১৯. সান্টাক্রুজ থেকে বোসদার প্রথম চিঠি

সান্টাক্রুজ থেকে বোসদার প্রথম চিঠি পেয়েছিলাম।

প্রিয় শংকর,

এয়ারওয়েজের দৌলতে এখানের এক হোটেলে এসে উঠেছি। ধোপার ছেলে এবং রাজপুত্রের সেই গল্পটা বার বার মনে পড়ছে। কাপড় কাচতে কাচতে বিরক্ত হয়ে যে ভগবানের কাছে মুক্তির প্রার্থনা করেছিল, ভগবান তাকে বর দিয়ে রাজপুত্র করে দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজপুত্রের কিছুই ভালো লাগে না। মন্ত্রীপুত্র, কোটালপুত্র সবাই আসে, কিন্তু রাজপুত্র মনমরা হয়ে বসে থাকেন। শেষে আর থাকতে না পেরে রাজপুত্র বললেন, এসো ভাই আমরা কাপড় কাচা, কাপড় কাচা খেলি। রাজপুত্র সেজে হোটেলের লাউঞ্জে বসে রয়েছি; তোমাদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, আর কাপড় কাচা, কাপড় কাচা খেলতে ইচ্ছে করছে।

তোমার সুজাতাদি এখানে ডিউটিতে এসেছিলেন। একদিন দেখা হয়েছে। যা যা ঘটবে তা অবশ্যই তোমাকে জানিয়ে যাব। ঘর-সংসারের কথা তেমন খুঁটিয়ে ভাববার অবকাশ কোনোদিন পাইনি—এখন ক্রমশ লোভ বাড়ছে।

তোমরা আমার ভালোবাসা জেনো।

কয়েকদিন পর বিছানায় চুপচাপ শুয়েছিলাম। ঠিক সেই সময় সুজাতাদি আমার ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন।এই যে শ্রীমান। খবর কী? তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বললাম, যাক, তাহলে এখনও সব ভুলে যাননি। সুজাতাদি হেসে বলেছিলেন, একেই বলে নেমকহারাম, হাজার মাইল ফ্লাইট ডিউটি করে হোটেলে এসেই একবস্ত্রে তোমার ঘরে চলে এসেছি। না এসেও বা উপায় কী?

তোমার দাদার অর্ডার, প্রথমেই ওদের খোঁজখবর নেবে।

দাদা কেমন আছেন? প্রশ্ন করলাম। সুজাতাদি বিষণ্ণভাবে বললেন, ও প্রশ্ন করো না। এক মাটির গাছকে শিকড় সুষ্ঠু তুলে নিয়ে অন্য মাটিতে লাগাতে গিয়ে বোধহয় ভুলই করেছি। তোমার দাদা আর সেই আমুদে রসিক দাদা নেই। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকেন। মুখে অবশ্য স্বীকার করতে চান না।

আমি বলেছি, দাদা যাতে আর মনমরা না হতে পারেন, সে ব্যবস্থা করুন! সুজাতাদি একটু লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলেন। তারপর বলেছিলেন, সেটা তো

তোমার দাদার উপর নির্ভর করে। আমার কী, আমি তো এখনই চাকরি ছেড়ে দিতে রাজি আছি।

তা হলে বাধাটা কোথায়? দাদার পোবেশন পিরিয়ড! ছমাস পরে, অসংখ্য বন্ধন মাঝে লভিবেন মুক্তির স্বাদ!

সুজাতাদি চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, অনুমতি করলে সাহিত্যিক ঢঙে বলতে পারি, আর কয়েক মাস পরে কোনো নভোচারিণী আমার সত্যসুন্দরদার স্বপনচারিণী হবেন।

সুজাতাদি রেগে গিয়ে বলেছিলেন, বড্ড ফকে হয়ে যাচ্ছ, এবার কানমলা খাবে।

রোজিকে খুব খুশি মেজাজে দেখছিলাম। সে বললে, আর আমার চিন্তার কারণ নেই। জিমি ম্যানেজার হচ্ছে। জিমির বিদ্যের দৌড় আমার জানা আছে। চিঠিপত্তর লেখা আমাকে না হলে চলবে না।

আমি কোনো উত্তর দিইনি। রোজির মুখেই শুনেছিলাম মার্কোর বিদায় নেবার সময় আগত।

দীর্ঘদেহী মার্কোর বিদায় দিন আজও আমার চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠছে। বাইরে শাজাহানের গাড়িতে মালপত্তর উঠে গিয়েছিল। বেয়ারারা প্যান্ট্রির সামনে সার দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্য কর্মচারীরাও বাদ যায়নি। সাদা প্যান্ট এবং হাফ শার্ট পরা মার্কোকে অনেকটা নৌবহরের ক্যাপটেনের মতো দেখাচ্ছিল। মার্কোর পাশে জিমিও দাঁড়িয়েছিল। মার্কো একে একে সবার সঙ্গে করমর্দন করলেন। তারপর বললেন, কিপ দি ফ্লাগ ফ্লাইং। যদি কোনোদিন কোনো কাজে অনেক দিন পরে শাজাহান হোটেলে আমি আসি, তা হলে যেন দেখি জিমির নেতৃত্বে শাজাহান আরও উন্নতি করেছে। জিমিকে মার্কোপোলো গম্ভীরভাবে বললেন, লুক আফটার মাই বয়েজ।

মার্কোপোলোর বিদায়ের পর মনে হল এক শূন্য অভিশপ্ত প্রাসাদে আমি একলা বাস করছি। শীতের দিনে ভারবেলায় আমরা যখন এখানে প্রবেশ করেছিলাম, তখন পান্থশালা আমাদের প্রিয় এবং পরিচিত জনে পরিপূর্ণ ছিল। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ব্রেকফাস্টের পর বিদায় নিলেন। দুপুরের লাঞ্চের পরে আরও কয়েকজনকে দেখতে পেলাম না। অপরাহে চায়ের পর অনেকে অদৃশ্য হলেন। রাতের ডিনারের সময় সমাগত। এখন কেউ নেই। সমাজ, সংসার, স্ত্রী-পুত্র, পরিজন সবাইকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়ে বৃদ্ধ গৃহস্বামী যেন একা রাতের জনশূন্য ডিনার টেবিলে এসে বসেছি।

 

মার্কোপোলোর বিদায়ের পর জিমি এবার নিজমূর্তি ধারণ করছে। জিমি বলছে, পুরনো কায়দায় আর হোটেল চলবে না। খোল নলচে দুই পাল্টে হোটেলকে নতুন করে তুলতে হবে। সত্যসুন্দরদার জায়গায় আধুনিক পদ্ধতিতে তাই একজন রুজলিপস্টিক-চর্চিতা যুবতী মহিলাকে আমদানি করেছেন।

ওই পোস্টে রোজির বসবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু জিমি সোজা বলে দিয়েছে, তোমার ওই ছিরিতে হোটেলের প্রধান রিসেপশনিস্ট হওয়া যায় না। কাউন্টারে উইলিয়ম ঘোষ এবং আমি কেবল টিমটিম করে জ্বলছিউইলিয়মকে অবশ্য জিমি এখন বেশির ভাগ সময় অ্যাকাউন্টের কাজে লাগাচ্ছে। টাকা-কড়ি জমা নেওয়া, চেক ভাঙানো এই সবই তাকে বেশি করতে হয়।

এরই মধ্যে উইলিয়মের কাছে শুনলাম, মিস্টার আগরওয়ালা হোটেলের কন্ট্রোলিং শেয়ার বিলেতের অংশীদারদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন। মিস্টার আগরওয়ালার কথা উঠলেই জিমি যেভাবে বিনয়ে বিগলিত হয়ে পড়ছিল তার থেকেই ব্যাপারটা বোধহয় আমাদের আন্দাজ করা উচিত ছিল।

উইলিয়ম বলেছিল, আপনার ভালো হলো। মিস্টার ফোকলা চ্যাটার্জিই সব দেখাশোনা করবেন। আপনার সঙ্গে তো ওঁর খুব জানাশোনা।

 

ফোকলা চ্যাটার্জি একদিন হোটেল দেখতে এলেন। জিমিকে প্রচুর আদর করে বললেন, আমরা কিন্তু ইউরোপিয়ান ম্যানেজমেন্টই রাখতে চাই। তবু সবকিছু যেন মডার্ন হয়—সিম্পসন সায়েবের ধাঁচে আজকাল হোটেল চলে না। তখন মেয়েরা ঘোমটা দিয়ে অন্তঃপুরে বসে থাকত। এখন তারা রাস্তায় বেরিয়েছে। জিমি গদগদ হয়ে বলেছে, যা বলেছেন, মিস্টার চ্যাটার্জি। পাইপের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ফোকলা বলেছেন, আমাদের মধ্যে কোনো সঙ্কীর্ণতা পাবেন না। আপনার দৈনন্দিন কাজের মধ্যে আমরা নাক গলাতেও আসব না। মিস্টার আগরওয়ালা চান, এবং আমিও চাই, আপনি অ্যাট্রাকটিভ গালর্স নিয়ে আসুন—সর্ব জাতির মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠুক এই শাজাহান হোটেল।

অনেক অজানা মুখেই হোটেলটা ক্রমশ ভরে উঠছে। এখন সব-কিছুই গোপনে হয়। ফোকলা চ্যাটার্জি আমাকে দেখেও দেখতে পান না। মাঝে মাঝে সত্যসুন্দরদা, বায়রন এবং মার্কোপোলো সায়েবের কথা মনে পড়ে। তারা পাশে থাকলে আজ এতখানি অসহায় বোধ করতাম না।

কিন্তু পৃথিবীতে কে কাকে চিরদিন দেখতে পারে? গোমেজ বলেন, একমাত্র অলমাইটি ছাড়া কারুর উপরেই তুমি চিরদিনের জন্যে নির্ভর করতে পার না।

নিজের ঘরে আলো না জ্বালিয়ে গোমেজ নিঃশব্দে বসেছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন, এতদিনে বোধহয় আমি নিজের ভুল বুঝতে পারছি। ঈশ্বর ছাড়া কারুরই জন্যে আমরা সঙ্গীতের অর্ঘ্য নিবেদন করতে পারি না। উই শুড্‌ ওনলি সার্ভ আওয়ার গড্‌।

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। গোমেজ বললেন,শাজাহানে আজ আমার শেষ কনসার্ট।

আমি চমকে উঠেছিলাম। গোমেজ বললেন, এরা আমাকে আর পছন্দ করছে না। সাফিসিয়েন্টলি চিয়ারফুল মিউজিক আমার যন্ত্র থেকে বেরিয়ে শাজাহানের হত্ ঘরকে প্রতিদিন যৌবনের রংয়ে রাঙিয়ে তুলতে পারছে না। জিমি এবং চ্যাটার্জি বলেছেন, আই মাস্ট গিভ দেম চিয়ারফুল মিউজিক অর কুইট।

আই মাস্ট কুইট। সাচ ইজ মাই মাস্টারস্ উইল। সেদিন ব্যান্ডেল চার্চে এক তীর্থযাত্রী ফাদারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তিনি দক্ষিণ ভারতের সমুদ্রতীরে একটা ছোট্ট চার্চের মিউজিকের দায়িত্ব আমার উপর দিতে চান। ঈশ্বরের সেই আশীর্বাদ আমি মাথায় তুলে নিয়েছি।

আমার চোখে জল আসছিল। কিন্তু গোমেজ এবার উঠে পড়লেন। আজ শেষ রজনী। আই মাস্ট গেট রেডি মাই লাস্ট কনসার্ট। আই ডোন্ট নো হোয়াই, কিন্তু বার বার আমার লন্ডনের সেই অন্ধকার রাত্রের শেপার লাস্ট কনসার্টের কথা মনে পড়ছে।

গোমেজ আজ তার ওয়ারড্রোবের সেরা স্যুটটি পরেছেন। তার ছেলেদের জামাকাপড়ের ইস্ত্রিতেও একটু খুঁত নেই। হাতির দাঁতের বাঁধানো ছোট্ট ছড়িটাও আগের থেকে অনেক বিশ্বাসের সঙ্গে ধরেছেন।

ক্যাবারে শুরু হতে তখনও দেরি রয়েছে। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে, সমাগত অতিথিদের নমস্কার জানিয়ে গোমেজ বললেন, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, আই উইল নাও ট্রিট ইউ টু সাম চিয়ারফুল মিউজিক।

সঙ্গীত শুরু হল। এ কি সেই প্রতাপচন্দ্র গোমেজ, যাঁকে এতদিন ধরে আমি শাজাহানে দেখে আসছি? এমন রক্ত-আগুন-করা চটুল সুর শাজাহানের এই ঐতিহাসিক প্রমোদকক্ষে বোধহয় কোনোদিন বেজে ওঠেনি। উপস্থিত পুরুষ অতিথিদের বিলাসী বক্ষে পার্বত্য উপজাতির রণদামামা বেজে উঠল। এমনই কোনো সুরের তালে তালে পা মিলিয়ে উর্বশী জিতেন্দ্রিয় ঋষিদের ধ্যানভঙ্গ করতেন। শাজাহানের অতিথিরা আর স্থির থাকতে পারছেন না। মনের নিষেধ অমান্য করেই তাদের দেহ দুলতে শুরু করেছে। মেঝের কার্পেটে জুতোপরা-পাগুলো তাল ঠুকছে। কিছুক্ষণ এমন চললে হ-এর সবাই ডিনার ড্রিংক ফেলে রেখে শাজাহানের ঐতিহাসিক জলসাঘরে নাচতে শুরু করবেন।

গোমেজের খেয়াল নেই। তিনি একমনে কারুর দিকে না তাকিয়ে ক্রমশই সঙ্গীতের গতি বাড়িয়ে যাচ্ছেন। আর আমার মনে হল সেই মুহূর্তে যুগযুগান্তরের নামহীন পরিচয়হীন সংখ্যাহীন যৌবনবতী আনন্দযাত্রীরা একই সঙ্গে মমতাজ হল-এ হাজির হয়েছেন, তাদের বহুজনদৃষ্টিধন্য দেহকে আবার প্রকাশ্যে নিবেদনের জন্যে অপেক্ষা করছেন। ওই তো আমি কনিকে দেখছি, প্যামেলাকে দেখছি, ফরিদাকে দেখছি, আরও অনেকে ভিড় করে রয়েছে, যাদের বোসদা কিংবা ন্যাটাহারিবাবুহয়তো চিনতে পারতেন। আজ যেন থিয়েটারের কম্বিনেশন নাইট। সম্মিলিত রজনীতে শাজাহানের যুগযুগান্তের অতিথি এবং প্রমোদ বিতরণকারিণীরা সবাই উপস্থিত হয়েছেন। একই ছবির উপর যেন অসংখ্য ছবি সুপার-ইম্পোজ করা হয়েছে। শাজাহানের এই বিশেষ ব্যাংকোয়েটে কেউ বাদ নেই। করবী আছেন, সাদারল্যান্ড আছেন, ক্লাইভ স্ট্রিটের সায়েবরা আছেন, সুরাপাত্র হাতে বার-বালিকারা আছেন, আরও অসংখ্য অপরিচিত জনরা আছেন।

হয়তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরও শুনতাম। কিন্তু বেয়ারা এসে আমাকে ডাকল—জিমি সায়েব সেলাম দিয়েছে।

কাউন্টারে রোজি এবং আমাদের নতুন মহিলা রিসেপশনিস্ট দাঁড়িয়েছিলেন। নতুন মহিলাটি ছোট্ট আয়নার সামনে প্রসাধনের ফিনিশিং টাচ দিতে ব্যস্ত ছিলেন। আর রোজি আপন মনে দাঁত দিয়ে নখ কাটছিল। আমাকে দেখেই রোজি চমকে উঠল। আমার দিকে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।কিছু বলবে? আমার প্রশ্নে রোজি আরও ভয় পেয়ে গেল। সে আবার আমার দিকে তাকাল।

জিমির ঘরে মিস্টার ফোকলা চ্যাটার্জিও বসেছিলেন। জিমি বললে, আই অ্যাম স্যরি, তোমাকে এই সময় ডেকে পাঠালাম। কিন্তু মিস্টার চ্যাটার্জি এখনই ক্যাবারেতে গিয়ে বসবেন। ওঁকে ওইসব খুঁটিয়ে স্টাডি করতে হচ্ছে। তাছাড়া আজ মাসের শেষ তারিখ। তোমার এবং আমাদের পক্ষেও সুবিধে। তোমাকে কাল থেকে আমাদের প্রয়োজন নেই।

পাইপটা মুখ থেকে বের করে ফোকলা বললেন, দাড়িগোঁফওয়ালা পুরুষদের দিয়ে রিসেপশনে যে কাজ চলে না, তা তুমি নিজেও বুঝতে পারছ নিশ্চয়। উইশইউ সাকসেস ইন লাইফ।জীবনে উন্নতি করো এই প্রার্থনা। ফাইলে দেখলাম মার্কো তোমাকে পিওরলি টেম্পরারি অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিলেন। দ্যাট মিনস এক মাসের মাইনেতেও তুমি এনটাইটল্ড নও। কিন্তু নিউ ম্যানেজমেন্ট পুরনো দিনের শোষণে বিশ্বাস করেন না। তারা সোসালিস্ট সোসাইটি গড়ে তুলতে সাহায্য করতে চান। সেই জন্যে তোমাকে এক মাসের এক্সট্রা মাইনে দেওয়া হচ্ছে।

জিমি আমার দিকে একটা নোট ভর্তি খাম এগিয়ে দিলেন। আমাকে কিছু বলবার সুযোগ না দেবার জন্যই ফোকলা বললেন, গুড় নাইট।

আমার পৃথিবীটা দুলতে আরম্ভ করেছে। ছাদে উঠে দেখলাম রোজি আমারই জন্যে অপেক্ষা করছে। আমার কাছে এসে সে বললে, আই অ্যাম স্যরি। বিশ্বাস করো, আমি চিঠি টাইপ করবার সময় জিমিকে বারণ করেছিলাম।ওর হাত চেপে ধরেছিলাম। কিন্তু জিমি মিস্টার চ্যাটার্জিকে আগে থেকেই বুঝিয়ে রেখেছে। কাউন্টারে ওরা মেয়ে রাখবে।

আকাশে তারা উঠেছে। সেই তারার দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি আর কী করবে রোজি? তোমায় ধন্যবাদ।

কিন্তু আমার দুঃখের সেই যেন শুরু। আরও সংবাদ যে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে তা বুঝিনি। গুড়বেড়িয়া তখনও কিছু জানতে পারেনি। গুড়বেড়িয়া বললে, বাবুজি, আপনার একটা চিঠি এসেছে।

সত্যসুন্দরদার চিঠিটা সম্পূর্ণ পড়বার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না। হাত থেকে ফসকে চিঠিটা মেঝেয় পড়ে গিয়েছিল। গুড়বেড়িয়া আমার সামনেই দাঁড়িয়ে থেকে ছিল। সে চিঠিটা তুলে আমার হাতে ফেরত দিয়ে বললে, কী হয়েছে, বাবুজী?

সংসারে এই হয়। আমি যাদের ভালোবাসি, যারা আমায় ভালোবাসে তাদের কোনোদিন সুখী হতে দেখলাম না। সত্যসুন্দরদা লিখেছেন

প্রিয় শংকর,

আর কাকে লিখব? আর কাকেই বা আমার লিখবার আছে? তোমার সুজাতাদির চিতাভস্ম আরবসাগরের জলে বিসর্জন দিয়ে এইমাত্র ফিরে এলাম। গতকাল গভীর রাত্রে টেলিফোনে আমাকে খবর দেওয়া হয়েছিল দিল্লির হোটেল থেকে উইলংডন বিমানবন্দরে যাবার পথে এক ভয়াবহ মোটর দুর্ঘটনায় এয়ার হোস্টেস সুজাতা মিত্র শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বিমান কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী নেকস্ট অফ কিনদের যে তালিকা থাকে, সুজাতা মিত্রের নামের পাশে সেখানে আমারই নাম লেখা ছিল।

পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে সুজাতার কাছে আমি সবচেয়ে প্রিয় হলাম। হাওয়াই কর্তৃপক্ষ সৌজন্যের কার্পণ্য করেননি। সুজাতার শেষ ইচ্ছামতো তার মৃতদেহও বিশেষ বিমানে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন।

সব স্মৃতিকে এখন দীর্ঘস্থায়ী এক স্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছে। নিজের চাকরি এবং স্বার্থের কথা ভেবে, বিয়েটা আমি পিছিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে আপন বলে স্বীকার করতে কোনো দ্বিধাই করেনি। শুনলাম, সুজাতার অফিসে ক্ষতিপূরণের টাকাও আমাকে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া আছে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সর্বদা দাঁড়িয়ে থেকে জীবনকে সে অনেকে সহজভাবে নিতে পেরেছিল। আমার মতো স্বার্থের দ্বন্দে নিজেকে ছোট মনে করেনি।

এমন আমাকে বড়লোক বলতে পারো। কিন্তু রাজপুত্র আবার বোপর ছেলেতে রূপান্তরিত হল। এখানে একলা টিকে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শাজাহানে ফেরবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সে উপায় নেই। তাই আফ্রিকার স্বর্ণ। উপকূলে মার্কো যে হোটেল গড়ে তুলছেন সেখানেই যাবার সংকল্প করেছি।

আগে বলিনি, আজ তোমাকে জানিয়ে যাই, হয়তো কোনোদিনই না হলে সে সুযোগ পাব না। সুজাতা তোমার সম্বন্ধে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করত। সে বলেছিল, দেখে নিও, he is an exceptional person।

একসেপশনাল! অসাধারণই বটে। শাজাহানের ছাদের ঘরগুলো একসঙ্গে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল। সত্যসুন্দরদার চিঠিটা আমি পকেটে পুরে ফেলেছিলাম। কিন্তু মনে হল ওরা সবাই জেনে ফেলেছে। সুজাতাদির ঔদ্ধত্য এবং আমার দুঃসাহস দেখে ওরা হেসে গড়িয়ে লুটোপুটি খাচ্ছে।

রাত অনেক হয়েছে। কিন্তু এই বাড়ির প্রতিটা ইট যেন নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে—শাজাহান থেকে চাকরি যাওয়া এই একসেপশনাল লোকটিকে তোমরা চিনে রাখো। পাগলের মতো আমি নিচেয় নামতে শুরু করেছি।

রাতের অন্ধকারে, ক্যাবারে উৎসবের শেষে, শাজাহান ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু শাজাহানের টেবিল, চেয়ার, সিঁড়ি সবাই যেন আমাকে দেখে হাসি চেপে রাখবার চেষ্টা করছে।

আমার এতদিনের পরিচিত কাউন্টারটাও আমাকে বুঝল না। সেও হাসছে, বলছে, লজ্জা করে না—কোথাকার কোন একটা মেয়ে প্রেমে মাতাল অবস্থায় কাকে কী বললে, আর গাধা তুমি সেইটা বিশ্বাস করলে।

মধ্যরাতের সেন্ট্রাল অ্যাভি, ধর্মতলা স্ট্রিট, চৌরঙ্গী রোড সবাই গভীর ঘুমে অচৈতন্য। শুধু শাজাহানের নিয়ন আলো একজন বরখাস্ত কর্মচারীকে ব্যঙ্গ করবার জন্যেই যেন নিভেছে আর জ্বলছে।

এখন আমার কিছু হারাবার ভয় নেই। আমার যা ছিল সবই বিসর্জন দিয়েছি। তবু লজ্জার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছি না। অনেকদিন আগে ক্লাইভ বিল্ডিংয়ের একটা অশিক্ষিত দারোয়ান এইভাবে আমাকে লজ্জায় ফেলেছিল। আর আজ সমস্ত স্থাবর কলকাতা সুযোগ পেয়ে আমাকে ব্যঙ্গ করছে-ওই চলেছেন, ওই তোমাদের একসেপশনাল পার্সন চলেছেন।

সেন্ট্রাল অ্যাভিন, চৌরঙ্গী, পার্ক স্ট্রিট ছাড়িয়ে পাগলের মতো হাঁটতে হাঁটতে থিয়েটার রোডের মোড়ে কখন হাজির হয়েছি খেয়াল করিনি। ইলেকট্রিক আলোর পোস্টগুলোও পথের ধারে আমাকে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েনি।

এখন যেখানে বিড়লা প্লানেটরিয়াম, সীমাহীন আকাশের সংখ্যাহীন জ্যোতিষ্কের সংবাদ যেখানে রয়েছে, ঠিক সেইখানেই আমি সাধারণ চোখেই আকাশের তারাদের সঙ্গে সেদিন সংযোগ স্থাপন করেছিলাম। ভিকটোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকে যাবার পথে বিশাল বনস্পতি দল আমাকে আশ্বাস দিয়েছিল। ওরা বলেছিল, আমরা জানিনা, হয়তো তুমি অসাধারণ, কে জানে! গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সুদূর আকাশের তারারাও যেন সেই মতে সায় দিয়েছিল—আমরা হাসব না, আমরা ব্যঙ্গ করব না। কে জানে কোথায় কী আছে—আমরা শুধু নীরবে দেখে যাব।

আগামী যুগে প্ল্যানেটরিয়ামের কোনো কল্পনাপ্রবণ দর্শক সীমাহীন গগনের ইশারা থেকে কোনো নবজীবনের ইঙ্গিত পাবেন কি না জানি না। কিন্তু সেই জনহীন রাত্রে দুর আকাশের তারারা আমাকে নতুন জীবনের আশ্বাস দিয়েছিল। বিস্ময়ভরা এই ভুবনে সেই মুহূর্তে আমি যেন নতুন করে জন্মগ্রহণ করলাম। সেই মুহূর্ত থেকেই এই পৃথিবীকে, এই শাজাহান হোটেলকে যেন অন্যরূপে দেখতে শুরু করলাম।

সুজাতাদি, করবী গুহ, কনি, গোমেজ, সত্যসুন্দর বোস, কারুর জন্যেই আমি আর বিধাতার আদালতে অভিযোগ করব না। আমি কেবল নিজেকে প্রকাশ করব। যে অসংখ্য প্রাণ আমাদেরই মতো নানা দুঃখে জর্জরিত, তাদের সঙ্গে নিজের দুঃখ সমানভাবে ভাগ করে নেব।

শান্ত মনে আবার চৌরঙ্গী পেরিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুর পথে এসে দাঁড়িয়েছি। দূরে নিয়ন-শোভিত শাজাহানের ক্লান্তিহীন ত্রিনয়ন তখনও জ্বলছে আর নিভছে।

শেষবারের মতো সেই আশ্চর্য জগতের দিকে তাকিয়ে এক বিচিত্র অনুভূতিতে আমার মন ভরে উঠল। অনেকদিন আগের এক পুরনো ঘটনা হঠাৎ মনে পড়ে গেল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আমাদের এই কলকাতা দেখতে এসে ইংরেজ কবি রুডইয়ার্ড কিপলিং আর এক প্রাচীন হোটেলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই ভয়াবহ শহরের ভয়াবহ রাত্রির সঙ্গে পরিচিত হয়ে, গভীর রাত্রে হোটেলে ফেরবার পথে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি তারই কাছাকাছি কোথাও তিনিও থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাম্রাজ্যবাদের উদ্ধত কবি এইখানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন : Al good Calcutta has gone to bed, the last tram has passed, and the peace of the night is upon the world, Would it be wise and rational to climb the spire of that kirk and shout : O true believers? Decency is a fraud and sham. There is nothing clean or pure or wholesome under the stars, and we are all going to perdition together. Amen!

মধ্যরাতের কলকাতায় দাঁড়িয়ে কর্মহীন, আশ্রয়হীন আমিও হয়তো সেই একই সর্বনাশের প্রার্থনা করতাম। কিন্তু অনেক অভিযোগ ও বিদ্বেষ থাকা সত্ত্বেও কিছুতেই তা পারলাম না।

সর্বনাশ, অধঃপতন ও ধ্বংসের চিন্তায় পুলকিত পাশ্চাত্যের গর্বিত কবি পরম ঘৃণায় বলেছিলেন, আমেন—তাই হোক। কিন্তু আকাশের অগণিত নক্ষত্র আমাকে আশা দিল, বল দিল। আমি বুঝলাম, আমাদের সামনে উদার অনন্ত সময় রয়েছে। মঙ্গলের স্পর্শে আমাদের এই পাপপঙ্কিল নগরীও একদিন নিশ্চয় পবিত্র হয়ে উঠবে।

শেষবারের মতো পিছন ফিরে আমার প্রিয় পান্থশালার দিকে তাকালাম। শাজাহানের ক্লান্তিহীন লাল আলো তখনও জ্বলছে আর নিভছে।

আমি এগিয়ে চললাম।

——-

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *