৩০. হাসপাতালে গোলাগুলি

অধ্যায় ৩০

একটু আগে মেডিকক্স হাসপাতালে যে গোলাগুলি হলো সেখানে পান্না কিংবা গোলামের কোনো ভূমিকা ছিল না। বাস্টার্ডও কিছু করেনি।

গুলিগুলো এমন জায়গা থেকে করা হয়েছিল যে, অস্ত্রধারী দু-জন ঘুণাক্ষরেও আশঙ্কা করেনি সেটা।

সবগুলো গুলি করেছে অমূল্যবাবু-বিছানার চাদরের নিচ থেকে!

মেডিকক্স হাসপাতালের কেবিনে পান্না আর তার সহযোগি যখন অস্ত্র হাতে ঢুকে পড়ে, অমূল্যবাবু তখন ভীষণ ভড়কে গেছিল। প্রথমে বুঝতেই পারেনি এরা কারা। পরে যখন বুঝতে পারে এই দু-জনের সঙ্গে বাবলুর পুরনো শত্রুতা রয়েছে তখন নিজেকেই অভিসম্পাত দিতে থাকে সে। তার কারণেই বাবলু এমন ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছে। সে যদি কক্সবাজারে এসে বাবলুকে আত্মগোপন থেকে বের করে আনতে বাধ্য না করতো, তাহলে এমন ঘটনা ঘটতো না।

মেঘনা রিসোর্টের ঘটনার পর সে খোঁজ নিয়ে দেখেছিল, খুলনার কোনো এটিএম বুথ ব্যবহার করে বাবলুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা হয়েছে। বাবলু বেঁচে আছে জেনেই স্বস্তিতে ছিল, বুঝতে পারছিল, কোনো একটা কারণে সে আত্মগোপনে থাকতে চাইছে। ইদানিং ব্ল্যাকরঞ্জুর দলটা সক্রিয় হয়ে ওঠার পর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। খোদ হোমমিনিস্টার ঢাকা ক্লাবের আড্ডায় তাকে জানিয়েছে, রঞ্জু সত্যি সত্যিই ফিরে এসেছে-একাধিক গোয়েন্দা রিপোর্টে এমনটাই দাবি করা হয়েছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে কক্সবাজারে কেন, দেশের কোথাও বাবলু নিরাপদ নয়। কেউ না কেউ তাকে দেখে ফেলবে, চিনে ফেলবে। আর সেই খবর চলে যাবে জায়গামতো। যে কোনো সময় বিপদে পড়ে যাবে সে। তাই অমূল্যবাবু চেয়েছিল তার বর্তমান অবস্থান কক্সবাজারে এসে তাকে খুঁজে বের করে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখবে। এখন পান্না নামের পুরনো এক শত্রুর আগমনে তার সেই আশঙ্কাই সত্যি প্রমানিত হলো।

অমূল্যবাবু বুঝতে পারছিল দু-জন অস্ত্রধারীকে খালি হাতে মোকাবেলা করা বাবলুর পক্ষে অসম্ভব। পান্নার চোখমুখ দেখে সে একদম নিশ্চিত ছিল বাবলুকে খুন করার পাশাপাশি তাকেও হত্যা করা হবে। বাবলুর অসহায়ত্বটা বুঝতে পারছিল ভালো করেই। সদ্যপ্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের চারতলার উপরে একদম নিরিবিলি এক কোণে, ৪১৪ নাম্বার কেবিনটি বিশাল এই ফ্লোরের শেষ মাথায় অবস্থিত। পুরো ফ্লোরে মাত্র দু-তিনজন রোগি ভর্তি আছে। লোকজনের আনাগোণা তেমন একটা নেই। হাসপাতালের এক কর্মকর্তাকে বাবু বলেও দিয়েছিল, তার কেবিনে যেন কেউ না আসে। সুতরাং নিজের ফাঁদে নিজেই পড়ে গেছিল, পান্না আর তার সঙ্গি নির্বিঘ্নে খুন করে সটকে পড়তে পারতো এখান থেকে।

তাদের দুজনের বাঁচার আশা যখন শূণ্যের কোঠায় তখনই আশা আলো দেখতে পায়, সেই সাথে বুঝতে পারে, কেন অসম্ভব প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়েও এই ছেলে বার বার টিকে যায়।

পান্নার সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে বাবলু উঠে দাঁড়ায়, দু-হাত তুলে আত্মসমর্পনের ভঙ্গি করে তার মতো একজন নিরীহ বয়স্ক লোকের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে। উঠে দাঁড়ানোর সময় আস্তে করে টি-শার্টটার প্রান্ত ধরে একটু উপরে তুলে দিয়েছিল সে, ঠিক তখনই দেখতে পায় তার কোমরের পেছনে গুঁজে রাখা পিস্তলটি। বাবলু যে সদাসতর্ক, তার নিত্য সঙ্গি পিস্তল, এটা সে জানতো।

বেডের মাথার কাছে চেয়ার নিয়ে বসেছিল সে, কেবিনের দরজাটা ছিল বেডের বিপরীত দিকে, তবে বেশ খানিকটা ডান দিকে। বাবলু এমনভাবে উঠে দাঁড়ায় যে দরজার সমানে থাকা অস্ত্রধারী দু-জনের কাছ থেকে যেন অমূল্যবাবুকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। আসলে তার উদ্দেশ্য ছিল অন্য কিছু বিছানায় শুয়ে থাকা বাবু যেন হাত বাড়িয়ে খুব সহজেই অস্ত্রধারী দু জনের অগোচরে পিস্তলটা নিয়ে নিতে পারে। বুঝতে পেরে চাদরের নিচ থেকে ডান হাতটা বাড়িয়ে অনায়াসে পিস্তলটা নিয়ে নিয়েছিল।

অস্ত্রধারীদের নজর ছিল বাবলুর দিকে, তার দিক থেকে কোনোরকম বিপদের আশঙ্কাই তারা করেনি। ও যখন পান্নার সঙ্গে কথা বলছিল তখনই সুযোগটা এসে যায়। পিস্তলটা চাদরের নিচে নিয়ে সেফটি লক অফ করে নেয় সে, এরপর অপেক্ষায় থাকে মোক্ষম সময়ের জন্য। সম্ভবত সেফটি লক অফ করার মৃদু শব্দটি বাবলু শুনেছিল। নিশানা করার সুবিধার্থে বাবলু আরেকটু ডানদিকে সরে যায় তখন। অস্ত্রধারীরা মনে করেছিল বাবলু মনেপ্রাণে চাইছে তার দূরসম্পর্কের কাকাকে যেন এরমধ্যে টেনে আনা না হয়, শুধু যেন তাকেই গুলি করা হয়। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তারা বুঝতে পারেনি, কয়েক মুহূর্ত পরই চাদরের নিচ থেকে একজন অসুস্থ বুড়ো মানুষ গুলি করতে শুরু করবে।

বাবলু অবশ্য উপস্থিত বুদ্ধির জোরে স্পষ্ট করেই সংকেতটা দিতে পেরেছিল-ফায়ার।

সঙ্গে সঙ্গে একটা নয় দুটো নয়, পর পর চারটা গুলি করে অমূল্য বাবু। এর দুটো পান্নার তলপেট আর বুকে বিদ্ধ হয়। বাকি দুটো গুলি গোলামের দিকে ছুড়লেও সে লাফিয়ে দরজার বাইরে চলে যেতে পেরেছিল। লাভ হয়নি, পাল্টা গুলি করার আগেই তাকে লক্ষ্য করে আরো দুটো গুলি করে বাবু। একটা ব্যর্থ হলেও অন্যটা গিয়ে লাগে তার গলা আর কাঁধের সংযোগস্থলে। তীব্র যন্ত্রণায় ঝাঁকিয়ে ওঠে অস্ত্রধারী, হাতের পিস্তলটা ছিটকে পড়ে গেলে ক্ষতস্থান হাত দিয়ে চেপে ধরে মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে শুরু করে দেয়।

অমূল্যবাবু অবাক হয়ে দেখতে পায়, বাবলু একটা বালিশ হাতে নিয়ে খোঁড়া পায়েই দ্রুত ছুটে যাচ্ছে গোলামের দিকে, মেঝেতে পড়ে থাকা পান্নার পিস্তলটা তুলে নিয়ে তা করে আহতের দিকে, দরজার কাছে পড়ে থাকা পান্নার তখনও প্রাণবায়ু নির্গত হয়নি, নাক-মুখ দিয়ে রক্তবমি করছিল। বালিশটা পিস্তলের মুখের কাছে চেপে ধরে গোলামকে দুটো গুলি করে সে, তারপর কিছুটা দ্বিধার সাথে পান্নার দিকে ফিরে তাকায়। গুলি করবে কী করবে না এই সিদ্ধান্ত নিতে কেন যে দেরি করেছিল, বাবু জানে না। তারপরই একই কায়দায় মুখে বালিশ চেপে গুলি করে।

একটা।

বাবলুর তিনটা গুলির শব্দ বেশ ভোঁতা শোনালেও হাসপাতালে ততোক্ষণে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেছে। কেউ সাহস করে ৪১৪ নাম্বার কেবিনের দিকে পা বাড়ায়নি। কেবিনের মেঝে আর দরজার বাইরে রক্তের ছড়াছড়ি। দু-দুটো লাশ পড়ে আছে। খুব দ্রুতই বাবলুকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। বালিশের কাভারটা একটানে খুলে ওটা দিয়ে হাতের অস্ত্রটা মুছে ছুঁড়ে মারে পান্নার মৃতদেহের দিকে, তারপর নিজের পিস্তলটা নিয়ে কোমরে খুঁজে নেয়। ততোক্ষণে বাবু বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছে।

“তুমি এক্ষুণি চলে যাও। আমাকে নিয়ে ভেবো না, এখানে আমার লোক আছে। আমি আসছি একটু পর…সব ম্যানেজ করে, তারপর পকেট থেকে ৭০৭-এর চাবিটা বের করে দেয়। “হোটেল ইম্পোরিয়াম…কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে ৭০৭-এ যাচ্ছে, আর কিছু বলার দরকার নেই।”

বাবলু চাবিটা নিয়ে ক্রাচ করে পা টেনে টেনে দরজার বাইরে যেতেই পেছন থেকে ডাক দেয় অমূল্যবাবু। “নিচে ওদের লোক আছে মনে হয়।”

মাথা নেড়ে সায় দেয় বাবলু। এ ব্যাপারে সে সতর্কই ছিল। করিডোর দিয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই দেখে ডান দিকের একটি কেবিনের দরজা ফাঁক করে এক তরুণ মাথা বের করে উঁকি মারছে, গায়ে তার সাদা অ্যাপ্রোন। সে বুঝতে পারে কোনো ইন্টার্ন ডাক্তার হবে। ভয়ার্ত চোখে করিডোরের এ-মাথা ও-মাথা দেখতে উদ্যত। বেচারির কলারটা খপ করে ধরে ফেলে সে।

“অ্যাপ্রোনটা খোলো!” শান্তকণ্ঠে বলেছিল।

ভয়ে কাঁপতে শুরু করছিল ডাক্তার।

বাবলু আর কথা না বলে একটানে শরীর থেকে অ্যাপ্রোনটা খুলে নেয়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটার সময়ই ওটা গায়ে চাপিয়ে সিঁড়ি দিয়ে যখন নামছে তখন সে একজন খোঁড়াপায়ের ডাক্তার বৈ অন্য কিছু না!

তিনতলায় নেমে দেখতে পায় লোকজন তখনও এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। একে ওকে জিজ্ঞেস করছে কোত্থেকে গোলাগুলির শব্দগুলো হয়েছে। দোতলায় এসেও একই দৃশ্য। ওখানে একজন রোগি তাকে দেখে ছুটে আসে।

“হাসপাতালে এইসব কী হইতাছে, ডাক্তরসাব?”

“আপনারা বাইরে কেন?” ধমকের সুরে সে বলে রোগিকে। “সবাই যার যার রুমে থাকুন! পুলিশ আসার আগে কেউ রুম থেকে বের হবেন না।”

রিসেপশনের কাছে এসে দেখতে পায় এক লোক কানে ফোন চেপে বেশ জোরে জোরে পুলিশকে দ্রুত চলে আসতে বলছে।

হাসপাতাল ভবন থেকে বের হয়ে দেখে দুটো প্রাইভেটকার পার্ক করা আছে বাইরের প্রাঙ্গণে। একটির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে চাপদাড়িওয়ালা এক লোক, অন্যটিতে কেউ নেই। সে বুঝে যায় চাপদাড়ির লোকটাই তায়েব। গাড়ির দিকে না তাকিয়ে সোজা মেইনগেটের দিকে পা বাড়ায় সে। তায়েবের পাশ দিয়ে যাবার সময় তাকিয়েও দেখেনি। ঐ গাড়িটার পাশ দিয়ে যেতেই চট করে ঘুরে গাড়ির পেছন দিক দিয়ে চলে আসে বাঁ-দিকের ডাইভিং ডোরের কাছে। তায়েব তখন রিয়ার-মিরর দিয়ে গাড়ির পেছনে যে মেইনগেটটা আছে সেটা দেখার চেষ্টা করছিল। তারপরই ড্রাইভিং ডোরের সামনে তাকে দেখতে পেয়ে ভড়কে যায় লোকটা।

*

এখন সেই তায়েবের পাশেই বসে আছে সে। লোকটার কাঁপতে থাকা হাতদুটো স্টিয়ারিং ধরে রেখেছে অনেক কষ্টে।

“আমি এই হাসপাতালে এসেছি এটা ওরা কিভাবে জানতে পারলো?”

ঢোক গিলল তায়েব। বাস্টার্ডের ডানহাতে পিস্তল। নিচু করে তার দিকেই তাক করা আছে। এই অবস্থায় গুলি করলে মৃত্যু হবার শতভাগ সম্ভাবনা না থাকলেও প্রজনন ক্ষমতা নির্ঘাত বিলোপ হয়ে যাবে।

“ম্‌-মন্টু মিয়া কইছে…” নিজের অপরাধ আড়াল করার জন্য বলল সে। “মন্টু মিয়া মানে?”

“দ্‌-দালাল মন্টু। ঐ যে হোটেলগুলাতে মাইয়ামানুষ সাপ্লাই দেয়…”

ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো বাবলু। একটু সময় লাগলেও বদমাশটাকে চিনতে পারলো। হোটেল বিচ হ্যাঁভেনে ওঠার পর একটা ঘটনা ঘটেছিল ওর সাথে। পাশের রুমে এক মেয়েকে দিয়ে জোর করে দেহব্যবসা করানো হচ্ছিল। মেয়েটির চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ওই রুমের দরজায় টোকা মারে। দু-জন পাণ্ডামতো লোককে দেখতে পায় ঘরে। তাদের সাথে কথা কাটাকাটি হবার পর পাণ্ডা দু-জন ওর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু কয়েক মুহূর্তেই ঐ দু-জনকে ঘায়েল করে ফেলে, মেয়েটাকে নিয়ে চলে আসে নিজের রুমে। আধঘণ্টা পর তার রুমের দরজায় নক করা হয়। দরজা খুলে দেখে হালকা পাতলা মাঝবয়সি এক লোক। মেয়েটার দালাল এই মন্টু মিয়া তাকে অনেক ভয় দেখায়, মেয়েটাকে তার হাতে তুলে দিতে বলে কিন্তু সে রাজি হয়নি। হোটেলের ম্যানেজারও এসে অনেক কাকুতি মিনতি করেছিল। তাদের দু জনকে পিস্তল দেখিয়ে নিবৃত্ত করে সে। ভয়ে লেজ গুটিয়ে চলে যায় তারা। বাবলু আর দেরি না করে মেয়েটার হাতে কিছু টাকা দিয়ে তাকে তুলে দেয় বাসে।

এরপর বিচ হ্যাঁভেন ছেড়ে ওশান কুইনে ওঠে সে। আগেই খোঁজ-খবর নিয়ে জেনে নিয়েছিল, হোটেলের মালিক কক্সবাজারের এক নাম্বার স্মাগলার, এখানে সে দুই নাম্বার আজিজ নামে পরিচিত। খুবই ক্ষমতাবান একজন মানুষ। বাবলুর হিসেব ঠিক ঠিকই মিলে গেছিল। এরপর মন্টু মিয়া ওশান কুইনের গেস্টকে আর ঘাঁটানোর আর সাহস করেনি।

“মন্টুর সাথে পান্নার কি সম্পর্ক?”

আবারো ঢোক গিলল তায়েব। “তা তো আমি কইবার পারুম না।”

বাবলু আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না, তার কোনো দরকারও নেই।

সৈকতসংলগ্ন মেরিন ড্রাইভ নামে পরিচিত হাইওয়ে দিয়ে গাড়িটা ছুটে চলছে। নিরিবিলি এক জায়গায় আসতেই তায়েবকে গাড়ি থামাতে বলল।

“বুঝলাম মন্টু বলেছে কিন্তু সে তো আমাকে চেনে না। আমি কে, পান্নার সাথে আমার কি ঝামেলা, এসবও জানে না। হিসেব মিলছে না, তায়েব ভাই…হিসেবটা মিলিয়ে দিন!”

তায়েব ঢোক গিলল। ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। “আমি জানি …বিশ্বাস করো, বাস্…” মুখ ফসকে বের হয়ে গেল।

তায়েবের কথা একটুও বিশ্বাস করলো না সে। মানুষের বলা মিথ্যেগুলো ধরতে পারে। আপনারা এখানে কবে এসেছেন?”

“কাল রাইতে,” স্টিয়ারিংয়ের উপর রাখা তায়েবের হাতদুটো এখনও কাঁপছে, যদিও গাড়িটা থেমে আছে।

“তাহলে আপনাদেরকে কে খবর দিলো আমি এখানে আছি?”

কোনো জবাব পাওয়া গেল না।

“আপনি কি ওদের সাথেই এসেছেন?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো তায়েব।

মুচকি হাসলো বাবলু। তার স্পষ্ট মনে আছে পান্না অস্ত্র হাতে কেবিনে ঢোকার পর তার সঙ্গিকে কি বলেছিল : তায়েব তো দেখি ঠিকই কইছে…খানকির পোলায় ল্যাংড়া হয়া গেছে। সে যে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, ক্রাচ ব্যবহার করে, এ কথা তায়েব জানে কিন্তু পান্নারা জানতো না। হিসেবটা খুবই সোজা। পান্নাদের সাথে আসেনি তায়েব, সে আগে থেকেই এখানে ছিল। খবরটা পান্নাদেরকে সে-ই দিয়েছে।

“পান্না আর তার সঙ্গের লোকটা মারা গেছে,” আস্তে করে বলল সে। দেখতে পেলো তায়েবের চোখমুখ আরো বেশি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে কথাটা শুনে। “এখন আমি যা জানতে চাইবো, সত্যি সত্যি জবাব দেবেন, মিথ্যে বলবেন না। মিথ্যে বললে এই গাড়িটাই আপনার কবর হয়ে যাবে।”

তায়েব ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো।

“আপনি এখানে কবে এসেছেন?”

প্রশ্নটার জবাব দিতে কয়েক মুহূর্ত সময় নিলো তায়েব। “আমি এহন এইখানেই থাকি।”

ভুরু কুঁচকে গেল বাবলুর। “আপনি এখানে কেন থাকেন?”

“বিজনেস করি।”

“কিসের?”

আবারো ঢোক গিলল। “টেকনাফ থেইকা মাল আনি…ঢাকায় সারাই দেই।”

“কিসের মাল?”

কথাটা বলতে ইতস্তত করলো একটু। “ই-ইয়াবা।”

স্থিরচোখে চেয়ে রইলো বাবলু। সে জানে এই মাদকটির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে দেশে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে। এর প্রধান কেন্দ্র কক্সবাজার টেকনাফ।

“কার থেকে ওসব কেনেন?”

“ব্‌-বইদ্যার লোকজনের কাছ থিকা।”

বাবলু আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না, চুপ মেরে রইলো কয়েক মুহূর্ত। কিছু একটা ভাবলো।

“বিয়ে করেছেন?”

“হ।”

“বাচ্চা-কাচ্চা আছে?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ভয়ার্ত তায়েব। “দ-দুইটা…একটা পোেলা একটা মাইয়া।” আড়ষ্ট কণ্ঠে কথাটা বলার সময় প্রায় কেঁদেই ফেলল সে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল বাস্টার্ড। হাতের পিস্তলটার দিকে তাকালো একবার, তারপর তায়েবের করুণ মুখের দিকে।

অধ্যায় ৩১

হতভম্ব হয়ে রাহিদ হাসান আশেপাশে তাকাচ্ছে।

একটু আগে এসএসবি ব্যাঙ্কের অফিস থেকে হোমিসাইডের ইন্টেরোগেশন রুমে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে। হাতে পলিগ্রাফ মেশিনের সেন্সর লাগানো আছে। হতবিহ্বল হয়ে ওগুলো দেখছে সে। বুঝতে পারছে, বিশাল বিপদে পড়ে গেছে। এই বিপদ আরো বেড়ে যাবে ইমরুল ধরা পড়লে।

জেফরি বেগ হোমিসাইডে আসার পর পর একটু ফ্রেশ হয়ে এক কাপ গরম কফি খেয়ে চলে এলো ইন্টেরোগেশন রুমে, তাকে দেখে রাহিদ হাসান কিছু বলতে গিয়েও বলল না।

“অনেক সুন্দর করে মিথ্যে বলতে পারেন, চেয়ার টেনে বসতেই বলল সে। “আপনি একজন প্যাথলজিক্যাল লায়ার।”

“আ-আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না,” নরম সুরে বলল সন্দেহভাজন।

মুচকি হাসলো জেফরি। “আপনি সবই বুঝতে পারছেন। এখন বলুন, যে লোকটার সাথে রাত দশটার দিকে দেখা হবে, তার নাম কি?”

ঢোক গিলল রাহিদ হাসান, বুঝতে পারছে না কী বলবে।

“ইমরুল…তাই না?” নিজে থেকেই বলল জেফরি। ঐ নাম্বারটা ট্র্যাক করে দেখেছে, এই নামেই ফোনের সিম রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। বৈধ সিম! রর মতো সন্ত্রাসি দলে যেটা বিরল ঘটনা। এখানেই খটকা। রঞ্জুর দলের হয়ে কাজ করলেও এই লোক বৈধ সিম ব্যবহার করে।

মাথা নিচু করে ফেলল এসএসবি ব্যাঙ্কের কর্মকর্তা।

“সে কে?”

কোনো জবাব এলো না। এ প্রশ্নের জবাব তার পক্ষে দেয়া অসম্ভব। প্রাণ খোয়াতে হবে তাহলে।

মুচকি হাসলো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। “আপনি না বললেও সমস্যা নেই, ইমরুল ধরা পড়বে, তখন সে-ই বলবে। আপনি যদি ভেবে থাকেন কথা না বললে বেঁচে যাবেন তাহলে বিরাট বড় ভুল করবেন।”

মুখ তুলে তাকালো রাহিদ হাসান, একেবারে ঘাবড়ে গেছে। তার ধারনা ছিল ম্যানেজার রিশাদ কবীর ব্যাঙ্কের রেপুটেশনের কথা চিন্তা করে তাকে এদের হাতে তুলে দেবে না। সে যা করেছে, তা যদি কোনোভাবে জানাজানি হয়ে যায় তাহলে এসএসবি ব্যাঙ্কের কতো বড় ক্ষতি হবে, কোনো ধারনাই নেই ঐ মাথামোটা লোকটার। পুলিশ কেস হলে মামলা হবে, আদালতে গড়াবে সেটা, সাংবাদিকেরা সবই জেনে যাবে, কোনোভাবেই এটা ধামাচাপা দেয়া যাবে না। তারপরও গর্দভটা তাকে এদের হাতে তুলে দিলো?!

দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তার ব্যাঙ্কিং ক্যারিয়ার শেষ। সম্ভবত দশ-বারো বছরের জেলও হয়ে যেতে পারে।

“বিয়ে করেছেন?”

জেফরির দিকে তাকিয়ে আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।

“বাচ্চা-কাচ্চা ক-জন?”

“এক ছেলে…”

“সম্ভবত আপনার ওয়াইফ জানে আপনি এসবের সাথে জড়িত।”

মুখ তুলে তাকালো রাহিদ হাসান। একটু অবাক দেখাচ্ছে তাকে।

“আমরা জানতে পেরেছি, স্ত্রীর সঙ্গে আপনার ডিভোর্স হয়ে গেছে।”

একটু বিব্রত বোধ করলো রাহিদ হাসান।

“যাই হোক,” বলল জেফরি বেগ। “মনে হচ্ছে, আপনার বন্ধু ইমরুল রঞ্জু গ্রুপে বেশ ভালোমতোই জড়িয়ে আছে, তার সম্পর্কে কিছু বলুন। রঞ্জু গ্রুপে সে কী করে?”

সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো রাহিদ। একটা বিষয় বুঝতে পারছে, আর কোনো কথা না বলাই ভালো। ঘটনা কোন দিকে যায় দেখা যাক। কথা বললে লাভ তো কিছু হবেই না, উল্টো বিপদ বাড়বে। এদের হাতে মার খেলেও এখন আর কিছু বলবে না, যদি না সহ্যের বাইরে চলে যায়।

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন, রেজাল্টও বেশ ভালো ছিল, চমৎকার একটা চাকরি করছিলেন, আপনি এসবের মধ্যে কেন জড়ালেন?”

মাথা নিচু করে রাখলো ব্যাঙ্কার। “আপনি সম্ভবত অ্যাডিক্টেড,” বলল জেফরি। “কীসের নেশা করেন?” ঢোক গিলল রাহিদ হাসান।

“ফেন্সি-ইয়াবা এগুলো খায় হয়তো,” পাশ থেকে আস্তে করে বলল জামান। এতোক্ষণ চুপ করে ছিল সে। “আরো খারাপ অভ্যাস আছে, স্যার।” তার ঠোঁটে বাঁকাহাসি।

ইন্টেরোগেশন টেবিলের ওপাশে বসে থাকা দু-জনের দিকে পালাক্রমে তাকালো রাহিদ। তার মাথা ভন ভন করছে এখন।

“ইমরুল কোথায় আসবে আপনার সঙ্গে দেখা করতে, বলুন?” জানতে চাইলো জেফরি।

জেফরি বেগ ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো লোকটার দিকে। প্রথম দিকে যতোটা নাজুক আর ভঙ্গুর বলে মনে হয়েছিল, আদতে মানুষটা সেরকম নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবি ছাত্র, নামকরা একটি ব্যাঙ্কে বড় পদে চাকরি করেছে দীর্ঘদিন, যথেষ্ট অভিজ্ঞ সে। বয়সও কম হয়নি। এসএসবি ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের রুমে ডেকে আনার পর শুরুতে তাকে যেমন নাভাস আর বিপর্যস্ত লাগছিল, সেটা খুব দ্রুতই কাটিয়ে উঠেছে। এক পর্যায়ে ম্যানেজারকে ভয় দেখানোরও চেষ্টা করেছিল। সেটা ছিল দারুণ একটি চাল। সম্ভবত এখন আবার নতুন কোনো ফন্দি আর্টছে। ইন্টেরোগেশন রুমে নিয়ে আসার পর থেকে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে সে।

“ইমরুল তাহলে রঞ্জু গ্রুপের হোমড়া চোমড়াদের একজন?” কোনো জবাব না পেয়ে তিক্তমুখে মাথা দোলালো জেফরি বেগ, তারপর টেবিলের দিকে ঝুঁকে এলো সে। “আপনাকে সবই বলতে হবে…একটু পর,” কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো, জামানের দিকে ফিরলো এবার। “ইমরুলকে নিয়ে আসার পর দুজনকে একসঙ্গে ইন্টেরোগেট করবো।”

জামান বুঝতে পারলো তার বস কী করবে। দু-জনকে হাতের মুঠোয় পেলে ইন্টেরোগেশনের খেলাটা ভালো খেলা যায়। তখন অপরাধীরাও পড়ে যায় বিপাকে, মনে করে অন্যজন বুঝি সব বলে দিয়েছে। কিংবা কতোটুকু বলেছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে না। খুব সহজেই দু-জনকে এমন ধারনা দেয়া যায় যে, নিজের গা বাঁচাতে অন্যজন তার উপরে দোষ চাপাচ্ছে। এই কৌশলটা বহুল চর্চিত হলেও এখনও বেশ কার্যকর।

জেফরি বেগ ইন্টেরোগেশন রুম থেকে বের হয়ে যেতেই জামানের ইচ্ছে করলো রাহিদ হাসানের গালে কষে কয়েকটা চড় মারে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে সে, ভাবতেও পারছে না এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে রঞ্জুর দলের হয়ে কেউ কাজ করতে পারে!

আস্ত একটা খাটাশ!

অধ্যায় ৩২

এনামুল হক ফ্রন্টডেস্কে চুপচাপ বসে থাকলেও ভেতরে ভেতরে তার মধ্যে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে সেটা কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। তারপরও বার বার হাতঘড়িতে সময় দেখছে বলে ফ্রন্টডেস্কের জুনিয়র এক ছেলে জিজ্ঞেস করে বসলো, আজ ভিআইপি কোনো গেস্ট আসছে কি না। বিদেশ থেকে তার একটা ফোন আসার কথা কিন্তু দেরি হচ্ছে–এই বলে এনামুল এড়িয়ে গেল।

এমন সময় মন্টু মিয়া গটগট করে তাদের সামনে দিয়ে চলে গেল লিফটের দিকে। যাবার সময় এনামুলের সাথে চোখাচোখিও হলো। কক্সবাজারের অনেক হোটেলেই এই লোক এভাবে কাউকে কিছু না বলে যেখানে সেখানে ঢু মারতে পারে। হোটেলের লোকজনের সাথে তার যে দারুণ সুসম্পর্ক রয়েছে, তাদের মধ্যে যে এক ধরণের বোঝাপড়া আছে, সেটা একান্তই গোপনীয় বিষয়। বদ্ধ দরজার ভেতরেই কেবল সম্পর্কটা ভালোমতো টের পাওয়া যায়। প্রকাশ্য দিবোলোকে এর সাথে খাতির রাখার মতো ঝুঁকি ম্যানেজার পদে থাকা লোকজন নিতে চায় না।

এনামুল হক এই লোকটাকে একদমই পছন্দ করে না। মেয়েমানুষের দালালি করা যার কাজ তাকে পছন্দ করার কোনো কারণও নেই, তবে হোটেল ব্যবসায় এদের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায়ও নেই, বিশেষ করে কক্সবাজারের মতো পর্যটন এলাকায়। কে না জানে, ট্যুরিজম দাঁড়িয়ে আছে আনহোলি ট্রিনিটির উপরে : অ্যালকোহল, সেক্স আর গ্যাম্বলিং।

গতকাল রাতে এই হোটেলে মন্টু মিয়ার দুটো মেয়ে কাজ করেছে। অফ সিজন না-হলে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতো কমপক্ষে দশ-বারোজনে। সে এখন এসেছে মেয়েগুলোকে কালেক্ট করতে। কোনো মেয়ে আবার তার অগোচরে নতুন কোনো কাস্টমার ধরে টু-পাইস কামালো কি না সেদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখে সে। এনামুল হক জানে, মন্টু মিয়ার হয়ে কাজ করে তার হোটেলের রুমসার্ভিসের কিছু ছেলেপেলে। আবার এটাও ঠিক, ঝাণু মেয়েগুলোও তাদের কাউকে কাউকে বখরা দিয়ে খেপ মারে। ঘটনা যাই হোক, কোনো মেয়ে যদি এই কাজটা খুব সতর্কতার সাথেও করে, কিভাবে যেন মন্টু মিয়া জেনে যায়। দুর্গন্ধ শোঁকার মতো নাক আছে লোকটার। কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়েই বুঝে যায় সব কিছু।

এনামুল হক যখন এসব ভাবছে তখন দেখতে পেলো আরেকজন লোক তার সামনে দিয়ে একটা ক্রাচ নিয়ে লিফটের দিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লোকটা তার গেস্ট নয়। অফ সিজন বলে গেস্টদের সংখ্যা খুবই কম, তাদের প্রত্যেককেই সে চেনে। তারপরও ফ্রন্টডেস্কে থাকা জুনিয়র এক ছেলের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো, কাঁধ তুলল ছেলেটা। চেনে না, এখানকার গেস্টও নয়।

এনামুল হক নিজেই উঠে চলে গেল লিফটের দিকে। “এক্সকিউজ মি, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”।

“৭০৭-এ,” কথাটা বলেই বাবলু বাটন প্রেস করে দিলো।

৭০৭? দারুণ বিস্মিত হলো এনামুল। তাদের মালিক রুমে নেই। রহস্যজনকভাবে কোথাও উধাও হয়ে গেছেন সকাল সকাল, আর জাতীয় দৈনিকে ভুয়া খবর বেরিয়েছে, গতকাল সন্ধ্যায় তাকে সন্ত্রাসিরা গুলি করেছে, তিনি এখন মেডি কক্স হাসপাতালে ভর্তি। এখন আবার এক ল্যাংড়া এসে তার রুমে যাচ্ছে!

“৭০৭-এর গেস্ট তো এখন রুমে নেই,” বলল এনামুল হক।

পকেট থেকে রুমের চাবিটা বের করে দেখালো বাবলু। “উনি এটা আমাকে দিয়ে বলেছেন সোজা উনার রুমে চলে যেতে, কাউকে কিছু না বলতে। আপনি কি আরো কিছু জানতে চান?”

এনামুল কিছু না বলে চুপচাপ চলে এলো ফ্রন্টডেস্কে। এসব কী হচ্ছে! মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না সে। তবে এটা বুঝতে পারছে, যা হচ্ছে। ভালো হচ্ছে না। সে কি কোনো ভুল করলো? এক পঙ্গু লোক এসে ৭০৭-এর চাবি দেখালো আর সে চুপচাপ চলে এলো এখানে! এমনও তো হতে পারে, তাদের মালিককে ঘায়েল করে, তাকে আটকে রেখে কোনো দুবৃত্ত তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে চলে এসেছে হোটেলে? হয়তো বাবুর রুমে মূল্যবান কিছু আছে…হাতিয়ে নিতে চাইছে? হতে পারে না?

অধ্যায় ৩৩

লিফটের দরজাটা খুলতেই চমকে গেল বাবলুর।

তার চেয়েও বেশি চমকে গেল মন্টু মিয়া। লিফটের সামনে অপেক্ষা করছিল সে, দরজা খুলতেই বরফের মতো জমে গেল, যেন ভুত দেখছে। তারপরই সম্বিত ফিরে পেয়ে চট করে ঘুরে উল্টো দিকে হনহন করে হাঁটা শুরু করলো, কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারলো না, পায়ের সঙ্গে কিছু একটা লেগে হুড়মুড় করে টাইলসের ফ্লোরে পড়ে গেল। উঠে দাঁড়ানোর আগেই বাবলু লিফটের বাইরে এসে পিস্তল তাক্‌ করলো তার দিকে।

“একদম নড়বি না!” শান্তকণ্ঠে বলল। তার ক্রাচটা পড়ে আছে একটু দূরে। মন্টু মিয়া দৌড় দিতেই ওটা ছুঁড়ে মেরেছে তার পা লক্ষ্য করে ওটার সাথে বাড়ি লেগেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে লোকটা।

ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মন্টু। তার মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরলেও কোনো জবাব পাচ্ছে না। এই বদমাশটা বাঁচলো কী করে? তিনজন লোক অস্ত্র নিয়েও একে মারতে পারলো না! এই লোক কি তাকে ধরার জন্যই এখানে এসেছে? লোকটা তো এই হোটেলে থাকে না, অন্য একটা হোটেলের গেস্ট! তার কথা সে জানলো কী করে!

“আমি কিছু করি নাই…” মন্টু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল।

“চুপ!” ধমক দিলো বাবলু। “একটা কথাও বলবি না। উঠে দাঁড়া।”

“ভাই, আমারে মাইরেন না…মাইরেন না…” দু-হাত জোর করে বলল মন্টু। “তায়েব…তায়েব আমারে জোর কইরা…”

“উঠে দাঁড়া! একদম চুপ।”

“হ্যান্ডস আপ!” কারোর চিৎকারে প্রকম্পিত হলো ফাঁকা হলওয়েটা।

বাবলু বিস্মিত হয়ে পেছন ফিরে দেখলো একটু আগে লিফটের সামনে এই লোকটিই তার কাছে জানতে চেয়েছিল সে কোথায় যাচ্ছে,।

“পিস্তলটা ফ্লোরে রাখেন!” বেশ জোর দিয়ে বলল ম্যানেজার এনামুল হক। “আস্তে আস্তে! উল্টা-পাল্টা কিছু করলেই গুলি করবো!”

লোকটার কথা আমলেই নিলো না বাবলু, পেছনে ফিরে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কেবল।

“যা বলছি করেন! নইলে কিন্তু গুলি করবো আমি!”

“আপনি আমাকে গুলি করবেন?” বেশ শান্তকণ্ঠে জানতে চাইলো বাবলু। তার চোখেমুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই, বরং ঠোঁটে প্রচ্ছন্ন হাসি।

এনামুল হক কোনো জবাব দিলো না, একটু নার্ভাস দেখাচ্ছে তাকে। পিস্তল ধরে রাখা হাতটি রীতিমতো কাঁপছে।

“জীবনে কখনও গুলি করেছেন?”

ভ্যাবাচ্যকা খেলো ম্যানেজার। পিস্তলের মুখে কেউ এতোটা স্বাভাবিক থাকতে পারে জানা ছিল না তার। “একদম চুপ!” নিজের দুর্বলতা আড়াল করার জন্য বেশ চেঁচিয়েই বলল। “বললাম না, পিস্তলটা ফ্লোরে রাখতে!”

“আর যদি না রাখি, গুলি করবেন আমাকে?”

“গুলি করবো মানে?!…মাথা উড়িয়ে দেবো! বৃ-বুক ঝাঁঝড়া করে দেবো?”

ম্যানেজারকে অবাক করে দিয়ে মুচকি হেসে পিস্তলটা কোমরে খুঁজে রাখলো বাবলু, তারপর লোকটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, “ওটা নামিয়ে রাখুন। মনে হয় না জীবনে কখনও গুলি করেছেন।”

এনামুল রীতিমতো অপমানিত বোধ করলো। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি নিশ্চয় গভীর জলের মাছ হবে। কোনো দাগি আসামি? সন্ত্রাসি?

“ওটা কোমরে গুঁজে রাখুন, নইলে আপনার গেস্টরা দেখে ফেললে ভয় পেয়ে যাবে।”

এনামুল হক তারপরও তা করে রাখলো অস্ত্রটি।

“সেফটি ক্যাচ অফ করে রাখলে গুলি করবেন কিভাবে?”

এনামুল তড়িঘড়ি করে যে-ই না পিস্তলের সেফটি ক্যাচটা অন করতে যাবে অমনি তার হাতটা খপ করে ধরে একটা মোচড় মেরে পিস্তলটা ছিনিয়ে নিলো বাবলু।

চোখের নিমেষে পিস্তলটা বেহাত হয়ে যাবার পর এনামুল হক ভড়কে গেল। শান্ত ভঙ্গিতে পিস্তলটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো বাবলু।

ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে থেকে স্রিয়মান কণ্ঠে জানতে চাইলে ম্যানজোর, “৭০৭-এর গেস্টের কী অবস্থা? উনি এখন কোথায়?”

“চলে আসবেন এখনই।” স্বাভাবিক কণ্ঠেই জবাব দিলো বাবলু।

“আ-আমি কিভাবে এ কথা বিশ্বাস করবো? আ-আপনি তো মিথ্যেও বলতে পারেন?”

“উনার রুমের চাবি আছে আমার কাছে।”

“স্-সেটা তো উনার কাছ থেকে জোর করেও নিতে পারেন, পারেন?”

ভুরু কুঁচকে তাকালো বাবলু, তারপর আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, “সেজন্যেই তো বলছি, একটু অপেক্ষা করুন। উনি চলে এলেই সব বুঝতে পারবেন।”

ম্যানেজার ঢোক গিলল। এখনও নিশ্চিত হতে পারছে না এই লোকের কথা বিশ্বাস করবে কি না। “এ-এই লোককে কেন মারতে চাচ্ছিলেন?” মেঝেতে পড়ে থাকা মন্টু মিয়াকে দেখিয়ে বলল।

দালালটার দিকে তাকালো বাবলু। “একে ধরার কোনো ইচ্ছে ছিল …সামনে পড়ে গেল, সে-ও দৌড় দিলো, তাই…” কথাটা আর শেষ করলো না।

“কী সমস্যা?”

ম্যানেজার চমকে পেছন ফিরে দেখতে পেলো অমূল্যবাবু এইমাত্র লিফট থেকে বের হয়ে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে ধীরপায়ে।

“স্যার!”

“এটা কে?” মন্টুর দিকে ইশারা করে জানতে চাইলো বাবু।

“এই লোক এসকর্ট বিজনেস করে। ও-ই পান্নাদের খবর দিয়েছে আমি কোন্ হোটেলে উঠেছি, হাসপাতালে কখন গেছি,” বলল বাবলু।

এবার ম্যানেজারের দিকে ফিরে তাকালো অমূল্যবাবু, তার চোখেমুখে বিস্ময়।

কাচুমাচু খেলো এনামুল হক। “ইয়ে মানে…স্যার…”

অসন্তুষ্ট হয়ে মাথা দোলালো বাবু। “ঠিক আছে, আপনি এখন ওকে একটা রুমে আটকে রাখুন, আমরা চলে যাবার পর ছেড়ে দেবেন।”

এমন কথা শুনে ম্যানেজার অবাক হলেও আর কোনো প্রশ্ন করলো না।

“আমি, কুনো খবর দিমু না, ছার…বিশ্বাস করেন, কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল মন্টু মিয়া।

লোকটাকে উঠে দাঁড়াতে ইশারা করলো ম্যানেজার।

“ছার, মাফ কইরা দেন। আর জীবনে এমুন কাজ করুম না,” উঠে দাঁড়িয়ে দু-হাত জোর করে বলল সে।

“আহ, চুপ করো তো,” বিরক্ত হয়ে বলল ম্যানেজার। আশ্বস্ত করার ইশারাও করলো, তারপর লোকটাকে নিয়ে লিফটের দিকে পা বাড়ালো সে।

৭০৭ নম্বার রুমে ঢুকে একটি সিঙ্গেল সোফায় বসে রইলো বাবলু। তার হাতে এখনও পিস্তল। “হাসপাতালের কী অবস্থা?”

“লাশ দুটো নিয়ে একটু ঝামেলা হয়ে গেছিল,” আস্তে করে বলল অমূল্যবাবু। “তবে ম্যানেজ করা গেছে।”

বাস্টার্ড আর এ নিয়ে কিছু জানতে চাইলো না। এই লোকের ক্ষমতা সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত আছে। দু-জন অস্ত্রধারী হাসপাতালে গিয়েছিল তাকে হত্যা করতে। দু-জনেই মারা গেছে। যেহেতু বাবুর লাইসেন্স করা পিস্তল নেই, তাই এমন দাবি করতে পারবে না যে, জীবন বাঁচাতে নিজের অস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করেছে ওদেরকে।

“ওরা-ই আমার কাছে চাঁদা চেয়েছিল…গুলি করেছিল,” আস্তে করে বলল অমূল্য বাবু।

প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকালো বাস্টার্ড। এই লোক কম কথা বলে, আরো কম দিয়ে থাকে সাফাই কিংবা ব্যাখ্যা। জবাবদিহিতার তো প্রশ্নই ওঠে না।

“ওদের প্রতিপক্ষ জানতো আমাকে মারতে আসবে…ওরা ওৎ পেতে ছিল, মেরেটেরে চলে গেছে হাসপাতাল থেকে।”

মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড। গল্প হিসেবে নিখুঁত। ক্ৰশফায়ারের গপ্পোর মতো বালখিল্য না। হয়তো অনেক ফাঁকফোকর আছে এতে কিন্তু তাতে কোনো সমস্যা নেই, ঘাটতিটুকু পুষিয়ে দেবে বাবুর ক্ষমতাবান বন্ধুবান্ধবেরা।

“ভাগ্যিস, পিস্তলটা সঙ্গে রেখেছিলে।”

সত্যি বলতে, পিস্তল না থাকলে অসহায় বোধ করে বলে খুলনা থেকে মৃদুলের পিস্তলটা নিয়ে এসেছিল কক্সবাজারে। তবে ওটা নিয়ে কখনও রুমের বাইরে যায়নি, দরকারও পড়েনি। অমূল্যবাবু এখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে আছে বলে তাকে দেখতে যাবার সময় বাড়তি সতর্কতার অংশ হিসেবে পিস্তলটা সঙ্গে করে নিয়ে গেছিল।

“দুপুরের ফ্লাইট চলে গেছে, আমরা সন্ধ্যেরটা ধরতে পারি।”

হাতের পিস্তলটার দিকে ইঙ্গিত করলো সে। “প্লেনে করে গেলে এটা কিভাবে নেবো?”

“ম্যানেজার ওটা ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারবে, তাকে আশ্বস্ত করে বলল বাবু। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “এবার তোমাকে বিদেশে যেতেই হবে। ঢাকা তোমার জন্য নিরাপদ হবে না।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো বাবলু।

“হোমিসাইডের ঐ জেফরি বেগের কথা বলছি না…ব্ল্যাক রঞ্জু ফিরে এসেছে ঢাকায়।”

মাথা দোলালো তৌফিক আহমেদ বাবলু, যে কি না নিজের হাতে ঐ সন্ত্রাসিকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে দিল্লিতে। “রঞ্জু মরে গেছে…ওর নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে।”

“শুধু চাঁদাবাজি না, খুনখারাবিও করছে অনেক।”

ভুরু কুঁচকে গেল বাবলুর। “আপনিও বিশ্বাস করেন রঞ্জু বেঁচে আছে?!”

অস্বস্তিকর প্রশ্নটা শুনে অমূল্যবাবু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “গোয়েন্দা সংস্থার কাছে খবর আছে, রঞ্জু বেঁচে আছে।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো বাবলু। “পাসপোর্টগুলো এক্সপায়ার্ড হয়ে গেছে,” অবশেষে বলল সে। “ওগুলো মেশিন রিডেল না। আর এখন পাসপোর্ট করাতে এনআইডি কার্ড লাগে, আমার সেটা নেই।”

“দেখি, কী করা যায়,” গম্ভীর হয়ে বলল।

“আমি একটু আসছি…ঘণ্টাখানেক লাগবে,” উঠে দাঁড়ালো বাবলু।

“কোথায় যাবে?”

“আমার রুমে দরকারি কিছু জিনিসপত্র আছে।” লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল। ভালো করেই জানে, এই লোক মিথ্যে কথা ধরে ফেলতে পারে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অমূল্যবাবু। মিথ্যেটা আসলেই ধরে ফেলেছে। তবে এ নিয়ে আর কিছু বলল না। “সাবধান…বাইরে ওদের লোক থাকতে পারে।”

অধ্যায় ৩৪

চোখ বন্ধ করে বার কয়েক নিশ্বাস নিয়ে নিলো অমূল্য বাবু।

প্রাচীন ভারতীয় যোগীরা বিশ্বাস করতো নিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করার মধ্য দিয়ে অসাধ্য সাধন করা যায়। যৌবনকাল থেকেই বাবু এটা করে আসছে। আর এটা যখন করে, চিন্তাভাবনার উথাল-পাতাল সমুদ্রের জল কাঁচের মতো স্বচ্ছ আর স্থির হয়ে যায়।

আজকের মতো ঘটনা আবারো ঘটবে। বাবল যতদিন বেঁচে থাকবে ততোদিনই এমন ঘটনা ঘটতে থাকবে। এটা থামবে না কখনও। ওর ঝাবিক্ষুব্ধ, রক্তাক্ত অতীত, অসংখ্য হত্যা, অগণিত শত্রু, সব সময় ওকে তাড়িয়ে বেড়াবে। এই সত্যিটা বাবলুও জানে, তার পরও সে কখনও দেশ ছাড়তে চায় না। এ দেশের লক্ষ-লক্ষ মানুষের মতো উন্নত বিশ্বে গিয়ে নিজের নিরাপদ আর আরাম-আয়েশের স্বপ্ন দেখে না সে। এই নোংরা আর দূষিত শহর, শতচ্ছিন্ন আইনের দেশ, বিশৃঙ্খলতার মধ্যেই থাকতে চায়।

নাড়ির টান?

অদেখা বাবা-মায়ের দেশ?

অব্যাখ্যাত এক ভালোবাসা?

অমূল্যবাবু জানে না। এদিক থেকে দেখলে ছেলেটা ঠিক তার মতোই হয়েছে। কিন্তু দেবদূতের মতো দেখতে এই ছেলেটা তার নিজের সন্তান নয়।

তার সন্তান থাকলে কি এমনই হতো?

মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলল বাবু। সংসার-সন্তান, এসবের চিন্তা তাকে বিব্রত করে। আবারো মনোযোগ ফেরালো বাবলুর ভবিষ্যত ভাবনায়।

ছেলেটার মধ্যে অদ্ভুত কিছু ব্যাপার আছে। যেভাবেই হোক মৃত্যুর মুখ। থেকে ফিরে আসতে পারে। মৃত্যুর সাথে কানামাছি খেলেই ওর এতোদূর আসা। যেন প্রতিটি ক্ষণ মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে বেঁচে আছে। সেজন্যেই তার মধ্যে একটা বেপরোয়া মনোভাব কাজ করে। কিন্তু সেটা তার সদা-সতর্ক চরিত্রের আড়ালে ঢেকে থাকে সব সময়।

আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো অমূল্যবাবু, ব্যালকনিতে গিয়ে তাকালো বিশাল জলরাশির দিকে। চকচকে রোদের কারণে সমুদ্রটা চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।

এই দেশে যেখানেই যাক না কেন, বাবলু নিরাপদে থাকতে পারবে না। এমন নয় যে, পুরনো শত্রুরা ওকে হন্যে হয়ে খুঁজে বের করবে। ছোট্ট আয়তনের বিশাল জনসংখ্যার এই ঘনবসতির দেশে সেটা করার দরকারও পড়বে না, এমনিতেই দেখা হয়ে যাবে অতীতের কোনো না কোনো প্রতিপক্ষের সঙ্গে। কতোবার মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে পারবে সে? কতোবার ভাগ্য তার পক্ষে থাকবে?

সব সময় না!

বিস্তৃত সমুদ্রের দিকে চেয়ে থেকে অমূল্যবাবু ভাবতে লাগলো, কিছু একটা করতে হবে। বাবলু যেন বাকি জীবনটা নির্বিঘ্নে কাটিয়ে দিতে পারে তার একটা ব্যবস্থা করতে হবে তাকে। এজন্যে সবার আগে দরকার ওর একটা ভিন্ন পরিচয়। বর্তমান সময়ে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ন্যাশনাল আইডি কার্ড আছে, আর ওটাই হবে ওর নতুন পরিচয়ের প্রথম ভিত্তি। এটা করা খুব বেশি কষ্টকরও নয়। বজ্র আঁটুনি ফস্কে গেঁড়ো প্রবাদটি সত্যি প্রমান করে দিয়ে, ন্যাশনাল আইডেন্টি কার্ডের প্রক্রিয়াটি হাস্যকররকমভাবেই অরক্ষিত। টাকা পেলে তারা মিয়ানমারের উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদেরও আইডিকার্ড বানিয়ে দেয়। পরিহাসের বিষয় হলো, এ দেশে সত্যিকারের নাগরিকেরাই বেশি হেনস্তার স্বীকার হয়। এনআইডি কার্ডের তথ্য ভুল করে সরকারি প্রতিষ্ঠান, আর সেটার খেসারত দিতে হয় কার্ডের মালিককে! অদ্ভুত এই নিয়মটাকে আজ পর্যন্ত কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি। মাঝে মাঝে সে ভাবে, এ দেশের সত্যিকারের সচেতন জনগোষ্ঠী বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আদৌ আছে কি না। এমন সিস্টেম যে দেশে, সেখানে একটা এনআইডি কার্ড বানিয়ে দেয়া কী এমন কঠিন কাজ?

কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। হোমিসাইডের ডেটাবেইজে বাবলুর ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংরক্ষণ করা আছে। ফলে নতুন পরিচয় কি ঐ ইনভেস্টিগেটরের হাত থেকে ওকে বাঁচাতে পারবে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারলো না। ঠিক করলো, এই বিষয়টা নিয়ে বিশ্বস্ত এক আইনজীবির সঙ্গে কথা বলবে।

দূর সমুদ্রের দিকে আর তাকিয়ে নেই অমূল্য বাবু, চোখ বন্ধ করে ধীরগতিতে নিশ্বাস নিচ্ছে এখন। সবার আগে বাবলুর জন্য নিরাপদ একটি আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে-যতোদিন না নতুন পরিচয়টি হচ্ছে।

তারপরও কি বাঁচতে পারবে ছেলেটা?

নির্মম সত্যিটা সে জানে : বাবলু ততোদিনই টিকে থাকবে, যতোদিন নিজের পথে থাকবে। আজীবন শত্রুর সঙ্গে লড়াই করেই বাঁচতে হবে তাকে এই লড়াইয়ে প্রতিটি বিজয় তাকে বাঁচিয়ে রাখবে কিছুদিনের জন্য। এটাই তার নিয়তি।

অধ্যায় ৩৫

অফ-সিজনে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতটি অনেক বেশি সুন্দর হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রতিটি সৌন্দর্যের পেছনে থাকে যন্ত্রণা, সেই নিয়ম মেনে এই সৌন্দর্যও আসে ফোক্কানদেরকে অভাবের মধ্যে নিপতিত করে দিয়ে।

জীর্ণ শরীরের কিছু ফোক্কান এখনও সৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ডাব নিয়ে। বালুকাবেলায় এখন পর্যটকের সংখ্যা হাতেগোনা। সৈকতে যে ছাতাগুলো আছে, তার প্রায় সবগুলোই গোটানো। সেইসব ছাতার নিচে কাঠের ‘কাউচ’গুলো স্তূপ করে জড়ো করে রাখা হয়েছে। তারপরও পেটের দায়ে তিন-চারজন ফোক্কান ঘুরে বেড়াচ্ছে সৈকতে। সারাদিন রোদে পুড়ে, বালুর উপরে হেঁটে বেড়িয়ে একেকজন বড়জোর চার-পাঁচটা ডাব বিক্রি করতে পারবে, তা-ও সিজনের চেয়ে অনেক কম দামে।

অমূল্য বাবুকে হোটেলে রেখে বাবলু কোনো অটো না নিয়ে সোজা চলে এসেছে প্রায় নির্জন সৈকতে। এক বাইকঅলাকে দেখতে পেলো সে, নিজের বাইক নিয়ে সৈকতে ছুটে বেড়াচ্ছে পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য। ছেলেটাকে ইশারায় ডাকলো। এর আগেও তার বাইকে করে দরিয়া নগরের জেলেপল্লীতে গেছে। একুশ-বাইশ বছরের ছেলেটা তাকে পেছনের সিটে বসিয়ে ছুটে চলল সৈকতের বালির উপর দিয়ে।

কক্সবাজার ছাড়ার আগে ফোক্কানদের সঙ্গে দেখা করা দরকার। যেতে যেতে সমুদ্র আর সৈকতের দিকে ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলো সে। ঢেউয়ের মতোই আছড়ে পড়তে শুরু করলো কিছু স্মৃতি।

মেঘনা রিসোর্টের ঘটনাটি না ঘটলে হয়তো কক্সবাজারে এসে এতোদিন থাকতো না, ফোক্কানদের সঙ্গেও দেখা হতো না। খুব বেশিদিন আগের নয়, স্মৃতিতে এখনও টাটকা। জেফরি বেগের সহকারির হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে কটেজের লেকে পড়ে যায় সে, তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল তখন, রিসোর্টের সমস্ত পানি গিয়ে লেকের মধ্যে পড়ার কারণে স্রোতের সৃষ্টি হয়েছিল, স্রোতের সেই পানি গিয়ে পড়ছিল মেঘনা নদীতে, তাই লেকে পড়তেই ভেসে যায়। দক্ষ সাঁতারুদের মতো আহত শরীরটা পানিতে ভাসিয়ে রাখতে পেরেছিল সে। লেক থেকে মেঘনা নদীতে গিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু সাঁতরে নদীর তীরের বাঁশঝাড়ে উঠে আসে। পকেট থেকে রুমাল বের করে পায়ের ক্ষতস্থানে বেঁধে একটু জিরিয়ে নেয়। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে ঝোঁপঝাঁড় ডিঙিয়ে একটা খেতিজমি পেরোয়, তারপরই চলে আসে মেইনরোডে। বাসের কন্ডাক্টররকে বলেছিল, মোটরসাইকেল অ্যাকসিডেন্ট করেছে।

মোহাম্মদপুরে বাচ্চুর গ্যারাজে যখন যায়, ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। তাকে দেখে খুব অবাক হয়েছিল মেকানিক। দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল না ওর সঙ্গে। এই বাচ্চুর আপন মামা হলেন বাবলুর বাবার বন্ধু, জিলানী ডাক্তার। বয়স হয়ে গেছে লোকটার, আগের মতো আর রোগি দেখেন না, অবসর সময় কাটান। বাড়ির সামনের ডিসপেন্সারিটা এখন বড়সর ক্লিনিক, এমবিবিএস পাস করা ছেলে ওটা চালায়। সেই ক্লিনিকে যাওয়া যাবে না। ভালো করেই জানতো, জেফরি বেগ তার লাশ না পেয়ে অনেক জায়গায়ই চুঁ মারবে, খোঁজ করবে, তার মধ্যে জিলানী ডাক্তারের বাড়িও থাকবে।

ভাইগ্নার কাছ থেকে ফোন পেয়ে একটু অবাক হয়েছিল ডাক্তার। “ভাইজানে তো অ্যাকসিডেন্ট করছে…সীসা ঢুকছে পায়ে।”

এ কথা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ মেরে যান জিলানী ডাক্তার। “তর ভাইরে ফোনটা দে…দেহি কুন ভাই পয়দা করলি রাইতে রাইতে!”

বয়স হলেও ডাক্তারের রসবোধ কমেনি। বাচ্চুর কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে কথা বলে সে। “স্লামালেকুম, চাচা…কেমন আছেন?”

“বাবুলের পোলা…” অস্কুটস্বরে বলেছিলেন জিলানী ডাক্তার। “ইটু আগে জিনজিরা থানা থেইকা পুলিশ আইছিল আমার ক্লিনিকে, তল্লাশি কইরা গেছে। তোমার কথা জিগাইলো, কইলাম, তুমি হেই যে গ্যাছো আর আহো। নাই!…কই আছো তা-ও জানি না। মিছা তো কই নাই, নাকি?”

মুচকি হাসি ফুটে উঠেছিল তার ঠোঁটে। “না, একদম সত্যি বলেছেন।”

“এইবার পায়ে খাইছো?”

“হুম।”

“বার বার কইলাম হাতে-পায়ে খাইবা না,” অশুভ কথাটা অবশ্য বলেননি তিনি। “দ্যাখতাছি কী করন যায়।”

দশ-পনেরো মিনিট পর ফোন দিয়ে জানিয়ে দেন কী করতে হবে। তারপরই বাচ্চু তাকে নিয়ে যায় মোহাম্মদপুরে একটি ক্লিনিকে, ঐদিন রাতেই তার পায়ে অপারেশন করা হয়। ক্লিনিকের ডাক্তার কোনো প্রশ্নই করেনি। এক সপ্তাহ সেই ক্লিনিকে থাকার পর পাসপোর্ট আর কিছু জরুরি কাগজপত্র গোপন জায়গা থেকে নিয়ে চলে যায় খুলনায়, মৃণালের বাড়িতে। ঢাকা ছাড়ার আগেই ওর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছিল। অনেক দিন পর তাকে পেয়ে ছেলেটা খুব খুশি হয়। মৃণাল এখন এলাকায় সারের ডিলার শিপ নিয়েছে, আয়রোজগার ভালোই। ওর ওখানে দুটো সপ্তাহ কাটানোর পরই চলে আসে কক্সবাজার। কারণ আর ক-দিন পর মৃণালের বাড়িটা সরগরম হয়ে উঠবে ওর এক দিদির বিয়ের কারণে। ঢাকা থেকে প্রচুর আত্মীয়স্বজনও আসবে, এমন ভিড়ের মধ্যে থাকতে চায়নি সে।

কক্সবাজারে এসে বিচের পাশে নিরিবিলি এক হোটেলে উঠেছিল। চমৎকার পরিবেশ, ভেবেছিল দশ-বারোদিন থেকে আবার ফিরে যাবে মৃণালের ওখানে কিন্তু সেটা আর হয়নি।

দ্বিতীয় দিন কক্সবাজারের সৈকতে একটা ছাতার নিচে বসে সমুদ্র দেখার সময় বারো-তেরো বছরের রোগাপটকা এক ছেলে আসে তার কাছে ডাব বিক্রি করতে। ছেলেটার মায়াভরা মুখের দিকে তাকিয়ে একটা ডাব কিনেছিল সে।

“ফোরকান?” নামটা ধরতে না পেরে বলেছিল।

“না, না,” মাথা দুলিয়ে জোর দিয়ে বলেছিল অল্পবয়সি ছেলেটি। “ফোক্কান।”

সম্ভবত ফোরকান নামটি কক্সবাজারে এসে ফোক্কান হয়ে গেছে। কিংবা আদতেই এমন নাম আছে এই অঞ্চলে। ডাবের ভারে ফোক্কানের ন্যুজ হয়ে থাকা শরীরটা দেখে তার প্রতি এক ধরণের মায়া জন্মে যায়। তার মুখ থেকে তার পরিবারের গল্প শোনার পর বাকি ডাবগুলোও কিনে নিয়েছিল ঐদিন। অবাক হয়েছিল ফোক্কান, তবে তার চেয়েও বেশি হয়েছিল খুশি।

এরপর প্রতিদিন তিনবেলা ডাব কিনতে শুরু করলে দ্রুতই ফোক্কানের সঙ্গে নিবিড় একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। তিন-ভাইবোনের সংসার ওদের, বাবা ভাড়া করা ট্রলার নিয়ে মাছ ধরে, আয়ের বেশিরভাগ অংশই চলে যায় ট্রলার মালিকের কাছে। কক্সবাজারের কলাতলি সৈকত ধরে দক্ষিণ দিকে প্রায় মাইলখানেক দূরে, দরিয়া নগরের জেলেপল্লীর পর্ণকুটিরে থাকে। প্রতিদিন তার মা জেলেপল্লীর ডাব গাছ থেকে কিছু ডাব সংগ্রহ করে দেয়, ফোক্কান সেগুলো বয়ে নিয়ে আসে কলাতলির সৈকতে, এই অফ-সিজনেও সেখানে বড় বড় কিছু হোটেলে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার লোকজন আসে, আসে অল্প কিছু পর্যটকও। তাদের কাছে চার-পাঁচটা ডাব বিক্রি করে বাবা-মাকে একটু সাহায্য করে।

এত ডাব দিয়ে সে কী করে, এ কথা জানতে চেয়েছিল পিচ্চি ফোক্কান। বলেছিল, ডাক্তার তাকে বলেছে প্রচর ডাব খেতে। তার কি বড় কোনো অসুখ হয়েছে? মুচকি হেসে বলেছিল, তেমন কিছু না, একটু ভালো খাওয়া দাওয়া করলেই ঠিক হয়ে যাবে।

একদিন কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে দূরের ছোট ছোট ট্রলারগুলোর দিকে আঙুল তুলে ফোক্কান দেখিয়েছিল, কোষ্টা তার বাপের। খুব অবাক হয়েছিল সে। এতোদূর থেকে নামবিহীন ট্রলারগুলো দেখে কীভাবে চিনতে পারলো!

ছেলের হাত ইশারা দেখতে পেয়ে সেই দুপুরেই ফোক্কানের বাপ সৈকতের কাছে ট্রলারটা ভিড়িয়ে পানি ডিঙিয়ে উঠে আসে। লোকটার বয়স বড়জোর চল্লিশ হবে। রোগাপটকা শরীরটা রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। যৌবনে হয়তো উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ছিল। পেটানো শরীরের পরিশ্রমী আক্কান আলী যতো হাড়ভাঙা খাটুনিই খাটুক না কেন, তিন সন্তানের আহার জোগাতে হিমশিম খায়। বড়ছেলে ফোক্কানের খুব ইচ্ছে পড়ালেখা করবে কিন্তু সেই সামর্থ্য তার নেই। বাকি দুই সন্তানের বয়স খুবই কম-পাঁচ বছরের এক মেয়ে আর সাত বছরের আরেক ছেলে।

এক সময় দরিয়া নগরের জেলেপল্লীতে ফোক্কানদের ঘরে যায়। কিভাবে এক প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে ফোক্কানের বাপের ট্রলারটা সমুদ্রে তলিয়ে গেছিল, জীবনবাজি রেখে সাঁতার কেটে প্রাণরক্ষা করেছিল, সেসব গল্প শোনে। আক্কান আলীও জানতে চেয়েছিল তার কথা। সে বলেছে, দেশের বাইরে ছিল অনেক বছর, কক্সবাজারে এসেছে হাওয়া বদল করতে, স্বাস্থ্য ঠিকঠাক করতে, আবারো চলে যাবে বিদেশে।

ফোক্কানের বাপ তখন বলেছিল, সে চাইলে রোজ রোজ হোটেলে না খেয়ে তার স্ত্রীর হাতে সুস্বাদু খাবার খেতে পারে। ঘরের কাজের পাশাপাশি তার স্ত্রী পাঁচ-ছয়জনের খাবার রান্না করে দেয় প্রতিদিন, তা থেকে সামান্য কিছু আয়রোজগার হয়। রাজি হলেও একটা শর্ত সে দেয়, কোয়াড-বাইকে করে তার হোটেলে খাবার নিয়ে আসবে ফোক্কান। যাতায়াতের ভাড়া সে-ই দেবে। ভালো করেই জানতো, নইলে এই টিফিন ক্যারিয়ার বয়ে নিয়ে আসার দায় বর্তাবে ছোট্ট শরীরটার উপরেই। সেই থেকে প্রতিদিন দুপুরে ফোক্কান তার মায়ের রান্না করা খাবার নিয়ে আসা শুরু করে। কতো ধরণের যে গল্প করতো ছেলেটা! পরিবারটির জন্য এই অচেনা-অজানা লোকটা হয়ে ওঠে দেবদূতের মতো। অচিরেই ফোক্কান আবার জেলেপল্লীর এক এনজিও’র স্কুলে যেতে শুরু করে।

তিনটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে তার, তিনটাই ভিন্ন ভিন্ন নামে। মেঘনা রিসোর্টের ঘটনার পর থেকে তওফিক আহমেদ নামের অ্যাকাউন্টটার কার্ড ব্যবহার করেনি ইচ্ছে করেই। তার ধারনা, জেফরি বেগ তাকে ট্রেস করার চেষ্টা করবে। সবচেয়ে বেশি টাকা যে অ্যাকাউন্টে, সেখানে তার কন্ট্রাক্টের টাকাগুলো জমা হতে, গত মাসে আক্কান আলীকে ট্রলার কেনার জন্য টাকা দেবে বলে ফোক্কানকে সঙ্গে নিয়ে কলাতলির একটি এটিএম বুথ থেকে বেশ কিছু টাকা তুলে দিয়েছিল। অমূল্যবাবু তার ব্যাঙ্কার বন্ধুর কাছ থেকে শুধু তার মানি ট্রানজ্যাকশানই জেনে নেয়নি, এটিএম বুথের সিসিক্যামের ফুটেজও দেখেছে, সেখানেই ফোক্কানকে দেখে বিস্মিত হয়েছে।

কোয়াড-বাইকটা থামতেই সম্বিত ফিরে পেলো-দরিয়া নগরের জেলেপল্লীর কাছে চলে এসেছে। বাইক থেকে নেমে পা বাড়ালো সৈকত সংলগ্ন মেরিন ড্রাইভের দিকে। কাজ সেরে এই বাইকে করেই আবার ফিরে যাবে হোটেলে। মেরিন ড্রাইভের পরই জেলেপল্লীটি অবস্থিত। যেতে যেতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। আবেগীয় ব্যাপার-স্যাপারগুলো তাকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। তবে কখনও কখনও এসব থেকে রেহাই পাবার উপায়ও থাকে না।

অধ্যায় ৩৬

“ঐ নাম্বারটা ট্রেস করা গেছে?”

কমিউনিকেশন্স রুমে ঢুকেই জেফরি বেগ জানতে চাইলো মনীষ নামের ছেলেটার কাছে। রমিজ লস্কর আর সাবের কামাল অফিস শেষ করে চলে গেছে। আজকের রাতের পালায় থাকবে এই নতুন ছেলেটি।

“জি, স্যার,” জবাব দিলো মনীষ। “পুরান ঢাকার দিকে আছে।” বিশাল মনিটরে একটা মানচিত্র ভেসে উঠেছে। “…আগামসি লেনে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “আমি চাই এই লোকটাকে তুমি এক মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করবে না।”

“জি, স্যার,” মাথা নেড়ে সায় দিলো মনীষ।

রাহিদ হাসান যে মুখ বন্ধ করে রেখেছে, কিছুই বলছে না তাতে অবশ্য একটা কথা পরিস্কার হয়ে গেছে : বিশাল কিছু লুকাতে চাইছে সে। নিরবতা কেবল সম্মতির লক্ষণই নয়, জেফরি বেগ সেটা জানে। নিরবতা আসলে কথা কয়! ইমরুল যে রঞ্জু গ্রুপের কেউকেটা, সে ব্যাপারে তার মনে এখন। আর কোনো সন্দেহ নেই। রাহিদ হাসান এই লোকের ব্যাপারে একদমই মুখ খুলছে না। জেফরির এখন মনে হচ্ছে, একে ধরলেই রঞ্জু গ্রুপের নাগাল পেয়ে যাবে সে।

নাকি খোদ রঞ্জুকেই!

ফোনালাপ থেকে যতোটুকু শুনেছে, নয়টার দিকে সে এক মেয়েকে নিয়ে কোনো এক ফ্ল্যাটে যাবে রাহিদ হাসানের সঙ্গে দেখা করতে। রাহিদ হাসান অবশ্য ফ্ল্যাটটা কোথায়, বলেনি।

“ওর ফোনটা টেপ করে কিছু পেয়েছো?”

“না, স্যার। এখন পর্যন্ত মাত্র একটাই কল করেছে…রুমানা নামের এক মহিলাকে। ঐ মহিলার সাথে দেখা করবে মনে হচ্ছে,” একটু থেমে আবার বলল, “একটা মেয়েমানুষ চাইছিল…সম্ভবত এসকর্ট বিজনেস করে।”

“মহিলা কোথায় থাকে?”

“একটু, স্যার…” মনীষ কিছু টাইপ করে গেল কিবোর্ডে। কম্পিউটার টেবিলের নিচে তার পাদুটো নাচাচ্ছে।

জেফরি বেগ চকিতে তাকালো ছেলেটার দিকে, তবে কিছু বলল না। উত্তেজনার সময়ে এভাবে পা নাচানোটা এই ছেলের মুদ্রাদোষ।

“এখন আছে মগবাজারে…বেপাড়ি পাড়ায়,” মনীষ বলল।

“কোথায় দেখা করবে, বলেছে কিছু?”

“বলেছে, আধঘণ্টা পর আসছে টোয়েন্টি ফোরে, একটা মেয়েকে নিয়ে যাবার জন্য।”

টোয়েন্টি ফোর? বুঝতে পারলো না জেফরি বেগ। জায়গটা কোথায় হতে পারে?

এমন সময় জামান ঢুকলো কমিউনিকেশন্স রুমে।

“আমাদের টার্গেট বলেছে একটু পর টোয়েন্টি ফোরে আসবে…এই টোয়েন্টি ফোরটা কি হতে পারে? “ জানতে চাইলো জেফরি।

“বলেন কি!” অবাক হলো জামান। “এটা তো মনে হচ্ছে বেইলি রোডের ক্যাফে টোয়েন্টি ফোর!”

এবার জেফরির অবাক হবার পালা। “আমাদের পাশেই তো!”

“জি, স্যার।”

“দেখি, ঐ লোকের মুভমেন্টটা বেইলি রোডের দিকে হয় কি না।” জেফরি বেগের দৃষ্টি মনিটরের দিকে।

“স্যার?” মনীষ বলল পেছন ফিরে। “মুভ করছে।”

“আমি শিওর, স্যার…এখানে আসবে,” জামান জোর দিয়ে বলল। “ঐ লোক যেহেতু কিছুই জানে না…একদম আনপ্রিপেয়ার্ড আছে। খুব সহজই হবে কাজটা।”

“ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের কেউ অস্ত্র ছাড়া থাকবে এমনটা ধরে নিও না,” জেফরি বেগ বলল মনিটরের দিকে তাকিয়ে।

জামানও জানে তার বসের কথা ঠিক। আগের চেয়ে রঞ্জুর এই দলটা অনেক বেশি চৌকষ, অনেক বেশি সতর্ক। পুলিশ-ডিবি-র্যাব এতোদিনেও সুবিধা করতে পারেনি তাদের বিরুদ্ধে।

পাঁচ মিনিট অপেক্ষার পর দেখা গেল, ইমরুল নামের লোকটা বেইলি রোডেই যাচ্ছে।

“বেইলি রোডে থেমে আছে, তার মানে এটাই ওদের মিটিং পয়েন্ট, স্যার,” মনীষ বলল।

“তুমি আমাদেরকে পোস্ট করতে থাকবে, আমরা গেলাম।” কথাটা বলেই জেফরি বেগ তার সহকারিকে নিয়ে কমিউনিকেশন্স রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

জামানের বাইকটা আর ব্যবহার করলো না, তারা দু-জন পায়ে হেঁটেই তিন-চার মিনিটের মধ্যে বেইলি রোডের ক্যাফে টোয়েন্টিফোরে চলে এলো। নতুন এই রেস্তোরাঁটা সন্ধ্যার দিকে অল্পবয়সি টিনএজারদের ভিড় থাকে।

ক্যাফের সামনে এসে দাঁড়ালো তারা দু-জন। কাঁচের দেয়াল দিয়ে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। খুব বেশি বড় নয়। সব মিলিয়ে বড়জোর ত্রিশজনের মতো কাস্টমার বসতে পারে।

এনআইডি থেকে নেয়া ইমরুলের ছবিটা ফোনে আছে, সেটা দেখে নিলো জেফরি। ভেতরে এরকম কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

“ভেতরে চলুন,” তাড়া দিলো জামান।

জেফরি বেগ যে-ই না ক্যাফের ভেতরে যাবে অমনি তার ফোনটা বেজে উঠল।

“ঐ লোকের ফোনের জিপিএস শো করছে না!” কলটা রিসিভ করতেই ফোনের ওপাশ থেকে মনীষ বলে উঠল। “হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেছে, স্যার।”

নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না জেফরি বেগ।

“আমার ধারনা লোকটা তার ফোন নষ্ট করে ফেলেছে।”

বহু কষ্টে নিজের রাগ দমন করলো জেফরি বেগ। তার মাথায় ঢুকছে না, এটা কী করে হলো। “তার মানে কি, লোকটা বুঝে গেছে?!” অবিশ্বসে বলে উঠল সে।

ওপাশ থেকে মনীষ কিছুই বলল না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। তার দিকে উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে জামান। “ফোনটা বন্ধ করার আগে ঐ নাম্বারে কোনো কল এসেছিল?”

“না, স্যার!” মনীষ জানালো। “আউটগোয়িং কোনো কল করেনি…ইনকামিং কলও না।”

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো জেফরি বেগ। কেউ কল করেনি, টেক্সটও করেনি, তারপরও কী করে টের পেয়ে গেল ঐ ইমরুল! একেবারে শেষ মুহূর্তে কে জানালো তাকে, তারা ওকে ধরতে আসছে?

“ফোন নাম্বারটা যে এনআইডি কার্ড দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে সেটার মালিক মোর্শেদ আলী নামের একজন, স্যার।”

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো জেফরির ভেতর থেকে। ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের কেউকেটা-ই হবে। অন্য নামে ফোন নাম্বার রেজিস্ট্রেশন করা তারই প্রমান। কানে ফোন চেপে আবারো সে তাকালো ক্যাফের ভেতরে। কোনো মহিলাকে দেখতে পাচ্ছে না। কিছু ছেলেমেয়ে বসে আছে। তাদের মধ্যে কেউই একা নয়। এর মানে মহিলা না এসে যদি এসকর্ট মেয়েটাকেও পাঠিয়ে থাকে, তাহলে সে-ও নেই!

রঞ্জুর এ দলটি এখন যে-ই চালাক না কেন, সে খুবই ধূর্ত আর অসম্ভব ক্ষমতা রাখে। র‍্যাব-পুলিশ-ডিবি এতোদিনেও এই দলটাকে ঘায়েল করতে পারেনি কেন সেটাও বুঝতে পারছে এখন।

ব্যর্থ মনোরথে হোমিসাইডে ফিরে এলো জেফরি বেগ। রাহিদ হাসানকে আচ্ছা করে পেটাতে ইচ্ছে করছে তার, কিন্তু এ জবীনে এখন পর্যন্ত নিজের অধীনে থাকা কোনো আসামি কিংবা সন্দেহভাজনকে ইন্টেরোগেশনের নামে টর্চার করেনি। এজন্যে অন্য সবার থেকে তাকে একটু আলাদা চোখেই দেখে সবাই। স্বতন্ত্র হবার যন্ত্রণা আছে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।

“স্যার, ঐ রাহিদ হাসানকে আরো কঠিনভাবে ইন্টেরোগেট করা উচিত,” সহকারি জামান বলল। “ও সব জানে।”

সহকারির দিকে তাকালো জেফরি। “আমরা খুব সতর্ক ছিলাম…” আনমনে বলল সে। “অনেক বেশিই ছিলাম, তারপরও কী করে খবরটা লিক হলো?”

“ব্যাঙ্ক থেকে নিশ্চয়ই লিক হয়নি?”

মাথা দোলালো জেফরি। “আমার মনে হয় না ব্যাঙ্ক থেকে লিক হয়েছে। ব্যাঙ্কের কেউ এটা জানেই না…ম্যানেজার ছাড়া।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান।

কয়েক মুহূর্তের জন্য জেফরির মনে এমন সন্দেহও উঁকি দিলো, হোমিসাইড থেকে খবরটা ফাঁস হয়নি তো! মাথা থেকে এমন চিন্তা ঝেটিয়ে দূর করে দিলো। নিজের সহকর্মিদের উপরে তার অগাধ আস্থা।

“হয় ঐ লোকের কাছে দুটো ফোন আছে নয়তো তাকে হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট করে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে,” সহকারি জামান বলল।

কথাটা যৌক্তিক বলেই মনে হচ্ছে জেফরি বেগের কাছে। ঘটনা যেভাবে ঘটেছে, তাতে এটাই স্পষ্ট। একেবারে শেষ মুহূর্তে কেউ ইমরুলকে সতর্ক করে দিয়েছে। কিন্তু কে কিভাবে সেটা জেনে গেল?

“ওই লোককে কী করবেন এখন?”

পুলিশের মতোই, যে কোনো আসামিকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হয় হোমিসাইডকেও। সেদিক থেকে দেখলে, হাতে এখনও সময় আছে। এই সময় শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত রাহিদ হাসানকে কোনোভাবেই ছাড়া যাবে না। কিছু একটা বলতে যাবে সে, অমনি তার ডেস্ক ফোনটা বেজে উঠল। একটু বিস্মিত হলো জেফরি। রাতের এই সময় সাধারণত কেউ তাকে অফিসের ফোনে কল দেয় না।

“হ্যালো?”

“এখনও অফিসেই আছো?” ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো। মহাপরিচালক ফারুক আহমেদের কণ্ঠটা।

“হ্যাঁ, স্যার।”

“কোনো আপডেট?”

গভীর করে নিশ্বাস নিলো জেফরি বেগ। “না, স্যার। সাসপেক্ট কিছুই বলছে না। আর যে লোকটাকে ধরতে গিয়েছিলাম, শেষ মুহূর্তে সে সটকে পড়েছে। কেউ তাকে জানিয়ে দিয়েছে মনে হচ্ছে।”

“বলো কি?!” অবাক হলো মহাপরিচালকও। “কে তাকে জানালো?”

কাঁধ তুলল ইনভেস্টিগেটর। “সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”

ওপাশ থেকে নিরবতা নেমে এলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। “সাসপেক্টকে কী করবে এখন?” কণ্ঠটা কেমনজানি দূর্বল শোনালো।

“কালকে আবার ইন্টোরোগেট করবো। চব্বিশ ঘন্টার আগে তাকে ছাড়ছি না।” জেফরি বেগের কাছে মনে হলো, মহাপরিচালক কিছু বলতে গিয়ে ইতস্তত করছে। কম দিন তো আর হলো না তাকে দেখছে। ভদ্রলোক কখন কি করে, কণ্ঠস্বর কখন কি রকম হয়, সবই বুঝতে পারে। “কিছু বলবেন, স্যার?”

“এসএসবি ব্যাঙ্কটা…” ফারুক আহমেদ বলল। “…ওটার তিনজন মালিকের মধ্যে দু-জনই সরকারি দলের এমপি। একজন আবার মন্ত্রী হয়েছে কিছুদিন আগে।” ফোনের ওপাশ থেকে মহাপরিচালক গভীর করে শ্বাস নিলো। “তারা খুব ওরিড হয়ে পড়েছে। বোঝোই তো, ক্ষমতাসীন দলের এমপি-মন্ত্রী…উপরমহলে দেন-দরবার শুরু করে দিয়েছে।”

“ওরকম জঘন্য এম্পুয়িকে নিয়ে উনারা চিন্তিত?!” এটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে তার। “ঐ এলুয়ি কী করেছে, উনারা কি জানেন না?” তার কণ্ঠ চড়ে গেল অনেকটাই।

জামান তার বসের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ফোনালাপটির এক প্রান্তের কথা শুনলেও বুঝে নিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তার।

“উনারা এম্পুয়িকে নিয়ে চিন্তিত নন,” ম্রিয়মান কণ্ঠে বলল ফারুক আহমেদ। “ব্যাঙ্কের রেপুটেশন নিয়ে চিন্তিত। বদমাশটাকে মুনেমের মামলায় আটক দেখালে তো সমস্যা।”

“সমস্যা!” জেফরি বেগের ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে।

“একটু শান্ত হয়ে আমার কথা শোনো। মুনেমের কেসে ওকে জড়ালে পুরো ব্যাপারটা আর গোপন থাকবে না, সব কিছু ফাঁস হয়ে যাবে। আর সেটা হলে এসএসবি ব্যাঙ্কের রেপুটেশন…বোঝোই তো। ব্যাঙ্ক টিকে থাকে রেপুটেশনের উপরে, সেটাই যদি না থাকে তাহলে…” কথাটা আর শেষ করলো না মহাপরিচালক।

“কিন্তু এই লোককে মুনেম মার্ডার কেসে না রাখলে তো হবে না, স্যার!” হতাশ কণ্ঠে বলল জেফরি। “ওকে বাদ দিয়ে এই কেস কিভাবে এগোবে?”

“ওকে বাদ দিতে বলছি না,” ফারুক আহমেদ বলল। “ওকে তুমি ইন্টেরোগেট করে তথ্য আদায় করো, ইউজ করো কিন্তু কেসে ইনভলভূমেন্ট দেখাবে না।”

বহু কষ্টে নিজের রাগ দমন করলো জেফরি বেগ। কয়েক বছর আগে হলেও সে খেপে গিয়ে বলে দিতো, তার পক্ষে এভাবে তদন্ত করা সম্ভব নয়। এমন কি, রেগেমেগে চাকরি ছাড়ার কথাও বলতো। কিন্তু বয়স আর অভিজ্ঞতা, দুটোই বেড়েছে। এখন সে অনেক বেশি সহমর্মি-অন্যের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভাবতে পারে।

‘মালিকেরাও কিন্তু চায় না ঐ বদমাশটা ছাড়া পেয়ে যাক,” জেফরি কিছু বলছে না বলে ফারুক আহমেদ বলে উঠল ফোনের ওপাশ থেকে। “তারা বরং তোমার আমার চেয়ে বেশিই চায় ঐ লোকের কঠিন শাস্তি হোক। কিন্তু ব্যাঙ্কের রেপুটেশনের কথা ভেবেই এ রকমটা চাইছে।”

জেফরি ভালো করেই জানে, সব সময় সব কিছু নিজের মতো করে এগোবে না। তাহলে হোমমিনিস্টারের যে আলটিমেটাম, সেটার কি হবে?”

“ওসব নিয়ে ভেবো না। এখন এই কেসটা নিয়ে ওদেরই কথা বলার মুখ নেই।” একটু থেমে আবার বলল ফারুক আহমেদ, “হোমমিনিস্টার একটু আগে আমাকে ফোন করে এই অনুরোধটা করেছেন।”

ফোনটা রাখার আগেই জেফরির মাথায় একটা কিছু উঁকি দিলো। দ্রুত ভেবে নিলো সেটা। “ঠিক আছে, কেসটা আমি অন্যভাবে ইনভেস্টিগেট করবো…রাহিদ হাসানকে জড়াচ্ছি না।”

সম্ভবত এতো দ্রুত আর এতো কম প্রচেষ্টায় জেফরিকে মানাতে পারবে, ফারুক আহমেদ নিজেও ভাবেনি। ভদ্রলোক হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন।

অধ্যায় ৩৭

দুই মাস পর…

গুলির শব্দে কেঁপে উঠল সোয়ান লেক সিটি নামের নতুন আবাসিক এলাকাটি।

এই প্রথম এখানকার বাসিন্দাদের এ রকম অভিজ্ঞতা হলো। তারা বুঝতে পারলো না, ঠিক কোথা থেকে গুলির শব্দগুলো হয়েছে। নিরাপত্তায় নিয়োজিত সিকিউরিটিদের জন্যেও এ রকম ঘটনা প্রথম। এখানে চাকরি নেবার পর, এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি তারা, ফলে ভড়কে গেল সবাই।

ঢাকার খিলখেতের উত্তর-পূর্বে নতুন এই হাউজিং সোসাইটিটি গড়ে উঠেছে। এখানকার রিয়েলস্টেটওয়ালাদের পাশাপাশি বাসিন্দারারাও দক্ষিণ পূর্ব দিকের একটি প্রাকৃতিক জলাশয়কে ‘লেক বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। এই লেকের উত্তর-পশ্চিম দিকের সাতটি পুটে অনেকটা এল’ আকৃতিতে ঘিরে আছে ছয়টি বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। বেশ সুপরিসর জায়গা নিয়ে এই আবাসিক এলাকাটি নির্মাণ করা হয়েছে। ভবনগুলো মোটেও গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নেই-ফলে হ্যান্ডশেক ব্যালকনি বলেও কিছু নেই এখানে। ছয়টি ভবনের সামনে রয়েছে খোলা একটি জায়গা, এরপরেই আছে লেকটি।

এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বেশ ভালো। সন্ধ্যার পর পর ঘরফেরত মানুষজনের আনাগোনা দেখা যায় বেশি, আর রাত নয়টা-দশটার মধ্যে সুনশান হয়ে ওঠে। চারপাশের বন্য পরিবেশ এখনও গ্রামের আবহ ধরে রেখেছে। ধীরে ধীরে সেটা গ্রাস করে নিচ্ছে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো।

দু-দিন আগে রোজার ঈদ ছিল, ঈদের ছুটি শেষে আজকেই সরকারি অফিস খুলেছে, কিন্তু পুরো শহরের মতো এখানকার ভবনগুলোর বেশির ভাগ বাসিন্দাই এখনও দেশের বাড়ি থেকে ফিরে আসেনি। যেগুলোতে লোকজন আছে, সেগুলোরও বাতি নিভিয়ে ফেলা হলো। ভুতুড়ে হয়ে উঠল পুরো এলাকাটি। বাসিন্দারা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই হয়তো মনে করেছে, বাতি বন্ধ করে, দরজা-জানালা লাগিয়ে রাখলেই এই গোলযোগ থেকে নিরাপদ থাকবে।

অন্যান্য ভবনের সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা লোকজন মেইনগেটের সামনে এসে সাহস করে আশেপাশে নজর বোলালেও সাত নম্বর ভবন থেকে কাউকেই বের হয়ে আসতে দেখা গেল না। সেই ভবনের কিছু ফ্ল্যাটে বাতি জ্বলতে দেখা গেলেও একটু পরই সব বাতি বন্ধ করে নিজেদের অস্তিত্ব উধাও করে ফেলল বাকিদের মতো।

পাঁচ নাম্বার ভবনের সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা মোখলেস সবেমাত্র বিয়ে করেছে, তাই সাহস করে মেইনগেটের বাইরে গিয়ে কিছু দেখার কথা চিন্তাও করলো না। সে বরং মেইনগেটটা লক করে নিজের সিকিউরিটি-বক্সে বসে চুপচাপ দেখে যেতে লাগলো বাইরের দৃশ্য। একটু আগে কালো রঙের মাইক্রোবাসে করে ডিবি’র কিছু লোকজন এসে যখন সাত নাম্বার ভবনে ঢুকেছে, তখনই সে অবাক হয়েছিল। এখন বুঝতে পারলো, ওদের আসার কারণটা কী-নিশ্চয়ই ডিবির সঙ্গে সন্ত্রাসিদের গোলাগুলি হচ্ছে!

এমন সময় সিকিউরিটি বক্সের ইন্টারকমটা বাজতে শুরু করলে মোখলেস অবাক হলো না, এমনটাই হবার কথা। আতঙ্কিত বাসিন্দাদের নানান প্রশ্নের জবাব দিতে হবে এখন। কিন্তু বলবেটা কী? কিছুই তো জানে না।

রিসিভারটা তুলে নিয়ে কোনো সুযোগই দিলো না ওপাশের বাসিন্দাকে। “স্যার, নিজের ঘরে থাকেন, বাইরের পরিস্থিতি ভালা না। কেউ ঘর থেইকা বাইর হোয়েন না। বাতি-টাতি অফ কইরা রাখেন। আমাগোর গেট লক করা আছে, চিন্তার কিছু নাই।”

ইন্টারকমটা রেখে দিতেই আবারো বেজে উঠল। একই কথা বলল তোতাপাখির মতো করে। কিন্তু এই অ্যাপার্টমেন্টের সবচেয়ে বাতিকগ্রস্ত অ্যালোটি, অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার মান্নান শিকদারের কলটা রিসিভ করে সহজে পার পাওয়া গেল না।

“তুমি কী করে জানলে, ওরা ডিবির লোক?” বুড়ো তার কথা শেষ হবার আগেই মিলিটারি মেজাজে বললেন।

“ওগোর গায়ে ডিবির পোশাক আছে তো, স্যার।”

“পোশাক দেখেই বুঝে গেলে ওরা ডিবি? গবেট!” ধমকে উঠলেন ব্রিগেডিয়ার। “ডাকাতও তো হতে পারে, নাকি?”

মোখলেস আর তর্কে গেল না। অ্যালোটিদের সঙ্গে তর্ক করা মানে চাকরির বারোটা বাজানো।

“চোখকান খোলা রেখো, ঠিক আছে?”

মোখলেস কিছু বলার আগেই লাইনটা কেটে দিলো ওপাশ থেকে। সত্যি সত্যি চোখকান খোলা রেখে তাকিয়ে রইলো সে সাত নাম্বার ভবনের দিকে। টান টান উত্তেজনায় কেটে গেল কয়েকটা মিনিট। এরপর আবারো গুলির শব্দ হলো কয়েকটা। ভড়কে গেল মোখলেস। যথারীতি বিগ্রেডিয়ার সাহেবের কল। ইন্টারকমটা কানে দিলো সে।

“আবারো ফায়ারিং হয়েছে। কাহিনি কি?!”

“বুঝতাছি না, স্যার, আতঙ্কের সাথে ফিসফিসিয়ে বলল সিকিউরিটি গার্ড মোখলেস।

“আমার মনে হচ্ছে ডাল মে কুচ কালা হ্যায়…অন্য কেস এটা!”

মোখলেসের নজর সাত নাম্বার ভবনের দিকে। হঠাৎ সে দেখতে পেলো, ওখান থেকে ডিবি’র ভেস্ট পরা এক লোক প্রাণপণে দৌড়ে সোয়ান লেক সিটির মেইন গেটটার দিকে চলে যাচ্ছে। ভয় পেয়ে সিকিউরিটি বক্সের ভেতরে নিচু হয়ে বসে পড়লো সে। ডিবির লোকটা কেন এমনভাবে পালালো, বুঝতে পারছে না। মাথা তুলে যে দেখবে, সেই সাহসও হচ্ছে না। অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও যখন দেখলো কোনো কিছু হচ্ছে না, কোনো সাড়াশব্দ নেই, তখন আবার মাথা উঁচু করে সাত নাম্বার ভবনের দিকে তাকালো। ঐ ভবনের সামনে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। এখনও সে কানে ইন্টারকমটা চেপে রেখেছে।

“অ্যাই, কি হয়েছে?” বিগ্রেডিয়ার সাহেবের গলায় যেন আওয়াজই বের হচ্ছে না।

“সাত নম্বর থিকা এক ডিবি জান লইয়া পলাইলো, স্যার!”

“মাই গড!” আতঙ্কিত হলেন বিগ্রেডিয়ার। “ব্যাপারটা তাহলে পুলিশকে জানানো উচিত।”

কানে রিসিভারটা চেপে রাখলেও সিকিউরিটি বক্সের জানালা দিয়ে উত্মক হয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো মোখলেস। “স্যার, মনে হইতাছে…” থেমে গেল সে, ওপাশে কেউ নেই।

সাত নাম্বার ভবনের মেইনগেটটা খোলা, সেখানকার সিকিউরিটি গার্ড জামিলকে দেখা যচ্ছে না। ছেলেটার সঙ্গে বেশ সখ্যতা আছে তার, মাঝেমধ্যে তারা চা-সিগারেট খায়, গপসপ করে। ওর জন্য দুশ্চিন্তা না করে পারলো না।

কিছুক্ষণ ভেবে উঠে দাঁড়ালো সে, সাহস সঞ্চয় করে বক্স থেকে বের হয়ে এলো এবার। তার এই বক্স থেকে দরজা খুলে সোজা বাইরে যাওয়া যায়-মেইনগেট খোলার দরকার পড়ে না। ভীরু পায়ে সাত নম্বর ভবনের মেইনগেটের দিকে পা বাড়ালো। তার ধারনা, যা হবার হয়ে গেছে, আর কোনো ভয় নেই। বন্ধুত্বের কথা না-হয় বাদই দেয়া গেল, এখনও যদি ইঁদুরের মতো গর্তে লুকিয়ে থাকে তাহলে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে যে সেটা কলঙ্কের ব্যাপার হয়ে যায়!

ছয় নাম্বার প্লটটা এখনও খালি পড়ে আছে, সেখানে কোনো ভবন গড়ে ওঠেনি, টিন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে জায়গাটা। ওখানে আসতেই একটা শব্দে ভিমি খেলো সে, চমকে মেইন গেটের দিকে তাকালো-ওখানকার দারোয়ান গেটটা খুলে দিয়েছে, পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান ঢুকছে ভেতরে। ডান দিক থেকে আরেকটা শব্দ শুনে সাত নাম্বার ভবনের দিকে তাকালো মোখলেস। ডিবির কালো রঙের গাড়িটা আস্তে করে বের হয়েছে মাত্র! পুলিশের গাড়িটাও এগিয়ে আসছে এদিকেই!

ভয়ে মোখলেসের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো। তার মনে হচ্ছে, নিজের বক্স থেকে বের হবার সাহসটা না দেখালেও পারতো। ছয় নাম্বার প্লটের টিনের বাউন্ডারির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। পুলিশের গাড়ি তার কাছে আসতেই কালো রঙের মাইক্রোবাসটা লেক-সাইড রোড দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে গেল। সেটার পিছু নেবার চেষ্টা করলো পুলিশের গাড়িটা, আর তখনই দুটো গুলি করা হলো কালো রঙের মাইক্রোবাস থেকে!

অধ্যায় ৩৮

দুটো মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জেফরি বেগ।

ঈদের ছুটির শেষ দিন ছিল কাল। আজকেই তাদের অফিস খুলেছে, যদিও সবাই যোগ দেয়নি, কাল থেকে বাকিরা যোগ দেবে। আজকে তাড়াতাড়ি অফিস শেষ করে বাড়িতে চলে গেছিল, সেখান থেকেই সোজা চলে এসেছে ঘটনাস্থলে। তার পরনে নিল রঙের জিন্সপ্যান্ট আর সাদা টিশার্ট, পায়ে মোকাসিম।

এখানকার এক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার ফোন করে পুলিশকে জানায় গোলাগুলির ঘটনাটি। তার পরই স্থানীয় থানার একটি টহল দল চলে আসে। তারা যখন এখানে ঢুকছিল তখনই কালো রঙের একটি মাইক্রোবাস সাত নাম্বার ভবন থেকে বের হয়ে লেক-সাইড রোড দিয়ে বের হয়ে যায়। পুলিশের ভ্যান গাড়িটার পিছু নেবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু গাড়ি থেকে তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি করা হলে তারা ক্ষান্ত দেয়। খোলা গেট দিয়ে বিনা বাধায় বেরিয়ে যায় মাইক্রোবাসটি।

পুলিশ ভবনের দারোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যতোটুকু জেনেছে, এখানে যারা ঢুকেছে তারা সবাই ডিবির পোশাকে ছিল। বলেছিল, এখানকার এক ফ্ল্যাটে ভয়ঙ্কর একজন সন্ত্রাসি লুকিয়ে আছে, তাকে ধরতে এসেছে।

এ পর্যন্ত যা জেনেছে তার উপর ভিত্তি করে ক্রাইমটা রিকন্ট্রাক্ট করলো জেফরি বেগ : প্রথমেই ডিবির ভেস্ট পরা এক লোক সবগুলো সিসিক্যামের কানেকশান খুলে ফেলে, একজন দারোয়ানের কাছ থেকে জেনে নেয় সিসিক্যামের ফুটেজ কোথায় স্টোর করা হয়, এরপরই পার্কিংলটের পেছনে, ছোট্ট একটা কক্ষ থেকে সিসিক্যামের ফুটেজগুলো যে সিপিউ’তে সংরক্ষণ করা হয় সেটা তাদের গাড়িতে রেখে আসে লোকটা। দারোয়ানকে সে বলেছে, তাদের রেইড শেষ না হবার আগ পর্যন্ত এই ভবন থেকে কাউকে ঢুকতে বা বের হতে দেয়া হবে না। এরপর তিনজন উপরে চলে গেলে মাইক্রোবাসটির ড্রাইভার সাত নম্বর ভবনের মেইনগেটের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখে গাড়িটা। তারপরই দুটো গুলির শব্দ হয় উপর তলা থেকে।

গাড়ির ড্রাইভার তখন দারোয়ানের সাথেই ছিল। এ সময় দারোয়ানকে ড্রাইভার বলেছিল, সে যেন সিকিউরিটি বক্সের ভেতরেই থাকে। কিছুক্ষণ পর আরেক দফা গুলির শব্দ হলে দারোয়ান ভয় পেয়ে যায়। ড্রাইভার উদ্বিগ্ন হয়ে লিফটের কাছে চলে গেছিল, ফোনও করেছিল কাউকে। কিছুক্ষণ পরই লোকটা দৌড়ে চলে যায় ভবন থেকে, দারোয়ান তখন ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে বক্সের ভেতরে বসে থাকে, কারোর পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে যায় সে। কিছুক্ষণ পর টের পায়, মেইনগেটের ভেতরে রাখা ডিবির গাড়িতে লোকজন উঠছে। সাহস সঞ্চয় করে ভয় কাটিয়ে মাথা উঁচু করে দেখার সাহস করতে গেছিল যখন, তখনই বাইরে গুলির শব্দ শোনে। পরে জেনেছে, পুলিশের গাড়ি চলে আসায় মাইক্রোবাস থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছিল।

এখন প্রশ্ন হলো, এখানে এসেছিল এক ড্রাইভারসহ তিনজন গানম্যান। দু-জন মরে পড়ে আছে, ড্রাইভার পালিয়ে গেছে কাউকে দেখে। কিন্তু দারোয়ান সেটা দেখতে পায়নি। তবে এটা পরিষ্কার, ঐ লোক তাদের হিট টিমের কেউ না। হিট টিমের কেউ মাইক্রোবাসটা নিয়ে পালায়নি। যদি তা ই হতো, ড্রাইভার পালিয়ে যেতো না। মাইক্রোবাসটা বের হবার সময়েই পুলিশের গাড়ি চলে এসেছিল।

তাহলে বাকি একজন সন্ত্রাসি গেল কোথায়?

ঘটনাস্থলে আসার পর দারোয়ানের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে পুলিশ, লোকগুলো ছয় তলায় গেছিল। ওই ফ্লোরে গিয়ে তারা দেখে ফ্ল্যাট ৫-বি ‘র দরজার লক ভাঙা। ভেতরে ঢুকে আবিষ্কার করে, ডিবির ভেস্ট পরা দুটো লাশ পড়ে আছে বেডরুমে। ডিবির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানায়, ঐ এলাকায় তাদের কেউ কোনো অপারেশনে যায়নি আজকে। নিহতদের ছবি পাঠালে ডিবি নিশ্চিত করেছে, এরা কেউই তাদের সংস্থার লোক না। পুলিশের আর বুঝতে বাকি থাকে না, খুনি কিংবা ডাকাতের দল নকল ডিবি সেজে ঢুকেছিল এই ভবনে।

ঈদের ছুটির কারণে আজকে প্রথম কর্ম দিবসে হোমিসাইডের জনবলের বেশিরভাগই অনুপস্থিত। ফরেনসিক টিমের রমিজ লস্কর, সাবের কামালসহ বাকিরা আগামিকাল কাজে যোগ দেবে। সহকারি ইনভেস্টিগেটর জামান ঢাকায় আছে, তাকে নিয়েই জেফরি বেগ ঘটনাস্থলে চলে এসেছে বটে, তবে নিজেকে ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার বলে মনে হচ্ছে। ভাবনাটা এই বলে উড়িয়ে দিলো, প্রযুক্তির উৎকর্ষতার আগে তদন্তকারি কর্মকর্তারা এভাবেই অনেক জটিল কেস সমাধান করেছে।

“আজকে মগজাস্ত্র ব্যবহার করতে হবে।”

তার সহকারি বলেছিল এখানে আসার সময়। কথাটা শুনে মুচকি হেসেছিল সে। “এতোদিন তাহলে মগজের ব্যবহার না করেই কাজ করেছি?”

“জি না, স্যার…আমি তো এমনিই বললাম,” গাল চুলকে বলেছিল জামান।

কথাটা আজকাল অনেকেই বলে, আগের জমানার ডিটেক্টিভেরা মগজের ব্যবহার বেশি করতো, এখনকার ইনভেস্টিগেটরা টেকনোলজি নির্ভর।

“এখানে ঢুকেছিল তিনজন?” লাশদুটো ভালো করে দেখে বলল জেফরি বেগ।

“জি, স্যার,” বলল জামান। লাশগুলোর সুরতহাল রিপোের্ট করার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে তাকে।

“তাহলে অন্যজন কোথায়?”

“লোকাল থানার পুলিশ পুরো ভবন সিকিউর করে তল্লাশি চালিয়েছে, কাউকে পায়নি।”

“হুম।” বলেই লাশ দুটো ভালো করে দেখে নিলো জেফরি বেগ : মাঝবয়সি একজন, বয়স চল্লিশের বেশি হবে না। অন্য সঙ্গিটির বয়স অবশ্য পঁচিশের আশেপাশে। একজন বিছানার উপরে চিৎ হয়ে পড়ে থাকলেও অন্যজন দরজার ভেতরে মুখ থুবরে পড়ে আছে।

“এই ফ্ল্যাটে কে থাকতো, জানা গেছে?” সহকারির দিকে না তাকিয়েই জানতে চাইলো জেফরি।

“দারোয়ান কেবল বলতে পেরেছে, এক হিন্দু ভদ্রলোক থাকতেন। নাম টাম ঠিকমতো বলতে পারেনি।”

বিস্মিত হলো জেফরি বেগ। “অ্যালোটির নাম জানে না, আজব?”

“মাত্র দু-মাস আগে উঠেছে, স্যার…কারো সঙ্গে মিশতো না, অন্য অ্যালোটিরাও লোকটার নাম জানে না। তাদের সাথে ওই লোকের কখনও কথাবার্তা হয়নি।”

“বয়স কেমন লোকটার?”

“দারোয়ান বলছে, পঁয়ত্রিশের কোঠায় হবে, তবে সে নিশ্চিত না।”

“নিশ্চিত না কেন?” জেফরি আবার লাশটার দিকে মনোযোগ দিলো।

“দারোয়ান ট্রমাটাইজ হয়ে আছে, তারপরও যতোটুকু বলেছে, লোকটা বেশ স্বাস্থ্য সচেতন, হালকা-পাতলা গড়নের…পেটানো শরীর। এক্সারসাইজ করতো রেগুলার। পাশের রুমটায় ট্রিডমিল আছে একটা, আরো কিছু জিম ইন্সট্রুমেন্টও দেখলাম।”

“এই ফ্ল্যাটের মালিক কে?”

“দারোয়ান বলতে পারেনি।”

“লোকটা দেখি ভালোই ট্রমাটাইজ হয়ে আছে,” বলল জেফরি।

“সমস্যা হলো, এখন খুব বেশি অ্যালোটি নেই, বেশিরভাগই ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গেছে…এখনও ফিরে আসেনি,” জামান বলল।

এবার উঠে দাঁড়ালো জেফরি বেগ। চারপাশে তাকিয়ে বলল, “নকল ডিবি সেজে দু-জন লোক এখানে দরজা ভেঙে ঢুকেছে, তারপর গোলাগুলি করেছে কিন্তু এখানে যে থাকতো তার সাথে পেরে ওঠেনি। “এদের অস্ত্রগুলো গেল কোথায়?”

জামান গাল চুলকালো। মনে হচ্ছে এখানে যে থাকতো সে-ই নিয়েছে।”

“এই ঘরের বাসিন্দার পরিচয় বের করাটা জরুরি। ওদের ফোনগুলোর সিডিআর বের করতে হবে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরির সহকারি। “জি, স্যার।”

“এটা ডাকাতির ঘটনা না, এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দাকে হত্যা করার জন্যই এসেছিল ওরা।”

“আমার ধারনা, এই ফ্ল্যাটে যে থাকতো সে-ও বড় কোনো সন্ত্রাসি হবে।”

“তুমি বলতে চাইছে, নিজেদের মধ্যে মারামারি?”

“সে রকমই মনে হচ্ছে।”

জেফরি বেগ কিছু একটা ভাবলো। “সিসিক্যামের ফুটেজের কি খবর?”

“এখানে ঢোকার পর সবগুলো সিসিক্যামের ফুটেজ যে সিপিইউতে স্টোর হতে ওটা গাড়িতে নিয়ে রেখেছিল ওদের একজন।”

এমন সময় লোকাল থানার এক এসআই ফ্ল্যাটে ঢুকে জেফরিকে স্যালুট ঠুকলো। “স্যার, দারোয়ান এখন বলছে, ডিবির লোকগুলো এই ভবনে ঢুকে প্রথমে নওরিন খান নামের এক মহিলার খোঁজ করেছিল।”

“নকল ডিবি,” শুধরে দিলো জেফরি বেগ।

থতমত খেলো এসআই। “জি, স্যার।”

“এ কথা আগে না বলে এখন বলছে কেন দারোয়ান?”

“লোকটা প্যানিল্ড হয়ে ছিল, স্যার…এখন কিছুটা ঠিক হয়েছে।”

বুঝতে পারলো জেফরি। সামান্য একজন দারোয়ান, প্রথমে সে-ই মোকাবেলা করেছে সন্ত্রাসিদেরকে। ওকে হয়তো ভয়ও দেখিয়েছে।

“এই ফ্লোরের কোন্ ফ্ল্যাটে ঐ মহিলা থাকে?”

“ফাইভ ডি’তে, স্যার। নওরিন খান নামের এক মহিলা, তার ছোটো বাচ্চা আর কাজের বুয়া থাকে। তারা কেউ ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যায়নি, এখানেই আছে। কিন্তু দরজায় নক করলেও কেউ রেসপন্স করেনি।”

ভুরু কুঁচকে গেল জেফরির। “চলো তো, দেখি…” জামান আর এসআইকে নিয়ে ক্রাইম সিনের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে গেল সে।

এই ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে চারটা করে ফ্ল্যাট, ছয় তলার একটি ফ্ল্যাটের ভেতরে এখনও কাজ চলছে, অন্যটির বাসিন্দারা ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গেছে। যে ফ্ল্যাটটায় এক মহিলা তার বাচ্চা নিয়ে থাকে সেটার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো তারা।

দরজায় কলিংবেল বাজালো জেফরি, কোনো সাড়াশব্দ এলো না ভেতর থেকে। জোরে জোরে বেশ কয়েক বার নক করলো দরজায়–একই ফল। এবার দরজার নিচের দিকে তাকালো ভেতরে আলো জ্বলছে কি না দেখার জন্য, আর তখনই কিছু একটা চোখে পড়লো তার, হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।

দরজার কপাটের বাইরে এক দুফোঁটা রক্ত!

অধ্যায় ৩৯

সোয়ান লেক সিটির সাত নাম্বার ভবনটির ছয় তলা এখন সতর্ক অবস্থায় আছে, স্থানীয় থানার এসআই অহাতে দাঁড়িয়ে আছে লিফটের সামনে। জেফরি বেগ আর জামানের হাতেও আম।

এই সতর্কতার কারণ, এখানে একজন সন্ত্রাসি লুকিয়ে থাকতে পারে-যাকে তারা খুঁজে পাচ্ছে না।

একটু আগেও জেফরি বেগ ভেবেছিল, ডেডবডি দুটো মর্গে পাঠিয়ে ক্রাইম সিনের ফ্ল্যাটটা সিলগালা করে চলে যাবে, আগামিকাল এভিডেন্স ভ্যান নিয়ে এসে ফিঙ্গারপ্রিন্টসহ বাকি আলামত সংগ্রহ করা হবে।

দরজার দু-পাশে জেফরি আর জামান দাঁড়িয়ে আছে, তাদের হাতে অন্ত্র, হাত দিয়ে দরজার নবটা সহকারিকে ইশারা করতেই মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান, নবটা ধরে আস্তে করে ঘোরালো সে। বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করলো, দরজাটা লক করা নেই! চোখাচোখি হলো জেফরির সঙ্গে। ইশারা করে সতর্ক হতে বলল সে। মাথা নেড়ে আশ্বস্ত করলো জামান।

জেফরি বেগ বাঁ-হাতের তর্জনি উঁচিয়ে দরজাটা খুলে দেবার ইশারা করলো তাকে। দরজা খুলে দিতেই প্রথমে সে উঁকি দিলো ভেতরে। ফ্ল্যাটটা অন্ধকারে ঢেকে আছে, কিছুই দেখতে পেলো না। আবারো দেয়ালে হেলান দিয়ে জোরে বলে উঠল : “ভেতরে কেউ থাকলে জবাব দিন।” কোনো সাড়া নেই। এখানে প্রচুর পুলিশ আছে, উল্টা-পাল্টা কিছু করার চেষ্টা করবেন না।

এরপরও ভেতর থেকে সাড়াশব্দ এলো না। সম্ভবত কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সন্ত্রাসি। অভিজ্ঞতা থেকে জানে, এরকম লোকজন নিজে থেকে ধরা দেবে না। এমন মুহূর্তে একটাই করণীয় থাকে, ঝুঁকি নিয়ে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে পড়া। বাঁ-হাত দিয়ে ইশারা করলো জামানকে : আমি যাচ্ছি ভেতরে, তুমি ব্যাকআপ দেবে।

মাথা নেড়ে সায় দিলো তার সহকারি।

গভীর করে শ্বাস নিয়ে পিস্তল হাতে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লো জেফরি বেগ, দু-হাতে ধরে রাখা পিস্তলটা তার চোখ বরাবর। ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকেই বাঁ-হাত দিয়ে দরজার পাশে সুইচ হাতড়ে বাতি জ্বালিয়ে দিলো, সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলো দৃশ্যটা।

ডান দিকে, ড্রইংরুমের মাঝখানে ছোটোখাটো রক্তের দলার মাঝে পড়ে আছে ডিবির ভেস্ট পরা মাঝবয়সি এক লোক।

লোকটার পায়ে আর বাঁ-কানের উপরে গুলি লেগেছে। চিৎ হয়ে পড়ে আছে সে, অস্ত্রটা তার হাত থেকে ছিটকে কাছেই পড়ে আছে।

জামান সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে লোকটার ঘাড়ে আঙুল রেখে পরীক্ষা করে দেখলো, যদিও এর কোনো দরকার ছিল না-একটা বুলেট তার মাথায় আঘাত করেছে, মৃত্যু হয়েছে সঙ্গে সঙ্গেই।

ঘরের ভেতরটা দেখে নিলো জেফরি বেগ। তাহলে দুটো নয়, সুরক্ষিত সোয়ান লেক সিটিতে মোট তিনটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এখন পর্যন্ত।

সে জানে, আশেপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে দাবানলের মতো।

ছয় তলার ফ্ল্যাট ৫-বি’তে থাকতো এক মহিলা আর তার নয়-দশ বছরের এক ছেলে। কাজের এক বুয়াও থাকতো কিন্তু তাদের কাউকেই ফ্ল্যাটে খুঁজে পাওয়া গেল না।

সহকারির দিকে ফিরে তাকালো। “ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা…ঐ সিঙ্গেল মাদার আর তার বাচ্চা ছেলেটা গেল কোথায়?”

“দারোয়ান বলেছে, তাদেরকে এখান থেকে যেতে দেখেনি।”

“ঘটনা তো গোলমেলে মনে হচ্ছে আমার কাছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরির সহকারি। হাঁটু গেড়ে বসে খুব সাবধানে মৃতদেহের পকেট দুটো চেক করে দেখলো সে। “এই লোকের সঙ্গে ফোন আছে।”

এই ফোনটার সিডিআর করে সন্ত্রাসির পরিচয়সহ আরো অনেক কিছুই জানা যাবে। আলামত হিসেবে জামান ওটা জব্দ করে নিলো।

লাশের দিক থেকে মুখ সরিয়ে জেফরি বলল, “এই ভবনের সিসিক্যাম ফুটেজ যেহেতু নেই, আশেপাশের ভবনগুলোর ফিড কালেক্ট করো, আর দারোয়ানকে এখানে পাঠিয়ে দাও, ওর সঙ্গে কথা বলবো।”

“জি, স্যার।” জামান বের হয়ে গেল ফ্ল্যাট থেকে।

স্থানীয় থানার এসআই’কে লাশটার সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করতে বলে ফ্ল্যাটের দিকে ভালো করে তাকালো জেফরি। তছনছ করার কোনো চিহ্ন নেই, অথচ একজন খুন হয়ে পড়ে আছে। মা আর ছেলের কিছু ছবি আছে ড্রইংরুমের দেয়ালে এবং সোফার পাশের টেবিলে। ছিমছাম ফ্ল্যাট, জাঁকজমক আসবাব নেই। বেশ রুচিসম্মতভাবে সাজানো। বোঝাই যাচ্ছে। বড় বড় রাজকীয় ধরণের উকট আসবাব দিয়ে ঘর ভরানোর বাতিক নেই মহিলার। বয়স কতো হবে?-ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ? আন্দাজ করলো সে। ছেলেটার দিকে নজর দিলো। এক-দেড় বছর বয়স থেকে শুরু করে সম্ভবত বর্তমান বয়সের একটা ছবি আছে। তাতে দেখা যাচ্ছে ছেলেটা হ্যারি পটারের মতো চশমা পরে, বেশ মায়াভরা মুখ। তবে বিষণ্ণ।

এই দুটো ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের মধ্যে কি সম্পর্ক আছে? এদের একজন সিঙ্গেল মাদার, অন্যজন ব্যাচেলর। প্রথমে হামলা করেছিল ৫ বি’তে। দু জন অস্ত্রধারী গেছিল ওখানে। ওটাই প্রাইম টার্গেট ছিল। এই ফ্ল্যাটে যে লোকটা পড়ে আছে সে বাইরে থেকে ঢুকেছে। লোকটার পায়ে গুলি লেগেছে, দরজার ঠিক বাইরে রক্তের ফোঁটা তারই প্রমান দিচ্ছে। এর সঙ্গে অন্ত্র আছে কিন্তু ঐ ফ্ল্যাটের দু-জনের কাছে এরকম কিছু পাওয়া যায়নি। সম্ভবত যার উপরে হামলা করেছিল সে-ই নিয়ে নিয়েছে।

দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো সে, এরই মধ্যে দারোয়ান এসে গেছে, দরজার সামনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। এখনও পুরোপুরি ধাতস্থ হতে পারেনি।

“এখানে যে মহিলা থাকতো সে কতোদিন ধরে আছে?” জিজ্ঞেস করলো জেফরি বেগ।

“তিন-চাইর মাস অইবো।”

“আর ওই ফ্ল্যাটে যে লোকটা থাকতো একা, সে কবে উঠেছিল?”

“দুই মাসের বেশি হইবো না, ছার।”

সময়ের এই গড়মিল বলে দিচ্ছে দুই ফ্ল্যাটের বাসিন্দার মধ্যে কোনো সম্পর্ক হয়তো নেই। তবে সন্ত্রাসিচক্রের লোকজন হলে ভিন্ন কথা, তারা হয়তো ইচ্ছে করেই আলাদা আলাদা সময় দুটো ফ্ল্যাটে উঠেছে নিজেদের সম্পর্কটা আড়াল করার জন্য।

“এই ফ্ল্যাটের মালিক কে?”

“জহির ছার।”

“তার ফোন নাম্বার আছে তোমার কাছে?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো দারোয়ান।

তার কাছ থেকে নাম্বারটা নিয়ে জেফরি বেগ কল দিলো।

“হ্যালো?” ওপাশ থেকে ভারিক্কি একটা কণ্ঠ বলল।

“জহিরসাহেব বলছেন?”

“হুম, বলছি…আপনি কে বলছেন?”

“আমি হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর জেরি বেগ বলছি।”

“হোমিসাইড?” আঁৎকে উঠলেন ভদ্রলোক।

“আপনার সোয়ান লেক সিটির ফ্ল্যাটে একটা ঘটনা ঘটে গেছে।”

“কোন ফ্ল্যাটে?” উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন ফ্ল্যাটের মালিক।

কয়টা ফ্ল্যাট আছে এই লোকের? অবাক হলো জেফরি। ফ্ল্যাটের মেইন দরজাটার কাছে হেঁটে গেল, ওটা পুরোপুরি ভোলা আছে। ফ্ল্যাট নাম্বারটা দেখে নিলো সে। “ফাইভ ডি।”

“ওহ্।”

“পরের ফ্ল্যাটটাও কি আপনার?”

“উমম…হ্যাঁ,” একটু থেমে আবার বলল, “ওখানে কী হয়েছে? আপনারা কেন? খুনটুন হয়েছে না কি?” আতঙ্কিত গলায় বললেন ভদ্রলোক।

“হুম…খুন হয়েছে, তবে ফ্ল্যাটের কেউ না। এখানে এক দল সন্ত্রাসি ঢুকেছিল, তাদের একজন মারা পড়েছে।”

“বলেন কি! কাহিনি কি? টিভি-নিউজে তো কিছু দেখলাম না।”

এত দ্রুত টিভিতে নিউজ দেখতে চায়! মনে মনে বলল জেফরি বেগ। “এই ফ্ল্যাটটা কে ভাড়া নিয়েছিল আপনার কাছ থেকে?”

“ভাড়া তো নিয়েছিল…ইয়ে…মানে, মামুনুর সাহেব।”

“উনার সম্পর্কে আরেকটু বলেন?”

“ভদ্রলোক একটা প্রাইভেট সার্ভিসে আছেন মনে হয়। তিন মাস আগে ভাড়া নিয়েছেন ফ্ল্যাটটা, এর বেশি কিছু জানি না।”

“কিন্তু এখানকার সবাই বলছে, এই ফ্ল্যাটে এক মহিলা তার বাচ্চাছেলেকে নিয়ে থাকতো, কোনো পুরুষ মানুষ থাকতো না।”

“বউ-বাচ্চা থাকতো কিন্তু মামুনুর সাহেব থাকতেন না?” অবাক হলো ফ্ল্যাটের মালিক।

“হুম। আপনি শিওর, মহিলা মামুনুর সাহেবের স্ত্রী?”

“আমাকে তো সেটাই বলেছে।”

“মামুনুর সাহেবের নাম্বারটা নিশ্চয়ই আপনার কাছে আছে, আমাকে সেটা দিন।”

ফ্ল্যাটের মালিকের কাছ থেকে নাম্বারটা নিয়ে আর দেরি করলো না, ডায়াল করলো সে। তিন বার রিং হবার পর কলটা রিসিভ করা হলো।

“হ্যালো, মামুনুর সাহেব বলছেন?”

“আপনি কে বলছেন?” কণ্ঠটা বেশ উদ্বিগ্ন।

“আমি হোমিসাইড থেকে বলছি। সোয়ান লেক সিটিতে।”

“সরি, রং নাম্বার।”

জেফরি বেগ আর কিছু বলার আগেই লাইনটা কেটে দিলো ভদ্রলোক। সঙ্গে সঙ্গে আবার কল দিলো। বেশ কয়েকবার রিং হলেও কলটা রিসিভ করা হলো না। তৃতীয়বারের মত কল করতে গেলে দেখা গেল ফোনটা বন্ধ। অবাক হলো সে। পাশের ফ্ল্যাটে, যেখানে দু দুটো লাশ পড়ে আছে, সেই ফ্ল্যাটে কে থাকতো কেউ বলতে পারছে না। নামটা পর্যন্ত জানে না এখানকার দারোয়ান থেকে শুরু করে অন্য অ্যালোটিরা। মালিক কে, তা-ও বলতে পারে না। আর এই ফ্ল্যাটটা যে ভাড়া নিয়েছে, সে এখানে থাকতো না, থাকতো এক মা আর তার শিশু সন্তান। যে লোক ভাড়া নিয়েছে সে অদ্ভুত আচরণ করছে। হেমিসাইডের কথা শুনেই কলটা কেটে দিয়েছে। এতে রহস্য কেন এই সোয়ান লেক সিটি’র দুটো ফ্ল্যাটে? এখানে আসলে কী ঘটেছে?

“স্যার, সিসিক্যামের ফুটেজ পেয়েছি,” ফ্ল্যাটে ঢুকে জামান বলে উঠল।

1 Comment
Collapse Comments

আনেক ধন্যবাদ এই প্লাটফ্রম যিনি বানাইছে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *