০৩. পৃথিবীর এই সরাইখানায়

পৃথিবীর এই সরাইখানায় আমরা সবাই কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় নিয়েছি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ব্রেকফাস্ট খেয়েই বিদায় নেবে, কয়েকজন লাঞ্চ শেষ হওয়া মাত্রই বেরিয়ে পড়বে। প্রদোষের অন্ধকার পেরিয়ে, রাত্রে যখন আমরা ডিনার টেবিলে এসে জড়ো হব তখন অনেক পরিচিত জনকেই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না; আমাদের মধ্যে অতি সামান্য কয়েকজনই সেখানে হাজির থাকবে। কিন্তু দুঃখ কোরো না, যে যত আগে যাবে তাকে তত কম বিল দিতে হবে, বোসদা বললেন।

এ-যে দার্শনিকের কথা হল, আমি বললাম।

হ্যাঁ, এ আমার নিজের কথা নয়—কোনো ইংরেজি কবিতার অনুবাদ। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক এখানে অনেকদিন ছিলেন, তিনি প্রায়ই লাইনগুলো আবৃত্তি করতেন। আমি যেন কোথায় লিখে রেখেছিলাম। যদি খুঁজে পাই, দেবোখন।

আমি বললাম, সুন্দর ভাবটি তো। যে যত বেশি সময় এই দুনিয়ায় থাকবে সংসারের বিল সে তত বেশি দেবে।

কিন্তু কবি ভদ্রলোক নিশ্চয়ই কোনো হোটেলে চাকরি করেননি। যদি করতেন, তাহলে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার সব ধ্বংস করে, বিলটা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে যে-সব লোক পৃথিবী থেকে সরে পড়েছে, তাদের কথা নিশ্চয় লিখতেন। আর আমাদের কথাও কিছু লিখে যেতেন। আমরা যারা প্রতিদিন ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এবং ডিনার ধ্বংস করছি, অথচ বিল দিচ্ছি না; কিন্তু গতর খাটিয়ে দেনা শোধ করবার চেষ্টা করছি।

একটু থেমে স্যাটা বোস বললেন, সত্যি কথা বলতে কি, আমি মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠি।

বোসদা বললেন, তাতে অবশ্য কষ্ট পাওয়াই সার হচ্ছে। কারণ হাঁপানিতে কেউ একটা সহজে মরে না। আমাদের যে বেরিয়ে যাবার উপায় নেই। সর্বনাশা এক মোহের আফিম ছড়ানো রয়েছে এখানে। একবার ঢুকলে আর বেরুনো যায় না। দরজা খুলে দিলেও, যাওয়া হয় না।

টাইপ করতে করতে ওঁর কথা শুনে যাচ্ছিলাম।

এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে স্যাটা বোস বললেন, মুখ চোখ বসে গিয়েছে কেন? রোজির ভয়ে রাত্রে ঘুম হচ্ছে না বুঝি?।

সত্যি কথা, বলতে হল।মেয়েটার এখনও খোঁজ নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হঠাৎ এসে না হাজির হয়।

চিন্তারই কথা। বোসদা বললেন। তবে নিজের জমিটা ইতিমধ্যে যত্ন করে লাঙল দিয়ে তৈরি করে রাখো। কর্তাকে খুশি রাখা প্রয়োজন।

 

কর্তাকে কী করে খুশি রাখতে হয়, তা কর্তার কাছেই শিখছিলাম। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ওমর খৈয়াম কী আর সাধে লিখেছিলেন, এই দুনিয়ায় পাণ্ডিত্যপূর্ণ বড় বড় কেতাব লেখার জন্যে জাঁদরেল পণ্ডিতের অভাব নেই; যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব করবার জন্যে সাহসী পুরুষও অনেক পাওয়া যায়; সসাগরা সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে পারেন এমন রাজনৈতিক প্রতিভাও অনেক আছেন; কিন্তু হায়, সরাইখানা চালাবার লোকের বড়ই অভাব।

হোটেলে প্রতি মুহূর্তে কত রকমের সমস্যারই যে উদ্ভব হয়। সে সব সমাধানের দায়িত্ব বেচারা ম্যানেজারের। চোরদায়ে তিনি যেন সব সময়ই ধরা পড়ে রয়েছেন। স্নানের জল যদি বেশি গরম হয়ে গিয়ে থাকে, তবে বেয়ারাকে খবর না দিয়ে, অনেকে টেলিফোনে তাঁকেই ডেকে পাঠান। হোটেল অতিথিদের অনেকেই শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বাসী; নিম্ন পর্যায়ে আলোচনা করে যে কিছু সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, তা তারা মনে করেন না। ফলে, স্নানের জল যদি একটু ঠাণ্ডা হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলেও বেচারা ম্যানেজারের ডাক পড়বে।

ঘুমোতে যাবার সময় কেউ যদি আবিষ্কার করেন, বিছানার চাদরের রং দরজা-জানালার পর্দার রংয়ের সঙ্গে ম্যাচ করেনি তাহলে তিড়িং করে লাফিয়ে ওঠেন। এবং সেই রাত্রেই পাগলের মতো ম্যানেজারকে সেলাম পাঠান। আমার চোখের সামনেই একদিন ঘটনাটা ঘটল। টেলিফোনে এস-ও-এস পেয়ে মার্কোপোলো প্রায় ছুটতে ছুটতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কী ব্যাপার জানবার জন্যে আমিও সঙ্গে সঙ্গে এলাম। নির্দিষ্ট ঘরের দরজায় মার্কোপোলো সায়েব টোকা মারলেন। ভিতর থেকে নারীকণ্ঠে শব্দ এল, কাম্ ইন প্লিজ।

ভদ্রমহিলা মধ্যবয়সী। জাতে ইংরেজিনী। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। ম্যানেজারকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে বললেন, আপনারা ডেঞ্জারাস। আপনারা মানুষ পর্যন্ত খুন করতে পারেন। মার্ডারার ছাড়া এমন কালার কম্বিনেশন আর কেউ পছন্দ করতে পারে না! এমন ভয়াবহ রং আমি জীবনে কোনো হোটেলে দেখিনি; আর একটু হলে আমি ফেন্ট হয়ে যাচ্ছিলাম।

রাগে আমার ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছিল। মার্কোপোলো কিন্তু রাগ করলেন না। রাগের নার্ভটা নাকি হোটেল ম্যানেজমেন্ট শিক্ষার ইস্কুলে ঢোকবার সময় কেটে দেওয়া হয়। মার্কোপোলো প্রথমেই হাজারখানেক দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, আহা! আশা করি ইতিমধ্যে আপনার কোনো শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি হয়নি। আমি এখনই তিনটে চাদর পাঠিয়ে দিচ্ছি। তিনটের মধ্যে আপনার যেটা খুশি পছন্দ করে নিন। তবে ওই যে-রংয়ের চাদরটা আপনার বিছানায় পাতা হয়েছে, ওটা আমেরিকান ট্যুরিস্টরা কেন যে পছন্দ করেন জানি না। বাধ্য হয়ে ওই ধরনের চাদর আমাকে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে তৈরি করাতে হয়েছে। কিন্তু তখন কি জানতাম যে আপনি এই ঘরে আসছেন।

বিজয়গর্বে বিগলিত ভদ্রমহিলা গম্ভীরভাবে বললেন, পৃথিবীর যেখানেই যাচ্ছি দেখছি ওরা রুচি নষ্ট করে দিচ্ছে। চিউইং গাম চুষতে চুষতে ওরা সৌন্দর্যের উপর বুলডজার চালাচ্ছে। মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, পয়সা হয়তো ওদের আছে, কিন্তু রুচি শিখতে এখনও অ্যানাদার ফাইভ হান্ড্রেড ইয়ার।

ভদ্রমহিলার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হয়ে মার্কোপোলো বেরিয়ে এলেন। পরে স্যাটা বোসের কাছে শুনেছি, যদি ভদ্রমহিলা আমেরিকান হতেন, তা হলে মার্কো বলতেন, ইংরেজরা কেন যে এই সেকেলে রং পছন্দ করে বুঝি না। অথচ আমরা নিরুপায়—গতকাল পর্যন্ত ক্যালকাটা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর। তবে এখন আমরা উঠে পড়ে লেগেছি—ব্রিটিশ ইমপিরিয়ালিজমের সব চিহ্ন এখান থেকে ক্রমশ মুছে যাচ্ছে।

গেস্টদের কাছে নরম মেজাজের শোধটা ম্যানেজার অবশ্য কর্মচারীদের উপর দিয়ে তুলে নেন। বেয়ারা, ফরাশ, খিদমতগার, বাবুর্চির প্রাণ বড় সায়েবের দাপটে ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে।

মার্কোপোলো সায়েব একদিকে আরও ভয়াবহ। ওঁর মেজাজ কখন যে কত ডিগ্রিতে চড়ে রয়েছে তা সবসময় বোঝা যায় না।

আমাকে কাজ দেওয়ার সময়ও মার্কো কেমন গম্ভীর হয়ে থাকেন। সব সময়েই যেন অন্যমনস্ক। সন্ধের সময় মাঝে মাঝে হাফ প্যান্ট আর সাদা হাফ শার্ট পরে, ছড়িটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কোথায় যান কেউ জানে না। ডিনারের সময়, যখন ডাইনিং হল্-এ তিলধারণের স্থান থাকে না, তখনও তাঁকে দেখা যায় না। বেচারা স্টুয়ার্ড এবং সত্যসুন্দরবাবুকে সব সামলাতে হয়।

স্টুয়ার্ড বলে, স্যাটা, এমনভাবে কতদিন চলবে?,

স্যাটা বলেন, অতো মাথা ঘামিও না, সায়েব। দেড়শ বছর ধরে যে জিনিসটা চলে আসছে, সেটা ঠিক নিজের জোরেই চলবে। তোমার কিংবা আমার ব্রেনের ব্যাটারি সেজন্যে অহেতুক খরচ করে লাভ নেই।

ম্যানেজার সায়েব যখন ফিরলেন, তখন তার অন্য মেজাজ। ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মুখে কে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। নিজের ঘরে ঢুকে সায়েব জামা-জুতো একটা একটা করে খুলে চারদিকে ছুড়ে ফেলতে আরম্ভ করেন। বেচারা মথুরা সিং চুপচাপ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। ভিতরে ঢুকে কোনো লাভ নেই, নেশার ঝেকে সায়েব হয়তো জুতো ছুড়েই মারবেন।

একটু পরেই মথুরা সিং-এর ডাক পড়ে, ঘরে ঢুকতেই জড়িত কণ্ঠে সায়েব বলেন, হেড বারম্যান কো বোলাও।

সেলাম পেয়েই হেড বারম্যান রাম সিং ব্যাপারটা বুঝতে পারে। কোমরে লাল পট্টি, ডান হাতে লাল ব্যান্ড এবং মাথার লাল পাগড়ি পরে সে পেগমেজারে মদ ঢালছিল। অন্য কারুর হাতে দায়িত্ব দিয়ে, তাকে সায়েবের ঘরে ঢুকে সেলাম দিতে হয়।

সায়েব তখন ষাঁড়ের মতো ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজ করেন। জিজ্ঞাসা করেন, রাম সিং, মাই ডার্লিং রাম সিং, হাওয়া কী রকম?

কোমর থেকে ঝোলা ঝাড়নে হাতটা মুছতে মুছতে হেড বারম্যান বলে, হুজুর, বার আজ বোঝাই। দুটো ডাশুল হেগ, তিনটে হোয়াইট হর্স এর মধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে। অনেক খদ্দের এসেছে-রেসের দিন। রাম সিং এবার নিবেদন করে, আরও খদ্দের আসছে। বার-এ তখন তার উপস্থিতি বিশেষ প্রয়োজনীয়।

ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজ করে সায়েব বলেন, ওই সব ছারপোকাগুলোকে নরকে যেতে দাও। তুমি এখানে আমার সঙ্গে গল্প করো।

রাম সিং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, মথুরা সিং-এর মুখের দিকে তাকায়। মথুরা সিং মুখে কিছু বলে না, মনে মনে খুশি হয়। থাকো এখন দাঁড়িয়ে। রোজই তো মাতালদের চুষে অনেক রোজগার করছ, আজ না-হয় একটু কমই কামালে। অন্য লোকগুলো একটু চান্স পাক।

নেশার ঘোরে সায়েব এবার গান ধরেন। সায়েব বাইরে থেকে খেয়ে এসেছেন, অন্নপূর্ণা আজ ভিখারিনি হয়েছেন। শাজাহান হোটেলের সর্বেসর্বার রসনা নিজের সেলারে তৃপ্ত হয়নি; তাই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাড়ার এক কুৎসিত বস্তিতে দেশি মদ টেনে এসেছেন। মুখের দুর্গন্ধে, বিলিতি মদে অভ্যস্ত রাম সিং-এর বমি ঠেলে আসছে। কিন্তু তবুও নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

সায়েবের এখনও মন ভরেনি। তাই গান ধরলেন। এ-গান অনেকদিনের পুরনো; কলকাতার প্রাচীন বিষাক্ত রক্তের সঙ্গে হাস্যরসিক ডেভি কারসনের এই গান মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। শাজাহান হোটেলের বার-এ এই গান অনেক মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করেছে। মদন দত্ত লেন, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট যখন গভীর ঘুমে অচেতন, তখন অনেক বিদেশি কণ্ঠ উনিশ শতাব্দীর মধ্যরাত্রে এই গান গেয়ে নতুন দিনকে স্বাগত জানিয়েছে, বেয়ারাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছে

জলদি যাও, হাই খিদমতগার, ব্রান্ডি শরাব, বেলাটী পানি লে আও।

মার্কোপোলোর মত্ত দেহে আজ অনেকদিনের হারিয়ে যাওয়া বাধাবন্ধহীন কলকাতার সেই উচ্ছুঙ্খল আত্মা যেন ভর করেছে। সায়েব সুর করে গাইতে লাগলেন–

To Wilsons or Spences Hall
On Holiday stay;
With freedom call for the mutton chops
And billiards play all day;
The servant catches from after the hukum Jaldi Jao
Hi Kairmatgar, brandy slurab Bilati pani lao.

সায়েবের তৃষ্ণা এখনও মেটেনি। পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলেন—লে আও..লে আও..হুইস্কি শরাব, ব্লাতি পানি লে আও।

তারপর মদে চুর হয়ে যাবেন মার্কোপোলো সায়েব। গেঞ্জি আর অন্তর্বাস পরা ওই বিশাল উন্মত্ত দেহটা দুজন চাকরের পক্ষে ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠবে। সায়েব গেলাস ভাঙবেন, শূন্য মদের বোতল মেঝেতে ছুড়ে ফেলবেন। রাম সিংকে বুকে জড়িয়ে ধরে নাচবেন, আর গাইবেন। তারপর হঠাৎ যেন তার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হবে। ডার্লিং, মাই সুইট ডার্লিং, বলে রাম সিংকে চুম্বন করতে গিয়ে চমকে উঠবেন।

ওঁর সবল দুই হাত দিয়ে রাম সিংকে ঘরের বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তিনি বিছানায় শুয়ে পড়বেন। তখন সাবধানে ওঁর ঘরের আলো নিভিয়ে দিতে হবে। অতি সন্তর্পণে ওঁর বুক পর্যন্ত চাদরে ঢেকে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। ঘণ্টাখানেক পরে মথুরা সিংকে আবার আসতে হবে। এবার আলোটা জ্বেলে ঘরের মেঝেটা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। কারণ ভোরবেলায় সায়েব যখন ঘুম থেকে উঠবেন তখন কিছুই মনে থাকবে না। হয়তো সারা ঘরময় ছড়ানো ভাঙা কাচের টুকরোয় নিজের পা কেটে বসবেন।

সেবার ওই রকম হয়েছিল। রাত্রে তাঁর ঘরে কেউ ঢুকতে সাহস করেনি। আর ভোরবেলায় ওঁর পা কেটে গেল। মথুরাকে ডেকে সায়েব বললেন, মাতাল হয়েছিলাম বলে, তোমরা আমাকে এইভাবে শাস্তি দিলে? তোমরা কেউ কি আমাকে ভালোবাসো না?

সেই থেকে মথুরা গণ্ডগোলের রাত্রে ঘুমোয় না। সায়েবের ঘরের বাইরে, একটা টুলের উপর সারারাত জেগে বসে থাকে। আর মাঝে মাঝে ঘড়ির দিকে তাকায়, কখন এই অসহ্য রাত্রির শেষে, সর্বপাপঘ্ন সূর্যের উদয় হবে। অশিষ্ট, অপ্রকৃতিস্থ পৃথিবী আবার দিনের আলোয় শান্ত হবে; নিজের জ্ঞান ফিরে পাবে।

রাত্রের এই নাটকের কাহিনি আমি মথুরার কাছেই শুনেছি। কিন্তু পরের দিন ব্রেকফাস্টের পর ম্যানেজারকে দেখে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। পরিশ্রমের অফুরন্ত উৎস যেন ওঁর শরীরের মধ্যে রয়েছে; দেহের উপর অত অত্যাচারের পরও পশুর মতো খাটতে দেখেছি তাকে।

মার্কোপোলো যেন আমাকে একটু সুনজরে দেখতে শুরু করেছেন। অন্যলোকের কাছে গম্ভীর হয়ে থাকলেও, আমার সঙ্গে কথা বলবার সময় মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। এক একদিন কাজের শেষে বলেছেন, এখনও বসে রয়েছ কেন? তুমি কি সাধু বনে গিয়েছ?

বলতাম, কই না তো?

তা হলে, এখনও এই হোটেলের বদ্ধ ঘরে বসে রয়েছ কেন? কলকাতা শহরে কত ফুর্তি পাখি হয়ে এখন উড়ে বেড়াচ্ছে। যাও, তার দু একটা ধরে উপভোগ করে নাও।

বায়রন সায়েবের খোজ পড়ল একদিন। সেই যে এক রাত্রে বায়রন সায়েব হোটেলে আমার চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন, তারপর আর কোনো খোঁজ নেই। আমার উপকার করবার জন্যই স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার মর্মর মূর্তির সামনে আবির্ভূত হয়ে, তিনি যেন আবার অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করলেন, বায়রনের সঙ্গে দেখা হয় তোমার?

বলতে হল, না।

সেই রাত্রের পর তোমার সঙ্গে একবারও দেখা হয়নি? উনিও দেখা করতে আসেননি, আর তুমিও যাওনি?

আজ্ঞে না।

মার্কোপোলো বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। নিজের হাতঘড়িটার দিকে একবার নজর দিলেন। তারপর জানলা দিয়ে বাইরের একটুকরো আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তখনও সূর্য অস্ত যায়নি, কিন্তু সন্ধ্যা হতেও বেশি দেরি নেই।

এবার তিনি যা বললেন, তা শোনবার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম। মাথাটা নাড়াতে নাড়াতে, চোখ দুটো ছোট করে বললেন, তুমি অত্যন্ত ক্লেভার। অনেক জেনেও তুমি মুখটাকে ইনোসেন্ট রাখতে পেরেছ।

আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তার কথাতে একটু রহস্যের গন্ধ পেলাম। তিনি হয়তো সন্দেহ করছেন, আমি কিছু সংবাদ জানি, অথচ বলছি না। বললাম, আপনার কথার অর্থ ঠিক বুঝতে পারছি না, স্যর।

মার্কোপোলো এবার লজ্জিত হয়ে পড়লেন। বললেন, না না, তুমি রাগ কোরো না, এমনি মজা করছিলাম।

হঠাৎ কথা বন্ধ করে মার্কোপোলো এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ওঁর ওই বিশাল চোখের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাকিয়ে থাকার মতো সাহস বা শক্তি আমার ছিল না। তাই চোখ নামিয়ে মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। একটু পরে আবার ওঁর মুখের দিকে তাকালাম। মনে হল, বড়ো করুণভাবে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

ধীরে ধীরে মার্কোপোলো বললেন, আমার একটা উপকার করবে? বায়রনের সঙ্গে একবার দেখা করে আসবে? প্লিজ।

বলতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বলতে হবে? না, কিছুই বলতে হবে না। যদি ওঁর সঙ্গে দেখা হয়, ওঁকে জানিও, আমি অধৈর্য হয়ে পড়েছি।

তখনই বেরোতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সায়েব বাধা দিলেন। বললেন, ইয়ংম্যান, চা-এর সময় হয়ে গিয়েছে। এখনই চা আসবে। আগে চা খাও।

মার্কোপোলো বেল টিপলেন। হোটেলের ঘড়ির কাঁটা তখন চায়ের ঘরেই হাজির হয়েছে। দুশো, আড়াইশো ঘরে একই সঙ্গে চা পৌঁছে দিতে হবে। বেয়ারারা এতক্ষণে প্যান্ট্রির সামনে দাঁড়িয়ে, চাপা গলায় বলছে—জলদি, জলদি।

বেলের উত্তরে বেয়ারা এসে হাজির হল না। সে নিশ্চয় ততক্ষণ প্যান্ট্রির সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে দুজন লোক দ্রুতবেগে কেটলির মধ্যে গরম জল ঢালছে। আর একজন লোক যন্ত্রের মতো প্রতি কেটলিতে চা ঢেলে যাচ্ছে। বেয়ারারা ইতিমধ্যেই ফ্রিজ থেকে দুধ এবং আলমারি থেকে চিনি বার করে নিয়েছে। এত কেটলি এবং ডিস কাপ যে একসঙ্গে হাজির হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না।

ম্যানেজার সায়েবের ঘরে চা আসতে দেরি হল না। কেটলির টোপর খুলে দিয়ে মথুরা সিং সেলাম করে দাঁড়াল। এই সেলামের জিজ্ঞাসা, সায়েব নিজের খুশিমতো চা তৈরি করবেন, না সে দায়িত্ব মথুরার উপর অর্পণ করবেন।

মার্কোপোলো মাথা নেড়ে বললেন, ঠিক হ্যায়। মথুরা সিং আর একটা সেলাম দিয়ে বিদায় নিল।

অভ্যস্ত হাতে কেটলির ভিতরটা চামচে দিয়ে নেড়ে নিয়েই ম্যানেজার সায়েব আঁতকে উঠলেন। বললেন, খারাপ কোয়ালিটির চা।

মথুরার ডাক পড়ল। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সে বললে, না হুজুর, সকালে যে চা খেয়েছেন, সেই একই চা।

ম্যানেজার সায়েব স্টুয়ার্ডকে সেলাম দিলেন। তিনিই হোটেলের ভাড়ারী; সুতরাং কোনো দোষ বেরুলে প্রথম ঘা তাকেই সামলাতে হবে।

দরজায় টোকা পড়তেই ম্যানেজার জিমিকে ভিতরে আসতে বললেন। চেয়ারে বসতে দিয়ে, ম্যানেজার বললেন, তোমার সঙ্গে চা খাবার জন্য প্রাণটা আইঢাই করছিল, তাই ডেকে পাঠালাম!

ব্যাপারটা যে সুবিধের নয়, তা জিমি ভাবে বুঝলেন। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো কিছু খারাপ আছে নাকি?

ম্যানেজার এবার বোমা ফাটালেন। মাইডিয়ার ফেলল, তোমার এই চা খেয়ে কোনো গেস্ট যদি এই হোটেলে আগুন ধরিয়ে দেয়, তাহলে আমি আশ্চর্য হব না। তোমার ওই চা স্টম্যাকে গেলে খুন করবার ইচ্ছেও হতে পারে।

অপ্রস্তুত স্টুয়ার্ড বললেন, বোধহয় আপনাদের কেটলিতে কোনো গোলমাল হয়ে গিয়েছে।

মুখ খিঁচিয়ে ম্যানেজার বললেন, এ প্রশ্নের উত্তর এখানকার নিকটতম আস্তাবলের ঘোড়ারা দিতে পারবে।

বিনয়ে গলে গিয়ে স্টুয়ার্ড বললেন, নতুন প্যাকেট খুলে চা তৈরি করে আমি এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি।

মার্কোপোলো এবার হা-হা করে হেসে ফেললেন। বললেন, জিমি, তুমি পারবে। খুব শিগগির তুমি আমার চেয়ারে বসতে পারবে।

আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, তোমাদের ফিউচার বড় সায়েবকে দেখে রাখো।

মথুরা সিং আবার নতুন চা নিয়ে এল। চা তৈরি করে, আমাদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে মার্কোপোলো বললেন, মুখের জোরেই হোটেল চলে। তোমাদের কলকাতাতেই একজন হোটেলওয়ালা ছিলেন। নাম স্টিফেন। কথার জোরে রাজত্ব করে গেলেন।

হু ওয়াজ হি? স্টুয়ার্ড জিজ্ঞাসা করলেন।

কলকাতার সবচেয়ে বড় হোটেলের ফাউন্ডার। কলকাতার বাইরেও একটা নামকরা হোটেল তার কীর্তি। আর ডালহৌসির স্টিফেন হাউস তো তোমরা রোজই দেখছ। গল্প আছে, উনি তোমার থেকেও খারাপ অবস্থায় পড়েছিলেন। চা-এর কেটলিতে চামচ চালাতে গিয়ে, এক ভদ্রলোক দেখলেন, শুধু চা নয়, চা-এর সঙ্গে একটা আরশোলাও গরম জলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

স্টুয়ার্ড অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, তখন কী হল?

ভদ্রলোক টি-পট হাতে করে সোজা স্টিফেনের ঘরে এসে ঢুকলেন। রাগে তিনি ঠক ঠক করে কাঁপছেন। কিন্তু স্টিফেন ঘাবড়ে যাবার পাত্র নন। অমায়িকভাবে, নিজের বেয়ারাকে ডেকে আর এক পট চা আনতে বললেন। তারপর নিজের হাতে চা তৈরি করে, ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিলেন।

ভদ্রলোক দেখলেন স্টিফেন যেন মনে মনে কী একটা হিসেব করবার চেষ্টা করছেন। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী হিসেব করছেন?

আজ্ঞে, আমাদের পাঁচশো ঘর। তার মানে পাঁচশো পট চা। একটা আরশোলা। তার মানে পাঁচশোয় একটা।

গল্প শেষ করে ম্যানেজার আবার চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।

স্টুয়ার্ড হা-হা করে হাসতে আরম্ভ করলেন। বাঃ! চমৎকার ব্যাখ্যা। ভদ্রলোকের আশ্চর্য বুদ্ধি ছিল।

হুঁ। কিন্তু দিনকাল দ্রুতবেগে পালটাচ্ছে, জিমি। এখন শুধু কথায় আর চিড়ে ভিজছে না, ম্যানেজার গম্ভীর হয়ে বললেন।খুব সাবধানে না চললে অনেক দুর্ভোগ পোয়াতে হবে।

জিমি উঠে পড়লেন, আমাকেও উঠতে হল।

মার্কোপোলো বললেন, হোটেলের গাড়িতে তোমাকে পাঠাতে পারতাম, কিন্তু জিনিসটা জানাজানি হোক আমি চাই না।

নমস্কার করে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় নেমে ট্রামের শরণাপন্ন হওয়া গেল।

 

কোনো বিশেষ শ্রেণির লোক দলবদ্ধভাবে কোথাও বাস করলে সে পাড়ার বাতাসে পর্যন্ত তাদের বৈশিষ্ট্য যে কেমন করে ছড়িয়ে পড়ে আমি বুঝতে পারি না। ছাতাওয়ালা গলির সঙ্গে ডেকার্স লেনের যে পার্থক্য আছে, তা আমার চোখ বেঁধে দিলেও বলে দিতে পারি। ব্যক্তি-জীবনের বৈশিষ্ট্যগুলো কেন যে গন্ধেও ধরা দেয় তা বলা শক্ত। এসপ্লানেড-পার্ক সার্কাসের ট্রামটা যখন ওয়েলেসলির মধ্য দিয়ে এলিয়ট রোডে ঢুকে পড়ল, তখনও এক ধরনের গন্ধ পেলাম। সত্যি কথা বলতে কী, এই গন্ধ কেউ বিশেষ উপভোগ করেন না। নোংরামির দিক থেকে এই অঞ্চল কলকাতা কর্পোরেশনের খাতায় কিছু প্রথম স্থান অধিকার করে নেই, এর থেকেও অনেক নোংরা গলিতে প্রতিদিন বহু সময় অতিবাহিত করি, কিন্তু কখনও এমন অস্বস্তি বোধ করি না।

পার্ক সার্কাসের ট্রাম থেকে নেমে পড়ে, বায়রন সাহেবের গলিটা কোনদিকে হবে ভাবছিলাম। আমার সামনেই গোটাকয়েক অধউলঙ্গ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাচ্চা দেশি মতে রাস্তার উপর ড্যাংগুলি খেলছিল। ছেলেরা যেখানে ঘোরাঘুরি করে, খেলাধুলা করে, সে জায়গার প্রকৃতি সম্বন্ধে কিছুটা আশ্বস্ত হওয়া যায়। কিন্তু মাত্র গজ কয়েক দূরেই একটা মদের দোকান। রাস্তার উপর থেকে সাইনবোর্ড ছাড়া দোকানের আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সাইনবোর্ডের উপর একটা নিষ্প্রভ ইলেকট্রিক বাতি অকারণে রহস্য সৃষ্টি করে নিস্পাপ পথচারীদের মনে নিষিদ্ধ কৌতূহল সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।

ড্যাংগুলি খেলা বন্ধ করে ছেলেরা এবার আমার দিকে নজর দিলে।

পকেট থেকে কাগজ বার করে লেনের নাম জিজ্ঞেস করাতে, ছেলেরা রাজভাষা ও রাষ্ট্রভাষার ককটেলে তৈরি এক বিচিত্র ভাষায় আমাকে পথ দেখিয়ে দিল।

ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসছিলাম। কিন্তু ওদেরই মধ্যে সিনিয়র এক ছোকরা এসে বললে, যে-সার্ভিস তারা দিয়েছে তার প্রতিদানে তারা কিছু আশা করে।

ট্যাক্সি ধরে দেবার জন্য চৌরঙ্গীতে ছোকরাদের পয়সা দিতে হয় জানতাম, কিন্তু ঠিকানা খুঁজে দেবার জন্য কলকাতা শহরে এই প্রথম চার আনা খরচ করে যখন বায়রন সায়েবের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ালাম তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে।

প্লাসটিকের অক্ষর দিয়ে দরজার সামনে বোধহয় নাম লেখা ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ অক্ষর কোন সময়ে বন্ধনমুক্ত হয়ে দরজা থেকে বিদায় নিয়েছে, শুধু R O N অক্ষরগুলো মালিকের মায়া কাটাতে না পেরে, কোনোরকমে ভাঙা আসর জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।

দরজায় বেল ছিল। কয়েকবার টেপার পরও কোনো উত্তর না-পেয়ে বুঝলাম, ওই যন্ত্রটির শরীরও সুস্থ নয়। তখন আদি ও অকৃত্রিম ভারতীয় পদ্ধতিতে ধাক্কা মারা শুরু করলাম। এবার ফল হল। ভিতর থেকে এক শৃঙ্খলবদ্ধ কুকুরের স্বাধীনতার-দাবি-জানানো স্লোগান শুনতে পেলাম। দরজা খোলার শব্দ হল; এবং পরের মুহূর্তেই যিনি ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি খোদ বায়রন সায়েব।

চোখ মুছতে মুছতে বায়রন বললেন, আরে, কী ব্যাপার?

প্রচুর আদর করে তিনি আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। এই ভরসন্ধ্যাবেলায় উনি কি ঘুমোচ্ছিলেন?

একটা ছেঁড়া বেতের চেয়ারে বসতে বলে বায়রন সায়েব চোখে মুখে জল দেবার জন্য বাথরুমে গেলেন। দেখলাম, টেবিলের উপর এক কাড়ি পুরনো আমেরিকান ডিটেকটিভ ম্যাগাজিন ছড়ানো রয়েছে। দেওয়ালের কোণে কোণে ঝুল এবং নোংরা জড়ো হয়ে আছে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে একটা ময়লা তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বায়রন বললেন, খুব অবাক হয়ে গিয়েছ, তাই না? ভাবছ লোকটা এখন ঘুমোচ্ছিল কেন? তার উত্তর দিচ্ছি। কিন্তু ফার্স্ট থিং ফাস্ট। আগে একটু চা তৈরি করি।

বললাম, এইমাত্র খোদ মার্কোপোলোর সঙ্গে চা খেয়ে এসেছি।

মার্কোপোলোর সঙ্গে বসে তুমি সেন্ট পারসেন্ট পিওর আগমার্কা অমৃত খেলেও আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমার সঙ্গে একটু চা খাবে না, তা কি হয়? তোমার এখনও বিয়াল্লিশ কাপ চা পাওনা।

বায়রন সায়েব নিজেই চা-এর ব্যবস্থা করতে আরম্ভ করলেন। বললেন, আমার স্ত্রী আজ ফিরবেন না। আপিস থেকে সোজা বাটানগরে এক বান্ধবীর বাড়িতে বেড়াতে যাবেন।

হিটারে কেটলি চাপিয়ে বায়রন বললেন, যা বলছিলাম, আমাকে ঘুমোতে দেখে তুমি নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে গিয়েছ। কিন্তু এটা জেনে রাখো, আমরা ডিটেটিভরা যা করি তার প্রত্যেকটারই পিছনে একটা গোপন উদ্দেশ্য থাকে।

তা তো বটেই, আমি সায় দিলাম।

হ্যাঁ, বায়রন সায়েব বললেন। আমার স্ত্রীকেও সবসময় ওই কথাটা বোঝাবার চেষ্টা করি। কিন্তু তুমি যেমন সহজেই আমার স্টেটমেন্ট মেনে নিলে, তিনি তা করবেন না। তিনি তখন হাজারটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন। অথচ, সবসময়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না। গোপনীয়তাটাই আমাদের ব্যবসা। আমাদের প্রফেশনে এমন অনেক কথা আছে, যা নিজের স্ত্রীকেও বলা সেফ নয়। হাজার হোক আমরা ইন্ডিয়াতে বাস করছি। দেওয়ালের কান যদি কোথাও থাকে সে এই দেশেতেই,—পার্টিকুলারলি এই ক্যালকাটাতেই আছে।

বললাম, আপনার তাহলে বেশ কষ্ট হয়।

বায়রন সায়েব ঘাড় নাড়লেন। সেই জন্যই আমাদের ডিটেকটিভ ওয়ার্লডে একটা মতবাদ আছে, ডিটেকটিভদের বিয়ে করাই উচিত নয়।

অ্যাঁ! নতুন থিওরির কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম।

বায়রন সায়েব বললেন, এতে চমকাবার কিছু নেই। পাদ্রিরা বিয়ে করবে, না চিরকুমার থাকবে এই নিয়ে চার্চে যেমন অনেকদিন মতদ্বৈধ ছিল, এটাও তেমনি। চিরকুমার স্কুল অফ ডিটেকটিভরা বলছেন, এই পেশার পক্ষে ওয়াইফরা পজিটিভ নুইসেন্স।

হাইকোর্টের অনেক বড় বড় ব্যারিস্টারও গোপনে এ মত পোষণ করেন, আমি বললাম।

করতে বাধ্য। প্রত্যেকটি উচ্চাভিলাষী অথচ বুদ্ধিমান লোক ওই কথা বলবেন।

হিটার থেকে কেটলিটা নামিয়ে বায়রন সায়েব বললেন, তবে কি জানো, আমার ওয়াইফকে আমি দোষ দিতে পারি না। সাসপিশন অর্থাৎ সন্দেহটাও আমাদের পেশার প্রথম কথা—শেষ কথাও বটে। আমার সেই গুণ আছে, অথচ আমার ওয়াইফের সন্দেহবাতিক থাকবে না, সেটাও ভালো কথা নয়। হাজার হোক, একটা ব্রেন সবসময় নিখুঁত কাজ করতে পারে না, ডবল ইঞ্জিন থাকলে বিপদের আশঙ্কা কম।

আমি চুপচাপ তাঁর কথা শুনছিলাম। গরম চা এক কাপ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, যা বলছিলাম, কেন এই অসময়ে ঘুমোচ্ছিলাম জানো? আজ রাত্রে আমার হয়তো একটুও ঘুম হবে না। সারারাত আমাকে একজনকে খুঁজে বেড়াতে হবে। কাকে খুঁজে বেড়াব, তার নাম হয়তো তোমার জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন নয়, পরে বলব। এই সিক্রেটটা গভর্নমেন্টের বাজেটের মতো; যতক্ষণ না পার্লামেন্টে অ্যানাউন্স করছি ততক্ষণ টপ সিক্রেট, কিন্তু তারপরই জনসাধারণের প্রপার্টি।

বায়রন সায়েব এবার আমার খোঁজ নিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, খবর কী? কাজকর্ম ঠিক চলছে তো?

বললাম, আজ্ঞে, হ্যাঁ। মেয়েটা এখনও ফেরেনি।

হুঁ, রোজির খবরটা তো নেওয়া হয়নি। কয়েকদিন খুব ব্যস্ত আছি। মেয়েটা ফিরবে কি না, খবরটা নিতেই হচ্ছে এবার। মিসেস ব্যানার্জিও খুব উতলা হয়ে পড়েছেন। দুদিন ওঁর মেয়েকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন।

বায়রন সায়েব এতক্ষণে ম্যানেজারের খবর জিজ্ঞাসা করলেন। আমাকে বলতে হল, তার জন্যই এই সন্ধ্যাবেলায় আমি এখানে এসেছি।

কিছু বলেছেন তিনি? বায়রন প্রশ্ন করলেন।

মার্কোপোলো খুব অধৈর্য হয়ে পড়েছেন, এ কথাটাই আপনাকে জানাতে বলেছেন।

বায়রন এবার বেশ গম্ভীর হয়ে উঠলেন। চা-এর কাপটা পাশে সরিয়ে দিয়ে, পকেট থেকে একটা সস্তা দামের সিগারেট বার করে ধরালেন। বললেন, বাবু, বড় ডাক্তার হওয়ার বাধা কী জানো? ইউ মাস্ট নট ফিল টু মাচ ফর দি পেসেন্ট-রোগী সম্বন্ধে তুমি খুব বেশি অভিভূত হবে না। আমাদেরও তাই। বিপদে পড়ে এসেছ। তোমাকে সাহায্য করবার জন্যে চেষ্টা করলাম, এই পর্যন্ত। পারলাম ভালো, না পারলে বেটার লাক নেস্ট টাইম। কিন্তু পারি না। জানো, চেষ্টা করেও পারি না। বেচারা মার্কোপোলো। ওর জন্যে সত্যিই আমার দুঃখ হয়।

একটা অশিক্ষিত, আধা-ভাঁড়, দরিদ্র এবং অখ্যাত ফিরিঙ্গির মুখের দিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মুখের সিগারেট শেষ করে ভদ্রলোক। আর একটা সিগারেট ধরালেন। বদ্ধ ঘরের মধ্যে অনেকটা ধোঁয়া জমে অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

বায়রন বললেন, তোমার অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু জানালাটা খুলে দিলে এখনই চারপাশের বাড়ির আধপোড়া কয়লার ধোঁয়া ঢুকে অবস্থা আরও খারাপ করে তুলবে।

একটু থামলেন বায়রন। তারপর বললেন, জীবনটাই ওই রকম। নিজের দুঃখের ধোঁয়ায় কাতর হয়ে, বাইরে গিয়ে দেখেছি সেখানে আরও খারাপ অবস্থা। আমার দুঃখকে ছাপিয়ে, সে-দুঃখ জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। তুমি তো আইনপাড়ায় অনেকদিন ছিলে। জীবনকে তুমি তো শাজাহান হোটেলের রঙিন শো-কেসের মধ্য দিয়ে দেখোনি। মার্কোপোলো বেচারার ইতিহাস তোমার ভালো লাগবে।

বায়রন সায়েবের মুখে সেদিন মার্কোপোলোর কাহিনি শুনেছিলাম।

 

ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ভেনিসের অভিজাত বংশীয় যে সন্তান অজানার আহ্বানে কুবলাই খানের দরবারে হাজির হয়েছিলেন, এ-কাহিনি আমার কাছে তার মতোই চিত্তাকর্ষক মনে হয়েছিল।

বাইরে থেকে ওঁকে দেখলে খুবই সুখী মনে হয়, তাই না?

বায়রন সায়েব জিজ্ঞাসা করেছিলেন। দু হাজার টাকা মাইনের চাকরি।

দু হাজার টাকা! আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

আজ্ঞে হ্যাঁ। যুদ্ধের পর ইউরোপে একটা জিনিস হয়েছে, কাজের মানুষ আর বেশি বেঁচে নেই। যারা আছে, তাদের সস্তা দামে পাওয়া যায় না। বড় হোটেল ভালোভাবে চালাতে গেলে ওই মাইনেতে আজকাল ম্যানেজার পাওয়া যায় না। রেঙ্গুনে ভদ্রলোক এ ছাড়াও বিক্রির উপর কমিশন পেতেন।

কিন্তু মার্কোপোলোর জীবন চিরকাল কিছু এমন সুখের ছিল না। মিডল-ইস্টে এক গ্রিক সরাইওয়ালার ছেলে। বিদেশে বেশ কিছুদিন থেকে, সামান্য পয়সা জমিয়ে সরাইওয়ালা নবজাত শিশু এবং স্ত্রীকে নিয়ে দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু পথে দুঃখের অভিজ্ঞতা প্রস্তুত হয়ে ছিল। নানা জায়গা ঘুরতে ঘুরতে তারা আরবের এক শহরে হাজির হলেন। রাত্রি কাটাবার জন্যে ওঁরা শহরের এক হোটেলে ঘরভাড়া করলেন। কিন্তু সেই হোটেলের বিল তাদের শোধ করতে হয়নি; হোটেলের ঘর থেকে তাদের আর বেরিয়েও আসতে হয়নি। সেই রাত্রেই এক সর্বনাশা ভূমিকম্পে শহরটা ধ্বংস হয়ে যায়।

দেশ-বিদেশের লোকেরা প্রকৃতির এই অভিশপ্ত শহরকে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে এলেন। কয়েক হাজার লোক নাকি সেবার ধ্বংসস্তুপের নীচে চাপা পড়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে।

ওই শহর থেকে মাইল তিরিশেক দূরে একদল ইতালীয় পাদ্রি সেই সময় কাজ করছিলেন। তাঁবু ফেলে তারা চোখের চিকিৎসা করেন। দৃষ্টিহীনদের দৃষ্টিদানের জন্য পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানোই তাদের কাজ। দুটো রেডক্রশচিহ্নিত অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে মালপত্তর চড়িয়ে সার্কাস পার্টির মতো তাঁরা কোনো গ্রামে এসে হাজির হন। মাঠের মধ্যে তাঁবু পড়ে। আকাশে পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়। পোর্টেবল লোহার খাটগুলো জোড়া লাগিয়ে গোটা-পনেরো বিছানার ব্যবস্থা হয়ে যায়। আর-একটা ছোট তাঁবুর মধ্যে যন্ত্রপাতি সাজিয়ে তৈরি হয় অপারেশন থিয়েটার।

স্থানীয় দাতব্য প্রতিষ্ঠানদের আগে থেকে খবর দেওয়া থাকে। ঢাক বাজিয়ে, পোস্টার বিলিয়ে, দূর-দূরান্তে জানিয়ে দেওয়া হয়—অন্ধজনকে আলো দেবার জন্য ফাদাররা এসে গিয়েছেন। নদীর ধারে গ্রামের তাঁবুতে তারা দিন পনেরো থাকেন, বহু রকমের সর্বনাশা চোখের রোগের চিকিৎসা করেন, প্রয়োজন হলে অস্ত্রোপচার করেন। তারপর কাজ শেষ হলে ক্যাম্প

গুটিয়ে আবার অন্য গ্রামের দিকে রওনা হয়ে যান।

ভূমিকম্পের খবর পেয়ে ক্যাম্প থেকে ইতালীয় ফাদাররা ছুটে এলেন। ধ্বংসস্তুপ সরাতে গিয়ে তারা এক ইউরোপীয় শিশুকে আবিষ্কার করলেন। তারই অনতিদুরে শিশুর বাবা ও মার প্রাণহীন দেহ পাওয়া গেল।

পিতৃমাতৃহীন শিশুকে ফাদাররা সঙ্গে নিয়ে গেলেন। ইতালিতে ফিরে নিজেদের অনাথ আশ্রমে মানুষ করতে লাগলেন।

শিশুর নাম কী হবে? প্রধান পুরোহিত বললেন, এর ভ্রমণ যোগ আছে। কোথায় এর জন্ম, কোথায় একে আমরা আবিষ্কার করলাম, এবং কোথায় একে আমরা নিয়ে এলাম। এর একমাত্র নাম হতে পারে মার্কোপোলো।

ভ্রমণের ভক্ত ছিলেন বোধহয় সেই ফাদার, আর সেই সঙ্গে ইতিহাসেরও।

অন্য কেউ-ই তেমন আপত্তি করলেন না। ফলে বিংশ শতকে ইতালির ভৌগোলিক সীমানায় ভেনিসের মার্কোপোলো আবার জন্মগ্রহণ করলেন।

বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনাথ শিশুরা যাতে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে, সেদিকে ধর্মীয় পিতাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। মার্কোপোলোকে তারা পাঠালেন কলেজ অফ হোটেলিং-এ। এ-দেশে যার আর কিছু হয় না, সে হোমিওপ্যাথি করে, শর্টহ্যান্ড শেখে, নয় হিন্দু হোটেল খুলে বসে। ও-দেশে তা নয়। কন্টিনেন্টে লোকেরা, বিশেষ করে সুইশ এবং ইতালিয়ানরা, হোটেল ব্যবসাকে হালকাভাবে নেয়নি। হোটেল-বিজ্ঞানে পণ্ডিত হবার জন্য দেশ-বিদেশের ছাত্ররা এখানকার হোটেল-কলেজে পড়তে আসে। এই কলেজের ডিপ্লোমা এবং ডিগ্রি পাওয়া ছেলেদের পৃথিবীর সর্বপ্রান্তে বড় বড় হোটেলে দেখতে পাওয়া যায়।

এই একটি ব্যবসা, যেখানে ইংরেজরা বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারেনি। নিজেদের রাজত্ব এই কলকাতা শহরেই, দু-একটা ছাড়া সব হোটেল, এবং কনফেকশনারি দোকান কন্টিনেন্টের লোকদের হাতে ছিল। এবং যে দু-একটার মালিকানা ইংরেজদের ছিল, তাদের উপরের দিকের কর্মচারী সবই সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স কিংবা ইতালি থেকে আসত।

হোটেল-কলেজ থেকে পাস করে পিতৃমাতৃহীন নিঃসঙ্গ মার্কোপোলো চাকরির সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। পাস করলেই কিছু বড় চাকরি পাওয়া যায় না। অনেক নিচু থেকে আরম্ভ করতে হয়। আর কাজ শিখতেও সময় লাগে। হোটেলের লোকেরা বলেন, কিচেন জানতেই পাঁচ বছর লাগে। দু বছর শুধু মদের নাম-ধাম এবং জন্মপঞ্জী কণ্ঠস্থ করতে। অরাও দু বছর হিসেব-নিকেশ শিখতে। তারপর বাকি জীবনটা মানব-চরিত্রের রহস্য বুঝতে বুঝতেই কেটে যায়।

মার্কোপোলোর চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। চাকরির ধাপে ধাপে উঠতে উঠতে মার্কোপোলো একদিন কলকাতায় হাজির হলেন। যে-হোটেলের আন্ডারম্যানেজার হয়ে তিনি এখানে এসেছিলেন, অনন্ত-যৌবনা কলকাতার বুকের উপর সে-হোটেল এখনও নিয়ন ও নাইলনের ভিড়ে উচ্চকিত হয়ে রয়েছে।

ধর্মভীরু এবং কৃতজ্ঞ মার্কোপোলো তার জীবনদাতা রোমান ক্যাথলিক ফাদারদের ভোলেননি। প্রতি রবিবারে শত বাধা সত্ত্বেও চার্চে গিয়েছেন; তাঁর জীবন রক্ষার জন্য পরম পিতার উদ্দেশে শত-সহস্র প্রণাম জানিয়েছেন। সময় পেলে ওরই মধ্যে ট্রেনে করে ব্যান্ডেল চার্চে পর্যন্ত হাজির হয়েছেন।

ভার্জিন মেরীর মূর্তির সামনে রঙিন মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করেছেন। হোটেলে থেকে এবং বার-এর তদারক করে যে জীবনের মধ্যে তিনি ঢুকে পড়তে পারতেন, তার থেকে মার্কোপোলো নিজেকে সর্বদা সযত্নে দুরে সরিয়ে রেখে দিয়েছেন।

ওই সময়েই একজন মিস মনরোর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল। নিজের হোটেলের হই-হই হট্টগোল থেকে খানিকক্ষণ শান্তি পাবার জন্য মার্কোপোলো পার্ক স্ট্রিটের একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁয় রাত্রে খেতে গিয়েছিলেন। ওইখানেই সুশান মনরো গান গাইছিল।

মার্কোপোলোর গল্প বলতে বলতে বায়রন সায়েব এবার একটু থামলেন। টেবিল থেকে অ্যাটাচি কেসটা টেনে এনে, একটা পুরনো খবরের কাগজের টুকরো তার ভিতর থেকে বার করলেন। টুকরোটা সযত্নে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি তো অনেক জায়গায় ঘোরো। এই মেয়েটিকে কোনোদিন কোথাও দেখেছ?

জীবনে যত বিজাতীয় মেয়ে দেখেছি, তাদের সঙ্গে ছবিটা মিলিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই অমন কাউকে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না।

বায়রন বললেন, অনেক কষ্টে ছবিটা স্টেটসম্যান অফিস থেকে জোগাড় করেছি। সেই সময় একদিন রেস্তোরাঁর মালিক কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। সেই সংখ্যাটা টাকা দিয়ে কিনতে হল।

এই পুরনো খবরের কাগজ থেকে সুশান মনরোর সমস্ত রূপটা মানসপটে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। ভদ্রমহিলা দেখতে এমন কিছু সুন্দর ছিলেন না, বায়রন সায়েব বললেন।

কিন্তু মার্কোপোলোর মনে হল, মৃদুলতার একটা ছন্দিত ভঙ্গি যেন তার চোখের সামনে নেচে বেড়াচ্ছে।

ডিনার বন্ধ করে মন দিয়ে সুশান মনরোর গান শুনলেন মার্কোপোলো। গান শেষ হলে নিজের টেবিলে গায়িকাকে নিমন্ত্রণ করলেন।

কেমন গান শুনলেন? মিস মনরো ওঁর টেবিলের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করলেন।

চমৎকার! একদল বিশিষ্ট অন্ধ অতিথির সামনে, আপনি যেন অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের এক চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করলেন।

মেয়েটি হাসল। আস্তে আস্তে বললে, কী করব বলুন, সমজদার শ্রোতা কোথায় পাব?

এই শহরের সব লোক কি কালা? মার্কোপোলো হেসে জিজ্ঞাসা করলেন।

কালা, কিন্তু কানা নয়! চোখটা খুব সজাগ, দৃষ্টি খুবই প্রখর। এখানকার রেস্তোরাঁ মালিকরা তা জানেন, তাই শ্রোতব্য শব্দ থেকে গায়িকার দ্রষ্টব্য অংশের উপর বেশি জোর দেন।

দুজনের জন্যে দু বোতল বিয়ারের অর্ডার দিয়ে, মার্কোপোলো হেসে ফেলেছিলেন। মেয়েটিকে বলেছিলেন, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনি চমৎকার গাইতে পারেন; ইউরোপে এমন গান গাইলে আপনার কদর হত!

আপনাদের হোটেলে কোনো সুযোগ পাবার সম্ভাবনা আছে? মিস মনরো এবার জিজ্ঞাসা করলেন।

মার্কোপোলো চমকে উঠলেন, আমাকে চেনেন আপনি?

করুণ হেসে মেয়েটি বললে, ছোট জায়গায় গান গাই বলে, বড় জায়গার খবর রাখব না?

মার্কোপোলো এবার মুষড়ে পড়লেন। গভীর দুঃখের সঙ্গে বললেন, কিছু মনে করবেন না। কিন্তু আমাদের হোটেল যারা চালান এবং সেই হোটেলে যাঁরা আনন্দ করতে আসেন, মেম্ ইন ক্যালকাটা কোনো জিনিসের সঙ্গেই তারা সম্পর্ক রাখেন না। আমাদের হোটেলে নাচবার জন্যে, গাইবার জন্যে যাঁরা আসেন, তাঁরা মে ইন ইউরোপ, কিংবা মে ইন ইউ-এস-এ। এমন কি, মেম্ ইন টার্কি বা ইজিপ্ট হলেও তাদের আপত্তি নেই; কিন্তু কখনই কলকাতা নয়।

মেয়েটি গান গাইবার জন্য আবার উঠে পড়েছিল। বিয়ারের বোতল দুটো সরিয়ে রাখতে রাখতে বলেছিল, আপনার কোয়ায়েট ডিনারের যদি কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করে থাকি, তবে তার জন্যে ক্ষমা করবেন।

মার্কোপোললা সেইদিনই তার মধ্যবিত্ত হৃদয়টি পার্ক স্ট্রিটের অখ্যাত সুশান মনরোর কাছে বন্ধক দিয়ে ফেলেছিলেন।

পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় তাঁদের দুজনের আবার দেখা হয়েছে।

মার্কোপোলো সুশান মনরোর মনের ভিতর ঢোকবার চেষ্টা করেছেন। আপনি কোনোদিন কোনো ইস্কুলে গান শেখেননি? বলেন কী? র নেচার। নিজের খেয়ালে নেচার এমন সংগীতের কণ্ঠ সৃষ্টি করেছে? মার্কোপোলো অবাক হয়ে গিয়েছেন।

শিখব কোথা থেকে? গানের ইস্কুলে যেতে গেলে তো পয়সার দরকার হয়, সুশান বলেছিল।

মার্কোপোলো ক্রমশ সব শুনেছিলেন। প্রথমে পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয়, পরে সুশানের ঘরে বসে মার্কোপোলো শুনেছেন, সুশানের ভাগ্য অনেকখানি মার্কোপোলোর মতো। বাবা-মা কেউ ছিল না। এ-পি-সি-আই মানুষ করেছিল। অনাথা মেয়েকে সমাজের উপযোগী করে গড়ে তোলবার জন্যে ওঁরা কোনোরকম কার্পণ্য করেননি। সাবালিকা হয়ে সুশান নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছে। প্রথমে নিউ মার্কেটের কাছে এক সুইশ কনফেকশনারির দোকানে কেক বিক্রি করত। কিন্তু গানের নেশা। প্রচারের লোভ। বিনা পয়সায় রাত্রে রেস্তোরাঁয় গান গাইতেও সে প্রস্তুত।

অনেক কষ্টে সুশান এইখানে ঢুকেছে। প্রথমে বেশ কষ্ট হত। সারাদিন দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেক বিক্রি করে, সোজা এখানে চলে আসতে হয়। এখানেই জামাকাপড় বদলিয়ে সে তৈরি হয়ে নেয়; বাড়িতে ফিরে যাবার সময় থাকে না। অথচ এমন প্রমোদনিকেতন যে লেডিজ টয়লেট-এর কোনো ব্যবস্থা নেই। একজন চাপরাশিকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে বারোয়ারি ল্যাভেটরি ব্যবহার করতে হয়। দুর্গন্ধে মাঝে মাঝে বমি হয়ে যাবার অবস্থা হয়।

এরা তোমায় কিছুই দেয় না? মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করেছেন।

রাত্রের খাওয়াটা পাওয়া যায়। আর মাসে দশ টাকা। সুশান বলেছে।

মাত্র দশ টাকা! ডিসগ্রেসফুল। ছারপোকার জাত এরা! মার্কোপোলো উত্তেজিত হয়ে বলেছেন।

তা-ও বা কদিন? সুশান বিষণ্ণভাবে বলেছে। মানে? মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করেছেন।

এখানে যে গান গাইত, তার নাম লিজা। পা ভেঙে সে বিছানায় পড়ে রয়েছে, তাই আমাকে গান গাইতে দিয়েছে। ডাক্তার লিজার পায়ের প্লাস্টারটা খুলে দিলেই আমার দিন শেষ হয়ে যাবে।

সুশানের জন্য মার্কোপোলো দুঃখ অনুভব করেছেন। ওরও যে বাবা-মা ছিল না, ভাবতেই সুশানের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ অনুভব করেছেন। রূপ তার তেমন ছিল না। যৌবন হয়তো ছিল; কিন্তু কেবল যৌবনের সেই পাতলা দড়ি দিয়ে মার্কোর মতো সমুদ্রগামী জাহাজকে বেঁধে রাখা সুশানের পক্ষে নিশ্চয়ই সম্ভব হত না।

কিন্তু মার্কোপোলো নিজেই ধরা দিলেন। বাঁধা পড়লেন। স্বেচ্ছায় একদিন সুশানকে বধূরূপে হোটেলে এনে তুললেন।

 

এই সুশানের জন্যই মার্কোপোলোকে শেষ পর্যন্ত কলকাতা ছাড়তে হল। এখানে ওকে সবাই জেনে গিয়েছে। এখানে থেকে ওর পক্ষে বড় হওয়া সম্ভব নয়। পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় যে একবার নিজের গান বিক্রি করেছে, তার পক্ষে চৌরঙ্গীর জাতে ওঠা আর সম্ভব নয়।

চেষ্টা করে রেঙ্গুনে চাকরি জোগাড় করলেন মার্কোপোলো। ম্যানেজারের চাকরি। এবার ওঁদের আর কোনো দুশ্চিন্তার কারণ থাকবে না। সেখানের কেউ আর সুশানের পুরনো ইতিহাস খুঁজে পাবে না।

কলকাতার হোটেলওয়ালারা মার্কোপোলোকে বলেছিল, এত ব্যস্ত কেন, এখানেই একদিন তুমি ম্যানেজার হবে।

মার্কোপোলো হেসে ফেলেছিলেন। কলকাতা আমার শ্বশুরবাড়ি বটে, কিন্তু বাপের বাড়ি নয়। আমার কাছে রেঙ্গুনও যা কলকাতাও তাই।

কিছুদিন ওখানে মন্দ কাটেনি। সুশান তার স্বপ্ন আর মার্কো তার চাকরি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। হোটেলটাকে ছবির মতো করে সাজিয়ে তুলবেন। বিদেশি আগন্তুকরা এসে অবাক হয়ে যাবেন। বার্মাতে যে এমন হোটেল থাকা সম্ভব, ভেবে পাবেন না।

কিন্তু রেঙ্গুনের আকাশে একদিন ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমান দেখা গেল। জাপানিরা আসছে।

বার্মা ইকুয়েশন। এমন যে হতে পারে, কেউ জানত না। এমন অবস্থার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না—মার্কোপোলোও না।

শেষ কপর্দকটি পর্যন্ত রাস্তায় হারিয়ে ওঁরা দুজন কলকাতায় ফিরে এলেন। এর আগেও, শৈশবে মার্কোপোলো একবার রিফিউজি হয়েছিলেন। কিন্তু তখন অন্যজনের করুণায় জীবন রক্ষা হয়েছিল। এখন নিজের ছাড়াও আর একটা জীবন-সুশানের জীবন-তার উপর নির্ভর করছে।

যাঁরা একদিন তাকে রাখবার জন্য পেড়াপাড়ি করেছিলেন, তারাই আজ মুখ ফিরিয়ে নিলেন, তার উপর ইতালীয় গন্ধ আছে বলে অনেকে নাক সিটকাল। ইতালিয় বলে মার্কোকে কলকাতার লোকেরা হয়তো জেলখানায় পাঠাত, যদি না তাঁর পকেটে গ্রিক পাসপোর্ট থাকত। ফাদারেরা ওই একটি দুরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন—নাম পালটালেও, তাঁরা মার্কোর জাত পালটাননি।

কলকাতার বাজারে মার্কোপোলোর দাম নেই; কিন্তু সুশানের চাহিদা বেড়েছে। হাজার হাজার ইংরেজ এবং আমেরিকান সৈন্যে দেশটা ভরে গিয়েছে। তারা রেস্তোরাঁয় খেতে চায়; এবং খেতে খেতে গান শুনতে চায়।

মার্কোপোলো আপত্তি করেছিলেন। ওইভাবে গান গাইলে, তুমি কোনোদিন আর জাতে উঠতে পারবে না। তোমাকে যে অনেক বড় হতে হবে। একদিন বিশ্বসুদ্ধ লোক তোমার গান শুনতে চাইবে; তোমার রেকর্ড ঘরে ঘরে বাজবে।

সুশান বললে, কিন্তু ততদিন? ততদিন কি না খেয়ে থাকব? যারা একদিন দশ টাকা দিতে চায়নি তারাই পঁচিশ টাকা নিয়ে সাধাসাধি করছে। লিজা পালিয়েছে ওখান থেকে। গান না থাকলে, মিলিটারিরা খেপে যাবে।

বাধ্য হয়েই রাজি হয়েছিলেন মার্কোপোলো। যে-স্বামীর খাওয়াবার মুরোদ নেই, তার তো ফোঁস দেখিয়ে লাভ নেই।

মার্কোপোলো নিজের চাকরি খুঁজছেন। আর সুশান গান গাইছে।

একদিন সুশান বললে, একটা ঘড়ি কিনেছি জানো?

টাকা পেলে কোথায়?

সুশান বলে, টাকার অভাব নেই। আমার গান শুনে খুশি হয়ে একদল আমেরিকান অফিসার সেদিন সঁদা তুলে ঘড়ির দাম জোগাড় করে দিয়েছে।

মার্কোপোলো বলেছেন, হুঁ।

এত রাত করে বাড়ি ফের তুমি, আমার ভয় লাগে। মার্কোপোলো বলেছেন।

আগে লাইসেন্স ছিল দশটা পর্যন্ত। এখন কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। রাত একটা পর্যন্ত গান গাইতে হয়।

তোমার কষ্ট হয় না? সুশান, এমন গান গাইতে তোমার ভালো লাগে? মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করেন।

কিন্তু ওরা যে টাকা দেয়। অনেক টাকা দেয়, জানো? ক্লান্ত সুশান উত্তর দিয়েছে।

সুশান বলেছে, তোমার জন্য একটা চাকরি জোগাড় করছি। করবে? লিলুয়া মিলিটারি ক্যানটিনের ম্যানেজার। আমার স্বামী শুনে ওরা খুব আগ্রহ দেখিয়েছে। মেজর স্যানন আগামিকাল তোমার সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপ করতে আসবেন।

মার্কোপোলোর বাধাবন্ধহীন আদিম গ্রিক রক্ত যেন গরম হয়ে উঠেছিল। তোমার-গান-গাওয়া-পরিচয়ের চাকরি? করুণা?

করুণায় এত ঘৃণা কেন? করুণায় তো ছোটবেলা থেকে এত বড় হয়েছ? সুশান সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল।

উত্তর দেননি মার্কোপোলো, মেজর স্যাননের আসবার সময় বাড়ি থেকে তিনি বেরিয়ে গিয়েছেন। এক বোতল বীয়ার নিয়ে মার্কোর জন অপেক্ষা করে মেজর স্যানন শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে ফিরে গিয়েছেন।

কিছুদিন পরে সুশান বলেছে, দুপুরেও একটা সুযোগ পাচ্ছি। লাঞ্চের সময় গাইবার জন্য ম্যানেজমেন্ট ধরাধরি করছে। আরও শ তিনেক টাকা বেশি দেবে।

মার্কোপোলো উত্তর দেননি। পরে একদিন জিজ্ঞাসা করেছেন, এইজন্যই কী তুমি গানের সাধনা করেছিলে, সুশান?

যারা গান যায়, তাদের স্বপ্ন কী? সুশান পালটা প্রশ্ন করেছে। এবং মার্কোর জবাবের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই উত্তর দিয়েছে, তারা চায় জনপ্রিয়তা। তা আমি পেয়েছি। আমি পপুলার।

একটা চাকরির সন্ধানে মার্কোপোলো পাটনায় গেলেন। চাকরি পেলেন, কিন্তু সেখানে মন ভরল না। পাটনা থেকে সোজা করাচি। ওখানকার একটা বড় হোটেলে অবশেষে চাকরি পাওয়া গিয়েছে।

চাকরি পেয়ে করাচি থেকে সুশানকে মার্কোপোলো চিঠি লিখেছেন। সুশান লিখেছে, দিন-রাত্তির যে কোথা দিয়ে কেটে যাচ্ছে জানি না। সবসময় শুধু গান গাইছি। পৃথিবীর লোকেরা এত গান ভালোবাসে!

মার্কোপোলো লিখেছেন, এখানকার পরিবেশটা সুন্দর। তোমার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। তাছাড়া শহর কলকাতা থেকে অনেক সাজানো-গোছানো। জাপানি বোমা পড়বার ভয়ও নেই।

সুশান লিখেছে, কলকাতার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। যারা একদিন দশ টাকা দিত না, তারাই হাজার টাকা দিচ্ছে। আর একটা রেস্টুরেন্ট আরও বেশি লোভ দেখাচ্ছে।

মার্কোপোলো লিখেছেন, তোমার জন্য মন কেমন করছে!

সুশান উত্তর দিয়েছে, ছুটি নিয়ে চলে এস। বড়জোর কয়েকদিনের মাইনে দেবে না।

করাচি থেকে চিঠি এসেছে, নতুন চাকরি; ছুটি নেব বললেই নেওয়া যায় না। হোটেলে অতিথি বোঝাই। অথচ দায়িত্বসম্পন্ন লোকের অভাব। তার থেকে তুমি চলে এস। গাইয়েদেরও তো বিশ্রাম দরকার!

কলকাতা থেকে উত্তর গিয়েছে, তোমার চিঠি পেলাম। আমেরিকান বেস-এ গান গাইবার জন্য বিশেষভাবে নিমন্ত্রিত হয়ে ছসপ্তাহের জন্য ভ্রমণে বেরোচ্ছি। স্যরি।

ছুটির চেষ্টা করেছেন মার্কোপোলো। কিন্তু পাননি। যখন ছুটি মিলল, তখন একটা বছর কোথা দিয়ে কেটে গিয়েছে।

ছুটিতে কলকাতায় এসে মার্কোপোল অবাক হয়ে গিয়েছেন। তার স্ত্রীর বাড়িঘরদোর কিছুই চেনা যাচ্ছে না। যে-বাজারে গাড়ির একটা টায়ার পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না, সেই বাজারে গাড়ি কিনেছে সুশান!

আমাকে জানাওনি তো। মার্কোপোলো বলেছেন।

ওহহা স্যরি, তোমাকে জানানো হয়নি। খুব সস্তায় পেয়ে গিয়েছি। মেজর স্যানন জোগাড় করে দিয়েছেন।

নিজের চোখে মার্কোপোলো যা দেখলেন, তা তার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। টাকা…সস্তা কেরিয়ার…সুশানের কাছে ওইগুলোই বড় হল? নিজের শিল্পের কথা, নিজের সাধনার কথা একবার ভেবে দেখলে না।

কিন্তু উপদেশ বর্ষণ করে লাভ কী? বাঘিনি রক্তের আস্বাদ পেয়েছে। সুশানের বাড়ির সামনে মিলিটারি অফিসারদের গাড়িগুলো প্রায় সর্বদাই দাঁড়িয়ে রয়েছে।

একান্তে সুশানকে ডেকে মার্কোপোলো বলেছেন, তুমি কি আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখেছ?

নিশ্চয় দেখেছি, রোজই দেখছি। একটু মোটা হয়েছি, এই যা। সুশান উত্তর দিয়েছে।

তোমার চোখ দুটো?

একটু বসে গিয়েছে। এমন পরিশ্রম করলে ম্যাডোনারও চোখ বসে যেত।

তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, আমাকে জানতে হবে সুশান। মার্কোপোলো গম্ভীরভাবে বলেছেন।

ভেরি ব্রাইট প্ল্যান, সুশান উত্তর দিয়েছে। রেস্তোরাঁর চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি। ওতে লস। তার থেকে থিয়েটার রোডের এই বাড়িটাতে বসে বসে গান গাইব, সঙ্গে কিছু খাবার ব্যবস্থা থাকবে। মেজর স্যানন একটা বার লাইসেন্স জোগাড় করে দেবেন কথা দিয়েছেন। যাকে তাকে আমি বাড়িতে ঢুকতে দেব না। শুধু সিলেক্টেড গেস্টদের আপ্যায়ন করব। আর তুমি যদি সব দেখাশোনার দায়িত্ব নাও, তাহলে আমি নিশ্চিন্তে গান নিয়ে পড়ে থাকতে পারি।

হোয়াট? সুইস কলেজ অব কেটারারস থেকে পাস করে আমি কৰ্গার্লের ম্যানেজার হব! গড় হেল্প মি!

সেই রাত্রেই মার্কোপোলো বুঝেছিলেন, আর হবে না।

ঘৃণায় ধর্মভীরু মার্কোপোলোর সর্বাঙ্গ রি রি করে উঠেছিল। গভীর রাত্রে থিয়েটার রোডের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে পরমপিতাকে মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করেছেন, কেন এমন হল? এমন শাস্তি তাকে কেন পেতে হল?

ভোরবেলায়, ব্রেকফাস্ট টেবিলে মার্কোপোলো সুশানকে জানিয়ে দিলেন, আর এক সঙ্গে নয়, এবার ছাড়াছাড়ি।

ডাইভোর্স! সুশান প্রথমে রাজি হয়নি। আমার হাজব্যান্ড আছে বলে, আনডিজায়ারেবল এলিমেন্টরা ডিসটার্ব করতে সাহস পায় না। আমেরিকান মিলিটারি পুলিসও আমার ফ্ল্যাটে অফিসারদের যাতায়াতে বাধা দেয় না। আমার সম্মানজনক পেশাটা নষ্ট না করলে, তোমার বুঝি রাত্রে ঘুম হচ্ছে না?

বিচ্ছেদ তো হয়েই রয়েছে। এবার কেবল আইনের স্বীকৃতি। মার্কোপোলো বলেছেন।

তার মানে তুমি কোর্টে আমার নামে অ্যাডালটারির অভিযোগ আনবে? তুমি বলবে, আমি পরপুরুষে আসক্ত?

এ-দেশের চার্চে বিয়ে হলেও, এ-দেশের আইন জানবার সময় বা সুযোগ কোনোটাই মার্কোপোলোর ভাগ্যে জোটেনি। এদিকে ছুটি ফুরিয়ে আসছে। যা-হয় একটা কিছু করে, এই পাপের শহর থেকে চিরদিনের মতো পালিয়ে যাবেন বিদেশি মার্কোপোলো।

আইনের পরামর্শ নিলেন তিনি। ডাইভোর্স চাইলেই পাওয়া যায় না। এর জন্য কাঠ খড় ছাড়াও সময় এবং অর্থ পোড়াতে হবে। যিনি বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রার্থনা করবেন তাঁকে উপস্থিত থাকতে হবে, প্রয়োজনীয় সাক্ষীসাবুদ কোর্টে হাজির করতে হবে।

কতদিন সময় লাগবে? মার্কোপোলো খোঁজ নিয়েছিলেন।

তা কেউ বলতে পারে না। দেড় বছর দু বছরও লেগে যেতে পারে, অ্যাটর্নি বলেছিলেন।

শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছিল, কাজের সুবিধার জন্যে সুশানই মামলাটা দায়ের করবে। স্বামীর বিরুদ্ধে সে চরিত্রহীনতার অভিযোগ আনবে। তাতে সুশানের সম্মানও রক্ষা পাবে; আর মার্কোও যা চাইছেন তা পাবেন। সুদূর কর্মক্ষেত্র থেকে তিনি মামলায় কোনো অংশগ্রহণ করবেন না, ফলে সহজেই একতরফা ডিক্রি হয়ে যাবে।

যাবার আগে সুশানের সঙ্গে মার্কো সব আলোচনা করেছিলেন। সুশানের মোটেই ইচ্ছে ছিল না। বিবাহিত ছাপটা থাকলে এ-কাজের সুবিধে হয়। সুশানের হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে মার্কো বলেছেন, যদি কোনোদিন তোমাকে ভালোবেসে থাকি তবে তার প্রতিদানে তুমি আমাকে এইটুকু অনুগ্রহ কোরো।

সুশান বলেছে, কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে চরিত্রহীনতার কী অভিযোগ আনব? তোমার নামের সঙ্গে কার নাম জড়াব?

মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন মার্কো। এমন কোনো মহিলা আছেন, যিনি ডাইভোর্স মামলায় কো-রেসপনডেন্ট হতে রাজি হবেন?

শেষ পর্যন্ত সুশান বলেছে, লিজাকে বলে দেখতে পারি। ওর তো সমাজে সম্মান হারানোর ভয় নেই। তাছাড়া, এক সময় ওর অনেক উপকারও করেছি।

কয়েকদিন পরে সুশান বলেছে, লিজার সঙ্গে কথা বলেছি। সে বলেছে, যার সঙ্গে গোপন অভিসারের অভিযোগ আনবে তাকে একটু দেখে রাখতে চাই!

ভোরবেলায় সুশানকে সঙ্গে করে মার্কো লিজার বাড়িতে হাজির হয়েছেন। সারারাত জেগে থেকে, লিজা তখন সবেমাত্র ঘুমোতে আরম্ভ করেছিল। ওদের ডাকে সে ঘুম থেকে উঠল।

দুজনকে একসঙ্গে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠেছে, ও-বাবা, পতিব্রতা স্ত্রী এবং চরিত্রহীন স্বামী জোড়ে হাজির!

মার্কো তখন লিজাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছেন! লিজা বলেছে, বোঝাতে হবে না। একটা পরীক্ষায় আগেই পাস করে এসেছি। আমার নিজের ডাইভোর্স কেষ্টা তো এই কোর্টেই হয়েছিল।

সুশান বলেছে, আইনের অত মারপ্যাচ বুঝি না। কী করতে হবে বলে দাও।

মার্কো এবার লিজাকে বললেন, সুশান আদালতে অভিযোগ আনবে যে সে-ই আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।

সরু গলায় লিজা খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। সেটা তো মিথ্যে নয়।

ও-ই তো আপনার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলে।

মার্কোপোলো বললেন, তারপর কয়েকটা বিশেষ দিনে-ধরুন চার কিংবা পাঁচদিন—সুশান দিনগুলো তোমার নোটবুকে লিখে নাও, আমাকে এইখানে.. পরের কথাগুলো বলতে মার্কোর সঙ্কোচ হচ্ছিল।

রাত্রিবাস করতে দেখা গিয়েছিল? এই তো, লিজা এবার হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।

আর আপনাকে আমি কয়েকটা চিঠি লিখব, উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে। আপনি তার ভাষা সম্বন্ধে কিছু মনে করবেন না। শুধু চিঠিগুলো পেয়েই খামসমেত সুশানের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। ওইগুলোই হবে প্রয়োজনীয় প্রমাণ। আর আপনি যদি আমাকে দু একটা লেখেন তাহলে তো খুবই ভালো হয়। আর কোনো চিন্তারই কারণ থাকে না। মার্কো কোনোরকমে বললেন।

আর কিছু? লিজা সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞাসা করলে।

আর, কোনো রেস্তোরাঁয় যদি আমাদের কিছুক্ষণ একসঙ্গে দেখা যায়, মন্দ হয় না। মার্কোপোলো মুখ বিকৃত করে বললেন।

লিজার হাসি এবার বীভৎস রূপ ধারণ করল। হাসতে হাসতে সে আবার বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। বালিসে মুখ গুঁজে সে হাসি চাপা দেবার চেষ্টা করতে লাগল। তারপর কাশতে কাশতে বলল, পুরো অভিনয়। ভেরি ইন্টারেস্টিং!

উত্তর না-দিয়ে মার্কো গম্ভীরভাবে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।

লিজা বললে, বেশ, আজই সন্ধেতে দুজনে কিছুটা সময় কাটানো যাবে।

মার্কো বললেন, অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনেই আপনার কাছে চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকব।

লিজা এবার সোজা হয়ে বসল। কী যেন ভাবল। তারপর থিয়েটারি কায়দায় বললে, হে কৃতজ্ঞ পুরুষোত্তম, তুমি কি অনুগ্রহ করে এক মিনিটের জন্য এই অধমা নারীর ঘরের বাইরে অপেক্ষা করবে? তোমার সর্বগুণান্বিতা সাধ্বী স্ত্রী মুহূর্তের মধ্যেই তোমার অনুগামিনী হবেন।

দরজার বাইরে মার্কো কিছুক্ষণ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। এক মিনিটের জায়গায় প্রায় দশ মিনিট কেটে গেল। তারপর সুশান ঘর থেকে

বেরিয়ে এল।

বাড়িতে এসে সুশান জিজ্ঞাসা করল, কত টাকা তুমি খরচ করতে পারবে?।

আমার আর্থিক অবস্থার কথা তোমার তো কিছু জানতে বাকি নেই। মার্কোপোলো বললেন।

লিজা টাকা চাইছে। বলছে, শুধু শুধু এই সব গণ্ডগোলে সে কেন যাবে? সুশান বললে।

মার্কো কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর অত্যন্ত সঙ্কোচের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার পক্ষে কোনোরকম সাহায্য করা।

সুশান রেগে উঠল। তুমি আমার মত জানো। তুমি করাচিতে রইলে, আমি এখানে-বিচ্ছেদ তো এমনিই হল। তা সত্ত্বেও তুমি যদি ডাইভোর্সের লাক্সারি উপভোগ করতে চাও, তাহলে তোমাকেই টাকা খরচ করতে হবে।

কত টাকা চাইছে? মার্কো জিজ্ঞাসা করেছেন।

দু হাজার।

এমন অবস্থায় কোনোদিন যে তাকে পড়তে হবে, মার্কো কখনও ভাবেননি। বিকেল বেলায় একটা রেস্তোরাঁয় বসে বসে মার্কো গোটা কয়েক কাল্পনিক গোপন চিঠি লিখেছেন লিজাকে। পৃথিবীতে আইনের নামে কী হয়, ভাবতে মার্কোর দেহটা রি রি করে উঠেছে।

সন্ধ্যাবেলায় লিজার বাড়িতে গিয়ে মার্কো কড়া নেড়েছেন। ভিতর থেকে লিজা বললে, ও ডার্লিং, তুমি তা হলে এসেছ! আর এক মিনিট। আমি প্রায় রেডি।

সেই এক মিনিট ওয়েলেসলির ওই নোংরা গলিটার বদ্ধ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মার্কো নিজেকে অভিশাপ দিয়েছে।

দরজা খুলে লিজা এবার বেরিয়ে এল। লিজাকে যেন চেনাই যায় না। সত্যই বারোয়ারি অভিসারে চলেছে যেন সে। কী উগ্র প্রসাধন! সস্তা সেন্টের গন্ধে গা ঘুলিয়ে ওঠার অবস্থা। পুরো এক টিন পাউডারই লিজা বোধহয় আজ মুখে মেখেছে। তার উপর আবার লাল রং।

রাস্তায় বেরিয়ে এসে ট্যাক্সি ডাকলেন মার্কো। ট্যাক্সিতে চড়ে বললেন, কোথায় যাবেন? চাঙ্গুয়া?

না। আজ বড় কোথাও যাব, লিজা বলেছে। তাহলে গ্র্যান্ড কিংবা গ্রেট ইস্টার্নে? মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করেছেন। লিজা আপত্তি জানিয়ে মাথা নাড়ল। আজ লিজার মন নাচছে শাজাহান হোটেলের জন্য। সৈন্যবাহিনীর লোকরা ডাইনিং হল্টা হয়তো বোঝাই করে রেখে দিয়েছে, তবু চেষ্টা করে একটা জায়গা করে নেওয়া যাবে।

হোটেল শাজাহান। অনেকদিন আগে লিজা ওখানে এসেছিল। সত্য বলে মনে হয় না, যেন ড্রিমল্যান্ড। সাত টাকা আট আনা একটা ডিনারে নেয় বটে, কিন্তু অদ্ভুত। একটা মেনুকার্ড চুরি করে এনেছিল লিজা। কতদিন রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে লিজা সেই কার্ডটা পড়েছে-Pamplemous a Sajahan; Couson Ajoblanco Beckti Allenby, Barot dvos Roti, Gateau Citrol, Cafe Noir

আরও কত কী!

শাজাহান হোটেলের নীলাভ আলোয় রাত্রি তখন দিন হয়ে উঠেছিল। হোটেলের অতিথি হয়ে কেমন যেন লাগছিল। অভিনেতা যখন দর্শক হয়ে নাটক দেখেন তখন মনের অবস্থা বোধহয় এমনই হয়।

মদ খেতে চেয়েছিল লিজা। মদের অর্ডার দিয়েছিলেন মার্কোপোলো। ব্র ককটেল—জিন, ফ্রেঞ্চ ভারমুথ, ইটালিয়ান ভারমুথ আর কমলালেবুর রস। সাড়ে পাঁচ টাকা পেগ।

ব্রঁ ককটেল শেষ করে কাঁচা হুইস্কি। মদ খেতে খেতে লিজা বলেছিল, আই অ্যাম স্যরি। আপনাকে বন্ধুর মতো সাহায্য করতে পারলাম না। টাকাটা আমার প্রয়োজন। আমার দিনকাল সুশানের মতো ভালো নয়। আর তা ছাড়া সুশানের যখন অনেক টাকা রয়েছে, তখন কেন সে দেবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, যেমন বলেছেন ঠিক তেমন কাজ করব।

লিজা এবার মার্কোর মুখের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণভাবে হাসল। হাসতে তবে যেন ওর বয়সটা বোঝা গেল। ওর চোখের কোলে কালো দাগগুলো দেখলে, যত বয়স মনে হয়, আসলে তার থেকে অনেক বয়স কম।

লিজা নিজেই বললে, সেই যে পিছলে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছিলাম এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হলাম না। মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। বেশিক্ষণ মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান গাইতে পারি না। সেদিন একজন কাস্টমার চিঙ্কার করে কী বললেন, জানেন?

কী? ইচ্ছে না থাকলেও মার্কোকে জিজ্ঞাসা করতে হল। খু

ড়ি এবং বুড়ি। বেঙ্গলি কাস্টমারগুলোনরকের ডাস্টবিন।

আর একটু হুইস্কি গলায় ঢেলে লিজা বললে, ঠিক করেছি, এবার থেকে কর্পোরেশনের বার্থ সার্টিফিকেটটা সব সময় বডিসের মধ্যে রেখে দেব। কেউ কিছু বললে, সার্টিফিকেটটা বার করে মুখের উপর ছুঁড়ে দেব।

উত্তর না দিয়ে মার্কো কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর বললেন, আপনি হয়তো জানেন না, এই কেসের জন্যে আমি একটা পয়সাও সুশানের কাছ থেকে নিচ্ছি না।

সিলি ওল্ড ফুল। তুমি এখনও বোকা রয়ে গেছ। তোমার কিছু বুদ্ধি হয়নি। মদের গেলাসটা চেপে ধরে লিজা বলেছিল।

মার্কো সেই রাত্রেই লিজাকে এক হাজার টাকা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আর সামান্য যা আছে, তা অ্যাটর্নিকে দিয়ে যেতে হবে। ওখানে ফিরে গিয়ে আপনাকে আবার কিছু পাঠাব।

মামলার খরচের টাকাও অ্যাটর্নির ঘরে জমা পড়েছিল। চরিত্রহীনতার অভিযোগে মার্কোপোলোর বিরুদ্ধে সুশানের বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন আদালতে পেশ করাও হয়েছিল।

আবেদন সই করবার দিনে অ্যাটর্নি বলেছিলেন, একটা ব্যাপারে আপনাদের সাবধান করে দেওয়া প্রয়োজন। পিটিশনে বলতে হয়, ডাইভোর্স পাবার জন্য দুপক্ষের মধ্যে কোনো যোগ-সাজশ নেই। আমরা বলি কলিউশন। যদি কোর্ট একবার সন্দেহ করেন এর পিছনে সাজানো কোনো ব্যবস্থা আছে তা হলেই বিপদ। কেউ যেন না জানে, মামলা করবার জন্য সুশানের টাকা আপনি দিয়ে গিয়েছেন। আজ থেকে আমরা আমাদের মক্কেল হিসেবে সুশানকেই শুধু চিনি; আপনাকে আমরা দেখিনি, জানি না। ভুলেও আমাদের কাছে কোনো চিঠি-পত্তর লিখবেন না।

এই পর্যন্ত বলে বায়রন একটু থামলেন। এলিট রোড থেকে বেরুনো একটা নোংরা গলির অপরিচিত পরিবেশে যে বসে আছি তা ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন আধুনিক মার্কোপোলোর দুঃখের ইতিহাসের ছবি মেট্রো সিনেমাতে দেখছিলাম।

বায়রন সায়েব বললেন, এর পরের ঘটনার জন্যে সত্যি দুঃখ হয়। মার্কোপোলো যদি তখন আপনার সায়েবের কাছে যেতেন।

লাভ হত না। আমি বললাম। স্বামী-স্ত্রীর যোগ-সাজশের মামলা তিনি কিছুতেই নিতেন না।

তা হয়তো নিতেন না। কিন্তু অন্য একটা পথ বাতলে দিতেন। বায়রন সায়েব বললেন।

তা হয়তো পারতেন। আমি বললাম।

যা হোক, কাটা দুধের জন্য শোকাশ্রু বিসর্জন করে লাভ কী? যা হয়েছিল তাই বলি—

কলকাতার ব্যবস্থা মোটামুটি পাকা করে মার্কোপোলো নিজের কর্মস্থানে ফিরে গিয়েছিলেন। অনেক কষ্টে পাঁচশ টাকা জোগাড় করে লিজাকে পাঠিয়েছিলেন; এবং অদূরভবিষ্যতে বাকিটা পাঠাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। চিঠি লিখে খোঁজ নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না। এমন কোনো বন্ধুও ছিল না, যে সমস্ত খবরাখবর জানাবে।

সুশান অবশ্য একবার চিঠি দিয়েছিল। জানিয়েছিল, আর একটা ভালো গাড়ি কিনেছে সে। এবং যে কাজের জন্য মার্কো এত উদ্বিগ্ন আছে, তাও এগুচ্ছে। তবে অ্যাটর্নি কিছু টাকা চেয়েছে।

ধার করে মার্কো সুশানের ঠিকানায় কিছু টাকাও পাঠিয়েছিলেন। তারপরেই বিপদটা ঘটল।

তাঁকে হঠাৎ পুলিসে ধরল। ওঁর ইটালিয়ান গন্ধ এতদিন পরে হঠাৎ কর্তৃপক্ষকে আবার সচেতন করে তুলল। আর ইটালির সঙ্গে মিত্রপক্ষের তখন কী রকম সম্পর্ক সে তো জানোই।

যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছিল মার্কোপোলোকে। জীবনে ধিক্কার জন্মে গিয়েছিল। ছাড়া পেয়ে সোজা ফিরে গিয়েছেন ইটালিতে। অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো মানসিক অবস্থা মার্কোর তখন ছিল। রিভিয়েরায় ছোটখাট কাজ করে কোনোরকমে জীবনধারণ করছিলেন।

তারপর হঠাৎ একদিন মনে পড়ল জীবনের হিসেব-নিকেশে কোথায় যেন একটা বড় ভুল জট পাকিয়ে রয়েছে। লেজারের একটা মোটা অঙ্ক মধ্যপ্রাচ্যে এক অভিশপ্ত নগরীতে সাসপেন্স অ্যাকাউন্টে পড়ে রয়েছে। জীবন সম্বন্ধে প্রবল অভিযোগে মার্কোপোলোর নিঃসঙ্গ অন্তর যেন দপ করে জ্বলে উঠল।

চাকরির চেষ্টা আরম্ভ করলেন, প্রথমে রেঙ্গুনের একটা হোটেলে। লোকের অভাব, ওরা অনেক টাকা মাইনেতে তাকে নিয়ে গেল। কিন্তু রেঙ্গুনে থাকবার জন্য তিনি তো ইটালিয়ান রিভিয়েরা ছেড়ে আসেননি। ওখানে কিছুদিন চাকরি করে, আবার চেষ্টা করতে লাগলেন।

এবার কেন্দ্র কলকাতা। শাজাহান হোটেলের ম্যানেজারের চাকরি খালি ছিল। মালিকরা তাঁর মতো লোক পেয়ে আদর করে নিয়েছেন।

কিন্তু কোথায় সুশান? কোথায় সেই ডাইভোর্স মামলা?

কলকাতার বিশাল জনারণ্যে যুদ্ধের সময় হঠাৎ জ্বলে-ওঠা একটা মেয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। অ্যাটর্নি আপিসে খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন। ওরা কিছু বলতে রাজি হয়নি। পুরনো অ্যাটর্নি নিজের শেয়ার পার্টনারকে বিক্রি করে দিয়ে, ব্রহ্মাণ্ডের বৃহত্তম পার্টনারের সঙ্গে হাত মেলাবার জন্য জীবনের ওপারে চলে গিয়েছেন।

কোর্টে খোঁজ নিয়েছিলেন। এই নামে কোনো ডাইভোর্স অর্ডার হয়নি। বায়রন এবার থামলেন।

তারপর? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

তারপরই আমার ডাক পড়েছে। চেষ্টা করছি। বায়রন বললেন।

ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত্রি অনেক হয়েছে। এবার যাওয়া দরকার।

বায়রন বললেন, মার্কোপোলোকে অধৈর্য হতে বারণ করো। খুব শিগগিরই যা হয় একটা হয়ে যাবে।

বিদায় নেবার আগে বায়রন বললেন, সায়েবের সঙ্গে থেকে থেকে তোমার তো অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছে। তোমার সাহায্য নিতে হবে আমাকে।

আপনি চাকরি দিয়েছেন, আর সামান্য সাহায্য চাইতে দ্বিধা করছেন?

পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরে, বায়রন বললেন, ছি ভাই, ওসব কথা বলতে আছে?

সেই রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেক ভেবেছিলাম। চেষ্টা করেও চোখে ঘুম আনতে পারছিলাম না। সুশান বা লিজাকে আমি দেখিনি, কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই ওদের দুটো কাল্পনিক মূর্তি চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।

সুশান এখন কোথায় কে জানে? সে কি এই শহরের কোনো অখ্যাত পল্লির অন্ধকার ঘরে কষ্টের দিনগুলো কোনোরকমে কাটিয়ে দিচ্ছে? কিংবা প্রচুর অর্থ উপার্জন করে, বাড়ি কিনে, রেস্তোরাঁ এবং সংগীতকে জীবন থেকে চিরতরে বিদায় দিয়ে, অবসরের আনন্দ উপভোগ করছে?

থিয়েটার রোডের সেই বাড়িতে সুশান নিশ্চয়ই আজ নেই। থাকলে বায়রন সায়েব অনেকদিন আগেই তাকে খুঁজে বার করে, মার্কোপোলোর সমস্যা সমাধান করে দিতেন। নিজের দাম্পত্যজীবনের সমস্যা না মিটিয়ে, সে আজ কোথায় পড়ে রইল? তার কি একবারও মনে পড়ে না, বিদেশি মার্কোপোলো একদিন তার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন এবং আরও অনেক কিছু বিসর্জন দেবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন?

মার্কোপোলোর বেদনাময় দাম্পত্যজীবনের জন্য প্রকৃত দুঃখ অনুভব করেছি। কিন্তু আবার অন্যদিকটাও বিচার করে দেখবার চেষ্টা করেছি। ভেবেছি, কী আশ্চর্য এই পৃথিবী! বেঁচে থাকার সমস্যা সমাধান করতে করতেই কত নিস্পাপ লোকের সমগ্র সামর্থ্য ব্যয়িত হচ্ছে; আর যাদের অন্নচিন্তা নেই, একঘেয়ে সুখে ক্লান্ত হয়ে তারা শখের সমস্যা তৈরি করছে। আবার ভেবেছি, কাউকে দোষ দেবার অধিকারই আমার নেই। জীবনে সমস্যা সৃষ্টি না-হলে বাঁচার আনন্দের অর্ধেকই হয়তো নষ্ট হত। দুঃখ আছে, দুশ্চিন্তা আছে, দৈন্য আছে বলেই তো জীবন এখনও জোলো এবং একঘেয়ে হয়ে ওঠেনি। সংসারের সুখের ইতিহাসে আমরা কেউই আগ্রহী নই। জগতের ইতিহাসে মানুষের পরম পূজ্যগণ সকলেই তো দুঃখের অবতার, তাদের কেউই আরামে লালিত লক্ষ্মীর ক্রীতদাস নন।

ভোরবেলায় যখন হোটেলে হাজির হয়েছি, গত রাত্রের চিন্তাগুলো তখনও মনের মধ্যে থেকে সম্পূর্ণ বিদায় নেয়নি। পার্থক্যটা তাই আশ্চর্য লাগল। এই তো কয়েক মুহূর্ত আগে আমি যেখানে ছিলাম তার চারিদিকে বস্তি; কঁচা নর্দমা, ডাস্টবিন। আর এখানে? ময়লা তো এখানেও সৃষ্টি হয়, কিন্তু সেগুলো যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায় বুঝি না। যা কিছু অশোভন, যা কিছু দৃষ্টিকটু তাকেই চোখের সামনে থেকে আড়ালে সরিয়ে রাখার শিল্পটি এরা আশ্চর্যভাবে আয়ত্ত করেছে।

এই প্রতিমুহূর্তে সুন্দর হয়ে থাকার পিছনে যে কি পরিমাণ পরিশ্রম আছে, তা শাজাহান হোটেলে ভোরবেলায় গেলে কিছুটা বোঝা যায়।

কলের ঝাঁটা দিয়ে (ভ্যাকুয়াম ক্লিনার) দিনের লাউঞ্জের কার্পেট পরিষ্কার করা হচ্ছে। অত সকালেই কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ক্লান্ত জমাদারগুলো মেঝেতে বসে যখন এক মনে মেঝে ঘসে যাচ্ছে তখন আমাদের এই কলকাতা শহরে প্রায় কেউই ঘুম থেকে ওঠেনি।

রাত একটা পর্যন্ত ওরা কিছু কাজ করতে পারে না। লাউঞ্জে তখনও লোক বসে থাকে। কাউন্টার থেকেই ক্যাবারে দর্শকদের হাততালি শোনা যায়। হোটেলের নাম শাজাহান; কিন্তু বার ও রেস্তোরাঁর নাম মমতাজ। ইতিহাসের সম্রাজ্ঞী মমতাজ তার স্বামী অপেক্ষাও ঐশ্বর্যবিলাসিনী ছিলেন কি না জানি না। কিন্তু আমাদের মমতাজ আরও অনেক সুন্দরী, আরও অনেক রোমাঞ্চময়ী। আমাদের মমতাজ রাজশয্যায় সারাদিন ঘুমিয়ে থাকেন। তার সব লীলাখেলা রাত্রে। কিন্তু কলকাতার পুলিস ও আবগারি বিভাগ মোটেই সুরসিক নন। ছোট ছেলের মতো কলকাতাওয়ালাদের আগলে রাখেন; ভাবেন রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে। সাধারণভাবে রাত দশটা। অনেক সাধ্যসাধনা করলে মধ্যরাত্রি। হেড বারম্যান নির্ধারিত সময়ের কিছু আগে ঘরের কোণে রাখা ছোট্ট নোটিশটা সামনে এনে টাঙিয়ে দেয়-Bar closes at twelve tonight.

রাতের অতিথিরা হঠাৎ যেন ঘুম থেকে উঠে বসেন! সময় হয়েছে নিকট, এবার বাঁধন ছিড়িতে হবে। যারা চালাক তারা কিন্তু চিন্তিত হন না, শুধু বারম্যানের দিকে তাকিয়ে কাছে আসতে ইঙ্গিত করেন।

বেয়ারা সে ইঙ্গিতের অর্থ বোঝে। বলে, কপেগ হুজুর?

সাহেব হিসেব করতে শুরু করেন। এক এক পেগে যদি আধঘণ্টা সময় গিলে ফেলা যায়, তাহলে আট পেগে রাত্রির অন্ধকারকে ভোরের আলোর খপ্পরে আনা যাবে। বারোটায় বার বন্ধ, কিন্তু বার-এ বসে আগে থেকে অর্ডার দেওয়া পানীয় পানে আপত্তি নেই। আর কয়েকটা ঘণ্টা টেবিলে জড়ো করে রাখা মদ সাবাড় করতে করতে কাটিয়ে দিতে পারলেই আবার যা হয় একটা সুযোগ এসে যাবে। যে তোবারক আলী আট পেগ মদ টেবিলে দিয়ে বার বন্ধ নোটিশ টাঙিয়ে দিয়ে, চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে, সেই আবার ততক্ষণে রাত্রির ঘুম শেষ করে ডান হাতে লাল ব্যাজটা জড়াতে জড়াতে আবার বার-এ এসে ঢুকবে। দেখবে সাহেব সবকটা পেগ উড়িয়ে দিয়ে তীর্থকাকের মতো ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে বসে আছেন, কখন আবার বার খুলবে।

 

শাজাহান হোটেলের মেন গেট পেরিয়ে ভিতরে এসে ঢুকলাম। সত্যসুন্দরবাবু কাউন্টারে ডিউটি দিচ্ছেন। বাঁ হাতে টেলিফোনটাকে কানে ধরে আছেন, আর ডান হাতে বোধহয় কোনো মেসেজ লিখে নিচ্ছেন। আমাকে দেখে সত্যসুন্দরদা মাথা নাড়লেন। ইঙ্গিতে বললেন, সোজা কিচেনে চলে যাও। ওখানে তোমার কাজ আছে। কী কাজ? কে কাজ দেবেন, কিছুই জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। সত্যসুন্দরবাবু তখন কাগজের উপর ঝুঁকে পড়ে বলছেন, হা, হ্যাঁ। শাজাহান রিসেপশন থেকে আমি স্যাটা বোস কথা বলছি। করবী গুহকে এখন ফোনে পাওয়া সম্ভব নয়। যদি আপনার কিছু বলবার থাকে বলুন, আমি লিখে নিচ্ছি। উনি ঘুম থেকে ওঠা মাত্রই আপনার মেসেজ পেয়ে যাবেন।

বোসদার মুখ দেখে বুঝলাম, টেলিফোনের অপর প্রান্তের ভদ্রলোক তাঁর উত্তরে খুশি হননি। বোসদা বলে উঠলেন, আমি সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু স্পেশাল ইনস্ট্রাকশন না থাকাতে, কোনো বোর্ডারকে আমরা ঘুমের মধ্যে জ্বালাতন করি না।…আজ্ঞে, এ-বি-সি। এ কেমন নাম? বলছেন ওই বললেই শ্ৰীমতী গুহ বুঝতে পারবেন। তবে আমাদের কাস্টম হল, পুরো নাম, ঠিকানা এবং টেলিফোন নম্বর টুকে নেওয়া…না, না, প্লিজ রাগ করবেন না; সব কিছু বলা–বলা আপনার ইচ্ছে। আমি তাকে বলব, মিস্টার এ-বি-সি ফোন করেছেন।

ফোনের ওধার থেকে ভদ্রলোক তখনও কী সব বলছেন। টেলিফোন পর্ব শেষ হবার জন্য অপেক্ষা না করে আমি সোজা কিচেনের দিকে পা বাড়ালাম।

হটাও, হটাও,—দূর থেকেই মার্কোপোলো সাহেবের বাজখাই গলার স্বর শুনতে পেলাম। কাছে এসে দেখলাম ঝাড়ুদাররা সব মাথা নিচু করে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভয়ে ওরা ঠক ঠক করে কাঁপছে। মুখের অবস্থা দেখে মনে হয় মিলিটারি ক্যাম্পে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে ওদের কেউ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ম্যানেজার সাহেবের দিকে ওরা এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন উনিই সেনাবাহিনীর মেজর—এখনই গুলি করবার হুকুম দেবেন।

দুনিয়ার আর কোথাও এর থেকে নোংরা হোটেল আছে? মার্কোপোলো তারস্বরে প্রশ্ন করলেন।

সবাই মাথা নিচু করে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। ওদের নীরবতায় বিরক্ত হয়ে মার্কোপোলো এবার গর্জন করে উঠলেন, ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব ইস্কুলের এক্স-স্টুডেন্টরা কি সবাই দলবেঁধে এই হোটেলে চাকরি নিয়েছে? তোমরা কথা বলো না কেন?

মার্কোপোলোর সন্ধানী চোখ এবার সার্চলাইটের মতো ঘুরতে আরম্ভ করল। ঘুরতে ঘুরতে চোখটা যেখানে এসে থামল, সেখানে স্টুয়ার্ড জিমি দাঁড়িয়েছিলেন। ম্যানেজার আবার তোপ দাগলেন, জিমি, তুমি কি গ্যান্ডি পার্টিতে জয়েন করেছ? সায়লেন্স-এর ভাও নিয়েছ?

স্টুয়ার্ড, যাঁর প্রতাপের খানিকটা অভিজ্ঞতা আমার আছে, যেন কেঁচো হয়ে গিয়েছেন। কোনোরকমে বললেন, সত্যি খুব নোংরা, আপনি যা বলছেন…

এবং তুমি সেই হোটেলের স্টুয়ার্ড-যার রান্নাঘর দিয়ে দিনেরবেলায় কুমিরের মতো বড় বড় ইঁদুর ছোটাছুটি করে।

ব্যাপারটা এতক্ষণে বুঝতে পারলাম। সায়েবের সামনে দিয়ে দুটো সঁদুর কিচেনের ফ্লোরে ছোটাছুটি করেছে। তারপরই এই দৃশ্য। সায়েব আর কাউকে ছাড়তে রাজি নন।

মুখের পাইপ থেকে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে, মার্কো এবার ঘুরে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, মাইডিয়ার ফেলাজ, তোমরা যেভাবে চলছ, যেভাবে স্টোরস এবং কিচেন নোংরা করে রাখছ, তাতে যদি সামনের সপ্তাহে দেখি, ইঁদুর কেন এখানে হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাহলেও আমি আশ্চর্য হব না।

জমাদাররা ততক্ষণে ঘরের মেঝে সাবধানে মুছতে আরম্ভ করেছে। স্টুয়ার্ড হেড কুককে ডেকে বললেন, আমি ঠিক লাঞ্চের পরই আসছি—সমস্ত কিছু আজ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখতে চাই। কেউ যেন আজ বাইরে না পালায়। প্রত্যেককে আমি এখানে হাজির দেখতে চাই।

পাইপটা হাতে নিয়ে আর একবার ঘুরতে গিয়ে, মার্কোপোলো আমাকে দেখতে পেলেন। যিনি এতক্ষণ ৪৪০ ভোল্টের মেজাজে ছিলেন, তিনিই এবার স্নিগ্ধ হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললেন, হালো, গুড মর্নিং।

আমার এই অভাবনীয় সৌভাগ্য স্টুয়ার্ডের বোধহয় মনঃপূত হল না। বাঁকা চাহনি এবং মুখের ভাব দেখে তার মনের কথাটা আমার বুঝতে বাকি রইল না। কিন্তু ও-নিয়ে সময় খরচ করবার উপায় ছিল না। পিঠে একটা চাপড় দিয়ে মার্কোপোলো বললেন, এসো।

এবার তাকে আমি অন্যরূপে দেখতে আরম্ভ করলাম। তিনি আমার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা শাজাহান হোটেলের ম্যানেজার নন। এঁকে কাল রাত্রে এলিয়ট রোডের এক অন্ধকার ঘরে আমি মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করেছি। আঘাতে আঘাতে শক্ত হয়ে যাওয়া ওই দেহটার মধ্যে খুঁজে পেয়েছি সেই শিশুকে, অনেকদিন আগে মধ্যপ্রাচ্যের ভূমিকম্পে যে সব হারিয়েছিল; এথেন্সের ফাদাররা যাকে আবার সব দিয়েছিল; আবার আমাদের এই কলকাতা যার সর্বস্ব হরণ করে নিয়েছিল।

শাজাহান হোটেলের ম্যানেজার আজ আমার খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন। তার পরিপূর্ণ রূপটা আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আর তিনিও ম্যাজিসিয়ানের মতো মুহূর্তে নিজের রূপ পালটিয়ে ফেললেন। কে বলবে, এই লোকটাই দু মিনিট আগে ইঁদুর দেখে হোটেলের সব কর্মচারীকে একসঙ্গে রসাতলে পাঠাবার চেষ্টা করছিলেন।

আমার মুখের দিকে মার্কো অমনভাবে কেন তাকিয়ে রয়েছেন? হয়তো ভাবছেন, আমি সব জেনে ফেলেছি। আবার ঠিক নিঃসন্দেহও হতে পারছেন না। ডিটেকটিভ বায়রন এই অজানা ছোকরাকে কতখানি বলেছেন আর কতখানি বলেননি, কে জানে। আমারও কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। সেই অস্বস্তি থেকে বাঁচবার জন্যই বললাম, স্যর, গতকাল মিস্টার বায়রনের কাছে আমি গিয়েছিলাম।

বাড়ি চিনতে তোমার কোনো কষ্ট হয়নি তো?

বললাম, না। অপরিচিত জায়গা বটে, কিন্তু নম্বর তো জানা ছিল।

আই হোপ, সমস্ত জীবনই কলকাতার ওই অঞ্চল তোমার কাছে অপরিচিত থাকবে। মাইডিয়ার ইয়ংম্যান, জীবনে সবরকম অন্যায়ের প্রলোভন থেকে দূরে থাকবার চেষ্টা কোরো। আমি তোমাকে উপদেশ দিতে চাই না; বাট বিলিভ মি, আমরা প্রায়ই নিজেদের দুঃখ নিজেরাই সৃষ্টি করি।

আমি চুপ করে রইলাম। আর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি কোনোরকমে টোক গিলে বললাম, গতকাল রাত্রে মিস্টার বায়রনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, আপনি যেন ধৈর্য হারাবেন না।

ধৈর্য! পৃথিবী কোনোদিন এর থেকেও ধৈর্যশীল মানবশিশুকে লালন করেছে? মার্কোপোলো যে কাকে প্রশ্ন করলেন বুঝতে পারলাম না। কিন্তু এই প্রথম মনে হল, যাকে আমি পাথর বলে মনে করেছিলাম আসলে সে একটা বরফের চাঙড়। আমারই চোখের সামনে বরফের বিশাল টুকরোটা গলতে শুরু করেছে।

যাঁর সঙ্গে আমার প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক, তিনি মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলেন আমি কে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার সঙ্গে বলতে গেলে আমার কোনো পরিচয়ই নেই। আই হার্ডলি নো ইউ। কিন্তু তোমার মুখ দেখে মনে হয় পৃথিবীকে তুমি চেনো না। তুমি জানো না, কোন পৃথিবী-হোটেলে বাস করবার জন্য ঈশ্বর আমাদের অ্যাকোমোডেশন বুক করেছেন। খুব সাবধান।

আমার কথা বলবার মতো সামর্থ্য ছিল না। শুধু নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়েছি। সংসারের দুঃখময় যাত্রাপথে অকারণে কতবারই তো মানুষের অযাচিত ভালোবাসা পেয়েছি। না চাইতে পেয়ে পেয়ে আমার লোভ যেন অনেক বেড়ে গিয়েছে। আজও ভালোবাসার অভাব হল না।

আমাকে স্বীকার করতেই হবে, তুমি খুব খারাপ টাইপিস্ট নও। গলার, হারটা ডান হাতে নাড়তে নাড়তে মার্কোপোলো বললেন।

মাথা নিচু করে তার প্রশংসা গ্রহণ করলাম। এই সামান্য সময়ে যদি তাকে খুশি করে থাকতে পারি, তবে তার থেকে আনন্দের কী হতে পারে? বিনা-চাকরির জীবনটা যে কী রকমের, তার কিছু নমুনা আমি আস্বাদ করে দেখেছি। বিশেষ করে একবার চাকরি করে যে আবার পথে বেরিয়ে এসেছে। সত্যসুন্দরবাবু হাসতে হাসতে একবার বলেছিলেন, মেয়েদের স্বামী, আর ছেলেদের চাকরি। অরিজিন্যাল বেকার আর চাকরি খোয়ানো বেকার—যেন কুমারী মেয়ে আর বিধবা মেয়ে। দুজনেরই স্বামী নেই। কিন্তু তফাতটা যে কী, সে একমাত্র বিধবাই বেখে।

সত্যসুন্দরবাবুর ভাষায় স্বামী হারিয়ে আবার স্বামী পেয়েছি, সুতরাং চাকরি যে কী দ্রব্য বুঝতে বাকি নেই। কোনো চেষ্টা না-করতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, নাইস অফ ইউ টু সে সো স্যর।

মার্কোপোলোর গোলগোল চোখ দুটো মধুর দুষ্টুমিতে ছটফট করতে লাগল। বললেন, এতদিন হাইকোর্টে চাকরি করেও তুমি মানুষ চেনোনি। নাইস আমি মোটেই নই।

আমার অস্বস্তিকর মুখের অবস্থা দেখে, মার্কোপোলো এবার আলোচনার মোড় ফেরালেন। বললেন, আই অ্যাম স্যরি। তোমাদের ও-পাড়াকে বেশ ভয় করি; কয়েকবার ওখানে গিয়েছি। সত্যি কথা বলতে কি, কোনো যাঁড় যদি আমাকে তাড়া করে, তবে লাইফ সেভ করবার জন্য আমি নদীতে ঝাঁপ দেব, তবু কিছুতেই ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের কোনো বাড়িতে উঠব না।

উত্তর না দিয়ে কেবল হাসলাম। মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় থাক?

বললাম, হাওড়ায়।

সে আবার কোথায়? মার্কোপোলো যেন অমন জায়গার নামই শোনেননি। বুঝিয়ে বললাম, গঙ্গার পশ্চিমদিকে হাওড়া স্টেশনের পরে।

ওঁর মুখ দেখে মনে হল, হাওড়া স্টেশনের পরে যে কোনো ভূখণ্ড আছে, তা যেন ওঁর জানাই ছিল না। যেন ওইখানেই স্থলভাগ শেষ হয়ে, সমুদ্র আরম্ভ হয়ে গেল!

মার্কোপোলো এবার যা প্রস্তাব করলেন তার ইঙ্গিত সত্যসুন্দরবাবুর কাছে আগেই পেয়েছিলাম। সত্যসুন্দরবাবু বলেছিলেন, এ আপনার সাধারণ আপিস নয় যে, দশটা পাঁচটায় বাঁধা জীবন—শনিবার অর্ধেক, রবিবারে পুরো ছুটি। যদি এখানে চাকরি পাকা হবার কোনো সম্ভাবনা থাকে, তাহলে কর্তা একদিন আপনাকে দুনিয়ার সঙ্গে সম্বন্ধ চুকিয়ে, শাজাহান হোটেলে এসে আশ্রয় নিতে হুকুম করবেন।

চাকরিটা রক্ষে করবার জন্য, দুনিয়ার যে কোনো বাড়িতে এসে থাকতে প্রস্তুত আছি আমি।

আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে, সত্যসুন্দরবাবু বলেছিলেন, যা বুঝছি, শাজাহান হোটেলের অন্ন আপনার জন্যে অনেকদিন বাঁধা রয়েছে। স্টুয়ার্ড জিমির হাবভাব দেখে আন্দাজ করতে পারছি আমি। আপনার সম্বন্ধে জিমি এখন খুব নরম হয়ে গিয়েছে। জিমি উপরওয়ালার মন বুঝে চলে।

সত্যসুন্দরবাবুর ভবিষ্যদ্বাণী সফল হল। মার্কোপোলো একটা বার্মা সিগার ধরিয়ে বললেন, তোমাকে একটা ইমপর্টান্ট ডিসিশন নিতে হবে। তোমার আগে যে এখানে কাজ করত তার নাম রোজি। তাকে এখানে থাকতে হত। তাতে ম্যানেজমেন্টের সুবিধে। পাঁচটার মধ্যে কাজ শেষ করে ফেলবার জন্যে আমাকে হাঁকপাক করতে হত না; জরুরি কাজগুলো আসামাত্রই সঙ্গে সঙ্গে শেষ করে ফেলা যেত। আমাকে বলতেই হবে, রোজির মতো ওয়ান্ডারফুল সেক্রেটারি আমি কখনও দেখিনি। তার আঙুলগুলো টাইপরাইটারের কি-বোর্ডের উপর দিল্লি মেলের স্পিডে ছোটাছুটি করত, অথচ মুখে হাসি লেগেই আছে। আনগ্রাজিং, কখনও কাজ করতে অসন্তুষ্ট হত না।

একদিন তো বেচারাকে রাত বারোটা থেকে ডিক্টেশন নিতে হল। আমার কাজ নয়। এক গেস্টের কাজ। সে ভদ্রলোক ভোরবেলাতেই দমদম থেকে লন্ডন চলে যাচ্ছেন। পথে করাচিতে একটা চিঠি ডেলিভারি দিতেই হবে। বেচারার টাইপরাইটার নেই, নিজেও টাইপ জানেন না। আমাকে এসে রাত এগারোটায় ধরলেন। আমি বললাম, এত রাত্রে, কোথায় স্টেনো পাব? সে ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা। এত বড় কলকাতা শহর, এখানে তোমরা চেষ্টা করলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।

আমার রোজির কথা মনে পড়ে গেল। বিলিভ মি, সেই রাত্রে রোজি প্রায় তিনটে পর্যন্ত টাইপ করেছিল। আমি জানতাম না। রোজিকে কাজে বসিয়ে দিয়ে আমি ঘুমোতে চলে গিয়েছিলাম। পরের দিন ভোরে রোজিও আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু পরে বিলেত থেকে ভদ্রলোকের চিঠি পেলাম। তিনি লিখেছেন—সেদিন আপনার সেক্রেটারি আকাশের পরীর মতো উপর থেকে নেমে এসে আমাকে রক্ষে করেছিলেন। তাঁকে এবং আপনাকে কীভাবে ধন্যবাদ দেব জানি না। তিনি রাত তিনটে পর্যন্ত টাইপ করলেন, অথচ একটুও বিরক্ত না-হয়ে কাজ শেষ করে, আমাকে সুপ্রভাত জানিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন!—মার্কোপোলো সগর্বে তাঁর সেক্রেটারির কাহিনি আমাকে বললেন।

তুমিও এখানে থেকে যাও। মার্কোপোলো বললেন।

মিস্টার মার্কোপোলো আমার সম্মতির জন্য অপেক্ষা করলেন না। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, আমি জিমিকে বলে দিয়েছি। সে নিশ্চয়ই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। যদি কোনো অসুবিধে হয় সে যেন আমার সঙ্গে দেখা করে।

মার্কোপোলো এবার বিল রেজিস্টারটা পরীক্ষা করবার জন্যে কাউন্টারের দিকে চললেন। আমি প্রথমটা বুঝতে না পেরে এবং শেষে বুঝতে পেরে ধপাস করে বসে পড়লাম। আকাশের নক্ষত্রদের কোন ষড়যন্ত্রে গৃহ থেকেও গৃহহারা হতে চলেছি কে জানে!

আমার নিজস্ব একটা নাম ছিল। হাইকোর্টে সেটা হারিয়ে এসেছিলাম। একটা ঠিকানা অবশিষ্ট ছিল। বহুকষ্টের মধ্যেও এতদিন ধরে কোনোরকমে সেটা রক্ষে করে আসছিলাম। পয়সা জমিয়ে একটা চিঠির কাগজ পর্যন্ত ছাপিয়েছিলাম। ইউরোপীয় কায়দায় তার ডানদিকে শুধু ঠিকানাটাই লেখা ছিল। নাম এবং ধাম সমেত একটা রবার স্ট্যাম্পও আত্মপ্রসাদের নেশায় নগদ বারো আনা পয়সা খরচ করে তৈরি করিয়েছিলাম। স্থানে-অস্থানে সেই স্ট্যাম্প অকৃপণভাবে ব্যবহার করে, সগর্বে আমার কৌলীন্য প্রচার করেছি! সে দুটো একসঙ্গে একইদিনে নিষ্প্রয়োজনীয় হয়ে গেল। শাজাহান হোটেলের বিশাল গহ্বরে যে মানুষটা এবার হারিয়ে যাবে তার নামও থাকবে না, ঠিকানাও থাকবে না। সে যেন সত্যিই সরাইখানার নামহীন গোত্রহীন অজানা মুসাফির।

 

রেজিস্টারে নাম লিখতে লিখতে সত্যসুন্দরবাবু মুখ তুলে তাকালেন। বললেন, আগাম খবর পেয়ে গেছি।

সামনে একজন বিদেশি অতিথি দাঁড়িয়েছিলেন। বেয়ারা দূর থেকে ছুটে এসে কাছে দাঁড়াতেই, সত্যসুন্দরবাবু বললেন, এক নম্বর সুইট।

বেয়ারা দেওয়ালের বোর্ডে যে অসংখ্য চাবি ঝুলছে, তার একটা সায়েবের দিকে এগিয়ে দিয়ে সেলাম করলে। সায়েব বাঁহাতে মাথার সোনালি চুলগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে, ডানহাতে চাবির রিঙটা ঘোরাতে ঘোরাতে উপরে উঠে গেলেন।

সত্যসুন্দরদা ফিস ফিস করে বললেন, একলা এসেছেন, কিন্তু ডবল বেডের রুম নিলেন। আমাদের সবচেয়ে সেরা সুইট, যার প্রতিদিনের রেট দুশো পঞ্চাশ টাকা। তাও বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট।

বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট কথাটার অর্থ তখনও আমার জানা ছিল না। শুনলাম, তার মানে থাকার ব্যবস্থা ছাড়া শুধু ব্রেকফাস্ট দেওয়া হবে। বাকি খাওয়ার জন্যে আলাদা বিল। যেসব টুরিস্টরা সারাদিন ঘোরাঘুরি করেন, তারা বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট রেট পছন্দ করেন। হোটেলও কম খুশি হয় না। হাঙ্গামাও কম।

বলেছিলাম, সায়েবের বয়স তো বেশি নয়। নিশ্চয়ই খুব বড়লোক।

মুণ্ডু! বোসদা হেসে ফেললেন। চাকরি একটা করেন বটে, কিন্তু সেই মাইনেতে শাজাহানের এক নম্বর সুইটে থাকা যায় না।

হয়তো আপিসের কাজে এসেছেন। আমি বললাম।

আপিস তো ওঁর এই কলকাতাতেই। থাকেন বালিগঞ্জের এক সায়েবের বাড়িতে পেইং গেস্ট হিসেবে। কিন্তু মাঝে মাঝে একলা চলে আসেন। অথচ ডবল-বিছানা ঘর ভাড়া নেন। মাসে অন্তত চার পাঁচবার আসেন। ভদ্রলোক কমনওয়েলথের লোক, তাই। না হলে প্রতিবার সিকিউরিটি পুলিসকে রিপোর্ট করতে হত; এবং তারাও অবাক হয়ে যেত বালিগঞ্জ থেকে একটা লোক বার বার শাজাহান হোটেলে এসে ওঠে কেন?

আমি এই জীবনের সঙ্গে তেমন পরিচিত হয়ে উঠিনি। বোসদা বললেন, এখানে যদি সন্ধের পর কেউ বেশ কয়েক ঘণ্টা বসে থাকে, তবে সেও বুঝতে পারবে। রাত্রে কালো চশমা পরে তিনি আসবেন। তার স্বামীর সাত আটখানা গাড়ি আছে, তবু তিনি ট্যাক্সি চড়েই আসবেন। একটা কথা আমি জোর করে বলতে পারি, মিস্টার অমুক আজ কলকাতায় নেই। হয় বোম্বাই গিয়েছেন, না হয় দিল্লি গিয়েছেন; কিংবা খোদ বিলেতেই বিজনেসের কাজে তাকে যেতে হয়েছে।

কে এই ভদ্রলোক? কে এই ভদ্রমহিলা? আমি নিজের কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারলাম না। বোসদা বললেন, এই হতভাগা দেশে দেওয়ালেরও কান আছে।

বোসদার হাত চেপে ধরে বললাম, আমার কান আছে বটে, কিন্তু আমি বোবা! যা কান দিয়ে ঢোকে, তা পেটেই বন্দি হয়ে থাকে। মুখ দিয়ে আর বের হয় না।

বোসদা বললেন, মিসেস পাকড়াশী। মাধব পাকড়াশীর হিসেবের খাতায় তিনি খরচ হয়ে গিয়েছেন। মিস্টার পাকড়াশীর জীবনে সব জিনিসই অনেক ছিল—অনেক গাড়ি, অনেক কোম্পানি, অনেক বাড়ি, অনেক টাকা। কিন্তু যে জিনিস মাত্র একটা ছিল, সেটাই নষ্ট হয়ে গেল। মিসেস পাকড়াশী আজ থেকেও নেই। দিনের বেলায় সমাজসেবা করেন, বক্তৃতা করেন, দেশের চিন্তা করেন। আর রাত্রে শাজাহানে চলে আসেন। সারাদিন তিনি প্রচণ্ড বাঙালি। কিন্তু এখানে তিনি প্রচণ্ড আন্তর্জাতিক। কখনও দেশের কাউকে ওঁর সঙ্গে দেখিনি। এক নম্বর সুইটে আগে যিনি আসতেন, তিনি তেইশ বছরের একজন ফরাসি ছোকরা। কিন্তু কমনওয়েলথের বাইরে হলেই আমাদের রিপোর্ট করতে হয়, সেইজন্যেই বোধহয় এই ইংরেজ ছোকরাকে পছন্দ করেছেন। বেচারা মিস্টার পাকড়াশী!

কারুর সম্বন্ধেই আপনার বেশি সহানুভূতি থাকবার প্রয়োজন নেই। আমি বললাম।

মিসেস পাকড়াশীর নিজেরও তাই ধারণা। বোম্বাই-এর তাজ হোটেলে, দিল্লির মেডেন্সে মিস্টার পাকড়াশীর সিঙ্গল না ডবল বেডের রুম ভাড়া নেন, কে জানে! তবে আজও তিনি কর্তাকে বেকায়দায় ধরতে পারেননি। আমার মনে হয়, ভদ্রলোক ভালো। দুপুরে মাঝে মাঝে লাঞ্চে আসতে দেখেছি। বিয়ার পর্যন্ত নেন। মিসেস পাকড়াশী তো আপনার বায়রন সায়েবকে লাগিয়েছিলেন; ভদ্রলোক তো দুবার বোম্বাই ধাওয়া করেছিলেন। কিন্তু যতদূর জানি, কিছুই পাওয়া যায়নি।

আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, এসব আপনি কী করে জানলেন?

জানতে হয় না, এমনিই জানা হয়ে যায়। আপনারও হবে। দুদিন পরে আপনিও জেনে যাবেন মিসেস পাকড়াশীকে। তার বয়ফ্রেন্ড সম্বন্ধেও বহু কিছু শুনবেন। তখন অবাক হয়ে যাবেন। হয়তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারবেন না।

কেন? আমি জানতে চাইলাম।

এখন নয়। সে সময়মতো একদিন বলা যাবে, যদি তখনও আগ্রহ থাকে। এখন একটু অপেক্ষা করুন, হাতের কাজগুলো সেরে নিই। এখনই একশো বাহান্ন, একশো পঞ্চান্ন আর একশো আটান্ন খালি হয়ে যাবে। বিলটা ঠিকই আছে। তবে লাস্ট মিনিটে কোনো মেমো সই করেছেন কি না দেখে নিই। কোনো মেমো ফাঁক গেলে সেটা আমারই মাইনে থেকে কাটা যাবে।

বিলগুলো চেক করে, সত্যসুন্দরবাবু পোর্টারকে ডাক দিলেন। বেচারা টুলের উপর বসেছিল। ডাক শুনেই হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এল।

এখানে কথা বলার একটা অদ্ভুত কায়দা আছে। স্বর এত চাপা যে, যাকে বলা হচ্ছে সে ছাড়া কেউ শুনতে পাবে না। অথচ তার মানেই যে ফি ফিস্ করে কথা, তা নয়। সত্যসুন্দরবাবু সেই ভাবে পোর্টারকে বললেন, সায়েবরা ঘরে রয়েছেন। ওঁদের প্যাকিংও প্রায় রেডি। সুতরাং আর দেরি কোরো না।

আমি বললাম, এমন কণ্ঠস্বর কেমন করে রপ্ত করলেন?

আপনারা যেমন বলেন বি-বি-সি উচ্চারণ, তেমনি এর নাম হোটেল-ভয়েস। বাংলায় বলতে পারেন সরাইকণ্ঠ! অনেক কষ্টে রপ্ত করেছি। আপনাকেও করতে হবে।—বোসদা বললেন।

বললাম, আপনি-পর্বটা এবার চুকিয়ে ফেললে হয় না? আমার অন্তত সান্ত্বনা থাকবে, শাজাহান হোটেলে এমন একজন আছেন, যাঁর কাছে আমি আপনি নই, যাঁর কাছে আমি তুমি।

বোসদা বললেন, তার বদলে, তুমি আমাকে কী বলে ডাকবে?

সে তো আমি আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছি—বোসদা।

বোসদা বললেন, মোটেই আপত্তি নেই, তবে মাঝে মাঝে স্যাটাদা বোলো। সায়েবগঞ্জ কলোনির অমন পিয়ারের নামটা যেন ব্যবহারের অভাবে অকেজো না হয়ে যায়।

কেন? এখানকার সবাই তো আপনাকে ওই নামে ডাকছে। আমি একটু আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম।

ওদের ডাকা, আর আপনজনদের ডাকা কি এক হল, ভাই?

সত্যসুন্দরবাবু এবার আমার প্রসঙ্গে ফিরে এলেন। বললেন, জিমির মুখেই শুনলাম, তুমি পাকাপাকিভাবে এখানেই আশ্রয় গ্রহণ করেছ। ভালোই হল।

আমার মনের মধ্যে তখন দুশ্চিন্তা এবং অস্বস্তি দুইই ছিল। বললাম, আপনি বলছেন, ভালো হল? আমার তো কেমন ভয় ভয় করছে।

সত্যদার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বললেন, হাসালে তুমি। ভয় অবশ্য হয়। শাজাহান হোটেলকে দূর থেকে দেখলে, কার না ভয় হয়? আমি সায়েবগঞ্জ কলোনির সিজিনড় সেগুন কাঠ, আমারই বুকে ফাট ধরার দাখিল হয়েছিল।

রিসেপশনে দাঁড়িয়ে বেশিক্ষণ কথা বলবার কোনো উপায় নেই।

আবার টেলিফোন বেজে উঠল। বোসদা ফোনটা তুলে নিলেন। শাজাহান রিসেপশন।…বেগইওর পাৰ্ডন। মিস্টার মিৎসুইবিসি…হ্যাঁ হ্যাঁ, উনি টোকিও থেকে ঠিক সময়েই পৌঁছেছেন। রুম নাম্বার টু হানড্রেড টেন।

ওদিক থেকে বোধহয় কেউ জিজ্ঞাসা করলে, মিস্টার মিৎসুইবিসি এখন আছেন কি না।

জাস্ট এ মিনিট বলে বোসদা চাবির বোর্ডটার দিকে নজর দিলেন। দুশো দশ নম্বর চাবিটা বোর্ডেই ঝুলছে। টেলিফোনটা তুলে আবার বললেন, নো, আই অ্যাম স্যরি। উনি বেরিয়ে গিয়েছেন।

টেলিফোন নামিয়ে বোসদা বললেন, তা হলে আর দেরি করছ কেন, কাসুন্দের সম্পর্কটা তাড়াতাড়ি চুকিয়ে এস।

এবার আমার দুশ্চিন্তার কারণটা প্রকাশ করতে হল। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। তবু কোনোরকমে বললাম, এত বড় হোটেলে থাকতে হলে যে-সব জিনিসপত্তর আনা দরকার, সেরকম কিছুই তো নেই। আমার তোশকটার যা অবস্থা। একটা হোল্ড-অলও এত তাড়াতাড়ি কারুর কাছে ধার পাব না যে ঢেকে আনব। এই দরজা ছাড়া অন্য কোনো দরজা দিয়ে ঢোকা যায় না?

বোসদা সে-যাত্রায় আমায় রক্ষে করলেন। আমার বিদ্যেবুদ্ধি সম্বন্ধে নিতান্ত হতাশ হয়েই যেন বললেন, তুমি নেহাতই বোকা। এই সামান্য জিনিস নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়? যদি ভাল লোশকই থাকবে তবে আমরা এখানে আশ্রয় নেব কেন? যত বড় হোটেলে উঠবে, তত কম জিনিস সঙ্গে নিয়ে এলেই চলে যায়। ফ্রান্সের এক হোটেল তো বিজ্ঞাপনই দেয়, আপনার খিদেটি ছাড়া আর কিছুই সঙ্গে নিয়ে আসবার প্রয়োজন নেই। আর এ-খিদে বলতে শুধু পেটের খিদে নয়, আরও অনেক কিছু বোঝায়।

বোসদা ডান কানে পেন্সিলটা খুঁজে রেখেছিলেন। সেটা নামিয়ে নিয়ে একটা স্লিপ লিখতে আরম্ভ করলেন। লেখা বন্ধ করে বললেন, লজ্জা নিবারণের বস্ত্র ছাড়া আর কিছুই এখানে আনবার দরকার নেই। আর সব ব্যবস্থা আপনা-আপনি হয়ে যাবে।

তারপর একটু ভেবে বললেন, স্যরি, আর একটা জিনিস আনতে হবে। খুব প্রয়োজনীয় আইটেম। সেটা তোমার ভালো অবস্থায় আছে তো?

কোনটা? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

টুথ ব্রাশ। নিজের ব্রাশ ছাড়া, এখানে আর কিছুই আনবার প্রয়োজন নেই। যাও, আর দেরি কোরো না। কাসুন্দের মা হাজার-হাত-কালীকে পেন্নাম ঠুকে, হাওড়া মিউনিসিপ্যালিটির সঙ্গে কানেকশন কাট অফ করে, সোজা এই চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে চলে এসো। আমরা ততক্ষণ তোমাকে সিভিক রিসেপশন দেবার জন্যে প্রস্তুত হই।

মালপত্র সঙ্গে করে শাজাহান হোটেলের সামনের রাস্তায় যখন ফিরে এলাম, তখন এক বিচিত্র অনুভূতিতে মনটা ভরে উঠছিল। শাজাহান হোটেলের নিওন বাতিটা তখন জ্বলে উঠেছে। সেই নিওন আলোর স্বপ্নভায় হোটেল বাড়িটাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম।

হোটেল বাড়ি নয়তো—যেন ফ্রেমে-আঁকা ছবি। তার যুবতী অঙ্গে আধুনিক স্কাইস্ক্র্যাপারের ঔদ্ধত্য নেই; কিন্তু প্রাচীন আভিজাত্যের কৌলীন্য আছে। রাত্রের অন্ধকারে, সুন্দরী বধুর কাকনের মতো নিওন আলোর রেখাটা মাঝে মাঝে জ্বলে উঠছে। সেই আলোর তিন ভাগ। দুদিকে সবুজ, মধ্যিখানে লাল। জ্বলা-নেভার যা কিছু চটুলতা, তা কেবল সবুজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর লাল আলো দুটো যেন কোনো ক্ষুব্ধ দৈত্যের পাতাবিহীন রক্তচক্ষু।

যেন ইন্দ্রপুরী। বিরাট গাড়ি-বারান্দা শুধু হোটেলের দরজাকে নয়, অনেক ঝলমলে দোকানকেও আশ্রয় দিয়েছে। হোটেলেরই যেন অংশ ওগুলো। বই-এর দোকান আছে, সাময়িকপত্রের আড়ত আছে, ডাক্তারখানা আছে, ভারতীয় তাত-শিল্পের সেরা নিদর্শন বোঝাই সরকারি দোকান আছে; নটরাজের মূর্তি, হাতির দাঁত, কাঠের কাজ করা কিউরিও শপ আছে; শাজাহান ব্র্যান্ড কেক এবং রুটি বিক্রির কাউন্টার আছে। তা ছাড়া মোটরের শো রুম আছে, টাকা পাঠাবার পোস্টাপিস আছে, টাকা ভাঙাবার ব্যাঙ্ক আছে; কোট-প্যান্ট তৈরির টেলারিং শপ আছে, সেই কোট কাচবার আর্ট-ডয়ারস এবং ক্লিনার্স আছে। মানুষের খিদমত খাটিয়েদের এই বিচিত্র ভিড়ের মধ্যে মরা জানোয়ারদের জামা-কাপড় পরাবার জন্য জনৈক ট্যাক্সিডার্মিস্ট কীভাবে টিকে রয়েছে কে জানে। বাঘ, সিংহ এখন শিকার করে কে? আর করলেও, অত যত্নে এবং পয়সা খরচ করে কে সেই মরা বাঘের পেটে খড় এবং ঘাড়ে কাঠ পুরে তাকে প্রায় জ্যান্ত করে তোলবার চেষ্টা করে?

কিন্তু এই ট্যাক্সিডার্মিস্ট এখানে থাকবার পিছনে ইতিহাস আছে। এই হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা শিকার করতে ভালোবাসতেন; তার এক বন্ধুও শিকারের নেশায় পাগল ছিলেন। দোকানে ঢুকলে ওঁদের দুজনের একটা অয়েল-পেন্টিং দেখতে পাবেন—একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মৃতদেহের উপর পা দিয়ে বিজয়গর্বে শাজাহান হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা এবং তার বন্ধু দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সে পা কিন্তু সায়েব ভদ্রলোক চিরকাল রাখতে পারেননি। রয়েল বেঙ্গল কুলের কোনো সাহসী যুবক পরবর্তীকালে সুযোগ বুঝে স্কিনার সায়েবের পদাঘাতের প্রতিশোধ নিয়েছিল। শাজাহান হোটেলের মালিক সিম্পসন সায়েব এবং তার বন্ধু স্কিনার চারখানা পা নিয়ে শিকারে বেরিয়েছিলেন—ফিরে এলেন তিনখানা নিয়ে। স্কিনার সায়েবের ঘোরাঘুরির চাকরি ছিল। সে-চাকরি গেল। বন্ধুর জন্য সিম্পসনের চিন্তার অন্ত নেই। স্কিনার সাহেব একসময় শখ করে ট্যাক্সিডার্মির কাজ শিখেছিলেন। বন্ধু বললেন, তুমি দোকান খোললা, আমার হোটেলের তলায়-ঘরভাড়া লাগবে না। আর হোটেলের শিকারি অতিথিদের তোমার ওখানে পাঠাবার চেষ্টা করব।

তারপর এই একশ পঁচিশ বছর ধরে কত লক্ষ ভারতীয় বাঘ, সিংহ, হরিণ এবং হাতি যে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে, তা তো আমরা সবাই জানি। সেই সব অকালে-মরা অরণ্য-সন্তানদের কত মৃতদেহ আজও অক্ষত অবস্থায় সমুদ্রের ওপারে ইংলন্ডের ড্রয়িং রুমে শোভা পাচ্ছে, তাও হয়তো আন্দাজ করা যায়। সুতরাং বুঝতে কষ্ট হয় না, কেমন করে খোঁড়া স্কিনার সায়েব স্কটল্যান্ডে একটা প্রাসাদ কিনেছিলেন; কেমন করে সেই যুগে কয়েক লক্ষ টাকাকে পাউন্ডে পরিবর্তিত করে, তিনি লন্ডনের জাহাজে চেপে বসেছিলেন।

স্কিনার সায়েবের সাফল্যের এই গল্প আমার জানবার কথা নয়। শুধু আমি কেন, স্কিনার অ্যান্ড কোম্পানির বর্তমান মালিক মুক্তারাম সাহাও জানতে পারতেন কি না সন্দেহ, যদি-না ওই দোকানে ক্যাশকাউন্টারের পিছনে পুরনো ইংলিশম্যান কাগজের একটা অংশ সযত্নে ফ্রেমে-বাঁধা অবস্থায় ঝোলানো থাকত। স্কিনার সায়েবের বিদায় দিনে ইংলিশম্যানের সম্পাদক ওই বিশেষ প্রবন্ধ ছাপিয়েছিলেন।

বাঁধানো প্রবন্ধে একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ইংলিশম্যানের নিজস্ব শিল্পীর আঁকা শাজাহান হোটেলের স্কেচ। সেই স্কেচ আমি যত্নের সঙ্গে বহুক্ষণ ধরে দেখেছি। শাজাহান হোটেলের লাউঞ্জেও সেকালের কোনো নামহীন শিল্পীর খানকয়েক ছবি আছে। এই ছবিগুলোই নতুন আগন্তুককে প্রথম অভ্যর্থনা করে। তাকে জানিয়ে দেয়, এ পান্থনিবাস হঠাৎ-গজিয়ে-ওঠা আমরিকী হোটেল নয়, এর পিছনে ইতিহাস আছে, ট্র্যাডিশন আছে—সুয়েজ খালের পূর্বপ্রান্তের প্রাচীন পান্থশালা আপনাকে রাত্রিযাপনের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।

নিজের ছোট্ট ব্যাগটা নিয়ে যখন লাউঞ্জে ঢুকলাম, তখন সেখানে বাইরের কেউ ছিল না। সত্যসুন্দরদা রিসেপশন কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে নাটকীয় কায়দায় আমাকে অভ্যর্থনা করলেন।

আমার কেমন লজ্জা লজ্জা করছিল। সত্যসুন্দরদা হাসতে হাসতে বললেন, জানোই তো, লজ্জা-ঘৃণা-ভয়, তিন থাকতে হোটেলের চাকরি নয়।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো। আমার ডিউটি শেষ হবে, উইলিয়াম ঘোষ এসে পড়বে। ওকে চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে, দুজনে একসঙ্গে বহভেদ করে ভিতরে ঢুকব।

উইলিয়ম কি ওপরেই থাকে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

না, ও বাইরে থেকে আসে। বৌবাজারের মদন দত্ত লেনে থাকে। ওর সঙ্গে তোমার বুঝি আলাপই হয়নি? ভেরি ইন্টারেস্টিং বয়। সত্যসুন্দরবাবু বললেন।

আমার নজর এতক্ষণে লাউঞ্জের পুরনো ছবিগুলোর উপর এসে পড়ে ছিল। সত্যসুন্দরদাও কাজ শেষ করে বসেছিলেন। আমার সঙ্গে ছবি দেখতে আরম্ভ করলেন। দেখতে দেখতে বললেন, সত্যি আশ্চর্য! কবেকার কথা। কিন্তু কালের পরিবর্তন স্রোতকে উপেক্ষা করে সিম্পসন সায়েবের শাজাহান হোটেল সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।

অথচ আজও বাড়িটাকে দেখে কে বলবে, তার এত বয়েস হয়েছে? আমি বললাম।

বোসদা বললেন, আমাদের উইলিয়ম খুব ভালো ছড়া জানে। খুঁজে খুঁজে, অনেক বাংলা প্রবাদও ছোকরা স্টক করে রেখেছে। উইলিয়ম বলে, বাড়ির বয়স বাড়ে না। বয়স বাড়াবাড়ি সম্পূর্ণ নির্ভর করে মালিকের উপর। উইলিয়মের ডাইরিতে লেখা আছে :

ইমারতির মেরামতি
জমিদারির মালগুজুরি
চাকরির হাজরি।

মানে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

সত্যসুন্দরদা বললেন, উইলিয়ম ঘোষ এখানে থাকলে তোমাকে হয়তো অনেক মানে বোঝাত। আমার সোজাসুজি মনে হয়—ঠিক সময়ে বাড়ি। মেরামত করা, জমিদারির সরকারি খাজনা আর চাকরির হাজরি দেওয়া প্রয়োজন।

তা এ-বাড়ির মালিকরা মেরামতিতে কোনোদিন কার্পণ্য করেছেন বলে মনে হয় না। আমি বললাম।

ঠিক সময়ে চুন-সুরকির স্নো-পাউডার মাখে বলেই তো বুড়ি চেহারাটা অত আঁটসাঁট রাখতে পেরেছে, সত্যসুন্দরদা হাসতে হাসতে বললেন, তবে এ শুধু বাইরের রূপ, ভিতরটা ভালোভাবে না দেখে কোনো মন্তব্য করলে পরে আপসোসের কারণ হতে পারে! সত্যসুন্দরদা সকৌতুকে চোখ টিপলেন।

একটা পুকুরের ছবি দেখলাম। দূরে লাটসায়েবের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। এই পুকুরটা কলকাতার বুক থেকে কীভাবে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল বুঝতে পারছিলাম না।

সত্যসুন্দরদা বললেন, এইটাই তোমার সেই বিখ্যাত এসপ্ল্যানেডের পুকুর। ওই এসপ্ল্যানেডে এখন ট্রাম ঘোরাঘুরি করে। ওই পুকুর নিয়ে কত গল্পই যে আছে, সে-সব যদি জানতে চাও, তা হলে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। ভারি মজার মানুষ-পুরনো গল্পের যেন ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি। এত ঘটনাও যে ঘটেছিল, আর এত ঘটনাও যে মনে রাখা একটা লোকের পক্ষে সম্ভব, তাকে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। বুড়ো সায়েব, বহুকাল ধরে কলকাতায় রয়েছেন।

সত্যসুন্দরবাবু বললেন, ওঁর কাছেই শুনেছি, সে-যুগের লোকের বিশ্বাস ছিল, এই এসপ্ল্যানেড ট্যাঙ্কের কোনো তল নেই। যতদূর নেমে যাবে শুধুই জল। পুকুরটাতে অনেক মাছ ছিল। তারপর যখন ওই পুকুরের জল পাম্প করে তুলে ফেলবার সিদ্ধান্ত হল, তখন হোটেল-ডি-ইউরোপের মালিক ফিনবার্গ সায়েব সাড়ে ছশ টাকায় সমস্ত মাছ কিনে নিতে রাজি হলেন। জল ছেচা আরম্ভ হল। চৌরঙ্গী তখন লোকে লোকারণ্য। অতল দিঘির সত্যই তল খুঁজে পাওয়া যায় কি না তা দেখবার জন্য প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে লোকত্তা এসে ভিড় করে দাঁড়াত। এদিকে হোটেল-ডি-ইউরোপের মালিক রাত্রে ঘুমোতে পারছেন না; অতগুলো টাকা শেষ পর্যন্ত জলে না যায়—কত মাছ উঠবে কে জানে।

জল ঘেঁচে নর্দমায় ফেলা হতে লাগল; আর কুলির মাথায় বুড়ি করে পাঁক চালান দেওয়া আরম্ভ হল ময়দানে। ওই পাঁকেই তৈরি হল ডালহৌসি ক্লাবের মাঠ।

শুনেছি, সাড়ে ছশ টাকা লাগিয়ে হোটেল-ডি-ইউরোপের মালিক বহু টাকা লাভ করেছিলেন। কতরকমের মাছই যে পাওয়া গিয়েছিল। আর দৈত্যের মতো এক একটা রুই মাছ-মণখানেকের মতো ওজন। দুএকটা আবার পাঁকের মধ্যে লুকিয়েছিল। ফিনবার্গ সায়েবের লোকেরা হৈ হৈ করে কাদা থেকে সেগুলো তুলে নিয়ে এসেছিল।

মাছের গল্প হয়তো অনেকক্ষণ ধরে চলত। কিন্তু হঠাৎ কে যেন আমাদের পিছনে এসে দাঁড়াল। আমাদের চমকে দিয়েই প্রশ্ন করলে, চৌরঙ্গীর মাছগুলো যখন জলের দরে নিলামে বিকিয়ে যাচ্ছিল, তখন শাজাহান হোটেলের মালিক কী করেছিলেন?

বোসদা মুখ ফিরিয়ে বললেন, আরে উইলিয়ম। দেরি করলে যে?

একটু দেরি হয়ে গেল স্যাটা। কলকাতার ব্যাপার তো, ট্রামের মেজাজ সব সময় সমান থাকে না। আজ একটু বিগড়িয়ে গিয়েছিল। উইলিয়ম হেসে উত্তর দিলে।

উইলিয়ম ঘোষের দিকে এতক্ষণ আমি হাঁ করে তাকিয়েছিলাম। কালোর মধ্যে এমন সুন্দর চেহারা সহজে নজরে পড়ে না। পরনে যদি ধুতি থাকত, এবং রংটা যদি একটু ফর্সা হত তা হলে বলতাম কার্তিক। এমন কুচকুচে কাজল চোখ, একমাত্র ছোটবেলায় আমার পুটুদির ছিল। কিন্তু পুটুদি তার কালো হরিণ চোখে সযত্নে প্রচুর কাজল লাগাতেন। দূর থেকে উইলিয়মকে দেখলে ওই একই সন্দেহ হয়। কিন্তু কাছে এলে তবে বোঝা যাবে, ও-কাজল তার জন্ম থেকেই পাওয়া।

সাদা শার্টের উপর কালো রংয়ের প্রজাপতি টাই পরেছে উইলিয়ম ঘোষ। চলো গোঁফটা যেন গলার প্রজাপতির সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে কাটা হয়েছে। হাল্কা নীল রংয়ের প্যান্ট পরেছে উইলিয়ম। সঙ্গে একই রংয়ের কোট। বোতাম-খোলা কোটের মধ্য থেকে সাদা শার্টের বুকপকেটটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে সিল্কের রঙিন সুতো দিয়ে লেখা—s। এই এস যে শাজাহানের এস, তা না বললেও বোঝা যায়।

খাতাপত্তর বুঝিয়ে দিয়ে বোসদা বললেন, উইলিয়ম, তোমার কপাল ভালো। শুভদিনে তোমার নাইট ডিউটি পড়েছে।

উইলিয়মকে আর কিছুই বলতে হল না, সে যেন সব বুঝে নিয়েছে। এক নম্বর সুইট কি বুক হয়েছে? মিসেস…কি এসে গিয়েছেন?

মিসেস পাকড়াশী এখনও আসেননি। আজ হঠাৎ নিজে ফোন করে ঘরটা ঠিক করলেন। বোধহয় আগে থেকে জানতেন না। নিশ্চয়ই জরুরি কাজে ভদ্রলোককে হঠাৎ চলে যেতে হয়েছে।

টমসন এসেছে? উইলিয়ম ঘোষ প্রশ্ন করলে।

হ্যাঁ, টমসন এসে গিয়েছে। দুখানা দশ টাকার নোট তোমার বাঁধা!

ব্যাডলাক ব্রাদার! চামড়াটা সাদা হলে, দুখানা কেন, আরও অনেক দশ টাকার নোট রোজগার করতে পারতাম।

নেমকহারামি করো না, উইলিয়ম। মিসেস পাকড়াশী ছাড়া আর কাউকে কখনও রিসেপশনিস্টকে টাকা দিতে দেখিনি আমি। ভদ্রমহিলার মনটা খুবই ভালো।

উত্তরে উইলিয়ম কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই বোসদা বললেন, এবার মন চলো নিজ নিকেতনে। চামড়ার ব্যাগটা নিজের হাতে তুলে নিতে যাচ্ছিলাম। বোসদা ডাকলেন, পোর্টার।

পোর্টার দূরে টুলের উপর বসে ছিল। উঠে এসে আমাদের দুজনকে সে সেলাম করলে। কিন্তু বোসদা তার উপর চটে উঠলেন। টুপিটা বেঁকে রয়েছে কেন? ম্যানেজার সায়েব দেখলে, এখনি হাতে একটি চিঠি ভিড়িয়ে দিয়ে বিদায় করে দেবেন।

ঠিক সার্কাস দলের ক্লাউন। ক্লাউনদের ড্রেস দেখেই যেন শাজাহান হোটেলের পোর্টারদের ইউনিফর্ম তৈরি করা হয়েছিল। বেগুনি রংয়ের গলা বন্ধ কোট-অথচ হাতের অর্ধেকটা কাটা। হাতার মধ্যিখানে আবার সবুজ রংয়ের লম্বা লাইন। সেই লাইনটা প্যান্টের উপর থেকে নিচে পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। মাথায় ভেলভেটের গোল টুপি—সেখানেও ওই সবুজ রংয়ের দাগ। টুপি, কোট এবং প্যান্ট পরার পর একটা তুলি এবং বড়ো রুল-কাঠ নিয়ে কেউ যেন একটা সবুজ রংয়ের সরল রেখা টেনে দিয়েছে। টুপির রেখাটা মাঝে মাঝে বেঁকে যেতে বাধ্য-কারণ মাল তোলবার জন্য টুপিটা খুলে প্রায়ই কাঁধের স্ট্যাপে আটকে রাখতে হয়।

পোর্টার তাড়াতাড়ি টুপিটা সোজা করে নিয়ে বললে, কসুর মাফ কিজিয়ে, হুজুর। বোসদা বললেন, লাউঞ্জে অতগুলো আয়না রাখা হয়েছে কেন? দেখে নিতে পারিস না?

পোর্টার আমার হাতের ব্যাগটা তুলে নিল। আমরা দুজনে বোসদার পিছন পিছন চলতে শুরু করলাম। লিফটে যাবে, না হেঁটে? বোসদা জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর কী ভেবে বললেন, না, লিফটেই চলো৷ লিফ্ট চলতে আরম্ভ করল।

দোতলায় একবার থেমে লিট আবার উঠতে আরম্ভ করল।

দোতলায় সব ঘর গেস্টদের জন্যে। শুধু মার্কোপোলো কোনোরকমে টিকে রয়েছেন। তিনতলাতে একবার লিটে থামল। এয়ারকন্ডিশনের এক-ঝলক ঠান্ডা বাতাস মুখের উপর নেচে গেল। তিনতলায় শুধু গেস্ট।

তিনতলা থেকে লিষ্ট যেমনি আরও উপরে উঠতে আরম্ভ করল, সঙ্গে সঙ্গে যেন আবহাওয়ার পরিবর্তন শুরু হল। যে লিটম্যান এতক্ষণ মিলিটারি কায়দায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেও যেন হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এক হাতে পা চুলকোতে লাগল; ঠান্ডা হাওয়াটাও সুযোগ বুঝে যেন কাজে ফাঁকি দিয়ে গরম হতে আরম্ভ করল। বোসদা বললেন, এয়ারকন্ডিশন এলাকা শেষ হয়ে গেল। এবার আমাদের এলাকা।

দরজা খুলে লিফ্ট যেখানে আমাদের নামিয়ে দিলে সেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোলাপসেবল গেট বন্ধ করে যেমনি লিফ্ট আবার পাতালে নেমে গেল, সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো কেউ জোর করে আমাদের অন্ধকার কারাগারে বন্দি অবস্থায় ফেলে রেখে, গেট বন্ধ করে পালিয়ে গেল।

বেশিক্ষণ ওই অবস্থায় থাকলে হয়তো ভয় পেতাম। কিন্তু পোর্টার বাঁ হাত দিয়ে সামনের দিকে টেনে একটা দরজা খুলে ফেললে। একঝলক ইলেকট্রিক আলো দরজা ভেঙে সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে পড়লো। সেই আলোতে দেখলাম, দরজায় লাল অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা-PULL; দরজাটা পেরিয়ে যেতে সেটা আপনাআপনিই দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। দরজার এদিকে একইভাবে লেখা-PUSH।

ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। বোসদা হেসে বললেন, বুঝতে পারলে না! দুনিয়ার পুরনো নিয়ম। এদিক থেকে ঠেলো, ওদিক থেকে টানো। দুনিয়ায় যাদের কপাল, চওড়া, তাদের সৌভাগ্যের দরজা এইভাবেই খুলে যায়। আর অভাগাদের বেলায় ঠিক উলটো—যেদিক টানবার কথা, সেই দিকে ঠেলে, আর ঠ্যালার দিক থেকে টানা হয়। তাদের ভাগ্যের দরজা তাই কিছুতেই নড়তে চায় না। আমাদের মধ্যে পাছে সেই ভুল কেউ করে, সেইজন্য লিখে সাবধান করে দিয়েছি!

সমস্ত ছাদ জুড়ে ছোট ছোট অসংখ্য কুঠরি রয়েছে, যার মাথায় টালি, টিন, না-হয় এসবেস্টস।

ওইগুলোই আমাদের মাথা গোঁজবার ঠাই। আমাদের বিনিপয়সার পান্থশালা; আর শাজাহান হোটেলের অন্তরাল। বোসদা বললেন।

জানলার পর্দা টুইয়ে ঘরের ভিতর থেকে সামান্য আলো বাইরে এসে পড়েছে। আকাশ অন্ধকার।

অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারিনি। প্রায়-উলঙ্গ কোনো মহিলা যেন একটা ইজি-চেয়ারে বসেছিলেন। আমাদের দেখে দ্রুতবেগে সেই নারীমূর্তি কোথায় ঢুকে পড়লেন।

আমি যে সঙ্গে রয়েছি তা যেন ভুলে গিয়ে বোসদা আপন মনে শিস দিতে দিতে নিজের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

বোসদার ঘরও অন্ধকার। সাদা পোশাকপরা একজন বেয়ারা ছুটে এল। তাকে দেখে বোসদা মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বললেন-হে রাত্রিরূপিণী, আলো জ্বালো একবার ভালো করে চিনি!

সত্যসুন্দরবাবুর ঘরে আলো জ্বলে উঠল। ঘরটার তেমন কোনো আব্রু, নেই। দেওয়ালগুলোও ইটের নয়। আসলে কাঠের কেবিন। পশ্চিমে আর উত্তরদিকে দুটো ছোট ছোট জানলা আছে। দক্ষিণে এক পাল্লা দরজা, ঠিক রাস্তার উপরেই। দরজা খোলা রাখলে ভিতরের সবকিছু দেখা যায়।

ঘরের ভিতরে ঢুকেই সত্যসুন্দরদা প্রথমে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকে থেকে তিনি বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। দুএক মিনিট মড়ার মতো চিত হয়ে পড়ে থাকবার পর, সত্যসুন্দরদার দেহটা একটু নড়ে উঠল। শোয়া অবস্থায় তিনি বেয়ারাকে ডাকলেন। বেয়ারা মহলে সত্যসুন্দরদার প্রতাপের নমুনা পেলাম। সে ঘরের মধ্যেই, কোনো কথা না বলে সত্যসুন্দরদার পা থেকে জুতোটা টেনে বার করে নেবার জন্যে ফিতে খুলতে লাগল।

বেয়ারা সাবধানে জুতো জোড়া খাটের তলায় সরিয়ে দিয়ে, অভ্যস্ত কায়দায় পায়ের মোজা দুটোও খুলে নিল। পাশে একটা সস্তা কাঠের রং-ওঠা আলমারি ছিল। সেইটা খুলে বেয়ারা একজোড়া রবারের স্লিপার খাটের কাছে রেখে দিল।

সত্যসুন্দরদা বললেন, তোমাদের দুজনের আলাপ হওয়া প্রয়োজন। বেয়ারার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ইনি আমার গার্জেন, গুড়বেড়িয়া। আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, বস গুড়বেড়িয়া, এই বঙ্গসন্তান নতুন চাকরিতে ঢুকেছেন। শাজাহান হোটেলের ঘোটলাট সায়েব বলে এঁকে জানবে। রোজি মেমসায়েবের ঘরে আপাতত ইনি থাকবেন।

গুড়বেড়িয়া বেচারা বিনয়ে গলে গিয়ে, মাথার পাগড়ি সমেত ঘাড় নামিয়ে আমাকে নমস্কার করলে।

সত্যদা বললেন, গুড়বেড়িয়া, ৩৬২-এ ঘরের চাবিটা নিয়ে এসো। সায়েব ওঁর নিজের ঘরে চলে গিয়ে এখন বিশ্রাম নেবেন।

গুড়বেড়িয়া সঙ্গে সঙ্গে অ্যাবাউট-টার্ন করে প্রায় ছুটতে ছুটতে চাবির সন্ধানে চলে গেল। সত্যদাকে বললাম, বাঃ, বেয়ারাটি বেশ তো।

সত্যদা হেসে ফেললেন, এখন বেশ না হয়ে ওর উপায় নেই। শ্রীমান গুড়বেড়িয়া বর্তমানে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন।

মানে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

আগে তিনতলায় ডিউটি পড়তো ওর। সেদিন আধ ডজন কাপ ভেঙে ফেলায়, কর্তারা এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। হোটেলের অতিথিদের কাছ থেকে বদলি হয়ে শাজাহানের স্টাফের সেবায় আত্মনিয়োগ করাটা অনেকটা বার্মা শেলের চাকরি ছেড়ে মাখনলাল হাজরার গোলদারি মসলার দোকানে খাতা লেখার কাজ নেওয়ার মতো। বেচারাকে হাতে না মেরে ভাতে মেরেছেন ম্যানেজার সায়েব। বকশিশের ফোয়ারা থেকে ছাদের এই মরুভূমিতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এদিকে হেড বেয়ারা পরবাসীয়া নিজের মেয়ের সঙ্গে ওর একটা সম্বন্ধ করছিল। শ্রীমানের এই আকস্মিক ভাগ্যবিপর্যয়ে সেও পেছিয়ে যাবার মনস্থ করেছে। বেচারা এখন তাই আমার সেবা করে বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার চেষ্টা করছে। ওর ধারণা, পরবাসীয়া এবং মার্কোগোলো দুজনের উপরই আমার বেজায় প্রভাব। আমার কোনো অনুরোধই ওঁরা নাকি ঠেলতে পারবেন না।

সত্যদা আরও কিছু হয়তো বলতেন। কিন্তু চাবি হাতে গুড়বেড়িয়া এসে পড়াতে তিনি চুপ করে গেলেন। গুড়বেড়িয়া আমাকে বললে, চলুন হুজুর।

সত্যদা বললেন, আমার কি আর তোমার সঙ্গে যাবার প্রয়োজন আছে?

মোটেই না। গুড়বেড়িয়া আমাকে সব দেখিয়ে দেবে।-বলে ওঁর কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

৩৬২-এ ঘরটা যে কয়েকদিন খোলা হয়নি, তা দরজার উপরে জমে ওঠা ধুলো থেকেই বোঝা যাচ্ছে। চাবি খুলে ভিতরের আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েই গুড়বেড়িয়া বোধহয় অন্য কোনো কাজে সরে পড়ল।

ঘরের মধ্যে ঢুকেই আমি কিন্তু বেশ অস্বস্তির মধ্যে পড়লাম। এই ঘরেই যে রোজি থাকত, তা ঢোকামাত্রই ড্রেসিং টেবিলের উপর যত্ন করে রাখা প্রসাধন সরঞ্জাম দেখেই বুঝতে পারলাম। যাবার সময় রোজি বোধহয় কিছুই নিয়ে যায়নি। ওর জিনিসপত্তর সবই পড়ে রয়েছে, মনে হল। যেন একটু আগে ছুটি নিয়ে মেয়েটা সিনেমা দেখতে গিয়েছে, এখন আবার ফিরে আসবে। এবং এসেই দেখবে তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে একটা অচেনা পুরুষ গোপনে তার শোবার ঘরে ঢুকে বসে রয়েছে।

এ-ঘরটা ছাদের পূর্বপ্রান্তে। ভিতর এবং বাইরের দেওয়াল ও দরজা ঘন সবুজ রংয়ের। মাথার উপর চটের সিলিঙটা কিন্তু সাদা। ছোট্ট ঘর। একটা খাট, একটা ড্রেসিং টেবিল এবং একটা ওয়াড্রোব প্রায় সবখানি জায়গা দখল করে বসে আছে। চেয়ার আছে কিন্তু মাত্র একটা। কৌতূহলী আগন্তুকদের সংখ্যা সীমাবদ্ধ রাখার জন্যই যেন চেয়ারের এই ইচ্ছাকৃত কৃত্রিম অনটন।

রোজির বিছানার উপর একটা রঙিন চাদর ঢাকা ছিল। তার উপরে বসেই জুতোটা খুলে ফেললাম। জামা ও প্যান্ট পাল্টিয়ে, বাঙালি কায়দায় একটা কাপড় পরতে পরতেই যেন সোঁ সোঁ করে আওয়াজ আরম্ভ হল। আকাশ যে কখন কালো মেঘে ভরে গিয়েছিল খেয়াল করিনি। প্রকৃতির প্রতি আমাদের ইচ্ছাকৃত অবজ্ঞাতে বিরক্ত হয়েই যেন, কালবৈশাখ তার ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করলেন।

হাওয়ার দৌরাত্ম্যে ৩৬২-এ ঘরের দরজাটা দেওয়ালের উপর আছড়ে পড়তে আরম্ভ করল। বাইরে থেকে চাবিটা খুলে নিয়ে, ভিতর থেকে দরজায় চাবি লাগিয়ে দিলাম। জানলাগুলোও তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিতে হল—কিন্তু তার আগেই বৃষ্টির ছাঁট এসে বিছানার কিছু অংশ ভিজিয়ে দিয়ে গেল। মাঝেমাঝে বিদ্যুতের চকমকি জানলার সামান্য ফাটলের মধ্যে দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে আমাকে যেন শাসিয়ে গেল। ওরা যেন বুঝতে পেরেছে, এ-ঘরে আমি অনধিকার-প্রবেশকারী।

বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। টিনের ছাদের উপর পাড়ার একদল বিশ্ববকাটে ছোঁড়া যেন অবিশ্রান্তভাবে তবলার চাটি মেরে চলেছে। আমি যে ছাদের মাথায় একটা ছোট্ট ঘরে বসে আছি, মনেই রইল না। যেন লোকবসতি থেকে বহুদূরে কোনো নির্জন দ্বীপে, আমি নির্বাসিত জীবন যাপন করছি। অবশিষ্ট পৃথিবীর সঙ্গে আমার সকল সংযোগ যেন চিরকালের মতো ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।

জামাকাপড়গুলো রাখবার জন্য আলমারিটা খুলেই চমকে উঠলাম। রোজির অনেকগুলো গাউন সেখানে হ্যাঙারে ঝুলছে। পাল্লা খোলামাত্র বাইরের হাওয়া এসে গাউনের ফুলবনে যেন বিপর্যয় বাধিয়ে বসল। সিল্ক, রেয়ন আর নাইলনের অঙ্গবাসগুলো নারীসুলভ চপলতায় খিল খিল করে হাসতে হাসতে একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। ওরা যেভাবে ঝুলছে, তার মধ্যেও যেন ভয়ানক কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে—প্রথমে ঘন কালো, তারপর ঘন সবুজ, এবার সাদা, তারপর টকটকে লাল। মাইনের সব টাকাই ভদ্রমহিলা বোধহয় জামা কিনতে খরচ করতেন। আলমারির বাঁদিকের পাল্লাতে ব্রাইট স্টিলের ফ্রেমে বন্দি একটা ছবি যেন ক্রসবিদ্ধ হয়ে রয়েছে।

ফ্রেমের মধ্যে বসে-থাকা মহিলাটিই যে রোজি, তা কেউ বলে না-দিলেও আমার বুঝতে দেরি হল না। এমন সর্বনাশা ভঙ্গিতে কোনো মেয়ে যে নিজের ছবি তুলতে দিতে রাজি হতে পারে, এবং তুললেও নিজের কাছে সযত্নে রাখতে পারে তা এ-ছবিটা না দেখলে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারতাম না। রোজির সম্পূর্ণ দেহটা ওখানে নেই। অর্ধেকও নেই। কিন্তু যতটুকু আছে, তার সবটুকুই এক পৈশাচিক প্রভাবে হাসছে। রোজির পুরু ঠোঁট দুটো সামান্য উল্টে রয়েছে। চোখ দুটো যেন নিজেরই দেহের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইছে।

ওর চুলগুলো কোকড়া—আফ্রিকার কোনো গহন অরণ্যের বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া কাহিনির ইঙ্গিত রয়েছে যেন ওই সাপের ফণাওয়ালা চুলগুলোর মধ্যে। এই মেয়ে টাইপ করে! ওর দাঁতগুলো ছবিতে ঠোঁটের মধ্যে দিয়ে সামান্য উঁকি দিচ্ছে। আলো আঁধারে ছায়াতে ভোলা ছবি। কিন্তু কে যেন ওর দাঁতগুলোর উপর আলো ফেলে সেগুলোকে স্পষ্ট করে তুলেছে। সেই আলোরই খানিকটা আইন অমান্য করে ওর বুকের উপরে এসে পড়বার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু রোজি বুঝতে পেরে তা হতে দেয়নি। শিথিল অঙ্গবাস দ্রুতবেগে ঠিক করে নেবার চেষ্টা করছিল।

ওকে ইউরেশীয় ভেবেছিলাম। কিন্তু ছবিতে যেন আর এক মহাদেশের ইঙ্গিত পেলাম। ওর চোখে, মুখে, দেহে সর্বত্র যে মহাদেশটি ছড়িয়ে রয়েছে, তার একসময় নাম ছিল অন্ধকার মহাদেশ–এখন অন্ধকার তুলে দিয়ে শুধু বলে আফ্রিকা।

আর কোথাও রাখবার জায়গা নেই বলেই আমার জামা-কাপড়গুলো আলমারির মধ্যেই ঢোকাতে হলো।

এই ঘরে রোজি নেই বটে, কিন্তু সারাক্ষণই অশরীরিণী রোজি উপস্থিত রয়েছে। এই প্রাচীন হোটেলবাড়ির বিদেহী আত্মারাও বোধহয় রাত্রের অন্ধকারে, ক্যাবারে কনসার্টের কোলাহল থেকে দূরে, এই খালি ঘরখানাতে আশ্রয় নিয়েছিল। গঙ্গার ওপার থেকে কাসুরে এক ছোঁড়া তাদের শান্তির আশ্রয়ে অহেতুক যেন বিঘ্ন ঘটাতে এসেছে। বাইরে বিরক্ত বৈশাখের বৃষ্টি তাই তিক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করছে, কে গা? কে তুমি?

 

সে-রাত্রের কথা মনে পড়লে, এতদিন পরেও আমার হাসি লাগে। নিজের ছেলেমানুষিতে নিজেই অবাক হয়ে যাই! কিন্তু তখন মনে হয়েছিল, প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে বিরক্ত বৃষ্টি ঝড়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দাপাদাপি শুরু করেছে। শাজাহান হোটেলের শতাব্দী-প্রাচীন আত্মা আরও জোরে জিজ্ঞাসা করছে, কে তুমি? কেন তুমি এখানে?

ঘরের সঙ্গেই বাথরুম। এই কদিন ওটার দিকেও কেউ যেন নজর দেয়নি। বাথটাবের ভিতর খানিকটা সাবানগোলা জল জমা হয়ে রয়েছে। টাবের ফুটোটা বাঁ-হাত দিয়ে খুলে দিলাম। জলটা বেরিয়ে যেতে, কলের মুখটা পুরোপুরি ঘুরিয়ে দিলাম। তোড়ে জল বেরিয়ে, টাবটা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেল। কিন্তু বাথরুমের মধ্যেও যেন রোজি রয়েছে। তার সাবানদানি, টয়লেটের সরঞ্জাম, টুথপেস্ট, ব্রাশ অনাদৃত রয়েছে।

অনভ্যস্ত আমি বৃষ্টিটা থামলে যেন একটু ভরসা পেতাম। বোসদাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, এ কোথায় এলাম?

বোসদা নিশ্চয়ই, তার স্বভাবসুলভ রসিকতায় উত্তর দিতেন, কলকাতার প্রাচীনতম শাজাহান হোটেলে।

হ্যাঁ, প্রাচীনতম। বোসদার কাছেই শুনেছিলাম—

সে কিছু আজকের কথা নয়। কোন দূর শতাব্দীর এক অখ্যাত বর্ষামুখর অপরাহ্নে জব চার্নক নামে এক ভদ্রলোক হুগলি নদীর তীরে এই কলকাতায় তাঁর তরী ভিড়িয়েছিলেন। সেদিন তার কষ্টের অবধি ছিল না। কিন্তু সেই ক্লান্ত অতিথিকে আশ্রয় দেবার জন্য কোনো সরাইখানার দরজা খোলা ছিল না। সুতানুটি হুগলির লোকেরা তখন হোটেল বা সরাইখানার নামও শোনেননি। জীবন তখন ছিল অনেক কঠিন। সে-রাত্রে চানক সায়েব নিজেই নিশ্চয় সব ব্যবস্থা করেছিলেন, যেমন অনাদিকাল থেকে বিদেশি পথিকরা করে এসেছেন।

তারপর কতদিন কাটল। নীল সমুদ্রের ওপার থেকে আরও কত আগন্তুক কলকাতার মাটিতে পদার্পণ করলেন। কিন্তু তখনও তাদের আশ্রয়ের জন্য কলকাতার নোনামাটিতে কোনো হোটেল গজিয়ে ওঠেনি।

হাসতে হাসতে বোসদা বলেছিলেন, ছোটোবেলায় রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা মুখস্থ করেছিলাম, কিন্তু তখন তার মানে বুঝতে পারিনি-দেশে দেশে মোর ঘর আছে, আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া। এখন বুঝি, কবি যা মিন করেছিলেন, তা হলো–পৃথিবীর সব দেশেই হোটেলের ঘর রয়েছে। অনেক ঘরই দেখছি, কিন্তু কোনোটাই তেমন পছন্দ হচ্ছে না। এখনও মনের মতো ঘর খুঁজে মরছি। কবি যদি আরও একশ বছর আগে জন্মগ্রহণ করতেন, তা হলে অমন সুন্দর কবিতাটা লেখা হতো না। কারণ তখন তো ক্যালকাটাতে কোনো হোটেলই ছিল না।

কলকাতার বুকে তখন যা গজিয়ে উঠছে তার নাম ট্যাভার্ন। আমাদের উইলিয়ম ঘোষের ভাষায়, মদ বোঝাই করবার পেট্রোলপাম্প। হুগলি নদীর তীরে জাহাজ বেঁধে রেখে আনন্দপিয়াসী ঘর ছাড়া নাবিকের দল ছুটে আসত কলকাতার সরাইখানায়। জীবনের কত বিচিত্র অধ্যায়ই না সেদিন অভিনীত হতো এই রঙ্গমঞ্চে!-বোসদা বলেছিলেন।

এতদিন পরে, অন্য এক শতাব্দীর উন্মাদ কোলাহল সত্যিই যেন আমার কানে এসে বাজতে লাগল। সেদিনের তপ্ত কামার্ত নিঃশ্বাস যেন আজ রাত্রে আমার অসতর্ক দেহের উপর এসে পড়েছে। প্রথমে দেহটা কেমন যেন শিরশির করে উঠেছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিতে পেরেছিলাম। মনে পড়ে গিয়েছিল, যে বিশালপুরীর সবচেয়ে উপরতলার নির্জন ঘরে এই বিজন রাত্রে আমি জেগে রয়েছি এবং সেখানে আমি আরও অনেক রাত্রি যাপন করব, সেখানেও ইতিহাসের কত অনধীত ধুলোয় মলিন হয়ে পায়ের তলায় পড়ে রয়েছে।

যে-বাড়িতে আমি প্রভাতের মিলন প্রতীক্ষা করছি, সোনার আলোর রথে চড়িয়ে রূপসী রাত্রিকে যে-বাড়ি থেকে বিদায় দিতে চাই, সেটি আজকের নয়। এই শতাব্দীরও নয়।

কোনো কিছুই স্থায়ী হয় না, এই আজব নগরে—বোসদা বলেছিলেন। জীবন? সেও স্থায়ী নয়। অমন যে জবরদস্ত চার্নক সায়েব, তিনিও দুবছরের মধ্যে কলকাতার এই নোনা মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তাঁকে তাড়াতাড়ি কবরের গর্ভে পুরে, তরে যেন শান্তি পেয়েছিল কলকাতা।

গতকাল সত্যসুন্দরদা বলেছিলেন, খ্যাতি? সেও এখানে পদ্মপত্রে জলের মতোই দীর্ঘস্থায়ী। গতকাল যিনি রাজা ছিলেন, শাজাহান হোটেলের সব চেয়ে দামী ঘরে রাত্রিযাপন করেছিলেন, আজ তিনি কুকির হয়ে কলকাতার পথে আশ্রয় নিয়েছেন। এই শহরের জীবন, যৌবন এবং অন্য সবই যেন ক্ষণস্থায়ী। মহাকালকে চোখ রাঙিয়ে, কলকাতার মাটিতে কোনো কিছুই দাঁড়িয়ে থাকতে সাহস করে না।

এরই মধ্যে অবিশ্বাস্য দম্ভে শাজাহান হোটেল দাঁড়িয়ে রয়েছে। বোসদা বলেছিলেন, বহু রাত্রির বহু দুঃখ, শোক, আনন্দ, উৎসব, কামনা, লোভ, গ্রহণ ও ত্যাগের ইতিহাস বুকের মধ্যে জমিয়ে রেখে আজও সে বেঁচে রয়েছে। কিন্তু সময়কে এমনভাবে অবজ্ঞা করে যে সে এতদিন টিকে থাকবে, তা সিম্পসন সায়েবও ভাবতে পারেননি।

সেন্ট জন্স চার্চের কবরখানা থেকে উঠে পড়ে, আজ রাত্রে বৃষ্টির সুযোগ নিয়ে দারোয়ানকে ফাঁকি দিয়ে সিম্পসন সায়েব যদি তাঁর প্রিয় শাজাহান হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ান, তবে তিনি অবাক হয়ে যাবেন। তার কীর্তির রথ তাকে বহু পিছনে ফেলে রেখে কলকাতার রাজপথ ধরে এগিয়ে চলেছে। বিস্ময়ে রুদ্ধবা হবেন সিম্পসন সায়েব। অনেক দিন আগে লোকে তাকে পাগল বলেছিল। জিজ্ঞাসা করেছিল, আজকাল সারাক্ষণ কি তুমি মদের নেশায় রয়েছ?

সিম্পসন রাগ করে বলেছিলেন, আমি টি-টোটালার—আমি মদ স্পর্শ করি না।

তা হলে কি লাস্যময়ী প্রাচ্যের অহিফেনের আশীর্বাদে রঙিন স্বপ্ন দেখছ? তারা প্রশ্ন করেছিল।

স্বপ্ন নয়, প্ল্যান করছি। ব্যবসার বুদ্ধি। আকাশে ফোর্ট উইলিয়ম তৈরি করার প্ল্যান!

তা কেন? এই ফোর্ট উইলিয়মের পাশেই, মাটির বুকে একটা হোটেলের প্ল্যান করছি। কলকাতা ভারতবর্ষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। ফলে অনেককে এখানে আসতে হবে। মাথা গুঁজবার ঠাই-এর জন্যে তারা ট্যাকের কড়ি খসাতে দ্বিধা করবে না। তাদের জন্যে আমি এমন এক হোটেল তৈরি করব, যা দেখে শুধু তোমরা নও, তোমাদের সন এবং গ্র্যান্ডসনরাও এই সিম্পসনকে ধন্যবাদ দেবে। আমার কোনো স্ট্যাচু থাকবে না, কিন্তু শাজাহান হোটেলের প্রতিটি ব্রেকফাস্ট, প্রতিটি লাঞ্চ এবং প্রতিটি ডিনারের মধ্যে আমি বেঁচে থাকব।

সিম্পসন সায়েব সেদিন সন এবং গ্র্যান্ডসনকে ডিঙিয়ে ভবিষ্যতের আরও গভীরে উঁকি মারতে সাহস করেননি। আজ রাত্রে সেন্ট জম্স চার্চের ফাদারদের সন্ধানী চোখকে ফাঁকি দিয়ে সিম্পসন সায়েব যদি পালিয়ে আসতে পারেন, তাহলে তার হোটেলে যাদের দেখতে পাবেন, তারা তাঁর পরিচিত বন্ধুদের গ্র্যান্ডসন নয়, গ্র্যান্ডসনের গ্র্যান্ডসনও নয়। গ্রেট, গ্রেট, গ্রেট—যতগুলো ইচ্ছে গ্রেট বসিয়ে দিয়ে, আমাদের এই ছাদে এসে তিনি দাঁড়াতে পারেন।

হঠাৎ দরজায় ধাক্কা শুনতে পেলাম। কে যেন বার বার ন করছে। ধড়মড় করে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখি গুড়বেড়িয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে। বৃষ্টি কখন থেমে গিয়েছে।

গুড়বেড়িয়া বললে, হুজুর, আপনি আলো জ্বেলে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?

সত্যি। বৃষ্টির ঘুমপাড়ানি ছন্দে, কখন যে চোখে ঘুম নেমে এসেছিল বুঝতে পরিনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, রাত্রি অনেক হয়েছে।

গুড়বেড়িয়ার উপর রাগ হল। এত রাত্রে এমনভাবে ডেকে তোলবার কী প্রয়োজন ছিল?

মনে হল গুড়বেড়িয়া ভয় পেয়ে গিয়েছে। বললে, হজুর, রাত্রে আলো জ্বালিয়ে এমনভাবে ঘুমিয়ে পড়বেন না। আপনারও মুশকিল, আমারও মুশকিল।

চোখের পাতা দুটো রগড়াতে রগড়াতে বললাম, কেন?

গুড়বেড়িয়া ফিসফিস করে বললে, সিম্পসন সায়েব পছন্দ করেন না। কোনো কিছুর অপচয় তিনি দেখতে পারেন না।

সিম্পসন সায়েব?

হ্যাঁ, হুজুর, গুড়বেড়িয়া বললে। যারা রাত্রে ডিউটি দেয়, তারা সবাই ওঁকে ভয় করে। রাত্রে তিনি যে ইন্সপেকশনে আসেন। বড্ড কড়া সায়েব, হুজুর। একটুও মায়া দয়া নেই। সারারাত একতলা, দোতলা, তিনতলা, চারতলা ঘুরে ঘুরে বেড়ান।

সিম্পসন সায়েবকে তোমরা চেনো?

হ্যাঁ হুজুর। এই হোটেলের এক নম্বর মালিক। ডান পা-টা একটু টেনে টেনে চলেন। ওঁকে আমরা সবাই চিনি।

গুড়বেড়িয়ার গলা যেন শুকিয়ে আসছে। টোক গিলে গলাটা ভিজিয়ে নেবার চেষ্টা করে সে বললে, ওই সায়েবের জন্য রাত-ডিউটিতে একটু বিশ্রাম করবার উপায় নেই।

গভীর দুঃখের সঙ্গে গুড়বেড়িয়া বললে, হুজুর, মানুষ-সায়েবকে বুঝি। কিন্তু ভূত-সায়েব বড়ো নিষ্ঠুর; একটুও মায়া দয়া করে না।

গুড়বেড়িয়া বললে, তখন আমি নতুন চাকরিতে ঢুকেছি হুজুর। রাত দুটো বাজে। সমস্ত গেস্ট ঘুমিয়ে পড়েছে। সব ঘর ভিতর থেকে চাবিবন্ধ। একটুও শব্দ নেই কোথাও। করিডরের আলো নিভিয়ে দিয়েছে। শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছিল না। একটু ঝিমুনির মতো আসছিল। টুলের উপর বসে, পা দুটো তুলে সবে একটু চোখ বুজেছি। এমন সময় মনে হলো, কে যেন আমার কোমরের বেল্ট খুলে নিচ্ছে।

চমকে উঠে বেল্টটা চেপে ধরতেই বুঝলাম সিম্পসন সায়েব এসেছেন। তখন হুজুর ওঁর পা জড়িয়ে ধরতে গেলাম, কিন্তু হুজুর ভূতের পা কিছুতেই ধরা যায় না। অথচ কোমরের বেল্টটা এবার খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে। শেষে কাঁদতে আরম্ভ করলাম। বললাম, আমি নতুন লোক, সায়েব। আর কখনও ভুল হবে না।

উনি কোনো কথায় কান না দিয়ে, বেল্ট নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত কী ভেবে, তিনতলার শেষ কোণে বেল্ট ফেলে রেখে চলে গেলেন।

গুড়বেড়িয়ার কথা শুনে আমি আধা ঘুমন্ত অবস্থাতেও হেসে ফেলতে যাচ্ছিলাম।

গুড়বেড়িয়া বললে, হাসবেন না, হুজুর। হাবসি সায়েবকে জিজ্ঞাসা করবেন। এখানে সবাই জানে, সিম্পসন সায়েব বেঁচে থাকতে, সারারাত ঘুরে বেড়াতেন। দেখতেন, সবাই কাজ করছে কি না। কাউকে ঘুমোতে দেখলেই, তার বেল্ট খুলে নিতেন। পরের দিন সকালে জরিমানা দিয়ে বেল্ট খালাস করতে হতো। বেল্ট না পরে ডিউটিতে আসা একদম বারণ ছিল।

আলো না-নেভাবার জন্য গুড়বেড়িয়ার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আমি ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। সেই সময় সিঁড়ির কাছে চার-পাঁচজনের খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। সেই মিলিত হাস্যে নারী ও পুরুষের কণ্ঠস্বর ছিল।

গুড়বেড়িয়া চাপা গলায় বললে, আমি চললাম। আপনিও আর কথা বলবেন না।

কিছু বুঝতে না পেরে, একটু রেগে বললাম, কেন?

ফিসফিস করে গুড়বেড়িয়া বললে, অনেক রাত হয়েছে। ল্যাংটা মেমসায়েবরা ঘরে ফিরে আসছেন। আপনি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ুন। আমাকে এক ভয়াবহ রহস্যের মধ্যে ফেলে রেখে গুড়বেড়িয়া দ্রুতবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আলো নেভালাম, শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম আসে না। আমার পরিচিত কাসুরে দরিদ্র ঘুম যেন শাজাহান হোটেলে ঢুকতে সাহস করছে না।

ওদিকে ছাদের উপর কারা খিলখিল করে হেসে উঠছে। সিঁড়ি বেয়ে হৈহৈ করে যে মেমসায়েবরা উপরে উঠে এলেন, গুড়বেড়িয়া যাদের এক অদ্ভুত নামে ডাকল, তাদেরই গলা। ঠিক আমারই পাশের ঘরে ওঁদের দু একজন এসে ঢুকলেন। পাতলা কাঠের পার্টিশনের মধ্যে দিয়ে তাদের গলার আওয়াজ পুরোপুরি ভেসে আসছে। তারাও কিছু চাপা গলায় কথা বলবার চেষ্টা করছেন না।

আমার ঘর অন্ধকার হলেও ওঁদের ঘরে আলো জ্বলছে। এবং সেই আলোরই কিছুটা কাঠের পার্টিশনের ফাঁক দিয়ে আমার ঘরে অনধিকার প্রবেশ করছে।

বাটলার, বাটলার! ও-ঘর থেকে নারীকণ্ঠে কে যেন ডেকে উঠলেন।

বেচারা গুড়বেড়িয়া যে ও-ঘরে ছুটে গেলো, তা বিছানায় শুয়ে শুয়েই আমি বুঝতে পারলাম।

ইউ বাটলার হ্যায়? মেমসায়েব বিরক্ত হয়েই প্রশ্ন করলেন।

না মেমসাব। আই গুড়বেড়িয়া ওয়েটার।

শুধু ওয়েটার বললেই ভালো করত। কিন্তু মধ্যিখানে নিজের নামটা ঢুকিয়ে দিয়েই গুড়বেড়িয়া মেমসায়েবকে আরও বিপদে ফেলে দিলে। কয়েকটা অশ্লীল শপথ করে মেমসায়েব বললেন, তুমি কী ধরনের ওয়েটার? সঙ্গে বোধহয় আরও কোনো ভদ্রমহিলা বসে ছিলেন। কারণ, শুনতে পেলাম মেম সায়েব বলছেন, আই টেল ইউ মামি, দিস ইজ মাই লাস্ট ভিজিট টু ইন্ডিয়া। এই শেষ, আর কখনো এই পোড়া দেশে আসব না।

ইন্ডিয়াতে এসে মহিলা যে প্রচণ্ড ভুল করেছেন, সে-কথা মেমসায়েব তার মাকে বার বার বোঝাতে লাগলেন। মামি, এত জায়গা থাকতে ইন্ডিয়াতে আসতে কেন তুমি রাজি হলে? মেমসায়েব জিজ্ঞাসা করলেন।

এঁরা কারা? বুঝতে পারছি না। কিন্তু সারা রাতই যে তারা কথা বলে কাটিয়ে দিতে পারেন তা বুঝলাম।

মেমসায়েব এবার গুড়বেড়িয়াকে শুদ্ধ ইংরিজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, হুইস্কির হিন্দি কি?

হুইস্কির হিন্দি যে হুইস্কিই, তা শুনে বললেন, চাই। এখনই চাই।

বার আন্ডার লক অ্যান্ড কি–গুড়বেড়িয়া খানিকটা ইংরিজিতে, খানিকটা মাতৃভাষায় বুঝিয়ে দিলে, বার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন ঠান্ডা পানি ছাড়া আর কিছুই সে দিতে পারবে না।

ও মামি, তুমি আমাকে কোন ফরেস্টে নিয়ে এসেছ? বলে মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করলেন।

মা বোধহয় তখন সান্ত্বনা দিতে লাগলেন, কেমন করে জানব, ক্যালকাটায় রাত একটার পর কোনো বার খোলা থাকে না? সোনা আমার, বাছা আমার, ঘুমিয়ে পড়বার চেষ্টা করো, এখনই ভোর হয়ে যাবে।

মেয়ে তখন গালাগালি শুরু করেছেন। গেট আউট, গেট আউট। আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যা। তুই শুধু আমার টাকা ভালোবাসিস। ওনলি মানি। টাকার বদলে মেয়েকে তুই শার্কদের কাছেও ছেড়ে দিতে রাজি আছিস।

প্যামেলা, প্যামেলা—ভদ্রমহিলা কাতরভাবে মেয়েকে সংযত করার চেষ্টা করলেন।

বেরিয়ে যা! বেরিয়ে তুই নিজের ঘরে যা, আমি এখন আনড্রেস করব। আমার সামনে কেউ থাকবে না। মেয়ে দাঁত চেপে চিৎকার করে উঠলেন।

মাই ডিয়ার গার্ল, আমি তোমার মা। মায়ের কাছে তোমার সঙ্কোচ থাকতে পারে না। আমারও মা ছিল। আমি তো কখনও অবাধ্য হতাম না। ভদ্রমহিলা বোঝাবার চেষ্টা করলেন।

ও, সেইজন্যে বুঝি তুই আঠারো বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলি? বাটলারের সঙ্গে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলি? মেয়ে ব্যঙ্গমিশ্রিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন।

মা এবার রেগে উঠলেন।প্যামেলা, আমি যাঁর সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিলাম তিনি তোমার বাবা।

ইয়েস! বাট হি ওয়াজ এ বাটলার। মেয়ে এবার খিলখিল করে হেসে উঠলেন।

আর আমার সমস্ত শরীর যেন শিউরে উঠল। এ আমি কোথায় এলাম? এ জগতের কিছুই যে বুঝতে পারছি না। সত্যসুন্দরদার উপর আমার রাগ হল। আমাকে এই ভাবে ফেলে তিনি কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছেন।

আমার অনেক পরিচিত মুখ যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল। রামজী হাজরা লেনের ছোকাদা, উমেশ ব্যানার্জি লেনের হেজাদা, নবকুমার নন্দী লেনের পানুদা, কাসুন্দের কেষ্টদা—সবাই এখন ঘুমে অচেতন হয়ে রয়েছেন। শুধু আমি জেগে রয়েছি। আমার জাগবার ইচ্ছে নেই, তবু জেগে রয়েছি চোখের পাতা বন্ধ করতে সাহস হচ্ছে না।

ওদিকে পাশের ঘরে তখন পুরোপুরি কথা-কাটাকাটি চলছে। ভদ্রমহিলার বাটলার বাবার অর্ধেক গোপন কাহিনি ইতিমধ্যে আমি জেনে ফেলেছি। বুড়ি মা শেষ পর্যন্ত বললেন, তা হলে আমি কি অন্য ঘরে গিয়ে শোব?

ইয়েস, ইয়েস। কতবার তোকে বলব? আর এখনও যদি না যাস, তা হলে আমি বয়কে ডাকব, বার করে দেবার জন্যে।

ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, একলা শুয়ে থাকতে পারবি তো? ভয় করবে না তো!

খিলখিল করে হেসে মহিলা বললেন, আমার মরার দিন পর্যন্ত তুই আমার পাশে শুয়ে থাকবি, তা আমি জানি।

ভদ্রমহিলার মা এবার বিদায় নিলেন বোধহয়। শুভরাত্রি জানালেন তিনি। গুড় নাইট, মাই গার্ল। মে গড় ব্লেস ইউ-ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।

ও-ঘরের আলো এবার নিবে গেল। শাজাহান হোটেলের রাত্রি এবার যেন সত্যিকারের রাত্রে রূপান্তরিত হল। আর গোবেচারা কাসুরে ভয়-পাওয়া ঘুম এবার সাহস পেয়ে পা টিপে টিপে আমার ঘরের মধ্যে ঢুকে আমাকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল।

সেইভাবে কতক্ষণ যে ছিলাম মনে নেই। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। দরজায় খুব আলতোভাবে যেন টোকা পড়ছে। জর্জ টেলিগ্রাফ ইস্কুলে একবার টেলিগ্রাফ শেখবার চেষ্টা করেছিলাম। একটা টেলিগ্রাফ কলও কিনেছিলাম। ঠিক তেমনি শব্দ—টরে টক্কা, টরে টক্কা।

তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে, অন্ধকারে চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলতেই চাপা পুরুষালি আওয়াজ পেলাম-প্যামেলা! তুমি দরজা খুললে তা হলে। আমি ভাবছিলাম তুমি খুলবে না।

নিদ্রাজড়িত কণ্ঠে আমি চাপা আর্তনাদ করে উঠেছিলাম, হোয়াট? কে? কে আপনি?

রাত্রের আগন্তুক এবার বোধহয় সংবিৎ ফিরে পেলেন। মাথা নিচু করে পালাতে পালাতে বললেন, স্যরি, রং নাম্বার।

আমার দেহটা তখন সত্যিই কাপতে আরম্ভ করেছে। স্লিপিং গাউন পরা হটা সেই সুযোগে যে কোনদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না।

আলো জ্বালিয়ে বাইরে এসে দেখলাম—টুলের উপর গুড়বেড়িয়া অঘোরে ঘুমিয়ে রয়েছে। তার পায়ের গোড়ায় একটা বেড়ালও মনের সুখে রাত্রির বিশ্রাম গ্রহণ করছে। ওদিকে টুলের পাশে একটা টেবিলে আর একটা বেড়াল পরম সুখে শেষ রাত্রের নিদ্রা উপভোগ করছে। গুড়বেড়িয়ার মাথার উপর একটা আলো শুধু জেগে রয়েছে-সব কিছু দেখে শুনে আলোটাও যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছে।

রাত্রির প্রতীক্ষা কাকে বলে জানতাম না। আজ বুঝলাম আমি সত্যিই প্রভাতের অপেক্ষায় জেগে রয়েছি। শাজাহান হোটেলের ছাদের উপরে ময়লা আকাশ ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে আসছে, আপিসের হেড ক্লার্ক নির্ধারিত সময়ের কিছু আগে থেকেই জুনিয়র বাবুদের আবির্ভাবের অপেক্ষায় যেমনভাবে ঘড়ির দিকে তাকাতে থাকেন, সূর্যের আশায় আমিও সেইভাবে পূর্ব দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

তখনও অন্ধকার কাটেনি। ঘোমটার আড়ালে রাঙাবউ-এর মান-অভিমান পালা শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই প্রায়ান্ধকারে ছাদের কোণে এক ভদ্রলোককে দেখতে পেলাম। আন্ডারপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরে তিনি খালি হাতের ব্যায়াম করছেন। ছোটার ভঙ্গিতে সামান্য লাফালাফি করছেন—স্লো মোশন পিকচার্সে যেমন দেখা যায়।

কালো মতো ভদ্রলোক। একেবারে তরুণ নন। সরু পাকানো চেহারা, জুলপির চুলগুলো যে পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে, তা দুর থেকেই বুঝতে পারলাম। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, ভদ্রলোক এক মনে ব্যায়াম করছেন, আর তার সামনে একটা স্টোভে জল ফুটছে। ব্যায়াম করতে করতেই ভদ্রলোক এক একবার জলের দিকে তাকাচ্ছেন।

আমাকে দেখেই ভদ্রলোক মৃদু হাসলেন। তারপর চমৎকার বাংলায় বললেন, নমস্কার। আপনারও কি ভোরবেলায় ওঠার অভ্যাস?

বললাম, না। আমার মা গালাগালি করেও আমাকে সকালে ঘুম থেকে তুলতে পারেন না। কিন্তু কেন জানি না, আজ ভোরবেলায় উঠে পড়েছি।

ভদ্রলোক যে আমার খবরাখবর রাখেন তা বুঝলাম। তিনি নিজেই বললেন, রোজির জায়গায় আপনি এসেছেন তো?

এবার ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন—আমার নাম পি সি গোমেজ—প্রভাতচন্দ্র গোমেজ। এখানে বাজনা বাজাই-ব্যান্ডমাস্টার।

আপনি এখানেই থাকেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

না থেকে উপায় নেই—রাত্রে যখন ক্যাবারে শেষ হয়, তখন কলকাতায় বাস ট্রাম থাকে না।

ভদ্রলোক এবার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। এক গ্লাস জল এনে স্টোভের পাত্রের মধ্যে ঢেলে দিলেন। আপনার জন্যেও এক কাপের ব্যবস্থা করছি।

আমি আপত্তি করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তিনি শুনলেন না। বললেন, প্রথম আলাপ। আমি সামান্য মানুষ, একটু কফি দিয়েই উৎসব করা যাক।

কফি? এই সাত সকালে?

গোমেজ হেসে ফেললেন। হ্যাঁ, ঠিক চারটের সময়, বিনা দুধ এবং বিনা চিনিতে এক পাত্র প্রচণ্ড কড়া কফি আমি খেয়ে থাকি। আপনি অত কড়া খেতে পারবেন না। আপনাকে চিনি মিশিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু স্যরি—দুধের কোনো ব্যবস্থা নেই আমার।

লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিলাম। এই ভোরবেলায় ভদ্রলোককে কষ্ট দিচ্ছি।

কাপে কফি ঢালতে ঢালতে গোমেজ বললেন, ব্রাহম—দি গ্রেট কম্পোজার—তিনি ভোরবেলায় এমনি কফি খেতেন।

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতেই শুনলাম, ব্রাহম নিজের কফি নিজেই তৈরি করে খেতেন। আর এই তেততা, কড়া এবং কালো কফির কাপে চুমুক দিতে দিতেই তিনি চারটে সিমফনি, দুটো পিয়ানো কনসার্টো, একটা ভায়োলিন কনসার্টো, আর একটা ডবল কনসার্টে ফর ভায়োলিন অ্যান্ড চেলো সৃষ্টি করে গিয়েছেন।

কথাগুলোর অর্থ আমি ঠিক ধরতে পারছিলাম না। কিন্তু গোমেজ যে দরদ দিয়েই বলছেন, তা বোঝা যাচ্ছিল। আমার কাপটা ধুয়ে দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু গোমেজ কিছুতেই রাজি হলেন না। হেসে বললেন, তা হয় না। ব্রাহম-এর বাড়িতে যখন সুম্যান অ্যাসতেন, তখন কি তিনি কফির কাপ ধুতেন?

সুম্যান ভদ্রলোক কে আমার জানা ছিল না। আমার মুখের অবস্থা দেখে গোমেজ বোধহয় সঙ্গীতবিদ্যায় আমার গভীরতার আন্দাজ পেলেন। বললেন, দি গ্রেট সুম্যান। যার একটা প্রবন্ধের জোরে অখ্যাত ব্রাহম রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন।

সঙ্গীতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোনো দিনই বিশেষ মধুর নয়। কিন্তু সেই অজ্ঞতা চাপা দিয়ে গোমেজকে প্রশ্ন করলাম, তার মানে, এখানে আমি কি সেই সঙ্গীত-রস-চূড়ামণি সুম্যান?

না, তা হয়তো নন, কিন্তু আপনি আমার অতিথি, গোমেজ বললেন। তারপর প্রসঙ্গ পরিবর্তন না করেই বললেন, ব্ৰাহমের কাছে আমি এই শিখেছি যে, পৃথিবীতে কোনো কষ্টই কষ্ট নয়—কোনো অভাবই অভাব নয়, কোনো বেদনাই বেদনা নয়। আমাদের সকল কাঁটা ধন্য করে সঙ্গীতের ফুল ফুটে ওঠে।

এদিকে সূর্য আকাশে উঠতে আরম্ভ করেছেন। মিষ্টি হেসে গোমেজ এবার নিজের ঘরে ঢুকে পড়লেন। বললেন, ছেলেগুলো এখনও ঘুমোচ্ছে। ওদের জাগিয়ে দেওয়া দরকার।

আর আমিও নিজের ঘরে ফিরে এলাম।

ঘরে ফিরেও রাত্রির সেই অভিজ্ঞতার কথা ভুলতে পারছিলাম না। উঁকি মেরে দেখলাম, আমার পাশের ঘরের দরজা বন্ধ। চায়ের ট্রে হাতে করে গুড়বেড়িয়া সেই ঘরের মধ্যে কিন্তু বেমালুম ঢুকে পড়ল। চায়ের ট্রে ভিতরে রেখে দুসেকেন্ডের মধ্যে সে ছিটকে বেরিয়ে এল। মুখটা কুঁচকে গজগজ করে নিজের ভাষায় বলতে লাগল, এ তো মহা ফ্যাসাদে পড়া গেল। ক্যাবারে মেমসাব ভিতর থেকে চাবিও লাগাবে না, অথচ কাপড়ও পরবে না।

ঘরের মধ্যে আমি চুপচাপ বসে ছিলাম। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। উঠে গিয়ে দরজা খুলেই দেখলাম সত্যসুন্দরদা। ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করতে করতে সত্যসুন্দরদা বললেন, নিজে উঠে দরজা খোলার দরকার নেই। শুধু বলবে, কাম ইন। আর যদি দরজা খোলবার অবস্থায় না থাকো তবে বলবে, জাস্ট-এ-মিনিট। এই মিনিট বলে তুমি হোটেলে আধ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় নিতে পারো।

সত্যসুন্দরদা জিজ্ঞেস করলেন, বিছানা-চা পেয়েছ তো?

বিছানা-চা?

হ্যাঁ, বিছানায় শুয়ে শুয়ে দাঁত মুখ না পরিষ্কার করে শাজাহান হোটেলের শাজাহানরা যে বেড-টি পান করেন, তারই বাংলা নাম বিছানা-চা।

বললাম, এই মাত্র কফি…

কথা শেষ করতে হল না। বোসদা যেন হাঁ করতেই সব বুঝে নিলেন। প্রথম দিনেই ছাত-কফি খেয়েছ তুমি—তুমি তো খুবই লাকি চ্যাপ। দুনিয়াতে দুটি মাত্র লোকের ওই সময়ে কফি পানের অভ্যাস আমাদের গোমেজ সায়েব, আর জার্মানির ব্রহ্ম সায়েব।

ব্রহ্ম না, ব্রাহ্‌ম।—আমি হেসে বললাম।

ওই হলো—যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন। তাছাড়া শেক্সপিয়ার সায়েবই না বলে গিয়েছেন-নামে কী আসে যায়? ব্রাহমকে ব্ৰহ্ম বললে কি সুরকার হিসেবে তার দাম কমে যাবে, না ব্রাহ্ম সমাজে ব্রহ্মের পুজো বন্ধ হয়ে যাবে?

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যসুন্দরদা এবার কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, কাল রাত্রে তুমি কি ঘুমোওনি?

না, ঘুমিয়েছি তো।-কোনোরকমে বললাম।

বোসদা সব বুঝলেন। আস্তে আস্তে বললেন, প্রথম প্রথম অমন হয়। আমারও হয়েছিল। তারপর দেখে দেখে তোমার চোখ পচে যাবে। মনে হবে এইটাই তো স্বাভাবিক।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বোসদা এবার গুড়বেড়িয়াকে ডাকলেন। বললেন, আমাদের দুজনের খাবার শংকরবাবুর ঘরে দিয়ে যেও।

তারপর আমার বিছানা থেকে উঠে পড়ে বললেন, তাড়াতাড়ি স্নান করে রেডি হয়ে নাও। একসঙ্গে নিচে নেমে যাব। শ্রীমান উইলিয়ম ঘোষ এতক্ষণে আমার ফোর্টিনথ জেনারেশনকে নরকে পাঠাচ্ছে।

মাখন মাখানো রুটি ও ওমলেট সহযোগে ব্রেকফাস্ট আরম্ভ হল। চায়ের কাপের আকার দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম। তা লক্ষ্য করেই বোধহয় বোসদা বললেন, ব্রেকফাস্টে ওরা একটু বেশি চা খায়। এই কাপগুলোর নাম ব্রেকফাস্ট কাপ।

আমাদের কথাবার্তা হয়তো আরও চলত। কিন্তু বেয়ারা এসে খবর দিল, একজন ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।

আমার সঙ্গে! আমি অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু কিছু বলবার আগেই যিনি ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন, তিনি বায়রন সায়েব ছাড়া আর কেউ নন।

গুড মর্নিং। স্যরি, বিনা নোটিশেই তোমাদের ঘরে ঢুকে পড়লাম। বায়রন সায়েব বললেন।

ওঁদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে বললাম, বোসদা, ইনিই বায়রন সায়েব, আমার চাকরি করে দিয়েছেন।

বোসদা নিজের পরিচয় দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই বায়রন সায়েব বললেন, আর আপনি হলেন শংকরের বন্ধু, শাজাহান হোটেলের ম্যানেজারের দক্ষিণ হস্ত মিস্টার সত্যসুন্দর বোস। এখানে এগারো বছর কাজ করছেন, তার আগে একবার আপনার মামার মারফত এ্যান্ডে ঢোকবার চেষ্টা করেছিলেন।

আমরা দুজনেই অবাক হয়ে গেলাম। বোসদা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বায়রন বললেন, আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আমরা প্রাইভেট ডিটেটিভ, আমাদের জেনে রাখতে হয়—জেনে রাখাটাই আমাদের ক্যাপিটাল। আর জানানোটা আমাদের বিজনেস।

বায়রন এবার আসল প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন। বোসদা বললেন, আমি কি উঠে যাব?

না, না, উঠবেন কেন? আপনাকে আমার দরকার। আজ সকালেই একটা খারাপ খবর পেলাম। তাই সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছি।

কী খবর? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড। রোজি বোধহয় ফিরে আসছে।

অ্যাঁ!—আমি আর্তনাদ করে উঠলাম।

বায়রন বললেন, মিসেস ব্যানার্জি মিস্টার ব্যানার্জির খবর পেয়েছেন। বোম্বাইতে মিসেস ব্যানার্জির ভাই খোকা চ্যাটার্জি আমার পাঠানো ঠিকানা থেকে ভগ্নীপতির পাত্তা করেছেন। বকাবকিতে মিস্টার ব্যানার্জির মন সংসারের দিকে আবার ফিরে গিয়েছে। রোজিকেও কীভাবে খোকা চ্যাটার্জি শান্ত করেছেন। মিস্টার ব্যানার্জি যখন ফিরছেন, রোজিও তখন আর কোথায় পড়ে থাকবে? বিশেষ করে বোম্বাই-এর মতো জায়গায়!

ভোরবেলায় এমন সংবাদ শোনবার জন্যে আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।

বায়রন বললেন, এখনই ভেঙে পোড়ো না। আমি মার্কোপোলোর সঙ্গে দেখা করে তবে যাব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যদি অন্য পোস্ট খালি না থাকে?

বোসদা একটু চিন্তা করলেন, তারপর উৎফুল্ল হয়ে উঠে বললেন, কিছু ভয় নেই।

আর সময় নষ্ট না-করে ওঁরা দুজন মার্কোপোলোর সঙ্গে দেখা করতে চলে গেলেন। আমি ওঁদের সঙ্গে যেতে সাহস করলাম না। মার্কোপোলোর ঘরের বাইরে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম।

মথুরা সিং আমাকে দেখে বললে, বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? ভিতরে যান।

মথুরা সিংকে আমি বলতে পারলাম না, কেন বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তিন প্রধান এতক্ষণে বৈঠক শুরু করে দিয়েছেন। মনে মনে ঈশ্বরকে প্রণাম জানিয়েছি। অযাচিতভাবে তিনি আমাকে বন্ধু দিয়েছেন—বিপদের দিনে, প্রতিদানের কোনো আশা না-নিয়েই বায়রন সায়েব এবং বোসদার মতো লোকেরা আমার হয়ে অন্যের সঙ্গে লড়াই শুরু করে দিয়েছেন।

প্রায় মিনিট পনেরো পরে তারা যখন বেরিয়ে এলেন, তখন দুজনের মুখেই হাসি। বায়রন বললেন, যদি তোমার কোনো থ্যাঙ্কস থাকে, মিস্টার বোসকেই দাও। রিসেপশনে দুজন লোকে যে কাজ চলে না, ক্যাবারেতে টিকিট বিক্রির লোক যে প্রায়ই পাওয়া যায় না, মমতাজ রেস্তোরাঁয় ড্রিংকস্ এবং ফুডের অর্ডার যে বাধ্য হয়েই বোসকে দশ ঘণ্টা ডিউটির পরেও নিতে হয়, তা মার্কোপোলোকে উনি জলের মতো সহজ করে বুঝিয়ে দিলেন।

আমি বোসদার মুখের দিকে কৃতজ্ঞ নয়নে তাকিয়ে রইলাম। বোসদা পিঠে একটা থাপ্পড় মেরে বললেন, এতদিন শুধু বসে বসে বাক্স বাজাতে; এবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের সঙ্গে কাজ করবে। রোজি অর নো রোজি, তুমি কাউন্টারে ডিউটি দেবে। আমারই লাভ হল, মিস্টার বায়রন। ওবিডিয়েন্ট ওয়াইফ আর একটা বশংবদ অ্যাসিস্ট্যান্ট না পেলে লাইফে বেঁচে সুখ কী?

কাউন্টারের কাজ? আমি প্রশ্ন করলাম।

হ্যাঁ, হা, হাতি ঘোড়া কিছু নেই। তুমিও পারবে। বোসদা বললেন।শুধু দুটো স্যুট তৈরি করে ফেলতে হবে। সে খরচ তোমার নয়, হোটেল দেবে।

কিন্তু আপনারা যে কতরকমের ভাষা কেমন অনর্গলভাবে বলে যান। আমি তো কোনো ভাষাই ভালো করে বলতে পারি না। আমি ভয়ে ভয়ে নিবেদন করলাম।

বোসদা এবার হা হা করে হেসে উঠলেন। বললেন, কাউন্টারে চলো, তোমাকে আমার জীবনের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলব।

কাউন্টারে উইলিয়ম ঘোষ তখন খাতাপত্তর বন্ধ করে বোসদার জন্যে অপেক্ষা করছিল। তাকে বিদায় দিয়ে বোসদা বললেন, সায়েব তো এখন তোমাকে ডিক্টেশন দিচ্ছেন না; আমার ফাইফরমাস খাটো। সব ট্রেড সিক্রেট আস্তে আস্তে শিখিয়ে দেব।

হ্যাঁ, যা বলছিলাম।—বোসদা আবার শুরু করলেন। আমি যেবার চাকরিতে ঢুকেছিলাম, সেবার ওঁরা কাগজে যা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, তার মানে দাঁড়ায়-শেক্সপিয়ারের মতো ইংরিজি, রবীন্দ্রনাথের মতো বাংলা, আর তুলসীদাসের মতো হিন্দি জানা একটি লোক চাই। মাইনে পঁচাত্তর টাকা। তার উত্তরে ওঁরা আমার মতো লোক পেলেন। সব কোয়ালিফিকেশনই আছে, কেবল একটু এদিকে ওদিক—তুলসীদাসের মতো ইংরিজি, শেক্সপিয়ারের মতো বাংলা এবং রবীন্দ্রনাথের মতো হিন্দি জানা লোক আমি! কিন্তু কাজ কি চলছে না? বেশ ভালোভাবেই চলছে। যা হোক, ওসব বাজে চিন্তা না করে এখন কাউন্টারের ভিতরে ঢুকে পড়ো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *