১৭. যেদিন প্রভাতে পরম বিস্ময়ে

যেদিন প্রভাতে পরম বিস্ময়ে শাজাহান হোটেলে পদার্পণ করেছিলাম, সেদিন থেকেই ঘড়ির কাঁটা দ্রুত পদক্ষেপে রাত্রের সন্ধানে ছুটতে আরম্ভ করেছে। এবার যেন সত্যিই বেলাশেষের সুর বেজে উঠবে। ক্লান্ত অপরাহু আমারই অজ্ঞাতে কখন দীর্ঘ-বিষণ্ণ ছায়া বিস্তার করেছে। দিগন্তের রঙে শাজাহানের আকাশ যেন রঙিন হয়ে উঠেছে।

এতদিন শাজাহান আমাকে কেবল মানুষ চেনবার দুর্লভ সুযোগই দেয়নি; আত্মীয় আবিষ্কারের অপার আনন্দও দিয়েছে। অপরিচিত এই পৃথিবীতে তাই কোনোদিন নিঃসঙ্গ বোধ করিনি। কিন্তু অশুভ চিন্তাগুলো এবার আমার বিনা অনুমতিতেই মনের মধ্যে মাঝে মাঝে উঁকি মারছে। আলোকোজ্জ্বল সভাগৃহে এবার একে একে নিভিছে দেউটি। শাজাহানের ঘাটে আমরা সবাই বেলাশেষের শেষ-খেলার প্রতীক্ষা করছি।

সত্যিই আমার মধ্যে পরিবর্তন আসছে। পান্থশালায় অগণিত অতিথির দিবারাত্রির আগমন নির্গমন এখন আর তেমনভাবে আমার মনে রেখাপাত করছে না। খেয়াঘাটে বসে বসে অতীত দিনের সহযাত্রীদের কথাই অপেক্ষমান যাত্রীর বার বার মনে পড়ছে। আমার হতশ্রী শিথিল স্মৃতি হঠাৎনবযৌবন লাভ করেছে। বিস্মৃতির ধুলো সরিয়ে বিবর্ণ ছবিগুলো আবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দু-নম্বর সুইটের সামনে দাঁড়ালেই করবী গুহের কথা মনে পড়ে যায়। রাতের ক্যাবারে উৎসবে দাঁড়ালেই কনি ও ল্যামব্রেটাকে দেখতে পাই। বার-এ দাঁড়ালেই বহু বর্ষ আগের এক অসহায় বারবনিতা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ছাদে উঠলেই দেখি দীর্ঘদেহ ডাক্তার সাদারল্যান্ড উইলিয়ামস লেনের লোকাল বয়েজদের কথা চিন্তা করছেন।

তবু এরই মধ্যে জীবন চলেছে। অনেকদিন আগে সিম্পসন নামে এক ইংরেজ ভগীরথ যে স্রোতস্বিনীকে আমাদের এই মরুভূমিতে আহ্বান করেছিলেন, তার গতি ধীর হলেও, আজও তা স্তব্ধ হয়নি। মমতাজ-এর বার-এ দাঁড়িয়ে ড্রিঙ্কের হিসেবনিকেশ করতে করতে সরাবজী তাই মেয়ের কথা চিন্তা করেন, তার নিজেরও যে একটা বার ছিল তা কিছুতেই ভুলতে পারেন না। উইলিয়াম ঘোষ অন্য এক মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি করেছে। স্টেটসম্যানের এনগেজমেন্ট স্তম্ভে সে সংবাদ পয়সা দিয়ে ছাপানো হয়েছে।

আর বেচারা রোজি, তার বাবা-মার অসুখ বেড়েছে। চিকিৎসা করাতে পারছে। টাকার জন্যে মেয়েটা হন্যে হয়ে উঠেছে।

ফোকলা চ্যাটার্জি প্রায়ই রোজির সঙ্গে কথা বলেন। আমাকেও জানালেন, আপনাদের রোজি মেয়েটা বেশ। মিস্টার সদাশিবমের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম। হাই অফিসার সদাশিবমের হাতে অনেক ক্ষমতা। মশায়, আগে প্রায়ই যেতাম। কিন্তু শুধু ল্যাজে খেলত। শেষে একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে বললে, যা চাইছ তাই করিয়ে দেব; কিন্তু বিকেলে বড় লোনলি ফিল করি। তা মশায়, দিলুম আপনাদের রোজির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে। এখন প্রায়ই অন্য হোটলে গিয়ে দেখা-সাক্ষাৎ করছেন ওঁরা। সদাশিবমের ওয়াইফ বোধহয় লাস্ট এক বছর বাপের বাড়িতে রয়েছে। আমার কী! আমাকেও তো কোটা, পারমিট, অর্ডার জোগাড় করে বেঁচে থাকতে হবে। দুনিয়ার যত মাল কি স্না পারচেজ অফিসার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট আর বুশ-সার্ট-পরা হাই অফিসারই এনজয় করে যাবে? আমাদের মত সাধারণ ইনোসেন্ট লোকদের কি মালের তেষ্টা লাগে না?

ফোকলা চ্যাটার্জি বলেছিলেন, দুঃখের কথা বলব কি, দেশে আপনারা অভাব অভাব বলেন, অথচ বিজনেস লাইনে আমরা মেয়ে পাচ্ছি না। একজন বাঙালি হিসেবে বলছি, বেঙ্গলি মেয়েদের সবাই চায়! সুযোগ রয়েছে, সুবিধে রয়েছে তবু লাইনে আসবে না। সত্যি কথা বলতে গেলে ফোকলা চ্যাটার্জির বদনাম হয়ে যাবে। বাপু, আগে খেয়ে পরে সুখে বেঁচে থাক,তারপর তো ধর্ম। হচ্ছেও তাই—অ্যাভারেজ বেঙ্গলি মেয়ে আর সেফ নয়—বুকের মধ্যে সব টি-বি। অথচ এমন জাত, ভাঙবেতবুমচকাবে না। বঙ্কিম, রবি ঠাকুর, বিবেকানন্দ এঁরাই জাতটাকে ডোবালেন। এখন অন্য যুগ, এখন প্র্যাকটিক্যাল লোক চাই। একা আমি ফোকলা চ্যাটার্জি কী করব মশাই? এই দেখুন না, আগরওয়ালা একজন হোলটাইম বাঙালি হোস্টেস চাইছে। ভালো মাইনে দেবে। দুহাতে এক্সট্রা ইনকাম। কিন্তু একটা মনের মতো লোকাল মেয়ে পাচ্ছি না। রোজিটা আমাকে খুব ধরেছে। চাকরিটা করে দিতেই হবে। ঘুড়ির নাকি অনেক টাকা দরকার। তা ভাবছি ওকেই করে দেব—আফটার অল পভার্টি নোজ নো কাস্ট। বিপদ আপদে সব মানুষকেই দেখতে হয়। সে যে জাতের হোক। তাই না?

ফোকলা চ্যাটার্জি বললেন, দেখি কী করা যায়। বেটা সদাশিবমটাই গণ্ডগোল বাধিয়েছে। মালের রোজিকে ভালো লেগে গিয়েছে, ওকে হাতছাড়া করতে চাইছে না, আমরাও ওকে চটাতে পারি না। এখন ক্রমশ কানে মন্তর দিচ্ছি, একই কাপডিসে বার বার চা না খেয়ে, রোজ ভাঁড়ে চা খাও।

ফোকলা চ্যাটার্জি যাবার আগে বলেছিলন, আপনাকে একটা সুখবর দিই। আমি আগরওয়ালা কোম্পানির ডিরেক্টর হচ্ছি। চুরি-জোচ্চুরি না করেও, কেবল অনেস্ট লেবার দিয়ে মানুষ এখনও উন্নতি করতে পারে।

 

সত্যসুন্দরদাও আর-এক আশ্চর্য জীবনের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছেন। হাওয়াই কোম্পানির যাত্রী এবং কর্মীবাহী বাসের দিকে আমরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকি। হয়তো এখনই পাড়বিহীন নীলাম্বরী শাড়ি পরে সুজাতা মিত্র আমাদের কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াবেন।

কাঁধে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগটা ডান হাতে ধরে, মিষ্টি হেসে সুজাতা বলবেন, সব ভালো তো? সত্যসুন্দরদা বলবেন, আপনার খবর কী বলুন?

মনের প্রকৃত ভাব চেপে রাখার চেষ্টা করে সুজাতা মিত্র বলবেন, খুউব ভালো ছিলাম। কোনো চিন্তা ছিল না, উদ্বেগ ছিল না। পৃথিবীর এক দেশে ব্রেকফাস্ট করে, আর-এক দেশে লাঞ্চ খেয়ে, অন্য আর-এক দেশে বিকেলে সিনেমা দেখে ফুর্তিতে ছিলাম।

কয়েকবার এমন দেখাতেই যে সত্যসুন্দরদার মনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল, তা আর কেউ না বুঝুক, আমি বুঝেছিলাম। তবু সত্যসুন্দরদা মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তায় চমকে উঠতেন। অবাধ্য মনটাকে শত চেষ্টাতেও তিনি বশে আনতে পারছিলেন না।

এবিষয়ে আমার কাছেও নিজেকে প্রকাশ করতে সত্যসুন্দরদা বোধহয় সঙ্কোচ বোধ করতেন। তাই নিজের মনের মধ্যেই নিজেকে বন্দি করে রাখা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

সত্যসুন্দরদার দ্বিধার পরিচয় একদিন কাউন্টারেই পেয়েছিলাম। সারারাত ডিউটি করে, আমাকে চার্জ দিয়ে যখন চলে গিয়েছিলেন, তখন দেখেছিলাম প্যাডের ওপর হিজিবিজি করে বোসদা অনেকবার কী একটা লিখেছেন। একটু চেষ্টা করতেই পাঠোদ্বার হয়েছিল। বোসদার কাছেই কথাটা যে অনেকবার শুনেছি—The wise receptionist keeps the counter between, in spirit as well as in fact. কাউন্টারের বাঁধ বন্যাকে আর ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না বলেই বোধহয় বোসদা নিজেকে বার বার সাবধান করে দিয়েছেন। তারপর এতই অন্যমনা ছিলেন যে, কাগজগুলো ছিড়ে ফেলতেও ভুলে গিয়েছিলেন।

কেন জানি না, আমার খুব ভালো লেগেছিল। সত্যসুন্দরদার মতো মানুষ চিরকাল এমনভাবে শাজাহানের অপরিপূর্ণ জীবনযাপন করবেন, তা ভাবতে সত্যিই আমার মন খারাপ হয়ে যেত।

যখন হয়, তখন বোধহয় এমনি করেই হয়। তখন কারুর ইচ্ছা-অনিচ্ছার মুখ চেয়ে যা ঘটবার, তা থমকে দাঁড়ায় না। তাই সুজাতা মিত্র এবার ঘন ঘন হাওয়াই ডিউটিতে কলকাতায় আসতে আরম্ভ করেছেন। তিনি যে কবে আমার সুজাতাদি হয়ে গিয়েছেন, তা-ও বুঝতে পারিনি। গল্প করতে ভালোবাসেন সুজাতাদি। হাসতে পারেন, হাসাতে পারেন সুজাতাদি। সুতরাং আমার সঙ্গে ভাব জমে উঠতে বেশি দেরি হয়নি।

আমাদের ডিউটি-রস্টারও সুজাতাদির জানা হয়ে গিয়েছিল। নিজের ঘরে স্নান শেষ করে, সুজাতাদি আজকাল লজ্জা কাটিয়ে সোজা উপরে চলে আসতেন। আমাকে বলতেন, চোখ বোজো। আমি চোখ বুজতাম। সুজাতাদি বলতেন, হাঁ করো, আমি হাঁ করতাম। সুজাতাদি সঙ্গে সঙ্গে মোড়ক খুলে একটা চকোলেট কিংবা লজেন্স মুখে ফেলে দিতেন। স্বাদ নেবার জন্যে আমি সঙ্গে সঙ্গে মুখ বন্ধ করতাম। দ্রুত আঙুল সরিয়ে নিতে নিতে তিনি বলতেন, এখনি আমার আঙুলটা কামড়ে দিয়েছিল আর কি। যা লোভী ছেলে!

আমি বলতাম, লোভী বলছেন কেন? বদনাম যখন হয়েছে, তখন আর একটা চাই। সত্যদাকে বলতেন, এবার চোখ বুজে, আপনি হাঁ করুন।সত্যদা মাথা নাড়তেন।না দেখে আমি ওভাবে কিছু মুখে পুরতে চাই না। শাজাহানের একটা মূল্যবান জীবন ওইভাবে রিস্ক করতে পারি না।সুজাতাদি বলতেন,ঠিক আছে, এতটুকু যখন বিশ্বাস নেই, তখন খেতে হবে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলেছি, যখন আপনাদের মধ্যে গণ্ডগোল চলছে, তখন আপনাদের ভাগের চকোলেটগুলোও আমাকে দিন! বোসদা বলেছেন,ওরে দুষ্টু ছোকরানা মিস্ মিত্র, আমার চকোলেটের ভাগটা আমাকে দিন।

সুজাতাদি যেদিন কলকাতায় থাকতেন, সেদিন আমাদের ছাদটা একেবারে পালটিয়ে যেত। বোসদার ঘরের মধ্যে সুজাতাদি হয়তো জোর করে ঢুকে পড়তেন, সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে আমাকে বলতেন, আপনার দাদার যেমন সাজানো গোছানো স্বভাব, তাতে মেয়েরাও লজ্জা পাবে।

বললাম, ভালোই হল। এতই যখন প্রসন্ন হয়েছেন, তখন আজকের রাতের তিনখানা সিনেমা টিকিটের দাম আপনি দিন!

সুজাতাদি বলেছেন, গ্ল্যালি। হ্যান্ডব্যাগ খুলে সুজাতাদি পয়সা বের করতে যাচ্ছিলেন। বোসদা বললেন, আপনিও যেমন! আপনি আজ আসবেন বলে চারদিন আগে শ্রীমান নাইট শোয়ের তিনখানা টিকিট কেটে রেখেছে।

সুজাতাদি বলেছেন, ছিঃ, বয়সে ছোট না!

আজকালকার ছেলে-ছোকরারা সেসব যদি মানত! বোসদা বললেন।

ছবিটা বড় ছিল। বারোটার আগে শেষ হয়নি। মেট্রো সিনেমা থেকে বেরিয়ে সেদিন যেন চৌরঙ্গীকে আমরা আরেক রূপে দেখেছিলাম। ট্যাক্সি করতে যাচ্ছিলাম, বোসদা হাঁটবার প্রস্তাব করলেন।

মধ্যরাত্রে কলকাতাকে আমি নানা দিনে নানাভাবে দেখেছি। কলকাতার সেই রূপকে সত্যিই আমি ভয় করি। কিন্তু আজ অন্য রকম মনে হল! চৌরঙ্গী ও সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুর মোড়ে স্যর আশুতোষের স্ট্যাচুর সামনে আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। ওইখানে দাঁড়িয়েই আমরা একটা স্কুটার যেতে দেখলাম। কলকাতার রাস্তায় তখনও স্কুটারের ছড়াছড়ি ছিল না। বোসদা বললেন, হায় রে, আমার যদি এমন একটা স্কুটার থাকত!।

সেই সামান্য রসিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে সুজাতাদি যে সত্যই বোসদার জন্যে একটা স্কুটারের ব্যবস্থা করবেন, তা আমাদের কল্পনার অতীত ছিল। সুজাতাদি আমার চালাক মেয়ে, তাই প্রথমেই বলেছিলেন, আমি একটা কাজ করে ফেলেছি; তার জন্যে আমাকে যদি একটা কথাও বলেন তাহলে আমি সত্যিই দুঃখ পাব।

বোসদা প্রথমে ঠিক বুঝতে না পেরে বলে ফেলেছিলেন, ভুল মানুষ মাত্রই করে। তার জন্যে আপনাকে বকতে যাব কেন?

ঠিক তারপরই সুজাতাদি স্কুটারের কাগজপত্তর বোসদার হাতে দিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, দুএকদিনের মধ্যে যখন গাড়িটা এসে পৌছবে তখন সুজাতাদি কলকাতায় থাকতে পারবেন না। এবার ফিরতেও সপ্তাহখানেক দেরি হবে। তার মধ্যে চালানোটা যেন ভালো করে অভ্যাস করা থাকে। তবে কলকাতার গাড়ি-ঘোড়ার যা অবস্থা, এখানে স্কুটারের কথা ভাবলেই ভয় হয়।

নিজের প্রতিজ্ঞাতে আবদ্ধ বোসদা রাগে গুমরে গুমরে মরছিলেন, কিন্তু কিছুই বলতে পারছিলেন না। তবে শেষ পর্যন্ত অভিযোগ করলেন—কী একটা ছেলেমানুষি করলেন, বলুন তো!

সুজাতাদি হেসে বলেছিলেন, সব দোষ ব্যুমেরাঙের মতো আপনার কাঁধেই ফিরে আসবে। কারণ হোটেলের কেউ তো আর স্কুটারের পিছনে আমার ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারবে না!

আর জানলে আমাদের দুজনেরই এখানে টেকা মুশকিল হবে! আমি বলেছিলুম।

সে-রাত্রে ছাদে বসে বসে অনেক কথা হয়েছিল। গুড়বেড়িয়া দেশে গিয়ে নব-বধূর মোহিনী মায়ায় ছুটি বাড়াতে প্রলুব্ধ হয়েছিল। মায়ের শারীরিক অসুস্থতা সম্বন্ধে তাই আর একটা টেলিগ্রাম এসেছিল। গুড়বেড়িয়ায় অনুপস্থিতিতে আমিই বেয়ারার কাজ করছিলাম। ওঁদের সামনে দাঁড়িয়ে সেলাম করেছিলাম, মেমসায়েবের কোনো অর্ডার আছে?

মেমসায়েব বলেছিলেন, বেশি পাকামো না করে, ওইখানে চুপচাপ বোসো। না হলে কানমলা খাবে।

কান বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলাম, মলুন—আমার একটা ওয়ার্ল্ড রেকর্ড হয়ে থাকবে। পৃথিবীর প্রথম দায়িত্বশীল রিসেপশনিস্ট, যার কর্ণজনৈক মহিলা অতিথি কর্তৃক মলিত হয়েছিল!

জোর করে একটু চা আনিয়েছিলাম। সে চা-এর ট্রে সুজাতাদির সামনে দিয়ে বলেছিলাম, আমরা গাট হয়ে বসলুম। আপনি টি তৈরি করে সার্ভ করুন।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বোসদা আবার বলেছিলেন, কী ছেলেমানুষি করলেন বলুন তো? এই স্কুটার নিয়ে কী করব, রাখব কোথায়?

এত বড়ো হোটেল, যেখানে ডজন ডজন মোটর দাঁড়াতে পারছে, সেখানে একটা স্কুটার রাখা যাবে না! এ আমি বিশ্বাসই করি না। আর ওটা নিয়ে কী করবেন?মাঝে মাঝে এই জেলখানা থেকে বেরিয়ে, গড়ের মাঠের উদার উন্মুক্ত আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে মুক্তির আনন্দ উপভোগ করবেন। সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত্রি হোটেল হোটেল করে নিজেকে অবহেলা করবেন না।

বোসদা তখনও গম্ভীর হয়ে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত সুজাতাদিবলেছিলেন, যদি কোনো দোষ করে থাকি, কী করে অপরাধ মার্জনা সম্ভব বলুন?

আপনার শাস্তি হল একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া, সেদিন যেমন গুনগুন করে পার্কে গাইছিলেন। এটাও আপনার একটা রেকর্ড হয়ে থাকবে, প্রথম অতিথি যিনি হোটেলে গান না শুনে, নিজেই গান শুনিয়েছিলেন,আমি বললাম।

সুজাতাদির আপত্তি ছিল না। কিন্তু বোসদা বারণ করলেন। বললেন, ছাদে আরও অনেক লোক আছে। জানাজানি হলে বিশ্রী ব্যাপার হবে।

সুজাতাদি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে পড়েছিলেন। আমরা দুজনে তখনও স্থির হয়ে বসে রইলাম। বোসদা বললেন, ওহো, তোমাকে বলা হয়নি। বায়রন সায়েব ফোন করেছিলেন। উনি আজই তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়া নাকি বিশেষ প্রয়োজন।

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। বোসদা গম্ভীর হয়ে বললেন, আমার যেন তেমন ভালো মনে হচ্ছে না। যেন বিরাট পরিবর্তনের সবুজ সিগন্যাল চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।

আমি ওঁর মুখের দিকে তাকালাম। বোসদা বললেন, মার্কোর ব্যাপার-স্যাপার তেমন সুবিধে নয়। কয়েকদিন রাত্রে হোটেলেই ফেরেননি। ছাতাওয়ালা লেনেই সময় কাটিয়ে এসেছেন। জিমিটাও এই সুযোগে ভিতরে ভিতরে দল পাকাবার তালে রয়েছে।

আমি বললাম, বায়রনের সঙ্গে দেখা হলে কিছুটা হয়তো জানা যাবে।

বোসদা বললেন, হাজার হোক মানুষটা ভালো। ওঁর দুঃখ দেখলে সত্যিই কষ্ট হয়।

 

সেই রাত্রেই বায়রন সায়েব দেখা করতে এসেছিলেন। সেই সাক্ষাতের পর বিবরণ আমার স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

এতদিন পরে লিখতে বসেও চোখের জলকে বাধা দিতে পারছি না। চোখের জলে নিজেকে প্লাবিত করা হয়তো পুরুষের পক্ষে শোভন নয়। কিন্তু কেমন করে বোঝাব, অপরিচিতের প্রীতি কেমনভাবে নিশ্চিত অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করে আমার জীবনকে বার বার সজীব ও সরল করে তুলেছে। গভীর গহন অন্ধকারে হৃদয়হীন জীবন-দেবতার মুখোমুখি যারা দাঁড়িয়েছে, হয়তো একমাত্র তাদেরই পক্ষে তা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব। কিংবা আমার অক্ষমতা। যা অনুভব করি, বুকের প্রতিবিন্দু নিশ্বাসের সঙ্গে যে কথা বলতে চাই, তা যদি সত্যিই আমি প্রকাশ করতে পারতাম, অন্তত তার কিছুটাও যদি প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারতাম, তাহলে সত্যিই আমার আনন্দের শেষ থাকত না। জীবনের চরমতম পরীক্ষার মুহূর্তে কোনো অচেনা পাঠকের অন্ধকার মনে সামান্য আশার আলো জ্বালাতে পারলে, বায়রন সায়েবের উদ্দেশে আমার শ্রদ্ধা জানানো হবে।

বায়রন আমার ঘরে ঢুকে বসে পড়েছিলেন। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, মার্কোর কাছ থেকে টাকা নিয়েছি আমি। মনে মনে দুঃখ ছিল, বেচারার জন্য কিছুই করে উঠতে পারলাম না।যদি বা সুশানের খবর পাওয়া গেল, তাতে কিছুই লাভ হল না। সুশান তো আর আমাদের নাগালের মধ্যে নেই। সুতরাং পুরনো ডাইভোর্স মামলার মাধ্যমে মুক্তি পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। বায়রন একটু থামলেন। তারপর বললেন, কিন্তু ঈশ্বর এমনি করেই বোধহয় অভাজনদের উপর কৃপাবর্ষণ করেন।

আমি ওঁর মুখের দিকে পরম কৌতূহলে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বললেন, একদিন সবাই জানতে পারবে। তবে তোমার বোধহয় আগে থেকে জানবার অধিকার আছে।বায়রন একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর বললেন, তোমরা বলো রাম না জন্মাতেই রামায়ণ গাওয়া হয়েছিল। মার্কোর জীবনেও প্রায় তাই হল। লিজাকে একদিন সাক্ষী হিসাবে খাড়া করবার জন্যে, পয়সা দিয়ে ওকে নিয়ে প্রেমের অভিনয় করেছিলেন মার্কো। আর এতদিন পরে, মার্কো সত্যিই লিজার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। লিজা প্রথমে বিশ্বাস করেনি। তারপর যখন সে সত্যিই বুঝল মার্কোর মনে কোনো কু-অভিসন্ধি নেই, তখন সে কাঁদতে আরম্ভ করেছিল।

তুমি যদি দেখতে মার্কো কীভাবে অসুস্থ লিজার সেবা করেন। সেদিন নিজের চোখে দেখলাম, দুহাতে তার বমি পরিষ্কার করছেন মার্কো। কী আছে ওর শরীরে? মার্কোপোলোকে দেবার মতো কোনো নৈবেদ্যই তার নেই। তবু মার্কো ওর মধ্যে কী যে খুঁজে পেয়েছেন!

মার্কো বলেন, মনে আছে যেদিন প্রথম সুশানের সঙ্গে তোমার বাড়িতে গিয়ে ছিলাম?

লিজা বলে, তোমার কাছে টাকা চাইতে সেদিন আমার যে কী কষ্টহয়েছিল। কিন্তু আমার কাছে তখন একটা আধলাও ছিল না। বাথরুমে পিছলে পড়া সেই যে আমার কাল হল; তারপর থেকে আর নিজের পায়ে দাঁড়াতেই পারলাম না।

বায়রন বলল, ওঁরা দুজনে এক সঙ্গে থাকবেন ঠিক করেছেন। এই কদিনের চিকিৎসাতে লিজা অনেক পালটিয়ে গিয়েছে, দেখলে তুমিই অবাক হয়ে যাবে। লিজার একদিন শাজাহানে আসবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মার্কো রাজি হননি। অন্য কেউ কিছু না বলুক, জিমিকে চিনতে ভঁর তো বাকি নেই। ম্যানেজারের বদনাম হোটেলের বদনামে রূপান্তরিত হতে বেশি সময় লাগে না।

বায়রনের মুখেই শুনলাম, মার্কোর বিদায় সংবাদ আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই পাব। লিজাকে বিয়ে করা এখানকার আইনে সম্ভব নয়। অথচ বিয়ে না করে, একসঙ্গে থাকবার মতো প্রবৃত্তি তার নেই। তাই মার্কো অন্য পথ বেছে নিয়েছেন। আফ্রিকান গোল্ডকোস্টে একটা চাকরি জোগাড় করেছেন। সে-দেশে এখনও বহুবিবাহে আপত্তি নেই। আলোক প্রাপ্ত ইউরোপ এবং সভ্য এশিয়া থেকে দূরে আফ্রিকার স্বল্পালোকিত সামান্য শহরের এক সামান্য হোটেলে ভাগ্যহত মার্কো এবং জনম দুঃখিনী লিজা স্বামী-স্ত্রী রূপে জীবনের শেষ কটা দিন কাটিয়ে দেবে-আইনের অনুমোদনের জন্যে তারা আর ভারত মহাসাগরের দিকে তাকিয়ে থাকবে না।

বায়রন এবার একটু ইতস্ততঃ করলেন। তারপর আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমারও ভালো হল। ওঁর কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলাম বলে, এতদিন আমার পক্ষেও নড়া-চড়া সম্ভব হচ্ছিল না। আমারও দায়িত্ব শেষ হল; এবার আমারও বিদায় নিতে কোনো বাধা রইল না।

মানে? বিস্ময়ে আমি বায়রনের মুখের দিকে তাকালাম।

বায়রন বেদনার্ত স্বরে বললেন, যতদিন প্রফেশনে ছিলাম, ততদিন কখনও বলিনি। আজ বলছি, কলকাতায় আমাদের সমাদরের কোনো সম্ভাবনা নেই। এদেশের লোকেরা নভেলে সিনেমায় থিয়েটারে প্রাইভেট ডিটেটিভদের সমাদর করতে রাজি আছে, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তাদের কথা একবারও মনে করে না। অথচ অস্ট্রেলিয়ায় তেমন নয়। সেখানে প্রাইভেট ডিটেকটিভদের অনেক সুযোগ রয়েছে। ডিটেকশন কোম্পানিতে আমি মাসিক মাইনের চাকরিও নিতে পারি। তেমনই একটা চাকরি এতদিনে জোগাড় হয়েছে। এখন তারই ভরসায় পাড়ি দিচ্ছি। পরে সুযোগ বুঝলে আবার প্রাইভেট প্র্যাকটিশ করব।

বায়রনের হাত দুটো আমি জড়িয়ে ধরেছিলাম, বলেছিলাম, ঈশ্বর যে এতদিনে আপনার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন, ভাবতে আমার আনন্দ হচ্ছে। আপনি এতদিনে সত্যি সুখী হবেন।

কেমন করে বুঝলে? বায়রন বেদনার্ত হাসিতে মুখ ভরিয়ে প্রশ্ন করলেন।

কেমন করে বুঝলাম? আইনের ভাষায় বলতে গেলে, নজির আছে।

নজির? বায়রন আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালেন।

যাঁর সুখ শান্তি পাবার প্রয়োজন ছিল, অথচ যাঁর দুঃখ আমাদের মর্মবেদনার কারণ হয়েছিল এমন একজন ভদ্রলোক বহু বছর আগে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে গিয়ে শান্তি লাভ করেছিলেন।

কে তিনি? বায়রন প্রশ্ন না করে থাকতে পারেনি। তখন বলেছিলাম, তিনি রক্ত-মাংসের মানুষ না। কিন্তু আমার পক্ষে কিছুতেই বিশ্বাস করা সম্ভব নয়, তিনি ডিকেন্সের ডেভিড কপারফিল্ড উপন্যাসের একটা চরিত্র মাত্র। তার নাম মিস্টার মিকবার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *