১১. ঈশ্বরের কি ভবিষ্যৎ আছে?

১১. ঈশ্বরের কি ভবিষ্যৎ আছে?

আমরা দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষ দিকে এগিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে এখন ধারণা জন্মাচ্ছে যে, আমাদের চেনা পরিচিত পৃথিবী যেন অতীত হয়ে যাচ্ছে। দশকের পর দশক আমরা এই জ্ঞান নিয়ে বসবাস করে এসেছি যে আমাদের আবিষ্কৃত মারণাস্ত্র পৃথিবীর বুকে থেকে মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। ঠাণ্ডা লড়াই হয়তো-বা শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা পুরোনোটির চেয়ে কম ভীতিকর ঠেকছে না। আমরা এক প্রতিবেশগত বিপর্যয়ের আশঙ্কার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি। এইডস ভাইরাস এক অকল্পনীয় মাত্রার মহামারী ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি সৃষ্টি করেছে। আগামী দুই কি তিন প্রজন্মের ব্যবধানেই জনসংখ্যা গ্রহটির ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। হাজার হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষ ও খরায় মারা যাচ্ছে। আমাদের আগের প্রজন্মগুলোও পৃথিবীর ধ্বংস আসন্ন মনে করেছে, কিন্তু তারপরেও যেন মনে হচ্ছে আমরা এক কল্পনাতীত ভবিষ্যতের মোকাবিলা করছি। আসছে বছরগুলোয় ঈশ্বরের ধারণা কীভাবে টিকে থাকবে? বিগত ৪,০০০ বছর ধরে চলমান সময়ের প্রয়োজন মাফিক এই ধারণা অভিযোজিত হয়ে এসেছে, কিন্তু আমাদের শতকে মানুষ ক্রমবর্ধমান হারে লক্ষ করছে যে, এই ধারণটি এখন আর তাদের কাজে আসছে না। ধর্মীয় ধারণাসমূহ যখন আর কার্যকর থাকে না তখন সেগুলো আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়। ঈশ্বর হয়তো আসলেই অতীতের ধ্যান-ধারণার অংশ। আমেরিকান পণ্ডিত পিটার বার্জার উল্লেখ করেছেন, আমরা প্রায়শঃ আমাদের সময়ের সঙ্গে অতীতের তুলনা করার সময় দ্বৈতনীতি অনুসরণ করি। অতীতকে যেখানে বিশ্লেষণ করে আপেক্ষিক করে তোলা হয়, বর্তমানকে সেখানে এই প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়; আমাদের বর্তমান অবস্থান পরম এক অবস্থায় পরিণত হয়। এভাবেই ‘নিউ টেস্টামেন্টের রচয়িতাদের তাঁদের সময়ের ভ্রান্ত সচেতনতায় আক্রান্ত হিসাবে দেখা হয়, কিন্তু বিশ্লেষক তাঁর সময়ের সচেতনতাকে অবিমিশ্র বুদ্ধিবৃত্তিক আর্শীবাদ ধরে নেন। ঊনবিংশ ও প্রাক-বিংশ শতাব্দীর সেকুলারিস্টরা নাস্তিক্যবাদকে বিজ্ঞান যুগে মানুষের অপরিবর্তনীয় অবস্থা হিসাবে বিবেচনা করেছে।

এই দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে বহু যুক্তি আছে। ইউরোপে চার্চগুলো শূন্য হয়ে আসছে; নাস্তিক্যবাদ আর মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী অগ্রপথিকের কষ্টার্জিত আদর্শ নয়, বরং সর্বজনীন এক অনুভূতি। অতীতে এটা সব সময় ঈশ্বর সম্পর্কিত বিশেষ কোনও বিশ্বাস বা ধারণা হতে উদ্ভূত হয়েছে, কিন্তু এখন যেন তা ঈশ্বরবাদের সঙ্গে অন্তর্গত সম্পর্ক হারিয়ে এক সেকুলার সমাজে বাস করার অভিজ্ঞতার সক্রিয় সাড়ায় পরিণত হয়েছে। নিৎশের সেই উন্মাদ ব্যক্তিটিকে ঘিরে রাখা আমোদিত জটলার মতো অনেকেই ঈশ্বরবিহীন জীবনযাপনের সম্ভাবনায় এখন অবিচালিত। অন্যরা তাঁর অনুপস্থিতিকে ইতিবাচক স্বস্তি হিসাবে দেখছে। আমাদের মধ্যে যারা অতীতে ধর্ম নিয়ে সঙ্কটপূর্ণ সময়ের মোকাবিলা করেছে তারা আমাদের ছোটবেলাকে আতঙ্কিতকারী ঈশ্বর হতে মুক্তিলাভকে স্বস্তিকর মনে করছে। এক প্রতিহিংসা পরায়ণ উপাস্যের সামনে আতঙ্কে নত না হওয়াটা সত্যি অসাধারণ সুন্দর, যিনি তাঁর আইন না মেনে চললে অনন্ত নরকবাসের ভয় দেখান। আমাদের এক নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা এসেছে; আমরা সাহসের সাথে ধর্ম বিশ্বাসের কঠিন বিধি-বিধানের আশপাশে ঘুরঘুর না করে নিজস্ব ধ্যান-ধারণা নিয়ে সামনে এগুতে পারি-অখণ্ডতা হারানোর অবিরাম ভয় নিয়ে থাকতে হয় না। আমরা মনে করি ভীষণ উপাস্যের যে অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে তিনি ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের প্রকৃত ঈশ্বর; আমরা কখনও উপলব্ধি করি না যে, ব্যাপারটা দুর্ভাগ্যজনক বিভ্রান্তি মাত্র।

নিঃসঙ্গতার বিষয়টিও রয়েছে। জঁ-পল সার্ত (১৯০৫-৮০) মানুষের চৈতন্যে ঈশ্বরাকার গহ্বরের কথা বলেছেন, যেখানে ঈশ্বর সব সময় ছিলেন। তা সত্ত্বেও, তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, যদি ঈশ্বর থেকেও থাকেন তবুও তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা প্রয়োজন, কেননা ঈশ্বরের ধারণা আমাদের স্বাধীনতাকে অচল করে দেয়। প্রচলিত ধর্মগুলো আমাদের বলে যে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার জন্যে আমাদের অবশ্যই মানুষ সম্পর্কিত ঈশ্বরের ধারণার একরূপ হতে হবে। এর বদলে মানুষকে অবশ্যই আমাদের মুক্তিকে প্রতিরূপ হিসাবে দেখতে হবে । সাত্রের নাস্তিক্যবাদ সান্ত্বনাদায়ক বিশ্বাস ছিল না, তবে অন্য অস্তিত্ববাদীগণ ঈশ্বরের অনুপস্থিতিকে ইতিবাচক মুক্তি হিসাবে দেখেছেন। মরিস মারলঅ-পন্তি (১৯০৮-৬১) যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ঈশ্বর আমাদের বিস্ময়ের বোধ বৃদ্ধি করার বদলে তা নাকচ করে দেন। ঈশ্বর যেহেতু পরম সম্পূর্ণতার প্রতিনিধিত্ব করেন, আমাদের আর কিছু করার বা অর্জনের থাকে না। আলবার্ট কামু (১৯১৩-৬০) এক বীরত্ব সূচক নাস্তিক্যবাদের প্রচার করেছেন। মানুষের সকল প্রেমময় অনুভব মানবজাতির ওপর বর্ষণ করার জন্যে ঈশ্বরকে প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করা উচিত। বরাবরের মতো নাস্তিকদের একটা যুক্তি রয়েছে। ঈশ্বরকে প্রকৃতপক্ষেই অতীতে সৃজনশীলতা রোধ করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি যদি সকল প্রশ্ন ও সমস্যার সামগ্রিক জবাব হয়ে থাকেন তাহলে সত্যিই তিনি আমাদের বিস্ময়ের অনুভূতি বা সাফল্যের বোধকে রুদ্ধ করে দিতে পারেন। এক প্রবল ও অঙ্গিকারবদ্ধ নাস্তিক্যবাদ পরিশ্রান্ত বা অপর্যাপ্ত আস্তিক্যবাদের চেয়েও বেশি ধর্মীয় হয়ে উঠতে পারে।

১৯৫০-এর দশকে এ. জে আয়ারের (১৯১০-৯১) মতো লজিক্যাল পজিটিভিস্টগণ প্রশ্ন তুলেছেন ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখার কোনও অর্থ হয় কিনা। প্রকৃতি বিজ্ঞানসমূহ জ্ঞানের একমাত্র বিশ্বাস ও নির্ভরযোগ্য উৎসের যোগান দিয়েছে, কারণ গবেষণাগারে তা পরীক্ষা করা যায়। ঈশ্বর আছেন কি নেই সে প্রশ্ন করতে যাননি আয়ার, বরং তাঁর জিজ্ঞাসা ছিল ঈশ্বরের ধারণার কোনও অর্থ আছে কি না। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, কোনও বক্তব্যের সত্য মিথ্যা প্রতিপন্ন করা না গেলে তা অর্থহীন। মঙ্গলে বুদ্ধিমান প্রাণী আছে’, বলাটা অর্থহীন নয়, কারণ প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি আবিষ্কারের পর এর যাচাই করার উপায় মিলবে বলে আমরা জানি। একইভাবে মহাকাশের বুড়ো মানুষে বিশ্বাসী একজন সাধারণ মানুষও অর্থহীন কথা বলে না, যখন সে বলছে, ‘আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি’: যেহেতু মৃত্যুর পর আমরা জানতে পারব কথাটা সত্যি না মিথ্যা। কিন্তু উন্নত ধরনের বিশ্বাসী সমস্যায় পড়ে যায় যখন সে বলে: “আমরা বুঝতে পারব তেমন কোনও অর্থে ঈশ্বর অস্তিত্ববান নন। কিংবা মানুষ যেভাবে মনে করে ঈশ্বর সেই অর্থে ভালো নন।’ এসব বক্তব্য খুবই অস্পষ্ট; এসব পরীক্ষা বা যাচাই করা অসম্ভব, সুতরাং এগুলো অর্থহীন। আয়ার যেমন বলেছেন: ‘আস্তিক্যবাদ খুবই বিভ্রান্তিময়, যেসব বাক্যে “ঈশ্বর” আবির্ভূত হন সেগুলো এত সঙ্গতিহীন এবং সত্য বা মিথ্যা যাচাই করার ক্ষমতাবিহীন যে মানা বা না মানা কিংবা বিশ্বাস করা বা না করার কথা বলা যৌক্তিক দিক থেকে অসম্ভব। নাস্তিক্যবাদ আস্তিক্যবাদের মতোই দুর্বোধ্য ও অর্থহীন। ঈশ্বরের ধারণায় অস্বীকার বা সন্দেহ প্রকাশ করার মতো কিছু নেই।

ফ্রয়েডের মতো পজিটিভিস্টরা বিশ্বাস করেছেন, ধর্মীয় বিশ্বাস এক অপরিণত অবস্থার পরিচায়ক যা বিজ্ঞান অতিক্রম করবে। ১৯৫০-এর দশকের পর থেকে ভাষাবিদ্যাগত দার্শনিকরা লজিক্যাল পজিটিভিজমের সমালোচনা করে আসছেন, তাঁরা বলেছেন, আয়ার যাকে ‘যাচাইয়ের নীতি’ বলছেন সেটার যাচাই অসাধ্য। বর্তমান যুগে কেবল ভৌত জগৎ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দানে সক্ষম বিজ্ঞান সম্পর্কে আমরা অপেক্ষাকৃত কম আশাবাদী হতে পারি। উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথ উল্লেখ করেছেন, লজিক্যাল পজিটিভিস্টরা নিজেদের এমন এক সময়ে বিজ্ঞানী হিসাবে তুলে ধরেছিলেন যখন ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিজ্ঞান প্রকৃতিকে মানুষ হতে একেবারে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দেখেছে। যেসব বক্তব্যের দিকে আয়ার ইঙ্গিত করেছেনা সেগুলো বিজ্ঞানের বস্তুগত সত্যের বেলায় খুবই কার্যকর, কিন্তু অপেক্ষাকৃত অস্পষ্ট মানবীয় অনুভূতির পক্ষে মানানসই নয়। কবিতা ও সঙ্গীতের মতো ধর্ম এই ধরনের আলোচনা বা যাচাইয়ের উপযুক্ত নয়। অতি সম্প্রতি অ্যান্টনি ফ্লিউর মতো ভাষাবিজ্ঞানীরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ধর্মীয় ব্যাখ্যার চেয়ে প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা খোঁজাই বেশি যুক্তিপুর্ণ। প্রাচীন প্রমাণ’ এখন আর কাজে আসছে নাঃ পরিকল্পনার যুক্তি অচল হয়ে যাচ্ছে, কেননা প্রাকৃতিক ঘটনাবলী তাদের নিজস্ব নিয়মে নাকি বাহ্যিক কিছু দিয়ে অনুপ্রাণিত সেটা জানার জন্যে আমাদের গোটা ব্যবস্থার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন। আমরা অনিশ্চিত’ বা ত্রুটিপূর্ণ সত্তা, ওই যুক্তি কিছু প্রমাণ করে না, যেহেতু সবসময়ই একটা ব্যাখ্যা থাকতে পারে যেটা পরম কিন্তু অতি প্রাকৃত নয়। ফয়েরবাখ, মার্ক্স বা অস্তিত্ববাদীদের চেয়ে কম আশাবাদী ফ্লিউ। কষ্টকর বা সগর্ব অস্বীকৃতি নয়, সামনে এগোনোর একমাত্র উপায় হচ্ছে যুক্তি ও বিজ্ঞানের প্রতি সহজ বাস্তব অঙ্গীকার।

আমরা অবশ্য দেখেছি যে, সকল ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি বিশ্বজগতের ব্যাখ্যা পাওয়ার জন্যে ঈশ্বরের দিকে তাকিয়ে থাকেনি। অনেকেই প্রমাণকে অবান্তর প্রসঙ্গ হিসাবে দেখেছে। বিজ্ঞান কেবল সেইসব পশ্চিমা ক্রিশ্চানের কাছেই হুমকি হিসাবে অনুভূত হয়েছে যারা ঐশীগ্রন্থকে আক্ষরিক অর্থে পাঠ করার ও বিভিন্ন মতবাদকে বাস্তব সত্য হিসাবে ব্যাখ্যা করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। যেসব বিজ্ঞানী ও দার্শনিক তাদের ব্যবস্থায় ঈশ্বরের কোনও স্থান খুঁজে পাননি, তারা সাধারণত ঈশ্বরের ধারণাকে আদি কারণ হিসাবে উল্লেখ করেন, যা। মধ্যযুগে ইহুদি, মুসলিম ও গ্রিক অর্থডক্সরা পরিত্যাগ করেছে। অধিকতর। অন্তস্থঃ ঈশ্বর-এর সন্ধান করেছে তারা, যিনি সবার জন্যে এক রকম, তাকে কোনও বস্তুগত সত্য হিসাবে প্রমাণ করা যাবে না। তাকে বুদ্ধদের নির্বাণের মতোই বিশ্বজগতের ভৌত ব্যবস্থায় চিহ্নিত করা যাবে না ।

ভাষাবিদ্যাগত দার্শনিকদের চেয়ে আরও নাটকীয় হচ্ছে ১৯৬০-এর দশকের চরমপন্থী ধর্মবিদ যারা সোৎসাহে নিৎশেকে অনুসরণ করে ঈশ্বরের প্রয়াণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। দ্য গস্পেল অভ ক্রিশ্চান অ্যাথিজম (১৯৬৬)-এ টমাস জে, অ্যাল্টাইযার দাবি করেন, ঈশ্বরের মৃত্যুর ‘শুভ সুসংবাদ আমাদের এক স্বৈরাচারী দুজ্ঞেয় উপাস্যের দাসত্ব হতে মুক্ত করেছে: ‘একমাত্র আমাদের অনুভূতিতে ঈশ্বরের মৃত্যু মেনে নিয়ে, এমনকি কামনা করার মাধ্যমেই আমরা এক দুজ্ঞেয় অজানা, এক অজানা অচেনা থেকে মুক্তি পেতে পারি যা ক্রাইস্টের মাঝে ঈশ্বরের আত্মবিচ্ছিন্নতার ফলে শূন্য ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে। অ্যাল্টাইযার অতিন্দ্রীয় ভাষায় আত্মার অন্ধকার রাত ও পরিত্যাগের বেদনার কথা বলেছেন। ঈশ্বরের মৃত্যু সেই নীরবতার কথা বলে যা ঈশ্বরের আবার অর্থবহ হয়ে ওঠার আগে প্রয়োজন ছিল। ধর্মতত্ত্বের পুনর্জন্মের জন্যে ঈশ্বর সম্পর্কিত আমাদের সকল ধারণার মৃত্যু ঘটতে হবে। আমরা সবাই এমন এক ভাষা ও ভঙ্গির অপেক্ষায় আছি যেখানে ঈশ্বর আরও একবার এক সম্ভাবনা হয়ে উঠবেন। অ্যাল্টাইযারের ধর্মতত্ত্ব অন্ধকার ঈশ্বরহীন পৃথিবীর প্রতি আঘাত সৃষ্টিকারী এক আবেগময় দাম্ভিকতা, যার প্রত্যাশা যে জগৎ তার গোপনীয়তা ত্যাগ করবে। পল ভ্যান বুরেন ছিলেন আরও স্পষ্ট এবং যৌক্তিক। দ্য সেকুলার মীনিং অভ দ্য গস্পেল (১৯৬৩)-এ তিনি দাবি করেন, এখন আর পৃথিবীতে ক্রিয়াশীল ঈশ্বরের কথা বলা সম্ভব নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রাচীন পুরাণকে অচল করে দিয়েছে। আকাশের বুড়ো মানুষের ওপর সহজ বিশ্বাস একেবারেই অসম্ভব, কিন্তুধর্মবিদদের অধিকতর উন্নত বিশ্বাসও তাই। আমাদের অবশ্যই ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে নাযারেথের জেসাসকে আঁকড়ে ধরতে হবে। গস্পেল এক মুক্তপুরুষের সুসমাচার যিনি অন্যদেরও মুক্তি দিয়েছিলেন। নাযারেথের জেসাসই ছিলেন মুক্তিদাতা, যিনি মানুষ বলতে যা বোঝায় তার সংজ্ঞা দিয়েছেন।

রেডিক্যাল থিওলজি অ্যান্ড দ্য ডেথ অভ গড (১৯৬৬)-এ উইলিয়াম হ্যাঁমিল্টন উল্লেখ করেছেন যে, এ ধরনের ধর্মতত্ত্বের শেকড় রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে সবসময়ই এক ধরনের ইউটোপিয় ঝোঁক ছিল এবং নিজস্ব কোনও ঐতিহ্য ছিল না। ঈশ্বরের মৃত্যুর ইমেজারি প্রযুক্তির যুগের বর্বরতা ও উম্মুল অবস্থাকে তুলে ধরে যা পুরোনো কায়দায় বাইবেলের ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস স্থাপন অসম্ভব করে তুলেছে। এই ধর্মতাত্ত্বিক ভাবনাকে হ্যাঁমিল্টন বিংশ শতাব্দীতে প্রটেস্ট্যান্ট হবার উপায় হিসাবে দেখেছেন। লুথার মঠ ছেড়ে জগতে বেরিয়ে পড়েছিলেন। একইভাবে তিনি ও অন্য ক্রিশ্চান চরমপন্থীরাও ঘোষিত সেকুলার ছিলেন। তারা ঈশ্বরের আবাস পবিত্র স্থান থেকে দূরে সরে গিয়ে প্রযুক্তি, ক্ষমতা, যৌনতা, অর্থ ও নগরীর পড়শীদের মাঝে মানুষ জেসাসের সন্ধান করেছেন। আধুনিক সেকুলার মানুষের ঈশ্বরের প্রয়োজন ছিল না। হ্যাঁমিল্টনের মনে কোনও ঈশ্বর-আকৃতি গহবর ছিল না। এই পৃথিবীতেই তিনি তার সমাধান খুঁজে পাবেন।

ষাটের দশকের এই প্রাণবন্ত আশাবাদে একটা কিছু কিন্তু রয়েছে। অবশ্যই চরমপন্থীরা ঠিকই বলেছিল যে, অনেকের বেলাতেই অতীতের ভাষায় ঈশ্বর সম্পর্কে আলোচনা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে, কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে এই মুক্তি ও এক নতুন ভোরের সম্ভাবনা অনুভব দুঃখজনকভাবে কঠিন হয়ে পড়েছে। এমনকি সময়ে সময়ে ঈশ্বরের মৃত্যুর সমর্থক ধর্মবিদরা সমালোচিত হয়েছেন, কেননা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বচ্ছল, মধ্যবিত্ত শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের। জেমস এইচ, কোনের মতো কৃষ্ণাঙ্গ ধর্মদিরা জানতে চেয়েছেন শ্বেতাঙ্গরা যেখানে নিজেরাই ঈশ্বরের নামে আসলে মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি করে রেখেছে সেখানে কী করে তারা ঈশ্বরের মৃত্যুর ফলে তাদের মুক্তি নিশ্চিত করার অধিকার আছে মনে করে। ইহুদি ধর্মবিদ রিচার্ড রুবেনস্তাইন নাৎসি হলোকাস্টের পর এত তাড়াতাড়ি কীভাবে তারা ঈশ্বরহীন। মানুষ সম্পর্কে এতটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে পারছে বুঝতে পারেননি। তিনি স্বয়ং বিশ্বাস করেছেন যে, ইতিহাসের ঈশ্বর হিসাবে গৃহীত উপাস্য অশউইযেই চিরদিনের জন্যে পরলোকগমন করেছেন। কিন্তু তারপরেও রুবেনস্তাইন ভাবতে পারেননি যে ইহুদিরা ধর্মকে বাদ দিতে পারবে। ইউরোপিয় ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রায় বিলুপ্তির পর অবশ্যই তাদের অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। অবশ্য উদারপন্থী। ইহুদিবাদের চমৎকার নীতিবান ঈশ্বর সঠিক ছিলেন না। ইনি বড় বেশি খুঁতহীন, জীবনের দুঃখকষ্টকে অগ্রাহ্য করে করেছেন; ধরে নিয়েছেন জগতের অবস্থার উন্নতি ঘটবে। রুবেনস্তাইন স্বয়ং ইহুদি অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বরকে পছন্দ করতেন। ইসাক লুরিয়ার সিসুম-সৃষ্ট জগতকে অস্তিত্ব দানকারী ঈশ্বরের স্বেচ্ছা-আত্মবিচ্ছিন্নকরণের মতবাদ-এ আলোড়িত হয়েছিলেন তিনি। সকল অতিন্দ্রীয়বাদী ঈশ্বরকে কিছু না হিসাবে দেখেছে, যেখান থেকে আমরা এসেছি এবং আবার যেখানে ফিরে যাব। রুবেনস্তাইন সাত্রর সঙ্গে সায় দিয়েছেন যে, জীবন শূন্য; অতিন্দ্রীয়বাদী ঈশ্বরকে মানুষের এই শূন্যতার অনুভূতিতে প্রকাশ করার কল্পনানির্ভর উপায় হিসাবে দেখেছেন তিনি।

অন্য ইহুদি ধর্মবিদরাও লুরিয়ার কাব্বালায় স্বস্তির সন্ধান লাভ করেছেন। হান্স জোনাস বিশ্বাস করেন যে, অশউইযের পর আমরা আর সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে পারি না। ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করার সময় স্বেচ্ছায় নিজেকে সীমিত করেছেন ও মানুষের দুর্বলতার অংশীদার হয়েছেন। এখন আর তাঁর কিছুই করার নেই। মানুষকে অবশ্যই প্রার্থনা ও তোরাহর মাধ্যমে গডহেড ও পৃথিবীর পূর্ণতা ফিরিয়ে দিতে হবে। অবশ্য ব্রিটিশ ধর্মতাত্ত্বিক লুই জ্যাকবস তমিতসুম-এর ইমেজকে কর্কশ ও মানবরূপী বলে ধারণাটিকে অপছন্দ করেন: এটা বড় বেশি আক্ষরিকভাবে ঈশ্বর কীভাবে পৃথিবী সৃষ্টি করলেন সে প্রশ্ন তুলতে উৎসাহিত করে। ঈশ্বর নিজেকে সীমিত করেন না, শ্বাস ত্যাগের আগে, যেমন বলা হয়েছে, শ্বাস বন্ধ করে রাখেন না। একজন অক্ষম ঈশ্বর অকেজো, তিনি মানুষের অস্তিত্বের অর্থ হতে পারেন না। বরং ঈশ্বর মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ; তাঁর চিন্তাধারা ও কৌশল আমাদের মতো নয়–এই ধ্রুপদী ব্যাখ্যায় ফিরে যাওয়াই শ্রেয়। ঈশ্বর বোধের অতীত হতে পারেন, কিন্তু অর্থহীনতার মাঝেও মানুষের সেই অনিবৰ্চনীয় ঈশ্বরকে বিশ্বাস করার এবং একটা অর্থ খুঁজে পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। রোমান ক্যাথলিক ধর্মবিদ হান্স কুঙ জ্যাকবসের সঙ্গে একমত, তমিসতসুম-এর চমকপ্রদ মিথের চেয়ে ট্র্যাজিডির অধিকতর যৌক্তিক ব্যাখ্যা বেছে নিয়েছেন তিনি। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, একজন দুর্বল ঈশ্বরে মানুষ বিশ্বাস রাখতে পারে না, বরং একজন জীবিত ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখে, যিনি অশৎউইযে মানুষকে প্রার্থনা করার শক্তি যুগিয়েছিলেন।

এখনও কিছু মানুষ ঈশ্বরের ধারণার অর্থ খুঁজে পায়। সুইস ধর্মতাত্ত্বিক কার্ল বার্থ (১৮৮৬-১৯৬৮) শ্লেইয়ারম্যাশারের ধর্মীয় অনুভূতির ওপর গুরুত্ব দানসহ উদার প্রটেস্ট্যানিজমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। তিনি প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্বেরও অগ্রণী বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করেছেন, যৌক্তিক ভাষায় ঈশ্বরের ব্যাখ্যা চাওয়া মানব মনের সীমাবদ্ধতার কারণে নয়, বরং পতনের ফলে মানুষ অপবিত্র হয়ে গেছে বলে। সুতরাং আমরা ঈশ্বর সম্পর্কে যেকোনও প্রাকৃতিক ধারণাই খুঁজে বের করি না কেন তা ত্রুটিপূর্ণ হতে বাধ্য আর এমন একজন ঈশ্বরের উপাসনা বহু-ঈশ্বরবাদীতারই সামিল। ঈশ্বর-জ্ঞানের একমাত্র বৈধ উৎস হচ্ছে বাইবেল। এটা যেন বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ: অভিজ্ঞতাবাদ, প্রাকৃতিক যুক্তিবাদ; মানুষের মন অপবিত্র ও অবিশ্বস্ত এবং অন্যান্য ধর্ম বিশ্বাস থেকে শেখার কোনও সম্ভাবনা নেই, কেননা বাইবেল একমাত্র বৈধ প্রত্যাদেশ। বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষমতায় ঐশীগ্রন্থের সত্যতা সম্পর্কে সমালোচনাহীন গ্রহণযোগ্যতাসহ এ রকম চরম সংশয়বাদের সমন্বয় অস্বাস্থ্যকর বলে মনে হয়।

পল টিলিচ (১৮৬৮-১৯৬৫) বিশ্বাস করতেন যে, পাশ্চাত্যের আস্তিক্যবাদের ব্যক্তিক ঈশ্বরকে অবশ্যই বিদায় নিতে হবে, আবার তার বিশ্বাস ছিল যে মানবজাতির জন্যে ধর্মের প্রয়োজন। গভীর উদ্বেগ মানবীয় অবস্থার অংশ: এটা মানসিক বৈকল্য নয়, কেননা এটা অনেপনীয় ও কোনও চিকিৎসাতেই নিরাময়যোগ্য নয়। আমরা আমাদের দেহকে ক্রমান্বয়ে অথচ অপ্রতিরোধ্যভাবে ক্ষয়ে যেতে দেখে অবিরাম নিশ্চিহ্ন হওয়ার আতঙ্ক আর শঙ্কায় থাকি। টিলিচ নিৎশের সঙ্গে একমত হয়েছেন যে, ব্যক্তিক ঈশ্বর একটি ক্ষতিকর ধারণা এবং মরণই তাঁর প্রাপ্য:

স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহে হস্তক্ষেপকারী ব্যক্তিক ঈশ্বরের ধারণা, কিংবা ‘স্বাভাবিক ঘটনাবলীর স্বাধীন কারণ হিসাবে ঈশ্বরের ধারণা ঈশ্বরকে অন্যান্য বস্তুর পাশাপাশি আরেকটি বস্তুতে, সত্তাসমূহের মাঝে একটা সত্তায় পরিণত করে, হতে পারে সর্বোত্তম, কিন্তু তারপরেও একটি সত্তা। এটা প্রকৃতপক্ষে কেবল ভৌত ব্যবস্থারই বিনাশ নয় বরং ঈশ্বরের কোনও অর্থপূর্ণ ধারণারও বিনাশ।

সারাক্ষণ বিশ্বকে মেরামতে ব্যস্ত একজন ঈশ্বর অসম্ভব; মানুষের স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতায় হস্তক্ষেপকারী একজন ঈশ্বর স্বেচ্ছাচারী। ঈশ্বরকে যদি তার আপন জগতে একটি সত্তা হিসাবে, একটি সত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত অহম, কাজের সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি কারণ হিসাবে দেখা হয়, তিনি তাহলে খোদ সত্তা নন। একজন সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞাত স্বৈরাচারী পার্থিব স্বৈরশাসকদের চেয়ে ভিন্ন কিছু নন তিনি, যারা সমস্ত কিছুকে, সবাইকে তাদের নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের পরিণতি করে থাকেন। এ রকম একজন ঈশ্বরকে প্রত্যাখ্যানকারী নাস্তিক্যবাদ যথার্থই যুক্তিসঙ্গত।

এর বদলে আমাদের এই ব্যক্তিক ঈশ্বরের ঊর্ধ্বে এক ঈশ্বরের সন্ধান করা উচিত। এখানে নতুন কিছু নেই। বাইবেলের কাল থেকেই আস্তিকরা তাদের উপাস্য ঈশ্বরের বৈপরীত্যমূলক রূপ সম্পর্কে সচেতন ছিল, তারা জানত অত্যাবশ্যকীয় আন্তব্যক্তিক ঐশ্বরিকতা ব্যক্তি ঈশ্বরের ভারসাম্য বজায় রেখেছে। প্রতিটি প্রার্থনাই একেকটি স্ববিরোধিতা, কেননা তা এমন কারও সঙ্গে কথা বলার প্রয়াস যার সঙ্গে কথা বলা অসম্ভব; এর মাধ্যমে এমন কারও আনুকুল্য চাওয়া হয় যিনি প্রার্থনার আগেই হয় তা দান করেছেন বা করেননি; এটা এমন এক ঈশ্বরকে ‘তুমি’ বলে, যিনি খোদ সত্তা হিসাবে আমাদের অহমের চেয়েও ‘আমি’র অনেক কাছাকাছি। টিলিচ অস্তিত্বের মূল হিসাবে ঈশ্বরের সংজ্ঞাকে বেছে নিয়েছেন। ঈশ্বরের উর্ধ্বে এমন ঈশ্বরে অংশগ্রহণ। জগৎ থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে না, বরং বাস্তবতায় নিমজ্জিত করে। এটা। আমাদেরকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়। খোদ-সত্তা সম্পর্কে কথা বলার সময় মানুষকে প্রতাঁকের আশ্রয় নিতে হয়; এর সম্পর্কে আক্ষরিক বা। বাস্তবভিত্তিক কথা বলা ভুল ও অসত্য। শত শত বছর ধরে ‘ঈশ্বর, কর্তৃত্ব ‘অমরত্ব’ প্রতীকগুলো মানুষকে জীবনের আতঙ্ক ও মৃত্যুর ভয়াবহতা বহনে সক্ষম করে তুলেছে, কিন্তু এসব প্রতীক যখন তাদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখন দেখা দেয় ভয় আর সন্দেহ। যারা এই শঙ্কা ও উদ্বেগের মুখোমুখি হয়েছে তাদের উচিত প্রতীকী শক্তি হারিয়ে ফেলা আস্তিক্যবাদের মর্যাদারহিত ‘ঈশ্বরের ঊর্ধ্বের ঈশ্বরের সন্ধান করা।

সাধারণ মানুষের উদ্দেশে বক্তব্য রাখার সময় টিলিচ কৌশলগত পরিভাষা ‘অস্তিত্বের মূলকে পরম বিষয়’ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে পছন্দ করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, এই ‘ঈশ্বরের ঊর্ধ্বে ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখার মানবীয় অনুভূতি আমাদের আবেগ বা বুদ্ধিবৃত্তিক বোধের অন্যান্য অবস্থা থেকে পৃথকযোগ্য কোনও বিশেষ অবস্থা নয়। আপনি বলতে পারবেন না যে, আমি এখন এক বিশেষ ধর্মীয় অভিজ্ঞতা লাভ করছি, কেননা ঈশ্বর, যিনি সত্তা ও আমাদের সকল সাহস, আশা ও নিরাশার পূর্বগামী ও মূল ভিত্তি। এটা কোনও নাম বিশিষ্ট সুস্পষ্ট কোনও অবস্থা নয় বরং তা আমাদের স্বাভাবিক মানবীয় অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। শত বৎসর আগে ঈশ্বর স্বাভাবিক মানবীয় মনস্তত্ত্ব হতে অবিচ্ছেদ্য বলে অনুরূপ দাবি করেছিলেন ফয়েরবাখ। এবার এই নাস্তিক্যবাদ এক নতুন আস্তিক্যবাদে পরিণত হয়েছে।

উদারপন্থী ধর্মতাত্ত্বিকরা একাধারে বিশ্বাস রাখা ও আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক পৃথিবীতে বাস সম্ভব কি না আবিষ্কার করার প্রয়াস পাচ্ছিলেন। ঈশ্বর সম্পর্কে নতুন ধারণা সৃষ্টি করতে গিয়ে তারা অপরাপর শাস্ত্রের শরণাপন্ন হয়েছেন; বিজ্ঞান, মনস্তত্ব, সমাজ বিজ্ঞান ও অন্যান্য ধর্ম। আবার, এই প্রচেষ্টায় নতুন কিছু ছিল না। আলেকজান্দ্রিয়ার অরিগেন এবং ক্লিমেন্ট এই অর্থে তৃতীয় শতাব্দীর উদারপন্থী ক্রিশ্চান ছিলেন, যখন তারা ইয়াইওয়েহ্‌র সেমিটিক ধর্মে প্লেটোনিজম প্রয়োগ করেছেন। এবার জেসুইট পিয়েরে তিলহার্দ (১৮৮১-১৯৫১) ঈশ্বরে তার বিশ্বাসের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানকে মেশালেন। তিনি প্রগৈতিহাসিক জীবনে বিশেষভাবে আগ্রহী প্যালিওন্টোলজিস্ট ছিলেন; নিজ বিবর্তনবাদের উপলব্ধিকে এক নতুন ধর্মতত্ত্ব প্রণয়নে ব্যবহার করেছেন। গোটা বিবর্তন প্রক্রিয়াকে তিনি এক ঐশীশক্তি হিসাবে দেখেছেন যা বিশ্বজগতকে বস্তু থেকে আত্মা, তারপর ব্যক্তি ও সবশেষে ব্যক্তির ঊর্ধ্বে ঈশ্বরের দিকে ধাবিত করেছে। ঈশ্বর পৃথিবীতে সর্বব্যাপী এবং অবতার, যা তার সত্তার স্যাক্রামেন্টে পরিণত হয়েছে। দে শার্দিন মত প্রকাশ করেছেন যে, মানুষ জেসাসের প্রতি মনোনিবেশ করার বদলে ক্রিশ্চানদের উচিত কলোসিয় ও এফিসিয়দের উদ্দেশে লেখা পলের চিঠির ক্রাইস্টের কসমিক পোর্ট্রেট গড়ে তোলা: এই দৃষ্টিকোণে ক্রাইস্ট ছিলেন বিশ্বজগতের ‘ওমেগা পয়েন্ট, বিবর্তন প্রক্রিয়ার ক্লাইমেক্স, যখন সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন ঈশ্বর। ঐশীগ্রন্থ আমাদের বলে যে, ঈশ্বরই ভালোবাসা আর বিজ্ঞান দেখায় যে, প্রাকৃতিক জগৎ বৃহৎ জটিলতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং এই বৈচিত্র্যের মাঝেই বৃহৎ ঐক্যের অভিসারী। পার্থক্যের মাঝে এই ঐক্য সমগ্র সৃষ্টিকে সচল করে ভোলা ভালোবাসা প্রত্যক্ষ করার আরেকটি উপায়। ঈশ্বরকে জগতের সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে মিলিয়ে ফেলায় এর সকল দুয়েতার অনুভূতি হারিয়ে যাওয়ায় দে শার্দিনের সমালোচনা করা হয়েছে, কিন্তু তার এই জাগতিক ধর্মতত্ত্ব ছিল প্রায়শঃ ক্যাথলিক আধ্যাত্মিকতাকে বৈশিষ্ট্যয়িতকারী contemptus mundi হতে এক কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন।

১৯৬০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ড্যানিয়েল ডে উইলিয়ামস (জন্ম. ১৯১০) প্রসেস থিওলজি নামে পরিচিত ধর্মতত্ত্বের আবিষ্কার করেন। এখানেও জগতের সঙ্গে ঈশ্বরের ঐক্যের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তিনি ঈশ্বরকে জাগতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে দেখা ব্রিটিশ দার্শনিক এ. এ. হোয়াইটহেড (১৮৬১-১৯৪৭) দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। হোয়াইটহেড স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নিরাসক্ত আরেকটি সত্তা হিসাবে ঈশ্বরের অর্থহীনতা প্রমাণে সফল হয়েছিলেন। তবে ঈশ্বরের গুণাবলী সম্পর্কে বিংশ শতাব্দীর ভাষ্য প্রণয়ন করেছিলেন তিনি:

আমি নিশ্চিত যে সত্তার চলমান সমাজে অংশগ্রহণ করার ফলে ঈশ্বর। কষ্টভোগ করেন। জাগতিক ভোগান্তিতে তাঁর অংশ গ্রহণ এই পৃথিবীতে সৃষ্ট দুঃখ কষ্টকে জানা, গ্রহণ করা ও তাকে ভালোবাসায় রূপান্তরিত করার সর্বোত্তম উদাহরণ। আমি ঐশী সংবেদনশীলতা নিশ্চিত করছি। এটা ছাড়া আমি ঈশ্বরের সত্তার কোনও অর্থ খুঁজে পাই না।

ঈশ্বরকে তিনি মহান সঙ্গী, সতীর্থ কষ্টভোগকারী, যিনি বোঝেন এভাবে বর্ণনা করেছেন। উইলিয়ামস্ হোয়াইটহেডের সংজ্ঞা পছন্দ করেছিলেন; ঈশ্বর সম্পর্কে কথা বলার সময় তাঁকে জগতের ‘আচরণ বা কোনও ঘটনা হিসাবে বর্ণনা করতে চাইতেন তিনি। আমাদের বোধের প্রাকৃতিক জগতের উর্ধ্বে অভিপ্রাকৃত ব্যবস্থাকে স্থাপন করা ভুল। অস্তিত্বের কেবল একটা ব্যবস্থাই ছিল । এটা অবশ্য রিডাকশনিস্ট ধারণা নয়। আমাদের প্রকৃতির ধারণায় এক সময় অলৌকিক বলে মনে হওয়া সকল আকাঙ্ক্ষা, ক্ষমতা ও সম্ভাবনাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এখানে আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি’কে আনতে হবে, বৌদ্ধরা যেমন সবসময় করে এসেছে। তার ভাবনায় ঈশ্বর প্রকৃতি হতে আলাদা কিনা জানতে চাওয়া হলে উইলিয়ামস বলতেন, তিনি নিশ্চিত নন। তিনি অ্যাপাথিয়ার প্রাচীন গ্রিক ধারণাকে ঘৃণা করতেন, একে প্রায় ব্লাসফেমাস মনে করেছেন তিনিঃ এটা ঈশ্বরকে দূরবর্তী, উদাসী ও স্বার্থপর হিসাবে তুলে ধরেছে। সর্বেশ্বরবাদের প্রচারণা করার কথা অস্বীকার করেছেন তিনি। তার ধর্মতত্ত্ব স্রেফ অৎশউইয ও হিরোশিমার ঘটনার পর অগ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা এক বিচ্ছিন্ন ঈশ্বরের ভারসাম্যহীনতা দূর করার প্রয়াস ছিল।

অন্যরা আধুনিক পৃথিবীর সাফল্যের ব্যাপারে কম আশাবাদী রয়ে গিয়েছে এবং নারী-পুরুষের প্রতি চ্যালেঞ্জ স্বরূপ এক দুৰ্জেয় ঈশ্বরকে বহাল রাখতে চেয়েছে। জেসুইট কার্ল রাহনার অধিকতর দুয়েমূলক ধর্মতত্ত্ব প্রণয়ন করেছেন, যা ঈশ্বরকে চূড়ান্ত রহস্য ও জেসাসকে মানুষের সম্ভাবনার চরম প্রকাশ হিসাবে দেখে। বার্নার্ড লনারগানও অনুভূতির বিপরীতে দুয়েতা ও চিন্তার গুরুত্বের ওপর জের দিয়েছেন। স্বাধীন বুদ্ধি আকাঙ্ক্ষিত দর্শন খুঁজে পায় না; এটা ক্রমাগত আমাদের মনোভাবের পরিবর্তন দাবি করে এমন উপলব্ধির বাধার মুখোমুখি হচ্ছে। সকল সংস্কৃতিতেই মানুষ একই রকম তাগিদে তাড়িত হয়ে আসছে: বুদ্ধিমান, দায়িত্বশীল, যুক্তিবান, প্রেমময় ও প্রয়োজনে পরবর্তিত হতে হবে। সুতরাং মানুষের মৌল চরিত্র নিজেকে এবং আমাদের প্রচলিত ধারণাকে ছড়িয়ে যাবার দাবি করে; এই নীতি মানুষের আন্তরিক অনুসন্ধানী প্রকৃতিতে ঐশী হিসাবে আখ্যায়িত সত্তায় ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু তারপরেও সুইস ধর্মতাত্ত্বিক হান্স উরস ফন বালতাসার বিশ্বাস করেন, যুক্তি ও বিমূর্ততায় ঈশ্বরকে খোঁজার বদলে আমাদের শিল্পকলার দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত; ক্যাথলিক প্রত্যাদেশ আবশ্যিকভাবে অবতারমূলক। দান্তে ও বোনাভেঞ্চারের ওপর অসাধারণ গবেষণায় বালতাসার দেখিয়েছেন, ক্যাথলিকরা ঈশ্বরকে মানবরূপে দেখেছে’। ধর্মীয় আচার ও নাটকের অঙ্গভঙ্গিতে সৌন্দর্যের ওপর গুরুত্ব দান ও শ্রেষ্ঠ ক্যাথলিক শিল্পীদের সৌন্দর্য চেতনা ইঙ্গিত দেয় ঈশ্বরকে অনুভূতি দিয়ে পাওয়া যাবে, মানুষের অধিকতর বৌদ্ধিক ও বিমূর্ত অংশ দিয়ে নয়।

মুসলিম এবং ইহুদিরাও বর্তমানের সঙ্গে মানানসই ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা আবিষ্কারের লক্ষ্যে অতীতের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়াস পেয়েছে। উল্লেখযোগ্য পাকিস্তানি ধর্মতাত্ত্বিক আবু আল-কালাম আজাদ (মৃত্যু, ১৯৫৯) এমন এক ঈশ্বরকে পাবার জন্যে কোরানের আশ্রয় নিয়েছেন যিনি এমন দুয়ে নন যে একেবারে অকার্যকর হয়ে গেছেন বা এতটা ব্যক্তিক নন যে মূর্তিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি কোরানের আলোচনার প্রতীকী ধরনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, একদিকে রূপক, মূর্ত এবং নরত্বমূলক বর্ণনার ভারসাম্যের কথা উল্লেখ করেছেন, অন্যদিকে আবার ঈশ্বর যে তুলনার অযোগ্য বারবার সেকথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন। অন্যরা জগতের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্কের ধারণা পেতে সুফীদের কাছে ফিরে গেছে। সুইস সুফী ফ্রিসিয়ক শুয়োন পরবর্তীকালে ইবন আল-আরাবীর নামে খ্যাত সত্তার একত্ব মতবাদের (ওয়াহয়দাত আল উজুদ) পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছেন যেখানে বলা হয়েছে যে যেহেতু ঈশ্বরই একমাত্র বাস্তবতা, তিনি ছাড়া আর কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই এবং খোদ এই জগৎ যথার্থভাবেই ঐশ্বরিক। এটা একটা নিগূঢ় সত্যি এবং সুফীদের অতিন্দ্রীয়বাদী অনুশীলনের পটভূমিতেই অনুধাবন করা যেতে পারে, একথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি এর যথার্থতা প্রতিপন্ন করেছেন।

অন্যরা ঈশ্বরকে মানুষের আরও নিকটবর্তী ও সময়ের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছিলেন। ইরানি বিপ্লবের পূর্ববর্তী বছরগুলোয় তরুণ দার্শনিক ডক্টর আলি শরিয়তি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী হতে ব্যাপক শ্রোতা টানতে সক্ষম হন। তিনিই মূলত শাহর বিরুদ্ধে তাদের ঐক্যবদ্ধ করায় ভূমিকা রেখেছিলেন, যদিও মোল্লাহরা তার ধর্মীয় বাণীর অনেক কিছুই অনুমোদন করেননি। বিক্ষোভের সময় জনতা আয়াতোল্লাহ খোমিনীর ছবির পাশাপাশি তার ছবিও বহন করত, যদিও এটা পরিষ্কার ছিল না যে খোমিনির ইরানে তাঁর অবস্থান কী হবে। শরিয়তি মনে করেছিলেন, পাশ্চাত্যকরণের ফলে মুসলিমরা তাদের সাংস্কৃতিক শেকড় হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে: এই অসঙ্গতি দূর করার জন্যে তাদের অবশ্যই ধর্ম বিশ্বাসের প্রাচীন প্রতীকসমূহকে নতুন করে ব্যাখ্যা করতে হবে। মুহাম্মদ (স) প্রাচীন পৌত্তলিক আচার হজ্জকে একেশ্বরবাদে প্রাসঙ্গিকতা দেওয়ার সময় ঠিক এ কাজটি করেছিলেন। নিজের লেখা গ্রন্থ হজ্জ-এ শরিয়তি তাঁর পাঠককে তীর্থ যাত্রার মাধ্যমে মক্কায় নিয়ে গেছেন, আস্তে আস্তে ঈশ্বরের এক গতিময় ধারণা তুলে ধরেছেন প্রত্যেক তীর্থযাত্রী নারী ও পুরুষকে কাল্পনিকভাবে যাকে নিজের জন্যে সৃষ্টি করতে হয়। এভাবেই কাবাহয় পৌঁছার পর তীর্থযাত্রীরা উপলব্ধি করতে পারে উপাসনা গৃহ খালি থাকাটা কত মানানসই: ‘এটা তোমার চূড়ান্ত গন্তব্য নয়; কাবাহ একটি নিদর্শন, এটা কেবল তোমাকে দিক চিনিয়ে দেয় যাতে পথ হারিয়ে না যায়। কাবাহু ঈশ্বর সম্পর্কে সকল মানবীয় প্রকাশকে অতিক্রম করার গুরুত্বের সাক্ষ্য, যেগুলো অবশ্যই শেষ কথায় পরিণত হতে পারবে না। কাবাগৃহ সাজসজ্জা বা জাকজমকহীন একটা সাধারণ বর্গাকৃতি ঘর কেন? কারণ এটা বিশ্ব জগতে ঈশ্বরের রহস্য তুলে ধরে: ঈশ্বর নিরাকার, বর্ণহীন, রূপহীন, মানুষ যে রকম আকার বা অবস্থাই বেছে নিক না কেন, দেখুক বা কল্পনা করুক, তা ঈশ্বর নয়। খোদ হজ্জ উত্তর ঔপনিবিশেক আমলে অসংখ্য ইরানির বিচ্ছিন্নতা বোধে এক অ্যান্টিথিসিস। এটা প্রতিটি মানুষের অস্তিত্ববাদী যাত্রা তুলে ধরে যারা তাদের জীরনকে ঘুরিয়ে নিয়ে অনির্বচনীয় ঈশ্বরের দিকে স্থাপন করছে। শরিয়তির অ্যাকটিভিস্ট বিশ্বাস বিপজ্জনক ছিল: শাহর গুপ্ত পুলিশ নির্যাতন চালানোর পর তাকে দেশ হতে বহিষ্কার করে; ১৯৭৭ সালে লন্ডনে তার মৃত্যুর জন্যে সম্ভবত তারাই দায়ী।

মার্টিন বুবের (১৮৭৮-১৯৬৫) এরও আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া ও মৌল ঐক্যের প্রয়াস হিসাবে অনুরূপ গতিময় দর্শন ছিল। ধর্ম এক ব্যক্তিক ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটা ব্যাপার যা প্রায় সব সময় অন্য মানুষের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের সময় ঘটে। দুটো বলয় রয়েছে; একটি হচ্ছে স্থান ও কালের পরিধি যেখানে আমরা বিষয় ও বস্তু হিসাবে-আমি-এটা-অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত হই। দ্বিতীয় জগতে আমরা অন্যের সঙ্গে তাদের প্রকৃত সত্তায় সম্পর্কিত হই, তাদেরকে তাদের মাঝেই চূড়ান্তরূপে দেখি। এটা আমি-তুমি’র জগৎ যা ঈশ্বরের সত্তাকে প্রকাশ করে। জীবন ঈশ্বরের সঙ্গে অন্তহীন এক সংলাপ, যা আমাদের মুক্তি বা সৃজনশীলতাকে ব্যাহত করে না, যেহেতু ঈশ্বর কখনও আমাদের কাছে তিনি কী চান বলেন না। আমরা তাকে কেবল একটা সত্তা ও আজ্ঞা হিসাবে অনুভব করি এবং আমাদের নিজেদের স্বার্থেই অর্থ খুঁজে বের করার প্রয়োজন হয়। এর অর্থ ছিল অধিকাংশ ইহুদি ঐতিহ্যের সঙ্গে বিচ্ছেদ। প্রচলিত টেক্সটের বুবেরের ব্যাখ্যা প্রায়শঃই প্রশ্ন সাপেক্ষ। ক্যান্টিয়ান হিসাবে তোরাহ পাঠের অবকাশ ছিল না বুবেরের । একে তিনি বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী হিসাবে দেখেছেন: ঈশ্বর কোনও আইন প্রণয়নকারী নন! “তুমি-আমি’ সাক্ষাতের অর্থ মুক্তি ও স্বতঃস্ফুর্ততা, অতীতের কোনও ঐতিহ্যের ভার নয়। তা সত্ত্বেও অধিকাংশ ইহুদি আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে মিতযভোত আর এখানেই ইহুদিদের চেয়ে ক্রিশ্চানদের কাছে বুবেরের বেশি জনপ্রিয়তার ব্যাখ্যা মিলতে পারে।

বুবের উপলব্ধি করেছিলেন যে, ঈশ্বর’ শব্দটি কলঙ্কিত, অবনমিত হয়ে গেছে, কিন্তু তাঁকে বাদ দিতে অস্বীকার গেছেন তিনি। এটার সমান একটা শব্দ কোথায় পাব আমি, একই সত্তাকে বর্ণনা করার জন্যে? এর রয়েছে ব্যাপক এবং জটিল অর্থ ও অসংখ্য পবিত্র সম্পর্ক। যারা ঈশ্বর’ শব্দটি প্রত্যাখ্যান। করে, তাদের অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে, কেননা এর নামে ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।

‘শেষ বস্তুসমূহ সম্পর্কে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নীরবতা অবলম্বনের প্রস্তাব রাখার কারণ বোঝাটা সহজ, যাতে অপব্যবহৃত শব্দসমূহ উদ্ধার প্রাপ্ত হয়। কিন্তু এটা মুক্তি পাওয়ার উপায় নয়। আমরা ঈশ্বর’ শব্দটিকে পরিষ্কার করতে পারব না, একে সমগ্রতেও পরিণত করতে পারব না। কিন্তু কলঙ্কিত ও ক্ষতবিক্ষত হলেও একে আমরা আবার মাটি থেকে তুলতে পারব এবং একে প্রবল দুঃখের সময় আকাশে স্থাপন করতে পারব।[১২]

অন্যান্য যুক্তিবাদীর বিপরীতে বুবের মিথের বিপক্ষে ছিলেন নাঃ স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গের পৃথিবীতে আটকা পড়ে যাওয়ার লুরিয় মিথ তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী তাৎপর্যমণ্ডিত মনে হয়েছে। গডহেড হতে স্ফুলিঙ্গের বিচ্ছেদ মানুষের বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি তুলে ধরে। আমরা যখন অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কিত হই, তখন আদি ঐক্য পুনঃস্থাপিত হয়, জগতে বিচ্ছিন্নতা হ্রাস পায় ।

বুবের যেখানে বাইবেল ও হাসিবাদের শরণ নিয়েছেন সেখানে আব্রাহাম জোশুয়া হেশেল (১৯০৭-৭২) ফিরে গেছেন র‍্যাবাই ও তালমুদের চেতনায় । বুবেরের বিপরীতে তার বিশ্বাস ছিল মিতযভোত আধুনিকতর মানুষের মর্যাদা হানিকর দিকগুলোর মোকাবিলায় ইহুদিদের সাহায্য করবে। এসব কর্মকাণ্ড তাদের নয় বরং ঈশ্বরের চাহিদা পূরণ করে। ব্যক্তিত্ব হরণ ও শোষণ আধুনিক জীবনের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে: এমনকি ঈশ্বরকে পর্যন্ত এমন একটা বস্তুর পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে যাকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করা যায়। আমাদের উদ্দেশ্য পূরণের উপায়ে পরিণত হয়েছেন তিনি। পরিণামে ধর্ম একঘেয়ে ও নিরস হয়ে গেছে; উপরিকাঠামোর ভেতরে কাজ করার জন্যে আমাদের দরকার এক গভীর ধর্মতত্ত্ব এবং আদি ভীতি, রহস্য আর বিস্ময় ফিরিয়ে আনা। যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা চালানো অর্থহীন। ঈশ্বরে বিশ্বাস এমন এক প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হতে জাগ্রত হয় যার সঙ্গে ধারণা বা যৌক্তিকতার কোনও সম্পর্ক নেই। যদি সেই পবিত্রতার অনুভূতি অনুভব করতে হয় তাহলে কবিতার মতো অবশ্যই রূপকার্থে বাইবেল পাঠ করতে হবে। মিতভোতকে এক প্রতীকী ভঙ্গি হিসাবে দেখতে হবে যা আমাদের ঈশ্বরের সত্তায় বাস করার তালিম দেয়। প্রতিটি মিত্যুভোত জাগতিক জীবনে ছোটখাট পরিসরে সাক্ষাতের একেকটি স্থান; কোনও শিল্পকর্মের মতো মিতযভোত-এর জগতের নিজস্ব যুক্তি ও ছন্দ রয়েছে। সর্বোপরি, আমাদের একটা বিষয়ে সজাগ থাকা প্রয়োজন যে, ঈশ্বরের মানবজাতির প্রয়োজন রয়েছে। তিনি দার্শনিকদের দূরবর্তী ঈশ্বর নন, বরং পয়গম্বরদের বর্ণিত করুণাময় ঈশ্বর।

নাস্তিক্যবাদী দার্শনিকরাও বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধে এসে ঈশ্বরের ধারণায় আকর্ষণ বোধ করেছেন। বিইং অ্যান্ড টাইম (১৯২৭)-এ মার্টিন হেইদেগার (১৮৯৯-১৯৭৬) অনেকটা টিলিচের মতো সত্তাকে দেখেছেন, যদিও তাঁকে ক্রিশ্চান অর্থে ঈশ্বর’ বলে স্বীকার করতে চাননি, এটা সত্তাসমূহ হতে আলাদা ও চিন্তার স্বাভাবিক ধরণ থেকে সম্পূর্ণই ভিন্ন। কোনও কোনও ক্রিশ্চান হেইদেগারের রচনায় অনুপ্রাণিত হয়েছে, যদিও নাৎসি শাসকদের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে এই মতবাদের নৈতিক মূল্য প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। ফ্রেইবার্গে দেওয়া উদ্বোধনী ভাষণ হোয়াট ইজ মেটাফিজিকস-এ হেইদেগার বেশ কিছু ধারণার কথা বলেছিলেন যেগুলো আগেই প্রটিনাস, ডেনিস এবং এরিগেনার রচনাবলীতে দেখা গিয়েছিল। ‘সত্তা’ যেহেতু সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতপক্ষে তা কিছু না কিছুই না, কোনও বস্তু যেমন নয়, তেমনি কোনও নির্দিষ্ট সত্তাও নয়। অথচ এটা অন্য সকল অস্তিত্বকে সম্ভব করে তুলেছে। প্রাচীন মানুষেরা বিশ্বাস করত কিছু না থেকে কিছু আসে না, কিন্তু হেইদেগার এই প্রবচনকে পাল্টে দেন; ভাষণের সমাপ্তি টেনেছিলেন তিনি লেইবনিযের উত্থাপিত একট প্রশ্ন দিয়ে: ‘একেবরে কিছু না থেকে কেনইবা সত্তাসমূহ উপস্থিত?’ এটা এমন একটা প্রশ্ন যা বিস্ময়ের ধাক্কা সৃষ্টি করে, বিস্ময় জাগায়; যা জগতের প্রতি মানুষের এক অব্যাহত প্রতিক্রিয়া হয়ে আছে: কেন কোনও কিছুর অস্তিত্ব থাকবে? হেইদেগার তাঁর ইন্ট্রোডকশন টু মেটাফিজিক্স (১৯৫৩) শুরু করেছিলেন একই জিজ্ঞাসা দিয়ে। ধর্মতত্ত্বের বিশ্বাস ছিল এর জবাব জানা আছে এবং সবকিছু মূল খুঁজে পেয়েছে ভিন্ন কিছু ঈশ্বরে। কিন্তু এই ঈশ্বর আরেকটি সত্তা মাত্র, এমন কিছু নন যিনি একেবারেই আলাদা। ধর্মের ঈশ্বর সম্পর্কে হেইদেগারের কিছুট হীন ধারণা ছিল-যদিও বহু ধার্মিক মানুষ একে মানে কিন্তু প্রায়শঃ অতিন্দ্রীয়বাদী পরিভাষায় সত্তা সম্পর্কে কথা বলেছেন তিনি। তিনি একে এক মহা স্ববিরোধিতা হিসাবে বর্ণনা করেছেন: চিন্তা প্রক্রিয়াকে সত্তার জন্যে অপেক্ষা করা বা তার কথা শোনা হিসাবে তুলে ধরেছেন এবং সত্তার প্রত্যাবর্তন ও প্রত্যাহারের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন বলে মনে হয়, অনেকটা অতিন্দ্রীয়াবাদীরা যেভাবে ঈশ্বরের অনুপস্থিতি বোধ করে থাকে সে রকম। সত্তাকে অস্তিত্ব দেওয়া চিন্তা করার ক্ষমতা নেই মানুষের। গ্রিকদের সময় থেকেই পাশ্চাত্যবাসীরা সত্তাকে বিস্মৃত হয়ে তার বদলে সত্তাসমূহে মনোনিবেশ করেছে, এ প্রক্রিয়া এনে দিয়েছে এর আধুনিক কারিগরি সাফল্য। জীবনের শেষ দিকে রচিত প্রবন্ধ ওনলি আ গড ক্যান সেইভ আস-এ হেইদেগার মত প্রকাশ করেছেন যে, আমাদের সময়ে ঈশ্বরের অনুপস্থিতির বোধ আমাদেরকে ‘সত্তাসমূহের সঙ্গে সম্পর্ক হতে মুক্ত করতে পারে। কিন্তু সত্তাকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনার জন্যে আমাদের কিছুই করার নেই। আমরা কেবল ভবিষ্যতে এক নতুন আবির্ভাবের প্রত্যাশা করতে পারি।

মার্ক্সবাদী দার্শনিক আর্নস্ট ব্লচ (১৮৮৫-১৯৭৭) ঈশ্বরের ধারণাকে মানুষের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বিবেচনা করেছেন। গোটা মানব জীবন ভবিষ্যতের দিকে নির্দেশিত; আমরা আমাদের জীবনকে অসম্পূর্ণ ও অসমাপ্ত হিসাবে অনুভব করি। জন্তু-জানোয়ারের বিপরীতে আমরা কখনও সন্তুষ্ট হই না, বরং সব সময় আরও বেশি কিছু প্রত্যাশা করি। এ ব্যাপারটি আমাদের ভাবতে ও উন্নতি অর্জনে বাধ্য করে, যেহেতু জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আমাদের অবশ্যই নিজেদের পেরিয়ে যেতে হয়, পৌঁছতে হয় পরবর্তী পর্যায়ে শিশুকে অবশ্যই টডলার হয়ে উঠতে হবে, টডলারকে তার সব অক্ষমতা পেরিয়ে বালক হয়ে উঠতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে। আমাদের সকল স্বপ্ন ও আকাক্ষা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকে। এমনকি দর্শনেরও সূচনা ঘটে বিস্ময়ের সঙ্গে, যা অজানার অনুভূতি, এখনও না ঘটার অভিজ্ঞতা। সমাজতন্ত্রও এক ইউটোপিয়া প্রত্যাশী, কিন্তু ধর্মবিশ্বাসের প্রতি মার্ক্সীয় অস্বীকৃতি সত্ত্বেও যেখানে প্রত্যাশা আছে সেখানেই আছে ধর্মও। ফয়েরবাখের মতো ব্লচ ঈশ্বরকে মানবীয় আদর্শ হিসাবে দেখেছেন, এখনও যার বাস্তবায়ন ঘটেনি, কিন্তু একে বিচ্ছিন্নতাকারী হিসাবে না দেখে বরং মানবীয় অবস্থার জন্যে আবশ্যক মনে করেছেন।

ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স হখেইমার (১৮৯৫-১৯৭৩) ঈশ্বরকে পয়গম্বরদের স্মারক গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ হিসাবে দেখেছেন। তিনি ছিলেন কি ছিলেন না, কিংবা আমরা তাকে বিশ্বাস করি কিনা, এসব বাড়াবাড়ি। ঈশ্বরের ধারণা ছাড়া পরম অর্থ, সত্য বা নৈতিকতা বলে কিছু নেই: নৈতিকতা হয়ে পড়ে রুচি, মনোভাব বা ঝোঁকের একটা ব্যাপার। রাজনীতি ও নৈতিকতা যদি কোনওভাবে ঈশ্বরের ধারণা অন্তর্ভূক্ত না করে, তারা প্রাজ্ঞ হওয়ার বদলে বরং একেবারে বাস্তবনিষ্ঠ ও ধূর্ত রয়ে যাবে । পরম বলে কিছুই na থাকলে আমাদের ঘৃণা করার কোনও কারণ থাকবে না কিংবা আমরা বলব যে যুদ্ধ শান্তির চেয়ে খারাপ। ধর্ম অত্যাবশ্যকভাবে অন্তরের অনুভূতি যে একজন ঈশ্বর আছেন। আমাদের অন্যতম প্রাচীন স্বপ্ন ছিল ন্যায় বিচারের আকাক্ষা (আমরা কতবারই না বাচ্চাদের বলতে শুনিঃ ‘এটা ঠিক নয়!’)। দুঃখ কষ্ট ও অনাচারের মুখে অগণিত মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও অভিযোগ লিপিবদ্ধ করে ধর্ম। এটা আমাদের সীমাবদ্ধ প্রকৃতি সম্পর্কে সজাগ করে তোলে; আমরা সবাই আশা করি পৃথিবীর অন্যায়-অবিচারই শেষ কথা হয়ে থাকবে না।

যাদের প্রচলিত কোনও ধর্মীয় বিশ্বাস নেই তারাও বারবার ঈশ্বরের ইতিহাসে আমাদের আবিস্কৃত মূল সুরের শরণাপন্ন হচ্ছে, এ বিষয়টি দেখায় যে, আমরা অনেকেই যেমন মনে করি আসলে এ ধারণাটি সে রকম বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। তা সত্ত্বেও বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে আমাদের বৃহৎ রূপের মতো ক্রিয়াশীল একজন ব্যক্তিক ঈশ্বরের ধারণা থেকে সরে যাবার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। এখানে নতুন কিছু ছিল না। আমরা যেমন দেখেছি, ইহুদি ঐশীগ্রন্থ, ক্রিশ্চানরা যেটাকে তাদের ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট বলে, অনুরূপ প্রক্রিয়া দেখায়; কোরান শুরু থেকেই আল্লাহকে জুদো-ক্রিশ্চান ঐতিহ্যের তুলনায় কম ব্যক্তিক রূপে দেখেছে। ট্রিনিটির মতো মতবাদসমূহ এবং মিথ ও অতিন্দ্রীয়বাদী ব্যবস্থার প্রতীকীবাদ, এসবই বোঝাতে চেয়েছে ঈশ্বর ব্যক্তিত্বের ঊর্ধ্বে। তবু এটা যেন বিশ্বাসীদের অনেকেই পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেনি। উলউইচের বিশপ জন রবিনসন ১৯৬৩ সালে অনেস্ট টু গড প্রকাশ করেন, এখানে তিনি উল্লেখ করেন, মহাশূন্যের প্রাচীন ব্যক্তিক ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখতে পারছেন না। ব্রিটেনে তখন মহাশোরগোল শুরু হয়ে গিয়েছিল। ডারহামের বিশপ ডেভিড জেনকিন্স-এর বিভিন্ন মন্তব্যও একই রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, যদিও শিক্ষিত সমাজে এসব ধারণা খুবই সাধারণ ব্যাপার ছিল। ক্যামব্রিজের ইম্যানুয়েল কলেজের ডীন ডন কিউপিট নাস্তিক পুরোহিত’ আখ্যায়িত হয়েছিলেন তিনি আস্তিক্যবাদের প্রথাগত বাস্তববাদী ঈশ্বরকে অগ্রহণযোগ্য মনে করে এক ধরনের ক্রিশ্চান-বৌদ্ধ মতবাদের প্রস্তাব রেখেছিলেন যা ধর্মীয় অনুভূতিকে ধর্মতত্ত্বের আগে স্থান দেয়। রবিনসনের মতো কিউপিট বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে এমন এক দর্শনে পৌঁছেছিলেন যা তিনটি ধর্ম বিশ্বাসের অতিন্দ্রীয়বাদীরা অধিকতর স্বজ্ঞামূলক উপায়ে অর্জন করেছিল। তবুও প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই, মহাশূন্যে কিছু নেই’ এগুলো নতুন কোনও কথা নয়।

পরম সম্পর্কে অসম্পূর্ণ ইমেজ নিয়ে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা রয়েছে। এটা স্বাস্থ্যকর প্রতিমা বিদ্বেষ, কেননা ঈশ্বরের ধারণাকে অতীতে ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৭০ এর দশকের পর থেকে পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এক ধরনের ধার্মিকতার উত্থান যাকে আমরা সাধারণভাবে ঈশ্বরের তিনটি ধর্মসহ প্রধান বিশ্ব ধর্মে ‘মৌলবাদ’ বলি। প্রবলভাবে রাজনৈতিক আধ্যাত্মবাদ দর্শনের দিক থেকে আক্ষরিক এবং অসহিষ্ণু। বরাবরই চরমপন্থী ও প্রলয়বাদী উদ্দীপনার শিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিশ্চান মৌলবাদীরা নিজেদের নিউ রাইট-এর সঙ্গে সম্পর্কিত করেছে। মৌলবাদীরা বৈধ গর্ভপাত বাতিল এবং নৈতিক ও সামাজিক শালীনতার ক্ষেত্রে কট্টরপন্থা অনুসরণের প্রচার করছে। রেগানের আমলে জেরি ফলওয়েলের মরাল মেজরিটি বিস্ময়কর রাজনৈতিক, ক্ষমতা অর্জন করেছিল। জেসাসের মন্তব্যকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণকারী মেরিস সেরুলোর মতো অন্য ইভেঞ্জিলিস্টরা বিশ্বাস করে যে, প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাসের চিহ্ন অলৌকিক ঘটনাবলী । বিশ্বাসী প্রার্থনায় যা চাইবে ঈশ্বর তাকে তাই দেবেন। ব্রিটেনে কলিন আকহার্টের মতো মৌলবাদীরা অনুরূপ দাবি করেছে। ক্রিশ্চান মৌলবাদীদের যেন ক্রাইস্টের প্রেমময় সহানুভূতির প্রতি তেমন একটা নজর নেই। তারা যাদের ঈশ্বরের শত্রু মনে করে তাদের নিন্দা জানতে দেরি করে। না। অধিকাংশই ইহুদি ও মুসলিমদের নরকবাস অবধারিত মনে করে। আর্কহার্ট যুক্তি দেখিয়েছেন, সকল প্রাচ্য ধর্মই শয়তান-অনুপ্রাণিত।

মুসলিম বিশ্বেও অনুরূপ পরিবর্তন এসেছে। পাশ্চাত্যে তা প্রবল প্রচারণা পেয়েছে। মুসলিম মৌলবাদীরা সরকারের পতন ঘটিয়েছে, ইসলামের শত্রুদের হত্যা করেছে বা মৃত্যুদণ্ডের হুমকি দিয়েছে। অনুরূপভাবে ইহুদি মৌলবাদীরা পশ্চিম তীর ও গাযা স্ট্রিপের অধিকৃত লোকালয়ে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে আরব অধিবাসীদের বঞ্চিত করার শপথ নিয়ে বসতি স্থাপন করেছে। এভাবেই তারা মেসায়াহর অত্যাসন্ন আবির্ভাবের পথ নির্মাণ করছে বলে বিশ্বাস করে। মৌলবাদ এর সকল রূপে ভয়ঙ্করভাবে হানিকর বিশ্বাস। এভাবে ১৯৯০ সালে নিউ ইয়র্কে আততায়ীর হাতে প্রাণ হারানোর আগে পর্যন্ত ইসরায়েলের ফার রাইটের’র সবচেয়ে চরমপন্থী সদস্য র‍্যাবাই মেয়ার কাহানে বলেছেন:

ইহুদিবাদে অসংখ্য বাণী নেই। বাণী একটিই। সেটা হচ্ছে ঈশ্বর যা চান সেটা করা। অনেক সময় ঈশ্বর চান আমরা যেন যুদ্ধে যাই, আবার কখনও চান আমরা যেন শান্তিতে বাস করি…কিন্তু বাণী মাত্র একটি…ঈশ্বর চেয়েছেন আমরা যেন এদেশে আসি একটি ইহুদি রাষ্ট্র করার জন্যে।১৩

এটা শত শত বছর ধরে অর্জিত ইহুদি অগ্রগতিকে মুছে দেয়, ফিরিয়ে নিয়ে যায় বুক অভ জোশুয়ার ডিউটেরোনমিয় দৃষ্টিভঙ্গিতে। এটা বিস্ময়কর নয় যে, মানুষ যখন এ জাতীয় অশালীন বাক্য শোনে, যেখানে ঈশ্বরকে দিয়ে অন্যদের মানবিক অধিকার অস্বীকার করানো হচ্ছে, তখন তারা যত শিগগির এই ঈশ্বরকে বাদ দেওয়া যায় ততই মঙ্গল মনে করে।

তা সত্ত্বেও, আগের অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখেছি, এ ধরনের ধর্মপরায়ণতা আসলে ঈশ্বর হতে সরে আসা। ক্রিশ্চান ‘পারিবারিক মূল্যবোধ, ইসলাম’ বা ‘পবিত্র ভূমির মতো এ জাতীয় মানবীয়, ঐতিহাসিক ঘটনাকে ধর্মীয় কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা বহু-ঈশ্বরবাদীতার নতুন ধরণ। ঈশ্বরের দীর্ঘ ইতিহাস জুড়ে এ ধরনের যুদ্ধংদেহী ন্যায়পরায়ণতা একেশ্বরবাদীদের কাছে অব্যাহত প্রলোভন হয়েছিল। একে অবশ্যই ভ্রান্ত বলে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের ঈশ্বরের সূচনা ছিল দুর্ভাগ্যজনক, কেননা গোত্রীয় উপাস্য ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ তার আপন জাতির প্রতি ভয়ঙ্করভাবে পক্ষপাতপূর্ণ ছিলেন। পরবর্তীকালের ক্রুসেডাররা যারা এই আদিম বৈশিষ্ট্যে ফিরে গেছে, তারা গোত্রের মূল্যবোধসমূহকে অগ্রহণযোগ্যভাবে মর্যাদায় স্থাপন করেছে ও মানব সৃষ্ট আদর্শের দুয়ে সত্তায় প্রতিস্থাপিত করেছে যা আমাদের সংস্কারকে চ্যালেঞ্জ করারই কথা। তারা এক গুরুত্বপূর্ণ একশ্বরবাদী থিমও অস্বীকার করছে। ইসরায়েলের পয়গম্বরগণ ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র পৌত্তলিক কাল্ট সংস্কার করার পর থেকে একেশ্বরবাদীদের ঈশ্বর সহানুভূতির আদর্শকে উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন।

আমরা দেখেছি, অ্যাক্সিয়াল যুগে বিকশিত অধিকাংশ আদর্শের ক্ষেত্রে সহানুভূতি একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। সমবেদনার আদর্শের কারণে বৌদ্ধরা বুদ্ধ ও বোধিসত্তাদের প্রতি ভক্তির সূচনা করে ধর্মীয় দিক নির্দেশনায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছিল। পয়গম্বরগণ জোর দিয়ে গেছেন যে, সমাজ সামগ্রিকভাবে এক অধিকতর ন্যায়বিচার ভিত্তিক ও সমবেদনামূলক নীতিমালা গ্রহণ না করলে কাল্ট ও উপাসনার কোনও অর্থ থাকে না। জেসাস, পল এবং র‍্যাবইদের হাতে এই দর্শনসমূহের বিকাশ ঘটেছে, যাদের সবাই একই ইহুদি আদর্শ অনুসরণ করেছেন ও এগুলোর প্রয়োগ ঘটানোর জন্যে ইহুদিবাদের গুরুতর পরিবর্তন সাধনের পরামর্শ রেখেছেন। কোরান সহানুভূতিপুর্ণ ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলাকে আল্লাহর পরিমার্জিত ধর্মের মূল সুরে পরিণত করেছে। সহানুভূতি বিশেষভাবে কঠিন একটা গুণ। এটা দাবি করে, আমরা যেন আমাদের অহমবোধ, নিরাপত্তাহীনতা ও সহজাত কুসংস্কারের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে যাই। এটা বিস্ময়কর নয় যে, ঈশ্বরের তিনটি ধর্মই কোনও না কোনও সময় এই উঁচু মান অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ডেইস্টরা প্রচলিত পাশ্চাত্যে খৃস্টধর্মমত প্রত্যাখ্যান করেছিলেন প্রধানত তা প্রকটভাবে নিষ্ঠুর ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল বলে। একই কথা আজও প্রযোজ্য। বেশ ঘন ঘন প্রথাগত বিশ্বাসীগণ, যারা মৌলবাদী নয়, তাদের আক্রমণাত্মক ন্যায়পরায়ণতার অংশীদার হয়ে পড়ে। তারা তাদের নিজেদের ভালোবাসা ও ঘৃণাকে তুলে ধরার জন্যে ঈশ্বরকে ব্যবহার করে, স্বয়ং ঈশ্বরের ওপর তা আরোপ করে। কিন্তু যেসব ইহুদি, ক্রিশ্চন এবং মুসলিম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে স্বর্গীয় উপাসনায় অংশ নেয় এবং বিভিন্ন জাতিগত ও আদর্শগত শিবিরে বিভক্ত মানুষকে অসম্মান করে থাকে, তারা তাদের ধর্মের অন্যতম মৌল সত্যেরই বিরোধিতা করে। যারা নিজেদের ইহুদি, ক্রিস্টান ও মুসলিম দাবি করে তাদের পক্ষে এক অসম সমাজ ব্যবস্থাকে মেনে নেওয়াটা সমানভাবে অসঙ্গত। ঐতিহাসিক একেশ্বরবাদের ঈশ্বর উৎসর্গ চান না, চান করুণা; জাঁকজমকপূর্ণ আচারের বদলে চান সহানুভূতি।

যারা ধর্মের কান্টিক ধরণ অনুশীলন করে ও যারা সহানুভূতিময় ঈশ্বরের একটি অনুভূতি গড়ে তুলেছে তাদের মাঝে প্রায়ই পার্থক্য লক্ষ করা যায়। পয়গম্বরগণ তাদের সেসব সমসাময়িকদের ভৎর্সনা করেছেন যারা মন্দিরের উপাসনাই যথেষ্ট ভেবেছে। জেসাস ও সেইন্ট পল, দুজনেই পরিষ্কার করে দিয়েছেন, দানবিহীন বাহ্যিক অনুসরণের কোনও অর্থ নেই: এটা ঘন্টা-ধ্বনি বা করতালের চেয়ে খুব বেশি ভালো নয়। আরবরা ঈশ্বরের দাবি অনুযায়ী সত্য ধর্মের শর্ত হিসাবে সহানুভূতির গুণাবলী অর্জন ছাড়াই আল্লাহর পাশাপাশি প্রাচীন আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রাচীন পৌত্তলিক দেবীদেরও উপসানা করতে চেয়েছিল, তাদের সঙ্গে মুহাম্মদের (স) সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল। রোমের প্যাগান সম্প্রদায়ের মাঝেও অনুরূপ বিভক্তি দেখা দিয়েছিল। প্রাচীন কাল্টিক ধর্ম স্থিতাবস্থার পক্ষে ছিল, অন্যদিকে দার্শনিকরা এমন এক বাণী প্রচার করেছেন যা পৃথিবীকে বদলে দেবে। এমন হতে পারে, এক ঈশ্বরের সহানুভূতির ধর্ম হয়তো সংখ্যালঘু একটি দলই অনুসরণ করছে; অধিকাংশ মানুষই আপোসহীন নৈতিক চাহিদাসম্পন্ন ঈশ্বর অনুভূতির চরম অবস্থার মুখোমুখি হওয়া কঠিন মনে করেছে। সিনাই পবর্ত হতে মোজেস আইনের ফলকসমূহ বয়ে আনার পর হতে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিজেদের সৃষ্ট প্রাচীন হুমকিহীন উপাস্যের মূর্তি সোনালি বাছুরের পূজা করতে পছন্দ করেছে। প্রধান পুরোহিত আরন সোনালি বাছুরের সোনালি মূর্তির নির্মাণ কাজে নেতৃত্বে দিয়েছেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রায়শঃই পয়গম্বর ও অতিন্দ্রীয়বাদী অনুপ্রেরণার প্রতি বধির হয়ে থাকে, যারা কিনা আরও বেশি চাহিদাসম্পন্ন ঈশ্বরের সংবাদ নিয়ে আসেন।

ঈশ্বরকে অস্বাস্থ্যকর মূল্যহীন মহৌষধ, জাগতিক জীবনের বিকল্প কষ্টকল্পনার বিষয়বস্তু হিসাবেও ব্যবহার করা হতে পারে। ঈশ্বরের ধারণাকে। প্রায়শঃ মানুষের আফিম হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যখন তাঁকে ঠিক আমাদের মতো কিন্তু বড় ও উন্নত-আরেকটি সত্তা হিসাবে ধরে নেওয়া হয়, তখন তা বিশেষ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়: যিনি তার স্বর্গে অবস্থান করেন, খোদ যেটাকে জাগতিক আনন্দের স্বর্গ মনে করা হয়। কিন্তু মূলত মানুষকে এই পৃথিবীর প্রতি মনোযোগী হতে ও অপ্রীতিকর বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াতে সাহায্য করার জন্যে ঈশ্বরকে ব্যবহার করা হতো। এমনকি সকল প্রকাশিত ক্রুটি সত্ত্বেও ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র পৌত্তলিক কাল্টও আচার ও পবিত্র কালের বিপরীতে আদি অপবিত্র সময়ের প্রচলিত ঘটনাপ্রবাহে তার অংশগ্রহণের ওপর জোর দিয়েছে। ইসরায়েলের পয়গম্বরগণ তাদের জনগণকে ঈশ্বরের নামে সামাজিক অপরাধ ও আসন্ন রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য করেছিলেন, যিনি এইসব ঐতিহাসিক ঘটনাবলীতে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। ক্রিশ্চান অবতারবাদ রক্ত মাংসের পৃথিবীতে স্বর্গীয় পরিব্যাপ্ততার ওপর জোর দিয়েছে। ইসলামে ইহজগতের প্রতি মনোযোগ বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে: মুহাম্মদের (স) চেয়ে বাস্তবাদী আর কেউ হতে পারেন না, যিনি একাধারে রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রতিভা ছিলেন। আমরা যেমন দেখেছি, মুসলিমদের পরবর্তীকালের প্রজন্মগুলো ন্যায়বিচার ভিত্তিক ও শোভন সমাজ প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে মানব ইতিহাসের স্বর্গীয় ইচ্ছা বাস্তবায়নের তার উদ্বেগে অংশীদার হয়েছে। একেবারে গোড়া থেকেই ঈশ্বরকে কাজের তাগিদ হিসাবে অনুভব করা হয়েছে। ঠিক যেই মুহূর্তে-এল বা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ হিসাবে-ঈশ্বর আব্রাহামকে হারানে তার পরিবার হতে নিয়ে গেছেন, তখন থেকেই এই কাল্টে পৃথিবীর বুকে নিরেট কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন যুক্ত হয়েছে ও প্রায়শঃই প্রাচীন পবিত্রতার কষ্টকর পরিত্যাগও যোগ হয়েছে।

এই স্থানচ্যুতির সঙ্গে বিশাল চাপও জড়িত ছিল। সম্পূর্ণ আলাদা পবিত্র ঈশ্বর পয়গম্বরগণের কাছে গভীর আঘাত হিসাবে অনুভূত হয়েছেন। তিনি তাঁর জাতির পক্ষ হতেও অনুরূপ পবিত্রতা ও বিচ্ছিন্নতা দাবি করেছেন। তিনি সিনাই পর্বতে মোজেসের সঙ্গে কথা বলার সময় ইসরায়েলিদের পাহাড়ের পাদদেশে যাওয়ার অনুমতি মেলেনি। পৌত্তলিকতার হলিস্টিক দর্শনকে বিদীর্ণ করে মানুষ ও ঈশ্বরের মাঝে সম্পূর্ণ নতুন এক ব্যবধান দেখা দিয়েছিল। সুতরাং, পৃথিবীর সঙ্গে বিচ্ছেদের একটা সম্ভাবনা ছিল যা ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য স্বাধীনতার জেগে ওঠা সচেতনতা প্রতিফলিত করেছে। এটা অঘটন নয় যে, একেশ্বরবাদ শেষ পর্যন্ত বাবিলনে নির্বাসনকালে শেকড় বিস্তার করেছিল, যখন ইসরায়েলিরাও ব্যক্তিগত দায়দায়িত্বের আদর্শ গড়ে তোলে যা ইহুদিবাদ ও ইসলাম, উভয় ধর্মেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা দেখেছি, মানুষের ব্যক্তিত্বের পবিত্র অধিকারের বোধ গড়ে তুলতে ইহুদিদের সাহায্য করার লক্ষ্যে র‍্যাবাইগণ। এক সর্বব্যাপী ঈশ্বরের ধারণা ব্যবহার করেছেন। তবু বিচ্ছিন্নতা তিনটি ধর্ম বিশ্বাসেই বিপদ হিসাবে অব্যাহত রয়ে গিয়েছে পাশ্চাত্যে ঈশ্বরের অনুভূতিতে অব্যাহতভাবে অপরাধবোধ ও এক নৈরাশ্যবাদী নৃতত্ত্ব সঙ্গী হয়েছিল। ইহুদিবাদ ও ইসলামেও, সন্দেহ নেই, তোরাহ ও শরিয়াহ্ অনুসরণকে অনেক সময়ই এক বাহ্যিক আইনের পরিপালন হিসাবে দেখা হয়েছে, যদিও আমরা। দেখেছি, যারা এইসব আইনী বিধিমালা সংকলিত করে ছেন তাদের ইচ্ছার চেয়ে দূরবর্তী আর কিছু হতে পারত না।

যেসব নাস্তিক এরকম দাসত্বমূলক আনুগত্যের দাবিদার একজন ঈশ্বর হতে মুক্তির পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে তারা আসলে এক অসম্পূর্ণ ও দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঈশ্বরের চেনা ইমেজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। আবার, এটা অতিমাত্রায় ব্যক্তিরূপী ঈশ্বরের ধারণা ছিল। ঐশীগ্রন্থে বর্ণিত ইমেজকে বড় বেশি আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করে ধরে নিয়েছে যে, ঈশ্বর আকাশের বুকে ‘বড় ভাই’ জাতীয় কিছু। অনিচ্ছুক দাসদের ওপর অচেনা আইন চালানো স্বর্গীয় স্বৈরাচারীর ইমেজকে বিদায় নিতেই হবে। আতঙ্ক সৃষ্টি করে জনগোষ্ঠীকে নাগরিক আইন মানতে বাধ্য করা এখন আর গ্রহণযোগ্য, এমনকি অনুসরণযোগ্যও নয়: ১৯৮৯ সালে শরৎকালে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান অত্যন্ত নাটকীয়ভাবেই তা তুলে ধরেছে। উত্তর-আধুনিকতার মেজাজ মর্জির সঙ্গে আইন প্রণেতা ও শাসক স্বরূপ মানবরূপী ঈশ্বর ইমেজ স্বাভাবিক নয়। কিন্তু তারপরেও যেসব নাস্তিক ঈশ্বরের ধারণা স্বাভাবিক নয় বলে দাবি করেছে তারা পুরোপুরি ঠিক নয়। আমরা দেখেছি, ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমরা লক্ষণীয়ভাবে অনুরূপ ঈশ্বরের ধারণা গড়ে তুলেছিল, যা পরম সত্তা সম্পর্কিত অন্যান্য ধারণার সঙ্গেও মেলে। মানুষ মানব জীবনের পরম অর্থ ও মূল্য খুঁজে পাওয়ার প্রয়াস পেলে তাদের মনোযোগ যেন একটা নির্দিষ্ট দিকে চালিত হয়। এর জন্যে তাদের বাধ্য করার প্রয়োজন পড়েনিঃ এটা এমন কিছু যা মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক বলেই মনে হয়।

তবুও অনুভূতিকে যদি অসংযত আক্রমণাত্মক বা অস্বাস্থ্যকর আবেগে পর্যবসিত হতে না দিতে চাওয়া হয়, তাহলে সেগুলোকে সমালোচনামূলক বুদ্ধিমত্তায় অনুপ্রাণিত হতে হবে। মনের বিভিন্ন প্রবণতাসহ চলতি অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ঈশ্বর অনুভূতিকে তাল রেখে অগ্রসর হতে হবে। ফালসাফাহ্ গবেষণার প্রয়াস ছিল ঈশ্বরে বিশ্বাসকে মুসলিম, ইহুদি ও পরে পাশ্চাত্য ক্রিশ্চানদের ভেতর জেগে ওঠা নতুন যুক্তিবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত করা। শেষ পর্যন্ত মুসলিম ও ইহুদিরা দর্শন থেকে সরে গেছে। তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে যুক্তিবাদ বিজ্ঞান, ওষুধ ও গণিতের মতো গবেষণামূলক বিষয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, কিন্তু ধারণাতীত একজন ঈশ্বর সংক্রান্ত আলোচনার জন্যে পুরোপুরি জুৎসই নয়। গ্রিকরা আগেই এটা বুঝতে পেরে নিজস্ব মেটাফিজিক্সে গোড়ার দিকেই অবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। ঈশ্বর আলোচনার দার্শনিক পদ্ধতির অন্যতম দুর্বলতা হচ্ছে এতে করে পরম উপাস্যকে একেবারে ভিন্ন মাত্রার একটা সত্তা হয়ে সকল অস্তিত্বমান বস্তুর মাঝে সর্বোচ্চ কিন্তু আরেকটি সত্তা বলে মনে হতে পারে। তা সত্ত্বেও ফালসাফাহর প্রয়াস গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যেহেতু এটা অন্যান্য অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঈশ্বরকে সম্পর্কিত করার প্রয়োজনীয়তাটুকু তুলে ধরতে পেরেছিল, সেটা কেবল এর সম্ভাব্য মাত্রাটুকু বোঝানোর জন্যে হয়ে থাকলেও। ঈশ্বরকে এক পবিত্র বন্দিশালায় বুদ্ধিবৃত্তিক বিচ্ছিন্নতায় ঠেলে দেওয়াটা অস্বাস্থ্যকর ও অস্বাভাবিক। এটা মানুষকে একথা ভাবতে প্ররোচিত করতে পারে যে, ঈশ্বর-অনুপ্রাণিত আচরণে শালীনতা ও যুক্তির সাধারণ মান প্রয়োগের কোনও প্রয়োজন নেই।

প্রথম থেকেই ফালসাফাহ বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। ওষুধ, গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি আগ্রহ থেকেই প্রথম দিকে মুসলিম ফায়লাসুরা মেটাফিজিক্যাল পরিভাষায় আল্লাহ সংক্রান্ত আলোচনায় অগ্রসর হয়েছিল। বিজ্ঞান তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল; তারা বুঝতে পেরেছিল, সতীর্থ মুসলিমদের মতো করে তারা আর ঈশ্বর সম্পর্কে ভাবতে পারছে না। ঈশ্বরের দার্শনিক ধারণা কোরানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লক্ষণীয়ভাবে আলাদা ছিল, কিন্তু ফায়লাসুফরা সেই সময়ে উম্মাহর মাঝে বিলুপ্তির আশঙ্কায় থাকা বেশকিছু দর্শন পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল। এভাবেই অন্যান্য ধর্মীয় ট্র্যাডিশনের প্রতি কোরানের অসাধারণ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল: মুহাম্মদ (স) একথা মনে করতেন না যে, তিনি একটি নতুন, বিশেষ ধর্মের প্রতিষ্ঠা করছেন, তিনি বিশ্বাস করতেন সত্য পথে পরিচালিত সকল ধর্ম একজন ঈশ্বর হতে এসেছে। অবশ্য উনবিংশ শতাব্দীতে উলেমারা এই দর্শন বিস্মৃত হতে শুরু করে ইসলামকেই একমাত্র সত্য ধর্ম হিসাবে ঘোষণা দিতে শুরু করেছিলেন। ফায়সুফরা পুরোনো বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গিতে ফিরে গিয়েছিল, যদিও ভিন্ন পথে সেখানে পৌঁছেছে তারা। আজকে অনুরূপ একটা সুযোগ আছে আমাদের হাতে। আমাদের বৈজ্ঞানিক যুগে আমাদের পক্ষে পূর্ব পুরুষের মতো করে ঈশ্বরের কথা ভাবতে পারি না, কিন্তু বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জ আমাদের প্রাচীন কিছু সত্য উপলব্ধিতে সাহায্য করতে পারে।

আমরা দেখেছি, অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের অতিন্দ্রীয়বাদী ধর্মের প্রতি আগ্রহ ছিল। ঈশ্বর পাশা খেলেন না, তাঁর এই বিখ্যাত মন্তব্য সত্ত্বেও তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ঈশ্বরের ধারণাকে প্রভাবিত করতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করেননি। ১৯২১ সালে ইংল্যান্ড সফরের সময় আর্চ বিশপ অভ ক্যান্টারবারি আইনস্টাইনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ধর্মতত্ত্বের উপর এর প্রভাব কী হতে পারে। জবাবে তিনি বলেছেন: কিছু না। অপেক্ষিকতা একেবারেই বৈজ্ঞানিক বিষয়, এর সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই![১৫] স্টিফেন হকিংয়ের মতো বৈজ্ঞানিকদের কারণে ক্রিশ্চানরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে, কেননা হকিং তাঁর সৃষ্টিতত্ত্বে ঈশ্বরকে স্থান দেননি। এই ক্রিশ্চানরা সম্ভবত এখনও ঈশ্বরকে মানবীয় পরিভাষায় সত্তা হিসাবে ভাবে, যিনি আমরা যেভাবে করতাম সেভাবেই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আদিতে সৃষ্টিকে একরকম আক্ষরিকভাবে ধরে নেওয়া হয়নি। বাবিলনে নির্বাসনের আগে ইহুদিবাদে স্রষ্টা হিসাবে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র প্রতি আগ্রহ প্রবেশ করেনি। এই ধারণাটি গ্রিক জগতে অপরিচিত ছিল: ৩৪১ সালের নাইসার কাউন্সিলের আগে খৃস্টধর্মের আনুষ্ঠানিক মতবাদ ছিল না। সৃষ্টি কোরানের একটি মৌল শিক্ষা, কিন্তু ঈশ্বর সম্পর্কিত অন্য সকল উচ্চারণের মতো একেও এক অলৌকিক সত্য সম্পর্কিত উদাহরণ বা ‘নিদর্শন’-আয়া-বলা হয়েছে। ইহুদি ও মুসলিম যুক্তিবাদীদের কাছে এটা কঠিন ও সমস্যাসঙ্কুল মতবাদ মনে হয়েছে এবং অনেকেই প্রত্যাখ্যান করেছে। সুফী ও কাব্বালিস্ট সবাই উৎসারণের গ্রিক উপমা পছন্দ করেছে। সে যাই হোক, সৃষ্টিতত্ত্ব পৃথিবীর উৎসের বৈজ্ঞানিক বর্ণনা ছিল না বরং মূলত এটা ছিল আধ্যাত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক সত্যের প্রতীক-নির্ভর প্রকাশ। মুসলিম বিশ্বে নতুন বিজ্ঞানের ব্যাপারে সামান্য বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে: আমরা যেমন দেখেছি, বিজ্ঞানের চেয়ে সাম্প্রতিক ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ ঈশ্বরের প্রচলিত ধারণার প্রতি বেশি রকম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাশ্চাত্যে অবশ্য ঐশীগ্রন্থের অধিকতর আক্ষরিক উপলব্ধি দীর্ঘদিন ধরে চালু রয়েছে। কোনও কোনও ক্রিশ্চান মনে করে, নতুন বিজ্ঞান তাদের ঈশ্বরে বিশ্বাসকে খাটো করেছে, তারা সম্ভবত ঈশ্বরকে নিউটনের মহাকারিগর হিসাবে কল্পনা করে, ঈশ্বরের ব্যক্তিরূপ ধারণা যেটা ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক উভয় প্রেক্ষিতেই প্রত্যাখ্যাত হওয়া উচিত। বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জ হয়তো বা চার্চগুলোকে ঐশীগ্রন্থের প্রতীকী বর্ণনার ব্যাপারে সজাগ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে নাড়া দিতে যাচ্ছে।

নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক নানাবিধ কারণে বর্তমান যুগে ব্যক্তিক ঈশ্বরের ধারণা যেন অগ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। নারীবাদীরা ব্যক্তিক উপাস্য-যিনি তার লিঙ্গের কারণে সেই গোত্রীয় পৌত্তলিক আমল থেকেই পুরুষ-তাঁর প্রতি বিকর্ষণ বোধ করছে। কিন্তু তাঁকে নারী হিসাবে উপস্থাপন করাটাও-দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় না হলে-একই রকম সীমাবদ্ধতায় আক্রান্ত হবে, কেননা এটা অসীম ঈশ্বরকে একেবারে মানবীয় মাত্রায় আবদ্ধ করে ফেলে। পাশ্চাত্যে দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয় পরম সত্তা হিসাবে ঈশ্বর সম্পর্কিত মেটাফিজিক্যাল ধারণাও অসন্তোষজনক বিবেচিত হচ্ছে। দার্শনিকদের ঈশ্বর অধুনা অচল হয়ে যাওয়া এক যুক্তিবাদের ফল, সুতরাং তার অস্তিত্বের প্রচলিত প্রমাণগুলো এখন আর কার্যকর নয়। আলোকন পর্বের ডেইস্টদের ব্যাপক হারে গৃহীত দার্শনিকদের ঈশ্বরকে বর্তমানকালের নাস্তিক্যবাদের দিকে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে দেখা যেতে পারে। প্রাচীন স্কাই গডের মতো এই উপাস্য মানুষ ও ইহজগৎ হতে এত দূরবর্তী যে অনায়াসে তিনি ডিউস ওতিসৌস-এ পরিণত হয়ে আমাদের চেতনা থেকে হারিয়ে যান।

অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বরকে সম্ভাব্য বিকল্প হিসবে দেখা যেতে পারে। অতিন্দ্রীয়বাদীরা বহু আগে থেকেই জোর দিয়ে এসেছে যে, ঈশ্বর আরেকটি ‘সত্তা’ নন, তারা দাবি করেছে, আসলে তার অস্তিত্ব নেই এবং তাকে কিছু না বলে ডাকাই শ্রেয়। এই ঈশ্বর আমাদের সেকুলার সমাজের পরম সত্তার অসম্পূর্ণ ইমেজের প্রতি অবিশ্বাসের প্রেক্ষিতে নাস্তিক্যবাদী মনোভাবের সঙ্গে মানানসই। ঈশ্বরকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রকাশযোগ্য বস্তুগত সত্য হিসাবে দেখার বদলে অতিন্দ্রীয়বাদীরা দাবি করেছে যে, তিনি সত্তার গভীরে রহস্যজনকভাবে অনুভূত অন্তরের অনুভূতি। কল্পনার মাধ্যমে এই ঈশ্বরের দিকে অগ্রসর হতে হবে এবং জীবনের রহস্য, সৌন্দর্য ও মূল্য ধরে শিল্পকলার কোনও ধরণ হিসাবে দেখা যেতে পারে। অতিন্দ্রীয়বাদীরা ধারণাতীত এই সত্তাকে প্রকাশ করার জন্যে সঙ্গীত, নৃত্য, কবিতা, কাহিনী, গল্প, চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যকলার ব্যবহার করেছে। অবশ্য সকল শিল্পকর্মের মতো। অতিন্দ্রীয়বাদে বুদ্ধিমত্তা, শৃঙ্খলা ও আত্মসমালোচনার প্রয়োজন যা অসংযত আবেগ ও অভিক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রহরা হিসাবে কাজ করে। অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বর নারীবাদীদেরও তুষ্ট করতে পারেন, কেননা সুফী ও কাব্বালিস্ট, উভয়ই দীর্ঘদিন ধরে ঈশ্বরে নারী উপাদানের বৈশিষ্ট্য যোগ করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে।

অবশ্য এর দুর্বলতাও আছে। শ্যাব্বেতাই যেভি বিপর্যয় ও পরবর্তী কালের সুফীবাদের পতনের পর বহু ইহুদি ও মুসলিম অতিন্দ্রীয়বাদকে সন্দেহের চোখে দেখে আসছে। পশ্চিমে অতিন্দ্রীয়বাদ কখনওই ধর্মীয় উদ্দীপনার প্রধান স্রোতধারা হয়ে ওঠেনি। প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক সংস্কারকগণ হয় একে বেআইনী ঘোষণা করেছেন নয়তো প্রান্তিকায়িত করেছেন; বৈজ্ঞানিক যুক্তির কাল এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি উৎসাহিত করেনি। ১৯৬০-এর দশকের পর থেকে যোগ মেডিটেশন ও বৌদ্ধধর্ম মতে আগ্রহের ভেতর দিয়ে অতিন্দ্রীয়বাদের প্রতি নতুন করে উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই পদ্ধতি আমাদের বস্তুনিষ্ঠ গবেষণামূলক মানসিকতার সঙ্গে সহজে খাপ খায় না। অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বর সহজবোধ্য নন। এর জন্যে অভিজ্ঞজনের অধীনে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ও যথেষ্ট সময় ব্যয়ের প্রয়োজন হয়। ঈশ্বর নামে পরিচিত সত্তার (অনেককেই এর কোনও নাম দিতে অস্বীকার করেছে) বোধ লাভের জন্যে অতিন্দ্রীয়বাদীদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। অতিন্দ্রীয়বাদীরা প্রায়শঃই জোর দিয়ে বলেছে, মানুষকে। শিল্পকর্মের অন্যান্য ক্ষেত্র সৃষ্টির জন্যে যেমন মনোনিবেশ প্রয়োজন হয় ঠিক সেরকমভাবে নিজেদের জন্যে ঈশ্বরের অনুভূতি সৃষ্টি করতে হবে। এটা আশুতোষ ফাস্ট ফুড ও চকিত যোগাযোগে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা একটা সমাজের মানুষের মনে আবেদন সৃষ্টি করার মতো নয়। অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বর তৈরি অবস্থায় মোড়কায়িত হয়ে হাজির হন না। কোনও রিভাইভালিস্ট প্রচার সৃষ্ট চকিত আনন্দের মতো তিনি অনুভূত হবেন না, এ ধরনের প্রচারকরা অতি দ্রুত গোটা দর্শকগোষ্ঠীকে হাততালি ও গুঞ্জন শুরু করতে উৎসাহিত করে তোলেন।

কিছু কিছু অতিন্দ্রীয়বাদী প্রবণতা অর্জন সম্ভব। আমরা যদি অতিন্দ্রীয়বাদীর মতো চৈতন্যের উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছতে নাও পারি, অন্তত এটা তো শিখতে পারব যে, ঈশ্বর, উদাহরণস্বরূপ, কোনও সাধারণ অর্থে অস্তি তুমান নন, কিংবা খোদ ‘ঈশ্বর’ শব্দটি স্রেফ এক সত্তার প্রতীক যিনি অনির্বচনীয়ভাবে একে অতিক্রম করে যান। অতিন্দ্রীয়বাদী অজ্ঞাবাদ আমাদের গোঁড়া নিশ্চয়তার সঙ্গে এসব জটিল বিষয়ের দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রবণতা দূর করার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে । কিন্তু এসব ধারণা যদি হৃদয়ঙ্গম করা না হয়। এবং ব্যক্তিগতভাবে উপলব্ধি করা না হয় তাহলে এগুলোকে অর্থহীন বিমূর্ত মনে হবে। ধার করা অতিন্দ্রীয়বাদ মূল কবিতা পাঠের বদলে সমালোচকের ব্যাখ্যা পড়ার মতো অসন্তোষজনক ঠেকতে পারে। আমরা দেখেছি, অতিন্দ্রীয়বাদকে প্রায়ই নিগূঢ় শাস্ত্র হিসাবে দেখা হয়েছে, সেটা অতিন্দ্রীয়বাদীরা অশ্লীল গোষ্ঠীকে বাদ দিতে চেয়েছে বলে নয় বরং এসব সত্য কেবল বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর মনের উপলব্ধির অংশ দিয়েই অনুধাবন করা সম্ভব বলে। এই বিশেষ পদ্ধতিতে অগ্রসর হলে এগুলোকে ভিন্ন অর্থবোধক বলে মনে হয় যা মনের যৌক্তিক অংশের কাছে বোধগম্য নয়।

ইসরায়েলের পয়গম্বরগণ তাঁদের ব্যক্তিগত অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে ঈশ্বরের প্রতি আরোপ করতে শুরু করার পর থেকেই একেশ্বরবাদীরা এক অর্থে তাদের নিজস্ব ঈশ্বর সৃষ্টি করে নিয়েছিল। ঈশ্বরকে খুব কমই অন্য যেকোনও বস্তুগত অস্তিত্বমানের মতো অনুভবযোগ্য স্ব-প্রতীয়মান সত্য হিসাবে দেখা হয়েছে। আজ বহু মানুষ যেন এই কল্পনানির্ভর প্রয়াস নেওয়ার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেছে। এটা কোনও মহা-বিপর্যয় নয়। ধর্মীয় ধারণাসমূহ যখন বৈধতা হারিয়েছে, সাধারণত অলক্ষে হারিয়ে গেছে সেগুলোে: যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে ঈশ্বর সম্পর্কিত মানুষের ধারণা অকার্যকর হয়ে পড়ে, সেটাকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু অতীতে অধিকাংশ মানুষ আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্র হিসাবে কাজ করার জন্যে নতুন নতুন প্রতাঁকের সৃষ্টি করেছে। মানবজতি সবসময় জীবনের প্রতি বিস্ময়বোধ ও অনির্বচনীয় তাৎপর্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিজেই বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। আধুনিক জীবনের বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠা লক্ষ্যহীনতা, বিচ্ছিন্নতা, উম্মুলতা ও সন্ত্রাস ইঙ্গিত করছে যে তারা যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই ‘ঈশ্বর’ বা অন্য কিছুতে বিশ্বাস সৃষ্টি করছে না-কোনওটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়-বহু মানুষ ডুবে যাচ্ছে হতাশায়।

আমরা দেখেছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যার নিরানব্বই ভাগই ঈশ্বরে বিশ্বাস করার দাবি করে, তা সত্ত্বেও মৌলবাদ, প্রলয়বাদ ও ধর্মপরায়ণতার চকিত ক্যারিশম্যাটিক ধরণ আমেরিকায় আশ্বাসের সৃষ্টি করতে পারছে না। অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি, মাদকসক্তি ও মৃত্যুদণ্ডের পুনর্বহাল আধ্যাত্মিক দিক থেকে সুস্থ সমাজের লক্ষণ নয়। ইউরোপে মানবীয় চেতনায় এক কালে যেখানে ঈশ্বরের অবস্থান ছিল সেখানে আজ ক্রমবর্ধমান শূন্যতা। এই বিরস নৈঃসঙ্গ যারা প্রকাশ করেছেন তাঁদের মধ্যে প্রধানতম হচ্ছেন-নিৎশের বীরত্বপূর্ণ নাস্তিক্যবাদ হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষায়-টমাস হার্ডি। বিংশ শতাব্দীর সূচনায়, ১৯০০ সালের ৩০ ডিসেম্বর রচিত দ্য ডার্কলিং থ্রাশ-এ তিনি জীবনের অর্থময়তার বিশ্বাস সৃষ্টিতে অক্ষম হয়ে ওঠা চেতনার মৃত্যুর কথা প্রকাশ করেছেন:

তুষার যখন ভূতূড়ে ধূসর
আর শীতের শেষ যখন
দিনের দুর্বল চোখকে
অস্থির করে তোলে,
তখন ঝোঁপের কোণে ঠেস দিই ।
লতাগুল্মের প্যাঁচানো ডাল
ভাঙা তারের মতো উঠে
গেছে আকাশ পানে
এবং মানুষগুলো সব যারা
ভয় পেয়ে গিয়েছিল যার যার
বাড়ির আগুন খুঁজে নিয়েছে।

জমিনের তীক্ষ্ণ চেহারা যেন
শতাব্দীর ঝড়ে থাকা নিঃসর্গ
মেঘলা আকাশ তার
শবাধার, হাওয়া তার
মরণ-বিলাপ।

প্রাচীন ক্রন্দন শুষ্ক
কঠিন, চুপসে গেছে,
আর জগতের প্রতিটি
আত্মা যেন আমারই মতো
অনুকম্পাহীন।

নিমেষে মাথার ওপরের
বিষণ্ণ ডালপালায় জেগে ওঠে কণ্ঠস্বর,
অনেকের মনকাড়া
সীমাহীন প্রার্থনা সঙ্গীতের
এক প্রাচীন ধাক্কা, নাজুক, শুষ্ক, ক্ষুদ্র,
হাওয়ায় আলোড়িত জলে,
এমনি করে আমাকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে।

এমন পরমানন্দের শব্দের
জন্যে গান গাইবার সামান্যই কারণ
লিখা আছে পার্থিব বস্তুতে,
বহু দূরে বা খুব কাছে,
তার প্রফুল্ল রাতের হাওয়ায়
ভেসে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি,
কোনও আশীর্বাদপ্রাপ্ত আশা, যার
কথা সে জানে, কিন্তু
জানি না আমি।

মানুষ শূন্যতা ও নৈঃসঙ্গ সহ্য করতে পারে না; তারা অর্থবহতার নতুন কেন্দ্র সৃষ্টি করে শূন্যতা পূরণ করবে। মৌলবাদের প্রতিমাসমূহ ঈশ্বরের সঠিক বিকল্প নয়; আমরা একবিংশ শতাব্দীর জন্যে নতুন প্রাণবন্ত বিশ্বাস সৃষ্টি করতে চাইলে আমাদের সম্ভবত উচিত হবে শিক্ষা ও সতর্কতার স্বার্থে ঈশ্বরের ইতিহাস নিয়ে ভাবা ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *