অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – রুদ্র-প্রিয়ম সিরিজ ৩ – দেবারতি মুখোপাধ্যায় – প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ২০১৮
অঘোরে ঘুমিয়ে শিব কোনো ইতিহাস নয়, একটি কাল্পনিক উপন্যাস। এই কাহিনি কোনো ব্যক্তি, সম্প্রদায়, ধর্ম, প্রতিষ্ঠান অথবা সংগঠনের অনুভূতিতে আঘাত বা কুৎসা করার উদ্দেশ্যে রচিত হয়নি। কোনো রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ বা প্রচারের উদ্দেশ্য এই উপন্যাসের লেখকের বা প্রকাশকের নেই। ঘোরে ঘুমিয়ে শিব উপন্যাসের সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত অথবা মৃত কোনো ব্যক্তির বা তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে এই কাহিনির কোনো মিল পাওয়া গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়। এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র, ঘটনাবলি এবং পটভূমির কিয়দংশ লেখকের কল্পনাপ্রসূত। উপন্যাসে উল্লিখিত বিভিন্ন তত্ত্বের ব্যাখ্যা এবং সেগুলোর সত্যতার দায় কোনোভাবেই লেখক বা প্রকাশকের নয়। বিভিন্ন তত্ত্বের সূত্র এবং সংশ্লিষ্ট গ্রন্থপঞ্জি বইয়ের শেষে উল্লেখ করা হয়েছে।
.
যাঁর কলমের মায়াবী গতিপথে দিক হারিয়েছি
বার বার, ওপার বাংলার সেই অবিসংবাদী স্রষ্টা
হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতির উদ্দেশে
লেখকের কথায়
‘বেশ তো লিখছিলেন রহস্যরোমাঞ্চ, ইতিহাস, বিজ্ঞান মিলিয়ে মিশিয়ে। প্রেম, সামাজিক লেখাও সমান্তরালে এগোচ্ছিল। পত্রপত্রিকা, পুজোসংখ্যায় গল্প-উপন্যাসও দেখতে পাচ্ছি নিয়মিত। কিন্তু হঠাৎ এইসব? আগুনে হাত কি না দিলেই চলছিল না?’
‘এত কিছু থাকতে হঠাৎ এমন বিতর্কিত বিষয় কেন? একেই সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা চারদিকে উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে, ধর্মকে শিখণ্ডী করে মানুষ রাজনীতি থেকে নিজের আখের গোছানো, সবেতেই ফায়দা লুটছে, সেখানে জেনেশুনে ঘৃতাহুতি দেওয়ার কী আছে বাপু!’
ওপরের উক্তি দুটি সমুদ্রে নিমজ্জিত হিমশৈলের চূড়ামাত্র। উপন্যাস প্রকাশের মাসছয়েক আগে উপন্যাসটির পটভূমিকা হিসেবে একটি ভিডিয়ো ট্রেলার আন্তর্জালে প্রকাশ করা হয়েছিল। তারপর থেকে এমন শয়ে শয়ে বার্তা গত কয়েক মাসে আমার কাছে এসেছে। বলা বাহুল্য, সেই সব বার্তাই যে নিখাদ প্রশ্নসূচক বা বিস্ময়সূচক ছিল তা নয়, অনেকগুলিই তার মধ্যে ছিল বেশ ভীতিপ্রদর্শনকারী।
প্রথমেই স্পষ্ট করে দিই, রুদ্র-প্রিয়ম সিরিজের তৃতীয় উপন্যাস হিসেবে অঘোরে ঘুমিয়ে শিব-এ এমন বিতর্কিত বিষয় বেছে নেওয়ার পেছনে রাজনৈতিক, ধার্মিক, বা ব্যাবসায়িক কোনো উদ্দেশ্যই আমার কাছে বড়ো হয়ে ওঠেনি। তাজমহল ভারতবর্ষের অহংকার, মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের এক অনন্যসুন্দর নিদর্শন। পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাজাহান তাঁর প্রিয়তমা মহিষী মুমতাজ মহলের অকালপ্রয়াণে কাতর হয়ে তাজমহল নির্মাণ করেন। শুভ্রধবল মার্বেল পাথরের এই অসামান্য স্মৃতিসৌধ দেখতে সারা পৃথিবী থেকে আগ্রা শহরে পর্যটকরা ভিড় জমান। আমিও ছোটো থেকে একাধিকবার আগ্রা গিয়েছি।
কিন্তু বছরসাতেক আগে আমার হাতে হঠাৎই একটা বই এসে পড়ে, যার লেখক পুরুষোত্তম নাগেশ ওক নামের এক প্রাক্তন সেনা অফিসার। ভদ্রলোক ব্রিটিশ আর্মির হয়ে সিঙ্গাপুরে যুদ্ধে লড়তে গিয়েছিলেন, কিন্তু নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কিছুদিন পরেই তিনি যোগ দেন আজাদ হিন্দু ফৌজ-এ।
স্বাধীনতার পর তিনি ভারতের ইতিহাস পুনর্লিখনের কাজে আগ্রহী হয়ে পড়েন, এই উদ্দেশ্যে একটি প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করেন এবং বিভিন্ন প্রামাণ্য নথি দিয়ে ইতিহাসকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন। তাঁর সমস্ত গবেষণার মধ্যে সবচেয়ে আলোড়ন ফেলা ও কৌতূহলউদ্রেককারী বক্তব্য ছিল, তাজমহল আদপেই শাজাহানের কীর্তি নয়, এটি আসলে প্রায় আটশো বছর আগের এক শিবমন্দির ও প্রাসাদ, যা কালের নিয়মে হস্তান্তর হতে হতে হিন্দু রাজা মানসিংহের দখলে এসে পড়ে, শাজাহান মানসিংহের পৌত্র জয়সিংহের থেকে এটি অধিগ্রহণ করে মুসলিম স্মৃতিসৌধে রূপান্তরিত করেন।
বিশ্বের ইতিহাসে চটজলদি জনপ্রিয়তা পাওয়ার লোভে আজগুবি তাক লাগানো বক্তব্য পেশকারী লোকের সংখ্যা কিছু কম নেই। ওকমহাশয় ঠিক না ভুল, তাঁর গবেষণা আদৌ ইতিহাসের প্রমাণনির্ভর না একপেশে অনুমাননির্ভর, তাই নিয়েও বিতর্ক হয়েছে প্রচুর। তাঁর বইয়ে লেখা যুক্তিগুলো একের পর এক নস্যাৎ করেছেন কেউ কেউ, আবার তাঁর থিয়োরিতে আবিষ্ট হয়েছেন এমন মানুষও আছেন।
ক্রমশ ওক-এর এই বক্তব্য সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে, অনেক ইতিহাসবিদ তাঁক সমর্থন করে আরও নতুন তথ্য সংযোজন করতে থাকেন, আবার অনেকে তাঁর মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। ইতিহাসের প্রকৃত সত্য অনুসন্ধান এবং ধর্মের গায়ে কুঠারঘাত এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য বোঝার মতো ধীশক্তি অধিকাংশ নাগরিকেরই নেই, সরকারও এই বিষয়ে ততোধিক সতর্ক। ফলে সময় এগোয়, আর সমান্তরালে তাজমহল সম্পর্কে এই দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটিও যুগ যুগ ধরে জনশ্রুতিতে স্থায়ী হতে থাকে।
ওক নিজে প্রকৃত ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট অবধি গিয়েছিলেন, অনেক ধর্মীয় বা রাজনৈতিক দলও যেকোনো কারণেই হোক, মাঝেমধ্যেই এখনও তাজমহলের এই বিতর্কিত দিক নিয়ে ধুয়ো তোলে।
আমি নিজে শাজাহানের রাজত্বকালে উপস্থিত ছিলাম না, কাজেই ওক ঠিক না ভুল, সেই তর্কে আমার কোনো বক্তব্য নেই, তাজমহল বিতর্কে উপসংহার টানার মতো ধৃষ্টতাও আমি করব না। আমি শুধুমাত্র এই বিতর্কের ওপর নির্ভর করে সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে একটি কল্পনাশ্রয়ী উপন্যাস লিখতে চেয়েছি। আবারও বলছি এটি কোনো ইতিহাস নয়, একটি নির্ভেজাল উপন্যাস। কোনো ঐতিহাসিক গবেষণায় সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে এই উপন্যাস রচনা করা হয়নি। তাজমহল বিতর্ক এই উপন্যাসের একমাত্র বিষয়ও নয়, একটি অংশমাত্র।
আমার বার বার আগ্রা যাওয়ার ক্ষেত্রে এবং তথ্যসংগ্রহের কাজে অনেক মানুষ এই উপন্যাস রচনায় ভীষণভাবে সাহায্য করেছেন। তাঁদের সংখ্যা এতই বেশি যে আলাদা করে উল্লেখ করা অসম্ভব। তাঁদের প্রত্যেকের কাছে আমি বিশেষভাবে ঋণী।
যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি বিতর্ককে কেন্দ্র করে কল্পনার তুলিতে সাহিত্য রচনাই এই উপন্যাসের উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য কতটা সফল, তাতে সিলমোহর দেবেন আপনারই। ভালো-মন্দ যা-ই লাগুক, প্রতিক্রিয়া জানালে ভালো লাগবে।
দেবারতি মুখোপাধ্যায়
www.authordebarati.com
প্রাক্কথন
২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭
প্রৌঢ় থরথর করে কাঁপছিলেন।
বড়োদিনের ঠান্ডায় বা কোনো অসুস্থতায় নয়, আতঙ্কে।
আলো ঝলমলে ক্রিসমাসের রাত। সবে বারোটার কাঁটা ছুঁয়েছে ঘড়ি। শতাব্দীপ্রাচীন উত্তরপ্রদেশের প্রাচীন নগরী আগ্রার অলিতেগলিতে সুন্দর আলোকসজ্জায় স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে চারদিক। ইতিহাসের লোদী রাজত্ব থেকে শুরু করে দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস, তাঁদের বিভিন্ন কীর্তি ইতস্তত চারদিকে ছড়ানো থাকলেও এই শহর আয়তনে বেশ ছোটো, আর্মি ক্যান্টনমেন্ট থাকার সুবাদে উত্তর ভারতের অন্যান্য ঘিঞ্জি শহরগুলোর তুলনায় বেশ পরিচ্ছন্নও বটে। যমুনা নদী একছড়া মুক্তোর মালার মতো এঁকেবেঁকে গোটা নগরীকে যেন সাপের মতো বেঁধে রেখেছে।
.
শোনা যায়, এককালে এই যমুনা নদীর দুই তীরে মুঘল দরবারের আমির-ওমরাহের প্রাসাদোপম বাড়ি, অট্টালিকা মুকুটের রত্নের মতো অবস্থান করত। আর সেই সমস্ত মনোরম স্থাপত্যের মাঝে রাজরানি হয়ে জ্বলজ্বল করত পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাজাহানের অমর কীর্তি- তাঁর পরলোকগতা স্ত্রী মুমতাজ বেগমের উদ্দেশে বানানো তাজমহল। আসলত খান, হসদার খান, মহব্বত খান, আজম খানদের মতো উচ্চপদস্থ মন্ত্রী-অমাত্যের প্রাসাদোপম হাভেলিগুলো তাজমহলের দু-পাশে, যমুনা নদীর দুই তীরে থাকায় আগ্রার সৌন্দর্য হাজারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, প্রচুর বিদেশি শিল্পীদের আঁকায় আজও উজ্জ্বল আছে সেই গৌরবময় স্মৃতি।
কালের নিয়মে সবই বদলায়। আগ্রা শহরও এখন তার কৌলীন্যের খোলস ছেড়ে জনসাধারণের জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে অভিযোজিত করে নিয়েছে। যে পথে একসময় দুলকিচালে হেঁটে যেত বাদশাহের হাতি, এখন সেখানে ছোটে অফিসটাইমের ব্যস্ত ভিড়ে ঠাসা বাস। বাদশাহজাদার বিশেষ পছন্দের কোনো নর্তকীর ঘুঙুরের মূর্ছনায় যে বাড়ির প্রতিটা ইট নৃত্যের তালে তালে যোগ্য সঙ্গত করত, এখন সেখানে হয়তো দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ কোনো শপিং মল।
কমলানগর এই শহরের বেশ অভিজাত জায়গা। তাজমহল থেকে কিছুটা পশ্চিমদিকে যমুনা নদীর পাড়েই প্রায় আয়তাকার এই অঞ্চলে বেশ উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত মানুষজনই থাকেন। বড়ো বড়ো একেকটি সুদৃশ্য বাড়ি, মাঝখান দিয়ে চওড়া রাস্তা, কিছুটা জায়গা অন্তর বাচ্চাদের খেলার পার্ক এই কমলানগরের জমির দাম প্রায় আকাশছোঁয়া করে তুলেছে।
আজ বড়োদিনের রীতি মেনেই সুন্দর করে সাজানো রাস্তায় সবাই পরিবারের সঙ্গে বেরিয়েছে। কেউ নদীর পাড় বরাবর হাঁটছে, কেউ আবার হেঁটে চলেছে দূরের খ্রিস্টান কলোনির গির্জার দিকে।
কোনো বাড়ি থেকে ভেসে আসছে গরম কেকের সুগন্ধ।
কিন্তু কমলানগরের একদম শেষে যে রাজস্থানী কাইলা দেবীর মন্দির রয়েছে, তার ঠিক পাশের সবুজ দোতলার বাড়িটার একদম কোণের ঘুপচি ঘরটাতে বসে সেই প্রৌঢ়র আতঙ্ক বেড়েই চলেছিল। নিজেকে শান্ত রাখতে দামি কুর্তার হাতা দিয়ে এই ঠান্ডাতেও তিনি কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছলেন।
দোতলা এই বাড়িটা বেশ সুন্দর, কমলানগরে বাকি বাড়িগুলোর মতোই সামনে গাড়িবারান্দা, গেট পেরিয়েই একপাশে সুন্দর একফালি বাগান।
কিন্তু কোনো কিছুই যেন ঠিক আর আস্ত নেই। এক ঝলক তাকালেই বোঝা যায়, গোটা বাড়িটার ওপর দিয়ে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে। গাড়ির সামনের কাচ ভেঙে কাচ ছড়ানো রয়েছে এদিক-ওদিক। ফুলের গাছগুলোর কাণ্ড ধরে কেউ বা কারা নির্দয়ভাবে টেনেছে, গাছের পাতাসুদ্ধু ডাঁটিগুলো গড়াগড়ি খাচ্ছে সামনের লনে। গেটটা ঈষৎ খোলা। তার ওপরের অংশে লেগে থাকা ছেঁড়া একটা জামার টুকরো হাওয়ায় উড়ছে পতপত করে।
প্রৌঢ় যে ছোট্ট খুপরির মতো ঘরটায় বসে কাঁপছিলেন, তার পেছনেই দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, তাতে আলো জ্বলছে টিমটিম করে। সেখান দিয়ে দ্রুতগতিতে শোনা যাচ্ছে কিছু পায়ের আওয়াজ।
যারা বীরবিক্রমে ওপরে উঠছে তারা একতলাটা প্রায় শ্মশান বানিয়ে দিয়েছে এর মধ্যে। একতলার পুরোটাই তাঁর লাইব্রেরি, গবেষণার জায়গা। প্রৌঢ়ের গলার কাছটা কষ্টে দলা পাকিয়ে উঠছিল, কোনো বই-ই বোধ হয় আর আস্ত নেই এই নরাধমদের আক্রমণে।
এই বিপদের মধ্যেও তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
প্রৌঢ়র এই ঘরটা অনেকটা পুরোনো দিনের জমিদারবাড়ির চোরাকুঠুরির মতো, দোতলার একটা ঘরের বিশাল এক আলমারির পেছন দিয়ে কপিকল টেনে ঢুকতে হয়। কেউ আগে থেকে না জানলে এই ঘরের হদিশ পাওয়া বেশ কঠিন। অনেক ভেবেচিন্তেই এই ঘরটা তিনি বানিয়েছিলেন। গোটা খুপরিটাতেই পুরোনো বইয়ের গন্ধ, ছোটো ছোটো দেরাজে রয়েছে দুর্মূল্য বই, অমূল্য পুথি।
দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠেই ওরা আবার বাধা পেল। সামনে আরও একটা দরজা, সেটা ভেতর থেকে বন্ধ। দোতলার মাটিতে পা দিতে গেলে এই দরজা খুলতেই হবে।
প্রৌঢ় শুনতে পেলেন, মুহুর্মুহু কর্কশ ধাক্কা পড়ছে সেই দরজায়, সঙ্গে চাপা গলায় শাসানি, ‘দরজা না খুললে কিন্তু ভেঙে ঢুকব। আমরা ঠিক এক থেকে পাঁচ গুনব, তার মধ্যে যদি না খুলিস…!’
প্রৌঢ় শুনতে পাচ্ছেন সব, ভয়ে তাঁর স্নায়ুর দৌরাত্ম্য এতই বেড়ে গেছে যে মনে হচ্ছে বুকে হাতুড়ি পেটার মতো হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনিও ওরা শুনতে পাবে। কাঁপতে কাঁপতে তিনি শুনতে পেলেন, ‘এক… দুই!’
রোগা মানুষটা কোনোমতে হাতের মুঠোয় ধরা জিনিসটা শক্ত করে ধরলেন, ঘামে ইতিমধ্যেই জবজবে হয়ে উঠেছে সেটা। অন্য হাতে পুরোনো আদ্যিকালের ঢাউস মোবাইলে কয়েকটা নম্বর হাতড়ে হাতড়ে টিপে কানে দিলেন।
রিং হচ্ছে, তার সঙ্গেই তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন দেওয়ালের ওপাশের হুংকার, ‘তিন… চার!’
ওপাশে কেউ ফোন রিসিভ করতেই প্রৌঢ় ঢোঁক গিলে ফিসফিস করে বলতে লাগলেন, ‘ওরা আ-আবার এসেছে। লাঠিসোঁটা নিয়ে। একতলায় পাগলের মতো খুঁজেছে, পায়নি। এইবার ওপরে আসছে।’
ওপাশ থেকে কে কী বলছে, প্রৌঢ় কিচ্ছু শুনতে পেলেন না। বললেন, ‘চিন্তা নেই, আমাকে মেরে ফেললেও জিনিসটা ওরা পাবে না। এমন বুঁদ হয়েছিলাম যে কখন যে ওরা ঢুকে পড়েছে বুঝতে পারিনি। একটা ব্যাপার আসলে কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। রাজার দশ রানি, কিন্তু ন-টা ঘর। কিন্তু ন-টা ঘরের মধ্যেই দশ রানিকে থাকতে হবে। এটার মানে কী? চান্দেলা রাজাদের এমন দৈন্যদশা কবে হল!’ প্রৌঢ় কাতরস্বরে বলতে লাগলেন, ‘যাইহোক তুমি কাউকে পাঠাও, বাড়ির কাছে এসে ফোন করতে বলবে, আমি আসতে বললে তখন যেন আসে।’
ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ শোনার আগেই প্রৌঢ়ের মনে হল, তাঁর কানে যেন তালা লেগে গেল।
হিংস্রভাবে ‘পাঁচ’ উচ্চারণের পরেই ক্রমাগত আঘাতে মড়মড় শব্দে ভেঙে পড়ল দোতলার সিঁড়ির মুখের দরজাটা। ধুপধাপ শব্দে কারা ওপরে উঠে আসতে লাগল।
১
এক মাস পর …
২৪ জানুয়ারি, ২০১৮
একটা নাতিদীর্ঘ অফিশিয়াল চিঠি, যার ছত্রে ছত্রে বিভিন্ন পরিসংখ্যান এবং তথ্য তুলে বক্তব্য পেশ, সবশেষে অভিযোগ এবং অনুসিদ্ধান্ত।
রুদ্রাণীর অত কিছু চোখে পড়ল না, শুধু চিঠির একদম নীচে মোটা হরফে লেখা বাক্যটাই ওর মাথায় বনবন করে ঘুরতে লাগল।
You are hereby temporarily suspended from duties and ordered to submit your explanation within 3 days from the receipt of this letter, pending investigation against the alleged corruption. Your ongoing suspension will be kept under review.
কপালের দু-পাশের রগ দুটো দপদপ করছিল, রুদ্রাণী প্রাণপণে সেই জায়গা দুটো টিপে ধরে চোখটা বন্ধ করল।
কেবিনের কাচের জানলার ওপাশে রক্তিম হয়ে ওঠা সূর্য তখন তার অস্তগামী ম্রিয়মাণ আভা মলিনাকারে বিতরণ করে চলেছে। দূরের মসজিদ থেকে গোধূলি সন্ধ্যার ‘আল্লা হো আকবর’ আজান ভেসে আসছে ধীর লয়ে।
সেই আজানের করুণ সুর যেন এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে রুদ্রকেও।
এই শহরের বেশিরভাগ অংশই এই অত্যাধুনিক একবিংশ শতকেও যেন সেই মুঘল আমলেই পড়ে রয়েছে। রাস্তাঘাটের গজিয়ে ওঠা সুপারমার্কেট, শপিং মলের মাঝেও কোথায় যেন মধ্যযুগের একটা সূক্ষ্ম সুতো গোটা শহরটাকে বেঁধে রেখেছে।
ঘরের পুরোনা ঘড়িটায় ঢং ঢং করে ছ-টা বাজল। সঙ্গে সঙ্গে সুরেশ বলে সাবস্টাফটা চা-বিস্কুট নিয়ে পর্দা সরিয়ে কেবিনে ঢুকল, ‘ম্যাডামজি, চায়ে।’
রুদ্র ক্লান্ত চোখে তখনও চিঠিটায় চোখ বোলাচ্ছিল, আলতোভাবে পেন বোলাচ্ছিল বাক্যগুলোর ওপর।
চিঠিটা এসেছে দিল্লির হেড অফিস থেকে, তারিখ আজকের। হিসেবমতো দিল্লি থেকে এখানে স্পিড পোস্টে আসতে কমপক্ষে একদিন লাগার কথা, কিন্তু গুরুত্ব অনুধাবন করে হেড অফিসের সাবস্টাফকে দিয়ে হাতে হাতে পাঠানো হয়েছে এই চিঠি।
যে ঘটনার জন্য রুদ্রর বিরুদ্ধে আঙুল উঠেছে, তা গতকালের। একদিনের মধ্যেই হেড অফিস ব্যাপারটা ট্র্যাক করে রুদ্রর এগেইনস্টে ইনভেস্টিগেশনও চালু করে দিল?
এত তৎপর কবে থেকে হল হায়ার ম্যানেজমেন্ট?
রুদ্র একটা বড়ো নিশ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে বসে কম্পিউটারে সেই কাস্টমারের অ্যাকাউন্ট ডিটেইলস খুলল। সাধারণ সেভিংস অ্যাকাউন্ট। গড় ব্যালেন্স থাকে হাজার তিরিশেক মতো।
কাস্টমারের পেশা?
রুদ্র চোখ সরু করে খুঁজতে লাগল ব্যাঙ্কের ডেটাবেসে, হাজার হাজার তথ্য কিলবিল করছে সেখানে।
ভদ্রলোকের বয়স আটান্ন, বাড়ি দয়ালবাগ। পেশা অধ্যাপনা। কোন কলেজে?
নাহ! সেটা লেখা নেই।
রুদ্র গভীরভাবে গত তিনদিনের ওই অ্যাকাউন্ট থেকে হওয়া সমস্ত ট্রানজ্যাকশন খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল। সাধারণত বাইরে থেকে কোনো টাকা এলে যে পাঠাচ্ছে, তার নাম দেওয়া থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে গত দু-দিনের ট্রানজ্যাকশনের ডিটেইলসে প্রেরকের কোনো তথ্য নেই। কিছু অর্থহীন অক্ষর রয়েছে, বিদেশের বেনামি অ্যাকাউন্ট থেকে নানা সোর্স পালটে টাকা পাঠালে যেমন হয়।
সুরেশ বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এবার ইতস্তত করতে শুরু করল। ম্যাডামকে বলে না গেলে চা টেবিলে থেকে থেকেই ঠান্ডা জল হয়ে যাবে।
পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সে আবার মিনমিন করল, ‘ম্যাডামজি, আপকি চায়ে।’
রুদ্র চমকে উঠে একহাতে চায়ের কাপটা সুরেশের হাত থেকে নিল, অন্য হাতে গোটা ট্রানজ্যাকশন স্টেটমেন্টটা প্রিন্ট করতে দিয়ে হিন্দিতে বলল, ‘সুরেশ, অমিতকে একবার ডেকে দাও তো!’
মিনিট দুয়েক পরে অমিত পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল। কাস্টমার ডিলিং চারটের পরই শেষ, এখন ব্যাঙ্কের ইন্টারনাল কাজের সময়। সারাদিনের কাজের শেষে অমিতের চোখ-মুখ বিধ্বস্ত, চুল উশকোখুশকো, ইন করা শার্ট এদিক-ওদিক বেরিয়ে পড়েছে, ‘বলুন, ম্যাডাম।’
রুদ্র ইঙ্গিতে অমিতকে বসতে বলে চিঠিটা ওর দিকে এগিয়ে দিল। এই ব্রাঞ্চে রুদ্র ম্যানেজার হয়ে এসেছে প্রায় বছরখানেক, ছোটো ব্রাঞ্চ হলেও বিজনেস এখানে বেশ ভালো। চারজন ক্লার্ক আর একজন অফিসার নিয়ে রুদ্রর সংসার। বাড়ি থেকে এতদূরে এসে একটা গোটা ব্রাঞ্চের হাল ধরা খুব সহজ কথা নয়, যদি না অমিতের মতো তরুণ দক্ষ একজন অফিসারকে রুদ্র জুনিয়র হিসেবে পেত। এখানকার কোন বিজনেসম্যান কতটা বিশ্বাসী, কাকে লোন দিলে সেটা নন পারফর্মিং অ্যাসেট অর্থাৎ অনাদায়ী হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য, কোথায় ক্যাম্পেন করলে টার্গেট অ্যাচিভ করা যাবে চটজলদি, সবেতেই অমিত প্রকৃত পরামর্শদাতার কাজ করে থাকে।
অমিত পড়তে পড়তে চমকে উঠল, ‘সাসপেনশন অর্ডার! আপনার?’ পুরোটা পড়ে ওর চোখ প্রায় কপালে উঠে গেছে, ‘এসব কী, ম্যাডাম! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
রুদ্র অলসভাবে ঘাড়ের পেছনে হাত দুটো রেখে চেয়ারে এলিয়ে দিল গোটা শরীরটা, ‘পরশু রাত থেকে এই ব্রাঞ্চের একটা সেভিংস অ্যাকাউন্টে অজানা কোনো সোর্স থেকে মোট দেড় কোটি টাকা ঢুকেছে। একবারে নয়, খেপে খেপে। প্রায় তিনশোটা ট্রানজ্যাকশন। ঢুকেছে গতকাল ভোর পর্যন্ত। সোর্সও স্পষ্ট নয়।’ প্রিন্ট আউটটা ও সামনের দিকে এগিয়ে দিল।
অমিত স্টেটমেন্টটা দেখতে দেখতে অস্ফুটে বলল, ‘এত টাকা!’
‘ইয়েস!’ রুদ্র চায়ের কাপে একটা চুমুক দিল, ‘হেড অফিসের বক্তব্য, কেন আমি ইমিডিয়েটলি ভিডিল্যান্সে জানাইনি।’
‘কিন্তু একটা ব্রাঞ্চে কয়েক হাজার অ্যাকাউন্ট। কোন অ্যাকাউন্টে কখন কী টাকা ঢুকছে, সেটা ব্রাঞ্চ হেড কী করে জানবে?’ অমিতের গলায় বিস্ময়।
‘অমিত! আর দু-তিন বছরের মধ্যে তুমিও ব্রাঞ্চ হেড হবে, এইরকম প্রশ্ন তোমার থেকে এক্সপেক্টেড নয়।’ রুদ্রর গলায় এই অবস্থাতেও মৃদু তিরস্কার ঝরে পড়ল, ‘প্রতিদিন সন্ধেবেলায় সব ব্রাঞ্চে একটা এক্সেপশন রিপোর্ট জেনারেট করতে হয়। এইরকম কোনো সন্দেহজনক অ্যাক্টিভিটি হলে সেই রিপোর্টেই সেটা ধরা পড়ে।’
‘তা, কালকের রিপোর্টটাতে এটা ছিল না, ম্যাডাম?’
রুদ্র একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘তুমি তো কাল ছুটি নিয়েছিলে, ব্রাঞ্চে চাপ ছিল। তারপর একটা লোনের ইনস্পেকশনে চলে গিয়েছিলাম বিকেলে দেরি হয়েছিল, ওখান থেকে বাড়ি চলে গেছিলাম। রিপোর্ট বের করার কথা মনে ছিল না।’
অমিত বলল, ‘কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সে-খবর হেড অফিসে পৌঁছোল কীভাবে? মানে, এগুলো তো যখন ব্রাঞ্চে অডিট করতে আসে, তখন ধরা পড়ে।’
‘সেটাই আমিও ভাবছি।’ রুদ্র বলল।
‘দাঁড়ান, আপনি প্রথমেই টেনশন করবেন না। দিল্লিতে হেড অফিসে আমার কিছু চেনাজানা আছে, আমি তাদের আগে ফোন করে দেখি কিছু জানা যায় কি না।’ অমিত ওর মোবাইলে খুটখাট করতে লাগল।
টেনশনের আর কী, রুদ্র মনে মনে ভাবল। ওর ভাগ্যটাই এই! যখনই কোনো আনন্দের সম্ভাব্য মুহূর্ত এগিয়ে আসতে থাকে, ঠিক সেই সময় পরিষ্কার নির্মেঘ আকাশে অনাহূত ঝঞ্ঝার মতো দেখা দেয় কালো কালবৈশাখী। যদিও নিয়তিতে ওর বিশ্বাস নেই বিন্দুমাত্র, তবু প্রতিবার ওর সঙ্গেই এমন হয় কেন?
আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরোবে ভেবেছিল। বাড়িতে গিয়ে ঘরদোর গোছানোর আছে। আগ্রা শহরে ও ট্রান্সফার হয়ে এসেছে প্রায় বছর ঘুরতে চলল। এই প্রথম বাবা মা ওর কাছে আসছেন। কাল সকাল বেলায় আগ্রা পৌঁছোবেন ওঁরা। এই সপ্তাহে প্রজাতন্ত্র দিবস আর শনি রবিবারের সঙ্গে এদিক-ওদিক ছুটি নিয়ে বেশ এক সপ্তাহের ছুটি প্ল্যান করে রেখেছিল রুদ্র।
আর আজ এত বড়ো বিপর্যয়!
অমিত দু-তিনজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলল। কথোপকথনের সঙ্গে সঙ্গে ওর কপালের ভাঁজ দুটো আরও চওড়া হচ্ছিল। অবশেষে ফোন রেখে বলল, ‘ম্যাডাম, এটা নাকি আগ্রা পুলিশ কমিশনারেটের অফিস থেকে ফোন যাওয়ার পর হেড অফিস ট্রেস করেছে।’
‘পুলিশ কমিশনারেট? কেন?’ রুদ্র কথাটা শেষ করতে পারল না, তার আগেই পর্দা সরিয়ে উঁকি দিলেন দু-জন সাফারি পরা ভদ্রলোক, ‘আগ্রা পুলিশ থেকে আসছি। আপনিই ব্রাঞ্চ ম্যানেজার তো?’
রুদ্র মনে মনে প্রস্তুত হয়ে নিল, তারপর মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল, ‘হ্যাঁ, আসুন।’
আড়চোখে ও সেই কাস্টমারের নামটা একবার দেখে নিল।
অঘোরেশ ভাট।
২
গ্রীষ্মের সকাল, এর মধ্যেই চড়া রোদ উঠে খাঁ খাঁ করছে। তবু তারই মধ্যে পুরো জায়গাটায় অন্তত হাজারখানেক লোকের সমাগম হয়েছে। গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা একমাত্র নদীর পাশেই এই শ্মশান, তবে এখন দূর থেকে শ্মশান না ভেবে কোনো আঞ্চলিক মেলা বলে ভ্রম হতে পারে। ঢাক, ঢোল, কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজে পাশের জনের কথাও ভালোভাবে শোনা যাচ্ছে না। তার ওপর অগুরু জাতীয় এক উৎকট উগ্র গন্ধযুক্ত সাদা ধোঁয়ায় চোখ জ্বলছে, দেখাও যাচ্ছে না বিশেষ। তার মধ্যে মন্ত্রোচ্চারণ চলছে, একাধিক ব্রাহ্মণ বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে ওর স্বামীর স্বর্গারোহণের পথকে সুগম করে তুলছেন।
সঙ্গে ওরও।
ওকে সিদ্ধি জাতীয় কিছু একটা বেটে খাইয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। ফলে, মাথাটা ঝিমঝিম করছিল বেশ, চোখ ঢুলে আসছিল অনবরত, সামনের মাটিটা হঠাৎ যেন উঁচু পাহাড়ের মতো ঠেকছিল। চোখটা জ্বালাও করছে বেশ।
এখানে আসার আগে ওর মাথায় অন্তত পাঁচ থেকে সাত ঘড়া জল ঢালা হয়েছে যথেচ্ছভাবে, সেই জল মোছানোর তাগিদও অনুভব করেনি কেউ। তবে তাতে এই গরমের মধ্যে ওর বেশ ঠান্ডাই লাগছে, শিরশিরে একটা কাঁপুনিও হচ্ছে মাঝে মাঝেই।
ওর এগারো বছর তিন মাসের অক্ষতযোনি দেহটায় লম্বা চুল থেকে জলের বড়ো বড়ো ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছিল। কপাল থেকে নেমে আসা একটা জলের ধারাকে হাত দিয়ে মুছতে যেতেই ওর গোটা হাত সিঁদুরে মাখামাখি হয়ে গেল।
ওর মনে পড়ল স্নানের পর ওর সারা মুখে সিঁদুর লেপে দেওয়া হয়েছে।
গ্রামের প্রধান পুরোহিতের কথাটা আবার মনে পড়ল- মাথায় সিঁদুর নিয়ে কুলীন স্বামীর চিতায় সহমৃতা হওয়া ভীষণ পুণ্যের কাজ।
তার মধ্যেই ও বেশ বুঝতে পারছিল, শরীরের ভেতরে আজ সকালেই প্রথম আবির্ভূত হওয়া ঝর্ণাধারাটা অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতোই রজঃস্রাবের প্রথম রক্ত নিয়ে বয়ে চলেছে ওর শরীরের নিম্নাঙ্গে। মা-কে মৃদু গলায় জানিয়েছিল ও ঘটনাটা।
শুনে মায়ের বিলাপ চতুর্গুণ বেড়ে গিয়েছিল।
প্রকৃতির কী অদ্ভুত পরিহাস! যে মেয়ে এগারো বছর বয়সে বিধবা হল, যে মেয়ে কখনো স্বামীসঙ্গই পেল না, যাকে আর কয়েক ঘণ্টা বাদে ষাটোর্ধ্ব কুলীন শিরোমণি স্বামীর সঙ্গে একই চিতায় উঠে সহমৃতা হয়ে এই ধরাধাম পরিত্যাগ করতে হবে, তাকেও কেন ঋতুমতী হতে হয়?
চোখ জুড়ে আসছিল, তবু অনেক কষ্টে সামনে চেয়ে দেখল কিছু প্রতিবেশিনী উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে চলেছেন, তারই মধ্যে সমান্তরাল ক্ষিপ্রতায় হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। তাঁদের বাড়িতে ছোটো ছেলে-মেয়েগুলো হয়তো এখনও খাবার খায়নি, কিন্তু তাতে খুব একটা ভ্রূক্ষেপ নেই কারুর। সতী হতে দেখাটাও মহাপুণ্যের কাজ, আর সেই পুণ্যের ভাগীদার হতে সবাই চায়।
ওর স্বামীর চিতা সাজানো হচ্ছে। সঙ্গে ওরও।
এতদূর থেকে ও শুধু চিতার কাঠের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা ওর স্বামীর পা দুটো দেখতে পাচ্ছিল। সে-দুটো দেখে ওর কোনোরকম ভাবান্তর হল না। স্বামীকে দেখেছেই বা ক-দিন? গোটা অঞ্চলের নানা গ্রামে তাঁর এত স্ত্রী ছিলেন, প্রত্যেকের কাছেই যেতে হত সেবা করার সুযোগ দিতে। নিয়মমাফিক হাজিরা দিতে দিতেই বছর ঘুরে যেত। ও সবচেয়ে ছোটো হওয়ায় কোনোদিন কথা বলেছে বলেও মনে পড়ে না। বিয়ে হয়েও তো ছিল আট মাস হল। স্বামীর স্পর্শও কোনোদিন পায়নি। তবু নিয়ম অনুযায়ী ওকেই সহমৃতা হতে হবে। সর্বকনিষ্ঠা ভার্যাই আদর্শ এই কাজে, এমনিতেই এই বয়সের বিধবা সমাজে সকলের সঙ্গে বসবাস করা খুবই অহিতকর, সকালে বলা গ্রামের প্রধান পুরোহিতের কথা আবার মনে পড়ল ওর। তার ওপর ওর স্বামী নিজেও মৃত্যুর আগে ওকেই সহমৃতা হওয়ার আদেশ দিয়ে গিয়েছেন।
মাদক মেশানো সিদ্ধি খাওয়ানোর জন্যই হোক, বা এই সাদা ধোঁয়ার জন্য, ওর মনে হল খুব শিগগিরই ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।
ওর স্বামীর দেহ সাজানো, তার পাশে ওকে যাতে ঠিকমতো শুইয়ে মৃত স্বামীর সঙ্গে একই চিতানলে জীবন্ত দগ্ধ করে স্বর্গে পাঠানো যায়, সেই নিয়ে লোকজন এতই ব্যস্ত, ওর দিকে আর তেমন কারুর ভ্রূক্ষেপ নেই।
এখন আবার এসব ব্যাপারে বেশি হইচই বা দেরি করা যায় না, ইংরেজ সরকারের পুলিশ খবর পেলেই ছুটে আসে। গ্রামের মান্যগণ্য ব্যক্তিরা গালাগাল দেয়, ম্লেচ্ছের দল, ওরা আর কী বুঝবে সনাতন হিন্দু ধর্মের পাপপুণ্য!
নদীর একদম পাড়েই ও বসে ছিল, ওকে একটু আগে পর্যন্ত ঘিরে থাকা মহিলামহল এখন চিতার দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছে, ও এমনিই নেতিয়ে পড়ছে, ওকে দেখার তেমন কৌতূহল এখন আর তাদের নেই।
আর দেরি করা ঠিক নয়।
ও সন্তর্পণে উঠে দাঁড়াল, সঙ্গেসঙ্গে ওর মনে হল মাথা এতটাই টলছে, ও পড়ে যাবে মাটিতে। তবু শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে নিজেকে ঘষটাতে ঘষটাতে ও জলের একদম কিনারায় নিয়ে গেল, তারপর একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে হাত-পা বাঁধা মৃতদেহের মতো ফেলে দিল নদীতে।
ওর নিজের শরীরটা যেন আর নিজের নয়, অন্যের হয়ে গেছে।
একটা হালকা ঝুপ করে শব্দ হল, তারপর সব চুপচাপ।
পাকা সাঁতারু সে, নিজেকে তলিয়ে যেতে দিল অনেকটা, তারপর নদীর অনেকটা গভীরে গিয়ে ডুবসাঁতার দিতে শুরু করল। নদীর ওইপারের জঙ্গলে গিয়ে একবার উঠতে পারলেই মুক্তি!
অন্যসময় এই নদী সে এক দমে কতবার এপার ওপার করেছে, ডাকাবুকো হিসেবে ওর নাম ছিল বেশ, কিন্তু আজ এই নেশার ঘোরে যেন মনে হচ্ছিল ওর হৃৎপিণ্ডটা কাঁপতে কাঁপতে গলার ওপরে উঠে আসছে। আর একটু হলেই বেরিয়ে পড়বে সেটা, জ্ঞান হারাবে ও।
অসীম মনের জোর নিয়ে ও ডুবসাঁতার দিতে দিতে অনেকটা এগোতে অবশেষে ওপারের মাটির স্পর্শ পেল। গায়ের কাপড়টা বুনোলতার মতোই পায়ের সঙ্গে জড়িয়ে ধরছে, তলপেটের চিনচিনে ব্যথা নিয়েও ও আস্তে আস্তে হাত দুটোকে পাখির মতো ঝাপটাতে ঝাপটাতে জলের ওপরদিকে উঠে এল, তারপর ডাঙায় উঠতে লাগল বড়ো বড়ো ঘাসগুলোকে ধরে। এদিকটায় কোনো ঘাট নেই। বুনো জঙ্গল, আসেও না কেউ।
অনেক কষ্টে ডাঙায় উঠতেই ওদিকে চোখ পড়ল ওর। জলের তলা থেকে হুলুস্থুলুটা তাহলে ঠিকই শুনেছিল।
ইতিমধ্যেই সবাই টের পেয়ে গেছে ও পালিয়েছে। একটা বড়ো ঝোপের পেছনে লুকিয়ে ও দেখতে পেল পুরোহিতদের মন্ত্রোচ্চারণ বন্ধ হয়ে গেছে, গ্রামের জোয়ানরা চিতা সাজানো থামিয়ে দিয়েছে, এমনকী ডোমেরা অবধি পাগলের মতো খুঁজে চলেছে তাকে। মহিলারা সরু গলায় নিজেদের মধ্যে এত বড়ো সর্বনাশ নিয়ে আলোড়ন তুলেছে।
ভয়ে ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল, মনে পড়ে গেল মাস ছয়েক আগে ওর একমাত্র প্রাণের সই ফুলরেণুর জ্যান্ত পুড়ে মরার সময়কার আর্তনাদ। চিতায় উঠিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার পর ঢাকঢোল সংকীর্তন হাজার গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে কিশোরী বিধবার আর্তচিৎকার কারুর কানে না পৌঁছোয়, তবু ও ঠিক শুনতে পেয়েছিল।
ফুলরেণু মরে যাওয়ার পর ও বাড়ির পেছনে গিয়ে হাতে জ্বলন্ত একটা কাঠকয়লা চেপে ধরে দেখেছিল। সেই পোড়ার মারাত্মক জ্বালা ওর এখনও মনে আছে।
ও আর ভাবতে পারল না।
পরিশ্রান্ত দেহেও ও আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল যাতে ওকে কেউ দেখতে না পায় এদিকে। একে শরীরে প্রথম ঋতুজনিত ক্লান্তি, তার ওপর নেশার দাপট।
কিন্তু শেষরক্ষা হল না। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় ওর সামনের ঝোপটা যেন ওকে উপহাস করেই ভীষণভাবে দুলতে লাগল।
আর ওরা ওকে দেখতে পেয়ে গেল।
উন্মত্ত হিংস্র পশুর মতো ওপাশের সব লোকগুলো নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে এপারে আসতে লাগল। কুলীন স্বামীর সঙ্গে কত পুণ্য করলে একইসঙ্গে স্বর্গে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়, আর সেখানে এত বড়ো প্রতারণা! এ তো কুলটা পতিতার চেয়েও সাংঘাতিক!
ধর্মের বিশ্বস্ত অনুচরগুলো যেন খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ছুটে আসতে লাগল এদিকে।
কয়েক মুহূর্তের জন্য ও দিশেহারা হয়ে গেল, তারপর আবার ঝাঁপ দিল নদীতে। স্রোতের চেয়েও বেশি গতিবেগে ও হিসেব করতে লাগল, ওরা আসছে আড়াআড়ি সাঁতার কেটে, তার আগেই নদীর পাড় বরাবর সাঁতার কেটে ওঁকে পৌঁছোতে হবে অনেক দূর।
জলের মধ্যে হাত-পা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ওর যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল।
আর ঠিক এই সময়ে উজ্জয়িনীর ঘুমটা ভেঙে গেল।
এই নিয়ে অন্তত তিনশোবার দেখা স্বপ্নটা ভেঙে ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসল উজ্জয়িনী। আগে ছোটোবেলায় যখন এই একই স্বপ্ন বার বার দেখে যেত, ভয় পেয়ে কেঁদে উঠত, বাকি রাতটা আর ঘুমোতে পারত না। কিন্তু এখন সয়ে গেছে। বড়ো হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই সওয়াতে হয়েছে আস্তে আস্তে, তার মধ্যে এটাও একটা।
উজ্জয়িনী একটা সিগারেট ধরিয়ে ওর এক কামরার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে এল। এখন ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি হলেও ঠান্ডা এই বছর শিলং শহরে খুব একটা পড়েনি। পাহাড়ি জায়গার উঁচুনীচু ঢাল পেরিয়ে ওর দৃষ্টি অনেক দূরে চলে গেল। সামনের সুবিশাল গলফলিঙ্কের মাঠটায় চাঁদের আলো পড়ে যেন মনে হচ্ছে আফ্রিকার মরুভূমির মাঝে কোনো মরূদ্যানে এসে পড়েছে ও। এখান থেকে ওর কলেজ হেঁটে প্রায় কুড়ি মিনিট লাগলেও এখন কলেজের মেন বিল্ডিং-এর চূড়াটা এখান থেকে বেশ দেখতে পেল ও। মোবাইলের ঘড়িতে দুটো দশ। ও বিশেষ বিচলিত হল না।
প্রতিদিনই মোটামুটি ও রাত দুটোয় ঘুম থেকে ওঠে।
এমনিতেই ইঞ্জিনিয়ারিং হোস্টেল বা মেসের কালচার হল রাত করে ঘুমিয়ে দেরি করে দিন শুরু করা, কিন্তু উজ্জয়িনীর ক্ষেত্রে দিন শুরু হয় অনেক তাড়াতাড়ি। অবশ্য ওর জীবনে সব কিছুই একটু বেশিই তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে।
সেইজন্যই বোধ হয় মাত্র এই আঠেরো বছর বয়সেই জীবনটা ওর এমন ঘেঁটে গেল।
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ও একটা ফোন করল, ‘হ্যালো!’
ওপাশ থেকে ঘুম জড়ানো কিন্তু উদবিগ্ন একটা কণ্ঠ শোনা গেল, ‘হুঁ, বলো। কালই তো পঁচিশ তারিখ। সব গোছগাছ হয়ে গেছে?’
উজ্জয়িনী উত্তর দিল না। দূরে শিলং শহরের প্রান্তে কালো জমাট বাঁধা পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে আরেকটা পা দিয়ে পায়ের নখ খুঁটতে লাগল, চাপা গলায় বেশ কিছুক্ষণ বাদে বলল, ‘আজ আবার ওই স্বপ্নটা দেখলাম।’
ওপাশের কণ্ঠ বলল, ‘এবারে বোধ হয় অনেকদিন পর দেখলে, না? রাতে শোয়ার আগে ওষুধটা খেতে ভুলে গিয়েছিলে কি?’
উজ্জয়িনী বলল, ‘হ্যাঁ। প্রায় ছ-মাস বাদে।’ তারপর কিছুটা বিরক্ত হয়ে একটু জোরে বলল, ‘না, ওষুধ খেতে ভুলিনি। আমি কিছু ভুলি না।’
কণ্ঠ বলল, ‘বেশ। কাল সকালে ক-টায় ফ্লাইট? কখন আসবে?’
শেষ শব্দ দুটো কি একটু বেশি আকুল শোনাল উজ্জয়িনীর কানে?
উজ্জয়িনী ফোন রেখে দিল। মনে মনে ও প্রাণপণে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিল, তবু জীবনের প্রথম পুরুষকণ্ঠের এমন আহ্বানে যেন ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল।
ও জানতেও পারল না ওপাশে থাকা ওর ভালোবাসার মানুষটা ততক্ষণে ফোনে কথা বলছে অন্য আরেকজনের সঙ্গে, ‘ঠিক সময়েই আসছে। এয়ারপোর্ট থেকেই কি তুলে নেব?’
‘খবরদার না। এয়ারপোর্টে ওর বাবার লোকজন থাকবে। বাড়ি যাক, তারপর। সতর্ক থেকো, এই খুচরো ঝামেলার জন্য কাল কোনো গণ্ডগোল হলে কিন্তু পৃথিবীর যে প্রান্তেই লুকোও না কেন, বস তোমার পেট ফুটো করে ভেতরে অ্যাসিড ঢেলে দেবে।’
‘না না, ঠিক আছে। এ তো নিজেই বাড়ি ছাড়ার জন্য পা তুলে আছে, আমাকে আলাদা করে কিছু করতে হবে না। শুধু অতটা রাস্তা নিয়ে যাওয়ার সময়টা একটু কেয়ারফুল থাকতে হবে।’
‘আসল কাজ এগোচ্ছে তো?’
‘হ্যাঁ। ঠিকমতো চলছে।’
‘গুড। আর হ্যাঁ, মারধর বা রেপ-টেপ করতে যাবে না। বডিতে যেন কোনো ইনজুরি না থাকে, পরে ওর বাবা বেগড়বাঁই করলে একদম কেটে যমুনায় ভাসিয়ে দেবে।’
‘ওকে। আর আমার পেমেন্টটা?’
‘আসল কাজটা করো, ঠিক সময়ে পেয়ে যাবে।’
৩
আগ্রার কমলানগরে কাইলা দেবীর মন্দিরের পাঁচিল বেয়ে যে ছায়ামূর্তিগুলো চুপিসারে সবুজ দোতলা বাড়িটায় একে একে ঢুকে পড়ছিল, তারা আজও কিছু একটা খুঁজতে এসেছিল।
এখন এই বাড়িতে কোনো লোক নেই, তাই দরজা ভাঙাভাঙিরও প্রয়োজন নেই। দোতলার বারান্দা দিয়ে ভেতরের ঘরে যাওয়ার দরজাটায় একটা লোহার সরু তার জাতীয় কিছু দিয়ে চাপ দিতেই সেটা মৃদু আর্তনাদ করে খুলে গেল। সঙ্গেসঙ্গে ওরা ঢুকে পড়ল ভেতরে।
দলটা সতর্কতার জন্য আলো তেমন জ্বালায়নি, সরু লেজার আলোর মতো এক ধরনের তীক্ষ্ন অথচ চাপা আলোয় পাগলের মতো ঘরের প্রতিটা কোণ তন্নতন্ন করে দেখছিল। সংখ্যায় ওরা পাঁচজন, তার মধ্যে একজন নেতৃস্থানীয়। দোতলার তিনটে ঘরই আঁতিপাঁতি করে খোঁজা হয়ে যেতে নেতাগোছের লোকটা হতাশ গলায় কাউকে ফোন করে ফিসফিস করল, ‘সব খুঁজলাম। কিচ্ছু নেই।’
ওপাশ থেকে কেউ গর্জে উঠল, ‘আলবাত আছে। ভালো করে না খুঁজে হাত তুলে দিস না, প্রফেসরের শোবার ঘরের দেরাজটা দ্যাখ!’
এপাশের নেতা মিনমিন করল, ‘সবই দেখেছি। কোথাও কিচ্ছু নেই। এই নিয়ে তিনবার খুঁজে গেলাম। তুমি বসকে একটু বুঝিয়ে বলো। পুরোনো কিছু ডায়েরি পড়ে আছে, সেগুলো কি নিয়ে যাব?’
ওপাশ বলল, ‘ধুর শালা! কতবার বলছি একটা গোল মুদ্রা, বড়ো মাপের কয়েনের মতো। এক কথা একশোবার হ্যাজাস কেন?’
এপাশের লোকটা আবার অন্যদেরকে ইশারায় বলল ভালো করে খুঁজতে, তারপর ফিসফিস করল, ‘কোনো গুপ্তধন-টনের সঙ্কেত নাকি বলো তো মুদ্রাটা? কাল বলছিলে কী সব ফর্মূলা লেখা আছে? কীসের ফর্মূলা?’
ওপাশের লোকটা খিঁচিয়ে একটা গালাগাল দিয়ে উঠল, ‘তোকে কবরে পাঠাবার। না বকে ভালো করে খোঁজ।’
‘যাহ বাবা! না বললে বুঝব কী করে কোন জিনিসটার কথা বলছ? দেরাজটা খুলেছি। এখানে তো অনেকরকম মুদ্রা দেখতে পাচ্ছি গো!’ এপাশের নেতা একটা ছোট্ট চাল দিল।
দেরাজটা আসলে এখনও খোলাই যায়নি। তালা মারা, ভাঙতে হবে।
ওপাশের লোকটা এবার একটু থমকে গেল। সতর্ক গলায় বলল, ‘একটা কালো রঙের মুদ্রা। তার ওপর এক পিঠে কিছু হরফ লেখা, সংস্কৃতে। অন্য পিঠে ছবি।’
‘আহা, সে তো আগেও বলেছ, কিন্তু এর পেছনের গল্পটা না জানলে কী করে খুঁজি?’ এদিকের নেতাটা মাতব্বরি ভঙ্গিতে বলল।
ওপাশের লোকটা ভ্রূ কুঁচকে কিছু ভাবল, তারপর বলতে লাগল, ‘সংক্ষেপে বলছি। আজ থেকে হাজার বছর আগে মধ্যভারতের জেজকভুক্তিতে চান্দেলা রাজারা প্রায় পাঁচশো বছর রাজত্ব করেছিল। যশোবর্মণ, কীর্তিবর্মণ এইসব রাজাদের নাম শুনেছিস?’
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও!’ দলের ছেলেগুলো সিঁড়ি বেয়ে ইতিমধ্যেই নেমে গেছে একতলায়, এদিকের লোকটা এবার একটা ধুলো-পড়া চেয়ারে বসে পড়ল, ‘জেজুভুকু… ক-কী বললে?’
‘এখন যেটা বুন্দেলখণ্ড, মানে উত্তরপ্রদেশের নীচ আর মধ্যপ্রদেশের ওপর দিক মিলিয়ে জায়গাটা, সেটাকেই তখন জেজকভুক্তি বলত। চান্দেলা বংশের রাজারা খুব শক্তিশালী ছিল, ওঁদের হিন্দু বেদে লেখা চন্দ্রবংশের উত্তরাধিকারী বলা হত। গুর্জর, প্রতিহার, রাষ্ট্রকূট, পারমার এইসব রাজাদের সঙ্গে চান্দেলা রাজাদের যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। বার বার গজনীর সুলতান মামুদের আক্রমণে এই সাম্রাজ্যের ক্ষতি হতে থাকে। শেষ রাজা পরমাদ্রিদেবের সময়ে কুতুবউদ্দিন আইবক পুরোপুরি এদের শেষ করে দিয়েছিল, তারপর ভারতে সুলতান রাজ শুরু হয়। বুঝলি কিছু?’
‘বাপ রে, মাথা ভোঁ ভোঁ করছে গো! ইতিহাসে আমি একেবারেই কাঁচা ছিলাম তো!’ এপাশের লোকটা ঘরের চারপাশে আলোটা ফেলতে ফেলতে বলল, ‘তার সঙ্গে এই বুড়োর সম্পর্ক কী? বুড়ো কি ওই চাঁদু বংশের কেউ?’
‘আগে চুপ করে শোন যা বলছি। এদিকে যমুনা নদী থেকে ওদিকে নর্মদা নদী পর্যন্ত ছিল এদের সাম্রাজ্য। বেশিরভাগ চান্দেলা রাজারা ছিল শিবের ভক্ত আর সেইজন্য দারুণ সব মন্দির বানাত। খাজুরাহোর মন্দিরগুলো ওদেরই বানানো। গেছিস?’ ওপাশের গলা বলল।
এদিকের লোকটা এবার লজ্জা পেল, ‘কেন যে দুঃখ দাও এসব বলে, হেব্বি রাগ হয় মাইরি এইজন্য। ওইসব অসভ্য ছবি দেখতে গিয়ে কী করব? বিয়েই তো করিনি এখনও! মোবাইলে দেখেছি, সে একেবারে রগরগে…।’
ওপাশের লোকটা এবার দাঁত কিড়মিড় করল, ‘শালা, দুইয়ের নামতা না জানা পাঁঠাকে বসেছি ক্যালকুলাস শেখাতে! ছবির গল্প রাখ। খাজুরাহোতে মোট পঁচাশিটা মন্দির ছিল, এখন মাত্র পঁচিশটা আছে। ওইসব ছবি যেগুলো বলছিস, সেগুলো ছাড়াও খাজুরাহো মন্দিরের আরেকটা বৈশিষ্ট্য আছে, সেটাই ওই বুড়ো প্রফেসর আবিষ্কার করেছিলেন।’
‘কী বৈশিষ্ট্য?’
‘প্রতিটা মন্দিরের ভেতরের কাজ, একেকটা শিলার ডিজাইন, এমনকী দুটো মন্দিরের মধ্যে যে দূরত্ব, প্রতিটার মধ্যে লুকিয়ে আছে একেকটা করে দুরূহ অঙ্কের তত্ত্ব, যার বেশিরভাগই এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। সেইগুলো সাংকেতিকভাবে লেখা ছিল কিছু শিলালিপিতে, ওইগুলো ডিকোড করাই ছিল ওই বাড়িতে আমার কাজ। শুধু খাজুরাহোই নয়, প্রতাপেশ্বর, অজয়গড়, কালিঞ্জর, কাণ্ডরীয় মহাদেব মন্দির, ওদের সব ভাস্কর্যেই চান্দেলা রাজারা লুকিয়ে রাখত একেকটা জটিল গাণিতিক কনসেপ্ট। ঘটে ঢুকল কিছু?’
‘অঙ্ক লুকিয়ে রাখত মানে? অঙ্ক কি মিষ্টি নাকি যে পিঁপড়ে এসে খেয়ে যাবে?’
‘তখন মুসলিমরা ঘন ঘন আক্রমণ করছে ভারতে, তাদের থেকে প্রাচীন অঙ্কগুলোকে সুরক্ষিত রাখা ছিল উদ্দেশ্য।’
‘অঙ্ক মানে কী? এক, দুই, তিন, চার এই সংখ্যাগুলো? এগুলোকে লুকিয়ে রাখত? কেন?’
‘ধুর শালা, অঙ্ক মানে বোঝাতে চাইছি জটিল কোনো থিয়োরি মানে জ্যামিতি। মিশরের স্টেপ পিরামিডের ছবি দেখেছিস? ফারাও জোসারের সমাধি?’
‘পিরামিডের ছবি দেখেছি। এখন সেটা স্টেপ কাট না লেয়ার কাট জানি না।’
‘অপোগণ্ড! অত হাজার বছর আগে কোনো ক্রেন নেই, বিদ্যুৎ নেই, অত বড়ো বড়ো পাথরগুলোকে ওইভাবে মিশরীয়রা একটার ওপরে একটা সাজিয়ে যে পিরামিড বানাত, সেটা জ্যামিতি প্রয়োগ করে।’
‘আচ্ছা। তার সঙ্গে এই বুড়ো আর ওই চাঁদু রাজাদের কী সম্পর্ক সেটাই শুধু বুঝছি না।’
ওপাশের লোকটা এবার বিরক্তির শ্বাস ফেলল, ‘আমাদের বৈদিক জ্যামিতির প্রাচীন গ্রন্থ বৌধায়ন শুল্ব সূত্রতে এই পিরামিডের গঠনের বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া আছে।’
‘বল কী মামা!’ এপাশের লোকটার চোখ ছানাবড়া, ‘মিশর থেকে এসে ওরা আমাদের বেদের ক্লাস করে গিয়েছিল?’
ওদিকের লোকটা এবার বিরক্তিতে খিঁচিয়ে উঠল, ‘এরকম লোফারদের মতো মামা বলে ডাকবি না। বৌধায়ন শুল্ব সূত্রতে একটা শ্মশান চিতা বানানোর জ্যামিতিক প্রসেস দেওয়া আছে, স্টেপ পিরামিড ওই শ্মশানচিতার নকল। শুধু তাই নয়, পিথাগোরাসের ওই অতিভুজের যে বিখ্যাত উপপাদ্য, সেটাও বৌধায়ন শুল্ব সূত্রতে লেখা আছে।’
‘বুঝলাম। কিন্তু এখন তাহলে কী খুঁজতে এসেছি এখানে? ওই সূত্র?’
ওপাশের লোকটা বেড়ালের মতো সতর্ক হয়ে গেল হঠাৎ, ‘একটা মুদ্রা, তার ওপরে অনেক আঁকিবুকি কাটা। শেষ চান্দেলা রাজা পরমাদ্রিদেবের সময়কার। তাতে লুকিয়ে আছে ওইরকমই একটা অঙ্কের থিয়োরি।’
‘সেটাও খাজুরাহো মন্দিরের?’ এদিকের লোকটা জিজ্ঞেস করল।
‘না।’ ওপাশ থেকে ভেসে এল, ‘এই আগ্রারই একটা মন্দিরের।’
‘আগ্রার মন্দির? কোন মন্দির গো?’ এপাশের লোকটা জিজ্ঞেস করার আগেই ফোনটা পিঁ পিঁ শব্দে কেটে গেল হঠাৎ।
এপাশের লোকটা সামান্য ঠোঁট কামড়ে ধরল। স্মার্টফোনের অটো-রেকর্ড অপশনটা তার কাজ ঠিকমতোই করেছে।
লোকটার মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। একটু আগের গোটা কথোপকথনটা স্টোরড হয়েছে ফোনের মেমারিতে এক হাতে লেজার লাইটটা নাচাতে নাচাতে রেকর্ডটা বের করে লোকটা মুহূর্তে ফরোয়ার্ড করে দিল কোথাও একটা।
৪
ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির দিল্লির হেড অফিসে আজ হেভিওয়েট মিটিং। বিশাল ডিম্বাকৃতি টেবিলের লম্বা দিকটায় রয়েছেন ডিরেক্টর জেনারেল মি অমূল্য ত্রিবেদী তাঁর মাথার ওপরেই পেছনের প্রকাণ্ড দেওয়ালে বসে রয়েছেন গান্ধীজি একপাশে পতপত করে উড়ছে জাতীয় পতাকা।
মি ত্রিবেদীর দু-পাশে সার দিয়ে বসে রয়েছেন ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র ইনভেস্টিগেটিং অফিসাররা সবাই।
২০০৮ সালের মুম্বাইতে তাজ হোটেলে বিধ্বংসী অ্যাটাকের পর সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে এক্সক্লুসিভলি মোকাবিলা করার জন্য ভারত সরকার ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি নামে এই ডিপার্টমেন্ট তৈরি করেছিল। এই এজেন্সির কার্যকলাপের ওপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সবসময় নজর রাখে আর কোনো রাজ্যের মধ্যে তদন্ত চালানোর জন্য এদের সেই রাজ্য সরকারের অনুমতির দরকার পড়ে না।
ভগতবীর সিং বলে নতুন জয়েন করা তরুণ পাঞ্জাবি অফিসারটা কিছুটা নার্ভাস হয়ে গিয়ে বোধ হয় ঘামছিল। আগে সে দিল্লি পুলিশের সাবইনস্পেকটর ছিল, কিন্তু দু-বছরেই ভালো কাজ করায় তাকে এই সম্মানজনক দপ্তরে ডেপুটেশনে পাঠানো হয়েছে দেড়মাস হল। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই এই বিভাগে সুযোগ পাওয়ায় ও ভীষণভাবে খুশি, কিন্তু একইসঙ্গে টেনশনও হচ্ছে। ডেপুটেশনে আসার আগে এক সপ্তাহের জন্য আগ্রায় নিজের বাড়িও ঘুরে এসেছে, নতুন উদ্যমে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সে এখন টগবগ করছে বলতে গেলে।
মিটিং এখনও শুরু হয়নি, সাইলেন্ট মোডে মোবাইলে ভগতবীর নিউজ চ্যানেলের আজকের আপডেটগুলো একনজরে দেখে নিচ্ছিল।
খবরের মাঝে নিজের শহর দেখলে সবারই চোখ সেখানে আটকে যায়, তেমনই একটা খবরে ওর চোখ আটকে গেল। আগ্রার একমাস আগে আক্রান্ত হওয়া সেই প্রফেসর আজও নিখোঁজ, অথচ তাঁর বাড়িতে নাকি এখনও প্রায়দিনই রাতদুপুরে পাঁচিল টপকে লোকের আনাগোনা চলছে।
লিঙ্কটা খুলে ও চোখ বোলাতে লাগল বিশদ খবরের ওপর। ভদ্রলোক নিখোঁজ হওয়ার পর প্রথম দশদিন পুলিশি প্রহরা ছিল বাড়ির ওপর, তারপর উঠিয়ে নেওয়া হয়। তদন্তেও কোনো প্রোগ্রেস নেই, অথচ পাড়ার লোক নিয়মিত লোকজনের আনাগোনার অভিযোগ করছে। জায়গাটা কমলানগরে, ওর বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়।
হঠাৎ সামনে ‘গুড ইভনিং জেন্টলমেন!’ শুনতে পেয়েই ভগতবীর তড়িঘড়ি ফোনটা বন্ধ করে সামনে তাকাল।
এন আই এ-তে আসার পর এটাই ওর প্রথম অফিশিয়াল মিটিং। এই দপ্তরের কর্মদক্ষতা সারা দেশের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কাছে এখন সুপরিচিত। ছিঁচকে চুরি ডাকাতি, রাহাজানি নয়, এই বিভাগের উদ্দেশ্য হল দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর কড়া নজর রাখা। সন্ত্রাসবাদ, বর্ডার পেরিয়ে স্মাগলিং, নারী এবং শিশুপাচার চক্র, ড্রাগ সাপ্লাই, বেআইনি অস্ত্র সাপ্লাই, এইসব ব্যাপার নিয়ন্ত্রণ করা।
আর এই ব্যাপারেই আজ দপ্তরের সিনিয়র ইনভেস্টিগেশন অফিসার মনোজ বশিষ্ঠ ওদের মতো জুনিয়রদের একটা প্রেজেন্টেশন দেবেন।
ডিজি সাহেব মি ত্রিবেদী আনুষ্ঠানিকভাবে মিটিং-এর শুভ সূচনা করলেন, ‘তোমাদের মতো পনেরোজন ইয়ং ইনভেস্টিগেটিং অফিসার আমাদের ডিপার্টমেন্টের সম্পদ। আশা করব সিনিয়রদের মতোই তোমরাও এই দপ্তরের ঐতিহ্য সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিনিয়র অফিসার মনোজ বশিষ্ঠ তোমাদের কিছু বলবেন।’
প্রাথমিক নিয়মনীতি, আলাপপরিচয় মিটলে মি বশিষ্ঠ উঠে দাঁড়ালেন। এই মুহূর্তে তিনি দিল্লি পুলিশের সবচেয়ে দক্ষ অফিসারদের মধ্যে একজন। এখন ডেপুটেশনে এন আই এ-র হয়ে কাজ করছেন। আগের বছরেই ইন্টারপোলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দু-জন কুখ্যাত মুজাহিদিন জঙ্গিনেতাকে ধরায় প্রধানমন্ত্রী এই নিষ্ঠাবান অফিসারটিকে পুরস্কৃত করেছেন। বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ, কিন্তু শরীর টানটান। নির্মেদ চেহারায় কোথাও এখনও বয়স একটুও থাবা বসাতে পারেনি। গালের কাঁচাপাকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি মি বশিষ্ঠের ব্যক্তিত্বকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ভগতবীর মুগ্ধ চোখে দেখছিল। সে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, ছোটো থেকে হিন্দি সিনেমায় পুলিশ অফিসারের রোল করা অ্যাকশন হিরোদের দেখে ওর পুলিশ হওয়ার শখ হয়েছিল। সে-শখ পূরণ হলেও এখনও অবধি কোনো চ্যালেঞ্জিং অ্যাসাইনমেন্ট ও পায়নি। তবে একবার যখন এই দপ্তরে ঢুকতে পেরেছে, নিশ্চয়ই পাবে! একদিন সেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে মি বশিষ্ঠের মতো পুরস্কার নেবে, মনে মনে ভাবল ও।
মি মনোজ বশিষ্ঠ উঠে দাঁড়িয়ে অ্যাডিশনাল ডিজি সাহেবকে স্যালুট করলেন, তারপর ঋজুভাবে এগিয়ে গেলেন সামনের প্রোজেক্টরের দিকে। ল্যাপটপে বসে থাকা কম্পিউটার অপারেটরকে নির্দেশ করলেন স্লাইড শুরু করতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘর অন্ধকার হয়ে প্রোজেক্টরের আলো দেওয়ালের প্রোজেকশন স্ক্রিনকে আলোকিত করে ফেলল।
মৃদু গলাখাঁকারি দিয়ে কোনো গৌরচন্দ্রিকা না করেই মি বশিষ্ঠ শুরু করলেন, ‘যে ব্রোশিয়োরটা দেওয়া হয়েছে আপনারা নিশ্চয়ই সেটা পড়েছেন। দিল্লিতে বেআইনিভাবে বেড়ে চলা অস্ত্রব্যবসাই আমার আজকের বিষয়। খুব সম্প্রতি একটা বিরাট ডিল হয়েছে এই শহরেই, আমাদের ইনফরমার খবর এনেছে।’ বশিষ্ঠ সামান্য থামলেন, ‘আগে জানিয়ে রাখি আর্মস সাপ্লাই এখন গোটা পৃথিবীতেই একটা ভয়াবহ লাভজনক ব্যাবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র সরবরাহ করে আমেরিকা, তারপর রাশিয়া আর চীন। কিন্তু সেটা বৈধ উপায়ে। বেআইনি অবৈধ আর্মস ডিলার প্রচণ্ডভাবে বেড়ে চলেছে, সেটা শুরু হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই।’ মি বশিষ্ঠ প্রোজেক্টরের দিকে তাকিয়ে রিমোটের বোতাম টিপলেন।
মুহূর্তে একটা পরিসংখ্যান, গ্রাফ সমেত স্লাইড স্ক্রিনে ভেসে উঠল, ‘তারপর একে একে পৃথিবীতে যত ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৮-এর আরব-ইজরায়েলের যুদ্ধ, ১৯৬০-এর কঙ্গো ক্রাইসিস, আশির দশকের ইরান ইরাকের লড়াই, নব্বই সালের গালফ যুদ্ধ, এত হাজার হাজার ছোটোবড়ো যুদ্ধে লাখ লাখ লোক মারা গেছে, হাজার হাজার মানুষ গৃহহারা হয়েছে, কিন্তু এই আর্মস ডিলারদের ব্যাবসা ততই ফুলেফেঁপে উঠেছে।
‘পৃথিবী কেঁপে গেছে এইরকম সব বিলিওনেয়ার আর্মস ডিলারদের নৃশংসতায়। তেমনই দু-একজন পৃথিবীখ্যাত আর্মস ডিলারদের সঙ্গে আগে সংক্ষেপে আপনাদের পরিচয় করাই।’
প্রোজেকশন স্ক্রিনে এবার টাকমাথা গোলগাল এক প্রৌঢ়ের সাদাকালো ছবি ফুটে উঠল।
‘আদনান খাস্তোজ্ঞি। আশির দশকের কুখ্যাত আর্মস ডিলার। সৌদি আরবের মক্কায় জন্ম, ১৯৬০ সালে আমেরিকান কোম্পানির সঙ্গে সৌদি সরকারের আর্মস সাপ্লাই ডিলে ব্রোকারি দিয়ে শুরু করেছিল। তারপর বিখ্যাত সব যুদ্ধে দু-পক্ষকেই লক্ষ লক্ষ ডলারের বিনিময়ে অস্ত্র সরবরাহ করে গেছে। একাধিকবার ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তছরুপ, আর্থিক কারচুপি রুখতে সুইজারল্যান্ডের মতো ট্যাক্স হ্যাভেনে টাকা সরিয়ে দেওয়া, বেআইনিভাবে অনেক ধরনের অস্ত্র সাপ্লাই করা, এইরকম নানা অভিযোগে বহুবার অ্যারেস্ট করা হয়েছিল। মারা গেছে গত বছরের জুন মাসে।’
‘এইরকম সারা পৃথিবীর পুলিশকে পাগল করে দেওয়া কুখ্যাত আর্মস ডিলার আরও কিছু আছে।’
এবারেও স্ক্রিনে ভেসে উঠল আর এক গোলগাল টাক।
‘সার্কিস সোঘানালিয়ান। ফ্লোরিডার একজন আর্মস ডিলার, যাকে মার্চেন্ট অফ ডেথ বলা হয়। আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে চলা ঠান্ডা যুদ্ধের সে সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র সাপ্লায়ার ছিল। লোকটা সাদ্দাম হুসেনের ইরাককেও লক্ষ লক্ষ ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় বিভিন্ন জঙ্গি দল, নিকারাগুয়া, ইকুয়েডরের মতো ছোটো ছোটো ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো সবাই ছিল সার্কিসের একচেটিয়া কাস্টমার। গালফ যুদ্ধের সময় ওর জেল হয়। এও মারা গেছে ২০১১ সালে, সাত বছর হল।’
‘স্যার!’ ভগতবীর স্কুলের ক্লাসরুমের মতো হাত তুলল, পরক্ষণে ভুল বুঝতে পেরে নামিয়েও নিল, ‘একটা প্রশ্ন ছিল।’
বশিষ্ঠ স্যার হাঁপিয়ে গিয়েছিলেন একটানা বলে, জল খাচ্ছিলেন বোতল থেকে, ইশারায় ভগতবীরকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে বললেন।
‘স্যার, এই আর্মস ডিলাররা এত আর্মস পেত কোথা থেকে? মানে রিভলভার, পিস্তল, রাইফেল এগুলো তৈরি কারা করত? বৈধভাবে অস্ত্র সাপ্লাই করতে গেলে তো অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি বা গান শেল ফ্যাক্টরি থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু এরা কোথা থেকে পেত?’
‘গুড কোয়েশ্চেন।’ বশিষ্ঠ স্যার বললেন, ‘এমনিই অনেক দেশের কাছে প্রচুর উদবৃত্ত অস্ত্র পড়ে থাকে। ধরো, কোনো একটা বড়ো যুদ্ধ শেষ হল কিংবা সন্ধি প্রস্তাবে লড়াই বন্ধ হয়ে গেল, সেক্ষেত্রে আর্মসের যে বিশাল ইনভেন্টরি সেটাকে বৈধভাবেই বিক্রি করে দেওয়া হয় গলিয়ে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই বৈধভাবে কেনা অস্ত্রগুলো নিয়ে গিয়ে অবৈধভাবে বিক্রি করা হয় কালোবাজারে, যে দেশ যুদ্ধ করার জন্য ছটফট করছে, তাকেও মোটা দরে বিক্রি করে দেয় ডিলাররা। কোটি কোটি টাকার খেলা চলে এর মধ্যে। অনেক ক্ষেত্রে সরকার নিজেই যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, সবচেয়ে বেশি নিলামে যে বিড করল, তাকে সেল করে দেয়। আর বন্দুক জিনিসটা দীর্ঘস্থায়ী।’ বশিষ্ঠ সামান্য হাসলেন, ‘আমি একশো বছরের পুরোনো রাইফেলও চালিয়েছি। সুতরাং একটা যুদ্ধ শেষের পর এইভাবেই আর্মসগুলো পৃথিবীর অন্য কোথাও পরবর্তী কোনো যুদ্ধে চলে যায় ঠিক। এটাকেই বলে শ্যাডো মার্কেট। এটা ক্যান্সারের মারণ কোষের মতো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে।’
ভগতবীর মাথা নাড়ল।
‘তা ছাড়া অনেক দেশীয় জায়গাতেও গোপনে আর্মস তৈরি করা হয়, যেমন ধরো আমাদের দেশেই, বিহারের মুঙ্গের বা মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া। এইসব অঞ্চলে আগে সরকারের অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি ছিল, সেই ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই জায়গায় শ্রমিকরা লুকিয়ে-চুরিয়ে অস্ত্র বানাতে শুরু করে। ওইসব জায়গায় তুমি যদি যাও প্রায় প্রতিটা বাড়িতে লেদ মেশিন দেখতে পাবে। ওখান থেকেই এখন সারাভারতে আর্মস সাপ্লাই প্রচুর বেড়ে গেছে। দামও কম, ঝক্কিও কম।’
ডিজি মি ত্রিবেদী এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন, এবার বললেন, ‘মনোজ, কালকের ব্যাপারটা বলো।’
‘ইয়েস স্যার!’ বশিষ্ঠ মাথা নাড়লেন, ‘কাল পশ্চিমবঙ্গের এক গ্রাম থেকে একটা লোককে ধরা হয়েছে যে পেশায় দর্জি, কিন্তু তলে তলে মুঙ্গেরের এক ডিলারের সঙ্গে যোগসাজশ করে আর্মস সাপ্লাই করছিল কয়েক বছর ধরে। বর্ডার পেরিয়ে বাংলাদেশেও নাকি ওর মাল গেছে। সেই লোক জেরায় বলেছে যে এক সপ্তাহ আগে ও এবং আরও কিছু ডিলার মিলে মোট একুশ কোটি টাকার আর্মস সাপ্লাই করেছে দিল্লিতে একটা পার্টির কাছে। পেমেন্ট পেয়েছে দফায় দফায়। পার্টির নাম হিসেবে বলেছে বিলগাইনার।’
বশিষ্ঠ আবার থামলেন, সবকটা তরুণ মুখের অভিব্যক্তি বুঝতে চেষ্টা করলেন নয়তো, ‘নামটা কি কারুর চেনা লাগল?’
সবাই নির্বাক, মাথা নাড়ল দু-পাশে। এই নাম কেউ শোনেনি।
‘ভিক্টর বিলগাইনার নব্বইয়ের দশকের পৃথিবীকাঁপানো আর্মস ডিলার ছিল। টার্কির লোক, কিন্তু বারো থেকে তেরোটা ভাষা অনর্গল বলতে পারত। সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় জঙ্গিদের আর্মস সাপ্লাই করে রাতারাতি কোটিপতি হয়েছিল, সেটা ১৯৯১ সাল। ইউনাইটেড নেশনস সিকিউরিটি কাউন্সিল পর্যন্ত ওর কার্যকলাপে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। আল কায়দার সঙ্গেও লোকটার যোগাযোগ ছিল। অদ্ভুত ব্যাপার, ও এত ধরনের মেক আপ করতে পারত, ওর আসল চেহারা এখনও অবধি কেউ জানে না।
‘বিলগাইনার শিক্ষিত লোক, নিজে আর্কিটেকচার নিয়ে পড়েছে, ইন্টারপোল পর্যন্ত নাজেহাল হয়ে গেছে ওকে ধরতে।’ বশিষ্ঠ টানা বলে যাচ্ছিলেন, ‘লোকটা মুম্বাইতেও এসেছে বহুবার, মুম্বাই আর দুবাইয়ের মাফিয়া সার্কেলে ওর ছিল হরদম যাতায়াত। কিন্তু দু-হাজার পনেরো সালের একটা প্লেন ক্র্যাশে সে মারা যায় বলে খবর, যদিও কোনো প্রমাণ নেই। তা ছাড়া ভিক্টর বিলগাইনারের মতো লোকেরা দেড়শো-দুশো কোটির ডিল করে, এত কম টাকার ডিল কেন সে করবে? করলে ভারতেই-বা এসে করতে যাবে কেন?
‘তাহলে?’ একজন অফিসার বলে উঠল।
‘তাহলে এটাই যে, হয় বিলগাইনার নিজে অথবা কেউ বা কারা বিলগাইনারের নাম ব্যবহার করে মার্কেটে নেমেছে। কিন্তু যারা একুশ কোটির মাল কেনে, তারাও ফেলনা লোক নয়, আর কেন কিনেছে, সেটাও একটা প্রশ্ন। এখন কোথাও কোনো বড়ো যুদ্ধ তেমন চলছে না। তাহলে এত আর্মস কেন লাগছে হঠাৎ? তাও দিল্লিতে?’
বশিষ্ঠ যেন ভগতবীরের দিকেই তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন, ‘তাহলে কি সামনেই কোনো গণ্ডগোল পাকাতে চলেছে যেটা আমরা এখনও ট্র্যাক করতে পারছি না?’
ভগতবীর কী বলবে ভেবে পেল না, এমন সময় বশিষ্ঠের ফোন বেজে উঠল, এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে হুঁ-হাঁ করে তিনি ফোন রেখে ডিজি সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে নীচুস্বরে কিছু বললেন।
ভগতবীর লক্ষ করল, বশিষ্ঠের কথা শুনতে শুনতে ত্রিবেদী স্যারের ভ্রূ সামান্য কুঁচকে গেল, মাথা নাড়তে লাগলেন অল্প, তারপর কিছুক্ষণ আলোচনা করে সামান্য বিরতি নিয়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘আগ্রায় একটা আর্জেন্ট মিশনে আগ্রা পুলিশ আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্স চাইছে। একজন ইয়ং অফিসারকে পাঠাব আমি। কে যেতে চাইছ?’
প্রশ্নটা শেষ করার পর দু-সেকেন্ডও কাটল না, ভগতবীর উৎসাহে হাত তুলে ফেলল।
নিজের শহরে অ্যাসাইনমেন্টের কথা শুনলে কার না মন নেচে ওঠে?
হাত তুলেই ওর খেয়াল হল অন্যরা ওর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে।
ধুস, উত্তেজনায় যে কী হয় ওর, এখানেও বাচ্চাদের মতো খালি বার বার হাত তুলে ফেলছে!
কিন্তু হাত নামিয়ে ফেলার পরেও ডিজি সাহেব ওর দিক থেকে চোখ সরালেন না, বেশ প্রসন্ন গলায় বললেন, ‘গুড! আগ্রা শহরে কিছু অদ্ভুত পোস্টার পড়েছে। তুমি এই ডেমনস্ট্রেশনটা শেষ হলে মি বশিষ্ঠর সঙ্গে যাবে, উনি তোমায় সব বুঝিয়ে দেবেন।’
৫
উত্তর ভারতের চরমভাবাপন্ন শহর। গ্রীষ্মে যেমন গরম, শীতে তেমনই হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। বিকেল গড়াতে-না-গড়াতেই অন্ধকার জমাট বাঁধা কুয়াশার মতো ঝুপ করে নেমে আসে শহরের অলিতেগলিতে।
দূরের মসজিদের আজান থেমে গেছে। একে একে দূরের বাজার এলাকায় আলো জ্বলে উঠছে সান্ধ্য পসরার। অদূরেই একটা মুঘল আমলের প্রকাণ্ড বন্ধ দরজার দু-পাশে সেজে উঠেছে আগ্রার বিখ্যাত পেঠা বলে একধরনের মিষ্টির দোকান। কনকনে ঠান্ডাতেও সেখানে লোকজনের ভিড় এখান থেকেই চোখে পড়ছে।
রুদ্রর ঠিক উলটোদিকে পুলিশের দু-জন অফিসার শান্তভাবে বসে আছেন। তাঁদের কফি আর কিছু ভুজিয়া দেওয়া হয়েছে। ধীর লয়ে তাঁরা চুমুক দিচ্ছেন কফির কাপে, যেন বিন্দুমাত্র তাড়াহুড়ো নেই।
একটু পরেই অপেক্ষাকৃত তরুণ যে অফিসারটি, যিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন নাহুম খান নামে, তিনি মিটিমিটি হেসে ঝিলিকভরা চোখে পাক্কা আগ্রা টানের হিন্দিতে বলে উঠলেন, ‘ম্যাডাম, আমরা এসেছি কয়েকটা রুটিন এনক্যোয়ারিতে। কিন্তু আপনাকে এত টেন্সড লাগছে কেন?’
‘আপনাদের জন্য টেন্সড রয়েছি সেটা আপনাকে কে বলল!’ রুদ্র একটা শ্বাস ফেলে মাথার পেছনে হাত দুটোকে রেখে চেয়ারে হেলান দিল, ‘এই ব্যাপারের জন্য আমার হায়ার অথরিটি আমাকে একটু আগেই এক্সপ্ল্যানেশন কল করেছে, টেম্পোরারিলি সাসপেন্ডও করেছে।’
নাহুম খানের মুখ থেকে হাসিটা মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল, সোজা হয়ে বসলেন তিনি, ‘সাসপেন্ড? কেন?’
‘সেটা তো আপনারাই ভালো বলতে পারবেন মি খান। চিঠিতে যা বুঝলাম, আমার ব্রাঞ্চের একজন ছাপোষা কাস্টমারের অ্যাকাউন্টে কাল দেড় কোটি টাকা ঢুকেছে। হেড অফিসের বক্তব্য সেটা দেখেও আমি ভিজিল্যান্সে কেন ইমিডিয়েট জানাইনি।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু সেইজন্য তো আপনাকে একটা সিম্পল চার্জশিট দিয়ে ছেড়ে দিতে পারত। সেই শো কজের আপনি উত্তর দিতেন। একদম সরাসরি সাসপেনশন অর্ডার কেন? মানে ওরা কি ধরেই নিয়েছে আপনি নিজে এর জন্য কিছু অন্যায় সুযোগ নিয়েছেন?’
রুদ্র বুঝতে পারল নাহুম খান ইচ্ছে করেই ‘ঘুস’ শব্দটা উচ্চারণ করলেন না।
একপাশে দাঁড়ানো অমিত বলল, ‘স্যার, হেড অফিসে আমার কিছু চেনাজানা আছে, ফোনও করেছিলাম এই ব্যাপারে জানতে। কিন্তু পুলিশ থেকে ব্যাপারটা জানানো হয়েছে ছাড়া আর কিছু জানতে পারলাম না।’
‘যাই হোক, ছাড়ুন!’ রুদ্র প্রিন্টার থেকে একে একে বেরোতে থাকা সব ডকুমেন্ট একজোট করতে লাগল।
পুলিশের কাছে নিজের দুঃখের কথা বলে সমবেদনা পাওয়ার চেষ্টা করে কী লাভ? আপাতত রুদ্রকে সাসপেন্ড করলেও হেড অফিস তিনদিনের মধ্যে ওর বক্তব্য লিখিতভাবে জানতে চেয়েছে, আত্মপক্ষ সমর্থনের একটা সুযোগ দিয়েছে, সেই ব্যাপারে বরং ওর ফোকাসড হওয়া উচিত। ও যে লোনের রিকভারিতে গিয়েছিল বলে রিপোর্টটা জেনারেট করতে পারেনি, এটা যে একটা অনিচ্ছাকৃত ভুল সেটা ওকে ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতেই হবে।
এই পুলিশ অফিসারেরা যা জানতে চান, সব উত্তর দিয়ে এদের জলদি বিদায় করাই ভালো।
আগামী তিনদিন বাবা মা-র সঙ্গে কত ঘোরার প্ল্যান ছিল। সব বারোটা বাজল, রুদ্র আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সবকটা ডকুমেন্ট ও সামনের দিকে এগিয়ে দিল, ‘এই নিন। অঘোরেশ ভাটের ডিটেইলস। প্যান কার্ড, ভোটার কার্ডের কপিও আছে। আর এইগুলো শেষ ছয় মাসের স্টেটমেন্ট।’
নাহুম খান ডকুমেন্টগুলো গুছিয়ে নিয়ে নিলেন, ‘ওকে ম্যাডাম, আমরা এখন চলে যাচ্ছি। থ্যাঙ্কস ফর দ্য কো-অপারেশন। পরে দরকার পড়লে আবার আসতে হতে পারে।’
রুদ্র মুখে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে ওদের বিদায় করল। উত্তর ভারতের বেশিরভাগ মানুষই একটু মেজাজি ধরনের হয়, সেটা এই বছরখানেকের অভিজ্ঞতায় ও উপলব্ধি করেছে। পাবলিক সার্ভিসে যুক্ত লোকজন তো আরওই। সেইদিক থেকে এই পুলিশ অফিসার বেশ ব্যতিক্রমী। সাধারণ পুলিশ অবশ্য নন, স্পেশাল সেল না কোথা থেকে এসেছেন বললেন।
ও বেশি সময় নষ্ট করল না, ‘অমিত, তিনদিনের মধ্যে আমাকে এই অভিযোগের বিরুদ্ধে একটা ঠিকমতো উত্তর দিতে হবে, যেটার বেসিসে তদন্ত শুরু হবে। আমার এক্সপ্ল্যানেশনে উপরমহল সন্তুষ্ট হলে সাসপেনশন এখন উঠলেও উঠতে পারে, না হলে এনকোয়্যারি শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে হবে।’ একটুক্ষণের জন্য ও ঠোঁট কামড়াল, ‘পরশু ছাব্বিশ তারিখ প্রজাতন্ত্র দিবসের ছুটি। হিসেবমতো তার মানে একদিন বেশি পাব উত্তর দেওয়ার জন্য।’
যে চেয়ার থেকে একটু আগে নাহুম খান উঠে গেলেন, সেখানেই বসে পড়ল অমিত, ‘তাহলে আপনি বলবেন, আমি টাইপ করব?’
‘এখনই না।’ মাথা নাড়ল রুদ্র, ‘আগে একটু সাজিয়ে নিই মনের মধ্যে। তুমি যাও, বাকি কাজ শেষ করো। আজ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাব। ভালো লাগছে না।’
অমিত চলে যেতে রুদ্র টেবিলের ওপর থেকে খবরের কাগজটা তুলে নিল। প্রতিদিন বিকেলের চা-টা খাওয়ার সময় ও সেদিনের কাগজটা পড়ে, আজকের তালেগোলে সেই সময় পায়নি। এর মধ্যে আরেক কাপ চা সুরেশ দিয়ে গেছে। রুদ্র চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাগজ পড়তে লাগল। মনের মধ্যে যতই তোলপাড় হোক, চুপচাপ বসে থাকলে টেনশন আরও বাড়বে।
এটা আগ্রা শহরের স্থানীয় কাগজ, তাই প্রথম পাতাতেই বড়ো বড়ো করে রয়েছে, ‘২৭ জানুয়ারি আগ্রায় হতে চলেছে আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন।’ রুদ্র বিশদ পড়ল না। আগ্রার মতো ছোটো শহরে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন হতে চলেছে, এই নিয়ে কয়েকদিন ধরেই ছোটোবড়ো সব মিডিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর পরিবেশন করে চলেছে। পড়তে পড়তে প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে তার বিবরণ। ক-টা দেশ আসছে, কোথায় সেই হেভিওয়েট প্রতিনিধিরা থাকবেন, কী করবেন, কোথায় কোথায় তাঁরা যাবেন, সেই এক খবর।
খবরের কাগজের প্রথম পাতা উলটে ভেতরের পাতায় যেতেই নীচের দিকের একটা খবর ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। কাগজটা ভাঁজ করে ভালো করে ও সেটা পড়তে লাগল।
নিজস্ব সংবাদদাতা, কমলানগর, আগ্রা-
এক মাস কেটে গেলেও আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড নিজামুদ্দিন বেগ-এর নিজের বাড়ি থেকে নিখোঁজ হওয়ার কোনো কিনারা করতে পারল না পুলিশ। অথচ স্থানীয় বাসিন্দা সূত্রে খবর, প্রায়ই গভীর রাতে প্রফেসর বেগ-এর ফাঁকা বাড়িতে দুষ্কৃতিদের আনাগোনা চলছে। প্রফেসরের কোনো খোঁজ না থাকলেও কী উদ্দেশ্যে এই গোপন আনাগোনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রফেসর বেগ নিরুদ্দেশ হওয়ার পর কিছুদিন সেই বাড়িতে পুলিশি প্রহরা থাকলেও পরে তা তুলে নেওয়া হয়। কমলানগর থানার ওসি মি জগদীশ পাণ্ডে ‘আগ্রা টাইমস’কে জানাচ্ছেন, তাঁরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন এবং এই ঘটনার পর পুলিশ প্রহরা সেখানে আবার মোতায়েন করা হবে।
প্রসঙ্গত, প্রফেসর নিজামুদ্দিন বেগ তাজমহল সম্পর্কে কিছু বিতর্কিত মন্তব্য করে কিছুদিন আগে মৌলবাদীদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। তাঁর ‘মহাদেব শিব ঘুমোচ্ছেন তাজমহলের অন্দরে- মুসলিমদের চারশো বছরের মিথ্যে এবার উন্মোচিত হোক’ শীর্ষক ধারাবাহিক কলাম প্রকাশিত হচ্ছিল প্রথম সারির এক দৈনিকে, যেখানে তিনি তাঁর গবেষণার ফলে লব্ধ একের পর এক তথ্য দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন যে তাজমহল পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাজাহান তাঁর মৃতা মহিষীর উদ্দেশে বানাননি, এটা আদতে বহু পুরোনো এক হিন্দু শিব মন্দির, যার নাম ছিল তেজো মহালয়। তাঁর এই ধারাবাহিক প্রবন্ধ শুধু বিদগ্ধ ঐতিহাসিক মহলেই নয়, চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল মৌলবাদীদের মধ্যেও। সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগও করেন এক ব্যক্তি। পশ্চিমে অবস্থিত মসজিদ কর্তৃপক্ষ তাঁদের পবিত্র স্থানকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কলুষিত করা হচ্ছে বলে তাজমহল প্রাঙ্গণেই বিক্ষোভ জানান। নিরুদ্দেশ হওয়ার ঠিক আগের সপ্তাহের কিস্তিতে প্রফেসর বেগ লিখেছিলেন, পরবর্তী সপ্তাহে সবচেয়ে বড়ো প্রমাণটি তিনি জনসমক্ষে আনবেন, প্রমাণ করে দেবেন তাজমহল লুকিয়ে আছে আসলে এক প্রাচীন বৈদিক অঙ্ক, যা এখনও জ্যান্ত। সেটা নিজেই নাকি প্রমাণ করে দেবে শিবমন্দিরের সত্যতা।
এই সংবাদ প্রকাশের পরেই বিক্ষোভ চরমে ওঠে এবং অধ্যাপকের কমলানগরের বাড়িতে হামলা এবং বিক্ষোভ শুরু হয়। একাধিক ইতিহাসবিদও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ড ব্রিজেশ মাথুর বলেন, ‘এইগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিকৃত কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়।’ ওই সংবাদপত্রের সম্পাদক লিখিত বিবৃতি দিয়ে জানান, বিশেষ কারণে ওই ধারাবাহিকটি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও হামলাকারীরা অধ্যাপকের বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে যেতে থাকে, পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু এরপরেই প্রফেসর বেগ রহস্যজনকভাবে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। এখনও অবধি তাঁর কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি। তাঁকে যে কিডন্যাপ করা হয়েছে এমন কোনো প্রমাণও পুলিশ পায়নি। এই নিয়ে বিরোধী দল আজ বিধানসভায় বিক্ষোভ দেখায়।
রুদ্র অন্য খবরে যেতে যেতে ভাবল, প্রফেসর নিরুদ্দেশ, তবু কেন দুষ্কৃতীরা বার বার হামলা চালাচ্ছে বাড়িতে? কীসের সন্ধানে?
ঘণ্টাখানেক বাদে রুদ্র স্কুটিতে করে বাড়ি ফিরছিল।
ঠান্ডা হাওয়া হেলমেট ভেদ করে ভেতরে ঢুকছে, এখানে সবাই গাড়ি চালানোর সময় ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে একধরনের মাস্ক পরে, রুদ্রও সেটাই পরেছিল শুধু চোখগুলো বেরিয়ে ছিল বাইরে।
ক্লান্ত দেহে, অবসাদে ডুবে থাকা মনে ও গাড়ি চালাচ্ছিল।
যে ব্রাঞ্চটাকে এই কয়েক মাস ধরে এত পরিশ্রম করে ও দাঁড় করাল, পুরোনো লোনগুলোর বেশিরভাগই রিকভার করে প্রফিট দেখাল হেড অফিসে, সেই ব্রাঞ্চ থেকেই ও সাসপেন্ড হয়ে গেল? তাও আবার কালো টাকা ঢোকায় মদত দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ, যাতে সত্যিই ওর কোনো দোষ নেই! কিন্তু দুর্নীতির কোনো দাগ একবার কেরিয়ারে লাগলে সেটা উল্কার মতো চারদিকে ছড়িয়ে যায়, অনেক সময় পরে নির্দোষ প্রমাণ হলেও সেটা কিন্তু অত বড়ো খবর হয় না। ইতিমধ্যেই অন্য ব্রাঞ্চে থাকা দু-জন বন্ধু ওকে মেসেজ করেছে খবরের সত্যতা জানতে।
বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছোটো রাস্তা থেকে রুদ্র যমুনা নদীর ওপর ব্রিজে উঠল। কী করতে বাড়ি ছেড়ে, কাছের মানুষদের ছেড়ে ও এখানে পড়ে আছে? রোজকার অভ্যাসমতো ওপারের তাজমহলটার দিকে একবার তাকাল, যমুনা নদীর তীরে রাজেন্দ্রাণীর মতো অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে অস্পষ্ট ওপরের গম্বুজ আর চারপাশের মিনারগুলো।
ওর হঠাৎ মনে পড়ল কাগজের লাইনটা, তাজমহলে লুকিয়ে আছে একটা জ্যান্ত অঙ্ক।
এর মানে কী? অঙ্ক কী করে জ্যান্ত হয়?
অন্যদিন মুগ্ধ চোখে দেখে, আজ বিষণ্ণভরা মনে রুদ্র ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
তাজমহলের একদম উলটোদিকে, অর্থাৎ যমুনা নদীর অন্য পাড়ের এক পরিত্যক্ত বাগানে তখন অন্ধকারের মধ্যে বিষম ব্যস্ততা। একদল শ্রমিক তখন চূড়ান্ত গোপনীয়তায় কিছু একটা কাজে ব্যস্ত। বাগান অবশ্য নামেই, শতাধিক বছরের না কাটা এলোমেলো গাছে এটা একটা ছোটোখাটো জঙ্গল হয়ে উঠেছে। বড়ো বড়ো আগাছার মধ্যে সবাই আঁতিপাঁতি করে খুঁজছে কিছু। যেমনটা তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকের হাতে শাবল, মাটি খোঁড়ার ছোটোবড়ো জিনিস। তাদের তদারক করছে কিছু মানুষ।
দূরে কয়েকজন রক্ষী, তারা নৈশপ্রহরার নামে পাহারা দিচ্ছে এই গোপন খনন।
শতাব্দীপ্রাচীন অঙ্কের ঘুম ভাঙতে মনে হয় আর বেশি দেরি নেই!
৬
পুরোনো দিল্লির যে ঘিঞ্জি গলিটা এঁকেবেঁকে এসে আজমেরি গেটের দরজার পাশে মিশে গেছে, ঠিক সেইখানটায় এসে পিচিক করে একদলা থুতু ফেলল মুন্না। ওর সারা শরীরে, চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। গোটা রাত ধরে ট্রেনের সাধারণ কামরায় একরকম বলতে গেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আসতে হয়েছে, শেষে ঘণ্টাখানেক একটু বসে ঝিমোতে পেরেছিল, তাতে ক্লান্তিটা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়ে যেন পা দুটোকে টেনে ধরছে।
শরীরের জড়তাটা একটা ঝটকা মেরে কাটিয়ে নিতে চেষ্টা করল ও, তারপর পায়ে পায়ে এগোল সামনের দিকে। এই তবে দিল্লির বিখ্যাত জি বি রোড! পাশের একটা ঝলমলে দোকানের সাইনবোর্ড পড়তে চেষ্টা করল, কী লেখা আছে যেন? মুন্না থমকে দাঁড়িয়ে বানান করে পড়ল, গার্সটিন ব্যাস্টিয়ন রোড। বাপ রে, কী খটোমটো নাম! নির্ঘাত কোনো সাহেবের নামে।
এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হল, ওই খটোমটো নামওয়ালা সাহেবও কি এই পাড়ায় আসত নাকি?
আসার আগে শাকিল বলেছিল, ‘কলকাতার সোনাগাছি তো গেছিস, জি বি রোড হল দিল্লির সোনাগাছি। কিন্তু এখানে ঝড়তিপড়তি পাবি না, টপ ক্লাস মাল সব। পুরো আজমেরি গেট থেকে লাহোরি গেট অবধি সোজা চলে যাবি ভাই, দু-পাশে কত চাই, পাঁচশোর ওপর বাড়ি, সকালটায় নীচে সব লোহার পার্টসের দোকান, রাতে দেখবি সামনের ওই দরজাগুলোতেই সব সার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’ মুন্না খুব উৎসাহ পাচ্ছে এমনভাবে বলেছিল, ‘কিন্তু রেট সাধ্যের মধ্যে হবে কি?’
‘আব্বে, তুই শাকিলের ভাই আর তোর হবে না? কী বলছিস!’ শাকিল ওর পিঠে চাপড় দিয়ে বলেছিল, ‘জি বি রোড শুরু করেই সোজা হাঁটবি, পাঁচ মিনিট হাঁটার পর দেখবি দিকে একটা সাইকেল সারানোর দোকান, তার গা দিয়ে সরু গলি আছে, ওটা দিয়ে সোজা ঢুকে যাবি, যে গোলাপি বাড়িতে ধাক্কা খাবি, ওটা চাঁদনির বাড়ি, সোজা দেখা করে আমার নাম বলবি। বলবি তুই শাকিলের ভাই, ব্যস! আর দেখতে হবে না। চাঁদনির হাতে ঝক্কাস সব মাল আছে, তোর সেটিং হয়ে যাবে পুরো!’ শাকিল জোরে চোখ টিপেছিল।
হ্যাঁ, দোকানটা দেখতে পাচ্ছে মুন্না, সামনে সার দিয়ে সব সাইকেল পড়ে আছে, দেখতে পাচ্ছে তার পাশ দিয়ে ঘিনঘিনে গলিটাও। কিন্তু ও ঢুকল না। ঘড়িতে এখন সন্ধে সাড়ে ছ-টা। আগে ওর কাজটা মিটুক। ফেরার পথে চাঁদনির সঙ্গে দেখা করে রাতটা কাটিয়ে গেলেই হবে।
সবে সন্ধে নেমেছে বলেই হয়তো, দু-পাশে সার দিয়ে হার্ডওয়্যারের দোকানগুলোর সামনের দরজাগুলোতে এখনও ভিড় জমেনি। রাস্তার আলোয় পুরো গলিটাকেই কেমন যেন সিনেমার মতো ঝলমলে লাগছে। কাছেপিঠে চড়া সুরে একটা চটুল হিন্দি গান বাজছে।
মুন্না একটু দাঁড়াল, ওই তো দূরে গুলশন পান সেন্টার। ও এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাছে এগিয়ে গেল গুটিগুটি, ধীরেসুস্থে সিগারেট কিনল একটা, পাশের দড়ি থেকে আগুন নিয়ে জোরে একটা টান দিল, ‘খুচরো তো নেই ভাই, দু-হাজারের নোট!’ মোলায়েম স্বরে কথাটা হাতে ধরা গোলাপি নোটটা এগিয়ে দিল ও।
এই নোট কি বাজারে চলবে? গান্ধীজির মুখে ধ্যাবড়া পেনসিলে আঁকিবুকি।
পানওয়ালা একটা গালাগাল দিতে গিয়েও বিরক্তির ভাব করে থেমে গেল, ওর নোটটার দিকে আলতো তাকিয়ে নীচের দিকে নিস্পৃহভাবে সুপুরি থেঁতো করতে করতে বলল, ‘কী নাম?’
মুন্নাও নিস্পৃহ গলায় বলল, ‘মুঙ্গের থেকে আসছি। দেখা করব। বলা আছে।’
প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর এ গলি সে-গলি ঘুরে শেষ পর্যন্ত যখন একটা ঘরে গিয়ে বসতে বলা হল মুন্নাকে, ততক্ষণে এই ঠান্ডাতেও ও ঘেমেনেয়ে উঠেছে। নীলচে নিয়নের আলোতে পিঠের ব্যাগটা নামিয়ে সেখান থেকে কিছুক্ষণ জল খেল ও, তারপর সোজা হয়ে বসে মনে মনে সাজিয়ে নিল কী বলবে। বন গাঁয়ে আসলে ও শিয়ালরাজা, এত বড়ো ব্যাপারে এসে আদতে ওর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে বার বার।
বাইরে এবার আরও চড়া লয়ে সফটওয়্যারে বিকৃত করা রিমেক গান শুরু হয়েছে। এখান থেকে খুব একটা দেখা না গেলেও এটা যেহেতু দোতলা, নীচের মেয়েলি হাসাহাসি কানে আসছিল মুন্নার। মন উচাটন হলেও কিছু করার নেই। এবার হাতে পয়সা বেশি নেই, একদিনের নোটিশে দিল্লি আসতে হয়েছে, রাতটা ওই শাকিলের চাঁদনির কাছে ম্যানেজ করতে পারলে কিছুটা টাকা বাঁচবে।
হঠাৎ দরজার কাছে একটা ছায়ামূর্তির আগমনে ও চমকে তাকাল। এই ঘরে আসার আগে তিন পর্বে দফায় দফায় ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, এটা কি ফাইনাল দফা?
সামনে এসে যে লোকটা ওর মুখোমুখি বসল, তাকে দেখে ও দমে গেল। হাইট মেরেকেটে সাড়ে পাঁচ ফুট হবে, উচ্চতার সঙ্গে বিসদৃশ হয়ে পেটের থেকে অনেকটা বেরিয়ে থাকা ভুঁড়িটায় আরও বেঢপ দেখাচ্ছে গোটা শরীরটা। গায়ের রংটা বেশ ফর্সা, কিন্তু কেমন যেন বাদামি। লোকটার ঊর্ধ্বাঙ্গে এই ঠান্ডাতেও শুধু একটা টি শার্ট, আর নীচে খাকিরঙা প্যান্ট। হাতে একটা আপেল।
পেছন পেছন আরও দুটো লোক এসে লোকটার দু-পাশে দাঁড়াল। হাবভাব মাছের গন্ধ পাওয়া সতর্ক হুমদো বেড়ালের মতো। বডিগার্ড নির্ঘাত।
সামনের সোফায় বসে লোকটা ওর দিকে কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপভাবে তাকাল, তারপর বলল, ‘মনসুর পাঠিয়েছে? কী চাই?’
এমন চেহারা থেকে এরকম গম্ভীর স্বর বেরোতে মুন্না একটু থমকে গেল, তবে তা কয়েক সেকেন্ডের জন্য। অনেক মহড়া দিয়ে এসেছে সে, আসল সময়ে সব পণ্ড করার বান্দা সে নয়। একবার এত বড়ো দাঁওটা মারতে পারলে এবারের ইলেকশনের টিকিট ওর বাঁধা। হাত কচলে দেঁতো হেসে বলল, ‘মনসুর ভাইয়া আমাকে খুব ভালোভাবে চেনেন। আমি মুন্না শেখ। বিহারের মুঙ্গের থেকে আসছি আপনার সঙ্গে দেখা করতে।’
‘ওহ, তুমিই সেই মুঙ্গেরের বাদশা?’
লোকটা কি ওকে বিদ্রূপ করছে? করলে করুক, এখন এইসব ছোটোখাটো খোঁচা গায়ে মাখলে মুন্নার চলবে না।
‘হে হে কী যে বলেন হুজুর!’ মুন্না কান-এঁটো-করা হাসি দিল একটা।
‘না সত্যি!’ লোকটা বেশ সিরিয়াস মুখে ওর দিকে তাকাল, ‘আমি মুঙ্গের সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছি। শুধু ইন্ডিয়া নয়, নেপাল বাংলাদেশেও মুঙ্গেরের মাল নাকি সাপ্লাই হয়। একটা পিছিয়ে থাকা রাজ্যের অখ্যাত শহরে রাতারাতি এত বড়ো সেট আপ তৈরি হল কী করে?’
‘রাতারাতি কী বলছেন হুজুর!’ মুন্না হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘দু-শো বছরের পুরোনো আমাদের মুঙ্গেরের এই ব্যাবসা। ইংরেজরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম ওখানে কার্ট্রিজ বন্দুক বানানোর কারখানা খোলে। তারপর দেশ স্বাধীন হল। বাষট্টি সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তো সরকারকে সব চারশো দশ বোরের মাসকেট বন্দুক সাপ্লাই দিয়েছিল মুঙ্গের অর্ডিন্যান্স কারখানাই।’
‘বটে? তুমি তো বেশ পড়ালেখা জানা লোক দেখছি!’ লোকটা বেশ চমৎকৃত হয়েছে মনে হল।
‘জ্বি না, স্যার।’ মুন্না লজ্জায় হাত কচলাচ্ছিল, ‘আসলে বাপ ঠাকুরদার তো এই ব্যাবসা, ছোটো থেকে এই গল্প শুনছি। তারপর সরকার দুম করে ওই কারখানা তুলে দিল আর মুঙ্গেরের হাজার হাজার লেবার পথে বসল। তারপর সবাই কী আর করবে, পেট তো চালাতে হবে! কাজ বলতে তো বন্দুক, বানানোটাই জানত তারা। তখন নিজেদের বাড়িতেই ছোটো ছোটো ওয়ার্কশপ, কারখানা, এইসব খুলে ফেলল। আমার ঠাকুরদাও তাই করেছিল। সেই থেকেই আর কি আমাদের ব্যাবসা…!’
‘কী কী বানাও তোমরা?’ লোকটা মোবাইলে কিছু দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল।
‘জ্বি, আগে তো শুরু হয়েছিল দিশি কাট্টা বন্দুক দিয়ে, এখন ছয় মিলিমিটারের পিস্তল, কারবাইন, এ কে ৫৬, এ কে ৪৭, সবরকমই বানাতে পারে আমাদের লোকেরা।’
‘ফরটি সেভেন?’ লোকটা যেন অবাক হল, ‘বটে? এম ১৬-ও বানাও?’
মুন্না মাথা চুলকোল, ‘এজ্ঞে, ওটা এখনো হয় না। এ কে ৪৭ এর রোল সাবমেশিনগানের মতোই, অল্প পার্টস, ৩০ ক্যালিবারের বুলেট, স্টপিং পাওয়ারও বেশি। এম ১৬-এর প্রচুর পার্টস, খুলতে জুড়তে অনেক ঝামেলা, তার ওপর ২২ ক্যালিবারের বুলেট, পাওয়াও একটু মুশকিল। আমাদের এ কে ৪৭ দেখতে হয়তো খুব সুন্দর হয় না, কিন্তু কাজে একদম বড়িয়া!’
‘হুম।’ লোকটা আপেলে একটা মস্ত কামড় বসাল, ‘দাম কীরকম হয়?’
মুন্না এতক্ষণে উৎসাহ পেয়ে নড়েচড়ে বসল, ‘হুবহু স্মিথ ওয়েসনের যে মডেল বলবেন, বানিয়ে দেব, দাম তিরিশ থেকে এক-এর মধ্যে হয়ে যাবে স্যার!’
‘ফরটি সেভেন কত করে?’
‘ওটা পাঁচ থেকে ছ-লাখ পড়ে যাবে। কার্বাইন যদি নেন, দুয়েতেই দিয়ে দেব।’
‘একটা শটের পিস্তল?’
মুন্না দমে গেল, ‘ওটা তো বাচ্চা ছেলেদের বন্দুক। একটাই বুলেট ফায়ার করতে পারবে।’
লোকটা সরু চোখে ওর দিকে তাকাল।
‘বাঁ-পাশের লম্বা দাড়িওলা লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠল, ‘যা জিজ্ঞেস করছে উত্তর দে!’
‘পাঁচশোর মধ্যে হয়ে যাবে।’ মুন্না মিনমিন করল, ‘তবে কোথাও ডেলিভারি করতে গেলে হাজার দুয়েক পড়ে যাবে। রাস্তায় পুলিশ, ড্রাইভারদের খাওয়াতে হবে তো!’
‘গ্রেনেডের স্টক কেমন আছে?’
‘হয়ে যাবে স্যার!’
‘ফুল পেমেন্টের কত দিনের মধ্যে ডেলিভারি দিতে পারবে?’
এমনিতে তো পঞ্চাশ পারসেন্ট অ্যাডভান্স দিতেই লোক গাঁইগুঁই করে, ভোটের আগে যা একটু জোর খাটানো যায়। আর এ প্রথমেই ফুল পেমেন্ট করে দেবে? আনন্দে মুন্নার চোখ চকচক করে উঠল, ‘জ্বি, সিঙ্গল শট পিস্তল হলে একটা বেলা বড়োজোর! মাল তৈরিই থাকে, শুধু আনার যা সময়।’
‘বহোত খুব!’ লোকটা এবার ওর দিকে বেশ সুপ্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকাল, ‘তা, মনসুর কী বলেছে, আমি তোমার থেকে মাল নেব? আমার সব ডিটেইলস আছে তোমার কাছে?’
মুন্না এবার কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, ‘না, মানে আপনি মনসুর ভাইয়ার চেনা, ডিটেইলস আমরা তো তেমন রাখি না, টাকা পেলেই…!’
‘যদি আমি পুলিশ হই? ফাঁদ পেতে পুরো স্টকটাই তোমার সিজ করে দিই?’ লোকটা বেশ মজার চোখ করে কথাটা বলল।
মুন্না এবার ঢোঁক গিলল। অনেকক্ষণ ধরেই আনতাবড়ি প্রশ্ন চলছিল, এবারেরটা একেবারে ইয়র্কার! এটা খেলার সাধ্যি মুন্না শেখের নেই।
লোকটা উঠে দাঁড়াল, একটা ঢেকুর তুলে বলল, ‘কাস্টমার সবসময় যাচাই করে নেবে। টাকা দিলেই মাল দেব, এই প্রিন্সিপল তোমার ব্যাবসায় চলে না। বুঝেছ?’
মুন্না ঘাড় দোলাল, ‘জ্বি।’
লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে পাশের লম্বা কুর্তা পরা লোকটাকে দেখিয়ে বলল, ‘ওয়াসিম তোমার সঙ্গে বসছে। ও তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবে। কাল সকালের মধ্যেই চাই। মাল আমরা কিনব, কিন্তু এখানে ডেলিভারি নেব না।’
মুন্না শুনে পুলকিত হয়ে উঠতে যাচ্ছিল, শেষ বাক্যটা শুনে ও অবাক হয়ে তাকাতে গেল লোকটার দিকে। যাচ্চলে, এখানে ডেলিভারি নেবে না তো আবার কোথায় নেবে!
কিন্তু লোকটা ততক্ষণে পর্দা সরিয়ে ওর দৃষ্টিশক্তির বাইরে চলে গেছে। ওয়াসিম মেরুন-রঙা সিল্কের কুর্তা গুটিয়ে বসেছে সোফার ওপর। কুর্তার পকেট থেকে কালো মতো যেটা উঁকি দিচ্ছে, সেটা যে আগ্নেয়াস্ত্র, তা আর্মস ডিলার মুন্না এতদূর থেকেও হলফ করে বলতে পারে। এই লোকটাকে দেখেই মনে হয় ঠান্ডা মাথায় কাউকে খুন করতে এর চোখের একটা পাতাও কাঁপে না।
মনসুর ভাইয়া সাবধান করে দিয়েছিল বিশাল বড়ো পার্টি বলে। বলেছিল, ‘মুন্না, ঠিকমতো ডিল করতে পারলে যা ইনকাম করবি, সারাজীবন চাইলে বসে খেতে পারবি।’
আপেল খাওয়া লোকটা কে? গায়ের রং দেখে মনে হয় জি বি রোডের এই এঁদো গলিটা যেন ওর জায়গা নয়। হিন্দিটাও অন্যরকম।
কী মতলব ওর? পোড় খাওয়া আর্মস ডিলার মুন্না শেখ এই ঠান্ডাতেও কেমন যেন ঘামতে লাগল।
৭
দুটো লোকের মধ্যে হওয়া কথোপকথনের অডিয়ো ক্লিপিংটা যতক্ষণ চলছিল, সাদা ধুতি পরা ছেলেগুলো একমনে শুনছিল, মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল সামনের বিশাল স্ক্রিনের দিকে। রেকর্ডটা শেষ হতেই স্ক্রিনের ওপারের ফর্সা লোকটা কথা বলে উঠল, ‘কী বুঝলে তোমরা?’
কেউ কোনো উত্তর দিল না। নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইল স্ক্রিনের ওপাশের গুরুর দিকে।
লোকটা বলল, ‘এটা তো বুঝতে পারছ যে এরা আগ্রা শহরে কোনো প্রাচীন মন্দির খুঁজছে?’
ছেলেগুলো এখনও চুপ।
ভিডিয়ো কনফারেন্স চলছে। বাইরে ২৪ জানুয়ারির মধ্যরাত। এই হল ঘরের পাশের জানলাগুলোর লাগোয়া গাছগুলোর পাতা মৃদুমন্দ দুলছে ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়ায়। একটা ছেলে সেদিকে আড়চোখে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। গুরুজি, তা সে যত দূরেই থাকুন, কারুর অমনোযোগিতা পলকে ধরে ফেলেন। শুধু এই ঘরেই রয়েছে কম করে ত্রিশটা সি সি ক্যামেরা, সবার প্রতি মুহূর্তের হিসেব মনিটর করছে সেগুলো।
স্ক্রিনে গুরুজি এবার বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কাবা শরিফ গেছ? সৌদি আরবের মক্কার কাবা মসজিদ? ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র তীর্থস্থান?’
একটা ছেলে একটু ইতস্তত করে হাত তুলল, ‘ছোটোবেলায় আব্বাজানের সঙ্গে গিয়েছিলাম। হজ করতে।’
‘বেশ। তোমার নাম কী?’ গুরুজি স্ক্রিনে হাসিমুখে তাকালেন।
‘কা-কমল গুরুজি।’
গুরুজি প্রসন্নমুখে মাথা নাড়লেন ঈষৎ, ‘আগে কামাল ছিল, তাই না?’
কমল নামের বছর উনিশ-কুড়ির ছেলেটা মাথা নাড়ল।
‘কমল, তুমি কি জানো, মক্কার ওই কাবা মসজিদ আসলে একটা হিন্দু মন্দির ছিল?’ গুরুজি কমলের দিকে তাকালেন।
কমল বলে ছেলেটার চোখে একটা উন্নাসিকতার চিহ্ন ফুটে উঠেই নিভে গেল। পাশ থেকে ফিচকেমতো ছেলেটা ফিসফিস করে উঠল, ‘ওই শুরু হল আবার! নেহাত টাকার জন্য পড়ে আছি, না হলে বেটাকে লাথি মেরে…!’
কমল হিন্দু সন্তান দলের সর্বকনিষ্ঠ এবং সর্বশেষ সদস্য। তার নাম কামাল, না কমল, কাবা মন্দির ছিল না মসজিদ বা গির্জা, তাতে কি তার কিছু যায় আসে?
হিন্দু সন্তান দল প্রতি মাসেই কুড়ি পঁচিশটা করে ধর্ম পরিবর্তন করাচ্ছে, ওরা অবশ্য এটার নাম দিয়েছে ‘ঘর ওয়াপসি’। মানে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসছে আর কি!
কমল মুসলমান ছিল। কিন্তু গুরুজির কথা অনুযায়ী তারও কয়েকশো বছর আগে কমলের পূর্বপুরুষ নাকি হিন্দুই ছিল, তাদের জোর করে মুসলিম করা হয়েছিল। কমলকে অবশ্য জোর করে করানো হয়নি, নিদারুণ দারিদ্র্যে পাঁচ লক্ষ টাকা যেন এক আকাশ টাকা, কমলরা আনন্দের সঙ্গে হিন্দু হয়ে গেছে। এখন দলের কাজকর্ম করেও ভালো রোজগার হচ্ছে।
সামনের বছর বোনের বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলেই… আরে ভাই, হিন্দু হও আর মুসলিম, পেটের জ্বালায় গরম চাপাটির খিদে একরকম!
‘কমল!’ গুরুজি আবার ডাকলেন।
‘হ্যাঁ, গুরুজি!’ কমল তড়িঘড়ি বাস্তবে ফিরে এল।
গুরুজি এবার সবার দিকে তাকালেন, ‘প্রাচীন যুগে সমস্ত সভ্যতার উন্মেষ এই ভারতবর্ষেই ঘটেছিল। সরস্বতী নদী ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাওয়ার ফলে তা ক্রমশ পৌঁছয় আরব, মেসোপটেমিয়ার দিয়ে। ঐ যে কথোপকথনের রেকর্ডটা শুনলে, উদ্দেশ্য ওদের যতই অসৎ হোক, কথাটা ঠিকই বলেছে, জ্যামিতির উপপাদ্য থেকে শুরু করে আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক জটিল আবিষ্কারই হয়েছিল ভারতে। তেমনই ইসলামের আবির্ভাবের আগে কাবা ছিল হিন্দু মন্দির। কিছু বছর আগে রাজা বিক্রমাদিত্যের এক শিলালিপি সেখান থেকে উদ্ধার হয়েছিল বলে শুনেছি। রাজা বিক্রমাদিত্য আরব দখল করেছিলেন। কাবায় তিনশো পঞ্চাশটা মূর্তি আছে যেগুলো বছরের একেকটা দিনের প্রতীক। সেই মূর্তিগুলোর মধ্যে প্রধান হলেন চন্দ্রদেব হুবল। শিবের সঙ্গে এই দেবতার প্রচুর সাদৃশ্য। শিবের মতো হুবলদেবও মাথায় চাঁদকে ধারণ করেন। শিবের মাথা থেকে যেভাবে গঙ্গা নির্গত হয়েছে, তেমনই হুবলদেবের ক্ষেত্রে জমজমের পবিত্র জল নির্গত হয়েছে।’
কমলের পাশের লোকটা আবার চাপা গলায় বলল, ‘আষাঢ়ে গপ্পো যত!’
‘মানে, আপনি বলছেন এটাও মুসলিমরা দখল করেছিল?’ একটা ছেলে প্রশ্ন করল।
‘আমি কিছুই বলছি না। আমি শুধু সত্যগুলো তোমাদের জানাচ্ছি। সিদ্ধান্ত নেবে তোমরা নিজেরাই।’ গুরুজি হাসলেন, ‘কাবায় মুসলিমরা অনেক আচারবিচার করে থাকেন, যেগুলো পুরোপুরি হিন্দু ধর্মের আচার। যেমন, কাবার পবিত্র পাথরকে কেন্দ্র করে তাঁরা সাতবার প্রদক্ষিণ করেন, ঠিক যেমন হিন্দুরা অগ্নিকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করে থাকেন, কাবার হজযাত্রীরা সাদা পোশাক পরেন, এটাও হিন্দু সংস্কার। এমনকী…’ গুরুজি এক মুহূর্ত থামলেন, ‘আল্লাহ শব্দটাও এসেছে সংস্কৃত থেকে, মা দুর্গার এক নাম ইলা, সেই ইলা থেকেই আল্লাহ। পণ্ডিত শতভলেকর আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন, কোরানের একটা বাণী আর যজুর্বেদের একটা শ্লোকের হুবহু এক অর্থ।’
গুরুজি বক্তব্য শেষ করতে উদ্যত হলেন, ‘এভাবেই হাজার হাজার হিন্দু মন্দির পরিবর্তিত হয়েছে মসজিদ বা মুসলিম সৌধে। আমাদের সেইসব হৃদসম্পদ পুনরুদ্ধার করতে হবে। হ্যাঁ আমরা বাধা পাব, রক্তাক্ত হব। কিন্তু কোনোভাবেই লড়াই ছাড়ব না। হিন্দু সন্তানরা, তোমরা প্রস্তুত?’
সবাই মাথা নাড়ল সঙ্গেসঙ্গে। কমলও মাথা নাড়ল। পাশের সেই ফিচেল ছেলেটাও। এই মিশনে প্রচুর টাকা, সেইজন্য ঝাঁপাতে ওরা সত্যিই তৈরি। ও না থাকুক, ওঁর পরিবার তো দুটো খেয়েপরে বাঁচবে!
‘গুরুজি, রেকর্ডে যে আগ্রার মন্দিরের কথা বলা হচ্ছিল, সেটাই কি তাজমহল?’ এক অত্যুৎসাহী ছেলে প্রশ্ন করল।
গুরুজি হাসলেন, ডান হাতটাকে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তুললেন স্ক্রিনের মধ্যে, ‘সেই প্রশ্নের উত্তর তোমরা খুঁজলেই পাবে। আর তো মাত্র দুটো দিন। অপেক্ষা শুধু প্রফেসরের ওই শ্লোকের মর্মোদ্ধারের। সন্তান দল প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তোমরা নিজেদের নিংড়ে লড়াই কোরো। হর হর মহাদেব!’
৮
২৫ জানুয়ারি, ২০১৮
এয়ারপোর্ট থেকে বুক করা ক্যাবটা যখন নিজামুদ্দিন স্টেশনে ঢুকল, তখন গতিমান এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে দিয়ে দিয়েছে, অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে ঘন ঘন।
সুরঞ্জন তড়িঘড়ি গাড়ি থেকে নেমে লাগেজগুলো নামিয়ে উৎফুল্ল মনে গুনগুন করে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে হাঁটা লাগালেন।
ভোরবেলা বেরিয়ে কোথাও যেতে হলেই বরাবর মনের মধ্যে কেমন একটা রোম্যান্স চলে আসে সুরঞ্জনের, সকালের তাজা আলোয় সব কিছুকেই বড়ো সুন্দর মনে হয় তাঁর। পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে গানের প্রথম দু-কলি শিস দিয়ে গেয়ে নিয়ে বেশ পরিতৃপ্ত হয়ে পেছন ফিরে তাকালেন তিনি।
পূরবীও একটা ট্রলি নিয়ে হাঁটছিলেন, কিন্তু ঢিমেতালে। সেই কাকভোরে বেরিয়ে দিল্লি আসার প্লেন ধরতে হয়েছে, তার ওপর কাল রাতে ঘুমটাও ঠিকমতো হয়নি। দিল্লি এয়ারপোর্টে নেমেই স্টেশনে হুড়মুড়িয়ে আসা, এক কাপ কালো কফি ছাড়া কিছু খাওয়াও হয়নি সকাল থেকে। পূরবীর কেমন একটা ঝিমঝিমে ভাব আসছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল, কোথাও বসে মাথাটা একপাশে এলিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতে। কিন্তু, সেটা তো এখন সম্ভব নয়। শরীর বিশ্রাম চাইলেও ট্রেন অপেক্ষা করবে না আর নিজের মনও সেটা চাইছে না। পূরবী সামনে ঝড়ের গতিতে হেঁটে চলা সুরঞ্জনের দিকে বেশ তির্যকভাবে তাকালেন। আনন্দের আতিশয্যে মানুষটা ভুলেই গেছে যে পেছনে কেউ রয়েছে। একটু কড়া গলায় ডাকতে গিয়েও সামলে নিলেন পূরবী।
থাক। জোর করে ক্লান্তিটাকে এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলে সুরঞ্জনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটার জন্য গতি বাড়ালেন পূরবী।
সুরঞ্জনের মুখে ক্লান্তির একদমই ছাপ নেই। একে মেয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার উত্তেজনায় ফুটছেন গত কয়েকদিন ধরেই, তার ওপর বাইরে এসেছেনও অনেকদিন পর।
ভুটানের সেই দীর্ঘ নির্বাসনের পর প্রথম যখন কলকাতায় নিজের বাড়িতে এসেছিলেন, কিছুদিন কেমন যেন থম মেরে গিয়েছিলেন*। বাইরের পৃথিবীকে অতদিন বাদে ঠিক যেন আগের মতো আর সাবলীলভাবে গ্রহণ করতে পারছিলেন না। লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই, তাঁদের যাবতীয় কৌতূহলের উত্তর দিতে গেলেই, একরাশ আড়ষ্টতা এসে গ্রাস করত তাঁকে। আর আত্মীয়স্বজন তো বটেই, প্রথম প্রথম মিডিয়ার আনাগোনাও লেগেই থাকত বাড়িতে। তাদের কতরকম ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অপ্রীতিকর প্রশ্ন! তার মধ্যে পুলিশের সঙ্গে তদন্তের সহযোগিতাও করতে হত। পূরবী সেসব এক হাতে সামলেছিলেন। তারপর দু-বছর ধরে ধীরে ধীরে রুদ্র, প্রিয়ম আর পূরবীর সাহচর্যে কাটিয়ে উঠেছেন সেই ট্রমাটা।
তারপর থেকে সময় ভালোই কাটছিল। সকাল থেকে নিজের খেয়ালখুশি মতো বই নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকা, পূরবী কলেজে বেরিয়ে গেলে কোনোদিন কলেজ স্ট্রিট, কোনোদিন নতুন কোনো প্রদর্শনী দেখা, কোনোদিন বা ন্যাশনাল লাইব্রেরি, এই করেই কেটে যাচ্ছিল বেশ। মাঝেমধ্যে টুকটাক কাগজে বা পত্রপত্রিকায় লিখতেন নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে। শনি রবিবার হলেই রুদ্র আর প্রিয়ম চলে আসত, গল্প-আড্ডায় বেশ কেটে যেত দিনগুলো।
কিন্তু তারপর প্রথমে প্রিয়ম গেল বাইরে, তারপর হঠাৎ রুদ্ররও ট্রান্সফারের অর্ডার আসতে কেরিয়ার গ্রোথের কথা ভেবে খুশি হওয়া উচিত হলেও সুরঞ্জন মনে মনে দুঃখই পেয়েছিলেন বেশি।
রুদ্রকে ওর ব্যাঙ্ক হঠাৎ বদলি করে দিল উত্তরপ্রদেশের আগ্রা শহরে। এমনিতে ওদের নিয়মমাফিক তিনবছর অন্তর ট্রান্সফার হওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এতটা দূরে হওয়াতে রুদ্রও প্রথমে বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিল।
ট্রেনে উঠে নিজেদের বসবার সিটটাও বেশ পছন্দ হয়ে গেল সুরঞ্জনের। এই ট্রেনটা নতুন চালু হয়েছে, বেশ বিদেশের কায়দায় প্রতিটা সিটের পেছনে আটকানো এল সি ডি টিভি, প্লেনের কায়দায় সুন্দর ডিজিটাল বোর্ড, লাগেজ রাখার লফট, কামরায় হাসিমুখে ঘোরাঘুরি করছেন হোস্টেসরা। এ ছাড়াও বিনোদনের আরও অনেকরকম উপকরণই মজুত। চওড়া জানলার পাশে বেশ জাঁকিয়ে বসলেন সুরঞ্জন, পূরবীর দিকে তাকিয়ে ভ্রূ নাচালেন, ‘দারুণ করেছে ট্রেনটা, বলো!’
সুরঞ্জনের হাবভাব সকাল থেকেই লক্ষ করছিলেন পূরবী, এবার হেসে ফেললেন, ‘হুঁ। মেয়েকে এগারো মাস বাদে দেখবে, তাই সব কিছু আরও সুন্দর লাগছে, তাই না! শুগারের ওষুধটা খেয়েছ না সেটাও ভুলে গেছ?’
সুরঞ্জন বললেন, ‘খেয়েছি খেয়েছি। রুদ্র কি ফোন করেছিল?’
পূরবী খাবারের ব্যাগটা একটু সাবধানে রাখছিলেন পায়ের কাছে, ওটাকে ইচ্ছে করেই লফটে তোলেননি। প্রিয়মের মা কাল এসে একগাদা খাবার দিয়ে গেছেন রুদ্রর জন্য, সেইগুলো রয়েছে, প্রিয়মদের কল্যাণীর বাড়ির গাছের কিছু সবজিও ঠেলেঠুলে ঢোকানো আছে, এ ছাড়া রয়েছে কলকাতার সেরা সেরা কিছু মিষ্টির প্যাকেটও।
লফটে তুলে দিলে সব যদি মাখামাখি হয়ে যায়?
পূরবী দুই হাঁটুর মাঝে শক্ত করে ধরে রাখলেন। রুদ্র অবশ্য পইপই করে বারণ করেছিল এত কিছু জিনিস টেনে না নিয়ে যেতে। কিন্তু মেয়েটা দিনে অন্তত তিনবার করে অনুযোগ করে ওখানে নাকি ভালো মিষ্টি পাওয়া যায় না, সারাদিন ছোলামটর খেয়ে খেয়ে ওর নাকি মুখ পচে যাচ্ছে!
মায়ের মন। এরপরও পূরবী এগুলো না নিয়ে কী করে যাবেন? একেই মেয়েটা ঘরগেরস্থালির কাজে কুঁড়ের বাদশা বললেও কম বলা হয়, খিদেয় পেট জ্বলে গেলেও খাবার নিজে নিয়ে খেত না। সেখানে একা একা থাকা, কী খাচ্ছে কে জানে! প্রিয়মও অতদূরে একা রয়েছে বটে, কিন্তু ও যথেষ্ট স্বাবলম্বী, নিজেরটুকু নিজে করে নিতে জানে। আর এই মেয়েটা নিজে তো কিছু শেখেইনি, যেটুকু শেখার কথা ছিল বিয়ের পর, সেটুকু তো দূর, প্রিয়ম ওর আরও বারোটা বাজিয়েছে লাই দিয়ে দিয়ে।
সুরঞ্জন তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন দেখে পূরবীর ঘোর কাটল, বললেন, ‘না। সেই ভোরে দমদমে প্লেনে ওঠার আগে কথা হয়েছিল। তারপর থেকে ফোনে পাচ্ছি না। চিন্তার কিছু নেই, ও স্টেশনেই থাকবে।’
সুরঞ্জন পকেট থেকে ফোনটা বের করলেন। স্মার্টফোন ব্যবহার করা শিখতে ওঁকে অন্তত বেগ পেতে হয়নি। দিব্যি টুকটাক দরকারি কাজ সারতে পারেন ফোনে। আর হাতিঘোড়া কিছু ব্যাপার তো নয়! আগ্রহ থাকাটাই বড়ো কথা। পূরবীর যেমন আগ্রহটাই নেই। না হলে যিনি কলেজে অঙ্কের অধ্যাপক, তাঁকে রুদ্র প্রায় এক বছর ধরেও হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুক শেখাতে পারল না! অনেক বোঝানো হয়েছে, কিন্তু পূরবী ওঁর পুরোনো ছোটো বোতাম টেপা ফোন নিয়েই খুশি।
সুরঞ্জন ডায়াল করতে যাবেন তার আগে দরজার কাছটায় কেমন একটা গোলমাল বেধে গেল। গোলমাল ঠিক নয়, উচ্চৈঃস্বরে কে যেন ইংরেজিতে গান জুড়েছে, তার মধ্যে মধ্যে কী সব বকছে আর উলটোদিকে এই কামরার হোস্টেসের মৃদু গলায় কথা শোনা যাচ্ছে।
আগে হলে সুরঞ্জন সঙ্গেসঙ্গে উঠে দেখতে যেতেন ব্যাপারটা কী। কিন্তু এই ক-বছরে আগের সেই স্বতঃস্ফূর্ত স্মার্টনেসটা অনেকটাই হারিয়ে গেছে।
সুরঞ্জন পূরবীর দিকে তাকালেন।
পূরবী উলটোদিকে বসে আছেন, ফলে দরজার দিকটা ভালোমতোই দেখতে পাচ্ছেন, চাপা গলায় বললেন, ‘তেমন কিছু না। এক ভদ্রলোক উঠছেন গান গাইতে গাইতে…।’
পূরবীর কথা শেষ হল না, হুড়মুড় করে সুরঞ্জনের গায়ে কী যেন এসে পড়ল। সুরঞ্জন চোখ তুলে দেখলেন এক ভদ্রলোক তাঁরই পাশের সিটটায় বসতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু পিঠের রুকস্যাকটা যে বেয়াদপভাবে পাশের জনের গায়ে বার বার ঠুকছে, সে-খেয়াল নেই। ভদ্রলোক তেরচা হয়ে বসে ওদিক ফিরে পায়ের জুতো নিয়ে কী-একটা করছেন, আর ওঁর রুকস্যাকের বাইরের ফিতে দুটো বিচ্ছিরিভাবে সুরঞ্জনের নাকে ঘষা খাচ্ছে।
নাকটা সরিয়ে নিলেন সুরঞ্জন, একটু সরে বসলেন বাঁ-পাশে জানলা ঘেঁষে, তাতেও বিশেষ সুরাহা হল না। রুকস্যাকটা মনে হয় কয়েক জন্ম কাচা হয়নি, কীরকম একটা গা-গুলোনো উৎকট গন্ধ ছাড়ছে সেটা থেকে, একসময়ের কালো রংটা প্রথমে মনে হয় ফ্যাকাশে ছাইরঙা হয়ে গিয়েছিল, তার ওপর দিনের পর দিন নোংরা লাগতে থাকায় কীরকম রাস্তায় পড়ে থাকা পানের পিকের মতো ছোপ ছোপ হয়ে রয়েছে গোটা ব্যাগটা। দেখলেই বমি পাচ্ছে।
সুরঞ্জন একবার ভাবলেন, একটু ঠিক করে বসতে বলবেন। কিন্তু সেই সুযোগ পেলেন না, ওই পাশে ক্রমাগত গান গেয়ে চলেছেন আগন্তুক।
ছোট্ট এই কামরায় বাকি পাঁচ-সাতজন লোক, সবাই এদিকেই চেয়ে রয়েছে। কিন্তু তাতে ওই তরফে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। জোরে জোরে গান গাইতে গাইতে সুরঞ্জনকে খোঁচা মারতে মারতে নির্বিকার দুলে চলেছে লোকটা।
আগে সুরঞ্জনের ধাঁ করে মাথা গরম হয়ে যেত। এ আবর কী! ন্যূনতম ম্যানারিজম না জানা লোকদের দু-চক্ষে দেখতে পারেন না তিনি। নিজের সহবত বোধের অভাবের জন্য এরা পারিপার্শ্বিক মানুষদের বিরক্ত করে আনন্দ পায়। আগে হলে এতক্ষণে কড়া করে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতেন তিনি। কিন্তু এখন তিনি অনেক শান্ত, সংযত। জানলার দিকে আরেকটু সরে বসলেন তিনি। দুর্গন্ধে টেকা দায়, তবু নিজেকে বোঝালেন তিনি, দেড়-দু-ঘণ্টার ব্যাপার, শুধু শুধু ঝামেলা করে লাভ নেই। ওদিকে পূরবী চোখ বুজে হেলান দিয়ে রয়েছেন সিটে।
এরপর উঠল মস্ত একটা বাঘের মতো দেখতে কুকুর, সম্ভবত জার্মান শেফার্ড, সঙ্গে দু-জন পুলিশ, হালকা গর্জন করতে করতে পুরো বগিটা সরেজমিনে তদন্ত করে গেল সে। এখন নিরাপত্তায় বেশ কড়াকড়ি করেছে রেল, সুরঞ্জন ভাবলেন।
তারপরেই হালকা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল।
মিনিট দশেক পরেও সুরঞ্জনের দিক থেকে কোনোরকম অভিযোগ না পেয়ে বোধ হয় গন্ধমাদন পাহাড়টা নড়েচড়ে একটু সোজা হয়ে বসল। দুর্গন্ধটা যেন আরও প্রকট হয়ে করে নাকে এসে লাগল। সুরঞ্জন আড়চোখে দেখলেন, ফর্সা একটা বিশাল মাপের মুখ, কাঁচাপাকা দাড়ি গোঁফে প্রায় ঢেকে রয়েছে, চামড়ায় রোদে পোড়া ভাব স্পষ্ট। মাথার ঝাঁকড়া চুল ঠিকমতো আঁচড়ানোও নেই। বাঁ-গালে একটা বেখাপ্পা ধরনের বড়ো তিল। বয়স সুরঞ্জনের মতোই, অন্তত ছ-ফুট দু-ইঞ্চির বিশাল দশাসই চেহারা, গায়ে একটা কালো কোট, সেটাও যাচ্ছেতাই ধরনের নোংরা। কালো প্যান্টটাও কতকাল কাচা হয়নি ইয়ত্তা নেই। এই ধরনের লোক এরকম অভিজাত ট্রেনে খুবই বেমানান, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কেউ কিছু বলছেন না।
বিরক্তি ঢাকতে সুরঞ্জন বাইরের দিকে চোখ ফেরালেন। দিল্লি শহর পেরিয়ে অনেকটা দূর চলে এসেছে ট্রেন। বেশ বলা হয়ে গেলেও এখানে এখনও কুয়াশার আলগা প্রলেপ রয়েছে রেল চত্বর পেরিয়ে দূরের বস্তি আর ল্যাম্পপোস্টগুলোয়। দূরের আবছা গ্রামগুলোয় সবে যেন ব্যস্ততা শুরু হয়েছে, এদিককার বাড়িগুলো যেন অনেকটা একই প্যাটার্নের, চৌকো খোপ খোপ ধরনের। জানলার সংখ্যাও খুব কম। আসলে এখানকার ওয়েদার চরমভাবাপন্ন, মানে যেমন গরম তেমনই ঠান্ডা। তাই এইসমস্ত সতর্কতা।
সুরঞ্জন একমনে দেখছিলেন, একবার চোখ ফিরিয়ে দেখলেন পূরবী ঘুমিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ পকেটে ফোন বাজল। ওপাশে রুদ্র, ‘কোথায় তোমরা?’
সুরঞ্জন বললেন, ‘এই তো, আর হয়তো আধঘণ্টা মতো লাগবে।’
‘হুঁ। আমি এই বেরোচ্ছি। তোমাদের ঢোকার আগেই আমি স্টেশনে পৌঁছে যাব। নেমে ফোন কোরো কিন্তু!’
ফোনটা বন্ধ করে রাখতে রাখতে, বাবার মন তো, সুরঞ্জনের কেমন যেন মনে হল, রুদ্রকে কি একটু মনমরা লাগল।
পকেটে ফোনটা ঢুকিয়ে কেমন একটা অস্বস্তি হতে ডান পাশে তাকিয়ে সুরঞ্জন একটু অবাক হয়ে গেলেন। গন্ধমাদন পাহাড়টা সোজা দৃষ্টিতে ওঁরই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখ দুটো ঈষৎ ঢুলুঢুলু, ভারী চশমার ওপারে কেমন একটা অন্তর্ভেদী দৃষ্টি।
গভীরভাবে সেই দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করছে সুরঞ্জনকে।
অস্বস্তিতে সুরঞ্জন জানলার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু কেউ একজন তাকিয়ে রয়েছে এটা জানতে পারলে বার বার সেইদিকেই চোখ চলে যায়। সুরঞ্জন আবার তেরচা চোখে চেয়ে দেখলেন তাঁর দিকে কেমন কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে রয়েছে লোকটা।
বাধ্য হয়েই চেয়ার ছেড়ে উঠে একবার বাথরুমে ঘুরে আসবেন ভাবছেন, কিন্তু উঠে এগোতে যেতেই চওড়া বলিষ্ঠ দুটো হাতের পাঞ্জা সজোরে আবার সুরঞ্জনকে টেনে বসিয়ে দেয় চেয়ারে।
এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে সুরঞ্জনের। বিনা অনুমতিতে গায়ে হাত দিয়ে জোর করে বসিয়ে দেওয়া, এ আবার কী ধরনের অসভ্যতা? রেগে গিয়ে সুরঞ্জন ইংরেজিতে বেশ জোরেই বলে ফেললেন, ‘কী করছেন কী আপনি?’
বেশ জোরেই বলেছেন কথাটা, পূরবী চোখ খুলে তাকালেন।
গন্ধমাদনও প্রথমে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ একটা বিশাল অট্টহাস্য করে নিজের ভাল্লুকের মতো কোটসমেত সুরঞ্জনকে জড়িয়ে ধরল।
ঘটনার আকস্মিকতায় পূরবী আর সুরঞ্জন প্রাথমিকভাবে হকচকিয়ে গেলেও সুরঞ্জন মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলেন, কিন্তু ওই দুর্গন্ধময় কোটের মধ্যে যে বিশাল বপুটা রয়েছে তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারলেন না। গন্ধে বমি আসছিল তাঁর।
লোকটা সুরঞ্জনের ছটফটানিতে নিজের বাঁধনটা একটু আলগা করল, তারপর ছেড়ে দিয়ে মুখোমুখি হয়ে কেমন সুর করে করে হিন্দিতে বলল, ‘লিটল বুদ্ধার এখনও এত রাগ? অ্যাঁ? হা হা হা হা…!’
সুরঞ্জন ছাড়া পেয়ে নিজের বিস্রস্ত চেহারাটা ঠিকঠাক করছিলেন, লোকটার কথা শুনে মুখ তুলে বিস্ময়ে তাকালেন। লিটল বুদ্ধা? সুরঞ্জন ঠিক শুনেছেন?
সুরঞ্জন দ্বিধাগ্রস্তভাবে স্মৃতির গহ্বর হাতড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ লোকটার মুখের দিকে আরও একবার চোখ পড়তেই ওর বাঁ-গালের পেল্লাই কালো তিলটা সব অন্ধকারকে আলোকিত করে দিল আর সুরঞ্জন হুস করে বছর চল্লিশ আগে দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে স্নাতকোত্তর করার দিনগুলোতে চলে গেলেন।
বিশাল চেহারা, বাঁ-গালে কালো তিল, উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা, কথায় কথায় হা হা করে হাসি, কালো জামা কালো প্যান্ট একজনেরই ট্রেডমার্ক ছিল।
অঘোরেশ। অঘোরেশ ভাট!
সুরঞ্জন বিস্মিতভাবে বললেন, ‘ব্ল্যাক পার্ল!’
………
* রুদ্র-প্রিয়ম সিরিজের ১ম উপন্যাস ঈশ্বর যখন বন্দি দ্রষ্টব্য
৯
কলেজের হোস্টেলে থাকলে ইচ্ছেমতো থাকা যায় না, এমনিতেই হইহট্টগোল হয় বেশি। তার ওপর উজ্জয়িনী চিরকালই একটু একাকীত্ব ভালোবাসে। তাই চার বছর আগে প্রথমে হোস্টেলে এলেও মাসদুয়েকের মধ্যেই এই নিরিবিলি জায়গায় এক কামরার ফ্ল্যাটটা জোগাড় করে চলে এসেছিল ও। সঙ্গে আসা বাবার পাঠানো লোকেরাই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
দাঁত মাজতে মাজতে উজ্জয়িনী ভাবল, যে সময়টায় ওর জীবন রঙে ভরে ওঠার কথা, পড়াশোনায়, নিজের ইচ্ছেমতো কিছু করতে পারার আনন্দে, খেলায় এই টিনএজটাকে মনেপ্রাণে অনুভব করার কথা, সেই সময়টার ও কী সাংঘাতিক একা! নিঃসঙ্গতা কুরে কুরে খায় ওকে।
হঠাৎই ওর নিজের প্রতি প্রচণ্ড রাগ হল। কেন ও আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের থেকে আলাদা? শুধু একটা নয়, দু-দুটো অস্বাভাবিকত্ব ওর মধ্যে কাজ করছে। সেই ছোট্ট থেকে ‘বিস্ময়শিশু’, ‘বিস্ময়বালিকা’ এইসব বিশেষণ শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ও, যত কাগজে, টিভিতে ওর নাম ছড়িয়েছে, তত ভেতরে ভেতরে ফোঁপরা হয়ে গেছে ও, নিজের ভেতরের আর বাইরের টানাপোড়েনে অসংখ্যবার ভেবেছে আত্মহত্যার কথা।
ওর এই পরিণতির পেছনে কি ওর বাবা মায়ের কোনো হাতই নেই?
বারো বছরে মাধ্যমিক পাশ করেছিল ও, চোদ্দোতে উচ্চমাধ্যমিক, তারপর সর্বভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং প্রবেশিকা পরীক্ষায় ওপরদিকে র্যাঙ্ক করে মেঘালয়ের এই প্রথম সারির সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মাত্র সাড়ে চোদ্দো বছরে ভরতি হয় ও, সরকারের থেকে স্পেশাল পারমিশন নিয়ে। এখন ওর ফাইনাল ইয়ার। তার সঙ্গে সমান্তরালভাবে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ওর সাঁতারের প্রতিভা। শর্ট ডিসট্যান্সের রাজ্যস্তরের ইভেন্টে দু-বার চ্যাম্পিয়নও হয়েছে ও। একমাত্র জলই যেন ওকে শান্তি দেয়, ডুবসাঁতার দিয়ে জলের অতলে নিজেকে তলিয়ে দিয়েই যেন পরম শান্তি অনুভব করে ও। কিন্তু মেঘালয়ে আসা ইস্তক সেই সুযোগও আর তেমন নেই।
ছোটো থেকেই উজ্জয়িনী শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছে ও, আর পাঁচটা সাধারণ শিশুর মতো নয়, ইংরেজিতে এদের বলা হয় প্রডিজি। প্রডিজি বাচ্চাদের ম্যাচিয়োরিটি অন্য শিশুদের চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি আসে, তাই সমাজ এদের বিস্ময়শিশু নাম অভিহিত করে, কিন্তু অনেকেই বোঝে না, এদের ব্যক্তিগত জীবন কতটা কষ্টের হয়ে ওঠে। এরা কারুর সঙ্গে সহজে মিশতে পারে না, সুস্থ স্বাভাবিক শৈশব থেকে বঞ্চিত হয় এরা।
উজ্জয়িনীর ক্ষেত্রে সেটা একটু বেশিই কষ্টের। কারণ এই অকালপক্ক মস্তিষ্কের সঙ্গে ওকে পূর্বজন্মের একটা তিক্ত স্মৃতিও বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়।
প্রথমে এমনি স্বপ্ন ভাবলেও, দেশের সেরা প্রায় আট থেকে দশজন মনস্তত্ত্ববিদ ওর সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে সহমত। ওর মস্তিষ্কের মধ্যে পূর্বজন্মের কিছু স্মৃতি এখনও রয়ে গেছে। যদিও আধুনিক বিজ্ঞান রি-ইনকারনেশন বা পুনর্জন্মকে স্বীকৃতি দেয় না, তবে সেই হ্যামলেটের হোরেশিওকে বলা কথাটা আজও সত্যি, বিজ্ঞান সব কিছুকে আজও ব্যাখ্যা করতে পারেনি।
ওর সাড়ে তিন-চার বছর বয়স থেকে উজ্জয়িনী ওই স্বপ্নটা দেখে আসছে। শুধু যে স্বপ্নটা ও ঘুমের মধ্যেই দেখে এমন নয়, মাঝে মাঝেই ওর মনে হয় ওকে কেউ বা কারা রে-রে করে তেড়ে আসছে, ও প্রাণপণে সাঁতার কাটতে চাইছে, পালাতে চাইছে তাদের হাত থেকে, কিন্তু হাঁপিয়ে উঠছে, পারছে না।
ডাক্তার প্রথমে বলেছিল কোনো কারণে হ্যালুসিনেশন হচ্ছে হয়তো। উচ্চবিত্ত বাবা-মা-র ইগোর মাঝে পড়ে অবচেতন মনে কোনো ভয় কাজ করছে। ওর কাউন্সেলিং চলেছিল, সঙ্গে বাবা মায়েরও।
কিন্তু, না। তাতে কোনো কাজ হয়নি।
পরবর্তী পর্যায়ে এসেছে অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট ড্রাগ, মেন্টাল ডিজঅর্ডার কাটানোর ওষুধ। তারাও ফেল করেছে ডাহা।
অবশেষে চোদ্দো বছর বয়সে উজ্জয়িনী কলকাতার এক নামি সায়কিয়াট্রিস্টের কাছে গিয়ে কিছুটা দিশা পেয়েছিল।
উজ্জয়িনীর বাবা নাগেশ সিং দিল্লির প্রথম সারির বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন, তার সঙ্গে এখন রাজনীতিতেও পা দিয়েছেন। এ ছাড়াও তাঁর আরও একটা পরিচয় আছে। তিনি জয় সিং-এর উত্তরপুরুষ। মুঘল আমলে যে কয়েকজন হাতে গোনা হিন্দু রাজা নিজেদের ক্ষমতাবলে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন জয়পুরের রাজা জয় সিং। তিনি ছিলেন শাজাহানের সমসাময়িক। শোনা যায় রাজা জয় সিং-এরই দেওয়া এক শূন্য উদ্যানে তাজমহল বানিয়েছিলেন সম্রাট শাজাহান।
তখনকার বেশিরভাগ হিন্দু রাজাদের আনুগত্যের কারণেই হোক, বা অন্য কোনো কূটনৈতিক কারণে বিয়ে হয়েছে মুঘল বা অন্যান্য সম্ভ্রান্ত কোনো মুসলিম পরিবারে। বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে ব্যাবসা বা মসনদে উন্নতি ছিল অতি প্রচলিত কৌশল। রাজা জয় সিং-এরও বেশ কিছু ছেলেমেয়ে বিয়ে করেন মুসলিম পরিবারে। কিন্তু জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজা রাম সিং সেই মুষ্টিমেয় রাজাদের মধ্যে একজন যাঁর বংশধরেরা কেউই ধর্মান্তরিত হননি। তিনি ছিলেন তৎকালীন কাশ্মীরের সুবেদার এবং শিবাজির এক বিশ্বস্ত বন্ধু।
উজ্জয়িনীর বাবা সেই রাজা রাম সিং-এর একমাত্র জীবিত হিন্দু বংশধর।
উজ্জয়িনীর বাবা রাজপুত হলেও মা বাঙালি। কিন্তু কিছু মানুষের ভালোবাসাটা তাঁদের নিজেদের জীবনে একটা বড়ো ভুল তো বটেই, পারিপার্শ্বিক অন্য সমস্ত মানুষের স্থিতিও নষ্ট করে দেয়। উজ্জয়িনীর বাবা মা-ও তেমনই। দু-জনেই সমান শিক্ষিত, রুচিশীল, যৌবনে দু-জনে ভালোবেসে বিয়ে করলেও তাঁদের দু-জনের মধ্যে কোনো কম্প্যাটিবিলিটিই নেই। সারাক্ষণের ইগোর লড়াই, পারস্পরিক শীতল কাদা ছোড়াছুড়িতে, তার সঙ্গে উজ্জয়িনীর নিজস্ব এই অস্থিরতায় ওই চোদ্দো বছর বয়সেই যখন ও নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবছে, তখন কলকাতার এক নামি মনস্তত্ত্ববিদ, যাঁর পাণ্ডিত্যও অগাধ, তিনিই প্রথম হ্যালুসিনেশনের ধারণা বাতিল করে মাকে বলেন, পুরোনা একটা ঘটনার সঙ্গে তিনি উজ্জয়িনীর এই স্বপ্নের ভীষণ মিল পাচ্ছেন এবং উনি সন্দেহ করছেন উজ্জয়িনীর পূর্বজন্মের কিছু স্মৃতি তার মস্তিষ্কের কোষগুলি এখনও ভোলেনি।
মাঝে মাঝে ভাবে উজ্জয়িনী, কেন ওর সঙ্গেই এইসব অতিলৌকিক ঘটনা জুড়ে গেল?
উজ্জয়িনী ঘড়ির দিকে তাকাল, তিনটে পঁয়ত্রিশ। এখনও কিছুটা সময় আছে তৈরি হতে। একটু আনমনা হয়ে ও ভাবতে থাকল ওই বয়স্ক সায়কিয়াট্রিস্টের বলা কথাগুলো।
ওর বেশ মনে পড়ে মা অবাক হয়ে বলেছিলেন ডাক্তারকে, ‘কী বলছেন! পূর্বজন্ম! মানে যাকে বলে জাতিস্মর! আপনাদের ডাক্তারি শাস্ত্র এসব মানে নাকি?’
ডাক্তারবাবু মাথা নেড়েছিলেন, ‘প্রচলিত ডাক্তারি শাস্ত্র হয়তো স্বীকার করে না, কিন্তু ব্রায়ান লেসলি ওয়েস নামে একজন আমেরিকান সায়কিয়াট্রিস্ট তাঁর বইয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে পুনর্জন্ম যে শুধু আছে, তাই নয়, এই জন্মের অনেক সমস্যা আগের জীবনের কথা জানতে পারলে ডাক্তারির মাধ্যমেই সারানো সম্ভব। এই নিয়ে ওঁর নিজস্ব একটা থেরাপিও আছে। তেমন হলে আমি না হয় যোগাযোগ করব ওঁর সঙ্গে। কিন্তু তা আগে,’ ভদ্রলোক সোজাসুজি উজ্জয়িনীর দিকে তাকিয়েছিলেন, ‘তোমার মনে হয়, তুমি সাঁতার কেটে পালাচ্ছ, আর ওরা পেছন থেকে এসে ধরে ফেলল, তাই তো?’
অন্য কোনো চোদ্দো বছরের মেয়ে এসব হয়তো কিছু বুঝতই না, কিন্তু উজ্জয়িনীর অকালপক্ব মস্তিষ্ক তো সবই বড্ড তাড়াতাড়ি বোঝে। ও ওপর নীচে ঘাড় নেড়েছিল।
বৃদ্ধ ডাক্তার বিড়বিড় করেছিলেন, ‘এই ঘটনাটার সঙ্গে একটা পুরোনো ঘটনার অদ্ভুত মিল পাচ্ছি আমি!’
উজ্জয়িনীর মা সুজাতা ভ্রূ কুঁচকে বলেছিলেন, ‘কী ঘটনা?’
ডাক্তার বলেছিলেন, ‘আমাদের ইতিহাসে ইংরেজ শাসনকে ভিলেনের মতো দেখানো হয়। ব্রিটিশরা আমাদের এক্সপ্লয়েট করেছিল ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও ঠিক, পাশ্চাত্য নবজাগরণের ছোঁয়া না লাগলে ধর্মের অপভ্রংশে আর অশিক্ষা, কুসংস্কারে ডুবে থাকা আমাদের দেশের লোকের যে কী অবস্থা হত! বিজ্ঞান বা যুক্তির কোনো অস্তিত্বই ছিল না বলতে গেলে। মেয়েদের জীবন সম্পর্কে তো আর কিছুই বলার নেই। সতীদাহ প্রথার নাম শুনেছ নিশ্চয়ই। হিন্দু ধর্মের একটা জঘন্য প্রথা যেখানে স্বামী মারা গেলে তার সঙ্গে স্ত্রীকেও মরতে হত?’
উজ্জয়িনী সায় দিয়েছিল। সতীদাহ প্রথা সম্পর্কে সে শুধু ইতিহাস বইয়ের সিলেবাসেই পড়েনি, বাইরের বইও পড়েছে। ইন ফ্যাক্ট ওর এই স্বপ্নটা যেকোনো সহমরণে যাওয়া সদ্যবিধবার, সেটা বুঝতে পারার পরেই আরও বেশি করে পড়েছে। তাই এটা ওর কাছে নতুন কিছু লাগল না। গম্ভীরমুখে ও জানিয়েছিল, ‘শুধু হিন্দুই নয়। প্রায় চব্বিশশো বছর আগেও এর প্রচলন ছিল। মেইনলি হিন্দুদের মধ্যে থাকলেও কাশ্মীরের কিছু মুসলিম সম্প্রদায়, ইন্দোনেশিয়ার কিছু উপজাতির মধ্যেও এটা ছিল।’
ডাক্তার চমৎকৃত হয়ে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, একদম ঠিক। ইংরেজদের আগে মুসলিম শাসকরা এই প্রথাটা পছন্দ না করলেও হিন্দু গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কিছু করে উঠতে পারেননি। এমনকী আকবর নিজেও চেষ্টা করেছিলেন এটা বন্ধ করতে। কিন্তু, পারেননি। ইংরেজরা আসার পর পাশ্চাত্য আধুনিক শিক্ষায় যখন একটা পরিবর্তনের স্রোত আসে ভারতে, তখন রামমোহন রায়ের মতো কিছু সংস্কারক চেষ্টা শুরু করলেন একদম আইনিভাবে যেন এটাকে বন্ধ করা হয়। তাতে রে রে করে উঠল কিছু প্রাচীনপন্থী মানুষ। একটা হিসেব দিই, ১৮১৫ থেকে ১৮১৮, এই তিন বছরের মধ্যেই শুধুমাত্র বাংলায় স্বামীর চিতায় জ্বলন্ত পুড়ে মরা সতীর সংখ্যা চারশো থেকে বেড়ে হয় প্রায় সাড়ে আটশো। তখন এমনিতেই একেকটা লোকের অনেকগুলো করে স্ত্রী থাকত, আর কুলীন ব্রাহ্মণ হলে তো কথাই নেই। বাচ্চা মেয়েগুলোকে জীবনের স্বাদ কী বোঝার আগেই আগুনে পুড়ে মরতে হত। মেয়েগুলোকে সিদ্ধি জাতীয় কিছু মাদক খাইয়ে অচেতন করে দেওয়া হত, চারপাশে এত ঢাকঢোল বাজত, প্রতিবাদ করার কোনো জায়গাই ছিল না। কিছুটা ছিল গোঁড়া ব্রাহ্মণদের মদত, আর তার সঙ্গে ছিল সম্পত্তির লোভ। অল্পবয়সের বিধবাকে মেরে ফেলতে পারলে পুরো সম্পত্তিই আত্মীয়দের, সেই লোভেও মেরে ফেলত ওরা।’
উজ্জয়িনী চুপচাপ শুনছিল। ডাক্তারবাবু যেটা বলছিলেন সেটার ও বহুবারের প্রত্যক্ষদর্শী।
‘১৮২৩ সালের অগাস্ট মাসে লর্ড আমহার্স্ট ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন। তার ঠিক পরে পরেই ১৮২৫ সালের অক্টোবর মাস নাগাদ কলকাতার কাছেই একটা সাংঘাতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। লর্ড আমহার্স্টের স্ত্রী লেডি আমহার্স্ট খুব ভালো লিখতেন। তিনি খুব মর্মস্পর্শীভাবে ঘটনাটা লিখেছিলেন, যেটা তোমার স্বপ্নের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।’ উজ্জয়িনীর দিকে ইশারা করে বলেছিলেন বৃদ্ধ সায়কিয়াট্রিস্ট, ‘বাচ্চা মেয়েটা ঠিক তোমার স্বপ্নের মতোই পালিয়ে নদীর ওপারে গিয়ে জঙ্গলে লুকোতে গিয়েছিল। লোকজন উন্মত্ত পশুর মতো তাকে আবার নদীতে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করে। অবশেষে সে ডুবে মারা যায়।’
উজ্জয়িনী প্রশ্ন করেছিল, ‘তারপর?’
ডাক্তার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন, ‘এই ঘটনাটার পর একদিকে ইংরেজরা, অন্যদিকে রামমোহন রায়ের মতো মানুষরা প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু করলেন। তখন লর্ড আমহার্স্ট প্রথমে কয়েকটা নিয়ম চালু করলেন, যেমন বিধবাকে নিজে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে সহমরণে যাওয়ার অনুমতি নিতে হবে, স্বামীর চিতা ছাড়া অন্য কোনোভাবে বিধবাকে মরতে দেওয়া যাবে না, বিধবার স্বামীর সম্পত্তি কোনো আত্মীয় পাবে না, সরকার বাজেয়াপ্ত করবে সব, যারা ওই কাজে হেল্প করবে তারা কেউ সরকারি চাকরি পাবে না, এইরকম।
তারও কিছুদিন পর ১৮২৯ সালে পুরোপুরি বন্ধ করা হয়েছিল এই প্রথা।’
উজ্জয়িনীর মা সুজাতা শুনছিলেন, কিন্তু উদবেগ মুখ-চোখ দিয়ে ফুটে বেরোচ্ছিল। বোধ হয় ভাবছিলেন একেই পড়াশুনো বা অন্য কিছুতে উজ্জয়িনী বয়সের অনুপাতে এতটা পিছিয়ে তার ওপর জাতিস্মরের ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়, মানসিক ট্রমাতেই তো মেয়েটা শেষ হয়ে যাবে!
দূরের প্রেসবাইটেরিয়ান গির্জায় ঢং ঢং করে চারটের ঘণ্টা বাজতেই উজ্জয়িনী চমকে উঠল। ভাবতে ভাবতে কোথায় চলে গিয়েছিল ও। পাশে-পড়ে-থাকা ফোনটা খুলল ও, কোনো নতুন মেসেজ কি এল?
নাহ, আর দেরি করা যাবে না, এবার রেডি হতেই হবে। এখান থেকে গাড়িতে গৌহাটি, সেখান থেকে প্লেনে দিল্লি। তারপর এই ক-মাসে ওর ভীষণ কাছের হয়ে ওঠা মানুষটাকে ও প্রথম দেখবে। হোক বাড়ির অমতে, কাছের সেই মানুষের সঙ্গে শুরু করবে নতুন জীবন।
রাজা জয়সিংহের উত্তর প্রজন্ম হওয়ার বংশমর্যাদা ও চায় না, চায় না বিলাসিতা, ঠুনকো আভিজাত্য, শুধু ওর ভালোবাসার মানুষটাকেই ও চায় এখন।
১০
ভোরের দিকে হঠাৎ মোবাইলের আওয়াজে রুদ্রর ঘুমটা ভেঙে গেল। এমনিতে রাতে শোয়ার আগে রুদ্র নিয়ম করে কিছুক্ষণ প্রিয়মের সঙ্গে কথা বলে। ওর এখানে রাত এগারোটা হলে লন্ডনে তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। প্রিয়ম তখন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার বাসে থাকে। প্রিয়মের সঙ্গে কথা হয়ে গেলে রুদ্র ফোনটাকে সাইলেন্ট করে শুয়ে পড়ে। কিন্তু কাল সন্ধে থেকে যে ঝড়ঝাপটা ওর ওপরে আকস্মিক শুরু হয়েছে, ফোনটাকে সাইলেন্ট করার কথা মনেই ছিল না। তা ছাড়া কাল রাতে প্রিয়মকে ফোন করেও কিছুতেই লাইন পায়নি।
তার ওপর, দমদম থেকে প্লেনে ওঠার আগে মা একবার ফোন করেছিলেন। সেও প্রায় ঘণ্টাখানেক হতে চলল। তখন প্রায় রাত হলে কী হবে, মায়ের গলার আওয়াজেই ও বুঝতে পারছিল মা কতটা আনন্দে রয়েছেন এতদিন পরে ওকে দেখবেন বলে। চেষ্টা করেও তাই এত বড়ো দুঃসংবাদটা ও আর তখন বলতে পারেনি। টুকটাক কথা বলে আবার শুয়ে পড়েছিল।
ফলত, এখন রিং-এর আওয়াজে ও ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল। বিছানার পাশেই রাখা ছোটো টেবিল থেকে ঘুমচোখে ফোনটা নিয়ে কানে দিল, ‘হ্যালো!’
টেবিলের অ্যালার্ম ঘড়িতে তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা।
ওপাশ থেকে একটা পুরুষালি গলা ভেসে এল, ‘আপনার দেওয়া সমস্ত ডকুমেন্ট খুঁটিয়ে দেখলাম, কিন্তু যে ঠিকানা আপনাদের ব্যাঙ্কে দেওয়া আছে, সেই ঠিকানায় অঘোরেশ ভাট নামে এখন কেউ থাকেন না।’
রুদ্র চোখটা ডলে ঘুমটা জোর করে তাড়াবার চেষ্টা করল, উঠতে চাওয়া হাইটাকে চাপতে চাপতে বলল, ‘ইনস্পেকটর খান! এত সকালে! কী ব্যাপার!’
নাহুম খান বলে চললেন, ‘ভদ্রলোক আগ্রা ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন, বছর পাঁচেক ওই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, পরে নিজের বাড়িতে উঠে যান। এর বেশি বাড়িওয়ালাও কিছু বলতে পারল না।’
রুদ্র বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিল মনে মনে, আবার একটা হাই তুলে বলল, ‘দেখুন আমি আমাদের কাছে যা যা ছিল সবই আপনাকে দিয়েছি। পেশা প্রফেসর লেখা চিল। আপাতত এখানকার সব কলেজগুলো দেখতে পারতেন তো!’
‘দেখেছি। কলেজ নয়, ভদ্রলোক আগ্রা ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন। কিন্তু কয়েক বছর আগে চাকরিটাও হঠাৎ ছেড়ে দেন।’
রুদ্র চুপ করে রইল এবার। ও একে মরছে নিজের জ্বালায়, বাবা মা আজ আসছেন, তাঁদের নিয়ে ঘুরতে বেরোবে, না, যুক্তি সাজিয়ে অফিসের চিঠির উত্তর দেবে সেই নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। তার ওপর পুলিশ কীভাবে একটা লোককে ট্রেস করবে তা নিয়ে ওকে ভোররাতে ফোন করছে কেন সেটা ওর বোধগম্য হল না।
নাহুম খান আবার বললেন, ‘তবে আরেকটা ক্লু পেয়েছি, সেইজন্যই আপনাকে ফোন করা।’
রুদ্র কিছু না বলে চুপ করে রইল।
‘আপনার কাছে ব্রাঞ্চের চাবি আছে নিশ্চয়ই?’
রুদ্র ভ্রূ কুঁচকোল, সঙ্গেসঙ্গে ওর মনে পড়ল, কাল অমিতকে ব্রাঞ্চের চাবিটা হ্যান্ডওভার করে দিয়ে আসতে ও একদম ভুলে গেছে, নিয়মমতো সাসপেনশনে থাকা ম্যানেজার চাবি নিজের হেফাজতে রাখতে পারে না।
ও বলল, ‘হ্যাঁ, আছে। কাল দিয়ে আসতে ভুলে গেছি। কিন্তু চাবি দিয়ে কী হবে? আমি সাসপেনশনে আছি, গিয়ে এভাবে একা ব্রাঞ্চ খুলতে পারি না এখন।’
‘আপনি পুলিশ অর্ডারে করবেন।’ নাহুম খান বললেন, ‘আপনার বাড়ির ঠিকানাটা বলুন, আমরা তুলে নিচ্ছি আপনাকে। টেনশন করবেন না, আমরা সিভিল ড্রেসেই যাচ্ছি, এই ধরুন আটটার মধ্যে। আসলে ব্যাপারটা এতটাই ক্রিটিক্যাল আর আর্জেন্ট…!’
ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম ভেঙে যাওয়ায় রুদ্রর কপালটা দপদপ করছিল, বিরসকণ্ঠে ও বলল, ‘কিন্তু আমি তো বেরিয়ে যাব স্টেশনে, আমার বাবা মা আসছেন আজ, রিসিভ করতে যেতে হবে।’
ওপাশে রুদ্রর কথাটা আদৌ পাত্তা দেওয়া হল কি না কে জানে, কেজো গলায় শোনা গেল, ‘কোনো কাস্টমার ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে বাড়ি কিনলে বা তৈরি করলে সেটার কিছু ডিটেইলস তো ব্যাঙ্কের কাছে থাকে?’
এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে রুদ্র খানিকটা অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, থাকে তো অবশ্যই। কত টাকা লোন, কতগুলো কিস্তিতে শোধ হবে, সব ডিটেইলসই থাকে।’
‘আর?’ নাহুম খানের গলাটা যেন উদগ্রীব শোনাল, ‘আর কী থাকে?’
রুদ্র কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘বাড়ির লোন হলে সেক্ষেত্রে সেই বাড়ির দলিল ব্যাঙ্কের কাছে জমা থাকে যতদিন না পুরো টাকা শোধ হয়।’
‘আর লোনটা শোধ হয়ে গেলে ওই দলিল আর ব্যাঙ্কের কাছে থাকে না?’
‘না, তখন কাস্টমারের দলিলের অরিজিন্যালটা ফেরত দিয়ে দিতে হয়। তবে, কপি থাকে ব্যাঙ্কের কাছে।’
নাহুম খান বললেন, ‘হ্যাঁ, এই ব্যাপারটাই জানতে চাইছিলাম। আপনি অঘোরেশ ভাটের যে ডকুমেন্টগুলো আমাকে দিয়েছেন, তার মধ্যে একটা বহু পুরোনো লোনের ফাইল আছে, যাতে লেখা আছে ভদ্রলোক প্রায় কুড়ি বছর আগে আপনাদের ব্যাঙ্ক থেকে বাড়ি তৈরির জন্য লোন নিয়েছিলেন। সেই লোন যদিও চুকেবুকে গেছে, কিন্তু সেই বাড়ির দলিলের ফটোকপি যদি খুঁজে পাওয়া যায়, তবে তো সেখানে ওই নতুন বাড়ির ঠিকানাটা থাকবে, তাই না?
.
নাহুম খান সাড়ে আটটা নাগাদ এলেন। সঙ্গে কালকের ভদ্রলোক নেই, শুধু আরেকজন অপেক্ষাকৃত তরুণ অফিসার, তাঁর মাথায় পাগড়ি, এই কুয়াশাঘেরা সকালেও চোখে কালো সানগ্লাস। নাহুম খান আলাপ করিয়ে দিলেন, ‘ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির অফিসার ভগতবীর সিং। আজই এসেছেন দিল্লি থেকে।’
ভগতবীর সিং হাত বাড়িয়ে দিলেন করমর্দনের জন্য, হেসে বললেন, ‘আপনার ব্যাঙ্কে আমার অ্যাকাউন্ট আছে ম্যাডাম। কলেজে পড়ার সময় টিউশনির টাকা জমাতাম ওটায়।’
রুদ্র হাসল, বলল, ‘আপনারা একটু বসুন, আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।’
নাহুম খানকে দেখেই বোঝা যায়, সারারাত তিনি ঘুমোননি, চুল উশকোখুশকো, চোখ লালচে হয়ে রয়েছে, ক্লান্তির ছাপ সারা দেহে স্পষ্ট, ‘হ্যাঁ, শিয়োর। আমরা ওয়েট করছি।’
রুদ্র ভেতরের ঘরে রেডি হচ্ছিল। আজকের কুয়াশা দেখে মনে হচ্ছে কনকনে হাওয়া চালাবে সারাদিন, লন্ডন থেকে কেনা লেদারের জ্যাকেটটা গায়ে চাপাল ও। প্রথমে ভেবেছিল একাই ওঁদের সঙ্গে গিয়ে ব্যাঙ্ক খুলে ওই দলিল বের করবে, তারপর মত পালটাল। সাসপেনশনে থাকার সময় এভাবে একা যাওয়াটা কেউ জানতে পারলে ও আরও বেশি ফেঁসে যেতে পারে। কাউকে না জানিয়ে কেন ও এভাবে গিয়ে ব্যাঙ্ক খুলেছে, সে-ব্যাপারে ওকে আবার শো-কজ করা হতে পারে। কী দরকার এর মধ্যে আবার জটিলতা বাড়িয়ে? তা ছাড়া একটা মর্টগেজ থাকা দলিল ছিল সেটা, লিখিত নথি ছাড়া তার কপি এভাবে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়াও যায় না, সেক্ষেত্রেও ওর অনুপস্থিতিতে অমিতের পারমিশন দরকার। তাই ও অমিতকে ফোন করে ব্যাঙ্কের সামনে অপেক্ষা করতে বলে দিয়েছে আগেই।
ওর মনটা এমনিতেও ভালো লাগছিল না। কাল দুপুরে পর থেকে প্রিয়মের সঙ্গে কথা হয়নি। গতকাল রাতেও ফোনে পায়নি, এখনও কিছুক্ষণ অন্তরই চেষ্টা করে চলেছে, কিন্তু কিছুতেই কানেক্ট হচ্ছে না। একেই হাজার হাজার মাইল দূরে থাকে ওর বরটা, তার ওপর ফোনে না পেলে চিন্তা হয় না? স্কাইপ, ফেসবুকের মতো সবরকম সোশ্যাল মিডিয়াতেও চেষ্টা করেছে, কোথাওই প্রিয়ম উপস্থিত নেই। শরীর-টরীর খারাপ হল নাকি? দেখবে একবার ওর অফিসে ফোন করে? পরক্ষণেই মনে পড়ল এখন তো ওখানে গভীর রাত। বিকেলের দিকে অফিসে একবার ফোন করতে হবে।
আজ এত বেলাতেও কুয়াশা বেশ ঘন হয়ে জমাট বেঁধে রয়েছে, এখানে বেশিরভাগ দোকানই এখনও তেমনভাবে খোলেনি। বালুগঞ্জ বাজার পেরিয়ে ওদের গাড়ি সদরবাজারে পড়তেই সিগনালে আটকে গেল। তখনই রুদ্রর চোখে পড়ল রাস্তার পাশের ফুটপাথের রেলিং-এ সার দিয়ে আটকানো রয়েছে শয়ে শয়ে পোস্টার। কী লেখা আছে, এতদূর থেকে সেটা চোখে না পড়লেও মোটা কালির ছাপা বলে পোস্টারগুলোকে একটু অন্যরকম লাগছে। হাওয়ায় সেগুলো পতাকার মতো পতপত করে উড়ছে।
রুদ্র লক্ষ করল, পথচলতি মানুষ ধীরে ধীরে আগ্রহী হচ্ছে, দু-একজন দাঁড়াচ্ছে, লেখাটা পড়ছে, আবার নিজেদের মধ্যে সামান্য আলোচনাও করছে।
রুদ্র ঝুঁকে দেখতে গেল কিন্তু সিগনাল সবুজ হতে ওদের গাড়িটা চলতে শুরু করল।
নাহুম খান বললেন, ‘আপনি কি একাই থাকেন? বাড়ি কোথায় আপনার?’
‘হ্যাঁ।’ রুদ্র বলল, ‘কলকাতায় বাড়ি। এখন এখানে ট্রান্সফার হয়ে এসেছি।’
‘বাঙালি? আপনার পরিবারে কেউ নেই?’
‘কেন থাকবে না?’ রুদ্র বিরক্ত চোখে নাহুম খানের দিকে তাকাল, ‘স্বামী, বাবা, মা সবাই আছেন। বাবা মা কলকাতাতেই থাকেন, আজ আসছেন আমার কাছে কিছুদিন থাকবেন বলে। আর আমার হাজব্যান্ড অফিসের কাজে ইংল্যান্ডে থাকেন।’
‘আপনার ড্রয়িং রুমে একটা ছবি দেখলাম, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের সঙ্গে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। ওটা কী ব্যাপারে?
রুদ্র এবার মনে মনে বেশ রেগে গেল। নাহুম খান আর ওর সহকর্মী আসার পর ওঁরা কিছুসময় বাইরের ঘরে বসে ছিলেন, তখন রুদ্র তৈরি হচ্ছিল ভেতরে। ওই সময়েই তার মানে পুরো ঘরটা খুঁটিয়ে দেখেছে লোকটা।
একে রুদ্রর মন ভালো নেই, তার ওপর এর প্রশ্নের যেন তুবড়ি ছুটছে সারাক্ষণ।
পুলিশকে সহযোগিতা করা মানে কি নিজের কাজ, কর্তব্য সব কিছু বিসর্জন দেওয়া? আজ বাবা মা আসছেন কত আনন্দ নিয়ে, রুদ্রর অফিসের ঝামেলা, প্রিয়মকে ফোনে পাচ্ছে না, আর সেখানে সব ছেড়েছুড়ে ও এখন পুলিশের গাড়িতে করে ব্যাঙ্কে চলেছে।
ও সংক্ষেপে ঘটনাটা বলল। জার্মানির সেই ব্যাপারটা নিয়ে ওখানে খুব হইহই হলেও এখানে তেমন কেউ জানে না। *তাতে একদিকে রুদ্রর সুবিধাই হয়েছিল। কীভাবে অ্যাডলফ হিটলারের ইউজেনিক্সকে নতুন করে প্রয়োগ করার মারণ ছক কষা হয়েছিল, কীভাবে ও ছুটিতে প্রিয়মের কাছে গিয়ে সেটা মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল, সেসব নিজে মুখে বলতে হলেই ও কেমন গুটিয়ে যায়, কী বলবে বুঝতে পারে না।
একটু শুনেই নাহুম খানের চোখ-মুখ বেশ পালটে গেল, ‘বলেন কী! আপনি একা এতসব কাণ্ড করেছিলেন?’
রুদ্র ব্যাজার মুখে বলল, ‘ধুর, আমি একা কেন করতে যাব! ইন ফ্যাক্ট, আমি কিছুই করিনি, জার্মান পুলিশই যা করার করেছিল, সঙ্গে আমার হাজব্যান্ডও ছিলেন।’ দ্রুত প্রসঙ্গ পালটাল ও, ‘যদি কিছু না মনে করেন, একটা প্রশ্ন করতে পারি আপনাকে?’
‘হ্যাঁ, বলুন?’ নাহুম ড্রাইভারকে সামনের বাঁ-দিকের রাস্তাটা নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রুদ্রর দিকে তাকালেন।
‘একটা লোকের অ্যাকাউন্টে অনেকটা টাকা ঢুকেছে। তাই নিয়ে আপনাদের মতো পুলিশের অফিসাররা এতটা উদবিগ্ন কেন?’ ভগতবীরের দিকে নির্দেশ করল ও, ‘উনি ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির লোক বললেন। আপনিও তো স্পেশাল সেলের অফিসার। এটা তো ইনকাম ট্যাক্সের দেখার কথা, তাই না!’ রুদ্র প্রশ্নটা না করে পারল না।
নাহুম খান এবার বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন, ‘ম্যাডাম, আসলে কী বলব আপনাকে, আপনি আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন, তা ছাড়া আপনি জার্মানিতে এত বড়ো একটা অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে বলছি, আমাদের কাছে হেডকোয়ার্টারে গতকাল একটা ফোন আসে। বিদেশি কোনো ক্রিপ্টেড সার্ভারের মাধ্যমে স্পুফ করে ফোনটা করা হয়েছিল, তাই লোকেশনটা এখনও ট্র্যাক করা যায়নি। সেখানেই বলা হয় যে অঘোরেশ ভাট বলে একটা লোক খুব বড়ো একটা হামলার ছক কষছে। সেই ব্যাপারেই আপনাদের ব্যাঙ্কে বড়ো অঙ্কের একটা টাকা জমা পড়েছে। আর কারণটাও খুব অদ্ভুত এবং স্পর্শকাতর।’
নিজে থেকে কারণটা জিজ্ঞেস করা উচিত হবে কি না রুদ্র বুঝতে পারল না, কিছু না বলে ও চেয়ে রইল নাহুম খানের দিকে।
নাহুম খান একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘কাল রাত থেকে গোটা শহর শুধু নয়, পুরো আগ্রা জেলার ছোটো বড়ো রাস্তার আশেপাশে একটা পোস্টার পড়েছে। কারা যে রাতারাতি এত হাজার হাজার পোস্টার সাঁটাল সেটাই বের করার চেষ্টা চলছে। জনসাধারণের মধ্যে মিশ্র ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে আস্তে আস্তে।’
রুদ্র চট করে পেছনে ফেলে আসা পোস্টারগুলোর দিকে তাকাল, ওগুলোর কথাই কি বলছেন এই অফিসার?
নাহুম খান বললেন, ‘তার মধ্যে আমাদের কাছে এই ক্রিপ্টেড ফোন। মনে হচ্ছে অঘোরেশ ভাট গোপন কোনো উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, যারা মনে করে তাজমহল মুঘল আমলে বানানোই নয়, ওটা তারও আগের এক হিন্দু শিব মন্দির ছিল, শাজাহান সেটাকেই মুমতাজের কবরখানায় পরিণত করেছেন।’
রুদ্র চমকে উঠল, এই একই কথা কাল ও কাগজেও পড়েছে। কী যেন নাম সেই নিখোঁজ অধ্যাপকের?
নাহুম খান বললেন, ‘অনেকবার এই নিয়ে আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কাছে পিটিশন জমা পড়েছে, জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে। আগ্রারই এক ইতিহাসবিদ এইসব করেছিলেন। তাজমহলের গর্ভগৃহে যেখানে মুমতাজ আর শাজাহানের কবর রয়েছে, তারও নীচে নাকি এখনও সেই শিবলিঙ্গ পোঁতা আছে।’
‘এটা কি সত্যি?’ রুদ্র অবাক হয়ে গেল।
‘দেখুন, সেটা তো বলতে পারব না।’ নাহুম খান কাঁধ ঝাঁকালেন, ‘সেটা ইতিহাসবিদদের কাজ, আমাদের নয়। কিন্তু আমাদের কনসার্ন হল, সরকারের তরফে অনুসন্ধানের ব্যাপারে কোনো পাত্তা দেওয়া হয়নি বলে ওই সংগঠন এখন তাজমহলে কোনোরকম নাশকতামূলক হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে তাজমহল ধ্বংস হয়ে গেলে মাটির নীচে শিবলিঙ্গ খোঁজা যায়।’
‘এটা ওই ফোনেই আপনাদের বলা হয়েছে?’ রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
‘না।’ নাহুম খান মাথা নাড়লেন দু-পাশে, ‘ফোনে শুধু বলা হয়েছে অঘোরেশ ভাট নামে একজনের নেতৃত্বে উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল তাজমহল যে আসলে শিবমন্দির ছিল, সেটা প্রমাণ করার জন্য ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনে সেখানে খুব বড়ো কোনো হামলা চালাবে। আর ওই পোস্টারগুলোতেও সেটাই লেখা আছে, শুধু নাম-ধাম কিচ্ছু নেই। আমাদের মনে হচ্ছে এর পেছনে মদত দিচ্ছে বিদেশি কোনো চক্র, তারাই এতে টাকা জোগাচ্ছে।’
‘প্রজাতন্ত্র দিবস তো কালকেই!’ রুদ্র বলল, ‘মানে হাতে আর চব্বিশ ঘণ্টাও সময় নেই!’
‘সেইজন্যই তো আমাদের পুরো হেডকোয়ার্টারের সকলের ঘুম উড়ে গেছে। দিল্লির এন আই এ অবধি পৌঁছে গেছে ব্যাপারটা, যে করে হোক, এটা আমাদের রুখতেই হবে। আরেকটা বাবরি মসজিদ কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না।’ নাহুম খান পাশে বসে থাকা ভগতবীর সিংকে দেখিয়ে বললেন, ‘সিংজিকে পাঠানো হয়েছে আমাদের সঙ্গে তদন্তে থাকার জন্য, ঘণ্টায় ঘণ্টায় ওঁর কাছে প্রোগ্রেস চেয়ে ফোন আসছে। বুঝতেই পারছেন, কী চাপ। তার ওপর এই অঘোরেশ ভাট আগে আগ্রা ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস পড়াতেন। এক মাস আগে ওই যে ইতিহাসবিদ আগে পিটিশন করেছিলেন, সেই নিজামুদ্দিন বেগ হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান, এখনও তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।’
হ্যাঁ, নিজামুদ্দিন বেগ! রুদ্র বলল, ‘কালই কাগজে পড়ছিলাম, ওঁর বাড়িতে এখনও নাকি হামলা চলছে!’
‘হ্যাঁ, জানি। আমার এক কলিগ ওই কেসটার তদন্ত করছেন। উনিও তার আগে অনেকগুলো কলাম লিখেছিলেন যে, গত তিনশো বছর ধরে তাজমহল সম্পর্কে সব ইতিহাসই মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিকৃত করা হয়েছে সত্যিটাকে, ভারত সরকারের উচিত অনুসন্ধান করে সত্যিটা দেশবাসীকে জানানো। ওইসব লেখার পর খুব গণ্ডগোল হয়, ওঁর বাড়িতেও বিক্ষোভ শুরু হয়, তখন কাগজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে লেখা বন্ধ করে দেন। তারপরেই উনি আচমকা নিখোঁজ হয়ে যান। একাই থাকতেন, পাড়াপ্রতিবেশী বা সহকর্মীদের থেকেও কোনো কিছু ক্লু পাওয়া যায়নি। কোনো অ্যাক্সিডেন্টও হয়নি, সব জায়গায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রোগ্রেস নেই সেই তদন্তে, তার মধ্যে আবার এই নতুন উপদ্রব।’ নাহুম খানের ফোনটা আচমকা বেজে উঠল, ফোনটা রিসিভ করে ভদ্রলোক কিছুক্ষণ হুঁ-হাঁ করে কেটে দিলেন, ভগতবীরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মানটোলায় একটা খুন হয়েছে।’
ভগতবীর আগ্রারই ছেলে, কিন্তু জায়গাটা চিনতে পারলেন না, ‘মানটোলা কোথায়? কে খুন হয়েছে?’
নাহুম থমথমে মুখে বললেন, ‘মানটোলা আগ্রা ফোর্টের কাছে, মুসলমিপ্রধান অঞ্চল। সাউথ আগ্রা নির্বাচন কেন্দ্রের আওতায় পড়ে। যে খুন হয়েছে সে ওখানকার বিধায়ক মুজাফফর খান ওয়াইসির ডান হাত।’ কথাটা বলে মাথাটা দু-দিক থেকে চেপে ধরলেন উনি, ‘উহ, মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব।’
‘মুজাফফর খান ওয়াইসি মানে সেই পাগল নেতা? যে হিন্দু হটাও স্লোগান তুলেছিল কয়েকদিন আগে?’ রুদ্র বলল। মনে পড়ল তখন ও সবে আগ্রায় এসেছে, রাস্তাঘাট জ্যাম করে মানুষকে চরম ঝামেলায় ফেলে মিছিল চলছিল ওদের।
‘কয়েকদিন মানে, ভোটের আগে। ওই করেই তো মানটোলার পুরো মুসলিম ভোটটা আদায় করল। ভুলভাল বকে কিন্তু ওর ইনফ্লুয়েন্স মারাত্মক, ওর একটা কথায় হাজার হাজার মুসলমান এককাট্টা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওর বাবা ছিলেন আগের বিধায়ক, তিনি ভালো ছিলেন, এইরকম বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলতেন না। ছেলে এসেই এইসব শুরু করেছে।’ নাহুম খান শঙ্কিত গলায় বলছিলেন, ‘যে খুন হয়েছে তার নাম গুল মহম্মদ, সে মুজাফফর খান ওয়াইসির একদম খাস পেয়ারের লোক ছিল। আজ ভোরে নাকি বাড়ি থেকে সবে বেরিয়েছিল, গুলিতে একদম ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।’
‘অদ্ভুত!’ রুদ্র মুখ দিয়ে বিস্ময়বোধক একটা শব্দ করল, ‘একদিকে মুসলিমবিদ্বেষী পোস্টার পড়ছে শহরে, ইতিহাসবিদ নিরুদ্দেশ হচ্ছে, অন্যদিকে কট্টর মুসলিম নেতা খুন হচ্ছে, কেউ আবার পুলিশে উড়ো ফোন করছে যারা চায় না যে তাজমহল হিন্দু মন্দির ছিল এটা প্রমাণ হোক!’
‘তবেই ভাবুন আমাদের অবস্থা,’ নাহুম খান বললেন।
‘কিন্তু কারা এটা ফোন করে পুলিশকে জানাল? কেনই-বা জানাল?’ রুদ্র বলল, ‘জানানোর পেছনে একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে, অঘোরেশের ওই সংগঠনের প্ল্যান বানচাল করা, মানে অঘোরেশ ভাটের কোনো শত্রু যে বা যারা চায় না তাজমহল হিন্দু মন্দির এটা প্রমাণ হোক!’
‘এটা কীরকম কথা বললেন ম্যাডাম!’ নাহুম খান এবার কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করলেন, ‘আমি মুসলমান বলে বলছি না, তাজমহল হিন্দু মন্দির না মুঘল স্থাপত্য সেটা প্রমাণ করার জন্য সেটাকে ধ্বংস করে দিতে হবে? তাজমহল ভারতবর্ষের গর্ব, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটা!’
‘না না, আমি সেটা বলিনি!’ রুদ্র বলল, ‘তাজমহল একটা ঐতিহাসিক সৌধ, ধ্বংসের কথা আসছে কোত্থেকে! এ তো সেই বাবরি মসজিদের মতো কথা হয়ে গেল। আর তা ছাড়া তাজমহলে হামলা মানে আমাদের দেশের পুরো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপরেই প্রশ্ন উঠে যাওয়া। ফোন যারা করেছে, তাদের উদ্দেশ্যটা কী, আমি সেটা বুঝতে চাইছিলাম।’
‘যাই হোক, আমাদের এখন নাওয়াখাওয়ার সময় নেই।’ নাহুম খান বললেন, ‘যদি আপনার অফিস থেকে নতুন কোনো ঠিকানা পাই, সেখানে গিয়ে যে করে হোক, ওই অঘোরেশকে আটক করতেই হবে।’
রুদ্র কী-একটা বলতে যাচ্ছিল, গাড়িটা হঠাৎ বাঁ-দিকে টার্ন নিতেই শ্বেতশুভ্র তাজমহলের ঝকঝকে চূড়াটার দিকে ওর চোখ পড়ল। আগ্রায় আসার পর থেকে যতবার এর পাশ দিয়ে যাতায়াত করেছে, চরম ব্যস্ততার মুহূর্তেও মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থেকেছে, চারশো বছরেরও বেশি পুরোনো, অথচ এখনও কী জেল্লা, কী আভিজাত্য!
রুদ্র হঠাৎ তাজমহল ছাড়া জায়গাটাকে ভাবতে চেষ্টা করল। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে যমুনা নদী, উলটোদিকে মেহতাববাগ আর আগ্রা ফোর্ট, এপাশে রানির মতো অবস্থান করছে তাজমহল। কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও কল্পনায় তাজমহলহীন আগ্রার ছবি ও আঁকতে পারল না, শুধু মনে হল, এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়া যেমন হিমালয় কল্পনা করা যায় না, তেমনই তাজমহল ছাড়া আগ্রা শহর ভাবা যায় না।
নাহুম খানের আশঙ্কা একদম অমূলক। কোনো কিছুর বিনিময়েই তাজমহলে হামলা মেনে নেওয়া যায় না। কিছুক্ষণের জন্য অফিসের ঝামেলা ও মন থেকে ঝেড়ে ফেলল।
দ্রুত গতিতে ফোনের বোতাম টিপল ও, ‘অমিত, আমরা এক্ষুনিই পৌঁছে যাচ্ছি ব্রাঞ্চে। তুমি কোথায়? শিগগিরি এসো।’
…………
* রুদ্র-প্রিয়ম সিরিজের দ্বিতীয় উপন্যাস নরক সংকেত দ্রষ্টব্য
১১
চাঁদনি মেয়েটা ভালোই। রাতে মোটা মোটা খানপাঁচেক রুটি আর তড়কা খেতে দিয়েছিল মুন্নাকে। সঙ্গে ঝাল ঝাল লঙ্কা আর কাঁচা পেঁয়াজ। বেশ তৃপ্তি করে খেয়ে মুন্না শুয়ে পড়েছিল। রোশনি বলে একটা মেয়ে বেশ ঘুরঘুর করছিল ওর আশেপাশে, হয়তো চাঁদনিই বলে দিয়েছিল, কিন্তু মুন্না বিশেষ উৎসাহ দেখায়নি। একে এত ক্লান্ত ছিল, শরীর চলছিল না, মনে হচ্ছিল কখন ঘুমোতে পারবে, তার ওপর প্রথম রাতেই কোথাও গিয়ে হ্যাংলামি করা ও পছন্দ করে না, কেমন যেন তাতে নিজেকে খেলো দেখায়। পেমেন্টটা পাক, তারপর ওসব হবে’খন।
সকালে উঠে বাথরুমের কাজ সেরেসুরে এসে ও বেশ মৌজ করে চাঁদনির ঘরের বাইরের খাটিয়াটায় বসে একটা সিগারেট ধরাল। জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে, ঘড়িতে সাড়ে আটটা, অথচ কুয়াশায় ছেয়ে রয়েছে চারপাশ। মস্ত একটা ধোঁয়া ছেড়ে মুন্না ফোন করল, ‘শোন, ভালো অর্ডার পেয়েছি। আড়াইশো পিস কাট্টা…!’
ওপাশ থেকে ফজলুল কী বিড়বিড় করল।
মুন্না একটা গালাগাল দিয়ে জোরে ধমক দিল, ‘শালা, এখনও পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস নাকি? আমি এখানে কাজে এসে খেটে মরছি, আর তুই…!’
মিনিটপাঁচেক কথা বলে মুন্না গজগজ করতে করতে ফোন রাখল। এই ওর একটা সমস্যা, মুঙ্গেরের সব ব্যাবসাদার ওর ভয়ে কাঁপলে কী হবে, ঠিকমতো সেকেন্ড ম্যান ও এখনও তৈরি করতে পারল না। ফজলুল, আনসার, জিয়াউল এরা সবাই বিশ্বাসী, মুন্নার জন্য ওরা জানও দিয়ে দিতে পারে, কিন্তু মুন্নার অবর্তমানে পুরো ব্যাবসাটাকে ঠিকমতো হ্যান্ডল করতে পারার ক্ষমতা ওদের নেই। নেই চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বুদ্ধিও। একটু ঢিলে দিলেই তাই ফাঁকি মারে।
যাই হোক ও অর্ডার যখন দিয়ে দিয়েছে, ফজলুল দিল্লিতেই রয়েছে, মাল পাঠিয়ে দেবে।
হঠাৎ কী মনে পড়তে ও আরেকটা ফোন করল, ‘কে হাসান? মুন্না বলছি। কলকাতা থেকে সন্তান দলের মাল এল?’
‘মন্টু বলে ছেলেটা আনছে ওস্তাদ!’
‘কোথা দিয়ে? হাওড়া?’ মুন্না শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘নাহ! কলকাতা স্টেশন। লোক কম থাকে, ট্রেনও বেশি চলে না।’
মুন্না মনে মনে খুশি হল। হাসান ছেলেটা কথা বলে কম, কিন্তু বুদ্ধি আছে মোটামুটি। ফজলুলের মতো দুমদাম কাজ করে না, মাথাটাও ঠান্ডা। সেইজন্য কলকাতার দায়িত্বটা মুন্না হাসানকে দিয়েছে। কলকাতার কিছু জায়গায় এখন ছোটো ছোটো ঠেক খুলছে ওরা, মুঙ্গের থেকে রেগুলার লোক পাঠানো হচ্ছে, তারা গিয়ে শেখাচ্ছে, আস্তে আস্তে ওখানকার প্রোডাকশন বাড়বে, তখন ব্যাবসা আরও ফুলেফেঁপে উঠবে।
কলকাতায় ডিম্যান্ড বরাবরই বেশি, তখন আর মুঙ্গের থেকে পাঠানোর ঝক্কিও থাকবে না। আর কলকাতা স্টেশনকে করিডোর বানানোর অনেক সুবিধা, ওখানে পুলিশের নজরদারি কম, তার ওপর বাংলাদেশের ট্রেন যায়, ওদিকেও মাল সাপ্লাইয়ের সুবিধা। প্রতিটা কামরার টয়লেটের ভেতরে ব্যাকপ্যাকে পার্টসগুলো আলাদা আলাদা করে রেখে আনা হচ্ছে, রেল পুলিশের সাধ্য কী ধরে! ধরলেও ওই পার্টস অ্যাসেম্বল করার ক্ষমতা ওদের বাপের সাধ্য নয়। ও আরও কিছু কথা বলে হৃষ্টচিত্তে ফোন রেখে দিল।
জি বি রোড এখন সবে জাগছে। বাইরের রাস্তা দিয়ে অটো ছুটছে কর্কশ শব্দে, দূরে কোথায় ঘণ্টা বাজছে ঢং ঢং। এই সকাল বেলা মুন্নার মনটা ফ্রেশ থাকে। আজও তেমনই রয়েছে।
দিল্লিতে শেষবার ও এসেছিল মাসকয়েক আগে, এই ঢং ঢং ঘণ্টাটা ওকে মনে পড়িয়ে দিল সেদিনের কথা।
সেবার ও আর হাসান একসঙ্গেই এসেছিল।
দিল্লির বাইরের দিকে একটা সুবিশাল বাগানবাড়ি, ওদের রীতিমতো চিরুনিতল্লাশি করে ঢোকানো হয়েছিল একটা ছোটো ঘরে। সেই ঘরের সঙ্গে লাগোয়া প্রকাণ্ড একটা হল ঘর, তার ঠিক মাঝখানে একটা সাদা গদি পাতা, তার ওপরে বসে ছিল একটা টকটকে ফর্সা লম্বা লোক, তার পরনেও শ্বেতশুভ্র ধুতি, নিরাবরণ ঊর্ধ্বাঙ্গ, কপালে একটা লাল তিলক।
লোকটার সামনে বসে ছিল প্রায় কুড়ি পঁচিশটা ছেলে, প্রত্যেকেরই পরনে সাদা ধুতি, খালি গা। একঝলক তাকালেই বোঝা যায়, এখানে কোনো গুরু-শিষ্য পড়াশুনোর ক্লাস চলছে।
হাসান ফিসফিস করে বলেছিল, ‘এ কোথায় এসে পড়লাম রে মুন্না! শালা মন্দির-টন্দির নাকি?’
মুন্না কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গিয়েছিল। বাইরের এই ঘর থেকে ভেতরের কথাবার্তা সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল।
লোকটার সামনে বসে থাকা একটা ছেলে বলল, ‘গুরুজি, আপনার কথামতো আইটি সেলের কাজ আমরা ঠিকমতো চালাচ্ছি। কিন্তু ইন্টারনেটে খুব ব্যঙ্গবিদ্রূপ হয় গোরু নিয়ে।’
‘গোরু নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ! মানে?’ লোকটা শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল।
‘মানে, অনেকে লেখে, হিন্দু সন্তান দল বলে গোরু আমাদের মা। মানুষের মা কখনো গোরু হতে পারে? তাহলে আমরাও কি গোরু? আমাদের বাবা কি ষাঁড়? এইসব বলে!’ ছেলেটা ইতস্তত করে বলল, ‘আরও নোংরা নোংরা ইঙ্গিত শুনতে হয়, আমরা কী জবাব দেব বুঝতে পারি না।’
লোকটা সামান্য হেসে অন্য সবার দিকে তাকাল, ‘তোমাদের মনেও কি এই একই প্রশ্নের উদয় হয়েছে?’
সবাই নিরুত্তর, কিন্তু নীরবে ঘাড় নাড়ল অনেকে।
‘বেশ।’ লোকটা চোখ বন্ধ করল, ‘আমরা আমাদের দেশকেও মা বলি। জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী। দেশ মানে তো মাটি, তাহলে মাটি কি আমাদের মা? এখানে মা বলতে তো জন্মদাত্রী মায়ের কথা বোঝানো হয়নি, দেশমাতৃকা বলতে বোঝানো হয়েছে যে মা আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। গোরুর তাৎপর্যও সমাজে সেটাই ছিল।’
‘কীরকম?’ একটা ছেলে প্রশ্ন করল।
‘আমাদের দেশ চিরকালই কৃষিভিত্তিক, প্রাচীনকাল থেকে চাষবাস আর পশুপালনই প্রধান পেশা সমতলবাসীদের। চাষের জমিতে লাঙল টানত একটা গোরু, তারপর গোরুর দুধ, ঘি, মাখন তৈরি করা হত প্রতিটা ঘরে। চাষের সার আর রান্নার জ্বালানির জন্য তারা গোবর ব্যবহার করত। একটা গৃহস্থ পরিবারে গোরু থাকা মানে এতগুলো দিক দিয়ে তাদের সমৃদ্ধি ঘটত। তাই সেই আঙ্গিক থেকেই গোরুকে মাতৃজ্ঞানে পুজো করা শুরু হয়।’ লোকটা থামল, ‘শুধু প্রাচ্যেই নয়, মিশরীয়রা সব পশু বলি দিত গোরু ছাড়া। তা ছাড়া, তোমরা খেয়াল করবে, এখনও কোনো পুজো বা যজ্ঞে গোত্র জিজ্ঞাসা করা হয়। গোত্র মানে গোরুর পাল। ভারতবর্ষের শুধু নয়, প্রাচ্যের অজস্র প্রসঙ্গের সঙ্গে গোরু ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এমনকী বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের গৌতম নামটিও গৌ অর্থাৎ গোরু এবং উত্তম এই দুটো শব্দ নিয়ে গঠিত। তোমরা জানো, একটা সময় গৌতম বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতারও মনে করা হত। তাই, দেশ যেমন আমাদের আশ্রয়দাতা মা, তেমনই গোরু আমাদের সমৃদ্ধকারী মা।’
ছেলেগুলো মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। মুন্না আর হাসানও। ঠিক ভুল যাই বলুক, লোকটার বাচনভঙ্গি অসাধারণ।
ছেলেগুলোর পাঠ সম্ভবত শেষ, তারা গুরুজিকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াচ্ছে। এইবার বোধ হয় ঢোকার জন্য মুন্নাদের ডাকা হবে।
একটা ছেলে এগিয়ে এল, সামান্য কুণ্ঠিতস্বরে লোকটাকে বলল, ‘গুরুজি, এই সপ্তাহের শেষ তিনদিন আসতে পারব না, গোয়াতে আমাদের একটা সভার আয়োজন করা হয়েছে।’
‘সেকী! তুমিও সেই গোয়ালাদের জায়গাতেই যাবে কেন!’ কপট হেসে লোকটা ভ্রূ তুলেছিল।
বিস্মিত ছেলেটা মাথা নাড়ল, ‘গুরুজি, গোয়ালা নয়, গোয়া।’
লোকটা তখন মৃদু হেসেছিল, ‘গোয়া-র উল্লেখ মহাভারতেও আছে, তখন এর নাম ছিল গোবরাষ্ট্র, অর্থাৎ গোয়ালাদের দেশ। ইন্টারনেটে যারা এঁড়ে তর্ক করে, তাদের এগুলো বুঝিয়ে বোলো।’ কথাটা শেষ করেই ডান হাতটা আশীর্বাদের ভঙ্গিতে সামনে তুলেছিল লোকটা, ‘তোমার যাত্রা শুভ হোক!’
.
পাশেই কারুর খুক খুক করে কাশির শব্দ শুনে মুন্না বর্তমানে ফিরে এল, দেখল রোশনি বলে সেই ছিনেজোঁকের মতো লেগে থাকা মেয়েটা হাতে চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চোখে স্পষ্ট আহ্বানের ডাক। এই সাতসকালেই কাজল-টাজল পরে রেডি।
মুন্না আলগোছে মেয়েটার সারা শরীরের ওপর চোখ বুলিয়ে নিল, মন্দ না। ঠিকমতো সব চুকেবুকে গেলে একে নিয়ে দু-তিনদিন ফুর্তি করাই যায়। পেমেন্ট তো আজ বিকেলেই পেয়ে যাচ্ছে। তারপর বলে দেওয়া জায়গায় ডেলিভারি করতে পারলেই মুন্নার কাজ শেষ। ফজলুলকে বলা আছে, দুটো চৌকস আনকোরা মুখ পাঠাচ্ছে সঙ্গে, যারা মালটা রেখে আসবে।
সঙ্গে অবশ্য মুন্নাও থাকবে।
কোথায় যেন ঠিকানাটা?
মুন্না কুকুরছানাকে তু তু করার মতো করে মুখটা ছুঁচোলো করে মিচকে হেসে রোশনির গাল দুটো টিপে চায়ের কাপটা হাত থেকে নিল। এত কাছে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে, গায়ে কেমন পাকা আনারসের মতো গন্ধ। উগ্র রঙের সালোয়ার কামিজটা আঁটোসাঁটো হয়ে চেপে বসেছে শরীরে।
মুন্না পকেট থেকে ঠিকানা লেখা কাগজটা বের করল। ওহ বাবা, কাল তাড়াহুড়োয় খেয়াল করেনি, এ যে দিল্লিতেই নয়। ফজলুলকে ফের ফোন করতে হবে তো!
ভালো করে দেখতে গিয়ে গরম চায়ের কিছুটা চলকে পড়ল লেখাটার ওপর, ধেবড়ে দিল সামান্য জায়গা। তবু ঠিকানার শুরুতে ‘অঘোরেশ ভাট’ আর ঠিকানার শেষের ‘আগ্রা’ লেখাটা অক্ষত অবস্থায় যেন জ্বলজ্বল করতে লাগল।
১২
দিল্লিতে থাকলে নাগেশ সিং মোটামুটি ভোর সাড়ে পাঁচটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে পড়েন, তারপর অল্প একটু এক্সারসাইজ করে ব্রেকফাস্ট সেরে শুরু হয় তাঁর দিন। কিন্তু এটা নতুন জায়গা, তার ওপর আজ বেরোনোর তাড়া, তাই আরও সকালে ঘুমটা ভেঙে গেল।
এমনিতেই কয়েকদিন হাজারো মিটিং, সময়ের পার্থক্যের কারণে ঘুম বা বিশ্রাম ঠিকমতো হচ্ছিল না, তার ওপর আজ শোয়ার মাত্র ঘণ্টা চারেকের মধ্যেই ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় মাথায় একপাশটা দপদপ করছে।
তবে একটু পরে জানলার কাচ দিয়ে সদ্য সকাল হওয়া শহরটা দেখে তাঁর মনটা ভালো হয়ে গেল। এমনিতেই উত্তর আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ছোট্ট বেলফাস্ট শহরটা ওঁর ভীষণ প্রিয়, তার ওপর ওঁর এই ফার্মহাউসটা এমন জায়গায় যেখান থেকে কেভহিল পর্বত আর অন্যদিকে ল্যাগান নদী দুটোই বেশ কাছে।
ইচ্ছে করেই শহর থেকে অনেকটা দূরে এমন ছিমছাম জায়গায় বছর কয়েক আগে এই বাংলোটা কিনেছিলেন তিনি, যাতে ব্যাবসার কাজে এসে ব্যস্ততার মাঝে এখানে কয়েকদিন বিশ্রাম নেওয়া যায়।
নাগেশ বেশি তাড়াহুড়ো করলেন না, হালকা ফ্রেশ হয়ে বাড়ির বাইরের একফালি বাগানে এসে দাঁড়ালেন। ব্যাবসার যে ডিলের জন্য এবার এসেছিলেন সেটা সফল হয়েছে, প্রায় আড়াই মিলিয়ন পাউন্ডের সাপ্লাই পেয়েছেন তিনি। আপাতত এখানকার কাজ শেষ, এবার দিল্লি ফিরেই তাঁর ব্রেনচাইল্ড আগ্রার আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়ে ঝাঁপাতে হবে। স্বয়ং প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই ব্যাপারে ফোন করে খোঁজখবর নিচ্ছেন। অবশ্য আসার আগে সব কো-অর্ডিনেশন তিনি করেই এসেছেন, তবু তিনি হলেন শান্তির দূত। আহ্বায়ক হিসেবে একজনও কেউ তাঁর খুঁত ধরতে পারুক, তিনি তো মোটেই চান না।
এটা তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারের সবচেয়ে বড়ো মাইলস্টোন হতে চলেছে!
ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে পূর্বদিকের উদীয়মান সূর্যের দিকে করজোড়ে তাকালেন তিনি,
ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্,
ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্!
হৃষ্টচিত্তে তিনি বাগানের এক কোণে পড়ে থাকা খুরপি নিয়ে ছোট্ট একটা চারার গোরার দিকটা অল্প খুঁড়তে লাগলেন। গাছপালার শখ তাঁর বরাবরের, দিল্লি বা জয়পুরের বাংলোর মতো তাই এই বেলফাস্টের বাংলোতেও মালি রেখে বাগান করার কথা তিনি দু-বার চিন্তা করেননি। তাঁর এই শখ মেয়ে উজ্জয়িনীও পেয়েছে, দিল্লিতে থাকার সময় ওইটুকু বয়সেই ছোটো ছোটো চারা লাগাত বাগানে, শিলং-এর ফ্ল্যাটের বারান্দাতেও পাহাড়ি ফুলগাছের টব লাগিয়েছে, আগের বছরই গিয়ে নাগেশ দেখে এসেছেন।
কাল রাতের হালকা বৃষ্টির কারণে মাটি এমনিতেই নরম হয়ে রয়েছে, অল্প খুঁড়তেই নীচ থেকে কিছু কাঁকর বেরিয়ে এল। নাগেশ হাত দিয়ে সেগুলোকে একটা একটা করে বেছে কাছেই রাখা ডাস্টবিনে ফেলতে লাগলেন।
দূরে কারুর পায়ের শব্দ পেয়ে মুখ তুলে তাকাতেই দেখলেন কস্তুরী ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে। গায়ে বিস্রস্ত রাতপোশাক, পায়ে স্লিপার। ঘুম আলগোছে লেগে রয়েছে ওর গালে, চুলে। গতরাতের হালকা কাজল এখনও চোখের নীচে অস্পষ্ট হয়ে বসে রয়েছে।
চোখাচোখি হতেই কস্তুরী হাসল, ‘গুড মর্নিং!’
নাগেশ মৃদু হেসে কাজে মন দিলেন, ‘মর্নিং। উঠে যখন পড়েইছ, তোমার লাগেজগুলো লাস্ট মিনিটে দেখে নাও একটু। ব্রেকফাস্ট করেই বেড়িয়ে পড়ব মরা।’
কস্তুরী আড়মোড়া ভেঙে বাচ্চা মেয়ের মতো অনুযোগের সুরে বলল, ‘এই তো এলাম! আর দু-দিন থাকলে হয় না?’
নাগেশ দু-পাশে মাথা নাড়লেন, ‘গিয়ে আমার অনেক কাজ আছে। ওই সম্মেলনটা রয়েছে। কনভেনার হিসেবে শেষ মুহূর্তে সব ঠিকঠাক অর্গানাইজ করা হয়েছে কি না, গিয়ে দেখতে হবে আমায়।’
কস্তুরী মুখটা সামান্য বেঁকিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল বাগানের বাঁ-দিকে। যতদূর দেখা যায়, চোখ জুড়িয়ে যাওয়া সবুজ উপত্যকা, মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দেওয়া ছোটো ছোটো টিলা। এই বাড়িটার কাছেপিঠে তেমন কোনো বাড়ি না থাকলেও একটু দূরের পরিষ্কার সরু রাস্তাটা গোটা উপত্যকাটার বুক দু-ভাগে চিরে এঁকেবেঁকে চলে গেছে শহরের দিকে। কিছুদূর গেলেই বাসস্ট্যান্ড, সেখান থেকে বেশ ঘন ঘন বাস পাওয়া যায় অফিসটাইমে। এ ছাড়াও আয়ারল্যান্ডের পাহাড় কেটে টানেল তৈরি করা রেলপথের ট্রেন তো জগদবিখ্যাত, সেই সরু গেজের রেললাইনও রয়েছে অদূরেই।
ওসব মিলিয়ে একটা পারফেক্ট নৈসর্গিক দৃশ্য, পুরো ক্যালেন্ডারের ছবির মতো!
কস্তুরী কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল দূরের কেভহিল পাহাড়ের দিকে, তারপর হঠাৎ বলল, ‘আচ্ছা, আপনার এখানকার অফিস তো একদম শহরের মধ্যে, এতদূরে এই বাড়িটা কিনেছিলেন কেন?’
‘প্রথমদিকে যখন আসতে হত, বেলফাস্ট শহরের প্রাণকেন্দ্রেই ছিলাম, ভিক্টোরিয়া স্কোয়ারের কাছে। একটা ছোট্ট খুপরির মতো ফ্ল্যাটে থাকতে হত। তাতে যেন দমবন্ধ হয়ে আসত। তখন সবে বাপঠাকুরদার জামাকাপড়ের বিজনেসটাকে বিদেশেও নিয়ে আসব ভাবছি, দিনের পর দিন এখানে বড়ো বাংলোয় থাকার মতো পয়সার জোর নেই। তারপর আস্তে আস্তে এখানকার কানেকশনটা স্ট্রং হতে এই বাংলোটা কিনেছিলাম।’ নাগেশ কথা বলতে বলতে মাটি চাঁছার খুরপিটা রেখে একটু জল দিতে উদ্যত হলেন।
নাগেশ সিং নিজে স্বল্পভাষী, কিন্তু তিনি একাই যে সিং গারমেন্টসকে সারা পৃথিবীতে একটা বিখ্যাত ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচয় করানোর প্রধান পুরোধা, সেই ব্যাপারে আপত্তি করবে না কেউই। প্রায় একশো বছরের ঐতিহ্য সিং পরিবারের এই ব্যাবসার, কিন্তু আয়ারল্যান্ডের বিখ্যাত আইরিশ লিনেন দিয়ে বানানো ভারতীয় কারিগরের শার্ট, প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের এই সংমিশ্রণ হওয়ার পর ব্যাবসা ফুলেফেঁপে বেড়েছে বহুগুণ। কোটিপতি ব্যবসায়ী হিসেবে পরে তিনি পা রেখেছেন রাজনীতির আঙিনায়, সেখানেও ইতিমধ্যেই সাফল্য আসতে শুরু করেছে। দিল্লির মসনদে নাগেশ সিং এখন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটা নাম। বংশমর্যাদার চেয়েও এখন যে নাগেশের অ্যাচিভমেন্ট বেশি গুরুত্ব পায় এটা ভেবেই ভালো লাগে।
‘সত্যিই! কী যে সুন্দর জায়গাটা! মনে হয় এখানেই থেকে যাই সারাজীবন!’ কস্তুরী মুগ্ধচোখে দূরের পাহাড়ের দিকে আঙুল তুলল, ‘পাহাড়টা দ্যাখো, মনে হচ্ছে কালো একটা মেঘের মতো যেন আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে।’
‘গালিভার্স ট্রাভেলস’ পড়েছ ছোটোবেলায়? জোনাথন সুইফট এই কেভহিল পর্বতকে দেখেই গালিভার্স ট্রাভেলস লিখেছিলেন। উনি তো এখানেই থাকতেন, সেখান থেকে কেভহিলকে নাকি একটা বিশাল দৈত্যের মতো লাগত। সত্যি লেখকের কল্পনা কতদূর হতে পারে ভাবো!’ বলতে বলতেই নাগেশ দেখলেন, দূরের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে হঠাৎ বাঁ-দিকের পাহাড়ের টানেল থেকে বেরিয়ে আসছে একটা লাল টুকটুকে বাস, এই বাড়ির সমান্তরালে এগিয়ে যাচ্ছে ডান দিকে, এখান থেকে মনে হচ্ছে যেন খেলনা একটা!
কস্তুরী বাচ্চার মতো হাততালি দিয়ে উঠল, ‘কী দারুণ বাসটা! ইস, এই তিনদিন আমরা সারাদিন অফিসেই কাটিয়ে দিলাম, তাও গেলাম গাড়িতে চড়ে। এই বাসটা কেরে গেলেও তো হত!’ আফশোসের ভঙ্গিতে ও তাকাল নাগেশের দিকে।
নাগেশ হাসলেন, ‘এই বাসটা আমাদের অফিসের দিকে যাচ্ছে না কস্তুরী, এটা সোজা চলে যায় হারল্যান্ড অ্যান্ড উলফ ফ্যাক্টরির দিকে। সেই বিশ্ববিখ্যাত জাহাজ কারখানা যারা টাইটানিক তৈরি করেছিল। আমাদের অফিসের টেরাস থেকে ওদের বড়ো বড়ো ক্রেনগুলো দূরে দেখা যায়, খেয়াল করোনি?’
কস্তুরী অবাক চোখে তাকাল, ‘হ্যাঁ দেখেছি তো, হলুদ হলুদ ক্রেন। ওরাই টাইটানিক তৈরি করেছিল?’
এখানে যে কেয়ারটেকারকে রাখা আছে, তাঁকে বলা আছে তিনি যেন মাসে দু-দিন কোনো মালিকে ডেকে বাগানটা পরিষ্কার করিয়ে রাখেন, তবু নাগেশের চোখে পড়ল, গেটের পাশেই ব্ল্যাকথর্ন গাছের একটা ঝোপ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তিনি এগিয়ে টান মেরে উপড়ে দিলেন সেটা, ‘হ্যাঁ। বহু পুরোনো ঐতিহাসিক কারখানা, ১৯১২ সালে ওরাই টাইটানিক তৈরি করে।’
কস্তুরী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল একটু আগে চলে যাওয়া বাসটার গতিপথের দিকে, তারপর হঠাৎ নাগেশের দিকে এগিয়ে এসে ঠোঁট ফোলাল, ‘আমি আজ কিছুতেই এখান থেকে যাব না। আরও দু-দিন থাকুন, প্লিজ! আমি কাল ওই ফ্যাক্টরি দেখতে যাব, নিয়ে চলুন না!’
নাগেশ মাথা নাড়লেন, ‘এবারে আর হবে না। আজ যেতেই হবে।’
‘না না, আমি আজ কিছুতেই যাব না।’ কস্তুরী জোরে জোরে পা ঠুকল বাগানের নরম মাটিতে।
নাগেশ এবার কস্তুরীর দিকে তাকালেন।
মাঝে মাঝে যখন একেবারে একা কোনো বিজনেস ট্রিপ করেন, প্লেনে জানলার পাশে বসে ফেলে আসা এতগুলো বছরের চাওয়াপাওয়ার হিসেব কষেন, তখন আরও একবার জীবনের এই এপিসোডটাকে মূল্যবোধের দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে দেখার চেষ্টা করেন। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন, আদৌ কি এটার কোনো প্রয়োজন ছিল? মধ্য চল্লিশ, সম্ভ্রান্ত রাজপরিবারের বংশধর, চূড়ান্ত সফল ব্যবসায়ী কাম রাজনীতিবিদ তিনি, এক কন্যাসন্তানের পিতা। বাড়িতে স্ত্রী রয়েছে।
তবু তিনি অফিসের এই তরুণী মেয়েটির সঙ্গে কেন জড়িয়ে পড়লেন? তাও আবার মাত্র কয়েক মাসে? তিনি কামুক প্রকৃতির পুরুষ নন, দুমদাম কোনো নারীর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়া তাঁর স্বভাবে নেই, স্ত্রী সুজাতাকে বিয়ে করেছিলেন ভালোবেসে। তবু জীবনের মধ্যভাগে এসে হঠাৎই যেন ওলটপালট হয়ে গেল সব, সুজাতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলা ইগো, কলহ, উজ্জয়িনীকে নিয়ে চিন্তার মাঝে মাস দুয়েক আগে একরাশ ঠান্ডা বাতাসের মতো জীবনে এসে পড়ল কস্তুরী, সাময়িক মোহে যাকে আর তিনি ফেরাতে পারেননি। কস্তুরী ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস আর পলিটিক্যাল সায়েন্সের ভালো ছাত্রী ছিল, নাগেশের সাংসদ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে সেই ব্যাপারেই সেক্রেটারি হিসেবে ওকে নেওয়া। তারপর যে কী হয়ে গেল! মাত্র এই কয়েকদিনে ও অনেকটা কাছে চলে এল।
শুধুই যে শারীরিক আকর্ষণ তা নয়, জীবনে বেড়ে চলা ব্যস্ততা, চাপের মাঝে কস্তুরীর ছেলেমানুষি, সারল্য যেন তাঁকে স্বস্তি দিয়েছিল, ওর সঙ্গে প্রতিদিনের কাজ-পরিকল্পনা আলোচনা করতে ভালো লাগত। আর রাতারাতি আগুনের মতো বেড়েছিল সুজাতার সঙ্গে দূরত্ব। এমনিতেই দু-জনের ইগো সম্পর্কটাকে খাদের কিনারায় নিয়ে গিয়েছিল, তার মধ্যে এই কস্তুরী অধ্যায় যেন তাতে শেষ পেরেক পোঁতার দায়িত্ব নিল। নাগেকশ বোঝেন সবই, কিন্তু কিছু করতে পারেন কই!
নাগেশ ছোটো একটা নিশ্বাস ফেলে হাসলেন, ‘মাঝে মাঝে তুমি এমন বাচ্চাদের মতো করো! বললাম না, কাজ আছে।’
‘কাজ থাক।’ কস্তুরী মাথা ঝাঁকাল, ‘একদিন পরে গেলে এমন কিচ্ছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। আমি এই প্রথম এখানে এলাম আর কিছু না দেখেই…? আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা কাল যাব, কেমন? আজ ফ্যাক্টরিটা দেখে আসি?’ কথাটা বলেই কস্তুরী বাড়ির দিকে পা বাড়াল, ‘আমি এখনই অফিসে ফোন করে বলছি ফ্লাইট রিশিডিউল করতে।’
‘না!’ নাগেশ এবার উঠে দাঁড়িয়ে ধমকে উঠলেন, ‘তুমি কাউকে ফোন করবে না। আমরা আজই ফিরব।’
নাগেশের স্বরে এমন কিছু ছিল, কস্তুরী ঘুরে তাকাল।
চোখেমুখে স্পষ্ট অভিমান গাঢ় হয়ে উঠছে দ্রুত, লালচে হয়ে উঠছে নাকের পাটা।
নাগেশ গুরুত্ব দিলেন না। দ্রুত হাতে আবার মাটিচাঁছার খুরপিটা তুলে নিতে নিতে মৃদু অথচ স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘আজ উজ্জয়িনী বাড়ি আসছে। কাল ওর জন্মদিন।’
১৩
অঘোরেশ এবার উত্তেজিত হয়ে আর জাপটানোর দিকে গেলেন না, উঠে দাঁড়িয়ে সটান সুরঞ্জনকে কোলে তুলে নিলেন। গোটা প্রথম শ্রেণির কামরার মানুষজন থেকে শুরু করে হোস্টেসরা পর্যন্ত হাঁ করে এদিকে চেয়ে। উলটোদিকে পূরবী এতটাই অবাক হয়ে গেছেন কোনো কিছু অভিব্যক্ত করতেও সম্ভবত ভুলে গেছেন।
সুরঞ্জনের সাংঘাতিক অপ্রস্তুত লাগলেও তিনি বাধা দিলেন না। কারণ তিনি খুব ভালো করে জানেন এখন বাধা দিলে অঘোরেশ আরও মজা পেয়ে নামাবেই না, করেই যাবে এরকম। তার চেয়ে চুপচাপ থাকলে বরং নিজে থেকেই নামিয়ে দেবে।
ঠিক সেটাই হল। মিনিট দুয়েক বাদে সুরঞ্জন হাঁফ ছেড়ে নিজের সিটে বসতে পারলেন। তবে খারাপ তাঁর নিজেরও লাগছে না। দিল্লি থেকে আগ্রা যাওয়ার পথে চল্লিশ বছরের পুরোনো রুমমেটের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে কারুরই খারাপ লাগে না, বরং নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মন।
কলকাতা থেকে ইতিহাস নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করে যখন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে সুরঞ্জন পড়তে গেছিলেন, মাস্টার্সের দুটো বছর অঘোরেশ ছিল ওঁর রুমমেট। সুরঞ্জনের হঠাৎ মনে পড়ে গেল প্রথম দিনের আলাপটা।
সুরঞ্জন বরাবরই মিতবাক, সেই প্রথম বাড়ি ছেড়ে অতদূর গিয়ে একা একা জীবন শুরু করা, স্বাভাবিকভাবেই আরও বেশি চুপচাপ ছিলেন। কিন্তু অঘোরেশ প্রথম সাত-আট দিনের মধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিছুটা ওর টকটকে ফর্সা রং, লম্বা চেহারা, যা ভিড়ের মধ্যেও আলাদা করে চোখে পড়বেই, আর বাকিটা ওর দিলখোলা মেজাজের জন্য।
প্রথম দিনেই আলাপ পরিচয় হওয়ার সময় অঘোরেশ হাসতে হাসতে জানিয়েছিল, ‘মেরা নাম অঘোরেশ ভাট। ইয়ে অঘোরেশ কা মতলব কেয়া হ্যায় পতা হ্যায় তুঝে…?’
কারুর সঙ্গে আলাপের প্রথম পর্বেই অঘোরেশ বেশ গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করত, শিবের এক অবতার যিনি নাকি কুচকুচে কালোরঙা শরীর নিয়ে ধ্যানরত ব্রহ্মাকে দেখা দিয়েছিলেন, তাঁকেই বলা হয় অঘোরশিব বা অঘোরেশ। আর এই নাম নিয়ে অঘোরেশের গর্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। গায়ের রং তার ধবধবে ফর্সা হলেও ওই নামকরণ সার্থক করার জন্য সে সবসময় কালো রঙের জামাকাপড় পরত।
যতদূর মনে পড়ছে, অঘোরেশ এসেছিল জম্মু কাশ্মীরের কোনো এক মফস্বল থেকে। তারও সাবজেক্ট ছিল ইতিহাস। খাঁটি কাশ্মীরি পণ্ডিত বংশের ছেলে ছিল সে। সুরঞ্জন বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করতেন, সারাক্ষণ ওই নিয়েই মেতে থাকতেন বলে অঘোরেশ ওঁকে মজা করে ডাকত লিটল বুদ্ধা। তখন সারা ভারত ফুটবলার পেলের জ্বরে ভুগছে, অঘোরেশ নিজেও পেলের ভক্ত ছিল। তাই সারা কলেজ অঘোরেশের এই কালো প্রীতির জন্য পেলের নামে নাম দিয়েছিল, ব্ল্যাক পার্ল।
মাস্টার্সের দুটো বছর এক ছাদের তলায় কাটালেও তারপর আর বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। সুরঞ্জন বাইরে চলে যান বৌদ্ধ ধর্মের ওপর পিএইচ ডি করতে। কিছু বছর বাদে কার কাছে বোধ হয় একবার শুনেছিলেন যে অঘোরেশ উত্তর ভারতেরই কোনো কলেজে পড়াতে ঢুকেছে। তখন তো এখনকার মতো সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যোগাযোগ রাখার সুযোগ ছিল না। অঘোরেশ স্মৃতির অতলে তলিয়ে যায় ধীরে ধীরে।
কিন্তু তলিয়ে গেলেও মনের কোথাও তো অঘোরেশ ছিলই, না হলে আজ এত কথা পরপর মনে পড়ে যাবেই-বা কীভাবে! সুরঞ্জন বর্তমানে ফিরে দেখলেন, অঘোরেশ তখনও খেয়ে চলেছে আর মিটিমিটি হেসে চলেছে।
সুরঞ্জন পূরবীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে উদ্যত হলেন, ‘অঘোরেশ। আমার জে এন ইউ-র রুমমেট। আমরা দু-বছর একসঙ্গে কাটিয়েছি।’
প্রাথমিক নমস্কার বিনিময় মিটে গেলে অঘোরেশ তাঁর দাড়িগোঁফের জঙ্গলের মধ্যিখানে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘তারপর, লিটল বুদ্ধা? হঠাৎ এদিকে কী মনে করে?’
সুরঞ্জনের বেশ ভালো লাগছিল, কিন্তু এই প্রশ্নে একটু সিটিয়ে গেলেন। অঘোরেশের সঙ্গে চার দশক কোনো যোগাযোগ নেই, ফলে স্বাভাবিকভাবেই সুরঞ্জনের জীবনের ভুটান এপিসোড ও জানে না। বলবেন কি নিজে থেকে? পরক্ষণেই ভাবলেন, নাহ! থাক। সময় এককালের রুমমেটকে এখন অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে, এসব বলে আর লাভ কী! এই তো ঘণ্টা দেড়েকের গল্পগুজব, তারপর যে যার পথে হাঁটা দেবেন আবার।
সুরঞ্জন অল্প হেসে বললেন, ‘আমি তো আর্কিয়োলজিকাল সার্ভেতে ছিলাম। অনেক বনের মোষ চরিয়ে সেসব পাট চুকিয়ে এখন ঘরের ছেলে ঘরেই। খাইদাই, বই পড়ি। আগ্রায় মেয়ের কাছে যাচ্ছি। মেয়ে ব্যাঙ্কে চাকরি করে, এখন ওখানে পোস্টিং। তুই?’
অঘোরেশ দু-হাত উলটে বললেন, ‘আমিও তো যে গোয়ালে ছিলাম সেই গোয়ালেই এখনও ঘাস খাচ্ছি।’
দশ পনেরো মিনিটের মধ্যেই আড্ডা বেশ জমে উঠল। অঘোরেশ একটু ছিটগ্রস্ত বরাবরই ছিলেন। সুরঞ্জনের যেখানে বিষয় ছিল বৌদ্ধ ধর্ম, সেখানে অঘোরেশ সারাক্ষণ মেডিয়েভাল ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি অর্থাৎ ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়েই পড়ে থাকতেন বেশি, সেটা সুরঞ্জনের এখনও মনে আছে। পরে ওই বিষয়েই এগিয়েছেন অঘোরেশ। এখন আগ্রা ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। তবে হয়েই এল, আর দু-বছর বাদেই অবসর। আগ্রাতেই সেটল করে গেছেন, তবে মাঝেমধ্যেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন এদিক সেদিক হঠাৎ হঠাৎ। জামাকাপড়ের তোয়াক্কা কোনোদিনও করতেন না, এখন তো ছেড়েই দিয়েছেন।
সুরঞ্জন কফির কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর শ্রীনগরের বাড়ির কী খবর? বাবা মা? তোর একটা ভাই ছিল না?’
অঘোরেশ একটু থেমে বললেন, ‘শ্রীনগরে তো আমাদের বাড়ি ছিল না। কুপওয়ারার লোলাব ভ্যালিতে থাকতাম আমরা। সেটা শ্রীনগর থেকে অনেকটা দূর।’
সুরঞ্জন বলল, ‘ওই হল। ওখানে কে কে আছেন এখন?’
অঘোরেশের মনে হয় খুব সর্দি হয়েছে। প্রায় বুক অবধি নেমে আসা দাড়ি গোঁফের মধ্যে মরুভূমির বুকে জেগে থাকা গাছের মতো বেরিয়ে থাকা নাক চেপে ধরে মাঝেমাঝেই হাঁচছেন। এখনও জোরে একবার নাক টেনে বললেন, ‘বাবা মারা গেছেন। মা, ভাই আছে। ভাই ওখানেই হোটেলের ব্যাবসা খুলেছে।’ তারপর একটু থেমে যোগ করলেন, ‘আসলে, আমি অনেকদিন হল ওদিককার খোঁজ নেওয়া ছেড়ে দিয়েছি। এদিকের কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত, যাওয়াও হয়নি অনেকদিন। আগ্রায় আমি আর আমার বউ থাকি।’
সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছেলেমেয়ে ক-টা তোর?’
অঘোরেশ হাঁচতে হাঁচতে ইশারায় হাতটা নাড়ালেন, ‘নেই।’
কথায় কথায় ট্রেন আগ্রা শহরে ঢুকে পড়েছে বেশ কিছুক্ষণ হল। উত্তর ভারতীয় অন্যান্য পুরোনো শহর, যেমন লখনৌ, বেনারসের মতো এখানেও অন্তত রেললাইনের আশপাশে ইতিহাসের কোনো ছিটেফোঁটা নেই, জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে ভাবছিলেন পূরবী। সেই চওড়া চওড়া রাস্তা, মানুষজন হাঁটছে, দোকানপাট, একদমই নর্মাল। পরক্ষণেই ভাবলেন, মুঘল স্থাপত্যের শহর বলে কি এখানকার মানুষজন কাজকর্ম করবে না নাকি! না, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক হবে না! নিজের ছেলেমানুষি চিন্তাভাবনায় নিজেরই হাসি এল পূরবীর।
অনেক দূরে তাকালে হয়তো মুঘল স্থাপত্যের অনুকরণে কিছু বাড়ি চোখে পড়ে, কিন্তু চারদিকেই এখন এত বিশ্বায়নের সৌজন্যে বিজ্ঞাপন, শপিং মলের ছড়াছড়ি যে আগ্রা মানেই যে ঐতিহাসিক ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার সঙ্গে কিছুতেই মেলাতে পারছিলেন না পূরবী। সুরঞ্জন আগে বহুবার এলেও তাঁর এই প্রথমবার। এমনিতেই আগ্রায় চলে আসা ইস্তক রুদ্র উইকএন্ড হলেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে ক্যামেরা গলায়, ওর মুখ থেকে শুনে শুনে তাজমহল ছাড়াও আগ্রা কোর্ট, ফতেপুর সিক্রি, আকবরের সমাধি সিকান্দ্রা, সব মুখস্থ হয়ে গেছে পূরবীর। রুদ্রর অ্যাপার্টমেন্টটাও নাকি বেশ ভালো জায়গায়, সব কিছুই ওখান থেকে মোটামুটি কছে পিঠে।
পূরবী রুদ্রকে আরেকবার ফোনে চেষ্টা করলেন, কিন্তু বেজে বেজে কেটে গেল। তিনি সুরঞ্জনের দিকে তাকালেন। পুরোনো বন্ধু পেয়ে বেশ খুশি হয়ে পড়েছেন সুরঞ্জন, বোঝা যাচ্ছে। তবে কথায় আছে না, ঢেঁকি স্বর্গের গেলেও ধান ভানে, দুটো ইতিহাসের লোক যেই এক হয়েছেন, ঘুরেফিরে সেই নিজেদের রিসার্চের বিষয় নিয়েই মেতে উঠেছেন। এই অঘোরেশ ভদ্রলোককে ট্রেনে ওঠার সময় যতটা অদ্ভুত লেগেছিল এখন আর ততটা লাগছে না। তবে একটু বোহেমিয়ান টাইপ, সন্দেহ নেই।
চোখাচোখি হতে পূরবী হাসলেন, বললেন, ‘আগ্রায় আমরা বেশ কিছুদিন থাকব। আপনি আসবেন আমাদের বাড়িতে।’
অঘোরেশ আবার দরাজ গলায় হেসে বললেন, ‘সে আর বলতে! লিটল বুদ্ধা আমায় আপনার মেয়ের ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে অলরেডি, দেখবেন কোনদিন হাজির হয়ে গেছি। তারপর এত জ্বালাব যে বিরক্ত হয়ে যাবেন। হা হা হা!’
ট্রেন গন্তব্যে ঢোকার পরে প্ল্যাটফর্ম আর ট্রেন, দুটোতেই একটা সাময়িক ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়, লোকজনের হইচই, লাগেজ নামানো, কুলিদের হাঁকডাক, সব মিলিয়ে সরগরম হয়ে ওঠে জায়গাটা।
ওঁরা অবশ্য তাড়াহুড়ো করলেন না। ট্রেনের এটাই লাস্ট স্টপেজ। সুতরাং তাড়াতাড়ির কিছু নেই। মোটামুটি ভিড়টা একটু থিতিয়ে যেতে নিজেদের লাগেজগুলো ঠিকমতো গুছিয়ে ট্রেন থেকে নামলেন ওঁরা।
অঘোরেশ তাঁর সেই নোংরা রুকস্যাকটা পিঠে চাপিয়ে রাজেশ খান্নার সিনেমার আদলে সুর করে বললেন, ‘আচ্ছা! তো হাম চলতে হ্যায়!’
সুরঞ্জন হেসে বললেন, ‘খুব শিগগিরি দেখা করব কিন্তু! তোর রিসার্চের বিষয়টা দারুণ ইন্টারেস্টিং। অন্তত আমার তো মনে হয় না, শাজাহানের সময়ের পিনাল কোড নিয়ে তেমন ভালো কাজ কেউ করেছে। ইন ফ্যাক্ট, এটা একটা পুরোনো অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভারতের স্বর্ণযুগকে দেখা, তাই না!’
অঘোরেশের মুখে একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি ভেসে উঠল, ‘স্বর্ণযুগ! হুঁঃ! ওটা পুরোপুরি কিছু ওই সময়ের হিস্টোরিয়ানদের বিকৃত করে দেখানো একটা মিথ। পিটার মান্ডির নাম শুনেছিস?’
পূরবী একটু অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন, রুদ্রকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না, খুঁজতে হবে। এদিকে এঁদের কথা আর শেষ হচ্ছে না। তিনি সুরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে মৃদু একটা ইশারা করলেন চোখ দিয়ে।
সুরঞ্জন বুঝতে পেরে গল্পে ইতি টানার জন্য বললেন, ‘শোন না, মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। তুই চল না, আলাপ করিয়ে দেব’খন।’
অঘোরেশ ইঙ্গিতটাকে সম্ভবত বুঝতে পারলেন না, পকেট থেকে একটা নস্যি জাতীয় কিছু বের করে হাতের তেলোয় ডলতে ডলতে বললেন, ‘পিটার মান্ডি ছিল একটা ব্রিটিশ ব্যবসায়ী, শাজাহানের রাজত্বের সময় আগ্রায় এসে ও বছরখানেক ছিল, ইন ফ্যাক্ট মুমতাজ মারা যাওয়ার ঠিক এক বছর বাদেই। ওর একটা ভালো বই আছে ইটিনেরারিয়াম মান্ডি নামে, শাজাহানের মাইনে করা স্তাবকদের লেখার থেকে যেটা অনেকটাই আলাদা আর নিরপেক্ষ। ওটা পড়লে বুঝতে পারবি ওই সময় কী সাংঘাতিক দুর্ভিক্ষ আর মুদ্রাস্ফীতিতে ছেয়ে গিয়েছিল দেশ। জায়গায় জায়গায় বিদ্রোহ, লুঠপাট, এমনকী বাজারে খাসির জায়গায় কুকুরের মাংস পর্যন্ত মিশিয়ে…।’
পূরবী ভেতরে ভেতরে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলেন, একে এতকাল মেয়েটাকে চোখের দেখা দেখেননি, আর এ কিছুতেই থামছে না।
এবার তিনি বলেই ফেললেন, ‘অঘোরেশজি, আমাদের মেয়ে ওয়েট করছে তো, আমরা একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি কোথায় ও দাঁড়িয়ে আছে। আপনি একদিন আসুন আমাদের বাড়িতে, তখন গল্প হবে না হয়, কেমন?’
অঘোরেশ কোথায় বোধ হয় হারিয়ে গেছিলেন, পূরবীর কথায় একটু থতোমতো খেয়ে গেলেন। ওদের দু-জনের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হাতটা একটু নেড়ে সুরঞ্জনকে বললেন, ‘ফোন করব লিটল বুদ্ধা! একটা জরুরি ব্যাপারে আলোচনা আছে অ্যান্ড ইউ আর দ্য রাইট পার্সন ফর দ্যাট! আমার তোকে অনেক কিছু বলার আছে। ফোন করব শিগগিরি!’ তারপর আর কিছু শোনার অপেক্ষা না করেই উলটোদিকে হাঁটতে শুরু করলেন, একবার পেছন ফিরেও দেখলেন না। অদূরেই একটা ওভারব্রিজে উঠে পড়ার পর আর দেখা গেল না তাঁকে।
সুরঞ্জনেরও একটু বিরক্তি লাগছিল, প্রায় পনেরো মিনিট হয়ে গেল ট্রেন ঢুকে গেছে স্টেশনে, এখনও রুদ্রর মুখটা দেখেননি। তবু অঘোরেশের এরকম হঠাৎ চলে যাওয়াটায় কেমন খারাপ লাগল।
অবশ্য অঘোরেশ একটু অদ্ভুত চিরকালই। হোস্টেলে থাকার সময়েও হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যেত কাউকে না বলে-কয়ে। প্রথমবার তো দু-রাত পেরিয়ে যাওয়ায় সুরঞ্জন রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়ে হোস্টেল ওয়ার্ডেনকে জানিয়ে ফেলেছিলেন। পরে জানা গেল ও নাকি বাজার করতে গিয়ে হঠাৎ কী খেয়াল চেপেছিল বাস ধরে সটান জয়পুর চলে গিয়েছিল, আম্বের ফোর্ট দেখবে বলে। তারপর থেকে দু-দিন তিনদিন না ফিরলেও সুরঞ্জন আর চাপ নিতেন না।
সুরঞ্জন মনে মনে ঠিক করলেন, এখন তো আছেন এখানে, ফোন করবেন দু-দিন বাদে বেটাকে।
১৪
উজ্জয়িনী মহারানিবাগের রাস্তার পাশ দিয়ে চুপচাপ হেঁটে চলেছিল। আজ সকালের ফ্লাইটে ও দিল্লির বাড়িতে এসেছে। এসেই কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। ইচ্ছে থাকলেও কোথাও একা যাওয়ার স্বাধীনতা ওর নেই, সারাক্ষণ প্রহরীর মতো বাবার নিযুক্ত করা প্রহরীরা ও না চাইলেও পাহারা দিয়ে যাবে। বাধ্য হয়েই ও গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে, তারপর একটা বড়ো মাল্টিপ্লেক্সে ঢুকে অন্য গেট দিয়ে বেরিয়ে এসেছে চুপিসারে। ড্রাইভারকে বলে এসেছে সিনেমা দেখবে। সিনেমা দেখার জন্য কম করে আড়াই তিন ঘণ্টা ড্রাইভার এমনিই অপেক্ষা করবে, তারপর যতক্ষণে খোঁজখবর শুরু করবে, ততক্ষণে ও অনেক দূরে চলে যাবে।
ভয়ে, টেনশনে ওর বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছিল। এক সেকেন্ডের জন্য ওর মনে হল, কাজটা ও ঠিক করছে তো? পরক্ষণেই একটা বেপরোয়া ভাব এসে ওকে ছুঁয়ে দিল, আলবাত ঠিক করছে! যারা আঠেরোটা বছরেও ওকে একটু শান্তি দিতে পারল না, ওকে বুঝতে পারল না, তাদের এত দাবিই-বা কীসের? সাবধানে রাস্তাটা ক্রস করে উজ্জয়িনী ভাবল।
দিল্লি। ওর জন্মভূমি। আঠেরো বছর আগে এখানেই ও জন্মেছিল। তবে আদৌ বাবামায়ের ভালোবাসার ফসল ছিল কি না কে জানে। জন্মভূমি হলেও ও বিশেষ কোনো টান অনুভব করে না শহরটার প্রতি। আসলে দিনের পর দিন এত একাকীত্ব, এত মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়েছে ওকে, সেগুলো যেন মনে পড়ে যায়। এই শহরের যেটুকু ওর ভালো লাগে, সেটা হল, বিশাল বিশাল রাস্তাঘাট, আর ওপরে দু-পাশ থেকে তোরণের মতো করে ছাওয়া গাছ, পুরো আকাশটা যেন ঢেকে মাথার ওপর ছাতা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু এখন ওর অতদিকে খেয়াল নেই। একা একা হাঁটলেও তীব্র এক ভয়মেশানো মাদকতা ওকে যেন আচ্ছন্ন করে রাখছিল, বাবার চেনা লোকের অভাব নেই, কেউ যদি ওকে দেখতে পেয়ে যায়?
সানগ্লাসটাকে ভালো করে চোখে এঁটে নিয়ে ওড়নাটাকে ভালো করে ঢেকে ও চলতে লাগল। এবারে ও প্রায় আটমাস পরে বাড়ি এল।
বাড়ি বলতেই অবশ্য মেয়ে হোস্টেল থেকে ফিরলে বাবা মায়ের যে হাসিখুশি মুখ সম্বলিত মুখ, দারুণ সব রান্না চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সে সব কিছু স্বাভাবিকভাবেই ওর কপালে জোটেনি, ইন ফ্যাক্ট কোনোদিনই জোটে না।
বাবা মা কেউই ছিলেন না, বাবার একজন কর্মচারী এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি নিয়ে এল। বাবা নাকি বিদেশে, আর মা বেরিয়েছেন কোথাও।
ওর বাবা শুধু যে দিল্লির একজন বিত্তশালী ব্যবসায়ী তাই নয়, শাসক দলের সাংসদও। সারাদিনই নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন তিনি। মা ব্যস্ত তাঁর কিটি পার্টি আর এন জি ও, শপিং এসব নিয়ে।
মেয়েকে আনতে যাওয়ার সময় তাঁদের কোথায়?
সাংঘাতিক প্রাচুর্যে মোড়া দিল্লির একটা অত্যন্ত অভিজাত এলাকায় প্রচুর চাকরবাকর সমেত বিশাল একটা অট্টালিকা। তার সামনে মালির হাতে সযত্নে বেড়ে ওঠা বাগান, একপাশে গ্যারাজ অখার অন্দরমহলের সর্বত্রই দামি সামগ্রী আর বহুমূল্য শৌখিনতার ছাপ। বাড়ি বলতে এইটুকুই বোঝে ও।
বরং বাড়ি থেকে বেরিয়ে মেঘালয়ে পড়তে গিয়ে বাবা মায়ের রোজকার অশান্তি, তিক্ততা থেকে ও মুক্তি পেয়েছে। শিলং-এর ওর ওই ছোট্ট সুন্দর ঘরটাই যেন এখন ওর পৃথিবী। ঘরের মধ্যেই থাক, বা সামনের গলফের মাঠটায়, কিংবা একটু হেঁটে যদি চলে যায় গমগমে জমজমাটি পুলিশবাজারে, নিজের মধ্যে যেন হারিয়ে যেতে পারে ও, বন্ধুহীন হয়েও সম্পূর্ণ নতুনভাবে আবার বেঁচে থাকার রসদ পায়, যেটা দিল্লি এলে অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায়।
সেইজন্য ও বাড়ি আসতেও চায় না। কিন্তু, কিছু করার নেই। এমন একেকটা সময় আসে, যখন ইচ্ছে থাকলেও শিলং-এ থাকবার উপায় নেই। সেমেস্টার শেষ হলেই বাবা মা ফোন করে এমন করে যে সেই মুহূর্তে গলে যায় ও।
কিন্তু কোনোবারই এসে অন্যবারের চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। আগেরবারে ছুটিতে যখন এসেছিল, প্রথম তিন থেকে চারদিন বাবা মা চুপচাপই ছিল, খুব উৎফুল্ল না হলেও একসঙ্গে ডিনারটুকু করছিল ওরা, বিশাল ওই ডাইনিং-এ মাত্র তিনজন খেতে বসলে কেমন ফাঁকা ফাঁকাই লাগে।
বিশাল ঝাড়বাতি, প্রকাণ্ড ড্রয়িং-এ নাগেশ সিং-এর পূর্বপুরুষদের বহুমূল্য সব তৈলচিত্র, মেহগনি, হাতির দাঁতের তৈরি আসবাব, এত কিছুর মাঝে তিনজনকে মনে হয় গিলে খেতে আসে বাড়িটা। তবু টুকটাক কথাবার্তা চলছিল উজ্জয়িনীর পড়াশোনা, কলেজের কথা এইসব। কিন্তু গত কয়েক মাসে বাবা মা-র সম্পর্ক একেবারে তলানিতে এসে পৌঁছেছে, সেটা ও শিলং-এ থেকেও বুঝতে পেরেছে।
ওকে ছোটো থেকে মানুষ করা বুয়া চুপি চুপি ফোনে বলেছে বাবার অফিসের এক মহিলা নাকি এর জন্য দায়ী। কস্তুরী তাঁর নাম।
কৌতূহলে তারপর থেকে ও যখনই ইউটিউবে বাবার ভাষণ শুনেছে, তখনই পাশে সেই মহিলাকে থাকতে দেখেছে। এমনকী, অনেক সময় বাবার অনুপস্থিতিতে মিডিয়ার মুখপাত্র হিসেবেও বক্তব্য রেখেছেন ওই মহিলা, ইন্টারনেটে দেখেছে ও।
উজ্জয়িনীর আঠেরো বছর মাত্র বয়স, কিন্তু এর মধ্যেই ও যেন ক্লান্ত হয়ে গেছে বাবা মা-র ঝগড়া, অশান্তি, কাদা ছোড়াছুড়ি দেখতে দেখতে, বাড়ির বাকি গোটা দশেক সারাক্ষণের কাজের লোকগুলোর মতোই এখন দেখেও না দেখার ভান করে ও নির্বিকারভাবে চলে যায় নিজের ঘরে। মনে পড়ে ছোটোবেলায় কত কাঁদত, একবার বাবাকে গিয়ে বোঝাত, একবার মাকে গিয়ে, দু-জনের কেউই বুঝত না, উলটে ওকে, একটা অবোধ শিশুকে সালিশি রেখে তিক্ত তর্ক করে যেত দু-জনে।
একটা ব্যাপার ওর কিছুতেই মাথায় ঢোকে না, এরা এত বছর ধরে ঝগড়া করছে, অশান্তি করছে, একটা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ হয়ে লোক হাসাচ্ছে, তবু এরা ডিভোর্স করে না কেন? কোথায় যেন পড়েছিল ও একবার, জন্তুর মতো একসঙ্গে থাকার চেয়ে মানুষের মতো আলাদা থাকা অনেক ভালো। কিন্তু এরা সেটা মনে করে না। বাবার যদি সত্যিই অফিসের ওই মহিলার প্রতি দুর্বলতা জন্মে থাকে, মাকে ডিভোর্স দিয়ে সুন্দর একটা জীবন তিনি শুরু করতেই পারেন, কিন্তু তিনি তা করবেন না।
মা-ও বলা ছাড়বেন না। স্বামীর এই সম্পর্ক মানতেও পারবেন না, আবার ছেড়েও যাবেন না।
মাঝখান থেকে উজ্জয়িনীর মরে যেতে ইচ্ছা করে।
বিশ্বাস করতে ওর সত্যিই কষ্ট হয় এরা একদিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিল!
উজ্জয়িনীর হঠাৎ খেয়াল হল, যে দোকানটার সামনে দাঁড়ানোর কথা, তার সামনে এসে পড়েছে। কিছুটা টেনশনে হোক, কিছুটা-বা আবহাওয়ার কারণে, ও বেশ ঘামছিল।
আজকের দিনটা ওর কাছে বেশ স্পেশাল।
গত কয়েক মাস ধরে যার সঙ্গে ও নিয়মিত কথা বলে আসছে, যে এতদিন ধরে ওর ডিপ্রেশনের সময় একটুও বিরক্ত না হয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে অকুণ্ঠভাবে, তার সঙ্গে ওর আজ সামনাসামনি দেখা হবে। হোক বয়স একটু বেশি, এমন করে উজ্জয়িনীর দুঃখ কষ্টগুলোকে কে আগে এত ভালো অনুভব করেছে?
এমনিতে খুব একটা বেশি সাজে না ও, কিন্তু পৈতৃক সূত্রে পাওয়া খাঁটি রাজপুত রক্তের সৌজন্যে এমনিই চেহারায় এমন একটা আভিজাত্য আছে যাতে লোকে দু-বার ফিরে তাকায় ওর দিকে। ওর অকালপক্ব মস্তিষ্কের মতো অন্তত শরীরটাও ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, সে ঠিক সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বেড়ে উঠছে, এইজন্য ভগবানকে অশেষ ধন্যবাদ দেয় ও।
একটা হালকা গোলাপি রঙের চিকনের সালোয়ার কামিজ পরেছে ও আজ। চুলটাকে যত্ন কর বেঁধেছে চুড়ো করে। ভোরের ফ্লাইটের ধকলে কিছুটা ক্লান্তি এলেও উত্তেজনায় সেই ক্লান্তিকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে উজ্জয়িনী।
আঠেরো বছর বয়সটা যেন শুঁয়োপোকার খোলস ছেড়ে প্রজাপতি হয়ে ওঠার আগের পর্যায়, প্রজাপতির রূপ তখনও ঠিকমতো পরিস্ফুট হয় না, অথচ শুঁয়োপোকাতে আটকে থাকতেও মন চায় না!
শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিল উজ্জয়িনী, মুখোমুখি চিনতে পারবে তো! জামার রং থেকে শুরু করে আরও বিবরণ যদিও দেওয়া আছে, তবু।
আর চিনতে পারলেও যদি ফোনের গলার আওয়াজের মতো উজ্জয়িনীকে ভালো না লাগে? যদি মোহ কেটে যায় এক লহমাতেই? কী করবে ও তাহলে? নিজের বুকের ধড়াস ধড়াস শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছিল বেশ।
কাঁধে কার একটা হাত পড়তেই ও চমকে পেছনে তাকাল, আর ওপাশের পুরুষকণ্ঠ খুব নরম অথচ গাঢ়ভাবে বলে উঠল, ‘উজ্জয়িনী! একটু দেরি হয়ে গেল। এত জ্যাম!’
ও আর সোজাসুজি তাকাতে পারল না, হালকা বাদামী রঙের শার্ট আর সমুদ্রনীল জিনস কি না সেটা ভেরিফাই করারও আর প্রয়োজন নেই ওর, ওই গলা ও ঘুমন্ত অবস্থাতেও বুঝি চিনতে পারবে! বরং কোথা থেকে ওর স্বভাব-বহির্ভূত একরাশ লজ্জা এসে গ্রাস করছিল ওকে।
খানিক আড়ষ্টভাবে ও বলল, ‘না, দেরি কোথায়! ঠিক আছে।’
১৫
রুদ্র ইচ্ছে করেই স্টেশনে ঢোকেনি, আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনটায় এমনিই এর আগে খুব বেশি আসেনি ও। অমিতের হাতে আসার সময় চাবিটা দিয়ে এসেছে, আপাতত অফিশিয়াল ডিউটি থেকে ওর ছুটি। কিন্তু ওর ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল। ভেতরে ভেতরে ওর মনটা বৈপরীত্যে মোড়া দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেছে এখন। একদিকে বাবা-মা-র সঙ্গে এতদিন পর দেখা হওয়ার আনন্দ, অন্যদিকে নাহুম খানের বলা কথাগুলো, অফিসের টেনশন। ভদ্রলোক ঠিকই অনুমান করেছিলেন, পুরোনো মর্টগেজ থাকা দলিলের ফটোকপিতে যে বাড়ি তৈরির জন্য লোন নেওয়া হয়েছিল, সেটার ঠিকানা পাওয়া গেছে। নাহুম খান আর ওই পাঞ্জাবি অফিসার সেখানেই যাওয়ার আগে ওকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন ওই খুনের জায়গায়।
ওদিকে একদিন কেটে গেল, অফিসের চিঠির কোনো উত্তরও লেখা হল না।
ওর হঠাৎ মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। ভালোভাবে জীবন কাটানোর জন্য চাকরি করা, কিন্তু সেই চাকরিই যখন জীবনের কাছের মানুষগুলোর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, আর তারপর সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে কোনো দোষে অভিযুক্ত করে মানসিক স্থায়িত্বটাকে তছনছ করে দেয়, তার চেয়ে দুঃখের আর কিছুই হতে পারে না।
তাও বাবা-মা ওর কাছে আসছেন, হঠাৎ কোনো প্রয়োজন হলে ও নিজেও কলকাতা যেতে পারবে, কিন্তু প্রিয়ম?
ফোনটা বের করে আবার কিছুক্ষণ চেষ্টা করল, কিন্তু প্রিয়মের ফোন সেই নট রিচেবল। রাগে ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হল ওর। মেসেজের পর মেসেজ করে যাচ্ছে সকাল থেকে, একটাও ডেলিভার্ড হচ্ছে না।
চোখটা হঠাৎ ছলছল করে উঠল রুদ্রর। কতদিন হয়ে গেল প্রিয়মকে দেখেনি! বিয়ের পরে তো বটেই বিয়ের আগেও কখনো এতদিন দু-জন দু-জনকে ছেড়ে থাকেনি। আগে অফিসে সামান্য কোনো সমস্যায় পড়লেই প্রিয়মকে না বলা পর্যন্ত ওর পেটের ভাত যেন হজম হত না, আর এখন এত বড়ো বিপদেও প্রিয়ম টেনশন করবে ভেবে ও কিছুই বলে উঠতে পারেনি।
ইউরোপ থেকে ছুটি কাটিয়ে ফিরে ওর যখন হঠাৎ আগ্রায় ট্রান্সফার অর্ডার এল, কিচ্ছু ভালো লাগত না। একদম প্রথমদিককার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল ওর। প্রথম কিছুদিনের জন্য ব্যাঙ্কের গেস্টহাউসে উঠেছিল। অফিসের সময়টুকু বাদে বাকি সময়টা একটা ভালো ফ্ল্যাট খুঁজতে হত। তারপর সন্ধের পর দালালদের সঙ্গে সেইসব আস্তানা দেখতে যেতে হত। একটা রান্নার লোক ঠিক করা, গ্যাসের লাইন, জলের লাইন, সবজির বাজারে গিয়ে দেখে দেখে বাজার করা, এইসব হাজারো ঝামেলা নিয়ে একা জীবন শুরু করতে করতে অসহ্য লাগত ওর!
কতবার একা ঘরে রাগের বশে ওর পুরোনো অভ্যেসমতো জলের গ্লাস ছুড়ে ফেলেছে মাটিতে, রাতের বেলা অফিস থেকে ফিরে সকালে রাঁধুনির করে যাওয়া ঠান্ডা খাবার উলটে দিয়েছে টেবিলে। কিন্তু কাকে রাগ দেখাবে এখানে? কে আছে ওর মাথা ঠান্ডা করার জন্য, মান ভাঙানোর জন্য? রাগ করে না খেয়ে ঘুমিয়েছে, জল ভরতি মেঝে থই থই করেছে সারাদিন, পড়ে থাকা খাবারে মাছি ভনভন করেছে। তারপর একসময় বাধ্য হয়ে নিজেই পরিষ্কার করেছে।
মাঝে মাঝে মনে হত একছুটে সব ছেড়েছুড়ে চলে যায়। এসব কোনোদিনও ও করেছে? ওদের কলকাতার ফ্ল্যাটের যাবতীয় দেখভাল প্রিয়মই করত, কাজের লোকদের চালনা থেকে শুরু করে রুদ্রকে সামলানোও। আর এখন? তার চেয়েও বড়ো কথা, আর ক-টা দিনই বাঁচবে? এই সেদিনই একটা আর্টিকলে পড়ছিল পৃথিবীর মানুষের গড় আয়ু এখন একাত্তর বছর। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বড়োজোর আর চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর বাঁচবে ও। আগে জীবনের অতগুলো বছর কাটল বাবাকে ছাড়া, আর এখন সব পেয়েও আবার ও একা।
তবে একদিক থেকে দেখতে গেলে এই নির্বাসিত জীবন রুদ্রকে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত অনেক কিছু শেখাচ্ছে। আগের থেকে এখন অনেক ম্যাচিয়োর্ড হয়েছে ও। আগে যেমন তুচ্ছ কারণে অকারণে প্রিয়মের সঙ্গে ঝগড়া করত ও, এখন রুদ্র সারাক্ষণ অনুভব করে, জীবনে যে ক-টা দিন ভালোভাবে সুস্থভাবে একসঙ্গে থাকা যায়, সেটা কখনো নষ্ট করতে নেই। এই যে এখন রুদ্র আর প্রিয়মের মধ্যে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময়ের ব্যবধান, রুদ্র যখন রাতে আটটার সময় অফিস থেকে ফেরে, তখন প্রিয়মের ওখানে সবে দুপুর আড়াইটে। প্রিয়ম ব্যস্ত গলায় কিছুক্ষণ কথা বলেই রেখে দেয়, অফিসের কাজের মাঝে। ওদিকে রুদ্ররও তখন অবসন্ন দেহে মনে হয় একটু বিশ্রাম নিয়ে নেয়।
দু-জনের একটু সময় করে কথা বলার জন্য এখন কত প্ল্যান করতে হয়। অথচ আগে যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন সে-সুযোগ পাওয়া যেত, তখন কত সামান্য কারণে ঝগড়া, তর্কবিতর্ক করে হেলায় সময়গুলো হেলায় নষ্ট করেছে রুদ্র।
তাই এখন ও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে, আবার যখন ওরা দু-জনেই কলকাতার বাড়িতে ফিরবে, আবার যখন ওদের ছোট্ট সুন্দর ফ্ল্যাটটায় ওরা একসঙ্গে থাকবে, কখনো শুধু শুধু আর ঝগড়া করবে না।
হেলান দিয়ে এসব ভাবতে ভাবতে কোথায় চলে গিয়েছিল রুদ্র, হুঁশ ফিরল ফোনের আওয়াজে, স্ক্রিনে বাবার ছবি দেখে তড়িঘড়ি রিসিভ করল ও, এরা এত দেরি কেন করছে, কখন তো বলল নেমে গেছে!
সুরঞ্জনের সহাস্য কণ্ঠস্বর শোনা গেল ওপাশে, ‘কী রে, কোথায় তুই?’
রুদ্র ফোন কানে একটু এগিয়ে গেল স্টেশনের গেটের দিকে, ‘আমি তো গেটের বাইরেই। তোমরা কোথায় বলো তো? কখন ট্রেন ঢুকে গেছে, আর তোমরা এখনও বেরোতে পারলে না?’
রুদ্রর পাশ থেকে সুরঞ্জন বলে উঠলেন, ‘কী করব বল, মেয়ে এক বছর বাইরে থেকে যদি নিজের বাপ-মাকে চিনতে না পারে, পাশ দিয়ে হেঁটে হনহন করে এগিয়ে যায়, তবে আর বেরিয়ে লাভ কী! ভাবছি ফিরতি ট্রেন ধরে কলকাতা ফিরে যাই!’
সুরঞ্জনের ছদ্ম দুঃখের গলা শুনে রুদ্র চমকে বাঁ-দিকে তাকিয়ে দেখল, সুরঞ্জন আর পূরবী কখন এদিকে চলে এসেছেন ও খেয়ালই করেনি।
আনন্দে ওর বুকটা নেচে উঠল, খুশিতে চিকচিক করে উঠল চোখ, এগিয়ে গিয়ে ও জড়িয়ে ধরল বাবাকে।
অনেক দিন বাদে সন্তানকে দেখলে সব বাবামায়েরই মন স্নেহে দ্রবীভূত হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও তাই হল। সুরঞ্জন মেয়েকে ভালো করে দেখলেন, পূরবী বলতে থাকলেন ‘ল্যাপটপে ঠিকই দেখেছিলাম, রোগা হয়ে গেছিস অনেক। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছিস না!’
রুদ্র অল্প হেসে সামনের একটা ট্যাক্সি ডাকল, ওদের লাগেজগুলো গাড়ির পেছনের ডিকিতে তুলতে তুলতে বলল, ‘সে তো হবই! রান্নার যা ছিরি! তুমি এসে গেছ, এবার ক-দিন একটু ভালমন্দ খেতে পাব! চলো ওঠো।’
পূরবী বললেন, ‘অফিস ছুটি নিয়েছিস তো?’
রুদ্র কিছু বলতে গিয়েও বলল না। যদিও ও ঠিক করেছে পুরো ব্যাপারটা বাবা মাকে খুলে বলবে। দু-জনেই সরকারি চাকরি করতেন, এই ধরনের চিঠির উত্তর কীভাবে দেওয়া উচিত, সে-ব্যাপারে ভালো গাইড করতে পারবেন, তবু এখনই ও খোলসা করল না কিছু।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে মল রোড দিয়ে সোজা এগিয়ে গাড়ি মহাত্মা গান্ধী রোডে পড়তেই সুরঞ্জনের মনটা স্মৃতিমেদুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। স্নাতকোত্তর সময়ে তো বটেই, পরেও আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় কাজের সূত্রে কতবার এসেছেন এই ঐতিহাসিক শহরে! কাজের সূত্রে এলে এই জায়গাতেই একটা হোটেলে উঠতেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে আসা সহযাত্রীদের কথা মনে করতে করতে সুরঞ্জন যেন তাঁর কর্মব্যস্ত জীবনে ফিরে যাচ্ছিলেন। মুখের মধ্যে অজান্তেই নানারকম হাসি খেলা করছিল।
রুদ্র সামনে বসলেও মা-মেয়ের কথা চলছিল নিরন্তর। পূরবী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইছিলেন কী খেয়ে অফিস বেরোয় রুদ্র, রান্নার লোকটা কেমন, দরজা ঠিকমতো বন্ধ করে শোয় কি না রাতে এইসব। এসব প্রশ্ন এর আগে ফোনে অন্তত দু-শোবার করা হয়ে গেছে, তবু আরও একবার একই উত্তর শুনে পূরবী শান্তি পান, কোনো বিচ্যুতি শুনলে একইরকম উষ্মা প্রকাশ করেন। এরই ফাঁকে বেশ রসিয়ে রসিয়ে ট্রেনে দেখা হওয়া সুরঞ্জনের পুরোনো বন্ধুর কীর্তিকলাপ বলতেও ভুললেন না।
তার মধ্যেই পূরবী সুরঞ্জনের মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হল তোমার, নিজের মনেই হাসছ কেন?’
সুরঞ্জন এবার সত্যিই হেসে ফেললেন, ‘বড্ড নস্টালজিক হয়ে পড়ছি। কত বার তো আসিনি আগে আগ্রায়! সেই দিল্লিতে পড়ার সময় থেকে। কত কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে।’
রুদ্র এবার একটু হাসল, ‘লোকে গোয়ায় গেলে শুনেছি এইসব হয় আর তুমি কিনা এই ঘিঞ্জি শহরে এসে নস্টালজিক হয়ে পড়ছ! কেসটা কী বাবা? যতদূর জানি মায়ের সঙ্গে তোমার রিলেশন তো তোমার জে এন ইউ-তে যাওয়ার আগে থেকেই ছিল? তবে?’ তারপর পেছনে ফিরে মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল, ‘কী বুঝছ মা?’
পূরবী হাত নেড়ে কপট রাগের ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি আর কী বুঝব বল! তখন তো আর তোদের মতো হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক এসব ছিল না যে সারাক্ষণ খোঁজ রাখতে পারব কোথায় যাচ্ছে, কী করছে। আমি সরলমনে বিশ্বাস করতাম।’
সুরঞ্জন রসিকতাটা ধরতে না পেরে একটু বিব্রত হয়ে বললেন, ‘ধুৎ! আমি কি ওইসব মিন করেছি নাকি! তোরাও পারিস বটে।’ তারপর একটু থেমে যোগ করলেন, ‘ওই যে ট্রেনে দেখা হল, আমার ওই বন্ধুর সঙ্গেই প্রথমবার এসেছিলাম। তারপরও অনেকবার এসেছি। সেসবই মনে পড়ছে আর কি!’
রুদ্র এবার একটু কৌতূহলী হয়ে বলল, ‘তোমার তো প্রথম থেকেই স্পেশালাইজেশন ছিল বৌদ্ধ কালচারের ওপরে। আগ্রা কেন আসতে হত তোমায়? এটা তো মুঘল আর্কিটেকচারের শহর!’
সুরঞ্জন বললেন, ‘মাস্টার্স করার সময় শুধু স্পেশালাইজেশন নয়, অন্য সাবজেক্টগুলোও থাকে। আর অফিসেও অনেকরকম ফিল্ডের কাজ থাকত।’ তারপর সোজা হয়ে বসে ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘এটা তোকে কে বলল যে আগ্রা শুধু মুঘল শহর? এটা খুব ভুল কথা। আগ্রা শহরের নাম মহাভারতেও মেনশন করা আছে এটা জানিস কি?’
রুদ্র এবার বেশ অবাক হয়ে বলল, ‘মহাভারতে? আমি তো জানতাম ওই ইব্রাহিম লোদি প্রথম দিল্লি থেকে আগ্রায় রাজধানী ট্রান্সফার করে আগ্রা শহর তৈরি করেছিল, সেটা তো সুলতানেট পিরিয়ড, মানে মুঘলদের ঠিক আগেই।’
সুরঞ্জন মেয়ের এমন অজ্ঞতায় বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ছোটো থেকে এত ইতিহাস বই পড়তিস, আর কী সব বলছিস! দিল্লি থেকে আগ্রায় রাজধানী নিয়ে এসেছিল সিকন্দর লোদি, ইব্রাহিম লোদির বাবা। আর সে তো অনেক পরের ব্যাপার!’ গাড়ির বাইরে দিয়ে হুস করে বেরিয়ে যাওয়া একটা ভাঙাচোরা স্থাপত্য দেখতে দেখতে সুরঞ্জন বললেন, ‘মহাভারতে আগ্রার নাম লেখা আছে অগ্রেবন, যার মানে হল অরণ্যের সীমারেখা। আর লোদির যে ব্যাপারটা বলছিস, ও তো শুধুমাত্র ওর ক্যাপিটাল দিল্লি থেকে এখানে ট্রান্সফার করেছিল, সেটা সম্ভবত ১৫০৬ সাল হবে। তারও প্রায় ত্রিশ বছর আগে এই শহর তৈরি করেছিলেন বাদল সিং নামে এক হিন্দু রাজা। তাঁর তৈরি বাদলফোর্ট তো এখনও আছে, একদিন নিয়ে যাব তোকে। লোদি সেই রাজার কাছ থেকে এই শহরটা দখল করে।’
রুদ্র বলল, ‘ওহ! আর তারপর সুলতানেট পিরিয়ড শেষ হবার পর মুঘল সাম্রাজ্য শুরু হতেই এটা ওদেরও ক্যাপিটাল হয়ে গেল, তাই তো!’
সুরঞ্জন অঘোরেশের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর মুঘল ইতিহাসে যেন আরও ডুবেছিলেন, মাথা নেড়ে বললেন, ‘সব মুঘল সম্রাটের আমলে নয়। সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গির আর শাজাহান এটাকে রাজধানী রেখেছিলেন। তখন এই শহরের নাম ছিল আকবরাবাদ। মাঝে শাজাহান তাঁর শাসনকালের শেষের দিকে রাজধানী দিল্লিতে শাহজাহানাবাদে ট্রান্সফার করলেও পরে ঔরঙ্গজেব আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসেন এখানেই। পরে অবশ্য ঔরঙ্গজেবই আবার সাউথের ঔরঙ্গাবাদে সরিয়ে নিয়ে যান রাজধানী।’
‘হ্যাঁ রে, প্রিয়মের সঙ্গে কথা হয়েছে আজ?’ পূরবী মাঝে বলে উঠলেন।
‘না, সকাল থেকে ফোনে ওকে পাচ্ছি না কেন জানি না!’ রুদ্র আরও একবার চেষ্টা করতে উদ্যত হল।
মা যে একটু বিরক্ত হচ্ছেন তা পেছনে না তাকিয়েও রুদ্র বিলক্ষণ বুঝতে পারছিল। এতদিন বাদে দেখা হয়ে ইতিহাসের কথা শুনতে প্রথমে রুদ্র ভেবেছিল ওর নিজেরও ভালো লাগবে না, কিন্তু শুনতে শুনতে ও যেন ওর ছোটোবেলায় ফিরে যাচ্ছিল, যখন বাবা ওকে দেশ-বিদেশের ইতিহাস, কতরকম রুদ্ধশ্বাস ঘটনা গল্পের মতো করে শোনাতেন। এক মুহূর্তের জন্য ও যেন নিজের জীবনের এই তীব্র সংকটটা ভুলে গেল।
মনটা হঠাৎ করে ওর দারুণ ভালো হয়ে উঠল।
ধুর, যা হবে দেখা যাবে, আপাতত এই সান্নিধ্যটা ও প্রাণপণে উপভোগ করুক! আর দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই ও প্রিয়মের অফিসে ফোন করবে।
ও বলল, ‘জানো বাবা, তাজমহল নিয়ে এখানে এখন বেশ গণ্ডগোল চলছে।’
সুরঞ্জন হালকাভাবে বললেন, ‘এ আর নতুন কী! তাজমহল নিয়ে বিতর্ক, ঝামেলা, এসব তো বরাবরই চলছে। জানিস লর্ড বেন্টিঙ্ক যখন ভারতের বড়োলাট ছিলেন তখন তাজমহলকে নিলামে চড়িয়েছিলেন? পুরো তাজমহলকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে পাথরগুলো বেচে ইংরেজ সরকারের আয় বাড়াতে চেয়েছিলেন তিনি। প্রায় করেই ফেলেছিলেন, একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছিল সেদিন।’
‘অ্যাঁ? তাজমহল ভেঙে পাথর বিক্রি?’ রুদ্র অবাক, ‘কোন বেন্টিঙ্ক? যিনি সতীদাহ প্রথা বন্ধ করেছিলেন?’
‘ইয়েস!’ সুরঞ্জন মিটিমিটি হাসলেন, ‘বেন্টিঙ্ক সমাজসংস্কারমূলক কাজ অনেক করেছিলেন বলে আমাদের কাছে খুব ভালো, কিন্তু ওই একটা মানুষের জন্যই শুধু তাজমহল নয়, তখনকার সবকটা ঐতিহাসিক স্থাপত্য ধ্বংস হতে বসেছিল।’
ছোটোবেলায় রুদ্রকে এভাবেই বাবা গল্পচ্ছলে ইতিহাসের অজানা কাহিনিগুলো শোনাতেন, রুদ্র বলল, ‘বলো বলো, পুরো ঘটনাটা শুনি একটু।’
সুরঞ্জন বললেন, ‘তখন উচ্চবিত্ত ব্রিটিশ পরিবারের লোকেরা ভারতে ঘুরতে আসত। তারা দিল্লি, আগ্রায় অজস্র মুঘল স্থাপত্য দেখত, আর নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার সময় স্মৃতিচিহ্ন বাবদ এগুলোর দামি পাথর খুঁড়ে সঙ্গে নিয়ে যেত। ফতেপুর সিক্রিতে গেলে দেখবি, শিসমহলের ভেতরের পুরোটাই খোবলানো, সব পাথর নিয়ে গিয়েছিল ইংরেজরা। তাজমহলে অনেক ধরনের মূল্যবান পাথর লাগানো ছিল। রাজস্থানের মাকরানা থেকে আনা বিখ্যাত সাদা মার্বল, পাঞ্জাবের জাস্পার পাথর, চীন থেকে আনা জেড আর ক্রিস্টাল পাথর, তিব্বতের নীলকান্তমণি, আফগানিস্তানের লাপিস লাজুলি, আরবের কার্নেলিয়ান পাথর, আরও কতরকম পাথর যে ব্যবহার করা হয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। ওইসময়ে রাজকোষের খুব শোচনীয় অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। তাই বেন্টিঙ্ক ভাবলেন তাজমহলকে ভেঙে ওইসব পাথরগুলো তিনি বিক্রি করে রাজকোষ ভরতি করে তুলবেন। তার আগে অবশ্য একবার অলরেডি তাজমহলকে মথুরার লক্ষ্মীচাঁদ নামে এক শেঠকে বিক্রি করা হয়ে গিয়েছিল, তাও মাত্র দেড়লক্ষ টাকায়। কিন্তু লক্ষ্মীচাঁদ যখন তাজমহল দখল করতে এলেন, স্থানীয় লোকেদের প্রচণ্ড বিক্ষোভে আর ভেতরে ঢুকতে পারেননি।
‘বেন্টিঙ্ক তাই ওসব রিস্কই নিলেন না। সব আটঘাট বেঁধে তিনি কলকাতার একটা কাগজে বড়ো করে তাজমহল বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে দিলেন। অনেক লোক সেই নিলামে বিড করল, যখন নিলাম একদম শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, তখন হঠাৎ জাহাজে করে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে জরুরি অর্ডার এল নিলাম বন্ধ করার জন্য। শোনা যায় ব্রিটিশ আর্মিরই কোনো সৈন্য বেন্টিঙ্কের ওই কাণ্ডকারখানার কথা বিলেতে রিপোর্ট করে দিয়েছিল। কে সেই সৈন্য তা জানা যায়নি, তবে সে ওই কাজটা না করলে,’ সুরঞ্জন থামলেন, ‘তাজমহল আজ আর কেউ দেখতে পেত না।’
‘কী সাংঘাতিক!’ রুদ্র মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল, ‘জানতামই না এটা!’
‘আর শুধু বেন্টিঙ্ককেই-বা দোষ দেব কেন।’ সুরঞ্জন বললেন, ‘লর্ড হেস্টিংসও অনেক দামি পাথর খুলে নিয়ে গিয়েছিলেন তাজমহল থেকে। লর্ড কার্জনও অনেক পাথরকে নিলামে চড়িয়েছিলেন। সেই নিলামের কপি আজও আমাদের আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার হেড অফিসে রাখা আছে।’
গল্পে গল্পে প্রায় মিনিট দশেক পরে ওঁদের গাড়িটা যখন রুদ্রর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে পৌঁছোল, তখন বেশ চড়া রোদ উঠে গেছে, ঘড়ির কাঁটা যদিও এগারোটা ছোঁয়নি এখনও।
এতদিন হয়ে গেল রুদ্র এখানে এসেছে, তবু, এখানকার জলবায়ুর সঙ্গে ও পুরোপুরি মিশ খাওয়াতে পারেনি, অফিস যাওয়ার সময় প্রায়ই তাড়াহুড়োতে মুখ-চোখ-গলা স্কার্ফে জড়িয়ে বেরোতে ভুলে যায়, আর কিছুক্ষণ স্কুটি চালানোর পরেই ওর যেন মনে হয় মুখ, গলা, হাতের অনাবৃত অংশগুলো পুরো জ্বলছে লু-র মতো এক গনগনে হাওয়ায়। শীতকালেও প্রায় একই অবস্থা।
কমপ্লেক্সের আশপাশ দেখে সুরঞ্জন আর পূরবী, দু-জনেরই বেশ পছন্দ হল। বেশ বড়ো এরিয়া নিয়ে তৈরি, ভেতরে মন্দির, কমিউনিটি হল থেকে শুরু করে একটা জিমও রয়েছে। বর্গক্ষেত্রের চার কোণের মতো চারটে কোনায় আকাশছোঁয়া চারটে ফ্ল্যাট, প্রতিটাই বারোতলা করে, মাঝের জায়গাটায় বাচ্চাদের ছোটো একটা খেলার মাঠ।
তবে রুদ্রর অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে বাইরের আর ভেতরের মধ্যে কোনো মিল পাওয়া গেল না। চারদিক ছত্রাকার, অগোছালো, গোটা ফ্ল্যাটটার যেখানে সেখানে জামাকাপড়ের স্তূপ।
দেখেশুনে পূরবী সেই আগের ডায়ালগ শুরু করলেন, ‘ভাবলাম একা থাকতে শুরু করেছিস, একটু অন্তত নিজেরটা করতে শিখবি, একইরকম রয়েছিস? কী করে পারিস এরকম নোংরার মধ্যে থাকতে?’
রুদ্র মায়ের গজগজানিকে বিশেষ পাত্তা দিল না, একটু অস্থিরভাবে বলল, ‘তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও তো, আমি কফি বানাচ্ছি, রতন ভাই এক্ষুনি এসে পড়বে, ও আলুর পরোটাটা হেব্বি বানায়!’
পূরবী আর কিছু না বলে বিরক্তির একটা ভঙ্গি করলেন। তিনি নিজেও সারাজীবন কলেজে পড়িয়েছেন, সঙ্গে সংসারও করেছেন, ঘরের রান্না বাইরের লোককে দিয়ে করানো তাঁর ঘোরতর অপছন্দ। অন্য কিছুর জন্য নয়, ওদের হাতে তেলমশলার কোনো ঠিক থাকে না। দিনের পর দিন ওই তেল ঝাল মশলা খেলে পেটের আর কিছু থাকবে না। পরিচ্ছন্নতাও একটা ফ্যাক্টর। রুদ্রকে তিনি প্রথমেই বলেছিলেন তেমন হলে মশলা বাটা, কুটনো কুটে দেওয়ার জন্য লোক রাখুক, কিন্তু রান্নাটা অন্তত নিজেই করুক, তাতে শরীরটা ভালো থাকবে। প্রিয়মের মা-ও সেটাই বলেছিলেন। এই তো প্রিয়ম কী সুন্দর নিজে রান্না করে খায়।
কিন্তু রুদ্র শোনে তো নি-ই, উলটে একটা ছেলেকে রেখেছে। একা থাকে, তার মধ্যে একটা ছেলেকে রান্নার জন্য রাখার কোনো মানে হয়? কিন্তু রুদ্র পাত্তাই দেয়নি, ঠোঁট উলটে জানিয়েছিল ছেলেটা খুব ভালো, আর এতই প্যাংলা, ফুঁ দিলে উড়ে যাবে। আর এখানে নাকি রান্নার লোক তেমন পাওয়া যায় না, একে অনেক কষ্টে পেয়েছে।
পূরবী মনে মনে ঠিক করলেন, যে ক-টা দিন এখানে আছেন, ওই রতনবেটাকে রান্নার খুন্তিও ধরতে দেবেন না, বড়োজোর সবজিগুলো কেটেকুটে দিতে বলবেন। আর কম তেল মশলা দিয়ে ভালো করে রান্নাটাও শিখিয়ে দিয়ে যাবেন। সুরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ফোন নিয়ে কী করছেন সুরঞ্জন। পূরবী বললেন, ‘কী করছ? তোমার জামা বের করে দিচ্ছি, গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নাও।’
সুরঞ্জন অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘হুঁ, যাচ্ছি। অঘোরেশ বার বার ফোন করছে জানো, কিন্তু ধরার আগেই কেটে দিচ্ছে। প্রায় পাঁচ-ছ-বার করল। আর এখন আমি রিং ব্যাক করছি, ধরছে না।’
পূরবী এবার বেশ রেগে গেলেন, ‘কোথায় এতদিন বাদে মেয়ের কাছে এলে, ফ্ল্যাটটা ঘুরে ঘুরে দেখবে, গল্প করবে, তা নয়, সেই পাগলাটে লোকটাকে নিয়ে পড়ে আছ?’
সুরঞ্জন বললেন, ‘আরে তা নয়, কোনো দরকারও তো হতে পারে। দেখলে না, যাওয়ার আগে বলে গেল আমাকে খুব ইম্পর্ট্যান্ট কী বলার আছে ওর?’
রুদ্র কফি নিয়ে আসতে পূরবী কাপে কফি ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘থামো তো! তোমার সঙ্গে এতকাল কোনো যোগাযোগই ছিল না, আর এখন এত জরুরি দরকার হয়ে গেল? যতসব ছিটগ্রস্ত কার্যকলাপ। আচ্ছা, তোমাদের লাইনের কি কোনো লোকই পুরোপুরি সুস্থ নয়? মানে ইতিহাস নিয়ে থাকতে থাকতে তারা সবাই অপ্রকৃতিস্থ টাইপ হয়ে গেছে?’
সুরঞ্জন এবার বেশ বিব্রতভাবে তাকালেন, একটু সন্দিগ্ধ গলায় বললেন, ‘মানে? সবাই মানে তুমি কাকে মিন করছ?’
পূরবী মোটেই দমলেন না, ‘তুমি নিজেই সেদিন বললে একই গাইডের আন্ডারে তোমার সঙ্গে পিএইচ ডি করেছিল একটা মেয়ে, পাগল হয়ে গেছে। তোমার ওই স্কটিশের স্যারেরও শেষের দিকে একটু মাথার গণ্ডগোল দেখা দিয়েছিল, আর তোমার এই বন্ধুটির তো তুলনাই নেই!’ পূরবী কফির মাগ হাতে রুদ্রর দিকে ঘুরলেন, ‘এমন জোরে জোরে গান গাইছে যে হেসে মরি, জানিস! আর দাড়ির মধ্যে উকুন ঘুরছে! ইস!’
সুরঞ্জন এবার প্রতিবাদ করলেন, ‘যাহ! নোংরা ছিল মানছি, কিন্তু দাড়িতে উকুন ছিল না মোটেও!’
পূরবী চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘আলবাত ছিল। আমি তো ওর একদম উলটোদিকে বসেছিলাম, আমি স্পষ্ট দেখেছি। তুমি পাশে বসে কী করে দেখবে। বরং আমি শিয়োর, তোমার মাথায় ওর থেকে উকুন চলে এসেছে গোটাকতক। যেরকম জাপটে ধরেছিল তোমায়!’
সুরঞ্জন এবার বেশ ঘাবড়ে গেলেন, তিনি পরিষ্কার পরিপাটি মানুষ, মাথায় উকুন রয়েছে, এটা কল্পনা করতেই তাঁর গা ঘিনঘিন করে উঠল। রুদ্রর দিকে অসহায়ভাবে চাইলেন তিনি, ‘কী হবে রে? উকুন সত্যিই চলে এসেছে? যে ক-টা চুল আছে সে-কটাও তো উঠে যাবে তাহলে! তার ওপর চুলকোবে, ডিম পাড়বে, বাচ্চা হবে, সে তো একেবারে বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড! উকুন কী করে তাড়াতে হয়, বল না!’
রুদ্রর খুব মজা লাগছিল, তার মধ্যেও ও খেয়াল করল, ভুটানের সেই নির্বাসন থেকে বাবা ফিরে আসার পর মা আর আগের মতো গম্ভীর নেই, অনেক প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠেছেন। কথায় কথায় মজা করেন, বাবার পেছনে লাগেন। অন্তত এই মাকে বাবা ফিরে আসার আগে পর্যন্ত ও চিনত না। মা ছিলেন একটু রাশভারী প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু এখন যেন ঠিক তার বিপরীত!
জীবনের ওই ক-টা অভিশপ্ত বছরের একা কাটানো সময়গুলো সুদে-আসলে পূরবী এখন পুষিয়ে নিতে চান হয়তো!
চোখটা ফেরাতেই ও জানলা দিয়ে বাইরের ল্যাম্পপোস্টে সকালের সেই পোস্টারগুলো একদম কাছ থেকে দেখতে পেয়ে গেল। হলদেটে হ্যান্ডবিল কাগজের ওপর ধ্যাবড়া কালো কালিতে ছাপা কয়েকটা অদ্ভুত বাক্য। এগিয়ে গিয়ে জুম করে মোবাইলে ছবিটা তুলে নিয়েই রুদ্র দেখল, বাবা তখনও ওর দিকে কাতর দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন।
ও অভয় দিল, ‘তুমি চিন্তা কোরো না, বাবা। আমি দেখে নেব। মা যেরকম ঘন দাড়ির জঙ্গল বলল, মনে হয় না ওরা ওইটুকু সময়ের মধ্যে সেই অরণ্য ভেদ করে অতটা পথ উড়ে তোমার চুল পর্যন্ত পৌঁছোতে পেরেছে। তবু যদি এক আধটা কলম্বাস উকুন থেকে থাকে, চাপ নিয়ো না, আমি ওষুধ কিনে আনছি, ভালো করে লাগিয়ে দেব মাথায়।’ তারপর ও হঠাৎ বলে উঠল, ‘আচ্ছা বাবা, তুমি ড নিজামুদ্দিন বেগ বলে কাউকে চেনো?’
সুরঞ্জন একটু ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘ঠিক মনে করতে পারছি না। কে বল তো?’
রুদ্র বলল, ‘আগ্রার এক কলেজের প্রফেসর। এক মাস ধরে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ওঁকে, এখানকার সব কাগজেই বেরিয়েছিল খবরটা। একা লোক, প্রথমে কেউ বুঝতেও পারেনি, তাই ভাবলাম, তুমি চেনো কি না!’
সুরঞ্জন একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? ভদ্রলোক সুস্থ তো?’
পূরবী মুখ টিপে চোখের ইশারা করলেন রুদ্রর দিকে চেয়ে, ভাবখানা এমন, দেখ আমি বলেছিলাম ইতিহাসের লোক মানেই পাগল টাইপ!
সুরঞ্জন সেটা ধরতে পেরে সঙ্গেসঙ্গে বললেন, ‘না না, আমি বলতে চাইছি, ভদ্রলোকের শরীর-টরীর ঠিক ছিল তো? বয়সের ভারে কোথাও পড়ে গিয়ে চোট-টোট লাগে যদি!’
রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘অসুস্থ বলে তো তেমন কিছু লেখেনি। আর বয়সও খুব বেশি নয়, পঞ্চান্ন না কত। সম্প্রতি কিছু বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন, তারপরই এই ব্যাপার। কী যে সব দিনকাল পড়েছে! তোমাকে পরে সব ডিটেইলে বলছি।’
এরপর রুদ্রর রান্নার ছেলেটা এসে পড়তে আড্ডা ভেঙে গেল। পূরবী ফ্রেশ হয়ে নিয়ে ছেলেটার সঙ্গে রান্নাঘরে গিয়ে লেগে পড়লেন তদারকিতে। রুদ্র যতই ওর রান্নার দরজা সার্টিফিকেট দিক, পূরবী ভালো করে হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে খুঁটিনাটি শেখাতে লাগলেন তাকে।
সুরঞ্জন আরও দু-একবার চেষ্টা করলেন অঘোরেশের ফোনে, কিন্তু পেলেন না।
১৬
বেলফাস্ট থেকে লন্ডন, লন্ডন থেকে দিল্লির ফ্লাইট। কস্তুরীকে নিয়ে নাগেশ বিজনেশ ক্লাসে বসেছিলেন। খাতায় কলমে কস্তুরী ওঁর এই টুরের সেক্রেটারি হলেও মূলত সঙ্গদান ছাড়া কিছুই তেমন ও করেনি। এখন নাগেশ মুখে মুখে ডিকটেশন দিচ্ছিলেন, সেটাই ও ল্যাপটপে টাইপ করছিল। প্লেন এখনও ছাড়েনি।
চিঠি ড্রাফট শেষ হলে কস্তুরী উচ্ছলভাবে বাইরে তাকিয়েই দূরের প্লেনগুলোর ওঠানামা দেখতে পেল। ওর অভিমান অনেকক্ষণ আগে কেটে গেছে। আসলে ওর মনটা অনেকটা আকাশের মতো, এই মেঘ, পরক্ষণেই বৃষ্টি।
নাগেশ কস্তুরীর উচ্ছল তাকিয়ে থাকা দেখছিলেন। ওর এই ছেলেমানুষি স্বভাবের জন্যই নাগেশের একঘেয়েমি আসে না।
এই যদি সুজাতা হত! সামান্য মনোমালিন্য নিয়ে অনায়াসে কুড়িদিন কাটিয়ে দিত, মনে মনে ভাবলেন নাগেশ। অভিমানেরও একটা সীমা থাকে, সেই সীমারেখা পার করলে আর ভালো লাগে না, তখন সেটা শুধুই বিরক্তি উৎপাদন করে।
কস্তুরী নাগেশের মনের কথা বুঝতে পারল কি না কে জানে, জানলার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকাল, ‘আপনি কিন্তু আমাকে এখনও বললেন না!’
‘কী বলব আবার?’ নাগেশ ভ্রূ কুঁচকোলেন। যতই স্বাভাবিক থাকুন, ভেতরে ভেতরে তিনি আসলে অস্থির হয়ে পড়ছেন। মেয়েটা কতদিন পর বাড়িতে আসছে, দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।
আলগোছে ঘড়ি দেখলেন একবার, এতক্ষণে দিল্লিতে নেমে যাওয়ার কথা। দীনেশকে বলা আছে গাড়ি নিয়ে গিয়ে ওকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসতে। আগামীকালের পার্টির ব্যাপারে আয়োজন তো করাই আছে। ভাবলে অদ্ভুত লাগে, এই সেদিন নার্সিং হোম থেকে পুঁটুলি করে নিয়ে এলেন ওইটুকু উজ্জয়িনীকে, ছাব্বিশে জানুয়ারির দিন জন্মেছিল মেয়ে, এর মধ্যেই এত বড়ো হয়ে গেল?
নাগেশ মনে মনে ঠিক করলেন, কালকের জন্মদিনের পার্টিতে কোনো খামতি রাখবেন না, সবাইকে নিমন্ত্রণ ইতিমধ্যেই করা হয়ে গেছে, শুধু উজ্জয়িনীই যা জানে না, ওর জন্য ওটা সারপ্রাইজই থাকবে। এইজন্যই তো অত বড়ো সম্মেলনটা প্রতিরক্ষা সচিবের অনুরোধেও ছাব্বিশ তারিখ করেননি, কালকের দিনটা শুধুই মেয়েটার জন্য।
মাঝে মাঝে নিজের বাচ্চা মেয়েটার জন্য বড়ো কষ্ট হয় নাগেশের। ছোটো থেকে কখনো মেয়েটা একটা সুস্থ বাড়ির পরিবেশ তো পেলই না, উলটে সঙ্গে অল্পবয়সে অতিরিক্ত ম্যাচিয়োরিটির বোঝা টানতে টানতে বেচারা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। প্রথম যখন নাগেশ আর সুজাতা বুঝেছিলেন উজ্জয়িনী আর পাঁচটা শিশুর মতো নয়, উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন ডাক্তারের কাছে। উজ্জয়িনী তিন বছরেই দুরূহ পাটিগণিতের অঙ্ক করতে শুরু করেছিল। তারপর মেয়ে প্রডিজি শুনে সাময়িক গর্ব হলেও এখন সেটাকে বরং অভিশাপ মনে হয় নাগেশের। মনে হয়, এর চেয়ে সাধারণ মেধাসম্পন্ন বাচ্চা হলেও ওর শৈশবটা অনেক আনন্দের হত। তার সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এল ওর সেই হ্যালুসিনেশনের অদ্ভুতুড়ে স্বপ্ন।
মেয়েকে কাছছাড়া করতে চাননি নাগেশ। চেয়েছিলেন দিল্লিতেই পড়ুক। কিন্তু তেরো-চোদ্দো বছর বয়সেই উজ্জয়িনীর সতেরো আঠারো বছরের মতো মানসিকতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল, সে নিজেই বলল, বাড়িতে থেকে পড়তে সে চায় না। এমনকী, বাবা মা ওর ওখানে ঘন ঘন যাক, সেটাও ও চায় না। মনে পড়লেই বুকটা মুচড়ে ওঠে নাগেশের।
ব্যবসায়ী হিসেবে, রাজনীতিক হিসেবে তিনি সফল হলেও, সত্যিই একজন স্বামী হিসেবে, পিতা হিসেবে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ!
কস্তুরী এবার ঠেলা দিল, ‘বলুন না প্লিজ, এই কনফারেন্সটা কীসের ওপর? অ্যান্টিটেররিজম? কারা আসবে?’
নাগেশ বর্তমানে ফিরে এলেন। প্লেন টেক অফ করে ফেলেছে। গোত্তা খেয়ে ধীরে ধীরে উঠছে ওপরের দিকে। চাপা একটা নিশ্বাস ফেলে মনটা অন্যদিকে ঘোরালেন, ‘তুমি কি জানো সারা পৃথিবীতে শুধু অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধের পেছনে এক বছরে খরচ হয় পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি?’
কস্তুরী মন দিয়ে শুনছিল, ‘পাঁচ ট্রিলিয়ন মানে কত টাকা হচ্ছে?’
‘এক ট্রিলিয়ন মানে এক লাখ কোটি। এক ট্রিলিয়ন ডলার মানে প্রায় পঁয়ষট্টি লাখ কোটি টাকা। এবার হিসেব করে নাও।’
কস্তুরী চমকে উঠল।
‘নিউক্লিয়ার বা রাসায়নিক মারণাস্ত্র তো ছেড়েই দাও, শুধু সাধারণ আর্মসেই আমেরিকা প্রায় আশি বিলিয়ন ডলার খরচ করে প্রতি বছর। আমেরিকা, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন, ইজরায়েল, চীন, এইসব দেশগুলো সবচেয়ে বেশি আর্মস তৈরি করে, সাপ্লাই করে। এই এত এত টাকা যদি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গরিবদের উন্নয়নের কাজে লাগানো যেত, কত ভালো হত বলো তো!’
কস্তুরী চুপ করে শুনছিল।
নাগেশ বললেন, ‘তার ওপর গোটা বিশ্বে অস্ত্র ব্যাবসাটা সাংঘাতিকভাবে ইরেগুলেটেড, মানে বেশিরভাগ দেশের সরকার এমন সব প্রাইভেট কোম্পানির কাছ থেকে অস্ত্র কেনে, যাদের কাছে টাকাটাই সব, অনেক সময় তাদের বৈধতাও থাকে না। সরকার দেখেও চুপ করে থাকে।’
কস্তুরী বলল, ‘নিজেদের ডিফেন্স শক্তিশালী করতে গেলে দেশগুলোকে অস্ত্র তো কিনতেই হবে, আর যেসব ফ্যাক্টরি অস্ত্র তৈরি করে, তাদের থেকেই তো কিনবে। এতে অসুবিধার কী আছে?’
‘অসুবিধার নেই?’ এয়ারহোস্টেসের হাত থেকে কফির কাপ নিয়ে নাগেশ বললেন, ‘যে কারখানা আজ টাকার বিনিময়ে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে কোনো দেশের সরকারের হাতে, তার যদি কোনো দেশাত্মবোধ না থাকে, কাল সেই কারখানাই তো অস্ত্র তুলে দেবে জঙ্গিদের হাতে, উগ্রপন্থীদের হাতে, টাকার বিনিময়ে। তখন? সারা পৃথিবী তো ধ্বংস হয়ে যাবে এভাবে!’
‘ঠিক! এটা ভেবে দেখিনি!’ কস্তুরী মাথা নাড়ল।
‘ইন ফ্যাক্ট, সেটাই হচ্ছে। অনেক বেআইনি অস্ত্র পাচারকারী সংগঠন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যারা একইসঙ্গে দু-পক্ষকেই অস্ত্র জোগান দিয়ে যাচ্ছে, দু-পক্ষ থেকেই তারা মোটা টাকা কামাচ্ছে, এদিকে দু-পক্ষেরই শয়ে শয়ে লোক মরছে।’ নাগেশ দম নেওয়ার জন্য এক মুহূর্ত থামলেন, ‘বছর কুড়ি আগে আফ্রিকার দুটো গরিব দেশ, ইথিয়োপিয়া আর এরিট্রিয়ার মধ্যে যুদ্ধ লেগেছিল, দুটো দেশই পাশাপাশি, প্রচুর অস্ত্রপাচারকারী দুটো দেশকেই হাজার হাজার আর্মস সাপ্লাই করে গেছে, দুটো দেশেরই কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে, হাজার হাজার লোক মারা গেছে। এদিকে রাতারাতি ওইসব আর্মস সাপ্লায়াররা কোটিপতি হয়ে গেছে। কেন, অপারেশন নো লিভিং থিং-এর নাম শোনোনি?’
কস্তুরী মনে করতে করতে বলল, ‘ওই একানব্বই সালের লাইবেরিয়া আর সিয়েরা লিওনের যুদ্ধটা, না?’
নাগেশ সায় দিলেন, ‘হ্যাঁ। পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটা। রাতারাতি শহরগুলোকে ধ্বংসাবশেষ বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। হাজার হাজার বাচ্চা ছেলের হাতে ভয়ংকর সব বন্দুক দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাদের চামড়া ফুটো করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল ড্রাগ, তারা যাকে পেরেছিল, তাকে মেরে ফেলেছিল, বাড়ি গাড়ি সব জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মেয়েরা এক রাতে রেপড হয়েছিল। নৃশংসতার চূড়ান্ত। আর এই পুরো নারকীয় ঘটনায় মদত দিয়েছিল অস্ত্রব্যাবসা। তাদের জন্যই এত সুলভ হয়েছিল অস্ত্র।’
‘ইস!’ কস্তুরী শিউরে উঠল।
‘সারা বিশ্বের চল্লিশ শতাংশ দুর্নীতির জন্য দায়ী হচ্ছে এই বেআইনি অস্ত্রব্যাবসা। অথচ সব দেশের সরকারই এটা নিয়ে চরম উদাসীন। তারা খালি বছরে একবার করে কোনো ভালো জায়গায় নিউক্লিয়ার ওয়েপন নিয়ে চুক্তি করে, সমাবেশ করে, টাকার শ্রাদ্ধ হয়, এদিকে পেছন দিয়ে যে এত লক্ষ লক্ষ আর্মস এইভাবে ক্ষতি করছে, সেদিকে কারুর হুঁশ নেই।’ নাগেশ তেতো গলায় কথাগুলো বললেন, ‘আর নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে যুদ্ধ লাগে প্রতিবেশী দেশগুলোতে, আর সেখানে আর্মস ট্রেড ফুলেফেঁপে ওঠে, রক্তের বন্যা বয়ে যায়। তাই আমরা ঠিক করেছি, সমস্যাটাকে তাড়াতে গেলে আগে শিকড়টাকে ওপড়ানোর চেষ্টা করব। তাই আমরা পার্লামেন্টের কিছু সদস্য বিদেশি একটা সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে এই মিটটার আয়োজন করেছি। বিদেশ মন্ত্রক, প্রতিরক্ষা মন্ত্রক আমাদের সাপোর্ট করছে। এমনকী রাষ্ট্রসংঘ পর্যন্ত শুভেচ্ছা জানিয়েছে। বুঝতে পেরেছ?’
‘সবই বুঝলাম। কিন্তু এটাই বুঝলাম না যে কারা এতে যোগ দিতে আসছে।’ কস্তুরী মুখ ভারী করল।
নাগেশ বললেন, ‘আমরা খেয়াল করে দেখেছি, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যেই এইধরনের সংঘর্ষ বাধে সবচেয়ে বেশি। তাই সেইরকম এক জোড়া করে প্রতিবেশী দেশ, যারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় ব্যস্ত, তাদের বিদেশ সচিবকে এই মিটে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, যাতে তারা নিজেদের তিক্ততা, দলাদলি ভুলে মিটমাট করে নিতে পারে, আর এটা শুধু তাদের স্বার্থেই নয়, দেশের টাকা এবং নাগরিক হত্যার স্বার্থে। আমরা প্রায় কুড়ি জোড়া দেশকে ইনভাইট করেছিলাম, তার মধ্যে শেষ পর্যন্ত আসার জন্য সম্মতি জানিয়েছে বারো জোড়া দেশ। সাতাশ তারিখ মিটটা হওয়ার কথা, সেইদিন এক জোড়া করে দেশ, যাদের আমরা পিস কাপল, মানে শান্তির জুটি বলছি, তারা নিজেদের মধ্যে একটা করে চুক্তি করবে যে সেদিনের পর থেকে কোনোরকম যুদ্ধ, ঝগড়ায় তারা আর লিপ্ত হবে না। উদবোধন করবেন স্বয়ং আমাদের বিদেশমন্ত্রী। ভি ভি আই পি সম্মেলন। নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হবে পুরো জায়গাটা।’
‘পাকিস্তানও আসছে?’ কস্তুরী জিজ্ঞাসা করল।
‘আসছে।’ নাগেশ বললেন, ‘এতে দুনিয়া জুড়ে পুরো বেআইনি আর্মস ব্যাবসাতেই একটা বড়োসড়ো ধাক্কা আসবে। সবচেয়ে বড়ো কথা, ভারত যে শুধু এই মিটটা হোস্ট করছে তাই নয়, এই মিটটার ফলে যে শান্তির বাণী দেওয়া হবে, তাতে ভারত যে কত বড়ো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, তা ইতিহাসের পাতায় চিরকাল লেখা থাকবে।’ বলতে বলতে নাগেশের গলার স্বর আবেগে কেঁপে উঠল। সাংসদ হওয়ার পর থেকেই নিজ উদ্যোগে শান্তিমূলক নানা কাজকর্মে নাগেশ সংসদে নজর কেড়েছেন, আগের বছরেও নারীপাচার নিয়ে এমনই একটা সম্মেলন আয়োজন করেছিলেন, কিন্তু তার সঙ্গে আয়তনে এবং ওজনে এবারেরটার তুলনাই চলে না।
‘কোথায় হবে এটা, সেটাই এখনও বললে না! প্রগতি ময়দানে? কস্তুরী বলল।
‘নাহ!’ নাগেশ সিটটাকে পেছনদিকে হেলিয়ে দিলেন, বাইরে এখন শুধুই মেঘ, বললেন, ‘ঐতিহাসিক চুক্তি, তাই ঐতিহাসিক জায়গায় আয়োজন করেছি। আগ্রায়।’
‘আগ্রার কোথায়?’ কস্তুরী জানতে চাইল।
‘একটা অডিটোরিয়ামে। তার আগের দিক সন্ধ্যাবেলা অতিথিদের তাজমহল ঘুরিয়ে দেখানো হবে, সেটায় অবশ্য আমি যাব না, বাড়িতে পার্টি থাকবে।’ নাগেশ উঠে দাঁড়ালেন। একটু বাথরুমে যাবেন।
নাগেশ সিং বাথরুমের দিকে এগোনোমাত্র কস্তুরী নিজের ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ খুলল। এখন এয়ারলাইনসগুলো আকাশেও ওয়াইফাই দিচ্ছে। ঝড়ের গতিতে ও কাউকে কিছু একটা টাইপ করতে লাগল।
টাইপ করতে করতে ওর মুখে ফুটে উঠল অদ্ভুত একটা হাসি।
১৭
দুপুর পেরোতে-না-পেরোতেই অঘোরেশের আবার ফোন এল সুরঞ্জনের কাছে।
পূরবী তখন খেয়ে উঠে একটা বই নিয়ে বসেছেন। কমপ্লেক্সের মধ্যে হওয়ায় মেন রোডের মোটামুটি কাছে হলেও গাড়িঘোড়ার কোলাহলটা এখানে খুব একটা এসে পৌঁছোয় না, মোটামুটি নিরিবিলিই বলা চলে। সুরঞ্জন বসে একটা পুরোনো ইংরেজি সিনেমা দেখছিলেন। সুরঞ্জনই ট্যাবে করে নিয়ে এসেছিলেন, গ্রেগরি পেকের পুরোনো মুভির দারুণ কালেকশন আছে ওঁর কাছে। কয়েক মাস আগে জন্মদিনে রুদ্র এখান থেকে ট্যাবটা পাঠিয়েছিল সুরঞ্জনকে উপহার হিসেবে। তারপর থেকেই সুরঞ্জন ট্যাবটাকে যতরকমভাবে পারা যায়, ব্যবহার করে চলেছেন।
আসলে ট্যাবটা পেয়ে সুরঞ্জন ভারি খুশি হয়েছেন। কোথাও গেলেই বইয়ের ভারে ব্যাগ আর ভারী হবে না। পাতা উলটে বুকমার্ক করার ঝামেলা নেই, পুরোনো কোনো কিছু দেখতে গেলে শুধু শব্দটা লিখে সার্চ করলেই চট করে বেরিয়ে যায়। অনেক ভালো ভালো সিনেমা মেমারি কার্ডে লোড করে রাখা যায়। পুরোনোপন্থীরা যে যা-ই বলুক, সুরঞ্জন এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনগুলোকে ইতিবাচকভাবেই নেন। পুরোনোকে সরিয়ে নতুন আসবেই। প্রযুক্তি, মানসিকতার পরিবর্তন তো সভ্যসমাজের অগ্রগতির পরিচায়ক, সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পুরোনোমাত্রেই ভালো, এই ধারণা আঁকড়ে থাকলে তো মানুষ আজও প্রস্তর যুগেই পড়ে থাকত!
অঘোরেশ এবার আর মিসড কল দিলেন না। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তাঁর গমগমে গলা সুর করে ভেসে এল, ‘হ্যালো, লিটল বুদ্ধা!’
সুরঞ্জন হিন্দিতেই বললেন, ‘বল। কখন পৌঁছোলি বাড়ি? সকালে ফোন করলাম তোর মিসড কল দেখে, তুললি না তো!’
অঘোরেশ বললেন, ‘ওসব পরে হবে, শোন, তোর সঙ্গে একটা দরকারি কথা আছে, খুব আর্জেন্ট।’
সুরঞ্জন একটু থমকে গেলেন। সকালেও অঘোরেশ এই কথাটাই বলছিলেন বটে। কিন্তু, আজ ভোরে ট্রেনে দু-জনের দেখা হওয়াটা তো নেহাতই কাকতালীয় ব্যাপার। চল্লিশ বছর আগেকার বন্ধুকে কি এত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার থাকতে পারে?
সুরঞ্জনের মনে পড়ে গেল, পূরবী অঘোরেশকে খুব একটা পছন্দ করেননি। আগ্রায় থাকার পরিকল্পনা মোটামুটি মাসখানেকের, তার মধ্যে অঘোরেশ আসা-যাওয়া শুরু করলে পূরবী যে আদৌ খুশি হবেন না, তা সুরঞ্জন বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু পুরোনো বন্ধুকে সোজাসুজি কিছু বলতে ভদ্রতায় বাধে।
তার ওপর সত্যিই হয়তো অঘোরেশের কিছু প্রয়োজন আছে। কোনো কিছু সমস্যার জন্য দোলাচলে রয়েছে সে, পরামর্শের জন্য বার বার ফোন করছে।
সুরঞ্জন বললেন, ‘কী কথা?’
‘আমি ইতিহাসের একটা খুব বিতর্কিত অধ্যায় নিয়ে অনেক দূর এগিয়েছি, এমন কিছু সত্য আবিষ্কার করেছি যেগুলো দিল্লির মসনদ কাঁপিয়ে দিতে পারে। সেই ব্যাপারেই তোর সঙ্গে একটু ডিসকাস করতে চাই। তুই চাইলে আমার সঙ্গে কাজও করতে পারিস, তোর মতো বিচক্ষণ লোক আমার দরকার।’
সুরঞ্জন অবাক হয়ে গেলেন, তারপর বললেন, ‘বেশ তো, আয় না আজ বিকেলে আমাদের এখানে। ঠিকানাটা বলব?’
অঘোরেশ বললেন, ‘না না, তোর বাড়ি যাব না, ব্যাপারটা একটু সিক্রেট। তুই বরং একটা কাজ কর। আমার বাড়ি চলে আয়। এখুনি আয় না!’
সুরঞ্জন ফোনটা চেপে ধরে রুদ্রর দিকে তাকালেন। রুদ্র উৎসুক চোখে চেয়ে আছে। সুরঞ্জন ভাবলেন পূরবী বই পড়ছেন পড়ুন, বসেই তো আছেন, বাপ মেয়ে মিলে পুরোনো বন্ধুর বাড়ি থেকে ঘুরে এলেই হয়!
সুরঞ্জন আর আপত্তি করলেন না। অঘোরেশের কথা শুনে ব্যাপারটায় বেশ কৌতূহল হচ্ছে, পূরবী অসন্তুষ্ট হতে পারেন ভেবে ওঁকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে কিন্তু কিন্তু করছিলেন, অঘোরেশের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তাবটা তাঁর ভালোই লাগল।
অঘোরেশ বললেন, ‘সদরবাজার চিনিস তো? ধুলিয়াগঞ্জে? তোর আসার দিক থেকে সদর বাজারের আগেই বালুগঞ্জে আমার বাড়ি। তুই এক কাজ কর, একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে আয়, আমি একদম বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকব।’
সুরঞ্জন বললেন, ‘না না, ঠিক আছে। আমার মেয়েকেও নিয়ে যাচ্ছি, তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। ও তো মোটামুটি সবই চেনে এখানে।’
ফোনটা রাখতে রুদ্র একটু অনিচ্ছার ভঙ্গিতে বলল, ‘এই তো এলে তোমরা, এখন আবার কোথায় যাবে? তোমার সঙ্গে আমার একটা ব্যাপারে একটু আলোচনা ছিল।’
পূরবী শুনতে পেলে রাগারাগি করবেন, সুরঞ্জন রুদ্রকে ইশারায় আস্তে কথা বলতে বললেন, ‘এসে শুনছি না হয়। এখন চল না! কলেজ লাইফের বন্ধু, বার বার ডাকছে। কী করে না বলি বল তো! একটু বাদেই চলে আসব না হয়! তোর মাকে কিছু বলতে হবে না।’
আধ ঘণ্টা বাদে বাবা মেয়ে বেরিয়ে পড়ল। শীতের দুপুর, তবু রোদের তেজ ভালোই রয়েছে। অটোয় উঠে রুদ্র কোতূহল থেকেই ফোন করল নাহুম খানকে, ‘ধরতে পারলেন?’
‘নাহ!’ নাহুম খানের হতাশ গলা পাওয়া গেল ওপাশ থেকে, ‘বাড়ি তালা মারা। আশপাশে জিজ্ঞাসা করলাম, বলল পাগলাটে বুড়ো, কখন আসে, কখন যায় কোনো ঠিকঠিকানা নেই। আমি এখন আগ্রা ইউনিভার্সিটিতে এসেছি, যদি আরও কিছু খোঁজ পাওয় যায়!’
‘ওকে। ধরতে পারলে জানাবেন। আর কোনোরকম হেল্প লাগলেও ফোন করবেন।’ রুদ্র ফোন রেখে দিল, ‘বাবা, তোমার এই বন্ধু কোন কলেজে পড়ান?’
‘আগ্রা ইউনিভার্সিটিতে।’ সুরঞ্জন বললেন।
রুদ্র চুপ করে গেল। অঘোরেশ ভাটও তো ওখানেই পড়াতেন, ভালোই হবে, বাবার এই বন্ধুর কাছ থেকে নতুন কোনো তথ্য পেলেও পাওয়া যেতে পারে। একই বিষয় যখন, নিশ্চয়ই চিনবেন।
বাড়ি খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হল না। দয়ালবাগ থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এলেন, তারপর রাকবগঞ্জ থানা পেরিয়েই অঘোরেশের সুবিশাল দেহটা রাস্তার ডান দিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন তিনি। আশ্চর্য, সেই সকালের পোশাকই এখনও ওর পরনে, বাড়ি গিয়ে কি জামাটাও ছাড়েনি?
ওঁর দাড়ির দিকে চোখ যেতে পূরবীর কথা মনে পড়তেই সুরঞ্জন একটু সন্ত্রস্ত হয়ে একটু দূরত্ব রেখে চলতে লাগলেন।
অঘোরেশ কোনো কথা বললেন না, রুদ্রর দিকে একবার তাকিয়েই চলতে শুরু করলেন। সুরঞ্জন আর রুদ্র পিছু নিল।
এই বালুগঞ্জ অঞ্চলটা বেশ অভিজাত এলাকার মধ্যেই পড়ে, বেশ ফাঁকা ফাঁকা খোলামেলা প্লটের ওপর একটা করে বাড়ি, সামনে পেছনে ছোটো জায়গাও আছে, অনেকটা সল্টলেকের মতো।
অঘোরেশের বাড়িটাও তেমনই, একটেরে একতলা বাড়ি, দেখে বোঝা যায় একসময় বেশ যত্ন নিয়ে করা হয়েছিল বাড়িটা। সামনে ছোট্ট একফালি লন, যদিও নিয়মিত দেখভালের অভাবে বড়ো বড়ো আগাছা জন্মে গেছে তাতে। সামনের একদিক গ্যারাজ, আর অন্যদিক দিয়ে ঢোকার রাস্তা।
অঘোরেশ পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুললেন। রুদ্র আশপাশটা ভালো করে দেখছিল, গোটা গলিটা নির্জন। শুধু একটা কুকুর অলসভাবে শীতের রোদে ঘুমোচ্ছে। দূরে একটা চায়ের গুমটি, দুপুর বলে সেটা মনে হয় বন্ধ। সেখানে একটা লোক চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে। আর কেউ কোথাও নেই।
বাড়িতে ঢুকে ডাইনিং হলে এসে সুরঞ্জন বেশ চমকে গেলেন। বাড়ির তুলনায় ডাইনিংটা বেশ বড়ো, অন্য ঘরগুলো হয়তো আকারে ছোটো হবে। কিন্তু ডাইনিং-এ বসার কোনো আসবাব নেই তেমন, ঘরের এক কোণে একটা সোফা সেট উলটিয়ে রাখা রয়েছে, জায়গার সাশ্রয় করতে যেমন করে রাখা হয়। আর পুরো ফ্লোর জুড়ে একটা পুরোনো জীর্ণ হয়ে যাওয়া কার্পেটের ওপর স্তূপাকৃতি বই। সেগুলোও অবিন্যস্তভাবে সাজানো, কেজি দরে বই বিক্রি করার সময় যেমন অনাদরে ফেলে রাখা হয়, ঠিক তেমনভাবেই হেলায় পড়ে রয়েছে রাশি রাশি বই।
পুরো ঘরটায় একটা সোঁদা পুরোনো গন্ধ! রুদ্র আড়চোখে বাবার দিকে একবার তাকিয়েই নজর ফেলল বইগুলোর দিকে।
সবই প্রায় ইতিহাসের বই।
সুরঞ্জন বেশ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেই ফেললেন, ‘কী রে? বইয়ের আলমারি নেই নাকি বাড়িতে? এরকমভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে রেখেছিস?’
অঘোরেশ মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘যাদের সবসময় লাগে, তাদেরকে বার বার জায়গা পালটিয়ে বিরক্ত করি না, তার চেয়ে যেমন আছে তেমনই থাক। বোস এখানে’, ঝুঁকে পড়ে বইগুলোকে একদিকে সরাতে সরাতে বললেন অঘোরেশ, ‘তোদের জন্য আমি একটু কফি করে আনি। আমিও তোদের সঙ্গেই বাড়ি ঢুকছি, সকালে স্টেশনে নামার পর থেকে অনেকগুলো কাজ ছিল।’
কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধে ভরে আছে গোটা ঘরটা, তার মধ্যে অঘোরেশ কাছে এলেই সেই বিশ্রী নোংরা গন্ধে নাক বুজে আসছিল। সুরঞ্জনের মেজাজটা তেতো লাগছিল। না এলেই পারতেন! পূরবী ঠিকই বলেছিলেন। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। মনে মনে ঠিক করলেন, আধ ঘণ্টার মধ্যেই উঠে পড়বেন এখান থেকে।
অঘোরেশ ভেতরে যাওয়ার পরেই সুরঞ্জন রুদ্রর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করলেন, ‘অঘোরেশটা সত্যিই মনে হচ্ছে খ্যাপাটে হয়ে গেছে রে! দুম করে না এলেই ভালো হত!’
রুদ্র তীক্ষ্নচোখে সামনের বইগুলো দেখছিল, প্রথমে বাবার কথাটা যেন শুনতে পেল না, ‘উঁ? কী বলছ?’
সুরঞ্জন পুনরাবৃত্তি করতে যাওয়ার আগেই ও বিস্ফারিত চোখে বাবার দিকে তাকাল, ‘কী নাম বললে? কী নাম তোমার এই বন্ধুর?’
সুরঞ্জন রুদ্রর আকস্মিক প্রশ্নে একটু অবাক হয়ে গেলেন, ‘বললাম তো, অঘোরেশ। অঘোরেশ ভাট।’
রুদ্র চোখ বড়ো বড়ো করে কিছু বলতে গেল, তার আগেই ভেতরের ঘরে অথচ দৃঢ় গলায় কথাবার্তা শুনতে পেল ওরা দু-জনে। অঘোরেশ যেন কাউকে কফি বানাতে বলছেন, এবং ওইপক্ষ থেকে সম্ভবত না-বাচক কথা শুনে অঘোরেশ একটু উঁচু গলায় উষ্মা প্রকাশ করছেন, একতরফাই চলছে বাকবিতর্ক।
সুরঞ্জন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন, যদিও অঘোরেশ নিজে কিছু বলেননি, তবু ওর চালচলন দেখে তিনি ভেবেছিলেন অঘোরেশ বিয়ে-থা করেননি। সুরঞ্জনের জন্য কফি বানাতে বলছেন বলেই কি ওর স্ত্রীর এত অসন্তোষ?
খুব বিব্রত হয়ে সুরঞ্জন মেয়েকে বললেন, ‘কী রে, চেঁচামেচি হচ্ছে নাকি বল তো? গিয়ে দেখব ভেতরে?’
রুদ্র যেন শুনতেই পেল না, ও ততক্ষণে নাহুম খানের মোবাইলে চেষ্টা করছে, কিন্তু এই বদ্ধ ঘরের জন্যই হোক বা অন্য কোনো কারণে কিছুতেই নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না।
সুরঞ্জন দেখলেন রুদ্রর চোখ-মুখ যেন পালটে গেছে, মুখে ঘোরাফেরা করছে একরাশ উদবেগ।
সুরঞ্জন বলতে গেলেন, ‘কী হয়েছে তোর? এরকম করছিস কেন? কাকে ফোন করলি?’
তার আগেই রুদ্র চাপা গলায় বলল, ‘যে করে হোক, একে এখন আটকে রাখতে হবে বাবা, তোমায় পরে সব বলছি! এখন কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না। পুলিশ ডাকছি এখুনি!’
‘পুলিশ!’ সুরঞ্জন অবাক হয়ে চুপ করে গেলেন। একবার ভাবলেন ভেতরে গিয়ে দেখবেন, তারপর ভাবলেন সেটা ঠিক ভদ্রতার দিক থেকে সমীচীন হবে না। আবার হুট করে অঘোরেশকে না বলে চলেও যাওয়া যায় না। ওদিকে রুদ্র ফোনে খুটখাট করে যাচ্ছে, কথা বলতে গেলেই ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলছে। বাধ্য হয়ে তিনি সামনে রাখা বইগুলোর দিকে মনোনিবেশ করলেন।
ধুলোমাখা বইয়ের সারির মধ্যে বেশিরভাগই ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসের বই। মুঘল সময়ের জীবনযাত্রা, সাধারণ মানুষ, শিক্ষা এসবের ওপর বিভিন্ন ইতিহাসবিদের লেখা বই। এর মধ্যে কিছু বই সুরঞ্জন নিজেও পড়েছেন। শাজাহানের সময় ভারতে আসা ব্যবসায়ী টাভারনিয়েরের লেখা, আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী, আরও বেশ কিছু পুরোনো বইয়ের ইংরেজি ভার্সান দেখতে পেলেন তিনি। কিন্তু সেগুলোর ওপরের পুরু ধুলোর প্রলেপ দেখে তাঁর আর হাত দিতে ইচ্ছে হল না।
বরং এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে একটু দূরে জানলার পাশে একটা নীচু টুলের ওপর রাখা একটা জিনিসের দিকে তাঁর চোখ চলে গেল। সিল্ক কাপড়ের ওপর জানলার বাইরে দিয়ে নরম রোদ এসে জিনিসটা চকচক করছে বলেই বোধ হয় চোখ পড়ল ওদিকে।
সুরঞ্জন উঠে এসে জিনিসটা হাতে নিলেন। লম্বায় দেড় ফুটের কিছু বেশিই হবে, চওড়ায় প্রায় এক ফুট সিল্কের কাপড় দিয়ে মোড়ানো একটা বস্তু।
সুরঞ্জন ওপরের মলাটটা খুললেন। মোটা এক ধরনের শক্ত কাগজের একটা বই। প্রতিটা পৃষ্ঠার চারপাশটা সোনালি রঙের ডিজাইন দেওয়া বর্ডার। সুরঞ্জনের অভিজ্ঞ চোখ দেখেই বুঝে নিল এটা কোনো পুরোনো পাণ্ডুলিপি। বর্ডারের ডিজাইনটাও চিনতে পারলেন তিনি, এই ধরনের গোল্ড আরবি ডিজাইন দিয়ে আগে বই বানানো হত।
সুরঞ্জন চোখ সরু করে জরিপ করতে লাগলেন, যতদূর মনে পড়ছে, এই ডিজাইনটা সতেরো আঠারো শতকে খুব চলত, পার্সি কাজ।
রুদ্র উঠে গিয়ে জানলার পাশে দাঁড়াতেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, সড়াৎ করে যেন বাইরের পাঁচিল থেকে কেউ একটা সরে গেল। ও সঙ্গেসঙ্গে হাততিনেক দূরে পাশের জানলাটায় গেল, কিন্তু পাল্লাটা খুলল না, সামান্য ফাঁক করে দেখল ওই চায়ের গুমটিতে বসে থাকা চাদর মুড়ি দেওয়া লোকটা সরে যাচ্ছে বাড়ির পাঁচিলের পাশ থেকে, যদিও তার দৃষ্টি এইদিকেই।
রুদ্রর ভ্রূ কুঁচকে গেল, কী হচ্ছে কেসটা? এই বাড়িটার ওপর কেউ নজর রাখছে?
অন্যমনস্কভাবে ও বাবার দিকে তাকাল, ‘কেন ওসব ঘাঁটছ?’
সুরঞ্জন শুনতেই পেলেন না, তিনি সাবধানে বইটার পাতা উলটোলেন এবং মুগ্ধ হয়ে গেলেন। একটা দুর্ধর্ষ তেলরঙে আঁকা ছবি প্রথম পাতাতেই, ছবিটা দেখেই তিনি চিনতে পারলেন, চোদ্দো শতকের সেই দুনিয়া কাঁপানো স্বৈরাচারী মোঙ্গল যোদ্ধা তৈমুর লং। মাথায় সেই চৈনিক মুকুট, পরনে যুদ্ধের পোশাক। ছবিটার নীচে ছোটো ছোটো হরফে কিছু লেখা। এক নজরে সেগুলো উর্দু মনে হলেও সুরঞ্জন বেশ চিনতে পারলেন, এটাকে বলা হয় ন্যাস্টালিক ক্যালিগ্রাফি, একধরনের পার্সি-আরবি মেশানো হরফ যেটা মধ্যযুগে সম্ভ্রান্ত পরিবারে লেখার জন্য খুব প্রচলিত ছিল।
পুরো পাণ্ডুলিপিটাই অসাধারণ সমস্ত হাতে-আঁকা ছবিতে ভরতি, সঙ্গে ন্যাস্টালিক ক্যালিগ্রাফিতে প্রচুর লেখা রয়েছে। বেশিরভাগ ছবিই রাজদরবারের, হাতিঘোড়া সহযোগে সম্রাটের আড়ম্বরপূর্ণ শাসনকালের ছবি, ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ি উপত্যকায় যুদ্ধজয়ের ছবি, এ ছাড়াও আরও একটা পোর্ট্রেট দেখার সঙ্গেসঙ্গে সুরঞ্জন চিনতে পারলেন। পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাজাহান।
সন্দেহটা অনেকক্ষণ ধরে মনের মধ্যে ঘনীভূত হচ্ছিল, অবশেষে আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন কর্তা নিশ্চিত হলেন।
‘এই বইটার নাম বাদশাহনামা, পার্সি উচ্চারণে পাদশাহনামা আর আরবি উচ্চারণে বাদশাহনামা। শাজাহানের সভাসদ আবদুল হামিদ লহরীর লেখা শাজাহানের জীবনচরিত। এটা অরিজিন্যাল পাণ্ডুলিপি!’ সুরঞ্জন ফিসফিস করে বললেন রুদ্রকে, ‘প্রায় চারশোর কাছাকাছি বছরের পুরোনো!’
রুদ্র চাপা গলায় বলল, ‘এটা এঁর কাছে এল কী করে?’
দরজার কাছে একটা মৃদু শব্দ হতে সামনে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই সুরঞ্জনের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। রুদ্রও সেদিকেই তাকাল চমকে উঠে।
দরজার কাছে কফির কাপ হাতে অঘোরেশ দাঁড়িয়ে। তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি সুরঞ্জনের হাতে ধরা পাণ্ডুলিপিটার দিকে।
১৮
সুরঞ্জন আর রুদ্র বেরিয়ে যাওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যেই কলিং বেল বাজতে পূরবী একটু অবাক হলেন। সবে চারটে বেজেছে। বিকেলের আলো এখনও খট খট করছে। এইসময় কারুর আসার কথা নেই।
রতন বলে রান্নার লোকটিও আসে আরও কিছুক্ষণ পর, ওকে অবশ্য এখনও রান্নার হেল্পার হিসেবেই ইউজ করছেন পূরবী। আনাজ কুটে দেওয়া, মশলা বেটে দেওয়া, ওই অবধি। খুন্তি ধরতে দেননি।
গায়ে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে অলস পায়ে এসে দরজার কি-হোলে চোখ রাখলেন পূরবী। কিন্তু নিকষ কালো অন্ধকার সেখানে। কিছুই দেখা গেল না।
লবিতে তো যথেষ্ট আলো রয়েছে, তবু কাউকে দেখা যাচ্ছে না কেন?
তবে কি যে এসেছে সে ইচ্ছে করে কি-হোলটা চাপা দিয়ে রেখেছে?
একটুক্ষণের জন্য পূরবী একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কী করবেন, বুঝতে পারছেন না। উত্তরপ্রদেশ জায়গাটা সম্পর্কে এমনিই একটু কেমন শঙ্কা আছে মনে, তার ওপর বাড়িতে আর কেউ নেই।
দরজার কাছে গিয়ে জোরে একবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কৌন হ্যায়?’
কোনো শব্দ নেই। অথচ বেল বাজল। এবার পরপর তিনবার।
পূরবী এবার আর সাতপাঁচ না ভেবে খুলেই ফেললেন দরজাটা। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন?
দরজা খুলতেই পূরবীর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। হতভম্ব মুখে তিনি শুধু বলতে পারলেন, ‘ওমা! এ কী!’
প্রিয়ম ট্রলিটাকে ঢোকাচ্ছিল, সঙ্গেসঙ্গে ইশারায় চুপ করতে বলল, তারপর ফিসফিস করল, ‘ও কোথায় মা? ঘুমোচ্ছে?’
পূরবী এবার হেসে ফেললেন। এমা, ছেলেটা সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এতদূর থেকে ছুটে এল, আর মেয়েটা এখনই বাড়ি নেই? নিজের মেয়ের কাছে এতদিন পরে এসে যতটুকু আনন্দ হয়েছিল, জামাইয়ের আচমকা আগমনে সেই আনন্দ যেন হাজারগুণ বেড়ে গেল।
খুশিতে ডগমগ হতে হতে পূরবী বললেন, ‘রুদ্র আর ওর বাবা তো বেরোল একটু! তুমি বোসো আগে, জল খাও। রুদ্র সকাল থেকে চিন্তা করছে তোমাকে ফোনে পাচ্ছে না বলে, আর তুমি…!’
প্রিয়মের মুখটা মুহূর্তে নিভে গেল, ক্লান্ত শরীরে ও এবার সোফায় বসে পড়ল, ‘যাহ! এইসময়েই বেরিয়ে পড়ল? আমি কাল থেকে ওকে চমকে দেব ভাবতে ভাবতে কত লুকোছাপা করে এলাম!’
পূরবী ততক্ষণে জল এগিয়ে দিয়েছেন, ‘আমার যে কী ভালো লাগছে! আমরাও তো আজই এসেছি। খুব ভালো করেছ প্রিয়ম!’
প্রিয়ম ঢকঢক করে জলটা খেল, ‘হ্যাঁ, ওইজন্যই তো আরও এই সময়ে এলাম। দু-সপ্তাহ আগে ও যখন বলল আপনারা এখন আসছেন আগ্রা, ভাবলাম এমনিতেও ছুটি তো নিই-ই না, আমিও চলে যাই। সবাই মিলে হইহই করা যাবে।’
‘খুব ভালো করেছ!’ আনন্দে পূরবী ফোন করতে যাচ্ছিলেন রুদ্রকে, প্রিয়ম হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘এখন কিছু বলবেন না মা! ও আসুক না! না হলে আর সারপ্রাইজের কিছুই থাকবে না যে!’
পূরবী সঙ্গেসঙ্গে ফোনটা কেটে দিলেন। মনের ভেতর যখন প্রচণ্ড আনন্দ হয় তখন মানুষ কী করবে ভেবে পায় না। ওঁরও সেটাই হচ্ছিল। একবার ভাবলেন এখুনি গিয়ে প্রিয়মের প্রিয় লুচি আর সাদা আলুর তরকারি বানিয়ে ফেলেন, আবার মনে হল, এতটা জার্নি করে এসে কি ওসব খেতে চাইবে?
দিশেহারা হয়ে ফ্রিজ থেকে ফল বের করতে করতে বললেন, ‘তুমি চিনলে কী করে? আগে তো কখনো আগ্রা আসোনি।’
‘ওর এই ঠিকানাটা তো আমার কাছে ছিলই, এয়ারপোর্ট থেকে ক্যাবে এলাম, ড্রাইভার নিয়ে চলে এল।’ প্রিয়ম হাসল, ‘আপনারা কেমন আছেন বলুন? বাবার শরীর ভালো আছে? কোথায় বেরিয়েছে ওরা?’
.
মুন্না দুপুর দুপুর উঠে বাস ধরে এসে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ের পাশের রাবুপুরা বলে এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছিল। দুপুরে গরম রুটি, ডিমতরকা আর পেঁয়াজ দিয়ে জম্পেশ খাওয়া হয়েছে। চাঁদনিকে শাকিল কী বলেছে কে জানে, হেব্বি যত্নআত্তি করছে ওর। সঙ্গে রোশনি বলে সেই লেজুড়টা তো আছেই। সে তো পারলে মুন্নার মুখও মুছিয়ে দেয় খাওয়ার পর। সে করুক, মুন্না বেইমান নয়, কারুর থেকে ফ্রি-তে সার্ভিস নেয় না, আজ এখানে পেমেন্ট পেলেই সুদে-আসলে সব পুষিয়ে দেবে।
মুন্না কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। পাশেই হাইওয়ে, সাঁ সাঁ করে গাড়ি ছুটছে প্রায় উল্কার গতিতে। দিল্লি থেকে আগ্রা যাওয়ার এটাই এখন সবচেয়ে ভালো রাস্তা। শুধু রাস্তায় টোলের চার্জ বড্ড বেশি, এই যা। না হলে হু হু করে পৌঁছে যাওয়া যায় আগ্রা। রাবুপুরা বলে এই জায়গাটা একটা গ্রাম, পাশেই যমুনা এক্সপ্রেসওয়ের টোল বলে এখানে ছোটোবড়ো অনেকগুলো ধাবা গজিয়ে উঠেছে। কৃষিপ্রধান গ্রামের অনেকের জীবিকা হঠাৎই এখন ধাবায় শিফট করেছে। তা ভালো। তাতে মুন্নাদের কারবারেরও সুবিধা হয়েছে।
মুন্না একটা দোকান থেকে গরম চা নিল। এই ঠান্ডায় হাইওয়ের হাওয়াতে হাত-পা কেঁপে যাচ্ছে যেন! দু-তিন চুমুক দেওয়ার পর শরীরে একটু আরাম বোধ হল। আলগোছে এক হাতে কাপ ধরে অন্য হাতে ফোন করল ফজলুলকে, ‘কোথায়?’
‘ওস্তাদ, একটু দেরি হবে। নজফগড়ে আছি। এই মাল এল। তুমি ওয়েট করো। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি।’ বিশাল চেঁচামেচির মধ্যে ফজলুলের গলা শোনা গেল।
মুন্না আর কোনো কথা না বলে কেটে দিল। দুপুরেই জেনে গেছে কোন গাড়িতে ওরা আসবে। জি বি রোডের ওই লোকের মুশকো চেলাটা, কী যেন নাম, ওয়াসিম, সে যতই বলুক হ্যান লাগবে ত্যান লাগবে, এত শর্ট নোটিশে বেশি ভ্যারাইটি জোগাড় করা যায় নাকি! তাও মুন্না শেখের চ্যানেল সব জায়গায় বলে কাল রাতে অর্ডার দিয়ে আজ রাতেই ডেলিভারি দিতে পারছে। অন্য কেউ হলে প্রথমেই হাত তুলে দিত। চায়ের কাপটা শেষ হতে পায়ে পায়ে ও এগিয়ে গেল আরও একটা ঘুপচি দোকানের দিকে, ‘অমলেট হবে?’
‘হবে।’ এক ঝলক দেখে সসপ্যানে তেল ছাড়তে ছাড়তে বলল লোকটা।
‘কড়া করে ভেজে দাও তো একটা। আর ঝাল দিয়ো।’ ওকে এখন এখানে কিছুটা সময় কাটাতে হবে।
হিসেবমতো চিন্তার কিছু নেই, প্রতিবারের মতো এবারেও গাড়ির পেটের মধ্যে তেলের ডুপ্লিকেট ট্যাঙ্ক ঢুকিয়ে তার মধ্যে করে আনা হচ্ছে, ওই নিয়ে চাপ নেই। পুলিশের ঠাকুরদার সাধ্য নেই ধরে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। ফজলুল দুপুরে যা বলল সেই অনুযায়ী শুধু ১২ বোরের পিস্তল পাওয়া গেছে, তাও মোটে দু-শোটা, কিছু গ্রেনেড আর কয়েকটা দিশি বন্দুক, যাকে ওদের ভাষায় বলে তামাঞ্চা, আর কিছুই নাকি নজফগড়ের স্টকে নেই।
কাল তো লোকটা বলেছিল আড়াইশো পিস ওয়ান শট পিস্তল আর কুড়িটা মতো কার্বাইন লাগবে, সেখানে কোনোটাই পুরো পাওয়া গেল না। সবই মুঙ্গেরে পড়ে আছে। শালা একদিনও যদি বেশি সময় দিত, মুন্না ঠিক হাসানকে দিয়ে কলকাতা থেকে আনিয়ে নিত, তখন পেমেন্টটাও বেশি পাওয়া যেত।
গতমাসেই তো মাত্র দু-দিনের মধ্যে আসামে আলফা দলকে সাপ্লাই করল কতগুলো এ কে ৪৭, ভালো ভালো ক-টা রাইফেল, পঞ্চাশ প্যাকেট গ্রেনেড। নর্থ ইস্টের লোকগুলো, কী যেন বলে ওদের, হ্যাঁ চিঙ্কি, বেটাচ্ছেলেরা হেব্বি পিটপিটে, পাশেই চীন থেকে বর্ডার টপকে ভালো ভালো মাল আনায়, দিশি মাল শুনেই প্রথমে নাক সিটকোচ্ছিল, তারপর সেই ওরাই ক-দিন বাদে মুন্না শেখের মালের প্রশংসা তো করেছে! আর সেখানে এবারে একটুর জন্য বড়ো কন্ট্র্যাক্টটা মিস হল, আফশোসে পিচিক করে থুতু ফেলল ও।
অমলেটটা তৈরি হয়ে গিয়েছে, গরম ধোঁয়া ওঠা প্লেটে চামচ বসিয়ে মুখে ঢোকাতেই কাঁচালঙ্কার ঝালে আর গরমে ‘উহ আহ’ করে উঠল ও। আর তখনই চোখে পড়ল, ও যেমন প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এখানে দাঁড়িয়ে গুলতানি করছে, ওদিকে আরেকটা লোকও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। ছ-টা সমান্তরাল লেনের বিশাল হাইওয়ে, পাশে ধাবাগুলো পরপর হয়ে ছোটো একটা গলি তৈরি হয়ে গেছে, সেই গলির একদিকে মুন্না, অন্যদিকে লোকটা।
কী ব্যাপারটা হচ্ছে? টিকটিকি নাকি?
ও কিছুই দেখেনি এমন ভান করে খেতে লাগল। এখানে তো কোনো শালা বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না। গাড়ি চালাতে চালাতে আসে, এখানে দাঁড়িয়ে খায়দায়, পেচ্ছাপ করে, ব্যস চলে যায়, সেখানে এ মক্কেল এতক্ষণ ধরে এখানে কী করছে? মুন্না আসার সময় থেকেই এসেছে, যতটুকু ও খেয়াল করতে পারছে।
পুলিশের লোক হলেও তেমন চাপের কিছু নেই, ফজলুল গাড়ির ভেতরে যেভাবে মাল সিজ করে, কারুর ক্ষমতা নেই ধরতে পারে। শুধু ডেলিভারির আগে এই মালটাকে আউট করে দিতে হবে যেভাবে হোক।
মুন্না ধীরেসুস্থে চিবিয়ে খেতে লাগল।
১৯
সুরঞ্জন এক মুহূর্তের জন্য খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন বিনা অনুমতিতে ম্যানুস্ক্রিপ্টটায় হাত দেওয়ার জন্য। অঘোরেশ এমনিই একটু অন্যরকম, দুম করে রেগে যায়, এই ব্যাপারে ওর প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটা আন্দাজ না করেই সুরঞ্জন বলে ফেললেন, ‘কী রে, এত দেরি হল কফি আনতে? তোর কালেকশন দেখছিলাম আর কি, ঘুরে ঘুরে!’
কিন্তু অঘোরেশ কিছু মনে করলেন না, কফির একটা কাপ সুরঞ্জনের দিকে বাড়ালেন, অন্যটা রুদ্রর হাতে দিলেন, তারপর খসখসে গলায় বললেন, ‘বেশ করেছিস। তোর সঙ্গে এই ব্যাপারে আলোচনা করব বলেই তো ডেকেছি।’ তারপর একটু থেমে একটা চিনির ডিব্বা এগিয়ে ধরলেন, ‘চিনির কৌটোটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই দেরি হল।’
সুরঞ্জন কিছু বললেন না। একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করবেন অঘোরেশের স্ত্রী কি ভেতরেই আছেন? খুব অসুস্থ না হলে একবার আলাপ করতেন। কিন্তু না, কথাটা গিয়ে ফেললেন। চুপচাপ কফির কাপটা হাতে নিয়ে স্তূপাকৃতি বইয়ের পাশে কার্পেটে বসে পড়লেন।
হঠাৎ করেই ঘরের মধ্যে যেন অস্বাভাবিক একটা নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে।
রুদ্র চুপচাপ লক্ষ করছিল। অঘোরেশ লোকটা ওরা আসার পর থেকে একবারের জন্যও রুদ্রর সঙ্গে কথা বলেননি, এমনকী রুদ্রর দিকে তাকাননি। মনে হচ্ছে সুরঞ্জন একাই যেন রয়েছেন ঘরে। ও-ও কিছু না বলে কফির কাপটা মাটিতে নামিয়ে রাখল।
অঘোরেশই মুখ খুললেন, পাণ্ডুলিপিটার দিকে ইশারা করে বললেন, ‘ওটা দেখলি?’
সুরঞ্জন বললেন, ‘হ্যাঁ।’ চিনিসর্বস্ব কালো কফিতে চুমুক দিয়ে তাঁর মুখ বিস্বাদ হয়ে উঠল। নির্ঘাত অঘোরেশ নিজেই কফিটা বানিয়েছে!
অঘোরেশ পাণ্ডুলিপিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘আবদুল হামিদ লহরীর লেখা শাজাহানের বায়োগ্রাফি বাদশাহনামা।’
সুরঞ্জন কিছু না বলে চেয়ে রইলেন অঘোরেশের দিকে।
অঘোরেশ বলে চললেন, ‘তোকে পুরো ব্যাপারটা খুলেই বলি। তুই তো আমাকে বহুদিন ধরেই চিনিস। মোনোটোনাস জীবন আমার একদম পছন্দ নয়। ইউনিভার্সিটিতে পড়াতাম ঠিকই, কিন্তু সবসময় নতুন কোনো কিছু জানার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম। বেশ কিছু বছর যাবৎ আমি এমন একটা জিনিস নিয়ে কাজ করছি যেটা জানলে তুই আশ্চর্য হয়ে যাবি।’
সুরঞ্জন বললেন, ‘সেদিন তো বললি, শাজাহানের সময়ের পিনাল কোড, ল। এসব নিয়ে তো?’
অঘোরেশ ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন, ‘ধুর! ওটা তো ওপর ওপর লোককে বলেছি। আসল টপিকটা এখনই কাউকে জানাতে চাই না। তবে আমার কাজ কয়েকদিনের মধ্যেই সারা পৃথিবী জানবে, তখন প্রতিটা ইতিহাস বই আবার নতুন করে লিখতে হবে।’
রুদ্র হঠাৎ বলে ফেলল, ‘ড নিজামুদ্দিন বেগও তো এই নিয়েই গবেষণা করছিলেন। আপনি তাঁকে চিনতেন?’
অঘোরেশ যেন থমকে গেলেন, গভীরভাবে তাকালেন রুদ্রর দিকে, ‘তুমি কী করে চিনলে ওঁকে?’
রুদ্র চোখে চোখ রেখে বলল, ‘উনি নিরুদ্দেশ, গোটা আগ্রা জানে। এখনও ওঁর বাড়িতে হামলা হয়ে চলেছে।’
অঘোরেশ জোরে জোরে মাথা নাড়লেন দু-দিকে, ‘না, আমি চিনি না। ওই নামে আমি কাউকেই চিনি না!’ তারপর সুরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই নিশ্চয়ই জানিস, শাজাহান তাঁর ঠাকুরদা আকবরের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। ঠাকুরদার জীবনী আকবরনামার মতোই শাজাহানও চেয়েছিলেন তাঁরও একটা সম্পূর্ণ জীবনী লেখা থাকুক। তিনি মুঘল দরবারে রাজত্ব করেছিলেন প্রায় ত্রিশ বছর। প্রথমে মহম্মদ আমিন কাজভিনি বলে একজন তাঁর জীবনী লিখতে শুরু করেন, তারপর মোট দুটো খণ্ডে কাজটা সম্পূর্ণ করেন আবদুল হামিদ লহরী। লহরী সায়েবকে শাজাহান নিজের সভায় একটা গুরুত্বপূর্ণ পদও দিয়েছিলেন।’
সুরঞ্জনের এই তথ্যগুলো জানা এবং অদ্ভুত কাকতালীয়ভাবে আজ সকালে রুদ্রর সঙ্গে গল্পও করেছিলেন এই নিয়ে। বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে তাঁর স্পেশালাইজেশন থাকলেও মাস্টার্সে মধ্যযুগের ইতিহাসও তাঁর সাবজেক্ট ছিল। তিনি সংক্ষেপে বললেন, ‘জানি।’
রুদ্র দু-জনের কথোপকথন শুনছিল, শুনতে শুনতেই ও জানলার পাশটায় গেল একবার, এবারেও পাল্লা না খুলে ফাঁক করল, না, কেউ নেই। ফাঁকটা বন্ধ করতে যেতেই ওর চোখে পড়ল দূরে চায়ের গুমটিটা, সেখানে একভাবে বসে রয়েছে লোকটা, তাকিয়ে আছে এইদিকেই।
রুদ্র চিন্তিতভাবে ঘরের ভেতরে তাকাল, অঘোরেশ উজ্জ্বল মুখে সুরঞ্জনকে বলছিলেন, ‘আচ্ছা একটা কথা বল, শাজাহানের নিজের সভাসদের লেখা এই বায়োগ্রাফিতে আমরা যদি এমন কোনো ইনফরমেশন বা ঘটনা পাই, যেটা শাজাহানের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে না, সেটা তো তাহলে সত্যি হবেই, তাই না? মানে, এই বায়োগ্রাফিটা নিশ্চয়ই বাদশা নিজে ভেরিফাই করে তারপর গ্রিন সিগনাল দিয়েছিলেন জনসমক্ষে আনার, তারপরেও এমন ঘটনা লেখা রয়েছে মানে সেটা সত্যিই ঘটেছিল, ঠিক কি না?’
সুরঞ্জন ওপরনীচে মাথা নাড়লেন। অঘোরেশ ঠিকই বলছেন। স্তাবকের লেখা বায়োগ্রাফিতে থাকা ভালো ঘটনাগুলো মিথ্যে না হলেও বহুমাত্রায় অতিরঞ্জিত থাকে, কিন্তু খারাপ কিছু লেখা থাকলে সেটা সত্যি হতে বাধ্য।
অঘোরেশ বললেন, ‘গুড!’ এবার পাণ্ডুলিপিটার একটা পৃষ্ঠা খুলে এগিয়ে দিলেন সুরঞ্জনের দিকে, ‘এটা ৪০৩ নম্বর পৃষ্ঠা। একুশ নম্বর লাইন থেকে জোরে জোরে পড়।’
সুরঞ্জনের ভ্রূ কুঁচকে গেল। ফার্সি-আরবি মেশানো ন্যাস্টালিক ক্যালিগ্রাফি তিনি পড়বেন কী করে! অঘোরেশের মধ্যযুগীয় ইতিহাসের ওপরেই পড়াশুনো, কিন্তু সুরঞ্জনের তো তা নয়! অতি উত্তেজনায় মনে হয় অঘোরেশের মাথা কাজ করছে না, ‘আমি কী করে পড়ব। তোর সাবজেক্ট। আমি পড়তে জানি নাকি! তুই পড়, আমি শুনি।’
অঘোরেশ সঙ্গেসঙ্গে ফেরত নিয়ে এলেন, ‘ও হ্যাঁ তাই তো! ঠিক আছে, আমি পড়ছি। উর্দুর মতোই, ডান দিক থেকে শুরু করে বাঁ-দিকে পড়তে হয়। শুধু পুরোনো ফার্সির প্রভাব আছে এতে। যাই হোক, আমি হিন্দিতে ট্রান্সলেট করে পড়ছি, তুই শোন।’
সুরঞ্জন একটু উশখুশ করে রুদ্রর দিকে তাকালেন, কিন্তু রুদ্র তাঁকে ইশারায় ধৈর্য ধরতে বলল।
সুরঞ্জন মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন। আরও দেরি হলে পূরবী চিন্তা করবেন। কিন্তু, অঘোরেশের আসল দরকারটা তো এখনও বোঝা যাচ্ছে না! তিনি ঠিক করলেন আর কুড়ি মিনিটের মধ্যে তাঁকে উঠতেই হবে।
অঘোরেশ থেমে থেমে হিন্দিতে ট্রান্সলেট করে পড়তে শুরু করলেন, ‘শুক্রবার, ১৫ জুমাদিল আওয়াল, পরলোকগতা রানি মুমতাজ-উল-জামানির সেই পবিত্র মরদেহ, যা বুরহানপুরে অস্থায়ীভাবে কবরস্থ করা হয়েছিল, তা রাজধানী আকবরাবাদে আনা হল। সঙ্গে এলেন যুবরাজ শাহ সুজা বাহাদুর, ওয়াজির খাঁ এবং রানির খাস দাসী সতিউন্নেশা খানম।
‘সম্রাট আদেশ দিলেন যে, প্রত্যহ দীন-দুঃখী ও পির-ফকিরদের মধ্যে জাকাত বিতরণ করা হোক। শহরের দক্ষিণে, যেখানে সবুজ তৃণগুল্মে আচ্ছাদিত বিশাল উদ্যান, যার মধ্যবর্তী স্থানে সেই বিশাল সাদা ইমারত, যা পূর্বে রাজা মানসিংহের সম্পত্তি ছিল এবং যার বর্তমান মালিক তাঁর পৌত্র রাজা জয়সিংহ, সেই প্রাসাদেই জন্নতবাসী রানিকে কবরস্থ করা হবে স্থির করা হল। যদিও রাজা জয়সিংহ তাঁর পূর্বপুরুষের সেই সম্পত্তিকে অতিশয় মূল্যবান মনে করতেন, তথাপি সম্রাট শাজাহানকে তা বিনামূল্যে ছেড়ে দিতে রাজি হলেন। কিন্তু ধর্মীয় নিয়মাবলি ও মৃতার প্রতি মর্যাদার কথা চিন্তা করে সতর্ক সম্রাট সেই প্রাসাদ বিনামূল্যে অধিগ্রহণ করাটা যুক্তিযুক্ত হবে না বিবেচনা করে শরিফাবাদ নামক স্থানে রাজা জয়সিংহকে পুনর্বাসন দিলেন। কাজেই সেই বিশাল প্রাসাদের বদলে জয়সিংহকে সরকারি জমি দান করা হল। শবদেহ আগ্রায় পৌঁছোবার পর, সেই শোভন শবদেহকে সেখানে চিরবিশ্রামে শায়িত করা হল। আকাশচুম্বী সেই সমাধিক্ষেত্রে উপস্থিত রাজধানীর উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা সরকারি নির্দেশে, সেই পুণ্যবতী রমণীর মরদেহকে সাধারণের দৃষ্টির আড়াল করল এবং সেই গাম্ভীর্যপূর্ণ, শীর্ষদেশে জয়সিংহের গম্বুজ শোভিত বিশাল প্রাসাদ রানি মুমতাজ-উল-জামানির এক অসাধারণ স্মৃতিসৌধে পরিণত হল। সমগ্র কাজের জন্য ৪০ লক্ষ অর্থ ব্যয় করা হল।’
অঘোরেশ এই পর্যন্ত পড়ে থামলেন, বললেন, ‘জুমাদিল আওয়াল হল ইসলামিক ক্যালেন্ডারের পঞ্চম মাস। প্রথম মাস মহরম দিয়ে শুরু করে বারোটা মাসে শেষ হত ওই ক্যালেন্ডার। মুমতাজ-উল-জামানি হলেন শাজাহানের স্ত্রী মুমতাজ। আসল নাম অবশ্য ছিল আরজুমান্দ বানু। আর ওই যে বলছে রানির মরদেহ আকবরাবাদে আনা হল, ওটা হল আগ্রারই তখনকার নাম। আর জাকাত মানে তো বুঝতেই পারছিস দানখয়রাত করা।’
সুরঞ্জন চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন, অঘোরেশ থামতে একটু কনফিউজড হয়ে বললেন, ‘মানে, এতে লেখা রয়েছে শাজাহানের স্ত্রী মুমতাজকে রাজা মান সিং-এর এক প্রাসাদকে স্মৃতিসৌধে পরিণত করে কবরস্থ করা হল?’
অঘোরেশের চোখ জ্বলজ্বল করছিল, নিজের ঊরুর ওপর হাত চাপড়ে বললেন, ‘ইয়েস!’
সুরঞ্জন বললেন, ‘কিন্তু, তা কী করে হয়! শাজাহান তো তাজমহল বানিয়েছিলেন মুমতাজের স্মৃতিসৌধ হিসেবে! তুই ঠিক পড়ছিস তো? এরকম তো কোনো প্রাসাদের কথা শুনিনি।’
অঘোরেশ চট করে উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর ফর্সা মুখ টকটকে লাল রং ধারণ করেছে, চোখগুলো যেন জ্বলছে, চিৎকার করে বললেন, ‘তোদের মতো লোকেদের জন্য ইতিহাস কোনোদিনও সত্যি কথা বলে উঠতে পারল না। তোদের চোখ থেকেও নেই, তোরা অন্ধ!’
সুরঞ্জন কড়া গলায় বললেন, ‘কী বলতে চাইছিস ঠিক করে বলবি কি? না হলে আমি এবার উঠি, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার!’
অঘোরেশ অমনি কাছে এসে সুরঞ্জনের হাত চেপে ধরলেন, ‘লিটল বুদ্ধা, খোদ শাজাহানের সরকারি বায়োগ্রাফিতে লেখা আছে যে তাজমহল শাজাহান বানাননি, রাজা মানসিংহের একটা প্রাসাদ, যাতে শিবমন্দির ছিল, সেটাকেই রেনোভেট করে তাজমহল নাম দিয়েছিলেন। আর ইতিহাসে এই কথাটা পুরো চেপে যাওয়া হয়েছে। আমি অনেক প্রমাণ পেয়েছি।’
সুরঞ্জনকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অঘোরেশ আরও জোরে হাত ঝাঁকালেন, ‘আর শোন, আমি শুধু প্রমাণ পেয়েই ছেড়ে দিচ্ছি না। সারা পৃথিবীর সামনে আমি সত্যিটা তুলে ধরব। সেরকমভাবেই আমরা এগোচ্ছি।’
সুরঞ্জন বললেন, ‘এই একটামাত্র কথার পরিপ্রেক্ষিতে এটা কী করে প্রমাণ হচ্ছে? শোন, দেড়-দু-হাজার বছর হলে একরকম ছিল, এই তো চার-পাঁচশো বছর আগেকার কথা, এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, শাজাহানের সময়কার আরও অনেক এভিডেন্স আছে, সেগুলো দেখলেই তো পাওয়া যাবে। সব কি চেপে যাওয়া যায় নাকি! তাজমহল বানাতে কুড়ি বছর সময় লেগেছিল, অত হাজার হাজার লেবার, তাদের পারিশ্রমিক, ম্যানেজমেন্ট, সব কিছুরই নিশ্চয়ই হিসাব…।’
অঘোরেশ মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, সব কিছুই চেপে যাওয়া হয়েছে। কত লেবার ছিল সে-ব্যাপারে কোনো জায়গাতেই সেরকম ক্লিয়ারলি কিচ্ছু বলা নেই। কোথাও বলা হয়েছে কুড়ি হাজার, কোথাও চল্লিশ হাজার, কোথাও আবার তারও বেশি। এরকম আর একটা ইম্পর্ট্যান্ট জিনিসের তো হিসাবের খাতাতে পরিষ্কার হিসেব থাকা উচিত, তাই না! শাজাহানের যথেষ্ট ভালো ভালো সব অ্যাকাউন্টেন্ট ছিল। আর তা ছাড়া শাজাহানের ত্রিশ বছরের শাসনকালে বাদশাহনামা ছাড়াও আরও অনেক বই লেখা হয়েছে। ইজায়েত খাঁ লিখেছিলেন শাজাহাননামা, বখতিয়ার খাঁ-র মিরাত-ই-আলম, মুফাজ্জাল খাঁ-র তারিখ-ই-মুফাজ্জালি, এত বড়ো একটা জিনিস তৈরি হচ্ছে কুড়ি বছর ধরে, সে-ব্যাপারে কোথাও কোনো উল্লেখ নেই কেন?’
সুরঞ্জন থতোমতো খেয়ে রুদ্রর দিকে তাকালেন।
এতক্ষণ বাদে রুদ্র মুখ খুলল, ‘একজন মাত্র সভাসদ, তাঁর লেখা একটা অনুচ্ছেদ থেকেই আপনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে তাজমহল শিবমন্দির ছিল? তাহলে তাজমহলের গায়ে কোরানের বাণী খোদাই করা আছে কেন? এত বড়ো বড়ো ইতিহাসবিদ, তাঁরা কি সব ভুল লিখেছেন?’
অঘোরেশ এবার রুদ্রর দিকে তাকালেন। চোখের দৃষ্টি একবার জ্বলেই আবার নিভে গেল, বললেন, ‘দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, স্বাধীনতার পর থেকে ইতিহাসের যে ক-টা প্রামাণ্য বই লেখা হয়েছে, সেগুলো সবই একপেশে, পক্ষপাতদোষে দুষ্ট। সত্যি কথা ক-টা লেখা হয়েছে? নেতাজির পেছনে কেমনভাবে চক্রান্ত করা হয়েছিল, লেখা আছে কোথাও? শয়ে শয়ে রাজপুত প্রাসাদকে কীভাবে মুসলমানরা নিজেদের হারেমে, নিজেদের মসজিদে পরিণত করেছিল, কোথাও বলা আছে? তোমরা সব এখনকার ছেলেমেয়েরা তো সেই ইতিহাসই পড়ছ! তাই, তোমরা সত্যিটা হজম করতে পারছ না।’ তিনি একটা লম্বা শ্বাস নিলেন, ‘যাই হোক, তুমি আরও জানতে চাইছ বলে বলছি, শোনো তাহলে। শাজাহান যখন দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ করছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গেই ছিলেন স্ত্রী মুমতাজ, সেখানেই ১৬৩১ সালে তিনি চোদ্দো নম্বর সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। বুরহানপুরে তাঁকে অস্থায়ী কবর দেওয়া হয়। এদিকে পরের বছরই লহরী সাহেব লিখছেন, তাঁর কবর তুলে নিয়ে এসে সমাধিস্থ করা হয় তাজমহলে। তাজমহল তৈরি করতে লেগেছিল নাকি প্রায় একুশ বছর, ১৬৩২ থেকে ১৬৫৩ সাল অবধি, তাহলে মাঝের কুড়িটা বছর বুরহানপুর থেকে তুলে নিয়ে মুমতাজের কবরকে কি খোলা মাঠে রাখা হয়েছিল? আর যে প্রাসাদ সবে তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে, তাতে মাত্র একবছর বাদেই কেন মুমতাজের কবর নিয়ে চলে আসা হবে যদি না শাজাহান একটা রেডিমেড প্রাসাদ আগে থেকেই পেয়ে থাকেন?’
সুরঞ্জন বললেন, ‘এগুলো তো অনুমান!’
‘অনুমান? কী করে অনুমান হচ্ছে? আচ্ছা, তাহলে আরও শোন।’ অঘোরেশ সামনে থেকে ধূলিধূসরিত একটা বই তুলে নিলেন, ‘শাজাহানের সময়ে ১৬৪১ সালে টাভার্নিয়ার নামে একজন ফ্রেঞ্চ অলংকার ব্যবসায়ী ভারতে আসেন। তিনি প্রায় পঁচিশ বছর সুরাট, আগ্রা এইসব জায়গায় ছিলেন। টাভার্নিয়ার লিখে গেছেন ভারতে আসার পরই তিনি শাজাহান পত্নীর বিখ্যাত সমাধিটি দেখতে যান।’ অঘোরেশ বইয়ের একটা পাতা খুলে সামনে এগিয়ে দিলেন, ‘তিনি লিখে গেছেন, জায়গাটা ছিল তাসি মকানের মাঝখানে, তাসি মকান তখন আগ্রার বিখ্যাত তুলোবিক্রির বাজার, পুরো বাজারটায় বেচাকেনার জন্য ছোটো ছোটো দোকান ছিল, আর পুরো তাজমহলের বাইরেই তখন ইট দিয়ে বিশাল পাঁচিল তুলে দেওয়া হয়েছিল, ফলে তিনি ভেতরে গিয়ে কিছু দেখতে পাননি, কিন্তু ভারা বাঁধার কাজে নাকি সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছিল।’
‘তো?’ রুদ্র বলল, ‘এ থেকে কী প্রমাণ হচ্ছে?’
‘প্রমাণ হচ্ছে এটাই যে, তাজমহল বহুমূল্য পাথর দিয়ে তৈরি, সেখানে এতরকমের খরচের মধ্যে ভারা বাঁধার খরচ সবচেয়ে বেশি এমন উদ্ভট কথা টাভার্নিয়ার বলবেন কেন? তার কারণ, শাজাহান শুধু হিন্দু প্রাসাদটির চারপাশে ভারা বেঁধে কোরানের বাণী উৎকীর্ণ করিয়েছিলেন আর কবরটা বানিয়েছিলেন। তা ছাড়া তাজমহলের তিন পাশে সার দিয়ে যে ছোটো ছোটো ঘর রয়েছে, সেটাই সেই তাসি মকান, হিন্দু রাজার আমলের তুলো বিক্রির বাজার।’
‘তাজমহলের পাশের ছোটো ছোটো ঘরগুলো তো যে শ্রমিকরা বানিয়েছিল, তাদের থাকার ঘর ছিল!’ রুদ্র বিমূঢ়ভাবে বলে উঠল, ‘মানে, গাইডরা তো তাই বলে!’
‘গাইডরা তো সব জেনে উলটে দিয়েছে, না! কোন কবরখানার চারপাশে শ্রমিকদের থাকার জায়গা করা আছে, একটু বলবে? দুনিয়ার কোথাও দেখেছ যে কোনো বিখ্যাত স্থাপত্যের চারপাশে শ্রমিকদের থাকার জায়গা? শ্রমিকদের কথা কে ভাবে?’
রুদ্র একটু ইতস্তত করে বলে উঠল, ‘মিশরের দানবীয় পিরামিডগুলো যখন তৈরি হয়েছিল, তখন কিন্তু তার আশেপাশেই সব শ্রমিক আবাসন তৈরি হয়েছিল।’
‘সেগুলো এত সুন্দর নয়।’ অঘোরেশ বললেন, ‘ইতিহাসবিদ কিন নিজে লিখে গিয়েছেন যে তাজমহলের শ্রমিকদের খুব কম অর্থের বিনিময়ে প্রচণ্ড খাটানো হত। আর তাজমহলের দু-পাশে দুটো যমজ প্রাসাদ, একটা মসজিদ, অন্যটা নাকি অতিথিশালা। কবরের পাশে অতিথিশালাই-বা কোথায় থাকে? তাজমহলের ডান পাশের মেহমানখানাটা আসলে সেই হিন্দু প্রাসাদের অতিথিভবন ছিল। আরও অনেক অনেক প্রমাণ আছে এর স্বপক্ষে।’
সুরঞ্জন নির্বাক। একটু কিন্তু কিন্তু করে বললেন, ‘পুরো ব্যাপারটাই কেমন জোর করে সাজানো মনে হচ্ছে!’
অঘোরেশ চোখ সরু করে কেটে কেটে বললেন, ‘তুইও দেখছি ব্রিজেশ মাথুরের মতো কথা বলছিস! তোরা আসলে সেট করে রাখা গতানুগতিক কাঠামোর বাইরে কিছু ভাবতে পারিস না!’
রুদ্র চমকে উঠল। ব্রিজেশ মাথুর ভারতের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ। বাবার কাছে ওঁর নাম অনেকবার শুনেছে। দেশে-বিদেশে অসংখ্য সমাবেশে সমাদৃত হয়েছেন উনি।
কিন্তু রুদ্রর চমকে ওঠা সেইজন্য নয়। এই ব্রিজেশ মাথুরই নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সেই প্রফেসর নিজামুদ্দিন বেগের কলামকে ‘বিকৃত কল্পনা’ বলে হেয় করেছিলেন, কাগজে পড়েছিল ও।
তার মানে অঘোরেশ ভাট আর নিজামুদ্দিন বেগের মধ্যে যোগাযোগ আছে এটা ধরে নেওয়া যায় কি?
রুদ্র শুনতে শুনতে ক্রমাগত ফোনে চেষ্টা করে যাচ্ছিল নাহুম খানকে।
ভদ্রলোক গেলেন কোথায়?
Leave a Reply