৩. রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির কুশীলব

তৃতীয় অধ্যায়

রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির কুশীলব

ঊনবিংশ শতাব্দীতে রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ি তাদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য এলাকায় সুপরিচিত ছিল। তাদের তালুকদারি ছিল, চাষের অনেক জমি ছিল এবং একসময় সুদের ব্যবসা করে তারা প্রচুর অর্থ কামাই করেছিল। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির পরিচিতি আরও ব্যাপক হয়। এই পরিচিতি শুধু অর্থের ওপরে নির্ভরশীল ছিল না, রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির পরিচয় তিনভাবে গড়ে ওঠে। প্রথমত, রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির কোনো কোনো সদস্য রাজনীতিতে যোগ দেন। তাঁদের অনেকেই ত্রিপুরা জেলায় রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত হন। দ্বিতীয়ত, রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির অনেক সদস্য তাঁদের পেশাগত স্বীকৃতি লাভ করেন। এঁদের কেউ উকিল ছিলেন, কেউ ডাক্তার ছিলেন, কেউ অধ্যাপক ছিলেন, আবার কেউবা ব্যাংকার ছিলেন। তৃতীয়ত, রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির সদস্যরা সরকারি চাকরিতে সাফল্যের জন্য পরিচিতি লাভ করেন। তাঁদের অনেকেই সরকারের উচ্চ পদে কাজ করেছেন। কাজেই রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির সত্যিকারের অবদান বুঝতে হলে এঁদের মধ্যে যারা বিখ্যাত ছিলেন, তাঁদের জীবনকথা বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। এঁদের মধ্যে কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনী নিচে তুলে ধরা হলো।[১]

বহিরঙ্গন

ফজলে আলী খাঁ: (জন্ম : ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দ, ১২৯৩ বঙ্গাব্দ; মৃত্যু : ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দ, ২৯ জানুয়ারি, ১৩৪৩ বঙ্গাব্দ ১৫ মাঘ)। পিতা : ছাদত আলী খাঁ। ফজলে আলী খাঁ ১২৯৩ বঙ্গাব্দে (আনুমানিক ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দ) ৯ ফাল্গুন তারিখে রসুল্লাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আনুমানিক ১৮৯৫-৯৬ সালে ঢাকা সরকারি মাদ্রাসায় অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। তিনি ১৯০৮ সালের দিকে এফএ পাস করেন। এরপর তিনি সরকারের আবগারি বিভাগে পরিদর্শক পদে যোগ দেন। ১৯১৭ সালের ২৭ আশ্বিন তারিখে তিনি শামসুন নাহারকে বিয়ে করেন। শামসুন নাহারের পিতা কাজী আহমদ আলী ছিলেন অবিভক্ত বাংলার একজন উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরে। তিনি বিক্রমপুরের প্রথম মুসলমান গ্র্যাজুয়েট ছিলেন এবং বিএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। তিনি বাংলা প্রদেশে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে যোগ দেন।

বিয়ের এক বছর পর ১৯১৮ সালে ফজলে আলী খাঁ সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কারণ ছিল দুটি। প্রথমত, এই চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ ছিল সীমিত। দ্বিতীয়ত, তার শ্বশুর এবং তাঁর পিতা উভয়েই চেয়েছিলেন তিনি যেন সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনভাবে ওকালতি করেন। তাই বিয়ের এক বছর পর ১৯১৮ সালে ফজলে আলী খাঁ সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন এবং কলকাতা আইন কলেজে ভর্তি হন। ১৯২১ সালে তিনি আইন পরীক্ষায় পাস করেন এবং স্বাধীনভাবে ওকালতি ব্যবসা করার যোগ্যতা অর্জন করেন। তবে যেহেতু তিনি বিএ পাস করেননি, সেহেতু তিনি বিএল ডিগ্রি পাননি। সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএল নামে একটি ডিপ্লোমার ব্যবস্থা ছিল। এই ডিপ্লোমা পাস করলে আদালতে ওকালতি করা যেত।

ওকালতি পাস করার পর তাঁর পিতা তার বড় ছেলেকে নবীনগরে ওকালতি করার জন্য ডেকে পাঠালেন। নবীনগর আদালতে খাঁ বাড়ির অনেক মামলা-মোকদ্দমা ছিল। মোকদ্দমার জন্য ফি দিয়ে উকিল রাখতে হতো। তাই সাদত আলী খাঁ তার বড় ছেলেকে খাঁ বাড়ির মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনার দায়িত্ব দেন।

ফজলে আলী খাঁ নবীনগর মুন্সেফ কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন। নবীনগরে ওকালতি করতে করতে তিনি সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। নবীনগর শহর হিন্দুপ্রধান ছিল। মুসলমানদের কোনো নেতা ছিল না। ফজলে আলী খাঁ নবীনগর আসার আগে মুসলমানদের নেতা ছিলেন মুরাদনগর থানার আবদু মিঞা সাহেব। আবদু মিঞা ইংরেজি জানতেন না কিন্তু এলাকায় ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি অনেক কাজ করেন। নবীনগর আদালতে দীর্ঘদিন প্র্যাকটিস করার পর ১৯২০ সালের দিকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ফলে এলাকায় আর কোনো মুসলমান আইনজীবী ছিল না। ফজলে আলী খাঁ নবীনগর আদালতে একমাত্র মুসলমান আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। আবদু মিঞা যখন অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন তিনি তার নবীনগরের বাসস্থান তার ভাগনে কালঘড়া গ্রামের ফজলে আলীকে দান করেন। ফজলে আলী খাঁর ভগ্নিপতি ছিলেন কালঘড়ার ফজলে আলী। তিনি তাঁর ভগ্নিপতির কাছ থেকে ওই বাড়ি ভাড়া নেন।

আবদু মিঞার স্থলে নবীনগরে প্রধান মুসলমান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন ফজলে আলী খাঁ। তাঁর স্ত্রী তাঁর সম্বন্ধে লিখেছেন :

আমার স্বামী ফজলে আলী খাঁন বাস্তবধর্মী কর্মী পুরুষ ছিলেন। লোকজন সভা সমিতি মোল্লা মৌলভী দেশের দশের সুখে দুঃখে হিতকর কর্মে সর্বদাই ব্রতী থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি সেখানে জেলা বোর্ডের মেম্বার ছিলেন এবং লোকাল বোর্ড ও ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন।[২]

তিনি লোকাল বোর্ড ও ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি রসুল্লাবাদ গ্রামে একটি নিম্নমাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এ স্কুলটি উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হলে তাঁর চাচা ওলফত আলী খাঁর নাম অনুসারে এর নামকরণ করা হয়। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৯ জানুয়ারি ৪৯ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন। তার এই আকস্মিক মৃত্যুর ফলে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে যেসব প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তার সমসাময়িক নবীনগর থানায় আরেকজন মুসলমান নেতা ছিলেন রতনপুর গ্রামের কে জি ফারুকি। কে জি ফারুকি ও ফজলে আলী খাঁ একই সঙ্গে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে কে জি ফারুকি মন্ত্রী হয়েছিলেন এবং ব্রিটিশ সরকার তাঁকে স্যার উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। দীর্ঘ জীবন পেলে হয়তো ফজলে আলী খাঁ-ও কে জি ফারুকির মতো সফল রাজনীতিবিদ হতে পারতেন। ফজলে আলী খাঁর মৃত্যুর পর তার গ্রামের লোক তার বাড়ির পাশের দীর্ঘ রাস্তাটির নামকরণ করেছিলেন ফজলে আলী খাঁ রোড।

আমীর আলী খাঁ: (জন্ম : ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দ, ১৩০০ বঙ্গাব্দ; মৃত্যু : ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ, ১৩৮৪ বঙ্গাব্দ ৯ আশ্বিন)। পিতা : ছাদত আলী খাঁ। তিনি আমার পিতা। ছাদত আলী খাঁর দ্বিতীয় পুত্রের নাম ছিল আমীর আলী খাঁ। তাঁর ডাকনাম ছিল কান্দু মিয়া। ছোটবেলায় অনেক কান্নাকাটি করতেন বলে মুরব্বিরা তাঁকে কান্দু মিয়া বলে ডাকতেন। তার ইংরেজি শিক্ষা শুরু হয় ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসার অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগে। সেখানে তিনি একাধারে পাঁচটি ভাষা শেখেন : বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, আরবি ও ফারসি। ১৯১৬ সালের দিকে তিনি প্রথম বিভাগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। তারপর তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং এফএ পরীক্ষাতেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। বিএ পরীক্ষায় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ইংরেজি ভাষায় তিনি বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তিনি তাঁর সমসাময়িকদের ইংরেজি পড়াতেন। হাবিবুল্লাহ খান জানাচ্ছেন তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য বিলাত যাওয়ার আগে তাঁর পিতা আবদুস শাকুর খাঁ তাকে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের কাছে আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য নিয়ে যান। হাবিবুল্লাহ খান রসুল্লাবাদ খ বাড়ির সন্তান পরিচয় পাওয়ার পর নুরুল আমিন আমীর আলী খাঁর কুশলাদি সম্পর্কে প্রশ্ন করেন এবং মন্তব্য করেন যে নুরুল আমিনসহ তার সমসাময়িকেরা আমীর আলী খাঁর কাছ থেকে ইংরেজি শিখেছেন।

তিনি ১৯২০ সালে বিএ পাস করেন। সে বছরই ১ জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে ইংরেজিতে এমএ পাস করলে স্কুলে বা কলেজে শিক্ষকতা করতে হতো। বয়স বেশি হওয়ায় সরকারি চাকরির সুযোগ ছিল না। তাই তিনি উকিল হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ইংরেজিতে এমএ ক্লাস ছেড়ে আইনের ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯২৩ কিংবা ১৯২৪ সালে তিনি বিএল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর এক বছর তিনি শিক্ষানবিশ ছিলেন। ১৯২৫ কি ১৯২৬ সালে কুমিল্লা বারে উকিল হিসেবে নিবন্ধিত হন এবং সেখানে ওকালতি শুরু করেন। এ সময়ে তিনি তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ফজলে আলী খাঁর শ্যালিকা সৈয়দা হুরন্নাহারকে বিয়ে করেন। এই স্ত্রীর গর্ভে তার দুই কন্যার জন্ম হয়। তাদের প্রথম কন্যার নাম ছিল মীনা (১৯৩০) এবং দ্বিতীয় কন্যার নাম ছিল বীণা (১৯৩৩)। বছর পাঁচেক সংসার করার পর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর প্রথম স্ত্রী ১৯৩৪-১৯৩৫ সালে মারা যান।

আমীর আলী খাঁ ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা বারেই প্র্যাকটিস করতেন। ১৯৩৬ সালে তার বড় ভাই ফজলে আলী খাঁ মারা গেলে নবীনগরে একটি বড় শূন্যতা দেখা দেয়। তখন নবীনগর মুন্সেফ আদালতে আর কোনো মুসলমান। আইনজীবী ছিল না। উপরন্তু পরিবারের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য তাঁর নবীনগরে উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি বিবেচিত হয়। তাই ১৯৩৬ সালে তার বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি নবীনগরে স্থায়ীভাবে চলে আসেন।

তিনি নবীনগরে মুন্সেফ কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন এবং তাঁর বড় ভাই যেসব পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি সেসব পদের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি ঢাকার নবাব এস্টেটের মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনার জন্য নবীনগর কোর্টে রিটেইনারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় নবীনগরে সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। নবীনগর কেন্দ্রীয় বহুমুখী সমবায় সমিতি বেশ সাফল্য অর্জন করে। তিনি এ সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নবীনগরে শিক্ষাবিস্তারেও তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। তিনি নবীনগর উচ্চবিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সম্পাদকের দায়িত্ব অনেক দিন পালন করেছেন। নবীনগরে তখন মেয়েদের জন্য কোনো উচ্চবিদ্যালয় ছিল না। মেয়েদের জন্য ‘ইচ্ছাময়ী বিদ্যালয় নামে একটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল। ব্যবস্থাপনার সংকটের জন্য এই বিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে তিনি এই বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।

তিনি নবীনগরে মুসলমানদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং মুসলিম লীগে যোগ দেন। তিনি ‘৪০ ও ৫০-এর দশকে নবীনগর থানা মুসলিম লীগের। সভাপতি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা মুসলিম লীগের সহসভাপতি পদে নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে যখন ভারতের কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন তিনি মুসলিম লীগের মনোনয়ন প্রার্থী হন। তাঁর প্রার্থিতার পক্ষে এলাকায় ব্যাপক গণসমর্থন দেখা যায় এবং কলকাতা থেকে জনমত। যাচাইয়ের জন্য মুসলিম লীগ যে কমিটি গঠন করে, তারা নবীনগর নির্বাচনী এলাকায় এসে সেটা স্পষ্টভাবে দেখতে পান। মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ড কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচনের জন্য তাঁকে মনোনয়ন দেয়। কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর এ মনোনয়ন পছন্দ হয়নি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিপক্ষে ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দিন। যেহেতু আমীর আলী খাঁ নবাব এস্টেটের আইন উপদেষ্টা ছিলেন, সেহেতু সোহরাওয়ার্দী তাঁকে নবাবের সমর্থক হিসেবে গণ্য করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতের মোক্তার আলী আহমদ খান আরেকজন প্রার্থী ছিলেন। এই মনোনয়নের বিপক্ষে তিনি মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি আপিল বোর্ডের কাছে আপিল করেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সমর্থনে আলী আহমদ খান চূড়ান্ত মনোনয়ন পান এবং আমীর আলী খাঁর মনোনয়ন বাতিল হয়ে যায়। এলাকার লোকজন তাকে খুবই ভালোবাসত। তাই তারা দাবি করেন আমীর আলী খাঁ যেন মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করেন। কিন্তু তিনি এতে রাজি হননি এবং মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থীকে নির্বাচিত করার জন্য কাজ করেন।

মুসলিম লীগের নেতা হওয়া সত্ত্বেও নবীনগরের হিন্দুদের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিতেন। হিন্দুদের উদ্যোগে সে সময়ে নবীনগরে নাটক মঞ্চস্থ হতো। কোনো কোনো থিয়েটারে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। নবীনগরে অনেক হিন্দু পরিবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। নবীনগরের সাহা পরিবারের সন্তান সনাতন সাহা ফজলে আলী খাঁর আমলে সমবায় ব্যাংকে নির্বাহী পদে যোগ দেন। সনাতন সাহা ফজলে আলী খাঁর ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। আমীর আলী খ ফজলে আলী খাঁর স্থলে সমবায় ব্যাংকে যোগ দিলে তিনি আমীর আলী খাঁর ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্ব নেন। পরে তিনি সরকারের সমবায় বিভাগে যোগ দেন। তাঁর স্থলে তাঁর ভাই মুরালি মোহন সাহাকে সমবায় ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই পরিবারের সঙ্গে রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির প্রায় তিন প্রজন্ম ধরে নিবিড় সম্পর্ক ছিল। সনাতন সাহা সমবায় বিভাগের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পর আমীর আলী খাঁর ভ্রাতুস্পুত্র আনোয়ার আলী খাঁনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। তাঁর ছেলে ননী গোপাল সাহা। ননী গোপালের ছেলেও আনোয়ার আলী খাঁনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন।

আমীর আলী খ শুধু শিক্ষা প্রসারের জন্যই কাজ করেননি, তিনি আমৃত্যু লেখাপড়া করে গেছেন। ইংরেজি সাহিত্যে তার প্রিয় লেখক ছিলেন জর্জ বার্নার্ড শ। বার্নার্ড শর নাটক সমগ্র তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল। অন্য কোনো বই না থাকলে প্রতিদিনই হারিকেনের আলোতে গভীর রাত পর্যন্ত তিনি বার্নার্ড শর লেখা পড়তেন এবং একা একা হাসতেন।

কোরআন শরিফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যায় ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে তিনি ঘণ্টাখানেক কোরআন শরিফ এবং তার অনুবাদ পড়তেন। তাঁর পছন্দের অনুবাদ ছিল আল্লামা ইউসুফ আলীর কোরআন শরিফের অনুবাদ। তিনি লাহোর থেকে প্রকাশিত ইসলামিক লিটারেচার নামের একটি সাময়িকীর গ্রাহক ছিলেন। এ ছাড়া মাওলানা আকরম খাঁর কোরআন শরিফের অনুবাদের প্রথম খণ্ডও তিনি খুব পছন্দ করতেন। ফেরাউনের মৃত্যু সম্পর্কে মাওলানা আকরম খাঁর অভিনব বক্তব্য তিনি তার শিশুসন্তানদের কাছে ব্যাখ্যা করতেন।

প্রায় ৮৪ বছর পর্যন্ত তিনি বেঁচেছিলেন। তবে তাঁর স্বাস্থ্য শেষ দিকে ভালো ছিল না। তাঁর বয়স যখন ষাট, তখন তার হাতে ব্যথা দেখা দেয়। এর ফলে তাঁর লিখতে অসুবিধা হতো এবং পড়াশোনাতেও অসুবিধা হতো। জীবনের শেষ দিকে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান। এ ছাড়া প্রোস্টেটের সমস্যায় আক্রান্ত হন। সে সময়ে গ্রামাঞ্চলে এ রোগের ভালো চিকিৎসা ছিল না। তাই কষ্টের মধ্যে তার জীবনের শেষ তিন-চারটি বছর অতিবাহিত হয়।

ইয়াকুব আলী খাঁ: (জন্ম : ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু : ২০০২ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : রেসালত আলী খাঁ। ইয়াকুব আলী খাঁ তার মাতুলালয়ে মাইজদীর চরমথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা রিয়াজত আলী খাঁ তখন নোয়াখালী শিক্ষা বোর্ডে কাজ করছিলেন। ১৯২৯ সালে ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্চম স্থান অধিকার করে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অঙ্কশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে ১৯৩৩ সালে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন এবং এ জন্য একটি স্বর্ণপদক পান। ১৯৩৩ সালে তিনি শুধু অঙ্ক বিভাগেই প্রথম স্থান অধিকার করেননি, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব বিভাগে সর্বোচ্চ স্থান লাভ করেছিলেন। তাই তাঁকে আরও একটি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। ১৯৩৫ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পরীক্ষায় অঙ্কে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজে লেকচারার নিযুক্ত হন। তিনি আইসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন কিন্তু কালাজ্বর হওয়ার জন্য পরীক্ষা দিতে পারেননি। এরপর তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষায় আইপিএস বা ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে মনোনীত হন। একই সঙ্গে তিনি বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদে নির্বাচিত হন। তিনি পুলিশ সার্ভিসে যোগ না দিয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে তিনি রানাঘাটে এসডিও ছিলেন। পাকিস্তান হওয়ার পর তাকে প্রথমে নাটোরে এসডিও পদে নিয়োগ করা হয়। এরপর তিনি গোপালগঞ্জ জেলার এসডিও হিসেবেও কাজ করেন। তিনি ভূমি রাজস্ব বিভাগের সহকারী সচিব ছিলেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৫৫ সালে তাঁকে কেন্দ্রীয় সরকারে বদলি করা হয়। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালে শরণার্থী ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য, শ্রম এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারে ফিরে আসেন এবং খাদ্য বিভাগের পরিচালক নিযুক্ত হন। তারপর তাকে রংপুরে ডেপুটি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৬৫ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের খাদ্যসচিব ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তাকে ইসলামাবাদের কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৬৮ সালে তাকে পূর্ব পাকিস্তানে রিলিফ কমিশনার পদে নিয়োগ করা হয়। ১৯৬৮ সালে তাঁকে আবার কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এবং যুগ্ম সচিব পদের দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি শেরেবাংলা নগরের স্থপতি হিসেবে লুই কানের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে চুক্তি চূড়ান্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধ যখন শেষ হয়ে আসছিল, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের অতিরিক্ত সচিব পদের জন্য তার মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত সচিব পদে তার পদোন্নতি সম্ভব হয়নি। তিনি ইসলামাবাদে আটকা পড়ে যান এবং ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন ও সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

১৯৩৭ সালে তিনি সিএস অফিসার ও জেলা প্রশাসক খান বাহাদুর ফজলুল করিমের কন্যা মাহবুবা বেগমকে বিয়ে করেন। তাদের ঘরে চার ছেলে এবং দুই মেয়ে।

শওকত আলী খাঁন : (জন্ম : ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু : ৬ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : ফজলে আলী খাঁ। শওকত আলী খাঁন ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষার পড়াশোনা শেষ করার আগেই তার পিতা ফজলে আলী খাঁ ১৯৩৬ সালে ইন্তেকাল করেন। শওকত আলী খাঁন ১৯৩৮ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪০ সালে তিনি আইএ পরীক্ষা না দিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এরপর সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৪৮ সালে শওকত আলী খাঁন বার্মাশেল কোম্পানি নামে একটি জ্বালানি কোম্পানিতে চাকরি পান। ওই বছরই শওকত আলী খাঁন পাকিস্তান মিলিটারিতে কমিশন পান এবং তা গ্রহণ। করে করাচিতে চলে যান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তিনি মেজর পদে পদোন্নতি লাভ করেন। এ সময় খুব অল্পসংখ্যক বাঙালি কর্মকর্তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পেয়েছিলেন।

মেজর জেনারেল রব, যিনি মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনানায়ক ছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁর ব্যাচমেট। সাবেক সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার কনিষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহী ছিলেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমির পরিচালনা পরিষদের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬০-এর দশকে তিনি সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন এবং তার শ্যালক বাদল ঘোষের সহায়তা নিয়ে খুলনায় এজাক্স পাটকল প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর স্ত্রী লিলি খানের পিতা ছিলেন ঘোড়াশালের হিন্দু এবং তাঁর মা ছিলেন বাগদাদ থেকে ভয়ে পালিয়ে আসা ইহুদি রমণী। লিলি খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন এবং বৈরুত আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিটি পাস করেন। তিনি যশোর সেনানিবাসের দাউদ উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শওকত আলী খাঁন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সপরিবার যুক্তরাজ্য গমন করেন। তিনি এজাক্স পাটকলের শেয়ার বিক্রি করে দেন এবং লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। তার স্ত্রীও লন্ডনে বাঙালি অভিবাসীদের কল্যাণ বিভাগে যোগ দেন। শওকত আলী খাঁন ১৯৭৬ সালের ৬ আগস্ট লন্ডনে মারা যান। তার দুই মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ে লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। ছোট মেয়ে রয়েছে বাংলাদেশেই।

আনোয়ার আলী খাঁন : (জন্ম : ২ অক্টোবর ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু : ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : ফজলে আলী খাঁ। আনোয়ার আলী খাঁন ১৯২৩ সালের ২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য তিনি ১৯৪৮ সাল থেকে ব্যবসা শুরু করেন। প্রথমে তিনি রায়েরবাজারে একটি ইটখোলা স্থাপন করেন এবং প্রায় বছর দশেক ইটের ব্যবসা করেন। এরপর তিনি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের গণস্বাস্থ্য বিভাগে নলকূপের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেন। ১৯৬০-এর দশকে ব্লু ট্রেডিং কোম্পানি নামে একটি কোম্পানি স্থাপন করেন এবং ওই কোম্পানি থেকে পল্টন নামে একটি সিগারেট তৈরির কারখানা চালু করেন। পরবর্তীকালে তিনি তাঁর ছোট ভাই আমান উল্লাহ খানের সঙ্গে স্টার গার্মেন্টস নামে একটি পোশাক শিল্পকারখানা স্থাপন করেন। এ ছাড়া তিনি সাউথ এশিয়া ইনস্যুরেন্স নামে একটি বিমা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি ছিলেন। তিনি পঞ্চাশের দশকে পুরান ঢাকার বনেদি পরিবারের মেয়ে আমাতুজ জোহরার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। জোহরা খান অত্যন্ত অতিথিবৎসল ছিলেন ও পরিবারের সবার খোঁজখবর রাখতেন। আনোয়ার আলী খাঁন ২০১৬ সালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর একমাত্র ছেলে জোবায়ের আহমদ খান লুডু ও একমাত্র কন্যা শম্পা বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করছেন।

এ কে এন আহমেদ : (জন্ম : ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ; মৃত্যু : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : রেজায়ে রাব্বী। এ কে এন আহমদ খাঁ বাড়ির সন্তান ছিলেন না। কিন্তু দুটি কারণে খাঁ বাড়ির সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রথমত, তার জন্ম হয় তার মামাবাড়ি রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়িতে। তাঁর মা ছিলেন সাদত আলী খাঁর কনিষ্ঠতম কন্যা। দ্বিতীয়ত, তিনি বিয়ে করেন রসুল্লাবাদ খ বাড়ির আমীর আলী খাঁর দ্বিতীয় কন্যা নীলুফার আহমদকে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিচারণা করে একটি লেখা প্রথম আলোতে প্রকাশ করেছিলাম। লেখাটি নিচে দেখা যাবে।

একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন যে ২৫ বছরের নিচে যেসব নাগরিক রাজনীতি করেন, তারা যদি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস না করেন, তাহলে ধরে নিতে হবে তাদের হৃদয় নেই। আর ২৫ বছরের বেশি বয়স্ক নাগরিক যারা রাজনীতি করেন, তারা যদি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাহলে ধরে নিতে হবে যে তাদের কোনো মগজ নেই। এ কে এন আহমেদ কৈশোরে সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন। পরিণত বয়সে তিনি পুঁজিবাদী সংস্থার জন্য কাজ করেছেন। তবু বিশ্লেষকের এই ভবিষ্যদ্বাণী এ কে এন আহমেদ সম্পর্কে পুরোপুরি খাটে না। সমাজতন্ত্রের পথ তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু এই পথ থেকে সরে আসার বেদনাবোধ তাকে সারা জীবনই পীড়িত করেছে। তিনি লিখেছেন যে এই পরিবর্তন তার জীবনে, তাঁর মননে এক বিরাট শূন্যতার (gaping hole) সৃষ্টি করে, যা সহজে পূরণ করা যায়নি। ৮৩ বছর 73167 015 78 Random Thoughts-o fola 101631609, ‘Nevertheless, I still feel that justice and equality embedded in the concept of socialism are right as ideas, and what should be really discredited is the inability of the socialist regimes to live up to them.’ Noua রাষ্ট্রসমূহে পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা থাকলেও জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক আদর্শে তার বিশ্বাস ছিল অটুট।

নাজির আহমেদের জন্ম হয়েছিল ১৯২৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। (এটি অবশ্য তাঁর সরকারি কাগজে লেখা জন্মতারিখ ছিল না)। তিনি ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রায় ৯২ বছরের দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা অবদান রেখে গেছেন।

তাঁর জন্ম হয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রসুল্লাবাদ গ্রামে মাতুলালয়ে। কিন্তু তিনি মানুষ হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে। তাঁর পিতা মরহুম রেজাই রব্বানী পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। অত্যন্ত সৎ, কর্মনিষ্ঠ কিন্তু চাঁছাছোলা ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ উচ্ছ্বাসবিহীন জীবন অতিবাহিত করতেন তিনি। তবু চার ছেলে এবং চার মেয়েকে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের জন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি। নাজির আহমেদের মা মুসিয়া খাতুন ছিলেন ভিন্ন মেজাজের। সচ্ছল ঘরের সন্তান, তিনি ছিলেন প্রাণোচ্ছল, অতিথিবৎসল, গান শুনতে ও বই পড়তে ভালোবাসতেন। এসব আবদার মেটাতে সংসারে টানাটানি। হতো। নাজির আহমেদকে তাঁর মা এবং বাবা দুজনেই প্রভাবান্বিত করেন। বাবার কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন অসাধারণ শৃঙ্খলাবোধ এবং বাস্তবতাবোধ। মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন মানুষের জন্য দরদ।

তাঁর লেখাপড়া শুরু কলকাতায়। কলকাতা থেকেই তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভালো ফল করে ১৯৪২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বছরের অনার্স) বিএ পাস করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে যাওয়ার আগেই পাড়ার এক কলেজছাত্রের তত্ত্বাবধানে সমাজতন্ত্রে তাঁর দীক্ষা শুরু হয়। তবে দীক্ষা সম্পূর্ণ হয় প্রেসিডেন্সি কলেজে। তিনি ছাত্র ফেডারেশনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন, এই সূত্রে তাঁর সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে শহীদুল্লা কায়সারের। ১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসে ভর্তি হন এবং ছাত্র ফেডারেশনের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখেন। সে সময়টা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম লীগের জমানা। প্রগতিশীল ছাত্রনেতারা তাই বারবার মুসলিম ছাত্রনেতাদের হাতে নিগৃহীত হন। যতটুকু জানা যায়, নাজির আহমেদের বিছানা ও বইপত্র বার দুই এসএম হলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এই সময় স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান। প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ব্যাংকে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। তিনি চাকরির জন্য দরখাস্ত করেন এবং চাকরি পেয়ে যান। তবে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরও শহীদুল্লা কায়সার, শওকত ওসমান ও নাজিমউদ্দিন হাসিমের মতো বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তার হৃদ্যতা অব্যাহত থাকে।

স্টেট ব্যাংকের প্রশিক্ষণে খুবই ভালো ফল করায় তাকে বিশ্বব্যাংকে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। বিশ্বব্যাংকের প্রশিক্ষণেও তিনি অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন এবং পঞ্চাশের দশকে বিশ্বব্যাংক তাকে বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব কর্মকর্তারূপে নিয়োগে প্রস্তাব দেয়। কিন্তু স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান সম্মত না হওয়ায় তিনি এই চাকরিতে যোগ দিতে পারেননি। অল্পকালের মধ্যেই তিনি স্টেট ব্যাংকে একজন সুদক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁকে স্টেট ব্যাংকে সচিব পদের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং পরবর্তীকালে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও তার কাছে অর্পিত হয়। তিনি সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে স্টেট ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার সর্বোচ্চ পদে নিযুক্ত ছিলেন এবং এরপর খুলনায় মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন। ষাটের দশকে তাঁকে পাকিস্তান শিল্প ব্যাংকে প্রেষণে পাঠানো হয় এবং পরে তল্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প ব্যাংকের প্রধান হিসেবে (Deputy Managing Director এর পদমর্যাদায়) নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্যোক্তাদের দ্রুত শিল্পঋণ মঞ্জুরিতে সহায়তা করেন। পাকিস্তান আমলে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান থাকাকালীন তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক স্থাপনে, পূর্ব পাকিস্তান ওয়ের হাউজিং করপোরেশন এবং ইকুইটি পার্টিসিফেশন ফান্ড (যার মাধ্যমে নতুন এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানে শেয়ার বিক্রি করা হতো) স্থাপনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁর বিভিন্ন উদ্ভাবনমূলক কর্মসূচির স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭০ সালে তাঁকে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাকে ঢাকা স্টেট ব্যাংকের দায়িত্ব। দিয়ে পাঠানো হয়। এ সময়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন নির্দেশ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁকে করাচিতে ফেরত নেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়, তবে স্টেট ব্যাংকের তদানীন্তন গভর্নরের হস্তক্ষেপের ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি কিন্তু তাঁকে লায়ালপুর জেলে নিয়ে কয়েক দিন ধরে দুইবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু তিনি এ চাপের কাছে নতিস্বীকার করেননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পাকিস্তানে আটকা পড়েন। ১৯৭৩ সালে তিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেন। যেহেতু তিনি দেশে ছিলেন না, সেহেতু তার পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম গভর্নর হওয়া সম্ভব হয়নি। দেশে ফিরে আসার পর তাকে প্রথমে সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিছুদিন পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গতি সঞ্চার করার জন্য ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্ত করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ডের পূর্ণ সমর্থন করেন এবং বঙ্গবন্ধু তাকে বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদেও মনোনয়ন দেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর তিনি যদিও গভর্নর পদে বহাল ছিলেন কিন্তু তকালীন রাজনৈতিক নেতাদের পূর্ণ আস্থা অর্জন করতে পারেননি। এর ফলে ১৯৭৬ সালে। তিনি গভর্নর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। যে স্বল্পকালীন সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন, সে সময়ে তিনি বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অবদান। রেখেছিলেন। কালোটাকার দৌরাত্ম্য বন্ধ করার জন্য তিনি প্রচলিত ১০০ টাকার নোট বাতিল করে নতুন ১০০ টাকার নোট প্রচলন করেন। তিনি প্রথম বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইএফআইসি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। পরে এ প্রতিষ্ঠানটি একটি বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রথম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নিয়োগের ব্যবস্থা করেন এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে।

গভর্নর পদ ছাড়ার পর তিনি গাম্বিয়ায় আইএমএফের আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন এবং পরে বিসিসিআই ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলে লন্ডনে ব্যাংকের পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিসিসিআই ব্যাংকে থাকাকালীন তিনি ঢাকায় বিসিসিআই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন এবং বেসিক ব্যাংক স্থাপন করেন। বেসিক ব্যাংকের সভাপতিরূপে তিনি এই ব্যাংকে যোগ্য কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেন। যার ফলে সরকারীকরণ করার পরও প্রায় দুই দশক ধরে ব্যাংকটি অব্যাহতভাবে মুনাফা করেছে। অতি সম্প্রতি দেশে রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যাংকটিতে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে। পরবর্তীকালে বিসিসিআই ব্যাংকের অবলুপ্তি ঘটে। তবে Random Thought শীর্ষক বইয়ে নাজির আহমেদ লিখেছেন যে তিনি বিসিসিআইএ থাকাকালীন বিবেকের বিরুদ্ধে কিছু করেননি এবং তার বিরুদ্ধে কোনো পক্ষ থেকে কোনো ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি।

আশির দশকে তিনি কূটনৈতিক জগতে প্রবেশ করেন। তাঁকে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি তিন বছর এ পদে নিয়োজিত ছিলেন এবং জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের দৃঢ়তর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। রাষ্ট্রদূতের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ইত্যাদি দেশে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন।

তিনি ১০টি বই লিখেছেন এবং অর্থনীতি ও সমসাময়িক বিষয়ে তাঁর অনেক নিবন্ধ বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ১০টি বইয়ের মধ্যে দুটি বই লেখা হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয় নিয়ে। একটি বইয়ের নাম হলো Japan-Centerpiece of the World (1985)। আরেকটি বইয়ের নাম USA Today and Tomorrow (2000) এই দুটি বইয়ে তিনি বিশ্বের দুটি অর্থনৈতিক পরাশক্তির সবলতা এবং দুর্বলতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্পর্কে তিনি দুটি বই লিখেছেন। একটি বইয়ের als 261 Of Deregulation and Central Bank Autonomy (1997) 01659PIU TRUST On Central Banking, Central Bank and Central Banker (2012)। এই দুটি বইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাঁর মূল্যবান বক্তব্য লেখা হয়েছে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা প্রশ্নে এ দুটি বইয়ে যে বক্তব্য লিপিবদ্ধ হয়েছে, তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। অর্থনীতির ওপর তিনি তিনটি বই প্রকাশ করেছেন। প্রথম প্রকাশিত বইয়ের নাম হলো Economic Essays (1982), দ্বিতীয় বইটির নাম Washington Consensus 019 Vota tolos a Globalisation and Related Issues. সাহিত্য ও আত্মজীবনীমূলক বই লিখেছেন তিনটি। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় কবিতার বই Tormented Soul (1985)। ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনাসংবলিত বই Random Thoughts। তার সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থের শিরোনাম হলো Lonely Thoughts (2011)।

তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ব্যাংকজগতের এক প্রবাদপুরুষ। কিন্তু তাঁর কৃতিত্ব শুধু ব্যাংকজগতে সীমাবদ্ধ নয়, কূটনীতিক হিসেবে তিনি বাংলাদেশের জন্য সাফল্য বয়ে এনেছেন। কূটনীতিক তত্ত্ব সম্পর্কে বই লিখেছেন, ব্যাংকিং এবং অর্থনীতি নিয়ে বই লিখেছেন। এসব বই জ্ঞানের জগৎকে প্রসারিত করেছে। এককথায় তিনি বাংলাদেশের অনেক বিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন।

আমরা তাঁর চূড়ান্ত মূল্যায়ন শেষ বিচারে কীভাবে করব? অনেক লেখক তাঁদের প্রত্যাশার কথা সমাধিলিপিতে (Epitaph) লিখে যান। যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছিলেন, ‘দাঁড়াও, পথিকবর, জন্ম যদি তব / বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল!’ শীর্ষক বিখ্যাত সমাধিলিপি। নাজির আহমেদ কোনো সমাধিলিপি লেখেননি কিন্তু এ সম্পর্কে তাঁর প্রত্যাশা ১৯৮৭ সালের ১৪ জুন তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন :

When I die I need not be idealized or enlarged in death beyond what I was in life. Indeed I would like to be remembered simply as a good and decent man who saw wrong and tried to right it, saw suffering and tried to heal it, saw injustices and tried to rectify it and above all one who used his limited position and influence for public good and not private gains.

অবশ্যই যারা এ কে এন আহমদের সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁরা এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত হবেন এবং একজন ভদ্র ও মার্জিত রুচির সহায়ক ব্যক্তিত্ব হিসেবে অনেকেই তাকে দীর্ঘদিন স্মরণ করবে।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুৎফে আলী খাঁন : (জন্ম : ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : রেসালত আলী খাঁ। তিনি তাঁর পিতার কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং মেডিকেল কোরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৭৭ সালে তাঁকে মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। অবসর গ্রহণের পর তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজের প্রশাসক নিয়োগ করা হয় এবং এরপর তাঁকে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭৯ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং ২০০০ সালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তার এক ছেলে ওয়াসিফ আলী খাঁন (অপু) একজন চিকিৎসক এবং দীর্ঘদিন ধরে আইসিডিডিআরবিতে ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধকের ওপর গবেষণা করছেন। তার আরেক ছেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী এবং সেখানে একটি প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী হিসেবে কাজ করছেন।

মোস্তাফিজুর রহমান খান : (জন্ম : ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : ফজলে আলী খাঁ। মোস্তাফিজুর রহমান খান (ডাকনাম মন্টু) ১৯২৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নবীনগরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা শহরে পড়াশোনা করেন। প্রবেশিকা এবং ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে তিনি ১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে বিএ অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে এমএ পড়েন। এমএ পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

তিনি ১৯৫২ সালে পাকিস্তানে সিভিল সার্ভিসের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে পুলিশ সার্ভিস অব পাকিস্তানে যোগ দেন। তিনি মুন্সিগঞ্জের এসডিপিও ছিলেন। ছিলেন ঢাকা শহরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। তিনি যশোর জেলার পুলিশ সুপারিটেনডেন্ট এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে দুর্নীতি দমন বিভাগে চট্টগ্রাম বিভাগের উপপরিচালক ছিলেন।

১৯৬৯ সালে তাঁকে কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ত বিভাগে উপসচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই পদে থাকাকালীন রাওয়ালপিন্ডিতে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করায় পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে এবং গৃহবন্দী করে রাখে। তিনি এই অবস্থায় লাহোর সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। তিনি পুলিশের চাকরিতে ফিরে যেতে উৎসাহী ছিলেন না। তখন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর বন্ধুবান্ধব তাকে পুলিশে নিয়োগের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বঙ্গবন্ধুকে বলেন, এই কর্মকর্তা ইংরেজদের মতো ইংরেজি লেখেন। ভালো লেখাপড়া জানা কর্মকর্তাদের বঙ্গবন্ধু খুব পছন্দ করতেন। তাই তারা বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিলেন এই কর্মকর্তাকে বঙ্গবন্ধুর অধীন অফিসে নিয়োগ দেওয়া হোক। ওই সময় পরিদর্শন বিভাগ নামে একটি বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাকে ওই বিভাগে পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর তিনি পুলিশ বিভাগকে এড়াতে পারেননি। ১৯৭৬ সালের মে মাসে তাঁকে অফিশিয়েটিং অ্যাডিশনাল আইজি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই পদে তিনি প্রায় ছয় বছর কাজ করেন। ১৯৮২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে তিনি আইজিপির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ৩১ জানুয়ারি ১৯৮৪ তারিখে এ পদ থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তদানীন্তন রাষ্ট্রপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জানতেন যে মোস্তাফিজুর রহমান খানের কোনো উচ্চাভিলাষ নেই। তাই তিনি তাঁকে আরও দুই বছরের জন্য আইজিপি পদে চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মোস্তাফিজুর রহমান খান। এতে সম্মত হননি। তিনি অবসর গ্রহণ করেন এবং ১৯৮৬ সালে তিনি পরলোকগমন করেন। তার বিয়ে অতি স্বল্পকাল টিকে ছিল। তাই তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। ছাত্রজীবন থেকে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। সিপিএম নেতা এবং জ্যোতিবসুর মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র তাঁর সহপাঠী ছিলেন। অশোক মিত্র ছাত্রাবস্থাতেই কমিউনিস্টপন্থী ছাত্র ফেডারেশন। করতেন। অশোক মিত্রের আত্মজীবনী আপিলা চাপিলাতে মোস্তাফিজুর রহমান খানের উল্লেখ রয়েছে। মোস্তাফিজুর রহমান খানের আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বামপন্থী সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ। আমৃত্যু ফয়েজ আহমদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।

আমান উল্লাহ খান : (জন্ম : ৩ এপ্রিল ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু : ৩১ ডিসেম্বর ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : ফজলে আলী খাঁ। আমান উল্লাহ খান ফজলে আলী খাঁর পঞ্চম সন্তান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবনে লেখাপড়া ছাড়াও তার দুটি বিষয়ে আগ্রহ ছিল। প্রথমত, তিনি বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি নাটক করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন বামপন্থী ছাত্রনেত্রী ফরিদা বারি মালিককে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ১৯৫৮ সালে স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাকুম অয়েল কোম্পানিতে (যা পরে এসো কোম্পানি কিনে নেয়) যোগ দেন। ১৯৭০ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি খুলনা বিভাগের এসো অয়েল কোম্পানির ম্যানেজার ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি এসো অয়েল কোম্পানির হেড অফিসে যোগ দেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে তেল সরবরাহ করার জন্য কোনো বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ছিল না। ঝুঁকি বেশি হওয়ায় বিদেশি কোম্পানিগুলোও এ ব্যাপারে উৎসাহী ছিল না। আমান উল্লাহ খান এই পর্যায়ে তেল কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দেন এবং বাংলাদেশ সরকারকে পেট্রল সরবরাহ শুরু করেন। প্রায় দুই বছরকাল এটি তাঁর একচেটিয়া ব্যবসা ছিল। এই ব্যবসায় তিনি প্রচুর কমিশন লাভ করেন। তিনি যুক্তরাজ্যে অভিবাসন করেন। আশির দশকে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং পোশাকশিল্পে তাঁর বড় ভাইয়ের সঙ্গে বিনিয়োগ করেন। তাঁর একমাত্র মেয়ে লোপা খান ও তার স্বামী প্রখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হানিফ বর্তমানে ঢাকাতেই আছেন। তাদের একমাত্র কন্যা সুহি ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।

আহসান উল্লাহ খান : (জন্ম : ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা: ফজলে আলী খাঁ। আহসান। উল্লাহ খ ফজলে আলী খাঁর ষষ্ঠ সন্তান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে রসায়নশাস্ত্রে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর বৃত্তি পেয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। ১৯৬০ সালে অক্সফোর্ড থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের টালাহাসি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি ডায়ান নামে তার এক ছাত্রীকে বিয়ে করেন। টালাহাসি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি মিশিগান অঙ্গরাজ্যে ইস্ট ল্যান্সিং-এ মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং দীর্ঘদিন সেখানে অধ্যাপনা করেন। এরপর তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে গবেষক হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ প্রফেসর (গবেষক অধ্যাপক) পদে নিযুক্ত রয়েছেন। তার একমাত্র ছেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কম্পিউটার কোম্পানিতে কাজ করছে।

হাবীব উল্লাহ খান : (জন্ম : ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : আবদুস শাকুর খা। আবদুস শাকুর খাঁ পুলিশের চাকরি করতেন। পুলিশের চাকরিতে ঘন ঘন। বদলি লেগে থাকত। তাই ছেলেকে ভালোভাবে পড়ানোর জন্য ষষ্ঠ শ্রেণিতে আলিগড় মুসলিম স্কুলে ভর্তি করা হয়। স্কুলটি পরিচালনা করত আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৪৬-১৯৪৭ সালের দাঙ্গার সময়ে হাবীব উল্লাহ খান। একা স্কুলে পড়ার জন্য আলিগড়ে যেতেন এবং স্কুল ছুটির সময় পূর্ব পাকিস্তানে বেড়াতে আসতেন। ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। ১৯৪৯ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাস করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি লন্ডন এরো অ্যান্ড অটো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ডিপ্লোমা করেন।

দেশে ফিরে আসার পর তিনি করাচিতে জেনারেল মোটরসে প্রডাকশন সুপারিনটেনডেন্ট পদে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে তিনি জেনারেল মোটরসের। পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি নিযুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হাবীব উল্লাহ খান জেনারেল মোটরস কিনে নেন এবং গান্ধার ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি গান্ধার ইন্ডাস্ট্রিজে যোগ দেন এবং ১৯৬৫ সালে গান্ধার ইন্ডাস্ট্রিজের পূর্ব পাকিস্তানের ম্যানেজার নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে তিনি চট্টগ্রামের গান্ধার ইন্ডাস্ট্রির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। এরপর তিনি নাভানাতে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরের পদে যোগ দেন।

জিয়াউর রহমান তাঁকে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতারমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। পরে তাঁকে পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭৯ সালে তিনি নবীনগর নির্বাচনী এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি হওয়া পর্যন্ত তিনি মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০০৫ সালে বিএনপি সরকার তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করে। ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি ওই পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রোটারি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং ১৯৮৮-৮৯ সালে তিনি বাংলাদেশে রোটারি ইন্টারন্যাশনালের ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তাঁর স্ত্রীর নাম সালমা খান। সালমা খান একজন অর্থনীতিবিদ। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ছিলেন এবং পরিকল্পনা কমিশনে বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। তিনি একজন নারীনেত্রী এবং নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করেছেন। তিনি ২০০৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।

মাকসুদ আলী খাঁন: (জন্ম : ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু : ৩০ আগস্ট ২০০১ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : ইয়াকুব আলী খাঁ। মাকসুদ আলী খাঁন ১৯৩৮ সালে পিতা ইয়াকুব আলী খাঁর কর্মস্থলে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রথম শ্রেণিতে ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভিত্তিতে তিনি টেলিফোনের প্রকৌশল বিভাগে যোগ দেন। কর্মদক্ষতার ফলে তিনি অতি দ্রুত পদোন্নতি এবং গুরুদায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকায় টেলিফোনের জেনারেল ম্যানেজার পদে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মীদের যোগাযোগের একমাত্র বাহন ছিল টেলিফোন। তাই পাকিস্তান বাহিনী প্রথমেই টেলিফোন বিভাগের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক সব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে। মাকসুদ আলী খাঁনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে ৯ মাস ধরে তার ওপর নির্যাতন করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি টেলিফোন বিভাগে যোগ দেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই টেলিফোন বোর্ডের উন্নয়ন ও অপারেশন বিভাগের সদস্য পদে পদোন্নতি লাভ করেন। এসব দায়িত্ব পালনকালে টেলিফোন ব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের সব দায়িত্ব তার ওপরে বর্তায়। তাঁর ভালো কাজের পুরস্কারস্বরূপ তাঁকে বাংলাদেশ টিঅ্যান্ডটি বোর্ডের সভাপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে ১৯৯০ সালে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে স্বৈরশাসক এরশাদের পতন ঘটে। এরশাদের দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন–এই অভিযোগ করে মাকসুদ আলী খাঁনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মাকসুদ আলী খাঁন দেশ ছেড়ে চলে যান। তিনি অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে একটি টেলিফোন কোম্পানিতে চাকরি নেন। দুর্ভাগ্যবশত তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০০১ সালের ৩০ আগস্ট সিডনিতে ইন্তেকাল করেন।

মাকসুদ আলী খাঁনের সবচেয়ে ছোট ভাইয়ের নাম মাসরুর আলী খাঁন (জামিল)। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। সেখানে লেখাপড়ায় খুব ভালো ফল করেন এবং প্রকৌশলশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। মাসরুর আলী খাঁন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর উদ্যোগেই ইয়াকুব আলী খাঁর পুরো পরিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব অর্জন করতে পেরেছেন। তাঁর বড় দুই ভাই (ফারুক খান এবং কায়সার খান) বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকে কাজ করেছেন। তারা বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন।

জি এম জেড খান : (জন্ম : ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : আমীর আলী খাঁ। জি এম জেড খান (গোলাম মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন খান) অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নবীনগর স্কুলে পড়েন। নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ও আইএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য মনোনীত হন এবং পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ার জন্য ইন্টার উইং বৃত্তি পান। এই সময়ে ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্রিনলেজ ব্যাংক চুক্তিবদ্ধ (Covenanted Officer) কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের জন্য ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ কর্নেল ব্রাউনের কাছে দুজন ছাত্রকে মনোনয়নের জন্য অনুরোধ করেন। কর্নেল ব্রাউন জিয়া খানের নাম সুপারিশ করেন। জিয়া ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্রিনলেজ ব্যাংকে চুক্তিবদ্ধ (Covenanted Officer) কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। তিনি প্রথমে লন্ডনে ব্যাংকিংয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের জন্য তাঁকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ফিলিপাইনে পাঠানো হয়। দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে ১৯৭৬ সালে তিনি ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্রিনলেজ ব্যাংকে দেশীয় কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ পদে পদোন্নতি পান। এরপর তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে ব্যাংকের নীতি হলো সর্বোচ্চ দুটি পদে বিদেশি কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে। সুতরাং এই ব্যাংকে এই মুহূর্তে তার আর পদোন্নতির সম্ভাবনা নেই। এই পর্যায়ে তিনি ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্রিনলেজ ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে হংকংয়ে বিসিসিআই ব্যাংকে যোগ দেন। কিছুদিন পর বিসিসিআই ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে তিনি ম্যানিলাতে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকে যোগ দেন। তিনি পদোন্নতি পেয়ে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের পাকিস্তান আবাসিক মিশনের উপপ্রধান পদে কর্মরত ছিলেন। এ সময়ে তিনি কানাডায় অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নেন এবং এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে টরন্টো শহরে তাঁর স্ত্রী এবং দুই কন্যাসহ বসতি স্থাপন করেন। জি এম জেড খান ১৯৭৫ সালে ঢাকা গার্হস্থ্যবিজ্ঞান কলেজের এমএসসিতে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকারিণী মাকসুদা আহমদকে বিয়ে করেন। তাঁদের বড় মেয়ে জারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন এবং তাদের কনিষ্ঠ কন্যা জেবা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলেসলি কলেজ থেকে বিএ এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন।

কবিরউদ্দিন খান : (জন্ম : ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : আমীর আলী খাঁ। কবিরউদ্দিন খান নবীনগর স্কুল ও ঢাকার তিতুমীর কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি ঢাকার গাড়ি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান নাভানা কোম্পানিতে যোগ দেন এবং বর্তমানে তিনি ওই কোম্পানির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার। তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ঢাকার আইএফআইসি ব্যাংকে সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট। তাদের তিন কন্যা। দুই কন্যা (তিথি ও নিতু) ইতিমধ্যে স্বামীসহ অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন করেছেন। তৃতীয়া কন্যা (আঁখি) যেকোনো সময় স্বামীসহ অভিবাসন পাওয়ার যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও পারিবারিক কারণে এখনো দেশে রয়ে গেছে।

ইউসুব আলী চাচা : সবশেষে একটি চরিত্র যোগ করতে চাই, যিনি খাঁ বাড়ির কুশীলবদের একজন নন, তবু খাঁ বাড়ির প্রত্যেকের সঙ্গে এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে ছিলেন যে তার প্রসঙ্গ একেবারে বাদ দেওয়া যায় না। তার নাম ইউসুব আলী। তিনি পাশের গ্রাম থেকে খাঁ বাড়িতে বাবুর্চি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁকে বিয়ে দেওয়া হয় এবং তাঁর স্ত্রীও খাঁ বাড়িতে কাজ করতেন। ইউসুব আলীর পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ছিল শুচিবাই। বিয়ের পর শীতকালে স্ত্রীকে এত গোসল করতে বাধ্য করতেন যে বেচারি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ইউসুব আলী আর বিয়ে করেননি। একান্নবর্তী খাঁ বাড়ি ভেঙে যাওয়ার পর সে বছরে দু-এক মাস করে খাঁ বাড়ির প্রত্যেক সদস্যের বাড়িতে থাকতেন। পরিবারের এক সদস্য অপর সদস্যকে কিছু পাঠাতে হলে তাঁকে খবর দেওয়া হতো। তিনি হাসিমুখে কাজ করে দিতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি খাঁ বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। আমার প্রজন্মের সবাই তাকে চাচা বলে ডাকত।

খাঁ বাড়ির অন্দরমহল

হাজেরা খান: (জন্ম : ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু : ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : গাজীউদ্দিন চৌধুরী। আমার মা কণিকাড়া চৌধুরীবাড়ির সন্তান। কণিকাড়া চৌধুরীবাড়িতে মেয়েদের কোনো স্কুলে ভর্তি করানো হতো না। মেয়েদের জন্য গভর্ন্যাস নিয়োগ করা হতো। আমার মা ও তার ছোট বোন সুফিয়া খালার জন্য ঢাকার নবাববাড়ির এক বিধবা মহিলাকে গভর্ন্যাস নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁর কাছে আম্মা নামাজ, রোজা, উর্দু ভাষা, রান্না করা এবং সেলাই করা শেখেন। বাড়ির ছেলেদের কাছ থেকে বাংলা পড়তে এবং লিখতে শেখেন। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তিনি স্বামীর ঘরে গিয়ে আরও ভালোভাবে বাংলা শেখেন। অবসর পেলে বাংলা বই ও খবরের কাগজ পড়তেন। নিজে উচ্চশিক্ষা লাভ করার সুযোগ না পাওয়া সত্ত্বেও তিনি মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। তিনি নবীনগর ইচ্ছাময়ী গার্লস স্কুলের পরিচালনা পর্ষদে বহুবার সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তিনি পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরিচালনা পর্ষদে থাকাকালীন তিনি ভালো শিক্ষক নিয়োগের ওপরে জোর দিতেন এবং দরিদ্র ছাত্রদের সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। নবীনগর ও রসুল্লাবাদের খাঁ বাড়ির ভূসম্পত্তি তিনি একাই দেখাশোনা করতেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি ২০০৪ সালের ১৪ অক্টোবর তারিখে মারা যান।

হেনা খান : (জন্ম ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : ফজলে আলী খাঁ। লেখাপড়ায় খাঁ বাড়ির মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন। খাঁ বাড়ির মেয়েদের মধ্যে প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন আমীর আলী খাঁর মেয়ে নীলুফার আহমদ (১৯৫৪)। খাঁ বাড়ির মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্নাতক হন ইয়াকুব আলী খাঁর প্রথম কন্যা ফরিদা খান। তিনি ১৯৬০ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ইয়াকুব আলী খাঁর কনিষ্ঠ কন্যা মুমতাজ খান গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। হেনা খানের অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন। তিনি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন, তখন তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর সংসার করতে করতে তিনি আস্তে আস্তে লেখাপড়া করতে থাকেন এবং ম্যাট্রিক, ইন্টারমিডিয়েট, বিএ এবং এমএ পাস করেন। তিনি ১৯৭২ সালে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে সপ্তম স্থান অধিকার করেন। তিনি ১৯৮০-এর দশকে তাঁর স্বামীর সঙ্গে যুক্তরাজ্যে ছিলেন। সেখানে অভিবাসন বিভাগের প্রবাসীকল্যাণ কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন এবং সেখান থেকেই অবসর গ্রহণ করেন।

নীলুফার আহমদ (বীণা) : (জন্ম : ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : আমীর আলী খ। নীলুফার আহমদ ১৯৩৩ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অতি অল্প বয়সে তিনি তার মাকে হারান। তিনি ঢাকার কামরুননেছা গার্লস স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের কর্মকর্তা এ কে এন আহমদকে বিয়ে করেন। ছোটবেলা থেকেই চিত্রকলায় তাঁর আগ্রহ ছিল। তিনি ঢাকা চারুকলা বিদ্যালয় থেকে চিত্রকলা বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তারপর আশির দশকে লন্ডনের চেলসি কলেজ অব আর্টস থেকে চিত্রকলা, ভাস্কর্য এবং স্কেচিংয়ে ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৮৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। জাপানে ১৯৮৬ এবং ১৯৮৭ সালে তার দুটি চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। My Little World নামে তার একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে।

বেলা খান : (জন্ম : ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : ফজলে আলী খাঁ। বেলা খান ফজলে আলী খাঁর কনিষ্ঠ কন্যা। তিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুল হামীদ চৌধুরীকে বিয়ে করেন। আবদুল হামীদ চৌধুরী ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের শাসনকালে তিনি কাতারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।

সালমা ইসলাম (রেখা) : (জন্ম : ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু : ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : আমীর আলী খাঁ। সালমা ইসলামের লেখাপড়া শুরু হয় নবীনগর ইচ্ছাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে। তবে স্কুলের লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগেই তার বিয়ে হয়ে যায়। এর কারণ ছিল এই যে, বাঙালি মেয়েদের তুলনায় তিনি ছিলেন খুব লম্বা। এ ধরনের লম্বা পাত্রীর জন্য উপযুক্ত পাত্র পাওয়া খুবই কঠিন। ছিল। উপরন্তু ওই সময়ে তার পিতার শরীর ভালো ছিল না। কাজেই বাইরা গ্রামে বসবাসরত দীর্ঘদেহী ও এমএ পাস নূরুল ইসলামের বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। গ্রামে থাকলেও সালমা খানের লেখাপড়ায় আগ্রহ মোটেও কমেনি। তিনি গ্রামে থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষা এবং আইএ পরীক্ষায় পাস করেন। বিএ পরীক্ষা তিনি দিয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাস করে উঠতে পারেননি। বাংলা সাহিত্যে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল এবং আমৃত্যু তিনি বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার বইপত্র পড়াশোনা করতেন। তার চার ছেলে এবং দুই মেয়ে রয়েছে।

হামীম খান: (জন্ম : ৩ জুন ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু : ৩১ মে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ)। স্বামী : ড. আকবর আলি খান। হামীম খান ১৯৪৯ সালের ৩ জুন ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ডা. মুজিবুর রহমান। ডা. মুজিবুর রহমানের পৈতৃক নিবাস সন্দ্বীপে। তিনি ১৯৩০-এর দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন এবং কলকাতায় ট্রপিক্যাল স্কুলে গবেষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। হামীম খানের জন্মের পর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য বিলাতে যান। সেখান থেকে তিনি চর্মরোগ এবং প্রাচ্যদেশীয় বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে ডিপ্লোমা অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে আসার পর উপযুক্ত পদোন্নতি না দেওয়ায় তিনি সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন এবং স্বাধীনভাবে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। তিনি সহজ ডাক্তারি নামে বাংলা ভাষায় চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপরে একটি বই লেখেন এবং সেটি খুবই জনপ্রিয় হয়।

হামীম খানের মায়ের নাম জাহানারা রহমান। জাহানারা রহমানের পিতা ছিলেন একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। জাহানারা রহমান লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে প্রথম ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন এবং ১৯৪৩ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। পঞ্চাশের দশকে বেগম জাহানারা রহমান ঢাকার বিভিন্ন সমাজসেবামূলক ক্রিয়াকাণ্ডে অংশ নেন। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মালিক ফিরোজ খান নূনের স্ত্রী ভিকারুননিসা নূনের নেতৃত্বে তিনি ঢাকায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল স্থাপনে বিশেষ অবদান রাখেন। বিশেষ করে কন্যাসন্তানদের স্কুলে পাঠাতে রাজি করানোর জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের সম্মতি আদায় করেন।

১৯৬০-এর দশকে তিনি অল পাকিস্তান উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (APWA) পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। তার মেয়াদকালে পশ্চিম পাকিস্তানের মারি শহরে APWA-এর সাধারণ সভা হয় এবং এ সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের দলের নেতৃত্ব দেন। ষাটের দশকেই তিনি APWA ছাড়াও উইমেন্স ভলান্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (WVA) সঙ্গে কাজ শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশের WVA সভাপতি নির্বাচিত হন এবং লালমাটিয়ায় মেয়েদের জন্য WVA কলেজ স্থাপনে নেতৃত্ব দেন।

হামীম খানের বড় ভাইয়ের নাম ড. এহসানুর রহমান। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিসিএস পাস করার পর যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করেন। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি হৃদরোগের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনি ডেলাওয়ার অঙ্গরাজ্যে হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।

হামীম খান সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুল থেকে ‘ও লেভেলে প্রথম শ্রেণিতে পাঁচটি বিষয়ে পাস করেন। এরপর ঢাকা হলিক্রস কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষায় দ্বাদশ স্থান অধিকার করেন। তিনি ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ফলে তাঁর এমএসসি পরীক্ষা ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৭৩ সালের দাঁড়ানো জাহানারা রহমান ও ডা. মুজিবুর রহমান। উপবিষ্ট এহসানুর রহমান এবং হামীম রহমান (শৈশবে) আগস্ট মাসে আমার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। আমি কানাডিয়ান কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে কানাডায় চলে যাই। হামীম খানও কানাডাতে চলে আসেন।

হামীমের সঙ্গে আমার বিয়ে একটি আকস্মিক ঘটনা। চাকরিতে যে বেতন পাচ্ছিলাম, তাতে আমার নিজের খরচই চলছিল না। তাই আমি বিয়ে করতে রাজি ছিলাম না। ১৯৭৩ সালে আমি সরকারি চাকরি ছেড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দিই। এই সময়ে আমি কানাডার কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়ে কানাডায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিই। আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে কানাডায় চলে যাচ্ছি–এই খবরে আমার পিতা-মাতা ভেঙে পড়েন। বিশেষ করে আমার মা দাবি করেন যে তিনি আমার সব খামখেয়ালি মেনে। নেবেন, যদি আমি বিয়ে করে বউ নিয়ে কানাডায় যাই। মায়ের কান্নাকাটিতে এবং ভাইবোনদের পীড়াপীড়িতেও আমি বিয়ে করতে রাজি হই না। এই পর্যায়ে আমার পিতা হস্তক্ষেপ করেন। তিনি আমাকে ডেকে বলেন, তার বয়স প্রায় ৮০ এর কাছাকাছি এবং তিনি বেশ অসুস্থ। চার বছর পর যদি পিএইচডি করে দেশে ফিরে আসি, তাহলে হয়তো কানাডা যাওয়ার আগে তার সঙ্গে দেখা হবে আমার শেষ দেখা। আমি তাঁর বড় ছেলে। বড় ছেলেকে নিয়ে সব পিতা-মাতারই অনেক স্বপ্ন থাকে। তিনি বললেন, তিনি স্বপ্ন দেখতেন তার বড় ছেলে তার লাশ কবরে নামাবে। তার বড় ছেলের সন্তানেরা বংশের নাম উজ্জ্বল করবে। অথচ আমি এখনো বিয়েই করিনি। যদি তিনি আমার বউকে আশীর্বাদ করে যেতে পারেন, তাহলেও মনে কিছুটা সান্ত্বনা পাবেন। এই বলে তিনি কাঁদতে থাকেন। বাবার কান্নায় আমিও ভেঙে পড়ি এবং তার প্রস্তাবে রাজি হই।

তখন আমার কানাডা যাওয়ার আর সপ্তাহ দুয়েক বাকি। কনে খোঁজার সময়ও ছিল অত্যন্ত সীমিত। আমার আম্মা এবং আমার বড় বোন বীণা আপা উপযুক্ত কনে খুঁজতে শুরু করেন। তাঁদের কাছে হামীম খান একজন। গ্রহণযোগ্য কনে বলে মনে হয়। হামীম খান আমার মামাতো ভাই আমিনুল ইসলাম চৌধুরীর স্ত্রীর ফুফাতো বোনের মেয়ে। আমিনুল ইসলাম চৌধুরী বিয়ের প্রস্তাব দেন। যে বিষয়টি সবচেয়ে আমার মাকে আকৃষ্ট করে, সেটি হলো হামীম খান একজন ভালো ছাত্রী। সুতরাং তিনি ধরে নেন যে এই কনেই তাঁর ছেলের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। আম্মা এবং বীণা আপা আমাকে পাত্রী দেখতে বলেন। আমি তাতে রাজি হইনি। তার কারণ হলো পাত্রী দেখে যদি আমি বলি যে পাত্রী আমার পছন্দ হয়নি, তাহলে সবাই ধরে নেবে আমি ফাঁকি দিতে চাচ্ছি এবং আমার বক্তব্য গ্রহণ করা হবে না। দ্বিতীয়ত, যদি একজন শিক্ষিত পাত্রী আমাকে না দেখে বিয়ে করতে রাজি হয়, তাহলে আমারও। তাঁকে বিয়ে করতে ভয় পাওয়া উচিত নয়। সুতরাং আমি দেখতে রাজি হইনি এবং বিয়ের আগে আমরা একে অপরকে দেখিনি। বয়সে আমরা ছিলাম কাছাকাছি। তিনি আমার চেয়ে সাড়ে চার বছরের ছোট ছিলেন।

বিয়ের পর দেখা গেল আমাদের মধ্যে যতটুকু মিল রয়েছে, তার চেয়েও অনেক বেশি বৈসাদৃশ্য রয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, ধর্মকর্মের ব্যাপারে ছিলাম উদাসীন। অন্যদিকে হামীম শুধু ধার্মিকই ছিলেন না, অনেক বিষয়ে ছিলেন মৌলবাদী। আমার শ্বশুর মুজিবুর রহমান সাহেবও অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। তাঁর বিশ্বাসের প্রভাব তার মেয়ের ওপরে পড়েছিল। আমি গ্রামে মানুষ হয়েছি, হামীম খানের গোটা জীবনই ঢাকা শহরে কেটেছে। সেদিক থেকেও আমাদের মধ্যে তফাত। ছিল। আমি ছোট মাছ পছন্দ করতাম, তিনি তা মোটেও পছন্দ করতেন না। আমি বাংলা গান, বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করতাম, তার পছন্দ ছিল হিন্দি গান। অনেক ছোটখাটো ব্যাপারে আমরা একমত ছিলাম না। বিয়ের প্রথম দিকে এসব নিয়ে কিছুটা খটাখটি হয়েছে, তবে হামীমের সহযোগিতার ফলে বিশেষ কোনো সমস্যা হয়নি।

আমাদের বিয়ে হওয়ার পর হামীমের কানাডার ভিসার জন্য দরখাস্ত করতে হয়েছে। তাই আমরা একসঙ্গে কানাডা যেতে পারিনি। হামীমকে মাসখানেক পর কানাডাতে আমার সঙ্গে যোগ দিতে হয়েছে। কানাডায় আসার আগে গৃহবধূর কাজকর্মে তার কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। ভালো ছাত্রী হিসেবে শুধু বই পড়তেন কিন্তু রান্নাঘরের ধারেকাছেও যেতেন না। কানাডায় যাওয়ার পর তাঁর রান্নার দায়িত্ব নিতে হয়। ঢাকা থেকে যাওয়ার আগে তাঁর মার কাছ থেকে বেশ কিছু রান্নার রন্ধনপ্রণালি লিখে নিয়ে যান। প্রথম দিকে রান্না ভালো হতো না কিন্তু কোনো রান্না ভালো না হলে তিনি হতাশ হয়ে যেতেন না। খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন কী ঠিকমতো করা হয়নি। রাঁধতে রাঁধতে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি ভালো রাঁধুনি হয়ে যান। বাড়িতে কাপড়চোপড় ধোয়া, শুকানো এবং ইস্তিরি করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। বিয়ের আগে আমি অনেক সময় ইস্তিরি ছাড়া জামাকাপড় পরতাম কিন্তু বিয়ের পর ইস্তিরি করা ছাড়া কোনো জামাকাপড় হামীম আমাকে পরতে দেননি। এমনকি আমার জুতা পর্যন্ত। তিনি পরিষ্কার করে দিতেন। একজন স্বামীকে সন্তুষ্ট করার জন্য গৃহবধূর যা করা আবশ্যক, তার সবই তিনি করেছেন।

গতানুগতিকভাবে সব স্বামীই তাঁদের স্ত্রীদের কাছে ঋণী থাকে, কিন্তু হামীম খানের কাছে আমার ঋণ শুধু গতানুগতিক নয়। তিনটি বিষয়ে তিনি আমার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রথমত, আমি যখন কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়তে যাই, তখন অঙ্ক সম্পর্কে আমার জ্ঞান ছিল সীমিত। প্রবেশিকা পরীক্ষার বাধ্যতামূলক অঙ্ক ছাড়া আমি আর কোনো অঙ্ক পড়িনি। অথচ কুইন্সের অর্থনীতি বিষয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উচ্চতর পর্যায়ের অঙ্ক জানার আবশ্যকতা ছিল। হামীম খান পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী হলেও তিনি অঙ্কে। খুবই দক্ষ ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি তাঁর কর্মজীবনে অঙ্কের শিক্ষকতাই করেছেন। অঙ্কে আমার দুরবস্থা দেখে তিনি আমাকে অঙ্ক শিখতে সাহায্য করেন। তার সহায়তার ফলেই আমার পক্ষে কুইন্সের অর্থনীতির জটিল কোর্সগুলো সুসম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। তার হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর। আমার হাতের লেখা ভালো ছিল না এবং লেখার সময়ে অনেক কাটাকাটি করতাম। তাই তিনি স্বেচ্ছায় কোর্সের জন্য প্রয়োজনীয় প্রবন্ধসমূহের কপি নিজের হাতে করে দিতেন। এর ফলে আমার সময় বেঁচে যায়।

দ্বিতীয়ত, হামীম খানের চেষ্টার ফলেই আমি সিগারেট খাওয়া ছাড়তে পেরেছি। আমার যখন বিয়ে হয়, তখন আমি ছিলাম চেইন স্মোকার। হামীম খান। বিশ্বাস করতেন সিগারেট খাওয়া না ছেড়ে দিলে আমি অল্প বয়সে মারা যাব। তাই সিগারেট খাওয়া নিয়ে আমাদের দুজনের প্রায়ই প্রচণ্ড ঝগড়া হতো। কিন্তু তিনি কোনোমতেই এ ব্যাপারে আপস করতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত এ লড়াইয়ে আমি হেরে যাই। এর কারণ হলো ১৯৭৭ সালে আমার আলসার হয় এবং আলসার থেকে রক্তপাত হওয়ার পরে আমাকে হাসপাতালে থাকতে হয়। ডাক্তাররা তখন বলেন যে সিগারেট খাওয়া বন্ধ না হলে ঘন ঘন আলসার হতে পারে। সুতরাং দীর্ঘজীবন চাইলে আমাকে সিগারেট খাওয়া ছাড়তে হবে। এ সময়ে আমাদের মেয়ের জন্ম হয়েছে। হামীম খান তখন প্রায়ই কাঁদতেন এই বলে যে তাঁর মেয়ে অদূর ভবিষ্যতে পিতাকে হারাবে। হামীম খানের চাপ, ডাক্তারদের হুঁশিয়ারি এবং মেয়ের জন্য ভালোবাসার ফলে আমার মধ্যে একটা বড় পরিবর্তন আসে। আমি ১৯৭৭ সালে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিই। সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে সব ঝুঁকি দূর হয়ে যায় না। সব ঝুঁকি দূর হতে কমপক্ষে ১০ বছর সময় লাগে। প্রায় ৪৫ বছর হলো আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। হামীম খান এবং আমার কন্যা উভয়ই পরলোকগমন করেছেন কিন্তু এখনো আমি বেঁচে রয়েছি। হামীম খানের কল্যাণেই সম্ভবত আমার জীবন দীর্ঘ হয়েছে।

তৃতীয়ত, হামীম খান কোনো দিনই হারাম উপার্জনকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি বেশি টাকা চাইতেন না কিন্তু চাইতেন যেন সব রোজগার হালাল হয়। সরকারি চাকরিতে অনেক প্রলোভন রয়েছে। এই প্রলোভন থেকে আত্মরক্ষা করতে হলে অবশ্যই কর্মকর্তাকে ঘুষ ও অবৈধ উপার্জনকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতে হয়। এই ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাকে সাহায্য করতে পারেন তাঁর স্ত্রী ও তাঁর পরিবার। যদি সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী ও পরিবার সহজ-সরল জীবনযাত্রায় সন্তুষ্ট থাকেন এবং অবৈধ অর্থকে ঘৃণা করেন, তাহলেই সরকারি কর্মকর্তার পক্ষে সৎ থাকা অনেক সহজ হয়। হামীম খান সারা জীবনই অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেছেন। তিনি সৎ থাকার জন্য আমাকে সমর্থন করেছেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করতে পারি। ঘটনাটি ঘটেছিল আমি যখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলাম। ঈদুল আজহার সময় অনেক করদাতা ও কর কর্মকর্তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের নেকনজরে আসার চেষ্টা করতেন। ঈদুল আজহার সময় তাঁদের অনেকেই খাসি ও গরুর রান চেয়ারম্যানের বাসায় পাঠাতেন। আমি ও হামীম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে এ রকম কোনো মাংস এলে তা কোনোমতেই গ্রহণ করা হবে না এবং তা ফেরত দিয়ে দেওয়া হবে।

ঈদের দিন বিকেলবেলা আমি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্য তার বাসায় যাই। সে সময়ে হামীম খান একা বাসায় ছিলেন। একটি মাইক্রোবাসে করে এক ভদ্রলোক বিরাট একটি গরুর রান নিয়ে আসেন। তিনি দাবি করেন টি রহমান সাহেব কোকো লঞ্চ কোম্পানির পক্ষ থেকে এ রান পাঠিয়েছেন। এটি যেন রাখা হয়। আমার স্ত্রী নির্দেশ পাঠালেন কোনো অবস্থাতেই এটি রাখা হবে না এবং এটি যেন ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়। বাহক বিড়বিড় করে হুমকি দিতে দিতে চলে যান।

আমি আসার পর আমার স্ত্রী আমাকে প্রশ্ন করেন, কোকো লঞ্চ কোম্পানির টি রহমান কে? তার মাংস আমি ফেরত দিয়ে দিয়েছি। আমি বললাম, তিনি প্রধানমন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ পুত্র। আমি তাকে আরও বললাম, আমি নিজে বাসায় থাকলে এভাবে ফেরত দিতে আমার ভয় হতো কিন্তু তুমি আমাকে এ ঝামেলা থেকে বাঁচিয়েছ। এখানে একটি সত্য কথা অবশ্যই লিপিবদ্ধ করতে হবে যে আমি যত দিন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলাম, তত দিন প্রধানমন্ত্রীর। পরিবারের পক্ষ থেকে কর সম্পর্কে কখনো কোনো তদবির আমার কাছে করা হয়নি। অনুরূপভাবে আমি যখন অর্থসচিব ছিলাম, তখনো পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর পরিবার এবং অফিস থেকে কখনো কোনো তদবির পাইনি।

বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে হামীম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করতে পারেননি। কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর সেখানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির জন্য তাকে নিয়ে যাই। বিভাগীয় প্রধান তার সুপারভাইজারের প্রশংসাপত্র দেখতে চাইলেন। তার সুপারভাইজারও (খুব সম্ভব ড. সিদ্দিক) কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের গ্র্যাজুয়েট স্কুলের প্রধান ছিলেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী। হামীমের প্রশংসাপত্র পড়ে তিনি বললেন, আমি তোমাকে সরাসরি এমএসসি ক্লাসে ভর্তি করে নিলাম। এমএসসি পরীক্ষার ভর্তি ফি এবং অন্যান্য ব্যয় অনেক বেশি। সুতরাং যাতে কোনো আর্থিক অসুবিধা না হয়, সেহেতু তিনি হামীমকে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট করার প্রতিশ্রুতি দেন। দু-তিন। দিন ক্লাস করার পর হামীম খান ঠিক করলেন যে তিনি পড়াশোনা করবেন না। অনেক বোঝানোর পরও তিনি তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। তিনি কুইন্সের পদার্থবিজ্ঞানের প্রধানকে জানিয়ে দেন যে ব্যক্তিগত কারণে তিনি এখন ভর্তি হবেন না। তার ভর্তি না হওয়ার একটি বড় কারণ ছিল আমাদের কোনো গাড়ি ছিল না। সুতরাং বাসে করে ক্লাসে যেতে তাঁকে ঠান্ডার মধ্যে কিছুটা পথ হাঁটতে হবে। এটি করতে তিনি রাজি ছিলেন না। তিনি ঘুমাতে পছন্দ করতেন। তখন আমরা জানতাম না কী জন্য তিনি ঘুমাতে পছন্দ করতেন। ১৯৯০-এর দশকে ধরা পড়ে তিনি muscular distrophy নামে একটি স্নায়বিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। তার ব্যাধিকে সংক্ষেপে মায়োটনিয়া (myotonia) বলা হয়ে থাকে। এই রোগে শরীরের বিভিন্ন পেশি অকেজো হয়ে যায় এবং আস্তে আস্তে এ রোগ ছড়াতে থাকে। বিশেষ করে হৃৎপিণ্ডের পেশি এ রোগে আক্রান্ত হলে রোগীকে বাঁচানো

সম্ভব হয় না। ১৯৯০ সালে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন বাংলাদেশ দূতাবাসে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত ছিলাম, তখন ডাক্তারের পরামর্শে তাকে টেস্ট করা হয়। টেস্ট করার পর প্রমাণিত হয় যে তার মায়োটনিয়া হয়েছে। বাইরের দিকে স্বাভাবিক থাকলেও ভেতরের দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। প্রায়ই মৃত্যুর কথা বলতেন। অনেক রাতে বুকে ব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠতেন। এ ধরনের রোগীদের অস্ত্রোপচারের ব্যাপারে খুবই সাবধান হতে হয়। ২০১৬ সালে তার অন্ত্রনালিতে কোনো প্রদাহ আছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে এন্ডোসকোপি (endoscopy) করার জন্য ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের ডাক্তারদের জানানো হয় যে যেহেতু তার মায়োটনিয়া রয়েছে, সেহেতু অস্ত্রোপচারের জন্য কোনো চেতনানাশক পদার্থ প্রয়োগ করার আগে বিশেষ সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। ইউনাইটেড হাসপাতালের ডাক্তাররা সতর্কতা অবলম্বন করেননি। তারা দাবি করেন যে স্বল্পমাত্রায় চেতনানাশক ব্যবহার করলে কোনো অসুবিধা হবে না। ডাক্তাররা যে মাত্রার চেতনানাশক ব্যবহার করেছিলেন, তা আমার স্ত্রী সহ্য করতে পারেননি। ফলে তাঁর হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। অনেক কষ্টে হৃৎপিণ্ড চালু করার পরও তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। দুদিন পর তিনি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যান। ইচ্ছা করলে হাসপাতালের বিরুদ্ধে আমি ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারতাম। আদালত হয়তো আমাকে ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতেন কিন্তু আমার স্ত্রীর প্রাণ তো আর ফিরে আসত না। তিনি ছিলেন আমার পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। আমি হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিইনি কিন্তু আল্লাহ নিশ্চয়ই দোষীকে শাস্তি দেবেন।

ছোটবেলায় হামীমকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করতেন যে বড় হয়ে তিনি কী হতে চান, তিনি উত্তর দিতেন মাদাম কুরি। বাংলাদেশের মাদাম কুরি হওয়া ছিল তাঁর লক্ষ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার ফলাফল দেখে মনে হচ্ছিল যে তিনি হয়তো একজন বড় বিজ্ঞানী হবেন। বিয়ের পর পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ায় তাঁর পক্ষে বিজ্ঞানী হওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বিজ্ঞানে গবেষণা না করলেও তিনি অঙ্কের শিক্ষকতা শুরু করেন। ঢাকার সানবীমস স্কুলে ২০ বছর ধরে তিনি প্রায় হাজারখানেক ছাত্রছাত্রীকে যত্ন করে অঙ্ক শিখিয়েছেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা বাংলাদেশে নিশ্চয়ই বিজ্ঞানের গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। যদিও হামীম খান মাদাম কুরি হতে পারেননি, তিনি মাদাম কুরি গড়ার কারিগর হওয়ার জন্য সারা জীবন কাজ করে গেছেন।

নেহরীন খান : (জন্ম : ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু : ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : ড. আকবর আলি খান। নেহরীন খান ১৯৭৭ সালের ১২ জুলাই তারিখে কানাডার কিংস্টন শহরের জেনারেল হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করে। ১৯৭৯ সালে মা-বাবার সঙ্গে সে দেশে ফিরে আসে। ১৯৮০ সালে তাকে কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে ভর্তি করা হয়। কিন্তু স্কুল তার মোটেও ভালো লাগত না। ক্লাসরুমে যাওয়ার পরই সে তার আম্মার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দিত। ১৯৮১ সালে তাকে ধানমন্ডির সানবীমস স্কুলে ভর্তি করা হয়। তার মা সে সময় সানবীমস স্কুলে অঙ্কের শিক্ষকতা শুরু করেন। মা স্কুলে থাকার ফলে সানবীমসে সে আর কান্নাকাটি করত না। ১৯৮৭ সালে তার বাবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসে ইকোনমিক মিনিস্টার পদে বদলি হন। নেহরীন মন্টগোমারি কাউন্টিতে বেভারলি ফার্মস স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। এরপর পোটোম্যাকের হার্বার্ট হুভার নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দুই বছর পড়ে। ১৯৯১ সালে সে ঢাকায় ফিরে আসে। ঢাকায় ফিরে ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা দেয়। পরে এসব পরীক্ষার ফল ভালো হয়নি। তার মায়ের ধারণা ছিল যে তার মেয়ে তার মতোই মেধাবী। সুতরাং সে একজন বিজ্ঞানী হবে এবং খুব সহজেই বিজ্ঞান বিষয়ে সে ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল পাস করবে। এখানে তার মা একটি বড় ভুল করেছিল। নেহরীনের বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ ছিল না। সে গল্প শুনতে পছন্দ করত। ইতিহাস পড়ায় তার আগ্রহ ছিল। সাহিত্যের বদলে বিজ্ঞান চাপিয়ে দেওয়াকে সে সহজে মেনে নিতে পারেনি। তবু সে মায়ের দাবি পূরণ করার চেষ্টা করত। ছোটবেলায় তার হাতের লেখা ছিল খারাপ। তার হাতের লেখাকে ভালো করার জন্য সে যখন লিখত তখন মা তার পাশে বসে থাকতেন এবং লেখা খারাপ হলে আঙুলে আঘাত করতেন। সে কান্নাকাটি করত। প্রায় বছরখানেক কান্নাকাটি করার পর সে তার হাতের লেখা পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়। মা ধরে নেন যে নেহরীন হাতের লেখা পরিবর্তনের মতো বিজ্ঞানশিক্ষাতেও সাফল্য অর্জন করবে। কিন্তু সেটি কোনোমতেই সম্ভব হয়নি। আমি তাকে জোর করে বিজ্ঞান পড়ানোর বিরোধী ছিলাম। এমনকি আমি তাকে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম সে বাংলা মিডিয়ামে ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে দেশের অন্য ছেলেমেয়েদের মতো লেখাপড়া করুক। তার মা এতে মোটেও রাজি ছিলেন না। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলা মিডিয়ামের মান নিচু। হয়তো তার মায়ের বক্তব্য সঠিক কিন্তু অন্যদিকে নেহরীনের একটি বড় লোকসান হয়ে যায়। বাংলা মিডিয়ামে পড়লে তার অনেক বন্ধু হতো কিন্তু ইংরেজি মিডিয়ামে পড়তে গিয়ে সে তার প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত যখন প্রমাণিত হলো যে নেহরীনের পক্ষে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়া সম্ভব নয়, তখন তাকে নবপ্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে ভর্তি করা হয়। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের শেষ পর্যায়ে নেহরীন খানের বাবা বিশ্বব্যাংকে বিকল্প নির্বাহী পরিচালক পদে মনোনীত হন। সে বাবার সঙ্গে আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে ওয়াশিংটনে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে (The American University at Washington D.C) ভর্তি হয় এবং ২০০৫ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ ডিগ্রি অর্জন করে। সে দেশে ফিরে পুনরায় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয় এবং সেখান থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি অর্জন করে।

কর্মজীবন : নেহরীন খান ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেয়। এক সেমিস্টার পড়ানোর পর সে ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউডা) এ প্রভাষক হিসেবে যোগ দেয় এবং কিছুদিন পর সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পায়। ২০১৬। সালে তার অকালমৃত্যু পর্যন্ত সে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সে ভিক্টোরিয়ান সাহিত্য, রোমান্টিক সাহিত্য ও শেক্সপিরিয়ান সাহিত্য পড়াত।

জীবনের ছোট গণ্ডি : আমার একমাত্র সন্তান নেহরীন খান তার আত্মজীবনীর খসড়ায় লিখেছে, ‘My parents also doted on me but now as I remember my childhood I think I was being protected as well as being spoilt. I had no friends at that age. My friends were my grandparents, my father and my mother.’ বয়স বাড়লে সে তার নিজের বয়সী বন্ধুদের পরিবারের মধ্যেই খুঁজে পায়। তার বন্ধু ছিল হামীমের খালাতো বোন লিনেটের মেয়ে ফারাহ। হামীমের ছোট মামা মাহমুদ হাসান (যিনি অগ্রণী ব্যাংকের এজিএম ছিলেন)। তার দুই মেয়ে টুইংকেল এবং টিনা ও হামীমের মেজ মামা শামসুল আলম (যিনি ছিলেন চট্টগ্রামের চা ব্যবসায়ী) তার মেয়ে নীলা ছিল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এ ছাড়া প্রতিবছর আমার ছোট ভাই জসীম এক মাসের জন্য ছুটিতে তার দুই মেয়ে জারা ও জেবাকে নিয়ে ঢাকায় বেড়াতে আসত। তা ছাড়া ঢাকায় ছিল আমার ছোট ভাই কবীরের বড় মেয়ে তিথি। এরা একসঙ্গে খেলত। তবে পরিবারের বাইরে তার কোনো বন্ধু ছিল না।

সারা জীবনই নেহরীন তার বাবা এবং মাকে সবচেয়ে বড় বন্ধু মনে করত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন তার বাবা প্রতিদিন তাকে সকালে স্কুলে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যেতেন এবং রাতে ক্লাস থাকলে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। একবার ওয়াশিংটন ডিসিতে গুপ্তঘাতকের প্রকোপ দেখা দেয়। এই সময়ে নেহরীন খানের পিতা তাকে সব সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যেতেন এবং নিয়ে আসতেন। একবার তারা যখন বাসায় ফিরছিলেন, তখন পুলিশ তাদের সামনে দিয়ে ঘাতকের গাড়ি তাড়িয়ে নিয়ে যায়। নেহরীন পিতার সাহচর্য খুবই পছন্দ করত। যেদিন সে মারা যায়, সেদিন সকালে সে তার পিতার কপালে হাত দিয়ে আশীর্বাদ করছিল। তার পিতা তাকে জিজ্ঞেস করেন কী হয়েছে, মা? সে জবাবে বলল যে তার পিতা সজাগ আছে কি না সেটা দেখছে। তার মৃত্যুর পর তার পিতার মনে হয় সে তার বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেছে।

নেহরীনের বিশ্বাস ছিল, তার মা তাকে যেকোনো বিপদ বা অকল্যাণ থেকে রক্ষা করবেন। ছোটবেলায় তাকে একটি গল্প শোনানো হতো, গল্পটি ছিল এ রকম–একটি হাতির বাচ্চাকে দুষ্ট লোকেরা চুরি করে। নেহরীন এ গল্প বিশ্বাস করতে অস্বীকার করে। সঙ্গে সঙ্গে সে প্রশ্ন করে, ‘হাতির মা কী করল?’ তার বিশ্বাস ছিল যে হাতির বাচ্চার মা-বাবা নিশ্চয় তাকে রক্ষা করবে। এ ধারণাটি অবশ্যই ভুল। নেহরীন তার জীবন দিয়ে শিখে গেল বাবা-মা সব সময় তাঁর সন্তানকে রক্ষা করতে পারেন না।

নেহরীনের অসমাপ্ত গবেষণা : নেহরীন তার স্বল্পস্থায়ী জীবনে তিনটি বিষয়। নিয়ে গবেষণা করেছে। প্রথম বিষয়টি হলো ইংরেজিতে যাকে বলে Home, বাংলায় যাকে বলা যেতে পারে ঘর। নেহরীন সারা জীবন ঘর খুঁজে বেড়িয়েছে। জন্ম তার কানাডায়। প্রায় দেড় বছর বয়সে কানাডা থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসে। আবার ১০ বছর বয়সে চার বছরের জন্য পিতার তত্ত্বালীন কর্মস্থল আমেরিকাতে চলে যায়। চার বছর আমেরিকায় থাকার পর দেশে ফিরে আসে। দেশে ফিরে এসে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি শেষ করার আগে আবার ২০০২ সালে তিন বছরের বেশি সময়ের জন্য পিতার কর্মস্থল আমেরিকাতে যায় এবং বছর তিনেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকে। বাংলাদেশ, কানাডা এবং আমেরিকায়। বারবার যাওয়া-আসার ফলে তার অভিবাসী সাহিত্যের ব্যাপারে আগ্রহ জন্মে। ভারতী মুখার্জি, ঝুম্পা লাহিড়ী, মণিকা আলী প্রমুখ ছিল তার প্রিয় লেখক। অভিবাসীদের সত্তাসংকট বা Identity crisis ছিল তার আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার বিষয়। নেহরীন লক্ষ করে যে অভিবাসীদের মধ্যে ঘরে ফেরার একটি প্রচণ্ড ঝোঁক রয়েছে কিন্তু অর্থাভাবে তারা কম বয়সে দেশে ফিরতে পারে না। যখন তাদের অর্থাভাব দূর হয়, তখন তারা দেশে ফিরতে চায়; কিন্তু দেশে ফিরে দেখতে পায়, যে দেশ ছেড়ে তারা গিয়েছিল, সে দেশ আর নেই। কালের বিবর্তনে সে দেশ হারিয়ে গেছে এবং এখন যে দেশ, সে দেশকে সে চেনে না। এ প্রসঙ্গে সে লিখেছে :

The immigrants imagine that their old home is like Keats’s Grecian Urn where nothing changes. The returning immigrants discover to their utter surprise that their dear and near ones have either passed away or changed. The new inhabitants in their homeland are unknown. The homeland that is vivid in their mind does not exist any longer.

তার গবেষণার দ্বিতীয় বিষয় ছিল মোনালিসা। ১৯৯৮ সালে নেহরীন আমার সঙ্গে প্যারিস লুভ জাদুঘরে লেওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসার ছবি দেখতে যায়। ছবিটি দেখে সে লেখে :

One thing that struck me as I looked on was how alive and real she looked. This picture portrays an actual woman of flesh and blood. She had lustreous almond shaped eyes with a watery sheen on them. She had quite visible eyebrows and eyelashes. It was so clear a picture that even the hair ends from her forehead could be seen. She looks so much alive that she seem to look back at the onlooker. Even the shadow of her nose was visibles and the fleshy inside of her nostrils were visible. Her lips curved into a pleasing smile though her face wore a melancholy look. Leonardo da Vinci copied every little cletail and every little line bring the portrait to life.

মোনালিসাকে নিয়ে গবেষণা করতে করতে সে আমাদের ঘরের মধ্যেই তার এক দোসর খুঁজে পায়। এ দোসরের নাম হলো লিপি। লিপি নেহরীনের ফুফাতো বোন। সে কানে শুনত না এবং কথা বলতে পারত না। অথচ সে সুন্দরী ছিল, চটপটে ছিল এবং জীবনকে ভালোবাসত। তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার একটি ছেলে, একটি মেয়ে হয়েছিল। কিন্তু স্বামী, ছেলেমেয়ে তাদের কারোর সঙ্গেই তার পুরোপুরি সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মোনালিসার সঙ্গে তুলনা করে সে লিখেছে :

Mona Lisa has a smile like her but Mona Lisa does not say anything and she is just a painting. But my cousin is a real human being. Mona Lisa will always remain smiling and she can never change her expression but my cousin can because she is capable of all emotions and can express them all. I dreamt of speaking to Mona Lisa because it is easy to do so but it is not at all easy to dream of speaking to Lipi. I wanted to hear Mona Lisa’s voice and I did in my dreams but I cannot hear my cousin speak. I would do anything to make her say a full sentence.

তার অসমাপ্ত নোটগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে সে মোনালিসা, লিপি এবং হেলেন কেলারকে নিয়ে একটি গল্প লেখার চেষ্টা করছিল। তিন নায়িকা সম্বন্ধেই আলাদা আলাদাভাবে অনেক কিছুই লিখেছে। এগুলো একত্র করলে হয়তো একটি সুন্দর গল্প রচিত হতে পারত।

নেহরীনের তৃতীয় গবেষণার বিষয় ছিল ভারতে মহিলাদের অবস্থান। নেহরীন শুধু ভারতীয় মহিলাদের আর্থিক দুরবস্থা নিয়েই চিন্তিত ছিল না, সে ভারতীয় মহিলাদের সামাজিক দুরবস্থা নিয়েও অনেক বেশি চিন্তিত ছিল। এ জন্য প্রয়োজন মহিলাদের চেতনার সম্প্রসারণ। এ সম্পর্কে লেখার জন্য সে আরও পড়াশোনা করছিল। নেহরীন খান কোনো লেখাই শেষ করে যেতে পারেনি। তবে তার লেখার জন্য যেসব নোট সে করেছিল, তা পড়লে বোঝা যায় যে তার অনেক সুন্দর লেখার সম্ভাবনা ছিল। এ লেখাগুলো পড়লে রবীন্দ্রনাথের উক্তি মনে পড়ে :

‘যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে
যে নদী মরু পথে হারালো ধারা
জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।’

পাদটীকা

১. আদিতে রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির সদস্যরা ‘ঁ’ দিয়ে খাঁ শব্দটি লিখত। ষষ্ঠ প্রজন্ম হতে অনেকে ‘ঁ ‘ দিয়ে খাঁ শব্দ লেখার পরিবর্তে খান লিখে থাকেন। এই রচনায় সপ্তম প্রজন্মের সদস্যদের খান লেখা হয়েছে এবং এর পূর্বের প্রজন্মের সদস্যদের ক্ষেত্রে খাঁ লেখা হয়েছে।

২. শামসুন নাহার খান, একটি নিমেষ, ১৯৮৫, প্রকাশক আনোয়ার আলী খাঁন, ঢাকা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *