১৩. কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধ

ত্রয়োদশ অধ্যায়

কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধ : মধ্য জুলাই ১৯৭১-ডিসেম্বর ১৯৭১

কলকাতায় একনাগাড়ে ছিলাম প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস। বদলি হয়ে জুলাইয়ের মাঝামাঝি যখন কলকাতায় এলাম, তখন অনেক মুক্তিযোদ্ধাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। অনেকেই আশা করেছিলেন যে বর্ষাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে দুটি কারণে টিকতে পারবে না। প্রথমত, পাকিস্তানি সেনারা সাঁতার জানে না। সুতরাং, বর্ষাকালে বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চল পানিতে ডুবে গেলে তারা চলাফেরা করতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা জলাভূমিতেই বড় হয়েছে। সুতরাং এখানে লুকিয়ে থেকে তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অনায়াসে আক্রমণ করতে পারবে। বাস্তবে দেখা গেল বর্ষাকালে পাকিস্তান। সেনাবাহিনী আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। যন্ত্রচালিত নৌযান দিয়ে তারা পুরো। দেশ পাহারা দিচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। ফলে এই সময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু হয়।

আবাস

কলকাতায় আমি এসে উঠি আমার চাচাতো বোন হেনা বুজির ৪ নম্বর পার্ক সার্কাস অ্যাভিনিউয়ে সোহরাওয়ার্দী ভবনে। দেশ বিভাগের আগে এই ভবনে থাকতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সোহরাওয়ার্দী। তাঁর একমাত্র সন্তান ছিলেন আইসিএস কর্মকর্তা ইকরাম উল্লাহর পত্নী শায়েস্তা ইকরাম উল্লাহ। তার মৃত্যুর পর শায়েস্তা ইকরাম উল্লাহ বাড়িটির মালিক হন। পাকিস্তান সরকার তার কাছ থেকে বাড়িটি ভাড়া নিয়ে একজন প্রথম সচিব ও একজন তৃতীয় সচিবকে দুটি ফ্ল্যাটে থাকার ব্যবস্থা করেছে। ওপরের ফ্ল্যাটে থাকতেন। কলকাতা পাকিস্তান দূতাবাসের প্রথম সচিব রফিকুল ইসলাম চৌধুরী। নিচের তলায় থাকতেন আমাদের ব্যাচমেট পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা আনোয়ারুল করিম চৌধুরী। আনোয়ারুল করিম চৌধুরীর বাড়ি আমরা আসার আগেই শরণার্থীশিবিরে পরিণত হয়েছে। দোতলায় আর আই চৌধুরীর বাড়িতে চারটি কামরা ছিল। একটি কামরায় থাকতেন আর আই চৌধুরী এবং তার পরিবারের ছেলেমেয়েরা। আর দুটি কামরায় থাকতেন মিসেস চৌধুরীর বন্ধু সাজেদা চৌধুরী, তাঁর স্বামী পুত্র-কন্যা ও ভাইসহ। কামরার বাইরে বারান্দায়ও অনেককে শুতে হতো। আরেকটি কামরা হেনা বুজি ভেবেছিলেন আমাকে ও কামাল সিদ্দিকীকে থাকতে দেবেন। কিন্তু খসরুজ্জামান চৌধুরী তার স্ত্রী ও শ্যালককে নিয়ে আসার পর কামরাটি তাঁকে দিয়ে দেওয়া হয়। আর যে দুটি কামরা ছিল, তার একটি কামরা ছিল স্টোর রুম। যেখানে সব জঞ্জাল রাখা হতো। আর ছাদের ওপরে একটি রুমে চাকররা থাকত। খন্দকার আসাদুজ্জামান এসে তার। পরিবারসহ চাকরদের কক্ষে থাকা শুরু করেন। ওপরে টিন দিয়ে তিনি। কক্ষটিকে একটু সম্প্রসারিত করেন। এই কক্ষটি ছিল অসম্ভব গরম।

স্টোর রুমটির ছাদ ছিল নিচু। সেখানে কোনো ফ্যান লাগানো সম্ভব ছিল না। কক্ষটির পরিসরও ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ। দুটি চৌকি সেখানে ঢোকানো সম্ভব হয়েছিল। আর ছিল একটি চেয়ার, আর একটি স্ট্যান্ড ফ্যান লাগানো হয়েছিল। রুমটি এত গরম ছিল যে স্ট্যান্ড ফ্যানের বাতাসে মোটেও ঠান্ডা হতো না। আমি যখন কলকাতায় আসি, তখন শ্রাবণের শেষ দিক। ভাদ্র মাসে গরম সবচেয়ে বেশি হয়। ওই সময়টায় রাত তিন-চারটা পর্যন্ত ওই কক্ষে ঘুমানো অসম্ভব ছিল। আমি এবং কামাল সিদ্দিকী রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে ১০টার দিকে রুমে ঢুকতাম। সবাই মনে করত আমরা ঘুমাতে গেছি। আসলে ঘণ্টাখানেক গল্পসল্প করে আমরা কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতাম। পার্ক সার্কাসের এই বাড়িতে পাকিস্তানি রাজাকাররা হামলা করতে পারে–এই ভয়ে সন্ধ্যার দিকে গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়া হতো। কামালের পিঠে চড়ে প্রতি রাতে আমি গেট টপকাতাম। কামাল এরপর নিজে গেট টপকাত। এরপর আমরা চলে যেতাম রাস্তার অপর পাড়ে, যেখানে পার্ক সার্কাসের ময়দান অবস্থিত। এই ময়দানে শারদীয় মেলা হতো। মেলার অধিকাংশ দোকান সারা রাত খোলা থাকত। মেলায় ক্রেতারা রাত তিন-চারটা পর্যন্ত বিভিন্ন দোকানে এসে জিনিস কিনতেন। আমরা মেলায় হাঁটতাম, খিদে পেলে ফুচকা খেতাম। অনেক সময় শীতল পানীয় দিয়ে তৃষ্ণা মেটাতাম।

কামাল সিদ্দিকীর সঙ্গে আমার পরিচয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে গভর্নর মোনায়েম খানের ওপর যে হামলা হয়, কামাল সিদ্দিকী তার আসামি ছিলেন। তিনি পুলিশের হুলিয়া থেকে বাঁচার জন্য তখন সলিমুল্লাহ হলে মান্নান ভূঁইয়ার রুমে আশ্রয় নেন। তবে তার সঙ্গে তখনো আমার বন্ধুত্ব হয়নি। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় কলকাতায়। এসে। পাশাপাশি দুই চৌকিতে ঘুমাতে গিয়ে। বেশির ভাগ বিষয়েই আমরা একমত ছিলাম। তবে কোনো কোনো বিষয়ে মতভেদও ছিল। মতভেদ এই বন্ধুত্বকে কখনো শিথিল করেনি। আমার সব বিপদ-আপদে আমাকে রক্ষা করার জন্য সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কামাল সিদ্দিকী। সারা জীবন তিনি আমার উপকারই করেছেন, আমি অতি অল্প প্রতিদানই দিতে পেরেছি। তাঁর কাছে আমার ঋণের শেষ নেই।

আহার

সোহরাওয়ার্দী অ্যাভিনিউয়ে হেনা বুজি বিনে পয়সায় আমাদের আহারের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার বাড়িতে তখন প্রায় ১৭-১৮ জন প্রতি বেলায় খাবার খেত। প্রত্যেক বেলায় খাবারের মেনু ছিল অভিন্ন। প্রতি বেলায় থাকত ভাত, গরুর মাংস, সবজি এবং ডাল। আমরা রাতের বেলা সাধারণত বাসাতেই খেতাম কিন্তু দিনের বেলায় অফিস অঞ্চলে খেয়ে নিতাম। তখন কলকাতায় খাবার ছিল অত্যন্ত সস্তা। দুটি শিক কাবাব, দুটি নান ও এক কাপ চা খেতে কলকাতার ফুটপাতে ১৪ আনা খরচ পড়ত। যেদিন কাবাব খেতে ইচ্ছে করত না, সেদিন রাস্তার আশপাশের রেস্টুরেন্ট থেকে তামিলনাড়ুর খাদ্য দোসা অথবা স্যান্ডউইচ খেতাম। রাতে খাবার একঘেয়ে লাগলে কখনো কখনো আমরা পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় খেতে যেতাম। সেখানে বিরিয়ানি খাওয়া হতো, সঙ্গে সঙ্গে গানও শোনা যেত। আগস্ট মাসের পর কামাল সিদ্দিকীর আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। কামাল সিদ্দিকীর বড় ভাই মহসিন সিদ্দিকী তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রকৌশলশাস্ত্রে ডক্টরেট করছিলেন। দেশে থাকতে দুই ভাইয়ের সম্পর্ক মোটেও ভালো ছিল না। কামাল সিদ্দিকী ছিলেন পিকিংপন্থী, মহসিন সিদ্দিকী ছিলেন মস্কোপন্থী। তাই দুই ভাইয়ের মধ্যে ঠোকাঠুকি লেগেই ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মহসিন সিদ্দিকী তার ছোট ভাইয়ের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি এটাসেটা (odd jobs) করে ওয়াশিংটনে অতিরিক্ত অর্থ অর্জন করেন এবং কামাল সিদ্দিকীকে ডলার পাঠান। সেই অর্থ কামাল সিদ্দিকী তার দুর্গত বন্ধুদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। কোনো কোনো দিন সে অর্থ দিয়ে তিনি আমাদের খাওয়াতেন। এবং সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন। কলকাতায় থাকতে আমরা বার চারেক সিনেমা দেখতে গিয়েছি। তবে কলকাতায় বাংলাদেশের সব শরণার্থীর জীবন একই ধরনের ছিল না। যারা দেশ থেকে টাকা লুটপাট করে নিয়ে এসেছিল, তাদের অনেকে কলকাতায় চূড়ান্ত বিলাসিতা করেছে। বগুড়ার ট্রেজারি থেকে লুট করা অর্থ নিয়ে এসে একজন অভিনেতা কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলের বার’ একদিন সম্পূর্ণরূপে নিজের জন্য ভাড়া করেছিলেন। তিনি মুম্বাইয়ে গিয়ে বিলাসবহুল হোটেলে রাত কাটিয়েছেন। এ ধরনের অতি অল্পসংখ্যক বাংলাদেশি শরণার্থী সব শরণার্থী সম্পর্কে অনেকের মনে কলঙ্কিত ধারণার জন্ম দেন।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ

আমাকে আগরতলা থেকে কলকাতায় বদলি করা হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব হিসেবে। তৌফিক ইমামকে প্রথমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব। নিযুক্ত করা হয়। তিনি তার পরিবারের স্থানান্তরের জন্য আগরতলায় ফিরে যান। তাঁর ফিরে আসার আগপর্যন্ত মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তিনি আমাকে দায়িত্ব দেন। মন্ত্রিপরিষদ সভার জন্য কিছু কার্যপত্রও তৈরি করা হয়। সভার সময় নির্ধারণ করা হয় রাত ১০টায়। আমি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির কক্ষে অনুমতি নিয়ে ঢুকি। কিন্তু মন্ত্রিসভার সদস্যরা সভার কার্যপত্রে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। তাঁরা প্রত্যেকে বিভিন্ন সাংসদের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। রাত যখন ১২টা বাজে, তখনো তাঁদের আলোচনা চলছে। একসময় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের এই সভা আরও কয়েক ঘণ্টা চলবে। এগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত রেকর্ড করার প্রয়োজন নেই। সুতরাং আপনি বাড়ি চলে যান।

আমি বাড়ি ফিরে আসি। এর পরের সপ্তাহেই তৌফিক ইমাম সাহেব ফিরে আসেন এবং তিনি মন্ত্রিপরিষদ সভার সিদ্ধান্ত রেকর্ড করা শুরু করেন। কোনো কোনো দিন রাত তিন-চারটা পর্যন্ত এই সভা অনুষ্ঠিত হতো। তৌফিক ইমাম সাহেব পুরো সময় সভায় থাকতেন এবং তা রেকর্ড করতেন। জুলাই ১৯৭১ এর প্রথম দিকে ১৯৫৯ ব্যাচের সিএসপি এবং সিলেটের ডেপুটি কমিশনার আবদুস সামাদ সাহেব কলকাতায় উপস্থিত হন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় স্থাপনের আগে প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত সব কাজকর্ম করা হতো সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীর দপ্তর থেকে। কিন্তু মন্ত্রিসভা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে প্রতিরক্ষার সব কাজ সর্বাধিনায়কের দপ্তর থেকে করা সম্ভব নয়। সে জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজন রয়েছে। তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব পদের জন্য যথেষ্ট জ্যেষ্ঠ কোনো কর্মকর্তা পাওয়া যাচ্ছিল না। ১০ জুলাই ১৯৭১ সালে আবদুস সামাদকে প্রতিরক্ষাসচিব নিযুক্ত করা হয়। তাঁর মন্ত্রণালয়ে দুটি উপসচিবের পদ ছিল। একটি পদের জন্য তিনি আমাকে চান, অন্য পদের জন্য সিলেটের বন সংরক্ষক এস এ ইমামকে চান। তাঁর অনুরোধে আমাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপসচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের জন্য বিশেষ সেল স্থাপন করা হয়। এই সেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. বেলায়েত হোসেন ও সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জাহিদ, সাংবাদিক আল-মুজাহিদী ও নজরুল ইসলামকে বিভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিসের স্থান নির্ধারণ করা হয় ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের টিনশেডের একটি কক্ষে। সেখানে আমাদের প্রত্যেককে একটি টেবিল ও একটি চেয়ার দেওয়া হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তার জন্য একটি টাইপরাইটার ও একজন টাইপিস্ট দেওয়া হয়।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পুরোপুরি কাজ শুরু করে এবং ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুজিবনগরে কাজ করে। প্রায় সাড়ে তিন মাস আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছি। এই সময় আমি মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগ যেসব উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে, সে সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। ভারতে যেসব নিয়মিত বাহিনী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করছিল, তাদের খাওয়াদাওয়া, অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে দেওয়া হতো। কিন্তু বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে প্রায় সর্বত্রই অনেক মুক্তিযোদ্ধা দায়িত্ব পালন করতেন। এঁদের খাওয়াদাওয়া, অস্ত্রশস্ত্র–এগুলো ভারতীয় সরকার সব সময় দিত না। এঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্ব।

এখানে দুটি ঘটনার উল্লেখ করি। একটি ঘটনা হলো অক্টোবর মাসে মাঠপর্যায় থেকে খবর আসে, বিভিন্ন স্থানে অনিয়মিত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের রাতে ঘুমানোর জন্য প্রয়োজনীয় কম্বল নেই। মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো পাঁচ হাজার কম্বল এসব বাহিনীর কাছে পাঠানো হবে। এ নির্দেশ যখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে আসে, তখন প্রতিরক্ষাসচিব আমাকে ডেকে বললেন, ‘পাঁচ হাজার কম্বল কিনে মেঘালয়ের তুরাতে পাঠিয়ে দাও। আমি বললাম, ‘কোনো টেন্ডার নেই, কোনো এস্টিমেট নেই, কীভাবে আমি পাঁচ হাজার কম্বল কিনব?’ প্রতিরক্ষাসচিব বললেন, ‘এটা যুদ্ধাবস্থা। এখানে কোনো টেন্ডার লাগে না। তুমি লোকজনকে জিজ্ঞেস করে হিসাব করো পাঁচ হাজার কম্বলের দাম কত হতে পারে। সে টাকার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে হাতে হাতে রিকুইজিশন নিয়ে যাও।’ রিকুইজিশন নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে গেলে আমাকে টাকা দিয়ে দেওয়া হয়। সেই টাকা নিয়ে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবসহ বড় বাজারে যাই এবং কম্বল দেখে পছন্দ হলে কোথাও পাঁচ শ কম্বল, কোথাও সাত শ কম্বল–এ রকম করে কম্বল কিনতে কিনতে পাঁচ হাজার কম্বল কিনে এগুলোকে থিয়েটার রোডের অফিসে আনার ব্যবস্থা করি। অন্যদিকে ফোর্ট উইলিয়ামে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ছিলেন। আমি তাকে বলি যে কম্বলগুলো মেঘালয়ের তুরাতে পাঠাতে হবে। সে বলল, তুমি কম্বলগুলো গাড়িতে ভরে সরাসরি ফোর্ট উইলিয়ামে নিয়ে আসো। সেখানে আমি তার কাছে কম্বল হস্তান্তর করি। এই সময় ভারতীয় লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমাকে চা খেতে দেন। চা খেতে খেতে তিনি বলেন, তোমরা বাঙালিরা পশ্চিম পাঞ্জাবিদের আক্রমণ ঠিকই প্রতিহত করছ। কিন্তু আমরা পূর্ব পাঞ্জাবের লোকেরা পশ্চিম পাঞ্জাবিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। বাঙালিদের রক্ষা করার জন্য পাঞ্জাবিরা পাঞ্জাবিদের মারছে। এ কাজ কতটুকু সঠিক তা জানি না।

তেমনি আরেকটি ঘটনা ঘটে প্রতিরক্ষাসচিব যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে এসে আমাকে একটি আদেশ দেন। সেই আদেশে তিনি লেখেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মাঠে অনেক ভালো যুদ্ধ করছে। কিন্তু এই যুদ্ধ সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ বাংলাদেশ বেতারে প্রচার করা সম্ভব হচ্ছে না। যদি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে উঁচু মানের টেপ রেকর্ডার পাঠানো যায়, তাহলে সেনাবাহিনীর যুদ্ধের অনেক বাস্তব বিবরণ তুলে ধরা সম্ভব হবে। আমাকে অবিলম্বে ২০টি টেপ রেকর্ডার কিনে শিলিগুড়িতে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়। আমি কম্বলের পদ্ধতি অনুসরণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করি। চৌরঙ্গিতে গিয়ে টেপ রেকর্ডারের দোকান থেকে উন্নত মানের টেপ রেকর্ডার কিনে থিয়েটার রোডে নিয়ে আসি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সেই টেপ রেকর্ডারগুলো শিলিগুড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই টেপ রেকর্ডারগুলোও কতটুকু কাজে লেগেছে, তা জানি না। তবে আমরা আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছি।

প্রায় ৫০ বছর পর সেই স্মৃতি রোমন্থন করলে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। ৫০ বছর আগে বিনা টেন্ডারে অনেক কারিগরি তথ্য না জেনেও যে সিদ্ধান্ত দ্রুততার সঙ্গে নিতে পেরেছি, আজকে ৫০ বছর পরে আমরা কি একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারব? অবিশ্বাস, হিংসা-বিদ্বেষ আজকের আমলাতন্ত্রকে অনেক খাটো ও খর্ব করে দিয়েছে।

এ সময়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আরও দুটি কাজ করে। প্রথমত, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্রথম ব্যাচে ১০০ জন অফিসার প্রশিক্ষণের জন্য নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই শিক্ষানবিশ অফিসারদের বাছাই করার দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিরক্ষাসচিব আবদুস সামাদকে। তিনি বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত আঞ্চলিক অফিসগুলোতে যান এবং সেখানে সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রার্থী নির্বাচন করেন। বিভিন্ন সময় তিনি তাঁর কনিষ্ঠ সহকর্মীদের তার বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেন। সাতক্ষীরা সীমান্তে টাকি শহরে যে ইন্টারভিউ হয়েছিল, তাতে আমি সদস্য হিসেবে কাজ করেছি। দুই মাসের মধ্যে এই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়। তাই প্রতিরক্ষাসচিব অনেক সময়ই কলকাতায় থাকতে পারতেন না।

আরেকটি বিষয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাকিস্তান সমর্থকদের ভয় পাওয়ানোর জন্য এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে দুই-তিন মাস সময়ে এ ক্ষেত্রে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।

মুজিবনগর সরকারের বিবর্তন

মুজিবনগর সরকার প্রথমে শুরু হয়েছিল একটি ছোট সরকার হিসেবে। মন্ত্রিপরিষদে মাত্র পাঁচজন সদস্য ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, এম মনসুর আলী ছিলেন অর্থমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমদ ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং কামারুজ্জামান ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু মন্ত্রীদের কাজও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। ১৯৭১ সালের ২০ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংগঠন এবং কার্যাবলির ওপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ একটি প্রতিবেদন পেশ করে। এই প্রতিবেদন থেকে বাংলাদেশ সরকারের গঠন সম্পর্কে একটি চিত্র পাওয়া যায়।

(১) প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়

(২) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

(৩) অর্থ ও শিল্প বাণিজ্য মন্ত্রণালয়

(৪) মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়

(৫) সাধারণ প্রশাসন বিভাগ

(৬) স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়

(৭) তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়

(৮) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

(৯) ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়

(১০) সংসদবিষয়ক বিভাগ

(১১) কৃষি বিভাগ

(১২) প্রকৌশল বিভাগ

মন্ত্রণালয়ের বাইরে আরও কয়েকটি সংস্থা ছিল, যারা সরাসরি মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্বাধীনে কাজ করত। যেমন :

(১) পরিকল্পনা কমিশন

(২) শিল্প ও বাণিজ্য বোর্ড

(৩) নিয়ন্ত্রণ বোর্ড, যুব ও অভ্যর্থনা শিবির

(৪) ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি

(৫) শরণার্থী কল্যাণ বোর্ড।

এ ছাড়া ১৫টি সংগঠন বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনে কাজ করছিল। এই সংগঠনগুলো নিম্নরূপ :

(১) যুব নিয়ন্ত্রণ পরিষদ ও প্রশিক্ষণ বোর্ড

(২) বাংলাদেশ হাসপাতাল

(৩) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

(৪) জয় বাংলা পত্রিকা।

(৫) বাংলাদেশ বুলেটিন

(৬) বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী সংগঠন

(৭) বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি

(৮) স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল

(৯) বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠী

(১০) বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠী

(১১) বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি

(১২) বাংলাদেশ সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ।

(১৩) নিউইয়র্ক বাংলাদেশ লীগ

(১৪) বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি, লন্ডন

(১৫) লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া।

এ তালিকার বাইরে একটি ডাক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ বিভাগ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ডাকটিকিট বিক্রির ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীতে তিন ধরনের সদস্য ছিল। এক ধরনের সদস্য ছিল নিয়মিত বাহিনীর সদস্য। এরা পাকিস্তান বাহিনীর বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের বাঙালি সদস্যদের নিয়ে গঠিত ছিল। মুক্তিবাহিনীকে ১১টি সেক্টরে মোতায়েন করা হয়। তিনজন বিশিষ্ট সেনা অফিসারের আদ্যক্ষর দিয়ে অতিরিক্ত বাহিনীর নামকরণ করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের নামে করা হয়েছিল জেড ফোর্স, খালেদ মোশাররফের নামে করা হয়েছিল কে ফোর্স এবং সফিউল্লাহর নামে করা হয়েছিল এস ফোর্স। এ ছাড়া আর দুই ধরনের বাহিনী ছিল। ছাত্র-তরুণ অসামরিক ব্যক্তি সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ যারা রাজনৈতিকভাবে শেখ মনি, সিরাজুল আলম খান এবং তোফায়েল আহমেদের অনুগত ছিলেন, তাঁরা ‘মুজিব বাহিনী’ বা ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ নামে পরিচিত ছিলেন। এ ছাড়া নৌকমান্ডো এবং নৌবাহিনীর লোকজনও মুক্তিফৌজে ছিল। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকেরা বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গড়ে তোলেন। সব নিয়মিত বাহিনী মিলে কমপক্ষে ২৫ হাজার সৈনিক ছিল।

এই নিয়মিত বাহিনীর বাইরে ছিল যুব ক্যাম্প। সারা দেশে সীমান্ত ঘিরে ভারতের অভ্যন্তরে ১০০টি ইয়ুথ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিটি ইয়ুথ ক্যাম্পের ধারণক্ষমতা ছিল ১ হাজার। সুতরাং ইয়ুথ ক্যাম্পে প্রায় ১ লাখ তরুণকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। এই ইয়ুথ ক্যাম্পগুলোর পরিচালনার দায়িত্বে ছিল প্রফেসর ইউসুফ আলীর নেতৃত্বে একটি বোর্ড। প্রতিটি ইয়ুথ ক্যাম্পে কমপক্ষে একজন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও একজন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য যুক্ত থাকতেন। ইয়ুথ ক্যাম্পকে সমর্থন করার জন্য প্রতিটি ক্যাম্পে অসামরিক কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।

১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই বাংলাদেশে নিম্নলিখিত প্রশাসনিক জোন প্রতিষ্ঠা করা হয় :

(১) দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল (১), সদর দপ্তর : সাবরুম

(ক) চট্টগ্রাম (খ) পার্বত্য চট্টগ্রাম (গ) নোয়াখালী জেলার ফেনী মহকুমা

(২) দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল (২), সদর দপ্তর : আগরতলা

(ক) ঢাকা (খ) কুমিল্লা (গ) ফেনী মহকুমা ব্যতীত নোয়াখালী জেলা

(৩) পূর্ব অঞ্চল, সদর দপ্তর : ধর্মনগর।

(ক) হবিগঞ্জ (খ) সিলেট জেলার মৌলভীবাজার মহকুমা

(৪) দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল (১), সদর দপ্তর : ডাউঁকি

(ক) সদর (খ) সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমা

(৫) দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল (২), সদর দপ্তর : তুরা

(ক) ময়মনসিংহ (খ) টাঙ্গাইল

(৬) উত্তর অঞ্চল (১), সদর দপ্তর : কোচবিহার

(ক) রংপুর

(৭) পশ্চিম অঞ্চল (১), সদর দপ্তর : বালুরঘাট

(ক) দিনাজপুর, (খ) বগুড়া, (গ) রাজশাহী

(৮) দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল, সদর দপ্তর : কৃষ্ণনগর

(ক) পাবনা, (খ) কুষ্টিয়া, (গ) ফরিদপুর, (ঘ) যশোর

(৯) দক্ষিণ অঞ্চল, সদর দপ্তর : বারাসাত

(ক) বরিশাল (খ) পটুয়াখালী, (গ) খুলনা [৩]

প্রতিটি অঞ্চলে সব জাতীয় পরিষদ সদস্য ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়। প্রতিটি আঞ্চলিক পরিষদে একজন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে সভাপতি করা হয়। আঞ্চলিক পরিষদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে সহায়তা করার জন্য নিম্নলিখিত সাতটি কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করা হয় :

(১) আঞ্চলিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা

(২) আঞ্চলিক শিক্ষা কর্মকর্তা

(৩) আঞ্চলিক ত্রাণ কর্মকর্তা

(৪) আঞ্চলিক প্রকৌশলী

(৫) আঞ্চলিক পুলিশ কর্মকর্তা

(৬) আঞ্চলিক তথ্য কর্মকর্তা

(৭) আঞ্চলিক হিসাব কর্মকর্তা।

সরকারের নতুন পদ সৃষ্টি ২০ অক্টোবরের পর শেষ হয়ে যায়নি। ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকারের মহাসচিব বা সেক্রেটারি জেনারেলের পদ সৃষ্টি করা হয়। এর আগে এম নুরুল কাদের সেক্রেটারি, জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পদে নিযুক্ত ছিলেন। অনেক সময় তিনি সেক্রেটারির পরে ‘কমা না দিয়ে সেক্রেটারি জেনারেলের পরে কমা’ ব্যবহার করতেন, যাতে অনেকের মনে হতো এম নুরুল কাদেরই বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। আসলে নুরুল কাদের কখনো সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন না, তার পদমর্যাদা ছিল সচিবের। ১২ ডিসেম্বর সেক্রেটারি জেনারেল পদে নিয়োগ দেওয়া হয় আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলার আসামি এবং ১৯৪৯ ব্যাচের সিএসপি অফিসার রুহুল কুদ্সকে।

মুজিবনগর সরকারে অন্তর্দ্বন্দ্ব

মুজিবনগর সরকার যতই বড় হতে থাকে, ততই তার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকার দুটি হুমকির সম্মুখীন হয়। প্রথমত, আওয়ামী লীগের তরুণ ছাত্রনেতারা যুদ্ধের জন্য কোনো সরকারের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, যুদ্ধের জন্য বিপ্লবী কমান্ড প্রতিষ্ঠা করাই যথেষ্ট। এই কমান্ড বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কাজ করবে। এই মতের প্রবক্তা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ এবং অন্যান্য ছাত্রনেতা। তারা ভয় প্রকাশ করেন যে তাঁদের হাতে নেতৃত্ব না থাকলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব উৎখাত হতে পারে। ভারত সরকার আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা মেনে নেয়। তাই বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর বাইরে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেস’ (BLF) নামে একটি স্বতন্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এই বাহিনীর সংগঠকেরা তাঁদের বাহিনীকে ‘মুজিব বাহিনী বলতেন। মুজিব বাহিনী’ নাম নিয়ে তাঁরা নিজেদের মুক্তিবাহিনীর বাইরের শক্তি বলে পরিচয় দিতেন। আওয়ামী লীগের প্রতি অতি বিশ্বস্ত ১০ হাজার ছাত্রকে এই বাহিনীতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এঁদের প্রশিক্ষণ হয় ভারতের দেরাদুনের অদূরে চাকরাতা প্রশিক্ষণঘাটিতে। মেজর জেনারেল এস এস ওবানকে এ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।[৪] তিনি মুজিব বাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেন এবং পাকিস্তান বাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য এঁদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও দেওয়া হয়। তাজউদ্দীন আহমদ এবং জেনারেল ওসমানী এঁদের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডে আনার পক্ষপাতী ছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই প্রস্তাব অনুমোদন করলেও ‘মুজিব বাহিনী’র সংগঠকদের বিরোধিতার কারণে এ প্রস্তাব কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে পরস্পরকে সব সময় সহযোগিতা করেনি। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেদের মধ্যে লড়াই করেছে।

দ্বিতীয় দ্বন্দ্ব দেখা দেয় মুজিবনগর সরকার এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সাংসদদের মাধ্যমে। প্রতিবিপ্লবীদের নেতৃত্বে ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তাঁকে সহায়তা করছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং জহিরুল কাইয়ুম। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে যে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সব সংসদ সদস্য রয়েছেন, সেটা প্রমাণ করার প্রয়োজন ছিল। তাই ভারত সরকারের সহায়তায় শিলিগুড়ির জঙ্গল অঞ্চলে ৫ জুলাই তারিখে আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ভারত সরকারের সমর্থন নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারকে আওয়ামী লীগ সাংসদেরা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন দেয়।

শিলিগুড়ি সম্মেলনের পর মুজিবনগর সরকারের প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ দূর হয় কিন্তু ভেতরে-ভেতরে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। এ ষড়যন্ত্রের নেতা ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তাঁকে সহায়তা করেন কুমিল্লার আওয়ামী লীগ নেতা জহিরুল কাইয়ুম এবং পররাষ্ট্রসচিব মাহবুবুল আলম চাষী (যাকে মার্কিন সরকারের কাছে পাকিস্তানের দেশরক্ষার গোপনীয় বিষয়াদি পাচার করার অভিযোগে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়)। তাজউদ্দীন আহমদ এবং ভারত সরকার প্রথম থেকেই খন্দকার মোশতাককে সন্দেহ করত। তাজউদ্দীন আহমদ খন্দকার মোশতাকের একান্ত সচিব হিসেবে কামাল সিদ্দিকীকে নিয়োগ করেন। নিয়োগের আগে তিনি খন্দকার মোশতাকের সন্দেহজনক আচরণ সম্পর্কে কামাল সিদ্দিকীকে জানান এবং খন্দকার মোশতাকের সব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাঁকে সরাসরি অবহিত রাখার জন্য কামাল সিদ্দিকীকে নির্দেশ দেন। কামাল সিদ্দিকী খোন্দকার মোশতাকের টেলিফোনের নিচে কয়েকটি অচেনা কাগজে টেলিফোন নম্বর দেখতে পান। টেলিফোন নম্বরগুলোকে কপি করে তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে দেন। তাজউদ্দীন আহমদ পরে কামাল সিদ্দিকীকে জানান যে টেলিফোন নম্বরগুলো কলকাতার আমেরিকান কনস্যুলেট জেনারেলের অফিসের। ভারতীয়দের তদন্তে আরও জানা যায় খন্দকার মোশতাকের পক্ষে জহিরুল কাইয়ুম মার্কিন দূতাবাসে দেখা করতে যান।

১৯৭১ সালের আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের যে সভা অনুষ্ঠিত হবে, সে সভার জন্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মনোনয়ন দেওয়া হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। তাঁর সঙ্গে তার একান্ত সচিব কামাল সিদ্দিকী যাবেন কাগজপত্র নিয়ে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তার একান্ত সচিবের বিশ্বসভায় অংশগ্রহণের উপযুক্ত কাপড়চোপড়ের জন্য দেড় হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। কামাল সিদ্দিকী এ টাকা তুলে তার মন্ত্রীর জন্য পোশাক তৈরি করার ব্যবস্থা করেন এবং নিজে একটি স্যুট ও একজোড়া জুতা কেনেন। তারপর হঠাৎ খন্দকার মোশতাকের নিউইয়র্ক সফর বাতিল করা হয়। জানা যায়, ভারত সরকার টের পেয়েছিল খোন্দকার মোশতাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছেন। তাঁর শর্ত ছিল পাকিস্তান যদি শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেয়, তাহলে শেখ মুজিব এসে যুদ্ধ বন্ধ করে দেবেন এবং এক পাকিস্তানের কাঠামোতে সাংবিধানিক সমস্যার সমাধান করবেন। ভারত সরকার তাই খন্দকার মোশতাককে দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট দিতে অস্বীকার করেন। কামাল সিদ্দিকীরও দেশের বাইরে যাওয়া হয়নি। শীতের সময়ে মাঝেমধ্যে বাইরে গেলে আমি কামাল সিদ্দিকীর কাছ থেকে নিউইয়র্কে যাওয়ার জন্য তৈরি করা তার কোটটি ধার করতাম।

মোশতাকের সমর্থকেরা যে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতা চেষ্টা করছে, তা মোশতাকের অন্য সহকর্মীদের আচরণ থেকেও বোঝা যাচ্ছিল। তাহেরউদ্দীন। ঠাকুর ছিলেন সরাইল থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য। তিনি খন্দকার মোশতাকের অনেক কাছের লোক ছিলেন। আমি কলকাতায় যোগ দেওয়ার পর একদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাই। সেখানে তাহেরউদ্দীন ঠাকুরের সঙ্গে আমার দেখা হয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে করতে একপর্যায়ে তাহেরউদ্দীন। ঠাকুর আমাকে বলেন, এসডিও সাহেব, আপনারা কেন এই রাজনৈতিক বিষয়ে জড়ালেন সেটা বুঝতে পারছি না। আমরা রাজনীতিবিদেরা অনেক বিষয়ে ঝগড়া করি আবার সেসব বিষয় নিয়ে আপসও করি। আমাদের জন্য কিছুই বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু আপনাদের আইনের ভিত্তিতে প্রশাসন চালাতে হয়। একবার যদি আইন ভাঙেন, তাহলে আপনাদের অবশ্যই শাস্তি হবে। সুতরাং যদি দেখা যায় কিছুদিন পর আপস করে আমরা ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরে গেছি, তখন কিন্তু আপনারা ফিরে যেতে পারবেন না। আপনাদের বিচার হবে।

তার এই বক্তব্য আমি সঙ্গে সঙ্গে কামাল সিদ্দিকীকে জানাই। আমরা দুজনে খসরুজ্জামান চৌধুরী, সাদাত হোসেনসহ অন্যান্য কনিষ্ঠ সহকর্মীর সঙ্গে আলোচনা করি এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই শুধু দেশের স্বার্থেই নয়, আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অপরিহার্য বলে। সুতরাং যারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তাদের সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই আপস করা যাবে না।

তবে মুক্তিবাহিনী এবং মুজিব বাহিনীর মধ্যে সব ক্ষেত্রে সংঘর্ষ এড়ানো যায়নি। মুজিব বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের আদৌ কোনো পাত্তা দিতেন না। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়। মুজিব বাহিনীর সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী–কারও আদেশই মানতেন না। তারা শুধু শেখ মনি ও কয়েকজন ছাত্রনেতার আদেশ মানতেন। এই দ্বন্দ্ব মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় নিরসন করা যায়নি। ভারত সরকার এ ব্যাপারে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। অন্তর্দ্বন্দ্ব মুক্তিবাহিনীর ভেতরেও ছিল। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে জেড ফোর্স, সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এস ফোর্স এবং খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে কে ফোর্সের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছিল। এই দ্বন্দ্ব মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিরসন। করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে হানাহানির মাধ্যমে এই অন্তর্দ্বন্দ্বের নিরসন হয়।

কলকাতায় জীবন

১৯৭১ সালে কলকাতা নগরী ছিল বাঙালির সাহিত্য-শিল্প এবং সংস্কৃতির পীঠস্থান। আমি যখন কলকাতায় যাই, তখন আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে কলকাতার ৯০ শতাংশ লোক বাঙালি। কলকাতায় আসার পর দেখলাম এ ধারণা ভুল। কলকাতার কেন্দ্রস্থলে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ লোক হিন্দি ভাষাভাষী। কলকাতা ময়দান থেকে শুরু করে পার্ক সার্কাস ও গড়িয়ারহাট পর্যন্ত বাংলার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকার। শারদীয় পূজার সংখ্যা বের হয়। একদিন বিকেলে আমি হাঁটতে যাচ্ছিলাম, তখন। হেনা বুজি আমাকে বললেন কয়েকটি পূজার সংখ্যা কিনে নিয়ে আয় তো। আমি পার্ক সার্কাস থেকে রওনা হলাম। রাস্তায় নামতেই অনেক বইয়ের দোকান। দোকানে ঢুকে দেখি শুধু ইংরেজি এবং হিন্দি বই আছে; কোনো বাংলা বই নেই। পার্ক সার্কাস থেকে তিন মাইল হেঁটে একটিও বাংলা বইয়ের দোকান পাইনি। শেষে আমি নিউমার্কেট যাই এবং নিউমার্কেটে গিয়ে নিউমার্কেটের পেছনের অংশে বাংলা বইয়ের দোকান এবং পূজাসংখ্যা পাই।

কলকাতায় বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধারা শুধু তাদের নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করতেন কিন্তু বাইরের লোকদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল ক্ষীণ। বাংলা ভাষাভাষী হিন্দুদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু বাংলা বা উর্দু ভাষাভাষী মুসলমানদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ছিল অত্যন্ত শক্ত। কলকাতার প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলমান ছিল পাকিস্তানের সমর্থক। হয় তাদের পরিবারের কাউকে ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে সম্পূর্ণ পরিবারের অভিবাসনের ব্যবস্থা করতে পাঠানো হয়েছে অথবা পুরো পরিবার কীভাবে পাকিস্তানে অভিবাসন করা যায়, সে সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা করছে। মুসলমানদের মধ্যে শতকরা ১০ ভাগ ছিল শিক্ষিত এবং সংস্কৃতমনা। শুধু এরাই মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য বুঝত। ড. ফারুক আজিজ খান মুজিবনগরে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব ছিলেন। স্প্রিং ১৯৭১ গ্রন্থে তিনি তাঁর সে সময়কার স্মৃতি লিপিবদ্ধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন।

Unfortunately, the Indian Muslims were totally against Bangladesh. They used to hold religious functions and meetings in which they made use of every opportunity to criticise us and accuse India for working against Pakistan. The attitude of the West Bengal Muslims was so bad that the Government of India had to take precaution against communal riots breaking out. Fleeing Bengalis in distress were very badly treated even by their relatives on the Indian side of the border, some were not given even temporary shelter for a few days.

মুক্তিযোদ্ধা ওয়ালিউল ইসলামও এ সম্পর্কে তার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথায় লিখেছেন :

লক্ষ্ণৌর সাপ্তাহিকী সিদকি ই জাদিদ-এর বিদগ্ধ সম্পাদক মাওলানা আবদুল মজিদ দরিয়াবাদী ১৯৭১ সালের ১১ জুন লিখেছেন, পাকিস্তানের ইসলামাবাদ কোন আলোচনা দাবী করে না; তবে সে দেশের সরকার মুসলিম সরকার; ঐ সরকারের বিরোধিতা ক্ষমা করা যায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের পর তিনি লিখলেন, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার ন্যায় পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র। যারা এর বিরোধিতা করেছে তাদেরকে নিন্দা করতে হবে। এটা শরিয়া তথ্য; এদেরকে মুক্তিফৌজ বা স্বাধীনতা সংগ্রামি তকমা দিয়ে ছাড় দেয়া যাবে না।

যাহোক, ঈদের দিন আমি ঈদের নামাজ পড়তে মসজিদে গেলাম। বড় কোনো মসজিদের বৃহৎ জামাতে যোগ দিইনি; লোয়ার সার্কুলার রোডের পাশে একটি ছোট্ট জীর্ণ মসজিদে নামাজ আদায় করেছিলাম। অথচ তখন কোনো কোনো উর্দু (মুসলিম) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল যে ৩৫০-এর অধিকসংখ্যক মুসলিম কলকাতার বাংলাদেশ মিশনে কাজ করছিলেন; তাঁরা ভারতীয় মুসলমানদের বেদরদি মনোভাবের জন্য নিজেরা স্বতন্ত্র জামাতে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেছেন। কিন্তু এমন কোনো জামাতের তথ্য আমার জানা নেই। আমি মিশনের খুব কাছেই থাকতাম। আর কলকাতার বাংলাদেশ মিশনে ১০০ জনের কমসংখ্যক লোক কাজ করতেন; ৩৬০+ নয়। যুদ্ধকালে এ তথ্যের বহুল প্রচার ঘটে।[৭]

তবে আমাদের জীবন একেবারে নিরানন্দ ছিল না। আমরা অনেক আড্ডা দিতাম। সে সময়ে কিছু সামাজিক ঘটনাও ঘটে। এ ধরনের একটি ঘটনা ছিল রফিকুল ইসলাম চৌধুরীর বড় মেয়ে নিম্মির সঙ্গে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা ক্যাপ্টেন ডালিমের বিয়ে। এই বিয়ের একটি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন ফারুক আজিজ খান। তিনি লিখেছেন :

While the task of organizing the liberation forces and making preparations for waging a decisive war against the Pakistan army was weighing heavy on the minds of many who had to share this responsibility, unexpected things, although would be considered rather usual under normal situations, also happened. One morning I found the prime minister in totally off-mood as if he hadn’t had much sleep in the night. For him it was quite usual to continue working late in the night on one thing or the other. But that morning I thought some thing more unusual had happened. Gathering courage I asked him if any thing had gone wrong. ‘Wrong?’, he snapped, ‘don’t you know anything?’ ‘No, sir’, I said nervously. I thought the Pakistan air force must have bombed somewhere or the army shelled some place or some thing really serious had happened about which I had no knowledge. ‘You seem to be out of touch with what is going on around you’, and then after a little pause he said, ‘Capt. Dalim has married the daughter of Mr. Rafiq Chowhury against the wishes of the family and I had to convince the father of the bride to accept the situation. I spent almost the whole night trying to convince Rafiq bhai who happens to be a relative of mine to accept the situation with grace. Now, tell me, am I to fight a war or act as a marriage broker?’. I could understand his sentiments and his difficulties. Both Mr. Rafiq Chowdhury who was a first secretary in the Bangladesh High Commission and Capt. Shariful Huq Dalim (who became famous on August 15, 1975) were very important persons in the government structure and that made the issue very sensitive. But human beings are human beings no matter where they were. One can not part with his feelings and sentiments just because he is in distress. In Vietnam for years the people survived under heavy American bombing and shelling and they had to live in trenches and yet they married, they raised families and they had moments of joy. We also had to have our lighter moments and the burden we were carrying in our minds was becoming somewhat bearable with every passing day. We were slowly getting used to the hardships and the uncertainties that lay ahead of all of us.’[৭]

আগস্ট ১৯৭১ সালে নিম্মি-ডালিমের বিয়ে উপলক্ষে সবাই খুশি। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যাপ্টেন ডালিম মৌলভীবাজার ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে গেলেন। একদিন তিনি মর্টার যাতে সঠিকভাবে নিক্ষেপ করা হয়, তার নির্দেশনা। দেওয়ার জন্য একটি উঁচু গাছে উঠে সেখান থেকে যারা মর্টার ছুড়ছিল, তাদের। নির্দেশ দিচ্ছিলেন। এক রাজাকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে এ তথ্য জানিয়ে দেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সরাসরি ডালিমকে গুলি করে। গুলি লেগে তার ডান হাত মারাত্মকভাবে জখম হয়। এ হাত আর কখনো ভালো হয়নি। হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে ক্যাপ্টেন ডালিম আবার কলকাতায় ফিরে আসলেন। এভাবেই। হাসি-কান্নার মধ্য দিয়ে আমাদের সবার জীবন চলছিল।

দিল্লি-আজমির ভ্রমণ

আগস্ট ১৯৭১ সালের শেষ দিকে হেনা বুজির একমাত্র ছেলে বাপ্পীর কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ কোর্সে ভর্তির সুযোগ হয়। কানাডাতে তার সব খরচের দায়িত্ব নেন রফিকুল ইসলাম চৌধুরীর ছোট ভাই ড. চৌধুরী, যিনি তখন মন্ট্রিয়লে একজন বিশিষ্ট হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। কানাডায় যাওয়ার জন্য নয়াদিল্লির কানাডিয়ান হাইকমিশনে বাপ্পীকে ইন্টারভিউ দিতে হবে। তাই তার নয়াদিল্লি যাওয়া প্রয়োজন। ভারতে তখন অনেক মুসলমান পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করছে। এদের কেউ টের পেলে বাপ্পীকে ছিনতাই করতে পারে। তাই সিদ্ধান্ত হয় যে বাপ্পীকে একা নয়াদিল্লি যেতে দেওয়া ঠিক হবে না। বাপ্পীর সঙ্গে আমিও যাব। আমি এক সপ্তাহের ছুটি নিলাম। আমি এবং বাপ্পী রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লি রওনা হই। রাজধানী এক্সপ্রেস একটি বিলাসবহুল ট্রেন ছিল। এই ট্রেনের সুযোগ-সুবিধা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশন কনট প্লেসে হোটেল ‘জনপথ’ নামে একটি হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে। হোটেলটিতে এয়ারকন্ডিশনের ব্যবস্থা ছিল। তাই কোনো অসুবিধা হয়নি। বাপ্পীর সঙ্গে আমি বাংলাদেশ দূতাবাসে যাই। নয়াদিল্লিস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি কে এম সাহাবুদ্দিন ও প্রেস কাউন্সিলর আমজাদ হোসেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন দিয়ে বেরিয়ে আসেন। নয়াদিল্লিতে একটি বাড়ি ভাড়া করে সেখানে সাহাবুদ্দিন বাংলাদেশের দূতাবাস খোলেন। আমরা যখন দিল্লিতে ছিলাম, তখন প্রতিদিনই দূতাবাসে যেতাম। একদিন বিকেলবেলা দূতাবাসে বসে আছি, তখন দেখতে পেলাম যে একজন। বাঙালি ভদ্রলোক ও একজন বাঙালি ভদ্রমহিলা সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য এসেছেন। তারা সাহাবুদ্দিনের কক্ষে এলে তাদের পরিচয় দিয়ে বললেন। যে ভদ্রলোক হচ্ছেন ছোট ভাই, যিনি মধ্যপ্রদেশে একটি কারখানার জেনারেল ম্যানেজার আর মহিলাটি হচ্ছেন তার দিদি, যার স্বামী রাজস্থানে অধ্যাপনা করেন। গত প্রায় ১০-১২ বছর ধরে ভাই-বোনের কোনো দেখা হয়নি। এই ভাই-বোনের বাড়ি ছিল বরিশালে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তাঁরা ভারতে চলে আসেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাই ভাই-বোন খুবই উৎফুল্ল হন। তারা ঠিক করেন যে তারা একসঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাসে। আসবেন। তাঁরা দিল্লিতে একত্র হয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে এসেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন জানানোর জন্য এবং তারা দুজন ১০ হাজার টাকা বাংলাদেশ দূতাবাসকে দান করেন। তারা বলছিলেন যে তারা বরিশালে ফিরে যেতে চান না কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ সফল হলে বরিশালে সবাই সুখে শান্তিতে থাকতে পারবে–এটিই হবে তাঁদের জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

বাপ্পীর ভিসার কাজ শেষ হলে আমরা প্রথমে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার জিয়ারত করতে যাই। মাজারের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত নোংরা এবং মাজারে ঢোকার পথে অসংখ্য কুষ্ঠরোগী ভিক্ষা করছিল। নিজামউদ্দিন। আউলিয়ার মাজারে ঢুকতে গিয়ে মোটেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। তবে ঢোকার পর মনে হলো যে এই মাজারে শাহজাহানের কন্যা জাহানারার মাজারও অবস্থিত। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করায় মাজারের বাইরে তারা একটি কবর দেখিয়ে বলেন এটি জাহানারার কবর। কবরে একটি প্রস্তরস্তম্ভে ফারসিতে কী যেন লেখা আছে। পড়তে পারিনি। তবে বাঙালি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কল্যাণে আমরা এর মর্মার্থ জানি, ‘গরিব ঘরে দীপ জ্বেলো না ফুল দিয়ো না কেউ ভুলে, শ্যামা পোকায় না পুড়ে পাখ, দাগ না পায় বুলবুলে। এরপর আমরা আজমির শরিফে মঈনুদ্দীন চিশতির মাজার জিয়ারত করতে রওনা হই। রাত ১০টার দিকে আমরা ট্রেনে আজমিরের উদ্দেশে যাত্রা করি। সারা রাত ট্রেনে ভ্রমণ করে পরদিন সকালে আমরা আজমির শরিফে যাই। রাত তিনটার দিকে লোকজনের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। লোকজনের চিৎকারের কারণ হলো যে তখন বাইরে মরুভূমিতে অসংখ্য ময়ূর দেখা যাচ্ছিল। আমরা। সবাই ময়ূর দেখে উত্তেজিত। একটু পরপর ময়ূরের ঝক দেখা যাচ্ছিল। আমরা মরুভূমিতে ময়ূরের সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়ে যাই। আজমির শরিফে মাজার ছিল অনেক পরিচ্ছন্ন। সেখানে মাজার জিয়ারত করে আমরা দিল্লি হয়ে কলকাতায় ফিরে আসি।

মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে দুটি অনুমান

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করা হলেও মুজিবনগরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল সীমিত। মূলত দেশরক্ষা সম্পর্কে মন্ত্রিপরিষদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত কার্যকর করাই ছিল এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। যুদ্ধের রণকৌশল এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করতেন মন্ত্রিসভা এবং সেনাবাহিনীর প্রধান। এ ব্যাপারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কোনো কাজ হচ্ছিল না। আমি আমার নিজের উদ্যোগে এ সম্পর্কে কিছু পড়াশোনা করি এবং দুটি সিদ্ধান্তে উপনীত হই। সিদ্ধান্ত দুটি নিয়ে তখন অনেকের সঙ্গে তর্কবিতর্কও করি।

৮ নম্বর থিয়েটার রোডের উল্টো দিকে ব্রিটিশ কাউন্সিলের পাঠাগার ছিল। তাই যেদিন মন্ত্রণালয়ে কাজ কম থাকত, সেদিন দুপুরের খাবার খেয়ে আমি ব্রিটিশ কাউন্সিল পাঠাগারে চলে যেতাম। সেখানে আমার প্রথম অনুসন্ধানের বিষয় ছিল মুক্তিবাহিনী কতটুকু কার্যকরভাবে কাজ করছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে গেরিলাযুদ্ধে যদি প্রতিপক্ষের কমপক্ষে ১০ গুণ বেশি শক্তি থাকে, তাহলে গেরিলাদের ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। নিয়মিত বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর সদস্য নিয়ে বাংলাদেশের কমপক্ষে ১ লাখ ২৫ হাজার সৈনিক ছিল। এ ধরনের বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কমপক্ষে ১২ লাখ ৫০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের প্রয়োজন ছিল। ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের পর দেখা যায় যে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈনিক এবং পুলিশ মিলে প্রায় ৯৩ হাজার জনবল ছিল। যদি ১ লাখ ২৫ হাজার গেরিলা কার্যকর হতো, তাহলে পাকিস্তান বাহিনীর কোনোমতেই টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। এ তথ্য থেকে দেখা যায়, অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী খুব কার্যকর হয়নি। এর কারণ ছিল মুক্তিবাহিনীর অধিকাংশ সদস্য ছিল ছাত্র। ছাত্ররা বয়সে তরুণ এবং অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়। আবেগপ্রবণ হয়ে যারা গেরিলাযুদ্ধ করতে আসে, তারা আশা করে যে অল্প দিনের মধ্যে জয় অর্জিত হবে। দীর্ঘ সময় যুদ্ধ চললে এ ধরনের গেরিলারা টিকে থাকতে পারে না। বাংলাদেশে কিছু বয়স্ক সৈনিক ছিল কিন্তু নিয়মিত বাহিনীর এসব সদস্য চিরাচরিত যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল। গেরিলাযুদ্ধের পদ্ধতি ছিল একেবারেই ভিন্ন। চিরাচরিত পদ্ধতির যুদ্ধ হতে গেরিলাপদ্ধতিতে যুদ্ধ করার জন্য প্রশিক্ষণ এবং মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল। এই পরিবর্তন তখন পর্যন্ত হয়নি। যদি দীর্ঘদিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই চলত, তাহলে প্রকৃত গেরিলাদের সংখ্যা অনেক কমে যেত। এর ফলে পাকিস্তান বাহিনীর বিপক্ষে এদের পক্ষে তাৎক্ষণিক সাফল্য অর্জন করা সম্ভব ছিল না। গেরিলাযুদ্ধ সম্পর্কে চে গুয়েভারার বইটি আমার এই অনুসন্ধানে কাজে লেগেছে। চে গুয়েভারা যে দেশেই গেরিলাযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, সেখানে তিনি তরুণ ছাত্রদের বদলে বয়স্ক ব্যক্তিদের নির্বাচন করতেন। বয়স্কদের মধ্যে যাদের নির্ভরশীল স্ত্রী এবং সন্তান ছিল, তাদের অগ্রাধিকার দিতেন। এ ধরনের গেরিলারা আবেগের বশবর্তী হয়ে নয়, সবকিছু জেনেশুনে গেরিলাযুদ্ধে অংশ নিতেন।

দ্বিতীয় অনুসন্ধেয় বিষয় ছিল ভারতের সক্রিয় সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব কি না? প্রথম অনুসন্ধেয় বিষয়টি সম্পর্কে গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের একার পক্ষে অদূর ভবিষ্যতে জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। সুতরাং ভারতের সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুত স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব ছিল। না। বরং বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর লুণ্ঠন ও অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। এখানে প্রশ্ন হলো যে ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করবে কি না? পাকিস্তান ভেঙে গেলে ভারতের জন্য সেটি একটি বড় বিজয়। এ জন্য সবাই আশা করছিল ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করবে। আমার কাছে মনে হয় যে শুধু পাকিস্তানকে দুর্বল করার জন্য নয়, ভারতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল অপরিহার্য। এক কোটির বেশি শরণার্থী নিয়ে ভারতের পূর্বাঞ্চলে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ছিল প্রায় অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন প্রায়ই উত্থাপিত হতো; অনেকে বলতেন প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতি, সামরিক বাহিনীর হতাহত হওয়া এবং অস্ত্রের ব্যবহারের ফলে প্রচুর ব্যয় হতো। ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য এবং ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগকে বাতিল করার জন্য ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীনতা না দিয়ে তার অঙ্গীভূত করতে পারে। এই আশঙ্কাও আমার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। সাত কোটি বাঙালিকে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে ভারতের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। এতে ভারতে মুসলমান এবং বাঙালি জনসংখ্যা বেড়ে যেত। এর ফলে ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তাই আমার বক্তব্য ছিল ভারতের সহায়তা নিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। আমার কাছে তাই মনে হয় ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা যেভাবে চলছে, সেটি সন্তোষজনক। আমার এ বক্তব্য সম্পর্কে আমি কোথাও লিখিনি, তবে সে সময়ে যেসব মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে, তাঁদের কাছে এই বক্তব্য তুলে ধরেছি।

পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা

জুন মাসে বাংলাদেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীরা কলকাতায় আশ্রয় নেন। এই বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন প্রফেসর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, প্রফেসর খান সরওয়ার মুরশিদ, প্রফেসর মোশাররফ হোসেন এবং ড. স্বদেশ রঞ্জন বোস। এঁদের নিয়ে বাংলাদেশ প্ল্যানিং বোর্ড স্থাপন করা হয়। এই বোর্ডের কয়েক জায়গায় অফিস ছিল। একটি অফিস ছিল পার্ক সার্কাসে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের উল্টো দিকে। আমি মাঝেমধ্যে ড. মোশাররফ হোসেনের অফিসে যেতাম এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করতাম। নভেম্বরের দিকে যখন ভারত সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে, তখন ভারতীয় প্ল্যানিং কমিশন বাংলাদেশ প্ল্যানিং কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা বাংলাদেশ প্ল্যানিং কমিশনের সঙ্গে ছিন্নমূল মানুষদের ত্রাণ এবং পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন সম্বন্ধে তাদের বক্তব্য জানতে চায়। এই আলোচনার সময় ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশন জানায় যে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সব শরণার্থীকে বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। অনেক হিন্দু শরণার্থী রয়েছে, যাদের সম্পত্তি বাংলাদেশে অবস্থানরত মুসলমানরা দখল করেছে। হিন্দুরা ফিরে গেলে তাদের সম্পত্তি উদ্ধার করা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলে হিন্দু শরণার্থীরা বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাইবে না। তাই তাদের সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ড. মোশাররফ হোসেন এ সম্পর্কে আমার মত জানতে চান। আমি তাঁকে বলি যে মুক্তিবাহিনী যুদ্ধে জয়ী হলে এ ধরনের সমস্যা উদ্ভবের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশন এ ব্যাপারে অবশ্যই একটি আইনি কাঠামো চান।

১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর মুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো সম্পর্কে উপপরিষদের বৈঠকে নিম্নরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—

(১) রাজনৈতিক নির্দেশ–জনাব এ এফ এম ফতেহ (সভাপতি)

(২) পুলিশ যন্ত্রপাতির পুনরুদ্ধার–স্বরাষ্ট্রসচিব

(৩) শত্রুপক্ষের সম্পত্তি নিষ্পত্তি এবং উদ্বাস্তু মানুষদের সম্পত্তির পুনরুদ্ধারবিষয়ক আইন–জনাব আকবর আলি খান

(৪) সৈন্যবাহিনীর বেসামরিক যোগাযোগ, এফ এফ এবং মুক্তিবাহিনীর সদস্যগণের আত্তীকরণ–প্রতিরক্ষাসচিব।

(৫) হানাদারদের সহযোগীদের ব্যবস্থাকরণ এবং বেসামরিক কর্মচারীদের সেবা প্রদান–মন্ত্রিসভা সচিব এবং প্রতিরক্ষাসচিব

(৬) সরকারি চাকরির জন্য কমিশন, সরকারি চাকুরেদের নিয়োগ, নির্দিষ্ট স্থানে নিযুক্তি, বদলি ইত্যাদি– সচিব, মন্ত্রিসভা

(৭) ছিন্নমূল মানুষদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন–ড. মোশাররফ হোসেন, সদস্য, পরিকল্পনা।

(৮) অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং এর সঙ্গে জড়িত সমস্যাবলি–ড. মোশাররফ হোসেন, সদস্য, পরিকল্পনা

(৯) উপায় এবং পথসমূহ–অর্থসচিব

(১০) বেসামরিক প্রশাসন গঠন–অর্থসচিব।

অনেক খেটে আমি শত্রুপক্ষের সম্পত্তি নিষ্পত্তি এবং উদ্বাস্তু মানুষদের সম্পত্তি পুনরুদ্ধারবিষয়ক আইনের খসড়া তৈরি করি। মন্ত্রিসভায় খসড়াটিকে নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয় এবং এটিকে চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় জেলা জজ এবং ত্রাণ কমিশনার জয়গোবিন্দ ভৌমিককে। এপ্রিল মাসে এই আইনটি জারি করা হয়, তত দিনে আইন ছাড়াই হিন্দু উদ্বাস্তুরা তাদের সম্পত্তি পুনর্দখল করেন। আইনটি বিশেষ কোনো কাজে লাগেনি।

সার্কাস, থিয়েটার, সিনেমা

বাংলাদেশ সরকার তার কাজ শুরু করে সার্কাস অ্যাভিনিউয়ে পাকিস্তানের দূতাবাস ভবনে। তারপরে ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের অন্যান্য মন্ত্রীসহ বেশির ভাগ দপ্তর চালু করা হয়। যুব ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় প্রিন্সেফ স্ট্রিটে অফিস ভাড়া নেয়; তথ্য অধিদপ্তর বালুহক্কক লাইনে অফিস খোলে। পরিকল্পনা সেল অফিস খোলে বালিগঞ্জ প্রেসে এবং পার্ক সার্কাস রোডে। শিক্ষা দপ্তর চালু হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙা ভবনে। বোর্ড অব ট্রেড অফিস খোলে অন্য জায়গায়। সরকারের কাজ বাড়তে থাকে। ফলে সরকার বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন স্থানে অফিস করতে থাকে। থিয়েটার রোডের অফিসে স্থানাভাব দেখা দেয়, সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে। অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ সরকারের অসামরিক সচিবালয় স্থানান্তরিত হলো শরৎ চ্যাটার্জি অ্যাভিনিউয়ে বন্ধ সিনেমা হল দপ্তশ্রী’তে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান সেনাপতি এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থিয়েটার রোডে থাকল। আর অন্য সব দপ্তর স্থানান্তরিত হলো ‘দপ্তশ্রীতে।

দেশের অনেক দূরে আমরা তখন, তবু দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য একের পর এক অফিস খোলা হতে থাকে। এই প্রক্রিয়াকে আমরা গভর্নমেন্ট গভর্নমেন্ট খেলা বলতাম। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সরকারের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল সার্কাস অ্যাভিনিউতে। এই সার্কাসের নায়ক ছিলেন ইয়াহিয়া খান নামে এক অসুর, যা কামরুল হাসানের আঁকা পোস্টারে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। এরপর অনেক স্বার্থগোষ্ঠী অভিনয় শুরু করলেন থিয়েটার রোডে। থিয়েটার রোডে সব স্বার্থগোষ্ঠীকে স্থান দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই অফিস শুরু হলো দপ্তশ্রী সিনেমা হলে। ওয়ালিউল ইসলাম যথার্থই লিখেছেন, ‘আমাদের এই যাদুকরি জগৎটি ছিল আপাতঃদৃষ্টিতে সার্কাস, থিয়েটার ও সিনেমার জগৎ।’[৯]

যদিও সার্কাস রোড, থিয়েটার রোড এবং সিনেমা হলে বাংলাদেশ সরকার অবস্থিত ছিল, তবু মুজিবনগর সরকার বলতে যে ছবি মুজিবনগরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মনে ভেসে ওঠে, সেটি হলো ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়ি। ব্রিটিশ শাসনামলে ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে বাংলা প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ছিল। খাজা নাজিমউদ্দিন ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তারা এই বাড়িতেই থাকতেন। ভারত বিভাগের পর এই বাড়িটি ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সকে দেওয়া হয়। তারা এই বাড়িটি অতিথিশালা হিসেবে ব্যবহার করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই বাড়িটিতেই বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত ছিল। যদি কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশের স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তাহলে তার উপযুক্ত স্থান হবে ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়ি। বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের কাছে অনেক কিছু চেয়েছে এবং পেয়েছেও। কিন্তু কখনো এই বাড়িটি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে। চাওয়া হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অরবিন্দ আশ্রম এই বাড়িটি তাদের বরাদ্দ দেওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে আবেদন করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার অরবিন্দ আশ্রমকে বাড়িটি বরাদ্দ দেয় এবং এই বাড়িটিতে অরবিন্দ আশ্রমের একটি কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এখন যদি এই বাড়িটি কিনতে হয়, তাহলে অরবিন্দ আশ্রমকে রাজি করাতে হবে। অরবিন্দ আশ্রম একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান এবং তাদের সম্পত্তি তারা বিক্রয় করতে রাজি হবেন কি না তাতে সন্দেহ রয়েছে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান স্মরণ করে ঢাকার রেসকোর্সে ইন্দিরা মঞ্চ স্থাপন করেছে। বিশ্বভারতীতে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে বাংলাদেশ হাউস প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অথচ মুজিবনগর সরকার বলতে যে স্থানটিকে বোঝানো হয়, সে স্থানটি সংরক্ষণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মুজিবনগর সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির মায়াবী জগতে বেঁচে থাকবে কিন্তু বাস্তবে এটি লোপ পেতে যাচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের অবদান

মুজিবনগর সরকারের অধীনে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। স্বাধীনতাই হচ্ছে একটি জাতির সবচেয়ে বড় পুরস্কার। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

বিশ্বের, বিশেষ করে ভারতের জনগণের কাছে ভাবমূর্তি গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ সরকার তার নিজস্ব পতাকা ব্যবহার করত। সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশের তরুণেরা, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, বঙ্গবন্ধু শিল্পগোষ্ঠী, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনসমর্থন সৃষ্টি করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যারা বাংলাদেশি অভিবাসী ছিলেন, তারা মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বেই সংগঠিত হন এবং বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন।

মুজিবনগর সরকার ইয়ুথ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণ ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে সুযোগ করে দেয়। এদের সবাইকে একসঙ্গে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে নামানো সম্ভব ছিল না। তাই তাঁদের মধ্যে হতাশার কারণ ছিল। এই হতাশা দূর করার জন্য সরকার মনস্তাত্ত্বিক এবং শারীরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে। যেসব সরকারি কর্মকর্তাকে সরকারের চাকরি দেওয়া সম্ভব হয়নি, তাঁদের ইয়ুথ ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইয়ুথ ক্যাম্প কর্মসূচি সাফল্যের সঙ্গে পরিচালিত না হলে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের আশঙ্কা ছিল। ইয়ুথ ক্যাম্প সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করে মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের যুবকদের একটি সুসংগঠিত বাহিনীতে পরিণত করে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে পুনর্গঠনের জন্য একটি পরিকল্পনার প্রয়োজন। ছিল। মুজিবনগর সরকার অতি অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে আগামী এক বছরের জন্য বিভিন্ন পণ্য ও সেবার চাহিদা নির্ণয় করে। অন্যদিকে অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য কর্মসূচি প্রণয়ন করে। নভেম্বর মাসে যখন ভারত-পাকিস্তান। যুদ্ধ প্রায় নিশ্চিত হয়ে দাঁড়ায়, তখন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতির অনেক সমস্যা এড়ানো সম্ভব হয়েছে। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা ছিল একটি জটিল ও দুরূহ কাজ। আমলাতন্ত্র তখন দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এক ভাগে ছিল যারা। মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে স্বাধীন বাংলা সরকারে কাজ করছিল। অন্যদিকে ছিল পাকিস্তানের তাঁবেদার সরকারের কাজে নিযুক্ত আমলারা। দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের খুব বেশি হলে শতকরা ২০ ভাগ মুক্তিবাহিনীকে সুযোগ-সুবিধা করে দেওয়ার জন্য দেশের ভেতরে কাজ করছিল। কিন্তু যখনই তারা ধরা পড়ার মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হতো, তখন তারা পালিয়ে যেত। এ ছাড়া যারা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে, তাদের ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়েছে। যুদ্ধের পরিবেশে এদের মধ্যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাছাই করা সম্ভব ছিল না। যুদ্ধের শেষে মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তাদের অনেক স্পর্শকাতর পদে নিয়োগ দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে কর্মরত কর্মচারীদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রোধ থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন, এ রকম অনেক কর্মকর্তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন মুজিবনগরের কর্মকর্তারা। তবে সবাই এই উপকারের কথা মনে রাখেননি। অনেক পাকিস্তানি কর্মকর্তাকে ওই সময় কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের অধীনে কাজ করতে হয়েছে। তাঁরা এটাকে ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে ধরে নেন এবং পরবর্তীকালে প্রতিবিপ্লবের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তার ক্ষতি করে।

মুজিবনগর সরকার শরণার্থী সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরির ব্যবস্থা করে। এতে কর্মচারীদের মনোবল বেড়ে যায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে মুজিবনগরে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যে বেতন দেওয়া হতো, তার অর্থ ভারত সরকার দেয়নি। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে অর্থ ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই অর্থের একটি অংশ ভারতীয় মুদ্রায় রূপান্তরিত করে সরকারের খরচ চালানো হচ্ছিল। অবশ্য ভারতের অনেক প্রাদেশিক সরকার এক কোটি থেকে দশ কোটি রুপি পর্যন্ত অনুদান বাংলাদেশ সরকারকে দেবে বলে ঘোষণা করে। তবে সে অর্থ আসার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। ভারতের প্রশাসকদের মনে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনের দক্ষতা এবং যোগ্যতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল। মুক্তিযুদ্ধে অনেক প্রশাসক মারা যাওয়ায় তারা ধরে নেয় যে ভারতীয় বাহিনী যখন বাংলাদেশে যাবে, তখন সেই বাহিনীর সমর্থনে বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনার ক্ষমতা বাংলাদেশ সরকারের নেই। তাই তারা পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বাঙালি আইএস কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে বাংলাদেশের ১৯টি জেলার জন্য ডেপুটি কমিশনার পদে মনোনয়ন দেন। তারা বাংলাদেশ সরকারকে এ সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে অনুরোধ করে। বাংলাদেশ সরকার স্পষ্ট বুঝতে পারে যে এটি একটি মারাত্মক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ভারতীয় অফিসারদের ডিসি নিয়োগ দিলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না। বাংলাদেশ সরকার এ ব্যবস্থায় রাজি হয়নি। বাংলাদেশের যেসব প্রশাসনিক ও পুলিশের কর্মকর্তা তখন মুজিবনগর সরকারের অধীনে ছিল, তাদের মধ্যে যথেষ্ট ভালো কর্মকর্তা ছিল। তবে তাদের অনেকের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল না। তাদের দেশপ্রেম, তাদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি মোকাবিলা করতে সহায়তা করবে–এই বিশ্বাসে বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিস থেকে ১৯টি জেলার ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। এই ডিসিরা প্রশাসনের অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তাদের তাদের জেলায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। মুজিবনগর সরকার না থাকলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যে দ্রুততার সঙ্গে প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তা করা সম্ভব হতো না।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। আমলাতন্ত্র এই রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সহায়তা করেছে। কিন্তু আমলাতন্ত্রের কোনো নিজস্ব অস্তিত্ব ছিল না। এর ফলে পাকিস্তান কিংবা ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। এই দুর্বলতা। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রশাসনে প্রতিফলিত হয়।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

নভেম্বর, ১৯৭১ থেকে ভারতীয় বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক সহায়তা অনেক বাড়িয়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে ভারত এবং পাকিস্তান বাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে আন্তর্জাতিক সীমারেখা অতিক্রম করে ভারত আক্রমণের চেষ্টা করে। এর ফলে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রথমে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভুটান সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পশ্চিম সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের অনেক জায়গা দখল করে নেয়। এবং করাচি ও লাহোরের সংযোগ সড়কের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবমেরিন ডুবিয়ে দেওয়া হয় এবং ভারতীয় নৌবাহিনী করাচি বন্দরে বারবার আক্রমণ চালায়। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সব বিমান দেশের পশ্চিমাঞ্চলে বিমানবন্দরগুলোতে লুকিয়ে রাখা হয়। এর ফলে পাকিস্তান বিমানবাহিনী প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। বাংলাদেশে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ভারতীয় নৌবাহিনী একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের সহায়তায় ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে কয়েকটি সেনাছাউনির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। এই অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন গভর্নর আবদুল মোতালেব মালিক ইস্তফা দেন। জেনারেল নিয়াজি ও রাও ফরমান আলী আত্মসমর্পণ করে বাংলাদেশে যুদ্ধরত পাকিস্তানি সৈনিকদের বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা নেন। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলবেলা পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সর্বাধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি ভারতের পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। ১৬ ডিসেম্বর আমি এবং কামাল সিদ্দিকী থিয়েটার রোড অফিসে সকালবেলা খোঁজখবর নিতে যাই। দুপুর ১২টার দিকে সংবাদ আসে যে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি প্রেরণের জন্য অনুরোধ আসে। ওই দিন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী একটি হেলিকপ্টারে করে সিলেট সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ পরিচালনা করছিলেন। এ সময়ে পাকিস্তান বাহিনীর গুলিতে হেলিকপ্টারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই আক্রমণে ওসমানীর গায়ে কোনো আঘাত লাগেনি কিন্তু তার সঙ্গী ভারতীয় বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ কর্নেল এম এ রব আহত হন। তাই জেনারেল ওসমানীর পক্ষে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যাওয়া সম্ভব ছিল না। যদি জেনারেল ওসমানী কলকাতায় থাকতেন, তাহলেও তিনি ভারতীয় সেনানায়কের কনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে এই অনুষ্ঠানে যেতেন কি না, সন্দেহ রয়েছে।

গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারও তখন কলকাতায় ছিলেন না। তিনি ব্যারাকপুরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে গিয়েছিলেন। তাঁকে দ্রুত কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়। তিনি যখন ঢাকায় যাওয়ার জন্য থিয়েটার রোডের অফিস থেকে যাচ্ছিলেন, তখন আমরা সেই অফিসে ছিলাম। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার যাওয়ার পর আমরা নিশ্চিত হই যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অবশ্যই আত্মসমর্পণ করবে। আমরা বাসায় ফিরে গিয়ে রেডিওর সামনে বসে পড়ি। রেডিওতে ঘোষণা এল শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হলো।[১১]

পাদটীকা

১. এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, ২০০৪ (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী), পৃষ্ঠা-৬৫-৬৬।

২. এইচ টি ইমাম। ২০০৪। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৫২

৩. এইচ টি ইমাম। ২০০৪। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৫১৯-৫২৪।

৪. এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান, এস আর মীর্জা, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন, ২০০৯ (ঢাকা : প্রথমা প্রকাশন), পৃষ্ঠা-১২৬

৫. Faruq Aziz Khan, Spring 1971, 1993 (Published by the writer), P-156

৬. ওয়ালিউল ইসলাম, একাত্তরের ইতিকথা, (প্রকাশিতব্য), পৃষ্ঠা-১৯৯

৭. Faruq Aziz Khan, Op.Cit, 1993, P-156-157,

৮. আফসান চৌধুরী, মুজিবনগর কাঠামো ও কার্যবিবরণ, ২০২১, (ঢাকা : কথাপ্রকাশ), পৃষ্ঠা-২৬৬

৯. ওয়ালিউল ইসলাম, (প্রকাশিতব্য)। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৯৯

১০. Faruq Aziz Khan, Op.Cit, 1993, P-194

১১. মুক্তিযুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনার জন্য পড়ুন : (১) B.Z. Khasru, Myths and Facts Bangladesh Liberation War, 2010 (Rupa Publications India Pvt. Ltd.), () Srinath Raghavan, A Global History of the Creation of Bangladesh, 2013, (Permanent Black) (৩) মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান, ফ্যান্টমস অব চিটাগং দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ, ২০০৫ (ঘাসফুল নদী)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *