মহাসিন্ধুর ওপার থেকে
ধর্মীয় সংগীতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও বিবর্তন
প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
.
মানালিকে
অনেক ডাক্তারি হল… এসো, এবার সুরে ফেরা যাক
.
প্রাককথন : আলাপ ও বিস্তার
সংগীত। জাদুশব্দে মোড়া আরেক ভুবন। আরেক জগৎ, গ্যালাক্সি, মিল্কি ওয়ে এবং ব্ল্যাকহোল। সংগীত বলতে ঠিক যে আমরা কী বুঝি তা হয়তো নিজেরাও জানি না। সংগীত কি শুধুই বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ, সনাতনি শ্লোকবিন্যাস অথবা উপনিষদ-এর শ্রুতিযোগ? নাকি মুনলাইট সোনাটা, গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টস, বাখ, মোৎসার্ট, চাইকোভস্কির স্বরলিপির জাদু? নাকি আউল-বাউল-লোকসংগীত-লোরচন্দ্রাণী, কবিরের দোঁহার কুয়াশা অথবা রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ পাড়ানির কড়ি?’
মনে হয় না এতসব কিছু দিয়েও বোঝানো যেতে পারে ‘সংগীত’-এর প্রকৃত মর্মার্থ। আসলে এর উত্তর বোধহয় লুকিয়ে রয়েছে আমাদেরই সত্তায়। এ এক প্রাকৃত সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক যা নিহিত রয়েছে সদ্যোজাতের কান্না থেকে শুরু হয়ে শ্মশানবন্ধুদের ‘হরিবোল’ ধবনির পরতে পরতে। ‘ইহা অনস্বীকার্য’।
যদিও ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘Mousike’ থেকে এর আবির্ভাব যার অর্থ—‘(art) of the muses’,১ তবু মনোবীক্ষণের বিচারে সৃষ্টির আদিপর্বে মানবসভ্যতার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের সমান্তরালেই এর উৎস। ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিস রচনার মূলস্রোতের বিপরীতে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ড. স্যামুয়েল জে. ফ্লেচার বলেছিলেন, ‘ক্রোম্যাগনন’ বা আদিমানব-শ্রেণিভুক্ত নিয়ানডারথালদের হাতেই প্রথম সংগীতের নথিকরণ।’২ মৃত বন্যপশুর ফাঁপা হাড় ঘাঁটতে গিয়ে এরাই প্রথম নাকি বের করেছিল সুর। যদিও তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয় বলেই স্বীকৃত। এই আদিমানবরাই প্রথম মেঘের ডাক, বৃষ্টির আওয়াজ, পাখির কুহু, ঝরনার ধবনি ও শিকারের শব্দে সংগীতের স্বাক্ষর চিনতে পারে।৩
মানবসভ্যতার বিকাশে এমন একটি সময় ছিল যখন মানুষ মুখে মুখেই ভাবের তথা জ্ঞানের আদান-প্রদান করত। লিপি বা বর্ণমালা তখনও অনাবিষ্কৃত। লব্ধজ্ঞান উত্তরসূরিদের মুখে মুখে বংশপরম্পরায় ঘুরত। আমাদের দেশে একে ‘শ্রুতি’ বলা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে এই ‘সময়’ এখন থেকে অন্তত আনুমানিক সাত-আট হাজার বছর আগের। কথিত আছে এই ‘শ্রুতি’-র একটি সাংগীতিক রূপ ছিল যা অনায়াসরপ্ত।৪ প্রাচীন পুথিতে পরবর্তীকালে লেখা প্রার্থনা, পূজাপাঠের মন্ত্র, জাদুবিদ্যা, মহাকাব্য, বীর অথবা শোকগাথা ইত্যাদিতে সংগীতের এক বিরাট প্রভাব আজও লক্ষণীয়। শুধু ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবীর সমস্ত সভ্য দেশের ইতিহাসও এই একই স্বাক্ষ্য বহন করে।
পৃথিবীর প্রাচীনতম তিনটি পুথি বা গ্রন্থ এক্ষেত্রে উদাহরণযোগ্য। সুমেরীয় সভ্যতার গিলগামেশ, প্রাচীন মিশরীয়দের মৃতের লিপি (The Egyptian Book of the Dead ) এবং বৈদিক ভারতের ঋগবেদ। বয়সের দিক থেকে ঋগবেদ এবং লিপির বয়সানুসারে গিলগামেশ সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। গিলগামেশ মহাকাব্য প্রাচীন সেমেটিক বা সুমেরীয় সভ্যতার এক অতুলনীয় দান যা মাটির ফলকের উপর ‘ক্যুনিফর্ম’ লিপিতে খোদিত। এর ভাষা আক্কাদিয়।৫
মিশরীয়দের মৃতের লিপি ৬ হল অবিস্মরণীয় কিছু মন্ত্রের অনবদ্য সংকলন। মন্ত্রগুলির মধ্যে বেশ কিছু শোকগাথা (elegy) এবং কিছু জাদুমন্ত্র (magical witch-craft rhymes) রয়েছে। কিছু কিছু প্রার্থনাও রয়েছে অবশ্য একই সঙ্গে। এইসব মন্ত্রগুলি ‘হাইয়ারোগ্লিফিকস’ নামক চিত্রলিপিতে ‘প্যাপিরাস’ পাতার ওপর লেখা। কিছু কিছু লিপি আবার প্যাপিরাসের বদলে ‘পার্চমেন্ট’ বা চামড়াতেও লেখা হয়েছে। এগুলি বেশিরভাগই ‘পিরামিড টেক্সট’ যা বিভিন্ন মন্দির বা সমাধিতে খোদিত।
ঋগবেদ তার চারটি ভাগ অর্থাৎ সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও সূত্র ছাড়াও ১০টি মণ্ডল, ১০২৮টি ঋক বা মন্ত্র নিয়ে এক বিশাল আর্য-কীর্তি।৭ এটি সম্ভবত বৈদিক সংস্কৃতে এবং কিয়দংশে প্রত্ন-খরোষ্ঠিলিপিতে লেখা হয়েছিল নানা ধরনের ভূর্জপত্রে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার জেমস প্রির্চাড ও টি. জি. অ্যালেনের মতানুসারে এই সবক-টি গ্রন্থই আনুমানিক সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো এবং এ সবক-টিরই প্রথম মাধ্যম ছিল সংগীত। সেই সময় এই সমস্ত লিপিই রীতিমতো মুখস্থ করে সুর করে গেয়ে গেয়ে ‘manifest’ করা হত। আরও প্রাচীন তিববতীয় ধর্মগ্রন্থ ও প্রাচীন চিনাভাষার লিপিতেও ভাষা ও ভাবের সাংগীতিক প্রকাশের সাক্ষ্য মেলে।
প্রকৃতপক্ষে মনুষের জীবনে সংগীতের বিবর্তন প্রকৃতিজাত। প্রাকৃতিক শব্দ, পাখির ডাক, জন্তুজানোয়ারের আওয়াজই মানুষের সাংগীতিক বোধের প্রথম প্রত্ন বর্ণমালা। এভাবেই আমরা মিল খুঁজে পাই জাপানি শাকুহাসি (Shakuhaci) এবং নিয়ানডারথালের হাড়ের বাঁশির ভেতর। সামবেদ-এও এর প্রভাব লক্ষণীয়। আর্যসভ্যতার পথ ধরে আমরা একে একে মিশরীয়, চৈনিক, গ্রিক, সুমেরীয়, তুর্কি, আরবি ও জাপসংগীতের মধ্যে খুঁজে পাই সেই অমোঘ ‘বৈপরীত্যের মেলবন্ধন’। বিখ্যাত আরব-পণ্ডিত আল-ফারাবির লেখা কিতাব আল-মিউসিকি আল-কবির ৮ আমাদের চিনতে শেখায় ইসলামি সংগীতের মুনশিয়ানা ও অভাবনীয় বিবর্তনের ধারাবাহিকতাকে। বিশ্বসাংগীতিক বিবর্তন ও ধর্মীয়-সামাজিক-রাজনৈতিক রীতিনীতিস্থ সংগীতের এক উজ্জ্বল দলিল এই বইটি। পৃথিবীতে এরকম বই আগামী একশো বছরেও আর লেখা হবে কিনা সন্দেহ!
মধ্যযুগের গোড়ায় (৫০০ – ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ)৯ পাশ্চাত্যের ইউরোপীয় সংগীতে আসে এক বিরাট পরিবর্তন। এই সময়ের একমাত্র সাংগীতিক ভাবধারা আমাদের কাছে পরিস্ফূট হয়ে ওঠে রোমান ক্যাথলিক চার্চের স্তবগাথার মধ্য দিয়ে, যাকে আমরা ‘গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টস’ নামে জানি। প্রথম প্রথম এই ‘চ্যান্টস’ ক্যাথলিক চার্চের যাজক শ্রেণিভুক্ত কোনো বিশেষ পুরুষ অথবা নারীর কণ্ঠে ধবনিত হত।
পরবর্তীকালে রেনেসাঁস যুগে (১৪০০ – ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ) এবং তার মধ্যভাগে (১৫০০ খ্রিস্টাব্দ) একে একে বিভিন্ন সুরকার, গায়ক এবং বাদ্যযন্ত্রীরা একত্রিত (Chorus) হয়ে নানা পবিত্র ‘চ্যান্টস’ রচনা করেন, যা গুটেনবার্গের সদ্য আবিষ্কৃত ছাপাখানার দৌলতে বহুলভাবে প্রচারিত হয়ে প্রচুর মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়।
বারোক (Baroque)১০ যুগে (১১০০ – ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) আবির্ভাব হয় প্রথম অপেরার যেখানে একই সঙ্গে সমবেত মহিলা গোষ্ঠীর সংগীতের (Contrapuntal chorus music) প্রকাশ ঘটে।
রেনেসাঁস যুগ থেকে মহিলাদের চার্চ-সংগীতে অংশগ্রহণ করা অনেক জায়গাতেই শুরু হয়েছিল—মধ্যযুগে যা একেবারেই অভাবনীয়। বারোক যুগে যেন এর পূণর্জন্ম হয়। জার্মান বারোক সংগীতকারেরা এর বিকাশে অগ্রগণ্য ভূমিকা নেন। এই সময়েই ছোটো ছোটো নানান রচনা বা ‘composition’-এর উদ্ভব হয়। উদ্ভব হয় একই সঙ্গে নানান তারের যন্ত্র, ব্রাশ, ড্রামস এবং ‘wood winds’ বা বাঁশির। সেই সঙ্গে উঠে আসে কয়্যার, পাইপ-অর্গ্যান, হারপিসকর্ড এবং ক্ল্যাভিকর্ডের রমরমা উপস্থিতি। এই সময়েই বহু সাংগীতিক ধারা বা মিউজিকাল ফর্মের আত্মপ্রকাশ। আত্মপ্রকাশ ঘটে সোনাটা ও কনসার্টের। ক্ল্যাসিকাল যুগে (১৭৫০ – ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে) এর ব্যাপ্তি আরও প্রশস্ত হয়। সোনাটা ও কনসার্টের পাশাপাশি উঠে আসে ‘সিম্ফনি’। জোসেফ হেইডন ও উলফগ্যাং ম্যোৎজার্ট এই সময়ের দুই চির উজ্জ্বল সংগীত জ্যোতিষ্ক।
উনিশ শতকের রোম্যান্টিক যুগের (১৮০০ – ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ)১১ পথনির্দেশকরূপে এগিয়ে আসেন লডউইগ ভন বিঠোফেন ও ফ্রানজ শ্যুবার্ট। এই রোম্যান্টিক যুগেই প্রথম সংগীতের বিষয়, বৈশিষ্ট্য, সামাজিক দায়বদ্ধতা ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর ভাবনাচিন্তা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়। ভাবনা চলে সংগীতের এই ক্রমবিবর্তনকে আরও নতুন রূপে, আলাদা মাত্রায় ও সৃজনশীলতার ছোঁয়ায় রাঙিয়ে তোলার। এই যুগেরই শেষ প্রান্তে অর্কেস্ট্রা, কনসার্ট-এর নাটকীয় রূপান্তর ঘটে যায় তৎকালীন গ্রামীণ ও নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় প্রবল ব্যাপ্তির মধ্য দিয়ে।
বিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় সংগীতের ছন্দ, শব্দ ও ‘স্টাইল’ নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়। মাতামাতি চলে এর সহজলভ্যতায়, দর্শক বা শ্রোতাদের চাহিদায় এবং পুঁজিবাদী সমাজে এর গ্রহণীয়তা নিয়েও। ইগোর স্ত্রাভিনস্কি, স্ক্রোয়েনবার্গ ও জন কেজ-এর মতো কিংবদন্তিরা এখানে তাদের সংগীত প্রতিভার প্রভূত উজ্জ্বল নিদর্শন রেখে এই বিংশ শতাব্দীতেই সূচনা করেন জ্যাজ-সংগীতের (Jazz Music)। সে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়!
এবার তাকানো যাক ভারতীয় উচ্চাঙ্গ বা মার্গসংগীতের স্বর্ণযুগের দিকে। হিন্দুসভ্যতার প্রচুর পুথি, ভার্স্কয ও চিত্রশিল্পে প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের উদাহরণ পাওয়া যায়। উদাহরণ পাওয়া যায় ঋগবেদ ও সামবেদ-এর মন্ত্রে। প্রাচীন ভারতে সংগীতবিদ্যা বহুযুগ ধরেই চলে আসছে। হিন্দুধর্মের প্রাচীন সংগীতকোষ সংগীত রত্নাকর-এ অনেক সংগীতাচার্যের নাম পাওয়া যায়। যেমন—বিশাখিল, দত্তিল, কম্বল, বায়ু, বিশ্বাবসু, রম্ভা, অর্জুন, নারদ, হনুমান, রাবণ, বিহুরাজ, শম্বুক, রুদ্রট, ভোজ, মাতৃগুপ্ত এবং তাদের ব্যাখ্যাকর্তারা, যথা—লোল্লট, উদ্ভট, অভিনব গুপ্ত, কীর্তিধর প্রমুখ।১২
হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীতকে কখনোই কোনো বিশেষ যুগ, সময় বা কাল দ্বারা চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। মূলত সামবেদ-কেই সংগীতের উৎপত্তিস্বরূপ এখানে মানা হয়ে থাকে। পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মা থেকে বেদ-এর উৎপত্তি। আবার মতান্তরে মহাদেব তাঁর পঞ্চমুখ থেকে পাঁচটি রাগ ও পার্বতীর মুখ থেকে একটি রাগের সৃষ্টি করেন।১৩ ব্রহ্মা এই ছ-টি বিশেষ রাগকে ছ-টি ঋতু অনুযায়ী ভাগ করেন। যেমন—গ্রীষ্মে দীপক, বর্ষায় মেঘ, শরৎ-এ ভৈরব, হেমন্তে শ্রী, শীতে মালকোষ ও বসন্তে হিন্দোল। মজার ব্যাপার, এই সকল রাগই পুরাণানুসারে ছ-টি করে ভার্যা বা স্ত্রীর অধীশ্বর এবং এইভাবেই ছত্রিশটি রাগিণীর উৎপত্তি। দেবর্ষি নারদ রচিত সংগীতশাস্ত্রকল্প -য় এর প্রসঙ্গ উল্লেখিত।
হিন্দুস্থানী সংগীতের প্রাথমিক রূপ পাওয়া যায় কবি জয়দেবের লেখা গীতগোবিন্দ-য়। হিন্দুস্থানি মার্গসংগীতে এই গ্রন্থের ভূমিকা ও প্রভাব অনস্বীকার্য। কৃষ্ণলীলায় পরিপূর্ণ এর সব কবিতাই বহু বিখ্যাত রাগ, রস ও তানাশ্রিত।
তবে বোগদাদের হারুণ-অল-রশিদ এই সংগীতের বিশেষ উন্নতিসাধন করেন। গজনীর মামুদ কনৌজ আক্রমণের সময় (১০১৮ খ্রিস্টাব্দ) সেখানে ৬০০০০ গায়ক বর্তমান। শুধুমাত্র সোমনাথ মন্দিরেই ৩০০ গায়ক ছিল। আলাউদ্দিনের সময় হিন্দুস্থানী সংগীতে দরবারির প্রথম ব্যবহার। এই সময়েই বিখ্যাত গায়ক বৈজুবাওরা (জন্ম-সাল নিয়ে মতান্তর) সংস্কৃত ও পালিভাষার ধ্রুব, প্রবন্ধ ও ছন্দ থেকে ধ্রুপদের সৃষ্টি করেন। আর এক বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ নায়ক গোপাল দাক্ষিণাত্য থেকে উত্তর ভারতে এসে হিন্দুস্থানী সংগীতের পূর্ণাঙ্গ রূপদান করেন যার মধ্যে সংগীতসাধক হরিদাস স্বামী ও তানসেনের অবদানও প্রাতঃস্মরণীয়।
দিল্লির পাঠান সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর সময়১৪ (চতুর্দশ শতাব্দীর প্রারম্ভে) দরবারি সংগীতের প্রচলন ও তার ঐতিহ্য আজও বিস্ময়কর। ইনিই প্রথম পারস্য থেকে বিখ্যাত সংগীতসাধক জনাব আমির খসরুকে নিমন্ত্রণ করেন। আমির খসরু একাধারে কবি, দার্শনিক, সংগীতজ্ঞ ও রাজনীতিক ছিলেন। খসরু সুফি সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তাঁর রচিত গান ও কবিতায় গুজরাতি, ফারসি, সংস্কৃত ও মৈথিলি ভাষার সমন্বয় দেখা যায়। বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ফারসি সুর, যেমন—সাজগিরী, ইমন, ওসাক, মাফেক, জীলাফা (পরবর্তী জিলা কাফি) খসরু প্রচলন করেন।১৫ তিনি গানও গাইতেন পারসিক পদ্ধতিতে! তাঁর ধারার ১২টি মোকাম বা রাগ, ২৪টি সুধা বা রাগিণী এবং ৪৮টি গুস্যা বা উপরাগ পাওয়া যায়। বহুবিধ যন্ত্রবাদ্য আবিষ্কৃত তাঁর হাতেই, যা আজ শুধু ভারতে নয় গোটা বিশ্বে সমাদৃত। এছাড়াও তানসেন-পরবর্তী যুগে ষোড়শ শতাব্দীতে গোয়ালিয়ার মহারাজ মান (মানসিংহ নন) হিন্দুস্থানি সংগীতের পুনর্জন্ম ঘটান। কর্নেল ক্যানিংহামের Archaeological Report of Gwalior-এ মহান এই রাজার সৃষ্ট নানান বিচিত্র রাগ-রাগিণীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
এই ভাবেই কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সনাতনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের জয়যাত্রা চলে। আজও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। এভাবেই যুগযুগান্ত ধরে কাল থেকে কালান্তরের পথে চলেছে সংগীতের যাত্রা। যাত্রা চলেছে প্রাচীন মানবসভ্যতা থেকে আধুনিক সভ্যতার পথে। যাত্রা চলেছে ঋগবৈদিক, পুরাণের যুগ থেকে আরব, মধ্য এশিয়া, চিন, জাপান, জাভা, বোর্নিও, সুমাত্রার পথে। যাত্রা চলেছে রোমান ক্যাথলিক চার্চ থেকে জ্যাজ, পপ, রক, রেগে, ব্লুজ-এর পথে। যাত্রা চলেছে বোবা কান থেকে সবাক চাউনির ইঙ্গিত পর্যন্ত।
এই এগিয়ে চলার পথে লণ্ঠন ধরেছেন হোমার নামের সেই অন্ধ পাগল কবি যিনি পূর্ব কায়েশের প্রপৌত্র গুবালের তৈরি হার্প বাজিয়ে ট্রয়ের যুদ্ধে গ্রিক সেনাদের উদবুদ্ধ করেন। উদবুদ্ধ করেন সেই বধির সুরকার বেঠোফেন যাঁর বিখ্যাত রচনা আজও আমাদের ভাবায়। উদবুদ্ধ করেন মূক-বধির সেই দ্বাদশবর্ষীয় বিস্ময়কর বেহালাবাদক ক্রিস বাক। উদবুদ্ধ করেন বিখ্যাত প্রাণীসংগীতজ্ঞ (Zoomusicologist) জার্জ হারজঘ যিনি আমাদের প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, ‘Does animal have music?’১৬। উদবুদ্ধ করেন তানসেন যাঁর দরবারি কানাড়ায় মোহিত হয়ে অদৃশ্য ঘাতক অস্ত্র ফেলে দেয়। উদবুদ্ধ করেন চাইকভৎস্কি, লিওনেত্তিরা। উদবুদ্ধ করেন ভাস্কর বুয়া, আল্লাদিয়া ও ফৈয়াজ খাঁ সাহেবরা। উদবুদ্ধ করেন রবিশঙ্কর, বিলায়েত, আলি আকবর, আলাউদ্দিন ও নিখিল ব্যানার্জিরা। আমরা উদবুদ্ধ হই। উদ্দীপ্ত হই। হতে ভালোবাসি।
পরিশেষে বলতে হয় সংগীতকে যতই ধর্মান্তরিত করা হোক না-কেন এটি সকল ধর্মের অতীত। সব ধর্মের, সব কালের, সব যুগের যুগরূপ। মানবজন্মের সৃষ্টি থেকে ধবংস, সভ্যতার বিবর্তন থেকে সভ্যতার বিমোচন সর্বত্রই এর গতি অবাধ, এর যাতায়াত অপ্রতিরোধ্য। তাই বোধ হয় বিখ্যাত দার্শনিক, সংগীতজ্ঞ Jean–Jacques Nattiez১৭ বলেছেন :
There is no noise, only sound, only music.
উপনিষদ-বেদ-পুরাণ-কোরান-বাইবেল-ত্রিপিটক যেখানে এক সূত্রে গাঁথা। একই মন্ত্রে দীক্ষিত। স্থল-জল-মহানভ অঙ্গন—সব মিলিয়ে যার ব্যাপ্তি অসীম। এই সেই দর্শনের ‘আলো’ যার গন্ধে ঘন্টা বাজে।১৮ এই সেই আদি-অনাদি ও পরিসমাপ্তির কালরেখা। সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর কান্না থেকে চিতার কাঠ পোড়ার শব্দে বিশ্ব থেকে মহাবিশ্বে, আদি থেকে অনাদি, সসীম থেকে অসীম গন্তব্যের পাথেয়। এই সেই আত্মপরিচয়। আত্ম-উপলব্ধির অনির্বাণ আলো। সমস্ত বাধা-বিপত্তি-লোভ-কাম-ক্ষুধার ঊর্ধ্বে উচ্চারিত মহেন্দ্রধবনি। এই সেই ‘সোহম’, এই সেই ওঁ। পৃথিবীর আদিশব্দ। ধবনি, বর্ণ, যতি, আঘাত।
এই সেই স + মগ + ঈকার + তৎ। সম-গৈ + ক্ত। সংগীত!
ইতিহাস আমাদের অনেক কিছু শেখায়। চিনতে শেখায় আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের বর্তমানকে। হয়তো তার জন্যই এতটা প্রেক্ষাপটের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। প্রয়োজন হয়ে পড়ে সংগীতের, যা সভ্যতার আগ্রাসীকরণ ও বিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে সাধারণ জীবনে। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় রীতিনীতি, সামাজিক সম্পর্ক, আচার-ব্যবহার ও শিক্ষাদীক্ষার সঙ্গে সংগীতের বহুদিনের একাত্মীকরণ। সংস্কৃতির অভিব্যক্তি বলতে আমরা সম্ভবত এই বুঝি। কোনো বিশেষ জাতির বা গোষ্ঠীর সংস্কৃতি বলতে তার সামগ্রিক জীবন থেকে শুরু করে ধর্মীয় আচারকলা, শিষ্টাচার ও সমাজসংস্কার পর্যন্ত। এরই মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল ধর্মীয় মনোভাব।১৯
আদিম যুগে যখনই বন্য, বর্বর মানুষ প্রথম প্রকৃতির করালরূপের সম্মুখীন হয়, তখন থেকেই ধর্মীয় সংগীত ভাবনার অঙ্কুরোদগম। এই আদিম মানুষেরাই প্রথম প্রকৃতির স্তব সৃষ্টি করে।২০ সৃষ্টি করে তাদের নিজেদেরই মঙ্গল বা সমাজের হিতসাধনের উদ্দেশ্যে। রচিত হয় অসংখ্য স্তব অগ্নি-বায়ু-পর্বত-নদী-সমুদ্র-আকাশকে নিয়ে। মানুষ চিরকালই অসহায়, নিঃসম্বল থাকেনি। সমাজের ঐক্যবদ্ধকরণ, সমাজব্যবস্থার উন্নয়ন ও সমাজজীবনের উন্নতিসাধনের জন্য এভাবেই ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয় ধর্মের। সৃষ্টি হয় উপাসক ও উপাসনার। সৃষ্টি হয় দেবদেবী, আচারবিচার ইত্যাদির। সৃষ্টি হয় সংগীতের—স্তব-স্তুতির। ধর্মীয় সংগীতের যাত্রা শুরু হয় এভাবেই। কালের পথ ধরে।
ধর্মীয় সংগীতের ব্যাপ্তি দিগন্তব্যাপী। সময়ের চাকা বেয়ে সমাজ ও ধর্মীয় ভাবধারার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিপুল পরিবর্তন এসেছে সংগীতেও। বহুযুগ ধরে বহু দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতায় সাবলীলভাবে উঠে এসেছে এই ধর্মীয় সংগীত। আজানের সুর থেকে ক্যাথলিক চার্চের গসপেল সংস, সামবেদের স্তুতি থেকে আহুরা মাজদার অতীন্দ্রিয় সুর সর্বত্র সংগীতের—অনন্ত বিস্তার। গ্রামবাংলার রমণীদের উলুধবনি থেকে শামানিষ্ঠদের গালবাদ্য, মন্দিরের আরতির ঘন্টাধবনি থেকে সূর্য উপাসক ইনকাদের হলোগ্রাম, খ্রিস্টানদের কনসার্ট থেকে পারস্যের সুফি সম্প্রদায়ের পবিত্র ‘ঘূর্ণন’, এ সবই কি সংগীতের আধার নয়? নয় কি বিভিন্ন সভ্যতার এক অনিবার্য মেলবন্ধন? এখানেই আমাদের সংস্কৃতির ‘বৃন্দাবন’। ধর্মের আলোর পথ ধরে মানুষের যাত্রাপথ ‘সুধা সাগর তীরে’। এখানেই সমস্ত শব্দের শেষ, শেষ সমস্ত অক্ষর ও জ্যোতি-প্রাকারের। এখানে শুধু সংগীত। নাদ। শব্দ। শব্দ নয়, শব্দব্রহ্ম। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় ও পুনঃসৃষ্টির সাম্যরূপ। ‘ইহাই ধর্মের সংগীত এবং ইহাই সংগীতের ধর্ম’!
স্বীকৃতি
অধ্যাপক রবার্ট র্যেইলে, ইস্তানবুল টেকনিকাল ইউনিভার্সিটি, তুরস্ক
অধ্যাপক হেলেন রিজ, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
অধ্যাপক ফ্যাবরিজিও ফারারি, ইউনিভার্সিটি অব চেস্টার, ইংল্যান্ড
অধ্যাপক টম সলোমন, ইউনিভার্সিটি অব বার্জেল, নরওয়ে
অধ্যাপক এম জাফর ওজেন, ইউনিভার্সিটি অব স্ট্যাভেনগার, নরওয়ে
অধ্যাপক জোসেফ টি ও’ কোনেল, ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো, কানাডা
অধ্যাপক এ কে স্যান্ডার্স, ইউনিভার্সিটি অব গুটেনবার্গ, সুইডেন
অধ্যাপক রেজাউদ্দিন আকিল, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত
অধ্যাপক অম্লান দাশগুপ্ত, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত
অধ্যাপক দীপক ঘোষ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত
অধ্যাপক ভাস্বর মৈত্র, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত
অধ্যাপক সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত
মুখ্য গ্রন্থাগার আধিকারিক, সুলেমানিয়া লাইব্রেরি, তুরস্ক
মুখ্য গ্রন্থাগার আধিকারিক, এশিয়াটিক সোসাইটি, ভারত
মুখ্য গ্রন্থাগার আধিকারিক, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, ভারত
মুখ্য গ্রন্থাগার আধিকারিক, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, তেহরান ইউনিভার্সিটি, ইরান
মুখ্য গ্রন্থাগার আধিকারিক, বিশপস কলেজ, ভারত
মুখ্য গ্রন্থাগার আধিকারিক, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত
মুখ্য গ্রন্থাগার আধিকারিক, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত
আধিকারিক, সংস্কৃতি মন্ত্রক, ভারত সরকার, নয়া দিল্লি, ভারত
ক্রসওয়ার্ডের সৌরভ, প্রচ্ছদশিল্পী সৌরীশ, নতুন বন্ধু ময়ূখ ও শুভঙ্কর,পারুল প্রকাশনীর কর্ণধার শ্রীগৌরদাস সাহা এবং
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সমস্ত শুভানুধ্যায়ী, মা, বাবা, বোন, বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীবৃন্দ
ধর্ম
ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাস ও তত্ত্বালোচনার আগে আমাদের জেনে নেওয়া উচিত—ধর্ম আসলে কী? এর উৎপত্তি কোথায়? অথবা, সমকালীন বিষয়ে এর প্রাসঙ্গিকতাই বা কতখানি এবং ধর্মের প্রকৃত সংজ্ঞাই বা কী?
আমাদের জীবনে আজও অনেক কিছুই রহস্যাবৃত, যার কোনো যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা দেওয়া অসম্ভব। জন্ম ও মৃত্যুর রহস্য আমাদের সাধারণ বুদ্ধির অগোচর। সৃষ্টির রহস্যতত্ত্ব নিয়ে অনেক আলোচনা আগেও হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। তবুও কোথাও-না-কোথাও আমাদের স্থিতির প্রয়োজন হয়। সদুত্তর পাওয়া যায় না সব কিছুর। প্রাকৃতিক ঘটনাবলি (অপ্রাকৃতিক তো বটেই!) আমাদের নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে। কখন, কোথায়, কেন, কীভাবে ঝড় উঠবে, মহাপ্লাবন আসবে, দুর্ভিক্ষ, মহামারি হবে বা আদৌ একে প্রতিরোধ করা যাবে কিনা দার্শনিক চিন্তাধারায় এ সবের ব্যাখ্যা দুষ্কর এবং সাধারণের নিয়ন্ত্রণাতীত।১ এই জাতীয় রহস্যের সঠিক সমাধান না-করতে পেরেই সর্বকালে সর্বদেশের মানুষ কোনো এক ইন্দ্রিয়াতীত (Supernatural power) শক্তির কথা কল্পনা করেছে। বস্তুত এর থেকেই ধর্ম এবং ধর্মীয় চিন্তাভাবনার উদ্ভব হয়েছে বলে বিজ্ঞানী এবং পণ্ডিতেরা মনে করেন। James G. Frazer তাঁর বিখ্যাত বই The Golden Bough-এ ধর্মের যা সংজ্ঞা দেন তা হল :
Powers superior to man which are believed to direct and control the course of nature human being.২
অন্যদিকে অগর্বান ও নিমকফ-এর সংজ্ঞানুসারে ‘Religion is an attitude towards super-human powers’।৩ সংস্কৃতে ধর্মকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ধৃ (= ধারণ) + ম (র্তৃ)। অর্থাৎ ধারণ করা হয়েছে যা তাই ধর্ম।৪ এ অর্থে ধর্ম হল—ঈশ্বরোপাসনার পদ্ধতি। আচার-আচরণ, ইহকাল ও পরকাল ইত্যাদি বিষয়ে নির্দেশ ও তত্ত্ব। এখানেই উঠে আসে পুণ্যকর্ম, সৎকর্ম, কর্তব্য, শাস্ত্রবিধান, সুনীতি (ধর্মসংগীত), সাধনার পথ ও পাথেয়। হিন্দুধর্মে ধর্মের অধিরাজ যম। যমের অংশজাত যুধিষ্ঠির। এইসব অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রতি সম্ভ্রমপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই নানারকম সুসংগত বিশ্বাস, আচার-আচরণের জন্ম। কালক্রমে এগুলিই ধর্মীয় বিশ্বাসের রূপ নেয়। অপরপক্ষে অনেক দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের মতে, আত্মার অবিনশ্বরতা সম্পর্কে বিশ্বাস থেকে ভগবান বা ঐশ্বরিক পুরুষ (Superman)-৫এ বিশ্বাস জন্মায়। এই বিশ্বাসই হল ধর্মের সার। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকে ধর্মের প্রকৃতি ও উদ্ভব ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়। এখানে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারা অনুসরণ করতে দেখা যায়। একটি বিবর্তনবাদের নিয়মে অপরটি কর্মনির্বাহী তত্ত্বানুসারে (functional theory)।৬ আশা করি ধর্ম সম্পর্কে আর বেশি তত্ত্ব কচকচানির কড়াক্কড় বাঁধনে না-জড়িয়ে এবার এগোনো যেতে পারে ধর্মীয় সংগীত প্রসঙ্গে। উপরের আলোচনা থেকে এটুকুনি অন্তত বোঝা যায় সমাজজীবনে ধর্মের ভূমিকা জটিল, বিতর্কমূলক অথচ ‘unputdownable’। যারা ধর্মীয় ভাবধারায় অনুপ্রাণিত তাদের কাছে ধর্ম আশীর্বাদস্বরূপ। তাদের মতে ধর্ম না-থাকলে জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ে। অপরদিকে যারা নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন তাদের কাছে ধর্মীয়তত্ত্ব এক অলীক দর্শন ও প্রগতির বিরোধী। তবে মনে রাখা প্রয়োজন ধর্ম বলতে প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় ব্যবস্থাকে (institutionalised religion) নির্দেশ করা হচ্ছে এবং ধর্মীয় ভাবধারাকে মূলস্রোত থেকে বিচ্যুত না-করার উদ্দেশ্যেই ধর্মীয় সংগীতের প্রবর্তন।
মানুষের জীবনে নানা প্রকার সংকট, বিপর্যয়, দুঃখ, শোক, মৃত্যু ও মনঃস্তাপ ইত্যাদির প্রভূত উপস্থিতি লক্ষণীয়। অসহায় মানুষ সৃষ্টির আদি থেকেই এই সংকটের দু-ভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করে।৭ একটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান (Religious culture) এবং তুকতাকের (Black magic) সাহায্যে। আমাদের বিষয়-এর প্রথম খণ্ডটিকে নিয়ে।
ধর্মীয় আচারের একটি অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হল—ধর্মীয় সংগীত। সাধারণত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বা সংগীত কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে অনুসরণ করে না। ভক্তগণ যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্নকালে বিভিন্ন উপাসকের উপাসনা বা প্রার্থনা নিবেদন করে সর্বশক্তির সেই আধারের কাছে কৃপা যাচঞা করেন। ভগবৎকৃপা লাভই যার মুখ্য উদ্দেশ্য, পার্থিব লাভ নয়। এভাবেই যুগযুগান্তর ধরে মানুষের মধ্যে কৃপা-শক্তি-সাহস লাভের উদ্দেশ্য ধর্মীয় আচারের মাধ্যমে গঠিত।৮ সংগীত শুধু তার এক অপরিহার্য মাধ্যম যা সহজ-সরল অথচ গভীর প্রভাবান্বিত।
মানবসভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশে যে ভাবে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের একই গতিবেগে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন ধর্মের, ধর্মীয় আচার-আচরণের। সৃষ্টি হয়েছে ধর্মীয় সংগীতের। নানারূপে, নানাভাষায় ও নানা বৈচিত্র্যের। এভাবেই সৃষ্ট সংগীত যুগযুগ ধরে রক্ষা করে চলেছে ধর্মীয় ভাবধারা। রক্ষা করে চলেছে ধর্মীয় বিশ্বাস-নির্ভরশীলতা ও ধর্মের নিশানকে। লোকায়ত সংস্কৃতি তাকে দিয়েছে প্রগাঢ়তা। সৃষ্টি হয়েছে উপাসক ও উপাসকের স্তুতি।৯ সনাতনী ধর্মীয় আদর্শ পর্যবসিত ও প্রতিফলিত হয়েছে এইসব সংগীতের মধ্য দিয়ে। প্রথম দিকে এই স্তুতি বা সংগীত যাজকশ্রেণিভুক্ত হয়ে থাকলেও অচিরেই তা গভীর রেখাপাত করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে। তখন এর ব্যাপ্তি হয়ে পড়ে ব্যক্তিনির্ভর ও অসীম।
সনাতনী ধর্মীয় সংগীতের উদাহরণ নানান সভ্যতায় পাওয়া যায়।১০ সুমেরীয় থেকে অ্যাজটেক অথবা ব্যাবিলনীয় সভ্যতা থেকে আর্যবৈদিক সভ্যতা সবেতেই এর সফল পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়। যুগ যুগান্তর ধরে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ স্তুতি সংগীতের উজ্জ্বল ও ভাবগম্ভীর পরিবেশনায় সমাজতান্ত্রিক সভ্যতার উন্নয়ন ও স্থিতিশীল প্রজ্ঞার কথা ধর্মাচরণের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে ভবিষ্যতের সম্মুখে। বিস্তারিতভাবে এই আলোচনায় যাবার আগে স্বল্প পরিসরে প্রাচীন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাসে বরং নজর দেওয়া যাক।
খ্রিস্টধর্ম
ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাস খ্রিস্ট ধর্মে যথেষ্টই সুদীর্ঘকায়। বিশেষ করে খ্রিস্টীয় চার্চসংগীতের ইতিহাস। সে যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার বলা হয়ে থাকে যোহান সেবাস্টিয়ান বাখ-কে যিনি অধিকাংশ রচনাই (composition) উৎসর্গ করেছিলেন লুথেরান চার্চের উদ্দেশ্যে। ধর্মীয় সংগীতও মাঝে মাঝে কালের অমোঘ নিয়মে পরিবর্তনশীল। সমসাময়িক খ্রিস্টীয় ধর্মীয়সংগীত এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কারণ প্রথম এই ধর্মীয় সংগীতই রচনার মূলসুরে আমূল পরিবর্তন আনে তার মধ্যে জনপ্রিয় লোকসংগীত বা আধুনিক composition-এর সমন্বয় ঘটিয়ে।১১ যদিও সংগীতের স্বর-রচনা (lyrics) বিন্দুমাত্র ধর্মীয় নিবেদনের (Religious approach) বহির্ভূত হয়ে ওঠেনি। গসপেল সংগীতের ক্ষেত্রেও এই পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। অতীতের খ্রিস্টীয় চার্চ সংগীতের তেমন বিশেষ কোনো আলেখ্য এই ধর্মের ইতিহাসে পাওয়া যায় না, শুধুমাত্র New testament-এর কিছু কিছু খণ্ড-কাব্য ছাড়া যা শুধুমাত্র ধর্মীয় মন্ত্র ব্যতীত অন্য কিছু নয়। এই সমস্তু খণ্ড-কাব্য বা মন্ত্রগুলি আজও গোঁড়া খ্রিস্টানদের রক্ষণশীল চার্চে শোনা যায় সংগীতের আকারে, উদাহরণস্বরূপ জাগরণী মন্ত্র ‘Awake, awake O sleeper!’ গাওয়া হয়ে থাকে সদ্যোজাত শিশুকে আশীর্বাদকালে অথবা কাউকে ধর্মান্তরিত করার সময়। এছাড়াও আমরা উল্লেখ পাই Phos Hilaron-এর বিশেষ করে যা প্রগতি প্রার্থনায় (Matins)১২ পুরোনো চার্চগুলিতে শোনা যায়। এই বিশেষ মন্ত্রটি বর্ণনা দেয় দিনের প্রথম সূর্যালোকের। পুরাতন কিংবদন্তি অনুসারে যিশু এবং তার শিষ্যরা (ইহুদি পরিবারভুক্ত) এই ধর্মীয়- সংগীতটি মুখস্থ করে গাইতেন বলে মনে করা হয়। এই বিশেষ ধরনের মন্ত্রগুলিকে বলা হত ‘Psalms’. খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে খ্রিস্টানরা এই সমস্ত মন্ত্র (Psalms) গেয়ে গেয়ে জড়ো হত ইহুদি উপাসনার স্থানগুলিতে (synagogues)। আধুনিক গির্জা সংগীতের রূপকারদের মধ্যে টিম হিউজেম ও ম্যাট রেডম্যান প্রসিদ্ধ।
হিন্দুধর্ম
ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাসে আরও এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সনাতনি হিন্দুধর্মে ধর্মীয় সংগীত অসম্ভব বৈচিত্র্যপূর্ণ ও রঙিন। হিন্দু লোকাচারে ঘন্টাধবনি, শঙ্খধবনি, নাকাড়া, উলুধবনি, হাততালি, খঞ্জনী, গালবাদ্য, ডম্বরু নিনাদ ইত্যাদি উল্লেখনীয়। হিন্দু ধর্মীয় সংগীত মূলত অন্যান্য ধর্মের মতোই হিন্দুধর্ম অনুপ্রাণিত।১৩ এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীত, কর্ণাটকী ও উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় গীতি, কীর্তন, ভজন, অংগীরা, ভাওয়াই, টুসু, ভাদু ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়। হিন্দুধর্মে ‘সুফি’ সংগীত বা বাউল গান ও তর্জাগীতিও অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে ভক্তি আন্দোলনের পথ ধরে হিন্দুধর্মে ধর্মীয় সংগীতের এক বিশাল অভ্যুত্থান ঘটে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, কবির, নানক ও দাদুর মতো ধর্মীয় গুরুদের পদাঙ্কনুসরণ করে। আজও সমগ্র ভারতবর্ষে (বিশেষত উত্তর ভারতে) ‘ওম জয় জগদীশ হরে’ ও ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে’ জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সাধারণত এটি স র গ ম প ধ ন অনুসারে গাওয়া হয়ে থাকে।
শিখধর্ম
এই ধর্ম মূলত কীর্তন প্রধান। শিখধর্মে বিশেষত শিখজাতির পবিত্র ধর্মগ্রন্থ শ্রীশ্রী গুরু আদিগ্রন্থ সাহেব থেকে উল্লেখিত পবিত্র স্তোত্র বা শ্লোকগুলিকে কীর্তনের আকারে গাওয়া হয়ে থাকে। এই সংগীতে প্রধানত হারমোনিয়াম, সেতার, তবলা, খঞ্জনী, মন্দিরার উল্লেখ পাওয়া যায়।১৪ সমস্ত শিখজাতির বিশেষ কর্তব্যের মধ্যে একটি এই কীর্তনসভায় সপরিবারে অংশগ্রহণ ও সাধ্যমতো তাকে গাওয়ার চেষ্টা। শিখধর্মে আরও একটি বিশেষ উল্লেখ মার্গ হচ্ছে ‘দাধি ভরণ’ যেখানে ‘ধাদ’ বা ‘ধার সারেঙ্গী’-র ব্যবহার হয়ে থাকে নামকীর্তনের মাধ্যমে শিখজাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বর্ণনে।
ইহুদি বা জিউশধর্ম
খ্রিস্টীয় ধর্মের বা ধর্মীয় সংগীতের প্রচুর পূর্ব-ব্যবহার এই ধর্মে দেখা যায়। জেরুজালেমের পবিত্র মন্দিরগুলিতে ইহুদিদের ধর্মীয় সংগীতের বিকাশ লক্ষণীয়। উপাসনার গৃহে বা বিশেষ ধর্মীয় নির্দেশিত স্থানগুলিতে পবিত্র তালমুদ থেকে শ্লোক বা জিউশসংগীত, রচনা ও গাওয়া হয়ে থাকে। পবিত্র তালমুদ অনুসারে বিখ্যাত সাধক জাসুয়া বিন হানানিয়া বা হানিয়া, যিনি পবিত্র ‘লেভির’ বংশধর ও ইহুদি যাজকশ্রেণির চারণকবিদের অন্যতম, ইহুদিদের পথনির্দেশ করেছেন কীভাবে সমবেত সংগীতকারের দল উপাসনার স্থানে জড়ো হয়ে ইহুদিদের মঙ্গলার্থে সংগীতসাধনা করেছেন (তালমুদ, সুক 53A)।১৫ রাখালিয়া সংগীত (Shepherdic music) জিউশ ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, বিশেষত স্প্যানিশ জিউশদের বা মধ্যযুগীয় স্পেন-এ বিস্তার লাভ করে ও পরবর্তীকালে রাজসভাতেও পরিবেশিত হয়। তখন থেকেই এটি স্পেন, মরক্কো, আর্জেন্টিনা, তুরস্ক (পারস্য) ও গ্রিসে জনপ্রিয়তার শিখর ছোঁয়। এই রাখালিয়া বা ‘Jewish Shepherdic Song’কে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, যা হল—আনন্দ ও বীরগাঁথা, প্রেমরস সংগীত এবং আধ্যাত্মিক সংগীত। বহু ভাষায় এর চর্চা হলেও মূলত হিব্রু ও লাতিনেই সর্বজনবিদিত।
ইসলামধর্ম
ধর্মীয় সংগীতের আরও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইসলামিক সংগীত মূলত মুসলিম ধর্মীয় সংগীত যা মূলত প্রকাশ্য জনসভায় বা মাজার-দরগা ও ইদগাহ (মসজিদ)-তে গাওয়া হয়ে থাকে। ইসলামের মূল কেন্দ্রবিন্দু আরব, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, মিশর, ইরান, মধ্য এশিয়া, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে। আল-ফারিবী বিরচিত কিতাব আল মিউজিক-আল কবীর (১০ম শতাব্দী) অনুসারে ফজর থেকে ঈশা এই পাঁচ রোজের নামাজে যে আজান দেওয়া হয় তা সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় সংগীত নির্ভর। এছাড়াও ইসলামি সংগীতে ‘হমদ-এ-খুদা’ ও ‘নাদ-এ-রসুল’-এর পরিচয় পাওয়া যায় যা মূলত শ্রেষ্ঠ পয়গম্বর হজরত মহম্মদের স্তুতিগাথা। এছাড়াও এখানে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে ইসলামি ‘সুফি’ সংগীত বা আধ্যাত্মিক সংগীত। মূলত খাদিম, পীর, দরবেশ জাতীয় ফকির শ্রেণির সাধকেরা এই সংগীতের প্রবক্তা।১৬ এছাড়াও এতে পাওয়া যায় ‘কাসিদা’ বা ‘কওয়াসিদা’ নামক কাব্যরূপের কথা, যা সর্বশক্তিমান আল্লার উদ্দেশ্যে গাওয়া ও পাঠ করা হয়ে থাকে। এটি চার ধরনের : ১. হমদ (মন্ত্র), ২. নত (মহম্মদের কৃপা যাচঞা করে রচিত),৩. মনকাবাত (সুফি ও অন্যান্য সাধকদের উদ্দেশ্যে স্তুতি) এবং ৪. মদাহ (শ্রদ্ধেয়দের প্রতি আদাব জানানো)।১৭ এখানে আরও দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সাংগীতিক রূপ আমরা পাই, কাওয়ালি এবং গজল। সাধারণ লোকে মনে করে থাকেন ইসলামে সংগীত নিষিদ্ধ (পবিত্র কোরান অনুসারে)। আশা করি সে ধারণা এবার ভাঙবে।
বৌদ্ধধর্ম
বৌদ্ধসংগীত বা বৌদ্ধিক ধর্মীয় সংগীত আরও এক চিরস্মরণীয় অবস্থান। সাধারণত এই সংগীত বৌদ্ধদর্শন অনুপ্রাণিত ও বৌদ্ধকলার এক অনিবার্য অঙ্গ। এই ধর্মে সাংগীতিক ভাবধারণা শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের সাহচর্যে লালিত হয়। প্রথম প্রথম বৌদ্ধসংগীত বৌদ্ধ সংঘগুলিতেই গীত হত। গাওয়া হত পালি-সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় জাতক ও ত্রিপিটক-এর নির্বাচিত অংশ নিয়ে। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নিয়মিত সাংগীতিক চর্চায় থাকতে হত। এতে আমরা উল্লেখ পাই ‘হনকিওকু’ (Honkyoku)-র যা ‘শাকুহাচি’ বা ‘হোচিকু’ সংগীতের অন্তর্গত এবং জাপানি জেন সন্ন্যাসীদের দ্বারা গাওয়া হত—যাঁদের বলা হয় ‘কোমুসো’১৮ (kyomuso)। এই ‘কোমুসো’-রা ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ায় ‘হনকিউকু’ চর্চা শুরু করে বোধি বা জ্ঞানের আশায়। এরপর জেন সংগীতে প্রভূত পরিবর্তন আসে। নির্মাণ হয় ‘হাইকু’ নামক ত্রিপদী-পদ্যের যা গাওয়াও হয়ে থাকে তিববতে।১৯ বৌদ্ধসংগীতে তন্ত্র- সাধনার উন্মেষ ঘটেছিল সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে যা এই ধর্মীয় সংগীতকে আরো ভাবগম্ভীর দর্শনের আধার করে গড়ে তোলে। আজও এই সংগীত ভারত, নেপাল, ভুটান, চিন, জাপান ও মঙ্গোলিয়ায় সমাদৃত।
সামাজিক ধর্ম ও তার বিবর্তনের পথে সংগীতের যে মহান ভূমিকা তা এই আলোচনায় হয়তো কিছুটা উপলব্ধি করা যায়। বিশ্বের এই প্রধান ধর্মগুলি ছাড়াও ধর্মীয় সংগীত অন্যান্য ধর্ম ও জাতীয়তাবাদেও তার স্বাক্ষর রেখেছে।২০ বিশ্বের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম ও তার ধর্মীয়সংগীতের অবস্থান নিয়ে আমরা আলোচনায় যাব। কিন্তু যাওয়ার আগে এটা বলে রাখা দরকার : ধর্মের জন্য সংগীত বা সংগীতের জন্য ধর্ম—তা হয়তো আমাদের বিষয় নয়। বিস্ময় এবং বিষয় শুধু আমাদের মননে, যান্ত্রিক কোষে, ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাব ও তার সাংগীতিক মাধুর্য থেকে আমাদের কতটা প্রাপ্তি—তা নিয়ে। আশা করি, কালের পথ ধরে হেঁটে একদিন এই সমস্যা বা বিতর্কেরও সমাধান হবে। এখন শুধু অপেক্ষা। ধর্মীয় চিন্তার রেশ মেখে আলোকোত্তীর্ণ সেই মোক্ষের পথে যেদিন শুনব কালের ঘন্টাধবনি।
১ম অধ্যায় – বেথলেহেম-বাইবেল-গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টস : খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীত
নেপথ্য ভাষণ
দৃশ্য ১
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর। বেথলেহেম শহরের সবাই একে একে এসে জড়ো হচ্ছে অখ্যাত সেই গোয়ালঘরের ভগ্নস্তূপে। ক্লান্ত, অবসন্ন মা মেরির কোলে সদ্যোজাত সেই দৈবশিশুর হাসির আলোয় ভরে উঠছে চারপাশ। আকাশ থেকে ক্রমাগত হয়ে চলেছে ঐশ্বরিক আশীর্বাদস্বরূপ তারাবৃষ্টি। এসে উপস্থিত হয়েছেন পুবের সেই সাধকত্রয়ী যাদের আমরা ‘ম্যাজাই’১ (Magi) নামে চিনি। তাঁরা এনেছেন উপহার—বহুদূর হতে—সদ্যোজাত সেই শিশুর জন্য। ছোট্ট গোয়ালঘরটি ভরে উঠছে ক্রমশ সেই সাধকদের অদ্ভুত স্তুতিগানে। দিগদিগন্ত জুড়ে অদ্ভুত সেই সংগীতের সুর যেন প্রতিধবনিত হচ্ছে।
দৃশ্য ২
৩০ খ্রিস্টাব্দ। বনপ্রান্তর, দিগদিগন্ত ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎচমকে। জেরুজালেমের জুডেয়ার (Judaea) নিকটবর্তী সেই রুক্ষ গলগোথা পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনটিত্রুশ কাঠ। দুটি ত্রুশকাঠে গেঁথে দেওয়া হয়েছে দুটি ছিঁচকে চোরকে যারা প্রাণ ভয়ে তখনও চিৎকার করছে, অথচ মধ্যস্থিত তৃতীয় ত্রুশকাঠের ব্যক্তিটির মুখে কোনো শব্দ নেই। নেই কোনো ক্ষোভ-ভয়-বিদ্বেষ। সারা শরীর তার রক্তাক্ত। রক্তাক্ত মাথায় তার চেপে বসে আছে কাঁটার মুকুট। আকাশের দিকে তাকিয়ে শেষবারের মতো কেঁপে উঠল তার ঠোঁট—’হে পিতা, তুমি এদের ক্ষমা করো! এরা জানে না এরা কী করছে!’২ আরও একবার আছড়ে পড়ল ঝড়, ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ, বৃষ্টি নেমে এল বধ্যভূমিতে। তারপর সব শান্ত, সৌম্য, নিস্তব্ধ! শুধু দূরে বসে থাকা কিছু মানুষের চোখে জল। তাদের কণ্ঠে কান্নার ধবনি। বিলাপের সুর। সেই সুর, সেই সংগীত যা রোমান সাম্রাজ্যকে কখনো শান্তিতে ঘুমোতে দেয়নি আর।৩
মনে হয় না, খ্রিস্ট্রীয় ধর্মে সংগীতের এরূপ প্রভাবশালী প্রয়োগ অন্যত্র কোথাও দেখা গেছে। যিশুর সঙ্গে সেদিন একাত্ম হয়েগেছিল জেরুজালেমের প্রান্তীয় সংগীত। খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীতের একটি কিংবদন্তি রূপ সেদিন ধর্মীয় সংগীত-এর রূপে চিরকালীন হয়ে গিয়েছিল এই ধর্মের মানসমন্দিরে। খ্রিস্টানরা আজও সে-সব অশ্রুত সুর, সংগীতের ধর্মীয়করণরূপে গেয়ে থাকেন। গেয়ে থাকেন ধর্মীয় উৎসবে, আমন্ত্রণে, শোকসমাবেশে। এর কোনো শেষ নেই, যেমন এর শুরু বলে কিছু নেই।
শাখা-উপশাখা
খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীত মূলত সেই বিশেষ প্রকারের সংগীত যা খ্রিস্টানদের শুধুমাত্র তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গায় নয়, বরং তাদের সামাজিকরূপেও সমানভাবে গভীর প্রভাব ফেলেছে। উদবুদ্ধ করেছে শুধু খ্রিস্টানদের নয়, সমানভাবে সব ধর্মের মানুষকে এবং তাদের ঐক্যবদ্ধতাকে সহনশীলতার ও ভ্রাতৃত্ববোধের চরম শিখরে নিয়ে যাবার জন্য। খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীত তাদের ধর্মের মতোই সমান গৌরবোজ্জ্বল ও কীর্তিধর। খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীতের মূল চারটি বিষয় হল—স্তুতি, উপাসনা, অন্তস্থঃকরণ এবং শোকযাপন।৪ অন্যান্য ধর্মীয় সংগীতের সাংগীতিক ভাবধারার মতো এটিও কালক্রমে বিবর্তিত হয়েছে খ্রিস্টীয় সংস্কৃতি, সমাজচেতনার আধার ও তার ভাবসমাধির অনুধ্যানে। এই ধর্মীয় সংগীত নানান শাখা-উপশাখায় অনুশীলিত হয়ে পরিস্ফূট হয়েছে ব্যক্তিনির্ভর মতাদর্শ ও ঐক্যের মানদণ্ডে। যুগ যুগ ধরে বিবর্তিত হয়েছে—স্তুতি, পাঠপরিক্রমণ, সনাতন ভাবদর্শন, সমসাময়িক সন্ধিক্ষণ ও নগরকেন্দ্রিক চার্চ সংস্কৃতিতে।৫ এর মধ্যে উপবিভাজনীয় শাখায়, যথা—রক্ষণশীল চার্চসংগীত, লোকগান, রক, জ্যাজ, মেটাল এবং হিপহপে।
পরিবেশন
খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীতকে তার পরিবেশনার আধারেও সমানভাবে বিভক্ত করা যায়। সনাতনি প্রথায় ব্যক্তিবিশেষে এই সংগীতকে শুনে শুনে রপ্ত করার প্রবণতা লক্ষণীয়। যা মূলত পুরোনো ক্যাথলিক চার্চগুলির তত্ত্বাবধানে লালিতপালিত। এটি পরিবেশনের দুটি বিশেষ দিক হল—১. যন্ত্রানুসংগীতের মাধ্যমে, অথবা ২. যন্ত্রাংশ ছাড়াও। রক্ষণশীল চার্চগুলিতে মূলত মধ্যযুগের প্রথমার্ধে যন্ত্রানুসংগীত ছাড়াই গাওয়া হয়ে থাকত। পরে অবশ্য বারোক যুগে, সেখানে প্রথম এর তুমুল পরিবর্তন পাই যা এই সংগীতকে আরও উন্নত ও জনপ্রিয় করে তোলে।৬ প্রথম প্রথম এই সংগীত যাজক সম্প্রদায়ের কেউ গাইত পরে অবশ্য তাতে ‘কয়ার’ বা সমবেত সংগীতের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। মূলত এর পরিবেশনের স্থানগুলি হল উপাসনাগৃহ যা ক্যাথলিক চার্চগুলিতে প্রতিদিন রোববার সকালে পরিবেশিত হত। যদিও ধীরে ধীরে এটি প্রকাশ্য জনসমক্ষে, কনসার্ট হলে এমনকী স্থানীয় পানাগারেও (Alehouse) পরিবেশিত হতে দেখা যায়। এখান থেকেই Worship band, church band এবং choir৭-এর উৎপত্তি।
সময় পরিধি
যদিও ত্রুসেডের সময় থেকেই নব্য খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীতের প্রচলন তবু মধ্যযুগে (৫০০ – ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ) রোমান ক্যাথলিক চার্চগুলি থেকেই এর জয়যাত্রা শুরু। এরপর রেনেসাঁস যুগ (১৪০০ – ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ), বারোক (১৬০০ – ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) এবং ক্ল্যাসিকাল পিরিয়ডে (১৭৫০ – ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) এর ব্যাপ্তি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।৮ রোমান্টিক যুগে বেটোফেন, বাখ, ও শুবার্টের তত্ত্বাবধানে এটি নন্দনশিল্পের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তরূপে দেখা যায়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমে আধুনিক সংগীতের ভাবধারায় খ্রিস্টীয় ধর্মীয়সংগীত নবরূপে, নবকলেবরে ধর্মীয় সংগীত জগতের আসরে উপস্থিত হয়।৯ এই সময়সীমা ও তার বিস্তার সত্যিই অবিস্মরণীয়।
সংগীত সম্মেলন ও উৎসব
সারা পৃথিবী জুড়ে নানান ধরনের খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীত সম্মেলন দেখা যায়। এর মধ্যে সর্বপ্রথম ও বিখ্যাত উৎসব হল Ichtus Music Festival যেটি ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়।১০ সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম ধর্মীয় সংগীত মহোৎসবগুলির মধ্যে ‘কর্নার স্টোন’ (cornerstone) এবং ‘ক্রিয়েশন’ (creation Festival) উল্লেখযোগ্য, যেখানে প্রতিবছর প্রায় ২ লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটে।১১ ধর্মীয় গসপেল সং থেকে শুরু করে গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টস, ব্লুজ, রক, চার্চ মেটাল ও জ্যাজ সংগীতও এখানে পরিবেশিত হয়। অনেক সময় ধর্মযাজকরাও এতে অংশ নেন।১২
গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টস
খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীতের সবচেয়ে পুরোনা, ঐতিহ্যশালী ও জনপ্রিয় রূপটি হল গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টস। বিশেষত খ্রিস্টীয় ধর্মীয় উৎসব ও অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠানে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এই সংগীতটি পরিবেশিত হয়ে থাকে। খ্রিস্টীয় ১০ম শতাব্দীতে এর প্রথম উদ্ভব ঘটলেও নানান পণ্ডিতদের মতে মূলত এটি মধ্যযুগীয় সংগীত যা রেনেসাঁস যুগে প্রথম লিপিবদ্ধ হয় গুটেনবার্গের ছাপাখানার১৩ দৌলতে। এটি মূলত গাওয়া হয়ে থাকে ‘পবিত্র কর্ম’রূপে দিনে ন-বার বিশেষ বিশেষ সময়ে—বিখ্যাত সন্ত বেনেডিক্টের নিয়মানুসারে। যদিও এর পিছনে প্রাচীন লোকসংগীতের প্রভাব বিশেষ লক্ষণীয়, তবু জনসাধারণের বিশ্বাস এটির প্রথম আবিষ্কারক হলেন পোপ সেন্ট গ্রেগরি যার নামানুসারে এই ধর্মীয় সংগীত সর্বজনবিদিত। বারোক যুগে এর ব্যাপ্তি ও প্রসার অভাবনীয়। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে এর মধ্যে প্রভূত আধুনিকীকরণ এলেও এই সংগীত তার মূল ভাবধারা আজও অক্ষুণ্ণ রেখেছে। এটি একটি বিশেষ স্বরলিপিতে লিপিবদ্ধকরণ হয়ে থাকে যা ‘নিউমেস’১৪ (Neumes) নামে পরিচিত। এটি মূলত সনাতনী ধারায় গাওয়া হয়ে থাকে যাতে পুরুষ ও নারীদের ধর্মীয় বিধান অনুসারে নির্মিত দলে ভাগ হয়ে পরিবেশন করতে হয়। গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টের নানান পর্যায়গুলি, যথাক্রমে—অ্যামব্রোসিয়ান, মোজারাবিক চ্যান্টস ইত্যাদি। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এটি প্রথম চার্চের বেড়াজাল টপকে সাধারণের জন্য প্রকাশিত হয় ক্যাসেট ও সিডির আকারে যাতে বহু বিখ্যাত শিল্পীর যেমন Noirin Ni Rain-এর সাংগীতিক প্রতিভার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই মুহূর্তে নিউ টেস্টামেন্ট অনুসারে যিশুর ‘লাস্ট সাপার’-এর অংশবিশেষ গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টের উত্তরাধুনিক রূপান্তরে যথেষ্ট জনপ্রিয়।১৫
উপসংহার
খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাস বিশ্ব ধর্মীয় সংগীতের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। বহুযুগ ধরে এর উর্বরতা খ্রিস্টী ধর্মকে আরও সবুজ করে তুলতে সক্ষম। এ এক অসীম রত্নভাণ্ডার যা শেষ হয়েও অনিঃশেষ রয়ে যায়। যিশু খ্রিস্টের অবদান, উদারতা ও আত্মোৎসর্গের উপাখ্যান এই ধর্মীয় সংগীতের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে ছড়িয়ে পড়েছে। আমেন!
২য় অধ্যায় – মহানির্বাণের সুর : বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগীত এবং অন্যন্য
ধর্মারোহণ
বৌদ্ধধর্মের জয়যাত্রার পুরোধা হলেন গৌতম বুদ্ধ বা সিদ্ধার্থ। গৌতমের জন্ম হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে।১ তার পিতা শুদ্ধোদন ছিলেন শাক্যবংশীয় রাজা। এছাড়াও বিনয়পিটক ও বুদ্ধচর্যা থেকে জানা যায় ভদ্দীয় ও দন্তপানি নামক শাক্য রাজাদের কথা।
সিদ্ধার্থের জন্ম হয় কপিলাবস্তু থেকে কয়েক মাইল দূরে লুম্বিণী নামে এক শালবনে। সিদ্ধার্থের জন্মের ৩১৯ বছর পর আপন রাজ্যাভিষেকের বিংশতিবর্ষে সম্রাট অশোক এই স্থানে একটি প্রস্তরশিলা স্থাপন করেছিলেন যা আজও বর্তমান। জন্মের পরমুহূর্তে সিদ্ধার্থের মাতৃবিয়োগ ঘটলে মাসি গৌতমীর তত্ত্বাবধানে তিনি বড়ো হয়ে ওঠেন।
ছোটোবেলা থেকে সিদ্ধার্থকে সংসার-বিষয়ে উদাসীন এবং সর্বদা চিন্তামগ্ন থাকতে দেখে পিতা শুদ্ধোদন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সন্তান হারানোর ভয়ে প্রতিবেশী কোলীয় গণরাজ্যের কন্যা যশোধরার সঙ্গে পুত্রের বিয়ে দেন। তাদের একটি সন্তান হয়, যার নাম রাহুল।
বৃদ্ধ, পীড়িত, মৃত ও সন্ন্যাসী—এই চার দৃশ্য দেখে সিদ্ধার্থ সংসার সম্পর্কে আরো উদাসীন হয়ে পড়েন এবং একদিন গৃহত্যাগ করেন ‘মোক্ষ’-র সন্ধানে। বুদ্ধগয়ায় একটি পিপুলগাছের তলায় বসে ধ্যান করার সময় তিনি ‘বোধি’ লাভ করেন ও গৌতম বুদ্ধ নাম গ্রহণ করেন।
সিদ্ধার্থের এই জ্ঞানদর্শন ছিল :
দুঃখই দুঃখের কারণ, দুঃখের বিনাশ আছে ও দুঃখ নিরোধের পথও আছে।
যে ধর্ম বর্তমান তা সবই কোনো হেতু থেকে জাত এবং সেই হেতুরও বিনাশ আছে।
মহাশ্রমণের এটিই ছিল শ্রেষ্ঠ অভিমত।
গৌতম ২৯ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেন (৫৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে)। গভীর চিন্তনের মাধ্যমে ছত্রিশ বছর বয়সে তাঁর ‘বোধি’ লাভ হয় (৫২৮ খ্রিস্টপূর্বে) এবং বৌদ্ধধর্মের সূচনা ঘটে। এরপর ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি তাঁর ধর্মের প্রচার সাধন করেন এবং ৪৮৩ খ্রিস্টপূর্বে আশি বছর বয়সে কুশীনগর নামক স্থানে তাঁর নির্বাণ ঘটে। সেই মুহূর্তের একশো বছরের মধ্যে ভারত, চিন, জাপান, শ্যামদেশ তথা অন্যান্য জায়গায় বৌদ্ধধর্মের বিকাশ লক্ষণীয় এবং আজও এই প্রভাব সমভাবে বর্তমান।২
নেপথ্য সংগীত
বৌদ্ধধর্মের প্রতিস্থাপনের সময় থেকেই বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগীতের উদ্ভব বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগীত মূলত বৌদ্ধশিক্ষা ও দর্শন—এই প্রধান দুটি অবলম্বনের ওপর দণ্ডায়মান। কালক্রমে এই ধর্মীয় সংগীতও বিভিন্ন ভাগে, যেমন শিন্টো ধর্মীয়, তাও ধর্মীয়, জেন ধর্মীয় ভাবধারায় উদবুদ্ধ হয় এবং এতে প্রচুর বিবর্তন পাওয়া যায়। এই বিশেষ সংগীত ভারতীয় দর্শনের প্রবহমান ধারার মধ্যে নব্য গবেষণা, নব্য আলোচনার ধারার সৃষ্টি করেছিল।৩ তিববতীয় বৌদ্ধসংগীত এই ধারাকে আরও ভাবগম্ভীর ও কালোত্তীর্ণ করে তোলে। বৌদ্ধমন্ত্র, বৌদ্ধ পুথি অবলম্বিত এই বিশেষ ‘শাস্ত্রীয়’ সংগীত বৌদ্ধ দর্শনকে সমগ্র পৃথিবীর কাছে এক অনন্যসাধারণ রূপদান করে। বৌদ্ধকলা, ধর্ম ও দর্শনের এটি এক অসাধারণ মেলবন্ধন৪। প্রাচীনযুগ থেকে আধুনিক যুগধারায় যা আজও এক বিস্ময়কর সৃষ্টি।
বৌদ্ধধর্ম
খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৮ অব্দ থেকেই বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি বৌদ্ধ সংগীতের বিকাশ। এই সংগীত পারতপক্ষে বৌদ্ধ দর্শন অনুপ্রাণিত এবং বৌদ্ধ শিল্পকলার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই প্রাচীন মন্ত্রগুলির উচ্চারণের মাধ্যমে গীতসংগীত মূলত বুদ্ধের চারটি মূল সিদ্ধান্তের প্রতিধবনি।
১. ঈশ্বরকে অস্বীকার করা (অন্যথায় মানুষ স্বয়ং নিজের প্রভু—এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা হয়)
২. আত্মাকে নিত্য স্বীকার না-করা (অন্যথায় নিত্য একরকম মানলে তার পরিশুদ্ধি ও মুক্তি অসম্ভব)
৩. কোনো গ্রন্থকে মূল প্রামাণ্য হিসেবে স্বীকার না করা (অন্যথায় বুদ্ধিমত্তা ও অভিজ্ঞতা মূল্যহীন)
৪. জীবনপ্রবাহকে এই শরীরের মধ্যে সীমিত করা (অন্যথায় জীবন ও তার নানা বৈচিত্র্য কার্যকারণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন না-হয়ে শুধুমাত্র এক আকস্মিক ঘটনারূপে প্রতিভাত হবে) কে প্রতিবিম্বিত করে।৫
বৌদ্ধ শিক্ষা, দর্শন ও সংগীত এই চার সিদ্ধান্তের উপর বিরাজমান। প্রথম তিনটি শিক্ষায় এটি বৌদ্ধধর্মকে অন্যান্য ধর্ম থেকে এবং চতুর্থটিতেবস্তুবাদ থেকে পৃথক করে। বৌদ্ধসংগীত এই চারটি ধারায় সুস্নাত হয়ে বৌদ্ধধর্মের দর্শনকে আলোকোত্তীর্ণ পথে পরিচালনা করে।
বৌদ্ধধর্মে তার সাংগীতিক ভাবধারা, মতানুসারে শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের মাধ্যমে বিকশিত হয়। প্রথম প্রথম এটি বৌদ্ধ সংঘ বা মঠগুলিতে গাওয়া হয়ে থাকত। বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগীত গাওয়া হত পালি-সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় জাতক ও ত্রিপিটক-এর নির্বাচিত অংশ নিয়ে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই মূলত এই গানগুলি গাইতেন বা প্রাচীন তারের যন্ত্রে তা বাজাতেন।৬ তাদের একসময় নিয়মিত সাংগীতিক চর্চায় লিপ্ত থাকতে হত।
বৌদ্ধ ধর্মীয়সংগীত মূলত আমরা যেটি পাই তা হল—’হনকিওকু’ (Honkyoku)। এটি বৌদ্ধ সংগীতের একটি বিশেষ খণ্ডরূপ। ‘হনকিওকু’ আসলে ‘শাকুহাচি’ (Shaku hachi) বা ‘হোচিকু (Hochiku) সংগীতের অন্তর্গত। বিশেষত জাপানি জেন সন্ন্যাসীরা এইগুলি গাইতেন যাঁদের প্রচলিত নাম ‘কোমুসো’ (Kyomuso)।৭ এই ‘কোমুসো’রাই ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ‘হনকিওকু’ চর্চা শুরু করেন পূর্ণব্রহ্ম বা বোধিলাভের আশায়। এর পরেই জেন ধর্মতেও সংগীতের আমূল পরিবর্তন আসে। সৃষ্টি হয় বৌদ্ধ ধর্মীয়সংগীত ও তার নবরূপীকরণ। নির্মাণ হয় ‘হাইকু’-র (Hyku) এবং এই ত্রিপদী পদ্যও কালক্রমে গোটা তিববতে প্রচলিত হয়।৮ এরপরে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে (আনুমানিক) বৌদ্ধ সংগীতে তিববতি তান্ত্রিকধারার মূল প্রভাব লক্ষ করা যায় যা বৌদ্ধ ধর্মীয় আঙ্গিককে আরো ভাবগম্ভীর করে তোলে।
এরপরে অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমরা উল্লেখ পাই কিনকো কুরাসাওয়ার (Kinko Kurasaur) যিনি কিনা ‘কোমুসো’ সম্প্রদায়ভুক্ত এবং যিনি সারা জাপান ঘুরে বেড়ান বহুবছর ধরে সেই বিশেষ সংগীত ‘হোচিকু’র সন্ধানে।৯ বহুবছর ভ্রমণের পর ছত্রিশ রকমের ‘হোচিকু’র খণ্ডস্বরলিপি উদ্ধার করে আনেন তিনি। এগুলি সেই সন্ন্যাসীর নামানুসারে ‘কিনকো-রু-হনকিওকু’ নামে সর্বজনবিদিত হয়। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মীয়সংগীতের একটি বড়ো পর্যায় বৌদ্ধধর্মীয় মন্ত্র বা শ্লোকনির্ভর। বৌদ্ধ মন্ত্রগুলি বৌদ্ধ দর্শন ও ভাবধারায় অনুপ্রাণিত এবং নানান নামে বা বৈশিষ্ট্যে নানা জায়গায় সমৃদ্ধ, যেমন—
অমিতাভ নামের পুনরুচ্চারণে আদি বৌদ্ধ সংঘগুলিতে।
শৌম্য (Shomyo) নামে জাপানি তেনডাই (Tendai)১০ এবং সীঙ্গন (Shingon) বৌদ্ধধর্মে।
এটি বিশেষ গালবাদ্য ও ওঁঙ্কার ধবনিরূপে তিববতি বৌদ্ধধর্মে পরিচিত।
তিববতি বৌদ্ধধর্ম ও তার সংগীত সর্বাপেক্ষা বৃহৎ বৌদ্ধদর্শন ও সাংগীতিকরূপ হিসেবে তিববতে প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে সুপ্রাচীন যন্ত্রসংগীত বিশেষত তারের যন্ত্র এবং সাতটি মুখওয়ালা বৃহৎ ‘শাকুহাসি’ বাঁশি তথা শঙ্খ এবং চামড়ার ড্রাম জাতীয় (নাকাড়া) বাদ্য বিদ্যমান। এই তিববতি সংগীত বেশির ভাগই প্রাচীন তিববতি-ব্রাহ্মী বা সংস্কৃতে পাওয়া যায়। এই শ্লোকগুলি অধিকাংশই জটিল, তত্ত্বসাপেক্ষ ও নানান ধর্মীয় উৎসবে গাওয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে ‘কিসিয়াং’ বা ‘ইয়াং’ মন্ত্রটি সময়সাপেক্ষে ব্যাপ্তি ও পরিধি বিস্তারে সক্ষম। অন্যান্য ঘরানাগুলির মধ্যে (তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মমতানুসারে) সনাতনি ‘গেলুপা’ (Gelugpa school), রোমান্টিক ‘নিংমাপা’ (Nyingmapa school) এবং ‘সাকোপা’ ও ‘কাওপা’তে বিভক্ত।১১ ‘সোম-ইয়া’ বা ‘শৌম্য’ ঘরানাতেও ‘ইয়োকোকু’ ও ‘রিকোওকু’ দ্রষ্টব্য।
শিন্টোধর্ম ও তার সংগীত
বৌদ্ধধর্ম পরবর্তী ও তার বহুলপ্রভাব বিজরিত এই ধর্ম মূলত জাপানে বিশেষ সমৃদ্ধ। আধুনিক জাপানের এক-তৃতীয়াংশ লোক এই শিন্টোধর্মাবলম্বী। এটি অষ্টম শতাব্দীতে জাপানে পরিচিতি লাভ করে। শিন্টো শব্দটি মূল চিনা শব্দ ‘শিনটাও’ (Shin-tao) অর্থাৎ ঈশ্বর বা মোক্ষলাভের পথ থেকে জাত। এর নামকরণই একে বৌদ্ধধর্ম থেকে সামান্য আলাদা করে দেয়। জাপানে এর আদিনাম ‘কামি-নো মিচি’ (kami-no-michi)।১২ প্রত্নতাত্ত্বিক ধর্মোৎসবের অঙ্গরূপেও এটি সর্বদা দর্শনের সনাতনী ভাবধারা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে একটু ভিন্ন। বিশেষত, শিন্টোধর্মের মূল প্রবক্তা—’ইয়ামাতো’ (Yamato) নামের একটি অতীন্দ্রিয় গোষ্ঠী, যারা বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ও বৈশিষ্ট্যমুখী হয়েও একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবধারা, বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক মতবাদে বিশ্বাস করত এবং এদেরই লেখনী দ্বারা এটি অষ্টম শতাব্দীতে সর্বজনবিদিত হয়। ধর্মশাসনের পাশাপাশি ইয়ামাতোরা অনেকেই স্বদেশশাসনে নিজেদের নিয়োজিত করেছিল যাদের আমরা ‘কোকুতাই শিন্টো’১৩ নামে জানি। এই ‘ইয়ামাতো’ গোষ্ঠী পদাঙ্কনুসরণ করেই শিন্টোর ধর্মীয় ইতিহাস প্রথম লেখা হয় এবং আজও এই সংগীত জাপান ছাড়াও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলিতে সমানভাবে সমাদৃত।
শিন্টোসংগীত হল মূলত শিন্টোধর্মের নানান উৎসবের সংগীত। শিন্টোধর্মীয় সংগীত বৌদ্ধধর্মের মতোই পুরাতনী সাংগীতিক ভাবধারায় উদবুদ্ধ। এটি আসলে ‘গাগাকু’ (Gagaku)-র একটি বিশেষ ভাগ, যেটি হল প্রাচীন জাপানি সংগীত ও নৃত্যকলার ভাণ্ডার। এছাড়াও শিন্টোসংগীতে পাওয়া যায় ‘কাগুরা’-র১৪ বৈশিষ্ট্যাবলি। ‘কাগুরা’ও প্রাচীন শিন্টো ধর্মীয়সংগীতের একটি মূল অধ্যায়, যার দুটি ভাগ :
১. মি-কাগুরা (Mi-kagura) যেটি সুপ্রাচীন শিন্টো ধর্মীয়সংগীতের অংশ
২. সাটো-কাগুরা (Sato-kagura) যেটি প্রাচীন শিন্টোসংগীত হলেও প্রাচীন ভাবধারামুক্ত।
এছাড়াও শিন্টো ধর্মীয়সংগীতে নানাবিধ যন্ত্রসংগীতের উপাদান লক্ষণীয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—’ফিউ’ (Fue) নামের একটি বিশেষ বাঁশি, ‘সুজুমি’ (Tsuzumi) নামের চামড়ার বাদ্যযন্ত্র। শিন্টো লোকসংগীতের মধ্যে অন্যতম হল ‘সাটোকাগুরা’ (Satokagura)।১৫ ‘তাইকো’ (Taiko) সংগীত এই ধর্মীয় সংগীতের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। বিখ্যাত ‘সাটো-কাগুরা’ যা কিনা প্রাচীন শিন্টোলোক-সংগীতের অংশ তা প্রথম প্রথম ‘ইয়ামাতো’ সন্ন্যাসীরা গেয়ে গেয়ে বেড়াতেন। পরবর্তীকালে এই সংগীতের পবিত্র দার্শনিক ভাবধারা, সহজধর্মিতা ও একমুখীকরণ জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় নেয়নি।
তাও বা ডাওধর্ম ও তার সংগীত
তাও বা ডাওধর্ম প্রাচীন চিনের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ধর্ম ও দার্শনিক মতবাদের নাম। এই ধর্মের প্রবর্তন ছয় খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিখ্যাত ধর্মগুরু ‘লাও জু’র (Lao TZu) লেখা তাও তে চিং গ্রন্থের মাধ্যমে ঘটে। তাও তে চিং বিশেষত অতীন্দ্রিয় শক্তির পথপ্রদর্শক।১৬ তাও ধর্মের এই সুপ্রাচীন ধর্মগ্রন্থটি মূলত প্রাচীন প্রাকৃতিক শক্তি ও প্রকৃতির মধ্যে এক অভাবনীয় মেলবন্ধনের নজির। যেখানে ব্যক্তিবিশেষ তার আদিসত্তার নিকট ও তার প্রকৃতি মূল্যায়নে সক্ষম সেটিই তাও-এর মূল উৎস। এই ধর্ম মূলত বৌদ্ধ মতবাদ, কনফুসীয় দর্শন ও প্রাচীন চৈনিক অতীন্দ্রিয়বাদের যোগসূত্রধার।১৭ এই বিশেষ ধর্মীয় মতবাদে তাও তে চিং ছাড়াও ‘চুয়াং জু’, ‘লি জু’ ও ‘হুই নান জু’ যুগে যুগে এই বিশেষ ধর্মীয় চিন্তাধারাকে আরও উন্নত পর্যায়ে সংহত করেছে। ‘তাও’ বা ‘ডাওইজমের’ প্রকৃত ব্যাপ্তি ঘটে বিখ্যাত ‘হান’ সাম্রাজ্যের (২৩ – ২২০ খ্রি.)-এর শেষ ভাগে। এরা মূলত ‘পবিত্র ত্রয়ী’র উপাসক যারা স্বর্গ-মর্ত্য ও মানুষের অধীশ্বর।১৮
কনফুসীয় ভাবধারার উন্মেষ অনেকাংশে তাওইজমেও পরিলক্ষিত হয়। এই তাও সংগীত এরই পরিপূরক। তাও সংগীত তার ধর্মের মতোই যথেষ্ট প্রভাবশালী ও মানবমননে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী যা প্রাচ্য দর্শনের ইতিহাসে বৌদ্ধ সংগীতের ও মতবাদের সমসাময়িক। সংগীতের সাথে ‘তাও’ ধর্মের সম্পর্ক বহুদিনের এবং ধর্মীয় সংগীত হিসেবে এর ভূমিকা ও প্রভাবও লক্ষণীয়। ‘তাও’ বা ‘ডাও’ ধর্মীয় সংস্কৃতিতে সংগীতের ভূমিকা নানাবিধ। তাও ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন সংগীতই হল ‘ঈশ্বরের সহিত কথোপকথনের’ একমাত্র মাধ্যম। এটি তাওধর্মাবলম্বীদের উৎসাহপ্রদানে, আত্মার অন্তরঙ্গ ধবনি শুনতে এবং এই বিশেষ ধর্মটিকে আরও ভালোভাবে জানতে সাহায্য করে। তাওকে অনুসরণ করতে হলে আগে নিজের অন্তর্ধ্বনিকে জানতে হবে। এই ধর্মীয় বিশ্বাসটি ‘ইন’ ও ‘ইয়াং’—এই দুটি ভিন্ন সংগীতের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত। এই বিশেষ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উৎসবটি অস্ট্রেলিয়ার ‘চিরসবুজ’ তাওয়িস্ট চার্চে১৯ ‘ডিয়াগন’ (Deagon) বা ‘কুয়ান ইন’-এর জন্মদিবস পালন উপলক্ষ্যে উদযাপিত হয়। ধর্মীয় সংগীত ও তার যন্ত্রানুষঙ্গ এখানে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। তাও ‘ধর্মীয়’ ধর্মগুরু বা যাজকেরা ‘কুয়ান ইন’-এর—যিনি ক্ষমার দেবতা—তাঁর স্তুতিপাঠ করেন। বিশেষত ‘চেলো’, ‘হার্প’, ও ‘দ্রামস’-এর যন্ত্রানুষঙ্গ কাজ করে থাকে। এই উৎসব তাও ধর্ম্বালম্বীদের একটি পবিত্র উৎসব যা তাও মতবাদীদের ধর্মমাহাত্ম্য, তাও দর্শন ও সংস্কৃতির পরিচায়ক। তাও ধর্মীয় সংগীত পরিবেশন কালে অধ্যক্ষগুরু হাত নাড়িয়ে এটি পরিচালনা করেন যা চিনা অতীন্দ্রিয়বাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। এক্ষেত্রে জনপ্রিয় ‘ইয়াং’ সংগীতের পরিবেশন হয় এবং ‘কুইং’ (ধাতব সংগীতযন্ত্র) ও ‘ফাকি’ (ধর্মীয় বাদ্যযন্ত্রবিশেষ) এই দুটি মুখ্য যন্ত্রের ব্যবহার হয়ে থাকে। এটি মূলত ধ্যানে, সমাধি ও পরমাত্মার আহ্বানকে জানানোর সংগীত। এছাড়াও ‘কুইং’ ও ‘মুইয়ু’২০ নামের আরো বিশেষ দুটি যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে ধর্মীয় পরিবেশের সৃষ্টি করা হয়।
‘তাও’ বা ‘ডাও’ ধর্মীয় সংগীতের এরূপ অসাধারণ ‘Manifestation’ খুব কম ধর্মেই দেখতে পাওয়া যায়। অনেক সময় মহান ধর্মগুরু লাও-জু-র লেখা তাও তে চিং থেকে নির্বাচিত অংশ পাঠ করে গাওয়া হয়ে থাকে এবং প্রাচ্য দর্শনের সেই আলোকোজ্জ্বল পথের পাথেয়রূপে একে গ্রহণ করা হয়। বিখ্যাত এই ধর্মীয়- সংগীত তাও-ধর্ম্বাবলম্বীদের রোজকার জীবনের একটি অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে বিবেচিত হয়।
কনফুসীয়ধর্ম ও তার সংগীত
কনফুসীয়ধর্ম বা ধর্মীয় মতবাদের জনক হলেন বিখ্যাত গুরু কনফুসিয়াস(৫৫১ – ৪৭৯ খ্রি.পূ.)। কনফুসিয়াসের উপদেশ ও কনফুসীয় মতবাদের ভাবধারায় আপ্লুত এই ধর্মের মূল রসদ তার সংগীত। কনফুসিয়ানধর্ম মহাগুরু কনফুসিয়াসের পঠনপাঠনআশ্রিত যা ছ-টি সর্বকালের সর্বজনবিদিত গ্রন্থ :
১. পরিবর্তন
২. ইতিহাস
৩. সংগীত
৪. ধর্মীয় স্তোত্র
৫. ধর্মীয় সংস্কৃতি ও আচার-আচরণ এবং
৬. ধর্মীয় তত্ত্ব ও প্রশ্নাবলি২১।
চিন প্রদেশে সবচেয়ে পুরোনো ও আধ্যাত্মিক এই দুনিয়ার ধর্মীয় সংগীতের প্রভাব বৃদ্ধিমাত্র একই সঙ্গে চিনদেশীয় ‘হান’ সাম্রাজ্যে এটির ব্যাপ্তি ঘটে। কনফুসীয় ধর্মে সংগীতের প্রভাব অপরিসীম। বিশেষত কনফুসীয় ধর্মসংগীত বৌদ্ধ ও জেনধর্মীয় সংগীতের মতোই সামঞ্জস্যপূর্ণ। কনফুসীয় ধর্মীয় সংগীতে মূলত বাঁশি, শিঙা, চেলো ইত্যাদির বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ধর্মীয় সংগীত ‘কোরাসে’ গাওয়া হয়২২যা সাধারণ মানবজীবনের দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে তাকে এক উন্নত মার্গের সন্ধান দেয়। এই সংগীত দিয়ে থাকে সেই প্রাচীন দীক্ষা যা বৌদ্ধ, জেন, শিন্টো ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত এবং প্রাচ্য দর্শনের এক বিশেষ সাংগীতিক রূপ ও দর্শনের আলোকমণ্ডলের ঠিকানা।
নিয়ো-কনফুসিয়ানিজম
নিয়ো-কনফুসীয় ধর্ম প্রকৃতপক্ষে কনফুসীয় ধর্মেরই একটি উত্তর-আধুনিক রূপ। কনফুসীয় ধর্মের আরও উন্নত এবং আধুনিক ধর্মসাধন এই ধর্মে লক্ষণীয়। মূল কনফুসীয় ভাবধারায় এটি অনুপ্রাণিত হলেও বৈশিষ্ট্য, ধর্মাচরণ ও ধর্মীয় রীতিনীতির দিক থেকে এটি কনফুসীয় ভাবধারা থেকে স্বতন্ত্র। এর মূল যোগসূত্র ‘তাং’ (Tang Dynasty) সাম্রাজ্যে এবং বিখ্যাত তাত্ত্বিক ‘তাং-জি তিয়ান’-এর (Tang xie Tian) ভাবাদর্শে এটি উদবুদ্ধ। পূর্ব এশিয়া যথা চিন, জাপান ও কোরিয়ায় বিস্তার। বিখ্যাত নিয়ো-কনফুসীয় সংগীতজ্ঞ হু জিং (Znu xi) ওয়াং ইয়ামমিং (wong yangming) কনফুসীয় সাংগীতিক ভাবধারাকে এক নতুন পথে চালিত করেন, যদিও এই ধর্মের বাদ্যযন্ত্রের পূর্বপরিগণিত বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে বিশেষ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না।
উপসংহার
পাশ্চাত্য ধর্মীয় সংগীতের তুলানান্তরে প্রাচ্যধর্ম ও ধর্মীয় সংগীতের অবদান বেশি বই-কম নয়। যুগ যুগ ধরে প্রাচ্য ধর্ম ও ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাসে এই বিশেষ পরিমণ্ডলটি ভাববাদ-অতীন্দ্রিয়বাদ ও দর্শনের মূল বিষয়কে সংগীতের সুনির্মল পরিবেশনায় বিশ্বের মুক্ত মানবজাতিকে আকৃষ্ট করেছে। বিংশ শতাব্দীতে এর সৌকর্য ও নানান তত্ত্ব সাংগীতিক ভাবধারাকে ছাড়িয়ে সৃষ্টি করেছে এক অমোঘ নির্দেশ যা কালক্রমে নির্দেশিত হয়েছে ‘সংগীতই ঈশ্বরলাভের প্রকৃত উপায়’ এই মোক্ষবাদে।
৩য় অধ্যায় – রাখালিয়া বাঁশি : জিউশ বা ইহুদীয় ধর্মীয় সংগীত
ভূমিকা
জিউশ বা ইহুদীয় ধর্মীয় সংগীত প্রভূত বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বহু বছরের পুরোনো সংস্কৃতির ধারক বাহক। মাঝে মাঝে এর অবতারণা ধর্মীয় সংগীতরূপে, মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ তা থেকে আলাদা। এর সুর, সংগীতমূর্ছনা এবং রচনা (composition) যুগে যুগে বৈচিত্র্যের ছাপ রেখেছে ইতিহাসে। জিউশ ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাস একই সঙ্গে উপাসনা বা প্রার্থনাসংগীত, লোকসংগীত ও আধুনিক চার্চসংগীতের রদবদলকে মূল্যায়িত করে।১ পুরাতনী উপাসনাসংগীত বস্তুত জেরুজালেমের ‘প্রার্থনা-কক্ষের সংগীত’ থেকে অভিন্ন। ‘মিসনা’ (Mishna) অনুসারে, চিরাচরিত ‘প্রার্থনা-কক্ষের সংগীত’-এর (Temple orchestra) অর্কেস্ট্রায় ১২টি বাদ্যযন্ত্রের বহুল ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় যা ১২জন গায়কের একটি দল পরিদর্শন করত।২
বেশ কিছু অতিরিক্ত বাদ্যযন্ত্র যা প্রাচীন হিব্রু সংগীতের আধার অথচ সেগুলি কিন্তু এই temple orchestra-য় ব্যবহৃত হতো না। এর মধ্যে ‘উগাব’৩, যা প্রাচীন চার্চে ব্যবহৃত অর্গ্যান জাতীয় বাদ্যযন্ত্র, এই বিশেষ প্রার্থনা সংগীতে অভাবিতভাবে ব্রাত্য থেকেছে।
পরবর্তীকালে এই পবিত্র জিউশ ‘প্রার্থনা বাক্য’-গুলি এবং—অর্ধেক ইহুদি রাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধবংস হলে—ধর্মীয় সংগীতাচরণ ইহুদি সংস্কৃতি থেকে এক প্রকার বন্ধ করে দেওয়া হয়। আরও পরে অবশ্য এটি, ‘পিউতিম’ (Piyyutim-ইহুদি কাব্যরূপ)-এর হাত ধরে আবার মূলস্রোতে ফিরে আসে। এই ‘পিউতিম’-ই ইহুদি সংগীতকে ভবিষ্যতে আরও নতুন মোকাম৪ জোগায়। টেম্পল অর্কেস্ট্রাতেও এই প্রাচীন হিব্রুকাব্যরূপের প্রভাব দেখা যায় যা ‘পিউতিম’-র রচয়িতা নিজেই বেছে থাকেন। একই সঙ্গে লোকসংগীত ও চারণসংগীত একে আরও উৎকর্ষ দান করেছে। এভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জিউশ বা ইহুদি ধর্মীয়সংগীত বিবর্তিত হয়েছে উন্নতির চরম শিখরে।
সমসাময়িক ইতিহাস
বিংশ শতাব্দীতে জিউশ ধর্মীয়সংগীতের ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্য চোখে পড়বার মতো। বিংশ শতাব্দীতে এই ধর্মীয়সংগীতের মহার্ঘতা Sholmo Carlebach-এর ‘Nigunim’ থেকে Devbie Friedman-এর Jewish feminst folk পর্যন্ত বিস্তৃত। বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ Velvel Pasternak এই শতাব্দীতে জিউশ ধর্মীয় সংগীতের সংরক্ষণ ও তার কালবিবর্তনের এক বিশাল স্বাক্ষর রেখেছেন।৫ এছাড়াও এই শতাব্দীতেই ‘Mordeehai Ben david’, ‘Abraham Fried’ এবং জিউশ ধর্মীয় ব্যান্ড মিউজিক যেমন—‘Yigal Salik’-এর ‘London Pirchei’ যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এক্কেবারে সাম্প্রতিককালে ‘রেগে’ আর্টিস্ট ‘Mati Syahu’ জিউশ’ Shepherdic song’ বা ‘মেষ পালকের গীতি’-র নতুন ‘Neo-rege’৬ ভার্শান বার করেন। এছাড়াও এক সম্ভ্রান্ত গোঁড়া চার্চসংগীতের দল ধর্মীয় ভাবধারা, ইহুদি সংস্কৃতি নিয়ে সুর রচনা শুরু করেছে যেটি মূলত ইংরেজি ও হিব্রুতে লেখা। খ্রিস্টীয় ধর্মীয়- সংগীতের পূর্বব্যবহার (ethnic treatment) এই ধর্মে বহুলাংশে দেখা যায়। জেরুজালেমের পবিত্র মন্দিরগুলিই বস্তুত এই ধর্মীয় সংগীতের পীঠস্থান। উপাসনাগৃহে বা ধর্মীয় নির্দেশিত স্থানগুলিতে ইহুদিদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তালমুদ-এর শ্লোক (chants) বা ইহুদিদের ধর্মীয় সংগীত পরিবেশিত হয়ে থাকে।৭
পবিত্র তালমুদ অনুসারে বিখ্যাত ইহুদি সাধক জাসুয়া বিন হানানিয়া বা হানিয়া, যিনি কিনা পবিত্র ‘লেভি’র বংশধর ও ইহুদি যাজকশ্রেণির চারণকবিদের অন্যতম, ইহুদিদের সুর্নিদিষ্টভাবে পথ নির্দেশ করেছেন কীভাবে সমবেত ইহুদি সংগীতকারেরা ইহুদিদের মঙ্গলার্থে পবিত্রস্থানে জড়ো হয়ে সংগীতসাধনা করেছেন (তালমুদ, সুক 53 এ)। রাখালিয়া সংগীত বা Shepherdic song এই ধর্মের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। স্প্যানিশ জিউশদের এই সংগীত মধ্যযুগীয় স্পেনে যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয় ও পরবর্তীকালে রাজসভাতেও তা পরিবেশিত হয়।
ইহুদি কিংবদন্তী অনুযায়ী বীরবালক ডেভিড ও নিষ্ঠুর সেনাধ্যক্ষ গালিয়াথের যুদ্ধ এবং সেই কিংবদন্তীজাত রচনাই এই সংগীতের মূল সম্পদ। ডেভিড নিজেও মেষপালক ছিলেন ও ভালো গান গাইতে পারতেন।৮ পরবর্তীকালে এই সংগীত স্পেন, মরক্কো, আর্জেন্টিনা, তুরস্ক ও গ্রিসে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
মূলত আনন্দ, বীরগাথা, প্রেমরস সংগীত (love Song) ও আধ্যাত্মিকতা—এই বিশেষ সংগীতের ধারণ। বহু ভাষায় এই ধর্মীয় সংগীতের চর্চা হলেও মূলত হিব্রু ও লাতিনই এর ভাষারূপে সর্বজনবিদিত।
প্রকারভেদ
ইহুদিদের ধর্মীয় সংগীত যুগ যুগ ধরে নানান রূপে, নানান ছন্দে-বর্ণে-শব্দে বিস্তার লাভ করেছে। এর বিশেষ বিভাগগুলি নিয়ে নীচে আলোচনা করা হল :
১. পিয়ুট (Piyyut)
‘পিয়ুত’ বা ‘পাইয়ুট’ একটি বিশেষ ধরনের জিউশ সংগীতের সাংগীতিক কাব্যরূপ, যা তৈরি হয়ে থাকে মূলত গাইবার জন্যই। এই জাতীয় গানকে ‘পিয়ুতিম’ (Piyyutm) বলা হয় যা মিসন্যায়িক (Mishnaic Period) যুগ থেকে চলে আসছে। এগুলি বেশির ভাগ হিব্রু বা অ্যারামাইক৯ (Aramaic) ভাষায় লিখিত। পরবর্তীকালে এই পিয়ুটগুলো সর্বসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। যেমন—আদেথ ওলাম (Adon Olam বা Master of the world) ইহুদি ধর্মীয় সংগীতে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রেখেছে।
২. জেমিরত (Zemirot)
‘জেমিরত’ মূলত ইহুদি মন্ত্র যা হিব্রু ভাষায় গাওয়া হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে Yiddish বা Ladino ভাষাতেও এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতের ব্যাপ্তি লক্ষণীয় যা বিশেষত ‘সাবাথ’ বা অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। তালমুদ-এর পবিত্র অংশ থেকে জেমিরত গাওয়া হয়ে থাকে।১০
৩. নিগুন (Nigun)
এটি একটি বিশেষ ধরনের সমবেত বা গোষ্ঠীগত ধর্মীয় সংগীতচর্চার রূপবিশেষ। এই পর্যায়ের সংগীতে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার উল্লেখ্য। মাঝে মাঝে বাইবেল কিংবা সনাতনি ইহুদীয় রচনাগুলি থেকে নিগুনের ব্যাপ্তিসাধন ঘটে।
পরবর্তীকালে নিগুণের দ্রুত পরিবর্তন ও উন্নতিসাধন একে আরও ব্যতিক্রমী করে তোলে। এই ব্যতিক্রমী অংশটি ‘হাসিদিয়’ (Hasidism) ভাবধর্মাচরণেও বিদ্যমান। ‘হাসিদিজম’-এ (Hasidism)১১ এই গানগুলি ইহুদিদের ‘রাবিব’ বা ‘প্রধানরাজা’-রা রচনা করেন। এতে ‘দেভেস’ (Deveks) বা ঈশ্বরের সঙ্গে কথোপকথন নামে বিশেষ সাংগীতিক রূপ পাওয়া যায় যা ব্যক্তিবিশেষের ধ্যানগর্ভের বা ভাবসমাধির পক্ষে আদর্শ। হাসিদিজমের প্রবক্তা মহান ‘বাল সেম থব’ (Baal Shem Tov) এই ‘নিগুণ’-গুলিকে১২ ঐশ্বরিক শক্তির আধার ও পরম- করুণাময়ের আশ্রয়রূপে ব্যাখ্যা করেন।
পিয়ুট, জেমিরত, নিগুণ ছাড়াও এই ধর্মীয়সংগীতের আরও কয়েকটি প্রকারভেদ যেমন—পিজমোনিন (Pizmonin) ও ‘বকাসত’ (Baqashot) উল্লেখযোগ্য। এই দুটি ধর্মীয় সাংগীতিক রূপই প্রাচীন ইহুদি লোকসংগীতের আধার।
এই সব ক-টি ইহুদি ধর্মীয় সংগীতের মূলখণ্ডচিত্র ও বাইবেল অনুপ্রাণিত। এই সংগীতের অধিকাংশ রচনাই বাইবেল, তালমুদ ও তানাঘ অন্তর্ভুক্ত অথবা প্রাচীন ইহুদি কবিদের (যেমন ইহুদা হালেভি ও ইস্রায়েল নাজারা) রচনা থেকে সংগৃহীত।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে আজও এগুলির চর্চা পুরোদমে চলেছে ও ধর্মীয় ইহুদি সংগীতের এই অসাধারণ বিবর্তন কালক্রমে প্রাচ্যের গণ্ডী টপকিয়ে পাশ্চাত্যেও সমানভাবে প্রভাব ফেলেছে।
জেরুজালেমের এই প্রাচীন ধর্মীয় সাংগীতিক রূপ রাখালিয়া সুরের হাত ধরে আজ সমগ্র বিশ্বে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে এবং প্রার্থনাসংগীতের জগতে গড়ে তুলেছে এক তুমুল আন্দোলন যা মরক্কো, তিউনিশিয়া, আলজিরিয়া, ইজরায়েল, গ্রিস, যুগোশ্লাভিয়া, মিশর ও অন্যান্য দেশেও সমান প্রভাব বিস্তার করেছে।১৩ আজও সেই ‘রাখালিয়া বাঁশি’ সর্বত্র ভেসে বেড়ায়—জেরুজালেম থেকে মহাপৃথিবীর পথে।
অন্যান্য সাংগীতিক প্রভাব
বাইবেলের সময় থেকেই নৃত্য, গীত ও বাদ্য জিউশ বা ইহুদিধর্মে এক গভীর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। স্বতন্ত্র কিছু আঞ্চলিক ও লোকসংগীতের বর্ণময় ভূমিকা ইহুদি ধর্মীয় সংগীতকে রঙিন করে তোলে।
এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখনীয় কিছু সংগীত নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে ইহুদিধর্মে সংগীতের বিবর্তন কীভাবে কালানুসারে সমৃদ্ধ হয়েছে। এই বিশেষ সাংগীতিক রূপগুলিকে বাদ দিলে ইহুদি ধর্মীয়সংগীতের আখ্যান অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে বলে মনে হয় :
১. ইজরায়েলি সংগীত
শাস্ত্রীয় ও আধুনিক ইজরায়েলি সংগীত সেইসব কতিপয় সাংগীতিক রূপ যা ইহুদিধর্মে বিশেষ প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। এর ধর্ম ও ধর্মীয় সাংগীতিক ভূমিকা (Religious music culture) এতটাই অসীম যে একে ইহুদি ধর্মীয়- সংগীতের Central Sun বললেও অত্যুক্তি হয় না। বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পূর্ণ এই ইজরায়েলি সংগীত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতের এক বিস্ময়কর যোগসূত্র। এই সংগীতের সাংগীতিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে হাসাদীয় সংগীত১৪ (Hasadic song), এশিয়ান ও অ্যারাবিক পপ, রক, ফোক-এর আশেপাশে ইয়েমেনাইট সংগীত (Yemenite Music), হিপ হপ ও হেভি মেটালেরও নিদর্শন পাওয়া যায়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জিওনিস্ট আন্দোলনের (Zionist movement) পৃষ্ঠপোষকরূপে লেখা হয়েছিল জনপ্রিয় লোকসংগীত। প্রথম দিকে এইসব সংগীতের সুর ও যন্ত্রানুষঙ্গ জার্মান, রুশ ও সনাতনি ইহুদি লোকসংগীতের অনুসরণে হিব্রুভাষায় লেখা হত।১৫ বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইজরায়েলি সংগীতকারেরা হিব্রুভাষা, সংস্কৃতি ও সাংগীতিক প্রয়োগের এক বিশাল পরিবর্তন আনেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত ইজরায়েলি সংগীতজ্ঞ ও সমালোচক মিনাশি রাভিনা (Menashe Ravina) ইজরায়েলি ও হিব্রু সংগীতের এই তুমুল বিবর্তনকে ‘ইহুদি ধর্মীয়সংগীতের রেনেসাঁ’ বলে ব্যাখ্যা করেন।
এরপর নানান রাজনৈতিক যুব আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন ও কিবুজ১৬ আন্দোলন (Kibbutz Movement) এই আঞ্চলিক সংগীতের আরও উন্নতি- সাধন করে। জিওনিস্ট মুভমেন্টের বিশেষ কিছু নজিরবিহীন বৈশিষ্ট্য এই সময় উঠে আসে ইজরায়েলি সংগীতে। এখনও ইহুদি ধর্মীয় সংগীতে এই ইজরায়েলীয় প্রভাব (impact of israel) বিদ্যমান। চিরস্মরণীয় হয়ে আছে প্রাচীন হিব্রু ভাষা, ধর্মীয় সংস্কৃতি ও সংগীতের সেই অভাবনীয় উন্নয়ন যা ইজরায়েলি সংগীতকে অমরত্ব দান করেছে।
২. ক্লেজমার (Klezmer)
আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীতে ইহুদি ধর্মীয় সংগীতের আসরে স্বতন্ত্র সংগীতের প্রভাব বিশেষরূপে পরিলক্ষিত হয় ক্লেজমেরিম (Klezmerim) সংগীতকারদের সংগীতে, যা মূলত পূর্ব ইউরাপের ‘আসকেনাজি জিউশ’১৭ (Askhenazi jews) সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা ধর্মীয় ভাবধারাকে পুনরায় তাদের সংগীতের মাধ্যমে—যা কিনা হিব্রু ফোক, রক ও মেটাল মিউজিকের ধারার অর্ন্তগত—উন্নতির শিখরে নিয়ে আসে। মূলত প্রাচীন হিব্রু বীরগাথা, লোকসংগীত ও জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত এই সংগীতকে ‘ক্লেজমীয় সংস্কৃতি’-র (Klezmian cultave) পীঠস্থানরূপে ব্যাখ্যা করা হয়।১৮ এছাড়াও নানান উৎসব ও দৈবসাধন সংগীতকে এখানে নতুনরূপে ধর্মীয় সাংগীতিক জীবনের অন্তর্ভুক্ত করার সফল চেষ্টা হয়েছে। এই সংগীতকারেরা প্রকৃত অর্থে ঈডিশ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন ও ইহুদি ধর্মীয় সংগীতকে এনেছিলেন ভক্তিমার্গে।
৩. মীজরাহী (Mizrahi)
মিজরাহী সংগীতকে বস্তুত ইহুদি ধর্মীয় সংগীতের নতুন ধারারূপে চিহ্নিত করা হয়। এই বিশেষ ইজরায়েলি সংগীতটির ধারা ইজরায়েলি লোকসংগীত ও আরবিয় বিশেষত মেডিটেরেনিয়ান সংগীতের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। চিরায়ত মিজরাহী সংগীতের রূপ উঠে আসে ইহুদি চারণকবিদের১৯ ধর্মীয় ভাবধারায়। এই বিশেষ সংগীতে মূলত বেহালা বা তারের যন্ত্রের একচ্ছত্র আধিপত্য বর্তমান। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যীয় যন্ত্রসংগীতের প্রভাবও বিশেষ লক্ষণীয়। এটি উচ্চস্বরে গাওয়া ও বাজানো হয়ে থাকে যা আধুনিক ইহুদি ও ইজরায়েলি সংগীতে বিশেষ জনপ্রিয়।
৪. রাখালিয়া সংগীত বা ল্যাডিনো (Ladino)
রাখালিয়া সংগীত বা ল্যাডিনো গীতি শেফার্ডিক জিউশদের আত্মার স্বর। এটি মধ্যযুগীয় স্পেনে২০ জাত ও পরবর্তীকালে নানান ইহুদি অঞ্চলে স্বীকৃতি পায়। পূর্বে উল্লেখিত ইহুদি ধর্মীয় সংগীতের সমসাময়িক ইতিহাস পর্বে এর বিস্তারিত আলোচনা দ্রষ্টব্য।
এত স্বল্প আলোচনায় জিউশ বা ইহুদি ধর্মীয় সংগীতের মাহাত্ম্য বোঝানো অসম্ভব। বাইবেলের সময় থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত এই ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাসে বার বার ঘটেছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতের মেলবন্ধন। বিখ্যাত আইরিশ সংগীতকার মরিস র্যাভেল বেহালা ও পিয়ানোতে রচনা করেন ‘Kaddisch’২১ যা সনাতনি ইহুদি উপাসনাসংগীতের আধুনিকীকরণ। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বিখ্যাত রুশ কম্পোজার সের্জেই প্রকোফিৎ লিখেছিলেন Hebrew Melodies যা ইহুদি লোকসংগীতের পিয়ানো ও ক্ল্যারিয়োনেটের আখ্যান। এরকম উদাহরণ আরও অনেক, অপরিমিত, অগণিত।
যুগযুগ ধরে হিব্রু ভাষাভাষীদের এই প্রাচীন ধর্মীয় সংগীত মানবসভ্যতার ইতিহাসের এমন এক অনন্যসাধারণ অধ্যায়, যা শুধুমাত্র দেশ-কাল বা ধর্মীয়করণের নিরিখে ভাগ করা অকল্পনীয়। বিশ্বধর্মীয় সংগীতের আসরে এক স্বতন্ত্র স্থান চিরকালের জন্য বাঁধা রয়ে গেছে সবার অলক্ষে জেরুজালেমের রুক্ষ মেঠো পথে, প্রাচীন মন্দির বা উপাসনাকক্ষের সংগীত, সমুদ্রের গল্প কিংবা রাখালিয়া বাঁশি-র মেঠো সুরে—আমাদেরই স্বপ্নে ও জাগরণে।
৪র্থ অধ্যায় – হামিন অস্ত! হামিন অস্ত! : মুসলমানি বা ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীত
মুখবন্ধ
‘ইসলাম’ শব্দের অর্থ ঈশ্বরের কাছে ঐকান্তিক সমর্থন। ‘ইসলাম’১ সেই বিশ্বাস যা মানুষকে ঈশ্বরের কাছে নিয়ে আসে, নিয়ে আসে একান্ত সমর্পণের মাধ্যমে। এ সেই আকুল সমর্পণ যা মানবজীবনকে ঈশ্বরে লীন হতে শেখায়। আর যাঁরা নিজেদের এই সমর্পণে নিয়ে আসেন তাঁরাই মুসলিম। এই সমর্পণ অনুদীর্ঘ, উদ্দেশ্যরহিত। এই সমর্থন বা আত্মবিনিয়োগ ধবনিত হয় মুসলমানদের ‘সালাম-আলায়কুম’-এ, যার অর্থ ‘ঈশ্বর বা আল্লা সবর্দা যেন আপনার ওপর শান্তিধারা বর্ষিত করেন’। প্রত্যুত্তরে ‘ওয়ালেকুম’ অর্থাৎ, ‘তা যেন নিজের উপরেও বজায় থাকে’।২ পয়গম্বর হজরত মহম্মদ ইসলামিক ইতিহাসের সেই সর্বজনবিদিত কিংবদন্তি—ঈশ্বরপ্রেরিত অন্তিম দূত—যিনি মানবজাতির কল্যাণসাধন করেছেন। ইনি কোনো নতুন ধর্ম প্রতিস্থাপন করেননি। শুধু প্রচার করেছেন বিশ্বভ্রাতৃত্ব, মৈত্রী ও ভালোবাসার নিবিড় পাঠ যা ঈশ্বরের অন্যান্য সন্তানেরা যেমন—আদম, নোয়া, ইব্রাহিম ও মোজেস করে এসেছেন। ত্রুসেডের সময় এই বিশেষ ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসীদের ‘মহামেডান’ (Muhammadan) বলা হয়েছিল যা অবমাননাকর। যাঁরা ইসলামের ‘রসুল’ ও হজরতের বাণী মেনে চলেন তাঁরাই ‘মুসলিম’ বা ‘মুসলমান’। পয়গম্বর মহম্মদ (৫৭০ – ৬৩১ খ্রি.)৩ তাঁর দীর্ঘ জীবনপথে বিশ্বসৌহার্দ্য, শান্তি ও ভালোবাসার বাণী এভাবেই ছড়িয়ে দিয়েছেন মানবসভ্যতার মননে।
‘ইসলামিক সংগীত’৪ বা মুসলিম ধর্মীয় সংগীত এই ধর্মের এক অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এটি মূলত নানান সাংগীতিক মাধ্যমে জনগণের মঙ্গলার্থে বা ধর্মীয় আবেগে বান ডাকার জন্য (অন্যান্য সকল ধর্মের ন্যায়) নানান স্থান-এ পরিবেশিত হয়। সনাতনি ইসলামিক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক দেশগুলির মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, মিশর, ইরান, মধ্য এশিয়া, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যেহেতু ইসলাম একটি বহুমুখী সংস্কৃতির প্রতিফলক সেহেতু এর ধর্মীয়সংগীতেও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য পরিলক্ষিত হয়।
‘ইসলামীয়’ ধর্মীয় সংগীতের প্রথম লিখিত বিবরণ পাওয়া যায়, দশম শতাব্দীতে আরবপণ্ডিত ও বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ আবু আল-ফারাবির (Abu Al-farabi) লেখায়। বিখ্যাত এই পণ্ডিতের লেখা কিতাব-অল মিউসিকি অল-কবির (প্রাকৃত ফারসি ভাষায় লেখা, The great book of music)৫ বহু পণ্ডিতের মতানুসারে বিশ্ব সংগীত ও ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতের আদিগ্রন্থ। পণ্ডিত আল-ফারাবি বহু বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানতেন এবং নানান যন্ত্রের উদ্ভাবক। এঁর সৃষ্ট লাতিন-আরবি সংগীতের ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক তত্ত্ব আজও আধুনিক ইসলামিক সংগীতে বর্তমান। এই সুফি সাধক শুধু বিদ্বানই ছিলেন না, ইসলামিক ধর্মীয়সংগীতে এঁর নানাবিধ অসামান্য অবদান চিরস্মরণীয়। আল-ফারাবি নিজে সনাতনি হিন্দু শাস্ত্রীয় বা মার্গসংগীতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর মতে মুসলমানদের আবশ্যিক কর্তব্যের মধ্যে দিনে পাঁচ মুহূর্তের ‘নামাজ’ (ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ) যথা, ফজর হতে ঈশা। প্রত্যেক ‘নামাজের’ সময় ব্যবহৃত ‘আজানে’ (ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জমায়েত) আরবি ও হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীতের রাগ-রাগিণীর বিধান পাওয়া যায়। এছাড়াও দুটি বিশেষ ইসলামীয় সংগীত যথা—’হমদ-এ-খুদা’ ও ‘নাদ-এ রসুল’৬-এর কথা এঁর লেখায় জানা যায়, যা বস্তুত মহম্মদের স্তুতিগান। এছাড়াও মুসলমানদের নানাবিধ উৎসবেও ধর্মীয় সংগীতের প্রচুর ব্যবহার (যেমন মহরমের সময় ‘মরসিয়া’৭ বা শোকগাথা) এঁর লেখাতেই জানা যায়।
ইসলামের ভাবদর্শন ইসলামীয় সংগীতের ব্যবহারব্যতীত অন্তঃসার শূন্য। এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীত মূলত প্রাচীন আরবদেশীয় যাযাবর শ্রেণি থেকে উদ্ভূত। ইসলামের প্রচারের বহু আগে থেকেই সেখানে ধর্মীয় বাতাবরণের সৃষ্টি। কোরান অনুসারে মক্কার আদিবাসিন্দারা পৌত্তলিক ছিলেন। এঁরা মরুভূমি, সূর্য ও যুদ্ধের দেবতার সাধনা করতেন। এঁদেরই লোকসংগীতে ইসলামের মূল স্বর নিহিত।
প্রকারভেদ
ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতকে আরও ভালোভাবে বোঝার সুবিধার্থে একে কয়েকটি খণ্ডে ভাগ করা যেতে পারে। ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতের প্রত্যেকটি ধারাই স্বতন্ত্র, স্বতঃস্ফূর্ত ও আধ্যাত্মিকতার মার্গদর্শনরূপে বিরাজমান। বিশেষ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য খণ্ড নিয়ে নীচে আলোচনা করা যেতে পারে :
১. শাস্ত্রীয় আরবি ·(Arabic Classical)
ইসলামীয় ধর্মীয়সংগীতের আদিখণ্ড। মূলত যাযাবর বা আরবি গোষ্ঠীগত সংগীত এখানে প্রকাশ পায়। নোমাডিক অধিবাসীদের মধ্যে এক্ষেত্রে সেলজুক তুর্কি বা আরবি তুর্কিদের কথা সর্বাগ্রে বিদ্যমান। এঁরাই প্রথমত ইসলামধর্মে দীক্ষিত হন। মূলত এঁরা ‘কুরেশ’৮ জাতিগত (মহম্মদ যে জাতিটির প্রধান ছিলেন) এবং ত্রুসেডের সময় আনাতোলিয়া বা পারস্য জয় করেন। অটোমান তুর্কি নামে পরিচিত এই বিশেষ জাতিটিতে সর্বপ্রথম ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ত্রুসেডের সময় এঁরা শুধু যুদ্ধই করেননি, এঁদেরই একটি বিশেষ জাতের চারণকবিরা নানাবিধ ধর্মীয় বীরগাথা, ঈশ্বরীয় উপাসনা ও প্রার্থনা রচনা করে গেয়ে গেয়ে বেড়ান। এই চারণকবিদের একটি ভাগ আধ্যাত্মিকতার পথ অবলম্বন করে ঐশ্বরিক স্তুতিগান ও ইসলামীয় দার্শনিক সংগীতে মনোনিবেশ করেন—যাঁদের আমরা ‘সুফি’ নামে চিনি। কয়েকশ বছরের পুরোনো এই সুপ্রাচীন ধর্মীয় সাংগীতিক উন্মেষ ইসলামধর্মে এক নতুন যুগের প্রবর্তন করে যা আজও সুচর্চিত ও ব্যবহারযোগ্য।
২. শাস্ত্রীয় তুর্কি (Turkish classical)
আনাতোলিয়া বা পারস্য জয়ের পর অটোমান তুর্কিদের রাজত্বে ইসলামিক সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় ও ধর্মীয় সংগীতের ভাবধারায় তুমুল পরিবর্তন আসে। তুর্কিদের রাজত্বকালে ধর্মীয় সংগীতে প্রথম যন্ত্রানুষঙ্গের সুপরিকল্পিত ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। বিখ্যাত ইসলাম বিশেষজ্ঞ ক্যারেন আমস্ট্রং-এর মতানুসারে পূর্ব ইসলামিক টার্কিতে বসবাসকারী নানা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলামীয় ভাবধারা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় এক আর্থ-সামাজিক উত্তরণ এ সময়ে লক্ষণীয়। এই সামাজিক ও রীতিনীতির প্রভূত বিবর্তন ইসলামি সংস্কৃতি ও শিল্প-সাহিত্যেও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। ধর্মীয় সংগীতে যোগ হয় তুর্কি সংস্কৃতির ছোঁয়া।৯ সৃষ্টি হয় নতুন রচনা, নতুন সুর। পরমকরুণাময় ঈশ্বরের উদ্দেশে এক নতুন নৈবেদ্য। এই সাংগীতিক বিবর্তনের যুগে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন নব্য শ্রেণির চারণকবির দল।
কোরান ও হাদিশ-এর বিভিন্ন রচনা থেকেই শুরু হয় ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতের জয়যাত্রা। পরবর্তীকালে এই সংগীতের জয়রথ দক্ষিণ এশিয়া থেকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্য প্রাচ্যের ধর্মীয় ভাবধারায় ও আধ্যাত্মিকতায় উদবুদ্ধ এই সংগীত দক্ষিণ এশিয়ার মার্গসংগীতের প্রভাবে আরও সমৃদ্ধি লাভ করে। এছাড়াও সাব-সাহারান আফ্রিকায়, ককেশাস,১০ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ ফিলিপিনের বৃহৎ মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকসংগীত ও সনাতনি সাংগীতিক ধারায় এই সংগীত আধ্যাত্মিকতার নতুন বিপ্লব ঘটায়।
ধর্মীয় সংগীতের শাখা-উপশাখা
ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীত নানান শাখা-উপশাখায় বিভক্ত। এই সমস্ত আবশ্যকীয় শাখা-উপশাখাগুলি যুগে যুগে ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতে আমূল পরিবর্তন এনেছে। পরিবর্তন এনেছে এর উপস্থাপনায়, ধর্মীয় মতবাদের ভিত্তিতে এবং ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মূল কাঠামোয় :
১. নাশিদ (Nasheed)
ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্বতন্ত্র দিক হল ‘নাশিদ’ বা ‘নাস-হিদ’। এটি ইসলামীয় সংগীতের এমন এক ধারা যেখানে নানান ইসলামীয় ভাবাদর্শকে লোকায়ত সংগীতের প্রেক্ষাপটে তুলে ধরা হয়েছে। এই ধর্মীয় সংগীতের বিশেষ রূপটিতে কোরান শরীফ-এর বিভিন্ন কলমা, বা তনায়াত সুর করে পড়া হয়ে থাকে এবং পরিবেশিত হয় সম্পূর্ণ যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াই। এই ‘নাশিদে’র১১ সঙ্গে বৈদিক সভ্যতার ‘শ্রুতি’-র মিল পাওয়া যায়। যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেশ কিছু এমন সংগীতকারের দলের পরিচয় পাওয়া যায় যাঁরা ‘নাশিদে’-র পরিবেশনায় প্রথম বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগ সাধন করেন। একসময় এই বিশিষ্ট সাংগীতিক ধারাটি পৃথিবীর বহু রক্ষণশীল মুসলমান সমাজে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যদিও পরবর্তীকালে এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই ‘নাশিদ’-এর প্রচলন সর্বত্র ছড়ায় এবং জনপ্রিয় হয়। ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীত ‘নাশিদ’ ব্যতীত অসম্পূর্ণ ও ভ্রান্ত।
২. সুফি (Sufi)
ইসলামিক ধর্মীয় সংগীতে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, গভীরতম ও আধ্যাত্মিকতার উজ্জ্বল ভাবদর্শনের আধার হল ‘সুফি’ সংগীত বা সাংগীতিক অধ্যায়। আরবিতে তাউফ (taawuf), পারস্যে সুফিগারী, ও ইরানে ‘তাসাউফ’১২ নামে এটি পরিচিত। ইসলামীয় দর্শন, ভাবজগৎ ও অতীন্দ্রিয়বাদের এক স্বতন্ত্র ঘরানা হল সুফিজম। এই বিশেষ ধর্মীয় সাংগীতিক ধারার অনুশীলনকারীদের ‘সুফি’ বলা হয়ে থাকে। সুফি সংস্কৃতি, দর্শন ও সংগীতের ধারক-বাহকদের ‘দারবিশ’ বা ‘দরবেশ’ বলা হয়ে থাকে।
প্রাচীন সুফি বিশেষজ্ঞরা একে ‘ঈশ্বরের প্রতি একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণের বিজ্ঞান’ বলে অভিহিত করে থাকেন। বিখ্যাত সুফি সাধক আহমেদ ইবন অজীবার মতে—’এটি এমন একটি বিজ্ঞান যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি নিজের অন্তরের শুদ্ধতা, ঈশ্বর বিশ্বাস ও পবিত্র ভাবদর্শনে ভ্রমণ করে শিখে নিতে পারে অনন্তের সন্ধান’। সুফি আন্দোলন যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়েছে এবং ঘটিয়েছে শতসহস্র সংস্কৃতির মেলবন্ধন, ভাষা ও সুরের যোগসূত্র। এই ভাবধারা মূলত ‘সুফি’ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিস্তৃত, যাঁরা নিজেদের পয়গম্বর মহম্মদের বংশধর বলে মানেন।
সমগ্র মুসলমান জগতের মতো সুফি মতাবলম্বীরাও মনে করেন তাঁরা ঈশ্বরের পথযাত্রী এবং একদিন মৃত্যু এবং ‘কেয়ামতের দিন’ পেরিয়ে তাঁরা সেই পবিত্র স্বর্গোদ্যানে হাজির হবেন। শুধু তাঁদের মাধ্যমটি ভিন্ন। সুফিদের মতে সংগীত বা আধ্যাত্মিক সুরের জগৎ-সাধনার মাধ্যমেই এই মার্গটি বা ‘মোকাম’ পাওয়া সম্ভব। অনেকের মতে ‘সুফি’ শব্দের উৎপত্তি আরবি ‘সুউফ-উলফা’ থেকে, যার অর্থ ‘পবিত্র পশমের টুপি’ যা দিয়ে মাথা ঢেকে ধর্মপ্রাণ মুসলিম আল্লার ‘ইবাদৎ’ করেন। আবার অনেকের মতে এটি লাতিন ‘সোফিয়া’ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ—’পবিত্র জ্ঞান’।১৩ সুফি—অনেকের মতে—গুরু-শিষ্য পরম্পরায় বিবর্তিত হয়।
মতান্তরে জানা যায়, প্রথম প্রথম সুফির প্রয়োগ হয়েছিল শুধুমাত্র ইসলামের বিশ্বপরিচিতি ঘটানোর স্বার্থে। আবার অন্যদের মতে, এটি সরাসরি পবিত্র কোরান থেকে জাত যা অবিরত পাঠ করে, গেয়ে, সুরযোজনা করে তার সমৃদ্ধি ঘটাত। ‘পবিত্র’ সেই ‘জগতে’ প্রবেশপথের এটিই মূলফটক বা প্রধানদ্বার। সুফি সাহিত্যেও এর প্রভূত অবদান লক্ষণীয়। সুফি সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য ‘প্রথম’ অবদান যাঁদের, তারা হলেন—উওয়েশ-অল কারণী, হর্ম বিন হিয়ান, হাসান বাসরী ও সৈয়দ ইবন-অল মুসিব।১৪ সুফি মহিলা সাধকদের মধ্যে রাবিয়া বাসরী উল্লেখনীয়। ঈশ্বরের প্রতি তাঁর নজিরবিহীন ভালোবাসার ব্যাখ্যা তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। হারিখ অল-মুহাগিবি প্রথম সুফি সাধক যিনি ইসলামীয় ধর্মীয় মনস্তত্ত্ব-র উপরে কাজ করেন। এছাড়াও রুমি, সুলতান বাহু, সেলিম চিস্তি, বুল্লেহশা ও ইদ্রীশ শা-র কথা ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। এঁরা শুধু সুফিসংগীতের মাধ্যমে ইসলামের সাধনাই করেননি উপরন্তু খুব সহজ-সরল-সাবলীল ভাষায় ঈশ্বরের আখ্যান বা ইসলামের দর্শন, আধ্যাত্মিকতা ও ভাববাদের এক অবিস্মরণীয় বিপ্লব ঘটান প্রাত্যহিক জীবনে। এঁদের নাম ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতে সর্বদা স্বর্ণোজ্জ্বল থাকবে।
সুফি সাধনার পথকে অনেক সময় ‘ধীকড়’ (dhikr) বা ‘জীকড়’ (zikr) বলা হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশীয় মুসলমানি ধর্মীয় সংগীতে ‘ধীকড়’ বেশ অনাড়ম্বর। এখানে বহুলাংশে সুফিসংগীত যন্ত্রানুষঙ্গ বর্জিত—মূলত লোকায়ত ভাবধারায় সম্পৃক্ত। সুফি সংগীতের চরম উৎকর্ষের নিদর্শন দেখা যায় পশ্চিম এশীয় দেশগুলিতে, যেখানে স্তুতিপাঠ, অসামান্য যন্ত্রানুষঙ্গ এবং ‘মেভলভী দরবেশ’দের ‘ঘুরন্ত’ নৃত্য-র অসাধারণ প্রদর্শন-এর মাধ্যমে।
‘ইদগাহ’, ‘দরগা’ বা ‘মাজার’ ছাড়াও সুফিসংগীত নানান জনসভাতেও পরিবেশিত হয়ে থাকে। পরিবেশিত হয়ে থাকে বিনোদনের মাধ্যমে পরম করুণাময়ের করুণালাভের উদ্দেশ্যে। এই হল সুফিসংগীত ও সংস্কৃতির উদ্দেশ্য-কর্ম ও বিধেয়।
৩. কাসিদা (Qasidah)
এটি মূলত ইসলামের এক ভিন্নধর্মী কাব্যরূপ। এটি ‘কুরাণ’-এর কিছু নির্বাচিত অংশ ও হজরতের স্তুতিপাঠ। ‘কাসিদা’১৫-কে চারভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে, যেমন :
ক. হমদ : এটি একটি বিশেষ কাব্যসংগীত যা আল্লার গুণগান করে। স্তুতিমন্ত্র বিশেষ।
খ. নাত বা নদ : এই বিশেষ সংগীতে পয়গম্বর মহম্মদের স্তুতি করা হয়ে থাকে।
গ. মনকবাত : এই বিশেষ সংগীত বা গান যা ইসলামের ‘ওয়াহিদ’ বা পরমপূজনীয় সাধকদের স্তুতি ও ইসলামীয় দর্শন ও ভ্রাতৃত্ববোধের উন্মেষ ঘটায়।
ঘ. মদাহ বা মদ-হা : এটিও ধর্মীয় গুরু ও শ্রদ্ধেয় পূর্বসূরিদের উদ্দেশ্যে গীত চারণগীতি।
‘কাসিদা’-র এই চারটি ভাগ ছাড়াও আরও একটি বিশেষ ধর্মীয় সাংগীতিক অঙ্গ হল—’গজল’। ‘গজল’ সেই সংগীত যা মানবজীবনে নশ্বর প্রেম, ভালোবাসা, প্রত্যাখ্যান ও প্রেমাস্পদসহ রসকাব্যের আধার। ‘গজল’ সেই পথ যা সাধারণ মনুষ্যজীবনের দুঃখ, দুর্দশা, প্রেম-ভালোবাসা ও গ্লানিকে পবিত্র মনন ভাবধারায় মেলাতে পারে।
এছাড়াও ‘সিয়া’ সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘নাত’ বা ‘নাদ’ প্রীতি লক্ষণীয়। এখানে ঈশ্বরের স্তুতি কালক্রমে পর্যবসিত হয় তাঁর সন্তান ও শেষ পয়গম্বর হজরত মহম্মদের স্তুতিগানে। এই অংশে আরও একটি বিশেষ সাংগীতিক ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়, যার নাম—’মরসিয়া’ জারি যা কিনা একটি বিশেষ শোকগাথা। এই শোকগাঁথা বস্তুত কারবালার যুদ্ধে নিহত হাসান-হুসেনের স্মৃতির উদ্দেশে গাওয়া হয়ে থাকে। মূলত মহরমের সময় এই ‘মরসিয়া’ গাওয়া হয়ে থাকে। সমবেত জনতা এই সময় ‘হা হাসান!’ ‘হা হুসেন!’ বলতে বলতে মরসিয়া গায়।
৪. কাওয়ালি (Qawali)
সুফিসংগীতের অন্যতম জনপ্রিয় অঙ্গ হল—’কাওয়ালি’। মূলত এটি সমবেত সংগীত এবং যাঁরা এই সংগীত পরিবেশন করেন তাদের ‘কাওয়াল’১৬ বলা হয়ে থাকে। এই সংগীত সুফিসংগীতের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও বহুচর্চিত অংশ। কাওয়ালির মূল সৃষ্টি অনেকের মতে পারস্যে আবার অনেকের মতে আরবে পয়গম্বর মহম্মদের ‘কুরেশ’ সম্প্রদায় থেকে, যদিও ইরানের মেভলভী দরবেশদের মধ্যে কাওয়ালির প্রথম উন্মেষ ঘটতে দেখা যায়।
অন্যতম জনপ্রিয় এই ধর্মীয় সংগীতমাধ্যমটি ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা করে। অত্যন্ত সহজ-সরল অথচ গভীর ভাবদর্শনে সম্পৃক্ত এই ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতটি অবিভক্ত ভারতের বিখ্যাত সুফিসাধক খাজা মইনুদ্দিন চিশতির সময় বিস্তার লাভ করে। খাজা মইনুদ্দিন চিস্তি নিজেও অসাধারণ কাওয়ালি গাইতেন। কিংবদন্তি আছে যে, মইনুদ্দিন একবার বোগদাদে নিজ বৈমাত্রেয় ভাই-এর বাড়িতে যান অথচ সেই ভাই নিজে ‘হাফিজ’ (প্রবল ধর্মপ্রাণ মুসলিম) হওয়ায় তিনি কোনো ধরনের কোনো সংগীত বরদাস্ত করতে পারতেন না। খাজা মইনুদ্দিন একবেলা সেখানে ঈশ্বর সাধনায় নির্মিত ‘কাওয়ালি’ সংগীত পরিবেশন করতে না-পেরে প্রচণ্ড অস্বস্তিতে পড়েন এবং বাড়ি ছেড়ে বহুদূরে মরুভূমির মধ্যে গিয়ে ‘কাওয়ালি’ গান। গানের এমনই প্রভাব যে সেই রুক্ষ মরুভূমিতে বৃষ্টি নামে ও মরুদ্যান তৈরি হয়। কাওয়ালির জনপ্রিয়তা এ জাতীয় কিংবদন্তি অনুসারে যে-কোন পর্যায়ে যেতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
‘কাওয়ালি’-তে মূলত অংশ নেন এক বা দুই প্রধান গায়ক বা ‘খাদিম’। একটি ছোটো গায়কের দল তাঁর গানের রেশ ধরেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কাওয়ালিতে প্রথম অংশ নেয় তবলা, গাব (নাল জাতীয় বাদ্য) এবং হারমোনিয়াম যন্ত্রানুষঙ্গরূপে। কাওয়াল গায়করা অতিদীর্ঘ বা নাতিদীর্ঘ ‘কাসিদা’ ধরে আল্লা বা হজরতের বা অন্যান্য খলিফাদের গুণগান করেই সরাসরি ‘হমদ’-এ প্রবেশ করেন। এখানে ‘হমদ’-এর বিলম্বিত রূপ প্রায় চোখেই পড়ে না। মূলত মধ্যম ও দ্রুত অঙ্গে এই সংগীত পরিবেশন করা হয় যাতে শ্রোতারা ইসলামের ধর্মীয় আচার-আচরণের পরিপূর্ণ স্বাদ থেকে বঞ্চিত না-হন।
ইতিহাসে বিখ্যাত নানান কাওয়াল গায়ক ও তাঁদের কাওয়ালির উৎকর্ষের পরিচয় পাওয়া যায়। বিখ্যাত সুফিসাধক খোজা মইনুদ্দিন চিস্তি, হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া,১৭ সেলিম দরবেশ, বদরুদ্দিন রিয়াজ কাজি প্রমুখের কাওয়ালি আজও গাওয়া হয়ে থাকে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে লখনউয়ের কাওয়াল বাচ্চা ভ্রাতৃদ্বয়, রাজস্থানের শাহনাওয়াজ কাওয়াল, আজিম দুরানী ইসলামাবাদী এবং নুসরত ফতে আলি খান ও বেগম আবিদা পরভীন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যুগে যুগে কাওয়ালির গঠন ও প্রয়োগতত্ত্ব নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে। মূলত আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় এইসব কাওয়ালি নানান মসজিদ, দরগা ও মাজারের সঙ্গে সঙ্গে ইদানীং বিশেষ জনসমাবেশেও পরিবেশিত হচ্ছে। আল্লা এক এবং একক—এই বাণীর সঙ্গে বিশ্বমৈত্রী, সংবেদনা ও সৌহার্দ্যর নিদর্শন হচ্ছে কাওয়ালি।
অন্যান্য ইসলামিক ধর্মীয়সংগীত
ইসলামের নানাবিধ বৈচিত্র্যের অন্যতম বৈচিত্র্য এর নানারকম ধর্মীয় সংগীতের প্রয়োগ ও বিবর্তনে। সুফিসংগীত অনুসারে কাসিদা, নাশিদ ও কাওয়ালি ছাড়াও অন্যান্য বেশ কিছু স্বতন্ত্র ধর্মীয়সংগীতের প্রয়োগ ও প্রভাব ইসলামে পাওয়া যায়, যেমন :
১. মাওলিদ
এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতটি মূলত পয়গম্বর হজরত মহম্মদের জন্মদিন উপলক্ষ্যে নানান ভাবে, নানান মতে পরিবেশিত হয়। এই সংগীত সনাতন মতে যন্ত্রানুসঙ্গ বর্জিত ভাবে পরিবেশিত হয়ে থাকে।
২. তাজিয়া
এই সংগীতটি মূলত মহরমে গাওয়া হয়। এটি একটি আবেগপূর্ণ, সাংগীতিক নাট্যরূপ যা ইরান, পাকিস্তান ও ভারত ব্যতীত খুব কম স্থানে পরিবেশিত হয়ে থাকে। এতে মূলত ‘মরসিয়া’১৮ গাওয়া হয় যা ধর্মীয় শোকগাথা এবং কারবালায় ইমাম হুসেন ও তার সঙ্গীদের মৃত্যুর উপর অশ্রুমোচন করার উদ্দেশ্যে।
৩. আসুরা
তাজিয়ার মতো এটিও মহরমের দিন শোকগাথারূপে গাওয়া হয়।
৪. সিকিরি
এটি আরবি শব্দ ‘ধীকড়’ অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ থেকে জাত। মূলত এটি কাদিরিয়া সুফি-সংগীতরূপে খ্যাত যা পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকা অর্থাৎ তানজানিয়া, মোজাম্বিক, মালাবী, জিম্বাবোয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়া-ইয়াও বা ইয়াও জাতিগোষ্ঠীতে প্রচলিত।
৫. মনজুমা
ইসলামি মানবতাবাদী সংগীত যা ইথিওপিয়া, ঘানা ও উগান্ডাতে বিখ্যাত।
৬. মাদিনাবায়ী
মূলত এটি আরবি ভাষায় রচিত পয়গম্বর মহম্মদের স্তুতিগান বিশেষ।
সাংগীতিক বৈধ-অবৈধতা
বহু মুসলিম পণ্ডিতদের মতানুসারে কোরান ও হাদিশ অনুসারে সংগীত ও সংগীতচর্চাকে ইসলামধর্মে অবৈধ বা ‘হারাম’ (forbidden)১৯ মানা হয়। ইসলামিক সংস্কৃতি অনুসারে হজরত মহম্মদ নিজে যে-কোনো সংগীত বা সংগীতচর্চাকে ইসলামে নিষিদ্ধ বা ইসলাম বিরোধী বলে ঘোষণা করেন। যদিও ইসলামি সংগীতজ্ঞ সাফি অল-দিন (১২৯৪ খ্রিস্টাব্দ), অল-মওসিলি (৮৫০ খ্রিস্টাব্দ) ও জিয়ারবে (৮২০ খ্রিস্টাব্দ)-র নেতৃত্বে ইসলামে সংগীতচর্চার যাত্রা শুরু তবু বহু মুসলিম হজরত নির্দেশিত সেই বাণী ‘তারাই আমার প্রেমাস্পদ ও স্নেহভাজন যারা ঈশ্বর সাধনার সময় যৌনচিন্তা, মসলিন, সুরা, নারী ও সংগীত বিসর্জন দেবে’—মেনে চলেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কণ্ঠসংগীতকে ‘হালাল’-রূপে (Permissible) মানা হলেও যন্ত্রসংগীতকে আজও বহুদেশে (ইসলামিক রাষ্ট্র) ‘হারাম’ রূপে মানা হয়। সনাতনি ইসলামি বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে—দাফ, বেনজির, জার্ব, রেবানা, তোম্বাক, রেবাব বা রবাব, খামাঞ্চে, তানবুর, আউদ ও শানাই বর্তমান। হারমোনিয়ামের প্রচলন শুধু ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে দেখা যায়।
এত কিছু বিধিনিষেধ সত্ত্বেও আজ ইসলামিক ধর্মীয়সংগীত বিশ্বধর্মীয় সংগীত সভায় তার স্বতন্ত্র স্থান পেয়েছে। এ শুধু ঈর্ষণীয় নয়, গর্বের, অহংকারের। তাই এই সংগীতকে অনুধাবন করে সোচ্চারে বলা যায়—’হামিনস্ত’! —পৃথিবীতে স্বর্গ বলে যদি কিছু থেকে থাকে তা সত্যি এখানে—এখানে—এখানেই! সুম্মা-মিন!
৫ম অধ্যায় – গৌস্ট ড্যান্স ও কালো-পায়ের গান : লোকায়ত আমেরিকান ধর্মীয় সংগীত
ভূমিকা
নেটিভ আমেরিকান বা আমেরিকো-ইন্ডিয়ান ধর্মীয় সংগীতের উদ্ভব, প্রয়োগ ও পরিবেশন দেখা যায় আমেরিকার উত্তরখণ্ডে। এটি মূলত আমেরিকার সুপ্রাচীন আদিবাসী সংগীত (tribal music)। অন্যান্য নানা দেশের লোকায়ত ধর্ম ও তার ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাসে নেটিভ আমেরিকান ধর্মীয় সংগীত একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অধ্যায়। পৃথিবীর এই অন্যতম সুপ্রাচীন আদিবাসী সংগীতের ধারা অনুসরণ করে পরবর্তীকালে আধুনিক আমেরিকান রক, জ্যাজ, ব্লুস, হিপহপ ও রেগে’-র পরিচয় পেয়েছি।
বস্তুত লোকায়ত আমেরিকান ধর্মীয় ভাবধারার১ ইতিহাসে সংগীতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর সমস্ত আদিবাসী সংস্কৃতি-বিজ্ঞান-সাহিত্য ও ধর্ম যুগে যুগে মুখ থেকে মুখে শ্রুতিভাষ্যের মাধ্যমে ছড়িয়েছে। আমেরিকার ক্ষেত্রেও তা ভিন্ন নয়। সংগীতের অবদানও এসকল ক্ষেত্রে উল্লেখনীয়। নব্য আমেরিকার ধর্মীয় ভাবধারা বিস্তারে সে-সকল প্রদেশের আদিবাসী সংগীতের সুগভীর প্রভাব লক্ষণীয়। আমেরিকার সুদীর্ঘ ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় সপ্তম শতাব্দীতে২ প্রথম ধর্মীয় সংগীতের প্রচলন। উত্তর আমেরিকার নানা অঞ্চলে বিস্তৃত নানান প্রকার আদিবাসীদের ধর্ম ও তার ধর্মীয় সংগীতের মধ্যে বিশাল এক মেলবন্ধন পরিলক্ষিত হয়। তা হল পৃথিবীর কিছু আদিম শব্দ ও সুরারোপনে। এ সকল শব্দ, লোকায়ত ধবনি বা শব্দ প্রাকার কোনো অভিধানে পাওয়া দুষ্কর। আদিম ধর্মীয় আচার-আচরণে এগুলির বহুমুখী বিবর্তন ঘটেছে যুগ যুগ ধরে। এখানেই আমেরিকার লোকসংগীতের স্বতন্ত্রতা।
ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী অভিযাত্রীদের আগমনের অনেক আগে থেকেই আমেরিকার প্রাচীন লোকধর্ম ও লোকাচার সর্বজনবিদিত। এর মধ্যে গ্রেটবাসিন অঞ্চলের লোকধর্ম ও তার ধর্মীয় সংগীতচর্চার ইতিহাস সর্বাপ্রেক্ষা প্রাচীন। কণ্ঠসংগীতের এক বিশেষ ‘স্টাইল’ এখানেই সর্বপ্রথম সৃষ্টি হয়। মূলত এটি মেসো-অ্যামেরিকান মেক্সিকোতে উদ্ভূত হয়ে উত্তর আমেরিকায় ছড়ায়।
নেটিভ অ্যামেরিকান ধর্মীয় সংগীতের এই প্রভূত বিস্তারের সময় মূলত তিনটি প্রধান এশিয়ান সাংগীতিক ধারা এই সংগীতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। এই তিনটি বিশেষ ধারা হল—চাকচি (chukchee), উকাগীর (yukaghir) ও কোর্য়াক (koryak)। এই বিশেষ সাংগীতিক ধারাগুলিকে পোলিও-সাইবেরিয়ান আদিবাসীদের লোকসংগীত হিসেবে অনেকে মনে করেন। এখান থেকেই পরবর্তীকালে সাংগীতিক বিবর্তনের মাধ্যমে তিনটি প্রাচীন আমেরিকান সংগীতের মূলধারার প্রচলন ঘটে, যা হল—উত্তর-পশ্চিম আঞ্চলিক (North-west) সংগীত, প্যুবলো (Pueblo) ও নাভাযো (Navajo) সংগীত। এই সব ক-টি স্বতন্ত্র সাংগীতিক ধারাই উত্তর আমেরিকার ধর্মীয় আচার-আচরণ ও সংগীতকে সমৃদ্ধ করে।৩
এই সমস্ত আমেরিকান লোকধর্মীয় সংগীতে কণ্ঠসংগীত ও যন্ত্রসংগীতের ব্যবহার বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কণ্ঠসংগীতের মধ্যে একক গায়ন (Solo), দ্বৈত সংগীত (Duet) ও সমবেত সংগীত (choral song)-এর প্রচলন দেখা যায়। যন্ত্রানুষঙ্গ ও যন্ত্রসংগীতে মূলত চামড়ার বাদ্য (drums) ও অন্যান্য (যেমন, rattles)-র বহুল ব্যবহার দেখা যায়। মূলত এই ধর্মীয় সংগীতগুলি ধীরগতিতে শুরু হয়, তারপর ধীরে ধীরে তাদের ছন্দ বাড়ে। একসময় এই সংগীত সর্বজনসমক্ষে যথেষ্টই পরিচিতি ও প্রসার লাভ করে।
নেটিভ আমেরিকার লোকায়ত ধর্মীয় সংগীতে বেশ কিছু প্রাকৃত শব্দ ও গুপ্তমন্ত্র৪ বিদ্যমান। মূলত এগুলি সুপ্রাচীন এবং অশ্রুত। এই বিশেষ শব্দ বা মন্ত্রগুলি প্রাচীন আদিবাসীদের পবিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এবং ধর্মীয় আচার-আচরণের মুখ্য অঙ্গরূপে পরিচালিত হয়। এমনকী মাঝে মাঝে ধর্মাচরণ বা ধর্মীয় ব্যাখ্যাগুলিও সংগীতের অংশরূপে প্রতিভাত হয়েছে। অনেকাংশেই তাই এই গানগুলির পাঠান্তর বা অনুবাদ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর মধ্যে যেগুলির পাঠান্তর বা ভাষান্তর সম্ভব তার মধ্যে ‘নাভাযো’-র ‘শি-নাশা’ অন্যতম যেটি নিউ মেক্সিকোতে বিশেষ ধর্মীয় আচার-আচরণের অন্যতম বলে মানা হয়। এছাড়াও এই উত্তর আমেরিকার ধর্মীয় লোকগীতির মধ্যে—’ডিক্সি’, ‘জামবালায়া’ ইত্যাদি বিদ্যমান যা প্রাচীন আমেরিকান আধিবাসীদের নবান্ন উৎসব ও ধর্মীয় স্তুতিগানরূপে পরিচিত।
উত্তর আমেরিকার এই লোকসংগীত ইতিহাস ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতেও সমান প্রভাব ফেলতে সক্ষম। বিভিন্ন লোকসাংস্কৃতিক উৎসব, অধিবেশন ও শ্রুতিপরম্পরায় বাহিত নানান শিক্ষামূলক গল্প এই সংগীতের মাধ্যমে পূর্বসূরি থেকে উত্তরসূরিতে জারিত হয়৫। সনাতনি ভাবধারায় সমৃদ্ধ এই লোকধর্মীয় সংগীত মূলত আদিবাসীদের নানান উপাস্যদের ও চিরঅবিনশ্বর আত্মার স্তুতিরূপেও উল্লেখিত। ধর্মীয় আচার-আচরণগুলিতেও নানান সংগীত, নৃত্য, পোশাক-পরিচ্ছেদ-এর অপরিহার্য ভূমিকা পরিলক্ষিত। প্রাচীন আমেরিকো উপকথাগুলি এই ধর্মীয় সংগীত, নৃত্য ও অন্যান্য আচার-ব্যবহারাদির মাধ্যমে পরিবেশিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে নানান বীরগাথা, এলিজি, স্তুতিপাঠ, মহাকাব্য ও ধর্মাচরণ বিদ্যমান।
প্রাচীন আমেরিকার লোকধর্মীয় সংগীতে লিঙ্গ বৈচিত্র্য৬ উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সংগীত পরিবেশনকালে সংগীতে, বাদ্যযন্ত্রে ও নৃত্যে পুরুষ ও মহিলাদের অংশগ্রহণ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র। প্রাচীন আমেরিকান ধর্মীয় সংগীতে (মূলত আদিবাসী সংগীত) নারীরা নেপথ্য কণ্ঠ ও নৃত্যে পরিবেশনীয় গুরুত্বপূর্ণ অংশপ্রদান করত। পুরুষেরা মূলত বাদ্যযন্ত্র, প্রধান কণ্ঠসংগীত ও নৃত্যে অংশ নিত। ধর্মীয় সংগীত পরিবেশনকালে পুরুষেরা মূলত শক্তি এবং নারীরা শান্তি, সমৃদ্ধি ও দেবস্তুতির ভূমিকায় অগ্রগণ্য ছিল। সূর্যের স্তুতি৭ (সংগীতে ও নৃত্যে), গৌস্ট ড্যান্স (অশরীরী নৃত্য) ও প্রাচীন আত্মাদের৮ (Spirit) সম্বোধনকালে নারী ও পুরুষ উভয়েরই মহৎ ভূমিকা দর্শনীয়। এক্ষেত্রে নারীরা মূলত নানারকমের নৃত্য, গীত ও প্রার্থনা৯ পরিবেশন করে থাকে। এটি এমন এক পর্যায় যেখানে প্রাচীন ধর্মীয় সংস্কৃতির আলাপ ও প্রয়োগ, ঐশ্বরিক স্তুতি, উপকথা ও বিভিন্ন লোকসংস্কৃতির চর্চা পুরুষ ও নারী উভয় সম্প্রদায়ই করত।
প্রকারভেদ
বিভিন্ন পণ্ডিতদের মতানুসারে নেটিভ আমেরিকান ধর্মীয় সংগীতকে কয়েকটি বিশেষ ভাগে ভাগ করা যায়। এই প্রতিটি বিভাগই উত্তর আমেরিকার ধর্মীয় সংগীত মাহাত্ম্যের অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নীচে এই বিশেষ ভাগগুলিকে নিয়ে আলোচনা করা হল :
১. দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত সংগীত (South-west)
প্রাচীন আমেরিকার লোকধর্ম ও ধর্মীয় সংগীতের অন্যতম প্রধান অধ্যায় হল দক্ষিণ-পশ্চিম। এই বিশেষ অংশটিতে লোকায়ত আমেরিকান সংগীতে দুটি প্রধান গোষ্ঠী ‘প্যুবলো’ (Pueblo) ও ‘আথাবাস্কান’১০ (Athabaskan) জনসম্প্রদায়ের লোকগীতি বা ধর্মীয় সংগীতের মেলবন্ধন লক্ষ করা যায়। দক্ষিণ আথাবাস্কান-এর ‘নাভাযো’ (Navajo) ও ‘আপাচে’ (Apache) জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় কণ্ঠসংগীতের সঙ্গে প্যুবলো গোষ্ঠীর নীচুপর্দার গভীর স্বর প্রয়োগের বৈচিত্র্য দর্শনীয়। আথাবাস্কান ধর্মীয় গীতিতে চামড়ার বাদ্যযন্ত্র (drums) ও তারের সংগীতের প্রচুর ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।
এছাড়া দক্ষিণ পুবলো সংগীত দুর্বোধ্যতা, জটিল দার্শনিক তত্ত্ব ও ধীর চলনের জন্য বিখ্যাত। আথাবাস্কানের চেয়ে অনেক শান্ত, স্থিতধী চলনের এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতে নানাবিধ যন্ত্রানুষঙ্গের প্রচলন পাওয়া যায় যা পবিত্র আত্মাদের স্তুতি করে। এর বিভিন্ন শাখা-উপশাখায় যথা ‘হোপি’, ‘জুনি’, তাও প্যুবলো’, ‘সানইডিফেনসো, ‘সান্টো ডোমিনিগো’ ইত্যাদিতেও এর প্রভাব বিদ্যমান। এর সাংগীতিক রূপ, মাত্রা, দৈর্ঘ্য ও স্বরবিন্যাস অন্যান্য সকল আদিবাসী সংগীত থেকে স্বতন্ত্র এবং গভীর ভাবনির্মাণে নির্মিত। প্যুবলো ধারার ‘কাচিনা’ নৃত্যসংগীত একটি বিশেষ নৃত্যশৈলী এবং হোপি ও জুনি সংগীত সর্বাপেক্ষা জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও এতে ‘পিমা’, ‘পাপাগো’, ‘য়ুমান’, ও ‘ইরিমো’ ভাবধারার মিশ্রণ বা বর্ণবৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়।১১
অন্যদিকে ‘আপাচে’ ও ‘নাভাযো’-দের দক্ষিণ আথাবাস্কান ধারাটি সর্বাপেক্ষা সরল ও বহুজনবিদিত, বিশেষত গ্রেটবাসিন অঞ্চলে। এই সংগীতে নানান স্বরপ্রয়োগের তারতম্য, যন্ত্রানুষঙ্গ ও ছন্দজ্ঞান বিশেষ জনপ্রিয়। এছাড়াও ‘পোমো’, ‘মিওয়াক’, ‘লুসিনো’, ‘গ্যাব্রিলিনো’ ও ‘য়ুমান’ জাতির ধর্মীয় সংগীতে প্যুবলো ও আথাবাস্কান সংগীতের বহুল প্রচলন ও যৌথপ্রয়োগ বিদ্যমান। দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত ধর্মীয় সংগীত ধারাটি এইভাবে যুগ যুগ ধরে নানা আদিবাসী গোষ্ঠীর ধর্মীয় আচার-আচরণে স্বতন্ত্রতার ছাপ রেখেছে। ছাপ রেখেছে আধ্যাত্মিকতা, ধর্মীয় মাহাত্ম্য ও আদিবাসী সংস্কৃতির ভাবধারায়।
২. পূর্ব বনভূমি অঞ্চল (Eastern woodland)
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সন্ধিস্থলে যা কিনা পূর্ব বনভূমি অঞ্চল (Eastern woodland)-রূপে পরিচিত সেখানকার আদিবাসীদের মধ্যে মূলত ‘সওয়াল-জবাবি’১২ (Antiphony) সংগীত বর্তমান। এটি ‘প্যুবলো’ সংগীতের একটি বিশেষ পর্যায়। এই বিশেষ সাংগীতিক সীমারেখার মধ্যে মেরিটাইম কানাডা, নিউ ইংল্যান্ড, গ্রেট লেকস ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলগুলি বিদ্যমান। এই বিশেষ অঞ্চলের আদিবাসীদের ধর্মীয় সংগীতের মধ্যে মূলত কণ্ঠসংগীতের প্রাধান্য বেশি। এখানে ধর্মীয় গীতিতে সংগীত ছন্দগতভাবে জটিল, ‘পর্দা’ অতিক্রম (Scale change) এবং ধর্মীয় নৃত্যের পরিবেশন উল্লেখনীয়। এই অঞ্চলে বাঁশি এবং হুইসল একক যন্ত্রানুষঙ্গরূপে পরিলক্ষিত এবং নানান ধরনের বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন দেখা যায়। এই পূর্ব বনভূমি অঞ্চল বস্তুত মিসিসিপি থেকে আটলান্টিক পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সংগীতের অপেক্ষাকৃত জটিল রূপটি ‘দক্ষিণ-পূর্ব ক্রীক’ ‘য়ুচি’, ‘কেরোকি’, ‘বাকতাও’, ‘ইরোকুইস’ ইত্যাদি জাতির মধ্যে এবং সরলাংশটি অ্যালগোকুইন১৩ ভাষাভাষী যথাযথ ‘ডেলাওয়ার’ ও ‘পেনবস্কট’ ইত্যাদির মধ্যে প্রচলিত। এই সকল জাতির ধর্মীয় সংগীতগুলিতে লোকসংগীতের প্রভাব ও আমেরিকার আদিবাসী সংস্কৃতির আচার-আচরণের জ্বলন্ত উদাহরণ পাওয়া যায়।
৩. সমতলভূমি (Plainland)
লোকায়ত আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের ধর্মীয় সংগীত ও পূর্বস্থলী বনভূমিতে প্রচলিত লোকাচারের নানান প্রভাব এতে পরিগণিত হয়। এই সমতলভূমির আদিবাসীদের লোকসংগীত নেটিভ আমেরিকান ড্রামস-এর এক অনন্য পর্যায়। একমাত্র এখানেই দ্বিতল চামড়ার ভারী ড্রাম ব্যবহৃত হয়, যা একক বাদন বা ঐকতানে বিশেষ উইলো কাঠের বাঁশির (Flageolet) সঙ্গে ব্যবহৃত হয়। এখানকার ধর্মীয় সংগীতে বিলম্বিত (Slow mode) ও দ্রুত (fast mode)-র বিন্যাস পাওয়া যায়। বস্তুত সমতলভূমির নানা অধিবাসী১৪ যেমন, ‘কালো-পা রেড ইন্ডিয়ান’, ‘ক্রো’, ‘ডাকোটা’, ‘আরাফো’, ‘কিওয়া’, ও ‘কোমাঞ্চে’ ইত্যাদির লোকসংস্কৃতি ও ধর্মীয় সংগীতে এর বহুল ব্যবহার দেখা যায়। সমতলের সংগীতে কণ্ঠসংগীতের অসাধারণ তারতম্য, স্বরকম্পন ও স্বরবিন্যাস দেখা যায়। বিশেষত ‘আরাফো’, ‘ডাকোটা’ ও ‘কালো-পা’ রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে গ্রীষ্মে Sun dance বা সূর্য নৃত্য ও বর্ষায় rain dance-এর প্রচলন আছে। এটি মূলত একক বা দলগতভাবে পরিবেশিত হয়। এছাড়াও পূর্বজ যোদ্ধাদের স্মৃতিতে, বা তাঁদের আত্মাদের প্রতি স্তুতিতেও এই সংগীত বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কথিত আছে আছে কোনো বিশেষ ধর্মীয় প্রভুর আত্মা সমগ্র আদিবাসীদের এই নৃত্যগীতে সহায়তা করে, এমনকী মুমূর্ষু কোনো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় সংগীতের প্রয়োগও এখানে পরিলক্ষিত হয়। মৃত্যুর আগে ও পরমুহূর্তে সেই ব্যক্তির অনন্ত, অক্ষয় আত্মার শান্তিকামনার উদ্দেশ্যে।
৪. গ্রেট বাসিন (Great Basin)
লোকায়ত আমেরিকার অন্যতম বিখ্যাত ধর্মীয় সংগীত ধারাটি হল—গ্রেট বাসিন১৫-এর সংগীত। এই অঞ্চলের সংগীত অত্যন্ত সহজ, সরল, বহুমুখী ও নানান বৈশিষ্ট্যযুক্ত। এখানে কণ্ঠসংগীতে স্বরপ্রয়োগ খুব সাধারণ কিন্তু তারতম্যে ভরপুর। মূলত এখানকার কণ্ঠসংগীত AABB CC AA BB CC এই ফর্ম মেনে চলে। এই বিশেষ রূপটিই একে অন্যান্য সংগীতগুলির থেকে স্বতন্ত্র করে তোলে। বস্তুত গ্রেট বাসিন অঞ্চলের ধর্মীয় সংগীত ধারাটি ‘নেভাদা’, ‘উটাহ’, ‘মোড়োাক’ ও ‘ক্ল্যামাথ’ অধিজাতিগুলির মধ্যে সবিশেষ প্রচলিত। এই অঞ্চলের লোকধর্মীয় সংগীতে প্রাচীন ধর্মীয় সংগীতের তীব্র প্রভাব লক্ষণীয় যার মধ্যে ‘গৌস্ট ড্যান্স’ বা ভূতুড়ে নৃত্য থেকে শুরু করে প্রকৃতির সাধনা পর্যন্ত বিদ্যমান। এখানকার সাংগীতিক ধারাটি সরল, একমুখী অথচ প্রক্ষিপ্ত। এখানে ইতিহাসের নানান বীরগাথার গল্প সংগীতের মাধ্যমে বলা হয়ে থাকে যা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলির ন্যায় পূর্বজ থেকে উত্তরসূরিতে প্রসারিত। এই অঞ্চলে বাদ্যসংগীতের মাধ্যম অন্যান্য কণ্ঠসংগীতের তুলনায় কম ব্যবহৃত। একই শব্দ বা শব্দবন্ধনীকে পুনঃপুনঃ উচ্চারণের ধারা এখানে লক্ষণীয়। ‘মোড়োক’ ও ‘ক্লামথ’১৬ গোষ্ঠীতে এই সাংগীতিক ধারার একটি উন্নত রূপ পরিলক্ষিত হয়। প্রথম প্রথম এই ধর্মীয়সংগীতটি শুধুমাত্র গ্রামের পুরোহিতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীকালে তা সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়ায় ও উত্তর আমেরিকার নেটিভ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সংগীতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়, যা আজও অক্ষুণ্ণ।
৫. উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সংগীত (North-West)
দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত, গ্রেট বাসিন ও পুবে বনভূমি অঞ্চলের ন্যায় আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের প্রাচীন ধর্মীয় সংগীতও যথেষ্ট কৃতিত্বের দাবি রাখে। এখানকার সুদীর্ঘ সাংগীতিক ধারাটি অন্যান্য সংগীতগুলির থেকে বেশ স্বতন্ত্র। এখানে সংগীতের সঙ্গে কণ্ঠতারতম্য, জটিল সুরারোপন ও যন্ত্রানুষঙ্গের ব্যবহার দেখতে সহজাত হলেও এর বিস্তার সহজাত নয়। এখানে যন্ত্রানুষঙ্গের বিশেষ প্রচলনের পাশে কণ্ঠসংগীতের অবদানও কিছু কম নয়। মূলত এটিও একক বা যৌথ বা সমবেত তিনটি সাংগীতিক ধারায় বিদ্যমান। যন্ত্রসংগীতে এখানে বাঁশি, চামড়ার বাদ্য ও হর্ন-এর প্রচলন আছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের প্রাচীন আদিবাসীদের মধ্যে যথা ‘সিমসিয়ান’, ‘মাকাহ’, ‘নু-চা-নথ’ এবং অন্যান্য ছোটো ছোটো জাতিগোষ্ঠীর ধর্মীয় সংগীত এই অঞ্চলে যথেষ্ট উন্নতিসাধন করেছে। কণ্ঠসংগীতের মধ্যে ‘সিয়াসিয়ান’ ও ‘কোয়াকওয়াকা ওয়াক’ জাতিগোষ্ঠী, বাদ্যসংগীতে ‘মাকাহ’ গোষ্ঠীগুলি যথেষ্ঠ জনপ্রিয়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের ধর্মীয় সংগীত তার লোকাচারের মতোই সমান মাহাত্ম্যপূর্ণ।১৭
৬. আর্কটিক (Archtik)
প্রাচীন আলাস্কা, উত্তর-পশ্চিম খণ্ড, য়ুকন ও গ্রিনল্যান্ড যা আর্কটিক শ্রেণিভুক্ত কণ্ঠসংগীতের জন্য বিখ্যাত। এ অঞ্চলের প্রাচীন আদিবাসীদের মধ্যে ‘য়ুকোন’, ‘এস্কিমো’ বিশেষ উল্লেখনীয় এদের গালবাদ্য, কণ্ঠসংগীত ও তারতম্যের জন্য। নানান প্রকার ড্রামস, বক্স, ও মরু-কাঠের বাঁশি এখানে ধর্মীয় যন্ত্রসংগীতরূপে পরিলক্ষিত হয়।১৮ পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে স্তুতি থেকে শিকার সংগীত নানান অনুষ্ঠানে ও ধর্মীয় আচারবিধিতে এই আর্কটিক অঞ্চলের লোকসংগীত তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের পরিচয় রাখে। ‘টামবোরিন’ জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের প্রথম প্রচলন এখানেই দেখা যায়, যা নেটিভ আমেরিকান ধর্মীয় সংগীতে এক বিশেষ স্থান বজায় রাখে। এই ট্র্যাডিশন আজও অব্যাহত।
যন্ত্রানুসংগীত
নেটিভ আমেরিকার লোক এবং ধর্মীয় সংস্কৃতির সংগীতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে যন্ত্রানুসংগীতের ভূমিকা। বহু যুগ আগে, রীতিমতো সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতের নথিকরণও হয়নি তখন থেকে আদিবাসী সংস্কৃতি ও ধর্মচেতনায় যন্ত্রসংগীতের প্রভাব বিদ্যমান। আদিবাসী জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই যন্ত্রসংগীতের অবদান যার মধ্যে মূলত ‘বাঁশি’ এবং ‘চামড়ার বাদ্যযন্ত্র’ উল্লেখনীয়।
১. নেটিভ আমেরিকান বাঁশি
নেটিভ আমেরিকান বাঁশি তার অসাধারণ বৈচিত্র্য, সুর এবং শ্রুতিমাধুর্যের জন্য জগদবিখ্যাত। উত্তর আমেরিকার কমবেশি সব ক-টি আদি জনগোষ্ঠীতে বাঁশির বহুল প্রচলন লক্ষণীয়। প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত এর জনপ্রিয়তা ও সর্বজনগ্রাহ্যতায় বিন্দুমাত্র ছেদ আসেনি। এই বাঁশি পৃথিবীর একমাত্র বাঁশি যাতে দুটি বায়ু প্রকোষ্ঠ (Air chambers) রয়েছে—যা যথাক্রমে বাঁশির ঊর্ধ্ব ও নিম্লভাগে অবস্থিত। প্রথম প্রকোষ্ঠটি মূল স্বরক্ষেপণে সাহায্য করলে দ্বিতীয়টি সাহায্য করে তার মূর্ছনায়। এই বিশেষ আঙ্গিকে গঠিত বাঁশি পৃথিবীর অন্য সমস্ত বাঁশির থেকে স্বতন্ত্র।১৯ লম্বায় এটি প্রায় দেড় হাত হয়ে থাকে। সনাতনি এই বাঁশি প্রথমে মূলত মেষপালকদের হাতে দেখা যেত, পরবর্তীকালে তা যোদ্ধা ও শিকারবাহিনীর নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে। এর গম্ভীর অথচ ভাবসম্পূর্ণ আওয়াজ-এ উত্তর আমেরিকার প্রাচীন মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। পুরাকাল থেকে আদি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে, রাজসভায়, শিকার, যুদ্ধে ও রোগ দূরীকরণের আধ্যাত্মিক সংস্কার-সংস্কৃতিতে এর প্রচলন অবাধ ও অপাপবিদ্ধ।২০ বিংশ শতাব্দীতে এসে ‘দো নেভাকুয়া’, ‘কার্ল ডিয়ার’, ‘জে ইগল’, ‘রবার্ট মির্যাবল’ প্রমুখ বিভিন্ন জনপ্রিয় নেটিভ আমেরিকান বাঁশিবাদকের পরিচয় পাওয়া যায়, যাঁরা এর মাহাত্ম্যকে দিনের পর দিন আরও গৌরবোজ্জ্বল করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
২. নেটিভ আমেরিকান ড্রামস
নেটিভ আমেরিকান ধর্মীয় যন্ত্রানুসংগীতের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রাচীন যুগে রেড ইন্ডিয়ান পুরোহিতরা এর প্রচলন ঘটালেও অচিরেই এটি জনজীবনে বিস্তার করে এবং মূলত শিকার ও যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন আদিবাসীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র ও তার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। এখানে দ্বিতল চামড়ার বাদ্যযন্ত্রের (নাকাড়া সদৃশ) পাশাপাশি জলতরঙ্গের প্রচলনও দেখা যায়। এই জাতীয় বাদ্যযন্ত্র২১ মূলত ‘নেভাদা’, ‘উটাহ’, ‘আরাফো’ ও ‘ডাকোটা’ আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত। কমবেশি সমস্ত উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের ধর্মীয় সংগীত ও নৃত্যে ড্রামের প্রচলন আছে। চামড়া ও গঠনশৈলীর তারতম্য ঘটিয়ে এর সাংগীতিক প্রভাব আরও বৈচিত্র্যমূলক করা হয়। ধর্মীয় রীতি, রেওয়াজেও বিশেষত পূর্বপুরুষদের স্তুতি, ভূতুড়ে নৃত্য ও অতীন্দ্রিয় শক্তির জাগরণ হিসেবে এই সুপ্রাচীন ধর্মীয় যন্ত্রসংগীতমাধ্যমটি যুগে যুগে এর সাংগীতিক ভাবধারাকে অক্ষুণ্ণ এবং বিশেষ প্রভাবান্বিত করে এসেছে এবং তা আজও সমানভাবে বিদ্যমান।
উপসংহার
পুরাতত্ত্বের বিচারে উত্তর আমেরিকার সনাতনি ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাস প্রায় কয়েকশত বর্ষ প্রাচীন যা শুরু হয় ষষ্ঠ শতাব্দীর দোরগোড়ায়। যদিও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের হাত ধরে এর পর্ব নথিকরণ সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু এর প্রচলন, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও রীতিনীতি বহু আগে থেকেই পূর্ণমাত্রায় বিকশিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতটির সাংগীতিক ভাবধারা ও ব্যবহারিক নৈপুণ্য নিয়ে গবেষণা শুরু হলেও প্রাচীন যুগে এই আদিবাসী জীবনের বিশেষ ধর্মীয় সংগীতের প্রভাবটি চিরকাল সংগীতপিপাসু ও সংগীতমনস্ক ব্যক্তিদের বিস্মিত করেছে। বিংশ শতাব্দীতে ‘প্যান-ট্রাইবালিজম’২২ নিয়ে আরও একটি বিশেষ বহিঃসংস্কৃতি অন্তর্ভুক্ত ধর্মীয় সাংগীতিক প্রভাব নেটিভ আমেরিকান ধর্মীয় সাংগীতিক ভাবধারাকে আরও গৌরবোজ্জ্বল করে তোলে। বিশ্বায়নের ফলে বহিঃবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ ও ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ভাব-বিনিময়ের মাধ্যমে এর বিশেষ ধর্মীয় মনোভাব ও তার বিস্তার আরও উন্নত শ্রেণির রূপকল্পনায় পর্যবসিত হয়। এর মধ্যে ‘পোউয়ো’, ‘পিয়্যুট’ ‘গৌস্ট ড্যান্স’ উল্লেখযোগ্য। নেটিভ আমেরিকান চার্চসংগীতও এইসব সাংগীতিক প্রভাববিমুক্ত নয়। এমনকী এখানে অদ্ভুত কিছু পদ্যভাষ্য’-র নিদর্শনও পাওয়া যায় যা আদিবাসী পুরোহিতদের মধ্যে আত্মার অতীন্দ্রিয়চর্চা ও ধর্মীয় রীতিনীতির অঙ্গরূপে চর্চিত হয়। এইসব পদ্যভাষ্য-র ভাষা, রূপ ও গঠনশৈলী নিয়ে আজও পণ্ডিতমহলে মতভেদ থাকলেও এর উৎকর্ষ নিয়ে তেমন কোনো দ্বিমত পাওয়া যায় না।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আরও একবার এটা প্রমাণিত হয়ে গেল যে, আধুনিক যুগের ধর্মীয় সংগীতে নানান ঐকান্তিক বিবর্তনের ধারা অক্ষুণ্ণ থাকলেও প্রাচীন আমেরিকার সুপ্রাচীন লোকধর্মীয় সংগীত মানবসভ্যতার সংস্কৃতির অন্যতম প্রাচীন ধারক ও বাহকরূপে পরিচালিত। আজও কান পাতলে সেইসব আদিম শব্দোচ্চারণ, মন্ত্রবিন্যাস, ধর্মীয় সংগীতের সুপ্রাচীন লোকাচার আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় নিজেদের শিকড়ে—নিজেদের ও পৃথিবীর প্রাচীন অন্তঃসারিত অস্তিত্বের চাপাপড়া কালের ভগ্নস্তূপের দিকে। এই সংস্কার, অতীন্দ্রিয়তা, ধার্মিক রীতিনীতি ও তার সাংগীতিক রূপবৈচিত্র্য এত সহজে বদলে যাওয়ার নয়। আর বদলালেও পৃথিবীর অন্যান্য লোক-ধর্মীয় সংগীতগুলির মতো এটিও ঠিকই খুঁজে নেবে তার চলার পাথেয়, তার সুর বিচরণের প্রশস্ত ভূমি, ছন্দ ও যন্ত্র-শব্দের প্রত্ন-শৈল্পিক আধার।২৩
৬ষ্ঠ অধ্যায় – গঞ্জিকা-গীতি ও জিওনিজম : রাস্তাফারিয়ান ধর্মীয় সংগীত
সূচনা
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ধর্মীয় ও অতীন্দ্রিয়বাদের পুরোধা হল আফ্রিকার ‘রাস্তা’ বা ‘রাস্তাফারি’ বা ‘রাস্তাফারীয়’ ধর্ম। এই বিশেষ ধর্মীয় ভাবধারাটির উদ্ভব হয় জামাইকায় যা তৎকালীন ইথিওপিয়ান রাজা ‘হেইলে স্যেলসিও’১ সিনিয়রের তত্ত্বাবধানে ও পৃষ্ঠপোষকতায় বিস্তার লাভ করে। ‘প্রথম হেইলে স্যেলসিও’ অনেক রাস্তাফারিদের মতে ‘যাহ’ অথবা ‘যাহ রাস্তাফারি’ নামে পরিচিত হন যার অর্থ ‘ঐশ্বরিক আবির্ভাব’ বা ‘ঈশ্বরের মানবসংস্করণ’। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই রাজার অকৃত্রিম পৃষ্ঠপোষকতায় ‘রাস্তাফারি’-র বিকাশ ঘটে। ‘হেইলে স্যেলসিও’কে খ্রিস্টধর্মের সেই ‘পবিত্র ত্রিত্ববাদ’-এর২ (Holy trinity) অংশরূপেও কল্পনা করা হয় যেখানে বাইবেল নির্দেশিত সেই ‘মসিহা’ বা ‘রক্ষাকর্তা’র কথা বলা হয়েছে যিনি মানবজীবনের কল্যাণসাধনের জন্য ফিরে আসবেন পৃথিবীতে।
‘রাস্তাফারি’ ধর্মের অন্যান্য প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল—গঞ্জিকা বা গাঁজা৩ (cannabis) সেবনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকচর্চা, প্রাচ্যের ভাবাদর্শকে অস্বীকার, ঔপনিবেশিক আফ্রিকার রাজনৈতিক ও সমাজতান্ত্রিক চেতনা এবং ধর্মীয় আত্মীকরণের এক নতুন বিশ্বদর্শন। এই ধর্মই আফ্রিকাকে এক বিশেষ ‘চিহ্নিত স্থান’-রূপে বিবেচনা করে যেখানে প্রথম মানবজাতির উন্মেষ ও কালো মানুষদের মধ্যে স্ব-অধীনতার জাগরণ নির্দেশ করা হয়।
‘রাস্তাফারি’ শব্দটি প্রথম পাওয়া যায় ‘রাস’ বা প্রধান এবং ‘তাফারি’ বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও শাসক হেইলে স্যেলসিও’-র পূর্ব উপাধি থেকে। মূলত এটি প্রাচীন জামাইকান ভাষা-রূপ।
অন্তর্দর্শন ও মতবাদ : আফ্রিকা মহাদেশের এই বিশেষ বৈচিত্র্যপূর্ণ ধর্মটির সামাজিক বৈশিষ্ট্য, রীতিনীতি ও ভাবাদর্শ রীতিমতো উল্লেখনীয়। এই ধর্মের অর্থাৎ ‘রাস্তাফারি’-র অন্তর্দর্শন ও বিভিন্ন মতবাদ নিয়ে আলোচনা করা হল :
১. যাহ (Jah)
রাস্তাফারি ধর্মাবলম্বীরা মূলত একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী যাদের এঁরা ‘যাহ’৪ (Jah) বলে সম্বোধিত করেন। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মতো ‘রাস্তা’-রাও বিশেষভাবে মনে করে থাকেন যে ‘যাহ’ রা মূলত ‘পবিত্র ত্রিত্ববাদে’-র (Holy trinity) অংশ যেখানে ঈশ্বরকে পিতা, পুত্র এবং পবিত্র আত্মা এই তিন সমন্বয়ে সাধিত বলে মনে করা হয়। ‘রাস্তা’রা বিশ্বাস করেন যে ‘যাহ’, মূলত পবিত্র আত্মার সমন্বয় সাধনকালে এঁরা মানবজাতির মধ্যে বসবাস করে। এক্ষেত্রে অনেকাংশে এঁরা ‘আমিই সে’ (সংস্কৃতে ‘সোহম’) এই রূপে নানাবিধ আচার-আচারিদের মাধ্যমে নিজেদের গঠিত করেন। এঁরা বিশেষরূপে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বীদের তত্ত্ব মেনে চলে যেখানে ঈশ্বর ধরাধামে প্রকট হয়েছেন যিশু খ্রিস্ট নামে মানবজাতির কল্যাণসাধনের জন্য। তাঁরা এটাও মনে করেন ব্যাবিলনের উত্থানের ফলে এই রাস্তাফারীয় ধর্মটির আংশিক মান কমেছে। এঁরা আবার মনে করে থাকেন ‘শব্দ বা ধবনি হল প্রকৃত সাংস্কৃতিক শক্তির আধার’। ‘যাহ’ শব্দটি আবার হিব্রুতে ‘য়সুহা’৫ ও আমহারিকে ‘লিয়েসাস’ নামেও পরিচিত। ‘রাস্তা’ বা ‘রাসতাফারি’য়ানদের বিশেষ ও সাধারণ অন্তর্দর্শনটি হল যে ‘যাহ’, উদ্ধারকর্তা (মসীহা)৬ অথবা খ্রিস্ট পুনরায় ফিরে আসবেন এবং এইবার ইথিওপিয়ান রাজা ‘হেইলে সেলাসিও’র রূপে বিরাজিত হবেন। এঁরা এখনও এই ভাবাদর্শের ওপর বেঁচে থাকেন। বেঁচে থাকেন স্বধর্ম শাসন ও ধর্মীয় আচার-আচারিদের সক্রিয়তায়।
২. পবিত্র ত্রিতত্ত্ববাদ (Holy trinity)
রাস্তাফারীয় মতবাদ খ্রিস্টীয় ‘পবিত্র ত্রিত্ববাদে’-র মূলক ধারক ও বাহক। তাঁদের মতে ‘হেইলে স্যেলসিও’৭ শব্দটি এই পবিত্র ত্রিতত্ত্ববাদের মূল ভাববাদের ছায়াসঙ্গী। বহু রাস্তাফারিয়ানদের মতানুযায়ী প্রথম হেইলে সেলাসিও বস্তুত ঈশ্বরের পিতৃ, সন্তান ও পবিত্র আত্মার মতাদর্শকে একই সূত্রে বাঁধেন ও চিন্তাধারার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন।
৩. যিশু খ্রিস্ট (Christ)
এই বিশেষ ধর্মাবলম্বী মানুষেরা, খ্রিস্টানদের মতোই মনে করেন যে যিশু খ্রিস্ট আসলে পৃথিবীতে ঈশ্বরের পুনর্জন্ম (ঈশ্বরের সন্তান বা অভিপ্রেত দূত নয়) ছাড়া অন্য কিছু নন। এঁরা বিশ্বাস করেন প্রভু যিশুর হাত ধরেই ‘যাহ’-রা প্রথম মানবধর্ম বিকাশের পাঠ গ্রহণ করেন পরে যা ব্যাবিলনের উত্থান ও ভাবাদর্শ দ্বারা বিক্ষিপ্ত হয়। ফলে পৃথিবীতে প্রভু যিশুর পুনরাগমনের লক্ষণ আরও একবার পুনর্গঠিত হয়। রাস্তাফারিয়নরা বিশ্বাস করেন পবিত্র হেইলে সেলাসি’-র মাধ্যমে এই ভবিষ্যদবাণী পরিপুষ্ট হবে। এঁরা আরও বিশ্বাস করেন যে প্রভু যিশু আসলে নিগ্রো ও নেগ্রিটো (Black)৮ বা কালো মানুষদের প্রতিনিধি যিনি ‘সাদা চামড়ার’ সমাজে অজ্ঞানতাবশত তাদের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত। এই ভ্রান্তি আফ্রিকার কালো মানুষদের সত্যতা ও মূল পরিচয় থেকে বঞ্চিত করে। আজও এই মতাদর্শ নিয়ে রাস্তাফারিয়ানদের সঙ্গে খ্রিস্টান ক্যাথলিক চার্চের মতানৈক্য বিদ্যমান।
৪. হ্যেইলে স্যেলসিও
ইথিওপিয়ার প্রবাদপ্রতিম সম্রাট হ্যেইলে স্যেলসিও (১৮৯২ – ১৯৭৫ খ্রি.) দীর্ঘ ৪৪ বছর (১৯৯০ – ১৯৭৪) ইথিওপিয়ায় রাজত্ব করেন। রাস্তাফারিয় ধর্ম্বাবলম্বীরা এঁকে প্রভু যিশুর পুনর্জন্মের স্বরূপ বলে মনে করেন এবং মনে করেন এঁর থেকেই ‘যাহ’ দের সৃষ্টি। এঁরা বিশ্বাস করেন এই সম্রাটের হাত ধরেই একদিন ‘প্রকৃত’ পৃথিবী এই মর্ত্যে নেমে আসবে যাকে ‘জিওন’৯ বলা হয়। রাস্তাফারিয়ানরা মনে করেন এই বিখ্যাত সম্রাটের আবির্ভাব বাইবেলের মূলখণ্ডে বহুপূর্বেই উল্লেখিত এবং এঁর রাজ্যাভিষেকে বাইবেলে পূর্ব নির্দেশিত উপাধি ‘রাজার রাজা’ বা ‘ঈশ্বরের নির্বাচিত’ ইত্যাদি এঁকেই প্রদান করা হয়। ‘রাস্তাফারি’ নামকরণটি এঁর নাম থেকেই পাওয়া যায়। রাস্তাফারিয়ানরা বিশ্বাস করেন ঈশ্বরের মৃত্যু নেই,১০ এবং ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে হ্যেইলে স্যেলসির তথাকথিত মৃত্যুও একটি বিবর্তন ছাড়া আর কিছুই নয়। রাস্তাফারিয়ানদের মতে প্রথম সেলাসীই তাদের ভগবান, রাজা ও পথপ্রদর্শক। এঁর সাম্রাজ্যেই আফ্রিকায় ধর্মীয় ভাবধারা, খ্রিস্টীয় দর্শন ও জাতীয়তাবাদের তুমুল জনজোয়ারের আবির্ভাব ঘটে যা আফ্রিকার কালো মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে এক আলোকোজ্জ্বল ও সমৃদ্ধিপূর্ণ ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই বিশেষ ধর্মীয় সাম্রাজ্যের আড়াইশো বছরের ইতিহাসে আজও ইথিওপিয়ায় সেলাসি সাম্রাজ্যের প্রভূত উন্নতি ও বিস্তার দেখা যায় এবং এই সাম্রাজ্যে জনকরূপে বাইবেলের সময়কার রাজা সলোমন ও রানি শিবা আজও এদেশে বিশেষ শ্রদ্ধেয় ও সমাদৃত হয়ে থাকেন। ইথিওপিয়ার জাতীয় মহাকাব্য কেবরা নেগাস্ত (Kebra Negast)১১ অনুসারে পূর্ব উল্লেখিত তথ্যের পাশাপাশি পাওয়া যায় ‘রাস্তাফারীয়’-দের সঙ্গে আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজের মতানৈক্য ও বৈপরীত্যের প্রসঙ্গ। ইথিওপিয়ায় এই বিশেষ ধর্মীয়গ্রন্থ অনুসারে ‘যাহ’ উল্লেখিত ‘রাস্তা’ দের সেই পবিত্র ও কাঙিক্ষত ভূমিটি হল মাউন্ট জিওন পর্বত। এই ‘নির্বান ভূমি’-র সন্ধান বা একে লাভ করতে হলে ‘রাস্তা’-দের অবশ্যই আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজের আধুনিকীকরণ, হিংসা-বিদ্বেষ ও লোভ-লালসার দুনিয়াকে উপেক্ষা করতে হবে যা ‘ব্যাবিলন’ নামে পরিচিত এবং যা অত্যন্ত কলুষিত। বাইবেলে উল্লেখিত রাজা নিমরো-র১২ (King Nimroh) সময় থেকেই ‘ব্যাবিলন’-কে পৃথিবীর ‘প্রকৃত ও কাঙ্ক্ষিত শাসক’ (যাহ) শ্রেণির বিরোধিতা করতে দেখা যায়। ফলস্বরূপ ‘রাস্তাফারিয়ান’রা এই বিশেষ পাশ্চাত্য সমাজটিকে সযত্নে বিরোধিতার সঙ্গে এড়িয়ে চলে। বিখ্যাত সংগীতকার যেমন বব মার্লে, দামিয়ন মার্ল, বেন হার্নার ও লরেন হিল ইত্যাদির গানেও এই ‘জিওনবাদ’-এর প্রভূত ব্যাপ্তি ও সমৃদ্ধির কথা শুনতে পাওয়া যায়।
৫. অ্যাফ্রোসেন্ট্রিজম ও কালো মানুষের গর্ব
রাস্তাফারি-ধর্মের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য আফ্রিকার প্রাচীন সংস্কৃতি, ভাবাদর্শ ও কালো মানুষের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করা। এদের মতে আফ্রিকায়, মূলত ইথিওপিয়ায়, একদিন ভূস্বর্গের বা ‘জিওন’-এর আবির্ভাব ঘটবে এবং সেই পবিত্র স্থানে আফ্রিকার সুপ্রাচীন আদর্শ ধর্মসংস্কৃতি, ধর্মীয় মতাদর্শ ও শিল্পসংস্কৃতির গৌরব ফিরে আসবে যা একদা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে লুণ্ঠিত হয়েছিল। এদের দৃঢ় বিশ্বাস এই ‘মহা আগমন’-এর পথ ধরেই সাদা চামড়ার লোকেদের আধিপত্য ও ভুয়োধর্মাচারণের পরিসমাপ্তি ঘটবে। পরিসমাপ্তি ঘটবে কালো মানুষদের উপর পাশ্চাত্যের সাদা চামড়ার লোকেদের মালিকানা। পরিসমাপ্তি ঘটবে অভাব-অনটন, দুঃখ-দুর্দশা, দাসত্বের ইতিহাসের। প্রাচীন আফ্রিকার সমাজ-সংস্কৃতির হৃতগৌরব এভাবেই একদিন ফিরে আসবে অ্যাফ্রোসেন্ট্রিসিজমের১৩ পথ ধরে, যার মূলে আফ্রিকার প্রাচীন ধর্মীয় সামাজিক রীতিনীতি, ভাবাদর্শ, ও প্রগতিশীল চেতনার। জাতিবর্ণধর্ম বিদ্বেষ ও পরাধীনতার জাল ছিঁড়ে আফ্রিকা সেদিন আবার বিশ্ব দরবারে স্বমহিমায় উপস্থিত হবে। এর চাইতে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন আফ্রিকার মানুষদের আর কিই-বা হতে পারে?
উৎসব বা পার্বণ
রাস্তাফারিয়ান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মূলত দু-প্রকারের ধর্মীয় উৎসব দেখতে পাওয়া যায়, যা হল :
১. ধর্মীয় জমায়েত (Reasoning)
ধর্মীয় জমায়েত ‘রাস্তাফারি’-দের একটি সাধারণ অনুষ্ঠান যেখানে ‘রাস্তা’ ধর্মাবলম্বীরা একত্রিত হন, ক্যানাবিস বা গঞ্জিকা সেবন করেন এবং ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি ও অতীন্দ্রিয় নিয়ে নানান আলোচনায় নিমগ্ন হন। যিনি এই সভার পৃষ্ঠপোষকতা করেন সেই ‘রাস্তা’-কে একটি ছোটো ধর্মীয় স্তুতিপাঠ বা গানের মাধ্যমে গাঁজার ছিলিমে সুদীর্ঘ টান মেরে এই আলোচনার সূচনা করতে হয়। আলোচনা চলাকালীন বা তার শেষে বাইবেল ও কেবরা নেগাস্ত থেকে নানান অধ্যায় সংগীতের১৪ মাধ্যমে পাঠ করা হয়ে থাকে (যা মূলত আফ্রিকার প্রাচীন লোকসংগীতের রূপ) এবং গাঁজার ধূমপানের মধ্যে দিয়ে এই আলোচনাকে আরও সমৃদ্ধ করা হয়। ইথিওপিয়া, আদ্দিস আবাবা ও জামাইকার নানান স্থানে এই প্রকার ধর্মীয় রীতিনীতি ও সংগীতের প্রচলন আজও বহুলাংশে দেখা যায়।
২. আল বিঙিঘ (Grounation)
আল বিঙিঘ আসলে একটি পবিত্র ধর্মীয় দিন যা রাস্তাফারি ধর্মাবলম্বীরা বহুদিন ধরে পালন করেন। ‘বিঙিঘ’ নামকরণটি মূলত প্রাচীন আফ্রিকান ‘নিয়াবিঙিঘ’১৫ থেকে জাত যা মূলত একটি প্রাচীন অধুনালুপ্ত ধর্মীয় লোকাচার। ‘বিঙিঘ’-রা মূলত নাচ, গান, মোচ্ছব, গঞ্জিকা সেবন-এর মাধ্যমে এই প্রাচীন ধর্মীয় রীতিনীতির পালন করে থাকে। ‘বিঙিঘ’রা নানান ধর্মীয় লোকসংগীত চারণের মাধ্যমে ও ছিলিমে অগ্নিসংযোগের প্রাকমুহূর্তে নানান ধর্মীয় আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে এই প্রথার সূচনা করে থাকেন। প্রাচীন আফ্রিকায় মূলত প্রধান ছয়-দিন। যেমন—জানুয়ারি ৭ তারিখ (ইথিওপিয়ান ক্রিসমাস), ফেব্রুয়ারি ৭ তারিখ (ইথিওপিয়ান নববর্ষ), এপ্রিল ২১ তারিখ (সম্রাট হেইল স্যেলাসি ১ম-র জামাইকায় আগমন), জুলাই ২৩ তারিখ (সম্রাট হেইল স্যেলাসির জন্মতিথি), আগস্ট ১৭ তারিখ (মার্কাস গাভের জন্মতিথি ও নভেম্বর ২ তারিখ (সম্রাট হেইল স্যেলাসির রাজ্যাভিষেক)-এ এই উৎসব পালিত হয়। সাধারণত রাস্তাফারিরা কোনোদিন কোনো চার্চে বা ঈশ্বরের মন্দিরে যেতে আগ্রহী নয় কারণ এঁরা বিশ্বাস করেন মানবশরীরের মধ্যেই ঈশ্বরের প্রকাশ তাই তাকে আলাদা করে কোনো মন্দিরে বা চার্চে প্রতিস্থাপন করা অসম্ভব। রাস্তাফারি ধর্মালম্বীদের এই ধরনের অনন্যসাধারণ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মীয় মতবাদ তাদের অন্যান্য ধর্ম থেকে স্বতন্ত্র করে তোলে। রাস্তাফারীয় সংগীত ধর্মীয় সংগীত-এর অনবদ্য এক অধ্যায় যা প্রাচীন আফ্রিকার গৌরবমণ্ডিত সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহকরূপে চিহ্নিত হয়ে থাকে।
ধর্মীয় সংগীত
সংগীত বা ধর্মীয় সংগীতের এক বিশাল প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় রাস্তাফারীয়দের মধ্যে। রাস্তাফারিয়ান ধর্মীয় সংগীত মূলত আফ্রিকার প্রাচীন লোকসংস্কৃতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন যা শুধুমাত্র ধর্মীয় চেতনার উন্মেষই ঘটায় না বরং এই বিশেষ ধর্মীয় আন্দোলনের ভাবধারা, মতাদর্শ ও আফ্রিকার আর্থ-সামাজিক সংস্কৃতির মূলধারাকেও প্রকাশ করে থাকে।
রাস্তাফারিয়ান ধর্মীয় সংগীত পৃথিবীর প্রাচীন আদিবাসী লোকসংগীত। এই ধর্মীয় সংগীত বিশেষত নানান ধরনের হয়ে থাকে, যার মধ্যে—’কুমিনা’, ‘নিয়াবিঙিঘ’, ‘মেন্টো’, ‘স্কা’, ‘রেগে’, ‘ডাব’, ‘রাগামাফিন’১৬ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে ‘নিয়াবিঙ্গি’ ও ‘রেগে’ প্রাচীন আফ্রিকা তথা আধুনিক আফ্রিকান সমাজে বিশেষ জনপ্রিয়।
১. নিয়াবিঙ্গি
‘নিয়াবিঙিঘ’ মূলত এক প্রকার প্রাচীন ধর্মীয়স্তুতি যা রাস্তাফারিয়ানদের নানান পুজা-পার্বণে ব্যবহৃত হয়। এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতে বাদ্যযন্ত্র (drumning), স্তুতিপদ, আদিবাসী নৃত্যশৈলী বর্তমান। ‘নিয়াবিঙিঘ’-তে এ ছাড়াও নানান প্রার্থনাসংগীত ও গঞ্জিকা সেবনের প্রচলন আছে। প্রাচীন রাস্তাফারীয়দের ধর্মীয় জমায়েতে নানা প্রকার প্রার্থনা, বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি প্রাচীন নৃত্যশৈলী, প্রাচীন স্তব ও নানান প্রকার ও প্রাচীন জনসংগীতের ভাবধারা বিশেষ পরিলক্ষিত। ‘নিয়াবিঙিঘ’ এরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
১৮৫০ থেকে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ‘নিয়াবিঙিঘ’১৭-র প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়। ‘নিয়াবিঙিঘ’ একটি প্রাচীন আদিবাসী ধর্মীয় সংগীত। এই ‘নিয়াবিঙিঘ’ শুধুমাত্র ধর্মীয় ভাবধারার প্রকাশ করে না বরং প্রাচীন রাস্তাফারীয়দের উত্থান তার ক্রমবিকাশ, উন্নতিসাধন, পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে তুলনামূলক বৈচিত্র্যের নানান দিক এখানে চর্চিত হয়। ‘নিয়াবিঙিঘ’ সংগীতে ড্রাম বা চামড়ার বাদ্যযন্ত্রের এক সপ্রতিভ ভূমিকা লক্ষণীয়। রাস্তাফারীয়ানরা মনে করেন ‘পবিত্র যাহ’-দের আত্মা ওই বাদ্যযন্ত্রে সমাদৃত। বাদ্যযন্ত্রের এই বিশেষ মতালোকে আর এক বিশেষ চামড়ার বাদ্যযন্ত্রের অধ্যায় যা ‘বুড়ু’ নামে বিখ্যাত জামাইকা ও ইথিওপিয়ার প্রান্তর সীমান্তে। এই অপ্রচলিত বাদ্যযন্ত্রের ধারাটি পরবর্তীকালে আধুনিক জামাইকান সংগীতকার ‘কাউন্ট ওসি’র১৮ সাহচর্যে পুনরাবিষ্কৃত হয়। প্রাচীন এই বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ‘নিয়াবিঙিঘ’ সংগীতেও বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়েছে।
ঔপনিবেশিক ও উত্তর ঔপনিবেশিক আফ্রিকার ধর্মীয় সংগীতে ‘নিয়াবিঙিঘ’র অবদান অসামান্য। পরবর্তী আধুনিক যুগে এর নানাবিধ বিবর্তন (যেমন— মেন্টো, জোকানো, Kumina) ঘটলেও আজও এই সংগীতের ধর্মীয় মাহাত্ম্য ও তার ব্যবহারিকরণ বিশেষভাবে বিশ্ব সংগীতের আসরে সমাদৃত। আফ্রো-ক্যারিবিয়ান সংগীতে ধর্ম ও ধর্মীয় বাতাবরণের ঐতিহ্যে এই সকল সাংগীতিক রূপের অনবদ্য প্রভাব আজও চিরস্মরণীয়।
২. র্যেগে (Reggae)
প্রাচীন জামাইকার ‘র্যেগে’-র উৎপত্তি নিয়ে সংগীতজ্ঞদের মধ্যে নানান মতানৈক্য রয়েছে। এদের একশ্রেণির বক্তব্য প্রাচীন জামাইকান আদিবাসীদের ধর্মীয় ভাবধারার রূপান্তর এই ‘র্যেগে’, অন্যদিকে আরেক শ্রেণির পণ্ডিতরা একে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের অধীনে শোষিত, নিষ্পেষিত ও নিগৃহীত কালো মানুষদের স্বাধীনচেতনার বহিঃপ্রকাশ। মতভেদ যাই থাকুক না-কেন প্রাচীন জামাইকার এক ঐতিহ্যপূর্ণ সাংগীতিক বিবর্তনের আধুনিক নিদর্শন হল—’র্যেগে’।১৯ ‘র্যেগে’ বস্তুত রাস্তাফারিয়ান ধর্মীয় সংগীতের এক প্রধান অধ্যায় যা সনাতনি আফ্রিকান লোকসংগীত ও ধর্মীয় আচারের উত্তর-ঔপনিবেশিক রূপকল্প। ‘নিয়াবিঙিঘ’ সংগীতেও ‘র্যেগে’-র প্রভাব বিদ্যমান। এটি মূলত রাস্তাফারীয় ধর্মীয় স্তুতি-সংগীত ও ‘বিঙিঘ’ নাচ-গান ও বাদ্যযন্ত্রের এক অপরূপ মেলবন্ধন। একে অনেকে ethnic jamaican jazz form বলেও অভিহিত করে থাকেন।
সংগীতজ্ঞদের মতে প্রথম জামাইকান ‘র্যেগে’-র উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে লিটল রয়-এর ‘বঙ্গো ম্যান’২০ গানটিতে। অন্যান্য শিল্পীদের মধ্যে ‘রাস্তাফারিয়ান র্যেগে’-র বিভিন্ন উদাহরণ, যেমন—পিটার টশ, বানি ওয়হিটলার, প্রিন্স ফার ১, লিনভ্যাল থম্পসন প্রমুখের সংগীতে রাস্তাফারি ধর্মের নানান স্তুতি-সংগীতের উদাহরণ পাওয়া যায়। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত জ্যজ গায়ক বব মার্লের হাত ধরে র্যেগের আধুনিকীকরণের পথ চলা শুরু। ‘রাস্তাফণ চ্যান্টস’২১ এই গানটিতেও প্রথম ‘র্যেগে’-র ব্যবহার ও প্রয়োগ বিস্ময়কর। বব মার্লেই প্রথম আফ্রিকান সোশ্যালিজম, রাস্তাফারি ধর্মের ভাবচেতনা, ও জাতীয়তা-বাদের এক অসাধারণ মেলবন্ধন ঘটান। অন্যান্য বিখ্যাত রাস্তাফারিয়ান র্যেগে’ সংগীতকারদের মধ্যে পিটার টশ, ব্ল্যাক উহুরু, ফ্রেডি ম্যাক গ্রেগর, ডন কার্লোস, মাইকেল প্রফেট, ডেনিস ব্রাউন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
মূলত সাংগীতিক ধারাগুলি বিভিন্ন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হলেও সেগুলি বিশেষত ‘যাহ’ সংস্কৃতি, রাস্তাফারীয় ধর্ম ও ধর্মীয় ভাবাদর্শকে উদবুদ্ধ করে, অনুপ্রাণিত করে। এটিই এর মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
পরিশেষ
প্রাচীন আফ্রিকান ‘নিয়াবিঙিঘ’ থেকে বব র্মালের আধুনিক ‘রাস্তাফারিয়ান র্যেগে’ পর্যন্ত প্রাচীন আফ্রিকান ধর্মীয় সংগীতের এক উজ্জ্বল বিবর্তন। ভারতবর্ষের বাউল ও ইরানের সুফি সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিশেষ মিলগত বৈশিষ্ট্যাবলির সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাফারিয়ান ধর্মীয়সংগীত তার সাংগীতিক দর্শন-এর ভাবধারায় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। জুডাইজম ও খ্রিস্টানধর্ম থেকে প্রবর্তিত এই নব্য ধর্মীয় সংগীত তার সাংগীতিক দর্শন-এর মাধ্যমে আজ বিশ্বের কাছে এক অনন্ত বিস্ময়। এই বিশেষ ধর্মীয় আন্দোলনটি ধর্মাচারণ অপেক্ষা এক নতুন জীবন দর্শনের আধাররূপে বেশি সমাদৃত। এটি এমনই এক ধর্মীয় মতাদর্শ যা সংগীত ও গঞ্জিকার আধ্যাত্মিক ব্যবহারের মাধ্যমে মোক্ষলাভের পথ নির্দেশ করে। যেখানে বস্তুবাদ, জড়বাদ তার ধর্মীয় বিবর্তনের মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়ে থাকে অতীন্দ্রিয়বাদের সুগভীর ভাবসমাধিতে। আজও এই ধর্মীয় সংগীত শতাব্দীর পর শতাব্দী অসহায়, লোকসম্বন্ধহীন মানুষদের সাধনার পথ ধরে মুক্তির আলো দেখায়। এখানেই এর স্বতন্ত্র সার্থকতা। ‘নিয়াবিঙিঘ’, ‘র্যেগে’, ‘বাইবেল’, ‘জিওনিজম’, ‘গঞ্জিকা’ ও ‘কেগরা নেগাস্ত’-এর প্রেক্ষাপটে রচিত সেই অনবদ্য পৃথিবী যা স্বয়ং ঈশ্বরকে পুনরুজ্জীবন দান করেছিল।
৭ম অধ্যায় – নোয়ার প্রার্থনা : আর্মেনিয়ান ধর্মীয় সংগীত
ভূমিকা
ককেশাস পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন খ্রিস্টান রাষ্ট্রটি হল আর্মেনিয়া১। মূলত ক্যাথলিক ভাবধারায় সম্পৃক্ত এই খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যসমৃদ্ধ দেশটির ধর্মীয়সংগীতও বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীতের মতো ক্যাথলিক চার্চসংগীতের প্রভাব এই আর্মেনীয় ধর্মীয় সংগীতে দেখা গেলেও এই ধর্মীয়- সংগীতের নানান উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য একে খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীত থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র করে তুলেছে।
ককেশাস পর্বতমালা ও তার সমতলের নিকটবর্তী হওয়ায় এই আর্মেনীয় ধর্মীয় সংগীতে প্রাচীন লোকায়ত সংগীতের বহুল প্রয়োগ ও ব্যবহার লক্ষণীয়। আর্মেনীয় ধর্মীয়সংগীতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী জিভান গাসপেরিয়ান (Djivan Gasparyan)-এর ‘ডুডুক’ সংগীত যা কিনা খ্রিস্টান পপ সংগীতের একটি সরলীকরণ-এর হাত ধরে আর্মেনিয়ান ধর্মীয় সংগীতে বিস্তার লাভ করে। এছাড়াও আর্মেনীয় সংগীতে দক্ষিণ ইউরোপ মূলত গ্রিস, স্পেন ও ইতালিয়ান সংগীতের বিরাট প্রভাব দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় আর্মেনীয় জাতিগোষ্ঠীরা তাদের সনাতনি লোকসংগীতের ধর্মীয়করণে এক বিশাল রূপান্তর আনে যা আর্মেনীয় ধর্মকে এক চমৎকার মাত্রায় নিয়ে যায়।
আর্মেনীয় ধর্মীয় সংগীতের মধ্যে প্রাচীনতম রূপ হল ‘আর্মেনিয়ান চ্যান্টস’২ বা স্তুতিগীতি যা আর্মেনীয় ধর্মীয় সংগীতে সর্বাধিক প্রচলিত ও জনপ্রিয়। এই স্তুতি বা ‘চ্যান্টস’ প্রাচীন ‘খায’ লিপিতে লেখা যা কিনা লোকায়ত আর্মেনিয়ার ধর্মীয় সংগীতের স্বরলিপিকরণ। এর অধিকাংশ স্তুতিগুলি বহু প্রাচীন, এমনকী কিছু কিছু স্তুতি খ্রিস্টীয় ধর্ম প্রবর্তনের আগেও প্রবর্তিত। এর মধ্যে বেশ কিছু চ্যান্টস রচনা করেন বিখ্যাত সেন্ট মেসরপ মাসতোত (St. Mesrop Mashtot)৩ যিনি সর্বপ্রথম আর্মেনিয়ান বর্ণমালার সৃষ্টি করেছিলেন। এই সমস্ত প্রাচীন স্তুতিগুলি ‘সারাকানস’৪ নামে পরিচিত। বহু সময়কাল ধরে নানা আর্মেনিয়ান সংগীতকার এই ‘সারাকানস’-গুলিকে পুনঃমূল্যায়ন করেন এবং একে উৎকর্ষে-এর এক নতুন রূপ দেন। এদের মধ্যে বিখ্যাত হলেন ‘লুসিনে থাকারিয়ান’ যিনি প্রাচীন ও পবিত্র ইচমিয়াদযিন ক্যাথিড্রাল চার্চে ‘সারাকান-গুলির পরিবেশনার মাধ্যমে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। সেন্ট মেসরপ-র মতো লুসিনেও এই প্রাচীন ‘সারাকান’-গুলিতে সুরযোজনা করেন যা পরবর্তীকালে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে বিখ্যাত আরেক সংগীতজ্ঞ ‘কোমিতাম র্ভাদা’ আরও ভালোভাবে সেটি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। প্রাচীন আর্মেনিয়ান ধর্মীয় সংগীত ছাড়াও সনাতনি আর্মেনিয়ান শাস্ত্রীয় সংগীতের জনকরূপে ‘র্ভাদা’৫ পরিচিত। তিনি ১৮৯৯ থেকে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আর্মেনিয়ান ভূখণ্ড পরিভ্রমণ করেন প্রায় ৩০০০ লোকসংগীত আবিষ্কার বা রচনা করে থাকেন যা পরবর্তীকালে আর্মেনীয় ধর্মীয় সংগীতকে এক নতুন মাত্রা দেয় এবং আর্মেনিয়ান ধর্মীয় সংগীতের স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে আর্মেনিয়ায় তার ধর্মীয় সংগীতের রচনা, ভাবধারা ও ব্যবহারের মাধ্যম নিয়ে আজও সমানভাবে চর্চা চলছে এবং এটি অনস্বীকার্য।
লোকসংগীত ও ধর্ম
সনাতনি আর্মেনিয়ান লোক বা চার্চসংগীতে ইউরোপের স্বরবিন্যাসের বা ইউরোপীয় সংগীতের স্বরবৈচিত্র্যের বিন্দুমাত্র প্রভাব দেখা যায় না। এটি মূলত tetrachord জাতীয় মাধ্যম। এই tetrachord-এর উপর প্রয়োগ আর্মেনিয়ান ধর্মীয় বা চার্চ- সংগীতকে প্রাচীন ইউরোপের চার্চসংগীত থেকে স্বতন্ত্র ও পৃথক বৈশিষ্ট্যনির্ভর করে তোলে। সোভিয়েত লোকসংস্কৃতি ও ভাবধারার মধ্যে আর্মেনীয় ধর্মীয় সংগীত যথেষ্ট রক্ষণশীলতা ও গোঁড়া ঐতিহ্যের পৃষ্ঠপোষকতা বজায় রেখেও নানাবিধ নতুন সুর ও স্বর রচনায় মন দেয়। খণ্ডানুসংগীতের মধ্যেও নানারকম প্রাচীন যন্ত্র যার মধ্যে ‘কানুন’, ‘দাভুল’, ‘আউদ’ ও ‘জুরনা’ অবস্থিত। এখানেই ‘ডুডুক’ ৬ সংগীতের কথা আমরা পেয়ে থাকি। রেনেসাঁ যুগে ডুডুক সংগীত আরও বিস্তার লাভ করে। বিখ্যাত ‘ডুডুক’ সংগীতকারদের মধ্যে মার্জার মারগ্যারিয়ান, লেভন মাদোয়ান, সারো ড্যানিলিয়ান ও ইয়োগিশ মানুকিয়ান ছাড়াও প্রবাদপ্রতিম ‘ডুডুক’ সংগীতকার জিভান গাসপ্যারিয়ান বর্তমান।
পূর্ববর্তী আর্মেনিয়ান ইতিহাসে, ‘খামাঞ্চা’৭ নামক তারের যন্ত্রের বহুল প্রচলন ছিল তার ব্যবহার সম্পর্কেও নানা তথ্য পাওয়া যায়। এই বিশেষ তারের যন্ত্রটি একটি বিশেষ আদিবাসী লোক চারণকবিরা ব্যবহার করতেন, যারা—’আসাউঘ’৮ (Ashough) নামে পরিচিত। ‘সায়াত নোভা’ নামের অষ্টাদশ শতাব্দীর এক ‘আসাউখ’-এর নানান রচনা আজও লোকমুখে পাওয়া যায়। আধুনিক যুগে এই বিশেষ যন্ত্র ও সম্প্রদায়ের চর্চা যারা করে থাকেন তাঁরা হলেন ‘আর্মেনাক শাহমুরাদিয়ান’, ‘রুবেন মেটোভেসিয়ান’, ‘হেয়রিক মুরাদিয়ান’, ‘রাফি হবহাসিয়ান’ প্রমুখগণ। আর্মেনীয় লোকধর্মীয় সংগীতের ধারায় মহিলা শিল্পীদেরও সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায় যাদের মধ্যে—’ওফেলিয়া হামবারজুমান’, ‘রিমা সারিবেকইয়ান’, ‘সুসানা সাফারিয়ান’, ‘ফ্লোরা মার্তিরোসিয়ান’ প্রমুখ বিখ্যাত।
গণহত্যা ও উত্তরযুগ : আর্মেনিয়ান সংস্কৃতি জীবনে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ একটি রক্তাক্ত অধ্যায়। এই খ্রিস্টাব্দে নব্য টার্কি বা তুর্কি শাসনতন্ত্রের হাতে এক বিরাট গণহত্যা সাধিত হয়, যাতে প্রায় লক্ষাধিক আর্মেনিয়ানরা নিহত হয়। মূলত ধর্মীয় বিভেদ ও আর্মেনিয়ান বিদ্রোহ দমনের জন্যই এই পৈশাচিক হত্যালীলা৯ চলে। এর পরবর্তী যুগে আর্মিনিয়ার ধর্মীয় সংস্কৃতি সামাজিক রীতিনীতিতে গভীর রেখাপাত হয়। প্রতিবাদের বাঁধ ভেসে যায় সর্বত্র। ধর্মীয় সংগীতে ও সংস্কৃতিতেও এর সমান প্রভাব পড়ে। এই একই সময় আর্মেনীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্ম-সংগীত ও সামাজিক আচার-বিচার রক্ষার্থে রিচার্ড হাগোপিয়ান, জন বার্বারিয়ান, জর্জ তুতানজিয়ান, নার্সিক ইসপিরিয়ন প্রভৃতি বিখ্যাত সংগীতকারেরা আর্মেনীয় প্রতিবাদী সংগীতের প্রচলন করেন। ইরান ও তেহরানেও আর্মেনীয় লোকসংগীতের এক নতুন বিদ্রোহী ধারা নিকোল গালানডেরিয়ান (১৮৮১ – ১৯৪৬)-এর১০ ধারায় আরও বিকশিত, সমৃদ্ধ ও ব্যাপ্তি লাভ করে।
ধর্মীয় আরমানি সংগীত
আর্মেনীয় ধর্মীয় সংগীতের এক বৃহৎ অংশ আরমানি শাস্ত্রীয় ও লোকসংগীত দখল করে রেখেছে। শাস্ত্রীয় আরমানি সংগীতকারদের মধ্যে ‘কেমানি তাতোস একসারাসিয়ান’ এক প্রাতঃস্মরণীয় নাম যিনি শাস্ত্রীয় অটোমান সংগীতকে আরও সমৃদ্ধ করে গেছেন।
এর সঙ্গেই আর্মেনিয়ান অপেরার কথাও পাওয়া যায় যেখানে আলেকভার স্পেনদিরৎ (১৮৭১ – ১৯২৮ খ্রি.) আরমেন টাইগ্রারিয়ান (১৮৭৯ – ১৯৫০ খ্রি.) প্রমুখ ওপেরা সংগীতকারদের উল্লেখ আবশ্যিক।
অবিভক্ত সোভিয়েত রাশিয়ায় গেভর্গ আর্মেনিয়ান, এডওয়ার্ড মিরজোয়ান, বরিস পার্সাদারিয়ান, আপোহ জোহরারিয়াল ইত্যাদি সংগীতকারদের অসাধারণ রচনা ও ধর্মীয় সংস্কৃতির এক সম্পূর্ণ নতুন রূপায়ন করেন। এছাড়া ‘সোমরাগো হেকানুস’, ‘Gohar Gaspayan’, ‘Gohar Galachain’, লুমনো অশরা, সারা টালিয়ন প্রমুখ বিখ্যাত। সাহান১১ আজরুনী একজন প্রথম শ্রেণির আর্মেনিয়ান পিয়ানোবাদক যিনি আর্মেনিয়ান চার্চসংগীতের জন্য বহু চ্যাপেল, চ্যান্টস ও গসপেল রচনা করেছিলেন যা আজও গাওয়া হয়ে থাকে এবং সমান জনপ্রিয়।
পরবর্তী অধ্যায়ে আর্মেনিয়ান ধর্মীয় সংগীতেও ব্যাপক বিবর্তন আসে এবং সুজান ইয়াকার, উডী বেনকুলিয়ন, বেলা দারবিনয়ান, এলভিনা মাকারইয়ান প্রভৃতি সংগীতকারের আর্মেনিয়ান ধর্মীয় পপ মিউজিক১২ (Religious Pop) বিশেষ প্রসার পায়। এই সময় ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম আর্মেনিয়ান জ্যাজ ব্যান্ড ‘ইরেভেন’ ধর্মীয় সাংগীতিক ধারাকে আরেক নতুন রূপ দান করে।
এই সকল সংগীত বা সাংগীতিক ধারা আর্মেনীয় ধর্ম-ধর্মীয়ভাবধারাকে বিশেষ আসনে নিয়ে যায়। ‘নোয়ার প্রার্থনা’ বা ‘আদানা’১৩ নামক বিখ্যাত রচনাগুলি বিশ্ব ধর্মীয় সংগীত সভায় আর্মেনিয়ান ধর্ম ও ধর্মীয় ভাবাদর্শকে বিশেষ জায়গা করে দেয়। ড্যানিয়েল ডেকার ও আরা গেভরজিয়ান-এর এই বিখ্যাত রচনা (Composition)-গুলি আর্মেনিয়ান ধর্মীয় সংগীতকে পুনরাবিষ্কার করে ও মহার্ঘ্যতা দান করে।
পরিশেষ
সুপ্রাচীন ‘ডুডুক’ সংগীত থেকে ‘নোয়ার প্রার্থনা’ এই বিশাল ধর্মীয় সাংগীতিক যাত্রায় আর্মেনীয় ধর্ম ও তার ব্যাপ্তি সত্যিই বিস্ময়কর। আরমো-আমেরিকান লোকসংগীতের ধারা এই ধর্মীয় সাংগীতিক ধারাকে আরও গভীরতা দান করে। প্রাচীন ‘সারাকানস’ লিপির স্তুতিসংগীত, আর্মেনিয়ান ক্যাথিড্রাল চার্চ সংগীত বা ‘ইরেভন’ (ধর্মীয় আর্মো জ্যাজ ব্যান্ড) বিশ্বসংগীতের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় যা আজও আর্মেনীয় ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ভাববাদ ও মতাদর্শকে অমর করে রেখেছে। আশা করা যায়, আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসেও এই ধর্মীয় সাংগীতিক ধারাটি চিরকাল লোকমানসপটে সংগীতের সুরমূর্ছনায় চিরসমাদৃত ও আদরণীয় হবে।
৮ম অধ্যায় – নীলনদের গান : প্রাচীন মিশরীয় ধর্মীয় সংগীত
মুখবন্ধ
প্রাচীন মিশরীয় ধর্মীয় সংগীত বহুযুগ ধরে মিশরীয় ধর্ম সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য ও মহার্ঘ্য অংশরূপে পরিচিত। মিশরীয় সংগীতের দেবতা হলেন—’থথ’ যিনি সর্বপ্রথম মিশরীয় লোকসংস্কৃতি১ ও সামাজিক জীবনে সংগীতের প্রচলন ঘটান। নানান মিশরীয় গুহাচিত্রে এঁকে বীণাবাদনরত অবস্থায় দেখা যায়। বহু পণ্ডিত ও সংগীতজ্ঞদের মতে প্রাচীনতম এই সভ্যতাতেই সর্বপ্রথম বাদ্যযন্ত্রের, যেমন—বীণা, হার্প, বাঁশি, ক্ল্যারিওনেটের ব্যবহার খুঁজে পাওয়া যায়। ইজিপ্সিয়ান লোকসংগীত যার একটি বৃহৎ অংশ সনাতনী সুফি ‘জিকর’২-এর অন্তর্গত ইজিপ্সীয় ধর্মীয় ভাবধারায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।
সাধারণত আধুনিক মিশরীয় সংগীতে নানান লোকায়ত সংস্কৃতি যেমন তুর্কি, আরবি ও পাশ্চাত্য সংগীতের মেলবন্ধন পাওয়া যায়। আরবি সংগীত মূলত সিরিয়াতে সপ্তম শতাব্দীতে ‘উমেদ’৩ বা ‘উমায়াদ’ শাসনতন্ত্রে সূচনা হয়। প্রাচীন আরবি সংগীতে বস্তুত বাইজানটাইন, ভারতীয় ও পারসিক সংগীতের প্রভাব গভীরভাবে পরিলক্ষিত হয়। আবার এই সাংগীতিক ধারাগুলি যথাক্রমে প্রাচীন গ্রিক, সেমিটিক ও প্রাচীন ইজিপ্সীয় সংগীতে অনুপ্রাণিত।
পৃথিবীর তিনটি প্রাচীনতম পুথি বা গ্রন্থের অন্যতম হল মিশরীয়দের মৃতের লিপি বা The Egyptian book of the dead।৪ মিশরীয়দের মৃতের লিপি হল অবিস্মরণীয় কিছু প্রাচীন মন্ত্রের এক অনবদ্য সংকলন। এর মধ্যে কিছু এলিজি (শোকগাথা), বীরগাথা (Heroic epic) এবং কিছু জাদুমন্ত্র (Magical witchcraft rhymes) আছে। আছে কিছু প্রার্থনাও। এইসব মন্ত্রগুলি ‘হায়রোগ্লিফিকস’ নামক চিত্রলিপিতে ‘প্যাপিরাস’-এর ওপর লেখা। এগুলি বেশির ভাগই Pyramid text যা বিভিন্ন ইজিপ্সীয় মন্দির ও সমাধিধারে খোদিত থাকত। মূলত ইজিপ্সীয় পুরোহিত যাজক সম্প্রদায়ের লোকেরা এগুলি সুর করে করে, গেয়ে গেয়ে পড়তেন।৫
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ইজিপ্সিয়ান বা মিশরীয় পপসংগীত মিশরীয় জনজীবনে আধুনিকতার এক নতুন জোয়ার আনে, বিশেষত তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে। মূলত এই পপসংগীত আধুনিক মিশরের লোকসংগীতের এক বিবর্তিত রূপ যা মূলত নানান সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গাওয়া হত। এই জনপ্রিয় মিশরীয় পপসংগীতে মহম্মদ মুনীর ও আমির দীয়াবের নাম উল্লেখযোগ্য। পপসংগীত ও তার আধুনিকীকরণের পাশাপাশি ধর্মীয় সাংগীতিক ধারাবিবর্তনও লক্ষণীয়, যার মধ্যে প্রাচীন ইসলামিক আচার-অনুষ্ঠান দেখা যায়। এই একই সময়ে ‘নে’ (ইজিপ্সিয়ান বাঁশি), ‘আউদ’ (তারযন্ত্র) ইত্যাদির বহুল প্রচলন মিশরীয় ধর্মীয়- সংগীতে পাওয়া যা সত্যিই অভাবনীয়।
মিশরের আধুনিক লোকসংস্কৃতি
প্রাচীন মিশরের ধর্মীয় সংগীতের আখ্যান নানান পৌরাণিক লেখার উদ্ধৃত। এর মধ্যে দশম শতাব্দীতে আবু আল-ফারাবির লেখা ‘কিতাব-উল-মিউসিকি আল কবীর’৬ উল্লেখযোগ্য। আল-গাজালীর নানান লেখাতেও মিশর ও আররি সংগীতের আখ্যান পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এর বহুল পরিবর্তন ঘটে এবং আধুনিকতার ছোঁয়ায় মিশরীয় সংগীতে এক নতুন দিগদর্শন উন্মুক্ত হয়। এই সময়েই আব্দুল হামুলী, আলমায, মাহমুদ ওসমান-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সকল অসাধারণ মিশরীয় সংগীতকারেরা প্রাচীন লোকসংগীত শিল্পী খেদিভ ইসমাইলের অনুগামী যিনি নিজে সৈয়দ দরবেশ, উম খুলতুম, মহম্মদ ওয়াহাব, জাকারিয়া আহমেদ প্রমুখ ইজিপ্সীয় সাংগীতিক কিংবদন্তীদের সংগীত রচনায় অনুপ্রাণিত ছিলেন।
বস্তুত আধুনিক ইজিপ্সীয় লোকসংগীতের ধারায় সবচেয়ে বেশি অবদান যাঁর তিনি হলেন বিখ্যাত সুরকার ও সংগীতজ্ঞ সৈয়দ দারবেশ, যিনি প্রথম প্রাচীন ইজিপ্সিয়ান লোকসংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্যের আধুনিক সংগীতের সমন্বয় ঘটান। প্রাচীন ইজিপ্সিয়ান ধর্মীয় সংগীতকে আরও একবার নতুন করে জনসমক্ষে দারবেশই নিয়ে আসেন। আজও এঁর রচিত নানান গান, দোঁহা, মরসিয়া মিশরীয় ইসলামিক সমাজের নানান আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও এঁর সমসাময়িক ‘কুলখুম’ ৭ আরেক জ্যোতিষ্ক। এঁকে মিশরীয় লোকধর্মীয় সংগীতের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও সর্বজনবিদিত শিল্পীরূপে জানি। এছাড়াও আদ-অল হালিম হাফিজ আরেক অনন্যসাধারণ সংগীতজ্ঞ যিনি প্রথম ইজিপ্সিয়ান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে তার সংগীত রচনার মাধ্যমে উদবুদ্ধ করে থাকেন।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় মিশরীয় সংগীতের ধার্মিক প্রেক্ষাপটে আধুনিকতার ঢেউ ওঠে। ইজিপ্সীয় সংগীতকারেরা তাদের মূল থেকে বিচ্যুত না-হয়ে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ও সমাজতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে এক নতুন উন্নয়ন ও পরিবর্তনের জোয়ার আনেন। আধুনিক পপসংগীতের পাশাপাশি উঠে আসে প্রাচীন লোকসংস্কৃতি ও ইজিপ্সীয় ধর্মীয় সংগীত চেতনা যার মধ্যে ‘ফেলাহীন’, ‘নুবিয়ান’ ও ইজিপ্সীয় বেদুইন৮-দের লোক-ধর্মীয় সংগীত উল্লেখযোগ্য। আব্দুল ইসকানদ্রাণী ও আইদিল গার্নিনি-র মতো বিখ্যাত সংগীতজ্ঞদের প্রভাবে এই সংগীত এক বিশেষ ‘মোকাম’ অর্জন করে।
প্রকারভেদ
প্রাচীন মিশরের নানাবিধ বৈচিত্র্যের পাশাপাশি মিশরীয় লোকধর্মীয় সংগীতের জগতেও বিপুল পরিবর্তন এসেছে। আধুনিকতার ছোঁয়া একে করে তুলেছে আরো সমৃদ্ধ। নিম্ললিখিত আলোচনায় বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত ও বিবর্তিত মিশরীয় ধর্মীয় সংগীতের নানা প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করা হল :
১. কপটিক ·(coptic)
মূলত মিশরীয় খ্রিস্টান গোষ্ঠীকে বলা হয়ে থাকে ‘কপটিক’।৯ প্রাচীন মিশরীয়-খ্রিস্টান চার্চে এই ‘কপটিক’ বা মিশরীয় খ্রিস্টান সংগীতের প্রচলন হয়। ‘কয়্যার’ সংগীত হিসেবেই এটি গাওয়া হয়ে থাকে। বিশেষত এই ‘কপটিক’ সংগীতে নানান ধরনের বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, যার মধ্যে—’ক্রিম্বাল’ ও ‘ট্রায়াঙ্গল’ উল্লেখযোগ্য। বাইবেল ও মিশরের লোকায়ত নানান স্তোত্র বা স্তুতি এই ‘কপটিকে’ গাওয়া হয়ে থাকে। প্রাচীন মিশরের নানান সাংগীতিক ধারা যার মধ্যে সিরিয়ান (মিশরীয় কপটিক চার্চে ‘স্যামি’ নামে পরিচিত) ও বাইজানটাইন (‘রুমি’ বা ‘রোমান’ নামে মিশরীয় কপটিক চার্চে পরিণত) ইত্যাদির এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ ও সুরমূর্ছনা এই প্রাচীন মিশরীয় ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাসে পাওয়া যায়।
২. সাইদি
ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগে মিশরীয় ধর্মীয় সংগীতে ‘সাইদি’-র উল্লেখ পাওয়া যায়। মূলত ‘সাইদি’-রা হল মিশরের উত্তরখণ্ডের একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী এবং এদের লোকসংগীত ও এদের নামে অর্থাৎ ‘সাইদি’১০ নামে পরিচিত। এদের সংগীতে প্রাচীন মিশরের নানান ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ধর্মাচরণের প্রসঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। বহু প্রাচীন যন্ত্রসংগীত ও কণ্ঠসংগীতের এক অসাধারণ যোগসূত্র ‘সাইদি’তে পাওয়া যায়। একই সঙ্গে প্রাচীন পুথি থেকে নির্বাচিত ধর্মীয় স্তুতি ও মন্ত্রোচ্চারণও ‘সাইদি’-র অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বিখ্যাত ‘সাইদি’ সংগীতকার—মেকাল কেনাওরী-র নেতৃত্বে ‘Les Musicines du nil’ (নীলনদের গান) নামক একটি জনপ্রিয় ‘সাইদি’ সংগীতগোষ্ঠীর প্রবর্তন হয় যা বিশ্বসংগীতের দরবারে মিশরীয় লোকসংগীতকে প্রতিনিধিত্ব করে। অন্যান্য বিখ্যাত ‘সাইদি’ সংগীতকারদের মধ্যে—আহমেদ ইসমাইল, ওমর গাজাওয়ী, সোহার মাগদী প্রমুখ উল্লেখনীয়।
৩. নুবিয়ান
মূলত দক্ষিণ মিশরের ও উত্তর সুদানের প্রাচীন জনগোষ্ঠী হল—’নুবিয়ান’১১। এদের বেশ কিছু অংশ কায়রো ও মিশরের অন্যান্য শহরে বিস্তৃত। মিশরের অন্যতম প্রাচীন লোকধর্মীয় সংগীত হল ‘নুবিয়ান’ সংগীত যা আজও মিশরের নানান অঞ্চলে শুনতে পাওয়া যায়। বিখ্যাত ‘নুবিয়ান’ সংগীতকারেদের অন্যতম আলি হাসান কুবান ও মহম্মদ মুনির এই প্রাচীন লোকধর্মীয় সংগীতের সঙ্গে আধুনিক জ্যাজ ও পপের সার্থক মেল ঘটান। এই বিশেষ লোকধর্মীয় সংগীতটি মূলত ইজিপ্সীয় আরাবিক ও প্রাচীন নোবিন ভাষায় চর্চিত হয়ে থাকে। পরবর্তীকালে বিখ্যাত মিশরীয় সংগীতজ্ঞ হামজা আল-দিন-এর তত্ত্বাবধানে ‘নুবিয়ানে’ আন্তর্জাতিকরণ ও প্রভূত ব্যাপ্তি লাভ হয়।
৪. শাবীহ
প্রাচীন মিশরের অন্যতম প্রাচীন লোকধর্মীয় সংগীতধারা হল—’শাবীহ’। পূর্বউল্লিখিত অন্যান্য প্রাচীন মিশরীয় সংগীতধারাগুলির মতোই এর বৈশিষ্ট্য। পরবর্তীকালে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে এতেও আধুনিকতার ছাপ পড়ে। মূলত ‘শাবীহ’১২ প্রাচীন মিশরীয় সমাজ, ধর্ম, লোকাচার ও জনসংস্কৃতিকে তুলে ধরে। বিভিন্ন ধর্মীয় ভাবধারার মেলও এই ‘শাবীহ’-তে দেখা যায়। হাসান হাকিম ও সাবান আদেল রহিমের মতো বিখ্যাত ‘শবীহ’ সংগীতকারদের অনুদানে আজ এটি অতিশয় সমৃদ্ধ ও ধর্মীয় ভাবধারাকে পরিলক্ষিত করে।
৫. আল জিল
‘আল জিল’-এর প্রথম নথিকরণ হয় সত্তরের দশকে। মূলত এটি একটি প্রাচীন মিশরীয় ধর্মীয় নৃত্য-শৈলী। কিংবদন্তি আছে বিখ্যাত মিশরীয় রানি নেফারতিতি নাকি এই নৃত্যে বিশেষ পারঙ্গমা ছিলেন। প্রাচীন মিশরীয় নানান পুথিতে ‘আল জিল’১৩-এর উল্লেখ পাওয়া যায় এবং নানান ইজিপ্সীয় দেবদেবীদের মনোরঞ্জনের জন্য এই নৃত্যশৈলীর প্রচলন হয়েছিল। আজও নানান ইজিপ্সীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানে—’আল জিল’-র ব্যবহার হয়ে থাকে। উত্তর আধুনিককালে পপ, রক ও র্যেগে জাতীয় বহিঃদেশীয় লোকসংগীতের প্রভাবে এটি বিশেষ প্রভাবান্বিত হয়।
পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রভাব
মূলত ঊনবিংশ শতকের একেবারে প্রথমভাগে সমাজতন্ত্রের হাত ধরে পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সংগীতের (western classical music) সঙ্গে মিশরীয়দের পরিচয় ঘটে। ধীরে ধীরে মিশরীয় যন্ত্রসংগীতে পিয়ানো, বেহালার সঙ্গে সঙ্গে নানান ড্রামস ও ক্ল্যারিওনেটের ব্যবহার শুরু হয়। তার অনেক আগেই অবশ্য প্রাচীন কগটিক চার্চ সংগীতের সাথে সাথে পাশ্চাত্য দর্শন, সাহিত্য ও সংগীতের সাথে মিশরীয়দের পরিচয় ঘটেছিল। এই সময়ে মিশরে প্রথম ‘অপেরা’র প্রচলন ঘটে। এক্ষেত্রে ‘গিওসফ ভাদি’-র মিশরীয় নাটক আইদা ১৪ (Aida) বা আদা প্রথম মঞ্চস্থ হয় ডিসেম্বর ২৪, ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে কায়রোতে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এক ঝাঁক নতুন মিশরীয় সংগীতকার যেমন—ইউসুফ গ্রেইস, আবুবকর খয়রাত, হাসান রশীদ প্রমুখ মিশরীয় লোক এবং ধর্মীয় সংগীতে বিরাট বিবর্তন আনেন। পরবর্তীকালে এই সাংগীতিক ধারা গামালি আবদেনারহিম, রাগেহ দাউদ, আহমেদ আল-সায়েদী ও মহম্মদ আবদেলফতাহ প্রমুখ প্রতিভাধর সংগীতজ্ঞদের হাত ধরে প্রভূত বিবর্তনের মাধ্যমে সর্বজনবিদিত হয়।
উপসংহার : পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা মিশরের সাংগীতিক ইতিহাস যথেষ্টই রোমাঞ্চকর। ইজিপ্সিয়ানদের বিখ্যাত পৌরাণিক পুথি—মৃতের লিপি থেকে আধুনিক শাবীহ ১৫ পর্যন্ত এই বিবর্তনের ধারা সর্বদাই পৃথিবীকে নতুন নতুন সংগীত ও তার প্রকৃত সুরদৃষ্টি দিয়েছে। প্রাচীন ইজিপ্সীয় ধর্মাচারণের সময় থেকে জাত এই বিশেষ সাংগীতিক ধারাটি আজও পৃথিবীর কাছে এক অপার বিস্ময়। প্রাচীন ইজিপ্সীয় গুহাচিত্রে ও এই সভ্যতার সাংগীতিক রূপের পরিপূর্ণ প্রতিফলন দেখা যায়। আজও এই প্রাচীন সংগীত পুরাকাল থেকে তার সামাজিক, রাজনৈতিক দর্শন ও সাংগীতিক ভাবাদর্শের জগতে সমানভাবে অবিরত সৃষ্টির জয়ডঙ্কা বাজিয়ে চলেছে এবং আশা করা যায় নীলনদের এপার-ওপার দু-কূল ছাপিয়ে এই সংগীত বিচরণ করবে গোটা পৃথিবীর বুকে। আমরা আশাবাদী। ইজিপ্সীয় মতে এই আশাবাদেরও একটি সাংগীতিক চেহারা বর্তমান, চিরমলিন ও অবিনশ্বর।
৯ম অধ্যায় – আহুরা-মাজদা ও অগ্নিস্তুতি : পারসি সমাজ ও জরথুস্ট্রীয় ধর্মীয় সংগীত
সূচনা
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীনতম ধর্ম ও দর্শনের নাম—’জরস্ট্রিয়ান’ যা আদতে পয়গম্বর জরাষ্ঠারের১ নাম থেকে উদ্ভূত। জরস্ট্রিয়ান বা জরথুষ্ঠীয় ধর্মের উপাসক বা প্রধান দেবতা ‘আহুরা মাজদা’-র২ নামে এটি অনেকাংশে ‘মাজদাইজম’ নামেও পরিচিত। প্রাচীন ইরানের এই লোকায়ত ধর্মের বিখ্যাত ধর্মগ্রন্থটি হল আবেস্তা বা জেন-আবেস্তা৩। একদা এই বিশেষ ধর্মীয় ভাবধারাটি বৃহত্তর ইরান, সিরিয়া, তাজাকিস্তান ও পারস্যের উত্তর পশ্চিমাংশে বিস্তার লাভ করলেও পরবর্তী সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামীয় ভাবাদর্শের উন্মেষ ঘটলে এর আধিক্য হ্রাস হয় এবং বিংশ শতাব্দীতে এই ধর্মের মাত্র ১৮০০০ অনুগামী বর্তমান যার অর্ধেকেরও বেশি আজ ভারতে অবস্থিত।
মূলত ১৮৭৪ সালে অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি সর্বপ্রথম ‘জরথুষ্ঠিয়ান’ শব্দটির নথিকরণ করে বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিক আর্চিবল্ড সেইস-এর ‘প্রিন্সিপলস অফ কমপারেটিভ ফিলোজফি’৪ থেকে। তারও আগে অবশ্য স্যার টমাস ব্রাউনের (১৬০৫ – ১৬৮২ খ্রি.) লেখা রিলিজিও মেডিসি-তে (১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দ) এই ধর্মের আংশিক উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে অক্সফোর্ড ডিকশনারি মার্চ ২০০১ খ্রিস্টাব্দে সমসাময়িক ‘মাজদাইজম’ শব্দটির ব্যবহার করে। জরথুস্টিয়ান মতবাদে ধর্মকে মূলত ‘মাজদাইসনা’ (Mazdayasana) বলা হয়ে থাকে যেখানে Mazda-র অর্থ আবেস্তান ভাষা ও ‘ইয়াসনা’ (Yasna) মানে ‘পূজা’ অথবা ‘অর্ঘ্যনিবেদন’।৫
ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য
জরথুষ্টীয় ধর্মাবলম্বীরা নানান ধরনের ধর্মীয় মতবাদ ও বৈশিষ্ট্যে বিশ্বাসী। সেগুলি যথাক্রমে হল :
১. এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক ও একক এবং এর নিয়ন্ত্রণকর্তা হলেন সর্বশক্তিমান দেবতা আহুরা মাজদা।৬
২. আহুরা মাজদা-র দুটি ব্যতিক্রমী সৃষ্টি হল—’আসা’ (Asha) যার অর্থ সত্য এবং শৃঙ্খলা যারা অসত্য ও বিশৃঙ্খলার বিপরীত এবং ‘দ্রুজ’ (druj) যার অর্থ অসত্যতা ও অনিয়ম যা সততা ও শৃঙ্খলার বিপরীত। মূলত এই প্রধান দুই বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে মানবজীবনের মোক্ষলাভের নির্দেশ।৭
৩. সৎচিন্তা, সৎভাবনা, সৎবাক্য ও সৎকর্ম দ্বারা মানবজীবনের মোক্ষলাভের নির্দেশ।
৪. আহুরা মাজদা-র নির্দেশিত পাথেয় অবলম্বন করেই মানুষ ‘অন্ধকার’-এর মধ্য দিয়ে ‘আলোর’ সন্ধান পাবে যা জ্ঞান ও অজ্ঞানতার পরিমেয়।
৫. এই পৃথিবী ও তার সমস্ত সৃষ্টিই আহুরা মাজদা থেকে সৃষ্ট এবং একদিন সমস্ত সৃষ্টিই আহুরা মাজদার সেই পবিত্র ‘আলো-অন্ধকার’-এর জগতে লীন হয়ে যাবে। এবং আবার নতুন করে রচিত হবে সৃষ্টি নবরূপকল্পনা।
অন্যান্য বৈশিষ্ট্য
১. অগ্নি ও জল
জরথুষ্টীয় ধর্মে জল (অপঃ, অবন) এবং অগ্নি-কে (আতার, আদার) পবিত্র ধর্মীয় ভাবধারার মূলসূত্র বা উপাদানরূপে পরিগণিত হয়। এই বিশেষ ধর্মীয় মতবাদটিতে এই দুটি উপাস্য-উপাদান সৃষ্টির মহার্ঘ্য সম্পদরূপে পরিগণিত হয় যা সৃষ্টি, বিনাশ ও স্থিতির শ্রেষ্ঠ মাধ্যমরূপে পূজিত হয়।
২. ধর্মান্তর ও প্রচার
জরথুষ্টীয়-রা মূলত প্রকৃতি-উপাসক৮ (Pagan worshipper)। জরথুষ্টীয়রা কখনওই ধর্মান্তর, ধর্মান্তরীকরণ ইত্যাদিতে বিশ্বাসী নয়। আহুরা মাজদা অনুসারে জরথুষ্টীয়দের ধর্মীয় ভাবনা ও চিন্তা এতটাই ব্যাপ্তি স্বীকার করে যে এতে আলাদা করে ধর্মীয় প্রচার ও ধর্মান্তরীকরণ নিষিদ্ধ।
৩. বৈবাহিক সম্পর্ক
অন্যান্য ধর্মীয় মতাদর্শের মতো জরথুষ্টীয়রাও নিজ ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে অন্য ধর্মের একই মত পোষণকারীদের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হতে বিশ্বাস করে। এই বিষয়টি নিয়ে ‘পার্সি’দের (জরাষ্ট্রীয় ধর্মাবলম্বী) মধ্যে মতোবিভেদ ও বিতর্কের শেষ নেই। যদিও কট্টরপন্থীরা স্বধর্মাবলম্বী ব্যতীত অন্য কোনো ধর্মের মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে নারাজ কিন্তু আধুনিক যুগের ক্রমবর্ধমান আধুনিক মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এই ধরনের কট্টরপন্থাও আজ পার্সিদের মধ্যে দ্রুত বিলীয়মান।৯
৪. জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্জন্ম
জরথুষ্টীয় ধর্মানুসারে জীবন একটি তাৎক্ষণিক ও আপেক্ষিক পর্যায় যা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পরিপূর্ণতা লাভ করে। পুনর্জন্মে বিশ্বাসী এই বিশেষ ধর্মের মানুষরা মনে করেন মৃত্যুর পরেও আত্মার বিকেন্দ্রীকরণের যার ফলে পুনর্জন্মের ধারাটি অব্যাহত থাকে। এই ধর্মেই মৃত্যু-পরবর্তী অন্তেষ্টির বিশেষ বিধান দেয় যেখানে জরথুষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের মৃত্যুর পরে ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্স’১০ (পার্শিতে দখমা)-এ শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। প্রাচীন প্রথা অনুসারে জরথুষ্টীয়রা বুভুক্ষু কাক, শকুন, চিল ইত্যাদি জাতীয় পাখিদের দ্বারা মৃতদেহ ভক্ষণ করাত, তাকে কবর দেওয়া বা পোড়ানো হত না। প্রাচীন রীতিনীতি অনুসারে জরথুষ্টীয়রা মনে করে থাকে মৃত্যুর পরেও এইভাবে মানুষ জগৎসংসারে মোক্ষলাভ করে।
ধর্মীয় সংগীত
জরথুষ্টীয় ধর্মের সঙ্গে সংগীতের সম্পর্ক বহুদিনের। প্রাচীন জরথুষ্টীয় ধর্মের বিভিন্ন লোকাচার ও ধর্মীয় রীতিনীতির সঙ্গে সংগীতের যোগসূত্র যুগোত্তীর্ণ। মূলত ইসলামধর্মের আগমনের বহুপূর্বেই জরথুষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে একক, দ্বৈত ও গোষ্ঠী সংগীতের (Choral)১১ প্রচলন ছিল।
নানান গ্রন্থ ও পণ্ডিতদের মতানুসারে যেসব প্রাচীন জরথুষ্টীয় ধর্মীয় সংগীতের উল্লেখ আমরা পেয়ে থাকি তা মূলত জরথুষ্টীয়ান ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা-র নানান অংশ বিশেষ-এর সাংগীতিক রূপ। আবেস্তা-র প্রথম নথিকরণ হয়েছিল সম্রাট সাপুর দ্বিতীয় (৩০৯ – ৩৭৯ খ্রিস্টাব্দে)-র সময় থেকেই। যদিও এর বেশ কিছু মূল্যবান অংশ ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে সাসানিড সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে বিলুপ্ত হয়। মূলত এরপরে যে প্রাচীন আবেস্তা-র লিপিবদ্ধ রূপ আমরা পাই তার প্রক্রিয়াকরণ শুরু হয়েছিল ১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে। পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন ভাষার মধ্যে ‘দিন দাবিরে’ উল্লেখযোগ্য যাতে আবেস্তা লেখা এবং পরবর্তীকালে যা নানান লোকায়ত সুরের প্রভাবে গাওয়াও হয়ে থাকে। প্রাচীন জরথুষ্টীয় সংগীতে ‘ইয়াসনা’-র১২ উল্লেখ পাওয়া যায়। বস্তুত ‘ইয়াসনা’ আবেস্তার প্রাথমিক লিপিবদ্ধ সংকলন যা বেশ কিছু ‘গাথা’ নিয়ে সজ্জিত যা কিনা মহান পয়গম্বর জরাষ্টারের নিজের রচনা বলে জরথুষ্টীয়রা মনে করেন। সেই জন্য প্রাচীনকাল থেকেই এর বিভিন্ন অংশ নানান জরথুষ্টীয় আচার-আচরণ ও ধর্মীয় উৎসবাদিতে গীত হয়ে থাকে। এছাড়াও এই জরথুষ্টীয় সংগীত ‘ইয়াষ্ট’-এর উল্লেখ পাওয়া যায় যা আহুরা মাজদার উদ্দেশ্যে রচিত স্তুতি।
এছাড়া নানান প্রার্থনা, যেমন পাঁচ ‘নিয়াশেতেও’১৩ (ইসলামের পাঁচ রোজের নামাজের মতো) লোকায়ত সংগীতে ধর্মীয় স্তুতির উল্লেখ পাওয়া যায়। ইরান, তুরস্ক ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এই প্রাচীন জরথুষ্টীয় ধর্মীয়- সংগীতের প্রচলন আজও পাওয়া যায়।
জরথুষ্টীয় ধর্মের অনুসরণকারী বিশেষত যারা দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাসকারী তারা ‘পারসি’ নামে পরিচিত। এই প্রাচীন উপগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশে আজ ভারতবর্ষে বসবাসকারী যাদের ধর্মীয় রীতিনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগীত মূল জরথুষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় সংগীতচর্চা থেকে অনুপ্রাণিত হলেও অনেকাংশে তা স্বতন্ত্র। দক্ষিণ এশিয়ায় পারসিদের নানান আচার উৎসবে, বিয়েতে, ধর্মীয় জমায়েত বা ধর্মান্তরিতকরণে (যা ‘নভরোজ’১৪ বা ‘নবজোত’ নামে খ্যাত) ‘আবেস্তা’ সংগীত ছাড়াও নানান লোকায়ত সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রানুষঙ্গের প্রভাব বর্তমান। ইরানের প্রাচীন কারমানশা প্রদেশের ‘তাম্বুরিন’ সংগীতের প্রভাবও আধুনিক পারসিদের ধর্মীয় সংগীতে বিদ্যমান। এছাড়াও ‘দাবরে মেহের’ ও ‘আহুরামাজদা’র স্তুতি ছাড়াও জরথুষ্টীয়দের মধ্যে ‘অগ্নি’ ও ‘জল’-এর স্তুতিও লক্ষণীয়। প্রাচীন জরথুষ্টীয়দের নানান উৎসবে ‘ফায়ার টেম্পল’১৫ বা ‘অগ্নি উপাসনার স্থান’গুলিতেও নানান ধর্মীয়- সংগীতের রূপ পাওয়া যায়। এই প্রাচীন ধর্মীয় সংগীত বহুলাংশে আজ ক্রমবিলীয়মান হলেও ইসলামিক জগতে ও তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রভাবে আজও পৃথিবীর নানান জায়গায় এই প্রাচীন ধর্মীয় সংগীতের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। পারসি থিয়েটারের আধুনিকীকরণে এই সংগীতের সমান যোগদান উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত পারসি সংগীতকার জুবিন মেহতা, কাইখোসরু সাপুরজি সোরাবজি ও ফ্রেডি মারকুরি এবং ভি. বালসারার নানান বিখ্যাত রচনায় প্রাচীন জরথুষ্টীয় ধর্মীয় সংগীতের বিপুল সম্ভার লক্ষণীয়।
পারসি সংগীতের আধুনিকীকরণ তার ধর্মীয় মাহাত্ম্যকে এইভাবেই ধীরে ধীরে বিশ্বের অন্যান্য ধর্মীয় সংগীতের সাপেক্ষে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করেছে এবং লোকায়ত ধর্মীয় সংগীতের পরিবেশনের মাধ্যমে তাকে এক পৃথক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানরূপে মর্যাদা দিয়েছে।
১০ম অধ্যায় – তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ : সনাতনি হিন্দু ধর্মীয় সংগীত
প্রাককথন
বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও মহান ধর্মীয় দার্শনিক ভাবধারা হল হিন্দুধর্ম। সিন্ধুসভ্যতার অববাহিকায় লালিতপালিত বলে ‘সিন্ধু’-র অপভ্রংশরূপে এটি ‘হিন্দু’১-রূপে পরিচিত। প্রাচীন পণ্ডিতদের মতানুসারে আর্যদের ভারতে আগমনের আগেই সিন্ধু উপত্যকায় এক সুসভ্য জাতি বসবাস করত যারা আর্যদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ অপেক্ষাও উন্নত ছিল। বর্বর, যুদ্ধবাজ জার্মানরা যেমন ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোম সাম্রাজ্যকে পরাভূত করেছিল, স্যার জন মার্শালের মতে আর্যগণও সেইভাবে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধু উপত্যকায় প্রভুত্ব বিস্তার করে। একই সঙ্গে বিস্তার ঘটে তাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্মীয় ভাবাদর্শের। আনুমানিক এই সময়েই হিন্দুধর্মের সূচনা। অনেকে মনে করেন প্রাচীন সভ্যজাতির মতো সিন্ধুবাসীরাও সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নাগরিকজীবন নির্বাহ করত। তারা কৃষি-শিল্প-বাণিজ্যে অভ্যস্ত ছিল। তামা-পিতলের যুগে থেকেও তারা যথেষ্ট উন্নতি করে। তাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িত একটি ‘বিশেষ’ ধর্ম ও চিত্রলিপির আভাস পাওয়া যায়। তাদের চিত্রলিপিতে যে অন্যান্য লিখিত উপকরণ পাওয়া গেছে সেগুলি আজও পাঠ করা যায়নি। কিন্তু অন্যান্য পরীক্ষা থেকে জানা গেছে, এই সিন্ধু সভ্যতা আসুর এবং ক্যালডিয়ান২ (Chaldean) সভ্যতার সমসাময়িক এবং এদের মধ্যে বিশেষ ধর্মীয় ভাবধারা বিদ্যমান ছিল—যেখানে লিঙ্গ ও অন্যান্য রকমের দেবচিত্র ও দেবমূর্তি পূজিত হত। এখানেই হিন্দুধর্মের সারাৎসার সন্নিহিত রয়েছে।
জৈমিনির মতে (৩০০ খ্রিস্টাব্দ) আর্যদের প্রাচীন সাহিত্য বেদ দু-ভাগে বিভক্ত—মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ।৩ মন্ত্রের সংকলন সংহিতা নামে পরিচিত। বেদ-এর চারটি অংশ ঋক, সাম, যজুঃ ও অথর্ব। অর্থবের নিজস্ব মন্ত্র বা সংহিতা আছে যা আজও একাধিক পাওয়া যায়। বহুযুগ ধরে ব্রাহ্মণগণ এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও ধর্মকে লিপিবদ্ধ না-করে কণ্ঠস্থ করে রাখতেন। বহু প্রাচীন সভ্যতা ও ধর্মেও এই রীতি দেখা যায়। সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে তাঁরা প্রচণ্ড পরিশ্রমের দ্বারা বেদের ছন্দ, ব্যাকরণ, উচ্চারণ ও সুরকে সুললিত সংগীতের মাধ্যমে কণ্ঠস্থ করেই সুরক্ষিত রেখেছিলেন এবং তা এককথায় অসাধারণ।
সিন্ধুসভ্যতার প্রচুর পুথি, ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পে প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের উদাহরণ৪ মেলে। উদাহরণ পাওয়া যায় ঋগবেদ, সামবেদ ও উপনিষদ-এর প্রাচীন মন্ত্রোচ্চারণে। প্রাচীন ভারতে সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের এই অসাধারণ বিদ্যাভাস বহুযুগ ধরেই চলে আসছে। হিন্দুধর্মের প্রাচীন সংগীতকোষ সংগীত রত্নাকর-এর হিন্দুধর্মের নানান বিখ্যাত সংগীতাচার্যদের৫ নাম পাওয়া যায়। বিশাখিল, দত্তিল, কম্বল, বায়ু, বিশ্ববসু, রম্ভা, অর্জুন, নারদ, হনুমান প্রমুখ সংগীতগুরু এবং লোল্লট, উদ্ভট, অভিনব গুপ্ত কীর্তিধর প্রমুখ সেই সময়কার সাংগীতিক ব্যাখ্যাকারদের নাম উল্লেখনীয়।
মূলত কোনো বিশেষ যুগ, সময় বা কাল দ্বারা হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় এবং ধর্মীয় সংগীতকে চিহ্নিত করা দুঃসাধ্য। সামবেদ-কেই হিন্দুধর্মের প্রাথমিক সাংগীতিক উৎসস্থলরূপে ধরা যেতে পারে। পুরাণ অনুসারে প্রজাপতি ব্রহ্মা থেকেই বেদ-এর উৎপত্তি। মতান্তরে মহাদেব তাঁর পঞ্চমুখ থেকে পাঁচটি এবং পাবর্তীর মুখ থেকে একটি রাগের সৃষ্টি করেন। ব্রহ্মা এই বিশেষ রাগগুলিকে ছয় ঋতু৬ অনুসারে ভাগ করেন। যেমন—গ্রীষ্মে দীপক, বর্ষায় মেঘ, শরতে ভৈরব, হেমন্তে শ্রী, শীতে মালকোষ ও বসন্তে হিন্দোল। পুরাণ অনুসারে এই সকল রাগেরই একটি করে স্ত্রী বর্তমান এবং এখান থেকেই ছত্রিশ রাগিণীর উৎপত্তি। দেবর্ষি নারদ বিরচিত সংগীত শাস্ত্রকল্প -এও এর প্রসঙ্গ উল্লেখিত আছে।
হিন্দু সংগীতের বা হিন্দুধর্মীয় সংগীতের প্রধান রূপকল্প হিসেবে ধরা যেতে পারে কবি জয়দেব বিরচিত গীতগোবিন্দ-কে। হিন্দুস্থানী মার্গ বা ধর্মীয় সংগীতে এই গ্রন্থের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রাধাকৃষ্ণলীলারসে সমৃদ্ধ এই কাব্যগ্রন্থটির বহু কবিতা গানের আকারে পরিবেশিত হয় এবং এর অধিকাংশগুলিই বহু প্রাচীন রাগ, রস ও তানাশ্রিত। ৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে বোগদাদের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ও দার্শনিক হারুন-অল রশীদ৭ এই সংগীতকে এক ভিন্নমাত্রা প্রদান করেন। চতুর্দশ শতাব্দীর প্রারম্ভে খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দীন খলজীর সময় রাজদরবারের সীমা অতিক্রম করে হিন্দুস্থানী মার্গসংগীতের প্রভূত প্রসার ও ব্যাপ্তি ঘটে। এই সময়ে বিখ্যাত গায়ক বৈজু বাওরা৮ (জন্মসাল নিয়ে মতান্তর) সংস্কৃত ও পালিভাষার ধ্রুব, প্রবন্ধ ও ছন্দের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়ে ধ্রুপদ সৃষ্টি করেন। আনুমানিক একই সময়ে দাক্ষিণাত্যের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ নায়ক গোপাল উত্তর ভারতে এসে এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতের প্রকৃত রূপদান করেন যার মধ্যে সংগীতাচার্য হরিদাস স্বামী ও বিখ্যাত গায়ক তানসেন-এর৯ অবদানও চিরউল্লেখনীয়।
দিল্লির পাঠান সম্রাট আলাউদ্দীন খলজীর সময় দরবারি সংগীতের প্রচলন ও বিস্তার। তাঁর সবান্ধব নিমন্ত্রণেই বিখ্যাত সংগীতসাধক আমির খসরু পারস্য থেকে ভারতে আসেন। ইনি মূলত সুফি সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। এঁর রচিত বহু গান ও কবিতায় গুজরাতি, ফারসি, সংস্কৃত, মৈথিলী ও পারসিক ভাষা ও সুরের সমন্বয় লক্ষ করা যায়। এঁর বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ফারসি সুর যেমন—সাজগিরী, ইয়ামন, ওসাক, মাফেক, জিলাফা ইত্যাদি বিখ্যাত। এঁর গায়কি অঙ্গ ছিল পারস্য সুফিদের পদ্ধতিতে। বীণা, তবলা জাতীয় বহুবিধ বাদ্যযন্ত্রও তিনি আবিষ্কার করেন যা পরবর্তীকালে হিন্দুস্থানী সংগীতকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। এছাড়া তানসেন পরবর্তীযুগে ষোড়শ শতাব্দীতে গোয়ালিয়রের মহারাজা মান হিন্দুস্থানী সংগীতের পুনর্জন্ম ঘটান। কর্নেল ডেভিড ক্যানিংহ্যামের Archaeological report of Gwalior-এ হিন্দু সংগীতের এই মহান পৃষ্ঠপোষক রাজা-সৃষ্ট নানান বিচিত্র রাগরাগিণীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
একই সঙ্গে সনাতনি হিন্দু ধর্মীয়সংগীতের নানান লোকাচারেও সংগীত যুগ যুগ ধরে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। এতে ঘন্টাধবনি, শঙ্খধবনি, নাকাড়া, উলুধবনি, হাততালি, গালবাদ্য, গুবগুবা, খঞ্জনি ও ডম্বরুনিনাদ উল্লেখনীয়। হিন্দু ধর্মীয় সংগীত১০ মূলত অন্যান্য ধর্মের মতোই স্বধর্ম অর্থাৎ হিন্দুধর্ম অনুসরণকারী। এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীত, কর্নাটকী, উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয়গীতি, কীর্তন, ভজন, অঙ্গীরা, ভাওয়াই, টুসু, দরবেশী, বাউল ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে ভক্তি আন্দোলনের পথ ধরে এই ধর্মীয় সংগীতের বিশাল অভ্যুত্থান ঘটে, যা নিয়ে পরবর্তী অংশে আলোচনা করা হল।
ভক্তি আন্দোলন
দ্বাদশ শতকের প্রথম ভাগে ভারতবর্ষে মুসলিম আধিপত্য সনাতনি ভারতীয় সংস্কৃতির উপর প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। হিন্দুধর্ম এ সময়ে প্রচণ্ড ধাক্কা খায়, ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতদের প্রভাব প্রতিপত্তি ক্ষুণ্ণ হয় এবং বহু হিন্দু ও বৌদ্ধ মঠ-মন্দির ধবংসপ্রাপ্ত হয়। হিন্দু রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা থেকে ভারতীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগীত বঞ্চিত হয় এবং সেই সঙ্গে শিল্পকলার অগ্রগতি কিছু সময়ের জন্য রুদ্ধ হয়ে পড়ে। ভারতে ইসলামের প্রতিষ্ঠার বহু পূর্বেই পারসিক, শক, কুষান, হুন বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন সময়ে ভারতে বসবাস ও রাজ্যস্থাপন করেছিল। কালক্রমে তারা ভারতীয় ধর্ম, ভাষা ও সামাজিক আচরণে বিলীন হয়ে যায়। তুর্কি আক্রমণকারীদের১১ ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। তুর্কিরা তাদের সঙ্গে এক সুনির্দিষ্ট ধর্ম, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, ধর্মীয় সংগীত, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়েই এদেশে আসে। প্রথম দিকে রাজনৈতিক মতবিরোধের সাথে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক ও ধর্মীয় সংঘর্ষও ঘটেছিল। ধর্মীয় সংঘাতের মূল কারণ ছিল হিন্দু ও ইসলামধর্মের মৌলিক পার্থক্য। এই পার্থক্য উভয় ধর্মের মিলনের পথে বাধা সৃষ্টি করে। হিন্দুধর্মের বর্ণাশ্রম ও ইসলামের গণতান্ত্রিক আদর্শের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। ইসলামধর্মের ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাবে প্রথমদিকে হিন্দুসমাজে রক্ষণশীলতা বৃদ্ধি পায়। সামাজিক বৈষম্য ও অত্যাচারের ফলে বহু হিন্দু, মুসলমানি ধর্মের গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং অচিরেই ইসলামধর্মে দীক্ষিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ধর্মান্তরিকরণ ছিল স্বেচ্ছাপ্রণোদিত, তরবারির সাহায্যে নয়। অবশ্য সে-সময় যে জোর করে ধর্মান্তরিকরণ হয়নি তা বলা হাস্যকর। সেই সময় ইসলামি আগ্রাসন থেকে হিন্দুধর্ম ও সমাজকে রক্ষার্থে হিন্দুসমাজের আচার-আচরণ ও রীতিনীতি কঠোর করা হয়।
যাই হোক, এভাবে দীর্ঘকাল ধরে পাশাপাশি বসবাস করার ফলে ভারতীয় ও ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে এক নিবিড় যোগসূত্র স্থাপিত হলেও উভয়ের মৌলিক সত্তা অক্ষুণ্ণ থাকে। ভারতীয়দের গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাহিত্য, শিল্প, স্থাপত্যের সঙ্গে মুসলমানদের ধ্যানধারণার সংমিশ্রণে এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি শেষপর্যন্ত গড়ে ওঠে, যা সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সংস্কৃতি১২ বলে পরিচিতি লাভ করে। ধর্মীয়, বিজ্ঞান, সামাজিক ও রাজনৈতিক আচার-আচরণ, শিল্প, স্থাপত্য, সাহিত্য এবং বিশেষ করে সংগীতের ক্ষেত্রে এই সমন্বয় ঘটে। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে মৌলিক ধর্মীয় ও সামাজিক পার্থক্য থাকলেও দুই ধর্মের বেশ কিছু সংস্কারক উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যোগসূত্র ও সমন্বয়ের প্রয়োজন অনুভব করেন। চতুর্দশ শতকে মহারাষ্ট্র, গুজরাত, পঞ্জাব ও বাংলার বিভিন্ন ধর্মাচার্যরা দুই প্রধান ধর্মেরই কিছু কিছু রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে ধর্মকে আরও বেশি মানবতাবাদী করে তুলতে প্রয়াসী হন। ইসলামের সংস্পর্শে একদিকে যেমন হিন্দুসমাজের রক্ষণশীলতা বেড়ে যায়, তেমনি অন্যদিকে ইসলামের গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রভাবে হিন্দুধর্মে ‘ভক্তিবাদ’১৩ বা উদারনৈতিক আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। মুসলমানদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ‘সুফিবাদ’ যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ভক্তিবাদের আদর্শ অতিপ্রাচীন। হিন্দুধর্মে আত্মার মুক্তির জন্য তিনটি বিশেষ গুণের কথা বলা হয়েছে, যেমন—’জ্ঞান’, ‘কর্ম’ ও ‘ভক্তি’।১৪ ভক্তিবাদের মূলকথা হল আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার অতীন্দ্রিয় মিলন। ভক্তিবাদে মূলত বর্ণাশ্রম ছিল না। ভক্তিবাদের নানান প্রচারকরা খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ ও চতুর্দশ শতকের প্রেক্ষাপটে এই মতবাদের প্রচার চালান। ধর্মীয় আচার-আচরণের বিরোধী ছিলেন এই ‘ভক্তি’ ও ‘সুফিবাদীরা। ঈশ্বরের প্রতি অচলাভক্তিকে এঁরা পরমধর্ম বলে মনে করেন। এই বিশেষ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় সংগীতের উত্থান ঘটে হিন্দুধর্মে।
এই বিশেষ রূপান্তরের সময়ে গোটা ভারতবর্ষজুড়ে ধর্মীয় মত-ভাবনার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় সংগীতের প্রবল জোয়ার ওঠে। এই দিক থেকে বিচার করলে ভক্তি বা সুফিবাদকে এক ধর্মীয় সাংগীতিক আন্দোলন বলা হলে তা ভুল হয় না। ভক্তিবাদের প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সেই সময় রচিত নানান ধর্মীয় সংগীত, দোঁহা, পদ, কীর্তন ইত্যাদি সমকালীন ভারতীয় সমাজের উপর প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছিল। ভক্তি শব্দের অর্থ ভজনা১৫ (Devotion) অর্থাৎ ঈশ্বরের নামগান। এর মূল কথা হল অন্তরের পবিত্রতা, ঈশ্বরের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি, সৎকর্ম, সদাচারণ, জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ও এক ঈশ্বরে বিশ্বাস।
ভক্তি আন্দোলনের উৎপত্তি দক্ষিণ ভারতে হলেও পরে তা উত্তর ভারতে প্রসারিত হয়। ভক্তি আন্দোলনের মূল প্রবক্তারা হলেন কবির, রামানন্দ, নামদেব, শ্রীচৈতন্য, মীরাবাই প্রমুখ। এঁরা সকলেই ধর্মীয় বিভেদ ভুলে মানবতাবাদের সমন্বয়ের কথা প্রচার করেন। এঁদের প্রত্যেকের সময়েই ধর্মীয় সংগীতের মহাজাগরণ ঘটে এবং সেখানে ভক্তিকেই ধর্মীয় উপাসনার পন্থারূপে গ্রহণ করা হয়। নানান সময়ে রচিত নানান ভজন, কীর্তন, পদ, দোঁহা ভারতের ধর্মীয় সাংগীতিক কাঠামোকে সমৃদ্ধ করে।
১. রামানন্দ
সুলতানি আমলে ভক্তিবাদকে কেন্দ্র করে ভারতে যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের জোয়ার দেখা যায় তার অন্যতম প্রধান প্রচারক ছিলেন ভক্তিবাদের প্রথম প্রবক্তা রামানুজের শিষ্য রামানন্দ।১৬ ইনিই প্রথম উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে ভক্তিবাদের সেতু রচনা করেন। ‘শ্রীরামচন্দ্রই ঈশ্বর’ এবং ‘তাঁর প্রতি অবিচল ভক্তিই মানুষকে মুক্তির পথ দেখাবে’—এই ছিল রামানন্দের বাণী। রামানন্দ জাতিভেদ, ধর্মীয় আড়ম্বর ও বর্ণবৈষম্য মানতেন না। রামানন্দ নিজে নানান ভক্তিমূলক পদ, আখ্যান ও সংগীত রচনা করে গেছেন যা আজও দক্ষিণ ভারতে বিশেষভাবে সমাদৃত।
২. কবির
মধ্যযুগের ভারতে ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সাধক হলেন কবির। ইনি রামানন্দের শিষ্য এবং প্রথম এঁর চিন্তাধারায় হিন্দু ভক্তিবাদ ও মুসলিম সুফিবাদের মেলবন্ধনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মধ্যযুগীয় ভারতীয় ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে ইনিই সর্বপ্রথম হিন্দু ও মুসলমানদের মিলনের আহ্বান জানান। কবির এই দুই ধর্মের কোনোটারই বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান মানতেন না। জাতিভেদ, মূর্তিপূজা ও নমাজ পড়ার তীব্র বিরোধী ছিলেন কবির। রামানুজের প্রধান এই ভাবশিষ্য মনে করতেন ঈশ্বর এক ও অভিন্ন যাঁকে শুধুমাত্র অন্তরের ভক্তি ও অনুরাগের১৭ মাধ্যমে লাভ করা যায়। গুরুর মতোই ইনিও তাঁর বাণী বা উপদেশগুলি দেহাতি হিন্দিতে ছোটো ছোটো কবিতা বা ‘দোঁহা’-র মাধ্যমে প্রচার করেন যার মধ্য দিয়ে তিনি সহজ-সরল সাংগীতিক উপস্থাপনার (ভজন) মাধ্যমে মানবজীবনদর্শন ও ঈশ্বরীয় সাধনার নানান জটিল তত্ত্বকে অত্যন্ত সহজ ও সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন।
৩. নানক
ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা হলেন শিখধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক। কবিরের মতো ইনিও একেশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। ধর্মের জটিল আচার থেকে মুক্ত হয়ে প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমে ভগবানের কাছে আত্মসমর্পণই ছিল তাঁর মূলবাণী। মূলত কোনো নতুন ধর্মস্থাপনের বাসনা নানকের ছিল না। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক সম্প্রীতি স্থাপনই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। এঁর শিষ্যরা ‘শিখ’১৮ নামে পরিচিত যার অর্থ ‘শিষ্য’ বা ‘অনুগামী’। তাঁর নানান উপদেশ গুরুগ্রন্থ সাহেব গ্রন্থে সংকলিত ও তাঁর রচিত নানান ভজন, কীর্তন বিখ্যাত যা গুরুমুখী বা প্রাচীন পঞ্জাবিভাষায় গোটা ভারতে সমাদৃত।
৪. নামদেব
খ্রিস্টীয় চর্তুদশ শতকের প্রথমদিকে মারাঠি-ভক্তিবাদী সন্ত নামদেব মহারাষ্ট্রের ও পশ্চিম ভারতের নানান স্থানে ভক্তি আন্দোলনের প্রচার করেন। ইনিও অন্য সবার মতো একেশ্বরবাদী এবং মূর্তিপূজা ও ধর্মের বাহ্যিক অনুষ্ঠানের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এঁর ধর্মমতের মূল কথা ছিল অন্তরের শুচিতা, ঈশ্বরে ঐকান্তিক ভক্তি ও ‘হরি’-র গুণকীর্তন। হিন্দু-মুসলমানের মৈত্রীস্থাপনে বিশ্বাসী সন্ত নামদেব মারাঠি ভাষায় বহু কবিতা, পদ ও ভজন রচনা করে গেছেন।
৫. বল্লভাচার্য
ভক্তিবাদের আরেক পুরোধা হলেন স্বামী বল্লভাচার্য।১৯ ইনি কৃষ্ণের উপাসক এবং অন্যান্য ধর্মগুরুদের মতো ইনিও জাতপাত, ধর্মবৈষম্য, জাতিভেদের তীব্র বিরোধী ছিলেন এবং তাঁর সময়ে তিনিও নানান কীর্তন ও পদের রচনা করেন যা আজও উত্তর ভারতে সাধারণ লোকের মধ্যে বিখ্যাত।
৬. শ্রীচৈতন্যদেব
কবির, নানক ও নামদেবের আন্দোলন ছাড়াও উত্তর-পূর্ব ভারতে বিশেষত অবিভক্ত বঙ্গদেশে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে ভক্তিবাদের তথা বৈষ্ণব ধর্মের বিকাশ হয়, যার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারক ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব।২০ শ্রীচৈতন্য বিশ্বাস করতেন যে নামগানের মধ্য দিয়ে অর্থাৎ পবিত্র সাংগীতিক সাধনার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরলাভ সম্ভব। নগর সংকীর্তনের মাধ্যমে শ্রীচৈতন্য ও তাঁর ভক্তরা বৈষ্ণবধর্মের প্রচার করেন। তাঁর নেতৃত্বেই সে-সময় ধর্মীয়-সংগীত ও তার প্রকৃত মূল্যায়নের নবজাগরণ ঘটে। শ্রীচৈতন্যর মূলকথা ছিল—বৈরাগ্য, জীবে দয়া ও ঈশ্বরের প্রতি ঐকান্তিক প্রেম। তিনি অহিংসাকে পরমধর্মরূপে গ্রহণ করেন এবং ধর্মীয় সাংগীতিক বাতাবরণের মাধ্যমে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সমানাধিকারের বাণী প্রচার করেন।
৭. শংকরাচার্য
এই একই সময়ে অসমে ভক্তিবাদের সঙ্গে সঙ্গে তন্ত্রবাদের যথেষ্ট প্রচার ঘটে। অসমের ভক্তিবাদ প্রচারকদের মধ্যে শংকরদেব বা শংকরাচার্য প্রধান।২১ তিনি একেশ্বরবাদ এবং হিন্দু সংগীত ও সংস্কৃতির ঐক্যে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর রচিত বহু ভজন-কীর্তন আজও ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে শ্রদ্ধার সঙ্গে গাওয়া হয়ে থাকে।
৮. মীরাবাই
মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনে এক অবিস্মরণীয় নাম হল মীরাবাই। তিনি একাধারে গায়িকা ও সাধিকা। কৃষ্ণ প্রেমরসে সম্পৃক্ত মীরাবাই২২ সংগীত ও ভজন-কীর্তনের মধ্য দিয়ে অভিষ্ঠকে লাভ করায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁকে নিয়ে প্রচুর কিংবদন্তি গড়ে উঠেছে। তাঁর রচিত ভজন বহু রাগাশ্রিত এবং হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতের এক উজ্জ্বল দলিল। আজও তার রচিত পদ ও ভজন গোটা ভারতবর্ষে সমৃদ্ধ।
৯. সুরদাস ও দাদূ
মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনের দুই খ্যাতনামা সাধক হলেন সুরদাস ও দাদূ। সুরদাস অন্ধ এবং কৃষ্ণভক্ত ছিলেন। তাঁর রচিত ভজন ও পদগুলি কৃষ্ণরস-এ পরিপূর্ণ ও হিন্দি সাহিত্য ও সংগীতের অমূল্য সম্পদ। একই ভাবে অন্য আরেক খ্যাতনামা সাধক দাদু জাতিধর্মবর্ণ ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিই যে সাধনার বাধা ও ধর্মের অন্তরায় তা বোঝাবার চেষ্টা করেন।২৩
সুফি আন্দোলন
ভারতে তুর্কিবিজয় ও দিল্লির সুলতানি শাসনের আমলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সমাজে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এমনকী ধর্মীয় পরিকাঠামোতেও নতুন চেতনার উদ্ভব হয়। বস্তুত মুসলমানসমাজের ধর্মীয় রক্ষণশীলতা, কুসংস্কার ও নৈতিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে প্রেম ও ভক্তির এক অভাবনীয় সংমিশ্রণে যে সংস্কারধর্মী নতুন ধর্মীয় মতবাদের বিকাশ ঘটে তাই হল সুফিবাদ।২৪ বিখ্যাত ঐতিহাসিক আববাবির মতানুসারে সুফিবাদ মূলত ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ব্যক্তিগত অনুভূতির মাধ্যমে আল্লার জীবন সান্নিধ্যকে উপলব্ধি করার মাধ্যম বিশেষ।
অনেকেরই ধারণা সুফি মতবাদ ইসলামের কুক্ষিগত বিষয় নয়। গ্রিক, হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের দার্শনিক তত্ত্বে ভিত্তি করেই সুফিবাদের সৃষ্টি। এর মতান্তরে বিখ্যাত ইসলামি বিশেষজ্ঞ ড. ইউসুফ হুসেন প্রমুখ মনে করেন—’সুফিবাদ ইসলামের সন্তান, ইসলামের অন্তর থেকেই এর উদ্ভব’। ইসলামের প্রথমপর্বেই এক রহস্যবাদী সম্প্রদায়ের উত্থান হয়। এরপর দশম শতকে ‘মুতাজিলা’ বা ইসলামীয় যুক্তিবাদী দর্শনের বিকল্প হিসেবে মরমিয়াবাদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ইসলামধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এই বিভিন্ন মরমিয়া সাধকগণ ঈশ্বরের প্রতি প্রেমের ওপরেই বেশি জোর দেন। গভীর ভক্তিমার্গে এঁদের অবস্থান এবং এঁরা মনে করতেন নিরঙ্কুশ সংগীত-সাহিত্য ধর্ম ও প্রেমই মানুষ ও ঈশ্বরের মিলন সেতু।
সুফি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে আরবি শব্দ ‘সাফা’ অর্থাৎ ‘পবিত্রতা’ থেকে। ঐতিহাসিকদের মতে এক শ্রেণির বিশেষ ইসলামি সাধকেরা অধিকাংশ সময় পশমের পোশাক (মূলত টুপি) পরতেন বলে এদের সুফি নামে অভিহিত করা হত। এদের জীবনচর্চা ছিল অনাড়ম্বর। সর্ব ধরনের বিষয়াসক্তি থেকে মুক্ত এই সুফিরা সর্বতোভাবে ঈশ্বর সাধনায় নিমগ্ন থাকতেন। বৈরাগ্য, চিত্তশুদ্ধি ও নৈতিকতার উপর এঁরা গুরুত্ব আরোপ করতেন। এঁরা মনে করতেন সংগীতই হল অভিষ্ঠ লাভ করার একমাত্র মাধ্যম। ভক্তি আন্দোলনে জড়িত বাউল ও কীর্তনগোষ্ঠীদের সঙ্গে এঁদের বহুল মিল পরিলক্ষিত হয়।
সুলতানি যুগে ভারতবর্ষে মোট ১২টি সুফি সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল। এই সম্প্রদায়গুলি ‘সিলসিলা’২৫ নামে পরিচিত। সুফী সম্প্রদায়ভুক্ত সাধকগণ ‘পীর’, ‘দরবেশ’ বা ‘ফকির’ নামে পরিচিত ছিলেন। তবে এই বিভিন্ন সুফী সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারতবর্ষে যে দুটি সম্প্রদায় সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ছিল তা হল—’চিশতি’ ও ‘সুরাবর্দী’ সম্প্রদায়।
১. চিশতি সম্প্রদায়
ভারতে ‘চিশতি’ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিখ্যাত সুফি সাধক খাজা মইনুদ্দিন চিশতি।২৬ ১১৯২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইনি মধ্য এশিয়া (মতান্তরে বাগদাদ) থেকে ভারতে আসেন ও আজমীরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এঁর শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—কুতুবউদ্দিন কাফি, নিজামউদ্দিন আউলিয়া ও নাসিরুদ্দিন চিরাগ প্রমুখ। এই শিষ্যদের মধ্যে নিজামুদ্দিন আউলিয়া (১২৩৮ – ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দ) সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও খ্যাতিমান ছিলেন। খাজা মইনুদ্দিন ও তাঁর শিষ্যরা প্রত্যেকেই ধর্মীয় সাধক ছাড়াও সংগীত সাধকরূপেও বিশেষ পরিচিত ছিলেন। এঁরা সকলেই ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বহু ধর্মীয় সংগীত, কাওয়ালি, মরসিয়া, দোহা ও নানান বন্দিশ রচনা করে গেছেন যা আজও অমর।২৭ এঁদের ধর্মীয় উদারতা, সাংগীতিক প্রভাব ও সর্বোপরি মানবিকতার জন্য বহু হিন্দু ও মুসলমান এঁদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। আজও পৃথিবীর তথা ভারতের নানান মসজিদ, দরগায় এঁদের রচিত পদ গাওয়া হয়ে থাকে যা ধর্মীয়সংগীতের অন্যতম উজ্জ্বল দলিল।
২. সুরাবর্দী সম্প্রদায়
সুফিদের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায়টি হল ‘সুরাবর্দী’ যা সেই সময় পাঞ্জাব, মূলতান, পেশওয়ার ও বাংলায় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। এই সম্প্রদায়ের প্রবাদপ্রতিম সাধক ছিলেন ‘সাহাবুদ্দিন সুরাবর্দী’ ও ‘হামিদউদ্দীন নাগরী’। নানান কারণে সুরাবর্দী সম্প্রদায়২৮ ভারতে ততটা প্রসার লাভ করেনি। যদিও ‘চিশতি’ সম্প্রদায়ের মতো এঁদেরও রচিত বহু গান, কাওয়ালি ও দরবেশী সংগীত জনপ্রিয়তা প্রায় তবুও এঁরা ‘চিশতি’দের মতো কঠোর সংযম, আত্মত্যাগ ও অনাড়ম্বর জীবনে বিশ্বাসী ছিলেন না। এঁরা অভিজাতদের সঙ্গে মেলামেশা ও নানান দরবারি কাজকর্মেও অংশ নিতেন।
অন্যান্য সম্প্রদায়
পরবর্তীকালে ভারতে আরও তিনটি সুফি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। যেমন—’কাদরি’, ‘শাওরী’ ও ‘নকশাবাদী’। এই সকল সম্প্রদায়গুলিই শরিয়ৎ-এর নিয়মবিধি অনুসরণ করত। এমনকী তৎকালীন সংগীতেও এদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। প্রতিটি সম্প্রদায়েরই তা সে ‘চিশতি’ অথবা ‘সুরাবর্দী’ হোক অথবা ‘কাদরী’ বা ‘নকশাবাদী’ হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতে অবদান উল্লেখযোগ্য। আধুনিক যুগে বুল্লেহ শাহ, ইদ্রীশ শাহ, মহম্মদ পীর বকশ ও জিয়াউদ্দীন বারানীর মতো প্রমুখ সাধকদের সাংগীতিক অবদান-এ এই সুফিবাদ২৯ আরও গৌরবোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এঁদের প্রত্যেকের নানান রচনা, কাওয়ালি, গজল আজও ভূ-ভারতে সর্বজনবিদিত।
সুফি ও ভক্তি আন্দোলনের প্রভাব
যদিও সমকালীন যুগে ভারতবর্ষে ধর্মের গোঁড়ামি, ক্ষমতাশীল শাসকগোষ্ঠীর আধিপত্য ও ধর্মীয় সংকীর্ণতা প্রবল আকার ধারণ করেছিল তবুও সুফি বা ভক্তি আন্দোলনের প্রভাব ভারতীয় সংস্কৃতি-সমাজ-সাহিত্য ও সংগীতে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। এই দুই বিশিষ্ট আন্দোলন ধর্মের গোঁড়ামি, অস্পৃশ্যতা, ব্যাভিচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে, অন্যদিকে দুই প্রধান ধর্মের সংস্কৃতি৩০ ও সামাজিক ঐক্য বজায় রাখে। এই দুই আন্দোলনের উদারতা ও মানবিক দৃষ্টিকোণ সর্বস্তরের মানুষকে আকৃষ্ট করে সহজ-সরল জীবনযাত্রায়। এছাড়া এই আন্দোলনগুলি সমাজজীবনে নৈতিকতা, মানবতাবাদ ও একতা গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়।
সাংগীতিক প্রভাব
সমকালীন যুগে এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আন্দোলন ধর্মীয় সংগীতের উন্নতিকরণের এক নতুন দিশা দেখায়। রামানন্দ, কবির, মীরাবাই-এর রচিত পদ, ভজন হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতের এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। একই সঙ্গে নানক, দাদু, শ্রীচৈতন্য বিরচিত কীর্তন তৎকালীন সমাজে ভক্তিমার্গের জনজোয়ার সৃষ্টি করে।৩১ নামদেব-এর রচনা হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীতকে ধর্মীয় চেতনার এক নতুন রূপ দেয়। একইভাবে সুফি আন্দোলনে খাজা মইনুদ্দিন চিশতি, আমির খসরু, জিয়াউদ্দীন বারানী ও সাহাবুদ্দিনের রচনা, কাওয়ালি, দোঁহা, গজল ও আধ্যাত্মিক গীতি হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। এই দুই আন্দোলনই তৎকালীন ভারতের ধর্মীয় সংগীতে শাস্ত্রীয় সংগীত, লোকায়ত ও বিদেশি সুরের এক অদ্ভুত এন্দ্রজালিক পৃথিবী রচনা করে যা বিগত পাঁচশো বছরেও অক্ষুণ্ণ। হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতের এক অনন্যসাধারণ এই অধ্যায় চিরকাল ধর্মীয় সংগীতকে ভারতবর্ষের বুকে অমর ও অবিনশ্বর ঘোষণা করে।
ধর্মীয় সংগীত মাধ্যম
হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীত মুলত হিন্দুধর্ম অনুপ্রাণিত। অবশ্য হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতকে শুধুমাত্র হিন্দুধর্ম দিয়ে বিশ্লেষণ করা অনুচিত। যুগ যুগ ধরে যে স্থানে ‘শক-হুন-গল, পাঠান, মোগল এক দেহে হলে লীন’ তাকে শুধুমাত্র হিন্দুধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করলে ভুল করা হবে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও বিভিন্ন মাধ্যম এই সাংগীতিক ধারাটিকে অনুপ্রাণিত, অনুশীলিত ও সমৃদ্ধ করেছে। সুফী ও ভক্তিবাদ এই সমৃদ্ধিকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। তবু আলোচনার সুবিধার্থে হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতকে হিন্দুস্থানীয় শাস্ত্রীয় সংগীত, কীর্তন, ভজন ও অন্যান্য সাংগীতিক ধর্মে বিভক্ত করা যেতে পারে। ধর্মীয় সংগীতের এই বিশেষ পর্যায়ে আমরা হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতের দুই মুখ্য মাধ্যম ভজন ও কীর্তন নিয়ে আলোচনা করব। জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে গোটা ভারতবর্ষের মানবসম্প্রদায়ের কাছে এই দুটি বিশেষ মাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা অসামান্য ও অপরিহার্য। বিগত পাঁচ শতাব্দীর চেয়েও বেশি সময় ধরে ভারতের লোকসমাজে এর স্থান অকল্পনীয় ও মানবঐক্যতা নিরুপণে আজও কীর্তন ও ভজন-এর বিকল্প কিছু নেই, না-কিছু ছিল বা থাকবে।৩২
১. ভজন
‘ভজন’ মূলত বহু প্রাচীন আধ্যাত্মিক হিন্দু ধর্মীয় সংগীত যা অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে ও লোকায়ত সুরমূর্ছনার এক অপূর্ব মেলবন্ধনে পরিবেশিত হয়। বিশেষত এই সংগীতে প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সনাতনি ভারতীয় সংস্কৃতিতে নানা প্রকার ভজন, যেমন—নির্গুণী, গোরক্ষনাথী, বল্লভপন্থী, অষ্টদান, মধুর-ভক্তি ও দক্ষিণ ভারতীয় সম্প্রাদ্য ভজন৩৩ লক্ষণীয়। এই সকল ভজনই তাদের নিজস্ব চারিত্রিক গুণগত মানে সর্বভারতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। ভজন মূলত পরমকরুণাময় ঈশ্বরের লীলাপ্রদর্শনকারী অথবা পরমেশ্বরের প্রতি ভক্তি প্রেমবর্ণনার আধাররূপে পরিচিত। হিন্দুধর্মে ভজন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বহুপ্রকারের ভজন হিন্দুধর্মের আরাধ্য নানান দেবদেবীর নামসংকীর্তনে সংযোজনায় সংযোজিত। এই সেই পবিত্র মাধ্যম যেখানে উচ্চারিত হয়—’রসানাম লক্ষণাম ভজনাম’—মাধ্যম যা অন্তরাত্মার সঙ্গে নিকটস্বরূপ। হিন্দুস্থানী ভজনে মূলত ধ্রুপদাঙ্গ, সুফি কাওয়ালি ও হরিদাসী কীর্তন-এর প্রভাব বর্তমান। হিন্দুস্থানী ভজনের কিংবদন্তী রূপকারদের মধ্যে নানক, কবির , মীরাবাই, নরোত্তম দাস, সুরদাস ও তুলসীদাস বিখ্যাত। এঁদের প্রত্যেকের বিরচিত ভজনই দেশ-কাল-সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে সর্বজনবিদিত হয়। এঁদের রচনাগুলি আজও হিন্দি সাহিত্যের এক একটি অমূল্য রত্ন প্রায়। এমনকী অ-হিন্দী ভাষাভাষীদের কাছেও এই ভজনগুলি৩৪ সমান জনপ্রিয়। হিন্দি ছাড়াও এই ভজনগুলিতে মৈথিলী, দেবনাগরী ও অন্যান্য উপভাষার প্রভাব লক্ষণীয়। হিন্দুস্থানী ভজনের ইতিহাসে কবিরের ‘চাদারিয়া ঝিনি রে ঝিনি’, মীরাবাই-এর ‘মানে চাকর রাখোজী’, তুলসী দাসের ‘রামচন্দ্র কৃপালু ভজো মন’ ও সুরদাসের ‘দর্শন দো ভগবান’ যুগ যুগ ধরে হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতের আকাশে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের স্বাক্ষর রেখে এসেছে। হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীতের আধারে বিরচিত এই সকল পদগুলি ঈশ্বর ভজনা ও অদ্বৈত প্রেমের শ্বাশ্বত বাণী বহন করে চলেছে। আধুনিক যুগে ডি. ভি পালুস্কর ও পণ্ডিত ভি. এন. ভাতখণ্ডের সাহচর্যে এর প্রভূত বিস্তৃতি ঘটে। আধ্যাত্মিক সাধনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যমরূপে আজও ‘ভজন’ ঈশ্বরীয় কৃপালাভের ও মোক্ষ সাধনের অনন্য অসাধারণ রূপকল্প।
২. কীর্তন
সংস্কৃতে ‘কীর্তন’ শব্দের অর্থ ‘পুনরুচ্চারণ’। কীর্তন মূলত অনন্তকে আহ্বান ও তার সাড়া জাগানোর ধর্মীয় সাংগীতিক পদ্ধতিবিশেষ। যখন এই মাধ্যম স্তোত্রাকারে ব্যক্তিবিশেষে ধ্যানের মাধ্যমে উচ্চারিত হয় তখন তাকে ‘জপ’ এবং যখন দলগতভাবে বাদ্যযন্ত্রানুষঙ্গের মাধ্যমে ধবনিত হয় তখন তাকে ‘কীর্তন’ বা ‘সংকীর্তন’ (‘সম’ অর্থাৎ ‘সম্পূর্ণ’) বলা হয়ে থাকে। ভগবদগীতা (৯।১৩)- তে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, পবিত্র ও মহান মানবেরা সর্বদা তাঁর নাম ‘সংকীর্তনে’র মাধ্যমে মোক্ষলাভের পথ খুঁজে ফেরেন। হিন্দু ধর্মীয় সংগীতের ইতিহাসে পঞ্চদশ শতাব্দীতে ভক্তি আন্দোলনে বাংলায় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও অন্যান্য বিখ্যাত সাধকেরা ‘কীর্তন’-এর৩৫ জনপ্রিয়তা ঘটান। এই বিশেষ সময়ে তামাম উত্তর-পূর্ব ভারত ভজনের পাশাপশি হরিনাম সংকীর্তন বা ‘কীর্তন’-এর প্রভাবে ভাবাবেগে উদবেল ও আলোড়িত হয়। ‘কীর্তন’ মূলত প্রাচীন সংস্কৃত ও ব্রজবুলি রচনা থেকে সংগৃহীত এবং পুনঃরচিত হয়ে থাকে এবং হারমোনিয়াম, শ্রীখোল, মৃদঙ্গ ও পাখোয়াজ, খঞ্জনী ও করতালির মাধ্যমে পরিবেশিত হয়। পরবর্তীকালে কীর্তন বৈষ্ণবধর্ম ছাড়াও, শিখ ধর্ম, বাউল সহজিয়া ও বৌদ্ধ ধর্মের কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়ে পড়ে যা গোটা ভারত জুড়ে ধর্মীয় সাংগীতিক আন্দোলনের অন্যতম মূল পৃষ্ঠপোষকরূপে পরিগণিত হয়। নিম্ললিখিত এই ক্ষেত্রবিশেষগুলি নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করা হল :
চৈতন্য-বৈষ্ণব ধারা
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে বঙ্গদেশে ভক্তি আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়ে। ভারতের অন্যান্য বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মতোই সেই সময় এই বঙ্গদেশে ভক্তি আন্দোলনের পথ ধরে এক মহৎ সংগীত সাধনার ব্যাপ্তি ঘটে থাকে যার পুরোভাগে ছিলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধক শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। সেই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমাজ-সংস্কারক ও ধর্মীয় সাধক শ্রীচৈতন্য সর্বপ্রথম গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধারার শ্রীকৃষ্ণের পবিত্র অষ্টোত্তর শতনামকে হরিনাম সংকীর্তনের মাধ্যমে বিপুল জনপ্রিয়তা দান করেন। তিনি জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে ভাগবত প্রেম, মৈত্রী ও ত্যাগের মন্ত্র বপন করে যান যার একমাত্র আধার ছিল—’কীর্তন’।৩৬ কথিত আছে মহাপ্রভু নিজে অসাধারণ কীর্তনীয়া ছিলেন এবং তাঁর সংগীতের আহ্বানে দলে দলে মানুষ বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন ও তৎকালীন বঙ্গদেশে ভক্তি ও ভাগবত প্রেমসাধনার জোয়ার ওঠে। শ্রীচৈতন্য তাঁর সমগ্র জীবন কীর্তনের মাধ্যমে ভাগবত আরাধনায় উৎসর্গ করেন এবং ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে পদব্রজে গোটা ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করে এর ব্যাপ্তি ঘটান। হাজার হাজার মানুষ তাঁর কীর্তনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঈশ্বরপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে এবং সংগীতের মাধ্যমে ঈশ্বরসাধনা ও মোক্ষলাভের পথ খুঁজে পায়। তার উল্লেখযোগ্য শিষ্যদের মধ্যে পরবর্তীকালে যবন হরিদাস, নিত্যানন্দ স্বামী ও অদ্বৈত ঠাকুর তথা বাসুদেব সার্বভৌম্য ও কেশব কাশ্মিরীর মতো পণ্ডিতেরা উল্লেখযোগ্য। শ্রীচৈতন্য বিরচিত ‘শিক্ষাষ্টকম’৩৭-এ তিনি কীর্তনের বা সংকীর্তনের মাহাত্ম্য উল্লেখ করে বলেছেন যে এটিই একমাত্র পাথেয় যা সাধারণ মানুষকে পরমকরুণাময় ঈশ্বরের পরমাত্মীয় করে তুলতে সক্ষম। কীর্তনের প্রসারে, রচনায় ও ব্যাপ্তিতে তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর স্থান চিরস্মরণীয়।
শিখ কীর্তন
খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে বিখ্যাত শিখ ধর্মগুরু ও ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা গুরুনানকের পৃষ্ঠপোষকতায় শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘কীর্তন’ বা ‘গুরুমত’ সংগীতের প্রচলন ঘটে যা পরবর্তীকালে নানকের যোগ্য উত্তরসূরি গুরু অর্জন-এর সাহচর্যে বিস্তার লাভ করে। শিখধর্মে বিশেষত শিখ জাতির পবিত্র ধর্মগ্রন্থ শ্রীশ্রী আদি গুরুগ্রন্থ সাহেব থেকে উল্লিখিত পবিত্র স্তোত্র বা শ্লোকগুলিকে কীর্তনের আকারে গাওয়া হয়ে থাকে। এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতটি অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির ছাড়াও অন্যান্য ঐতিহাসিক গুরুদ্বারেও গাওয়া হয়ে থাকে। এই সংগীত পরিবেশনকালে প্রধানত হারমোনিয়াম, তবলা, খঞ্জনী, সেতার ও মন্দিরার বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। শিখ কীর্তনের অধিকাংশ গানগুলিই হিন্দুস্থানী রাগ, তাল ও ধবনিকেন্দ্রিক।৩৮ পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে ভক্তি আন্দোলনের সময় থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত শিখ সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ধারার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে কীর্তন জুড়ে যায়। গুরুগ্রন্থসাহেব-এর নানান স্তোত্র ও গান আজও শিখ সম্প্রদায়ের মৈত্রী, ঐক্য ও সংহতি স্থাপনে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে।
শিখকীর্তন বা ধর্মীয় সংগীতে ব্যবহৃত স্তোত্র বা মন্ত্রগুলিকে ‘সাবাদ’৩৯ বলা হয়ে থাকে। মূলত এই ‘সাবাদ’টিকে ‘মূলমন্ত্র’ বা ‘গুরুমন্ত্র’ নামে অভিহিত করা হয়। যে লিপি অনুসারে ‘সাবাদ’ বা অন্যান্য গুরুমন্ত্র রচিত হয়ে থাকে তা ‘গুরুমুখি’ নামে পরিচিত। এটি পাঞ্জাবের একটি সুপ্রাচীন ও বিশেষত লোকায়ত ভাষা, যাতে আজও অধিকাংশ শিখ সম্প্রদায়ের লোকেরা কথা বলে থাকেন। প্রতিটি শিখ কীর্তন বা ভজন মূলত শিখদের পূর্বউল্লেখিত পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অংশ এবং এর প্রতিটি রচনাই সুপ্রাচীন হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীত-এর আধারে রচিত এবং নানান গুরুদ্বারে একক বা অলিখিতভাবে পরিবেশিত হয়ে থাকে। গুরু নানক, গুরু অর্জন ও পরবর্তী রঞ্জিত সিংহ প্রমুখেরা প্রচুর ভজন বা কীর্তন রচনা করে গেছেন যা আজও আপামর জনচেতনাকে জাগরিত করতে সক্ষম। শিখধর্মে এছাড়াও আরো একটি উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় সাংগীতিক মার্গ হচ্ছে ‘দাধি ভরন’ এখানে ‘দাধ’৪০ বা ‘ধার সারেঙ্গীর’ ব্যবহার হয়ে থাকে ঈশ্বরীয় নামকীর্তনের মাধ্যমে শিখ জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বর্ণনে। শিখ ভজন বা কীর্তনের ন্যায় ‘দাধি ভরন’-কেও একটি অত্যন্ত পবিত্র সাংগীতিক মাধ্যম- রূপে পরিগণিত করা হয়ে থাকে যা আজও শিখ জাতির নানান উৎসবে ও জমায়েতে বিশেষ মর্যাদা ও ভক্তির সঙ্গে পরিবেশিত হয়ে থাকে।
পাশ্চাত্য কীর্তন
আধুনিক যুগে ভক্তি আন্দোলন এবং তার মাধ্যমগুলি পাশ্চাত্যের দেশগুলিতেও বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের মেয়র রুডলফ গিউলিয়ানির উদ্যোগে টমস্কিন স্কোয়ার পার্কে প্রথম প্রকাশ্য কীর্তন সংগঠিত হয় ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের উৎসাহে। ইন্ট্যারনাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণা কনশাসনেস (ISKON)৪১-এর উদ্যোগে প্রাচ্যের কীর্তন আজ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে সমাদৃত। পাশ্চাত্য কীর্তনে প্রভুপাদ ছাড়াও কৃষ্ণা দাস, করুণামৃতা দাসি, জয় উত্তল, বামদেব, রাগিনী ও ইন্দ্রদাস প্রমুখ সিদ্ধ কীর্তনীয়ারা দেশজ কীর্তনের নামমাহাত্ম্য ও বাণী প্রচার করে চলেছেন। এই বিশিষ্টদের সাহচর্যেই আজ কীর্তন সমগ্র পৃথিবীর মৈত্রী-ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যবোধের প্রেমকাব্যের মূর্ত প্রতীক।
বাউল-ফকির ধারা
হিন্দুস্থানী ধর্মীয় সংগীতের অন্যতম প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল বাউল ও ফকির ধারা। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও অতীন্দ্রিয় সাংগীতিক সংস্কৃতি এটি। ধর্মীয় ভাবদর্শন ও সাংগীতিক ঐতিহ্যের এক অনন্যসাধারণ মেলবন্ধন এই বাউল-ফকির সংগীত। পঞ্চদশ শতাব্দীতে বঙ্গদেশে এর উত্থান। এই বিশেষ ধর্মীয় সাংগীতিক গোষ্ঠীটি পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী নয়। এরা জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে একেশ্বরবাদের সাধনায় সংগীতের মাধ্যমে নিমজ্জমান। এই বিশেষ সম্প্রদায়টিকে কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠী দিয়ে বিচার করা যায় না যদিও এদের মধ্যে হিন্দু, বৈষ্ণব ও মুসলিম সুফি সম্প্রদায়ের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এই বিশেষ সম্প্রদায়টিকে তাদের বিশেষ পোশাক-পরিচ্ছদ, সাধারণ জীবনযাপন, নিবিড় সরলসংগীত সাধনার মাধ্যমে ব্রহ্মকে জানার ব্যাকুলতা ও একতারা, দো-তারা, খমক, গুপিবস্ত্র ইত্যাদি বিশেষ বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারকারীরূপে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। বঙ্গজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গরূপে পরিচিত এই বিশেষ সম্প্রদায়টিকে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো (UNESCO) ‘Masterpieces of the oral and intangible Heritage of humanity’ রূপে স্বীকৃতি প্রদান করেছে।
মূলত ‘বাউল’ শব্দটিকে নিয়ে প্রচুর মতবাদ রয়েছে। বিখ্যাত পণ্ডিত শশিভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয়ের মতে এটি সংস্কৃত ‘বাতুল’ থেকে জাত আবার অনেকের মতে এটি সংস্কৃত ‘ব্যাকুল’ থেকে আগত। যদিও প্রথম বাউলের আবির্ভাব নিয়ে মতভেদ রয়েছে তবুও পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত বহু গ্রন্থ ও পুথি রচনায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে বৃন্দাবনদাস বিরচিত চৈতন্যভাগবত ও কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত৪২ উল্লেখযোগ্য। বঙ্গদেশে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে বৈষ্ণব সাধক নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র প্রথম বাউল সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করেন। বাউল ফকির ধারা গ্রাম বাংলার অন্যতম সাংস্কৃতিক পর্যায়। এর উৎপত্তি বা জীবনদর্শন নিয়ে যতই মতভেদ থাকুক না-কেন বাউল ফকির সম্প্রদায় মূলত তন্ত্র, সুফিবাদ, বৈষ্ণব ও বৌদ্ধ মতাদর্শের এক মিলিত ফসল। এই বিশেষ সম্প্রদায়ে দু-প্রকারের অঙ্গ যথা হিন্দুতন্ত্র ও বৌদ্ধতান্ত্রিক ‘সহজিয়া’-র৪৩ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। নানা পণ্ডিতদের মতানুসারে বাউল-ফকিরিধর্ম মূলত প্রাচীন চর্যাপদের যোগসাধনার অবিচ্ছেদ্য রূপ, যার মধ্যে বৌদ্ধ সহজিয়াতন্ত্রের রূপ দেখা যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বঙ্গদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাউল ফকির সংস্কৃতি গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। আজও এর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চিরঅম্লান।
সংগীত সাধনা
বাউলাঙ্গ সংগীত মূলত অতীন্দ্রিয় প্রেম, ঈশ্বরিক ভালোবাসা ও আত্মনিবেদনের এক অনুপম মাধ্যম। বাউল ফকির সংগীতে একেশ্বরবাদী চিন্তাধারা, অখণ্ড ব্রহ্মর আহ্বান ও ঈশ্বরের প্রতি অনিঃশেষ প্রেম নিবেদন ছাড়াও সেই সময়কার গ্রাম বাংলার আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, প্রশাসনিক লেনদেন ও গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ছোঁয়া বিদ্যমান। বাউল ‘সহজিয়া’ ধারা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবিত করেছিল। রবি ঠাকুরের নানান গানে বাউল সংগীতের চলন ও প্রভাব দেখা যায়। আজও বাউল ফকির সম্প্রদায়ের সংগীত সাধনা ও সংগীতের মাধ্যমে ঈশ্বরলাভের দর্শন সর্বজনবিদিত ও প্রভূত জনপ্রিয়।
মূলত বাউল-ফকিরি ধর্ম দেহতত্তের যে দুটি প্রধান আঙ্গিকের উপর নির্মিত তা দেহ-সাধনা, ও মন-সাধনা নামে পরিচিত। এর পাশাপাশি ‘চার-চাঁদ’, ‘নবদ্বার’, ‘প্রকৃতি’ ও ‘দম সাধনা’ ইত্যাদি মার্গেও এদের আচার-বিধি পরিলক্ষিত হয়। বাংলায় বাউলদের সঙ্গে ফকিরদের সুফি ঐতিহ্যও বিখ্যাত। ইসলামি সুফি ঐতিহ্য ও মর্মমুখী চিন্তার ক্রমবিকাশে এই মতবাদের উদ্ভব। মহম্মদের একদল অনুচর সাধক সুফি নামে পরিচিত ছিলেন। সুফি মানে পশম বা পবিত্রতা। ইসলামের সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় মতাদর্শের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। হজরতের মৃত্যুর পর থেকেই ইসলামে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শুরু হয়। সুফি সাধকেরা তাঁদের রচনায় ও আচার- অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এর প্রতিবাদ জানান। যার ফলে সুফিদের উপর রাষ্ট্রের দমন নীতি শুরু হয়। মনসুর হাল্লাজু ও সুরাবর্দীর মতো মহান সাধকেরা এই দমন নীতির শিকার হন। বাউলদের মতোই সুফিদের জীবনযাপন, উপাসনা, নাচ-গান ও কোরান হাদিশ-এর ব্যাখ্যা ইসলামের বিরোধী ছিল। এঁরা নামাজ, রোজা, কালেমা, হজ ও জাকাত মানতেন না। ক্রমে এই ধর্মীয় আন্দোলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। পারস্যে একে বিপুল সমাদরে গ্রহণ করা হয়। প্রখ্যাত সুফি সাধকদের নামে গড়ে ওঠে নানান সম্প্রদায়। এই সকল সাধকেরা জ্ঞানকে অনন্ত মেনে ও সত্যকে অক্ষয় মনে করে সংগীতের মাধ্যমে অভিষ্ঠলাভের ইচ্ছায় মানবধর্মের উন্নতিসাধনে নিজেদের ব্রতী করেন। চিস্তিয়া, কাদেরিয়া প্রমুখ উদারপন্থী সুফিসাধকেরা এ প্রসঙ্গে উল্লেখনীয়। এঁরা জাতিধর্মবর্ণ বিভেদ মানতেন না। এঁদের অনেকেই ভারতীয় সাধুদের পোশাক, খাদ্য, সাধনপদ্ধতির আংশিক ব্যবহারও করেছেন।
বাংলায় ‘সুফি’-র চাইতে পীর, ফকির বা দরবেশ নামটি বহুপ্রচলিত ও সর্বজনবিদিত। আরবি ভাষায় এর অর্থ নিঃস্ব মানুষ বা ইসলামি উপাসক। দরবেশ শব্দটি ফারসি ‘দরআবেজ’ থেকে জাত। যার অর্থ দরজায় ঝুলছে এমন কিছু। বিশেষত ইসলামি মাধুকরী অর্থেই এটি ব্যবহৃত হয়। যারা সেই মাধুকরী বা ভিক্ষা গ্রহণ করেন তাদের দরবেশ বলা হয়। এদের পোশাক লাল-হলুদ-সাদা ইত্যাদি বহু বর্ণের টুকরো দ্বারা নির্মিত বলে একে দরবেশি পোশাক বলা হয়। এই ফকিররা কিন্তু সমাজবিমুখ ছিলেন না। যাযাবর গোষ্ঠীর পাশাপাশি এরা গার্হস্থ্য জীবনযাপন, কৃষি ও ব্যবসায় নিবেদিত ছিলেন। বাংলার ফকিরদের মধ্যে মাদারিগোষ্ঠী প্রধান। এরা মূলত পারস্যমৃত্তিকাজাত। সৈয়দ বদিউদ্দিন এর প্রতিষ্ঠাতা যিনি ‘কুতুব-উল-মাদার’—যা কিনা সুফিসাধকদের শ্রেষ্ঠ সম্মান—উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। অসাধারণ পণ্ডিত এই মানুষটি পারস্যদেশ থেকে দৈবআদেশে ভারতবর্ষে আসেন এবং তাঁর অনুগামীরা মাদারি পীর নামে পরিচিত হন। পরবর্তীকালে এই গোষ্ঠীরই আরেকজন বিখ্যাত ফকির মজনুশাহ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।
বাউলদের মতো সুফি মতবাদও কোরান-এর অন্তর্নিহিত ঐতিহ্যের উপর নির্ভরশীল। দেহের মধ্যে যে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান তাকে জানার সাধনায়, খুঁজে পাবার আবেগে গড়ে ওঠে দেহসাধনার লোকায়ত সংস্কৃতি। নরনারী যুগলপ্রেম, আশিক মাশুকের প্রসঙ্গে সুফি ও বাউলসাহিত্য সম্পৃক্ত। মখদুম সৈয়দ, চিশ্চিয়া, রজ্জব, সারমাদ, সুরাবর্দী প্রভৃতি সুফিসাধকেরা এই দেহসাধনায় নিমজ্জিত হয়েছিলেন। দেহসাধনার সাধকরূপে এঁদের জীবনচর্চা ও দেহবাদ কেন্দ্রীভূত। ভারতের ধর্মীয় লোকগানের জগতে এরই পাশাপাশি ঝুমুর, গম্ভীরা, মুসলিম বিবাহগীতি, মর্সিয়াজারি, রামায়ণগান, সাঁওতালী বিবাহসংগীত, শ্যামাসংগীত, ব্রাহ্মসংগীত, কবিগান, রায়বেশে, মনসা ও শীতলার ভাসান ইত্যাদির সঙ্গে দেহতত্ত্বগীতি এক অন্য দর্শন ও জীবনবোধের কথা বলে। হিন্দু ধর্মীয় সংগীত এরই ধারক ও বাহক।
সূত্রাবলি ও গ্রন্থপঞ্জি
সূত্রাবলি
প্রাককথন
আলাপ ও বিস্তার
১. Penelope Murray and Peter Wilson (2004) ; Music and the Muses ; The Culture of Mousike in Classical Athenian City, OUP, 978–0199242399, p.5
২. Samuet Fleischacker (1997) ; Integrity and Oral Relativism : Philosophy of history and Culture, Brill Academic Press, 978–9004095267, p. 128
৩. Brian Fagan (2010) ; The Cro-Magnon, Bloomsbury, Bloomsbury press, 978–1596915824 ; p. 85
৪. N. Ramanathan (1997), Sruti in Ancient, Medieval and Modern Context, (available at www.musicresearch.in), p. 32
৫. N.K. Sanders (1972), Introduction to the Epic of Gilgamesh, Penguin, p. 16
৬. Jahn Taylor (2010) ; Ancient Egyptian Book of the Dead, British Museum Press, London, 978–0714119939, p. 7
৭. Karol Weaver (1994), A Popular Dictionary of Hinduism, Curzon Press, 0700710493, p. 24
৮. Prof. Sayed Hussein Nassir and Prof. Mehdi Aminrazavi (2007) ; An Anthology of Phiosophy in Prersia, Vol 1, I, B. Tauris, p. 135
৯. Richard O’ Nidel, World Music : The Basics, Routledge, pp. 219-222
১০. Ibid, p. 237
১১. Ibid, p. 249
১২. Raj. Anand Krishna (1998), Sarangdeva and His Sangit-ratnakara, New Delhi, Sangeet Natak Academy, pp. 25–36
১৩. বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (২০০৬) ; হিন্দুস্থানী সংগীতে তানসেনের স্থান, থীমা : কলকাতা ; পৃ. ১৩
১৪. তদেব, পৃ. ১৪
১৫. তদেব, পৃ. ১৬
১৬. Jean Jacques Nattiez (1990), Music and Discourse, Princeton University Press, 0691027145, pp. 48-55
১৭. Ibid, p. 62
১৮. কৃষ্ণরূপ চক্রবর্তী (১৯৯০), সুকুমার রায়ের আর্শ্চয জগৎ, আনন্দ পাবলিশার্স : কলকাতা, পৃ. ৩৩
১৯. Sri Chinmoy (1982), Sound and the Silence, part 2, Agni Press, Delhi, p. 67
২০. Ibid, p. 68
প্রেক্ষাপট
ধর্মীয় সংগীত : সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, পর্যালোচনা
১. Graham Harvey (2000); Indigenous Religions : A Companion, Cassell: London and New York, p. 6
২. James George Frazer (2009) ; The Golden Bough, OUP, 9780199538829, p. 20
৩. William F. Ogburn and M. F. Nimkoff (1960), A Handbook of Sociology, Routledge and Kegan Paul, 9780710032553, p. 8
৪. S. Radhakrishnan (1969), Religion and Society, George Allen and Unwin, UK, p. 52
৫. Ibid, p. 101
৬. Upton Sinclair (2004) ; The Profits of Religion, Kessinger Pub, 97814167942268, p. 128
৭. S. Radhakrishnan (1923) ; Indian Philosophy-Vol 1, New Delhi, OUP, p. 66
৮. R.E. Hume (1921), The thirteen principles of Upanishads, OUP, Delhi, p. 23
৯. Peter B. Clarke (1993), The Religions of the World : Understanding in Lining Faiths, Marshall Edu. Ltd, USA, p. 131
১০. Ibid, p. 133
১১. VIv Broughton (1996), Too Close to Heaven : The Illustrated History of Gospel Music, Midnight Books, 1900516004, p. 87
১২. Ibid. p. 92
১৩. Carl T. Jackson (1994), Vedanta for the West, Indiana University Press, 025333098X, p. 134
১৪. Khushwant Singh (2006), The illustrated History of the Sikh, OUP, India, 9780195677478, pp. 47–53
১৫. Vilvel Pasternak (2003), The jewish Music Companion, Tara Publication, 9781928918240, p. 9
১৬. Amnon Shiloah (1995), Music in the world of Islam, Wayne State University Press, 0814325890, p. 44.
১৭. Ibid, p. 47
১৮. Corey Bell, (2006), Sounds of Dharma : Buddhism and Music, Buddha’s Light Pub, p. 63
১৯. Ibid, pp. 72–74
২০. Richard O’ Niel, The World Music : The Basic, Routledge, p. 39
১ম অধ্যায়
বেথলেহেম বাইবেল গ্রেগোরিয়ান চ্যান্টস : খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সংগীত
১. Biblical Magi (2 : 1–12), Gospel of Mathew
২. ‘father…forgive them, for they know not what they do’ ; (23 : 34), Gospel of Luke
৩. Michael Grant, Jesus (2004), Rigel, 978189799887, pp. 156–157
৪. Geoffrey Wainwright and Karen B. Tucker (2006), The Oxford History of Christian worship, OUP, UK, 019538864, p. 168
৫. Ibid, pp. 171–175
৬. Viv Broughton (1996), Too Clse to Heaven : The Illustrated History of Gospel Music, Midnight books, 19005160064, p. 221
৭. Ibid, p. 239
৮. Donald J. Grout (1996), A History of Western Classical Music, W. W. Norton and Co., 0-393-928039, p. 77
৯. Ibid, p. 191
১০. Robert Darben (2005), People get ready : A New History of black Gospel Music, Continuum, 0826417593, p. 99
১১. Ibid, p. 113
১২. Ibid, p. 123
১৩. Richard Hoppin (1978), An Anthology of Medieval Music, W. W. Norton, 039309809, p. 51
১৪. Ibid, p. 69
১৫. Katherine Lemee (19940 ; Chant : The Origins, Form, practice and healing power of Gregorian Chant, Harmony, 0517700379, p. 155
২য় অধ্যায়
মহানির্বাণের সুর : বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগীত এবং অন্যান্য
১. Andrew Skitton (2004), A concise history of Buddhism, wind horse, 978-09044766929, p.41
২. Julianne Schober (2002), A sacred biogrphy in the Buddhist tradition of South-East Asia, Motilal Banarsidass, p. 20
৩. Mark fowler (2005), Zen Buddhism : Belief and practice, Sussex academy press, p. 32
৪. Julianne Schober, p. 63
৫. Ibid, p. 128
৬. Deborah Wong (2001), sounding the centre : history and aesthetics in Thai Buddhist performance, Univ. Of Chicago press, 978–0226905860, p.28
৭. Robort E. Buswell (2003) ; Encyclopaedia of Buddhism ; Machillan, 0028657187, p. 57
৮. Ibid, p. 130
৯. Thomas Merton (1967) ; Mysteries and Zen Master, Farrar, Straus and Giroux, New York, 0374520011, p. 87
১০. Jacqueline Stone (2003), Original Enlightenment and the transformtion of medieval Japanese Buddhism, University of Hawaii, 08247820266, p. 15
১১. Graham Coleman (1993) ; The Handbook of Tibetan Culture, shambhala, 1570620024. p. 71
১২. C. Scott. Littleton (2002), Shinto : Origin, rituals, festivals, spirits and secret places, OUP, 0195218868, p. 49
১৩. Ibid, p.55
১৪. Ibid, pp. 63–65
১৫. Ibid, p. 117
১৬. Russell Krikland (2004) ; Taoism : Enduring Tradition, Routledge, 0415263220, p. 52
১৭. Ibid, p. 61
১৮. Ibid, p. 63
১৯. John Bowker (2000), The Music, the Oxford Dictionary of World Religions, p. 239
২০. Ibid, p. 241
২১. Jonathan Clements (2008) ; Confucius : a biography, Sutton,978-0750947756, p. 167
২২. Ibid, pp. 179–181
৩য় অধ্যায়
রাখালিয়া বাঁশি : জিউশ বা ইহুদীয় ধর্মীয় সংগীত
১. Michael Brenner and Jeremiah Riemer (2010), A short history of the Jews, Princeton University press, 978-0765759665, p. 47
২. Ronald H. Isaacs (1997), Jewish Music : Its History, people and song, Jeson Anonson ; 978-0765759665, p. 47
৩. Ibid, p. 53
৪. Ibid, p. 118
৫. Velvel Pastenak (2003) ; the Jewish music companion, Tara publication ; 978-1928918240 ; p.9
৬. Ibid, p. 64
৭. Norman Solomon (2009), The Talmud : A selection, Penguin classics, 978-0141441788, p. 132
৮. Ibid, p. 261
৯. Semanuel Rubin (2006) ; Music in Jewish history and culture ; Hermione Park press, 978-089901336, p. 42
১০. Ibid, p. 74
১১. Abraham Z, Idelsohn (1992), Jewish Music : Its historical development, Dover press, 978-0486271477, p. 69
১২. Ibid, p. 77
১৩. Brad statson (2008) ; Jewish sacred music and Jewish identity, Paragon house, 978–1557788726, p. 212
১৪. Peter Gradenwitz (1996), The Music of Israel : From the biblical era to modern times, Amadeus press, 978-1574670127, p. 39
১৫. Ibid, p. 234
১৬. Paul Bohlman (1988) ; The study of folk music in Modern world, Indiana university press, p. 118
১৭. Seth Rogovoy (2000) ; The Essential Klezmer ; Algonquin books, 978–1565122444, p. 25
১৮. Ibid, p. 71
১৯. Ilan Stavans (2005), The Schocken book of modern Sephardic literature, Schocken ; 978-0805242287, p. 220
২০. Ibid, p. 165
২১. Philip V. Bohlman (2009) ; Jewish musical modernism : old and real, university of Chicago press, 978-02260063863, p. 185
৪র্থ অধ্যায়
হামিন অস্ত! হামিন অস্ত! : মুসলমানি বা ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীত
১. Karen Armstrong (2002), Islam : a short history, Modern library, 978-0812966183, p. 20
২. Ibid, p. 27
৩. Karen Armstrong (2007) ; Muhammad : A prophet for our time, Harper One, 978-0061166772, p. 9
৪. Amnon Shiloah (1995), Music in the world of Islam : A socio-cultural study, Wayne State University press, 978-0814325896, p. 16
৫. Sayed Hussin Nassir and Mehdi Aminrazavi (2007) ; An Anthology of philosophy in Persia, vol., I. B. Tauris, p. 135
৬. Armon Shiloah, p. 87
৭. Karen Armstrong (2007) ; Islam, p. 113
৮. Habib H. Touma (2003) ; The Music of the Arabs, Amadeus press, 978-0691150109, p.57
৯. Bernard Lewis (2010), Music of a Distant Dream, Princeton up, 978-0691150109, p. 57
১০. Ibid, p. 179
১১. Amnon Shiloah (1995), p. 136
১২. Regula B. Qureshi (2006), Sufi music of India and Pakistan, OUP, 978-015979107, p. 15
১৩. Ibid, p. 37
১৪. Ibid, pp. 72-74
১৫. Suzanne P. Stetkevych (2002), The Poetics of Islamic legitimacy, Indiana UP, p. 86
১৬. Regula b. Qureshi, p. 181
১৭. Ibid, pp. 113-119
১৮. Kristina Nelson (2001), The Art of Reciting the Quran, AUC Press, 978-9774245947, pp. 97-99
১৯. M.A.S. Abdul Haleem (2008), The Quran : Oxford world classics ; OUP, 978-0199535958, p. 321
৫ম অধ্যায়
গৌস্ট ড্যান্স ও কালো-পায়ের গান : লোকায়ত আমেরিকান ধর্মীয় সংগীত
১. R. David Edmunds (2006), The People : A History of Native America: Wadsworth Pub, 978-0669244953, p. 18
২. Ibid, pp. 29-31
৩. John co Troutman (2009), Indian Blues : American Indians and the politics of music, University of Oklahoma Press, 978-0806140193, p.58
৪. Ibid pp. 92-94
৫. Ibid p. 121
৬. Tim Lawrence (2004), Love saves the day : A History of American Dance Music Culture, Duke up, 978-0822331988, p.67
৭. Ibid, p.72
৮. Ibid, p. 74
৯. Ibid, p. 81
১০. James Wilson (2000), The earth shall weep : A History of Native America, Grove Press, 9780802136800, p. 226
১১. Ibid, p. 312
১২. Ibid, p.337
১৩. Carl Waldman (2006) ; Encyclopaedia of the Native American tribes, Checkmark Books, 9780816062744, p. 139
১৪. Ibid, p. 86
১৫. Ibid, p. 86
১৬. Ibid, p. 212
১৭. Ibid, p. 231
১৮. Ibid, p. 231
১৯. Tim R. Crawford (2001), Flute Magic : An introduction to the Native American Flute, Mel Bay, 97800786658169, p. 31
২০. Ibid, p.141
২১. John W. Troutman, p. 204
২২. Michael V. Pisani (2006), Imagining Native American music, Yale Up, 9780300108934, p. 276
২৩. Ibid, pp. 187-191
৬ষ্ঠ অধ্যায়
গঞ্জিকা-গীতি ও জিওনিজম : রাস্তাফারিয়ান ধর্মীয় সংগীত
১. Stephan D. Glazier (2001) ; Encyclopaedia of African and Afro-American Religions, Routledge, 9780415922456, p. 263
২. Ibid, p. 271
৩. Ibid, pp. 273-275
৪. Nathaniel S. Murrell (1998) ; Chanting down babylon : The Rastafari Reader, Temple UP, 97811566 39847, p.95
৫. Ibid, p. 97
৬. Stephan D. Glazier, p. 278
৭. Jah Ahkell (1999); Rasta : Emperor Hailey Sellasie and the Rastafarians, Frontline, 97800948390012, p. 8
৮. Ibid, p. 14
৯. Ibid, p. 16
১০. Ibid, pp. 19-21
১১. Gerald Housman (2008) ; The Kebra Negast : Lost Bible of Rastafarian Wisdom, St. Martin’s Press, 97800312167936, p.9
১২. Ibid, p.12-13
১৩. Ibid, p. 126
১৪. Leonard E. Barrett (1997) ; The Rastafarians, Beacon Press, 9780807010396, p. 147
১৫. Ibid, p. 221
১৬. David Moskowitz (2005), Caribbean Popular Music : An Encyclopaedia, Greenwood, 9783133331589, p. 85
১৭. Ibid, p. 225
১৮. Ibid, pp. 231-233
১৯. Hank Bordowitz (2004), Every little thing gonna be alright : The Bob Marley Reader, DA Capo Press, 97800306813405, p. 45
২০. Ibid, p. 53
২১. Ibid, p. 126
৭ম অধ্যায়
নোয়ার প্রার্থনা : আর্মেনিয়ান ধর্মীয় সংগীত
১. Simon Payaslian (2007) ; The History of Armenia, Palgrave-Macmillan, 978023060000645, p.11
২. Ibid, p. 56
৩. Jonathan Mc Collum (2004) ; Armenian Music : A comprehensive Bibliography, The Scarecrow Press, 9780810849679, p. 44
৪. Ibid, p. 49
৫. Ibid p. 131
৬. Levon Abrahemian (2001) ; Armenian folk arts, Culture & Identity, Indiana UP, 9788025337047, p. 95
৭. Ibid p. 119
৮. Ibid, p. 77
৯. Donald E. Miller (1999) ; Survivors : An Oral History of the Armenian Genocide, California UP, 978052019564, p. 25
১০. Ibid, p, 178
১১. Komitas V. Komits (1997) ; Armenian Sacred and folk music, Routledge, 9780700706372, p. 77
১২. Ibid, p.84
১৩. Ibid, p. 174
৮ম অধ্যায়
নীল নদের গান : প্রাচীন মিশরীয় ধর্মীয় সংগীত
১. lan Shaw (2004) ; The Oxford History of Ancient Egypt, OUP, 978019280487, p. 153
২. Scott L. Marcus (2006) The Music in Egypt, OUP, 9780195146455, p. 59
৩. Ibid, p. 116
৪. Robert P. Winston (2008) ; The Egyptian book of the Dead, Penguin, 978001490455502, pp. 24-27
৫. Scott L. Marcus, p. 134
৬. Sayed Hussein Nassir and Mehdi Aminrazavi (2007) ; An Anthology of philosophy in Persia, vol. 1, 1, 1B. Tauris, p. 135
৭. Virginia Danielson (1998) ; The voice of the Egypt, University of Chicago Press, 9780226136127, p. 95
৮. Ibid, pp. 186-188
৯. Scott L. Marcus, p. 98
১০. Ibid, p. 127
১১. lan Shaw, p. 289
১২. Ibid, pp. 299-302
১৩. Irena Lexova (1999) ; Ancient Egyptian Dances, Dover Press, 9780486409061, pp. 37-39
১৪. Ibid, p. 56
১৫. Ibid, p. 137
৯ম অধ্যায়
আহুরা-মাজদা ও অগ্নি স্তুতি : পার্শি সমাজ ও জরাথুস্ট্রীয় ধর্মীয় সংগীত
১. Norman Solomon (2000) ; Judaism : A very short introduction, OUP, 9780192863905, p. 6
২. Ibid, p.8
৩. Ibid, p. 14
৪. Karen Armstrong (1994) ; A History of God, Ballentine Books, 9780345384560, pp. 25-29
৫. Ibid, p. 35
৬. Norman Solomon, p. 22
৭. Ibid, p. 68
৮. John R. Hinnells (2005) ; The Zoroastrians Diaspora : Religion and Migration, OUP, 97801988267591, p. 112
৯. Ibid, p.289
১০. Ibid, p. 396
১১. Piloo Nanarutty (2006) ; The Gathas of Zarathustra : Hymns in praise of Wisdom, Mapin Pub., 97818920693, p. 55
১২. Ibid, pp. 37-39
১৩. Ibid, p. 78
১৪. Jesse S. Palsetia (2001) ; The Parsis of India, Brill Indological Library, 9789004121140, p. 149
১৫. Ibid, p. 231
১০ম অধ্যায়
তমসো মা জ্যোতিঃর্গময় : সনাতনি হিন্দু ধর্মীয় সংগীত
১. A. L. Basham (2005) ; The wonder that was India, Picador : India, 9780330439091, pp. 27-30
২. Ibid, p. 69
৩. S.N. Dasgupta (2000) ; A History of Indian Philosophy, Motilal Banarsidass: Kolkata, 9788120804081, p. 12
৪. A.L. Basham, p. 72
৫. বীরেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী (২০০৬); হিন্দুস্থানী সংগীতে তানসেনের স্থান, থীমা : কলকাতা, 8186017658, পৃ. ১৩
৬. তদেব, পৃ. ১৪
৭. তদেব, পৃ. ১৫
৮. তদেব
৯. তদেব
১০. John S. Hawley (2008) ; Songs of the Saints of India OUP : USA, 97801956942208, p. 64
১১. Shahabuddin Iraqi (209) ; Bhakti movement in medieval India Social and political perspective, Manohar : New Delhi, 8173048002, p. 49
১২. Ibid, p. 77
১৩. Deepak Sharma (2010) ; The Classical Indian Philosophy : A Reader, Cloumbia University Press : USA, 9780231133999, p. 21
১৪. Ibid, p. 32
১৫. Karen P. Prentiss (2000), The embodiment of Bhakti, OUP : USA, 9780195129130, p.8
১৬. John S. Hawley, p. 40
১৭. Ibid, p. 76
১৮. Ibid, p. 141
১৯. John S. Hawley (2005) ; Three Bhakti Voices : Mirabai, Surdas and Kabir in their time and ours, OUP : USA, 9780195670851, p. 117
২০. Ibid, p.213
২১. Karen P. Prentiss, p.82
২২. Ibid, p.96
২৩. Ibid, p. 99
২৪. Raziuddin Aquil (2010) ; Sufism and Society in Medieval India : Devates in Indian History, OUP : New York, 9780198064442, p. 39
২৫. ….(2009) ; Sufism, culture and politics : Afghans and Islam in Medieval North India, OUP : New Delhi , 9780195685121, pp. 57-59
২৬. Ibid, p. 136
২৭. Ibid, p. 178
২৮. Ibid, p. 196
২৯. Ibid, p. 229
৩০. David N. Lovenzen (2005) ; Religious movements in South Asia 600-1800, OUP : New York, 9780195664485, p. 16
৩১. Ibid, p.48
৩২. Ibid, p.56
৩৩. Reginald Massey ; The Music of India, Kalm & Averill Pub. ; 9781871082500, pp. 44-47
৩৪. Ibid, p. 63
৩৫. Ibid, p. 81
৩৬. D. Dennis Hudson (2000) ; Krishna’s Mandala : Bhagavad Religion and Beyond, OUP : USA, 97801980062769, p. 127
৩৭. Ibid, p. 94
৩৮. Michael Nijhawan (2006) ; Dhadi Durbar : Religion, Violence and performance of Sikh History, OUP : New Delhi, 9780195679670,p. 58
৩৯. Ibid, p. 79
৪০. Ibid, p. 121
৪১.. David N. Lovenzen ; p. 146
৪২. Jeanne Openshaw (2002) ; The seeking Bauls of Bengal, Cambridge UP : London, 9780521811255, p.88
৪৩. Ibid, p. 97.
Leave a Reply