৮. একাডেমিতে শিক্ষানবিশকাল

অষ্টম অধ্যায়

একাডেমিতে শিক্ষানবিশকাল – অক্টোবর ১৯৬৭-সেপ্টেম্বর ১৯৬৮

১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কোনো এক সময় আমি সিভিল সার্ভিসে নিয়োগপত্র পাই। পত্রটি স্বাক্ষর করেন ১৯৫৪ ব্যাচের পূর্ব পাকিস্তানি সিএসপি কর্মকর্তা এম মাহবুবুজ্জামান। এ চিঠিতে আমাদের সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে কী ধরনের কাপড়চোপড় নিয়ে যেতে হবে, সে সম্পর্কে একটি তালিকা দেওয়া হয়। এই তালিকায় ঘোড়ায় চড়ার জন্য প্যান্ট এবং জুতা থেকে শুরু করে টেনিস-র্যাকেট, টেনিসের ড্রেস, স্যুট, ডিনার জ্যাকেট ইত্যাদি অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমাদের জানানো হয়, একাডেমিতে যোগ দেওয়ার পর সরকার প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে বিশেষ অনুদান দেবে। কিন্তু চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগেই আমাকে অনেক কিছু কিনতে হবে। আমার হাতে তখন টাকা নেই। আমার বড় চাচাতো ভাই মেজর (অব.) শওকত আলী খাঁন আমাকে এক হাজার টাকা উপহার দেন। আনুদা ৫০০ টাকা এবং শহীদদা ৫০০ টাকা উপহার দেন। এই দুই হাজার টাকা দিয়ে আমি কেনাকাটা করে লাহোর যাওয়ার প্রস্তুতি নিই।

১৯৬৭ সালের সিএসপিপিএফএস কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ

এই ব্যাচে মোট প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা ছিল ৩৫ জন। তার মধ্যে ৩৪ জন ১৫ অক্টোবর ১৯৬৭ সালে লাহোরে অবস্থিত সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে যোগ দেন। পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বিদেশে ছিলেন এবং মাস তিনেক পরে তিনি যোগদান করেন। এই কর্মকর্তাদের পরিচয় নিচে লিপিবদ্ধ করা হলো—

ব্যাচে প্রথম স্থান অধিকার করেন শাহেদ সাদুল্লাহ। তাঁর পিতা এ এম সাদুল্লাহ আইপিএস কর্মকর্তা ছিলেন এবং আমরা যখন পরীক্ষা দিই, তখন তিনি কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য ছিলেন। শাহেদ সাদুল্লাহ ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি এমএ পরীক্ষা না দিয়ে সরাসরি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নেন এবং প্রথম স্থান অধিকার করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শাহেদ। সাদুল্লাহ কক্সবাজারের এসডিও ছিলেন। তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেন এবং ১৬ ডিসেম্বরের আগে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে সেকশন অফিসার হিসেবে বদলি হয়ে যান। তিনি বিয়ে করেন একজন বাঙালি মেয়েকে। তবে তাদের প্রথম সন্তান কানে শুনতে পেত না। তাই কন্যার চিকিৎসার জন্য ইসলামাবাদ থেকে বিদেশে যাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেন; শেষ পর্যন্ত অন্য কোনো চাকরি না পেয়ে পিআইএর নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি প্রেষণে লন্ডনে বদলি হন। এই পদে ৮-১০ বছর কাজ করার পর তিনি চাকরি ছেড়ে দেন এবং যুক্তরাজ্যে অভিবাসন করেন। তিনি লন্ডনের একটি পাকিস্তানি উর্দু পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। এখন তিনি যুক্তরাজ্যেই আছেন।

দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন মরহুম মিজানুর রহমান। যিনি শেলী ডাকনামে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তুখোড় ছাত্র ছিলেন এবং পাকিস্তান ছাত্র শক্তির একজন নেতা ছিলেন। তিনি সিএসএস পরীক্ষা দেবেন। কি না, এ সম্পর্কে দ্বিধান্বিত ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ১৯৬৭ সালে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অধ্যাপক গোলাম ওয়াহেদ চৌধুরীর গবেষণা সহকারী হিসেবে ইসলামাবাদ সচিবালয়ে কাজ করেন। অধ্যাপক চৌধুরী ছিলেন ইয়াহিয়া খানের অতি কাছের উপদেষ্টা। তাই মিজানুর রহমান শেলীও বিতর্কিত হন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেননি। তিনি ফোর্ড ফাউন্ডেশনের একটি বৃত্তি নিয়ে বিলাতে যান এবং স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি পরে ঢাকায় ফিরে আসেন। তাঁকে সিভিল সার্ভিসে যোগদানের অনুমতি দেওয়া হয়। তিনি সমাজকল্যাণ বিভাগের পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। এই পদে থাকাকালীন তাঁর কিছু কার্যকলাপ নিয়ে বিতর্ক হয়; রাগ করে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। সিডিআরবি (Centre for Development Research, Bangladesh) নামে একটি পরামর্শক সংস্থা স্থাপন করেন এবং এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স নামে একটি গবেষণামূলক সাময়িকী প্রকাশ করেন। আগস্ট, ২০১৯ সালে তিনি মারা যান।

ব্যাচে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন মরহুম এ বি এম আবদুশ শাকুর। তিনি মাদ্রাসা থেকে কামিল পাস করে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁর প্রবেশিকা পরীক্ষার সার্টিফিকেটে বয়স কম করে দেখানো হয়েছিল। আসলে তিনি এ ব্যাচের গড় কর্মকর্তাদের চেয়ে চার-পাঁচ বছরের বড়। তবে তার চেয়েও বয়সে বড় কর্মকর্তা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে ১৯৬৭ সালে এসেছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বান্দরবানের এসডিও ছিলেন। চট্টগ্রামে তিনি এডিসি ছিলেন। এরপর তাঁর চাকরি চলে যায়। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি চাকরি ফিরে পান এবং পটুয়াখালী জেলার ডেপুটি কমিশনার হন। তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি একজন জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং প্রথম আলোর বর্ষসেরা বই পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি ২০১৩ সালে মারা যান।

বাঙালিদের মধ্যে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন ড. শাহ মোহাম্মদ ফরিদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে বিএ অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় এবং এমএ ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি সংস্থাপনসচিব, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব ছিলেন। মুখ্য সচিব থাকাকালীন তিনি একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে কাজ করার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী এবং উৎকেন্দ্রিক ছিলেন। ড. মিজানুর রহমান শেলী কৌতুক করে বলতেন, ‘Neither a friend, nor a foe, but a Farid’. শাহ ফরিদ লোকজনের উপকার করতেন এবং তাদের কাছ থেকে প্রতিদান প্রত্যাশা করতেন। তাঁর কাছ থেকে সামান্য উপকার পেয়েছে, এমন ব্যক্তির কাছেও তিনি প্রতিদান চাইতেন; প্রতিদান না পেলে তার বিরুদ্ধে বলতেন। দুষ্টু লোকেরা বলে, তাঁর কাছে সিভিল সার্ভিস ছিল একটি লেনদেনের প্রতিষ্ঠান।

বাঙালিদের মধ্যে পঞ্চম স্থানে ছিলাম আমি (গ্রন্থকার)।

বাঙালিদের মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে ছিলেন খসরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরগঞ্জের এসডিও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি ময়মনসিংহের ডেপুটি কমিশনার ছিলেন। এরপর তিনি ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ছিলেন। তিনি সরকারি বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনেডি স্কুল থেকে এমপিএ এবং সিরাকিউস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি দীর্ঘদিন লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ২০১৬ সালে মারা যান এবং তাঁর মৃত্যুর পর স্বাধীনতা পুরস্কারে সম্মানিত হন।

বাঙালিদের মধ্যে সপ্তম স্থান অধিকার করেন মামুনুর রশীদ। তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে মনোনীত সদস্য ও পাকিস্তান সরকারের সচিব আবদুর রশীদের দ্বিতীয় ছেলে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। পরবর্তীকালে ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগের সচিব এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েছিলেন। চাকরির শেষ বছরে তার বিরুদ্ধে বয়স জালের অভিযোগ উত্থাপিত হয় এবং তিনি পদত্যাগ করেন।

বাঙালিদের মধ্যে অষ্টম স্থান অধিকার করেন কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নশাস্ত্রে বিএ অনার্স ও এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসডিও ছিলেন এবং তিনি সেখানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধের পর তিনি কুমিল্লার ডেপুটি কমিশনার হন। তিনি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় পরিষদ সচিবালয়ের সচিব ছিলেন। তিনি সবশেষে বাংলাদেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হন।

বাঙালিদের মধ্যে নবম স্থান অধিকার করেন এ কে শামসুদ্দিন। তিনি রসায়নশাস্ত্রে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণি লাভ করেন এবং সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার আগে পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনে কাজ করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সিরাজগঞ্জের এসডিও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর ভূমিকার জন্য পাকিস্তান বাহিনী তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

১০

বাঙালিদের মধ্যে দশম স্থান অধিকার করেন আবদুল হামিদ চৌধুরী। তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অত্যন্ত কৃতী ছাত্র ছিলেন। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য-প্রশাসক ছিলেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রাজনীতিবিষয়ক যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব, খাদ্যসচিব এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন।

১১

বাঙালিদের মধ্যে একাদশ স্থান অধিকার করেন ওয়ালিউল ইসলাম। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং যশোরে বাংলাদেশের প্রথম ডেপুটি কমিশনার ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি অস্ট্রেলিয়ায় জুটমিল করপোরেশনের জেনারেল ম্যানেজারের কাজ করেন। পরবর্তীকালে তিনি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়; সড়ক, জনপথ ও রেল পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি দীর্ঘদিন। স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংস্কারের জন্য স্থানীয় উপদেষ্টা হিসেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও ইউএসএআইডের সঙ্গে কাজ করেছেন।

১২

বাঙালিদের মধ্যে দ্বাদশ স্থান অধিকার করেন আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। তিনি ভূমিসচিব ছিলেন। সচিবের পদমর্যাদায় যমুনা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে তিনি এই সেতু সম্পূর্ণ করে চালু করেন। তাঁর এই অবদানের জন্য ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স তাঁকে বিশেষভাবে সম্মানিত করে। তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। অবসর গ্রহণের পর বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাকের তিনি নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। তিনি ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মন্ত্রীর পদমর্যাদাসহ উপদেষ্টা ছিলেন। বর্তমানে তিনি ঢাকায় ইব্রাহীম মেমোরিয়াল ডায়াবেটিক হাসপাতালের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি।

১৩

পূর্ব পাকিস্তান থেকে সিএসপিতে ত্রয়োদশ স্থান অধিকার করেন সৈয়দ রেজাউল হায়াত। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন এবং পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে সড়ক ও রাজপথ বিভাগের সচিব ছিলেন। ২০১২ সালে। তিনি মারা যান।

১৪

সারা পাকিস্তানে ব্যাচের চতুর্থ স্থান অধিকার করেন ইকতিদার আহমদ চৌধুরী। তিনি একজন প্রকৌশলী ছিলেন। সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার আগে যুক্তরাজ্য থেকে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করছিলেন। সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার পর তাঁর বেতন প্রায় ৭৫ শতাংশ হ্রাস পায়। জুলফিকার আলী ভুট্টোর শাসনামলে সিএসপি তুলে দেওয়া হয়। ইকতিদার আহমদ চৌধুরী তখন পদত্যাগ করেন এবং বহুজাতিক কোম্পানিতে প্রকৌশলীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সম্প্রতি তিনি মারা গেছেন।

১৫

সারা পাকিস্তানে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছিলেন আমিনুল্লাহ চৌধুরী। তাঁর পিতা রেলওয়ে সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা ছিলেন এবং অনেক দিন চট্টগ্রামে কাজ করেছেন। আমিনুল্লাহ চৌধুরী পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি এবং বিএল ডিগ্রি অর্জনের পর লন্ডনে উচ্চশিক্ষার জন্য যান। লন্ডন থেকে তিনি বাণিজ্যিক আইনে এলএলএম ডিগ্রি পাওয়ার পর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নেন। তিনি পাঞ্জাব সরকারের মাঠপর্যায়ের প্রশাসন ও সচিবালয়ে চাকরিজীবনের প্রায় পুরোটাই অতিবাহিত করেছেন। তিনি সচিবের পদমর্যাদায় পাকিস্তান সিভিল এভিয়েশন অথরিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। সে সময়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নওয়াজ শরিফ। তিনি পারভেজ মোশাররফকে বরখাস্ত করার জন্য ষড়যন্ত্র করে তাঁকে শ্রীলঙ্কা সফরে পাঠান এবং তার অনুপস্থিতিতে তার বরখাস্তের আদেশ জারি করেন। পারভেজ মোশাররফ করাচি ফিরে আসতে চাইলে তার বিমানকে করাচি বিমানবন্দরে। নামতে বাধা দেওয়া হয়। এর ফলে পারভেজ মোশাররফের অনুগত সেনাবাহিনী বিমানবন্দর দখল করে এবং পারভেজ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক শাসন জারি করে। আমিনুল্লাহ চৌধুরীকে জেলে পাঠানো হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি সিভিল সার্ভিস সম্পর্কে গবেষণা শুরু করেন। সিভিল সার্ভিসের ওপর তার রচিত বই Practical Administrator সমাদৃত হয়েছে। তিনি ২০১৩ সালে মারা যান।

১৬

সারা পাকিস্তানে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেন তারেক সুলতান। তিনি ছিলেন পাঞ্জাবের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থনীতিতে বিএ অনার্স ও এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি প্রায় পুরো চাকরিজীবন পাঞ্জাব প্রদেশের জেলা প্রশাসন এবং সচিবালয়ে অতিবাহিত করেন। তিনি পাঞ্জাবের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব (উন্নয়ন) ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে তিনি ইসলামাবাদে সচিবের দায়িত্ব নিতে রাজি হননি। তাঁকে কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবের পদমর্যাদা দিয়ে লাহোর স্টাফ কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগ করা হয়। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পর তাঁকে পাঞ্জাব পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য নিয়োগ করা হয়। তিনি ২০১৮ সালে মারা গেছেন।

১৭

সারা পাকিস্তানে সপ্তম স্থান অধিকার করেন সায়েদুল্লাহ জান। তিনি সীমান্ত প্রদেশের হাইকোর্টের এক বিচারপতির সন্তান। তিনি সীমান্ত প্রদেশের মাঠপর্যায়ে কাজ করেন এবং সীমান্ত প্রদেশের মুখ্য সচিব নিযুক্ত হন। পরে তিনি পাকিস্তানের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হিসেবে কাজ করেন। তিনি একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে মারা যান।

১৮

সারা পাকিস্তানে অষ্টম স্থান অধিকার করেন এম আবদুল্লাহ। তিনি পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। ধর্মের বিষয়ে তাঁর গভীর অনুরাগ রয়েছে। তিনি সিভিল সার্ভিসকে নৈতিক আচরণবিধির ভিত্তিতে পুনর্গঠন করতে চান। তিনি খাইবার পাখতুনখোয়াতে মুখ্য সচিব ছিলেন। বর্তমানে তিনি পেশোয়ারে অবসর যাপন করছেন।

১৯

সারা পাকিস্তানে দশম স্থান অধিকার করেন আলী কাজিম। তিনি লাহোর গভর্নমেন্ট কলেজের একজন তুখোড় ছাত্র ছিলেন। তিনি লাহোর গভর্নমেন্ট কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সেখানে তিনি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিলেন। আলী কাজিম পাঞ্জাব সরকারের জেলা পর্যায়ে এবং সচিবালয়ে কাজ করেন। তিনি পাঞ্জাবের গভর্নরের সচিব নিযুক্ত হয়েছিলেন। এ সময়ে সরকারের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন। তিনি লাহোরের একটি বিখ্যাত আইন ব্যবসাসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। সম্প্রতি তিনি সম্পূর্ণ অবসর নিয়ে লাহোরের বাইরে একটি গ্রামে বাস করছেন।

২০

সারা পাকিস্তানে একাদশ স্থান অধিকার করেন সৈয়দ মেহেদী। তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের কৃতী ছাত্র এবং ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপকও ছিলেন। অধ্যাপক হিসেবে তার প্রিয় ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলেন। নওয়াজ শরিফকে, যিনি পরবর্তীকালে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি পিএসপিতে যোগ দেন এবং ১৯৬৭ সালে সিএসপির জন্য মনোনীত হন। তিনি পাঞ্জাবের জেলা প্রশাসনে একজন নামকরা কর্মকর্তা ছিলেন। নওয়াজ শরিফ যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তিনি তাকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নিযুক্ত করেন। মুখ্য সচিব হিসেবে তিনি ছিলেন নওয়াজ শরিফের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা। পারভেজ মোশাররফের বরখাস্ত হওয়ার ষড়যন্ত্রে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং এ জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীকালে তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।

১৯৬৭ সালে ১৫ জন কর্মকর্তাকে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই কর্মকর্তারা ছিলেন নিম্নরূপ–

আহমদ তারেক করিম। তিনি ইংরেজিতে বিএ অনার্স পাস করার পরই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে চাকরি পান। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি জার্মানিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি ইরান ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তাঁকে পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর তিনি অবসর নেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করেন। বাংলাদেশে আবার সরকার পরিবর্তিত হলে আহমদ তারেক করিম দীর্ঘদিন দিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেন। বর্তমানে তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন।

তারেক ওসমান হায়দার। তিনি ছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাষ্ট্রদূত সাজ্জাদ হায়দারের ছেলে। অক্সফোর্ড থেকে অনার্স ডিগ্রি নিয়ে তিনি পাকিস্তান পররাষ্ট্র দপ্তরে যোগ দেন। তবে তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল খামখেয়ালিতে ভরা। ব্যাচের সবাই তার পাগলামির ভয়ে অস্থির থাকত। তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হয়েছিলেন এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন।

মোহাম্মদ সেলিম। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের কৃতী ছাত্র এবং অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্র বিভাগে কাজ করেন। ১৯৮৩ সালে হেগে পদস্থ থাকাকালে তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে এবং তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

তৈয়ব সিদ্দিকী। তিনি যখন পিএফএসে যোগ দেন, তখন তাঁর বয়স ২৫-এর অনেক বেশি। তাকে ঠাট্টা করে ব্যাচের সবাই ‘ড্যাড’ বা ‘বাবা’ বলে ডাকত। ১৯৭০-এর দশকে তিনি জর্ডানের পাকিস্তানি দূতাবাসে তৃতীয় সচিব পদে নিযুক্ত ছিলেন। সেই সময় ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল হক পাকিস্তানের সামরিক উপদেষ্টা ছিলেন। জর্ডানে দুজনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পরে জিয়াউল হক পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি হন। জিয়াউল হকের সময় তৈয়ব সিদ্দিকীকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত করা হয়।

শাফকাত হোসেন শেখ। তিনি লাহোর সরকারি কলেজে বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। পররাষ্ট্র দপ্তরে যোগ দেওয়ার পর তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ দূতাবাসে কাজ করেন। তিনি নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তাঁকে পাঞ্জাব পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য নিয়োগ করা হয়।

বশির আহমদ। তিনি একজন পাঠান ছিলেন। পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেওয়ার পরও তিনি পাঠান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এর ফলে চাকরিতে যোগ দেওয়ার কয়েক বছর পরই তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরবর্তীকালে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন এবং একবার পাকিস্তান সংসদের উচ্চকক্ষে সিনেটর পদে নির্বাচিত হন।

মুশতাক আহমদ মেহের। তার বাড়ি ছিল মুলতানে। তিনি অত্যন্ত লম্বা ছিলেন এবং ব্যাচের সবাই ঠাট্টা করে তাকে ‘উট’ বলত। তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদ থেকে অবসর নেন। তিনি বাংলাদেশ ও কুয়েতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।

চৌধুরী জাভেদ হোসেন। তিনি একজন পাঞ্জাবি ছিলেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরে অনেক উঁচু পদে তিনি কাজ করেছেন। তেহরানে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।

মুনির আকরাম। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে পড়াশোনা করার সময় সিএসএস পরীক্ষা দিয়ে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে নিয়োগ পান। তিনি কোর্স চালু হওয়ার কয়েক মাস পর সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে যোগ দেন। জেনেভায় জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানসমূহে তিনি পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি। ছিলেন। তিনি নিউইয়র্কে পরপর দুবার জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে তার স্থায়ী প্রতিনিধির চাকরি চলে যায়। ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে আবার জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

১০

মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে লন্ডনের পাকিস্তান দূতাবাস থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের উপস্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন। তবে রাজনৈতিক কারণে তাকে কোথাও রাষ্ট্রদূত করা হয়নি। তাকে সচিবের পদমর্যাদা দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষণ একাডেমির অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন।

১১

আনোয়ারুল করিম চৌধুরী। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা দূতাবাসে তৃতীয় সচিব পদে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সচিব ছিলেন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে তাঁকে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলের পদমর্যাদা দিয়ে স্বল্পোন্নত দেশসমূহে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের তরফ থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নিয়োগ করা হয়। এই পদ থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন। তিনি Culture of Peace আন্দোলনের প্রবক্তা। ডাইসাকু ইকিদার সঙ্গে লেখা তাঁর বই Culture of Peace ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে।

১২

জিয়াউশ শামস চৌধুরী। প্রথম জীবনে পররাষ্ট্র দপ্তরে চাকরি তার একেবারেই ভালো লাগেনি। সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে থাকাকালীন তিনি কয়েকবার পদত্যাগপত্র দাখিল করার চেষ্টা করেছেন। তবে সতীর্থদের এবং একাডেমির পরিচালকের অনুরোধে তিনি তা প্রত্যাহার করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি পররাষ্ট্র দপ্তরের আচার-আচরণের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেন। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে রাষ্ট্রদূত এবং অস্ট্রেলিয়ায় হাইকমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন।

১৩

রাশেদ আহমদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। পররাষ্ট্র ক্যাডারের সদস্য হিসেবে তিনি বেশির ভাগ সময়ই বিদেশি। দূতাবাসগুলোতে কাজ করেছেন। তিনি জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ২০০০-২০০৫ পর্যন্ত সময়কালে তিনি কসোভোর জন্য জাতিসংঘের আঞ্চলিক প্রশাসনের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি কসোভোর স্বাধীনতার জন্য কসোভোর সার্বিয়ান এবং আলবেনিয়ান নেতৃত্বের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতা করেন।

১৪

আমিনুল ইসলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে তিনি অনেক দেশে কাজ করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিবের কাজও করেছেন তিনি। পরবর্তীকালে সচিবের পদমর্যাদায় তিনি কানাডায় রাষ্ট্রদূতের কাজ করেছেন।

১৫

মোস্তফা কামাল। তিনি একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। পররাষ্ট্র দপ্তরে চাকরিতে যোগ দেন কিন্তু বিদেশে কাজ করতে গিয়ে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। ফলে পররাষ্ট্র বিভাগের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নির্বাহী হিসেবে কাজ করেন। বর্তমানে তিনি পিটসবার্গ শহরে অবসর জীবন যাপন করছেন।

লাহোর একাডেমির প্রশিক্ষকেরা

আমরা যখন সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিই, তখন একাডেমির পরিচালক ছিলেন আবদুল মজিদ। তিনি ১৯৩৯ ব্যাচের আইসিএস অফিসার ছিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে রাজশাহীতে ও ময়মনসিংহে ডেপুটি কমিশনারের কাজ করেছেন। তিনি পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের সচিব ছিলেন, কিন্তু কোনো কারণে তিনি তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের বিরাগভাজন হন। তাই তাকে অতিরিক্ত সচিব পদ থেকে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। তিনি সিভিল সার্ভিস একাডেমির পরিচালক পদেও অতিরিক্ত সচিবের পদমর্যাদা ভোগ করতেন। তিনি অতিরিক্ত সচিবের পদমর্যাদা নিয়ে পাঞ্জাব সরকারের ভূমি রাজস্ব বোর্ডের সদস্য পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮০-এর দশকে করাচিতে ইন্তেকাল করেন।

১৯৫৪ ব্যাচের পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তা আকরাম জাকি ছিলেন উপপরিচালক। মূলত পররাষ্ট্র সার্ভিসের কর্মকর্তাদের তদারকি ছিল তাঁর প্রধান দায়িত্ব। তিনি নেপালের কৈরালা বংশের এক মহিলাকে বিয়ে করেন। পরবর্তীকালে তিনি বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের কাজ করেছেন।

উপপরিচালক ছিলেন ড. তারেক সিদ্দিকী। ১৯৫৫ সালে তিনি সিএসপিতে যোগ দেন। তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে লালমনিরহাট ও চাঁদপুরে এসডিও ছিলেন এবং ঢাকায় জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরোর উপপরিচালক ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসনে এমপিএ ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি আমাদের লোকপ্রশাসন বিষয়ে পড়াতেন। অত্যন্ত সুন্দরভাবে তিনি পড়াতেন। তার সঙ্গে বিতর্ক করার জন্য শিক্ষানবিশদের উদ্দীপ্ত করার লক্ষ্যে তিনি বলতেন, ‘You will not be my friend unless you fight with me.’ যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় তিনি একজন যুগোস্লাভ মহিলার পাণি গ্রহণ করেন। কিন্তু ওই মহিলা পাকিস্তানে আসতে রাজি হননি। তাই বিয়ে ভেঙে যায়। তবে ওই বিয়েতে তার একটি কন্যাসন্তান হয়। আমরা যখন তার ছাত্র, তখন তার কোনো স্ত্রী ছিল না। পরবর্তীকালে ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির একজন অধ্যাপিকাকে তিনি বিয়ে করেন। তাদের দুই ছেলে হয়।

তারেক সিদ্দিকী কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব হন। এরপর তিনি আল্লামা ইকবাল উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেন। তিনি ভালো বাংলা বলতেন এবং সব প্রশিক্ষণার্থীর প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে যেসব কর্মকর্তা আটকা পড়েছিলেন, তাদের অনেককে তিনি বাংলাদেশে আসার জন্য ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন। পিপিপি দলের আজ্ঞা অনুসারে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনায় অস্বীকৃতি জানালে জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁকে কোনো কারণ না দর্শিয়ে পাঞ্জাব সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের পদ থেকে বরখাস্ত করেন। পরে জিয়াউল হক পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হলে স্ব-উদ্যোগে তাকে চাকরিতে ফিরিয়ে আনেন। সরকারি চাকরি চলে যাওয়ার পর তিনি স্যুটের বদলে কওমি ড্রেস পরা শুরু করেন। জিয়াউল হক রাষ্ট্রপতি থাকাকালে এই কওমি ড্রেসকে জাতীয় পোশাক হিসেবে স্বীকৃতি দেন। বছর দুয়েক আগে। ড. তারেক সিদ্দিকী ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর স্ত্রী তার আগে মারা যান।

১৯৫৯ ব্যাচের আরেকজন উপরিচালক ছিলেন শেখ মাকসুদ আলী। শেখ মাকসুদ আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স এবং এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হন। তিনি পটুয়াখালী মহকুমার এসডিও ছিলেন। পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিনি ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ১৯৬৪ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিনি যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হন এবং ১৯৭২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বাংলাদেশে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং কমপ্লেক্সে রেক্টর এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। তাঁর স্ত্রী হোসনে আরা ছিলেন একজন অর্থনীতিবিদ। তিনি পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। বছরখানেক আগে শেখ মাকসুদ আলী ইন্তেকাল করেন। তার স্ত্রী তার আগেই মারা যান।

কাসেম রিজভী। তিনি ১৯৫০ ব্যাচে সিএসএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। আমরা যখন ছাত্র, তখন তিনি কমিশনার ছিলেন। তিনি আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের ভূমি আইন সম্পর্কে পড়াতেন। তিনি বলতেন ভালো, তবে ভূমি আইন সম্পর্কে তিনি তত জানতেন না।

মাসুদ নবী নূর। তিনি পাঞ্জাব সরকারের তথ্যসচিব ছিলেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের ভূমি আইন সম্পর্কে আমাদের পড়াতেন। তবে তাঁর বক্তৃতায় গভীরতা ছিল না।

শেখ ইমতিয়াজ আলী। তিনি লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ডিন ছিলেন। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে এলএলএম ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি আমাদের সাক্ষ্য আইন পড়াতেন। তিনি একজন অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন। আইনের জটিল বিষয়গুলোকে অতি সহজভাবে উপস্থাপন করতেন। তিনি ক্লাসে প্রশ্ন করতেন এবং ছাত্ররা প্রশ্নের উত্তর না দিলে খুবই অসন্তুষ্ট হতেন। আমি প্রায়ই তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতাম। একদিন তিনি একটি কল্পিত কেস উপস্থাপন করেন। যেখানে দুই পক্ষের উকিল একই ঘটনার সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ব্যাখ্যা দুটি সম্পর্কে বলে তিনি বললেন, তোমাদের আদালতে যদি কেস উত্থাপিত হয়, তাহলে তোমাদের রায় কী হবে? আমি হাত তুলে প্রথম উকিলকে সমর্থন করলাম। উত্তর শুনে তিনি যা বললেন, তার সারমর্ম এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। তিনি বললেন :

My dear learned friend, you think that when you sit in a court one party will come and tell you the truth; the other party will come and tell you lies. You will give verdict in favor of truth. My dear learned friend, this will never happen. Both the parties will tell you lies. You will have to find the truth from two lies.

ব্যাখ্যা করে বললেন, ধরো ‘ক’ এবং ‘খ’-এর মধ্যে ঝগড়া হলো। ‘ক’ ‘খ’-কে চড় মারল। ‘খ’ ‘ক’-কে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য তার আইনজ্ঞের কাছে গেল। আইনজ্ঞ বলল যে শুধু চড় মারাতে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া যাবে না। মামলাটা জটিল করার জন্য সে একটা ব্লেড দিয়ে ‘খ’-এর হাতে একটি ক্ষত সৃষ্টি করল। তারপর একজন অনুগত ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল যে অর্থের বিনিময়ে প্রত্যয়ন করল ‘ক’ ‘খ’-কে খুন করার জন্য ছুরিকাঘাত করেছে। এই ঘটনার পক্ষে সাক্ষীও জোগাড় হলো। ‘খ’ এই মামলা করেছে। শুনে ‘ক’ তার উকিলের কাছে গেল। তার উকিল বলল, আপনার শ্বশুরবাড়ি কোথায়?’ ‘ক’ বলল, ময়মনসিংহে’। আইনজ্ঞ বললেন, আপনি আদালতকে বলবেন ঘটনার আগের দিন আপনি ময়মনসিংহে যান এবং ঘটনার পরদিন আপনি ময়মনসিংহ থেকে ফিরে আসেন। ওই সময়ে ময়মনসিংহে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে এ রকম মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে এমন ৫০-৬০ জন লোক জোগাড় করুন। আদালতে যখন বিচার শুরু হলো, তখন একদল বলছে ‘ক’ ‘খ’-কে ছুরি দিয়ে মারার চেষ্টা করেছে। আরেক দল বলছে সে ঢাকা শহরেই ছিল না। এই দুই মিথ্যা থেকে বিচারককে সত্য বের করতে হবে। এভাবে উদাহরণ দিয়ে তিনি আমাদের সাক্ষ্য আইন পড়িয়েছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য ক্লাসের ছাত্রদের তিনি learned friend বলে সম্বোধন করতেন। সাধারণত উকিলেরা আদালতে একে অপরকে learned friend বলে সম্বোধন করেন। learned friend ছিল তার কাছে মামুলি সম্বোধন। এর সঙ্গে বিদ্যার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তবে আমার ব্যাচমেটদের এ সম্বোধন খুবই পছন্দ হয়। তাই সবাই আমাকে learned friend বলে ডাকেন। এখানে উল্লেখযোগ্য ইমতিয়াজ আলী শেখ পাকিস্তানে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

আমের রেজা। তিনি আমাদের সিভিল প্রসিডিউর কোড পড়াতেন। কোডের সব বিষয় ছিল তাঁর নখদর্পণে। যেকোনো প্রশ্নের তিনি চটপট উত্তর দিতে পারতেন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। খুব সম্ভব তিনি লাহোর হাইকোর্টে বিচারপতিও হয়েছিলেন।

দাউদ ইলিয়াস। তিনি একাডেমিতে ডেভিড নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন একজন ইংরেজ মহিলা। তাঁর স্ত্রীকে লাহোরে দুবৃত্তরা একবার অপহরণ করে নিয়ে যায়। তবু তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক অটুট ছিল। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিসিএল ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি আমাদের ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড পড়াতেন। বিষয়টিতে তার জ্ঞান তেমন গভীর ছিল না, কিন্তু অক্সফোর্ডের উচ্চারণভঙ্গিতে তার বক্তৃতা শুনতে আমাদের ভালোই লাগত। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার পর তিনি ম্যানিলায় এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের সহকারী আর্থিক উপদেষ্টা পদে যোগ দেন এবং পরবর্তীকালে ব্যাংকটির প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা পদে পদোন্নতি লাভ করেন। সেখান থেকেই তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

১০

আবদুল হাফিজ সিদ্দিকী। তিনি হায়দরাবাদ রাজ্যে জেলা জজ ছিলেন। হায়দরাবাদ রাজ্য ভারত দখল করে নিলে তিনি পাকিস্তানে চলে আসেন। তাকে সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে আইনের প্রভাষকের পদ দেওয়া হয়। তিনি আমাদের পেনাল কোড পড়াতেন। ভালো বক্তৃতা দিতে পারতেন না তিনি। তাই তাঁর বক্তৃতা আমাদের খুব পছন্দ হতো না। আইন পড়ানো। ছাড়াও তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের উর্দু পড়াতেন। এ বিষয়ে তিনি পরীক্ষকের কাজও করতেন।

সিভিল সার্ভিস একাডেমির ভৌত অবকাঠামো

লাহোরের কেনেল রোডে অবস্থিত ছিল সিভিল সার্ভিস একাডেমি। কেনেল রোড ছিল একটি বহমান ও সুন্দর খালের পাড়ে। ১৯৪৭ সালের আগে সিভিল সার্ভিস একাডেমি পাঞ্জাবের রেসিডেন্টের আবাস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পাঞ্জাবে অনেক করদ রাজ্য ছিল। এই করদ রাজ্যগুলো পাঞ্জাবের গভর্নরের অধীন ছিল না। ভাইসরয়ের পক্ষ থেকে এ রাজ্যগুলোর তত্ত্বাবধান করতেন। পাঞ্জাবের রেসিডেন্ট। রেসিডেন্সির মূল ভবন ছিল দোতলা। এই ভবনে তিনটি অংশ ছিল। মধ্যের অংশে দোতলায় ছিল একটি বড় হলঘর এবং একটি বিশাল ডাইনিং রুম। আরেকটি বড় কক্ষে ছিল একাডেমির লাইব্রেরি। নিচে দুটি বড় কক্ষ ক্লাস রুম হিসেবে ব্যবহৃত হতো আর ছিল একাডেমির ডিরেক্টর ও একাডেমির তিন ডেপুটি ডিরেক্টরের তিনটি কক্ষ। এর পূর্ব দিকে ছিল আরেকটি ভবন। যার অর্ধেকটি ব্যবহৃত হতো অফিস হিসেবে। বাকি অর্ধেকটিতে থাকতেন একাডেমির তিনজন উপপরিচালক। আরও পূর্ব দিকে একটি গেস্টহাউস নির্মাণ করা হয়। এই গেস্টহাউসের প্রতিটি কক্ষ ছিল শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। একাডেমির প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য কক্ষ বরাদ্দ দেওয়ার পরও এখানে আট-দশটি কক্ষ খালি থাকত। এই কক্ষগুলোতে একাডেমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন সিএসপি কর্মকর্তারা অতিথি হিসেবে থাকতে পারতেন। মূল ভবন থেকে পশ্চিম দিকে একাডেমির পরিচালকের নির্দিষ্ট বাসস্থান ছিল।

একাডেমিতে মূল ভবনে পাশাপাশি দুটি কক্ষে তিনজন প্রশিক্ষণার্থী থাকতেন। একজন থাকতেন এক শয্যাবিশিষ্ট একটি কক্ষে। পাশের দুই শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে থাকত দুজন প্রশিক্ষণার্থী। একাডেমির সময়কালকে তিনটি সেমিস্টারে ভাগ করা হয়। প্রথম সেমিস্টারে কে কোন কক্ষে থাকবেন, সেটা নির্ধারণ করত একাডেমি কর্তৃপক্ষ। প্রথম সেমিস্টারে আমার কক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের একজন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাকে থাকার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। তাঁর নাম সাফকাত হোসেন শেখ। তিনি প্রায়ই রাতে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য একাডেমির বাইরে চলে যেতেন এবং অনেক রাতে ফিরে আসতেন। তবে একাডেমিতে এমনভাবে কাজকর্ম করতে হতো যে রুমে বসে থাকার সময় খুবই কম পাওয়া যেত।

একাডেমির রুটিন

একাডেমিতে দিন শুরু হতো সূর্য ওঠার এক ঘণ্টা আগে। প্রতিটি উইংয়ে প্রতি তিনজন প্রশিক্ষণার্থীর জন্য একজন মেস বিয়ারার থাকত। এই মেস বিয়ারারকে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত Batman বা একান্ত পরিচারক থেকে। নিয়োগ করা হতো। সেই মেস বিয়ারাদের একাডেমিতে থাকার কোনো জায়গা ছিল না। তাদের থাকতে হতো একাডেমি থেকে মাইল তিনেক দূরে। এক বস্তিতে। তারা প্রতিদিন সূর্য ওঠার ঘণ্টা দুয়েক আগে রওনা হতো। একাডেমিতে এসে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর জন্য বেড-টি নিয়ে তাদের কক্ষে যেত। বেড-টি খাওয়ার সময় ঘোড়ায় চড়ার জন্য কাপড়চোপড়, জুতা ইত্যাদি বের করে দিত। প্রশিক্ষণার্থীরা একাডেমির ভেতরে ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণের জন্য মাঠে যেত। সেখানে প্রত্যেককে ঘোড়ায় চড়তে হতো। সব প্রশিক্ষণার্থীকে একসঙ্গে ঘোড়ায় চড়ানোর জন্য যথেষ্ট ঘোড়া ছিল না। তাই দুই ব্যাচে আধঘণ্টা করে ঘোড়ায় চড়তে হতো। ঘোড়াগুলো দশাসই ছিল। আমার মতো খর্বাকৃতি বাঙালি এ ধরনের ঘোড়া দেখলেই ভয় পেত। তার মধ্যে ঘোড়াগুলোর মেজাজের তারতম্য ছিল। কোনো কোনো ঘোড়া সওয়ার মোটেও পছন্দ করত না। কেউ উঠলে তাকে ফেলে দেওয়ার জন্য নানা কসরত করত। এই ধরনের ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণ করাই হলো ওস্তাদ সওয়ারির আসল আনন্দ।

দ্বিতীয় শ্রেণির ঘোড়া সাধারণত গন্ডগোল করত না। তবে মাঝেসাঝে উগ্র রূপ ধারণ করত। তৃতীয় শ্রেণিতে ছিল দু-তিনটি ঘোড়া, যেগুলো কখনো উত্তেজিত হতো না। এই তৃতীয় শ্রেণির ঘোড়া পেলে ঘোড়ায় চড়া কোনো রকমে সামাল দেওয়া যায়। ঘোড়ার মাঠে যাওয়ার সময় আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যেত। যদি ভালো ঘোড়া না পাওয়া যায়, তাহলে পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙার প্রচুর সম্ভাবনা ছিল। প্রত্যেক ব্যাচেই ঘোড়া থেকে পড়ে কমপক্ষে একজন কর্মকর্তাকে হাসপাতালে এবং বিছানায় শুয়ে মাসখানেক সময় কাটাতে হয়েছে। আমার বন্ধুরা বলত যে ঘোড়ার মাঠে আমাকে নাকি ফাঁসির আসামির মতো দেখাত। ঘোড়ার মাঠের প্রধান শিক্ষক ছিলেন চনন খান। সে প্রথম থেকেই আমার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। বেশির ভাগ সময়ই আমাকে চড়ার জন্য ভালো ঘোড়া দেওয়া হতো এবং সেই সঙ্গে ভালো প্রশিক্ষকও দেওয়া হতো। তাই শেষ পর্যন্ত একদিনও আমি ঘোড়া থেকে পড়িনি। এমনকি প্রশিক্ষণের শেষ দিকে আমাদের লাহোর একাডেমি থেকে বাইরের সড়ক দিয়ে লাহোর রেসকোর্সে ঘোড়দৌড়ের জন্য নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে অতি দ্রুত ঘোড়া চালানো বা গ্যালোপিং (Gallopping) শেখানো হতো। মাঝারি গতিতে ঘোড়া চালানোকে বলত ক্যান্টারিং (Cantering) এবং শ্লথগতিতে ঘোড়া চালানোকে বলত ট্রটিং (Trotting) বা দুলকিচাল। একাডেমিতে শেষ দুই পদ্ধতিতে ঘোড়া চালানো হতো। তবে একাডেমির সহিসদের সহযোগিতায়। শেষ পর্যন্ত আমি ঘোড়া চালানোর পরীক্ষায় ভালোভাবেই পাস করে যাই। আমি ৫০-এর মধ্যে ৩০ নম্বর পাই। সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন সৈয়দ মেহেদী (৪৪) এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী (৪৩)। আমার চেয়ে কম নম্বর পেয়েছিলেন আমিনুল্লাহ চৌধুরী (২৭) ও খসরুজ্জামান চৌধুরী (২৯)।

আইসিএসদের জন্য ঘোড়ায় চড়তে জানা একটি অত্যাবশ্যক শর্ত ছিল। পাকিস্তানে সিএসপি এবং পিএফএস অফিসারদের জন্য এই শর্ত প্রয়োগ করা হয়। সিএসপি অফিসারদের অনেক ক্ষেত্রে তখনো ঘোড়ায় চড়তে জানা প্রয়োজন ছিল। ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য তাঁদের অনেক সময় দুর্গম পল্লি অঞ্চলে সফর করতে হতো, যেখানে ঘোড়া ছাড়া চলাচলের আর কোনো বাহন ছিল না। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এ ধরনের প্রয়োজন ছিল না। ঘোড়ায় প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করার কারণ ছিল ভিন্ন। সরকার মনে করত যারা ভালো ঘোড়া চালাতে পারে, তাদের পক্ষে যেকোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব। সুতরাং আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণের ওপরে জোর দেওয়া হতো।

ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণ ছাড়াও একাডেমির কর্মসূচিতে আরও দুটি প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক ছিল। প্রথমত, একাডেমিতে বিকেলবেলা প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর লন-টেনিস খেলার কথা। একাডেমিতে প্রায় ১০টির মতো টেনিস কোর্ট ছিল। সব প্রশিক্ষণার্থী টেনিসের জন্য উপযোগী কাপড়চোপড় পরে টেনিস-র্যাকেট নিয়ে বিকেলবেলা খেলার জন্য টেনিস কোর্টে যেত। সেখানে দু-একজন প্রশিক্ষক ছিলেন, তবে আমি একেবারেই টেনিস খেলতে জানতাম না। আমার মতো প্রশিক্ষণার্থী বোধ হয় আর কেউ ছিল না। তাই আমার সঙ্গে খেলার জন্য প্রশিক্ষণার্থী পাওয়া যেত না। আমি টেনিস খেলায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। টেনিস আমি কখনো নিয়মিত খেলিনি। স্বাস্থ্যের জন্য টেনিস খেলা অত্যন্ত উপকারী। তাই প্রায় প্রত্যেক সিএসপি অফিসার টেনিস খেলতেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে আমি ডেপুটি কমিশনার ও এসডিওদের যত আবাস দেখতে পেয়েছি, তার প্রতিটিতেই একটি টেনিস কোর্ট ছিল।

দ্বিতীয়ত, আগে সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে টাইপ করতে শেখানো হতো। আমরা যখন একাডেমিতে যাই, তখন টাইপিং শেখানো বন্ধ হয়ে যায়। তবে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে টাইপিং শেখার জন্য উৎসাহিত করা হতো। সরকার বিদেশ থেকে টাইপরাইটার আমদানি করে অত্যন্ত কম দামে প্রশিক্ষণার্থীদের কাছে এ যন্ত্রগুলো বিক্রি করত। আমি একটি টাইপরাইটার মেশিন কিনেছিলাম। এক আঙুলে টাইপ করতে পারতাম কিন্তু টাইপিংয়ে কখনো দক্ষতা অর্জন করতে পারিনি।

একাডেমিতে সব খাবার তৈরি করত একাডেমির বাবুর্চিরা। খাবারের মান। খুবই উন্নত ছিল। ডাইনিং টেবিলে বসে ছুরি কাটা দিয়ে আমাদের খেতে হতো। ডাইনিং টেবিলে আমাদের মধ্যে কথাবার্তা হতো। অনেক সময় পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে ঝগড়াও হতো। একাডেমিতে প্রধানত মাংসের বিভিন্ন পদ, রুটি, ভাত, ডাল ও সবজি দেওয়া হতো। মাছ সপ্তাহে দু-এক দিন দেওয়া হতো। পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষার্থীরা সাধারণত মাছ খেতেন না। মাস দুয়েক খাওয়ার পর এ খাবার আমাদের কাছে একঘেয়ে মনে হয়। এই একঘেয়ে খাবারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার দুটি পথ ছিল।

একটি পথ ছিল লাহোর জিমখানা ক্লাবে ছুটির দিনে মধ্যাহ্নভোজন করা। আমাদের আগের ব্যাচ পর্যন্ত নিয়ম ছিল যে সব প্রশিক্ষণার্থী জিমখানা ক্লাবের সদস্য হবেন। আমাদের পূর্বের ব্যাচ থেকে জিমখানা ক্লাবের সদস্য পদ ঐচ্ছিক করা হয়। যারা খুশি তারা সদস্য হতে পারতেন, যারা চাইতেন না, তাঁদের সদস্য হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। আমাদের কোর্সের উদ্বোধনী ভাষণে পরিচালক জিমখানা ক্লাবের সদস্য হতে পারার সহজ সুযোগের কথা উল্লেখ করেন। তবে তিনি মন্তব্য করেন, জিমখানা ক্লাবের সদস্য না হওয়াই ভালো। আমাদের ব্যাচের একজন ছাড়া সবাই জিমখানা ক্লাবের সদস্য হই। ব্যতিক্রম ছিলেন শাহেদ সাদুল্লাহ। দুষ্ট লোকেরা বলত যে পরিচালকের ঐচ্ছিক নম্বর

বেশি পাওয়ার জন্য শাহেদ সাদুল্লাহ পরিচালকের উপদেশকে শিরোধার্য করে। নিয়েছিলেন। জিমখানা ক্লাবের সদস্য হওয়ার একটি সুবিধা ছিল যে জিমখানা ক্লাবের সদস্যরা পাকিস্তানের যেকোনো শহরের ক্লাবে গেলেই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারতেন। জিমখানা ক্লাবের সদস্য কার্ড দেখিয়ে যেকোনো ক্লাবের সদস্য হওয়া যেত। এভাবেই আমাদের ব্যাচের প্রায় সবাই পূর্ব পাকিস্তানে এলে ঢাকা ক্লাবের সদস্য হন। অবশ্য আমি যদিও জিমখানা ক্লাবের সদস্য ছিলাম, তবু ঢাকা ক্লাবের সদস্য কখনো হইনি।

দ্বিতীয় উপায়টি আমাদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের ব্যাচমেট শাহ মোহাম্মদ ফরিদ। একাডেমিতে নিয়ম ছিল যে যদি কেউ অসুস্থ হয়, তাহলে তার জন্য ভিন্ন ধরনের খাবার পরিবেশন করা হবে। পাঞ্জাবিরা মনে করে জ্বর হলে রোগীকে রুটি খেতে দিতে নেই, এতে জ্বর বাড়ে। জ্বর হলে রোগীকে ভাত বা খিচুড়ি দিতে হয়। তাই একাডেমির ডাইনিং হলে যদি কেউ খবর পাঠিয়ে দেয় যে তার জ্বর জ্বর লাগছে, তাহলে তার জন্য ভিন্ন খাবার আসবে। এই খাবারে থাকত ভুনা খিচুড়ি, মোরগের মাংসের তরকারি, সবজির ভুজিয়া এবং কেরামাল কাস্টার্ড বা পুডিং। এই খাবারের জন্য ডাইনিং হলে যেতে হতো না, আমাদের শোবার ঘরে মেস বেয়ারারকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দেওয়া হতো। এতে আমরা শুধু পছন্দের খাবারই পেতাম না, আমাদের সময়ও বাঁচত। তাই প্রায়ই ছুটির দিন বিকেলবেলায় আমরা ডাইনিং হলে জ্বরের খবর পাঠিয়ে দিতাম।

শিক্ষাসফর

চারটি শিক্ষাসফর সিভিল সার্ভিস একাডেমির প্রশিক্ষণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ছিল—

দক্ষিণাঞ্চল সফরে লাহোর থেকে করাচি পর্যন্ত যাওয়া হতো। সিন্ধু প্রদেশের সাক্কার হয়ে করাচির রাস্তা ছিল প্রায় ৮০০ মাইল (১২১০ কিলোমিটার)। আমাদের যাত্রা শুরু হয় সাহিওয়াল জেলার ওকারা মহকুমা হয়ে প্রাচীন শহর হরপ্পাতে যাওয়ার মাধ্যমে। লাহোর থেকে হরপ্পার দূরত্ব ছিল প্রায় ১৯৬ কিলোমিটার। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার একটি বড় কেন্দ্র ছিল হরপ্পা নগরী। তবে ১৯৩০-এর দশকে লাহোর থেকে যখন দক্ষিণ দিকে রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছিল, তখন সেই রেলপথ সরাসরি প্রাচীন হরপ্পা নগরীর ওপর দিয়ে নির্মাণ করা হয়। তখনো সিন্ধু সভ্যতার অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিল। না। এই নগরীর মধ্য দিয়ে রেললাইন নির্মাণে লাভ হয়, কেননা কয়েক হাজার বছরের পুরোনো ইটগুলো রেললাইনে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। কিন্তু এই রেলপথ নির্মাণের ফলে সিন্ধু সভ্যতার অনেক ধ্বংসাবশেষ চিরতরে হারিয়ে যায়। আমরা হরপ্পার জাদুঘরে সিন্ধু সভ্যতার কিছু স্মারক দেখতে পাই। হরপ্পা থেকে মহকুমা শহর খানেওয়াল হয়ে আমরা মুলতান পৌঁছাই। লাহোর থেকে মুলতানের দূরত্ব প্রায় ৩৩৭ কিলোমিটার। আমরা সন্ধ্যার দিকে মুলতান পৌঁছাই।

মুলতানে আমাদের রাখা হয় সেখানকার মেহমানখানায়। মেহমানখানার সুযোগ-সুবিধা ছিল খুবই সীমিত, এমনকি শৌচকার্য করার জন্য কোনো টয়লেট ছিল না। সেখানে প্রথম ‘থান্ডার বক্স’ দেখতে পাই। থান্ডার বক্স একজন ব্যবহার করার পর মেথর এসে পরিষ্কার করে দিলে আরেকজন তা ব্যবহার করতে পারত। সন্ধ্যায় আমরা যাই দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইসলাম প্রচারক শেখউল ইসলাম বাহাউদ্দিন আবু মোহাম্মদ জাকারিয়া আল কুরেশি আল আসাদির (যিনি বাহাউল হক নামে পরিচিত ছিলেন) মাজারে। মাজারটি ছিল প্রাচীন মুলতান দুর্গের ওপরে। তাই মাজারটিতে যেতে হলে অনেকটা পথ উঁচুতে হেঁটে যেতে হতো। আমরা যখন মাজারে প্রবেশ করছিলাম, তখন হঠাৎ দেখতে পাই একজন সাধক একটি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান গাইছে ‘দমাদম মাস্তকেন্দর, আলিদা পয়লা নম্বর। গানের অনুরণন পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই এই গান সারা পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। মাজার থেকে বেরিয়ে আমরা মুলতানের বাজারে যাই। বাজারের কাছেই ছিল মুলতানের বিখ্যাত গণিকালয়। আমাদের ব্যাচমেট ইকতেদার আহমদের নেতৃত্বে আমরা গণিকালয়ে ঢুকি। রাতে বিদ্যুতের আলোয় পুরো গণিকালয়টি ঝলমল করছিল। সেখানে ঘোড়ার গাড়িতে করে গণিকারা কেউ বাইরে যাচ্ছিল, কেউ ফিরে আসছিল। বাইরে থেকে মিষ্টি সুরে অনেক গান শোনা যাচ্ছিল।

পরদিন সকালে আমরা সিন্ধু প্রদেশের সাক্কার শহরের দিকে রওনা হই। মুলতান থেকে সাক্কারের দূরত্ব হলো ২৩৪ মাইল (৩৭৬ কিলোমিটার)। বিকেলের দিকে আমরা সাক্কারে সেচ বিভাগের ইন্সপেকশন বাংলোতে উপস্থিত হই। বাংলোর সামনে জি এম ব্যারাজে জমানো সিন্ধু নদের বিশাল জলরাশি। এই জলরাশি দেখে মনে হচ্ছিল যে আমরা যেন পশ্চিম পাকিস্তানে নেই। সাক্কার যেন পূর্ব পাকিস্তানের অংশ। আমাদের উপপরিচালক ড. তারেক সিদ্দিকী ১৯৫৫ সালে সিএসপি হন। সে সময় তার ব্যাচ যখন সাক্কার শহরে এসেছিল, তখন তার ব্যাচমেট সুলতানুজ্জামান খান স্যুট-কোট পরে ‘আমার সোনার বাংলা’ বলে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন। বহু কষ্টে তাঁর ব্যাচমেটরা তাঁকে ঝাঁপ দিতে দেননি। আমরা কেউ সিন্ধুর পানিতে ঝাঁপ দিইনি ঠিকই কিন্তু সবার মনেই সোনার বাংলার স্মৃতি ভেসে ওঠে।

পরদিন সকালে আমরা শিকারপুর হয়ে মহেঞ্জোদারোর উদ্দেশে রওনা হই। শিকারপুরে তখন এসডিএম ছিলেন ১৯৬৪ ব্যাচের বাংলাদেশের সিএসপি কুদরত-এ-এলাহী চৌধুরী। তার সঙ্গে শিকারপুরের রাস্তায় দেখা হয়। শিকারপুর শহরটি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য শহর থেকে একেবারে ভিন্ন। এই শহরে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ ছিল হিন্দু। তাই রাস্তায় মসজিদের পাশাপাশি মন্দিরও দেখা যাচ্ছিল। দোকানপাটে দেখা যাচ্ছিল শাড়ি, আর রাস্তার পাশে ছিল অনেক মিষ্টির দোকান। এ মিষ্টিগুলো সাধারণত পশ্চিম পাকিস্তানে পাওয়া যায় না। দোকানের বাইরে থেকে দেখা রসগোল্লা, সন্দেশ, চমচম ইত্যাদি মিষ্টি আমাদের বাংলাদেশের মিষ্টির দোকানের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। এরপর লারকানা শহর হয়ে আমরা মহেঞ্জোদারোতে উপস্থিত হলাম। মহেঞ্জোদারো একটি বিশাল প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসস্তূপ। এখানে অনেক বড় উপাসনালয়, খাদ্যগুদাম, রাস্তাঘাট, দালানকোঠা ছিল। আমরা মহেঞ্জোদারো শহরের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করলাম। মহেঞ্জোদারো মিউজিয়ামে মহেঞ্জোদারো এবং তার সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতার স্মরণচিহ্নগুলো দেখতে পাই। রাতে মহেঞ্জোদারো থেকে আমরা সাক্কারে ফিরে আসি।

সাক্কার থেকে আমরা করাচি রওনা হই। করাচি যাওয়ার আগে আমরা থাট্টা শহরে থামি। থাট্টা শহরে অজস্র মুসলমান সাধকদের কবর রয়েছে। আমরা কিছু কবর ঘুরে দেখি। সেখানে তখন এসডিএম ছিলেন ১৯৬৫ ব্যাচের সিএসপি সৈয়দ আবদুস সামাদ। তার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়।

থাট্টা থেকে আমরা করাচিতে হোটেল মেট্রোপোলে গিয়ে উঠি। সেখানে আমাদের জন্য সস্তায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। করাচিতে আমাদের কায়েদে আজমের মাজার দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে নৌবাহিনীর সদর দপ্তরে আমাদের নেওয়া হয় এবং একদিন ক্লিফটন সমুদ্রসৈকতে পিকনিকের ব্যবস্থা করা হয়। করাচিতে তখন ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্টের সদর দপ্তর ছিল। এই দপ্তরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন ১৯৪২ সালের আইসিএস কর্মকর্তা এম এ এইচ কার্নি। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে তিনি আমাদের জন্য বিরাট এক ডিনারের আয়োজন করেছিলেন। একদিন আমরা প্রাতরাশ গ্রহণ করি করাচির কমিশনার দরবার আলী শাহের সঙ্গে। করাচি থেকে ইসলামাবাদে রাজধানী স্থানান্তরের পর এবং একত্র পশ্চিম পাকিস্তানে সিন্ধু প্রদেশের অবলুপ্তির পর করাচি শহরের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হন কমিশনার। শহরে তখন অসংখ্য শিল্পোদ্যোক্তা এবং বহুজাতিক কোম্পানি ছিল। এরা এদের অনুষ্ঠানে কমিশনারের উপস্থিতি চান। ফলে দুপুরে এবং রাতে কমিশনারের কোথাও না কোথাও নিমন্ত্রণ থাকত। যারা দুপুরে এবং রাতে খাওয়ার দাওয়াত দিতে পারত না, তারা কমিশনারের জন্য প্রাতরাশের ব্যবস্থা করত। এর ফলে কমিশনারের বাড়িতে খুব কমই রান্নাবান্না হতো। দরবার আলী শাহ আমাদের জন্য তার বাসভবনে প্রাতরাশের ব্যবস্থা করেন। আমাদের সবাইকে নিজ হাতে সিগারেট দেন এবং সবার সঙ্গে বন্ধুর মতো গল্প করেন। রাতে মেট্রোপলিটন হোটেলে কোনো না কোনো কোম্পানি আমাদের জন্য ভোজনের ব্যবস্থা করত। তবে এসব নিমন্ত্রণে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক ছিল না। আমরা কোনো কোনো সময় রাতে বেরিয়ে পড়তাম। একদিন রাতে আমার খালাতো ভাই এইচ ডব্লিউ চৌধুরীর বাড়িতে যাই। তিনি তখন পাকিস্তান শিল্প ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা। তার সঙ্গে আমার আরেক খালাতো ভাই মানিক চৌধুরীও থাকতেন। তিনি আমাকে খাওয়ানোর জন্য করাচির ইলিশ মাছ নিয়ে আসেন। আমার ধারণা ছিল ইলিশ মাছ শুধু বাংলাদেশে পাওয়া যায়। করাচিতে গিয়ে আমার সেই ভুল ভাঙে। ইলিশ মাছ পৃথিবীর অনেক বড় নদীর মোহনায় পাওয়া যায়। তবে পদ্মার ইলিশের মতো স্বাদ অন্যান্য নদীর ইলিশের হয় না। করাচিতে আমি যে ইলিশ খেয়েছিলাম, তা দেখতেই শুধু ইলিশের মতো ছিল; কিন্তু বাংলাদেশের ইলিশের স্বাদ তাতে মোটেও ছিল না।

করাচি থেকে ফেরার পথে আমরা হায়দরাবাদ শহরে যাই। সেই শহরে একদিকে যেমন আছে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, অন্যদিকে অনেক নতুন সরকারি দালানকোঠাও গড়ে তোলা হয়েছে। হায়দরাবাদে তখন কমিশনার ছিলেন। ১৯৪৯ ব্যাচের সিএসপি মসরুর হাসান খান। তার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। এ ছাড়া আমরা একটি কৃষি গমবষণাকেন্দ্র দেখতে যাই। হায়দরাবাদ থেকে আমরা যাই ভাওয়ালপুরে। সেখানে একটি অব্যবহৃত রাজপ্রাসাদে আমাদের রাখা হয়। ওই এলাকার কৃষিব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেওয়া হয়। হায়দরাবাদ থেকে আমরা যাই পানজনদ নামে একটি স্থানে। সেখানে সিন্ধুর পাঁচটি নদী একত্রে মিলেছে। সেখানে সেচ বিভাগের ইন্সপেকশন বাংলোতে আমরা মধ্যাহ্নভোজন করি। রাতে আমরা ফিরে আসি রহিম ইয়ার খান নামক জেলা শহরে। এখানকার একজন ভূস্বামী রাতে আমাদের জন্য ডিনারের ব্যবস্থা করেন। রহিম ইয়ার খান থেকে লাহোরের দূরত্ব ছিল প্রায় ৫৯০ কিলোমিটার। মধ্যাহ্নভোজনের জন্য আমরা খানেওয়াল মহকুমা শহরের কাছে অবস্থিত মিচেল কোম্পানির ফলের বাগান এবং কারখানায় যাই। সেখানে খুবই উন্নত মানের যান্ত্রিক চাষাবাদ করা হচ্ছিল। রাতে আমরা সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে ফিরে আসি।

পল্লী উন্নয়ন একাডেমি কুমিল্লা সফর। কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে আমাদের দুই সপ্তাহের জন্য সফরে নিয়ে যাওয়া হয়। আইয়ুব খানের বুনিয়াদি গণতন্ত্রের সূতিকাগার ছিল কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমি। এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন ১৯৩৮ ব্যাচের আইসিএস অফিসার আখতার হামিদ খান। তিনি পরে আইসিএস চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। এখানে ইউনিয়ন কাউন্সিল, সমবায় সমিতি এবং কোতোয়ালি থানা সমবায় সমিতি–এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম আমাদের হাতে-কলমে দেখানো হয়। এ ছাড়া প্রতিদিনই কুমিল্লা একাডেমির প্রশিক্ষকেরা গ্রামীণ সমাজ, গ্রামীণ অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন। তিন-চারটি ক্লাস নিয়েছিলেন আখতার হামিদ খান নিজে। কুমিল্লা মডেলে এলিট শ্রেণির লোকেরা বেশি উপকৃত হচ্ছে–এ ধরনের প্রশ্ন করলে আখতার হামিদ খান রেগে যান। তিনি স্বীকার করেন যে কুমিল্লা মডেলে দুর্বলতা আছে, তবে এ দুর্বলতা মডেলকে নিয়ে কাজ করতে করতে দূর করতে হবে; রাতারাতি দূর করা সম্ভব নয়। কুমিল্লায় আমাদের ব্যাচের কর্মকর্তাদের তিনটি মধ্যহ্নভোজের নিমন্ত্রণ করা হয়। একটি ভোজনের ব্যবস্থা করেছিলেন কুমিল্লার ডিসি আবদুস সালাম সাহেব। আরেকটি লাঞ্চ দেন আমার ফুফা আজিজুর রহমান সাহেব, যিনি কুমিল্লা কনভেনশন লিগের সভাপতি এবং জাতীয় সংসদের সদস্যও ছিলেন। সবশেষ ভোজের ব্যবস্থা করেন আমার চাচা আবদুস শাকুর খান। তিনি প্রাদেশিক প্রদেশের সদস্য ছিলেন। তাঁর ছেলে হাবিবুল্লাহ খান তখন গওহর-আইয়ুবের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান গান্ধার ইন্ডাস্ট্রিজের পূর্ব পাকিস্তানের ম্যানেজার ছিলেন। আমার কুমিল্লা অবস্থানকালে আমার বাবা-মা নবীনগর থেকে কুমিল্লায় শাকুর খান সাহেবের বাসায় চলে আসেন। প্রতিদিনই সন্ধ্যাবেলায় আমি তাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। ড. তারেক সিদ্দিকী সে সময় আমাদের প্রত্যেককে একটি করে কৃষক সমবায় সমিতি পরিদর্শন করিয়ে সে সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন পেশ করার নির্দেশ দেন। যেহেতু সন্ধ্যাবেলায় আমি শহরে চলে যেতাম, সেহেতু আমার কাজের বিশেষ অগ্রগতি হয়নি। একদিন সন্ধ্যায় ড. তারেক সিদ্দিকী আমাকে কুমিল্লা যাওয়ার আগে ধরে ফেলেন এবং বলেন যে এখনই তোমাকে গ্রামে যেতে হবে। তোমাকে সমবায় সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। আমি রিকশা করে একাডেমি থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে অবস্থিত গ্রামটিতে যাই। সেখানে গিয়ে আমি সমবায় সমিতির অফিস খুঁজতে শুরু করি। যাকেই জিজ্ঞেস করি, সে কোনো উত্তর দেয় না। ঘণ্টাখানেক পর একজন শিক্ষক আমাকে কানে কানে বললেন, সামনের বাড়িটিতেই এই অফিস অবস্থিত ছিল। কিন্তু এই অফিস এখন আর নেই। কারণ গ্রামের দলাদলিতে সমবায় সমিতির সভাপতিকে দিন দশেক আগে জবাই করা হয়েছে। ভয়ে কেউ ওই অফিসে এখন আর যায় না। আমি কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি। আমার রিপোর্টে আমি লিখলাম, গ্রামের দলাদলি হ্রাস করা না গেলে সেখানে সমবায় সমিতির বিকাশ সম্ভব হবে না।

মধ্য পাঞ্জাবে শিক্ষাসফর। ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে আমাদের পাঁচ দিনের একটি সফরে পাঞ্জাবের মধ্যাঞ্চলে শিক্ষাসফরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা লাহোর থেকে গিয়ে লায়ালপুর (যা এখন ফয়সালাবাদ নামে পরিচিত) কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্টহাউসে গিয়ে উঠি। লায়ালপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভিন্ন বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের সঙ্গে পরিচিত করানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা তাঁদের বিষয়ে বক্তৃতা দেন এবং তাঁদের গবেষণাগার দেখান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন নতুন প্রজাতির শস্য, ফল এবং গবাদিপশুর আবিষ্কারের জন্য কাজ চলছিল। অনেক ক্ষেত্রে তারা সফল হয়েছিলেন এবং এ সফল পরীক্ষাগুলো কৃষকদের মধ্যে মাঠে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। এর ফলে এখানে কৃষি অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ অধিবেশন হয় ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে। ভাইস চ্যন্সেলরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তফাত কোথায়? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যে বরাদ্দ আসে, তার। সিংহভাগ ব্যয় করা হয় গবেষণার জন্য। তারা দালানকোঠা নির্মাণে অতি অল্প ব্যয় করেন। আর পূর্ব পাকিস্তানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার বেশির ভাগই দালানকোঠা নির্মাণে ব্যয় করা হয় কিন্তু গবেষণার জন্য ব্যয় অত্যন্ত কম। গবেষকদের উৎসাহিত না করলে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উন্নতি হবে না।

লায়ালপুর থেকে আমরা একদিন সারগোদা বিমানবাহিনীর কেন্দ্রে যাই। সেখানে প্রশ্ন ওঠে যে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের আকাশসীমার প্রতিরক্ষা সম্ভব কি না। তখন পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র এক স্কোয়াড্রন বিমান ছিল। তার বিপরীতে চীনা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পূর্ব ভারতে অনেক স্কোয়াড্রন বিমান ছিল। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতীয় বিমানবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান বিমানবাহিনীকে সম্পূর্ণ অচল করে দেওয়ার শক্তির অধিকারী ছিল। পাকিস্তান বিমানবাহিনী কেন্দ্রের পরিচালক এ মত প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমান উড়ে ভারতের ওপর বোমা ফেলতে ফেলতে ঢাকা বিমানবন্দরে গিয়ে অবতরণ করবে। তারপর সেই বিমান ঢাকা থেকে জ্বালানি এবং বোমা নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বোমা ফেলতে ফেলতে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে আসবে। সুতরাং ভারত কোনোমতেই পূর্ব পাকিস্তানের বিমানবাহিনীকে অচল করতে পারবে না। তাঁর এই বক্তব্য শুনে সব পূর্ব পাকিস্তানি প্রশিক্ষণার্থী হেসে ওঠেন। এ নিয়ে বিমানবাহিনীর কর্মকর্তার সঙ্গে আমাদের কিছুটা কথা-কাটাকাটি হয়। এ বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীকালে, অর্থাৎ ‘৬৮ এবং ‘৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানি প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের ঝগড়া হয়েছে বলে জানা যায়।

এ ছাড়া আমরা ঝং শহরে যাই। সেখানে একটি বিরাট পশুর মেলা বসেছিল। সেখানে আমরা অনেক ধরনের গরু, ছাগল, মহিষ, মোরগ ইত্যাদি দেখতে পাই। ঝং জেলায় কৃষি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। এই জেলা শুধু কৃষির জন্যই নয়, হির-রঞ্জার আবাসস্থলও ছিল এই জেলা। হির এক ধনীর দুলালী ছিলেন এবং রঞ্জা ছিল এক গরিব চাষির ছেলে। এরা প্রেমে পড়লে হিরের পরিবার তাদের রোমান্স ভেঙে দেওয়ার জন্য হিরকে এক ধনীর ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়। হির এই বিয়ে ভাঙতে চাইলে তাকে বিষ খাওয়ানো হয়। হির বিষ খেয়ে মারা গেলে রঞ্জাও একই বিষ খায় এবং মারা যায়। তাদের কবর ঝং শহরে অবস্থিত। তবে এই কবর জিয়ারত করার সুযোগ আমাদের হয়নি।

উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সফর। আমাদের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল সীমান্ত সফরের জন্য পেশোয়ার শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে আমাদের কিছু ক্লাসও নিতে হয়। একাডেমির পরিচালক আমাদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেন, তবে একাডেমিতে কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা তখনো শুরু হয়নি। এই একাডেমির প্রশিক্ষকদের মান কুমিল্লা একাডেমির চেয়ে নিচু বলে মনে হয়েছে। পেশোয়ার থেকে আমাদের কোহাট জেলা সদরে নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার পথে দাঁড়াআদমখেল নামে একটি বসতিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে লাইসেন্স ছাড়া বন্দুক বেচাকেনা হতো। পেশোয়ার থেকে কোহাটের রাস্তা ছিল তখন অত্যন্ত দুর্গম। প্রায়ই এই সড়কে দুর্ঘটনা ঘটত। আমরা কোহাট থেকে সহিসালামতে ফিরে আসি।

পেশোয়ার থেকে আমাদের একদিন লান্ডিকোটালে বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। লান্ডিকোটাল অঞ্চলে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এখানে আফগানিস্তানে যাওয়ার নাম করে পাকিস্তানকে শুল্ক না দিয়ে সরাসরি বিদেশি পণ্য নিয়ে আসা হতো। কিন্তু এগুলো আফগানিস্তানে বিক্রি না করে বিক্রি করা হতো লান্ডিকোটালে। এই স্মাগলিং ব্যবসা এখানকার জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস ছিল। আমি লান্ডিকোটালে বিদেশি স্যুটের কাপড় এবং স্যুটকেস কিনেছিলাম। লান্ডিকোটাল ভ্রমণের পরদিন আমরা লাহোর ফিরে আসি। এই সফরের সময় আমরা নওসেরা নামক একটি শহরের মধ্য দিয়ে আসা-যাওয়া করেছি। নওসেরা ছিল একটি মহকুমা শহর। পেশোয়ার একাডেমির বাইরে যাওয়ার জন্য আমাদের কোনো সুযোগ ছিল না। আমাদের ব্যাচমেট মামুনুর রশীদের কল্যাণে একটি গাড়ির ব্যবস্থা হয়। এই গাড়িতে করে আমরা রিসালপুর বৈমানিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র ঘুরতে যাই। সেখানে বাঙালি প্রশিক্ষকদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। মামুনুর রশীদের ফুফাতো ভাই একজন প্রশিক্ষক ছিলেন। তাঁর কল্যাণে আমরা ‘বেইজ’-এর দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে পাই।

তিন মাসের জন্য কোয়েটা জেলায় জেলা প্রশাসন প্রশিক্ষণ

সিভিল সার্ভিস একাডেমির প্রশিক্ষণের শেষ তিন মাস জেলা প্রশাসনে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নিতে হতো। যাঁরা পূর্ব পাকিস্তানি কর্মকর্তা ছিলেন, তাঁদের পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো জেলায় প্রশিক্ষণ নিতে হতো। যারা পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তা ছিলেন, তাদের পূর্ব পাকিস্তানের কোনো জেলায় প্রশিক্ষণ নিতে হতো। প্রশিক্ষণার্থীরা তিন কিংবা চারজনের একটি দলে সফর করতেন। শাহেদ সাদুল্লাহ, আবদুশ শাকুর, শাহ মোহাম্মদ ফরিদ এবং আমি–এই চারজন একটি দল গঠন করি এবং কোয়েটাকে জেলা প্রশাসনের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিই। মিজানুর রহমান শেলী এবং আরও পাঁচজন সহকর্মী মালাকন্দ পার্বত্য জেলায় যাওয়ার জন্য দরখাস্ত করেন। কিন্তু মালাক জেলার রাজনৈতিক এজেন্ট জানান, এই অঞ্চলের প্রশিক্ষণ পাকিস্তানের বেশির ভাগ অঞ্চলে চলবে না। তাই তাদের অন্য কোথাও প্রশিক্ষণে পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত এই দলকে কোহাট পাঠানো হয়। ওয়ালিউল ইসলামের নেতৃত্বে চারজনের আরেকটি দল কালাত বিভাগে প্রশিক্ষণের জন্য আসেন। তাদের কালাত উপস্থিতির পর কমিশনার অভিমত প্রকাশ করেন যে এখানে প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই। সুতরাং তাদের কালাত থেকে হায়দরাবাদ জেলায় পাঠানো হয়।

আমরা ট্রেনে করে লাহোর থেকে কোয়েটা রওনা হই। সাক্কার স্টেশন পার হওয়ার পর ট্রেন অনেক টানেলের ভেতর দিয়ে কোয়েটা শহরের দিকে অগ্রসর হয়। কোয়েটা শহরে পৌঁছানোর পর আমাদের রেলস্টেশনে অভ্যর্থনা জানান ১৯৬৬ ব্যাচের সিকান্দার হায়াত খান জামালির ছোট ভাই তাজ জামালি। তিনি আমাদের কোয়েটা মিউনিসিপ্যালটির রেস্টহাউসে নিয়ে যান। রেস্টহাউসটি মোটামুটি ভালো ছিল। লাহোর থেকে আমাদের সঙ্গে একজন মেস বিয়ারার আসেন, তাঁর নাম ছিল ফকির মোহাম্মদ। তার মেয়ের জামাই কোয়েটায় রেলওয়েতে কাজ করত। সে মেয়ের সঙ্গে থাকত এবং দিনের বেলায় এসে আমাদের কাজকর্ম করে দিত। আমরা যখন বাইরে সফরে যেতাম, তখন আমরা চাইলে সে আমাদের সঙ্গে যেত।

কোয়েটায় পৌঁছার পরদিন আমরা কোয়েটা ডেপুটি কমিশনার জামশেদ বারকির সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। জামশেদ বারকি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে সিএসপিতে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তাঁকে ১৯৬১ ব্যাচের সিএসপি কর্মকর্তা হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের স্বাগত জানান। তিনি বলেন যে উপজাতীয়দের কিছু কোন্দলের জন্য তিনি খুবই ব্যস্ত আছেন। কাজেই কোয়েটাতে আমরা যা করতে চাই, তা যেন। আমরা নিজেরাই করে নিই। আমরা যা করব, তাতেই তার অনুমতি রয়েছে। আর বললেন, তোমাদের সঙ্গে আমার দেখা হবে ডিনারে। তোমরা মাসে অন্তত একটি ডিনার আমার সঙ্গে খাবে। তিনি তার কথা রেখেছিলেন। তিন মাসে তিনি আমাদের তিনটি ডিনারে ডেকেছিলেন। ডিনারেই তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন। সুতরাং কোয়েটায় আমরা কী কাজ করব, সেটা আমরাই ঠিক করে নিই। একাডেমি থেকে আমাদের প্রত্যেককে একটি করে বিষয়ের ওপর প্রতিবেদন লিখতে বলা হয়েছিল। যেমন আমার দায়িত্ব ছিল কোয়েটা জেলায় কৃষি বিভাগের কার্যকলাপ। আমার সহকর্মী আবদুশ শাকুরকে দেওয়া হয়েছিল উপজাতীয়দের নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসনের ভূমিকা সম্পর্কে প্রতিবেদন লেখার দায়িত্ব।

এ ছাড়া আমাদের তৃতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়। তৃতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আমাদের কতগুলো মামলা নিষ্পন্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই দুটি কাজ করা হলে বাকি সময় আমরা যা খুশি করতে পারি।

এ সময়ে সরকারি আইনের ফাঁকে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের একটি উৎস আমাদের নজরে আসে। কোনো সরকারি কর্মচারী যখন সফরের জন্য তাঁর দপ্তর ছেড়ে বাইরে যান, তখন তিনি দশ দিন পূর্ণ হারে দৈনিক ভাতা পান। দশ দিন পার হলে দশ দিন থেকে এক মাস অর্ধেক হারে দৈনিক ভাতা পান।

এক মাস পার হওয়ার পর তখন ওই স্থান তার অস্থায়ী দপ্তর হিসেবে গণ্য হবে। এবং তাঁকে আর দৈনিক ভাতা দেওয়া হবে না। তবে যদি কোনো কর্মকর্তা তাঁর নতুন দপ্তরে যাওয়ার দশ দিনের মধ্যে আবার অন্য কোথাও কমপক্ষে তিন দিনের জন্য সফরে যান, তাহলে আরও দশ দিন তাকে পূর্ণ হারে দৈনিক ভাতা দিতে হবে। এভাবে দশ দিন পরপর সফরে গেলে পুরো তিন মাস সময় পূর্ণ হারে দৈনিক ভাতা পাওয়া সম্ভব। আমরা তদনুসারে কর্মসূচি প্রণয়ন করলাম। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য একটি গাড়ির দরকার ছিল। সৌভাগ্যবশত জামালি গোত্রের কোয়েটায় একটি রেস্টহাউস ছিল। এ রেস্টহাউসে একটি গাড়ি ছিল মেহমানদের জন্য। সিকান্দার হায়াত খান। জামালির নির্দেশে এই গাড়িটি চালকসহ আমাদের দিয়ে দেওয়া হয়। তাই আমরা যখন যেখানে খুশি যেতে পারতাম।

কোয়েটা জেলায় তখন দুটি মহকুমা ছিল। একটি মহকুমার নাম ছিল পিশিন। সেখানে একটি ফলের বাগানের মধ্যে অতি সুন্দর একটি রেস্টহাউস ছিল। সেই রেস্টহাউসের বাবুর্চি খুব ভালো রান্না করতে পারত। সেই রেস্টহাউসের বাগানের আপেল, আখরোট, বাদাম, আঙুর ইত্যাদি ফলও আমরা খেতে পারতাম। সুতরাং যখনই কোয়েটায় নয় দিন হয়ে যেত, তখনই আমরা পিশিন চলে যেতাম।

আরেকটি মহকুমা ছিল চমন। চমনের অতিথি ভবন ছিল আফগানিস্তান সীমান্তে। অতিথি ভবনের বারান্দা থেকে আমরা আফগানিস্তানের গাড়িঘোড়ার চলাচল দেখতে পেতাম। চমনে লান্ডিকোটালের মতো কিছু চোরাচালান করা পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হতো। আমরা কয়েকবার চমনে গিয়েছি। আমাদের আগের। ব্যাচের কর্মকর্তারা লাহোর থেকে পাসপোর্ট করে এনেছিলেন। এ পাসপোর্ট ব্যবহার করে তাঁরা চমন থেকে কাবুলে গিয়েছিলেন। আমরা যেহেতু পাসপোর্ট করে আনিনি, সেহেতু আমাদের পক্ষে আফগানিস্তানে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

কোয়েটা থেকে আমরা জিয়ারত যাই। জিয়ারত একটি শৈলশহর। এই শহরে বেলুচিস্তানের এজিজির (Assistant to Government General) জন্য একটি সুন্দর বিশ্রামাগার ছিল। গ্রীষ্মকালে এজিজি এবং তাঁর অতিথিরা এ বাড়িতে এসে থাকতেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ১৯৪৮ সালে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তিনি বিশ্রাম করার জন্য জিয়ারত এসেছিলেন। এখানে তার মৃত্যুর লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর তাঁকে বিমানে করে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জিয়ারতে অনেক ধনী ব্যক্তি বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। জামালি পরিবারের পরিচিত এক ধনীর বাংলোয় আমরা তিন। রাত ছিলাম। জিয়ারতের আশপাশে বিভিন্ন অঞ্চল আমরা ঘুরে দেখেছি।

কোয়েটায় থাকাকালে আমরা ফোর্ট স্যান্ডেম্যান (Fort Sandeman) বেড়াতে যাই। অনেক উঁচুতে অবস্থিত এই শহরে গ্রীষ্মকালে পর্যটকেরা বেড়াতে যেতেন। ফোর্ট স্যান্ডেম্যানে তখন এপিএ (Assistant Political Agent) ছিলেন লুফুল্লাহিল মজিদ। তাঁর অতিথি হিসেবে আমরা ফোর্ট স্যান্ডেম্যানে যাই। ব্রিটিশ শাসনামলে এই দুর্গে একটি বিরাট সেনানিবাস ছিল। যখন পাকিস্তান সৃষ্টি হয়, তখন সীমান্তের পাঠানদের সঙ্গে পাকিস্তান। সরকারের চুক্তি হয় যে তারা পাকিস্তান আক্রমণ করবে না। তাই এখান থেকে সেনানিবাস তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৬৮ সালে আমরা যখন ফোর্ট স্যান্ডেম্যানে যাই, তখন সেনানিবাসের মেস ভবনটি ছিল শূন্য। এই শূন্য ভবনে আমরা চারজন কয়েক দিন ছিলাম। মেস ভবনের উল্টো দিকে উঁচু পাহাড়ে দুটি বাড়ি ছিল। নিচের বাড়িটিতে থাকতেন এপিএ লুৎফুল্লাহিল মজিদ আর ওপরের বাড়িটিতে থাকতেন পলিটিক্যাল এজেন্ট। পলিটিক্যাল এজেন্ট আমাদের একদিন ডিনারে ডেকেছিলেন। লুফুল্লাহিল মজিদও আমাদের ডিনার দিয়েছিলেন। এ ছাড়া আমাদের তিনি পাঠানদের একটি বসতিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে সবাই মিলে মাটিতে বসে মধ্যাহ্নভোজন করি।

যাহোক, আমাদের কোয়েটা সফর শেষ হলে আমরা লাহোর ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। এই সময় জামালিরা আমাদের নিমন্ত্রণ করে তাদের বাড়ি হয়ে লাহোর ফিরে যাওয়ার জন্য। জামালিদের বাড়ি ছিল জেকোবাবাদ জেলার নাসিরাবাদ মহকুমায়। আমরা কোয়েটা থেকে সিবি হয়ে জেকোবাবাদ পৌঁছাই। সে সময়ে জেকোবাবাদে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ছিলেন সৈয়দ মুহিবুল্লাহ শাহ। সার্কিট হাউসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার পর আমরা নাসিরাবাদ মহকুমায় যাই। নাসিরাবাদ মহকুমাকে তখন ঝটপট বলা হতো। ঝটপটে একটি গ্রামে জামালিরা থাকতেন। ওই অঞ্চলে সিন্ধু নদীর পানি একটি খালের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হয়। সুতরাং সেখানে কৃষিতে সেচের ব্যবস্থা ছিল। তাই এ অঞ্চলে ভালো ধান এবং গম ফলত। জামালিরা আমাদের জন্য একদিন মধ্যহ্নভোজনের ব্যবস্থা করে। সেই ভোজনে আস্ত দুম্বার রোস্ট করা হয়েছিল। এই অঞ্চলের কৃষকেরা সামন্ত প্রভুদের হাতে বন্দী ছিলেন। আমরা গ্রাম দেখতে বেরিয়ে ছিলাম। গ্রামের কৃষকদের আর্থিক অবস্থা ছিল দুর্বল। শিক্ষার হার ছিল খুবই নিচু। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের অবস্থান ছিল অত্যন্ত দুর্বল। ঝটপট থেকে গাড়িতে করে আমাদের সাক্কার নিয়ে যাওয়া হয়। সাক্কার থেকে ট্রেনে করে আমরা আবার লাহোর ফিরে যাই। ১৯৯০-এর দশকে ঝটপট অঞ্চলে অনেক পরিবর্তন। এসেছে। এখন নাসিরাবাদ বা ঝটপট মহকুমা আর নেই। সেখানে জামালি গোত্রের জাফর আহমদ জামালির নামে জাফরাবাদ জেলা স্থাপন করা হয়েছে।

সফর শেষে একাডেমিতে ফিরে আসার পর আমাদের ফাইনাল পাসিং আউট পরীক্ষা শুরু হয়। সব পরীক্ষা শেষে আমাদের একটি ডিনার হয় এবং একটি গ্রুপ ছবি তোলা হয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নেওয়া পরীক্ষা ছাড়াও সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে পরিচালকের জন্য ১০০ নম্বর রাখা হয়েছিল। আমাদের ব্যাচে ২০ জন প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে ১৯ জনের সর্বনিম্ন নম্বর ছিল ৬০ (ওয়ালিউল ইসলাম ও সৈয়দ রেজাউল হায়াত) এবং সর্বোচ্চ নম্বর ছিল ৯২ (পেয়েছিল শাহেদ সাদুল্লাহ)। শুধু একজন পেয়েছিল মাত্র ৪৮ নম্বর, তার নাম মামুনুর রশীদ। এই নম্বর নির্ধারণে পরিচালক উপপরিচালকদের অভিমত নিতেন। এ ছাড়া একাডেমির অনানুষ্ঠানিক গোয়েন্দাদের পরামর্শও নিতেন। মেস বেয়ারাররা ছিল এই গোয়েন্দা। প্রতি প্রশিক্ষণার্থী একাডেমিতে কী করে এবং তার চারিত্রিক প্রবণতাগুলো কী, সে সম্পর্কে তথ্য মেস বেয়ারাররা সংগ্রহ করত। পরিচালক নম্বর দেওয়া ছাড়াও প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থী সম্পর্কে একটি রেখাচিত্র (Pen Picture) লিখতেন। এই রেখাচিত্রে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর সবলতা এবং দুর্বলতাসমূহ লেখা হতো। আমার সম্পর্কে পরিচালকের সুপারিশ আমি দেখেছি। তিনি লিখেছিলেন এই প্রশিক্ষণার্থী একজন ভালো ছাত্র ছিল, ভালো বিতর্ক করত। তারপর দুর্বলতা সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে লিখেছেন, এই কর্মকর্তা ধর্ম এবং বিংশ শতাব্দীর বাস্তবতার মধ্যে সমন্বয় খুঁজে পাচ্ছেন না। ইসলাম সম্পর্কে আরও পড়াশোনা করলে হয়তো তিনি সেটা পেতে পারেন। সবশেষে তিনি সুপারিশে লিখেছেন, এই কর্মকর্তা সৎ, তাঁর সতোর মধ্যে কোনো খাদ নেই। এ ধরনের কর্মকর্তা বিচার বিভাগের জন্য বেশি উপযোগী। এই মন্তব্য দিয়ে তিনি আমাকে বিচার বিভাগে পাঠাতে চেয়েছিলেন। যদি পাকিস্তান টিকে থাকত এবং আমি সিভিল সার্ভিসে টিকে থাকতাম, তাহলে তাঁর এই মন্তব্য

আমার জন্য অভিশাপ হিসেবে বিবেচিত হতো। পাকিস্তান টেকেনি, নির্বাহী। কর্মকর্তাদের বিচার বিভাগের বদলির ব্যবস্থা উঠে গেছে। তাই তাঁর সুপারিশ কোনো কাজে লাগেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *