নরক সংকেত – রুদ্র—প্রিয়ম সিরিজ ২- দেবারতি মুখোপাধ্যায় – প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর ২০১৭
.
ক্লাস টু—তে পড়ার সময় থেকে টেলিফোন ডিরেক্টরি খুঁজে যে
মানুষটিকে প্রায়ই ফোন করে বিরক্ত করতাম আর তিনি ধৈর্যসহকারে
আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেন, আরেকটু বড়ো হয়ে
যাঁর হাত থেকে পুরষ্কার নিতে গিয়ে
পেয়েছিলাম আশীর্বাদ, যাঁর লেখায়
ঋদ্ধ হয়েছে আপামর বাঙালী
সেই পরমশ্রদ্ধেয়
শ্রীসুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের করকমলে
১
দেওয়ালের যে কোণটা গিয়ে ধাক্কা খেয়েছে ল্যাবের দরজায়, সেই কোণের ঠিক উলটো দিকে বিশাল চেহারার একটা লোক একই জায়গায় পায়চারি করতে করতে টহল দিচ্ছিল। অনেকটা যেন সরল দোলগতিতে। এপাশ থেকে ওকে দেখা না গেলেও দূরের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তৈরি হওয়া লম্বা ছায়াটায় ওকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।
ধীরে ধীরে সেই ছায়াটার দৈর্ঘ্য কাছে এলেই বাড়ছে। আবার দূরে সরে গেলে কমে যাচ্ছে।
একই লয়ে।
এপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কালো মুখোশ পরা লোকটা শেষ একবার ভালো করে সাজিয়ে নিল ছকটা। সে এসব কাজে পুরোপুরি পেশাদার, কালো রুমালটাকে পকেটে রাখা শিশির ভেতরের তরলে চপচপে করে ভিজিয়ে নিল। তারপর ছায়াটার দৈর্ঘ্য বাড়তে বাড়তে সবচেয়ে বড়ো হতেই শিকারি অজগরের মতো নিঃশব্দে ঘুরে গিয়ে বাঁ—হাত দিয়ে লোকটার গলাটা পেছন দিয়ে বেড়ির মতো আটকে ডান হাতে রুমালটা চেপে ধরল মুখে।
লোকটা অস্ফুটে একটা আওয়াজ করল, তারপর অত বড়ো শরীরটা সামান্য কেঁপে নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
ধপ করে একটা শব্দ হল, একইসঙ্গে নিপুণ হাতে দেওয়ালের একটু উপরে রাখা ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরাটার উপর কালো রুমালটা দিয়ে পুরো স্ক্রিনটা মুড়ে দিল মুখোশ পরা লোকটা। ভাঙচুর সে কোনোকালেই পছন্দ করে না, তা ছাড়া অ্যালার্মও থাকতে পারে, ভাঙলেই হয়তো বেজে উঠবে।
একটা সাড়ে ছয় ইঞ্চির চকচকে ছুরি দিয়ে সে আড়াআড়ি চালিয়ে দিল অজ্ঞান হয়ে যাওয়া লোকটার গলায়।
সরু টাটকা রক্তের একটা ধারা গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। মুখোশ পরা লোকটা বেশ তৃপ্ত ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ দেখল মুমূর্ষু মানুষটার আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াটা।
ওর হাতের কাজ এমনই। এতটাই পরিষ্কার, এতটাই নিখুঁত যে সেটাকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে ফেলা চলে, নিজের কাজে মুগ্ধ হয়ে ও নিজেকেই মনে মনে একবার তারিফ করে ফেলল। মুখোশের বাইরে বেরিয়ে থাকা বাদামী চোখদুটো যেন তৃপ্তিতে চকচক করে উঠলো।
তারপর ঠিক একটা কালো বিড়ালের মতোই সে নিঃসাড়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
পেছন পেছন আরও একজন। তার মুখে অবশ্য কোনো মুখোশ জাতীয় কিছু নেই। তবে ক্যামেরা তো এখন ঢাকা।
* * *
এই ঘটনার প্রায় দু—ঘণ্টা পরে শহরের এক প্রধান রাজপথে একজন মানুষ দ্রুত পায়ে হাঁটছিল। ডান পায়ে বেশ চোট লেগেছে, জোরে হাঁটতে গিয়ে তাতে আরও লাগছে, তবু লোকটা থামছিল না।
আর মাত্র দশ মিনিট বাকি আছে এয়ারপোর্টের চেক ইন কাউন্টার বন্ধ হতে।
লোকটার নাম সিগফ্রেড।
এয়ারপোর্টের সামনে এসে সিগফ্রেড একটু অধৈর্য হয়ে পড়ল, বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তার গায়ে লেদারের জ্যাকেট থাকলেও মাথায় কোনো টুপি নেই, ফলে ধীরে ধীরে বরফের সাদা কুচোয় তার চুলগুলো ভিজে উঠছিল। মনে মনে এই কারণে একটু অসহিষ্ণু হয়ে পড়লেও নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে সে বেশ স্বস্তি পেল। পা দুটো ঢেকে রাখলে ঠান্ডাটা আর অতটা লাগে না, সেইজন্য হাঁটু অবধি বড়ো ফারে ফারে ঢাকা গামবুট পরেছে, কাজেই অতটা কষ্ট হচ্ছে না।
তবে আজ ঠান্ডাটা ভীষণ জাঁকিয়ে পড়েছে। নিউজ চ্যানেলের পূর্বাভাস অনুযায়ী আজ তুষারপাত তো হবেই, টেম্পারেচারও মাইনাসে চলে যাবে। যদিও মার্চ মাসের শেষাশেষি, এই সময় বরফ পড়াটা এখানে একটু অস্বাভাবিক, জানুয়ারি মাসের পর ঠান্ডাটা বেশ কমে যায় এদিকে।
কিন্তু আজ একটা ব্যতিক্রমী দিন।
এরকম ঘোষণায় তাই রাত আটটার মধ্যেই রাস্তাঘাট কিছুটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল।
শপিং মল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেও ঝাঁপ পড়ে গেছে। আর এখন রাত সাড়ে বারোটার সময় অবশেষে ঝিরিঝিরি বরফ পড়া শুরু হয়েছে।
এয়ারপোর্টের কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়ার আগে সিগফ্রেড শেষবারের জন্য একবার পিছনে তাকাল, চোখ বুলিয়ে নিল চারদিকে। জনশূন্য বার্লিন শহর ঘন কুয়াশার মধ্যে কেমন হাইবারনেশনে থাকা সাপের মতো গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। লাইটপোস্টের আলোয় সেই জমাটবাঁধা কুয়াশাকে যেন আকাশের ধূমকেতুর মতো লাগছে অনেকটা। বিশাল বিশাল ডিজিটাল সাইনবোর্ডগুলো শুধু একটার পর একটা বিজ্ঞাপন দেখিয়ে নিজেদের ডিউটি করে চলেছে অবিরাম স্লাইড শোয়ে।
বার্লিন শহরের উত্তরদিকের এই টেগেল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট অন্য শহরের এয়ারপোর্টগুলোর মতো শহর থেকে খুব দূরে নয়, যাওয়া আসা বেশ সুবিধার, তাই এই এয়ারপোর্টটাকে সিগফ্রেড পছন্দই করে। বিশেষত এক নম্বর টার্মিনালের দুর্দান্ত আর্কিটেকচারাল ডিজাইনটা তো ওর দারুণ লাগে। একটা ষড়ভুজের আদলে পুরো ডিপারচার ক্যাম্পাসটা তৈরি করা হয়েছে, ঠিক যেন একটা বিশাল বেঞ্জিন।
ওর প্রিয় কেমিক্যাল কম্পাউন্ড বেঞ্জিনের সঙ্গে খুব মিল।
যদিও সুযোগসুবিধার দিক থেকে টেম্পলহফ এয়ারপোর্টকে কেউ টেক্কা দিতে পারবে না, কিন্তু সেটা তো এখন রাজনীতির ডামাডোলে দেশের সবচেয়ে বড়ো রিফিউজি ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে।
তাই এই টেগেল এয়ারপোর্টকেই মেনে নিতে হবে।
অন্তত কিছুদিনের জন্য।
বোর্ডিং পাস করে নিয়েই ও আর দাঁড়াল না, সিকিউরিটি চেক মিটিয়ে প্লেনে ওঠার করিডরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। সঙ্গে লাগেজ তেমন কিছুই নেই, একটা শুধু বড়ো পিঠের ব্যাগ। তবু সেটাকে ক্যারেজে দিয়ে দেবে, ওই বিশাল আয়তনের ব্যাগ কোলে করে নিয়ে প্লেনে বসে থাকতে বিরক্ত লাগে।
প্লেনে উঠে প্রথমেই ব্যাগ থেকে ফোন আর খুলে রাখা একটা সিম বের করে সিগফ্রেড ফোনটা চালু করল, ‘কাজ হয়ে গেছে। আসলটা পিটারকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি প্লেনে উঠে গেছি। পৌঁছে কথা বলব।’ একটু থেমে ও বলল, ‘কিন্তু এখনও বুঝলাম না এত জায়গা থাকতে আমি লন্ডন কেন যাচ্ছি!’
ওপাশ থেকে গম্ভীর একটা গলা ভেসে এল, ‘বুঝলে তো তুমি আমার জায়গায় থাকতে, এরকম অপদার্থের মতো পরজীবী হয়ে জীবনটা কাটাতে হত না তোমায়। এইসব কথা ফোনে না বলে যেটা বলেছি সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করো।’
সিগফ্রেড দমে গেল। দোষটা ওরই, কেন যে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যায়!
আরও দু—একটা দরকারি ফোন সেরে নিয়ে ও সিমটাকে খুলে ফেলে যত্ন করে রাখল পার্সে। ঝাড়া হাত পা হয়ে বসে জুতো—পরা পা দুটোকে সামনের দিকে এলিয়ে যতদূর সম্ভব আধশোয়া হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করল।
আগে এইসব অপমানজনক কথায় খুব কষ্ট হত, রাগে অভিমানে নিজের মনেই নিজেকে আঘাত করত। আজকাল আর কিচ্ছু মনে হয় না।
যার জন্য পৃথিবীতে এসেছে, সে যখন জেনেশুনেই ওর প্রাণভোমরা অন্য একজনের হাতে তুলে দিয়ে গেছে, ও আর কী করবে?
আজ সারাদিন অনেক খাটুনি গেছে, তবু শেষ পর্যন্ত সাকসেসফুল হয়েছে, এটাই যা তৃপ্তির বিষয়। ও তো এখন অন্যের হাতের পুতুল ছাড়া কিছুই নয়, তবু বেঁচে থাকতে তো হবে, তার জন্য এই সাফল্য পাওয়াটা ওর ভীষণ দরকার ছিল।
আচ্ছা লোকটা সত্যিই মরে গেছে তো?
ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল ওর। এইসব খুন—টুন করা ওর একদম পোষায় না, মনটাও খারাপ হয়ে যায়। তবু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পালটাতেই হয়, নিজের অস্তিত্বের তাগিদে।
তবে ও নিজে পরীক্ষা করে দেখেনি, অপেক্ষা করছিল দূরে। পিটার আগে গিয়ে লোকটাকে অজ্ঞান করে ছুরি চালিয়েছিল লোকটার গলায়। এসব পিটারের বাঁ হাতের খেল সেটা ও জানে।
পিটারের কাজ মিটে যেতে ও পেছন পেছন গিয়েছিল। লোকটার গলা ফাঁক করা বীভৎস দেহটার দিকে ও ভুলেও তাকায়নি। ওইসব দেখলে মুহূর্তে নার্ভ বিকল হয়ে যেত ওর।
জিনিসটা খুঁজতে বেশি সময় লাগেনি। মিনিট দশেকের মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল ওরা দু—জন। পাওনাগণ্ডা আগেই মেটানো ছিল, পিটার রওনা দিয়েছিল অন্যদিকে, আর ও এদিকে।
হঠাৎ যেন ওর মনে হল ওর ঘাড়ের কাছে কে গরম নিশ্বাস ফেলল।
একমুহূর্তের জন্য চমকে উঠে প্লেনের ভেতরটা সিগফ্রেড দেখে নিল, সবই মনের ভুল। পেছনের সিটে একটা বাচ্চা মেয়ে বসে রয়েছে।
আসলে মাথায় চিন্তা কিলবিল করছে অজস্র, তবু কালকে সারাদিন যদি একটু রিল্যাক্স করা যায়। একটা চাপা শ্বাস নিয়ে ও মোবাইলে খবরের চ্যানেল খুলল। লাইভ নিউজ নয়, একটু ডকুমেন্টারি গোছের কিছু দেখবে।
ওর প্রায় কবরে চলে যাওয়া ইতিহাসবিদ হওয়ার শখটা এইভাবেই সিগফ্রেড মাঝে মাঝে মেটায়। ডকুমেন্টারি ভিডিয়োগুলো দেখতে দেখতে ও—ও চলে যায় সেই জায়গায়, রোমাঞ্চিত হতে থাকে নতুনের আবিষ্কারে।
এই জীবনে তো আর কিছু হল না। তবে আজও ও পায়ে শিকল বাঁধা ক্রীতদাসের মত স্বপ্ন দেখে, একদিন এই কলের পুতুলের মত জীবন শেষ হবে ওর। নিজের মতো বাঁচবে একদিন!
২
খুব ছোটোবেলায় বাড়ির ছাদ থেকে যখন মাথার অনেক ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া প্লেনগুলোকে দেখা যেত, কেমন যেন রূপকথার পুষ্পকরথের কথা মনে হত। মনে হত ওর কাছাকাছি গেলেই হয়তো দেখতে পাওয়া যাবে দাদুর কোলে বসে শোনা সেই রাজা রানিদের, কিংবা সীতাকে নিয়ে রাবণের পালানোর দৃশ্য।
আবার কখনো কখনো প্লেন চলে যেত অনেকক্ষণ, কিন্তু পেছনে ছেড়ে যেত সাদা সরু রেখা ঝকঝকে নীল আকাশের বুক চিরে, তা দেখে যেন বিশ্বাসই হত না ওর ভেতরে কোনো মানুষ থাকতে পারে। মনে হত মহাকাশে পাঠানো কোনো রকেট বুঝি পৃথিবীর মায়া কাটানোর আগে শেষ মুহূর্তে রেখে গেছে নিজের অস্পষ্ট ছাপ।
তখন সবে সবে বইয়ের পাতায় পড়ছে মহাকাশে প্রথম পৌঁছোনো সেই রাশিয়ার মানুষ ইউরি গ্যাগারিনের কথা। কিংবা ভ্যালেন্টিনা টেরেসকোভা।
মনে হত ওই রকেটে করে এক্ষুনি যেন হুস করে চলে গেলেন ওঁরা মহাকাশের গোলকধাঁধায়।
কিন্তু বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্লেনে চড়তে শুরু করার পর থেকে সেই উত্তেজনা এখন অনেকটাই স্তিমিত। এমনিতে টেক অফের কিছুক্ষণ পর পর্যন্তই যা একটু ভালো লাগে আশপাশ দেখতে, বড়ো বড়ো আকাশচুম্বী বাড়িগুলো, রাস্তাঘাট কেমন আস্তে আস্তে ছোটো হতে হতে চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে যায়। মুক্তোর দানার মতো আলোর বিন্দুর মালা হয়ে ছোটো হতে থাকে শহরগুলো। তারপর সেটাও আর দেখা যায় না, একঘেয়ে সাদা অস্পষ্ট কুয়াশার মতো আচ্ছন্ন হয়ে থাকে পুরোটা সময়।
তবু আজ হিথরো এয়ারপোর্টে প্লেন ল্যান্ড করার আগে ওপর থেকে ছবির মতো সাজানো বাড়িঘর, প্রায় উল্কার গতিতে ছুটে চলা গাড়ি, সুন্দর প্ল্যানমাফিক তৈরি করা মসৃণ রাস্তা দেখতে দেখতে রুদ্রাণীর ছোটোবেলার কথাই যেন মনে পড়ে গেল। যদিও এই সাতাশ বছরের জীবনে বলতে গেলে ওর প্রথম এই এতদূরে আসা। ছোটোবেলায় বাবার দেখাদেখি আর্কিয়োলজিস্ট হতে চাইলেও পরিস্থিতির চাপে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ও এখন একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে চাকরি করে। ওর ইঞ্জিনিয়ারিং—এর ক্লাসমেট প্রিয়মকে বিয়ে করেছে প্রায় বছর দুয়েক। তারপর দুজনেই কলকাতায় সেটল করেছিল।
কিন্তু, বছরখানেক আগে অফিসের কাজে প্রিয়মকে বেশ কিছুদিনের জন্য চলে আসতে হয়েছে লন্ডনে। আর রুদ্র তার অফিসের কারণে রয়ে গেছে কলকাতাতেই।
তাই অনেকদিন বাদে ওদের দুজনের আজ দেখা হবে।
রুদ্র লক্ষ করল প্লেন অনেকটাই নীচে নেমে আসায় ঘন নীল আকাশের মধ্যে ভেসে বেড়ানো ধবধবে সাদা পেঁজা তুলোর মতো কিউমুলাস মেঘগুলোকেও দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার।
উইন্ডো সিটে বসে ঝুঁকে নীচটা দেখতে দেখতে ও আধখোলা বইটা বন্ধ করে ব্যাগে ঢোকাল।
একমুহূর্তের জন্য মনে হল ইউরোপের আকাশ যেন ভারতের থেকে অনেক বেশি পরিষ্কার।
এমনিই হিথরো খুব বড়ো এয়ারপোর্ট, তার ওপর নেমে ইমিগ্রেশন মিটিয়ে লাগেজ নিতে নিতে আরও আধঘণ্টা মতো সময় লাগল, এখন সব এয়ারপোর্টেই বেশ কড়াকড়ি। কথা ছিল বেরিয়ে ও প্রিয়মকে ফোন করবে, কিন্তু তার আর দরকার হল না, লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে বাইরে আসতেই ও হাত নাড়তে থাকা প্রিয়মকে দেখতে পেয়ে গেল।
লাগেজ ট্রলিটা ঠেলে কাছাকাছি পৌঁছে রুদ্র একটু লাজুক হাসল। এমনিতে লজ্জা—টজ্জা ওর ধাতে নেই মোটেও, তবু এতদিন বাদে নিজের স্বামীকে দেখলে একটু লজ্জা আসে বই কী!
প্রিয়ম একটা উজ্জ্বল নীল হলুদ রঙের ডোরাকাটা টিশার্ট পরেছে, সঙ্গে গাঢ় মেরুন রঙের জিনস। পায়ে একটা ঝকঝকে কালো স্পোর্টস শু।
এইগুলোর কোনোটাই ও দেখেনি আগে। এখানেই কিনেছে নিশ্চয়ই।
রুদ্র প্রিয়মের দিকে এগোতে এগোতে আনন্দের মাঝেও একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। আগে প্রিয়মের সব জামা পছন্দ করে ও—ই কিনে আনত, কিংবা অর্ডার দিত অনলাইনে।
এখন আর সেটা নেই। প্রিয়মকে নিজেই নিজেরটা কিনতে হয়।
চুলটাও চকচক করছে, জেল লাগিয়েছে মনে হয়। বাবা, এতসব স্টাইল তো আগে জানতই না। রুদ্র ঠোঁট কামড়াল, প্রিয়ম কত পরিপাটি হয়ে গেছে!
আচ্ছা, ওদের মাঝের এই কয়েক হাজার মাইলের দূরত্ব কি ওকে প্রিয়মের জীবন থেকেও দূরে সরিয়ে দিচ্ছে?
মনখারাপটা জোর করে দূরে সরিয়ে দিতে—না—দিতেই প্রিয়ম একগাল হেসে এসে জড়িয়ে ধরল ওকে। রুদ্র প্রথমে এই প্রকাশ্য আলিঙ্গনে একটু আড়ষ্ট হয়ে গেলেও দেশটার কথা মনে পড়ে যেতে আর হেজিটেট করল না। এতদিন বাদে প্রিয়মের স্পর্শে ওর ভেতরটা কেঁপে উঠল কেমন, চোখ ঝাপসা হয়ে গেল হঠাৎ, তীব্র অভিমানে বুকটা মুচড়ে উঠল যেন।
কবে শেষ হবে ওদের এই আলাদা থাকার পালা?
অনেকদিন তো হল প্রিয়মকে ওর কোম্পানি অনসাইটে এখানে পাঠিয়েছে, প্রথমে এক বছরের জন্য পাঠালেও দিন দিন মেয়াদ বাড়িয়েই চলেছে। আর কতদিন এভাবে ও ইন্ডিয়ায়, প্রিয়ম ইংল্যান্ডে, এভাবে কাটাবে?
ওর মুখটা হঠাৎ ভারী হয়ে যেতে দেখে প্রিয়ম বলল, ‘কী হয়েছে? টায়ার্ড লাগছে? প্লেনে ঘুম হয়নি ভালো?’
রুদ্র কিছু না বলে মাথা নাড়ল, সোজাসুজি তাকাল প্রিয়মের দিকে। দিনরাত স্কাইপে যতই দেখুক, মুখোমুখি দেখার সঙ্গে তার কোনো তুলনা চলে না। আর তা ছাড়া ভিডিয়ো চ্যাটে ওর সব মানুষকেই কেমন টিভির লাইভ রিপোর্টারগুলোর মতো লাগে। সবার যেন একইরকমভাবে নাকটা অস্বাভাবিক বড়ো, কানগুলো খাড়া খাড়া হয়ে থাকে, হাসলে চোয়ালটা বড্ড বেশিই হাঁ হয়ে যায়, সব মিলিয়ে কেমন বোকা বোকা একটা প্যাকেজ! ওর এই মনে হওয়াটা প্রিয়মকেও বলেছে আগে, শুনে প্রিয়ম হেসেওছে একচোট, কিন্তু সত্যিটা তো সত্যিই!
এয়ারপোর্ট ক্যাম্পাসের একদম বাইরে বেরিয়ে এসে রুদ্রর আবার ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে গেল। সত্যিই আবার মনে হল এখানকার সব কিছুর মতোই আকাশটাও যেন অনেক বেশি পরিষ্কার, মিষ্টি নীল রঙের মাঝে সরু সরু সাদা প্লেন যাওয়ার রেখা যেন কাটাকুটি খেলছে অবিরাম।
প্রিয়ম কোথা থেকে একটা কালো ট্যাক্সি নিয়ে এসে ঝপাঝপ ওর লাগেজগুলো তুলে ফেলল। রুদ্র অবাক হয়ে দেখছিল এখানকার ট্যাক্সিগুলোও কী সুন্দর আর ঝকঝকে। অনেকটা সেই পুরোনো সিনেমায় দেখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের বেঁটে মোটা আর্মির ছোটো ছোটো ভ্যানগুলোর মতো। পেছনটাও বেশ চওড়া। সব মিলিয়ে ভিন্টেজ একটা লুক আছে।
এই তবে লন্ডনের বিখ্যাত ব্ল্যাক ক্যাব!
ও ভেতরে ঢুকে বসল। কানগুলো এখনো ভোঁ ভোঁ করছে।
প্রিয়ম বসতে—না—বসতেই ফোন বেজে উঠল। রুদ্র লক্ষ করল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই প্রিয়মের মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে গেল। একটু অসহিষ্ণুভাবে রিসিভ করে বলে উঠল, ‘শি হ্যাজ জাস্ট অ্যারাইভড! আই উইল কল ইউ লেটার, ওকে?’
রুদ্র বলল, ‘কে?’
প্রিয়ম ফোনটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, ‘আরে একটা লোক, তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে বলেছিলাম যে আমি ফোন করব, তা না, তর আর সইছে না যেন!’
রুদ্র অবাক হয়ে গেল, ‘আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে? এখানে? কে সে?’
‘পরে বলব। এখন বাড়ি চলো আগে।’ গাড়ি চলতে শুরু করতেই প্রিয়ম একটু ঝুঁঁকে এসে বলল, ‘মহারানি নামার পর থেকেই এমন চুপ করে আছেন কেন? শীত করছে, না, খিদে পেয়েছে?’
রুদ্র এবার ভ্রূ কুঁচকে প্রিয়মের দিকে তাকাল। শীত যে ওর একটুও করছে না তা নয়, এপ্রিল মাসের শেষ হলেও এখানে বেশ ভালোই ঠান্ডা, আগে বুঝতে পারলে বেরোবার আগেই গায়ে গরম কিছু একটা চাপিয়ে নিত ও, কিন্তু তাই বলে প্রিয়ম ইয়ার্কি করবে কেন? আর খিদে ওর মোটেও পায়নি।
ও কেন চুপ করে আছে সেটা কি প্রিয়ম সত্যিই বুঝতে পারছে না, নাকি, বুঝেও ইচ্ছে করে এমন করছে?
ভুটান থেকে ফিরে এসে দিনগুলো কী সুন্দর কেটেছিল,* রুদ্রর বাবা মা ছুটির দিন হলেই চলে আসতেন ওদের ফ্ল্যাটে, প্রিয়মের বাবা মা—ও কল্যাণী থেকে আসতেন, তারপর ছুটির দিনগুলো হইহই করে কাটত! ভুটানের ওই আন্তর্জাতিক চক্রের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেওয়ায় মিডিয়া বেশ শোরগোল ফেলেছিল। তারপর বেশ কিছুদিন সরকারি, বেসরকারি তরফে ওকে সম্বর্ধনা দেওয়া, বেশ কয়েকটা পুরস্কারও পেয়েছিল রুদ্র, সব্বাই মিলে যেত সেই অনুষ্ঠানগুলোতে।
কিন্তু সুখ যেন ওর কপালে বেশিদিন সয় না। মাসছয়েকের মধ্যেই প্রিয়মের কোম্পানি হঠাৎ ওকে এখানে পাঠিয়ে দিল।
প্রথম প্রথম সে কী মন খারাপ, অফিস থেকে এসে কাটতেই চাইত না সময়, খালি মনে পড়ত প্রিয়ম থাকলে কী বলত, কী করত।
সারাক্ষণ খালি পুরোনো কথা মনে পড়ত।
আস্তে আস্তে অভ্যেস হয়ে গেছে, এখন আর অতটা মন কেমন করে না। তবু একা জীবনে ক্লান্তি লাগে বড়ো!
এখন প্রিয়মের কাছে এসেছে ঠিকই, কিন্তু লন্ডনে রুদ্র থাকবে মাত্র এক সপ্তাহ। তারপরেই ওকে চলে যেতে হবে প্যারিস, ওর ব্যাঙ্কের তরফে প্যারিস স্কুল অফ বিজনেসে একটা পনেরো দিনের ওয়ার্কশপে যোগ দিতে এসেছে রুদ্র। সেই ওয়ার্কশপ শেষে লন্ডনে আরও দু—সপ্তাহ মতো কাটিয়ে দেশে ফেরার কথা ওর। কিন্তু ওই পনেরো দিন ওয়ার্কশপের সময়ে প্রথমে প্রিয়মের ওর সঙ্গে যাওয়ার কথা থাকলেও সেটা এখন বাতিল করতে হবে। প্রিয়ম ওইসময় অফিস ছেড়ে প্যারিস যেতে পারবে না ওর সঙ্গে। নাকি সেইসময় প্রোজেক্টে ভীষণ চাপ থাকবে।
এই নিয়ে দুজনের বেশ কিছুদিন মন কষাকষি চলেছে এবং অবশেষে রুদ্রর মনে খুব চাপা একটা অভিমান জমা হয়েছে।
রুদ্র এখনও কথা বলছে না দেখে প্রিয়ম ওর হাতে আলতো একটা চাপ দিল, ‘কী হল? মন খারাপ?’
রুদ্র কোনো কথা না বলে ডান পাশে ছবির মতো সুন্দর লন্ডন শহর দেখতে লাগল। লাল টুকটুকে টেলিফোন বুথ, উঁচু উঁচু গথিক স্টাইলের প্রাসাদ, তারই সঙ্গে শপিং মল। রাজকীয় বনেদিয়ানা আর আধুনিকতার সার্থক মিশেল যেন এই শহর। রুদ্রর কলকাতার পার্কস্ট্রিট চত্বর মনে পড়ে গেল। ইংরেজদের দুশো বছরের শাসনের জন্য কলকাতাও তো অনেকটা এমনই ছিল। এখনও এরকম বহু বাড়ি আছে, কিন্তু উপযুক্ত দেখভালের অভাবে সেগুলো আজ প্রায় ধ্বংসের মুখে।
প্রিয়ম আবার বলল, ‘উফ, এতদিন বাদে এলে, চুপ করে থাকলে ভালো লাগে? এক কাজ করো, তোমাকেও যেতে হবে না প্যারিসের ওই ওয়ার্কশপে। মেডিক্যাল কিছু দেখিয়ে মেল করে দাও না তোমার অফিসে?’
রুদ্র এবার ম্লান হাসল, ‘ওরকম কখনো হয়! আমি এই এক সপ্তাহ ছুটি কাটিয়েই ওই ওয়ার্কশপ অ্যাটেন্ড করব, এরকমই কথা আছে।’
প্রিয়ম বলল, ‘আরে সে তো সুস্থ থাকলে। বরের শরীর খারাপ দেখিয়ে মেল করে দাও বরং। এমনিতেই আগের সপ্তাহে আইফেল টাওয়ারের সামনে ব্লাস্ট হয়েছে, যেতে হবে না তোমায়। এখানেই থাকো!’
রুদ্র আনমনে বলল, ‘কতক্ষণ লাগবে এখান থেকে তোমার বাড়ি?’
প্রিয়ম বলল, ‘বেশিক্ষণ নয়। আর পাঁচ মিনিট মতো। তোমায় তো বলেছিলাম এয়ারপোর্টের কাছেই থাকি আমি, হিলিংডন বলে একটা জায়গায়। ওটা ঠিক প্রপার লন্ডন শহরে নয়, গ্রেটার লন্ডন বলতে পারো। আমার অফিসটা ওখান থেকেই কাছে হয় তো!’
গাড়ি ততক্ষণে ব্যস্ত বাজার ছেড়ে ফ্লাইওভার ধরে নিয়েছে, ছুটে চলেছে ফাঁকা অঞ্চলের মধ্য দিয়ে। রাস্তার দু—ধারে বিশ্ববিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের গাড়ির শোরুম দেখা যাচ্ছে একের পর এক। কোনোটা পাঁচতলা, কোনোটা বিশাল জাহাজের আকৃতির, আবার কোনোটা আরও অদ্ভুত ডিজাইনের।
ফ্লাইওভার থেকে নামতেই চারপাশে অসম্ভব সুন্দরভাবে সাজানো সব বাড়ি। সামনে একফালি করে সাজানো বাগান, আর প্রতিটা একইরকম প্যাটার্নের। তাদের প্রতিটার ওপরে তিনকোনা কালো রঙের ছাদ, তার ওপরে গোটাকতক লালচে চিমনি। বাড়িগুলোর রংও সব এক, গাঢ় খয়েরি ব্রিক স্টাইলে তৈরি, দরজা জানালাগুলো সব কাচের, তাতে ঘন পর্দা টানা। কোনোটাই দোতলার বেশি উঁচু নয়। আর অদ্ভুতভাবে প্রতিটা বাড়িই পরপর জোড়া, মানে একটার সঙ্গে অন্যটার দেওয়াল এক।
কী অদ্ভুত! সেই সিনেমায় দেখা, প্রচুর নভেলে পড়া ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বাড়ি। মনে মনে ভাবল রুদ্র।
রুদ্রর দৃষ্টি অনুসরণ করে বাইরে তাকিয়ে প্রিয়ম বলল, ‘এই হল টিপিকাল ইউরোপিয়ান বাড়ি। বাড়িগুলো লক্ষ করে দ্যাখো, সব জোড়া। ওই যে মাঝে মাঝে কালো পাইপগুলো দেখছ, ওই দিয়ে একটার সঙ্গে অন্য বাড়ি আলাদা করে আইডেন্টিফাই করা হয়।’
রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘এগুলো ইউরোপিয়ান বাড়ি নয়, এগুলোকে বলে ভিক্টোরিয়ান হাউস। প্লেনে আসতে আসতে লিজা পিকার্ডের একটা বই পড়ছিলাম এই ভিক্টোরিয়ান যুগের লন্ডন নিয়ে। ডিটেইলে ছবি দিয়ে লেখা আছে সেখানে। রানি ভিক্টোরিয়া শাসন করেছিলেন মোটামুটি আঠেরোশো সাঁইত্রিশ থেকে উনিশশোর একদম গোড়ার দিক অবধি। ওই সময়েই এই স্টাইলের বাড়ি তৈরি হত। তার আগে অবধি ইংল্যান্ডে কাচ আর ইটের ওপর মোটা ট্যাক্স ছিল। ভিক্টোরিয়া সেইগুলো তুলে দেন।’
প্রিয়ম বলল, ‘ওহ, তাই? কাচ আর ইটের ওপরে কোনো ট্যাক্সই ছিল না?’
রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘না। তার ওপর সেই সময় এখানে রেললাইন পাতা হয়, ট্রেন কানেক্টিভিটি শুরু হয়। ফলে একদিকে মালপত্রের দাম আর অন্যদিকে পরিবহণের খরচ দুটোই সস্তা হয়ে যায়। তখনই এই একধরনের মালমশলা একটা জায়গায় তৈরি করে নিয়ে এসে এইসব বাড়িগুলো করা হয়। তার ওপর ওই সময়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশনও শুরু হয়েছিল। রেনেসাঁসের পর পপুলেশন বাড়ছিল হু হু করে, তার সঙ্গে বাড়ছিল গ্রামগঞ্জ থেকে শহরে আসতে থাকা লেবারের সংখ্যা। পপুলেশন আর মাইগ্রেশন, মেইনলি এই দুটো কারণেই এই একটাইপের বাড়ি করা শুরু হয়েছিল। বইটা দারুণ ইন্টারেস্টিং, রেয়ার কিছু ছবিও আছে। এখানে রেখে যাব, পড়ে দেখো।’
প্রিয়ম প্রচণ্ড অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘উফ! এত নলেজ তুমি কোথায় রাখো রুদ্র? পেটে গ্যাস হয় না তোমার? অ্যাটলিস্ট পেটগরম?’
এবার এতক্ষণ ধরে জমে থাকা অভিমানকে আর ইগোর বোতলে আটকে রাখতে পারে না রুদ্র, রেগেমেগে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দেয় প্রিয়মের পিঠে, ‘আমার পেটে গ্যাসই হোক বা পেটগরম, তুমি তো আর আমার জন্য অফিসে ছুটি নিতে পারবে না, না! একবছর বাদে বউ এল, তবু তার জন্য কোনো টাইম নেই। ভালো!’
টুকটাক কথায়, খুনসুটিতে ওদের ট্যাক্সি পৌঁছে যায় গন্তব্যে। প্রিয়ম থাকে একটা হাইরাইজ কমপ্লেক্সে। নামার সঙ্গে সঙ্গে হিমেল হাওয়া এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যায় ওদের। রুদ্র এমনিই শীতকাতুরে, ওর বেশ ঠান্ডা লাগলেও এখন ইউরোপে সামার। প্রায় দিনই রোদ ওঠে, এখানকার বাসিন্দাদের জন্য অত্যন্ত আরামদায়ক আবহাওয়া। সারা বছরে এই সময়েই তাই সবচেয়ে বেশি টুরিস্টের আনাগোনা হয় এই অঞ্চলে।
অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে প্রিয়ম প্রথমেই দু—কাপ কফি বসিয়ে দিল। রুদ্রর ভীষণ ঠান্ডা লাগছিল, ভীষণ অবসন্নও মনে হচ্ছিল তবু ও ফ্রেশ না হয়ে ভালো করে ঢেকেঢুকে আগে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল।
এখনও তেমন জেটল্যাগজনিত ক্লান্তি কিছু আসছে না, তবে মাথাটা বেশ ভার হয়ে রয়েছে।
এই জায়গাটা খুব সুন্দর। বেশ ফাঁকা ফাঁকা, রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে, তবু ট্র্যাফিক সিগনাল ভাঙছে না কোনো গাড়ি। যদিও পাশেও একটা বড়ো ডিপার্টমেন্টোল স্টোর রয়েছে। রাস্তা দিয়ে সেকেন্ডে পাঁচটা করে গাড়ি ছুটে চলেছে, তবু কী শান্তশিষ্ট। কলকাতার মতো হইচই, জ্যামজট কিছুই নেই এখানে। এখানকার লোকজন নিয়ম মেনে চলে বলেই বোধ হয় সব কিছু এত সুন্দর। পরক্ষণেই নিজের দেশের সমর্থনে ঘুঁটি সাজায় ও মনে মনে, পপুলেশনটা একটা বড়ো ফ্যাক্টর, আর টাকাটাও। এদের লোকজন এত কম, তার ওপর প্রথম বিশ্বের দেশ, এরা তো ঝকঝকেভাবে থাকবেই। এদের নিয়ে গিয়ে ফেলে দেওয়া লোক না বাপু আমাদের বড়বাজার কিংবা হাওড়া স্টেশন চত্বরে, সব নিয়ম পালাবে অমনি। পরিস্থিতিই মানুষকে অবাধ্য, বেপরোয়া করে তোলে।
প্রিয়ম কফি নিয়ে আসতে রুদ্র দূরে আঙুল তুলল। এই এগারো তলা থেকে সবুজ উজ্জ্বল একটা ফাঁকা ঢেউ খেলানো জায়গা দেখা যাচ্ছে, তাতে কয়েকটা জিনিস উল্কার গতিতে ঘোরাফেরা করছে, এত উঁচু থেকে সেগুলো কী ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ‘ওই জায়গাটা কী?’
প্রিয়ম চোখ সরু করে, ‘ওটা তো পার্ক, তাতে বিভিন্ন খেলাধুলো হয় দেখি।’
হঠাৎ কী মনে পড়তে রুদ্র ভেতরে চলে গেল, ট্রলির একটা সাইড খাপ থেকে ওর বাইনোকুলারটা বের করে বাইরে এল, চোখ লাগিয়ে বলল, ‘আরে! কী অদ্ভুত জিনিস দেখেছ? একটা কিছু রেস হচ্ছে, লোকগুলো অদ্ভুত একেকটা গাড়ি চালাচ্ছে, ফর্মুলা ওয়ান? নাহ, তাও তো নয়, সামনেটা সাইকেলের মতো, অথচ চালাচ্ছে হাত দিয়ে…!’
প্রিয়ম এবার বলল, ‘ওহ! বুঝেছি। প্যারাসাইকেল কম্পিটিশন চলছে। প্রায়ই চলে ওখানে।’
রুদ্র চোখ থেকে বাইনোকুলারটা নামাল, ‘কী সেটা?’
প্রিয়ম বলল, ‘যাদের পা নেই, বা থাকতেও অকেজো, তাদের জন্য এই স্পেশাল টাইপের সাইকেল টুর্নামেন্ট হয় ওই গ্রাউন্ডটায়। সাইকেলই, ভালো করে খেয়াল করো, কিন্তু তিনটে চাকা, আর সামনের চাকাটাকে হাত দিয়ে খুব জোরে জোরে প্যাডল করতে হয়, চালানো বেশ টাফ, একদম শুয়ে চালাতে হয়।’
রুদ্র ঘড়ি দেখল, সাড়ে সাতটা বেজে গেছে, অথচ এখনও দিব্যি দিনের আলো খটখট করছে। কী আশ্চর্য!
কিন্তু এত ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না।
ও বলল, ‘এই চলো না, দেখে আসি! এখান থেকে ভালো বুঝতেই পারছি না!’
প্রিয়ম বলল, ‘এইমাত্র এলে, এখন আবার ওখানে যাবে? ফ্রেশ হবে না?’
রুদ্র বলল, ‘একটু পরে হব। এখন চলো না, প্লিজ! কীরকমভাবে চালাচ্ছে সাইকেলগুলো একটু দেখে আসি কাছ থেকে!’
রুদ্রর মাথায় একবার যখন কোনো জেদ চেপেছে, তখন সে যাবেই, এটা প্রিয়ম খুব ভালো করে জানে। কাজেই ও আর কিছু বলল না। প্রায় পনেরো ঘণ্টা জার্নি করে এসে রুদ্রর যদি যেতে এত উৎসাহ থাকে, প্রিয়মের আর কী অসুবিধা।
প্রিয়মের ফ্ল্যাট এগারো তলায়। দুটো লিফট পুরো অ্যাপার্টমেন্টটায় সমান্তরালভাবে চলে।
লিফটের ভেতরে ঢুকেই রুদ্র বলে উঠল, ‘কী স্লো গো লিফটটা! এর থেকে তো সিঁড়ি দিয়ে আমরা তাড়াতাড়ি নেমে যেতাম।’
প্রিয়ম মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, এই লিফট দুটো বড্ড স্লো। কী আর করা যাবে, কোম্পানি যে অ্যাকোমোডেশন দিয়েছে, এই ঢের।’
অ্যাপার্টমেন্টটার একদম নীচে গ্যারাজ, সেখানে সার দিয়ে গাড়ি দাঁড় করানো আছে। এন্ট্রান্সের ঠিক পাশেই প্রায় সাড়ে ছ—ফুট লম্বা একটা গাঁট্টাগোট্টা আফ্রিকান লোক বসে, সে ওদের দেখেই ধবধবে সাদা দাঁত বের করে হাসল।
প্রিয়মও হেসে বলল, ‘হ্যালো জন! কী খবর?’
জন বলে লোকটা কাঁধ নাচাল, ‘ফাইন।’
প্রিয়ম রুদ্রর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। জন এই অ্যাপার্টমেন্টের কেয়ারটেকার। এই এগারো তলা বিল্ডিংটা মেইটেন্যান্সের দায়িত্বে আছে। এছাড়া গ্যারাজ, লিফট সব কিছুরই সে দেখভাল করে। একতলায় গ্যারাজের পাশের ঘরে তার থাকার জায়গা।
টুকটাক কথা সেরে বেরোনোর আগে প্রিয়ম জনকে বলল, ‘একটু সাবধানে থেকো। পরপর যা সব হামলা হচ্ছে।’
জন আবার তার ধবধবে সাদা দাঁত বের করে হাসল, মাথা নাড়ল সম্মতির ভঙ্গিতে, ‘ইউ টু!’
এগারো তলার উপর থেকে দেখা গেলেও পার্কটায় হেঁটে যেতে প্রায় আট মিনিট মতো সময় লাগল। একটা বড়ো পার্কের মধ্যে ওই প্যারাসাইকেল টুর্নামেন্ট গ্রাউন্ড, তাতে উল্কার গতিতে হুস হুস করে হাত দিয়ে জোরে জোরে প্যাডল ঘুরিয়ে চলেছেন কিছু প্রতিযোগী। এছাড়া লোক প্রায় নেইই। একজন টাইম দেখছেন স্টপওয়াচ দিয়ে, অন্য একজন মহিলা খাতায় কিছু নোট করছেন মাঠের একপাশের ঘাসে বসে।
রুদ্রর চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছিল, ঠান্ডায় বেশ কাঁপুনি ধরলেও ওর খুব ভালো লাগছিল দেখতে। মাঠের একপাশের ঘাসে ও—ও বসে পড়ল।
সন্ধেবেলার পড়ন্ত নরম রোদের ওম মেখে পুরো জায়গাটা যেন স্নিগ্ধ হয়ে রয়েছে।
প্রিয়ম পাশে এসে বসতেই রুদ্র বলল, ‘কি ভালো লাগছে না!’
প্রিয়ম মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, এই জায়গাটা খুব সুন্দর। আমি তো প্রায় রোববারই বিকেলবেলা চলে আসি এখানে। ইনফ্যাক্ট এখানে এসে একজনের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, সে—ব্যাপারেই তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।’
রুদ্র আনমনে বলল, ‘কে?’
প্রিয়ম বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম পরে বলব, কিন্তু তুমি যেভাবে এখনই এখানে চলে এলে। ওই যে দেখলে না গাড়িতে ফোন করেছিলেন? একজন জার্মান ভদ্রলোক। মাসখানেক আগে রবিবার সকালে কী করব, সময় কাটছিল না। তখন হাঁটতে হাঁটতে এখানে এসে বসেছিলাম। সেদিন অবশ্য কোনো টুর্নামেন্ট ছিল না, এমনিই প্র্যাকটিস চলছিল। দুজনেই এই ঘাসের উপর বসেছিলাম, উনিই এসে আলাপ করলেন। জার্মানির লোক, কিন্তু থাকেন লন্ডনেই। এখানকার বেশ নামকরা ডাক্তার। অঙ্কোলজিস্ট, মানে ক্যান্সারের ডাক্তার।’
রুদ্র কতটা শুনছিল বোঝা গেল না, একজন সাইক্লিস্ট চালানো থামিয়ে ওদের একদম কাছে এসে সাইকেল থেকে নেমেছেন, ও খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিল তার সাইকেলটাকে।
প্রিয়ম বলল, ‘কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে বাড়ি ফিরেছি, সন্ধেবেলা দেখি ফেসবুকে ভদ্রলোক ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন আমায়। অ্যাকসেপ্ট করলাম। তার দু—একদিন বাদেই দেখি আমাকে মেসেজ করে জানতে চেয়েছেন যে তুমি আমার বউ কি না।’
রুদ্র এবার প্রিয়মের দিকে তাকাল, ‘আমি তোমার বউ কি না, মানে?’
প্রিয়ম বলল, ‘আমিও এগজ্যাক্টলি এটাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তুমি আমার বউ কি না মানে? এ আবার কী আপত্তিজনক প্রশ্ন! দিব্যি দেখছে ফেসবুকে রিলেশনশিপ স্টেটাস, গাদাগাদা ছবি, তারপরেও এরকম অদ্ভুত জিজ্ঞাসা কেন? তখন উনি বললেন, যে আমার প্রোফাইলে তোমার নাম, ছবি এসব দেখে উনি চিনতে পেরেছেন তুমিই সেই বিখ্যাত ব্যক্তি যে কিনা ভুটানের ওই সাংঘাতিক কেসটা সলভ করে বাবার মতো ওরকম বিখ্যাত একজন আর্কিয়োলজিস্টকে উদ্ধার করেছিলে আর ওই গ্যাংটাকেও ধরেছিলে।’
রুদ্র এবার ধমক দিল, ‘বাজে কথা রাখো। ঠিক করে বলবে কি কেসটা কী?’
প্রিয়ম এবার হেসে ফেলল, ‘এই দ্যাখো, তুমি বিশ্বাস করছ না। সত্যি বলছি। আরে ওই কেসে সেই গ্যাঙের পাণ্ডারা এখানকার লোক ছিল, এই তো বেডফোর্ডশায়ারের। কাজেই এরা তো জানবেই। বিবিসি যে আর্টিকলটা বের করেছিল না ইন্টারনেটে, যেটা খুব পপুলার হয়েছিল, সেটা নাকি উনি পড়েছিলেন। বিবিসির দেখাদেখি আরও কিছু নিউজ মিডিয়াও কভার করেছিল কেসটা। সেইসব দেখেই উনি তোমাকে চিনতে পেরেছেন।’
রুদ্র বলল, ‘তারপর?’
প্রিয়ম মাথা দোলাল, ‘আমিও সেই সুযোগে আমার বউয়ের একটু ঢাক পিটিয়ে দিলাম। উনি তো কাগজে পড়েছিলেন, আর আমি আরও বিস্তৃতভাবে গুণকীর্তন করলাম। শুনে তো সে ব্যাটা ভারি ইমপ্রেসড!’
রুদ্র এবার চুপ করে গেল। এটা ঠিকই যে, বিবিসির প্রতিবেদনটা বেশ সাড়া ফেলেছিল। দেশেও ওটা পড়ে অনেকেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
কিন্তু তাই বলে ছবি দেখে চিনতে পেরে যাওয়াটা একটু অদ্ভুত নয় কি? এতটাও বিখ্যাত হয়ে যায়নি ও।
রুদ্র বলল, ‘কী নাম ভদ্রলোকের?’
প্রিয়ম বলল,’নামটাও বেশ মজার। সিগমুন্ড শ্যুমাখার। আমি তো নাম শুনে মজা করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে আপনি কোন তরফের রিলেটিভ, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের নাকি মাইকেল শ্যুমাখারের। তখন হেসে বললেন, কারুরই নয়।’
রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ‘উনিও কি এদিকেই কোথাও থাকেন?’
প্রিয়ম বলল, ‘সেটা জিজ্ঞাসা করা হয়নি, তবে কাছেপিঠেই থাকেন কোথাও নিশ্চয়ই, কারণ পরেও আরেকদিন আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তখনই আরও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানছিলেন তোমার ব্যাপারে।’
রুদ্র বলল, ‘আমার ব্যাপারে?’
প্রিয়ম বলল, ‘হ্যাঁ, ভারতবর্ষের ব্যাপারে দেখলাম খুব ইন্টারেস্ট, দু—বার ঘুরেও এসেছেন। ওঁর মায়ের দাদু না কে, তিনি ছিলেন ফ্রান্সের লোক, পন্ডিচেরিতে ফ্রেঞ্চ কলোনিতে চাকরি নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ডায়েরি পড়েই ওঁর ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিশাল আগ্রহ জন্মেছে, এখনও রীতিমতো খবর রাখেন সব কিছুর। তো, তারপরই একদিন ফোন করে ব্যাটা বলে কি, তোমার সঙ্গে একবার কথা বলা যেতে পারে কি? ভীষণ দরকার, তোমার ফোন নম্বর দিলে ভালো হয়। তখন আমি বললাম যে তুমি তো এখানে আসছই ক—দিনের মধ্যে। তখন বললেন তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।’
রুদ্র এবার অবাক হয়ে গেল। কয়েকদিন ছুটি কাটিয়ে ওয়ার্কশপ সেরে একটু রিল্যাক্স করবে ভাবল, এ আবার কী দরকারে দেখা করতে চাইছে? ও জিজ্ঞেস করল, ‘দরকারটা কী সেটা বলেছেন কী?’
প্রিয়ম বলল, ‘না, সে—ব্যাপারে তো কিছু জিজ্ঞেস করিনি। দ্যাখো হয়তো ওই মায়ের দাদুর ডায়েরিতে ভারতের কিছু গুপ্তধন সম্পর্কে কোনো খোঁজ পেয়েছেন, ওঁর মনে হয়েছে তুমিই সেই ট্রেজার খুঁজে এনে দিতে পারবে।’
রুদ্র এবার একটু বিরক্ত হল, ‘সেই থেকে আজেবাজে বকে চলেছ!’
প্রিয়ম বলল, ‘আরে সত্যি! খুব আগ্রহ দেখলাম তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য। কাল বিকেলে আসবেন বলেছেন। আজই আসতে চাইছিলেন, আমি বললাম আজ ও এতটা জার্নি করে এল, টায়ার্ড আছে, তাই কাল আসুন।’
রুদ্র ফোনটা খুলে ফেসবুকে খুঁজছিল ভদ্রলোককে, বলল, ‘ডাক্তার বললে, না? কেমন বয়স?
প্রিয়ম বলল, ‘বয়স ওই পঁয়ত্রিশ মতো, তবে বেশ নামকরা ডাক্তার। অনেক দেশ—বিদেশের সেমিনারে লেকচার দেওয়ার ছবিও রয়েছে। আর বেশ ফিটও। এমনি জার্মানরা তো বিশাল লম্বা হয়, ইনি অত লম্বা নন, তবে বেশ মজবুত শরীর।’
রুদ্র ছবিটা দেখছিল। প্রিয়ম ঠিকই বলেছে। বেশ বলিষ্ঠ চেহারা, খুব ফর্সা আর টিকোলো নাক। জার্মানির ডুসেলডর্ফ শহরের একটা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে বর্তমানে লন্ডনের একটা ক্লিনিকের সঙ্গে যুক্ত লেখা রয়েছে।
রুদ্রর এবার খুব শীত করছিল। টুর্নামেন্টও শেষ হয়ে গেছে, একের পর এক প্রতিযোগী তাদের সাইকেলগুলো পাশের একটা ঘরে রেখে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে।
হাওয়ার কনকনে ভাবটাও বাড়ছে ক্রমশ।
রুদ্র একটা হাই তুলে উঠে দাঁড়াল, ‘বুঝলাম। চলো, খুব টায়ার্ড লাগছে। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব আজ।’ পেছনে ফিরেও একবার তেরচা চোখে তাকাল ও, ‘আর কাল আসতে বলেছ মানে আমাদের লন্ডন আই, বিগ বেন, মাদাম তুসো, সব প্রোগ্রাম বাতিল?’
প্রিয়ম জোরে জোরে মাথা নাড়ল, ‘আরে না না, পাগল নাকি! সন্ধেবেলা আসতে বলেছি, আমরা তো তার মধ্যে ঘুরে চলে আসব।’
_____
* রুদ্র প্রিয়ম সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘ঈশ্বর যখন বন্দি’
৩
সিগফ্রেড ঘরে এসে ভালো করে মুখচোখ ধুয়ে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে ছিল। গত কয়েকদিন সে টেনশনে ঘুমোতেই পারেনি, কিন্তু আজ একটু হলেও স্বস্তির বিশ্রাম নেবে।
অন্যবার লন্ডনে এলে ওর মনটা বেশ খুশি খুশি থাকে, অন্তত সাময়িক হলেও সারাক্ষণ নজরদারির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। কিন্তু, এবারে সেটা আর হচ্ছে না। সারাক্ষণ একটা মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে।
শুয়ে শুয়ে বিছানার একপাশে—পড়ে—থাকা রুকস্যাকটার একটা চেন খুলে হাতড়ে হাতড়ে সে একটা মানিব্যাগ বের করল, তারপর সেখান থেকে সিমটা বের করে ফোনে ঢুকিয়ে কানে দিল, ‘তুমি আমাকে প্লিজ আর দু—দিন টাইম দাও প্লিজ!’
ওপাশ থেকে একটা হিসহিসে গলা শোনা গেল, ‘ওয়ার্থলেস একটা! আর কত টাইম লাগাবে তুমি? তোমাকে কি আমি বলেছিলাম আগ বাড়িয়ে এইসব করতে? এমন ক্রিটিক্যাল অবস্থায় একটা করে দিন যাওয়া মানে রিস্ক আরও বাড়ানো।’
সিগফ্রেড একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘বুঝতে পারছি। আমি চেষ্টা তো করছি হার্ট অ্যান্ড সোল!’
ওপাশের গলাটা খিঁচিয়ে উঠল, ‘কীসের চেষ্টা? চেষ্টা করার জন্যও একটা মিনিমাম যোগ্যতার প্রয়োজন পড়ে। পইপই করে বলেছিলাম কেউ যেন তোমায় ট্রেস করতে না পারে, সেখানে এত তাড়াতাড়ি জিমি তোমায় খুঁজে পেয়ে গেল কী করে? তুমি কি ওখানে গিয়ে সারা শহর টো টো করে বেড়াচ্ছ নাকি? নাকি নিজের অরিজিন্যাল পাসপোর্ট নিয়ে চলে গেছ বহাল তবিয়তে! এটা কেন বুঝতে পারছ না যে কান টানলে মাথা আসার মতো তোমাকে একটু কালটিভেট করলেই আমাকেও লিঙ্ক করে ফেলতে পারে জিমি!’
সিগফ্রেড বলল, ‘আমি সাবধানেই ছিলাম। জিমির সঙ্গে আমার হঠাৎ একদিন মুখোমুখি দেখা হয়ে গিয়েছিল, তারপর থেকেই পেছনে লেগেছে। এয়ারপোর্টের সিসিটিভি থেকে মুখ চিনেছে হয়তো। স্টুডিয়োয় কিন্তু পিটার ক্যামেরাটা আগেই ঢেকে দিয়েছিল।’
দাঁতে দাঁত চিপল ওপাশের গলা, ‘বাহ! কী সুন্দর এক্সকিউজ! এয়ারপোর্টে ঢোকার সময় কি মুখটা ভালো করে দেখিয়ে গিয়েছিলে যে একবার দেখেই চিনতে পেরে গেল?’
সিগফ্রেড আবার মিনমিন করল, ‘চিনতে যে পেরে গেছে আমি এখনও শিয়োর নই, তবে নজরে রাখছে এটা ঠিক।’ বলেই ও বলল, ‘আর তা ছাড়া তুমি কী করে শিয়োর হচ্ছ যে এটাই সেই ছবিগুলো? এটা তো অন্য কিছুও হতে পারে।’
‘তুমি দয়া করে তোমার ভোঁতা মগজটা এই ব্যাপারে লাগানো বন্ধ করো! ফ্রান্সিস গ্যালটনের সেই ফর্মূলাটাও এনকোড করা হয়েছিল প্রথমে, আমি নিজে পড়েছি দাদুর ডায়েরিতে। আর যে সেটা চুরি করে নিয়ে পালিয়েছিল সেও আইসল্যান্ডেই গিয়েছিল, কিন্তু সেখানে গিয়ে সে টিম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।’ গলাটা এবার আরও জোরে ধমক দিল, ‘তুমি কি আমাকে তোমার নিজের মতো ভাবো?’
সিগফ্রেড তড়িঘড়ি বলল, ‘আচ্ছা, বুঝলাম। আমাকে আর দু—দিন টাইম দাও, প্লিজ! আমি কেপেবল একজনকে পেয়েছি, সে একটু চেষ্টা করে দেখুক।’
‘কাকে? রিলায়েবল কি না দেখেছ?’ তিতিবিরক্ত ওপাশের গলা পরক্ষণেই সাবধানী।
সিগফ্রেড বলল, ‘হ্যাঁ। পুরোপুরি রিলায়েবল। আমি ক্রেডেবিলিটির জন্য ফেসবুকেও অ্যাড করেছি। তোমার ওই জিমিও সন্দেহ করতে পারবে না।’
‘ফেসবুক! এর মধ্যে আবার ফেসবুক এল কোথা থেকে! জিনিসটা তোমার কাছে আছে তো?’
সিগফ্রেড ঢোঁক গিলল। তাড়াতাড়ি বলল, ‘হ্যাঁ, আছে।’
‘মনে রেখো, এবারেও যদি কিছু গণ্ডগোল হয়, তোমার সব কিছু কিন্তু চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যাবে!’ ওপাশ থেকে আবার গলা চড়ল।
সিগফ্রেড আঁতকে উঠল, ‘না না! দু—দিন সময় দাও, আমি প্রোগ্রেস দেখাতে পারব।’
ফোনটা ততক্ষণে পিঁ পিঁ শব্দ করে কেটে গেছে।
সিগফ্রেড ত্বরিত গতিতে সিমটা ফোন থেকে খুলল, তারপর প্রবল আক্রোশে পাশেই রাখা মানিব্যাগটা ছুড়ে মারল সামনের দেওয়ালে।
সব কিছুর একটা লিমিট আছে!
দিনের পর দিন ওরই প্রাপ্য সম্পত্তি দখল করে লোকটা ব্ল্যাকমেল করে চলেছে ওকে। সিগফ্রেড অতটা কড়া মনের নয়, মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছে আপ্রাণ, কিন্তু ওর এই ভদ্রতাটাকে শয়তানটা দুর্বলতা ভেবে ফেলেছে এখন।
মাঝে মাঝে সিগফ্রেড ভাবে, একইসঙ্গে, একই মাতৃজঠরে জন্মেও কী করে দুটো মানুষের ভাগ্য সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে হাঁটে!
এর পেছনে কি ওর বাবা মায়ের কোনো হাতই নেই, যারা ছোট্টবেলাতেই ওদের শৈশবটা একটা অনিশ্চিত আবর্তে ফেলে দিয়েছিল? দাদার ভাগ্য ভালো ছিল, সে মানুষ হয়েছে ভালো পরিবেশে, ভালো আবহে। আর সিগফ্রেড নিজে খারাপ কপাল নিয়ে জন্মেছিল, প্রতিভা থাকতেও সে কিছুই করতে পারল না, তার উপর এমন একজনের অভিভাবকত্বে তাকে ফেলে দেওয়া হল, যাতে তার সবটাই শেষ হয়ে গেল।
আর এখন তো সে একটা নষ্ট হয়ে যাওয়া অধ্যায়, যাকে শুধুমাত্র দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ব্যবহার করা হয়ে চলেছে ক্রমাগত।
ভাবলেও ওর গলার কাছটা দলা পাকিয়ে ওঠে যে ও একদিন ইতিহাস নিয়ে পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে পড়তে দেওয়া হয়নি। বদলে তাকে পড়তে হল কেমিস্ট্রি, সেটাও অবশ্য ওর মন্দ লাগত না।
কিন্তু শেষ করার আগেই ওর জীবনটা চিরকালের মতো অন্ধকারে তলিয়ে গেল।
৪
পরের দিন সন্ধেবেলা পর্যন্ত রুদ্র আর প্রিয়মকে আর অপেক্ষা করতে হল না। তার আগেই ড শ্যুমাখারের সঙ্গে দেখা করতে হল।
রুদ্ররা ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়েছিল। দোতলা হুডখোলা বাসে করে বাকিংহাম প্যালেস, বিগ বেন, লন্ডন আই, পিকাডেলি সার্কাস সব ঘুরে ওরা যখন ন্যাশনাল গ্যালারিতে ঢুকেছে, তখন প্রিয়মের ফোন এল।
দুশো বছরের পুরোনো এই ঐতিহ্যবাহী ন্যাশনাল গ্যালারি, তাতে দু—হাজারের ওপর দুষ্প্রাপ্য সমস্ত ছবি রয়েছে। ট্রাফালগার স্কোয়ার চত্বরটাই দারুণ সুন্দর। ফ্রান্স আর স্পেনের সঙ্গে ঐতিহাসিক ট্রাফালগারের যুদ্ধে জেতার পর ব্রিটিশ নেভির পক্ষ থেকে এই স্কোয়ার বানানো হয়েছিল। একদিকে নিখুঁত ব্রোঞ্জের স্ট্যাচু, অন্যদিকে ফোয়ারা, তার মাঝে অজস্র পায়রার ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়ানো, সব মিলিয়ে একটা দারুণ পরিবেশ।
প্রতিটা ছবি ওরা তন্ময় হয়ে দেখছিল, ডিটেইলড নোটগুলো পড়ছিল, এমন সময় প্রিয়মের ফোন বাজতে প্রিয়ম কথা বলতে বাইরে চলে গেল।
মিনিট পাঁচেক বাদে ফিরে এল, ‘রুদ্র, ড শ্যুমাখার ফোন করেছিলেন।’
রুদ্র তখন বেশ মনোযোগ দিয়ে ভ্যান গঘের আঁকা একটা ছবি দেখছিল, অন্যমনস্কভাবে ছবি থেকে চোখ না তুলেই বলল, ‘একটু দেরি করে আসতে বলেছ তো? এখান থেকে মাদাম তুসো যাব তো, অনেক সময় লাগবে ওটা ঘুরতে।’
প্রিয়ম বলল, ‘ওঁর কী—একটা কাজ পড়ে গেছে সন্ধেবেলা, তাই আসতে পারবেন না।’
রুদ্র বলল, ‘বাঁচা গেছে। তাহলে আর জলদি ফেরার তাড়া নেই। শোনো, আমি কাল গুগল ম্যাপে দেখছিলাম মাদাম তুসো মিউজিয়াম থেকে একদম পায়ে হাঁটা দূরেই বেকার স্ট্রিট। শুনেছি ২২১ বি ঠিকানায় এখন একটা মিউজিয়াম হয়েছে? ওটা দেখে আসব, কেমন? উফ, ভাবতেই কেমন রোমাঞ্চ লাগে, না?’
প্রিয়ম মাথা নাড়ল, ‘আরে না। উনি বললেন দরকারটা খুব জরুরি। তাই, এখনই দেখা করতে চান, আধ ঘণ্টা সময় দিলেও চলবে।’
রুদ্র এবার ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘এখন? মানে? এখন না ঘুরে—টুরে বাড়ি চলে যাব? আচ্ছা মুশকিল তো!’
প্রিয়ম এবারেও মাথা নেড়ে বলল, ‘না বাড়ি যেতে হবে না। উনি অপেক্ষা করছেন।’
রুদ্র এবার আরও অবাক হয়ে গেল, ‘কোথায়?’
প্রিয়ম আমতা আমতা করে বলল, ‘মাদাম তুসো মিউজিয়ামের সামনের একটা কপিশপে। বললেন, ওখানকার কফি নাকি দারুণ।’
রুদ্র এবার রেগে গেল, ‘মাদাম তুসোর সামনে গিয়ে আমরা ভেতরে না ঢুকে বাইরে বসে কফি খাব? কোথা থেকে তুমি জোটাও বলো তো এইসব লোকেদের? ওঁর সঙ্গে বকতে বকতে যদি মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যায়? কী এত দরকার আমার সঙ্গে? চিনি না, জানি না।’
প্রিয়ম মানানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘উনি আধ ঘণ্টার বেশি সময় নেবেন না বারবার বলছেন। তারপরেই আমরা মাদাম তুসোয় ঢুকে পড়ব।’
রুদ্র বিরক্তির একটা শব্দ বের করল মুখ দিয়ে, ‘ডিসগাস্টিং!’
প্রিয়ম বলল, ‘কী করব বল, এরকমভাবে বার বার কেউ যদি রিকোয়েস্ট করে! এত চাপ নিয়ো না, আমি তো বলেই দিচ্ছি ওঁর দরকারটা কী।’
রুদ্র কটমট করে তাকাল, ‘কী দরকার শুনি?
প্রিয়ম বিজ্ঞের মতো মাথা দোলাল, ‘ওই তো, দাদু ইন্ডিয়া গেছিল, কিছু গুপ্তধন—টনের খোঁজ পেয়েছিল নির্ঘাত, উদ্ধার করার আগেই বোধ হয় উপরে চলে গিয়েছিল, সেই কথা ডায়েরিতে লিখে গেছে, এ চায় তোমায় দিয়ে উদ্ধার করাতে। সিম্পল! তুমি বরং চিন্তা করো কত পারসেন্ট কমিশন নেবে সেই গুপ্তধনের। এ তো আর তোমার সমাজসেবা নয়। হে হে।’
রুদ্র নিজের মনেই গজগজ করতে লাগল, ‘তোমার এই স্বভাবটার জন্য না লাইফে তুমি অনেক পস্তাবে দেখো, প্রয়োজনে ‘না’ বলতে জানো না বলে। দরকারটা যখন তাঁর, তাঁকে তো আমাদের সময় সুযোগ মতো আসতে হবে, তাই না! ঘুরতে বেরিয়েছি একরকম মাইন্ডসেট নিয়ে, তার মধ্যে এরকম ব্রেক পড়লে কী যে বিরক্ত লাগে!’
ঘণ্টাখানেক পর মাদাম তুসো মিউজিয়ামের ঠিক উলটোদিকের খুব সুন্দর ছোট্ট কফিশপটায় বসে যখন রুদ্র কফিতে চুমুক দিচ্ছিল, তখন অবশ্য আার অতটা খারাপ লাগছিল না।
এখানে সামারের সময় সব রেস্টুরেন্টেরই বাইরেটা বসার ব্যবস্থা করা হয়। একটা মিষ্টি বেগুনি ফুলের গাছ দিয়ে পুরো কফিশপটাই মোড়ানো। কী গাছ এটা, রুদ্র মনে মনে চিন্তা করছিল। অনেকটা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ার মতো। একদম ছড়িয়ে রয়েছে। আর মাটিতে পড়ে সারা রাস্তাটাকে রাঙিয়ে তুলেছে অজস্র রংবেরঙের ফুল।
ঠিক যেন বসন্তের পলাশ।
ওঁরা পৌঁছোনোর আগেই ড শ্যুমাখার সেখানে এসে বলে ছিলেন। যদিও ওঁর অনুরোধ অনুযায়ী বাইরে না বসে ওদের রেস্টুরেন্টের ভেতরেই বসতে হল, রুদ্র কিন্তু মনে মনে ঠিক করে ফেলল যতদিন এখানে থাকবে ততদিন সকাল বিকেল ও এইরকম বাইরে বসে গায়ে রোদ মেখে কফি খাবে।
কিছু কিছু মানুষের মুখ দেখলেই বোঝা যায়, মানুষটা ভালো। ড শ্যুমাখারও তেমনই। বেশ অমায়িক ভদ্রলোক। একটা ক্যাজুয়াল ছাইরঙা ট্রাউজার আর কনুই পর্যন্ত হাতা গোটানো কালো শার্টে ওঁকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছিল। টকটকে ফর্সা লালচে গায়ের রং, সোনালি চুল, যদিও সামনেটায় এই অকালেই টাক পড়েছে কিছুটা, মুখেও সামান্য বলিরেখা হানা দিয়েছে, তবে কালো ফ্রেমের চশমার মধ্য দিয়ে চোখের ঝকঝকে নীল রঙের মণি দুটো স্পষ্ট বোঝা যায়। উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে হ্যান্ডসেক করার সময় রুদ্র অবশ্য বুঝল ভদ্রলোক ডান পা—টা সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটছেন।
প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিলেন ড শ্যুমাখার, ‘আপনাদের প্রাইভেট সময়ে ভাগ বসানোর জন্য ভেরি সরি। তবে আমি বেশি সময় নেব না একেবারেই। আসলে আমার প্রয়োজনটা এতটাই আর্জেন্ট, আর আপনার সম্পর্কে ওই আর্টিকলটা পড়ার পর থেকে মনে হচ্ছে আপনিই আমাকে হেল্প করতে পারেন। মানে, আপনি ওই ভুটানের মিস্ট্রিটা যেভাবে সলভ করেছিলেন, অন্য কোনো ডিটেকটিভই…!’
রুদ্র বাধা দিয়ে হাসিমুখে বলল, ‘আপনি প্রথমেই একটা জিনিস ভুল করছেন ড শ্যুমাখার। আমি ডিটেকটিভ নই। আমি ছাপোষা একজন চাকুরিজীবী, ব্যাঙ্কে চাকরি করি। ভুটানে আমার বাবা একটা বিপদে পড়েন, সেখান থেকে তাঁকে বের করতে গিয়ে আমি ওই ব্যাপারটায় জড়িয়ে পড়ি। এটা আমার প্রোফেশন নয় মোটেই। আর আমার হাজব্যান্ডও আমায় হেল্প করেছিল।’ প্রিয়মের দিকে আঙুল দেখায় ও।
ড শ্যুমাখার হাঁ হাঁ করে ওঠেন, ‘ইয়েস, আমি জানি সেটা। আমি সবটাই পড়েছি ম্যাডাম। আমি এমনিই ইন্ডিয়ানদের খুব অ্যাডমায়ার করি, আর আমার মনে হয়েছে আপনিই এই ব্যাপারটায় পারফেক্ট। আপনি যখন এখানে এসেইছেন একটু যদি আমাকে হেল্প করেন, আই উড বি গ্রেটফুল টু ইউ। আর এটা আমার জন্য না, ফর দ্য সেক অফ হোল ম্যানকাইন্ড!’
রুদ্র লক্ষ করল ভদ্রলোকের ইংরেজি একদমই জড়ানো নয়, বেশ পরিষ্কার বোঝা যায়। ও বলল, ‘আমি তো এখানে এসেছি ঘুরতে, বেশিদিন তো থাকব না, আমার নিজেরও কাজ আছে অফিশিয়াল….!’
ড শ্যুমাখার এবার ওঁর মাথার সামনের ফাঁকা অংশটা কিছুক্ষণ চুলকে নিলেন, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘আপনি যদি একবার শোনেন ম্যাডাম….!’
রুদ্র এবার একটু অস্বস্তিতে পড়ল।
অন্তত এত সুন্দর কফিশপে বসে কফি খাওয়ানোর পরও ব্যাপারটা না শুনলে অভদ্রতা করা হবে।
ও তাড়াতাড়ি হেসে বলল, ‘নিশ্চয়ই। বলুন। আপনি কি এখানেই থাকেন?’
ড শ্যুমাখার এবার বললেন, ‘হ্যাঁ। বাই প্রোফেশন আমি ডাক্তার। আমার জন্ম জার্মানিতে। আমার বাবা ছিলেন জার্মান, কিন্তু তাঁর মা ছিলেন পর্তুগিজ। আর আমার মা আবার ছিলেন ফ্রেঞ্চ।’
ভদ্রলোকের বলার ভঙ্গিমাটা বেশ মজাদার লাগল রুদ্রর, ও—ও তাই হালকা রসিকতা করল, ‘বাবা জার্মান, ঠাকুমা পোর্তুগিজ, মা ফ্রেঞ্চ, আপনি তো একদম পুরো ইউরোপকেই রক্তে বয়ে নিয়ে চলছেন দেখছি!’
ড শ্যুমাখারও হাসলেন, ‘এইটা একদম খাঁটি কথা বলেছেন আপনি। অনেক জাতির রক্ত বইছে আমার শরীরে। তবে কী,’ ভদ্রলোক এক মুহূর্ত থামলেন, ‘হাইব্রিড প্রোডাক্ট হয়েও আমি নিজেকে জার্মান বলতেই ভালোবাসি। জীবনের অনেকগুলো বছর ওখানেই কেটেছে তো! জার্মানিই আমার নিজের দেশ।’
রুদ্র স্মিত মুখে মাথা নাড়ল।
ভদ্রলোক বলে চললেন, ‘যেটা বলছিলাম। আমার মায়ের দাদু ফ্রান্স থেকে আপনাদের ইন্ডিয়াতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে গিয়েছিলেন আর পন্ডিচেরিতে বেশ কিছুদিন ছিলেনও। পরে উনি দেশে ফিরে গেলেও ওঁর ছেলে মানে আমার মায়ের বাবা ফেরেননি। উনি ওখানেই সেটল করে গিয়েছিলেন। আমার মায়েরও ছোটোবেলা ওখানেই কেটেছে। তবে আমার দাদু খুব অল্পবয়সে মারা যান, তাই তারপর মা—রা সবাই আবার ফ্রান্সে ফিরে যান।’
প্রিয়ম মাঝপথে বাধা দিল, ‘কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তো ছিল ইংরেজদের। আপনার মায়ের দাদু ফ্রান্সের লোক বলছেন যে?’
এবার রুদ্র মুখ খুলল, ‘উঁহু, ইংরেজদের যেমন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল, তেমনই ইংরেজদের দেখাদেখি ফ্রেঞ্চরা, পোর্তুগিজরা সবাই ইন্ডিয়াতে বা এশিয়ার দেশগুলোতে ব্যাবসা করার জন্য তাদের নিজস্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খুলেছিল। কিন্তু কেউই ইংরেজদের দাপটে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি, বেশিদিন কোম্পানি চালাতওে পারেনি। ড শ্যুমাখার ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কথাই বলছেন। ফ্রেঞ্চরা তবু কিছুটা হলেও পেরেছিল পন্ডিচেরি বা চন্দননগরে, পোর্তুগিজরা একেবারেই পারেনি, যদিও ওরাই প্রথম ভারতে এসেছিল। ভাস্কো দা গামা মনে আছে তো?’
প্রিয়ম বলল, ‘হ্যাঁ। সেই ক্লাস ফোরের ইতিহাস। ১৪৯৮ সাল, কালিকট বন্দর।’ বলেই ড শ্যুমাখারের দিকে তাকাল, ‘আপনি তাহলে ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কথা বলছেন?’
ড শ্যুমাখার এবার উদ্ভাসিত মুখে বললেন, ‘ইয়েস! ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেখানকার সব কথা দাদুর ডায়েরিতে আমি পড়েছি। উনি তো ওখানে অনেকদিন ছিলেন। উনিও ডাক্তার ছিলেন। তার সঙ্গে প্রতিদিনের রোজনামচা লিখে রাখা ছিল ওঁর শখ। ওঁর লেখা পড়েই অনেক কিছু জেনেছি। তখনকার ইন্ডিয়া, স্পিরিচুয়ালিটি, মানুষের লাইফস্টাইল সব। ইন ফ্যাক্ট সেসব পড়েই আমার ইন্ডিয়া নিয়ে এত ইন্টারেস্ট। তো যাই হোক, আমি অবশ্য জন্মে থেকেই জার্মানিতে। ওখানেই পড়াশুনো। কেরিয়ারের মাঝামাঝি সময়ে আমি লন্ডনে শিফট করেছি, আমার কাজের সুবিধার জন্যই। আমি দুটো ক্লিনিকের সঙ্গে অ্যাটাচড, এ ছাড়াও আমার নিজস্ব একটা রিসার্চ ল্যাবও আছে। আমি ক্যান্সারের ওপর কাজ করি আর সেই ব্যাপারেই আপনার হেল্প আমার খুব দরকার।’
এইবার রুদ্র সত্যিই খুব অবাক হয়ে গেল। প্রিয়ম এতক্ষণ বেশ আত্মপ্রসাদের ভঙ্গিতে রুদ্রর দিকে তাকাচ্ছিল ওর আন্দাজ ঠিক ছিল বলে, কিন্তু শেষ কথাটায় ও—ও হকচকিয়ে গেল। থতোমতো মুখে রুদ্রর দিকে তাকাল।
রুদ্র বলল, ‘ক্যান্সার! ক্যান্সারের ওপর রিসার্চে আমি কীভাবে আপনাকে হেল্প করতে পারি?’
মি শ্যুমাখার বললেন, ‘বলছি। তার আগে পুরোটা শুনুন। আমি ক্যান্সারের প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছি বহুদিন ধরে, তা প্রায় বছর দশেক হল। এখান থেকে বেশি দূরে নয় আমার ল্যাব। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং—এর জন্যই হোক, বা পলিউশন, কিংবা এখনকার মানুষজনের সেডেন্টারি লাইফস্টাইল, ক্যান্সার হু হু করে বেড়ে চলেছে। ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনই ক্যান্সারের মেইন কারণ। তো এই নিয়ে সারা পৃথিবীতেই অনেক গবেষণা চলছে এবং অনেকরকম মেডিসিন বা থেরাপিও বেরিয়েছে যার ফলে প্রাথমিক স্টেজে ডায়াগ্নোসিস করা গেলে পেশেন্টকে এখন সারিয়ে তোলাও সম্ভব হচ্ছে। যেমন কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন, সার্জারি বা ইমিউনোথেরাপি। এগুলো জানেন তো?’
প্রিয়ম মাথা নাড়ল, ‘ক্যান্সারের ট্রিটমেন্টে এখন অনেকরকম প্রসিডিয়র বেরিয়েছে। স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেও তো সারানো হচ্ছে এখন।’
ড শ্যুমাখার মাথা দোলালেন, ‘ঠিক। কিন্তু এগুলোর সবকটাই কিন্তু কারেক্টিভ মেজার। কারেক্টিভ রিসার্চে ক্যান্সারের সলিউশন এভাবে বের করা গেলেও এটা দিয়ে একশো পারসেন্ট সাকসেস রেট কিন্তু অ্যাচিভ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া এভাবে সারিয়ে তোলার প্রসেসটাও অত্যন্ত পেইনফুল আর ওই পেশেন্টের শরীরে ক্যান্সার আবার ফিরে আসার সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে যায়। তাই, আমি সেদিকে ইন্টারেস্টেডও নই। আমি রিসার্চ করছি ক্যান্সারের প্রিভেন্টিভ মেজার নিয়ে।’ এক সেকেন্ড নিশ্বাস নেওয়ার জন্য থামলেন ভদ্রলোক, ‘আচ্ছা, আগে বুঝিয়ে বলে দিই প্রিভেন্টিভ আর কারেক্টিভ মেজারটা ঠিক কী।’
রুদ্র এবার মুখ খুলল, ‘জানি। যেকোনো অসুখ দু—রকমভাবে সলভ করা যায়, একটা প্রিভেন্টিভ, অন্যটা কারেক্টিভ। কারেক্টিভ হল, রোগটা হবার পর ওষুধ দিয়ে সরিয়ে তোলা। মানে জ্বর হল, তারপর ওষুধ খেলাম। কিন্তু প্রিভেন্টিভ সলিউশন মানে, রোগটা হবার যে কারণ সেটাকেই এলিমিনেট করে দেওয়া। মানে এমন কিছু একটা ট্রিটমেন্ট যাতে জ্বরটাই হবে না। এভাবে প্রচুর রোগকে অনেক দেশ থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া গেছে। যেমন স্মলপক্স বা পোলিয়ো। এই প্রিভেন্টিভ মেজারের জন্যই হওয়ার পরেই বাচ্চাদের বিভিন্ন রোগের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। তাই তো?’
কথা শেষ করে ও লক্ষ করল ভদ্রলোকের হাতের উপরের দিকে বেশ কয়েকটা ছোটো ছোটো গর্তের দাগ, অনেকটা আগেকার দিনে বাচ্চাদের টিকা দিতে গেলে যেরকম হত।
ড শ্যুমাখারের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল উনি বেশ ইমপ্রেসড হয়ে গেছেন, ‘একদম ঠিক বলেছেন আপনি। আমি এই প্রিভেন্টিভ মেজার নিয়েই কাজ করছি। পৃথিবী থেকে ক্যান্সার হওয়ার কারণগুলোকেই যদি সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তো মানবজাতির একটা বিশাল জয় হবে, তাই না।’
রুদ্র মন দিয়ে শুনছিল, এবার একটু চিন্তিত গলায় বলল, ‘কিন্তু, ক্যান্সারকে এলিমিনেট করা কি সম্ভব? মানে, এটা তো কোনো ভাইরাসঘটিত রোগ নয়, যে সেই ভাইরাসটার ভ্যাকসিন বের করে, বা সেই ভাইরাসটাকে নিশ্চিহ্ন করে রোগটা সারানো যাবে! দু—তিন হাজার বছর আগেও তো ক্যান্সারের অস্তিত্ব ছিল, সেটা তখন ক্যান্সার বলে আইডেন্টিফাই করা যেত না।’ কথাটা শেষ করে ও দেখল, ড শ্যুমাখার বেশ গভীর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন।
ও বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘যদিও আমি কোনো মেডিক্যাল লাইনের লোক নই তবু যেটুকু বই পড়ে জানি সেটা হল, ক্যান্সার পার্টিকুলার একটা রোগ নয়, শরীরের কোনো জায়গার কোষ যদি অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করে আশপাশের টিসুতে ছড়িয়ে পড়ে, সেটাই ম্যালিগন্যান্সি বা ক্যান্সার। এমনিতে শরীরের প্রয়োজনমতো নতুন কোষ তৈরি হয়, কিন্তু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকভাবে কোশ তৈরি হতে থাকে। আর ক্যান্সার কেন হয়, তার কোনো ওয়েল—ডিফাইনড লিস্টও তো নেই মনে হয়।’
ড শ্যুমাখার ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, ‘হুঁ। আপনি ঠিকই বলেছেন। এমনিতে কোনো কোষ যখন বুড়ো হয় বা ড্যামেজড হয়ে যায়, তখন সেগুলো মরে যায়, তার জায়গায় নতুন কোশ তৈরি হয়। কিন্তু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে পুরোনো ড্যামেজড কোষগুলো মরে না, আর দরকার না থাকতেও নতুন কোশ তৈরি হতে থাকে, আর এই এক্সট্রা কোশগুলোই বাড়তে বাড়তে টিউমর ফর্ম করে।’
প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, ‘টিউমর হওয়া মানেই কি সেটা থেকে ক্যান্সার হয়?’
শ্যুমাখার দু—দিকে মাথা নাড়লেন, ‘না। টিউমর হয় দু—ধরনের, বিনাইন আর ম্যালিগন্যান্ট। বিনাইন টিউমর একমাত্র ব্রেনে না হলে লাইফরিস্ক নেই, এগুলো সাইজে যদিও বড়ো হয়, কিন্তু আশপাশের টিসুগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে না বা সেগুলোকে অ্যাটাক করে না। কিন্তু ম্যালিগন্যান্ট মানে ক্যান্সারের টিউমরের ক্ষেত্রে এরা আশপাশের টিসু শুধু নয়, রক্তের মধ্য দিয়ে আরও অনেক দূর গিয়ে নতুন নতুন জায়গায় টিউমর তৈরি করে, আর এরা ক্ষতিও করে।’ একটানা বলে ড শ্যুমাখার রুদ্রর দিকে ডাকালেন, ‘এবারে আপনার প্রশ্নে আসি। হ্যাঁ, ক্যান্সার কোনো ভাইরাসঘটিত রোগ নয়, তাই স্মলপক্স বা পোলিয়োর মতো প্রসেসে একে দূর করা যাবে না। কিন্তু ক্যান্সার হল একটা জেনেটিক রোগ, জিনের মাধ্যমেই এটা ছড়িয়ে পড়ছে, সেটাকে ফোকাস করে আমরা রুট ধরে এগোলেই কিন্তু ক্যান্সারকে পুরোপুরি এলিমিনেট করা যায়, বুঝতে পারলেন?’
রুদ্র কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, পাশ থেকে প্রিয়ম একটু উশখুশ করে উঠল। এবারে ও প্রিয়মের দিকে তাকাল, ‘কী হয়েছে?’
প্রিয়ম বাংলায় বিড়বিড় করল, ‘আর কিন্তু মাত্র পনেরো মিনিট তোমার মাদাম তুসো খোলা থাকবে!’
বাইরের কারুর সামনে তাঁর অজানা কোনো ভাষায় কথা বলা বেশ অভদ্রতা, রুদ্র মুখে কিছু না বলে চোখ দিয়ে একটা তিরস্কারের ভ্রূকুটি করল। ওর নিজেরও এবার মনে পড়ে গেল আজ ওদের মাদাম তুসো দেখতে যাওয়ার কথা। ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হচ্ছে প্রায় আধ ঘণ্টার ওপর, ভালোও লাগছে, কিন্তু এখনও দরকারটা কী, ও বুঝে উঠতে পারল না।
মূল পয়েন্টে এসে আলোচনায় ইতি টানার জন্য ও ড শ্যুমাখারের দিকে ফিরল, আপনার রিসার্চের ওয়েটা সত্যিই বেশ অ্যাপ্রিশিয়েটিং। আপনার সাকসেসের জন্য অনেক শুভকামনা রইল।’ বলেই ও একটা এয়ারহোস্টেস—মার্কা হাসি ঝোলাল মুখে, ‘এইবার তো আমাদের উঠতে হবে, তাই দরকারটা যদি একটু তাড়াতাড়ি বলেন!’
ড শ্যুমাখারার উপর নীচে মাথা নাড়লেন, হাত দুটোকে পেছনে আড়মোড়া করে চেয়ারে হেলান দিলেন, ‘হ্যাঁ। আমার ওই পন্ডিচেরির দাদু ডাক্তার হলেও তিনি প্র্যাকটিসের থেকে বেশি কেমিস্ট্রি নিয়ে গবেষণায় মেতে থাকতেন। তাঁর ডায়েরিতে বিভিন্ন অসুখ, সেগুলো থেকে সেরে ওঠার উপায়, বিভিন্ন বায়োকেমিক্যালস, ড্রাগস নিয়ে প্রচুর গবেষণার কথা লেখা আছে। আমার তো মনে হয়, তিনি সময়ের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। আমার এই বায়োকেমিক্যাল ড্রাগস নিয়ে রিসার্চের প্রতিভাটা হয়তো আমি ওঁর থেকেই পেয়েছি। আমার বলতে লজ্জা নেই, আমার অনেক ওষুধের পেটেন্টের মূল ভাবনা আমি ওঁর ওই ডায়েরি থেকেই পেয়েছি।’ ভদ্রলোক একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে হাসলেন।
প্রিয়ম এবার আর আড়াল আবডাল করল না খুব একটা, মৃদু একটা খোঁচা মারল রুদ্রর কোমরে।
সেটা লক্ষ করে ড শ্যুমাখার তড়িঘড়ি বললেন, ‘আমার নিজস্ব রিসার্চে অনেকটাই এগিয়েছিলাম, কিন্তু সম্প্রতি আমি ওঁর ডায়েরিতে এমন একটা জিনিস খুঁজে পেয়েছি, যা থেকে আগামী একমাসের মধ্যে এমন ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যাতে তারপর থেকে নতুন যে শিশুরা পৃথিবীতে জন্মাবে, ক্যান্সার কোনোদিনও তাদের বা তাদের বংশধরদের শরীরে থাবা বসাতে পারবে না। শুধু শিশু নয়, প্রাপ্তবয়স্ক যারা এখনও সুস্থ আছে, তাদেরও কোনোদিন ক্যান্সার হবে না।’
রুদ্র এবার অবাক হয়ে গেল, ‘মানে? সেটা কীভাবে সম্ভব?’
ড শ্যুমাখার একটু চাপা গলায় উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘সম্ভব, কিন্তু একদম অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। উনি এমন একটা মৌলিক পদার্থ আবিষ্কার করেছিলেন যেটা অ্যাপ্লাই করে মানুষের জিনগুলোকে এমনভাবে মডিফাই করে দেওয়া যায় যাতে কোনো কোষের অ্যাবনর্মাল গ্রোথ হবে না!’
‘তাদের ক্ষেত্রে হয়তো অ্যাবনর্মাল গ্রোথ হবে না, কিন্তু তাদের নেক্সট জেনারেশনের ক্ষেত্রে তো হতেই পারে।’
ড শ্যুমাখার দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘না, একধরনের কোষ আছে, যাতে জিন থেরাপি অ্যাপ্লাই করলে সেটা পরবর্তী সব প্রজন্মের ক্ষেত্রে অ্যাপ্লিকেবল হয়।’
‘তাই?’
শ্যুমাখার বললেন, ‘হ্যাঁ। এবার বুঝতে পারছেন এতে মানবজাতির কত বড়ো ওয়েলফেয়ার হবে? সেই ব্যাপারেই আপনার কাছ থেকে আমার সাহায্য চাই, খুব আর্জেন্ট আর সিক্রেটও বটে।’ প্রিয়মের দিকে তাকালেন তিনি, ‘আপনার হাজব্যান্ডের সঙ্গে লাকিলি পরিচয় হয়েছিল আমার, যদিও আপনার সম্পর্কে আগেই পড়েছিলাম আমি। আমার মনে হয়েছে আপনিই আমাকে হেল্প করতে পারেন। আর এতটা দরকার না থাকলে আপনার সঙ্গে দেখা করতামও না আমি।’
রুদ্র এবার আর তাড়াহুড়ো করতে পারল না। এবার একটু একটু আগ্রহ হচ্ছিল ওর বিষয়টার ওপর। কোনো যন্ত্রণাকাতর কেমোথেরাপি নয়, রে দেওয়া নয়, ক্যান্সার রোগটারই আর অস্তিত্ব থাকবে না পরবর্তী প্রজন্মে?
এর থেকে ভালো আর কী হতে পারে?
হঠাৎ নিজের দাদুর কথা মনে পড়ে গেল রুদ্রর। মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে। ছোটোবেলায় বাবা মা দুজনেই অফিস বেরিয়ে যেতেন, খুব ছোটোবেলায় স্কুল থেকে ফিরে ও দাদুর কাছেই থাকত। দাদুর কোলে চেপেই স্কুলে যেত, বিকেলে খেলতে যেত মাঠে। বই পড়ার অভ্যেস দাদুই করিয়ে দিয়েছিলেন ওকে। দেশ—বিদেশের জানা অজানা কতরকম গল্প শুনত ও দাদুর কোলে বসে। অলিভার ট্যুইস্ট, গালিভার্স ট্রাভেলস, রবিনসন ক্রুসো, হাঞ্চব্যাক অফ নোতরদাম!
এমনকী শেক্সপিয়রের কালজয়ী সব ক্লাসিক্সও ওই বয়সের উপযোগী করে ওকে গল্প শোনাতেন দাদু।
সেই দাদু ওর ক্লাস ফোরে পড়ার সময় হঠাৎ চলে গেলেন। তখন বোঝেনি ও, কতদিন স্কুল থেকে ফিরে কাজের মাসির হাত থেকে খাবার না খেয়ে একা একা গুমরে গুমরে কেঁদেছে, দাদুর কথা জানতে চেয়ে বাবা—মা—কে অতিষ্ঠ করেছে। বেশ কয়েক মাস লেগেছিল ওর স্বাভাবিক হতে। পরে বড়ো হয়ে শুনেছিল দাদুর ক্যান্সার হয়েছিল ফুসফুসে। ফাইনাল স্টেজ। কিচ্ছু করা যায়নি। অথচ সিগারেট তো দূর, দাদু চা কফিও বেশি খেত না।
এত বছর পর সেসব কথা মনে পড়তে চোখে জল এল না ঠিকই, সময় সব ক্ষততেই মলম লাগিয়ে দেয়, কিন্তু বুকের ভেতরটা কেমন মুচড়ে উঠল ওর। প্রায়ই আজকাল ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে দ্যাখে একদম ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদেরও ক্যান্সার ধরা পড়ছে, কেমো চলার সময় তাদের কষ্ট দেখা যায় না।
হঠাৎ হঠাৎ আশপাশের চেনাজানার পরিধি থেকে টুপটাপ খসে পড়ছে একেকজন, এই মারণরোগে।
ড শ্যুমাখারের দাবি ঠিক হলে এর চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না।
৫
সেপ্টেম্বর ১৯৩১, জার্মানি
অ্যাডি, মি হফম্যানের স্টুডিয়োর ওই মেয়েটা এসেছে আবার। আমি বললাম তুমি দেখা করবে না, কিন্তু কিছুতেই কথা শুনছে না। একভাবে বসে আছে নীচে।’ অ্যাঞ্জেলা কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে অ্যাডি খেয়ালই করেনি।
সোফায় শরীরের ঊর্ধ্বাংশ হেলিয়ে রেখে মেঝের কার্পেটের ওপর পা দুটোকে এলোমেলো ছড়িয়ে বসে ছিল অ্যাডি। গায়ে কয়েকদিনের পুরোনো রাতপোশাক। সকাল থেকে ওর মন রাগে তেতো হয়ে আছে। অথচ গত ছ—টা দিন ও মুখে কুটোটি কাটেনি। এত ব্যস্ত শিডিউলে অন্য সময় দিনের প্রায় আঠেরো ঘণ্টা ব্যস্ত থাকে ও, কিন্তু কয়েকদিন সব কিছু থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে নিয়েছে। চুপচাপ এই ছোট্ট বিছানার পাশের সোফাতেই কাটিয়েছে একভাবে।
কিছুক্ষণ পরে অ্যাঞ্জেলা আবার ভারী গলায় বলল, ‘চলে যেতে বলব তো?’
অ্যাডি উত্তর দিল না। হফম্যান ওর পরিচিত ফটোগ্রাফার, পার্টির মিটিং মিছিলে ছবি তোলে। ইভা বলে নতুন মেয়েটা হফম্যানের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ঢুকেছে কিছুদিন হল।
এই অবস্থায় কী চায় সে?
আসছে কেন বারবার?
ও মুখ তুলে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল, ওর উদাস দৃষ্টি গিয়ে পড়ল রাস্তায়। ওর বাড়ির বাইরে মৃদু কোলাহল শোনা যাচ্ছে, অনেকগুলো জার্মান বুটের সশব্দ পদচারণা শোনা যাচ্ছে।
এত আওয়াজ কীসের?
জার্মানির উত্তর—পূর্বদিকে অবস্থিত এই বার্লিন শহর প্রায় সাতশো বছরের পুরোনো। পত্তনের গোড়া থেকেই যখন যে রাজত্ব চলেছে এই অঞ্চলে, বার্লিন থেকেছে তার কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে যুগে যুগে এই শহর সংস্কৃতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান এবং আর্কিটেকচারের ধারক হয়ে থাকলেও মাঝেমধ্যে হিংসার হাত থেকেও রেহাই পায়নি। ষোলোশো আঠেরো সাল থেকে শুরু হওয়া পুরো সেন্ট্রাল ইউরোপে চলা ত্রিশ বছরের বিখ্যাত ধর্মযুদ্ধে তো গোটা বার্লিন শহর প্রায় ধ্বংসই হয়ে গিয়েছিল। অর্ধেকেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল, মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল অসংখ্য বাড়ি। প্রুসিয়া সাম্রাজ্যের সময় হৃত গৌরব আবার ফিরে পায় বার্লিন।
তারপর ইতিহাসের পাতা উলটেছে সময়ের চাকার সঙ্গে সঙ্গে, এক দল গড়ে তুলেছে নিপুণ ভাস্কর্য, আরেক দল ক্ষমতায় এসে তা গুঁড়িয়ে দিয়েছে নিষ্ফল আক্রোশে।
সবই রিপুর খেলা।
এই বার্লিনকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহরে পরিণত করার কত স্বপ্নই না দেখেছিল অ্যাডি। নাওয়াখাওয়া ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কর্মযজ্ঞে। এই শহরের জন্য জেল খেটেছে, এই শহরের জন্য দিনের পর দিন গলার শির ফুলিয়ে বক্তৃতা দিয়ে উদবুদ্ধ করেছে জনসাধারণকে। বিশুদ্ধ আর্য জাতির দেশের আদর্শ রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তো সে এই শহরকেই বেছে নিয়েছিল।
কিন্তু এখন আর কিচ্ছু ইচ্ছেই করছে না।
কিছু ভালোই লাগছে না ওর। মনে হচ্ছে সব ছেড়েছুড়ে চলে যায় দূরে কোথাও কোনো শান্ত জনশূন্য প্রান্তরে।
অথচ এই বছরটা ওর খুব ভালোই যাচ্ছিল। ল্যান্ডসবার্গ জেলে বসে লেখা ওর প্রথম বই বেস্টসেলার হয়েছে। মাত্র কয়েক মাসে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। ভালো রোজগার হয়েছে সেটা থেকে। ওর সাধের দলও এখন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্টিতে পরিণত হয়েছে। দেশের তাবড় তাবড় শিল্পপতিরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে ওর পার্টিই দেশের একমাত্র ভবিষ্যৎ, অ্যাডিই দেশের মুখ। তাদের মোটা টাকার ইনভেস্টমেন্টে সদ্য মিউনিখ শহরে পার্টির হেডকোয়ার্টার খোলা হয়েছে, নাম দেওয়া হয়েছে ‘ব্রাউন হাউস’।
দেশেও সমর্থকদের সংখ্যা বাড়ছে ক্রমশ। তার মূলে অবশ্যই ওর অসাধারণ বাগ্মিতা।
তবু এরই মধ্যে গেলি নেই, এটা যেন এই ছ—দিনেও ও হজম করতে পারছে না। থেকে থেকে মনে পড়ছে সেই সুন্দর দিনগুলোর কথা, যখন গেলির সঙ্গে মাঠে ছুটতে ছুটতে ও নিজেও প্রাণোচ্ছল কৈশোরে ফিরে যেত, নাম—না—জানা পাখি, প্রজাপতি দেখে আনন্দ পেত নিজের অজান্তেই!
গেলি আর কোনোদিনও ফিরবে না। তাহলে অ্যাডি কী করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে?
অ্যাঞ্জেলা আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, উত্তর না পেয়ে সে যখন ঘর থেকে প্রায় বেরিয়ে গেছে, অ্যাডির হঠাৎ মনে হল এই ইভা বলে মেয়েটার সঙ্গে গেলির চোখ দুটোর খুব মিল।
আগে যে—একবার কথা হয়েছিল, তখনও লক্ষ করেছিল, কথা বলার ধরনেও সাদৃশ্য আছে বেশ। শুধু যৌবনে উপনীত হওয়া এই মেয়েটার চেহারায় লাবণ্য আরও বেশি, গেলির মতো কৈশোরের সুপ্ত কুঁড়ি নয়।
ও পিছু ডাকল, ‘অ্যাঞ্জেলা, ওই মেয়েটাকে নিয়ে এসো এখানে।’
অ্যাঞ্জেলা একটু অবাক হল, ‘এখানে? না নীচের কনফারেন্স রুমে?’
অ্যাডি বলল, ‘এখানেই নিয়ে এসো।’
এই ঘরে কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি এখনও অবধি। তার ওপর দু—দিন আগে যখন এই মেয়েটা এসেছিল, অ্যাডি দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
অ্যাঞ্জেলা অবাক হলেও মুখে সেটা প্রকাশ করল না, ‘ঠিক আছে। আমি নিয়ে আসছি।’
অ্যাডির চোখ দুটো খুব জ্বালা করছিল, এমনিতেই সেই অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে মাঝে মাঝেই ওর চোখ থেকে জল পড়তে থাকে, মুহূর্তের জন্য অন্ধকার হয়ে যায় হঠাৎ হঠাৎ আর এই —কদিনের ক্রমাগত চোখের জলে এ দুটো মনে হয় ভালোরকম অবাধ্যতা শুরু করেছে।
নিজের বিস্রস্ত পোশাকটা একটু গুছিয়ে দেওয়ার জন্য সোফা ছেড়ে উঠতেই বাঁ—পাশে বিছানার ওপর বালিশের ভাঁজে আধশোয়া অবস্থায় রাখা কালকের গোলাপ ফুলটা চোখে পড়ল। ফুলটার কয়েকটা পাপড়িতে কালো ছোপ ধরেছে, সেই পাপড়িগুলো গুটিয়ে ঈষৎ কোঁচকাতে শুরু করেছে।
পাশের হলদেটে সাদা ক্রিম—রঙা সাটিনের ওপর লেসের কাজ করা সুন্দর ফ্রকটার গায়ে সেই কুঁচকোনো পাপড়ির একটা এলিয়ে পড়েছে অবহেলায়, ওই শুকিয়ে যাওয়া ফুলের পাপড়িটা যেন নিঃশব্দে বিদ্রুপ করছে ওই ফ্রকটাকে।
মুহূর্তের মধ্যে অ্যাডির মাথায় যেন আগুন ধরে গেল, রাগে উন্মত্ত হয়ে ও চিৎকার করল,’অ্যাঞ্জেলা! অ্যাঞ্জেলা! ম্যাক্স! সবাই কি মরে গেছ নাকি?’
অ্যাঞ্জেলা ওই মেয়েটাকে নিয়ে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠছিল, হঠাৎ অ্যাডির উন্মত্ত চিৎকার শুনে ত্রস্ত পায়ে দোতলার এককোণের ছোট্ট ঘরটায় গিয়ে ঢুকল। এটা অ্যাডির ঘর নয়, অ্যাডি দোতলার অন্যপাশের সবচেয়ে বড়ো ঘরটায় থাকে, কিন্তু এই কয়েকদিন এখান থেকে একবারের জন্যও সে বের হয়নি।
অ্যাঞ্জেলা ঘরে ঢুকে বিস্মিতভাবে বলল, ‘কী হয়েছে অ্যাডি?’
অ্যাডি ফুলটার দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করল, ‘ফুলটা পালটানো হচ্ছে কিনা সেই খোঁজটাও তোমাদের রাখার সময় হয় না? বাসি শুকিয়ে যাওয়া ফুল রেখেছ?’
অ্যাঞ্জেলা দ্রুত গতিতে ফুলটা তুলে নিয়েই বেরিয়ে গেল। মেয়েটা পেছন পেছন এসেছিল, থতোমতো খেয়ে দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে রইল।
অ্যাঞ্জেলা কিছু বলল না। বাইরের মেয়েটার সামনে অপমানে ওর চোখে জল এসে গেছে। অ্যাডি যে বাসি ফুল সহ্য করতে পারে না, সেটা অ্যাঞ্জেলা ছোট্টবেলা থেকে জানে। এমনকী অ্যাডির নিজের মা মারা যাওয়ার সময়েও কফিনের ওপরের স্মৃতিসৌধে দেওয়া প্রচুর ফুলের স্তবকের মধ্যে একগুচ্ছ শুকিয়ে যাওয়া ফুল নিয়ে এরকমই তুলকালাম করেছিল।
কিন্তু এই সময়েও কি ওর সঙ্গে অ্যাডি একটু ভালোভাবে কথা বলতে পারে না? ও কি এই বাড়ির আর পাঁচটা কাজের লোক? নাকি অ্যাডি নিজে সেটাই মনে করে। ভুলে গেছে যে অ্যাঞ্জেলা ওর দিদি! হোক সৎ, ছোটো থেকে সৎ দিদি বলে কর্তব্যে কোনোরকম গাফিলতি করেছিল অ্যাঞ্জেলা ছোটো ভাইয়ের প্রতি?
আর যে চলে গেছে সে না হয় অ্যাডির বোনঝি, আর অ্যাঞ্জেলার?
অ্যাঞ্জেলার সে নিজের সন্তান!
ওর স্বামী মারা যাওয়ার পর তিলতিল করে বড়ো করা, ওর নিজের শরীরের রক্ত মাংস দিয়ে তৈরি প্রাণবন্ত মেয়েটা মাত্র তেইশ বছরে নিজেকে শেষ করে দিল, মা হয়ে ওর নিজের বুকটা ফেটে যাচ্ছে না?
মনে হচ্ছে না, এক ছুটে গিয়ে অ্যাডির সাধের যে পিস্তলটা দিয়ে ওর ছোট্ট মেয়েটা নিজেকে শেষ করে দিয়েছে, সেই পিস্তলটা দিয়েই অ্যাডির মাথাটা মুহূর্তে এফোঁড়—ওফোঁড় করে দিতে?
মামার ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে! মেয়েটাকে দিনের পর দিন ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখে, একরকম মানসিক রুগী করে তোলার সময় কোথায় ছিল এই স্নেহ?
অবশ্য স্নেহ কত ওর জানা আছে! ভিয়েনায় থাকতে ঘুণাক্ষরেও যদি ও বুঝতে পারত মামা হয়ে অ্যাডির ওই ভালোবাসাটা শুধুই স্নেহ নয়, তার মধ্যে মিশে আছে নিজের বিকৃত লালসা চরিতার্থ করার কাম, মা হয়ে কক্ষনো নিজের মেয়েকে আসতে দিত এখানে অ্যাডির সঙ্গে?
ওর ছোটো বাচ্চাটা!
ফুলদানিটা সাজাতে সাজাতে ও আবার নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার আগে পর্যন্ত গেলি পালাতে চেয়েছিল এই অভিশপ্ত বাড়ি থেকে, লুকিয়ে চলে যেতে চেয়েছিল ওর কাছে ভিয়েনায়, কিন্তু অ্যাডির সিকিউরিটিরা কড়া হাতে ফেরত নিয়ে এসেছিল তাকে, আর তরপর অ্যাডি নিজে এসে বন্ধ দরজায় তালা দিয়ে রেখেছিল দিনের পর দিন, সব খবর আছে ওর কাছে।
ভালোবাসা!
অ্যাডি যতই শোকপালন করুক, বাড়ির কোনো কাজের লোকের জানতে বাকি নেই, আর কাজের লোক তো দূর। সারা জার্মানি বলতে গেলে জেনে গেছে তাদের অসামান্য বক্তা, বিখ্যাত নেতার কীর্তি। এমনকী, একটা কাগজ তো পরিষ্কার লিখেছে, ইট’স আ মার্ডার!
হতে পারে গেলি সুইসাইড করেছে, কিন্তু তাকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মতো মানসিক অত্যাচার যে করল, সে খুনি নয়?
অনেক… অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করছে অ্যাঞ্জেলা।
এখন মনে হয় কী কুক্ষণে গেলিকে ও আসতে দিয়েছিল এখানে।
ভারাক্রান্ত মনে ফুলদানিটা নিয়ে পর্দা সরিয়ে ঢুকতে যেতেই ও বিস্ময়ে স্থবির হয়ে গেল। ঘৃণায় কেঁপে উঠল ওর মন।
ঘরের ঠিক সেইখানটায় বেঁকেচুরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অ্যাডি, ঠিক যেখান’টায় ছ—দিন আগে অ্যাঞ্জেলার তেইশ বছরের মেয়েটা নিজের মাথায় নিজেই গুলি করে নিশ্চল হয়ে পড়েছিল।
গভীর অশ্লেষে অ্যাডি চুমু খাচ্ছে মি হফম্যানের স্টুডিয়োয় নতুন যোগ দেওয়া ইভা নামের ওই মেয়েটাকে!
৬
বাইরে প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে। সকাল থেকে অনেক হাঁটাহাঁটি হয়েছিল, তাই এখন বেশ খিদে খিদে পাচ্ছে। তবু ড শ্যুমাখারের কথা শুনতে শুনতে বুঁদ হয়ে যাচ্ছিল রুদ্র।
গত এক ঘণ্টা ধরে ড শ্যুমাখার ওঁর রিসার্চের ধরনটা সহজবোধ্য করে ব্যাখ্যা করেছেন ওদের কাছে। ওঁর বোঝানোর ধরনটা বেশ সহজ সরল, যে কেউই বুঝতে পারবে। জিন কীভাবে বংশগতির ধারক, ক্রোমোজোম, ডি এন এ, নিউক্লিক অ্যাসিড কী, ক্যান্সারের ক্ষেত্রে জিনের ভূমিকা, সব কিছুর একটা ওপর ওপর ধারণা হয়েছে রুদ্র আর প্রিয়মের।
উলটোদিকে মাদাম তুসোর দরজা অবশেষে বন্ধ হয়ে যেতে একটা নিশ্বাস ফেলে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে রুদ্র বলল, ‘কাল বাড়ি থেকে ব্রেকফাস্ট করেই মাদাম তুসোয় চলে আসব, কেমন? আজ তো আর হল না।’
প্রিয়মের মুখটা অনেকক্ষণই কালো হয়ে গিয়েছিল, এবার গলে যাওয়া মোমবাতির মতো নিভে গেল। অস্ফুটে বলল, ‘কাল তো অফিস!’
রুদ্র একটু চোখের ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করল প্রিয়মকে, তারপর ড শ্যুমাখারের দিকে তাকাল, ‘আপনার পুরো রিসার্চ টপিকটাই বুঝলাম। এখন বলুন আমি কী করতে পারি।’
ড শ্যুমাখার এবার একটু দম নিলেন, প্রিয়মের দিকে একঝলক তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘বলছি। তার আগে আপনাকে জানাচ্ছি, আমার এই কাজটায় আমি সাকসেসফুল হই, সেটা কিন্তু অনেকেই চায় না। তারা মোটামুটি পুরো ইউরোপে জাল ফেলে রেখেছে আমার রিসার্চটাকে ভেস্তে দেওয়ার জন্য। ইন ফ্যাক্ট এই কারণেই আমি কোনো প্রফেশনাল ইনভেস্টিগেটরের বদলে আপনার মতো বিদেশি একজনের হেল্প চাই। আপনি হেল্প করলে আপনাকে চট করে কেউ সন্দেহই করবে না।’
রুদ্র এবার একটু বিস্মিত হল, ‘ভেস্তে দিতে চাইছে! কিন্তু কেন? এটা তো একটা নোবল কাজ! সবাই চাইবে।’
ড শ্যুমাখার এবার বিষণ্ণ হাসলেন, ‘ম্যাডাম, নোবল কাজ করতে যাওয়ার রাস্তাতেই তো বিপদ আসে বেশি। ভালো কাজই তো লোকে নিতে পারে না, না! সেই কোপারনিকাস, গ্যালিলিওর সময় থেকেই হয়ে আসছে। এই যে সারা পৃথিবী জুড়ে ইনভেস্টমেন্ট ছড়ানো রয়েছে ক্যান্সারের ওপর, এত বিলিয়ন ডলার টার্ন ওভার সেইসব ফার্মা কোম্পানিগুলোর, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন, স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশনের ওপর দাঁড়ানো এত বড়ো একটা ইন্ডাস্ট্রি, পুরোটাই ধসে পড়বে যে এক লহমায়। রোগটাই যদি উধাও হয়ে যায়, তারা তো পথে বসবে রাতারাতি। হাজার হাজার মানুষের চাকরি তো যাবেই, পুরো ইন্ডাস্ট্রিটাই উঠে যাবে। ফার্মা জায়ান্টগুলোর শেয়ার প্রাইস কোথায় যাবে বলুন তো? রাতারাতি ধসে পড়বে স্টক মার্কেট।’
রুদ্র মাথা নাড়ল। এদিকটা ও ভেবে দেখেনি। বাংলায় একটা মজার কথা প্রচলিত আছে, মানুষের অসুখ না হোক এটা ডাক্তাররা কখনোই চাইবেন না, তাতে তাঁদের রুটিরুজিতে যে টান পড়বে। তাই তাঁরা চান অসুখ হোক, চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলবেন তাঁরা।
নির্মম সত্যি।
এও অনেকটা সেরকমই।
শ্যুমাখার বলে চলছিলেন, ‘তাই তারা অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছে যাতে আমি প্রিভেন্টিভ প্রসেসে বেশি এগোতে না পারি। কিন্তু রিসেন্টলি এই ব্যাপারটা জানার পর আরও ডেসপ্যারেট হয়ে উঠেছে তারা। যেকোনো উপায়ে আমার রিসার্চটা আটকাতে চায়। এমনকী, আমার নিজের ল্যাবেতেই বেশ কিছু ইনফর্মার হয়তো আছে, আমি তাদের ঠিক ধরতে পারছি না। তারা আমার রিসার্চ সিক্রেট পাচার করে দিলে আমার অপোনেন্টরা এই রিসার্চটা এগোনো দূর, আমাকেই বাঁচিয়ে রাখবে কিনা সন্দেহ!’ ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘তাই এত গোপনীয়তা মেইনটেইন করে আপনার কাছে আসা।’
রুদ্র বাধা দিল, ‘এক মিনিট। রিসেন্ট কোন ব্যাপারটার কথা বলছেন?’
ড শ্যুমাখার এবার একটু এদিক—ওদিক চাইলেন। আশপাশে তেমন কেউ নেই। যদিও ঘড়িতে এখন প্রায় সন্ধে সাতটা, বাইরে দিনের আলো ঝলমল করছে। তাই যে ক—জন গোনাগুনতি খদ্দের, সব বাইরেই বসে আছে। এদের এখানে মাত্র দুটো মাস গরম থাকে, অন্য সময় হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। বৃষ্টিও এখানে ভীষণ অনিশ্চিত, শুরু হয়ে যায় যখন তখন। তাই রোদ ঝলমলে দিন এরা খুব এনজয় করে, রোদের তাপ এরা মিস করতে চায় না একটুও।
তাই ভেতরের এই স্যাঁৎসেঁতে আলোআঁধারিতে ওরা তিনজন আর কফিশপের দুজন ওয়েটার ছাড়া কেউ নেই।
ড শ্যুমাখার একটু ইতস্তত করলেন, তারপর শার্টের ওপরের দুটো বোতাম চট করে খুলে ভেতর থেকে একটা ছোটো খাম করে আনলেন।
লম্বায় আড়াই ইঞ্চি, চওড়ায় দু—ইঞ্চি মতো আকারের একটা এনভেলপ।
রুদ্র দেখল ড শ্যুমাখার সামান্য কাঁপা হাতে খামটা খুলে ছোটো ছোটো পোস্টকার্ডের আদলে কয়েকটা শক্ত কাগজ বের করলেন।
রুদ্র কিছু না বলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল।
ড শ্যুমাখার একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘আমার ওই দাদু আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে এমন একটা আবিষ্কার করেছিলেন যেটা দেখলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। অনেক অসুখেরই ওষুধ বের করেছিলেন তিনি তবে তাঁর নিজের লেখাতেই বোঝা যায়, শেষের দিকে উনি দিনরাত পড়ে থাকতেন ক্যান্সারের ওষুধ নিয়ে।’
রুদ্র বলল, ‘অতদিন আগে ক্যান্সার নিয়ে রিসার্চ শুরু হয়ে গিয়েছিল?’
ড শ্যুমাখার তাঁর খয়েরি ভ্রূ দুটোকে বেশ কিছুটা ওপরে তুলে বললেন, ‘কী বলছেন ম্যাডাম! প্রাচীন গ্রিস আর মিশরে পর্যন্ত কার্সিনোমো নিয়ে গবেষণা হয়েছে। তবে হ্যাঁ, আধুনিক যুগে বলতে গেলে শুরু হয় ১৮৫০ সাল নাগাদ, ইথার দিয়ে যে অ্যানাস্থেশিয়া, মানে টেম্পোরারি অজ্ঞান করা যায়, সেটা যখন আবিষ্কার করা হয়, তখন থেকে। তারপর সেই টেকনোলজি দিয়ে টিউমর অপারেশনও শুরু হয়। সেগুলোই হল ক্যান্সার রিসার্চের ফার্স্ট স্টেপ।’
রুদ্র বলল, ‘উনিও কি আপনার মতো প্রিভেন্টিভ মেজার নিয়ে কাজ করতেন?’
শ্যুমাখার বললেন, ‘কাকতালীয়ভাবে তাই। ওঁর ডায়েরিতেই আমি জানতে পারি, উনি এমন একটা কেমিক্যাল এলিমেন্ট তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছিলেন যা খোলা বাতাসে নাইট্রোজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে একটা কম্পাউন্ড তৈরি করবে, যেটা মানবশরীরে প্রবেশ করলে জিনটাকে এমনভবে মডিফাই করে দেবে, তার শরীরেও কোনোদিন ক্যান্সার দেখা দেবে না আর তার নেক্সট জেনারেশনেও ক্যান্সার থাবা বসাতে পারবে না। ডি এন এ স্ট্রাকচারের বদলের ফলে রোগটাই উধাও হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে।’
এবার প্রিয়মও ওর ছটফটানি থামিয়ে বেশ অবাক হয়ে গেল, ‘এটা কি সম্ভব? মানে, উনি তৈরি করেছিলেন?’
ড শ্যুমাখার এবার একটা বড়ো নিশ্বাস ফেললেন, ‘ইয়েস! উনি করেছিলেন কিন্তু মনে হয় ইমপ্লিমেন্ট করার আগেই হঠাৎ মারা যান উনি। তারপর থেকে ওঁর ওই থিসিসটা অবহেলায় পড়েছিল ডায়েরির ভাঁজে, এত বছর কেউ বোঝেইনি কী সম্পদ লুকোনো আছে তাতে। আমি সেটাকে উদ্ধার করেছি।’
রুদ্র চুপ করে শুনছিল, কিন্তু প্রিয়ম আরও উত্তেজিত হয়ে উঠল, ‘আপনি তৈরি করে ফেলেছেন, তাহলে সেটা অ্যাপ্লাই করছেন না কেন? সারা পৃথিবী টলে যাবে তো!’
ড শ্যুমাখার বললেন, ‘সেখানেই আটকে গেছি। উনি এমনভাবে লিখে গেছেন ওই এলিমেন্ট তৈরির প্রসেসটা, কিছুতেই আমি বুঝে উঠতে পারছি না।’
রুদ্র এবার মুখ খুলল, ‘আচ্ছা, আপনার রিসার্চ টপিকটায় অনেকেই বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে জেনেও আপনার দাদুর ডায়েরি থেকে পাওয়া এই জিনিসটার ব্যাপারে আপনি কাদের বলেছেন?’
ড শ্যুমাখার মুখ দিয়ে চুক চুক করে আফশোসের একটা শব্দ করলেন, ‘ওখানেই আমি আবেগের বশে একটা ভুল করে ফেলেছি ম্যাডাম। আমার খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন কো—রিসার্চারকে বলে ফেলেছিলাম উত্তেজনার বশে। তখনও বুঝিনি যে, ওদের মধ্যেই ইনফর্মার থাকতে পারে। ইনফ্যাক্ট তারপর থেকেই বিভিন্নভাবে আমাকে থ্রেট করা হচ্ছে। কখনো রাস্তায় জোরে কোনো গাড়ি চেপে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, কখনো কোনো ফোন আসছে যে এই ব্যাপারে আমি এগোলে ফল ভালো হবে না। যেকোনো সময় এটা খোওয়া যেতে পারে।’
রুদ্র বলল, ‘আপনাদের এখানকার পুলিশ তো ভীষণ এফিশিয়েন্ট বলেই জানি। আপনাদের গভর্নমেন্ট তার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে ভীষণ কেয়ারিং। তাদের সাহায্য নিচ্ছেন না কেন?’
ড শ্যুমাখার সামান্য হাসলেন, ‘বাইরে থেকে ওরকম অনেক কিছুই মনে হয় ম্যাডাম।’ ওঁর মুখটা হঠাৎ কঠিন হয়ে গেল, ‘আমাদের গভর্নমেন্ট এখন মিডল ইস্টের শরণার্থীদের আশ্রয় দিতেই ব্যস্ত, আমাদের দিকে তাদের নজর পড়বে ভোটের আগে আগে। আর শুধু আমাদের সরকারই বা বলি কেন? গোটা ইউরোপের সব গভর্নমেন্টই বলতে গেলে এখন লিবিয়া, সিরিয়া, টিউনিশিয়ার লোকেদের হেল্প করতে গিয়ে নিজেদের সিটিজেনদের অবহেলা করা শুরু করেছে। এগুলো সবই ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্সের খেলা, বুঝলেন না।’ কথা শেষ করে কাগজের টুকরোগুলো তিনি বাড়িয়ে দিলেন সামনের দিকে।
রুদ্র একটু ঝুঁকে দেখল, ও যেগুলোকে দূর থেকে কাগজের টুকরো ভাবছিল, সেগুলো ফটোগ্রাফ, আগেকার দিনে যেমন ছোটো ছোটো চৌকো আকৃতির সাদা কালো ফটো হত। ও অবাক হয়ে বলল, ‘ফটোগ্রাফ?’
ড শ্যুমাখার বললেন, ‘হ্যাঁ। মোট দশটা ফটো। আসলে ভদ্রলোক তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। পন্ডিচেরির ওই সমুদ্রের পাড়ে বসে এমন সমস্ত চিন্তাভাবনা করে গেছেন যা আজকের দিনেও লোকে ভাবতে পারে না, ওঁর ডায়েরিটা পড়লে অবাক হতে হয়। এই ফটোগুলোর মধ্যে ওই মৌলটা তৈরির লেখা আছে কিন্তু একটু অদ্ভুতভাবে, যেটা আমি বুঝতে পারছি না। তবে ডায়েরির লেখা যদি ঠিক হয়, ওই মৌল যদি সত্যিই তৈরি করতে পারি, সেটাকে নাইট্রোজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করিয়ে শরীরে প্রবেশ করানোর সঙ্গে সঙ্গে সেটা কাজ শুরু করবে। আর তাতে মানবসভ্যতা এক মহা অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে।’ ড শ্যুমাখার চোখ থেকে চশমাটা খুললেন, ‘আপনি ভুটানে এইরকমই একটা কঠিন পাজল সলভ করে একটা সুপারন্যাচারাল স্পিসিস তৈরি করা আটকেছিলেন না?’
রুদ্র ছবিগুলো দেখছিল। সাদা কালো চৌকো আকৃতির, ওপরনীচে পুরোনো দিনের নেগেটিভের খোপগুলোও বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট। ও মাথা নাড়ল, ‘আমি একা নয়। প্রিয়ম ছিল, আরও অনেকেই ছিলেন সেটায়।
শ্যুমাখার বললেন, ‘আমি পড়েছিলাম সেটা। ওটা ভালো কাজ তো ছিলই, কিন্তু এই মিশনে যদি আপনি আমাকে হেল্প করতে পারেন, জানবেন সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষ আপনাকে দু—হাত তুলে আশীর্বাদ করবে।’
৭
জার্মানির রাজধানী বার্লিনের ঠিক পাশেই পটসড্যাম শহর, এটি নিজেও জার্মানির ব্র্যান্ডেনবার্গ রাজ্যের রাজধানী। বার্লিনের মতো অতটা ঐতিহ্যমণ্ডিত না হলেও চোখজুড়োনো হ্যাভেল নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই শহরে যুগে যুগে প্রচুর বিদেশির আগমন ঘটেছে। ফ্রান্স, রাশিয়া, নেদারল্যান্ড, বোহেমিয়া এবং আরও অনেক দেশ থেকে বিভিন্ন সংস্কৃতির এবং বিভিন্ন ভাষার মানুষজন এখানে এসে বসবাস করার ফলে এই পটসড্যাম শহরে এখন বৈচিত্র্যমণ্ডিত অনেক ধরনের লোকজনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। বিভিন্ন কালচারের সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে দারুণ সমস্ত আর্কিটেকচার।
এই পটসড্যাম শহরেই জার্মানির প্রধান পুলিশবাহিনী ফেডেরাল পুলিশের হেডকোয়ার্টার। এমনিতে জার্মানির প্রতিটা রাজ্যের নিজস্ব পুলিশ ফোর্স রয়েছে, তাদের বলা হয় ল্যান্ডপুলিশ। আর এই ফেডেরাল পুলিশবাহিনী কোনো রাজ্যের অধীনে নয়, সারা দেশের নিরাপত্তার দেখভাল করে এরা, তাই এরা সরাসরি ফেডেরাল মিনিস্ট্রির অধীনে।
রোদ ঝলমলে এক সকালে নিজের দপ্তরে বসে ফেডেরাল পুলিশের চিফ পুলিশ কমিশনার অ্যান্টন স্নেইডার মুখে মুখে ডিকটেট করছিলেন, আর তাঁর সেক্রেটারি লিনা ঝড়ের গতিতে ল্যাপটপে টাইপ করছিল।
বাইরে সুন্দর রোদ উঠেছে, তার সঙ্গে হালকা হাওয়াও দিচ্ছে বেশ, মি স্নেইডার পুলিশের দুঁদে বড়োকর্তা হলেও একটু প্রকৃতিপ্রেমিক গোছের, বাইরের লাল হলুদ পাতাওয়ালা বিশাল গাছটার দিকে তকিয়ে মাঝে মাঝেই উদাস হয়ে পড়ছিলেন তিনি। একটা কবিতার লাইন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল হঠাৎ তারই মধ্যে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গের এই ডিকটেশন দিতে গিয়ে বার বার খেই হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি।
লিনা একবার একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘স্যার, আগের সেনটেন্সটা শেষ করলেন না তো! ইউ আর কর্ডিয়ালি ইনভাইটেড টু … তারপর?’
মি স্নেইডার তাঁর কবিতায় কী—একটা শব্দের মিল খুঁজছিলেন মনে মনে, লিনার কথায় একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘উফ লিনা! তুমি কি নতুন ঢুকেছ নাকি চাকরিতে? দেখছ আমি ওঁদের ইনভাইট করছি, তাহলে ইনভাইটেড টু আমাদের এই অফিসেই হবে, নিশ্চয়ই আমার বাড়িতে আমি রাষ্ট্রসঙ্ঘের কর্তাদের নিমন্ত্রণ করব না। কমন সেন্সটা অ্যাপ্লাই করো।’
লিনা বকুনি খেয়েও কিছু মাইন্ড করল না। স্নেইডার স্যার একটু এরকমই। মাঝে মাঝেই বেখেয়ালি হয়ে পড়েন। তবে মানুষটা ভালো। কাজ ছাড়াও লেখালেখি নিয়ে থাকেন, আর মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যান, বাক্স—প্যাঁটরা গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে। বলেন, ওটাই তাঁর অক্সিজেন।
ও মাথা নীচু করে টাইপ করতে লাগল, ‘ওকে, স্যার!’
মি স্নেইডার আবার কবিতার মধ্যে ডুবে যেতে যেতে ভাবলেন, নাহ! যেটুকু মনে মনে লিখলেন সেটা এইবেলা নোট করে রাখা ভালো। এখন আগামী কয়েকদিন অনেক ইম্পর্ট্যান্ট সব কাজ রয়েছে, মিটিংও রয়েছে কয়েকটা আন্তর্জাতিক কমিটির সঙ্গে, এখন কাব্য করলে তাঁর চলবে না।
তিনি সোজা হয়ে বসে কী—একটা বলতে যাবেন, তার আগেই টেবিলের টেলিফোন বেজে উঠল। লিনা ফোনটা রিসিভ করে কয়েক সেকেন্ড কথা বলেই ফোনটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিল, ‘আপনার আর্জেন্ট ফোন স্যার!’
মি স্নেইডার ফোনটা ধরলেন তাড়াতাড়ি, অনেক স্টেপ পেরিয়ে তাঁর কাছে ফোন আসে, নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু।
লিনা দেখল ফোনটা ধরে শুনতে শুনতে মি স্নেইডারের ভ্রূ দুটো অনেকটা উঠে গেল, হুঁ—হাঁ ছাড়া কিছু বলছেন না, মিনিট পাঁচেক বাদে ফোনটা রেখেই উঠে দাঁড়ালেন। আগে ওঁর বেশ সুন্দর সুঠাম চেহারা ছিল, এখন একটু মোটা হচ্ছেন, উঠে দাঁড়ালে হালকা ভুঁড়ির আভাস পাওয়া যায়।
মি স্নেইডার উঠে কোমরের বেল্টটাকে ঠিক করে নিলেন, সামনের বেলটা দু—বার বাজিয়ে বললেন, ‘লিনা, কোলন ক্যাথিড্রালের সামনে একটা ব্লাস্ট হয়েছে একটু আগে। আমি ফেলিক্সের সঙ্গে একটু বসব। তুমি ওই রাজ্যের ডিফেন্স সেক্রেটারির সঙ্গে আমার একটা মিটিং শিডিউল করো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব!’
লিনা উদ্ভ্রান্ত মুখে উঠে দাঁড়াল।
এই দেশেও ব্লাস্ট শুরু হয়ে গেল?
তাও আবার জার্মানির সবচেয়ে নামকরা টুরিস্ট ডেস্টিনেশন কোলন ক্যাথিড্রালে?
ওয়েস্ট ফেলিয়া রাজ্যের রাজধানী কোলন শহরের একদম কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত প্রায় ন—শো বছরের পুরোনো এই রোমান ক্যাথলিক চার্চ সারা ইউরোপের সবচেয়ে বড়ো গথিক চার্চ। ওখানকার আর্চবিশপ জার্মানির একজন অত্যন্ত মান্যগণ্য ব্যক্তি, স্বয়ং চ্যান্সেলরও খাতির করে চলেন তাঁকে।
ওখানে হামলা মানে তো বিশাল ব্যাপার!
ও উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, ‘স্যার কতজন মারা গেছে?’
স্নেইডার তাঁর পার্সোনাল ল্যাপটপটা খুলে কাজ করতে করতে বললেন, ‘ক্যাথিড্রালের ভেতরে কিছু হয়নি, বাইরে যে বড়ো দুটো রাস্তার ক্রসিং, সেইখানে একটা বাইকে ব্লাস্ট হয়েছে। বাইকটা চালিয়ে যাচ্ছিল, সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকার সময় কেউ একটা এক্সপ্লোসিভ ছুড়ে দেয় পাশের কোনো গাড়ি থেকে, মুহূর্তের মধ্যে সেটা ব্লাস্ট করে। গ্রেনেড জাতীয় কিছু। পেছনে যে ছিল সে ভীষণভাবে ইনজিয়োর্ড, আর সামনের জন স্পট ডেড। দুজনেই আগের বছর সিরিয়া থেকে এসেছিল, টেম্পোরারি রিফিউজি পাসপোর্ট হোল্ডার।’
লিনা ততক্ষণে ওর ফোনে একটা লাইভ নিউজ চ্যানেল খুলে ফেলেছে।
কোলন ক্যাথিড্রাল এতটাই বিশাল, প্রায় ছ—শো বছর লেগেছিল তৈরি হতে। এখনও সবসময় চার্চের কোনো—না—কোনো অংশে মেরামতি চলতেই থাকে। প্রতিদিন সারা পৃথিবী থেকে হাজার হাজার মানুষের ভিড় হয় সেখানে।
ওখানে অ্যাটাক মানে পুরো জার্মানির ইন্টারনাল সিকিউরিটির ওপরেই প্রশ্ন উঠে যাওয়া।
নিউজে দেখাচ্ছে ক্যাথিড্রালের একদিকের বাইরের রাস্তায় একটা বাইক দুমড়ে—মুচড়ে পড়ে আছে, তার পাশে ছড়িয়ে—ছিটিয়ে রক্ত।
পাশেই একটা আপাদমস্তক কালো পলিথিনে ঢাকা ডেডবডি স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
নিউজ অ্যাঙ্কর উত্তেজিতভাবে বলছেন, ‘ইংল্যান্ডের ইসলিংটন, ফ্রান্সের প্যারিস, গ্রিসের কাভালা, ইংল্যান্ডের কিংস্টন এবং আজ জার্মানির কোলন। গত দু—মাসে এই নিয়ে পরপর পাঁচবার ইউরোপের পাঁচটি শহর কেঁপে উঠল বিস্ফোরণে। বিস্ফোরণের তীব্রতা খুব বেশি না হলেও এইগুলোর মধ্যে প্রতিটাই টুরিস্ট স্পট, মারাও গেছেন বিদেশিরাই, ফলে এটাকে নিরাপত্তা ব্যবস্থার গাফিলতি বলেই মনে করছে প্রতিটা সরকার। এই প্রত্যেকটা ঘটনার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি না সেই ব্যাপারেও প্রশ্ন তুলেছেন সমগ্র ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। ঘটনাচক্রে এই সপ্তাহেই ফেডেরাল পুলিশের হাইকম্যান্ড বৈঠকে যোগ দিতে আসছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের কিছু শীর্ষ নেতৃত্ব। তার আগেই এই ঘটনা কিছুটা হলেও কি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে? এই ব্যাপারে বৈঠকে বসেছেন দেশের ডিফেন্স মিনিস্টার। ইতিমধ্যেই তিনি ফেডেরাল পুলিশকে জরুরি ভিত্তিতে তদেন্তর নির্দেশ দিয়েছেন।
মি স্নেইডার চোখ কুঁচকে বললেন, ‘আহ লিনা, তোমাকে বলেছি না, কখনো কোনো মিডিয়ার নিউজ শুনবে না? শুনলেও সারমর্ম শুনে বন্ধ করে দেবে। না হলে আমরা নিরপেক্ষভাবে ভাবতেই তো পারব না, জার্নালিস্টদের বলতে থাকা ঘটনাগুলো কল্পনা করেই যুক্তি সাজাতে থাকব, তাই না!’
লিনা মাথা নেড়ে নিউজ চ্যানেলটা বন্ধ করল, ‘ওকে, স্যার! আমি যাচ্ছি।’
স্নেইডারের ফোনে একের পর এক মেসেজ ঢুকছিল, তিনি সেগুলো দেখতে দেখতে ইন্টারকমের ডায়াল ঘোরালেন, ‘মেরি, সব স্টেটের ল্যান্ডপুলিশ চিফদের সঙ্গে আমার একটা ভিডিয়ো কনফারেন্স অ্যারেঞ্জ করো, এক্ষুনি! আর ওই কোলন সিটির চিফকেও ইনক্লুড করো।’
লিনা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সিনিয়র ইনস্পেকটর ফেলিক্স ঢুকল।
স্নেইডার ততক্ষণে ডুবে গেছেন কাজে। তিনি কবিতা লেখার ব্যাপারে যতটা দায়িত্ববান,কাজের ব্যাপারেও ঠিক ততটাই। লিনা চলে যাওয়ার পরেও ওই অ্যাঙ্করের বলা কথাগুলো তাঁর মাথায় ঘুরছে। এইজন্যই তিনি পারতপক্ষে খবর শোনেন না। ইন্টারনেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে ফেলিক্সের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘ফেলিক্স, মেরি কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা মিটিং শিডিউল করছে। তুমি আমাকে ততক্ষণ একটা ফাইল বানিয়ে দাও তো আজকের ব্লাস্টের।’
ফেলিক্স বলল, ‘অল রাইট স্যার।’
ফেলিক্স চলে যেতে গিয়েও কিছু ফিরল, ‘স্যার, শুধু কোলন নয়, লাস্ট দু—মাসে ইংল্যান্ডের দুটো টাউন, গ্রিসের কাভালা আর প্যারিসেও ব্লাস্ট হয়েছে। ওগুলোরও বানিয়ে দিচ্ছি।’
মি স্নেইডার চোখ ছোটো করলেন, ‘তুমি কি কোনো নিউজ চ্যানেল শুনে এলে নাকি? আরে, ওগুলো তো আমাদের এক্তিয়ারেই নয়। অন্য দেশ। এমনকী, এই কোলনের ঘটনাটাও ওই স্টেটের পুলিশের আন্ডারে, তবে যেহেতু ডিফেন্স মিনিস্টার বলেছেন তাই আমাদের দিকে ডেলিগেট হচ্ছে।’
ফেলিক্সকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পরক্ষণেই মত বদলালেন তিনি, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। ওগুলোরও কেস হিস্ট্রি করে নিয়ে এসো। ডিটেইলড ফরেনসিক রিপোর্ট চাই না আমার, পুরো সিনপসিসটা হলেই চলবে।’
ফেলিক্স ঘাড় নাড়ল, ‘ঠিক আছে, স্যার। আরেকটা কথা আপনাকে বলার ছিল। বার্লিন সিটি পুলিশ থেকে একজন কনস্টেবলকে পাঠানো হয়েছে ওই ক্যাসপার ফটোগ্রাফি স্টুডিয়োর গার্ডের পোস্ট—মর্টেম রিপোর্টটা নেওয়ার জন্য।’
স্নেইডার চোখ সরু করে কিছুক্ষণ ভাবলেন।
ফেলিক্স মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য বলল, ‘আপনি চেয়ে পাঠিয়েছিলেন না? স্পেশাল টিম পাঠালেন জিনিসটা পাহারা দেওয়ার জন্য, তবুও তো কিছু করা গেল না।’
স্নেইডার মাথা নাড়লেন, ‘ওহ! সেই চুরির কেস!’
ফেলিক্স বলল, ‘শুধু চুরি নয় স্যার, ওদের ল্যাবের গার্ডটাও তো মার্ডার হয়ে গেল মাঝখান থেকে সিসি ক্যামেরা মনিটরিং—এর লোকটাও তখন ছিল না।’
স্নেইডার বললেন, ‘হুম। ঠিক আছে, তুমি অরিজিন্যাল রিপোর্টটা রেখে একটা কপি দিয়ে দাও ওদের।’
ফেলিক্স ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে স্নেইডার বিড়বিড় করলেন, ‘ওই চুরি যাওয়া জিনিসটাও তো এখনও পাওয়া গেল না।’
৮
লন্ডনের আকাশ ভারি খামখেয়ালি।
এই রোদ ঝলমলে আকাশ: পরক্ষণেই ইলশেগুঁড়ির মতো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু। সবচেয়ে আশ্চর্যের এই রাত আটটাতেও সূর্যের ক্ষীণ আলো। মাদাম তুসোর উলটোদিকের সেই কফিশপ থেকে বেরোনোর সময়েও দিব্যি ঝকঝকে ছিল আকাশ, আর এখন বেশ ভালো বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
তবে এখানকার লোকজন মনে হয় এই অদ্ভুতুড়ে আবহাওয়ায় বেশ অভ্যস্ত, পথ চলতে চলতে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হতেই একটুও চলার গতি না কমিয়ে ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে ফেলছে তারা, এই এগারো তলা থেকেও মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বাইরেটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল রুদ্র।
প্রিয়ম রান্নাঘরে খাবার গরম করছিল। এমনিতে একা থাকলে রাতে ও পাঁউরুটি, নুডলস বা বার্গার খেয়ে নেয় প্রায়ই। কোনো কোনোদিন রুটিও বানিয়ে নেয়।
কিন্তু, এখন কয়েকদিন একটু ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়া হবে। বেশ জুত করে ধনেপাতা দিয়ে চিকেনের একটা প্রিপারেশন বানিয়েছে আজ, শেষ মুহূর্তের টেস্ট করে দেখা পর্ব চলছে এখন। মাঝে মাঝেই নিজের শখের কোনো একটা রান্না করা ওর প্যাশন, বেশ স্ট্রেসবাস্টার হিসেবেও কাজ করে সেটা।
প্রিয়ম একটু জোরে হাঁক পাড়ল, ‘একটু শুনে যাও রুদ্র, প্লেটগুলো ধুয়ে একটু টেবিলে রাখবে?’
বার দুয়েক ডেকেও যখন কোনো সাড়া পেল না, প্রিয়ম বুঝল, প্রায় এক বছর একা থেকেও রুদ্রর বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয়নি, দিব্যি একরকম আছে।
আসলে করতেই হবে বলে সত্যিই বোধহয় কিছু হয় না। যে মনে করে যে আমি ঘরের কোনো কাজ করব না, সে বিন্দাস কিছু না করে হেলেদুলে কাটিয়ে দিতে পারে সারাটা জীবন, না হলে কাল থেকে এসে সেই যে লাগেজগুলো রুদ্র লবিতে রেখেছে, সেগুলো গুছিয়ে আনপ্যাক করার কোনো চিহ্নই দেখতে পাচ্ছে না প্রিয়ম। শুধু জামা পরার সময় কোনোমতে চেনটা খুলে পরে নিচ্ছে, তারপর ঘুরে এসেই দলা পাকিয়ে ফেলে রাখছে কাবার্ডের মাথায়।
প্রিয়ম আসার সময় পইপই করে বলে দিয়েছিল ওর ঘরে পরার জন্য কয়েকটা টিশার্ট নিয়ে আসতে, এখানে বড্ড দাম। সেগুলো ব্যাগ থেকে খুলে যে প্রিয়মকে দেওয়া, ওসবের বালাই নেই।
বেমালুম বসে আছে।
আরে এখানে তো আর ইন্ডিয়ার মতো কোনো হেল্পিং হ্যান্ড নেই, সব তো প্রিয়মকেই করতে হয়, সেটা আর কে বোঝাবে!
আর কিছু না বলে প্লেট আর ডিশগুলো নিয়ে বাইরে আসতেই প্রিয়ম দেখল বাইরের বারান্দায় যাওয়ার দরজার ওপরের কাচটা খোলা, তা দিয়ে হাওয়া আর বৃষ্টির ছাঁট, দুটোই ঢুকছে হু হু করে, আর জানলায় একটা হাত আলতো রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র, সামনে ফোনের স্ক্রিন খোলা। বৃষ্টির ফোঁটা এসে লাগছে ফোনে, ওর গালে, গলা দিয়ে চুইয়ে পড়ছে জল, ওর কোনো হুঁশ নেই।
পাশেই উঁচু তাকটার উপরে রাখা আজকের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ কাগজটাও ভিজছে বৃষ্টির জলে। ঘুরেটুরে এসে প্রিয়ম কিছুক্ষণ পড়েছিল কাগজটা, তারপর বোধ হয় রুদ্র নিয়েছিল, নিয়ে ওইখানে রেখে দিয়েছে।
কোনো একটা জিনিস যদি কখনো জায়গায় রাখে!
প্রিয়ম টেবিলে প্লেটগুলো রেখে কাগজটা নিয়ে জানলার দিকে এল, কিন্তু রুদ্র এমন নিষ্পাপ ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে হাসল, যে ও আর রাগ করতে পারল না। বললো, ‘শোনো, কাল তুমি যদি বেরোও, একটু চোখ কান খোলা রেখে রাস্তাঘাটে চলাফেরা কোরো। আজকের কাগজেও সেই মার্ডার দুটোর তদন্তের কোনো প্রোগ্রেস নেই। পুলিশ কোনো কূলকিনারাই পাচ্ছে না।’
রুদ্র বলল, ‘কোন মার্ডার?’
প্রিয়ম কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল, ‘আগের মাসে ইসলিংটনের একটা কমপ্লেক্সে একটা ছোটো ব্লাস্ট হয়েছিল, তাতে পাঁচজন রিফিউজি মারা গেছিল। আবার কয়েকদিন আগে কিংস্টনে দু—জন। তাদেরকে তো একদম ডাইরেক্ট গুলি করেছিল। কাউকে ধরতেই পারছে না। কী যে কি হচ্ছে কে জানে! এখানকার পুলিশও দেখছি দিন দিন আমাদের ওখানকার মতো ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে, আসল কালপ্রিটদের ধরতে পারছে না, এদিকে আমাদের মতো বাইরের লোকদের কিছু হলেই ”পাসপোর্ট পাসপোর্ট” করে পাগল করে মারে।’
রুদ্র বলল, ‘রিফিউজি মানে? কোথাকার রিফিউজি?’
প্রিয়ম বলল, ‘আরে মিডল ইস্টের অনেকগুলো দেশের। ওদিককার সব যুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থীদের ইউরোপের অনেক দেশের সরকারই তো আশ্রয় দিয়েছে, তারাই সব রিফিউজি আর কি! ওই ড শ্যুমাখার বলছিলেন না?’
রুদ্র বলল, ‘হুঁ। কিংস্টনেও রিফিউজিই খুন হয়েছিল?’
প্রিয়ম বলল, ‘হ্যাঁ। বাচ্চা দুটো ছেলে। ইসলিংটন, কিংস্টন, বারনেট এরকম ক—টা শহরতলিতে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ওদের থাকার ব্যবস্থা করেছে, আর সেইসব জায়গাগুলোকেই দেখছি টার্গেট করা হচ্ছে। ওদেরই কোনো সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি দলের কাজ মনে হয়।’
রুদ্র কোনো উত্তর দিল না, চুপচাপ কী যেন ভাবছিল বাইরে তাকিয়ে।
কোনো জবাব না পেয়ে প্রিয়ম পেছন থেকে আলতো জড়িয়ে ধরল বউকে, ‘এভাবে ভিজছ, ঠান্ডা লেগে যাবে তো? হাওয়াটাও তো খুব ঠান্ডা।’
রুদ্র যেন চমকে উঠল, ‘উঁ?’
প্রিয়ম পাশে সরে এল, ‘কী ভাবছ বলো তো?’
রুদ্র ওর হাত থেকে খবরের কাগজটা নিয়ে খবরটা পড়তে পড়তে বলল, ‘আচ্ছা, তোমাদের এই অ্যাপার্টমেন্টটায় কি শুধু তোমাদের অফিসের লোকরাই থাকে?’
প্রিয়ম একটু অবাক হল, ‘হঠাৎ এরকম প্রশ্ন? আমাদের কোম্পানি আর আরেকটা কোম্পনির জয়েন্ট অ্যাকোমোডেশন এটা। অর্ধেক ফ্লোরে ওরা থাকে, অর্ধেকে আমরা। কেন বলো তো?’
রুদ্র বলল, ‘সেই কোম্পানিটা কি চাইনিজ বা জাপানিজ বা ওই দিকের কোনো দেশের?’
প্রিয়ম বলল, ‘না তো! ইন্ডিয়ারই কোম্পানি, ব্যাঙ্গালোর বেসড।’
রুদ্র চুপ করে গিয়ে খবরের কাগজটা হাতে নিল, পড়তে পড়তে কিছুক্ষণ বাদে বলল, ‘ওহ। যাই হোক, ভাবছি ড শ্যুমাখারের দাদুর দাবি অনুযায়ী সত্যিই যদি ওরকম কোনো কেমিক্যাল এলিমেন্ট তৈরি করা যায়, আর সেটা যদি হিউম্যান বডিতে অ্যাপ্লাই করে জিন মডিফাইও করা সম্ভব হয়, কিন্তু জিন তো যতদূর জানি একটা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ইউনিট যেটা দিয়ে ডি এন এ তৈরি হয়, সেটাকে কীভাবে অ্যাফেক্ট করবে?’
প্রিয়ম বলল, ‘দ্যাখো, আমরা তো আর ওই লাইনের লোক নই, তাই কোনো আইডিয়া নেই আমার। তবে জিন থেরাপি বলে তো একধরনের ট্রিটমেন্ট হয় আজকাল, সেটাও তো বোধ হয় এইরকমই।’
রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘সেটাই আমি এতক্ষণ পড়ছিলাম ইন্টারনেট থেকে। জেনেটিক ডিসঅর্ডার ঠিক করার জন্য খারাপ বা ড্যামেজড জিনগুলোর জায়গায় কোষে নতুন ভালো জিন ঢোকানোই হল জিন থেরাপির মেইন ফান্ডা। ওই যে শ্যুমাখার বললেন না, বিশেষ একধরনের কোশে জিন থেরাপি অ্যাপ্লাই করলে সেটা নেক্সট জেনারেশন ইনহেরিট করে; সেটাই দেখলাম। দ্যাখো আমাদের শরীরে দু—ধরনের কোষ হয়, সোমাটিক আর জার্মলাইন। সোমাটিক কোশে জিন থেরাপি অ্যাপ্লাই করা হলে সেটা শুধু ওই পেশেন্টের ক্ষেত্রেûই প্রয়োজ্য হয়, মানে ধরো যে রোগটা হয়েছিল সেটা সেরে গেল, কিন্তু তার পরের জেনারেশনে কারুর যে রোগটা আর হবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কিন্তু জার্মলাইন কোশগুলোতে যদি জিন থেরাপি অ্যাপ্লাই করা যায়, তবে সেটা পুরো পার্মানেন্ট এফেক্ট হয়, আর পরবর্তী জেনারেশনেও এটা ইনহেরিটেড হয়ে যায়। মানে একটা কোনো রোগ সারানোর জন্য কোনো পেশেন্টের শরীরের জার্মলাইন কোষে জিন থেরাপি অ্যাপ্লাই করা হলে তার তো রোগটা সারবেই, তার পরবর্তী সব প্রজন্ম থেকেই রোগটা ভ্যানিশ হয়ে যাবে।’
প্রিয়ম শুনছিল, এবার বলে উঠল, ‘তার মানে তো বোঝাই যাচ্ছে, ড শ্যুমাখারের দাদু ওই জার্মলাইন কোশেই যাতে নাইট্রোজেনের সঙ্গে রিয়্যাকশনের মাধ্যমে জিনের রদবদল ঘটানো যায় এমন কোনো কেমিক্যাল এলিমেন্ট আবিস্কার করেছিলেন যার কোনো অস্তিত্ব এখনও অবধি আমাদের পিরিয়ডিক টেবিলে নেই। মার্ভেলাস ইনভেনশন কিন্তু, যাই বল তুমি।’
রুদ্র অন্যমনস্কভাবে খেতে বসল, ‘হুঁ। কিন্তু যতটুকু পড়লাম, পিরিয়ডিক টেবিলে নতুন এলিমেন্ট এখন যেগুলো অ্যাড হচ্ছে, সেগুলো কোনোটাই….’ তারপরেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘এমা, ধনেপাতা দিয়ে মাংস রান্না করলে? ইস, আমি ধনেপাতা খাই না, ভুলে গেলে? কেমন গন্ধ লাগে।’
প্রিয়ম রুদ্রকে খুব ভালোমতোই চেনে। শান্তভাবে বলল, ‘আগে থেকে কমেন্ট করার অভ্যেসটা তোমার আর গেল না দেখছি। কলকাতাতেও এমন করতে। একবছর বাদে বউ কাছে এল, ভাবলাম কোথায় একটু ভালোমন্দ রেঁধে আমাকে খাওয়াবে, তা না, সেই নিজেই হাত পুড়িয়ে রান্না করলাম, আর এখন টেস্ট না করেই বকে চলেছ। আগের মাসে অনিন্দ্য আর ওর বউকে ডিনারে ইনভাইট করেছিলাম, এটা খেয়ে তো পুরো ফিদা হয়ে গেছিল।’
রুদ্র বিকৃত একটা মুখ করে প্লেটটা ঠেলে দিল এদিকে।
‘আগে খেয়ে দ্যাখো না!’ প্রিয়ম এবার রেগে গেল।
রুদ্র অত্যন্ত সিটকোনো বিচ্ছিরি একটা মুখ করে চামচে করে একটুকরো মাংস তুলল, ‘শোনো, ধনেপাতা ধনেপাতাই, তা দিয়ে আর কত ভালো রান্না হবে? ওই সেই ডিম ছাড়া কেকের মতো।’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখে দিয়ে সতর্ক ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ চিবিয়ে স্বাদ বোঝার চেষ্টা করল ও, তারপর আরও এক চামচ মুখে দিল। সেটাও কিছুক্ষণ চিবিয়ে তারপর চামচটা পাশে নামিয়ে রেখে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে একটুখানি জুস তুলে নিয়ে জিভে দিল।
তারপর আরেকবার। বেশ অনেকটা।
এবার ওর মুখচোখ পালটে গেছে, ‘এই, তুমি এটা দারুণ বানিয়েছ কিন্তু। পুরো হোটেলের মতো। সত্যিই ধনেপাতা দিয়ে বানানো এটা?’
প্রিয়মের প্রচণ্ড ইচ্ছে হল রুদ্রর মাথায় জোরে দুটো গাঁট্টা বসিয়ে দেয়। কিন্তু তবুও আর কথা বাড়াল না। বলল, ‘ক্যাসারোলে রুটি আছে, নিয়ে শুরু করো। আমাকে দুটো দাও। কাল তো আমাকে অফিস যেতে হবে, ক্লায়েন্ট মিটিং আছে। পরশু দিন তাহলে কোথায় যাবে, মাদাম তুসো না ডার্ডল ডোর?’
রুদ্র বলল, ‘মাদাম তুসোই যাব। ডার্ডল ডোর পরে হবে না হয়। আচ্ছা, এই ড শ্যুমাখারের কি খুব নাম লন্ডনে?’
প্রিয়ম বলল, ‘তা তো জানি না। কেন?’
রুদ্র বলল, ‘না বলছি।’ খেতে খেতে ফোন ঘেঁটে যাচ্ছিল ও একনাগাড়ে, ‘হ্যাঁ, ড শ্যুমাখারের ভালোই নাম আছে। ক্যান্সার নিয়ে রিসার্চ করছেন অনেকদিন ধরে। অনেক সায়েন্টিস্ট অ্যাসিস্ট করেন ওঁকে। প্রচুর রিসার্চ পেপারও রয়েছে দেখছি। লন্ডন ছাড়াও ওয়েলসে একটা অঙ্কোলজি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর। অথচ বেশ ডাউন টু আর্থ, না?’
ফোনটা প্রিয়মের দিকে ঘুরিয়ে একটা ছবি দেখাল রুদ্র, ইংল্যান্ডের বর্তমান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের হাত থেকে কোনো একটা অ্যাওয়ার্ড সেরিমনিতে প্রাইজ নিচ্ছেন ড শ্যুমাখার। কালো সুটে বেশ অভিজাত দেখাচ্ছে ওঁকে।
প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় এটা?’
রুদ্র ফোনটা নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে ছবির ক্যাপশনটা ভালো করে দেখতে দেখতে বলল, ‘দু—বছর আগে এখানকার গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে বোন ম্যারো ক্যান্সারে উল্লেখযোগ্য কন্ট্রিবিউশনের জন্য লাইফটাইম অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে ওঁকে।’
প্রিয়ম খেতে খেতে বলল, আচ্ছা। ভালো তো। এত বড়ো একজন রিসার্চার তাঁর গবেষণার বিষয়ে তোমার কাছ থেকে হেল্প চেয়েছেন, এর থেকে ভালো ব্যাপার আর কী হতে পারে? ফটোগুলো দেখলে?’
রুদ্র খাওয়া থামিয়ে খুঁটিয়ে কী দেখছিল, বলল, ‘উঁ? হুঁ, দেখলাম।’
প্রিয়ম এবার তাড়া লাগাল, ‘খেয়ে নিয়ে উঠে দ্যাখো না, খাবারটা তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কী ভাবছ বলো তো?’
রুদ্র কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গিয়ে দু—পাশে মাথা নাড়ল, ‘কিছু না। আচ্ছা, কাল আমি একা একা কী করব বলো তো?’
প্রিয়ম একটু চিন্তা করল, ‘সেটা আমিও ভাবছিলাম। এক কাজ করতে পারো, আমার সঙ্গেই বরং ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়ো, সিটি টুর করানোর জন্য বাস আছে, তাতে টিকিট কেটে উঠে পড়ো, সব জায়গা ঘুরিয়ে দেবে।’
রুদ্র বলল, ‘সেগুলো তো বেশিরভাগ আজই সব ঘুরে নিলাম। সেই তো এক জায়গাগুলোই ঘোরাবে। তার চেয়ে বাড়িতেই থাকব, কয়েকটা বিষয়ে একটু পড়াশুনো করতে হবে। আচ্ছা, এখান থেকে ড শ্যুমাখারের ল্যাবে যদি যেতে চাই, কী করে যাব?’
প্রিয়ম এবার একটু অবাক হল, ‘সে কী! উনি তো কাল বার বার বলে দিলেন কোনোভাবেই আমরা যেন ওঁর ওয়ার্কপ্লেসে গিয়ে দেখা না করি, ওঁর অফিসেই অনেক স্টাফ আছে যারা এই কাজটার বিরুদ্ধে, কোনোভাবে তারা বুঝতে পারলে সব বানচাল হয়ে যাবে। তোমার কিছু জানার থাকলে তো উনি বলেই দিলেন, ফোন করে কোথাও দেখা করে নিতে।’
রুদ্র বলল, ‘জানি। ওসব নিয়ে চাপ নিয়ো না। কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। কী করে যাব বলো তুমি।’
প্রিয়ম তবু একটু কিন্তু কিন্তু করতে লাগল।
হাজার হোক, ওরই রেফারেন্সে রুদ্রর সঙ্গে আলাপ করেছেন ভদ্রলোক, রুদ্র দুম করে ভুলভাল কিছু করে বসলে পরে ওকেই অপ্রস্তুত হতে হবে, ও বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘তুমি বুঝতে পারছ না। ভদ্রলোক তো আমার অ্যাপার্টমেন্টটাও চেনেন। তুমি তো কয়েকদিন বাদেই ফিরে যাবে। আমাকে তো এখানে থাকতে হবে।’
রুদ্র এবার রেগে গেল, ‘উফ! এত ভাবো কেন বল তো তুমি? বলছি তো কোনো প্রবলেম হবে না। এটুকু ভরসা যদি আমার উপর না রাখতে পার, তবে ওঁর সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেওয়াই আমার উচিত হয়নি।’
প্রিয়ম এবার আর বেশি গাঁইগুঁই করতে পারল না, ঠিকানাটা শুনে বলে দিল কীভাবে যেতে হবে।
রুদ্র খেয়ে উঠে ফটোগুলো নিয়ে বসল।
ড শ্যুমাখার এগুলো ওকে দিতে চাইছিলেন না প্রথমে, বলছিলেন স্ক্যানড কপি দেবেন, কিন্তু অরিজিন্যাল না হলে অনেক কিছুই না পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
যদিও রুদ্র নিজেই জানে না কতদূর কী করতে পারবে, তবু চেষ্টা তো করাই যায়!
আলটিমেটলি এটা একটা ভালো কাজ।
তা ছাড়া এখন প্যারিসের ওই ওয়ার্কশপে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তো ও মোটামুটি ফ্রি—ই রয়েছে।
রুদ্র প্রোফেশনাল পাজলব্রেকার বা ক্রিপটোলজিস্ট নয়, নয় কোনো গোয়েন্দাও, তবু ভুটানের ঘটনাটা একটু হলেও ওকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। অন্তত যুক্তিবাদী মন, খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করার চোখ আর নিরপেক্ষভাবে একটা ঘটনাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শেখা, এই তিনটে ক্ষমতা হয়ত কিছুটা হলেও ওর আছে। প্রিয়ম যেমন চট করে কোনো ঘটনা একতরফা দেখে বা কারুর কথা একতরফা শুনেই কনভিন্সড হয়ে যায়, ও তেমন হয় না মোটেই। নিজেকে মাঝামাঝি জায়গায় রেখে একজন এক্সটারনাল এন্টিটি হিসেবে পুরো জিনিসটাকে দেখে চেষ্টা করে।
যেমন এই মুহূর্তে ফটোগুলো ও দেখছিল ঠিকই, কিন্তু মাথা থেকে সেই ছোটো বাদামি চোখের আর গাঢ় খয়েরি হাইলাইট করা চুলের লোকটাকে ও তাড়াতে পারছিল না।
কফিশপের ভেতরে বসে প্রথম ও লোকটাকে দেখেছিল বাইরের টেবিলের একটায় বসে কফিতে চুমুক দিতে। ও নিশ্চিত ড শ্যুমাখার লোকটিকে দেখতে পাননি।
তারপর দেখেছিল বেরোনোর সময়। বিশাল বাইকটা নিয়ে কফিশপের বাইরের ফুটপাথেই দাঁড়িয়ে ছিল।
কফিশপ থেকে প্রথমে ড শ্যুমাখার বেরিয়ে গিয়েছিলেন, তারও প্রায় মিনিট দশেক বাদে ওরা বেরিয়েছিল ডাক্তারের কথামতো। প্রিয়ম একটা ক্যাব বুক করেছিল, তাতে করে এসে এই অ্যাপার্টমেন্টের সামনে নামার সময়েও ও রিয়ার গ্লাসে একঝলকের জন্য দেখেছে লোকটার সেই বিশাল কালো লাল বাইকটা। ওরকম বাইক তো ইন্ডিয়াতে দেখাই যায় না, এখানে অবশ্য চোখে পড়ছে ভালোই। তার মানে ওরা যতক্ষণ কফিশপে ছিল, লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল, তারপর ওদের ক্যাবের পেছন পেছন এসেছে এই অ্যাপার্টমেন্ট অবধি।
কিন্তু কেন? ড শ্যুমাখারের কথা অনুযায়ী তথাকথিত সেই সমস্ত ফার্মা কোম্পানি বা ক্যান্সার রিসার্চ ল্যাব, যারা ভীষণভাবে চেষ্টা করছে ওঁর এই রিসার্চটা বানচাল করতে, তাদেরই কোনো লোক কি? তাই যদি হবে, তারা এত এফিশিয়েন্ট যে শ্যুমাখার প্রথমবার ওর সঙ্গে দেখা করতে আসামাত্রই ওরা ট্র্যাক করে ফেলল?
নাকি তারা যেকোনো উপায়ে এই ফটোগুলো হাতানোর চেষ্টা করছে?
অনেকক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রুদ্র এবার উঠে রান্নাঘরে গেল। দেখল প্রিয়ম একমনে বেসিনে প্লেটগুলো ধুচ্ছে। ওর এবার একটু খারাপ লাগল। ইস, প্রিয়মটা কীরকম দ্যাখো, একা একাই সব কাজ করছে, ওকে একবার ডাকবে তো!
একটু অপরাধীর গলায় গিয়ে ও বলল, ‘দাও আমাকে কিছু, মেজে দিই আমি।’
প্রিয়ম গম্ভীর গলায় বলল, ‘থাক। হয়েছে। আর তোমাকে মাজতে হবে না। কাচের বাসন, তোমার অভ্যেস নেই, এখুনি হয়তো মাজতে গিয়ে ভেঙে ফেলবে, তখন আর একটা কাজ বাড়বে। কলকাতায় থাকো, সামনে পেছনে কাজের লোক নিয়ে ঘোরো, এখানে দিনের পর দিন থাকতে হলে বুঝতে পারতে। তার চেয়ে পারলে ঘরে গিয়ে বিছানাটা একটু পরিষ্কার করো।’
রুদ্র মিষ্টি হেসে প্রিয়মের গালে একটা আলতো চুমু খেয়ে একটু রাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল, ‘সত্যি! তুমি এত ভালো প্রিয়ম, তবু তোমার একটুও অহংকার নেই।’
প্রিয়ম এবার রাগতে গিয়েও হেসে ফেলল, ‘দেখে শেখো। কোনোদিনও শিবরাত্রিতে একঘণ্টাও উপোস করে রইলে না, অথচ এইরকম একটা কমপ্লিট ধামাকা প্যাকেজ পেয়ে গেলে। এবার যাও, গিয়ে যেটা বললাম দয়া করে করো, ল্যাপটপ চার্জার সব ছড়িয়ে—ছিটিয়ে আছে। খুব ঘুম পাচ্ছে আমার। সারাদিন প্রচুর হাঁটাহাঁটি হয়েছে।’
রুদ্র পাখির মতো উড়তে উড়তে চলে যাচ্ছিল ঘরে, যাওয়ার আগে বন্ধ জানলার কাচ থেকে আলতো একবার উঁকি দিল বাইরের অন্ধকারে। এত ওপর থেকে কিছুই যদিও বোঝা যাচ্ছে না, ওই খয়েরি চুলের লোকটা কি এখনও দাঁড়িয়ে আছে?
৯
মার্চ ১৯৩৩
এই সময়ে জার্মানির সবচেয়ে বেশি আলোচিত খবরের কাগজগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ‘স্ট্রেট পাথ’। আগে এই কাগজের অফিস থেকে ‘সানডে ইলাস্ট্রেটেড’ নামে একটা কাগজ বেরোত, ফ্রিৎজ গার্লিকের মতো পো—খাওয়া সাংবাদিক সেই অফিসটাকে কিনে সেখানেই তাঁর এই নতুন সাপ্তাহিক কাগজের পত্তন করেছেন। আর মাত্র সাড়ে দিন বছরেই এর সার্কুলেশন অন্যান্য কাগজকে টেক্কা দিতে শুরু করেছে।
ইতিহাস নিয়ে ডক্টরেট করলে কী হবে, জার্নালিস্ট হিসেবে ফ্রিৎজ গার্লিকের উত্থান প্রায় উল্কার গতিতে বলা চলে। অবশ্য প্রথম জীবনে অনেক ঘাটের জল খেয়েছেন তিনি লেখালেখির সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়েছিলেন একসময়, তারপর এম এন এন কাগজের চিফ এডিটর থাকার সময় কলমের তুখোড় ধারের জন্য তাঁর নাম সারা জার্মানিতে হু হু করে ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু এই মুহূর্তে ফ্রিৎজ গার্লিকের বড়ো রাস্তার ওপরের একটা বহু পুরোনো বাড়ির দুটো তলা নিয়ে তৈরি খবরের কাগজের ছোট্ট অফিসটার উপর যেন সারা বার্লিন শহরের মানুষজনের ক্ষোভ এসে জমা হয়েছে। এরকম কিছু হতে পারে ফ্রিৎজ যে একেবারেই আন্দাজ করেননি তা নয়, তাই আগেভাগেই দুটো নতুন সিকিউরিটি গার্ড মোতায়েন করেছিলেন নীচে।
কিন্তু এতটা জনরোষ তিনি নিজেই কল্পনা করতে পারেননি।
যাদের শুভবুদ্ধি জাগ্রত করার জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লিখে চলেছেন, তুলে ধরতে চাইছেন অদূর ভবিষ্যতের সাংঘাতিক খারাপ কিছু ঘটার পূর্বাভাস, সেই সাধারণ মানুষই তাঁর বিপক্ষে?
নাকি এরা সবাই পার্টির ওয়ার্কার!
একতলার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মুখে যে দরজাটা, সেটাকে শক্ত করে বন্ধ করে রাখা হয়েছে, গার্ড দুটো ওখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদের হাতে বন্দুক থাকায় কেউ জোর করার সাহস না পেলেও রাস্তা থেকে দোতলার জানলা লক্ষ করে তারা পাথরের টুকরো, পচা ডিম ছুড়ে চলেছে ক্রমাগত।
‘লোকজন কি সব পাগল হয়ে গেল নাকি?’ জানলার কাচ দিয়ে একঝলক মুখ বাড়িয়ে দেখতে গিয়ে কোনোরকমে একটা বড়ো পাথরের টুকরোর থেকে মাথাটা বাঁচালেন ফ্রিৎজ, ‘এইরকম করছে কেন?’
সাব—এডিটর কার্ল পাশেই একটা চেয়ারে বসে ছিল, আশপাশে অফিসের অন্যান্য কর্মচারীরাও চলে এসেছে। একতলায় এই কাগজের ছাপাখানা, সেখানকার শ্রমিকদেরও এখন এই ঘরেই নিয়ে আসা হয়েছে। মেশিন সব বন্ধ করে দেওয়া—হয়েছে আপাতত। কার্ল বলল, ‘তোমাকে আমি বারণ করেছিলাম ফ্রিৎজ, এখন নয়, বছর তিনেক আগে থেকেই। শোনোনি কিছুতেই। এখন কি ভাবছ যার বিরুদ্ধে এতদিন আজেবাজে লিখলে, এখন সে চ্যান্সেলর হওয়ার পর তোমায় ছেড়ে দেবে? এখন তো শুধু ওর পার্টির ওয়ার্কাররা এরকম হুজ্জুতি করছে, যে কোনোদিন সে পুলিশ পাঠাল বলে!’
ফ্রিৎজ আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না রাগে, ‘আজেবাজে লিখে চলেছি? তুমি এই কথা বলছ কার্ল?’
কার্ল বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘আরে বাবা, আমি ওদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলছি ফ্রিৎজ! এটা তো স্বীকার করবে যে, আমাদের কাগজের সেল হোক আর লোকে যতই কিনুক, ওকে জার্মানির মানুষজন চায়। না হলে অ্যাডলফ এত বিপুল ভোটে জিতল কী করে!’
ফ্রিৎজ টেবিলের উপর আক্রোশে একটা ঘুসি মারলেন, ‘মানুষ যদি চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে যায় আর চোখ বন্ধ অবস্থাতেই কাউকে ভোট দেয়, সেটাকে কি জনসমর্থন বলে? অ্যাডলফ একটা মনস্টার, যে মানুষের মধ্যে শুধু সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ তৈরি করছে তাই নয়, ও জার্মান ছাড়া অন্য প্রতিটা জাতিকে কার্যত লুপ্ত করে দিতে চায়, ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, লুপ্ত করে দিতে চায়! ও একটা সাইকোপ্যাথ! ওর নিজের দিদির মেয়েকে নিজের বিকৃতির জন্য সুইসাইড করতে বাধ্য করেছে। ওর দিদি ভিয়েনায় ইহুদি বাচ্চাদের নিয়ে একটা একটা অনাথ—আশ্রম চালাত, সেটা পর্যন্ত ধ্বংস করেছে। কেন, ইহুদিরা মানুষ নয়? জার্মানিকে তারা নিজের দেশ মনে করে না? সমস্ত ইহুদিদের শেষ করতে চায় ও।’
কার্ল মাথা নাড়ল, ‘না, সেসব তো অনেক আগে বলত। জেল থেকে ফিরে এসে নতুনভাবে দলের দায়িত্ব নেওয়া থেকে, ইলেকশনের সময় অবধি কিন্তু আর এরকম কিছু বলেনি অ্যাডলফ, এটা লক্ষ করেছ কি? হয়তো বুঝতে পেরেছে নিজের ভুল।’
ফ্রিৎজের মুখ থেকে শ্লেষ ঝরে পড়ল, ‘ভুল বুঝতে পেরেছে? তাও আবার অ্যাডলফ? তোমরা সত্যিই সব দিবাস্বপ্ন দেখছ কার্ল! এটা ওর চাল, ও এটা বুঝতে পেরেছিল যে ওইসব বললে ও জিততে পারবে না, তাই ক—দিন চুপ ছিল। ক্ষমতায় এসেছে, এইবার ওর স্বরূপটা দেখতে থাকো তোমরা। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, এইরকম একটা অসুস্থ বিকৃত লোক কিনা জার্মানির চ্যান্সেলর হল আজ থেকে?’ চিৎকার করে কথাগুলো বলে এই সপ্তাহের ‘স্ট্রেট পাথ’—এ ওঁর নিজের লেখা এডিটোরিয়ালের পেজটা তুলে নিলেন ফ্রিৎজ, ‘আর কী করে জিতল তার ব্যাখ্যা তো আমি বিস্তারিত করেছি এই উইকেই! তুমি কি আজকাল নিজেদের কাগজটুকুও ভালো করে পড় না কার্ল?’
নীচের ছাপাখানার শ্রমিকরা অবাক চোখে দেখছিল। প্রত্যেকের গায়ে পুরোনো একটা করে ছেঁড়াখোঁড়া কোট, অপুষ্টিতে আর অনিশ্চয়তায় শীর্ণ চিন্তিত মুখ। যুগে যুগে যা হয়ে এসেছে, আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খোঁজ নিয়ে কোনো লাভ নেই, এটাই মনে করে এরা। এদের মনে এখন শুধু একটাই ভয়, নতুন গভর্নমেন্ট যদি এই কাগজটাকেই বন্ধ করে দেয়, পেট চলবে কীভাবে! একেই তো এই ভয়ানক মুদ্রাস্ফীতি। টাকার দাম এতটাই বেড়ে গেছে, যে সেই টাকার আর কোনো দামই নেই।
তবু কিছু কিছু ব্যতিক্রমী লোক তো সব জায়গাতেই থাকে যারা একটু অন্যভাবে ভাবতে চেষ্টা করে, তেমনই একজন ফ্রেডরিক। সে অবশ্য মামুলি শ্রমিক নয়, ছাপার ব্লকগুলো রিপেয়ার আর মেইনটেইন করা ওর কাজ, তার সঙ্গে টাইপিংটাও মোটামুটি পারে। বছরখানেক হল এই কাজে যোগ দিয়েছে। ফ্রিৎজ স্যারের সঙ্গে ওর সরাসরি তেমন কোনো কথাই হয় না, তবু সে দূর থেকে এই অগাধ পাণ্ডিত্যের মানুষটাকে খুব শ্রদ্ধা করে।
ফ্রেডরিক বলল, ‘স—স্যার! আজকের কাগজে একটা বিজ্ঞপ্তি দেখেছেন?’
ফ্রিৎজ ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন, ‘কীসের বিজ্ঞপ্তি?’
ফ্রেডরিক বলল, ‘যারা জন্ম থেকেই বিকলাঙ্গ, বা মানসিক প্রতিবন্ধী, কিংবা যারা এমন রোগে আক্রান্ত যে কোনোদিনই সুস্থ হতে পারবে না, তাদের পেছনে সরকারের প্রচুর টাকা খরচা হচ্ছে। তাই ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছে যে সরকারি উদ্যোগেই এদের মেরে ফেলা হবে। খুব শিগগিরই নাকি বিলও আনবে নতুন সরকার। মানে,’ ফ্রেডরিককে উত্তেজিত দ্যাখাল, ‘আমাদের বাবা মায়েরা যদি অসুস্থ হয়ে থাকেন, তাঁদের বাঁচিয়ে রাখার স্বাধীনতাটুকু আমাদের থাকবে না? কিংবা আমাদের সন্তান যদি অসুস্থ হয়? এ কীরকম নিয়ম স্যার?’
বাইরে তখন মানুষের উল্লাসে কান পাতা দায়। অনেকক্ষণ ধরে এই ‘স্ট্রেট পাথ’ কাগজের অফিসে ভাঙচুর করে তারা এবার ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, দুর্বলকে বেশিক্ষণ প্রত্যাঘাতবিহীন নিপীড়নেও সুখ নেই।
এবার তারা হইচই করতে করতে চলেছে বার্লিনের অন্য প্রান্তে। সারা জার্মানি যেন রাস্তায় নেমে পড়েছে, ঘরে বসে নেই কেউ। নাতসি পার্টির লাল কালো স্বস্তিকা চিহ্নের ফ্ল্যাগে, ফেস্টুনে পোস্টারে সারা রাস্তাটা যেন ঢেকে গেছে। ছোটো চৌকো কালো গোঁফের ওই লোকটার বিশাল বিশাল কাট আউট বয়ে নিয়ে চলেছে মানুষ। হাজার হাজার মানুষ তাদের ডান হাত উপরে মুষ্টিবদ্ধ করে তুলে ধরে সোল্লাসে জয়ধ্বনি করছে, ‘হেইল হিটলার! হেইল হিটলার!’ অর্থাৎ ‘হিটলারের জয়!’
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এইরকম ঘটনাবহুল বছর জার্মানিতে খুব কম এসেছে। এই বছরের একদম গোড়ায় জানুয়ারি মাসে যুক্তফ্রন্টের প্রধান হিসেবে অ্যাডলফ দেশের চ্যান্সেলর অর্থাৎ দেশপ্রধান হয়েছিল। সেই ফ্রন্টে নাতসিরা ছিল তিন নম্বর দল। কিন্তু মাসখানেকের মধ্যেই জার্মান মন্ত্রীসভা রেইচস্ট্যাগে হঠাৎ আগুন লাগল। ফ্রিৎজ বা অন্য যেকোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই সেসময় বুঝেছিলেন যে এটা নাতসি পার্টিরই কাজ। ওরা তিন নম্বর দল হয়ে থাকলে হিটলার চ্যান্সেলর হলেও তাকে বাকি দুটো বড়ো দলের কথামতোই চলতে হত। তাই আগুন লাগানোটা তাদের পরিকল্পিত।
কিন্তু নাতসিরা রেইচস্ট্যাগের সেই আগুনের জন্য কম্যুনিস্টদের অভিযুক্ত করল এবং আবার জেনারেল ইলেকশনের দাবি তুলল। আর তার পরেই এই ইলেকশন। এতে নাতসি পার্টির বিপুল সাফল্যে হিটলার এখন বলতে গেলে দেশের একনায়ক হয়ে গেল, দ্বিতীয় বলার মতো কোনো বিরোধী দলই রইল না রেইচস্ট্যাগে।
কী ভবিষ্যৎ এই দেশের ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে তাঁর।
ফ্রিৎজ ফ্রেডরিকের প্রশ্নে মুখ তুলে তাকালেন। উত্তেজনায় রাগে দুঃখে তাঁর মুখ ঘামে ভিজে উঠেছে, তবু তাঁর ভালো লাগল। একজন অন্তত হিটলারের কার্যকলাপকে সন্দেহ করছে। বাকিরা তো স্রোতে তাল মিলিয়ে পুরো সম্মোহিত হয়ে গেছে হিটলারের জাদুতে।
কার্ল ফ্রেডরিকের কথাটাকে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘আরে দাঁড়াও। বিল আনলেই তো আর সেটা পাশ হয়ে যাবে না রেইচস্ট্যাগে। সব পার্টি রাজি হলেই না সেটা আইন হবে। এখন থেকে এত চাপ নিচ্ছ কেন তোমরা?’
ফ্রিৎজ তেতোমুখে হাসলেন। নাতসি পার্টি যেরকম গরিষ্ঠতা নিয়ে এসেছে, তাতে অন্য পার্টিগুলোকে রেইচস্ট্যাগে খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ, আর তারা নাকি ভোট দেবে। ওদের ভোটের দামই তো নেই কোনো।
অ্যাডলফ কি হিপনোটাইজ করেছে কার্লের মতো শিক্ষিত লোকগুলোকে যে এরা নিজেদের সাধারণ বোধবুদ্ধিগুলোও হারিয়ে ফেলছে?
ফ্রিৎজ ভালো করে ঘরে উপস্থিত শ্রমিকদের দিকে তাকালেন, বেশিরভাগকেই তিনি চেনেন না, নীচে কাজ করে এরা।
এরাই তো আমজনতা! এরাই আসল জার্মানির মুখ, খেটে খাওয়া সমাজের প্রতিভূ। এরা তাঁর কাগজ পড়ে না ঠিকই, কিন্তু এরা দেশকে ভালোবাসে।
অন্তত যাঁদের জন্য তিনি কলমে তুফান তুলছেন সেই নির্বিকার হয়ে থাকা তথাকথিত জার্মানির উচ্চবিত্তদের থেকে বেশি দেশের ভালো চায় এরা।
আর এদের চাওয়ার মধ্যে কোনো স্বার্থ নেই।
ফ্রিৎজ আধভাঙা স্বরে ভগ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘আজ থেকে জার্মানিতে শয়তানের রাজত্ব শুরু হল। তোমরা প্রস্তুত থেকো।’
১০
সারাদিন এত টায়ার্ড থাকা সত্ত্বেও রাতে বিছানায় শুয়ে রুদ্রর কিছুতেই ঘুম এল না, যদিও প্রিয়ম ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ আগেই। কোথায় যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে, রুদ্র নিজেও বুঝতে পারছে না। আজ সারাদিনে এত কিছু ঘটল, এত জায়গায় ঘুরল, এরকম একটা নতুন ব্যাপারে ইনভলভড হল, সব কিছুর মধ্যে কোথায় যেন একটা খটকা লাগছে ওর।
সারাক্ষণ উশখুশ করছিল শুয়ে শুয়ে।
ওদিকে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকছে প্রিয়মের নাক ডাকাও। একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লে অসুবিধা হয় না। কিন্তু পরে ঘুমোনোর চেষ্টা করলেই এই একটা প্রাচীন সমস্যা ওদের, রুদ্রর চুপচাপ শুয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ে যাচ্ছিল কলকাতার দিনগুলো।
কম কাণ্ড করেছে ও প্রিয়মের এই ডাক ডাকা কমাতে? ঝগড়াঝাঁটি, ডাক্তার বদ্যি, মা—মাসিদের টোটকা। কিছুতেই কিছু হয়নি। একবার তো অনলাইনে একটা কী যেন ক্লিপই অর্ডার দিয়ে দিয়েছিল, সেটা কানে গোঁজা হেডফোনের মতো নাকের দুটো ফুটোয় গুঁজে শুতে হয়। সেটা লাগাতে গিয়ে তো প্রিয়মের নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হবার জোগাড়। পরের দিন ফোনে শুনে মায়ের সে কী বকুনি! অন্ধকার ঘরে একা একা জেগে থাকতে থাকতে সেকথা মনে পড়তেই হেসে ফেলল ও।
কিন্তু এতদিন পর সেই একই প্রবলেম ফেস করতে গিয়ে রুদ্রর আর রাগ হচ্ছিল না, আগের মতো প্রিয়মকে দুম দুম করে ধাক্কা দিয়ে তোলেওনি।
দূরত্ব এমন একটা জিনিস, যে এতদিন বাদে কাছে পেয়ে ভালোমন্দ কোনো মুহূর্তই আর মিস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
আর কিছুক্ষণ এদিক—ওদিক করে শেষমেষ দেড়টা নাগাদ আর ঘুমোনোর চেষ্টা না করে প্রিয়মের নাকটা আলতো করে টিপে দিয়ে ও উঠে পড়ল।
প্রিয়মের অ্যাপার্টমেন্টটা ছোটো হলে কী হবে, ও বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে ভালোবাসে। যদিও এই কয়েকদিনেই বেশ নোংরা করে ফেলেছে রুদ্র, তবু প্রিয়মের ছোট্ট ল্যাপটপ টেবিলের লাগোয়া চেয়ারটায় বসে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় বেশ ভালোই লাগছিল ওর। কাছেই রুম হিটারটা চলছিল, সেটা থেকে বেরোনো গরম হাওয়ায় বেশ আরাম হচ্ছিল।
প্রথমেই ও ব্যাগ থেকে ফটোগুলো বের করে একটার পর একটা সাজিয়ে ফেলল টেবিলের ওপর। সাদা কালো হলদেটে কাগজের ফোটোগ্রাফ। সব মিলিয়ে দশটা সাদাকালো ফটো। কোণগুলো আলতো মোড়ানো ছাড়া প্রায় অবিকৃত।
এত বছরের পুরোনো, অথচ নষ্ট হয়নি একটুও, নিশ্চয়ই খুব যত্নের সঙ্গে রাখা ছিল।
প্রতিটা ফটোই বোঝা যাচ্ছে তোলা হয়েছে একটা টেবিলের টপ ভিউ অর্থাৎ একদম উপর থেকে নব্বই ডিগ্রি অ্যাঙ্গলে। সেই টেবিলের ওপর রাখা একটা করে কাগজের ছবি তোলা রয়েছে একেকটা ফটোয়, প্রতিটা ফটোতেই অদ্ভুত সব হরফ।
তার মানে, রুদ্র চিন্তা করল, সম্ভবত একটাই লেখার প্যাড থেকে দশটা পাতা পরপর ছিঁড়ে এই নম্বরগুলো লিখে ফটো তোলা হয়েছে। কাগজটা ছবির মধ্যে থেকে খুঁটিয়ে দেখতে চেষ্টা করল রুদ্র। লেখার প্যাডের কাগজগুলো যে রুল টানা সেটা বোঝা যাচ্ছে, লাইনগুলো অস্পষ্ট হলেও একেবারে মিলিয়ে যায়নি ছবিতে।
কিন্তু এই অজস্র চিহ্ন, এগুলো কী?
কোনো এনক্রিপ্টেড সংকেত?
চিহ্নগুলো ভালো করে লক্ষ করল রুদ্র, হাতে লেখা, কিন্তু বেশ মোটা কালিতে। খুব অদ্ভুত ধরনের হরফে লেখা।
এই এত অজানা হরফের মধ্যে নতুন একটা মৌল বানানোর প্রসেস লেখা আছে?
আশ্চর্য তো।
ড শ্যুমাখারের দাদু শুধু ডাক্তারই নয়, এই সমস্ত ব্যাপারেও বেশ পোক্ত ছিলেন বোঝা যাচ্ছে।
ও প্রথমেই দশটা ফটোর ছবি তুলে নিল মোবাইলে, একদম উপর থেকে। ড শ্যুমাখারের মতো অভিজ্ঞ লোক যখন এটা ডিকোড করতে পারেননি, তখন ও কতটা কী পারবে জানে না। তবু চেষ্টা করতে তো দোষ নেই!
তেমন হলে না হয় প্রিয়মকেও বলবে একটু হেল্প করতে।
ও এবার রাইটিং প্যাডের কাগজগুলোর একটা বেছে নিয়ে সেদিকে কনসেনট্রেট করল। প্রাথমিক দৃষ্টিতে দেখলে হিজিবিজি মনে হলেও একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায় এটা কোনো এনক্রিপটেড লেখা। পুরো লেখাটায় কোনো বক্ররেখা নেই, সোজা সোজা রেখাংশ দিয়ে ছোটো ছোটো হরফ তৈরি করা হয়েছে মোটা কালিতে, তার কোনো কোনোটার মধ্যে ছোট্ট ফুটকি দেওয়া।
এটা কি হায়ারোগ্লিফ টাইপের কোনো প্রাচীন ভাষা? মনে হতেই রুদ্র ল্যাপটপে হায়ারোগ্লিফ ভাষা দিয়ে সার্চ করল, কিন্তু সেটার সঙ্গে এইগুলোর কোনো মিল পেল না। আর তা ছাড়া ড শ্যুমাখারের দাদু ফ্রান্সের লোক ছিলেন, ভারতে থাকতেন, হায়ারোগ্লিফ বা ওই জাতীয় ভাষায় লিখতে যাবেনই বা কেন?
ফ্রান্সের কোনো প্রাচীন ভাষা হতে পারে কি? সেটা নিয়েও কিছুক্ষণ নেমে ঘাঁটাঘাঁটি করল, কিন্তু কিছুই পেল না।
খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে আর একটা জিনিস ও লক্ষ করল, প্রতিটা ছবিতে বিভিন্ন প্যার্টার্নের হরফ থাকলেও একদম নীচে ডান দিকে যে দুটো হরফ রয়েছে সেটা প্রতিটা ছবিতেই একইভাবে রয়েছে এবং সেটার ছাপার হরফটাও একটু সরু।
সাদাকালো ছবি, ফলে রং বোঝার কোনো সুযোগ নেই। রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে চিন্তা করছিল, একটা লেখার প্যাডের একদম নীচে প্রতিটা পাতায় একই ডিজাইনের ওই হরফ, তাহলে ওটা কোনো কিছুর লোগো? তাই যদি হয়, এটার মানেই বা কী?
এতক্ষণ ধরে দেখেও কোনোটারই কিছু মাথামুণ্ডু বুঝতে পারল না রুদ্র।
তবে কোনো সন্দেহ নেই এটা কোনো হিডন কোড। এগুলোকে বলে ক্রিপটোগ্রাফি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় ফাইনাল ইয়ারে এই ক্রিপটোগ্রাফি আর ডিজিটাল এনক্রিপশনের ওপর একটা পেপার ছিল ওদের। প্রাচীন যুগ থেকেই কোনো গুপ্ত সংকেতের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের চোখ এড়িয়ে মেসেজ পাঠানোর চল ছিল। এখন ডিজিটাল যুগে এসে সেটা অনেক উন্নত হয়েছে। এই ধরনের সাংকেতিক কোডগুলোকে বলে সাইফার, মনে পড়ল রুদ্রর। এই সাইফারগুলোকে ডিকোড করার অনেকরকম টেকনিক ছিল, সেগুলো দিয়ে করে দেখতে হবে।
একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ও উঠে দাঁড়াল। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে তিনটে। এবার একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে বটে। মাথাটাও যন্ত্রণা করছে আলগা। সংকেতগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে ও বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল।
আচ্ছা, ড শ্যুমাখারের পেছনে না হয় এখন অনেক শত্রু রয়েছে, যারা নিজেদের স্বার্থে চায় না এই রিসার্চটা এগোক কিন্তু একশো বছর আগে পন্ডিচেরিতে সমুদ্রের ধারে বসে যখন ওঁর দাদু এটা নিয়ে গবেষণা করছিলেন, তখন কারা ওঁর রাস্তায় বাধা দিচ্ছিল যে ওঁকে এরকম জটিল কোডে ব্যাপারটা লিখে যেতে হল? এমনি এমনি নিশ্চয়ই কেউ এইরকম করে একটা ভালো রিসার্চকে ধোঁয়াশায় রেখে দেবে না! তাও আবার সেটাকে এইভাবে ছবি তুলে রেখে?
ড শ্যুমাখারকে জিজ্ঞাসা করতে হবে ওঁর দাদুর মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল।
১১
‘কোলনের ব্লাস্টে স্যার একদমই খুশি নন। পেছনের জন স্পটডেড হয়নি কেন? দু—দিন অবধি বেঁচে ছিল!’ সামনে বসা কুড়ি থেকে পঁচিশ জন ছেলের সামনে মাস্টারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে কে ছিল ওটায়?’
দুটো ছেলে আড়ষ্টভাবে উঠে দাঁড়াল। ওই লিডার গোছের মহিলাকে বাদ দিলে এই হল ঘরটায় থাকা সবারই বয়স কুড়ি থেকে বাইশের মধ্যে।
এই বয়সটাই সবচেয়ে ভালো। শরীরে রক্ত গরম থাকে, ঠিকভাবে উদবুদ্ধ করতে পারলে এরা মিশন সাকসেসফুল করার জন্য জান লড়িয়ে দেয়।
মহিলাটিকে দেখে এক লহমায় তার বয়স বোঝা মুশকিল, চল্লিশও হতে পারে। আবার ত্রিশ হওয়াও বিচিত্র নয়। খয়াটে গড়ন, খানিকটা কুঁজোও।
সামনের ছোটো করে ছাঁটা সোনালি চুলে মুখটাকে বেশ নিষ্ঠুর দেখায়।
উঠে দাঁড়ানো ছেলে দুটোর মধ্যে একজন বলল, ‘থ্রোইংটা ঠিক হয়নি একটু সরে গিয়েছিল, বাইকটাও হঠাৎ স্টার্ট দিয়ে দিয়ে দিল…!’
মহিলা সরু চোখে জরিপ করলে ছেলে দুটোকে কিছুক্ষণ, তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘তোমরা কি কোনো শট পাট কম্পিটিশনে গিয়েছিলে?
ছেলেটা এইরকম অদ্ভুত প্রশ্নে প্রথমে হকচকিয়ে গেল, তারপর বিস্মিত মুখে মাথা নাড়ল।
মহিলা চিৎকার করে উঠল, ‘তবে এখনও এইরকম ছেলেমানুষি ভুল হয় কী করে? আগের মিশনগুলোয় যারা গেল, এমনই একটা ভলিয়ুমে স্লোগানটা বলল কেউ শুনতেই পেল না, এটাতে আবার দু—দিন বেঁচে রইল ভিক্টিম। তোমাদের পেছনে কত ইউরো করে খরচ করা হচ্ছে, ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া? তোমাদের বাড়িতে মাসের প্রথমেই যে মোটা টাকাটা পৌঁছোয়, সেটা কি এইরকম ইয়ার্কি মারবার জন্য?’
ছেলেটা মাথা নীচু করল।
বাইরে একটানা কোথাও একটা পাখি ডেকে চলেছে। টুপটাপ শব্দে জল পড়ছে বাইরের ভাঙাচোরা কার্নিশে।
এইরকম অলস দুপুরে কারুর খুন জখমের কথা শুনতে ভালো লাগে?
জার্মানির দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের ব্ল্যাক ফরেস্ট অঞ্চল। এর চারপাশে রাইন নদীর ঢালু উপত্যকা ছড়িয়ে থাকলেও গভীরতায়, বৈচিত্র্যে, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যে ব্ল্যাক ফরেস্ট ইউরোপের অন্যতম সুবিস্তৃত অরণ্যভূমি। কোথাও এতটাই ঘন যে সূর্যের আলো পর্যন্ত ঢুকতে পরে না, কোথাও বরফে ঢাকা হিমবাহ, কোথাও আবার গড়ে উঠেছে ছোটো গ্রাম, ছোটো জনবসতি পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে।
ব্ল্যাক ফরেস্ট কেকের নাম এসেছে এই অঞ্চল থেকেই। কেউ মনে করে এই জঙ্গলের আলো আঁধারি মেশানো কালো অন্ধকার, তার মাঝে শুভ্রশীতল বরফের ছোঁয়া, আর মধ্যে মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ি নাম—নাজানা ফুলের গাছ, এই ডিজাইনটাই ব্ল্যাক ফরেস্ট কেকে আনা হয়েছে, কোকো কেকের উপর সাদা ক্রিম আর লাল চেরির টপিং দিয়ে।
আবার কারুর মতে ব্ল্যাক ফরেস্ট অঞ্চলে বসবাসকারী এক উপজাতির মহিলারা যে বিশেষ পোশাক পরতেন, কালো রঙের ঘাগরা, সাদা রঙের ব্লাউজ, আর লাল উলের টুপি, সেখান থেকেই ব্ল্যাক ফরেস্ট কেকের উৎপত্তি।
প্রাচীন যুগ থেকে এখানে অনেক জাতি উপজাতি বসবাস করলেও গত দু—তিনশো বছর ধরে এই বিশাল জায়গাটা বিভিন্ন যুদ্ধের সময় আদর্শ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল। শোনা যায় এই জঙ্গলেরই মধ্যে লুকোনো এক বাঙ্কারে একবার হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল হিটলারকে।
নিঝুম হল ঘরে ছোটো সোনালি চুলের মহিলাটি পায়চারি করার ভঙ্গিতে চলতে চলতে প্রতিটা ছেলেকে গভীর চোখে পরখ করছিল। তারপর গলা নামিয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘তোমাদের বয়সি ছেলেরা যে টাকাটা পাচ্ছ, সেটা বড়ো বড়ো কর্পোরেট হাউসও পে করে না এই বয়সে। তোমাদের জামা, জুতো, ঘড়ি এভরিথিং ইজ ব্র্যান্ডেড। ওয়ার্ল্ড ক্লাসের ট্রেনিং প্রোভাইড করা হয় তোমাদের। কেন? বিকজ ইউ পিপল আর দ্য রিয়েল সেভিয়ার অফ ইউরোপ! তোমাদের হাত ধরেই সব কিছু আবার নিট অ্যান্ড ক্লিন হবে। নিজেদের তোমরা দেশপ্রেমিক মনে করতে শেখো, তবেই কাজে মন আসবে। বুঝেছ?’
ছেলেগুলো নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।
সোনালি চুল বোঝানোর ভঙ্গিতে বলতে লাগল, ‘এভাবে চললে তো কোনো দেশই বুঝতে পারবে না আমাদের আসল মোটিভ। অ্যাট লিস্ট আমাদের উদ্দেশ্যটা তো আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে দিতে হবে! আরে আমরা তো কোনো ছিঁচকে টাইপ টেররিস্ট নই! আমরা যা করছি, দেশের জন্য করছি! এই যে আইসিসরা কোনো পরিষ্কার মোটিভ ছাড়াই এইভাবে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে, কালও নিউজ চ্যানেলে দেখলাম, একটা ইয়াজিদি মেয়েকে পাঁচদিন না খাইয়ে তারপর তার বাচ্চার মাংস রেঁধে খাইয়েছে, লক্ষ লক্ষ মেয়েকে যৌনদাসী হিসেবে অমানুষিক অত্যাচার করছে ওরা, কেন? কারণ ওরা মুসলিম নয়। আমরা কি এইরকম কোনো বিকৃত কাজ করছি? আমাদের উদ্দেশ্য একটাই, ইউরোপকে শুদ্ধ করা, ইউরোপকে সুপ্রিমে নিয়ে যাওয়া। বুঝতে পারছ তোমরা?
সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে সে আবার বলল, ‘আর কিন্তু এক সপ্তাহ বাকি আছে ফাইনাল মিশনের। তার আগে ট্রেনিং—এ কারুর কোনো গাফিলতি যেন না চোখে পড়ে আমার! স্যারের কাছে কিন্তু ডিটেইলড রিপোর্ট যাবে প্রত্যেকদিনের।’
একটু আগে ধমক খাওয়া ছেলেটা পাশের জনের কানে ফিসফিস করল, ‘তারপর কি আমাদের কাজ শেষ?’
পাশের জন দলের মধ্যে একটু মুরুব্বি গোছের, সে বলল, ‘এই মিশন শেষ। তারপর অন্য কাজ, যতদূর জানি।’ একটু চোখ ছোটো করে হাসল সে। ‘তোমার চাপ কীসের? আমাদের ডিউটি ইউরোপকে বাঁচানো, বেস্ট পারফরম্যান্স দেওয়া, আমরা দিয়ে যাব, সে যে কাজই হোক!’
ধমক খাওয়া ছেলেটা ঢোঁক গিলল। এরা সবাই নিজেদের একেকটা হিরো ভাবছে, এমন মগজ ধোলাই করা হয়েছে। গোটা ইউরোপকে নাকি বাঁচাবার দায়িত্ব ওদের এই মাত্র ক—জনের কাঁধে। আরে ভাই, সব দেশের বড়ো বড়ো আর্মি ফোর্সগুলোর কাজ কী তাহলে? আর তা ছাড়া মানুষকে মেরে কী করে কোনো দেশকে বাঁচানো যায়, সেটা ওর মাথায় ঢোকে না। ও নিজে এত কিছু বোঝেও না, অন্যদের মতো কোনো দেশপ্রেমও উথলে ওঠে না ওর, শুধু টাকার জন্য জীবন বিপন্ন করে পড়ে রয়েছে এখানে। এসেছিল টাকার লোভে, আর এখন তো বেরোনোর পথ পুরোপুরি বন্ধ। প্রতিটা মিশনে যাওয়ার আগে ওরা না ফিরলে যে কত টাকা পৌঁছে দেওয়া হবে ফ্যামিলির কাছে, সেই লোভেই বিভোর থাকে ওরা এখন।
সোনালি চুল আবার বলল, ‘ফাইনাল মিশনের দিন স্যার নিজেও থাকবেন। বুঝতেই পারছ কতটা অপটিমাম লেভেলে পারফর্ম করতে হবে তোমাদের? একটুও যেন কোনো কিছু এদিক থেকে ওদিক না হয়।’
ছেলেটা একটা ছোটো নিশ্বাস ফেলল। এই স্যার বলে লোকটার কথা দিনে অন্তত চারবার করে শুনেত হয় ওদের।
এই ‘স্যার’ লোকটা কে ভাই?
ওরা প্রত্যেকে যেন ঘড়ির কাঁটায় চলা একেকটা রোবটে পরিণত হয়েছে!
আচ্ছা ওরা কি সত্যিই দেশপ্রেমিক?
১২
পরের দিন সকালে উঠে প্রিয়ম অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর ব্রেকফাস্ট সেরে রুদ্র একটা ফোন করল ড শ্যুমাখারকে। প্রথমে অনেকক্ষণ আউট অফ রিচ বলছিল। তারপর একবার রিং—হতে —না—হতেই ভদ্রলোকের গলা শোনা গেল, ‘হ্যাঁ ম্যাডাম, বলুন। গুড মর্নিং!’
‘গুড মর্নিং!’ রুদ্র মিষ্টি করে হাসল, ‘আজ কি একটু ফ্রি আছেন? দেখা করা যেতে পারে কি একবার? একটু আলোচনা ছিল।’
ভদ্রলোক যেন একটু চিন্তা করছেন, ‘আজ? উমম, দুপুরে হলে অসুবিধা হবে কি? এই ধরুন লাঞ্চের পর, তিনটে নাগাদ?’
রুদ্র বলল, ‘একেবারেই নয়। বলুন, কোথায় যাব? আপনার ক্লিনিকে যাব কি?’
‘না না!’ ড শ্যুমাখার হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘ক্লিনিকে একদমই আসবেন না, এখানে এসব ডিসকাশন একেবারেই নিরাপদ নয়, বলেছিলাম না আপনাকে?’
রুদ্র বলল, ‘না, আমি গেলে কাউকে বুঝতে দিতাম না কিছু। যাই হোক, তাহলে বলুন কোথায় দেখা করবেন?’
ড শ্যুমাখার একটু থেমে বললেন, ‘এক কাজ করুন। হাইড পার্কে আসতে পারবেন?’
রুদ্র বলল, ‘সেটা কোথায়? আচ্ছা ঠিক আছে, আমি দেখে নিচ্ছি জি পি এস —এ।’
ড শ্যুমাখার তবু বলে দিলেন কীভাবে হাইড পার্ক যেতে হবে হিলিংডন থেকে। রাখার আগে একটু চাপা গলায় বললেন, ‘আর জিনিসগুলো সাবধানে রেখেছেন তো? আজ আনতে পারলে ভালো হত।’
‘কয়েকদিন একটু অপেক্ষা করুন, আমি এগোতে না পারলে আপনাকে দিয়ে দেব। চিন্তা করবেন না। ওটা খুব নিরাপদে রাখা আছে।’ আশ্বস্ত করে ফোনটা ছাড়ল রুদ্র।
লন্ডন শহরের যে চারটে বড়ো রয়াল পার্ক আছে, তার মধ্যে এই হাইড পার্ক একটা। রুদ্র আসার আগে লন্ডনের ওপর লেখা সেই বইটাতেও পড়ছিল, কেনসিংটন প্যালেস আর বাকিংহাম প্যালেসের মাঝামাঝি খুব স্ট্র্যাটেজিকাল লোকেশনে এই পার্কটা। প্রায় পাঁচশো বছর আগে ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের লোকেদের শিকার করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। তখন অবশ্য সাধারণ মানুষ ঢুকতে পারত না। এখন এই পার্কে হাজার হাজার ফুলের সমাবেশ, তার সঙ্গে কোনো জনসমাবেশের জন্য রয়েছে স্পিকার’স কর্নার।
মানুষগুলো চলে যায়, কিন্তু স্থাপত্য ইতিহাস হয়ে যায়।
রুদ্র ড শ্যুমাখারের বলে দেওয়া মতো পার্কেরই একদিকে ওয়েলিংটন আর্কের সামনে অপেক্ষা করছিল। এখানকার প্রতিটা ঐতিহাসিক বাড়ি বা সৌধই এত সুন্দর, বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। বেশিরভাগ সৌধই কোনো—না কোনো যুদ্ধজয়ের গৌরব বহন করে চলেছে। কত ছবি তুলবে! ফোনের মেমরি কার্ড ফুল হয়ে যাবে, তবু ছবি শেষ হবে না, এত সুন্দর সব কিছু।
আসলে পুরো ইউরোপটা এতটাই অভিজাত, চোখের পলক ফেলা যায় না।
পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে ও একটু আদুরে গলায় ফোন করল প্রিয়মকে, ‘তুমি আজ যদি ছুটি নিতে, দারুণ ঘোরা হত সারাদিন। কী সুন্দর ওয়েদার আজ!’
ওপাশ থেকে প্রিয়মের গলা ভেসে এল, ‘হুঁ, সে তো জানি। কিন্তু কী করব, ক্লায়েন্টগুলো আসার আর সময় পেল না, আমি যত বলি আমার সবচেয়ে বড়ো ক্লায়েন্ট এসেছে এখন ইন্ডিয়া থেকে, কে শোনে কার কথা।’
রুদ্র হেসে গড়িয়ে পড়ল। প্রিয়ম ইয়ার্কি মারতেও পারে।
প্রিয়ম বলল, ‘তুমি কোথায় রয়েছ?’
রুদ্র বলল, ‘হাইড পার্কে এসেছি। ড শ্যুমাখার আসছেন।’
প্রিয়ম বলল, ‘নিজে নিজে চলে গেলে? ক্যাবে?’
রুদ্র বলল, ‘না, বাসে এলাম।’
প্রিয়মের হতাশ গলা শোনা গেল, ‘ধুস! ভাবলাম বউকে নিয়ে পুরো লন্ডন চেনাব, সেখানে বউ তো দেখছি আমার আগেই সব ঘুরে ফেলল! তাও আবার একটা আধবুড়োর সঙ্গে! আমি নিজেই এখনও ওদিকটায় যাইনি কখনো।’
রুদ্র কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ দূরে পার্কে এন্ট্রান্সের বাইরে ওই লাল কালো যমদূতের মতো বাইকটা দেখেই চমকে উঠল। এক ঝলকের জন্য চোখাচোখি হতেই সেই জাপানি লোকটা আড়ালে চলে গেল।
এই লোকটা কে? যেখানে ও যাচ্ছে সেখানেই ওকে ফলো করে চলেছে?
পরক্ষণেই ও ড শ্যুমাখারকে হন্তদন্ত হয়ে এদিকে আসতে দেখল। ডাক্তারবাবু আজ ফর্মালে, একটা কালো রঙের প্যান্ট পরেছেন, উপরে আকাশি রঙের একটা ফুলহাতা শার্ট। চোখে চশমাটাও অন্য পরেছেন, ধূসর ফ্রেমের সরু রিমলেস চশমা।
রুদ্রর হঠাৎ রানি এলিজাবেথের হাত থেকে ওঁর পুরস্কার নেওয়ার ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল।
ও আড়চোখে বাইকের লোকটার দিকে তাকাতে গেল, কিন্তু আর দেখতে পেল না।
বাইকটাও ভ্যানিশ।
আচ্ছা, এই বাইকওলা লোকটা কাকে ফলো করছে? ওকে? না, ড শ্যুমাখারকে? সন্দেহ নেই, ডাক্তারকেই ফলো করছে, ওকে করবেই—বা কেন! ওকে চেনেটাই—বা কে। তবে যদি ছবিগুলো হাতানো ওর মুখ্য উদ্দেশ্য হয়, তবে কি ও বা ওরা জানতে পেরে গেছে রুদ্রর কাছে ছবিগুলো রয়েছে?
কী করে জানল?
ড শ্যুমাখার কাছে এসে বললেন, ‘চলুন ম্যাডাম, একটু দেরি হয়ে গেল।’
রুদ্র ড শ্যুমাখারের পিছু পিছু পার্কের পাশেই একটা ছোটো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল। একবার ভাবল এই ফেউ লাগার কথাটা বলবে, কিন্তু সেটা বলার আগেই ড শ্যুমাখার দু—কাপ কফির অর্ডার দিয়ে ওর দিকে ঈষৎ ঝুঁঁকে বললেন, ‘কিছু এগোলেন ব্যাপারটায়?’
রুদ্র বলল, ‘না, সে—রকম কিছু নয়। জাস্ট একটু দেখছিলাম। তবে দু—একটা ব্যাপার চোখে পড়েছে।’
ড শ্যুমাখার আগ্রহের স্বরে বললেন, ‘কীরকম?’
‘যেমন,’ রুদ্র বোঝাতে চেষ্টা করল, ‘কোনো একটা রাইটিং প্যাডের একটা করে কাগজে মোটা কালির পেন দিয়ে লিখে সেগুলোকে একদম টপ ভিউ থেকে ছবি তোলা হয়েছে। আর, প্রতিটারই নীচে একই ধরনের দুটো হরফ রয়েছে, এটা কিছুর লোগো হতে পারে।’
ড শ্যুমাখার বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ওটা খেয়াল করেছি। কী বলুন তো, আমি তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।’
রুদ্র বলল, ‘আচ্ছা, তার আগে একটা কথা আমায় বলুন, এইরকম কি কোনো মৌল থাকতে পারে যেটা শুধুমাত্র ল্যাবোরেটরিতে তৈরি করা সম্ভব, কিন্তু কোনোভাবেই সেটা নেচারে, মানে প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায় না?’
ড শ্যুমাখার বললেন, ‘হ্যাঁ, কেন যাবে না? ওগুলোকে বলে সিন্থেটিক এলিমেন্ট। পিরিয়ডিক টেবিলের মোটামুটি অ্যাটমিক নম্বর পঁচানব্বই থেকে একশো আঠেরো যে মৌলগুলো আছে, সেগুলো সবই তাই। প্রচণ্ড আনস্টেবল বলে ওগুলোকে প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, কয়েকটার তো হাফ—লাইফ কয়েক মাইক্রোসেকেন্ড। হাফ—লাইফ কী জানেন তো?’
রুদ্র হাসল। অনেকদিন কেমিস্ট্রির টাচে না থাকলেও উচ্চমাধ্যমিকে পঁচানব্বই পেয়েছিল ও, সেখানে হাফ—লাইফ জানবে না, ইয়ার্কি নাকি! ওইসব সময়ে তো মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণি মানে এই পিরিয়ডিক টেবিল কণ্ঠস্থ ছিল।
ও বলল, ‘হ্যাঁ। তেজস্ক্রিয় পদার্থ, মানে রেডিয়ো অ্যাক্টিভ এলিমেন্টগুলো তো খুব আনস্টেবল হয়, সেগুলো ক্ষয় হতে হতে প্রাথমিক অবস্থার অর্ধেক হতে যত সময় নেয়, সেটাকে বলে ওই পদার্থের হাফ—লাইফ। যার হাফ—লাইফ যত কম, তত আনস্টেবল। মানে, ওই যে আপনি বললেন, ওই সিনথেটিক এলিমেন্টগুলোর হাফ—লাইফ কয়েক মাইক্রোসেকেন্ড, তার মানে ওই সময়টুকুর মধ্যেই ওটা ক্ষয়ে অর্ধেকে পরিণত হবে।’
ড শ্যুমাখার বললেন, ‘আপনি ব্যাঙ্কে চাকরি করেন না?’
রুদ্র একটু লাজুক মুখে বলল, ‘হ্যাঁ।’
উনি আরও অবাক হয়ে গেলেন, ‘ফিন্যান্সের লোক হয়ে আপনি কেমিস্ট্রি বা বায়োলজির এত কিছু জানলেন কী করে বলুন তো?’
আপনি আর কী করে জানবেন ডাক্তারবাবু, আমাদের দেশের সবাইকেই সব বিষয়ে পণ্ডিত হতে হয়। আর সরকারি অফিসে চাকরি করতে হলে তো হয়েই গেল, পিয়োন হওয়ার পরীক্ষায় পাশ করতে গেলেও ইতিহাস, বিজ্ঞান, ইকনমিক্স গুলে খেতে হয়!
ও বলল, ‘আমার হাইস্কুলে এগুলো সাবজেক্ট ছিল তো!’
ড শ্যুমাখার বললেন, ‘ভেরি ইম্প্রেসিভ! আপনার ওপর আমার বিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছে। পারলে আপনিই পারবেন।’
রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, সিনথেটিক এলিমেন্টগুলোর হাফ—লাইফ এত কম, তার মানে সেগুলো ডেফিনিটলি রেডিয়ো অ্যাক্টিভ, তাই তো?’
ড শ্যুমাখার মাথা নেড়ে বললেন, ‘এখনও পর্যন্ত চব্বিশটা সিনথেটিক এলিমেন্ট রয়েছে পিরিয়ডিক টেবিলে, প্রতিটাই হাইলি রেডিয়ো অ্যাক্টিভ, কিন্তু!’ ওঁকে কিঞ্চিত অসহিষ্ণু দেখাল, ‘কিন্তু আপনি প্লিজ বলবেন, এগুলো জিজ্ঞেস করছেন কেন? এগুলোর কোনো ক্লু কি পেয়েছেন আপনি ওই ছবিগুলো থেকে?’
রুদ্র এবার একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘বলছি। আগে কয়েকটা জিনিস জানার আছে আমার। নতুন কোনো এলিমেন্ট যদি কেউ তৈরি করেন যেটার অ্যাটমিক নম্বর একশো পনেরো বা তারও বেশি, সেটা কি রেডিয়ো অ্যাক্টিভ হতেই হবে।’
ড শ্যুমাখার বললেন, ‘অত ভারী মৌলর নিউট্রন—প্রোটন রেশিয়ো খুব হাই হবে, কাজেই রেডিয়ো অ্যাক্টিভ হওয়াটাই স্বাভাবিক। খুবই আনস্টেবল হবে সেটা।’
রুদ্র বলল, ‘আপনি বলেছিলেন মৌলটা বাতাসে থাকা নাইট্রোজেনের সঙ্গে মিশে রিঅ্যাকশন করে যে কম্পাউন্ডটা উৎপন্ন করবে, সেটা ব্লাড ভেসেলে প্রবেশ করালে সেটা মানুষের জিনটাকে বদলে ফেলবে, তাই তো? কিন্তু ওটা যদি রেডিয়ো অ্যাক্টিভ হয়, তবে তো শরীরের ক্ষতিও করবে।’
ড শ্যুমাখার চমকে উঠে বললেন, ‘আপনি নাইট্রোজেনের সঙ্গে রিঅ্যাকশন করতে পারে, এরকম এলিমেন্টের সন্ধান পেয়েছেন ওই ছবিগুলোতে? তৈরির প্রসেসটা বুঝতে পেরেছেন?’
রুদ্র বলল, ‘বলছি। আপনি আগে আমার প্রশ্নটার উত্তর দিন। মৌলটা যদি তৈরি করাও যায়, সেটা ক্যান্সারকে দূর করলেও শরীরের তো অন্যভাবে ক্ষতি করবে, ব্যাপারটা তো আলটিমেটলি বাজেই হবে।’
ড শ্যুমাখার একটু অধৈর্যভাবে বললেন, ‘এখনও পর্যন্ত, নাইট্রোজেন ফিক্সেশন মলিবডেনাম করতে পারে, আর সেটাও থ্রু এনজাইম। বাতাসের সংস্পর্শে এসে করতে পারে না কারণ নাইট্রোজেন এমনিতেই অত অ্যাক্টিভ নয়। আর মলিবডেনামের কোনো এইরকম আইসোটোপ আছে কিনা আমার জানা নেই যেটা নাইট্রোজেনের সঙ্গে নিজে নিজেই রিয়্যাক্ট করে মানুষের ব্লাডে ঢুকে তার জিনটাকে মডিফাই করে দেবে, মানে আমাদের ইউজেনিক্স সেকথা বলে না। আপনি এবার প্রসেসটা বলুন। আমি ভাবতেই পারিনি আপনি এত তাড়াতাড়ি…..!’
রুদ্র মাঝপথে বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ইউজেনিক্সটা কী?’
ড শ্যুমাখার এবার একটু চমকে গিয়ে বললেন, ‘জিন, জিনটাকে মডিফাই করার কথা বলছিলাম আর কি!’
রুদ্র একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘দেখুন ড শ্যুমাখার, আপনি একটা ভালো কাজে আমার হেল্প চেয়েছিলেন বলে আমি আগ্রহ দেখিয়েছিলাম, তো তাতে যেটুকু বুঝতে পেরেছি, সেটা হল প্রতিটা ছবিতে অজস্র যে হরফগুলো লেখা রয়েছে, সেগুলো সবই আসলে ইংরেজির এক একটা অক্ষরকে রিপ্রেজেন্ট করছে।”
ড শ্যুমাখার হাঁ হয়ে গেলেন, ‘ইংরেজির অক্ষর? আ—আপনি শিয়োর? ইংরেজিরই? কীরকম একটু বলবেন?
রুদ্র বোঝাবার চেষ্টা করল, ‘এগুলোকে বলে ক্রিপটোগ্রাফি। আমি এখনও পুরোটা বুঝতে পারিনি, তবে এটা লক্ষ করেছি একই ধরনের হরফ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লেখা হয়েছে। ইংরেজিতে ছাব্বিশটা অক্ষর রয়েছে মোট, সবকটা ছবিতেই মোট তেরো ধরনের হরফ রয়েছে, সেগুলোর কোনোটার ভেতরে ফুটকি রয়েছে, কোনোটার ভেতরে নেই। তার মানে, যদি এটা ধরে নিই, ফুটকি দেওয়া হরফটা অন্য কোনো অক্ষরকে রিপ্রেজেন্ট করছে, তাহলে তেরো দু—গুণে ছাব্বিশটা টোটাল হরফ রয়েছে, যেটা আমাদের ইংরেজি বর্ণমালাতেও আছে।’
ড শ্যুমাখারের চোখ অস্বাভাবিক জ্বলজ্বল করছিল, ‘আপনি সত্যিই জিনিয়াস!’
রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘জিনিয়াসের কিছু না, এটা একটা নর্মাল অবজারভেশন যেটা যেকোনো কোড ডিসাইফার করতে গেলে প্রয়োজন হয়। আমি এখনও ওই হরফগুলোর মানে বুঝতে পারিনি।’
উত্তেজনায় ড শ্যুমাখারের চোখটা লাল হয়ে যাচ্ছিল, ‘ছবিগুলো এনেছেন?’
রুদ্র বলল, ‘না। আপনি আমাকে আর দু—দিন মতো টাইম দিন। আমি চেষ্টা করছি। তার মধ্যেও আমি কিছু না বের করতে পারলে আপনাকে প্রোফেশনাল ক্রিপটোলজিস্টের কাছে যেতে হবে। কারাণ তারপর আমাকে প্যারিস চলে যেতে হবে, সেখানে আমার ওয়ার্কশপ আছে।’
শ্যুমাখার বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন সেটা রুদ্র আরও বুঝতে পারল, যখন দেখল বিল মেটাতে গিয়ে তাড়াহুড়োয় ওঁর হাত থেকে পার্সটাই পড়ে গেল। রুদ্র তুলে দিতে যেতে সেটার খোলা মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল প্রায় পাঁচ ছ—টা সিম। একে একে সেগুলো তুলে ওঁর হাতে দিল রুদ্র।
মিনিট কুড়ি পরে রুদ্র যখন ড শ্যুমাখারকে বিদায় জানিয়ে বাড়ি ফেরার বাস ধরল, তখন ওর মনটা বেশ খুশি লাগছিল এই ভেবে, ভদ্রলোক বড়ো মুখ করে ওর সাহায্য চাইতে এসেছিলেন, ও এখনও পর্যন্ত একটু হলেও হেল্প করতে পেরেছে। সবচেয়ে বড়ো কথা এতে প্রিয়মেরও মুখরক্ষা হবে।
ড শ্যুমাখারের অভিব্যক্তি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এত তাড়াতাড়ি এতটা প্রোগ্রেস উনি আশা করেননি।
গুনগুন সুরে একটা সুর ভাঁজতে ভাঁজতে ও প্রিয়মকে ফোন করল, ‘আমার অ্যাপো কমপ্লিট। এখন বাড়ির পথে। তুমি কোথায়?’ বলেই ও লক্ষ করল লাল কালো বিশাল বাইকটা ওর বাসের ঠিক পাশে পাশেই যাচ্ছে।
জাপানি লোকটা বাইক চালাতে চালাতেই একঝলক তাকাল ওর দিকে। তারপরেই স্পিড কয়েক গুণ বাড়িয়ে হু হু করে চলে গেল সামনের দিকে।
মুহূর্তে মিলিয়ে গেল যেন চোখের সামনে থেকে।
১৩
মার্চ ১৯৩৩,
ফ্রেডরিক ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরছিল। বার্লিনের বড়ো বড়ো রাজপথগুলো এখন আলোয় ঝলমল করলেও এইসব দিক এখনও টিমটিমে গ্যাসের আলোয় চলছে।
হালকা বরফে সারা রাস্তাটা সাদা গুঁড়োয় ছেয়ে রয়েছে। লোকজন প্রায় নেই—ই। রাস্তার দু—পাশের বাড়ি প্রায় নিস্তব্ধ, কোথাও মৃদু লয়ে গান চলার আওয়াজ ভেসে আসছে।
এই রাস্তাটার মোড় ঘুরেই ওর সেই প্রিয় রেস্টুরেন্টটা চোখে পড়ল। এখানকার খাবার দারুণ সুস্বাদু, অবশ্য মাসের একদম প্রথমেই মাইনে পেয়ে একবার এখানে এসে শখ মেটানোর সুযোগ পায় ফ্রেডরিক। খাবারের চেয়েও ওর বেশি প্রিয় হল এখানকার সেই বেহালা বাজানো লোকটা। বেশ বয়স্ক, কিন্তু বাজানোর হাতটা চমৎকার। চোখদুটো বুজে ভাঁজ পড়া গালে তন্ময় হয়ে বাজিয়ে যায় সে।
রোজ এইখান দিয়েই বাড়ি ফেরে ফ্রেডরিক, মাসের বাকি উনত্রিশটা দিন ওই লোকটার সেই সুরের মূর্ছনার স্বাদ নিতে নিতেই পেরোয় জায়গাটা।
কিন্তু আজ লোকটাকে ও দেখতে পেল না। অথচ রেস্টুরেন্টটা কিন্তু খোলা। শুধু খোলা তাই নয়, বেশ ভিড়, বাইরেটা কিছু একটা সাইনবোর্ড লাগানো চলছে।
ফ্রেডরিকের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। রোজ এখান দিয়ে যাওয়ার সময় ওই বেহালা শোনাটা কেমন অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। একটু হতাশ হয়ে ও পা বাড়াল সামনের দিকে।
ফ্রেডরিক এখনও বিয়ে—থা করেনি। এখান থেকে অনেক দূরে সেই কোলন শহরের দিকে তার বাবা মা থাকে। বেশ কয়েক বছর আগেই সে বার্লিন চলে এসেছিল, কয়েক বছর আগের সেই ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধির ঠিক আগে আগেই। সেসব দিনগুলো অনেক লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছিল ওকে, মনে পড়লে এখনও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় আর তারপর বিশাল পরাজয়ের ফলে গোটা জার্মানিতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যে রাতারাতি এক পাউন্ড পাঁউরুটির দাম প্রায় কুড়ি হাজার গুণ বেড়ে গিয়েছিল। ওই প্রচণ্ড ঠান্ডায় নিজের একমাত্র কোটটাকে সম্বল করে দিনের পর দিন বার্লিনের মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছে সে। তবু ফিরে যায়নি গ্রামে। সেই অবস্থাতেই একে ওকে ধরে ছাপাখানায় অ্যাপ্রেন্টিস থেকে কাজ শিখেছে। এখন একটু স্থিতাবস্থার দিকে এগোচ্ছিল, কিন্তু আজকের পর আর মনে হচ্ছে না তার চাকরিটা থাকবে। চাকরি তো দূর, ‘স্ট্রেট পাথ’ খবরের কাগজটাই আর থাকবে না, যা মনে হচ্ছে।
ঘরে ফিরে ও ওভারকোটটা খুলল, ঘরে পরার একমাত্র মোটা উলের শার্টটা পরে নিল গায়ে। এমনিতে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে এখনও তার নেই, কিন্তু ছোটেবেলা থেকে যে একমাত্র স্বপ্নটা মনে মনে লালন করে সে বাড়িঘর ছেড়ে এই বার্লিনে এসে পড়ে রয়েছে দু—পয়সা রোজগারের আশায়, সেটা করতে না পারলে ও সত্যিই ভেঙে পড়বে।
হতাশ মুখে ও ঘরের একপাশে রাখা ট্রাঙ্কটার কাছে গিয়ে হাতড়ে হাতড়ে একটা ছবি বার করল। একটা বহু পুরোনো হলদে হয়ে যাওয়া ছবি, দুমড়ে—মুচড়ে গেছে, তবু ও সেটা চোখের কাছে নিয়ে এসে পরম ভালোবাসার সঙ্গে দেখতে লাগল।
খবরের কাগজ থেকে কাটা একজন পর্বতারোহীর ছবি। একটা সম্পূর্ণ খাড়াই পাহাড় বেয়ে উঠছেন তিনি, দুটো হাত দিয়ে উপরে আটকানো একটা দড়ি ধরা। পা দুটো দিয়ে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় পাহাড়টাকে ধরে রেখে ভারসাম্য রক্ষা করছেন। সাদা কালো ছবিতে হলেও ওই প্রতিকূল পরিবেশে তাঁর মুখের অভিব্যক্তিটাও সুন্দর ফুটে উঠেছে ছবিটায়।
ছবিটি হ্যান্স ডুঁলফারের। জার্মানির সর্বশ্রেষ্ঠ পর্বতারোহীদের মধ্যে একজন। শুধু যে দুর্গম অনেক শৃঙ্গই তিনি জয় করেছিলেন তাই নয়, মাউন্টেনিয়ারিং করার জন্য অনেক ধরনের টেকনিকও তিনি বের করেছিলেন।
ফ্রেডরিকদের গ্রামের স্কুলে একটা অনুষ্ঠানে তিনি একবার গিয়েছিলেন, তখন ওর বয়স বড়োজোর বারো কিংবা তেরো। ওই বয়সে সব কিছুই আশ্চর্য লাগে, অনুসন্ধিৎসা আর কৌতূহলে মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খায় সবসময়, রূপকথা আর ভালো লাগে না, অ্যাডভেঞ্চারের দিকে মন টানে।
হ্যান্স ডুঁলফার তখন টগবগে যুবক, সদ্য আইসল্যান্ডের দুটো শৃঙ্গ জয় করে ফিরেছিলেন। ওদের স্কুলের ছোটো ছোটো ওই কচিকাঁচাদের মনে সেদিন পাহাড়ে ওঠার নেশাটা চারিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। তিনিই বলেছিলেন কেমনভাবে মিউনিখের অ্যালপাইন ক্লাবে পাহাড়ে চড়ার ট্রেনিং দেওয়া হয়।
অন্যদের মনে হয়তো কিছুই তেমন প্রভাব পড়েনি, কিন্তু ফ্রেডরিকের মনে উনি যে স্বপ্নটা বুনে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটার জাল বোনা থেকে ও আর এই জীবনে বেরোতে পারবে বলে মনে হয় না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মাত্র তেইশ বছর বয়সে যখন হ্যান্স ডুলফার মারা গিয়েছিলেন, খবরের কাগজে ও পড়েছিল সেটা। মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ততদিনে ফ্রেডরিক মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছে জীবনের লক্ষ্য। বার্লিন বা মিউনিখের মতো কোনো বড়ো শহরে গিয়ে বছর কয়েক অর্থোপার্জন করে নিয়েই পাহাড়ে ওঠার ট্রেনিং নেবে। সেইমতো এত কিছু।
বার্লিনে আসার পরে পরেই টাকা জমিয়ে এখানকার একটা ছোটো ক্লাব থেকে বেসিক ট্রেনিংটাও নিয়ে রেখেছে। ছোটোখাটো ট্রেকিং—এও গেছে।
কিন্তু এই অভিজ্ঞতা দিয়ে দুর্গম শৃঙ্গ অভিযান করা যায় না।
ও একটা চাপা নিশ্বাস ফেলল। মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যিই কি এই জীবনে ও ছবিতে দেখা ওই তুষারধবল শৃঙ্গগুলোর উপরে উঠতে পারবে? নাকি ছোট্ট থেকে দেখা ওই পর্বতারোহী হওয়ার স্বপ্নটা সারাজীবন শুধু স্বপ্ন হয়েই রয়ে যাবে!
ও কিছুক্ষণ চুল্লিতে হাত সেঁকল, তারপর খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়বে ভাবল। এখানে জীবন বড়ো একা, বিশেষত ভিক্টর আলাদা হয়ে যাওয়ার পর থেকে। এই বাড়িটা শহরতলির দিকে বলে অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটা আলাদা ঘর পেয়েছে, না হলে মাস তিনেক আগে অবধিও সেই বাঙ্কার সিস্টেমে গুঁতোগুঁতি করে শুতে হত।
ও একটা ছোটো নিশ্বাস ফেলল কাজটা চলে গেলে আবার হয়তো সেখানেই ফিরে যেতে হবে।
কেউ স্পষ্ট করে বললও না আজ, কাল আদৌ অফিস খুলবে কি না।
কাল যদি আরও বড়ো হামলা হয়? মৃদু আওয়াজ হতেই ও ফিরে তাকাল, ওর কোটের পকেট থেকে ঠকাস করে মাটিতে পড়ল এই সপ্তাহের ‘স্ট্রেট পাথ’ খবরের কাগজটা।
নিজে যে কাগজের অফিসে চাকরি করে, সেই কাগজই পড়া হয় না, এমনই দুরবস্থা ওর।
সময় কোথায়?
বাড়ি ফিরে জল তোলা, রান্না করা, চুল্লি জ্বালিয়ে রেখে ঘর গরম করা! বিরস মুখে কাগজটা তুলতে যেতে চোখে পড়ল ফ্রিৎজ স্যারের লেখা সম্পাদকীয় কলামটা, এটার কথাই আজ বলছিলেন স্যার, কেন হিটলারকে মানুষ জেতাল এত ভোট দিয়ে।
একটা হাই তুলে আগুনের পাশটায় বসে ও পড়তে লাগল লেখাটা,
‘মহোদয় দেশবাসী ভাইয়েরা। এর থেকে আর দুঃখের কিছুই নেই, শেষ পর্যন্ত একজন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গালাগানো, স্বৈরাচারী শাসককে আমরা আমাদের দেশের সর্বোচ্চ পদে অভিষিক্ত করতে চলেছি। যিনি শান্তিতে নয়, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিশ্বাস করেন, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নয়, নিজের জাতিকে উত্তম প্রতিপন্ন করতে অন্যদের নৃশংসভাবে ধ্বংস করতেও যিনি পিছপা হন না। বন্ধুগণ, ইহুদিরা যুগ যুগ ধরে জার্মানিতে বসবাস করছে। আমাদের দেশের অনেক মান্যগণ্য পদে তাঁরা রয়েছেন, অগণিত ইহুদি ভাইয়েরা যুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করেছেন, প্রাণও দিয়েছেন, কোনোদিনও এই নিয়ে কোনো অসন্তাোষ সৃষ্টির নজির এদেশে নেই। কিন্তু মাননীয় নতুন চ্যান্সেলর তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ার শুরুর প্রথম থেকে বলে এসেছেন ওঁর অপরিসীম ইহুদি বিদ্বেষের কথা। বলে এসেছেন কীভাবে ক্ষমতায় এলে পুরো ইহুদি জাতিকে ওঁর নাতসি বাহিনী নিশ্চিহ্ন করতে পিছপা হবে না। ওই জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিলেই নাকি আমাদের দেশে বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি এই সমস্ত সমস্যা উধাও হয়ে যাবে। অসাধারণ যুক্তি! গণহত্যা করে যদি সামাজিক সমস্যা দূর করতে হয়, তবে তো সেই যুক্তিকে গোটা পৃথিবীই একদিন জনহীন প্রাঙ্গণে পরিণত হবে। কিন্তু সেই বুদ্ধি ওই মহামতির নেই। ব্যক্তিগত জীবনেও তাঁর উন্মাদসম স্বৈরাচারিতার শিকার হয়েছেন অনেকেই, এমনকী তাঁর নিজের আত্মীয়স্বজনরাও। তবু আমরা, বুদ্ধিমান জার্মানরা, তাঁকেই আমাদের দেশের প্রধান হিসেবে নির্বাচন করলাম!
কেন করলাম?
কেন আমরা বুঝলাম না যে তিনি আমাদের সাময়িক মানসিক চাপটাকে হাতিয়ার করে, দেশের বর্তমান টালমাটাল অবস্থার সুযোগ নিয়ে আমাদের সমর্থন আদায় করে নিলেন?
আসুন দেখে নিই আমাদের এহেন দুর্বুদ্ধির কারণ। জার্মানির অর্থনীতি এমনিতেই বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রচুর খরচের পর বিধ্বস্ত, তার ওপর বিশ্বযুদ্ধে হারার সব দায় জার্মানির ওপরেই চাপিয়ে ভার্সাই—এর চুক্তি করা হয়েছিল, তাতেও অনেক টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছিল। আপনারা প্রত্যেকেই অবগত আছেন সেই টাকার জোগাড় করতে আমাদের সরকার নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে টাকা ছাপাতে শুরু করে। কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কে যে পরিমাণ সোনা রিজার্ভড থাকে, তার সমপরিমাণ টাকাই সেই দেশ ছাপাতে পারে। তার বেশি টাকা ট্যাঁকশাল থেকে ছাপালে সাময়িক হয়তো বাজারে টাকার জোগান বাড়ে, কিন্তু সেই টাকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি এবং দ্রব্যমূল্যের দামও বাড়তে থাকে। পাল্লা দেওয়ার জন্য সরকার আরও টাকা ছাপাতে শুরু করে এবং সবশেষে টাকার কোনো দামই আর থাকে না। সেটাই ঘটেছিল আমাদের ক্ষেত্রে। এমন সময়ও আমাদের দেখতে হয়েছে যখন লক্ষ লক্ষ রুবলের কাগজের নোট পুড়িয়ে মানুষ চুল্লি গরম করেছে, বাচ্চারা দলা পাকানো নোট নিয়ে খেলছে কিংবা বস্তা করে রাস্তায় লক্ষ লক্ষ টাকা ফেলে গেছে, এদিকে খাবারের দোকানের সামনে একটুকরো রুটির জন্য প্রচুর টাকা পকেটে নিয়েও মানুষ খাবার কিনতে পারেনি। অস্বীকার করে লাভ নেই, এই হাইপার ইনফ্লেশন নিয়ন্ত্রণ করতে তৎকালীন সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলেন।
তার ওপর বছর চারেক আগের বিশ্বব্যাপী সেই গ্রেট ডিপ্রেশন তো সকলেরই মনে আছে। স্টক মার্কেটে সেই ধসের ফলে সারা বিশ্বেই মারাত্মক মন্দা দেখা দিয়েছিল। আর তাতেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতি জার্মানিরই হয়েছে, কারণ জার্মানির ইকনমি বিদেশি মূলধন, অর্থাৎ প্রধানত আমেরিকার থেকে নেওয়া লোন আর বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে। তার ওপর ফ্রান্স যখন আমাদের রাঢ় অঞ্চল আক্রমণ করল, তখন পরিস্থিতি একেবারেই আয়ত্তের বাইরে চলে গেল। আমাদের কারখানাগুলোর উৎপাদন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেল, ফলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ছাঁটাই হতে শুরু করল, ব্যাঙ্কগুলো অবধি ফেল করতে লাগল, আর ইনফ্লেশন অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধি যে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে সেটা তো সর্বজনবিদিত। আগের চ্যান্সেলর মি ব্রুয়েনিং কোথায় এই সাংঘাতিক অবস্থার মোকাবিলা করবেন, তা নয়, প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে তিনি দুম করে আটচল্লিশ নম্বর ধারা জারি করে দিলেন, অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট’স রুল। বিরোধীদের প্রবল বিরোধিতায় মন্ত্রিসভা রেইচস্ট্যাগে কাজকর্ম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। ফলস্বরূপ এই নতুন ইলেকশন।
এই পরিস্থিতিতে জার্মানির মানুষরা একজন বিকল্প খুঁজছিল। যেকোনো বিকল্প। আমরা এই রাজনৈতিক টানাপোড়েনে নিজেরা শেষ হয়ে বিধ্বস্ত, ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই হিটলারের জায়গায় একটা কুকুরও দায়িত্ব নিতে চাইলে আমরা বারণ করতাম না। আর তাই নির্বাচনের এই সাংঘাতিক ফলাফল। আমরা বিশ্বযুদ্ধ, মূল্যবৃদ্ধি, মন্দা, একে একে ধাক্কায় ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে গেছি, হারিয়েছি বহু প্রিয় আপনজনকে, তাই হয়তো আমাদের শুভ বুদ্ধিও বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই সমস্ত জার্মানির মানুষের প্রতি আমার তরফ থেকে রইল গভীর সমবেদনা।’
পড়তে পড়তে ফ্রেডরিক আগুনের এতটাই কাছাকাছি চলে গিয়েছিল যে অন্যমনস্কতায় ওর আঙুলে ছ্যাঁকা লেগে গেল, ঠান্ডা একটা স্রোত চলে গেল ওর পিঠের মাঝখান দিয়ে।
ফ্রিৎজ স্যারকে ও খুব শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে তাঁর ওই অনমনীয় ভঙ্গিকে। কিন্তু তিনি একইরকমভাবে প্রকাশ্যে হিটলারকে কুকুর বলেছেন? এর ফল কি শুধু দলের লোকেদের ওই ডিম আর পাথর ছোঁড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকবে?
নাকি আরও বড়ো কোনো শাস্তি পেতে হবে ওঁকে!
এই ঠান্ডাতেও নিজের অজান্তেই ফ্রেডরিক শিউরে উঠল।
১৪
‘হোয়াটসঅ্যাপে এইসব কী পাঠিয়েছ!’ আঁতকে উঠল সিগফ্রেড ফোনটা করেই।
‘এ কী! চিনতে পারছ না! কিন্তু যাকে ছবি তোলার দায়িত্ব দিয়েছিলাম সে তো এ ব্যাপারে যথেষ্ট এক্সপার্ট! ভালো করে আগুনে পুড়িয়ে তারপর বেশ ফটোজেনিক অ্যাঙ্গল থেকেই তো ছবিগুলো তুলেছে যতদূর জানি।’ ওপাশের গলাটা কথাটা বলল বেশ তির্যক সুরে, রসিয়ে রসিয়ে।
‘তুমি ক্যানাবিসের পুরো স্টকটা আগুন ধরিয়ে দিলে?’ ককিয়ে উঠল সিগফ্রেড।
‘না না, পুরোটা নয়। মাত্র তিনটে প্যাকেট। পুরোটাও পুড়বে, তবে আর কয়েকদিন পরে। কী করব, একে ব্যানড জিনিস, তার ওপর কথার দাম তো রাখতেই হবে সিগফ্রেড। যেমন তোমার মাকে কোন যুগে কথা দিয়ে ফেলেছিলাম বলে তোমার মতো অপোগণ্ডকে আজও পুষতে হচ্ছে আমায়। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার শ্রাদ্ধ করছি তোমার পেছনে।’
সিগফ্রেডের মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গেল, মনে হল, যা মনে আছে সব উগরে ফেলে ও, সহ্যের একটা সীমা আছে। ওর নিজের প্রাপ্য টাকা বিকৃতমনস্ক নরকের কীটটা দখলে রেখে দিয়ে ওকেই ব্ল্যাকমেল করে চলেছে দিনের পর দিন!
কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারল না। বদলে চোখে জল এসে গেল হঠাৎ। ওর এই নরম মনের সুযোগ নিয়েই তো লোকটা দিনের পর দিন নিংড়ে চলেছে ওকে। অথচ আজ দাদা যে উচ্চতায় গেছে, ততটা না হলেও কিছু তো ভালো করতে পারত ও জীবনে! ইতিহাস নিয়ে পড়ে অন্তত নিজের মনে ঘুরে বেড়াত দেশবিদেশ। বদলে কী পেল? ছোট্ট থেকে একটা বদ্ধ ঘরে পাহারার মধ্যে মানুষ হল, আর বড়ো হয়ে সেই বন্দিদশা আরও বেড়ে গেল।
সেই ছোটোবেলা থেকে শারীরিক মানসিক অত্যাচারের শিকার হতে হতে নিজেকে অসংখ্যবার শেষ করে দেওয়ার কথা ভেবেছে, শেষ মুহূর্তে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছে মনের জোর। অবশেষে ড্রাগের দুনিয়ায় বুঁদ হয়ে ভুলতে চেয়েছে দুঃখ। তাতেও নিস্তার পায়নি, উলটে সেটাকেই ওর দুর্বলতা ধরে নিয়ে করতে বাধ্য করা হচ্ছে একের পর এক অবৈধ কাজ।
পুলিশের কাছে যাওয়ার কথা ভাবলে তো কেঁপে ওঠে, কীভাবে উলটো ক্রাইমে ফাঁসিয়ে ওকেই একবার লোকটা জেল খাটানোর উপক্রম করেছিল।
মায়ের মুখ আজ আর মনে পড়ে না, তবু একটা যে অস্পষ্ট ফটোগ্রাফ আছে ওর কাছে, সেটা দেখে মা—কে মাঝে মাঝেই বলে সে, কেন এমন করলে মা আমার সঙ্গে! কেন একটা পশুর কাছে টাকা পয়সা সব দিক দিয়ে বেঁধে রেখে গেলে আমায়!
সিগফ্রেড স্বাভাবিক হয়ে বলল, ‘আমি চেষ্টা করছি। ওই ব্যাপারটায় একজন অনেকটা এগিয়েছে, হোপফুলি বের করতে পারবে।’
ওপাশের গলাটা গর্জে উঠল, ‘আগের দিনও তুমি এই কথাই বলেছিলে। আর তুমি কি সবাইকে প্রচার করে বেড়াচ্ছ নাকি হাতে মাইক নিয়ে?’
‘না না!’ ও তড়িঘড়ি বলল, ‘আমি অন্য গল্প বলেছি। প্লিজ আর দু—দিন দেখো।
ওপাশের গলাটা এবার অধৈর্য শোনাল, ‘আর কতদিন দেখব? আমার কাছে তো অরিজিন্যাল নেগেটিভগুলো রয়েছে, কোনো উপায়ে কেউ সেগুলোর খোঁজ পেলে তো আমি ফেঁসে যাব। তার ওপর সামনের মাসে দেশে ইলেকশন। গদি উলটে গেলে ড্যানিয়েল আর হেলথ মিনিস্টার থাকবে না, গদি না উলটোলেও থাকার চান্স কম, ওর পার্টি ইতিমধ্যেই ওর ওপর কড়া নজর রাখতে শুরু করেছে। ড্যানিয়েল ওই পোস্ট থেকে সরে গেলে আমার ছেলেগুলোও কিছু করতে পারবে না। তাই সামনের মাসের আগেই আমাদের যে করে হোক মেডিসিনটা অ্যাপ্লাই করতেই হবে সিগফ্রেড, নাহলে এতগুলো ছেলেকে ট্রেনিং দেওয়া, এত টাকার আর্মস, এতগুলো প্ল্যানমাফিক কাজ, এত ইনভেস্টমেন্ট, পুরো মিশনটাই জলে যাবে আমার।’
সিগফ্রেড বলতে গেল, ‘আমি আমার বেস্ট চেষ্টাটাই করছি।’ কিন্তু তার আগেই ওপাশের গলা আবার ধমকে উঠল, ‘নাহ, তোমাকে না ইনভলভ করলেই ভালো হত দেখছি ব্যাপারটায়। এত ভালো স্ট্র্যাটেজি ঠিক করলাম, ভেবেছিলাম শুধু ওদের সরাব, কিন্তু টেলিপ্যাথিকালি ঠিক এইসময়েই নেগেটিভগুলোরও খোঁজ মিলল, ভাবলাম এটা নির্ঘাত দাদুর আশীর্বাদ! ছোট থেকে দাদুর ডায়েরিতে যা পড়ে এসেছি, সেটা যে এইভাবে পাওয়া যাবে, ভাবতেই পারিনি। কিন্তু, শেষ মুহূর্তে এসে মনে হয় তোমার জন্য সব বানচাল হবে!’
সিগফ্রেড হতাশ হয়ে ফোনটা রাখল। লোকটাকে ঘৃণার থেকেও বেশি এখন ভয় করতে শুরু করেছে ওর। লোকটা তার দাদুর উপর দিয়ে যাচ্ছে। জার্মানির খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী যার কবজায়, সারা ইউরোপ জুড়ে যার এতই স্ট্রং নেটওয়ার্ক যে কোনো দেশেরই পুলিশ এতদিনে এতগুলো অ্যাটাকের কোনো হদিশ করতে পারছে না, সে না জানি আরও কত কী ভয়ংকর কাজ করতে পারে, বিশেষত সে যদি একটা সাংঘাতিক সাইকোপ্যাথ হয়।
তাও তো সিগফ্রেড এটা বলেনি যে ছবিগুলোই ওর কাছে নেই, বললে যে কি হত!
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেগুলোকে ফেরত পেতে হবে। একটা নিশ্বাস ফেলে কেমিস্ট্রির বইতে মনোনিবেশ করল ও। দু—দিন ধরে এইসব পড়ে কেঁচে গণ্ডূষ করতে হচ্ছে ওকে। মেয়েটা এত ধুরন্ধর আগে বোঝা যায়নি, একটু ক্যাজুয়ালি নিয়ে ফেলেছিল সিগফ্রেড, গল্প ফেঁদেছিল হালকাভাবে, কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, মাত্র একটু তাল কাটলেই বিপদ!
তখন আরেক উটকো ঝামেলা হাজির হবে।
ও জানতেও পারল না ওর কলটা কেটে দিয়েই ওপাশের অধৈর্য লোকটা আরেকজনকে ফোন লাগিয়েছে, ‘সিগফ্রেডের দিকে নজর রাখো, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে। জলদি রিপোর্ট চাই আমার। ছবিগুলো ওর কাছে আছে কি না কনফার্ম করো।’
১৫
পরের দিন প্রিয়ম অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল।
রুদ্র অনেকক্ষণ আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে আজ, প্রিয়ম ওঠার আগেই ও স্যান্ডউইচ আর কফি বানিয়ে ফেলেছে।
প্রিয়ম বেশ অবাক।
‘দারুণ হয়েছে কিন্তু স্যান্ডউইচটা! চিজ পেলে কোথা থেকে?’ একটা মস্ত কামড় বসিয়ে জিজ্ঞাসা করল প্রিয়ম।
রুদ্র বলল, ‘কাল ফেরার পথে কিনে এনেছি। পাশেই একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে না?’ বলে ও ট্রলি থেকে প্রিয়মের জন্য আনা কয়েকটা টি—শার্ট বের করল, ‘এই দ্যাখো, এই গুলো নিয়ে এসেছি তোমার জন্য, ক—দিন বেরই করা হয়নি।’
অবশেষে ঝোলা থেকে বিড়াল বেরিয়েছে! প্রিয়ম মনে মনে স্বগতোক্তি করল। বলল, ‘হুটহাট করে বেরিয়ে যেয়ো না। এইসব কান্ট্রিসাইডে অতটা সিকিউরিটি নেই, কোথায় কখন কী গণ্ডগোল হবে! পাসপোর্টটাকে সাবধানে রেখো। আর কোনো দরকার হলে জনকে ডেকো।’
কাল রাত থেকেই ভালো বৃষ্টি শুরু হয়েছে, বাইরে ত্রিভুজ আকৃতির কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে ক্রমাগত। রুদ্রর গতকাল রাতেও ভালো ঘুম হয়নি। সারাক্ষণ কী সব স্বপ্ন দেখে যাচ্ছিল, ও নিজে রানি এলিজাবেথের হাত থেকে প্রাইজ নিচ্ছে, ড শ্যুমাখার ওঁর রিমলেস চশমা পরে ছুটে আসছেন, চিৎকার করে কী সব বলছেন, আর লাল কালো বাইকগুলো জাপানি লোকটা ওঁকে আটকাচ্ছে।
ধুর! মাথায় যেন হাজার হাজার জট কিলবিল করছে!
প্রিয়ম বেরোনোর আগে ওকে একটা আলতো চুমু খেয়ে বলল, ‘আজকে কোথাও বেরিয়ো না, কেমন? আমি তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করব।’
রুদ্র মাথা হেলাল।
মাঝে মাঝে ওর খুব লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
আজ সারাদিন সত্যিই ও কোথাও বেরোবে না। বৃষ্টির দিনে ঘরে বসে জানলা নিয়ে বাইরেটা দেখতে যে কী ভালো লাগে! ও দরজাটা বন্ধ করে এসে প্রিয়মের ছোটো টেবিলটাকে টেনে এনে জানলার সামনে রাখল, তারপর ছবিগুলো নিয়ে বসল আয়েশ করে।
কালকের পর থেকে ড শ্যুমাখারের সঙ্গে আর কথা না হলেও ভদ্রলোক মেসেজ করেছেন বেশ কয়েকবার, প্রতিটাতেই ইঙ্গিতে লিখেছেন ফটোগুলো সাবধানে রাখতে, ওঁর ওপর যেকোনো মুহূর্তে অ্যাটাক হতে পারে, আর যদি ওরা জানতে পারে জিনিসটা ওঁর কাছে নয়, রয়েছে রুদ্রর কাছে, ওরা রুদ্রকেও ছাড়বে না, যেকোনো উপায়ে ওটা হস্তগত করার চেষ্টা করবে।
এই ওরা—টা—কারা?
ড শ্যুমাখারের কথা অনুযায়ী কোনো ফার্মা কোম্পানি বা ক্যান্সারের বিভিন্ন থেরাপি যারা সাপ্লাই করে তারা। তাদের এতটা নেটওয়ার্ক থাকবে যে কনস্ট্যান্ট ওঁকে ফলো করে যাবে বা রুদ্রকে?
ও প্রথমে আবার ছবিগুলো নিয়ে বসল, কিছুক্ষণ পর সেগুলোকে একপাশে রেখে ল্যাপটপ খুলল।
কয়েকটা খটকা মাছের কাঁটার মতো গলায় বিঁধে রয়েছে, সেগুলোকে আগে ঘোচাতে হবে।
প্রায় দেড়—দু ঘণ্টা ধরে ইন্টারনেটে অনেক কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করে ওর ঠিক স্বস্তি হল না। বাবাকে একবার ফোন করল, ‘বাবা, দুটো এইচ দেখলে তোমার কী মাথায় আসে প্রথমে?’
বাবা তো অবাক, ‘গিয়ে থেকে কোনো ফোন নেই তোর, প্রিয়মকে ফোন করে জানলাম যে ঠিকঠাক পৌঁছেছিস। আর এখন ফোন করে হঠাৎ দুটো এইচ কেন? কেমন লাগছে বল?’
রুদ্র বলল, ‘খুব ভালো লাগছে, কিন্তু বড্ড ঠান্ডা। এই এখন দুটো সোয়েটার গায়ে জড়িয়ে বসে আছি। তোমার তো ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রিও একটা পেপার ছিল মাস্টার্সে, বলো না, ডাবল এইচ ফ্রান্সের কোনো হিস্টোরিকাল লোগো কি?’
বাবা ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘ফ্রান্সের?’
প্রায় আধঘণ্টা বাবার সঙ্গে কথা বলে ও উঠে পড়ল।
মাথার মধ্যে কিলবিল করা জটগুলো এখন এদিক—ওদিক ছোটাছুটি করে আরও তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। খটকাগুলো তো দূর হলই না, উলটে বাবা আরও সব অদ্ভুত প্রসঙ্গ তুলে আরও ঘেঁটে দিলেন।
এর মধ্যে বৃষ্টি থেমে তো গেছেই, বরং হালকা রোদও দেখা দিয়েছে। ও ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। এখানকার একটা জিনিস দেখে বেশ হাসি পায়, রাস্তায় লোকজনের বালাই নেই, টুকটাক এদিক—ওদিক হয়তো কাউকে হনহন করে হাঁটতে দেখা যায়, চোখের পলক ফেলতে—না—ফেলতেই সাঁ সাঁ বেরিয়ে যায় গাড়ি, এদিকে রাস্তার দু—ধারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গাড়ি, যেন মানুষের থেকে এখানে গাড়ি বেশি। অথচ কোনো কান—ওষ্ঠাগত—করা হর্ন নেই, চিৎকার চেঁচামেচি কোলাহল কিচ্ছু নেই।
এখানকার মানুষ নিয়ম মেনেও চলে খুব।
এ ব্যাপারে কাল রাতে খেতে বসে প্রিয়ম একটা দামি কথা বলেছিল, ‘ইন্ডিয়াতে নিয়ম ভাঙাকে বেশিরভাগ মানুষ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়, ভাবে ধুর, অমুক মানছে না যখন আমিও মানব না। ফাইন করতে এলে না হয় তাতে কিছু ঘুষ দিয়ে দেব। আর এখানে রুলটাকে অ্যাকসেপ্ট করেই মানুষজন আনন্দ পায়, তাই এদের দেশ এত পরিষ্কার, এত উন্নত।’
হঠাৎ ও দেখল নীচের কার্নিশে কেমন সুন্দর একটা নাম—না—জানা পাখি এসে বসেছে। একটু আগের বৃষ্টিতে তার সারা গা ভেজা, একটুক্ষণ অন্তর একবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠছে সে, জলের ফোঁটা ঝরে পড়ছে ছোট্ট ছোট্ট পালকগুলো থেকে। কী পাখি এটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, যদিও রুদ্র এমনিতেও তেমন পাখি চেনে না, তবু চড়াইয়ের মতো ছোট্ট কমলা—নীল মেশানো উজ্জ্বল গাঢ় রঙের পাখিটাকে দেখে ভারি কৌতূহল হল ওর, হঠাৎ মনে হল একটা ছবি তুলে গুগলে ইমেজ সার্চ দিলেই তো জানা যেতে পারে পাখিটার নাম!
চট করে মোবাইলের ক্যামেরাটা অন করে রেলিং থেকে আলতো ঝুঁকল ও, আর ওর অতিরিক্ত উৎসাহের জন্যই হোক, কিংবা কোনো ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের অ্যালার্মে, পাখিটা ফুুৎ করে উড়ে গেল।
ঠিক তখনই নীচে দাঁড়িয়ে থাকা কালো লাল বাইকটা ওর চোখে পড়ল, এখান থেকে পিঁপড়ের সাইজের মনে হওয়া পাশে—দাঁড়িয়ে—থাকা সেই লোকটাকেও। এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হল ও এখন ফ্ল্যাটে একা, অমনি নিজের অজান্তেই ওর শিরদাঁড়া বেয়ে কেমন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
চোখ সরু করে রুদ্র দেখার চেষ্টা করল, লোকটা বিল্ডিং—এর একদম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বলে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তবে কারুর সঙ্গে কথা বলছে। ওই জন বলে সিকিউরিটি লোকটার সঙ্গে কি? পাশে সেই বিশাল বাইকটা একদিকে হেলে কেমন ক্লান্ত একটা জন্তুর মতো দাঁড়িয়ে আছে।
ও আরেকটু ঝুঁকেও কিছু দেখতে পেল না, তারপর হঠাৎ কী মনে পড়তে ঘর থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে এল।
বাইনোকুলারটা চোখে লাগাতেই পিঁপড়ের মতো লোকটা হঠাৎ কয়েক গুণ বড়ো হয়ে গেল, এখন বেশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, লোকটা জনের সঙ্গে কথা বলছে। সেদিন সন্ধের আলো—আঁধারিতে বা কালকের বাস থেকে দেখাতে ভালো বুঝতে পারেনি। আজ রুদ্র লক্ষ করল, লোকটা সাইজে ছোটোখাটো, কিন্তু দারুণ গাঁট্টাগোট্টা। একটা খাকি—রঙা প্যান্ট পরেছে, আর ওপরে নীল একটা উইন্ডচিটার। মঙ্গোলয়েড ধাঁচের হলদেটে ফর্সা লোহার মতো কঠিন মুখ, আর চোখ দুটো কমন রোবটের মতো ভাবলেশহীন, নির্দয়। রোদ পড়ে খয়েরি চুলটা চকচক করছে।
ওর বুকের ভেতরটা নিজের অজান্তেই কেমন দুলে উঠল। লোকটা কি জনের কাছে জানতে চাইছে রুদ্ররা কোন ফ্লোরে থাকে?
এই অ্যাপার্টমেন্টটা প্রিয়মদের কোম্পানি থেকে লিজে নেওয়া, আহামরি কিছু সিকিউরিটি নেই এখানে, নাম—কা—ওয়াস্তে ওই জন বলে সিকিউরিটি গার্ডটা থাকে, ওর প্রাথমিক কাজ হল কেউ এলে তার নাম—ঠিকানা একটা রেজিস্টারে নথিভুক্ত করা কিন্তু সে কতটুকু ঠিকমতো নিজের কাজ করে, তা রুদ্র জানে না। কাল যাওয়া বা ফেরা, কোনো সময়েই লোকটাকে ওর চেয়ারে দেখতে পায়নি।
জন কি ওকে আগে থেকেই চেনে? কিন্তু তা কী করে হবে? জন কেন ওকে চিনতে যাবে!
রুদ্র কি একবার প্রিয়মকে ফোন করবে?
ধুর, পরমুহূর্তেই ও মন বদলে ফেলল, প্রিয়ম অফিসে বসে কী করতে পারবে টেনশন ছাড়া?
বুকের ভেতরের শব্দ গুণোত্তর প্রগতিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল, তার মধ্যেই ও দূরবীনের অ্যাপারচারটা সর্বোচ্চ বাড়িয়ে দেখল, লোকটা এদিক—ওদিক একবার তাকিয়ে নিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য উপরের দিকে তাকাল, তারপর মাথা নেড়ে ঢুকে এল ওদের অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর।
রুদ্রর হঠাৎ মনে হল ওর হৃৎপিণ্ডটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল। লোকটা যে ওর কাছেই আসছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর আসছে ওই ফটোগুলোর খোঁজে। ড শ্যুমাখার প্রথমে ওকে দিতে চাননি ফটোগুলো, একরকম জোর করেই রুদ্র নিয়ে এসেছে, এরপর যদি ওর কাছ থেকে জিনিসটা খোয়া যায়, ও একেবারেই মুখ দেখাতে পারবে না। এই লোকটা সেদিন ড শ্যুমাখারের সঙ্গে ওদের কথোপকথনের সময় থেকে শুরু করে ক্যাবে ওদের পিছু নিয়ে এই অ্যাপার্টমেন্ট অবধি এসে সব দেখে গেছে।
ওই ফটোগুলোর জন্য এত?
ড শ্যুমাখারা তাহলে ঠিকই বলেছিলেন! এমন মানুষও আছে যারা শুধুমাত্র নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থের জন্য মানবজাতির এত বড়ো উপকার চায় না। আর যারা নিজেদের লাভের জন্য মানুষের মৃত্যু চায়, তারা যে প্রয়োজনে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
আলোর চেয়েও বেশি গতিতে রুদ্র চিন্তা করতে লাগল ওর এখন কী করা উচিত। ও কি ওয়েট করবে লোকটা এসে কী বলতে চায় সেটা শোনার জন্য? সেটা কি বড্ড রিস্ক হয়ে যাবে না?
যদি জোরজবরদস্তি করে ফটোগুলো হাতিয়ে নেয়? ড শ্যুমাখারের কাছে ও কী উত্তর দেবে?
না, ও মনস্থির করে ফেলল। লোকটা আসার আগেই ওকে এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। কেয়ারটেকারটা যদি বলেও দিয়ে থাকে যে রুদ্ররা এগারোতলায় থাকে, তাহলে লিফটে করে লোকটার আসতে সময় লাগবে বড়োজোর তিন থেকে চার মিনিট।
আচ্ছা, ও কি দরজা খুলবে না? না, সেটা কোনো সলিউশন নয়। দরজা ভেঙে ঢোকাটা এই ধরনের লোকেদের কাছে কোনো ব্যাপার নয়।
তবে? পুলিশে ফোন করবে?
কিন্তু ড শ্যুমাখার বারবার ব্যাপারটাকে গোপন রাখতে বলেছেন।
ও আর বেশি ভাবল না, চট করে একবার রান্নাঘরে গেল, তারপর ঘরের যে ট্র্যাকসুটটা পরে ছিল, তার ওপরেই একটা জ্যাকেট গলিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে লিফট লবিতে চলে এল। ট্র্যাকসুটের ভেতরের থার্মালে গুঁজে নিল পার্স আর ফটোর এনভেলপটা।
ফোনটা হাতে নিয়ে এই ঠান্ডাতেও ঘামতে ঘামতে ও দেখল এই অ্যাপার্টমেন্টের দুটো লিফটের একটা ধীরে ধীরে গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে উপরে ওঠা শুরু করেছে, এক …. দুই…. তিন। অন্য লিফটটা তেরোতলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওটাই সবচেয়ে উঁচু ফ্লোর, এবার ওটা নীচে নামবে। ও যদি লিফটের বোতাম টেপে, কোনটা আগে আসবে? যদি ওই লোকটার লিফটটাই নীচে থেকে আসে।
বোতাম টিপে রুদ্র অপেক্ষা করতে লাগল। উপরের লিফটটা নামতে শুরু করেছে, ওদিকে নীচেরটাও উঠছে পাঁচ, ছয়… সাতে। একবার ভাবল ও কি সিঁড়ি দিয়ে নেবে যাবে? কিন্তু বাঁ—পাশে তাকিয়ে দেখল সিঁড়ির দিকে যেতে গেলে এই করিডরে ওকে অনেকটা হেঁটে যেতে হবে, ততক্ষণে লোকটাকে নিয়ে নীচের লিফটটা এসে পড়বে, আর লোকটা করিডরে নেমে এদিকে তাকালেই ওকে দেখতে পেয়ে যাবে।
তেরোতলা এই বাড়িটার প্রতিটা ফ্লোরে তিনটে করে ফ্ল্যাট। হোটেলের কায়দায় তৈরি বলে একটু কোজি টাইপের। এমনি ঠিকঠাক হলেও লিফট দুটো যেন একটু বেশিই স্লো, প্রথম দিন এসেই খেয়াল করেছিল রুদ্র, প্রিয়মকে বলেওছিল কথাটা।
আজ সেটা আরও বেশি করে অনুভব করছিল রুদ্র। একেকটা সেকেন্ড যেন একেকটা ঘণ্টা মনে হচ্ছে।
অবশেষে নীচের লিফটা যখন দশ নম্বর ফ্লোর পেরিয়ে এগারোয় এসে পড়েছে, শুধু দরজাটা খুলতে বাকি, ঠিক তখনই উপর থেকে আসা লিফটটার দরজাটা খুলে গেল। রুদ্র এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ঢুকে পড়েই জিরো টিপল। কোথায় যাবে ও জানে না, তবে আপাতত এই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেরোতে হবে। জিনিসটা কোনোভাবেই খোয়া যেতে দেওয়া চলবে না।
কিন্তু শেষরক্ষা হল না পুরোপুরি। এই লিফটগুলো এত স্লো, ওর লিফটটার দরজা যখন বন্ধ হতে আর এক ইঞ্চিও ফাঁক নেই, ঠিক তখনই করিডরে বেরিয়ে ওকে দেখতে পেয়ে গেল লোকটা।
এবার লোকটাকে একদম স্পষ্ট দেখল রুদ্র। পিঠে একটা রুকস্যাক জাতীয় ব্যাগ, গায়ে নীল একটা উইন্ডচিটার আর খাকি প্যান্ট। ফর্সা মুখটা লম্বাটে গোছের, হালকা চাপ দাড়ি, ভাবলেশহীন যান্ত্রিক ছোটো ছোটো বাদামি রঙের চোখ। কালো মোটা ভ্রূ দুটো একে অপরের সঙ্গে জুড়ে থাকায় নিষ্ঠুরতা যেন একটু বেশি ফুটে উঠেছে সেখানে।
ওকে দেখেই লোকটার চোখগুলো বড়ো বড়ো হয়ে উঠলো, কিন্তু এই লিফটের দিকে এগিয়ে আসার আগেই দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।
লিফট নীচে নামতে শুরু করলেও রুদ্রর বুকের ভেতরের ঢিপঢিপ শব্দটা কমছিল না একটুও। কী করবে ও এখন? মাঝের কোনো ফ্লোরে নেমে পড়বে? হঠাৎ আরেকটা সম্ভাবনার কথা মনে হতেই ও চমকে উঠল। আচ্ছা লোকটার যদি মাথায় একটু বুদ্ধি থাকে, লিফটের চেয়ে বেশি গতিবেগে সিঁড়ি দিয়ে দু—তিন তলা নীচে নেমে গিয়ে সেই ফ্লোরে লিফটের বোতাম টিপলেই রুদ্রর লিফটের দরজাটা খুলে যাবে ওর সামনে। সেক্ষেত্রে?
রুদ্র মাথার দু—পাশটা আলতো টিপে ধরল। উত্তেজিত হলে হবে না, মাথা ঠান্ডা অবস্থায় ভাবতে হবে ওকে। নাহ, ড শ্যুমাখারের উদবেগটাকে ওর আরও সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত ছিল।
আপাতত লিফটটা থামার কোনো লক্ষণ নেই। একদম নীচে চলে যাওয়া ভালো। কোনোমতে কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়েই একটা ফোন করবে ও ড শ্যুমাখারকে। তারপর তেমন হলে ক্যাব নিয়ে ওঁর ক্লিনিকে চলে যাবে। প্রিয়মকেও বলবে অফিস থেকে ওখানে চলে আসতে। একসঙ্গে দুজনে ফিরবে এখানে, তখন নিশ্চয়ই …. রুদ্রর ভাবনায় হঠাৎ বাধা পড়ল।
আড়ষ্ঠভাবে ও দেখল আট নম্বর ফ্লোরে এসে লিফটটা থেমে গেল একটা আলগা ঝাঁকুনি দিয়ে। আর দরজাটা ধীরে ধীরে ফাঁক হওয়া শুরু করতেই ও বাইরের করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা নীল উইন্ডচিটার আর খাকি প্যান্টের লোকটাকে দেখতে পেয়ে গেল।
লোকটার একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে থাকা ঠান্ডা চাউনিতে ও কেমন যেন স্থবির হয়ে গেল।
লোকটা একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে থাকা ঠান্ডা চাউনিতে ও কেমন যেন স্থবির হয়ে গেল।
লোকটা সোজা লিফটের ভেতর এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়াল, তারপর একইরকম ভাবলেশহীন গলায় বলল, ‘আই নিড দোজ ফতোজ।’
রুদ্র লোকটার চোখে চোখ রেখে নির্বিকারভাবে বলল, ‘হুইচ ফটোজ?’
লোকটা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘ইউ নো। দোজ ওল্ড আইস ফতোজ।’
রুদ্র কয়েক মাইক্রোসেকেন্ডের জন্য চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর জিনসের পকেটে হাত ঢোকাল।
লিফট প্রায় গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে গেছে।
লোকটা সেইরকম পাথরের মতো চোখে এদিকে তাকিয়ে আছে।
রুদ্র পকেট থেকে খবরের কাগজ মোড়ানো চিলি পাউডারটা বের করল, তারপর বিদ্যুৎগতিতে বাঁ—হাতে কিছুটা লঙ্কাগুড়ো নিয়েই একটু ঝুঁকে সোজা ছুড়ে দিল লোকটার চোখে, লোকটা প্রথমে ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল, তারপর চাপা একটা আর্তনাদ করে ছিটকে পড়ল লিফটের এক কোণে।
লিফটের দরজা খোলামাত্র তিরবেগে ও ছুটে বেরিয়ে এল লিফট থেকে, ছুটতে ছুটতে গ্যারাজ পেরিয়ে কেয়ারটেকার লোকটাকে দেখতে পেয়েই যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবে পকেটে হাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে পড়ল।
এই কয়েক মিনিটের মধ্যে এর থেকে ভালো আর কী অস্ত্র জোগাড় করতে পারত ও? ক্রেডিটটা অবশ্য প্রিয়মেরই প্রাপ্য, এত সুন্দরভাবে সব গুছিলে রাখে রান্নাঘরে!
উত্তেজনায় ওর ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে, চোখ—মুখ লাল হয়ে গেছে।
বাসের জানলা দিয়ে ওদের কমপ্লেক্সের এন্ট্রান্সটা দেখা যাচ্ছে। বাস স্টার্ট দেওয়ার আগের মুহূর্তে ও দেখল ওই জাপানি লোকটা কেমন টলতে টলতে বেরিয়ে আসছে, চোখে রুমাল, কিন্তু প্রাণপণ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। কোনোমতে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ওর বিশাল বাইকটার কাছে যেতে যেতেই রুদ্রর বাস পেরিয়ে এল জায়গাটা।
রুদ্র নড়েচড়ে বসল। আশা করা যেতে পারে কেয়ারটেকারটা কিছু বুঝতে পারেনি। এই জাপানি লোকটাও চিৎকার করে ওঠেনি তেমন জোরে, সেটাও ও এক্সপেক্ট করেছিল যে লঙ্কার গুঁড়ো চোখে পড়ে জ্বলে খাক হয়ে গেলেও লোকটা নিজের অস্তিত্ব খুব একটা কাউকে জানাতে চাইবে না।
রুদ্র খুব সাবধানে পকেট থেকে খবরের কাগজের টুকরোটা বের করে যেটুকু লঙ্কাগুঁড়ো অবশিষ্ট ছিল, সেটা আস্তে আস্তে ঝেড়ে ফেলতে লাগল।
কী কাণ্ড! এরকম কী—একটা হিন্দি সিনেমা দেখেছিল না, অনেককাল আগে?
এত উত্তেজনার মধ্যেও হাসি পেয়ে গেল ওর। চোখটা বন্ধ করে নিল, হাওয়ায় যদি উড়ে আসে!
খবরের কাগজটা মোটামুটি পরিষ্কার করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ড শ্যুমাখারের নম্বর টিপল ও, আর তখনই হঠাৎ লোকটার বলা কথাগুলো ওর মনে পড়ে গেল।
আইস ফটো মানে কী? বরফের ফটো?
১৬
জুলাই, ১৯৩৩,
অ্যাডলফ অস্থিরভাবে তাঁর রাজকীয় প্রাসাদের দোতলার ব্যালকনিতে পায়চারি করছিলেন। সূর্য পশ্চিমদিকে ঢলে পড়েছে প্রায়, তবু তার হালকা লাল আভা ছড়িয়ে আছে সারা আকাশে। পাখিরা সারাদিনের কাজের শেষে একে একে ফিরছে তাদের বাসায়।
জুলাই মাসের শেষাশেষি। জার্মানিতে এখন সুন্দর আবহাওয়া। ঠান্ডা থাকলেও তা আরামদায়ক।
তাঁর গায়ে এখন পুরোদস্তুর সামরিক পোশাক। মাথায় খাকি মেরুন টুপি, বর্ডারটা অবশ্য সোনালি রঙে বোনা, গায়ে খাকি ওভারকোট, কোমরে বেল্ট, পায়ে হাঁটু পর্যন্ত গামবুট। এমনিতে চ্যান্সেলর হিসেবে তাঁর পোশাক যথেষ্ট অনাড়ম্বর, তবে বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মান সৈন্য হিসেবে লড়াই করে পুরস্কার স্বরূপ যে আয়রন ক্রসটা পেয়েছিলেন সেটা তিনি কখনো পরতে ভোলেন না। ওটা তাঁকে শুধু গর্বিতই করে না, মনে শক্তিও জোগায়।
আনমনে তিনি তাঁর মোটা অথচ চৌকো গোঁফটায় তা দিলেন।
পার্টির মুখ হিসেবে যখন সবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছিলেন তখন একজনের পরামর্শে নিজের একটা আলাদা পরিচিতি করার জন্য এই গোঁফটা রাখতে শুরু করেছিলেন তিনি। সেই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়নি। সারা পৃথিবীর চোখ এখন এই চৌকো গোঁফের দিকে। কেউ তাঁকে ভয় পায়, কেউ করে ঘৃণা।
কিন্তু তাঁকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা কারুর নেই।
রেলিং—এ ভর দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আডলফ ভাবলেন চ্যান্সেলর হিসেবে তাঁর বেশ কয়েক মাস পূর্ণ হতে চলেছে। নিন্দুকেরা যে যাই বলুক, এখনও অবধি বিশ্বযুদ্ধের পরের সেই লাঞ্ছিত পরাজিত জার্মানিকে তিনি অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অর্থনীতির অবস্থা বেশ ভালো হয়েছে, বেকারত্বও কমেছে এক লাফে অনেকটা। বিশ্বযুদ্ধের সেই অপমানজনক পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তাঁর জার্মানি এখন অনেকটাই সক্ষম।
শুধু তার আগে ছাঁকনিতে ছেঁকে নিতে হবে গোটা দেশটাকে। জার্মানরা হল বিশুদ্ধ আর্য জাতির বংশধর, তাদের মধ্যে হাবিজাবি রক্ত এসে মেশাটা বন্ধ করতে হবে চিরতরে।
ক্ষমতায় আসার আগে যখন তিনি জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির মামুলি একজন বক্তা ছিলেন, তখন ইহুদিদের তাড়ানো নিয়ে অনেক রক্তগরম করা বক্তৃতা দিতেন। বলতে গেলে ওই বলার গুণেই রাতারাতি পরিচিত হয়েছিলেন তিনি। তখন তাঁর বক্তৃতা শুনে কেউ বাহবা দিত, কেউ আবার তিরস্কার করত। সেই পার্টিকে নাম পালটে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি, বা সংক্ষেপে নাতসি পার্টি করেছিলেন তিনিই।
কিন্তু তারপরের ওই ন—টা মাস রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে ল্যান্ডসবার্গের জেলে কাটানো সময়টুকুতে যখন এসব ছেড়ে আত্মজীবনী লেখা নিয়ে মেতে উঠেছিলেন, তখন অন্তত তিনি এইটুকু বুঝেছিলেন যে আর যাই হোক, কোনো দেশের শাসক দল হিসেবে ক্ষমতায় আসতে গেলে এই সমস্ত কথা বলে অপ্রিয়ভাজন হওয়ার চেয়ে আগে আমজনতা যা শুনতে চায় তাই বলো, পরে ক্ষমতায় এসে যা করবার করো।
আর সেটাই করতে চলেছেন তিনি এখন। জার্মানির দেশপ্রধান পদটার নাম চ্যান্সেলর। এ ছাড়াও প্রেসিডেন্ট থাকেন একজন। চ্যান্সেলর তো অ্যাডলফ হয়ে গেছেন, এখন শুধু অপেক্ষা বুড়ো প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের মরার, ইতিমধ্যেই মৃত্যুশয্যায় সে, মরলেই ওই পদটারও অবসান ঘটাবেন অ্যাডলফ, নিজেই দুটো দায়িত্ব মাথায় নিয়ে একচ্ছত্র অধিপতি ‘ফুয়েরার’ হবেন জার্মানির।
অ্যাডলফ হিটলারের বিরুদ্ধে কোনো দল থাকবে না, অ্যাডলফ হিটলারের বিরুদ্ধাচরণ করা কোনো মানুষকে জার্মানির নিশ্বাস নিতে দেবেন না তিনি।
ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে বড়ো ছোটো সমস্ত পার্টিকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন অ্যাডলফ। কম্যুনিস্ট পার্টি, সোশ্যালিস্ট পার্টি, এমনকী ট্রেড ইউনিয়নও ব্যানড। কথায় কথায় ধর্মঘট করা অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল ওই সব দলগুলোর। প্রোডাকশনের ক্ষতি ছাড়া ধর্মঘটে কিছুই হয় না, অতএব ধর্মঘট করাও এখন বেআইনি। দেশের ভেতরের রাজ্যগুলোর যে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ছিল, সেই অটোনমি দেওয়ারও আর প্রয়োজন মনে করেননি অ্যাডলফ, অটোনমি দেওয়া মানেই আজ যে প্রজা কাল সে রাজা হয়ে উঠবে, কী দরকার! প্রতিটা রাজ্যে নাতসি নেতাদের গভর্নর করে দেওয়া হয়েছে।
জার্মানির মাটিতে দাঁড়িয়ে যে অ্যাডলফ হিটলারকে সমালোচনা করবে, তার আয়ু আর বড়োজোর চব্বিশ ঘণ্টা স্থায়ী হবে। আর জার্মানির বাইরে? তাদের জন্য তো মাস্টার প্ল্যান আসছেই শিগগিরই। জার্মানির সেনাবাহিনীকে এমনভাবে তৈরি করছেন তিনি, যুদ্ধ শুরু হলে অন্য দেশগুলো যেন লড়া তো দূর, সামনে দাঁড়াতে না পারে। মেথামফেটামাইন ড্রাগটা গোটা আর্মিকে খাইয়ে তাদের থেকে অতিমানবীয় পারফর্ম্যান্স আদায় করবেন তিনি। এই ব্যাপারে ড মরেলের সঙ্গে আলোচনাও সেরে রেখেছেন। যুদ্ধ শুরু করার আগে সব দিক নিপুণভাবে রেডি রাখতে চান অ্যাডলফ, যাতে যুদ্ধের মাঝে দিশেহারা না হয়ে পড়তে হয়। ওই পারভিটিন স্টিম্যুল্যান্টটাও লক্ষ লক্ষ পরিমাণে সাপ্লাই করতে হবে আর্মি শিবিরগুলোয়।
হোক সেটা শরীরের জন্য ক্ষতিকারক, দেশকে সবার উপরে নিয়ে যাবে তারা, প্রতিশোধ নেবে দেশের অপমানের, তবেই না তারা দেশপ্রেমিক?
দেশের জন্য এইটুকু করতে পারবে না?
মোটামুটি পরিকল্পনা সেরে নিয়েছেন অ্যাডলফ। পোল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া সব একে একে শেষ করবেন তিনি। ওদিকে চেক, হাঙ্গেরিগুলো তো সোজা টার্গেট, রাশিয়ার মস্কো শহরটাকে গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে একটা সুন্দর লেকে পরিণত করার ইচ্ছে বহুদিন ধরে মনে মনে পোষণ করছেন তিনি।
তবে কিনা পৃথিবীর ব্যস্ততম মানুষেরও কখনো কখনো মনে রোম্যান্স জেগে ওঠে। তেমনি গোধূলি আলোর এই পড়ন্ত বিকেলের আকাশ দেখতে দেখতে অ্যাডলফের বহুদিন বাদে গেলির কথা মনে পড়ে গেল। সেই ফুলের মতো নিষ্পাপ, শিশুর মতো উচ্ছল গেলি, যে মাত্র তেইশ বছরে শেষ করে দিয়েছিলো জীবনটা!
তখন অ্যাডলফ বোঝেননি, নিষ্ফল আক্রোশে নিজের মুঠোর মধ্যে রাখতে চেয়েছিলেন সবসময় গেলিকে, রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেও গেলিকে নিজের কাছে রেখে অদ্ভুত এক শান্তি পেতেন। মনে করেছিলেন গেলি সম্পূর্ণ তাঁর, একমাত্র তাঁর। মামা হয়ে তাঁর এমন আচরণ দেখে লোকে কত কথা বলেছে, দিদি অ্যাঞ্জেলা পর্যন্ত গেলি চলে যাওয়ার পর ওঁকে ক্ষমা করতে পারেনি অ্যাডলফ জানেন।
তবু আজ এতদিন বাদে এসে তিনি বোঝেন, গেলিকে তিনি সত্যিই ভালোবেসেছিলেন।
হয়তো একমাত্র গেলিকেই তিনি ভালোবাসতেন!
তবে সবার তো ভালোবাসার ভাষা সমান হয় না।
ইভার ডাকে হঠাৎ চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল ওঁর, ‘অ্যাডি, ভিক্টর ব্র্যাক এসেছে। বসতে বলেছি।’
মুহূর্তে বর্তমানে ফিরে এলেন অ্যাডলফ। আজ একটা অত্যন্ত বড়ো সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন তিনি, যার জন্য হয়তো প্রচুর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে ওঁকে। বিশেষত ওই ‘স্ট্রেট পাথ’ কাগজের এডিটরটার। সম্মুখীন হতে হবে হাজারো ভ্রূকুটির।
ওই ফ্রিৎজ গার্লিককে চরম শাস্তি না দিয়ে শান্তি নেই, একদম গোড়া থেকে উঠে—পড়ে লেগেছে ওঁর ভাবমূর্তি নষ্ট করতে। শয়তানটার কথা ভাবলেই মাথায় রক্ত উঠে যায় অ্যাডলফের। কাগজটা নিষিদ্ধ হয়েও থামেনি, বেনামে একের পর এক কাগজে অ্যাডলফের নামে কুৎসা লিখে যাচ্ছে সে, অ্যাডলফ কি কিছুই খবর রাখেন না নাকি!
ক্ষমতায় আসার মাসখানেকের মধ্যেই গ্রেপ্তার করেও ফেলেছিলেন ওই নরকের পোকাটাকে, কিন্তু জোরদার প্রমাণাভাবে গয়েবেল বলল আপাতত ছেড়ে দিতে।
জোসেফ গয়েবেল পাবলিক এনলাইটমেন্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা ডিপার্টমেন্টের মন্ত্রী। পদমর্যাদায় ওর ওপরে আরো দু—তিনজন মন্ত্রী থাকলেও দূরদর্শিতার জন্য অ্যাডলফ ওর কথায় বেশ গুরুত্ব দেন। গয়েবেল যখন বলছে এভাবে ফ্রিৎজকে ধরে রাখলে জনতা খেপে যেতে পারে, তখন সেটা না করাই ভালো, ভেবেছিলেন অ্যাডলফ।
তবে তিনি নিজে বিশ্বাস করেন শত্রুর শেষ রাখতে নেই।
বেশিদিন ফেলে রাখলেই আবার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে প্ল্যানটা পুরো গুছিয়ে নিলেন অ্যাডলফ। আজকের সিদ্ধান্তটার সমালোচনা হয় হোক, কিন্তু দেশপ্রধান হিসেবে তিনি যা করতে চলেছেন, ইতিহাস ওঁকে মনে রাখবে চিরকাল। সারা পৃথিবীর মধ্যে জার্মান জাতিকে বুদ্ধিতে, বীরত্বে, মননে শ্রেষ্ঠ করে তুলবেন তিনি, জার্মান জাতিকে পৃথিবীর সর্বোত্তম জাতিতে পরিণত করবেন। প্রতিটা জার্মান হবে সুপারম্যান।
আর সেটা অনন্তকালের জন্য!
শান্ত লয়ে তিনি কনফারেন্স রুমে এসে ঢুকলেন। জার্মানির দেশনায়ক হিসেবে যথেষ্ট অনাড়ম্বর তাঁর জীবন, উচ্ছৃঙ্খলতা তাঁর পছন্দ নয় কোনোকালেই। এমনিতেই তাঁর পেটের অবস্থা ভালো নয়, সারাদিন অসংখ্য ওষুধের ওপর থাকতে হয় তাঁকে, তার ওপর অত্যধিক পরিশ্রমে শরীর ভেঙে পড়ছে দিন দিন।
তবু বিশ্রাম নিতে তিনি নারাজ।
ভিক্টর বসে ছিল, অ্যাডলফকে ঢুকতে দেখে শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাত সামনে উঁচু করে তুলে ধরে মস্ত একটা অভিবাদন ঠুকল, ‘হেইল হিটলার!’
সে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার চ্যান্সেলরের বাসভবনে এল। প্রথমবার তো খুব উত্তেজিত ছিল, তার মতো একজন সাধারণ পার্টি ওয়ার্কারকে স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান ডেকে পাঠানোয়। ভয়ও পেয়েছিল।
কিন্তু পরে বুঝেছিল সে অ্যাডলফের বেশ নেকনজরে পড়ে গিয়েছে।
অ্যাডলফ কিছু না বলে ইঙ্গিতে বসতে বললেন, ‘ভিক্টর, কিছু এগোল?’
ভিক্টর বিনীতভাবে বলল, ‘আজ্ঞে গ্যালটন মারা গেছেন তাও বাইশ বছর হয়ে গেল। ওঁর অনেক দিকে গবেষণা ছিল, ওঁর বিভিন্ন ছাত্র বিভিন্ন ফিল্ডে ছড়িয়ে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে বেশ বিখ্যাত। তাই কী ব্যাপারে না বললে…!’
অ্যাডলফ চুপ করে গেলেন। এই ভিক্টর ব্র্যাক বিশ্বস্ত বলেই মনে হয়, অনেক ভেবেচিন্তেই এই কাজের জন্য ওকে বেছেছেন তিনি তবে কথায় বলে দেওয়ালেরও কান আছে। আর এইসব ব্যাপারে তো কাউকে বিন্দুমাত্র টের পাওয়ানো চলবে না। এইজন্যই তিনি মন্ত্রীসভার পোড় খাওয়া হোমরাচোমরাদের কাউকে ডাকেননি। এমনকী হিমলার, গয়েবেল, গোরিং, পার্টির বড়ো বড়ো নেতাদেরও ইনভলভ করেননি।
অ্যাডলফ কাজে বিশ্বাসী। কাজটা মিটে যাক, একদম আইন পাশ হবে, ইমপ্লিমেন্টেশন শুরু হবে, তারপর মানুষ জানবে।
ফ্র্যান্সিস গ্যালটনের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে হবে, শুধু এমনটাই প্রাথমিক আলাপে ছেলেটাকে বলেছিলেন অ্যাডলফ।
এই ফ্র্যান্সিস গ্যালটনের সম্পর্কে অ্যাডলফ প্রথম জানতে পারেন ল্যান্ডসবার্গের জেলে বসে। ভদ্রলোকের লেখা একটা বই পড়ে এতটাই চমৎকৃত হয়ে গিয়েছিলেন যে সাময়িক পার্টির প্রতি বিরাগটা কাটিয়ে তাঁর ইচ্ছে হয়েছিল এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়েন কর্মকাণ্ডে। অসম্ভব ট্যালেন্টেড ছিলেন ওই বৈজ্ঞানিক, কিন্তু এতটাই অস্থিরমতি যে কোনো গবেষণাই তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেননি।
ওঁর লেখা বই পড়েই অ্যাডলফ প্রথম জানতে পারেন কেন একটা জাতিকে শুদ্ধ করা ভীষণভাবে প্রয়োজন। ওর ওই বই পড়েই বর্তমান জার্মানির দুরবস্থার কারণ প্রথম অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তিনি।
তিনি নিজেই আস্তে আস্তে উপলব্ধি করেছেন, বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির শোচনীয় হার, তারপরের এই অরাজকতা এগুলোর সব কিছুর পেছনে আসল এবং অন্যতম কারণ হল প্রচুর আজেবাজে জাতির বাজে রক্ত এসে জার্মান জাতিতে মিশে যাওয়া। জার্মান মানুষেরা হল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আর্য জাতির বংশধর। আদিম যুগে আর্যজাতি সেন্ট্রাল ইউরোপ থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর নানা প্রান্তে। তাদের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উত্তরপুরুষ হল সুইডেন আর নরওয়ে অঞ্চলের নর্ডিক জাতির মানুষেরা। প্রকৃত জার্মানরা হল এই আর্য—নর্ডিক সংমিশ্রণের সার্থক রূপ। এই যে জার্মানদের সোনালি চুল, সুঠাম চেহারা, শক্ত, ঋজু গড়ন, অসীম দৈহিক শক্তি এইগুলো কি তারই ইঙ্গিত দেয় না?
গার্ডটি চলে যেতেই অ্যাডলফ উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। যদিও ইতিমধ্যে বারপাঁচেক তাঁর উপর হত্যার চেষ্টা হয়ে গেছে, তবু সবসময় পাহারা দেওয়াটা একেবারেই না পসন্দ তাঁর।
‘শোনো ভিক্টর, তুমি খুব ভালো করে বুঝে নাও আমি কী চাইছি। আগের দিন তো তোমায় কিছুটা বলেছি, একটা দেশ। একটা জাতি তখনই দুর্বল, ভঙ্গুর হয়ে পড়ে যখন তার ভেতরে প্রচুর অন্য রক্ত এসে মেশে, আর সেই জাতিটাকে বাঁচাতে গেলে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন শুদ্ধিকরণ। সেইজন্যই ফ্র্যান্সিস গ্যালটনকে আমাদের প্রয়োজন, কারণ তিনি ইউজেনিক্সের কথা বলে গেছেন।’
ভিক্টর চুপ করে শুনছিল। সে কাজপাগল মানুষ, চ্যান্সেলর যা বলবেন সেটা তার কাছে শিরোধার্য। বিশেষত এই মিশনটার জন্য যখন তাকেই পছন্দ করেছেন অ্যাডলফ, এই একটা সাফল্যই ওর কেরিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।
চ্যান্সেলর বলতে লাগলেন, ‘পৃথিবীর জনসংখ্যা সাংঘাতিক হারে বাড়ছে। সেখানে জার্মান জাতিকে সবার উপরে নিয়ে যেতে গেলে প্রয়োজন আমাদের জিনটাকে উন্নত করা। আর খারাপ জিনগুলোকে ছুড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া। আর তার জন্য দরকার সিলেক্টিভ ব্রিডিং। যে কেউ নিজে রোগের ডিপো হয়ে যাকে তাকে বিয়ে করল, ছেলেমেয়ে হয়ে গেল, এরকম আর চলবে না। এরকম ভালোখারাপ জিনমেশানো মানুষদের জন্য আমার সরকার আর পয়সা খরচ করবে না।’ নিশ্বাস নেওয়ার জন্য একমুহূর্ত থামলেন অ্যাডলফ, ‘আর এটা কিন্তু নতুন নয়। তুমি কি জানো প্রাচীন যুগে গ্রিসের স্পার্টাতে কোনো বিকলাঙ্গ শিশু জন্মালেই তাকে ওখানকার টেগেটাস পাহাড়ের উপর থেকে আছড়ে ফেলে মেরে ফেলা হত?’
ভিক্টর এবার চমকে উঠল, ‘অ্যাঁ! জ্যান্ত বাচ্চাকে?’
অ্যাডলফ মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘ইয়েস! স্পার্টাতে কোনো বাচ্চা জন্মালেই তাকে মদে চুবিয়ে কিংবা খোলা হাওয়ার মধ্যে রেখে দিয়ে পরীক্ষা করা হত সে কতটা শক্তিশালী, ভবিষ্যতে বিভিন্ন স্ট্রাগলের সঙ্গে লড়াই করে সে যুঝতে পারবে কি না। না পারলে মরো, পারলে থাকো। আর এইজন্যই সে সময় বীরত্বে, শ্রেষ্ঠত্বে কেউ স্পার্টার সমকক্ষ হতে পারেনি। কারণ ওদের রাজ্যে দুর্বল অসুস্থ মানুষের কোনো স্থানই ছিল না। যাদের দেশকে কিছু দেওয়ার ক্ষমতা নেই, তাদের বাঁচিয়েই রাখা হত না। এইজন্য তারা ইউজেনিয়া বলে এক দেবীর আরাধনাও করত, শুধু শক্তিশালী সুস্থ শিশুই বেঁচে থাকতে পারতো ওই দেশে।’
ভিক্টর একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আর বাচ্চাগুলোর বাবা মা? তারা কিছু বলত না?’
অ্যাডলফ এবার একটু বিরক্ত হলেন, ‘একটা রাষ্ট্রকে সর্বশ্রেষ্ঠ করতে গেলে বাবা মা, স্বামী—স্ত্রী, এইসব ইমোশনের দাম দিলে হয় না ভিক্টর! স্বয়ং প্লেটো বলে গেছেন কোনো দেশকে উন্নত করতে হলে ইউজেনিক্স প্রয়োগ করতেই হবে। অর্থাৎ ভালো জিনগুলোকে প্রোমোট করো, আর খারাপ জিনগুলোকে জাস্ট হাপিশ করে দাও।’ তারপর দুটো হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললেন, ‘আমিও সেটাই চাই। আমি চাই জার্মানিতে প্রতিটা মানুষ সবদিক থেকে শ্রেষ্ঠ হোক, কোনো দুর্বলের স্থান নেই এখানে। আর এই ব্যাপারে আমি তিনটে অ্যাজেন্ডা ঠিক করেছি।’
ভিক্টর এবার উৎসুক চোখে চাইল।
অ্যাডলফ থুতনিকে দুটো আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, ‘ইউথেনাশিয়া, ম্যারেজ মনিটরিং আর সবশেষে ইউজেনিক্স!’
ভিক্টর বলল, ‘মানে?’
হিটলার বলে চললেন, ‘এক, সারা জার্মানিতে হাজার হাজার হসপিটল বা মেন্টাল অ্যাসাইলামে লক্ষ লক্ষ মানুষ পড়ে আছে, যারা কোনোদিনও সুস্থ হবে না। যারা শেষদিন অবধি একইরকমভাবে বোবা কালা, পাগল বা যেকোনোরকম প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে থাকবে। কেউ পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে রয়েছে, কেউ সমকামের মতো বিকৃতিতে আসক্ত। আবার কয়েকশো আসামি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে জেলে রয়েছে। এরা দেশকে কিছু দিতে পারবে?’ চেঁচিয়ে উঠলেন অ্যাডলফ, ‘কিচ্ছু না! তাই তাদের পেছনে আমার সরকার অর্থ বা সময় কিছুই আর নষ্ট করবে না। তাদের প্রত্যেককে মেরে ফেলা হবে। একেকটা লিস্ট তৈরি করে, একসঙ্গে অনেকজনকে নিয়ে সুন্দরভাবে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে তাদের। এটাকেই বলে ইউথেনাশিয়া বা মার্সি কিলিং।’
ভিক্টর আবার চমকে উঠল। অ্যাডলফ ভোটে জেতার পর এমন একটা গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল বটে, কিন্তু তারপর আর কিছু না হতে ভেবেছিল গুজব।
অ্যাডলফ বলতে লাগলেন, ‘দুই জার্মানির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে যাতে কোনো শারীরিক বা মানসিক বিকৃতি না আসে, সেইজন্য মানুষকে তার বংশগত কী কী রোগ আছে তা রেজিস্টার করে রাখতে হবে। আর এইজন্য আমি নতুন আইন আনব। স্বাস্থ্য আদালত তৈরি হবে, কেউ বিয়ে করতে চাইলে স্বাস্থ্য আদালতে অ্যাপ্লাই করতে হবে, তাদের দুজনের স্বাস্থ্য, বংশ সব খতিয়ে দেখে তবেই বিয়ের জন্য অনুমতি দেওয়া হবে।’
ভিক্টর এবার মুখ খুলল, ‘বিয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা! মানবে মানুষ?’
অ্যাডলফ তাঁর চৌকো গোঁফটা তা দিতে দিতে একটু অবাক হওয়ার ভান করে একটা ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন, ‘আমার দেশে মানুষ আইন মানে না ভিক্টর, আমি মানতে বাধ্য করি। এটা তুমি জানো বোধ হয়! আর এটা তো ভবিষ্যতের কথা ভাবলে তাদের ভালোর জন্যই! অসুস্থ বিকৃত প্রতিবন্ধী জীবনের কোনো মানে আছে?’
ভিক্টর আবার চুপ করে গেল। বিড়বিড় করে বলল, ‘কোনো রোগের রেকর্ড না থাকা দুজন সুস্থ মানুষ বিয়ে করলেই যে তাদের সন্তানও সুস্থ হবে এরকম কোনো গ্যারান্টি তো…!
অ্যাডলফ মাথা নাড়লেন, ‘গ্যারান্টি নেই ঠিকই, কিন্তু বিকলাঙ্গ হবার সম্ভাবনা তো অনেকটাই কমে যাবে, না? এমনকী এই নিয়ে প্লেটো একটা উপায়ও বলে গিয়েছিলেন, প্রত্যেককে পরীক্ষা করা হবে, যাদের জিন খারাপ, রোগগ্রস্ত, তাদের বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। শুধু গুড জিনের কাপলদেরই বিয়ের পারমিট দেওয়া হবে।’
ভিক্টর বলল, ‘তিন নম্বর?’
অ্যাডলফ বললেন, ‘তিন নম্বর হল, আমি পুরো জার্মান জাতির ওপর ফ্র্যান্সিস গ্যালটনের ইউজেনিক্স অ্যাপ্লাই করব। জার্মান সেনারা কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে ক্লান্ত হবে না, জার্মান শিশুরা সব দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠবে, পায়ের তলায় রাখবে সারা বিশ্বকে। প্রতিটা জার্মান হবে গ্রিক দেবতাদের মতো সুন্দর, লিওনার্দোর মতো সৃজনশীল, আলেকজান্ডারের মতো সাহসী বীর আর,’ একটু থামলেন তিনি, ‘আমার মতো বুদ্ধিমান। কোনো খারাপ জিন তাদের শরীরে থাকবে না, এমনভাবেই তাদের তৈরি করা হবে।’
ভিক্টর এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না, ‘কী বলছেন স্যার! এসব তো রূপকথাতে হয় জানি। এরকমভাবে তৈরিটা করবেন কী করে! এ যে খোদার ওপর খোদকারি!’
অ্যাডলফ স্থির চোখে তাকালেন, ‘আমার কথা এখনও শেষ হয়নি ভিক্টর। গ্যালটন অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন মানুষ ছিলেন, কিন্তু এতটাই চঞ্চলমতি ছিলেন যে কোনো কাজেই বেশিদিন লেগে থাকেননি। উনি এমন কোনো ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন যা মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে এটা করা সম্ভব আর পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষেত্রেও সেটা অ্যাপ্লিকেবল হবে। ওঁর ডায়েরিতে এমনই লিখে গেছেন উনি, আমি নিজে পড়েছি। সেটা আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে ভিক্টর। ভেবে দ্যাখো, এভাবে আমরা জার্মান জাতিকে কোথায় নিয়ে চলে যাব। আর তারপর ভার্সাইয়ের অপমানের বদলা, বিশ্বযুদ্ধের প্রতিশোধ সব একে একে নেব আমি।’ উত্তেজনায় চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে গেছে অ্যাডলফের, ‘আর হ্যাঁ। তার সঙ্গে সঙ্গেই চলবে জেনোসাইড, ইহুদিদের পুরো লুপ্ত করে দেওয়ার প্রসেস। ব্যাটারা বহু বছর ধরে আমাদের জায়গায় এসে আমাদেরকেই সব জায়গা থেকে বঞ্চিত করেছে। শালা রিফিউজির দল! বড়ো বড়ো গ্যাস চেম্বার তৈরি কর, তাতে যতগুলোকে পারো, একসঙ্গে ঢুকিয়ে লেথাল গ্যাস ছেড়ে দাও। ব্যস! খরচও কম হবে, ঝামেলাও নেই।’
ভিক্টরের মুখে বাক্যস্ফূর্তি হচ্ছিল না। ও অপলক তাকিয়ে রইল চ্যান্সেলরের দিকে। ধবধবে সাদা হাতির দাঁতের কাজ করা সিংহাসনের মতো রাজকীয় চেয়ারে বসে তার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রয়েছেন অ্যাডলফ হিটলার, জার্মানির বিখ্যাত দেশপ্রধান।
অ্যাডলফ বললেন, ‘আর হ্যাঁ, আগেই বলেছি, গ্যালটন ইংল্যান্ডের লোক ছিল। বার্মিংহামে বাড়ি। শত্রু দেশ, কাজেই সতর্ক হয়ে এগোতে হবে তোমায়। টাকার চিন্তা কোরো না, যত টাকা ইনভেস্ট করতে হয়, করব আমি। কিন্তু গোপনীয়তা রক্ষা করবে।’
ভিক্টর এবার হাতে ধরে রাখা টুপিটা মাথায় পরে নিয়ে উঠে দাঁড়াল, মাননীয় চ্যান্সেলরকে একটা স্যালুট ঠুকল, বলল, ‘বাকিটা আমার উপর ছেড়ে দিন স্যার। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই জানাচ্ছি আপনাকে।’
অ্যাডলফও উঠে দাঁড়ালেন। ভিক্টর ছেলেটার সম্পর্কে পুরো ডেটা আছে ওঁর কাছে। অর্থনীতি নিয়ে পড়েছে, কিন্তু তার পরে সব ছেড়েছুড়ে পার্টিতে যোগ দিয়েছে। বেশ উদ্যমী ছেলে, মিউনিখে নাতসি পার্টির যে হেডকোয়ার্টার আছে, সেই ব্রাউন হাউসে ইতিমধ্যেই একে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
এমন ছেলেই তো তাঁর চাই!
পারলে এ—ই পারবে।
অ্যাডলফ স্যালুট গ্রহণ করলেন না, পরিবর্তে করমর্দন করলেন ভিক্টরের সঙ্গে, ‘এই তিনটে অ্যাজেন্ডার যে অপারেশন চলবে, তোমাকে তার প্রধান নিযুক্ত করতে চাই আমি। হেলথ ডিপার্টমেন্টের যে কোর্ট তৈরির কথা বললাম, তারও প্যানেলে আমি তোমাকেই রাখব। এই বয়সে এই সব পোস্ট পেলে ভবিষ্যতে কতদূর উঠতে পারবে তুমি কল্পনা করতে পারছ?
ভিক্টর বিমূঢ়ভাবে মাথা নাড়ল। এই ক—দিন আগেও সে ছিল পার্টির একজন সাধারণ কর্মী। আর এখন সে একটা এত বড়ো মিশনের হেড?
চ্যান্সেলর নিজে তাকে এই দায়িত্ব দিচ্ছেন?
ও এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিল, কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল।
চ্যান্সেলরের কথা শেষ হয়ে গেছে। দরজা খুলে ঘর থেকে বেরোনোর জন্য উদ্যত হয়েও একবার পেছনে ফিরলেন জার্মানির দেশপ্রধান। কেটে কেটে বললেন, ‘ভিক্টর, খুব শিগগির পোল্যান্ড অ্যাটাক করে যুদ্ধ ঘোষণা করব আমি। জার্মানিকে আগের যুদ্ধে যাদের কাছে চূড়ান্ত অপমানিত হতে হয়েছিল, যাদের ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে আমরা দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলাম, সেইসব দেশকে তছনছ করে দেব। আর হ্যাঁ!’ অ্যাডলফ কী—একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘ইহুদিগুলো সব শেষ হলে ওদের শরীরের নানা অর্গ্যান প্রিজার্ভ করে রাখতে হবে একটা মিউজিয়ামে।’
ভিক্টর বলল, ‘মিউজিয়াম!’
‘ইয়েস!’ বললেন, অ্যাডলফ, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের তো জানা উচিত যে কেন আমি একটা গোটা জাতিকে ধ্বংস করেছি? ওদের জিন কত ইনফিরিয়র, কত নিকৃষ্ট, সেটা তো রেকর্ড করে রাখতে হবে, না!’
১৭
প্রিয়ম অফিস থেকে বেরিয়ে রুদ্রকে বারতিনেক চেষ্টা করেও ফোনে পেল না। রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল। আজ অফিসে এতটাই চাপ ছিল যে প্রিয়ম লাঞ্চ টাইমেও ফোন করার সময় পায়নি। শুধু একটা মেসেজ করেছিল রুদ্র খেয়েছে কি না। তারও কোনো উত্তর নেই।
নির্ঘাত ও অফিসে এসে থেকে ফোন করেনি বলে রেগে গেছে।
প্রিয়ম বেশি চাপ নিল না। রুদ্রর রাগ ও খুব ভালো করেই জানে, একদম সাইন কার্ভের মতো। এই রাগ এই হাসি। যেমন ধুম করে রেগে যায়, তেমনই সেই রাগ গলে জল হতেও সময় লাগে না বিশেষ।
প্রিয়ম আর বেশি ফোন করল না। এখন বার বার ফোন করলে আরও রেগে যেত পারে। তার চেয়ে একেবারে গিয়েই কথা হবে, আর তো পনেরো—কুড়ি মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাচ্ছে বাড়ি।
বাসে উঠে কানে হেডফোন গুঁজে বব ডিলান শুনতে শুনতে একটু রিল্যাক্স করছিল প্রিয়ম। কাল সারাদিন অনেক ঘোরার প্ল্যান আছে। মাদাম তুসো তো যাবেই, যদি সম্ভব হয় ডার্ডল ডোরটাও চলে যাবে ওখান থেকেই। কতদিন হয়ে গেল লন্ডন শহরে এসেছে, তবু এত পপুলার জায়গাগুলোতে যাওয়াই হয়নি ওর, ইন্ডিয়া থেকে আসা কলিগরা কবে দেখে নিয়েছে সব। সেবার অরিন্দমরা ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কী ঝুলোঝুলি, তিমির তো ফ্ল্যাটেই চলে এল ওকে বগলদাবা করে নিয়ে যাবে বলে।
কিন্তু প্রিয়ম যায়নি।
কেন জানে না, রুদ্রর সঙ্গে ঘুরতে যে আনন্দটা পাওয়া যায়, সেটা অন্য কারুর সঙ্গেই পাওয়া যায় না। ওর গম্ভীরভাবে প্রিয়মকে জ্ঞান বিতরণ করা, পরক্ষণেই কোনো শিশুসুলভ আবদার করা, সব কিছুই প্রিয়মকে আনন্দ দেয়। সেটা রুদ্র ওর স্ত্রী বলে নয়, ওদের পারস্পরিক বন্ধুত্ব আর বোঝাপড়ার জন্যই। ওর একা একা যেতে ইচ্ছেই করত না, ঠিক করে রেখেছিল রুদ্র এলে একসঙ্গে ঘুরতে যাবে।
আচ্ছা, এর মাঝে একদিন সময় করে স্কটল্যান্ড ঘুরে এলে কেমন হয়? শুনেছে ছবির মতো জায়গা, নির্জন উপত্যকা আর চোখজুড়োনো নৈসর্গিক দৃশ্য।
হঠাৎ একটা ফোন আসতে ওর ঘোরার পরিকল্পনায় ছেদ পড়ল। স্ক্রিনে দেখল ড শ্যুমাখারের নাম ভেসে উঠেছে। রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই ও ড শ্যুমাখারের একটু উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, ‘আচ্ছা, ম্যাডামকে ফোনে পাচ্ছি না। উনি আমাকে সকালে একবার ফোন করেছিলেন!’
প্রিয়ম একটু অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমিও একটু আগে ফোন করেছিলাম। পেলাম না। ফোন সাইলেন্ট করা থাকতে পারে।’
ড শ্যুমাখার একটু উদবিগ্ন গলায় বললেন, ‘কিন্তু উনি আমাকে ফোন করে শুধু এইটুকু বললেন যে, ফটোগুলো উনি আমার কাছে দিয়ে দিতে চান, ওগুলো নিজের কাছে রাখা উনি নিরাপদ মনে করছেন না। এইটুকু বলতেই লাইনটা কেটে গেল, তারপর থেকে উনি আর ফোন তুলছেন না।’
প্রিয়ম এবার সোজা হয়ে বসল। রুদ্র ফটোগুলো নিজের কাছে রাখা নিরাপদ মনে করছে না? কিন্তু কেন?
ও বলল, ‘কখন ফোন করেছিল আপনাকে?’
ওদিক থেকে ড শ্যুমাখারের গলা শোনা গেল, ‘তা ধরুন সকালে সাড়ে এগারোটা নাগাদ।’
প্রিয়মের এবার হঠাৎ টেনশন হতে লাগল। সকাল সাড়ে ন—টায় অফিস পৌঁছোনোর পর থেকে রুদ্রর সঙ্গে ওর আর কথা হয়নি। ওর কোনো বিপদ হল না তো? সংক্ষপে ও ড শ্যুমাখারের ফোনটা ছাড়তে চাইল, ‘আপনি রাখুন। আমি দেখছি।’
ড শ্যুমাখার ফোনটা কাটার আগে বললেন, ‘আমি কি আপনার অ্যাপার্টমেন্টে আসব এখন? ছবিগুলো হারিয়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
ও উত্তর না দিয়ে ফোন করল রুদ্রকে। এবারেও সেই এক জিনিস, রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল।
দেখতে দেখতে বাসও চলে এসেছে ওর স্টপেজে। কোনোমতে বাস থেকে নেমেই প্রিয়ম জোরে জোরে পা চালাল। এখন প্রায় সন্ধে ছ—টা। অন্যদিন দিনের আলো খটখট করে, কিন্তু আজ বেশ নিভু নিভু হয়ে এসেছে চারদিক। ঠান্ডা একটা হাওয়াও বেশ কাঁপুনি দিচ্ছে গায়ে। রাস্তাঘাটও ভেজা ভেজা। এদিকে কি বৃষ্টি হয়েছে এখুনি?
কিন্তু প্রিয়মদের অফিসের ওখানে তো কিছু বোঝা যায়নি।
দ্রুতগতিতে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতে ঢুকতে এক মুহূর্তের জন্য উপরের দিকে তাকাল প্রিয়ম, অন্ধকারে কিছুই বোঝা গেল না। বিশাল এই বাড়িটা যেন আকাশের বুক চিরে একটা দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
মাঝে মাঝে ইংল্যান্ডের এই অতিরিক্ত নির্জনতা অসহ্য লাগে প্রিয়মের। ইন্ডিয়ার সেই কোলাহলটাও প্রয়োজন মানুষের জীবনের কখনো কখনো! একটা প্রাণ থাকে যেন সেই হইহইমুখর জায়গায়। এখানে সবকিছুই বড়ো বেশি যান্ত্রিক।
ফ্ল্যাটে পৌঁছে চার থেকে পাঁচবার বেল টিপেও যখন কোনো সাড়া পেল না, তখন বাধ্য হয়ে প্রিয়ম ধাক্কা দিতে লাগল জোরে জোরে। এখানকার দরজার এই একটা সমস্যা। বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভেতর থেকে বন্ধ কি না।
রুদ্র কি বাইরে বেরিয়েছে কোথাও? সেক্ষেত্রে ওর তো এটা মাথায় থাকা উচিত যে প্রিয়ম এখন বাড়ি ফিরবে এবং আর কোনো ডুপ্লিকেট চাবি না থাকায় ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?
প্রিয়মের বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছিল। ও ধাক্কার প্রাবল্য বাড়িয়ে দিল।
আরও দশ থেকে বারোবার জোরে জোরে শব্দ করার পর দরজাটা আলতো ফাঁক হয়ে খুলে গেল। উশকোখুশকো চুলে, ঘুম জড়ানো লাল চোখে রুদ্র উঁকি দিল বাইরে, ‘ওহ তুমি! এসে গেছ! এরকম জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছ কেন? বেল বাজাবে তো!’
প্রিয়মের প্রচণ্ড ইচ্ছে হল রুদ্রর চুলের ঝুঁটিটা টেনে ওর মাথায় জোরে জোরে গাঁটা বসিয়ে দেয় খানকয়েক। অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করল ও, ‘তুমি ফোন ধরছিলে না কেন?’
রুদ্র ভেতরে যেতে যেতে একটা বিশাল হাই তুলল, ‘ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শুনতেই পাইনি।’
প্রিয়ম এবার ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘সেই সকাল থেকে নাগাড়ে ঘুমোচ্ছ? আমার কথা তো ছেড়েই দিলাম, আমি চিন্তা করলাম কি করলাম না, তা নিয়ে তো তোমার কোনো মাথাব্যথাই নেই জানি, ড শ্যুমাখার ফোন করেছেন, ধরোনি কেন? বেচারি টেনশনে পড়ে ছুটে আসছেন!’
রুদ্র প্রিয়মের জন্য কফি করতে যাচ্ছিল, এবার থমকে গেল একটু, ‘ড শ্যুমাখার এখানে আসছেন?’
প্রিয়ম এবারও কড়া গলায় বলল, ‘আসবেন না? তুমি ফোন করে কী না কী বলেছ ফটোগুলো তোমার কাছে নিরাপদ নয়, আর তারপর থেকেই ফোন ধরা বন্ধ করে দিয়েছ।’
রুদ্র কী যেন চিন্তা করছিল, ‘উনি এই ফ্ল্যাটটা চেনেন?’
প্রিয়ম এবার একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম যে ওই টুর্নামেন্টের দিনই ওঁকে পার্ক থেকে আমার অ্যাপার্টমেন্টটা দেখিয়েছিলাম। আর ফ্লোর তো বলেই দিয়েছি, উনি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আসছেন।’
রূদ্র এবার চমকে উঠল। ভ্রূদুটোকে সাংঘাতিক রকমের কুঁচকে কী ভাবতে লাগল।
প্রিয়ম এবার একটু অধৈর্য হয়ে বলল, ‘কী হয়েছিল বলবে কি?’
রুদ্র অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘বলছি। আগে ড শ্যুমাখারকে একটা ফোন করে জিজ্ঞাসা করো তো উনি কোথায়?’
প্রিয়মের ভেতরে ভেতরে ভীষণ বিরক্তি লাগছিল, তবু কথা না বাড়িয়ে ও ফোন করল, কিছুক্ষণ কথা চালানোর পর, ড শ্যুমাখারকে এখানে আসার বিবরণ ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে ফোন রাখল ও, ‘উনি সবে বেরিয়েছেন। আসতে তাও আধঘণ্টা মতো লাগবে।’
রুদ্র বলল, ‘গুড! আচ্ছা প্রিয়ম, তুমি বলছিলে না, এখান থেকে স্টেশন খুব কাছে? সেখান থেকে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনও ছাড়ে? মানে, প্যারিস বা ইংল্যান্ডের বাইরে অন্য কোনো জায়গায় যাওয়ার?’
প্রিয়ম বলল, ‘এখান থেকে কাছে যে স্টেশন সেটা তো ছোটো একটা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন, ওখান থেকে দেশের বাইরে কোথাও যাওয়া যায় না।’ কথাটা বলেই ও খেয়াল করল, রুদ্র একটা মাঝারি মাপের রুকস্যাক লফট থেকে নামিয়ে ফেলল। তারপর আশপাশে পড়ে থাকা কিছু জামাকাপড় ঝড়ের গতিতে প্যাক করতে শুরু করল, তারই মধ্যে ছুটে গিয়ে ফ্রিজ থেকে কিছু শুকনো খাবারের প্যাকেট নিয়ে এসে চোখের নিমেষে গুঁজে দিল ভেতরে।
প্রিয়ম অবাক হয়ে বলল, ‘কী ব্যাপারটা কী বলবে একটু খুলে?’
রুদ্র এবার মুখ তুলে তাকাল, ‘এখন অত কথা বলার সময় নেই প্রিয়ম! শুধু এইটুকু বলতে পারি যেভাবেই হোক এখান থেকে আমাদের এখন পালাতে হবে। তুমি চট করে ফ্রেশ হয়ে নাও। দশ মিনিটের মধ্যে এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে আমাদের।’
‘মানে!’ প্রিয়ম একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেল, ‘এই সন্ধেবেলা এখান থেকে বেরিয়ে কোথায় পালাব? আর কেনই—বা পালাব!’
রুদ্র মাথা নীচু করে গোছাতে গোছাতে বলল, ‘এখানে আমরা একদমই নিরাপদ নই। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হও।’
প্রিয়ম এবার রেগে গেল, ‘তুমি কি আমাকে খুলে বলবে কী হয়েছে আজকে? কেউ কি আজ এসেছিল? তুমি ড শ্যুমাখারকে বলেছ যে ফটোগুলো তুমি নিজের কাছে রাখা নিরাপদ মনে করছ না? কী হয়েছে? সেরকম কিছু হলে খুলে বলো আমাকে, উনি আসুন, তারপর না হয় আমরা তিনজনে মিলে বসে একটা আলোচনা…!’
রুদ্র এতক্ষণ শান্তভাবে কথা বলছিল, এবার ও একটু উষ্ণভাবে বলল, ‘বললাম তো, তোমাকে আমি পরে সব খুলে বলছি। এখন আমাদের এখান থেকে শিগগিরই পালাতে হবে। তুমি যখন এই ব্যাপারটায় আমাকে জড়িয়েছ, তখন আমি কী করছি বা কেন করছি তার ওপর তোমার কনফিডেন্স থাকা উচিত, তাই না!’
প্রিয়ম এবার চুপ করে গেল, ‘কী করতে চাইছ তুমি এখন?’
রুদ্র বলল, ‘আমি তোমার আর আমার দুজনেরই এক সপ্তাহের মতো জামা গুছিয়ে নিচ্ছি। এখানে থাকা যাবে না কোনোমতেই।’
প্রিয়ম এবার শান্তভাবে বলল, ‘বেশ তো! চলো তাহলে আজকের মতো অরিন্দমদের বাড়ি গিয়ে উঠি। ওদের বড়ো অ্যাপার্টমেন্ট, কোনো অসুবিধা হবে না।’
রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘না। এখান থেকে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেন চলে না? ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে? সেটা কীভাবে ধরব?’
প্রিয়ম বলল, ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রেন ছাড়ে সেন্ট প্যানক্রাস স্টেশন থেকে। ইউরোস্টার বা অন্যান্য দেশের ট্রেন ধরতে হলে ওই স্টেশনেই যেতে হয়। সেটা তো এখান থেকে অনেক দূর। এত রাতে কীভাবে যাব!’
রুদ্র রুকস্যাকটাকে পিঠে বেঁধে নিল, ‘ক্যাবে?’
প্রিয়ম বাথরুম লাগোয়া বেসিনটায় মুখে—চোখে হালকা জল দিচ্ছিল, সারাদিন অফিসে একনাগাড়ে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা, তারপর বাড়ি ফিরে রুদ্রর এই পাগলামি!
ও ক্লান্ত গলায় বলল, ‘কত বিল হবে জানো? সেন্ট প্যানক্রাস যেতে হলে এই হিলিংডনেই একটা ছোটো স্টেশন আছে, সেখান থেকে ট্রেন ধরে যাওয়া যাবে। তার চেয়ে কি এয়ারপোর্ট চলে যাবে?’
রুদ্র দ্রুত গতিতে মাথা নাড়ল, ‘দেখছি। তুমি বেরিয়ে এসো। দরজাটা লক করব।’ কথাটা বলেই ও আর দাঁড়াল না, ঝপাঝপ জুতো পরে দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় ঘরের আলোগুলো নিভিয়ে দিল।
প্রিয়ম কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না, ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে ও বলল, ‘কিন্তু ড শ্যুমাখার কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বেন যে! ওঁর ওই ফটোগুলো কি সঙ্গে করে নিয়ে চলে যাবে নাকি!’
রুদ্র প্রিয়মের কথা শুনতেই পেল না, ঝড়ের বেগে ভেতরে গিয়ে ল্যাপটপটা নিয়ে এল, সেটাকে একহাতে রুকস্যাকে ঢোকাতে ঢোকাতে দরজাটা লক করেই লিফট লবিতে এগিয়ে গেল।
নীচে নেমে ওরা দেখল কেয়ারটেকার লোকটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। প্রিয়ম কিছু বলার আগেই রুদ্র মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘ভালো আছেন? আমরা প্যারিস যাচ্ছি ঘুরতে। ফিরব এক সপ্তাহ বাদে। যদিও ফ্লাইটের আর বেশি দেরি নেই, তবে এখান থেকে তো এয়ারপোর্ট কাছেই, তাই না!’
জন নামে এই লোকটার সঙ্গে খুব হৃদ্যতা না থাকলেও মোটামুটি হাই হ্যালোর সম্পর্ক প্রিয়মের। রুদ্রর কথা শুনে জন বলল, ‘হ্যাঁ, বড়োজোর দশ মিনিট লাগবে বাসে।’ তারপর প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে ফর্মাল একটা হাসি হাসল, ‘ভালো করে ঘুরে আসুন। হ্যাপি জার্নি!’
বাইরে বেরিয়ে যেদিকে বড়োরাস্তা, সেদিকে না গিয়ে উলটোদিকের নির্জন পথ ধরে হাঁটতে লাগল ওরা। রুদ্র ফোনে জি পি এস অন করেই রেখেছিল, গুগলের দেখানো লোকেশন অনুযায়ী চলছিল। ঘরের ভেতরে একদমই বুঝতে পারেনি বাইরে ভালো ঠান্ডা। সকালের বৃষ্টিটার জন্যই হয়তো তাপমাত্রা আরও কমে গেছে। মোটা পুলওভার ভেদ করে যেন ছুঁচের মতো বিঁধছে ঠান্ডা হিম, দূরে পশ্চিম দিকের আকাশে সূর্য প্রায় ঢলে পড়েছে, শুধু তার কমলা আভাটুকু ছড়িয়ে রয়েছে সারা আকাশটায়।
প্রিয়ম বিশেষ কথা বলছিল না। শুধু একবার অস্ফুটে বলল, ‘এয়ারপোর্ট কিন্তু উলটোদিকে।’
রুদ্র এবার একটু হাসল, বেচারাকে এমন অন্ধকারে রাখাটা ঠিক নয়। সারাদিন এত খেটেখুটে অফিস থেকে এল, এদিকে ধাতানির ভয়ে কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারছে না। কিন্তু কিছু করার নেই, এখন ওকে সব বুঝিয়ে বলে তারপর বেরোতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যেত।
পকেট থেকে ডান হাতটা বের করে ও প্রিয়মের হাতটা ধরল, ‘জানি। হিলিংডন স্টেশন যাচ্ছি। ওখান থেকে সেন্ট প্যানক্রাস। তোমার খিদে পেয়েছে, না? ট্রেনে উঠেই খেয়ে নিয়ো।’
প্রিয়ম চুপ করে রইল। ড শ্যুমাখার ইতিমধ্যে তিন চারবার ফোন করেছেন। ও রিসিভ করেনি। কী বলবে? যে, আপনি এত কষ্ট করে এলেন, আর আমরা একটু ফ্রান্স ঘুরতে চলে যাচ্ছি, এক সপ্তাহ পরে আসুন? রুদ্রর মাথায় কখন কী চাপে কিছুই বোঝা যায় না। জনকে বলল এয়ারপোর্টে যাচিছ, এদিকে চলে এল এইদিকে। কিন্তু প্রিয়মের এখন কিছু বলবারও নেই। এই ব্যাপারটায় তো রুদ্র প্রথম থেকেই ইনভলভ হতে চায়নি, ও—ই একরকম জোর করে ড শ্যুমাখারের সঙ্গে দেখা করিয়েছিল।
এখন মনে হচ্ছে না করালেই ভালো হত।
প্রিয়ম ছোটো একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি তোমার সঙ্গে প্যারিস যেতে পারব না বলে এরকম জোর করে বের করে নিয়ে এলে? অফিসে কিছু বলা হল না, কত প্রবলেম হবে জানো?’
রুদ্র চুপ করে হাঁটতে লাগল। এই ব্যাপারটা যে ও একেবারেই ভাবেনি তা নয়, কিন্তু এমন একেকটা সময় আছে যখন দুম করে কোনো সিদ্ধান্ত না নিলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়।
প্রিয়ম আবার বলল, ‘আমার পাসপোর্টটা নিয়েছ?’
রুদ্র মাথা হেলিয়ে শুধু বলল, ‘নিয়েছি।’ তারপর প্রিয়মের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে সুইচ অফ করে দিল ও। প্রিয়ম জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে বলল, ‘এটা কিছুক্ষণ বন্ধ থাক। আমারটাও অফ রেখেছি।’
ঘণ্টাখানেক পর ওরা ছোট্ট হিলিংডন স্টেশন থেকে টিউবে চেপে যখন সেন্ট প্যানক্রাসে পৌঁছোল, তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা। রুদ্রর জোরাজুরিতেও প্রিয়ম কিছু মুখে দেয়নি, চুপচাপ মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিল সারাটা রাস্তা। কথাও বলছে না বিশেষ। রুদ্র বুঝতে পারছিল প্রিয়ম বেশ রেগে গেছে। এমনিতে প্রিয়ম শান্ত হলে কী হবে, একবার রেগে গেলে চট করে স্বাভাবিক হতে চায় না।
ও আর বেশি ঘাঁটাল না। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেন ধরার আগে পেট ভরে কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। ও প্রিয়মকে বলল, ‘স্টেশনের বাইরে যাবে একবার? খেয়ে আসি কিছু, এসে না হয় টিকিট কাটব?’
প্রিয়ম শুধু বলল, ‘আমার খিদে নেই। তুমি যাবে তো যাও।’ তারপর রুদ্র একদৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে দেখে যোগ করল, ‘আর এখানে ব্যাপারটা অত সোজা নয় যে টিকিট কাটলে, আর উঠে পড়লে। তুমি একটা দেশ থেকে বেরিয়ে আরেকটা দেশে যাবে। ইন্ডিয়া থেকে আসার সময় যেরকম সিকিউরিটি চেক, ইমিগ্রেশন পেরিয়ে এসেছ, এখানেও সেগুলো করতে হবে। প্যারিসের ট্রেন কখন আছে দ্যাখো, তারপর টিকিট কেটে ইমিগ্রেশনের জায়গায় যেতে হবে। সব কিছু দুমদাম নিজের মর্জিমতো করলে হয় না।’
রুদ্র এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল, এবার মুখ খুলল, ‘বুঝলাম। তা অফিস থেকে ফিরে তো কিছু খাওনি। তাই বলছিলাম, চলো বাইরে থেকে খেয়ে আসি কিছু, তেমন হলে প্যাক করে নিয়ে চলে আসব। সারা রাত ট্রেন জার্নিতে খিদে পেয়ে যাবে তো।’
প্রিয়ম হাত দুটোকে কাঁধের পেছনে আড়াআড়ি রেখে হেলান দিয়ে বসে ছিল, শেষ কথাটাতে ও চমকে উঠে রুদ্রর দিকে তাকাল, ‘সারা রাত? প্যারিস এখান থেকে দু—ঘণ্টা লাগে মাত্র!’
রুদ্র বলল, ‘জানি। কিন্তু আমরা তো পারিস যাচ্ছি না।’
প্রিয়ম বলল, ‘তবে? কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
রুদ্র প্রিয়মের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘জার্মানি। বার্লিন। প্রায় দশ ঘণ্টা লাগবে পৌঁছোতে, যা দেখলাম।’ সরাসরি ট্রেন নেই। ব্রাসেলস হয়ে যেতে হবে।’
প্রিয়ম এবার এতটাই অবাক হয়ে গেল যে কী বলবে বুঝতে পারছিল না। কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, ‘মানে?’
রুদ্র প্রিয়মের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘তোমাকে সবই খুলে বলব। তুমি আমাকে একটা কাজের দায়িত্ব দিয়েছ, সেটা ঠিকভাবে করতে গেলে যদি তুমিই এখন বিরক্ত হও, তাহলে আমি কী করব বলো তো? আর এখন এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছি আমি, মাঝপথে বেরোবার উপায়ও নেই। সব বলছি। আগে চলো বাইরে গিয়ে কিছু খেয়ে আসি। পরিস্থিতি কতটা ভয়ংকর তুমি কল্পনাও করতে পারছ না!’
রুদ্রর গলায় এমন একটা কিছু ছিল যাতে প্রিয়ম আর উপেক্ষা করতে পারল না। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এল রুদ্রর সঙ্গে।
বাইরে বেরিয়ে রুদ্র একটা ফুড কর্নার থেকে কিছু স্যান্ডউইচ আর সসেজ প্যাক করে নিল। ওর নিজের জোরদার খিদে পেয়ে গেছে। প্রিয়মের নিশ্চয়ই আরও বেশি পেয়েছে, কিন্তু এখন গুম হয়ে আছে বলে কিছু বলছে না।
সেন্ট প্যানক্রাস স্টেশনটা নিজেই যেন একটা দর্শনীয় স্থান। একঝলকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা একটা স্টেশন। একটা পুরোনো আমলের হেরিটেজ বিল্ডিংকে যে কত সুন্দরভাবে তার বনেদিয়ানাটাকে মর্যাদা দিয়ে নতুন সুযোগসুবিধার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যায়, এই সেন্ট প্যানক্রাস স্টেশনটাই যেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পুরো স্টেশনটার ভেতরের ছাদটা গোলাকৃতি স্বচ্ছ কাচ আর রট আয়রনের রিব দিয়ে তৈরি হওয়ায় কেমন একটা বিশাল মাপের ইগলুর আকার নিয়েছে।
পরিস্কার ঝকঝকে চওড়া প্ল্যাটফর্ম, তাতে একের পর এক ট্রেন ঢুকছে, বেরিয়েও যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে বিশ্বখ্যাত সমস্ত ব্র্যান্ডের আউটলেট সাজানো থরে থরে, ঠিক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি শপগুলোর মতো।
রুদ্রর আরও ভালো করে দেখার ইচ্ছে চারদিকটা, কিন্তু মনটা এমন অশান্ত হয়ে রয়েছে, এখন আর এসব দেখার মতো মানসিকতা নেই।
প্রিয়ম আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। রুদ্র ফেসবুকটা খুলল একবার। এখানকার অধিকাংশ পাবলিক প্লেসেই ওয়াই—ফাই ফ্রি থাকে। এই সেন্ট প্যানক্রাস স্টেশনেও তাই। কালকের পর বিভিন্ন গোলমালে ফেসবুক চেক করাই হয়নি। অ্যাপটা খুলতেই গুচ্ছের নোটিফিকেশন ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওয়ালে, তার মধ্যে নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টও এসেছে।
নোটিফিকেশনগুলো দেখার আগে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের বাটনটা টিপল রুদ্র।
একটাই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। মিউচুয়াল ফ্রেন্ড দেখাচ্ছে প্রিয়মকে।
ড সিগমুন্ড শ্যুমাখার।
১৮
অগাস্ট, ১৯৩৩
অ্যাডলফ টেবিলল্যাম্পের আলোয় মন দিয়ে লিখছিলেন। গভীর রাত। এমনিতে খুবই অল্প ঘুমানোর সময় তাঁর, সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা ঘুমেই পুষিয়ে নিতে হয় তাঁকে। গ্যাসের ব্যথায় সেটুকুও ভালো ঘুম হয় না প্রায়শই। মেইন ক্যাম্ফ—এর তুমুল সাফল্যের পর আরেকটা বই লেখার কাজে হাত দিয়েছেন তিনি এটা অবশ্য ঠিক বই নয়, তাঁর রোজকার দিনলিপি বলা চলে। এটা প্রকাশ করারও কোনো পরিকল্পনা নেই। বইয়ের মতো অত স্ট্র্যাটেজিকালি না লিখে সারাক্ষণ মনের মধ্যে ঘুরে ফিরে হেঁটে চলা ভাবনাচিন্তাগুলোকেই এই ডায়েরিতে ধরে রাখছেন তিনি।
বিশেষত ভিক্টর ব্র্যাককে যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন সেই ব্যাপারটা। খুব গোপনে রাখলেও একটা তো নোট লিখে রাখা দরকার, তাই এখানেই সেটা একটু একটু করে লিখছেন রোজ।
তাঁর টেবিলের পাশেই বিছানায় অঘোরে ঘুমিয়ে ইভা। অ্যাডলফ একবার তাকালেন সেই দিকে। ক্রিম—রঙা রাতপোশাকে হলদে নীল মৃদু আলোয় ইভাকে বেশ মোহময়ী লাগছে। তার পশমের মতো সোনালি চুলগুলো ফুলেফেঁপে পড়েছে কপালের ওপর, গালে নরম আলো যেন পিছলে যাচ্ছে।
এই সময় সব মেয়েকেই কি খুব লাবণ্যময়ী লাগে?
বেশ কিছুদিন হল ইভা এই বাড়িতে চলে এসেছে, কিন্তু ওকে বিয়ে করার ব্যাপারে এখনও মনস্থির করতে পারেননি অ্যাডলফ। তিনি সাধারণ মানুষের কাছে নিজেকে কাজপাগল নেতা হিসেবেই প্রতিপন্ন করতে চান, সেখানে বিয়ে করে সংসারী হলে তাঁর বিশ্বস্ততায় মানুষ সন্দেহ করতে পারে। ইভা মেয়েটা এমনিতে ভালোই, সে নিজে বিশেষ কিছু দাবি করে না। কিন্তু কয়েক মাস পরে দাবি করলেও করতে পারে, তাই এখন থেকেই সেই পরিকল্পনা করে রেখেছেন অ্যাডলফ।
বাচ্চাটা হলেই এমন কোথাও পাঠিয়ে দিতে হবে, যাতে জার্মানির কেউ তার পরিচয় জানতে না পারে। এখন এইসব বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসারে জড়িয়ে পড়তে একদমই চান না অ্যাডলফ।
তবে তাঁর সন্তান যেন ছোটো থেকেই তাঁর আদর্শে দীক্ষিত হয়, জার্মানিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাঁড় যেন ঠিক সময়ে তাঁর হাত থেকে তুলে নেয়, সেই ব্যাপারে খেয়াল রাখবেন তিনি।
এমন সময় ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল ঘরের টেলিফোনটা।
এই ঘরের টেলিফোনের নম্বর খুব ঘনিষ্ঠ মহল ছাড়া কারুর কাছে নেই। সাধারণত কেউ ফোন করলে সেটা সরাসরি চলে যায় চ্যান্সেলর অফিসের অপারেটরের কাছে, সে প্রয়োজনমতো কল ট্রান্সফার করে বিভিন্ন কর্তার কাছে।
অ্যাডলফ উঠে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে ভিক্টরের সতর্ক গলা শোনা গেল, ‘হেইল হের চ্যান্সেলর! ভিক্টর বলছি। একজনকে পেয়েছি, আপনার সঙ্গে দেখা করাতে চাই। কবে নিয়ে আসব?’
অ্যাডলফ ভ্রূ কুঁচকে একটু চিন্তা করলেন। এমনিতে আগামী তিন মাসের সমস্ত মিটিং, অ্যাপয়েন্টমেন্টের রেকর্ড রাখে তার ব্যক্তিগত সচিব উইলসন, কিন্তু তাকে তো এখন জিজ্ঞাসা করা যাবে না। তিনি কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন, ‘কাল বেলা এগারোটায় নিয়ে এসো। দেরি হয় না যেন। আমি বারোটায় মিউনিখ বেরিয়ে যাব।’
ভিক্টর সায় দিয়ে ফোনটা নামিয়ে রেখে চুপিসাড়ে বেরিয়ে এল বুথ থেকে। বুথের লোকটা ঘুমে ঢুলছিল, ওকে একবার আড়চোখে দেখে পয়সাটা নিয়ে নিল। সত্যি, টেলিফোন আসার পর থেকে যে কী সুবিধে হয়েছে। যদিও সরকারি অফিস বা মান্যগণ্যদের দপ্তর ছাড়া কোথাও সেভাবে এখনও টেলিফোন নেই। শুধু গোটা বার্লিন শহরের প্রধান চারটে স্কোয়ারে বসানো হয়েছে, তবু সুবিধে এটাই যে দিনরাত খোলা থাকে।
ভিক্টর দ্রুতগতিতে হাঁটছিল। এত রাত হয়েছে তবু সে এখন বাড়ি যাবে না। এমনিতে এই কয়েকটা সপ্তাহ সে দিনরাত এক করে খেটেছে, গোপনে লন্ডন চলে গিয়ে সেখানে খোঁজখবর চালানো, গ্যালটন নামের ওই বৈজ্ঞানিকের বাড়িতে কারা কারা থাকে, তাদের উপর নজর রাখার জন্য লোক ঠিক করা, ভদ্রলোকের প্রচুর ছাত্র সারা ইউরোপে ছড়িয়ে—ছিটিয়ে আছে, তাদের ব্যাপারে তথ্য জোগাড় করা। প্রায় কুড়ি পঁচিশ দিন সে ঠিক করে ঘুমোতেই পারেনি। অবশেষে সে যে চ্যান্সেলরের বিশ্বাসের মান রাখতে পেরেছে, এটাই তার কাছে সবচেয়ে বড়ো তৃপ্তির। ডান হাতে ধরা বাক্সটাকে সাবধানে নিয়ে ও হাঁটছিল। খেয়াল রাখছিল সেটা যেন সোজা থাকে। আজ সে তার পুরোনো এক বন্ধুর বাড়িতে যাবে, বেশ কয়েকদিনের খাটুনির পর একটু রিল্যাক্স করতে বড় ইচ্ছে করছে।
ভিক্টর অনেকটা হেঁটে আধঘণ্টার মধ্যে শহরের পশ্চিম প্রান্তে নতুন তৈরি হওয়া ওয়েস্ট এন্ড অঞ্চলে চলে এল। পাশেই ইউ বান অর্থাৎ আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ের স্টেশন। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সেটাকে এই গভীর রাতে কেমন ঘুমন্ত দৈত্যের মতো দেখাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে ওর অনেক কিছু মনে পড়ে গেল—সেদিনগুলোর কথা, যখন ওরা দুজনে মিলে প্রথম বার্লিনে পা রেখেছিল।
তখন সবে এই মাটির নীচের রেলপথ অর্থাৎ ইউ বান রেলওয়ে তৈরি হয়েছে। ওর স্পষ্ট মনে পড়ল যেদিন প্রথম চেপেছিল ওই ইউ বান ট্রেনে, স্টেশন থেকে কিছুটা বেরিয়েই যখন ধুপ করে ট্রেনটা গর্তে ঢুকে গেল, চারপাশের ঝলমলে আকাশ সরে অন্ধকার টানেলের মধ্য দিয়ে চলতে লাগল ওদের ট্রেন, ওদের দুজনেরই ভয়ে মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। ঠিক যেন মনে হয়েছিল ছোটোবেলায় পড়া রূপকথার একটা রাক্ষস গিলে খেয়ে নিল ওদের ট্রেনটাকে। সত্যি, তখন কী বোকা ছিল ও।
আর এখন তো পুরো বার্লিন শহরটাকেই সবদিক থেকে সুন্দরভাবে জুড়ে ফেলেছে এই ইউ বান রেলওয়ে। আগে শুধু এস বান, মানে মাটির উপর দিয়ে চলা সুবার্বন ট্রেন ছিল, তাতেই মানুষ বেশি যাতায়াত করত, কিন্তু ইউ বান শুরু হওয়ার পর এর দ্রুততার জন্যই, বা ঘন ঘন সার্ভিস, মানুষ এটাতেই ভিড় করে বেশি। ভাড়াও বেশ কম।
যুদ্ধের পর আস্তে আস্তে ছন্দে ফিরছে বার্লিন।
স্টেশনটাকে বাঁ—পাশে ফেলে রেখে ও এগিয়ে এল রেইসক্যাঞ্জলার স্কোয়ারের দিকে। আগে এইসব জায়গা কত ঘুরে ঘুরে বেড়াত। এখন পার্টির কাজে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়ে কতদিন যে কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া রাস্তায় বেরোয়নি।
রেইসক্যাঞ্জলার স্কোয়ার এই শহরের একটা বিখ্যাত জায়গা। একটা বিশাল বড়ো গোলাকার উদ্যান, তার চারপাশে বৃত্তাকারে রাস্তা, আবার সেই গোল রাস্তাটা থেকে বিভিন্ন দিকে অনেকগুলো রাস্তা বেরিয়ে গেছে শহরের বিভিন্ন অভিমুখে। একটা রাস্তা আবার একপাশে চলে গেছে ইউ বান রেলওয়ে স্টেশনটার দিকে।
ভিক্টর যখন খুব ছোটো, বাবা মায়ের সঙ্গে যখন রাইন নদীর তীরে হারেন বলে সেই জায়গাটায় ছোট্ট বাড়িটায় থাকত, তখন স্কুলে ওদের টিচার একদিন গল্পচ্ছলে পড়িয়েছিলেন এই স্কোয়ার তৈরির কথা। এই ওয়েস্টএন্ড অঞ্চলটা তৈরি করে এই স্কোয়ারটার নাম দেওয়া হয়েছিল চ্যান্সেলরের অফিসের নামে। রেইসক্যাঞ্জলার।
এখন অবশ্য হিটলার চ্যান্সেলর হওয়ার পর বার্লিনের, শুধু বার্লিন কেন গোটা জার্মানি, প্রায় সব শহরেরই অসংখ্য রাস্তাঘাট, স্কোয়ারের নাম পালটে ওর নামে হয়ে যাচ্ছে।
এটারও নাম এখন অ্যাডলফ হিটলার স্কোয়ার।
এখন মনে হয় লোকজনের বাড়ির নামও হিটলারের নাম দিয়ে হবে, গত মাসে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ মারা যাওয়ার পর তো হিটলারই জার্মানির সর্বাধিনায়ক। প্রেসিডেন্ট আর চ্যান্সেলর দুটোই এখন হিটলার, অবশ্য তাতে ভিক্টরেরই সুবিধা।
স্কুলে এই রেইসক্যাঞ্জলার জায়গাটার গল্প শুনে তখন কী কৌতূহল ওদের দুজনের! দুজনে মিলে পরামর্শ করেছিল বড়ো হয়েই ওরা একদিন বার্লিনে পাড়ি জমাবে, তারপর ঘুরে ঘুরে দেখবে সব কিছু তারপর সারাজীবন একসঙ্গে থাকবে। ফ্রেডরিক ওর পাহাড়ে চড়ার ট্রেনিং নেবে আর ভিক্টর ছবি আঁকবে, ভরতি হবে নামকরা আর্ট স্কুলে।
ফ্রেডরিকের স্বপ্ন কতটা সফল হয়েছে ও জানে না, তবে ও নিজে যে কতদিন রং তুলি নিয়ে বসেনি! চিত্রশিল্পী হওয়ার ইচ্ছে কবেই লুপ্ত হয়ে গেছে ক্ষমতার লোভের কাছে।
স্কোয়ারটা পেরিয়ে কিছুটা হেঁটেই ও একটা ছোটো গলিতে ঢুকল, এখানে সার সার দিয়ে ছোটো ছোটো বাড়ি, যুদ্ধের সময় জার্মান সেনাদের থাকার জন্য এরকম প্রচুর কলোনি তৈরি করেছিল আগের সরকার। এখন সেগুলো দখল করেছে গরিব খেটে খাওয়া মানুষজন। সেও আগে এইরকমই একটা বাড়ির ঘুপচি ঘরে থাকত, কিন্তু বছর দুয়েক আগে পার্টিতে বেশ উন্নতি হওয়া শুরু হতে ও এখন মিউনিখে একটা সুন্দর বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে গেছে।
ও একের পর এক বাড়ি পেরিয়ে গলির প্রায় শেষের দিকের একটা বাড়িতে ঢুকল। একতলার অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা ঘরের দরজায় আলতো টোকা দিল। একবার, দু—বার। তারপর একটু জোরে, তিনবার।
ওপাশ থেকে একটা ঘুমজড়ানো গলা ভেসে এল, ‘কে?’
ভিক্টর বলল, ‘তোর যুদ্ধে মরা বাপ আমি, হতভাগা! খোল শিগগিরই!’
দরজাটা খুলতেই ও কেকটা উঁচু করে তুলে ধরে ছোটোবেলার বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল, ‘হ্যাপি বার্থডে, ভাই! তুই তো আমাকে ভুলেই গেছিস!’
ফ্রেডরিক ঘুম চোখে দরজা খুলেছিল। ভিক্টরকে ও ভোলেনি, ভোলার প্রশ্নও নেই, কিন্তু আজ যে ওর নিজের জন্মদিন সেটা সত্যিই ও ভুলে গিয়েছিল।
ভিক্টর আজ অনেক বড়ো মানুষ, তবু এই ব্যস্ততার মধ্যেও এই সামান্য বন্ধুর জন্মদিন সে মনে রেখেছে?
ফ্রেডরিকের মনটা আনন্দে ভরে উঠল, জড়িয়ে ধরে বন্ধুর পিঠ চাপড়ে দিল দু—বার, ‘আয় ভেতরে। বার্লিন কবে এলি?’
ভিক্টর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘এসেছি একটা কাজে, কয়েকদিন হল। তুই তো ভুলেও একটা খবর রাখিস না! না একটা চিঠি, না দেখা সাক্ষাৎ! এখনও কি ওই বিজ্ঞাপনের প্রেসটাতেই কাজ করছিস?’
ফ্রেডরিক উত্তর না দিয়ে হাসল।
ভিক্টর বলল, ‘বললাম চলে আয় আমার কাছে, ঠিক ঢুকিয়ে দেব একটা—না—একটা কাজে। সেই এক গেঁতোমি নিয়ে পড়ে রইনি!
ফ্রেডরিক বলল, ‘না রে, এখন ভালোই চলছে।’
ভিক্টর বাড়ি নিয়ে মিউনিখে চলে যাওয়ার পরেই ‘স্ট্রেট পাথ’ কাগজে ঢুকেছিল ফ্রেডরিক, সেটা ও ঘুণাক্ষরেও বন্ধুকে জানায়নি। যতই ছোটোবেলার বন্ধু হোক, সে এখন নাতসি পার্টির নেতা, শত্রুর কাগজে কাজ করে এটা জানানোর মতো মূর্খামি কেউ করে?
ভিক্টর মুখটা বেঁকাল সামান্য, কত ভালো চলছে, সেটা ঘরদোর দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একটা জরাজীর্ণ ট্রাঙ্ক, পুরোনো একটা চুল্লী, খাট আর টুকিটাকি জিনিস ছাড়া ঘরে কিছুই নেই।
আর কিছু না বলে ওভারকোটেরপকেট থেকে ও একটা বোতল বের করল, ‘তোর হাতের খেল দেখা। বিয়ার এনেছি, জম্পেশ করে বানা তোর সেই বিখ্যাত ককটেল। অনেকদিন খাইনি। আজ একটু জমিয়ে নেশা করব।’
ফ্রেডরিক মৃদু হাসল, ‘আবার সেই মাতলামি করবি! এই বাড়িতে চেঁচামেচি করল কিন্তু অন্যরা অবজেকশন দেয়।’
ভিক্টর মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, ‘থাম তো! অবজেকশন, আমাকে? শালা সোজা জেলে ঢুকিয়ে দেব, অবজেকশন দেওয়া পেছন দিয়ে বেরিয়ে যাবে। তুই বানা।’
১৯
সেন্ট প্যানক্রাস স্টেশনে ইমিগ্রেশন, সিকিউরিটি চেকিং মিটে গেল কিছুক্ষণ বাদেই। রুদ্রর আগে থেকেই ফ্রান্সের ভিসা করানো ছিল বলে জার্মানি যেতে কোনো বাধা নেই। এখানকার নিয়ম হল একটা দেশের ভিসা করানো থাকলেই ইউরোপের অনেকগুলো দেশে যাওয়া যায়। এটাকে বলে শেনজেন ভিসা, সমস্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য। শুধু ইংল্যান্ডের জন্য আলাদা ভিসা লাগে।
ওরা দুজনে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করছিল ওদের ট্রেনের। এতক্ষণ পরপর এত কিছু ঘটে গেল, কেউই আর কোনো কথা বলছিল না।
রুদ্রই প্রথম নীরবতা ভাঙল, ‘আজ সকালে তুমি অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর একটা লোক আমার কাছে ছবিগুলো হাতাতে এসেছিল।’
প্রিয়ম উদাস চোখে তাকিয়ে ছিল দূরে। আনমনে বলল, ‘কোন লোক?’
রুদ্র বলল, ‘একটা জাপানি লোক। সঙ্গে একটা বিশাল বাইক। লোকটাকে আমি কাল মাদাম তুসোর উলটোদিকের ওই কফিশপটায় বসে থাকতে দেখেছিলাম, তারপর আমরা বেরোনোর পর দেখেছিলাম, আর আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার সময়ে বাইক নিয়ে দেখেছিলাম। আজ সকালে এসে ও ওই সিকিউরিটি জনের সঙ্গে কথা বলছিল। লিফটে করে ওপরে এসে পৌঁছোনোর আগেই আমি নেমে যাই, কিন্তু মাঝপথে আমায় ধরে ফেলে ঠিক।’
প্রিয়ম এবার ভ্রূ কুঁচকে রুদ্রর দিকে তাকাল, ‘তারপর?’
রুদ্র ফোনটা বের করল, ‘বলছি। আগে এই ছবিটা দ্যাখো তো।’
প্রিয়ম একঝলক দেখেই বলল, ‘এটা তো কাল রাতেই দ্যাখালে। ড শ্যুমাখার রানি এলিজাবেথের থেকে প্রাইজ নিচ্ছেন। এসব ছাড়ো, ওই লোকটা কে সেটা বলো।’
রুদ্র ফটোটাকে জুম করল, ‘ভালো করে ড শ্যুমাখারকে লক্ষ করো তো!’
প্রিয়ম ঝুঁকে পড়ে দেখতে দেখতে বলল, ‘দেখলাম তো! কালো রঙের সুট, হাতে একটা বেশ দামি ঘড়ি, পায়ে কালো শু, চোখে রিমলেস…।’
রুদ্র একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল, ধীরে ধীরে বলল, ‘চোখ দুটো লক্ষ করেছ?’
প্রিয়ম ছবিটাকে আরও জুম করতে গেল, কিন্তু আর হল না, ‘চোখ? হ্যাঁ, দেখছি তো। চোখে আবার কী পেলে তুমি?’
রুদ্র এবার বলল, ‘মণির রংটা দেখেছ?’
প্রিয়ম আরও একবার ছবিটা নিয়ে দেখে ওর দিকে তাকাল, ‘মণির রং যা হয় তাই, কালো।’ পরক্ষণেই ও অবাক হয়ে বলল, ‘ওয়েট ওয়েট! ড শ্যুমাখারের চোখের মণিটা নীলচে না?’
রুদ্র বলল, ‘কারেক্ট! নীলচে নয়, পুরোপুরি নীল রঙের মণি ভদ্রলোকের। আর সেইজন্য কাল থেকে এই ছবিটা দেখলেই আমার কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল, কিছু একটা গণ্ডগোল আছে সেটা আমার ইনটিউইশন বলছিল।’
প্রিয়ম ততক্ষণে যে ওয়েবপেজে ওই ছবিটা ছিল, তাতে ঢুকে ওই অনুষ্ঠানের বাকি ছবিগুলো দেখতে শুরু করেছে। একটা ছবিতে ড শ্যুমাখারের ক্লোজ আপ ছবি নেওয়া হয়েছে, কৃতিত্বের হাসি হাসছেন উনি। সেখানেও তাঁর মিশমিশে কালো মণিটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ও একটু কনফিউজড হয়ে গিয়ে বলল, ‘কেসটা কী বলো তো? লেন্স ইউজ করেছে?’
রুদ্র কাধ ঝাঁকাল, ‘যদি লেন্স ইউজ করে থাকে, তবে কোনটা ওর চোখের আসল রং, নীল না কালো?’
প্রিয়ম এবার আর কোনো উত্তর দিতে পারল না।
রুদ্র বলল, ‘আচ্ছা, এবার আরেকটা কথা বলো, কাগজের ফোটোগ্রাফ যদি কেউ কোনো কেমিক্যাল প্রিজারভেটিভ ছাড়া সাধারণ ডায়েরির মধ্যে রেখে দেয়, সেটা কতদিন থাকতে পারে?’
প্রিয়ম বলল, ‘সেটা কী করে বলব?’
রুদ্র খাবারের প্যাকেটটার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা স্যান্ডউইচ বের করে আনল, সেটায় এক কামড় বসিয়ে বলল, ‘বলতে পারবে না, না? আচ্ছা, বিয়ের পর যখন প্রথম তোমাদের কল্যাণীর বাড়িতে গিয়ে ছিলাম কিছুদিন, তোমার বাবা—মায়ের বিয়ের ফটোগুলো দেখেছিলাম মনে আছে? তোমার মা—ই বের করে দেখিয়েছিলেন।’
প্রিয়ম বলল, ‘হ্যাঁ, কিন্তু সে তো অর্ধেকই নষ্ট হয়ে গেছে, ওরা ঠিকমতো অ্যালবামেও রাখেনি প্রথম থেকে, কেমন সাদা সাদা স্পট ছেয়ে গেছে বেশিরভাগ ফটোতেই, অনেকদিন হল তো!’
রুদ্র বলল, ‘হুঁ। কতদিন হল তোমার বাবা মা—র বিয়ে হয়েছে যেন?’
প্রিয়ম বলল, ‘প্রায় ত্রিশ বছর। কেন?’
রুদ্র বলল, ‘ত্রিশ বছরে যদি ফটোর ওই দশা হয়, তাও একভাবে আলমারির মধ্যে থেকে, তবে প্রায় একশো বছর আগের ছবি, তার ওপর ইন্ডিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এত দেশ ঘুরেছে, সেগুলোর তো ওই সাদা স্পটে পুরো ফটোটাই ঢেকে যাওয়া উচিত। শুধু তাই নয়, ফটোর পেপারটাও ড্যামেজড হয়ে ছিঁড়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ড শ্যুমাখারের দাদুর ডায়েরির ভাঁজে রেখে যাওয়া ওই দশটা ফটো কিছুই হয়নি, একদম অবিকৃত রয়েছে। ফটোপেপারটাও সাদা হয়নি, নেতিয়ে যায়নি একটুও, শুধু কোনাগুলো হালকা মোড়ানো, সেই ভাঁজটাও দেখে মনে হচ্ছে টাটকা। যেন আমি সন্দেহ করতে পারি বলে দেওয়ার আগে ইচ্ছে করে কোণগুলো মোচড়ানো হয়েছে।’
‘আমাকে একটা দাও তো, খাই। বড্ড খিদে পেয়েছে।’ প্রিয়ম এবার রুদ্রর হাত থেকে স্যান্ডউইচটা নিয়ে একটা কামড় দিল, ‘এটা কিন্তু একটা ভালো পয়েন্ট ধরেছ তুমি, আমার মাথাতেও আসেনি। সত্যিই তো, অত বছরের পুরোনো ছবি এখনও এমন ইনট্যাক্ট থাকে কী করে?’
রুদ্র বলল, ‘হুঁ। সকালে যে লোকটা এসেছিল, তাকে আমি আগের দিন দেখেছিলাম আমাদের ফলো করতে, তাই কাল সকালেও যখন দেখলাম জনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে, তারপর আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকছে, আমি ভেবেছিলাম এ সেই দলের লোক, যারা ডেসপারেটলি ড শ্যুমাখারের ওই রিসার্চটা পণ্ড করতে চায়, যেকোনোভাবে ওই ফটোগুলো হাতানোই ওর উদ্দেশ্য। তাই আমি আর রিস্ক নিইনি। ওকে আসতে দেখেই আমিও ফটোগুলো নিয়ে লিফট দিয়ে নীচে নেমে যাই। তখন এতটাই পাজলড হয়ে গেছিলাম, মনে হচ্ছিল আমার কাছ থেকে যদি ফটোগুলো ছিনিয়ে নেয়, আমি মুখ দেখাব কী করে, সেই সময়েই হঠাৎ ড শ্যুমাখারকে ফোন করে ফেলি। ঠিক করেছিলাম ওঁর সঙ্গে দেখা করে ফটোগুলো হ্যান্ডওভার করে দেব, কী দরকার শুধু শুধু রিস্ক নিয়ে! কিন্তু মাঝপথেই লোকটা ঢুকে এল লিফটের মধ্যে।’
প্রিয়ম চুপচাপ শুনছিল, রুদ্র থামার সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘তারপর?’
রুদ্র কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই হুড়মুড়িয়ে কিছু একটা ওর ওপরে পড়ল, ও ছিটকে উঠে এল চেয়ার থেকে। ওর সারা গা ভিজে গেছে, ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠেছে প্রিয়মও।
ওরা দুজনে কথা বলছিল প্ল্যাটফর্মের ওপর এয়ারপোর্টের কায়দায় সাজানো সার সার চেয়ারে বসে। লোকজন এমনিতেই কম, তার ওপরে এই প্ল্যাটফর্মটায় কোনো ট্রেন নেই, তাই এত রাতে একদমই ফাঁকা চারদিক। ওদের নিজেদের ট্রেন এখনও দেয়নি ডিসপ্লে বোর্ডে। তারই মধ্যে ওদের ঠিক পেছনের চেয়ারটায় কেউ একটা বিশাল বড়ো লাগেজ রেখে চলে গেছে, ওরা খেয়াল করেনি। সেই লাগেজের একদম ওপরের পকেটে থাকা একটা জলের বোতলের ছিপি খুলে গেছে হঠাৎ, মুহূর্তে ছিপি খুলে বোতলের সবটুকু জল পড়েছে রুদ্রর কাঁধে। এই ঠান্ডায় এত কনকনে জল গায়ে পড়ার থেকেও এতটাই আচমকা ঘটল ঘটনাটা, ওরা কিছুক্ষণের জন্য হতবাক হয়ে গেল।
প্রিয়মই প্রথম কথা বলল, ‘ওয়াশরুমে চলো শিগগিরই! কে রেখে গেছে এরকম কেয়ারলেসভাবে? পাসপোর্টটার কিছু হয়নি তো?’
তাই তো রুদ্র খেয়ালই করেনি, পাসপোর্টটা তো হাতেই ধরে বসে ছিল ও, তাকিয়ে দেখল কোনাগুলো ভিজে গেছে অল্প, ঠিক সময়ে ও সরে গেছে বলে বেশিরভাগ জলটাই ওর ঘাড়ে পড়েছে, ঘাড় বেয়ে পিঠের দিকে গিয়ে পুরো ভিজিয়ে দিয়েছে, সপসপ করছে ওর পুলওভারের ভেতরের থার্মালটা।
ও বলল, ‘কার বলো তো লাগেজটা?’
প্রিয়ম বলল, ‘কী জানি! কাউকে তো এদিকে আসতে দেখিনি! তুমি আগে চলো ওয়াশরুমে। এই ঠান্ডায় ভিজে গায়ে থাকলে এক্ষুনি সর্দি হবে তোমার। ভাগ্যিস বোতলটা খুলে গেছিল, অত ভারী স্টিলের জলভরতি বোতল মাথায় পড়লে তো আরেক কেলেঙ্কারি হত। চলো চলো।’
কিন্তু ওয়াশরুম অবধি আর যাওয়া হল না। তার আগেই ওদের ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম নম্বর দিয়ে দিল ডিসপ্লে বোর্ডে। প্রিয়ম তবু বলল, ‘চলো, ওয়াশরুম ঘুরে তারপর যাব। তুমি রুকস্যাক থেকে একটা এক্সট্রা জামা বের করো।’
কিন্তু রুদ্র রাজি হল না, ‘দরকার নেই। লন্ডন থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরোতে চাই। তেমন হলে ট্রেনে উঠে চেঞ্জ করব না হয়।’
ওরা ওই প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্তও ওই বিশাল লাগেজের মালিকের দেখা পাওয়া গেল না। সেন্ট প্যানক্রাস খুব বড়ো স্টেশন। এ—মাথা থেকে ও—মাথা হাঁটতে হল যতক্ষণ ধরে, ততক্ষণে ঠান্ডা জল ভেতরে ঢুকে রুদ্রর কাঁপুনি লাগতে শুরু করেছে।
গলার কাছটাও ব্যথা করতে শুরু করেছে কেমন।
ট্রেনে উঠে ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে অস্ফুটে একটাই কথা ও বিড়বিড় করল, ‘জলের বোতল খুলে পড়তেই পারে, কিন্তু এই ঠান্ডায় এত কনকনে জল কে নিয়ে বেরোয়!’
শেষমুহূর্তে টিকিট কাটার জন্য বেশ চড়া দাম দিয়ে টিকিট কাটতে হয়েছে ওদের, এখানে ট্রেনের টিকিটের দামও প্লেনের মতো বাড়ে কমে। তবে, বার্থ ভালোই পেয়েছে ওরা, একটাই ক্যুপের মধ্যে দুজন। জার্মানি এখান থেকে লাগবে প্রায় দশ ঘণ্টা। মাঝে ব্রাসেলসে পালটাতে হবে ট্রেন। তার মানে, রুদ্র মনে মনে হিসাব করল কাল সকাল দশটার আগে ট্রেন বার্লিন ঢুকবে না।
ওয়াশরুম থেকে জামা পালটে এসে ও দেখল, প্রিয়ম খাবারগুলো সামনের ছোট্ট টেবিলের ওপর সাজিয়ে ফেলেছে।
রুদ্র দরজাটা ভাল করে লক করে এসে ওর হাতব্যাগটা খুলল, একটা লুকোনো চেন খুলে বের করে আনল ফটোর খামটা।
প্রিয়ম বলল, ‘আচ্ছা, তুমি যে দুমদাম করে আমায় বের করে দিয়ে এলে, আমার যদি শেনজেন ভিসা করানো না থাকত? তবে তুমি একাই চলে যেতে?’
রুদ্র মুচকি হাসল, ‘তুমি তো আগের মাসেই বলেছিলে ফ্রান্সের ভিসা করিয়ে রেখেছ, আমার সঙ্গে প্যারিস যাবে বলে। পরে তো তোমার এই অফিসের কাজটা পড়ে গেল।’
প্রিয়ম কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসল, ‘মনেও রাখতে পারো তুমি! যাই হোক, লোকটা কে, সেটা বলো এবার।’
রুদ্র সংক্ষেপে পুরো ঘটনাটা বলল।
প্রিয়ম শুনে হতবাক হয়ে গেল, ‘তুমি লোকটার চোখে লঙ্কাগুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়ে পালিয়ে এলে? যদি চিৎকার করত? পুলিশ ডাকত? তোমাকে তো ইমিডিয়েট বেসিসে অ্যারেস্ট করত! আমারও ওয়ার্ক ভিসা নিয়ে টানাটানি হত।’
রুদ্র বলল, ‘রিস্ক নিতেই হয়েছিল। কিছু করার নেই। ফটোগুলো আমি দেব না বলেই ঠিক করেছিলাম। আর দেব না বললে যদি জোর করে কেড়ে নিত, তাই ইন্ডিয়ান থেরাপি দিলাম একটু।’
প্রিয়ম তবু তোতলাচ্ছিল, ‘তবু লঙ্কাগুঁড়ো! কী ডেঞ্জারাস! লোকটা মরে যায়নি তো?’
রুদ্র উড়িয়ে দিল একফুঁয়ে প্রিয়মের কথা, ‘চোখে লঙ্কাগুঁড়ো ছেটালে কেউ মরে? কী যে বল তুমি! শুধু চোখটা জ্বলে খাক হয়ে যাবে, এই যা। আর লোকটা নিজে দু—নম্বরি বলে চেঁচিয়ে জানাজানি করবে না সেই কনফিডেন্সটা আমার ছিল। তাই, ওটা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। এর জন্য অবশ্য তোমার একটা থ্যাঙ্কস প্রাপ্য, কত সুন্দর করে মশলাগুলো কিচেনে গুছিয়ে রাখো তুমি।’
প্রিয়ম কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না, তারপর নরম গলায় বলল, ‘এবার বলবে কী, তোমার মাথায় আরও কী কী মতলব ঘুরছে? তুমি কখন যে কী করে ফেলছ, ইনফ্যাক্ট দুমদাম আরও কী কী করে ফেলতে পারো সেটা আমি বুঝে উঠতে পারছি না।’
রুদ্র মুখ টিপে বলল, ‘আপাতত কিছুই করছি না, বার্লিন যাচ্ছি।’
‘আমরা কেন বার্লিন যাচ্ছি? তুমি ফটোগুলো এই মুহূর্তে হাতছাড়া করতে চাইছ না খুব ভালো কথা, কিন্তু তাই বলে এত দূর কেন, প্যারিস গেলেই তো হত। কিংবা ইংল্যান্ডেরই অন্য কোনো শহরে, ওয়েলস বা স্কটল্যান্ডের দিকটাও চলে যাওয়া যেত। এর জন্য আমার অফিসে কতদিন ছুটি লাগবে আমি নিজেই জানি না। একে এখন এত প্রেশারে আছি। আর তা ছাড়া।’ প্রিয়ম বোতল থেকে জল খেল অনেকটা, ‘ড শ্যুমাখারকে ব্যাপারটা বললে উনিও হেল্প করতে পারতেন! আল্টিমেটলি জিনিসটা হাতছাড়া না হওয়ার পেছনে তো ওঁর গরজটাই বেশি।’
রুদ্র এবার মাথা নাড়ল, ‘আমার নিজের মনে কিছু কনফিউশন তৈরি হয়েছিল, সেগুলোর উত্তর না পেলে আমি কাউকেই ভরসা করতে পারছিলাম না। ড শ্যুমাখারের ছবিতে একরকম চোখ, সামনাসামনি আরেকরকম কেন? একশো বছরের পুরোনো ফটোগ্রাফ এত নতুনের মতো ঝকঝকে হয় কী করে? যে মুহূর্তে আমি ফোনে ড শ্যুমাখারকে বলে দিয়েছি যে আমি ফটোগুলো নিজের কাছে রাখা নিরাপদ মনে করছি না, সেই মুহূর্ত থেকে ড শ্যুমাখার যেকোনো উপায়ে ফটোগুলো ফেরত পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন, এদিকে এই লোকটাও যে কার হয়ে এই ফটোগুলোকে দখল করার জন্য ফলো করছিল সেটাও মাথায় ঢুকছে না। কে যে সত্যি, আর কে যে মিথ্যে, আমি পুরোপুরি কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি।’
প্রিয়ম মুখ দিয়ে একটা বিরক্তির শব্দ করে বলল, ‘আমরা এক্সটারনাল হিসেবে এত ঝামেলা না নিয়ে পুলিশের কাছে গিয়ে ব্যাপারটা বলে জিনিসটা জমা দিয়ে দিলেই হত। সব ঘোরা বাতিল, সব প্ল্যান বানচাল।’
রুদ্র এবার সোজা চোখে তাকাল প্রিয়মের দিকে, ‘আর যদি ড শ্যুমাখারের দাবি সত্যি হয়? ওর মতলব ভালো না মন্দ জানি না, কিন্তু ওই মৌলর ব্যাপারটা তো ঠিক হতেও পারে। ক্যান্সারের মতো অভিশাপের হাত থেকে পুরো পৃথিবীকে মুক্ত করতে পারি জেনেও সেটাকে ব্যুরোক্র্যাটিক ঝামেলার মধ্যে ফেলে দেব? পুলিশের কাছে জমা দেওয়া মানেই এই নিয়ে সরকারি তরফে ইনভেস্টিগেশন শুরু হবে। ওই এলিমেন্ট প্রয়োগ করা উচিত কি উচিত নয়, তা নিয়ে পৃথিবীর সমস্ত দেশকে মত দিতে হবে আন্তর্জাতিক মহলে। কাজ কিছু হবে কি না তার নেই ঠিক, সারা পৃথিবী জুড়ে এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যাবে। কোনো রেভলিউশনারি ভালো কাজ করতে গেলে চুপচাপই করতে হয়, অত হইহই করে আর সেটা করা যায় না। লাদেনকে মারার সময় ওবামা কি সারা দুনিয়াকে জানিয়ে অপারেশনটা চালিয়েছিল? সাকসেসফুল হওয়ার পর বলেছিল সবাইকে। আর সেটাই উচিত।’
প্রিয়মের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, ও বলল, ‘তার মানে তুমি বলতে চাইছ ড শ্যুমাখার কোনো অসাধু কাজের জন্যও তোমার মদত চাইতে পারেন?’
রুদ্র বলল, ‘চাইতেই পারেন। সেটা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না।’
‘কিন্তু এইটা আমার মাথায় এখনও ঢুকল না যে হোয়াই বার্লিন?’ প্রিয়ম বলল।
রুদ্র এবার খামটা খুলল। ফটোগুলোকে সাবধানে বের করে সাজিয়ে রাখল সামনে। একটা ফটো তুলে পেছন দিকটা ঘুরিয়ে ওপরের দিকে তুলল, ‘কিছু দেখতে পাচ্ছ?’
প্রিয়ম হাত থেকে ফটোটা নিতে যেতেই রুদ্র বলল, ‘উঁহু। ওভাবে দেখলে দেখতে পাবে না। ওপরের দিকে নিয়ে দ্যাখো, হলোগ্রাম তো।’
প্রিয়ম ফটোটা নিয়ে ওপরের দিকে তুলে কিছুক্ষণ দেখল, ‘কয়েকটা অস্পষ্ট ইংরেজি হরফ দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু ওয়ার্ডটার কোনো মানে নেই। কী বলো তো?’
রুদ্র বলল, ‘আগে যখন ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল না, আমরা ফটো তুলে তারপর ফিলমটা স্টুডিয়োতে দিতাম, মনে আছে? সেখান থেকে প্রিন্ট করার সময় ফটোর পেছনে স্টুডিয়োগুলো এইরকম করে নিজেদের হলোগ্রামটা খোদাই করে দিত।’
প্রিয়ম বলল, ‘হ্যাঁ, শুধু ফটো কেন, ভালো কোয়ালিটির পেপারেও তো কোম্পানির হলোগ্রাম করা থাকে, কাগজটা ওপরের দিকে তুলে আলোয় দেখলে বোঝা যায়।’
রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘এই ফটোগুলোর পেছনে যে দুটো শব্দ লেখা আছে, সে—দুটো জার্মান শব্দ। ক্যাসপার ফোতোগ্রাফি।’
প্রিয়ম খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলল, ‘কিন্তু ফটোগ্রাফি বানানটা তো অন্যরকম।’
রুদ্র বলল, ‘জার্মান ভাষায় ওটাই বানান। আমি নেটে সার্চ করেছি, ক্যাসপার শব্দের অর্থ জার্মান ভাষায় হল রয়্যাল।’
প্রিয়ম বলল, ‘মানে, রয়্যাল ফটোগ্রাফি?’
রুদ্র এবার ফটোটা প্রিয়মের হাত থেকে নিয়ে টেবিলে সাজাতে সাজাতে বলল, ‘ক্যাসপার ফটোগ্রাফি বার্লিনের একটা বড়ো স্টুডিয়ো। বছর চল্লিশের পুরোনো। বেশ নামকরা। ফটোগুলো ওখান থেকেই প্রিন্ট করা হয়েছে।’
প্রিয়ম এইবার ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘বছর চল্লিশের পুরোনো? কিন্তু ড শ্যুমাখারের দাদু তো প্রায় একশো বছর আগে এই ফটোগুলো রেখে গেছেন।’
রুদ্র হাতের কাজ থামিয়ে এবার প্রিয়মের দিকে তাকাল, ‘এবার বুঝতে পারছ কেন আমি এতটা ধন্দে রয়েছি? ড শ্যুমাখারের দাদু একশো বছর আগে ভারতের পন্ডিচেরিতে বসে ফটোগুলো তুলে প্রিন্ট করিয়ে ডায়েরিতে রেখে দিলেন, এদিকে জার্মানির একটা চল্লিশ বছরের স্টুডিয়োর হলোগ্রাম সেই ফটোগুলোর পেছনে ছাপা হয়ে গেল, এটা কী করে সম্ভব? আমি ওই স্টুডিয়োর ওয়েবসাইটটাও ভালো করে দেখেছি, এরকম নয় যে আগে ওদের কোনো পেরেন্ট অফিস ছিল কোথাও। পরিস্কার লেখা আছে উনিশশো আশি সালে তৈরি হয়েছে।’
প্রিয়ম চিন্তা করে করতে বলল, ‘তুমি কি বার্লিনে যাচ্ছ ওই স্টুডিয়োটায় যাবে বলে?’
রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘গিয়ে আমি জিজ্ঞেস করব যে কীভাবে এই হলোগ্রামটা এই ফটোগুলোয় এল। আর শুধু সেজন্যই যাচ্ছি তা নয়, বার্লিনে ড শ্যুমাখারের সম্বন্ধেও কিছু খোঁজখবর নেওয়ার আছে আমার।’
প্রিয়ম বলল, ‘কিন্তু তোমাকে ওরা উত্তর দেবেই—বা কেন। তুমি তো কোনো পুলিশ বা সরকারি তরফে যাচ্ছ না, তার ওপর বিদেশি। আর তা ছাড়া, যে এই কাজের সঙ্গে তোমাকে ইনভলভ করেছে, সে নিজেই যদি তোমার মনে কনফিউশন তৈরি করে থাকে, তবে তো ব্যাপারটা থেকে সরে আসাই ভালো ছিল, এটা তো আর নিজেদের কোনো সমস্যা নয়, এ যেন আগ বাড়িয়ে বিপদের মধ্যে জড়ানো, তাই নয় কি?’
রুদ্র স্থির চোখে তাকিয়ে রইল প্রিয়মের দিকে।
প্রিয়ম আবার বলল, ‘এই উটকো ঝামেলার জন্য মাঝখান থেকে আমার অফিস কামাই, তোমার ঘোরা ক্যানসেল, সামনের সপ্তাহে সেমিনার, কী করবে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
রুদ্র এবার হাসল, ম্লান মুখে বলল, ‘তোমার এই কথাটা শুনে মার্টিন নিয়েমোলারের সেই বিখ্যাত কবিতাটা মনে পড়ে গেল। কাকতালীয়ভাবে তিনিও জার্মানিরই লোক ছিলেন। আজ দুপুরে জার্মানি নিয়ে যখন ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম, তখন এটা আরও একবার চোখে পড়েছিল একটা ব্লগে। কবিতাটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা। হিটলারের নাতসি বাহিনী যখন চরম অত্যাচার চালাচ্ছে সারা দেশে, আনছে একের পর এক অদ্ভুত আইন, সাধারণ মানুষের সমস্ত মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, তখনও জার্মানির ওপরমহলের লোকেরা চুপ করেই ছিলেন, ঠিক তোমারই মতো, সারা দেশে যতই অত্যাচার হোক, তাঁদের নিজেদের গায়ে যতক্ষণ না আঁচ লাগছে, তাঁরা কেন কিছু বলবেন? তাই তাঁরা নির্লিপ্ত ছিলেন। পড়েছ কবিতাটা?’
প্রিয়ম দু—দিকে মাথা নাড়ল।
রুদ্র ফোনে গুগল খুলে কবিতাটা বের করল, তারপর এগিয়ে দিল প্রিয়মের দিকে।
‘প্রথমে ওরা সোশ্যালিস্টদের জন্য এসেছিল, আমি কিছু বলিনি
কারণ আমি তো সোশ্যালিস্ট নই!
তারপর ওরা ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের জন্য এল, আমি কিচ্ছু বলিনি
কারণ আমি তো ট্রেড ইউনিয়নিস্ট নই!
তারপর ওরা এল ইহুদিদের জন্য, আমি তখনও কিচ্ছু বলিনি
কারণ আমি ইহুদি নই!
সবশেষে ওরা এল আমার জন্য
কিন্তু তখন আমার হয়ে বলার জন্য আর
কেউই বেঁচে ছিল না!’
প্রিয়ম বলল, ‘ইহুদি তো ইজরায়েলের লোকেদের বলে, তাই না?’
রুদ্র বলল, ‘ইহুদি একটা বহু পুরোনো জাতি, জার্মানিতেও তারা প্রচুর আছে। তবে ইজরায়েলেই বেশি। কবিতাটার আসল মানেটা কী বুঝলে? যেমন ধরো, ওদের দেশে হিটলার ক্ষমতায় এসে অন্য সমস্ত পার্টি, ট্রেড ইউনিয়ন ব্যান করে দিয়েছিল, উচ্চবিত্তরা কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি। যদিও এই কবিতাটা তার আগেই লেখা, তবু ওই কনটেক্সটে ভীষণভাবে প্রযোজ্য। হিটলার তো কনসেনট্রেশন ক্যাম্প করে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে মেরে ফেলেছিল। তাতেও খুব একটা প্রোটেস্ট করেনি কেউ।’
প্রিয়ম বলল, ‘অ্যাঁ! লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরেছিল? সে কী?’
রুদ্র এবার অবাক হল, ‘হিটলারের কাজকর্ম পড়োনি নাকি হিস্ট্রিতে?’
প্রিয়ম এবার বলল, ‘পড়েছিলাম, সে তো কোন যুগে, আর আমার আগের বছরেই পরীক্ষায় হিটলার এসেছিল, তাই ওটা বাদই দিয়েছিলাম একরকম।’
রুদ্র ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর বলল, ‘তোমার কথাবার্তা শুনে না মাঝেমধ্যে মনে হয় তুমি ডাক্তার হলে কী করতে! পেশেন্টের যদি দেখতে এমন একটা রোগ হয়েছে, যেটা তোমার আগের ইয়ারে এসেছিল বলে তুমি সাজেশনে পড়নি, তখন কি পেশেন্টকে না দেখেই ছেড়ে দিতে?’
প্রিয়ম এবার বলল, ‘সেটা অন্য ব্যাপার, বস! সব কিছুই নিজের ইন্টারেস্টের ওপর ডিপেন্ট করে। ইতিহাস আমার জঘন্য লাগত, পড়তে বসলেই ঘুম পেত। তোমার বাড়িতে ঐতিহাসিক অ্যাম্বিয়েন্স ছিল, তাই। আমার বাড়িতে কস্মিনকালেও কোনো ইতিহাসের লোক ছিল না, ফলে আমি পাতিহাঁসও হইনি। আমার ফেভারিট ছিল অঙ্ক, সেটাতে আমি সবসময় এক ক্লাস করে এগিয়ে থাকতাম।’
রুদ্র এবার চোখ পাকাল, ‘আমার বাবা যেমন আর্কিয়োলজিস্ট ছিলেন, মা—ও তেমনই কলেজে অঙ্ক পড়ান, তুমি নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি। অঙ্কে ভালো মানেই সে ইতিহাস জানবে না এটা কোনো কথা হল? বেসিকটা জানা উচিত সবারই। আর অঙ্কে আমিও যথেষ্ট ভালো ছিলাম স্যার।’
প্রিয়ম বলল, ‘আচ্ছা বাবা, দেশে ফিরেই আবার নাইন টেনের হিস্ট্রি বই কিনে পড়া শুরু করব, শান্তি? এখন বলবে কী? হিটলার ইহুদিদের মেরেছিল কেন? কেউ কিছু বলেনিই—বা কেন?’
রুদ্র বলল, ‘কে আবার কী বলবে? কোনো অপোনেন্ট পার্টির অস্তিত্বই রাখেনি হিটলার। সব পার্টি ব্যান করে দিয়েছিল। আর হিটলার ইহুদিদের সবচেয়ে বড়ো শত্রু মনে করত।’
প্রিয়ম বলল, ‘আচ্ছা একটা কথা বলো, হিটলার তো জার্মানির প্রধানমন্ত্রী ছিল?’
রুদ্র বলল, ‘হ্যাঁ। ওদের দেশে ওই পোস্টটাকে বলে চ্যান্সেলর।’
প্রিয়ম বলল, ‘হ্যাঁ, সেটা জানি। তা, চ্যান্সেলর হয়েছিল মানে তো লোকেরাই ওকে জিতিয়েছিল, রাইট? তারপরেও ওকে কুখ্যাত নেতা বলে কেন? শুধু স্বৈরাচারী ছিল বলে?’
রুদ্র এবার বাবু হয়ে বসল বার্থের মধ্যেই, ‘আমি আজ সারা দুপুর নেট থেকে হিটলারের সম্পর্কে প্রচুর পিডিএফ নামিয়ে পড়াশুনো করেছি। কারণ ড শ্যুমাখারের সঙ্গে হিটলারের কোনো একটা যোগাযোগ আছে।’
প্রিয়ম চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ‘অ্যাঁ? শ্যুমাখারের সঙ্গে হিটলারের? সে আবার কী?’
রুদ্র বলল, ‘ইয়েস! সেকথায় পরে আসছি। আগে তোমাকে মোটামুটি একটা ধারণা দিয়ে দিই, না হলে তুমি বুঝতে পারবে না। আমি নিজেও এত ডিটেইলে জানতাম না, বাবা ফোনে বলল, তারপর নিজেও পড়লাম। শোনো, হিটলার একটা খুব রেয়ার ক্যাটেগরির সাইকো ছিল, ওর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল একমাত্র জার্মানরাই পৃথিবী শাসন করবে, তারাই একমাত্র সব ব্যাপারে এগিয়ে থাকবে। হিটলারের রাজত্বের ঠিক আগে আগেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল, তাতে মিত্রশক্তি, মানে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকার জোট জিতেছিল। আর অন্যদিকে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, এইসব দেশ খুব বাজেভাবে হেরেছিল। যুদ্ধ শেষ হয় ভার্সাইয়ের সন্ধি দিয়ে, তাতে যুদ্ধের সব দোষ সব দায় মিত্রশক্তির জয়ী দেশগুলো চাপায় জার্মানির ওপর। এমনকী জার্মানির আর্মড ফোর্সও বন্ধ করে দেয়।’
প্রিয়ম মন দিয়ে শুনছিল, ‘তারপর?’
রুদ্র বলল, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানি একেই ধুঁকছিল, তার ওপর ওই দেশগুলোর মোটা ক্ষতিপূরণের বোঝা মেটাতে গিয়ে জার্মানিতে মারাত্মক ইনফ্লেশন দেখা দেয়। টাকার কোনো দামই ছিল না, একেকটা জিনিসের দাম রাতারাতি হাজার হাজার গুণ বেড়ে গিয়েছিল। এইসব কিছুর জন্য হিটলার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ছোটো থেকে ওর একটা ধারণা হয়েছিল—জার্মানির হার, বেকারত্ব, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সব কিছুর জন্য দায়ী মাইগ্রেশন। ইহুদিরা অন্য দেশ থেকে জার্মানিতে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। সেই আক্রোশ থেকেই ও মাস কিলিং শুরু করে।’
প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, ‘মানে, ইহুদিদেরকে ধরে ধরে খুন করত?’
রুদ্র বলল, ‘তার চেয়েও ভয়ংকর। হলোকাস্ট—এর নাম শোননি? পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যক্কারজনক কালো অধ্যায় বলতে পারো। ষাট লক্ষেরও বেশি ইহুদিকে হিটলারের নাতসি পার্টি মেরে ফেলেছিল। হাজার হাজার কিলিং ক্যাম্প খোলা হয়েছিল।’
প্রিয়ম বলল, ‘কিলিং ক্যাম্প! মানে সেই ক্যাম্পে খুন করা হত লোকজনকে?’
রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘একদম। বিষাক্ত গ্যাস ঢুকিয়ে মেরে ফেলা হত তাদের। পনেরো লক্ষের বেশি ইহুদি শিশুকেও মারা হয়েছিল তাতে।’
প্রিয়ম মাথা নাড়ল, ‘হুঁ, এই নিয়ে একটা সিনেমা দেখেছিলাম অনেকদিন আগে। আচ্ছা ওগুলোই কি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প?’
রুদ্র বলল, ‘না। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে হিটলারের দৃষ্টিভঙ্গিতে যারা দেশের শত্রু তাদের সবাইকে রাখা হত। তাদের মধ্যে ইহুদি, রোমানরা ছিল। আবার দাগি ক্রিমিনাল বা গুরুতর অসুস্থদেরও রাখা হত। তাদেরকে দিয়ে অমানুষিক খাটানো হত। মুরগির খামারের মতো গাদাগাদি করে থাকতে হত ওদের, যখন—তখন কারণে অকারণে মেরে ফেলত। মেয়েদের ওপর অকল্পনীয় অত্যাচার চলত। মানে, সব নাগরিক অধিকারই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তাদের। আর কিলিং ক্যাম্পে শুধুই বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে, কিংবা একদম অনাহারে রেখে খাটিয়ে খাটিয়ে মারা হত। অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরি পড়নি?’
প্রিয়ম চোখ সরু করে শুনছিল। ও একটু আবেগপ্রবণ, দুঃখের সিনেমা বা বই পড়লেও ওর চোখে জল চিকচিক করে ওঠে, সেখানে এ তো সত্যি ঘটনা। তুলনায় রুদ্র অনেক শক্ত।
রুদ্র থামতেই প্রিয়ম বলে উঠল, ‘এই বিষাক্ত গ্যাসটা কী?’
রুদ্র বলল, ‘হিটলারের সময়ে কেমিস্ট্রিতে অনেকরকম ইনভেনশন শুরু হয়েছিল। শুধু পয়জনাস গ্যাসই নয়, শক্তি বাড়ানোর ক্যাপসুলও বের করা হয়েছিল, ক্ষতিকারক ড্রাগ ছিল তাতে। ওইজন্যই একটা মিথ আছে শোননি? জার্মান সৈন্যরা কখনো ক্লান্ত হত না? ওদের শরীরে ওই ড্রাগগুলো ইনজেক্ট করা হত।’
প্রিয়ম চুপ করে মাথা নাড়ল।
রুদ্র এবার বলল, ‘যাই হোক যেটা বলছিলাম, হিটলারের এত কাণ্ডেও জার্মানির উচ্চবিত্তেরা কোনো প্রতিবাদই করেনি তারা নিজেরা নিরাপদ আছে ভেবে। তার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুরো জার্মানিই শেষ হয়ে গেল।’ এক মুহূর্ত থেমে ও একটা লম্বা শ্বাস নিল, ‘আসলে আমরা সবাই স্বার্থপর, যতক্ষণ না নিজের গায়ে আঁচ লাগছে, ততক্ষণ পাশের লোকেরা পুড়ে মরছে দেখলেও আমরা কেয়ার করি না, ভাবি আমি তো ঠিক আছি, আমার কী দরকার আগ বাড়িয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে! ঠিক তুমি যেমনটা বললে। আর এইরকমভাবেই একদিন নিজের গায়েও এসে সেই আগুনটা লাগে। আজকে যদি ড শ্যুমাখারের কথা ঠিক হয়, ওর মতলব বদ বুঝতে পারছি, কিন্তু সত্যিই যদি ওইরকম কোনো কেমিক্যাল বানানো যায়, সারা পৃথিবী চিরকালের মতো ক্যান্সারকে জয় করতে পারবে, কিন্তু তবুও তা নিয়ে তোমার কোনো মাথাব্যথাই নেই, কেন? না, তোমার কোনো প্রিয় মানুষের ক্যান্সার হয়নি এখনও। এই যদি দুম করে আমার ক্যান্সার ধরা পড়ে…।’
প্রিয়মের এবার চোখমুখ কুঁচকে গেল, একটু জোরেই বলল, ‘আজেবাজে বকছ কেন বলো তো?’
রুদ্র চোখ দুটো সরু করে বলল, ‘আজেবাজে কিছুই বকছি না, শুনলে তো সেদিন, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন অলরেডি ডিক্লেয়ার করে দিয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে ক্যান্সার মহামারির আকার নেবে, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দেখা দেবে। আর সত্যিই তো তাই হচ্ছে! তুমি দ্যাখো না, ইদানীং অফিসে, পাড়ায়, বন্ধুমহলে সব জায়গায় হঠাৎ হঠাৎ শুনতে পাও না? অমুকের ক্যান্সার, তমুক হঠাৎ মারা গেল ক্যান্সারে?’
প্রিয়ম ঘাড় নাড়ল, ‘হুঁ। খুব বেড়ে গেছে আজকাল। মানুষের লাইফস্টাইল, খাবারদাবারে পেস্টিসাইডস, কেমিক্যালস, তারপর পলিউশনও এইজন্য দায়ী।’
রুদ্র বলল, ‘তবে?’
প্রিয়ম বলল, ‘তাহলে এত এদিক—ওদিক না ভেবে, ওই শ্যুমাখারের মণির রং কী, এই ফটোগুলো কোথা থেকে ডেভেলপড এইসব নিয়ে মাথাখারাপ না করে ফটোগুলো থেকে কিছু বের করতে পারো কি না দেখলেই হয়। সত্যি যদি কোনো নতুন এলিমেন্ট তৈরির প্রসিডিয়র লেখাও থাকে, তুমিই তো প্রথম বুঝতে পারবে সেটা।’
রুদ্র একটু অধৈর্য হয়ে বলল, ‘তোমাকে যদি কেউ কোনো জিনিস চুরি করে নিয়ে এসে গিফট করে, আর সেটা তুমি জানতে পারো, তারপরেও তুমি নিয়ে নেবে? কী বলছ বলো তো! আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না!’
প্রিয়ম বলল, ‘যাব্বাবা, চুরিডাকাতি আবার এর মধ্যে কোত্থেকে এল! ড শ্যুমাখারের দাদুই তো এটা…!’
রুদ্র বলল, ‘আরে, সেটা তো ওর নিজের কথা। সত্যি মিথ্যে জানি আমরা? ডায়েরিটা দেখিয়েছেন উনি আমাদের? ওঁর কথামতো ডায়েরিতে তো পুরো জিনিসটা নাকি ওই দাদু ন্যারেট করে গেছেন যে এই ফটোগুলোর মধ্যেই ওই এলিমেন্ট তৈরির প্রসেস রয়েছে, ওঁর রিসার্চ প্রোগ্রেস সব কিছু নিজের ভাষায় লিখে গেছেন, সেটা তো শ্যুমাখার আমাদের দেখাননি!’ একটু থেমে ও বলল, ‘আর আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট শিয়োর যে বললেও উনি দেখাতে পারবেন না।’
Leave a Reply