০১. উদ্ভব…

১. উদ্ভব…

আদিতে মানবজাতি এমন একজন ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছিল যিনি বস্তুনিচয়ের সৃষ্টির মূল কারণ এবং আকাশ ও পৃথিবীর শাসনকর্তা। কোনও প্রতিমা দিয়ে তাঁর উপস্থাপন ঘটেনি বা উপাসনা করার জন্যে তাঁর কোনও মন্দির কিংবা পুরোহিতও ছিল না। মানুষের সংস্কারের প্রেক্ষিতে তিনি ছিলেন অনেক উঁচু স্থানের অধিকারী। আস্তে আস্তে তার জাতির চেতনা থেকে হারিয়ে যান তিনি। তিনি এতটাই দূরবর্তী হয়ে পড়েছিলেন যে, লোকে আর তাঁকে আকাক্ষা করতে চাইল না। পরিণামে, বলা হয়ে থাকে, অদৃশ্য হয়ে যান তিনি।

এটা অন্তত একটা মতবাদ, ১৯১২ সালে প্রকাশিত দ্য অরিজিন অভ দ্য আইডিয়া অভ গড গ্রন্থের মাধ্যমে ফাদার উইলহেম স্মিডট একে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। স্মিডট মত প্রকাশ করেছেন যে, বহু সংখ্যক দেব-দেবীর উপাসনা শুরু করার আগে নারী-পুরুষ এক আদিম একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল। মূলত তারা একজন পরম উপাস্যের (Supreme Deity) অস্তিত্ব স্বীকার করত, যিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং সুদূরে অবস্থান করে মানুষের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকেন। এরকম পরম ঈশ্বরে (High God) (অনেক সময় স্কাই গড’ আখ্যায়িত করা হয়, যেহেতু তিনি স্বর্গের সঙ্গে সম্পর্কিত) বিশ্বাস এখনও আফ্রিকার বহু আদি গোত্রের ধর্মীয় জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে। তারা প্রার্থনার মাধ্যমে ঈশ্বরের নৈকট্য অন্বেষণ করে; বিশ্বাস করে যে তিনি তাদের ওপর নজর রাখছেন এবং পাপের শাস্তি দেবেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনে তিনি অনুপস্থিত: তাঁর কোনও বিশেষ কাল্ট নেই এবং কোনও প্রতিমার মাধ্যমেও উপস্থাপিত হননি। গোত্রের সদস্যরা বলে থাকে যে, তিনি প্রকাশের অতীত, মানুষের এই জগৎ দিয়ে তাঁকে কলঙ্কিত করা যায় না। কেউ কেউ বলে থাকে তিনি ‘চলে গেছেন।’ নৃতাত্ত্বিকগণ মত প্রকাশ করেছেন যে, এই ঈশ্বর দূরবর্তী ও মহিমান্বিত হয়ে ওঠায় কার্যতঃ তিনি নিম্নতর আত্মা ও অধিকতর বোধগম্য দেবতা দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছেন। স্মিডটের মতবাদও একই কথা বলছে। প্রাচীনকালে পরম ঈশ্বর পৌত্তলিকদের দেবনিচয়ের অধিকতর আকর্ষণীয় দেবতা দিয়ে। প্রতিস্থাপিত হয়েছেন। সুতরাং, আদিতে ঈশ্বর একজনই ছিলেন। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে জীবনের রহস্য ও যন্ত্রণা ব্যাখ্যা করার জন্যে মানব সৃষ্ট প্রাচীন ধারণাসমূহের মধ্যে একেশ্বরবাদ ছিল অন্যতম। এখানে এমন একজন। আরাধ্য বা উপাস্য কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন তারও একটা আভাস মেলে ।

এ ধারণার সত্য-মিথ্যা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে বহু তত্ত্ব রয়েছে। তবে মনে হয় দেবতার সৃষ্টি এমন একটা ব্যাপার মানবজাতি যা সব সময় করে এসেছে। যখন কোনও একটা ধর্মীয় আদর্শ তাদের জন্যে অকার্যকর হয়ে পড়ে, স্রেফ তার স্থানে অন্য এক ধারণা বসিয়ে দেওয়া হয়। এসব ধারণা স্কাই গডের মতো কোনওরকম হট্টগোল ছাড়াই হারিয়ে যায়। আমাদের বর্তমান কালেও অনেকে বলবেন ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের উপাস্য ঈশ্বরও স্কাই গডের মতো দূরবর্তী হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ প্রকৃতই এমনও দাবি করেছেন যে, তিনি পরলোকগমন করেছেন। বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের মানুষের জীবন যাপনের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান হারে তার অপসারণ ঘটছে। তাঁরা আমাদের চেতনায় ঈশ্বর আকৃতির গহ্বরের কথা বলেন, যেখানে তার অবস্থান ছিল; কারণ কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও আমাদের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি এবং মানুষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মতবাদসমূহের তিনি অন্যতম। আমরা কী হারাতে বসেছি বোঝার জন্যে-মানে, যদি সত্যি তিনি অপসৃয়মান হয়ে থাকেন-আমাদের দেখতে হবে এই ঈশ্বরের উপাসনা শুরু করার সময় মানুষ কী করছিল। কী তার অর্থ ছিল এবং কীভাবে তার উৎপত্তি ঘটেছিল। এ জন্যে আমাদের ফিরে যেতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন কালে, যেখানে ১৪,০০০ বছর আগে আমাদের ঈশ্বরের ধারণা ধীরে ধীরে আবির্ভূত হয়েছিল।

আজকের দিনে ধর্মকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হওয়ার অন্যতম কারণ আমাদের অনেকেই এখন আর অদৃশ্য বিষয়াদি দিয়ে পরিবেষ্টিত থাকার অনুভূতি লালন করি না। আমাদের বিজ্ঞান ভিত্তিক সংস্কৃতি আমাদেরকে চোখের সামনের ভৌত ও বস্তুজগতের দিকে মনোযোগ দিতে শেখায়। জগৎ দেখার এই পদ্ধতি ব্যাপক ফল অর্জন করেছে। অবশ্য এর একটা পরিণাম হচ্ছে আমরা আমাদের ‘আধ্যাত্মিক’ বা ‘পবিত্র’ অনুভূতি হেঁটে ফেলেছি যা অধিকতর প্রথাগত সমাজে মানুষের জীবনের প্রত্যেকটা স্তরে প্রভাব বিস্তার করে থাকে, এক কালে যা মানুষের জগতকে বোঝার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল। সাউথ-সীর দ্বীপমালার অধিবাসীরা এই রহস্যময় শক্তিকে মানা (mana) আখ্যায়িত করে, অন্যরা একে এক ধরনের উপস্থিতি বা সত্তা হিসাবে অনুভব করে-কখনও কখনও এটা তেজস্ক্রিয়তা বা বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো এক ধরনের নৈর্ব্যক্তিক ক্ষমতা হিসাবে অনুভূত হয়। গোত্রীয় প্রধান, গাছপালা, পাথর ও জীব জানোয়ারে এর আবাস বলে বিশ্বাস করা হতো। লাতিনরা পবিত্র মনে নুমিনা আত্মার অনুভূতি লাভ করে। আরবরা মনে করত গোটা পরিবেশ জিন-এ পরিপূর্ণ। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ এই বাস্তবতার সংস্পর্শে আসতে চেয়েছে, এগুলোকে কাজে লাগাতে চেয়েছে, কিন্তু আবার একে স্রেফ শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছে তারা। অদৃশ্য শক্তিসমূহকে যখন তারা ব্যক্তি সত্তায় পরিণত করে তাদের বাতাস, সূর্য, সাগর ও তারার সঙ্গে সম্পর্কিত কিন্তু মানবীয় চরিত্রের অধিকারী দেবতা বিবেচনা করতে শুরু করে, তখন তারা অদৃশ্যের সঙ্গে নিজেদের ও চারপাশের জগতের একাত্মতার সাধনাই প্রকাশ করেছিল।

ধর্মের ইতিহাসবিদ জার্মান রুডলফ অটো ১৯১৭ সালে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ দ্য আইডিয়া অভ দ্য হোলি প্রকাশ করেন। তাঁর বিশ্বাস নুমিনাসের এই অনুভূতিই ধর্মের মৌল বিষয়। এটা পৃথিবীর উৎপত্তি বা নৈতিক আচরণের একটা ভিত্তি খোঁজার ইচ্ছার অগ্রবর্তী। বিভিন্নভাবে মানুষ মুমিনাস শক্তি অনুভব করেছে-কখনও এটা বুনো ঘোর লাগা উত্তেজনা সৃষ্টি করে, কখনও এনে দিয়েছে গভীর প্রশান্তি; কখনও কখনও মানুষ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সহজাত রহস্যময় শক্তির উপস্থিতিতে ভয়, বিস্ময় ও তুচ্ছতার অনুভূতি লাভ করেছে। মানুষ যখন তার মিথসমূহ সৃষ্টি ও দেবতাদের উপাসনা শুরু করে তখন প্রাকৃতিক ঘটনাপ্রবাহের নিখুঁত ব্যাখ্যা আকাঙ্ক্ষা করেনি। রূপায়িত কাহিনী, গুহাচিত্র ও খোদাইচিত্রগুলো ছিল তাদের বিস্ময় ও ভাবনা প্রকাশের প্রয়াসের পাশাপাশি এই ভিন্নতর রহস্যময় শক্তিকে নিজেদের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত করার প্রয়াস। প্রকৃতপক্ষেই বর্তমানকালের কবি, শিল্পী ও সঙ্গীত শিল্পীরাও একই রকম আকাক্ষায় তাড়িত হন। উদাহরণ স্বরূপ, প্যালিওলিথিক যুগে কৃষি কাজের বিকাশ ঘটার সময় মাদার গডেসের উপর বিশ্বাস এই অনুভূতির প্রকাশ করেছে যে, মানুষের জীবনকে বদলে দেওয়া উর্বরতার পবিত্র মূল্য রয়েছে। শিল্পীরা তাঁকে নগ্ন অন্তঃসত্ত্বা নারী হিসাবে এঁকেছেন। সমগ্র ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতে নৃতাত্ত্বিকগণ এর আবিষ্কার করেছেন। বহু শত বছর মহান মাতা (Great Mother) কল্পনাযোগ্যভাবেই গুরুত্বপূর্ণ রয়ে গেছেন। প্রাচীন স্কাই গডের মতো পরবর্তীকালে দেবীদের মধ্যে হারিয়ে যান তিনি, অপরাপর উপাস্যের পাশে স্থান করে নেন। অত্যন্ত শক্তিশালী দেবী ছিলেন তিনি, স্কাই গডের চেয়ে শক্তিশালী তো বটেই–যিনি অস্পষ্ট সত্তা রয়ে গিয়েছিলেন। প্রাচীন সুমেরিয়ায় ইনানা, বাবিলনে ইশতার এবং কানানে আনাত নামে ডাকা হতো তাঁকে; মিশরে আইসিস আর গ্রিসে আফ্রোদাইত। এইসব সংস্কৃতিতে মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনে তার ভূমিকা বর্ণনা করার জন্যে আশ্চর্যজনকভাবে একই ধরনের গল্প-গাথা সৃষ্টি হয়েছিল । এইসব মিথ আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করার কোনও পরিকল্পনা ছিল না, বরং অন্য যে কোনওভাবে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে জটিল ও দূরবর্তী এক সত্তাকে বর্ণনার রূপকাশ্রিত প্রয়াস ছিল এগুলো । এই নাটকীয় ও স্মৃতি জাগানিয়া। দেব-দেবীর গল্পগুলো মানুষকে তার চারপাশের অদৃশ্য অথচ ক্ষমতাবান শক্তিসমূহকে অনুভব করার ক্ষমতাকে সংগঠিত করায় সাহায্য করেছে।

প্রকৃতপক্ষেই এমন মনে হয় যে, কেবল এই ঐশ্বরিক জীবনে অংশ নেওয়ার মাধ্যমেই তারা সত্যিকার অর্থে মানুষ হয়ে উঠতে পারে বলে প্রাচীনকালের মানুষের বিশ্বাস ছিল। পার্থিব জীবন আবশ্যকীয়ভাবে ভঙ্গুর এবং মৃত্যু দ্বারা আবৃত, কিন্তু নারী-পুরুষ দেবতার কর্মকাণ্ড অনুকরণ করলে তারা। তাদের উন্নত ক্ষমতা ও কার্যকারিতার অংশীদার হতে পারবে। এইভাবে, বলা হয়ে থাকে যে, দেবতারাই মানুষকে তাদের শহর ও মন্দির নির্মাণের কায়দা শিখিয়ে দিয়েছেন–যেগুলো স্বর্গে তাঁদের নিজস্ব আবাসের অনুকরণ মাত্র। দেবতাদের পবিত্র জগৎ-মিথসমূহে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে-কেবল মানুষের অনুসরণীয় আদর্শ নয়, বরং এটা মানুষের অস্তিত্বের প্রটোটাইপ। এটাই আদি নকশা বা আর্কিওটাইপ যার ভিত্তিতে মর্তে আমাদের জীবন গড়ে তোলা হয়েছে। এভাবে পৃথিবীর প্রত্যেকটা জিনিস স্বর্গের কোনও কিছুর অনুরূপ বলে বিশ্বাস করা হতো, অধিকাংশ প্রাচীন সংস্কৃতির আচরিক ও সামাজিক সংগঠন এবং আমাদের কালের অধিকতর প্রথাগত সমাজকে প্রভাবিত করে আসছে এই ধারণা।[১] উদাহরণ স্বরূপ, প্রাচীন ইরানে ইহ জগতের (গেতিক) প্রত্যেক ব্যক্তি বা বস্তুর আবার আর্কিওটাইপাল পবিত্র জগতে (মেনক) একটা করে প্রতিরূপ রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হতো। আধুনিক দুনিয়ায় আমাদের পক্ষে এমন একটা ধারণা মেনে নেওয়া কঠিন, কারণ আমরা স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতাকে মহান মানবীয় মূল্যবোধ হিসাবে দেখে থাকি। তবু বিখ্যাত উক্তি Post coitum omne animal tristis est এখনও একটি সাধারণ অনুভূতির প্রকাশ করে: এক আন্তরিক ও প্রবলভাবে প্রত্যাশিত মুহূর্তের পর আমরা প্রায়শঃই অনুভব করি আর কিছু বুঝি আমাদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে, ধরতে পারিনি। কোনও দেবতার অনুকরণ এখনও গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বোধ রয়ে গেছে: সাবাথের দিন বিশ্রাম গ্রহণ কিংবা মনডি বৃহস্পতিবারে কারও পা ধোয়া-খোদ কর্মকাণ্ডসমূহ অর্থহীন-এখনও তাৎপর্যপূর্ণ ও পবিত্র, কারণ মানুষ বিশ্বাস করে একদিন ঈশ্বর একাজগুলো করেছিলেন।

একই ধরনের আধ্যাত্মিকতা মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন সভ্যতার বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। বর্তমান ইরাকের অন্তর্গত তাইগ্রিস-ইউফ্রেতিস উপত্যকায় প্রায় ৪,০০০ বিসিই কালে সুমেরিয় নামে পরিচিত এক জাতি বাস করত, যারা ওইকুমিনের (সভ্যজগত) অন্যতম আদি মহান সংস্কৃতির গোড়াপত্তন করেছিল। তাদের উর, ইরেচ ও কিশ নগরীসমূহে সুমেনিররা নিজস্ব কুনিফর্ম লিপি আবিষ্কার করে, যিগুরাত আখ্যায়িত অনন্য সাধারণ মন্দির-টাওয়ার নির্মাণ করে, গড়ে তোলে অসাধারণ আইন, সাহিত্য ও মিথলজি। অল্প দিনের ব্যবধানেই এখানে হামলা চালিয়েছিল সেমেটিক আক্কাদিয়রা, সুমেরদের ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিল তারা। আরও পরে, ২,০০০ বিসিইর দিকে অ্যামোরাইটরা সুমেরিয় আক্কাদিয় সভ্যতা দখল করে নেয় ও বাবিলনকে তাদের রাজধানীতে পরিণত করে। অবশেষে আনুমানিক ৫০০ বছর পরে, অসিরিয়রা নিকটবর্তী আশুরে বসতি স্থাপন করে ও শেষপর্যন্ত বিসিই অষ্টম শতকে বাবিলন দখল করে নেয়। বাবিলনের এই ঐতিহ্য কানানের ধর্ম ও মিথলজিকেও প্রভাবিত করে, যা পরে প্রাচীন ইসরায়েলিদের প্রতিশ্রুত ভূমিতে পরিণত হয়। প্রাচীন বিশ্বের অন্যান্য জাতির মতো বাবিলনবাসীরাও তাদের সাংস্কৃতিক অর্জনকে দেবতাদের অবদান হিসাবে আখ্যায়িত করেছে, তারা তাদের পৌরাণিক পূর্বসূরিদের কাছে নিজেদের জীবনধারা উম্মোচিত করেছিলেন। এভাবে বাবিলনকেই স্বর্গের একটা প্রতিরূপ হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে, এর মন্দির স্বর্গীয় কোনও প্রাসাদের প্রতিরূপ। স্বর্গীয় জগতের সঙ্গে এই সম্পর্ক বা যোগাযোগ বার্ষিক ভিত্তিতে মহান নববর্ষের উৎসবে পালন ও চিরকালীন রূপ পেত। বিসিই সপ্তম শতকে এটা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাবিলনে নিসান–আমাদের এপ্রিল মাসে পালিত এই উৎসবে ভাবগম্ভীর পরিবেশে রাজার মাথায় পরবর্তী এক বছরের জন্যে শাসনভার তুলে দিয়ে মুকুট পরানো হতো। কিন্ত এই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অধিকতর স্থায়ী ও কার্যকর দেবতাদের শাসন মেনে নিতে পারলেই টেকা সম্ভব ছিল, যারা জগৎ সৃষ্টির সময় আদি বিশৃঙ্খলার ভেতর শৃঙ্খলা এনেছিলেন। উৎসবের এগারটি পবিত্র দিন এভাবে আচরিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ অপবিত্র কালের অংশ। গ্রহণকারীদের দেবতাদের পবিত্র ও অনন্তকালে নিক্ষেপ করত। পুরোনো, মুমূর্ষ বছরকে বাতিল করার জন্যে ছাগল বলী দেওয়া হতো; জনসম্মুখে রাজার অপমান ও তার জায়গায় উৎসবের রাজার সিংহাসন আরোহণ আদি বিশৃঙ্খর পুনরাবৃত্তি ঘটাত; ধ্বংসের শক্তির বিরুদ্ধে দেবতাদের লড়াইয়ের অনুকরণে নকল যুদ্ধের আয়োজন করা হতো।

এইসব প্রতীকী কর্মকাণ্ডের পবিত্র মূল্য ছিল; বাবিলনবাসীকে এগুলো পবিত্র শক্তি বা মানায় বিলীন হতে সক্ষম করে তুলত যার ওপর তাদের মহান সভ্যতা নির্ভরশীল ছিল। যেকোনও সময়ে বিশৃঙ্খলা ও বিভাজনের শক্তির শিকার পরিণত হওয়া সংস্কৃতিকে ভঙ্গুর অর্জন মনে করা হতো। উৎসবের চতুর্থ দিন অপরাহ্নে পুরোহিত ও কয়ারিস্টরা বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে দেবতাদের বিজয় তুলে ধরা মহাকাব্য এনুমা এলিশ আবৃত্তি করার জন্যে সার বেঁধে পবিত্র মন্দিরে। প্রবেশ করত। এ কাহিনী পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশের সত্য ভিত্তিক বিবরণী নয়, বরং এক গূঢ় রহস্য তুলে ধরার ও এর পবিত্র শক্তি উৎসারণের কোনও এক সুচিন্তিত প্রতীকী প্রয়াস। সৃষ্টির আক্ষরিক বর্ণনা দান ছিল অসম্ভব, কেননা । কল্পনাতীত ওই ঘটনাবলীর সময় কেউ উপস্থিত ছিল নাঃ মিথ ও প্রতীকসমূহই তাই এসব বর্ণনার উপযুক্ত উপায় বা মাধ্যম। এনুমা এলিশের প্রতি সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিপাত বহু শতাব্দী পরে আমাদের নিজস্ব স্রষ্টা ঈশ্বরের জন্মদানকারী আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে খানিকটা আভাস দেয়। যদিও সৃষ্টি সংক্রান্ত বাইবেলিয় ও কোরানের বিবরণ শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ আলাদা রূপ ধারণ করে, কিন্তু এই অদ্ভুত মিথগুলো কখনও সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়নি; বরং আরও পরে ঈশ্বরের ইতিহাসে একেশ্বরবাদী রূপকের আড়ালে আবার ফিরে এসেছে।

স্বয়ং দেবতাদের সৃষ্টির প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু হয়েছে কাহিনীর; এই থিম ইহুদি ও মুসলিয় অতিন্দ্রীয়বাদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে দেখব আমরা। আদিতে, এনুমা এলিশ বলছে, দেবতারা জোড়ায় জোড়ায় এক আকৃতিহীন জলীয় বিস্তার থেকে আবির্ভূত হন-খোদ এই জিনিসটি আবার স্বর্গীয়। বাবিলিনিয় মিথে-পরবর্তীকালে যেমন বাইবেলেও-শূন্য থেকে কোনও কিছু সৃষ্টি হয়নি; এই ধারণা প্রাচীন জগতে ছিল অপরিচিত। দেবতা বা মানুষের অস্তিত্বের আগে অনন্তকাল থেকে এই পবিত্র কাঁচামালের অস্তিত্ব ছিল। বাবিলনবাসীরা এই আদিম স্বর্গীয় বস্তু সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে একে মেসোপটেমিয়ার জলাভূমির মতো পতিত অঞ্চল ধরে নিয়েছিল, যেখানে বন্যা বারবার মানুষের ভঙ্গুর সৃষ্টিকে মুছে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চলত। সুতরাং এনুমা এলিশ-এ সৃষ্টি-পূর্ব বিশৃঙ্খলা বা পিণ্ড কোনও ভয়ঙ্কর ফেনিয়ে ওঠা বস্তু নয়, বরং এক কাদাময় বিশৃঙ্খলা যেখানে সবকিছু সীমা, সংজ্ঞা এবং পরিচয়বিহীন:

মিষ্টি ও তেতো
যখন এক সঙ্গে মিশে গেল, রঞ্জিত হয়নি কোনও তৃণ, স্রোতে
কাদাময় হয়ে ওঠেনি জল;
দেবতাগণ ছিলেন নামহীন, স্বভাবহীন, ভবিষ্যতহীন। [২]

এরপর আদি পতিত ভূমি থেকে উত্থিত হলেন তিনজন দেবতা: আপসু (নদীর মিঠা পানির অনুরূপ), তাঁর স্ত্রী তিয়ামাত (লোনা সমুদ্র) ও মাম্মু, বিশৃঙ্খল জরায়ু। তারপরও সত্যি বলতে এই দেবতারা ছিলেন আদি ও নিম্ন শ্রেণীর মডেল যাদের উন্নতির প্রয়োজন ছিল। ‘আপসু’ ও ‘তিয়ামাত’ নামগুলো ‘গহ্বর’ (abyss) ‘শূন্যতা’ (Void) কিংবা ‘অতলান্ত সাগর’ (bottomless gulf) হিসাবে অনুবাদ করা যেতে পারে। এগুলো আদিম আকৃতিহীনতার আকারহীন জড়তার কথা বলে যেগুলো তখনও স্বতন্ত্র পরিচয় লাভ করে উঠতে পারেনি।

পরবর্তী পর্যায়ে উৎসারণ (emanation) নামে পরিচিত এক প্রক্রিয়ায় ওদের মধ্য হতে অন্যান্য দেবতার আবির্ভাব ঘটেছে যা আমাদের ঈশ্বরের ইতিহাসের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। একে অপর হতে জোড়ায় জোড়ায় আবির্ভূত হয়েছেন নতুন দেবতা। স্বর্গীয় বিবর্তন ক্রিয়াশীল থাকায় পূর্ববর্তী দেবতার চেয়ে নতুন দেবতারা অর্জন করেছিলেন উন্নততর পরিচয়। গোড়াতে এসেছেন লাহমু এবং লাহাম; এদের নামে অর্থ ‘পঙ্ক’ (silt): (জল আর মাটি এখনও এক সঙ্গে মেশানো)। এরপর এলেন আনশের ও কিশার, (আকাশের দিগন্ত ও সাগরের প্রতিরূপ)। তারপর অনু (আকাশমণ্ডলী) ও ইয়া এলেন; যেন শেষ হলো গোটা প্রক্রিয়া। স্বর্গীয় জগতের আকাশ, নদী ও মাটি ছিল প্রত্যেকটা অপরের চেয়ে আলাদা ও সুস্পষ্ট। কিন্তু সৃষ্টির সূচনা ঘটেছিল কেবল: কেবল যন্ত্রণাদায়ক ও অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতার শক্তিকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল। তরুণ ও গতিশীল দেবতারা তাদের পিতামাতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন, কিন্তু আপসু ও মামুকে পরাজিত করতে পারলেও তিয়ামাতের বিরুদ্ধে টিকতে পারলেন না ইয়া । তিয়ামাত তাঁর পক্ষে যুদ্ধ করার জন্যে বিপুল সংখ্যক কদাকার দানব সৃষ্টি করলেন। সৌভাগ্যক্রমে চমৎকার একটা ছেলে ছিল ইয়া’র: মারদুক, সান গড, স্বর্গীয় ধারায় সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি। দেবতাদের মহাসংসদের এক সভায় মারদুক এই শর্তে তিয়ামাতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দিলেন যে, বিনিময়ে তাঁকে শাসন ক্ষমতা দিতে হবে। কিন্তু এরপরেও অনেক কষ্টেসৃষ্টে দীর্ঘস্থায়ী এক বিপজ্জনক লড়াইতে তিয়ামাতকে হত্যা করতে সক্ষম হলেন তিনি। এই মিথে সৃজনশীলতা হচ্ছে এক ধরনের সংগ্রাম, সীমাহীন বৈরিতার বিরুদ্ধে যাকে অর্জন করতে হয়েছে।

অবশ্য, শেষ পর্যন্ত তিয়ামাতের বিশাল শবদেহের ওপর দাঁড়িয়ে মারদুক এক নতুন বিশ্ব সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়েই আকাশের খিলান ও মানুষের পৃথিবী সৃষ্টির জন্যে তিয়ামাতের দেহ টুকরো করেন। এরপর সৃষ্টি করলেন বিধান যা সমস্ত কিছু যথাস্থানে রাখবে। শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। কিন্তু বিজয় তখনও সংহত হয়নি। বছরের পর বছর বিশেষ শাস্ত্রীয় আচারের মাধ্যমে একে বারবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ কারণেই দেবতাগণ নতুন পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল বাবিলনে মিলিত হলেন, এখানে এক মন্দির নির্মাণ করা হলো যাতে স্বর্গীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা যায়। ফলাফল, মারদুকের সম্মানে নির্মিত বিশাল যিগুরাত-’পার্থিব মন্দির অসীম স্বর্গের প্রতীক। কাজ শেষ হওয়ার পর একেবারে শীর্ষে আসন গ্রহণ করলেন মারদুক আর অন্য দেবতাগণ সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন: এটা দেবতার প্রিয় শহর, বাবিলন নগরী, আপনার প্রিয় দেশ!’ এরপর আচার পালন করলেন তাঁরা, যেখান থেকে গোটা বিশ্বজগৎ এর নিয়ম কানুন পায়, অদৃশ্য গোপন জগৎ সহজ হয়ে যায় এবং দেবতাগণ বিশ্বজগতে যার যার নির্দিষ্ট স্থান লাভ করেন। এসব আইন ও আচার অনুষ্ঠান পালন প্রত্যেকের জন্যে বাধ্যতামূলক; এমনকি সৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দেবতাদেরও এগুলো মানতে হবে । এই মিথ বাবিলনবাসীরা যেভাবে দেখেছে সেভাবে সভ্যতার অন্তর্নিহিত অর্থ প্রকাশ করে। এরা ভালো করেই জানত যে তাদের পূর্বসুরিরাই যিগুরাত নির্মাণ করেছিল, কিন্তু এনুমা এলিশের গল্পটি তাদের এই বিশ্বাসকেই ফুটিয়ে তোলে যে, তাদের সৃজনশীল প্রয়াস কেবল স্বর্গীয় ক্ষমতায় অংশী হতে পারলেই টিকে থাকবে। নববর্ষে তাদের পালিত শাস্ত্রীয় আচার মানুষের সৃষ্টির আগেই নির্ধারণ করা হয়েছে: বস্তুনিচয়ের খোদ প্রকৃতির মাঝেই লেখা আছে এসব, এমনকি দেবতারাও যা মানতে বাধ্য। এই মিথ তাদের এই বিশ্বাসও ফুটিয়ে তোলে যে, বাবিলন এক পবিত্র ভূমি, বিশ্বজগতের কেন্দ্রস্থল ও দেবতাদের আবাসসকল প্রাচীন ধর্মেই এই ধারণাটি দারুণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একটি পবিত্র নগরীর ধারণা–নারী-পুরুষ যেখানে সকল বস্তু ও ফলের উৎস পবিত্র ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার বোধ অনুভব করে–আমাদের নিজস্ব ঈশ্বরের তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

সবশেষে যেন চকিত চিন্তা থেকেই মানুষ সৃষ্টি করলেন মারদুক। তিনি কিংশুকে (কিংগু ছিলেন তিয়ামাতের জড়বুদ্ধি সহচর, আপসুর পরাজয়ের পর যাকে সৃষ্টি করেছিলেন) আটক ও হত্যা করে স্বর্গীয় রক্ত ও মাটি মিশিয়ে সৃষ্টি করলেন প্রথম মানব। সবিস্ময় ও সশ্রদ্ধায় তা প্রত্যক্ষ করলেন দেবতারা। মানুষের সৃষ্টিরই এই পৌরাণিক বিবরণে কিছুটা রসিকতার ছোঁয়া আছে; মানুষ সৃষ্টির সেরা নয়, বরং সবচেয়ে নির্বোধ ও অকর্মা দেবতা থেকে উদ্ভূত। তবে এ কাহিনী আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও তুলে ধরে-প্রথম মানুষকে এক দেবতার দেহাবশেষ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছিল: সীমিত পরিসরে হলেও সে স্বর্গীয় প্রকৃতির অংশীদার। মানুষ ও দেবতাদের মাঝে সাগরসম দূরত্ব নেই। স্বাভাবিক পৃথিবী, নারী-পুরুষ ও স্বয়ং দেবতাগণ, সবাই একই প্রকৃতির অংশীদার; তারা একই স্বর্গীয় বস্তু হতে সৃষ্ট। পৌত্তলিক দর্শন ছিল হলিস্টিক: দেবতাগণ সম্পূর্ণ রূপতাত্ত্বিক স্তরে মানবজাতির সঙ্গে সম্পর্করহিত নন: ঐশ্বরিকতা মানুষ থেকে আবশ্যিকভাবে বিচ্ছিন্ন নয়। সুতরাং, দেবতাদের বিশেষ আবির্ভাব বা স্বর্গ থেকে স্বর্গীয় আইন অবতীর্ণ হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। দেবতা ও মানবজাতিকে একই সংকট মোকাবিলা করতে হয়, পার্থক্য একটাই সেটা হচ্ছে, দেবতা অনেক শক্তিমান ও অমর। এই হলিস্টিক দর্শন কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই সীমিত ছিল না, বরং প্রাচীন বিশ্বে একটি সাধারণ বিষয় ছিল। বিসিই ষষ্ঠ শতকে পিন্ডার তাঁর অলিম্পিক গেমসের গানে এই বিশ্বাসের গ্রিক রূপটি তুলে ধরেছেন:

মানুষ ও দেবতার জাতি একই;
একই মায়ের কাছ থেকে আমরা নিশ্বাস নিই।
কিন্তু সর্ববিষয়ে ক্ষমতার পার্থক্য আমাদের বিচ্ছিন্ন রাখে।
কারণ একটি কিছুই নয়;
কিন্তু তামাটে আকাশ চিরস্থায়ী তৎপরতার মতো স্থির
তবু মনের কিংবা দেহের বিশালত্ব দিয়ে
আমরা অমরদের মতো হতে পারি। [৪]

নিজস্ব সাফল্য অর্জনে ব্যায়ামরত ক্রীড়াবিদদের তাদের নিজস্ব রূপে না দেখে, পিন্ডার তাদের দেবতাদের দেখানো উদাহরণের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন, যাঁরা ছিলেন সকল মানবীয় অর্জনের আদর্শ। ধরা-ছোঁয়ার অতীত এমন কেউ হিসাবে মানুষ দাসের মতো দেবতাদের অনুকরণ করছে না বরং নিজেদের সুপ্ত স্বর্গীয় প্রকৃতি জাগিয়ে তোলার প্রয়াস পাচ্ছে।

মারদুক ও তিয়ামাতের মিথ কানানবাসীদের প্রভাবিত করেছিল বলে মনে হয়: তারাও ঝড় ও উর্বরতার দেবতা বাআল-হাবাদ (Baal-Habad)-এর প্রায় একই রকম কাহিনী বর্ণনা করেছে। বাইবেলে প্রায়ই একেবারে প্রশংসাহীন সুরে এই দেবতার উল্লেখ আছে। সাগর ও নদীর দেবতা ইয়াম-নাহারের সঙ্গে বাআলের যুদ্ধের কাহিনী বিসিই চতুর্থ দশকে প্রস্তরলিপিতে পাওয়া গেছে। কানানের পরম প্রভু এলের (El) সঙ্গে বাস করতেন বাআল ও ইয়াম দুজনই। এলের সভায় ইয়াম তাঁর হাতে বাআলকে তুলে দেওয়ার দাবি জানালেন। দুটি মন্ত্রপুতঃ অস্ত্রের সাহায্যে ইয়ামকে পরাস্ত করলেন বাআল, তাকে যখন হত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন, এমন সময় আশেরাহ (এলের স্ত্রী ও দেবকুলের মাতা) আবেদন জানালেন যে, একজন বন্দিকে হত্যা করা অসম্মানজনক। বাআল লজ্জিত হয়ে ইয়ামকে ছেড়ে দিলেন, যিনি পৃথিবীকে বানের জলে ভাসিয়ে দেওয়ার ক্রমাগত হুমকি দিয়ে সাগর ও নদীর বৈরী দিকের প্রতিনিধিত্ব করেন, অন্যদিকে ঝড়ের দেবতা বাআল পৃথিবীকে করে তোলেন উর্বর। মিথের আরেকটি ভাষ্যে বাআল সাতমাথাঅলা ড্রাগন লোকান, হিব্রুতে লেভিয়াথান নামে আখ্যায়িত, কে হত্যা করেন। প্রায় সকল সংস্কৃতিতেই ড্রাগন হচ্ছে সুপ্ত, অসংগঠিত ও বৈশিষ্ট্যহীনতার প্রতীক। এইভাবে বাআল এক প্রকৃত সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে আদি আকারহীনতায় প্রত্যাবর্তন রোধ করেছেন ও উপহার হিসাবে তার সম্মানে দেবতাদের নির্মিত এক অপরূপ প্রাসাদ লাভ করেছেন। সুতরাং, একেবারে আদিম ধর্মে সৃজনশীলতাকে স্বর্গীয় হিসাবে দেখা হয়েছে: এখনও আমরা বাস্তবপক্ষে নতুন রূপদানকারী ও বিশ্বজগতের নতুন অর্থ প্রকাশক সৃজনশীল ‘অনুপ্রেরণা”-কে প্রকাশ করতে ধর্মীয় ভাষা ব্যবহার করে থাকি।

কিন্তু বিপরীত দিকে যাত্রা করেন বাআল: মৃত্যু বরণ করেন তিনি, তাঁকে অবতরণ করতে হয় মৃত্যু ও দেবতা মত-এর জগতে। পুত্রের পরিণতি জানতে পেরে পরম ঈশ্বর এ সিংহাসন ছেড়ে নেমে আসেন, গায়ে চাপান মোটা পোশাক, গালে বাড়তি জিনিস খুঁজে দেন, কিন্তু পুত্রকে উদ্ধার করতে পারেন না। বাআলের প্রেমিকা ও বোন আনা স্বর্গরাজ্য ছেড়ে নেমে এসে তার যমজ আত্মার সন্ধ্যানে বের হন, ‘গরু যেভাবে বাছুর বা ভেড়া যেভাবে তার বাচ্চাকে চায় সেভাবে তাঁকে কামনা করলেন তিনি। মৃতদেহের খোঁজ পাবার পর তাঁর সম্মানে অন্তেষ্টিভভাজের আয়োজন করলেন, তারপর মত-কে বন্দি করে তরবারির আঘাতে টুকরো টুকরো করে ভুট্টার মতো পিষে পুঁতে দিলেন জমিনে। অন্যান্য মহান দেবীগণ ইনানা, ইশতার ও আইসিস সম্পর্কেও একই রকম কাহিনী বর্ণিত হয়েছে–যারা নিহত দেবতার সন্ধান করেছেন ও পৃথিবীর মাটিতে নতুন জীবন ফিরিয়ে এনেছেন। যা হোক, আনাতের বিজয়কে অবশ্যই আচরিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বছরের পর বছর স্থায়ী রূপ দিতে হবে । পরে–আমরা জানি না কীভাবে, কারণ আমাদের সূত্র পূর্ণাঙ্গ নয়–বাআলকে পুনরুজ্জীবিত করে আনাতকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বিপরীত লিঙ্গের একীভুতকরণের ভেতর দিয়ে প্রতীকায়িত পরিপূর্ণতা ও সাম্যের এই মহিমান্বিতকরণ প্রাচীন কানানে আচরিক যৌনতার মাধ্যমে পালিত হতো। এইভাবে দেবতাদের অনুকরণের মাধ্যমে নারী-পুরুষ বন্ধ্যাত্যের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের অংশীদার হতো আর সাগরের সৃজনশীলতা ও উর্বরতা নিশ্চিত করত। একজন দেবতার মৃত্যু, দেবীর অনুসন্ধান ও স্বর্গীয় পরিমণ্ডলে বিজয়ীরূপে প্রত্যাবর্তন বহু সংস্কৃতিতেই চিরকালীন ধর্মীয় থিম ছিল এবং ইহুদি, ক্রিশান ও মুসলিমদের উপাস্য এক ঈশ্বরের একেবারে ভিন্ন ধর্মেও তা পুনরাবৃত্ত হবে।

বাইবেলে আব্রাহামের ওপর এই ধর্ম প্রযুক্ত হয়েছে। আনুমানিক বিসিই বিংশ ও উনবিংশ শতকের মাঝামঝি কোনও এক সময় উর ত্যাগ করে শেষ পর্যন্ত কানানে বসতি গড়েছিলেন আব্রাহাম। আমাদের কাছে আব্রাহামের সমসাময়িক কোনও দলিলপত্র নেই, তবে পণ্ডিতরা মনে করেন তিনি হয়তো যাযাবর গোত্রপ্রধানদের কেউ ছিলেন যিনি বিসিই তৃতীয় সহস্রাব্দের শেষ দিকে স্বজাতিকে নিয়ে মেসোপটেমিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্যে আগমনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই যাযাবররা, মেসোপটেমিয়া ও মিশরিয় সূত্রসমূহে যাদের আবিরু, আপিরু বা হাব্বির নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে, পশ্চিমা সেমিটিক ভাষায় কথা বলত, হিব্রু এমনি একটি ভাষা। এরা মৌসুমী চক্রের ধারা অনুযায়ী দল বেঁধে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাড়ি জমানো যাযাবর বেদুঈনদের মতো ছিল না; এদের কোনও বিশেষ গোত্রে ফেলা বেশ কঠিন; ফলে এরা প্রায়শঃই রক্ষণশীল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ত। মরুবাসীদের তুলনায় এদের সাংস্কৃতিক মর্যাদা ছিল উন্নততর। কেউ কেউ মার্সেনারি হিসাবে কাজ করত, অন্যরা সরকারি কাজে যোগ দিয়েছিল, বাকিরা বণিক, দাস বা কামারে পরিণত হয়। বুক অভ জেনেসিসে বর্ণিত আব্রাহামের কাহিনীতে তাঁকে সদোমের রাজার পক্ষে মার্সেনারি হিসাবে কর্মরত দেখানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তার স্ত্রী সারাহ মারা গেলে বর্তমান পশ্চিম তীরবর্তী হেবরনে জমি ক্রয় করেন আব্রাহাম।

জেনেসিসে বর্ণিত আব্রাহাম ও তাঁর নিকটতম বংশধরদের কাহিনী আধুনিককালের ইসরায়েল-এর কানানে তিনটি প্রধান হিব্রু বসতি ধারার ইঙ্গিতবহ হয়ে থাকতে পারে। একটি ধারা আব্রাহাম ও হেবরনের সঙ্গে সম্পর্কিত আনুমানিক বিসিই ১৮৫০ সংঘটিত হয়েছে। অভিবাসনের দ্বিতীয় ধারাটি আব্রাহামের পৌত্র জ্যাকবের সঙ্গে সম্পর্কিত যার নাম পরে ইসরায়েল রাখা হয়, (ঈশ্বর যেন তার শক্তির প্রকাশ ঘটান’); বর্তমান পশ্চিম তীরের আরব শহর নাবলুস, তখনকার শেচেমে বসতি করেছিলেন তিনি। বাইবেল আমাদের জানাচ্ছে, ইসরায়েলের বারটি গোত্রের পূর্বপুরুষে পরিণত জ্যাকবের পুত্র কানানের এক ভয়াবহ খরার সময় মিশরে অভিবাসী হয়েছিলেন। আনুমানিক বিসিই ১২০০ সালে ঘটেছিল হিব্রু বসতির তৃতীয় পর্যায়, এই সময় আব্রাহামের বংশধর বলে দাবিদার গোত্রগুলো মিশর থেকে কানানে এসে পৌঁছেছিল। তারা বলেছিল মিশরিয়রা তাদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছিল, কিন্তু তাদের নেতা মোজেসের উপাস্য ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ তাদের মুক্তি দিয়েছেন। জোরপূর্বক কানানে প্রবেশাধিকার আদায় করার পর তারা স্থানীয় হিব্রুদের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তুলে ইসরায়েলি জাতি হিসাবে পরিচিতি লাভ করে । বাইবেল এটা স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, আমাদের পরিচিত প্রাচীন ইসরায়েলিরা মোজেসের ঈশ্বর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র প্রতি আনুগত্যের সুবাদে ঐক্যবদ্ধ বিভিন্ন জাতিগত দলের একটা কনফেডারেশন ছিল। অবশ্য বাইবেলিয় বিবরণ বহু শত বছর পর, আনুমানিক বিসিই অষ্টম শতকে লিপিবদ্ধ হয়েছে, যদিও তা নিশ্চিতভাবে অতীতের কল্পকাহিনীর সূত্রই অনুসরণ করেছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে জার্মানির বাইবেল পণ্ডিতগণ একটা জটিল পদ্ধতি গড়ে তোলেন যার মাধ্যমে বাইবেলের প্রথম পাঁচটি পুস্তক জেনেসিস, এক্সোডাস, লেভিটিকাস, নাম্বারস ও ডিউটেরোনমি-এর চারটি আলাদা উৎস শনাক্ত করা গেছে। পরবর্তীকালে এগুলোকে বিসিই পঞ্চম শতকে পেন্টাটিউক নামে পরিচিত একটি চূড়ান্ত খণ্ডে একীভূত করা হয়। সমালোচনার এই ধারা তীব্র বিরোধের মুখে পড়লেও এখন পর্যন্ত কেউ এমন কোনও সূত্র আবিষ্কার করতে পারেননি যা দিয়ে সৃজন এবং প্লাবনের মতো বাইবেলের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সম্পূর্ণ ভিন্ন বিবরণ কিংবা মাঝে মাঝে বাইবেলে পরস্পর বিরোধিতা পরিলক্ষিত হয় কেন তার কারণ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। বাইবেলের দুজন আদি লেখক, জেনেসিস ও এক্সোডাসে যাদের রচনা পাওয়া যায়, সম্ভবত অষ্টম শতকে লিখেছিলেন, যদিও কেউ কেউ আরও আগের কথা বলেন। একজন ‘J’ নামে পরিচিত ছিলেন, কারণ তিনি তাঁর ঈশ্বরকে ‘ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌’ ডাকেন, অপরজন ‘E’ যেহেতু অধিকতর আনুষ্ঠানিক স্বর্গীয় উপাধি ‘ইলোহিম’ ব্যবহার পছন্দ করতেন। অষ্টম শতক নাগাদ ইসরায়েলিরা কানানকে দুটো পৃথক রাজ্যে বিভক্ত করেছিল। দক্ষিণের জুদাহ্ রাজ্যে রচনায় ব্যস্ত ছিলেন ‘J’. এদিকে ‘E’এসেছিলেন উত্তরের ইসরায়েল রাজ্য থেকে (মানচিত্র দেখুন, পৃ: ১৪)। পেন্টাটুয়েকের অন্য দুটি উৎস-ডিউটেরোনমিস্ট (D) এবং প্রিস্টলি (P)-র বর্ণিত ইসরায়েলের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কিত বিবরণ আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে। আলোচনা করব।

আমরা দেখব যে, বহু ক্ষেত্রে এবং E উভয়ই মধ্যপ্রাচ্য তাদের প্রতিবেশীদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতেন, কিন্তু তাদের বিবরণ দেখায়, বিসিই অষ্টম শতক নাগাদ ইসরায়েলিরা তাদের নিজস্ব একটা দর্শন গড়ে তুলতে যাচ্ছিল। উদাহরণস্বরূপ: তারা বিশ্বজগতের সৃষ্টির এক বিবরণের মাধ্যমে ঈশ্বরের ইতিহাসের বর্ণনা শুরু করেছেন, এনুমা এলিশের বিচারে যা নেহাৎ দায়সারা গোছের:

ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ঈশ্বর যখন আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেন, সেই সময় পৃথিবীতে কোনও বুনো ঝোঁপ জন্ম নেয়নি, গজিয়ে ওঠেনি কোনও বুনো গাছও, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ঈশ্বর তখনও বৃষ্টি বর্ষণ করাননি বা জমি কর্ষণের জন্য তখনও আবির্ভাব ঘটেনি মানুষের। যাহোক, জমিন থেকে বন্যার জল ক্রমশঃ বেড়ে উঠে ভরিয়ে দিচ্ছিল গোটা ভূমি। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ঈশ্বর মাটির মানুষকে (আদম) মাটি (আদামাহ) হতে তৈরি করলেন। তারপর তার নাকে ফুঁ দিয়ে প্রাণ সঞ্চার করলেন তিনি এবং এইভাবে মানুষ জীবীত প্রাণে পরিণত হল।[৬]

এটা ছিল একেবারে ভিন্ন পথে যাত্রা। মেসোপটেমিয়া ও কানানের সমসাময়িক পৌত্তলিকদের মতো বিশ্ব সৃষ্টি ও প্রাগৈতিহাসিক কালের ওপর গুরুত্ব আরোপের বদলে সাধারণ ঐতিহাসিক কালের ব্যাপারেই যেন বেশি আগ্রহী। বিসিই ষষ্ঠ শতকের আগে ইসরায়েলে সৃষ্টি বিষয়ে প্রকৃত আগ্রহ দেখা যায়নি, সেই সময় আমরা যাকে ‘P’ আখ্যায়িত করি, এই রচয়িতা, বর্তমান জেনেসিসের প্রথম অধ্যায়ের তাঁর রাজকীয় বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ই যে আকাশ ও পৃথিবীর একক স্রষ্টা, এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন তিনি। অবশ্য মানুষ ও স্বর্গীয় সত্তার মধ্যকার সুনির্দিষ্ট পার্থক্য সম্পর্কে ‘J–এর ধারণা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। স্রষ্টা বা দেবতার মতো একই উপাদানে গঠিত হওয়ার বদলে মানুষ (আদম), পান হতে বোঝা যায়, পৃথিবী (আদামাহ)রই অংশ।

পৌত্তলিক পড়শীদের বিপরীতে জাগতিক ইতিহাসকে দেবতাদের আদিম, পবিত্র সময়ের তুলনায় তুচ্ছ, নাজুক ও গুরুত্বহীন বলে নাকচ করে দেননি তিনি। পৌরাণিক সময়কাল অতিক্রম না করা পর্যন্ত অত্যন্ত দ্রুত অগ্রসর হয়েছেন তিনি, যেখানে প্লাবন ও টাওয়ার অভ বাবেলের মতো গল্পগুলো অন্তর্ভুক্ত; তারপর ইসরায়েলের জাতির ইতিহাস বর্ণনায় হাত দিয়েছেন। দ্বাদশ অধ্যায়ে আব্রাম, পরে যার নাম আব্রাহাম হিসাবে (বহুজনের পিতা) পুণর্নামকরণ হয়েছে, যখন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র কাছ থেকে নির্দেশিত হলেন যে, বর্তমান পূর্ব তুরস্কের হারানে তাঁর পরিবার ত্যাগ করে ভূমধ্যসাগর নিকটবর্তী কানানে অধিবাসী হওয়ার, তখন এর শুরু। আমাদেরকে জানান হয়েছে যে, তাঁর পৌত্তলিক পিতা তোবেহ্ উর থেকে আগেই সপরিবারে পশ্চিমে যাত্রা করেছিলেন। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ এবার আব্রাহামকে বলছেন, তার বিশেষ নিয়তি নির্ধারিত রয়েছে: তিনি এমন এক শক্তিশালী জাতির পিতায় পরিণত হবেন একদিন যাদের মোট সংখ্যা আকাশের তারার সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে এবং একদিন তাঁর উত্তরসুরিরা কানানের অধিকার লাভ করবে আপন ভূমির মতো করেই। ‘J’ বর্ণিত আব্রাহামের আহ্বান শোনার কাহিনী এই ঈশ্বরের আগামী ইতিহাসের ধারা স্থির করে দিচ্ছে। প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যে আচার অনুষ্ঠান ও মিথে স্বর্গীয় মানার (mana) অভিজ্ঞতা অনুভূত হতো। মারদুক, আআল ও আরাত নিজেদের তাদের উপাসকদের সাধারণ, তুচ্ছ জীবনের সঙ্গে জড়াবেন বলে ভাবা হয়নিঃ পবিত্র সময়ে তাঁদের কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েলের ঈশ্বর বাস্তব জগতের চলতি ঘটনাপ্রবাহে আপন ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। বর্তমানেই এক আজ্ঞা হিসাবে অনুভূত হয়েছেন তিনি। নিজ সম্পর্কে তাঁর প্রথম প্রত্যাদেশ ছিল একটি নির্দেশ: আব্রাহামকে আপন জাতিকে ত্যাগ করে কানান। দেশে পাড়ি জমাতে হবে।

কিন্তু ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ কে? আব্রাহাম কি মোজেসের মতো একই ঈশ্বরের উপাসনা করেছেন, নাকি তাকে ভিন্ন কোনও নামে চিনতেন তিনি? বর্তমান কালে বিষয়টি আমাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কিন্তু বাইবেলে যেন এ বিষয়টি অদ্ভুতভাবে অস্পষ্টতায় আবদ্ধ এবং এ প্রশ্নের স্ববিরোধী জবাব দেয়। ‘‘ বলছেন যে, আদমের পৌত্রের কাল থেকেই মানুষ ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র উপাসনা করে আসছে, কিন্তু ষষ্ঠ শতকে ‘P’ যেন বোঝাতে চাইছেন জ্বলন্ত ঝোপে (Buruing Bush) তিনি মোজেসের কাছে আবির্ভূত হওয়ার আগ পর্যন্ত ইসরায়েলিরা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র কথা জানতই না। ‘P’ ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে দিয়ে ব্যাখ্যা করাচ্ছেন, তিনি প্রকৃতই আব্রাহামের ঈশ্বর, যেন এটি একটি বিতর্কিত ধারণা: মোজেসকে তিনি বলছেন, আব্রাহাম তাঁকে ‘এল শাদ্দাই’ বলে ডাকতেন এবং স্বর্গীয় নাম ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ছিল তাঁর অজ্ঞাত।’ অসামঞ্জস্যতাটুকু যেন বাইবেলের রচয়িতা বা সম্পাদকদের খুব একটা বিচলিত করেনি। আগাগোড়া তাঁর ঈশ্বরকে ‘ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌’ নামে অভিহিত করেছেন। তাঁর রচনাকালে ইয়েহ্ওয়েই ছিলেন ইসরায়েলের ঈশ্বর, এখানে আর কিছু দেখার ছিল না। ইসরায়েলি ধর্ম ছিল বাস্তবভিত্তিক, আমাদের বিচলিত করে তোলার মতো অনুমান নির্ভর। বর্ণনার ব্যাপারে তেমন উৎসাহী ছিল না। কিন্তু তারপরেও আমাদের এটা ধরে নেওয়া উচিত হবে না যে আব্রাহাম বা মোজেস বর্তমানের আমাদের মতো করে তাঁদের ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতেন। বাইবেলের কাহিনী ও পরবর্তীকালের ইসরায়েলি ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের পরিচয় এত নিগুঢ় যে আমরা পরবর্তী সময়ের ইহুদি ধর্ম সংক্রান্ত জ্ঞান এইসব প্রাচীন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের ওপর আরোপ করতে প্ররোচিত হই। এভাবে আমরা ধরে নিই, ইসরাইয়েলের তিন পূর্ব পুরুষ আব্রাহাম, তার পুত্র ইসাক ও পৌত্র জ্যাকব একেশ্বরবাদী ছিলেন, তাঁরা একজন মাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। ব্যাপারটা এমন ছিল বলে মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে, এটা বলা বোধ হয় অধিকতর সঠিক হবে যে, এইসব আদি হিব্রু পৌত্তলিক কানানে তাঁদের প্রতিবেশীদের নানান ধর্মীয় ধ্যানধারণার অংশীদার ছিলেন। নিশ্চয়ই তারা মারদুক, বাআল ও আনাতের মতো দেব দেবীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে থাকবেন। হয়তো তারা একই দেবতার উপাসনা করেননিঃ এমন হতে পারে যে আব্রাহামের ঈশ্বর, ইসাকের ‘আতঙ্ক’ কিংবা বা ‘কিনসম্যান’ ও জ্যাকবের ‘মাইটি ওয়ান’ তিন জন ভিন্ন দেবতা ছিলেন। [৮]

আরও অগ্রসর হতে পারি আমরা। এটা হওয়া খুবই সম্ভব যে আব্রাহামের ঈশ্বর ছিলেন কানানের পরম ঈশ্বর এল। এই দেবতা স্বয়ং আব্রাহামের কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছেন এল শাদ্দাই (পর্বতের এল) হিসাবে যা ছিল এল-এর প্রচলিত উপাধির একটি।[৯] অন্যত্র তাঁকে এল এলিয়ন (The Most High god) বা এল অভ বেথেল বলা হয়েছে। কানানের পরম ঈশ্বরের নাম ইসরায়েল বা। ইশমা-এল এর মতো হিব্রু নামে সংরক্ষিত আছে। তারা এমনভাবে তাঁকে প্রত্যক্ষ করেছিল যা মধ্যপ্রাচ্যের পৌত্তলিকদের অপরিচিত ছিল না। আমরা দেখব, বহু শতাব্দী পরে ইসরায়েলিরা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌স্র মানা বা ‘পবিত্রতা’-কে ভীতিকর অভিজ্ঞতা হিসাবে আবিষ্কার করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, সিনাই পর্বতচূড়ায় এক বিস্ময় ও ভয় জাগানো আগ্নেয়গিরির অগ্নৎপাতের মাঝে মোজেসের সামনে দেখা দেন তিনি, ইসরায়েলিদের তাঁর সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে হয়েছে। সে তুলনায় আব্রাহামের দেবতা এল অনেক নমনীয় উপাস্য। আব্রাহামের সামনে বন্ধু হিসাবে আবির্ভূত হন তিনি, কখনও কখনও এমনকি মানুষের রূপও গ্রহণ করতেন। এপিফ্যানি নামে পরিচিত এক ধরনের অনুপ্রেরণা প্রাচীন পৌত্তলিক সমাজে সর্বজনবিদিত ছিল। যদিও সাধারণভাবে দেবতারা মরণশীল নারী-পুরুষের জীবন-ধারায় সরাসরি ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করা হতো না, তবুও পৌরাণিক কালে বিশেষ সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা দেবতাদের প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। ইলিয়াদ একরম এপিফ্যানিতে পরিপূর্ণ। গ্রিক ও ট্রোজান উভয়ের কাছেই স্বপ্নের মাধ্যমে দেব-দেবীরা। এসেছেন, এই সময় মানবীয় ও স্বর্গীয় জগতের সীমানা প্রাচীর উন্মোচিত হয় বলে বিশ্বাস করা হতো। ইলিয়াদের একেবারে শেষ পর্যায়ে এক আকর্ষণীয়। তরুণ প্রিয়ামকে পথ দেখিয়ে গ্রিক জাহাজ বহরের কাছে নিয়ে যান যিনি শেষ পর্যন্ত নিজেকে হারমিস বলে পরিচয় দিয়েছেন। গ্রিকরা যখন তাদের বীরদের স্বর্ণযুগের কথা ভাবে, তারা অনুভব করে যে সেই বীরগণ দেবতাদের অনেক কাছাকাছি ছিলেন, দেবতারা আবার যা হোক মানব সন্তানদের মতো। একই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। এপিফ্যানির এইসব গল্প হলিস্টিক পৌত্তলিক দর্শন প্রকাশ করেছে: স্বর্গ যখন অত্যাবশ্যকীয়ভাবে প্রকৃতি বা মানুষের চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল না তখন কোনওরকম ঝামেলা ছাড়াই তার অভিজ্ঞতা লাভ সম্ভব ছিল। জগৎ দেবতায় পরিপূর্ণ ছিল; যে কোনও সময়। অপ্রত্যাশিতভাবে কোনও এক কোণে কিংবা হেঁটে বেড়ানো কোনও পথিকের মাঝে তাদের দেখা মিলে যেতে পারে। মনে হয় সাধারণ মানুষ হয়তো বিশ্বাস। করত যে, এই ধরনের সাক্ষাৎ তাদের জীবনেও সম্ভব পর। এ থেকে অ্যাক্টস অভ দ্য অ্যাপসলস এর অদ্ভুত কাহিনীর ব্যাখ্যা মিলতে পারে। বিসিই প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে বর্তমানে তুরস্ক নামে পরিচিত দেশের লিস্ট্রাবাসী অ্যাপসল পল ও তাঁর শিষ্য বার্নাবাসকে জিউস ও হারমিস বলে ভুল। করেছিল।[১১]

মোটামুটি একইভাবে ইসরায়েলিরা যখন তাদের স্বর্ণযুগের কথা ভাবে, তারা আব্রাহাম, ইসাক ও জ্যাকবকে তাদের ঈশ্বরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ শর্তাধীনে জীবন যাপন করতে দেখে। কোনও শেখ বা চীফটেইনের মতোই এল তাঁদের বন্ধুত্বপূর্ণ উপদেশ দেন: ভ্রমণের সময় পথ দেখান, জানিয়ে দেন কাকে বিয়ে করতে হবে, স্বপ্নে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। মাঝে মাঝে তাঁকে মনুষ্য আকৃতিতে দেখতে পান তারা। এই ধারণাটি পরবর্তীকালে ইসরায়েলিদের জন্যে অভিশাপে পরিণত হবে। জেনেসিসের অষ্টাদশ অধ্যায়ে ‘J’ আমাদের বলছেন, হেবরনের নিকটবর্তী মামরির ওক গাছের পাশে আব্রাহামের সামনে আবির্ভূত হলেন ঈশ্বর। দিনের উত্তপ্ততম সময়ে চোখ তুলে তাকিয়ে তিনজন আগন্তুককে নিজ তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসতে দেখেছিলেন আব্রাহাম। মধ্যপ্রাচ্যের স্বাভাবিক আতিথেয়তাবোধ থেকে তিনি ওঁদের বসে বিশ্রাম নেওয়ার ওপর জোর দেন তারপর দ্রুত খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কথোপকথনের ভেতর দিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এই লোকগুলোর মাঝে একজন তার দেবতা ছাড়া আর কেউ নন, ‘ যাকে সবসময় ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌’ বলছেন। বাকি দুজন ফেরেশতা বা অ্যাঞ্জেল বলে জানা গেল। এই রহস্য উদঘাটনে কেউই খুব একটা বিস্মিত হয়েছিল বলে মনে হয় না। বিসিই অষ্টম শতাব্দীতে ‘J’ যখন বাইবেল রচনা করছেন, তখন কোনও ইসরায়েলি এভাবে ঈশ্বরকে দেখার প্রত্যাশা করত নাঃ অধিকাংশই এমন ধারণাকে ভীতিকর মনে করত। J’-এর সমসাময়িক ‘E’ ঈশ্বরের সঙ্গে ধর্মপিতাদের অন্তরঙ্গতার গল্পগুলোকে বেমানান মনে করেছেন: আব্রাহাম বা জ্যাকবের কাহিনী বর্ণনার সময় ‘E’ ঘটনাবলীকে বহুকাল আগের বোঝাতে পছন্দ করেছেন এবং প্রাচীন কিংবদন্তীকে মনুষ্য রচনা তুল্য দাবি করার ব্যাপারে সীমা মেনে চলেছেন। এভাবে তিনি বলেছেন, ঈশ্বর একজন ফেরেশতার মাধ্যমে আব্রাহামের সঙ্গে কথা বলেছেন। ‘ অবশ্য এ ধরনের খুঁতখুঁতে মনোভাব পোষণ করেননি, নিজের বর্ণনায় এইসব আদিম এপিফ্যানির পুরোনো স্বাদ বজায় রেখেছেন।

জ্যাকবও বেশ কিছু এপিফ্যানির অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। একবার নিকটজনের মাঝ থেকে একজন স্ত্রী পছন্দ করার জন্যে হারানে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। যাত্রার প্রথম পর্যায়ে, জর্দান উপত্যকার কাছে লুয (Luz)-এর একটা পাথরকে বালিশের মতো ব্যবহার করে ঘুমিয়ে পড়েন। সেরাতে স্বপ্নে একটা মই দেখতে পান তিনি যেটা স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করেছে: দেবতা ও মানুষের জগতের মাঝখানে ওঠানামা করছে ফেরেশতারা। মারদুকের যিগুরাতের কথা মনে না করে পারি না আমরা: স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝে ঝুলন্ত যিগুরাতের চূড়ায় একজন মানুষ তার দেবতাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারত। মইয়ের শেষ ধাপে জ্যাকব এল-কে দেখেছেন বলে স্বপ্নে দেখলেন, এল তাঁকে আশীর্বাদ করলেন এবং আব্রাহামকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি করলেন: জ্যাকবের বংশধররা এক শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হয়ে কানান দেশের মালিক হবে। তিনি আরও একটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যা জ্যাকবের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রেখেছিল বলে আমরা। দেখব। পৌত্তলিক ধর্ম প্রায়শঃই এলাকা বা অঞ্চলভিত্তিক হতো: একটা নির্দিষ্ট এলাকায় কেবল বিশেষ দেবতার এখতিয়ার থাকে, বাইরে কোথাও গেলে সেখানকার স্থানীয় দেবদেবীর উপাসনা করাই বুদ্ধিমানের পরিচায়ক। কিন্তু জ্যাকবকে এল প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে জ্যাকব কানান ত্যাগ করে যখন অচেনা দেশে যাবেন তখনও তিনি তাকে রক্ষা করবেন: ‘আমি তোমার সঙ্গে আছি তুমি যেখানেই যাবে, আমি তোমাকে নিরাপদে রাখব। প্রথম দিকের এপিফ্যানির এই কাহিনী দেখায়, কানানের পরম ঈশ্বর অধিকতর বিশ্বজনীন তাৎপর্যের অধিকারী হয়ে উঠতে শুরু করেছিলেন।

ঘুম থেকে উঠে জ্যাকব উপলব্ধি করলেন যে, তিনি বোকার মতো এমন। এক পবিত্র জায়গায় রাত্রি যাপন করেছেন, যেখানে দেবতাদের সঙ্গে মানুষের কথোপকথন হওয়া সম্ভব: ‘সত্যিই ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ এখানে আছেন, অথচ আমি তা জানতেই পারিনি। তাকে দিয়ে বলাচ্ছেন ‘J’। পৌত্তলিকরা স্বর্গীয় শক্তির মুখোমুখি হলে যেভাবে অনুপ্রাণিত হতো ঠিক সেরকম বিস্ময় বোধ করলেন। জ্যাকব: ‘এ জায়গাটা কী ভীতিকর। এটা ঈশ্বরের ঘর (বেথ প্রথা) ছাড়া তাঁর কিছু নয়; এটাই স্বর্গের দরজা।”[১৩] সহজাতভাবেই তিনি তার সময় ও সংস্কৃতির। ধর্মীয় ভাষায় নিজের মনোভাব প্রকাশ করেছেন: দেবতাদের আবাস খোদ বাবিলনকে ‘দেবদাদের তোরণ’ (Beb-ili) নামে ডাকা হতো। দেশের পৌত্তলিক রীতি অনুযায়ী জায়গাটাকে আলাদা করার সিদ্ধান্ত নিলেন জ্যাকব। বালিশ হিসাবে ব্যবহৃত পাথরটাকে উল্টে তেল মেখে পবিত্র করে নিলেন। এখন থেকে এ জায়গাকে আর লুয ডাকা যাবে না, ডাকতে হবে বেথ এল-এল-এর ঘর। কানানের উর্বরতার ধর্ম বিশ্বাসে খাড়া পাথর সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল, যা বিসিই অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত বেথ-এল-এ বিকাশ লাভ করতে দেখব আমরা। যদিও পরবর্তীকালের ইসরায়েলিরা এ ধরনের ধর্ম বিশ্বাসের তীব্র সমালোচনা করেছে, কিন্তু বেথ-এলে’র পৌত্তলিক স্যাঙ্কচুয়ারি জ্যাকব ও তার ঈশ্বরের আদি কিংবদন্তীর সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।

বেথ-এল ত্যাগ করার আগে জ্যাকব ওখানে প্রত্যক্ষ করা ঈশ্বরকে আপন ইলোহিম হিসাবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এটা একটা কৌশলগত উপাধি, এ দিয়ে নারী-পুরুষের জন্যে দেবতার পক্ষে করা সম্ভব সবকিছুই বোঝানো হয়। জ্যাকব স্থির করেছিলেন, এল (কিংবা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌, ‘J’ যেমন আখ্যায়িত করছেন) যদি সত্যিই হারানে তাঁর হেফাযত করতে পারেন, তাহলে তিনি বিশেষভাবে কার্যকর। একটা বোঝাপড়ায় পৌঁছলেন তিনিঃ এলের বিশেষ নিরাপত্তার বিনিময়ে জ্যাকব তাকে ইলোহিম হিসাবে মেনে নেবেন, তাঁকেই একমাত্র দেবতা বলে গণ্য করা যায়। ইসরায়েলিদের ঈশ্বরের বিশ্বাস ছিল খুবই বাস্তবভিত্তিক। আব্রাহাম ও জ্যাকব দুজনই এলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছেন, কারণ এল তাদের উপকারে এসেছেন: ধ্যানে বসে তার অস্তিত্বের। প্রমাণ রাখেননি তাঁরা, এল কোনও দার্শনিক বিমূর্ত কল্পনা ছিলেন না। প্রাচীন বিশ্বে মানা ছিল স্বয়ং-প্রকাশিত জীবনের বাস্তবতা, এটা কার্যকরভাবে প্রদান করতে পারলেই দেবতা আপন উপযোগিতার প্রমাণ রাখতে পারতেন। ঈশ্বরের ইতিহাসে এই বাস্তববাদিতা বরাবরই এক উপাদান হয়ে থাকবে। উপকারে আসে বলেই কোনও জাতি ঐশী সম্পর্কে একটা বিশেষ ধরনের ধারণা বা বিশ্বাস মেনে নেয়, সেটা বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক দিক থেকে নিখুঁত বলে নয়।

বহু বছর পর স্ত্রী ও পরিবারসহ হারান থেকে প্রত্যাবর্তন করেন জ্যাকব । কানানের ভূমিতে প্রবেশ করার সময় আবার এক অদ্ভুত এপিফ্যানির অভিজ্ঞতা লাভ করেন তিনি। পশ্চিম তীরে জাব্বক-এর ফেরিঘাটে এক আগন্তুকের দেখা পান যার সঙ্গে সারা রাত হাতাহাতি মারপিট চলে তার । ভোর হওয়ার সময় অধিকাংশ অলৌকিক সত্তার মতো প্রতিপক্ষ জানালেন যে, তাঁকে এবার বিদায় দিতে হবে, কিন্তু জ্যাকব তাঁকে আকড়ে থাকলেন: পরিচয় প্রকাশ না করা। পর্যন্ত তাঁকে যেতে দেবেন না। প্রাচীন বিশ্বে ব্যক্তি বিশেষের নাম জানা থাকলে তার ওপর বিশেষ ক্ষমতা লাভ করা যেত; কিন্তু আগন্তুক যেন এই তথ্যটুকু দেওয়ার ব্যাপারে অনীহা দেখাচ্ছিলেন। অদ্ভুত মারপিট অব্যাহত থাকলে জ্যাকব সচেতন হয়ে উঠলেন যে, তার প্রতিপক্ষ স্বয়ং এল ছাড়া অন্য কেউ নন:

তখন যাকব বিনয় করিয়া কহিলেন, ‘বিনয় করি, আপনার নাম কি? বলুন।’ তিনি বলিলেন, ‘কি জন্যে আমার নাম জিজ্ঞাসা কর?’ পরে তথায় যাকবকে আশীর্বাদ করিলেন। তখন যাকব সেই স্থানের নাম পানুয়েল (এল-র মুখ) রাখিলেন। ‘কারণ আমি এলকে সম্মুখা-সম্মুখি হইয়া দেখিলাম, তিনি বলিলেন, ‘তথাপি আমার প্রাণ বাঁচিল।’[১৪]

এই এপিফ্যানির চেতনা পরবর্তীকালের ইহুদি একেশ্বরবাদের চেতনার চেয়ে বরং ইলিয়াদের চেতনার অনেক কাছাকাছি, ঈশ্বরের সঙ্গে এমন আন্তরিক সংযোগ পরবর্তীকালে ব্লাসফেমাস চিন্তা মনে করা হতো।

যদিও এইসব আদি কাহিনী ধর্মপিতাদের তাদের দেবতার সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি মোটামুটি সে সময়কার পৌত্তলিকদের মতো করেই দেখায়, তবু এগুলো এক নতুন ধরনের ধর্মীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। গোটা বাইবেলে আব্রাহামকে বিশ্বাসী মানুষ অভিহিত করা হয়েছে। আজকাল বিশ্বাসকে আমরা ধর্মমতের প্রতি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্মতিদান হিসাবে সংজ্ঞায়িত করতে চাই, কিন্তু, আমরা যেমন দেখেছি, বাইবেলের রচয়িতাগণ ঈশ্বরে বিশ্বাসকে বিমূর্ত বা আধ্যাত্মিক বিশ্বাস হিসাবে দেখেননি। তাঁরা আব্রাহামের বিশ্বাসের প্রশংসা করার সময় তার অর্থডক্সির (ঈশ্বর সম্পর্কে একটা সঠিক ধর্মীয় মতামত ধারণ বা গ্রহণ) গুনকীর্তন করেননি বরং আমরা যেভাবে কোনও ব্যক্তি বা আদর্শে বিশ্বাস করার কথা বলি সেভাবে তাঁর আস্থার কথা বলেছেন। বাইবেলে আব্রাহাম বিশ্বাসী পুরুষ, কারণ তিনি মনে করেন, ঈশ্বর তাঁকে দেওয়া চমৎকার সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন, সেগুলোকে অসম্ভব মনে হলেও। স্ত্রী সারাহ যেখানে বন্ধ্যা সেখানে আব্রাহাম কেমন করে এক মহান জাতির পিতা হবেন? প্রকৃতপক্ষেই, সারাহ মা হতে পারবেন, এই ধারণাটা এতটাই হাস্যকর ছিল যে তিনি মেনোপজ পর্ব অতিক্রম করে গিয়েছিলেন-প্রতিশ্রুতি শোনামাত্র আব্রাহাম ও সারাহ অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলেন। সকল প্রতিকূল অবস্থা ছাপিয়ে যখন অবশেষে তাদের পুত্রের জন্ম হলো, তাঁরা তাঁর নাম রাখলেন ইসাক, এ নামের অর্থ ‘হাসি’ বোঝাতে পারে। কিন্তু রসিকতা তিক্ততার রূপ নিল যখন ঈশ্বর এক ভয়ঙ্কর দাবি করে বসলেন: আব্রাহামকে অবশ্যই তার একমাত্র পুত্রকে তার উদ্দেশে উৎসর্গ করতে হবে।

পৌত্তলিক সমাজে মানুষ উৎসর্গ করা ছিল সাধারণ ব্যাপার। নিষ্ঠুর হলেও এর মাঝে যুক্তি ও নীতি ছিল । প্রথম সন্তানকে প্রায়শঃই দেবতার বংশধর বলে বিশ্বাস করা হতো, মাকে যিনি droit de seigneur নামক কর্মের মাধ্যমে অন্তঃসত্ত্বা করেছেন। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দেবতার শক্তি কমে গিয়েছে; সুতরাং, সেটা পূরণ ও প্রাপ্ত সকল মানার সঞ্চালন নিশ্চিত করার জন্যে প্রথম সন্তানকে তার স্বর্গীয় অভিভাবকের কাছে ফিরিয়ে দিতে হতো। অবশ্য ইসাকের ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসাক ছিলেন ঈশ্বরের উপহার, কিন্তু তাঁর স্বাভাবিক সন্তান নন। উৎসর্গ করার কোনও কারণই ছিল না, প্রয়োজন ছিল না স্বর্গীয় শক্তি পুরণের। প্রকৃতপক্ষে, উৎসর্গের ফলে আব্রাহামের গোটা জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ত, তিনি এক মহান জাতির পিতা হবেন-এমন প্রতিশ্রুতির ওপর ছিল যার ভিত্তি। এই দেবতা ইতিমধ্যেই প্রাচীন বিশ্বের অপরাপর উপাস্য থেকে আলাদাভাবে ধরা দিতে শুরু করেছিলেন। তিনি মানবীয় দুঃখ-দুদর্শার অংশীদার ছিলেন না, নারী ও পুরুষের কাছ থেকে তাঁর শক্তি সঞ্চয় করার প্রয়োজন পড়েনি। তিনি ছিলেন ভিন্ন এবং যাচ্ছেতাই দাবি তুলতে পারেন। আব্রাহাম তাঁর উপাস্যে আস্থা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি আর ইসাক মোরিয়াহ পর্বতের উদ্দেশে তিন দিনের যাত্রায় নামলেন। মোরিয়াহ পর্বতই পরবর্তীকালে জেরুজালেমস্থ টেম্পলের নির্মাণস্থানে পরিণত হয়। ঐশী নির্দেশের কথা কিছুই জানতেন না ইসাক, নিজের সর্বনাশের কাঠ পর্যন্ত বহন করতে হচ্ছিল তাঁকে। একেবারে শেষ মুহূর্তে আব্রাহাম হাতে ছুরি নেওয়ার পরেই কেবল ঈশ্বর নিবৃত্ত হলেন; আব্রাহামকে জানালেন এটা স্রেফ একটা পরীক্ষা ছিল। আব্রাহাম এক মহান জাতির পিতা হবার যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন, যে জাতির লোকসংখ্যা আকাশের তারা বা সৈকতের বালিকণার সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে।

কিন্তু আধুনিক মানুষের কাছে এটা এক ভয়ঙ্কর কাহিনী: এখানে ঈশ্বর স্বেচ্ছাচারী ও খেয়ালি ধর্ষকামী হিসাবে উপস্থাপিত হয়েছেন। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, আজকের বহু লোক যারা ছোটবেলায় এ কাহিনী শুনেছে তারা এমন একজন উপাস্যকে বর্জন করে। মিশর থেকে এক্সোডাসের মিথ, ঈশ্বর যখন মোজেস ও ইসরায়েলের সন্তানদের মুক্তির দিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেটাও আধুনিক অনুভূতির প্রতি সমান আক্রমণাত্মক। এ কাহিনী ভালো করেই জানা। ইসরায়েলিদের ছাড়তে অনিচ্ছুক ছিলেন ফারাও, তাই তার ওপর বল প্রয়োগ করার জন্যে ঈশ্বর মিশরের জনগণের উপর দশটি প্লেগ পাঠান। নীল নদ রক্তে পরিণত হয়; গোটা প্রান্তর ব্যাঙ আর পঙ্গপালে সয়লাব হয়ে গেল; নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবে গেল সারা দেশ। সবার শেষে ভয়ঙ্করতম প্লেগটি পাঠালেন ঈশ্বর: মিশরিয়দের প্রথম সন্তানকে হত্যা করার জন্যে পাঠানো হলো মৃত্যুর ফেরেশতাকে, কিন্তু নিষ্কৃতি দেওয়া হয় হিব্রু দাসদের সন্তানদের। এটা বিস্ময়কর নয় যে, ফারাও ইসরায়েলিদের ছেড়ে দিতে রাজি হলেও পরে আবার সসৈন্য ধাওয়া করলেন তাদের। সী অভ রীডস-এ তাদের নাগাল পেলেন তিনি, কিন্তু ঈশ্বর সাগর দ্বিখণ্ডিত করে ইসরায়েলিদের অপর পারে যেতে সাহায্য করে রক্ষা করলেন। মিশরিয়রা যখন তাদের পিছু ধাওয়া করতে গেল, তিনি আবার সাগরকে মিলিয়ে দিয়ে ফারাও ও তাঁর বাহিনীকে নিমজ্জিত করে ফেললেন ।

এটা নিষ্ঠুর, পক্ষপাতমূলক ও ঘাতক দেবতা: একজন যুদ্ধ দেবতা যিনি ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ স্যাবোথ বা সৈন্যদলের ঈশ্বর নামে পরিচিত হয়ে উঠবেন। তিনি প্রবলভাবে পক্ষপাতমূলক, পছন্দের ব্যক্তি ছাড়া আর কারও প্রতি মায়াদয়াহীন এবং একজন গোত্রীয় উপাস্য মাত্র। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ এমন ভয়ঙ্কর দেবতা থেকে গেলে, তত তাড়াতাড়ি তার বিলোপ ঘটত তত সবার মঙ্গল হতো। বাইবেলে যেভাবে আমাদের কাছে এসেছে, এক্সোডাসের চূড়ান্ত মিথকে ঘটনাপ্রবাহের আক্ষরিক বিবরণ বোঝানো হয়নি। অবশ্য প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের জন্যে একটা পরিষ্কার বাণী হয়ে থাকতে পারে, যারা দেবতাদের সাগর দ্বিখণ্ডিত করার ক্ষমতায় অভ্যস্থ ছিল। কিন্তু মারদুক ও বাআলের বিপরীতে ইয়েহওয়েহ্‌ ঐতিহাসিক পৃথিবীতে এক সত্যিকার সাগর দ্বিখণ্ডিত করেছেন বলে বলা হয়েছে। এখানে বাস্তববাদিতার সামান্যই ছোঁয়া আছে। ইসরায়েলিরা এক্সোডাসের কাহিনী পুনঃবর্ণনা করার সময় আজ আমরা যেমন ঐতিহাসিক নির্ভুলতায় আগ্রহী তেমন আগ্রহী ছিল না বরং আদি বা মূল ঘটনার তাৎপর্যটুকু বের করার প্রয়াস পেয়েছে, সেটা যাই থাকুক না কেন। কোনও কোনও আধুনিক পণ্ডিত মত প্রকাশ করেছেন যে, এক্সোডাস-কাহিনীটি কানানে মিশর ও এর মিত্রপক্ষের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে সংঘটিত এক সফল কৃষক বিদ্রোহের কিংবদন্তীর রূপ। সে সময়ে এমন একটা ঘটনা নজীরবিহীন ব্যাপার হওয়ার কথা, ফলে প্রত্যেকের মনে গভীর রেখাপাত করাই স্বাভাবিক। ক্ষমতাধর ও শক্তিমানের বিরুদ্ধে নির্যাতিতের ক্ষমতা লাভের এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয়ে থাকত সেটা।

আমরা দেখব, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ এস্লোডাসের নিষ্ঠুর নির্দয় দেবতা রয়ে যাননি, যদিও মিথটি তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রতিটির ক্ষেত্রেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ছিল। এটা বিস্ময়কর মনে হতে পারে, ইসরায়েলিরা তাঁকে দুয়ে ও আবেগময় এক প্রতাঁকের আড়ালে শনাক্তকরণের অতীত একটা রূপ দিয়েছে। তারপরও এক্সোডাসের রক্তাক্ত কাহিনী স্বর্গ ও প্রতিহিংসাপূর্ণ ধর্মতত্ত্বের বিপজ্জনক ধারণা জাগানো অব্যাহত রাখবে। আমরা দেখব, বিসিই সপ্তম শতাব্দীতে ডিউটেরোনমিস্ট লেখক (D) নির্বাচনের ভীতিকর ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করার জন্যে এই প্রাচীন মিথ ব্যবহার করছেন, যা বিভিন্ন সময়ে তিনটি ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাসে নিয়তি নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে। মানবীয় যে কোনও ধারণার মতো ঈশ্বরের ধারণাকেও নিজ স্বার্থে ব্যবহার ও অপব্যবহার করা যায়। মনোনীত জাতি ও স্বর্গীয় নির্বাচনের মিথ প্রায়শঃ ডিউটেরোনমিস্ট আমল থেকে আমাদের সময়েও দুঃখজনকভাবে প্রকট হয়ে আছে যা ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিম মৌলবাদের সময় পর্যন্ত সংকীর্ণ গোত্রীয় ধর্মতত্ত্বের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু ডিউটেরোনমিস্ট এক্সোডাস মিথের একটা ভাষ্য সংরক্ষণ করেছেন যা একেশ্বরবাদের ইতিহাসে সমানভাবে এবং আরও ইতিবাচকভাবে কার্যকর, যেখানে বলা হচ্ছে ঈশ্বর নির্যাতিত ও অক্ষমদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ডিউটেরোনমি-২৬-এ আমরা যা পাচ্ছি সেটা হয়তো ‘J’ এবং ‘E’-র লিখিত বিবরণের আগে লিখিত এক্সোডাসের ব্যাখ্যা হতে পারে। ফসলের প্রথম ফল ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র পুরোহিতদের হাতে তুলে দিয়ে নিচের ঘোষণাটি উচ্চারণ করার নির্দেশ দেওয়া হলো ইসরায়েলিদের:

এক নষ্টকল্প আরামিয় আমার পিতৃপুরুষ ছিলেন; তিনি অল্প সংখ্যায় মিশরে নামিয়া গিয়া প্রবাস করিলেন; এবং সে স্থানে মহৎ, পরাক্রান্ত ও বহু প্রজাতি হইয়া উঠিলেন। পরে মিশরিয়রা আমাদের প্রতি দৌরাত্ম। করিল, আমাদিগকে দুঃখ দিল ও কঠিন দাসত্ব করাইল; তাহাতে আমরা আপন পিতৃপুরুষদের ঈশ্বর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র কাছে ক্রন্দন করিলাম আর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ আমাদের রব শুনিয়া আমাদের কষ্ট, শ্রম ও উপদ্রবের প্রতি দৃষ্টি করিলেন। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ বলবান হস্ত, বিস্তারিত বাহু ও মহা ভয় করত এবং নানা চিহ্ন ও অদ্ভুত লক্ষণ দ্বারা মিশর হইতে আমাদিগকে বাহির করিয়া আনিলেন। আর তিনি আমাদিগকে এই দেশ, মধু প্রবাহী দেশ দিয়াছেন এখন, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌, দেখ, তুমি আমাদের যে ভূমি দিয়াছ তাহার ফলের অগ্রিমাংশ আমি আনিয়াছি।[১৬]

ইতিহাসের প্রথম সফল কৃষক বিদ্রোহের সম্ভাব্য অনুপ্রেরণাদায়ী ঈশ্বর একজন অভ্যুত্থানের ঈশ্বর। তিনটি ধর্ম বিশ্বাসের প্রত্যেকটিতে তিনি সামাজিক ন্যায়বিচারের এক আদর্শের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, যদিও এটা বলতেই হবে যে ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমরা প্রায়ই এই আদর্শ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে এবং ঈশ্বরকে স্থিতাবস্থার ঈশ্বরে পরিণত করেছে।

ইসরায়েলিরা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে ‘আমাদের পূর্ব পুরুষের ঈশ্বর’ বলে ডেকেছে, তবু মনে হয় যে, তিনি হয়তো ধর্মপিতাদের উপাস্য কানানের পরম ঈশ্বর এলের চেয়ে ভিন্ন কোনও উপাস্য। হয়তো ইসরায়েলের ঈশ্বর হওয়ার আগে অদ্য কোনও জাতির ঈশ্বর ছিলেন তিনি। মোজেসের কাছে প্রথম দিকের আবির্ভাবের ঘটনাগুলোয় ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ বারবার ও দীর্ঘসময় ধরে নিজেকে আব্রাহামের ঈশ্বর বোঝানোর প্রয়াস পেয়েছেন, যদিও মূলত তাঁকে এল শাদ্দাই ডাকা হয়েছে। এই জোর দাবি মোজেসের ঈশ্বরের পরিচয় সংক্রান্ত একটা অত্যন্ত প্রাচীন বিতর্কের প্রতিধ্বনি হয়ে থাকতে পারে। এমন মত প্রকাশ করা হয়েছে যে, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌হু আদতে ছিলেন যোদ্ধা দেবতা, আগ্নেয়গিরির দেবতা, মিদিয়ান বা বর্তমান জর্দানে যাঁর উপাসনা করা হতো। ইসরায়েলিরা কোথায় ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে আবিষ্কার করেছিল আমরা সেটা কখনও জানতে পারব না, যদি আদৌ তিনি একেবারে আনকোরা উপাস্য হয়ে থাকেন। আবার, বর্তমানে আমাদের জন্যে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা হতে পারে, তবে বাইবেলের লেখকদের জন্যে এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। পৌত্তলিক প্রাচীনকালে দেবতারা প্রায়ই একে অন্যের সঙ্গে মিশে যেতেন, কিংবা এক এলাকার দেবতাকে অন্য জাতির একই ধরনের দেবতা হিসাবে গ্রহণ করা হতো । আমরা এটুকুই নিশ্চিত হতে পারি যে, তাঁর উৎস যাই হোক না কেন, এক্সোডাসের ঘটনাবলী ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে ইসরায়েলিদের সুনির্দিষ্ট ঈশ্বরে পরিণত করেছিল এবং মোজেস ইসরায়েলিদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, ইনিই। আব্রাহাম, ইসাক ও জ্যাকবের প্রিয় ঈশ্বর এল ।

তথাকথিত ‘মিদিয়নিয় তত্ত্ব’-অর্থাৎ ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ মূলত মিদিয়ান জাতির দেবতা ছিলেন-বর্তমানে সাধারণভাবে নাকচ করে দেওয়া হয়, কিন্তু মিদিয়ানেই মোজেস প্রথম ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন। এটা স্মরণ করা হবে যে, ইসরায়েলি দাসের ওপর নির্যাতনকারী জনৈক মিশরিয়কে হত্যা করার পর মিশর থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন মোজেস। মিদিয়ানে আশ্রয় নেন তিনি, বিয়ে করেন এবং শ্বশুরের ভেড়ার যত্ন নেওয়ার সময়ই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখেন: আগুনে একটা ঝোঁপ পুড়ছে কিন্তু ছাই হচ্ছে না। ভালো করে দেখার জন্যে তিনি আরও কাছাকাছি গেলে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ মোজেসকে নাম ধরে ডাক দিয়েছিলেন, চেঁচিয়ে উঠেছেন মোজেস: ‘আমি হাজির! (হিনেনি, পূর্ণ মনোযোগ ও আনুগত্যের দাবিদার ঈশ্বরের মুখোমুখি হওয়ার পর ইসরায়েলের সকল পয়গম্বর এই জবাবই দিয়েছেন):

তখন তিনি ঈশ্বর কহিলেন, ‘এ স্থানের নিকটবর্তী হইও না, তোমার পদ হইতে জুতা খুলিয়া ফেল; কেননা যে স্থানে তুমি দাঁড়াইয়া আছ উহা পবিত্র ভূমি।’ তিনি আরও কহিলেন ‘আমি তোমার পিতার ঈশ্বর, আব্রাহামের ঈশ্বর, যাকেবের ঈশ্বর,’ তখন মোজেস আপন মুখ আচ্ছাদন করিলেন কেননা তিনি ঈশ্বরের প্রতি দৃষ্টি সরাইতে ভীত হইয়াছিলেন।

ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ প্রকৃতই আব্রাহামের ঈশ্বর, এই নিশ্চয়তা সত্ত্বেও ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ একেবারে ভিন্ন ধরনের উপাস্য, আব্রাহামের সঙ্গে বন্ধুর মতো খাবার গ্রহণকারী ঈশ্বরের চেয়ে আলাদা। ইনি আতঙ্ক জাগান ও দূরত্ব বজায় রাখার ওপর জোর দেন। মোজেস যখন তার নাম-পরিচয় জানতে চাইলেন, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ পান ব্যবহার করে জবাব দিলেন, যেটা, আমরা দেখব, বহু শত বছর ধরে একেশ্বরবাদীরা চর্চা করবে। সরাসরি নিজের নাম প্রকাশ করার বদলে তিনি জবাব দিলেন, “আমি যা আমি তাই।’ (Ehyeh asher ehyeh-I am who I Am)।” কী ছিল এর মানে? পরবর্তীকালের দার্শনিকগণ স্থির করেছেন যে, তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তা, নিশ্চয়ই তা বোঝাননি। এই পর্যায়ে হিব্রু ভাষার এমন কোনও আধিবিদ্যিক মাত্রা ছিল না, আরও ২,০০০ বছর পরে অর্জিত হয়েছিল তা। ঈশ্বর যেন আরও স্পষ্ট কিছু বোঝাতে চেয়েছিলেন। Ehyeh asher ehyeh ইচ্ছাকৃত অস্পষ্টতা প্রকাশের জন্যে ব্যবহৃত হিব্রু বাকধারা। বাইবেল যখন ‘ওরা সেখানে গিয়েছিল সেখানেই গেছে,’ ধরনের বাকধারা ব্যবহার করে তখন এটা বোঝায়: ‘ওরা কোথায় গেছে তার কোনও ধারণাই নেই আমার। সুতরাং, মোজেস যখন ঈশ্বরের পরিচয় জানতে চান কার্যতঃ তার জবাব ছিল: “আমার পরিচয় জানতে হবে না!’ বা ‘নিজের চরকায় তেল দাও!’ ঈশ্বরের প্রকৃতি সম্পর্কে কোনওরকম আলোচনা চলবে না আর পৌত্তলিকরা যেমনটি করে থাকে, দেবতাদের নাম উচ্চারণের সময় অবশ্যই তাঁকে ব্যবহার করা যাবে না। ইয়াহুগুয়েহ্ হলেন শর্তহীন একক। আমি তাই যা আমার হওয়ার কথা। যেমন ইচ্ছা রূপ নেবেন তিনি এবং কোনও রকম নিশ্চয়তা দেবেন না। সোজাসুজি তাঁর জাতির ইতিহাসের ধারা অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এক্সোভাসের মিথ চূড়ান্ত বলে প্রমাণিত হবে: এমনকি সর্বাধিক প্রতিকূল পরিবেশেও এটা ভবিষ্যতের জন্যে আশা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।

ক্ষমতায়নের এই নতুন বোধের বিনিময়ে মূল্য দিতে হয়েছিল। মানবীয় উপলব্ধির বিচারে স্কাই গডকে অনেক বেশি দূরবর্তী মনে হয়েছিল। মারদুক, বাআল এবং মাতৃদেবী (Mother Goddesses)রা মানবজাতির অনেক কাছাকাছি ছিলেন, কিন্তু ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ আবার মানুষ ও স্বর্গের মাঝে বিরাট দূরত্ব ফিরিয়ে এনেছিলেন। সিনাই পর্বতের কাহিনীতে এ বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে। পর্বতের কাছে পৌঁছার পর জনতাকে পোশাক পবিত্র করে দূরে অবস্থান করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মোজেস ইসরায়েলিদের সতর্ক করতে বাধ্য হয়েছেন: ‘পাহাড়ের কাছাকাছি যাবে না বা ওটার পাদদেশ স্পর্শ করবে না। যে পাহাড়ের গায়ে হাত দেবে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। জনতা পাহাড় থেকে দূরে অবস্থান করেছে আর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ আগুন ও মেঘের মাঝে অবতীর্ণ হয়েছেন:

পরে তৃতীয় দিন প্রভাত হইলে মেঘগর্জন ও বিদ্যুৎ এবং পৰ্ব্বতের উপরে নিবিড় মেঘ হইল আর অতিশয় উচ্চরবে তূরীধ্বনি হইতে লাগিল; তাহাতে শিবিরস্থ সমস্ত লোক কাঁপিতে লাগিল। পরে মোজেস ঈশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবার জন্যে লোকদিগকে শিবির হইতে বাহির করিলেন। আর তাহারা পৰ্ব্বতের তলে দণ্ডায়মান হইল। তখন সমস্ত সিনাই পৰ্ব্বত ধূমময় ছিল; কেননা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ অগ্নিসহ তাহার উপরে নামিয়া আসিলেন আর ভাটীর ধূমের ন্যায় তাহা হইতে ধূম উঠিতে লাগিল এবং সমস্ত পর্বত অতিশয় কাঁপিতে লাগিল।[২০]

মোজেস একাকী পাহাড়চূড়ায় উঠলেন এবং ল (Law) উৎকীর্ণ পাথরখণ্ডসমূহ গ্রহণ করলেন। পৌত্তলিক দর্শনের অনুরূপ প্রকৃতি হতে আহরণের বদলে শৃঙ্খলা, সাম্য ও ন্যায়বিচারের মূল নীতিমালাসমূহ অর্থাৎ আইন এবার মহাকাশ হতে অবতীর্ণ করা হলো। ইতিহাসের ঈশ্বর জাগতিক বিশ্বের অধিকতর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেন, তাঁর লীলাক্ষেত্র কিন্তু আবার এ থেকে গভীরভাবে আলাদা থাকার প্রবণতাও রয়েছে।

বিসিই পঞ্চম শতাব্দীতে সম্পাদিত এক্সোডাসের চূড়ান্ত টেক্সট-এ সিনাই পর্বতে ঈশ্বর মোজেসের সঙ্গে একটা চুক্তিতে (covennant) উপনীত হওয়ার কথা বলা হয়েছে (এ ঘটনাটি ১২০০ সাল নাগাদ সংঘটিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। এ বিষয়ে পণ্ডিতদের মাঝে বিতর্ক আছে: কোনও কোনও সমালোচক বিশ্বাস করেন যে, বিসিই সপ্তম শতাব্দীর আগে এই চুক্তি ইসরায়ের্লে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সময় যাই হোক, চুক্তির ধারণা আমাদের জানায় যে, ইসরায়েলিরা তখন একেশ্বরবাদী হয়ে ওঠেনি, কেননা এটা কেবল বহু ঈশ্বরের পটভূমিতেই খাপ খায়। ইসরায়েলিরা এটা বিশ্বাস করত না যে সিনাইয়ের ঈশ্বর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ই একমাত্র ঈশ্বর, তবে তারা অঙ্গীকার করেছিল, অন্য সব দেবতাকে অগ্রাহ্য করে তারা কেবল ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌রই উপাসনা করবে। গোটা পেন্টাটিউকে একটা একেশ্বরবাদী ঘোষণা বা বাক্য খুঁজে বের করাও খুব কঠিন। এমনকি সিনাই পর্বতে হস্তান্ত। রিত টেন কমান্ডমেন্টসও অন্য দেবতাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছে: ‘আমার সামনে তোমাদের জন্যে আর কোনও অচেনা দেবতা থাকবে না।’[২১] মাত্র একজন উপাস্যের উপাসনা করার ধারণাটি বলতে গেলে এক নজীরবিহীন পদক্ষেপ ছিল। মিশরিয় ফারাও আখেনাতেন মিশরের অন্যান্য প্রচলিত দেবতাকে অগ্রাহ্য করে সূর্য দেবতার উপাসনার প্রয়াস পেয়েছিলেন, কিন্তু তার উত্তরাধিকারীরা অবিলম্বে সেই নীতিমালা পরিবর্তন করে ফেলেন। মানার সম্ভাব্য উৎসকে অগ্রাহ্য করা সোজাসুজি বোকামি মনে হয়েছে ইসরায়েলিদের। পরবর্তীকালের ইতিহাস আমাদের দেখায়, অন্য দেবতার কাল্ট অগ্রাহ্য করতে দারুণ অনিচ্ছুক ছিল তারা। যুদ্ধে আপন দক্ষতার প্রমাণ রেখেছিলেন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌, কিন্তু উর্বরতার দেবতা ছিলেন না তিনি। কানানে বসতি করার পর ইসরায়েলিরা সহজাত প্রবৃত্তির বশেই আবার কানের ভূস্বামী বাআলের কাল্টের আশ্রয় নিয়েছে, যিনি স্মরণাতীত কাল থেকে শস্য উৎপাদন করে আসছিলেন। পয়গম্বরগণ ইসরায়েলিদের চুক্তির শর্ত মেনে চলার অনুরোধ জানিয়েছেন, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী প্রচলিত পদ্ধতিতে বাআল, আশেরাহ, ও আনাতের উপাসনা অব্যাহত রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে বাইবেল আমাদের জানাচ্ছে যে, মোজেস সিনাই পর্বতে থাকার সময় বাকি। সবাই কানানের পুরোনো পৌত্তলিক ধর্মে ফিরে গিয়েছিল। তারা প্রচলিত প্রতিমা সোনালি আঁড় তৈরি করে তার সামনে প্রাচীন আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। সিনাই পর্বত চূড়ার আতঙ্ক জাগানো দিব্যপ্রকাশের বিপরীতে এই ঘটনার উপস্থাপন সম্ভবত পেন্টটিউকের সর্বশেষ সম্পাদকমণ্ডলীর ইসরায়েলের বিভাজনের তিক্ততার রূপ তুলে ধরার একটি প্রয়াস। মোজেসের মতো পয়গম্বরগণ ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র উচ্চ ধর্ম প্রচার করেছেন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ দেবতা, প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে একতার হলিস্টিক দর্শন মোতাবেক প্রাচীন আচার পালন করতে চেয়েছে।

তারপরও এক্সোডাসের পর ইসরায়েলিরা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে তাদের একমাত্র ঈশ্বর হিসাবে মানার অঙ্গীকার করেছিল। পরবর্তী বছরগুলোয় পয়গম্বরগণ এই চুক্তির কথা তাদের মনে করিয়ে দেবেন। কেবল ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে এলোহিম হিসাবে উপাসনা করার অঙ্গীকার ছিল তাদের। বিনিময়ে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র প্রতিশ্রুতি ছিল তারা তার বিশেষ জাতিতে পরিণত হবে এবং তার অসাধারণ কার্যকর প্রতিরক্ষা ভোগ করবে। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ তাদের এই বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, চুক্তি ভঙ্গ করলে তিনি তাদের নিষ্ঠুরভাবে ধ্বংস করে দেবেন। কিন্তু তারপরেও ইসরায়েলিরা এই চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। জশুয়া পুস্তকে আমরা সম্ভবত ইসরায়েল ও তার ঈশ্বরের এই চুক্তির আদি বিবরণ পাই। চুক্তিটি ছিল এক আনুষ্ঠানিক সমঝোতা স্মারক, দুটি পক্ষকে একসঙ্গে আবদ্ধ করার জন্যে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে প্রায়শঃই এর ব্যবহার হতো। একটা নির্দিষ্ট ধরণ অনুসরণ করেছে এটা। চুক্তির টেক্সট শুরু হতো অধিকতর শক্তিশালী রাজার পরিচয় দিয়ে, তারপর বর্তমান কাল পর্যন্ত উভয়পক্ষের সম্পর্কের ইতিহাস বর্ণনা করা হতো। সবশেষে চুক্তির অমর্যাদা হলে শাস্তির প্রকৃতিসহ অপরাপর শর্তাবলী উল্লেখ করা হতো। গোটা চুক্তির অত্যাবশ্যকীয় বিষয়টি ছিল শর্তহীন আনুগত্যের দাবি। চতুর্দশ শতাব্দীতে হিট্টিট রাজা দ্বিতীয় মুরসিলিস এবং তার সামন্ত দুপ্পি তাশেকের মাঝে স্বাক্ষরিত চুক্তি বা কভেন্যান্টে রাজা দাবি তুলেছিলেন: “আর কারও কাছে আশ্রয় চাইবে না। তোমার পিতা মিশরে উপঢৌকন পাঠিয়েছে, তুমি তা করবে না…আমার বন্ধুর সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব হবে, আমার শত্রুর শত্রু হবে তুমি।’ বাইবেল আমাদের বলছে ইসরায়েলিরা কানানে পৌঁছে আপনজনদের সঙ্গে মিলিত হলে আব্রাহামের সকল বংশধর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র সঙ্গে এক চুক্তিতে উপনীত হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মাজেসের উত্তরাধিকারী জোশুয়া, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। চুক্তিটি প্রচলিত প্যাটার্ন অনুসরণ করেছে। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র পরিচয় দেওয়া হয়েছে, আব্রাহাম, ইসাক ও জ্যাকরের সঙ্গে তার কর্মকাণ্ডের উল্লেখ করা হয়েছে; এরপর এক্সোডাসের ঘটনাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। সবশেষে জোশুয়া চুক্তির শর্তাবলী উল্লেখ করে সমবেত ইসরায়েলি জাতির আনুষ্ঠানিক সম্মতি দাবি করেছেন:

অতএব এখন তোমরা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে ভয় কর, সরলতায় ও সত্যে তাহার সেবা কর, আর তোমাদের পিতৃপুরুষেরা (ফরাৎ) নদীর ওপারে ও মিশরে যে দেবতাগণের সেবা করিত তাহাদিগকে দূর করিয়া দেও; এবং ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র সেবা কর। যদি ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র সেবা করা তোমাদের মন্তু বোধহয়, তবে যাহার সেবা করিবে তাহাকে অদ্য মনোনীত কর; নদীর ওপারস্থ তোমাদের পিতৃপুরুষের সেবিত দেবগণ হয় হউক, কিম্বা যাহাদের দেশে তোমরা বাস করিতেছ সেই ইমোরিয়দের দেবগণ হয় হউক।[২২]

ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ও কানানের প্রচলিত দেবতাদের মধ্য থেকে যে কোনও এক পক্ষকে বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল জনগণের। দ্বিধা করেনি ওরা। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র মতো আর কোনও দেবতা ছিলেন না; আর কোনও উপাস্যকে তাঁর উপাসকের পক্ষে এমন কার্যকর দেখা যায়নি। ওদের জীবন ধারায় তার শক্তিশালী হস্তক্ষেপ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে যে, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ই তাদের এলোহিম হওয়ার যোগ্যতা রাখেন: অন্য দেবতাদের বাদ দিয়ে তারা কেবল ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌রই সেবা করবে। জোশুয়া তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন: ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ দারুণ ঈর্ষাপরাণ । তারা চুক্তির শর্তাবলী উপেক্ষা করলে তিনি তাদের ধ্বংস করে দেবেন। জনতা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রইল: একমাত্র ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কেই তারা ইলোহিম হিসাবে বেছে নিয়েছে। তবে এখন আপনাদের মধ্যস্থিত বিজাতীয় দেবগণকে দূর করিয়া দেও, ও আপন আপন হৃদয় ইসরায়েলের ঈশ্বর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র দিকে রাখ।[২৩]

বাইবেল দেখাচ্ছে, জনগণ চুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত ছিল না। যুদ্ধের সময়, যখন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র সমারিক নিরাপত্তা প্রয়োজন হতো তখন চুক্তির কথা মনে করত তারা, কিন্তু শান্তির সময় অতীতের কায়দায় বাআল, আনাত ও আশেরাহর উপাসনায় মগ্ন হতো। যদিও ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র কাল্ট ঐতিহাসিক প্রবণতার দিক থেকে মৌলিকভাবে আলাদা ছিল, কিন্তু প্রায়ই প্রাচীন পৌত্তলিকতার ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করেছে। বাদশাহ সলোমন যখন তার পিতা ডেভিড কর্তৃক জেরুসাইটদের কাছ থেকে অধিকৃত নগরী জেরুজালেমে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ সম্মানে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, সেটা কানানের দেবতাদের মন্দিরসমূহের অনুরূপ ছিল । তিনটি বর্গাকৃতি জায়গার সমাহার ছিল তা, যা চৌকো আকৃতির একটা কক্ষে শেষ হয়েছে। এই কক্ষই ‘পবিত্রতম মন্দির’ নামে পরিচিত, যেখানে ইসরায়েলিদের এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ানোর সময় বহনযোগ্য বেদী আর্ক অভ দ্য কভেন্যান্ট রাখা ছিল। মন্দিরের ভেতরে ছিল এক বিরাটাকৃতি ব্রোঞ্জ বেসিন যা কানানের মিথের আদিম সাগর ইয়াম-এর স্মারক: চল্লিশ ফুট দীর্ঘ মুক্ত একজোড়া পিলার, আশেরাহর উর্বরতার কাল্টের ইঙ্গিতবাহী। বেথ-এল, শিলোহ হেবরন, বেথলহেম ও ডান-এ কানবাসীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রাচীন মন্দিরগুলোয় ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র উপাসনা অব্যাহত রেখেছিল ইসরায়েলিরা, এসব জায়গায় প্রায়ই পৌত্তলিক আচার অনুষ্ঠান করা হতো। মন্দিরটি অচিরেই আলাদা মর্যাদার অধিকারী হয়ে উঠেছিল, যদিও, আমরা দেখব, ওখানে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য আনঅর্থডক্স কর্মকাণ্ডও ঘটতে দেখা গেছে। ইসরায়েলিরা মন্দিরটিকে স্বর্গে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র দরবারের অনুকৃতি হিসাবে দেখতে শুরু করেছিল। প্রায়শ্চিত্ত দিবসে ছাগল উৎসর্গ করার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শরৎকালে তাদের নিজস্ব নববর্ষ উৎসব ছিল; এর পাঁচদিন পরে কৃষি বর্ষের শুরুতে উদযাপিত হতো ট্যাবারন্যাকলস ভোজ-এর নবান্ন উৎসব। মত প্রকাশ করা হয়েছে যে, ট্যারন্যাকলস ভোজের সময় মন্দিরে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র অভিষেকের সম্মানে উচ্চারিত কিছু শ্লোক (Psalms) মারদুকের অভিষেকের মতো আদি বিশৃঙ্খলা দমন করার ঘটনার স্মৃতিচারণ।২৯ বাদশাহ সলোমন স্বয়ং বিশিষ্ট সিনক্রিটিস্ট ছিলেন: অনেক পৌত্তলিক স্ত্রী ছিল তাঁর যাঁরা নিজস্ব দেবতার উপাসনা করতেন, বাদশা সলোমনের সঙ্গে তাঁর পৌত্তলিক পড়শীদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।

ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র কাল্টের জনপ্রিয় পৌত্তলিকতার আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার বিপদ বরাবরই ছিল। নবম শতাব্দীর শেষার্ধে এটা বিশেষভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। ৮৬৯ সালে রাজা আহাব উত্তরের ইসরায়েল রাজ্যের শাসনভার লাভ করেন। তাঁর স্ত্রী বর্তমান লেবাননের তায়ার ও সিদনের রাজকন্যা আন্তরিক পৌত্তলিক ছিলেন। গোটা দেশকে বাআল ও আশেরাহর ধর্মের অধীনে আনতে আগ্রহী ছিলেন তিনি। বাআলের পুরোহিতদের আমদানি করেন তিনি, উত্তরাঞ্চলীয়দের মাঝে দ্রুত অনুসারী যোগাড় করে ফেলেন তাঁরা, এরা রাজা ডেভিডের দ্বারা বিজিত হয়েছিল ও সুপ্ত ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ গোষ্ঠী। আহাব ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র প্রতি বিশ্বস্ত থাকলেও জেজেবেলের ধর্মান্তকরণের প্রয়াসে বাদ সাধেননি। অবশ্য তার শাসনাকালের শেষ দিকে যখন গোটা দেশ এক তীব্র খরায় আক্রান্ত হলো, তখন এলি-যাহ (ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ আমাদের ঈশ্বর’) নামের একজন পয়গম্বর পশমি চাদর ও চামড়ার লংক্লথ পরে দেশময় ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ প্রতি অবিশ্বস্ততার জন্যে সবাইকে অভিশাপ দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। কারমেল পাহাড়ে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ও বাআলের মধ্যে এক প্রতিযোগিতা প্রত্যক্ষ করার জন্য রাজা আহাব আর প্রজাদের আহ্বান জানালেন তিনি। সেখানে বাআলের ৪৫০ জন পয়গম্বরের উপস্থিতিতে জনতার উদ্দেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন: আর কতদিন ওরা উপাস্যের মাঝে দোদুল্যমানতায় ভুগবে? এরপর দুটো ষাঁড় আনতে বললেন তিনি, একটা নিজের জন্যে, অপরটি বাআলের পয়গম্বরদের জন্যে; দুটো ভিন্ন বেদীতে স্থাপন করতে হবে ওগুলো । যার যার ঈশ্বরকে ডাকবেন তারা এবং দেখবেন কোন দেবতা দুর্যোগ গ্রাস করার জন্যে অগ্নি প্রেরণ করেন। রাজি! চেঁচিয়ে জানান দিল জনতা। বাতালের পয়গম্বরগণ সারা সকাল তাঁকে আহ্বান জানিয়ে গেলেন; বেদী ঘিরে বিশেষ নাচে অংশ নিলেন, চেঁচামেচি করে ছুরি ও বর্শা দিয়ে নিজেদের ক্ষতবিক্ষত করলেন। কিন্তু ‘কোনও কণ্ঠস্বর শোনা গেল গেল না, মিলল না জবাব।’ এলি যাহ তিরস্কার করলেন: ‘আরও জোরে চেঁচাও!’ চেঁচিয়ে বললেন তিনি, কেননা তিনি একজন দেবতা: অন্য কাজ করছেন বা ব্যস্ত আছেন; কিংবা হয়তো কোথাও যাত্রা করেছেন; হয়তো ঘুমিয়ে আছেন, এবার জেগে উঠবেন।’ কিছুই ঘটল না: ‘কোনও কণ্ঠস্বর শোনা গেল না, জবাব নেই, তাদের প্রতি কোনও ভ্রূক্ষেপই করা হলো না।

এবার এলিযাহর পালা। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র বেদীর চারপাশে ভিড় জমাল জনতা। বেদীর চারপাশে নালা খনন করে সেখানে পানি ঢেলে আগুন জ্বালানো আরও কঠিন করে তুললেন এলিযাহ্। এরপর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে আহ্বান জানালেন তিনি। এবং অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গ থেকে আগুন নেমে এসে বেদী আর ষাঁড়কে গ্রাস করে নিল, শুষে নিল নালার সব পানি। মুখ থুবড়ে পড়ল জনতা। ‘ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ই ঈশ্বর, জোর গলায় বলল তারা, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ই ঈশ্বর।’ এলিযাহ্ মহানুভব বিজয়ী ছিলেন নাবাআলের পয়গম্বরদের আটক কর?’ নির্দেশ দিলেন তিনি। কাউকে ছাড়া যাবে নাঃ নিকটবর্তী এক উপত্যকায় নিয়ে ওদের হত্যা করলেন তিনি।[২৫] পৌত্তলিক মতবাদ সাধারণত অপর জাতির ওপর আরোপিত হতে চায় না। জেজেবেল ছিলেন কৌতূহলোদ্দীপক ব্যতিক্রম যেহেতু দেবালয়ে অন্যান্য দেবতার পাশে আরেকজন দেবতার খুব সহজেই স্থান মিলত। এইসব প্রাচীন পৌরাণিক ঘটনাবলী দেখায় যে, শুরু থেকেই ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র ধর্মমত ভয়ঙ্কর নির্যাতন ও অন্যান্য ধর্ম বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। পরবর্তী অধ্যায়ে এই বিষয়টি আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করব আমরা। গণহত্যার পর এলিযাহু কারমেল পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা খুঁজে প্রার্থনায় বসলেন, ক্ষাণিক পর পর দিগন্ত জরিপ করার জন্যে দাস পাঠাতে লাগলেন। অবশেষে ক্ষুদ্র এক মেঘখণ্ডের খবর নিয়ে এল। সে-মানুষের হাতের সমান হবে ওটার আকার-সাগর থেকে উঠে আসছে। এলিযাহ্ তখন দাসকে পাঠালেন আহাবকে খবর দেওয়ার জন্যে যেন বৃষ্টি পথরোধ করার আগেই তিনি দ্রুত বাড়ি ফিরে যান। বলতে গেলে কথা বলার মুহূর্তেই ঝড়ো মেঘে আকাশ অন্ধকার করে মুষলধারায় বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল। প্রবল উচ্ছ্বাসে এলিযাহ্ তাঁর আলখেল্লা গুটিয়ে আহাবের রথের পাশাপাশি ছুটতে শুরু করলেন। বৃষ্টি প্রেরণের মাধ্যমে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ঝড় দেবতা বাআলের ভূমিকা দখল করে নিয়েছেন; প্রমাণ করেছেন, যুদ্ধের মতো উর্বরতাদানেও সমান পারঙ্গম তিনি।

পয়গম্বরদের হত্যা করার প্রতিক্রিয়া ঘটার আশঙ্কায় পালিয়ে সিনাই পেনিনসুলায় চলে যান এলিযাহ্; ঈশ্বর যেখানে মোজেসকে দর্শন দিয়েছিলেন সেই পাহাড়ে আশ্রয় নেন। সেখানে এক নতুন থিওফ্যানির অভিজ্ঞতা লাভ করেন তিনি যা নতুন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌বাদী আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ করেছে। স্বর্গীয় প্রতাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পাহাড় প্রাচীরের এক ফোকরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয় তাঁকে:

স্বয়ং ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ সেই স্থান দিয়া গমন করিলেন; এবং ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র অগ্রগামী প্রবল প্রচণ্ড বায়ু পর্বতমালা বিদীর্ণ করিল, শৈল সকল ভাঙ্গিয়া ফেলিল, কিন্তু সেই বায়ুতে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ছিলেন না। বায়ুর পরে ভূমিকম্প হইল, কিন্তু সেই ভূমিকম্পে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ছিলেন না। ভূমিকম্পের পরে অগ্নি হইল, কিন্তু সে অগ্নিতে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ছিলেন না। অগ্নির পরে ঈষৎ শব্দকারী ক্ষুদ্র একক স্বর হইল, তাহা শুনিবামাত্র এলিযাহ্ শাল দিয়া মুখ ঢাকিলেন।[২৬]

পৌত্তলিক উপাস্যদের বিপরীতে প্রকৃতির কোনও শক্তি নন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌, বরং একেবারে আলাদা জগতের। সরব নীরবতার বৈপরীত্যের মাঝে প্রায় দুর্বোধ্য মৃদু হাওয়ার গুঞ্জনে তার উপস্থিতি উপলব্ধি করা গেছে।

এলিযাহ্র কাহিনীতে ইহুদি ঐশীগ্রন্থের অতীত কালের সর্বশেষ পৌরাণিক বিবরণ রয়েছে। গোটা ওইকুমিনের সময় পরিবর্তনের হাওয়া ছিল পরিবেশে। বিসিই ৮০০-২০০ পর্যন্ত সময়কালকে অ্যাক্সিয়াল যুগ বলা হয়েছে। সভ্য জগতের সকল প্রধান অঞ্চলে মানুষ নতুন নতুন আদর্শ বা মতবাদ তৈরি করেছে যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও গঠনমূলক রয়ে গেছে। নতুন ধর্মীয় ব্যবস্থাগুলো পরিবর্তিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। আমাদের উপলব্ধির সম্পূর্ণ অতীত কোনও কারণে সকল প্রধান সভ্যতা বাণিজ্যিক যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও সমান্তরালভাবে গড়ে উঠেছিল (যেমন চীন ও ইউরোপিয় অঞ্চলের কথা বলা যায়)। এক নতুন সমৃদ্ধির ফলে একটি বণিক শ্ৰেণী গড়ে উঠেছিল । রাজা, পুরোহিত, মন্দির এবং রাজপ্রাসাদ থেকে বাজারে ক্ষমতার স্থানান্তর ঘটছিল। নতুন অর্জিত সম্পদ বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আলোকনের দিকে নিয়ে যাবার পাশাপাশি ব্যক্তির বিবেক বোধকেও জাগিয়ে তুলেছে। নগরীসমূহে পরিবর্তনের ধারা ত্বরান্বিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অসাম্য ও শোষণের বিষয়টি স্পষ্টতর হয়ে ওঠে, জনগণ বুঝতে শুরু করে যে তাদের আচরণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিয়তি প্রভাবিত করতে পারে। এইসব সমস্যা ও উদ্বেগের সমাধানের লক্ষ্যে প্রত্যেক অঞ্চল স্পষ্টতঃ পৃথক মতবাদ গড়ে তোলে: চীনে তাওবাদ ও কুনফুসিয়বাদ, ভারতে হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধমতবাদ এবং ইউরোপে দার্শনিক যুক্তিবাদ; মধ্যপ্রাচ্য একক কোনও সমাধান খুঁজে বের করেনি, তবে ইরান ও ইসরায়েলে যথাক্রমে থরোস্টোপ ও হিব্রু পয়গম্বরগণ যথাক্রমে একেশ্বরবাদের ভিন্ন রূপের জন্ম দিয়েছিলেন। ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হতে পারে, সেসময়ের অন্যান্য মহান ধর্মীয় দর্শনের মতো ‘ঈশ্বরে’র ধারণাও আক্রমণাত্মক বা আগ্রাসী পুঁজিবাদের চেতনার মাঝে বাজার অর্থনীতিতে বিকাশ লাভ করেছিল।

পরবর্তী অধ্যায়ে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র পরিবর্তিত ধর্ম নিরীক্ষায় যাবার আগে আমি এমনি দুটো নতুন বিকাশের দিকে সংক্ষেপে নজর বোলানোর প্রস্তাব রাখছি। ভারতে ধর্মীয় বোধ সমরূপ ধারায় গড়ে উঠেছিল, কিন্তু এর আলাদা প্রবণতা ঈশ্বরের ইসরায়েলি ধারণার বিচিত্র বৈশিষ্ট্য ও সমস্যাদিকে আলোকিত করবে। প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের যুক্তিবাদও (Rationalism) গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমরা তাদের ধারণা গ্রহণ করেছে এবং সেগুলোকে নিজস্ব ধর্মীয় অভিজ্ঞতায় সংযোজনের প্রয়াস পেয়েছে, যদিও গ্রিক ঈশ্বর তাদের ঈশ্বরের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিলেন।

বিসিই সপ্তদশ শতাব্দীতে বর্তমান ইরান থেকে আর্যরা ইন্দাস উপত্যকায় হামলা চালিয়ে স্থানীয় জনগণকে পরাভূত করে। তারা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ধারণা চাপিয়ে দেয়, যেগুলো আমরা বেদ নামে পরিচিত গীতি কবিতার সংকলনে প্রকাশিত হতে দেখি। এখানে আমরা বহুসংখ্যক দেবতার উল্লেখ দেখতে পাই, যারা মধ্যপ্রাচ্যের দেবদেবীদের মতো মোটামুটি একই মূল্যবোধ প্রকাশ করেন এবং শক্তি, প্রাণ ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে প্রকৃতির শক্তির একাত্মতা তুলে ধরেন। কিন্তু তারপরও এমন ইঙ্গিত ছিল যাতে মানুষ বুঝতে শুরু করেছিল যে, অসংখ্য দেবতা হয়তো সবাইকে ছাপিয়ে যাওয়া একজন মাত্র স্বর্গীয় সত্তার প্রকাশ হতে পারেন। বাবিলনবাসীদের মতো আর্যরাও সজাগ ছিল যে তাদের মিথগুলো বাস্তব ঘটনার বিবরণ নয়, বরং এমন এক রহস্যের প্রকাশ যার যথাযথ ব্যাখ্যা দান এমনকি দেবতাদের পক্ষেও সম্ভব নয়। আদি বিশৃঙ্খলা থেকে দেবতা ও পৃথিবী সৃষ্টির প্রক্রিয়ার কল্পনা করতে গিয়ে তারা উপসংহারে পৌঁছায় যে কারও পক্ষে-এমনকি দেবতার পক্ষেও-অস্তিত্বের রহস্য উপলব্ধি করা সম্ভব নয়:

আহলে কে বলতে পারবে কখন এর উৎপত্তি ঘটেছে,
কখন এই উৎসারণ সংঘটিত হয়েছে,
ঈশ্বর কি একে বিন্যস্ত করেছেন, নাকি করেন নাই,–
কেবল এর স্বর্গীয় প্রতিপালকই জানেন।
কিংবা হয়তো তিনিও জানেন না![২৭]

বেদের ধর্ম জীবনের উৎস ব্যাখ্যা করার দিকে যায়নি বা দার্শনিক প্রশ্নাবলীর বিশেষ ধরনের উত্তর দেয়নি। তার বদলে মানুষকে অস্তিত্বের বিস্ময় ও আতঙ্কের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করার লক্ষ্যে একে গড়ে তোলা হয়েছে। উত্তরের চেয়ে বেশি প্রশ্নের উত্থাপন করেছে এবং মানুষকে সশ্রদ্ধ বিস্ময়ে ধরে রাখার জন্যে গড়া হয়েছে।

বিসিই অষ্টম শতাব্দী নাগাদ যখন ‘J’ ও ‘E’ তাদের বিবরণ লিপিবদ্ধ করছেন, সেই সময় ভারতীয় উপমহাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মানে ছিল, বৈদিক ধর্ম প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে। আর্য আগ্রাসনের পর বহু শত বছর চাপা পড়ে থাকা স্থানীয় জনগণের ধারণা ফের জেগে ওঠে ও এক নতুন ধর্মীয় আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। কর্মে নতুন আগ্রহ, অর্থাৎ কারও নিয়তি তার কর্ম দিয়ে নির্ধারিত হয়, এই ধারণা মানুষকে নিজের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের জন্যে দেবতাদের দায়ী করায় অনাগ্রহী করে তোলে। ক্রমবর্ধমান হারে দেবতাদের একজন একক দুৰ্জ্জেয় সত্তার (Reality) প্রতীক হিসাবে দেখা হচ্ছিল। বৈদিক ধর্ম উৎসর্গের আচার অনুষ্ঠানে ভরে উঠেছিল, কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় অনুশীলন যোগ (মনোযোগ একীভূত করার বিশেষ চর্চার মাধ্যমে মনের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ) বোঝায় যে, বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব ধর্মের ওপর মানুষ অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছিল। উৎসর্গ ও শাস্ত্রীয় আচার যথেষ্ট বিবেচিত হয়নিঃ এই আচার অনুষ্ঠানের অন্তর্গত অর্থ আবিষ্কার করতে চেয়েছে তারা। আমরা স্মরণ করব যে, ইসরায়েলের পয়গম্বরগণও একই রকম অসন্তোষ বোধ করেছিলেন। ভারতে দেবতাদের আর উপাসকদের দেহাতীত কোনও সত্তা হিসাবে দেখা হচ্ছিল না, বরং নারী-পুরুষ সত্যের অভ্যন্তরীণ উপলব্ধির সন্ধান করেছে।

ভারতে দেবতাগণ আর খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। এখন থেকে ধর্মীয় গুরুগণ তাঁদের হাড়িয়ে যাবেন, যাদের দেবতাদের চেয়েও মঙ্গন বিবেচনা করা হবে। এটা ছিল মানুষের মূল্যের এক উল্লেখযোগ্য ঘোষণা ও নিজ হাতে নিয়তিকে নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা: উপমহাদেশের মহান ধর্মীয় দর্শনে পরিণত হবে এটা। হিন্দু ও বৌদ্ধ মতবাদের নতুন ধর্মগুলো দেবতাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেনি বা মানুষকে তাদের উপসনা করতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। তাদের দৃষ্টিতে এ ধরনের অস্বীকৃতি ও নিষেধাজ্ঞা ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াতো। পরিবর্তে হিন্দু ও বৌদ্ধরা দেবতাদের ছাড়িয়ে যেতে, অতিক্রম করতে নতুন পথের সন্ধান করেছে। অষ্টম শতাব্দীতে সাধুগণ আরণ্যক এবং উপনিষদ নামের প্রবন্ধে এইসব বিষয় আলোচনা শুরু করেন যা সম্মিলিতভাবে বেদান্ত নামে পরিচিত: সর্বশেষ বেদ। আরও অসংখ্য উপবিষদ প্রকাশ পেল, বিসিই পঞ্চম শতাব্দীর শেষ নাগাদ এগুলোর সংখ্যা দাঁড়ায় ২০০টিতে। আমরা যাকে হিন্দু ধর্ম বলি সেটাকে সরলীকরণ করা অসম্ভব, কারণ এই ধর্মমত পদ্ধতি এড়িয়ে চলে .ও কোনও একটি ব্যাখ্যা পর্যাপ্ত বলে মানে না। তবে উপনিষদ দেবত্বের একটা পরিষ্কার ধারণা গড়ে তোলে যা দেবতাকে অতিক্রম করে যায় কিন্তু সর্ববস্তুতে নিবিড়ভাবে উপস্থিত থাকতে দেখা যায় ।

বৈদিক ধর্মে উৎসর্গের আনুষ্ঠানিকতায় মানুষ পবিত্র শক্তি অনুভব করেছে। এই পবিত্র শক্তিকে তারা ব্রাহ্মণ (Brahman) বলত। পুরোহিত গোত্রও ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত) এই ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস ছিল। আনুষ্ঠানিক উৎসর্গকে সমগ্র বিশ্বের ক্ষুদ্র রূপ হিসাবে দেখা হতো বলে ব্রাহ্মণগণ আস্তে আস্তে সমস্ত কিছুর আধার এক শক্তিতে পরিণত হন। সমগ্র বিশ্বকে ব্রাহ্মণের। রহস্যময় সত্তা থেকে সৃষ্ট এক স্বর্গীয় লীলা হিসাবে দেখা হয়েছে, যিনি সকল অস্তিত্বের অন্তর্গত অর্থ। উপনিষদ মানুষকে সবকিছুতে ব্রাহ্মণের অনুভূতি লালনের উৎসাহ যুগিয়েছে। এটা আক্ষরিক অর্থে দিব্যপ্রকাশের একটা প্রক্রিয়া: সকল সত্তার গুপ্তভূমির প্রকাশ ছিল এটা, সব ঘটনাই ব্রাহ্মণের প্রকাশে পরিণত হলো: বিভিন্ন ঘটনার পেছনে ঐক্যের ধারণার মাঝেই প্রকৃত দর্শন নিহিত। কোনও কোনও উপনিষদ ব্রাহ্মণকে ব্যক্তি-শক্তি হিসাবে দেখেছে, কিন্তু অন্যগুলো একেবারেই নৈর্ব্যক্তিক মনে করেছে। ব্রাহ্মণকে তুমি বলে সম্বোধন। করা যায় না; কারণ এটা নিরপেক্ষ; নারী বা পুরুষ অর্থে সে-ও বলা যাবে না, আবার সার্বভৌম উপাস্যের ইচ্ছা হিসাবেও অনুভব করা যাবে না। ব্রাহ্মণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন না। নারী ও পুরুষের সঙ্গে দেখা করতে পারেন না; এইরকম সকল মানবীয় কর্মকাণ্ডের উর্ধ্বে ব্যক্তিগতভাবে এটা আমাদের প্রতি সড়িও দেন নাঃ পাপ একে ‘আক্রান্ত করতে পারে না, একে আমাদের ভালোবাসতে’ বা ‘ক্ষিপ্ত হতে বলা যায় না। বিশ্ব সৃষ্টি করার জন্যে একে ধন্যবাদ বা প্রশংসা করাও একেবারে বেমানান।

এই স্বর্গীয় শক্তিটি আমাদের আবৃত করে না রাখলে, পালন না করলে এবং অনুপ্রেরণা না যোগালে একেবারে দূরবর্তী হয়ে যেতেন। যোগের কৌশলসমূহ মানুষকে এক অন্তর্গত জগতের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছিল । আমরা দেখব, অঙ্গভঙ্গি, শ্বাসপ্রশ্বাস, খাদ্যগ্রহণ ও মানসিক একাত্মতার এইসব অনুশীলন অন্যান্য সংস্কৃতিতেও স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করেছিল যা ভিন্নভাবে ব্যাখ্যায়িত অথচ মানুষের জন্যে স্বাভাবিক আলোকপ্রাপ্তি ও আলোকিত হওয়ার এক বোধ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। উপনিষদের দাবি অনুযায়ী সত্তার নতুন মাত্রার অভিজ্ঞতাই বাকি বিশ্বকে টিকিয়ে রাখা পবিত্র শক্তি। প্রত্যেক ব্যক্তির মাঝে বিরাজিত চিরন্তন নীতিকে বলা হয় আত্মা। পুরোনো হলিস্টিক পৌত্তলিক দর্শনের একটা নতুন রূপ বা ভাষ্য এটা। আমাদের অন্তর ও বাইরের অত্যাবশ্যকীয়ভাবে স্বর্গীয় একক জীবানর (One Life) নতুন আবিষ্কার চান্দোগা উপনিষদ লবণের উদাহরণ টেনে। এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছে। শ্ৰেতাকেতু নামের এক তরুণ বার বছর একটানা বেদ পড়ে মুখস্থ করে ফেলেছে। তার বাবা উদ্দালক তাকে এমন একটা প্রশ্ন করলেন যার জবাব দিতে পারল না সে। তখন তার একেবারে। অজানা মৌলিক সত্য সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার কাজে হাত দিলেন উদ্দালক। ছেলেকে তিনি পানিতে এক টুকরো লবণ ফেলে পরদিন সকালে তাকে পরিণাম জানাতে বললেন। বাবা যখন তাকে লবণ দেখাতে বললেন, শ্ৰেকেতু তা খুঁজে পেল না, কারণ তা পুরোপুরি গলে গিয়েছিল। উদ্দালক এবার তাকে প্রশ্ন শুরু করলেন:

‘এপ্রান্তে একটু চুমুক দেবে? কেমন স্বাদ?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

‘লবণ।’

‘মাঝখানে চুমুক দাও। কেমন স্বাদ?’

‘লবণ।’

‘ওই প্রান্তে চুমুক দাও। কেমন স্বাদ?’

‘লবণ।’

এটা ফেলে দিয়ে আমার কাছে এসো। নির্দেশ পালন করল সে; [কিন্তু] তাতে লবণ যেমন ছিল তা থেকে বদলাল না।

[তার বাবা] তাকে বললেন: ‘আমার প্রিয় পুত্র, এটা সত্যি যে তুমি এখানে সত্তা উপলব্ধি করতে পারছ না, কিন্তু এটাও ঠিক যে এটা এখানেই আছে। এই প্রথম সত্তা–সমস্ত বিশ্বজগৎ এর সত্তা হিসাবে রয়েছে। এটাই বাস্তব: এটাও সত্তা: তুমি যা, শ্রেতাকেতু!’

এভাবে যদিও আমরা দেখতে পাই না, ব্রাহ্মণ সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছেন এবং আত্মার মতো আমাদের প্রত্যেকের মাঝে অনন্তকাল ধরে অবস্থান করছেন।[২৮]

আত্মা ঈশ্বরকে প্রতিমা, সূদূরর্তী ‘বাহ্যিক’ সত্তায় আমাদের ভয় আর আকাক্ষার প্রতিফলন হওয়া থেকে বিরত রাখে । হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী ঈশ্বরকে আমাদের পরিচিত পৃথিবীতে আরোপিত সত্তা হিসাবে দেখা হয় না। আবার এটা জগতের সঙ্গে একাকারও নয়। যুক্তি দিয়ে এর অর্থ বোঝার কোনও উপায় নেই আমাদের। কেবল এক অভিজ্ঞতার (anubhaba) মাধ্যমে এর ‘প্রকাশ’ ঘটে–আমাদের কাছে যা শব্দ বা ধারণা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। ব্রাহ্মণকে ‘শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায় না, যাকে ঘিরেই শব্দসমূহ উচ্চারিত হয়…মন দিয়ে যাকে ভাবা যায় না, বরং মন তাঁকে দিয়েই ভাবে।’[২৯] এরকম পরিব্যাপ্ত ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়, এর সম্পর্কে চিন্তা করাও অসম্ভব, কেবল একে চিন্তার একটা বিষয়ে পরিণত করা হবে মাত্র। এটি সত্তার অতীতে যাওয়ার আদি আনন্দ বোধের মাঝে অনুভবযাৈগ্য এক বাস্তবতা: ঈশ্বর।

যারা জানে যে এটা ভাবনার অতীত তাদের ভাবনাতেই আসেন, তাদের ভাবনায় আসেন না যারা মনে করে ভেবে এর নাগাল পাওয়া যাবে।
জ্ঞানীর জ্ঞানের অতীত এটা, সাধারণের চেনা।
অনন্ত জীবনের দ্বারোদঘাটনের সচেতনতার আনন্দে চেনা যায় একে।[৩০]

দেবতাদের মতো, যুক্তি অস্বীকার করা হয়নি, বরং অতিক্রম করে যাওয়া। হয়েছে। ব্রাহ্মণ বা আত্মার অনুভূতি সঙ্গীত বা কবিতার মতো যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না, এ ধরনের শিল্প সৃষ্টি ও তা উপলব্ধি করার জন্যে বুদ্ধির প্রয়োজন; কিন্তু এটা এমন এক অভিজ্ঞতা বা বোধের যোগান দেয়, যা পুরোপুরি যৌক্তিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক সীমানা অতিক্রম করে যায়। ঈশ্বরের। ইতিহাসেও এটাও একটা অপরিবর্তনীয় থিম হয়ে থাকবে।

যোগির (Yogi) মাঝে ব্যক্তিক দুয়ের আদর্শ বিজড়িত থাকে যে আলোকপ্রাপ্তির জন্যে পরিবার ও সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সত্তার ভিন্ন। বলয়ে নিজেকে স্থাপন করে। বিসিই ৫৩৮ সাল নাগাদ সিদ্ধার্থ গৌতম নামের এক তরুণও তাঁর সুন্দরী স্ত্রী, পুত্র, বানারসের আনুমানিক ১০০ মাইল উত্তরে কপিলাবস্তুর বিলাসবহুল বাড়ি ছেড়ে ভিক্ষু সাধুতে পরিণত হয়েছিলেন। দুর্দশার দৃশ্য দেখে পীড়িত বোধ করেছিলেন তিনি, চারপাশের সবকিছুতে প্রত্যক্ষ করা অস্তিত্বের যন্ত্রণা উপশম করার রহস্য উদ্ধার করতে চেয়েছেন তিনি। ছয় বছর ধরে অসংখ্য হিন্দু গুরুর পায়ের কাছে বসেছেন, নানান ভয়ঙ্কর প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করেছেন, কিন্তু কোনও সমাধানই পাননি। সন্ন্যাসীদের মতবাদ তার মনপুতঃ হয়নি, আবার তার কৃচ্ছতা সাধনও তাকে আরও হতাশ করে তুলেছিল। অবশেষে এইসব পদ্ধতি বাদ দিয়ে নিজেকে যখন ধ্যান নিমগ্ন করলেন, একরাতে আলোকপ্রাপ্ত হলেন তিনি। গোটা সৃষ্টি আনন্দে উদ্বেলিত হলো, দুলে উঠল পৃথিবী, স্বর্গ থেকে পুষ্প বর্ষিত হলো, সুবাসিত হাওয়া বইল এবং বিভিন্ন। স্বর্গে দেবতারা আনন্দে মেতে উঠলেন। এবং আবারও, পৌত্তলিক দর্শনের মতো, দেবতা, প্রকৃতি ও মানুষ সহানুভূতিতে এক সূত্রে বাঁধা পড়ল। কষ্ট থেকে মুক্তি আর নির্বাণ লাভের যন্ত্রণার অবসানের এক নতুন আশা জেগে উঠেছিল। গৌতম পরিণত হলেন বুদ্ধে অর্থাৎ আলোকপ্রাপ্ত জনে। গোড়াতে দূরাত্মা মারা প্রলোভন দেখিয়ে তাকে যথাস্থানে অবস্থান করে অর্জিত আনন্দ উপভোগে প্রলুব্ধ করতে চাইল: এ বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে কোনও লাভ হবে না, কারণ কেউ তাঁর কথা বিশ্বাস করবে না। প্রচলিত দেবনিচয়ের দুজন দেবতা, মহাব্রহ্মা এবং সাকর দেবতাদের প্রভু-বুদ্ধের কাছে এসে পৃথিবীতে তাঁর নতুন পদ্ধতির ব্যাখ্যা করার আবেদন জানালেন। রাজি হলেন বুদ্ধ; পরবর্তী পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে তার বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে গোটা ভারত চষে বেড়ালেন: এই যন্ত্রণাময় জগতে একটা মাত্র বিষয়ই স্থির ও স্থায়ী। সেটা হলো ধম্ম, সঠিক জীবন যাপনের মূল কথা, একমাত্র যা আমাদের দুঃখকষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারে।

এর সঙ্গে ঈশ্বরের কোনও সম্পর্ক নেই। দেবতাগণ সংস্কৃতির অংশ ছিলেন বলেই পরোক্ষে তাদের অস্তিত্ব মেনে নিয়েছিলেন বুদ্ধ, কিন্তু মানবজাতির তেমন প্রয়োজনে তাঁরা আসেন বলে বিশ্বাস করেননি। তারাও রোগ-শোকে আক্রান্ত হন: আলোকপ্রাপ্তিতে তাকে তারা সাহায্য করেননি; অন্য সব প্রাণীর মতো তারাও পুনর্জন্মের চক্রের অংশ, শেষ পর্যন্ত তারাও মিলিয়ে যাবেন। তারপরেও তাঁর জীবনের জটিল মুহূর্তগুলোয়-তার বাণী প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ের মতো তাঁর মনে হয়েছিল দেবতারা বুঝি তাকে প্রভাবিত করছেন, সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। সুতরাং বুদ্ধ দেবতাদের অস্বীকার। করেননি, তবে তিনি বিশ্বাস করতেন চূড়ান্ত নির্বাণ লাভ দেবতাদের চেয়েও উঁচু মর্যাদার। বৌদ্ধরা যখন ধ্যানের মাধ্যমে চরম আনন্দ বা দুয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করে, তখন তারা আধ্যাত্মিক বা অতিপ্রাকৃত সত্তার সঙ্গে যোগাযোগের ফলে তা ঘটেছে মনে করে না। এসব অবস্থা বা পর্যায়ে মানুষের জন্যে স্বাভাবিক, সঠিক পথে জীবন যাপনকারী ও যোগের কৌশল আয়ত্তে আনা যে কারও পক্ষে এ অভিজ্ঞতা অর্জন সম্ভব। সুতরাং, কোনও দেবতার ওপর ভরসা করে অনুসারীদের নিজেদের রক্ষা করার তাগিদ দিয়েছেন বুদ্ধ।

আলোকপ্রাপ্তির পর বানারসে প্রথম অনুসারীর দেখা পাওয়ার পর আপন পদ্ধতির ব্যাখ্যা করলেন বুদ্ধ-এক অত্যাবশ্যকীয় সত্যের ওপর ভিত্তি করে যা গড়ে উঠেছে: সকল অস্তিত্বই দুঃখ (dhukka)। এটা পুরোপুরি যন্ত্রণাময়, সমগ্র জীবন খুবই জটিল। অর্থহীন প্রবাহে বিভিন্ন বস্তু আসে যায়। কোনও কিছুরই চিরন্তন তাৎপর্য নেই। কোথাও কিছু একটা ভুল আছে, এই বোধ নিয়ে ধর্মের শুরু। প্রাচীন পৌত্তলিকতার যুগে এই বোধ স্বর্গীয় জগৎ আমাদের চেনা জগতের সমরূপ আদর্শ জগতের কিংবদন্তীর দিকে টেনে নিয়ে গেছে, যা মানবজাতিকে শক্তি যোগাতে সক্ষম। বুদ্ধ শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, সকল প্রাণীর প্রতি দয়া প্রদর্শন, ভদ্র, দয়াময় ও সঠিক আচরণ দেখিয়ে ও কথা বলে এবং মনকে আচ্ছন্ন করতে পারে এমন মাদক বা সমজাতীয় পদার্থ গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রেখে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব। বুদ্ধ স্বয়ং নিজেকে এই পদ্ধতির আবিষ্কারক দাবি করেননি। একে খুঁজে পাওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন তিনিঃ ‘আমি এক প্রাচীন পথ, প্রাচীন সড়ক দেখেছি। বহুযুগ আগে বুদ্ধদের পথে চলাচলের পথ।’[৩১] পৌত্তলিকতার বিধি-বিধানের মতো অস্তিত্বের অত্যাবশ্যকীয় কাঠামোর সঙ্গে এটা সম্পর্কিত, জীবনের সহজাত অবস্থার সঙ্গে জড়িত। যৌক্তিক প্রমাণ দিয়ে দেখানো যায় বলে এর বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা ছিল তা নয়, বরং কেউ নির্ধারিত পথে জীবন পরিচালনা করতে উদ্যোগী হলে সে এর কার্যকারিতা বুঝতে পারবে বলেই এটা সেই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। দার্শনিক বা ঐতিহাসিক প্রকাশের চেয়ে কার্যকারিতাই বরং সব সময় যে কোনও ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল: গত শত বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বৌদ্ধরা এই ধরনের জীবনযাত্রা এক দুৰ্জ্জেয় বোধ জাগায় বলে জেনে এসেছে।

কর্ম মানুষকে অসংখ্য যন্ত্রণাময় জীবনের পুনর্জন্মের চক্রে বন্দি করেছে। কিন্তু নিজেদের অহমবোধকে সংস্কার করতে পারলেই তারা নিয়তিকে বদলাতে পারবে। পুনর্জন্মের প্রক্রিয়াকে জ্বলন্ত শিখার সঙ্গে তুলনা করেছেন বুদ্ধ, যার সাহায্য আরেকটি শিখা জ্বালানো হয়; শিখাঁটি না নেভা পর্যন্ত চলতে থাকে এভাবে। কেউ ভুল প্রবণতা নিয়ে জ্বলন্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে স্রেফ আরেকটা বাতি জ্বালবে সে। কিন্তু শিখাঁটি নির্বাপিত হয়ে গেলে, যন্ত্রণাচক্রের অবসান ঘটবে, নির্বাণ প্রাপ্তি ঘটবে। নির্বাণে’র আক্ষরিক অর্থ ‘শীতল হওয়া বা বিদায় নেওয়া। অবশ্য এটা স্রেফ একটা নেতিবাচক পর্যায় নয়, বরং বৌদ্ধদের জীবনে তা এমন এক ভূমিকা পালন করে যা ঈশ্বরের ভূমিকার অনুরূপ। এডওয়ার্ড কনযে তার বুদ্ধিজম: ইটস এসেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এ যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, বৌদ্ধরা প্রায়শঃই নির্বাণ বা পরম সত্তাকে ব্যাখ্যা করার জন্যে আস্তিকের মতো একই ইমেজারি ব্যবহার করে থাকে:

আমাদেরকে বলা হয়েছে যে, নির্বাণ চিরস্থায়ী, স্থিতিশীল, অপচনশীল, অনড়, জরাহীন, মৃত্যুহীন, অজাত এবং অসৃষ্ট; এটা শক্তি, আনন্দ এবং সুখ, নিরাপদ আশ্রয়, আশ্রম ও আক্রমণের অতীত এক স্থান; এটাই প্রকৃত ও পরম সত্তা: এটাই মঙ্গল, চরম লক্ষ্য এবং আমাদের জীবনের এক এবং একমাত্র পরিণতি, চিরন্তন, গুপ্ত ও দুর্বোধ্য শান্তি। [৩২]

কোনও কোনও বৌদ্ধ এই রকম তুলনায় আপত্তি তুলতে পারে, কেননা তারা মনে করে ঈশ্বরের ধারণা তাদের পরম সত্তার ধারণা প্রকাশের ক্ষেত্রে খুবই সীমিত। এর পেছনে প্রধান কারণ হলো অস্তিকগণ ঈশ্বর’ শব্দটি সীমিত অর্থে এমন এক সত্তাকে বোঝাতে ব্যবহার করে যিনি আমাদের চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন নন। উপনিষদের সন্ন্যাসীদের মতো বুদ্ধ নির্বাণের ব্যাপারটিকে অন্য যে কোনও মানবীয় বৈশিষ্ট্যের মতো করে সংজ্ঞায়িত বা আলোচনা করা যাবে না। বলে জোর দিয়েছেন।

নির্বাণ লাভ ক্রিশ্চানরা যেমনটি প্রায়শঃই বুঝে থাকে সেরকম ‘স্বর্গে গমন’-এর মতো ব্যাপার নয়। বুদ্ধ বরাবরই নির্বাণ বা অন্য পরম বিষয়াদি সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার গেছেন, কেননা সেটা ‘অসঙ্গত’ বা ‘অনুচিত’ ছিল। আমাদের পক্ষে নির্বাণের সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ আমাদের ভাষা ও ধারণা অনুভূতি এবং বেদনার জগতের সঙ্গে বাঁধা। অভিজ্ঞতাই একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রমাণ। তার অনুসারীরা নির্বাণের অস্তিত্ব জানতে পারবে, কারণ সুন্দর জীবন যাপনের চর্চা তাদের সেটা প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম করে তুলবে।

এই যে সন্ন্যাসী, অজাত, অসৃষ্ট, অগঠিত, অমিশ্র। যদি, সন্ন্যাসীরা অজাত, অদৃষ্টে, অগঠিত, অমিশ্র না হয় তাহলে, জাত, সাধারণ, গঠিত এবং মিশ্র থেকে মুক্তি সম্ভব হবে না। কিন্তু অদৃষ্টে অজাত, অগঠিত ও অমিশ্র আছে, সুতরাং জাত, সাধারণ, গঠিত ও মিশ্র থেকে আছে মুক্তি। [৩৩]

তাঁর সাধুদের নির্বাণের প্রকৃতি নিয়ে আঁচ অনুমান করা ঠিক হবে না। বুদ্ধ যেটা করতে পারেন সেটা হচ্ছে একটা ভেলার ব্যবস্থা করে দেওয়া যার সাহায্যে তারা ‘অপর পারে’ যেতে পারবে। তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো যে নির্বাণপ্রাপ্ত একজন বুদ্ধ কি মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকেন, প্রশ্নটিকে ‘বেঠিক’ বলে নাকচ করে দিয়েছিলেন তিনি। এ যেন অগ্নিশিখা নিভে যাওয়ার পর সেটা। কোন দিকে গেছে জানতে চাওয়ার মতো। নির্বাণে বুদ্ধ আছেন বলা যেমন ভুল হবে তেমনি তিনি নেই বলাটাও সমান ভুল: ‘আছে’ শব্দটার সঙ্গে আমাদের বোধগম্য কোনও অবস্থার সম্পর্ক নেই। আমরা দেখব, শত শত বছরের পরিক্রমায় ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কিত প্রশ্নেরও। একই রকম জবাব দিয়ে এসেছে। বুদ্ধ দেখাতে চেয়েছিলেন যে, বোধ ও যুক্তির অতীত কোনও সত্তাকে বোঝাতে ভাষা যথাযথভাবে সমৃদ্ধ নয়। তিনি কিন্তু যুক্তিকে অস্বীকার করেননি, বরং স্পষ্ট ও সঠিক চিন্তা এবং ভাষার। ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি অবশ্য বলেছেন যে, কোনও ব্যক্তির ধর্মজ্ঞান বা বিশ্বাস, সে যেসব আচার অনুষ্ঠানে অংশ নেয়, সেগুলোর মতোই গুরুত্বহীন। এগুলো কৌতূহলোদ্দীপক হতে পারে, কিন্তু চরম তাৎপর্যমণ্ডিত কোনও বিষয় নয়। একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে উন্নত বা সুন্দর। জীবন, যদি সে সত্যকে প্রকাশে ব্যর্থ হয়।

অন্যদিকে গ্রিকরা প্রবলভাবে যুক্তি ও কারণ সম্পর্কে আগ্রহী ছিল। প্লেটো (Ca ৪২৮– Ca ৩৪৮ বিসিই) জ্ঞানতত্ত্ব ও প্রজ্ঞার প্রকৃতি সংক্রান্ত সমস্যাদি নিয়ে যারপরনাই ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর প্রথম দিকের অধিকাংশ রচনাই সক্রেটিসের যুক্তির পক্ষে যুক্তি হিসাবে রচিত হয়েছিল। সক্রেটিস মানুষকে তার চিন্তা উস্কে দেওয়া প্রশ্নের সাহায্যে তাদের ধারণা ব্যাখ্যা করতে বাধ্য করতেন। ৩৯৯ সালে তরুণ সমাজকে পথভ্রষ্ট করা ও অপবিত্রতার অপরাধে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ভারতীয় জনগণের পদ্ধতির প্রায় সমরূপ ছিল তা। তিনি ধর্মের প্রাচীন অনুষ্ঠান ও মিথের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট বোধ করেছেন, এগুলোকে তাঁর চোখে অর্থহীন, অনুপযুক্ত ঠেকেছে। ষষ্ঠ শতকের দার্শনিক পিথাগোরাস দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন প্লেটো, যিনি হয়তো আবার পার্সিয়া ও মিশরের মাধ্যমে ভারত থেকে আগত ধারণায় প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারেন। তার বিশ্বাস ছিল, কোনও আত্মা দেহে আশ্রয় নেওয়া পতিত ও দূষিত দেবতা, অনেকটা কবরের শবের মতো এবং চিরস্থায়ী পুনর্জন্মের চক্রে অভিশপ্ত । আমাদের সত্তার সঙ্গে বেমানান এক পৃথিবীতে নিজেকে আগন্তুক মনে হবার সাধারণ মানবীয় অনুভূতিকে ভাষা দিয়েছেন তিনি। পিথাগোরাসের শিক্ষা ছিল আচরিক পরিশুদ্ধতা অর্জনের ভেতর দিয়ে আত্মাকে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে যা একে সুশৃঙ্খল মহাবিশ্বের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম করে তুলবে। প্লেটো স্বর্গের অস্তিত্ব, বোধগম্য জগতের অতীত অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা, আত্মা পতিত স্বর্গীয় সত্তার চেনা জগতের বাইরে একটা দেহে আটকা পড়েছে, যেটা মনের ক্ষমতার যৌক্তিকরণের মাধ্যমে আবার স্বর্গীয় অবস্থান ফিরে পেতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করতেন। বিখ্যাত গুহার মিথে পৃথিবীতে মানুষের জীবনের অন্ধকার ও অস্পষ্টতার বিবরণ দিয়েছেন প্লেটো: সে কেবল গোটা প্রাচীরে ঠিকরে যাওয়া অনন্ত বাস্তবতার ছায়া প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু আস্তে আস্তে তাকে বের করে আনা সম্ভব, স্বর্গীয় আলোয় নিজের মনকে খাপ খাইয়ে আলোকপ্রাপ্তি ও মুক্তি লাভ করতে পারে সে।

পরবর্তী জীবনে প্লেটো হয়তো অনন্ত আকৃতি বা ধারণা থেকে সরে এসে থাকতে পারেন, কিন্তু বহু আস্তিকের কাছে তাদের ঈশ্বরের ধারণা ব্যাখ্যার প্রয়াসে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এসব ধারণা ছিল স্থিতিশীল, স্থায়ী বাস্তবতা, মনের শক্তির যৌক্তিকীকরণের ভেতর দিয়ে যেগুলো উপলব্ধি করা সম্ভব। আমরা আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে যেসব অস্থির, ত্রুটিপূর্ণ ঘটনাবলীর মোকাবিলা করে থাকি সেগুলোর চেয়ে অনেক বেশি পূর্ণাঙ্গ, স্থায়ী ও ফলপ্রসূ বাস্তবতা। এই জগতের বস্তুসমূহ প্রতিধ্বনি মাত্র, স্বর্গীয় জগতের অনন্ত আকারে ‘অংশগ্রহণ করে’ বা ‘অনুসরণ করে’। ভালোবাসা, ন্যায়বিচার ও সৌন্দর্য, ইত্যাদির মতো আমাদের সাধারণ ধারণার সমরূপ ধারণা রয়েছে। কিন্তু সকল আকৃতির মাঝে সেরা হচ্ছে ভালোর ধারণা। প্লেটো আদি আদর্শজগতের প্রাচীন মিথকে দার্শনিক রূপে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর চিরন্তন ধারণাসমূহকে পৌরাণিক শ্মীয় জগতের যৌক্তিক ভাষ্য হিসাবে দেখা যেতে পারে, জাগতিক বিষয়াদি যার তুচ্ছ ছায়ামাত্র। তিনি ঈশ্বরের প্রকৃতি আলোচনা করেননি, বরং আকৃতির স্বর্গীয় জগতে নিজেকে সীমিত রেখেছেন, যদিও কখনও কখনও মনে হয় যে, আদর্শ সৌন্দর্য বা ভালো প্রকৃতিই এক পরম সত্তার কথা বোঝাচ্ছে। প্লেটোর স্থির বিশ্বাস ছিল যে, স্বর্গীয় জগৎ স্থির, পরিবর্তনহীন। চলিষ্ণুতা ও পরিবর্তনকে গ্রিকরা নিম্নস্তরের বাস্তবতা হিসেবে দেখেছে: সত্য পরিচয়ধারী যে কোনও কিছু বরাবর একইরকম থাকে, স্থায়িত্ব ও অপরিবর্তনীয়তাই এর বৈশিষ্ট্য। সুতরাং সবচেয়ে নিখুঁত গতি হচ্ছে বৃত্ত, কারণ এটা চিরস্থায়ীভাবে ঘুরছে ও মূলবিন্দুতে ফিরে আসছে: ঘূর্ণায়মান মহাজাগতিক বলয়গুলো তাদের সাধ্যানুযায়ী স্বর্গীয় জগতকে অনুকরণ করে যাচ্ছে। স্বর্গের এই চরম স্থায়ী ইমেজ ইহুদি, ক্রিস্টান ও মুসলিমদের ওপর সীমাহীন প্রভাব বিস্তার করবে, যদিও এর সঙ্গে প্রত্যাদেশের ঈশ্বরের তেমন একটা মিল ছিল না; যিনি সব সময় ক্রিয়াশীল, সৃষ্টিশীল এবং বাইবেল অনুযায়ী, মানবজাতি সৃষ্টির পর অনুতপ্ত হয়ে গোটা মানবজাতিকে বন্যার পানিতে ধ্বংস করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে মত পর্যন্ত পরিবর্তন করেন।

প্লেটোর একটা অতিন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে একেশ্বরবাদীদের কাছে যা খুবই জুৎসই মনে হয়। প্লেটোর স্বর্গীয় আকৃতিসমূহ মহাশূন্যের বাস্তবতা বা সত্তা নয়, বরং নিজের মাঝেই এর দেখা পাওয়া সম্ভব। সিম্পোজিয়াম নামের নাটকীয় সংলাপে প্লেটো দেখিয়েছেন চমৎকার শরীরের ভালোবাসা কীভাবে পরিশুদ্ধ ও আদর্শ সৌন্দর্যের ভাববাদী চিন্তায় রূপান্তরিত করা যায়। সক্রেটিসের শিক্ষক দায়োতিমার মুখে তিনি ব্যাখ্যা করিয়েছেন যে, এই সৌন্দর্য অনন্য, চিরকালীন এবং পরম, আমরা এ বিশ্বে যা কিছু দেখতে পাই তার কোনওটার মতোই নয়

চিরন্তন সমস্ত কিছুর আগে আদি এই সৌন্দর্য; এটা কখনও রূপ পরিগ্রহ করে না বা শেষ হয়ে যায় না, বাড়ে না বা কমেও যায় না; তারপর, আংশিক সুন্দর বা আংশিক কুৎসিত এর কোনও পর্যায় নয়, কখনও সুন্দর, কখনও অসুন্দর নয়, একের প্রেক্ষিতে সুন্দর আর অন্যের বিপরীতে অসুন্দর নয়, এক স্থানে সুন্দর আর অন্যত্র অসুন্দর নয়, দর্শকদের মত অনুযায়ী পরিবর্তনশীল নয়, আবার এই সৌন্দর্য মুখমণ্ডল। বা হাতের সৌন্দর্য বা দেহাতীত কোনও কিছুর সৌন্দর্য চিন্তার মতো নয়, কিংবা চিন্তা বা বিজ্ঞানের সৌন্দর্যের মতো নয়, কিংবা এমন কোনও সৌন্দর্য নয় যা অন্যত্র বিরাজমান সেটা জীবিত কোনও প্রাণী হোক, আকাশ কিংবা মাটি হোক, কিংবা যাই হোক না কেন, একে সে দেখবে পরম, এককভাবে অবস্থানরত, অনন্য, চিরন্তন হিসাবে। [৩৪]

সংক্ষেপে সুন্দরের মতো ধারণার সঙ্গে আস্তিকরা যাকে ‘ঈশ্বর’ বলবে তার অনেক মিল রয়েছে। কিন্তু এর দুয়েতা সত্ত্বেও ধারণাসমূহ মানুষের মনেই পাওয়া যাওয়ার কথা। আমরা আধুনিক মানুষ চিন্তাকে কাজ হিসাবে দেখি যেন আমরা কিছু করছি। প্লেটো একে দেখেছেন এমন কিছু যা আমাদের মনে ঘটে: চিন্তার বিষয়বস্তু যে ব্যক্তি চিন্তা করছে তার মনে বা বুদ্ধিতে ক্রিয়াশীল বাস্তবতা। সক্রেটিসের মতো তিনি চিন্তাকে স্মরণের একটি প্রক্রিয়া হিসাবে দেখেছেন, আমরা সব সময় যা জানতাম কিন্তু ভুলে গেছি এমন কিছু স্মরণ করার আকাঙ্ক্ষা। মানুষ যেহেতু পতিত স্বর্গীয় সত্তা, স্বর্গীয় জগতের আকৃতিসমূহ তাদের মাঝেই বিরাজ করে এবং যুক্তির মাধ্যমে সেগুলো ‘স্পর্শ’ করা সম্ভব, যেটা কেবল যৌক্তিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ নয় বরং আমাদের অভ্যন্তরস্থ অন্তঃসত্তাকে ছোঁয়ার প্রয়াস। ঐতিহাসিক একেশ্বরবাদের তিনটি ধর্মের প্রত্যেকটির অতিন্দ্রীয়বাদী সাধকদের এই ধারণা প্রবলভাবে প্রভাবিত করবে।

প্লেটো বিশ্বাস করতেন মহাবিশ্ব অত্যাবশ্যকীয়ভাবে যৌক্তিক। এটা বাস্তবতার আরেকটি মিথ বা কাল্পনিক ধারণা। অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ বিসিই) আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছেন। তিনিই প্রথমবারের মতো সকল বিজ্ঞানের ভিত্তি যৌক্তিক ব্যাখ্যাকরণের (Logical Reasoning) গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এই পদ্ধতির মাধ্যমে মহাবিশ্বকে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। মেটাফিজিক্স নামে পরিচিত (নামটি তার সম্পাদকের দেওয়া, যিনি এইসব গবেষণামূলক প্রবন্ধকে ‘ফিজিক্সের পরে’: মেটা টা ফিজিক্স-এ স্থান দিয়েছিলেন), চৌদ্দটি নিবন্ধে সত্যের তত্ত্বগত উপলব্ধির প্রয়াসের পাশাপাশি তত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও প্রথাগত জীববিদ্যারও গবেষণা করেছিলেন তিনি। তা সত্ত্বেও তিনি গভীর বুদ্ধিবৃত্তিক বিনয়ের অধিকারী ছিলেন, জোর দিয়ে বলেছেন কারও পক্ষেই সত্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়, তবে আমাদের প্রত্যেকে সম্মিলিত উপলব্ধির ক্ষেত্রে যার যার ক্ষুদ্র ভূমিকা রাখতে পারে। প্লেটোর রচনাবলী সম্পর্কিত তার মূল্যায়ন নিয়ে উল্লেখযোগ্য বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে তিনি যেন আকৃতি সম্পর্কে প্লেটোর দুয়ের ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী ছিলেন, এগুলোর আদি স্বাধীন সত্তা থাকার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন। অ্যারিস্টটল মত প্রকাশ করেছেন যে, কেবল আমাদের পরিচিত নিরেট বস্তগত জগতে যতক্ষণ আছে ততক্ষণই আকৃতির অস্তিত্ব রয়েছে।

ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রতি দুর্বলতা সত্ত্বেও প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি ছিল অ্যারিস্টটলের; ধর্ম ও মিথের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তিনি। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, বিভিন্ন রহস্যবাদী ধর্মে নবীশে পরিণত হওয়া ব্যক্তিদের কোনও বাস্তব জ্ঞান অর্জন করার প্রয়োজন হয়নি, বরং বিশেষ অবস্থায় স্থাপনের মাধ্যমে বিশেষ আবেগ অনুভব করতে হয়েছে।[৩৫] এভাবেই তার সুবিখ্যাত সাহিত্য তত্ত্ব ট্র্যাজিডি আতঙ্ক ও করুণা বোধের পরিশুদ্ধতাকে (Katharsis) সৃষ্টি করে যা পূনর্জনের অভিজ্ঞতার মতো। মূলত ধর্মীয় উৎসবের অংশ হিসাবে গড়ে ওঠা গ্রিক ট্র্যাজিডিসমূহ অত্যাবশ্যকীয়ভাবে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের সত্যনিষ্ঠ বিবরণ ছিল না বরং তা ছিল আরও নিগূঢ় সত্য আবিষ্কারের প্রয়াস। প্রকৃতপক্ষে কাব্য ও মিথের চেয়ে ইতিহাস অনেক বেশি গুরুত্বহীন, তুচ্ছ: ‘একটা যা ঘটে গেছে তার বিবরণ দেয়, অপরটি বলে কী ঘটতে পারত। সে কারণে কাব্য ইতিহাসের চেয়ে ঢের বেশি দার্শনিক ও সিরিয়াস প্রাকৃতির; কারণ কাব্য বিশ্বজনীনতার কথা বলে, ইতিহাস বলে নির্দিষ্ট বিষয়ের কথা।’[৩৬] ঐতিহাসিক চরিত্র হিসাবে অ্যাচিলিস, ইদিপাস না থাকতে পারে কিন্তু আমরা হোমার ও সফোক্লিস-এর যেসব চরিত্রের সংস্পর্শে আসি সেগুলোর সঙ্গে তাদের জীবনের ঘটনাবলী অপ্রাসঙ্গিক যা মানব অবস্থা সম্পর্কে ভিন্নতর অথচ আরও গভীর সত্য প্রকাশ করে। ট্যাজিডির ক্যাথারসিস সম্পর্কিত অ্যারিস্টটলের বিবরণ এমন এক সত্যের দার্শনিক উপস্থাপন হোমো রিলিজিয়াসরা যা সবসময় সহজাত প্রবৃত্তি দিয়েই অনুধাবন করেছে: ঘটনাপ্রবাহের প্রতীকী, পৌরাণিক বা আচরিক উপস্থাপন নৈমিত্তিক জীবনে সহনীয় নয়, কিন্তু এগুলোকে আরও বিশুদ্ধ, আরও আনন্দময় রূপে পরিবর্তন করতে সক্ষম।

পরবর্তীকালের একেশ্বরবাদীর উপর, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের ক্রিশ্চানদের ওপর অ্যারিস্টটলের ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণা ব্যাপক প্রভাবে রেখেছে। ফিজিক্স-এ তিনি বাস্তবতার প্রকৃতি ও বিশ্বজগতের সারবস্তু পরীক্ষা করেছেন। তার লব্ধ জ্ঞান সৃষ্টি সংক্রান্ত প্রাচীন উৎসারণবাদী দার্শনিক ভাষ্য; অস্তিত্বের বিভিন্ন ধারাক্রম অনুযায়ী পর্যায় রয়েছে (hierarchy of existences), যার প্রত্যেকটি তার নিচের পর্যায়কে আকৃতি দান করে ও সেটার আকার ধারণ করে; কিন্তু প্রাচীন মিথের বিপরীতে অ্যারিস্টটলের তত্ত্ব অনুযায়ী এই উৎসারণ তাদের উৎস থেকে যত দূরে যায় ততই দুর্বল হয়ে পড়ে। একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছেন অটল চালক (Unmoved Mover), অ্যারিস্টটল যাকে ঈশ্বর বলে শনাক্ত করেছেন। এই ঈশ্বর নিখুঁত সত্তা এবং সেকারণে চিরন্তন, অনড় ও আধ্যাত্মিক। ঈশ্বর খাঁটি চিন্তা আবার একই সময়ে ভাবুক ও ভাবনা, নিজেকে জ্ঞানের সর্বোচ্চ লক্ষ্য উপলব্ধি করার এক অনন্ত মুহূর্তে ন্যস্ত রয়েছেন। বস্তু যেহেতু অসম্পূর্ণ ও মরণশীল, সুতরাং ঈশ্বরের কিংবা সত্তার উচ্চতর শ্রেণীতে কোনও বস্তুগত উপাদান নেই। অটল চালক সকল গতি ও বিশ্বজগতের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেন, কেননা প্রত্যেক গতির পেছনে কারণ থাকতে বাধ্য যা কোনও একক উৎস পর্যন্ত অনুসরণ করা সম্ভব। আকর্ষণের এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি বিশ্বকে চালু করেন, কেননা সকল সত্তাই খোদ পরম সত্তার দিকে ধাবমান।

এক অগ্রাধিকার স্থানে মানুষের অবস্থান: তার মানব আত্মার বুদ্ধির মতো স্বর্গীয় আশীর্বাদ রয়েছে, যা তাকে ঈশ্বরের নিকটবর্তী করে তোলার সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গীয় প্রকৃতির অংশীদার করেছে। যুক্তি প্রয়োগের এই দেবসম ক্ষমতা তাকে জীব-জানোয়ার ও গাছপালার উপরে স্থাপন করেছে। অবশ্য দেহ ও আত্মারূপে মানুষ সমগ্র মহাবিশ্বের এক ক্ষুদ্ররূপ, নিজের মাঝে মৌলিক বস্তুগুলোর পাশাপাশি যুক্তির স্বর্গীয় গুণও ধারণ করে। আপন বুদ্ধিমত্তাকে পরিশুদ্ধ করে অমর ও স্বর্গীয় হয়ে ওঠাই তার দায়িত্ব। প্রজ্ঞা (Sophia) মানবীয় গুণাবলীর ভেতর শ্রেষ্ঠ দার্শনিক সত্যের ধ্যানের (Theoria) মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটে, যা প্লেটোর মতানুযায়ী, স্বয়ং ঈশ্বরের কর্মকাণ্ডের অনুকরণের ভেতর দিয়ে আমাদের স্বর্গীয় করে তোলে। কেবল যুক্তি দিয়েই থিয়োরিয়া অর্জন করা সম্ভব নয়, বরং এর জন্যে প্রয়োজন শৃঙ্খলিত বোধের ভেতর দিয়ে আপন সত্তাকে অতিক্রম করে যাওয়া। অবশ্য খুব স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তি এ ধরনের প্রজ্ঞার অধিকারী হতে পারে, এবং অধিকাংশই কেবল দৈনন্দিন জীবনে দূরদৃষ্টি ও বুদ্ধিমত্তার অনুশীলন বা চর্চা ফ্রনেসিস (Phronesis) পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।

তাঁর ব্যবস্থায় অটল চালক (Unmoved Mover)-এর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান সত্ত্বেও অ্যারিস্টটলের ঈশ্বরের ধর্মীয় প্রাসঙ্গিকতা ছিল সামান্যই। তিনি বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেননি, কেননা তাতে করে অসঙ্গত পরিবর্তন ও পার্থিব কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন হতো। যদিও সমস্ত কিছু তার দিকে ধাবমান, কিন্তু এই ঈশ্বর বিশ্বজগতের অস্তিত্ব সম্পর্কে একেবারেই নিস্পৃহ, নিরাসক্ত, কারণ তার পক্ষে নিম্নস্তরের কোনও কিছু সম্পর্কে ভাবনা সম্ভব নয়। তিনি অবশ্যই এ জগতকে পরিচালনা করেন না বা পথ দেখান না, আমাদের জীবনেও কোনও রকম প্রভাব রাখেন না, সে যেমনই হোক। ঈশ্বর তার অস্তিত্বের প্রয়োজনের তাগিদে তাঁর কাছ থেকে উৎসারিত মহাবিশ্বের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন কিনা সেটাই এক বিরাট প্রশ্ন। এমন একজন ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্নটি প্রান্তিক হতে বাধ্য। অ্যারিস্টটল নিজেই হয়তো শেষ জীবনে তার তত্ত্ব ত্যাগ করতেন। অ্যাক্সিয়েল যুগের মানুষ হিসাবে তিনি ও প্লেটো উভয়ই ব্যক্তি বিশেষের বিবেক, সুন্দর জীবন ও সমাজে ন্যায় বিচারের বিষয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। তবু তাদের চিন্তা ভাবনা ছিল এলিটিস্ট। প্লেটোর আকৃতি সংক্রান্ত নিখুঁত জগৎ বা অ্যারিস্টটলের দূরবর্তী ঈশ্বর সাধারণ মরণশীলদের জীবনে খুব একটা প্রভাব রাখার অধিকারী ছিলেন না, এ সত্যটি পরবর্তীকালে তাঁদের ইহুদি ও মুসলিম ভক্তরা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।

সুতরাং অ্যাক্সিয়াল যুগের নয়া মতবাদগুলোয় একটা সাধারণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল যে, মানুষের জীবনে অত্যাবশ্যকীয় এক দুয়ে উপাদান রয়েছে। আমাদের আলোচনায় বিভিন্ন পণ্ডিতগণ এই দুয়েকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠার বেলায় নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে একে গুরুত্বপূর্ণ বলে মেনে নিয়েছেন সকলেই। তাঁরা প্রাচীন মিথলজিগুলোকে পুরোপুরি বাতিল করে দেননি, বরং নতুন করে ব্যাখ্যা করেছেন; মানুষকে সেগুলো ছাড়িয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। একই সময় এইসব অতি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদসমূহ যখন গড়ে উঠছিল, ইসরায়েলের পয়গম্বরগণ তখন পরিবর্তিত অবস্থার চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য গড়ে তুলছিলেন যার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ একমাত্র ঈশ্বরে পরিণত হন। কিন্তু এই ক্ষেপাটে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ কীভাবে অন্যান্য উচ্চমার্গীয় দর্শনের সঙ্গে মানিয়ে উঠবেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *