২০. জেলে থাকতেই বাবা

॥ ২০ ॥

জেলে থাকতেই বাবা তখনকার কেন্দ্রীয় বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনের পর তাঁর মুক্তি দাবি করে, অন্ততপক্ষে তাঁব সেন্ট্রাল অ্যাসেমব্লিতে যোগদানের গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকার করিয়ে নেবার জন্য, বিরোধী পক্ষ অনেক শোরগোল কবলেন। কিন্তু সবকারের মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হল না। বাবার অ্যাসেমব্লির আসনটি খালিই পড়ে

বই।

এক দুপুরে যখন বাবাব মুক্তির আদেশ এল তখন আমি স্কুলে। মনে আছে, খবরটা (পেয়ে হেডমাস্টার মশাইয়ের অনুমতি নিয়ে ইস্কুল থেকে বাড়ি সাবা পথটা দৌড়ে এসেছিলাম। বাবা জেল থেকে বেরিয়ে দেখলেন দেশের পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গেছে। বাংলা দেশে কংগ্রেসের তখন একজন বিশিষ্ট নেতার প্রয়োজন। দুই প্রধান নেতার মধ্যে। যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত জেলে থাকতেই মারা গেছেন। রাঙাকাকাবাবু ইউরোপে, কবে ফিরবেন খুবই অনিশ্চিত। বাংলার কংগ্রেসের বেশির ভাগ দল ও উপদল বাবাকেই চাইলেন।

ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সবেমাত্র ভারতের জন্য এক নতুন সংবিধান-গভর্নমেন্ট অব ইণ্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯৩৫–পাস করেছে। জাতীয়তাবাদীরা বুঝলেন যে, বড় একটা চ্যালেঞ্জ এগিয়ে আসছে। বিশেষ করে বাংলা দেশের পরিস্থিতিটা ছিল খুবই জটিল। সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের শাসকেরা যে ওষুধের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেটা ছিল ব্যাধির চেয়েও মারাত্মক। সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা বলে যে ফরমুলাটি তাঁরা বাংলা দেশের উপর। চাপিয়ে দিলেন তার ফলে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ক্রমে আরও তিক্ত হয়ে উঠল এবং হিন্দু ও মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক সংস্থাগুলি আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ভাল করে লড়তে হলে কংগ্রেসে তখন একজন শক্তিমান পুরুষের দরকার ছিল।

৬৩

অন্যদিকে বাবা ফিরেছেন খবর বেরোতেই হাইকোর্টে একটা প্রচণ্ড শোরগোল পড়ে গেল। মক্কেলরা ব্রীফের স্তূপ মাথায় করে উডবার্ন পার্কে ভিড় করলেন। খবরের কাগজে বেরোল, মিঃ বোস ফ্লাডেড উইথ ব্রীফস।

১৯৩৫-এর শেষে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে প্রথম বিয়ে লাগল। আমার দিদি মীরার সম্বন্ধ মোটামুটি ঠিক করে বাবা সোজা এলগিন রোডের বাড়িতে মাজননীর সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। বাবাকে দেখেই মাজননী বললেন যে, তিনি সবেমাত্র স্বপ্নে দেখেছেন যে দাদাভাই গায়ের চাদর ও লাঠি নিয়ে বেরোবার জন্য তৈরি হচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করতে দাদাভাই বললেন–অবশ্যই স্বপ্নে–যে তিনি মীরাবাঈয়ের জন্য বর দেখতে যাচ্ছেন। বাবা আশ্চর্য হয়ে মাজননীকে জানালেন, তিনি তো বর দেখেই সোজা তাঁর কাছে এসেছেন। শুনে মাজননী বাবাকে বললেন ঐ সম্বন্ধটাই পাকাপাকি করে ফেলতে। পরে আমাদের বড় ভগ্নীপতিকে অনেকেই স্বপ্নে পাওয়া জামাই’ বলে অভিহিত করতেন।

বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বাবা কিছু আধুনিকতা আনতে চাইলেন। বললেন, ভিয়েন বসিয়ে পাত পেড়ে খাওয়ানোটা সংক্ষেপে করতে হবে। তার বদলে টী-পাটি হবে। এই প্রস্তাবে আত্মীয়-স্বজন ও পরিবারের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অনেকে আপত্তি তুললেন–যেন শাস্ত্র অশুদ্ধ হয়ে যাবে! যা-ই হোক, বাবা নিজের মতে অবিচল রইলেন। তবে কার্যত বাবার পাত পেড়ে খাওযানো ও টী-পাটি দুটোই খুব বড় করে হল। টী-পাটি থেকে বসু-বাড়ির মহিলা-মহলে অনেকে দূরে সরে রইলেন।

১৯৩৬ সালে বাবার উপর কংগ্রেসের কাজের চাপ ক্রমেই বাড়তে লাগল। রাঙাকাকাবাবুর অনুপস্থিতিতে বাবাই বাংলার কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সেই বছরে কংগ্রেসের পূর্ণ অধিবেশন হবে লখনৌতে–সভাপতি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। সেই সময় কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থীর রাজনীতি দানা বাঁধতে আরম্ভ করেছে এবং সাধাৰণভাবে বলা যায় জওহরলাল, রাঙাকাকাবাবু ও বাবা এক পথের যাত্রী। বাঙাকাকাবাবু ঠিক করলেন যে, তিনি লখনৌতে কংগ্রেসে যোগ দেবেন এবং মার্চ-এপ্রিল নাগাদ দেশে ফিরে আসবেন। খবরটা প্রচার হয়ে যাওয়া মাত্র রাঙাকাকাবাবু ভিয়েনার ইংরেজ কূটনৈতিক প্রতিনিধির কাছ থেকে এই চিঠি পেলেন :

12th March 1936

I have today received instructions from the Secretary of State for Foreign Affairs to communicate to you a warning that the Government of India have seen in the press statements that you propose to return to India this month and the Government of India desire to make it clear to you that should you do so you cannot expect to remain at liberty.

J. W. Taylor

His Majesty’s Consul যেমন কথা তেমন কাজ। রাঙাকাকাবাবু সরকারের হুমকি উপেক্ষা করে এপ্রিলের গোড়ায় বোম্বাই বন্দরে পৌঁছনো মাত্র তাঁকে গ্রেপ্তার করা হল।

কংগ্রেসের সভাপতির কাজ তুলে নেবার পর ১৯৩৬-৩৭ সালে বেশ কয়েকবার পণ্ডিত

৬৪।

জওহরলাল কলকাতায় সফরে আসেন। বাবার আমন্ত্রণে তিনি আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়িতে উঠতেন। তিনি একতলার যে ঘরে থাকতেন সেটার নামই হয়ে গিয়েছিল পণ্ডিতজির ঘর–পণ্ডিতজিকা কামরা। তাঁর ব্যক্তিত্বের এক অসাধারণ আকর্ষণ ছিল–আমরা তো তাঁকে দেখবার জন্য তাঁর ঘরের আনাচে-কানাচে ক্রমাগতই ঘোরাফেরা করতাম। তাঁর জীবনযাত্রার ধারাটা ছিল সহজ ও স্বাভাবিক, কিন্তু সব দিক দিয়েই ফিটফাট ও নিয়মমাফিক। তাঁর অতিবিনয়ী ও সদাহাস্যময় সেক্রেটারি উপাধ্যায়জি একটি বিশেষ কাজের জন্য আমাকে প্রায়ই ভোরে পণ্ডিতজির ঘরে নিয়ে যেতেন। বাথরুমে জল গরম করবার গ্যাসের যন্ত্রটি আমাকে চালু করে দিতে হত। কী জানি কেন, পণ্ডিতজি হেসে বলতেন, ও কাজটা বড়ই গোলমেলে, আমি পারি না। সেই সময় প্রায়ই দেখতাম, পণ্ডিতজি মেজেতে একটি চাদর পেতে ব্যায়াম করছেন।

খাওয়া-দাওয়াব ব্যাপারে পণ্ডিতজি খুবই হিসেবি ছিলেন। বিদেশী ও দেশী দুরকম রান্নাই টেবিলে তাঁর জন্য দেওয়া হত। তিনি কিন্তু খুব বেছে অল্প খেতেন, গুরুপাক খাদ্য মোটেই খেতেন না। মনে পড়ে, খাবার পর তাঁকে ফলমিষ্টি দেওয়া হয়েছে। আপেলটা বা সন্দেশটা ছুরি দিয়ে আধখানা করে অর্ধেকটা নিয়ে মুচকি হেসে বাকিটা আমাদের কারুর দিকে ঠেলে দিয়ে বলতেন, “উইল ইউ হ্যাভ দি আদার হাফ? সারাদিন খাটাখাটুনির পর বাত্রের খাওয়াটা তিনি খুবই হালকা রাখতেন–স্ক্র্যামবেলড ডিম ও কফি। হয়তো বাইরের কাউকে নেমন্তন্ন করা হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি পদ রান্নাও হয়েছে, সব দেখেশুনে হাসতে হাসতে বাবার দিকে চেয়ে বলতেন, “শরৎ বোসের ডিনার ইজ এ স্যান্স, ইট নেভার এনড়স। সিগারেট খেতেন গুনে গুনে। খাবার পর দুটি-একটি। মনে আছে, বাবা আমাকে পণ্ডিতজির জন্য ভাল বিলিতি সিগারেট ব্ল্যাক অ্যাণ্ড হোয়াইট কিনতে দিয়েছেন—অতিথি-সৎকারে কোনো বাধা নেই। বহুদিন পবে ১৯৬০-এ দিল্লিতে পতিজির সঙ্গে কাজে দেখা করতে গিয়েছি, দেখি একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছেন। বললাম, আপনি এত সিগারেট খাচ্ছেন কেন। আগে তো খেতেন না! উত্তবে বললেন, শুনেছি সুভাষ তো যুদ্ধের সময় চেন-স্মোকিং করত, তাই না? আমি সায় দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার সিগারেট চলে নাকি?’ আমতা-আমতা করে বললাম, মাঝে মাঝে চলে। তাহলে চলুক না একটা বলে আমাকে একটা সিগারেট খাওয়ালেন। আরও বললেন, ‘বোধহয় নানারকম স্ট্রেনের জন্য সিগারেট খাই, সুভাষও বোধহয় তাই করত।

জওহরলালকে দেখবার জন্য উডবার্ন পার্কে কী ভিড়ই না হত! কংগ্রেসীদের ভিড় তো আছেই, তার উপর সব স্তরের সব বয়সের মানুষ ভেঙে পড়ত। তিনি ভিড় সামলাতে ভালই পারতেন, কিন্তু কখনও কখনও ধৈর্য হারাতেন ও রেগে যেতেন। দুটি জিনিস তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। এক, দু’মিনিটের কাজ আছে বলে কুড়ি মিনিট সময় নষ্ট করা। দুই, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা।

যখন কংগ্রেসের প্রচারে তিনি বেরাতেন, সারাদিনে প্রায়ই আঠারো-বিশটা সভায় বক্তৃতা করতেন। বাবা ও জওহরলালকে এক সঙ্গে বেশ কয়েকটা সভায় বক্তৃতা করতে শুনেছি। পণ্ডিতজির গলায় জোর ছিল কম, মাইক না হলে চলত না। মিটিং করতে যাবার সময় গাড়িতে তাঁর জন্য ফ্লাস্কে ভরে গরম জল দেওয়া হত। বক্তৃতার মধ্যে মধ্যে তিনি জলে চুমুক দিতেন।

৬৫

॥ ২১ ॥

রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে খেতে বসেছি কার্শিয়ঙে আমাদের গিধাপাহাড়ের বাড়িতে। কালু সিং ইউরোপীয় ধাঁচের খাবার দিচ্ছে, প্রথমেই সূপ। আমরা তো সূপের বাটিটা উল্টো দিকে কাত করে নিয়ে চামচে করে সূপ খেতে অভ্যস্ত। রাঙাকাকাবাবু কিন্তু সূপের বাটিটা নিজের দিকে কাত করে খাচ্ছেন। বললেন, “তোমরা বাটিটা উল্টো দিকে কাত করে খাচ্ছ কেন?” ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে তাকিয়ে আছি। মুচকি হেসে বললেন, “তোমরা যেমন করে খাচ্ছ সেটা তো ইংবেজি কায়দা, ইউরোপের অন্যান্য দেশে কিন্তু আমি যেমন করে খাচ্ছি তেমনি করে খায়।” •

আমরা যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, আচার-ব্যবহারে, অভ্যাসে ও রুচিতে, ইংরেজদের অন্ধ অনুসরণ করি, সেটা রাঙাকাকাবাবু সুস্থ ও মুক্ত মনোভাবের পরিচায়ক বলে মনে করতেন না। অনেক দিনের দাসত্বের ফলে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের সব ক্ষেত্রে আমরা এই ধরনের মনোভাবের পরিচয় দিই। ছোটখাটো দৃষ্টান্ত দিয়ে বাঙাকাকাবাবু আমাদের বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন যে, সব বিষয়ে ইংরেজদের অনুকরণের স্পৃহা থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত ইউরোপে থাকার ফলে রাঙাকাকাবাবু মধ্য ইউরোপের, বিশেষ করে জার্মানদের, কৃষ্টি, শিক্ষা ও জীবনযাত্রার ধরন ইত্যাদির দাবা বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন। তা ছাড়া মধ্য ইউরোপের ভারতপ্রেমী বিদগ্ধ মানদের সঙ্গে মেলামেশা করে তিনি বুঝেছিলেন যে, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সমানে-সমানে হতে পারে। কারণ সেখানে প্রভু-প্ৰজার সম্পর্কের লেশমাত্র নেই। জামান। পণ্ডিত ও ভারততত্ত্ববিদরা বহুদিন আগে থেকেই আমাদের দেশের প্রাচীন সভ্যতা, ধর্ম, দর্শন ও কৃষ্টির দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। অপর পক্ষে ইংরেজরা আমাদের দেশে এসেছিলেন মূলত ব্যবসা করতে এবং শেষ পর্যন্ত রাজা হয়ে বসেছিলেন। দুটোর মধ্যে অনেক ফারাক।

আমি যে-সময়ের কথা বলছি তখন রাঙাকাকাবাবু কার্শিয়ঙে আমাদের বাড়িতে বন্দী হয়ে বয়েছেন, এবং আমি ও আমার দাদা অমিয়নাথ সরকারের বিশেষ অনুমতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে গরমের ছুটি কাটাচ্ছি। বছর দুয়েক আগে বাবা নিজের বাড়িতে বন্দী-জীবন কাটিয়ে গেছেন। রাঙাকাকাবাবুর ওপরও শর্ত ও বিধিনিষেধ ঠিক একই রকম ছিল। দেখা করা বা কথা বলা কারুর সঙ্গেই চলবে না। পুলিস-পাহারা বেশ কড়া। হিলকার্ট রোডে একমাইল উপর দিকে ও একমাইল নীচের দিকে বেড়াতে পারতেন, পেছন-পেছন বন্দুকধারী পুলিস তাঁকে অনুসবণ করত। আমাদের তো কোনো কাজ নেই, কেবল রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে বেননা, খাওয়া-দাওয়া ও গল্প করা। তবে আমি তখনও পর্যন্ত কথা বলতাম খুব কম,

সেজন্য রাঙাকাকাবাবু আমাকে ‘সাইলেন্ট বয়’ আখ্যা দিয়েছিলেন।

‘সাইলেন্ট হবার যেমন কতকগুলি অসুবিধা আছে, তেমনি সুবিধাও আছে। কথাবার্তা কম বললে পারিবারিক দিক থেকে সামাজিক দিক থেকে খানিকটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়তে হয়। তবে চুপচাপ থেকেও যদি চোখ কান ও ‘মন খুলে রাখা যায়, এবং একাগ্র হয়ে সব-কিছু বিচার করা যায়, তাহলে শেষ পর্যন্ত লাভ বই লোকসান হয় না। বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আমি তো অনেকদিন খোলাখুলি বাক্যালাপ করতে পারতাম না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে আমি এত অকপটে কথাবার্তা বলেছি যে, নিজেই আশ্চর্য হয়ে

গেছি। কথাবার্তা কম বলার আর একটা বড় লাভ হচ্ছে গভীর চিন্তার অবকাশ পাওয়া। অনেক বড় হবার পরেও এবং হাজার কাজের মধ্যেও মহাত্মা গান্ধী সপ্তাহে একদিন যৌন থাকতেন। গান্ধীজি আমাদের বাড়িতে থাকতে দেখেছি তিনি কেমন টুকরো-টুকরো কাগজে কথার জবাব লিখে লিখে দিচ্ছেন–তা প্রশ্নকর্তা যিনিই হোন না কেন। মনে আছে বাড়িতে একদিন চায়ের আসরে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বাবাও আছেন। কেউ বললেন ব্যারিস্টারি করা আমার দ্বারা হবে না, কারণ আমি বড়ই কুনো’, মুখে তো কথাই ফোটে না। বাবা কিন্তু বললেন, ওর আইনব্যবসার ‘গুরুজি’ স্যার নৃপেন্দ্রনাথ সরকার ছেলেবেলায় নাকি খুবই লাজুক ছিলেন, এবং কথাবার্তায় পটু ছিলেন না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কত বড় ব্যারিস্টার হয়েছিলেন।

গল ব্লাডার অপারেশনের পর বেশ কিছুদিন হজমের দিক থেকে অসুবিধা থাকে। পরে নিজের একই অপারেশনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি সেটা ভাল করে বুঝতে পারি। রাঙাকাকাবাবুকে সেজন্য ১৯৩৬ সালে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে খুব সাবধানে থাকতে হত। কালু সিং খুব সাদাসিধে ইউরোপীয় ধরনের খাবার তৈরি করে দিত। উপায় নেই তো, সে অন্য কথা–কিন্তু আমার মনে হয়, রাঙাকাকাবাবুর নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হত। কারণ, মুখরোচক সুস্বাদু খাবার তিনি খুব উপভোগ করতেন, এবং দেখেছি, সময়-সময় অতিরিক্ত পরিমাণ খেয়ে ফেলতেন। খেয়ে হাঁসফাঁস করতেন আর বলতেন, “ও খাবারগুলো পেটের মধ্যে দমে বসে আছে!” কড়াইশুটির কচুরি, শিঙাড়া, চিকেন কাটলেট ইত্যাদি সামনে দেখলে তাঁর মুখে বেশ আনন্দের ভাব ফুটে উঠত।

১৯৩৭ সালে পুজোর সময় বাবা, রাঙাকাকাবাবু ও আমরা ভাইবোনেরা প্রায় সকলে কার্শিয়ঙে একসঙ্গে ছিলাম। তখন যেন দুই ভাইয়ে খাওয়ার কম্পিটিশন। বাবার মিষ্টি কম খাওযার কথা, কিন্তু মিষ্টি তিনি খাবেনই। রাঙাকাকাবাবুর গুরুপাক ভাজা মুখরোচক জিনিস খেলে অসুবিধা হয়, কিন্তু তিনি ছাড়বার পাত্র নন। বাজারের মুখরোচক খাবারও তিনি সুযোগ পেলেই খেতেন। ১৯৩৭-এর এপ্রিলে মুক্তি পাবার পর এলগিন রোডের বাড়িতে তিনি দাদাভাইয়ের ঘরে থাকতেন। সেই ঘরটি বর্তমানে নেতাজী ভবনে’ নেতাজীর ঘর বলে পরিচিত। ঠিক পাশের ঘরেই থাকতেন মাজননী। দুপুরবেলা সামনের রাস্তা দিয়ে ‘হট পাটিস’ ফেরি করে যেত। বাড়ির সামনে প্যাটি কিনলে তো মাজননী দেখে ফেলতে পাবেন। সুতরাং রাঙাকাকাবাবু পাশের গলিতে ফেরিওয়ালাকে বসিয়ে চুপিসারে প্যাটি কিনিয়ে আনতেন ও ভাইপো-ভাইঝিদের সঙ্গে নিয়ে আনন্দ করে খেতেন।

বন্দী অবস্থায় কার্শিয়ঙে রাঙাকাকাবাবুর সকাল-সন্ধে বেড়ানো চাই। জুন মাস, বর্ষা নেমে গিয়েছে। পাহাড়ের বৃষ্টি কি ছাতা ব্যতির বাধা মানে? তা ছাড়া হিলকার্ট রোডে তো নদীর স্রোতের মতো জল বয়ে চলেছে। তাতে কী? বেড়াতে বেরোতেই হবে। আর বেড়াতে বেড়াতে কত গল্প! ছেলেবেলার গল্প, পারিবারিক নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা, নানা লোকের চরিত্র বিশ্লেষণ, দেশের কথা, বিশ্বরাজনীতির কথা ইত্যাদি। খানিকটা দুঃখের। সুরে হয়তো বললেন, “জানো, আমি যখন ছোট ছিলাম, প্রায় সকলেই বলত, আরে ওটা একটা বদ্ধ পাগল, জীবনে ওর কিছুই হবে না।” আমি মনে-মনে ভাবতাম, কথাটা তো পুরোপুরি ভুল নয়, পাগলামির তো চূড়ান্ত দেখছি, আর সাধারণ মানুষে যাকে ‘কিছু হওয়া

৬৭

বলে তা তো সুভাষচন্দ্রের কিছুই হয়নি। অসাধারণত্ব ও পাগলামির ব্যবধান বোধহয়

অঙ্গই।

॥ ২২।

এটা তো সকলেই জানেন যে, প্রথম জীবনে রাঙাকাকাবাবু সাইকোলজি বা মনস্তত্ত্বে খুব আগ্রহী ছিলেন এবং এক সময়ে ভেবেছিলেন এই বিষয়টা নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেবেন। কিনা। ১৯৩৬-এ কার্শিয়ঙে পারিবারিক নানা সমস্যা বা পরিবারের বিভিন্ন লোকের বা ছেলেমেয়েদের আচার-ব্যবহার, লেখাপড়া, কেরিয়ার ইত্যাদি নিয়ে কথা উঠত। তাঁর কথাবার্তা থেকে বোঝা যেত যে, তিনি প্রত্যেকটি ব্যক্তির জীবনের ধারা ও আচরণ। বৈজ্ঞানিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেন। এমন কী আমাদের জেনারেশনের যে-কোনো ছেলে বা মেয়ের স্বভাব-চরিত্রের ও আচরণের বেশ একটা ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারতেন। কার চরিত্রের কোন দিকটা সবল, কোন দিকটা দুর্বল, এসব বিষয়ে তাঁব নিজের একটা পরিষ্কার ধারণা ছিল। নিজের জেনারেশনের লোকেদের সম্বন্ধে তিনি আমাদের সামনে আলোচনা করতেন কম, কিন্তু আমার ধারণা সেক্ষেত্রেও তাঁর মতামত খুব পরিষ্কার ছিল। তিনি তো অন্যদের মতো সংসারে জড়িয়ে পড়েননি। কিন্তু পারিবারিক কোনো সমস্যা বা কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির কথা উঠলে তিনি একটা কথা বারবার আমাদের বলতেন, সংসারে সুখস্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে “উদার হওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।” তিনি আমাদের বোঝাতে চাইতেন যে, ছোটখাটো, অপ্রিয় বা হিংসাপ্রসূত যা-কিছু আছে সেগুলি উদার মনোভাব নিয়ে উপেক্ষা করতে না পারলে সাংসারিক বা সামাজিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে বাধ্য।

ইউরোপের নানা দেশে ঘুরে, ভিন্নভিন্ন দেশের নেতৃস্থানীয় লোকেদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ও কথাবার্তা বলে বিশ্ব-রাজনীতির ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে রাঙাকাকাবাবুর বেশ একটা পরিষ্কার ধারণা হয়ে গিয়েছিল। এব্যাপারে আমাদের অধিকাংশ নেতার অনীহা ও অজ্ঞতা তাঁকে পীড়া দিত। একদিকে তখন তো জাপান ছাড়া এশিয়ার ও আফ্রিকার প্রায় সব দেশই ছিল পরাধীন। অন্য দিকে আমেরিকা ও রাশিয়া ছিল এশিয়া আফ্রিকার দেশগুলি সম্বন্ধে মোটামুটি ভাবে নিস্পৃহ। সেজন্য ইউরোপীয় রাজনীতি ভাল করে না বুঝলে বিশ্বরাজনীতিব রূপ ও গতি বোঝা সম্ভব ছিল না। আমাদের লড়াই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। কোন কোন নতুন শক্তি ব্রিটিশ সাম্রাবাদকে চ্যালেঞ্জ বা খর্ব করতে পারে, এবং

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে সহায়ক হতে পারে এ-বিষয়ে। রাঙাকাকাবাবু গভীরভাবে বিচার-বিবেচনা করেছিলেন। এদিক দিয়ে তাঁর চিন্তাধারা দেশের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের থেকে পৃথক ছিল, ফলে তাঁর কাজের ধারাও অন্য স্রোতে বইত। আদর্শবাদ ও ব্যবহারিক রাজনীতির বেশ একটা সমন্বয় তিনি করতে পেরেছিলেন। আজকের দিনের ছেলেমেয়েরা তাঁর লেখা ও কর্মজীবন থেকে অনেক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।

রাঙাকাকাবাবুর কথাবাতা থেকে মনে হত না যে, তাঁর ছেলেবেলাটা শান্তিপূর্ণ ছিল। ইস্কুল-কলেজ যাওয়া-আসা করা, পরীক্ষা পাস করা, বৃত্তি পাওয়া গতানুগতিক এসব নিশ্চয়

৬৮

ছিল, কিন্তু তাঁর ভিতরে নিজের বিবেকের সঙ্গে ও বাইরে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই করতে করতে তিনি বড় হয়েছিলেন। এ-ধরনের অভিজ্ঞতা খুব কম লোকেরই হয়। আমাদের দেশের অন্য অনেক নেতার ক্ষেত্রে দেখেছি, পরিণত বয়সে বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতার ফলে অথবা হঠাৎ বিশেষ কারুর ডাকে সংগ্রামের পথে চলে আসেন। রাঙাকাকাবাবু কিন্তু ছিলেন সত্যই আজীবন সংগ্রামী। একথাটি আমি প্রথম বুঝি ১৯৩৬ সালে কার্শিয়ঙে আঁকাবাঁকা পথে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে।

১৯৩৬-এর শেষের দিকে সরকার রাঙাকাকাবাবুকে কলকাতায় নিয়ে এসে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে দেয়। তাঁর শরীরও ভাল যাচ্ছিল না। তাছাড়া শীতের সময় কার্শিয়ঙে থাকাটা খুব সুখেরও নয়। মেডিকেল কলেজে বিভিন্ন সময়ে কত রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী বা বিপ্লবী যে বন্দী হয়ে থেকেছেন, তার ইয়ত্তা নেই, এর একটা হিসেব নিলে হয়। পরে ১৯৪২-এ আন্দোলনের সময় আমার নিজেরও এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ১৯৩৬-এ আমরা দল বেঁধে সরকারের অনুমতি নিয়ে মেডিকেল কলেজে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। বাবা তখন নতুন সাধারণ নির্বাচনের কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত। বেশ বোঝা যেত, রাঙাকাকাবাবু বাবার সঙ্গে হাত মেলাবার জন্য ছটফট করতেন, নানাভাবে বাবার কাছে নির্বাচনের প্রচার সম্বন্ধে বা কংগ্রেসের প্রার্থী নির্বাচন সম্বন্ধে নিজের মতামত পাঠিয়ে দিতেন।

মাজননীর শরীর তখন ভাল নয়, নিয়মিত মেডিকেল কলেজে গিয়ে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করা তাঁব পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিছুদিন পরে সরকার রাঙাকাকাবাবুকে পুলিস পাহারায় এলগিন রোডের বাড়িতে সন্ধ্যার সময় কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে আসত, আবার ফেরত নিয়ে যেত। তাঁকে দেখবার জন্য সেই সময় বাড়িতে আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবদের বেশ ভিড় হত।

১৯৩৬-এ ইউরোপ থেকে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে এক অতিথি এলেন, রাঙাকাকাবাবুরই আমন্ত্রণে। ভিয়েনার শ্রীমতী হেডি ফুলপ-মিলার। রাঙাকাকাবাবু ভিয়েনাতে থাকার সময় শ্রীমতী ফুলপ-মিলার তাঁকে খুবই দেখাশুনো কবেছিলেন। তাছাড়া ভারতবর্ষের দর্শন, কলা ও কৃষ্টির প্রতি তাঁর টান ছিল গভীর। বিশেষ অনুমতি নিয়ে তিনিও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাঙাকাকাবাবুকে দেখতে যেতেন। শ্ৰীমতী ইউরোপীয় অপেরা সঙ্গীতে পারদর্শিনী ছিলেন এবং কলকাতার রেডিওতে তিনি গানও গেয়েছিলেন। সমঝদারেরা তখন বলেছিলেন, অত উঁচু মানের ইউরোপীয় সঙ্গীত তখনও পর্যন্ত কলকাতার রেডিও স্টেশন থেকে কমই প্রচারিত হয়েছে। আমাদের বাড়িতে অতিথি থাকার ফলে শ্ৰীমতী ফুলপ-মিলারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের খুব অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাড়ির সব ছেলেমেয়েকে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন। তিনি চিরকাল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন এবং ইউরোপে পরে আমাদের সঙ্গে তাঁর বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে।

১৯৩৭ সালে এপ্রিলে রাঙাকাকাবাবু মুক্তি পেলেন। মুক্তির পর স্বাস্থ্যের জন্য তিনি। কিছুদিন ড্যালহাউসি পাহাড়ে ধরমবীর-দম্পতির সঙ্গে কাটিয়ে আসেন। ছাত্রজীবনে, ১৯২০-২১ সালে, ইংল্যাণ্ডে ডাক্তার ও শ্রীমতী ধরমবীরের সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর পরিচয় হয়। শ্ৰীমতী ধরমবীর ছিলেন ইংল্যাণ্ডবাসী রাশিয়ান মহিলা। তাঁর মাতৃসুলভ ব্যবহার ও

চরিত্রের মাধুর্যে রাঙাকাকাবাবু যে শুধু গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন তাই নয়। দিলীপকুমার রায়ের মুখে শুনেছি, শ্ৰীমতী ধরমবীরকে দেখার পর ইউরোপীয় মহিলাদের সম্বন্ধে তাঁর ধারণা ও মতামতের পরিবর্তন ঘটে। এর আগে রাঙাকাকাবাবুরই আমন্ত্রণে এক ধরমবীর-কন্যা বেশ কিছুদিন আমাদের সঙ্গে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করেছিলেন। সেই সময় আমরাও শ্রীমতী ধরমবীরকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম।

ড্যাহাউসি থেকে ফিরে রাঙাকাকাবাবু পুরোপুরি আবার দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ১৯৩৭-এর অক্টোবরে কলকাতায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশন হবে। তার আগেই সব ব্যবস্থা করতে পুজোর সময় তিনি কার্শিয়ঙে বাবার সঙ্গে মিলিত হলেন।

। ২৩ ॥

যেখানে গভীর প্রীতি ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক, সেখানে অনেক সময় অভিমানের মাত্রাটাও বেশি হয়! ১৯৩৭-এ রাঙাকাকাবাবু মুক্তি পাবার আগেই মাজননী মার কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, মুক্তির পর রাঙাকাকাবাবু যেন উডবার্ন পার্কে না থেকে এলগিন রোডের বাড়িতে তাঁর কাছে থাকেন। বিধবা হবার পর যে-কোনো মায়ের এরকম ইচ্ছা হওয়া স্বাভাবিক। তবে আমার মনে হয় মাজননীর ঐ প্রস্তাবে আমার মার মন ঠিক সায় দেয়নি। যাই হোক শাশুড়ির কথামতো মা রাঙাকাকাবাবুকে মাজননীর ইচ্ছার কথা বলেন এবং সোজাসুজি আরও বলেন যে, তিনি রাঙাকাকাবাবুর পথ আগলাবেন না। কথাটা শুনে রাঙাকাকাবাবুর। খুব অভিমান হয় এবং মাকে বেদনায় ভরা একখানা চিঠি লেখেন। এমন কথাও তিনি লিখেছিলেন যে, আমার মা যেন একরকম জোর করেই তাঁর জীবনের এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটাচ্ছেন। আসলে অবশ্য তেমন কিছুই হয়নি, বাবা-মার সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর গভীর প্রীতির সম্পর্কে কোনোদিন কোনো ছেদ পড়েনি। রাঙাকাকাবাবুর সেই চিঠিখানা মা পরে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।

আগেই তো বলেছি ১৯৩৭-এর পুজোর সময় ড্যালহাউসি থেকে ফিরে রাঙাকাকাবাবু কার্শিয়ঙ-এ আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকদিন ছিলেন। দিনকতক পরেই কলকাতায় অল ইণ্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির অধিবেশন বসবে। কংগ্রেসের সভাপতি পণ্ডিত জওহরলাল তো আসবেনই, গান্ধীজিও আসবেন। দুজনেই বাবার আমন্ত্রণে আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়িতে থাকবেন। কংগ্রেসের অধিবেশনের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাদি নিয়ে বাবা ও রাঙাকাকাবাবু কার্শিয়ঙ-এ নিজেদের মধ্যে ক্রমাগতই আলোচনা চালাতেন। নানা দিকে অনেক চিঠি লেখালেখি চলত। বাবা ও রাঙাকাকাবাবু একসঙ্গে কার্শিয়ঙ-এ আছেন খবর পেয়ে কিন্তু কার্শিয়ং ও দার্জিলিঙ থেকে অনেক পরিচিত ও অপরিচিত লোকজন তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। এতে সময় নষ্ট হত, কাজেরও অসুবিধা হত। খুব বাঞ্ছনীয় নয় এমন কেউ আসছেন দেখা গেলেই দুই ভাই ঠিক ছোট শিশুদের মতো খেলার ছলে নিজেদের মধ্যে তর্ক জুড়ে দিতেন। রাঙাকাকাবাবু হয়তো বললেন, ‘এই রে, আবার অমুক আসছে, ঐ যে মেজদার পরম বন্ধু, তোমার কাছেই আসছে। আমি বেড়াতে চললুম, মেজদা, তুমিই তাহলে আদর-আপ্যায়ন করো। জবাবে বাবা বললেন, ‘ও মোটেই আমার ৭০

প্রিয় বন্ধু নয়, ও তোর শাকরেদ, তোর কাছেই আসছে। তুই কথাবার্তা বল, আমি কাজ করি।’ এধরনের কবির লড়াই চলতে-চলতে অতিথি এসেই পড়তেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাঙাকাকাবাবুকেই সামাল দিতে হত। বেশ ঘটা করে বলতেন, ‘আরে আরে আসুন, বসুন! কতদিন দেখা নেই, জমিয়ে গল্প করা যাক’ ইত্যাদি। আমরা এই ধরনের অভিনয় বেশ উপভোগ করতাম।

ঐ সময় বাঙাকাকাবাবুর শরীর বেশ সেরে গিয়েছে। কার্শিয়ঙে পৌঁছেই চ্যালেঞ্জ দিয়ে বললেন, বলো, কে আমার সঙ্গে ভোরে বেড়াতে বেরোবে। ঠাণ্ডার সময়, তার উপর

আবাব সূর্যোদয়ের আগেই উঠতে হবে। আগের বছরে তাঁর সঙ্গে থাকবার সময় বুঝেছিলাম। বাড়ির কোনো-কোনো লোককে তিনি উইক-মাইণ্ডেড-এর পর্যায়ে ফেলতেন। যাতে আমাকে তিনি ঐ দলে না ফেলেন, আমি বোকার মতো রাজি হয়ে গেলাম। বুদ্ধিমানেরা আবাম কবে ঘুমোচ্ছে, আর আমি নিজৰ মান রাখতে গিয়ে কী বিপদেই না পড়লাম। ভোরে তিনিই আমাকে ঘুম থেকে তুললেন! দেখলেন যে, আমি ঠিকমতো জামাকাপড় পরেছি, আর তাবপব শুরু হত একটা অসম প্রতিযোগিতা। রাঙাকাকাবাবুর হাঁটার ধরন তখন বদলে গিয়েছে। এখন কি জানি যে, ইনি ভবিষ্যতের আজাদ হিন্দ ফৌজের অধিনায়ক! কেবলই পিছিয়ে পড়ি, আব খানিকটা দৌড়ে তাঁকে ধরি। গিধাপাহাড় থেকে মহানদী স্টেশন তিন মাইল। মহানদী স্টেশনে পৌঁছে ভাবছি হয়তো ফেরবার আগে একটু বিশ্রাম নেবেন। কোথায় বিশ্রাম! একেবারে ‘রাইট আউট টান আর আবাব মিলিটারি কায়দায় হাঁটা হাতের ছাতাটা সোজাসুজি ধরে, হাত পুরোপুরি দুলিয়ে জোর কদমে এগিয়ে যাওয়া।

জওহরলাল আমাদের বাড়িতে আগেও থেকেছেন। তাঁর জন্য কী ধরনের ব্যবস্থাদি করা দরকার মোটামুটি জানাই আছে। তবে গান্ধীজির জীবনযাত্রা তো একেবারেই অন্য–সেজন্য বাবা, মা ও বাঙাকাকাবাবু খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। একটা কথা অবশ্য আমি এখন জানতাম না–গান্ধীজির সঙ্গে বসু-বাড়ির প্রথম যোগাযোগ অনেক পুরনো। ১৯১৫~~২৬ সালে মামলায় বন্দী বাঙাকাকাবাবুকে মাজননীর লেখা একখানা চিঠিতে দেখছি, গান্ধীজি আমাদের কটকের বাড়িতে গিয়েছেন, দাদাভাই মাজননীর কাছে তাঁর নিবাসি পুত্রের কথা জিজ্ঞাসা করেছেন। কটকের বাড়িতে গান্ধীজি একটা সভাও করেছিলেন বলে শুনেছি। যাই হোক, ১৯৩৭-এ উডবার্ন পার্কের বাড়িতে যখন মহাত্মা আসবেন তখন তিনি দেশের অবিসংবাদী নেতা। তাঁর সঙ্গে থাকবেন অন্তত জন-ছয়েক ব্যক্তি। ঠিক হল যে, বাড়ির তিনতলাটা পুরোপৃবি তাঁর জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে। বেশ বড় ছাদও আছে। সেখানে গান্ধীজি বেড়াতে পাবেন, প্রার্থনাসভাও হতে পারবে। বান্নাবাড়ির একটা অংশও তাঁর জনা ছেড়ে দেওয়া হবে।

বড় দিনকতক আগেই কলকাতায় চলে এলেন। হাওড়া স্টেশনের ভিড় এড়াবার জন্য গান্ধীজিকে আগের একটি ছোট স্টেশনে নামিয়ে নেওয়া হল এবং উডবার্ন পার্কের বাড়িতে তোলা হল! আমবা ছোটরা দিনকয়েক পরে এলাম। তখন গান্ধীজি ও জওহরলাল দুজনেই আমাদের বাড়িতে। জওহরলালের বোন বিজয়লক্ষ্মীও উডবার্ন পার্কে উঠলেন, তাঁর জন্য দোতলায় একটি ঘর বিশেষ করে সাজিয়ে দেওয়া হল। জওহরলালের কন্যা ইন্দিরাও এসেছিলেন, তবে আমাদের বাড়িতে ছিলেন না। ক্ষীণকায় লাজুক মুখচোরা অল্পবয়সী

१३

একটি মেয়ে বলে তাঁকে মনে আছে।

মহাত্মা গান্ধীকে তার আগে তো দেখিনি। বাড়িতে পৌঁছেই উপরতলায় তাঁকে দেখতে যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। বারান্দায় উঠে দেখি, গান্ধীজির ঘরের সামনেই রাঙাকাকাবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘চলল, মহাত্মাজির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই, প্রথমেই কিন্তু প্রণাম করবে।’ ঘরে ঢুকেই দেখলাম ছোট্ট-খাট্টো একটি মানুষ, পুরনো ধরনের চশমা নাকে এটে, মেজেতে বিছানায় বসে কী যেন লিখছেন। আমি প্রণাম করতেই চশমার উপর দিয়ে একবার চোখ তুলে চাইলেন, রাঙাকাকাবাবু পরিচয় করিয়ে দিতে মাথাটা একটু নাড়লেন, কিন্তু মুখের ভাবের বিশেষ পবিবর্তন হল না। সরোজিনী নাইডু গান্ধীজিকে একবার মিকি মাউস বলে অভিহিত করেছিলেন। আমি ভাবলাম এই মিকি মাউসটি আমাদের দেশের একচ্ছত্র নেতা। স্বীকার করছি গান্ধীজিকে প্রথম দেখে আমি একটু দমেই গিয়েছিলাম। সেই সময় তিনি নিশ্চয়ই গুরুতর কোনো কাজে ব্যস্ত ছিলেন এবং আমার। মতো কিশোবের দিকে নজর দেওয়ার অবকাশ ছিল না। কিন্তু তার পব দিনে পূব দিন নানা অবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন কাজের মধ্যে তাঁকে দেখে আমি সত্যিই খুব অভিভূত হয়েছিলাম। এক অতি অসাধারণ ব্যক্তি যে আমাদের দেশের নেতা সে-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না।

গান্ধীজি ১৯৩৭ ও ১৯৩৮ সালে বেশ কিছুদিন ছিলেন। সেই সময় কত রকম লোক যে উডবার্ন পার্কে দেখেছি তাব ইয়ত্তা নেই : অন্য কংগ্রেস-নেতাদের মধ্যে জওহরলাল ছাড়া। রাজেন্দ্র প্রসাদ, বল্লভভাই প্যাটেল, সরোজিনী নাইডু ও মৌলানা আজাদকে বেশ মনে আছে। রাজেন্দ্র প্রসাদ সম্বন্ধে আমার ধারণা হয়েছিল যে, তিনি একজন অতি বিনয়ী। ভদ্রলোক এবং গান্ধীজির একান্ত অনুগত। ক্রমাগতই হাঁপানিতে ভুগতেন, সেজন্য তিনতলায় ওঠানামা করতে তাঁর বেশ কষ্ট হত। বল্লভভাইয়ের এমন গম্ভীর মেজাজ যে, আমরা কাছে ঘেঁষতে চাইতাম না। তবে তাঁর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে কোনো কথা ছিল না। সন্ধ্যায় বেড়াবার সময গান্ধীজির সঙ্গে প্রায়ই মৌলানা আজাদ থাকতেন। তাঁর চেহারা বেশ। আকর্ষণীয় ছিল। সরোজিনী নাইডু খুব কথা বলতেন, ইংবেজি তো নয়, যেন সংগীতের মৃছনা। সকলের সঙ্গেই তিনি অন্তরঙ্গ। খেতে খুব ভালবাসতেন এবং খেতেনও, যদিও প্রায়ই বলতেন ডাক্তাব রায়ের বারণ আছে।

॥ ২৪ ॥

ষাটের দশকের শেষের দিকে একদিন ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরছি, প্রবীণ শিখ ড্রাইভার নানারকম গল্প কবতে করতে বাড়িতে পৌঁছে দিল। গাড়িবারান্দায় থেমেই বলে উঠল, “তুমি শরৎবাবুর বাড়িতে আসবে আগে বলোনি কেন, এ-জায়গাটা আমার খুব চেনা। কতবার কত লোককে এখানে পৌঁছে দিয়েছি।” বিশেষ করে তিরিশ বছর আগেকার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। বলল, “তখন গান্ধীজি এখানে রয়েছেন, আমরা দল বেঁধে এসেছি সন্ধ্যায় তাঁর প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে। ছাদ ভরে গিয়েছে, সেজন্য আমরা ঐ দরজাটার সামনে ধস্তাধস্তি করছি। শেষ পর্যন্ত দরজার বড় কাঁচটা আমাদের চাপে ভেঙে গেল! কথাটা শুনে আমারও সেই সময়কার অনেক কথা মনে পড়ে গেল। সন্ধ্যায়

৭৩

প্রার্থনাসভার সময় ভিড় সামলাতে আমাদের হিমসিম খেতে হত। মনে আছে আমি একদিন লোহার কোলাপসিবল গেট ধরে সামনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। ছাদে আর জায়গা নেই। গাডিবারান্দায় যাঁরা আছেন তাঁদের অনেক বোঝাবার চেষ্টা করছি, বলছি, ঝতেই তো পারছেন এটা পাবলিক প্লেস নয়, বসতবাড়ি, জায়গা কম; আপনাবা আর একদিন আসুন। এক ভদ্রলোক আমাকে শাসিয়ে বললেন, “দ্যাখো তোমার যুক্তি আমি মানতে রাজি নই, মহাত্মা গান্ধী ইজ এ পাবলিক ম্যান, হোয়্যাবএভার হি স্টেজ বিকামস এ পাবলিক প্লেস। তাঁর প্রার্থনাসভায় যোগ দেবার অধিকার থেকে তুমি আমাদের বঞ্চিত করতে পারো না।”

সন্ধ্যায় উডবার্ন পার্কের বাড়ির ছাদটা প্রার্থনাসভার সময় ভরে তো যেতই, কত লোক যে আশেপাশে বারান্দায় বা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকত তার হিসেব নেই। তাছাড়া বাডিব। সামনের রাস্তায় বিকেল থেকেই ভিড় জমে থাকত। তারা মাঝে-মাঝে গান্ধী মহারাজ কি জয় ধ্বনি দিত। প্রার্থনাসভা আরম্ভ হবাব আগে গান্ধীজি মাঝে-মাঝে ছাদের ধারে এসে তাদেব দর্শন দিতেন। তাঁকে দেখা গেলে আরও ঘন-ঘন ও সজোরে ধ্বনি উঠত।

আমাদের বাড়িতে প্রার্থনাসভায় কেবল যে রামধূন হত তা-ই নয়, অন্য ধবনের অনুষ্ঠানেরও ব্যবস্থা করা হত। সবচেয়ে জমত যখন দিলীপকুমার রায় গান গাইতেন। ভক্তিমূলক ও দেশাত্মবোধক গান তো গাইতেনই। মাঝে-মাঝে ইংরেজিতেও প্রার্থনা-সঙ্গীত গাইতেন। এক সন্ধ্যায় অনেকক্ষণ ধরে তিনি আবাউড উইথ মি’ গেযেছিলেন। কী পবিত্র পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন। উমা বসুকে তিনিই সঙ্গে করে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন, যাব গান শুনে গান্ধীজি তাঁকে “নাইটিঙ্গেল অব ইণ্ডিযা” নাম দিয়েছিলেন।

এই সূত্রে দিলীপবাবুর কথা একটু বলে নিই। গান্ধীজি আমাদের বাড়িতে আসবাব কিছু আগে দিলীপকুমার আমাদের সঙ্গে বেশ দিনকতক ছিলেন। গানের আসর ছাড়াও তাঁর প্রাণোচ্ছল কথাবার্তায় সাবা বাড়ি মাতিয়ে বাখতেন। ছোটদের সঙ্গে সমানে তাল দিযে চলতে পারতেন। দুপুরে তিনি যখন খেতে বসতেন মা তো থাকতেই, আমরাও আশেপাশে ঘোৰাঘুরি করতাম তাঁর রসিক মনের আস্বাদ পাবার আশায়। একদিন বললেন, তোমাদের একটা পরীক্ষা নেব, শক ঠিকমতো উচ্চাবণ কবার পরীক্ষা। দু’লাইনের একটা ছড়া ঠিকমতো যে যত তাড়াতাড়ি বলতে পারবে, তব ততই কৃতিত্ব। তিনি আমাদের সঙ্গে পাল্লা দেবেন। ছড়াটি হল,

এেলে চুল তাজা

জলে চুন তাজা। তাড়াতাড়ি করে বলতে গিয়ে আমাদের তো কথা উল্টোপাল্টা হয়ে যায় কিংবা উচ্চারণে আটকে যায়। ক্লিীপবাবুই শেষ পর্যন্ত জিতে গেলেন।

তিনি তো গেরুয়া পরতেন। আমি ভাবতাম গেরুয়া-পরা সন্ন্যাসী এত হাসিখুশি হন ক করে। রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ও সখ্য কারুরই চোখ এড়াত না। যুদ্ধের পর দিলীপবাবুর সঙ্গে বেশ কিছুকাল দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। নেতাজী রিসার্ট ব্যুরোর কাজ খানিকটা এগোবার পর আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি, পুনাতে তাঁর আশ্রমে গিয়ে দেখা করি। তার কাছে রাঙাকাকাবাবুব যা চিঠিপত্র ছিল, সেগুলো তো অসঙ্কোচে আমার হাতে। তুলে দিয়েছিলেনই, শুধু তাই নয়, শেষ পর্যন্ত তিনি রিসার্চ ব্যুরোর কাজে ক্রমাগত আমাদের। উৎসাহ ও আশীবাদ দিয়ে গেছেন। নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর দুটি খুব বড় অনুষ্ঠানে তিনিই ৭৪

প্রধান ছিলেন। বারেবারেই আমাকে বলেছেন, “এটা খুব বড় কাজ, চালিয়ে যেও। দেশ যদি সুভাষকে ভুলে যায় তাহলে দুঃখের আর সীমা থাকবে না?”

একদিন তো গান্ধীজির জন্য আমাদের ছাদে উড়িষ্যার ছোঁ-নৃত্যের আয়োজন করা হয়েছিল। আর একদিন হল ব্রতচারী নাচ, গুরুসদয় দত্ত নিজে নাচ পরিচালনা করলেন এবং নাচে অংশগ্রহণও করলেন। ঐ দুদিন আমাদের মনে হয়েছিল বুঝিবা আমাদের ছাদ ভেঙে পড়বে। অতগুলো মানুষের দাপাদাপি এবং সঙ্গে-সঙ্গে সমবেতকণ্ঠে গান ও ঢাক-ঢোলের কান-ফাটানো আওয়াজ!

সকাল-সন্ধ্যায় লাঠি হাতে কারুর কাঁধে ভর দিয়ে এই ছাদেই গান্ধীজি পায়চারি করতেন। গরমের দিনে অতি সাধারণ একটি খাটে শুয়ে ছাদে বাতও কাটিয়েছেন। উঠতেন ভোর চারটেতে। সেজন্য তোরের প্রার্থনাসভা ও বেড়ানোর খবর আমি জানি না। রাত আটটা নাগাদ শুয়ে পড়তেন। আমি এখনও ভেবে অবাক হই, রাত না জেগে গান্ধীজি এত কাজ কী করে করতেন। তাঁর সারাদিনের প্রোগ্রাম ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় চলত, কোনও কারণেই তার হেরফেব হত না। সন্ধ্যায় তাঁর খাবার সময় ছটা, এক মিনিট আগেও হবে না, এক মিনিট পরেও হলে চলবে না। যদি কোনও বিশেষ অতিথি সেই সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান, তিনি এসে কথা বলতে পারেন, গান্ধীজি কিন্তু খেতে-খেতেই তাঁর কথা শুনবেন।

গান্ধীজি তাঁর পাশে বেশ কয়েকটি অনুগত শিষ্য-শিষ্যা পেয়েছিলেন। আর পেয়েছিলেন সত্যিই একজন দক্ষ সেক্রেটারি-মহাদেব দেশাই। মহাদেব দেশাই এত কাজের মধ্যেও অভাবনায় শৃঙ্খলা বজায় রাখতেন। তাঁকে অবশ্য খাটতে হত খুব কিন্তু মুখে সব সময়েই হাসি লেগে থাকত। মহাদেব দেশাই বেশ ভালই বাংলা জানতেন এবং দু-চার ছত্র বাংলা লিখে মাঝে-মাঝে আমাদের দেখাতেন। গান্ধীজিও নাকি সেই সময় বাংলা শিখেছিলেন। মহাদেব দেশাইকে সাহায্য করতেন পিয়ারেলাল। গান্ধীজির দলে অন্যদের মধ্যে ছিলেন সুশীলা নায়ার, কানু গান্ধী ও আভা গান্ধী। একবাব কস্তুরবাও এসেছিলেন কয়েকদিনের জন্য। তাঁর শান্ত স্নিগ্ধ চেহারা ও ব্যবহারে সকলেই মুগ্ধ হয়েছিলাম!

গান্ধীজি যখন আমাদের মধ্যে থাকতেন, সাত-সকালে ঘন্টা বাজিয়ে হাজির হত একটা ছাগল, সঙ্গে আসত দুটি ছাগ-শিশু। গান্ধীজি যে ছাগলের দুধ খেতেন, সেটা তো সকলেই জানেন। তবে তাঁর খাওয়া-দাওয়ার ধরনটা আমাদের একটু অদ্ভুত ঠেকত। শাকসজি সিদ্ধ, দই ও রসুনবাটা ইত্যাদি একটা কাঠের পাত্রে নিজের হাতে মিশিয়ে তিনি একটা জগাখিচুড়ি তৈবি করতেন–খেতে কেমন হত কে জানে! সঙ্গে কিছু ফলমূল থাকত। তিনি কিন্তু বেশ তৃপ্তি করে খেতেন। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার সম্বন্ধে তাঁর একান্ত নিজস্ব কিছু মতামত ছিল–পরীক্ষা-নিৰীক্ষা করে এসব বের করেছিলেন বলে তিনি দাবি করতেন। ডাক্তারদের মতামতের তিনি বড় একটা ধার ধারতেন না, তা সেই ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় বা যে-কেউ হোন না কেন। আমাদেব রান্নাবাড়িতে পিযারেলাল এক বিশেষ দেশী যন্ত্রের সাহায্যে গান্ধীজির জন্য পাউরুটি তৈরি করতেন। কিন্তু গান্ধী-মাকা পাঁউরুটি খেতে খুব ভাল হত বলে আমাদের মনে হত না। সেই সময় কলকাতার বিশেষ কোনও হোটেলের পাউরুটির বেশ নামডাক ছিল। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিযে গান্ধীজিকে সেই পাউরুটি চেখে দেখতে রাজি করানো গেল। খেয়ে তিনি কিন্তু স্বীকার করলেন যে, আমাদের পাঁউরুটিই ভাল।

॥ ২৫ ॥

১৯৩৭-৩৮ সালে গান্ধীজি ও জওহরলাল তো কলকাতায় আমাদের বাড়িতে থাকতেন। তা ছাড়া সেই সময় দেশের অন্যান্য বড় বড় নেতাদেরও বেশ কাছ থেকে দেখা যেত। এ-সুযোগ কে ছাড়তে চায়। ১৯৩৭-এর কলকাতায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির। সভায় একটা প্রধান আকর্ষণ ছিল মঞ্চে একসাথে জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্রের উপস্থিতি। অটোগ্রাফ সংগ্রহের জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। জওহরলাল ও রাঙাকাকাবাবুকে ঠিক সময়ে ধরতে পারলে অটোগ্রাফ পেতে বিশেষ অসুবিধা হত না।

গান্ধীজির বেলায় কিন্তু নিয়ম ছিল একেবারে অন্যরকম। পাঁচটা টাকা অটোগ্রাফের খাতার ভিতরে গুঁজে দিয়ে তবেই জমা দিতে হত, রোজই অটোগ্রাফের বইয়ের স্তূপ ঘরের এককোনায় দেখা যেত। এই ভাবে গান্ধীজি হরিজন ফাণ্ডের জন্য টাকা তুলতেন। দর্শন করতে এসে অনেক মহিলাও গয়না খুলে গান্ধীজির হাতে সমর্পণ করে যেতেন। কোনো কোনো অটোগ্রাফপ্রার্থী আবদার করতেন যে, ইংরেজি অক্ষবে গান্ধীজির সই চাই। এ-সব ক্ষেত্রে বিশেষ আরজির প্রয়োজন হত। মনে আছে, একদিন বিশেষ কোনো অটোগ্রাফপ্রার্থীর হয়ে সাহস করে ওঁর কাছে গিয়ে বললাম যে, তিনি যেন দয়া করে। দেবনাগরীতে না লিখে ইংরেজিতে সই করে দেন। নাকের ডগায় চশমার উপর দিয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইলেন গান্ধীজি, তারপর মুচকি হেসে বললেন যে, সেবারকার মতো তিনি ইংরেজিতে সই করে দিচ্ছেন, কিন্তু ‘ইফ এনিবডি এস এগেন আস ফর। অ্যান অটোগ্রাফ ইন ইংলিশ, প্লীজ টেল হিম দ্যাট দি চার্জ ইজ টেন রুপিজ, অ্যাণ্ড নট ফাইভ।

লক্ষ করার বিষয় যে, দেশের কাজে দেশবাসীর কাছে কোনো দাবি রাখতে মহাত্মা গান্ধীর দ্বিধা ছিল না। পরে যেমন আজাদ হিন্দ আন্দোলনের সময় রাঙাকাকাবাবু পূর্ব-এশিয়ার ভারতীয়দের কাছে দেশের মুক্তিব জন্য সর্বস্ব দাবি করেছিলেন–সব ত্যাগ করে ফকির হতে বলেছিলেন।

আগেই তো বলেছি, যতই গান্ধীজিকে কাছ থেকে দেখতে লাগলাম, ওঁর অসাধারণত্ব ততই প্রকট হতে লাগল। কেবল অসাধারণত্ব নয়, অভিনবত্বও বটে। ব্যক্তিগত বা জাতীয় জীবনে তিনি কোন কিছুই পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না। চিকিৎসার ব্যাপারে তিনি সোজাসুজি ডাক্তার বিধান রায় বা নতুনকাকাবাবু ডাক্তার সুনীল বসুকে বলে দিতেন যে, পাশ্চাত্তের চিকিৎতা-পদ্দতি তাঁর কাছে গ্রাহ্য নয়। বেশি রসুন খাওয়া নিয়ে আপত্তি করলে জবাব দিতেন যে, তিনি পরীক্ষা করে দেখেছেন সেটা তাঁর পক্ষে ভাল, তাঁর ব্লাড প্রেশার ঠিক রাখে। গঙ্গার ঘাট থেকে মাটি আনিয়ে কাপড়ের মধ্যে পুরু করে প্রলেপ তিৈর করে কপালে ও পেটের উপর রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে থাকতেন। বড় বড় ডাক্তারেরা হাঁ করে দেখতেন। অন্যদিকে আবার কয়েকটি ব্যাপারে তিনি বৈজ্ঞানিক রীতিনীতিও মেনে চলতেন। যেমন, তাঁর জন্য আনা শাকসক্তি জীবাণুমুক্ত করার জন্য পোটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট মেশানো জলে ভিজিয়ে রাখা হত। শরীর ভাল রাখার জন্য তিনি একটি বিখ্যাত জামান কোম্পানির গ্লুকোজ খেতেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তিনি খুবই কড়াকড়ি করতেন। বাবা গান্ধীজির জন্য ৭৬

বাতারাতি তাঁর ঘরের পাশের বাথরুমে বিশেষ কয়েকটি ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাথরুম পরিষ্কার রাখার ভার গান্ধীজি কাউকে ছাড়বেন না। গৃহস্বামী যতই বিব্রত হোন না কেন, নিজের বাথরুম গান্ধীজি নিজের হাতে পরিষ্কার করবেনই।

গান্ধীজির খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাদি করতেন আমার মা ও বোন গীতা। যোগাড় দিতেন আমাদের মাসতুতো দাদা রবীন্দ্রকুমার ঘোষ, যাঁকে সকলেই ‘ডটিদা’ বলে জানত। ডাঁটিদা গান্ধীজির জন্য কলকাতার বাজার তোলপাড় করে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট যা আছে এনে হাজির করতেন। এ ব্যাপারে কেউ কোনো সমালোচনা করলে ডাঁটিদা বড়ই দুঃখ পেতেন। জানতে পারলে গান্ধীজি কিন্তু ডাঁটিদার পক্ষে এগিয়ে আসতেন। বলতেন, “রাববাবু আমার জন্য বাজারের সেরা জিনিস আনেন। তাঁর সম্বন্ধে যে-কেউ কিছু ভাল বললেই ডাঁটিদা ‘একেবারে অভিভূত হয়ে পড়তেন, চোখে জল এসে পড়ত। এই সূত্রে ভৗটিদা সম্বন্ধে আরও কিছু বলি। এমন প্রাণখোলা পরোপকারী মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। বিশেষ করে গান্ধীজি আমাদের বাড়িতে আসার সময় থেকে বাবা মা ও আমাদের সঙ্গে তাঁর বিশেষ প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে, মাত্র কয়েক বছর আগে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সেটা বজায় ছিল। মনে হত যেন কেবল অন্যের কাজ হাসিমুখে করবার জন্যই বিধাতাপূরুষ ডাঁটিদাকে এ-জগতে পাঠিয়েছিলেন। সেই থেকে সুদিনে ও দুর্দিনে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে তিনি প্রায় রোজই আসতেন; যেমন সব রকম কাজের ভাব নিজে থেকেই নিতেন, তেমনি জমিয়ে আড়াও দিতেন। বাবা তাঁকে ডাকতেন “ডাঁটি-মহারাজ’ বলে, বাবাব প্রতি আনুগত্যে তাঁর কোনোদিন হেরফের হয়নি। যুদ্ধের সময় যখন আমি সুদূর পাঞ্জাবে বন্দী, তখন মার কাছে লুকিয়ে একটি চিঠি পাঠাবার সময় আমি ডাঁটিদার ঠিকানা ব্যবহার করার কথা ভেবেছিলাম। নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর কাজে তিনি শেষদিন পর্যন্ত তাঁর অকুণ্ঠ ও সহৃদয় সাহায্য দিয়ে গেছেন।

কলকাতায় গান্ধীজির অন্যান্য কাজের মধ্যে একটা বিশেষ কাজ ছিল। বাংলার রাজবন্দীদের নিয়ে ব্রিটিশ সরকার বড়ই বেগ দিত। কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা হলে তারা অহিংস সত্যাগ্রহী বন্দীদের মুক্তি দিলেও বাংলার বিপ্লবী রাজবন্দীদের সহজে ছাড়তে চাইত না। এ-বিষয়ে রাঙাকাকাবাবুর মনোভাব ছিল খুব কঠিন ও পরিষ্কার। তাঁর মত ছিল যে, যখনই যুদ্ধবিবতি হবে, সব রাজবন্দীকে মুক্তি দিতে হবে, হিংসা-অহিংসার অজুহাত দিয়ে এই নীতির ব্যতিক্রম করা চলবে না। ব্রিটিশ সরকারের উপর এই ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করার জন্য তিনি গান্ধীজির সহযগিতা চান। গান্ধীজি কলকাতায় এসে একদিকে ইংরেজ গভর্নরের সঙ্গে কথা বলছিলেন, অন্যদিকে জেলে গিয়ে আমাদেব বিপ্লবী বন্দীদের সঙ্গে দেখা করছিলেন। গান্ধীজির ও বাবা-রাঙাকাকাবাবুর এ ব্যাপারে কাজের ধারাটা ঠিক একরকম না হলেও, উদ্দেশ্য ছিল এক। শেষ পর্যন্ত সমস্যার একটা সুরাহা হয়, বেশির ভাগ বন্দী মুক্তি পান, এবং তাঁরা কংগ্রেসে সামিল হয়ে জাতীয় আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন।

১ নং উডবার্ন পার্কে আমাদের বাড়িতে দুই মহামানবের মিলন হয়েছিল দু’বার। গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথ। একবার আমি তো সাক্ষীই ছিলাম, অন্যবার একটা বিপদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজিকে দেখতে ছুটে এসেছিলেন। একদিন সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ খবর এল, রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাড়িতে গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে

৭৭

পড়লেন। রবীন্দ্রনাথ উপরে উঠতে পারবেন না। গান্ধীজি তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। একতলায় যে-ঘরটা পণ্ডিতজির ঘর বলে চিহ্নিত ছিল, সেই ঘরে দুজনের দেখা হল। যাবার সময় হলে গান্ধীজি নিজের হাতে করে রবীন্দ্রনাথের চটিজোড়া এগিয়ে দিলেন। রবীন্দ্রনাথ চলে যাবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে ক্যামেরা-ট্যামেরা নিয়ে

সাংবাদিকরা এসে পড়লেন, কিন্তু একটু দেরি হয়ে গেল।

অন্যবাৰ যখন রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন, তখন গান্ধীজি খুবই অসুস্থ, বরে চাপ অসম্ভব রকম বেড়ে গিয়েছিল। সারা বাড়ি থমথম করছে। বাবা, বাঙাকাকাবাবু, জওহরলাল চিন্তায় আকুল। ডাক্তাব রায় ও নতুনকাকাবাবু অস্থির হয়ে যা করতে পারেন কবছেন। গান্ধীজি তখন দোতালায় বাবার ঘরে রয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজিকে দেখতে আসতে চাইলেন। এবার তাঁকে চেয়ারে করে উপরে তুলতে হল। চেযাব বহন করলেন সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু, শবৎচন্দ্র বসু ও মহাদেব দেশাই।

॥ ২৬ ॥

১৯৩৭-এর মাঝামাঝি থেকেই কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল যে, রাঙাকাকাবাবু সম্ভবত ১৯৩৮-এ কংগ্রেসের সভাপতি নিবাচিত হবেন। অক্টোবরে জওহরলালের সভাপতিত্বে অল ইণ্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনের পব এবং গান্ধীজি কলকাতায় ঘুরে যাবার পর গুজবটা জোরদার হল। বাঙাকাকাবাবু সেই সময় ইউরোপে ও দেশের কোনো কোনো বন্ধুর ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে এই মর্মে আভাস দিচ্ছিলেন। সেকালে কংগ্রেসের সভাপতির পদের গুরুত্ব আজকালকার ছেলেমেযেদেব পক্ষে অনুমান করা শক্ত। কংগ্রেসের সভাপতিকে এখন ‘বাষ্ট্রপতি’ বলা হত। স্বাধীনতাকামী কোটি-কোটি ভারতবাসীর কাছে তিনিই হতেন আমাদের জাতীয়তাব প্রতিভূ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। ভারতের বাইবেও ভারতপ্রেমী বিদেশী বন্ধুদের কাছে এব গুরুত্ব কম ছিল না। পুরনো চিঠিপত্র দেখছি, রাঙাকাকাবাবু কংগ্রেসের প্রধান হবার সম্ভাবনায় তাঁরা খুবই আনন্দিত হচ্ছেন। এটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ যে, এই সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৩৭ সালের শেষে রাঙাকাকাবাবু অল্প সময়ের জন্য হলেও ইউবোপ সফরে যান।

ঐ ইউরোপ ভ্রমণ মাত্র কয়েক সপ্তাহের জন্য হলেও নানা দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমত, রাঙাকাকাবাবু নিজের চোখে ইউরোপের রাজনীতির চেহারাটা একবার দেখে নিলেন। দ্বিতীয়ত, ইউরোপে ও পরে ইংল্যাণ্ডে বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলোচনা হয়। তৃতীয়ত, ১৯৩৭ সালের মাঝামাঝি থেকেই তিনি আত্মজীবনী লেখার পরিকল্পনা করছিলেন। ইংল্যাণ্ডের এক নামকরা প্রকাশন-সংস্থার সঙ্গে বই প্রকাশ করার চুক্তির মূল কপি আমাদের কাছে রয়েছে। তাতে দেখছি, প্রকাশক আত্মজীবনীর সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি ১৯৩৭-এর নভেম্বরের মধ্যে চাইছেন। নানা কাজের মধ্যে যে বাঙাকাকাবাবু চুক্তি অনুযায়ী লেখা শেষ করতে পারেননি তা তো বোঝাই যাচ্ছে।

ঝড়ের মতো যাদের জীবনের গতি, লেখালেখির কাজ ভাল করে করতে হলে দেখছি হয় তাঁদের জেলে যেতে হয়, নয়তো নিবাসনে। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত যদি রাঙাকাকাবাবু

৭৮

ইউরোপে নিবাসনে না থাকতেন, তাহলে ‘দি ইণ্ডিয়ান স্ট্রাগল’ লেখা হত কিনা সন্দেহ। কী হুড়োহুড়ির মধ্যে তিনি লেখার কাজ করতেন, তার দুটো বড় দৃষ্টান্ত দিতে পারি। হরিপুরা। কংগ্রেসের সভাপতির ভাষণ রাঙাকাকাবাবু দুদিনের মধ্যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একটানা লিখেছিলেন। দৃশ্যটি মনে আছে। তিনি এলগিন বোডের বাড়িতে তাঁর ঘরে বসে পাতার পর পাতা লিখে চলেছেন। দু-এক পাতা লেখা হলেই একজন দৌড়ে সেটা উডবার্ন পার্কের বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছে। উডবান পার্কে টাইপ করা হচ্ছে, টাইপ করা হলে বাবার সেক্রেটারি নারদ চৌধুরী মহাশয় সেটা মিলিয়ে দেখে দিচ্ছেন। তারপর আব-একজন দৌড়ে সেটা প্রেসে পৌঁছে দিচ্ছে। হবিপুরার পথে বওনা হবার ঘণ্টাখানেক আগে পর্যন্ত রঙাকাকাবাবু তাঁব ভাষণ লিখছিলেন। নিজে ফিরে একবার পড়বার বা শোধবাবার কোনো সময় তিনি পাননি। তার সঙ্গে ভাষণের ছাপা কপি দেওয়া সম্ভব হয়নি। সাবা বাত এবং পরের দিন পবোদমে প্রেসের কাজ চালিয়ে, বই বাঁধিয়ে পরের দিন রাতের ট্রেনে পাঠানো হয়। আজাদ হিন্দ সবকারের এতিহাসিক ঘোষণাপত্রটিও বাঙাকাকাবাবু সিঙ্গাপুরে একটা পুরো রাত জগে লিখেছিলেন। ২১শে অক্টোবব সরকার ঘোষণা হবে, কিন্তু ১৯শে পর্যন্ত ঘোষণাপত্রটি লেখা হয়নি। ১৯শে বাত বারোটায় শুরু করে ২০শে ভোর ছটা পর্যন্ত কালো কফিতে চুমুক দিতে-দিতে একটানা লিখে গেলেন : দু-একখানা পাতা লেখা হচ্ছে, আর আবিদ হাসান বা এন. জি. স্বামী পাশের ঘরে এস্ এ আয়ারেব হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন। আয়ার টাইপ করে চলেছেন। টাইপ করা হবার পর বিন্দুবিসর্গও বদলাতে হয়নি। যেমন আমবা দেখেছিলাম হবিপুরা ভাষণের বেলায়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে দুটি অতি মূল্যবান ও

স্মরণীয় দলিল এই ভাবে ঝড়ের বেগে লেখা হয়েছিল।

আত্মজীবনী তো একরাতে লেখা যায় না। ১৯৩৭-এর ডিসেম্বরেব ইউরোপ যাত্রায় তিনি প্রথমেই গেলেন অস্ট্রিয়ায় তাঁর প্রিয় স্বাস্থ্যনিবাস বাদগাস্টাইনে। সেখানে শ্ৰীমতী এমিলিয়ের সাহায্যে দিন দশেক ইংরাজিতে আত্মজীবনীর দশটি পরিচ্ছেদ লিখলেন। জন্ম থেকে আই. সি. এস থেকে পদত্যাগ পর্যন্ত তিনটি খাতায় লেখা হল। এখানে উল্লেখ করতে পারি যে, বাঙাকাকাবাবুর গুরুত্বপূর্ণ অনেক চিঠি বা প্রবন্ধ পেনসিলে লেখা, এটিও ৩ই। সেজন্য সংরক্ষণের কাজে নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।

আত্মজীবনীতে বাঙাকাকাবাবু বসুবাড়ির সাতাশ পুরুষ পর্যন্ত পারিবাবিক ইতিহাস সংক্ষেপে বর্ণনা কবেছেন। এর আগে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষ ও তাঁদের জীবন ও কার্যাবলী সম্বন্ধে বিশেষ ঔৎসুক্য প্রকাশ করিনি। জানতামও খুব কম। আমাদের গোষ্ঠীর বা পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দশরথ বসু। তাঁর চার পুরুষ পরে মুক্তি বসু কলকাতার চোদ্দ মাইল দক্ষিণে মাহীনগর গ্রামে গিয়ে বসবাস আরম্ভ করেন। সেই থেকে আমরা। মাহীনগরেব বসু-পরিবার বলে খ্যাত। দশরথের এগারো পুরুষ পর থেকে বসু-পরিবার জনজীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মহীপতি বসু সেই সময় বাংলার অর্থ ও যুদ্ধমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মহীপতির নাতি গোপীনাথ আরও এগিয়ে যান এবং তৎকালীন বাংলার অধিপতি সুলতান হুসেন শাহের অর্থমন্ত্রী ও নৌ-সেনাপতি নিযুক্ত হন। সুলতান তাঁকে পুরন্দর খাঁ উপাধি দেন এবং মাহীনগরের কাছেই পুরন্দরপুর বলে যে একটা গ্রাম আছে সেটা তাঁরই জায়গির। পুরন্দরের বাগানই এখন হয়েছে মালঞ্চ গ্রাম। এই মালঞ্চে দাদাভাইয়ের বেশ

৭৯

একটা প্রকাণ্ড বাগান ছিল। পূজোর সময় ছেলেবেলায় আমরা যখন দল বেঁধে দেশে যেতাম, সেই সময় রাঙাকাকাবাবুকে এই বাগানের পুকুরে সাঁতার কাটতে দেখেছি।

দুশো বছর আগে মাহীনগরের কাছ দিয়েই হুগলী নদী বইত। কিন্তু নদীর গতি ধীরে-ধীবে সরে যাওয়ায় মাহীনগর ও আশপাশের গ্রামগুলিতে মহামারী দেখা দেয় এবং গ্রামবাসীরা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়েন। বসুবাডির একটি শাখা পূরন্দরের বংশধরেরা কাছেই কোদালিয়া গ্রামে বসবাস শুরু করেন। আমরা কোদালিয়াকেই আমাদের গ্রাম বলে জেনে এসেছি। গ্রামের নামের বেশ একটা ইতিহাস আছে। পুরন্দর বা গোপীনাথ বসু প্রগতিবাদ ছিলেন। জাত, কুল ইত্যাদি সম্বন্ধে সামাজিক নিয়ম ও বিধিগুলি পরিবর্তন কৰাৰ জন্য তিনি এক বিরাট সম্মেলন ডেকেছিলেন, যাতে নাকি এক লক্ষেরও বেশি লোক যোগ দিয়েছিলেন। ঐ বিরাট সমাবেশে জল সবববাহের জন্য অনেক লোক লাগিয়ে তিনি লম্বা একটা পুকুর বা খাল কাটিয়েছিলেন। কাজের পর মজুবেরা তাদের কোদালগুলি যেখানে জড় করে রাখতেন, সেখানেই কোদালিয়া গ্রামটি গড়ে ওঠে।

যাই হোক, রাঙাকাকাবাবু তাঁর আত্মজীবনী সম্পূর্ণ কববার সময় পেলেন না, এবং লণ্ডন থেকে বই প্রকাশের পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। ১৯৩৮-এর জানুয়াবি প্রথমে তিনি লণ্ডনে পৌঁছলেন। সেখানেই খবব পেলেন যে, তিনি কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। লণ্ডনে দেশী বিদেশী বহু লোকের সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলোচনা হয়। বেশ কয়েকটি সভায় তিনি বক্তৃতা কবেন। একটি সভায় বন্ধুভাবাপন্ন ব্রিটিশ লেবাব পার্টির নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তিও উপস্থিত ছিলেন। রাঙাকাকাবাবু তাঁদের স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন যে, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে ইংল্যাণ্ডের কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো সাহায্য তিনি প্রত্যাশা করেন না, লড়াই করেই আমবা আমাদেব স্বাধীনতা অর্জন করব। সেই সময় (কানো কূটনৈতিক আলোচনাব জনআযাল্যাণ্ডের নো ডি, ভ্যালে লণ্ডনে ছিলেন, তাঁর সঙ্গেও বাঙাকাকাবাবুর দেখা হয়। ফেরার পথে ইটালির রাষ্ট্রনাযক মুসসালিনিৰ সঙ্গেও তাঁব সাক্ষাৎ হয়েছিল।

ইউরোপ বওনা হবাব সময় বসু বাড়ি একটা বিবার্ট দল দমদম বিমানঘাঁটিতে তাঁকে বিদায় জানাতে গিয়েছিল। মাসখানেক পরে কংগ্রেসেব সভাপতি নির্বাচিত হয়ে তিনি যেদিন ফিরলেন, সেদিন দমদমে খুব ভিড়। তাঁকে দেখে মনে হল, অল্পদিনের ঐ ইউরোপ সফবে তার স্বাস্থ্যের বেশ উন্নতি হয়েছে–সবল, সুঠাম দেই, গায়েব বঙ যেন ফেটে পড়ছে।

॥ ১৭ ॥

বাডিব কেউ বিশেষ কোনো সম্মান বা জীবনে বড় রকমেব প্রতিষ্ঠা লাভ করলে পবিবাবে, বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের মধ্যে নানা রকম প্রতিক্রিয়া হয়। প্রতিক্রিয়াগুলি যদি আমি বিশ্লেষণ করে দেখি তাহলে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষের মনের ও চরিত্রের একটা ছবি বেশ ফুটে ওঠে। বসবাড়িও ব্যতিক্রম ছিল না।

বলাই বাহুল্য, রাঙাকাকাবাবু কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ার ফলে সামগ্রিকভাবে বসুবাডির ছোটবড় সকলেরই মর্যাদা বেড়ে গেল এবং সকালেই বেশ গৌরব বোধ করলেন। তবে।

৮০

আমার মনে হয় রাঙাকাকাবাবু রাষ্ট্রপতি হবার আগে পর্যন্ত বসুবাড়ির মধ্যমণি ছিলেন না। অনেকেই তাঁকে দূর থেকে দেখতেন দূরত্ব রেখে চলতেন, এমনও কেউ কেউ ছিলেন। যাব ফিরেও তাকাতেন না। এখন থেকে কিন্তু রাঙাকাকাবাবুকে ঘিরেই বসবাড়ি চলতে লাগল। সবাই তাঁকে ঘিরে দাঁড়ালেন। মাজননীর ইচ্ছায় তিনি অনেকদিন পরে এলগিন রোডের সাবেক বাড়িতে বসবাস আবম্ভ করলেন। দাদাভাইয়ের শোবার ঘবটি তাৰ জন্য বরাদ্দ হল। বাড়ির অনেক ব্যবস্থা পালটাতে হল কাবণ সভাপতির তো একটা ভাল, অফিস চাই। তাছাড়া বোজ কত লোক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসবে, বব জায়গা চাই। বাড়ির পেছনের দিকের একটা বড় ঘর খাওয়াদাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হত, সেটা আসবাবপত্র গুছিয়ে রাঙাকাকাবাবুর অফিস হল। আজও নেতাজী ভবনে ঘবটি একইভাবে

জানো আছে। অতিথিদের বসবার জন্য নীচের তলায় একটা ও উপর তলায় একটা ঘর বাখা হল।

অনেকদিন বাংলা থেকে কেউ কংগ্রেসের সভাপতি হননি। সেই ১৯২২ সালে ওয়া কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন দেশবন্ধু দাশ। পরে আইন অমান্য আন্দোলনের সময় কলকাতার এসপ্ল্যানেডে বেআইনি কংগ্রেসের একটি বিশেষ ও ক্ষণস্থায়ী অধিবেশনের সভানেত্রীত্ব করেছিলেন যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তা। এতদিন পাব। বাঙাকাকাবাবুর এই পদ লাভ করার একটা বিশেষ ও সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য ছিল। এ কথাটা আজ বাংলা দেশে অনেকেই ভুলে গেছেন। প্রথমতঃ, বাংলার জনমানসে সেদিন একটা নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, বাংলার রাজনীতিতে তখন একটা ছন্নছাড়া ভাব এসেছিল, সেটা কেটে গেল। তৃতীয়ত, বাংলার বিপ্লববাদী রাজনৈতিক কর্মীরা বাঙাকাকাবাবুর মাধ্যমে সর্বভাবতীয় বাজনীতিতে খানিকটা প্রতিনিধিত্ব পেলেন। চতুর্থত, ব্যাপাবটা ছিল মহাত্মা গান্ধী ও রাঙাকাকাবাবু দুজনের দিক থেকেই একটা ঐতিহাসিক

পেরিমেন্ট। স্বাধীনতা-সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে জাতীয় সংগ্রামের দুটি স্রোত যুক্ত করে গ্রসর হবার চেষ্টা দুদিক থেকেই করা হয়েছিল। আমি অবশ্য কটব ও গোঁড়া “ম ভাষবিরোধাদের কথা বাদ দিচ্ছি। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত গান্ধী-সুভাষ সম্পর্কের ইতিহাস ও দেশের রাজনীতিতে তার প্রতিক্রিয়া, আমাদের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

বল অতীতকে বোঝবার জন্যই আমি একথা বলছি না। আজকের রাজনীতি মূলত সেই সময়কার ঘটনাবলীরই পরিণাম! ঐক্যবদ্ধ ও প্রগতিশীল ভারতবর্ষ গড়ে তুলতে হলে গান্ধীজির গণজাগরণ ও লোকশক্তির পথ এবং সুভাষচন্দ্রের বৈপ্লবিক সংগ্রামী ও বৈজ্ঞানিক মতাদর্শের একটা সমন্বয় ঘটানো যায় না? এ প্রশ্নের উত্তর আজকের যুবসমাজ দিতে পারে।

একটা অপ্রিয় কথা না বলে পারছি না, যদিও ব্যাপারটা গুটিকতক ব্যক্তির ক্ষেত্রেই খাটে। রাঙাকাকাবাবুর সমসাময়িক কোনো কোনো রাজনীতিবিদ ও বন্ধু তিনি কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় বেশ ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন। ব্যক্তিগত ও জনজীবনে মানুষের চবিত্রের এই দুর্বলতা প্রায়ই দেখা দেয়। যাঁরা বড় তাঁরা উদার হয়ে এসব উপেক্ষা করেন।

মাজননী, বাবা, মা ও বাড়ির অন্য অনেকে দল বেঁধে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে হরিপুরায় গিয়েছিলেন। রাঙাকাকাবাবুর খুব ইচ্ছা ছিল যে বাসন্তী দেবীও তাঁর সঙ্গে হরিপুরায় যান। এ বিষয়ে তিনি ঠাকুমাকে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লেখেন, কিন্তু ঠাকুমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

৮১

বাসন্তী দেবীকে লেখা রাঙাকাকাবাবুর চিঠি। কংগ্রেস খুব জমকালো হয়েছিল। একান্নটি বলদ দিয়ে টানা এক্কাগাড়ি ধরনের একটা সাজানো রথে বসিয়ে সভাপতিকে বিবাট শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দৃশ্যটি ফিলমে ধরা আছে এবং আমরা মাঝে মাঝে দেখি। সভাপতিব অভিভাষণ রাঙাকাকাবাবু খানিকটা হিন্দিতে পড়েছিলেন। যাঁরা শুনেছিলেন তাঁরা বলেন যে তখনও তিনি ঠেকে ঠেকে হিন্দি বলতেন। অবশ্য আগে থেকেই তিনি হিন্দি শিখতে আরম্ভ করেছিলেন। শেখবার জন্য একজন শিক্ষকও রেখেছিলেন। অমায়িক, স্বল্পভাষী ঐ পণ্ডিতজি যে কেবল বাড়িতে এসে রাঙাকাকাবাবুকে হিন্দি অভ্যাস করাতেন তাই নয়। রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে তিনি সফরেও যেতেন, যাতে ক্রমাগতই হিন্দি শিক্ষা চলতে পারে। কয়েক মাসের মধ্যেই রাঙাকাকাবাবু হিন্দিভাষা বেশ রপ্ত করে ফেললেন। ক্রমে ক্রমে কথাবার্তায় ও বক্তৃতায়

৮২

তিনি উর্দু কথা মেশাতে আরম্ভ করলেন। শুনেছি, অন্য কেউ সভায় হিন্দুস্তানি বা উর্দুতে বক্তৃতা করলে রাঙাকাকাবাবু খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং নতুন কয়েকটি কথা মনে মনে তুলে নিতেন। পবের সভায় তিনি নিজেই সেই কথাগুলি ব্যবহার করতেন।

রাঙাকাকাবাবুর হরিপুরা ভাষণ স্কুলকলেজের ছেলেমেয়েদের মনোযোগ দিয়ে পড়া উচিত। ঐ ভাষণে তিনি ইতিহাসের পটভূমিতে ভারতের মুক্তি সংগ্রামের প্রকৃতি, গতি ও লক্ষ্যের একটা পরিষ্কার ছবি তুলে ধরেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞানভিত্তিক ও বাস্তবধর্মী। রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি সম্বন্ধে কোনো গোঁড়ামি–যা আজ আমরা এত দেখতে পাই–তাঁর মধ্যে ছিল না। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমাদের জাতীয় ভাষা সম্বন্ধে তাঁর মতামত বিচার করে দেখলে হয়। তিনি বলেছিলেন যে, হিন্দুস্তানি–হিন্দি ও উর্দুর একটা সহজ সংমিশ্রণ–আমাদের জাতীয় ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা উচিত। আরও বলেছিলেন যে,

জাতীয় সংহতি ও যোগাযোগের সুবিধার জন্য রোমান বা ল্যাটিন লিপি আমাদের গ্রহণ করা

উচিত।

বসুবাড়ির যাঁরা রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে হরিপুরায় গিয়েছিলেন তাঁরা বেশ আদরযত্ন পেয়েছিলেন। গুজরাটের জীবনযাত্রার ধরন তো অন্য রকম, বিশেষ করে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে। তা সত্ত্বেও দেশের যেখানেই যাই না কেন, বুঝতে পারি কেমন একটা মূলগত ঐক্যের বাঁধনে আমরা ভারতবাসীরা একসূত্রে বাঁধা। আর-একটা বড় কথা হল, গান্ধীজির ইচ্ছায ও নির্দেশে বামিক অধিবেশনগুলি গ্রামে করার নীতি কংগ্রেস সবেমাত্র গ্রহণ করেছে। যেটা কদিন আগেও একটা ছোট্ট গ্রাম ছিল, সেখানে অত বড় সম্মেলনের ও জনসমাবেশের জন্য সবরকম ব্যবস্থা দেখে আমাদের বাড়ির সকলেই খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন।

শুনেছি, হরিপুরায় রাষ্ট্রপতির মা, আমাদের মাজননীর বিনয় ও স্বভাবিকতা সকলকে মুগ্ধ করেছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের সমযটা তো ছিল ত্যাগ ও সেবার যুগ। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেব আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে দম্ভের অভিব্যক্তি ছিল কম।

হরিপুরা কংগ্রেসের পর বাঙাকাকাবাবু মাজননী ও বাড়ির অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে বাম্বাই যান। সেই সূত্রে বোম্বাইয়ে এক গুজরাটি দম্পতি নাথালাল পারিখ ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে বসবাড়ির বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁদের বাড়িতেই রাঙাকাকাবাবু অতিথি ছিলেন। পরেও যতবার বোম্বাই গিয়েছেন তাঁদেব বাড়িতেই থেকেছেন। ইউরোপে থাকতেই নাথালালের সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। ১৯৩৮ থেকে সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

১৯৩৮ সালের শেষের দিকে কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে রাঙাকাকাবাবু একটা বিরাট কাজের সূচনা করেছিলেন–স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশ পুনর্গঠনের পরিকল্পনার জন্য ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি গঠন। সেই সূত্রে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে বেশ কয়েকবার এলগিন রোডের বাড়িতে এসে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আলোচনা করতে দেখেছি।

॥ ২৮ ॥

আমার মনে হয় অনেক অসুবিধার মধ্যে রাঙাকাকাবাবুকে কংগ্রেস সভাপতির কাজ চালাতে হয়েছিল। কংগ্রেসের সদর অফিস ছিল এলাহাবাদে। সভাপতির কাজের যা চাপ

সেটা সামলাতে তাঁর জন্য কলকাতায় অন্তত দুজন দক্ষ সেক্রেটারির প্রয়োজন ছিল। তিনি অবশ্য মোটামুটি একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা ছিল নেহাতই চলনসই, উপযুক্ত বা পর্যাপ্ত নয়। অতিরিক্ত ব্যস্ততার মধ্যে তাঁর চিঠিপত্র, অফিসের কাগজপত্র ইত্যাদি খুবই এলোমেলো হয়ে যেত। ফলে পরে সবকিছু একত্র ও সুসংবদ্ধ করে দেশবাসীর জন্য বাঁচিয়ে রাখতে নেতাজী রিসার্চ বোকে খুবই বেগ পেতে হয়েছে।

বাঙাকাকাবাবুর অত্যধিক খাটুনিব আরও একটা দিক ছিল। ১৯২১ সালে জনজীবনে প্রবেশ করার সময় থেকে বাজনীতিব বাইরেও তিনি কলকাতা ও বাঙলার নানা ধরনের জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রেখেছিলেন। তা সে সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান, ছাত্র ও যুবকদের নানা সংগঠন, বিদ্যায়তন, লাইব্রেরি, ব্যায়ামাগার–যাই হোক না কেন। তাছাড়া কলকাতা কবপোবেশন তো ছিলই, যেটা একাধাবে বাজনীতি ও খানিকটা সমাজ সংগঠনেব এলাকা ছিল।

বাঙাকাকাবাবু যে-কোনো প্রতিষ্ঠানেব সঙ্গেই যুক্ত হতেন, তার কাজকর্মের খুটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামাতেন, কেবল উপদেশ, পৰামৰ্শ ও বক্তৃতার মধ্যে তাঁর কাজ সীমাবদ্ধ থাকত না। আমি নিজে তখনও ভেবেছি, কংগ্রেসের সভাপতি হবার পর তিনি স্থানীয় ও প্রাদেশিক নানা কাজ ও সমস্যা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিচ্ছেন না কেন। যেমন কংগ্রেসের সভাপতি হবার পরও তিনি করপোরেশনের অলডারম্যান হয়েছিলেন। প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির দৈনন্দিন কাজেও তাঁকে বেশ সময় দিতে হত। কত লোকের সঙ্গে যে রোজ দেখা করতেন বলবার নয়। অনেকের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট হত মোটরগাড়িতে। এমন কী, হয়তো বাইরে সফরে বেরোচ্ছেন, বাড়ি থেকে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত কারুর সঙ্গে জরুরি কথা বলবেন। অথবা কাউকে হয়তো বললেন বর্ধমান কি আসানসোল পর্যন্ত চলুন, ট্রেনে কথা

এমন লোকের ড্রাইভারও জবরদস্ত হওয়া দবকার! ১৯৩৭ সালে কার্শিয়ঙ-এ আমাদের সঙ্গে থাকার সময় এক বিলেত-ফেরত নেপালি ড্রাইভারকে পছন্দ করে রাঙাকাকাবাবু কলকাতায় নিয়ে আসেন। বাহাদুর’ ড্রাইভাৰ DKW নামে এক মজবুত জামান গাড়িতে রাঙাকাকাবাবুকে নিয়ে ঘুরত। প্রায়ই তা শেষ মুহূর্তে ট্রেন ধরতে হত, বাহাদুর রাঙাকাকাবাবুকে নিয়ে দশবারো মিনিটে এলগিন রোড থেকে হাওড়া স্টেশন পৌঁছে দিয়ে রেকর্ড করত। কতবার যে পুলিসে হাত অমান্য করেছে তার ঠিক নেই। ঝড়ের বেগে

যেও যে ঠিক সময়ে পৌঁছতেন তা না। অনেক সময় মেল ট্রেনও কয়েক মিনিট দেরিতে ছাড:–বাষ্ট্রপতি না-আসা পর্যন্ত গার্ড হুইসল দিতেন না।

রাঙাকাকাবাবু তো ক্রমাগতই বড়-বড় জনসভায় বক্তৃতা করতেন। মধ্য কলকাতার শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কেই সভা হত বেশি। মেডিকেল কলেজ থেকে জায়গাটা তো কাছেই–১৯৩৮ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত রাঙাকাকাবাবুর অনেক বক্তৃতা সেখানে শুনেছি। আমি কিন্তু বাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে সভায় যেতাম না, জনসাধারণের সঙ্গে মিশে গিয়ে মাঠে বসে বক্তৃতা শুনতাম। রাঙাকাকাবাবু প্রায় প্রত্যেক মীটিঙেই দেরি করে আসতেন। আমি হিসেব করে দেখেছিলাম, মোটামুটিভাবে আড়াই ঘণ্টা দেরি নিয়মেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। লোকেরা কিন্তু স্থির ও শান্ত হয়ে ঘণ্টা পর ঘণ্টা অপেক্ষা করত এবং তাঁর লম্বা-লম্বা বক্তৃতা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত কেউ নড়ত না। ৮৪।

বক্তৃতার ধরনটা রাঙাকাকাবাবু একেবারেই বদলে ফেলেছিলেন। শুদ্ধ বাংলায় দার্শনিকের মতো বক্তৃতা তিনি জনসভায় আর করতেন না–সহজ ও সোজাসুজি কথাবার্তার ঢঙে বলতেন। মাঝে-মাঝে রসিকতার সুরে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন তুলে সকলকে চমকে দিতেন। যেমন, একদিন জিজ্ঞাসা করে বসলেন, “যদি ইংরেজরা এই যুদ্ধে হেরে যায়, আপনারা কি দুঃখিত হবেন?” কোনো জবাব নেই, সব চুপ। তখন বললেন, “ও, ভয় করছে বুঝি! আমি আপনাদের হয়ে বলে দিচ্ছি, আমরা মোটেই দুঃখিত হব না।” আর একবার প্রশ্ন করলেন, “এই যে জামানরা লণ্ডনের উপর জিনিসপত্র ফেলছে, তাতে আপনাদের কি কষ্ট হচ্ছে?” আবার সব চুপ। নিজেই জবাব দিলেন, বললে, “আপনাদের। মনের কথা আমিই বলে দিচ্ছি, এতে আমাদেব কোনো কষ্ট নই।” তিনি জবাবগুলি বলে দেবার পর তুমুল হাততালি পড়ত। আর একটা কথা তিনি প্রায় প্রতি সভায় বক্তৃতার শেষে জিজ্ঞাসা করতেন–স্বাধীনতার শেষ সংগ্রামের জন্য সকল প্রস্তুত আছেন কিনা। সকলেই

একবাক্যে হাত তুলে সম্মতি জানাতেন।

দেশত্যাগ করার আগে যে তিন বছর রাঙাকাকাবাবু এলগিন রোডের বাড়িতে ছিলেন, সেই সময়কার কথা বলতে গিয়ে একজনকার সম্বন্ধে না লিখলেই নয়। আমার খুড়তুতো বোন ইলার কথা। সেই সময় যে স্নেহ, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে ইলা রাঙাকাকাবাবুর দেখাশুনো সেবা করেছিলেন, তার তুলনা পাওয়া শক্ত। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়, অসুখে-বিসুখে এবং অনেক ছোটবড় কাজে রাঙাকাকাবাবু অনেকটা ইলাৰ উপর নির্ভর করতেন। মহানিষ্ক্রমণের সময় ইলার ভূমিকা সম্বন্ধে পরে বলব। তবে রাঙাকাকাবাবুর কথা বলতে গেলেই আমার এই কোমলহৃদয় প্রিয় বোনটির কথা মনে পড়ে যায়। অবশ্য বাড়ির সব ছেলেমেয়েরাই যার যেমন সাধ্য রাঙাকাকাবাবুর কাজ করতে কখনও পেছপা হত না। ১৯৩৮-এ এলগিন রোডের বাড়িতেই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি মিটিং হল। বাড়ির সকলেই কাজে লেগে গেল।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ১৯৩৮-৩৯-এ আমাদেব (দশের দুই মনীষীর সঙ্গে বাঙাকাকাবাবুর সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার ঘটেছিল। একজন হলেন রবীন্দ্রনাথ, আর অন্যজন হলেন গান্ধীজি। রবীন্দ্রনাথ নিজেই পরে বলেছেন যে, অনেকদিন পর্যন্ত রাঙাকাকাবাবুব নেতৃত্ব সম্বন্ধে তাঁর মনে কিছু দ্বিধা ছিল। পূবননা চিঠিপত্র পড়ে মনে হয় রাঙাকাকাবাবুরও রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে কিছু অভিমান ছিল। কিন্তু ১৯৩৮-এ রবীন্দ্রনাথের সব দ্বিধা কেটে গিয়েছে এবং তিনি রাঙাকাকাবাবুকে দেশনেতার সর্বোচ্চ আসনে আহবান কবলেন। শুধু তাই নয়, আগামী কালের মুক্তিসংগ্রামের অধিনায়ককে তিনি সুভাষচন্দ্রের মাধ্যেই দেখতে পেলেন।

১৯৩৮-এর শেষের দিকে যখন রাঙাকাকাবাবু দ্বিতীয়বার কংগ্রেসের সভাপতি পদের জন্য প্রার্থী হবেন বলে ঠিক করলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজির প্রতিক্রিয়া একরকম তো হলই না, পরস্পরবিরোধী হল বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ রাজনীতির ডামাডোলে নিজেকে বড়-একটা জড়াতেন না। কিন্তু এক্ষেত্রে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, তিনি তাঁর মতামত গান্ধীজিকে জানিয়েছিলেন। তাঁর মতে, আমাদের মঙ্গলের জন্য দেশের দুই আধুনিক-মতাবলম্বী নেতা জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্রকে নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করা উচিত।

জওহরলালকে ইতিমধ্যেই সুভাষচন্দ্র নাাশনাল প্ল্যানিং কমিটির চেয়ারম্যান করেছেন, সুতরাং রবীন্দ্রনাথ বললেন, সুভাষচন্দ্রকেই কংগ্রেসের সভাপতির পদে রাখা উচিত। গান্ধীজি কিন্তু একমত হলেন না। এক বছর আগেই গান্ধীজি রাঙাকাকাবাবুকে সাদরে। সভাপতির পদে আহ্বান করেছিলেন। কেন গান্ধীজি নিজের মত ও পথ একেবারে পালটে ফেললেন এটা ঐতিহাসিকদের কাছে একটা গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা বোঝাপড়ার জন্য জওহরলাল কিছু চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনো ফল হল না। বোধ হয়, সেই সময় গান্ধীজির উপর উগ্র ও কট্টর গান্ধীবাদীদের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। এদিকে রাঙাকাকাবাবুর স্থির বিশ্বাস হল যে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে একটা আপসের চেষ্টা বার্থ করতে তাঁর উচিত সভাপতি পদের জন্য লড়া। ফলে কংগ্রেসের মধ্যে একটা তীব্র

লডাই অনিবার্য হয়ে উঠল।

১৯৩৯-এব জানুয়ারির শেষে ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি-নিবাচন হল। এ-ধরনে নির্বাচন কংগ্রেসের ইতিহাসে আর হয়নি। সেই সময় আমাদের বড় দাদার বিয়ে লাগল। বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে, সেজন্য কলকাতায় আত্মীয়স্বজনদের বেশ একটা বড় জমায়েত হল। যেদিন কংগ্রেস-সভাপতি নির্বাচনে সারা দেশে ভোট নেওয়া হচ্ছে সেই দিনই বিকালে বাবা উডবার্ন পার্কের সাউথ ক্লাবের মাঠে বিয়ের চা-পাটি দিচ্ছেন। রাঙাকাকাবাবুও আছে। একে-একে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ফলাফল জানা যাচ্ছে হয় টেলিগ্রাম বা প্রেস মারফত-দৌড়ে এসে কেউ-না-কেউ খবরটা দিয়ে যাচ্ছেন। সে কী উত্তেজনা। প্রথমটা

প্রতিযোগিতা খুবই তীব্র মনে হচ্ছিল, ভোট প্রায় সমান-সমান চলছিল।

রাঙাকাকাবাবু চা খাচ্ছেন আব শান্তভাবে হিসেব করে দেখছেন, ভোটের ধারা সম্বন্ধে মাঝে-মাঝে নিজের মন্তব্য করছেন। ক্রমে এটা বোঝা গেল যে, রাঙাকাকাবাবুর দিকের পাল্লাটাই ভাবী। চা-পাটি শেষ হবার পর রাঙাকাকাবাবু এলগিন রোডের বাড়িতে তাঁর অফিসঘরে গিয়ে বসলেন। বাড়ির ছোটবড় সকলেই আমরা তাঁকে ঘিরে রইলাম। শেষের ফলাফলগুলো তখন আসছে। রাঙাকাকাবাবু ক্রমাগতই টেলিফোনে কথা বলছেন। এই সূত্রে একটা কথা আমার মনে গেঁথে আছে। প্রত্যেক বারই বলছেন “আমরা জিতছি” বা “আমরা জিতব, একবারও ভুলে বলছেন না যে “আমি জিতছি”। এই সামান্য কথার মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে ব্যাপারটা ব্যক্তিগত নয় সকলে মিলে একটা আদর্শের জন্য

লড়াই।

আর-একটা কথাও মনে আছে। রাঙাকাকাবাবুর নিবাচনের জয়ের খবরে বাড়ির ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কেউ-কেউ প্রাদেশিক ও বিচ্ছিন্নতাবাদের সুরে কথা বলতে আরম্ভ করেছিলেন। যেন এটা ছিল সর্বভারতীয় শক্তির বিরুদ্ধে বাংলার একটা সাফল্য বা কৃতিত্ব। রাঙাকাকাবাবু কিন্তু এই ধরনের কথাবাতা ও ধারণা সঙ্গে-সঙ্গেই সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করেছিলেন। তাছাড়া গান্ধীজির একটা খুবই দুঃখজনক মন্তব্যের পরেও তিনি তাঁর মানসিক স্থৈর্য হারাননি। নির্বাচনের ফল ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কোনো হীন আপসের বিরুদ্ধে রায় বলে মেনে নিয়ে তিনি আবার কংগ্রেসের মধ্যে একতা ফিরিয়ে আনবার আপ্রাণ চেষ্টা

اط

করেছিলেন।

সপ্তাহ-দুই পরে রাঙাকাকাবাবু ওয়াধায় গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কলকাতা ফেরবার পথে ট্রেনেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মনে হয়, অসুখের গুরুত্বটা তিনি নিজেও ঠিক বুঝতে পারেননি। কলকাতায় ফিরে তিনি স্বাভাবিক কাজকর্ম করার চেষ্টা করলেন। দু-একদিন পরেই সফরে বের হবার কথা। ভাবলেন প্রোগ্রাম ঠিকই চলবে। কিন্তু একেবারেই শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। সব কাজকর্ম বন্ধ হল, সফর বাতিল হল। নতুনকাকাবাবু ডাঃ সুনীল বসুকে রাঙাকাকাবাবুর স্বাস্থ্য নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হতে কখনও দেখিনি। ডাঃ নীলরতন সরকার, ডাঃ মণি দে-র মতো বড় বড় ডাক্তার প্রায়ই যাওয়া-আসা করতে লাগলেন। রাঙাকাকাবাবু গোঁ ধরে বসলেন, যাই হোক না কেন, মার্চ মাসে প্রথমে ত্রিপুৰী কংগ্রেসে তাঁকে যেতেই হবে। ডাক্তাররা বললেন, তিনি যদি ডাক্তারদের সব নির্দেশ

মেনে চলেন তাহলে ত্রিপুরী কংগ্রেসে যাওয়ার আশাও তাঁকে ত্যাগ করতে হবে। এদিকে আবার ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মীটিং ওয়াধা বসবার কথা। ওয়ার্কিং কমিটির মীটিং-এ যাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। রাঙাকাকাবাবু কমিটির মীটিং পিছিয়ে দেবার প্রস্তাব করলেন। উত্তরে কমিটির প্রায় সব সই পদত্যাগ করে বসলেন! চাবদিক থেকে নানা রকম বিপদ যেন রাঙাকাকাবাবুকে চেপে ধরল। ৩ল অসুখ নিয়ে কেবল ডাক্তাররাই নয়, বাড়ির সকলেই খুবই শঙ্কিত হয়ে ছিলেন। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে তাকে আবার বেশ একটা বড় বকমের রাজনৈতিক লড়াইও লড়তে হচ্ছিল। বাঙাকাকাবাবু নিজেই পরে লিখেছিলেন যে, জীবনে তিনি অনেক ভূগেছেন কিন্তু ত্রিপুরী কংগ্রেসের সময় এক মাস তিনি যে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট পেয়েছিলেন, সেরকম কষ্ট জীবনে পাননি। রোগ নির্ণয় করতে ডাক্তারদের অসুবিধা হচ্ছিল, কারণ উপসর্গগুলি ছিল অদ্ভুত বনের। জ্বব আসে যায় কিন্তু কিছুতেই ছাড়ে না। রাঙাকাকাবাবুর কাছে শুনেছি, দুই ফুসফুসেই কি এক মারাত্মক রকমের নিউমোনিয়া হয়েছিল এবং রাঙাকাকাবাবু সেযাত্রায় রক্ষা পাবেন কিনা। সেবিষয়ে ডাক্তারদের বেশ সন্দেহ ছিল।

যাই হোক, রাঙাকাকাবাবু ত্রিপুরী যাবেনই। নতুনকাকাবাবু দুজন সহকারী ডাক্তার নিয়ে সঙ্গে যাবেন, বাড়ির আরও অনেকে সঙ্গে থাকবেন। আমি ত্রিপুরী যাইনি, সেখানকার সব ঘটনার কথা বাবা মা ও অন্যান্যদের কাছে পরে শুনেছিলাম। বাড়ি থেকে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত তো অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে দিয়ে যাওয়া হল। রাঙাকাকাবাবু যখন ত্রিপুরীর সভাপতির ক্যাম্পে পৌঁছলেন তখন তাঁর জ্বর ১০৩ ডিগ্রি। কংগ্রেস কাকে ডাক্তাররা তাঁর অবস্থা দেখে খুবই উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। শুনেছি তাঁরা নাকি বলেছিলেন, তাঁকে জব্বলপুরের ভাল হাসপাতালে রাখা হোক, ক্যাম্পে রাখাটা নিরাপদ নয়। রোগী নিজে কিন্তু

ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

অনেক জ্বর নিয়েও রাঙাকাকাবাবু অ্যাম্বুলেন্সে চেপে মণ্ডপে গিয়ে বিষয়-নিবাচনী সভায় সভাপতিত্ব করেন। ফলে তাঁর অবস্থার আরও অবনতি হয়। কংগ্রেসের পূর্ণ অধিবেশনে তাঁকে যেতে দেওয়া হয়নি। বাবা তাঁর অভিভাষণ পড়েছিলেন। শুনেছি ক্যাম্পে শুয়ে শুয়ে তিনি মাইক্রোফোনে বাবার গলা শোনার অপেক্ষায় থাকতেন। মাঝে-মাঝে বলে উঠতে,

ঐ শোনো, মেজদা বলছেন।

ত্রিপুরী কংগ্রেসের এমন একটি প্রস্তাব পাস হল যাতে করে সভাপতির হাত-পা বেঁধে

দেওয়া হয় বলা যেতে পারে। যাঁদের রাঙাকাকাবাবু তাঁর সমর্থক বলে মনে করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই অন্য দিকে চলে যান কিংবা কোনো অজুহাত দেখিয়ে দু’ নৌকোয় পা রেখে নিজেদের বাঁচাবার চেষ্টা করেন। তাছাড়া ত্রিপুরীতে উপরতলার রাজনৈতিক মহলের। ক্ষুদ্রতা রাঙাকাকাবাবুকে বিশেষ পীড়া দিয়েছিল। তিনি পরে লেখেন, এতই বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে সবকিছু ছেড়ে হিমালয়ের কোলে আশ্রয় নেবার ইচ্ছা তাঁর আবার জেগেছিল। কিন্তু ঐ সাময়িক দুর্বলতা তিনি কাটিয়ে উঠেছিলেন। ভারতের সব প্রান্তের অগণিত লোকের ভালবাসা ও সমর্থনের যথেষ্ট পরিচয় তিনি নানা ভাবে পেয়েছিলেন। ফলে তাঁব মনের বল আবার ফিরে এসেছিল। ত্রিপুরী যে আসল ভারতবর্ষের প্রতিভূ নয় তা তিনি বুঝেছিলেন এবং আবার দেশের ও দশের সেবায় আত্মনিয়োগ করবার সঙ্কল্প গ্রহণ করেছিলেন।

ডাক্তারদের ও বাড়ির সকলের মত হল যে, ত্রিপুরীর পর রাঙাকাকাবাবুকে কলকাতায় না এনে অন্তত কিছু দিন অন্য কোনো অপেক্ষাকৃত জনবিরল ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা উচিত। কলকাতার পথে ধানবাদে তাঁকে নামিয়ে নেওয়া হল এবং আমাদের ন’কাকাবাবু সুধীন্দ্রের জামাডোবার বাংলোতে তোলা হল।

॥ ৩০ ॥

ত্রিপুবী কংগ্রেস ও তারপর ১৯৩৯-এর মে মাসে কলকাতায় নিখিল-ভারত কংগ্রেস কমিটির বৈঠকের মধ্যে যে সময়টুকু ছিল সেটা আমাদের দেশের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরের দশকে দেশের ইতিহাসের গতি কী হবে, সেটা সেই সময়ই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। বসুবাড়ির সকলকে যেটা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সেটা মূলত ছিল রাঙাকাকাবাবুর শারীরিক অবস্থা এবং সেই সঙ্গে তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবনের অনিশ্চয়তা। ন’কাকাবাবু সুধীরচন্দ্রের জামাডোবার বাড়িতে বিশ্রাম, সেবা ও চিকিৎসার ফলে তিনি ধীরে-ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন।

গান্ধীজি জামাডোবায় আসতে রাজি না হওয়ায় রাঙাকাকাবাবু কংগ্রেসের মধ্যে বিবাদ মেটাবার জন্যে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ পত্রালাপ আরম্ভ করলেন। আমাদের দেশের ও বিদেশের ঐতিহাসিকেরা তাঁদের এইসব চিঠিপত্র নিয়ে আজকাল গবেষণা ও আলোচনা করেন।

ত্রিপুরী কংগ্রেসের নির্দেশ ছিল, রাষ্ট্রপতিকে মহাত্মা গান্ধীজির মতানুসাবে ওয়ার্কিং কমিটী গঠন করতে হবে। কিন্তু এব্যাপারে গান্ধীজি কিছুতেই রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে সহযোগিতায় রাজি হলেন না। পণ্ডিত জওহরলাল একবার জামাডোবায় এলেন, কথাবার্তাও হল, কিন্তু। কাজ বিশেষ এগুল না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল যে, অল ইণ্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনের দিনকয় আগে গান্ধীজি কলকাতার কাছে সোদপুর আশ্রমে থাকবেন এবং সেই সময় দুজনের মধ্যে মুখোমুখি কথাবার্তা হবে। ওই সময় কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাও কলকাতায় আসবেন। তাঁদেরও আলোচনার জন্য পাওয়া যাবে।

রাঙাকাকাবাবু বেশ সুস্থ হয়েই কলকাতায় ফিরলেন। নিজেই তিনি বলতেন, জীবনে কতবার কত রকম অসুখ যে তাঁর হয়েছে–তার হিসেব নেই। কিন্তু তাঁর সেরে ওঠার ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। আবার দেখা গেল তাঁর বলিষ্ঠ ও উজ্জ্বল চেহারা। ৮৮

বাবা তো রাঙাকাকাবাবুকে জামাডোেবায় নামিযে চলে এসেছিলেন। ত্রিপুরীতে রাজনীতির যে চেহারা তিনি নিজের চোখে দেখে এসেছিলেন সেটা তাঁকে গভীরভাবে আঘাত করেছিল। গান্ধীজিকেও তিনি এ-বিষয়ে বেশ তীব্র ভাষায় চিঠি লিখেছিলেন। এই সূত্রে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে তাঁর অন্তরের সম্পর্ক সম্বন্ধে কিছু বলি। বাৰাব নিজের জীবনেও তো অনেক রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। অনেক অন্যায়, অবিচার, অসদ্ব্যবহার, ঈষাপ্রসূত শত্রুত তিনি অবিচলিত চিত্তে সহ্য করেছেন। তা সে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা সহকর্মী, যে-দিক থেকেই আসুক না কেন। কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে যা তিনি শান্তভাবে মুচকি হেসে উড়িয়ে দিতে পারতেন, ভাই সুভাষের ক্ষেত্রে তা পারতেন না।

সুভাষের প্রতি কেউ কোনও অবিচার বা অন্যায় করেছে–এটা যদি তার মনে গেঁথে যেত একবার, তিনি আর অবিচল থাকতে পারতেন না। তীব্র ভাষায় এবং জোরের সঙ্গে তাব প্রতিবাদ ও প্রতি-আক্রমণ করতেন। বাঙাকাকাবাবুর প্রতি এবি মনের ভাব সম্বন্ধে আমরা দু-একধরনের কথা শুনতাম—এক, সুভাষকেই তিনি নিজের বড় ছেলের স্থান দিয়েছিলেন, এবং তার দাবি ছিল অনস্বীকার্য। দুই, নিজে ছেলেদের চেয়ে তিনি সুভাষকে বেশি ভালবাসতেন। আমাদের কিন্তু এতে হিংসা হত না, গৌরবই ৩

পরে, যুদ্ধের সময় রাঙাকাকাবাবুর বিদেশের কার্যকলাপ নিয়ে অনেকে অনেক অপ্র কথা। বলেছিলেন, অনেকে তো কুৎসা রটনা করতেও ইতস্তত কবেননি। এদের বাবা মনেমা। কোনদিনও ক্ষমা করতে পারেননি। আমার মনে হয়, এর কারণ ছোট ভাইযেব প্রতি তার গভীর ভালবাসা। শুধু তাই নয়, রাঙাক বাবুর নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম, বাজনৈতিক প্রতিভা ও অতুলনীয় আত্মত্যাগের তুলনা তিনি সমসামযিক কোনও ব্যক্তির মাধ। দেখেনি। বড় ভাই ছোট ভাইকে বুক ফুলিয়ে নেতা বলে স্বীকার করছেন–এ নজির ইতিহাসে আব আছে কি

সন্দেহ! ১৯৩৯-এর মে মাসে কংগ্রেস কমিটীর অধিবেশনের দিনক আগে গান্ধীড়ি কলকাতায় এলেন এবং সোদপুরের আশ্রমে উঠলেন। গান্ধীজির সঙ্গে বাঙাকাকাবাবুর দীর্ঘ আলোচনা চলতে লাগল, কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব মেটাবার জন্য। মনে আছে, রাঙাকাকাবাবু প্রায়ই খুব সকালে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে আসতেন। পণ্ডিতজিকে সঙ্গে নিয়ে আমাদেব ‘ওয়াণ্ডারার গাড়িতে করে সোদপুর রওনা দিতেন। এই ওয়াণ্ডারার গাড়িটিকে অনেক ঐতিহাসিক কাজে লাগানো হয়েছে। নেতাজীর মহানিষ্ক্রমণের আগে ও পবে। আজ নেতাজী ভবনের মিউজিয়ামে গাড়িটি অন্যতম বড় আকর্ষণ।

গান্ধীজির সঙ্গে অনেক আলোচনা করেও কোনও মীমাংসার সূত্র খুঁজে পাওয়া গেল না। একদিন দেখি, রাঙাকাকাবাবু ও জওহরলাল একটু বেলায় উডবার্ন পার্কের বাড়িতে ফিরে নামনের বারান্দায় গম্ভীর মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। যেন গুরুতর কিছু ঘটে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পরে রাঙাকাকাবাবুই স্তব্ধতা ভাঙলেন। বললেন, “যাও, খাওয়া-দাওয়া করো, আফটার অল, ম্যান মাস্ট লিভ।”

জওহরলাল উত্তরে শুধু বললেন, “ইয়েস, ম্যান মাস্ট লিভ।” তার পর দুজনে দুদিকে চলে গেলেন।

কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারে যখন কংগ্রেসের সভা বসল, তখন সকলেই খুব উৎকণ্ঠিত। রাঙাকাকাবাবু কংগ্রেসের নির্বাচিত সভাপতি, কিন্তু তিনি নিজেই প্রস্তাব

৮৯

করলেন, সরোজিনী নাইডু সভানেত্রী হোন। কারণ, সভাপতি নিজেই এক বিতর্কের বিষয়। মনে আছে, সরোজিনী নাইডু অতি সুন্দর ইংরেজিতে এক আবেগময়ী বক্তৃতা করেছিলেন রাঙাকাকাবাবুকে সভাপতি পদে বহাল থাকতে অনুরোধ জানিয়ে। তাঁর বক্তৃতার পরে অনেকেই মনে হয়েছিল, এই ধরনের মর্মস্পর্শী আবেদনের পরে রাঙাকাকাবাবু কী করবেন।

রাঙাকাকাবাবু কিন্তু সম্পূর্ণ অবিচলিত থেকে ধীবে ও শান্তভাবে তাঁর বিবৃতি পড়লেন : যুক্তির ভিত্তিতে তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি যখন ত্রিপুরী কংগ্রেসের নির্দেশ অনুসালে চলতে পারছেন না, সভাপতির পদ ত্যাগ করা ছাড়া তাঁর সামনে আর কোনও পথ খোলা নেই। তিনি পদত্যাগেব কথা ঘোষণা করার সঙ্গে-সঙ্গে সভায, বিশেষ করে অভ্যাগতদের মধ্যে, তীব্র আলোড়ন শুরু হল।

নতুন সভাপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ সভার সমাপ্তি ঘোষণা করার পবে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের চারদিকে বিক্ষোভ ফেটে পড়ল। নেতাদের সভার বাইরে বেব করা ও যারাঁর বাসস্থানে পৌঁছে দেওয়া বিরাট এক সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। রাঙাকাকাবাবু স্বেচ্ছাসেবকদের একটা বহ রচনা করতে বললেন, এবং উত্তেজিত জনতাকে বারবার বলতে লাগলেন যে, বাংলা আতিথেয়তার ঐতিহ্য যেন কোনও মতে ম্লান না হয়। তিনি নিজে স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্যে অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে এক-এক করে আগলে গাড়িতে তুলে দিলেন।

আমরা ছোটরা কয়েকজন গোলমালের মধ্যে একটু দলছাড়া হয়ে পড়েছিলাম। পাশের একটা গেট দিয়ে কোনওরকমে বেরিয়ে একটা গাড়ি ধবে বেশ দেরিতে বাড়ি পৌঁছলাম। আমরা গুজব শুনেছিলাম যে, পণ্ডিত জওহরলাল নাকি ধস্তাধস্তির ফলে আঘাত পেয়েছেন। তিনি তো আবার আমাদের বাড়িতেই অতিথি। একটু ভয়ে-ভয়েই আমরা বাড়িতে ঢুকলাম। ঢুকতেই পণ্ডিতজির সেক্রেটারি উপাধ্যায়জির সঙ্গে দেখা। তিনি তো একগাল হেসে আমাদের সম্ভাষণ জানালেন। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আমরা তাঁর কাছ থেকে জেনে নিলাম যে, পণ্ডিতজির কোনও আঘাত লাগেনি এবং সুস্থ শরীরেই আছেন। নিশ্চিন্ত হয়ে

শুতে গেলাম।

১৯৩৯-এর মে মাসে দেশের জাতীয় নেতৃত্ব দ্বিধাবিভক্ত হল। গান্ধীজি কংগ্রেসের নেতৃত্ব ফিরে পেলেন। রাঙাকাকাবাবু একলা নিজের পথে চলতে আরম্ভ করলেন।

১৯৩৭ সালেব কথা! রাঙাকাকাবাবু জেল থেকে ছাড়া পাবার কিছুদিন পরে এলগিন রোডের বাড়িতে কংগ্রেসে ও আমাদের জনজীবনের নেতৃস্থানীয় বেশ কিছু লোক একটা সভা করেন। সভায় স্থির হয় যে, সুভাষ কংগ্রেস ফাণ্ড বলে একটা তহবিল খোলা হবে, এবং যথেষ্ট টাকা সংগ্রহ হলে সেটা রাঙাকাকাবাবুর হাতে তুলে দেওয়া হবে। উদ্দেশ্য, রাঙাকাকাবাবুর নেতৃত্বে কলকাতায় একটা কংগ্রেস ভবন গড়ে তোলা। এইভাবেই মহাজাতি সদনের পরিকল্পনা শুরু। ধীরে-ধীরে টাকা তোলার কাজ এগোতে থাকে। ১৯৩৮ সালে রাঙাকাকাবাবু যখন কংগ্রেসের সভাপতি এবং পৌরসভার অলডারম্যান, তখন কলকাতা

করপোরেশন এক প্রস্তাব পাশ করে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউর উপর বেশ খানিকটা জমি বাঙাকাকাবাবুর হাতে তুলে দেন।

জমির ব্যবস্থা হয়ে যাবার পর রাঙাকাকাবাবু তাঁর মনেব মতো একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠানে। পরিকল্পনার কাজে হাত দেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল খুবই বড় ও আধুনিক। তাঁর ইচ্ছা ছিল যে, আমাদের জাতীয় ও জনজীবনের সব দিক দিয়ে বিকাশ ও সমৃদ্ধির জন্য নানা ব্যবস্থা ঐ ভবনে থাকবে। এক কথায় মহাজাতি সদন হবে ভবিষাৎ জাতি গঠনের পীঠস্থান। মনে আছে, যুদ্ধের সম্ভাবনা মনে রেখে তিনি পরিকল্পনা কবেছিলেন যে, বিমান আক্রমণের সময় আশ্রয় নেবার জনা ভবনের নীচে বড় ধরনের আধুনিক এয়াব রেড সেলটার ও থাকবে।

যথাসময়ে রাঙাকাকাবাবু তাঁর পরিকল্পনা রবীন্দ্রনাথের কাছে পেশ করলেন। তা ছাড়া, ভবনটির একটি নাম দিতে এবং বাড়িটির ভিত্তিস্থাপন করতে কবিকে অনুরোধ করলেন। ১৯৩৯-এর জানুয়ারির প্রথমেই রাঙাকাকাবাবু শান্তিনিকেতন যান এবং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আম্রকুঞ্জে সংবর্ধনা দেন। তখনও ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন হয় তীব্র। লড়াইয়ের পর এবং গান্ধীজির অমতে বাঙাকাকাবাবু সভাপতি নির্বাচিত হবা নেকেই ভাবতে লাগলেন ঐ অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ কী করবেন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু; মন স্থির করে ফেলেছেন। তিনি রাঙাকাকাবাবুকেই সোজাসুজি চিঠি লি োনালেন যে, কলকাতার কোনো এক বড় হলে তিনি রাঙাকাকাবাবুকে সংবর্ধনা দেবে এবং রাষ্ট্রনায়ক। রূপে বরণ করবেন। যে-কোনো কারণেই হোক, কবির সেই সভা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। কিন্তু ঐ উপলক্ষে রাঙাকাকাবাবুকে উদ্দেশ করে রবীন্দ্রনাথ যে “দেশনায়ক” অভিভাষণটি লিখেছিলেন, সেটি অমর হয়ে আছে।

যাই হোক, শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও অগাস্ট মাসে রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এসে তাঁরই নাম দেওয়া মহাজাতি সদনের ভিত্তিস্থাপন করতে রাজি হলেন। রাঙাকাকাবাবু তখন আর কংগ্রেসের সভাপতি নেই; তিনি তখন বিরোধী পক্ষের নেতা। তবুও বীন্দ্রনাথ এলেন।

আমরা বাড়ির প্রায় সকলেই দল বেঁধে বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে মহাজাতি সদনের ভিত্তিস্থাপনের মণ্ডপে পৌঁছলাম। মণ্ডপ ছাপিয়ে বাইরে বিরাট জনতা। রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্রকে একসঙ্গে দেখবার সুযোগ কে ছাড়তে চায়? ভলান্টিয়ারদের সাহায্যে অনেক কষ্টে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। আমার খুব ইচ্ছা ছবি তোলা। কিন্তু তুলব কি করে? মণ্ডপের ভিতরে আলো কম, ফ্লাশ না হলে তো আমার ক্যামেরায় ছবি উঠাবে না। আমাদের বন্ধু আনন্দবাজারের ফোটোগ্রাফাব বীরেন সিংহকে বললাম, আপনি ফ্লাস দেবার ঠিক আগে আমাকে ইশারা করবেন, আমি সেই সময় আমার ক্যামেরার শাটার খুলে দেব। বীরেনবাবুর ফ্ল্যাশে আমার ক্যামেরায় এইভাকে কয়েকটি ঐতিহাসিক ছবি উঠে গেল।

মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ও বাঙাকাকাবাবুব বক্তৃতা আমাদের ছেলেমেয়েদের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত–জাতি হিসাবে আমাদের আদর্শের ধারাবাহিকতা ও লক্ষ্য বোঝবার জন্য।

এর কিছুদিন আগে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বৈঠক হয়েছিল। রাঙাকাকাবাবুর ডাকে দেশের নানা দিক থেকে বেশ কয়েকজন নেতা উডবার্ন পার্কের ছোটবাড়ির ছাদে মিলিত হয়েছিলেন। উদ্দেশ কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী একটা বিরোধী পক্ষ গড়ে তোলা। অনেকেই এসেছিলেন। যাঁকে বিশেষ করে মনে আছে তিনি

হলেন মাদ্রাজের বর্ষীয়ান নেতা কংগ্রেসের ভূতপূর্ব সভাপতি শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার। বহুদিন আগে দেশবন্ধুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। এবার এলেন তাঁরই মন্ত্রশিষ্যকে শক্তি যোগাতে। তাঁকে দেখলেই মনে শ্রদ্ধার ভাব জাগত। এই সভা অনুষ্ঠিত হবার কিছুদিনের মধ্যেই রাঙাকাকাবাবু ফরওয়ার্ড ব্লক গঠনের কথা ঘোষণা করেন।

১৯৩৯-এব সেপ্টেম্বরে ইউরোপে যুদ্ধ বেধে গেল। আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের গতি ও ধারা বদলে গেল। স্বাভাবিক সময়ে বাকবিতণ্ডা করা, দাবিদাওয়া নিয়ে পথে-ঘাটে আন্দোলন করা, বড় বড় প্রস্তাব পাশ করে শত্রুপক্ষকে যুদ্ধে আহ্বান করা এক কথা; আর যুদ্ধের মধ্যে নিজেদের কর্তব্য ঠিক করে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ অন্য কথা। প্রায় দু’বছর ধরে রাঙাকাকাবাবু ক্রমাগতই বলছিলেন যে, বিশ্বযুদ্ধ এগিয়ে আসছে, সংগ্রামের জন্য তৈরি হতে হবে। ত্রিপুরী কংগ্রেসে তো সোজাসুজি বলে দিলেন যে, মাস ছয়েক পরে ইউরোপে যুদ্ধ বাধবে। হলও তাই। আরও বলেছিলেন যে, পরাধীন জাতির পক্ষে যুদ্ধবিগ্রহ খুব একটা অবাঞ্ছিত কিছু নয়–ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পুরো সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতার জন্য আমাদের চূড়ান্ত সংগ্রাম শুরু কবে দিতে হবে।

সত্যি-সত্যি যুদ্ধ আরম্ভ হবার পর দেখলাম অনেকেই সুর পালটালেন। রাঙাকাকাবাবু কিন্তু একই সুরে একই কথা-সংগ্রামের কথা বলে চললেন। ফরওয়ার্ড ব্লক গঠনের পর তিনি সারা ভারত পরিক্রমা করেছিলেন, বিপুল জনসমর্থন পেয়েছিলেন, এবং লক্ষ-লক্ষ লোককে নিজের মনের কথা শুনিয়েছিলেন। ফলে তাঁর স্থির বিশ্বাস হয়েছিল যে, ভারতবর্ষ মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে, প্রয়োজন হল যোগ্য নেতৃত্বের, যে-নেতৃত্ব স্বাধীনতার শেষ সংগ্রাম পরিচালনা করবে।

১৯৩৯ সালের একটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার কথা আমি অনেক পরে ১৯৩৯ সালে জানতে পারি। শুনতে পেলাম এক চীনা ভদ্রলোক, যিনি ১৯৩৯ সালে কলকাতায় চীন সরকারের কূটনৈতিক প্রতিনিধি ছিলেন, কলকাতায় এসেছেন। নাম হুয়াও চাও চিন। নামটা যেন দলিলপত্রে কোথাও দেখেছি বলে মনে হল। টেলিফোনে যোগাযোগ করে চৌবঙ্গির এক হোটেল থেকে তাঁকে নেতাজী ভবনে ধরে নিয়ে এলাম। নেতাজী ভবনে এসে তিনি খুব খুশি, বললে, এই ঘরেই তো ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়েছিল। বাঙাকাকাবাব কে গোপনে ডেকে জানতে চেয়েছিলেন. চীন সরকার তাঁকে আশ্রয় দিতে রাজি হবে কিনা। দেশে থেকে তিনি স্বাধীনতার সংগ্রাম চালাতে পারবেন না, কারণ ইংরেজ সবকার যে-কোনো অজুহাতে যতদিন যুদ্ধ চলবে ততদিন তাঁকে বন্দী করে বাখবে। ডানা ভদ্রলোকটি খোঁজখবর করে রাঙাকাকাবাবুকে জানান যে, সৌজন্যমূলক যাত্রায় কোনো বাধা নেই, তিনি টানে স্বাগত, কিন্তু রাজনৈতিক কার্যকলাপের সুযোগ চীন সরকার তাকে দিতে পারবেন না, কারণ ইংরেজ সরকারের সঙ্গে তাঁদের বন্ধুত্বের চুক্তি রয়েছে। ব্যাপারটা থেকে দুটি শিক্ষা পেলাম। এক, রাঙাকাকাবাবু অনেকদিন থেকেই বিদেশে গিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করার কথা ভাবছিলেন। দুই, যে-কোনো সরকারের বিদেশনীতি নিজের জাতীয় স্বার্থে চালিত হয়; রাজনৈতিক আদর্শগত প্রশ্ন সেখানে বড় নয়। ব্রিটিশ সরকারও রাঙাকাকাবাবুকে সেই সময় চীন যাবার জন্য পাসপোের্ট দিতে অস্বীকার করেছিল।

॥ ৩২

স্কুল কলেজ ফাঁকি দিয়ে সভা-সমিতিতে যাওয়া সাধারণত বাবা-মা পছন্দ করতেন বলে মনে হয় না। তাছাড়া উডবার্ন পার্কের বাড়িতে যে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা বিরাজ করত, ছাত্রজীবনে হুজুগে মেতে যাওয়া তার সঙ্গে ঠিক খাপ খেত না। তবে এ-সবই সাধারণ ও স্বাভাবিক অবস্থার কথা। অনেকগুলো ব্যতিক্রম তো আমার জীবনেই ঘটেছে। স্কুলজীবনেই তো আইন অমান্য আন্দোলনের সময় রাস্তায় বেরিয়েছি। বাবা তখন জেলে, মা তো সব জেনেও কিছু বলেননি বা সোজাসুজি বাবণও করেননি। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়বার সময় ১৯৩৭ সালে আমরা একটা বড়রকমের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলাম–আন্দামান থেকে আমাদের বিপ্লবী বন্দীদের দেশে ফিরিয়ে আনবার দাবিতে। বাবা তখন বাঙলার আইনসভায় বিরোধীপক্ষের নেতা। বাবারই নেতৃত্বে টাউন-হলে বিরাট প্রতিবাদ-সভা হবে। সব স্কুল-কলেজে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। কলেজগুলোর মধ্যে বাজভক্তদের দুটো শক্ত ঘাঁটি ছিল সেন্ট জেভিয়ার্স ও প্রেসিডেন্সি। এই দুই কলেজের কর্তৃপক্ষ যেমন ভিন্নমতাবলম্বী ছিলেন, ছাত্রদের বড় একটা অংশও ছিল রাজভক্তদের দলে ও জাতীয় আন্দোলনে অনাগ্রহী। সুতরাং ঐ দুই কলেজে ধর্মঘট সফল করবার জন্য আমরা উঠেপড়ে লাগলাম। সেই সময় একটা বড় সুবিধা ছিল যে ছাত্রদের সংগঠন ছিল একটাই এবং ঐক্যবদ্ধ। অনেক তাত্ত্বিক বিষয়ে আমাদের মতামত ভিন্ন হলেও, যে-কোনো জাতীয় প্রশ্নে আমরা সকলে মিলে উঠেপড়ে লাগতাম।

সেন্ট জেভিয়ার্সে ধর্মঘট সফল হল এবং আমরা মিছিল করে প্রেসিডেন্সিতে গেলাম। আমাদের হানায় প্রেসিডেন্সির দরজাও খুলে গেল। অন্য কলেজের সব ছাত্র তো ছিলই। ছাত্রদের একটা বিরাট মিছিল ট্র্যাণ্ড রোড ধরে ঘুরে টাউনহলে যাবার চেষ্টা করল। স্ক্র্যাণ্ড বোডে ঘোড়সওয়ার এক বড় পুলিশের দল ঘোড়া ছুটিয়ে ভীষণ ভাবে বৌন চার্জ করল। আমরা যারা সামনের দিকে ছিলাম, স্ট্র্যাণ্ড রোডের লোহার রেলিং-এ নিজেদের সেঁটে রেখে কোনোক্রমে প্রাণ বাঁচালাম। যাঁরা মাঝামাঝি ছিলেন তাঁদের খুব আঘাত লাগল, আবার অনেককে পুলিশ টেনে টেনে ভ্যানে তুলল। সন্ধ্যার পর পুলিশের চোখ এড়িয়ে টাউনহলে হাজির হলাম। বাবাকে সভায় দূর থেকে দেখলাম। বেশি রাতে হেঁটে বাড়ি ফিরে যা হয়েছিল বাবাকে বললাম। শান্তভাবে শুনে মুচকে হেসে শুতে যেতে বললেন।

মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা তখন পর্যন্ত বাইরেকার কোনোরকম আন্দোলন থেকে দূরেই থাকত। মেডিকেলে ভর্তি হবার পর দেখলাম যে, সেখানে একটি নতুন অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে। সে-সময়ে বাংলার মুসলিম লীগের রাজত্ব। সরকারের প্ররোচনায় ছাত্রসম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনকী ছাত্র ইউনিয়নের আইনকানুনেও ভাগাভাগির নীতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া মিলিটারি থেকে মনোনীত কিছু অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ছাত্র মেডিকেল কলেজে পড়তে আসত-নাম ছিল মিলিটারি মেডিকেলস্। ফলে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদের বেশ অসুবিধার মধ্যে কাজ করতে হত। ব্যক্তিগতভাবে আমার একটা সুবিধা ছিল। বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চরিত্র এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁদের সুনাম অন্য সম্প্রদায়ের ছাত্রদের বিশ্বাস ও সমর্থন লাভ করতে আমাকে সাহায্য করেছিল। তাছাড়া সব

সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে আমরাও বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর উদার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করতে চেষ্টা করতাম। ফলে, প্রথমে ছাত্র ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি ও পাবে সভাপতি নিবাচনে আমি সব দিক থেকেই সমর্থন পেয়েছিলাম।

১৯৩৬ সালে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে কার্শিয়ঙ-এ থাকার সময় থেকে তাঁর রাজনৈতিক চিন্ত প্রত্যক্ষভাবে আমাকে প্রভাবিত করতে আবম্ভ কৰে। সেই সময় অবশ্য অন্য অনেকের মতো সংৰকমৰ ৰাজনৈতিক বই, কাগজপত্র আমি পড়তাম। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির ও দলের কার্যকলাপও আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে লক্ষ কবতাম। মনে আছে, সেই সময় কিছুদিনের জন মানবেন্দ্রনাথ বাযের লেখা আমার উপর খুবই প্রভাব বিস্তার করেছিল। সবকিছু দেখেশুনে বিচার করে একটা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক মতামত গড়ে তুলতে সময় লাগে। নানারকম লেখা পড়ে ও আলোচনা শুনে অপরিণত বয়সে আমি কখনও কখনও রাঙাকাকাবাবুর মত ও পথ সম্বন্ধে বিভ্রান্ত হয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গভীর চিন্তা ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের পর সব দ্বিধা ও সংশয় কেটে গেছে। আজও তো দেখি অনেকেই তাদের মধ্যে বাঙালি ছাত্র ও যুবার সংখ্যা কম নয়-রাঙাকাকাবাবুর আদর্শ পুবোপুরি হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি এবং তাঁর কার্যাবলীব যথেষ্ট মর্যাদা দিতে কুণ্ঠা বোধ কবেন। আমি তখন সবেমাত্র ম্যাট্রিক পাস কবেছি। বাড়ি একজন রাঙাকাকাবাবুকে বললেন, আমি অনা কোনো রাজনৈতিক মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। রাঙাকাকাবাবু আমার দিকে চেয়ে মুচকে হেসে বললেন, তাতে কী হয়েছে, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন নিজেব পরিণত বয়সে দেখছি,–অন্য অনেকের ক্ষেত্রে কিন্তু সব ঠিক হয়ে যায়নি।

১৯৩৮ সালে কংগ্রেসের সভাপতি হবার পর একদিন রাঙাকাকাবাবু আমাকে ডেকে বললেন, আমি যেন নিয়মিত মস্কো বেডিও থেকে প্রচারিত খবরাখবব শুনি। যদি কখনও আমাদের দেশের রাজনীতি সম্বন্ধে, বিশেষ কবে তাঁর নিজের কার্যকলাপ সম্বন্ধে, তারা কিছু বলে তাহলে আমি যেন নোট করে রাখি। উডবার্ন পার্কে একটা ভাল রেডিও ছিল, তাতে বদেশের প্রোগ্রাম ভাল শোনা যেত। আমি তো রাত জেগে ক্রমাগতই শুনতে লাগলাম। বেশি রাতে বাবা যখন কাজ সেরে উপরে উঠতেন, প্রায়ই দেখতেন যে রেডিও বেজে চলেছে আর আমি হয়তো রেডিওতে মা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছি। আমাকে তুলে দিয়ে হেসে বলতেন, এই রে, সুভাষের পাল্লায় পড়েছে! অনেক শুনেও আমি রাঙাকাকাবাবুকে বিশেষ কোনো খবর দিতে পারিনি। কারণ মস্কো রেডিও প্রধানত তাদের নিজেদের খবরই প্ৰাচার করত, আর ক্রমাগতই স্টালিনের মহিমাকীর্তন শুনতে হত। রাঙাকাকাবাবু কেন আমাকে একাজটি দিয়েছিলেন আমি জানি না। তবে আমার দিক থেকে একটা বড় লাভ হল যে নানা দেশের খবরাখবরে আমার বেশ একটা উৎসাহের ভাব জাগল ও বিদেশী

রেডিও শোনার অভ্যাসটা স্থায়ী হয়ে দাঁড়াল।

কংগ্রেসের সভাপতিপদ থেকে ইস্তফা দেবার পর থেকে রাঙাকাকাবাবু ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনোরকম আপসের বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন যে, ১৯৪০-এর মার্চ মাসে যখন বিহারের রামগড়ে কংগ্রেসের পূর্ণ।

অধিবেশন হবে সেই সময় পাশেই সর্বভারতীয় ভিত্তিতে তিনি আপসবিরোধী সম্মেলন। ডাকবেন। বিহারের কৃষকনেতা স্বামী সহজানন্দ ঐ সম্মেলন সংগঠনের ভার নিলেন।

৯৪

আমার খুব ইচ্ছা হল অন্তত একদিনের জন্য রামগড়ে যাই। মেডিকেল কলেজে তখন খুব কাজ। যাই হোক, মাকে চুপিচুপি বলে রেলভাড়া নিয়ে তো রাত্রে ট্রেনে রওনা দিলাম। সকালে রামগড়ে পৌঁছে দেখলাম ভীষণ ঝড়বৃষ্টিতে সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। বাইরেও জল, প্রতিনিধিদের ক্যাম্পেও। রাঙাকাকাবাবুর ক্যাম্পে গিয়ে দেখি, পৃবিবেশ কর্দমাক্ত। তারই মধ্যে তিনি একটা চারপাইতে বসে কাগজপত্র দেখছেন। শুনলাম সবেমাত্র সব ক্যাম্প ঘুরে কে কেমন আছে দেখে, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করে নিজের ঘরে ফিরেছেন। আমাকে দেখে গম্ভীরভাবে বললেন, কী, রাতটা থাকা হবে নাকি? আমি আমতা-আমতা করে বললাম, না, রাত্রের ট্রেনে ফিরে যাব, কলেজ চলছে তো। ‘‘ বলে খাওয়া-দাওয়ার

বস্থার যা অবশিষ্ট আছে আমাকে জানালেন। আমার মনে হল, আমি রামগড়ে যে গেছি তাতে তিনি খুশি, কিন্তু কেবল একদিনের যাওয়াটা তাঁব পছন্দ হয়নি।

পাশেই কংগ্রেসের অধিবেশন। হাতে কিছু সময় আছে দেখে কংগ্রেসের এলাকায় 15ংলাম। কংগ্রেসের পূর্ণ অধিবেশন যেখানে হবার কথা সেটা ছিল বিরাট গোলাকাব নিচু জমি, জল জমে সেটা একটা পুকুরে পরিণত হয়েছিল। সুতরাং সেখানে সভা হাতে

বোন। খানিকটা দূরে উঁচু জায়গায় একটা বড় গাছের তলায় মঞ্চ তৈরি করে সভা চলছিলমৌলানা আজাদ বক্তৃতা করছিলেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের দরুণ কংগ্রেস তো ঠিকমতো হতেই পাবল না। সংক্ষেপ করে সেই দুপুরেই সমাপ্তি ঘোষণা করা হল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে মেঘ কেটে গেল। বিকেলে যখন আপসবিরোধী সম্মেলনের পূর্ণ অধিবেশন বসবে তখন বেশ সূর্যের আলো। বেশ জমজমাট সভা হল। আমি অভ্যাসমতো বেশ কিছু ছবি তুললাম।

আপসবিরোধী সম্মেলনেব কর্মসূচী অনুযায়ী এপ্রিল মাসে জাতীয় সপ্তাহে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন শুরু হল। সারা দেশে সুভাষ-অনুগামীদের বাপক ধরপাকড় চলতে লাগল।

র নিজের কী হবে আমাদের তখন তাই চিন্তা।

॥ ৩৩।

১৯৪০ সালটা ছিল নানা দিক দিয়ে বেশ গোলমেলে বছর। বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর রাজনৈতিক জীবনে এমন সব ঘটনা ঘটল যে, বসুবাডিৰ সকলের উপরেই কোনো-না-কোনো ভাবে তার প্রভাব পড়ল। আগের বছরে কংগ্রেসের নেতারা শৃঙ্খলা ভাঙবার দায়ে রাঙাকাকাবাবুকে দল থেকে প্রায় বের করে দিয়েছিলেন। তখন বাবা বাংলার বিধানসভায় বিরোধী কংগ্রেস দলের নেতা। ক্রমে ক্রমে বাবার সঙ্গেও কংগ্রেসের উপরতলার নেতাদের মতভেদ ও তিক্ততা বাড়তে লাগল। শেষ পর্যন্ত ১৯৪০-এর শেষের দিকে বাবাকেও কংগ্রেস হাইকমাণ্ড শৃঙ্খলা ভাঙার অভিযোগে দলনেতার পদ থেকে সরিয়ে দিলেন। কিন্তু দিলে হবে কী,দলের অধিকাংশ সদস্যই বাবার নেতৃত্ব মেনে নিয়ে কংগ্রেস দল হিসাবেই কাজ চালিয়ে গেলেন। যেমন বাংলার প্রদেশ কংগ্রেসের অধিকাংশ সদস্য রাঙাকাকাবাবুর নেতৃত্বে প্রদেশ কংগ্রেস চালিয়ে যাচ্ছিলেন। যাই হোক, ভাগাভাগির ফলে বাইরে যেমন, বিধানসভাতেও তেমন দুটি কংগ্রেস দল হয়ে গেল। অন্যটির নেতা হলেন কিরণশঙ্কর রায়।

৯৫

কিরণবাবু ও তাঁর পবিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের বহুদিনের হৃদ্যতা। আমরা ছেলেবেলায় উডবার্ন পার্কের বাড়িতে তাঁদের অনেক দেখেছি। তিরিশের দশকের প্রথমে যখন বাঙাকাকাবাবু বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি, তখন কিরণশঙ্কর ছিলেন সেক্রেটারি। কিরণবাবুর চেহারায় বেশ একটা আভিজাত্যের ছাপ ছিল। ওপর থেকে তাঁকে

•ী: প্রকৃতির মনে হলেও তিনি খুব বসিক ও হৃদয়বান লোক ছিলেন। শুনেছি তাঁর তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বুদ্ধির জন্য অনেকে তাঁকে বোস গ্রুপের চাণক্য বলে অভিহিত করতেন। শেষের দিকে রাজনীতির ডামাডোলে অন্য দলে চলে গেলেও বাবার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত প্রীতির সম্পর্ক দেখে অনেকে অবাক হতেন। কিরণবাবুর অকালমৃত্যুর কিছুদিন আগেও রোগে শয্যাশায়ী পুরনো বন্ধুকে বাবা নানা কাজের মধ্যেও দেখতে যেতেন এবং ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরতেন।

বিধানসভায় বাবা দুজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে উডবার্ন পার্কে প্রায়ই দেখতে পেতাম। একজন তুলসীচন্দ্র গোস্বামী, অন্যজন সন্তোষকুমার বসু। তুলসীবাবুর মতো সুপুরুষ বড় একটা দেখিনি, তবে তাঁর সম্বন্ধে যেটা বেশি মনে পড়ে, সেটা হল তাঁর শিষ্টাচার। তাঁর ব্যবহারে ও কথাবার্তায় শিক্ষা ও ভদ্রতার যে পরিচয় পাওয়া যেত, তার তুলনা নেই। হয়তো বাবার জরুরি কোনো চিঠি নিয়ে আমি তাঁর বাড়িতে গেছি, তিনি নিজে বেরিয়ে এসে দবজাব গোড়া পর্বদা তুলে ধরে সবিনয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন, যতক্ষণ না আমি ঢুকছি। ভাবটা হল যে, এই যুবকটি তাঁর বাড়িতে পদার্পণ করে তাঁকে কৃতার্থ করেছে। তুলসীবাবু হয়তো আমাদের বাড়িতে এসেছেন, বাবার হয়ে আমি তাঁকে অভ্যর্থনা কবতে নেমেছি এবং তাঁরই কায়দায় পরদা তুলে ধবে দাঁড়িয়ে আছি। তা কিন্তু হবে না, তিনি মুখ নিচু করে দাঁডিযেই আছেন, আমি এগুলে তিনি এগুবেন। তাঁর বক্তৃতার ক্ষমতার কথা তো বলাই বাহুল্য। বাজবন্দীদের মুক্তি দাবি কবে তার একটা বক্তৃতা বিধানসভায় শুনেছিলাম, আজও কানে বাজে।

সন্তোষকুমার বসু আমাদের সকলের সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবে অন্তরঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনিও খুব ভাল বক্তা ছিলেন, আর তাঁর গলার জোব ছিল খুব। ১৯৩৭ রাঙাকাকাবাবুর অভার্থনাসভায় মাইক খাবাপ হয়ে যায়। ডাক পড়ল সন্তোষবাবুর! তিনি শুধু-গলায় সকলকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন। বৃদ্ধ বয়সেও নেতাজী রিসার্চ বয়োর কাজে যথাসাধ্য সহায়তা করে গেছেন। তাঁর কাছে লেখা রাঙাকাকাবাবুর অনেকগুলো চিঠি তিনি নেতাজী-ভবনের সংগ্রহশালায় দান করে গেছেন।

স্কুলজীবনে আমবা আমাদেব জ্যাঠাবার সতীশচন্দ্র বসুকে দেখতাম কম। কারণ তিনি পাটনায় ব্যারিস্টারি করতেন। তিরিশের দশকের শেষের দিকে তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং এখানকাব হাইকোর্টে প্র্যাকটিস আরম্ভ করেন। সেই সময় থেকে আমরা তাঁকে প্রায় রোজই দেখতে পেতাম। উডবার্ন পার্কের দক্ষিণের বারান্দায় বাবার টেবিলের পাশে আর-একটি টেবিলে তিনি প্রায়ই এসে বসতেন। তন্নতন্ন কবে খবরের কাগজ পড়া তাঁর একটা অভ্যাস ছিল, কোথায় কী হচ্ছে, সবকিছু তাঁর নখের ডগায় থাকত। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েবে সঙ্গে তাঁর খুব ভাল জমত। প্রায় প্রত্যেককেই তিনি বেশ মজার-মজার নাম দিতেন আর ক্রমাগতই ছড়া কাটতেন। ছোটখাটো ফুটফুটে একটি মেয়ের নাম দিলেন ‘বাঘ’, বেশ বড়সড় একটি ছেলের নাম দিলেন ‘ইঁদুর’, ইত্যাদি। আমাদের বাড়িতে

যেদের বুডি’ বা তার কাছাকাছি, না দেওয়ার রেওয়াজ লি। এদেব : শা,

• শো না চারশো, এই নিয়ে ছোটদের সঙ্গে সবল ও সব আলোচনা চল।

বান্ধবরাও বাদ যেতেন না। যেমন, কোনো একনেব নাম ছিল অকন ২ দিলেন “; আলবানি।

১৯২১ সালে রাঙাকাকাবাবু কখন কেমব্রিজ সে আই সি এস থেকে ইস্তফা দিলেন :0ঠাবাবু এখন বিলেতে ছিলে; জ্যাঠাবাবুকে ইবে কব পাবেছিলেন।

ঙাকাকাবাবুকে বুঝি-সঝিয়ে মত বদলাবার চেষ্টা করতে তিরিশের দশকের শেষে .লকাতা ফেরবার পর বাঙাকাকাবাবুর ইচ্ছা জাঠা কপায়েশনের কাউন্সিল

ছিলেন। পরে বিধানসভারও স : যুদ্ধের সময় বসুবাডিতে পর পর কয়েকটি ম হয়। বাড়িতে শোকের ছাযা মে স! জ্যাঠাৰাবু এক নিদারুণ শাক পেয়েছিলেন। তার বড় ছেলে ধবেনাথ– :লেই {ণেশ বলে জানতে-~অকালে মারা যান।

১৯১৪ সালটি যতই এগোতে লাগল, দশে রাজনীতিতে বাঙাকাকাবাবু * : এক : পড়তে লাগলেন। দক্ষিণপন্থা বা মধ্যপন্থদের কথা ছেড়েই দিলাম যাব। এখ নজেদের খুব জোরগলায় বামপন্থী বলে প্রচার করে থাকেন, তাঁপাও কি এই সঙ্কটের “ বাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে ছিলেন নাসংগ্রাম কিন্তু চলছিল! আপোস বিৰােধী সম্মেলনে * আমৰা ধরেই নিয়েছিলাম, তিনি যে-কোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পং। সারা

•বতে তাঁর সহকর্মীদের জেলে পূবে ইংবেজ সকাব রাঙাকাকাবাবুকে মাস তিনেক ৮৬ “খ দিল। ইতিমধ্যে তিনি একটা নতুন ধরনের আন্দোলনের ডাক দিকে। বাংলার শে? সাধন নবাব সিবাজউদ্দৌলাকে হেয় করব না তথাকথিত অন্ধকপ ২ :্যার নিদর্শন। সব বাইটার্স বিল্ডিং-এর দক্ষিণ পশ্চিম কোণে হলওয়েল মমন্ট ছিল। প্রতি এ অপমানের প্রতিবাদে ও মনুমেন্টটি, অপসাবণের দাবিতে বাঙাকাকাবাবু সাগ্রহ

পালন করা ঠিক করলেন। তাঁর এই আন্দোলনে হিন্দু ও মুসলমান এই সম্প্রদায়ের। * ‘দেব কাছ থেকে বশ সাড়া পাওয়া গেল। বাঙাকাকাবাবু ঘোষণা করলেন যে, প্রথম

• ৩ জুলাই নি সগ্রহীদের নেতৃত্ব দেবেন। সেই দিনই দুপরে তা গ্রেপ্তার

নন।

উলাই থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্সি (জলে বন্দী ছিলেন। এ সময় কয়েকবার বাড়ির অনাদেব সঙ্গে আমি জেলে তাঁর সঙ্গে দেখা কৰতে গিযেছি। তাঁকে খুব প্রফুল্ল দখাও। জেল-কর্মচারীদের সঙ্গে রসিকতা করে প্রায়ই বলতেন, “কা, ‘বুশ সাম্রাজ্য আব ৩ দিন “ ৩ব পবেই বলতেন, “না, আপনারা ভয় পাবেন না। আপনারা যেখানে আছেন সেখানেই থাকবেন, আমবা যারা বন্দী আছি বেরিয়ে যাব, অন্য

নেব বন্দী আসবে।” এখন কেই বা জানত যে, সেই সময় তিনি তাঁর জীবনের কঠিনতম সংকল্প নিতে যাচ্ছেন।

যেমন মান্দালয় জেলে বহুদিন আগে করেছিলেন, এবাবও বাঙাকাকাবাবু স্থির করলেন 2, বাজবন্দীরা জেলে দুর্গাপূজা করবেন। গত্যন্তর না দেখে সরকার রাজি হয়ে গেল। পুজোর সব যোগাড় অবশ্য বাড়ি থেকে দেওয়া হল। বিসর্জনেব দিন বিকালে আমরা দল বেধে জেল গেট-এ উপস্থিত হলাম। লরি কবে প্রতিমা জেল থেকে বের করে আনা হল।

লরির পেছন-পেছন রাঙাকাকাবাবু ও অন্য বন্দীরা গেট পর্যন্ত এলেন। প্রতিমা বিসর্জনের ভার বাইরে সমবেত যুবকেরা নিলেন। অভ্যাসমতো আমি ব্যাপারটার কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম।

গ্রেপ্তারের পর থেকেই তাঁর বিনা বিচারে বেআইনি আটকের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যে তিনি আবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেন্দ্রীয় বিধানসভায় নিবাচিত হলেন, ঢাকা কেন্দ্র থেকে। দুর্গাপূজার পর থেকেই তিনি সরকারকে একটার পর একটা চিঠি লিখতে লাগলেন। শেষপর্যন্ত কোনো সদুত্তর না পেয়ে তাদের জানালেন যে, যদি সরকার তাঁকে মুক্তি না দেয়, তাহলে তিনি আমরণ অনশন করবেন। চিঠিগুলি। ইতিহাসের পাতায় গেঁথে রাখার মতো। একটি চিঠিকে তো তিনি নিজেই তাঁর জীবনের বাণী বলে চিহ্নিত করে গেছেন।

॥ ৩৪।

কিছু তথ্য আছে যার থেকে মনে হয় যে, ১৯৪০-এর প্রথম দিকে রাঙাকাকাবাবু দেশ ত্যাগ করার উপায় ও সম্ভাবনা সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন। উত্তর-পশ্চিম ভারতে সেই সময কীতি-কিষান পার্টি বলে একটি দল ছিল। সেই দল সম্ভবত সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে একটা যোগাযোগ গড়ে তুলতে চাইছিল। তাছাড়া, ঐ অঞ্চলে রাঙাকাকাবাবুর নিজের দলের বিশ্বস্ত অনুগামীও বেশ কয়েকজন ছিলেন। এদের মধ্যে বেছে-বেছে কয়েকজনকে বাঙাকাকাবাবু তাঁর গোপন বিদেশযাত্রার আয়োজনে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ফল দেখে বোঝাই যায় যে, ঐ প্রাথমিক চেষ্টা বিশেষ কার্যকরী হয়নি। সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে যে কোনো ব্যবস্থাই করা যায়নি সেটা পরের অভিজ্ঞতা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়।

ব্যাপারটার আর একটা দিকও আছে। মার্চ মাসে আপস-বিরোধী সম্মেলনের পর থেকেই রাঙাকাকাবাবুর অনুগামী ও সহকর্মীদেব ব্যাপক ধরপাকড় আরম্ভ হয়ে যায়। তার ওপর আবার তিনি হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের জন্য আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। ৩ জুলাই তিনি প্রথম সত্যাগ্রহী হবেন বলে ঘোষণাও করলেন। ঐ ঘোষণার পর সরকার আর চুপ করে থাকল না, সেই দিন সকালেই তাঁকে গ্রেপ্তার করল।

এখন কথা হল, রাঙাকাকাবাবু যখন অন্তর্হিত হওয়ার কথা ভাবছেন তখন তিনি কেন লওয়েল মনুমেন্ট সত্যাগ্রহের নাক দিয়ে গেপ্তারের ঋকি নিলেন? এর দুরকম ব্যাখ্যা হতে পারে। প্রথমত, এটা ছিল হয়তো সরকার পক্ষকে ধোঁকা দেওয়ার একটা উপায়। যাতে তাবা মনে করে যে, তিনি যখন অন্য ধরনের প্রশ্ন নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছেন, তাঁর অন্য কোনো বৈপ্লবিক কর্মসূচী নেই। দ্বিতীয়ত, রাঙাকাকাবাবু হয়তো ভাবছিলেন যে, সরকার শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করবে না। এরকম চিন্তা করার যুক্তিও ছিল। যুদ্ধ আরম্ভ হবার কিছুদিনের মধ্যেই বাংলার গভর্নমেন্ট সভাসমিতি, মিছিল ইত্যাদির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। রাঙাকাকাবাবু অমান্য করে নানা জায়গায় সভা করেন ও যুদ্ধবিরোধী প্রচার করেন। সরকার কিন্তু এটা চুপচাপ হজম করে নেয়। তারপর মে ও জুন মাসে ঢাকায় ও নাগপুরে বড় বড় সম্মেলন করে বাঙাকাকাবাবু খোলাখুলি ভাবে দেশবাসীকে সংগ্রামের পথে

৯৮

আহ্বান করেন। এসব দেখেশুনেও সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করতে এগোয়নি। তা ছাড়া হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলন এমন একটা ব্যাপার, যাতে মুসলমান সম্প্রদায়ের বেশ সহানুভূতি ছিল। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ দলের কেউ কেউ তাঁর প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন।

রাঙাকাকাবাবু যাই ভেবে থাকুন না, তিনি বন্দী হলেন। যুদ্ধের মধ্যে যখন সারা জগতে ভাঙাগড়া চলছে তখন জেলের মধ্যে হাত গুটিয়ে বসে থাকা তাঁর মোটেই পছন্দ ছিল না। তাঁর স্থির বিশ্বাস হয়েছিল যে, অদৃষ্টের বিধানে পৃথিবীর ঐ সংকটকালে দেশের মুক্তির জন্য তাঁকে দুঃসাহসিক কিছু করতে হবে। শত্রুপক্ষ তো একদিকে তাঁকে ভারতরক্ষা আইনে বিনা বিচারে বন্দী করল, অন্যদিকে একটি জনসভায় রাজদ্রোহাত্মক বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ও ফরওয়ার্ড ব্লক’ পত্রিকায় একটি আপত্তিকর প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য দুটি মামলা রুজু করল।

মামলার শুনানি আলিপুর কোর্টে হত। প্রেসিডেন্সি জেল থেকে কড়া পুলিস-পাহারায় বাঙাকাকাবাবুকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হত। আমরা দল বেঁধে মামলা শুনতে যেতাম। রাঙাকাকাবাবুর পক্ষের উকিল পুলিসের রিপোর্টারদের জেরা করে বেশ নাস্তানাবুদ করতেন। আমাদের বেশ মজা লাগত। একবার বেশ জোরের সঙ্গে এবং যুক্তির ভিত্তিতে রাঙাকাকাবাবুর পক্ষ থেকে জামিনের আবেদন করা হল। ম্যাজিস্ট্রেট তো আইনমতো জামিন মঞ্জুর করলেন, কিন্তু তারপরেই বললেন, তিনি জামিন দিচ্ছেন কিন্তু সেটা কার্যকরী হবে কি না তা নিয়ে তাঁর যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ, অন্য এক আইনের বলে সরকার রাঙাকাকাবাবুকে বিনা বিচারে ধরে রেখেছে। এই দু-মুখো সরকারি নীতির বিরুদ্ধে বাঙাকাকাবাবু লড়াই আরম্ভ করলেন। কেন্দ্রীয় বিধানসভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবেও তিনি মুক্তি দাবি করলেন, কিন্তু কোনো ফল হল না। বোঝা গেল, রাঙাকাকাবাবুর প্রতি গভর্নমেন্টের মনোভাব বেশ কঠোর।

বাবার শরীর সে-সময় ভাল যাচ্ছিল না। রাঙাকাকাবাবু জেলে গেলেই অসুস্থ হতেন কিন্তু বেরিয়ে এসে কিছুদিনের মধ্যে আবার বেশ সবল হয়ে উঠতেন। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত জেলে থাকার সময় বাবার শরীর বেশ ভেঙে যায়। কিন্তু পরে অনেক চেষ্টা করেও বাবা আগের স্বাস্থ্য ফিরে পাননি, যদিও কাজকর্ম তিনি পুরোদমে শেষ পর্যন্ত চালিয়ে গেছেন। অল্প বয়স থেকে তাঁর ডায়াবেটিস রোগ থাকায় এবং জেলে অসুখটা বেড়ে যাওয়ায় তিনি হয়তো কখনোই পুরোপুরি সেরে উঠতে পারেননি। ছুটির সময় বাবা প্রায়ই স্বাস্থ্যকর কোনো জায়গায় কিছুদিন কাটিয়ে আসতেন। অবশ্য কাজ তাঁর। পেছন-পেছন দৌড়ত। পুরোপুরি অবসর তিনি কখনোই পেতেন না। ১৯৪০-এর পুজোর ছুটিতে বাবা-মা দেরাদুন যাওয়া স্থির করলেন। তার আগে বাবা মাঝে মাঝে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। মার কাছে শুনেছি, সেই সময় রাঙাকাকাবাবু বাবাকে বার বার বলতেন, যখন উত্তর ভারতে যাবেন তিনি যেন সীমান্ত প্রদেশের মিঞা আকবর শাহকে ডেকে পাঠান এবং রাশিয়ায় যেতে বলেন। আকবর শাহ ছিলেন রাঙাকাকাবাবুর বিশ্বস্ত অনুগামী, সীমান্ত প্রদেশের ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা। এর থেকে বোঝা যায় যে, রাঙাকাকাবাবুর ইচ্ছা ছিল নিজের কোনো বিশ্ব রাজনৈতিক সহকারীর মাধ্যমে বিদেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে কথাবার্তা আরম্ভ করা। নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী প্রেসিডেন্সি জেলে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গী ছিলেন। রাঙাকাকাবাবুর আগেই নরেনবাবুর মুক্তি পাওয়ার একটা

সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। পেনবাবুকে রাঙাকাকাবাবু বলেছিলেন, মুক্তির পর গোপনে বিদেশে (বাশিয়া ও ইউরোপে। চলে যাওয়ার চেষ্টা করতে। ইউরোপের কয়েকজন রাষ্ট্রনায়কের নামে তিনি চিঠি দেবে বলেছিলেন এবং সেগুলি কীভাবে লুকিয়ে জেলের বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে, ৩ শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এই সূত্রে নরেনবাবু আমাকে বলেছিলেন যে, তাঁর বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনার সময় রাঙাকাকাবাবু আমার সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য করেছিলেন।

ঠিক কবে রাঙাকাকাবাবু স্থির সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি নিজেই বিদেশে পাড়ি দেবেন সেটা বলা শক্ত। এই কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে যে তিনি কয়েক মাস ধরে এগোচ্ছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এটা ধরেই নেওয়া যায় যে, যেদিন তিনি মুক্তির দাবি

আমরণ অনশনেব সঙ্কল্প নিয়েছিলেন, সেদিন তিনি চূড়ান্তভাবে মনস্থির করে ফেলেছিলেন। এত বড় ঝুঁকি আমাদের দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে কেউ নিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। দেরাদুন থেকে ফেরার পর বাবা আবার রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে জেলে দেখা করতে আরম্ভ করলেন। একদিন তো বাবা খুবই চিন্তিত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। সরকারপক্ষের বন্ধুভাবাপন্ন ব্যক্তিরা বাব বার বলছেন, সুভাষবাবুকে এই মারাত্মক পথ থেকে নিবৃত্ত করুন। কারণ, গভর্নমেন্টের মনোভাব খুবই কঠোর এবং তারা কিছুতেই তাঁকে মুক্তি দেবে না। এদিকে বাবা জানেন যে, রাঙাকাকাবাবুর আমরণ অনশন মানে আমরণ অনশন। তাঁর দাবি স্বীকৃত না হলে কেউ তাঁকে ফেরাতে পারবে না। যাই হোক, রাঙাকাকাবাবু কালীপুজোব। দিন অনশন আরম্ভ করলেন। বাড়ির সকলেরই মনের যা অবস্থা–সেটা লিখে বোঝানো

দিন-সাতেক অনশন চলার পর হঠাৎ এক বিকেলে খবর এল যে, সরকার রাঙাকাকাবাবুকে বিনাশর্তে মুক্তি দিযেছে। এব্যাপারে ভারত ও বাংলার সরকারের মধ্যে যে-সব চিঠিপত্র বিনিময় হয়েছিল, সেগুলি আমি সম্প্রতি দেখেছি। সেই সময়েই কিন্তু বাবা, রাঙাকাকাবাবু ও বসূবাড়ির এক অকৃত্রিম বন্ধু ভেতরের খবব রাঙাকাকাবাবুকে জানাতেন। তিনি হলেন তখনকার অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসেব নৃপেন ঘোষ। নৃপেনবাবু সবকার-ঘেঁষা সংবাদ সংস্থায় কাজ করতেন, কিন্তু কোনো গোপন খবর তাঁর গোচরে এলে তিনি বাবা বা রাঙাকাকাবাবুকে গোপনে জানিয়ে যেতেন। বাংলার গভর্নর ও মন্ত্রিসভা হঠাৎ বেশ ভয় পেয়ে গেল। জেলের সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবেব রিপোর্ট বেশ খারাপ ছিল এবং তাতে ইঙ্গিতও ছিল যে, অনশন চলার সময় জেলে বন্দীর মৃত্যু মোটেই অসম্ভব নয়। এদিকে ভারত সরকার কোনোমতেই তাঁকে মুক্তি দিতে বাজি নয়। বাংলার সরকার তাঁকে কিছুদিনের জন্য মুক্তি দেওযর সিদ্ধান্ত নেওযায় ভাবত সরকার ঘোর আপত্তি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। উত্তরে কলকাতা থেকে ইংরেজ গভর্নর লিখেছিলেন, কোনো চিন্তা কোরো না। আমরা সুভাষ বসুর সঙ্গে, বিড়াল যেমন ইঁদুরের সঙ্গে খেলে, তাই করছি।

জেলের সুপারিনটেনডেন্ট রাঙাকাকাবাবুর প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি বার বার রাঙাকাকাবাবুর কাছে এসে অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ জানাতেন। বলতেন, আপনি বুঝছেন না কেন ইভন এ লাইভ ডংকি ইজ বেটাব দ্যান এ ডেড লায়ন! সুপারিনটেনডেন্টব হাতে ফলের রস খেয়েই রাঙাকাকাবাবু অনশন ভঙ্গ করেন।

রাঙাকাকাবাবুকে ছেড়ে দিয়েছে শুনেই আমরা এলগিন রোডের বাড়িতে ছুটলাম। ১০০

শুনলাম আম্বুলেন্সে করে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আমি গিয়ে দেখলাম নিজের ঘবে তিনি শুয়ে বয়েছেন। বেশ ফ্যাকাশে ও দুর্বল দেখাচ্ছিল তাঁকে, কিন্তু চোখ আগে মতোই উজ্জ্বল। ওঁর গোঁফ জেলে থাকতেই দেখেছিলাম, দেখলাম সেই গোঁফ আরও ঘন হয়েছে। খোঁচা খোঁচা দাড়িও গজিয়েছে।

অভ্যাসমতো আমি দরজার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলাম, ইঙ্গিতে কাছে ডাকলেন। ২াছে যেতেই কোনো কথা না বলে আমাৰ হাত নিজে হাতের মধ্যে নিয়ে চুপ করে রইলেন

অনেকক্ষণ।

। ৩৫ }

*

“ “

১৯৪০-এর ডিসেম্বরে আমার জীবনে যা ঘটল! ছিল আমার কল্পনাও লাইবে। .-ঘটনা ভাৰতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সচা কেবল তার সঙ্গে আমি এড়িয়ে “এব, সে কথা কি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিলাম? ইতিহাস «ক আমাদের না লেনিই তার কাজ করে যায়। আমাণ মতো খড়কুটো শ্রোতা ন দুবাৰ গতিতে {ভস চলে। পাক মনে হয় কোথায় যেন পৌঁছে গেলাম।

বা ইতিহাসপুৰুষ বা যে কেবল বৃদ্ধি ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সবকিছু ঠিক করেন।

•, ইনটুইশন বা স্বভাবজাত একটা অনুভূতি তাঁদের থাকে। কাকাবাব ঐ স্বভাবজাত অনুভূতি সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন এব” দেখিয়েছিলেন যে, গবে ইতিহাসে বড় ডে নেতাবা অনেক সময়েই কেবল বুদ্ধিব বিচাৰে •ায়, ভি৭ থেকে আসা অনুভূতি সাহায্যে অনেক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরে ঐসব সিদ্ধান্ত ইতিহাসের বিচারে ঠিক বলেই প্রমাণিত হয়েছে। আমার মনে হয় বাঙাকাকাবাবুও কেবল বিচাৰপৃদ্ধি, বিশ্লেষণ ও

ক্তির দ্বারা নয়, অনুভূতিৰ দ্বাৰা চালিত হতেন।

অনেকে আজও জিজ্ঞাসা করেন আমাকেই বা তিনি ডেকে নিলেন ক। এর উত্তর দ ও শক্ত। কতটা সামগ্রিকভাবে বিচার করে বা কতটাই বা কেবল ভূf এর ভিত্তিতে তিনি ব্যক্তিবিশেষকে কাজের জন্য বেছে নিতে কে জানে! হ৫ে পাশে, আমার অজান্তে অনেক দিন ধবে এর জন্য প্রস্তুতি চলছিল এবং সেজন্যই আমি ৩ ডাকে সাড়া দিতে পোরলাম। তবে প্রথমেই এটা বলে রাখি যে, একটা বিরাট ঐতিহাসিক রে খুবই ছোট

এবং অদৃশ্য যন্ত্র ছিলাম আমি।

বসূবাড়ির ছেলেমেয়েদের জীবন যে গতানুগতিক ছিল তা ঠিক বলা যায় না। দেশে তখ- একটা সর্বাত্মক সংগ্রাম চলছে, আদর্শবাদের ঝড় সারা দেশকে তোলপাড় কৰছে। বাড়ির দুই শ্রেষ্ঠ পুরুষ সেই সংগ্রামে অংশীদাব। এ সব-কিছুৰ খানিকটা ছোঁয়া তো আমাদের গায়ে লাগবেই। ১৯৪০-এর আগেও আমাদের মধ্যে কেউ কেউ নানাভাবে কমবেশি ছাত্র-আন্দোলন, যুব-আন্দোলন বা গণ-আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বাড়ির বাইরেও আমরা দেখতে পেতাম, দেশে হাজার হাজার লোক—ারী পুরুষ কিশোক ছাত্র–দেশের কাজে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। কত পরিবাব নিঃস্ব হয়েছেন। কত ছেলেমেয়ে পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। জেলে গিয়েছেন। চোখের সামনেই তো কতজনকে প্রাণ বিসর্জন দিতেও দেখলাম। এসবের প্রভাব সামগ্রিকভাবে আমাদের ওপর পড়তে

১০১

বাধ্য। তবে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া যে একইরকম হবে এমন কোনো কথা নেই। আমার সমসাময়িক অনেক ছাত্র ও যুবককে তো দেখেছি, নানা যুক্তি বা অজুহাত দেখিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে জাতীয় সংগ্রামের স্রোত থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখতেন।

যাই হোক, আমার জীবনের গতি সাধারণ অর্থে গতানুগতিক না হলেও সেই সময় পর্যন্ত এমন কিছু ঘটেনি যেটা সত্যিই অসাধারণ বলা যায়। অসাধারণ বলতে আমি বলছি এমন একটা কিছু যেটা জীবনটাকে ওলটপালট করে দেয় এবং এক নতুনপথে চালিত করে। রাঙাকাকাবাবু তাঁর বিরাট পরিকল্পনায় একটা ছোট্ট কাজের ভার দিয়ে আমার জীবনে সেই

অসাধারণত্ব এনে দিলেন।

ব্যাপারটা শুরু হল খুবই সহজভাবে। রাঙাকাকাবাবুর ব্যক্তিগত পরিচারক করুণা একটা ছুটির দিনে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে এসে আমার ঘরে ঢুকে আমাকে বলে গেল ‘কাকাবাবু দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমাকে একবার দেখা করতে বলেছেন। বাডির কাউকে দিয়ে তো বলাতে পারতেন বা টেলিফোনে ডাকতে পারতেন। আমার মা প্রায় রোজই রাঙাকাকাবাবুকে দেখতে যাচ্ছিলেন। মা আমাকে ইতিমধ্যেই বলেছিলেন যে, রাঙাকাকাবাবু আমার দিনের রুটিন সম্বন্ধে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করেন। আমি কখন কলেজে যাই, কখন ফিরি, পড়াশুনার চাপ খুব বেশি কিনা। কলেজের পর খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ি কিনা, সপ্তাহের কোন দিনটা হালকা থাকে, ইত্যাদি। মাকে যখন এত কথাই আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করছিলেন, মাকেই তো বলে দিতে পারতেন, আমি যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি।

আমি বেলা তিনটে নাগাদ এলগিন রোডের বাড়িতে হাজির হলাম। কেন তিনি আমাকে ডেকেছেন এ-বিষয়ে আমার বিশেষ কৌতূহল ছিল না। আমাকে তিনি কী আর এমন কথা বলবেন! তবে তাঁর ঘরে ঢুকতেই মনে হল তিনি যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছেন, ঘরে আর কেউ নেই। স্নান-খাওয়া সেরে তাঁকে বেশ স্নিগ্ধ ও শান্ত দেখাচ্ছিল, যদিও একটু ফ্যাকাসে ও ক্লান্তির ভাবও ছিল। আমি তখনও পর্যন্ত বাবা বা রাঙাকাকাবাবুর সামনে একলা পড়ে গেলে একটু ঘাবড়ে যেতাম, কী জানি যদি কথাবার্তা চালাতে হয়। রাঙাকাকাবাবু যে আমাকে ‘সাইলেন্ট বয়’ নাম দিয়েছিলেন সেটা খুবই যথার্থ ছিল। দূব থেকে তাঁর সঙ্গে হাসি-বিনিময় এবং দু-একটা হ্যাঁ, না, পারি, পারি না, ভাল, মন্দ নয়, হতে পারে–এই ছিল বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে, বিশেষ করে রাঙাকাকাবাবু বা বাবার সঙ্গে আমার কথাবাতার ধরন।

বালিশে ঠেসান দিয়ে তিনি খাটে বসে ছিলেন। পাশেই দাদাভাইয়ের পুরনো জমকালো খাট। অভ্যাসমতো আমি দাদাভাইয়ের খাটে বসলাম। তিনি ইশারা করে আমাকে ঘুরে আসতে বললেন এবং তাঁর খাটে তাঁর ডানদিকে হাত চাপড়ে বললেন, এসো, এখানে বোসো। আহ্বানটা ছিল খুবই সহজ ও অন্তরঙ্গ, হুকুম নয়। কিন্তু আমার নাড়ির গতি তো বেড়ে গেল। মুহূর্তের জন্য মনে হল, কী জানি কোনো অন্যায় করে ফেলেছি নাকি, বকুনি-টকুনি কপালে নেই তো!

শান্ত ও সস্নেহ দৃষ্টিতে আমার দিকে অল্প কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। আমিও শান্ত হয়ে গেলাম, নাড়ির গতি স্বাভাবিক হয়ে গেল। তাঁর চোখ ও চাহনি নিয়ে পরে কত কথাই না শুনেছি, ঐ চোখের টানে কত লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন! কত আমির ফকির হয়েছেন, কত সংসারী সর্বত্যাগী হয়েছেন। ১০২

বললেন, আমার একটা কাজ করতে পারবে?

তখন তো ভেবে দেখার সময় পাইনি। গত চল্লিশ বছর ধবে তত বারবার ঐ পাঁচটি কথা নিজেকে বারবার শুনিয়েছি। কত কথা যেন ঐ কয়টি কথাব মধ্যে আছে। তাঁর কাজ আমি করব। তিনি নিশ্চয়ই এমন-কিছু আদেশ করবেন না যেটা আমার সাধ্যের বাইরে। তবে এ-প্রশ্ন কেন? কখনও কখনও মনে হয়েছে যেন একটা অনুরোধের সুর ঐ প্রশ্নের মধ্যে ছিল। আসলে কিন্তু তা নয়, আসলে ছিল প্রাণের ডাক। এমন করে তো আগে তিনি কখনও আমাকে কিছু বলেননি। মনে আছে, বহুদিন আগে উডবান পার্কের বাড়িতে একদিন আমাকে একটা ছোট কাজ দিয়েছিলেন-কোথায় যেন গাড়ি পাঠাতে হবে। আমি ভাই-বোনেদের সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত থাকায় কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের ঘরে এসে মুখ ভার করে বেশ জোর গলায় আমাকে বলেছিলেন, একটা কাজ বললাম কবতে পারলে

! এই তো কদিন আগেই মুক্তির পরের দিন বিলেতে আমার এক দাদার কাছে একটা টেলিগ্রামের খসড়া করতে বললেন। একে আমার ইংরেজি জ্ঞান কম, তার উপর তাঁব যা বলার ইচ্ছা সেটা যদি আমার খসড়ায় প্রকাশ না পায়—এই ভেবে আমি গড়িমসি করছিলাম। খসড়া তৈরি হচ্ছে না দেখে আমাকে তো বেশ বকুনির সুবে বললেন, একটা টেলিগ্রামের খসড়াও করে উঠতে পারছ না! নিজের অক্ষমতায় আমি বেশ লজ্জা (পেয়েছিলাম।

পরে বুঝেছিলাম যে, সেইদিন যে “আমার একটা কাজ’-এর কথা তিনি বললেন সেটা সম্পূর্ণ এক নতুন অর্থে। একটা কাজের ভার দিয়ে নিয়তি সুভাষচন্দ্র বসুকে আমাদের মধ্যে পাঠিয়েছিলেন। কাজটা ছিল একান্তই তাঁর। তবে সেই কর্মযজ্ঞের চূড়ান্ত মুহূর্তে আমাদের মতো কয়েকটি সাধারণ মানুষকে তিনি ডেকে নিয়েছিলেন।

১৯৪৪ সালে লাহোের ফোর্টে ইংবাজ সরকারের দুর্ধর্ষ অ্যাডিশনাল হোম সেক্রেটারি রিচার্ড টটেনহ্যাম আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আচ্ছা, দেশত্যাগের প্রাক্কালে তোমার কাকার সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠই ছিল, নয় কি? উত্তরে আমি বলেছিলাম, যে-কোনো ভারতীয় পরিবারে কাকা-ভাইপোর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠই হয়ে থাকে। উত্তরটা ছিল ভুল। কী জানি কেন, ইংরেজ অফিসারটিরও উত্তরটি ঠিক মনঃপূত হযনি। আসলে বাঙাকাকাবাবু ১৯৪০-এব ডিসেম্বরে জীবনের জটিল যে-প্রান্তে পৌঁছেছিলেন সেখানে কাকা-ভাইপোর সম্পর্কটা হয়ে গিয়েছিল নিতান্তই গৌণ। শুরু হল এক নতুন সম্পর্ক, আত্মিক সহধর্মিতার সম্পর্ক। অতি সহজভাবে আমাকে যে-পথে তিনি ডাক দিলেন, সে-পথের শেষ যে আমি দেখব এমন কোনো প্রতিশ্রুতি সেদিন ছিল না।

॥ ৩৬ ৷৷

=

আমি তাঁর একটা কাজ করতে পারব কিনা এই প্রশ্নের জবাব নানাভাবে দেওয়া যায়। আমি হয়তো বলতে পারতাম, হ্যাঁ, পারব, নিশ্চয়ই পাব। বলুন না কী করতে হবে? অথবা আমি বলতে পারতাম, চেষ্টা করে দেখতে পারি। অথবা বলা যেত, আগে কাজটা কী বলুন। না জানলে কী করে বলব? আমি কিন্তু বিশেষ কিছু না বলে অস্পষ্ট একটা আওয়াজ করে একটু আলতো মাথা নাড়লাম। রাঙাকাকাবাবু আমার প্রতিক্রিয়াটা নিশ্চয়ই লক্ষ

$$sorderer গাড়ির মূল রেজিষ্ট্রেশন রেলেন। ‘চলি তা হবে একটু সময় নিয়ে দ্বিতীয় প্রশ্নে বলে গেলেন।

* * 15, ‘{ড়ি চালাতে পারে।’

আমি .ম গাড়ি চালাতে পাবি এর উত্তর আমার মতো মুখ:রা লাজুক কিশোরের পক্ষে ৮৩ শক্ত। অনেকেই জানতেন যে, আমি ছোট বয়স থেকেই গাড়ি চড়তে ও চালাতে ভালবাসি, প্রাই শাড়ি চালাই এবং ভালই চালাই। মা ও বাড়ির অন্যদের আমি এদিক-ওদিক নিয়ে যাই? উ-চালানোটা আমার কাছে ছিল একটা শখ ও আর্ট। গাড়ির কলকবজা কম্বিন্ধে আম, জ্ঞান ছিল অল্প এবং যন্ত্রপাতি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে বেশি। ১০৪

‘শাহ ছিল। গাড়ির প্রতি তার এই ঝোঁক দেখে কিছুদিন আগেই পা আম! • একটা গাড়ি কিনেছিলেন। জামান গাড়ি, নাম ‘ওয়াণ্ডাবাব’– } . .?

ডিটাও যেন আমাকে ভুল কবত। গাডিটিব গিয়া-টি, স্, এক আলাদ কমের ছিল। ড্রাইভাৰ?? কই চালাল ওয’ৰায় গলা বসে। লাকেব চুনে বাবার পৃছ হত। আমি হাতে– এক মাকেই চালাতে “তেন। আমার দুশি লা *** বাবা পৰে। এ• * * কমল ‘য়ে দিয়েছিলেন। আমি আবা ভাবে যে একব??– Fলঃ • ১ :

ও প্রতি বাবার 4-ধনের ‘দখে কেউ-এক টু! ৫—? *** :বশ

• মধ্যে ছিল—- আমাক ‘ফেভাবি সা• অফ শবৎ** * * * আসল কি ২. পূব কাছে আমি কোনোকিছু চাইনি যা পেF, “{:: : :

বিশ্বযুদ্ধের সময় বাব। ২/ বুন, • ওয়াণ্ডাবাব গাভি,, • • • • {“.!{দেব বেশ পরিচিত এক থু। যা পাবার— + “ “ “ + ব; .!’ এল হলে আমি ঐতিহাসিক বৰণ :.?” {১৮+ : • ‘.. : লি

• ২ার গাড়ি আমার হাতে!

৩১{ স একটি গ +৮ম< :- • ** * * ‘ ‘‘। ৩. ও স্বাদ আ িালনে! “ “।

এ কেমন ০ ১লা পারি, .! .মি it.”। ‘ 0; } . • ‘-এই এ*$ কি এই!ি … ‘ই প্রশ্ন :—- :: • n! পাল্লা . * ৫ চালিয়েছি কি না; ঘাসে আ ব 13, লন, ‘স! + 1 ..

a15 নই। আমি,” বললাম ( 1 ‘17 “ “ … : : : : : : লাশ

* ৩ হলে ৫ ল : *। :মি প্রশ্নটি যে!–। পথে,,,। ‘ . ‘! ব!

• লি প্রশ্নঃ সবই!ি *# মলি। ১: {{{ • :: :: তিনি ** চুল বাটা ১ ল’.লন কল; একটি বা. এ কে . . . ‘ত। ‘হি দিতে হবে, যে কি, ও A T! ‘ ‘ ‘

1 of 1 : বল? *** যে, ** ৫. ***, “.” : ৩০ মা

*ছি zিংবা আমি শ>ই ২, ৬, ২! . . . .—- * . %}; কিছু। এম এ ১৭৩ বৈশিষ্ট। ., cy: * * * * ৭। “, আবার শুণ বলেও ৫। ঐশি ৩ •1: “, . • • • • ৫, * 1 :প হোক—প্রথম গানে আমার বাহিক » পঞৰ ২ ৩ : আমি দুঃখ

**. পড়ি না আনন. ও আহাৰ হই না; ২১ ও ২২!, }}:- * ‘, গভীরে চলে যা, বেশ কিছুদিন পরে তার মাসিক প্রতিক্রিয়া এমি অনূভব কত

– রি! বাঙাকাকাবাবুল আকস্মিক প্রশ্নে আমি শতই ছিলাম :

আমি তাঁকে নাকিরে ‘ড করে কোথাও নিয়ে চলে যা, কেউ তার না! ব্যাপারটা

• ‘ধহয় আমার মস্তিষ্কে ঠিক ধরেনি। তার দিকে একদষ্ট য়ে শুইলাম যেটা আমি আগে

৯ পতাম না। একটু এগোলেন; বললেন, “এ-বাড়িতে কেবল ইলা শুনতে “ এরও “ন, “ইলাকে আমি টেস্ট করে দেখেছি, সে রবে?”

!

কিছুদিন পরে ইলাই আমাকে বলল যে, আমার সম্বন্ধে রাঙাকাকাবাবু তাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন এবং সে আমাকেই কাজের ভার দেওয়াটা সমর্থন করেছিল। এলগিন রোডের বাড়ির খুড়তুতো জ্যাঠতুতো ভাইবোনদের মধ্যে ইলার সঙ্গেই আমার সম্পর্কটা ছিল সবচেয়ে নিকট এবং তার সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসা ছিল সহজ। সুতরাং ব্যাপারটা এইভাবে

শুরু হওয়াতে আমরা দুজনেই খুশি হয়েছিলাম।

আমাকে সতর্ক করে দিয়ে রাঙাকাকাবাবু বললেন যে, একটা ফুল-ফ’ প্ল্যান আমাদেব তৈরি করতে হবে যাতে কেউ ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে না পারে। এই সব কথা মাথায় নিয়ে আমি ধীবেসুস্থে বাড়ি ফিরে এলাম। তিনতলায় নিজের ঘরে গিয়ে রাঙাকাকাবাবুর কথাগুলো মনে-মনে নানা দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করতে লাগলাম। বাস্তবিক তিনি কী করতে যাচ্ছেন পুরোপুরি পরিষ্কার হল না। তবে এটা যে একটা সাধারণ রাজনৈতিক লুকোচুরির

•য় সেটা বুঝতে দেরি হল না। আমাকে বলেছিলেন যে, আমি যেন ব্যাপারটা খুঁটিয়ে ভেবে

দেখে একটা প্ল্যান ছকে নিয়ে পরের দিন সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে দেখা করি। সেই থেকে শুরু হল রাতের পর রাত গোপনে কথাবার্তা বলা। প্রথম দিনের কয়েকটা প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে তিনি একটা অসাধ্য সাধন করলেন। আমার মুখচোরা স্বভাব ও আড়ষ্ট ভাব একেবারে দূর করে দিলেন। কী করে করলেন? আমার মনে হয়, তাঁর যে আমার উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে এটা বুঝিয়ে দিয়ে আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুললেন। একই উপায়ে দেশে ও বিদেশে তিনি কত লোকের আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছেন এবং আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তিদের দিয়ে বড় বড় কাজ করিয়েছেন। এর পর থেকে তাঁর সঙ্গে এমন খোলাখুলিভাবে কথাবার্তা আরম্ভ করি যে, আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাই। রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আমার সম্পর্কের এই নতুন অধ্যায় আরম্ভ হবার সঙ্গে সঙ্গে বাবার সঙ্গেও আমার আচরণের ধরনটা বদলে গেল। বাবার সঙ্গেও আমি নানা বিষয়ে খুব খোলাখুলিভাবে কথাবার্তা ও মতবিনিময় আরম্ভ করলাম। যে-কাজে আমি জড়িয়ে পড়লাম, বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে একেবারে একাত্ম হতে না পারলে সে কাজ করা সম্ভব ছিল না।

লুকিয়ে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার প্ল্যান ছাড়াও অন্য কতরকম প্রশ্নও আমার মাথায় ভিড় করে এল। প্রথমত আমি ভাবলাম, আমাকে রাঙাকাকাবাবু ডাকলেন কেন? আমার চেয়ে ভাল গাড়ি চালাতে পারে ও মোটরগাড়ির কলকবজা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল–এমন লোক তো পরিবারের মধ্যে আছে। আবার মনে হল, যদি বাড়ির সকলকে না জানিয়ে কিছু করতে হয়, বাইরের কোনো লোক দিয়ে কাজটা করানো ভাল নয় কি? আরও ভাবলাম, অন্যদের কথা না-হয় বাদই দিলাম, বাবা-মাকে না বলেই আমাকে কাজটা করতে হবে। নাকি? অনেক রাত পর্যন্ত চিন্তা করেও এসব প্রশ্নের ঠিক-ঠিক জবাব পেলাম না। শেষ। পর্যন্ত নিজেকে বললাম, এ-সব নিয়ে আমার অত মাথা ঘামাবার কী আছে, রাঙাকাকাবাবু সামলাবেন। তার পর এলগিন রোডের বাড়ি থেকে কী করে তাঁকে নিয়ে সকলের অজান্তে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া যায় তার নানারকম সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা আরম্ভ করলাম। মেডিকেল কলেজের পাঠ্য, অ্যানাটমি, ফিজিওলজি ইত্যাদি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।

১০৬

বাড়ি থেকে লুকিয়ে পালাতে হলে কোন পথ ও দরজা দিয়ে বেরোনো যাবে, স্বাভাবিকভাবে সেই চিন্তাই মাথায় আসে প্রথমে। কারণ বাড়ির লোকজনকে অন্ধকারে বাখাটাই সমস্যা। ছদ্মবেশ যত ভালই হোক, আত্মীয়-স্বজনদের ক্ষেত্রে তার বিশেষ কোনও মূল্য নেই। বাডির কারও যদি একবাব সন্দেহের উদ্রেক হয়, তাহলেই মুশকিল। মনে সন্দেহ জাগলে অনেকেই সেটা চেপে রাখতে পারেন না। অন্যদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে দেন। রাঙাকাকাবাবুই আমাকে বলেছিলেন যে, এ-অবস্থায় পড়লে হয় প্ল্যানটা পুরোপুরি বদলাতে হয়, নয় যাঁর মনে সন্দেহ জেগেছে তাঁকে ব্যাপাবটা খানিকটা বলে দলে টেনে নিয়ে তাঁর মুখ বন্ধ করতে হয়। আর একটি উপায় হচ্ছে সন্দিহান ব্যক্তিটিকে কোনও অজুহাতে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া–যাতে আসল ঘটনাটি ঘটার সময় তিনি কাছাকাছি

থাকেন। এই ধরনের অনেক সূক্ষ্ম প্রশ্ন রাঙাকাকাবাবু আমার সঙ্গে আলোচনা কবছিলেন এবং বাড়ির ব্যাপারে ও আত্মীয়-স্বজনদের সম্বন্ধে বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল।

এলগিন রোডের বাড়িটা উত্তর থেকে দক্ষিণে লম্বা ব্যারাকের মতো। মাঝখানে সারি দিয়ে ঘর, দুপাশে লম্বা খোলা বাবান্দা। কোনও ঘর বা ভেতবে দালান বা উঠোন দিয়ে না গিয়ে বাড়ির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাওয়া যায়। তিনটে সিডি। বাড়ির মাঝামাঝি একতলা থেকে চাবতলার ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে পুরনো স্টাইলেব ভাল কাঠের সিডি। দ্বিতীয়টি বাড়ির পেছনের দিকে দোতলা রান্নাবাডি থেকে নেমে গেছে। তৃতীয়টি এখন আর নেই। বাড়ির একেবারে দক্ষিণে একটি ছোট্ট চার-ঘরওয়ালা দোতলা বাড়ি ছিল। যদিও বাড়িটি একটি ব্রিজ দিয়ে রান্না-বাড়ির সঙ্গে লাগানো ছিল, সেটির একটা আলাদা সিঁড়িও ছিল। ছোট্ট বাডিটিব কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ায় পাব ওটি ভেঙে ফেলা হ! যা হোক, কোনও ঘরেব কাউকে ব্যস্ত না কবে পূব বা পশ্চিমে লম্বা বারান্দা ধরে সাজা এগিয়ে গেলে তিনটে সিডির যে-কোনও একটায় পৌঁছনো বেশ সহজ ছিল। বাড়ি থেকে বেরোবার পথও তিনটি ছিল বলা যায়। একটা মেন গেট। বাড়ির সামনের দিকেই কোণ ঘেঁষে রাস্তার ওপরেই একটি ছোট দজা ছিল–পশ্চিমের লম্বা বারান্দার শেষে। আব একটা পথ দরকার পড়লে করে নেওয়া যেত। বাড়ির পেছনের মাঠে সেজোকাকাবাবু সুরেশচন্দ্রের একটা কাবখানা ছিল, তার ভেতর দিয়ে।

এত সুবিধে যখন আছে, পেছনের বারান্দা আছে, পাশের ছোট দরজা আছে, একটু ব্যবস্থা করলে যখন বাড়ির পেছন দিযেও বেরোনো যায়, গেটের কথা কি কেউ ভাবে? আমিও ভাবিনি। আমি চিন্তা করতে লাগলাম, রাঙাকাকাবাবুকে বোধহয় পশ্চিমের মানে পেছনের বারান্দা দিয়ে সোজা দক্ষিণে চলে যেতে হবে, তারপর রান্নাবাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নেমে একতলার পেছনের বারান্দা দিয়ে উত্তর দিকে ফিরে এসে ছোট দরজা দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে হবে। অথবা যদি বাড়ির পেছন দিক দিয়ে বেরোনো স্থির হয়, তাহলে পেছনের ছোট বাডির সিঁড়ি ব্যবহার করে মাঠের দিকে যেতে হবে। রাস্তায় হাঁটার জন্য তো ছদ্মবেশ থাকবে। আমি গাড়ি নিয়ে এলগিন রোডেই খানিকটা এগিয়ে পোস্ট অফিসের কাছাকাছি ওর জন্য অপেক্ষা করব। কিংবা বাড়ির দক্ষিণদিক দিয়ে এলগিন লেনে এসে তিনি গাড়িতে উঠবেন। এই ধরনের প্ল্যান মাথায় করে আমি রাঙাকাকাবাবুর কাছে হাজির

১০৭

হলা; দেখা যাক তিনি কী বলেন।

“কী ভেবে দেখেছ? কিছু প্ল্যান মাথায় এল?”

আমি না বললাম, ধৈর্যের সঙ্গে তিনি শুনলেন। আমি যখন থামি, তিনি তাঁর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাঁ হাতের তর্জনী ঠোঁটে ঠেকিয়ে কখনও আমার দিকে চেয়ে কখনও দেওয়ালে দৃষ্টি বেখে ভাবতে থাকেন। তারপর বললেন, “বে, আরও ভাবো। একটু তাড়া আছে। বড়দিনের কাছাকাছি যে-কোনও দিন বেরিয়ে পড়তে হতে পারে।”

তিনি অন্য দিক থেকে একটা সঙ্কেত আশা করছেন। সেটা পেলেই যাত্রা শুরু করা

#

..

-।,

{লো রাজ দ সজ্জা রু করে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে কথা বলা স্বাভাবিকভাবেই কারও 5.লি ১নে সন্দেহ বা কৌতূহলের উদ্রেক করল। ইলা এবিষয়ে তাঁকে জানায়। : কবি নির্মিত বেডিও শুনতেন এবং যুদ্ধের গতি খুব মনোযোগ দিয়ে অনুস কব। সেই সঙ্গে মানা ইংরেজলে বেশ নাস্তানাবুদ করছে। শুনে বাঙাকাকাবা খুব স্ব হয়ে, মা-: তা। জেলে থাকতে তিনি রেডিও শুনতেন, তাঁর সে. 1. ও বকাবকি কি ধ; করেছিলেন। বাঙাকাকাবাবুই প্রেরণায় দেশ-বিদেশে ‘বডি :: (শানা মো: শা; দাঁড়িয়ে গিযেছিল। যার কাহল, বাঙাকাকাবাবু তাঁদে শলে দলে . আমি বলশী স্টেণ শাল বিহে পাণি, জন। এ ব্যাপারে তিনি আমার

হা ‘। এ «; 4. লোক আছে, য; বোতুহল মিটাল সন্দেহ যায় না। এই 0«কজন ছিলেন; মাসে পালাককা; গাংই দেখতাম ঘরের সামনে দরজাটা এক ঠেলে নিলেও, বাকাকাবাব আমি কী কবছি। দেখে নিযেই

জ্ঞাটা হবি’, দিনে। পালানকাকা খুব স্মল! প্রকবি, কিন্তু বেশ মজার লো ছুলে দিইযেৰ এক বোনের একমাত্র ইলে। বাবা-কাকাবাবুর একমা শি- বি৫ে যেছিল তাদেই গামের পাশে পরর এক ভাল পরিবাবে! দাদাভাই *$শকতায় এনে শা, শিম্যাশা পাক গান লোড হাড়িতে দিন কাটিয়ে খেতে **৫- শার্শা বস ১৭ দলা বা এক এলিবো না যে, আরাম করে তাম? (.৩ন! .:মতি হলে : বাস সম্বন্ধে তাঁর খুব চিন্তা হত, কেবলই কোথা গেল। ‘কে! ল’ ক হাঁক কব!। এক টা দিতে দিতে ঝিমুতে-ঝিতে বলতেন, “পালা, প… 1, <!-। হাওঃ ক “ পালনকাকার ভাল নাম ছিল হানচন্ড খি! পালান”ক। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই সুবাড়িতে মানুষ হয়েছিলেন। প্রথম জীবনে “ক পথে কি? ২৫; কয় জানেও ভাল হয় এলগিন রোড ন উডবার্ন পার্কে বাড়ি থাকতেন। ১া সাহ র ভাল ছিল।খলাগুলো বেশ পটু ছিলেন। তাছাড়া

শি। ফুল ভাল না করতে পারে। তিনি প্রায়ই রাঙাকাকাবাবুর গা-হাত-পা টিপে দিতেন। আঃ “, E দের

ম ত হলে বলতেন, “তোমার মাথাটা তো ধরেছে মনে হচ্ছে, এস এ « টিপে দিই।”

“পালা একা হল যে বললেন আমি যে বেজ সায় ঘর বন্ধ করে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আলাদা * এলি সে যেন কেমন কেন কে! শুনে রাঙাকাকাবাবু ঠিক করলেন, পালানকাকক নিও-তে কোথাও চালান করে দিতে হবে। সে-সময় পালানকাকা। বেকাব। একটা চাকবি গোগাড় করে দেবার জন্য রাঙাকাকাবাবুকে খুব পীড়াপীড়ি

7H

HH

I

A

বেছিলেন। রাঙাকাকাবাবু জামশেদপুবে টাটা কোম্পানির বডসাহেবের কাছে একটা চিঠি

খে দিলেন। সেটা নিয়ে পালানকাককে জামশেদপুবে গিয়ে ধন দিতে বললেন। তাঁকে শাঝালেন, এতদিন বেকার থাকার মতো ফ্লোর আর নেই। “চিঠি দিলাম, তুমি নির গিয়ে গ্যাঁট হয়ে বোসো, যতদিন না চাকরি হচ্ছে সেখান থেকে পড়বে না।” পালানকাকা গ্যাঁট হয়ে বসেই রইলেন, ইতিমধ্যে আমাদের কাজ সমাধা হয়ে গেল।

পালানকাকাব সরল প্রকৃতির সুযোগ নিয়ে বাঙাকাকাবা? অন্যধানে কিছুদিন পর শত্রুপক্ষ তাঁকে ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছিল। ইলাকে পালানকাকা একদিন এসে বলল,

ওরা বলছে আমাকে বেশ কিছু টাকাপয়সা দেবে, যদি আমি ছোড়দার শালান; সমাজ ও খবর জোগাড় করে দিতে পাবি।” বাধহ ইলা ব্যাপারটা জনে মনে কবেই তিনি সোজাসুজি পুলিশের কারসাজি ফাঁস করে দিলে।

এলগিন রোডের বাড়িতে লোক অনেক, আত্মীয়-স্বজন ও নানা ধরনের বাইরের লোক ক্রমাগতই আসেন। জীবনযাত্রার ধরন-ধাবণ স্বাভাবিকভাবেই নানারকম ছাড়া। কিববাকরের সংখ্যাও কম নয়, তাবা সাবা বাড়িতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। নতুনকাকাবাবুব একটা বড় অ্যালসেশিযন কুকুরও আছে, সে আবার এর-তাব ওপর পয়ে পড়ে, বিশে করে রাত্রে। আমি যখন ওই বাড়ি থেকে লুকিয়ে বেরোবার পথ ও উপায় সম্বন্ধে ভাবছি, পাঙাকাকাবাবু তখন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্ল্যানের ভিত্তিতে আলোচনা আৰম্ভ করলেন। লিলেন, “এত লোকের মধ্যে এ বাড়িতে ব্যাপারটা আয়ত্তে রাখা শ; ধরা, এ-বাডি থেকে আমি (

খোলাখুলিভাবেই চলে গেলাম। আমার স্বাস্থ্য যে খারাপ, সে-কথা তো সকলেই জানে। স্বাস্থ্য উদ্ধারের অজুহাতে কোথাও চলে যাই, সেখান থেকে যথাসময়ে উধাও হয়ে যাব।”

আবার নতুন করে চিন্তা আরম্ভ হল :

এলগিন রোডের বাড়ি থেকে সরে গিয়ে অন্য কোথাও থেকে অন্তধানের পরিকল্পনা ভাবে করা যেত। রাঙাকাকাবাবুই এই দুই সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। প্রথমটা ছিল ৩৬বার্ন পার্কের বাড়িতে চলে যাওয়া। দ্বিতীয়টা ছিল রিষড়ার বাবার বাগানবাড়ি থেকে অন্তধানের ব্যবস্থা করা। রাঙাকাকাবাবু বললেন যে তিনি অনশন করে মুক্তি পেয়েছেন, সুতরাং ওর স্বাস্থ্য যে ভাল নয় সেটা সকলেরই জানা। ডাঃ মণি দেব ডাক্তারি বুলেটিনও খববের কাগজে বেরিয়েছে, তাতেও তাঁর ভগ্নস্বাস্থ্যের উল্লেখ আছে। প্রচার করে দেওয়া যাক যে, এলগিন রোডের বাড়িতে তিনি একটা ঘবে বন্দী হয়ে আছেন, স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য যথেষ্ট আলো-হাওয়া ও বেড়াবার সুযোগ পাচ্ছেন না। সেজন্য তিনি উডবার্ন পার্কের বাড়ির তিনতলার একটি ঘরে থাকবেন। পাশেই বড় ছাদ, খুব আলো বাতাস পাবেন, আর বেড়াতেও পারবেন। রিষড়ার বাড়িতে গেলে তো কথাই নেই। সেখানে তো গঙ্গার উপর বাবার একটা সুন্দর বাগানবাড়ি আছে। অসুস্থ লোকের পক্ষে চমৎকার জায়গা।

আমাকে রাঙাকাকাবাবু বললেন, উডবার্ন পার্কের বাড়ি থেকে সব ব্যবস্থা করতে তো আমার সুবিধাই হওয়া উচিত। রিষড়ার বাড়িতে সাধারণত একটি লোকই থাকে, তাকে

১০৯

2www.১%

আমাকে পাঠানো ডি ভ্যালেরার অটোগ্রাফ কীভাবে আয়ত্তে আনা যায় সেটা ভেবে দেখতে হবে।

আমি ভাল কবে ভেবে দেখলাম। মনে হল রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দিনকতক খোলাখুলি ভাবে কথাবার্তা বলে আমার বুদ্ধিটা যেন একটু খুলেছে। আমি স্থির সিদ্ধান্তে এলাম যে, প্রথম পর্যায়ে অন্য কোথাও চলে গিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে অন্তর্ধানের পরিকল্পনা মোটেই সুবিধার হবে না। আমি সোজাসুজি রাঙাকাকাবাবুকে বললাম, সকলেই জানে যে আপনি বেশ অসুস্থ, এই একটি ঘরে থাকেন, এমনকী বারান্দায়ও বেরোন না। বিশেষ করে যেসব পুলিশের চর আপনার গতিবিধির উপর নজর রাখে এবং বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়, তাদেরও ঐ একই ধারণা। ওদের আচরণ লক্ষ করে আমারও মনে হয়েছে যে, তাদের মধ্যে একটা আত্মসন্তুষ্টির ভাব এসেছে এবং মনে হয় ওরা কাজে একটু ঢিলে দিয়েছে। এই অবস্থায় বাঙাকাকাবাবু যদি সকলকে জানিয়ে অন্য বাড়িতে চলে যান তাহলে সবাই আবার সজাগ ও সতর্ক হয়ে যাবে। পুলিশের দিক থেকে আবার নতুন ব্যবস্থা হবে, ফলে আমাদের অসুবিধাই হবে। তাছাড়া উডবার্ন পার্কের বাড়িতে শৃঙ্খলাটা বেশ কড়া, যে-সব লোকজন বাড়িতে থাকে ও কাজ করে, বিশেষ করে নীচের তলার বেয়ারা, গেটের দরওয়ান ও দুই ড্রাইভার, তারা সকলেই খুবই বিশ্বস্ত ও সতর্ক, সন্দেহজনক গতিবিধি দেখলেই শোরগোল তুলবে। বিষার বাড়িতে অবশ্য লোকজন কম, কিন্তু আমার বিশ্বাস কলকাতার বাইবে বাঙাকাকাবাবু কোথাও গেলেই পুলিশ সেখানে নতুন করে অনেক লোক বসাবে। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, উডবার্ন পার্কের বা রিষড়ার বাড়ি ব্যবহার না করাই ভাল। বলেই মনে হল বোধহয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছি, এতটা মাস্টাবি না করলেও হত। কিন্তু রাঙাকাকাবাবু বলে উঠলেন, ঠিক বলেছ, ও-পথে যাওয়া চলবে না। কিছু অসুবিধা থাকলেও এবাড়ি থেকেই যাত্রা করার প্লান করতে হবে।

একদিন একটু বেশি কাছে ডেকে রাঙাকাকাবাবু একটা খুব শক্ত প্রশ্ন করলেন, বাবা-মাকে না জানিয়ে কাজটা করতে পারবে? আমি সোজাসুজি উত্তর দিলাম না। স্থির হয়ে কিছুক্ষণ তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে অস্পষ্টভাবে বললাম, ঠিক আছে।

রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আলোচনা যখন খুব জোর কদমে চলছে, আমার মনে হল অন্য কয়েকটা ঐতিহাসিক অন্তর্ধানের কাহিনী খুঁটিয়ে দেখে নিলে হয়, কিছু আইডিয়া পাওয়া যেতে পারে। শিবাজির ব্যাপারটা বড়ই পুরনো, বর্তমান যুগের গাড়ি বা অন্যান্য যানবাহন ব্যবহার তো সেখানে নেই। আয়াল্যাণ্ডের স্বাধীনতাযুদ্ধের এক প্রধান হোতা ডি ভ্যালেরার ১১০

ইংল্যাণ্ডের লিঙ্কন জেল থেকে পালানোর কাহিনীটা মনে ধরল। যদিও পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভেদ দুই ক্ষেত্রে যথেষ্ট, আমাদের প্রতিপক্ষ তো একই। ভাগ্যিস ডি ভ্যালেরার জেল একে অদৃশ্য হবার ব্যাপারটা পড়ে নিয়েছিলাম। ১৭ই জানুয়ারি রাতে গাড়িতে বাঙাকাকাবাবু ডি ভ্যালেরার এসকেপ সম্বন্ধে জানি কিনা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। ১৯১৯ সালে ডি ভ্যালেরা–যাঁকে তাঁর সংগ্রামসঙ্গীরা ‘ডেভ’ বলে ডাকতেন–যে-জেলে বন্দী ছিলেন তার পিছনের দিক দিয়ে একটা ছোট দরজা ছিল। জেলের পাদ্রিসাহেব সেই নবজা দিয়ে যাতায়াত করতেন এবং দরজার চাবিটি তিনি প্রায়ই এদিক-ওদিক ফেলে লাখতেন। ডি ভ্যালেরা মোমবাতির মোম গালিয়ে চাবিটির একটি ছাপ নিয়ে নিলেন। ছপটির সাহায্যে একটি ক্রিসমাস কার্ডে চাবির একটা নকশা একে ‘ডেভ’-এর এক সাথী কৌতুকের ছলে কয়েকটি ইঙ্গিতপূর্ণ কথা লিখে বাইরে বন্ধুদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

ইরে থেকে চাবি তৈরি করে কেকের মধ্যে লুকিয়ে জেলে পাঠানো হল। বার-দুয়েক তো *লি ঠিক হল না। তৃতীয় বার বাইরে থেকে পাঠানো চাবিটি জেলের মধ্যে এক বন্দী

ষে-মেজে ঠিক করলেন। ডি ভ্যালেরাকে নিয়ে যাবার জন্য জেলের পিছনের জঙ্গলে যাঁরা লকিয়ে ছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন আয়াল্যাণ্ডের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাদপুরুষ আইরিশ পাবলিকান আর্মিব নায়ক মাইকেল কলিনস। সিগন্যাল আদান-প্রদানের পর ডি ভ্যালেরা তা ঠিকমতো ভিতরের দবজাটা খুললেন, এবং বাইরে থেকে তাঁকে দেখা গেল। বাইরের লোহার দরজায় চাবি লাগিয়ে মাইকেল কলিনস চাড় দিতেই কলের ভিতরে চাবিটি গেল ভেঙে। কলিনস মুষড়ে পড়ে বলে উঠলেন, “আই হ্যাভ ব্রোকেন এ কী ইন দি লক, ৬৬।” চমকে উঠে ডি ভ্যালেরা তাঁব হাতের চাবিটি দিয়ে ভিতরের দিক থেকে একটু Jলা দিতেই ভাগ্যের জোরে ভাঙা চাবিটি পড়ে গেল। লিঙ্কন শহর পর্যন্ত সকলে ইলেন। পথে কিছু সিপাই-সান্ত্রী ছিল, যেমন আমরাও গাড়ি থেকে পথে কিছু

খছিলাম। তাদের সম্ভাষণ করতে করতে তাঁরা এগোলেন। অন্ধকার রাতে মৃ বন্দীদের যে তাৰবেগে একটা ট্যাক্সি উধাও হয়ে গেল।

ডি ভ্যালেরার কাহিনী পড়ে আমি একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম। তাঁব জেল থেকে পলাবার ব্যবস্থাদি করেছিলেন অভিজ্ঞ বিপ্লবীরা। তাও কত রকমের অসুবিধা হয়েছিল। আমি ভাবলাম, আমার মতো ছেলে-ছোঁক দিয়ে কি রাঙাকাকাবাবু এত শক্ত কাজ সামাল নিতে পারবেন! কোথায় মাইকেল কলিনস আর কোথায় আমি! দায়িত্বটা যে কত বড় সেটাই বোঝার ক্ষমতা আছে কিনা কে জানে? যাই হোক, নিজেকে বোঝালাম, যথাসাধ্য করতে হবে।

১৯৪৮ সালের শেষের দিকে বাবা-মা ও দুই বোনের সঙ্গে ডাবলিনে গিযেছি। আমার মনের মধ্যে কৌতূহল ও চাপা উত্তেজনা ছাপিয়ে উঠছে। সেখানে দেখতে পাব সেই ডি ভ্যালেরাকে। হয়তো কিছু কথাবার্তা বলারও সুযোগ হবে। ডাবলিনের ‘ডয়েল’ বা পালামেন্ট ভবনে ডি ভ্যালেরা বাবাকে অভ্যর্থনা করলেন। বাবার সঙ্গে তাঁর অনেক কথা হল। তিরিশের দশকে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে ডি ভ্যালেরার কয়েকবারই দেখা হয়েছে। দুই ক্তিযোদ্ধার মধ্যে খুবই সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাবা সপরিবারে তাঁর কাছে তায়াতে বসুবাড়ির সঙ্গে ডি ভ্যালেরার সম্পর্কটা আরও গম্ভীর হল। আমি তাঁকে বললাম,

১১১

L

I

* ১৯৪০–এ বাংলার দুভ সস!

নি আমাল্যাণ্ড থেকে রেড ক্রস মারফত য-সাহা পাঠিয়েছিলেন তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কবে রাঙাকাকাবাবু আপনাকে উদ্দেশ করে এক বেতার-ভাষণ দিয়েছিলেন।” শুনে ৬ি ভ্যালেরা চঞ্চল হয়ে উঠলেন। বললেন, “সূভা-ে ঐ ভাষণটি যোগাড় করে অতি অবশ্য আমাকে পাঠিয়ে দেবে।” সঙ্গে ক্যামেরা ছিল। আ~ কম, তব বেশ কয়েকটি ছবি তুললাম। পরে লণ্ডন থেকে ছবি তৈরি করে তাঁকে পাঠাই এ একটি ছবি সই করে আমাকে ফেরত দিতে অনুবোধ করি। ডি ভ্যালবা কালক্ষেপ না ক’, সান-৮ সম্ভাষণ জানিয়ে আমার অনুরোধ বক্ষা কবেছিলেন।

১৯৪০-এ বাবার শবরটা মোটেই ভাল যাচ্ছিল না। রাঙাকাকাবা মুক্তি পাবার কিছু পবেই বাবা স্বাস্থ্যের জন্য কালিম্পঙে চলে গেলেন, আইন ব্যবসায়ে তাঁর প্রিয় শি: সুধীরঞ্জন দাসেব অতিথি হয়ে। মনে আছে, দু-তিনবার রাঙাকাকাবাবু বাবার কাছে চি! লিখে সবাসবি শিয়ালদা স্টেশনে দার্জিলিঙ মেলে পৌঁছে দিয়েছেন যাতে মাঝপথে কোনো

ডাকঘরে পুলিশের লোক সেগুলি খুলে না দেখে। আর কিছুদিন পরে বড়দিনের ছুটি বা ডুব আর-সকলকে নিয়ে মা আমার বড় দাদার কাছে ধানবাদ অঞ্চলে বারারি চত” গেলেন। ফলে এখন আমি রাঙাকাকাবাবুর গোপন-যাত্রার জন্য প্রস্তুতি আরম্ভ করল, তখন উবান পাকে বাড়ি খালি।

॥ ৩৯

সব দিক বিবেচনা করে যখন ঠিক হল যে এলগিন রোডের বাড়ি থেকেই যাত্রার ব্যবস্থা ফলও হবে, বাঙাকাকাবাবু নতুন করে চিন্তা আরম্ভ করলেন। তবে ঠিক কী উপায়ে বাড়ি থাকে লুকিয়ে যাওয়া হবে সে-বিষয়ে কিছুদিন তিনি পবিষ্কার করে বললেন না। অন অনেক ব্যবস্থা করার ছিল, সেগুলি নিয়ে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। প্রথমত একটা ছদ্মবেশ তো চাই। সেজন্য নিজে কী কাপড়জামা আছে দেখতে চাইলেন। তাঁর গবম কাপডজামা, বিশেষ করে যেগুলি তিনি আগে ইউরোপে ব্যবহার করেছিলেন সেগুলি উডবার্ন পার্কে বাড়িতে মার কাছে থাকত। তিনি সকলকে বললেন যে, অনেকদিনের জনা তো তিনি শীঘ্রই জলে চলে যাবেন, তাঁর কাপড়চোপড়, জিনিসপত্র কোথায় কী আছে দেখে নিতে চান : আমি মাকে বলে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে তাঁর যা-কিছু ছিল, তীরই পবিাবক বমণীকে দিয়ে এলগিন রোডের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। কিছু জামাকাপড় তিনি ফেবতও দিলেন তার মধ্যে কিছু ছিল যা আমাকে সে নি, হবে অন্তর্ধানের পর রাঙাকাকাবাবু কাপড়চোপড় নিয়ে এ-বাড়ি ওবাড়ি করাটা বাড়ির কারুর কারুর মনে সন্দেহের উদ্রেক করেছিল।

এরই মধ্যে বেশ একটা কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপাব ঘটল! বাঙাকাকাবাবু দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁর অনুগামীদের একটা মিটিং ডাকলেন। মিটিংটা উপলক্ষ মাত্র, আসল কাজটা ছিল উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মিঞা আকবর শাহের সঙ্গে। একদিন সন্ধ্যায় রাঙাকাকাবাবুর ঘরে গিয়ে দেখি একজন পাঠান ভদ্রলোক রয়েছেন। বাড়ির দু-একজনও ছিলেন-আর ছিলেন রাঙাকাকাবাবুর সেক্রেটারি অমূল্য মুখার্জি। আমাকে রাঙাকাকাবাবু বললেন যে, সেই সন্ধ্যায়ই মিঞাসাহেব ফিরবেন। তাঁর রেলের টিকেট কাটা ও বার্থ রিজার্ভ ১১২

করা হয়নি, সেজন্য অমূল্যবাবুকে তিনি আগেই হাওড়া স্টেশনে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আমি যেন ওয়াণ্ডাবার গাড়িতে করে তাঁকে সময়মতো স্টেশনে পৌঁছে দিই। পথে তিনি হোটেল। থেকে তাঁর মালপত্র তুলে নেবেন এবং ধর্মতলায় কিছু কেনাকাটা আছে-~-তাও সেরে। নেবেন। নজর কবলাম, রাঙাকাকাবাবুর খাটে একটা মাপবাৰ যিতে পড়ে ছিল।

গাড়ি চালাচ্ছিল ড্রাইভার, মিঞা আকবর শাহ ও আমি বসে ছিলাম পিছনের সীটে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পব মিঞাসাহেব ইংরেজিতে কথা আবম্ভ করলেন। বললেন, বাঙাকাকাবাবু তাঁকে বলেছেন যে, তাঁর অন্তধনের 4াপাবে এদিককাব ভার আমার উপক, পড়েছে, অন্য প্রান্তের ভার তাঁর নিজের উপব। সব ব্যবস্থা ঠিক হয়ে গেলে তিনি একটা সিগন্যাল পাঠাবেন। প্রথমে মিজাপর স্ট্রীটের এক হোটেল থেকে তাঁর মালপত্র তুলে নিলেন। তারপর বললেন ধর্মতলা স্ট্রীটে ওয়াছেল মোল্লার দোকানে নিয়ে যেতে, সেখান (থকে তিনি রাঙাকাকাবাবুর জন্য দু-একটা জিনিস কিনে দেবেন। আমার সঙ্গে বাবস্থা হল, তিনি স্টেশনে নামবাব সময় ইচ্ছা করে জিনিসগুলো ভুলে গাড়িতে ফেলে যাবেন। ওয়াছেল মোল্লাব দোকানে আমরা একসঙ্গেই ঢুকলাম, জিনিস কিনবার জায়গাটা তাঁকে দেখিয়ে দিয়ে আমি দূরে সরে রইলাম। দেখলাম মিঞাসাহেব পায়জামা টুপি নিজের গায়ে লাগিয়ে দেখছেন। যেন নিজের জনাই কিনছেন। রাঙাকাকাবাবুব জন্য তিনি একজোড়া তিলে পায়জামা ও একটি ফেজ ধৰনের লোমশ ‘আস্থাখান’ টুপি কিনলেন। তিনিই পাকেটটি হাতে কবে গাড়িতে উঠলেন। সীটের পেছনে সেটা ফেলে নাখলেন। হাওড়া সেশনে পৌঁছেই দেখলাম, অমূল্যবাবু স্টেশনের গাড়িবান্দায় অপেক্ষা করছেন। বাঙাকাকাবাবু আমাকে আগেই বলে দিয়েছিলেন, আমি যেন স্টেশনে না নামি। চট করে মালপত্র নামিয়ে দিয়ে আমি মিঞাসাহেবকে বিদায় জানিয়ে ড্রাইভারকে বললাম বাড়ি ‘লুন। কিন্তু কী মুশকিল, স্টেশনের চত্বৰ ছাড়বার আগেই ড্রাইভাব বাবুর নজাব পড়ল, ম সাহেব প্যাকেটটি ফেলে গেছেন। আমাকে বলল, “ দৌড়ে দিয়ে আসব নাকি?” আমি বলৰি ভান করে বললাম, “অত হাঙ্গাম আমার পোষাবে না, ভুলে গেছেন তো আমি কী

ব, পরে পার্সেল করে পাঠিয়ে দিলেই হবে। তাড়া আছে, বাডি চলুন।” বাড়ি ফিরে {কেটটি আমাৰ আলমাবিতে বন্ধ করলাম। মিঞা আকবর শাহেব সঙ্গে কথাবার্তা ও বাজার করবাব পর আমি পবিষ্কার বুঝে গেলাম যে, বাঙাকাকাবাবু অসাধারণ বৈপ্লবিক কিছু করতে বিদেশে পাড়ি দেবেন। পরে আমাকে বললেন, আমাকে বেশ কিছু কেনাকাটা কবতে হবে। নিউ মার্কেট থেকে এক জোড়া কানেলের শার্ট ও ‘মেড ইন ইংল্যাণ্ড মাক চিরুনি, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, সাবান ইত্যাদি কিনেছিলাম মনে আছে। মজবুত মোটা ধরনের এক জোড়া কাবলি জুতা কিনতে খুব অসুবিধায় পড়েছিলাম। শেষপর্যন্ত মোটামুটি পছ-দসই একজোড়া পেযেছিলাম। হ্যারিসন বাডেব একটা বড় দোকান থেকে একটা মাঝারি মাপের সুটকেশ, একটা অ্যাটাচি কেস ও বিছানাব জন্য একটা হোলডল কিনলাম। রাঙাকাকাবাবুব কথামতো বাক্সগুলির উপরে কালো কালি দিয়ে M.2. লিখিয়ে নিয়েছিলাম। ছোট লোশক, বালিশ ইত্যাদি ধর্মতলা স্থাটের একটা দোকান থেকে যোগাড় করলাম। একটা সুবিধা ছিল যে, যখন আমি বাক্সপ্যাঁটরা বিছানা ইত্যাদি কিনছিলাম. উডবার্ন পার্কের বাড়ি এখন খালি। বাড়ির চাকরবাকরেরা যাতে এসব কিছু না দেখে ফেলে সেজন্য দুপুরবেলা যখন ড্রাইভাববা ছুটি

নেয় আর অনন্যরা বিশ্রাম করে, সেই সময় নিজে গাড়ি চালিয়ে বড়সড় জিনিসগুলো সংগ্রহ করেছিলাম। নীচের তলার বেয়ারাটি দুপুরে খাওয়ার পরে সামনের বারান্দায় কুম্ভকর্ণের মতো নিদ্রা যেত। তাকে পাশ কাটিয়ে চুপিসারে সব জিনিসপত্র আমি তিনতলায় নিজের ঘরে নিয়ে ফেললাম। বেশ কিছু আলমারির ভিতরে গেল। বড় বাটি রইল অন্য বাক্সের সঙ্গে খাটের তলায়।

রাঙাকাকাবাবুর জন্য একটা ভুয়ো ভিজিটিং কার্ড ছাপাতে হবে। এক টুকরো কাগজে পেন্সিলে বড় বড় অক্ষরে যেমন ছাপাতে হবে লিখে দিলেন। বললেন, সম্পূর্ণ অজানা দোকানে যেতে হবে এবং আমার পোশাক চালচলন এমন হওয়া চাই যে, মনে হবে আমি নিজের জন্যই কার্ড ছাপাচ্ছি। নিজের হাতে রাঙাকাকাবাবুর লেখাটা কপি করে নিয়ে এক সন্ধ্যায় স্যুট-টাই ইত্যাদি চাপিয়ে হ্যাট হাতে নিয়ে তো বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি। সদর দরজা পেরোতেই ডাঁটিদাদার (রবীন্দ্রকুমার ঘোষ) মুখোমুখি হয়ে গেলাম। তিনি তো ঐ পোশাকে আমাকে কখনও দেখেননি, বাবা তো পাহাড়ে পরবার জন্য ওগুলি করিয়ে দিয়েছিলেন। কী যে করি! যাই হোক, সরলপ্রাণ ডাঁটিদা নিজেই বলে উঠলেন, “বাইরে ডিনার-টিনার আছে বুঝি?” আমতা-আমতা করে আমি বললাম, “এই, মানে, হ্যাঁ, একটা, মানে ডিনার…!” ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম রাইটার্স বিল্ডিং-এর পিছনে রাধাবাজারে। যতটা পারি গম্ভীর মেজাজে টানা টানা ইংরেজিতে কার্ডটা অডার দিলাম :

MOHD. ZIAUDDIN B.A., LI B.

Travelling Inspector The Empire of India Life Insurance Co. Ltd.

Permanent address:

Civil Lines, Jubbulpore.

পরে কার্ড যখন রাঙাকাকাবাবুর হাতে দিলাম, তাঁর তত পছন্দ হয়েছে বলেই মনে হল।

উডবার্ন পার্কে তো দুটো গাড়ি–একটা বড় স্টুডিবেকার প্রেসিডেন্ট যেটা বাবা ব্যবহার কবতেন। আর অন্যটা ওয়াণ্ডারার। একদিন রাঙাকাকাবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কোন গাড়িটা আসল কাজের জন্য নেওয়া হবে। স্টুডিবেকার খুব জোরদার গাড়ি। চলে খুব ভাল, চালাতেও আরাম। ওয়াণ্ডারার গাড়িটাও ভাল, সব জামান জিনিসই যেমন হয়, তবে লম্বা পাড়িতে গোলমাল করবে না তো? মনে হল রাঙাকাকাবাবু প্রথমটায় স্টুডিবেকারের পক্ষেই ছিলেন। কিন্তু আমরা ভেবে দেখলাম, বড় গাড়িটা বড়ই চেনা, রাস্তায় দেখলে অনেকেই বলে ওঠে, ঐ যে শরৎ বোসের গাড়ি বা ঐ যে শরৎ বোস যাচ্ছেন। সুতরাং ওয়াণ্ডারার নেওয়াই শেষ পর্যন্ত ঠিক হল।

একদিন রাঙাকাকাবাবু আমার ও গাড়ির একসঙ্গে পরীক্ষা নিলেন। বললেন, “সকাল-সকাল বেরিয়ে ওয়াণ্ডারার গাড়ি চালিয়ে রাস্তায় কোথাও না থেমে তুমি বর্ধমান চলে যাও। বর্ধমান রেল-স্টেশনে দুপুরের খাওয়াটা খেয়ে আবার সোজা চলে এসো। এসেই আমাকে বলল, গাড়ি কেমন চলল, তোমারই বা কতটা ক্লান্তি হল।” ফিরে আমি ভাল রিপোর্টই দিলাম। আর-একদিন বললেন, “রিষড়ার বাড়ির লোকটিকে একটু প্রস্তুত ১১১

করে রাখা যাক, বাড়ির লোকেরাও জানুক যে তুমি কখন কখন ঝাত্রে বাড়ির বাইরে থাকো।” এক সন্ধ্যায় রিষড়ায় চলে যেতে বললেন। আমি একটু দেরি করে রিষড়ায় পৌঁছে মালিকে বললাম, “আজ রাত হয়ে গেছে, আমি এখানেই থেকে যাব, বিছানাপত্রের ব্যবস্থা করে দাও, কিছু খাবার নিয়ে এসো।” রাঙাকাকাবাবু বলেছিলেন, তাঁকে আরও দুরের কোনো স্টেশনে তুলে দিয়ে ফেরবার সময় আমাকে বিষয় থেকে যেতে হতে পারে। লোককে বলারও সুবিধে হবে যে আমি রিষড়ার বাগানবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *