১৩. পুরনো দিনের স্মৃতিরা

শুনেছি, নিভৃত মধুর ভাবনার অবসরে পুরনো দিনের স্মৃতিরা ভিড় জমায়। একান্তে মধু ভাবনায় ড়ুবে থাকার মতো সচ্ছল অবসর আমার নেই, তবুও সময়ে-অসময়ে এবং কারণে-অকারণে শাজাহান হোটেলের বেদনাবিধুর স্মৃতির মেঘগুলো আজও আমার হৃদয়ের আকাশকে মেঘাচ্ছন্ন করে তোলে। কেন এমন হয়, কেমন করে হয় তা জানি না, জানবার মতো কৌতূহলও আমার নেই। তবে এইটুকু এতদিনে বুঝেছি যে, শাজাহান হোটেলকে না দেখলে পৃথিবীর পাঠশালায় আমার শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যেত। মানুষের মনের গহনে যে গোপন মানুষটি লুকিয়ে রয়েছে তাকে যদি চিনতে হয় তবে পথের ধারে পান্থশালায় নেমে আসতে হবেই।

যেদিন পরা বিস্ময়ে ধর্মাধিকরণের অভাবনীয় রহস্যময় রাজপুরীতে প্রবেশ করেছিলাম, সেদিন অন্ধকার পথের নিশানা দেবার জন্য আমার পাশে এক অভিজ্ঞ জীবনদরদী ছিলেন। সেদিন কোনো কিছুই আমাকে খুঁজে বার করতে হয়নি; যা আমার জানবার প্রয়োজন, যেমনভাবে তা দেখাবার প্রয়োজন তা সেই পরমস্নেহশীল বিদেশি নিজেই ব্যবস্থা করেছিলেন। শাজাহানের সরাইখানায় অসংখ্যর ভিড় থেকে অসাধারণকে খুঁজে বার করে আমাকে দেখাবার জন্যে কেউ নেই। তবু এই আশ্চর্য ঐশ্বর্যময় ভুবন পথপ্রদর্শকহীন এক সামান্য কর্মচারীকে বহু মণিমাণিক্য উপহার দিয়েছে। কল্পনার রঙে যে পরমপ্রতিভাবান শিল্পী সাহিত্যের পটে নব নব চরিত্রের সৃষ্টি করেন, তিনি আমার নমস্য। কিন্তু আমি অভিজ্ঞতার ক্রীতদাস। আমার স্মৃতির কারাগারে বন্দি পুরুষ ও নারীর দল সুযোগ পেলেই বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়, তাদের মুক্তি দাবি করে, আমি স্বাধীন মনে কল্পনার সৃষ্টিকে প্রশ্রয় দেবার সুযোগ পাই না।

আজও তারা কারার বন্ধন ছিন্ন করে চৌরঙ্গীর পাঠকের মনের জানালার ধারে এসে দাঁড়াতে চাইছে। কিন্তু হোটেলের সামান্য কর্মচারী আমি কী করব? নিজের অক্ষমতার তীব্র যাতনা সেইদিন বুঝতে পেরেছিলাম যেদিন শাজাহান হোটেলে মিসেস্ পাকড়াশী পার্টির ব্যবস্থা করেছিলেন। ককটেল পার্টি–রিসেপশন টু অনিন্দ্য অ্যান্ড শ্যামলী।

অনিন্দ্যর বিবাহ উপলক্ষে ডিনার পার্টি পাকড়াশী-হাউসে ইতিমধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শাজাহানের উর্দিপরা বয়রা সেখানে গিয়ে পরিবেশন করেছিল। আমারও যাবার হুকুম হয়েছিল। বোসদা বোধহয় আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন, তাই আমাকে সে যাত্রা রক্ষা করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ম্যানেজারকে জানাবার প্রয়োজন নেই, তোমার বদলে আমিই যাবখন।

সেদিন অনেক রাত্রে বোসদা হোটেলে ফিরে এলেন। আমি তখন ঘর থেকে একটা চেয়ার বের করে ছাদের উপর চুপচাপ বসেছিলাম। বোসদা যখন ফিরে এলেন, তখন ঘামে তার শার্ট ভিজে গিয়েছে। আমাকে বসে থাকতে দেখে রাগ করলেন। বললেন, শুধু শুধু এখনও জেগে রয়েছ কেন?

আমি হাসলাম। গলার টাইটা আলগা করতে করতে বোসদা বললেন, দেড় হাজার লোকের স্পেশাল কেটারিং তো সোজা জিনিস নয়। হাড় ভাজা ভাজা হয়ে গিয়েছে। আমি তখনও চুপ করে ছিলাম। বোসদা বললেন, কী এত ভাবছ?

বললাম, কিছুই না। একটা সিগারেট ধরিয়ে বোসদা বললেন, আমরা ছোটোবেলায় সুর করে গাইতাম–ভাবিতে পারি না পরের ভাবনা।

বললাম, সারাজীবনই তো আপনি আমাদের মতো পরের ভাবনা ভেবে গেলেন।

বোসদা আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, তোমরা কী আমার পর?

যাদের আপন ভাবছেন, একদিন হঠাৎ বুঝবেন, তারা সবাই পর। আমি বোসদার দিকে তাকিয়ে বললাম। অন্ধকারে সিগারেটের অস্পষ্ট আলোকে আমার মুখটা বোসদা বোধহয় ভালভাবে দেখতে পেলেন না। বললেন, কেন? বিপদে পড়লে তুমি কি আমাকে দেখবে না?

মনে মনে বললাম, নিজেকে আমার বুঝতে একটুও বাকি নেই। এই তো দুনম্বর সুইটে আমার সাহায্যপ্রার্থিনীকে কেমন দেখলাম।

দেখে দেখে এবং শাজাহানের বিষ গ্রহণ করে করে সত্যসুন্দর বোস নীলকণ্ঠ হয়ে গিয়েছেন। আকাশের দিকে একঝলক ধোঁয়া ছুড়ে দিয়ে বললেন, সংসারের হোটেলখানায় কেউ কাউকে সার্ভ করতে পারে না। আমরা কেবল ভাল ওয়েটারের মতো সামনে ট্রে ধরতে পারি, তার থেকে যার যা পাওনা তুলে নিতে হবে।

কথা শেষ করেই বোসদা এবার হেসে উঠলেন। বললেন, এখন তোমাকে আর ঐ ট্রে ধরতে হবে না। তোমাকে যা ধরতে হবে তার নাম পেগ। কারণ মিসেস পাকড়াশী ককটেলের ব্যবস্থা করেছেন, এই হোটেলেই। শুধু ডিনারে আজকাল কলকাতার কোনো শুভকাজ সম্পন্ন হয় না। এখন পাকস্পর্শের পর জলস্পর্শ। অর্থাৎ কোনো হোটেলে একদিন বিশেষভাবে নির্বাচিত অতিথিদের সেবাযত্ন। এ-সবের ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে, কারণ কাল থেকে ওখানে তোমার ডিউটি, মিস্টার সরাবজি হবেন তোমার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। কিন্তু সে-সব পরে শুনবে, এখন ঘরের ছেলে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো।

আর আপনি? আমি প্রশ্ন করেছিলাম।

আমি এখন স্নান করব। স্নান সেরে গায়ে একটু পাউডার ছড়িয়ে কিছুক্ষণ কুমীরের মতো চুপচাপবিছানার উপর পড়ে থাকব, তারপর রাত-ডিউটির জন্যে একতলায় নেমে যাব।

এই পরিশ্রমের পর রাত-ডিউটি! আমি বারণ করেছিলাম। আমার হয়ে মিসেস পাকড়াশীর বাড়িতে তিনি যখন কাজ করে এসেছেন, তখন আমি এবার ওঁর বদলিতে যাই। কিন্তু সত্যসুন্দরদা কিছুতেই রাজি হলেন না। বললেন, আমি তোমার উপর-ওয়ালা। ডিউটি-চাৰ্টতৈরি করবার দায়িত্ব আমার না তোমার? একরকম জোর করেই বোসদা আমাকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

অবসন্ন দেহটা ক্লান্তিভরা রাত্রের অন্ধকারে বিছানায় নিশ্চিন্ত প্রশ্রয়ে কখন যে ঘুমকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছিল খেয়াল করিনি। হঠাৎ মনে হল ঘরের দরজায় যেন টোকা পড়ছে। ধড়মড় করে উঠে দরজা খুলতেই দেখলাম, একটা টর্চ হাতে করে সত্যসুন্দরদা দাঁড়িয়ে আছেন। আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, সরি, তোমাকে এমন সময় ডেকে তুলতে বাধ্য হলাম। তোমাকে ঘরটা এখনি ছেড়ে দিতে হবে। ব্যাপারটা পরে বলছি। এখন চল দিকিনি, তোমার বিছানার চাদরটা সোজা করে দিই।

দ্রুতবেগে বোসদা বিছানাটা ঠিকঠাক করে দিলেন। আমাকে বললেন, তাড়াতাড়ি মুখে চোখে একটু জল দিয়ে নাও।

বাথরুমের ভিতরে মুখে চোখে জল দিতে দিতেই শুনলাম, বোসদা কাদের লছেন,আসুন। আপনারা ক্লান্ত হয়ে রয়েছেন, বিশ্রাম না করলে হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম, এক ভদ্রলোক আমার বিছানায় বসে পড়ে জুতো খুলতে আরম্ভ করেছেন। জুতো খুলতে খুলতেই তিনি বললেন, মিস্ মিত্রের কী ব্যবস্থা হবে? বোসদা বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি এখনই সব ঠিক করে দিচ্ছি।

রাত্রের ম্নান আলোকে ঘুম-জড়ানো চোখে দেখলাম, হালকা ফাইবারের ব্যাগ হাতে, ফিকে নীল রংয়ের সিল্কের শাড়ি পরে এক তরুণী ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বোসদা তার ব্যাগটা তুলে নিয়ে বললেন, আসুন।

ভদ্রমহিলা প্রতিবাদ জানালেন। বললেন, সে কী, আপনি আমার ব্যাগ বইবেন, তা কখনও হয় না। বোসদা সে-কথায় কান না দিয়ে বললেন, আসুন।

এবার আমরা বোসদার ঘরের সামনে এলাম বোসদা ব্যাগটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, একটু দাঁড়াও, আমি চাবিটা নিয়ে আসি।

ভদ্রমহিলা লজ্জায় যেন নীল হয়ে গিয়েছেন মনে হল। বললেন, কেন আমার ব্যাগ ধরে দাঁড়িয়ে থাকবেন? আমার অত্যন্ত লজ্জা করছে।

আমি চুপ করে রইলাম। ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে এক বিষণ্ণ-নয়না সুন্দরীকে আবিষ্কার করলাম। আমারই চোখের সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি যেন প্রিন্সেস অব স্যাত্ আইজ ছাড়া আর কেউ নয়। তার দৃঢ় নমনীয় গ্রীবার মধ্য দিয়ে যে সৌন্দর্য খুঁজে পেলাম তা স্নিগ্ধ নয়, শান্ত নয়, কর্কশও না, মধুরও না। সামান্য হাই তুলে ভদ্রমহিলা বললেন, এত রাত্রে কাউকে এমনভাবে বিপদে ফেলার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না।

ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বরেও বৈশিষ্ট্য। নাচের ঘুঙুর যদি আরও চাপা হত, ট্রামের ঘর্ঘর যদি ঘনশ্যাম ঘাসের ভেলভেটে আরেকটু অস্পষ্ট হত, আরেকটু সংযত, তাহলে অনেকটা যেন মিস্ মিত্রের স্বর হত তারা।

চাবি নিয়ে এসে বোসদা দরজাটা খুললেন। চাপা গলায় বললেন, আজকের রাতটা কোনোরকমে এখানে কাটিয়ে দিন।

মিস্ মিত্র ঘরটার চারিদিকে তাকিয়ে বললেন, কার ঘর আমি জোর করে অধিকার করলাম? বোসদা বললেন, সে-সব পরে খোঁজ করা যাবে, এখন শুয়ে পড়ুন। ভদ্রমহিলা শুনলেন না। বললেন, কার ঘর না বললে, আমার ঘুমই আসবে না। বোসদা চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, মিঃ স্যাটা বোসের।

কী বোস? ভদ্রমহিলার বিষণ্ণ চোখে এবার সত্যিই হাসি ফুটে উঠল।

বোসদা বাধ্য হয়ে, এবার নিজেই উত্তর দিলেন, ছিলাম সত্যসুন্দর, কপালদোষে স্যাটা হয়েছি!

ভদ্রমহিলা বললেন, আমরা বাসেই থাকতে পারতাম, কিংবা কয়েক ঘণ্টা লাউঞ্জে কাটিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু কী যে করলেন আপনি। এখন আপনারা শোবেন কোথায়?

আমার তো পোবার প্রশ্নই ওঠে না, মিস্ মিত্র, আমি তো ডিউটিতে থাকব। আর এই শ্রীমানেরও একটু পরে কাজ রয়েছে।বাথরুমের দরজাটা খুলে বোসদা বললেন, চাবিটা একটু শক্ত আছে, সামনের দিকে টেনে একটু জোরে ঘোরাবেন, তাহলেই দরজা খুলে যাবে। টাওয়েলটা ধোপ-ভাঙা, সুতরাং ব্যবহার করতে পারেন।

মিস্ মিত্রকে নমস্কার করে আমরা দুজনে বেরিয়ে আসছিলাম। ভদ্রমহিলাও আমাদের সঙ্গে বেরিয়ে এলেন। কোনোরকমে বললেন, আপনাকে কীভাবে কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝে উঠতে পারছি না!

শুভরাত্রি জানিয়ে বোসদা আমাকে নিয়ে নীচে নেমে এলেন। বললেন, আর কোনো উপায় ছিল না। তোমাকে ছাড়া কাউকে জাগাবার মতো অধিকারও আমার নেই।

বোসদা বললেন, ভদ্রমহিলা হচ্ছেন হাওয়াই হোস্টেস। ওঁদের প্লেনে হঠাৎ যান্ত্রিক গোলযোগ হওয়ায় হোটেলে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। প্লেনের অফিসারদের জন্যে সাধারণত আমাদের আলাদা ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু আজ শোচনীয় অবস্থা। ঘর খালি নেই। তারাও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। ভদ্রমহিলা একবার বললেন, আপনার কষ্ট করবার দরকার নেই, লাউঞ্জের সোফাতেই গড়িয়ে নিচ্ছি। কিন্তু তা কখনও হয়? বাধ্য হয়েই তোমাকে ডেকে তুললাম। কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার তো। সকালেই দুএকটা ঘর খালি হয়ে যাবে। তখন ওঁদের সরিয়ে দেব।

আমি বোধহয় আর একটা হাই চেপে রাখার চেষ্টা করছিলাম। বোসদা পিঠে হাত দিয়ে বললেন, হোটেলে যদি কাজ করতে হয়, তাহলে রাত জাগার অভ্যাস রাখা ভাল। রাত্রে কারা জেগে থাকে জানো? আমি বললাম, ছোটবেলায় শুনেছি, দুষ্টু এবং অবাধ্য ছেলেরাই রাত্রে জেগে থাকে।

ঠিক। পৃথিবীর অবাধ্য দুষ্টু ধেড়ে খোকারাই রাত্রে জেগে থাকে। সারারাত্রের অত্যাচারে ক্লান্ত হয়ে ভোরের সান্ধ্য মুহূর্তে তারা ঘুমিয়ে পড়ে।

কিছুই কাজ নেই, জেগে থাকা ছাড়া। কাউন্টারে আমরা দুজন জেগে বসে রয়েছি। বসে বসে বোসদা একটুকরো কাগজের উপর পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকছেন। পেন্সিলের আঁচড়ে শাজাহানের লাউঞ্জকে নকল করবার চেষ্টা করছেন। বাইরে আর একজন দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে শাজাহান হোটেলের প্রায়-মিলিটারি পোশাক। তার হাতে একটা পেন্সিল ও খাতা।

এক অদ্ভুত স্বাধীনতার আনন্দে মনটা ক্রমশ ভরে উঠল। কেউ কোথাও নেই, শাজাহান হোটেলের সর্বেসর্বা যেন আমরাই। এই বিশাল হোটেলের অসংখ্য ঘরে যাঁরা রয়েছেন, তারা পরম বিশ্বাসে আমাদের উপর সব দায়িত্ব অর্পণ করে নিঝুম রজনীতে ঘুমিয়ে রয়েছেন। রাতের রেলগাড়ির ড্রাইভার ও ফায়ারম্যানের মতো অতি দূরতীর্থের যাত্রীদলকে আমরা দুজনে যেন কোনো সোনার প্রভাতের দিকে নিয়ে চলেছি। মণিমাণিক্যে ভরা সেই নতুন প্রভাতে এই ঘুমন্ত মহাদেশের তীর্থযাত্রীরা কি পরম বৈভব খুঁজে পাবেন জানি না; কিন্তু আমরা তখন তাদের আনন্দে ভাগ বসাবার জন্যে জেগে থাকব না। হোটেলের দায়িত্ব অন্য কারুর উপর দিয়ে, দিনের আলোতে আমরা তখন অবহেলিতা অভিমানিনী রাত্রিকে আমাদের ছোট্ট ঘরে ডেকে আনবার চেষ্টা করব।

মিস্টার আগরওয়ালা নতুন হোস্টেস রেখেছেন। রাত্রির নিস্তব্ধতার মধ্যেও দেখলাম, দুনম্বর সুইট থেকে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। আমি চিনতে পারিনি। বোসদা কানে কানে বললেন, ইনি আমাদের দেশের একজন নামকরা শ্রমিকনেতা। আগরওয়ালাদের কারখানাগুলোর শ্রমিকদের ইনিই নেতৃত্ব করেন। একটা ট্যাক্সি সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়লেন। গাড়িটা শ্যামবাজারের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। দারোয়ানজি পকেট থেকে নোটবই বের করে কী একটা টুকে নিলেন।

বোসদা হেসে বললেন, গাড়ির নম্বরটা আমরা রাত্রে টুকে রেখে দিই। অত রাত্রে যারা যাতায়াত করে, তাদের কপালে যে কী আছে তার ঠিক নেই।

রাত্রি যে শেষ হয়ে আসছে এবার বুঝলাম। লেনিনবাবু একটা খাটো ধুতি পরে গামছা হাতে স্তব পাঠ করতে করতে বেরিয়ে যাচ্ছেন। এত সকালে আইন কানুন মানা হয় না তাই; না-হলে হোটেলের কোনো কর্মচারীকে ঐ বেশে সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেওয়া হয় না। স্তব পাঠ করতে করতেই তিনি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি প্রশ্ন করলাম, কোথায় চললেন?

মায়ের কাছে। মা আমার সব দোষ ক্ষমা করবেন। সারাদিন ধোপার ময়লা ঘেঁটে ঘেঁটে যত পাপ করেছি, তা এবার মার চরণে বিসর্জন দিয়ে আসব। বোসদার দিকে তাকিয়ে লেনিনবাবু বললেন, আপনি তো সার সায়েব মানুষ, আপনাকে বলে লাভ নেই। এই ছোকরাকে, এই ব্রাহ্মণসন্তানকে অ্যালাউ করুন। ভোরবেলায় স্নানের অভ্যাসটা থাকলে অনন্ত নরকবাসের হাত থেকে বেঁচে যাবে।

বোসদা মৃদু হাসলেন। বললেন, আমি কি ওকে আটকে রেখেছি? ইচ্ছে হলে যাক। ন্যাটাহারিবাবু বললেন, তা হলে চলুন। এই সকালে ঘাটে গিয়ে দেখবেন কত পুরুষ আর মেয়েমানুষ সারারাতের পাপ ধুয়ে ফেলছে। আমাদের হেডবারম্যান রাম সিং এতক্ষণে স্নান শেষ করে পুজোয় বসে গিয়েছে।

আমি বললাম, আপনি একাই যান।

উনি চলে যেতে বোসদা বললেন, পাগল। ফেরবার সময় লোকটা এক ঘটি জল সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। প্রথমে হোটেলের সামনে একটু ছড়িয়ে দেবে। পিছনের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে, বালিশ বিছানার পাহাড়ের উপর জল ছড়িয়ে দিয়ে বলবে, মা দুর্গতিনাশিনী, দেখিস মা।

একটা ঘর এই ভোরবেলায় খালি হয়ে গেল। এক আমেরিকান দম্পতি রাঁচির দিকে চলে গেলেন। বোসদা বললেন, ওপরে আমাদের একটা ঘর না হলে চলে না। দেখ, দুজনের কেউ উঠেছেন কি না।

উপরে উঠে গিয়ে দেখলাম, বোসদার ঘর ভিতর থেকে বন্ধ। হাওয়াই হোস্টেস মি মিত্র এখনও ঘুমিয়ে রয়েছেন। আমার ঘরের দরজাটা খোলা। গুড়বেড়িয়া বললে, সায়েব উঠে পড়েছেন। চা খেয়েছেন।

দরজায় নক করতেই হাওয়াই জাহাজের ভদ্রলোক বললেন, কাম ইন।

ঢুকে গিয়ে আমি বললাম, রাত্রে আপনার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছে। নিচের একটা ঘর খালি হয়েছে। আপনি চলুন।

গুড়বেড়িয়ার হাতে মালপত্র চালান করে দিয়ে, ভদ্রলোককে নিচের ঘরে ঢুকিয়ে বোসদাকে খবর দিয়ে এলাম।

বোসদা হেসে বললেন, এখানে থেকে থেকে ভাগ্যটা একেবারে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। তোমার কপালের জন্যে হিংসে হচ্ছে। ভদ্রমহিলাকে কখন যে বিদেয় করে একটু ঘুমোতে পারব জানি না।

আজ এতদিন পরে বোসদার সেই কথাগুলো মনে পড়লে কেমন হাসি আসে। আশ্চর্যও লাগে। সুজাতা মিত্রের কথা, বোসদার কথা, ভাবলে মনটা কেমন হয়ে যায়। আজও কোনো কর্মহীন নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায় আমি যেন সুজাতা মিত্রকে খুব কাছাকাছি দেখতে পাই। অকারণে আমার বয়সী চোখ দুটো সেই সুদুর অতীতে ফিরে যেতে চায়। আমি বুঝি, এ অন্যায়, সংসারের নিষ্করুণ পথে চিত্তের এই চঞ্চলতা মানায় না। আমার পরিচিতা একান্ত আপনজন সকৌতুকে এবং সস্নেহে অভিযোগ করেন, তোমার সব ভাল। শুধু এই ছেলেমানুষিটুকু ছাড়া। সংসারের পাঠশালায় এত শিখেও তুমি সেই কৈশোরেই রয়ে গেলে, বড় হয়ে উঠলে না।

যিনি আমার কাছে বারবার এই অভিযোগ করেন, তিনি হয়তো চান আমার অপরিণত মন কৈশোরের প্রবৃত্তি কাটিয়ে যৌবনের রংয়ে নিজেকে রঙিন করে তুলুক। কিন্তু কেন জানি না বেশ বুঝতে পারি কৈশোর থেকে সোজা আমি বার্ধক্যে এসে দাঁড়িয়েছি। ওঁদের দুজনকে স্কুটারের পিঠে ভ্রমণ করে ফিরে আসতে দেখে আমি সুজাতাদিকে বলেছিলাম শুনুন, জগন্নাথ চক্রবর্তীর কবিতা–

কদমে চলেছে দুই সাঁঝের তারকা
স্কুটারের পিঠে,
ফাঁপানো চুলের গুচ্ছে লাল ফিতে
ওড়নায় লেপটানো পিঠ অসম্বৃত
অদম্য অকুতোভয় স্কুটারের তরুণ চালক।

আর আবৃত্তি করতে দেননি, সুজাতাদি আমার কানটা চেপে ধরেছিলেন। আমি বলেছিলাম, লাগছে। ছেড়ে দিন।

বোসদা বলেছিলেন, আঃ, না হয় বলেই ফেলেছে।সুজাতাদি বলেছিলেন ওড়না ও কোথায় পেল?

এতদিন পরে সে-সব স্বপ্নের মতো মনে হয়।

সুজাতা মিত্রের কাহিনিতে একদিন আমাকে আসতেই হবে। কিন্তু তার আগে ককটেল এবং মিস্টার সরাবজি।

মিস্টার সরাবজি ভারতীয় প্রথায় হাতজোড় করে খাঁটি বাঙলায় বলেছিলেন, আসুন, বসুন। এই বার-এ আপনাকে পেলে আমি আর কিছুই ডর করি না।

সরাবজি আমাদের নতুন বার ম্যানেজার। বৃদ্ধ ভদ্রলোক, পাকা আপেলের মতো টকটকে রং। বয়সের ভারে একটু নুয়ে পড়েছেন। অবাক হয়ে বললাম, আপনি বাংলা জানেন?

কী যে বলেন। আমি যখন কলকাতায় এসেছিতখন আপনারা এই ওয়ার্লডে আসেননি, আমার নিজেরই তখন চৌদ্দ বছর বয়স।সরাবজিতার সাদা প্যান্টের বলেসটা টাইট করে নিয়ে আমার পিঠে হাত রাখলেন।

আমি বললাম, আবগারি খাতাগুলো ঠিক করে রাখা দরকার, ওগুলোর নাম শুনলে ভয় লাগে।

সরাবজি তাঁর চোখের মোটা চশমাটা খুলে প্রসন্ন হেসে বললেন, ওদের আমি ভয় পাই না। আমি যদি ডিউটি ফাঁকি দেবার চেষ্টা না করি, যদি আমি ড্রিঙ্কে জল না মেশাই, যদি আমি কোনো সন্দেহজনক মেয়েকে একলা বার-এ বসে থাকতে না দিই, তাহলে এক্সাইজ ডিপার্টমেন্টকে আমি কেন ভয় করতে যাব?

শাজাহানের বার-এ সরাবজি নিজের হাতে বোতলগুলো সাজিয়ে রাখছিলেন। হেড বারম্যান রাম সিং সায়েবের দিকে তাকিয়ে ছিল। সরাবজি অভ্যস্ত হাতে একটা বোতল আলোর দিকে নিয়ে নেড়ে দেখলেন কতটা আছে, তারপর আবগারি ডিপার্টমেন্টের স্টক রেজিস্টারের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে গিয়ে ওঁর যেন একটু সন্দেহ হল। বললেন, রাম সিং, খাতায় লেখা চার পেগ, অথচ পাঁচ পেগের মতো মাল রয়েছে মনে হচ্ছে।

রাম সিং অপ্রস্তুত হয়ে বললে, হুজুর, হাতের মাপ তো; কোথাও একটু কম, কোথাও একটু বেশি পড়ে যায়।

সরাবজি বললেন, আমি এর ভিতর নেই। নিজের হাতে আমি কাউকে কমও দেব না, বেশিও দেব না।

আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে সরাবজি বললেন, আমরা যখন এই লাইনে আসি তখন এক আধ পেগ ড্রিঙ্কের জন্যে কেউ মাথা ঘামাত না। তখন যার দাম ছটাকা ছিল এখন তা ছিয়াশি টাকাতেও পাওয়া যায় না। এখন কাস্টমারকে এক ফোঁটা কম দেওয়া মানে ফাঁকি দেওয়া।

সরাবজি গম্ভীর হয়ে গেলেন। নিজের মনেই বোতলগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। তারপর আমাকে বার-এ একলা রেখে সেলারে চলে গেলেন।

মাটির গর্ভে দেড় শো বছরের প্রাচীন একটা অন্ধকার ঘর আছে, সেখানে সাধারণের যাওয়া নিষেধ। সেই অন্ধকার সেলারের কোণে এমন বোতলও আছে যা শাজাহানের প্রতিষ্ঠাতা সিম্পসন সায়েব নিজের হাতে ঢুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। তারপর শাজাহানের বুকের ওপর দিয়ে ইতিহাসের চাকাকতবারই তে গড়িয়ে গিয়েছে। সোলাটুপি এবং খাকি প্যান্ট পরে তরুণ ইংরেজ সৈন্যদক্ষ চঁদপাল ঘাটে জাহাজ থেকে নেমে হিন্দুস্থানের প্রথম রাত্রি শাজাহান হোটেলে কাটিয়েছেন। সেদিন সেই নিঃসঙ্গ সৈনিককে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে এই কুঠুরি থেকেই স্কচ বোতল বেরিয়ে এসেছে। গঙ্গানদীতে পাল-তোলা জাহাজের বদলে যেদিন কলের জাহাজ দেখা গিয়েছিল, সেদিনও শাজাহানের সেলার থেকে পাঠানো পানীয়তেই উৎসব-রাত্রি মুখর হয়ে উঠেছিল। তারপর খাকি টুপি এবং হাফ প্যান্টপরা একদল লোক হাতে নকশা নিয়ে কলকাতায় হাজির হয়েছিলেন। তাদের দলপতি দাড়িওয়ালা ম্যাকডোনাল্ড স্টিফেনস স্পেনসেসের বড়াপোচখানায় উঠেছিলেন। আর দলের কয়েকজন আশ্রয় নিয়েছিলেন আমাদের এই শাজাহানে। বার-এ বসে বসে তারা দিনরাত কাগজে কি সবনকশা আঁকতেন। বারম্যানরা বলত, পাগলা সায়েবের দল এসেছে —এরা কলের গাড়ি আনবে ব্লাইত থেকে। তামাম হিন্দুস্থানের পায়ে এরা বেড়ি পরিয়ে দেবে-লোহার রাস্তা তৈরি করবে, এবং একদিন তার উপর দিয়ে বিরাট বিরাট দৈত্য ছোটাছুটি করবে। দৈত্যদের লড়াই-এহারিয়ে দিয়ে সায়েবরা লোহার বাক্সে বন্দি করে রেখেছে। দৈত্যরা তাই কিছুই করতে পারবে না, শুধু মাঝে মাঝে মনের দুঃখে নিশ্বাস ছাড়বে—আর সেই কালো নিশ্বাসে হিন্দুস্থানের সুখের গ্রাম, সোনার ধানক্ষেত পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। সায়েবরা মনে মনে তা জানেন, মাঝে মাঝে ওঁদের মনে দুঃখ হয়—সেইজন্যে দিনরাত মদে চুর হয়ে থাকেন। সায়েবরা বিদায় নিয়েছেন। একদিন এই বাধাবন্ধহীন ফুর্তিকেন্দ্র শাজাহানের পানাগারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সর্বনাশ হয়েছে। কেউ কোনোদিন যা ভাবতে পারেনি তাই হয়েছে—পামার কোম্পানি ফেল করেছে। রাতারাতি অনেক রাজা ফকির হয়েছেন। দেউলিয়া রাজার দলকে মনোবল দেবার জন্যে শাজাহানের সেলার থেকে আবার ব্রান্ডি, হুইস্কি এবং জিন-এর বোতল বেরিয়ে এসেছে। হুইস্কির মোহিনী মায়ায় কলকাতা আবার সব ভুলে গিয়েছে। নতুন বড়লাট এসেছেন, নতুন ঘোটলাট এসেছেন—আবার পুরনো বোতল ভেঙে নবাগতদের স্বাস্থ্যপান করা হয়েছে।

তারপর শাজাহানের কর্তারা একদিন মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন। বড়াপোচখানায় নতুন কল এসেছে। লিফট। পায়ে হেঁটে আর কাউকে উপরে উঠতে হবে না। অবশ্য বড়াপোচখানায় এখন এই লিট কেবল লেডিজদের জন্যে। তারা খিলখিল করে হাসতে হাসতে একটা খাঁচার মধ্যে গিয়ে বসলেন, আর দুজন বেয়ারা দড়ির কপিকল দিয়ে সোঁ সোঁকরে টেনেতাদের উপরে তুলে দিচ্ছে। এর পর কেউ কি আর লিবিহীন এই সেকেলে শাজাহানে আসবে? সে-চিন্তাও তারা যখন করেছেন তখন তাদের সামনে ছিল শাজাহান হুইস্কি—স্পেশালি বন্ড ইন স্কটল্যান্ড ফর হোটেল শাজাহান।

এমনি করেই একদিন শাজাহানে আকাশে নতুন শতাব্দীর সূর্যোদয় হয়েছে। দিন পালটিয়েছে, দৃষ্টিভঙ্গি পালটিয়েছে, পোশাক পালটিয়েছে, রাজা, হোটেলের মালিক, বারমেড, বারম্যান সব পালটিয়েছে, কিন্তু হুইস্কির পরিবর্তন হয়নি। আকাশের চন্দ্র সূর্য এবং মাটির হুইস্কি-এদের কোনোদিন পরিবর্তন হবে না—হবস সায়েব আমাকে একবার বলেছিলেন। তার কাছেই শুনেছিলাম, শাজাহানের সেলারে সিম্পসন সায়েব যে এক কেস রেড ওয়াইন রেখেছিলেন, তার একটা বোতল খোলা হয়েছিল সেবার যখন লর্ড কার্জন আমাদের এই হোটেলে পদার্পণ করেছিলেন। তারপর বাকি কটা বোতল আজও কোনো বৃহৎ অতিথির আবির্ভাব অপেক্ষায় শতাব্দীর নিদ্রায় অচেতন হয়ে রয়েছে।

সরাবজি একটু পরেই ফিরে এলেন। এখন দুপুরবেলা-লাঞ্চের ভিড় শেষ হয়ে গিয়েছে। কয়েকজন ক্লাইভ স্ট্রিট কর্তা এই কোণে ঝুঁদ হয়ে বসে রয়েছেন, লাঞ্চ করতে এসে নেশার ঘোরে অফিসের ঠিকানা ভুলে গিয়েছেন বেয়ারাকে জিজ্ঞাসা করছেন, টুম জানটা হ্যায়? বিকুল গড়বড় হো গিয়া।

বেয়ারা বেচারা বলেছে, হুজুর, আপনি কোন অফিসে কাজ করেন তা আমি কী করে জানব? নেশার ঘোরে সায়েব এবার আমাকে ডেকে পাঠালেন। তোমরা এই সব শুড়-ফর নাথিং ফেলোদের রেখেছ কেন?

সরাবজি এবার কাউন্টার থেকে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। সায়েবকে বললেন, তুমি অমুক অফিসে কাজ করো।

সায়েব চমকে উঠলেন, এতক্ষণে মনে পড়েছে আমি ওখানকার ম্যানেজিং ডিরেক্টর। অথচ কোথায় কাজ করি তা মনে করতে না পেরে আমি দেড় ঘণ্টা এখানে বসে আছি।

সায়েব চলে যেতে, সবজিকে বললাম, কেমন করে বললেন?

সরাবজি হাসলেন,এদের প্রায় সবাইকে আমি চিনি। শুধুঅফিসনয়, এদের বাড়ির ঠিকানাও হোটেলের লোকদের জেনে রাখতে হয়, রাত্রে প্রায়ই এদের বাড়ি ফিরে যাবার সামর্থ্য থাকে না। ড্রাইভার থাকলে অসুবিধে হয় না, কিন্তু অনেকে যে নিজেই গাড়ি চালিয়ে আসেন তখন গাড়ি পড়ে থাকে, ট্যাক্সি করে আমরা বাড়ি পৌঁছে দিই।

এর পর গল্প করবার মতো সময় আমাদের ছিল না। সন্ধের ককটেলে অনেক কাজ।

যদি কখনও আধুনিক এই পৃথিবীতে আদিম সভ্যতার রসাস্বাদন করতে চান তবে শাজাহান হোটেলের ককটেলে আসবেন। মিসেস পাকড়াশীর পার্টিতে আমি সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম। সরাবজি আমার কানে কানে বলেছিলেন, ককটেলের চারটে অধ্যায় আছে। প্রথম প্রহরে ঠাকুর চেঁকি অবতার, দ্বিতীয় প্রহরে ঠাকুর ধনুকে টঙ্কার, তৃতীয় প্রহরে ঠাকুর কুকুরকুণ্ডলী, চতুর্থ প্রহরে ঠাকুর বেনের পুঁটুলি।

প্রথম অধ্যায়ে অতিথিরা সহজ সাধারণতখন—কেমন আছেন? হাউ ড়ু ইউ ড়ু? মিসেস সেনকে দেখছি না কেন! উনি কি রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষা নিলেন নাকি? পুওর মিস্টার সেন! মেয়েদের এই বয়সটা ডেঞ্জারাস। একটু অসাবধান হয়েছেন কি দেখবেন বাড়ির বউ মিশনে মন দিয়ে বসে আছেন। অসহ্য। যা হোক, মিসেস পাকড়াশী এতদিনে তা হলে একটা কাজের কাজ করলেন। আরও দুবছর আগে অনিন্দ্যর বিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। এখন ওয়েস্টের দিকে তাকিয়ে দেখুন—অ্যাভারেজ ম্যারেজবল এজ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। যোলো-সতেরো বছরের ছেলেমেয়েরা বিয়ে করে সংসার পাতছে, পেতেই মেটারনিটি হোমে যাচ্ছে। আর ইন্ডিয়াতে বিয়ের বয়স শুধুই বাড়ছে কিছুদিন পরে হয়তো অ্যান্টি-সারদা অ্যাক্ট পাশ করাতে হবে।…কংগ্রাচুলেশনস মিসেস পাকড়াশী। হোয়াট অ্যাবাউট এ ড্রিঙ্ক?।

নিচ্ছি, মিস্টার ব্যানার্জি। আমি অরেঞ্জ স্কোয়াশ নিচ্ছি। তা বলে আপনারা লজ্জা করবেন না। আপনারা ওদের দুজনের হ্যাপি লাইফ ড্রিঙ্ক করুন। ক্যারি অন। শ্যামপেন ককটেলও রয়েছে। আচ্ছা চলি, ওখানে মিস্টার আগরওয়ালা একলা দাঁড়িয়ে রয়েছেন, আমাদের জন্যে উনি অনেক করেন। রিয়েল ফ্রেন্ড।

মিসেস পাকড়াশী চলে যেতেই ব্যানার্জিকে বলতে শুনলাম, হ্যালো পি-কে, মিসেস পাকড়াশীর পার্টির মাথামুণ্ডু বুঝি না! ড্রেস ইভনিং করা উচিত ছিল। তা না লাউঞ্জ স্যুট। ব্যাড়। আফটার অল ইভনিং স্যুট না হলে পার্টির ডিগনিটি থাকে না। ক্যালকাটা যেভাবে উচ্ছন্নে যাচ্ছে তাতে এমন একদিন আসছে যেদিন তোমারই অফিসের ক্লার্ক লুঙি পরে তোমার পাশে বসে ড্রিঙ্ক করবে। অথচ তুমি কিছুই বলতে পারবে না।

দ্বিতীয় অধ্যায় একটু যোরালো।তখন হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতোনাচে রে। শোনা গেল, কেন-যে আমরা কোট প্যান্ট টাই পরে গরমে সেদ্ধ হচ্ছি! কী দরকার এই সব ফরম্যালিটির? বোয়–খিদমতগার-ইধার আও। দো রোব বয় বানাও।স্কচ হুইস্কি, ব্রান্ডিশরাব ঔর এ-বিটি।জলদি জলদিখিদমতগার, তুম বহুৎ আচ্ছা আমি হ্যায়।.শ্রীমতী অনিন্দ্যকে দেখছ। জ্ব নয় তো যেন এক জোড়া ধনু! সহর্ষে ধনু ভঙ্গ করে ভদ্রমহিলা কথা বলছেন। আর একজন বললেন, ঠিক হল না। বলো, মৃগলোচনা সুন্দরী তার যৌবনমত্ত তনুদেহ হিল্লোলিত করে কথা বলছেন।

তৃতীয় অধ্যায়—হুইস্কির কল্যাণে তখন দারা-পুত্র-পরিবার তুমি কার কে তোমার। তখন চারিদিকে কথার ফুলঝুরি-জানেন, আমার ওয়াইফ কি সিলি? ড্রিঙ্ক করেছি শুনলে কাঁদতে আরম্ভ করে। আরে, এ কী ধরনের ন্যাকামো? সত্যি বলছি, আমি একটা এ ডবল এ। মাধব পাকড়াশীও তাই—আবার বাঙালি মেয়ের হাঙ্গামায় গেলেন। মোমের পুতুলটি ছোকরার লাইফ মিজারেবল্ করে দেবে। হ্যাঁ বাবা, বিয়ে যদি করতে হয় পাঁচ-নদীর তীরে। ওয়ান্ডারফুল, ওদের মেয়েরা ড্রিঙ্কের কদর বোঝে। রবি ঠাকুরও ওদের বুঝেছিলেন। না-হলে এত দেশ থাকতে পাঞ্জাবের নামটা জাতীয় সঙ্গীতে আগে ঢোকালেন কেন? পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা দ্রাবিড় উত্তাল বঙ্গ—কবি একদম মেরিট অনুযায়ী সাজিয়ে দিয়েছেন। ওই দেখ, রাজপাল কেমন মিসেস রাজপালের সঙ্গে বসে মনের সুখে পেগের পর পেগ ফাঁক করে দিচ্ছে। কী নিয়েছে ওরা? প্যারাডাই? ওয়ান্ডারফুল-জিন, অ্যাপ্রিকট আর অরেঞ্জের মিক্সচার; সত্যিই স্বর্গীয়। যে নাম দিয়েছিল তার পেটে সামথিং ছিল, আর ওই নিসঙ্গ সুন্দরী, উনি কী টানছেন? ওঁর কদর অনেক, অনিন্দ্য পাকড়াশীর স্ত্রী সম্বন্ধে বোম্বাই-এর ফ্যাশন কাগজে প্রবন্ধ লিখবেন। হোয়াট? হোয়াইট লেডি নিয়েছেন—জিন আর লাইম? পুওর গার্ল–দেখে মনে হচ্ছে প্রিয়-বিরহক্লিষ্ট! ওঁর আসঙ্গমুগ্ধ নারীচক্ষু কাউকে খুঁজে পাক, ওঁর অধর লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠুক, তখন ওঁকে একটা পুরো গেলাস পিংক লেডি দাও। তাতে থাকবে জিন, সঙ্গে ডিম এবং গ্রেনাডিন। ওয়ান্ডারফুল। তখন ওঁর মৃগলোচনে কাজলের মসিরেখা ফ্লুওরেসেন্টে পেস্টের মতো জ্বলজ্বল করে। আরে ব্রাদার, তোমার হল কী? এরই মধ্যে হাত গুটিয়ে বসে আছ? তুমিও কি আজকালকার ফ্যাশনেবল্ লেম্বুপানি সায়েব হয়ে গেলে নাকি? বোকামি কোরো না। এমন সুযোগ রোজ আসবে না। এমন চান্স পাবে না। শ্যামপেন ককটেলে লোক কিছু তোমাকে রোজ ইনভাইট করবেনা।মনে থাকে যেন, এক পেগ বারো টাকা। টেনে নাও ব্রাদার। অক্ষিতারকার কটাক্ষ, স্ফুরিত অধরের হাস্য ভুলে গিয়ে কারণ-সাগরে ড়ুব দাও।

চতুর্থ এবং শেষ অধ্যায়ে অনেক কম লোক। তৃতীয় বারেই বোন্ড আউট হয়ে অনেকেই পালিয়েছে। হোস্টের তখন যাবার ইচ্ছে, কিন্তু পালাবার উপায় নেই। অতিথিদের মধ্যে ড্রিঙ্ক ছেড়ে উঠবার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না কেউ নেশার ঘোরে অহিংসপথে সত্যাগ্রহ করে বসে আছেন। আর কেউ হয়ে উঠেছেন হিংস্র। যেন কাচের বাসনের দোকানে মত্ত ষাঁড় ঢুকে পড়েছে। গেলাস ভাঙছে, খালি বোতল ছোড়াছুড়ি চলেছে। কী যে হচ্ছে কেউ বুঝতে পারছে না। মিসেস পাকড়াশী স্বামীর সঙ্গে সরে পড়েছেন। পাকড়াশী ইন্ডাস্ট্রিজের পি-আর-ও শুধু বিল মেটাবার জন্যে এবং প্রয়োজন হলে পুলিসের হাঙ্গামা সামলাবার জন্যে রয়ে গেলেন। এক এক করে হঘর প্রায় শূন্য হয়ে গেলো। কিন্তু তখনও দু-একজন সেখানে বসে থাকতে চান। পি-আর-ও বললেন, স্যার, বার বন্ধ করবার সময় হয়ে আসছে।

শাট আপ। এ কী ধরনের ভদ্রতা? নেমন্তন্ন করে নিয়ে এসে না খেতে দেওয়া?

পি-আর-ও বেচারা তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। অতিথিরা কাজ শেষ করবার জন্য ঢকঢক করে আরও কয়েকটা পেগ সেরে ফেললেন, তারপর টলতে টলতে বেরিয়ে গেলেন। কাচের টুকরো পরিষ্কার করতে গিয়ে বেয়ারারা দেখল, এক কোণে টেবিলের তলায় কে একজন সায়েব ফ্ল্যাট হয়ে শুয়ে রয়েছেন। কাছে গিয়ে দেখলাম, ফোকলা চ্যাটার্জি বেসামাল অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। কোনোরকমে উঠে বেরিয়ে যাবার সময় বললেন, খুবই সাবধানী ব্যাটসম্যান। কিন্তু ভাগনের বিয়েতে ইচ্ছে করেই বোল্ড আউট হলাম।

এর নামই ককটেল পার্টি। ঝলমলে সন্ধ্যায় পুত্র এবং পুত্রবধুকে নিজের দু-দিকে নিয়ে মিসেস পাকড়াশী যখন বার-এ ঢুকেছিলেন, তখন সবটা কল্পনা করে নিতে পারিনি।

অনিন্দ্য পাকড়াশী আজ একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন আমাকে দেখে একবার একটু থেমেছিলেন, হয়তো দু-একটা কথা বলবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু মিসেস পাকড়াশী বললেন, খোকা, এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাজে গল্প করবার সময় নয়, গেস্টরা তোমারই জন্যে অপেক্ষা করছেন।

অনিন্দ্যর সঙ্গে আর কথা বলবার সুযোগ পাইনি। বলবার ইচ্ছেও ছিল না। তবু বার বার হাল্কা হাসির ফোয়ারার মধ্যে, রঙিন মদের সোনালি নেশার ভিতর দিয়ে একটা বিষণ্ণ মহিলার মুখ বার বার অহেতুকভাবে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল।

মিসেস পাকড়াশীর পার্টিতে আমার হয়তো কোনো লাভ হয়নি। কিন্তু হোটেলের হয়েছিল—একটা ককটেল থেকে তারা দশ হাজার টাকার চেক পেয়েছিলেন। আবগারি ইন্সপেক্টর হিসেব পরীক্ষা করতে এসে বললেন, চমৎকার, এই রকম ককটেল যত হয় তত আপনাদেরও লাভ, গভর্নমেন্টেরও লাভ।

বেয়ারাদেরও লাভ। সরাবজি হাসতে হাসতে বললেন।

দুনিয়াতে সবারই লাভ, ক্ষতি কেবল লিভারের, গলার আওয়াজে মুখ ফিরিয়ে দেখি হবস সায়েব!

হবসের সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয়নি। তাকে আমাদের মধ্যে পেয়ে খুব আনন্দ হল। মাথার টুপিটা খুলতে খুলতে সায়েব বললেন, মার্কোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। এক বন্ধুর জন্যে ঘর চাই। কিন্তু ম্যানেজারকে পেলাম না।

এর জন্যে ম্যানেজারকে কী প্রয়োজন? আমরা তো রয়েছি।অভিমানভরা কণ্ঠে আমি অভিযোগ জানালাম। হবস বললেন তা হলে ব্যবস্থা করে দাও।

ওঁকে নিয়ে বার থেকে বেরোবার পথে সরাবজির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সরাবজিকে দেখেই মিস্টার হবস যেন একটু অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, তুমি! তুমি এখানে?

সরাবজি ম্লান হাসলেন। সবই তার ইচ্ছা। আমরা কী করতে পারি? সরাবজির সামনে হবস দাঁড়িয়ে পড়লেন। কোনো ব্যক্তিগত কথা থাকতে পারে আন্দাজ করে আমি এগিয়ে গেলাম। কাউন্টারে খাতায় হবস সায়েবের বন্ধুর কোনো জায়গা করে দেওয়া যায় কি না দেখতে লাগলাম। তিনি এসে আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, কলকাতার হোটেলজীবনকে আমি যতদূর জানি তাতে এইটুকু বলতে পারি, রিসেপশনিস্ট ইচ্ছে করলে সব সময় জায়গা করে দিতে পারে।

বোসদা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, একদিন সত্যিই তা ছিল। কিন্তু ফরেন ট্যুরিস্ট, বিজনেস-টুর এবং কনফারেন্সের দৌলতে সে-ক্ষমতা কোথায় উবে গিয়েছে। ম্যানেজার নিজেই সব সময় বুকিং-এর উপর শ্যেন দৃষ্টি রেখেছেন।

হবস সায়েবের বন্ধুর অবশ্য কোনো অসুবিধা হল না। সেদিন সৌভাগ্যক্রমে জায়গা খালি ছিল, পাওয়া গেল।

হবস প্রশ্ন করলেন, সরাবজি কবে থেকে এখানে এলেন?

এই কিছুদিন। আমি বললাম।

ওঁর মেয়ের কী খবর?

আমি কিছুই জানি না। সুতরাং বোকার মতো ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। হবস এবার প্রশ্ন করলেন, মার্কো কোথায়?

বেরিয়ে গিয়েছেন।

একটু হেসে তিনি বললেন, তোমাদের এই হোটেলটা আমি যেন এক্স-রে চোখ দিয়ে দেখতে পাই। বোধহয় তিনি কর্পোরেশন স্ট্রিটে মেকলে পান করতে গিয়েছেন। লর্ড মেকলের নামে যে কোনো পানীয় আছে তা জানতাম না। সাহেব হেসে বললেন, পেনাল কোডের রচয়িতা ঐতিহাসিক মেকলে বেঁচে থাকলে আঁতকে উঠতেন। বাঙালিরা তার সর্বনাশ করেছে। দেশি মা কালী-মার্কা ধেনোর নাম দিয়েছে মেকলে। তোমাদের অনেক আচ্ছা আচ্ছা কাপ্তেন, ডিম্পল স্কচ, জন হেগ, হোয়াইট হর্স ফেলে মেকলে খেতে যান।

হবস এবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছুক্ষণ দেখেই যাই। মার্কোর সঙ্গে একটু প্রয়োজনও ছিল।

আমরা দুজনে লাউঞ্জে বসলাম। বোসদা এগিয়ে এসে বললেন, ওঁকে কিছু অফার করো। চা বা কফি পাঠিয়ে দেব? আমরা সামান্য হোটেল কর্মচারী কীই বা ওঁকে দিতে পারি। পৃথিবীর খুব কম লোকেই হোটেল সম্বন্ধে ওঁর থেকে বেশি জানে।

হবস বললেন, বেশ, কফি খাওয়াও। উনিশ শতকের অষ্টম দশক থেকে তোমাদের হোটেলে কতবারই তো খেয়ে গেলাম, আর একবার খাওয়া যাক।

বোসদা আমাদের জন্যে কফির অর্ডার দিয়ে আবার কাজে বসে গেলেন। হবসের মাথাটা সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়েছে। বলছেন, ইউরোপের সেরা কোনো ঔপন্যাসিক যদি এখানে এসে কয়েক বছর থাকতেন, তা হলে হয়তো এক আশ্চর্য উপন্যাস লিখতে পারতেন। ওয়েস্টের বহু হোটেল আমি দেখেছি কিন্তু ইস্টের সঙ্গে তার তুলনা হয় না। সিম্পসন, সিলভারটন, হোরাবিন থেকে আরম্ভ করে তোমাদের মার্কোপোলো, জুনো এমনকি এই সরাবজি—সব যেন বিশাল ঐতিহাসিক উপন্যাসের এক-একটা চরিত্র।

হাতে সময় ছিল। সায়েবকেও সময় কাটাতে হবে তাই বোধহয় গল্প জমে উঠল। কফির কাপে চুমুক দিয়ে তিনি বললেন, নরি সরাবজি যে কোনোদিন তোমাদের হোটেলে এসে চাকরি নেবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। ওকে আমি সেই প্রথম মহাযুদ্ধের আগে থেকে দেখছি। তখন হাফেসজির দোকানে ছোকরা ড্রিঙ্ক সার্ভ করত। আমার মনে আছে, আমাদের এক বন্ধু একবার একসাইজ ডিপার্টমেন্টে রিপোর্ট করেছিল। ওর আসল নাম সরাবজিও নয়—বোধহয় ম্যাডান না ওই ধরনের কি একটা! সরাবের লাইনে থেকে ছোকরা সরাবজি হয়ে গেল।

ম্যাডানের তখন কত বয়স-চোদ্দ বছরের বেশি নয় বোধহয়। বেচারা কাঁদতে কাঁদতে এসে আমার হাত চেপে ধরেছিল। অত কম বয়সের ছেলেদের মদের দোকানে চাকরি দেবার নিয়ম নেই, রিপোর্ট করেছে কে, এবার চাকরি গেল। আমার দুঃখ হয়েছিল। অনেক চেষ্টা করে সে রিপোর্ট আমি চাপা দিতে পেরেছিলাম। তখন থেকেই ওর সঙ্গে আমার আলাপ! আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পার্সিদের মধ্যে এমন দারিদ্র তো নেই। ওদের এত ট্রাস্ট আছে, এত দান নেবার সুযোগ আছে যে, কোনো কমবয়সী ছেলের পথে ঘোরবার প্রয়োজন নেই।

তাই মনে একটু সন্দেহও জেগেছিল বিপদ মিটলে একদিন হাফেসজির দোকানে গিয়েছিলাম। সেদিন বার-এ তেমন ভিড় ছিল না। একটা ছোটো পেগের অর্ডার দিয়ে বসলাম। সরাবজি আমাকে দেখেই ছুটে এল। আস্তে আস্তে বললে, আপনি এইভাবে না দেখলে এতক্ষণ আমাকে চৌরঙ্গীর পথে পথে ঘুরতে হত।

আমি বললাম, তুমি এত কম বয়সে ছোটো কাজ করছ কেন?

সরাবজি ভাঙা ভাঙা ইংরিজীতে বলেছিল, আমি অরফ্যান বয়, অরফ্যান স্কুলে মানুষ হয়েছি। আমার মাথায় বুদ্ধি নেই, ওঁরা অত চেষ্টা করলেন, তবু পড়াশোনা হল না। ওঁরা বলেছিলেন, কোন একজন ইন্ডিয়ান গ্রামারিয়ান প্রথম জীবনে একেবারে জড়বুদ্ধি ছিলেন, তারপর চেষ্টা করে তিনি সব শিখেছিলেন। আমিও ট্রাই করেছিলাম। কিন্তু হল না। আমার মাথায় ঢুকল না। তাই শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে এসেছি।

আমি বলেছিলাম, কোনো ট্রাস্টের সাহায্য নিতে পারো। সরাবজি রাজি হয়নি। না স্যর, জন্ম থেকে বাবা মা-ই যাকে সাহায্য করতে রাজি হল না, সে কী করে অন্যের কাছে সাহায্য চাইবে? সেটা ভাল দেখায় না। গড় নিশ্চয়ই চান, আমিই নিজেকে সাহায্য করি। আমি আপনাদের আশীর্বাদে কেবল সেই চেষ্টাই করব।

হবস সায়েব আবার একটু থামলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, স্বাধীন ভারতবর্ষে তোমরা তো মেয়েদের সব বিষয়ে সমান অধিকার দিয়েছ, তাই না?

আমি বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ। সায়েব হাসতে লাগলেন। এবার তাহলে একটা ছেলেঠকানো প্রশ্ন করি। বল দেখি, কোন ক্ষেত্রে মেয়েদের স্বাধীনতা এখনও স্বীকৃত হয়নি?

আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। আমার পিঠে একটা হাত রেখে হবস বললেন, সরাবজিকে জিজ্ঞাসা করো, সে এখনি বলে দেবে, নারী-স্বাধীনতার বিরোধী দলের শেষ দুর্গ হল হোটেল। বার লাইসেন্সে লেখা আছে কোনো নিঃসঙ্গ মহিলাকে বার-এ ঢুকতে দেওয়া হবে না। মেয়েরা তোমাদের দেশে একা একা যেখানে খুশি যেতে পারে, এভারেস্টের চূড়ায় উঠলেও কেউ আপত্তি করবে না। কিন্তু আজও বার-এ কোনো মহিলার একলা প্রবেশ নিষেধ। সঙ্গে পুরুষ সঙ্গী থাকলে অবশ্য কোনো আপত্তি নেই। যতক্ষণ ইচ্ছে যে কোনো ড্রিঙ্কের আনন্দ উপভোগ করা চলতে পারে।

মিস্টার হবস হাসতে লাগলেন। বললেন, সংবিধানের ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিরোধী এই নিয়ম কোনো মহিলা একবার আদালতে যাচাই করে দেখলে পারেন। তবে নিয়মটা অনেকদিন থেকেই চলছে। এবং যারা আইন করেছিলেন, তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল অন্য। নিঃসঙ্গ মহিলারা বার-এ আসতে চান অন্য উদ্দেশ্যে। আর আজও তারা এসে থাকেন। খারাপ বারগুলোতে ঢুকলেই বোঝা যায়। সেকেন্ডহ্যান্ড দেহের পসরা সাজিয়ে দেশ বিদেশের মেয়েরা বড়শিতে রুই কাতলা ধরবার জন্যে প্রতীক্ষা করছে।

মিস্টার হবস হাসলেন। নিয়মটা বোধহয় খারাপ নয়। কিছু পুরুষ শুধু এই আইনের জোরেই করে খাচ্ছে। মেয়ে ধরবার জন্যে ফর্সা জামা এবং ফুল প্যান্ট পরে গরিব অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছেলেরা দাঁড়িয়ে থাকে। হ্যালো ডলি, আজ কিন্তু আমাকে নিয়ে যেতে হবে। যত রাত হোক তোমার জন্যে আমি বসে থাকব।

ডলি বলে, পিটারের মাকে কথা দিয়েছি। পিটারকে এসকর্ট হিসেবে নিয়ে যাব। একটা টাকা দিলেই হবে।

আমি বারো আনায় রাজি আছি। আমার পয়সার দরকার। ছোকরা বলে।

তোমরা যে চিংড়িমাছের মতো হয়ে গেলে দেখছি, তোমাদের দাম মেয়েমানুষের থেকেও কম। বারো আনা পয়সার জন্যে ওই গুণ্ডা রাজত্বে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার সঙ্গে বসে থাকতে রাজি আছ?

আবগারি আইনকে ফাঁকি দেবার জন্যে এই এসকর্ট বা সঙ্গীদের না হলে অনেক বার-এ ঢোকা যায় না আর এইভাবেই ম্যাডান অর্থাৎ সরাবজি কলকাতায় প্রথম অন্ন সংস্থান করেছিল।

হবস বললেন, সরাবজির মুখেই শুনেছি, এক ছোকরা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান তাকে এই সুযোগ করে দিয়েছিল। বয়স তার কম—আইন অনুযায়ী এই বয়সের সঙ্গী নিয়েও বার-এ ঢোকা যায় না কিন্তু হাফেসজি বার-এর মালিক মিস্টার হাফেসজি আইন সম্বন্ধে অত খুঁতখুঁতে ছিলেন না। তিনি এসকর্টের বয়স নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। কম বয়সের এসকর্টরা দামে সস্তা হয়, এবং বেচারা মেয়েদের পক্ষে খরচের ভার কিছুটা কমে যায়, তা তিনি বুঝতেন। তিনি শুধু বলতেন, তোমরা ওই অসভ্যতাটুকু কোরো না-একটা লেমনেড নিয়ে দুজনে ভাগ করে খেও না। এতে হোটেলের সুনামের ক্ষতি হয়, অন্তত দুটো বোতল সামনে রাখো।

সরাবজি যখন কলকাতার পথে পথে দুমুঠো অন্নের জন্যে ঘুরছে তখন ধর্মতলা স্ট্রিটের উপর এক ছোকরার সঙ্গে আলাপ হয়। সে বদলি খুঁজছিল। সিনথিয়াকে সে-ই রোজ বার-এ নিয়ে যায়। তার সঙ্গে বসে থাকে; তারপর চারে খদ্দের আসে, দর-দাম ঠিক হয়ে যায়, তখন নতুন আগন্তুককে সিনথিয়ার পাশে বসতে দিয়ে সে কেটে পড়ে। সঙ্গীকে রোজ আসতে হয়, অথচ তার কয়েকদিনের জন্যে খুগপুরে যাওয়া দরকার। রেলের কারখানায় জানাশোনা একজন ভদ্রলোক আছেন—তার কাছে চাকরির তদ্বির করতে হবে।

তাই ছোকরা ম্যাডান, অর্থাৎ সরাবজির সঙ্গে পরিচয় হতে তাকে সিনথিয়ার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। বললে, মাত্র এক সপ্তাহের কাজ কিন্তু। আমি ফিরে এলেই তোমাকে কেটে পড়তে হবে। তখন যেন গণ্ডগোল পাকিও না। দুএকজন আগে আমাদের লাইনে এই নোংরা চেষ্টা করেছে, মেয়েরা দুটো মিষ্টি কথা শুনিয়েছে, হয়তো একটা চি রেট দিয়েছে, তাতেই মাথা ঘুরে গিয়েছে। কিন্তু বাজারে ঠ্যাঙানি বলে একটা জিসি এখনও আছে। সামনের দুটো দাঁত যদি ঘুষি মেরে উড়িয়ে দিই তা হলে সেখানে আর দাঁত গজাবে না, মনে থাকে যেন।

ম্যাডান রাজি হয়ে গিয়েছিল এখন কদিন তো খেয়ে বাঁচা যাক। সিনথিয়ার সঙ্গে সেপ্রথম বার-এ ঢুকেছিল। প্রথমে একটু ভয় ভয় করেছিল। সিনথিয়া একটা পায়ের উপর আর একটা পা তুলে দিয়ে মুখ থেকে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলেছিল, দেখি, তুমি লাকি চ্যাপ কি না। হয়তো এখনি কাস্টমার পেয়ে যাব।

সরাবজির কেমন ভয় লাগছিল। এমন বেয়াড়া পরিবেশ জীবনে সে কখনও দেখেনি। সিগারেটের ধোঁয়ায় এমন অবস্থা যে, মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে কাঁচা ঘুটেতে কেউ আগুন দিয়েছে। দুরে গোটা তিনেক লোক বাজনা বাজাচ্ছে। মাঝে মাঝে তারা ইশারায় মেয়েদের ডাকছে-বসে বসে লেমনেড না গিলে এখানে এসে একটু নাচো গাও। আমাদের বার-এর সামর্থ্য নেই যে, আবার পয়সা দিয়ে নাচ গানের মেয়ে রাখবে। অথচ মিউজিক ও ডান্স লাইসেন্স রয়েছে। প্রতি বছর এক আঁচল পয়সা দিয়ে লাইসেন্স রিনিউ করতে হচ্ছে।

সরাবজি দেখেছিলেন, বার-এর মধ্যে শুধুই লেমনেড চলেছে। জোড়ে জোড়ে সিনথিয়া এবং তার মতো এসকর্টরাই বসে রয়েছে। ঘরের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সিনথিয়া বলেছে, রাত নটা পর্যন্ত এইভাবে চলবে, তারপর খরিদ্দাররা আসতে শুরু করবে। আজ আবার ভাল জায়গা পেলাম না। একটু দেরি করলেই ভাল জায়গাগুলো অন্য মেয়েরা নিয়ে নেয়। সেলারগুলো একটু কোণ চায়। কোণগুলো সব ভর্তি হলে তবে ওরা আমাদের দিকে আসবে। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সিনথিয়া বলেছে, আমার বাপু অত ধৈর্য নেই। সেই সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে আমি বসে থাকতে পারব না। আর, রহিমকে কিছু পয়সা দিলে হয়। তাও তো এমনিই মাসে এক টাকা দিতে হয়, আর কত দেব?

সরাবজির বোধহয় গলা শুকিয়ে আসছিল। সে আর একটু লেমনেড খেতেই সিনথিয়া হাতে একটা টোকা দিয়েছিল। হ্যালো ম্যান, তুমি কি আমাকে ডোবাবে নাকি? কতক্ষণ এখানে বসতে হবে ঠিক নেই, আর তুমি এরই মধ্যে অর্ধেক গেলাস সাবাড় করে দিয়েছ। যদি আবার লেমনেড কিনতে হয় তোমাকে পয়সা দিতে হবে বলে দিলাম। আমার পয়সা অত সস্তা নয়, কোথায় খদ্দের তার নেই ঠিক, অথচ খোলামকুচির মতো পয়সা ছড়িয়ে চলেছি।

সরাবজি আর কোনও কথা বলেনি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে, সামনে গেলাসের মধ্যে কণাগুলো তখনও মুক্তির স্বাদ পেয়ে নেশাখোরের মতো নাচছে। সিগারেটের গন্ধে কাশি আসছে। ঘরের মধ্যে এবার দুজন সেলার এসে ঢুকল। বিরাট লম্বা-কড়িকাঠে মাথা ঠেকে যায়। সিনথিয়া চেয়ার ছেড়ে তাদের দিকে ছুটে গেল। কিন্তু তার ছিপে মাছ আটকালো না। সিনথিয়া ফিরে এসে একটু হাঁপাল, তারপর আবার সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়াটা সঙ্গীর মুখের উপর ছেড়ে দিল। সঙ্গীর তখন সেদিকে খেয়াল নেই। সে একমনে জলবিন্দুর রাজ্যে যে সঙ্গীত ও নৃত্য চলেছে তাই দেখছে।

সিনথিয়া বললে, ঠিক আছে, এখন আর একটু খেয়ে নাও। কাল থেকে বেরোবার আগে দুতিন গ্লাস জল খেয়ে আসবে। এখানে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে তার ঠিক নেই। ভাগ্য ভাল থাকলে হয়তো একঘণ্টা পরেই পয়সা নিয়ে চলে যেতে পারবে।

আরও কথা হত। কিন্তু হঠাৎ সিনথিয়া ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়ল। হ-এর অরণ্য উল্লাসের মুখে কে যেন ছিপি এঁটে দিল। বেয়ারা এসে সব মেয়েদের টেবিলের দিকে দ্রুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগল, সবার সঙ্গী আছে তো? না হলে গভরমেন্টের লোক বিপদে ফেলবে, কী যে ওঁদের মর্জি-মাঝে মাঝে দেখতে আসেন কোনো মেয়ে একলা বসে আছে কি না।

সরাবজি শুনলে ম্যানেজার বলছে, দেখুন স্যার। সবার এসকর্ট রয়েছে। জেনুইন কাস্টমার।

ইনস্পেক্টর এবার ওদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সিনথিয়া এসবে অভ্যস্ত। সে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সরাবজির আঙুলগুলো নিয়ে খেলতে লাগল। তারা যেন গল্প করছিল এমন ভাব দেখাবার জন্যে বললে, আচ্ছা জন, তারপর কী হল?

সরাবজি ভয় পেয়ে গিয়েছে। সে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছে। তাকে উঠে পড়তে দেখে ম্যানেজার অসন্তুষ্ট হলেন। ইনস্পেক্টর জিজ্ঞাসা করলেন, এঁকে সঙ্গে করে আপনি বার-এ এসেছেন?

সে বেচারা বুঝতে পারছিল না কী উত্তর দেবে! সিনথিয়া কিছু বলেও দেয়নি। সিনথিয়া এবার তার দিকে চোখ টিপলে। সেও কোনোরকমে মাথা নাড়ল।

ইনস্পেক্টর বোধহয় সব বুঝলেন। হেসে বললেন, একেবারে নতুন বুঝি?

ম্যানেজার বললেন, কী বলছেন স্যার, জেনুইন কাস্টমার। প্রায়ই আসে।

ম্যানেজারের কানের কাছে মুখ এনে ইনস্পেক্টর হ্যাঁ, লেমনেড খাবার এমন সুন্দর জায়গা তো কলকাতায় নেই।

তারপর খরিদ্দার এসে গিয়েছে। নিজের পয়সা নিয়ে সরাবজি চলে এসেছে। তারই শূন্য স্থানে এসে বসেছে হাফেসজি বার-এর নতুন অভ্যাগত।

পরের দিন সিনথিয়ার সঙ্গে আবার দেখা হয়েছে। সিনথিয়া বলেছে, তোমার পয় আছে। গতকালের লোকটা দিল্ খুলে ড্রিঙ্ক করিয়েছে, তারপরেও টাকাকড়ি নিয়ে ছোটলোকমি করেনি। মেহনত পুষিয়ে দিয়েছে। এমন খদ্দের রোজ পেলে আমাদের দুঃখের কিছুই থাকবে না।

সরাবজি আবার গিয়ে বসেছে। সিনথিয়ার পাশে বসে লেমনেড খেতে খেতে সে খদ্দের-এর আবির্ভাব কামনা করেছে। আজও আশ্চর্য সৌভাগ্য। গেলাসে এক চুমুক দেবার পরেই আগন্তুক এসে গিয়েছেন। পান-সঙ্গিনী হিসেবে সিনথিয়াকেই তিনি বেছে নিয়েছেন। সরাবজি গেলাসটা ছেড়েই উঠে আসছিল। সিনথিয়া বললে, মুখের জিনিসটা ফেলে দিও না। ওটা শেষ করে চলে যাও।

পরের দিনসরাবজি আবার সিনথিয়ার কাছে গিয়েছে। রিয়েলি লাবি চ্যাপ! সিনথিয়া বলেছে। কাল কী হল জানো? খদ্দেরকে নিয়ে ট্যাক্সিতে বেরিয়ে পড়েছিলাম। এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে এলাম, তার ট্রেন ধরবার তাগিদ ছিল। ফিরে এসে আফসোস হল, আর একবার গিয়ে বসা যেত। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে দিয়ে যা ভুলই করেছিলাম। একাই ঢুকতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ম্যানেজার সাহস করলে না। বললে, আবগারি দারোগারা প্রায়ই আসছে-গোলমাল পাকাবে। তাছাড়া তোমার তো এক রাউন্ড হয়েও গেল—অন্য বোনদের করে খাবার সুযোগ দাও।

সিনথিয়া নিজে থেকেই সরাবজিকে কিছু বেশি পয়সা দিয়েছে। বলেছে–তুমি অত ল্যাদাড়ু কেন? টেবিল ছেড়ে চলে যাবার আগে খদ্দেরের কাছে বকশিশ চাইবে। আমিও তখন বলব, আমার লোককে কিছু দিয়ে দিন। আমরা তো ভদ্রঘরের মেয়ে বাবা-মাকে লুকিয়ে এসেছি। পয়সা না পেলে ও বাড়িতে গিয়ে বলে দেবে, আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না।

সরাবজি তবু পয়সা চাইতে পারেনি। চুপচাপ বসে থেকে সে বার-এর রূপ দেখেছে। মালিকের সঙ্গে পরিচয় করেছে। দেখেছে রাত্রের অন্ধকারে পুলিসের লোকেরা মাঝে মাঝে বার-এ আসে। হাফেসজি ছোটাছুটি আরম্ভ করে দেন। আদর আপ্যায়ন করেন। কোনো ড্রিঙ্ক করবেন কিনা জিজ্ঞাসা করেন। তারপর পুলিস খাতা চায়-বার ইনস্পেকশন বুক। ইংরিজিতে হুড়হুড় করে পুলিস অফিসার লিখে দেন–Inspected the bar at ll p.m. Mr Hafesji was in personal uttendance. Place full of customers. All ladies had escorts Nothing unusual to report.

কথা থামিয়ে হবস এবার একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন। বললেন, আজও প্রতি রাত্রে কলকাতার বারগুলোর খাতায় ওই একই মন্তব্য লেখা হচ্ছে।

হবস বললেন, কয়েকদিন পরেই সিনথিয়ার পুরনো সঙ্গী ফিরে এসেছিল। সিনথিয়া কিছুতেই নতুন এসকর্টকে ছাড়তে চায়নি। বলেছিল, এমন পয়মন্ত ছেলেকে আমি কিছুতেই ছাড় না।

কিন্তু ম্যাডান রাজি হয়নি। বলেছে, আমি অন্যায় করতে পারব না। ওর কাজ আমি নিলে ভগবান অসন্তুষ্ট হবেন।

ভগবান এবার বোধহয় একটু মুখ তুলে তাকালেন! সিনথিয়ার সঙ্গী হাফেসজির বার-এ চাকরি পেয়ে গেল। ম্যাডান নিজেকে ধন্য মনে করেছে। সকালে যখন বার খোলে তখন কোনোই কাজ থাকে না। হাফেসজির বার খালি পড়ে থাকে। দুএকজন যদি বা আসে তারা এক-আধ পেগ টেনেই পালায়। আবার দুপুরে একদল আসে। মফস্সলের লোক। সন্ধ্যার অন্ধকারে সুন্দরী কলকাতার সান্নিধ্যসুখ উপভোগের সময় নেই তাদের। তারপর রাত্রি। হাফেসজি নিজে এসে কাউন্টারে বসেন। বার-এর রঙ এবং রূপ একেবারে পরিবর্তিত হয়।

মিস্টার হবস এবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার দেরি করিয়ে দিচ্ছি না তো?

বললাম, মোটেইনা। সরাবজিকে চেনবার এমন সুযোগ আপনি না থাকলে কোনোদিন পেতাম না।

হবস মাথা নাড়লেন।আমি নিজেই ওকে বুঝতে পারলাম না। আজ এখানে তাকে না দেখলে হয়তো সরাবজি আমার কাছে আরও পাঁচটা লোকের একটা হয়ে থাকত। কিন্তু এখন সে আমারই কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে।

আমি বললাম, সরাবজিকে আপনি আমার কাছে গল্পের নায়কের মতো করে তুলছেন।

হবস বললেন, অবজ্ঞা কোরো না, তোমাদের এই হোটেলের প্রতিটি ইটের মধ্যে এক একটা উপন্যাস লুকিয়ে রয়েছে।

হবস এবার একটু থামলেন। তারপর আবার শুরু করলেন। বুড়ো বয়সে বকবক করা মানুষের স্বভাব হয়ে দাঁড়ায়। আর চিন্তার শক্তি যখন উবে যায় তখন কোটেশন দেবার রোগে ধরে। আমারও একটা কোটেশন দিতে ইচ্ছে করছে। তোমাদের হোটেলেই স্যাটা আমাকে বলেছিলেন, a bar is a bank where you deposit your money and lose it; your time and lose it; your character and lose it; your self-control and lose ir; your own soul and lose it.

সবই খরচের খাতায়। এই পচা ব্যাঙ্কে তোমার টাকা, সময়, চরিত্র, সন্তানের সুখশান্তি এবং আত্মাকে গচ্ছিত রেখে খোয়াতে হয়। কিন্তু একজন ফুলে ওঠে। সে হাফেসজি। অন্যের খরচ-করা পয়সা হাফেজির ব্যাঙ্কে গিয়ে জমা পড়ে।

ম্যাডান যে কবে সরাবজি হয়ে গিয়েছে খবর পাইনি অনেকদিন ওর সঙ্গে দেখাও হয়নি। তারপর কয়েক বছর পরে হঠাৎ ধর্মতলার মোড়ে ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আমাকে দেখেই সে ছুটে এল। আমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরল। বললে, আমাকে মনে পড়ছে? আপনার দয়াতে সেবার চাকরিটা রক্ষে হয়েছিল।

আমি হাফেসজির দোকান ছেড়ে দিয়েছি।

সে কি? ঝগড়া হল নাকি?

না, ঈশ্বর মুখ তুলে তাকিয়েছেন! আমি নিজেই একটা দোকান করেছি।

বার? সে তো অনেক পয়সা লাগে।

ঈশ্বর যাকে দেখেন তার তো কিছুই প্রয়োজন হয় না। ধর্মতলায় একটা বার পেয়ে গেলাম যে মালিক সে অসুখে ভুগছে। তাকে বিলেত চলে যেতে হল। তাই আমাকে পার্টনার করে নিয়েছে। আমি দেখাশোনা করব, তাকে লাভের ভাগ দেব।

জোর করে সে আমাকে বার-এ ধরে নিয়ে গিয়েছে। সমস্ত দেখিয়ে বলেছে, অনেক শান্ত দোকান। ওখানকার মতো নয়। আমি দেখেছি অনেকে বসে ড্রিঙ্ক করছে কিন্তু হৈ হৈ হট্টগোল নেই।

ম্যাডান বলেছে, আমি নাম পালটিয়ে নিয়েছি। শরাবের লাইনেই যখন থাকতে হবে তখন আমি সরাবজি।

আমি বললাম, কিন্তু শরাবের সঙ্গে নিজে কোনো সম্পর্ক না করলে চলবে কেন?

সরাবজি লজ্জায় জিভ কেটেছে। কী যে বলেন, আমার ঠোঁট জীবনে মদ স্পর্শ করেনি। হাজার হাজার পেগ মদ বোতল থেকে ঢেলে অন্য লোককে দিয়েছি, কিন্তু তার আস্বাদ কী আমি জানি না।

আবার দেখা হয়েছে। সরাবজি আমাকে তার বিয়েতে নেমন্তন্ন করেছে। বলেছে, আপনার জন্যেই তো সব। সেদিন যদি হাফেসজির দোকানে টিকতে না পারতাম, তাহলে আমার কিছুই হত না।সরাবজি বলছে, যাকে বিয়ে করেছি সে বেচারা একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল—হাজার হোকমদের দোকানে কাজ করি।

সরাবজির বউকে প্রায়ই মার্কেটে দেখেছি। সত্যি লক্ষ্মী বউ। নিজে রেস্তোরাঁর কাঁচা বাজার করেন। অন্য কারুর হাতে বাজারের ভার দিলেই ঠকাবে। মাংসর দাম বেশি লেখাবে, ওজনে কম দেবে। আমি বলেছি, আপনি বাজার করেন?

মিসেস সরাবজি বলেছেন, আমি না দেখলে ও-বেচারাকে দেখবে কে? নিজে বাজার করি বলে জিনিসটা ভাল হয়, খদ্দেররা প্রশংসা করে, অথচ দাম কম লাগে।

আমি প্রশ্ন করেছি, আপনি কি দোকানেও স্বামীকে সাহায্য করেন?

মিসেস সরাবজি বলেছেন, ওইখানেই তো মুশকিল। ওখানে আমার যাওয়া সম্পূর্ণ বারণ। আমি একবার বলেছিলাম কিচেনের লোকদের সঙ্গে একটু কথা বলে আসব। কিন্তু উনি খুব অসন্তুষ্ট হলেন। আমি বাজার নিয়ে বাড়ি যাই মেনু ঠিক করে দিই। উনি সেখান থেকে মালপত্তর নিয়ে দোকানে চলে আসেন। যেদিন কাজে আটকে পড়েন, সেদিন কিচেনের মেটকে পাঠিয়ে দেন। কেউ না এলে আমি টেলিফোন করি, কিন্তু তবু দোকানে যাওয়ার হুকুম নেই। উনি বলেন, দুনিয়ার যেখানে খুশি যেতে পার, কিন্তু আমার বার-এ নয়।

আর আপনিও বিনা বাক্যব্যয়ে তা মেনে নিয়েছেন। আমি উত্তর দিলাম।

মিসেস সরাবজি বোধহয় একটু লজ্জা পেলেন কিন্তু আমার সঙ্গে তার স্বামীর কি সম্পর্ক তা জানেন, তাই ফিসফিস করে সলজ্জ হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললেন, আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু উনি বলেন, তোমার দেহেনাসন্তান আসবে। বার-এর বাতাস সেই অনাগত অতিথির ক্ষতি করতে পারে।

হবস এবার বোধহয় হাঁপিয়ে পড়লেন। বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, সরাবজির সন্তান হয়েছে খবর পেয়েছি। আরও খবর পেয়েছি সমস্ত দোকানটাই সে কিনে নিয়েছে। ওর অংশীদার আর বিদেশ থেকে ফিরবেন না, তাই সামান্য যা সঞ্চয় ছিল এবং স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে দিয়ে সরাবজি বার ও রেস্তোরা কিনে নিলে।

আমার সঙ্গে বার-এ আবার দেখা হয়েছে। সরাবজি বলেছে এসব আপনার জন্যেই সম্ভব হয়েছে, এই বার আপনার নিজের বলেই জানবেন।

তখন সবেমাত্র সন্ধ্যা। সরাবজি বললে, আমার এই বার হাফেসজির বারের মতো নয়। আমি ভালো জিনিস দিই, জল মেশাই না। মেয়েদের ঢুকতে দিই না। তবুও শান্তি নেই।

প্রশ্ন করলাম, কেন?

সরাবজি বললে, আমার বার সাড়ে-দশটায় বন্ধ। কিন্তু বিকেল থেকে যারা বসে থাকে, তারা ক্রমশ গরম হয়ে উঠতে আরম্ভ করে। প্রথম পেগে স্বাস্থ্য, দ্বিতীয় পেগে আনন্দ, তৃতীয় পেগে লজ্জা এবং চতুর্থ পেগ থেকে পাগলামো, তখন আমার ভালো লাগে না। রোজ কিছু না কিছু গোলমাল লেগেই থাকে।

সরাবজি বললে, আমার বার-এর যথেষ্ট সুনাম আছে। যারা শান্ত পরিবেশে শান্তিতে ড্রিঙ্ক করতে চায় তারাই আসে। তবু মাঝে মাঝে গোলমাল শুরু হয়ে যায়।

নিজের চোখেই তার নমুনা দেখলাম। বেয়ারা এসে বললে, কেবিনে এক সায়েব ডাকছেন।

সরাবজি উঠে পড়ল। ব্যাপারটা দেখবার জন্যে আমিও ওর পিছু পিছু গেলাম। ইন্ডিয়ান সায়েব ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, নটা গুণ্ডা ড্রিঙ্ক-পানি ডালটা।

জিভ কেটে সরাবজি বললে, কী বলছেন আপনি? আমার বার-এ ও-সব জোচ্চুরি চলে না। বলেন তো বোতল পাঠিয়ে দিচ্ছি—তার থেকে আপনার সামনে ঢেলে দেবে।

খরিদ্দার বললেন, পাইব পেগ আলরেডি ড্রিঙ্ক করেছি, তবু মনে হচ্ছে যেন স্বামী বিবেকানন্দের চেলা।

কেবিন থেকে বেরিয়ে বার-এর কাউন্টারে আসতে আসতে সরাবজি বললে, আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। এমন কেস রোজই দুএকটা এসে পড়ে, নতুন লোক বুঝতে পারে না।

একটা হুইস্কির বোতল হাতে করে কেবিনে এসে সরাবজি বললে, আমরা ডাইরেক্ট মাল নিয়ে আসি। যদি বলেন, সামনে সীল খুলে সার্ভ করছি।

আমি বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম। শুনলাম, এবার ভদ্রলোক আসল প্রসঙ্গ অবতারণা করলেন।গার্ল চাই।

হবস এবার হেসে ফেললেন। বললেন, ভাঙা ভাঙা ইংরিজিতে সরাবজি যা উত্তর দিয়েছিল তা কোনো সাহিত্যিকের কানে গেলে বিশ্বজোড়া সুনাম অর্জন করত। সরাবজির হাত ধরে ভদ্রলোক বললেন, প্লিজ…প্লেজার গার্ল।

সরাবজিও তার হাতটা চেপে ধরল। তারপর তাকে বোঝাতে লাগল, গার্লস হিয়ার নো গুড়। হাউস গার্ল, গার্লস ইন ইয়োর ফ্যামিলি ফার ফার বেটার।

হোটেল গার্লস টেক অল মানি। সরাবজি নিজের ভাব প্রকাশের জন্যে তারপর যেন অভিনয় শুরু করলে। তুলনামূলক সমালোচনা করতে গিয়ে জানালে, স্ট্রিট গার্লস ডোন্ট লাভ ইউ, দে লাভ ইওর মানিব্যাগ। হাউস গার্ল-সিস্টার ইইওর হাউস-লাভ ইউ। ইফ সি হিয়ারস, সি উইল উইপ-এবার সরাবজি কেঁদে কেঁদে অভিনয় করতে লাগল। ভদ্রলোক বোধহয় যেন একটু লজ্জা পেলেন। কোনোরকমে মদের বিল চুকিয়ে, একটা পয়সাও টিপস না দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন।

সরাবজি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, দেখলেন তো? আগে একলা ছিলাম, তখন সব সহ্য হত। এখন বয়স হচ্ছে, মেয়ের বাবা হয়েছি, কেমন যেন অসহ্য লাগে।

আমি কিছুই না বলে ফিরে এসেছি। খবর পেয়েছি, সরাবজির দোকান এখন ভালোভাবেই চলছে। অনেক মদের স্টক ওর। যা অন্য জায়গায় পাওয়া যায় না তাও ন্যায্যমূল্যে সরাবজির বার-এ পাওয়া যায়। সরাবজি বলেছে, ঈশ্বর ওপরে আছেন, সৎপথে থেকে ব্যবসা করছি। তিনি দেখবেন।

আরও একদিন সবজির সঙ্গে দেখা হয়েছে। ভদ্রলোক মুখ শুকনো করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি গাড়িতে যাচ্ছিলাম। গাড়ি থামিয়ে বললাম, কী ব্যাপার?

সরাবজি বললে, ড্রিঙ্ক করলে মানুষের বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায় কেন বলতে পারেন?

বললাম, হয়তো অ্যালকহলের রাসায়নিক ফল।

সরাবজি বললে, আমি কান মলেছি! মাতালদের আমি কোনোদিন আর কিছু বলব না। জানেন, দোকানে আসবে এক সঙ্গে; এক সঙ্গে মদ খাবে, এক সঙ্গে মস্করা করবে, তারপর এক সঙ্গে ঝগড়া বাধাবে। সেদিন রাত নটার সময় দু ভদ্রলোক নেশার ঘোরে চিৎকার করছিলেন। টেবিলে গেলাস বাজাচ্ছিলেন। গান গাইছিলেন। আর একদল লোক—এঁরা আমার দোকানের লক্ষ্মী, রোজ তিন চারশ টাকার মদ নেন,তারাও পাশে বসেছিলেন। তাদের একজন আমার কাছে এসে বললেন, আপনার বার যে তাড়িখানা হয়ে গেল। ভদ্রলোকরা এখানে আর ড্রিঙ্ক করতে আসবেন না। হাফেসজির মেয়েরা বারের লোকগুলোকে আপনি গ্রশ্রয় দিচ্ছেন। ওদের সামলান, না হলে আমরা আর আসব না।

বাধ্য হয়ে আমি গিয়ে ভদ্রলোক দুজনের কাছে দাঁড়ালাম। তারা দুজনে তখন রেডিওতে ক্রিকেট খেলার রিলে করছেন। ইন্ডিয়া এক ওভারে এম সি সি-কে খতম করে, পরের ওভারে অস্ট্রেলিয়াকে মাঠে নামিয়ে দিয়েছে। এক ভদ্রলোক বলছেন, তা হয় না। আর এক ভদ্রলোক বলছেন, আমার যা খুশি তাই করব। তাতে কার পিতৃদেবের কী? এবার অকথ্য গালাগালির বর্ষণ। আমি বললাম, আপনারা এ কী করছেন?

ওরা বললে, বেশ করছি। তুমি কে হে হরিদাস পাল?

আমি বাধ্য হয়েই বললাম, এ-রকম হই-চই এই বারে চলতে পারে না, এতে অন্য কাস্টমারদের অসুবিধে হয়।

ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে উঠলেন। অন্য লোকদের ডেকে বললেন, জানেন, মাতাল হয়েছি বলে বের করে দেবে বলছে। বারের মালিক-এর এত বড় স্পর্ধা।

অন্য কয়েকজন ওঁদের দলে গিয়ে, চিৎকার করে বললেন, মালিকের এত সাহস! ব্রাদার, আমরা এখনি সবাই এখান থেকে বেরিয়ে যাব। মদ খেয়ে হই হই করবে না তো কি গীতা পড়ে শোনাবে?

সরাবজির চোখ এবার ছলছল করে উঠল। সবচেয়ে আশ্চর্য কি জানেন? যারা আমার কাছে কমপ্লেন করেছিল, তারাও টেবিল ওয়াক-আউট করে গেল। আমি তাদের হাত ধরে বললাম, আপনারা বললেন বলেই, আমি ভদ্রলোককে বারণ করতে গেলাম। ওরা কী বললে জানেন?

বললে, আমরা মাতাল মানুষ, নেশার ঘোরে যদি কিছু বলেই থাকি, তা বলে আপনি একজন ভাইকে অপমান করবেন? হু আর ইউ? কলকাতায় কি আর মালের দোকান নেই? এই দোকানে ঘুঘু চরবে। আমরা এখানে প্রয়োজন হলে পিকেটিং করব।

সরাবজি বললে, প্রায় তিন সপ্তাহ আমার হোটেল বন্ধ, কেউ আসে না। শেষে বাধ্য হয়ে আজ এক ভদ্রলোকের বাড়িতে গিয়েছিলাম।বহু কষ্ট করে তার ঠিকাটা জোগাড় করেছি। হাতজোড় করে তার কাছে ক্ষমা চাইলাম। বললাম, যদি আমার কোনো দোষ হয়ে থাকে আমি ক্ষমা চাইছি। তবে আপনারাই আমাকে বলতে বলেছিলেন, তাইভদ্রলোককেআমি গোলমাল করতে বারণ করেছিলাম। ভদ্রলোক রাজি হয়েছেন। আবার দলবল নিয়ে আসবেন। কিন্তু ভদ্রলোক সাবধান করে দিয়েছেন, মাতালদের কথায় বিশ্বাস করে আর কখনও কাউকে অপমান করবেন না।

হবস এবার বর্তমানে ফিরে এলেন। বললেন, এই সবজিকেই আমি চিনতাম। বেশ গুছিয়ে এবং ভদ্রভাবে ব্যবসা করছিল। একটিমাত্র মেয়ে, তাকেও বাইরে ইস্কুলে রেখে পড়িয়েছে। তার মেয়েকেও আমি দেখেছি। চিড়িয়াখানাতে আলাপ হয়েছিল, মেয়েকে সঙ্গে করে বাবা গিয়েছিলেন। এই পর্যন্তই জানতাম। কিন্তু সরাবজি কী করে ধর্মতলা থেকে শাজাহানে হাজির হল, জানি না।

হবস এবার নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। বললেন, তোমাদের ম্যানেজার মনে হচ্ছে আজ আর ফিরবে না! ব্যাপার কী? হোটেল ছেড়ে প্রায়ই আজকাল বেরিয়ে যাচ্ছেন। একা স্যাটা বোস কি এই হোটেল চালাবে?

হবস উঠে পড়লেন। যাবার আগে বললেন, যাক, সরাবজির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, এটাই আনন্দের কথা।

 

আবার যখন ডিউটিতে ফিরে গিয়েছি, সরাবজির সঙ্গে দেখা হয়েছে। তার টিকলো নাক এবং প্রশস্ত বুকও যেন ঈশ্বরের চরণে বিনয়ে নত হয়ে রয়েছে। কম কথা বলেন তিনি। তবুও আজ তাকে আমার বহুদিনের পরিচিত মনে হল। শাজাহনের বার ম্যানেজারের মধ্যে আর-একজন আমিকে খুঁজে পেলাম। আমারই মতো নিজের পায়ে হাঁটা পথেই তিনি সংসারের সুদীর্ঘ সমস্যা অতিক্রম করে এসেছেন।

হেড বারম্যান বলেছে, জব্বর সায়েব বাবু, সব ককটেল হাতের মুঠোর মধ্যে। কতরকমের মিক্সিং যে জানেন।

আমরা দাঁড়িয়ে দেখেছি বার-এ তিল ধারণের জায়গা নেই। বিজনেসের যন্ত্রপাতিতেও তেল দরকার হয়, সেই আধুনিক লুব্রিকেশন তেল হল হুইস্কি। ঝুঁদ হয়ে চোখ বুজে উপস্থিত ভদ্রমহোদয় এবং ভদ্রমহিলারা গলায় হুইস্কি ঢেলে দিচ্ছেন, খালি গেলাস আবার বোঝাই হচ্ছে। স্বল্পভাষী সরাবজি আমাকে বললেন, মৃতদেহ টিকিয়ে রাখতে হুইস্কির মতো জিনিস নেই। যদি কোনো মৃতদেহ সংরক্ষণ করতে চাও তবে তাকে হুইস্কির মধ্যে রাখো—আর জ্যান্ত লোককে যদি মারতে চাও তাহলে তার মধ্যে হুইস্কি ঢাললা!

সরাবজির সঙ্গে ক্রমশ আমার পরিচয় নিবিড় হয়েছে। বুঝেছি, তার মধ্যে বুদ্ধির শাণিত তীক্ষ্ণতা নেই। কিন্তু সৎপথে থাকার তীব্র বাসনা আছে, আর আছে ঈশ্বরে অগাধ বিশ্বাস।

সরাবজি যেন আজও সব বুঝতে পারেন না। অন্তরের দ্বন্দ থেকে আজও মুক্ত হতে পারেননি তিনি। এবং সে গল্পের শেষ অংশ আমি তার নিজের মুখেই শুনেছিলাম।

বার-এর এক কোণে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন-কবে এই বার-পর্ব শেষ হবে, সুরা-পিয়াসীদের মনে পড়বেতাদেরও বাড়ি আছে, সেখানে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। তারা বিল চুকিয়ে উঠে পড়বে, বারম্যানরা চেয়ারগুলো ঠিক করে রাখবে, আমি ক্যাশ বন্ধ করে হিসেব করব, তারপর ছুটি।

সরল মানুষ সরাবজি। বললেন, বাবুজী, আমার তো লেখাপড়া হয়নি। কিন্তু যারা পড়াশোনা করে, যারা চিন্তা করে, তাদের আমার খুব ভালো লাগে। আমার স্ত্রীর কাছে আমি দুঃখ করি।সরাবজি আমাকে প্রশ্ন করলেন, তোমরা তো তবু বই-টই পড়ো। মানুষ কেন হুইস্কি খায় বলতে পারো?

আমি বললাম, মিস্টার স্যাটা বোসের ধারণা, হুইস্কির মধ্যে ভীরু সাহস খোঁজে, দুর্বল শক্তি খোঁজে, দুঃখী সুখ খোঁজে, কিন্তু অধঃপতন ছাড়া কেউই কিছু পায় না।

ছোটছেলের মতো সরল বিশ্বাসে সরাবজি হেসেছিলেন। সরাবজি প্রশ্ন করে ছিলেন, আচ্ছা, আমরা যারা মদ বিক্রি করি তাদের সম্বন্ধে কেউ কিছু বলেননি?

আমি পরম বিস্ময়ে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। উনি চেয়ারে বসে পড়ে বলেছিলেন, আমি তোমাকে সব বলছি। হয়তো তুমি বুঝবে। লেখাপড়া জানি

বলে আমি নিজে উত্তর খুঁজে পাইনি। আমার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করতে পারতাম, সে অনেক লেখাপড়া শিখেছে। কিন্তু নিজের মেয়েকে এ-সব জিজ্ঞাসা করা যায়?

মেয়েকে সত্যিই ভালোবাসেন সবজি। তার জীবন মরুভূমিতে একমাত্র মরূদ্যানের মতো সে। বলেছেন, তুমি আমার মেয়েকে জানো না। এমন বুদ্ধিমতী এবং পণ্ডিত মেয়ে তুমি কোথাও পাবে না। এবং সে সুন্দরীও বটে। সরাবজি বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন।কত মোটা মোটাবই যে সে পড়ে। জানো, সে রোজ আমাকে চিঠি লেখে। আমারও খুব বড় বড় চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি যে লেখাপড়া শিখিনি, আমার যে বানান ভুল হয়। মেয়ের কাছে লিখতে লজ্জা হয়। মেয়ে অবশ্যি বলে, বাবা, তুমি ওসব নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাবে না। তুমি আমাকে বড় বড় চিঠি লিখবে। জানো, সে এখন বিলেতে পড়ছে। যে ক্লাশ ফোর পর্যন্ত পড়ে অনাথ আশ্রম থেকে এসেছিল, তার মেয়ে। গর্বে বৃদ্ধ অশিক্ষিত সরাবজির বুক ফুলে উঠল।

কোনো মহাপুরুষ বলেছিলেন, পৃথিবীতে যত রকমের প্রেম আছে তার মধ্যে মেয়ের প্রতি বাবার ভালোবাসা সবচেয়ে স্বর্গীয়। He beholds her both with and without regard to her sex। স্ত্রীর প্রতি আমাদের ভালোবাসার পিছনে কামনা আছে, ছেলের প্রতি ভালোবাসার পিছনে আমাদের উচ্চাশা আছে, কিন্তু মেয়ের প্রতি ভালোবাসার পিছনে কিছুই নেই। বইতে পড়া কথাগুলোই আজ সরাবজির মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠতে দেখলাম।

সরাবজির দুঃখের কথা সেদিনই শুনেছিলাম। সরাবজি কোনোদিন স্ত্রী বা মেয়েকে বার-এ আসতে দেননি।

সকাল নটা পর্যন্ত বাড়িতে থাকতেন তিনি। তারপর বাজার নিয়ে রেস্তোরাঁয় আসতেন। দুপুরে বাড়ি থেকে ভাত আসত। বিকেলে একবার চা খাবার জন্যে বাড়ি যেতেন। তারপর শুরু হত বার-পর্ব। যত রাত বাড়বে তত সমস্যা বাড়বে। সাড়ে দশটায় দরজা বন্ধ করা প্রতিদিনই সমস্যার ব্যাপার। অনেকে উঠতে চায় না। অনেকে বলে, বার খুলে রাখো। বলতে হয়, খুলে রাখবার লাইসেন্স নেই। লোকে গালাগালি করে, গেলাস ভাঙে। সরাবজি দেখতে পারেন না। কয়েকজনের জন্যে রিকশা বা ট্যাক্সি ডেকে দেন। নেশার ঘোরে হয়তো গাড়ি চাপা পড়বে।

লোকগুলো যখন আসে কেমন সুস্থ। হাসে,নমস্কার করে, কেমন আছে খবর নেয়। কিন্তু তারপরেই ধীরে ধীরে রং বদলাতে শুরু করে।কতবার ইচ্ছে হয়েছে, বলেন, সামান্য একটু খেয়ে বাড়ি ফিরে যান। হাউস গার্লরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু বলতে সাহস হয় না।

মেয়ে বলেছে, বাবা, তোমার দোকানে যাব। না মা, ওখানে যেতে নেই। ওখানে আমার অনেক কাজ, খুব ব্যস্ত থাকতে হয়।

কেন বাবা, গেলে কী দোষ হয়?

ছিঃ, অবাধ্য হয়ো না মা, ওখানে যেতে নেই।

বড় হয়েছে মেয়ে, ফুলের মতো বসন্তের সৌন্দর্য নিয়ে ফুটে উঠেছে তাঁর মেয়ে। কত বুদ্ধি, কত জ্ঞান, কত বিদ্যা অথচ কত সরল। সংসারের কিছুই জানে না। মেয়ে কতবার বলেছে, বাবা, তোমার মতো আমিও ব্যবসা করব। বাবা বলেছেন, মা মা, তুমি প্রফেসর হবে। বিরাট পণ্ডিত হবে। দেশ-বিদেশের লোকরা বলবে, ওই মুখ লোকটার মেয়ে কত শিখেছে।

মেয়ের বিলেত যাওয়ার সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। মেয়েকে ছেড়ে সরাবজি কেমন করে অতদিন থাকবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না, কিন্তু উপায় কী? ডক্টর মিস সরাবজি হয়ে তার মেয়ে যেদিন আবার ফিরে আসবে, সেদিন? সেদিন তো কাগজে তার মেয়ের ছবি বেরিয়ে যাবে।

কিন্তু সে রাত্রে মেয়ের যে কী হল। সরাবজির বার-এ তখন তান্ডব-নৃত্য শুরু হয়েছে। মেঝের উপর তখন একজন শুয়ে পড়েছে। মুখ দিয়ে গাঁজা বেরোচ্ছে। বেঞ্চের উপরদুজন গুম হয়ে গেলাস নিয়ে বসে আছে। বলছে, বেয়ারা, আউর এক পেগ লে আও।

বেয়ারা বলেছে, হুজুর, এই পেগের বিলটা। আমরা কী করব হুজুর, একসাইজ আইন। বিল পরের পর আসবে, আর মিটিয়ে দিতে হবে। সরাবজি কাছে গিয়ে প্রশ্ন করছিলেন, আপনাকে কী দেব?।

একেবারে নির্ভেজাল হুইস্কি। যেন গলা দিয়ে নামতে নামতে সব জ্বালিয়ে দেয়।

বেয়ারারা একা সব সামলাতে পারছিল না। তাই সরাবজি নিজেও ছোটাছুটি করছিলেন। এমন সময় কার আবির্ভাবেমাতালদের মধ্যে যেন চাপা গুঞ্জন উঠল।

কে? চমকে উঠে সরাবজি দেখলেন তাঁর মেয়ে।

তুই? তুই এখানে? সরাবজি কোনোরকমে বললেন।

মেয়ে বাবাকে চমকে দেবার জন্যেই এসেছিল। বাবাকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরবে। আর কদিন? তারপর কতদিন আর বাবার সঙ্গে দেখা হবে না। অথচ এখন বাবার পাশে বসে বসে গল্প করতে ইচ্ছে করছে। জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে, বাবা, তুমি যখন অনাথ আশ্রমে ছিলে তখন তোমাদের মাখন দিত?

বাবা বলবেন, না মা, মাখন কোথায়। তিন টুকরো পাউরুটি কেবল।

মেয়ে নিজেও এমন দৃশ্য কোনদিন দেখেনি। একটা বিরাট কড়ার মধ্যে কতকগুলো অপ্রকৃতিস্থ লোক যেন টগবগ করে ফুটছে। বাবার হাতের পেগ মেজারটা কেঁপেউঠেকিছুটামদ টেবিলে পড়ে গেল। মেঝেতে যে লোকটা পড়ে ছিল সেও এবার উঠে বসে চিৎকার করে বললে, আমিও একটা বড়া পেগ চাই।

মেয়ে স্তম্ভিত। আনন্দ করে বাবাকে নিয়ে পালাবে বলে ঠিক করেছিল। তার মুখে কে যেন কালি ছিটিয়ে দিয়েছে। বাবা, আমার সঙ্গে যাবে না?

মেয়ের হাত ধরে বাবা রাস্তায় বেরিয়ে এলেন, তার দেহ কাঁপছে। কোনোরকমে বলেছেন, তুমি বাড়ি যাও। এখন বার বন্ধ করবার উপায় নেই। ওরা রেগে গিয়ে সব ভেঙে দেবে।

বাড়িতে ফিরে এসে সরাবজি দেখেছিলেন মেয়ে শুয়ে পড়েছে।

পরের দিন মেয়ের সামনে যেতে তার ভয় করেছে। মেয়ের কাছে তিনি ধরা পড়ে গিয়েছেন।

বিলেত যাবার দিন এগিয়ে এসেছে। কিন্তু মেয়ে কেমন মনমরা হয়ে আছে। সভ্যতার সর্বনাশা রশ্মি যেন মেয়েটার নরম মনকে একেবারে পুড়িয়ে দিয়েছে। সরাবজি ভেবেছেন, মেয়েকে গিয়ে জড়িয়ে ধরবেন। বলবেন, কেন মা তুই এ-সব ভাবছিস, তুই পড়াশুনা কর। তুই কত বড় হবি।—কিন্তু কিছুই বলতে পারেননি।

তারপর যাবার দিনে ভোরবেলায় বোধহয় বাবা ও মেয়ের একান্তে দেখা হয়েছিল। মা তখন ঘুমিয়ে। বাবা নিভৃতে মেয়ের ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন। তুই কিছু বলবি? তোর মুখ দেখে কদিন থেকে মনে হচ্ছে তুই আমাকে কিছু বলতে চাস।

মেয়ের ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠেছে। কোনোরকমে বলেছে, আমার ভয় করছে, বাবা। যাদের সেদিনকে তোমার দোকানে দেখে এলাম তাদের মা, বোন, স্ত্রী, মেয়েরা হয়তো চোখের জল ফেলছে। তারা কি আমাদের ক্ষমা করবে?

বাবা চমকে উঠেছিলেন। বলতে গিয়েছিলেন, আমি কী করব? আমার কী দোষ? আমি তো আর ওদের টেনে নিয়ে এসে বার-এ ঢোকাচ্ছি না। আমি সৎপথে ব্যবসা করি। কিন্তু কিছুই বলতে পারেননি।

মেয়ে ট্রেনে চড়ে বোম্বাই গিয়েছে। এবং সেখান থেকে জাহাজে বিলেত। কিন্তু সরাবজি নিজের জালে জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি চোখের সামনে শুধু মেয়ের বিষণ্ণ মুখ দেখতে পেয়েছেন। মেয়ে যেন তাকে প্রশ্ন করছে—তারা কি তোমায় ক্ষমা করবে?

মনের দ্বন্দে কাতর হয়ে পড়েছেন সরাবজি। নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, আমি কি বলেছি তোমরা অত পেগ খাও। এক পেগ খেয়ে উঠে গেলেই পারো। আমি কী করব, আমি না খাওয়ালে তোমরা অন্য দোকানে গিয়ে খাবে। তবু মেয়ে যেন তাকে প্রশ্ন করছে। তিনি মনে মনে বলেছেন, ওদের স্ত্রী আর মেয়েরা তো বারণ করলেই পারে। আমি কী করব? আমি সামান্য মদের ব্যবসায়ী, যত দোষ আমারই হল?

কিন্তু কিছুতেই পারেননি। যতই উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন ততই যেন একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্ন তার মনের মধ্যে গেঁথে বসেছে। সেই চিহ্নটা ক্রমশ বড় হয়ে উঠেছে। . সরাবজি ভয় পেয়ে গিয়েছেন। স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছেন—যত লোক তার দোকানে এসেছে তাদের মা, বোন, বউ, মেয়ে সবাই চোখের জলে তাকে অভিশাপ দিচ্ছে। সেই অভিশাপের বিষবাষ্প শুধু তাকে নয়, তার সংসার, এমনকী তার মেয়েকেও গ্রাস করছে।

সরাবজি পাগলের মত হয়ে উঠেছেন, তারপর একদিন মরিয়া হয়ে বার বিক্রি করে দিয়েছেন। সেই রাত্রেই মেয়েকে তিনি চিঠি লিখতে বসেছিলেন, আমার কী দোষ? ওরা যদি নিজে এসে দোকানে বসে মদ খেয়ে নিজেদের সংসার নষ্ট করে থাকে, তাতে আমার কী দোষ?

এইখানেই শেষ হলে ভালো হত। বিক্রির টাকাটা ব্যাঙ্কে রেখে সরাবজি ছোট্ট সংসার চালিয়ে নিতে পারবেন ভেবেছিলেন।

কিন্তু সেখানেই মুশকিল হল, ব্যাঙ্ক ফেল পড়ল; যেদিন বিক্রির চেকটা ব্যাঙ্কে জমা দিয়েছিলেন তার দুদিন পরে।

হয়তো অভিশাপ, হয়তো চোখের জলের ফল।

সরাবজি কী করবেন? মেয়েকে তার পড়াতে হবে। অবশিষ্ট যা আছে তাতে মেয়েকে বিলেতে রাখা যাবে না। কাজ চাই। কিন্তু ক্লাশ ফোর পর্যন্ত পড়া লোককে কে চাকরি দেবে?

তাই ঘুরে ফিরে আবার বার। সরাবজি ফিসফিস করে আমাকে বললেন, এবার আমি তো চাকরি করছি। আমি কী করব? যদি কোনো অভিশাপ কেউ দেয় সে নিশ্চয় আমাকে লাগবে না।

সরাবজির চোখে নিশ্চয়ই জল ছিল না। কিন্তু আমার মনে হল সেখানে দুফোটা জল রয়েছে। সবজি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি চোখ বুজে ঈশ্বরকে বোধহয় আর একবার প্রশ্ন করছেন, চাকরি করলে নিশ্চয়ই কোনো দোষ নেই? আমাকেও তো সংসার প্রতিপালন করতে হবে।

আত্মদ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হতভাগ্য সবজি উঠে পড়ে এবার নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলেন। আর আমি সংসারের সৌরমণ্ডলে এক নতুন জ্যোতিষ্ক আবিষ্কারের আনন্দে বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *