1 of 2

৪৮. সুকৃতির আদেশ ও দুস্কৃতির প্রতিরোধ

অধ্যায় : ৪৮ সুকৃতির আদেশ ও দুস্কৃতির প্রতিরোধ

ধারা-১১৩১ ন্যায়ের আদেশ এবং অন্যায়ের প্রতিরোধ (ক) ন্যায়াচার (সুকৃতি) বলিতে যাহা কুরআন, সুন্নাহ ও শরীআতের নীতিমালার পরিপন্থী নহে এমন সুকর্মকে বুঝায়।

(খ) এমন প্রতিটি কথা ও কর্মকে অন্যায়াচার (দুষ্কৃতি) বলে, কুরআন, সুন্নাহ ও শরীআতের নীতিমালা অনুযায়ী যাহা বলা বা করা অসমর্থনযোগ্য বা পাপ হিসাবে গণ্য।

(গ) ন্যায়ের আদেশদান এবং অন্যায়ের প্রতিরোধ সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।

বিশ্লেষণ

কুরআন মজীদে ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধকে “আমর বিল-মারুফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার” পরিভাষায় ব্যক্ত করা হইয়াছে। মারূফ’ অর্থাৎ ন্যায়াচার বলিতে শরীআতের দৃষ্টিতে বাঞ্ছনীয় প্রতিটি কথা ও কর্মকে বুঝায়, যাহা বলা বা করার জন্য নির্দেশ বা উৎসাহ প্রদান করা হইয়াছে। যেমন, উত্তম নৈতিক চরিত্র অবলম্বন, প্রতিশোধের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা প্রদর্শন, বিবাদ মীমাংসা করা, জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, শরীআতের বিধিনিষেধ মান্য করা ইত্যাদি। পক্ষান্তরে মুনকার’ অর্থাৎ অন্যায়াচার বলিতে এমন প্রতিটি কথা ও কাজকে বুঝায় যাহা বলিতে বা করিতে শরীআতে নিষেধ করা হইয়াছে, নিরুৎসাহিত করা হইয়াছে এবং যাহার জন্য শাস্তি নির্ধারণ করা হইয়াছে। এক কথায় প্রতিটি পাপাচার মুনকার হিসাবে গণ্য। যেমন শরাব পান, ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া, চুরি-ডাকাতি করা, অপরের মান-সম্মান ও সম্পদে অন্যায় হস্তক্ষেপ, ভালো কাজে বাধাদান, মন্দ কাজে সহযোগিতাদান ইত্যাদি।

৫৯২

ফকীহগণের ঐক্যমত অনুযায়ী ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধ কোন ঐচ্ছিক কর্ম নয় যে, ইচ্ছা করিলে কেহ তাহা ত্যাগ করিতে পারে, বরং ব্যক্তির যিম্মায় ইহা একটি বাধ্যতামূলক কর্ম। ফকীহগণের সংখ্যালগিষ্ঠের মত অনুযায়ী ইহা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য একটি বাধ্যতামূলক কর্ম, বরং হজ্জের তুলনায়ও গুরুত্বপূর্ণ ফরয। কারণ হজ্জের বেলায় সামর্থ্যের শর্ত যুক্ত আছে, কিন্তু এক্ষেত্রে কোনরূপ শর্ত যুক্ত নাই। এমনকি একজন মূর্খ ব্যক্তিও, সে শরীআতের বিধিনিষেধ যতখানি জানে তদনুপাতে, এই কাজের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত।

ফকীহগণের গরিষ্ঠসংখ্যকের মতানুযায়ী আমর বিল মারূফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার একটি ফরয পর্যায়ের দায়িত্ব হইলেও কিছু সংখ্যক মুসলমান এই দায়িত্ব পালন করিলে অন্যরাও দায়মুক্ত হইয়া যাইবে এবং কেহ এই দায়িত্ব পালন না করিলে সকলেই মারাত্মক গুনাহগার হইবে। তাহাদের মতে, জিহাদ ও “আমর বিল-মারূফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার” একই পর্যায়ভুক্ত ফরয। এই পর্যায়ে মহান

আল্লাহর বাণীঃ

ولتكن منكم أمة يدعون إلى الخير ويأمرون بالمعروف وينهون

عن المنكر ط وأولئك هم المفلحون ..

“তোমাদের মধ্যে এমন একদল হউক যাহারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করিবে এবং সৎকার্যের নির্দেশ দিবে ও অসৎ কার্যে নিষেধ করিবে। ইহারাই সফলকাম” (সূরা আল ইমরান : ১০৪)।

كنتم خير أمة أخرجت للناس تأمرون بالمعروف وتنهون عن

المنكر وتؤمنون بالله .

“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মাত। মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হইয়াছে। তোমরা সত্ত্বার্যের নির্দেশ প্রদান করিবে, অসৎকার্যে নিষেধ করিবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনিবে” (সূরা আল ইমরান : ১১০)।

والمؤمنون والمؤمنت بضهم أولياء بعض يأمرون

بالمعروف وينهون عن المنكر .

“মুমিন পুরুষগণ ও মুমিন মহিলাগণ পরস্পরের সহযোগী। তাহারা সকার্যের নির্দেশ দেয় এবং অসকার্য নিষেধ করে” (সূরা তওবা : ৭১; এই পর্যায়ে আরও দ্র.

৩ঃ ১১৩-৪; ৫ঃ ২,৭৮-৯; ২২ ও ৪১; ৪ : ১১৪; ৪৯৪ ৯)।

৫৯৩

আবূ বা সিদ্দীক (রা) তাহার এক ভাষণে বলেন, হে লোকসকল! তোমরা নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করিয়া উহার ভুল ব্যাখ্যা করিয়া থাক :

ايها الذين أتموا عليم أنفسگم ج يضركم من ضل إذا

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের দায়িত্ব তোমাদের উপর। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও তবে যে পথভ্রষ্ট হইয়াছে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করিতে পারিবে

“ (সূরা মাইদা : ১০৫)।

অথচ আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলিতে শুনিয়াছি?

ما من قوم عملوا بالمعاصي وفيهم من يقدر أن ينكر عليهم

قلم يفعل الأ يوشك أن يعمهم الله بعذاب من عنده .

“কোন সম্প্রদায় অপরাধে লিপ্ত হইলে এবং তাহাদের মধ্যে তাহাদেরকে প্রতিরোধ করার মত শক্তিশালী লোেক থাকা সত্ত্বেও তাহারা বাধা না দিলে অচিরেই আল্লাহ তাহাদের সকলকে শাস্তি প্রদান করিবেন।”

আবু সালাবা আল-খুশানী (রা) বলেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট উপরোক্ত (মাইদাঃ১০৫) আয়াতের তাৎপর্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তিনি বলেনঃ

يا أبا ثعلبة تمر بالمعروف وانه عن المنكر فاذا رايت شحا مطاعا وهوى متبعا ودنيا مؤثرة واعجاب كل ذی رای برای فعليك بنفسك ودع عنك العوام .

“হে আবু সালাবা! ন্যায়াচারের নির্দেশ দাও এবং অন্যায়াচারের প্রতিরোধ কর। তুমি যখন লক্ষ্য করিবে যে, মানুষ লালসার পিছনে পড়িয়া গিয়াছে, কামনা-বাসনা ও কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করিতেছে, পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিতেছে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ মতানুযায়ী চলিতেছে, তখন তুমি নিজেকে সংশোধন কর এবং জনগণকে ত্যাগ কর”।

ররাসূলুল্লাহ (সা) আরও বলেন

والذي نفسي بيده لتامين بالمعروف وتنهون عن المنكر ولتان على يدي الظالم ولتاطره على الحق اطرا أو ليضربن الله بقلوب بعضكم على بعضه للعنگم كما لهم .

৫৯৪

“সেই সত্তার শপথ যাহার হাতে আমার জীবন! তোমরা অবশ্যই সৎ কাজের নির্দেশ প্রদান করিবে, অসৎ কাজে বাধা দিবে এবং যালেমের উভয় হাত ধরিয়া তাহাকে সৎপথ অবলম্বনে বাধ্য করিবে। অন্যথায় তোমাদের অন্তর পাপাচারীদের অন্তরের অনুরূপ হইয়া যাইবে। অতঃপর তোমরা বনূ ইসরাঈলের মত অভিশপ্ত জাতিতে পরিণত হইবে”।

من رای منم منكرا فليره بيده فإن لم يستطع فبلسانه فان

لم يستطع فبقلبه وذلك أضعف الإيمان .

“তোমাদের কেহ অন্যায়াচার হইতে দেখিলে সে যেন তাহা স্বীয় হস্ত দ্বারা প্রতিহত করে। তাহার সেই সামর্থ্য না থাকিলে সে যেন বাচনিক বারণ করে। তাহার সেই সামর্থ্য না থাকিলে সে যেন মনে মনে উহার পরিবর্তন কামনা করে। আর ইহাই হইল দুর্বলতম ঈমান”।৬

التامين بالمعروف وتنهون عن المنكر ولتحاضين على الخير

أو ليستحم

الله جميا بعذاب أو أوء مرن عليكم شراركم ثم

يدوا خياركم فلا يستجابوا لهم .

“তোমরা অবশ্যই সৎ কাজের নির্দেশ প্রদান করিবে, অসৎ কাজে বাধা দিবে এবং কল্যাণকর কাজে উৎসাহ প্রদান করিবে। অন্যথায় আল্লাহ তোমাদেরকে এক ব্যাপক আযাব দ্বারা ধ্বংস করিবেন অথবা তোমাদের মধ্যকার নিকৃষ্ট পাপীদেরকে তোমাদের শাসক নিযুক্ত করিবেন। তখন তোমাদের সৎলোকেরা দোয়া করিলেও তাহা কবুল করা হইবে না।”৭।

عن عمر بن الخطاب قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول بئس القوم قوم لا يامرون بالقسط ويئس القوم قوم لا

امرون بالمعروف ولا ينهون عن المنكر .

“উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলিতে শুনিয়াছি ও যে সম্প্রদায় ন্যায়-ইনসাফ করার নির্দেশ দেয় না তাহারা কতই না নিকৃষ্ট। যে সম্প্রদায় ন্যায়াচারের নির্দেশ দেয় না এবং অনাচার প্রতিহত করে না সেই সম্প্রদায় কতই না নিকৃষ্ট”।

ধারা-১১৩২ ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধের শর্তাবলী ন্যায়ের আদেশদাতা ও অন্যায়ের প্রতিরোধকারীকে – বালেগ, বুদ্ধিমান, সামর্থ্যবান ও ন্যায়পরায়ণ মুসলমান হইতে হইবে।

বিশ্লেষণ

বালেগ ও সুস্থ বুদ্ধি-জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তির উপরই শরীআত আরোপিত দায়িত্ব অর্পিত হইয়া থাকে। নাবালেগ ও পাগল আইনের বন্ধনের ঊর্ধ্বে। এইজন্য ন্যায়ের আদেশদান ও অন্যায়ের প্রতিরোধের দায়িত্ব বালেগ ও বুদ্ধিমান ব্যক্তির উপরই অর্পিত হইয়া থাকে। উক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্যও থাকিতে হইবে। অন্যায় ও পাপ কর্মে লিপ্ত ব্যক্তিকে প্রতিহত করার সামর্থ্য যাহার নাই, তাহার দায়িত্ব হইল উক্ত পাপাচারকে ঘৃণা করা এবং পাপাচারীর সহিত সম্পর্ক না রাখা। ন্যায়ের আদেশদাতা ও অন্যায়ের প্রতিরোধকারীর মুসলিম হওয়াও একটি অপরিহার্য শর্ত। কারণ আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের উপরই উক্ত দায়িত্ব অর্পণ করিয়াছেন। একদল ফকীহ্র মতে, বিশেষত মালিকী ও শাফিঈ ফকীহগণের মতে, ন্যায়ের আদেশদাতা ও অন্যায়ের প্রতিরোধকারীর ন্যায়পরায়ণ হওয়াও একটি অপরিহার্য শর্ত, তাহার মধ্যে পাপাচারী চরিত্র থাকা বাঞ্ছনীয় নহে। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন :

أتأمرون الناس بالبر وتنسون أنفسكم .

“তোমরা কি মানুষকে সৎকার্যের নির্দেশ দাও, আর নিজদিগকে বিস্মৃত হও” (সূরা বাকারা : ৪৪)।

১০

أيها الذين آمنوا لم تقولون ما تفعلون . كبر مقتا عند الله

أن تقولوا ما لا تفعلون .

১০০

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যাহা কর না তাহা কেন বল? তোমরা যাহা কর তোমাদের তাহা বলা আল্লাহর দৃষ্টিতে অতিশয় অসন্তোষজনক” (সূরা সাফ : ২, ৩)।

ফকীহগণের এই দলের মতে অন্যকে সৎপথ প্রদর্শন করা নিজের সৎপথে অবলম্বনের পরের ব্যাপার। যে ব্যক্তি নিজেকে সংশোধন করিতে অক্ষম সে

৫৯৬

অন্যকে সংশোধন করিবে কিভাবে। কিন্তু ফকীহগণের অগ্রগণ্য মতানুযায়ী ন্যায়ের আদেশদান ও অন্যায়ের প্রতিরোধের জন্য কোন ব্যক্তির ন্যায়পরায়ণ হওয়া জরুরী হইলেও অপরিহার্য শর্ত নহে। কারণ উক্ত কাজ করার জন্য কোন ব্যক্তির সম্পূর্ণ নিষ্পাপ হওয়া জরুরী নহে। তাবিঈ সাঈদ ইবন জুবাইর (র) বলেন, উক্ত কাজের যোগ্য হওয়ার জন্য পাপমুক্ত হওয়া শর্ত হইলে এমন একজন লোকও পাওয়া যাইবে

। উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ের অর্থ এই নহে যে, ফাসেক ব্যক্তি ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করিবে না। বরং উক্ত আয়াতে এমন ব্যক্তিকে সতর্ক করা হইয়াছে, যে ন্যায়ের কথা বলে কিন্তু নিজে তদনুরূপ করিতে অবহেলা করে। নিজের কথা ও কর্মের মাধ্যমে নিজেকে সত্যবাদী হিসাবে প্রতিভাত করা প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।

গরিষ্ঠ সংখ্যক ফকীহর মতে, সরকার এই দায়িত্ব পালনের জন্য লোক নিয়োগ করিলেও মুসলমান হিসাবে সকলের উপর উক্ত দায়িত্ব পালন বাধ্যকর থাকিয়া যায়। সুকৃতির আদেশ ও দুস্কৃতির প্রতিরোধ সংক্রান্ত কুরআন মজীদের বাণী ও মহানবী (সা)-এর হাদীস নির্বিশেষে সকল মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক করিয়াছে। মুসলিম শাসনের কোন যুগেই রাষ্ট্র অননুমোদিত ব্যক্তিকে উক্ত কাজ করার জন্য

অপরাধী সাব্যস্ত করা হয় নাই।

ধারা-১১৩৩ দুষ্কৃতির বিরুদ্ধে কখন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে?

অন্যায় বিদ্যমান থাকিলে এবং তাহা বাস্তবিকভাবে প্রকাশ্যে সংঘটিত হইলে তাহা যুক্তিসংগত পন্থায় প্রতিরোধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যাইবে।

বিশ্লেষণ

ন্যায়ের আদেশ এক ধরনের উপদেশ, সৎপথ প্রদর্শন ও প্রশিক্ষণের সমষ্টি। ইহা যে কোন সময় করা যাইতে পারে। ইহার জন্য স্থান ও কাল নির্দিষ্ট নাই। কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সময় ও স্থান নির্দিষ্ট আছে। যেমন অন্যায় প্রত্যক্ষ গোচর না হইলে ইহার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রশ্নই উঠে না।

অতএব প্রথমত, যে কর্মটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গ্রহণ করা হইবে তাহা অন্যায়কর্ম হইতে হইবে। বালেগ, নাবালেগ, বুদ্ধিমান পাগল যাহাকেই অন্যায় কর্মে লিপ্ত দেখা যাইবে তাহাকেই উহা হইতে বিরত রাখিতে হইবে। যেমন কোন

৫৯৭

ব্যক্তি নাবালেগকে যদি শরাব পানরত দেখে তবে তাহার কর্তব্য হইবে উক্ত বালককে শরাবপান হইতে নিবৃত্ত রাখা।

দ্বিতীয়ত, উক্ত অন্যায় কর্মটি যখন বাস্তবে সংঘটিত হয় তখনই উহার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গ্রহণ করা যাইবে। কিন্তু কর্মটি সংঘটিত হইয়া গেলে আর প্রতিরোধের অবকাশ থাকে না। তখন তাহা বিচার বিভাগীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আওতায় চলিয়া যায়। কেহ অন্যায় কর্ম সংঘটিত হওয়ার আশংকা করিলেই উহার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। এই পর্যায়ে যাহার দ্বারা অন্যায় কর্ম সংঘটনের আশংকা করা হইতেছে তাহাকে সদুপদেশদান পর্যন্ত সীমিত থাকিতে হইবে এবং তাহাকে গালমন্দ বা আঘাত করা যাইরে না।

তৃতীয়ত, কোন ব্যক্তি কেবল প্রকাশ্যে কোন অন্যায় কাজ হইতে দেখিলেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারে। গোপনে কোথাও অন্যায় কর্ম হওয়ার সন্দেহ হইলে সে তাহা উদঘাটনে উঠিয়া পড়িয়া লাগিবে না। এই পর্যায়ে সে অবশ্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে তাহার সন্দেহের বিষয়টি অবহিত করিতে পারে। তবে যদি তাহার প্রবল ধারণা হয় যে, কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির বাড়িতে ডাকাতি-খুন-খারাবি বা অনুরূপ কোন অন্যায় কর্ম সংঘটনের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করিয়াছে, এই অবস্থায় সে নিজে বা লোকজন ডাকিয়া প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।১০

চতুর্থত, অন্যায়কর্ম প্রতিরোধের জন্য যুক্তিসংগত পন্থা গ্রহণ করিতে হইবে। পরবর্তী ধারায় এই সম্পর্কে আলোচনা করা হইবে।

ধারা-১১৩৪ অন্যায় কর্ম প্রতিহত করার পন্থাসমূহ অন্যায় কর্ম প্রতিহত করার জন্য নিম্নবর্ণিত পন্থা অবলম্বন করা যাইবে

(১) প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণকারী ব্যক্তি তাহার সম্মুখে সংঘটিত কর্মকে অপরাধ বলিয়া চিহ্নিত করিবার পর, অপরাধীকে উপদেশের মাধ্যমে নিবৃত্ত করিতে চেষ্টা করিতে পারিবে;

(২) অপরাধ সংঘটিত হইবার পর্যায় উপস্থিত হইলে উহা প্রতিহত করিবার জন্য যে প্রকার এবং যতখানি পর্যন্ত শক্তি প্রয়োগ অত্যাবশ্যকীয় হয়, সেই প্রকার এবং ততখানি পর্যন্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন ও কর্ম করা যাইবে;

৫৯৮

(৩) অপরাধের প্রকার, পরিমাণ ও মাত্রা অনুযায়ী প্রতিরোধের জন্য সামান্য প্রহার হইতে শুরু করিয়া মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানো যাইবে;

(৪) অপরাধী নিবৃত্ত হইলে অতঃপর আরও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার জন্য সর্বপ্রকার হিংস্রতা পরিহার করিতে হইবে।

বিশ্লেষণ

অন্যায় কর্ম চিহ্নিত করার অর্থ এই যে, কোন ব্যক্তি অজ্ঞতাবশত অন্যায়কর্মে লিপ্ত হইলে তাহাকে দ্রতার সহিত নম্রভাবে বুঝাইয়া দিতে হইবে যে, উহা একটি অন্যায় কাজ। বদমেজাজের সহিত তাহাকে প্রথম বাক্যেই উস্কাইয়া দেওয়া ঠিক নহে। সদুপদেশ কেবল এমন ব্যক্তিকেই করা হইবে যাহার সম্পর্কে আশা করা যায় যে, সে উক্ত সদুপদেশ শ্রবণ করিয়া অন্যায় কর্ম হইতে বিরত হইবে। যাহার সম্পর্কে ধারণা হইবে যে, সে সদুপদেশ গ্রহণ করিবে না, তাহাকে সদুপদেশ দিয়া কোন লাভ নাই। এই পর্যায়ে অপরাধীদেরকে কঠোর ভাষায় নিষেধ করিতে হইবে। কিন্তু নিষেধকারী মিথ্যা বলিবে না এবং অন্যায়কারীকে ফাসেক, জাহেল আহম্মক ইত্যাদি বলিয়া গালিগালাজ করিবে না।

হস্ত দ্বারা প্রতিরোধ করার অর্থ এই যে, অন্যায় কর্মকে সহস্তে বিলীন করিয়া দিতে হইবে। যেমন, শরাব ঢালিয়া ফেলিয়া দেওয়া, জবরদখলকারীকে জবরদখলি সম্পত্তি হইতে উৎখাত করা, কেহ রাস্তায় বেরিকেড সৃষ্টি করিলে তাহা অপসারিত করা ইত্যাদি।

অন্যায়কারী সদুপদেশ ও কঠোর নিষেধ এবং হস্ত দ্বারা নিষেধ উপেক্ষা করিলে প্রথমে তাহাকে প্রহারের হুমকি দিতে হইবে। সে তাহাতেও বিরত না হইলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিতে হইবে। কিন্তু এই ধরনের হুমকি প্রদান করা যাইবে না- আমি তোেমার বাড়িঘর লুট করিব, তোমার সন্তানদের হত্যা করিব। একটি চপেটাঘাত বা চাবুকাঘাত খাইয়াই অন্যায়কারী প্রতিহত হইলে তাহাকে পুনরায় আগাত করা যাইবে না।

কিন্তু অবস্থা যদি এই দাঁড়ায় যে, অন্যায়কারীকে অস্ত্র দ্বারা আঘাত করা বা হত্যা করা ব্যতীত প্রতিহত করা সম্ভব নহে, তাহা হইলে উক্ত পদক্ষেপই গ্রহণ করা যাইবে। যেমন কোন পাপাচারী কোন নারীকে ধর্ষণ করার জন্য তাহার উপর ঝাপাইয়া পড়িয়াছে এবং কোনক্রমেই তাহাকে উহা হইতে বিরত করা যাইতেছে

। এই অবস্থায় তাহাকে হত্যা করা বৈধ হইয়া যায় এবং বিষয়টি ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার আওতায় চলিয়া যায়। অন্যায় প্রতিহতকারীর একার পক্ষে অন্যায়কারীকে প্রতিহত করা অসম্ভব হইলে সে অপর ব্যক্তিগণের সহযোগিতা গ্রহণ করিবে। এই অবস্থায় যাহাদের সহযোগিতা চাওয়া হইবে উক্ত ব্যক্তিকে সহায়তা করা তাহাদের কর্তব্য হইয়া যাইবে।

অন্যায় প্রতিরোধকারী যদি এমন কোন পন্থা অবলম্বন করে যাহা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তাহার বাড়াবাড়ি বলিয়া সাব্যস্ত হয়, তবে সে তাহার উক্ত বাড়াবাড়ির জন্য দোষী সাব্যস্ত হইবে। যেমন উপদেশের মাধ্যমে কাজ উদ্ধার হইলে সেখানে লাঠি ব্যবহার করিলে উহা বাড়াবাড়ি বলিয়া গণ্য হইবে।

তথ্য নির্দেশিকা ১. আল-জাসসাস, আহকামুল কুরআন, ২ খণ্ড, পৃ. ২৯; তাফসীরুল মানার, ৪খণ্ড, পৃ. ৩৪, ৩৫। ২. তাফসীরে কবীর, ৩খণ্ড, পৃ. ১৯; আল-কাশশাফ, ১ খণ্ড, পৃ. ৩১৯; ইবনুল আরাবী, আহকামুল

কুরআন, ১ খণ্ড, পৃ. ১২৮; আল-কুরতুবী, আহ্কামুল কুরআন, ৪ খণ্ড, পৃ. ১৬৫; আসনাল

মাতালিব, ৪ খণ্ড, পৃ. ১৭৯; মাওয়াহিবুল জালীখণ্ড, ৩ খণ্ড, পৃ. ৩৪৮। ৩. আত-তাশরীউল জানাঈ, ১ খ, পৃ. ৪৯০। ৪. আত-তাশরীউল জানাঈ, ১ খণ্ড, পৃ. ৪৯০-৯১। ৫. বায়হাকী ও মিশকাতের বরাতে হাদীসের আলোকে মানব জীবন, পৃ. ১৬৯-৭০। ৬. সহীহ মুসলিম। ৭. মুসনাদে আহমাদ; আরও দ্র. তিরমিযী। ৮. আত-তাশরীউল জানাঈ, ১ খণ্ড, পৃ. ৪৯১। উক্ত গ্রন্থে একই স্থানে এই সম্পর্কিত আরও

কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ হাদীস দেখা যাইতে পারে। ৯. তাফসীরুল মানার, ৪খ পৃ. ৩৩ প.; ইহইয়া উলুমিদ্দীন, ২খণ্ড, অধ্যায় ৭, পৃ. ১৯প.;

আল-জাসসাস, আহকামুল কুরআন, ২খণ্ড, পৃ. ৩৩; আল-বাহরুর রাইক, ৫খণ্ড, পৃ. ৪৫; আসনাল মাতালিব, ৪খণ্ড, পৃ. ১৭৯ প.; মাওয়াহিবুল জালীখণ্ড, ৩খণ্ড, পৃ. ৩৪৮;

আল-কাশশাফ, ১খণ্ড, পৃ. ৩১৯-এর বরাতে আত-তাশরীউল জানাই, ১খণ্ড, পৃ. ৫০১। ১০. আহকামুস সুলতানিয়া, পৃ. ২১৮।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *