৪০. সোয়ন লেক সিটি

অধ্যায় ৪০

সোয়ন লেক সিটি

সোয়ান লেক সিটির মেইনগেটটা পশ্চিম দিকে, গেটের ডান দিক থেকে এক, দুই এবং তিন নাম্বার ভবন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁ-দিকে চার এবং পাঁচ নাম্বার ভবন, সাত নাম্বার ভবনের আগের পুটটা খালি পড়ে আছে এখনও। কী একটা আইনী ঝামেলার কারণে সেখানে কোনো ভবন নির্মাণ করা যায়নি। খালি জায়গাটা নিল রঙের টিন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ভবনগুলো আর লেকের মাঝে খোলা জায়গা রাখা হয়েছে।

এখানকার চার নাম্বার ভবনটির মেইনগেটে দুটো সিসিক্যাম রয়েছে, তার মধ্যে একটি ক্যামেরার ফুটেজে কিছু পাওয়া গেছে বলে জানালো জামান। বুদ্ধি করে ফুটেজটা নিজের মোবাইলফোনে নিয়ে নিয়েছে সে।

উৎসুক হয়ে সেই ফোনের দিকে চেয়ে আছে জেফরি বেগ।

সন্ধ্যা ৭:২১ মিনিটে কালো রঙের একটি মাইক্রোবাস এসে থামলো সাত নাম্বার ভবনের সামনে, গাড়ি থেকে নামলো তিনজন লোক। তাদের গায়ে ইংরেজিতে বড় অক্ষরে ‘ডিবি’ লেখা ভেস্ট-ঠিক যেরকম ভেস্ট পরে সত্যিকারের ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের লোকজন রেইড দিয়ে থাকে।

ক্যামেরার এই অ্যাঙ্গেল থেকে গাড়ির পেছন দিকটা দেখা যাচ্ছে কেবল, ফলে সেটা কে চালাচ্ছে দেখার উপায় নেই। রাতের বেলায় স্বল্প আলোতে গাড়ির নাম্বারপ্লেটটা একেবারেই অস্পষ্ট ধরা পড়েছে ক্যামেরায়। ইমেজ ব্লো আপ করলেও কিছু বোঝা যাবে না। অবশ্য বোঝা গেলেও লাভ হতো কি না সন্দেহ। জেফরির ধারনা, নকল ডিবির মতো নাম্বারপ্লেটটাও ভুয়া।

“ফাস্টফরোয়ার্ড করে দিচ্ছি,” ফুটেজটা সামনের দিকে টেনে দিলো জামান। “সাউন্ড নেই এই ফুটেজে, গুলিগুলো কখন করা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না।”

এখন দেখা যাচ্ছে মাইক্রোবাসটাও ঢুকে পড়লো ভবনের ভেতরে। বেশ কিছুটা সময় স্টিল ফটোগ্রাফির মতো সব কিছুই থমকে রইলো। তারপরই দেখা গেল ঐ ভবন থেকে ডিবির ভেস্ট পরা একজন দৌড়ে সোয়ান লেক সিটির মেইন গেট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। লোকটার চেহারা স্পষ্ট দেখা গেল। কিছুটা ভারিক্কি শরীরের, মুখে চাপদাড়ি, মাঝবয়সি একজন।

“আরেকটু টেনে দিচ্ছি, স্যার,” জামান বলল।

ফুটেজে এবার দেখা গেল, খালি প্লটের কাছে চলে এসেছে এক লোক, এগিয়ে যাচ্ছে সাত নাম্বার ভবনের দিকে, হঠাৎ পেছনে ফিরে তাকাতেই থমকে দাঁড়ালো সে। এমন সময় ঐ ভবনের ভেতর থেকে ডিবির মাইক্রোবাসটা বেরিয়ে এলো, ফ্রেমে ঢুকতে দেখা গেল পুলিশের একটি ভ্যান। মাইক্রোটা লেক-সাইড রোড দিয়ে মেইনগেটের দিকে ছুটে গেল, থেমে গেল পুলিশ ভ্যানটি।

“অল্পের জন্য পুলিশ গাড়িটা আটকাতে পারেনি, স্যার,” বলল জামান।

সিসিক্যামে যতোটুকু দেখা যাচ্ছে, মাইক্রোবাসটা পেছনের সিটে কেউ ছিল না।

“শুধু কনফার্ম হলাম কিছু ব্যাপারে,” হতাশ হয়ে বলল জেফরি। “নকল ডিবি সেজে এসেছিল ড্রাইভারসহ চারজন সন্ত্রাসি, তাদের মধ্যে তিনজনই মারা পড়েছে…ড্রাইভার গাড়িটা রেখে পালিয়ে গেছে। সম্ভবত যাকে মারতে এসেছিল, সে-ই ওদের গাড়িটা নিয়ে পালিয়ে গেছে।”

“জি, স্যার। লোকটা যদি সন্ত্রাসি দলের কেউ না হতো তাহলে তো পালাতো না।”

“হুম। কিন্তু ঐ মহিলা আর বাচ্চাটা গেল কোথায়?”

জামান কিছু বলল না।

“এই ভবন থেকে যেহেতু বের হতে দেখা যায়নি, মনে হচ্ছে মাইক্রোবাসে করেই চলে গেছে,” বলল জেফরি। নয়তো এখানকার কোনো ফ্ল্যাটে লুকিয়ে আছে।”

“ফ্ল্যাটগুলো সার্চ করবো?”

“এ ছাড়া তো উপায় দেখছি না,” বলল জেফরি বেগ।

লোকজনকে হয়রানি করতে চায় না, কিন্তু বেশিরভাগ সময় এটা এড়ানোরও উপায় থাকে না। পুলিশকে দিয়ে তল্লাশিটা করাও, আমি পাশের ভবনের দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলে আসছি।”

ঘর থেকে বের হয়ে গেল সে, লিফটে করে সোজা নেমে গেল নিচতলায়। সাত নাম্বার ভবন থেকে বের হয়ে পাশের খালি প্লট আর পাঁচ নাম্বার ভবনটা পেরিয়ে চার নাম্বার ভবনের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। এই ভবনের সামনে দুই তরুণ আর এক বয়স্ক লোক উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। জেফরিকে কাছে আসতে দেখে দুই তরুণ আস্তে করে ঢুকে পড়লো ভবনের ভেতরে, তবে বয়স্কজন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

“আপনি কি কিছু দেখেছেন, স্যার?” প্রবীণ অ্যালোটির উদ্দেশে বলল সে।

স্যার সম্বোধন করায় খুশি হলেন ভদ্রলোক। “না না, কিছু দেখিনি, অফিসার। আমি তো নিজের ফ্ল্যাটে ছিলাম, গুলির শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনিনি।”

“এখানকার দারোয়ান কে?”

“মোখলেস?” বৃদ্ধ হাঁক দিলেন জাঁদরেল ভঙ্গিতে।

ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ভীতসন্ত্রস্ত এক যুবক।

“ঘটনার সময় তুমি কোথায় ছিলে?”

“এইখানে, স্যার,” সিকিউরিটি বক্সটা দেখিয়ে বলল।

“কি দেখেছো তুমি?”

ঢোক গিলল মোখলেস। “একটা মাইক্রো আইলো ওই বিল্ডিংয়ের সামনে,” হাত তুলে সাত নাম্বার ভবনটা দেখিয়ে বলল। “ডিবি নামলো গাড়ি থিকা, তার পর গাড়িটাও ঢুইক্যা পড়লো ভিতরে। এর কিছুক্ষণ বাদেই গোলাগুলি শুরু হইয়া গেল।”

“তুমি তো ঐ গাড়িটা চলে যেতে দেখেছো, তাই না?”

“হ, স্যার…সাহস কইরা বাইর হইছিলাম, তহনই পুলিশ আইলো, তার পর দেখি মাইক্রোটাও বাইর হইলো বিল্ডিং থিকা।”

“ওই গাড়িটা কে চালাচ্ছিল, দেখেছো?”

“না, স্যার। গাড়িটা লেকের পাড় দিয়া গেছে, পিছন থিকা আমি কিছু দেখি নাই।”

“কিন্তু সিসিক্যাম ফুটেজে দেখেছি, তুমি ঐ ভবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলে।”

“অ্যাই, তুমি যা যা দেখেছো সব বলল,” বুড়ো লোকটা পাশ থেকে ধমকে উঠলেন। “এই অফিসারকে কো-অপারেট করো।” শেষ কথাটা আরো বেশি ধমক দিয়ে বললেন।

জেফরি ফিরে তাকালো বুড়োর দিকে। “থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।”

“ইউ আর ওয়েলকাম,” হাসিমুখে কিন্তু গর্বিত ভঙ্গিতে বললেন বৃদ্ধ। “ইনসিডেন্টটা যখন হচ্ছিল তখনই আমি ওকে বলেছিলাম, চোখকান খোলা রাখতে, লোকাল থানাকে আমিই কল করে জানিয়েছি।”

সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালো জেফরি বেগ। “খুব ভালো করেছেন, স্যার।”

“জায়গাটা নিরাপদ ভেবেছিলাম, এখন দেখছি এ দেশে কোথাও সেইফ না। আমার ছেলে ঠিকই বলেছে, অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেলেই ভালো হবে,” আক্ষেপ করতে করতে বুড়ো চলে গেলেন ভবনের ভেতরে।

ভবনের দারোয়ান মোখলেস একটু কাচুমাচু খেলো। “আমি তো সাহস কইরা আগাইছিলাম কিন্তু গাড়িটা কে চালাইতেছিল দেখি নাই, বিশ্বাস করেন, স্যার।”

একটু ভেবে আবার জানতে চাইলো জেফরি, “এই ঘটনার আগে এমন কিছু দেখেছো, সন্দেহজনক কিছু? অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা?”

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো মোখলেস। “এইরাম কিছু তো চোখে পড়ে নাই, তয় সন্ধ্যার দিকে ঐখানে…” খালি প্লটটা দেখিয়ে বলল, “…সাত নম্বরের এক ম্যাডামের লগে এক লোক খুব চিল্লাফাল্লা করছিল।”

নড়েচড়ে উঠল জেফরি। এক মহিলার কথা বলছে! “কোন মহিলার কথা বলছে, ছয় তলায় থাকেন যিনি?”

“হ, স্যার। ম্যাডামের একটা বাচ্চা পোলা আছে।”

জেফরি বুঝতে পারলো, ঐ মহিলার কথাই বলছে, যার ঘরে তৃতীয় লাশটা পাওয়া গেছে। “কী দেখেছো তুমি, একটু ভালো করে বলো তো?”

গভীর করে দম নিয়ে নিলো মোখলেস। “সন্ধ্যার দিকে আমি বক্সে বইসা ছিলাম, চিল্লাফাল্লা শুইন্যা বাইর হইয়া দেখি, ঐ বিল্ডিংয়ের ম্যাডারে এক ব্যাটা ধমকাইতেছে।”

“তার পর?”

“এরপরই আমারে তিনতলার মুমিনস্যার ইন্টারকমে কল দিয়া মোটর ছাড়তে কইলো, ট্যাঙ্কির পানি ফুরাইয়া গেছিল…মোটর ছাইড়া আইসা দেখি ঝগড়াঝাটি সব শ্যাষ।”

“শেষ মানে?”

“ওইখানে কেউ নাই।”

“ও,” বলল জেফরি বেগ। “এটা ঠিক কোন সময়ের কথা, মনে আছে তোমার?”

“খাড়ান,” বলে মোখলেস গেস্টদের রেজিস্ট্রেশন খাতাটা দেখে নিলো। “আমি মোটর ছাইড়া যখন এইখানে আসি তখন তিনতলায় একজন গেস্ট আইছিল।” খাতাটা দেখে সময় জেনে নিলো সে, মুখে ফুটে উঠল হাসি। “এই যে, স্যার…ছয়টার দিকে।”

জেফরি বেগ দেখতে পেলো, ঐ গেস্টের নাম আর ফোন নাম্বারের পাশে সময়টা লেখা আছে।

তার মানে, ছয়টার একটু আগে ঐ ঘটনাটা ঘটেছে। সে জানে, এই ভবনের ফুটেজ আছে জামানের কাছে, ওটা আবার দেখা দরকার। দারোয়ান যেটা দেখেনি সেটা হয়তো ফুটেজে থাকবে।

মোখলেসের সঙ্গে কথা শেষ করে সে আবার চলে এলো সাত নাম্বার ভবনের ক্রাইমসিনে।

“পাঁচ নাম্বার ভবনের সিসিক্যাম থেকে যে ফুটেজটা পেয়েছে সেটা কতোক্ষণের?” ক্রাইম-সিনে ঢুকেই জানতে চাইলো জেফরি।

“আমি আজকের পুরো ফুটেজটাই ডাউনলোড করেছি, তবে আপনাকে শুধু ঘটনার কিছু আগে পরের অংশগুলো দেখিয়েছিলাম, স্যার।”

“আমাকে ৬টার একটু আগের ফুটেজ দেখাও।”

“ওকে স্যার,” কথাটা বলেই নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো জামান।

“চার নাম্বার ভবনের দারোয়ান বলল, বাইরের এক লোকের সাথে এই ফ্ল্যাটের মহিলার ঝগড়া-ঝাটি হয়েছিল ছয়টার দিকে।”

মোবাইলফোনের স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে তাকালো জামান, আবারো ফোনের দিকে নজর দিলো। “আমি ৫টা ৫০ থেকে ফুটেজটা প্লে করছি, ফোনের ডিসপ্লের দিকে তাকিয়েই বলল। “এই যে, স্যার…”

জামানের স্মার্টফোনের ছয় ইঞ্চি পর্দার দিকে তাকিয়ে জেফরি বেগ দেখতে পেলো, সিসিক্যাম ফুটেজে সাত নাম্বার ভবনের মেইন গেটটা দেখা যাচ্ছে। সোয়ান লেক সিটির চার নাম্বার ভবনের এই সিসিক্যামটা ডানে বাঁয়ে বেশ কিছু জায়গাও কাভার করে।

কোনো জনমানবের চিহ্ন নেই বলে ফুটেজটা আরেকটু সামনের দিকে টেনে দিলো জামান।

৫টা ৫৩ মিনিট। সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কার এসে থামলো খালি প্লটটার সামনে। একটু পর সেখান থেকে বেরিয়ে এলো এক মহিলা। পরনে শালোয়ার-কামিজ, মাথাটা ওড়না দিয়ে পেচিয়ে রাখা। মহিলা উপুড় হয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা মানুষটাকে কিছু বলল। তারপরই গাড়িটা লেকের পাড় ঘেষে ডানে ঘুরে মেইন গেটের দিকে চলে গেল। মহিলা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে চেয়ে রইলো গাড়িটার দিকে, তারপর যে-ই না পা বাড়াবে সাত নাম্বার ভবনের দিকে, অমনি টিন দিয়ে ঘেরা খালি প্লটের ভেতর থেকে বের হয়ে এলো প্যান্ট-শার্ট পরা এক লোক। ক্যামেরা তার পেছনে থাকায় মুখটা দেখা যাচ্ছে না।

সেই লোক পেছন থেকে ডাকতেই মহিলা ঘুরে দাঁড়ালো, চমকে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। তার মানে পরিচিত কেউ। দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে, ভড়কে গেছে পুরোপুরি। এরপরই তাদের মধ্যে কথাবার্তা চলল কিছুক্ষণ। বেশ কয়েক বার মাথা দুলিয়ে অসম্মতি জানালো মহিলা। লোকটার আচরণ ক্রমশ ক্ষিপ্ত হতে শুরু করলো, আঙুল উঁচিয়ে শাসানোর ভঙ্গি করলো আগ্রাসিভাবে। এক পর্যায়ে মহিলার হাত ধরেও টান দিলো।

এমন সময় মারমুখি লোকটার পেছনে চলে এলো কালো রঙের টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরা একজন। এই লোকটারও মুখ দেখা যাচ্ছে না ক্যামেরায়। পেছন থেকে এসেই লোকটার কলার ধরে বসলো সে। চমকে ঘুরে দাঁড়ালো ক্ষিপ্ত লোকটা। আর তখনই চেহারাটা স্পষ্ট দেখা গেল।

বজ্রাহত হলো জেফরি বেগ। মাই গড!

অধ্যায় ৪১

“এই লোক এখানে কী করতে এসেছিল?!”

পজ দেয়া ফুটেজের দিকে তাকিয়ে অনেকটা বিড়বিড় করে বলে উঠল জেফরি বেগ।

জামানও ভিরমি খেয়েছে এই লোককে দেখে।

যে মুখটা দেখতে পাচ্ছে সেটা ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি জেফরি। প্রায় দুই মাস পর মুখটা দেখতে পেলো আবার।

রাহিদ হাসান!

ফোনের পর্দায় স্থির হয়ে আছে ভড়কে যাওয়া মুখটি।

“স্যার, আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল জামান। “ব্ল্যাক রঞ্জুর দল জড়িত মনে হচ্ছে!”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। রাহিদ হাসান এখানে আসার পরই একদল লোক নকল ডিবি সেজে হামলা করেছে এখানকার একটি ফ্ল্যাটে-এর সাথে অবশ্যই রঞ্জুর দলের কানেকশান আছে।

হোমিসাইডের মহাপরিচালকের অনুরোধে এই লোককে মুনেমের কেসে জড়ায়নি, পরদিন সকালে মুক্তি দিয়ে দেয়। অবশ্য লোকটার ফোনে ছোট্ট একটা ডিভাইস ইস্প্যান্ট করে দিয়েছিল এই আশায়, যেখানেই যাক না কেন, ফোন বন্ধ করে রাখলেও তার কথাবার্তা শুনতে পাবে, সেই সাথে জানা যাবে কোথায় আছে। তো রাহিদ হাসান হোমিসাইড থেকে বের হয়ে সোজা চলে যায় পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় তার পৈতৃক বাড়িতে। পথে কাউকে সে ফোন করেনি, কেবল পাড়ার মুদি দোকানে গিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট কেনার সময়ই লোকটার কণ্ঠ শোনা গেছিল। এরপর তার ফোনে কোনো কল কিংবা এসএমও আসেনি, সে-ও কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। অধীর আগ্রহ নিয়ে জেফরি বসে ছিল হোমিসাইডের কমিউনিকেশন্স রুমে, কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও কিছুই পায়নি।

পর দিন দেখা যায় ফোনটা দ্রুত গতিতে ছুটছে! ঢাকা থেকে চলে গেছে গাজীপুরে। তার মানে বাস কিংবা গাড়িতে উঠেছিল সম্ভবত। গাজীপুরে যাবার পরই ফোনটা বন্ধ হয়ে যায়, যদিও আশেপাশের মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছিল তখন। অভিজ্ঞ রমিজ লস্কর জানায়, ফোনটা বদ্ধ কোনো জায়গায় রাখা আছে, তাই এমন মৃদু শব্দ আসছে। জামান এবং রমিজ ধারনা করেছিল, রাহিদ হাসান ঢাকা ছেড়েছে জীবন বাঁচানোর জন্য। সম্ভবত সে বুঝতে পেরেছে, রর দল তাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। কিন্তু জেফরি বেগের তা মনে হয়নি। ধুরন্ধার লোকটা বুঝে গেছিল, ফোন দিয়ে ট্র্যাক করা হচ্ছে তাকে। সম্ভবত ইমরুল নামের লোকটাকে যে তারা ট্র্যাক করছিল সেটা জানার পরই সে এটা বুঝে যায়।

এখন দেখতে পাচ্ছে, এই লোক গাজীপুরে না, ঢাকা শহরেই আছে। হয়তো কিছুদিন গা ঢাকা দেবার পর চলে এসেছে আবার।

“এর পেছনে আরো সময় দেয়া দরকার ছিল,” তিক্তমুখে বলল জেফরি।

“প্লে করবো, স্যার?” জানতে চাইলো জামান।

মাথা নেড়ে সায় দিলো হেমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর।

রাহিদ হাসানের কলার ধরে টান মারলো লোকটি, এ সময় মহিলাকে কী যেন বলল সে। দেখে বোঝা যাচ্ছে, লোকটাকে মহিলা চেনে। রাহিদ হাসান হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে আগন্তুকের দিকে। তার ভাবভঙ্গি দেখে জেফরির মনে হচ্ছে, আগন্তুককেও সে চেনে।

নাকি অবাক হয়েছে?! নিশ্চিত হতে পারলো না।

লোকটা মাথা নেড়ে কিছু বললে মহিলা চুপচাপ সাত নাম্বার ভবনের দিকে চলে গেল। রাহিদ হাসান পুরোপুরি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। লোকটা তাকে কিছু বলে কলারটা ছেড়ে দিলো, তারপরই হন হন করে মেইন গেটের দিকে যেতে শুরু করলো রঙ্গুর ঘনিষ্ঠ লোকটি। আগন্তুক ধীর পায়ে চলে গেল সাত নাম্বার ভবনের দিকে, একবারও পেছনে ফিরে তাকালো না।

রাহিদ হাসান অবশ্য যেতে যেতে পেছন ফিরে তাকালো।

অধ্যায় ৪২

ভুতুরে ব্যাপার হলো, পুরো ভবনের যে কয়টি ফ্ল্যাটে লোকজন আছে তার সবগুলোতে তল্লাশি চালিয়েও ঐ মা আর ছেলেকে পাওয়া গেল না। ভবনের ছাদেও খোঁজ করা হয়েছিল-সেখানেও নেই।

“তাহলে ঐ মাইক্রোবাসে করেই ওরা চলে গেছে,” অনেকটা আনমনেই বলে উঠল জেফরি বেগ। তার আগেই সন্দেহ হয়েছিল, এই মহিলার সঙ্গে পাশের ফ্ল্যাটের লোকটার সম্পর্ক আছে।

জামান কিছু বলল না, কারণ সিসিক্যাম ফুটেজে অবশ্য গাড়িটার পেছনের সিটে কাউকে দেখা যায়নি। “নিহত তিন অস্ত্রধারীর পরিচয় বের করতে হবে, স্যার।”

সহকারির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো জেফরি বেগ। “মগজাস্ত্র ব্যবহার করে?”

“না, স্যার…সিডিআর করলেই তো হবে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ। সিডিআর মানে কত্স ডিটেইলস রেকর্ড এখন সারাবিশ্বে যেকোনো ইনভেস্টিগেশনেই ব্যবহার করা হয়। মোবাইল অপারেটররা প্রতিটি মোবাইলফোনের সিম নাম্বারের কল, এসএমএসসহ সব তথ্য রেকর্ড করে রাখে, আর এটা মোটেও স্পাইং করার জন্য করা হয় না। একজন গ্রাহক অপর গ্রাহকের সাথে কতো সময় কথা বলছে, কতোগুলো এসএমএস করেছে, কতো মিনিট ইন্টারনেট ব্রাউজিং করেছে, এগুলোর হিসেব রাখতে হয় তাদেরকে। সিডিআর-এর এই ডেটা গ্রাহকদের মাসিক বা বাৎসরিক খরচ এবং সে অনুযায়ী মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর আর্থিক হিসেব-নিকেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন গ্রাহকের ব্যবহৃত অপারেটর, কোন একটি কল করার বা শুরুর সঠিক সময় এবং তারিখ, কলটির স্থায়ীত্ব, কল কেটে দেয়ার সময়, যে ব্যক্তিকে কল করা হয়েছে তার নাম্বার, উভয়ের মোবাইলের ইন্টারন্যশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টি-আইএইএমই এবং ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল সাবস্ক্রাইবার আইডেন্টিটি নাম্বার-আইএমএসআই নাম্বার, উভয়ের নিকটবর্তী বেইজ স্টেশনের তথ্যও থাকে। এমনকি গ্রাহকের ব্যবহৃত নেটওয়ার্ক টাইপ-টু জি, থ্রি জি, ভয়েস কল, এসএমএস বা ইন্টারনেট ডেটাও একেবারে নিখুঁতভাবে সিডিআর-এর ডেটাতে পাওয়া যায়।

নিহত তিন সন্ত্রাসির মোবাইলফোন যেহেতু পাওয়া গেছে, এ কাজটা ভালোমতোই করা যাবে।..

“আজকে নাইট-শিফটে কে আছে?”

“মনীষ, স্যার…একটু আগে জয়েন করেছে।”

“তাহলে ওকে নাম্বারগুলো দিয়ে দাও, সিডিআর করে দেখুক কি নামে রেজিস্ট্রেশন করেছে সিমগুলো, সেই সাথে বাকি ডেটাগুলোও যেন কালেক্ট করে।”

“ওকে, স্যার,” বলল জেফরির সহকারি।

আবারো হিসেব মেলানোর চেষ্টা করলো জেফরি বেগ। রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ লোক রাহিদ হাসান এখানকার এক মহিলার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়, তখনই এই ভবনের এক লোকের হাতে নাজেহাল হয়ে চলে যায় সে, এরপরই নকল ডিবি সেজে এখানে হানা দেয় সশস্ত্র একটি দল। দারোয়ানের ভাষ্যমতে, তারা সবার আগে নওরিন খান কোন্ ফ্লোরের কোন্ ফ্ল্যাটে থাকে সেটা জেনে নিয়েছে। তার মানে, ঐ রহস্যময় লোকটি কোথায় থাকে সেটা তারা জানতো না, পরে মহিলাকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিশ্চয় জেনে নিয়েছে। কিন্তু পাশের ফ্ল্যাটে হানা দেবার পর দু-জন সন্ত্রাসি মারা যায়। বাকি ছিল একজন, তার লাশটা পাওয়া গেছে ঐ মহিলার ফ্ল্যাটেই।

“রঞ্জুদের প্রতিপক্ষ নাইনস্টার গ্রুপের কেউ থাকতো না তো এখানে?”

জামানের আইডিয়াটা বাতিল করে দিলো জেফরি। “যদি তা-ই হতো, রাহিদ হাসানকে এমনি এমনি ছেড়ে দিতে না ঐ লোক।”

দ্রুত মাথা খাটাতে লাগলো জেফরি বেগ। নওরিন নামের মহিলার সঙ্গে রাহিদ হাসান এবং পাশের ফ্ল্যাটের লোকটারও সম্পর্ক আছে। আজকের খুনগুলো ঠিক কী নিয়ে হয়েছে, সেটাও ভালো করেই জানে ঐ মহিলা। কিন্তু বিষয়টা নিছক ব্যক্তিগত কারনে ঘটেছে বলেও মনে হচ্ছে না তার কাছে। অজ্ঞাত লোকটি রাহিদ হাসানের সঙ্গে এমন কিছু করেনি যে তার জন্যে এতো দ্রুত একটি হিট টিম পাঠাবে।

ঝটপট নিজের ফোন থেকে একটা নাম্বার দেখিয়ে জামানকে বলল, “এই নাম্বারটাও ট্রেস করতে দাও মনীষকে…আমি একজ্যাক্ট লোকেশন চাই। লোকটাকে ফোন দিয়েছিলাম একটু আগে, কলটা রিসিভ করে রং নাম্বার বলে কেটে দিয়েছে, এরপর থেকে ফোনটা বন্ধ। আমি নিশ্চিত, এই লোক জানে ঐ মহিলা কোথায় আছে।”

“ওকে স্যার।” নাম্বারটা হোমিসাইড হেডকোয়ার্টারে থাকা মনীষকে এসএমএস-এ পাঠিয়ে দিতে দিতে জামান বলল, “যে কয়জন অ্যালোটি আছে তাদের কাছ থেকে কিছুই পাইনি। সবাই একই কথা বলছে, ঐ লোক দু-মাস আগে এখানে উঠেছে, নাম-পরিচয় কিছুই জানে না এখানকার কেউ। কারো সাথেই লোকটার কথাবার্তা হতো না। তবে পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চাটার সঙ্গে ইদানিং তাকে লেকের পাড়ে কথা বলতে দেখেছে কেউ কে। বাচ্চাটা নাকি সারাক্ষণ ট্যাব নিয়ে থাকে।”

জেফরি বেগ কিছু একটা ভাবছিল, জামানের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলো। “ঐ অ্যাপার্টমেন্টের মালিক কে সেটা আজকেই বের করা সম্ভব। এখানকার অ্যালোটিদের যে সোসাইটি আছে তার নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করো। সে জানে ঐ ফ্ল্যাটের মালিক কে।”

অধ্যায় ৪৩

সোয়ান লেক সিটির সাত নাম্বার ভবনের সোসাইটির প্রেসিডেন্ট কাদের বক্স সাহেবও ঈদের ছুটিতে দেশের বাড়িতে চলে গেছেন। অন্য এক অ্যালোটির কাছ থেকে ভদ্রলোকের ফোন নাম্বারটা সংগ্রহ করে জামান কথা বলে জেনে নিয়েছে, ছয়তলার ঐ ফ্ল্যাটের মালিক সোয়ান লেক সিটির ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান ঢাকা কনসোর্টিয়াম নামের রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানটিই। সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক একাধিক। ফ্ল্যাটটা ঠিক কোন মালিকের, এটা তিনি জানেন না। এখানকার দুটো ফ্ল্যাট বাদে সবগুলোর মালিকই থাকে সপরিবারে। শুধু দুটো ফ্ল্যাট ভাড়া-আর দুটোই টপফ্লোরে, ছয়তলায়। দু মাস আগে ওখানে উঠেছে এক লোক। তাদের সোসাইটির কোনো মিটিংয়ে ভদ্রলোক আসেননি এখন পর্যন্ত। কারো সাথে কথা বলতো না, কেউ তাকে ভালো করে চেনেও না। ঈদের ছুটি না হলে, সব অ্যালোটি থাকলে হয়তো কেউ না কেউ আরো ভালো বলতে পারতো, কিন্তু তার পক্ষে এর চেয়ে বেশি বলা সম্ভব নয়। সোসাইটির প্রেসিডেন্ট বলেছে, ঐ ভদ্রলোক সম্ভবত হিন্দু। নামটা অবশ্য বলতে পারেননি।

তবে নওরিন খানকে ভদ্রলোক চেনেন, সাংবাদিক জহির সাহেবের ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছেন তিন-চার মাস আগে।

“কাল সকালের আগে ঢাকা কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে না, স্যার,” জামান বলল। “অফিস আওয়ারে কল দিতে হবে।” এমন সময় তার ফোনটায় বিপ্ করে শব্দ হলো। “স্যার, ইনকামিং মেসেজটা ওপেন করে বলল জামান। “একটু আগে যে দুটো নাম্বার দিয়েছি মনীষকে, তার মধ্যে একটা নাম্বারের লোকেশন বের করতে পেরেছে।” কাছে এসে ফোনের ডিসপ্লে তুলে ধরলো জেফরির সামনে। “মামুনুর রহমান আছে মিরপুর দশ নাম্বারে…এটাই তার একজ্যাক্ট লোকেশন। এখন অবশ্য অন্য একটা সিম ব্যবহার করছে ভদ্রলোক। এই যে…এই নাম্বারটা।”

মুচকি হাসলো জেফরি বেগ। বেশির ভাগ মানুষ যে ভুল করে, মামুনুর রহমানও সেই ভুল করেছে। ভেবেছে, ফোন থেকে সিম খুলে অন্য সিম ব্যবহার করলেই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। ফোনের আইএইএমই নাম্বার দিয়ে যে ট্রেস করা যায়, অনেকেই জানে না। ভাগ্যিস!

স্মার্টফোন যে আধুনিক যুগের সেইভ ব্রেসলেট-এটাই বেশিরভাগ স্মার্ট মানুষজন জানে না। দাসপ্রথা যখন ছিল তখন প্রত্যেক দাসদের শরীরে ছাপ্পড় মারা থাকতো, পায়ে থকাতো শেকল আর ঘণ্টি-যেখানেই যাক, মানুষজন বুঝে যেতো, পরিচয় লুকাবার উপায় ছিল না সহজে। হালের আট ফোন কি ঠিক সেই কাজটাই করছে না?

“তার আগের সিমটাতে বিগত দুই ঘণ্টায় যে-সব নাম্বার থেকে ফোন করা হয়েছিল, সেগুলো বের করেছে মনীষ?”

“জি, স্যার। খুবই অল্প কিছু কল, তাই দ্রুত চেক করতে পেরেছে।” প্রসন্নভাবে হাসি দিলো জামান। “মনীষ খুবই এক্সপার্ট ছেলে, ওকে সব বলে দিতে হয় না…ট্রেস করেছে, স্যার।” একটু থেমে ফোনটার মেসেজ স্ক্রল করে পড়লো। “মামুনুর সাহেবের আগের নাম্বারে মাত্র একটা নাম্বার থেকেই কল করা হয়েছে আজকে, ঐ নাম্বারটার রেজিস্ট্রেশন চেক করে দেখেছে, নওরিন খানের নামে রেজিস্ট্রেশন করা আছে…ওটা এখনও চালু আছে, স্যার।”

“লোকেশন…?”

“উত্তরার এগারো নাম্বার সেক্টরের একটা বাড়ি।”

একটু অবাক হলো জেফরি বেগ, ভুরু কুঁচকে গেল তার। “আমি তো ভেবেছিলাম ঐ মামুনুর রহমানের সঙ্গেই আছেন ভদ্রমহিলা।” কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো, মহিলাকে এখনই ফোন দেবে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলো, এটা করলে মহিলা বুঝে যাবে তাকে ট্র্যাক করা হচ্ছে, তখন হয়তো গা ঢাকা দিতে পারে।

“যে বাড়িতে মহিলা আছে সেটা অ্যাপার্টমেন্ট ভবন না, ডুপ্লেক্স। গুগলের স্ট্রিট ভিউ দেখে জানিয়েছে মনীষ।”

নড়েচড়ে উঠল জেফরি বেগ। অ্যাপার্টমেন্ট ভবন হলে লোকেশন ট্রেস করতে পারলেও ঠিক কোন্ তলায় আছে সেটা জানা সম্ভব হয় না। কিন্তু একতলা কিংবা দোতলা বাড়ি হলে কাজটা সহজ হয়ে যায়।

জামানের দিকে ফিরলো এবার। “লোকাল থানায় ইনফর্ম করো, আমরা ওখানে যাবো। এক্ষুণি যেন তাদের একটা পেট্রল টিম বাড়িটার সামনে থাকে। কাউকে সেখানে ঢুকতে কিংবা বের হতে যেন না দেয়।”

“ওকে, স্যার,” জামান বলল।

অধ্যায় ৪৪

ঈদের ছুটির আমেজ শেষ হয়নি বলে পথঘাট কিছুটা ফাঁকা। জামানের বাইকে করেই রওনা দিয়েছে জেফরি, সোয়ান লেক সিটি থেকে বের হয়ে সোজা উত্তরমুখি রাস্তাটা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। এখনও সুদীর্ঘ পথটির বেশিরভাগ অংশ কাঁচা। কোথাও ইট বিছানো, বাকিটা নগ্ন মাটির-একেবারে গ্রামের পথের মতো। রাস্তার দু-পাশে অসংখ্য খালি প্লট পড়ে আছে। তবে জেফরি জানে, এক থেকে দু-বছর পর এখানে এলে জায়গাটা চিনতে পারবে না। দেখা যাবে অনেক ভবন গড়ে উঠেছে, পুরোপুরি বদলে গেছে।

খিলক্ষেত পেরিয়ে জামানের বাইকটা চলে এলো ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে। চওড়া মহাসড়কটি সব সময়ই ব্যস্ত থাকে ঢাকার একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কারণে। কিছুটা পথ এগোতেই বিমানবন্দরটি অতিক্রম করলো তারা। কিছুক্ষণ পর মাসকট প্লাজা পেরিয়ে চলে গেল এগারো নাম্বার সেক্টরের দিকে।

এমন সময় জামানের রিংটোন বেজে উঠলে বাইকটা রাস্তার পাশে থামালো, পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখতে পেলো মনীষ কল দিয়েছে। কানে ফোন চেপেই জেফরির দিকে ফিরলো সে, বদলে গেল তার মুখের অভিব্যক্তি।

“কী হয়েছে?” আশঙ্কার সাথেই জানতে চাইলো জেফরি বেগ।

“একটু আগে নওরিন খানের ফোনটার জিপিএস বন্ধ হয়ে গেছে!”

“বলো কি?” অবাক হলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর। কিভাবে টের পেলো ঐ মহিলা?”

“চিন্তার কিছু নেই, স্যার,” ফোনটা পকেটে রেখে দিয়ে বলল জামান। “পুলিশ ঐ বাড়ির সামনে আছে, মহিলা বের হতে পারবে না।”

“জলদি চলো!” তাড়া দিলো জেফরি বেগ।

জামানের বাইকটা আবার চলতে শুরু করলো। “মনীষ আমাকে কো অর্ডিনেশন সেন্ড করে দিয়েছে,” বলল সে। “জায়গাটা আমি চিনি, আমার এক আত্মীয় থাকে ওই রোডে।”

সহকারির পিঠে আতো করে চাপড় মারলো জেফরি। জিপিএস এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়াটা তাকে ভাবাচ্ছে। ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের ইমরুল নামের একজনও ঠিক একই কাজ করেছিল। তারা ওই লোকটার খুব কাছাকাছি চলে আসতেই জিপিএস বন্ধ হয়ে যায়। তার মানে নষ্ট করে ফেলেছিল ফোনসেটটা। তার ধারনা, রঞ্জুর দলের কেউ আগেভাগে জেনে গিয়ে ঐ লোককে সতর্ক করে দিয়েছিল। কিন্তু এই মহিলা, নওরিন খানের বেলায় সেটা কিভাবে সম্ভব হলো? কে তাকে আগেভাগে জানিয়ে দিলো?

ফাঁকা রাস্তা পেয়ে জামান তার বাইকটা যতো দ্রুত সম্ভব চালালো। বাড়িটা কোথায় সে জানে, ফলে খুঁজতে হলো না, সোজা বাইক চালিয়ে চলে এলো বাড়িটার সামনে। দেখতে পেলো, পুলিশের একটা ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক পুলিশ অফিসার আর দু-জন কনস্টেবল।

জামানের বাইকটা পিকআপ ভ্যানের সামনে থামতেই জেফরি নেমে পড়লো।

“আমি হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর…” হেলমেটটা খুলে নিজের পরিচয় দিলো সে। “…জেফরি বেগ।”

“স্লামালেকুম, স্যার, পুলিশ অফিসার স্যালুট দিলো। তার বুকের নেমপ্লেটে লেখা : কালাম।

“আপনারা এখানে আসার পর এই বাড়ি থেকে কেউ বের হয়েছে?”

“না, স্যার…কেউ ঢোকেনি।”

“আপনি আমার সাথে আসুন।”

ততক্ষণে বাইকটা স্ট্যান্ডের উপরে রেখে দিয়েছে জামান, সে-ও যোগ দিলো তাদের সঙ্গে।

চারপাশে সব সুউচ্চ দালানের মাঝে এটাই একমাত্র দোতলা বাড়ি। ভেতরে, মেইনগেটের দু-পাশেই বড় বড় ফুলের গাছ আছে, সেই গাছগুলোর ডালপালা সীমানা প্রাচীরের উপর দিয়ে উপচে পড়েছে বাইরে। দরজার পাশে কলিংবেলের সুইচ টিপে অপেক্ষা করলো।

একটু পর খুট করে শব্দ হলো ভেতর থেকে, খুলে গেল দরজাটা।

মেইন গেটের বাইরে স্ট্রিট লাইটের কারণে যে মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলো জেফরি বেগ, তাতে পুরোপুরি ভিমি খেলো সে।

মাই গড!

অধ্যায় ৪৫

সোয়ান লেক সিটি
৩ ঘন্টা আগে

লিফটটা থামতেই বেরিয়ে এলো সে, সঙ্গে সঙ্গে চোখ গেল সামনের বাঁ দিকের ফ্ল্যাটের আধভেজানো দরজার দিকে। ফাঁক দিয়ে ছোট্ট একটা মাথা বের হয়ে আছে। মায়াভরা নিষ্পাপ চোখ দুটোকে বন্দি করেছে মোটা ফ্রেমের চশমা। যেন টিন টিনের চোখে হ্যারি পটারের চশমাটা বসিয়ে দেয়া হয়েছে।

তাকে দেখামাত্র দরজার ফাঁকটা সঙ্কুচিত হয়ে গেল সামান্য।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গেল সে। তার হাতে বড়সর দুটো প্যাকেট। নিজের ফ্ল্যাটের দরজার নবে চাবি ঢোকাতে বেগ পেলো। কায়দা করে প্যাকেট দুটো বামহাতে নিয়ে ডানহাতে প্যান্টের পকেট থেকে চাবিটা বের করে দক্ষতার সাথেই লকটা খুলে ফেলল।

দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাবে অমনি খুট করে একটা শব্দ হলে ডান দিকে ফিরে তাকালো সে। ছোট্ট মাথাটা দরজার ফাঁক গলে চেয়ে আছে তার দিকে। দরজার নিচে একটা ট্যাব পড়ে আছে।

ফ্ল্যাটে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। ফাঁকা অ্যাপার্টমেন্টের দিকে তাকিয়ে কোনো দীর্ঘশ্বাস কিংবা একাকিত্বের যন্ত্রণা বোধ করে না সে। সত্যি বলতে, একা থাকতে ভালোই লাগে, চিরটাকাল একাই থেকেছে, একাকিত্বই তার কাছে স্বাভাবিক একটি অবস্থা।

প্যাকেট দুটো ডাইনিংরুমের টেবিলের উপরে রেখে বেডরুমের দিকে পা বাড়ালো। জুতোটা খুলে ঘরের বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো চিৎ হয়ে। গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। বিক্ষিপ্ত সব চিন্তা হুড়োহুড়ি করছে মাথায়। সবগুলোই এলোমেলো। অনেকটা ঝড়ের মধ্যে উড়তে থাকা ময়লা-আবর্জনার মতো। বাচ্চাছেলেটার কথা বাদ দিয়ে অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে চাইছে এখন।

কয়েক মাস ধরে আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছে ব্ল্যাক রঞ্জুর দলটা। প্রায়ই পত্রিকায় তাদের অপকর্মের সংবাদ আসছে। সাংবাদিকেরা এমনভাবে জোর দিয়ে বলছে, যেন তারা রঞ্জুকে সচক্ষে দেখেছে, তার সাক্ষাৎকার নিয়েছে।

কিন্তু সে জানে, রঞ্জু মারা গেছে। নিজের হাতে তাকে পুড়িয়ে মেরেছে।

কলিংবেলটা বেজে উঠলে তার ভাবনায় ছেড় পড়লো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। কয়েক দিন ধরে এই অস্বস্তিকর অবস্থা চলছে। ভালো করেই জানে, চার-পাঁচবার বাজাবে, তারপর ক্ষান্ত দেবে। কিন্তু তার ধারনা মিথ্যে প্রমান করে দিয়ে বেজেই চলল সেটা। অবাক হয়ে দেখলো, অবজ্ঞা করতে পারছে না, নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাকে। শব্দগুলো যেন তার মাথার ভেতরে হাতুড়িপেটা করছে। অসহ্য লাগলো। বিছানার চাদর খামচে ধরলো সে, যেন নিজেকে আটকে রাখতে চাচ্ছে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলো না, দরজাটা খুলে দিলো। নিচ থেকে মায়াভরা যে মুখটা চেয়ে আছে, তাতে মিশে আছে আতঙ্ক।

“তোমার আম্মু খুব রাগ করবে। চলে যাও।”

“আম্মু তো এখনও আসেনি,” জবাব দিলো ছেলেটি। যথারীতি হাতে আছে ট্যাবটা।

“হয়তো অফিসে কাজের চাপ আছে তাই দেরি হচ্ছে।”

“আজকে তো অফিস ছিল না।”

ভুলেই গেছিল, ঈদের ছুটি চলছে এখনও। “তাহলে কোনো জরুরি কাজে গেছে নিশ্চয়ই।”

“আমার খুব ভয় করছে,” সত্যি সত্যি ভয়ার্ত অভিব্যক্তি দেখা গেল বাচ্চাটার চোখেমুখে। “আম্মু কখনও এতো দেরি করে না।”

চুপ মেরে রইলো সে। তার মা অবশ্য মাঝেমধ্যেই দেরি করে অফিস থেকে ফেরে। মাসে কয়েকবার এমনটা হয়। চাকরিজীবিদের জন্য খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

“চিন্তা কোরো না, এসে পড়বে।”

“আমি তো ফোন করেছিলাম…ধরেনি।”

“রিংটোন বন্ধ করে রেখেছে তাই টের পায়নি। তুমি ঘরে যাও। অপেক্ষা করো।”

ছেলেটাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো, বিছানায় গিয়ে আবার শুয়ে পড়লো সে। এমন ছোট্ট হৃদয়ে আঘাত করতে খুব খারাপ লাগছে। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো।

যেহেতু রঞ্জু বেঁচে নেই, এসব নিয়ে তার ভাবনারও কিছু নেই। ঐ দলটা এখন যে-ই চালাক না কেন, রঞ্জুর নাম ভাঙাচ্ছে। পলিটিশিয়ানরা যেমন নাম ভাঙায় প্রয়াত নেতার, সন্ত্রাসি দলগুলোও নিজেদের নেতাকে বাঁচিয়ে রাখে মৃত্যুর পরও। পার্থক্য হলো, ওরা নিছক কোনো ছবিকে পুঁজি করে এটা করতে পারে না, রটিয়ে দেয় তাদের নেতা আসলেই বেঁচে আছে। তবে আসল সত্যিটা খুব দ্রুতই বেরিয় আসে। এতো বড় মিথ্যে বেশি দিন টিকিয়ে রাখা যায় না। সাধারণত দলত্যাগীরা জানিয়ে দেয় আসল সত্যিটা। রঞ্জুর বেলায়ও তাই হবে।

ঠিক কতোক্ষণ পর সে জানে না, আবারো কলিংবেলটা বেজে উঠল। বুঝতে অসুবিধা হলো না কার কাজ এটা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো আবার, দরজার কাছে গিয়ে খুলে দিলো।

‘“আম্মু তো এখনও আসেনি।”

“চিন্তা কোরো না, একটু পরই ফিরে আসবে। ঘরে গিয়ে ওয়েট করো,” আবারো বলতে হলো কথাটা। “বুঝতে পারছে না কেন, তোমার আম্মু যদি জানে আমার ফ্ল্যাটে এসেছে তাহলে খুব রাগ করবে।”

“আম্মু কেন রাগ করবে?”

“কারণ তোমার আম্মু চায় না তুমি আমার ফ্ল্যাটে আসো।”

“তাহলে চলো, আমরা নিচে যাই,” হুট করেই চপলতায় আক্রান্ত হলো বাচ্চাটা। “লেকের সামনে গিয়ে বসি?”

গভীর করে শ্বাস নিলো সে। “তোমার আম্মু চায় না তুমি আমার সঙ্গে কথা বলো।”

“কেন চায় না?”

বাচ্চাদের প্রশ্নের পিঠে প্রশ্নগুলো শুনতে ভালোই লাগে কিন্তু এ মুহূর্তে ভালো লাগছে না তার। যেকোনো মুহূর্তে তার মা চলে এলে ভীষণ রাগ করবে, বাজে একটা ঘটনা ঘটে যাবে। ভদ্রমহিলা ঈদের দু-দিন আগে যখন আবিষ্কার করলো, তার বাচ্চাছেলেটি পাশের ফ্ল্যাটের এক লোকের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছে, ব্যাপারটা সহজভাবে নিতে পারেনি। নিজের ছেলেকে তো নিষেধ করেছেই, এমন কি ঈদের আগের দিন তাকে সরাসরিই বলে দিয়েছে, তার ছেলের সঙ্গে যেন না মেশে।

“তুমি তোমার ঘরে যাও…মা একটু পরই এসে পড়বে, “ যে কাজটা করতে অপছন্দ করে তাই করলো, নিষ্পাপ একটা মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দিলো সে।

ভালো করেই জানে, ছেলেটা তার সঙ্গে কথা বলার জন্য ছুঁতো খুঁজছে। ভীষণ একা থাকে। যতোটুকু শুনেছে, ছেলেটার বাবা নেই। জন্মের পর পরই মারা গেছে। কিভাবে মারা গেছে, বাচ্চাটা জানে না।

একটা ট্রাউজার, টি-শার্ট আর ক্যাপ পরে নিলো, একটু আগে বাইরে থেকে খাবার-দাবার কিনে নিয়ে এলেও ঘরে থাকতে আর ভালো লাগছে না। বাচ্চাটার সাথে অমন আচরণ করায় একটু খারাপ লাগছে, তাই ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

ঢাকার অন্যান্য জায়গার তুলনায় এই সোয়ান লেক সিটি বেশ নিরাপদ। শহরের অনেকেই জানে না এরকম একটি জায়গা আছে। নির্জনতার সাথে সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশও অটুট আছে এখনও। প্রায় দুই মাস আগে অমূল্যবাবু তাকে এখানে নিয়ে আসার দিনই পাশের ফ্ল্যাটের এই হ্যারি পটারের সাথে তার পরিচয়। লোকজন তার ফ্ল্যাটে আসবাবপত্র তোলার সময় দেখতে পায়, অবাক চোখে চেয়ে আছে নয়-দশ বছরের এক বাচ্চা ছেলে। চোখে মোটা কাঁচের চশমা, হাতে ট্যাবটা।

“এখন থেকে তুমি এই ফ্ল্যাটে থাকবে?” কৌতূহলি হয়ে জানতে চেয়েছিল।

বাচ্চাদের কাছ থেকে তুমি সম্বোধন শুনলে তার খুব ভালো লাগে। ছেলেটার দিকে হেসে বলেছিল, “হ্যাঁ।”

“তোমার বেবি নেই? ওয়াইফ নেই?”

“না।”

জবাবটা খুব হতাশ করেছিল ছেলেটাকে। “কেন নেই?”

“কারণ আমি বিয়ে করিনি।”

“কেন করোনি?”

“এমনি।”

“এমনি কেন?”

প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে আবারো হেসে ফেলেছিল সে। “সবাই বিয়ে করে না। কেউ কেউ বিয়ে না করেও থাকে, আমার মতো।”

“না, না। বড় হয়ে গেলে সবাই বিয়ে করে, তারপর তাদের বেবি হয়।”

“তাহলে আমি এখনও বড় হইনি।”

কথাটা শুনে বিস্মিত হয়েছিল বাচ্চাটা। “কিন্তু তুমি তো অ-নে-ক বড়!…ক্যাপ্টেন আমেরিকার মতো।”

এভাবেই তাদের মধ্যে পরিচয়, তারপর খুব দ্রুত সখ্যতা গড়ে ওঠে।

ছেলেটির মা খুব সকালে তাকে স্কুলে দিয়ে চলে যায় অফিসে। দুপুরের দিকে কাজের বুয়া স্কুল থেকে নিয়ে আসে। এরপর সন্ধ্যা পর্যন্ত ট্যাবে গেম খেলে সময় কাটায়। পাশের ফ্ল্যাটে ওঠার পর থেকে বিকেলের দিকে প্রায়ই ছাদে কিংবা সিঁড়িতে মুখ গোমড়া করে বসে থাকতে দেখতো, মন খারাপ কি না জিজ্ঞেস করলে জবাব দিতো, তার কিছুই ভালো লাগছে না। তো একদিন ছেলেটাকে নিয়ে ছাদে যায়, এরপর লেকের ধারে বসে গল্পও করে। দ্রুতই ব্যাপারটা নিত্যদিনকার ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়, স্কুল থেকে ফিরেই তার ঘরে চলে আসতে শুরু করে গল্প করার জন্য। তার সঙ্গে ছেলেটার এই সখ্যতার কথা কাজের বুয়া জানলেও ছেলেটার মা এতোদিন জানতো না। কারণ ছেলেটা তার সঙ্গে সময় কাটানোর ফলে টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখার একচেটিয়া সুযোগ পেয়ে গেছিল মহিলা।

তো, ঈদের দু-দিন আগে ছেলেটার মা অফিস থেকে একটু আগেভাগে চলে এসে যখন ছেলেকে না পেয়ে বুয়ার কাছে জানতে চায়, তখনই জেনে যায় পাশের ফ্ল্যাটে আছে। এরপরই তার কলিংবেলটা বেজে ওঠে। পিপহোল দিয়ে ছেলেটার মায়ের উদ্বিগ্ন মুখ দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল। নিজের সন্তানকে ফ্ল্যাট থেকে নিয়ে যাবার পাঁচ মিনিট পর আবারো তার কলিংবেলটা বেজে ওঠে। দরজা খুলতেই কোনো রকম ভণিতা না করে মহিলা বলে দেয়, সে চায় না তার ছেলে বয়সে বড় কারোর সাথে মিশুক।

কথাটা শুনে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল সে। পরদিন থেকে ছেলেটা আর তার ফ্ল্যাটে আসেনি। কিন্তু আজকে আবার আসার চেষ্টা করছে। ভালো করেই জানে, অতোটুকু বাচ্চাছেলে, জন্মের পর বাবাকে পায়নি, তার মতো একজনের মধ্যে হয়তো ফাদার-ফিগার খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু মহিলা কেন নিজের সন্তানকে তার সঙ্গে মিশতে দিতে চায় না, আন্দাজ করতে কষ্ট হয়নি। অপরিচিত এক লোকের নির্জন ফ্ল্যাটে গিয়ে একটা বাচ্চা আড্ডা দিচ্ছে–এটা মোটেও স্বস্তিদায়ক ব্যাপার না। বয়স্ক লোকজনের হাতে বাচ্চারা নিপীড়নের শিকার হয় হরহামেশাই। সেদিক থেকে দেখলে মহিলা দায়িত্ববান মায়ের মতোই আচরণ করেছে।

নিয়তির নির্মম পরিহাস, মহিলা যদি জানতো বাচ্চাদের সাথে এমন জঘন্য কাজ করাটাকে কী পরিমাণ ঘৃণা করে সে!

অধ্যায় ৪৬

সোয়ান লেক সিটিতে আক্ষরিক অর্থেই একটা লেক আছে।

আদতে ওটা ডোবা ছিল, সেটাকে পরিষ্কার করে লেক বলার কারণটা সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক। আকারে বড়সর লম্বাটে পুকুরের মতো, তবে এখানকার ডেভেলপাররা গালভরা নাম দিয়েছে সোয়ান লেক। নামের প্রতি সুবিচার করে দিনে বেলায় কয়েকটা রাজহাঁসও ঘুরে বেড়ায়।

তার খুব ভালো লাগে এই লেকসাইড রোডটা ধরে হাঁটাহাঁটি করতে। কখনও কখনও মেইন গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়।

এখনও সোয়ান লেক সিটির আশেপাশের এলাকাগুলো ফাঁকাই আছে, খালি প্ৰটগুলোতে জমির মালিক আর রিয়েল-এস্টেট কোম্পানির সাইনবোর্ড পোঁতা। মেইন গেট থেকে যে সুদীর্ঘ রাস্তাটা চলে গেছে, সেটার প্রায় পুরোটাই কাঁচা। সেই রাস্তা ধরেও মাঝেমধ্যে হাঁটে। তবে আজকে ঠিক করলো, লেকসাইড রোডটা কয়েক চক্কর দেবে, বাইরে আর যাবে না।

সোয়ান লেক সিটির বেশিরভাগ বাসিন্দা এখনও গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে আসেনি। একেবারে নিষ্প্রভ লাগছে। ঈদের দুদিন আগে থেকেই পুরো এলাকা ফাঁকা হতে শুরু করে, নইলে লেক-সাইড রোডে কিছু টিনএজার বসে গল্পগুজব করতো নিত্যদিনকার মতো।

এখানে আসার পর সারাটা দিন ঘরে থাকতে থাকতে একঘেয়েমী এসে যায়, তাই বিকেল কিংবা সন্ধ্যার পর একটু বাইরে হাঁটাহাঁটি করে আসে। মেইনগেটের ঠিক কাছেই, এক নাম্বার ভবনের নিচে ছোটোখাটো একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরও আছে, সেখান থেকেই বেশিরভাগ খাবার কেনে সে। কিছুদিন ধরে ইউটিউব দেখে দেখে রান্নাবান্নাও শিখে নিয়েছে। শুরুতে এক মহিলা তাকে রান্না করা খাবার দিয়ে যেত মাসিক চুক্তিতে কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে সেই মহিলার কোনো খোঁজ নেই, ফোনটাও বন্ধ। চাইলে সে অমূল্যবাবুকে এটা জানাতে পারতো কিন্তু ইচ্ছে করেনি। মানুষের কাছ থেকে খুব বেশি অনুগ্রহ নিতে অভ্যস্ত নয়। এমনিতেই লোকটা তার জন্য যথেষ্ট করেছে। ঈদের আগের দিন সোয়ান লেক সিটিতে এসেছিল তার জন্য নতুন জামা-কাপড় নিয়ে। একটু অবাকই হয়েছিল সে, পরে বুঝতে পারে, জামা কাপড় দেবার জন্য আসেনি, আসল উদ্দেশ্য ছিল তার নতুন পরিচয়পত্র দেয়া।

এনআইডি কার্ডটা হাতে নিয়ে মুচকি হেসেছিল সে। নতুন নাম, নতুন পরিচয়, নতুন জন্মদাতা!

“কিন্তু হোমিসাইডে আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট আছে, সেটার কি হবে?” নিজের দুশ্চিন্তাটা প্রকাশ না করে পারেনি।

অমূল্যবাবু এটা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত ছিল না, কেন ছিল না সেটা অবশ্য খুলে বলেনি। তার যততা আশঙ্কা ছিল ব্ল্যাক রঞ্জুকে নিয়ে। ইদানিং রঞ্জুর গ্রুপটা যে ঢাকায় তৎপর হয়ে উঠেছে, সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল।

“তুমি নিশ্চিত, ব্ল্যাক রঞ্জু মরে গেছে?”

অমূল্যবাবুর কাছ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে অবাকই হয়েছিল। জোর দিয়ে বলেছিল, দিল্লিতে নিজের হাতে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে ঐ সন্ত্রাসিকে। ওভাবে আগুনে পোড়ার পর কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। তার পরও বাবু। তাকে সতর্ক থাকার কথা বলেছে। খুব বেশি দরকার না হলে যেন সোয়ান লেক সিটি থেকে বের না হয়। কিছু দিনের মধ্যেই তার নতুন পাসপোর্টের ব্যবস্থা করা হবে। তখন চাইলে যেকোনো সময় দেশের বাইরে যেতে পারবে, ঘরে আর বন্দি হয়ে থাকতে হবে না।

বাবুর কথা শুনে সে কেবল মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল। এই জায়গাটা ঢাকার মধ্যে হলেও খুবই বিচ্ছিন্ন আর নিরিবিলি। মানচিত্রের দিকে তাকালেও বোঝা যাবে, এটা শহরের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত, অনেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার জন্য এ রকম জায়গা বেশ উপযুক্ত।

লেকটা চক্কর দিয়ে আবারো যখন নিজের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের কাছে চলে এলো, দেখতে পেলো এক লোক আক্রমণাত্মক হয়ে হুমকি দিচ্ছে। জায়ানের মাকে। মহিলা চলে যেতে চাইলে লোকটা খপ করে তার হাত ধরে ফেলল, নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো জায়ানের মা কিন্তু পারলো না, শক্ত করে ধরে রেখেছে লোকটা।

“তুই শুনবি না তোর বাপ শুনবো!”

হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো সে, দ্রুত চলে এলো লোকটার পেছনে।

“আমার কথা না শুনলে-”

পেছন থেকে শক্ত হাতে লোকটার কলার ধরেই হ্যাঁচকা টান দিলো সে।

ভয়ঙ্করভাবে চমকে পেছনে তাকালো লোকটা। বিস্ময়ে চোখদুটো গোল গোল হয়ে গেল তার।

“উনাকে ছাড়ুন,” শান্ত গলায় বলল।

লোকটা যেন ভুত দেখছে চোখের সামনে। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।

“ছাড়ুন!” বলেই কলারটা ধরে ঝাঁকুনি দিলো।

জায়ানের মায়ের হাতটা ছেড়ে দিলো হতভম্ব লোকটি।

তার কলার ছেড়ে দিয়ে জায়ানের মায়ের দিকে তাকালো। “আপনি আপনার ফ্ল্যাটে চলে যান।”

মহিলা চুপচাপ সাত নাম্বার ভবনের দিকে পা বাড়ালো।

“ও-ওয় আমার এক্স…” তোতলালো লোকটা।

“এক্স-ওয়াই-জেড যে-ই হোন না কেন, জোর খাটাতে পারেন না।”

“আ-আমার কথা আছে ওর লগে…”

“উনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান না,” নির্বিকারভাবে বলল সে।

লোকটা কিছু না বলে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তার দিকে।

গভীর করে শাস নিয়ে নিলো এবার। “এখানে আর আসবেন না।”

বার কয়েক চোখের পলক ফেলল লোকটা, তারপর আস্তে করে ঘুরে মেইন গেটের দিকে হাঁটা ধরলো। যেতে যেতে পেছন ফিরে তাকালো এক বার। তার চোখেমুখে বিস্ময়।

কিন্তু সাত নাম্বার ভবনের দিকে যাবার সময় সে একবারও পেছন ফিরে তাকালো না।

লিফটের কাছে আসতেই দেখতে পেলো জায়ানের মা দাঁড়িয়ে আছে, চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ, কিছুটা নার্ভাসও। এক হাতের আঙুলের নখ কামড়াচ্ছে।

তাকে আসতে দেখে আরো নার্ভাস হয়ে গেল, কী বলবে ভেবে পেলো না। মহিলা সম্ভবত তাকে ধন্যবাদ জানাতে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাইছে। যদিও এসবের কোনো দরকার নেই।

লিফটের কাছে এসে বোতাম চাপলো। চোখের কোণ দিয়ে দেখলো, মহিলা কথা বলতে চাইলেও পারছে না, দ্বিধায় পড়ে গেছে।

লিফটের দরজা খুলে গেলে চুপচাপ ঢুকে পড়লো ভেতরে, মহিলা জায়গামতোই দাঁড়িয়ে রইলো মাথা নিচু করে। হাতের নখ কামড়ে যাচ্ছে এখনও।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো সে। আপনি কি উপরে যাবেন-প্রশ্নটা করতে গিয়েও করলো না। এমনিতেই পুরুষ মানুষের সঙ্গে একা কোনো মেয়ে লিফটে উঠতে অস্বস্তি বোধ করে, আর এই মহিলাকে দেখে মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড দ্বিধায় পড়ে গেছে। তার দিকে একটু তাকিয়েই আবার চোখ নামিয়ে ফেলল। আস্তে করে লিফটের পাঁচ নাম্বার বোতামটা চেপে দিলো সে।

দরজা বন্ধ হবার আগে দেখতে পেলো, মহিলা তার দিকে তাকিয়ে আছে, সেই দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা।

অধ্যায় ৪৭

খিলক্ষেতের সোয়ান লেক সিটি থেকে বের হয়ে পথের পাশে একটু থামলো রাহিদ হাসান উজ্জ্বল। পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য মোবাইলফোনের স্টোরে থাকা একটা ছবি বের করে দেখলো সে। নাহ্, তার ভুল হয়নি। কয়েক বছর আগের ছবি হলেও এই দুর্ধর্ষ খুনির চেহারায় খুব কমই পরিবর্তন হয়েছে।

“বাস্টার্ড!” দাঁতে দাঁত পিষে বলল। শুয়োরটা এখন ঢাকায়! যতোটুকু শুনেছে, এই খুনি দিল্লিতে গিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছিল রঞ্জুকে।

কিন্তু মরেনি!

বাঁকা হাসি ফুটে উঠল রাহিদ হাসানের ঠোঁটে। ওরকম আগুনে পুড়েও বেঁচে গেছে। অবশ্য পুরো শরীর ঝলসে গেছে, মুখটার কী হাল হয়েছে। এর আগেও বেশ কয়েক বার মরতে মরতে বেঁচে গেছে সে। কই মাছের প্রাণ! মনে মনে বলল। মাঝে মাঝে ভাবে, রঞ্জু বোধহয় কখনও মরবে না!

চোখমুখ বিকৃত করে একদলা থুতু ফেলল রাহিদ হাসান। ভাবা যায়, তার সাবেক স্ত্রী এই বানচোতটার সঙ্গে একই বিল্ডিংয়ে থাকে! নওরিনের সঙ্গে কী সম্পর্ক বাস্টার্ডের? শুধুই পাশাপাশি থাকে তারা?

যদি তা-ই হয় তাহলে বলতেই হবে, তার ভাগ্য ভালো। এসেছিল এক কাজে, দেখা পেয়ে গেল এমন একজনের!

বেশ কিছুদিন ধরে টাকা-পয়সার সঙ্কটে আছে। এসএসবিসি ব্যাঙ্কের চাকরিটা খুইয়েছে, অল্পের জন্য বড় বাঁচা বেঁচে গেছে সে। তবে বড় কোনো প্রতিষ্ঠানে আর চাকরি করতে পারবে না এই জীবনে। ওখানকার অ্যাকাউন্টটাও সিজ করে ফেলেছে কর্তৃপক্ষ। রঞ্জু অবশ্য তাকে মাসোহারা দেয়, পরিমাণটা যে খারাপ তা-ও বলার উপায় নেই। কিন্তু ওই পরিমাণ টাকা যে তার জন্য যথেষ্ট না, সেটা কেমনে বোঝায়?

হোমিসাইডের হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার পর দুইটা সপ্তাহ ঝিম মেরে ছিল, তার পরই অস্থির হয়ে ওঠে। গোপনে এদিক ওদিক যাতায়াত শুরু করে দেয়। অচিরেই বুঝতে পারে, নিজের ব্যাঙ্কের বাইরে অন্য কোনো ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট না করে মস্ত বড় ভুল করেছে। ঈদের আগে দিয়ে তাকে যে টাকা দিয়েছিল, সবটাই জুয়া খেলে শেষ করে ফেলেছে ঈদের দিন রাতে।

রঞ্জু যখন দাপটের সঙ্গে ঢাকায় ছিল তখন বারিধারায় একটা অবৈধ ক্যাসিনো চালাতো তার এক ঘনিষ্ঠ লোককে দিয়ে, ওই ক্যাসিনোর টাকা পয়সার হিসেব রাখার দায়িত্ব দিয়েছিল তাকে। ক্যাসিনোর হিসেব রাখতে গিয়েই জুয়া খেলার অভ্যেস হয়ে যায় তার। এই জুয়া খেলার জন্য নেপাল থাইল্যান্ড আর দুবাই পর্যন্ত চলে যেতো! উদ্দাম যৌনতা, জুয়া আর নানান রকম নেশায় বুঁদ হয়ে না থাকলে সে ডিপ্রেশনে চলে যায়। মনে হয় জীবনটা অর্থহীন। কিছু ভালো লাগে না।

ঢাকায় এখন শত শত অবৈধ ক্যাসিনো গড়ে উঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনির নাকের ডগায়। যারা আইন বানায়, আইনের দেখভাল করে, তারাই এসব ক্যাসিনোর উদ্যোক্তা, ফলে এগুলো শতভাগ নিরাপদ। ঢাকার সর্বোত্তরে, তুরাগ নদীর তীরে ওয়াটার ফ্রন্ট নামের এ রকম এক ক্যাসিনোতে তার নিয়মিত যাতায়াত। ওখানে গেলেই নিজেকে রাজা বলে মনে হয়। ওই ক্যাসিনোতে তাকে প্রথম নিয়ে গেছিল রঞ্জুর বড় ভাই মনোয়ার হোসেন মঞ্জু। শুনেছে, তাকেও নাকি এই বাস্টার্ডই খুন করেছে।

এদিকে সামনে ঈদ, প্রচুর টাকা লাগবে। বিশেষ করে ঈদের ছুটিতে আসা প্রবাসী গ্যাম্বলারদের সঙ্গে খেলতে হবে এক হাত। দশ-বারো বছর ধরে কখনও ঈদের ছুটিতে এটা মিস করেনি। এবার কী হবে ভাবতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল।

টাকার চিন্তায় যখন অস্থির তখনই মনে পড়ে যায়, একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল তার সাবেক স্ত্রীর নামে। টাকা-পয়সার লেনদেনও করতো সে নিজেই, নওরিন কখনও এই অ্যাকাউন্টের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। ওটাতে এখনও বিশ-বাইশ লাখ টাকা আছে। এই দুর্দিনে সেটা যথেষ্ট। কিন্তু সমস্যা হলো, অ্যাকাউন্টটার চেকবই শেষ হয়ে গেছে, আর কার্ডটা যে কোথায় রেখেছে, খুঁজেও পাচ্ছে না। বোধহয় হারিয়েই ফেলেছে। এখন এই অ্যাকাউন্টটার কাগজপত্র তুলতে হলে নওরিনকে লাগবে। এছাড়া আর উপায় নেই। সেজন্যেই সাবেক স্ত্রীকে খুঁজে বের করার জন্য উঠেপড়ে লাগে।

ডিভোর্সের পর একবারের জন্যেও ছেলেকে দেখতে যায়নি। অনেক দিন জায়ানকে দেখে না, তাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে-এমন একটা অজুহাত দেখিয়ে দেখা করবে বলে ঠিক করে কিন্তু সমস্যা হলো নওরিন তার ছেলেকে নিয়ে কোথায় থাকে, সেটাই জানে না। ওর বৃদ্ধ মা চলে গেছে কানাডায় বড় মেয়ের কাছে। শশুড় তো মারা গেছিল তাদের ডিভোর্সেরও আগে।

তখনই মাথায় উঁকি মারে একটা চিন্তা-ফেসবুক। এই জিনিস কে না। ব্যবহার করে এখন? মুদি দোকানি, গার্মেন্টস শ্রমিক, রিক্সাওয়ালা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি। নওরিনেরও আছে, কিন্তু ডিভোর্সের আগেই তাকে সেখান থেকে ব্লক করে দিয়েছিল। এটা অবশ্য বড় কোনো সমস্যা না, নওরিনের অনেক আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধব এখনও তার ফ্রেন্ডলিস্টে রয়ে গেছে।

প্রথমে একটা ফেইক আইডি তৈরি করে নওরিনের আইডিতে ঢোকার চেষ্টা করে দেখে তার প্রোফাইলটা নেই, সম্ভবত ডি-অ্যাক্টিভ করে রেখেছে কিংবা আইডি বদলে ফেলেছে। এরপর তার ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা নওরিনের কিছু বন্ধু-বান্ধবের খোঁজ করে। তাদের বিভিন্ন ওকেশনের পোস্টগুলোতে ট্যু মারে সে বিশেষ করে বিবাহবার্ষিকী কিংবা ছেলে-মেয়ের জন্মদিনগুলোতে। সুহানা নামে নওরিনের এক বান্ধবির বিবাহবার্ষিকীতে অনেকের মতো প্রাপ্তি নামের একটি আইডি থেকেও তাকে উইশ করে-আইডিটার কাভার পিকে তার ছেলে জায়ানের ছবি! বুঝে যায়, এটাই নওরিনের নতুন আইডি। ওয়াল স্ক্রলিং করে করে পেয়ে যায় কয়েকটি ছবির একটি পোস্ট : জায়ান, নওরিন আর সুহানার ছেলেমেয়ে-স্বামীর হাস্যোজ্জ্বল ছবি। কিছুদিন আগে, রোজার সময় ইফতারের দাওয়াত খেতে গেছিল তারা নওরিনের বাসায়। কিন্তু সেখানে কেবল তাদের ছবি আছে। জায়গাটা কোথায় সেটা বোঝার উপায় নেই। উজ্জ্বল তখন একই তারিখে সুহানার আইডি স্ক্রল করে একই ধরণের অনেকগুলো ছবি দেখতে পায়, তার মধ্যে একটা ছিল রাতের বেলায় সুন্দর এক লেকের পাড়ের ছবি। সুহানা তার স্বামী-সন্তান নিয়ে কয়েকটা সেল্ফি তুলেছিল-সম্ভবত ইফতার শেষে চলে যাবার সময়। শুধু ছবিটা থাকলেও নওরিনের খোঁজ পাওয়া সম্ভব হতো না, কিন্তু কমেন্টগুলো দেখতে গিয়ে আবিস্কার করে, একজন প্রশ্ন করছে, ‘আপু এত্ত সুন্দর জায়গা! এটা কোথায়? এই কমেন্টের রিপ্লাই দিয়ে সুহানা বলেছে : ‘সোয়ান লেক সিটি…অসম্ভব সুন্দর জায়গা। আই জাস্ট লাভ ইট!

মুচকি হেসে উঠেছিল উজ্জ্বল। সোয়ান লেক সিটি। গুগলে ব্রাউজ করতেই নতুন এই আবাসিক এলাকাটির অবস্থান জেনে যায়। পরদিন ঈদ ছিল বলে সেখানে আর টু মারেনি, দাওয়াত খেতে যেতে পারের কোথাও। কিংবা বাসায়ও মেহমান আসতে পারে।

সোয়ান লেক সিটিতে ভালো সিকিউরিটি থাকলেও তার জন্য ঢোকাটা ডাল-ভাতের ব্যাপার ছিল। মেইনগেটের সিকিউরিটি যখন জানতে চাইলো কোথায় যাবে, তখন মুহূর্তে নাটকের পরিচালক বনে যায় সে-চমৎকার একটি লোকেশনের খোঁজ দিয়েছে তার অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর, এখন সরেজমিনে এসেছে দেখতে। জায়গাটা ভালোই, শুটিং করা যাবে।

এ কথা শোনার পর হাসিমুখেই সিকিউরিটির লোকজন তাকে ঢুকতে দেয় ভেতরে।

কিন্তু সুহানার সেল্ফি থেকে জায়গাটা খুঁজে পেলেও কোন ভবনের কতো তলায় নওরিন থাকে, সেটা জানতে আরেকটু কষ্ট করতে হয়েছে। সেল্ফিটা দেখে আন্দাজ করে নিতে পেরেছিল, শেষের দিকের কোনো ভবনই হবে। কিন্তু শেষ ভবনের আগেরটায় খালি প্লট দেখতে পায়। অনেকটা আন্দাজ করে সে চলে যায় সাত নাম্বার ভবনের সামনে, দারোয়ানের কাছে গিয়ে জানতে চায়, জায়ানরা কোথায় থাকে তাদের গ্রামের বাড়ির আত্মীয় সে, ঈদের ছুটিতে বেড়াতে এসেছে। জায়ানের মায়ের ফোনটা বন্ধ পাচ্ছে, ফোন করে পাচ্ছে না। এ কথা শুনে দারোয়ান জানায়, এই ভবনের একেবারে উপরতলায় থাকে জায়ানরা, আর ম্যাডাম বিকেলের দিকে বেরিয়ে গেছে, এখনও ফেরেনি। জায়ান আর কাজের মহিলা আছে, ইন্টারকমে ফোন করে বলবে, তাদের আত্মীয় এসেছে?

তার কোনো দরকার নেই, দারোয়ানকে হেসে বলেছিল। ছোট্ট জায়ান তাকে চেনে না, সে বরং অপেক্ষা করবে। লেকের পাড়ে ঘুরে বেড়ায় কিছুক্ষণ, প্রস্রাবের বেগ পেলে খালি প্লটের টিনের বেষ্টনির ফাঁক দিয়ে ঢুকে প্রস্রাব করে নেয়। ওখান থেকে বের হয়েই দেখে, একটা গাড়ি ঢুকছে মেইনগেট দিয়ে। গাড়িটা তার দিকে আসতেই পেছন ফিরে টিনের দিকে মুখ করে রাখে, আড়চোখে দেখে গাড়িটা থেমেছে তার কাছেই, সাত নাম্বার ভবন থেকে একটু দূরে। সেই গাড়ি থেকেই নওরিনকে বের হয়ে আসতে দেখে। তার সাবেক স্ত্রী আনমনা ছিল, কাছেই টিনের বেড়ার সামনে যে সে দাঁড়িয়ে আছে, লক্ষ্য করেনি। গাড়িটা চলে গেলেও নওরিন কয়েক মুহূর্ত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে গাড়িটার দিকে চেয়ে থাকে। তারপর যখন পা বাড়াবে তখনই সে এগিয়ে যায়। তাকে দেখতে পেয়ে ভুত দেখার মতো চমকে গেছিল তার সাবেক স্ত্রী। এরপরই তাদের কথার মাঝখানে এসে বাগড়া দেয় ঐ খুনি।

রঞ্জুকে সে সবচেয়ে দামি উপহারটা দেবে আজ রাতে। তবে ওর নাগাল পাওয়াটা এখন সহজ নয়, অনেক বেশি সতর্ক থাকে। চাইলেও ওর সঙ্গে কেউ দেখা করতে পারে না, কোথায় থাকে সেটাও কম লোকেই জানে। এমনকি ফোনেও হুটহাট কল করা নিষেধ আছে।

তবে তার সঙ্গে এমন একজনের খাতির আছে, যার মাধ্যমে রঞ্জুর কাছে খুব দ্রুতই খবরটা পৌঁছে দেয়া যাবে। পকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করে একটা নাম্বারে কল দিলো সে।

এখানে আর আসবেন না! খানকির পোলা…যাগোরে পাঠামু, পারলে তাগোরে ঠেকাইস।

অধ্যায় ৪৮

নিরবিচ্ছিন্ন সময় কাটাতে সবার মতো ফেসবুকে না, সে বেছে নিয়েছে ইউটিউব। নানা ধরণের কন্টেন্ট আছে ওখানে, সারাদিন দেখলেও ফুরোয় না। তবে সে দেখে বেছে বেছে। তার আগ্রহের সব বিষয়ের উপরে যে সব। ডকুমেন্টারি আছে, সেগুলো। আজকাল সময় কাটানোর সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে উঠেছে এটা। তাই বলে আসক্তির পর্যায়ে যায়নি ব্যাপারটা, সব ধরণের আসক্তি থেকে মুক্ত রেখেছে নিজেকে।

ল্যাপটপট থেকে ইউটিউবে একটা ডকুমেন্টারি দেখে পশ্চিমদিকের ব্যালকনিতে এসে বসলো।

সোয়ান লেক সিটি এখনও অনেকটাই নিরিবিলি। নিচের খোলা জায়গা আর লেকের দিকে ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলো। কয়েক দিন আগে হলেও বিকেল থেকে সন্ধ্যাটা কাটতো জায়ানের সাথে। দশ বছরের এই ছেলে এতো বেশি কথা বলে যে, মাঝেমধ্যে ভাবে, আজকালকার সব বাচ্চা জায়ানের মতো কি না। ছেলেটা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, কথায় কথায় ইংরেজি বলে আর এই বয়সেই সারাক্ষণ ট্যাব নিয়ে পড়ে থাকে। সম্ভবত অল্প বয়সে চোখে মোটা কাঁচের চশমাটার জন্য দায়ি এই স্ক্রিন অ্যাডিকশন। স্কুল থেকে ফিরেই ট্যাব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাকে ট্যাব ছাড়া কখনও দেখেছে বলে মনে পড়ে না। কিন্তু যে বাচ্চাটা সপ্তাহের ছয়দিন দুপুরের পর, স্কুল থেকে ফিরে মাকে কাছে পায় না, কাজের মহিলাই যার একমাত্র সঙ্গি, সে কী নিয়ে ব্যস্ত থাকবে?

জায়ানের মায়াভরা মুখটার দিকে তাকালে মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। কেমন বিষণ্ণ একটা মুখ। অল্পবয়সের একটি বাচ্চা, তার মুখ থাকবে হাসিখুশি। দুষ্টুমি করে জ্বালিয়ে খাবে সবাইকে-অথচ সব সময় ট্যাব নিয়ে পড়ে থাকে, আর খুব কমই তাকে হাসতে দেখা যায়।

এক দিন জায়ান বিষণ্ণ মুখে তাকে বলেছিল, “আমার মতো তোমারও কি কেউ নেই?”

ছোট্ট শিশুর মুখ থেকে এমন কথা শুনে খুব অবাক হয়েছিল সে। “তোমার কেউ নেই মানে?…মামণি আছে না?”

কাঁধ তুলেছিল বাচ্চাটা। “কিন্তু মামণি ছাড়া তো আর কেউ নেই।”

মুচকি হেসেছিল বাবলু। “মা থাকলে আর কী লাগে! মা-ই তো সব।”

“কিন্তু আমার স্কুল ফ্রেন্ডদের আরো অনেকেই আছে…বাবা আছে, চাচ্চু আছে, মামা আছে, কাজিন আছে।”

“হুম,” সায় দিয়েছিল সে। “কিন্তু সবার থাকে না, এটা বুঝতে হবে তোমাকে। এই যে আমাকে দেখো, আমার কেউ আছে?”

গম্ভীর হয়ে বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়েছিল জায়ান। “হুম, তোমারও কেউ নেই।”

হেসে ফেলেছিল সে।

তার ভাবনায় ছেদ পড়লো বিপ্ করে একটা শব্দে। বেডরুমে ঢুকে বিছানার উপর থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। অপরিচিত নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এসেছে। ভুরু কুঁচকে গেল তার। মেসেজটা ওপেন করলো।

থ্যাঙ্কস।

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। তার এই নাম্বারটা আছে মাত্র দু-জনের কাছে-অমূল্যবাবু আর জায়ান। কিন্তু জায়ান তাকে থ্যাঙ্কস দেবে কেন?

এমন সময় আরেকটি ইনকামিং মেসেজ চলে এলো তার ফোনে।

আই ক্যান মিট ইউ!!! মাম্মি সেইড নো প্রবলেম 😊

এবার বুঝতে পারলো, প্রথম এসএমএসটা জায়ানের মা পাঠিয়েছিল ছেলের ট্যাব থেকে।

অধ্যায় ৪৯

সোয়ান লেক সিটি চালু হবার পর একবারই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনি এখানে হানা দিয়েছিল, সেটা অবশ্য কোনো অপরাধীকে ধরতে নয়, বিরোধী দলের মাঝারিগোছের এক নেতাকে গায়েবী মামলায় পাকড়াও করতে এসেছিল। রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল তখন। সেই ঘটনার পর আর কখনও পুলিশ কিংবা র‍্যাবের টহল দল এখানে আসেনি।

কিন্তু আজকে ডিবির একটা মাইক্রোবাস ঢুকতেই মেইনগেটের দারোয়ান ইউনুস মিয়া লম্বা করে স্যালুট ঠুকলো।

গেটের সামনে গাড়িটা থামলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। “গেট খোলো।” ডিবির ভেস্ট পরা ড্রাইভার বলল।

দারোয়ান ইউনুসের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল, কী কারণে তারা এখানে এসেছে। কিন্তু ডিবি-পুলিশের সাথে যতো কম কথা বলা যায় ততই মঙ্গল। এর আগের বার এ রকম প্রশ্ন করে একটা থাপ্পড় জুটেছিল গালে।

গাড়িটা আস্তে করে ঢুকে পড়লো ভেতরে। সাত নাম্বার ভবনের সামনে থামতেই মাইক্রোবাস থেকে নেমে পড়লো তিনজন লোক, তাদের প্রত্যেকের গায়ে খাকি রঙের যে ভেস্টটা আছে, তার পেছনে বড় করে ইংরেজিতে লেখা : ডিবি। একজনের মাথায় সানক্যাপ, আরেকজনের বেশ পুরু গোঁফ। অন্যজন একটু হাল্কা পাতলা শরীরের, মুখে কোনো দাড়ি-গোঁফ নেই। চেহারা দেখলে মনে হয় সব সময় বিরক্ত হয়ে থাকে।

সাত নাম্বার ভবনের দারোয়ান জামিল ডিবির লোকদের দেখে। সিকিউরিটি বক্সের ভেতরে উঠে দাঁড়ালো, ঢোক গিলে সালাম ঠুকলো নিঃশব্দে।

“তুমিই দারোয়ান?” গোঁফওয়ালা একজন জানতে চাইলো। “জি, স্যার।”

“আর কোনো দারোয়ান আছে?”

“না, স্যার। আমি বিকাল থেইকা ভোর পর্যন্ত ডিউটি দেই, অন্যজন সকাল থেইকা বিকালে দেয়।”

“সে এখন কোথায়?”

“ঈদের ছুটিতে দ্যাশে গেছে, আসে নাই এখনও।”

ভবনের মেইনগেটের পাশে যে ছোট গেটটা আছে সেটা দিয়ে ঢুকে পড়লো তিনজন লোক।

“এখানে একজন সন্ত্রাসি থাকে, তাকে ধরতে এসেছি আমরা,” গোঁফওয়ালা বলল গম্ভীর কণ্ঠে।

ভয়ে ঢোক গিলল জামিল।

“সিসিক্যামগুলা কোথায়?” ক্যাপওয়ালা চারপাশে তাকিয়ে জানতে চাইলো।

জামিল দেখিয়ে দিলো মেইনগেটের ভেতরে, বাইরে আর শেষ মাথায় লিফটের সামনে থাকা সিসিক্যামগুলো। ক্যাপওয়ালা সেগুলো দেখে মুচকি হাসলো। পুরনো মডেলের সিসিক্যাম, এখনকারগুলোর মতো না।

“এগুলোর মেশিন…মানে, কম্পিউটারগুলা কোথায়?”

“পিছনে, স্যার।” পার্কিংলটের একেবারে পেছন দিকটা দেখিয়ে বলল।

ক্যাপওয়ালা বাকি দু-জনের দিকে তাকালে তারা মাথা নেড়ে সায় দিলো।

“নওরিন খান কোন্ তলায় থাকে?” গোঁফওয়ালা জানতে চাইলো।

চোখ পিট পিট করে তাকালো জামিল। “ম্যাডাম তো ছয়তলায় থাকেন।”

“কতো নাম্বার ফ্ল্যাট?”

“পাঁচের ডি।”

“ঘণ্টাখানেক আগে নওরিন ম্যাডামের সাথে যে লোকটা ছিল, সে কোন ফ্লোরে থাকে?”

দারোয়ান বুঝতে পারলো না। “ম্যাডাম তো একলাই ঢুকছে, কুনো লোক আছিল না লগে,” সত্যিটাই বলল সে। জায়ানের মাকে ঢুকতে দেখলেও তার পর পর কেউ ঢুকেছে কি না খেয়াল করেনি। সিকিউরিটি বক্সের ভেতরে বসে ইউটিউবে এক হুজুরের ওয়াজ শুনছিল মনোযোগ দিয়ে।

একটু ভেবে নিলো গোঁফওয়ালা। “তার সাথে এই ফ্ল্যাটের কোন্ লোকের খাতির-টাতির বেশি?”

গাল চুলকালো জামিল। “ম্যাডামের লগে তো কাউরে কথা কইতে দেখি না,” এবারও সত্যিটাই বলল। জায়ানের মাকে এখানকার কারো সঙ্গে কখনও কথা বলতে দেখেনি। পুরুষ মানুষের সাথে তো নয়-ই।

গোঁফওয়ালা আর কিছু না বলে লম্বুকে নিয়ে লিফটের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।

“কম্পিউটার রুমের চাবি নিয়ে আসো আমার সঙ্গে,” ক্যাপওয়ালা বলেই ভেতরের দিকে জেনারেটর রাখার ছোট্ট একটা রুমের দিকে চলে গেল। ঐ রুমটার পাশেই, আরেকটা ছোট্ট রুমে একটা মনিটর আর ডেস্কটপ কম্পিউটার আছে। কম্পিউটারের কানেকশান বিচ্ছিন্ন করে দিলো সে।

“কী করেন, স্যার?” জামিল প্রশ্নটা না করে পারলো না। এগুলোর জন্য পরে তাকেই জবাবদিহি করতে হবে।

“আমাদের অপারেশন যাতে রেকর্ড না হয়…” বলল ক্যাপওয়ালা। “আজকাল মানুষজন সব কিছু ফেসবুকে দিয়া দেয়।”

জামিল ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো। এটা অবশ্য সত্যি। গত বছর পাশের ভবনের পলিটিশিয়ান লতিফ সাহেবকে ধরতে এসেছিল পুলিশ, তাকে ধরে নিয়ে যাবার পরই সিসিক্যামের ফুটেজ ফেসবুকে দিয়ে দিয়েছিল তার ছেলেমেয়েরা। তাদের বাবাকে যে ধরে নিয়ে গিয়ে গুম করে ফেলবে না, সেজন্যেই এটা করেছিল তারা।

দারোয়ানের দিকে ফিরলো ক্যাপওয়ালা। “তুমি সিকিউরিটি বক্সে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকো, জায়গা থেকে একদম নড়বে না।”

জামিল ঢোক গিলে চলে গেল। যেতে যেতে পেছনে একটা শব্দ শুনে ফিরে তাকালো, কম্পিউটারের সিপিউটা তুলে নিচ্ছে ডিবির লোকটা।

“এইটা কি নিয়া যাইবেন, স্যার?” দূর থেকেই বলল সে।

“বেশি কথা বলো!” ধমক দিয়ে বলল লোকটা। “মেইনগেটটা খুইলা দাও…গাড়ি ঢুকবো ভিতরে।”

গেটটা খুলে দিতেই বাইরে পার্ক করে রাখা মাইক্রোবাসটা পার্কিং এরিয়ায় ঢুকে পড়লো ব্যাক গিয়ারে। পুরোপুরি না ঢুকে গেটের একটু ভেতরে রাখলো ড্রাইভার। লোকটার সাথে তার চোখাচোখি হলো। ঠোঁটের কোণে সিগারেট চেপে রেখেছে, ইঞ্জিন বন্ধ করে গাড়ি থেকে নেমে এলো সে।

ক্যাপওয়ালা কম্পিউটারের সিপিউটা মাইক্রোবাসে রাখলো।

“কেউ যেন ঢুকতে না পারে এইখানে,” ড্রাইভারকে বলল সে, তারপরই চলে গেল লিফটের দিকে।

ডিবির ড্রাইভার গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো পাহারাদারের ভূমিকায়।

সিকিউরিটি বক্সের ভেতরে বসে জামিল সব দেখতে লাগলো। নওরিন ম্যাডামরে ধরতে আসছে! মনে মনে বলল সে। না জানি কী করছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *