৯০. নগ্ন শরীরটা চাদরে ঢেকে

অধ্যায় ৯০

নগ্ন শরীরটা চাদরে ঢেকে রেখেছে ইমরুল, ঘুম ভেঙে যাওয়ায় চোখদুটো এখন খোলা। গাড়ির ভেতরে আগুন লাগবে কিভাবে বুঝতে পারছে না।

পাশে বেঘোরে পড়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালো। এই মেয়ে সিগারেট খায় কিন্তু গাড়িতে করে নিয়ে আসার সময় তো সিগারেটটা অ্যাস্ট্রেতেই ফেলেছিল। আর যদি বাইরেও ফেলে, এতোক্ষণ পর আগুন লাগবে কেন?

মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার, উজ্জ্বল কেন এতো দেরি করছে। নিচে গিয়ে দেখার পরই ইন্টারকমে তাকে জানানো উচিত না, আসলে কী হয়েছে। সে কি টেনশনে থাকবে না? এটা জানাতে এতোক্ষণ লাগে!

এমন সময় ফ্ল্যাটের দরজা খোলার শব্দটা কানে গেল তার। বিছানায় উঠে বসলো। “কাহিনি কী? গাড়িতে ক্যামনে আগুন-”।

কথাটা আর শেষ করতে পারলো না, উজ্জ্বলের পেছনে পিস্তল হাতে ডিবির ভেস্ট পরা একজনকে দেখতে পেয়ে তার হৃদস্পন্দ থমকে গেল। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো কেবল, মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বের হলো না।

“একদম শব্দ করবি না?” বলল বাস্টার্ড।

ইমরুলের চেহারা দেখে মনে হলো, সাক্ষাৎ আজরাইলকে দেখছে চোখের সামনে। উজ্জ্বলের চেহারাও তার মতোনই, যেন কাঁদতে চেয়েও পারছে না, থর থর করে কাঁপছে।

উজ্জ্বলকেও বিছানায় গিয়ে ইমরুলে পাশে বসার জন্য ইশারা করলো বাস্টার্ড। “চুপচাপ বসে থাকবি, একটা শব্দও করবি না,” কথাটা বলে মেয়েটার দিকে তাকালো। “ওর কী অবস্থা?”

ঢোক গিলল ইমরুল। “ঘুমায়া আছে।”

মাথা দোলালো বাস্টার্ড। উজ্জ্বল আর ইমরুলের দিকে তাকালো কঠিন চোখে। “এখন বল, কিসিঞ্জার কোথায় থাকে?”

ইমরুলের কোটর থেকে যেন চোখদুটো ঠিকরে বের হয়ে যাবে। উজ্জ্বলও অবাক হলো। এই খুনি কী বলছে! একটু আগে বলল, রঞ্জুর খোঁজ পেয়ে গেছে, এখন কিসিঞ্জারকে চাচ্ছে! হাতেগোণা দুয়েকজন বাদে ভাইজানের কথা কেউ জানে না। কিছুই ঢুকছে না তার মাথায়।

“আ-আমি তো জানি না, ভাই!” কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল উজ্জ্বল।

ইমরুলের দিকে নলটা ঘুরতেই সে বলে উঠল, “আ-আমিও জানি না।”

অসন্তোষে মাথা দোলালো বাস্টার্ড। “আমি জানি, রঞ্জুর দলটা এখন ঐ লোক চালায়, আর তুই…” উজ্জ্বলের দিকে নলটা তা করলো, “…আজকে আমার খোঁজ দিয়েছিস ওকে। এখন, হয় বলবি নয় মরবি।” কথাটা বলেই বিছানায় শুয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালো। “আগেই বলেছি, এই পিস্তল দিয়ে গুলি করলে শব্দ হয় না।” নির্বিকার মুখে ঘুমন্ত মেয়েটার নগ্ন পিঠে গুলি চালালো বাস্টার্ড। সামান্য ঝাঁকিয়ে উঠল মেয়েটি, তারপরই নিথর হয়ে গেল আবার।

উজ্জ্বল আর ইমরুল আর্তনাদ করে উঠল সুতীব্র ভয়ে। আতঙ্কের চোটে নিশ্বাস ঘন হয়ে উঠল তাদের।

কাঁধ তুলল বাস্টার্ড। “কোনো আওয়াজ হয় না।”

ঘরের দু-জন মানুষ বিশ্বাসই করতে পারছে না, এভাবে নির্দোষ একটা মেয়েকে গুলি করে মারতে পারে কেউ!

এবার উজ্জ্বলের মাথায় পিস্তলের নলটা ঠেকালো। “আজকে যে কাজ করেছিস, তোকে আমার মেরে ফেলা উচিত কিন্তু জায়ানের জন্যই মারবো না, যদি আমাকে কিসিঞ্জারের খোঁজ দিতে পারিস।”

লক্ষ্য করলো উজ্জ্বলের নার্ভ পুরোপুরি ধ্বসে পড়েছে। তাকে আরেকটু চাপ দিতে হবে। আমার হাতে সময় কম। আমি তিন গুণববা…এর মধ্যে বললে বাচবি, নয়তো…” কাঁধ তুলল সে।

গুণতে আর হলো না, দু-হাত তুলে চিৎকার দিলো উজ্জ্বল। “ভাই, আমি আসলেই জানি না…!” ইমরুলকে দেখিয়ে বলল, “ওয় কইতে পারবো!”

ভুরু কুঁচকে গেল বাস্টার্ডের, ইমরুলের দিকে তাকালো। লোকটার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

অধ্যায় ৯১

অন্ধকার ঘরে ফোনটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে আছে কিসিঞ্জার।

এর আগে কেউ কখনও এতো রাতে খবর পাঠায়নি। একটু আগে সিগন্যাল অ্যাপসে মেসেজ পাঠিয়েছে তাদের পে-রোলে থাকা এক পুলিশ। সেটা পড়ার পরই তার কপালের ভাঁজ ঘন হয়ে গেছে।

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো। অমূল্যবাবু যে রঞ্জু গ্রুপের হাতে কিডন্যাপড়, এটা ঢাকার সবগুলো পুলিশ স্টেশন জানে! খোদ পুলিশের

আইজি উঠেপড়ে লেগেছে। হোমমিনিস্টার নাকি উদ্বিগ্ন।

তাদের হয়ে কাজ করে উত্তরা থানার এমন এক এসআইকে হোমিসাইডের লোকজন ধরে নিয়ে গেছে।

ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে বসে রইলো সে। এমন সময় তার হাতের ফোনটার ডিসপ্লে আলোকিত হয়ে উঠল। চমকে গেল কলার আইডি দেখে।

ইমরুল ফোন দিয়েছে! এতো রাতে!

“কি হয়েছে?” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো কিসিঞ্জার।

“হ্যালো, মিস্টার আন্যার হোসেন!” ওপাশ থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠল।

ভুরু কুঁচকে গেল তার। কয়েক মুহূর্তের জন্য চিনতে পারলো না। তারপরই বুঝতে পারলো। চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। বাস্টার্ড!

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো কিসিঞ্জার। ঐ খুনি তার ছোটভাইয়ের ফোন থেকে কল করেছে। কিন্তু কিভাবে তার খোঁজ পেলো? বাস্টার্ড তাকে আবারো বিস্মিত করেছে। একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছে এবার।

“ইমরুল কোথায়?” যথাসম্ভব শান্তকণ্ঠে জানতে চাইলো সে।

“বাবু কোথায়?”

কিসিঞ্জারের মুখে সব সময় লেপ্টে থাকা হাসিটা এখন আর নেই। পুরোপুরি বিলোপ হয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে, অন্য একটা চেহারা বসিয়ে দেয়া হয়েছে তার মুখের উপরে। “ঘুমাচ্ছেন…” টের পেলো গলা শুকিয়ে গেছে। “…পাশের ঘরে।”

“এখন বলেন, আপনার ভাইয়ের দাম কতো…দুশো নাকি পাঁচশো? নাকি আরো বেশি?”

কাষ্ঠহাসি দিতে গিয়েও দিতে পারলো না কিসিঞ্জার। গভীর করে শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। আলতো করে মাথা দোলালো

সে, যদিও ফোনের ওপাশে যে আছে দেখতে পাচ্ছে না। সে জানে, রাজা পুরোপুরি কোণঠাসা। কিস্তিমাত!

“বাবুকে আমি ছেড়ে দিচ্ছি,” আস্তে করে বলল।

“কিভাবে?”

“উনার বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি।” শুকনো গলাটায় ঢোক গিলে নিলো। “ওর কোনো ক্ষতি কোরো না।” কিসিঞ্জার টের পেলো তার নিশ্বাস ঘন হয়ে উঠেছে, শুরু হয়ে গেছে শ্বাস কষ্ট।

“আধঘণ্টা পর বাবু যদি উনার বাড়িতে ফিরে না যান,” শীতল কণ্ঠে বলল বাস্টার্ড। “আপনার ভাইকে আমি মেরে ফেলবো।”

হুমকিটা এতো স্বাভাবিক কণ্ঠে দিলো যে, কিসিঞ্জার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল। ওপাশ থেকে কলটা কেটে দেয়া হলেও কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে বসে রইলো সে।

অধ্যায় ৯২

রিজার্ভ পুলিশ থেকে ব্যাকআপ টিম নিয়ে ছুটে চলেছে জেফরি বেগ আর জামান।

রঞ্জুদেরকে গুলশান থানার পুলিশের হাতে তুলে দেবার আগেই হোমিসাইডের ডিজি ফারুক আহমেদ ফোন দিয়েছিল তাকে।

“সরি, একটা ইনভাইটেশনে ছিলাম…ফোনটা মিউট করা ছিল। বের হয়ে দেখি তুমি কয়েক বার কল দিয়েছে। কী হয়েছে? খারাপ কিছু? এতো রাতে তুমি বাড়িতে যাওনি?” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলেছিল।

“স্যার, ব্ল্যাক রঞ্জু আর তার ডানহাতকে গ্রেফতার করেছি।”

“কি?!” অবিশ্বসে বলে উঠেছিল মহাপরিচালক। “মাই গড!” নিজেকে ধাতস্থ করে বলে ফারুক আহমেদ। “করেছো কী! অ্যামেইজিং! তুমি জানো, এটা কতো বড় ঘটনা?”

রাতের ক্লান্তি ভুলে স্মিত হেসেছিল জেফরি। “কগ্র্যাচুলেশন্স, মাই বয়! ইউ (মেক মি প্রাউড ওয়ান্স অ্যাগেন!”

“থ্যানক্স, স্যার।” একটু থেমে আবার বলেছিল, “হোমমিনিস্টারের ঘনিষ্ঠ লোকটা…অমূল্যবাবু…উনি এখন রঞ্জু গ্রুপের অন্য একজনের কজায় আছেন। আমরা তার অবস্থান লোকেট করতে পেরেছি।”

“ওয়াও! গ্রেট!” ফারুক আহমেদ আবারো উচ্ছ্বসিত হলো! “এতো কিছু কিভাবে করলে এক রাতে?!”

প্রশংসাটা আমলে না নিয়ে বলেছিল, “আপনাকে ফোন দিয়েছিলাম একটা হেল্পের জন্য।”

“বলো বলো, কি হেল্প লাগবে?”

“রিজার্ভ থেকে দশ-বারোজন আমর্ড পুলিশের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ওটা হলেই আমরা রেইডটা দিতে পারবো…লোকটাকে উদ্ধার করতে পারবো।”

“লোকাল থানার ব্যাপকআপ পাচ্ছো না?”

“সরি টু সে,” বলেছিল জেফরি। “ঢাকার প্রায় প্রতিটা থানায়ই রঞ্জুর পে রোলে থাকা পুলিশ আছে, স্যার।”

“মাই গড!”

“আমাকে দ্রুত ব্যাকআপ টিমের ব্যবস্থা করে দিন।”

“এক্ষুণি দিচ্ছি…ওয়েট অ্যা মিনিট,” বলেই কলটা রেখে দিয়েছিল হোমিসাইডের ডিজি।

বারিধারার জে-ব্লকের ২ নাম্বার রোডের একটি বাড়িতে রেইড দিতে যাচ্ছে তারা। এটা ইউএস অ্যাম্বাসির ঠিক পেছনেই। এক দল পুলিশ নিয়ে এতো রাতে ওখানে রেইড দেবার সময় যেমন সতর্ক থাকতে হবে, তেমনি যতোটুকু সম্ভব গোলাগুলি এড়ানোরও চেষ্টা করতে হবে।

জেফরি বেগ তার সহকারি জামানের বাইকে করে আর রিজার্ভ পুলিশের ছয়জনের একটি দল তাদের আনমার্ক করা গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেল নির্দিষ্ট বাড়িটার সামনে।

একটু আগেও মনীষ জানিয়েছে, রঞ্জুদের ভাইজানের ফোন এখনও ঐ ভবনেই আছে। কিন্তু আসল সমস্যাটা অন্যখানে-ছয় তলা ভবনের কোনো একটি ফ্ল্যাটে কিসিঞ্জার আটকে রেখেছে অমূল্যবাবুকে। প্রতিটি ফ্ল্যাট চেক করে দেখাটা বেশ ঝক্কির। তবে ঈদের ছুটির শেষ দিন আজ। জেফরি বেগ আশা করছে, ফ্ল্যাটের বেশিরভাগ বাসিন্দা এখনও গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে আসেনি এখনও।

বন্ধ মেইনগেটের সামনে এসে জামান তার বাইকটা থামিয়ে প্রথমে কলিংবেল বাজালো, তারপর ছোটো গেটটায় কয়েক বার টোকা দিলো, সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। গেটের পাশে সিকিউরিটি বক্সের জানালায় টোকা দিলো। রাতের এ সময় কেউ আসবে না ভেবে দারোয়ান হয়তো নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমাচ্ছে।

সাদা পোশাকের এক পুলিশ আর জামান গেটে নক করে গেল ধৈর্য ধরে।

“হ্যালো? কেউ আছেন? গেটটা খুলুন?” বার কয়েক বলল জামান।

বিরক্ত হয়ে উঠল জেফরি। পাঁচ-ছয় মিনিট চলে গেল গেটের সামনেই। সবাই যখন মেজাজ হারাতে বসেছে, তখনই গেটের ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠল : “কে?”

“আমরা পুলিশ…গেট খোলো!” পুলিশি মেজাজেই বলল রিজার্ভ পুলিশের একজন।

“দাঁড়ান, খুলতাছি,” বলল গেটের ভেতর থেকে। মেইনগেটের মধ্যে যে ছোটো গেটটা আছে, সেটা খুলে দিলো দারোয়ান। তাদেরকে দেখে খুব একটা ভড়কালো না লোকটা।

“অ্যালোটিদের মধ্যে এখন কারা কারা আছে?”

“পুরা বিল্ডিংয়ে তিনটা ফ্ল্যাটে লোকজন আছে, বাকিগুলা খালি…এখনও ফিরা আসে নাই।”

“কোন তিনটাতে মানুষজন আছে?”

“কি হইছে, স্যার? কোনো সমস্যা?” জানতে চাইলো দারোয়ান।

ক্লান্তিতে পেয়ে বসেছে তাকে, প্রশ্নটা শুনে সামান্য বিরক্ত হলো। “এখানে একজনকে খুঁজতে এসেছি।”

“ওহ্,” বলল দারোয়ান। “দুইতলা, চাইর তলা আর পাঁচ তলায় মানুষজন আছে। বাকিগুলান ফাঁকা।”

“উনাদের নাম কি, বয়স কতো?”

একটু ভেবে নিলো দারোয়ান। “দুই তলার হালিমসাহেব থাকেন পরিবার নিয়া…সতুর বছর হইবো, বেশিও হইতে পারে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ।

“চাইর তলার আফজাল সাহেবের বয়স ষাইট। আর পাঁচ তলায় থাকেন ইসলাম সাহেব…পঞ্চাশের বেশি হইবো মনে হয়।”

“ইসলাম সাহেব কি একাই থাকেন?”

“না, স্যার…তার ছোটো ভাইও থাকে।”

“আজ রাতে দশটার পর কোনো ফ্ল্যাটে কি একজন বৃদ্ধ লোককে নিয়ে আসা হয়েছে?”

ঠোঁট ওল্টালো দারোয়ান। “ইসলাম সাহেব গাড়ি নিয়া আসছিল দশটা এগারোটার দিকে…আমি গেট লাগাইতেছিলাম, পিছনের সিটে কেউ ছিল কি দেখি নাই।”

জেফরির কাছে মনে হলো, আগে এই লোকের ফ্ল্যাটটাই তল্লাশী করবে। ইসলাম সাহেব কয় তলায় থাকেন?”

“পাঁচে।”

“ফ্ল্যাট নাম্বার কততো?”

“একটাই ফ্ল্যাট ওই ফ্লোরে।”

রিজার্ভ পুলিশদের দিকে ফিরে তাকালো জেফরি। “আপনাদের দুজন গেটে থাকুন, এখান থেকে কাউকে বের হতে দেবেন না। বাকিরা আসুন আমার সঙ্গে। আমাদেরকে এক এক করে সবগুলো অ্যাপার্টমেন্টই সার্চ করতে হবে। প্রথমে করবো ইসলাম সাহেবের ফ্ল্যাটটা।”

“স্যার?” দারোয়ান বলল। “ইসলাম সাহেব তো একটু আগে বাইর হইয়া গেছে।”

“কি?!” আৎকে উঠল জেফরি বেগ।

“আপনারা আসার দশ মিনিট আগে গাড়ি নিয়া বাইর হইলো।”

“একা বের হয়েছে?”

“না, তারা দুই ভাই-ই বাইর হইছে।”

তাহলে অমূল্যবাবু কোথায়? ভুরু কুঁচকে গেল জেফরির। অনেক কষ্টে রাগ দমন করলো সে। “তুমি ভালো করে দেখেছো সঙ্গে কোনো বয়স্ক লোক ছিল না?”

“তারা দুইজনেই ছিল, আর কেউ ছিল না। আমি শিওর, স্যার।”

অথচ কিসিঞ্জারের ফোনটা এখনও এখানেই আছে। তার মানে নিজের ফ্ল্যাটে ফোনটা রেখে সটকে পড়েছে শেষ মুহূর্তে! কিন্তু টের পেলো কী করে? এতো সতর্কতার পরও কী করে এরা আগেভাগে টের পেয়ে যায়?

“এখানে সিসিক্যাম আছে না?”

ঠোঁট ওল্টালো দারোয়ান। “ছিল তো…অনেক দিন ধইরা নষ্ট।”

অবাক হলো সে। “এরকম অভিজাত এলাকার অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে এতোদিন ক্যামেরা নষ্ট হয়ে থাকে!”

“অ্যালোটিরা ঠিক না করাইলে আমরা কী করবো, স্যার?” সাফাই গাইবার সুরে বলল দারোয়ান।

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো জেফরি বেগ। মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেগই পাচ্ছে। ঐ ফ্ল্যাটটা তল্লাশী করার জন্য জামান আর চারজন পুলিশ নিয়ে লিফটের কাছে চলে গেল সে। লিফটের ইন্ডিকেটর দেখে অবাক হলো-এতো রাতে লিফটে করে কেউ নেমে আসছে! সতর্ক হয়ে উঠল তারা, জামান তার অস্ত্রটা বের করে হাতে নিয়ে নিলো। টুং করে শব্দ হতেই লিফটের দরজা খুলে গেল, আর ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো অমূল্যবাবু!

অধ্যায় ৯৩

এক দল পুলিশসহ জেফরিকে দেখেও যথারীতি নির্বিকার রইলো অমূল্যবাবু।

বিস্মিত হলেও অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না জেফরি বেগ। “ঐ লোকটা…সে কোথায়?” জবাবটা জানার পরও জিজ্ঞেস করলো।

“একটু আগে হুট করেই চলে গেল আমাকে রেখে,” শান্ত কণ্ঠে বলল। বাবু।

গভীর করে শ্বাস নিলো জেফরি বেগ। বুঝতে পারলো, কোনো না কোনোভাবে আবারো আগেভাগে খবর পেয়ে গেছিল লোকটা। “কোন ফ্ল্যাটে রেখেছিল আপনাকে?”

“পাঁচ তলায়।” একটু থেমে আবার বলল, “আমার ফোনটা নষ্ট করে ফেলেছে ওরা,” অমূল্যবাবু বলল। “আপনি হোমমিনিস্টারকে জানিয়ে দিন, আমি ঠিক আছি, চিন্তা যেন না করে।”

ভুরু কুঁচকে গেল জেফরির। “এ কথা আপনি জানলেন কী করে?”

“চলে যাওয়ার আগে ওরা বলাবলি করছিল।”

বুঝতে পারলো জেফরি বেগ, আবারো কোনো পুলিশ খবরটা দিয়ে দিয়েছে।

পার্কিংএরিয়ার দিকে পা বাড়ালো অমূল্যবাবু।

“কোথায় যাচ্ছেন?” জানতে চাইলো জেফরি।

থমকে দাঁড়ালো লোকটা, পেছনে ফিরে বলল, “বাসায়।”

“আপনাকে গাড়িতে করে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছি আমি।”

“তার কোনো দরকার নেই, ওরা আমার গাড়িসহ নিয়ে এসেছে এখানে।”

আলতো করে মাথা নাড়লো জেফরি বেগ।

অমূল্যবাবু ধীরপায়ে হেঁটে গেল পার্কিংএরিয়ার দিকে, লাল রঙের একটা গাড়ির দরজা খুলে জেফরির দিকে আরেক বার তাকালো। “ধন্যবাদ, আপনাদেরকে।”

নির্বিকার রইলো জেফরি বেগ, কিছুই বলল না। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে।

দারোয়ানকে কিছু বলতে হলো না, তড়িঘড়ি মেইনগেটটা খুলে দিলো সে। লাল রঙের গাড়িটা আস্তে করে বের হয়ে গেল ভবন থেকে।

কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো জেফরি, তারপর পকেট থেকে ফোনটা বের করে হোমিসাইডের ডিজিকে কল করলো।

“স্যার, ঐ লোককে উদ্ধার করেছি, আপনি হোমমিনিস্টারকে জানিয়ে দিন, উনি একদম ঠিক আছেন।”

“ওহ্! গ্রেট গ্রেট, মাই বয়,” ফোনের ওপাশ থেকে হোমিসাইডের ডিজির উচ্ছ্বসিত কণ্ঠটা শোনা গেল আরেকবার। “আজকের রাতটা দেখি…” কথা খুঁজে পেলো না ভদ্রলোক।

ফারুক আহমেদের খুশি হবার কারণটা খুবই সঙ্গত। পরিমিতবোধের কারণে জেফরি বেগ নিজে হয়তো স্বাভাবিক আচরণ করছে কিন্তু আজকের রাতে যে অর্জন, সেটার কোনো তুলনাই হয় না।

“উনি একদম ঠিক আছেন…উনার গাড়িতে করেই বাসায় চলে গেছেন, স্যার।”

“আচ্ছা, আমি এখনই মিনিস্টার সাহেবকে জানিয়ে দিচ্ছি, খুব টেনশনে আছেন উনি,” একটু থেমে আবার বলল, “তুমিও বাসায় চলে যাও রাত তো প্রায় শেষ হয়ে গেছে। সারাটা রাত অনেক ধকল গেছে তোমার উপর দিয়ে। ইটস বিন অ্যা লং ডে। কালকে দেখা হচ্ছে। আমাদেরকে এটা সেলিব্রেট করতে হবে।”

“জি, স্যার,” বলল জেফরি। ফোনটা পকেটে রেখে জামানের দিকে তাকালো।

“এখন কি করবো, স্যার?”

“ঐ ফ্ল্যাটটা সিলগালা করতে হবে। লোকাল থানাকে খবর দিতে পারো।”

“ওকে, স্যার।”

কয়েকজন পুলিশ নিয়ে জামান উপরে চলে গেল।

অফিস আওয়ারে সাবের কামাল আর রমিজ লস্কর এসে তল্লাশী চালিয়ে দেখবে, ফ্ল্যাটে আলামত আছে কি না। তার ধারনা, এ রকম কিছু পাওয়া গেলেও যেতে পারে, যেহেতু লোকটা তড়িঘড়ি পালিয়েছে।

রিজার্ভ পুলিশদের দিকে ফিরে কিছু বলতে যাবে, অমনি মেইনগেটের বাইরে গাড়ির হর্ন বেজে উঠল। এক বার দুবার না, পর পর তিন-চার বার।

এতো রাতে কে এলো? অবাক হলো জেফরি বেগ। “দারোয়ানকে বলো দেখতে,” গেটের সামনে থাকা দু-জন পুলিশের উদ্দেশ্যে বলল সে।

“…গেছে তো, স্যার,” জবাব দিলো একজন পুলিশ।

আবারো হর্ন বেজে উঠল। সুনশান ভোরে বেশ পীড়াদায়ক লাগলো সেটা।

পুলিশের একজন বিরক্ত হয়ে গেট দিয়ে বের হয়ে দেখতে গেল, বাকি পুলিশদের নিয়ে জেফরি বেগ ততক্ষণে চলে এসেছে মেইনগেটের কাছে।

ভবনের সামনে একটা প্রাইভেটকার থেমে আছে, মাঝবয়সি এক ভদ্রলোক গাড়ির কাঁচ নামিয়ে মাথা বের করে বিস্ময়ে চেয়ে আছে। চোখেমুখে ভড়কে যাবার চিহ্ন। “আপনারা কারা? দারোয়ান কোথায়? কি হয়েছে এখানে?”

পুলিশ কিছু বলার আগেই জেফরি বেগ এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমরা হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছি, এখানকার এক ফ্ল্যাটে তল্লাশী করার জন্য।”

“হোমিসাইড…?” আরো বেশি ভড়কে গেল লোকটা। “খুনটুন হয়েছে নাকি?”

“না, একজন আসামিকে ধরতে এসেছিলাম।”

“বলেন কি!”

“আপনি এখানে থাকেন?”

“হ্যাঁ…তিনতলায়…দেশের বাড়িতে গেছিলাম, ফেরিতে অনেক লম্বা লাইন…ঢাকায় ঢুকতে ঢুকতে দেরি হয়ে গেছে।”

বুঝতে পারলো জেফরি বেগ। ঈদের ছুটি শেষে লোকজন সব এক সাথে ফিরতে শুরু করেছে।

“দারোয়ান কোথায়? গেটটা খুলে দিতে বলুন।”

পেছনে ফিরে তাকালো জেফরি, দারোয়ানকে দেখতে পেলো না। “দারোয়ানকে ডাকো তো,” সাদা পুলিশের একজনকে বলল সে।

ছোটো গেটের ভেতর ঢুকে পড়লো সেই পুলিশ। সিকিউরিটি বক্সটা ফাঁকা দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে জেফরির দিকে তাকালো। “স্যার, দারোয়ান তো নাই!”

একটু আগে অমূল্যবাবু যখন গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল, তখন গেটটা খুলে দিয়েছিল লোকটা।

“আপনারা যখন এখানে ঢুকলেন, তখন দারোয়ান ছিল না?” লোকটা গাড়ি থেকে নেমে এসে বলল।

“দারোয়ানই গেটটা খুলে দিয়েছিল,” বলল জেফরি।

“মনে হয় ওর রুমে গেছে,” অ্যালোটি বলল। “পার্কিংএরিয়ার পিছনেই থাকে,” বলেই নিজের ফোনটা বের করে একটা কল দিলো। “অ্যাই রতন? তুমি কোথায়? গেটে নেই কেন?” ওপাশ থেকে কথা শুনে গেল অ্যালোটি। “বলো কি?!” জেফরির দিকে তাকালো। “জলদি গেটে আসো, পুলিশ এসেছে এখানে।”

“কি হয়েছে?” জানতে চাইলো জেফরি।

“ওকে নাকি এখানকার এক অ্যালোটি নিজের ঘরে থাকতে বলেছে।”

জেফরি বেগের ভুরু কুঁচকে গেল। ঘটনা বুঝতে পারছে না এখনও। দারোয়ানকে কখন এটা বলল?

ভবনের ভেতর থেকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এক লোক বের হয়ে এলো। “স্লামালেকুম, স্যার।”

কিন্তু এই লোকটা অন্য একজন!

বিস্মিত হলো জেফরি বেগ। তাহলে দারোয়ান যে ছিল…?

“স্যার, পাঁচ নম্বরের সালাম সাহেব আমারে কইলো ঘরের দরজা বন্ধ কইরা রাখতে,” বলল লোকটা। “আধঘণ্টার আগে যেন বাইর না হই।”

জেফরি বেগ মুহূর্তেই বুঝে গেল কী হয়েছে। দারোয়ানকে কোনো প্রশ্নই করলো না সে। কিন্তু তার মাথায় এটা কিছুতেই ঢুকছে না, অমূল্যবাবু কেন তার অপহরণকারিকে বাঁচালেন?! পুরো ব্যাপারটা ধোঁয়াশা লাগছে তার কাছে।

গেটের পাশে জামানের বাইকটার দিকে চোখ গেল তার। তাড়াহুড়ার কারণে কিংবা সতর্কতার জন্যে বাইকের ইগনিশনেই চাবিটা লাগিয়ে রেখেছে সে। আর সেটা দেখেই জেফরি বেগের মাথায় পাগলামীটা চেপে বসলো হুট করেই।

অধ্যায় ৯৪

শেষ রাতে একটা লাল রঙের প্রাডো গাড়ি নির্জন ঢাকার রাস্তায় ছুটে চলেছে। ফাঁকা রাস্তা, তারপরও গতি পঞ্চাশের বেশি উঠছে না। যেন খুব একটা তাড়া নেই।

গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছে কিসিঞ্জার। তার মুখে সেই স্মিত হাসিটা আর নেই। এই একটা অভিব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার চেহারার আদলটাই পাল্টে গেছে পুরোপুরি। তাকে আর চেনা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে। অন্য কোনো মানুষ! রিয়ার-মিরর দিয়ে চেয়ে আছে সে অমূল্যবাবুর দিকে।

গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে চকিতে রিয়ার-মিররে চোখ রাখলো বাবু।

“আর কয়দিন সময় আছে?”

“তিন…চার মাস…” দীর্ঘশ্বাসটি পুরোপুরি লুকাতে পারলো না কিসিঞ্জার।

বাবুর বুকের ভেতর থেকে ভারি একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো। চুপ মেরে রইলো আরো কয়েক মুহূর্ত।

একটু আগে তার রুমে যখন কিসিঞ্জার এসেছিল, তখনই বুঝে গেছিল, কিছু একটা হয়েছে। বিছানায় শুয়ে থাকলেও তার চোখে ঘুম ছিল না।

“চলুন দাদা, আপনাকে আপনার বাড়িতে দিয়ে আসি,” বলেছিল সে।

অমূল্যবাবু তখন পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যায়, কিসিঞ্জার আসলে বিরাট বড় কোনো সমস্যায় পড়েছে। কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়েছিল সে, খেয়াল করেছিল খুব তাড়াহুড়া করছে কিসিঞ্জার আর তার সহচর। চোখেমুখে যতোটা না ভয় দেখেছে তারচেয়েও বেশি দেখেছে পরাজয়ের গ্লানি।

তারা তিনজন নিচে নামার পর দেখে গেটে দারোয়ান নেই, রাতের এ সময় নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। কিসিঞ্জারের সহচর দারোয়ানের ঘরের দিকে যেতেই মেইনগেটের কলিংবেলটা বেজে ওঠে।

সত্যি বলতে কিসিঞ্জার এবং তার সহচর তখনই বুঝে গেছিল পুলিশ চলে এসেছে। লোকগুলো ক্রমাগত গেটে নক করতে থাকে। এক পর্যায়ে বলে ওঠে, “আমরা পুলিশ…গেট খোলো!”

বিপর্যস্ত কিসিঞ্জারের মুখের দিকে তাকিয়ে বাবু বুঝতে পারে, পুরোপুরি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে লোকটা। কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্যি, তার প্রতি করুণা জেগে ওঠে। কটা দিনই বা বাঁচবে, এই শেষ সময়ে এসে এতো বড় পরাজয়, লাঞ্ছনা, অসম্মানের শিকার হোক তা চায়নি। তখনই চট করে তার মাথায় পরিকল্পনাটা আসে। কিসিঞ্জারকে সেটা জানালে, বাবুর দিকে তাকিয়ে থাকে সে। বাইরের গেটে ধাক্কা মারার শব্দ আরো জোড়ালো হতে থাকে তখন।

তারা দেখতে পায় দারোয়ান বের হয়ে এসেছে নিজের ঘর থেকে। কিসিঞ্জারের সহচর লোকটার কাছ থেকে গেটের চাবি নিয়ে তাকে তার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে থাকতে বলে।

“জলদি করো,” তাড়া দিয়ে বলেছিল বাবু। “সিটে শুয়ে থেকো…দরজা আনলক করে রাখবে…চাবিটা রাখবে ইগনিশনে। আমি ম্যানেজ করতে পারবো ওদেরকে।”

কিসিঞ্জার তখন মাথা নেড়ে সায় দিয়ে লাল রঙের প্রাডো গাড়ির পেছনের সিটে গিয়ে ওঠে। আর তার সহচর চোখেমুখে সন্দেহ থাকলেও চলে যায় মেইনগেটের দিকে।

অমূল্যবাবু লিফটে করে উপরে চলে যায়, পাঁচ মিনিট পর আবার নিচে নেমে আসে, লিফটের দরজা খুলতেই দেখে জেফরি বেগ দাঁড়িয়ে আছে। দলবল নিয়ে। বাবু লক্ষ্য করে তার কথামতো মেইনগেটে দারোয়ান সেজে দাঁড়িয়ে আছে কিসিঞ্জারের সেই সহচর।

“বাস্টার্ড কিভাবে জানি আমার ছোটভাইকে পেয়ে গেছে।”

কথাটা অবিশ্বাস্য শোনালো অমূল্যবাবুর কাছে। রিয়ার-মিরর দিয়ে তাকালো সে। কিসিঞ্জারের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ প্রকট।

বাবলু কী করে এই লোকের ভাইকে খুঁজে বের করলো, বাবু জানে না। যেমন জানে না। গভীর করে শ্বাস নিলো অমূল্যবাবু। “আমি তোমাকে বলেছিলাম, ওর পেছনে লেগো না।”

চুপ মেরে রইলো কিসিঞ্জার।

“আমি ওকে ফোন করে বলে দিচ্ছি, তোমার ভাইকে যেন ছেড়ে দেয়। তোমার ফোনটা দাও।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিসিঞ্জার। “ফোন রেখে এসেছি।”

আক্ষেপে মাথা দোললো অমুল্যবাবু। হোমিসাইড যে তার ফোন ট্র্যাক করে চলে এসেছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তাই বের হবার সময় সঙ্গে করে ফোনটা নিয়ে আসেনি কিসিঞ্জার।

“ও কী বলেছে তোমাকে?”

“বলেছে, আধঘণ্টার মধ্যে আপনি যদি আপনার বাড়িতে ফিরে না যান..আমার ভাইকে মেরে ফেলবে।”

মাথা নাড়লো বাবু। “তাহলে তোমার ভাইকে ও কিছু করবে না।”

আবারো রিয়ার-মিরর দিয়ে তাকালো কিসিঞ্জার। অমূল্যবাবু অবাক হয়েই দেখতে পেলো, তার চোখদুটো ছলছল করছে।

কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলল না। নিশুতি রাত, জনমানবহীন সড়ক, কিসিঞ্জারের গাড়িটা ছুটে চলছে উত্তরার দিকে।

“আপনি কী করে জানলেন, আমি অসুস্থ?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল অমূল্যবাবু। “দেখে বোঝা যায়।” জবাবটা ছোট্ট করে দিলেও সত্যিটা হলো, দীর্ঘ এই জীবনে অনেক ক্যান্সার পেশেন্ট দেখেছে। তার বড়ভাই, মেন্টর, জনসন চৌধুরী দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে মারা গেছিলেন। খুব কাছ থেকে তাকে দেখেছে বাবু।

“প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার,” বলল কিসিঞ্জার। রিয়ার-মিরর দিয়ে পেছনের সিটের দিকে তাকালো বাবু।

পরিহাসের হাসি ফুটে উঠল কিসিঞ্জারের ঠোঁটে। “বিলিয়ন ডলার থাকলেও বাঁচার উপায় নেই।”

আবারো গাড়ির ভেতরে নিরবতা নেমে এলো। বাবু জানে, কী বলতে চাচ্ছে কিসিঞ্জার। বিলিয়নেয়ার স্টিভ জবসেরও এই রোগটা হয়েছিল, হাজার কোটি টাকা থাকা সত্ত্বেও অসহায়ভাবে তাকে আত্মসমর্পন করতে হয়েছে রোগটার কাছে।

“এসব কেন করলে?” গভীর করে শ্বাস নিয়ে বলল অমূল্যবাবু। “প্রতিশোধ নিতে?”

ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে চুপ মেরে রইলো কিসিঞ্জার। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, “আপনি কি মনে করেন, মরণঘাতী রোগ হবার পর কেউ রাতারাতি সে সন্ন্যাসী হয়ে যাবে? পয়গম্বর হয়ে যাবে?”

চকিতে রিয়ার মিরর দিয়ে তাকালেও বাবু কিছুই বলল না।

“দুনিয়াটা এতো সুন্দর না, দাদা,” গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো। “সামান্য মৌমাছিও নিজের মৃত্যু জেনে পাল্টা আঘাত হানে…মরণ কামড় দেয়!”

ভারি দীর্ঘশ্বাস ফেলল বাবু।

“আমার সঙ্গে যারা অন্যায় করেছে, তাদের সবাইকে…” কথাটা শেষ করলো না আর।

“তাই বলে বাবার শাস্তি ছেলেকে দেবে?”

রিয়ার-মিরর দিয়ে বাবুর দিকে তাকালো কিসিঞ্জার। মুনেম চৌধুরীর কথাটা বাবু জানে! মুখে ফুটে উঠল পরিহাসের হাসি। “কখনও কখনও এভাবেও প্রতিশোধ নিতে হয়…” গাড়িটা রাস্তার মোড় নিলো এ সময়। “যখন আপনার শত্রুর আর শাস্তি পাবার মতো অবস্থায় থাকে না!”

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো বাবু। “তুমি যদি আমাকে গুরু মেনে থাকো তাহলে গুরুদক্ষিণা চাইবো।”

রিয়ার-মিররে চোখাচোখি হলো দু-জন মানুষের। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো কিসিঞ্জার।

“যে কয়টা দিন বাঁচো, এসব থেকে দূরে থেকো, শান্তিতে থেকো, শেষ সময়ে শান্তিতে থাকাটা অনেক জরুরি।” বাবুর চোখ রাস্তার দিকে। “এটাই আমি চাই তোমার কাছ থেকে।”

রিয়ার-মিরর দিয়ে অমূল্যবাবু দেখতে পেলো কিসিঞ্জার তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে, হঠাৎ তার দৃষ্টি বদলে গেল, ভর করলো আতঙ্ক।

অমূল্যবাবু সামনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো, তার বাড়ির কাছে কালো রঙের একটি মাইক্রোবাস রাস্তার পাশে পার্ক করা, আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বাবলু!

অধ্যায় ৯৫

“ও কিছু করবে না।”

শান্ত কণ্ঠে বলল বাবু। রিয়ার মিরর দিয়ে দেখতে পেলো কিসিঞ্জারের চোখেমুখে ভয়ের চেয়ে পরাজয়ের চিহ্ন বেশি।

লাল রঙের গাড়িটার গতি কমিয়ে আস্তে করে মাইক্রোবাসের কাছে থামালো অমূল্যবাবু। “তোমার পিস্তলটা দাও।”

অবাক হয়ে তাকালো কিসিঞ্জার।

“দাও,” তাড়া দিলো আবার।

বাবুর শান্ত কণ্ঠে কিছু একটা ছিল, কিসিঞ্জার আস্তে করে মাথা নেড়ে সায় দিলো, পিস্তলটা কোমর থেকে বের করে বাবুর হাতে তুলে দিলো সে।

অমূল্যবাবু দেখতে পেলো বাবলু দাঁড়িয়ে আছে, হাতে পিস্তল থাকলেও নামিয়ে রেখেছে সেটা। শক্ত হয়ে আছে তার চোয়াল।

কিসিঞ্জারের পিস্তলটা ফতুয়ার পকেটে ঢুকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল বাবু। “ওর ভাই কোথায়?” বাবলুর কাছে এসে জানতে চাইলো।

লাল রঙের প্রাডো গাড়িটার দিকে তাকালো বাস্টার্ড। কিসিঞ্জার স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তাদের দিকে। “এই গাড়িতেই আছে,” মাইক্রোবাসটার দিকে ইঙ্গিত করলো।

মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবু। “ওর কাছে দিয়ে দাও।”

কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না বাস্টার্ড, মাইক্রোবাসটার স্লাইডিং ডোর খুলে ফেলল, ভেতরে দেখা গেল মাঝখানের সিটে পড়ে আছে ইমরুল। তবে দরজাটা পুরোপুরি না খোলার কারণে পেছনের সিটে যে নিথর হয়ে পড়ে আছে তায়েব, সেটা দেখা গেল না। উজ্জ্বলকে পান্থপথের ফ্ল্যাটেই ট্রাঙ্কুলাইজার গান দিয়ে শুট করে ইমরুলকে নিয়ে চলে এসেছে এখানে। গাড়িতে ওঠার পর তাকেও অজ্ঞান করেছিল, হাত-পা-মুখ বেঁধে রাখার ঝক্কিতে আর যায়নি।

কিসিঞ্জারকে গাড়ি থেকে নেমে আসার ইশারা করলো অমূল্যবাবু। পেছনের দরজা খুলে লাল রঙের প্রাডো গাড়ি থেকে নেমে এলো মরণব্যধিতে আক্রান্ত লোকটি। বাস্টার্ডের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আস্তে করে চোখ নামিয়ে ফেলল সে।

মাইক্রোবাসটার সামনে এসে ভাইয়ের দিকে তাকালো, চোখদুটো ছল ছল করে উঠল তার। ইমরুল নেশাগ্রস্তের মতো পড়ে আছে।

বাবলুর দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো অমূল্যবাবু।

“ট্রাঙ্কুলাইজার গান…” ছোট্ট করে বলল সে। “কিছুক্ষণ পর পুরোপুরি হুঁশ ফিরে আসবে।”

ভাইকে জড়িয়ে ধরে তাকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করলো কিসিঞ্জার। নিজের পায়ে দাঁড় করাতে বেশ বেগ পেলো। বেঢপ মাতালের মতো লাগছে ইমরুলকে, ঢুলছে আর অবাক হয়ে দেখছে ভাইকে কিন্তু কোনো কথা বেরুচ্ছে না।

লাল রঙের প্রাডো গাড়ির পেছনের সিটে বসালো ইমরুলকে, সে নিজে বসলো ড্রাইভিং সিটে। ইগনিশনে চাবিটা ঢুকিয়ে স্টার্ট দেবার পর ফিরে তাকালো অমূল্যবাবুর দিকে। “পারলে আমাকে মাফ করে দেবেন, দাদা।”

“চলে যাও…যে ক’টা দিন আছে, শান্তিতে থেকো।”

গভীর করে শ্বাস নিয়ে মাথা দোলালো কিসিঞ্জার। গাড়িটা নিয়ে চলে গেল প্রায় নিঃশব্দে।

“আপনি এই লোককে চেনেন?” বাবলু জানতে চাইলো।

“হুম।”

কয়েক মুহূর্ত অমূল্যবাবুর দিকে চেয়ে রইলো সে।

“লম্বা গল্প…পরে বলবো।” তারপর বলল, “তুমি ঐ হোটেলে চলে যাও…জেফরি বেগ যেকোনো সময় চলে আসতে পারে।” এটা আর বলল না, একটু আগে লোকটাকে ফাঁকি দিয়ে কিভাবে চলে এসেছে।

“মনে হয় না আসবে।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো অমূল্যবাবু।

“ব্ল্যাক রঞ্জুকে নিয়ে ব্যস্ত আছে এখন।”

তার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো বাবু, তারপর আলতো করে মাথা নেড়ে পা বাড়ালো নিজের বাড়ির দিকে। একটু এগিয়েই গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো আবার। “কাল আসবো দেখা করতে।” তারপর প্রসন্ন মুখে ধীর পায়ে চলে গেল নিজের বাড়ির দিকে।

গেটের কাছে বসেছিল নন্দ, বাবুকে দেখে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। ছেলেটার মাথায় হাত বোলালো অমূল্যবাবু। “ভয় পেয়ে গেছিলি, না?”

নন্দ কিছুই বলল না। ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরেই বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল বাবু।

দূর থেকেও বাবলু দেখতে পেলো ছেলেটা কাঁদছে। ঠিক এভাবে ফোক্কানও তাকে জড়িয়ে ধরেছিল কক্সবাজার থেকে চলে আসার সময়। কয়েক মুহূর্তের জন্য ভাবলো, নন্দর মতো সে-ও কি কখনও কোনো দিন অমল্যবাবুকে জড়িয়ে ধরতে পারবে?

মুচকি হাসলো সে। কিছু কিছু সম্পর্ক যতো গাঢ়ই হোক, অদৃশ্য একটি দেয়াল থাকে, সারা জনমেও সেই দেয়াল ভাঙা যায় না! অমূল্যবাবুর সঙ্গে তার সম্পর্কটা হয়তো সে রকমই।

কালো রঙের মাইক্রোবাসটায় চড়ে বসলো সে। গাড়িটা পরিত্যাগ করার সময় হয়েছে অবশেষে। কিন্তু বাবুর বাড়ির এতো কাছে না, আরেকটু দূরে গিয়ে, রাস্তার পাশে রেখে চলে যাবে। বাকিটা টহল পুলিশ সামলাবে।

রাস্তাটার মোড় নিয়েছে যেখানে, সেখানে এসে থামালো গাড়িটা। ভোরের আলো ফুটেছে, একেবারেই সুনশান হয়ে আছে চারপাশ। গাড়ি থেকে নেমে দরজা বন্ধ করে হাঁটতে শুরু করলো। এতো ভোরে কেবলমাত্র কপালগুণেই কোনো সিএনজি পেতে পারে। বুঝতে পারলো, অনেকটা পথ হাঁটতে হবে।

সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী ঘুম জড়ানো চোখে ঝাড়ু দিচ্ছে বিরাণ রাস্তায়, ছ্যাস ছ্যাস করে শব্দ হচ্ছে কেবল। তাকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় লোকটা একবার তাকালো।

কিছুক্ষণ পর, যখন ঝাড় দেবার শব্দটা প্রায় মিইয়ে এসেছে, তখনই একটা যান্ত্রিক শব্দ কানে গেল তার। পেছনে না তাকিয়েও বুঝে গেল ওটা কোনো বাইকই হবে। তবে হাঁটার গতি বাড়ালোও না, আবার থমকেও দাঁড়ালো না। শব্দ শুনে বুঝতে পারলো, তার পেছনে বাইকটা থেমে পড়েছে। বাইকারের মনে কী চলছে, বুঝতে পারলো।

দ্বিধা।

কিন্তু তার মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই-একই ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগলো। অনেক দিন পর খুব নির্ভার লাগছে। অদ্ভুত অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, তাতে না আছে উছুলতা, না আছে বিমর্ষতা। এমন কি উদ্বেগও নেই।

অনেকটুকু এগিয়ে যাবার পর থমকে দাঁড়ালো সে, আস্তে করে ঘুরে দেখলো। যেমনটা ভেবেছিল-বহু দূরে, রাস্তার পাশে যেখানে মাইক্রোবাসটা রেখে এসেছে, ঠিক তার কাছেই একজন বাইকের উপর বসে তাকিয়ে আছে। তার দিকে। হেলমেটটা খুলে বাঁ-হাতে ধরে রেখেছে।

ভোরের আলো ফুটে উঠেছে, কিন্তু স্ট্রিট লাইটগুলো এখনও জ্বলছে। অদ্ভুত রকমের আলোয় হেঁয়ে আছে চারপাশ। দূরত্বের কারণে বাইকারের মুখটা অস্পষ্ট দেখালেও আন্দাজ করে নিতে পারলো।

কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে। তারপর আবারো ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো সে।

এরপর একবারের জন্যেও পেছনে ফিরে তাকালো না।

অধ্যায় ৯৬

জেফরি বেগ নিশ্চিত করে জানে না কেন সে হুট করে জামানের বাইকটা নিয়ে উত্তরায় চলে এসেছে।

বারিধারায় আসল দারোয়ানকে আবিষ্কার করার পরই বুঝে গেছিল, কী ঘটে গেছে-বাবু তার চোখের সামনে দিয়ে নিজের অপহরণকারিকে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় সটকে পড়েছে!

অমলবাবুর এমন আচরণের কারণ কি, সে জানে না। শুধু এটা জানতেই এরকম খামখেয়ালি আচরণ করেছে? নিশ্চিত হতে পারলো না।

মেইনগেটের বাইরে যখন জামানের বাইকটার দিকে চোখ পড়েছিল, ইগনিশনে চাবিটা দেখেই কী জানি হয়েছিল তার মধ্যে। যার কোনো ব্যাখ্যা সে নিজেকেও দিতে পারছে না। হয়তো বাইক আর চাবিটা তাকে প্ররোচিত করেছিল। তাই কাউকে কিছু না বলে বাইকটা নিয়ে ছুটতে শুরু করে।

কিসিঞ্জারের ফ্ল্যাটটা তল্লাশী চালাচ্ছে জামান, তাকে না জানিয়ে আসার এটা একটা কারণ হলেও, সত্যিটা সে ভালো করেই জানে-জামান কাছে থাকলে এমন পাগলামি হয়তো করতোই না। তার সহকারিও তাকে বাধা দিতো, কিংবা তাকে একা ছাড়তো না। তবে কোনোভাবেই জামানকে নিয়ে এমন কাজ করতো না সে।

পাগলামি আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো একা একা-ই করতে হয়!

অমূল্যবাবুর বাড়ির কাছাকাছি একটা মোড়ের দিকে আসতেই দেখে, বেশ খানিকটা দূরে, ফাঁকা রাস্তার একপাশে কালো রঙের ডিবির মাইক্রোবাসটা পার্ক করা আছে! বাইকটা নিয়ে গাড়িটার কাছে এসে থামে সে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে, ফাঁকা রাস্তায় সিটি কর্পোরেশনের এক পরিচ্ছন্নতা কর্মী ঝাড়ু দিচ্ছে।

তারপরই চোখ যায় দূরের রাস্তার দিকে।

বহু দূরে, ভোরের আলোয় এক নিঃসঙ্গ পথচারী হেঁটে যাচ্ছে ধীরস্থির পদক্ষেপে। যেন কোনো তাড়া নেই। কোনো উদ্বেগ নেই।

জেফরি বেগ হেলমেটটা খুলে ফেলে। দূর থেকেও অবয়বটা দেখে সে নিশ্চিত হয়ে যায়, ওটা আর কেউ না, বাস্টার্ড। কিন্তু কিছুই করতে ইচ্ছে করেনি তার। অব্যাখ্যাত আর অদ্ভুত অনুভূতিতে আক্রান্ত হয় সে। চেয়ে থাকে অপসৃয়মান অবয়বটার দিকে।

তারপরই হঠাৎ থামে সে, আস্তে করে ঘুরে তাকায় পেছনে। কিন্তু অতো দূর থেকে মুখটা স্পষ্ট বোঝা যায়নি।

কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে আবারো ঘুরে দাঁড়ায়, হাঁটতে শুরু করে ঠিক আগের মতোই।

একটা গোঙানী শুনে চমকে বাঁ-দিকে তাকালো জেফরি বেগ। এতোক্ষণ যেন সম্মোহিত হয়ে দেখছিল অপসৃয়মান অবয়বটি। বুঝতে পারলো, আওয়াজটা আসছে কালো রঙের মাইক্রোবাসের ভেতর থেকে!

গাড়ির স্লাইডিং ডোরটা আনলক করা, সেটা খুলে ফেলতেই দেখে পেছনের সিটে হাত-পা-মুখ বাঁধা এক লোক পড়ে আছে। খুব সম্ভবত এই লোকটাকে সে আজকে দেখেছে সিসিক্যাম ফুটেজে। এরপরই দূরের রাস্তার দিকে তাকায় সে।

কেউ নেই।

ব্ল্যাক রঞ্জুর উত্থান পর্বের ব্যবচ্ছেদ

কিসিঞ্জার যখন লুকিয়ে তার মৃত্যুপথযাত্রি মাকে দেখতে ঢাকায় এসেছিল, তখনই দিল্লির ঘটনাটি ঘটে যায়।

ঢাকা থেকেই শুনতে পায় দুঃসংবাদটি-রঞ্জু আর বেঁচে নেই। তাকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে বাস্টার্ড। প্রথমে তার বিশ্বাস হয়নি। সত্যি বলতে, খবরটা সে পেয়েছিল ঘটনা ঘটার বেশ কিছুদিন পর। ততদিনে তার মা মারা গেছে, মানসিকভাবে যাতনার মধ্যে ছিল সে। যে কয়দিন ঢাকায় ছিল, খুবই সতর্কতার সাথে আর আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে তাকে, ফলে সত্যাসত্য যাচাই করার উপায় ছিল না। দিল্লিতে রঞ্জুর যে ঘনিষ্ঠ লোকটি ছিল, সেই রাজেশের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেনি, লোকটার ফোন বন্ধ ছিল। সে তখন গা ঢাকা দিয়েছে।

ঢাকা থেকে আবার ত্রিপুরা সীমান্ত দিয়ে ঢুকে সে চলে যায় কলকাতায়, ওখানে গিয়ে জানতে পারে কিসমতের ভারতীয় স্বামী দীন ইসলাম রঞ্জুর মৃত্যুর খবর শোনার পরই ভোল পাল্টে ফেলেছে। রঞ্জু তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছিল ব্যবসা করার জন্য, সেখান থেকে নিয়মিত লাভের অংশ দিতো। দীন ইসলাম কিসমতকে সরাসরি হুমকি দেয়, সে যে জাল কাগজপত্র তৈরি করে এখানে আছে, সে কথা জানাজানি হয়ে গেলে সমস্যায় পড়বে। কিসমতের বুঝতে অসুবিধা হয় না, রঞ্জুর টাকাগুলো আত্মসাৎ করার মতলবে আছে তার স্বামী। বিরাট কোনো ক্ষতি করার আগেই কিসিঞ্জারের সঙ্গে সে-ও কলকাতা ছেড়ে দিল্লিতে চলে যায়।

রঞ্জুর পার্টনার রাজেশ কিসিঞ্জারকে চেনে রঞ্জুর বড়ভাই হিসেবে। এই লোকের মাধ্যমেই বিরাট অঙ্কের টাকা খাঁটিয়েছিল। মাদার তেরেসা স্ট্রিটের যে বাড়িতে রঞ্জু উঠেছিল সেটা এই লোকই কিনেছিল মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং নির্মাণ করে অ্যাপার্টমেন্ট বানিয়ে বিক্রি করার জন্য। কাজ শুরুর আগে ঐ বাড়িটাতে তেল মওজুদ করেছিল রাজেশ, সেগুলোর কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর রাজেশও ফিরে আসে দিল্লিতে, যোগাযোগ হয় কিসিঞ্জারের সঙ্গে। তার কাছ থেকেই জানতে পারে, আগুনে সবাই মারা গেলেও একজন অগ্নিদগ্ধকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, তার অবস্থা খুবই সঙ্গিন। মুখমণ্ডলসহ শরীরের অনেক অংশই পুড়ে গেছে। দিল্লির একটি হাসপাতালে ভর্তি আছে সে। অচেতন আছে বলে তার পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।

কিসিঞ্জার আর কিসমত আরা-ও হাসপাতালে গিয়ে অচেতন লোকটাকে দেখে চিনতে পারেনি।

কিসিঞ্জারের কাছে কিসমত জানতে চায়, তার ভাইয়ের সহায়-সম্পত্তির কি হবে? দেশে এবং দিল্লি-কলকাতায় বিভিন্ন জায়গায় বেনামে অনেক সম্পত্তি আছে রঞ্জুর, বিশ্বস্ত লোকজনের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকাও খাঁটিয়েছিল বিভিন্ন ব্যবসায়। কিসিঞ্জার জানতো, রঞ্জু না থাকলে ঐ সব লোকজন বিশ্বস্ত থাকবে না। কিসমত আরাকে রঞ্জুর উত্তরাধিকারি হিসেবে মেনে নেবে না কেউ। ঢাকায় যে রঞ্জুর অসংখ্য ফ্ল্যাট আছে সেগুলোও বেহাত হয়ে যাবে অচিরেই। কিছু ফ্ল্যাট নিজেদের সেফহোম হিসেবে ব্যবহার করলেও বেশিরভাগই ভাড়া দিয়ে রাখা হয়েছিল, প্রতি মাসে সেখান থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা আসততা। ফ্ল্যাটগুলোর তদারকি করতো রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ এক লোক। মৃত্যুর খবরটি চাউর হতেই ওগুলো আত্মসাৎ করে ফেলবে ঐ লোক। সত্যি বলতে, দীর্ঘদিনের সঞ্চিত বিপুল সম্পত্তির প্রায় সবই বেহাত হয়ে যাবে, কিসিঞ্জার আর কিসমত কিছুই করতে পারবে না। ব্ল্যাক রঞ্জু তার সন্ত্রাসি দলটা চালাতো নিজেই। ফলে, কারা কোন্ দায়িত্বে ছিল, কার কাছে কি আছে, তাদের নাম-ধাম কি, সে সম্পর্কে খুব কমই জানতো বাকিরা।

নিজের সুক্ষ্ম বুদ্ধির উপরে যতোই আস্থা থাকুক, রঞ্জুর অনুপস্থিতিতে ওর সম্পত্তিগুলো কিভাবে উদ্ধার করা যাবে, ভেবে পায়নি কিসিঞ্জার। তবে হাসপাতাল থেকে আগুনে পোড়া অজ্ঞাত লোকটিকে দেখে আসার দিন রাতের বেলায় ঘটনাচক্রে একটা সমাধান পেয়ে যায় সে।

মদ খেতে খেতে তাকে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলতে শুরু করেছিল কিসমত আরা। ঐ সময় দিল্লিতে তারা এক সঙ্গেই থাকতো।

“বউ তো নাই…থাকেন কেমনে, ভাইজান?”

এ কথা শুনে মিটিমিটি হেসেছিল কিসিঞ্জার।

“কষ্ট হয় না?” কামার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল। “আমার তো হয়।” তারপর কিসিঞ্জারের কাছে এসে কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, “আমি বেশি দিন পারি না…আমার পুরুষ মানুষ লাগে!”

দুর্দান্ত সঙ্গম শেষে পাশাপাশি শুয়ে সিগারেট খেতে খেতে কিসমত আরা বলেছিল, তার কেন জানি মনে হচ্ছে, হাসপাতালে যাকে দেখেছে সে ঝন্টু!

এ কথা শুনে নড়েচড়ে ওঠে কিসিঞ্জার। সে জানতো, রঞ্জুর ডান হাত ছিল এই ঝন্টু।

“তোর কেন এটা মনে হলো?” আগ্রহি হয়ে জানতে চেয়েছিল কিসিঞ্জার।

কিসমত তখন জানায়, হাসপাতালে আগুনে পোড়া লোকটির শরীরের। অর্ধেক অংশ আর মুখটা ব্যান্ডেজে ঢাকা থাকলেও বাঁ-দিকের পাঁজরের নিচের অক্ষত একটি অংশ উন্মুক্ত ছিল, সেখানে একটা জন্মদাগ দেখেছে সে।

“এটা তুই কেমনে জানলি?”

কিসিঞ্জারের ভুরু কপালে উঠে গেছিল। যদিও সে শুনেছিল, কিসমত আরা কোনো কালেই লাজুক মেয়ে ছিল না, কৈশোর থেকেই খুব ডানপিটে আর বেপরোয়া, অল্প বয়সেই ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করতে শুরু করেছিল, মদ-গাঁজা-সিগারেটও খেতো তখন থেকে।

কিসমত তখন বলে, প্রথম স্বামীকে হত্যা করার পর যখন কলকা চলে এসেছিল তখন কিছুদিন ঝন্টুর সঙ্গে ছিল সে। সাভারের এক বাড়িতে লুকিয়ে ছিল, সেখান থেকে ঝন্টু যখন কলকাতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করে তাকে, যশোের বর্ডারে তখন কিলিং নিয়ে ঝামেলা চলছিল বিডিআর বিএসএফের মধ্যে, সীমান্তে থম থমে পরিস্থিতি, অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দেয়া বন্ধ ছিল কয়েকটা দিন, সেই সময়টাতে যশোরের এক হোটেলে থেকেছে তারা, তখনই তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়।

“জানেনই তো,” সিগারেটে টান দিয়ে বলেছিল কিসমত। “পুরুষ মানুষ ছাড়া আমি বেশি দিন থাকতে পারি না।”

মিটিমিটি হেসেছিল কিসিঞ্জার। মেয়েটার এমন খোলামেলা কথাবার্তা ভালোই লাগতো।

“এমনে পুড়ছে…চিনা-ই যায় না!” আফসোসের সুরে বলেছিল রঞ্জুর বোন।

ঠিক তখনই কিসিঞ্জারের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায় : রঞ্জু আগুনে পুড়ে ঝলসে গেলেও বেঁচে আছে!–এটা করতে পারলেই দিল্লি আর কলকাতায় রঞ্জুর যে বিনিয়োগ রয়েছে সেটা উদ্ধার করতে পারবে, এমন কি ঢাকার সম্পত্তিগুলোও ফিরে পাবে তারা। ঐ লোক যদি সত্যিই ঝন্টু হয়ে থাকে, তাকে সামনে রেখে পর্দার পেছন থেকে অনায়াসেই কাজটা করা যাবে।

“মানুষ বিশ্বাস করবো?” কিসিঞ্জারের বুকে থুতনি রেখে বলেছিল নগ্ন কিসমত আরা।

মেয়েটার চুলে হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত করেছিল তাকে, সবাই বিশ্বাস করবে। এক্ষেত্রে মানুষটা যখন ঝন্টু তখন বাড়তি সুবিধা পাবে তারা। কারণ রঞ্জুর সব লোকজনকে ভালো করে চেনে সে।

রঞ্চ বেঁচ থাকতেও আড়ালে থাকতো সতর্কতার অংশ হিসেবে। তার নিজ দলেরও খুব কম সংখ্যক লোকই তাকে সামনাসামনি দেখেছে, কথা বলেছে। আর এটাও করা হয়েছিল কিসিঞ্জারের পরামর্শেই। এমন কি ঢাকার বিভিন্ন থানায় শীর্ষ সন্ত্রাসি ব্ল্যাক রঞ্জু হিসেবে একমাত্র যে ছবিটা আছে,

পত্রিকাগুলো সব সময় যে ছবিটা রঞ্জু হিসেবে ছাপায়, সেটাও তার বুদ্ধি। ছিল। রঞ্জুর প্রায় কাছাকাছি চেহারার অকাল প্রয়াত একজনের ছবি জোগাড় করে পুলিশের এক সোর্সকে দিয়ে কয়েকটি থানায় সরবরাহ করা হয়েছিল। কালক্রমে সেটাই হয়ে ওঠে ব্ল্যাক রঞ্জুর একমাত্র ছবি। এই কৌশল এতোটাই সফল হয়েছিল যে, দীর্ঘ প্রায় এক যুগ রাজার হালে টিকে ছিল রঞ্জু।

কিসমতের কাছ থেকে ঝন্টুর জন্মদাগের কথা শোনার পর দিনই তারা হাসপাতালে যায়, গিয়ে দেখে আগুনে পোড়া রোগির জ্ঞান ফিরে এসেছে। কিসমত আরার কথাই সত্যি প্রমানিত হয়এই লোক আর কেউ না, ব্ল্যাক রঞ্জুর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠদের একজন, ঝন্টু।

এমন বিদেশ-বিভূঁইয়ে তাদের দুজনকে কাছে পেয়ে বেঁচে থাকার আশা দেখতে পায় ঝন্টু। তার কাছ থেকেই শুনেছে, কিভাবে অস্ত্রের মুখে বাস্টার্ড তাকে মাইক্রোবাসে নিয়ে গিয়ে আরো তিনজনের সঙ্গে মাথায় গুলি করেছিল। শেষ মুহূর্তে বাঁচার জন্য মাথাটা সরানোর চেষ্টা করেছিল সে। তাতে করে গুলিটা মারণঘাতী হতে পারেনি। জ্ঞান ফিরে নিজেকে আবিষ্কার করে আগুনে জ্বলতে থাকা গাড়ির ভেতরে। তার কাছে মনে হচ্ছিল, একটা গরম মাইক্রোওভেনের ভেতরে ঝলসানো হচ্ছে তাকে। বাঁচার জন্য প্রাণপণে চিৎকার দিতে শুরু করে। আগুন যখন গাড়ির ভেতরে চলে আসে, তখন ভেবেছিল আর বুঝি রক্ষা নেই। পড়ে থাকা তিনটি লাশের মধ্যে উঠে বসার চেষ্টা করেও পারেনি, তার শরীরে সেই শক্তিই ছিল না। বাঁচার জন্য নিশ্বাস বন্ধ করে একটা চিৎকার দেয়। ভালো করেই জানতো, গরম নিশ্বাস নিলেই মরে যাবে। আগুনের উত্তাপে তার শরীর আর মুখ যখন পুড়তে শুরু করলো, তখন মনে হয়েছিল, খামোখাই বেঁচে উঠেছে। এর চেয়ে ভালো ছিল মাথায় গুলি খাওয়ার পর যন্ত্রনাহীন মৃত্যু! শাস নেবার যখন ফুসফুসটা ফেঁটে যাবার উপক্রম হচ্ছিল, তখনই টের পায় বাইরে লোকজনের চিৎকার আর গাড়ির দরজা ভাঙার শব্দ।

গাড়ির ভেতর থেকে তাকে বাইরে আনার পরই জ্ঞান হারায় সে। তার। শুধু মনে আছে, কয়েকজন লোক ধরাধরি করে নিয়ে যাবার সময় নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল : ‘আভি তাক জিন্দা হ্যায়!

কিসিঞ্জার আর কিসমতকে দিল্লির হাসপাতালের ডাক্তার জানিয়েছিল, মাথায় গুলিবিদ্ধ অনেকেই অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়, ঝন্টুর বেলায় তেমনটাই হয়েছে। তবে যে গুলিটা তার মাথায় পেয়েছে, সেটাও ড্যাম্প ছিল সম্ভবত। কেন না, খুলি ভেদ করে পুরোপুরি ঢুকতে পারেনি।

কিসমত আরা ঝন্টুকে আশ্বস্ত করে, তাকে বিদেশের নামি-দামি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিত্সা করাবে, সারিয়ে তোলার জন্য যা যা করার দরকার সব করবে, কিন্তু এর জন্য একটা কাজ করতে হবে তাকে-ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে রঞ্জু। এটা করলেই কেবল তার চিকিৎসার খরচ জোগাড় করা যাবে।

পরিকল্পনাটি ধারনার চেয়েও বেশি ভালোভাবে কাজ করেছিল।

রঞ্জুর পার্টনার রাজেশকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে আগুনে পোড়া ঝন্টুরূপী রঞ্জুর মুখোমুখি করা হলে অবিশ্বাসে চেয়ে থাকে লোকটা। অসুস্থ হলেও দারুণ দক্ষতার সঙ্গেই রঞ্জুর মতো করে তার সঙ্গে কথা বলেছিল ঝন্টু। তার কারণ, আমোদপ্রিয় ঝন্টু সব সময় বিভিন্ন মানুষজনের মিমিক্রি করতো, তা দেখে মজাও পেতে ঘনিষ্ঠ সার্কেলের সবাই। অন্য অনেকের মতো ব্ল্যাক রঞ্জুর মিমিক্রিটাও করতো দক্ষতার সঙ্গে। তার এই দক্ষতা এমনই ছিল, রঞ্জু যখন কলকাতায় চলে যায় তখন সে রঞ্জু সেজে দলের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতো, চাঁদা চেয়ে ফোন দিতো অনেক সময়।

রঞ্জু বেঁচে আছে শুনে রাজেশ তার কাছে থাকা বিপুল পরিমাণের টাকা দিয়ে দেয় উন্নত চিকিৎসা করার জন্য। তার সহায়তায় নতুন রঞ্জুকে ভারতীয় নাগরিক বানিয়ে, তার পাসপোর্ট করিয়ে দুবাইর বেভারলি হিল্স হসপিটালে ট্রিটমেন্ট করা হয়। এই সময়েই ঢাকায় রটিয়ে দেয়া হয়, রঞ্জু বেঁচে আছে, মারাত্মক আহত হয়ে বিদেশের মাটিতে চিকিত্সা নিচ্ছে, অচিরেই ফিরে আসবে দেশে।

প্রথম দিকে কিছুটা কাজও হয়, রঞ্জর দলের পুরনো অনেকেই আবার সংগঠিত হয়ে চাঁদাবাজি করতে শুরু করে। কিন্তু কিছু লোকের বেঈমানির কারণে সেটা বেশি দিন চলেনি। তারা রটিয়ে দেয়, রঞ্জু আসলে মারা গেছে, তার নাম ভাঙিয়ে দলের কেউ কেউ ফায়দা নিচ্ছে। রঞ্জুর দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে এই রটনাটি কন্ধে পায়। একে একে সটকে পড়তে শুরু করে তার দলের অনেকেই, কেউ যোগ দেয় প্রতিপক্ষ নাইন স্টার গ্রুপে, কেউ বা ফাইভস্টারে। পুরো দলটা ভেঙে যায় অচিরেই।

চাইলেও এ সময়ে দ্রুত কিছু করতে পারেনি কিসিঞ্জার। দিল্লি কলকাতায় থাকা রঞ্জুর বিপুল পরিমাণের টাকা-পয়সার অনেকটাই উদ্ধার করতে পেরেছিল তারা। দুবাইতে থাকার সময় কিসিঞ্জার আর কিসমত নিজেদেরকে স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিতে। কিসমতের ভারতীয় পাসপোর্ট সুরভী ইসলামের সঙ্গে মিল রেখে কিসিঞ্জারও দীন ইসলাম নামে একটি ভারতীয় পাসপোর্ট বাগিয়ে নেয় মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে-আদতে যেটা কিসমতের দ্বিতীয় স্বামীর নাম ছিল।

দুবাইতে যাওয়ার আগেই দীন ইসলামকে কলকাতায় রঞ্জুর এক পুরনো আখড়ায় ডেকে এনেছিল কিসমত। রঞ্জু বেঁচে আছে, এ কথা শুনে সে বিশাস করেনি। তার পর ঝন্টুর সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিতেই মৃত্যুভয়ে থর থর করে কাঁপতে থাকে। স্বামীকে আল্টিমেটাম দেয় কিসমত, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার ভাইয়ের টাকা ফেরত না দিলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা হবে তার নামে। দীন ইসলাম ভড়কে গিয়ে বেশিরভাগ টাকা ফিরিয়েও দিয়েছিল কিছু দিনের মধ্যে, বাকি টাকাগুলোর জন্য সময় চাইলেও কিসমত আরা সেগুলো মাফ করে দেয়, কারণ একটু পরই লোকটাকে মেরে ফেলা হয় কলকাতায় রঞ্জুর বিশ্বস্ত কয়েকজন লোককে দিয়ে। তার লাশটাও উধাও করে ফেলা হয়।

দুবাইতে বেশ কিছুদিন চিকিৎসা নিতে হয়েছে ঝন্টুকে, তার পেছনে খরচ হয়েছে দেদার। এই দীর্ঘ সময়ে কিসমত আরা তার ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে দেশে গেছিল বেশ কয়েক বার। ঢাকায় বিশ্বস্ত কিছু লোকজনের মাধ্যমে অনেক ধরণের ব্যবসায় টাকা খাঁটিয়েছিল রঞ্জু, তাদের সঙ্গে দেখা করে নিয়মিত টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে সে। কিন্তু রঞ্জুর শতাধিক ফ্ল্যাটের তদারকি করতো যে ভাইগ্না মতিন, সে গাদ্দারি করে বসে। কিসমতকে সে শাসিয়ে বলেছিল, রঞ্জু মরে গেছে। জানে বাঁচতে চাইলে কিসমত যেন ঢাকা ছাড়ে। নইলে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেবে। তার নামে যে খুনের মামলা আছে, সেটা ভাইগ্না মতিন জানতো। এমন হুমকি পেয়ে কিসমত আরা দুবাইতে ফিরে যায়, তার কাছ থেকে সব শোনার পর কিসিঞ্জার ঠিক করে, যতো দিন ঝন্টু সেরে না উঠবে তারা কিছুই করবে না। বিশ্বস্ত যে কয়জন টাকা পাঠাচ্ছে সেটাই যথেষ্ট।

সত্যি বলতে টাকা-পয়সার তেমন অভাব তাদের ছিল না। কিসিঞ্জার তার ছোটভাই ইমরুলের মাধ্যমে ঢাকায় কিছু বিনিয়োগ করেছিল, সেখান থেকেও ভালো টাকা-পয়সা আসততা।

দুবাইতে তাদের সময় ভালোই কাটছিল। এক সময় কিসমত আরা এমনও মনে হতে থাকে, ঝন্টু ভালো হয়ে গেলেও হয়তো তাকে নিয়ে আর দেশে ফিরে যাওয়া হবে না, দুবাইতেই থেকে যাবে কিসিঞ্জার।

ঝন্টু কিছুটা সেরে ওঠার পরও দেশে ফিরে যেতে চায়নি। আগুনে পোড়া মুখ নিয়ে সে হীনমন্যতায় ভুগতো। সিনেমা দেখে তার এমনও ধারনা হয়েছিল, প্রচুর টাকা খরচ করে প্লাস্টিক সার্জারি করলে আগের চেহারাটা ফিরে পাবে। তার মুখের গঠন যে আর ফিরে পাওয়া যাবে না, এটা বোঝাতে বেশ বেগ পেয়েছিল তারা।

কিন্তু একদিন হুট করেই কিসিঞ্জার বলে, তারা দেশে ফিরে যাবে নতুন ব্ল্যাক রঞ্জুকে নিয়ে, তার দলটা আবার নতুন করে গড়ে তুলবে। এবার আরো বেশি সতর্ক থাকবে তারা, অনেক বেশি শক্তিশালী হবে এই দলটি। রঞ্জুর সঙ্গে যারা বেঈমানি করেছে, তাদের সব কটাকে শিক্ষা দেয়া হবে, উদ্ধার করা হবে সব সহায়-সম্পত্তি আর টাকা-পয়সা।

এ কথা শুনে খুবই অবাক হয়েছিল কিসমত আরা। কিন্তু সে-ও কখনও জানতে পারেনি, প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়েছে কিসিঞ্জার।

“আর ঐ বাস্টার্ড?” দেশে ফিরে যাবার কথা শুনে ঝন্টু বলেছিল। “ওর কী হইবো?”

কিসিঞ্জার তাকে আশ্বস্ত করে, বাস্টার্ডকেও খোঁজা হবে। এটা সে করবে শুধু প্রতিশোধ নেবার জন্য নারঞ্জুকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যেও।

প্রায় পাঁচ-ছয় মাস আগে তারা তিনজন নতুন পাসপোর্ট নিয়ে দেশে ফিরে আসে, শুরু করে দল গোছানোর কাজ। পুরনোদের সঙ্গে প্রথমে যোগাযোগ করার কাজটা করতো কিসমত আরা, তারপরই ‘র’র সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়া হতো। এ কাজটা দারুণ সফলতার সাথেই করে গেছে ঝন্টু। একজনেরও সন্দেহ হয়নি, এটা ব্ল্যাক রঞ্জু না!

নতুন রঞ্জুর নাগাল যেন সহজে কেউ না পায়, সেজন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছিল কিসিঞ্জার। সবচেয়ে বেশি সতর্কতা দেখিয়েছিল, মোবাইলফোন ব্যবহারের বেলায়। কিসিঞ্জার, রঞ্জু আর কিসমত আরা-ই কেবল লোকাল সিম ব্যবহার করতো, বাকিরা কেউই তাদের সঙ্গে সরাসরি ফোনে যোগাযোগ করতে পারতো না। আইটি এক্সপার্টদের পরামর্শে সিগন্যাল নামের একটি নিরাপদ মেসেজিং অ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগ করতো অন্যদের সঙ্গে।

ঝন্টুর মাধ্যমে খুব দ্রুতই দলটা গোছানো সম্ভব হয়েছিল। কিসিঞ্জারের বুদ্ধিতেই পুরনোদের প্রায় সবাইকে ভালো সুযোগ সুবিধা দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়। ওরা বিভিন্ন দলে ভিড়ে গিয়েছিল, ফলে ওদেরকে পেয়ে দ্রুতই মাঠের দখল নিয়ে নেয় রঞ্জুর দল। যদিও তাদের দিয়ে তেমন কাজ করানো হতো না, বেশিরভাগ কাজই করানো হতো নতুন লোকজনকে দিয়ে।

ঢাকায় নতুন পরিচয় নিয়ে বারিধারার একটি ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করে কিসিঞ্জার। ক্যান্সারে আক্রান্ত বলে নিজেকে আড়ালে রাখতো, একাকি থাকতো। তবে অল্প কিছুদিন পরই আবু সালাম নামের একজন সার্বক্ষণিক সঙ্গি জুটে যায় তার। এই লোক তার দুরসম্পর্কের মামাতো ভাই। পাড়া মহল্লায় ফোন রিচার্জের দোকান দিয়ে সংসার চালাচ্ছিল। অভাব-অনটনেই ছিল কিন্তু দিশেহারা হয়ে পড়ে প্রিয় সন্তানের ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে। ছোটভাই ইমরুলের কাছ থেকে খবরটা শোনার পর আর্দ্র হয়ে ওঠে কিসিঞ্জারের হৃদয়। সিদ্ধান্ত নেয়, বারো বছরের মেয়েটিকে বাঁচাবে সে। কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও তার বাঁচার কোনো আশা নেই-অথচ এই বাচ্চা মেয়েটি মাত্র চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখ টাকায় বেঁচে যাবে।

এই বিপুল টাকা পেয়ে আবু সালাম যার পর নাই কৃতজ্ঞ হয়। এরপর থেকে নিজেকে কিসিঞ্জারের খেদমতে নিয়োজিত করে সে। তার ক্যান্সারের কথাটা কেবল আবু সালামই জানতো। ওষুধপথ্যও কিনে আনতো সে-ই।

দল গুছিয়ে নেবার পরই ভাইগ্না মতিনের কাছ থেকে রঙুর ফ্ল্যাটগুলো উদ্ধার করে কিসিঞ্জার। সেই ফ্ল্যাটগুলোর কিছু কিছু নিজেদের ব্যবহারের জন্য নিলেও বাকিগুলো ভাড়া দিয়ে দেয়। জীবন বাঁচাতে ভাইগ্না মতিন

আত্মগোপনে চলে গেলেও শেষ রক্ষা হয়নি।

কিসিঞ্জার কোন্ ফ্ল্যাটে থাকে, সেটা তার সার্বক্ষণিক সঙ্গি আবু সালাম ছাড়া আর কেউ জানতো না। রঞ্জুর অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে বারিধারারটা ‘নিকুঞ্জ’ আর নিকেতনেরটার নাম বনশ্রী। এ দুটো বেছে নেয়া হয় কিসিঞ্জার, ঝন্টু আর কিসমতের জন্য।

আগে থেকেই রঞ্জুর হয়ে ঢাকার অনেক থানার পুলিশ কাজ করতো, কিসিঞ্জার সেটার পরিধি আরো বিস্তৃত করে। ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের কোনো সদস্য ধরা পড়লেই সিগন্যাল অ্যাপসে মেসেজ করে জানিয়ে দিতো সেইসব পুলিশ। রঞ্জুরূপী ঝন্টুর যদি কাউকে ফোন করে হুমকি কিংবা চাঁদাবাজি করার দরকার পড়তো তাহলে একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হতো। কালো রঙের কাঁচে ঢাকা একটি গাড়িতে করে ঝন্টু চলে যেতো তার অবস্থান থেকে একটু দূরে, সেখান থেকে সস্তা চায়নিজ ফোনে আনরেজিস্টার্ড সিম ব্যবহার করে কল করতো। কাজ শেষে ফোন আর সিমটা নষ্ট করে ফেলা হতো। ফলে, এই কল ট্রেস করা যেতো না।

উত্তরা থানার এসআই যখন জানালো বাস্টার্ডের বাপের সন্ধান পাওয়া গেছে, তখন কিসিঞ্জার তাকে তুলে আনার ব্যাপারে আগ্রহি হয়ে উঠেছিল একটা কারণেই ঈদের দিন কানাডা থেকে তার সাবেক স্ত্রী আর তার গায়ক স্বামী দেশে এসেছিল। মাত্র এক সপ্তাহ পরই তারা চলে যাবে। এই সময়ের মধ্যে ঐ গায়ককে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল কিসিঞ্জার। ভেবেছিল, বাস্টার্ডের বাপকে জিম্মি করে কাজটা তাকে দিয়ে করানো যাবে। তবে ফোনে অমূল্যবাবুর ছবিটা দেখার পর অবাক হয়ে যায় সে। যদিও পরে বাস্টার্ড যখন কিসমতকে জিম্মি করে তাকে ফোন দেয়, তখন তাকে কোণঠাসা করার জন্য ঐ গায়ককে খুন করার প্রস্তাবটা দেয়।

কিন্তু দৃশ্যপটে জেফরি বেগের আবির্ভাব সব কিছু জটিল করে ফেলে।

এতো সতর্কতার পরও সামান্য একটা ভুল হয়ে যায় তাদের। বাস্টার্ড যেহেতু নিজেই একজন পেশাদার খুনি, পুলিশের চোখে ফেরারি আসামি, তার বেলায় অতোটা সতর্কতা দেখায়নি রঞ্জুরূপী ঝন্টু। নিজের ফোন থেকেই কল দিয়েছিল বাস্টার্ডকে। অন্যদিকে বাস্টার্ড যখন পিস্তলের মুখে কিসমত আরাকে দিয়ে কিসিঞ্জারকে কল দিয়েছিল, তখন প্রচণ্ড ভয় আর নাভাস থাকার কারণে সে সিগন্যাল অ্যাপস ব্যবহার করেনি-সরাসরি কল করেছিল, ফলে হোমিসাইডের জেফরি বেগ সহজেই তাকে ট্র্যাক করতে সক্ষম হয়। কিসিঞ্জার বুঝতেই পারেনি সে কোণঠাসা পড়ছে। প্রায় একই সময়ে তার ভাই ইমরুলকে কজায় নিয়ে নেয় বাস্টার্ড, আর হোমিসাইডের জেফরি বেগ দলবল নিয়ে চলে আসে তার অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনে।

উপসংহার

পরদিন জেফরি বেগ ঘুম থেকে উঠল বেশ বেলা করে।

নিজের ঘরে যখন ফিরে এসেছিল তখন ভোরও প্রায় শেষ হবার দিকে। উত্তরা থেকে বারিধারায় ফিরে যাবার পর জামানের অবাক করা মুখটার দিকে তাকাতে পারছিল না। নিজের আচরণের কোনো ব্যাখ্যা ছিল না তার কাছে। অবশ্য ততক্ষণে জামানও জেনে গেছিল অমূল্যবাবু কী রকম চালাকিটা করেছে তাদের সঙ্গে।

“অনেক দেরি হয়ে গেছিল তো, স্যার,” বলেছিল তার সহকারি। “ওই লোক ততক্ষণে নাগালের বাইরে চলে গেছিল।”

“হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলেছিল সে। সহকারির এমন কথা শুনে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল-তাকে আর ব্যাখ্যা করতে হবে না। “অনেক ঘুম পেয়েছে…চলো।”

জামানের বাইকে করে নিজের কোয়ার্টারে ফিরে আসার আগে হাসপাতালের প্রিজন সেলে গিয়ে দেখে পোড়ামুখের সন্ত্রাসি আর তার বোনের জ্ঞান ফিরে এসেছে, কিন্তু প্রলাপ বকছে উদভ্রান্তের মতো।

“আমি রঞ্জু না! আমি ঝন্টু! আপনারা ভুল করতাছেন?”

মুচকি হেসে বলেছিল, “ঝন্টুর নামেও অনেক খুনখারাবির মামলা আছে। রঞ্জুর সব অপকর্মের সঙ্গি সে।” তার পর একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে নিচু কণ্ঠে বলেছিল, “সাজা তো একটুও কমবে না, বেড়ে যাবে। তার চেয়েও বড় কথা, এটা কেউ বিশ্বাসই করবে না।”

ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সন্ত্রাসি।

“তবে আদালত যদি তোমার কথা বিশ্বাসও করে, তোমাকে ঝন্টু হিসেবে ফাঁসি দিয়ে দেবে।” এ কথা বলে চলে এসেছিল সে।

ঐ সন্ত্রাসির কথা অবশ্য বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। রঞ্জু যে খুবই ধূর্ত, সেটা সে জানে। এটা খুবই স্বাভাবিক, ধরা পড়ার পর ঐ কুখ্যাত সন্ত্রাসি নিজের পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করার চেষ্টা করবে-তা-ই করেছে সে।

এক দিক থেকে দেখলে, রঞ্জুর পরিচয় নিয়ে তার মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই। এই সন্ত্রাসির সত্যিকারের পরিচয় কি সেটা আদালতই খতিয়ে দেখবে। পোড়ামুখের আড়ালে কোন্ ব্যক্তি আছে সেটাও আসলে জরুরি না। জরুরি হলো, সে ব্ল্যাক রঞ্জু হয়ে কাজ করছিল। এই পরিচয়েই শুরু করেছিল ত্রাসের রাজত্ব। তার দলের সবাই তাকে রঞ্জু বলেই জানে। আর সেই ব্ল্যাক রঞ্জু এখন গ্রেফতার হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনির হাতে। এটাই সব-আর কোনো কথা নেই।

বাড়িতে ফেরার সময় গর্বিত মুখে জামান বলেছিল, “স্যার, আপনি লেগে না থাকলে ওদের ধরা যেতো না, এতো বড় অ্যাচিভমেন্টও হতো না।”

প্রসন্নভাবে হেসে জামানের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিল সে, “তুমি সঙ্গে থাকলে এটা সম্ভব হতো না। মনে রাখবে, কোনো কাজই একা একা সফলভাবে শেষ করা যায় না অনেকের সাহায্য লাগে। তুমি, মনীষ, পুলিশের ব্যাকআপ, ফারুকস্যার…সবার অবদান আছে।”

জামান আর কিছু বলেনি।

সহকারির পিঠে হাত লেখে বলেছিল, “আজকে বিকেল পর্যন্ত রেস্ট নাও, সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে।”

একটা হাই তুলে আড়মোড়া দিলো জেফরি বেগ। বেডসাইড ঘড়িতে সময় দেখলো : সকাল পেরিয়ে দুপুরের দিকে গড়িয়েছে। ফোনটা হাতে তুলে নিলো। যা ভেবেছিল তা-ই। শ’খানেক মিসকল আর সমসংখ্যক টেক্সট মেসেজ। অভিনন্দন জানাতেই করেছে সবাই।

সেখান থেকে হোমিসাইডের ডিজির মেসেজটা পড়লো : সে যে অসাধ্য সাধন করেছে এক রাতে, হোমিসাইডের মুখ উজ্জ্বল করেছে, আজকের প্রেস কনফারেন্সে যে তাকে থাকতেই হবে, সেটা জোর দিয়ে বলেছে। আরো বলেছে, ঘুম থেকে উঠেই যেন তাকে ফোন দেয়।

কিন্তু কাউকে কলব্যাক করতে ইচ্ছে করছে না তার। টেক্সট করতেও না। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। এই বিশাল সাফল্যে ঠিক উচ্ছ্বসিতও না, আবার পুরো ব্যাপারটাকে মামুলী কিছু বলেও মনে হচ্ছে না। তবে নির্ভার লাগছে বেশ।

সম্ভবত সবচেয়ে বড় বড় সাফল্যের সময় এমনই অনুভূতি হয়। তবে সে নিশ্চিত হতে পারলো না। কারণ এতো বড় সাফল্য এর আগে আসেনি।

সাফল্য!

পরিহাসের হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। ঈদের ছুটিতে হোমিসাইডের ফুল টিম ছিল না যখন তখনই কি না ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার হয়ে সবচেয়ে বড় সফলতাটির দেখা পেয়েছে।

পরক্ষণেই মনে পড়লো, ব্ল্যাক রঞ্জুর মতো কুখ্যাত এক সন্ত্রাসিকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে মুনেম চৌধুরীর কেসটাও সল্ভ হয়ে গেছে। এক দিনে এর চেয়ে বেশি সাফল্য আর আসবে কি না সে জানে না। যদিও আর কেউ না জানুক, এতো বড় সাফল্যটি এসেছে বাবলুর বদৌলতে!

সে যদি সোয়ান লেকে রঞ্জুর লোকগুলোর হাতে মারা যেতো কিংবা রঞ্জুকে মেরে ফেলতো, তাহলে এতটা সফল হতো না। বাবলু যে তার কথা রেখেছে, তাতে সে অবাক হয়েছে ঠিকই, তবে ফোনকল দেবার আগে এবং পরে তার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল, তার কথা রাখবে সে! কেন এমনটা আশা করেছিল, নিজেও জানে না। এটা হয়তো অব্যাখ্যাত এক যোগসূত্র। হয়তো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ব্যাপার। ঘটনা যাই হোক, বাবলু তার কথা রেখেছে। রকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটেছে একটা কালো অধ্যায়ের।

বাবলু যদি নিজের পেশা পাল্টে থাকে, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায়, তাহলে কি সে তাকে রেহাই দেবে?

এমন সময় ফারুক আহমেদ কল করে বসলো তাকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কলটা রিসিভ করলো।

“ঘুম থেকে উঠেছে কখন?” সে কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে উত্যু কণ্ঠে বলে উঠল ডিজি।

“এই তো স্যার…”

“আমি জানি তুমি অনেক টায়ার্ড, সারাটা রাত এই সব নিয়েই কেটে গেছে, কিন্তু আজকের প্রেস কনফারেন্সটা মিস করা যাবে না, মাইন্ড ইট।” একটু থেমে আবার বলল, “হোমমিনিস্টার নিজে কংগ্র্যাচুলেট করেছে আমাকে…তোমাকে। আর প্রেসের কথা কী বলবো, এখানে এসে দেখো, ঢুকতেই পারবে না!”

ভুরু কপালে উঠে গেল জেফরির।

“শত শত সাংবাদিক! উফ, হিমশিম খাচ্ছি রীতিমতো। ওদের প্রশ্নের উত্তর—”

“স্যার?” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল জেফরি বেগ। “আপনি আমাকে শত শত সাংবাদিকের প্রেস কনফারেন্সে থাকতে বলছেন?”

“হ্যাঁ,” জোর দিয়ে বলল ফারুক আহমেদ। “তুমি না থাকলে কে থাকবে? হ্যামলেট ছাড়া কি হ্যামলেট নাটক হয়?”

এক হাতে গাল চুলকালো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। “ওখানে থাকলে কি হবে বুঝতে পারছেন, স্যার?”

“কি হবে?” মহাপরিচালক যেন বুঝতে পারলো না।

“আমি তো সেলিব্রেটি হয়ে যাবো।

“ হা-হা করে হেসে উঠল ফারুক আহমেদ। “তা অবশ্য ঠিক।”

“কিন্তু সব পেশার লোকজনের কি সেলিব্রেটি হওয়া মানায়, স্যার?”

ওপাশের জন চুপ মেরে গেল।

“আমরা যে কাজ করি, আমরাদের সেলেব্রেটি হওয়া মানায় না।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা গেল। “তাহলে তুমি আসতে চাইছো না?”

“হোমিসাইডের প্রধান হিসেবে আপনিই থাকবেন, আর কারোর থাকার দরকার নেই, স্যার।”

আবারো দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেল ফোনের ওপাশ থেকে। “সব করলে তুমি আর ওখানে থাকবো…” কথাটা শেষ করলো না ডিজি। “ওকে, আমি তোমাকে ইনজিস্ট করবো না, বাট ওয়ান থিং আই ক্যান সে টু ইউ…আই উইল মিস ইউ।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।”

“আরে থ্যাঙ্কস তো দেবো আমি,” মহাপরিচালক বলল।

ফোনটা রাখতেই মুচকি হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। হ্যামলেট ছাড়া কি হ্যামলেট নাটক হয়?

তবে শেক্সপিয়ার ছাড়া হ্যামলেট ঠিকই মঞ্চস্থ হয়।

কথাটা নিজের কাছেই উন্নাসিকের মতো শোনালো। মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে বিছানা থেকে উঠতে যাবে অমনি একটা ইনকামিং মেসেজ এলো তার ফোনে। অপরিচিত নাম্বার থেকে করা মেসেজটা ওপেন করলো সে :

কংগ্রাচুলেশন্স।

শুধু এটুকুই। কেন, কীসের জন্য, কিচ্ছু নেই।

পার্থিব রায় চৌধুরী?

নতুন নাম, নতুন পরিচয়-কিন্তু নতুন জীবন কি?

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *