১৮. কোনো কর্মহীন অলস অপরাহ্নে

কোনো কর্মহীন অলস অপরাহ্নে আত্মীয়হীন গৃহকোণে নিঃসঙ্গ আপনি কখনও কি বহুদিন আগের হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের কথা চিন্তা করেছেন? প্রকৃতির বিশেষ কোনো পরিবেশে মনের মাটিতে যখন বৃষ্টি পড়ে তখন লোভী মনের কাছে পাওয়া থেকে না পাওয়াটাই হয়তো বড়ো হয়ে ওঠে। কিন্তু স্মৃতির ভারে জর্জরিত বিষণ্ণ মন যখন সুযোগ বুঝে সুদূর অতীতের দিকে দৃষ্টি দিতে শুরু করে, তখন পাওয়া এবং না পাওয়া থেকে, পেয়ে হারানোর বেদনা আরও বড়ো হয়ে ওঠে। শাজাহানের বিস্ময়ভরা পরিবেশে একদিন যাদের পেয়েছিলাম, সত্যিই যে তাদের হারাতে হবে, তা বুঝিনি।

হাওড়া স্টেশনের ট্রেনের কামরায় বায়রনকে যেদিন তুলে দিয়েছিলাম সেদিন সত্যিই হারিয়ে যাওয়ার বেদনা অন্তরে অনুভব করেছিলাম। ট্রেনের জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বায়রন শেষবারের মতো সত্যসুন্দরদা এবং আমার সঙ্গে করমর্দন করেছিলেন। তিনি আমার কেউ নন, এমন কিছু দীর্ঘদিনের পরিচয়ও ছিল না, তবু শূন্যতা বোধ করেছিলাম।

কিন্তু সেই যে শুরু, তা কেমন করে জানব! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বোসদাকে বলেছিলাম, এবার পা চালানো যাক, সেই কখন হোটেল থেকে দুজনে একসঙ্গে বেরিয়ে এসেছি।

সত্যসুন্দরদা কিন্তু কোনো ব্যস্ততা দেখালেন না। বললেন, উইলিয়ম রয়েছে, জিমি রয়েছে, ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে, আমার একটু চা খেতে ইচ্ছে করছে।

আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। শাজাহানের চা ছেড়ে হাওড়া স্টেশনের চা কেমন করে সত্যসুন্দরদার ভালো লাগবে?

রেস্তোরাঁয় ঢুকতে ঢুকতেও কিছু বুঝতে পারিনি। চেয়ারে বসে সত্যসুন্দরদা বললেন, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

আমি সত্যসুন্দরদার মুখের দিকে তাকালাম। বোসদা একটু লজ্জিত এবং দুঃখিত হয়েই বললেন,কী ছিলাম আর এখন কোথায় হাজির হয়েছি। নিজেকে এতদিন লোহার তৈরি বলে মনে করতাম। এখন বুঝলাম, সব ভুল।

বোসদার কথায় আশ্চর্য হয়ে ওঁর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। বোসদা এবার সঙ্কোচ কাটিয়ে বললেন, তুমি আমার ছোট ভাই-এর মতো; শাজাহান হোটেলে তুমি আমার একমাত্র বন্ধুও বটে। তোমার পরামর্শ আমার প্রয়োজন।

প্রয়োজনের সময় বোসদা সে আমার কথা ভেবেছেন তা মনে করে সত্যিই আমার আনন্দ হল।

একটা খালি ডিস নাড়তে নাড়তে বোসদা বললেন, এখন সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসেছে। আর মুলতবি রাখলে চলবে না। সুজাতাকে আজই উত্তর দেব বলে কথা দিয়েছি। এতদিন সহজভাবে কাটিয়ে এসে এবার যে মনটা আমার বিদ্রোহ করে উঠবে তা কল্পনারও অতীত ছিল।

ভালোই তো, আপনি তো কোনো অন্যায় করছেন না। আমি বললাম।

ডিসটা নিয়ে খেলা করতে করতেই বোসদা হাসলেন। চকচকে টেবিলের রঙিন কাচে সত্যসুন্দরদার সেই ছায়া প্রতিফলিত হয়েছে, তার সঙ্গেই তিনি যেন বোঝাপড়া করবার চেষ্টা করছেন। নিজের মনেই বোসদা বললেন, ন্যাটাহারিবাবুর কাছে শুনেছিলাম প্রেমরোগ অনেকটা হামের মতো কমবয়সে স্বাভাবিক, কিন্তু বেশি বয়সে দুশ্চিন্তার কারণ। কথাটা যে নিতান্ত মিথ্যে নয়, তা এখন বুঝতে পারছি।

আমি আবার বোসদার মুখের দিকে তাকালাম। বোসদা বললেন, একদিকে ভদ্রমহিলার মতো মেয়ে খুঁজে পাওয়া শক্ত। চাকরিও করেন, কাজও করেন। অথচ মনের মধ্যে ছেলেমানুষ। বাধাবন্ধনহীন এই বোড়ো হাওয়ার ভাবটুকু আমার ভালো লাগে। এই গুণটা সুজাতার মধ্যে তুমি লক্ষ্য করোনি?

ওঁর কোনো দোষ দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব। চকোলেট খাইয়ে খাইয়ে আমার নিরপেক্ষ বিচারশক্তি উনি নষ্ট করে দিয়েছেন!

হাসবার চেষ্টা করেছিলেন বোসদা, কিন্তু হাসতে পারলেন না। মনের চিন্তাগুলো দল বেঁধে গায়ের জোরে হাসির গলা চেপে ধরেছে। চাপবারই কথা। বোসদা বললেন, আমাকে ঠিক করতে হবে, শ্যাম রাখব, না কুল রাখব—চাকরি, না সুজাতা?

তার অনেক অসুবিধা সত্ত্বেও বোসদা শাজাহান হোটেলকে ভালোবেসেছিলেন। কোনো এক সামান্য পরিচিতা মৃগনয়নার জন্যে তাকে যে হোটেলের সিংহাসন ত্যাগ করার কথা ভাবতে হবে কেউ কি কোনোদিন তা জানত? বোসদা বললেন, সুজাতার ধারণা শাজাহানের রিসেপশন টেবিলে দাঁড়িয়ে আমি নিজের ক্ষমতার অপচয় করছি। এখনও পালাবার সুযোগ আছে। যে অভিজ্ঞতা এখান থেকে জোগাড় করেছি তাতে এয়ারওয়েজেই ভালো চাকরি পাওয়া যেতে পারে।

এ-সব কী বলছেন বোসদা? আমার যেন মাথা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। বোসদা বললেন, সুজাতার সঙ্গে এখনও আমাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কোনো কথা হয়নি; কথা বলবার সময়ও আসেনি। তবে যদি সত্যিই কোনোদিন আমাদের মনস্থির করতে হয়, সেদিন শাজাহানে চাকরি করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

কেন? আমি প্রশ্ন করলাম।

বিয়ের পর এয়ার হোস্টেসের চাকরি থাকবে না। শাজাহানের ম্যানেজারও কিছু ছাদের ঘরগুলোকে ফ্যামিলি কোয়ার্টারে পরিবর্তিত করবার অনুমতি দেবেন না। যা মাইনে পাই তাতে কলকাতায় আধখানা ঘরও কেউ ভাড়া দেবে না।

ক্যাপ্টেন হগকে দেখেছ নিশ্চয়। আমাদের এখানে প্রায়ই এসে থাকেন। হাওয়াই জগতের বিশিষ্ট লোক। যথেষ্ট প্রতিপত্তি। সুজাতার সঙ্গে ওঁর কথা হয়েছে। আমার উপরে খুবই সন্তুষ্ট। আমাকে এরোড্রোম বা বুকিং অফিসে একটা ভালো চাকরি দিতে রাজি আছেন। দমদম, উইলিংডন, সান্টাক্রুজ, না কোথায় যেতে হবে ঠিক নেই, কিন্তু সুজাতার ধারণা এখানকার থেকে অনেক কম কষ্ট করে আমি অনেক সুনাম অর্জন করতে পারব! বোসদা এবার আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।

কী বলব আমি? বোসদা নিজেই বুঝে উঠতে পারছেন না। চায়ের কাপটা অবহেলাভরে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললেন, শাজাহানের বাইরে আমি বেঁচে রয়েছি এ-কথা কিছুতেই ভাবতে পারছি না। নাই-বা হলো বড় চাকরি; নাই-বা পাওয়া গেল অনেক টাকা। কিন্তু বেশ সুখে রয়েছি। এমন স্বাধীনতা, প্রতিমুহূর্তে জীবিকার এমন রোমাঞ্চ আর কোথায় পাব?

না বলতে ইচ্ছে হয়েছিল আমার। আমাদের এমন নিশ্চিন্ত সংসার থেকে বোসদার মতো শুভার্থীকে হারাতে আমার স্বার্থপর মনটা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু কেমন করে তাকে সুখ এবং পরিপূর্ণতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখব? বললাম, না বোসদা, আপনি যান। সুযোগ জীবনে সব সময় আসে না। দেরিতে হলেও সে যখন এসেছে তাকে গ্রহণ করুন।

তাঁর দুটো উষ্ণ হাত দিয়ে বোসদা আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,গত জন্মে নিশ্চয়ই তুমি আমার আপন ভাইছিলে। এতদিন শাজাহানে কাজ করছি। কখনও কাউকে এত ভালোবাসিনি। সেই যেদিন প্রথম তোমায় দেখলাম, সেই মুহূর্তেই আমি হেরে গেলাম—লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।

বোসদার দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠল না। কেমন করে বোঝাব, আমার জীবনের কতখানি অংশ তিনি জুড়ে রয়েছেন। তাকে বাদ দিয়ে আমার শাজাহান-অধ্যায়ের কী অবশিষ্ট থাকে?

 

বোসদার চাকরির ব্যবস্থা যে পাকা হয়ে গিয়েছে, তা তাঁর কাছ থেকেই শুনেছিলাম। হোটেলকে কবে নোটিশ দেবেন ভাবছিলেন। বললাম, দেরি করবেন না। শাজাহানে অনেক পরিবর্তন আসছে মার্কোরও যাবার সময় আসন্ন।

বোসদা শুনে চমকে উঠেছিলেন। মার্কোও চলে যাচ্ছেন? এবার নিশ্চয়ই জিমির বহুদিনের স্বপ্ন সম্ভব হবে। শাজাহানের গদিতে এবার সে জাঁকিয়ে বসে রাজ্য চালাতে পারবে। একদিক থেকে নৈরাজ্যও বলতে পারো।

বললাম, এমন কথা বলছেন কেন?

লোকটাকে চিনতে আমার অন্তত বাকি নেই। যেমন চোর, তেমন কুঁড়ে, তেমন হিংসুটে, তেমন অপদার্থ। দল পাকাবার রাজা। আমাকে এখনই তাহলে কথা বলতে হয়। মার্কো থাকতে থাকতে রেজিগনেশন অ্যাকসেপ্ট না হলে, আমাকেও ভুগতে হবে।

মার্কোর সঙ্গে বোসদা যখন দেখা করতে গিয়েছিলেন, আমি ছাদের উপর সুজাতাদির সঙ্গে বসেছিলাম। সুজাতাদি একটু পরেই নাইট ফ্লাইটে চলে যাবেন। সুজাতাদি বললেন, তোমার খুব খারাপ লাগছে, তাই না? বোধহয় আমি তোমাদের সাজানো জীবনে বিপর্যয় এনে ভুল করলাম।

আমি বললাম, সুজাতাদি, কেন আর কষ্ট দিচ্ছেন? একদিন আমার সব সহ্য হয়ে যাবে।

তখন হয়তো আমার কথা, তোমার দাদার কথা তোমার মনে পড়বে না। নতুন মানুষদের সঙ্গে বসে এই শাজাহানের ছাদে গল্প করবে।

আমি বললাম, অনেকদিন পরে মনে পড়বে এক শাপভ্রষ্ট পুরুষকে কোনো অজ্ঞাতপরিচয় মহিলা শাজাহান আশ্রম থেকে উদ্ধার করেছিলেন। নারীর কল্যাণস্পর্শে পাষাণে রূপান্তরিত এক পুরুষ-অহল্যা আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছিল।

সুজাতাদি চুপ করে রইলেন। আজ আমাদের সত্যিই কথা বলবার মতো মনের অবস্থা নেই। সুজাতাদি ও বোসদার মধ্যে হাইফেনের মতো এতদিন আমি ছিলাম। আমারও বোধহয় কিছু কর্তব্য আছে। তাই প্রশ্ন করলাম, চাকরি তো হচ্ছে। আপনাদের নিজেদের পরস্পরকে যাচাই করা শেষ হল কি?।

সুজাতাদি বিষণ্ণ হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললেন, আমি তাড়াতাড়িতে বিশ্বাস করি না ভাই। সময় একদিন নিশ্চয় সব সমস্যার সমাধান করে দেবে।

আমি বলেছি, আপনার বাড়িতে কিছু বলেছেন?

সুজাতাদির মুখ এবার আরও বিষণ্ণ হয়ে উঠল। বাড়ি বলতে লোকে যা বোঝে তা তো আমার নেই ভাই। তোমার দাদার মতো আমিও আত্মীয়হীন। তোমার দাদাকে যেমন ছুটি নিয়ে কোনোদিন দেশে যেতে দেখোনি, আমিও তেমনি ছুটির কথা ভাবি না। মাত্র সেবার এতদিন পরে কয়েকদিন ছুটি নিয়ে কলকাতায় তোমাদের সঙ্গে হৈ-চৈ করলাম। তোমার দাদার তবু সাহেবগঞ্জ আছে, ইচ্ছে করলে যেতে পারেন। পদ্মার ওপারে, আমাদের সে উপায়ও নেই।

বললাম, সুজাতাদি, আর কেউ না থাক আমি আছি। পৃথিবীর মানুষদের কাছে এত নিয়েছি যে, দেবার কথা ভাবলে ভয় হয়; কত জন্ম ধরে আমাকে এর সুদ গুনতে হবে ঠিক নেই। যদি কারুর জন্যে সামান্য কিছু করতে পারি, বোঝাটা হয়তো একটু হাল্কা হবে।

সুজাতাদি বললেন, অনেক করেছ ভাই। তোমরা ছাড়া আমার কে আছে বলো?

বোসদাকে এবার ফিরে আসতে দেখলাম। অন্ধকারেও ওঁর মুখে বিষণ্ণতার ছাপ দেখলাম। একটা মোড়ার উপর বসে উনি শাজাহানের আকাশকে শেষবারের মতো খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। আমরা কোনো প্রশ্ন করবার মতো সাহস না পেয়ে ওঁর মুখের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলাম। সুজাতাদির ইঙ্গিতে শেষ পর্যন্ত আমিই বললাম, কী হল?

সত্যসুন্দরদা একটা সিগারেট বের করে, উদাসভাবে দেশলাইয়ের বাক্সে সেটা ঠুকতে লাগলেন। নিজের মনে ভাবতে ভাবতেই সিগারেটে আগুন দিলেন, তার পর বললেন, কোনো জিনিস তৈরি করতে কত সময় লাগে, অথচ ভাঙতে এক মুহূর্তই যথেষ্ট। কোটি কোটি দিনরাত্রির মুহূর্ত থেকে তিলে তিলে শাজাহানের যে মধু সংগ্রহ করেছিলাম; এক কথায় তা ঝড়ে উড়ে গেল। মার্কোপোলো বললেন, আমি তোমার পথের প্রতিবন্ধক হব না। পিছনের ব্রিজ পুড়িয়ে দিয়ে, সামনে এগিয়ে যাও ইয়ংম্যান। এমন কি যদি চাও তুমি আমার সঙ্গে আফ্রিকান গোল্ডকোস্টে আসতে পারো। সেখানে দুজনে মিলে আমরা নতুন হোটেল গড়ে তুলব। অনেকদিন আগে মিস্টার সিম্পসন যা করেছিলেন, আমরা এই শতাব্দীতে দুজনে মিলে আফ্রিকাতেও তাই করব। আমার কাগজে মার্কো সই করে দিয়েছেন। ভদ্রলোক এখন খুবই ব্যস্ত রয়েছেন। জিমিকে চার্জ বুঝিয়ে দিতে হচ্ছে।

 

বোসদার বিদায় অভিনন্দনের জন্যে আমরা ছোটো শাজাহানকেই নির্বাচন করেছিলাম। শাজাহানের সামান্য কর্মচারীরা বলেছিল, বাবুজি তামাম দুনিয়ায় স্যাটাবাবুর মতো লোক মিলবে না। উনি আমাদের জন্যে কত করেছেন। সায়েবদের সঙ্গে ঝগড়াকরেছেন, ওঁর জন্যেই আমরা এখন ফ্রি চা পাচ্ছি। নিজের পয়সা দিয়ে কতজনের যে চিকিৎসাকরিয়েছেন। উনি না থাকলে রহিমের পায়ের ভেরিকোজ ভেন কোনোদিন কি সারত? আমরাও হুজুর ওঁকে ব্যাংকোয়েট দেব।

ওদের সাধ্যমতো চার আনা করে চাঁদা তুলেছিল। পৃথিবীর কোনো হোটেলের কোনো কর্মচারীর বোধ হয় এমন ব্যাংকোয়েটে উপস্থিত থাকবার সৌভাগ্য হয়নি। সে যে আমাদের অকাল-ব্যাংকোয়েট। হোটেলের ছুটি নেই-ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনারের সময় লোকদের মরবার ফুরসত থাকে না। তাই ছোট শাজাহানে মধ্যরাত্রে সেই বিদায়সভার অধিবেশন বসেছিল। সেদিন রাত্রে তার আগে কেউ খায়নি। ছোট শাজাহানের বয়রা অতক্ষণ থাকতে রাজি হয়নি, তাই আমাদের সব কর্মীরাই পরিবেশনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। টিনের বড় ঘরে, ষাট পাওয়ারের আলোতে সেদিন যে ব্যাংকোয়েট হয়েছিল, তা সত্যিই কোনোদিন ভুলব না। ন্যাটাহারিবাবুর ইচ্ছে ছিল সব গেলাসে একটা করে ন্যাপকিনের রুল দেবেন। কিন্তু অত ন্যাপকিন কোথায় পাবেন? আমাদের সবার জন্যেই কলাই করা থালা, আর মাটির ভাঁড়। কিন্তু বোসদার জন্যে ভালো কাচের ডিস, ছুরি, কাটা। সত্যসুন্দরদার গ্লাসে ন্যাপকিনের ফুলও রয়েছে। ন্যাটাহারিবাবু আমাকে বললেন, কী ফুল করেছি দেখছেন তো-শুয়োরের মাথা নয়, বিশপ।

খেতে বসে দামী ঐকারি দেখে সত্যসুন্দরদা অসন্তুষ্ট হলেন। রহিমকে ডেকে বললেন, ভালো করোনি। শাজাহান থেকে ডিস, ছুরি, কাটা কেন আনতে গেলে, যদি কথা ওঠে?

রহিম বোসদার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বললে, না হুজুর, বড়ো শাজাহান থেকে আমরা কিছুই আনিনি। এগুলো আপনার জন্যে নিউ মার্কেট থেকে আমরা কিনে এসেছি।

আমি দেখলাম বোসদার চোখদুটো সজল হয়ে উঠেছে। আমার দৃষ্টি এড়াবার জন্যে তিনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

আমাদের এই আয়োজন সামান্য হলেও ব্যাংকোয়েটের সব আভিজাত্যই আছে। হাত দিয়ে খেতে খেতে সেই কথাই মনে হচ্ছিল। বোসদাও কাঁটা চামচ সরিয়ে হাত দিয়ে খেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার ভক্তরা রাজি হয়নি। বলেছিল, না হুজুর, জোগাড় করতে পারলে আমরা সবাই কাঁটা চামচ দিয়ে খেতাম। এটা যে ব্যাংকোয়েট।

বাংকোয়েটে একটি মাত্র জিনিসের অভাব ছিল। সেটি সঙ্গীত। কিন্তু তার অভাবও যে অমনভাবে মিটে যাবে আশা করিনি।

আমাদের উৎসবের মধ্যেই মিস্টার গোমেজ হঠাৎ সান্ধ্য পোশাকে সজ্জিত হয়ে হাজির হলেন।কী ব্যাপার, আমাকে ফাঁকি দেওয়া হয়েছে! আমাকে ডাকা হয়নি কেন?

বেয়ারাদের একটু গানবাজনার ইচ্ছে, ছিল, কিন্তু ছোটো শাজাহানের নোংরা পরিবেশে তারা গোমেজ সায়েবকে নেমন্তন্ন করতে সাহস করেনি।

প্রতাপচন্দ্র ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে বললেন, জেন্টলমেন, আমার সামর্থ্য থাকলে মিস্টার স্যাটা বোসের এই বিদায়সভায় আমি ভায়োলিন কনসার্টের ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু আমার সে সামর্থ্য নেই। লোকবল থাকলেও, যন্ত্র নেই। গত তিনদিন ধরে মিস্টার স্যাটা বোসের অনারে আমি একটা বিশেষ সুর কম্পোজ করেছি। নাম দিয়েছি—ফেয়ারওয়েল। ফেয়ারওয়েল টু ডিনার, ডান্স, ক্যাবারে; ফেয়ারওয়েল টু ক্যান ক্যান, হুলাহু, রক অ্যান্ড রোল। নাউ জেন্টেলমেন, দিস ইজ পি সি গোমেজ প্রেজেন্টিং টু ইউ এ ভায়োলিন রিসাইটাল—দি ফেয়ারওয়েল কম্পোজড অন দি অকেশন অফ ফেয়ারওয়েল টু মিস্টার স্যাটা বোস।

সব কোলাহল মুহুর্তের মধ্যে যেন স্তব্ধতায় রূপান্তরিত হল। আমরা সবাই বিস্মিত হয়ে গোমেজ এবং তাঁর সেই আশ্চর্য যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওই যন্ত্রের ভাষা শেখবার সুযোগ আমাদের কারুরই হয়নি। কিন্তু তবুও আমাদের কারুরই আজ বোঝবার অসুবিধা হল না। সে আমাদের সকলেরই মনের কথা বলছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *