০৫. একত্ব: ইসলামের ঈশ্বর

৫. একত্ব: ইসলামের ঈশ্বর

৬১০ সালের দিকে হিজাজের সমৃদ্ধ শহর মক্কায় এক আরব বণিক, যিনি কোনওদিন বাইবেল পড়েননি এবং সম্ভবত ইসায়াহ্, জেরেমিয়াহ্ বা ইযেকিয়েলের নামও শোনেননি, এমন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন যা আশ্চর্যজনকভাবে তাঁদের অভিজ্ঞতার অনুরূপ। মক্কার কুরাইশ গোত্রের সদস্য মুহাম্মদ ইবন আব্দাল্লাহ প্রত্যেক রমযান মাসে আধ্যাত্মিক ধ্যানে মগ্ন হবার উদ্দেশ্যে সপরিবারে হিরা পর্বতে যেতেন। পেনিনসুলার আরবদের মাঝে এটা একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল। আরবদের পরম ঈশ্বরের উদ্দেশে প্রার্থনা ও পবিত্র মাসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা দরিদ্রদের মাঝে খাবার আর অর্থ দান করে সময় কাটাতেন তিনি। সম্ভবত উদ্বেগাকুল ভাবনাতেও প্রচুর সময় ব্যয় করতেন তিনি। মুহাম্মদের (স) পরবর্তী জীবনচরিত হতে আমরা জানি যে, মক্কার সাম্প্রতিক অতিচমকপ্রদ সাফল্য সত্ত্বেও সেখানকার এক উদ্বেগজনক অস্থিরতার ব্যাপারে দারুণ সজাগ ছিলেন তিনি। মাত্র দুই প্রজন্ম আগে আরবের মরুপ্রান্তরের অন্যান্য বেদুঈন গোত্রের মতো যাযাবরের কঠিন জীবন যাপন করে এসেছে কুরাইশরা: প্রতিদিন টিকে থাকার জন্যে প্রয়োজন হয়েছে কঠিন সগ্রামের। অবশ্য ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষদিকের বছরগুলোয় ব্যবসা বাণিজ্যে দারুণ সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয় তারা এবং মক্কাকে আরবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত করে। ওরা এত ধনী হয়ে ওঠে যা তাদের স্বপ্নের অতীত ছিল। কিন্তু তাদের আমূল বদলে যাওয়া জীবনধারার অর্থ ছিল তীব্র ও নিষ্ঠুর এক পুঁজিবাদের কাছে প্রাচীন গোত্রীয় মূল্যবোধগুলোর পরাস্ত হয়ে যাওয়া। মানুষ কেমন যেন দিশাহারা ও উন্মুল বোধে আক্রান্ত ছিল। মুহাম্মদ (স) জানতেন যে এক বিপজ্জনক পথে এগোচ্ছে কুরাইশরা; নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করার জন্যে একটা মতাদর্শ খুঁজে পাবার প্রয়োজন ছিল।

এসময় যেকোনও রাজনৈতিক সমাধানই ধর্মীয় ধরনের হতো। মুহাম্মদ (স) জানতেন, কুরাইশরা অর্থ-কেন্দ্রিক এক নতুন ধর্ম গড়ে তুলছিল। এটা খুব একটা বিস্ময়কর ছিল না, কারণ নিশ্চয়ই তাদের মনে এই ধারণা জন্মেছিল যে সম্পদই যাযাবর জীবনের বিপদ থেকে তাদের রক্ষা করেছে, আরবের মরুপ্রান্তরের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অপুষ্টি ও গোত্রীয় সহিংসতা থেকে দূরে সরিয়ে এনেছে, যেখানে প্রত্যেক বেদুঈন গোত্র প্রতিদিন বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কার মোকাবিলা করত। এখন পর্যাপ্ত খাবার হয়েছে তাদের, মক্কাকে বাণিজ্য ও বিপুল বিনিয়োগের আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত করছিল তারা। নিজেদেরই আপন ভাগ্য নিয়ন্তা বলে ভেবেছে; কেউ কেউ এমনকি এমনও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, সম্পদ তাদের এক ধরনের অমরত্ব দান। করবে। কিন্তু মুহাম্মদের (স) বিশ্বাস ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণতার (ইসতাকা) এই কাল্ট গোত্রের বিলুপ্তি ডেকে আনবে। প্রাচীন যাযাবর আমলে সর্বাগ্রের বিবেচনা ছিল গোত্র, ব্যক্তি সব সময় দ্বিতীয় সারিতে ছিল: গোত্রের প্রতিটি সদস্য জানত অস্তিত্বের জন্যে তারা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। ফলে দলের দরিদ্র ও দুর্বল সদস্যের প্রতি লক্ষ রাখাকে দায়িত্ব হিসাবে দেখতে হতো তাদের। কিন্তু এখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বোধ সাম্প্রদায়িক আদর্শের জায়গা দখল করে নিয়েছে, প্রতিযোগিতা পরিণত হয়েছে রেয়াজে। লোকেরা নিজস্ব সম্পদ গড়ে তুলছে, দুর্বল কুরাইশদের প্রতি ক্ষেপও করছে না। প্রত্যেকটা ক্ল্যান বা গোত্রের ক্ষুদ্রতর পারিবারিক গ্রুপ মক্কার সম্পদের ভাগ পাওয়ার লক্ষ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছিল এবং অপেক্ষাকৃত অসফল ক্ল্যানগুলোর কোনও কোনওটা [মুহাম্মদের (স) নিজস্ব হাশিম ক্ল্যানের মতো নিজের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন মনে করেছে। মুহাম্মদ (স) বিশ্বাস করছিলেন যে কুরাইশরা তাদের জীবনযাত্রার কেন্দ্রে আরেকটা দুয়ে মূল্য যোগ করতে না শিখলে, অহংকার ও প্রলোভন হতে মুক্ত না হলে তাঁর গোত্র নৈতিক দিক দিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে; পারস্পরিক সংঘাতে ধ্বংস হয়ে যাবে রাজনৈতিকভাবেও।

আরবের বাকি অংশের অবস্থাও ছিল হতাশাব্যাঞ্জক। বহু শতাব্দী ধরে হিজাজ এবং নাজদ অঞ্চলের বেদুঈন গোত্রগুলো জীবনের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর স্বার্থে পরস্পরের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। বেঁচে থাকার জন্যে অত্যাবশ্যক সাম্প্রদায়িক চেতনা গড়ে তুলতে সাহায্য করতে আরবরা মুরুব্ৰাহ্ নামে এক আদর্শ গড়ে তুলেছিল যা ধর্মের বহু কাজ সম্পন্ন করত। প্রচলিত ধারণায় আরবদের ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না। বিভিন্ন পৌত্তলিক দেবতারা ছিলেন, আরবরা তাঁদের মন্দিরে উপাসনা করত, কিন্তু তারা এমন কোনও মিথলজি গড়ে তোলেনি যা এসব দেবতার ও পবিত্র স্থানের। সঙ্গে জীবনের চেতনার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে। পরকালের জীবন সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না তাদের, তবে তারা বিশ্বাস করত যে দহর-যাকে সময় বা নিয়তি হিসাবে অনুবাদ করা যায়–সর্বোচ্চ-মৃত্যু হার যেখানে অস্বাভাবিক রকম বেশি ছিল, সেখানে এমন একটা প্রবণতা সম্ভবত অত্যাবশ্যকই ছিল। পশ্চিমের পণ্ডিতগণ প্রায়শঃই মরুবাহকে ‘পৌরষ’ হিসাবে অনুবাদ করে থাকেন, কিন্তু এর তাৎপর্যের পরিধি ছিল আরও ব্যাপক: এটা দিয়ে যুদ্ধে সাহস বোঝাত, দুখ-কষ্ট সহ্য করার ধৈর্য বোঝাত আর বোঝাত গোত্রের প্রতি চরম আনুগত্য। মুরুবাহর গুণাবলী একজন অরবকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অগ্রাহ্য করে মুহূর্তের নোটিসে তার সায়ীদ বা গোত্রপ্রধানের নির্দেশ পালনের দাবি করে ও তাকে গোত্রের বিরুদ্ধে সংঘটিত যেকোনও অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার বীরের দায়িত্ব গ্রহণে নিবেদিত প্রাণ থাকতে হতো, গোত্রের দুর্বল সদস্যদের রক্ষা করতে হতো। গোত্রের অস্তিত্ব নিশ্চিত করার জন্যে সায়ীদ সম্পদ ও অন্যান্য জিনিস সমভাবে বণ্টন করতেন ও ঘাতক গোত্রের একজন সদস্যকে হত্যা করার মাধ্যমে আপন জাতির যেকোনও সদস্যের হত্যার বদলা নিতেন । এখানেই আমরা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে সাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ দেখতে পাই: স্বয়ং ঘাতককে শাস্তি দেওয়ার কোনও দায়িত্ব ছিল না, কারণ প্রাক-ইসলামি যুগের সমাজে একজন ব্যক্তি কোনও রকম চিহ্ন না রেখেই উধাও হয়ে যেতে পারত। তার বদলে শক্ৰগোত্রের যেকোনও একজন সদস্যই এধরনের উদ্দেশ্য অর্জনের ক্ষেত্রে আরেকজনের সমান ছিল। কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বহীন এক অঞ্চলে, যেখানে প্রত্যেক গোত্রীয় গ্রুপ আলাদা আইনের প্রতীক ছিল এবং যেখানে আধুনিক পুলিসের মতো কোনও শক্তির অস্তিত্ব ছিল না, সেখানে মোটামুটিভাবে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একমাত্র উপায়ই ছিল প্রতিশোধ বা রক্ত বিবাদ। কোনও গোত্র প্রধান প্রতিশোধ গ্রহণে ব্যর্থ হলে এর সদস্যরা মর্যাদা হারাত এবং অন্যরা শাস্তির ভয় না করেই এর সদস্যদের অনায়াসে হত্যা করতে উৎসাহী হয়ে উঠত। এভাবে প্রতিশোধ ছিল ন্যায়-বিচারের রূঢ় ও তৈরি একটা ধরণ, যার মূল অর্থ ছিল কোনও গোত্রই যেন খুব সহজে অন্যটির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে না পারে। এতে বিভিন্ন গোত্র সহিংসতার এক বিরামহীন চক্রে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও থাকত, যেখানে লোকজন একটা প্রতিশোধ আক্রমণের সমানুপাতিক হয়নি মনে করলে আরও খুনখারাবির জন্ম হতে পারত।

সন্দেহাতীতভাবে নিষ্ঠুর হলেও মুরুবাহর অনেকগুলো জোরাল দিকও ছিল। এটা সমতাবোধের গভীর ও জোরাল বোধ উৎসাহিত করেছে এবং বস্তুসামগ্রীর প্রতি নির্লিপ্ততার জন্ম দিয়েছে, যা, আবার বলতে হয়, সম্ভবত জীবন ধারনের জন্যে প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় রসদপত্রের ঘাটতি আছে এমন এক অঞ্চলে জরুরি ছিল: দান ও বদান্যতার কাল্টও গুরুত্বপূর্ণ গুণ ছিল; এগুলো আগামী দিনের চিন্তা না করার শিক্ষা দিয়েছিল আরবদের। আমরা দেখব, এসব গুণ ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বহু শত বছর আরবদের উপকারে এসেছে মুরুবাহ, কিন্তু ষষ্ঠ শতাব্দী নাগাদ এটা আর আধুনিকতার শর্তাবলী পুরণ করতে পারছিল না। প্রাক-ইসলামি যুগের শেষ পর্যায়ে, মুসলিমরা যে সময়কালকে জাহিলিয়া-অজ্ঞতার কাল-বলে অভিহিত করে থাকে, এক ব্যাপক অসন্তোষ আর আধ্যাত্মিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল বলে মনে হয়। আরবরা চারপাশ থেকে দুই পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য স্যাসানিয় পারসিয়া এবং বাইযান্তিয়াম দিয়ে পরিবেষ্টিত ছিল। বসতি অঞ্চলসমূহ থেকে আধুনিক ধ্যানধারণার অনুপ্রবেশ ঘটছিল আরবে; সিরিয়া বা ইরাক ভ্রমণ শেষে প্রত্যাবর্তনকারী বণিকগণ সত্যতার বিস্ময়কর কাহিনী সাথে করে নিয়ে আসছিল।

তা সত্ত্বেও আরবরা যেন চিরস্থায়ী বর্বরতার অভিশাপে অভিশপ্ত মনে হয়েছে। গোত্রগুলো অবিরাম হানাহানিতে লিপ্ত ছিল, যার ফলে নামমাত্র সম্পদ একত্রিত করে ঐক্যবদ্ধ আরব জাতিতে পরিণত হওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল; যদিও এরকম একটা অস্তিত্ব গড়ে ওঠার ব্যাপারে আবছাভাবে সজাগ ছিল তারা। নিজের হাতে নিয়তি তুলে নিয়ে নিজস্ব সভ্যতা গড়ে তুলতে পারছিল না তারা। সে জায়গায় পরাশক্তিগুলোর অব্যাহত শোষণের শিকার হয়ে চলছিল: প্রকৃতপক্ষে দক্ষিণ আরবের অধিকতর উর্বর ও অনন্য এলাকা এখনকার ইয়েমেন-মৌসুমী বৃষ্টির আর্শিবাদ ছিল এখানে-পার্সিয়ার এক সামান্য প্রদেশে পরিণত হয়েছিল। একই সময়ে এ অঞ্চলে অনুপ্রবেশকারী ধারণাসমূহ পুরোনো সাম্প্রদায়িক নীতিকে দুর্বল করে তোলা ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদের সংবাদ নিয়ে আসছিল। উদাহরণ স্বরূপ, পরকালের জীবন সম্পর্কিত ক্রিশ্চান মতবাদ প্রতিটি ব্যক্তির অনন্ত নিয়তিকে পবিত্র মূল্য দিয়েছিল: ব্যক্তিকে দলের অধীনে স্থাপনকারী এবং গোত্রের অস্তিত্বের ওপরই নারী-পুরুষের অমরত্ব পুরোপুরি নির্ভরশীল বলে দাবিদার গোত্রীয় আদর্শের সঙ্গে এটা কীভাবে খাপ খেতে পারে?

মুহাম্মদ (স) অসাধারণ মেধার অধিকারী মানুষ ছিলেন। ৬৩২ সালে যখন তিনি পরলোকগমন করেন, তখন আরবের প্রায় সকল গোত্রকে এক নতুন ঐক্যবদ্ধ সমাজ বা উম্মাহ অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। আরবদের নিজস্ব ঐতিহ্যের সঙ্গে চমৎকার মানানসই আধ্যাত্মিকতা এনে দিয়েছেন তিনি, যা এমন এক শক্তির উদ্বোধন ঘটিয়েছে যে মাত্র একশো বছরের ব্যবধানে হিমালয় পর্বতমালা থেকে পিরেনীজ অবধি বিস্তৃত নিজস্ব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে তারা। প্রতিষ্ঠা করেছে এক অসাধারণ সভ্যতার। কিন্তু মুহাম্মদ (স) ৬১০ সালের রমযান মাসে যখন হিরা পর্বতের চূড়ায় ছোট্ট গুহায় প্রার্থনায় নিমগ্ন হন, এরকম এক অসাধারণ সাফল্যের কথা চিন্তাও করেননি তিনি। বহু আরবের মতো মুহাম্মদও (স) বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, প্রাচীন আরবীয় দেবনিচয়ের পরমেশ্বর আল্লাহই-যার অর্থ স্রেফ ‘ঈশ্বর’-ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের উপাস্য ঈশ্বর। এও বিশ্বাস ছিল যে কেবল এই ঈশ্বরের একজন পয়গম্বরের পক্ষেই আপন জাতির সমস্যা সমাধান সম্ভব, কিন্তু তিনি নিজেই যে সেই পয়গম্বর হতে যাচ্ছেন এটা কখনওই বিশ্বাস হয়নি তার। আরবরা আসলেই দুঃখের সঙ্গে অনুভব করত যে আল্লাহ কখনও তাদের প্রতি কোনও পয়গম্বর প্রেরণ করেননি বা কোনও ঐশীগ্রন্থ অবতীর্ণ করেননি, যদিও স্মরণাতীতকাল থেকে তারই মন্দির রয়েছে ওদের মাঝে। সপ্তম শতাব্দী নাগাদ অধিকাংশ আরব বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে মক্কার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সুপ্রাচীনকালের চৌকো আকৃতির বিশাল উপাসনাগৃহ কাবাহ্ মূলত আল্লাহর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত, যদিও এখন তা নাবাতিয় দেবী হুবালের অধিষ্ঠান। মক্কাবাসীরা আরবের সবচেয়ে পবিত্র স্থান কাবা গৃহ নিয়ে দারুণ গর্ব বোধ। করত। প্রতি বছর গোটা পেনিনসুলার আরবরা মক্কায় হজ্জ বা তীর্থযাত্রায় সমবেত হয়ে কয়েকদিন ধরে প্রচলিত আনুষ্ঠানিকতা পালন করত। কাবাহর চারপাশের পবিত্র এলাকা স্যাঙ্কচুয়্যারিতে সব রকমের সহিংসতা ছিল নিষিদ্ধ। যাতে মক্কায় আরবরা পুরোনো গোত্রীয় বর্বরতা সাময়িকভাবে স্থগিত জানা থাকায় শান্তিপূর্ণভাবে পরস্পরের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারে। কুরাইশরা জানত, স্যাঙ্কচুয়্যারি ছাড়া তাদের পক্ষে বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন সম্ভব ছিল না। তারা এও জানত যে কাবাহ্ গৃহের অভিভাবকত্ব এবং এর প্রাচীন পবিত্রতা রক্ষার সাফল্যের ওপর অন্যান্য গোত্রের মাঝে তাদের সম্মান বহুলাংশে নির্ভরশীল। কিন্তু যদিও আল্লাহ কুরাইশদের বিশেষ কৃপা করার জন্যে আলাদা করে নিয়েছেন, কিন্তু তিনি আব্রাহাম, মোজেস বা জেসাসের মতো একজন বার্তাবাহক কখনও পাঠাননি, আরবদের নিজস্ব ভাষার কোনও ঐশীগ্রন্থও ছিল না।

সুতরাং আধ্যাত্মিক দিক থেকে হীনম্মন্যতার এক ব্যাপক বোধ কাজ করছিল। আরবরা যেসব ইহুদি ও ক্রিশ্চানের সংস্পর্শে আসত তারা ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রত্যাদেশ না পাওয়ায় তাদের বর্বর জাতি বলে ক্ষেপাত। আরবরা তাদের চেয়ে বেশি জ্ঞানের অধিকারী এসব লোকদের প্রতি একধরনের মিশ্র অসন্তোষ আর শ্রদ্ধা বোধ করত। ইহুদিবাদ ও খৃস্টধর্ম এ অঞ্চলে খুব বেশি সাফল্য অর্জন করতে পারেনি যদিও, আরবরা ধর্মের এই অগ্রসর রূপকে নিজেদের প্রচলিত পৌত্তলিকতাবাদের চেয়ে উচ্চতর বলে স্বীকার করত। মক্কার উত্তরে ইয়াসরিব (পরবর্তীকালে মদিনা] ও ফাদাক নামের বসতিতে অজ্ঞাত উৎসের কিছু ইহুদি গোত্রের বাস ছিল; এবং পার্সিয়ান ও বাইযান্তাইন সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী সীমান্ত এলাকার উত্তরাঞ্চলীয় গোত্রগুলোর কিছু কিছু গোত্র মনোফিসাইট বা নেস্টোরিয়ান খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বেদুঈনরা মারাত্মক রকম স্বাধীনচেতা ছিল, তারা ইয়েমেনি ভাইদের মতো পরাশক্তির শাসনাধীনে না যাবার ব্যাপারে ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ; তারা এটাও বুঝতে পেরেছিল যে পারসিয় ও বাইয়ান্তাইন উভয় এলাকাই সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বার্থে ইহুদিবাদ ও খৃস্টধর্মকে ব্যবহার করছে। সম্ভবত তারা সহজাত প্রবৃত্তির বশে এও বুঝেছিল যে নিজস্ব ঐতিহ্য ক্ষয়ে যাওয়ায় সাংস্কৃতিকভাবে যথেষ্ট স্থানচ্যুতির স্বীকার হয়েছে তারা; আর যাহোক বিদেশী ভাষা ও ঐতিহ্যের আশ্রয়ে বিদেশী কোনও মতাদর্শ অন্তত চায়নি তারা।

আরবদের কেউ কেউ যেন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সংস্রবহীন অধিকতর নিরপেক্ষ একশ্বেরবাদের একটা ধরন আবিষ্কারের প্রয়াসে নিয়েজিত ছিল। পঞ্চম শতাব্দীতে প্যালেস্তাইনি ক্রিশ্চান ইতিহাসবিদ সোযোমেনোস আমাদের জানাচ্ছেন, সিরিয়াবাসী আরবদের কেউ কেউ তাদের ভাষায় আব্রাহামের সত্য ধর্ম পুনরাবিষ্কার করেছিল। ঈশ্বর তোরাহ্ বা গস্পেল প্রেরণের আগেই এসেছিলেন আব্রাহাম, সুতরাং তিনি ইহুদি বা ক্রিশ্চান কোনওটাই ছিলেন না। মুহাম্মদ (স) তাঁর নিজস্ব পয়গম্বরত্বের আহ্বান পাওয়ার অল্পদিন আগে, তার প্রথম জীবনীকার মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (মৃ. ৭৬৭) আমাদের জানাচ্ছেন যে, মক্কার চারজন কুরাইশ আব্রাহামের সত্য ধর্ম হানিফায়ার সন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কোনও কোনও পশ্চিমা পণ্ডিত এই ক্ষুদ্র হানিফায়াহ্ দলটিকে জাহিলিয়াহ্র সময়ের আধ্যাত্মিক অস্থিরতার প্রতীক ধর্মীয় কাহিনী বলে যুক্তি দেখিয়েছেন, কিন্তু এর কিছু ঐতিহাসিক বাস্তবতা থাকতে বাধ্য। চারজন হানিফের মধ্যে তিনজন প্রথম দিকের মুসলিমদের সুপরিচিত ছিলেন: উবায়দাল্লাহ ইবন জাহশ ছিলেন মুহাম্মদ (স)-এর চাচাত ভাই, ওয়ারাকা ইবন নওফল, যিনি পরে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেন, ছিলেন মুহাম্মদের (স) প্রথমদিকের আধ্যাত্মিক পরামর্শক এবং যায়েদ ইবন আমর ছিলেন মুহাম্মদের (স) অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর এবং ইসলামি সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবন আল খাত্তাবের চাচা। একটা গল্প প্রচলিত আছে: আব্রাহামের ধর্মের সন্ধানে মক্কা ত্যাগ করে সিরিয়া ও ইরাকের পথে রওনা দেওয়ার আগে যায়েদ একদিন কাবাহগৃহের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে উপাসনাগৃহকে ঘিরে প্রাচীন কায়দায় প্রদক্ষিণরত কুরাইশদের উদ্দেশে বলছিলেন: “হে কুরাইশগণ, যার হাতে যায়েদের আত্মা তার দোহাই, আমি ছাড়া তোমাদের আর কেউই আব্রাহামের ধর্ম অনুসরণ করছ না।’ এরপর দুঃখের সঙ্গে আবার যোগ করেছেন, “হে খোদা, যদি জানতাম কীভাবে উপাসনা আপনার পছন্দ আমি সেভাবেই আপনার উপাসনা করতাম; কিন্তু আমি যে জানি না।

যায়েদের ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় ৬১০ সালের রমজান মাসের সপ্তদশ রাতে, যখন মুহাম্মদ (স) ঘুম থেকে অকস্মাৎ জেগে উঠে এক সর্বগ্রাসী স্বর্গীয় উপস্থিতিতে নিজেকে আচ্ছন্ন অবস্থায় আবিষ্কার করেছিলেন। পরে এই অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতাকে তিনি স্পষ্ট আরবীয় পরিভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন যে একজন দেবদূত তাঁর সামনে আবির্ভূত হয়ে জোরাল নির্দেশ দিয়েছেন: ‘আবৃতি কর’ (ইকরা)। হিব্রু পয়গম্বরগণ যেমন প্রায়শঃই ঈশ্বরের বাণী উচ্চারণে অনীহা দেখিয়েছেন, মুহাম্মদ (স) তেমনি প্রতিবাদ করে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, “আমি আবৃত্তিকার নই!’ তিনি কাহিন অর্থাৎ আরবের সেসময়ের অনুপ্রাণিত ভবিষ্যৎ-বক্তা গণক বা সন্যাসী ছিলেন না। কিন্তু, বলেছেন মুহাম্মদ (স), দেবদূত তাকে তীব্র আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেন, তখন তাঁর মনে হয়ে ছিল বুঝি দম বেরিয়ে যাচ্ছে। যখন মনে হচ্ছিল আর সহ্য করতে পারবেন না, দেবদূত তাকে ছেড়ে দিয়ে আবার নির্দেশ দেন ‘আবৃত্তি কর? ইকরা! ফের আপত্তি জানান মুহাম্মদ (স) এবং আবার তাকে আলিঙ্গন করলেন দেবদূত, সহ্যের শেষ সীমা অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত জাপ্টে ধরে রাখলেন। অবশেষে, তৃতীয় ভয়ঙ্কর মারাত্মক আলিঙ্গনের শেষ পর্যায়ে মুহাম্মদ (স) আবিষ্কার করলেন তাঁর মুখে এক নতুন ঐশীগ্রন্থের প্রথম শব্দগুলো উচ্চারিত হচ্ছে:

পাঠ, কর তোমার প্রতিপালকের নামে, যিদি সৃষ্টি করিয়েছেন-সৃষ্টি করিয়াছেন মানুষকে আলাক* হইতে। পাঠ কর, আর তোমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়াছেন–শিক্ষা দিয়াছেন মানুষকে যাহা সে জানিত না**

[* সংযুক্ত, ঝুলন্ত, রক্ত, রক্তপিণ্ড ইত্যাদি। তফসীরকারগণ এর অর্থ রক্তপিণ্ড করেছেন। কিন্তু আধুনিক জীববিজ্ঞানীগণ মাগর্ভে জ্বণের ক্রমকিবাশের বর্ণনায় বলেন যে, পুরুষের শুক্র ও নারীর ডিম্বানু মিলিত হয়ে যে জ্বণের সৃষ্টি হয় তা গর্ভধারণের পঞ্চম বা ষষ্ঠ দিনে জরায়ু গাত্র সংলগ্ন হয়ে পড়ে এবং এই সম্পৃক্তি সংঘটিত না হলে গর্ভাধান স্থায়ী হয় না। একারণে বর্তমানে ‘আলাক’ শব্দের অনুবাদ করা হয় এমন কিছু যা লাগিয়া থাকে। সূত্র আল-কুরানুল করীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।

** মুহাম্মদ (স)-এর ৪০ বছর বয়সে প্রতি হেরা গুহায় এই সুরার প্রথম পাঁচটি আয়াত সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়। এটাই প্রথম প্রত্যাদেশ ।]

আরবী ভাষায় প্রথমবারের মতো ঈশ্বরের বাণী উচ্চারিত হয়েছিল। এই ঐশীগ্রন্থটি শেষ পর্যন্ত কুরান: আবৃত্তি নামে পরিচিত হয়ে উঠবে।

আতঙ্ক ও বিতৃষ্ণায় সজাগ হয়ে ওঠেন মুহাম্মদ (স); একজন তুচ্ছ ঘৃণিত কাহিনে পরিণত হয়েছেন ভেবে শঙ্কা বোধ করেছেন তিনি, লোকে উট হারালে পরামর্শ করার জন্যে কাহিনদের কাছে যেত। কাহিনের ওপর জিনের আসর হয়েছে বলে মনে করা হতো, এক ধরনের পরী যারা সারা এলাকা ঘুরে বেড়ায়, এরা খুব খেয়ালি হতে পারে, মানুষকে ভুল পথে টেনে নিতে পারে। কবিরাও নিজেদের জিনের আসরগ্রস্ত মনে করতেন। এভাবে হাসান ইবন সাবিত নামে ইয়াসরিবের এক কবি, যিনি পরে মুসলিম হয়েছিলেন, বলেছেন যে, তিনি যখন কবিত্ব অর্জন করেন তখন তাঁর জিন আবির্ভূত হয়ে তাকে জোর করে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে মুখ দিয়ে অনুপ্রাণিত কথামালা বের করিয়েছিল। কেবল এধরনের অনুপ্রেরণার সঙ্গেই মুহাম্মদ (স) পরিচিত ছিলেন। নিজেই হয়তো একজন জিনের আসরগ্রস্ত মজনুন-এ পরিণত হয়েছেন, এই চিন্তা তাঁকে এমন হতাশায় পূর্ণ করে দিয়েছিল যে বেঁচে থাকার ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। কাহিনদের আগাগোড়া ঘৃণা করতেন মুহাম্মদ (স), এদের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সাধারণত দুর্বোধ্য প্রলাপের মতো ছিল, তিনি সবসময় কোরানকে আরবের প্রচলিত কবিতা হতে স্বতন্ত্র বোঝাতে যত্নবান ছিলেন। এবার গুহা থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এসে পাহাড়-চূড়া থেকে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত। নিয়ে ফেললেন তিনি। কিন্তু পাহাড়ের পাশে আবার এক সত্তার মুখোমুখি হয়েছিলেন, যাকে তিনি পরে জিব্রাইল বলে শনাক্ত করেছেন:

আমি যখন পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছেছি, আকাশ থেকে ভেসে আসা একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম: “হে মুহাম্মদ! আপনি আল্লাহর পয়গম্বর এবং আমি জিব্রাইল!’ কে কথা বলছে দেখার জন্যে আকাশের দিকে তাকালাম, আর অদ্ভুত ব্যাপার, মানুষের রূপ ধরে দিগন্তে দাঁড়িয়ে আছেন জিব্রাইল…তার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি, সামনেও যেতে পারছিলাম না, পেছনেও না; এবার তার ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম, কিন্তু আকাশের যেদিকেই তাকাই, দেখি আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।

ইসলামে জিব্রাইলকে প্রায়ই প্রত্যাদেশের পবিত্র আত্মা হিসাবে শনাক্ত করা হয়ে থাকে যার মাধ্যমে আল্লাহ্ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ইনি কোনও সাধারণ প্রাকৃতিক দেবদূত নন, বরং এক সীমাহীন সর্বব্যাপী উপস্থিতি, যার কাছ থেকে পলায়ন অসম্ভব। ঐশ্বরিক সত্তার অপরিমেয় উপলব্ধি অর্জন করেছিলেন মুহাম্মদ (স), হিব্রু পয়গম্বরগণ যাকে কাদ্দোশ, পবিত্রতা, ঈশ্বরে ভীতিকর অন্যরূপ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এই উপলব্ধি অর্জনের সময় তাঁরাও মৃত্যুর কাছাকাছি এবং শারীরিক ও মানসিক পর্যায়ে চরম অবস্থার বোধে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু ইসায়াহ্ বা জেরেমিয়ার বিপরীতে, মুহাম্মদ (স)-এর সমর্থন পাওয়ার মতো প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যের কোনও সান্ত্বনার স্থল ছিল না, যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের যন্ত্রণায় নিজের অজান্তেই স্ত্রী খাদিজার শরণাপন্ন হলেন মুহাম্মদ (স) ।

থরথর কাঁপতে কাঁপতে চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে খাদিজার কোলে আঁপিয়ে পড়লেন মুহাম্মদ (স)। আমাকে আবৃত্ত করো!’ আবৃত্ত করো!’ স্বর্গীয় সত্তার কবল হতে নিজেকে আড়াল করার জন্যে জোর গলায় চেঁচালেন । আতঙ্ক খানিকটা প্রশমিত হওয়ার পর মুহাম্মদ (স) খাদিজার কাছে জানতে চাইলেন সত্যিই তিনি মজনুনে পরিণত হয়েছেন কিনা। ঝটপট তাকে আশ্বস্ত করেন খাদিজা: ‘আপনি আপনার আত্মীয়স্বজনদের প্রতি সহানুভূতিশীল। আপনি দরিদ্র ও অবহেলিতকে সাহায্য করেন, তাদের ভার বহন করেন। আপনি আপনার জাতির হারিয়ে যাওয়া উন্নত নৈতিক চরিত্রের পুন:প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। অতিথিদের আপনি সম্মান দেখান, দুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে যান। এমনটা হতে পারে না, প্রিয়তম! ঈশ্বর এমন খামখেয়ালি আচরণ করেন না । খাদিজা বর্তমানে ক্রিশ্চান ও ঐশীগ্রন্থ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাঁর চাচাত ভাই ওয়ারাকা ইবন নওফলের সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দিলেন। ওয়ারাকার মনে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ ছিল নাঃ মুহাম্মদ (স) মোজেস এবং অন্য পয়গম্বরদের ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রত্যাদেশ পেয়েছেন, আরবদের জন্যে স্বর্গীয় দূতে পরিণত হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত, কয়েক বছর পেরুনোর পর মুহাম্মদ (স) নিশ্চিত হন যে, আসলেও ব্যাপারটা তাই; কুরাইশদের মাঝে প্রচারণা শুরু করেন তিনি, তাদের নিজস্ব ভাষার এক ঐশীগ্রন্থ উপহার দেন।

অবশ্য, বাইবেলের বিবরণ অনুসারে তোরাহ যেমন সিনাই পর্বতে মোজেসের ওপর এক দফায় অবতীর্ণ হয়েছিল, তার বিরীতে কোরান দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে একটু একটু করে, এক লাইন এক লাইন, এক পঙক্তি এক পঙক্তি করে মুহাম্মদের (স) উপর অবর্তীণ হয়েছিল। প্রত্যাদেশসমূহ ছিল এক কষ্টকর অভিজ্ঞতা: ‘এমন একটাও প্রত্যাদেশ পাইনি যেটা গ্রহণ করার সময় আমার আত্মা ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে মনে হয়নি, পরবর্তী কালে বলেছেন। মুহাম্মদ (স)। খুব মনোযোগের সঙ্গে স্বর্গীয় বাণী শুনতে হতো তাঁকে, এক একটা দিব্যদর্শনের অর্থ ও তাৎপর্য বোঝার জন্যে সংগ্রাম করতে হয়েছে যা সবসময় নিরেট তথ্য রূপে তাঁর কাছে অবতীর্ণ হতো না। মাঝে মাঝে, বলেছেন তিনি, ঐশীবাণীর বিষয়বস্তু ছিল পরিষ্কার: জিব্রাইলকে যেন দেখতে পেতেন তিনি, তাঁর বক্তব্য শুনতেন। কিন্তু অন্যান্য সময় প্রত্যাদেশসমূহ হুদ ও সালিহ্ পয়গম্বরের কথা উল্লেখ আছে। বর্তমানে মুসলিমরা জোরের সঙ্গে বলে যে মুহাম্মদ (স) হিন্দু ও বৃদ্ধদের কথা জানলে তাদের ধর্মগুরুদেরও অন্তর্ভুক্ত করতেন: তাঁর পরলোকগমনের পর ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের মতো ইসলামি সাম্রাজ্যে তাদেরও পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। একই নীতি অনুযায়ী, যুক্তি দেখায় মুসলিমরা, কোরান হয়তো আমেরিকান ইন্ডিয়ান বা অস্ট্রেলিয় আদিবাসীদের শামান বা পবিত্র ব্যাক্তিদেরও সম্মান প্রদর্শন করত।

ধর্মীয় অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকায় মুহাম্মদের (স) বিশ্বাস অচিরেই পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল। কুরাইশদের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর মক্কাবাসী মুসলিমদের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। গোত্রীয় নিরাপত্তাবিহীন দাস ও মুক্ত দাসরা এমন নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয় যে কয়েকজনের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে এবং মুহাম্মদের (স) ক্ল্যানকে বশ্যতা স্বীকার করানোর প্রয়াসে বয়কট পর্যন্ত করা হয়েছিল: এই বঞ্চনাই সম্ভবত মুহাম্মদ (স)-এর প্রাণপ্রিয়া স্ত্রী খাদিজার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদের (স) জীবনও বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে। উত্তরাঞ্চলের বসতি ইয়াসরিবের পৌত্তলিক অধিবাসীরা মুসলিমদের স্ব স্ব ক্ল্যান ত্যাগ করে সেখানে অভিবাসী হবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কোনও আরবের জন্যে এমন একটা পদক্ষেপ নেওয়া ছিল চরম নজীরবিহীন: আরবে গোত্রের পবিত্র একটা মূল্য ছিল, এই ধরনের পক্ষ ত্যাগ ছিল আবশ্যকীয় নীতিমালার লঙ্ঘন । বিভিন্ন গ্রোত্রীয় দলের মাঝে দৃশ্যতঃ অন্তহীন যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল ইয়াসরিব। পৌত্তলিকদের অনেকেই মরুদ্যানের সমস্যাদির রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক সমাধান হিসাবে ইসলাম গ্রহণে প্রস্তুত ছিল। বসতিতে ইহুদিদের বড় আকারের বেশ কয়েকটি গোত্র ছিল যারা একেশ্বরবাদ গ্রহণে পৌত্তলিকদের মানসিক ভূমিকে প্রস্তুত করে দিয়েছিল। এর মানে হচ্ছে, আরবীয় দেব-দেবীদের অসম্মানে কুরাইশদের মতো তারা আক্রান্ত বোধ করেনি। ৬২২ সালের গ্রীষ্মকালে যথারীতি প্রায় সত্তর জন মুসলিম সপরিবারে ইয়াসরিবের উদ্দেশে পাড়ি জমায়।

ইয়াসরিবে (বা মদীনা, অর্থাৎ শহর, মুসলিমরা পরে যে নামে ডাকবে) হিজরা বা অভিবাসনের আগের বছর মুহাম্মদ (স) ইহুদিবাদ সম্পর্কে উপলব্ধির আলোকে নিজের ধর্মকে এর আরও কাছাকাছি আনার উদ্দেশ্যে অভিযোজন করেন। বহু বছর একাকী কাজ করার পর তিনি হয়তো একটি প্রাচীন ও প্রতিষ্ঠত ঐতিহ্যের সদস্যদের সঙ্গে বসবাস করার প্রত্যাশী হয়ে উঠেছিলেন। এভাবেই ইহুদিদের প্রায়শ্চিত্ত দিবসে মুসলিমদের উপবাস পালনের নির্দেশ দেন তিনি এবং ইহুদিদের মতো দিনে তিনবার প্রার্থনা করার নিয়ম চালু করেন, এর আগে দিনে দুবার প্রার্থনা চলছিল। মুসলিমদের ইহুদি নারী বিয়ের অনুমতি ছিল; খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কিত কিছু নিয়মকানুন পালন করারও প্রয়োজন ছিল। সর্বোপরি, ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের মতো মুসলিমদেরও এখন অবশ্যই জেরুজালেমের দিকে মুখ করে প্রার্থনা করতে হবে। শুরুতে মদীনার ইহুদিরা মুহাম্মদকে (স) একটা সুযোগ দিতে তৈরি ছিল: মরুদ্যানের জীবনযাত্রা অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিল; মদীনার অসংখ্য গোঁড়া পৌত্তলিকদের মতো তারাও মুহাম্মদকে (স) সন্দেহাবসর দিতে চেয়েছিল, কেননা তিনি ইতিবাচকভাবে তাদের ধর্ম বিশ্বাসের দিকে ঝুঁকে ছিলেন। অবশ্য, শেষ পর্যন্ত তারা মুহাম্মদের (স) বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং মক্কা হতে আগত নবাগতদের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন পৌত্তলিকদের সঙ্গে যোগ দেয়। প্রত্যাখ্যানের পক্ষে ইহুদিদের শক্ত ধর্মীয় যুক্তি ছিল: পয়গম্বরত্বের যুগ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে বলে বিশ্বাস করত তারা। একজন মেসায়াহর অপেক্ষায় থাকলেও এ পর্যায়ে কোনও ইহুদি বা ক্রিশ্চান তারা পয়গম্বর হবেন বলে তারা বিশ্বাস করত না। কিন্তু তারপরেও রাজনৈতিক বিবেচনা থেকেও ওরা অনুপ্রাণিত হয়েছিল: আগের দিনে যুদ্ধরত আরব গোত্রগুলোর যে কোনও একটির পক্ষে যোগ দিয়ে ফায়দা লুটেছিল ওরা। মুহাম্মদ (স) অবশ্য এ দুটো গোত্রকেই নতুন মুসলিম উম্মাহয় কুরাইশদের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন-এক ধরনের অতি-গোত্র (Super tribe), ইহুদিরাও যার সদস্য ছিল। মদীনায় নিজেদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়তে দেখে ইহুদিরা বৈরী ভাবাপন্ন হয়ে পড়ে। তারা মুসলিমদের গল্প শুনে ঠাট্টা তামাশা করার উদ্দেশ্যে মসজিদে সমবেত হতো। ঐশীগ্রন্থ সম্পর্কে উন্নত ধারণা থাকায় কোরানের কাহিনীর ভুল খুঁজে বের করার কাজটা তাদের পক্ষে ছিল খুব সহজ, কিছু কিছু কাহিনীতে বাইবেলের ভাষ্যের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য রকম ভিন্নতা ছিল। মুহাম্মদের (স) পয়গম্বরত্বের দাবি নিয়েও টিটকারী দিত ওরা, বলত যে লোক নিজেকে পয়গম্বর দাবি করে অথচ উট হারিয়ে গেলে বলতে পারে না সেটা কোথায়-এতো বড়ই বেখাপ্পা ব্যাপার।

ইহুদিদের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়াটা সম্ভবত মুহাম্মদের (স) জীবনে সবচেয়ে বড় হতাশাব্যাঞ্জক ঘটনা ছিল; এতে তার ধর্মীয় অবস্থান প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোনও কোনও ইহুদি আবার বন্ধুসুলভ ছিল, তারা মুসলিমদের সঙ্গে সম্মানসূচক পদে যোগ দিয়েছিল। বাইবেল নিয়ে মুহাম্মদের (স) আলাপ-আলোচনা করে অন্য ইহুদিদের সমালোচনার জবাব বাতলে দিত তারা; ঐশীগ্রন্থ সম্পর্কে এই জ্ঞান মুহাম্মদকে (স) আপন দর্শন উন্নত করার ক্ষেত্রেও সাহায্য করেছে। প্রথমবারের মতো মুহাম্মদ (স) পয়গম্বরদের সঠিক পর্যায়ক্রম জানতে পারেন, এতদিন পর্যন্ত তাঁর এ সংক্রান্ত ধারণা ছিল অস্পষ্ট। তিনি এবার বুঝতে পারেন যে, মোজেস বা জেসাসের আগেই আব্রাহামের আগমন ঘটা অত্যন্ত জরুরি ছিল। এর আগে পর্যন্ত মুহাম্মদ (স) সম্ভবত ধরে নিয়েছিলেন যে ইহুদি ও ক্রিশ্চানরা একই ধর্মের অনুসারী, কিন্তু এবার তিনি জানলেন, ওদের পরস্পরের ভেতর মারাত্মক মতদ্বৈততা রয়েছে। আরবদের মতো বহিরাগতদের চোখে দুটো অবস্থার মাঝে তেমন একটা পার্থক্য ধরা পড়েনি; তোরাহ্ ও গস্পেলের অনুসারীরা র‍্যাবাইগণ কর্তৃক পরিবর্ধিত কথ্য আইন (Oral Law) ও ট্রিনিটির ব্লাসফেমাস মতবাদের মতো ভ্রান্ত বিষয়াদি আব্রাহামের খাঁটি ধর্ম বা হানিফায়াহয় যোগ করেছে ধরে নেওয়াটা যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল। মুহাম্মদ (স) আরও জানতে পারেন, ইহুদিদের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থে তাদের অবিশ্বাসী জাতি আখ্যায়িত করা হয়েছে যারা স্বর্ণ বাছুরের উপাসনা করার জন্যে পৌত্তলিকতায় ফিরে গিয়েছিল। ইহুদিদের বিরুদ্ধে কোরানের যুক্তিগুলো খুবই উন্নত, এতে বোঝা যায় ইহুদিদের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় মুসলিমরা নিজেদের কতটা হুমকির মুখে ভেবেছিল, যদিও কোরান তখনও জোরের সঙ্গে বলেছে যে পূর্ববর্তী প্রত্যাদেশের সকল জাতি’[৩২] ভ্রান্তিতে পড়েনি এবং সব ধর্মই আসলে এক।

মদীনার বন্ধুসুলভ ইহুদিদের কাছে মুহাম্মদ (স) আব্রাহামের জ্যেষ্ঠ পুত্র ইশমায়েলের কাহিনীও জানতে পারেন। বাইবেলের বর্ণনানুসারে উপপত্নী হ্যাঁগারের গর্ভে জন্ম নেওয়া আব্রাহামের এক ছেলে ছিল, কিন্তু সারাহর গর্ভে ইসাক জন্ম নেওয়ার পর তিনি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন এবং হ্যাঁগার ও ইশমাইলকে ত্যাগ করার দাবি তোলেন। আব্রাহামকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে ঈশ্বর তখন তাঁকে ইশমায়েল এক মহান জাতির পিতা বলে গণ্য হবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। আরবীয় ইহুদিরা স্থানীয় কিংবদন্তীও এর সঙ্গে জুড়ে দিয়ে বলেছিল যে, আব্রাহাম মক্কা উপত্যকায় হ্যাঁগার ও ইশমায়েলকে ফেলে যান, এখানে ঈশ্বর স্বয়ং তাদের দায়িত্ব নেন। শিশু ইশমায়েল তৃষ্ণায় ছটফট করার সময় তিনি পবিত্র যমযম কূপ উন্মোচিত করে দেন। পরে আব্রাহাম ইশমায়েলকে দেখতে আসেন; তারপর পিতা-পুত্র মিলে একমাত্র ঈশ্বরের প্রথম মন্দির কাবাহ নির্মাণ করেন। আরবজাতির পিতায় পরিণত হন ইশমায়েল, সুতরাং ইহুদিদের মতো তারাও আব্রাহামের বংশধর। এ কাহিনী নিঃসন্দেহে মধুর শুনিয়েছিল মুহাম্মদের (স) কানে: আরবদের নিজস্ব ঐশীগ্রন্থ উপহার দিচ্ছেন তিনি, এবার আদিপুরুষদের ধর্মানুরাগে তিনি তাদের ধর্মবিশ্বাসকে স্থাপন করতে পারবেন। ৬২৪ সালের জানুয়ারি মাসে যখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে মদীনার ইহুদিদের বৈরিতা স্থায়ী, স্বাধীনতার ঘোষণা দিল আল্লাহর নতুন ধর্ম। জেরুজালেমের বদলে মক্কার দিকে মুখ করে প্রার্থনা করার জন্যে মুসলিমদের নির্দেশ দিলেন মুহাম্মদ (স)। প্রার্থনার দিক (কিবলা) পরিবর্তনকে মুহাম্মদের (স) সর্বশ্রেষ্ঠ সৃজনশীল ক্রিয়া হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পুরোনো দুটো প্রত্যাদেশের ওপর অনির্ভরশীল মক্কার দিকে ফিরে প্রার্থনা করার মধ্য দিয়ে মুসলিমরা আভাসে জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা কোনও প্রতিষ্ঠিত ধর্মের অংশ নয়, বরং কেবল ঈশ্বরের কাছেই আত্মসমর্পণ করেছে। এক ঈশ্বরের ধর্মকে বিবদমান বিভিন্ন পক্ষে অশোভনভাবে বিভক্তকারী কোনও ক্ষুদ্র গোত্রে যোগ দিচ্ছে না তারা। তার বদলে আব্রাহামের আদি ধর্মে ফিরে যাচ্ছে, যিনি প্রথম মুসলিম ছিলেন এবং তাঁর পবিত্র গৃহ নির্মাণ করেছিলেন:

তাহারা বলে ‘ইয়াহুদি বা খৃস্টান হও, ঠিক পথ পাইবে।’ বল, বরং একনিষ্ঠ হইয়া আমা ইব্রাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ করিব এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তোমরা বল, আমরা আল্লাহতে ইমান রাখি এবং যাহা আমাদের প্রতি ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাহার বংশধরগণের প্রতি অবতীর্ণ হইয়াছে এবং যাহা তাহাদের প্রতিপালকে নিকট হইতে মুসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে দেওয়া হইয়াছে। আমরা তাহাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁহারই নিকট আত্মসমর্পণকারী। [৩৩]

স্বয়ং ঈশ্বরের চেয়ে সত্যের তুচ্ছ মানবীয় ব্যাখ্যা বেছে নেওয়া নিঃসন্দেহে পৌত্তলিকতা।

মুসলিমরা মুহাম্মদের (স) জন্ম তারিখ বা প্রথম প্রত্যাদেশের দিন থেকে তাদের বছর গণনা করে না-এসবে আসলে নতুনত্ব কিছু ছিল না-বরং হিজরার বছর থেকে (মদীনায় অভিবাসন) কাল গণনা করে থাকে, যখন মুসলিমরা ইসলামকে রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরিণত করে ইতিহাসে ঐশী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটাতে শুরু করেছিল। আমরা দেখেছি, কোরান শিক্ষা দেয় সকল ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির দায়িত্ব হচ্ছে ন্যায়বিচার ও সমতা ভিত্তিক একটা সমাজের জন্যে কাজ করা । প্রকৃতই মুসলিমরা তাদের রাজনৈতিক দায়িত্ব খুব গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। গোড়াতে রাজনৈতিক নেতা হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেননি মুহাম্মদ (স), কিন্তু অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহ আরবদের জন্যে সম্পূর্ণ নতুন এক রাজনৈতিক সমাধানের দিকে ঠেলে দিয়েছিল তাঁকে। হিজরা এবং ৬৩২ সালে পরলোকগমনের মধ্যবর্তী দশ বছর সময় কালে মুহাম্মদ (স) এবং প্রথম দিকের মুসলিমরা মদীনার প্রতিপক্ষ ও মক্কার কুরাইশদের বিরুদ্ধে টিকে থাকার তীব্র সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, এদের সবাই উম্মাহকে নিশ্চিহ্ন করতে প্রস্তুত ছিল। পশ্চিমে মুহাম্মদকে (স) প্রায়শঃই যুদ্ধবাজ ব্যক্তি হিসাবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে, যিনি অস্ত্রের জোরে অনিচ্ছুক বিশ্বের উপর ইসলাম চাপিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রাণের দায়ে লড়েছেন মুহাম্মদ (স) এবং কোরানে ন্যায়-যুদ্ধের ধর্মতত্ত্ব সৃষ্টি করছিলেন যার সঙ্গে অধিকাংশ ক্রিশ্চান একমত পোষণ করবে; তিনি কখনওই কাউকে তার ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেননি। প্রকৃতপক্ষে কোরান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, ধর্মের ব্যাপারে কোনও জবরদস্তি’ চলবে না। কোরানে যুদ্ধকে নিন্দনীয় বলা হয়েছে, আত্মরক্ষার যুদ্ধই কেবল ন্যায়-যুদ্ধ । কখনও কখনও উন্নত মূল্যবোধ রক্ষার স্বার্থে যুদ্ধ প্রয়োজন হয়ে পড়ে, যেমন ক্রিশ্চানরা হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রয়োজন বলে বিশ্বাস করেছিল। মুহাম্মদের (স) রাজনৈতিক যোগ্যতা ছিল খুবই উঁচু মানের। মুহাম্মদের জীবনের শেষ প্রান্তে অধিকাংশ আরবীয় গোত্র উম্মাহয় যোগ দিয়েছিল, যদিও মুহাম্মদ (স) ভালো করেই জানতেন যে তাদের ইসলাম হয় নামমাত্র বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাহ্যিক । ৬৩০ সালে মক্কা নগরীর দুয়ার মুহাম্মদের (স) জন্যে উন্মুক্ত হয়, বিনা রক্তপাতে তিনি নগরীর দখল লাভ করেন। ৬৩২ সালে পরলোকগমনের অল্পদিন আগে তিনি বিদায় হজ্জ সম্পাদন করেছিলেন, যার মাধ্যমে প্রাচীন আরবীয় পৌত্তলিক অনুষ্ঠান হজ্জের ইসলামিকরণ করে আরবদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় তীর্থ যাত্রাকে তার ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভে পরিণত করেন।

অনুকূল পরিস্থিতিতে জীবনে একবার হজ্জ পালন প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য। স্বাভাবিকভাবেই তীর্থযাত্রীরা মুহাম্মদকে (স) স্মরণ করে, কিন্তু এর আচার-অনুষ্ঠানগুলো পয়গম্বরের চেয়ে বরং আব্রাহাম, হ্যাঁগার ও ইশমায়েলের কথা তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যেই বোঝানো হয়েছে। বহিরাগতের চোখে এসব আচার অনুষ্ঠান অদ্ভুত ঠেকে-ভিনদেশী যেকোনও সামাজিক বা ধর্মীয় আচারের মতোই-কিন্তু এগুলো এক প্রবল ধর্মীয় অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে সক্ষম এবং অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ইসলামি আধ্যাত্মিকতার সাম্প্রদায়িক ও ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্যাদি তুলে ধরে। বর্তমানে নির্দিষ্ট সময়ে মক্কায় সমবেত হাজার হাজার তীর্থযাত্রীর অনেকেই আরব নয়, কিন্তু তারা প্রাচীন আরবীয় অনুষ্ঠানগুলোকে আপন করে নিতে পেরেছে। জাতি বা শ্রেণীর সকল ব্যবধান আড়ালকারী ঐতিহ্যবাহী তীর্থযাত্রার পোশাকে যখন তারা কাবাহয় সমবেত হয়, তাদের মনে অনুভূতি জাগে যে তারা দৈনন্দিন জীবনের অহমিকাপূর্ণ ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পেয়ে এমন এক গোষ্ঠীর সাথে মিশে গেছে যার লক্ষ্য এক, ভাবনা এক। উপাসনাগৃহের চারপাশে প্রদক্ষিণ শুরুর আগে সমবেত কণ্ঠে চিৎকার করে তারা বলতে থাকে, হে আল্লাহ তোমার সেবায় আমি হাজির।’ এই আনুষ্ঠানিকতার অবিচ্ছেদ্য অর্থ অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন ইরানি দার্শনিক আলি শরিয়তি:

প্রদক্ষিণ করতে করতে আপনি যখন কাবাহর নিকটবর্তী হন, আপনার মনে হবে একটা ক্ষীণ ধারা বিশাল এক নদীর সঙ্গে মিলিত হচ্ছে। এক স্রোতের ধাক্কায় মাটির সঙ্গে সম্পর্ক হারান আপনি। সহসা বানের জলে ভাসতে থাকেন। কেন্দ্রের কাছে যাবার পর মানুষের ভিড় আপনার ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করে যে নতুন জীবন লাভ করেন আপনি। এখন আপনি জনতার অংশ; এখন একজন মানুষ, জীবিত ও চিরন্তন…কাবাহ এই পৃথিবীর সূর্য যার মুখ আপনাকে এর কক্ষপথে টেনে নিয়ে যায়। আপনি এই বৈশ্বিক ব্যবস্থার অংশে পরিণত হয়ে যান। আল্লাহর চারপাশে প্রদক্ষিণ করতে গিয়ে অচিরেই নিজেকে বিস্মৃত হবেন আপনি…এমন একটা পদার্থে পরিণত হয়ে গেছেন আপনি যা ক্রমশঃ গলিত এবং অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এটা ভালোবাসার চরম এবং পরম চূড়া। [৩৪]

ইহুদি ও ক্রিশ্চানরা গোষ্ঠীগত আধ্যাত্মিকতার উপরও জোর দিয়েছে। হজ্জ প্রত্যেক ব্যক্তি মুসলিমকে উম্মাহর প্রেক্ষিতে ঈশ্বরকে কেন্দ্রে স্থাপন করে ব্যক্তিগত সংহতির একটা অভিজ্ঞতা দান করে। অধিকাংশ ধর্মের ক্ষেত্রেই শান্তি ও সমতা তীর্থযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; তীর্থযাত্রীরা একবার স্যাঙ্কচুয়্যারিতে পা রাখার পর সব ধরনের সহিংসতা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তীর্থযাত্রীরা একটা কীটও মারতে পারবে না, কর্কশ কণ্ঠে কথা বলবে না। এ কারণেই ১৯৮৭ সালের হজ্জ-এর সময় ইরানের তীর্থযাত্রীরা দাঙ্গা বাধানোর ফলে ৪০২ জন নিহত ও ৬৪৯ জন আহত হলে বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের মাঝে তীব্র ক্ষোভের জন্ম হয়েছিল।

৬৩২ সালের জুন মাসে স্বল্পকালীন অসুস্থতার পর অপ্রত্যাশিতভাবে পরলোকগমণ করেন মুহাম্মদ (স)। তাঁর পরলোকগমনের পর বেদুঈনদের কেউ কেউ উম্মাহর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের প্রয়াস পেয়েছিল, কিন্তু আরবের রাজনৈতিক ঐক্য ছিল অটুট। শেষ পর্যন্ত বিরূপ গোত্রগুলোও এক ঈশ্বরের ধর্ম গ্রহণ করে: মুহাম্মদের (স) বিস্ময়কর সাফল্য আরবদের দেখিয়েছে যে শত শত বছর ধরে তাদের উপকারে আসা পৌত্তলিকতাবাদ আধুনিক বিশ্বে বেকার। আল্লাহর ধর্ম সহমর্মিতার নীতির প্রচলন ঘটিয়েছিল যা ছিল অধিকতর উন্নত ধর্মের বৈশিষ্ট্য: ভ্রাতৃত্ববোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচার এর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি শক্তিশালী সাম্যবাদ ইসলামি আদর্শের বৈশিষ্ট্য হিসাবে অব্যাহত রয়ে যাবে ।

মুহাম্মদ (স) জীবদ্দশায় এখানে নারী-পুরুষের সাম্যও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল । বর্তমানে পাশ্চাত্যে কথায় কথায় ইসলামকে উৎপত্তিগতভাবে নারী বিদ্বেষী ধর্ম হিসাবে তুলে ধরা হয়, কিন্তু খৃস্টধর্মের মতো আল্লাহর ধর্মও আদিতে নারীদের পক্ষে ইতিবাচক ছিল। প্রাক-ইসলামি যুগ জাহিলিয়াহর সময় নারীদের প্রতি আরবদের মনোভাব অ্যাক্সিয়াল যুগ পূর্ববর্তী দৃষ্টিভঙ্গির মতো ছিল। উদাহরণ স্বরূপ, বহুগামিতা ছিল সাধারণ ব্যাপার, স্ত্রীরা যার যার বাবার বাড়িতে অবস্থান করত। অভিজাত নারীরা বিশেষ ক্ষমতা ও মর্যাদা ভোগ করতেন-যেমন মুহাম্মদের (স) প্রথম স্ত্রী খাদিজা অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী ছিলেন কিন্তু সংখ্যাগুরু নারীদের অবস্থান ছিল দাসদের সমপর্যায়ের; তাদের কোনও রাজনৈতিক বা মানবাধিকার ছিল না; শিশুকন্যা হত্যা ছিল সাধারণ ব্যাপার। মুহাম্মদের (স) প্রথমদিকের দীক্ষিতদের মাঝে নারীরা ছিল, তাদের মুক্তির পরিকল্পনা ছিল তাঁর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোরান কন্যাশিশু হত্যার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং মেয়ে সন্তান জন্ম নিলে শঙ্কিত হওয়ার কারণে আরবদের ভর্ৎসনা করেছে। কোরান নারীদের উত্তরাধিকার ও তালাকের বৈধ অধিকারও দিয়েছে: ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে পশ্চিমের নারীদের এর তুল্য কিছুই ছিল না । উম্মাহর কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে নারীদের উৎসাহিত করেছেন মুহাম্মদ (স); নারীরাও তাদের মতামত শোনা হবে এই আত্মবিশ্বাস হতে সরাসরি নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, একবার মদীনার নারীরা মুহাম্মদের (স) কাছে অভিযোগ জানাল যে, পুরুষরা কোরান পাঠে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে, তারা পুরুষদের নাগাল পেতে মুহাম্মদের (স) সাহায্য চাইল। মুহাম্মদ (স) সাহায্য করলেন। ওদের একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল, নারীরাও যেখানে ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সেখানে কোরান কেন কেবল পুরুষদের সম্বোধন করেছে। ফলে নারী-পুরুষ উভয়কে সম্বোধন করে এক প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়েছিল যাতে উভয় লিঙ্গের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সমতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে কোরান বারবার আলাদাভাবে নারীদের সম্বোধন করেছে, ইহুদি বা ক্রিশ্চান ধর্মগ্রন্থে যার নজীর বিরল।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, খৃস্টধর্মের মতো এই ধর্মটিও পুরুষদের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, তারা এমনভাবে বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা করেছে যা মুসলিম নারীদের পক্ষে নেতিবাচক। কোরান মর্যাদার প্রতীক হিসাবে কেবল মুহাম্মদের (স) স্ত্রীগণের জন্যেই পর্দার পরামর্শ দিয়েছে, সবার জন্যে নয়। অবশ্য সভ্য জগতে ইসলাম স্থান করে নেওয়ার পর মুসলিমরা নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদায় অবনমিতকারী ওইকুমিনের রেওয়াজ গ্রহণ করে। তারা মহিলাদের অবগুণ্ঠণে আড়াল করার ও পার্সিয়া ও ক্রিশ্চান বাইযান্তিয়ামের হেরেমে আলাদা করে রাখার রীতি গ্রহণ করে। এসব জায়গায় এভাবে নারীদের অবস্থা প্রান্তিক হয়ে গিয়েছিল। আব্বাসিয় খেলাফতের (৭৫০-১২৫৮) সময় নাগাদ মুসলিম নারীদের অবস্থা ইহুদি ও ক্রিশ্চান সমাজে তাদের স্বগোত্রীয়দের মতোই করুণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজ মুসলিম নারীবাদীরা পুরুষদের কোরানের আদি চেতনায় ফিরে যাবার আবেদন জানাচ্ছে।

এটা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, অন্যান্য ধর্ম বিশ্বাসের মতো ইসলামকেও নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে; এরই পরিণামে এর বিভিন্ন সেক্ট ও বিভক্তি দেখা দিয়েছে। এর প্রথমগুলো-সুন্নী ও শিয়াহ্নর মাঝে বিভক্তি-মুহাম্মদের (স) আকস্মিক মৃত্যুর পর নেতৃত্ব লাভের প্রতিযোগিতা থেকেই আঁচ করা গিয়েছিল। মুহাম্মদের (স) ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবু বকর সংখ্যাগরিষ্ঠ দ্বারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, কিন্তু কারও কারও মনে হয়েছে মুহাম্মদ (স) হয়তো চাচাত ভাই এবং মেয়েজামাই আলি ইবন আবি তালিবকেই উত্তরাধিকারী বা খলিফা হিসাবে দেখতে চাইতেন। আলি স্বয়ং আবু বকরের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তী কয়েক বছরে তাঁকেই প্রথম তিন খলিফা: আবু বকর, উমর ইবন আল-খাত্তাব এবং উসমান ইবন আফফানের নীতিমালায় অসন্তুষ্ট ভিন্ন মতাবলম্বীদের আনুগত্যের কেন্দ্র মনে হয়েছে। অবশেষে ৬৫৬ সালে আলি চতুর্থ খলিফা হন: শিয়ারা পরে তাঁকে উম্মাহর প্রথম ইমাম বা নেতা আখ্যায়িত করবে। নেতৃত্বের প্রশ্নে শিয়াহ্ ও সুন্নীদের বিভক্তি বিশ্বাসের চেয়ে বরং অধিকতর রাজনৈতিক ছিল; এর ফলে মুসলিম ধর্মে ঈশ্বর সম্পর্কিত এর ধারণাসহ রাজনীতির গুরুত্ব ঘোষিত হয়েছে। শিয়াহ-ই-আলি (আলির পক্ষাবলম্বী] সংখ্যালঘু রয়ে যায় ও প্রতিবাদসূচক এক ধর্মানুরাগের সৃষ্টি করে যা মুহাম্মদের (স) দৌহিত্র হুসাইন ইবন আলির করুণ পরিণতিতে মূর্ত হয়ে উঠেছে। হুসাইন উমাইয়া শাসন মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন (যিনি আলির মৃত্যুর পর খেলাফত দখল করেছিলেন) এবং উমাঈয়া খলিফা ইয়াযিদের ক্ষুদ্র একদল সমর্থকের হাতে ৬৮০ সালে আধুনিক ইরাকের কুফার কাছে কারবালা সমতলে নিহত হন। সকল মুসলিমই হুসাইনের হত্যাকাণ্ডকে স্মরণ করে শিহরিত হয়, কিন্তু তিনি শিয়াদেরই বিশেষ নেতায় পরিণত হয়েছেন, কখনও কখনও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে মৃত্যুতে বরণ করে নেওয়া যে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে, এ তারই উদাহরণ। মুসলিমরা আপন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা শুরু করে দিয়েছিল। প্রথম চারজন খলিফা কেবল বাইযান্তাইন ও পার্সিয়া সাম্রাজ্যের আরবদের মাঝে ইসলাম ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন, এ দুটো সাম্রাজ্যই তখন ছিল পতনোখ। কিন্তু উমাঈয়া খলিফাঁদের অধীনে সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকা অব্দি অব্যাহত থাকে, যার পেছনে আরব সাম্রাজ্যবাদ যতখানি প্রেরণা হিসাবে ক্রিয়াশীল ছিল, ধর্ম ততটা ছিল না।

নতুন সাম্রাজ্যের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্যে কারও ওপর বল প্রয়োগ করা হয়নি; প্রকৃতপক্ষে, মুহাম্মদের (স) পরলোকগমনের পর প্রায় শত বছর সময় কালে ধর্মান্তরকরণকে উৎসাহিত করতে দেখা যায়নি, ৭০০ সালের দিকে আইন করে এর ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছিল: মুসলিমরা বিশ্বাস করত যে ইহুদিবাদ যেমন জ্যাকবের বংশধরদের জন্যে, ইসলামও তেমনি আরবদের ধর্ম । কিতাবি জাতি বা আহল আল-কিতাব হিসাবে ইহুদি ও ক্রিশ্চানরা জিস্মি বা সংরক্ষিত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিসাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ করেছিল। আব্বাসিয় খলিফারা ধর্মান্তরকরণ উৎসাহিত করতে শুরু করলে তাদের সাম্রাজ্যে বহু সেমিটিক ও আর্য নতুন ধর্ম গ্রহণে আগ্রহী হয়ে ওঠে। খৃস্টধর্মে জেসাসের ব্যর্থতা এবং অসম্মানের মতো ইসলামের সাফল্যও গঠনমূলক ছিল। জাগতিক সাফল্যকে অবিশ্বাসকারী খৃস্টধর্মের মতো কোনও মুসলিমের ব্যক্তিগত ধর্মীয় জীবনে রাজনীতি বাহ্যিক কোনও ব্যাপার নয়। মুসলিমরা নিজেদের ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী একটা ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ গঠনে অঙ্গিকারাবদ্ধ মনে করে। উম্মাহর পবিত্র মূল্য রয়েছে, নির্যাতন ও অনাচার অবিচার থেকে মানবতাকে রক্ষার এই প্রয়াসকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভের এক নিদর্শন হিসাবে এর রাজনৈতিক স্বাস্থ্য একজন মুসলিমের আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে ক্রিশ্চানের জীবনে বিশেষ ধর্মতত্ত্বীয় মতামতের (ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট, মেথডিস্ট, ব্যাপ্টিস্ট) মতো অবস্থান দখল করে থাকে । ক্রিশ্চানদের চোখে রাজনীতির প্রতি মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি অদ্ভুত ঠেকে থাকলে, তাদের একথা ভাবা উচিত, তাদের দুর্বোধ্য ধর্মতত্ত্বীয় বিতর্কও ইহুদি ও মুসলিমদের কাছে সমান অদ্ভুত মনে হয়।

সুতরাং ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক বছরগুলোয় ঈশ্বরের প্রকৃতি সম্পর্কে মুসলিমদের চিন্তা বা অনুমান প্রায়শঃই খেলাফতের অবস্থা ও শাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত রাজনৈতিক উদ্বেগ হতে উদ্ভূত ছিল । খৃস্টধর্মে জেসাসের ব্যক্তিত্ব ও প্রকৃতি সম্পর্কিত বিতর্কের মতোই উম্মাহর নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি কে হবেন এবং তাঁর চরিত্র কেমন হওয়া উচিত, এ সম্পর্কিত জ্ঞানগর্ভ বিতর্ক ইসলামে একই রকম গঠনমূলক বলে প্রতিভাত হয়েছে। রাশিদুন (প্রথম চার ‘সঠিক পথে পরিচালিত’ খলিফা)-এর পর্যায় অতিক্রান্ত হওয়ার পর মুসলিমরা আবিষ্কার করে যে তারা মদীনার যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ক্ষুদ্র সমাজের বদলে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে বাস করছে। এক সম্প্রসারমান সাম্রাজ্যের অধিকর্তা তারা; নেতারা যেন ইহজাগতিকতা ও প্রলোভনে তাড়িত হচ্ছেন। অভিজাত সমাজে দুর্নীতি ও বিলাসিতা ছড়িয়ে পড়েছিল; দরবারের আচার পয়গম্বর ও তাঁর সহচরদের কৃচ্ছ্বতাপূর্ণ জীবন যাপনের চেয়ে একেবারে ভিন্ন রূপ নিয়েছিল। অধিকতর ধার্মিক মুসলিমরা কোরানের সাম্যবাদের বক্তব্য নিয়ে শাসনযন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে ইসলামকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক করে নেওয়ার প্রয়াস পেয়েছে। এতে বিভিন্ন সমাধান আর সেক্টের উদ্ভব হয়।

সর্বাধিক জনপ্রিয় সমাধানটি আবিষ্কার করেছিলেন আইনবিদ ও ট্র্যাডিশনিস্টবৃন্দ যারা মৃহাম্মদ (স) ও রাশিদুনদের আদর্শে প্রত্যাবর্তনের প্রয়াস পেয়েছিলেন। এর ফলে তোরাহ্র বিধিমালার অনুরূপ শরীয়াহ্ আইনের উদ্ভব ঘটে। এই আইন কোরান ও পয়গম্বরের জীবন ও বাণীর ওপর ভিত্তি করে প্রণীত। মুহাম্মদ (স) ও তাঁর প্রথম দিকের সহচরদের বাণী (হাদিস) এবং আচরণ (সুন্নাহ) সম্পর্কিত বিস্ময়কর সংখ্যাক কথ্য বিবরণী প্রচলিত ছিল, অষ্টম ও নবম শতকে বেশকজন সম্পাদক এগুলো সংগ্রহ করেন; এদের মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত কয়েকজন হলেন মুহাম্মদ ইবন ইসমাইল আল-বুখারি এবং মুসলিম ইবন আল হিজ্জাজ আল-কুশাই। যেহেতু মুহাম্মদ (স) পরিপূর্ণভাবে ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণ করেছেন বলে বিশ্বাস করা হয়, সুতরাং মুসলিমদের প্রতিদিনের জীবনে তার অনুসরণ করতে হবে। এভাবে কথায়, ভালোবাসায়, খাদ্য গ্রহণে, পরিচ্ছন্নতা ও উপাসনায় ঈশ্বরের প্রতি উন্মুক্ত মুহাম্মদের (স) জীবন অনুকরণ করার মধ্য দিয়ে ইসলামি পবিত্র আইন মুসলিমদের ঈশ্বরের নিকটবর্তী জীবন যাপনে সাহায্য করে থাকে। পয়গম্বরের আদর্শ অনুসরণ করে মুসলিমরা তাঁর মতো ঈশ্বরের নৈকট্য অর্জনের আশা করে। এভাবে একজন মুসলিম যখন সালাম আলাইকুম (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক) বলে অপরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে একটা সুন্নাহ অনুসরণ করে, যেমনটি মুহাম্মদ (স) স্বয়ং করতেন, যখন তারা জীবে দয়া প্রদর্শন করে, বা তাঁর মতো এতিম ও দরিদ্রদের প্রতি করুণা দেখায়, অন্যদের সঙ্গে আচরণে বিশ্বস্ত ও মহৎ হয়, তখন তাদের ঈশ্বরের স্মরণ হয়। বাহ্যিক আচার-আচরণকে শেষ কথা হিসাবে দেখা যাবে না, বরং তা কোরানে বর্ণিত ও স্বয়ং পয়গম্বরের দেখানো তাকওয়া বা ‘ঈশ্বর সচেতনতা অর্জনের উপায়, যাতে ঈশ্বরের সার্বক্ষণিক স্মরণ (জিকির) জড়িত। সুন্নাহ ও হাদিসের বৈধতা নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে: কোনও কোনওটাকে অন্যগুলোর চেয়ে অধিকতর বিশ্বস্ত মনে করা হয়। কিন্তু শেষ বিচারে এইসব বিবরণের ঐতিহাসিক সত্যতার চেয়ে এগুলো যে কাজে এসেছে। সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ: শত শত বছর ধরে লক্ষ লক্ষ মুসলিমের জীবনে এগুলো ঈশ্বরের পবিত্র বোধ জাগাতে সক্ষম হয়েছে।

পয়গম্বরের বাণী বা হাদিস প্রধানত দৈনন্দিন জীবনের বিষয়াবলীর সঙ্গে সম্পর্কিত, তবে অধিবাদ, সৃষ্টিতত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্বও রয়েছে। এসব বক্তব্যের বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বয়ং ঈশ্বর কর্তৃক সরাসরি মুহাম্মদের (স) কাছে উচ্চারিত বলে বিশ্বাস করা হয়। এসব হাদিস কুদসি (পবিত্র বিবরণ) বিশ্বাসীর মনে ঈশ্বরের অবস্থান ও উপস্থিতির ওপর জোর দেয়: উদাহরণ স্বরূপ, একটি সুবিখ্যাত হাদিস-এ কিছু পর্যায়ের উল্লেখ করা হয়েছে যা দিয়ে একজন মুসলিম ঐশ্বরিক উপস্থিতি অনুভব করতে পারে, যা বিশ্বাসীর মনে মূর্ত হয়েছে বলে মনে হয়। আপনাকে কোরান এবং শরিয়াহর নির্দেশাবলী পালনের মাধ্যমে শুরু করতে হবে, তারপর ধর্মানুরাগের স্বেচ্ছা কর্মকাণ্ডের দিকে অগ্রসর হবেন:

আমার নির্ধারিত দায়িত্ব কর্তব্য পালন করার মাধ্যমে আমার দাস আমার নিকটবর্তী হয়, যা আমার সর্বাধিক পছন্দনীয়। এবং আমার দাস অবশ্য পালনীয় কর্মকাণ্ডের দ্বারা আমার নিকটবর্তী হয়ে আমার ভালোবাসা অর্জন করে: আর আমি যখন তাকে ভালোবাসি, আমি তার কানে পরিণত হই যা দিয়ে সে শোনে, চোখে পরিণত হই, যা দিয়ে সে দেখে, হাত হয়ে যাই যা দিয়ে সে ধরে এবং পায়ে পরিণত হই যা দিয়ে সে হাঁটে। [৩৬]

.

ইহুদিবাদ ও খৃস্টধর্মের মতো দুৰ্জেয় ঈশ্বর এই জগতে অনুভূত এক সর্বব্যাপী সত্তা। মুসলিমরা অপর দুটি অপেক্ষাকৃত পুরোনো ধর্মের মতো একই রকম পদ্ধতিতে ঐশ্বরিক উপস্থিতির অনুভূতি গড়ে তুলতে পারে।

মুহাম্মদের (স) জীবনধারা অনুসরণ করে যারা এই ধরনের ধর্মানুরাগ গড়ে তোলে তাদের বলা হয় আহল আল-হাদিস বা ট্র্যাডিশনিস্ট। প্রচণ্ড সাম্যতার নীতির কারণে সাধারণ মানুষের কাছে এদের একটা আবেদন ছিল; উমাঈয়া ও আব্বাসিয়দের দরবারের বিলাসিতার বিরুদ্ধে ছিল তারা, কিন্তু শিয়াদের বিপ্লবাত্মক কৌশলের পক্ষাবলম্বন করেনি। খলিফার ব্যতিক্রমী আধ্যাত্মিক গুণাবলী প্রয়োজন থাকার কথা তারা বিশ্বাস করত নাঃ খলিফা কেবল একজন প্রশাসক। কিন্তু তারপরেও কোরান ও সুন্নাহর ঐশ্বরিক প্রকৃতির ওপর জোর দিয়ে প্রত্যেক মুসলিমকে অন্তস্থঃভাবে বিদ্রোহী ও চরম ক্ষমতার তীব্র বিরোধী ঈশ্বরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের উপায় বাতলে দিয়েছিল তারা। মধ্যস্থতাকারীর দায়িত্ব পালন করার জন্যে পুরোহিত গোষ্ঠীর কোনও প্রয়োজন স্বীকার করা হয়নি। প্রত্যেক মুসলিম তার নিয়তির জন্যে ঈশ্বরের কাছে দায়ী।

সর্বোপরি ট্যাডিশনিস্টরা শিক্ষা দিয়েছে যে, কোরান এক চিরন্তন বাস্তবতা, যা তোরাহ বা লোগোসের মতো স্বয়ং ঈশ্বরের সময়ের সূচনার আগেই এর অস্তিত্ব ছিল তার মনে। তাদের কোরানের অসৃষ্ট’র তত্ত্ব বোঝায় যে কোরান আবৃত্তি করার সময় মুসলিমরা সরাসরি অদৃশ্য ঈশ্বরের বাণী শুনতে পায় । কোরান তাদের অন্তস্তলে ঈশ্বরের উপস্থিতি প্রকাশ করে। এর পবিত্র বাণী আবৃত্তি করার সময় তাদের মুখে তাঁর বক্তব্য ধ্বনিত হয়, আর যখন তারা পবিত্র গ্রন্থটি হাতে নেয়, যেন স্বয়ং ঈশ্বরকেই স্পর্শ করে। প্রথম যুগের ক্রিশ্চানরাও ব্যক্তি জেসাস সম্পর্কে একই কথা ভেবেছিল:

যাহা আদি হইতে ছিল,
যাহা আমরা শুনিয়াছি,
যাহা স্বচক্ষে দেখিয়াছি,
যাহা নিরীক্ষণ করিয়াছি,
এবং স্বহস্তে স্পর্শ করিয়াছি,
জীবনের সেই বাক্যের বিষয়
লিখিতেছি।[৩৭]

জেসাস বা বাণীর প্রকৃত মর্যাদা বা অবস্থানের প্রশ্নটি ক্রিশ্চানদের যথেষ্ট যন্ত্রণা দিয়েছে। এবার মুসলিমদের মাঝে কোরানের প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক শুরু হবে: আরবী টেক্সট ঠিক কোন অর্থে প্রকৃত ঈশ্বরের বাণী? কোরানের এই মর্যাদা বৃদ্ধিকে কোনও কোনও মুসলিম ব্লাসফেমাস মনে করেছে, যেমনটি জেসাসকে লোগোসের মানব রূপ কল্পনা করায় কোনও কোনও ক্রিশ্চান মর্মপীড়া বোধ করেছিল।

অবশ্য শেষ পর্যন্ত শিয়ারা এমন সব ধারণা গড়ে তোলে যেগুলো খৃস্টিয় অবতারবাদেরই আরও কাছাকাছি। হুসাইনের করুণ মৃত্যুর পর শিয়ারা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, কেবল তার বাবা আলি ইবন আবি তালিবের বংশধররাই উম্মাহর নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য। এরা ইসলামেরই এক সুস্পষ্ট আলাদা গোত্রে পরিণত হয়। একাধারে চাচাত ভাই ও মেয়ে-জামাই হিসাবে মুহাম্মদের (স) সঙ্গে আলির রক্তের সম্পর্ক ছিল অনেক বেশি। যেহেতু মুহাম্মদের (স) কোনও ছেলেই শেষ পর্যন্ত বাঁচেনি, আলি ছিলেন তাঁর নিকটতম পুরুষ আত্মীয়। কোরানে পয়গম্বরদের প্রায়ই বংশধরদের জন্যে প্রার্থনা করতে দেখা যায়। স্বর্গীয় আশীর্বাদের এই ধারণাকে প্রসারিত করে শিয়ারা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, আলির পরিবারের মাধ্যমে কেবল মুহাম্মদের (স) পরিবারেরই ঈশ্বরের প্রকৃত জ্ঞান (ইলম) রয়েছে। কেবল তাঁরাই উম্মাহকে ঐশ্বরিক নির্দেশনা পৌঁছে দেওয়ার যোগ্যতা রাখেন। আলির কোনও বংশধর ক্ষমতাসীন হলে মুসলিমরা আবার ন্যায়বিচারের স্বর্ণযুগের আশা করতে পারবে ও ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী উম্মাহ পরিচালিত হবে।

ব্যক্তি আলির প্রতি ভক্তি বিস্ময়কর প্রাবল্য লাভ করায় কিছু চরমপন্থী শিয়াহ্ গ্রুপ আলি ও তার উত্তরসুরিদের স্বয়ং মুহাম্মদের (স) চেয়েও মর্যাদা সম্পন্ন অবস্থানে নিয়ে যাবে এবং প্রায় ঐশ্বরিক মর্যাদা দান করবে। তারা প্রাচীন পার্সি মনোনীত দেবতার বংশের পরিবারের ঐতিহ্য অনুসরণ করছিল, যে পরিবার বংশ পরম্পরায় স্বর্গীয় মহিমা বিস্তার করে চলেছে। উমাঈয়া আমলের শেষ দিকে কিছু কিছু শিয়াহ্ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে আলির বংশধরদের একটা বিশেষ ধারাতেই নির্ভরযোগ্য ইলম সীমাবদ্ধ। কেবল এই পরিবারেই মুসলিমরা ঈশ্বর মনোনীত উম্মাহর প্রকৃত ইমাম বা নেতার সন্ধান পাবে। তিনি ক্ষমতায় থাকুন বা না থাকুন, তাঁর পথ-নির্দেশনার কোনও বিকল্প নাই; সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব তার প্রতীক্ষায় থাকা; তাঁর নেতৃত্ব মেনে নেওয়া। যেহেতু এইসব ইমামকে আনুগত্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে দেখা হতো, তাই খলিফাঁদের চোখে তারা ছিলেন রাষ্ট্রের শত্রু: শিয়াহ্ ঐতিহ্য অনুসারে বেশ কয়েকজন ইমামকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়; কেউ কেউ আত্মগোপনে যেতেও বাধ্য হন। কোনও ইমাম পরলোকগমণের সময় আত্মীয়দের মধ্য হতে একজনকে তার ইলমের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যেতেন। আস্তে আস্তে ইমামগণ ঈশ্বরের অবতার হিসাবে পূজ্য হতে শুরু করলেন: তাঁদের প্রত্যেকে পৃথিবীর বুকে ঈশ্বরের উপস্থিতির প্রমাণ’ (হুজ্জাহ) ছিলেন ও রহস্যময় কোনও উপায়ে মানুষের মাঝে ঈশ্বরকে ধারণ করেছিলেন। তাঁর বাণী, সিদ্ধান্ত ও নির্দেশাবলী আসলে ঈশ্বরেরই বাণী, সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ। ক্রিশ্চানরা যেমন জেসাসকে ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়ার পথ, সত্য এবং আলো হিসাবে দেখেছিল, শিয়ারাও তাদের ইমামদের ঈশ্বরের কাছে যাবার দ্বার (বাব) এবং প্রত্যেক প্রজন্মের জন্যে পথ (সাবিল) এবং দিক নির্দেশনা মনে করে সম্মান দেখায়।

শিয়াদের বিভিন্ন শাখা আলাদা আলাদাভাবে স্বর্গীয় উত্তরাধিকার সন্ধান করেছে। উদাহরণস্বরূপ, টুয়েলভার’ (দ্বাদশবাদী) শিয়ারা হুসাইনের মাধ্যমে আগত ৯৩৯ সালে সর্বশেষ ইমাম আত্মগোপনে গিয়ে মানব সমাজ হতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আলির পরবর্তী বার প্রজন্মকে মর্যাদা দিয়েছে, তাঁর কোনও বংশধর ছিল না বলে এই ধারার পরিসমাপ্তি ঘটে। সেভেনারস (সপ্তবাদী) হিসাবে পরিচিত ইসমায়েলিরা বিশ্বাস করত, এদের মাঝে সপ্তম জনই শেষ ইমাম ছিলেন। দ্বাদশবাদীদের মাঝে এক ধরনের মেসিয়ানিক ধারা দেখা দিয়েছিল, এরা বিশ্বাস করত যে দ্বাদশ বা গোপন ইমাম স্বর্ণযুগের সূচনা করতে আবার ফিরে আসবেন। নিঃসন্দেহে এসব ধারণা বিপজ্জনক ছিল। এগুলো কেবল রাজনৈতিকভাবে দ্রোহমূলকই ছিল না, এগুলোকে খুব সহজেই আনাড়ি, সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। তো অধিকতর চরমপন্থী শিয়ারা কোরানের প্রতীকী ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে এক নিগূঢ় ধারা গড়ে তুলেছিল যা আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে দেখতে পাব । এদের ধর্মানুরাগ অধিকাংশ মুসলিমের পক্ষে দারুণ রকম দুর্বোধ্য ছিল, যারা এই অবতারবাদী ধারণাকে ক্লাসফেমাস মনে করেছে, ফলে শিয়াদের অস্তিত্ব অভিজাত শ্রেণী ও বুদ্ধিজীবীদের মাঝেই বেশি দেখা গেছে। ইরানি বিপ্লবের পর থেকে পশ্চিমে আমরা শিয়া মতবাদকে উৎপত্তিগতভাবে ইসলামের মৌলবাদী অংশ হিসাবে তুলে ধরতে প্ররোচিত হয়েছি, কিন্তু এধরনের সিদ্ধান্ত ঠিক নয়। শিয়া মতবাদ এক অভিজাত ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। আসলে, যেসব মুসলিম কোরানের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগতভাবে যৌক্তিক যুক্তিতর্ক প্রয়োগ করতে চেয়েছে শিয়াদের সঙ্গে যথেষ্ট মিল রয়েছে তাদের। মুতাযিলি নামে পরিচিত এই যুক্তিবাদীরা নিজস্ব আলাদা গ্রুপ গড়ে তুলেছিল; সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অঙ্গীকারও ছিল তাদের: শিয়াদের মতো মুতাযিলিরাও রাজদরবারের বিলাসিতার বিরুদ্ধে ছিল এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে ঘনঘন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠত।

রাজনৈতিক প্রশ্ন মানুষের জীবন ধারায় ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে এক ধর্মতত্ত্বীয় বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। উমাঈয়াদের সমর্থকরা প্রায় কপটতার সঙ্গে দাবি করেছিল যে, তাদের অনৈসলামিক আচরণের জন্যে তারা দায়ী নয়, কেননা ঈশ্বরই এভাবে তাদের নিয়তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ঈশ্বরের পরম শক্তি ও সর্বজ্ঞতার ব্যাপারে কোরানে জোরাল ধারণা রয়েছে; পূর্বনির্ধারিত এই নিয়তির সমর্থনে বহু টেক্সট খাড়া করা যেতে পারে। কিন্তু কোরান আবার সমানভাবে মানুষের দায়িত্ব সম্পর্কেও জোর দেয়: “নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনও জাতির অবস্থার পরিবর্তন ঘটান না যতক্ষণ না সে-জাতি নিজেদের অন্তরে পরিবর্তন ঘটায়। পরিণতিতে শাসকগোষ্ঠীর সমালোচকরা স্বাধীন ইচ্ছা ও নৈতিক দায়িত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। মুতাযিলিরা মধ্যপন্থা গ্রহণ (ইতাহু-আলাদা থাকা) করে চরম অবস্থান হতে নিজেদের সরিয়ে নেয়। মানুষের নৈতিক চরিত্র রক্ষার জন্যেই স্বাধীন ইচ্ছার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল তারা। যেসব মুসলিম ঈশ্বরকে ন্যায়-অন্যায়ের মানবীয় ধারণার ঊর্ধ্বে বলে বিশ্বাস করে, তারা তার ন্যায়বিচারের বিরোধিতা করেছে। যে ঈশ্বর কেবল ঈশ্বর হবার কারণে সকল সুনীতির লঙ্ঘন করে পার পেয়ে যান, তিনি আসলে দানব; স্বৈরাচারী খলিফার চেয়ে ভালো কিছু নন। শিয়াদের মতো মুতাযিলিরা ঘোষণা করেছিল যে, ন্যায়-বিচার ঈশ্বরের মূলসত্তা। তিনি কারও প্রতি অন্যায় করতে পারেন না; যুক্তি বিরোধী কোনও কিছুর নির্দেশ দিতেও পারেন না।

এখানেই ট্র্যাডিশনিস্টদের সঙ্গে তাদের বিরোধ সৃষ্টি হয়। ট্র্যাডিশনিস্টরা যুক্তি উপস্থাপন করে যে, মানুষকে আপন ভাগ্যের স্রষ্টা এবং নিয়ন্তা বানিয়ে তারা ঈশ্বরের সর্বময় ক্ষমতার অসম্মান করছে। তারা অভিযোগ তোলে, মুতাযিলিরা ঈশ্বরকে খুব বেশি যৌক্তিক ও বেশি রকম মানুষের মতো করে ফেলেছে । ঈশ্বরের অত্যাবশ্যকীয় দুর্বোধ্যতার ওপর জোর দেওয়ার জন্যেই পূর্বনির্ধারিত নিয়তির মতবাদ গ্রহণ করেছিল তারা: আমরা তাকে বোঝার দাবি করলে তিনি আর ঈশ্বর থাকবেন না, মানুষের তুচ্ছ কল্পনায় পরিণত হবেন । ঈশ্বর ভলো খারাপের মানবীয় ধ্যান-ধারণার উর্ধ্বে; তাকে আমাদের মান ও প্রত্যাশায় বন্দি করা যাবে নাঃ ঈশ্বরের নির্ধারিত বলেই কোনও কাজ ভালো বা খারাপ, স্বয়ং ঈশ্বরকে বাধ্য করার মতো এসব মানবীয় মূল্যবোধের দুয়ে মাত্রা আছে বলে নয়। মুতাযিলিদের পক্ষে একথা বলা ভুল ছিল যে পুরোপুরি মানবীয় আদর্শ ন্যায়-বিচারের ধারণা ঈশ্বরের মূল সত্তা। পূর্ব নির্ধারিত নিয়তি ও স্বাধীন ইচ্ছার সমস্যা, যা ক্রিশ্চানদেরও ভুগিয়েছে, ব্যক্তিক ঈশ্বরের ধারণার একটা কেন্দ্রীয় সমস্যার দিকে অঙুলি নির্দেশ করে। ব্রহ্মার মতো একজন নৈর্ব্যক্তিক ঈশ্বর ‘ভালো’ বা ‘খারাপে’র উর্ধ্বে অবস্থান করছেন, এটা অনায়াসে বলা যায়, যেগুলোকে দুয়ে ঈশ্বরের মুখোশ হিসাবে দেখা হয়। কিন্তু যে ঈশ্বর কোনও রহস্যময় উপায়ে একজন ব্যক্তি, যিনি মানুষের ইতিহাসে অংশ নেন, নিজেকে সমালোচনার পাত্রে পরিণত করেন তিনি। এই ‘ঈশ্বরকে জীবনের-চেয়ে-বৃহৎ স্বৈরাচারী বা বিচারক বানানো অত্যন্ত সহজ ও ‘তাকে দিয়ে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করানো যায়। ঈশ্বরকে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রিপাবলিকান বা সমাজতন্ত্রী, কিংবা বর্ণবাদী বা বিপ্লবী রূপ দিতে পারি। এই বিপদ অনেককে ব্যক্তিক ঈশ্বরকে ধর্মবিরোধী ধারণা হিসাবে দেখতে প্ররোচিত করেছে, কারণ এটা আমাদেরকে আমাদের সংস্কারে প্রোথিত করে ও আমাদের মানবীয় ধারণাকে পরম পর্যায়ে উন্নীত করে।

এই বিপদ এড়াতেই ট্র্যাডিশনিস্টরা ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের ব্যবহৃত কালোত্তীর্ণ ঈশ্বরের সত্তা ও তার কর্মকাণ্ডের মাঝে পার্থক্যের অবতারণা করেছে। তারা দাবি করে যে, যেসব গুণাবলী দুৰ্জেয় ঈশ্বরকে পার্থিব জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে সক্ষম করে তোলে-যেমন, ক্ষমতা, জ্ঞান, ইচ্ছা, শ্রবণ, দর্শন, বক্তব্য-কোরানে যেসব গুণ আল্লাহর বলে উল্লেখ আছে যেগুলো অসৃষ্ট কোরানের মতোই অনন্ত কাল ধরে ঈশ্বরের সঙ্গে অবস্থান করছে। এগুলো সব সময় আমাদের বোধগম্যতার অতীত রয়ে যাবে, যা ঈশ্বরের জ্ঞানাতীত সত্তার চেয়ে ভিন্ন। ঠিক ইহুদিরা যেমন ঈশ্বরের প্রজ্ঞা বা তোরাহ্ কালের সূচনার আগে থেকেই ঈশ্বরের সঙ্গে ছিল বলে কল্পনা করেছে, এবার মুসলিমরাও একইভাবে ঈশ্বরের ব্যক্তিত্ব সংক্রান্ত ধারণা গড়ে তুলতে শুরু করছিল এবং বোঝাতে চেয়েছে যে তাঁকে মানব মনে পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করা যাবে না। খলিফা আল মামুন (৮১৩-৮৩২) যদি মুতাযিলিদের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাদের ধারণাকেই মুসলিমদের রাষ্ট্রীয় মতবাদ ঘোষণার প্রয়াস না পেতেন, এই দুর্বোধ্য যুক্তি হয়তো বা মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোককেই প্রভাবিত করতে পারত। কিন্তু খলিফা মুতাযিলিদের বিশ্বাসকে চাপিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ট্রাডিশনিস্টদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন শুরু করলে সাধারণ মুসলিম জনগণ এই অনৈসলামিক আচরণে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। আহমাদ ইবন হানবাল (৭৮০-৮৫৫) নামে এক নেতৃস্থানীয় ট্র্যাডিশনিস্ট আল-মামুনের ইনকুইজিশন থেকে অল্পের জন্যে রেহাই পেয়ে জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর ধর্মপরায়ণতা ও ক্যারিশমা-নিপীড়কদের জন্যে প্রার্থনা করেছেন তিনি-খেলাফতকে চ্যালেঞ্জ করে ও অসৃষ্ট কোরান সংক্রান্ত তার বিশ্বাস মুতাযিলিদের যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণ-অভ্যুত্থানের মূল চেতনা হয়ে দাঁড়ায়।

ঈশ্বর সম্পর্কে কোনও রকম যৌক্তিক আলোচনার সমর্থনে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন ইবন হানবাল। এভাবে মধ্যপন্থী মুতাযিলি আল-হুঁয়াঈয়ান আল কারাবিসি (মৃ. ৮৫৯) যখন আপোসফার প্রস্তাব রাখলেন যে, ঈশ্বরের বাণী হিসাবে কোরান অসৃষ্ট, কিন্তু যখন তা মানবীয় ভাষায় প্রকাশ করা হয় তখন তা সৃষ্টিতে পরিণত হয়, ইবন হানবাল এই মতবাদের তীব্র নিন্দা জানান। আল কারাবিসি তাঁর মতবাদ আবার বদলাতে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি ঘোষণা দেন যে, কোরানের লিখিত ও উচ্চারিত আরবী যতক্ষণ ঈশ্বরের চিরকালীন বক্তব্যের ধারক ততক্ষণ অসৃষ্ট। কিন্তু ইবন হানবাল একেও অবৈধ ঘোষণা করেন, কেননা এরকম যুক্তিভিত্তিক উপায়ে কোরানের উৎস সম্পর্কে আঁচ-অনুমান করা অর্থহীন। অব্যক্ত ঈশ্বরকে জানতে যুক্তি লাগসই উপায় নয়। তিনি মুতাযিলিদের বিরুদ্ধে ঈশ্বরকে সব রকম রহস্যহীন করে ধর্মীয় মূল্যহীন এক বিমূর্ত ফরমুলায় পরিণত করার অভিযোগ আনেন। কোরান পৃথিবীতে ঈশ্বরের কর্মকাণ্ড বর্ণনা করার সময় যখন বলে যে ঈশ্বর বলেন এবং দেখেন এবং আরশে বসেন, ইবন হানবাল জোরে দিয়ে বলেন যে, এসবকে আক্ষরিক অর্থেই ব্যাখ্যা করতে হবে, কিন্তু কীভাবে ‘জিজ্ঞেস করা যাবে না’ (বিলা কাঈফ)। তাঁকে বোধ করি চরমপন্থী আথানাসিয়াসের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যিনি অধিকতর যুক্তিবাদী ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অবতারবাদের চরম ব্যাখ্যার ওপর বেশি জোর দিয়েছিলেন। ইবন হানবাল ঈশ্বরের অত্যাবশ্যক অনিবৰ্চনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন, যা সব ধরণের যুক্তি ও ধারণাগত বিশ্লেষণের অতীত একটা বিষয়।

কিন্তু কোরান তারপরেও ক্রমাগত বুদ্ধিবৃত্তি ও উপলব্ধির গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছে। ইবন হানবালের অবস্থান কিছুটা সরলমনা ছিল। বহু মুসলিমই একে বিকৃত ও অস্পষ্টতার দোষে আক্রান্ত মনে করেছে। আবু আল-হাসান ইবন ইসমাইল আল-আশারি (৮৭৮-৯১৪) এক আপোসরফার সন্ধান পেয়েছিলেন। মুতাযিলি ছিলেন তিনি, কিন্তু পরে এক স্বপ্নে পয়গম্বর কর্তৃক হাদিস পাঠ করার তাগিদ পেয়ে ট্র্যাডিশবাদে যোগ দেন। আল-আশারি এর পর সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে চলে গিয়ে অত্যুৎসাহী ট্র্যাডিশনিস্টে পরিণত হন। মুতাযিলিদের ইসলামের কলঙ্ক আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করেন তিনি। আবার স্বপ্নে মুহাম্মাকে (স) দেখেন তিনিঃ এ পর্যায়ে পয়গম্বরকে অসস্তুষ্টই দেখাচ্ছিল, তিনি বলেছিলেন: “আমি তোমাকে যৌক্তিক বিবেচনা বিসর্জন দিতে বলিনি, বরং সত্য হাদিসকে সমর্থন দিতে বলেছি! এরপর থেকে আল-আশারি ইবন হানবালের অজ্ঞাবাদী চেতনাকে সমর্থন করার জন্যে মুতাযিলিদের যৌক্তিক কৌশলের প্রয়োগ ঘটাতে শুরু করেছিলেন। মুতাযিলিদের যেখানে অভিমত ছিল যে, ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ অযৌক্তিক হতেই হুদ ও সালিহ পয়গম্বরের কথা উল্লেখ আছে। বর্তমানে মুসলিমরা জোরের সঙ্গে বলে যে মুহাম্মদ (স) হিন্দু ও বৃদ্ধদের কথা জানলে তাদের ধর্মগুরুদেরও অন্তর্ভুক্ত করতেন: তাঁর পরলোকগমনের পর ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের মতো ইসলামি সাম্রাজ্যে তাদেরও পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। একই নীতি অনুযায়ী, যুক্তি দেখায় মুসলিমরা, কোরান হয়তো আমেরিকান ইন্ডিয়ান বা অস্ট্রেলিয় আদিবাসীদের শামান বা পবিত্র ব্যাক্তিদেরও সম্মান প্রদর্শন করত।

ধর্মীয় অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকায় মুহাম্মদের (স) বিশ্বাস অচিরেই পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল। কুরাইশদের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর মক্কাবাসী মুসলিমদের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। গোত্রীয় নিরাপত্তাবিহীন দাস ও মুক্ত দাসরা এমন নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয় যে কয়েকজনের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে এবং মুহাম্মদের (স) ক্ল্যানকে বশ্যতা স্বীকার করানোর প্রয়াসে বয়কট পর্যন্ত করা হয়েছিল: এই বঞ্চনাই সম্ভবত মুহাম্মদ (স)-এর প্রাণপ্রিয়া স্ত্রী খাদিজার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদের (স) জীবনও বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে । উত্তরাঞ্চলের বসতি ইয়াসরিবের পৌত্তলিক অধিবাসীরা মুসলিমদের স্ব স্ব ক্ল্যান ত্যাগ করে সেখানে অভিবাসী হবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কোনও আরবের জন্যে এমন একটা পদক্ষেপ নেওয়া ছিল চরম নজীরবিহীন: আরবে গোত্রের পবিত্র একটা মূল্য ছিল, এই ধরনের পক্ষ ত্যাগ ছিল আবশ্যকীয় নীতিমালার লঙ্ঘন । বিভিন্ন গ্রোত্রীয় দলের মাঝে দৃশ্যতঃ অন্তহীন যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল ইয়াসরিব। পৌত্তলিকদের অনেকেই মরুদ্যানের সমস্যাদির রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক সমাধান হিসাবে ইসলাম গ্রহণে প্রস্তুত ছিল। বসতিতে ইহুদিদের বড় আকারের বেশ কয়েকটি গোত্র ছিল যারা একেশ্বরবাদ গ্রহণে পৌত্তলিকদের মানসিক ভূমিকে প্রস্তুত করে দিয়েছিল। এর মানে হচ্ছে, আরবীয় দেব-দেবীদের অসম্মানে কুরাইশদের মতো তারা আক্রান্ত বোধ করেনি। ৬২২ সালের গ্রীষ্মকালে যথারীতি প্রায় সত্তর জন মুসলিম সপরিবারে ইয়াসরিবের উদ্দেশে পাড়ি জমায়।

ইয়াসরিবে (বা মদীনা, অর্থাৎ শহর, মুসলিমরা পরে যে নামে ডাকবে) হিজরা বা অভিবাসনের আগের বছর মুহাম্মদ (স) ইহুদিবাদ সম্পর্কে উপলব্ধির আলোকে নিজের ধর্মকে এর আরও কাছাকাছি আনার উদ্দেশ্যে অভিযোজন করেন। বহু বছর একাকী কাজ করার পর তিনি হয়তো একটি প্রাচীন ও প্রতিষ্ঠত ঐতিহ্যের সদস্যদের সঙ্গে বসবাস করার প্রত্যাশী হয়ে উঠেছিলেন। এভাবেই ইহুদিদের প্রায়শ্চিত্ত দিবসে মুসলিমদের উপবাস পালনের নির্দেশ দেন তিনি এবং ইহুদিদের মতো দিনে তিনবার প্রার্থনা করার নিয়ম চালু করেন, এর আগে দিনে দুবার প্রার্থনা চলছিল। মুসলিমদের ইহুদি নারী বিয়ের অনুমতি ছিল; খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কিত কিছু নিয়মকানুন পালন করারও প্রয়োজন ছিল । সর্বোপরি, ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের মতো মুসলিমদেরও এখন অবশ্যই জেরুজালেমের দিকে মুখ করে প্রার্থনা করতে হবে। শুরুতে মদীনার ইহুদিরা মুহাম্মদকে (স) একটা সুযোগ দিতে তৈরি ছিল: মরুদ্যানের জীবনযাত্রা অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিল; মদীনার অসংখ্য গোঁড়া পৌত্তলিকদের মতো তারাও মুহাম্মদকে (স) সন্দেহাবসর দিতে চেয়েছিল, কেননা তিনি ইতিবাচকভাবে তাঁদের ধর্ম বিশ্বাসের দিকে ঝুঁকে ছিলেন। অবশ্য, শেষ পর্যন্ত তারা মুহাম্মদের (স) বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং মক্কা হতে আগত নবাগতদের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন পৌত্তলিকদের সঙ্গে যোগ দেয়। প্রত্যাখ্যানের পক্ষে ইহুদিদের শক্ত ধর্মীয় যুক্তি ছিল: পয়গম্বরত্বের যুগ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে বলে বিশ্বাস করত তারা। একজন মেসায়াহর অপেক্ষায় থাকলেও এ পর্যায়ে কোনও ইহুদি বা ক্রিশ্চান তারা পয়গম্বর হবেন বলে তারা বিশ্বাস করত না। কিন্তু তারপরেও রাজনৈতিক বিবেচনা থেকেও ওরা অনুপ্রাণিত হয়েছিল: আগের দিনে যুদ্ধরত আরব গোত্রগুলোর যে কোনও একটির পক্ষে যোগ দিয়ে ফায়দা লুটেছিল ওরা। মুহাম্মদ (স) অবশ্য এ দুটো গোত্রকেই নতুন মুসলিম উম্মাহয় কুরাইশদের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন-এক ধরনের অতি-গোত্র (Super tribe), ইহুদিরাও যার সদস্য ছিল। মদীনায় নিজেদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়তে দেখে ইহুদিরা বৈরী ভাবাপন্ন হয়ে পড়ে। তারা মুসলিমদের গল্প শুনে ঠাট্টা তামাশা করার উদ্দেশ্যে মসজিদে সমবেত হতো। ঐশীগ্রন্থ সম্পর্কে উন্নত ধারণা থাকায় কোরানের কাহিনীর ভুল খুঁজে বের করার কাজটা তাদের পক্ষে ছিল খুব সহজ, কিছু কিছু কাহিনীতে বাইবেলের ভাষ্যের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য রকম ভিন্নতা ছিল। মুহাম্মদের (স) পয়গম্বরত্বের দাবি নিয়েও টিটকারী দিত ওরা, বলত যে লোক নিজেকে পয়গম্বর দাবি করে অথচ উট হারিয়ে গেলে বলতে পারে না সেটা কোথায়-এতো বড়ই বেখাপ্পা ব্যাপার।

ইহুদিদের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়াটা সম্ভবত মুহাম্মদের (স) জীবনে সবচেয়ে বড় হতাশাব্যাঞ্জক ঘটনা ছিল; এতে তার ধর্মীয় অবস্থান প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোনও কোনও ইহুদি আবার বন্ধুসুলভ ছিল, তারা মুসলিমদের সঙ্গে সম্মানসূচক পদে যোগ দিয়েছিল। বাইবেল নিয়ে মুহাম্মদের (স) আলাপ-আলোচনা করে অন্য ইহুদিদের সমালোচনার জবাব বাতলে দিত তারা; ঐশীগ্রন্থ সম্পর্কে এই জ্ঞান মুহাম্মদকে (স) আপন দর্শন উন্নত করার ক্ষেত্রেও সাহায্য করেছে। প্রথমবারের মতো মুহাম্মদ (স) পয়গম্বরদের সঠিক পর্যায়ক্রম জানতে পারেন, এতদিন পর্যন্ত তার এ সংক্রান্ত ধারণা ছিল অস্পষ্ট । তিনি এবার বুঝতে পারেন যে, মোজেস বা জেসাসের আগেই আব্রাহামের আগমন ঘটা অত্যন্ত জরুরি ছিল। এর আগে পর্যন্ত মুহাম্মদ (স) সম্ভবত ধরে নিয়েছিলেন যে ইহুদি ও ক্রিস্টানরা একই ধর্মের অনুসারী, কিন্তু এবার তিনি জানলেন, ওদের পরস্পরের ভেতর মারাত্মক মতদ্বৈততা রয়েছে। আরবদের মতো বহিরাগতদের চোখে দুটো অবস্থার মাঝে তেমন একটা পার্থক্য ধরা পড়েনি; তোরাহ্ ও গস্পেলের অনুসারীরা র‍্যাবাইগণ কর্তৃক পরিবর্ধিত কথ্য আইন (Oral Law) ও ট্রিনিটির ব্লাসফেমাস মতবাদের মতো ভ্রান্ত বিষয়াদি আব্রাহামের খাঁটি ধর্ম বা হানিফায়াহয় যোগ করেছে ধরে নেওয়াটা যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল। মুহাম্মদ (স) আরও জানতে পারেন, ইহুদিদের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থে তাদের অবিশ্বাসী জাতি আখ্যায়িত করা হয়েছে যারা স্বর্ণ বাছুরের উপাসনা করার জন্যে পৌত্তলিকতায় ফিরে গিয়েছিল। ইহুদিদের বিরুদ্ধে কোরানের যুক্তিগুলো খুবই উন্নত, এতে বোঝা যায় ইহুদিদের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় মুসলিমরা নিজেদের কতটা হুমকির মুখে ভেবেছিল, যদিও কোরান তখনও জোরের সঙ্গে বলেছে যে পূর্ববর্তী প্রত্যাদেশের সকল জাতি[৩২] ভ্রান্তিতে পড়েনি এবং সব ধর্মই আসলে এক ।

মদীনার বন্ধুসুলভ ইহুদিদের কাছে মুহাম্মদ (স) আব্রাহামের জ্যেষ্ঠ পুত্র, ইশমায়েলের কাহিনীও জানতে পারেন। বাইবেলের বর্ণনানুসারে উপপত্নী হ্যাঁগারের গর্ভে জন্ম নেওয়া আব্রাহামের এক ছেলে ছিল, কিন্তু সারাহর গর্ভে ইসাক জন্ম নেওয়ার পর তিনি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন এবং হ্যাঁগার ও ইশমাইলকে ত্যাগ করার দাবি তোলেন। আব্রাহামকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে ঈশ্বর তখন তাকে ইশমায়েল এক মহান জাতির পিতা বলে গণ্য হবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। আরবীয় ইহুদিরা স্থানীয় কিংবদন্তীও এর সঙ্গে জুড়ে দিয়ে বলেছিল যে, আব্রাহাম মক্কা উপত্যকায় হ্যাঁগার ও ইশমায়েলকে ফেলে যান, এখানে ঈশ্বর স্বয়ং তাদের দায়িত্ব নেন। শিশু ইশমায়েল তৃষ্ণায় ছটফট করার সময় তিনি পবিত্র যমযম কূপ উন্মোচিত করে দেন। পরে আব্রাহাম ইশমায়েলকে দেখতে আসেন; তারপর পিতা-পুত্র মিলে একমাত্র ঈশ্বরের প্রথম মন্দির কাবাহ্ নির্মাণ করেন। আরবজাতির পিতায় পরিণত হন ইশমায়েল, সুতরাং ইহুদিদের মতো তারাও আব্রাহামের বংশধর। এ কাহিনী নিঃসন্দেহে মধুর শুনিয়েছিল মুহাম্মদের (স) কানে: আরবদের নিজস্ব ঐশীগ্রন্থ উপহার দিচ্ছেন তিনি, এবার আদিপুরুষদের ধর্মানুরাগে তিনি তাদের ধর্মবিশ্বাসকে স্থাপন করতে পারবেন। ৬২৪ সালের জানুয়ারি মাসে যখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে মদীনার ইহুদিদের বৈরিতা স্থায়ী, স্বাধীনতার ঘোষণা দিল আল্লাহর নতুন ধর্ম। জেরুজালেমের বদলে মক্কার দিকে মুখ করে প্রার্থনা করার জন্যে মুসলিমদের নির্দেশ দিলেন মুহাম্মদ (স)। প্রার্থনার দিক (কিবলা) পরিবর্তনকে মুহাম্মদের (স) সর্বশ্রেষ্ঠ সৃজনশীল ক্রিয়া হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পুরোনো দুটো প্রত্যাদেশের ওপর অনির্ভরশীল মক্কার দিকে ফিরে প্রার্থনা করার মধ্য দিয়ে মুসলিমরা আভাসে জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা কোনও প্রতিষ্ঠিত ধর্মের অংশ নয়, বরং কেবল ঈশ্বরের কাছেই আত্মসমর্পণ করেছে। এক ঈশ্বরের ধর্মকে বিবদমান বিভিন্ন পক্ষে অশোভনভাবে বিভক্তকারী কোনও ক্ষুদ্র গোত্রে যোগ দিচ্ছে না তারা। তার বদলে আব্রাহামের আদি ধর্মে ফিরে যাচ্ছে, যিনি প্রথম মুসলিম ছিলেন এবং তাঁর পবিত্র গৃহ নির্মাণ করেছিলেন:

তাহারা বলে ‘ইয়াহুদি বা খৃস্টান হও, ঠিক পথ পাইবে।’ বল, বরং একনিষ্ঠ হইয়া আম ইব্রাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ করিব এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তোমরা বল, আমরা আল্লাহতে ইমান। রাখি এবং যাহা আমাদের প্রতি ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাহার বংশধরগণের প্রতি অবতীর্ণ হইয়াছে এবং যাহা তাহাদের প্রতিপালকে নিকট হইতে মুসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে দেওয়া হইয়াছে। আমরা তাহাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁহারই নিকট আত্মসমর্পণকারী।[৩৩]

.

স্বয়ং ঈশ্বরের চেয়ে সত্যের তুচ্ছ মানবীয় ব্যাখ্যা বেছে নেওয়া নিঃসন্দেহে পৌত্তলিকতা।

মুসলিমরা মুহাম্মদের (স) জন্ম তারিখ বা প্রথম প্রত্যাদেশের দিন থেকে তাদের বছর গণনা করে না–এসবে আসলে নতুন কিছু ছিল না-বরং হিজরার বছর থেকে (মদীনায় অভিবাসন) কাল গণনা করে থাকে, যখন মুসলিমরা ইসলামকে রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরিণত করে ইতিহাসে ঐশী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটাতে শুরু করেছিল। আমরা দেখেছি, কোরান শিক্ষা দেয় সকল ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির দায়িত্ব হচ্ছে ন্যায়বিচার ও সমতা ভিত্তিক একটা সমাজের জন্যে কাজ করা। প্রকৃতই মুসলিমরা তাদের রাজনৈতিক দায়িত্ব খুব গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। গোড়াতে রাজনৈতিক নেতা হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেননি মুহাম্মদ (স), কিন্তু অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহ আরবদের জন্যে সম্পূর্ণ নতুন এক রাজনৈতিক সমাধানের দিকে ঠেলে দিয়েছিল তাঁকে। হিজরা এবং ৬৩২ সালে পরলোকগমনের মধ্যবর্তী দশ বছর সময় কালে মুহাম্মদ (স) এবং প্রথম দিকের মুসলিমরা মদীনার প্রতিপক্ষ ও মক্কার কুরাইশদের বিরুদ্ধে টিকে থাকার তীব্র সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, এদের সবাই উম্মাহকে নিশ্চিহ্ন করতে প্রস্তুত ছিল। পশ্চিমে মুহাম্মদকে (স) প্রায়শঃই যুদ্ধবাজ ব্যক্তি হিসাবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে, যিনি অস্ত্রের জোরে অনিচ্ছুক বিশ্বের উপর ইসলাম চাপিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রাণের দায়ে লড়েছেন মুহাম্মদ (স) এবং কোরানে ন্যায়-যুদ্ধের ধর্মতত্ত্ব সৃষ্টি করছিলেন যার সঙ্গে অধিকাংশ ক্রিশ্চান একমত পোষণ করবে; তিনি কখনওই কাউকে তাঁর ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেননি। প্রকৃতপক্ষে কোরান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, ধর্মের ব্যাপারে কোনও জবরদস্তি’ চলবে না। কোরানে যুদ্ধকে নিন্দনীয় বলা হয়েছে, আত্মরক্ষার যুদ্ধই কেবল ন্যায়-যুদ্ধ। কখনও কখনও উন্নত মূল্যবোধ রক্ষার স্বার্থে যুদ্ধ প্রয়োজন হয়ে পড়ে, যেমন ক্রিশ্চানরা হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রয়োজন বলে বিশ্বাস করেছিল। মুহাম্মদের (স) রাজনৈতিক যোগ্যতা ছিল খুবই উঁচু মানের। মুহাম্মদের জীবনের শেষ প্রান্তে অধিকাংশ আরবীয় গোত্র উম্মাহয় যোগ দিয়েছিল, যদিও মুহাম্মদ (স) ভালো করেই জানতেন যে তাদের ইসলাম হয় নামমাত্র বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাহ্যিক। ৬৩০ সালে মক্কা নগরীর দুয়ার মুহাম্মদের (স) জন্যে উন্মুক্ত হয়, বিনা রক্তপাতে তিনি নগরীর দখল লাভ করেন। ৬৩২ সালে পরলোকগমনের অল্পদিন আগে তিনি বিদায় হজ্জ সম্পাদন করেছিলেন, যার মাধ্যমে প্রাচীন আরবীয় পৌত্তলিক অনুষ্ঠান হজ্জের ইসলামিকরণ করে আরবদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় তীর্থ যাত্রাকে তাঁর ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভে পরিণত করেন ।

অনুকূল পরিস্থিতিতে জীবনে একবার হজ্জ পালন প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য। স্বাভাবিকভাবেই তীর্থযাত্রীরা মুহাম্মদকে (স) স্মরণ করে, কিন্তু এর আচার-অনুষ্ঠানগুলো পয়গম্বরের চেয়ে বরং আব্রাহাম, হ্যাঁগার ও ইশমায়েলের কথা তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যেই বোঝানো হয়েছে। বহিরাগতের চোখে এসব আচার অনুষ্ঠান অদ্ভুত ঠেকেভিনদেশী যেকোনও সামাজিক বা ধর্মীয় আচারের মতোই-কিন্তু এগুলো এক প্রবল ধর্মীয় অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে সক্ষম এবং অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ইসলামি আধ্যাত্মিকতার সাম্প্রদায়িক ও ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্যাদি তুলে ধরে। বর্তমানে নির্দিষ্ট সময়ে মক্কায় সমবেত হাজার হাজার তীর্থযাত্রীর অনেকেই আরব নয়, কিন্তু তারা প্রাচীন আরবীয় অনুষ্ঠানগুলোকে আপন করে নিতে পেরেছে। জাতি বা শ্রেণীর সকল ব্যবধান আড়ালকারী ঐতিহ্যবাহী তীর্থযাত্রার পোশাকে যখন তারা কাবাহয় সমবেত হয়, তাদের মনে অনুভূতি জাগে যে তারা দৈনন্দিন জীবনের অহমিকাপূর্ণ ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পেয়ে এমন এক গোষ্ঠীর সাথে মিশে গেছে যার লক্ষ্য এক, ভাবনা এক। উপাসনাগৃহের চারপাশে প্রদক্ষিণ শুরুর আগে সমবেত কণ্ঠে চিৎকার করে তারা বলতে থাকে, হে আল্লাহ তোমার সেবায় আমি হাজির।’ এই আনুষ্ঠানিকতার অবিচ্ছেদ্য অর্থ অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন ইরানি দার্শনিক আলি শরিয়তি:

প্রদক্ষিণ করতে করতে আপনি যখন কাবাহর নিকটবর্তী হন, আপনার মনে হবে একটা ক্ষীণ ধারা বিশাল এক নদীর সঙ্গে মিলিত হচ্ছে। এক স্রোতের ধাক্কায় মাটির সঙ্গে সম্পর্ক হারান আপনি। সহসা বানের জলে ভাসতে থাকেন। কেন্দ্রের কাছে যাবার পর মানুষের ভিড় আপনার ওপর। এমন চাপ সৃষ্টি করে যে নতুন জীবন লাভ করেন আপনি। এখন আপনি জনতার অংশ; এখন একজন মানুষ, জীবিত ও চিরন্তন…কাবাহ এই পৃথিবীর সূর্য যার মুখ আপনাকে এর কক্ষপথে টেনে নিয়ে যায়। আপনি। এই বৈশ্বিক ব্যবস্থার অংশে পরিণত হয়ে যান। আল্লাহর চারপাশে প্রদক্ষিণ করতে গিয়ে অচিরেই নিজেকে বিস্মৃত হবেন আপনি…এমন একটা পদার্থে পরিণত হয়ে গেছেন আপনি যা ক্রমশঃ গলিত এবং অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এটা ভালোবাসার চরম এবং পরম চূড়া।[৩৪]

.

ইহুদি ও ক্রিশ্চানরা গোষ্ঠীগত আধ্যাত্মিকতার উপরও জোর দিয়েছে। হজ্জ প্রত্যেক ব্যক্তি মুসলিমকে উম্মাহর প্রেক্ষিতে ঈশ্বরকে কেন্দ্রে স্থাপন করে ব্যক্তিগত সংহতির একটা অভিজ্ঞতা দান করে। অধিকাংশ ধর্মের ক্ষেত্রেই শান্তি ও সমতা তীর্থযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; তীর্থযাত্রীরা একবার স্যাঙ্কচুয়্যারিতে পা রাখার পর সব ধরনের সহিংসতা নিষিদ্ধ হয়ে যায় । তীর্থযাত্রীরা একটা কীটও মারতে পারবে না, কর্কশ কণ্ঠে কথা বলবে না। এ কারণেই ১৯৮৭ সালের হজ্জ-এর সময় ইরানের তীর্থযাত্রীরা দাঙ্গা বাধানোর ফলে ৪০২ জন নিহত ও ৬৪৯ জন আহত হলে বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের মাঝে তীব্র ক্ষোভের জন্ম হয়েছিল।

৬৩২ সালের জুন মাসে স্বল্পকালীন অসুস্থতার পর অপ্রত্যাশিতভাবে পরলোকগমণ করেন মুহাম্মদ (স)। তাঁর পরলোকগমনের পর বেদুঈনদের কেউ কেউ উম্মাহর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের প্রয়াস পেয়েছিল, কিন্তু আরবের রাজনৈতিক ঐক্য ছিল অটুট। শেষ পর্যন্ত বিরূপ গোত্রগুলোও এক ঈশ্বরের ধর্ম গ্রহণ করে: মুহাম্মদের (স) বিস্ময়কর সাফল্য আরবদের দেখিয়েছে যে শত শত বছর ধরে তাদের উপকারে আসা পৌত্তলিকতাবাদ আধুনিক বিশ্বে বেকার। আল্লাহর ধর্ম সহমর্মিতার নীতির প্রচলন ঘটিয়েছিল যা ছিল অধিকতর উন্নত ধর্মের বৈশিষ্ট্য: ভ্রাতৃত্ববোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচার এর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি শক্তিশালী সাম্যবাদ ইসলামি আদর্শের বৈশিষ্ট্য হিসাবে অব্যাহত রয়ে যাবে।

মুহাম্মদ (স) জীবদ্দশায় এখানে নারী-পুরুষের সাম্যও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল । বর্তমানে পাশ্চাত্যে কথায় কথায় ইসলামকে উৎপত্তিগতভাবে নারী বিদ্বেষী ধর্ম হিসাবে তুলে ধরা হয়, কিন্তু খৃস্টধর্মের মতো আল্লাহর ধর্মও আদিতে নারীদের পক্ষে ইতিবাচক ছিল। প্রাক-ইসলামি যুগ জাহিলিয়ার সময় নারীদের প্রতি আরবদের মনোভাব অ্যাক্সিয়াল যুগ পূর্ববর্তী দৃষ্টিভঙ্গির মতো ছিল। উদাহরণ স্বরূপ, বহুগামিতা ছিল সাধারণ ব্যাপার, স্ত্রীরা যার যার বাবার বাড়িতে অবস্থান করত। অভিজাত নারীরা বিশেষ ক্ষমতা ও মর্যাদা ভোগ করতেন-যেমন মুহাম্মদের (স) প্রথম স্ত্রী খাদিজা অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী ছিলেন-কিন্তু সংখ্যাগুরু নারীদের অবস্থান ছিল দাসদের সমপর্যায়ের; তাদের কোনও রাজনৈতিক বা মানবাধিকার ছিল না; শিশুকন্যা হত্যা ছিল সাধারণ ব্যাপার। মুহাম্মদের (স) প্রথমদিকের দীক্ষিতদের মাঝে নারীরা ছিল, তাদের মুক্তির পরিকল্পনা ছিল তাঁর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোরান কন্যাশিশু হত্যার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং মেয়ে সন্তান জন্ম নিলে শঙ্কিত হওয়ার কারণে আরবদের ভৎর্সনা করেছে। কোরান নারীদের উত্তরাধিকার ও তালাকের বৈধ অধিকারও দিয়েছে: ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে পশ্চিমের নারীদের এর তুল্য কিছুই ছিল না। উম্মাহর কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে নারীদের উৎসাহিত করেছেন মুহাম্মদ (স); নারীরাও তাদের মতামত শোনা হবে এই আত্মবিশ্বাস হতে সরাসরি নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, একবার মদীনার নারীরা মুহাম্মদের (স) কাছে অভিযোগ জানাল যে, পুরুষরা কোরান পাঠে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে, তারা পুরুষদের নাগাল পেতে মুহাম্মদের (স) সাহায্য চাইল। মুহাম্মদ (স) সাহায্য করলেন। ওদের একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল, নারীরাও যেখানে ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে সেখানে কোরান কেন কেবল পুরুষদের সম্বোধন করেছে। ফলে নারী-পুরুষ উভয়কে সম্বোধন করে এক প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়েছিল যাতে উভয় লিঙ্গের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সমতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে কোরান বারবার আলাদাভাবে নারীদের সম্বোধন করেছে, ইহুদি বা ক্রিশ্চান ধর্মগ্রন্থে যার নজীর বিরল।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, খৃস্টধর্মের মতো এই ধর্মটিও পুরুষদের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, তারা এমনভাবে বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা করেছে যা মুসলিম নারীদের পক্ষে নেতিবাচক। কোরান মর্যাদার প্রতীক হিসাবে কেবল মুহাম্মদের (স) স্ত্রীগণের জন্যেই পর্দার পরামর্শ দিয়েছে, সবার জন্যে নয়। অবশ্য সভ্য জগতে ইসলাম স্থান করে নেওয়ার পর মুসলিমরা নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদায় অবনমিতকারী ওইকুমিনের রেওয়াজ গ্রহণ করে। তারা মহিলাদের অবগুণ্ঠণে আড়াল করার ও পার্সিয়া ও ক্রিশ্চান বাইযান্তিয়ামের হেরেমে আলাদা করে রাখার রীতি গ্রহণ করে। এসব জায়গায় এভাবে নারীদের অবস্থা প্রান্তিক হয়ে গিয়েছিল। আব্বাসিয় খেলাফতের (৭৫০-১২৫৮) সময় নাগাদ মুসলিম নারীদের অবস্থা ইহুদি ও ক্রিশ্চান সমাজে তাদের স্বগোত্রীয়দের মতোই করুণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজ মুসলিম নারীবাদীরা পুরুষদের কোরানের আদি চেতনায় ফিরে যাবার আবেদন জানাচ্ছে।

এটা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, অন্যান্য ধর্ম বিশ্বাসের মতো ইসলামকেও নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে; এরই পরিণামে এর বিভিন্ন সেক্ট ও বিভক্তি দেখা দিয়েছে। এর প্রথমগুলো-সুন্নী ও শিয়ার মাঝে বিভক্তি-মুহাম্মদের (স) আকস্মিক মৃত্যুর পর নেতৃত্ব লাভের প্রতিযোগিতা থেকেই আঁচ করা গিয়েছিল । মুহাম্মদের (স) ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবু বকর সংখ্যাগরিষ্ঠ দ্বারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, কিন্তু কারও কারও মনে হয়েছে মুহাম্মদ (স) হয়তো চাচাত ভাই এবং মেয়েজামাই আলি ইবন আবি তালিবকেই উত্তরাধিকারী বা খলিফা হিসাবে দেখতে চাইতেন। আলি স্বয়ং আবু বকরের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তী কয়েক বছরে তাঁকেই প্রথম তিন খলিফা: আবু বকর, উমর ইবন আল-খাত্তাব এবং উসমান ইবন আফফানের নীতিমালায় অসন্তুষ্ট ভিন্ন মতাবলম্বীদের আনুগত্যের কেন্দ্র মনে হয়েছে। অবশেষে ৬৫৬ সালে আলি চতুর্থ খলিফা হন: শিয়াহ পরে তাঁকে উম্মাহর প্রথম ইমাম বা নেতা আখ্যায়িত করবে। নেতৃত্বের প্রশ্নে শিয়াহ্ ও সুন্নীদের বিভক্তি বিশ্বাসের চেয়ে বরং অধিকতর রাজনৈতিক ছিল; এর ফলে মুসলিম ধর্মে ঈশ্বর সম্পর্কিত এর ধারণাসহ রাজনীতির গুরুত্ব ঘোষিত হয়েছে। শিয়াহ-ই-আলি (আলির পক্ষাবলম্বী] সংখ্যালঘু রয়ে যায় ও প্রতিবাদসূচক এক ধর্মানুরাগের সৃষ্টি করে যা মুহাম্মদের (স) দৌহিত্র হুসাইন ইবন আলির করুণ পরিণতিতে মূর্ত হয়ে উঠেছে। হুসাইন উমাঈয়া শাসন মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন (যিনি আলির মৃত্যুর পর খেলাফত দখল করেছিলেন) এবং উমাঈয়া খলিফা ইয়াযিদের ক্ষুদ্র একদল সমর্থকের হাতে ৬৮০ সালে আধুনিক ইরাকের কুফার কাছে কারবালা সমতলে নিহত হন। সকল মুসলিমই হুসাইনের হত্যাকাণ্ডকে স্মরণ করে শিহরিত হয়, কিন্তু তিনি শিয়াদেরই বিশেষ নেতায় পরিণত হয়েছেন, কখনও কখনও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে মৃত্যুতে বরণ করে নেওয়া যে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে, এ তারই উদাহরণ। মুসলিমরা আপন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা শুরু করে দিয়েছিল। প্রথম চারজন খলিফা কেবল বাইন্তাইন ও পার্সিয়া সাম্রাজ্যের আরবদের মাঝে ইসলাম ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন, এ দুটো সাম্রাজ্যই তখন ছিল পতনোন্মুখ। কিন্তু উমাইয়া খলিফাঁদের অধীনে সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকা অব্দি অব্যাহত থাকে, যার পেছনে আরব সাম্রাজ্যবাদ যতখানি প্রেরণা হিসাবে ক্রিয়াশীল ছিল, ধর্ম ততটা ছিল না।

নতুন সাম্রাজ্যের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্যে কারও ওপর বল প্রয়োগ করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, মুহাম্মদের (স) পরলোকগমনের পর প্রায় শত বছর সময় কালে ধর্মান্তরকরণকে উৎসাহিত করতে দেখা যায়নি, ৭০০ সালের দিকে আইন করে এর ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছিল: মুসলিমরা বিশ্বাস করত যে ইহুদিবাদ যেমন জ্যাকবের বংশধরদের জন্যে, ইসলামও তেমনি আরবদের ধর্ম। কিতাবি জাতি বা আহল আল-কিতাব হিসাবে ইহুদি ও ক্রিশ্চানরা জিস্মি বা সংরক্ষিত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিসাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ করেছিল। আব্বাসিয় খলিফারা ধর্মান্তরকরণ উৎসাহিত করতে শুরু করলে তাদের সাম্রাজ্যে বহু সেমিটিক ও আর্য নতুন ধর্ম গ্রহণে আগ্রহী হয়ে ওঠে। খৃস্টধর্মে জেসাসের ব্যর্থতা এবং অসম্মানের মতো ইসলামের সাফল্যও গঠনমূলক ছিল। জাগতিক সাফল্যকে অবিশ্বাসকারী খৃস্টধর্মের মতো কোনও মুসলিমের ব্যক্তিগত ধর্মীয় জীবনে রাজনীতি বাহ্যিক কোনও ব্যাপার নয়। মুসলিমরা নিজেদের ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী একটা ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ গঠনে অঙ্গিকারাবদ্ধ মনে করে । উম্মাহর পবিত্র মূল্য রয়েছে, নির্যাতন ও অনাচার অবিচার থেকে মানবতাকে রক্ষার এই প্রয়াসকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভের এক নিদর্শন হিসাবে এর রাজনৈতিক স্বাস্থ্য একজন মুসলিমের আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে ক্রিশ্চানের জীবনে বিশেষ ধর্মতত্ত্বীয় মতামতের (ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট, মেথডিস্ট, ব্যাপ্টিস্ট) মতো অবস্থান দখল করে থাকে। ক্রিশ্চানদের চোখে রাজনীতির প্রতি মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি অদ্ভুত ঠেকে থাকলে, তাদের একথা ভাবা উচিত, তাদের দুর্বোধ্য ধর্মতত্ত্বীয় বিতর্কও ইহুদি ও মৃসলিমদের কাছে সমান অদ্ভুত মনে হয় ।

সুতরাং ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক বছরগুলোয় ঈশ্বরের প্রকৃতি সম্পর্কে মুসলিমদের চিন্তা বা অনুমান প্রায়শঃই খেলাফতের অবস্থা ও শাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত রাজনৈতিক উদ্বেগ হতে উদ্ভুত ছিল। খৃস্টধর্মে জেসাসের ব্যক্তিত্ব ও প্রকৃতি সম্পর্কিত বিতর্কের মতোই উম্মাহর নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি কে হবেন এবং তার চরিত্র কেমন হওয়া উচিত, এ সম্পর্কিত জ্ঞানগর্ভ বিতর্ক ইসলামে একই রকম গঠনমূলক বলে প্রতিভাত হয়েছে। রাশিদুন (প্রথম চার ‘সঠিক পথে পরিচালিত’ খলিফা)-এর পর্যায় অতিক্রান্ত হওয়ার পর মুসলিমরা আবিষ্কার করে যে তারা মদীনার যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ক্ষুদ্র সমাজের বদলে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে বাস করছে। এক সম্প্রসারমান সাম্রাজ্যের অধিকর্তা তারা; নেতারা যেন ইহজাগতিকতা ও প্রলোভনে তাড়িত হচ্ছেন। অভিজাত সমাজে দুর্নীতি ও বিলাসিতা ছড়িয়ে পড়েছিল; দরবারের আচার পয়গম্বর ও তাঁর সহচরদের কৃচ্ছ্বতাপূর্ণ জীবন যাপনের চেয়ে একেবারে ভিন্ন রূপ নিয়েছিল। অধিকতর ধার্মিক মুসলিমরা কোরানের সাম্যবাদের বক্তব্য নিয়ে শাসনযন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে ইসলামকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক করে নেওয়ার প্রয়াস পেয়েছে। এতে বিভিন্ন সমাধান আর সেক্টের উদ্ভব হয়।

সর্বাধিক জনপ্রিয় সমাধানটি আবিষ্কার করেছিলেন আইনবিদ ও ট্র্যাডিশনিস্টবৃন্দ যারা মুহাম্মদ (স) ও রাশিদুনদের আদর্শে প্রত্যাবর্তনের প্রয়াস পেয়েছিলেন। এর ফলে তোরাহ্র বিধিমালার অনুরূপ শরীয়াহ্ আইনের উদ্ভব ঘটে। এই আইন কোরান ও পয়গম্বরের জীবন ও বাণীর ওপর ভিত্তি করে প্রণীত। মুহাম্মদ (স) ও তাঁর প্রথম দিকের সহচরদের বাণী (হাদিস) এবং আচরণ (সুন্নাহ) সম্পর্কিত বিস্ময়কর সংখ্যাক কথ্য বিবরণী প্রচলিত ছিল, অষ্টম ও নবম শতকে বেশকজন সম্পাদক এগুলো সংগ্রহ করেন। এদের মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত কয়েকজন হলেন মুহাম্মদ ইবন ইসমাইল আল-বুখারি এবং মুসলিম ইবন আল হিজ্জাজ আল-কুশাই। যেহেতু মুহাম্মদ (স) পরিপূর্ণভাবে ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণ করেছেন বলে বিশ্বাস করা হয়, সুতরাং মুসলিমদের প্রতিদিনের জীবনে তার অনুসরণ করতে হবে। এভাবে কথায়, ভালোবাসায়, খাদ্য গ্রহণে, পরিচ্ছন্নতা ও উপাসনায় ঈশ্বরের প্রতি উন্মুক্ত মুহাম্মদের (স) জীবন অনুকরণ করার মধ্য দিয়ে ইসলামি পবিত্র আইন মুসলিমদের ঈশ্বরের নিকটবর্তী জীবন যাপনে সাহায্য করে থাকে। পয়গম্বরের আদর্শ অনুসরণ করে মুসলিমরা তাঁর মতো ঈশ্বরের নৈকট্য অর্জনের আশা করে। এভাবে একজন মুসলিম যখন সালাম আলাইকুম (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক) বলে অপরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে একটা সুন্নাহ অনুসরণ করে, যেমনটি মুহাম্মদ (স) স্বয়ং করতেন, যখন তারা জীবে দয়া প্রদর্শন করে, বা তাঁর মতো এতিম ও দরিদ্রদের প্রতি করুণা দেখায়, অন্যদের সঙ্গে আচরণে বিশ্বস্ত ও মহৎ হয়, তখন তাদের ঈশ্বরের স্মরণ হয়। বাহ্যিক আচার-আচরণকে শেষ কথা হিসাবে দেখা যাবে না, বরং তা কোরানে বর্ণিত ও স্বয়ং পয়গম্বরের দেখানো তাকওয়া বা ঈশ্বর সচেতনতা অর্জনের উপায়, যাতে ঈশ্বরের সার্বক্ষণিক স্মরণ (জিকির) জড়িত। সুন্নাহ ও হাদিসের বৈধতা নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে: কোনও কোনওটাকে অন্যগুলোর চেয়ে অধিকতর বিশ্বস্ত মনে করা হয়। কিন্তু শেষ বিচারে এইসব বিবরণের ঐতিহাসিক সত্যতার চেয়ে এগুলো যে কাজে এসেছে সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ: শত শত বছর ধরে লক্ষ লক্ষ মুসলিমের জীবনে এগুলো ঈশ্বরের পবিত্র বোধ জাগাতে সক্ষম হয়েছে।

পয়গম্বরের বাণী বা হাদিস প্রধানত দৈনন্দিন জীবনের বিষয়াবলীর সঙ্গে সম্পর্কিত, তবে অধিবাদ, সৃষ্টিতত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্বও রয়েছে। এসব বক্তব্যের বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বয়ং ঈশ্বর কর্তৃক সরাসরি মুহাম্মদের (স) কাছে উচ্চারিত বলে বিশ্বাস করা হয়। এসব হাদিস কুদসি (পবিত্র বিবরণ) বিশ্বাসীর মনে ঈশ্বরের অবস্থান ও উপস্থিতির ওপর জোর দেয়: উদাহরণ স্বরূপ, একটি সুবিখ্যাত হাদিস-এ কিছু পর্যায়ের উল্লেখ করা হয়েছে যা দিয়ে একজন মুসলিম ঐশ্বরিক উপস্থিতি অনুভব করতে পারে, যা বিশ্বাসীর মনে মূর্ত হয়েছে বলে মনে হয়: আপনাকে কোরান এবং শরিয়াহর নির্দেশাবলী পালনের মাধ্যমে শুরু করতে হবে, তারপর ধর্মানুরাগের স্বেচ্ছা কর্মকাণ্ডের দিকে অগ্রসর হবেন:

আমার নির্ধারিত দায়িত্ব কর্তব্য পালন করার মাধ্যমে আমার দাস আমার নিকটবর্তী হয়, যা আমার সর্বাধিক পছন্দনীয়। এবং আমার দাস অবশ্য পালনীয় কর্মকাণ্ডের দ্বারা আমার নিকটবর্তী হয়ে আমার ভালোবাসা অর্জন করে: আর আমি যখন তাকে ভালোবাসি, আমি তার কানে পরিণত হই যা দিয়ে সে শোনে, চোখে পরিণত হই, যা দিয়ে সে দেখে, হাত হয়ে যাই যা দিয়ে সে ধরে এবং পায়ে পরিণত হই যা দিয়ে সে হাঁটে। [৩৬]

ইহুদিবাদ ও খৃস্টধর্মের মতো দুৰ্জেয় ঈশ্বর এই জগতে অনুভূত এক সর্বব্যাপী সত্তা। মুসলিমরা অপর দুটি অপেক্ষাকৃত পুরোনো ধর্মের মতো একই রকম পদ্ধতিতে ঐশ্বরিক উপস্থিতির অনুভূতি গড়ে তুলতে পারে।

মুহাম্মদের (স) জীবনধারা অনুসরণ করে যারা এই ধরনের ধর্মানুরাগ গড়ে তোলে তাদের বলা হয় আহল আল-হাদিস বা ট্র্যাডিশনিস্ট। প্রচণ্ড সাম্যতার নীতির কারণে সাধারণ মানুষের কাছে এদের একটা আবেদন ছিল; উমাঈয়া ও আব্বাসিয়দের দরবারের বিলাসিতার বিরুদ্ধে ছিল তারা, কিন্তু শিয়াদের বিপ্লবাত্মক কৌশলের পক্ষাবলম্বন করেনি। খলিফার ব্যতিক্রমী আধ্যাত্মিক গুণাবলী প্রয়োজন থাকার কথা তারা বিশ্বাস করত নাঃ খলিফা। কেবল একজন প্রশাসক। কিন্তু তারপরেও কোরান ও সুন্নাহর ঐশ্বরিক প্রকৃতির ওপর জোর দিয়ে প্রত্যেক মুসলিমকে অন্তস্থঃভাবে বিদ্রোহী ও চরম ক্ষমতার তীব্র বিরোধী ঈশ্বরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের উপায় বাতলে দিয়েছিল তারা। মধ্যস্থতাকারীর দায়িত্ব পালন করার জন্যে পুরোহিত গোষ্ঠীর কোনও প্রয়োজন স্বীকার করা হয়নি। প্রত্যেক মুসলিম তার নিয়তির জন্যে ঈশ্বরের কাছে দায়ী।

সর্বোপরি ট্যাডিশনিস্টরা শিক্ষা দিয়েছে যে, কোরান এক চিরন্তন বাস্তবতা, যা তোরাহ্ বা লোগোসের মতো স্বয়ং ঈশ্বরের; সময়ের সূচনার আগেই এর অস্তিত্ব ছিল তাঁর মনে। তাদের কোরানের অসৃষ্ট’র তত্ত্ব বোঝায় যে কোরান আবৃত্তি করার সময় মুসলিমরা সরাসরি অদৃশ্য ঈশ্বরের বাণী শুনতে পায়। কোরান তাদের অন্তস্তলে ঈশ্বরের উপস্থিতি প্রকাশ করে। এর পবিত্র বাণী আবৃত্তি করার সময় তাদের মুখে তাঁর বক্তব্য ধ্বনিত হয়, আর যখন তারা পবিত্র গ্রন্থটি হাতে নেয়, যেন স্বয়ং ঈশ্বরকেই স্পর্শ করে। প্রথম যুগের ক্রিশ্চানরাও ব্যক্তি জেসাস সম্পর্কে একই কথা ভেবেছিল:

যাহা আদি হইতে ছিল,
যাহা আমরা শুনিয়াছি,
যাহা স্বচক্ষে দেখিয়াছি,
যাহা নিরীক্ষণ করিয়াছি,
এবং স্বহস্তে স্পর্শ করিয়াছি,
জীবনের সেই বাক্যের বিষয়
লিখিতেছি।[৩৭]

জেসাস বা বাণীর প্রকৃত মর্যাদা বা অবস্থানের প্রশ্নটি ক্রিশ্চানদের যথেষ্ট যন্ত্রণা দিয়েছে। এবার মুসলিমদের মাঝে কোরানের প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক শুরু হবে: আরবী টেক্সট ঠিক কোন অর্থে প্রকৃত ঈশ্বরের বাণী? কোরানের এই মর্যাদা বৃদ্ধিকে কোনও কোনও মুসলিম ব্লাসফেমাস মনে করেছে, যেমনটি জেসাসকে লোগোসের মানব রূপ কল্পনা করায় কোনও কোনও ক্রিশ্চান মর্মপীড়া বোধ করেছিল।

অবশ্য শেষ পর্যন্ত শিয়ারা এমন সব ধারণা গড়ে তোলে যেগুলো খৃস্টিয় অবতারবাদেরই আরও কাছাকাছি। হুসাইনের করুণ মৃত্যুর পর শিয়াহরা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, কেবল তার বাবা আলি ইবন আবি তালিবের বংশধররাই উম্মাহ্র নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য। এরা ইসলামেরই এক সুস্পষ্ট আলাদা গোত্রে পরিণত হয়। একাধারে চাচাত ভাই ও মেয়ে-জামাই হিসাবে মুহাম্মদের (স) সঙ্গে আলির রক্তের সম্পর্ক ছিল অনেক বেশি। যেহেতু মুহাম্মদের (স) কোনও ছেলেই শেষ পর্যন্ত বাঁচেনি, আলি ছিলেন তার নিকটতম পুরুষ আত্মীয়। কোরানে পয়গম্বরদের প্রায়ই বংশধরদের জন্যে প্রার্থনা করতে দেখা যায়। স্বর্গীয় আশীর্বাদের এই ধারণাকে প্রসারিত করে শিয়া বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, আলির পরিবারের মাধ্যমে কেবল মুহাম্মদের (স) পরিবারেরই ঈশ্বরের প্রকৃত জ্ঞান (ইলম) রয়েছে। কেবল তারাই উম্মাহকে ঐশ্বরিক নির্দেশনা পৌঁছে দেওয়ার যোগ্যতা রাখেন। আলির কোনও বংশধর ক্ষমতাসীন হলে মুসলিমরা আবার ন্যায়-বিচারের স্বর্ণযুগের আশা করতে পারবে ও ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী উম্মাহ্ পরিচালিত হবে।

ব্যক্তি আলির প্রতি ভক্তি বিস্ময়কর প্রাবল্য লাভ করায় কিছু চরমপন্থী। শিয়াহ গ্রুপ আলি ও তাঁর উত্তরসুরিদের স্বয়ং মুহাম্মদের (স) চেয়েও মর্যাদা সম্পন্ন অবস্থানে নিয়ে যাবে এবং প্রায় ঐশ্বরিক মর্যাদা দান করবে। তারা প্রাচীন পার্সি মনোনীত দেবতার বংশের পরিবারের ঐতিহ্য অনুসরণ করছিল, যে পরিবার বংশ পরম্পরায় স্বর্গীয় মহিমা বিস্তার করে চলেছে। উমাইয়া আমলের শেষ দিকে কিছু কিছু শিয়া বিশ্বাস করতে শুরু করে যে আলির বংশধরদের একটা বিশেষ ধারাতেই নির্ভরযোগ্য ইলম সীমাবদ্ধ। কেবল এই পরিবারেই মুসলিমরা ঈশ্বর মনোনীত উম্মাহর প্রকৃত ইমাম বা নেতার সন্ধান পাবে। তিনি ক্ষমতায় থাকুন বা না থাকুন, তাঁর পথ-নির্দেশনার কোনও বিকল্প নাই; সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব তার প্রতীক্ষায় থাকা; তাঁর নেতৃত্ব মেনে নেওয়া। যেহেতু এইসব ইমামকে আনুগত্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে দেখা হতো, তাই খলিফাঁদের চোখে তাঁরা ছিলেন রাষ্ট্রের শত্রু: শিয়াহ্ ঐতিহ্য অনুসারে বেশ কয়েকজন ইমামকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়; কেউ কেউ আত্মগোপনে যেতেও বাধ্য হন। কোনও ইমাম পরলোকগমণের সময় আত্মীয়দের মধ্য হতে একজনকে তাঁর ইলমের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে। যেতেন। আস্তে আস্তে ইমামগণ ঈশ্বরের অবতার হিসাবে পূজ্য হতে শুরু করলেন: তাঁদের প্রত্যেকে পৃথিবীর বুকে ঈশ্বরের উপস্থিতির প্রমাণ’ (হুজ্জাহ) ছিলেন ও রহস্যময় কোনও উপায়ে মানুষের মাঝে ঈশ্বরকে ধারণ করেছিলেন। তাঁর বাণী, সিদ্ধান্ত ও নির্দেশাবলী আসলে ঈশ্বরেরই বাণী, সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ। ক্রিশ্চানরা যেমন জেসাসকে ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়ার পথ, সত্য এবং আলো হিসাবে দেখেছিল, শিয়াহ্রাও তাদের ইমামদের ঈশ্বরের কাছে যাবার দ্বার (বাব) এবং প্রত্যেক প্রজন্মের জন্যে পথ (সাবিল) এবং দিক নির্দেশনা মনে করে সম্মান দেখায় ।

শিয়াদের বিভিন্ন শাখা আলাদা আলাদাভাবে স্বর্গীয় উত্তরাধিকার সন্ধান করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘টুয়েলভার’ (দ্বাদশবাদী) শিয়ারা হুসাইনের মাধ্যমে আগত ৯৩৯ সালে সর্বশেষ ইমাম আত্মগোপনে গিয়ে মানব সমাজ হতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আলির পরবর্তী বার প্রজন্মকে মর্যাদা দিয়েছে, তাঁর কোনও বংশধর ছিল না বলে এই ধারার পরিসমাপ্তি ঘটে। সেভেনারস (সপ্তবাদী) হিসাবে পরিচিত ইসমায়েলিরা বিশ্বাস করত, এদের মাঝে সপ্তম জনই শেষ ইমাম ছিলেন। দ্বাদশবাদীদের মাঝে এক ধরনের মেসিয়ানিক ধারা দেখা দিয়েছিল, এরা বিশ্বাস করত যে দ্বাদশ বা গোপন ইমাম স্বর্ণযুগের সূচনা করতে আবার ফিরে আসবেন। নিঃসন্দেহে এসব ধারণা বিপজ্জনক ছিল । এগুলো কেবল রাজনৈতিকভাবে দ্রোহমূলকই ছিল না, এগুলোকে খুব সহজেই আনাড়ি, সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। তো অধিকতর চরমপন্থী শিয়ারা কোরানের প্রতীকী ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে এক নিগূঢ় ধারা গড়ে তুলেছিল যা আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে দেখতে পাব। এদের ধর্মানুরাগ অধিকাংশ মুসলিমের পক্ষে দারুণ রকম দুর্বোধ্য ছিল, যারা এই অবতারবাদী ধারণাকে ক্লাসফেমাস মনে করেছে, ফলে শিয়াদের অস্তিত্ব অভিজাত শ্রেণী ও বুদ্ধিজীবীদের মাঝেই বেশি দেখা গেছে। ইরানি বিপ্লবের পর থেকে পশ্চিমে আমরা শিয়া মতবাদকে উৎপত্তিগতভাবে ইসলামের মৌলবাদী অংশ হিসাবে তুলে ধরতে প্ররোচিত হয়েছি, কিন্তু এধরনের সিদ্ধান্ত ঠিক নয়। শিয়া মতবাদ এক অভিজাত ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। আসলে, যেসব মুসলিম কোরানের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগতভাবে যৌক্তিক যুক্তিতর্ক প্রয়োগ করতে চেয়েছে শিয়াদের সঙ্গে যথেষ্ট মিল রয়েছে তাদের। মুতাযিলি নামে পরিচিত এই যুক্তিবাদীরা নিজস্ব আলাদা গ্রুপ গড়ে তুলেছিল; সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অঙ্গীকারও ছিল তাদের: শিয়াদের মতো মুতাযিলিরাও রাজদরবারের বিলাসিতার বিরুদ্ধে ছিল এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে ঘনঘন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠত।

রাজনৈতিক প্রশ্ন মানুষের জীবন ধারায় ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে এক ধর্মতত্ত্বীয় বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। উমাঈয়াদের সমর্থকরা প্রায় কপটতার সঙ্গে দাবি করেছিল যে, তাদের অনৈসলামিক আচরণের জন্যে তারা দায়ী নয়, কেননা ঈশ্বরই এভাবে তাদের নিয়তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ঈশ্বরের পরম শক্তি ও সর্বজ্ঞতার ব্যাপারে কোরানে জোরাল ধারণা রয়েছে; পূর্বনির্ধারিত এই নিয়তির সমর্থনে বহু টেক্সট খাড়া করা যেতে পারে। কিন্তু কোরান আবার সমানভাবে মানুষের দায়িত্ব সম্পর্কেও জোর দেয়: “নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনও জাতির অবস্থার পরিবর্তন ঘটান না যতক্ষণ না সে-জাতি নিজেদের অন্তরে পরিবর্তন ঘটায়। পরিণতিতে শাসকগোষ্ঠীর সমালোচকরা স্বাধীন ইচ্ছা ও নৈতিক দায়িত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। মুতাযিলিরা মধ্যপন্থা গ্রহণ। (ইতাহু-আলাদা থাকা) করে চরম অবস্থান হতে নিজেদের সরিয়ে নেয় । মানুষের নৈতিক চরিত্র রক্ষার জন্যেই স্বাধীন ইচ্ছার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল তারা । যেসব মুসলিম ঈশ্বরকে ন্যায়-অন্যায়ের মানবীয় ধারণার ঊর্ধ্বে বলে বিশ্বাস করে, তারা তার ন্যায়বিচারের বিরোধিতা করেছে। যে ঈশ্বর কেবল ঈশ্বর হবার কারণে সকল সুনীতির লঙ্ঘন করে পার পেয়ে যান, তিনি আসলে দানব; স্বৈরাচারী খলিফার চেয়ে ভালো কিছু নন। শিয়াহুদের মতো মুতাযিলিরা ঘোষণা করেছিল যে, ন্যায়-বিচার ঈশ্বরের মূলসত্তা। তিনি কারও প্রতি অন্যায় করতে পারেন না; যুক্তি বিরোধী কোনও কিছুর নির্দেশ দিতেও পারেন না।

এখানেই ট্র্যাডিশনিস্টদের সঙ্গে তাদের বিরোধ সৃষ্টি হয়। ট্র্যাডিশনিস্টরা যুক্তি উপস্থাপন করে যে, মানুষকে আপন ভাগ্যের স্রষ্টা এবং নিয়ন্তা বানিয়ে তারা ঈশ্বরের সর্বময় ক্ষমতার অসম্মান করছে। তারা অভিযোগ তোলে, মুতাযিলিরা ঈশ্বরকে খুব বেশি যৌক্তিক ও বেশি রকম মানুষের মতো করে ফেলেছে। ঈশ্বরের অত্যাবশ্যকীয় দুর্বোধ্যতার ওপর জোর দেওয়ার জন্যেই পূর্বনির্ধারিত নিয়তির মতবাদ গ্রহণ করেছিল তারা: আমরা তাঁকে বোঝার দাবি করলে তিনি আর ঈশ্বর থাকবেন না, মানুষের তুচ্ছ কল্পনায় পরিণত হবেন। ঈশ্বর ভলো খারাপের মানবীয় ধ্যান-ধারণার ঊর্ধ্বে; তাকে আমাদের মান ও প্রত্যাশায় বন্দি করা যাবে নাঃ ঈশ্বরের নির্ধারিত বলেই কোনও কাজ ভালো বা খারাপ, স্বয়ং ঈশ্বরকে বাধ্য করার মতো এসব মানবীয় মূল্যবোধের দুয়ে মাত্রা আছে বলে নয়। মুতাযিলিদের পক্ষে একথা বলা ভুল ছিল যে পুরোপুরি মানবীয় আদর্শ ন্যায়-বিচারের ধারণা ঈশ্বরের মূল সত্তা। পূর্ব নির্ধারিত নিয়তি ও স্বাধীন ইচ্ছার সমস্যা, যা ক্রিশ্চানদেরও ভুগিয়েছে, ব্যক্তিক ঈশ্বরের ধারণার একটা কেন্দ্রীয় সমস্যার দিকে অঙুলি নির্দেশ করে। ব্রহ্মার মতো একজন নৈর্ব্যক্তিক ঈশ্বর ‘ভালো’ বা ‘খারাপে’র ঊর্ধ্বে অবস্থান করছেন, এটা অনায়াসে বলা যায়, যেগুলোকে দুয়ে ঈশ্বরের মুখোশ হিসাবে দেখা হয়। কিন্তু যে ঈশ্বর কোনও রহস্যময় উপায়ে একজন ব্যক্তি, যিনি মানুষের ইতিহাসে অংশ নেন, নিজেকে সমালোচনার পাত্রে পরিণত করেন তিনি। এই ‘ঈশ্বরকে জীবনের-চেয়ে-বৃহৎ স্বৈরাচারী বা বিচারক বানানো অত্যন্ত সহজ ও তাঁকে দিয়ে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করানো যায়। ঈশ্বরকে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রিপাবলিকান বা সমাজতন্ত্রী, কিংবা বর্ণবাদী বা বিপ্লবী রূপ দিতে পারি। এই বিপদ অনেককে ব্যক্তিক ঈশ্বরকে ধর্মবিরোধী ধারণা হিসাবে দেখতে প্ররোচিত করেছে, কারণ এটা আমাদেরকে আমাদের সংস্কারে প্রোথিত করে ও আমাদের মানবীয় ধারণাকে পরম পর্যায়ে উন্নীত করে।

এই বিপদ এড়াতেই ট্র্যাডিশনিস্টরা ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের ব্যবহৃত কালোত্তীর্ণ ঈশ্বরের সত্তা ও তাঁর কর্মকাণ্ডের মাঝে পার্থক্যের অবতারণা করেছে। তারা দাবি করে যে, যেসব গুণাবলী দুয়ে ঈশ্বরকে পার্থিব জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে সক্ষম করে তোলে-যেমন, ক্ষমতা, জ্ঞান, ইচ্ছা, শ্রবণ, দর্শন, বক্তব্য-কোরানে যেসব গুণ আল্লাহর বলে উল্লেখ আছে–যেগুলো অসৃষ্ট কোরানের মতোই অনন্ত কাল ধরে ঈশ্বরের সঙ্গে অবস্থান করছে। এগুলো সব সময় আমাদের বোধগম্যতার অতীত রয়ে যাবে, যা ঈশ্বরের জ্ঞানাতীত সত্তার চেয়ে ভিন্ন। ঠিক ইহুদিরা যেমন ঈশ্বরের প্রজ্ঞা বা তোরাহ্ কালের সূচনার আগে থেকেই ঈশ্বরের সঙ্গে ছিল বলে কল্পনা করেছে, এবার মুসলিমরাও একইভাবে ঈশ্বরের ব্যক্তিত্ব সংক্রান্ত ধারণা গড়ে তুলতে শুরু করছিল এবং বোঝাতে চেয়েছে যে তাঁকে মানব মনে পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করা যাবে না। খলিফা আল মামুন (৮১৩-৮৩২) যদি মুতাযিলিদের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাদের ধারণাকেই মুসলিমদের রাষ্ট্রীয় মতবাদ ঘোষণার প্রয়াস না পেতেন, এই দুর্বোধ্য যুক্তি হয়তো বা মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোককেই প্রভাবিত করতে পারত। কিন্তু খলিফা মুতাযিলিদের বিশ্বাসকে চাপিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ট্রাডিশনিস্টদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন শুরু করলে সাধারণ মুসলিম জনগণ এই অনৈসলামিক আচরণে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। আহমাদ ইবন হানবাল (৭৮০-৮৫৫) নামে এক নেতৃস্থানীয় ট্র্যাডিশনিস্ট আল-মামুনের ইনকুইজিশন থেকে অল্পের জন্যে রেহাই পেয়ে জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর ধর্মপরায়ণতা ও ক্যারিশমা-নিপীড়কদের জন্যে প্রার্থনা করেছেন তিনি-খেলাফতকে চ্যালেঞ্জ করে ও অসৃষ্ট কোরান সংক্রান্ত তাঁর বিশ্বাস মুতাযিলিদের যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণ-অভ্যুত্থানের মূল চেতনা হয়ে দাঁড়ায় ।

ঈশ্বর সম্পর্কে কোনও রকম যৌক্তিক আলোচনার সমর্থনে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন ইবন হানবাল। এভাবে মধ্যপন্থী মুতাযিলি আল-হুঁয়াঈয়ান আল কারাবিসি (মৃ. ৮৫৯) যখন আপোসফার প্রস্তাব রাখলেন যে, ঈশ্বরের বাণী হিসাবে কোরান অসৃষ্ট, কিন্তু যখন তা মানবীয় ভাষায় প্রকাশ করা হয় তখন তা সৃষ্টিতে পরিণত হয়, ইবন হানবাল এই মতবাদের তীব্র নিন্দা জানান। আল কারাবিসি তাঁর মতবাদ আবার বদলাতে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি ঘোষণা দেন যে, কোরানের লিখিত ও উচ্চারিত আরবী যতক্ষণ ঈশ্বরের চিরকালীন বক্তব্যের ধারক ততক্ষণ অসৃষ্ট। কিন্তু ইবন হানবাল একেও অবৈধ ঘোষণা করেন, কেননা এরকম যুক্তিভিত্তিক উপায়ে কোরানের উৎস সম্পর্কে আঁচ-অনুমান করা অর্থহীন। অব্যক্ত ঈশ্বরকে জানতে যুক্তি লাগসই উপায় নয়। তিনি মুতাযিলিদের বিরুদ্ধে ঈশ্বরকে সব রকম রহস্যহীন করে ধর্মীয় মূল্যহীন এক বিমূর্ত ফরমুলায় পরিণত করার অভিযোগ আনেন । কোরান পৃথিবীতে ঈশ্বরের কর্মকাণ্ড বর্ণনা করার সময় যখন বলে যে ঈশ্বর বলেন এবং দেখেন এবং ‘আরশে বসেন’, ইবন হানবাল জোরে দিয়ে বলেন যে, এসবকে আক্ষরিক অর্থেই ব্যাখ্যা করতে হবে, কিন্তু কীভাবে ‘জিজ্ঞেস করা যাবে না’ (বিলা কাঈফ)। তাঁকে বোধ করি চরমপন্থী আথানাসিয়াসের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যিনি অধিকতর যুক্তিবাদী ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অবতারবাদের চরম ব্যাখ্যার ওপর বেশি জোর দিয়েছিলেন। ইবন হানবাল ঈশ্বরের অত্যাবশ্যক অনিবৰ্চনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন, যা সব ধরণের যুক্তি ও ধারণাগত বিশ্লেষণের অতীত একটা বিষয়।

কিন্তু কোরান তারপরেও ক্রমাগত বুদ্ধিবৃত্তি ও উপলব্ধির গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছে। ইবন হানবালের অবস্থান কিছুটা সরলমনা ছিল। বহু মুসলিমই একে বিকৃত ও অস্পষ্টতার দোষে আক্রান্ত মনে করেছে। আবু আল-হাসান ইবন ইসমাইল আল-আশারি (৮৭৮-৯১৪) এক আপোসরফার সন্ধান পেয়েছিলেন। মুতাযিল ছিলেন তিনি, কিন্তু পরে এক স্বপ্নে পয়গম্বর কর্তৃক হাদিস পাঠ করার তাগিদ পেয়ে ট্র্যাডিশবাদে যোগ দেন। আল-আশারি এর পর সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে চলে গিয়ে অত্যুৎসাহী ট্র্যাডিশনিস্টে পরিণত হন। মুতাযিলিদের ইসলামের কলঙ্ক আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করেন তিনি। আবার স্বপ্নে মুহাম্মাকে (স) দেখেন তিনিঃ এ পর্যায়ে পয়গম্বরকে অসস্তুষ্টই দেখাচ্ছিল, তিনি বলেছিলেন: “আমি তোমাকে যৌক্তিক বিবেচনা বিসর্জন দিতে বলিনি, বরং সত্য হাদিসকে সমর্থন দিতে বলেছি! এরপর থেকে আল-আশারি ইবন হানবালের অজ্ঞাবাদী চেতনাকে সমর্থন করার জন্যে মুতাযিলিদের যৌক্তিক কৌশলের প্রয়োগ ঘটাতে শুরু করেছিলেন । মুতাযিলিদের যেখানে অভিমত ছিল যে, ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ অযৌক্তিক হতেই পারে না, সেখানে আল-আশারি যুক্তি-তর্ক দিয়ে দেখান যে ঈশ্বর আমাদের উপলব্ধির অতীত । মুতাযিলিরা ঈশ্বরকে সামজ্ঞস্যপূর্ণ অথচ বিরস ধারণায় নামিয়ে আনার বিপদের মাঝে ছিল; আল-আশারি কোরানের পরিপূর্ণ ঈশ্বরের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে চেয়েছেন, এর অসামঞ্জস্যতা সত্ত্বেও। প্রকৃতই, ডেনিস দ্য আরোপাগাইতের মতো তার বিশ্বাস ছিল প্যারাডক্স ঈশ্বর সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি বাড়াবে। আর পাঁচটা মানবীয় ধারণার মতো ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণাও আলোচিত বা বিশেষিত হতে পারে, ঈশ্বরকে এমন পর্যায়ে নামিয়ে আনার বিরোধী ছিলেন তিনি। জ্ঞান, ক্ষমতা, জীবন, ইত্যাদি স্বর্গীয় গুণাবলী বাস্তব, অনন্তকাল হতে এগুলো ঈশ্বরের অধিকারে ছিল। কিন্তু এসব ঈশ্বরের সত্তা হতে আলাদা, কারণ ঈশ্বর অত্যাবশ্যকীয়ভাবে একজন, অদ্বিতীয় এবং সহজ। তিনি স্বয়ং সারল্য বলে তাঁকে জটিল কোনও সত্তা হিসাবে বিচেনা করা চলবে না। আমরা তার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সংজ্ঞা দিয়ে বা তাকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে বিশ্লেষণ করতে পারি না। আল-আশারি এই প্যারাডক্স দূর করার কোনও প্রয়াস পেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এভাবে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, কোরান যখন বলে যে ঈশ্বর আরশে বসেন, আমাদেরকে অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে এটা সত্যি, যদিও এটা বসার খাঁটি চেতনা উপলব্ধি করার বোধের অতীত।

আল-আশারি আরোপিত অসচ্ছতা ও চরম যুক্তিবাদের মাঝামাঝি একটা পথ খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। কোনও কোনও অক্ষরবাদী দাবি করেছে যে, কোরানের বক্তব্য অনুযায়ী আশীর্বাদপ্রাপ্তরা যদি স্বর্গে ঈশ্বরকে দেখার সুযোগ পায়, সেক্ষেত্রে তার বাস্তব কাঠামো অবশ্যই আছে। হিশাম ইবন হাকিম এতদূর পর্যন্ত বলেছেন যে:

আল্লাহর দেহ আছে, স্পষ্ট, প্রশস্ত, উঁচু ও দীর্ঘ, সমান মাত্রার, আলোয় উজ্জ্বল, এর ত্রিমাত্রায় বিপুল আকারের, স্থানের অতীত অবস্থানে, খাঁটি ধাতুর দণ্ডের মতো, গোলাকার কোনও রত্নের মতো উজ্জ্বল, রঙ, স্বাদ, গন্ধ এবং স্পর্শসহ।[৩৯]

শিয়াদের কেউ কেউ এই মত গ্রহণ করেছে, কারণ তারা বিশ্বাস করে, ইমামরা ঈশ্বরের অবতার ছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ, মুতাযিলিরা জোর দিয়ে বলেছে, কোরান যখন ঈশ্বরের হাতের কথা বলে, একে অবশ্যই তাঁর মহানুভবতা ও বদান্যতার রূপক হিসাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। আল-আশারি অক্ষরবাদীদের বিরোধিতা করে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, কোরান অনুযায়ী আমরা প্রতীকী ভাষায়ই কেবল ঈশ্বর সম্পর্কে কথা বলতে পারি। তবে তিনি ট্র্যাডিশনিস্টদের পাইকারী যুক্তি বিসর্জন দেওয়ারও বিরোধিতার করেছেন । তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, মুহাম্মদ (স) এসব সমস্যার মোকাবিলা করেননি, তা না হলে তিনি মুসলিমদের দিক নির্দেশনা দিয়ে যেতেন; এখন সকল মুসলিমের দায়িত্ব হচ্ছে ঈশ্বরের প্রকৃত ধর্মীয় ধারণা বজায় রাখার জন্যে এ ধরনের ব্যাখ্যামূলক উপায়গুলোকে উপমা (কিয়াস) হিসাবে ব্যবহার করা।

আল-আশারি ক্রমাগত আপোসমূলক অবস্থানের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। এভাবে তিনি যুক্তি খাড়া করেছেন যে, কোরান ঈশ্বরের চিরন্তন ও অসৃষ্ট বাণী, কিন্তু কালি, কাগজ, আরবী ভাষা, যা দিয়ে পবিত্র বিষয়বস্তু ধারণ করা হয়েছে তা সৃষ্ট। তিনি মুতাযিলিদের স্বাধীন ইচ্ছার মতবাদের সমালোচনা করেছেন, কারণ একমাত্র ঈশ্বরই মানুষের কাজের স্রষ্টা হতে পাবেন; কিন্তু মুক্তি অর্জনে মানুষের কোনও ভূমিকা নেই, ট্র্যাডিশনিস্টদের এই দৃষ্টিভঙ্গিরও বিরোধিতা করেছেন তিনি। তার সমাধান কিছুটা জটিলই ছিল: ঈশ্বর কর্মের স্রষ্টা কিন্তু মানুষকে সেগুলোর সুফল বা কুফল অর্জনের অনুমতি দেন। অবশ্য ইবন হানবালের বিপরীতে আল-আশারি প্রশ্ন তুলতে প্রস্তুত ছিলেন, প্রস্তুত ছিলেন এইসব আধ্যাত্মিক সমস্যা খতিয়ে দেখার জন্যে। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি উপসংহারে পৌঁছান যে, যে রহস্যময় ও অনিবৰ্চনীয় সত্তাকে আমরা ঈশ্বর বলে ডাকি, তাঁকে গোছানো, যুক্তিভিত্তিক কোনও পদ্ধতিতে আবদ্ধ করার চেষ্টা চালানো ঠিক নয়। আল-আশারি মুসলিম ট্র্যাডিশন কালামের (আক্ষরিক অর্থে বাণী’ বা ‘আলোচনা) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সাধারণত ধর্মতত্ত্ব হিসাবে যার অনুবাদ করা হয়ে থাকে। দশম ও একাদশ শতাব্দীতে তাঁর অনুসারীরা কালামের কার্যপদ্ধতির পরিমার্জনা করে তাঁর মতবাদকে উন্নত করে। প্রথম দিকের আশারিরা ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের আলোচনার জন্যে একটা আধ্যাত্মিক কর্মকাঠামো গড়ে তুলতে চেয়েছিল। আশারি মতবাদ বা ধারার সর্ব প্রথম ধর্মতাত্ত্বিক ছিলেন আবু বকর আল-বাকিলানি (মৃ. ১০১৩)। আল-তাওহীদ (একত্ব) শিরোনামের প্রবন্ধে মুতাযিলিদের সঙ্গে একমত পোষণ করে তিনি বলেছেন যে, যুক্তি প্রয়োগ করে মানুষ ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে: প্রকৃতপক্ষে কোরানই দেখিয়েছে যে আব্রাহাম কেমন করে পদ্ধতিগতভাবে প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে করতে চিরন্তন স্রষ্টাকে আবিষ্কার করেছিলেন । কিন্তু আল-বাকিলানি প্রত্যাদেশের সাহায্য ছাড়া আমাদের ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য টানার সাধ্যে আছে বলে মানেননি, কারণ এগুলো স্বাভাবিক বিষয় নয়, বরং ঈশ্বর কর্তৃক নির্দিষ্ট। আল্লাহ্ ভালো-মন্দের মানবীয় ধারণায় আবদ্ধ নন।

আল-বাকিলানি মুসলিমদের ধর্ম বিশ্বাসের একটা আধ্যাত্মিক যুক্তি আবিষ্কারের লক্ষ্যে অ্যাটোমিজম’ বা ‘অকেশনালিজম’ নামে পরিচিত তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন: আল্লাহ ছাড়া আর কোনও প্রভু, সত্তা বা নিশ্চয়তা নেই। তিনি দাবি করেছিলেন, বিশ্বের প্রতিটি জিনিস ঈশ্বরের সরাসরি মনোযোগের ওপর নির্ভরশীল। গোটা মহাবিশ্বকে অসংখ্য অ্যাটোমে পরিণত করা হয়েছে: স্থান এবং কাল ধারাবাহিক নয়, আর কোনও কিছুরই নির্দিষ্ট পরিচয় নেই। আথানাসিয়াসের মতোই আল-বাকিলানি সুবিশাল মহাবিশ্বকে চরমভাবে শূন্যে পরিণত করেছিলেন। কেবল ঈশ্বরই বাস্তব; কেবল তিনিই আমাদের অস্তিত্বহীনতা হতে উদ্ধার করতে পারেন। তিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালন করেন; প্রতি মুহূর্তে আপন সৃষ্টির অস্তিত্ব বজায় রাখেন। সৃষ্টির টিকে থাকার কারণ ব্যাখ্যা করার মতো কোনও প্রকৃতিক আইন নেই। যদিও অপরাপর মুসলিমরা বেশ সাফল্যের সঙ্গে বিজ্ঞানের চর্চায় আত্মনিয়োগ করছিল, কিন্তু আশারিবাদ মৌলিক দিক থেকে প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিরোধী রয়ে যায়, তবে তারপরেও এর ধর্মীয় প্রাসঙ্গিকতা ছিল। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঈশ্বরের উপস্থিতি ব্যাখ্যা ও বিশ্বাস সাধারণ যুক্তির ওপর নির্ভর করে না বোঝানোর এক আধ্যাত্মিক (metaphsical) প্রয়াস ছিল এটা বাস্তব সত্যের বিবরণের পরিবর্তে শৃঙ্খলা হিসাবে কাজে লাগানো হলে এটা মুসলিমদের কোরানে উল্লিখিত ঈশ্বর সচেতনতা গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে। বিপরীত দিকে, বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য বাদ দেওয়ার মাঝে এবং আবশ্যিকভাবে দুর্ভেদ্য এক ধর্মীয় মনোভাবকে আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করার মাঝেই এর দুর্বলতা নিহিত। এর ফলে একজন মুসলিম যেভাবে ঈশ্বরকে দেখে আর অন্যান্য বস্তুকে যেভাবে বিবেচনা করে, এ দুয়ের মাঝে পার্থক্যের সৃষ্টি হতে পারে। মুতাযিলি ও আশারিবাদী, উভয় দলই ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে সাধারণ যৌক্তিক চিন্তা ভাবনার সঙ্গে ঈশ্বরের ধর্মীয় অনুভূতিকে যুক্ত করতে চেয়েছিল। এটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল। মুসলিমরা বোঝার চেষ্টা করছিল যে, আমরা যেভাবে অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করি সেভাবে ঈশ্বরকে নিয়ে আলাপ করা সম্ভব কিনা। আমরা দেখেছি, গ্রিকরা নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, নীরবতাই তাদের মতে ধর্মতত্ত্বের সবচেয়ে জুৎসই ধরণ। শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ মুসলিমও একই উপসংহারে পৌঁছাবে।

মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর সহচরবৃন্দ আল-বাকিলানির তুলনায় ঢের আদিম সমাজের সদস্য ছিলেন। ইসলামি সাম্রাজ্য সভ্য দুনিয়ায় বিস্তৃত হয়েছে, ফলে মুসলিমরা ঈশ্বর ও জগতকে দেখার বৃদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে আরও উন্নত পদ্ধতির সংস্পর্শে এসেছে। সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে প্রাচীন হিব্রু দর্শনের পূর্ণাপন করেছেন মুহাম্মদ (স) এবং পরবর্তী প্রজন্ম সমূহকেও ক্রিশ্চান চার্চের মোকাবিলা করা কিছু সমস্যা অতিক্রম করতে হয়েছে। কেউ কেউ এমনকি ক্রাইস্টের ওপর দেবত্ব আরোপের খৃস্টিয় মতবাদের বিরুদ্ধে কোরানের অবস্থান সত্ত্বেও অবতারবাদী ধর্মতত্ত্বের শরণাপন্ন হয়েছে। ইসলামি প্রয়াস দেখায় যে, দুজ্ঞেয় অথচ ব্যক্তিক ঈশ্বরের ধারণা একই ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করতে চায়, একই রকম সমাধানের দিকে ধাবিত করে।

কালামের পরীক্ষা দেখায়, যদিও ঈশ্বরকে যৌক্তিকভাবে দুর্বোধ্য প্রমাণ করার জন্যে যৌক্তিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা সম্ভব, কিন্তু কোনও কোনও মুসলিম এতে অস্বস্তি বোধ করবে। পশ্চিমে খৃস্টধর্মে কালাম কখনও তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। মুতাফিলিদের সমর্থক আব্বাসিয় খলিফারা এদের মতবাদ বিশ্বাসীরা গ্রহণ না করায় চাপিয়ে দিতে পারেননি । মধ্যযুগের পুরো সময়টায়। ভবিষ্যতের চিন্তাবিদদের ওপর যুক্তিবাদের প্রভাব অব্যাহত থাকে, কিন্তু তা সংখ্যালঘুর প্রয়াস রয়ে যায়; অধিকাংশ মুসলিম গোটা বিষয়টিকে অবিশ্বাস করে বসে। খৃস্টধর্ম ও ইহুদিবাদের মতো সেমিটিক অভিজ্ঞতা থেকে ইসলাম আবির্ভূত হয়েছিল, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের হেলেনিক কেন্দ্রসমূহের গ্রিক যুক্তিবাদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। অন্য মুসলিমরা ইসলামের ঈশ্বরের আরও প্রবল হেলেনাইজেশনের প্রয়াস পেয়েছিল এবং তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মে এক নতুন দার্শনিক উপাদানের যোগ করেছে। ইহুদিবাদ, খৃস্টধর্ম এবং ইসলাম, এই তিনটি ধর্ম দর্শনের বৈধতা ও ঈশ্বরের রহস্যময়তার সঙ্গে এর প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে আলাদা কিন্তু খুবই তাৎপর্যপূর্ণ উপসংহারে পৌঁছুবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *