে আছ কেন, মা! বলো কী হয়েছে?

আংকেলের কণ্ঠে আকুলতা দেখে রুবা প্রশ্ন করে, কী শুনেছেন আপনি?

কিছু শুনিনি আমি। জিজ্ঞাসাবাদের স্বীকার হয়েছি। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে তোক এসেছিল বাড়িতে। ওনারা ভালো আচরণ করেছেন আমাদের সঙ্গে। কেবল জানতে চেয়েছেন সিমির ব্যাপারে। বাড়িতে এসেছে কি না খোঁজ নিয়েছেন।

ওহ্। বলে চুপ থাকে রুবা। কী বলবে বুঝতে পারছে না।

চুপ করে আছ কেন? বলল, কী হয়েছে সিমির?

গতকাল রুমমেটদের কিছু না জানিয়ে রহস্যজনকভাবে রুম ছেড়ে গেছে সিমি। কোথায় গেছে তা আমরা কিছু বুঝতে পারছি না।

কাঁদতে শুরু করেছেন সিমির বাবা। বোবা হয়ে গেছে রুবা। এই বর্বর লোকটির কণ্ঠে কান্না কেন? মেয়ের জন্য কি তবে মমতা অমলিন?

আংকেল। কাঁদবেন না, প্লিজ। শক্ত থাকুন। বিপদে শক্ত থাকতে হয়।

কী করব আমরা? কোথায় খোঁজ নেব, বলো।

যথেষ্ট বুদ্ধি হয়েছে সিমির। নিজেকে রক্ষা করে চলবে সে। দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই। কোথায় আছে নিশ্চয় জানাবে। ধৈর্য ধরুন আপনি। আমরাও আছি ধৈর্য ধরে।

রুবার আশ্বাস ও সান্ত্বনায় আশ্বস্ত হচ্ছে না সিমির বাবার মন। মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক খুব খারাপ। খারাপ সম্পর্কের কারণে দীর্ঘদিন যোগাযোগ রাখেনি মেয়ে। পড়াশোনার খরচ নিজে চালাচ্ছিল ঢাকায়। একাকী ঢাকায় কোনো বিপদে পড়েছে কি না, কে জানে! ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের লোকজন বাড়িতে চলে এসেছে। বিষয়টাকে হালকা করে দেখার কোনো উপায় নেই। নিশ্চয় বড় কোনো বিপদ হয়েছে! অশুভ কোনো চক্রের সঙ্গে জড়িয়েছে কি সিমি? কোনো ক্রাইমের সঙ্গে কি সেঁটে গেছে? প্রশ্ন আসে বাবার মনে। মুষড়ে পড়েন তিনি। বিধ্বস্ত গলায় বলেন, যেকোনো খবর জানিয়ো। তোমার সংবাদের অপেক্ষায় থাকব আমি। বাড়িতে সিমি কিছু জানাবে বলে মনে হয় না। দীর্ঘদিন ধরে সে খেপে আছে আমার ওপর।

রুবা প্রায় বলে ফেলেছিল–সব জানি আমি। কথাটি সামলে নিল। এ মুহূর্তে হৃদয়বান এক বাবার সঙ্গে কথা বলছে ও। বুঝতে পারে। ওনাকে কষ্ট দিতে চায় না এখন। ভুল যা হবার হয়ে গেছে। আঘাত করে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে না এখন। বরং একজন বাবা যদি নিজের ভুল থেকে শিক্ষা পায়, সেটা হবে বড় লাভ। ভুল শুধরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে কি আসতে পারবে সিমি? সম্ভাবনার দুয়ার বন্ধ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। সব জায়গায় খোঁজ করছে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে। লুকানোর কোনো বিষয় না এটি। বোঝার বাকি থাকে না। সিমির এই অধঃপতনের জন্য নিজেকেও দায়ী মনে হচ্ছে। সিমিকে আফরিন হাতে পেয়েছে তার মাধ্যমে। নিজেকেও আর টেনশন-মুক্ত রাখা যাচ্ছে না। ঘটনাপরম্পরায় কানেক্ট হয়ে যাচ্ছে নিজেও। কোনো অপরাধ না করেও নির্মম টেনশন ঢুকে যাচ্ছে মনে।

ঠান্ডা গলায় রুবা বলে, আংকেল, যা হবার হবে। দুশ্চিন্তা করে নিজেকে অসুস্থ করে তুলবেন না। কোনো খবর পেলে জানাব আমরা, আপনিও জানাবেন আমাদের।

লাইন কেটে রুমে ফিরে আসে রুবা। দুই রুমমেট ঘুমাচ্ছে নিশ্চিন্তে। ঘুমে কি থাকা যায় নিশ্চিন্তে? যায় না। জীবনযাপনের চাপ ঘুমেও হানা দেয়, দুঃস্বপ্নের মাধ্যমে রিলিজ হয় সে চাপ। মণি ও সানিয়া সেই যাতনা ঘুমেও বহন করছে, দেখে বোঝা যায় বাইর থেকে। দুই প্রিয় মানুষকে মেসেজ পাঠিয়েছিল কল করার জন্য। কল আসছে না। ওদের কল পাওয়ার জন্য ব্যাকুল মনে চাপ বাড়ে। চাপ টের পাচ্ছে না রুবা। নিজের বেডে এসে শুয়ে পড়ে। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে ও। না। ঘুম আসছে না। নীরবে মুখ ঢেকে যাচ্ছে আঁধারে। মনের চাপ মুখে বসিয়ে দিচ্ছে কালো পর্দা। এ পর্দা ভেদ করে সামনে কিছুই দেখতে পারছে না রুবা। অনুভব করছে অজানা শঙ্কা। শঙ্কা নিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে ও।

আবার রিংটোন বেজে ওঠে। নাম না দেখেই চট করে ইয়েস বাটনে চাপ দেয় রুবা।

হ্যালো, কে বলছেন প্লিজ?

আপু, আমি। আনিকা। তোমার ফোনবুকে কি আমার নাম নেই? অভিমানী প্রশ্ন আনিকার।

কথার জবাব না দিয়ে দ্রুত বেড থেকে নেমে কক্ষের বাইরে আসে রুবা। অস্থির হয়ে নিরুত্তর সময়টুকুতে আবার প্রশ্ন করে আনিকা, কথা বলছ না কেন, আপু?

শীতল গলায় রুবা জবাব দেয়, ঘুমাচ্ছে রুমমেটরা, ওদের ডিস্টার্ব না করে বাইরে এলাম। জবাব দিতে দেরি হয়েছে সেজন্য।

তুমি কল করতে বলেছ। তাই কল করলাম। খবর কী? নতুন চাকরি কেমন লাগছে?

তোকেও ফোন করেছিলাম। এনগেজড পেয়েছি দুবার। দীর্ঘক্ষণ তোর ফোন এনগেজড থাকছে! বিষয়টা কী?

হোঁচট খেয়ে থেমে গেল আনিকা। কী জবাব দেবে ভাবতে লাগল। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে আবার প্রশ্ন করে রুবা, পড়াশোনা চলছে তো ঠিকঠাক?

প্রথম প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় আনিকা। দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে বলে, পড়ছি সামর্থ্য অনুযায়ী।

সামর্থ্য বলছিস কেন? চেষ্টা করতে হবে না? বেশি বেশি চেষ্টা করে সামর্থ্যের লেভেল বাড়াতে হবে না?

চেষ্টা করছি, আপু।

চেষ্টার মধ্যে জোর কম আছে মনে হচ্ছে। পড়ার সময়ও তোর সেলফোন এনগেজড থাকে। যখন ফোন করি, এনগেজড পাই। বোঝা যাচ্ছে পড়ার চেয়ে ফোনের দিকে বেশি ঝোঁক তোর?

এ কথাটার প্রতিবাদ না করে আনিকা আবার বলে, চিন্তা কোরো না। তুমি। পড়ায় আরও জোর দেব আমি।

সময় চলে গেলে জোর দিয়ে কী লাভ হবে?

সময় চলে যাবে না, আপু। সময় অপচয়ও করছি না। পড়ার সময় পড়ছি।

পড়লে ভালো। পড়াশোনা ছাড়া মেয়েদের মুক্তি নেই, মনে রাখিস।

ধমক আর বকা দেওয়ার জন্য কল দিতে বলেছ?

ধমক দিচ্ছি কোথায়। খোঁজখবর রাখছি তোর। টিনএজে নানা সমস্যা থাকে, চারপাশে নানা সমস্যা তৈরি হয়। অনেকে টপকাতে পারে, অনেকে পারে না। সাবধান থাকতে হয় এ কারণেই।

তোমার কথাবার্তার ধরনটা তো আজ দেখছি বেশি নেগেটিভ। বিষয়টা কী? কোনো সমস্যা হয়েছে, আপু?

বয়সে ছোট হলেও বোকা নয় আনিকা, চালাক। আপুর কথাবার্তার পরিবর্তনটুকু ধরতে পেরে প্রশ্ন করে বসেছে। নিজের প্রতি ছোঁড়া তিরটার মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে রুবার দিকে। কিছুটা নড়ে ওঠে থেমে যায় রুবা। দ্বন্দ্বে পড়ে যায়, নিজের সমস্যার কথা এখনই আনিকাকে জানানো উচিত কি না, ভেবে পায় না। চুপ থেকে ভাবতে থাকে।

আনিকা আবার বলে, অফিসের কথা বললে না যে! কেমন লাগছে অফিস?

অফিস নিয়ে সমস্যা নেই। ভালোই লাগছে। অফিসের কাজটা সেবামূলক। তাই আগ্রহ পাচ্ছি।

বাহ! তাহলে তো ভালোই আপু, সমস্যা কোথায়? সমস্যার কথা টানলে কেন?

নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চায় রুবা। গোটাতে পারে না, ভেতরের চাপ ঠেলে বের করে দিতে চাইছে গোপন টেনশনের কথা, তবুও আটকে রাখে নিজেকে। কথা ঘুরিয়ে বলে, আমাদের প্রতিষ্ঠানের হেড, কান্ট্রি ডিরেক্টরের কথা বলছিলাম। উনি কুষ্টিয়া বেড়াতে যাবেন। বেড়ানো এবং অফিশিয়াল কাজ দুটো টার্গেট করে যাবেন। বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত।

চিন্তিত কেন? উনি কি সত্যি সত্যিই ব্রাঞ্চ খুলবেন কুষ্টিয়াতে?

খুলতেও পারেন, জানি না ডিটেলস।

কুষ্টিয়া এলে কি বাসায় নিয়ে আসবে ওনাকে?

না। বাসায় যাবেন বলে মনে হয় না। যে পার্সোনালিটি ওনার! বাসায় যাবেন কেন?

না এলেই ভালো। বাসায় এনে নিজেকে ছোট কোরো না।

ছোট হওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন?

ছোট হবে না? আমাদের বাসার পরিবেশ কি তোমাকে ছোটভাবে তুলে ধরবে না ওনার সামনে?

অনেক বড় মাপের মানুষ উনি। অন্যকে ছোট চোখে দেখেন না। সমান চোখে দেখে থাকেন সবাইকে। আমাদের যা আছে, যে অবস্থা তা-ই দেখবেন, ক্ষতি কি?

বাবা যদি ওনাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে?

করলে করবে। কেউ নিজেকে ছোট প্রমাণ করতে চাইলে কী-ই বা করতে পারি আমরা। তা ছাড়া মনে হচ্ছে, যতই খারাপ হোক না কেন, বাবা তো বাবাই। কঠিন বাবার তলেও নরম বাবা লুকিয়ে থাকতে পারে। সেটা খুঁজে নিতে হবে আমাদের।

শোনো আপু, এসব তত্ত্ব কথা শুনিয়ো না। বাবাকে নিয়ে উন্নত ধারণা না রাখাই ভালো হবে, সে ডোবাবে তোমাকে। আমাকেও।

ডোবালে কি ডুবে যাব আমরা? মাথা উঁচিয়ে চলার সাহস পেয়েছি। উঁচিয়ে থাকব। কথা শেষ করে কতক্ষণ চুপ থাকে রুবা। ভেতরে ধস টের পায় ও। উঁচিয়ে চলতে চাইলে কি চলা যায়? নিয়তি কি নেই সামনে? কী আছে আগামী দিনগুলোতে কে জানে। সিমির ঘটনা কোথায় টেনে নেবে, তাও জানা নেই। শঙ্কা চলছে ভেতরে। ঘোলাটে ঘূর্ণির মতো স্রোত ঘুরে ফিরে দখল করে নিচ্ছে চিন্তা। তৈরি করছে নেতিবাচক আবেগ।

আবার প্রশ্ন করে আনিকা, কী হয়েছে আপু তোমার? কোনো বিপদ?

সরাসরি জবাব না দিয়ে আগের প্রসঙ্গ টেনে রুবা বলে, বাবা ডোবাতে পারবে না আমাদের। কেউ কাউকে ডোবাতে পারে না। নিজে ডোবাতে পারে নিজেকে।

আমাকে মিন করে কিছু বলছ, আপু?

একা তোকে বোঝাচ্ছি না। দুজনাকে বোঝাচ্ছি। যখনই ফোন করি তোর ফোন এনগেজড পাই। বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত আমি, জানালাম তোকে। আশা করি, আবেগে ভেসে দিন পার করবি না। চিন্তা ও বুদ্ধি খরচ করে চলবি।

আচ্ছা। চিন্তিত হয়ো না। মনে থাকবে তোমার কথা। এখন রাখি, আপু? রুবা বলে, আমার কথায় কষ্ট নিসনে। রাখ তাহলে। আল্লা হাফেজ।

লাইন কাটার সঙ্গে সঙ্গে আবার কল এল। রবিনের কল। ছোট বোন আনিকার সঙ্গে কথা বলে মন ভালো হয়েছে, খারাপও হয়েছে কিছুটা। এই ভালো এই খারাপ! এমন হয় কেন মন!

চিরায়িত কণ্ঠে রবিন খোটা দিয়ে বলে, কল করতে বললে, কল করছি তো করছি, এনগেজড পাচ্ছি কেবল। কার সঙ্গে এত কথা!

রাগ না করে রুবা বলে, আনিকার সঙ্গে কথা বলেছি এতক্ষণ। তোমাকে না পেয়ে ওকে ধরার চেষ্টা করেছি। পরে সে-ই কল করেছে।

উত্তর শুনে নেমে যায় রবিনের গলা। সহজ হয়ে বলে, কী জন্য কল দিতে বলেছ?

বন্ধের দিন আজ। ভাবলাম, একসঙ্গে কাটানো যায় কি না। তুমি ফ্রি থাকলে বের হতে পারি।

রবিন বলে, ফ্রি নেই। একজনের সঙ্গে দেখা করার কথা। প্রয়োজন আমার, চাকরির ব্যাপার। ১১টার দিকে যাব, কটায় ফিরব, জানি না।

ওহ্। বলে থেমে থাকে রুবা।

রবিন বলে, বিকেলের দিকে বের হতে পারি তোমার সঙ্গে।

বিকেলে তো বেশিক্ষণ থাকা যায় না বাইরে। সন্ধ্যার পর হোস্টেলে ফিরলে নানা জনে নানা কথা বলে।

কে বলে? কেন বলবে? রবিনের কণ্ঠে বিদ্রোহী প্রশ্ন।

কেন বলে, এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। কে বলে জানা আছে। যথাসম্ভব শীতল কণ্ঠে রুবা বলে, চারপাশের মানুষজন বলে, তুমিও পছন্দ কর না সন্ধ্যার পর ফেরাটা।

আমার সঙ্গে যাবে, আর আমি পছন্দ করব না? এটা কী ধরনের অভিযোগ?

কথা হচ্ছে সন্ধ্যার পর ফেরা নিয়ে। কার সঙ্গে বের হলাম সেটা নিয়ে নয়। সন্ধ্যার আগে ফেরার অভ্যাস করার জন্য তোমার সঙ্গও যথাসম্ভব এড়িয়ে চলি বিকেলের দিকে। তোমার সঙ্গে থাকলে ফিরতে রাত হয়ে যায়। পাড়ার লোকদের শ্যেন দৃষ্টি তখন উপেক্ষা করা কঠিন, বিরক্ত লাগে।

থেমে গেল রবিন। পাড়ার লোকদের কাছে খারাপ হোক রুবা, সেটা মোটেই চায় না সে। এখনো বেকার। চাকরি হচ্ছে না। বেকারত্বের জ্বালা বহন করা কঠিন। বেকারত্বের কারণে অন্তরের হতাশা, ক্ষুব্ধতা সামাল দিতে পারে না। তাই বলে ভালোবাসা নেই রুবার জন্য, মানতে পারছে না। অবশ্যই ভালোবাসে প্রাণ উজাড় করে। সেই ভালোবাসার প্রকাশভঙ্গি সব সময় একরকম থাকে না। নিজের হতাশা প্রকাশ পায় বেশি। সামাল দিতে হবে হতাশা, বুঝতে পারে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রবিন গুনগুন করে গেয়ে ওঠে–আমার মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি/তোমার লাগিয়া তখনি, বন্ধু, বেঁধেছিনু অঞ্জলি ॥

রুবার চোখে পানি চলে আসে। আনন্দে ভরে ওঠে মন। আনন্দের কান্না যে কত সুখের! টের পায় ও। রবিন তাকে বুঝতে পারছে। এটাই বড় আনন্দের বিষয়। বোঝাপড়ার ওপর বড় কোনো ওষুধ নেই। বোঝাপড়া থাকলে ত্যাগ করা যায় অনেক বড় স্বার্থও।

চোখের পানি সামলে রুবা বলে, আমাকে বুঝতে পারছ তুমি। এটা আমার বড় প্রাপ্তি। বড় আনন্দ।

রবিন উত্তর দেয়, তোমাকে বুঝিনি কখন? সব সময় বুঝতে পারি।

রুবা পাল্টা বলে, বুঝতে পারলেও না বোঝার মতো আচরণ কর অনেক সময়। তখন তোমাকে অচেনা লাগে। ভয়ংকর লাগে। মনে হয়, ছিঁড়ে ফেলি সব সম্পর্ক।

ওরে বাবা! এত বড় চিন্তা আসে মাথায়?

আমাকে সন্দেহ করলে আসে চিন্তাটা। সন্দেহ করবে কেন? সন্দেহ থাকলে ভালোবাসা থাকে না। জোরালো হয় না টান।

তুমিও সন্দেহ কর আমাকে। করো না?

চুপ হয়ে গেল রুবা। তাই তো! নিজের দোষটা দেখেনি ও। দেখেছে রবিনের দোষ। এজন্য দায়ী করছে তাকে। নিজের দোষও নিজেকে দেখতে হবে। বুঝতে পারে, সুস্থ থাকার জন্য এ ধরনের ভালো মনোভাবের বিকল্প নেই।

একঝলক আলো এসে পড়ে নিজের মুখে। রুবা বলে, এক ঘণ্টার জন্য হলেও বিকেলে দেখা কোরো।

রবিন বলে, আচ্ছা।

তাহলে রাখি এখন, বিকেল চারটায় চলে এসো ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমার পশ্চিম পাশের ফুটপাথে। বলে ফোন কেটে দিচ্ছিল রুবা।

রবিন প্রায় চিৎকার করে, মনে পড়েছে, এমন একটি ঘটনা টেনে এনে বলে, গতকাল পত্রিকায় একটা ছবি ছাপা হয়েছিল। একটা মেয়ে ধরা পড়েছে। মেয়েটির নাম আফরিন। তোমার একটা নতুন বান্ধবী হয়েছে, বলেছিলে আফরিন তার নাম। সেই মেয়েটি না তো ওই মেয়েটি?

দ্রিম করে একটা ধাক্কা লাগে মস্তিষ্কে। ভেবেছিল, বিকেলে ঠান্ডা মাথায় রবিনের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করবে। তার আগে প্রশ্ন করে বসেছে রবিন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে লাইন কেটে দিল রুবা। ভাবখানা এই যে, রবিনের কথা শোনার আগে লাইন কেটে দিয়েছে। লাইন কেটে দিলেও টেনশনের স্রোত থেমে যায়নি। বরং জোরালো গতিতে আসছে টেনশনের আক্রমণ। আবার কল আসতে পারে ভেবে ও বন্ধ করে দিল মুঠোফোন। বন্ধ করেও শান্তি নেই। রুমে ঢুকে তাকাল দুই রুমমেটের দিকে। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তারা। যেন শান্তির পায়রা উড়ে যাচ্ছে শরতের ওই দূর আকাশে। ওই আকাশে উড়ে যাচ্ছে সানিয়া, উড়ে যাচ্ছে মণি। নিজেও যেন উড়ে যাচ্ছে সাদা মেঘের দেশে…

১১

বিজ্ঞাপনের কাটপিসটা কয়েকবার উল্টে-পাল্টে পড়ে রবিন–বেপজার অন্তর্ভুক্ত বিদেশি বায়ার দ্বারা পরিচালিত সুপ্রতিষ্ঠিত গার্মেন্টস ও বায়িং হাউজে অতিসত্বর দক্ষ/অদক্ষ পুরুষ/মহিলা নিয়োগ করা হবে। সহঃ মার্চেন্ডাইজার-৮ জন (বিএ/এমএ)। বায়িং কিউসি-১০ জন (এইচএসসি)। ফ্যাক্টরি কিউসি-১২ জন, সুপারভাইজার–১৫ জন (৮ম)। বেতন ভাতা-আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারিত হবে। আছে হোস্টেল সুবিধা। হাজিরা ও ঈদ বোনাস, প্রয়োজনে দেওয়া হবে সনদপত্র।

কেন যেন মনে হচ্ছে চাকরিটা হতে পারে। চাকরির চেয়ে বড় হচ্ছে থাকার ব্যবস্থা করা। চাকরির সুবাদে থাকার জায়গা জুটলে মাথার ওপর থেকে চাপ কমে যাবে। ঢাকা শহরে থাকার চাপটা বড়। এমন বড় চাপ থাকলে চুপসে যায় মনের কোমল দিক। ঝলসে যেতে হয় ভেতরে ভেতরে। নিত্যদিন পুড়তে থাকা রবিন হাল ছেড়ে দিল না। কথা বলেছে ফোনে। বিজ্ঞাপনে দেওয়া ফোন নম্বরের ব্যবস্থাপকের কণ্ঠে পেয়েছে মার্জিত রুচিবোধের পরিচয়। বাসায় দেখা করতে বলেছেন বন্ধের দিন। দক্ষ নয় ও। অদক্ষ একজন চাকরিপ্রার্থীকে বাসায় যেতে বলবেন কেন? সহঃ মার্চেন্ডাইজারের কাজ কী, কাজের ধরন কী, কিছুই জানে না রবিন। কোয়ালিফিকেশনের ভেরিয়েশনটাও চোখে পড়ার মতো। বিএ কিংবা এমএ পাস হতে হবে। ডিগ্রির রেঞ্জটা এমন কেন! ঘাপলা আছে কি কোথাও? ভাবতে ভাবতে সার্টিফিকেটগুলো একবার দেখে ফাইলে নিয়ে বাসা থেকে বের হলো রবিন। ব্যবস্থাপকের বাসা ভূতের গলিতে, গ্রীন রোড ধরে রিকশায় যাওয়া যাবে। সায়েন্সল্যাবে বাস থেকে নামবে। তারপর ল্যাবএইডের সামনে দিয়ে রিকশায় অল্প পথ। হেঁটেও যাওয়া যাবে। হাঁটার পরিবর্তে রিকশায় চড়ার পরিকল্পনা আঁটে রবিন। নতুন কারও বাসায় ঘেমে গেলে স্মার্টনেস থাকবে না। রিকশায় যাওয়াটা ভালো হবে। ভেবে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। বাসের কিউতে দাঁড়াল ও। আজ রাস্তা অনেক ফাঁকা। অফিস খোলার দিন দম বন্ধ লাগে। অফিস আওয়ারে রাস্তায় বেরোলে নিঃস্ব লাগে, নিজেকে মনে হয় এতিম। বিরাট ঢাকা শহরে চাকরি নেই। টিউশনি করা ও পড়াশোনা চালানো দুটোই কঠিন কাজ। করেও যাচ্ছে কাজগুলো। জীবনসংগ্রামের অনিশ্চিত পথে হতাশা বাসা বাঁধে। মাঝে মাঝে মনে হয়, সব ছেড়েছুঁড়ে চলে যাবে কুষ্টিয়ায়, নিজের বাড়িতে। ইচ্ছা থেমে যায় রুবার কথা ভেবে। ঢাকা শহরে সংগ্রাম করে টিকে আছে একটা মেয়ে, ভালো চাকরি পেয়েছে। তাকেও টিকে থাকতে হবে, পেতে হবে প্রতিষ্ঠা। রুবার সঙ্গে সংসার করতে হবে। থেমে গেল ভাবনার চাকা। নির্দিষ্ট বাস এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। লাইন ধরে টিকিট কাটা যাত্রীরা উঠে যাচ্ছে বাসে। ডিসিপ্লিন আছে লাইনে। যাত্রীরা সুশৃঙ্খল। সাধারণত এমনটি হয় না। একটা হুড়োহুড়ি লঙ্কাকাণ্ড লেগে থাকে বাসে ওঠার সময়। এখন যাত্রীদের শৃঙ্খলাবোধ দেখে সাহস ফিরে আসে রবিনের মনে। শান্ত হতে থাকে অস্থিরতাবোধ। মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো সুশৃঙ্খল হতে থাকে। সাহস বেড়ে গেল ওর। বাড়তি সাহস নিয়ে উঠে বসে বাসে।

চলতে শুরু করেছে বাস। চলছে রবিনের মনও। মনের মধ্যে নতুন গতি টের পাচ্ছে ও। কোনো যাত্রী দাঁড়ানো নেই। সবাই বসে আছে নিজ নিজ সিটে। সিটের বাইরে অতিরিক্ত যাত্রী ওঠানো নিষেধ। ঠিকঠাক পালিত হচ্ছে নিয়ম। চারপাশটা এমন সুন্দর হতে পারে না?

ভাবনায় ছেদ পড়ে বেজে ওঠা মুঠোফোনের শব্দে। অচেনা নম্বর। ধরবে কি ধরবে না, ভাবতে ভাবতে চাপ দেয় ইয়েস বাটনে। ভারী কণ্ঠ শোনা যায় অপর প্রান্ত থেকে–আপনি কি রবিন?

জি। রবিন বলছি।

কথা বলা যাবে আপনার সঙ্গে?

আমি বাসে। চারপাশে অনেক যাত্রী।

তাহলে ছোট্ট একটা প্রশ্ন করব। ছোট্ট উত্তর দেবেন। অনেস্ট উত্তর চাই।

কে আপনি? ভারী গলার আওয়াজ শুনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রশ্ন করে রবিন।

পরিচয় পেলে ভয় পেতে পারেন। পরিচয় পরে দেব। আগে প্রশ্ন করছি। প্রশ্নের উত্তর দিন।

কী জানতে চাচ্ছেন, বলুন।

রুবা আপনার গার্লফ্রেন্ড, তাই না?

কারেন্টে শক খাওয়ার মতো কাণ্ড ঘটে যায়। ঝিনঝিন করে ওঠে মাথা। ভাবতেই পারেনি রুবা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করবে লোকটি। হঠাৎ কেমন হয়ে গেল বুকটা। উত্তর বেরোল না মুখ থেকে।

আবার লোকটি বলে, আমরা জেনেছি আপনি ভালো ছেলে। নিজেকে ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছেন। এও জানি, আপনি সৎ। তাই আপনার সঙ্গে কথা বলছি সম্মানের সঙ্গে, প্রশ্ন করছি। উত্তর পেলে আপনার ও রুবার লাভ হবে, ক্ষতি হবে না। নির্ভয়ে বলুন।

পরিচয় না জেনে এ প্রসঙ্গে কথা বলতে বা উত্তর দিতে চাচ্ছি না। রবিনের কথায় উত্তেজনা নেই, আছে ভয়। দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা ওর।

তাহলে ভয় না পেয়ে শুনুন, ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে বলছি আমি।

কয়েকবার ঢোক গেলে রবিন। কষ্ট হচ্ছে ঢোক গিলতে। শুকিয়ে গেছে গলা। দম উঠে বসে আছে গলায়। ও শান্ত থেকে উত্তর দেয়, রুবা আমার গার্লফ্রেন্ড।

গার্লফ্রেন্ড হিসেবে রুবা নিশ্চয় আপনার চোখে সুন্দর। নিশ্চয় ভালো। তবুও প্রশ্ন করছি, ওর সম্পর্কে নেতিবাচক জানেন কিছু?

রবিনের মনে প্রশ্ন আসে ইন্টেলিজেন্সের সদস্য হলে প্রশ্নকর্তা অফিসে ডেকে পাঠাতে পারত। টেলিফোনে কথা বলছে কেন? উত্তর ভাবতে গিয়ে শক্ত হয়ে যায় ও। গম্ভীর কণ্ঠে বলে, বলেছিলেন একটা প্রশ্ন করবেন। কথা রাখছেন না আপনি। বারবার প্রশ্ন করছেন।

ইনকোয়ারির স্বার্থে করতে হচ্ছে প্রশ্নগুলো। যথাযথ উত্তর না পেলে আরও ব্যাপক খোঁজখবর নিতে হবে আমাকে। তাই অল্পতে বিষয়টা সেরে নিতে চাচ্ছিলাম। আর একটা প্রশ্ন করব। উত্তর দিন প্লিজ।

নীরব থাকে রবিন।

প্রশ্নকর্তার কণ্ঠে বিনয়। অথচ দৃঢ় গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, রুবার ব্যাপারে পরিকল্পনা কি আপনার? খোঁজখবর রাখেন ওর বিষয়ে?

মাথা গরম হতে থাকে রবিনের। বিনয়ের জবাবে নিজেও বিনীত থাকার চেষ্টা করে। ভরা গলায় দাপটের সঙ্গে বলে, শিগগির বিয়ে করছি আমরা। চাকরি হয়ে গেছে ওর। আমার এখনো হয়নি। হলে বিয়ে করব। যাকে বিয়ের কথা ভাবছি নিশ্চয় তার সব খোঁজখবর জানি। অসাধারণ গুণবতী, সংগ্রামী একটি মেয়ে রুবা। ঢাকা শহরে টিকে আছে নিজের বুদ্ধি খরচ করে, কষ্ট করে। অবশ্যই সৎ এবং ভালো মেয়ে সে। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের গোয়েন্দাদের লাভ হবে না ওর পেছনে ছুটে। সে কোনো অপরাধ করতে কিংবা অপরাধে সহযোগিতাও করতে পারে না।

ইন্টেরোগেটর বেশ নরম কণ্ঠে বললেন, উত্তেজিত না হয়ে ভয় না পেয়ে কথা বলেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে। রুবার ব্যাপারে আপনার কনফিডেন্স দেখে খুশি হয়েছি। লাইন কেটে দিলেন প্রশ্নকর্তা।

লাইন কেটে যাওয়ার পর সেটের মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকে রবিন। রিসিভড কলে গিয়ে দেখে নেয় নম্বরটা। ল্যান্ডফোন থেকে এসেছে কল। সেভ করে রাখে নম্বরটি। গোয়েন্দা-অফিস হলে বোঝা যাবে। পরে খোঁজখবর নেবে ভেবে পকেটে ঢুকিয়ে রাখে সেট। কথা হয়েছে চলন্ত গাড়িতে। যথাসম্ভব ছোট গলায় কথা বলেছে ও। আশপাশের যাত্রীদের দিকে তাকাল এবার। কারও মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। এক্সপ্রেশনও বোঝা যাচ্ছে না তাদের।

যাত্রীদের নিয়ে ভাববে না রবিন। মন শক্ত করে তাকাল সামনে। গাড়ি প্রায় চলে এসেছে। রাসেল স্কোয়ার ক্রস করছে বাস। ডানে-বাঁয়ে ঘুরেফিরে আবার দেখে রবিন। পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা কেটে গেছে। জেগে উঠেছে মন আবার। উদ্বেগের জোয়ার এসেছে এবার। ভুলে গেছে ও নিজের চাকরির কথা মনে পড়ছে রুবার কথা। কোনো বিপদে জড়িয়ে যায়নি তো রুবা? আফরিন নামে যে মেয়েটি ধরা পড়েছে সে রুবার নতুন ফ্রেন্ডটি নয় তো? চট করে শতগুণ হারে অজানা ভয় খামছে ধরে রবিনকে। আফরিনকে জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে কি গোয়েন্দারা খোঁজ করছে রুবার বিষয়ে? উড়িয়ে দিতে পারল না প্রসঙ্গটা। স্বয়ংক্রিয় নেতিবাচক চিন্তায় ভারী হয়ে ওঠে বুকটা। শ্বাস চেপে আসছে। চোখ বন্ধ করে নাক দিয়ে বড় করে শ্বাস নেয় রবিন। মুখ দিয়ে বড় করে শ্বাস ছেড়ে বুকের ভেতরের অস্বস্তিটা বোঝার চেষ্টা করে। হ্যাঁ। কিছুটা কমেছে অস্বস্তি ভাব। খারাপ চিন্তার জাল সরিয়ে ভালো চিন্তা করতে থাকে রবিন। অটোসাজেশন দিতে থাকে–কোনো ভয় নেই, কোনো অপরাধ করেনি রুবা, রুবার কোনো বিপদ হবে না এসব পজিটিভ ভাবনায় ডুবিয়ে রাখে নিজেকে।

সায়েন্সল্যাবের স্টপেজে দাঁড়িয়েছে বাস। হঠাৎ খেয়াল করল ও এসে গেছে গন্তব্যে। দ্রুত নেমে আসে বাস থেকে। শক্ত করে ফাইলটি ধরে বসে ছিল নিজের অজান্তে। বাইরে এসে তাকাল সামনে। অর্কিড প্লাজার রূপ বদলে গেছে। মার্কেটের বিরাট একটি অংশ ঢুকে গেছে ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হসপিটালের এক্সটেনশন ভবনের ভেতর। পেট্রলপাম্প ঘুরে হেঁটে চলে এল গ্রীন রোডে। রিকশায় ওঠে রবিন। যন্ত্রের মতো বলে, ভূতের গলিতে চলুন।

রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে। রোবটের মতো বসে আছে ও। চাকরিপ্রার্থী, যে টেনশন থাকার কথা, সে রকম কোনো টেনশন নেই–এখন। বড় টেনশন গেছে গোয়েন্দার কথায়, শুধু টেনশন না, মনে হয়েছে সিডর বয়ে গেছে ব্রেনের ভেতর দিয়ে। বড় ঝড়ের কারণে ছোট ঝড় টের পাচ্ছে না ও। খুব স্বাভাবিক, ভয়হীন, রবিনের রিকশা কিছুক্ষণ পর এসে ঢোকে ভূতের গলিতে। ঢাকা শহরে ভূতের গলি! ভাবতেই হাসি এল। প্রাণ খোলা হাসি না–প্রাণহীন হাসি। ভূতপ্রেত বলে কি আছে কিছু! এ এলাকাতে কি ভূত বাস করত কোনো এক সময়! হতে পারে। ঢাকা শহরের এই অংশ একসময় ছিল ঘন জঙ্গল। কিছুদূর পর আছে হাতিরপুল বাজার। হাতির সঙ্গে সম্পর্ক আছে ঘন জঙ্গলের। সেই সূত্রে ঘন জঙ্গলে হয়ত থাকত ভূত-প্রেত। সনাতন বিশ্বাস ওপড়াতে চায় না রবিন। নিজের বিশ্বাসের মূলেও ঢুকে গেছে কঠিন প্রশ্ন খারাপ দলের সঙ্গে মিশে যায়নি তো রুবা? সনাতন বিশ্বাস টলাতে পারে না এ সময়ের প্রেক্ষাপট। বাস্তবের চিন্তাও হার মানায় সনাতন চিন্তাকে। নির্মম সময়টা সনাতনের মতো ভুলভ্রান্তির ওপর গড়ে উঠুক, সেটা চায় না রবিন।

ভূতের গলিতে বাড়ির নম্বর দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছে ও। হ্যাঁ। পেয়ে গেছে, ঘিঞ্জি এলাকায় আলিশান বাড়ি। ব্যবস্থাপক মানে ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিজেই কি মালিক? একক মালিকানা, নাকি লিমিটেড কোম্পানি? খেয়াল করেনি বিষয়টা। চাকরির জন্য যাচ্ছে মালিকের বাসায়, ঘটনাটির মধ্যে যেমন প্রশ্ন আসে, চাকরি পাওয়ার ব্যাপারেও আশা জাগে।

রিকশা থেকে নেমে ও দাঁড়াল সিকিউরিটি বুথের সামনে। রুবার চিন্তা ভুলে গেল রবিন। খুঁসে ওঠে চাকরির চিন্তা। ম্যানেজিং ডিরেক্টর বাসায় আসতে বলল কেন ফোনে? দুই নম্বর ঘাপলা আছে বিষয়টাতে মনে হয়নি। বেড়ে গেছে আত্মবিশ্বাস। মনে হতে থাকে, ও পেয়ে যাচ্ছে চাকরি। নিজের যোগ্যতার ঘাটতি নেই, চাকরি না দিয়ে যাবেন কোথায় ব্যবস্থাপক সাহেব।

থেমে গেছে ভাবনা। একজন গার্ড সামনে এসে বলে, কত নম্বর ফ্ল্যাটে যাবেন?

থমকে যায় রবিন। সহজ উত্তর দেয়, ফ্ল্যাট নম্বর জানা নেই।

যাবেন কার কাছে?

নাম জেনে নেয়নি রবিন। ফোনে কথা বলেছেন ব্যবস্থাপক। বাসার নম্বর দিয়েছেন। নাম জিজ্ঞাসা করা হয়নি, ফ্ল্যাট নম্বরও নেয়নি। বড় বোকামি হয়ে গেছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকাল ও গার্ডের মুখের দিকে।

গার্ড ভুরু কুঁচকে আবার প্রশ্ন করে, কার সঙ্গে দেখা করবেন?

পরিস্থিতি সামলে নেয় রবিন। লাজুক হেসে বলে, ফোনে কথা হয়েছে, উনি একজন গার্মেন্টস ও বায়িং হাউজের ব্যবস্থাপক।

গার্ড বলে, ও বুঝেছি, বসুন ওয়েটিং রুমে। আরও কয়েকজন এসেছেন। চাকরি প্রার্থী। সবাই বসে আছেন ওয়েটিং রুমে। আপনিও বসুন। উনি নিচে নেমে কথা বলবেন।

হতাশা হানা দেয় বুকে। সাঁই করে উঁচু থেকে নিচে নেমে আসে উচ্চাশা।

অ্যাপার্টমেন্টের নিচতলায় উত্তর পাশে রয়েছে একটি বড় কমিউনিটি রুম। তার পাশে রয়েছে আরেকটি ছোট্ট কক্ষ। তিনটি লম্বা সোফা রয়েছে রুমে। মাঝে আছে একটা গোলাকার টি-টেবিল। টেবিলে সাজানো আছে আর্টিফিশিয়াল ফ্লাওয়ার। কক্ষের ভেতর একনজর তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয় রবিন। মাঝের সোফার কোণার সিটটি খালি, শূন্য সিটে বসে রবিন। সোফার অন্য পাশে বসে আছে দুজন মেয়ে। এখানে এসে মুষড়ে গেছে মন। রুবার জন্য চিন্তা পালিয়ে গিয়েছিল। মেয়ে দুটিকে দেখার পর আবার হানা দেয়। চিন্তা। ঢাকা শহরে টিকে থাকতে ছেলেদেরই দুর্বিষহ অবস্থা, মেয়েদের অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকে কে জানে।

অফিস বাদ দিয়ে বাসায় ডেকেছেন কেন ব্যবস্থাপক? প্রশ্নটি আবার নাড়া দেয় মনে। বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না। একজন ভদ্রলোক ঢুকলেন রুমে। বুঝতে বাকি রইল না, তিনিই ব্যবস্থাপক।

সরি! আপনাদের বসিয়ে রেখেছি। আমার নাম হাবীব মোর্শেদ খান। বিজ্ঞাপন দেখে আপনারা আমার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেছেন। গার্মেন্টসটি মফস্বল শহরে, ঢাকা থেকে দূরে। এজন্য যারা ঢাকা থেকে কল করেছেন বাসায় আসতে বলেছি তাদের।

প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে রবিন। মফস্বল শব্দটি চট করে নিরুৎসাহ জাগিয়ে দিল। ঢাকায় থাকতে হবে, ঢাকায় প্রতিষ্ঠা পেতে হবে ওকে। এ ধরনের চিন্তায় ডুবেছিল মন। ঢাকার বাইরে গিয়ে চাকরির দরকার নেই। ভালো চাকরির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবে ও। ভাবনার সঙ্গে বদলে গেল মনের অবস্থা।

নিজেকে আর চাকরিপ্রার্থী মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে না কৃপাপ্রার্থী। অন্য ধরনের ব্যক্তিত্ব জেগে ওঠে। জেগে উঠলেও অশোভন কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটাল না ও। চুপচাপ বসে শুনছে হাবীব মোর্শেদ খানের কথা। চাকরিপ্রার্থীদের বিগলিত বিনয় দেখে ছোট মনে হয় নিজেকেও। এত গলে যেতে পারে মানুষ! এত অসহায় হতে পারে! এমন আচরণ করতে হয় চাকরির জন্য! ভাবতে পারল না রবিন। নিজের ব্যক্তিত্ব জলাঞ্জলি দিতে হয়, এমন চাকরির প্রয়োজন নেই। এ পরিবেশ থেকে উঠে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে। উঠতে পারছে না। কথা বলতেও ইচ্ছা করছে না। ঢাকায় থাকবে, ঢাকায় সেটেলড হবে, ঢাকার বাইরে যাবে না–এই সেন্টিমেন্টের পেছনে বড় কোনো যুক্তি নেই। সবাই ঢাকায় থাকলে দেশ চলবে কীভাবে? ইন্ডাস্ট্রিগুলো কেবল ঢাকায় কেন হবে? ঢাকার বাইরেও হোক। দেশের উন্নতির জন্য বিষয়টা জরুরি। এই বিষয়টা বুঝতে চাইবে না রুবা।

সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রত্যেকে একই ভাষায় কথা বলেছে। প্রত্যেকের চাকরিটা জরুরি। কেবল মুখ খোলেনি রবিন। বিষয়টা লক্ষ করেছেন হাবীব মোর্শেদ খান।

খেয়াল করেও কোনো কথা বলছেন না তার সঙ্গে আলাদাভাবে। মোর্শেদ খান বললেন, একটা ব্যাচে ৩০ জনকে চাকরি দিয়েছিলাম। সেখানে দুজন জয়েন করেছিল মাদক ব্যবসায়ী চক্রের এজেন্ট হিসেবে একজন ছেলে, একজন মেয়ে। চাকরির কিছুদিনের মধ্যে ৫০ শতাংশ স্টাফ আসক্ত হয়ে পড়ে মাদকে। এই ভয়াবহ বাস্তবতা মাথায় রেখে ইন্টারভিউটা আমি নিজে করতে চাই। কেউ মাদকসেবী হলে চলবে না। তাকে রিক্রুট করব না। খোলামেলা কথা আমার। ধূমপানও চলবে না। ধূমপান করলে নিজেরা নিজেদের উইথড্র করে নিতে পারেন।

একজন বলে, স্যার আমি ধূমপান করি। চাকরিটা আমার জরুরি। ধূমপান ছেড়ে দেব।

মোর্শেদ খান স্পষ্ট গলায় বলেন, প্লিজ আসতে পারেন আপনি। সত্য বলার জন্য ধন্যবাদ–একটা সুযোগ রাখতে চাই। তিন মাস পর দেখা করবেন। যদি স্মোকিং ছাড়তে পারেন ফোন করবেন আমাকে। বিষয়টা অগ্রাধিকার দেব আমি, আপনার সিভি রেখে যান।

আবার যেন কী বলতে চাচ্ছিল ছেলেটা। কাতরতা, অনুনয়, বিগলিত কণ্ঠে উঠে দাঁড়িয়ে হাবীব মোর্শেদ খানের পায়ে ধরার অবস্থা।

আরে! কী করছেন! ছি! চাকরির জন্য এত ছোট হবেন কেন। শক্ত হোন। আমার শর্ত পূরণ করুন। অগ্রাধিকার দেব পরের রিক্রুটমেন্টে।

একটি মেয়ে বলে, স্যার আমার মা শয্যাশয়ী। বাবা নিখোঁজ। মানবিক কারণে চাকরিটা আমার দরকার।

দেখুন, মানবিক কারণে চাকরি দেওয়ার এজেন্সি খুলে বসিনি আমি। অবশ্যই কর্মচারীদের প্রতি মানবিক আচরণ করব আমি। তবে প্রতিষ্ঠানকেও আপন ভাবতে হবে, নিজের যোগ্যতার সর্বোচ্চ শ্রম দিতে হবে উন্নতির জন্য। প্রথমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করব। যার যার পদের জন্য যোগ্য করে তুলব সবাইকে। মানবিক কারণে চাকরি হবে না। চাকরি হবে আপনার কমিটমেন্টের কারণে। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়াটা জরুরি। দুর্বল কাউকে চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। মেডিকেল টেস্ট করাব। ডোপ টেস্টও করাব সবার। ফিট হলে অবশ্যই চাকরি হবে।

মেয়ে দুটো একে অপরের দিকে তাকাল। ওদের তাকানোর ধরন একটু অন্য রকম লাগল। খেয়াল করে রবিন, তারা কথা বলছে চোখের ভাষায়। তাদের চোখের পাতার কম্পনের মধ্য দিয়ে বাইরে প্রকাশ পাচ্ছে শঙ্কা। ওরা কি তবে মাদক ব্যবসায়ী চক্রের এজেন্ট? আচমকা ইনটিউশন জাগে। দেখতেও নেশাখোরের মতো লাগছে ওদের। তবে ফিগারটা খারাপ না।

হাবীব মোর্শেদ খানও সবাইকে অবজার্ভ করলেন। তারপর ঠান্ডা গলায় বললেন, যারা শর্ত মানতে পারবেন সিভি জমা দিন। নির্দিষ্ট ল্যাবে শারীরিক পরীক্ষা হবে সবার। রিপোর্ট পাওয়ার পর নিশ্চিত করব চাকরির বিষয়টা। হ্যাঁ, বলে রাখছি। বিজ্ঞাপনে পড়াশোনার যে যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে, সে ব্যাপারেও কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না।

উপস্থিত সবাই সিভি জমা দিচ্ছে। ধূমপানকারীও জমা দিয়েছে। মেয়ে দুটি এখনো ইতস্তত করছে।

হাবীব মোর্শেদ খেয়াল করলেন, উপস্থিত সবার মধ্যে রবিন বেশ স্মার্ট। মোটামুটি সুদর্শন। কোনো কথা বলেনি। সিভি জমা না দিয়েই চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। ওকে থামিয়ে হাবীব সাহেব বললেন, কোনো কথা বললেন না। সিভিও জমা দিচ্ছেন না। আমার শর্তের বাইরে আপনি?

না। হাসিমুখে বলল রবিন। শর্তের বাইরে নই। ঢাকার বাইরে চাকরি করতে পারব না এখন। এজন্যে সিভি জমা দিচ্ছি না। তবে চাকরির ব্যাপারে শর্ত তিনটি মনঃপুত হয়েছে আমার। ভালো লেগেছে আপনার স্পষ্ট কথা।

ভালো লাগার কিছু নেই। সহজ হিসাব, সহজ কথা। চাকরির জন্য এসে এমন নির্লিপ্ত থাকতে দেখিনি কাউকে। আপনি থেকেছেন। নতজানু হননি। আমার প্রথম কথার আলোকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন সিভি দেবেন না। গুড ডিসিশন। ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সবার থাকে না। আপনার আছে। এ বিষয়টাও ভালো লাগল আমার।

হাসে রবিন। ঢাকায় চাকরি দরকার। তবে চাকরির জন্য কোনো কাতরতা দেখাবে না। এটা তার ব্যক্তিত্বে যায় না। মানায় না। হাবীব মোর্শেদ খানের প্রশংসাসূচক কথায় সাহসী হয়ে ওঠে মন। ধীরস্থিরভাবে বলে, ঢাকায় কোনো প্রতিষ্ঠান নেই আপনার? ঢাকায় সম্ভব হলে সিভি দিয়ে যেতাম।

একটু থেমে, কী যেন ভেবে হাবীব মোর্শেদ বলেন, বসুন। ওদের বিদায় করে কথা বলব আপনার সঙ্গে।

মেয়ে দুটি বলে, আমরা যাচ্ছি।

আপনারা কি একত্রে এসেছেন? আমরা বলছেন কেন? প্রশ্ন করলেন। মোর্শেদ খান।

প্রশ্ন শুনে থতমতো খেল দুজনই। একজন বলে, এ বাসায় ঢোকার সময় পরিচয় হয়েছে দুজনের।

চট করে রবিনের মনে হলো, মিথ্যা বলছে মেয়েটি।

অন্য মেয়েটি মাথা দুলিয়ে সায় দিল ওর কথায়।

দুজনের এক্সপ্রেশনে পার্থক্য আছে, ভিন্নতা আছে। স্পষ্ট বোঝা না। গেলেও মনে হচ্ছে তারা পূর্বপরিচিত।

হাবীব সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, সিভি দেবেন না আপনারা?

প্রায় একসঙ্গে দুজনেই বলে, না। সিভি আনিনি।

রবিনের মগজে এবারও ধাক্কা লাগে। হাবীব সাহেবও একটু নড়ে সতর্ক চোখে তাকিয়ে দেখলেন দুজনকে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলেন, আসুন আপনারা।

রবিনের বুঝতে বাকি নেই মিথ্যা বলেছে মেয়ে দুটি। ফাইল আছে ওদের হাতে। ওরা সিভি এনেছিল। শারীরিক পরীক্ষা কিংবা ডোপ টেস্টের কথা শুনে কি কেটে পড়ল ওরা? তবে কি ড্রাগ নেয় মেয়ে দুটি? প্রশ্ন ঢুকে গেল মনে। ওদের চলার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে রবিন। এই রুমে বসে বাইরের গেটের একাংশ দেখা যায়। গেটের বাইরে গিয়ে মেয়ে দুটি হাত ধরাধরি করে ডানে হাঁটা শুরু করে। মুখের পাশ এবং দেহভঙ্গিমা দেখে বোঝা যাচ্ছে, হেসে উঠেছে ওরা। অর্থাৎ মেয়ে দুটি পূর্বপরিচিত। হাবীব মোর্শেদ খানের অভিজ্ঞতা সঠিক মনে হলো। মাদক ব্যবসায়ীরা প্রতিটি সেক্টরে কৌশলে তাদের এজেন্ট ঢুকিয়ে দিচ্ছে। নিয়োগ করছে এজেন্ট। ব্যবসার জাল ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশের প্রতিটি সেক্টরে, আনাচে-কানাচে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় ছাপা হচ্ছে এসব খবর। গুরুত্ব দেয় না কেউ। হাবীব সাহেব গুরুত্ব দিয়েছেন। এ দূরদর্শিতার জন্য মনে মনে ও ধন্যবাদ দিল হাবীব সাহেবকে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল রুবার কথা। ফাঁদ তৈরি হচ্ছে চারপাশে। মাদকের ফাঁদে টেনে নেওয়া হচ্ছে। ছেলেমেয়েদেরকে। সাবধান করতে হবে রুবাকে। আফরিন নামে একজন গডমাদার ধরা পড়েছে। রুবার নতুন বান্ধবীর ব্যাপারে সতর্ক হতে বলতে হবে। আচমকা সেই টেনশনটা আবার ঢুকে গেল ব্রেনে। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে রুবার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছে কেন? সেও কি জড়িয়ে গেছে কোনো ফাঁদে? নাহ্! এসব কী ভাবছে, মাথা নেড়ে ও চিন্তাটা দূর করার চেষ্টা চালায়। তারপর তাকাল হাবীব মোর্শেদ খানের দিকে। চাকরিপ্রার্থীদের রেখে যাওয়া বায়োডাটাগুলো দেখছেন তিনি। একসময় চোখ তুলে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, ঢাকায় চাকরি খুঁজছেন?

জি। ছোট্ট করে জবাব দেয় রবিন।

সবাই ঢাকায় থাকতে চাইলে বাইরে যাবে কারা?

বিশেষ দরকার আছে আমার। পড়াশোনার পাশাপাশি ইভিনিং শিফটে এমবিএ শেষ করতে চাই আমি।

ওহ। ভালো কথা। ভালো চিন্তা। অ্যাপ্রিশিয়েটেবল!

যদি সম্ভব হয়, আপনার ঢাকার অফিসে আমার যোগ্যতা অনুযায়ী কোনো পদ যদি দেওয়া যায়, উপকার হবে। মানবিক দিক বলব না। বাস্তবতার জন্য এ দাবিটুকু করলাম।

দেখুন, দীর্ঘদিন সৌদি আরবে চাকরি করেছি আমি। টাকাপয়সা উপার্জন করেছি। দেশে এসে গার্মেন্টস ও বায়িং হাউস দিয়েছি। সৎ লোক খুঁজছি। পাচ্ছি না। সৎ, সাহসী ও ধর্মভীরু লোক দরকার আমার। নামাজ পড়েন আপনি?

চলমান কথা থেমে যায় হঠাৎ। কিছু সময় চুপ থেকে স্পষ্ট গলায় সত্য বলে রবিন, না, নামাজ পড়ি না।

হাবীব মোর্শেদ খান বলেন, ধন্যবাদ আপনাকে। বায়োডাটা রেখে যান। দেখি ভেবে।

বায়োডাটা জমা দিয়ে বাইরে চলে আসে রবিন। বোঝার বাকি থাকে না, চাকরি হচ্ছে না হাবীব মোর্শেদ খানের প্রতিষ্ঠানে। নামাজের ব্যাপারে মিথ্যা বলা যায় না। এমনিতে মিথ্যা বলতে পারে না রবিন। নামাজের ব্যাপারে তো না-ই। ঢাকার জীবনটা কঠিন। প্রতিনিয়ত একটা না একটা চাপ এসে পড়ছে। টিউশনি করে থাকা-খাওয়া জোগাড় করা সহজ নয়। টিউশনি চলে যাওয়ার শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। মিরপুরে যে মেয়েটিকে পড়ায়, এবার নাইনে উঠেছে সে। বাড়ন্ত গড়নের তিমু হঠাৎ লম্বা হয়ে গেছে। চঞ্চলতা বেড়ে গেছে। অদ্ভুত আচরণ করে। ইদানীং ওর মা প্রায়ই বসে থাকে পড়ার ঘরে। অস্বস্তি লাগে। মা কি বিশ্বাস করতে পারছে না ওকে? এমন কোনো অশোভন আচরণ কি করে ফেলেছে ও মেয়েটির সঙ্গে? লক্ষ করেছেন মা? নিজেকে মেপে নিল দেখে রবিন। না। ছাত্রীকে যে দৃষ্টিতে দেখা উচিত, সেই চোখে দেখছে ও। স্নেহ করছে সেভাবে। মনোযোগ দিয়ে পড়াচ্ছে। কেন পাহারা দিচ্ছে ওর মা? বোঝে না রবিন। পাহারা দিলেও ওই বাড়িতে যত্নআত্তির অভাব নেই। ভালো ব্যবহার পায়, ভালো নাশতা দেওয়া হয়, ঈদ উপলক্ষে গিফট পায়, বোনাসও পায়। এমনটি সাধারণত পায়নি ইতিপূর্বে। পাহারার বিষয়টি মনে দাগ কাটে, খচখচ করে মন। অস্বস্তি লাগে। না জানি কখন চলে যায় টিউশনিটা। ভয়ে থাকে। একটা টিউশন চলে গেলে আরেকটা পেতে সময় লাগে। কম ঝামেলা পোহাতে হয় না। বেশ তিক্ত পূর্ব-অভিজ্ঞতার এসব কথা মাথায় এলে ছোট হয়ে যায় মন। দুশ্চিন্তা ঝেড়ে নিজেকে সহজ করার চেষ্টা করে ও। একবার ঘড়ির দিকে তাকায়। দুপুর সাড়ে ১২টা এখন। রুবাকে কল করতে ইচ্ছা করছে। গ্রীন রোড ধরে রিকশায়, লেগুনা বা টেম্পোতে যেতে লাগবে পাঁচ মিনিট। আনন্দ সিনেমার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে কল করলে চলবে ভেবে রিকশায় চড়ে বসে রবিন।

কল করে রুবাকে। রিং হওয়ার মুখে থেমে যায় আবার। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে জুমার আজানের ধ্বনি। হাবীব মোর্শেদ খানের কথাটা মনে পড়ে। সৎ, সাহসী ও ধর্মভীরু লোক দরকার আমার। নামাজ পড়েন আপনি?

সিদ্ধান্ত বদলায় রবিন। রুবার চেয়ে মসজিদে যাওয়া শ্ৰেয় এখন। নামাজের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। ভালো লাগতে পারে মসজিদে গেলে। রুবাকে নিয়ে টেনশনের যে নার্গিস ঝড় শুরু হয়েছে, থামবে কবে জানে না। খোলামেলা আলাপ না হলে থামবে বলে মনেও হয় না। খোলামেলা আলাপ না করলে নানা ধরনের খারাপ চিন্তা চলে আসতে পারে ব্রেনে। সেই চিন্তার জালে জড়ালে ভুলভাবে বিশ্লেষিত হতে পারে রুবা। না। ভুল বিশ্লেষণ করা যাবে না। উন্মোচিত হতে হবে সত্যটা। কেন পেছনে লেগেছে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ, কারণ জানতে হবে। তার আগে ফ্রেশ হওয়া দরকার মনটা। মসজিদে যাওয়া ভালো। আশপাশে বড় মসজিদ কোথায়? হঠাৎ মনে পড়ে, ধানমন্ডি ৭ নম্বর রোডে লেকের পাড়ে মনোরম পরিবেশে রয়েছে তিনতলা বড় মসজিদ। রিকশাওয়ালাকে বলে, ভাই, ধানমন্ডি ৭ নম্বরে বড় মসজিদে যাব।

চলতে শুরু করেছে রিকশা। যেতে যেতে একটা কল করতে ইচ্ছা হয় রুবাকে।

কল অপশনে গিয়ে ডায়াল কল থেকে রুবা নামটি ধরে চাপ দেয় ইয়েস বাটনে।

না, কানেক্ট হচ্ছে না কল। মোবাইল বন্ধ।

আবার মন খারাপ হতে থাকে। সমান তালে বাড়তে থাকে দুশ্চিন্তা। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে কি রুবাকেও কল করা হয়েছে? মোবাইল বন্ধ কেন?

আরও বেড়ে গেল অস্থিরতা।

মসজিদের সামনে এসে দাঁড়ায় রিকশা। রিকশা থেকে নেমে দেখে, লেকের গেট দিয়ে ঢোকার মুখে বসে আছে অসংখ্য ফকির-মিসকিন, লুলাভুলা ছিন্নমূল মানুষের দল। হাত পেতে আছে কেউ, কেউ বাড়িয়ে ধরেছে থালা। ওদের মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে মসজিদের দিকে এগিয়ে যায় রবিন। বাঁ পাশে লেক। লেকের অপর পাড়ে শেখ হাসিনার বাড়ি, সুধা সদন। বাড়ির দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে যায় গতকালের টিভি নিউজের মূল দৃশ্যপটের কথা। বিএনপির দেশনেত্রী খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগের জননেত্রী শেখ হাসিনা কথা বলেছেন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। হেসেছেন। তাঁদের দুজনের হাসি দেখে বুক ভরে গেছে আনন্দে। দেশের মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। দুজনার হাসিবিনিময়, কথোপকথনের ছবি ছাপা হয়েছে আজকের প্রতিটি পত্রিকার প্রধান শিরোনাম হিসেবে। কত অল্পতে খুশি হতে পারে মানুষ। রবিনের মনেও খুশির অনুরণন জেগে ওঠে। দেশ গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ভেবে স্বস্তি পাচ্ছে জনগণ। স্বস্তি কি বয়ে আনবে শান্তি? মসজিদে ঢুকতে ঢুকতে এমন ভাবনা আসছে মনে। রবিনের মনে ইনটিউশন জাগে–নিশ্চয় শান্তি আসবে। নিশ্চয় জয়-পরাজয় মেনে নিয়ে দুই দল কাজ করবে দেশের উন্নতির জন্য। দলীয় প্রার্থী হিসেবে হিলারি হেরে গিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ওবামার কাছে। হেরেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কারণে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওবামার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। এখন শোনা যাচ্ছে, হিলারি ক্লিনটন হবেন ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কী শিক্ষণীয় রাজনীতি! ম্যাককেইনও হেরে ওবামার সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন। দেশের স্বার্থে ওবামার পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন। বাংলাদেশেও তিনি আসবেন জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে।

আমাদের দেশের রাজনীতি যদি এমন হতো! ভাবতে ভাবতে ওজু করে মসজিদে ঢোকে রবিন। ঢুকতেই অন্য রকম আবহ জেগে ওঠে। সরে যায় দুশ্চিন্তার ঝড়, মস্তিষ্কের গহিনে বইতে থাকে শান্তির বাতাস।

১২

নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসে রবিন। ৭ নম্বর রোড ধরে হাঁটছে মিরপুর রোডের দিকে। পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে রুবার নম্বর কানেক্ট করার চেষ্টা করল ও। হঠাৎ দেখে, টুপি পরা একজন লোক তাকিয়ে আছে ওর দিকে। চেনা-চেনা লাগছে। পাঞ্জাবি পরনে লোকটি অন্য কেউ নয়। ঘন্টা খানেক আগে দেখা হাবীব মোর্শেদ খান। টুপি থাকার কারণে টাক দেখা যাচ্ছে না। টাক মাথায় দেখতে এক রকম লেগেছে। টুপি মাথায় লাগছে অন্য রকম। মুঠোফোনে রবিনের চলমান হাতের কাজ থেমে যায়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাত উঠে যায় ওপরে, কাছে গিয়ে স্পষ্টভাবে বলে, স্লামুয়ালাইকুম।

হাবীব মোর্শেদ খান জবাব দিলেন, ওয়ালাইকুমসালাম। মৃদু হেসে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো কালো টয়োটা করোলা জিপে উঠে বসেন তিনি।

রবিন হাঁটতে থাকে সামনে। হাত আবার চলে আসে মুঠোফোনে–টেপাটেপির কাজ শুরুর আগে আবার মুখ ঘুরিয়ে তাকাল ও চলমান গাড়িটির দিকে। হাবীব মোর্শেদ খানের মুখ দেখা যাচ্ছে না। ওনাকে দেখানোর জন্য মসজিদে ঢুকেছে, এমন কিছু কি ভেবেছেন তিনি? ভাবতেও পারেন। ভাবলে কী আর করা! নিজের কাছে স্বচ্ছ ও। আজান শুনে মসজিদে চলে এসেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু করেনি। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডাক এসেছে ভেতর থেকে। সেই ডাকে চলে এসেছে মসজিদে। হাবীব মোর্শেদ খান কী ভাবল, ভেবে লাভ নেই। তার পরও ভাবনাটা তাড়াতে পারছে না। এমন কো-ইনসিডেন্স কেন ঘটল? উত্তর জানা নেই। সামনে তাকিয়ে আবার দেখে চলমান গাড়িটি। কালো রঙের গাড়ির ভেতর থেকে যেন আলো বেরোচ্ছে। ওই আলো টানছে তাকে–মনে হচ্ছে কাছে ডাকছে। যাহ্। কী সব অদ্ভুত ভাবনা হানা দিচ্ছে! মাথা ঝেড়ে আবার হাতে নেয় মুঠোফোন। কল করে আবার রুবাকে। এখনো বন্ধ রুবার ফোন। তবে কি ইন্টেলিজেন্সের লোকজন রুবাকেও ফোন করেছে? সে কারণেই কি ফোন বন্ধ রেখেছে?

কোথায় যাওয়া যায় ভাবতে গিয়ে খিদা টের পায় পেটে। ছাত্রী তিমুদের বাসায় যাওয়া যেতে পারে। প্রায় শুক্রবারই ও যায় ওদের বাসায়। অশোভন কিছু হবে না। দুপুরের খাবার সেখানে খেয়ে নেবে। তিমুর মা বেশ সজ্জন মহিলা। পড়ানোর সময় নিরাপদ দূরত্বে বসে পাহারায় থাকেন, নাকি মেয়ের পড়ার মনোযোগ দেখেন কে জানে। যা-ই ভাবুক, ওদের বাসায় যেতে সংকোচের কিছু নেই। বহুদিন অসময়ে গিয়েছে, খুশি হবে তিমু। ওর মাও অখুশি হবেন না। তিমুদের বাসায় যাওয়ার জন্য মিরপুরের গাড়ির জন্য কলাবাগান স্টপেজে লাইনে দাঁড়ায় রবিন। বাসে ওঠার আগে আবার কল দেয় রুবাকে। এখনো বন্ধ ফোন। অজানা শঙ্কা চেপে ধরে বুক। উদ্বেগ আর বিষণ্ণতা একসঙ্গে গেড়ে বসে মনে। মিশ্র অনুভূতি নিয়ে উঠে বসে মিরপুরের বাসে।

.

ডোরবেল টিপতেই দরজা খোলে তিমু।

স্যার! আপনি! প্রায় চিৎকার করে ওয়েলকাম জানায় তিমু। শোবার ঘরে বসে ছিলেন তিমুর মা। মেয়ের চিৎকার শুনে বসার ঘরে এসে দেখেন তিমুর গৃহশিক্ষককে।

তিমুর মায়ের মনে কোনো প্রশ্ন ঢুকেছে কি না বুঝতে পারল না রবিন। ওনার মুখের দিকে তাকালেও বোঝা যেত না। হাসিমুখে বললেন, ভালো আছেন?

জি আপা। ভালো। এদিকে এসেছিলাম একটা কাজে। ভাবলাম, তিমুর খোঁজ নিয়ে যাই।

ভালো করেছেন এসে। আজ রান্নাবান্না ভালোই হয়েছে। খেয়ে যাবেন। বলে কিচেনের দিকে পা বাড়ালেন তিনি।

খাওয়ার কথা শুনে স্বস্তি পায় রবিন। হা-না কিছু না বলে তিমুর দিকে তাকিয়ে বলে, সাজুগুজু করে কোথায় যাচ্ছিলে অসময়ে?

তিমু হাসে। ঝলমল করে ওঠে ওর চোখ। খিলখিল করে বলে, সাজিনি। ঘরে এরকমই থাকি আমি।

ওহ্। তাই তো, ঘরের ড্রেস পরে আছে তিমু। অথচ মনে হচ্ছে নতুন করে সেজেছে। হঠাৎ খেয়াল করল, পোশাকে সাজেনি তিমু, প্রকৃতি তাকে সাজিয়ে তুলেছে মায়াময় লাবণ্যে। তিমুর মুখ থেকে উৎসারিত হচ্ছে মায়ার ঢেউ, মায়ার আলো। ওই আলো ফুলের মতো মেলে ধরেছে তাকে। চারপাশ ভরে যাচ্ছে আলোয়। একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয় রবিন।

স্নেহের চোখে ভিন্ন আলো লাগা ঠিক নয়। জানে ও। আগে সতর্কতা ছিল না। কারণ অন্য চোখে কখনো দেখেনি। অন্য চোখ বেরিয়ে আসছে এখন। কেন আসছে? অসৎ হয়ে যাচ্ছে কি?

খিলখিল হেসে তিমু বলে, কী ভাবছেন, স্যার?

চোখ তুলে রবিন তাকাল তিমুর চোখের দিকে। সহজ হয়ে বলে, জানি না।

না। মিথ্যা বলছেন আপনি। জানেন, কী ভাবছেন। বলছেন না আমাকে। ঠিক না, স্যার?

কোনো জবাব না দিয়ে আবারও তাকাল রবিন। তাকানোর ভঙ্গি দেখে আবারও খিলখিল করে হেসে ওঠে তিমু।

স্যার। মজার মজার কাণ্ড ঘটছে আমার জীবনে। একটু কি শেয়ার করা যাবে আপনার সঙ্গে?

এ বয়সে কিশোরীরা লাজুক থাকে। মুখ ফোটে না। বুক ফেটে যায় ওদের। অথচ তিমুর মুখ ফুটছে খলবল করে। এমন করে আগে কখনো কথা বলেনি। ওর কথা শোনা উচিত। ইমোশন শেয়ার করার সুযোগ দেওয়া উচিত। শেয়ার করার সুযোগ পেলে ভুল পথে পা বাড়ানোর সুযোগ কমে যায়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রবিন বলে, শেয়ার করো। অনুভূতি শেয়ার করা ভালো।

অনুমতি পেয়ে খুশি হয় তিমু। উল্লসিত কণ্ঠে বলে, আমি কি বেশি সুন্দর হয়ে যাচ্ছি, স্যার?

তুমি সুন্দরই। সুন্দর হয়ে যাচ্ছ মানে কী?

চারটা এসএমএস পেয়েছি স্যার, চারজন প্রপোজ করেছে আমাকে। আমি নাকি সুন্দর হয়ে উঠছি। বড় হয়ে উঠছি।

এটা তোমার বড় হওয়ার বয়স। এ বয়সে আলাদা লাবণ্য আসে মুখে, দৈহিক গড়নে আসে পরিবর্তন। এজন্য বোধ হয় সবার চোখে পড়ছ। এসএমএসও পাচ্ছ হয়তো এ কারণে।

ওরা সবাই কি ভালোবাসে আমাকে?

অনেকে তোমার প্রতি আকর্ষিত হতে পারে। আকর্ষণ মানে ভালোবাসা না।

আকর্ষণ মানে তাহলে কী?

কী বলবে রবিন, বলতে সময় নেয়।

উত্তর দিতে দেরি হচ্ছে দেখে তিমু আবার বলে, আমারও একজনের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। তাকে কি আমি এসএমএস দিতে পারি, স্যার?

তুমি এখন কিশোরী। টিনএজ তোমার। এ বয়সে আবেগের বন থাকে বেশি। ভুল হয় বেশি। ভেবেচিন্তে উত্তর দেওয়া উচিত। বুঝতে হবে, অপাত্রে এসএমএস দিচ্ছ কি না। ব্ল্যাকমেইলের শিকারও হতে পারো। সব মাথায় রেখে রেসপন্স করতে হবে। বুদ্ধির কাজ হবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা, মিষ্টি কথায় পটে না যাওয়া।

না স্যার। ভুল হবে না। যাকে এসএমএস পাঠাব, আমি জানি, সে ভালো। ব্ল্যাকমেইল বা ক্ষতি করবে না আমার।

টিনএজে সবাই এমন ভেবে থাকে। যাকে ভালো লাগে, তাকে বিচার করে ভালো লাগা দিয়ে। সে ক্ষতি করতে পারে, বদ হতে পারে–চিন্তা করতে পারে না।

তিমু বলে, আমি পারি স্যার। ভালো মানুষ চিনি আমি।

তার পরও বলব, বুঝেশুনে পথ চলতে।

নিজের প্রতি বিশ্বাস আছে আমার। বিপদ হবে না, স্যার।

বিশ্বাস থাকা ভালো। তবে অতি বিশ্বাস বিপদের কারণ হতে পারে। সতর্ক থেকো।

ভাববেন না, সতর্ক থাকব আমি। বলেই নিজের নতুন কেনা দামি ফোনসেট নকিয়া এন ৮২ মডেলটি দেখানোর জন্য সামনে বাড়ায় তিমু।

সেট দেখে চমকে ওঠে রবিন। এ বয়সে এত দামি সেট দেওয়া ঠিক হয়নি। ওর মা-বাবা ঠিক কাজ করেনি। চুপচাপ ভাবছিল কথাটা।

তিমু আবার প্রশ্ন করে, সেটটা সুন্দর না, স্যার?

হুঁ, সুন্দর। গম্ভীর মুখে জবাব দেয় রবিন।

মনে হচ্ছে পছন্দ করেননি আপনি।

পছন্দ করব না কেন? অবশ্যই পছন্দ হয়েছে। তবে মনে হলো, এত কম বয়সে এ ধরনের সেট তুলে দেওয়া ঠিক হয়নি তোমার হাতে।

আপনি কি জেলাস হয়েছেন?

জেলাস হব কেন? আমার ছাত্রী ভালো সেট ব্যবহার করবে, আনন্দের কথা। হেসে দেয় রবিন।

তাহলে মুখ গোমড়া কেন আপনার?

নিজের ভাবনার প্রতিচ্ছবি ঘটছে ওর মুখে। নিজের মুখ নিজে দেখার সৌভাগ্য হয় না আয়না ছাড়া। বুঝতে পারে রবিন, তিমু বুঝে ফেলছে ভেতরের কথা। ধরা পড়ে যাচ্ছে ওর উচ্ছল অভিব্যক্তির সামনে। ভাবনা না লুকিয়ে বলে, তোমার আনন্দ আমারও আনন্দ। আনন্দ আরও আনন্দময় হয়ে উঠবে যদি পরীক্ষার রেজাল্টও এমন ঝলমলে হয়। উজ্জ্বল হয়।

রেজাল্ট ভালো হবে, নিশ্চিত থাকুন। ওটা নিয়ে ভাববেন না আপনি।

ভাবতে চাই না। তবুও ভাবনা চলে আসে।

অযথা দুর্ভাবনা করবেন কেন?

পূর্ব-অভিজ্ঞতার কারণে আসছে দুর্ভাবনা। হাতে মুঠোফোন থাকলে পাড়ার ছেলেরা জ্বালাবে, ক্লাসের ছেলেরা জ্বালাবে, অপরিচিতরা জ্বালাবে, এমনকি নিজেদের কাছের মানুষেরাও জ্বালাতে পারে। সহজে তোমার মগজে ঢোকার পথ পেয়ে যাবে ওরা। সহজে ঢুকে যেতে পারবে তোমার শোবার ঘরে, পড়ার টেবিলে হানা দিতে পারবে সহজে।

তাতে অসুবিধা কী?

অসুবিধা আছে অনেক। পচা গর্তে পা পড়লে বুঝবে মূল অসুবিধাটা। সবচেয়ে ক্ষতি হবে পড়াশোনার। মন টানবে মুঠোফোন। বই-খাতা তখন চলে যাবে মন-টানের বাইরে। মন বসবে না বইয়ে। মনোযোগ থাকবে না লিখতে গেলে। খারাপ হয়ে যাবে হাতের লেখা, বানানও ভুল হবে, সবচেয়ে বড় কথা পঠিত বিষয় মগজে ছাপ ফেলবে না মনোযোগহীনতার কারণে। তখন খারাপ হতে বাধ্য মেমোরি রেজিস্ট্রেশন। রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার খারাপ হলে খারাপ হয়ে যাবে রেজাল্টও।

ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রেজাল্টে চলে আসেন আপনি। রেজাল্ট ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না?

পারি। অবশ্যই ভাবি। তোমার সব ধরনের ভালো কামনা করি। একজন শিক্ষকের সেটাও বড় দায়িত্ব।

তবে কি মুঠোফোনের বিপক্ষে আপনি? চান না, ওটা ব্যবহার করি?

উত্তর না দিয়ে চুপ হয়ে গেল রবিন।

চুপ করে আছেন কেন? আহ্লাদের সঙ্গে ধমক দিয়ে প্রশ্ন করে তিমু।

কী জবাব দেবে ভাবছে রবিন। মুঠোফোনের বিপক্ষে না। কিন্তু এই বয়সি মেয়েদের হাতে মোবাইল ফোনের বিপক্ষে ও। ঠান্ডা গলায় বলে, এখন তোমার আবেগ তীব্র। এমন আবেগের জোয়ার থাকলে আমার ভালো কথাও ভুল ব্যাখ্যা করতে পারে তোমার বয়সি একটা মেয়ে। ঠান্ডা করো মাথা। পরে জবাব দেব।

বুঝতে পারছি, মুঠোফোনের বিপক্ষে, পক্ষে না আপনি। অভিমান করে বলে তিমু।

তিমুর প্রতিক্রিয়ায় সায় না দিয়ে এ মুহূর্তে না বলাটা বিপজ্জনক। হ্যাঁ বলাও উচিত নয়। মধ্যপথে থাকা শ্রেয় ভেবে চুপ করে থাকে রবিন।

সব ফ্রেন্ডের হাতের মুঠোয় এখন মুঠোফোন থাকে। এটা সাধারণ একটা ব্যাপার। অথচ আপনি আর আম্মু এটার বিপক্ষে।

আমরা দুজন তোমার ভালো চাই, কী বলল, চাই না?

হ্যাঁ। ভালো চান। মানি। দুজনই আমার ফ্রিডম হরণ করতে চান। ফ্রেন্ডদের কাছে আমাকে ছোট রাখতে চান। শুধু রেজাল্ট ভালো করার তাগিদ দেওয়া মানে ভালো চাওয়া নয়। কেবল স্বার্থপরের মতো রেজাল্ট ভালো চান আপনারা। অন্য কিছু ভালো হোক, চান না।

অন্য কিছু ভালো বলতে কী বোঝাচ্ছ তুমি?

জানি না। বাপি আমার শখ পূরণ করেছে। ফোনসেট চেয়েছি, কিনে দিয়েছে। বাপি আমায় বিশ্বাস করে। আর মামণি দিতে চায় না ফ্রিডম। ছলে-বলে-কৌশলে সেট নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। ভেবেছিলাম, আপনাকে দিয়ে বলাব মামণিকে। এখন দেখছি বলানো যাবে না, আপনিও মামণির দলে।

আবার চুপ হয়ে গেল রবিন। ভাবে, আহ্লাদী মেয়ের দাবি পূরণ করেছেন বাবা। মায়ার কাছে হেরেছেন তিনি। মেপে দেখেননি বাস্তবতা। মা দেখছেন বাস্তবতা। শিক্ষক হিসেবে সেও দেখতে চায় সেই দৃষ্টিকোণ থেকে। মোবাইলের নেশা পেয়ে বসলে নিজেকে সামলানো কঠিন। কথা বলার নেশা বড় সমস্যা তৈরি করে। পড়াশোনায় অমনোযোগী করে ছেলেমেয়েদের।

স্যারকে চুপ থাকতে দেখে তিমু বলে, বাপি কি ভালো চায় না আমার?

অবশ্যই চায়। একশ ভাগ বিশ্বাস করে বলে দামি সেট কিনে দিয়েছেন তোমাকে। এ সেটে আছে উচ্চক্ষমতার ডিজিটাল ক্যামেরা, অত্যাধুনিক সব অপশন। মডার্নাইজেশনের সঙ্গে তোমার বাবা তোমাকে পরিচিত করে তুলতে চাইছেন। অবশ্যই ভালো। কিন্তু ভালোর মধ্যে নিয়ন্ত্রণ থাকা এখানে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।

হেসে ওঠে তিমু। মোবাইলের ভালো গুণের কথাও স্যার জানে, ভেবে খুশি হয়। খুশি মনে বলে, যাকে পছন্দ করি তাকে এসএমএস দেওয়ার অধিকারও নিশ্চয় আছে আমার। কী বলেন?

খোলামেলা কথা শুনে অবাক হয় রবিন। ভয়ও পায়। না জানি কোন অশুভ চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে তিমু! শঙ্কিত চোখে তাকিয়ে থাকে কোমলমতি ছাত্রীর মুখের দিকে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে রুবার কথা। কোনো অশুভ চক্রের জালে কি জড়িয়ে গেছে রুবাও?

সামনে থেকে সরে গেছে তিমু। একটা রহস্যময় হাসির ঢেউ ছড়িয়ে বলে, মামণি খাবার সাজিয়েছে টেবিলে। আসেন। একসঙ্গে খাব আমরা।

তিমুর দিকে খেয়াল না করে রবিন নিজের সেটটি হাতে নিয়ে কল দেয়। রুবাকে। এখনো মোবাইল বন্ধ! জেগে ওঠা শঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে, জোরালো হচ্ছে। জোরালো ভয় নিয়ে খাবার টেবিলে সহজ হতে পারছে না রবিন। খাবার আইটেম দেখেও অবাক হয়। এটাই ওদের বাসায় দৈনন্দিন মেনু মন মানে না কথাটা। মনে হচ্ছে স্পেশাল ডিশ এসেছে টেবিলে। স্পেশালিটির কী আছে? সাধারণ এক গৃহশিক্ষক ও। এত আয়োজন কেন? তিমুর মায়ের আচরণেরও কোনো ব্যাখ্যা নেই। পড়ানোর সময় ওদের আশপাশেই থাকেন। সন্দেহ করে ওকে? সন্দেহ করলে এত আপ্যায়ন কি করত? না। সন্দেহ না। মাথা নাড়িয়ে উড়িয়ে দেয় ভাবনা। এসব ভাবতে গিয়ে রুবার কথাও উড়ে যায় মাথা থেকে। হঠাৎ রিংটোন বেজে ওঠে। বাঁ হাতে চোখের সামনে ফোনসেট তুলে দেখে রুবার কল।

খুশির ঝলক ভেসে ওঠে মুখে।

উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করে, মোবাইল বন্ধ ছিল কেন?

ঘুমাচ্ছিলাম। বন্ধের দিন, টানা ঘুমালাম সেট বন্ধ করে।

ওহ। বাঁচালে। টেনশন হচ্ছিল।

কী করছ এখন? প্রশ্ন করে রুবা।

খাচ্ছি। পরে কথা বলব।

খাওয়ার সময় কথা বলা যায় না? ইন্টারভিউ দাওনি?

পরে কথা বলব, বলে লাইন কেটে দেয় রবিন।

ভালো আছে রুবা। নিশ্চিন্তে আছে ভেবে স্বস্তি ফিরে আসে মনে।

তিমু বলে, কে ফোন করেছে?

রবিন উত্তর দেয়, আমার এক ফ্রেন্ড?

মনে হলো ফ্রেন্ডের ফোন পেয়ে খুশি হয়েছেন আপনি!

হ্যাঁ। ফ্রেন্ডের ফোনে মন খুশি হবে, এটাই স্বাভাবিক।

ওহ্। নিজে ফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বললে অসুবিধা নেই, মন খুশি হলে সেটা ভালো দিক, আর আমার বেলায় উল্টা, না?

এবার মুখ তুলে তাকায় তিমুর মা। তাকায় রবিনও। দুজন একই সঙ্গে দেখে তিমুর মুখের ভাষা। কোনো জবাব দিতে পারছে না কেউ। তারপর তিমুর মা ও রবিন তাকায় একে অপরের দিকে। চোখে বিস্ময় দুজনের। তিমুর কোশ্চেন ভীত করে তোলে দুজনকে।

.

তিমুদের বাসা থেকে বেরিয়ে রবিন কল করে রুবাকে। পুরো রিং বেজে থেমে গেছে কল।

বিষয়টা কী? কল ধরছে না কেন? কী করবে, ভেবে পাচ্ছে না। উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে থাকে রাস্তায়। এবার কল ব্যাক করেছে রুবা–বলে, খাওয়া শেষ হলো?

হুঁ। এখন রাস্তায়।

কোথায় খেলে? রেস্টুরেন্ট, না মেসে?

দুটোর একটাও না। খেলাম ছাত্রীর বাসায়।

নিমন্ত্রণ, না উড়ো খাওয়া? হেসে জানতে চায় রুবা।

রবিন নির্ভেজাল সরল উক্তি করে, হ্যাঁচড়ার মতো খাওয়া। খাওয়ার সময় কারও বাসায় হাজির হওয়া মানে চেয়ে খাওয়া, উড়ো খাওয়া বলতে পারো।

হঠাৎ ছাত্রীর বাসায় কেন? আমার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা হলো না?

ইচ্ছা হয়েছিল। টেনশনও আছে তোমার ব্যাপারে। চেয়েছিলাম দেখা করতে। মোবাইল বন্ধ থাকার কারণে সম্ভব হয়নি।

টেনশন শব্দটা শুনে ভাটা পড়ে প্রশ্নের জোয়ারে। চুপ থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ধীরস্থিরভাবে রুবা আবার প্রশ্ন করে, কিসের টেনশন?

দেখা করব এখন তোমার সঙ্গে। সাক্ষাতে কথা বলব।

কোথায় আসব?

যেখানে সুবিধা হয় তোমার। সহজে যেন আবার সঠিক টাইমে ফিরে যেতে পারো হোস্টেলে, তেমন জায়গায় এসো।

সঠিক টাইমে ফিরতে পারব না। আজ বেশিক্ষণ থাকব তোমার সঙ্গে। চলে এসো ধানমন্ডি লেকের পাড়ে। ডিঙি নৌকায় ঘুরব লেকের পানিতে।

ওকে। রওনা দাও তুমি। আমি হাজির হচ্ছি ৮ নম্বর রোডের ব্রিজের পাশে ডিঙ্গিতে।

দুজন প্রায় একই সঙ্গে পৌঁছেছে ডিঙ্গি রেস্টুরেন্টের সামনে।

রুবা তাকাল রবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ইন্টারভিউর ফলাফল। চুপ হয়ে যায়। বুঝতে পারে, রবিনের মুখের প্রকাশভঙ্গিতে উচ্ছ্বাসের আভাস নেই, খুশির ঝিলিক নেই। আছে শঙ্কা। আছে উদ্বেগের ছাপ।

হাসিমুখে রুবা প্রশ্ন করে, ইন্টারভিউ কেমন হলো?

কেবল হতাশার স্বর নয়, উদ্বেগের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে রবিন জবাব দিল, ঢাকার বাইরে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, সিভি জমা দিইনি ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য। তবে ব্যবস্থাপক সাহেব আমাকে পছন্দ করেছেন মনে হলো, সুযোগ পেলে ঢাকার জন্য ডাকবেন, বলেছেন। চেয়ে নিয়েছেন সিভি।

গুড। তাহলে একেবারে নৈরাশ্যজনক হয়নি ইন্টারভিউ।

নৈরাশ্যজনক না, আবার আশাও দেখছি না।

ভেঙে পড়লে চলবে না। খুঁজতে খুঁজতে এভাবেই হয়ে যাবে চাকরি। শক্ত রাখতে হবে মন।

মন শক্ত আছে।

তো, মন খারাপ কেন? এত মলিন লাগছে কেন? মনে হচ্ছে উল্কণ্ঠায় ভুগছ।

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ। দুশ্চিন্তা লাগছে।

কেন?

উত্তর না দিয়ে রুবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে রবিন। মনের মধ্যে জেগে উঠেছে সম্প্রতি পড়া মনোবিদ হেনরি কেইসারের একটি কথা–অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকবে, যদি ভাবা যায়, প্রত্যেক মানুষই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি মানুষের কতগুলো মৌলিক দাবি বা অধিকার রয়েছে। এই দাবি বা অধিকার লঙ্ন করা উচিত নয়, অবজ্ঞা করা উচিত নয়। মূল্যায়ন করতে হবে, মর্যাদা দিতে হবে অধিকারের। ওর প্রতি রুবার মৌলিক দাবি কী? অধিকার কী? রুবার প্রতি তার অধিকারের সীমানা কতটুকু? ভেবে চুপ হয়ে থাকে রবিন।

চুপ করে আছ কেন?

মুখ খোলে রবিন–সবাই আত্মকেন্দ্রিক আমরা। নিজেদের প্রতি বেশি উৎসাহী, বেশি আগ্রহী, নিজেদেরকে বেশি ভালোবাসি আমরা, অন্যের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে চাই, অন্যের অনুমোদন পেতে চাই সব কাজে, তাই না?

কী বলছ এসব! কিছুই বুঝতে পারছি না! রুবার কণ্ঠে বিস্ময়।

রবিন ভাবে, নিজেকে নিয়ে তৃপ্ত নয় ও। যে তৃপ্ত নয়, সে অন্যের সঙ্গে উদার আচরণ করতে পারে না। বন্ধুসুলভ পরিচয় দিতে জানে না, সম্মান করতে পারে না অন্যকে। সেও কি সম্মান করতে পারেনি রুবাকে? এজন্য কি গোপনে দূরে সরে গেছে রুবা, গোপন করছে নিজের অন্তর্জগতের কথা? প্রশ্নগুলো লুকিয়ে রবিন জানতে চায়, তোমার কোনো সমস্যা হয়নি তো?

উত্তর না পেয়ে প্রশ্ন পেয়েছে রুবা। প্রশ্নের উত্তর দেওয়া জরুরি। এজন্য এসেছে এখানে। নিরিবিলিতে কথা বলার ইচ্ছায় ছুটে এসেছে লেকের পাড়ে।

রুবা বলে, ডিঙিতে চড়ি, চলো। ভাসতে-ভাসতে বলব সব কথা।

ধৈর্যহারা হয়ে যায় রবিন। অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করে, কোনো বিপদ হয়নি তো তোমার?

না। আমার হয়নি। চলো ডিঙি বোটে বসে কথা বলি।

কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে থাকে। বোটে চড়ার রসিদ কাটার জন্য কাউন্টারের দিকে হাঁটছে দুজন পাশাপাশি।

আচমকা রবিন আবার প্রশ্ন করে, গোপন কিছু লুকাচ্ছ না তো আমার থেকে?

না। গোপন কিছু লুকাব কেন? লুকানোর কী-ই বা আছে আমার? জীবনে চলতে গেলে নানা সমস্যা তৈরি হতে পারে। সমস্যা তৈরি হয়েছে তেমন একটা। তোমাকে বলা দরকার। বলতে এসেছি এখানে।

কাউন্টার থেকে রসিদ নিয়ে বোটের দিকে যাওয়ার পথে রবিন আবার প্রশ্ন করে, ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে কি ফোন করেছে তোমাকে?

দ্রিম করে কেঁপে ওঠে বুক। নিজেকে সামলে রুবা বলে, না তো? ফোন করেছে তোমাকে? এ প্রশ্ন করছ কেন?

আত্মমর্যাদাবোধের ঘাটতি নেই। তোমার সঙ্গে সম্পর্ক কখনো খারাপ হবে না, এ বিশ্বাসও দৃঢ় আমার মনে। তবুও অসহনশীলতা জাগছে মনে। বলল রবিন।

অসহনশীলতা মানে কী?

মানে সহজ। ফোন পেয়েছি ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে।

কেন?

বিষয়টা নিশ্চয় জানো তুমি। বলোনি আমাকে। এজন্য অধৈর্য আক্রমণ করছে মনে। অসহনশীলতার এটাই বড় কারণ।

ওহ। তাহলে জেনে গেছ সব?

না। কিছু জানিনি এখনো। তবে বুঝেছি, সিরিয়াস কিছু ঘটেছে?

ইন্টেলিজেন্সের লোকজন কী জানতে চেয়েছে?

খোঁজ নিয়েছে তোমার ব্যাপারে।

ভয় পেয়েছ?

হুম।

ভয়ের কিছু নেই। কারণ ভয় পাওয়ার মতো কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত নই আমি। দৃঢ়ভাবে বলল রুবা।

সেটা জানি। ওরা খোঁজখবর নিচ্ছে, এটাই বড় বিস্ময়!

ওরা নিশ্চয় প্রয়োজনে খোঁজখবর নিচ্ছে। নিশ্চয় বুঝে যাবে আমার কোনো অপরাধ নেই।

অপরাধ কার?

নতুন পরিচিত মেয়েটির, আফরিন, সেই গডমাদার। বিরাট চক্রের একজন। সম্ভবত টার্গেট করেছিল, ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিল আমাকে। পারেনি। ধরা পড়েছে এখন।

ওহ্। তাহলে এ কথা।

শুধু এটুকু নয়। আরও আছে কথা। আমার রুমমেট সিমিকে সে দলে ভিড়িয়েছিল। সিমি পলাতক এখন। ওর ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছে। সেই সূত্রে হয়তো আমাদেরও যাচাই-বাছাই করছে।

বিষয়টা ভয়ের না?

ভয়ের। তবে অপরাধ করিনি আমরা, ভয় পাব কেন?

তা ঠিক। নিজের স্বচ্ছতা জটিল অবস্থা মোকাবিলার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার, বড় প্ল্যাটফর্ম। স্বচ্ছতার প্লাটফর্মে আছি আমি। ভয় পাব কেন?

উদ্বেগ কমে আসে রবিনের। স্বস্তি বোধ করছে এখন। কমে গেছে টেনশন। ঘটনার অস্বাভাবিকতা আর পীড়িত করছে না নিজেকে। দুজনার সম্পর্কের মর্যাদা ও বন্ধন আরও উন্নত হয়ে গেছে গোপনে।

ও জানে, সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য অন্যের প্রতি আগ্রহ দেখাতে হবে। সমালোচনা বা বিরূপ ভাবনা থেকে বিরত থাকতে হবে, ভুল সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে, প্রথমেই নিজের মনে গড়ে ওঠা বাজে ধারণা ঠেকাতে হবে। বাজে ধারণা গড়ে উঠছিল, ধারণাটা তাড়াতে পেরেছে রবিন। কতটুকু পারল সেই ভাবনা ত্যাগ করে কীভাবে দাঁড়ানো যায় রুবার পাশে, কতটুকু সাপোর্ট দেওয়া যায়, সেই চিন্তা এখন দখল করছে মন। ঘটনার মধ্য থেকে আরও বেশি আন্তরিকতা, আরও বেশি মমতা জাগছে দেখে ধন্যবাদ দেয়। রবিন নিজেকে।

রুবা বলে, বিষয়টা জানাতে চেয়েছিলাম। এজন্য দেখা করতে চেয়েছিলাম আজ। আগেই জেনে গেছ তুমি। নিশ্চয় খারাপ ধারনা তৈরি হয়েছে তোমার মনে, তাই না?

টেনশন তৈরি হয়েছিল। এটাকে বলতে পারো চাপ। তবে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, কোনো অপরাধ করোনি তুমি।

এ বিশ্বাসের জন্য ধন্যবাদ তোমাকে। বিশ্বাসটা আমার বড় অ্যাসেট তোমার পক্ষ থেকে। আই নিড ইট ফর হোল লাইফ।

কথা চলছে। বোটে উঠে বসেছে তারা। শান্ত লেকের পানির বুক কেটে এগিয়ে যাচ্ছে ডিঙি।

হঠাৎ রবিনের মুঠোফোনে মেসেজটোন বেজে ওঠে। খেয়াল করেনি ও।

রুবা বলে, তোমার ফোনে মেসেজ এসেছে।

পকেট থেকে সেট বের করে নিউ মেসেজ অপশনে গিয়ে দেখে মেসেজ বোম-ইউ আর মাই ড্রিম।

কার মেসেজ, জানতে চায় রুবা?

বুঝতে পারছি না কার। নম্বর সেভ করা নেই। তবে হট মেসেজ।

হট মেসেজ, মানে?

মানে কড়া মেসেজ। হাসতে হাসতে জবার দিল রবিন।

মেসেজের কনটেন্ট কী, বলো।

সেটা পরে বলছি। কনটেন্ট শুনলে জেলাস হয়ে যাবে তুমি। এখনকার বেড়ানোর আনন্দ মাটি হয়ে যাবে। নম্বরটা বলছি। তোমার সেট থেকে কল করে দেখো, প্রেরক ছেলে, না মেয়ে।

এ রহস্যের কারণ কী? রুবা জানতে চায়।

কারণ সোজা। কোনো মেয়ে এমন মেসেজ পাঠাতে পারে না। নিশ্চয় ছেলেরা কেউ দুষ্টুমি করে পাঠিয়েছে।

আরে! মেসেজটা কী, একটু বলল না।

আগে কল করো তুমি। নাও, নম্বরটা…

বেশ কিছুক্ষণ পর কল করে রুবা। ইয়েস। রিংটোন হচ্ছে। কল ধরেছে অপর পক্ষ।

চালাকি করে রুবা বলে, কি রে নাহিদ, কেমন আছিস?

সরি। রং নম্বর। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে মিষ্টি একটা কণ্ঠস্বর।

রং নম্বর হবে কেন? ঠিক নম্বরে ফোন করেছি। তুই নাহিদ না?

আপনি ভুল করছেন। আমার নাম তিমু। নাহিদ না।

সরি বলে লাইন কেটে দেয় রুবা।

রবিন প্রশ্ন করে, কে?

কিশোরী কণ্ঠ, নাম তিমু।

চমকে ওঠে রবিন। এমন মেসেজ পাঠাতে পারে তিমু? বিশ্বাস হচ্ছে না।

চেনো নাকি?

হ্যাঁ। চিনব না কেন? আমার ছাত্রী।

ওহ! তাহলে হট মেসেজ পাঠিয়েছে ছাত্রী?

তাই তো মনে হচ্ছে।

দেখি মেসেজটা।

থাক। দেখো না। এমন মেসেজ দেখা উচিত না তোমার।

দেখলে কী হবে?

খামাখা অবিশ্বাস ঢুকবে মনে। অবিশ্বাসী করে তুলতে চাই না তোমাকে।

অবিশ্বাসী হব না। খোলামেলা আলাপ করছি আমরা। বুঝতে পারছি, মেসেজটার সঙ্গে তোমার ইনভলভমেন্ট নেই। দাও সেটটা, পড়ে দেখি।

দেখতে চাইলে দেখাব। মনে হচ্ছে, তিমু মেসেজটা দেয়নি। ওর সেট থেকে অন্য কেউ পাঠিয়েছে কি না ভাবছি। এত ছোট মেয়ে এমন মেসেজ পাঠাতে পারে না।

ঘোঁট হবে কেন? তোমার ছাত্রীর টিনএজ শুরু হয়েছে। টিনএজে অনেক কৌতূহল জাগতে পারে। সহজে তোমার প্রতি আকর্ষিত হতে পারে। এটা টিনএজের দোষ। তোমার কোনো ভুল না। দাও পড়ি।

অবচেতন থেকে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। সেটটা রুবার হাতে না দিয়ে বরং লুকানোর চেষ্টা করে। একই সঙ্গে মনে পড়ে তিমুর একটি কথা–আমারও আকর্ষণ তৈরি হয়েছে একজনের প্রতি। তাকে কি এসএমএস দিতে পারি আমি?

চমকে ওঠে রবিন। চমকে ওঠা এড়ায় না রুবার চোখ।

এমন চমকে উঠলে কেন? ডাল মে কুছ কালা হ্যাঁয়?

রবিন হেসে জবাব দেয়, কালা নেই। সব ধলা। আমার মাঝে যেহেতু কালো নেই। পুরো বিষয়কে স্বচ্ছতা দিয়ে দেখতে হবে তোমাকে।

আচ্ছা দাও। স্বচ্ছতা দিয়ে দেখব।

শোনো, ব্যক্তিমাত্রই আলাদা। সবার একটা গোপন জগৎ থাকা উচিত। সেই জগতের খবর আপন কেউ না জানলেই ভালো। গুরুজনেরা এমন কথা বলে এসেছেন। অনেক অপ্রয়োজনীয় কথা এড়িয়ে যাওয়া ভালো।

অপ্রয়োজনীয় হলে এড়িয়ে যাব। দেখাতে না চাইলে দেখব না।

থ্যাংকস। প্রত্যেক মানুষের কিছু উদ্ভট আর বিরক্তিকর বৈশিষ্ট্য থাকে। তাকে বিচার করতে হবে সেইভাবে। নিজের সঙ্গে না মিললেও অন্যের বৈশিষ্ট্য ও আগ্রহকে সম্মান করার মানসিকতা থাকলে সংঘাত কম হবে। তিমুর পাঠানো এসএমএসটাকে উদ্ভট আচরণ হিসেবে মেপে দেখতে পারলে কৌতূহল কমে যাবে তোমার।

১৩

সন্ধ্যা রাত এখন। প্রায় আটটা বাজে। এখনো ফিরছে না রুবা। অস্থির হয়ে পায়চারি করছে হোস্টেলের দুই রুমমেট সানিয়া ও মণি।

মণি বলে, ভয় করছে সানিয়া। এত দেরি করে কখনো ফেরে না রুবাপু!

সানিয়া জবাব দেয়, আমারও লাগছে ভয়। কোনো বিপদ হলো না তো আপুর!

মোবাইল ফোনে কানেক্ট করার চেষ্টা করছে মণি। ঢোকা যাচ্ছে না মোবাইলে। বন্ধ আছে ফোনসেট। সানিয়াও চেষ্টা করছে। না। কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না আপুকে।

টেনশনে জ্যাম হয়ে গিয়েছিল মাথা। বুদ্ধি খোলেনি। হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে মণি। পেয়ে গেছি-রবিন ভাইয়াকে ফোন করি। হয়তো ওনার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে।

ইয়েস। সানিয়া কবুকে গিয়ে রবিনের নাম বের করে কল দেয়। হ্যাঁ। রিং হচ্ছে।

কল অ্যাটেন্ড হতেই অপর পক্ষকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সানিয়া বলে, ভাইয়া, আপু কি আপনার সঙ্গে এখন?

সানিয়ার নাম দেখে সেটটি রুবার হাতে তুলে দিয়েছিল রবিন। কল ধরেছে রুবা। হাসতে হাসতে জবাব দেয়–শুক্রবারও রবিনের সঙ্গে সময় কাটাতে পারব না? পারমিশন নেই তোমাদের?

ওহ! আপু! বাঁচালে! ভয়ে জমে বরফ হয়ে গিয়েছিলাম আমরা দুজন। তোমার নম্বরে কানেক্ট করতে পারছিলাম না। এত দেরি করো না তো আজকাল!

সরি! সরি! দুজনার জন্য দুবার সরি বললাম। আমার সেটে চার্জ দেওয়া হয়নি দুদিন। ভুলে গিয়েছিলাম। চার্জ শূন্য হয়ে গেছে সন্ধ্যার পর থেকে। এজন্য সেট বন্ধ। ফোন করে জানানো উচিত ছিল তোমাদের। অনুচিত কাজ করেছি। আবারও সরি।

সানিয়ার হাত থেকে সেট কেড়ে নেয় মণি।

চিৎকার করে বলে, তাড়াতাড়ি এসো আপু। সিমির সিট অন্য একজনকে দেওয়ার চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। কী করব আমরা?

কাকে?

দুটো নতুন মেয়ে ঢুকেছে হোস্টেলে। নতুন কাউকে দেখলে ভয় লাগে। স্মার্ট হলে আরও ভয় বাড়ে। তুমি এসো। কর্তৃপক্ষের কাছে যেতে হবে আমাদের।

ঠান্ডা গলায় রুবা বলে, ভয় পেয়ো না। এখন ম্যানেজমেন্টের কোনো লোক পাব না, কাল দেখা করব আমরা।

কখন আসছ তুমি?

এখনই আসছি।

একা এসো না। রবিন ভাইয়াকে বোললা, যেন নামিয়ে দিয়ে যায় তোমাকে।

হ্যাঁ। সঙ্গে আসছে ও। গ্রীন রোডে আমাদের গলির মাথা পর্যন্ত থাকবে আমার সঙ্গে।

সাবধানে এসো। মনে হয় আমাদের গতিবিধি ফলো করে কেউ-অদৃশ্য চোখ গেঁথে আছে পিঠে, ভয় করে ভীষণ। দেখো, কেউ যেন খারাপ না ভাবে আমাদের।

শোনো মণি, কে কী ভাবল সেটা নিয়ে মাথা ঘামালে চলবে না। অন্যের সমর্থন, অনুমোদন, আনুকূল্য চাওয়া মানে করুণা ভিক্ষা করা। করুণা চাইতে গেলে ছোট হতে হবে নিজেদের। অন্যের কাছে ভালো থাকতে চাইলে ভিখিরির মতো চলতে হবে, আত্মমর্যাদাবোধ ভেসে যাবে। বুঝলে? চিয়ার আপ বেবি। কোনো অপরাধ করিনি আমরা। ভীত হব কেন অযথা?

থ্যাংকস আপু। তোমার সঙ্গে কথা বললে প্রাণ ফিরে আসে দেহে। বিরূপ ঢাকা শহরে টিকে থাকার জোর পাই। তুমি এসো তাড়াতাড়ি। আরও কথা আছে, জরুরি।

কী জরুরি কথা? বলে ফেলল। টেনশনে রেখো না।

সানিয়া ফোন কেড়ে নিয়ে বলে, পরে বলব। তুমি এসো। আমার ব্যালান্স কম।

আসছি। টেনশন কোরো না অযথা।

লাইন কেটে যায়। সেটটা রবিনের হাতে তুলে দিতে গিয়ে রুবা তাকাল রবিনের চোখের দিকে। কী আছে ওই চোখে? কী ভাবছিল রবিন? ভীত হয়েছে কি ওদের কথোপকথন শুনে, নাকি সন্দেহ করছে ওদের? নাকি চাকরি না পাওয়ার কারণে হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত সে? সমালোচনা সহ্য করতে পারে না রবিন। মাঝে মাঝে রুবা টোকা দিয়ে দেখেছে। সমালোচনার জবাবে তাৎক্ষণিক খেপে যায়, বিতৃষ্ণা ঝরে পড়ে তার কণ্ঠে। অসহনশীল হয়ে ওঠে, অপ্রাসঙ্গিক কথার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেয়–ভাবে, তার সমালোচনা করা হচ্ছে, ভাবে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু সে-ই। রাগ করে অনেক দিন কথা বন্ধ রাখে, যোগাযোগ করে না, বিচ্ছিন্ন থাকে, একাকী থাকতে চায়। মাঝে মাঝে শঙ্কিত হয়ে পড়ে রুবা–যাকে ভালোবাসে তার মধ্যে হীনম্মন্যতা দেখতে চায় না ও। হীনম্মন্য কারও সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা কষ্টকর। হীনম্মন্য ব্যক্তির ভয় চাপা দিয়ে রাখে তার মেধা, নিজের যোগ্যতার প্রকাশ ঘটাতে পারে না তারা, জানে ও। রবিন কি এখন শুনেছে তাদের কথা, নাকি এসএমএস নিয়ে ভাবছে? এত লুকোছাপা করল কেন সে? নানা প্রশ্ন ভিড় করছে রুবার মনে। উত্তর পাওয়ার আগে মুখ খোলে রবিন, অনেকক্ষণ আটকিয়ে রাখলাম আজ তোমাকে।

আটকালে কোথায়? আমিই আটকে আছি বা ধরে রেখেছি তোমাকে।

আমার তাড়া দেওয়া উচিত ছিল।

তোমার একার উচিত বলছ কেন? আমারও উচিত ছিল না? পাল্টা প্রশ্ন করে রুবা।

হুম। সজাগ হওয়া উচিত দুজনার।

মুগ্ধ চোখে রুবা তাকাল রবিনের দিকে। নিজেকে সমালোচনা করছে সে। খুবই ভালো কথা। নিশ্চয় হীনম্মন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারবে। প্রশংসা করে রুবা বলে, মনে হচ্ছে চাকরিটা হয়ে যাবে তোমার এবার।

কীভাবে বুঝলে?

মন বলছে। দারুণ লাগছে এখন, তৃপ্ত মনে হচ্ছে তোমাকে।

প্রশংসা শুনে গলে গেল রবিন। ক্যাবলার মতো হাসল।

এই গলে যাওয়া ভাব পছন্দ নয় রুবার। আত্মমর্যাদাবোধের ঘাটতি থাকলে অল্প প্রশংসায় গলে যায় মানুষ। এ যুক্তিতে বিশ্বাসী রুবা। একটু খোঁচা দেওয়ার উদ্দেশে বলে, টিনএজারের এসএমএসের চেয়ে কি আমার সান্নিধ্য বেশি ভালো?

তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল রবিন। ক্রোধান্ধ চোখে তাকাল রুবার দিকে।

হো হো করে হেসে ওঠে রুবা। হাসি থামিয়ে একসময় শান্ত গলায় বলে, হেরে গেলে তুমি আমার পরীক্ষায়।

কী পরীক্ষা?

কী পরীক্ষা সেটা বলার প্রয়োজন নেই। আমার খোঁচা দেওয়া প্রশ্ন হেসে উড়িয়ে দেওয়া উচিত ছিল তোমার। না হেসে রেগে গেছ তুমি। এটা তোমার হার।

ঠান্ডা গলায় রবিন বলে, এ ধরনের পরীক্ষা আর কোরো না কখনো।

রুবা বলে, আচ্ছা। করব না। হাসো এবার।

হাসি এল না রবিনের মুখে। টেনেটুনে হাসি ফোঁটানোর চেষ্টা করে বিফল হয় সে।

আনন্দ নিয়ে ফিরল রুবা। আনন্দের অতলে গোপনে কী যেন ঢুকে গেছে মনে। কী? ঈর্ষা? বোঝে না ও।

রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে রুবাকে জড়িয়ে ধরে মণি। যেন বড় বোনকে পেয়ে ঝরে পড়ছে ছোট বোনদের আবদার।

শোনো, পাশের রুমে দুটো নতুন মেয়ে উঠেছে। ওই রুমে খালি হয়েছে একটি সিট। এখন দুজনের একজন উঠতে চায় সিমির সিটে। সিমি তো সিট ছেড়ে দেয়নি!

অনেকক্ষণ ভেবে রুবা বলে, সিমির সিট ধরে রাখতে পারব না আমরা! কেউ না কেউ উঠবে এ সিটে।

দমে যায় মণি। সানিয়া বলে, আপু, মেয়েটাকে ভালো লাগেনি। রুমে এসেছিল সে। সিট দেখে গেছে। হাতে একটা ব্যাগ ছিল। এটা-সেটা খাবার নিয়ে এসেছিল। খাওয়াতে চেয়েছে আমাদের। খাতির জমাতে চেয়েছে।

কী খাওয়াতে চেয়েছে?

কমলা।

কমলা খেলে ক্ষতি কি? নিশ্চয় বন্ধুত্ব করতে চেয়েছে, মন জয় করতে চেয়েছে তোমাদের।

না। বন্ধুত্ব নয় কেবল। মনে হচ্ছিল ও অন্য রকম। নিজে কমলা খেল। আমরা দেখলাম বসে বসে।

তোমরাও খেতে।

তুমি বলছ খেতে? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার, আপু। একটু পর ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করল। গলগল করে কী যেন খেল বোতল থেকে। খেয়ে বলে, ভালো জিনিস। খেলে ঘুম হয় ভালো। ত্বক সুন্দর হয়, লাবণ্য বাড়ে মুখের। স্লিম থাকা যায়। মণিকে বলে খাও।

স্লিম থাকা যায় শুনে মণি প্রায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। টেনে ধরেছি ওর কামিজ। তাই খেতে পারেনি। না বলতে পেরেছি আমরা।

সানিয়ার কথা শুনে দমে যায় রুবা। ওদের পরীক্ষা করতে সোর্স আসেনি তো রুমে? প্রশ্নটা উড়িয়ে দিয়ে মনে মনে রুবা ভাবে, আসুক সোর্স। নিজেরা খারাপ মেয়ে না। ফাঁদে ফেলা যাবে না ওদের। মণি আর সানিয়াকে উৎসাহ দিয়ে বলে, ভালো করেছ। মেয়েটির খাবার ফিরিয়ে দিয়ে

না বলতে পেরেছ, অ্যাক্সিলেন্ট! ওয়েলডান! ভেতর থেকে অপ্রতিরোধ্য জোশ জেগে ওঠে। প্রতিরোধ ও সংগ্রামের প্রশ্নে প্রস্তুত হয়ে ওঠে মন। জোর দিয়ে বলে, ওই মেয়েকে ঢুকতে দেব না এ ঘরে। প্রয়োজনে দুই মাস সিট ভাড়া দেব আমি। ভয় পেয়ো না তোমরা। দুই মাসের মধ্যে নিশ্চয় একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে আমাদের।

আশ্বস্ত হয় দুই রুমমেট। মুখের কথায় জোর থাকলেও ঘাবড়ে যায় রুবা। কোথাকার পানি কোথায় গড়ায় কে জানে। ড্রেস চেঞ্জ করে ওয়াশ রুম থেকে ফিরে খাটে এসে হেলান দিয়ে বসে রুবা। মণি ও সানিয়া ওর পাশে বসে।

সানিয়া জিজ্ঞাসা করে, এখন আমাদের করণীয় কী হওয়া উচিত, আপু?

ওয়েট অ্যান্ড সি–এ ছাড়া বলার কিছু নেই। গোয়েন্দারা খোঁজ করছে চারদিকে। ওই মেয়েটিও সেই উদ্দেশে আমাদের রুমে আসতে পারে।

মণি বলে, না আপু, তা মনে হয়নি। কর্তৃপক্ষের পুরো অনুমতি নিয়ে ঢুকেছে ওরা হোস্টেলে। এক রুমে উঠলেও সিট খুঁজে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন রুমে। কর্তৃপক্ষ সিটটা ওদের একজনের নামে বরাদ্দ করলে আমাদের কিছু করার থাকবে না। তুমি বরং টেলিফোনে ঊর্ধ্বতন কারও সঙ্গে কথা বলো।

বলা উচিত। কার সঙ্গে কথা বলা দরকার বুঝতে পারছি না। কথা বললে কর্তৃপক্ষ সিমির ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে জেনে ফেলবে। আমরা তেমন করে কিছু বলিনি এখনো।

চিন্তায় পড়ে গেল তিন রুমমেট। ভাবার সুযোগ পেল না বেশিক্ষণ। একটি মেয়ে এসে ঢোকে রুমে।

খুব বিনয়ের সঙ্গে বলে, আপনি রুবাপু?

নড়ে সোজা হয়ে বসে রুবা বলে, হ্যাঁ।

খুঁজছিলাম আপনাকে। পাশের রুমে উঠেছি আমি। ওদের দুজনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। এখন এলাম আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে।

রুবা বলে, পরিচিত হোন।

আমার নাম দিঘি। কিশোরগঞ্জে বাড়ি। একটা চাকরি পেয়েছি ঢাকায়। এজন্য চলে এলাম। এ হোস্টেলে উঠেছি। একটা সিট দরকার।

আমি হোস্টেলের মালিক নই। সিট দেওয়ারও কেউ নই। যথাসম্ভব দ্র গলায় বলল রুবা।

শুনলাম, একটা সিট খালি হয়েছে আপনাদের ঘরে। যদি অনুমতি দিন, সিটটার জন্য হোস্টেল মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি আমি।

সিট খালি হয়নি আমাদের ঘরে।

খালি হয়নি কথাটা কি ঠিক? শুনলাম, সিমি নামে একটা মেয়ে থাকত এ ঘরে। কাউকে কিছু না বলে পালিয়েছে। এটাকে খালি বলা যায় না?

মাথা ঠান্ডা রেখে রুবা আবার বলে, না। খালি বলা যায় না। দুমাস সিটটার ভাড়া পাবেন কর্তৃপক্ষ। এ দুমাস সিটটা খালি বলতে পারি না আমরা।

ভাড়া পেলেও সিটটা খালি থাকছে। আপাতত কি থাকতে পারি আমি, আপু?

দৃঢ় গলায় রুবা বলে, না।

দিঘি বলে, দেখুন, সুযোগ দিলে আপনাদের উপকার হবে। অনেক জানাশোনা আছে আমার।

জানাশোনা শব্দটা শোনার পর তিন রুমমেট একে অন্যের মুখের দিকে তাকায়, কথা বলে নেয় চোখে চোখে। সেটা খেয়াল করার সময় পায়নি দিঘি। চোখের পলকে ঘটে গেছে চোখাচোখি যোগাযোগ।

শান্ত থেকে আবারও দৃঢ়তার সঙ্গে রুবা উচ্চারণ করে, অন্য রুমে খোঁজ করে দেখুন। এখন এ সিটের ব্যাপারে নজর দেবেন না, প্লিজ।

কেন? অসুবিধা কোথায়?

সুবিধা-অসুবিধার বিষয় না। বিষয় হচ্ছে, এখন একটা সমস্যায় আছে এ সিটের বোর্ডার। সিট হারালে আরও সমস্যায় পড়বে। অযথা তার ঝামেলা বাড়ানো ভালো।

ওহ্। তাই বলেন। তাহলে পালিয়ে যাননি উনি। যোগাযোগ রাখছে। আপনার সঙ্গে, তাই না?

প্রশ্ন শুনে মোচড় খেল রুবা। গোয়েন্দা সংস্থার কেউ–মনে হচ্ছে মেয়েটিকে। যোগাযোগের ব্লু বের করার চেষ্টা করছে রুবার সঙ্গে। নিজের অবস্থান স্বচ্ছ করার জন্য রুবা বলে, না। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই।

তাহলে ছাড়তে চাচ্ছেন না কেন সিটটা?

সে ফিরে এলে বিপদে পড়বে না?

ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা আছে কি?

সম্ভাবনা থাকবে না কেন? তা ছাড়া সিমির বাবা যোগাযোগ করেছেন আমার সঙ্গে।

ওহ্! বলে থেমে যায় দিঘি। উঠতে গিয়েও উঠল না। বিনয়ের সঙ্গে আবার বলে, আপনারও চাকরি হয়ে গেছে শুনলাম। বড় চাকরি পেয়েছেন। নিশ্চয় আলাদা বাসা নেবেন। বিয়েও নিশ্চয় করবেন। তখন কি পেতে পারি আপনার সিটটা?

কী সাংঘাতিক মেয়ে রে বাবা! সরাসরি রুবার সিট দখল করতে চায়!

বিরক্ত হয়ে মণি প্রশ্ন করে, এসব কী বলছেন?

দিঘি বলে, সরি। আপনাদের বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন–বাস্তব কথা বলেছি আমি। সিট আমাকে দিলে আখেরে ভালো হবে আপনাদের।

রুবা বলে, অন্য রুমে সিট খুঁজে দেখুন, প্লিজ। ভেতরের উত্তেজনা সামাল দিয়ে শীতল গলায় মেয়েটিকে না বলে দিয়েছে রুবা।

উঠে যায় দিঘি। বিফল হয়েও মুষড়ে পড়েনি সে, বুঝতে পারে তিন রুমমেট। উঠে যাওয়ার সময় বডি ল্যাংগুয়েজ বলে দিয়েছে এ রুমে উঠবে সে। কেউ ঠেকাতে পারবে না তাকে।

দিঘির বডি ল্যাংগুয়েজ দেখে মন বিষাদে ঢেকে গেছে। প্রথমে উদ্বেগ হানা দিলেও মন খারাপ হতে থাকে রুবার, সানিয়া, মণিরও।

সিমির ঘটনার পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে তিন রুমমেটের। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেই। কী ঘটছে, কী ঘটবে জানে না তারা। কল্পনাও করতে পারছে না ভয়াবহতা নিয়ে। এ রকম জটিল অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধারের উপায় কী, তাও জানা নেই। ঘটনার প্রতিক্রিয়া এক জায়গায় বসে নেই। একাধিক দিক থেকে আসছে আক্রমণ। সংগতিহীন নানামুখি আক্রমণ থেকে বাঁচার উপায় কী? ভাবতে গিয়ে আরও দ্বন্দ্বে ঢুকে যায় তিনজন। সর্বশেষ অ্যাটাক হচ্ছে সিট নিয়ে। সহজে কি ছেড়ে দেবে? সিট ছেড়ে দিতে আপত্তি নেই। যে আসতে চাইছে তার আচরণ নিয়ে ভয় বাড়ছে। কী ধরনের মেয়ে সে? বোঝার উপায় নেই বলা যাবে না। বোঝা যাচ্ছে সহজ মেয়ে নয়। পরিস্থিতি আবার কোথায় টেনে নেবে তাদের? শঙ্কায় কুঁকড়ে থাকে তিনজন। যেকোনো জটিল ঘটনার ফল সবার ওপর সমান চাপ তৈরি করে না। কেউ কেউ জটিল পরিস্থিতিতে আনন্দে কাটাতে পারে, সময় পার করতে পারে হেসে-খেলে। অনেকে ধরাশায়ী হয়ে যায় অল্প কারণে। সিমির ঘটনাকে অল্প কারণ হিসেবে মাপতে পারছে না। ওপর দিয়ে সাহস দেখালেও বাজে চাপ ও ভাবনার কারণে ধসে গেছে রুবাও। তবু জুনিয়র দুই রুমমেটের জন্য শক্ত থাকতে হচ্ছে তাকে। ঘটনার সামাজিক মোটিভ ভয়াবহ। অগ্রহণযোগ্য। অপরাধের সঙ্গে জড়ানো বড় সামাজিক চ্যালেঞ্জ এখন সামনে। নিজেদের নিরপরাধ অবস্থান শক্ত রাখতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতি সামলে ওঠার মানসিক ক্ষমতা কখনো কম ছিল না। এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে, সিমির ঘটনার ধকল সামাল দেওয়ার শক্তি কমে গেছে। এটা ঠিক, এ বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পেরে ওঠার শক্তি কমে গেছে ভাবার যুক্তিসংগত কারণ নেই। এমন বেহালদশায় টেনশন আসবেই। এ টেনশনের স্রোত ঠেকাতে হলে তিনজনকে এক কথায় চলতে হবে, থাকতে হবে সংঘবদ্ধ। রাতের খাবারের পর একবার সিমির সিটের দিকে তাকাল রুবা। হাহাকার করে ওঠে মন। কত লক্ষ্মী মেয়ে ছিল সিমি,ওর চেয়ে বেশি কারও জানা নেই। সেই মেয়ে এখন সমাজের চোখে অপরাধী। অপরাধী ছিল না সিমি। মনোদহন ও সামাজিক ঘটনা ঠেলে দিয়েছে তাকে দূরে–সহজে হয়ে গেছে অপরাধী। হয়তো বুঝে ওঠার আগে অপরাধীর খাতায় নাম লিখে ফেলেছে সে? কীভাবে উদ্ধার করবে সিমিকে? মায়া জাগে ওর জন্য। বুক ফেটে যায় ওর বর্তমান অবস্থার কথা ভেবে।

বসে বসে সিমির কথা ভাবছিল রুবা। মণি পড়ছিল নীরবে। সানিয়া দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বোলাচ্ছিল নোট খাতার ওপর। দরজায় টোকা পড়ে। কে যেন এসেছে। তিন রুমমেট তাকাল একে অপরের দিকে। লক করা ছিল না দরজা, ভেজানো ছিল। মণি জিজ্ঞাসা করে, কে?

পাশের রুমের জোছনা আমি। আসব?

রুবা উত্তর দেয়, দরজা ভেজানো। লক করা নেই, এসো।

পাশের রুমের বোর্ডার হিসেবে জানাশোনা আছে জোছনার সঙ্গে। বেশি কথা বলে সে মণির সঙ্গে। মণির খাটে গিয়ে বসে। মুখ মলিন। উদ্বিগ্ন।

মণি বলে, কি রে, মন খারাপ কেন?

নতুন দুই মেয়ে উঠেছে রুমে। আমাদের রুমের শান্তি পালিয়ে গেছে।

মেয়েটার নাম দিঘি, তাই না?

হ্যাঁ। একজনের নাম দিঘি। অন্যজনের নাম মুনিয়া।

রুমের শান্তি কীভাবে হরণ করেছে তারা?

ওরা অন্য ধাঁচের মেয়ে। মিলছে না আমার সঙ্গে। একটা সিট খালি হয়েছিল আমাদের রুমে। এক সিটে দুজন উঠেছে। এখন রুমে থেকে উচ্ছেদ করতে চায় আমাকে।

উচ্ছেদ করতে চায় মানে? বললেই মেনে নিবি নাকি? প্রশ্ন করল রুবা।

মেনে নেওয়ার কথা না। টিকে থাকা বড় কথা। ওদের সঙ্গে পেরে উঠব বলে মনে হচ্ছে না।

মনের জোর এভাবে হারাচ্ছ কেন? আবার প্রশ্ন করল রুবা।

বোতল থাকে ওদের ব্যাগের ভেতর। একবার দেখেছি বোতল থেকে গলগল করে কী যেন খেয়েছে। আমাকেও অফার করেছে খাওয়ার জন্য।

কী খায়, জিজ্ঞাসা করোনি?

করেছি। বলেছে ওষুধ। ওষুধ খেলে নাকি স্লিম থাকা যায়।

কী বলেছ তুমি?

না বলেছি। স্ট্রংলি প্রত্যাখ্যান করেছি ওদের প্রপোজাল।

ভালো করেছ। সাবধানে থাকতে হবে। খারাপ অবস্থা মোকাবিলা করার নামই জীবন। সফলতা পেতে হলে মোকাবিলা করতে হবে অশুভ শক্তি।

একা কীভাবে মোকাবিলা করব? আমার অন্য দুই রুমমেট ভিড়ে গেছে। ওদের দলে। কীভাবে যেন পটিয়ে ফেলেছে ওদের। একা হয়ে গেছি রুমে আমি।

বলো কি! তোমার পক্ষ ছেড়ে রুমমেটরা ভিড়ে গেছে ওদের দলে?

হ্যাঁ। ওদের লোভ দেখিয়েছে, টাকা রোজগারের উপায় বাতলিয়ে দিয়েছে। আমার সামনে বলেছে–ওষুধ ব্যাগে করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দিয়ে আসলে অনেক রোজগার হবে। টিউশনি করে খরচ চালাতে হবে না।

.

এত সহজে রাজি হয়ে গেল রুমমেটরা? বাধা দিল না?

সেটাই বড় জাদু! তিনজন ভালো বন্ধু ছিলাম আমরা। সহজে পা দিয়েছে। ওরা লোভের ফাঁদে।

এখন কী করবে তুমি?

ওই রুমে থাকতে চাই না। আপনাদের রুমে তো খালি আছে সিমির সিট। সিটটা দেওয়া যাবে আমাকে?

সিমি ফিরে এলে কোথায় থাকবে? ওর বিপদ হবে না?

কোনো জবাব দিতে পারছে না জোছনা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সবার মুখের দিকে।

রুবা বলে, আপাতত টিকে থাকার যুদ্ধ করো। না রেগে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় সমস্যাটা মোকাবিলা করো। আমরা আছি তোমার পাশে। ফাঁদে পা দিয়ো না। কখনো না।

উঠে চলে যায় জোছনা। দরজা লাগিয়ে রুবার খাটে এসে বসে মণি। সানিয়াও এসে বসেছে। মুখোমুখি গোল হয়ে বসেছে তারা। মণি বলে, দিঘির চেয়ে জোছনা এলে ভালো হবে। দিঘিকে ঠেকাতে না পারলে, জোছনাকে এ রুমে নিয়ে আসব আমরা।

সানিয়া বলে, ভালো প্রস্তাব। কিন্তু যদি ফিরে আসে সিমি? ওর সিটটা রাখা উচিত না আমাদের?

ও সেঁটে গেছে অপরাধ জগতে। আসবে বলে মনে হয় না। কোনো যোগাযোগও করছে না। বলল মণি।

রুবা বলে, এত দ্রুত একজনকে অপরাধী বলা ঠিক না। সিমিকে ভালো করে চিনি আমরা। ভুল করতে পারে, অপরাধ করতে পারে না সে।

মণি জবাব দেয়, আপু। সিমিকে বেশি আদর করতে তুমি। তাই আবেগ দিয়ে দেখছ ঘটনাটা। আসল কথা হলো অপরাধ না করতে চাইলেও সে যে গেঁথে গেছে অপরাধের বঁড়শিতে, সন্দেহ নেই।

চুপ হয়ে থাকে রুবা। কিছু সময় পর বলে, ঠিক আছে, ভেবে দেখব পরে। এটা ঠিক, দিঘির চেয়ে জোছনা এলে আমাদের রুমের শান্তি বিঘ্নিত হবে না। আগের মতো শান্তি বজায় থাকবে। কথা শেষ করে উদাস হয়ে গেল রুবা। পাড়ার মাস্তানদের কথা মনে পড়ল–যাইবেন?, ভাড়া যাইবেন?, রেট কত?, এই হোস্টেলের মেয়েরা ভাড়া খাটে, জানি আমরা। এত তেজ ভালা না।

মাস্তানদের কথা একদম উড়িয়ে দিতে পারছে না রুবা। হোস্টেল নিয়ে এমন অশোভন ধারণা পেল কোত্থেকে মাস্তানেরা? তবে কি কোনো কোনো মেয়ে বিপথে থেকে রোজগার করছে? একের জন্য বদনামের চুনকালি লেগে যাচ্ছে সবার মুখে! মানতে পারছে না রুবা। ভীষণ কষ্ট হতে থাকে। দুই রুমমেটকে মনের এ অবস্থা ব্যাখ্যা না দিয়ে শুয়ে পড়ে। ভাবে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে এসব অশুভ ইঙ্গিতের বিরুদ্ধে। শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে ভেতর থেকে। হোস্টেলের সবার সঙ্গে বিষয়টি আলাপ করা যাবে না। কর্তৃপক্ষকে বলে কি লাভ হবে? ওরা নিয়মমতো সিট রেন্ট পেলে খুশি। হোস্টেলে সবাই ভালো থাকলে ওদের শান্তি। বাইরে কে কী করছে সেটা কি সামাল দিতে পারবে তারা? উদ্যোগ নেবে সমাধানের? মেয়েরা আসছে বিভিন্ন এলাকা থেকে। সবার বৈশিষ্ট্য এক রকম নয়। এ অবস্থায় সংঘবদ্ধ হওয়াটাও কঠিন। মনে চাপ বাড়ে। জ্যাম হতে থাকে মাথা। নিজেকে হালকা করার জন্য নাক দিয়ে বড় করে শ্বাস টেনে মুখ দিয়ে ছেড়ে উঠে বসে ও। এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়েছে আবার।

১৪

নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে হাজির হয়েছে রুবা। এখনো ঘর খোলা হয়নি! তাজ্জব বনে যায় ও। এ অফিসের ডিসিপ্লিনের সঙ্গে ঘটনাটি মিলছে না। বাইরের গেটের গার্ড আছে ডিউটিতে। মূল ভবনের তালা খোলা হয়নি বলে অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে ও। একজন-দুজন করে স্টাফরা আসছে। সবাই দাঁড়াচ্ছে বাইরে। মূল ভবনের তালা কে খোলে? চাবি থাকে কার কাছে, জানে না রুবা। অফিসের বিরাট সাইনবোর্ডটা তাকিয়ে আছে তার দিকে। নির্যাতিতা নারীদের নিয়ে কাজ তাদের। এখন মনে হচ্ছে কেবল নারীরা নয়, পুরুষেরাও নির্যাতনের শিকার হয় যানজটে। রাস্তায় বিরাট জ্যাম দেখে এসেছে। ভিআইপি রোডে গাড়ি চলতে দেখেনি। দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য গাড়ি। ফুটপাত দিয়ে আসার কারণে সময় বেশি লাগেনি। যানজটের কবলে পড়েনি ও। তবে কি চাবিওয়ালা আটকে আছে যানজটে?

একেক জনের স্ট্রেস একেক ধরনের। যারা যানজটে আটকে আছে তারা নিশ্চয় মানসিক চাপে আছে। অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে পুরো ঘটনাকে এভাবে মূল্যায়ন করায়, ধৈর্য তৈরি হয়ে গেছে ওর মনে। নিশ্চয় খবর আছে। আজ চাবিওয়ালার! কান্ট্রি ডিরেক্টর কিংবা ডিরেক্টর অ্যাডমিন নিশ্চয় ছেড়ে দেবেন না বিষয়টি। মজার ব্যাপার হলো ওঁরাও এসে পৌঁছাননি। তবে কি সবাই আটকে আছে ঢাকা শহরের রাস্তায়?

সামনে তাকিয়ে রুবা দেখছে একজন স্টাফ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ছুটে আসছেন। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললেন, সরি। আটকে পড়েছিলাম রাস্তায়। গাড়ি থেকে নেমে এক কিলোমিটার ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে এসেছি। নইলে কখন আসতে পারতাম, বলতে পারছি না।

অবাক হয়ে রুবা শোনে প্রশাসনিক কর্মকর্তার কথা।

মূল ভবন খোলা হয়েছে। ভেতরে ঢুকে মূল ভবনের বারান্দায় বসেছে রুবা। ওর কক্ষের দরজা খোলা হয়নি। খোলা যাচ্ছে না। ওই কক্ষের চাবি থাকে রুম-অ্যাটেন্ডেন্ট রাইয়ানের হাতে। রাইয়ানও এসে পৌঁছায়নি।

প্রশাসনিক কর্মকর্তা এগিয়ে এসে রুবাকে বলেন, আজ কারও বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেওয়া যাবে না। রাইয়ান সিনসিয়ার ছেলে। সেও আসেনি। বুঝতে হবে বিরাট গ্যাঞ্জাম তৈরি হয়েছে রাস্তায়।

প্রটোকলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা কি বড়, না ছোট ভাবতে গিয়ে হঠাৎ উত্তর পেয়ে যায় রুবা। তিনি স্টাফদের নিয়ন্ত্রণ করেন, হয় সমান পদ, নয় নিচের পদ হবে। শ্রদ্ধা নিয়ে তিনি বললেন, ম্যাডাম আর স্যারও এখনো এসে পৌঁছাতে পারেননি, প্রায় ৩০ মিনিট লেট। নিশ্চয় বড় কোনো সমস্যা হয়েছে। রাস্তায়।

এ সময় ছুটতে ছুটতে আসে রাইয়ান। অফিস কক্ষের গেট খুলে নতজানু হয়ে সে দাঁড়াল রুবার সামনে।

রুবা বলে, জ্যামে পড়েছিলে?

জি ম্যাডাম।

সবাই আটকে আছে জ্যামে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ইজি হও।

রুবার কথা শুনে পরানে পানি পেল রাইয়ান। দ্রুত হাতে চেয়ার-টেবিল মুছে দিয়ে এগিয়ে এসে বলল, ম্যাডাম রুম তৈরি। আসুন ভেতরে।

টেবিলে বসে ধর্ষিতা মেয়েটির ফাইল নিয়ে বসে রুবা। একটা অফিস আদেশ সংযুক্ত আছে ফাইলে। আদেশ অনুযায়ী কাজে মনোযোগ দেয় ও। হতাশার মধ্য থেকে আশার আলো জ্বলে ওঠে–২৫ নভেম্বরকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ২০০৮-এর স্লোগানটির ওপর চোখ পড়ে–নারী নির্যাতন আর নয়, কখনো নয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) খোলা হয়েছে। ইতিপূর্বে শুনেছিল কথাটা। ওসিসি থেকে নির্যাতিত নারীদের স্বাস্থ্যসেবা, পুলিশি ও আইনি সহায়তা, মানসিক ও সামাজিক কাউন্সেলিং, আশ্রয়সেবা ও সামাজিক পুনর্বাসন, ডিএনএ পরীক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের এই মাল্টিসেকটোরাল প্রোগ্রামে এনজিও কার্যক্রমও সম্পৃক্ত করা হবে। এনজিওরাও এসব সেবা দানে নির্যাতিত নারীদের পাশে থাকবে। এ ধরনের কাজের মধ্যে আনন্দ জাগে। চ্যালেঞ্জিং এ কাজের সঙ্গে নিজেকে উজাড় করে দেবে রুবা–এমন আত্মবিশ্বাসের আলোয় তেজস্বী হয়ে ওঠে ও। আজ পুনর্বাসন কেন্দ্রে যাওয়ার কথা। ডিরেক্টর অ্যাডমিন জাহেদ আকবর স্যারও যেতে চেয়েছিলেন। মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে হবে। আপিল করতে হবে কেসটা। আইনি সহায়তা পুরোটা দেবে ওদের প্রতিষ্ঠান। মানসিকভাবেও শক্ত রাখতে হবে মেয়েটিকে। মেয়েটির নাম শিমুল। গ্রামের মেয়ে–ফুলের নামে নাম। মা-বাবার বড় আদরের ধন শিমুল। এখন মা নেই। বাবাও নেই। নিঃস্ব মেয়েটি নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কেবল যৌন নিপীড়নের শিকার হয়নি সে, মানসিকভাবেও নির্যাতিত হয়েছে, ছিন্নভিন্ন হয়েছে তার আবেগের দাবি। অযত্ন অবহেলার শিকার হয়েছে, দৈহিক নির্যাতনও ভোগ করেছে। এমন অবস্থায় বেঁচে থাকার কোনো পথ খোলা নেই মেয়েটির। বারবার চেষ্টা করছে আত্মহননের।

জোরালো প্রশ্ন ছুটে আসে ব্রেনে, কেন হেরে যাবে মেয়েরা?

সিমির কথা মনে পড়ছে। সুযোগ পেলে সিমিকে আবার ফিরিয়ে আনবে আলোর জগতে। ওদের প্রতিষ্ঠান কি দাঁড়াবে তার পাশে? কোনো অপরাধীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাহায্য করা যাবে? মনে হয় না। তবুও চেষ্টা করে যাবে ও। সিমির জীবনের কষ্টের কথা জানে। ইমোশনাল অ্যাবিউজের শিকার হয়েছিল বাবার কারণে। অবহেলা, বঞ্চনার যন্ত্রণা সইতে হয়েছে তাকে। ভেতরের ক্ষোভ, কষ্ট সহজে ঠেলে দিয়েছে তাকে অচেনা পথে। অজানা পথে বড় হওয়ার হাতছানি সামাল দিতে পারেনি সিমি। তার মাশুল কেবল সে একা দিচ্ছে না। রুমমেটরাও পুড়ছে দুশ্চিন্তার আগুনে। ওর বাবারও কষ্ট হচ্ছে এখন। গোয়েন্দারা কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না। রবিনকেও ফোন করেছে। খোঁজ নিয়েছে। হোস্টেলে আসা নতুন দুটি মেয়ে দিঘি ও মনিয়ার আচরণও সন্দেহজনক–হয়তো গোয়েন্দাদের সোর্স হিসেবে ঢুকেছে অথবা নিজেরা নেশা করে, নেশার বোতল কেনাবেচা করেও মনে হলো ওই রুমের জোছনার কথায়। বিষয় দুটো ঝামেলার। হোস্টেলে থাকা নিরাপদ হবে না। বাইরেও নিরাপদ নয় আনম্যারেড মেয়েরা। বিয়ের আগে বাইরে একাকী বাসা নিয়ে থাকা যাবে না। এত সব ভাবনার সুতা ছিঁড়ে যায়, কল এসেছে ইন্টারকমে। রিসিভার উঠিয়ে রুবা বলে, আস্সালামুয়ালাইকুম।

গুড মর্নিং তাবাসসুম।

গুড মর্নিং, স্যার।

ম্যাডাম ফোন করে জানিয়েছেন, আসতে দেরি হবে ওনার। বিশাল জ্যামে বসে আছেন তিনি। আমারও প্রায় ঘন্টা খানেকের মতো দেরি হয়েছে।

জি স্যার। রাস্তায় বড় জ্যাম দেখেছি।

আপনি ঠিক সময়ে আসতে পেরেছিলেন?

জি স্যার। ঠিক সময়ে এসেছি। কাছেই আমার হোস্টেল। ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে চলে এসেছি। প্রায় বলে ফেলেছিল, এসে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। সামাল দিতে পেরেছে নিজেকে। কারও বিরুদ্ধে অযাচিত অভিযোগ না করা শ্রেয়। এ বিশ্বাসে শক্ত থেকে রুবা পাল্টা প্রশ্ন করে, শিমুলের ফাইল পড়েছি। ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই। বলেছিলেন স্পটে নিয়ে যাবেন আপনি।

হ্যাঁ। মনে আছে আজকের শিডিউল। ম্যাডাম না আসা পর্যন্ত যাওয়া যাবে না। একটা কাজ গুছিয়ে রাখতে হবে আমাদের। আমার কক্ষে আসুন। কুষ্টিয়াতে প্রজেক্টের ব্যাপারে ম্যাডাম বেশি ইন্টারেস্টেড। বিষয়টা নিয়ে প্রাথ মিক আলাপ করে নেব আমরা। পরে প্রজেক্ট প্রপোজাল জমা দেব। আমাদের সঙ্গে থাকছেন অ্যাকাউন্টেন্ট ফারাহ আলম।

আমার রুমে আসুন শুনে উদ্বেগ হানা দিয়েছিল মনে। ফারাহ আলম থাকবে শুনে স্বস্তি আসে। কেন হয় এমনটা? ভেবে পায় না রুবা। নিজে কি দুর্বল ধাচে গড়া? তেমন মনে হয় না নিজেকে। এমন লাগে কেন? জাহেদ আকবর স্যার তো সজ্জন। কথাবার্তায় নরম। কথা বলেন সব সময় সমীহ বজায় রেখে। তবুও কেন ভীত হয় মন? নিজের মনের গোপন স্তরে কী রয়েছে কে জানে? অবচেতন ঘরের লুকোনো অবস্থা থেকে কি ছুটে আসে ভয়ের সিগন্যাল? আজকাল নিউজ ছাপা হয়-বসের হাতে নিপীড়নের শিকার হয় মেয়েরা, যৌন হয়রানির মতো ঘটনাও অহরহ ঘটছে চারপাশে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানেও অনেক শিক্ষকের হাতে যৌন নির্যাতিত হচ্ছে ছাত্রীরা। এ নির্যাতনের কারণ কী? নিপীড়ক শিক্ষিত, জ্ঞানী, সম্মানিত ব্যক্তিরা! ওরা কেন মেয়েদের ওই চোখে দেখে?

নিজের চেয়ার থেকে উঠে কিছুক্ষণ পর বসের কক্ষে ঢোকে রুবা। দরজায় টোকা দিয়ে বলে, মে আই কাম ইন স্যার?

ইয়েস মিস তাবাসসুম। আসুন।

মিস শব্দটা শোনামাত্র গরম হয়ে ওঠে কান। ভদ্রলোকদের ভদ্র ভাষা। অথচ প্রথম দিনও শব্দটি ভড়কে দিয়েছিল ওকে। এ ধরনের সম্বোধন শুনতে অনভ্যস্ত রুবার অভ্যাস তৈরি হতে সময় লাগছে। প্রথম দিনের মতো না হলেও কম লাল হয়নি ও। মুখে ত্বরিত ছুটে গেছে লাল আভা, ফ্লাশিং।

চেয়ারে বসার সময় কিছুটা সংকোচ বোধ করল ও। জাহেদ আকবরের চোখ এড়াল না বিষয়টি।

গমগম গলায় তিনি বলেন, বি ইজি জাহানারা তাবাসসুম। মনে হচ্ছে, জড়িয়ে যাচ্ছেন আপনি। প্রথম দিন দেখেছিলাম নার্ভাসনেস। আজ দেখছি সংকোচ, জড়ানো ভাব কেন? বি ইজি, মাই কলিগ!

ভয়েসের কারণে উবে যায় জড়তা। মাই কলিগ শব্দটি ভেতরকে পিটিয়ে সহজ করে দিয়েছে ওকে। ফারাহ আলমকে না দেখে জড়তা চেপে ধরেছিল।

জাহেদ আকবর আবার বলেন, ফারাহ আলম ওর কক্ষে নেই। মোবাইলে ফোন করেছিলাম আপনাকে কল দেওয়ার পর। তিনিও রাস্তায়, বসে আছেন জ্যামে।

জাহেদ আকবরের কথা শেষ হওয়ার আগে বেজে ওঠে রুবার সেলফোন। দ্রুত লাইন কেটে দেয় ও।

জাহেদ সাহেব বলেন, ডোন্ট ওরি। জরুরি হলে কল অ্যাটেন্ড করুন। নইলে সাইলেন্ট মোডে রাখুন সেট।

ওনার কথা চলার সময় আবার কল আসে। রবিনের কল। এবার রিসিভ করে বলে, মিটিংয়ে আছি। পরে কল দেব আমি।

কয়েক সেকেন্ড শোনো, চাকরির কার্ড পেয়েছি আমি। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির ঢাকা অফিসে চাকরি। সহকারী ম্যানেজার পদ। বেতনও মনে হচ্ছে ভালো হবে। ব্যবস্থাপক একটা চিঠি দিয়েছেন সঙ্গে। বলেছেন, সত্য কথা বলার জন্য চাকরিটা হয়েছে আমার। আর শোনো, তুমি তো কথা বলতে পারছ না। আমি বলছি, সত্য কথা হচ্ছে, আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন নামাজ পড়ি কি না। আমি বলেছি, পড়ি না। এটা সত্য কথা। পড়ি না বলার পর কেমন যেন অনুশোচনা জাগে। ওই দিন মসজিদে ঢুকেছিলাম জুমার নামাজ পড়ার জন্য। কী কো-ইনসিডেন্স দেখো, মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেখি গার্মেন্টসের সেই এমডি! এখন বোঝো! নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। এ আনন্দ উপহার দিলাম তোমাকে! কথা শেষ করে উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে লাইন কেটে দেয় রবিন।

মুহূর্তের ব্যবধানে ঝলমল করে ওঠে রুবার মুখ।

জাহেদ আকবর জিজ্ঞাসা করেন, সুখবর?

জি। সুখবর। গলার ভেতর থেকে উচ্ছ্বাস ছুটে আসে রুবার।

যাক। ভালো লাগল। দিনের শুরুতে সুখবর পেয়েছেন। খবরটা কী, বলার দরকার নেই। তবে আমাদের কাজ হচ্ছে দুঃখবর নিয়ে।

দুঃখবর কী, স্যার?

দুঃখবর মানে কষ্টের খবর। যে সকল নারী কষ্টে আছে, তাদের নিয়ে আমাদের কাজ।

ওহ্।

শোনেন, বিরল প্রজাতির এক পাখি নিয়ে পত্রিকায় একটা খবর প্রকাশিত হয়েছে–খবরটি চোখে পড়েছে আমার। পাখিটি ধরা পড়েছিল মেহেরপুরের তেরঘরিয়া বিলে। মেহেরুল্লাহ নামের এক যুবক শিকারির হাত থেকে কিনে নিয়েছিল সেটি ৭০ টাকায় বিনিময়ে। বিরল প্রজাতির ওই পাখিটি অসীম আকাশে ছেড়ে দিয়েছিল মেহেরুল্লাহ। শৃঙ্খলমুক্ত করেছিল পাখিটাকে।

বাহ্, দারুণ কাজ করেছেন মেহেরুল্লাহ!

হ্যাঁ। এ রকম কাজ আমাদেরও করতে হবে।

পাখি ছেড়ে দেব আকাশে?

না। শৃঙ্খলিত, অবহেলিত, নির্যাতিত মেয়েদের উদ্ধার করব আমরা। তাদের ভোলা পৃথিবীতে ছেড়ে দেব না। জীবনে প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার উদ্যোগ নেব।

খুশিতে ঝলমল করে ওঠে রুবা। দৃপ্ত কণ্ঠে বলে, আমাদের কাজটাও মেহেরুল্লাহর কাজের মতো অনেক বড়।

হুম। বড় কাজ করতে গেলে, বড় করতে হবে মনও। বেরিয়ে আসতে হবে জড়তার খোলস থেকে।

রুবা বলে, ঠিক বলেছেন স্যার। মনে থাকবে আপনার উপদেশ।

মনের মধ্যে হিসাব কষে রুবা। সিমিও এখন শৃঙ্খলিত। আটকে আছে জালে। জাল ছিন্ন করে বের করে আনতে হবে তাকে। যত খারাপ হোক, ঘৃণা করা চলবে না সিমিকে। সুস্থ জীবনে ফেরত এনে আবার তার মেধাকে খাটাতে হবে ভালো খাতে। তবেই বন্ধুত্বের মূল্য দেওয়া হবে, রুমমেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা হবে। বড় বোনের মতো আচরণ করতে হবে ওর সঙ্গে। উদ্ধারের উদ্যোগ না নিলে পচা গর্তে আরও ডুবে যাবে, আরও বেশি দুর্গন্ধ ছড়াবে সে।

জাহেদ আকবর বলেন, কান্ট্রি ম্যাডাম খবর পেয়েছেন, গ্রামে গ্রামে। মেয়েরা নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হয়। মুখ বুজে সহ্য করে সব, প্রতিবাদ করতে পারে না, প্রতিবাদের ভাষা জানা নেই তাদের। এজন্য গ্রামমুখী প্রকল্প গ্রহণে ঝোঁক বেশি ম্যাডামের। দাতাদের চোখও অসহায়, অশিক্ষিত মানুষের দিকে। ধর্মবিদ্বেষী কোনো পদক্ষেপ নেব না আমরা। যার যার ধর্মের আলোকে আলোকিত করার প্রচেষ্টা থাকবে আমাদের। কেবল পাশে দাঁড়ানো। ঢাকা থেকে দূরবর্তী প্রজেক্ট নেওয়ার জন্য কুষ্টিয়া চয়েস করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে, এ কারণে নিয়োগের সময় আপনার ইস্যু গুরুত্ব পেয়েছে বেশি।

ভীতি কেটে যাচ্ছিল মনের। জাহেদ আকবরের কথা শুনে আবার ঘাবড়ে গেল রুবা। ভীত গলায় বলে, কুষ্টিয়াতে আমাকে বদলি করে দেবেন না তো?

না না। এখানকার কাউকে কুষ্টিয়াতে নিয়োগ দেব না আমরা। কুষ্টিয়া প্রজেক্টের কাজের জন্য নতুন নিয়োগ হবে। শুরুতে কয়েক মাস হয়তো থাকতে হবে আমাকে। প্রয়োজনে আপনিও থাকবেন কিছুদিন। সেখানকার দায়িত্ব তুলে দিতে হবে প্রশিক্ষিত স্থানীয় জনশক্তির হাতে। ম্যাডাম যাবেন কুষ্টিয়ায়। সেখানে থাকার ভালো কোনো হোটেল বা রেস্টহাউসের বিষয়ে জানাশোনা আছে আপনার?

জানাশোনা নেই। নানা কারণে কুষ্টিয়ায় থাকার প্রতি অনীহা আছে আমার। তবে এটা জানি, কুষ্টিয়া শহরে জি কে ঘাট নামক স্থানে আছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলো। বেশ উন্নত। ঢাকা থেকে ব্যবস্থা করে যেতে হবে। সিকিউরিটি খুব ভালো।

ইয়েস। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হেড অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করব আমি। ঢাকায় বসে রিজার্ভেশন নিয়ে নেব। থ্যাংকস ফর ইউর ইনফরমেশন। ম্যাডামকে জানাব বিষয়টা। ম্যাডাম বলেছিলেন, বিষয়টা নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে। কিছুদিন নিজেদের বাসায় থাকতে পারবেন আপনি, তাই না?

হ্যাঁ। তা থাকা যাবে। শহরের মিলপাড়াতে আমাদের বাসা। রিকশায় জি কে ঘাটে ভাড়া নেবে ১০ থেকে ১৫ টাকা।

জাহেদ আকবর আশ্বস্ত হয়ে বলেন, ঠিক আছে, আপনি রুমে যান, আমাদের ক্লায়েন্ট শিমুলের ফাইল ভালোভাবে স্টাডি করুন। ম্যাডাম এলে কথা সেরে অফিসের গাড়িতে পুনর্বাসন সেন্টারে যাব আমরা।

রুমে এসে রবিনকে কলব্যাক করে রুবা।

ফোন কানেক্ট হওয়ার পর অভিনন্দন জানায় কনগ্রাচুলেশন!

থ্যাংক ইউ, রুবা! তোমার টেলিফোন পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। আনন্দ-সংবাদটা প্রথমে জানিয়েছি তোমাকে!

ধন্য মনে হচ্ছে নিজেকে। তো

প্রথম শব্দটা ব্যবহার করলে কেন? প্রথমের পর দ্বিতীয় থাকে। তৃতীয়ও থাকবে। দ্বিতীয় জন কে? তৃতীয় জনই বা কে?

দ্বিতীয় জন হচ্ছে আমার ছাত্রী তিমু।

তিমু মানে সেই টিনএজার? প্রশ্ন করল রুবা।

সেই টিনএজার মানে? অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে রবিন।

মানে যে তোমাকে এসএমএস পাঠিয়েছিল, হট মেসেজ, মেসেজটা এড়িয়ে গিয়েছিলে, দেখতে দাওনি আমাকে, সে?

হ্যাঁ, সেই মেয়েটি আমার ছাত্রী, তিমু। সরল উত্তর রবিনের।

ওহ্। গলা কিছুটা বসে যায় রুবার।

তৃতীয় জন কে?

তৃতীয় জন হচ্ছেন মা।

গলা আরও বসে যায় রুবার। স্থির কণ্ঠে বলে, প্রথম জন মা হলে খুশি হতাম। দ্বিতীয় জন আমি হলে খুশির ঢেউ থাকত আকাশসমান। এখন মনে হচ্ছে খুশির ঢেউ শান্ত পুকুরের মতো, ছোট ছোট।

রবিন বলে, সেকি! কাকে আগে বললাম কাকে পরে বললাম, এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন? আনন্দ মানে আনন্দ। আগে-পরে ভেবে আনন্দের মাত্রা কমিয়ে আনবে কেন?

আনন্দ কমিয়ে আনিনি। কমে গেছে আনন্দঢেউ! আমি কী করব? কথা শেষ করে লাইন কেটে দেয় রুবা।

শূন্য চোখে তাকাল ও সামনে। শূন্যতার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল অপূর্ণতার আঁধার। খোলা চোখে দেখল আঁধার ভরে উঠছে ঘোলাটে আঁধারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *