৪. নবীনগরের প্রেক্ষাপট

চতুর্থ অধ্যায়

নবীনগরের প্রেক্ষাপট

নবীনগর নামের উৎপত্তি এবং তাৎপর্য সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। এক ঘরানার ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, নবীনগর শব্দটি নবীন গড়–এ দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। গড় শব্দের অর্থ হলো কেল্লা অথবা দুর্গ। নবীনগরে এ ধরনের কোনো কেল্লা বা দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় না। নবীন নামের কোনো রাজপুত্র বা জমিদারেরও খোঁজখবর পাওয়া যায় না। সুতরাং নবীন গড় থেকে নবীনগরের উৎপত্তি–এ ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না।

দ্বিতীয় ঘরানার ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, নবীনগরের নাম মুসলমানদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্মরণে রাখা হয়েছে। নবীনগর থানায় ১৮৮২ সালে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৭৫ হাজার ৭২২ জন। হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার ৩৯৪ জন। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৭১.৪ শতাংশ ব্যক্তি ছিলেন মুসলমান। আর মাত্র ২৮.৬ শতাংশ ব্যক্তি ছিলেন হিন্দু। এই অঞ্চলে মুসলমান প্রাধান্য ছিল। নবীনগর থানার গ্রামের নামসমূহ বিশ্লেষণ করলে তিন ধরনের গ্রামের নাম দেখা যায়। প্রথমত, হিন্দুধর্মীয় নায়কদের নামে ছিল অনেক গ্রাম। যেমন : গোপালপুর, শ্রীরামপুর, শ্যামগ্রাম, ভোলাচং ইত্যাদি। আবার অনেক গ্রাম ছিল মুসলমানদের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের নামে। যেমন : নবীনগর, আলমনগর, আলিয়াবাদ, ইব্রাহিমপুর, রসুল্লাবাদ ইত্যাদি। আর কিছু গ্রামের নাম ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের ওপর করা হয়েছে। যেমন : কণিকাড়া, বগডহর ইত্যাদি। সুতরাং নবীনগর নাম নবীর নামে করা হয়েছিল, এই অনুমানই স্বাভাবিক।

তবে ১৮৭২ সালে নবীনগর শহর কিংবা থানার নাম সরকারি কাগজপত্রে পাওয়া যায় না। ১৮৭২ সালের আদমশুমারিতে নবীনগর থানার নাম লেখা হয়েছে গৌরীপুরা। এটি অবশ্যই একটি হিন্দু নাম এবং এই নামে শুধু থানা বা শহর পরিচিত ছিল না, এই নামে একটি দেওয়ানি আদালতও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৮৮০ থেকে ১৮৯০ সালের মধ্যে গৌরীপুরার নাম নবীনগরে পরিবর্তিত হয়। থানার নাম, শহরের নাম এবং দেওয়ানি আদালতের নাম নবীনগর হয়ে যায়। সম্ভবত এই অঞ্চলে মুসলমানদের প্রাধান্য লক্ষ করে। ব্রিটিশ শাসকেরা এই নাম পরিবর্তন করেন।

১৮৯৪ সালে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পিতা জগদ্বন্ধু দত্ত কসবার আদালত থেকে নবীনগর আদালতে সেরেস্তাদার হিসেবে বদলি হলে তিনি পিতার সঙ্গে পড়াশোনার জন্য নবীনগরে আসেন। ১৮৯৪ সাল থেকে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছর একনাগাড়ে তিনি নবীনগরে ছিলেন। ১৮৯৪ সালে নবীনগরের বর্ণনা দিয়ে তিনি লিখেছেন, নবীনগর ক্ষুদ্র বুড়ি নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত। নবীনগর স্কুলের দালানের পূর্ব দিকে নদী, তার পূর্ব দিকে শস্যভরা মাঠ, বর্ষায় সেই মাঠ জলমগ্ন হইয়া যাইত। বর্ষাকালে চতুর্দিকের মাঠ জলমগ্ন হইলে ছোট বড় সব রকমের নৌকা পাল তুলিয়া যাতায়াত করিত। এই দৃশ্য আজও আমার মনে আঁকা আছে। পূর্ববঙ্গে পল্লীগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতি মনোহর ছিল, এই সৌন্দর্যের মধ্যে। আমি বর্ধিত হইয়াছি।

ধীরেন দত্তের মতে, নবীনগর গ্রাম বুড়ি নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত। বর্তমানে নবীনগরের জনসাধারণ এই বুড়ি নদীকে তিতাস নদ বলে থাকে। আসলে তিতাস নদ বুড়ি নদী থেকে স্বতন্ত্র। বুড়ি নদী গোমতি নদীর একটি শাখানদী এবং এই নদীটি কণিকাড়ার মধ্য দিয়ে নবীনগরের পাশ দিয়ে নবীনগরসংলগ্ন মনতলা গ্রামের উত্তর দিকে প্রবাহিত তিতাস নদে পড়েছে। তিতাস নদ সরাইল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিক থেকে মনতলার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিত্রী নামক গ্রামের পাশে মেঘনা নদীতে পড়েছে। এখন বুড়ি নদী মৃত। এই নদী দিয়ে বন্যার সময়ে যে স্বচ্ছ জলরাশি নবীনগরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো, এখন আর তা হয় না। পলি পড়ে এই নদী প্রায়ই বন্ধ হয়ে যায়। ড্রেজার দিয়ে খনন করে কোনো রকমে এখনো লঞ্চ চলাচল করে।

জলাভূমিতে অবস্থিত নবীনগরের জমি খুবই উর্বর ছিল। এখানে বেশির ভাগ অঞ্চলে ধান এবং পাট প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হতো। তবে বন্যার সময়ে অনেক অঞ্চলের ফসল একেবারেই তলিয়ে যেত। ধীরেন দত্ত লিখেছেন, ‘ত্রিপুরা জেলায়, বিশেষ করিয়া নবীনগরে, খাদ্যদ্রব্যের দাম অত্যন্ত সস্তা ছিল। দুধের সের তত্ত্বালে ২/৩ পয়সা, ৪ পয়সার মাছ কিনিলে দশজনের একটি পরিবারের পক্ষে তাহা প্রচুর ছিল। বহু পরিবার অনশনে অর্ধাশনে দিন কাটাইত। ধীরেন দত্তের লেখা পড়ে মনে হয় তখন সমাজে ধনবৈষম্য ছিল প্রকট। যাদের অবস্থা সচ্ছল ছিল, তারা অতি সস্তায় ভালো খাবার খেতে পারত। কিন্তু যারা গরিব ছিল (যাদের মধ্যে বহু পরিবার অন্তর্ভুক্ত) অনশনে-অর্ধাশনে দিন কাটাত। ১৯৩০-এর দিকে নবীনগরের স্মৃতিচারণা করেছেন শামসুন নাহার খান। তিনি লিখেছেন :

নদী তীরের স্থানগুলি যেমন ধীরে ধীরে সমৃদ্ধি লাভ করে, কোন এক অতীতে তেমনি করে নিশ্চয়ই তিতাস নদীটির তীরেও ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল জনবহুল একটি লোকালয়-নবীনগর। নদীটি ছিল তখন উচ্ছল নব যৌবনা তরুণী। নদীভিত্তিক নবীনগরে তখন পাশের গ্রাম গ্রামান্তর হতে আমদানী হতো প্রচুর খাদ্য সম্ভার, গড়ে উঠলো হাট বাজার।

টাটকা মাছ, নির্ভেজাল দুধ, আর নির্ভেজাল ঘৃতের জন্য নবীনগরের তখন যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। দূর দূরান্ত হতে সাহেব বাবুগণ বেড়াতে এসেছেন প্রাণ ভরে মাছ দুধ খাবার লোভে। আর এখন সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিতাস গেছে বুড়িয়ে, মাছ গেছে পালিয়ে, অমৃতসম ঘৃতও গেছে ফুরিয়ে। জনসংখ্যার দিক দিয়ে নিরঙ্কুশ মুসলিমপ্রাধান্য সত্ত্বেও নবীনগরে সমাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন শিক্ষিত হিন্দুরা। এ সম্পর্কে শামসুন নাহার খান। লিখেছেন :

তখন আমাদের সময়ে নবীনগরের সমস্ত প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন শিক্ষিত হিন্দুগণ। মুসলমান সমাজে শিক্ষার প্রচলন ছিল তখন খুব কম। গ্রামের অধিকাংশ মুসলমান ছিল চাষী, মুটে, মজুর। তারা হিন্দু জমিদার বাড়ীতে খেটে খাওয়া মাঝি, মাল্লা, দারোয়ান।

হিন্দু মহাজনগণ তখন ব্যবসায় বাণিজ্য করে হয়েছেন লক্ষপতি। আর মুসলমান অশিক্ষিত চাষী ভাইয়েরা হিন্দু মহাজনদের কাছ হতে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে পরিশোধে অপরাগ হয়ে ঋণের দায়ে ভিটে মাটি হারিয়ে হয়েছে পথের ভিখারী। এমনি করে তখন মুসলমান সমাজের একটি বিরাট অংশ হিন্দু মহাজনদের উৎপীড়নে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছিল।

বর্ণ হিন্দুরা শুধু মুসলমানদেরকেই অস্পৃশ্য মনে করতেন না, হিন্দু সমাজের যারা খেটে খাওয়া মানুষ, তাদেরকেও অস্পৃশ্য গণ্য করত। এ প্রসঙ্গে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন :

হিন্দু সমাজের যাহারা কায়িক পরিশ্রম করিত তাহারাই ছিল অস্পৃশ্য। সমাজের যাহারা সম্পদস্রষ্টা তাহারাই ছিল অবহেলিত। হিন্দু সমাজের ভিতর মৎস্যজীবীদের (কৈবর্ত শ্ৰেণী), যাহারা সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদস্রষ্টা বলা যাইতে পারে। কিন্তু আমি ছোটবেলায় দেখিয়াছি, সেইসব লোককে আমরা ‘গাবর’ এই অবহেলাসূচক ভাষায় আখ্যা দিয়াছি। সেই সময়ে আরও লক্ষ্য করিয়াছি, সাহা সমাজের ভিতর যাহারা কায়িক পরিশ্রম করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিয়াছে, অর্থাৎ যাহারা সামান্য পণ্যদ্রব্য গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে নিয়া গ্রামবাসীর নিকট বিক্রয় করিত, তাহারা ছিল সেই সমাজের ‘গাওয়াল’। তাহাদিগকে আমরা সর্বদা অবহেলার চক্ষে দেখিয়াছি। সমাজের ভিতর এক শ্রেণীর লোক ছিল জল-অনাচরণীয়, যাহারা জল স্পর্শ করিলে জল অশুদ্ধ হইয়া যাইত। আর এক শ্রেণীর লোক ছিল যাহারা জল-অনাচরণীয় নহে। চাষ ছিল যাহাদের ব্যবসা, অর্থাৎ যাহারা ছিল সম্পদস্রষ্টা, তাহাদিগকে আমরা ঘৃণা করিয়াছি। সমাজের উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ বিবাহে শূদ্র শ্রেণীর এক সম্প্রদায় ‘পাটে ধরার’ কাজ করিত অর্থাৎ বর এবং কনেকে প্রশস্ত পিড়িতে বসাইয়া সাতবার প্রদক্ষিণ করাইত। ইহা ঘৃণ্য কাজ বলিয়া ধারণা ছিল। সেই শূদ্র সমাজের লোক আমাদের গ্রামের এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে এই কাজ করিবে না বলিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আমি লক্ষ্য করিয়াছি, সমাজের উচ্চস্তরে যাহারা তাহাদের এই কার্যের জন্য শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর হন। এই শূদ্রদের অনেকেই এই কার্যের জন্যে জাকর (Service tenure) জমি অর্থাৎ বিনা খাজনায় জমি দখল করিত। সমাজের উচ্চস্তরের লোকেরা এই জমি হইতে তাহাদিগকে উচ্ছেদ করিয়া দেন।[৫]

নবীনগরের সমাজ উনবিংশ শতাব্দী থেকে প্রতিপত্তিশালী জমিদারদের প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো। জমিদারেরা সমাজে দুই ধরনের কুপ্রথা প্রবর্তন করেন। এ প্রসঙ্গে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন :

তাহারা তাহাদের যে কোন উৎসবে ঢাকা হইতে বাঈজি আনিয়া নাচের জলসা করিত, আর তাহার সহিত সব রকম মাদকদ্রব্যের যথেচ্ছ ব্যবহার হইত। তাহাতে সমাজের নৈতিক অধঃপতনের দৃশ্য দেখিতে পাইয়াছি।[৬]

দ্বিতীয় কুপ্রথা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন :

হিন্দু সমাজজীবনে বহু কুপ্রথা বিদ্যমান ছিল। ঘাটুর (Dancing boy) প্রচলন ছিল। অশিক্ষিত হিন্দু-মুসলমান উভয়েই এই কুপ্রথার সমর্থক ছিল। বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল। তবু সমাজ সত্যের মর্যাদা দিত, সে মর্যাদা আজ সম্পূর্ণ তিরোহিত হইয়াছে।[৭]

জমিদারেরা শুধু খারাপ রীতিই প্রবর্তন করেননি, তাঁরা যাত্রাগান এবং কবিগানের পৃষ্ঠপোষকতাও করেছেন। এ প্রসঙ্গে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন :

অপরপক্ষে নবীনগরে যাত্রাগান শুনিয়াছি। ‘প্রহ্লাদ-চরিত্র’, ‘ধ্রুব’ ও ‘প্রবীর-পতন’–যাত্রাগান শুনিয়া আমি মুগ্ধ হইয়াছিলাম। প্রহ্লাদের একনিষ্ঠা, সত্যের প্রতি মর্যাদা, নীতিরক্ষার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ পরবর্তীকালে আমার মহৎ উপকার করিয়াছে। এছাড়া কবিগানের প্রচলন ছিল, হরি আচার্যের কবির দল বিখ্যাত ছিল। তাহারা যদিও শিক্ষিত ছিল না, তাহারা ছিল স্বভাব-কবি কিন্তু দুঃখের বিষয় আজকাল এই কবিগানের প্রচলন কমিয়া আসিয়াছে।[৮]

নবীনগরে যাত্রা ও থিয়েটার দুটিই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পূজার সময়ে প্রতিবছর এখানকার পেশাদার ব্যক্তিরা থিয়েটার করতেন। সেই থিয়েটারে নবীনগরের দেওয়ানি আদালতে ব্যবসায়রত উকিলরা অংশ নিতেন। এ ছাড়া স্কুলের শিক্ষক এবং হিন্দু ভদ্রলোকেরাও অংশ নিতেন।

পরবর্তীকালে নবীনগরে পেশাদার থিয়েটার মঞ্চের আবির্ভাব ঘটে। এই পেশাদার থিয়েটার প্রবর্তনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল মদন মিয়ার। তিনি নবীনগর ইউনিয়ন কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন। তাঁর থিয়েটারের দল দীপালি নাট্যসংঘ নামে পরিচিত ছিল। এই নাট্যসংঘ সামাজিক এবং পৌরাণিক কাহিনি অভিনয় করত। পৌরাণিক কাহিনির অভিনয়ের জন্য মদন মিয়া অনেক অর্থ ব্যয়ে বেশ কিছু দৃশ্যপট তৈরি করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে হিন্দু ভদ্রলোকরা ভারতে অভিবাসন করেন। এতেও দীপালি নাট্যসংঘের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়নি। তাঁরা ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর নবীনগরে থিয়েটার করতেন এবং থিয়েটারের দল নিয়ে অন্যান্য উপজেলাতেও বিভিন্ন নাটক মঞ্চস্থ করতেন। মদন মিয়া ১৯৬৫ সালের দিকে মারা যান। তিনি মারা যাওয়ার পরে ড. আমজাদ হোসেন দীপালি নাট্যসংঘের নাটক পরিচালনা করতেন এবং ১৯৭০-এর দশকেও এই নাট্যসংঘের কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে নবীনগরে বেশ কয়েকজন অসাধারণ সংগীতজ্ঞ জন্মগ্রহণ করেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খা। তিনি নবীনগর থানার শিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আলাউদ্দিন খাঁর বংশের লোকেরা বিশ্বাস করেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সমর্থক সিরাজউদ্দিন খাঁ নামে একজন সেনাপতি শিবপুর গ্রামে নয়নিকা নামে একজন স্থানীয় কন্যাকে বিয়ে করেন এবং জমিজিরাত কিনে শিবপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। সেনাপতি সিরাজউদ্দিন খাঁর ছেলে সবদর হোসেন খাঁ কৃষিকাজের চেয়ে সংগীতে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি সেতার বাজাতেন। তাঁর তিন ছেলে ছিল। আফতাব উদ্দিন খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ ও আয়েত আলী খাঁ। আলাউদ্দিন খাঁর প্রথম ওস্তাদ ছিলেন তাঁর ভাই ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ। আফতাব উদ্দিন খাঁ একজন অসাধারণ প্রতিভাবান সংগীতজ্ঞ ছিলেন। তিনি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে পাখিদের ডেকে আনতে পারতেন। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে সংগীতশিক্ষা লাভ করার পর ১০ বছর বয়সে আলাউদ্দিন খাঁ পালিয়ে গিয়ে একটি যাত্রাদলে গান শেখেন। সেখানে ড. কেদারনাথ নামে একজন চিকিৎসক তাঁর সংগীতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যান এবং সেখানে নুলো গোপাল নামে একজন সংগীতজ্ঞের কাছে আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতশিক্ষা শুরু করেন। নুলো গোপাল প্লেগে মারা গেলে তিনি কলকাতায় সানাই, নাকোয়ারা, তিকোয়ারা, জগঝম্পা, পাখোয়াজ, মৃদঙ্গ, তবলা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখেন। তিনি ওস্তাদ আহম্মদ আলী খাঁর কাছে পাঁচ বছর সরোদশিক্ষা লাভ করেন। এরপর তিনি উত্তর ভারতের রামপুর রাজ্যে তানসেন ঘরানার ওস্তাদ ওয়াজি খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। রামপুরের নবাবের সুপারিশে তাঁকে মধ্যপ্রদেশের মাইহার রাজ্যের মহারাজ ব্রিজনাথের দরবারে সংগীতজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই মাইহার থেকেই তাঁর প্রতিভার সুখ্যাতি ভারত এবং পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। তার শিষ্যদের মধ্যে ওস্তাদ আলী আকবর খা, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, খাদেম হোসেন খান, ওস্তাদ মীর কাশেম খান, রওশন আরা বেগম, অন্নপূর্ণা দেবী, ওস্তাদ ফুলঝুরি খান, ওস্তাদ খুরশিদ খান, ওস্তাদ আশীষ খান, ওস্তাদ ধ্যানেশ খান, পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্য, পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জী, পান্নালাল ঘোষ, ইন্দ্রনীল ভট্টচার্য এবং সরণ রানী উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া আলাউদ্দিন আলী খাঁর ভাই ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ এবং তার দুই ভ্রাতুস্পুত্র ওস্তাদ আবেদ হোসেন খাঁ ও ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খাও সংগীতজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।

নবীনগরে দ্বিতীয় সংগীত ঘরানার প্রবর্তক ছিলেন মনমোহন দত্ত। ১২৮৪ বঙ্গাব্দে তিনি নবীনগর থানার সাতমোরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মনমোহন গ্রাম্য স্কুল এবং ছাত্র বৃত্তি স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। তাঁর স্বহস্তে লেখা নীলা রহস্য নামক বই থেকে দেখা যায়, তিনি ইংরেজি ভাষার সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর রচিত গান মলয় সংগীত নামে পরিচিত। মলয় শব্দের অর্থ হলো উদ্যান, বাগান বা দখিনা বাতাস। যে গানের সুর মানুষের মনে দখিনা বাতাসের আমেজ এনে দেয়, সে গানই হলো মলয় সংগীত। তিনি ছিলেন লোককবি লালন ফকিরের ভাবশিষ্য। তাই পৃথিবীর সকল ধর্মেই ঈশ্বরের সন্ধান করেছেন। একটি গানে এই বক্তব্যকে তিনি সুন্দর করে লিখেছেন :

হরি তোমায় জানতে গিয়ে, পড়েছি এক বিষম গোলে।
আসল কথার ঠিক পাইনা তার, শুনি কেবল যে যা বলে।
পুরাণে কয় এরুপ সেরুপ, কে জানে তার কিবা কোন্ রুপ,
বেদান্তে কয় অরুপ স্বরুপ, ঘটে পটে সর্বস্থলে।
বাইবেলে কয় ঈশার পিতা, আর যত হয় সবই মিথ্যা,
ঠিক পাইনা তার কোন কথা, কোন্ কথা রয়েছে মূলে।
কোরাণে কয় ঠিক দূরস্ত, বটে মহম্মদের দোস্ত।
হয়ে গেল অমন হেস্তনেস্ত, পড়ে মস্ত কথার ভুলে।
গৌরাঙ্গে কয় কৃষ্ণরাধা, বৌদ্ধ বুদ্ধের কথা,
নাস্তিকে কয় ঈশ্বর মিথ্যা আপনি জগৎ চলে।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর প্রথম সংগীতগুরু ও বড় ভাই আফতাব উদ্দিন ছিলেন মনমোহন দত্তের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মনমোহন দত্ত গান লিখতেন আর আফতাব উদ্দিন সেসব গানে সুর দিতেন। এইভাবে নবীনগর থানায় ওস্তাদি গান এবং লোকজ গানের সুন্দর সংমিশ্রণ গড়ে ওঠে।

তবে সবাই লোকজ গানে বিশ্বাস করত না। মুসলমানদের মধ্যে অনেকে গানবাজনাকে হারাম মনে করত। তারা শরিয়ত অনুসারে জীবনযাপনের চেষ্টা করত। তবে মুসলমানদের মধ্যেও দলাদলি ছিল। কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা নিয়ে মৌলভিদের মধ্যে প্রায়ই দ্বন্দ্ব দেখা দিত। এর ফলে বড় বড় আলেম ওলামাদের মধ্যে বাহাস’ অনুষ্ঠিত হতো। সব সময় বাহাস’ শান্তিপূর্ণ হতো না, অনেক সময়ে সামান্য বিষয়ে (যথা : আরবি শব্দ দোয়াল্লিনের উচ্চারণ জোয়াল্লিন হবে কি না) ঝগড়াঝাটি এমনকি খুনোখুনির ঘটনা পর্যন্ত ঘটত। মুসলমানদের মধ্যে লোকজ গানের ভক্ত ছাড়াও আরেক ধরনের বিশ্বাসী ছিল, যারা গানবাজনার মাধ্যমে কোরআন শরিফের চর্চা করতেন। বীরগাঁও গ্রামে আবুল খয়ের রফিকুল ইসলামের পিতা একজন পীর ছিলেন। তিনি তাঁর শিষ্যদের দোতারা বাজিয়ে কীর্তন এবং ভাটিয়ালির সুরে কোরআন তেলওয়াত করতে উৎসাহিত করতেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে এলাকার সুন্নি আলেমরা তাঁর সঙ্গে বাহাসের ব্যবস্থা করেন। আলেমরা বলেন, আপনি তো জানেন ইসলাম ধর্মে গান গাওয়া হারাম। কীভাবে আপনি কোরআন শরিফের পবিত্র বাণী ভাটিয়ালি এবং কীর্তনের সুরে আপনার শাগরেদদের দিয়ে গাওয়ান। উত্তরে তিনি বলেন, ‘আপনাদের যারা শাগরেদ তারা লেখাপড়া জানে এবং তারা ভদ্রলোকের ছেলে। আমার যারা শাগরেদ তারা চাষাভুষা জেলের ঘরের সন্তান। আরবি জানা দূরে থাক, তারা বাংলাও জানে না। তাদেরকে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য তাই আমি গানের ব্যবস্থা করি। যদি এই ব্যবস্থাও না করতে দেন, তাহলে এরা কোনোমতেই মুসলমান হতে পারবে না। তাঁর এই যুক্তিতে সুন্নি মৌলভি সাহেবেরা তাঁকে মাফ করে দেন। নবীনগরে একসঙ্গে হিন্দু মৌলবাদ, ইসলামি মৌলবাদ এবং লোকধর্ম বিরাজ করেছে। এদের মধ্যে সম্প্রীতির ভাব ছিল না। বিশেষ করে যারা ধর্মান্ধ মুসলমান ছিলেন, তাঁদের শিষ্য নবীনগর থানার বাইরেও ছিল। এরা নবীনগর থানার বাইরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অংশ নিয়েছে। কিন্তু সব উত্তেজনা সত্ত্বেও নবীনগর থানায় কখনো বড় ধরনের দাঙ্গা ঘটেনি। সব সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করেছে।

নবীনগরের গর্ব ছিল নবীনগর উচ্চ ইংরেজি স্কুল। ১৮৯০-এর দিকে নবীনগরে একটি মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। স্কুলগৃহটি প্রথমে কাঁচা ঘর ছিল, তা আগুনে পুড়ে গেলে পাকা করে তৈরি করা হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, সম্ভবত ১৮৯৮ সালে এই মধ্য ইংরেজি স্কুলটিকে উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়। স্কুলের রেকর্ড থেকে দেখা যাচ্ছে যে ১৮৯৬ সালে নবীনগর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত জানাচ্ছেন, এই বিদ্যালয় স্থাপনে নবীনগরের তৎকালীন সাহা জমিদারগণ এবং উকিল মহোদয়গণ, বিশেষ করিয়া মরহুম আব্দু মিঞা সাহেব, সক্রিয় অংশগ্রহণ। করিয়াছিলেন। মরহুম আব্দু মিঞা সাহেব ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না, তবু ইংরাজি শিক্ষার বিস্তার হউক ইহাই তাহার প্রাণের আকাঙ্ক্ষা ছিল।১০

আব্দু মিয়ার আনুষ্ঠানিক নাম ছিল মুন্সি আব্দুস সোবহান। তাঁর পিতা ছিলেন মুরাদনগর অঞ্চলের ঢাকার নবাবের তালুকদার। তাঁর বাড়ি মুন্সি বাড়ি নামে এলাকায় খ্যাত ছিল। আব্দু মিয়ার যখন বয়স সাত বছর, তখন তার ছোট বোন। ও মাকে রেখে তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। আদু মিয়ার পক্ষে পৈতৃক বাসস্থান থেকে দূরে গিয়ে ইংরেজি শিক্ষা সম্ভব ছিল না। তাই তিনি বাংলা ভাষাতেই শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল মুরাদনগর থানার ধামঘর ইউনিয়নের ভুবনগড় গ্রামে। তিনি দেখতে পান যে মুরাদনগর ও নবীনগর থানার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা ব্রিটিশদের প্রচলিত আইন সম্পর্কে ভালো না জানার ফলে সংখ্যালঘু হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের হাতে অত্যাচারিত হচ্ছে।

উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ইংরেজি না জানলে উকিলদের পক্ষে মক্কেলদের অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। ১৮৩৫ সালে ইংরেজশাসিত ভারতবর্ষে ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়। এর আগে রাষ্ট্রভাষা ছিল ফারসি। সুতরাং তখন যারা ওকালতি করতেন, তাঁদের ফারসি ভাষা জানতে হতো। ফরাসি ভাষা থেকে ইংরেজি ভাষা রাষ্ট্রভাষা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি জানা যথেষ্ট উকিল। পাওয়া যেত না। তাই অনেক উকিলই ফারসি এবং বাংলায় আইন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে ওকালতি করতেন। বেশির ভাগ ফৌজদারি আদালতে প্রধান বিচারক থাকতেন একজন ইংরেজ আইসিএস অফিসার। তাদের পক্ষে বাংলায় সাক্ষ্য এবং সওয়াল জবাব বোঝা কষ্টকর ছিল। তাদেরকে বোঝানোর জন্য মোক্তাররা বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে এক অদ্ভুত ভাষায় আদালতের কাছে বক্তব্য পেশ করতেন। এ ধরনের বক্তব্য সম্পর্কে একটি ছড়া রয়েছে। ছড়াটি নিম্নরূপ :

আনসার আলী মনসুর আলী
বিগেন টু দ্য মারামারি আন্ডার দ্য বটগাছ
আনসার আলী মারল বাড়ি অন দ্য হেড অব মনসুর আলী
আনসার আলী ফাইট মনসুর আলী ডাইড।

আনসার আলী মনসুর আলীর ঝগড়াকে এ ধরনের ভাষায় আদালতে পেশ করা হতো। তবে দেওয়ানি আদালতে সব মুন্সেফই ছিলেন ভারতীয়। তাঁদের বেশির ভাগই বাংলা জানতেন। তাই বাংলা ভাষায় আইন শিক্ষা লাভ করে ওকালতি করা সম্ভব ছিল। আব্দু মিঞা বাংলা ভাষাতে যতটুকু সম্ভব আইনশিক্ষা লাভ করেন। তাঁর পৈতৃক আবাস ভুবনগড় থেকে স্থল ও জলপথে প্রায় সতেরো মাইল দূরে অবস্থিত নবীনগর আদালতে আইনের ব্যবসা শুরু করেন।

উকিল হিসেবে তিনি খুবই সফল হন। উপরন্তু তালুকদারির মুনাফার আয় নিয়ে তিনি একজন সচ্ছল মুসলমান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। তবে তিনি বুঝতে পারেন, ইংরেজি ভাষা না জানলে মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা করা সম্ভব হবে না। তাই তিনি মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারের জন্য নবীনগরে উচ্চ ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ ও জমি দান করেন এবং প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে স্কুলের ব্যবস্থাপনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ৩০ বছরের বেশি সময় ওই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার তিন কন্যা ও চার ছেলে ছিল। তার জ্যেষ্ঠ কন্যা আফিয়া খাতুনের সঙ্গে তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল হালিম চৌধুরীর বিয়ে হয় এবং তাঁদের সন্তানদের মধ্যে রয়েছেন। কবীর চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, নাদেরা বেগম প্রমুখ প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী। তার ছেলেরা ও বংশধরেরাও বেশির ভাগই কৃতবিদ্য ছিলেন। এঁদের মধ্যে বিশেষ করে তাঁর পৌত্র এ কে এম সাদেক সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। তাঁর এক প্রপৌত্র আবদুল্লাহ ইউসুফ হারুন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে কয়েকবার সদস্য নির্বাচিত হন।

১৮৯৮ সালে নবীনগর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন ভুবন মোহন সরকার। কিছুদিন এই স্কুলে কাজ করার পর তিনি নবীনগর থেকে চলে যান। এরপর নবীনগর স্কুলের প্রধান শিক্ষক হন প্যারি মোহন রায়। তাঁর বাড়ি ছিল সিলেট শহরে। বয়সে যুবক হলেও তিনি অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নবীনগর স্কুলটি গড়ে ওঠে। প্যারি মোহন রায়ের পর নবীনগর স্কুলের প্রধান শিক্ষক হন চারুচন্দ্র ঘোষ। তাঁর সম্পর্কে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, তাহার অনাড়ম্বর জীবন, অমায়িক, মধুর চরিত্র, কর্তব্যনিষ্ঠা, ত্যাগব্যঞ্জক চেহারা আজও ভক্তির সহিত স্মরণ করি। তাঁহার নিকট আমি অনেক নৈতিক শিক্ষা লাভ করিয়াছিলাম। তিনি একটি ‘হিতসাধনী সভা’ স্থাপন করিয়াছিলেন। তাহার আমি একজন সভ্য ছিলাম। আমি এই হিতসাধনীর সভ্য হিসাবে একটি শপথ গ্রহণ করি–’চিকিৎসক কর্তৃক উপদিষ্ট না হইলে কখনও কোনো মাদকদ্রব্য গ্রহণ করিব না।’ এই শপথ পরবর্তীকালে আমার মহৎ উপকারে আসিয়াছে।[১১]

চারুচন্দ্র ঘোষের প্রধান শিক্ষকতাকালে নবীনগর স্কুল থেকে পাস করে উপেন্দ্রকুমার রায় ১৯০৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি মেধাতালিকায় ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেন এবং ২০ টাকা বৃত্তি পেয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাঁর সহপাঠী শ্রী মধুকরচন্দ্র পাল ১০ টাকার বৃত্তি পান। ১৯০৪ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নবীনগর স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন। সেই বছর তার বিশিষ্ট বন্ধু তারাভূষণ পাল ১০ টাকা বৃত্তি পেয়ে পরীক্ষায় পাস করেছিলেন। ১৯০৪ সাল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীনগর স্কুলের ছাত্ররা প্রায়ই মেধাতালিকায় স্থান করে নিয়েছে। প্রায় ১০০ বছর ধরে প্রতিবছরই বোর্ডে মেধাতালিকায় স্থান না পেলেও প্রবেশিকা পরীক্ষায় কমপক্ষে দু-তিনজন ছাত্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হতো।

নবীনগরে কোনো শিল্প ছিল না। শুধু কিছু সরকারি অফিস ছিল। এর ফলে একে ছোট শহর হিসেবে গণ্য করা হতো। ১৯৫০-এর দশকে নবীনগরে একটি দেওয়ানি আদালত ছিল। নবীনগর ও বাঞ্ছারামপুরে ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলোকে তদারকি করার জন্য এখানে একটি সার্কেল অফিসারের অফিস ছিল। ছিল একটি থানা। স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের একটি অফিস ছিল। কুমিল্লা জেলা বোর্ড পরিচালিত একটি দাঁতব্য চিকিৎসালয় ছিল। এই দাঁতব্য চিকিৎসালয়ে একজন এলএমএফ পাস করা ডাক্তার পদস্থ করা হতো। এর বাইরে উপেন বাবু নামে একজন এমবিবিএস ডাক্তার নবীনগরে ছিলেন। নবীনগরে একটি পশুচিকিৎসালয় ছিল। ছিল একটি ডাকঘর। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা ইন্সপেক্টরের অফিস ও থানা কৃষি অফিস ছিল। নবীনগরে বালকদের জন্য উচ্চবিদ্যালয় ছাড়াও বালিকাদের জন্য মধ্যপর্যায়ের একটি বিদ্যালয় ছিল, যার নাম ইচ্ছাময়ী বালিকা বিদ্যালয়। এ ছাড়া একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। চারটি মসজিদ ছিল। হিন্দু-মুসলমানের সংখ্যা ছিল প্রায় সমান সমান। মুসলমানরা হিন্দু জমিদারদের ভয়ে নবীনগর গ্রামে কোরবানি উপলক্ষে গরু জবাই করতেন না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলমানরা আশপাশের গ্রামে গরু কোরবানি দিয়ে নবীনগরে মাংস নিয়ে আসত। গ্রামে রাস্তাঘাট খুবই কম ছিল। বাড়িঘর অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হতো কিন্তু কোনো উঁচু বেড়া দেখা যেত না। সর্বত্র খোলামেলা ছিল। নবীনগরে পঞ্চাশের দশকে বিনোদনের উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সাধারণের জন্য কোনো পাঠাগার ছিল না। শুধু অফিসারদের জন্য একটি ক্লাব ছিল। সেই ক্লাবে একটি রেডিও ছিল। এই রেডিও ব্যাটারি দিয়ে চালাতে হতো। ব্যাটারি লঞ্চ থেকে চার্জ করা হতো। ছোটবেলায় কখনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলে আমরা ক্লাবে রেডিওতে তার খবর শুনতে যেতাম। এই রেডিও ছাড়া নবীনগরে আর কোনো রেডিও ছিল না। ক্লাবে নিয়মিত কোনো খবরের কাগজ রাখা হতো না। নবীনগরে নিয়মিত চারটি দৈনিক আসত। একটি দৈনিক আমাদের বাসায় আসত, আরেকটি দৈনিক আসত স্কুলে। তৃতীয় গ্রাহক ছিলেন ডা. উপেন্দ্র বাবু, যিনি কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকা রাখতেন। চতুর্থ গ্রাহক ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার প্যারী বাবু। তিনি দৈনিক ইত্তেফাঁক রাখতেন। তার দোকানেই পত্রিকা পাঠকদের সবচেয়ে বড় ভিড় হতো। নবীনগরে কোনো বিদ্যুৎ ছিল না। সত্তরের দশকে এখানে প্রথম বিদ্যুৎ আসে। বাংলাদেশের জন্মের পরই নবীনগরের শান্ত জীবনে পরিবর্তন আসে।

পাদটীকা  

১. ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা, ১৯৯৫ ঢাকা : শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতিরক্ষা পরিষদ, পৃষ্ঠা-১৪

২. ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রাগুক্ত, ১৯৯৫। পৃষ্ঠা-১৬

৩. শামসুন নাহার খান, একটি নিমেষ, ১৯৮৫। (ঢাকা : আনোয়ার আলী খান), পৃষ্ঠা-৩৪

৪. শামসুন নাহার খান, প্রাগুক্ত, ১৯৮৫, পৃষ্ঠা-৩৫

৫. ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রাগুক্ত, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা-১৭-১৮

৬. ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রাগুক্ত, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা-১৫-১৬

৭. ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রাগুক্ত, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা-১৬

৮. ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রাগুক্ত, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা-১৬

৯. Mobarak Hossain Khan, Khan, (Ustad) Alauddin, 2003, Banglapedia, Vol. 6, PP-78-79

১০. ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রাগুক্ত, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা-১৫

১১. ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রাগুক্ত, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা-১৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *