০১. আমার জীবনের প্রথম স্মৃতি

[ওসিআর ভার্সন, মূদ্রন সংশোধন করা হয়নি]

বসু-বাড়ি – শিশিরকুমার বসু
প্রথম প্রকাশ : আষাঢ়, ১৩৭২

আমার জীবনের প্রথম স্মৃতি, যেটা আজ কেবল আবছা-আবছা মনে পড়ে, সেটা কিন্তু এখন খুবই মজার বলে মনে হয়। যদিও যখন সেটা ঘটেছিল তখন সেটাই আমার জীবনের সমাপ্তি হতে পারত। বয়স তখন আমার বছর চারেক হবে, কাশ্মীরে বেড়াতে গিয়ে শ্রীনগরের হাউসবোট থেকে ঝেলাম নদীতে পড়ে গিয়ে তলিয়ে গেলাম। বাবা ও মা, শরৎচন্দ্র ও বিভাবতী বেরিয়েছেন। আমার দাদাভাই ও মাজননী আছেন পাশের অন্য এক হাউসবোটে। এইখানে বলে রাখি যে, আমরা আমাদের পিতামহ জানকীনাথকে দাদাভাই ও পিতামহী প্রভাবতাঁকে মাজননী বলে ডাকতুম।

আমার দিদি ও এক দাদা অবাক হয়ে দেখছে আমি নদীর জলে ডুবছি আর উঠছি। কিছু একটা ঘটেছে আন্দাজ করে একটি লোক ছুটে এল, নাম তার কালু সিং! আমার পোশাকের অংশ জলের ওপর দেখতে পেয়ে সে জলে ঝাঁপ দিয়ে আমাকে টেনে তুলল। কালু সিং পাহাড়ি লোক, সাঁতার জানে না, তাও জলে ঝাঁপ দিল। আমাদের বাড়ির কথা বলতে গেলে কালু সিংকে বাদ দেওয়া যায় না। তার সম্বন্ধে পরে কিছু বলব।

কাশ্মীরে বাবা-মা আমাদের ভাইবোনদের নিয়ে বেড়াতে গেছেন। সঙ্গে নিয়ে গেছেন দাদাভাই ও মাজননীকে। আর সঙ্গে আছেন রাঙাদাদাবাবু বীরেন্দ্রনাথ দত্ত–মাজননীর এক ভাই-যিনি কলকাতায় আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। আর ছিলেন আমাদের পরিবারের এক বিশেষ বন্ধু ব্যারিস্টার প্রভাসচন্দ্র বসু। বাবা তখনই কলকাতা হাইকোর্টের বড় ব্যারিস্টারদের মধ্যে একজন। সেকালে হাইকোর্টের একটাই বড় ছুটি হত। পুজোর কিছুকাল আগে থেকে শুরু করে। ছুটিতে সাহেব জজ ব্যারিস্টাররা হোম লীভে বিলেত যেতেন। বাবার শখ ছিল বড় ছুটিতে পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া। সেই সূত্রে ছেলেবেলায় আমরা বেশ কয়েকটা পাহাড়ি জায়গা দেখবার সুযোগ পেয়েছি। কয়েকবার বাবা দাদাভাই ও মাজননীকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। ১৯২২-২৩’এ কার্শিয়াংয়ে বাবা বাড়ি করবার পর অবশ্য সেখানেই যাওয়া হত বেশি।

আমার দাদাভাই জানকীনাথ বসু সত্যিই অসাধারণ লোক ছিলেন, যদিও তাঁর সম্বন্ধে যথেষ্ট লেখা হয়নি। আমি যখন ফার্স্ট ক্লাস বা স্কুলের শেষ বছরে ঢুকব, সেই সময় তিনি মারা যান। শৈশবে বা কৈশোরে তাঁকে কেমন মনে হত, শুধু সেটুকুই আমি বলতে পারি।

তিনি বেশির ভাগ সময় কটকে থাকতেন এবং আমরা থাকতুম কলকাতায়। তিনি পুজোর সময় মাজননী প্রভাবতাঁকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় আসতেন। অসুখ করলে চিকিৎসার জন্য আসতেন, কিংবা বাবা-মায়ের সঙ্গে পাহাড়ে বেড়াতে যাবেন বলে আসতেন। দাদাভাই ও মাজননীর পুজোর সময় কলকাতা আসাটা আমাদের বাড়ির একটা বিশেষ ঘটনা ছিল। সেই সময় বাড়ির অন্য অনেকে-কাকা-জ্যাঠারা–যাঁরা কাজে কলকাতার বাইরে থাকতেন, তাঁদের অনেকেও কলকাতায় জড়ো হতেন। ৩৮/২ এলগিন বোডের বাড়ি সরগরম হয়ে উঠত।

দাদাভাই ও মাজননী কলকাতা পৌঁছবার দিন এলগিন রোডের বাড়িতে সকলে মিলে সারি দিয়ে ঠাকুর-প্রণামের মতো একটা ব্যাপার করত। তাঁরা দুজনে তাঁদের ঘরে পাশাপাশি বসতেন। আর আমরা একে একে প্রণাম করতুম। দাদাভাই প্রত্যেককে আলাদা করে আদর করতেন এবং কাছে টেনে নিয়ে প্রত্যেককে বিশেষ কিছু আলাদা করে বলতেন। আমরা যেন প্রত্যেকেই বিশেষ কোনো গুণের অধিকারী। আমরা সকলেই গভীরভাবে অনুভব করতুম তাঁর অফুরন্ত স্নেহের স্পর্শ। মাজননী প্রায় একইভাবে আমাদের কাছে টেনে নিতেন এবং নানা রকম প্রশ্ন বা মন্তব্য করতেন, যার ধরন ছিল একটু আলাদা। যেমন, কার রঙ আগের চেয়ে কালো হয়ে গেছে, কে যেন গায়ে মোটেই সারছে না, কিংবা আর কেউ বড়ই মোটা হয়ে পড়ছে, ইত্যাদি। তিনি তাঁর মন্তব্যগুলি সাধারণত আমাদের মায়েদের উদ্দেশে ছুঁড়তেন, যাঁরা কাছেই মাথায় কাপড় টেনে সলজ্জ ও সশ্রদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেন। দুজনেরই আমাদের উপর প্রভাব ছিল বিরাট, কিন্তু কোথায় যেন একটু তফাত ছিল। দাদাভাইয়ের প্রতি আমাদের ভালবাসা ছিল ভালবাসাই, মাজননীর ক্ষেত্রে ভালবাসার সঙ্গে মেশানো ছিল খানিকটা ভয়।

পুজো হত আমাদের গ্রাম কোদালিয়ায়, কলকাতা থেকে মাইল চোদ্দ হবে! দাদাভাই ও মাজননীর উপস্থিতিতে পুজো হলে ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াত গ্রামের সব স্তরের মানুষের একটা বিরাট মিলন-যজ্ঞ। আমরা ছোটরা তার মধ্যে প্রায় হারিয়ে যেতাম বলা চলে। একদিকে দাদাভাই তাঁর চিরসঙ্গী ছাতাটি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সকলকে হাসিমুখে সম্ভাষণ করছেন, অন্যদিকে মাজননী বিরাট এক কর্মযজ্ঞের কত্রী, বাড়ির আর সকলেই সন্ত্রস্ত হয়ে তাঁকে সাহায্য করতে ব্যস্ত।

বিজয়ার দিন দেশের পূজো সেরে দাদাভাই ও মাজননী কলকাতার বাড়িতে ফেরার পরে যে ব্যাপারটা হত, সেটাকে বসুবাড়ির কংগ্রেস বলা চলে। আত্মীয়স্বজন যে যেখানে আছেন সবাই ৩৮/২ এলগিন রোডে ভেঙে পড়তেন। মঞ্চে কিন্তু একজন সভাশ্রেষ্ঠর বদলে দুজন থাকতেন–দাদাভাই ও মাজননী।

অত বড় বাড়িতেও জায়গা কুলোয় না। তার উপর প্রণাম, আলিঙ্গন ও সম্ভাষণের ঠেলায় শেষ পর্যন্ত সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। শেষে জলযোগ ও উপাদেয় শরবতে অধিবেশন শেষ হত। আমরা ছোটরাও তার ভাগ পেতাম। ১০

বাড়ির ছোটরা দাদাভাইকে একান্তভাবে পেতাম, যখন তিনি আমাদের সঙ্গে করে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। তাঁর যখন বছর চল্লিশেক বয়স, তখন তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর থেকে তিনি শরীরের দিক থেকে ডাক্তারের পরামর্শমতো কড়া নিয়ম মেনে চলতেন।

নিয়মের মধ্যে প্রধান দুটি ছিল সকালে হেঁটে বেড়ানো এবং খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সংযম। দাদাভাই জীবনের তিরিশ বছর নুন না খেয়ে চালিয়ে গেছেন। কী দিয়ে রান্না হবে, কী কী খাওয়া চলবে বা চলবে না, মাজননী পাশে বসে তদারক করতেন, এবং প্রায়ই “লোভ”-এর কুফলের কথা দাদাভাইকে মনে করিয়ে দিতেন। মাঝে-মাঝে বলতেন, “তোমার তো খালি লোভ!” কথাটা শুনে আমাদের কেমন-কেমন লাগত। কারণ দাদাভাইয়ের লোভ কিছু ছিল বলে তো কখনও মনে হয়নি।

আমার মা রান্নাবান্নায় বেশি আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু দাদাভাইয়ের জন্য মাজননীর নির্দেশমতো ইকমিক কুকারে রান্না চাপাতেন। উডবার্ন পার্কের বাড়ির দোতলার দক্ষিণের বারান্দায় দাদাভাই মাটিতে আসন পেতে খেতে বসেছেন, এই দৃশ্য বেশ মনে পড়ে। পাশেই টেবিল-চেয়ার, কিন্তু তিনি মাটিতে বসেই খেতেন। নিয়মমাফিক তাঁকে কইমাছ ঘিয়ে ভেজে খেতে হত।

ডাক্তারি দুরমকই চলত–অ্যালোপ্যাথি ও কবিরাজি। আমাদের নতুনকাকাবাবু সুনীলচন্দ্র নিজেই বড় ডাক্তার ছিলেন। বাড়ির কবিরাজ ছিলেন শ্যামাদাস বাচস্পতি। তাঁর স্নিগ্ধ সৌম্য চেহারা বেশ মনে পড়ে। আমাদের ডাক্তার কাকা আর-একজনকে পরামর্শের জন্য প্রায়ই ডাকতেন, তিনি হলেন স্যার নীলরতন সরকার। যাঁরা একবার দুবার স্যার নীলরতনকে দেখেছেন, তাঁরা তাঁকে ভুলবেন না। চেহারায় অপূর্ব দীপ্তি, আচরণে সে কী মাধুর্য। তাঁর স্মিত হাসিটি দেখলেই রোগীর অসুখ অনেকটা সেরে যেত।

দাদাভাইয়ের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছি কলকাতার ইডেন গার্ডেনে, শিলংয়ের লেকে এবং পুরীর সমুদ্রের ধারে। আমার মা বিভাবতাঁকে দাদাভাই ‘মাজননী’ বলে ডাকতেন। দাদাভাইয়ের ইচ্ছামতো প্রত্যেকবার বেড়াতে বেরোবার আগে মা’র অনুমতি নিয়ে আসতে হত। অনেকবার এমন হয়েছে, দাদাভাইয়ের সঙ্গে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, দাদাভাই জিজ্ঞেস করলেন, মাজননীকে বলে এসেছি কিনা। না হলে ফিরে গিয়ে মার অনুমতি নিয়ে আসতে হত। মা অপ্রস্তুত হতেন। বলতেন দাদাভাইয়ের সঙ্গে বেড়াতে যাবে, আমাকে জিজ্ঞেস করবার কী আছে! দাদাভাইয়ের বেড়ানোর ধরন ছিল ছাতা মাথায় সহজ, ধীর মাপা গতি। কতটা বেড়ানো হবে তাও ঠিক করা আছে। বাবা বা রাঙাকাবাবুর (সুভাষচন্দ্র) সঙ্গে বেড়ানো একেবারে ভিন্ন ব্যাপার। বাবার গতি মাঝামাঝি হলেও ঢিলেমি চলবে না-সমান তালে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে ইটা তো একটা লড়াই, সে কথা পরে বলব।

আগেই তো বলেছি, দাদাভাইয়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ছিল পুরোপুরি স্নেহের, শাসনের কোনও লেশমাত্র নেই। সেকালে তো বাড়িতে অনেক চাকরবাকর থাকত, তারাও কিন্তু তার স্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিল না।

একবার অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য দাদাভাই মাজননীকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়িতে রয়েছেন। খুব পুরনো দুই ভৃত্য শেখ কালু ও মাগুনি দাদাভাইয়ের খুব সেবা করত, তাছাড়া বামুন-ঠাকুর তো আছেই। বিদায়ের সময় এলে দেখেছি তাদের হাত ধরে দাদাভাইয়ের কৃতজ্ঞতার কান্না। শেখ আমেদ আমাদের পুরনো ড্রাইভার, সে খুবই অস্বস্তি বোধ করত, যখন দাদাভাই তার কাঁধে হাত দিয়ে বন্ধুর মতো সম্ভাষণ করতেন, “আচ্ছা, আমেদ ভাই, কেমন আছ বলো তো!”

তোমরা যদি সুভাষচন্দ্রের আত্মজীবনী ‘ভারতপথিক’ পড়ো, তাহলে দেখবে যে, তাঁরাও যখন ছোট ছিলেন, বাড়ির চাকরবাকরদের তখন পরিবারভুক্ত মানুষ বলেই গণ্য করা হত।

১৯৩৩ সালে পুরীতে গিয়েছি মাকে সঙ্গে নিয়ে। সেকালে মেয়েরা একলা ঘোরাফেরা করতেন না, ট্রেনে যাত্রা তো নয়ই। আমি তখন নেহাতই বালক। আমাকে মা সঙ্গে নিলেন। বোধহয় নিয়মরক্ষার জন্য। কারণ আমার চেয়ে বয়সে বড় কোনো পুরুষ বাড়িতে ছিলেন

। বাবা জেলে, দাদারা কেউ হাতের কাছে নেই। দাদাভাই তাঁর কথাবাতায় আমাকে মার ছোট্ট অভিভাবকের মর্যাদা দিতে লাগলেন এবং এমন সব আলোচনা করতে লাগলেন যেন আমি বেশ বড় হয়ে গিয়েছি। তিনি জেনেছিলেন আমি সংস্কৃত পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়েছি। মুখস্থ বিদ্যা আর কী! তিনি ধরে নিলেন যে, আমি অনেক সংস্কৃত শিখে ফেলেছি। বললেন, আমি যেন গীতা পড়তে আরম্ভ করি।

মাজননী তো মোড়ায় বসে আমাকে খাওয়াতে বসতেন। নানারকম রান্না, বিশেষ করে মাছের ভিন্ন ভিন্ন পদ। আমি তখনও স্বল্পাহারী আর পেটরোগা। তাঁর নিজের ছেলেরা আমাদের বয়সে কত এবং কী কী খেত, মাজননী তার একটা ফর্দ আমাকে রোজই শোনাতেন। আমি লজ্জার খাতিরে যতটা পারতাম খেতাম এবং পরে ভুগতাম। খাওয়া ব্যাপারে, বিশেষ করে মাছ খাওয়ার ব্যাপারে, আমাদের এক আত্মীয় সম্বন্ধে একটা মজার গল্প সেইসময় শুনেছিলাম। সম্পর্কে তিনি আমাদের জ্যাঠামশাই।

গল্প শুনেছি, প্রকাণ্ড একটা মাছ কিনে এনে তিনি নিজে তদারক করে কাটিয়ে কটা টুকরো হল গুনে আমার এক পিসিমাকে ভাজতে দিতেন। গুনে গুনে মাছ ভাজা খেয়ে এক কুঁজো জল খেয়ে, যাবার সময় বলতেন, “কই, মাছের তেলটা দে!”

আমি যখন খুবই ছোট, তখন দাদাভাই আমাকে একটা নাম দিয়েছিলেন জংবাহাদুর। আমার মত এক লাজুক নির্বিরোধী ছেলেকে এরকম দুধর্ষ নাম কেন দিয়ে ফেললেন, আমি জানি না। বোধহয় দার্জিলিং কার্শিয়াং আমাদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে নেপালি নামটি তাঁর মনে ধরেছিল। বহুদিন পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পাঞ্জাবে রাজবন্দী থাকার সময় এই নামটি আমি ব্যবহার করেছিলাম, পুলিশের চোখে ধূলো দেওয়ার জন্য। আমি লায়ালপুরের। জেল থেকে ১৯৪৫-এ আমার মাকে নানা খবর দিয়ে জেল কর্তৃপক্ষ ও পুলিসের চোখ এড়িয়ে একটি গোপন চিঠি পাঠিয়েছিলাম। সেই চিঠিতে নিজেকে আমি জংবাহাদুর বলে উল্লেখ করেছিলাম। পুলিস তো এনামটি জানে না। সুতরাং চিঠিটা ধরা পড়লেও কোনো বিপদ নেই।

বসুবাড়িতে মাজননীর কর্তৃত্ব ছিল সর্বব্যাপী। মানুষটি ছিলেন ধবধবে ফর্স, ছোটখাটো–কিন্তু মনের জোর ছিল অপরিসীম। যুদ্ধের সময় আমরা অনেক রকমের যুদ্ধ-জাহাজের নাম শুনতাম। আমি মনে মনে মাজননীকে তুলনা করতাম। একটি জামান। পকেট ব্যাটলশিপের সঙ্গে।

সংসারটি ছিল বিরাট। নিজেরই আট ছেলে ছয় মেয়ে। তাছাড়া মাজননীর নিজের ভাইদের মধ্যে চার-পাঁচ জন ছিলেন কমবয়সী। তাঁরা দিদির কাছে কটকে থেকে ভাগ্নেদের সঙ্গে পড়াশুনো করতেন। তার উপর মেয়েদের মধ্যে জন দুয়েক কম বয়সে বিধবা হওয়ায় তাঁদের সংসারের ভারও দাদাভাই ও মাজননীর ওপর পড়েছিল। চাকর-বাকরও অনেক, জন্তু-জানোয়ারের সংখ্যাও বাড়িতে কম নয়। সব মিলে এক সাম্রাজ্যের অধীশ্বরী ছিলেন মাজননী। আজকাল তো দেখি, দু-চারজনের সংসার নিয়ে অনেক গৃহকত্রই হিমসিম খান। মাজননী সবদিক নজর রেখে অতি পরিপাটি করে সংসার চালাতেন।

কোনো ব্যাপারে ফাঁকি দিয়ে মাজননীর কাছে পার পাওয়ার উপায় ছিল না। কটকের বাড়িতে পড়ার ঘরে ছেলেরা ও নিজের ছোট ভাইয়েরা যখন পড়তে বসতেন, তখনও তিনি পাশের ঘর থেকে নজর রাখতেন। তিনি প্রথম প্রথম ইংরেজি বিশেষ কিছুই জানতেন না। ওঁর এক ভাই তার সুযোগ নিয়ে তিনি পাশের ঘরে এলেই একই পাঠ বারবার জোর গলায় পড়ে তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করতেন যে, পড়াশুনা খুব চলছে। কিন্তু মাজননী ধরে ফেলতেন। পরে ডেকে তাঁকে বললেন যে, ইংরেজি না জানলেও মন দিয়ে শুনে তিনি বুঝেছেন যে, একই পাঠ বারবার পড়ে তিনি তাঁকে ধোঁকা দিচ্ছেন। পরে অবশ্য এক মেমসাহেব রেখে মাজননী খানিকটা ইংবেজি শিখেছিলেন।

হাতের লেখা ছিল তাঁর মুক্তোর মতো। আমাদের মায়েরা আমাদের হাতের লেখা অভ্যাস করাবার সময় মাজননীর হাতের লেখা দেখে লিখতে বলতেন। সব ব্যাপারে নিখুঁত হবার চেষ্টায় কিন্তু একটা বড়ই অসুবিধার সৃষ্টি করতেন তিনি। সব কাজেই তাঁর সময় একটু বেশি লাগত। স্নান, খাওয়া, নিজের হাতে খাবার তৈরি করা, ট্রেন ধরবার সময়, সব ব্যাপারে তিনি এতই দেরি করতেন যে, বাড়ির সকলেই ছটফট করতেন। কলকাতা যাওয়া হবে। শুনেছি কটক স্টেশনের দিকে পুলের উপর রেলগাড়ির শব্দ পেলে তবেই তিনি ধীরেসুস্থে বাড়ি থেকে যাত্রা করতেন।

একটা ব্যাপারে মাজননীর বিশেষ দুর্বলতার কথা আমাদের বাড়িতে এখনও অনেকেই বলেন। সেটা হল গায়ের রঙ। অনেকেরই ধারণা, ফস রঙের প্রতি তাঁর একটা অস্বাভাবিক টান ছিল। ছেলেদের বৌ পছন্দ করার ব্যাপারে মাজননীর কথাই ছিল শেষ কথা এবং রঙ ময়লা হলে তাঁর হাতে পাস করা খুবই কঠিন ছিল। তিনি ভাবী কুটুম্বদের বাড়ির সামনে জুড়িগাড়িতে বসে থাকতেন। যাঁদের সঙ্গে কুটুম্বিতা হয়নি, তাঁদের বাড়িতে প্রবেশ করতে তাঁর সংস্কারে বাধত!

মেয়েকে গাড়ির ভিতরে আনিয়ে তিনি পরীক্ষা নিতেন। তার মধ্যে একটা ছিল ক্রীম পাউডারের প্রলেপ অতি উত্তমরূপে মুছে নিয়ে ভাল করে দেখা যে, মেয়ের গায়ের রঙ আসলে কী রকম! নাতি-নাতনিদের বেলায়ও এই নীতি একটা চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি করত।

আমাদের মধ্যে অনেকের মনে হত মাজননী হয়তো গায়ের রঙের জন্য পক্ষপাতিত্ব করেন। কেবল গায়ের রঙ কেন, রান্নার রঙ নিয়েও তিনি টিমনী কাটনে। ঝোলের রঙ যদি কালো। হত, বামুন ঠাকুরকে তিনি বলতেন, “কী, নিজের গায়ের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে রান্না করেছ

नाकि?”

মাজননী ছিলেন অনেক দিক দিয়ে খুবই উদার, আবার অন্য ব্যাপারে সেকালকার নানা সংস্কারের সাক্ষী। তোমরা হয়তো শুনে অবাক হবে যে, তাঁদের সময় স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বেড়াতে বেরনো ছিল একটা অভিনব ব্যাপার। লোকে নানা কথা বলত, বলত এ আবার

18

কেমন সাহেবিয়ানা। মাজননী কিন্তু দাদাভাইয়ের সঙ্গে জুড়ি-গাড়ি চেপে খোলাখুলিভাবে কটকে সন্ধ্যাবেলা নদীর ধারে বেড়াতে যেতেন। অন্য দিকে আবার মুরগি ও মেছ খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে তিনি এমন সব মতামত দিতেন, যা আমাদের কানে বাজত। আমার বাবা ছিলেন বেশ ভোজনবিলাসী, আর মা ছিলেন চিররুণা। সেজন্য আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়িতে দেশী-বিদেশী নানা রকমের রান্না হত। দাদাভাই ও মাজননী উড়বার্ন পার্কের বাড়িতে থাকলে আলাদা রান্নাঘরের ব্যবস্থা করতে হত। এলগিন রোডের বাড়িতে

তো আমিষ ও নিরামিষ রান্নার আলাদা ব্যবস্থা সব সময়েই দেখেছি। ডাক্তারের পরামর্শে। আমার মাকে নিয়মিত মুরগি খেতে দেওয়া হত। মাজননী বলতেন, স্বাস্থ্যের জন্য মুরগি খেতে তাঁর আপত্তি নেই, তিনিও নাকি কখনও কখনও ডাক্তারি মতে অসুখে-বিসুখে মুরগির সুপ খেয়েছেন। কিন্তু মুরগি খাওয়া শেষ হলেই তিনি নাকি কাপড়-চোপড় বদলে ফেলতেন। আমরা বিস্ময়ে ভাবতাম, পেটে তো মুরগি রইলই, কাপড়টা বদলে লাভ কী!

তাঁর হাতের সব কাজই ছিল নিখুঁত। হাতের লেখার কথা তো আগেই বলেছি। সেলাইয়ের কাজও তাই। যাকে ইংরেজিতে বলে পারফেকশনিস্ট। তাঁর হাতের তৈরি চন্দ্রপুলি খাবার জন্য আমরা লাইন দিতেও প্রস্তুত ছিলাম বলা চলে। কেনাকাটার ব্যাপারে তাঁর চোখে ধূলো দেওয়া একেবারেই অসম্ভব ছিল। এলগিন রোডের বাড়িতে মাজননীর আম কেনা ছিল দেখবার মতো ব্যাপার। সেকালে আমওয়ালারা কিলো হিসাবে নয়, শয়ে শ’য়ে বিক্রি করত বাড়িতে এসে। দরাদরিতে আমওয়ালারা মাজননীর কাছে তো হার। মানতই, একো আম বিক্রি করেও একটাও নিকৃষ্ট বা পচা বা কাঁচা ফল চালাতে পারত না।

একটা তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলে আজকের মতো শেষ করি। ছেলেবেলা থেকে রাঙাকাকাবাবু সুভাষচন্দ্র তো তার মা বাবার অনেক চিন্তার কারণ হয়েছেন, তাঁর অনেক পাগলামি তাঁদের সহ্য করতে হয়েছে। ১৯২১ সাল। ছেলে তো ঠিক করে বসে আছেন যে, আই সি এস ছেড়ে দেবেন। দেশের কাজে ঝাঁপ দেবেন। বাবা জানকীনাথ বোঝাবার চেষ্টা করছেন, দেশে ফিরে ভেবেচিন্তে ঠিক করলেই তো হয়। মা প্রভাবতী মন্তব্য করলেন, তিনি মহাত্মা গান্ধীর ত্যাগের মন্ত্রে বিশ্বাস করেন। তোমরা বোধ করি জানো, মহাত্মা গান্ধী তখন সবেমাত্র দেশকে অসহযোগের পথে ডাক দিয়েছেন।

॥ : ॥

আমার অন্নপ্রাশন হয়নি, শরীর খারাপ ছিল বলে। মা পরে আমাকে একথা জানিয়ে বলেছিলেন, পুরুত মশাই বিধান দিয়ে দিলেন, ঠিক আছে, অন্নপ্রাশন বিয়ের সময় হবে। পদে-পদে পুরুতমশাইদের বিধান মেনে আমাদের চলতে হত। আর এক সমস্যা হল ইলে যাবার সময়, তখনও পর্যন্ত একটা ভাল নাম রাখা হয়নি। যেদিন ইস্কুলে ভর্তি হতে যাব, ভোরে বাবা-মা তাঁদের ঘরে ডাকলেন। শীতের সকালে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ভিজে মাঠের দিকে চেয়ে নাম দিয়ে ফেললেন শিশিরকুমার। নিজের নাম বোধ করি অনেকেরই পছন্দ হয় না। পরে আমারও মনে হয়েছে নামটা অন্যরকম হলেও তো হত। তবে একটা কথা ভেবে আমার খুব ভাল লাগে। সেটা এই যে, আমার নাম রেখেছিলেন আমার বাবা-মা। অন্য কেউ নয়।

১৫

বাড়ির ছেলেমেয়েদের নাম রাখা নিয়ে প্রায়ই সমস্যা দেখা দিত। বাড়িতে লোক তো অনেক, নানা মত। আমার মা এ-বিষয়ে রাঙাকাকাবাবুর পরামর্শ নিতেন। রাঙাকাকাবাবু যে-সব নাম দিতেন, অনেকেরই সেগুলো পছন্দ হত না। তাছাড়া তিনি প্রায়ই একসঙ্গে অনেকগুলি নাম তুলতেন। সমস্যা সমাধানের জন্য ঠাট্টা করে বলতেন, “যতগুলি নাম এসেছে সবগুলোই রেখে দেওয়া যাক; যার নাম সে বড় হয়ে একটা বেছে নেবে।”

সেকালে, বিশেষ করে আমাদের আগের জেনারেশনে, ছেলেমেয়েদের নাম মিলিয়ে রাখার একটা রেওয়াজ ছিল। দাদাভাই মাজননী সেই ধারা অনুসরণ করে তাঁদের আট ছেলের নাম ‘শ’ বা ‘স’ দিয়ে রেখেছিলেন এবং সকলেরই নামের শেষ ‘চন্দ্র। নামগুলো বলি–সতীশচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, সুরেশচন্দ্র, সুধীরচন্দ্র, সুনীলচন্দ্র, সুভাষচন্দ্র, শৈলেশচন্দ্র ও সন্তোষচন্দ্র। ফলে সকলেই ইংরেজিতে এস সি বোস। বুঝতেই পারছ, এত বড় পরিবার, সব ছেলের নাম যদি এক ধরনের হয় গোলমালের সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। ধরো, এস্ সি বোসের নামে চিঠি এল। পাবে কে? একান্নবর্তী পরিবার, শ’য়ে শ’য়ে কাপড়জামা, চাদর, ওয়াড় ইত্যাদি ধোপর বাড়ি যায়, কী করে সামলানো যায়! প্রত্যেকটি কাপড়-জামায় সুন্দর করে সেলাই করে নম্বর দেওয়া থাকত। যেমন, আমরা মেজ ছেলের পরিবার। আমাদের ছিল দু’নম্বর। দু’নম্বর মাকা কাপড় মেজ ছেলের ঘরে যেত।

কত নম্বরের বৌ, এ-সমস্যাও কখনও-কখনও দেখা দিত। মাজননীর ভাইদের মধ্যে কেউ কেউ বসু বাড়িতেই থাকতেন, অন্যরাও প্রায়ই যাওয়া-আসা করতেন। সেকালে বাড়ির বৌয়েরা শ্বশুরকুলের বড়দের সামনে (শ্বশুর, ভাশুর ইত্যাদি) বেরোতেন না, কথাও বলতেন না। সামনে পড়ে গেলে লম্বা ঘোমটা টেনে ঘুরে দাঁড়াতেন। ধরো, এক মামাশ্বশুর কিছু বলবেন। তিনি জানবেন কী করে কত নম্বরের বৌ? বৌকে ইশারায় আঙুল গুনে দেখিয়ে দিতে হত কত নম্বর!

আমার তখন বছর চারেক বয়স, রাঙাকাকাবাবু, বাবা, মা ও আমরা পাঁচ ভাইবোন (বসুবাডির দু’নম্বর ও ছ’নম্বর) সাবেক বাড়ি ৩৮/২ এলগিন রোড থেকে পাশের বাড়ি ৩৮/১ এলগিন রোডে উঠে গেলাম। এর দুটো ফল হল। এক, বাবা-মা সাংসারিক দিক থেকে খানিকটা স্বাধীন হলেন; দুই, রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আমাদের একটা বিশেষ সম্পর্কের শুরু হল।

শুনেছি বাবা মেজ ছেলে হলেও ব্যক্তিত্বের জোরে ছেলেবেলা থেকেই বাড়িতে তাঁর বেশ প্রাধান্য ছিল। ছেলেবেলায় বাবা ও তাঁর বড় ভাই আমাদের জ্যাঠাবাবু সতীশচন্দ্র খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। দুজনেরই সাহিত্যে খুব অনুরাগ ছিল–ইংরেজি সাহিত্যে। অনেক নামকরা লেখা, নাটক, কবিতা, বক্তৃতা ইত্যাদি তাঁদের কণ্ঠস্থ ছিল। সন্ধ্যায় কটকে নদীর ধারে বেড়াতে গিয়ে তাঁরা আবৃত্তি করতেন, জোর গলায় বক্তৃতা অভ্যাস করতেন। দেখতেন কার গলা কতদূর যায়। দুজনেই পরে ব্যারিস্টার হন। ব্যারিস্টার হিসাবে বাবার নামডাক বেশি হলেও বাবা প্রায়ই আইন বিষয়ে তাঁর দাদার গভীর জ্ঞানের কথা বলতেন। রাঙাকাকাবাবু যে এক অতি অসাধারণ মানুষ, ছেলেবেলা থেকেই বাবা তা কী করে বুঝলেন বলা শক্ত। বিশেষ করে যখন অন্য অনেকেই ভাবতেন যে, সুভাষ ছেলেটি বদ্ধ পাগল। জীবনে ওর কিছুই হবে না। ছেলেবেলায় রাঙাকাকাবাবু যে-সব চিঠি লিখেছিলেন, সেগুলি বাবা খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন! আই সি এস থেকে পদত্যাগ করার সময়ও রাঙাকাকাবাবু যে। ১৬

লম্বা-লম্বা চিঠি বাবাকে লিখেছিলেন, সেগুলিও রয়েছে।

বসু বাড়িতে বাবাই প্রথম বিলেত যান। এ হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও আগের কথা। বিলেতের জীবনযাত্রা তো অন্যরকম–পোশাক-আশাক, খাওয়া-দাওয়া, সাংস্কৃতিক জীবন ইত্যাদি। বাবা খুব ভোলা মনে বিলেতের যা-কিছু ভাল এবং গ্রহণযোগ্য তার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। ভাল সাহেবি পোশাক ও ভাল বিলিতি খাবার তিনি ভালবাসতেন। আসল কথা হল সব কিছু উঁচু মানের হওয়া চাই–সেটা দেশী হোক বা বিদেশীই হোক। শরৎ বোস সাহেবের উৎকৃষ্ট চুরুট খাওয়ার কথা তো অনেকেই জানেন। কিন্তু তিনি জীবনে কোনদিন কোনো মাদক পানীয় বা নিষিদ্ধ মাংস স্পর্শ করেননি।

এব্যাপারে এক মজার গল্প প্রায়ই বাবা বলতেন। ব্যারিস্টারি পড়বার সময় নিয়মমাফিক বেশ কয়েকটি আনুষ্ঠানিক ডিনার খেতে হত। বাবা যে টেবিলে বসবেন, সেই টেবিলে জায়গা পাবার জন্য যাঁরা মাদক পানীয়তে আসক্ত তাঁদের মধ্যে এক ভাগ বেশি পাবার আশায় কাড়াকাড়ি পড়ে যেত।

এদিকে বিলেত যাবার অনেক আগে থেকেই বাবা দেশের মুক্তি-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি সঙ্গীদের নিয়ে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রাস্তায় রাস্তায় দেশাত্মবোধক গান গেয়ে বেড়িয়েছেন। আঠারো বছর বয়স থেকেই তিনি জাতীয় কংগ্রেসের সভ্য ছিলেন। বিলেতে থাকার সময় এক বন্ধুর সঙ্গে বাবা প্যারিসে বেড়াতে যান। প্যারিসে তখন আয়াল্যাণ্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক মহীয়সী বিপ্লবী নেত্রী মাদা গন্ ম্যাকব্রাইড নির্বাসিত জীবনযাপন করছিলেন। বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর মাদা গন তাঁর বন্ধুকে বলেছিলেন, দেখে নিও, এই যুবকটি একদিন ভারতের শ্রেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে একজন হবে।

আমাদের বংশে বাবাই প্রথম বিলেত যান। বিলেত যাওয়া মানে তো কালাপানি পার হওয়া! সুতরাং শাস্ত্রে অশুদ্ধ! দেশে ফেরার পর সামাজিক সংস্কার রক্ষা করতে বাবাকে বেশ ঘটা করে আনুষ্ঠানিক প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল।

আমি জন্মাবার আগেই বাবা পেশাগত ভাবে অনেক উপরে উঠে গেছেন। আইন-ব্যবসায় কৃতী হতে হলে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, বাবাকেও সারাদিন কোট করার পরও রোজ অনেক রাত পর্যন্ত খাটতে হত। ভোর থেকেই আবার কাজ শুরু। সুতরাং ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা হত কম। মার কাছে শুনেছি বহুদিন ধরে বাবা ছেলেমেয়েদের রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে আসতেন। বাবার সঙ্গ আমরা ভাল করে পেতাম কোর্টের ছুটিতে পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে। সেখানে কিন্তু খাওয়া-দাওয়া, বেড়ানো সবই সকলকে নিয়ে। গল্পগুজব, হাসি-ঠাট্টা পুরোদমে চলত। বেশ কিছুদিন আমি বাড়ির ছোট ছেলে ছিলাম। সেজন্য আমার প্রতি বাবার খানিকটা পক্ষপাতিত্ব জন্মে গিয়েছিল বলে শোনা যায়। আমার পরের বোন গীতার ক্ষেত্রেও বোধহয় একই কথা বলা যায়।

১৯২৪ সালের শেষের দিকে রাঙাকাকাবাবু গ্রেফতার হন। আমরা তখন বাবা-মা’র সঙ্গে কাশ্মীর থেকে ফিরছি। কিছুদিন পরেই ইংরেজ সরকার রাঙাকাকাবাবুকে বয় পাঠিয়ে দেয়। বর্ষায় নির্বাসিত হবার আগে রাঙাকাকাবাবুর কথা আমার বিশেষ মনে নেই; কারণ তখন আমি নেহাতই ছোেট। কিন্তু ১৯২৪ সালে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে বাড়িবদলের সময় থেকে আরম্ভ করে শেষ পর্যন্ত বাবা-মা ও আমাদের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্কে

১৭

কোনদিন কোনো ছেদ পড়েনি। তিনি জেলেই থাকুন বা দুর বিদেশেই থাকুন, রাঙাকাকাবাবু কোনো-না-কোনোভাবে যেন সব সময়েই আমাদের মধ্যে উপস্থিত। অবশ্য এর মূলে ছিল আমার বাবা-মার সঙ্গে তাঁর এক আশ্চর্য ও বিশেষ সম্পর্ক।

॥ ৫॥

মেয়ে পছন্দ করে সম্বন্ধ পাকাপাকি হবার পরেও বেশ কিছুদিন আমার মার বিয়ে আটকে ছিল। কারণ বাড়ির বড় ছেলে আমার জ্যাঠাবাবুর শাস্ত্রীয় মতে সম্বন্ধ পেতে দেরি হচ্ছিল। তোমরা জানো কি না জানি না, বহুদিন কায়স্থ-সমাজে কুলীন ও মৌলিক এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিয়ে চলত না। প্রায় বারো পুরুষ আগে আমাদের এক নামকরা পূর্বসূরী গোপীনাথ বসু বা পুরন্দর খাঁ ঠিক কয়েন যে, নিয়মটা কেবল বড় ছেলের বেলায় মানলেই চলবে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত জ্যাঠাবাবুর ভাল কুলীনের ঘরে সম্বন্ধ পাওয়া গেল এবং বড় ও মেজ ভাইয়ের একই সঙ্গে বিয়ে হল। মার বয়স তখন চোদ্দ, আর জ্যাঠাইমার বয়স আরও কম। দুজনেই পরস্পরকে দিদি বলে ডাকতেন, কারণ একজন বয়সে বড়, অন্যজন সম্পর্কে বড়।

বিয়ে আটকে যাওয়ায় আমার দাদামণি ও দিদিমণি (আমরা দাদামশাই ও দিদিমাকে ঐভাবে ডাকতাম) অস্থির হয়ে পড়লেন। লোকে বলতে লাগল, মফস্বলের কোন এক উকিলের ছেলের জন্য অনির্দিষ্ট কাল বসে থাকবে? দাদামণি অক্ষয়কুমার দে দাদাভাই জানকীনাথকে ধরলেন, অন্তত পাকা দেখাটা করে রাখা যাক। দাদাভাই বললেন, আমার মুখের কথাই পাকা, অনুষ্ঠান করে পাকা দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। সেই থেকে বাড়ির ছেলেদের বিয়েতে পাকা দেখা উঠে গেল। সকলে একটা শিক্ষাও পেলেন–মুখের কথার দাম যে দেয়, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান তার কাছে বড় নয়।

মা বিভাবতী ছিলেন উত্তর কলকাতার এক বনেদি পরিবার পটলডাঙার দে-বিশ্বাস বাড়ির মেয়ে। এক বোন, এক ভাই। শুনেছি ছেলেবেলায় বোনের দাপটই ছিল বেশি, আর ভালমানুষ দাদা (আমাদের মামাবাবু) বোনের সব আবদার ও হুকুম মেনে চলতেন। পরিবারটি ছিল বসুবাড়ির মতো আর একটি বিরাট একান্নবর্তী সংস্থা। কলেজ স্কোয়ারে সংস্কৃত কলেজের উল্টো দিকে প্রকাণ্ড চকমেলানো বাড়িতে অসংখ্য লোক বাস করতেন। বইয়ের দোকানের দৌলতে তোমরা নিশ্চয়ই শ্যামাচরণ দে স্ত্রীটের নাম শুনেছ। শ্যামাচরণ ছিলেন আমার দাদামণি অক্ষয়কুমারের জ্যাঠামশাই। কলেজ স্কোয়ারে আমাদের মামার বাড়ির বাইরের ঘরটিতে এক বিরাট ফরাস পাতা থাকত ও বড়বড় তাকিয়া সেখানে গড়াগড়ি দিত। শ্যামাচরণের সময় ঐ বাইরের ঘরে সেইসময়কার অনেক জ্ঞানীগুণী লোক নিয়মিত জমায়েত হতেন এবং আড্ডা দিতেন। তার মধ্যে ছিলেন ঈরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি। পরের জেনারেশনে পটলডাঙ্গার দে-

বিসরা বেশ কয়টি নামকরা জামাই পেয়েছেন, যেমন শরৎচন্দ্র বসু, রাজশেখর বসু (পরশুরাম) ও নরেন্দ্রকুমার বসু।

দাদামিণ ওকালতি করতেন। ফিটফাট একটি ঘোড়ার গাড়ি চেপে কোর্টে বেরোতেন। তাঁর জীবনীশক্তি ছিল অফুরন্ত এবং সত্যিকারের রসিক লোক ছিলেন তিনি। জীবনের সব

ভাল দিকগুলি উপভোগ করতে চাইতেন–সংস্কারমুক্ত মন ছিল তাঁর। বাড়ির গোঁড়ামি অগ্রাহ্য করে সে সময়কার সেরা সাহেবি রেস্টোরান্ট ফিরপো-পেলিটিতে গিয়ে ভাল মাংস ইত্যাদি খেয়ে আসতেন। বেশ মনে আছে, জীবনে প্রথম সিনেমা দেখেছি দাদামণির সঙ্গে। ভাল চা ও উৎকৃষ্ট লস্যি মানুষকে কী আনন্দ দিতে পারে সেটা দাদামণির মধ্যে দেখেছি। বুড়ো বয়সেও, যখন একটি দাঁতও অবশিষ্ট নেই, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাংসের হাড় চিবিয়ে খেতেন। অন্যদিকে আবার ইংরেজি সাহিত্যের প্রতিও ঝোঁক ছিল খুব। জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর ইরো। কলকাতার টাউন হলে “সুরেন বাঁড়ুজ্যে”র ভাল-ভাল বক্তৃতা অনর্গল আমাদের শুনিয়ে যেতেন।

একমাত্র মেয়ে বিভা ছিল দাদামণির চোখের মণি। শ্বশুরবাড়িতে মেয়েকে দেখতে প্রায়ই কোর্ট-ফেরত উডবার্ন পার্কের বাড়িতে আসতেন। তবে বেশি সময় এক জায়গায় তিনি বসতে পারতেন না। “বিভা, বিভা” বলে হাঁকতে-হাঁকতে ঝড়ের মতো আসতেন, চায়ের কাপ শেষ হতে না হতেই আবার হাঁকতেন, “চললুম” আর সবেগে প্রস্থান করতেন। শুনেছি বিয়ের দিন জামাইকে দেখে প্রথমত দিদিমণি খুব উৎসাহিত হননি। কিন্তু দাদামণি জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, জামাই অনেক বড় হবে এবং তাঁর মেয়ে “রাজরানি” হবে। পরে বাবার দুটি লম্বা জেল বাসের সময় দাদামণি দুঃখ করে মা’কে বলতেন–তাকে তো আমি সত্যিই রাজরানি করে দিয়েছিলাম, তবে এ কী হল! রাজরানি রাজরোষে পড়েছিলেন।

ছেলেবেলায় দাদামণি ছিলেন আমাদের খেলার সাথী। পরে কলেজের ছাত্র হবার পর মামার বাড়িতে অন্য কারণে দাদামণিই ছিলেন ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রধান আকর্ষণ। দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতাম। সরেন বাঁড়ুজ্যের পুরনো রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে তিনি খোলা মনে সুভাষচন্দ্রের রাজনীতি ও দেশের বিপ্লবী আন্দোলনের আদর্শ ও ধারা বোঝবার চেষ্টা করতেন। যুদ্ধের সময় বিদেশ থেকে নেতাজির রেডিওবক্তৃতা তিনি নিয়মিত মন দিয়ে শুনতেন। সুভাষচন্দ্রের সংগ্রামের আহ্বানে সত্তর বছরের বৃদ্ধও উত্তেজিত হয়ে হাতের মুঠো শক্ত করে পায়চারি করতে আরম্ভ করতেন।

দিদিমণি সুবালা নাতি-নাতনিদের নিয়ে খানিকটা বাড়াবাড়ি করতেন বলা চলে। তবে আবার বেশ রাশভারী ও অভিমানী মহিলা ছিলেন। আচার-অনুষ্ঠান সম্বন্ধে গোঁড়ামি ছিল যথেষ্ট। সেকালে তাঁর মতো এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ছোট পরিবার বড় একটা দেখা যেত না। জামাই তো বড়ই ব্যস্ত, দেখা পাওয়াই ভার। সেজন্য আদর-আপ্যায়নের সিংহভাগ নাতি-নাতনিরাই পেত। শেষ জীবনটা ছিল গভীর শোকের। জামাই ও একমাত্র মেয়ের মৃত্যু তাঁকে দেখে যেতে হয়েছিল।

মামাবাবু অজিতকুমার দে-কে বাদ দিয়ে আমাদের ছেলেবেলা বা ছাত্রজীবনের কথা ভাবতেই পারি না। বাবা সেই সময় দু’বারে আট বছর জেলে ছিলেন। প্রথমবার আমি স্কুলে পড়ি। দ্বিতীয়বার আমি মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। আমার সামান্য জীবনের একটা বড় ঘটনা এই যে, দ্বিতীয়বার আমিও বাবার বন্দী-জীবনের ভাগ পেয়েছিলাম এবং বেশ কিছুদিন জেলবাস করেছিলাম। যাই হোক, আমার মা দু’বারই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেশ বিপাকেই পড়েছিলেন। মামাবাবু-আমরা তাঁকে ডাকতুম মাম বলে–অতি সহজভাবেই আমাদের দেখাশুনোর ভার তুলে নিলেন। তাঁর

১১

মনটা ছিল খুব নরম, উগ্রপন্থী রাজনীতি তাঁর জন্য ছিল না। কিন্তু আমাদের পারিবারিক বিপর্যয়ের সময় তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে তিনি আমাদের আগলে রেখেছিলেন।

আমার মনে হয় মামার বাড়ির পারিবারিক শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের মূলে ছিলেন বাড়ির বৌমা ও আমাদের মামিমা রেণু বা সুরমা। বাঙালির ঘরে বৌমার প্রকৃত কল্যাণময় রূপ আমি মামিমার মধ্যে দেখেছিলাম। তিনি ছিলেন বঙ্গবাসী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা গিরিশচন্দ্র বসুর ছোট মেয়ে। সম্ভ্রান্ত পরিবার। সকলের সেবাযত্ন করাই যেন মামিমার জীবনের ব্রত ছিল। নিজের পরিবারের ও বাইরের ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির ও রুচির লোকেদের তিনি ঠিক সামলে রাখতে পারতেন। মেডিকেল কলেজের ছাত্রজীবনের পুরোটাই আমি মামিমার সহৃদয় আতিথ্য পেয়েছি। মেডিকেল কলেজে ছাত্রদের প্রোগ্রাম সকাল থেকে সন্ধ্যা। মামারবাড়ি কলেজের কাছেই, সুতরাং মামিমার কাছে দুপুরের মাছ-ভাত খাওয়াটা পাকাপাকিভাবে বরাদ্দ। যুদ্ধের সময় গুরুতব অসুস্থ অবস্থায় রাজবন্দী হয়ে মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে কিছুদিন ছিলাম। মামিমার রান্না-করা পথ্য পুলিস-পাহারা পেরিয়ে আমার। কাছে পৌঁছে যেত।

৬ ॥

আমি যে যুগে জন্মেছি সেটা ছিল অসহযোগের যুগ। গান্ধীজী তাঁর অহিংসা অসহযোগের মন্ত্র দিয়ে সারা দেশকে মাতিয়ে তুলেছেন। বিদেশী সরকারের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখা চলবে না, সব বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বাবলম্বী হতে হবে। তাঁর প্রভাব থেকে। ছেলে বুড়ো কেউ বাদ পড়েনি। প্রাথমিক স্কুল থেকে আরম্ভ করে ম্যাট্রিক পর্যন্ত আমি ও আমার সমবয়সীরা সেই খাঁটি স্বদেশিয়ানার মধ্যে বড় হয়েছি। আমার মনে হয় বসুবাড়ির যাঁরা কলকাতায় থাকতেন, তাঁদের উপর স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল বেশি। এর কতকগুলি কারণ ছিল। প্রথমত রাঙাকাকাবাবু সুভাষচন্দ্র তো দেশের ডাকে আই সি এস। ত্যাগ করে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের দলে যোগ দিয়েছেন। বাবার সঙ্গে ছিল রাঙাকাকাবাবুর বিশেষ সম্পর্ক। বাবাও অল্পদিনের মধ্যে দেশবন্ধুর এক প্রধান সহযোগী হয়ে উঠলেন। আব বাবা ও রাঙাকাকাবাবু যাই করুন না কেন, তাতেই আমার মায়ের সায় ছিল। সুতরাং বুঝতেই পাবছ আমাদের শিশুজীবন ও কৈশোর সব দিক দিয়ে স্বদেশী-প্রভাবিত ছিল। অবশ্য আমি এটা বলছি না যে বসু-বাড়িতে এর ব্যতিক্রম ছিল না।

গান্ধীজী দেশকে জাগিয়েছিলেন প্রধানত চবকা ও খদ্দরের মাধ্যমে। আমাদের বাড়িতে কোন ব্যাপারেই, ছোটদের বেলাতেও, খদ্দর ছাড়া কিছু চলবে না। সব জামাকাপড়, পান্ট, শার্ট, পাঞ্জাবি, বিছানাব চাদর, বালিশের ওয়াড়, ধুতি, শাড়ি, গায়ের চাদর, জানালা-দরজার পরদা, সবই খদ্দরেব। সেকালে কিন্তু আজকালকার মতো মোলায়েম খদ্দর পাওয়া যেত

। মোটা খদ্দরের কাপড়জামা পরতে হত। বাবা কোটের পোশাকও খদ্দরের পরতেন। কোন বিশেষ কারণে সিল্ক পরতে হলে, সেটাও পুরোপুরি দেশী সিল্ক হওয়া চাই। আজও সেজন্য আমাদের কাছে খদ্দর এক বিশেষ ধরনের ঐতিহ্যবাহী পরিধান। আগেই তো বলেছি, বাবা-মা আমাদের নিয়ে পাহাড়ে বেড়াতে যেতেন। সেকালে ভাল গরম কাপড় বেশির ভাগই বিলেত থেকে আসত। খুঁজে-পেতে পাঞ্জাব কাশ্মীরে তৈরি গরম কাপড় ২০

যোগাড় করে মা আমাদের গরম কাপড়-জামা বানিয়ে দিতেন।

খদ্দর পরা ছাড়া বাড়ির যাঁরাই পারতেন চরকাতে বা তকলিতে সুতো কাটতেন। সেই সুতো দিয়ে আবার কাপড় তৈরি করতে দেওয়া হত। যাঁরা এটা পারতেন, তাঁরা বিশেষ গৌরবের অধিকারী হতেন। আমারও মনে আছে খানিকটা বড় হবার পর আমিও তকলিতে অনেক সুতো কেটেছি। তোমরা হয়তো ভাবছ আমি খদ্দর নিয়ে এত কথা বলছি কেন। বড় কথা হল যে, খাদি ও চরকার মাধ্যমেই আমরা আমাদের দেশের নবজাগরণের শরিক হয়েছিলাম। বিলেতি কাপড় পরা বা বিলেতি জিনিস ব্যবহার করা ছোট বয়স থেকেই আমাদের কাছে লজ্জার কথা বলে মনে হত। যাঁরা তা করতেন, তাঁদের আমরা কৃপার চোখে দেখতাম এবং আমাদের হিসাবে তাঁরা ছিলেন বিজাতীয়।, রাঙাকাকাবাবু ১৯২৪ সালের শেষ থেকে ১৯২৭-এর প্রথম পর্যন্ত বর্মায় বন্দী ছিলেন। ঐ সময় তিনি বাবা-মাকে অসংখ্য চিঠি লিখেছিলেন। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মধ্যে খদ্দর, সুতো-কাটা, কাপড়-বোনা সম্বন্ধেও তিনি খোঁজ-খবর নিতেন। এই সূত্রে বহু দিন পরের, ১৯৩৭ সালের একটা কথা মনে পড়ল। ততদিনে খদ্দরের ঝোঁকটা দেশে অনেকটা কমে এসেছে। তাছাড়া অনেক দেশী মিলের কাপড় চালু হয়েছে। রাঙাকাকাবাবু জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন, এলগিন রোডের বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছি, গায়ে একটি মিলের কাপড়ের শার্ট। সম্ভাষণের পর বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন এবং শেষে গম্ভীরভাবে বললেন, “কী, খদ্দর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে নাকি?” আমি আমতা-আমতা করলাম। বাড়ি ফিরে মাকে বললাম, পুরোপুরি খদ্দরেই ফিরে যাওয়া যাক।

আমাকে যখন কিণ্ডারগার্টেনে ভর্তি করা হবে স্থির হল, তখনও পুরোপুরি দেশী কোনো স্কুলে ঐ বিভাগ চালু ছিল না। ভবানীপুরের মেয়েদের স্কুল ডায়োসেশনে আমাকে ভর্তি করা হল। ঐ মিশনারি স্কুলের নীচের কয়েকটি ক্লাসে অল্প সংখ্যায় ছেলেদের নেওয়া হত, এখনও হয় শুনেছি। স্কুলের কী তখন ছিলেন একজন জাঁদরেল মিশনারি মহিলা-ডরোথি ফ্রান্সেস। দেখলেই ভয় করত, ফলে স্কুলের ডিসিপ্লিন ভাল ছিল। শিক্ষয়িত্রীরা কিন্তু বেশির ভাগই বাঙালি ছিলেন এবং আমাদের খুব আদরযত্ন করতেন। কলকাতার বহু অভিজাত হিন্দু, মুসলমান ও খ্রীষ্টান পরিবারের ছেলেমেয়েরা ঐ স্কুলে পড়ত। সাহেবঘেঁষা ও কতা-ভজা পরিবারের অবশ্য অভাব ছিল না। তাঁদের জন্য কয়েকটি সাহেবি স্কুল ছিল।

রাঙাকাকাবাবুকে আমার মা ডাকতেন ‘ছোটদা। ছোটদা তাঁর মেজবৌদিদিকে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা সম্বন্ধে নিজের মতামত জানাতেন ও পরামর্শ দিতেন–সে তিনি জেলেই থাকুন বা বিদেশেই থাকুন। শিশুশিক্ষা সম্বন্ধে রাঙাকাকাবাবুর মতামত খুব ব্যাপক, প্রগতিশীল ও বৈজ্ঞানিক ছিল। শিশুমনের যাতে সার্বিক বিকাশ হয় তার ব্যবস্থা করার জন্য রাঙাকাকাবাবু মাকে নানারকম পরামর্শ দিতেন। ডায়োসেশন স্কুলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য হাতের কাজ, গান বাজনা, খেলাধুলা ইত্যাদির মোটামুটি ভাল ব্যবস্থাই ছিল। আমার মনে আছে আমি নিজে লেখাপড়ার চেয়ে হাতের কাজে বেশি আগ্রহী ছিলাম এবং ডায়োসেশনে প্রাইজ যা-কিছু পেতাম তা হাতের কাজের জন্য, লেখাপড়ায় নয়। কিন্তু স্কুলের শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারে এই ভেবে রাঙাকাকাবাবুর পরামর্শে বাবা-মা ছবি আঁকা শেখাবার জন্য আমার খুব কম বয়সেই একজন মাস্টারমশাই রেখে দিলেন। আমার দিদি মীরাকেও কিছুদিন পরে ঐ শিক্ষায় আমার সঙ্গী করে দেওয়া হল। আমি কোনদিনও

ছবি আঁকায় বিশেষ পারদর্শী হতে পারলাম না, কিন্তু মাস্টারমশাই শ্রীহরেন সেনগুপ্ত আমার মধ্যে শিল্প ও শিল্পকর্ম সম্বন্ধে এমন একটা রুচি ও ধারণার সৃষ্টি করেছিলেন যেটা পরবর্তী জীবনে আমার খুব কাজে লেগেছে। আমাদের মাস্টারমশাইরা যে বাবা-মা’র কল্যাণে সহজেই আমাদের পরিবারভুক্ত হয়ে যেতেন তাই নয়, বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর দেশের কাজেও তাঁরা অংশীদার হতেন। যে হরেন সেনগুপ্তমশাই আমার শিশু বয়সের আর্টের শিক্ষক, তিনি বৃদ্ধবয়সে আজও নেতাজীর কাজ করে চলেছেন। আজকের নেতাজী মিউজিয়মের সব তৈলচিত্ৰই তাঁর আঁকা।

ছেলেবেলায় অসুখ-বিসুখ তো আমার লেগেই থাকত। মাকে সেজন্য অনেক দুভোগ পোয়াতে হয়েছে। মা হোমিওপ্যাথিক গৃহচিকিৎসার বই হাতের কাছে রাখতেন, আর থাকত একটা কাঠের বাক্সে সুন্দরভাবে সাজানো হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ছোটছোট শিশি। হোমিওপ্যাথিক গুলি তো খেতে ভাল, খেয়েছিও অনেক। কবিরাজী চিকিৎসারও বাড়িতে বেশ চলন ছিল। সেকালের শ্রেষ্ঠ কবিরাজ ও দাদাভাইয়ের বিশেষ সুহৃদ শ্যামাদাস বাচস্পতির কথা তো আগেই বলেছি। কবিরাজী ওষুধ তৈরি করতে হাঙ্গামা অনেক এবং সবক্ষেত্রে তা সুস্বাদুও নয়। কিন্তু মা ওষুধ ও রুগির পথ্য হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ালে না বলবার উপায় ছিল না। অ্যালোপ্যাথিও চলত পাশাপাশি, কারণ আমাদের নতুনকাকাবাবু সুনীলচন্দ্র ছিলেন বিলেত-ফেরত ডাক্তার। তিনি নিজে তো আছেনই, অন্যান্য অনেক বিশেষজ্ঞ বন্ধুদেরও প্রয়োজনমতো হাজির করতেন।

বাড়ির অসুখ-বিসুখের ব্যাপারে, বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে, রাঙাকাকাবাবুর মতামত ছিল বিজ্ঞানধর্মী। যেমন ধরো, আমার ম্যালেরিয়া হয়েছে এবং ক্রমাগত তেতো কুইনিন মিকচার গলাধঃকরণ করতে হচ্ছে। রাঙাকাকাবাবু মাকে লিখলেন, কেবল ওষুধ খাওয়ালেই তো চলবে না, রোগের মূল কারণ বের করে তার প্রতিবিধান করতে হবে। বললেন, বাড়িতে মশার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করুন। দিদির হল টাইফয়েড, রাঙাকাকাবাবু বলে পাঠালেন, বাড়িতে এত সংক্রামক রোগ কেন হয়, এ-বিষয়ে অনুসন্ধান হওয়া দরকার। রাঙাকাকাবাবুর নিজেরও অসুখ-বিসুখ কম করেনি। পরে ১৯৩৬ সালে আমাদের কার্শিয়ঙের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে থাকবার সময় দেখেছি, আধাডাক্তারি ও গৃহচিকিৎসার বই পড়ছেন। কিছুদিন আগেই ইউরোপে তাঁর পেটে অপারেশন হয়েছিল। দেখলাম গল ব্লাডার বা পিত্তকোষ সম্বন্ধে অনেক কিছু জানেন। তাঁর প্রায়ই সায়াটিকার ব্যথা হত, শরীরের এই বিশেষ নার্ভ সম্বন্ধে দেখলাম তিনি বেশ ওয়াকিবহাল। নানা রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ সম্বন্ধে তাঁর বেশ জ্ঞান থাকায় তাঁর আর একটি সুবিধা হয়েছিল। প্রয়োজন হলে জেলের কর্তৃপক্ষ বা পুলিসকে বেশ ধোঁকা দিতে পারতেন।

॥ ৭ ॥

১৯৩৪ সাল। বাবা তখন কার্শিয়ঙে গিধাপাহাড়ে নিজের বাড়িতে অন্তরীণ হয়ে আছেন। হঠাৎ এক সকালে কার্শিয়রে বাড়ির চৌকিদার আমাদের কলকাতার ১ নং উডবার্ন পার্কের বাড়িতে এসে উপস্থিত। এসেই মা’র সঙ্গে কিছু গোপন কথাবাত। লুকিয়ে এসেছে। বাবা কিছু জরুরি গোপনীয় কাগজপত্র কালু সিংয়ের মারফত পাঠিয়েছেন। মার

হাতে সেগুলি নিরাপদে সমর্পণ করে কালু সিং হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

কালু সিং নেপালি ব্রাহ্মণ। কার্শিয়ঙে যে বিদেশী সাহেবের কাছ থেকে বাবা বাড়িটি কিনেছিলেন, তারও সে চৌকিদার ছিল। বাড়ির সঙ্গে-সঙ্গে সে বাবার চৌকিদার হয়ে গেল। সপরিবারে সে আমাদের বাড়ির এলাকার মধ্যেই থাকত। বাবার প্রতি তার আনুগত্য ছিল সম্পূর্ণ, এবং বাবাও তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন। পরে ১৯৩৬ সালে রাঙাকাকাবাবু যখন বাবার মতো কার্শিয়ঙের বাড়িতে অন্তরীণ হন, তখন তাঁর সঙ্গেও কালু সিংয়ের একই রকম সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

প্রথমেই কালু সিংয়ের যে গোপনযাত্রার কথা বললাম, তার বিবরণ পরে শুনেছিলাম। বাবা ঠিক করলেন যে, একটা জরুরি বার্তা পুলিসের চোখ এড়িয়ে মার হাতে পৌঁছে দেওয়া দরকার। কালু সিং কাগজপত্র তার জুতার মধ্যে রাখল। তারপর যেন একটু বেড়াতে যাবার ভান করে রাস্তায় নেমে এল। আমাদের বাড়িটা ছিল কার্শিয়ঙ শহর থেকে প্রায় আড়াই মাইল দূরে। বাড়ির কাছ দিয়েই গয়াবাড়ি ও তিনধরিয়া পর্যন্ত একটা পাহাড়ি রাস্তা বা পাকদণ্ডি নেমে গেছে। পাহারাওয়ালারা দেখল কালু সিং নিয়মমাফিক পাকদণ্ডির দিকে একটু ঘোরাফেরা করছে। তাদের অগোচরে সে পাকদণ্ডি ধরে গয়াবাড়ি পৌঁছে গেল। গয়াবাড়ি থেকে পাহাড়ি ছোট ট্রেন ধরে শিলিগুড়ি। তারপর শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং মেলে চেপে সোজা কলকাতা। বাবা ছাড়া আর কেউ জানলেন না যে, কালু সিং কোথায় গেছে।

আগেই তো বলেছি, বাবা কাল সিংকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন। অন্য পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার সময়ও কালু সিংকে আনিয়ে নিতেন। সে হত আমাদের যাত্রার ম্যানেজার আর ছোট ছেলেমেয়েদের ভারও তারই। সে যেমন খুব ডিসিপ্লিনের ভক্ত ছিল এবং আমদের খুব কড়া শাসনে রাখত, তেমনই আমাদের খেলার সাথীও ছিল। বাড়িতে কোনো বিয়ে বা অন্য কোনো বড় অনুষ্ঠান উপলক্ষেও কালু সিং কলকাতায় চলে আসত এবং বাবাও তাকে বিশেষ কোনো দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হতেন।

বাবার কাছে শুনেছি, এবং দেখেছিও কার্শিয়ঙে একলা অন্তরীণ থাকার সময় কালু সিং রোজ সন্ধ্যায় বাবার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘণ্টা গল্প ও নানা বিষয়ে আলোচনা করত। কেবল সাংসারিক কথাবাতাই নয়। দেশের নানা সমস্যা নিয়ে বাড়ির কর্তা ও চৌকিদারের মধ্যে আলোচনা হত। বাবা নিজেই বলেছেন, অনেক ব্যাপারে কালু সিংয়ের মতামত তিনি মেনে নিতেন।

রাঙাকাকাবাবুরও ঠিক একই রকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারকে কী কী ভাবে বেকায়দায় ফেলা যায়, এরকম বিষয় নিয়েও কাল সিং লামা সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে আলোচনা করত। সে তো ইংরেজি লেখাপড়া শেখেনি, কিন্তু তার বুদ্ধি ও কমনসেন্স ছিল প্রখর, বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর পাল্লায় পড়ে সে রাজনীতির অনেকটাই বুঝে ফেলেছিল। ক্রমে-ক্রমে আমাদের প্রকাণ্ড পরিবারের প্রায় সকলকেই সে চিনে ফেলেছিল। আমাকে সে পরে বলত যে, ঐ দুই ভাইকে দেখবার বা জানবার পর, আর কাউকে তার তেমন পছন্দ হত

আগেই তো বলেছি শিশুবয়সে কাশ্মীরে কাল সিং আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল। হয়তো বা সেজন্যই তার সঙ্গে আমার এক বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ছাত্রাবস্থায় আমি বাবা-মা’র

মত নিয়ে একলাই কার্শিয়ঙে কালু সিংয়ের হেফাজতে থেকেছি। যে পাহাড়ের গায়ে আমাদের বাড়ি, তার নাম গিধাপাহাড়। কালু সিংয়ের মতে নামটা এসেছিল ‘গৃধ বা শকুন থেকে, কারণ পাহাড়ের চূড়োটা ছিল শকুনের মাথার মতো। গিধাপাহাড় ছিল আমাদের, বিশেষ করে আমার, ছেলেবেলার অতি প্রিয় ও আনন্দের জায়গা। সেখানেই আমরা বাবা-মা’কে একসঙ্গে খুব কাছে পেতাম। আর কাল সিংয়ের তদারকিতে সবকিছুই ছোটদের মনের মতো চলত। সেই তো আমাকে প্রথম পাহাড়ে চড়তে শেখায়। বাড়ি থেকে গিধাপাহাড়ের চূড়োটা পর্যন্ত ওঠা ছিল এই শিক্ষার প্রথম ধাপ। তারপর সে আমাকে গিধাপাহাড়ের চেয়ে আরও খানিকটা উঁচু আর একটা পাহাড়ে নিয়ে গেল, যেখান থেকে। আমাদের জল আসত। শেষ পর্যন্ত কালু সিং আমাকে পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অজানা এক পথে কার্শিয়ঙ স্টেশনে পৌঁছে দিল। মনে আছে যাত্রাটা আমার চিত্তে বেশ শিহরণ জাগিয়েছিল।

কালু সিংয়ের পারিবারিক জীবন ছিল বড়ই শোকের। তার চার ছেলে একের পর এক মারা যায়। বাবার বিশেষ ইচ্ছা ছিল যে, বুড়ো বয়সে সে যাতে একটু আরামে থাকতে পারে, সেজন্য আলাদা একটু জমিতে তার জন্য ছোট একটি বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেবেন। বাবার অকালমৃত্যুর জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। বাবার মৃত্যুর বছর তিনেক পরেই সে মারা যায়। শেষ বিদায়ের দিনকতক আগে মা’কে ছোট সুন্দর এক চিঠিতে সে তার শেষ সেলাম জানিয়ে গিয়েছিল।

আমাদের কলকাতা ফ্রন্টে কালু সিংয়ের শাকরেদ ছিল বাবার ড্রাইভার আমেদ। সে কেবল গাড়িই চালাত না, বাড়ির অনেক ম্যানেজারিও তাকে করতে হত। এলগিন রোডের বাড়ি থেকে শুরু করে উডবার্ন পার্কের নতুন বাড়ির অনেক কাজকর্ম আমেদের তদারকিতেই হত। সে ছিল বেনারসের লোক। কিন্তু ছুটিছাটা কমই নিত। গাড়ি সে এত ভাল চালাত যে, অন্য কারুর গাড়িতে উঠলে বাবা অস্বস্তি বোধ করতেন। সেকালে বাড়ির কর্মরত লোজনেরা কেমন সত্যিই পরিবারের লোক হয়ে যেত এবং তাদের সঙ্গে সকলেরই কেমন আন্তরিক ও প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠত, তার একটা উদাহরণ দিই। বাবা ১৯৩২ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত রাজবন্দী ছিলেন। সে-সময় মা খুবই অর্থকষ্টে পড়েছিলেন। সংসারের সব খরচ কমাতে হয়েছিল। বড় গাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হল। মা আমেদকে ডেকে বললেন, সে বাবার কাছে যে মাইনে পেত, এখন আর অত দেওয়া সম্ভব নয়। ড্রাইভার হিসাবে আমেদের বেশ সুনাম ছিল এবং ভাল মাইনেতে আর-একটা চাকরি সে সহজেই পেতে পারত। মা আমেদকে বললেন, “তোমারও তো সংসার আছে, চলবে কী করে? তুমি ভাল মাইনেতে একটা চাকরি নাও।” আমেদ প্রথমটায় কিছু বলল না, পরে ফিরে এসে বলল, “আপনি যা পারেন দেবেন; যখন পারবেন না দেবেন না। আপনার সংসার যদি চলে তো আমারও চলবে।”

যদিও তখনও গাড়ি চালাবার বয়স আমার হয়নি, বাবার প্রথম জেলবাসের সময় আমেদ আমাকে লুকিয়ে গাড়ি চালাতে শিখিয়েছিল। অনেক পরে ১৯৪১ সালে রাঙাকাকাবাবুকে কলকাতা থেকে গোপনে গোমো পৌঁছে দেবার সময় আমি আমেদের শিক্ষার সুফল পেয়েছিলাম। বাবাও আমার গাড়ি চালানো পছন্দ করতেন, কারণ আমি আমেদের কায়দায় গাড়ি চালাতাম। ২৪

সেকালে বাড়ির লোকজনেরা নানাভাবে বড় পরিবারের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে যেত এবং পরিবারের সুখদুঃখের সাথী হত। তাদের বাদ দিয়ে আমরা আমাদের

ছেলেবেলার কথা ভাবতেই পারি না।

দাদাভাই ও মাজননীর আমলের দুজনের কথা খুব শুনেছি এবং পরবর্তীকালে তাদের দেখেছিও। একজন ছিল দাদাভাইয়ের ব্যক্তিগত পরিচারক সুদাম, অন্যটি বসবাড়ির পরিচারিকা সারদা। রাঙাকাকাবাবুর প্রতি সারদার মমতার কথা তো বোধ করি তোমরা জানো।

একটা মজার গল্প বলে আজকের প্রসঙ্গটা শেষ করি। রাঙাকাকাবাবু যখন কংগ্রেসের সভাপতি, তখন তাঁর ব্যক্তিগত এক বেয়ারা ছিল। তার বাড়ি উডিষ্যায়। সে ছিল যাকে বলে ‘ওয়ান মাস্টার ম্যান’। পণ্ডিত জওহরলালের সঙ্গে রাঙাকাকাবাবু একবার একই ট্রেনে, একই কামরায় যাচ্ছেন। কোনো একটি জায়গায় ট্রেনটি দাঁড়িয়েছে। সিগন্যাল হয়ে গেছে, কিন্তু ট্রেন আর ছাড়ে না। রাষ্ট্রপতির (তখন কংগ্রেস-সভাপতিকে রাষ্ট্রপতি বলা হত) বেয়ারা মহাশয় নেমে এনজিন-ড্রাইভারের কাছে গিয়ে গরম জল দাবি করছে, তার সাহেব দাড়ি কামাবেন বলে। আগে জল দাও, তবে গাড়ি ছাড়ো। তারপরে কামরায় ফিরে জওহরলালকে সেই ভোরবেলায় ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলে বলেছে, “আপনি তাড়াতাড়ি সেরে নিন, আমার সাহেব উঠে বাথরুমে যাবেন তো।” জওহরলাল তো কৌতুক বোধ করলেন, কিন্তু ঘুম থেকে উঠে ব্যাটা শুনে সুভাষচন্দ্র খুবই অপ্রস্তুত।

॥ ৮ ॥

ঠিক মনে আছে তো, না অনুমান করছি! সেই ১৯২৫ সালের শিশুবয়সের ঘটনা। আমার মনের কোণে একটা ছবি আছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ দীর্ঘকায় এক মানুষ আমাদের কার্শিয়রে বাড়ির সামনে ধীরে-ধীরে পায়চারি করছেন। পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে দেখছি আমার স্মৃতিভ্রম হয়নি। মান্দালয়ে বন্দী রাঙাকাকাবাবুকে বাবা লিখছেন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে সঙ্গে নিয়ে, দার্জিলিঙে তাঁর মৃত্যুর দিন পনরো আগে, আমাদের কার্শিয়ঙের বাড়িতে একটা দিন কাটিয়ে গিয়েছিলেন। বাবা আরও লিখেছেন বড়ই দুঃখের কথা যে, কার্শিয়ঙে আমাদের বাড়িতে দেশবন্ধুর একটা ছবি তুলে রাখা হয়নি। যাই হোক, দেশবন্ধুর শেষ বাইরে যাওয়া ও থাকা হল আমাদের গিধাপাহাড়ের বাড়িতে। শরৎচন্দ্র বসুর পরিবারের সঙ্গে।

আরও কিছু মনে আছে ভাসা-ভাসা। আমরা বাবা-মার সঙ্গে গিয়েছি দার্জিলিঙে দেশবন্ধুকে দেখতে। আমরাও একটা দিন কাটিয়ে এসেছিলাম স্টেপ অ্যাসাইড’-এ। ঐ বাড়িতে দেশবন্ধু তাঁর জীবনের শেষ কটা দিন ছিলেন। তোমরা যারা দার্জিলিঙ গেছ, নিশ্চয়ই বাড়িটা দেখেছ। আমাদের বাড়ির একটা প্রথা ছিল, মা যখনই ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোনো অসুস্থ বয়োজ্যষ্ঠকে দেখতে যেতেন, আমাদের বলতেন তাঁর পা টিপে দিতে। এখন মনে হয়, এটা ছিল শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও শুভ কামনার একটা নিদর্শন। আমার স্মৃতিতে আছে। রোগশয্যায়-শোয়া দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আমি পা টিপে দিয়েছিলাম। এই স্মৃতির মধ্যে গভীর এক অনুভূতি আছে, সেটা তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।

বড় হয়ে আমরা আর দেশবন্ধুকে দেখিনি। আমরা তাঁকে শেষ দেখে আসার দিনকতক পরেই তিনি দার্জিলিঙে দেহত্যাগ করেন। কলকাতায় তাঁর মরদেহ নিয়ে যে শোকযাত্রা হয়েছিল, তার তুলনা নেই। সারা বঙ্গভূমি যেন পিতৃহারা হয়েছিল। যখনই কলকাতায় কোনো বড় শোভাযাত্রা বা শোকযাত্রা হত, মা আমাদের দেখতে নিয়ে যেতেন। একটা সুবিধামতো জায়গাও ছিল। মাজননীর এক ভাই ও আমাদের লালদাদাবাবু, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, ওয়েলিংটন স্কোয়ারের মোড়ের এক বাড়িতে থাকতেন। তাঁর বাড়ির ছাদ থেকে আমরা দেখতাম। যদিও আমি তখন খুবই ছোট, সেই বিরাট জনসমুদ্রের একটা ছবি আমার মনে গেঁথে আছে। কয়েক বছর পরে যতীন দাসের শবদেহ নিয়ে ও হিজলি জেল-পুলিসের গুলিতে নিহত দুই রাজবন্দীর শেষযাত্রাও ঐ ছাদ থেকেই দেখেছি। এই দুটিই রাঙাকাকাবাবুর নেতৃত্বে হয়েছিল। এই ধরনের জনসমাবেশ আমাদের বেশ প্রভাবিত করত। আমি নিজে মুখচোরা ছিলাম বলে ভিতরের তোলপাড়টা যেন একটু বেশিই হত।

দেশবন্ধুকে আমরা আর না দেখলেও বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর মধ্যে তাঁকে আমরা চিরকালই দেখে এসেছি। তাঁদের উপর দেশবন্ধুর বিরাট প্রভাবের কারণ সম্বন্ধে আমি অনেক চিন্তা করেছি এবং এখনও করি। দেশবন্ধুর কথা বলতে গিয়ে দুজনেই অভিভূত হয়ে পড়তেন। আসল কথা হল দেশবন্ধু তাঁর অনুগামীদের নিবিড়ভাবে ভালবাসতেন, যে-ধরনের ভালবাসা জগতে বিরল। তাছাড়া তাঁর অতুলনীয় ত্যাগের দৃষ্টান্ত তো আছেই। আর আছে তাঁর অসাধারণ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও মেধা। এই সূত্রে একটা কথা বলি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়–যখন তোমরা জন্মাওনি–অনেক বড় বড় নেতা ও দেশসেবক পেয়েছি ও দেখেছি। তাঁদের মধ্যে এমন কয়েকজন ছিলেন, যাঁরা কেবল দিতেই এসেছিলেন, কিছু নিতে আসেননি। এই ধরনের ত্যাগধর্মী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী পৃথিবীতে খুব কমই দেখা যায়। তাই বলছি, নেতৃত্ব খুঁজতে আমাদের বিদেশে-বিভুয়ে হাতড়ে বেড়াবার দরকার নেই।

দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর বাবা একদিকে তাঁর স্মৃতিরক্ষার কাজে, অন্যদিকে বাসন্তী দেবী ও তাঁর পরিবারের দেখাশুনোর ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাবা দেশবন্ধুকে সি আর বলে উল্লেখ করতেন। পরে দক্ষিণ ভারতের এক নেতাকে অনেকে সি আর বলে অভিহিত করতে আরম্ভ করেন। বাবা এতে বিরক্ত হয়ে বলতেন, সি আর বলতে একজনকে বোঝায়–চিত্তরঞ্জন দাশ, আর কাউকে ঐ নামে ডাকা ঠিক নয়। দেশবন্ধুর ‘ফরওয়ার্ড কাগজ চালাবার ভারটা বিশেষ করে বাবার উপর পড়ে। রাঙাকাকাবাবু তো তখন বায় বন্দী। দেশবন্ধুর মৃত্যুতে তিনি খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। বার বন্দীশালা থেকে লেখা তাঁর অনেক চিঠি আছে, বেশির ভাগই বাবাকে লেখা। তোমরা সেগুলি পড়ে দেখো। অনেক কিছু জানতে ও বুঝতে পারবে।

দেশবন্ধু হঠাৎ চলে গেলেন। কিন্তু যাঁকে রেখে গেলেন, তিনি সারাজীবনের জন্য বসুবাড়ির পরমাত্মীয় হয়ে রইলেন। আগে থেকেই বাবা ও রাঙাকাকাবাবু বাসন্তী দেবীকে ‘মা’ বলে ডাকতেন। কখন কোন মার কথা বলছেন, এই নিয়ে আমাদের মাঝেমাঝে গোলমাল হয়ে যেত। আমরা ওঁকে ডাকতুম ঠাকুমা বলে, এতে কোনো অসুবিধা ছিল না। ১৯২৫ সালে আমাদের শিশুবয়স থেকে শুরু করে আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত বাসন্তী দেবী বা ঠাকুমা আমাদের অত্যন্ত আপনজন ছিলেন। বাড়ির

সকলকে তিনি চিনতেন ও ভালবাসলে, তাদের খুটিনাটি সব খবর রাখতেন। দেশব

তো সব কিছুই দেশকে দান করে গেলেন। বাবা ও তাঁর অন্য অনুগামীরা বাসী দেবী ও পরিবারের জন্য একটা বাড়ির ব্যবস্থা করলেন। রাঙাকাকাবাবু ক্রমাগতই জেল থেকে বলে পাঠাতেন, বাবা ও মা যেন নিয়মিত ঠাকুমার দেখাশুনা করেন। বাবা কাজের চাপে যতটা পারতেন না, মা সেটা পূরণ করে দিতেন। মার সঙ্গে সারা জীবন কতবার যে আমরা ছোটরা ঠাকুমার বাড়ি গিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। ঠাকুমার হাতের রান্না অসম্ভব ভাল ছিল। অনেক খেয়েছি। রাঙাকাকাবাবু যখন জেলের বাইরে ও দেশে থাকতেন, কাজের শেষে অনেক রাতে ঠাকুমার বাড়িতে হাজির হতেন, তার হাতের ডাতে-ভাত খেতে চাইতেন ও গল্প জুড়ে দিতেন। এতই রাত করতেন যে, রাস্তায় পাহারারত পুলিসের ফরেদের বড়ই অসুবিধা হত–বিশেষ করে বর্ষার রাতে। ঠাকুমা রাঙাকাকাবাবুকে বলতেন, অন্তত, ঐ বেচারিদের রেহাই দেবার জন্য বাড়ি ফিরতে।

রাঙাকাকাবাবু বলতেন, কেন, দেশদ্রোহীরা খানিকটা কষ্ট পাক না! ঠাকুমা প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন, বেশির ভাগই সঙ্গে থাকতেন বিধবা পুত্রবধূ সুজাতা দেবী, যাঁকে আমরা কাকিমা বলে ডাকতাম। আমার বেশ মনে আছে, ছেলেবেলায় উডবার্ন পার্কের বাড়িতে আমার টনসিল অপারেশন হল। জ্ঞান হলে চোখ মেলেই দেখলাম, দুজন আমার মাথার কাছে বসে আছেন। একদিকে আমার মা ও অন্যদিকে ঠাকুমা বাসন্তী দেবী।

১৯৩২ সালে বাবা যখন প্রথমবার জেলে যান, তখন ঠাকুমা আমাদের জন্য খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। যখনই পারতেন আসতেন। ঐ সময়কার একটা ঘটনার কথা বললে তোমরা বুঝবে। রাঙাকাকাবাবু বৰ্ম থেকে যখন ফেরেন, তখন একটা সুন্দর বুদ্ধমূর্তি এনেছিলেন। উডবার্ন পার্কের দোতলার দালানে সেটা রাখা হয়েছিল। ঠাকুমা বললেন ঐ বুদ্ধমূর্তি বাড়িতে রাখা চলবে না, এর প্রভাব ভাল নয়, সুভাষ তো সর্বত্যাগী হয়ে গেছেই, সংসারী হয়েও এখন শরৎও সেই পথে গেল, কী জানি এ-পরিবারে আরও কী হয়! তিনি জোর করেই একদিন মূর্তিটি নিয়ে চলে গেলেন ও চিত্তরঞ্জন সেবাসদনের মধ্যে এক মন্দিরে রাখলেন। নেতাজী-ভবনে নেতাজী মিউজিয়ম হবার পর আমি ঠাকুমাকে অনুরোধ করি মূর্তিটি ফিরিয়ে দিতে। এখন সেটি নেতাজী ভবনেই আছে।

মাজননী সম্বন্ধে ঠাকুমার খুব উঁচু ধারণা ছিল। আমাদের বহুবার গর্বের সঙ্গে বলতেন, “জানিস, তোদের মাজননী কী বলেন! বলেন,আমিই নাকি সুভাষের আসল মা, তিনি নাকি কেবল ধাত্রী! বল তো, কটা মা একথা বলতে পারে, বিশেষ করে সুভাষের মতো ছেলে যার আছে।”

১৯৩৩-এর গোড়ায় ঠাকুমা আমাদের সঙ্গে জবলপুর গিয়েছিলেন, জেলে বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। রাঙাকাকাবাবু ইউরোপে চলে যাবেন চিকিৎসার জন্য। বিদায়ের সময় রাঙাকাকাবাবু বেশ খানিকটা কান্নাকাটি করলেন। দেশবন্ধু কেন তাঁকে ‘ক্রাইং ক্যাপ্টেন’ বলতেন বুঝলাম। বাসন্তী দেবী কিন্তু এরকম অবস্থায় নিজের আবেগ খুবই সংযত রাখতেন এবং মোটেই কাঁদতেন না।

অনেকদিন পরের কথা। নেতাজী রিসার্চ ব্যরো তখন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ঠাকুমার কাছে গেলাম, যদি তাঁর কাছে রাঙাকাকাবাবুর চিঠিপত্র কিছু থাকে, দেশবাসীর জন্য আমরা সেগুলি প্রকাশ করতে পারি। খুঁজেপেতে কিছু চিঠি পেলেন। আমাকে বললেন, তিনি

চিঠিগুলি আমাকে দিতে পারেন যদি আমি কথা দিই যে, কপি করে আমি সেগুলি তাঁকে ফেরত দেব। আমি কথা দিলাম। কথামতো আমি পরে একদিন তাঁর কাছে চিঠিগুলি ফেরত নিয়ে গেলাম। আমাকে বলেন, খাওয়ালেন, অনেক গল্পও করলেন। আমি যখন বাড়ি ফিরব বলে উঠে চলে আসছি, আমাকে ফিরে ডাকলেন। চিঠিগুলির বাজটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “তুই আচ্ছা বোকা তো, আমি কি সত্যিই চিঠিগুলি ফেরত নেব নাকি?”

কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল।

জব্বলপুর সেন্ট্রাল জেলের সেগ্রিগেশন ব্লকে আমরা দল বেঁধে বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। ১৯৩৩ সালের গোড়ার কথা। রাঙাকাকাবাবু ইউরোপ চলে যাবেন চিকিৎসার জন্য। আমরা সকলে বাবা ও রাঙাকাকাবাবুকে ঘিরে বসে আছি, হঠাৎ বাবা হাঁক দিলেন, “গিন্নি! গিন্নি!” সকলে অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। মা তো পাশেই বসে আছেন। আসলে বাবা ডাকছেন ধবধবে সাদা খুব সপ্রতিভ একটি পোষা পায়রাকে।

ঠাকুমা, বাসন্তী দেবী রাগের ভান করে বললেন, “শরৎ, এতে আমার ঘোর আপত্তি আছে। আসল গিন্নি পাশে বসে আর তুমি কি না আর কাকে ‘গিন্নি, গিন্নি’ বলে ডাকছ!” খুব একটা হাসির রোল উঠল। বাবা ও রাঙাকাকাবাবু যখন কাজে ডুবে থাকতেন তখন তো কোনোদিকে তাকাবারই সময় থাকত না, পাখি জন্তু-জানোয়ার তো দূরের কথা। জেলে গিয়ে দুজনেরই একটা প্রধান অবলম্বন হত তারা। পশুপাখি ও অন্য কয়েদি সাথীদের নিয়েই যেন তাঁরা সংসার করতেন।

মান্দালয় জেলে রাঙাকাকাবাবুর সংসারে মুরগি, পায়রা, টিয়াপাখি ইত্যাদির একটা বড় দল ছিল। চৌবাচ্চার ধারে সারি দিয়ে ময়ূরপঙ্খী পায়রার দল জল খেতে বসার দৃশ্যও তাঁকে মুগ্ধ করত। বেড়াল তিনি পছন্দ করতেন না। বিশেষ করে যদি বদ রঙের হয়। তবে শুনেছি পূর্ব এশিয়ায় তাঁর একটা পোষা বাঁদরও ছিল, আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কের কাঁধে বসে সে নানা রকম খেলা দেখাত। হয়তো বা মন হাল্কা রাখবার ছিল সেটা একটা উপায়।

জব্বলপুর জেলে আমরা দেখলাম দুই ভাই তো বেশ বড় চিড়িয়াখানা নিয়ে বসে আছেন। পায়রা ও অন্যান্য পাখি ছাড়াও এক পাল খরগোশ রয়েছে। বিচিত্র রঙের। পাখি, খরগোশ ইত্যাদির নাম ধরে রাজবন্দীরা মাঝে-মাঝে ডাকেন আর তারা আমাদের মতো অতিথিদের সম্ভাষণ জানিয়ে যায়।

রাঙাকাকাবাবু তো ইউরোপ চলে গেলেন। মাস কয়েক পরে বাবাকে কার্শিয়াঙে আমাদের গিধাপাহাড়ের বাড়িতে সরকার অন্তরীণ করল। একদল পায়রা ও খরগোশ কলকাতায় আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়িতে স্থানান্তরিত হল। আমিই তাদের ভার নিলাম বলা যায়। তবে কার্শিয়াঙে গিয়ে বাবার অন্য রকমের শখ হল। নানা জাতের পাহাড়ি কুকুর সংগ্রহ করলেন তিনি। দার্জিলিঙের পুলিসের কতা মাঝে-মাঝে বাবার তদারকি করতে

Sb

আসতেন। সাহেবের সঙ্গে বেড়াতে-বেড়াতে বাবা “কোলসন্! কোলন?” বলে হকিতে লাগলেন, আর সাহেবের মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একটা ছোটখাট সুন্দর পাহাড়ি কুকুর লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এল। কোলসন্ সাহেব তখন কলকাতার পুলিস কমিশনার! পরে আবার “কাউন্টেস! কাউন্টেস!” বলে বাবা ডাক দিলেন। খুব লোমশ আহ্লাদী চেহারার একটি কুকুর সানন্দভাবে লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে এল। তখন। ভারতের বড়লাট-পত্নী ছিলেন কাউন্টেস অব উইলিংড়ন।

কুকুরেই গল্পটি শেষ নয়। এক পাহাড়ি কাঠুরে জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে ভালুকের ছানা। কুড়িয়ে গেল। আমাদের বাড়িতে এসে সেটি সে বাবার হাতে সঁপে দিয়ে গেল। আমরা যখন তাকে প্রথম দেখলুম সে তখন খুবই ঘোট, বোতলে দুধ খায়। আমার কিন্তু বেশ মনে আছে, সেই ছোট অবস্থাতেও ভালুকটি এমন চেপে পা জড়িয়ে ধরত যে ছাড়ানোই দায়। বড় হলে তার জন্য খাঁচা তৈরি হল। বাবার মুক্তির পর খাঁচাবন্দী অবস্থায় তাকে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে আনা হল। কিন্তু তখন সে বেশ হিংস্র হয়ে উঠেছে। পশু-বিশেষজ্ঞরা তাকে বাড়িতে রাখা ভাল মনে করলেন না। সুতরাং বাবা তাকে আলিপুরের চিড়িয়াখানায় উপহার দিলেন।

এতক্ষণ তো বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর জেল-জীবনের হাল্কা দিকটাই বলছিলাম। কিন্তু এ-বিষয়ে আরও অনেক কিছুই বলার আছে। তোমরা তো জানো রাঙাকাকাবাবু বর্মার জেলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মুক্তির জন্য যেমন দেশে আন্দোলন চলছিল, তেমনি বাবা ও ইংরেজ সরকারের মধ্যে নানা রকম প্রস্তাব ও পাল্টা প্রস্তাব নিয়ে লেখালেখি চলছিল।

রাঙাকাকাবাবুর কারা-জীবন বৈচিত্র্যময়। প্রথমবার ১৯২১-২২ সালে তিনি জেলে যান দেশবন্ধুর সঙ্গে, ছিলেন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। সবসুদ্ধ এগারো বারোবার তিনি জেলে গিয়েছেন। শেষবার ১৯৪০ সালে তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্সি জেলে। রাজবন্দী হিসাবে তিনি ও বাবা নীতিগত ব্যাপারে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে কখনও আপোস করেননি। যেমন রাজনৈতিক জীবনেও তাঁরা যেটা ঠিক পথ বলে মনে করতেন সেটা থেকে কখনও সরে আসতেন না। অবশ্য এই কারণে সরকারের বিরুদ্ধে এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের সঙ্গে কতবার তাঁদের প্রচণ্ড লড়াই করতে হয়েছে, কতবার তাঁরা কোণঠাসাও হয়েছেন। সাধারণভাবে রাঙাকাকাবাবু বলতেন যে, জেলে ইংরেজ অফিসারদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব দেখালেই কাজ দেয় বেশি। তাছাড়া, আমার মনে হয় যে, জাতির দাসত্ব যেমন তাঁর কাছে অসহ্য ছিল, তেমনি নিজের ব্যক্তিগত বন্দিদশাও তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না। ফলে, জেলে গেলেই তাঁর শরীর ভেঙে পড়ত। রাজবন্দীদের দাবিদাওয়া নিয়ে তিনি জেলের ভেতরে যে লড়াই চালাতেন তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জয়ী হতেন। তিনি। জেলে থাকার সময় তিনি দু’বার অনশন করেছিলেন। একবার মান্দালয় জেলে দুর্গাপূজা করার অধিকার ইত্যাদি প্রশ্নে, আর-একবার ১৯৪০ সালে প্রেসিডেন্সি জেলে মুক্তির দাবিতে। দুবারই শেষ পর্যন্ত সরকারকে তাঁর দাবি মেনে নিতে হয়েছিল।

তিনি যখন বময় খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং সরকারি ও বেসরকারি ডাক্তাররা যখন একমত হলেন যে, তাঁর জীবন বিপন্ন তখন ইংরেজ সরকার তাঁর মুক্তি ও চিকিৎসার ব্যাপার নিয়ে নানারকম শর্তের কথা তুলতে লাগলেন। যেমন ভারতের মাটি না ছুঁয়ে তিনি যদি

Censored and we

mo.i.

614

منه ومعلمه

1 B, C I.D.

Bangal.

1.3.4.

My dean ho this

I do not know whellien you have received an lead– few bellen. I puspread upeine from mentioning and thing scß about the shiks ticams. I was afraid has they who

withheld and you would be just to anxiely, then what han athen I was not inone in anticipating net my bellis would to withheld Ý his antacid an ens about the shik.

a 27..4 I received a un ling telyan at

SUB

about 5 mm. and sent the reps & expren at ones. luß I do an d when it reached om.

I am weak ho ana Minie na a ku; м сам– х., As, Interned. I had heained and brain honth in the

Pind few days but ren to the parach hang

accentomes 6 the fact. I am keeping bag was In you as I can, i nic to conseny energ. The

shine still continues and will do so for some time to come. Until in the from me that I hans hoke my fact you can take it for pants that the smice s conto

Hot wat nithe a punch of salt sa

• great sustain. I to get readache and dizjniens

ও বাবাকে সে,মালয় থেকে রাঙাকাকাবাবুর চিঠি-১৯২৬

সুইজারল্যাণ্ড চলে যান তাহলে তাঁরা রাজি। অথবা তিনি যদি কারও সঙ্গে দেখা বা যোগাযোগ না করে আলমোড়ায় অন্তরীণ থাকতে রাজি হন তাহলেও তাঁরা তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেন। এ ধরনের সব শর্তই তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।

শেষ পর্যন্ত ১৯২৭ সালের গোড়ায় যখন সরকার ঠিক করলেন যে রাঙাকাকাবাবুকে দেশে ফিরিয়ে আনবেন তখনও তাঁরা ঠিক করে বসু-পরিবারকে জানালেন না যে তাকে নিয়ে তাঁরা ঠিক কী করতে চান। কলকাতায় তাঁকে ফিরিয়ে এনে গভর্নরের লঞ্চে গঙ্গার বুকে তাঁকে বন্দী করে রাখলেন, যেন তাঁরা তাঁকে নদীর নির্মল বাতাস খাওয়াচ্ছেন। হঠাৎ দার্জিলিঙ থেকে গভর্নরের আদেশ এল তাঁকে তাঁরা মুক্তি দিচ্ছেন। তার আগেই আমরা গঙ্গার ঘাট থেকে নৌকো করে লঞ্চে গিয়ে দল বেঁধে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছি।

মুক্তির পর তাঁকে ৩৮/১ এলগিন রোডের বাড়িতে ভোলা হল। সেখানেই বাবা-মায়ের সঙ্গে আমরা থাকতাম। সেই প্রথম ডাক্তার বিধান রায়কে দেখলাম। বাড়ির দোরগোড়ায় পা দিলেই জানা যেত ডাক্তার রায় এসেছেন। ভারী গলায় খুব হাঁকডাক করতেন। ডাক্তার রায় ও আমাদের নতুন কাকাবাবু সুনীলচন্দ্র একসঙ্গে রাঙাকাকাবাবুকে দেখতেন। প্রয়োজন-মতো স্যার নীলরতন সরকার ও কবিরাজমশাই শ্যামাদাস বাচস্পতির পরামর্শ নিতেন।

ওই সময় থেকেই বাড়ির ও রাঙাকাকাবাবুর সব কথা আমার মোটামুটি ভাল মনে আছে। ডাক্তারদের পরামর্শে কিছুদিন পবেই তাঁকে শিলং নিয়ে যাওয়া হল। শিলঙে বাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে খেলাধূলা ও গান গাওয়ার গল্প তোমাদের আগেই বলেছি। দাদাভাই, মাজননী এবং বাড়ির অনেকেই সেই সময় শিলঙে গিয়েছিলেন। ১৯২৭ সালে শিলঙে বসুবাড়ির জমায়েত বেশ একটা বড় ঘটনা। রাঙাকাকাবাবুই ছিলেন জমায়েতের মধ্যমণি। ছেলেমেয়েদের পুরো দলটিই ছিল তাঁর হেফাজতে। কার স্বাস্থ্য ভাল করার জন্য কী কী করা দরকার তিনি বলে দিতেন। কাকে মোটা করতে হবে,কে বড়ই মোটা সুতরাং খাওয়া কমিয়ে এবং দৌড় করিয়ে রোগা করতে হবে ইত্যাদি। দুঃখের বিষয় আমিই শিলঙে বেশ লম্বা জ্বরে পড়লাম এবং অনেকদিন শয্যাগত ছিলাম। সেই সময় ডাক্তার বিধান রায়ের শিলঙে বাড়ি ছিল এবং তিনিই আমার চিকিৎসা করেন। আমার মনে আছে, যখন পথ্য দেবার সময় হল, ডাক্তার রায় তাঁর ভাবী গলায় বললেন, “এখন তোকে আমি সব খেতে দিতে পারি। কী খাবি বল? খাট খাবি? আলমারি খাবি? টেবিল খাবি? চেয়ার খাবি?” কথাগুলি শুনেই আমি বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলাম!

সে সময় জানতাম না জেলে যাওয়া-আসা আমাদের পারিবারিক জীবনের একটা অঙ্গ হয়ে দাঁড়াবে। বাবাকে যে শেষ পর্যন্ত ওই পথেরই যাত্রী হতে হবে, রাঙাকাকাবাবু বোধ করি আগেই বুঝেছিলেন। তিরিশের দশকে মহাত্মা গান্ধী আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দেবার কিছুদিন আগে থেকেই রাঙাকাকাবাবু মাকে মাঝে মাঝে বলতেন বাবাকে যদি দেশের কাজে জেলে যেতে হয়, মা সবকিছু সামলে নিতে পারবেন তো?

আরও বলতেন, মা যেন নিজেকে মনে-মনে দুঃসময়ের জন্য প্রস্তুত করে রাখেন। আমার মা শেষ পর্যন্ত বাংলার শত শত মায়েদের দুঃখ-দারিদ্র্যের ভাগী হয়েছিলেন।

॥ ১০

বময় রাজবন্দী থাকতেই রাঙাকাকাবাবু বাংলার লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সভ্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, উত্তর কলকাতা কেন্দ্র থেকে। নির্বাচনের সময় খুব উত্তেজনা, সেই উত্তেজনার কিছু আঁচ আমাদের মতো শিশুদের গায়েও লেগেছিল। একটা পোস্টার এখনও মনে আছে রাঙাকাকাবাবুর ছবির সামনে জেলের গরাদ আঁকা। মা ছোটদেরও দু-একটা নির্বাচনকেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের ‘উইলিস নাইট’ গাড়ি সামনে ও পেছনে রাঙাকাকাবাবুর জেলবন্দী মাকা ছবি নিয়ে ঘুরছে, এখনও বেশ মনে পড়ে। রাঙাকাকাবাবুর বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন একজন নরমপন্থী কিন্তু বেশ প্রভাবশালী ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ যতীন্দ্রনাথ বসু। রাঙাকাকাবাবুর বেশ বড় রকমেরই জিত হল। ফল ঘোষণার রাত্রে কলকাতায় আতশবাজি পুড়িয়ে বিজয়োৎসব হল, আকাশে বিশেষভাবে তৈরি হাউই উঠল–আলোর অক্ষরে লেখা “সুভাষচন্দ্রের জয়”।

আগেই তো বলেছি মুক্তিলাভের কিছুদিন পরে রাঙাকাকাবাবুকে শিলং নিয়ে যাওয়া হল স্বাস্থ্য ভাল করার জন্য। কিন্তু দেশে বিদেশে যেখানেই থাকুক না কেন, এবং স্বাস্থ্য যত খারাপই হোক না কেন, রাঙাকাকাবাবু কখনই মানসিক বিশ্রাম নিতেন বলে মনে হয় না। শিলঙের ‘কেলসাল লজ’-এ তাঁর শোবার ঘরে অনেক রাত পর্যন্ত আলো জ্বলে, এটা অনেকের নজরে পড়ল, বিশেষ করে মাজননীর। বই পড়া, চিঠি লেখা ছাড়াও বিধানসভার জন্য নানা রকম প্রশ্ন তৈরি করা ইত্যাদি অনেক কাজ। তাঁকে বলা হল, স্বাস্থ্য ভাল করতে এসে এত রাত জাগা চলবে না। সুতরাং রাঙাকাকাবাবুকে একটা উপায় বের করতে হল। রাত্রে অন্য ঘরগুলির লাগোয়া সব দরজার ফাঁকগুলি কাপড় খুঁজে বন্ধ করে রাখতেন, যাতে

তাঁর ঘরের আলো কেউ দেখতে না পায়।

রাঙাকাকাবাবু যে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেন সেটা সকলেই জানত। পুলিসও জানত। ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর গোপন গৃহত্যাগের রাত্রে আমরা ব্যাপারটিকে কাজে লাগিয়েছিলাম পুলিসকে ধোঁকা দেবার জন্য। রাঙাকাকাবাবু আমাদের বোন ইলাকে বলে গিয়েছিলেন যে, আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অন্তত এক ঘন্টা পর পর্যন্ত যেন। তাঁর ঘরের আলো জ্বলে। তাহলে যদি পুলিসের চরেরা তাঁর ঘর নজর করে, তারা মনে করবে যে, সুভাষবাবু তাঁর নিয়মমতো বেশি রাত পর্যন্ত কাজ করছেন।

আলো অন্ধকার নিয়ে আর একটা গল্প এখানে বলতে পারি। রাঙাকাকাবাবুর অন্তর্ধানের পর প্রায়ই কাজের শেষে এবং বেশ রাতে বাবা আমাকে তাঁর দোতলার শোবার ঘরে ডাকতেন। আমি শুতাম তিনতলায় রাস্তার দিকের ঘরে। শীতের রাতে মশারির ভিতরে বসে বাবা আমার সঙ্গে অনেক কথাবার্তা বলতেন। বিশেষ গোপনীয় কোনো কথা যখন দু-চারজন লোককে মনের মধ্যে আগলে রাখতে হয়, তখন নিজেদের মধ্যে খবর আদান-প্রদান ও আলোচনা করলে মনটা খানিকটা হাল্কা হয়। কথাবাতা শেষ হলে বাবা আমাকে বলতেন আমি যেন তিনতলার কোনো আলো না জ্বালিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি। তিনি চাইতেন না যে, রাস্তায় যে পুলিসের চরেরা টহল দেয়, তাদের সন্দেহ হয় যে, আমি বেশি রাত পর্যন্ত কোনো কাজে লিপ্ত আছি।

বড় কাজ হাতে নিয়ে আমরা কেমন আলো-আঁধারের নানারকম খেলা খেলতাম!

রাঙাকাকাবাবু কলকাতা ফেরার কিছু আগেই মা আমাদের নিয়ে শিলঙ থেকে চলে এলেন। ১৯২৭-এর শেষের দিকে। জেলে থাকতে তো রাঙাকাকাবাবু অন্য রকমের সংসাব পেতে বসতেন–একদিকে থাকত কয়েদীরা তাদের সুখ-দুঃখ নিয়ে, অন্যদিকে থাকত পশুপাখির দল। যখন জেলের বাইরে থাকতেন, তখন তিনি সব সময়েই চাইতেন

যে, বাড়ির ছেলেমেয়েরা তাঁকে ঘিরে থাকে। শুনেছি আমি জন্মাবার আগে এলগিন রোডের বাড়িতে তিনি ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে লুকোচুরি খেলতেন। এও শুনেছি, তিনি প্রায়ই চিলের ছাদে উঠে লুকিয়ে বসে থাকতেন। শিলঙে রুগ্ন শরীর নিয়েও আমাদের সঙ্গে খেলতে খেলতে তিনি যেভাবে পাকদণ্ডি দিয়ে ওঠানামা করতেন, তাতে আমাদেরও ভয় করত।

মা আমাদের নিয়ে আগে কলকাতায় ফিরে আসায় রাঙাকাকাবাবুর বেশ মন খারাপ হয়েছিল। মাকে শিলঙ থেকে লিখলেন, “আপনারা সকলে হঠাৎ চলে যাওয়াতে–একটু মুশকিলে পড়েছিলুম। খালি বাড়িটা খাঁ-খাঁ করতে লাগল–মনটা কেমন করে উঠল–দৈনন্দিন জীবনের খেইগুলো যেন কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেল–একটু কষ্ট হয়েছিল বললে অত্যুক্তি হবে না। যাই হোক, মা’র তখন অনেক কাজ। উডবার্ন পার্কে বাবাব নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। সময়মতো পুরো সংসারটা গোছগাছ করে তুলতে হবে। আর নতুন জায়গায় সাজিয়ে বসাতে হবে। ধাপে-ধাপে নতুন কোনো জিনিস তৈরি হওয়া, যেমন বাড়ি তৈরি, দেখতে বেশ একটা মজা আছে। আমরা তো অবাক হয়ে দেখতাম। ১৯২৮ সালে বাবার বাড়ি সম্পূর্ণ হল। সেকালের অনেক বড় বড় বাড়ির তুলনায় সব দিক দিয়ে ১ নং উডবার্ন পার্কের একটা নতুনত্ব ছিল। বাবা বাড়ির পরিকল্পনা আধুনিক ঢঙে করেছিলেন, উঁচু দরের মালমশলাও ব্যবহার করা হয়েছিল। তুলনায় এলগিন রোডের পুরনো বাড়িটা ছিল নেহাতই সেকেলে। ঘটা করে গৃহপ্রবেশ হল। রাঙাকাকাবাবু আমাদের সঙ্গে ৩৮/১ এলগিন রোড থেকে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে উঠে এলেন। তিনতলার পূর্বদিকের ঘরটা তাঁকে দেওয়া হল শোবার জন্য, একতলার পশ্চিমের ঘর তাঁর অফিস। খাওয়া-দাওয়া হত দোতলার দক্ষিণের বারান্দায়। একতলার বেশির ভাগটাই বাবার কাজের জন্য লাগত।১ নং উডবার্ন পার্কের মতো বাড়িতে বাস করার ফলে আমাদের চাল বিগড়ে যেতে পারে বলে অনেকেরই আশঙ্কা হয়েছিল! ১৯৪৪ সালে আমি যখন লাহোর দুর্গের নির্জন সেলে বন্দী, ফোর্টের ভারপ্রাপ্ত অফিসার ঠাট্টার সুরে একদিন বললেন, “তুমি তো উডবার্ন পার্কের সেই ‘প্যালেসে থাকো, না? তোমার তো দেখছি তাহলে এখানে পোষাবে

! পালাবার জন্য সুড়ঙ্গ কাটতে আরম্ভ করো না কেন? তবে বলে রাখি, পালাতে পারলে বেঁচে গেলে, ধরা পড়ে গেলে কিন্তু গুলি করে দেবার হুকুম আছে।”

বসু বাড়ির অনেক কথা বেশ কয়েকটি বাড়িতে ছড়িয়ে আছে। বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর কর্মজীবন ৩৮/২ এলগিন রোড (আজকের নেতাজী-ভবন) ও ১ নং উডবার্ন পার্ক জুড়ে রয়েছে। শরৎ-সুভাষের জীবন যেমন একে অন্যটির পরিপূরক, এই দুটি বাড়িও ঠিক তাই। তাছাড়া রয়েছে কার্শিয়ঙে গিধাপাহাড়ে বাবার ছোট্ট বাড়িটি। যার ইতিহাসও খুবই সমৃদ্ধ। অনেক পরে বাবা রিষড়ায় একটা সুন্দর বাগানবাড়ি করেছিলেন। তার ঐতিহাসিক গুরুত্বও কম নয়। যদি আরও পুরনো দিনে চলে যাই, তাহলে কটকের জানকীনাথ-ভবন ও ৩৪

1, Tondbum Park. OFFICE OF THE GENERAL SECRETARY

RECEPTION COMMITTEE

36. WELLINGTON STREET. Calcutta, the 3rd Decouhor, 1988

REF. NO. Sop

১ + 337 368 My dear Hahatmaji,

I am forwarding to you a lottor from a young friend who is anxious to attond on you during your stay in Calcutta. I do not know if you still romembor him but ho attended on you on sovoral occasions. I desire to havo your instructions 28 to what I should tell him in reply.

I shall be grertly obliged if you #111 kindly let me know how many Voluntaore you would require for your camp together with thoir qualifications. It would also hole us if you could inform us as to how many membore thoro will be in your party. with profound regards

I wa, Youre me larte

6, a %%

17, t (; • :}}

মহাত্মা গান্ধীকে লেখা রাঙাকাকাবাবুর চিঠি দাদাভাইয়ের পুরীর বাড়ি জগন্নাথধামের কথা ভুললে চলবে না।

১ নং উডবার্ন পার্কের প্রতিষ্ঠা একটি বড় ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে যেন যুক্ত হয়ে আছে। ঐ বাড়িতে প্রবেশ করার পর থেকেই বাবা ও রাঙাকাকাবাবু ১৯২৮ সালের কলকাতা কংগ্রেসের অধিবেশনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। রাঙাকাকাবাবু ঐ কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবকদের জেনারেল অফিসার কম্যাণ্ডিং রূপে আমাদের জাতীয় জীবনে ও মুক্তি আন্দোলনে এক নতুন নজির সৃষ্টি করেন। বাবা ছিলেন অভ্যর্থনা সমিতির কোষাধ্যক্ষ। মা তো সব সময়েই বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর সব কাজের সাথী। বাড়ির যে-সব ছেলেমেয়ে গান গাইতে পারত, তারা গানের দলে যোগ দিয়েছিল। গানের দলের ভার নিয়েছিলেন সরলা

দেবী চৌধুরানী। মনে আছে, সেই উপলক্ষেই তিনি নিয়মিত উডবার্ন পার্কে যাওয়া-আসা আরম্ভ করেন। মহিলা স্বেচ্ছাসেবিকাদের অধিনায়িকা লতিকা ঘোষও প্রায়ই আসতেন। সব কিছু মিলে আমাদের উডবার্ন পার্কের নতুন বাড়ির প্রথম বছরটা যেন ছিল–”দি ইয়ার অব

দি ক্যালকাটা কংগ্রেস’।

রাঙাকাকাবাবু স্বেচ্ছাসেবকদের কী কঠোর ও কঠিন শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন, তখন তা বুঝতে না পারলেও পরে জেনেছি। যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা আজও বলেন যে, কলকাতা কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবকদের শৃঙ্খলা ও কর্মকুশলতা আজও তুলনাহীন। পুরোপুরি সামরিক কায়দায় শিক্ষিত ঐ দল ভিন্ন-ভিন্ন বিভাগে সংগঠিত হয়েছিল, যেমন অশ্বারোহী, সাইকেল-আরোহী, পদাতিক ইত্যাদি। কংগ্রেসের সভাপতি পণ্ডিত মতিলাল নেহরুকে নিয়ে যে শোভাযাত্রা হয়, সেটা আমরা ছোটরা ওয়েলিংটন স্ট্রীটে আমাদের লালদাদাবাবুর বাড়ির ছাদ থেকে দেখেছিলাম। স্বাধীনতার আগে এ-ধরনের সামরিক বা আধা-সামরিক শোভাযাত্রা আর হয়নি। রাঙাকাকাবাবু সামরিক পোশাকে একটি মোটরগাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে বেটন হাতে শোভাযাত্রা পরিচালনা করেছিলেন। সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য।

পার্ক সাকাস ময়দানে কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। পাশেই একটা বড় ধবনের একজিবিশন ছিল। এখনও মনে আছে, প্রদর্শনীতে আমাদের জাতীয় জীবনের নানা ঘটনার চলমান মডেল দেখাবার ব্যবস্থা হয়েছিল।

প্রায়ই আমাদের কংগ্রেস-প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হত। সভা-মণ্ডপে বা প্রদর্শনীতে। ফলে ভবিষ্যতের ও স্বপ্নের স্বাধীন ভারতের কিছু স্বাদ ও স্পর্শ যেন তখন থেকেই আমরা পেতে আরম্ভ করেছিলাম। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, রাঙাকাকাবাবুই ঐ কংগ্রেসে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলেন, গান্ধীজির ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত শাসনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে। ভারতের নবজাগ্রত যুবশক্তির বত্রিশ বছরের নেতার প্রস্তাব অল্প ভোটেই অগ্রাহ্য হয়ে যায়।

॥ ১১ ॥

আমি জীবনে কখনও বাবার কাছে বকুনি খাইনি। ছেলেমেয়েদের শাসনের ভারটা ছিল মা’র উপর এবং শাসনও ছিল বেশ কড। এর মানে এই নয় যে, বাবা আমাদের উপর নজর রাখতেন না। তাঁর কর্তৃত্বের ধরনটা ছিল আলাদা। কিছুই তাঁর চোখ এভাত না। কোর্ট থেকে ফিরে স্নান সেরে দোতলার দক্ষিণের বারান্দায় বাবা খানিকটা বিশ্রাম নিতেন। কাজে নীচে নেমে যাবার আগে প্রায়ই আমাদের পড়ার ঘরের দরজাটা একটু ঠেলে মুচকি হেসে ছেলেমেয়েদের উপব চোখ বুলিয়ে নিতেন। এটাই ছিল যথেষ্ট। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কিন্তু মা’র হুকুমই ছিল শেষ কথা। দশ-বারো বছর বয়স পর্যন্ত মাকে বেশ ভয় করতাম, তার পর সম্পর্কটা বদলে গেল। তিরিশের দশকে আইন অমান্য আন্দোলনের সময় বাবা জেলে যাওয়াতে আমরা যেন একটু তাড়াতাড়িই সাবালক হয়ে উঠলাম, কম বয়সেই বাড়িব নানা

রকম দায়িত্ব আমাদের উপর এসে পড়ল। মাও সেটা স্বচ্ছন্দে মেনে নিলেন।

উডবার্ন পার্কের বাড়ির সব কিছুই খুব নিয়ম ও শৃঙ্খলায় চলত। বাবা খাপছাড়া ও অগোছালো অভ্যাস পছন্দ করতেন না। মাও দেখতেন যাতে কোনো দিক দিয়েই কোনো ঢিলেমি না হয়। সবকিছুই যন্ত্রের মতো চলত, কোনো কিছু বিগড়োলে তৎক্ষণাৎ সেটা

শুধরে নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এলগিন রোডের সাবেক বাড়ির তুলনায় উডবার্ন পার্কের বাড়ি, কেবল চেহারায় নয়, জীবনযাত্রার সব দিক থেকে অনেক আধুনিক ও প্রগতিশীল ছিল। ঐতিহ্য ও প্রগতি মিশিয়ে মা ও বাবা সংসারে বেশ একটা স্বাচ্ছন্দ্য এনেছিলেন। রাঙাকাকাবাবু ১৯৩৭ থেকে ১৯৪১-এর জানুয়ারি পর্যন্ত এলগিন রোডের বাড়িতে ছিলেন। সেই সময়েও তাঁর যখন কোনো বিশেষ অতিথি বা বিশেষ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন হত, তখন তিনি উডবার্ন পার্কে ব্যবস্থা করতে বলতেন। অতিথিসকারের ব্যাপারে তিনি খুঁটিনাটি নিজেই দেখতেন ও জানতে চাইতেন। মনে আছে একবার কোনো বিশেষ বিদেশী অতিথিকে তিনি উডবার্ন পার্কের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছেন। আমাকে বললেন মাকে জানিয়ে আমি যেন ব্যবস্থার ভার নিই। সব ঠিক আছে–রিপোর্ট দিতে আমি যখন তাঁর কাছে হাজির হলাম, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন কটা ও কী কী

পদ রান্না হচ্ছে। আমি উত্তর দিতে না পারায় তিনি দমে গেলেন।

উডবার্ন পার্কের বাড়িতে উঠে আসবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কিণ্ডারগার্টেন ছেড়ে আমার বড় স্কুলে যাওয়ার সময় হল। তখন সচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেরা বেশির ভাগই বিদেশী মিশনারি স্কুলে পড়ত। বিশেষ করে বিলেত-ফেরত বারিস্টার-ডাক্তারদের ছেলেরা তো বটেই। আমরা ছিলাম ব্যতিক্রম। আমি আমার দাদাদের মতো সাউথ সুবাবান স্কুলে ভর্তি হলাম। ডায়োসিশান স্কুলের অন্তরঙ্গ পরিবেশ থেকে সাউথ সুবার্বান স্কুলের সমুদ্রে পড়ে আমি তো বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। স্কুলে যেতে বেশ ভয়-ভয় করত। আজ বলতে বাধা নেই যে, সাউথ সুবাবানে প্রথম কয়েক বছর মনে মনে আমি বেশ অসুখী ছিলাম। আসল কথা, নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারিনি। যাই হোক, সমাজের সব স্তরের ছেলেদের সঙ্গে মেশবার ও একসঙ্গে লেখাপড়া করবার এই অভিজ্ঞতাটা আমাদের প্রয়োজন ছিল। অবশ্য বসুবাড়ির ছেলে বলে মাস্টার মশাইরা ও সতীর্থরা। আমাদের একটু বিশেষ চোখে দেখতেন। উপরের ক্লাসে ওঠার পর ধীরে-ধীরে আমার মনের জড়তা অনেকটা কেটে গেল। তাছাড়া উপরের ক্লাসের মাস্টার মশাইরা বেশ দক্ষ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন এবং লেখাপড়ায় বেশ একটা নতুন স্বাদ এনে দিয়েছিলেন। আমাদের বাড়ির মাস্টার মশাই ফণীন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত আমার সব ভাইবোনেদের একে একে পড়িয়েছিলেন। শক্ত শক্ত অঙ্ক ফণীবাবু এত সহজে কষে ফেলতেন যে, আমি অবাক হয়ে যেতাম। আমি স্কুলে ফল মোটামুটি ভালই করতাম। কিন্তু ফণীবাবুর আশা ঠিক পূর্ণ করতে পারতাম বলে মনে হয় না। পরীক্ষার ফল বেরোলে মা সেই রিপোর্ট সই করাতে বাবার কাছে পাঠিয়ে দিতেন। বাবা রিপোর্ট ভাল করেই দেখতেন। তবে বিশেষ কোনো মন্তব্য না। করে সই করে দিতেন।

আজকালকার ছেলেমেয়েরা বোধহয় শুনে আশ্চর্য হবে যে, আমরা বাবা ও মা দুজনকেই ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতাম। জ্যাঠা, কাকা, জ্যাঠাইমা, কাকিমাদের বেলায়ও তাই। বয়সের ফারাকটা বেশি হলে বাবাদের জেনারেশনে ছোটরা বড় ভাইবোনেদেরও ‘আপনি বলত, আমরাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বলতাম। রাঙাকাকাবাবু বাবার সঙ্গে ‘তুমি’ বলেই কথা বলতেন। মাকে ‘আপনি’। সম্বোধনের ধরনটা আজকালকার মতো না হলেও অন্তরঙ্গতা কমত না। বরং আমার বিশ্বাস পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভাব বেশি বই কম ছিল না।

খেলাধুলোর ব্যাপারে আমরা উৎসাহ পেতাম কম। বিশেষ করে ময়দানের

৩৭

প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলো নিয়ে হুজুগ বাবা বেশ অপছন্দ করতেন। তিনি প্রায়ই ঠাট্টা করে বলতেন, কোর্ট থেকে ফেরার পথে প্রায়ই দেখি বাইশ জন লোক একটা বল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে, আর কয়েক হাজার লোক তাই নিয়ে উত্তেজিত হয়ে লাফালাফি করছে, এর আবার মানে কী! তবে রাঙাকাকাবাবুর উদ্যোগে আমাদের শারীরিক ব্যায়াম ও খেলাধুলোর অন্য রকম ব্যবস্থা পাকাপাকিভাবে বাড়ির ছাদে হয়েছিল। সাধারণ ব্যায়াম, লাঠি ও ছোরা খেলা, যুযুৎসু ইত্যাদি শেখবার জন্য একজন শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর নাম দিগেন্দ্রচন্দ্র দেব। পূর্ববঙ্গের মানুষ, শরীরে অসম্ভব শক্তি। তাঁর ওয়েট লিফটিং দেখে আমরা তাজ্জব বনে যেতাম। রাঙাকাকাবাবু এই ধরনের শিক্ষা দেশের কাজে প্রস্তুতি হিসাবে আমাদের নিতে বলতেন। দিগেনবাবুর সাহায্যে রাঙাকাকাবাবু আরও কয়েকটি জায়গায় ছেলেমেয়েদের সংঘ বা ক্লাব গড়ে তোলেন এবং আত্মরক্ষার নানা রকম শিক্ষার প্রসারের সাহায্য করেন। আমরাও মাঝে মাঝে নানা অনুষ্ঠানে যেতাম এবং লাঠি ও ছোরাখেলার প্রতিযোগিতায় যোগ দিতাম। আমাদের বাড়ির ছাদেও বার্ষিক অনুষ্ঠান হত। মনে পড়ে লাঠির দুধারে আগুন লাগিয়ে আমাকে লাঠি ঘোরাতে হত। অনুষ্ঠানের শেষে দিগেনবাবু ফ্রী ফাইটে চ্যালেঞ্জ করে আমাকে বেশ নাস্তানাবুদ করতেন।

দিগেনবাবু ছিলেন কট্টর জাতীয়তাবাদী। মনে আছে, দেশ ভাগ হওয়ার আগে একবার আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। বলেছিলেন তিনি পৈতৃক ভিটে ছাড়বেন না। আরও বলেছিলেন, দেশ ভাগ করছ করো, আমাদের জলে ফেলে দিচ্ছ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কালাপাহাড় হয়ে ফিরে এসে তোমাদের শায়েস্তা করব!

বাড়ির কয়েকটি পার্শ্বচরিত্র সম্বন্ধে না বললে গল্পটা জমে না। একজনের কথা প্রথমে বলি, যিনি আমাদের সঙ্গেই উডবার্ন পার্কে বেশ কয়েক বছর ছিলেন। তিনি হলেন বাবার এক মামা, আমাদের রাঙাদাদাবাবু বীরেন্দ্রনাথ দত্ত। রাঙাকাকাবাবু থাকতেন তিনতলায় পূবের ঘরে, আর রাঙাদাদাবাবু থাকতেন তিনতলার পশ্চিমের ঘরে। খুব মজাদার লোক, পুরোপুরি সাহেব ও খুব শৌখিন। তাঁর কর্মকুশলতার জন্য তাঁকে দেশবন্ধু-প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড পত্রিকার ম্যানেজার করা হয়েছিল। কাজকর্ম তিনি ভালই করতেন এবং বাড়ির যে-কোনো বড় কাজকর্মে তিনি ম্যানেজারি করতে ভালবাসতেন। সাহেবি পোশাক তাঁর যে কেবল প্রিয় ছিল তাই নয়, ছিল পুরোপুরি কেতাদুরস্ত। বাবা যে কোর্টেও খদ্দরের সুটি পরতেন, সেটা ছিল রাঙাদাদাবাবুর মতে সম্পূর্ণ অচল। আমাদের বাড়িতে একটা কথা খুব চলত, এবং অনেকের নামের সঙ্গে লাগিয়ে দেওয়া হত-বি এন জি এস। মানে ‘বিলেত না গিয়ে সাহেব’। রাঙাদাদাবাবু একজন প্রকৃত বি এন জি এস ছিলেন। স্বদেশিয়ানার তিনি ধার ধারতেন না। দত্ত-সাহেব’ খেতে বসতেন একটা বড় গোছের বিব’ পরে, যাতে দেশী ঢঙে খেতে গিয়ে তাঁর সাহেবি পোশাক নষ্ট না হয়। তিনি অফিস থেকে ফিবে ভাল সিল্কের জামাকাপড় পরে যখন নীচে নামতেন, তখন উৎকৃষ্ট বিলিতি সেন্টের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ত। ছোটদের সঙ্গে তাঁর বনত ভাল, কারণ ভাল চকোলেট, বিস্কুট, কেক ইত্যাদি তিনি আমাদের মাঝেমাঝেই সরবরাহ করতেন। সাকাস দেখতে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানাভাবে তিনি আমাদের মন ভিজিয়ে রাখতেন। রাঙাদাদাবাবু অসুখ করলে কিন্তু ধৈর্য হারাতেন। একবার তো মাঝরাতে পেটে ব্যথা হওয়াতে মহা শোরগোেল আরম্ভ করলেন। ডাক্তারকাকা সুনীলচন্দ্র এলগিন রোডের বাড়িতে থাকেন। রাঙাকাকাবাবু তো বাধ্য হয়ে মাঝরাতে

৩৮

বেরোলেন। কিন্তু এলগিন রোডের বাড়ির গেট বন্ধ, অনেক হাঁকডাক করেও কিছু হল না। তখন সুভাষচন্দ্র বসু পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢুকলেন, পেছনের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ডাক্তারভাইকে তুললেন। বললেন,”শিগগির চলো, সতী (তাঁদের অসুস্থ ছোট ভাই সন্তোষচন্দ্র) তো বাড়ি কাঁপায়, রাঙামামাবাবু পাড়া কাঁপাচ্ছেন।”

স্বরাজ সম্বন্ধে রাঙাদাদাবাবুর নিজস্ব একটা ধারণা ছিল এবং আমাদের জন্য একটা বাণী ছিল। তিনি আমাদের প্রায়ই বলতেন, “দেখ, তোদের ঐ স্বরাজ হবার দু-একদিন আগে আমাকে খবর দিস যাতে আমি ঠিক সময়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশত্যাগ করতে পারি।”

॥ ১২ ॥

উডবার্ন পার্কে উঠে আসার পর থেকেই বোঝা গেল বাঙাকাকাবাবু মাকে দেশের কাজে ধীরে-ধীরে টেনে আনছেন। বাড়ির সামনেই বড় মাঠ ছিল! মা’কে দিয়ে মাঠে রাঙাকাকাবাবু মহিলা-সভার আয়োজন করাতে লাগলেন। সভায় নানারকম দেশাত্মবোধক বক্তৃতা হত। মনে আছে জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগী ম্যাজিক লণ্ঠনের সাহায্যে রঙিন ছবি দেখিয়ে উদ্দীপনাময় বক্তৃতা করছেন। নীলবিদ্রোহের সময় ইংরাজদের অত্যাচারের ছবি পরদায় ফেলা হচ্ছে, এখনও মনে গেঁথে আছে। সভার শেষে দেশাত্মবোধক গান কোরাসে গাওয়া হত। দেশবন্ধুর বাড়ির মহিলারা তাতে যোগ দিতেন। তাছাড়া হাতের সুতোয় তৈরি খদ্দরের কাপড় মা বিক্রি করতে বেরোতেন, জাতীয় তহবিলের জন্য চাঁদা তুলতে। পরে গান্ধীজির লবণ সত্যাশ্ৰহ আরম্ভ হবার পর কন্ট্রাব্যাণ্ড সল্ট’ বা ‘বেআইনী লবণ’ মা বাড়ি-বাড়ি পৌঁছে দিতেন। মা’র আলমারিতে ছোট-বড় শিশিতে ঐ লবণ সাজানো থাকত দেখেছি। ঐ বস্তুটিই ছিল তখন আমাদের ইংরাজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের একটি প্রতীক।

বাবার মতো রাঙাকাকাবাবুরও সময় ছিল কম। দেশের ও কংগ্রেসের কাজে তিনি দিনরাত ডুবে থাকতেন। সকালের দিকে তাঁকে বড়-একটা দেখতাম না, বেশি রাত পর্যন্ত খাটা-খাটুনির পর সকালে বেশ কিছুক্ষণ ঘুমোতেন। দাড়ি কামানোটা ঘুমের মধ্যেই হত। কাজটা করত আমাদের বাড়ির জমকালো নাপিত-মহাশয় হরিচরণ দাস। দক্ষিণ কলকাতার অনেকগুলি সম্ভ্রান্ত বাড়িতে প্রতিদিন ভোরে সাইকেল চেপে সে রাউণ্ড দিত। সে বেশ গর্বের সঙ্গে বলত কত বড় ও নামজাদা মানুষের দাড়ির দায়িত্ব তার হাতে। তার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘দি রয়াল বারবার। বর্ষার দিনে কলকাতা ভেসে গেলেও হরিনাপিতের সাইকেল ঠিক চালু থাকত। এতগুলো দামি দাড়ি তো আর ফেলে রাখা যায় না।

রাঙাকাকাবাবু খেতে আসতেন অনেক বেলায়। তাঁর খাবার সময় দক্ষিণের বারান্দাব পাথরের টেবিলে তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিলেন আমার মা। রাত্রের খাওয়ার ব্যবস্থা একই রকম। তিনি নিয়মিত অনিয়ম করতেন। খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে যখন তিনি বিকেলে পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতেন, আমরা প্রায়ই তাঁকে দেখতে পেতাম। গায়ে ধোপদুরস্ত খদ্দরের কোঁচানো ধুতি ও পাঞ্জাবি, কাঁধে কোঁচানো খদ্দরের চাদর। পোশাক অনাড়ম্বর, কিন্তু পরিপাটি ও খুবই মানানসই। অনেকদিন পর্যন্ত তিনি নিয়মিত নাগরা পরতেন, পরে সাধারণ চটি বা কাবলি ধরনের জুতো পরতে আরম্ভ করেন। কখনও কখনও বা তিনি খুবই গম্ভীর বা।

৩৯

গুনগুন করে গান গাইতে-গাইতে নামতেন বা উঠতেন। বাথরুমে তাঁর গান কিন্তু খুবই। শোনা যেত। যেমন ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’, ‘তাতল সৈকতে বারিবিন্দুসম’, ‘শিকল পরা ছল’ ইত্যাদি। রাজনৈতিক আবহাওয়াটা কেমন, তার উপরই বোধ করি তাঁর ‘মুড’ নির্ভর করত। তাঁর ‘মুড’-এর কথা বলতে গিয়ে অনেক কথা মনে পড়ে। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যখন হাসিঠাট্টা করতেন তখন তিনি একেবারেই ছেলেমানুষ। হয়তো বললেন, এসো, তোমাদের ভাল একটা গল্প শোনাই, কথামালার গল্প। গম্ভীর ভাবে বলতে আরম্ভ করলেন– একদা এক হাড়ের গলায় বাঘ ফুটিয়াছিল…’। ছোট ছোট ভাইপো-ভাইঝিরা যতই প্রতিবাদ করে, ততই তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে থাকেন, না, তিনি ঠিকই বলছেন। কখনও হয়তো আমাদের একজনের মাথা দু’হাতে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে মুখে কলসীতে জল নাড়ার মতো আওয়াজ করে প্রমাণ করতে চাইতেন যে, আমাদের মাথা জলে ভরা। কতরকম হাল্কা ঠাট্টা যে তিনি আমাদের জন্য আবিষ্কার করতেন তার ঠিক নেই। আর হাসির তো কোন বাঁধ ছিল না, ছোটদের সঙ্গে গড়াগড়ি দিয়ে হাসতেন।

রাঙাকাকাবাবুর রাগের মুড’ও কিন্তু দেখবার মতো ছিল। সারা মুখ টকটকে লাল হয়ে যেত, কথা বেশি নয়, কিন্তু চাপা ভারী গলায় যে কয়েকটি কথা বলতেন, তাতেই বুক কেঁপে উঠত। তবে তাঁর ধৈর্য ছিল অসীম, সেজন্য ব্যক্তিগত রাগারাগি খুব কমই ঘটত।

দেশাত্মবোধক বা ভক্তিমূলক গান শুনতে-শুনতে যখন তিনি বিভোর হয়ে যেতেন, তখন তাঁর চেহারা দেখবার মতো হত। তাঁর বাল্যবন্ধু দিলীপকুমার রায় ১৯৩৭-৩৮ সালে প্রায়ই। উডবার্ন পার্কের বাড়িতে জমিয়ে গানের আসর বসাতেন। দুই ভাই-বাবা ও রাঙাকাকাবাবু- পাশাপাশি বসে গান শুনতেন। দুজনেই একেবারে অভিভূত হয়ে যেতেন, তাঁদের মুখে এক অপূর্ব জ্যোতি ফুটে উঠত, দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ত।

অনেক ব্যাপারে রাঙাকাকাবাবু এমনই সরল ও অবুঝ ছিলেন যে, তাঁর আচরণ ও কথাবার্তা অন্যদের হাসির খোরাক জোগাত। একসময় মা কলকাতার বাইরে গেছেন। ঠাকুমা বাসন্তী দেবীর কাছে গিয়ে রাঙাকাকাবাবু নালিশ জানালেন, “দেখুন, মেজবৌদিদি বাড়িতে না-থাকলেই ধোপাটা খুব দুষ্টুমি করে, আমার পাঞ্জাবির সব বোতামগুলি ছিঁড়ে ফেরত দেয়, মেজবৌদিদি থাকলে তো এমন করতে সাহস পায় না!” ঠাকুমা খুব খানিকটা হেসে তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন যে, সংসারের খুটিনাটি কী ভাবে চলে।

একেবারে অন্য ধরনের এক ‘মুড’ ও আচরণের কথা মনে পড়ল। যদিও আমি তখন খুবই ছোট, যা দেখেছিলাম তা ভোলবার নয়। রাঙাকাকাবাবু ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার ভিতরের দালানে দাঁড়িয়ে আছেন! যেন একটি পাথরের মূর্তি-নিশ্চল ও গম্ভীর। মা বেরিয়ে এলেন। রাঙাকাকাবাবু আস্তে-আস্তে একটি কাগজের মোড়ক এগিয়ে দিয়ে থমথমে গলায় বললেন, “যতীন দাসের অস্থি, যত্ন করে রেখে দেবেন।” সকালে মা’র সঙ্গে। আমরা শহিদ যতীন দাসের শোকযাত্রা দেখে এসেছি। শেষ কাজ সব সেরে শ্মশান থেকে ফিরতে রাঙাকাকাবাবুর সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।

বাড়ির বাইরেও নানা সভা ও অনুষ্ঠানে আমরা মার সঙ্গে যেতাম। সবগুলিই রাঙাকাকাবাবুর উদ্যোগে। বিভিন্ন এলাকায় মহিলাদের সভায় তিনি বক্তৃতা করে বেড়াতেন। তাঁর সব কথাবার্তা বুঝতে পারতাম না, এবং বক্তৃতা বেশি লম্বা হলে প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়তাম। তবে স্বদেশী যাত্রা মুকুন্দ দাসের গান, শরীর-চচা, লাঠি ও ছোরা খেলা ৪০

ইত্যাদির অনুষ্ঠানে বেশ উৎসাহ পাওয়া যেত। উত্তর কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে বাঙলাদেশের সবচেয়ে বড় কুস্তিগির গোবরবাবুর কুস্তি দেখেছি মনে আছে। দেশের কাজে টাকা তোলার জন্যও গানবাজনার অনুষ্ঠানও রাঙাকাকাবাবু করতেন। খুবই ছেলেবেলার একটি ছবি মনে আঁকা রয়েছে। ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে এক বিরাট অনুষ্ঠান হচ্ছে। মঞ্চের উপর অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছেন সুভাষচন্দ্র বসু, কাজি নজরুল ইসলাম ও দিলীপকুমার রায়। নজরুল নিজেই গাইলেন “দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার,” ঘণ্টা। বাজিয়ে তাল মিলিয়ে। দিলীপবাবু গাইলেন তাঁর মন-মাতানো “রাঙা জবা কে দিল তোর পায়”।

মা’র সঙ্গে পারিবারিক নানা অনুষ্ঠানেও তো যেতাম। লাল জামা গায়ে বিয়েবাড়িও কত গিয়েছি। কিন্তু স্বীকার করতে বাধা নেই যে, গতানুগতিক পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠান মনে ততটা দাগ কাটত না যতটা কাটত জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নানারকম অনুষ্ঠান ও সমাবেশ।

সকলেরই একথা জানা যে, জেলে যাওয়া-আসা রাঙাকাকাবাবুর জীবনের অনেকটাই জুড়ে ছিল। তাঁর গ্রেফতারের বা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের খবর আমরা প্রায়ই বড় হরফে খবরের কাগজে পড়তাম। এ-ধরনের খবর তো সুখের হতে পারে না, তবে শৈশবেও মনে-মনে দেশের জন্য রাঙাকাকাবাবুর লাঞ্ছনাভোগে গৌরব অনুভব করতাম, এবং স্বপ্ন দেখতাম কবে আমিও ঐ গৌরবের ভা, পাব। আজকালকার ছেলেমেয়েরা হয়তো শুনে আশ্চর্য হবে যে, আমরা খবরের কাগজ প্রথম পাতা থেকেই পড়তে আরম্ভ করতাম। সব না বুঝলেও দেশ-বিদেশের রাজনীতির খবর নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম। খেলাধুলোর খবরের পাতা সে-সময় আমাদের কাছে বড় আকর্ষণ ছিল না। তাছাড়া জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র ছাড়া অন্য পত্র-পত্রিকা উডবার্ন পার্কের বাড়িতে ঢুকত না।

উডবার্ন পার্কের বাড়ির একতলায় বেশ বিচিত্র রকমের ভিড় লেগে থাকত। প্রথমত, বাবার পেশার সঙ্গে যুক্ত উকিল ব্যারিস্টার ও মক্কেলদের ভিড়। দ্বিতীয়ত, রাজনীতির লোকদের বা কংগ্রেসীদের ভিড়–প্রধানত রাঙাকাকাবাবুর জন্য। আর, তৃতীয়ত, নানা ধরনের সাহায্য-প্রার্থীদের সমাবেশ। কে বোস-সাহেবের কাছে এসেছে ও কে সুভাষবাবুকে চায়, সেটা সামনের দালানেই ঠিক হয়ে যেত। বাবার নাগাল পাওয়া অপেক্ষাকৃত শক্ত ছিল, কারণ কোর্টের কাজে তিনি সকাল-সন্ধ্যা খুবই ব্যস্ত থাকতেন। তারই ফাঁকে-ফাঁকে তিনি ফরওয়ার্ড কাগজ, করপোরেশন বা কংগ্রেসের জরুরি কাজ সারতেন। এই সূত্রে আর একটি পার্শ্বচরিত্রের কথা বলি–আমাদের খুড়ো-দাদাবাবু শৈলেন্দ্রনাথ বসু। বসুবাড়ির এই দুর সম্পর্কের আত্মীয়টি ছিলেন বাবাদের জেনারেশনের সর্বজনীন খুড়ো’। তিনি বাবার হাইকোর্টের বাবুর কাজ করতেন। কোর্টের সময়টুকু ছাড়া তিনি সারা দিনটাই আমাদের। বাড়িতে কাটাতেন এবং বাড়ির নানা কাজে সাহায্য করতেন। মোটা-মোটা ৰাধানো খাতায় তিনি বাবার পেশাগত হিসাব-পত্র রাখতেন। তিনি কিন্তু প্রায়ই বাবার স্বভাবসিদ্ধ গোছানো ও নিয়মমাফিক কাজকর্মের সঙ্গে তাল রাখতে পারতেন না এবং পিছিয়ে পড়তেন। “এই যা, ভুলে গেছি” কথাটা তাঁর মুখে প্রায়ই শোনা যেত। আর বাবা তাঁকে বলতেন, “খুড়ো, মেমারি পিল পাও, মেমারি পিল খাও।” যাই হোক, খুড়ো-দাদাবাবু ছিলেন এক অতি প্রাণখোলা ও পরোপকারী লোক। বাড়ির ছেলেবুড়ো সকলেই ছিল তাঁর বন্ধু। বাবা যতই

৪১

রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়তে লাগলেন, পেশাগত কাজ ক্রমেই তাঁকে কমিয়ে দিতে হত। বাবা অন্য কাজের জন্য যখন ‘ব্রীফ ফেরত দিতে বাধ্য হতেন, খুড়ো-দাদাবাবু বড়ই দুঃখ পেতেন। বলতেন, “খুড়ো (মানে আমার বাবা) এমন করে ঐশ্বর্য পায়ে ঠেলছেন।” যেদিন কংগ্রেসের বড় মিটিং বাড়িতে বসত, খুড়ো-দাদাবাবু অবাঞ্ছিতের মতো

মনে উপরে চলে আসতেন আর আফসোস করতেন। বলতেন, “আজ তো নীচে মোহনবাগানের ম্যাচ, ‘ভূতের রাজত্ব, আমার কিছু করবার নেই।” শেষ পর্যন্ত বাবা যখন জেলে গেলেন খুড়ো-দাদাবাবু খুবই মুষড়ে পড়েছিলেন। কিন্তু আমাদের তিনি ছাড়েননি।

যাট দশকের মাঝামাঝি হবে। সন্ধ্যায় আমি উডবার্ন পার্কের বাড়িতে একতলায় আমার চেম্বারে বসে আছি। এক ভদ্রলোক তাঁর কার্ড পাঠালেন, বড় একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় অফিসার।

ভিতরে এসে বললেন, তিনি রুগী দেখাতে আসেননি। প্রায় রোজই তিনি অফিস থেকে বাড়ি যান আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে এবং রোজই বাড়িটাকে বাইরে থেকে নমস্কার করে যান। সেদিন কী মনে করে ঢুকে পড়েছেন।

তাঁর কথা শুনে আমি অবাক হয়ে তাঁর দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে বইলাম। তিনি তখন বললেন, “দেখুন, আমি যে আজ জীবনে প্রতিষ্ঠালাভ করেছি সে-সবই আপনার বাবার জন্য। আমি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের ছেলে ছিলাম, আপনার বাবার সাহায্যেই আমি লেখাপড়া করি। সেজন্য ১ নং উডবার্ন পার্কের এই বাড়ি আমার কাছে এক পবিত্র স্থান। কিছু মনে করবেন না, বিরক্ত করে গেলাম।”

দাদাভাই জানকীনাথ খুব কষ্টের মধ্যে লেখাপড়া শিখেছিলেন। মায়ের কাছে শুনেছি যে, তিনি বাবাকে বলেছিলেন, যখন সামর্থ্য হবে তখন বাবা যেন গরিব কিন্তু যোগ্য কিছু ছাত্রকে লেখাপড়া করতে সাহায্য করেন। দাদাভাইয়ের কথামতো বাবা নিজে আইন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠালাভের পরে একদল দুঃস্থ কিন্তু মেধাবী ছাত্রকে নিয়মিত পড়াশোনার খরচ দিতেন। আমরা কৌতূহলী হয়ে ভাবতুম, মাসের প্রথমে নীচের তলায় ছেলে-ছোকরাদের এত ভিড় হয় কেন? খুড়োদাদাবাবুকে (শৈলেন্দ্রনাথ বসু) এ ব্যাপারে সব খাতাপত্র রাখতে হত। তিনি প্রায়ই হিসাবপত্র গোলমাল করে ফেলতেন।

বাবা চেপে ধরলে বলতেন, “বেশ কিছু না, আমি তো কেবল এক মাস পিছিয়ে আছি।” যখনই পারতেন বাবা ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতেন। তাদের পরীক্ষার ফলাফল নিয়মিত বাবাকে দেখাতে হত।

বাবা জেলে যাবার পর ঐ সব ছাত্ররা খুবই অসুবিধায় পড়েছিল। অনেকেরই হয়তো লেখাপড়াই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এদেরই মধ্যে দুজন ভদ্রলোক যাঁরা তাঁদের ছাত্রাবস্থায় বাবার সমর্থন ও সাহায্য পেয়েছিলেন, আমাদের দুঃসময়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। দুজনকেই আমরা দাদা বলতাম এবং এখনও বলি। মায়ের আর্থিক অনটনের কথা ভেবে তাঁবা ছেলেমেয়েদের কাপড়জামা ইত্যাদি উপহার দেবার অছিলায় আমাদের সাহায্য করতেন। অসুখে-বিসুখে আমাদের কাছে কাছে থাকতেন। আমাদের

৪২

প্রফুল্ল রাখবার জন্য নানা জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেতেন।

রাঙাকাকাবাবু তো সবসময়ই রাজনৈতিক কাজ নিয়ে মেতে আছেন, রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে তাঁর তত দিনরাত মেলামেশা। গুপ্ত বিপ্লবী দলের ছেলেমেয়েদের প্রেরণাও অনেকক্ষেত্রে সুভাষচন্দ্র। বাবার সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিশেষ করে বিপ্লবী ছেলেমেয়েদের সম্পর্ক ছিল একটু ভিন্ন রকমের, কিন্তু খুবই গভীর। সেটা সাধারণ লোকের চোখে পড়ত না। দেশের কাজে সহকর্মী জেলে গেলে তাঁদের পরিবারবর্গের দেখাশোনা, বিপ্লবী ছেলেমেয়েদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা ইত্যাদি করতেন। এই কাজেও দুই ভাই ছিলেন একে অন্যের পরিপূরক। বাবা ১৯৩২ সালে গ্রেপ্তার হবার পর তাঁর পক্ষ সমর্থন করে পরিবারের এক শুভার্থী এক বড় ইংরেজ অফিসারেব সঙ্গে কথা বলতে যান। ইংরেজ অফিসারটি বললেন, “দেখ, শরৎ বসু তো অনেক টাকা উপার্জন করেন। ইনকাম-টাক্সও তো অনেক দেন। তবে আমরা দেখছি যে, এখন ব্যাঙ্কে তাঁর টাকা নেই বললেই চলে। আমরা জানি, শরৎ বসুর কোনও বাজে বিলাসিতা শখ বা অভ্যাস নেই, তবে টাকাগুলো যায়। কোথায়? নিশ্চয়ই তিনি গোপনে কংগ্রেসের কাজে ও বিপ্লবীদের টাকা দেন।”

এই যে বিপ্লবী ছেলেমেয়েদের কথা বললাম, তাঁরাও অজান্তে আমাদের বেশ প্রভাবিত করতেন। খবরের কাগজে তাঁদের সম্বন্ধে দু’রকম খবর বেরোত। এক, অত্যাচারী ইংবেজ অফিসারদের ওপর আক্রমণের কাহিনী বা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনেব মতো দুঃসাহসিক অভিযান। দুই, এইসব বিপ্লবীদের বিচারের বিবরণ অথবা তাদের নিবাসন বা ফাঁসির খবর। এইসব খবর আমাদের মনের মধ্যে তোলপাড় করত। বাংলার তরুণ বীরদের আত্মত্যাগে আমরা যেমন অভিভূত হতাম, তেমনি গর্বিতও হতাম। বাবা ও বাড়ির অন্যরা এই ধরনের খবরে যে বেশ বিচলিত বোধ করতেন, সেটা আমাদের মতো ছোটরাও বুঝতে পারত। বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে এই সব ছেলেমেয়েদের যেন একটা নাড়ির টান ছিল। কোনও ফাঁসির খবর এলে সারা বাড়িতে একটা থমথমে ভাব বিরাজ করত। আরও একটু বড় হবার পরে বাবার মুখে একটা কথা বেশ কয়েকবার শুনেছি।

বাবা রুদ্ধ আবেগের সঙ্গে বলতেন, “দেখ, এই সব ছেলেমেয়ের অনেককেই আমি কাছ থেকে দেখেছি ও জেনেছি। এরা সব স্টার্লিং গোল্ড’, খাঁটি সোনা।”

অনেক পরে বিপ্লবী বন্ধুদের কাছে শুনেছি, বাবা বিনয় বসুর প্রাণ বাঁচাবার জন্য তাঁকে লুকিয়ে বিদেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন এবং তার জন্য যত টাকা লাগে নিজেই দিতে রাজি ছিলেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভিযানের বিপ্লবীদের যখন বিচার শুরু হল, আদালতে তাঁদের পক্ষ সমর্থনের জন্য বাবা চট্টগ্রামে যাওয়া-আসা করতে লাগলেন। সেই সময় অনন্ত সিংহের বোন ইন্দুমতী আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়িতে এসে বেশ কিছুদিন ছিলেন। ইন্দুমতীর সঙ্গে আমরা ছোটরাও বেশ ভাব জমিয়েছিলাম।

রাঙাকাকাবাবুর জীবন ছিল একমুখী–দেশ আর দেশ। বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর জীবনযাত্রায় খানিকটা তফাত থাকা স্বাভাবিক। বাবার আইন ব্যবসা আছে, আছে দেশের কাজ, আরও আছে নিজের সংসারের দায়িত্ব। নেহাত কাজের কথা ছাড়া কথাবার্তা বলার অবকাশ কম। বসে গল্পগুজব বা তুচ্ছ সামাজিকতা করার কথাই ওঠে না। এই কারণে অনেকেই বাবার নাগাল পেত না। ভাবত, তিনি বোধহয় পাত্তাই দিচ্ছেন না। ফলে, কখনও কখনও ভুল বোঝাবুঝি হত।

৪৩

বাড়িতে তো অসুখ-বিসুখ করেই। এ ব্যাপারে আমি ছিলাম ফাস্ট। আমার এত অসুখ করত যে কী বলব! কত রকমের অসুখ। বাবা বাড়িতে অসুখবিসুখের সময় একেবারে শান্ত ও অবিচলিত থাকতেন। আমাদের নতুন কাকাবাবু ডাক্তার সুনীল বসুর উপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল। তাঁর হাতে ছেলেমেয়েদের বা মায়ের চিকিৎসার ভার ছেড়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত থাকতেন। যখন বিশেষ কারণে অন্য ডাক্তার ডাকতে হত, নতুন কাকাবাবুর। মতামতই বাবা গ্রহণ করতেন। ছোটবেলায় বুঝিনি, পরে বুঝেছি বিপদের সময় শান্ত ও অবিচলিত থাকার মূলে ছিল বাবার গভীর ভগবৎ বিশ্বাস।

বাবার দুটি দীর্ঘমেয়াদী কারাবাসের সময় বাড়িতে ছেলেমেয়েদের, মায়ের, দাদাভাই, মাজননীর ও অন্য অনেকের গুরুতর অসুখ-বিসুখ, অপারেশন ইত্যাদি হয়েছিল। প্রথমবার কারাবাসের সময় তিনি হারিয়েছিলেন দাদাভাইকে, দ্বিতীয়বার মাজননীকে। সব বিপর্যয়ই বাবা অসীম ধৈর্যের সঙ্গে মেনে নিয়েছিলেন নিয়তির অমোঘ সত্য হিসাবে।

এই সূত্রে নতুন কাকাবাবুর কথা কিছু বলি। সুনীলচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন, চোখেমুখে বুদ্ধির দীপ্তি, এবং কথাবার্তায় খুব সপ্রতিভ। তিনি বিলেত থেকে বিশেষজ্ঞ হয়ে ফেরার পবে কিছুদিন হ্যাঁরিংটন স্ট্রীটের এক ফ্ল্যাট বাড়িতে ডাক্তারি শুরু করেন। দরকার পড়লেই মা তাঁকে খবর দিতেন। এমন হাঁকডাক করতে করতে তিনি আসতেন যে, বাড়িতে বেশ একটা চাঞ্চল্য দেখা দিত। চিকিৎসা তো করতেনই। সঙ্গে সঙ্গে জমিয়ে গল্প জুড়ে দিতেন, নানা রকম রসালো গল্প। তিনি পুরোপুবি সাহেব ছিলেন পোশাক-আশাকে, আদব-কায়দায় এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়। মাঝে মাঝে তিনি তাঁর ফ্ল্যাটে আমাদের নিয়ে যেতেন। বিলিতি কেক, বিস্কুট, চকোলেট উডবার্ন পার্কের বাড়িতে ঢুকত না। নতুন কাকাবাবুর কল্যাণে আমরা তার কিছু স্বাদ পেতাম।

তাঁব রাজনৈতিক মতামত অন্য ধরনের ছিল। তিনি বেশ খানিকটা ইংরেজ-ঘেঁষা ছিলেন বলা চলে। কিন্তু তার জন্য ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোনও তারতম্য ঘটত না।

তোমবা হয়তো ভাবছ, যে পরিবারে সুভাষচন্দ্র জন্মেছিলেন, সেই পরিবারে অন্য মতের লোক কী ভাবে আসে! কিন্তু সেটাই স্বাভাবিক। কেবল রাজনৈতিক মতামতের জন্য ব্যক্তিগত সম্পর্কের তিক্ততা আসাটাই অস্বাভাবিক। ডাক পড়লেই নতুন কাকাবাবু আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর রাজনৈতিক এমন কী বিপ্লবী বন্ধুদেরও মনপ্রাণ দিয়ে সেবা করতেন।

নতুন কাকাবাবুর কথা বলতে গিয়ে আর একজনকার কথা মনে পড়ে গেল। সেই সময়–তিরিশ দশকের প্রথমে তু কাকাবাবুর সঙ্গে তাঁদের ছোটমামা, আমাদের ছোটদাদাবাবু, রণেন্দ্রনাথ দত্ত থাকতেন। ছোটদাদাবাবুর চেহারা ছিল সাহেবের মতো। আচার-ব্যবহারেও তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর সাহেব। দেশী কায়দায় খাবার দিলে তিনি আমাদের দেশী শাক-সজি সম্বন্ধে মজার মজার মন্তব্য করতেন। যেমন “আবার তোদের সেই লক্ষ্মীছাড়া বেগুন, আর হতচ্ছাড়া পটল!”

কয়েকটি ব্যতিক্রম থাকলেও বাবাদের জেনারেশনে মামা-ভাগ্নের মধ্যে একটা বিষয়ে বেশ সাদৃশ্য ছিল। সেটা হল খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে। তাঁরা সকলেই ভোজনরসিক ছিলেন। বাবা ও রাঙাকাকাবাবুও এই দলে পড়তেন। পরিমাণেও তাঁরা বেশি খেতেন।

আমাদের জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত না বলে তাঁরা

৪৪

আমাদের খানিকটা কৃপার চোখে দেখতেন। ছোটদাদাবাবু রণেন্দ্রনাথ ও লালদাদাবাবু সত্যেন্দ্রনাথের ডিমের ওমলেটের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল। শুনেছি ছোটদাদাবাবু রাতের খাওয়া শেষ করে মুখ ধুয়ে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে অন্যদের বলতেন, ওমলেটের টুকরো তাঁর মুখে ফেলে দিতে, যাতে তিনি ওমলেটের স্বাদ যেটা তাঁর কাছে ছিল অমৃতসমান–মুখে নিয়ে ঘুমোতে পারেন। লালদাদাবাবু সারা জীবন আমাদের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে গেছেন। যখনই তিনি

আসতেন তখনই তাঁকে বড় মাপের একটা ওমলেট দেওয়া হত।

পিসিমাদের কাছে শোনা আর একটা পুরনো গল্প বলি। এলগিন রোডের বাড়িতে তো অনেক লোক। লালদাদাবাবু, তখন তাঁর বয়স অবশ্য কম, বাজি রাখলেন যে, বাড়িতে সকলের জন্য যতটা ভাত রান্না হয় সবটা তিনি একলাই খাবেন। প্রায় বাজিমাত করে এনেছিলেন। শেষ গ্রাস নেওয়ার সময় আর পারলেন না, সবটাই উঠে গেল।

॥ ১৪ ॥

১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। বাবা পেশাগত কাজ নিয়ে ধানবাদ অঞ্চলে গেছেন। ভোবে একদিন দেখা গেল পুলিস আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। দরজা খুলতেই পুলিস-অফিসারদের একটি বড় দল বাড়িতে ঢুকল। হাতে খানাতল্লাশির পরোয়ানা। খানাতল্লাশির সময় বাড়ি থেকে কেউ বেরোতে পারবে না। ইতিমধ্যে মা অবশ্য অন্য উপায়ে খবর পাঠিয়ে দু-চারজন আত্মীয় বন্ধু আনিয়ে নিলেন। এধরনের ব্যাপার তো কাছ থেকে আগে দেখিনি। সার্চের রকম-সকম দেখেও অবাক হয়ে গেলাম। বাবার অফিস ঘর ছাড়াও আরও দুটি ঘরে বই ঠাসা ছিল; একদিকে আইনের অনেক বই, অন্যদিকে রাজনীতি, ইতিহাস, সাহিত্য ইত্যাদি নানা ধরনের বই। বাবার অফিসের কাগজপত্রও পুলিসে তছনছ করে ফেলল। প্রত্যেকটি চিঠি খুলে পরীক্ষা করল। তাক ও আলমারি থেকে বইগুলি নামিয়ে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পাতা উল্টে উল্টে দেখল, কোনো বইয়ের ভিতরে লুকননা কিছু আছে কি না! তারপর বাকি বাড়িটা তো আছেই। খানাতল্লাশি শেষ করতে সারা দিন লেগে গেল। বেশ কিছু বই ও কাগজপত্র, যেগুলি তাদের রাজদ্রোহাত্মক বলে মনে হল, তারা আলাদা করে তালিকাভুক্ত করল এবং যাবার সময় নিয়ে চলে গেল। তালিকাটি পরে হারিয়ে গিয়েছিল এবং দেশ স্বাধীন হবার পরেও আমরা কিছু ফেরত পাইনি। এইভাবে বাবার লাইব্রেরির বেশ একটা অংশ আমরা হারাই। পরে রাঙাকাকাবাবুর একটি মূল্যবান সংগ্রহের একই অবস্থা হয়েছিল। ১৯৩৬ সালে রাঙাকাকাবাবু যখন দেশে ফেরেন, অনেক বই কাঠের বাক্সে বোঝাই করে তিনি মালবাহী জাহাজে দেশে পাঠিয়েছিলেন। নিজে তো বোম্বাই পৌঁছোতেই গ্রেপ্তার হন। তাঁর বইগুলির বড় অংশই বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়।

কলকাতায় যখন বাড়ি তল্লাশি চলছে, সরকার বাহাদুর সেই সন্ধ্যায় ঝরিয়ায় বাবাকে গ্রেপ্তার করার সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছেন। পরে বাবার কাছে শুনেছি, সারাদিন কাজের পর বাত্রের খাওয়াদাওয়া সেরে বাবা ও তাঁর সঙ্গীরা তাঁদের বাংলোয় যখন একটু আরাম করে গল্পগুজব করছেন, তখন দেখা গেল চারিদিকের অন্ধকার ভেদ করে দুটি

48

বাবা সেখানে পৌঁছে দেখলেন ভাই সুভাষচন্দ্র তাঁকে অভ্যর্থনা করবার জন্য ইতিমধ্যেই জব্বলপুবের বেশ কিছু দূরে সিউনি বলে এক পাণ্ডববর্জিত জায়গায় তাঁকে নিয়ে গেল। হতে যাচ্ছে। গ্রেপ্তারের পর সরকার বাবাকে কলকাতায় নিয়ে আসেনি। সুদুর মধ্যপ্রদেশে মোটবগাড়িব জোবালো আলো তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে। বাবা আন্দাজ করেছিলেন কী মাকে লেখা রাঙাকাকাবাবুর চিঠি

সেখানে পৌঁছে গেছেন। মাসখানেক আগে গান্ধীজির সঙ্গে বোম্বাইয়ে দেখা করে কলকাতা ফেরবার পথে রাঙাকাকাবাবুকে কল্যাণ স্টেশনে গ্রেপ্তার করে পরে সিউনি সাব-জেলে বন্দী করেছিল।

১৯৩০ সাল থেকেই বাবা স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ছিলেন। রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আলোচনার পর বাবা ১৯৩০-এর মাঝামাঝি দাদাভাইকে। একটা চিঠি লিখে জানান যে, তিনি কংগ্রেসের কাজে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করবার জন্য কিছুদিনের জন্য আইনব্যবসা বন্ধ রাখছেন। ঐতিহাসিক ঐ চিঠিটি সম্প্রতি নেতাজী রিসার্চ ব্যুরো প্রকাশ কবেছে। সেই যে বাবা এক বন্ধুর পথে পা বাড়ালেন, তারপর আর ফিরে তাকাননি, রাঙাকাকাবাবুর সংগ্রামের সাথী হয়ে সব বিপদ-আপদ অগ্রাহ্য করে জীবনেব। শেষ দিন পর্যন্ত কেবল এগিয়েই গিয়েছেন।

বিহারের কয়লাখনি অঞ্চলটি বসুবাড়ির দিক থেকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ জায়গা। এখনই তো বললাম বাবা প্রথমবার ঐ অঞ্চল থেকেই গ্রেপ্তাৰ হন। সেই থেকে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সেখানে ঘটেছে। আমার নিজের ঐ অঞ্চলে যাওয়া-আসা অবশ্য আরও আগে থেকে–যখন আমি খুবই ছোট। তার অনেক সুন্দর স্মৃতিও আমার মনে ধরা আছে। আমাদেব ন’কাকাবাবু সুধীবচন্দ্র বসু ঐ অঞ্চলে কাজ করতেন। তিনি কয়লা সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ন’কাকিমা শান্তিলতা দেবী আমাৰ শিশু-বয়স থেকেই আমাকে নিজের

ছেলের মতো স্নেহ করতেন। জীবনের প্রথম বছরেই আমার অসুখ করতে আরম্ভ করে।

সেই সময় আমাব মা নিজের অসুস্থতার জন্য ন’কাকিমার হাতে আমার দেখাশুনোর ভার। ছেড়ে দেন। সেই থেকে কাকিমার সঙ্গে আমার এক বিশেষ মমতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি অনেকদিন পর্যন্ত তাঁকে শাস্তিমা বলে ডাকতাম। তাঁর নিজের ছেলে ছিল না। বড় মেযে ছায়া আমার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট ছিল। সে অসাধারণ সুন্দরী ছিল এবং তার স্বভাবটি ছিল খুবই কোমল। ছায়া ও আমার মধ্যে ছিল আপন ভাই-বোনের সম্পর্ক। আমার স্কুলের ছুটির সময় ন’কাকাবাবু ন’কাকিমা বেশ কয়েকবার তাঁদের কাছে আমাকে নিয়ে গেছেন এবং খুব সুখে ও আনন্দে আমি তাঁদের কাছে থেকেছি। কলকাতা থেকে গিয়ে বিহারের শুকনো, অনুর্বর, উঁচুনিচু খনি-অঞ্চল বেশ নতুন রকম ঠেকত। ন’কাকাবাবু গাড়িতে চাপিয়ে প্রায় রোজই আমাদের নিয়ে বেড়াতে বেরোতেন। ফলে ছেলেবেলা। থেকেই ঐ অঞ্চলটির সিজুয়া, জামাডোবা, কাতবাস ইত্যাদি জাযগার সঙ্গে আমার বেশ একটা পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। ন’কাকাবাবুর মতো প্রাণখোলা স্নেহপ্রবণ লোক আমি কমই

দেখেছি। বসুবাড়ির অন্য অনেকের মতো খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে তাঁবও বেশ দুর্বলতা ছিল। তাঁব মতে জ্বব হলে পথ্য হওয়া উচিত লুচি আব মাংস। সত্যিই তিনি নিজে জ্বরে পড়লে ঐ পথ্য করতেন। আমার স্বাস্থ্যের গোলমাল হলে ন’কাকিমা যখন খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে ধরাকাট করতেন, ন’কাকাবাবু তাতে ঘোর আপত্তি জানাতেন। পরে ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরী কংগ্রেসের পর রাঙাকাকাবাবু স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য বেশ কিছুদিন ন’কাকাবাবুর জামাডোবার, বাড়িতে ছিলেন। গান্ধীজিকে তার অনেক ঐতিহাসিক চিঠি জামাডোবা থেকে লেখা। কংগ্রেসের মধ্যে বাদ-বিসংবাদ নিয়ে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আলাপ করতে জওহরলাল সেই সময় জামাডোবায় এসেছিলেন। তাছাড়া এটা তো এখন সকলেরই জানা যে, ১৯৪১-এ রাঙাকাকাবাবুর ঐতিহাসিক অন্তর্ধানের ব্যাপারে ঐ অঞ্চলটির একটি গুরুত্বপূর্ণ পটভূমি

আমার আকা রাঙাকাকাবাবুর ছবি ছিল। ধানবাদের কাছাকাছি বারারিতে তিনি একদিন আত্মগোপন করেছিলেন, এবং গোমো থেকে পেশোয়ারের পথে রওনা হন। এ বিষয়ে আমি “মহানিষ্ক্রমণ”-এ লিখেছি। পরে আবও কিছু বলব।

ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে যে, দুঃসময়ের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। এর যথার্থতা আমরা বাবার দুই দীর্ঘ কারাবাসের সময় বেশ উপলব্ধি করেছিলাম। প্রথমবার-১৯৩২-১৯৩৫

৪৮

মা খুবই কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন। প্রথমত নিজের সংসার চালাতে হবে। বাবার জমানো পুঁজি ছিল নাব্যাঙ্কে টাকা জমানোর অভাস বা অবকাশ তাঁর কোনোদিনই ছিল না। দ্বিতীয়ত বাবা গ্রেপ্তার হবার বছর খানেক পরেই রাঙাকাকাবাবুকে স্বাস্থ্যের কারণে ইউরোপ পাঠাবার ব্যবস্থা হয়। রাঙাকাকাবাবুর ইউরোপের খরচ চালাবে কে? বাবা তো নিজেই জেলে। সুতরাং এই ভারটাও মার উপর পড়ল। সেই সময় পরিবাবের কয়েকজন অকৃত্রিম বন্ধু মাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন, যাঁদের কথা আমরা আজও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। এই সূত্রে দুজন বন্ধু ও তাঁদের পরিবারের কথা আগে বলি। একজন প্রভাসচন্দ্র বসু, অন্যজন নৃপেন্দ্রচন্দ্র মিত্র। দুজনকেই আমরা চিরকাল কাকাবাবু ডেকে এসেছি। বাবা গ্রেপ্তারেব একবছর আগে আমার বড় দাদাকে জামানিতে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। বাবা গ্রেপ্তার হওয়া মাত্র প্রভাসচন্দ্রবাবু এসে মাকে বললেন যে, বাবা যতদিন জেলে থাকবেন, দাদার জামানির খরচের ভার তাঁর। বাবা ফিরে শোধ দেবেন। প্রভাসচন্দ্র ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা অবশ্য তার অনেকদিন আগে থেকেই শুরু হয়েছে। বাবা-মার সঙ্গে ছুটিতে আমরা যখন পাহাড়ে বেড়াতে যেতাম প্রায়ই কাকাবাবু প্রভাস বসু, কাকিমা ও তাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের সাথী হতেন। পেবাবু। তো বাবার জেলবাসের সময় নিজেই আমাদের পাহারা দেওয়ার ভার নিয়ে ফেললেন। প্রায় রোজই সন্ধ্যায় তিনি আমাদের দেখতে আসতেন। বলতে পারি সেই সময় আমাদেব প্রধান অবলম্বন ছিলেন তিনজন, মামাবাবু অজিতকুমাব দে, প্রভাসচন্দ্র বসু ও নপেন্দ্রচন্দ্র মিত্র। বাবার সঙ্গে সৌহাদেব ফলে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গেও শেষোক্ত দুজনের বিশেষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নৃপেনবাবুকে রাঙাকাকাবাবু নিজের ব্যক্তিগত এটর্নি নিযুক্ত কবেন, যাতে আইনানুসাবে নৃপেনবাবু তাঁর প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। আজ তাঁর বয়স নব্বই ছাড়ালেও নৃপেনবাবু সাধ্যমতো নেতাজী ভবনের কাজে অংশ গ্রহণ কবেন। তিনিই বর্তমানে নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর চেয়ারম্যান।

সিউনি সাব-জেলে বন্দী হবার পর থেকেই বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। চিকিৎসার সূত্রে ব্রিটিশ সরকার রাঙাকাকাবাবুকে নিয়ে দেশের নানা জায়গায়। ঘোরাতে থাকে, মাদ্রজ, ভাওয়ালি, লখনৌ, জব্বলপুর। বাবাকে জব্বলপুরেই রাখে। বাঙাকাকাবাবুর স্বাস্থ্যের অবস্থা শেষ পর্যন্ত এতই খারাপ হয় যে, ভাবত সরকাবের সঙ্গে বসু-পরিবারেব পক্ষ থেকে কথাবার্তা শুরু করা স্থিব হয়। ভারত সরকারের কট্টর হোম মেম্বারের সঙ্গে এ-বিষয়ে কথা বলার ভাবও পড়ে আমার মা’র উপব। লখনৌয়ের বলরামপুর হাসপাতালে বাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে প্রথমে আলোচনা করে মা দিল্লি যান হোম মেম্বার হ্যাঁটে সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে। ইংরেজ সরকারের সঙ্গে চুক্তি হল যে, চিকিৎসাব জন্য রাঙাকাকাবাবুকে তারা ইউরোেপ যেতে দেবে, তবে ভারতের মাটি ছাড়ার পরই তিনি মুক্ত হবেন। ১৯৩৩-এর ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি রওনা হয়ে গেলেন ভিয়েনার পথে।

ইউরোপ থেকে রুগ্ণ অবস্থায় রাঙাকাকাবাবুর একটি ছবি মা’র কাছে পাঠান। আমার আর্টের মাস্টারমশাই হরেনবাবু আমাকে সেটা আঁকতে দিয়েছিলেন। শৈশবে আঁকা সেই ছবিটি এখনও আমার কাছে আছে।

॥ ১৫ ॥

১৯৩৩-এর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ইউরোপ যাত্রা করবার আগে দাদাভাই, মাজননীর সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর দেখা হল না। মা যখন দিল্লিতে ইংরেজি হোম মেম্বারের সঙ্গে এ-বিষয়ে কথা বলছিলেন, তখনই বোঝা গিয়েছিল যে, সরকারের মনোভাব খুবই কঠোর। যাত্রার আগে কিছুদিনের জন্য কেবল তাবা রাঙাকাকাবাবুকে বাবার কাছে জব্বলপুর সেন্ট্রাল জেলে এনে রাখতে রাজি হল। তাঁকে দেখতে দল বেঁধে আমরা জব্বলপুর গিয়েছিলাম আগেই বলেছি।

বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে জেলে দেখা করবার সময় আমাদের নানারকম অভিজ্ঞতা হত। প্রথমত, দুজনেই বাজবন্দীদের অধিকার সম্বন্ধে অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। যাঁরা তাঁদের সঙ্গে দেখা কবতে আসছেন, সরকারি বা জেলের কর্মচারীরা তাঁদের সঙ্গে যথোচিত ব্যবহার করছেন কী না! না করলে তুমুল গোলমাল শুরু হত। যেমন হয়তো পরিবারবর্গের বডি-সার্চ করার আদেশ হল। এরকম ক্ষেত্রে বিশেষ করে মহিলাদের বেলায়, বাবা ও বাঙাকাকাবাবু তো দেখা করতেই অস্বীকার করতেন। এমন ঘটনা আমাদের ক্ষেত্রে পরে ঘটেছে। কিন্তু জেলেব নিয়ম অনুযায়ী দেখা করবার সময় পুলিসের লোকও উপস্থিত থাকবেই। সব কথা তো তাদের সামনে বলা সম্ভব নয়। তাদের চোখে ধুলো দেবাব নানাবকম উপায় বাবা ও রাঙাকাকাবাবু বের করতেন। যেমন, জব্বলপুর জেলে তাঁদের ব্যারাকের মধ্যে পাটিশন দিয়ে পুজোর ঘর করেছিলেন। তাঁরা আমাদের, বিশেষ করে মা বা বাড়ির মহিলাদের, পুজোর ঘর দেখাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তেন এবং চাইতেন আমরা যেন ইণ্টাবভিউ শেষ হবার আগে অতি অবশ্য পুজোর ঘর দর্শন করে যাই। ঠাকুরের আসনের নীচে গোপনীয় কাগজপত্র লুকনো থাকত। মা বা বাড়ির অন্য কোনও মহিলা সেগুলি সংগ্রহ করে লুকিয়ে বাইরে নিয়ে আসতেন।

রাঙাকাকাবাবু আবার আমাদের মতো অতিথিদের জন্য নানারকম জলখাবারের আয়োজন করতেন। জেল কর্তৃপক্ষের কাছে এর জন্য অতিরিক্ত বেশন দাবি করতেন। তাঁদের সঙ্গে যে-সব সাধারণ কয়েদি থাকত, তাদের মধ্যে দু-একজনের উপর রান্নার ভার দেওয়া হত এবং তাবা বাঙাকাকাবাবুর নিদশমতো নানাবকম খাদ্যদ্রব্য তৈবি কবত। তবে আর যাই হোক, আমার মনে হয়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু রান্নার ব্যাপানে বিশেষ পটু ছিলেন

! চপেব মাংস প্রায়ই আধসিদ্ধ থেকে যেত, সন্দেশ বলে যা আমাদের পরিবেশন করতে তা প্রায় হত পাথবের মতো শক্ত।

রাঙাকাকাবাবুব জন্য জব্বলপুর জেলের মধ্যেই তাড়াহুড়ো কবে ইউরোপের উপযোগী গবম জামা-কাপ, টুপি, জুতো ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হল। পুলিস-পাহাবায় দর্জি ও জুতো বানাৰাৰ লোককে হাজির করা হল। ইউরোপ গিয়ে রাঙাকাকাবাবু কী ধরনের পোশাক ব্যবহার করবেন, সে বিষয়ে তাঁর নির্দিষ্ট মতামত ছিল। কোনো সরকারি বা বেসরকারি অনুষ্ঠানে বা কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করবার সময় ভারতীয় পোশাক। পরাটাই তিনি উচিত মনে করতেন। আমার মনে হয়, তিনি এইভাবে একটি সর্বজনগ্রাহ্য ও সর্বভারতীয় পোশাক উদ্ভাবনের চেষ্টা ছিলেন। লম্বা আচকান, কাশ্মীরি টুপির সঙ্গে তিনি ইউরোপীয় প্যান্ট ও ফিতে-বাঁধা জুতো মিলিয়ে পরতেন–এই পোশাকে তাঁর বহু ছবিও

৫০

আছে। একটা কথা তাঁকে ইউরোপ থেকে ঘুরে আসার পরে বলতে শুনেছি। ইউরোপে চুড়িদার পায়জামা পরা সম্বন্ধে তাঁব আপত্তি ছিল। কারণ, ঐ ধবনের পায়জামা ইউরোপে ‘আণ্ডারওয়েয়ার’এর পর্যায়ে পড়ে এবং তিনি শুনেছেন সেখানকার সমাজে চুড়িদার পায়জামাপরা কোনো-কোনো ভারতীয়কে অসুবিধাজনক অবস্থায় পড়তে হয়েছে। অবশ্য রাঙাকাকাবাবু পরে কোনো-কোনো ক্ষেত্রে পুরোপুরি ইউরোপীয় পোশাক আনুষ্ঠানিকভাবেও পরেছেন। তবে, পোশাক যাই হোক না কেন, বিদেশে গিয়ে ব্যক্তিগত আচার-ব্যবহারে যাতে কোনোরকম খুঁত না থাকে সে-বিষয়ে তিনি খুব সজাগ থাকতেন। তিনি বলতেন, বিদেশে গেলেই পোশাক–আশাক, আচার-ব্যবহার খুবই রুচিসম্মত হওয়া চাই। কারণ, সব সময়েই মনে রাখতে হবে যে, আমরা অন্য দেশে কোনো না কোনো ভাবে আমাদের মহান দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি। আমরা ব্যক্তিগতভাবে কী রকম আচাব ব্যবহার করি তার উপর আমাদের দেশের সুনাম নিৰ্ভব কবছে।

জব্বলপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে কড়া পুলিস পাহারায় অ্যাম্বুলেন্সে চাপিয়ে সবকারি কর্মচারীরা রাঙাকাকাবাবুকে স্টেশনে নিয়ে গেল এবং স্ট্রেচারে করে বোম্বাই মেলে তাঁর নির্দিষ্ট কামরায় তুলে দিল। খবরটি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় স্টেশনে বেশ ভিড় হয়েছিল। বাড়ির যারা জব্বলপুর গিয়েছিলাম, প্রায় সকলেই তাঁকে বিদায় জানাবার জন্য স্টেশনে উপস্থিত ছিলাম।

তাঁর জাহাজ বোম্বাই ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তাঁকে মুক্তি দেয়নি। জব্বলপুর জেলে বাবা একলা পড়ে গেলেন। তাঁর স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়তে লাগল। বাবার স্বাস্থ্য ও পারিবারিক সমস্যা নিয়ে সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা ও লেখালেখি আরম্ভ হল। আমাদের পরিবারের দুই বন্ধু প্রভাসচন্দ্র বসু ও নৃপেন্দ্রচন্দ্র মিত্র এবং মামা অজিতকুমার দে উঠে পড়ে লাগলেন। বাবার গ্রেপ্তারের পর দিল্লির সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে বিরোধীপক্ষ থেকে মাঝে মাঝে নানারকম প্রশ্ন তোলা হত। ইংরেজ সরকারের পক্ষ থেকে একবার হোম মেম্বার চক্ষু বক্তবর্ণ করে বলে বসলেন, “গভর্নমেন্ট হ্যাভ রিসনস টু বিলিভ দ্যাট হি ইজ ডিপলি ইনভলভড় ইন দি টেররিস্ট মুভমেন্ট।” (সরকারের বিশ্বাস করার কারণ আছে যে, তিনি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।) সুতবাং সরকার বাবাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনবার প্রস্তাব বিবেচনা করতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। অনেক চেষ্টার পর, বাবার স্বাস্থ্য যখন সত্যিই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন তারা বাবার কার্শিয়ঙের বাড়িতে তাঁকে বন্দী করে রাখতে রাজি হল।

নিজের বাড়িতে পাহারাওয়ালা-বেষ্টিত হয়ে বন্দী হয়ে থাকাটা একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। বাবা পথ দেখালেন। পরে ১৯৩৬-এ রাঙাকাকাবাবুও একই ভাবে কার্শিয়ঙে আমাদের বাড়িতে বন্দীজীবন যাপন করেন।

রাঙাকাকাবাবু ইউরোপ চলে যাবার পরে ও বাবা কার্শিয়ঙে স্থানান্তরিত হবার পরে মা আমাকে নিয়ে পুরীতে দাদাভাই ও মাজননীর সঙ্গে দেখা করতে যান। মায়ের উদ্দেশ্য ছিল দাদাভাইকে অবস্থাটা পুরোপুরি বুঝিয়ে বলা। মা যে দিল্লিতে নিজে দরবার করেও ইউরোপ যাবার আগে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দাদাভাই ও মাজননীর দেখা করার ব্যবস্থা করতে পারেননি, সেজন্য মায়ের গভীর দুঃখ ছিল। ফলে দাদাভাইয়ের সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর আর

HFIL

জীবনে দেখা হয়নি। মাকে সান্ত্বনা দিয়ে দাদাভাই সেই সময় বলেছিলেন, “তোমাকে তো আমি আমার ‘মাজননী’ বলেই এতদিন জানতাম, দুঃখ কোরো না, তুমি তো আজ আমার ছেলের কাজ করলে।”

পুরী থেকে ফিরে মায়ের সঙ্গে আমরা সকলে ছুটির সময় সরকারের অনুমতি নিয়ে বাবার কাছে আমাদের গিধাপাহাড়ের বাড়িতে থাকতে গেলাম। বাড়িটি কার্শিয়াং শহর থেকে বেশ কিছু দূরে এবং মোটরের রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা ওপরে। দিনরাত রাইফেলধারী ডবল-ডবল সিপাই বাড়িটি পাহারা দিত। তা ছাড়া আমাদের সন্দেহ হত যে, আরও জনাকয়েক স্থানীয় বাসিন্দাকেও কিছু পারিশ্রমিক দিয়ে পুলিশ তাদের কাজে লাগাত। কার্শিয়াং থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার সব সময় কড়া নজর রাখতেন। দার্জিলিংয়ের ইংরেজ ডেপুটি কমিশনারও নিয়মিত এসে সব ব্যবস্থা দেখে যেতেন। বাবার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন সিভিল-সার্জন মেজর এস বি মুখার্জি। মেজর মুখার্জির মতো নিষ্ঠাবান ভদ্রলোক কমই দেখেছি। সরকারি কাজ করতে এসে বাবার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা বহুদিন অব্যাহত ছিল। পরে মেজর মুখার্জির অকস্মাৎ মৃত্যুতে বাবা ভ্রাতৃবিয়োগের ব্যথা পেয়েছিলেন এবং তাঁর পরিবারের কষ্ট লাঘব করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন।

স্বাস্থ্যের কারণে সরকার বাবাকে পুলিস পাহারায় বিকেলে হিলকার্ট রোডে ওপরের দিকে এক মাইল ও নীচের দিকে এক মাইল বেড়াতে দিত। আমরাও বাবার সঙ্গে বেড়াতাম। মাঝে মাঝে বেড়াবার সময় রাস্তায় অঘটন ঘটে যাবার উপক্রম হত। যাঁরা দার্জিলিং বা ঐ অঞ্চলে বেড়াতে যেতেন, তাঁদের ঐ রাস্তা দিয়েই যেতে হত। বাবাকে দেখতে পেয়ে অনেকে উত্তেজিত হয়ে গাড়ি থামিয়ে কিছু বলবার চেষ্টা করতেন। পেছনেই তো পুলিস। বাবা মুখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন কথা বলা বাবণ।

গ্রেপ্তার, খানাতল্লাশি, নিবাসন সম্বন্ধে তো কত কথা বললাম। একটা কথা এই সূত্রে না বলে পারছি না। আজকালকার ছেলেমেয়েরা এসপ্ল্যানেডে যে মাঝে মাঝে গ্রেপ্তার গ্রেপ্তার খেলা দেখে, এখানে-ওখানে রিলে-অনশন, চব্বিশ ঘণ্টার অনশনের গল্প শোনে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমরা কিন্তু এ ধরনের ফাঁকি দিয়ে দেশ উদ্ধারের প্রহসনের সাক্ষী ছিলাম।

। গ্রেপ্তার বা খানাতল্লাশি বা অনশন ছিল অতি গুরুতর ও সর্বনাশা ব্যাপার। ব্যক্তির পক্ষে তো বটেই, বহু পরিবারের ক্ষেত্রেও। বিশেষ করে সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসু ও বাংলার বিপ্লবীরা সংগ্রামের এসব হাতিয়ার কখনও ফাঁকা লোক-দেখানো তামাশার মতো ব্যবহার করতেন না। যখন পুরনো দিনের কথা লিখি, তখন ভাবি, কবে আবার অকৃত্রিম দেশপ্রেম ও আদর্শবাদের ঢেউ বাংলা তথা ভারতবর্ষকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

॥ ১৬ ॥

কার্শিয়ঙে গিধাপাহাড়ে আমাদের বাড়ি ও নীচে আঁকাবাঁকা হিলকার্ট রোডের সঙ্গে বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর স্মৃতি আমার মনে মিশে আছে। কারণ ঐ বাড়িতে দু’জনকে খুব কাছ থেকে দেখেছি এবং দু’জনের সঙ্গেই হিলকার্ট রোডে যে কত বেড়িয়েছি তার হিসেব নেই। লেখাপড়ার ব্যাপারে বা জীবনের ছোট বড় মূল প্রশ্ন নিয়েই, অনেক শিক্ষা সেখানেই

পেয়েছি। এখনও প্রায়ই মনে পড়ে, গিধাপাহাড়ের বাড়ির বসবার ঘরে বাবা বিবেকানন্দের বক্তৃতা তাঁর দরাজ গলায় শোনাচ্ছেন। রাঙাকাকাবাবু আন্তজাতিক রাজনীতির কথা সহজ করে বোঝাচ্ছেন, বা তাঁদের সঙ্গে হিলকার্ট রোডে বেড়াচ্ছি, কথা বলছি, আর মধ্যে মধ্যে খুব আওয়াজ করে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের খেলনার মতো রেলগাড়ি নাচতে নাচতে চলে যাচ্ছে।

বাবা যখন কার্শিয়ঙে বাড়িতে বন্দীজীবন যাপন করছেন, আমি তখন ইস্কুলের মাধ্যমিক স্তরে প্রবেশ করেছি। দেখা যায় বিপর্যয়ের মধ্যেও অনেক সময় কিছু কল্যাণ হয়।

বাবা কার্শিয়ঙে বন্দী থাকার সময় ইস্কুলে ছুটি হলেই আমরা মা’র সঙ্গে সকলে মিলে তাঁর কাছে গিয়ে থাকতাম। সরকারের এই অনুগ্রহে আমার বিশেষ একটা লাভ হয়েছিল। বাবার কাছে কিছু লেখাপড়া করবার সুযোগ পেয়েছিলাম। প্রথমত, বাবার বোধহয় মনে হয়েছিল যে, আমার ইংরেজি ভাষার জ্ঞান যথেষ্ট নয়। সেজন্য যখন কাছে থাকতাম না তখন। আমাকে ইংরেজিতে চিঠি লিখতে বলতেন। চিঠিগুলির ভুলত্রুটি দাগ দিয়ে সংশোধন করে ফেরত পাঠিয়ে দিতেন। কাছে থাকলে কী কী বাবা পড়াতেন বা পড়তে বলতেন সে সম্বন্ধে কিছু বলি।

আমার মনে হয় বাবার বিশ্বাস ছিল যে, ভাষা ও সাহিত্যেই আমাদের শিক্ষার বুনিয়াদ। আমরা যা কিছু পরে শিখি সবই ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে আমাদের গভীরে প্রবেশ করে–সেটা আদর্শগত ব্যাপারই হোক বা বিজ্ঞান-ইতিহাস-রাজনীতি যাই হোক না কেন। আর একটা কথা বাবা খুব জোর দিয়ে বলতেন, ভাষা ভাল করে শিখতে হলে মুখস্থ করা চাই। অনেকেই জানেন যে, বাবা ইংরেজ কবি মিলটনের কাব্য প্যারাডাইস লস্ট’ অনর্গল মুখস্থ বলে যেতে পারতেন। কলেজে ঢোকার পর সেই কাব্যের অংশবিশেষ মুখস্থ করতে আমরা তো হিমশিম খেতাম।

বাঙলা ভাষার ক্ষেত্রে বাবা প্রথমেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনা পড়তে বলেন। শুধু পড়াই নয়, বঙ্কিম গ্রন্থাবলী থেকে কতকগুলি লম্বা লম্বা রচনা মুখস্থ করতে হত। মনে আছে আমার দিদি মীরাকে ও আমাকে কমলাকান্তের ‘আমার দুর্গোৎসব’ পুরোটা মুখস্থ করে বাবাকে শোনাতে হয়েছিল। প্রাণ যায় আর কী। কেবল মুখস্থ হলেই চলবে না, উচ্চারণ ও পড়ার কায়দা ঠিক হওয়া চাই। কযেকটা অংশ এখনও ঠিক মুখস্থ আছে :

“সপ্তমী পূজার দিন কে আমাকে এত আফিঙ্গ চড়াইতে বলিল। আমি কেন আফিঙ্গ খাইলাম। আমি কেন প্রতিমা দেখিতে গেলাম।”

“আমি এই কালসমুদ্রে মাতৃ-সন্ধানে আসিয়াছি। কোথা মা? কই আমার মা? কোথায় কমলাকান্ত-প্রসূতি বঙ্গভূমি?”।

“এস ভাই সকল! আমরা কালস্রোতে ঝাঁপ দিই! এস আমরা দ্বাদশ কোটি ভুজে ঐ প্রতিমা তুলিয়া মাথায় বহিয়া, ঘরে আনি…ভয় কী? না হয় ডুবিব, মাতৃহীনের জীবনে কাজ কী?…”।

ইংরেজি শেখাতে বাবা একদিকে বাইবেল, অন্যদিকে বিবেকানন্দের গ্রন্থাবলী পড়াতেন। তিনি নিজে কোরানও পড়তেন। বাবা বলতেন ভাল ইংরেজি শিখবার প্রথম পদক্ষেপ মন দিয়ে বাইবেল পড়া। বাইবেলের অনেক অংশও আমাকে মুখস্থ করতে হত। ইংরেজিতে

বিবেকানন্দের সম্পূর্ণ গ্রন্থাবলী বাবার কাছে ছিল। পরিচ্ছেদ বেছে বেছে পড়তে দিতেন। শিকাগোর পালামেন্ট অব রিলিজনস-এ বিবেকানন্দের ইংরেজি বক্তৃতা মুখস্থ করতে হয়েছিল। এখনও বেশ খানিকটা মুখস্থ আছে। বাবা বলতেন,বিবেকানন্দের মতো ইংরেজি লেখা তিনি খুব কমই পড়েছেন। আর ভাষার মধ্য দিয়ে তাঁর বাণী যদি নিতে পারা যায় তাহলে তো কথাই নেই। এখনও বাবার গলায় শুনতে পাই বিবেকানন্দের সেই বিখ্যাত বক্তৃতা থেকে কয়েকটি লাইন : May the bell that tolled this morning in honour of this convention be the death knell of all fanaticism, of all persecution with the sword or with the pen and of all uncharitable feelings between persons wending their way to the same goal.

ইংরেজি কবিতাও মুখস্থ করে শোনাতে হত। শেলির ‘দি স্কাইলার্ক’ পুরোটা কণ্ঠস্থ করে বাবার কাছে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল–আরও ছিল কোলরিজের ‘দি এনসিয়েন্ট মেরিনার।

বাবা ‘গল্পগুচ্ছ’ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ পড়া আরম্ভ করতে বলেছিলেন। বিদেশী গল্পের ক্ষেত্রে রাশিয়ান লেখকরা ছিলেন বাবার খুব প্রিয়, বিশেষ করে লিও টলস্টয়। টলস্টয়ের ‘টোয়েন্টিথ্রী টেলস’ আমাকে প্রথম পড়তে দিয়েছিলেন। পরে টলস্টয়ের কিছু-কিছু প্রবন্ধও পড়িয়েছিলেন। বাবা বলতেন যে, গান্ধীজি অনেক ব্যাপারেই টলস্টয়পন্থী ছিলেন। পরে বড় হয়ে বাবার সংগ্রহ থেকে টলস্টয়ের ও টুর্গেনিভের বড় বড় উপন্যাস পড়েছি।

কার্শিয়ঙে গিয়ে বাবার শরীরের কিছু উন্নতি হল। যদিও বন্দী হয়ে থাকার যে অশান্তি, সে তো যাবার নয়। অন্যদিকে ইউরোপ-প্রবাসী রাঙাকাকাবাবুকে নিয়ে বাবা-মার খুব চিন্তা। মাঝে মাঝে বিভিন্ন ডাক্তারের মতামত রাঙাকাকাবাবু জানাচ্ছেন, কোনোটা আশাপ্রদ, আবার কোনোটা নয়। নানা রকমের চিকিৎসা তিনি করাচ্ছিলেন। বেশ কিছুদিন তো ভিয়েনা ছেড়ে চেকোস্লোভাকিয়ার কার্লসবাদ স্বাস্থ্যনিবাসে গিয়ে সেখানকার প্রাকৃতিক উষ্ণ। জল অনেক খেলেন। কিন্তু তাঁর গল-ব্লাডার’ বা পিত্তকোষের অসুখ কিছুতেই বাগ মানছিল না। শেষ পর্যন্ত অস্ত্রোপচার করাতেই হয়, সেকথা পরে বলব।

ইউরোপে চিকিৎসা তো হবে, কিন্তু খরচ? সেটাও একটা বড় চিন্তা। বাবা জেলে যাওয়ার পর কটকের সংসার চালাবার জন্য দাদাভাই জানকীনাথকে আবার কোর্ট বেরোতে হয়। আমাদের জন্য শেষ পর্যন্ত দিল্লির সরকার যে ভাতা মঞ্জুর করেন তার পরিমাণ বাবার মাসিক আয়ের তিরিশ ভাগের একভাগ হবে! বাবার যা কিছু জীবনবীমার পলিসি ছিল সে তো সব ভেস্তে গেল। এই অবস্থায় আমার মাকে রাকাকাবাবুর জন্য অন্য পথ খুঁজে বের করতে হল। ঐ সূত্রে দুজনের কথা বিশেষ করে বলছি। একজন ছিলেন নাড়াজোলের কুমার দেবেন্দ্রলাল খান, মেদিনীপুরের বিপ্লবীদের পিতৃতুল্য রাজা নরেন্দ্রলাল খানের ছেলে। দেবেন্দ্রলাল খান এগিয়ে এলেন বাঙাকাকাবাবুর জন্য অর্থ-সাহায্য নিয়ে। মাকে বললেন, এ সাহায্য গ্রহণ করতে যেন কোনো দ্বিধা না করেন, কারণ তিনি কেবল একটি জাতীয় কর্তব্য করছেন। সেই থেকে দেবেন্দ্রলালও আমাদের আর এক কাকাবাবু হয়ে গেলেন, এবং দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমে খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। বাবা দেবেন্দ্রলালের কোনো সামাজিক আমন্ত্রণও কখনও এড়িয়ে যেতে পারতেন না। বলতেন, ওখানেও চিরকালের জন্য আমরা বাঁধা পড়ে আছি!

৫৪

ব্যারিস্টারিতে বাবার ‘গুরুজী ছিলেন স্যার নৃপেন্দ্রনাথ সরকার। রাজনীতিতে তাঁদের মতামত ছিল সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুজনের মধ্যে ছিল গভীর প্রীতির সম্পর্ক। বাবার কাছে শুনেছি, দেশবন্ধু প্রায়ই বলতেন, লাইফ ইজ লারজার স্যান পলিটিকস। বাবা ও নৃপেন্দ্রনাথের সম্পর্কটা ছিল এর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখন তো দেখছি উলটো কথা শেখানো হয়। বোধহয় অনেকে আজও জানেন না কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট জেনারেল ও পরে ভারত সরকারেব ল মেম্বার স্যার নৃপেন্দ্রনাথ সরকার সুভাষচন্দ্র বসুর ইউরোপে চিকিৎসার জন্য গোপনে মাকে অর্থ সাহায্য করতেন। সরকার সাহেবের সঙ্গে এই সূত্রে দেখা করতে মা বেশ কয়েকবার আমাকে সঙ্গে কার তাঁর এলগিন রোডের বাড়িতে নিয়ে গেছেন। সরকার-সাহেব গভীর মেহের সুরে বাবা ও বাঙাকাকাবাবুর খবর নিতেন এবং অতি নম্রভাবে একটি খাম মার দিকে এগিয়ে দিতেন।

বাবার কাছে লেখাপড়ার কথা বললাম। বাড়ির ছেলেমেয়েদের আরও একটা বিধান ছিল-সন্ধ্যাবেলা একসঙ্গে বসে স্তোত্র পাঠ। এটা বোধহয় রাঙাকাকাবাবুই আরম্ভ করে দিয়েছিলেন, কারণ বড় ভাইবোনেদের কাছে শুনেছি ছেলেবেলায় তাঁদেরও এলগিন রোডের বাড়ি. এটা করতে হত। আমাদের স্কুলজীবনে উডবার্ন পার্কেও ঐ নির্দেশ জারি ছিল, কিন্তু কাশিয়ঙে গেলে স্তোত্রপাঠের অধিবেশন প্রতি সন্ধ্যায় বসবেই। আমাদের প্রত্যেকের নিজের নিজের স্তবের খাতা ছিল এবং স্তবগুলি মুখস্থ করতে হত। দুটি স্তবের কয়েকটি মনে আছে। একটি ভবানী-স্তোত্র :

ন তো ন মাতা ন বন্ধুনদাতা। ন পুত্রো ন পুত্রী ন ভূতত্যা ন ভর্তা ন জায় ন বিদ্যা ন বৃত্তি মমৈৰ

গতিস্তং গতিস্তং ত্বমেকা ভবানী। অন্যটি ছিল শিবস্তোত্র :

প্রভুমীশমনীশমশেষগুণম গুণহীনমহীশ গরলাভরণ, রণনির্জিতদুর্জয়দৈত্যপুরম্। প্রণমামি শিবং শিবকল্পতরুম।

॥ ১৭ ॥

ব্রিটিশ সরকার ইউরোপ যাওয়র ব্যাপারে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে একটা চাতুরি করেছিল। ১৯৭১ সালে লণ্ডনের ইণ্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে পুরনো নথিপত্র দেখতে গিয়ে আমি এটা বুঝতে পারি। একদিকে তো লণ্ডন থেকে ইণ্ডিয়া অফিস (মানে সেকালকার আমাদেব দেশশাসনের হতাকতারা) ইউরোপের নানা দেশে ইংরেজ সরকারের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, অতি বিপজ্জনক এক ব্যক্তি ইউরোপে এসেছেন, তাঁর উপর যেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা হয়। অন্যদিকে তাঁদের জানাচ্ছেন যে, সুভাষচন্দ্র বসুর পাসপোর্টে গস্তুব্যস্থান হিসাবে ইটালি ও অস্ট্রিয়া এই দুটি দেশের নাম লেখা আছে। এতে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, অন্য কোনো দেশে, যেমন ইংল্যাণ্ড, যাবার ছাড়পত্র তাঁর

নেই। আসলে কিন্তু তারা গোপনে স্বীকার করছে যে, ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষের যে-কোনো অধিবাসীর (যার ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান পাসপোর্ট আছে) ইংল্যাণ্ডে যাবার অধিকার আছে। আবার বলছে যে, সুভাষচন্দ্র বসুর একটা ধারণা হয়েছে যে, তাঁর ইংল্যাণ্ডে যাবার ছাড়পত্র নেই, এই ভুল ধারণাটা যেন ব্রিটিশ কূটনীতিকেরা ভেঙে না দেন! কারণ, দুটি জায়গা থেকে তাঁকে দূরে রাখা বিশেষ দরকার-লণ্ডন ও বার্লিন। ঐ দুটি জায়গায় অনেক ভাবতীয় ছাত্র আছে। ইংরেজ সরকারের ভয়, সুভাষচন্দ্রের প্রভাব তাদের উপর পড়লে সমূহ বিপদ। যাই হোক, তিরিশের দশকে এই চাতুরি কাজ করলেও, চল্লিশের দশকে বিশ্বযুদ্ধর মধ্যে রাঙাকাকাবাবু ব্রিটিশ সরকারকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে তাদের ছাড়পত্র বিনাই তিনি পৃথিবীর যে-কোনো দেশে ইচ্ছামতো বিচরণ করতে পারেন।

১৯৩৪-এর মাঝামাঝি, রাঙাকাকাবাবু যখন ইউরোপে ও বাবা কার্শিয়ঙে অন্তরীণ, দাদাভাই জানকীনাথ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে শেষ পর্যন্ত কটক থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হল। প্রায় মাস তিনেক ধরে যমে-মানুষে লড়াই চলল।

১৯৩১ সালে আমাদের কাকাবাবু শৈলেশচন্দ্রের বিয়ে ছিল দাদাভাইয়ের জীবনের শেষ আনন্দোৎসব। ছোটকাকা সন্তোষচন্দ্র আগেই মারা গিয়েছিলেন, ফলে কাকাবাবুই সেই সময়। বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ। তাঁর বিয়েতে বসু-বাড়ির যে যেখানে আছেন, কলকাতায় এসে মিলিত হন। বিয়ের পর ১নং উডবার্ন পার্কের মাঠে বৃহত্তর বসু-পরিবারের একটা গ্রুপ ফোটোগ্রাফ তোলা হয়। শ’খানেক লোক–বসু বাড়ির চার পুরুষ একসঙ্গে। ছবিটা তুলতে ফোটোগ্রাফারকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল, কারণ ক্যামেরার পরিধির মধ্যে সকলকে ধরানোই যাচ্ছিল না। আমাদের সৌভাগ্য, রাঙাকাকাবাবু বিয়ের সময় জেলের বাইরে ছিলেন এবং সব অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন।

১৯৩১ সালের পর থেকে নানারকম পারিবারিক বিপর্যয়বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর গ্রেফতার এবং একের পর এক নিকট-আত্মীয় ও কনিষ্ঠদের মৃত্যু–দাদাভাইয়ের শরীর ও মন ভেঙে দিয়েছিল। এলগিন রোডের বাড়িতে তাঁর জীবনের শেষ দু-তিন মাসের স্মৃতি আমাদের সকলের মনেই খুব বেদনার উদ্রেক করে। বেশ কিছুদিন তিনি একেবারেই শয্যাগত ছিলেন। তাঁর চিকিৎসার সব ব্যবস্থা নতুনকাকাবাবু করেছিলেন, বাড়িতে বড় বড় ডাক্তাব-কবিরাজের ক্রমাগতই আনাগোনা। আত্মীয়স্বজন বন্ধুরা প্রায় সব সময়েই ভিড় করে থাকতেন। বিশেষ করে সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে তিল ধারণের জায়গা থাকত না। এখন তো গুরুতর অসুস্থ রোগীর ঘরে ডাক্তাররা কাউকে ঢুকতেই দেন না। আর আজকাল বেশি অসুখ করলে তো হাসপাতালে দেওয়াই বেওয়াজ। দাদাভাইয়ের ঘর–যেটা এখন নেতাজীর ঘর বলে সকলে জানে–প্রায়ই ভরে থাকত। আমি আজ ডাক্তার ও মানুষ হিসাবে প্রায়ই ভাবি, কোনটা ঠিক–অসুস্থ অবস্থায় আত্মীয়স্বজন বন্ধু-পরিবৃত হয়ে বাড়িতে থাকা, না হাসপাতাল বা নার্সিং হোমের এক নির্জন ঘরে একলা-একলা দিন গোনা। যাই হোক, ছেলেবেলায় কিন্তু আমার কখনোকখনো মনে হয়েছে যে, দাদাভাইয়ের ঘরে বড় বেশি লোক ভিড় করে থাকে, সকলেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চায় এবং অতিরিক্ত গোলমাল হয়। তা ছাড়া প্রায়ই হঠাৎ-হঠাৎ যখন দাদাভাইয়ের অবস্থা আশঙ্কাজনক হত তখন চারিদিকে খবর পাঠানো হত ও বাড়িতে লোক ভেঙে পড়ত। মৃত্যুপথযাত্রী এক বৃদ্ধের কানের কাছে সমবেত কণ্ঠে ও সরবে নামকীর্তন শুনে আমি তো বেশ হকচকিয়ে যেতাম।

ডাক্তাররা যখন বুঝলেন যে, সে-যাত্রায় দাদাভাইয়ের রক্ষা পাবার আশা কম, তখন বাবাকে গৃহবন্দী অবস্থায় কলকাতায় এনে রাখবার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হল। অনুসন্ধান করে সরকার যখন আশ্বস্ত হলেন যে, দাদাভাইয়ের জীবনসংশয় সম্বন্ধে কোনো সংশয় নেই, তখন তাঁরা বাবাকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করলেন। বাবা উডবার্ন পার্কের বাড়তেই গৃহবন্দী হলেন, তবে তাঁকে এলগিন রোডের বাড়িতে যাওয়া-আসা করার অনুমতি দেওয়া হল। দিনের বেশির ভাগটাই বাবা এলগিন রোডের বাড়িতে দাদাভাইয়ের কাছে কাছে থাকতেন। দুই বাড়ির মধ্যে ব্যবধান তো খুবই কম, যাওয়া-আসা হেঁটেই করতেন। সেই সময় গোয়েন্দাদের কড়া পাহারা খুব নজরে পড়ত। মনে আছে, বাবা বা রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে যখনই আমরা হেঁটে এবাড়ি-ওবাড়ি করতাম, তাঁরা আমাদের রাস্তায় পৃলিসের চর বা “টিকটিকি”দের চিনিয়ে দিতেন। তাদের হাবভাব ও আচরণে এমন একটা বিশেষত্ব ছিল যে, ভাল করে নজর করলেই আন্দাজ করা যেত তারা কী জাতের লোক। পরে “টিকটিকি” চিনে নেবার ক্ষমতা নিজের জীবনে বেশ কাজ দিয়েছিল।

দাদাভাই মাঝে-মাঝে যখন খানিকটা সুস্থ বোধ করতেন, বাবাকে কাছে ডেকে তাঁর মাথায় হাত দিয়ে অনেক মনের কথা বলতেন। একদিন খুব আবেগের সঙ্গে বাবাকে বলেছিলেন, “তুমিই বসু বাড়ির মধ্যমণি এবং আমার বিশ্বাস, বংশের মর্যাদা তোমার হাতে অক্ষুণ্ণ থাকবে।” দাদাভাইয়ের মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে বাবাকে একটা মর্মান্তিক কাজ করতে হয়েছিল। ডাক্তাররা যখন জবাব দিয়ে গেছেন এবং সকলেই দাদাভাইয়ের শেষ দিনের অপেক্ষায় রয়েছেন, বাবা এলগিন রোডের বাড়িতে শান্তভাবে বসে সরকারকে একটি চিঠি লিখলেন। লিখলেন যে, তাঁর বাবার জীবন তিলে তিলে শেষ হয়ে আসছে, সরকার

যেন আগে থেকেই তাঁকে পিতার শেষকৃত্য করবার জন্য এবং তাঁর শেষ-যাত্রায় অংশ গ্রহণ করবার অনুমতি দিয়ে রাখেন। কারণ, কখন কী হয় তা বলা যায় না। রাজবন্দীদের সম্বন্ধে যে-কোনো সরকারি সিদ্ধান্তই সময়সাপেক্ষ। কী জানি কেন, বাবা ঐ চিঠির খানিকটা আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন।

একেবারে শেষের দিকে ঠিক হল যে, দাদাভাইকে শেষ দেখার জন্য বাঙাকাকাবাবুকে ইউরোপ থেকে এবোপ্লেনে আনানো হবে। আমার মনে হয়, এটাই ছিল রাঙাকাকাবাবুর প্রথম এরোপ্লেন-যাত্রা। সেকালে রাত্রে এরোপ্লেন চলত না। গতিও ছিল আজকের তুলনায় খুবই মন্থর। ইউরোপ থেকে ভারতে আসতে দিন তিনেক লেগে যেত। অনেক চেষ্টা করেও রাঙাকাকাবাবু ঠিক সময়ে কলকাতায় পৌঁছতে পারলেন না-দেড় দিন দেরি হয়ে গেল।

এদিকে ইংরেজ সরকার তাদের পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলেছে। আমরা দল বেঁধেই দমদম বিমানবন্দরে গিয়েছি। বিমানবন্দরটি তখন ছিল নেহাতই ছোট। এরোপ্লেনের হ্যাঁঙ্গার ছাড়া ঘরবাড়ি কিছু ছিল না। কিন্তু বন্দরের এলাকাটা বেশ বড়ই ছিল। আমরা সেখানে পৌঁছে দেখলাম, পুলিস চারিদিক থেকে বিমানবন্দরটি ঘিরে ফেলেছে, কারুর ঢোকবার বা বেরোবার অনুমতি নেই। বেশ কিছুক্ষণ পুলিসের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা চলল, কিন্তু কোনো রকমেই বিমানের কাছাকাছি আমরা যেতে পারলাম না। বিমান থেকে নামতেই রাঙাকাকাবাবুর উপর একটা কড়া আদেশ জারি হল। তাঁকে এলগিন রোডের বাড়িতে অন্তরীণ হয়ে থাকতে হবে, সেই অবস্থাতেই তাঁকে স্বৰ্গত পিতার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করতে হবে এবং তারপর আবার ইউরোপ পাড়ি দিতে হবে। পুলিসের গাড়িতে পাহারা সমেত

তাঁকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেল।

এলগিন রোডের বাড়ির গাড়িবারান্দায় বাবার সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর আবেগরুদ্ধ পুনর্মিলনের দৃশ্য আমার বেশ মনে আছে।

॥ ১৮ ॥

বড় একটা পরিবারের মাথার উপরে যিনি থাকেন, তাঁর ব্যক্তিত্ব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সকলকে কেমন একসূত্রে বেঁধে রাখে, তার একটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ছিলেন আমাদের দাদাভাই জানকীনাথ। সব বড় বড় পরিবারের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ধারা থাকে, বসুবাড়িতেও ছিল। যেমন একদিকে এক বৈল্পবিক ধারা ও ত্যাগধর্মী মানুষ, তেমনই অন্যদিকে গোঁড়া সংস্কারের ধারা ও পুরোপুরি সংসারধর্মী বিষয়ী মানুষ। এই দুই বিপরীত ধারার মধ্যে আবার বেশ কিছু পাঁচমেশালি লোক। যা একটা বড় পরিবারের বেলায় খাটে, দেশ ও জাতির ক্ষেত্রেও বোধহয় সেটা সত্য! দাদাভাই ছিলেন নানা রঙের ও নানা ধর্মের এই বসু বাড়ির সমন্বয়ের প্রতীক। দেশ ও জাতিকে এক করে রাখার জন্যও এই ধরনের প্রতাঁকের প্রয়োজন হয়।

দাদাভাইয়ের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে বসুবাড়ির ইতিহাসের একট যুগ শেষ হয়ে গেল। যে-সব বাড়ির বড় ঐতিহ্য আছে, একটা জেনারেশনের অবলুপ্তির পর সেই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার কে বহন করবে এটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই এরকম ঘটনার পর বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারটাকেই বড় করে দেখেন। বসু বাড়িতেও স্বাভাবিকভাবে এই প্রশ্ন উঠেছিল, কিন্তু, সুখের বিষয়, ব্যাপারটার সুষ্ঠুভাবে এবং সর্বসম্মতিক্রমে সমাধান হয়ে গিয়েছিল। আদর্শগত ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার স্বাভাবিকভাবেই বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর উপর পড়ল, কারণ বসু বাড়িতে তাঁরা দুজনই দেশের ও দশের কাজে ব্রতী ছিলেন।

দাদাভাইয়ের তিন ভাইয়ের মধ্যে আমরা কেবল আর-একজনকেই দেখেছিলাম। দাদাভাই ছিলেন সবচেয়ে ছোট, তাঁর উপরেই ছিলেন সেজ-দাদাভাই, দেবেন্দ্রনাথ। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন পণ্ডিত লোক। সারা জীবন শিক্ষকতা করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত

অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। অবসর নেওয়ার পর উত্তর কলকাতার বাদুড়বাগানে থাকতেন। মা’র। সঙ্গে অনেকবার তাঁর বাড়ি গিয়েছি। তিনি দাদাভাইয়ের মতোই অতান্ত সুপুরুষ ছিলেন এবং তাঁকে দেখলেই শ্রদ্ধার ভাব জাগত। শিক্ষক হিসাবে তাঁর নিজের পরিবারেও তিনি বেশ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। নিজের স্ত্রী ও কন্যাকে একেবারে প্রথম পাঠ থেকে শুরু করে ইংরেজি সাহিত্যের উঁচু স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। মা’র কাছে শুনেছি, আমাদের সেজ-দিদিমণি মাত্র অক্ষর-পরিচয় নিয়ে বাড়িব বউ হয়ে এসেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে শেক্সপীয়র মিলটন আলোচনা করতেন। দেবেন্দ্রনাথ দাদাভাইয়ের মৃত্যুর বছর চারেক আগেই মারা যান।

আমাদের ছয় পিসির মধ্যে একজনকে তো আমি দেখিনি। ন-পিসিমা অল্পবয়সেই মারা যান। কিন্তু ন-পিসেমশাই সরোজেন্দ্রকুমার দত্ত ও তাঁর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বসবাড়ির ঘনিষ্ঠতা চিরকাল বজায় ছিল। বড়-পিসিমা প্রমীলা অল্পবয়সেই বিধবা হন। বাবা প্রায়ই তাঁকে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে এনে রাখতেন। সেই সময় আমি প্রায়ই রাত্রে বড়পিসিমার হেফাজতে থাকতাম। রাত্রে তাঁর ভাল ঘুম হত না, অনেকক্ষণ বই পড়তেন–বেশির ভাগই

৫৮

সুঠার পিৎ শ্রদ্ধে এমন ভোর্সনে।

মিং এ ২ »া®ff-য়।

my by be morfn. ১৭ পৌষ ১৩৫১

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অটোগ্রাফ। কিন্তু ইংরেজি বই। কথা বলবার জন্য নানা অজুহাতে আমাকে জাগিয়ে রাখবার চেষ্টা করতেন। তাঁর ইংরেজির জ্ঞান ও উচ্চারণ খুব ভাল ছিল এবং অনেক সময়ে ভাইপো-ভাইঝিদের ইংরেজি উচ্চারণ শুধরে দিতেন। বড়-পিসিমার হাতের নিরামিষ রান্না ছিল উৎকৃষ্ট, আমরা তো তাঁর হাতের রান্না খাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতাম।পরে অনেক সময় ভেবেছি, এরকম সর্বগুণসম্পন্ন মহিলাদের জীবন অকাল-বৈধব্যের ফলে আমাদের সমাজে কেমন যেন বিস্বাদ ও বিফল হয়ে যায়। পিসিমাদের সম্বন্ধে সাধারণভাবে বলতে পারি, তাঁদের স্বভাবের মাধুর্যই আমার মনে গেঁথে রয়েছে। সেজ-পিসিমা তরুবালা ও নতুন-পিসিমা প্রতিভা তো খুবই কোমল স্বভাবের ছিলেন। এরই মধ্যে মেজ-পিসিমা সরলা। ও ছোট-পিসিমা কনকলতা ছিলেন একটু মেজাজি।

গভীর শোকের মধ্যে হলেও ১৯৩৪-এর শেষে বাবা ও রাঙাকাকাবাবু নিজেদের মধ্যে পরামর্শ ও আলোচনার বেশ একটা ভাল সুযোগ পেয়েছিলেন। রাঙাকাকাবাবু প্রায় দু বছর ইউরোপ প্রবাসের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে বাবাকে ওয়াকিবহাল করতে পেরেছিলেন। আমার মনে হয়, দুই ভাই তাঁদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনার অনেকটাই সেই সময় ছকে ফেলেছিলেন। আমার বেশ মনে আছে, বাবা ও রাঙাকাকাবাবু এলগিন রোডের বাড়ির তিনতলার উত্তরের একটি ঘরে মেঝেতে মুখোমুখি বসে দীর্ঘ আলোচনা করছেন। তারই ফাঁকে রাঙাকাকাবাবু একদিন আমাকে উপরে ডেকে নিয়ে গিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করার পর আমি কী করব জানতে চেয়েছিলেন। আমি কেবল এইটুকুই বলতে পেরেছিলাম যে, আর্টস

পড়ে সায়ান্স পড়াটাই আমি মোটামুটিভাবে ঠিক করেছি। সিদ্ধান্তটা ঠিক হয়েছিল বলে আমি আজ মনে করি না। সেই সময় সাহস করে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে যদি বিশদ আলোচনা করতে পারতাম তাহলে খুব ভাল হত।

দাদাভাই যেদিন রাত্রে মারা গেলেন, তার পরের দিনই ছিল আমার বার্ষিক পরীক্ষার দুটি পেপার। বাবা জিজ্ঞাসা করলেন পরীক্ষা না দিলে বিশেষ কোন অসুবিধায় পড়ব কি না। দুটো পেপারে না বসেও আমি অপ্রত্যাশিতভাবে পরীক্ষায় বেশ ভাল করে ফেললাম।

৫৯

দাদাভাইয়ের মৃত্যুর পর বসু-বাড়িতে পুরো এক মাস অশৌচ পালন করা হয়েছিল। আগেই বলেছি আমাদের বাড়িতে গোঁড়ামির একটা ধারা ছিল। আচার-অনুষ্ঠানের শেষ ছিল না। অনেকেই তথাকথিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে বেশ বাড়াবাড়িই করতেন। এটা তো। সকলেরই জানা যে, বাবা ও রাঙাকাকাবাবু দুজনেই, আপাতদৃষ্টিতে নয়, অন্তরের গভীরে ধার্মিক ছিলেন। অনেক অর্থহীন আচার সম্বন্ধেও তাঁরা একটা উদার মনোভাব দেখাতেন। আমার মনে হয়, তাঁরা কারও বিশ্বাসে বা শ্রদ্ধায় অযথা আঘাত দিতে চাইতেন না। দাদাভাইয়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান বেশ বড় কবেই হয়েছিল। সাত ছেলের দানসামগ্রীর সাতটা সেট দেখে আমি তো বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। গো-দানের জন্য গোরু-বাছুরও প্যাণ্ডেলের বাইরে হাজির ছিল। তবে যখন কানাঘুষো শুনলাম যে, শ্রাদ্ধের কাজ আরম্ভ হওয়ার আগেই গেটের বাইরে দানসামগ্রী নিয়ে পুরোহিতদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের চুক্তি হয়ে গেছে, তখন ঐ ধরনের আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জোর ঘা খেল। গোরু-বাছুরের অধিকারী তো মূল্য আদায় করে তার পোেষ্য নিয়ে বাড়ি গেল।

ব্রাহ্মণ-ভোজনের এক দৃশ্য আমি কোনদিন ভুলিনি। একদল ব্রাহ্মণ এসেছেন বসু-বাড়ির দায় উদ্ধার করতে। খেতে বসেছেন ছাদে। খাবার পরিবেশনকারীরা হিমসিম খাচ্ছেন—এত তাড়াতাড়ি সব উধাও হচ্ছে। দেখি বেশ কয়েকজন ব্রাহ্মণের পাঞ্জাবির ভিতরে বেশ বড় গোছর ঝোলা! খানিকটা খাচ্ছেন, আর বেশ খানিকটা ঝোলাতে ফেলছেন।

অন্যদিকে বাবা ও রাঙাকাকাবাবু অন্য ধরনের ব্রাহ্মণ-ভোজনের ব্যবস্থা করেছিলেন। কয়েকজন পণ্ডিত ও সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ বন্ধু এসেছেন খেতে। তাঁদের জন্য ব্যবস্থা। আলাদা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আমার বোন গীতার অটোগ্রাফের খাতায় তিনি ঐ উপলক্ষে দু লাইন লিখে রেখে গেলেন।

॥ ১৯ ॥

বাবা জব্বলপুরে বন্দী থাকার সময় একবার মা আমাদের মামার বাড়িতে রেখে মামাবাবুকে সঙ্গে নিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। আমরা তো বয়সে তখন। খুবই ছোট, বাবাকে দেখতে যেতে না পারলে আমাদেব মন বেশ খারাপ হত। কথাটা শুনে বাবা সেন্সরের চোখ এড়িয়ে আমাদের নামে একখানা সুন্দর চিঠি মার হাত দিয়ে পাঠিযেছিলেন। চিঠিটির কথা আমার বেশ মনে আছে–ইংবেজিতে লেখা, শুরু করেছিলেন ‘মাই চিলড্রেন’ দিয়ে। চিঠিটি ছিল আবেগে ভরা। আমাদের মন প্রফুল্ল রাখতে বলে তিনি লিখেছিলেন যে, বিধির নিয়ম সব সময়ে আমাদের পক্ষে বোঝা সহজ নয়, কোনো মহৎ উদ্দেশ্যসাধনের জন্য বিধাতা তাঁকে এক কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছেন। এই সূত্রে বলি, বাবা ও রাঙাকাকাবাবু দুজনেই বিধাতাকে মাতৃরূপে দেখতেন। বাবার চিঠিপত্রে সেজন্য পদে-পদে ‘ডিভাইন মাদার’-এর উল্লেখ থাকত। ঐ চিঠিতে বাবা আরও বলেছিলেন যে, তাঁদের ব্যক্তিগত নিযাতনভোগের মধ্যে নিশ্চয়ই দেশ ও দেশবাসীর কোনো কল্যাণ নিহিত রয়েছে। যেদিন তাঁদের কৃচ্ছসাধন সম্পূর্ণ হবে, সেদিন তিনি আবার আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেন। আমরা তখন জানতাম না যে তিরিশের দশকের প্রথম

জেলবাসের চেয়ে আরও কঠিন পরীক্ষা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল। বিশ্বযুদ্ধের সময় দক্ষিণ ভারতে বাবার সুদীর্ঘ বন্দী-দশা তাঁর মন ভাঙতে না পারলেও স্বাস্থ্য সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দিয়েছিল।

রাঙাকাকাবাবুর জেল-জীবনের নানারকম অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে তো আগে কিছু লিখেছি। বাবা বন্দী-জীবন কেমন কাটাতেন তার একটা ধারণা দেবার জন্য জব্বলপুর জেল থেকে মা’র কাছে লেখা একখানা চিঠি থেকে খানিকটা পড়ে শোনাই।

“..তুমি আমার জন্য কিছুমাত্র চিন্তিত হইও না। আমি একলা আছি বটে, কিন্তু সত্য বলছি মন ভাঙেনি এবং আশা করি ভগবানের কৃপায় মন ভাঙিবে না। অবশ্য সুভাষ যখন ছিল তখন নানা বিষয়ে আলোচনা করিয়া সময় কাটিত; এখন সে সুযোগ নাই। তবে পড়াশুনা করিয়া সময় একরকম কাটিয়া যাইতেছে; এবং সেই জন্য আরও কিছু বইয়ের জন্য আমাকে লিখেছি। কতক বই সুভাষ লইয়া গিয়াছে। সে বচাবাব আবও কষ্ট হইবে, বিশেষত যখন শরীর অসুস্থ। তবে ভগবান তাহাকে বাল্যাবস্থা থেকে সন্ন্যাসী করিয়াছেন এবং বন্দীজীবনে সে একরকম অভ্যস্ত। সুভাষ ফিরে আসতে বোধহয় আরও তিন সপ্তাই; ততদিন পড়াশুনা লইয়া সময় কাটাইয়া দিব। মনে যে নানাবকম চিন্তা আসে না একথা বলা মিথ্যা হবে; কিন্তু তোমরা যদি সুস্থ শরীরে থাক ও মনের জোর করিয়া থাক তাহলে আমিও কতকটা নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিতে পারি। আমি শরীরের প্রতি খুব যত্ন করি এবং রান্নাব সম্বন্ধে নিজে ব্যবস্থা করি এবং কী রকম কবে রাঁধতে হবে তাহাও মাঝে মাঝে বলিয়া দি। দেখছ ত দরকার হলে এসবও করিতে পারি! যখন পড়াশুনা করিতে ভাল লাগে না, তখন কয়েদিদের সঙ্গে তাহাদের চুরি-ডাকাতির গল্প জুড়িয়া দি!…

১৯৩৫ সালের মাঝামাঝি বাবা মুক্তি পান। রাঙাকাকাবাবু এখন ইউরোপে; অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি ইউরোপের নানা দেশে যে কাজ করেছিলেন তার যথার্থ মূল্যায়ন এখনও হয়নি। মার কাছে ও বাড়ির বন্ধুবান্ধবদের কাছে রাঙাকাকাবাবু নিয়মিত চিঠি লিখতেন, তাছাড়া দেশের খবরের কাগজে যতটা সম্ভব তাঁর কাজকর্ম সম্বন্ধে খবর ছাপাবার চেষ্টা করা হত। অন্য দেশের পত্রপত্রিকায় তাঁর সম্বন্ধে যা বেরোত, তিনি প্রায়ই বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। আমরা সকলেই এই সব সূত্রে তাঁর খবর পাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। তাছাড়া তিরিশের দশকে ইউরোপ প্রবাসের সময় তিনি তাঁর বই ‘দি ইণ্ডিয়ান স্ট্রাগল ১৯২০–৩৪’ লেখেন। বইটি সহজ ও স্বচ্ছ ইংরেজিতে লেখা। সেজন্য স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও বইটি পড়তে পারে। বই লেখবার জন্য নানারকম তথ্য ও উপাদান রাঙাকাকাবাবু চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। যতটা সম্ভব সংগ্রহ করে সেগুলি তাঁকে পাঠানো হয়েছিল। তবে প্রবাসে যথেষ্ট বই বা কাগজপত্র তিনি পাননি, সেজন্য বেশির ভাগটাই তাঁকে মন থেকে লিখতে হয়েছিল। দাদাভাইকে শেষ দেখা দেখতে দেশে আসার সময় তিনি তাঁর বইয়ের পাণ্ডুলিপির একটা কপি সঙ্গে নিয়ে আসছিলেন, কিন্তু দেশের মাটিতে পা দেওয়া মাত্র কবাচিতে পুলিস সেটা বাজেয়াপ্ত করে নেয়। বইটি পরের বছরের গোড়ায় লণ্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। কিন্তু কালক্ষেপ না করে ব্রিটিশ সরকার সেটা ভারতে নিষিদ্ধ করে দেয়। এই বই লেখার সূত্রেই রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে পরবর্তীকালে আমাদের কাকিমা শ্ৰীমতী এমিলি শেঙ্কেলের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়। তাছাড়া ভিয়েনা ও ইউরোপের অন্যত্র বেশ কয়েকটি সম্ভ্রান্ত, বিদগ্ধ ও ভারতপ্রেমী পবিবারের সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর গভীর বন্ধুত্ব

রাঙাকাকাবাবুর কার্ড (ইউরোপে ব্যবহৃত) হয়। তাঁরা সকলেই শেষ পর্যন্ত বসু বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন ডাক্তার ও শ্রীমতী ফেতার, রেনি ও হেডি ফুলপমিলাব, আলেকজাণ্ডার ও কিটি কুরতি ও আয়াল্যাণ্ডের শ্রীমতী উডস।এদেশ থেকে কেউ কিছু দেবার আগেই শ্রীমতী ফেতার ও শ্ৰীমতী ফুলপ-মিলার বহু চিঠি, কাগজপত্র ও ছবি নেতাজী বিসার্চ ব্যুরোতে পাঠিয়েছিলেন। শ্রীমতী কুরতি তো নেতাজী সম্বন্ধে একটি ছোট কিন্তু মূল্যবান বই-ই লিখেছেন।

বহুদিন ধরে পবাধীন থাকবার একটা বড় কুফল হচ্ছে যে, দাসত্বের মানসিকতা জাতিকে পেয়ে বসে। আমরা ছিলাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি উপনিবেশ। ইংরেজর চোখ দিয়ে সারা জগৎকে দেখতে আমাদের শেখানো হয়েছিল। আব বাইরের জগৎ বলতে আমরা বুঝতাম ইংল্যাণ্ড। প্রথম সাবিব জাতীয়তাবাদী নেতাদের মধ্যে রাঙাকাকাবাবুই প্রথম ইংল্যাণ্ডকে বাদ দিয়ে নিজের চোখ দিয়ে ও মুক্ত মনে জগৎকে বিচার করতে শুরু করেন এবং ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের পক্ষে ইউরোপের নানা দেশে সরাসরি প্রচার আরম্ভ করেন। ইংল্যাণ্ড যে ইউরোপ নয়, এবং মধ্য ইউরোপের সঙ্গে যে আমাদের একটা ঐতিহাসিক যোগসূত্র আছে, সেটা রাঙাকাকাবাবুই প্রথম আমাদের বোঝাতে আরম্ভ করেন। এখন দেখছি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করা বরং সহজ, কিন্তু ব্যক্তি ও জাতি হিসাবে মানসিক স্বাধীনতা অর্জন করা শক্ত ও সময়সাপেক্ষ। আজও দাস-সুলভ মনোভাব আমাদের কাটেনি, কোন বিদেশী ও বিজাতীয় মতাদর্শ আমাদের পক্ষে ভাল, এই নিয়ে আমরা প্রতিযোগিতায় নামি। তিরিশের দশকেই ইউরোপ থেকে রাঙাকাকাবাবু বলেছিলেন যে, বিংশ শতাব্দীতে মানবসাজ পুনর্গঠনের নতুন ভাব, নতুন আদর্শ ও নতুন পরিকল্পনা ভারতের মাটিতেই জন্ম নেবে।

৬২

বছর দুয়েক নানারকম চিকিৎসার পর শেষ পর্যন্ত ভিয়েনার ডাক্তাররা রাঙাকাকাবাবুর উপর অস্ত্রোপচারের সিধান্ত নিলেন। পিত্তকোষ বা গলব্লাডার বিকল হয়ে যাওয়াই তাঁর সব অসুখের মূল কারণ বলে সাব্যস্ত হল। ভিয়েনার বিখ্যাত সার্জেন প্রোফেসর ডেমেল অপারেশন করেন। পরে বাঙাকাকাবাবুর কাছে শুনেছি তাঁর এক অদ্ভুত শখের কথা। তিনি বলে বসলেন যে, তিনি নিজের অপারেশন দেখবেন। সুতরাং লোকাল অ্যানেসথিসিয়া দিয়ে যেন কাটাকুটি করা হয়। কিন্তু অপারেশন শুরু করবার পর এত অসহ্য ব্যথা হতে থাকে যে, ডাক্তাররা তাঁকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করতে বাধ্য হন।

সেকালে অজ্ঞান করে বড় অপারেশন করা আজকালকার মতো নিরাপদ ছিল না। সেজন্য, যদি কোনো বিভ্রাট হয় এই মনে করে রোগীকে বলা হত, শেষ ইচ্ছা বা উইলের। আকারে কিছু লিখে রাখতে। রাঙাকাকাবাবু প্রোফেসর ডেমেলের হাতে এক টুকরা কাগজ দিয়ে বলেন, তিনি যেন সেটা তাঁর ভারপ্রাপ্ত এটর্নি নৃপেন্দ্রচন্দ্র মিত্রের কাছে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। বাঙাকাকাবাবু ইংরেজিতে দু লাইন লিখেছিলেন যার মর্মার্থ হল :

“আমার যা কিছু সম্পদ তা রইল আমার দেশবাসীর জন্য; আমার যা কিছু দায় আছে, আমি আমার মেজ দাদাকে দিয়ে গেলাম।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *