ভুলবে সে গান যদি (চেনা, অচেনা গানের গল্প) – প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি, ২০২০
ছোট্ট রায়ানকে
একদিন যে বড়ো হয়ে
এই বইয়ের মর্ম বুঝবে ঠিক…
প্রাককথন
কথা ফোটবার আগে গান ফুটেছে প্রাণে। যেমন ভাবে ফুল ফোটে, যেমন ভাবে ঝরনা তার নিজস্ব ছন্দে কিংবা নদী সমুদ্রে গিয়ে মেশে, তেমনি ভাবে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি গান, গানের চোরাস্রোত বয়েই চলেছে মানুষের বুকের ভেতর। এই পৃথিবীর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সে সব সুর ছন্দ হাওয়ায় হাওয়ায় ঘুরে বেড়ায়, সেই সব সুর একদিন মানুষ কন্ঠে তুলে নিল। জল-বৃষ্টি-আগুন-উত্তাপ এসবের মধ্যে দিয়ে গান হয়ে উঠেছে। গান তৈরি করেনি কেউ। বহু বহু বছর বহু বহু সুর বহু তান গানের শরীর মন তৈরি করেছে। এই যে আমরা যাকে বলছি সভ্যতা, সেই সভ্যতার নিজস্ব গানও তৈরি হল। সেই সব গানের পেছনে কত বিচিত্র সব গল্প। গল্প না জেনেও মানুষ গান ভালোবেসেছে, গল্পগুলো জেনে ফেললে তো সোনায় সোহাগা। নাটকের গান, মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে থাকা গুনগুন করে গাওয়া লোকসংস্কৃতির গান, শহুরে সংস্কৃতির গান, সিনেমার গান—এইসব খুঁজতে গিয়ে প্রসেনজিৎ একটা ম্যাজিক ঘটিয়েছে। গানের গল্প নিয়ে সে এক অনবদ্য বই লিখে ফেলল। বই লেখার কোনও পূর্ব পরিকল্পনা ছিল কিনা সেটা আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয় শুধু বুঝতে পারি যে, গান ওকে টেনেছে, তার পেছনের গল্পটা ও খোঁজবার চেষ্টা করেছে। সেটা বেনারস হতে পারে কিংবা বার্মিংহাম। আমার পড়তে পড়তে বারবার মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবীর এই গানগুলো জড়ো হয়েছে রং-বেরঙের গল্পে।
গানের রান্নাঘরে টুকিটাকি যা সরঞ্জাম থাকে তাকে নিয়েই দারুণ স্বাদের গান তৈরি হয়ে ওঠে। শুধুমাত্র মাস্টার শেফরাই জানেন সেই রেসিপি। প্রসেনজিৎ তার লেখায় গান বাজনার সেই রথী-মহারথী শেফদের সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দিয়েছেন। আর সেইসব মুহূর্তরা জীবন্ত হয়ে উঠেছে আমাদের চোখের সামনে। যেমন—জেমস পিয়ারপন্ট এবং তার জিঙ্গলবেলের গল্প। মানুষটিকে ইতিহাস ভুলে গিয়েছে কিন্তু তার কীর্তি, সে রয়ে গেল সারা পৃথিবীর ক্রিসমাসের গল্পের সঙ্গে। একই রকমভাবে ‘টম এন্ড জেরি’র কম্পোজার ওয়াল্টার স্কট ব্ল্যাডলির এই তথাকথিত ফানি স্কোর কীভাবে টম এন্ড জেরির দুনিয়া থেকে আমাদের দুনিয়া হয়ে উঠেছে, তা এক কথায় অভাবনীয়। সত্যি বলতে ‘টম এন্ড জেরি’ অসম্পূর্ণ ওরকম একটা মিউজিক স্কোর ছাড়া। বিখ্যাত সমস্ত ক্লাসিক্যাল কম্পোজারদের মিউজিকগুলোকে এই ওয়াল্টার স্কট কী করে ‘ফানিজ’ করে রূপান্তর করলেন সেইসব গল্প পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে এগুলোর কোনও জুড়ি নেই। আবার সেখান থেকেই প্রসেনজিৎ চলে এসেছে গঙ্গার পাড়ে দক্ষিণেশ্বর, যেখানে আমরা দেখতে পাই ঠাকুরকে গান শোনাচ্ছেন বিবেকানন্দ। তানপুরায় সুর বাঁধতে বাঁধতে টাটকা নতুন গান তৈরি করে ফেললেন। শেষদিন পর্যন্ত নরেনের গলায় বারবার করে ঠাকুর সেই গান শুনতে চাইতেন। এইসব গানের ক্ষণ-মুহূর্তরা প্রসেনজিতের কলমে নদীর স্রোতের মতো ম্যাজিক তৈরি করে। আচ্ছা বলুন তো ‘আজ জানে কি জিদ না করো’—এরকম একটা গানের গল্প যদি আপনার কাছে থাকে তাহলে জীবনে আর কি চাই! পড়তে পড়তে পাঠক তার নিজের ঘর-বারান্দা ছেড়ে সেই ইতিহাসের অলি-গলি-শহরতলি গল্পগুলোর সামনে এসে দাঁড়ায়। গল্পের ভাষা এত সাবলীল ও স্পষ্ট যেন গান ঘিরে এক অনর্গল জলতরঙ্গের বেজে চলা।
সেই গল্প পড়তে পড়তে একটা দেশ, তার ইতিহাস, সংস্কৃতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যেন ছায়াছবির মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একসময় বাংলা গানে ‘স্টোরিজ অফ সংগস’ নামে ভিক্টোরিয়া মেমরিয়ালের সৌজন্যে একটা মিউজিকাল থিয়েটার করেছিলাম। অনেকটা ব্রডওয়ে মিউজিকের মতো। প্রচুর শিল্পী টেকনিশিয়ানস একসঙ্গে কাজ করেছিলেন সেখানে। সেটাও ছিল গানের গল্প। দর্শকদের উৎসাহ পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে আরও বড়ো করে আমেরিকার হিউসটনে এই প্রোডাকশনটি খুব জনপ্রিয়তা পায়। তাই আমি হলফ করে বলতে পারি গানের পেছনের গল্পের প্রতি মানুষের কী পরিমাণ আগ্রহ আছে। এরকম এটা কাজ করতে গেলে কত অলি-গলি তল্লাট ঢুঁ মারতে হয়। সবচেয়ে বড়ো কথা কোনও গানকেই বাদ দেয়নি প্রসেনজিৎ। ওর কাছে সমস্ত গানই ওর ঘর। ও যেন সেই ঘরের গল্প বলেছে, যে ঘর বিশ্বচরাচর। সারা পৃথিবীর গান জড়ো হয়েছে ওর কলমে। আমার আশা মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে এই বই। আমার সমস্ত ভালোবাসা আর শুভকামনা যতদূর যেতে পারে রইল প্রসেনজিতের সঙ্গে।
দেবজ্যোতি মিশ্র
কলকাতা, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯
উপক্রমণিকা
”ভুলবে সে গান যদি না হয় যেয়ো ভুলে
উঠবে যখন তারা সন্ধ্যাসাগরকূলে
তোমার সভায় যবে করব অবসান
এই কদিনের শুধু, এই কটি মোর তান।”
গানের গল্প বিষয়ক বইয়ের ভূমিকা যখন, গল্প দিয়েই তবে শুরু করা যাক। শ্রী শ্রী রবি ঠাকুর সহায়!
১৯৫৬ সাল। একবছর আগেই মুক্তি পেয়েছে সত্যজিৎ রায়ের কালজয়ী ‘পথের পাঁচালী’। রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে তার খ্যাতি ক্রমেই ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। ওদিকে বাংলা থেকে হাজার মাইল দূরে বম্বেতে তখন ঘুম উড়েছে শচীন কর্তার। কিংবদন্তি সুরকার, গায়ক শচীন দেব বর্মন। সম্প্রতি হাতে পেয়েছেন নতুন ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব। গুরু দত্ত-এর ‘পিয়াসা’। শহর কলকাতার প্রেক্ষাপটে এক মরমি কবির উত্থান পতনের অবিস্মরণীয় আখ্যান। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি গানে সুরারোপনের কাজ শেষ। কথা লিখেছেন বিখ্যাত শায়ের শাহির লুধিয়ানভি। কিন্তু একটি বিশেষ দৃশ্যে এসে হোঁচট খাচ্ছেন শচীন কত্তা।
দৃশ্যটি এরকম যে, বাড়ি থেকে বিতাড়িত গল্পের নায়কও কবি বিজয় আশ্রয় খুঁজতে খুঁজতে এসে পৌঁছেছে কুখ্যাত গণিকাপল্লীতে। কিন্তু পতিতালয়ে যৌনতাড়নার চেয়ে বেশি তাঁকে স্পর্শ করেছে সমাজ থেকে একঘরে হয়ে যাওয়া, অসূর্যম্পশ্যা বারবণিতাদের জীবন। তাদের সেই দুঃখ কষ্ট, বিষাদ। সুরা হাতে পথে হেঁটে যেতে যেতে সমাজের এই অবক্ষয়ের দৃশ্যটি তাকে ভাবায়, ব্যথিত করে। উঠে আসছে গান। সেই গান গণিকাপল্লীর রাস্তায় তীব্র আশ্লেষে গাইতে গাইতে চলেছে নায়ক। সেই গান যেন তার একান্ত উপলব্ধির প্রতিবাদ।
বলার অপেক্ষা রাখে না, নিঃসন্দেহে ধাক্কা দেওয়ার মতো দৃশ্য। কিন্তু তবু একটা জুতসই সুর, খুঁজে পাচ্ছেন না শচীন দেব বর্মন। রেকর্ডিং স্টুডিওতে ক্রমশ বাড়ছে ব্যস্ত পায়চারি। তা সেখানে উপস্থিত ছিলেন হাজারা সিং নামের এক পাঞ্জাবি গিটারবাদক। হাওয়াইয়ান গিটারে সিদ্ধহস্ত। ‘দাদা’ সুর খুঁজে পাচ্ছেন না, তাতে চিন্তিত তিনিও। অনেককক্ষণ ধরে টুংটাং করছিলেন তার গিটারে। এবারে তা নামিয়ে রাখলেন। ঠিক তখনই ঘটল সেই ঘটনা।
হাজারা সিং-এর হাত থেকে হঠাৎই অন্যমনস্কতায় পড়ে গেল ‘প্লেকট্রাম’, যা দিয়ে গিটার বাজানো হয়। পড়ল গিটারের তারের উপর। আকস্মিক পতনে অদ্ভুত শব্দ উঠে এল। চমকে উঠলেন শচীন কত্তা।
এই তো সেই সুর, যা তিনি খুঁজছিলেন গত তিন দিন ধরে। কি আশ্চর্য! সঙ্গে সঙ্গেই হুকুম হল ”ফিরসে বাজাও হাজারা সিং, ফিরসে”। হাজারা সিং অপ্রস্তুত। তিনি তো কিছু বাজাননি, যা হয়েছে তা নিতান্তই দুর্ঘটনা! তবু দাদার কথা রাখতে তাই করলেন অভিজ্ঞ গিটারবাদক। আবারও হাত থেকে প্লেকট্রাম আছড়ে পড়ল গিটারের তারে। একবার, দু’বার, বহুবার। সেই যান্ত্রিক মূর্ছনায় মুগ্ধ শচীন দেব বর্মন। নিমেষে তৈরি হল সুর। আবহধ্বনির সূত্র ধরে। সৃষ্টি হল ‘জিনহে নাজ হ্যায় হিন্দ পার উহ কহা হ্যায়’ গানটি। এর পরবর্তী ঘটনা ইতিহাস। এই ঘটনার কথা উল্লেখ করে রাহুল দেব বর্মন বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর বহু মহৎ সৃষ্টির পিছনে আছে আকস্মিক দুর্ঘটনা। সঙ্গীতের দুনিয়ায় সবই সম্ভব।’
আমার জীবনেও গান নিয়ে গবেষণা অনেকটা এই ‘এক্সিডেন্টাল ক্রিয়েশনে’র মতো। ছোটোবেলা থেকে গান-বাজনার পরিবেশে বড়ো হলেও আমি যে কোনোদিন গানবাজনা নিয়েই গবেষণা করব, এটা স্বপ্নেও ভাবিনি। যখন ছোটো ছিলাম, নাতি পিয়ানো শিখবে নাকি তবলা, এ নিয়ে রীতিমতো ‘টাগ অফ ওয়ার’ চলত আমার আর ঠাকুরদার মধ্যে। ঠাকুরদা ছিলেন ওস্তাদ শ্রীখোলবাদক। সাহেবি কায়দায় মানুষ হওয়া ঠাকুমা বরাবর পাশ্চাত্য সংগীতের গুণগ্রাহী। অর্গান ও পিয়ানো দুটোই ভালো বাজাতেন। যদিও আমি বেছে নিয়েছিলাম—সেতার। আমারই এক পাড়াতুতো মাসিমার কাছে হয়েছিল হাতেখড়ি। তারও অনেক পরে সরোদের তালিম। পার্ক সার্কাসে থাকার সময়, আমার গুরু উস্তাদ মতিউর ইসলামকে খুঁজে পাই। নতুন করে তিনিই চেনান সুরের সাম্রাজ্য। আজ বুঝতে পারি সেই তালিম, সেই পর্যবেক্ষণ, সেই অনুসন্ধিৎসার বীজ আমার মধ্যে সযত্নে বপন করেছিলেন তাঁরাই। আজ নিজের লেখা গানের বইয়ের ভূমিকা লিখতে গিয়ে বারবার পুরোনো কথাই উঠে আসছে স্মৃতির সরণি বেয়ে।
২০০৬-১১ পর্যন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পুস্তক বিপনন সংস্থায় কর্মরত থাকাকালীন, গান ও তা নিয়ে গবেষণার বিষয়টি নতুন করে মাথায় চাপে। প্রাপ্তি ছিল, কিছু অসামান্য পণ্ডিত, বিদগ্ধ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সংস্পর্শ। প্রাপ্তি ছিল কিছু ‘নক্ষত্রজ্জ্বল’ ছাত্রছাত্রীদের বন্ধু হিসেবে পাওয়া। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই পরিবেশ আমার মধ্যে নতুন করে গান, সুর, লোক-সংস্কৃতি নিয়ে জানার উৎসাহ, চেনার তাগিদ, হারানো পথে নতুন সুরের সন্ধানের ইচ্ছেটাকে উসকে দেয়। তারপর সে এক অদ্ভুত সময়ের মুখোমুখি। চাকরির মধ্যে সময় বের করে এই জেলা, সেই জেলা, এই গ্রাম সেই গ্রাম ঘুরে বেরিয়েছি সুরের টানে। সঙ্গী শুধু ডায়েরি, পেন, জলের বোতল আর রেকর্ডার। পেয়েছি কিছু কাছের মানুষদের সাহচর্য। আমার সঙ্গে তারাও বেরিয়ে পড়েছে সুরের আহ্বানে। সেই হারানো সুরের খোঁজে ছুটে গেছি নতুন শহর, নতুন দেশেও। সেই যৌথ খামার, সেই ছুটে চলা আজও অটুট।
২০১০ সালে প্রকাশিত হয় ‘মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’। ধর্মীয় সংগীতের আনাচ-কানাচের সন্ধান স্বরূপ। কিন্তু তা ছিল নিতান্তই একাডেমিক গবেষণার ফসল। আজ দশবছর বাদে আবারও নতুন করে গান নিয়ে লিখতে বসা। অধিকাংশ লেখাই তুলে ধরেছিলাম ফেসবুকের দেওয়ালে। অনুজপ্রতিম কবি, প্রকাশক ঐত্রেয়ীর আগ্রহে তা এবার ঠাঁই পেল দুই মলাটের মধ্যে। এখানে কোনও একাডেমিক গবেষণার তত্ত্বতালাশের কড়া বাঁধুনি নেই। যা আছে তা ভুলে যাওয়া কিছু গান, কিছু সুর নিয়ে মজলিশি গল্প, যা বারবার আমায় বিস্মিত করেছে, চিনতে শিখিয়েছে সুরের সেই অজ্ঞাত পরিচয়ের নানা বাঁক, ইউটোপিয়া জগতকে।
ঋত প্রকাশনের কাছে তাই কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কৃতজ্ঞ ঐত্রেয়ী সরকারের কাছে, আমার এই সামান্য লেখা, এই ‘এক্সিডেন্টাল ক্রিয়েশন’-র উপর ভরসা রাখার জন্য। বইটির জন্য এক চমৎকার প্রচ্ছদ বানিয়ে দিয়েছেন বিতান চক্রবর্তী মহাশয়। তাঁর কাছেও কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমার বোন রাজস্থান-বিশারদ, গবেষক ড. প্রত্যুষা দাশগুপ্ত এই বইয়ের নানার লেখার ঠিকুজি-কুলুজি নিয়ে দিয়েছেন যথাযথ পরামর্শ। এই কাজে সদা-সর্বদা উৎসাহ জুগিয়েছেন আমার স্ত্রী সুদেষ্ণা, মা-বাবা ও আমার একমাত্র পুত্র শ্রীমান রায়ান। বরাবর দক্ষ সমালোচক হিসেবে পাশে থেকেছেন আমার প্রিয়বন্ধু সুজন চট্টোপাধ্যায়, অঙ্গনা দত্ত, দীপিতা চ্যাটার্জী, সৌরীশ ঘোষ, অরুনিমা, স্নেহা, পিউ ও অন্যান্যরা। বইটি নিয়ে মনোগ্রাহী মুখবন্ধ লিখে দিয়ে চিরঋণী করেছেন প্রখ্যাত সুরকার ও সুরসাধক দেবজ্যোতি মিশ্র মহাশয়। আমাদের সকলের প্রিয় শিল্পী ‘মথুরা-নগরপতি’ দেবুদা, যার সুর ও সিনেমা-সংগীত এই প্রজন্মের কাছে চিরস্মরণীয় ও বিস্ময়। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ শব্দগুলি বড়ো ছোটো মনে হয়। এঁনাদের সম্মিলিত ভরসাতেই হারানো সুর, কথা ও সংগীত নিয়ে এই যৎসামান্য প্রচেষ্টা তুলে ধরা হল পাঠকদের কাছে।
‘ভুলবে সে গান যদি’-র সূত্রে সত্যি সত্যিই ভুলে যাওয়া সেই সুরের সামান্য রেশটুকু কাউকে যদি সামান্য হলেও অনুরণিত, অনুপ্রাণিত করে তবেই এই প্রচেষ্টা সার্থক বলে মনে করব। এইটুকুই বলা। আর যা কিছু অনুচ্চারিত তা রাখা থাকল এই বইয়ের ছত্রে, ছত্রে। বাকিটা সময়ের হাতে।
প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
দিল্লী, জানুয়ারি, ২০২০
।।কওমি তারানা।।
২ নভেম্বর। শাহরুখ খানের জন্মদিন।
২ নভেম্বর। টলি অভিনেতা চিরঞ্জিতের জন্মদিন।
২ নভেম্বর। প্রিয় সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও জন্মেছেন এই দিনেই।
২ নভেম্বর। একটি ভুলে যাওয়া ঐতিহাসিক ‘গান’-এর জন্মদিন। যার কথা কেউ বলে না।
ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত সেই গানটি নিজে একটি বিশ্রুত অধ্যায়, যাকে ভুলেছে ইতিহাস। যাকে ভুলেছি আমরাও। অনাদরে, অবহেলায় ইতিহাসের ধুলোমাখা, ছেঁড়া পাতা থেকে প্রতিবছর এই দিনটিতে সেই গানটি নিঃশব্দে মুখ বাড়ায়। অথচ আমরা দেখতে পাই না, শুনতে পাই না। শুধু গানটি রয়ে যায়। রয়ে গেছে আজও।
১৯৪৩ সাল। সারাদেশ জুড়ে তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ। কাতারে কাতারে মানুষ ঝাঁপ দিচ্ছে সেই মহাযজ্ঞের আগুনে। ভারতের স্বতন্ত্রতা সংগ্রামের সেই লেলিহান অগ্নিকুন্ডের একদিকে দাঁড়িয়ে অহিংস অথচ অসহযোগ আন্দোলনের পুরোধা ‘মহাত্মা’ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি, অন্যদিকে সশস্ত্র সেনা অভ্যুত্থানের স্বপ্নে বিভোর ‘নেতাজী’ সুভাষচন্দ্র বসু। তার ‘দিল্লি চলো’ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে একটু একটু করে বর্মা সীমান্ত পেরিয়ে দিল্লি দখলের স্বপ্ন দেখছে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ বা ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’। এমনই এক অগ্নিগর্ভ মুহূর্তে জন্ম এই গানটির। বছর দুয়েক আগে গানটির কথা প্রথম মাথায় আসে ‘নেতাজী’র। এই গানটি তারই ‘ব্রেন চাইল্ড’।
বড়োই অস্থির হয়ে পড়েছেন সুভাষচন্দ্র। তার ‘আই এন এ’ শেষমেশ গঠন তো হয়েছে, কিন্তু সেনাবাহিনীর জন্য চাই একটি যুতসই গান। যাকে বলে ‘মিলিটারি মার্চ সং’। গত দু’ বছর ধরে এ নিয়ে বিস্তর চিন্তাভাবনা করেছেন তিনি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে কিছুতেই মাথা থেকে নামাতে পারেননি। আর সেটাই হয়েছে মুশকিল।
সে বছরই অক্টোবরে সিঙ্গাপুরে ‘Provisional Government of Free India’ (আর্জি-এ-হুকুমতে-আজাদ হিন্দ)-এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দিন ‘বন্দেমাতরম’ গেয়েছিলেন ‘আই এন এ-র সেনানীসহ সমবেত জনতা। তখন ‘বন্দেমাতরম’-এর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। কিন্তু আজাদ হিন্দ সেনাবাহিনীর অনেক অহিন্দুরা এই গানের দর্শন ও ভাষার সঙ্গে পরিচিত না হওয়ায় অস্বস্তিতে পড়েন। তখনই মনে মনে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন ‘নেতাজী’। একটি স্বতন্ত্র গান চাই। এমন একটি গান যাতে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা এবং আঞ্চলিকতার ভেদাভেদ মুছে যাবে। যা শুনে রক্ত গরম হয়ে উঠবে সবার। যে গান গাইতে গাইতে দেশমাতৃকার জন্য আত্মহুতি দিতে পিছপা হবে না সেনারা। কিন্তু বাংলায় নয়, তা চাই হিন্দি বা হিন্দুস্থানীতে। কারণ, নেতাজীর আই এন এ-তে অহিন্দু ও অবাঙালী সেনার সংখ্যা কিছু কম নয়, বরং অনেকাংশে বেশিই। কালক্রমে তা-ই হয়ে উঠবে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’-এর অলিখিত জাতীয় সংগীত। কিন্তু সমস্যা হয়েছে, রবি ঠাকুরের ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ শোনার পর আর কোনও গানের কথা ভাবতেও পারছেন না নেতাজী। ‘রানী ঝাঁসি রেজিমেন্ট’-এর ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগলেরও তা-ই প্রথম পছন্দ। কিন্তু সেখানেও যে ভাষাগত ও দর্শনের ‘পরিচিত’ সমস্যা। তাহলে উপায়? এমন সময়, হঠাৎই একদিন বিদ্যুৎ চমকের মতো নেতাজীর মাথায় খেলে গেল একটি ‘আইডিয়া’। একটি ‘স্বতন্ত্র’ ও বিকল্প গান—হ্যাঁ, হবে। ‘জনগণমন’ই হবে। শুধু ভাষাটি যাবে বদলে। অর্থাৎ, হিন্দি বা হিন্দুস্থানীতে হবে একটি বিশেষ সংস্করণ। সুর একই থাকবে, শুধু লয় ও তালে আসবে সামান্য দ্রুততা। ব্যাস! যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। ডাক পড়ল সেনাবাহিনীর উর্দু ও ফার্সির পন্ডিত ‘শায়ের’ ক্যাপ্টেন আবিদ হাসান ‘সাফরানী’ (মতান্তরে আবিদ আলী) ও গোর্খা ‘ব্যান্ডমাস্টার’ ক্যাপ্টেন রাম সিং ঠাকুরি (মতান্তরে ঠাকুর)-র। হুকুম হল ‘জনগণমন’-র ‘মাধুর্য’ ও ‘অন্তর্ভাষ্য’ বহাল রেখে তা হিন্দিতে লিখবেন আবিদ মিয়াঁ। তাকে সাহায্য করবেন ‘আজাদ হিন্দ রেডিও’র সঞ্চালিকা ও লেখিকা মমতাজ হুসেন। প্রয়োজনে নেতাজী নিজেও থাকবেন।
যন্ত্রসংগীতের বিরল প্রতিভা ক্যাপ্টেন রাম সিং ঠাকুরি থাকবেন যন্ত্রানুসঙ্গ পরিচলন (মিউজিকাল অ্যারেঞ্জমেন্ট) ও সুরারোপের দায়িত্বে। পরবর্তীকালে পণ্ডিত বংশীধর শুক্লার রচনা ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’-তে সুর দিয়ে তা অমর করেন ঠাকুরি।
তারপর সৃষ্টি হল ইতিহাস। রচিত হল ‘শুভ সুখ চৈন কি বরখা বরষে/ভারতভাগ্য হ্যায় জাগা’। প্রকাশ্যে এল রবিচ্ছায়ায় নির্মিত সেই হিন্দি গান—যা পরবর্তীকালে ‘কওমি তারানা’ নামে প্রসিদ্ধ হবে। পরাধীন ভারতের প্রথম জাতীয় সংগীত। পরে, সেই গান শুনে খুশি হয়ে ক্যাপ্টেন ঠাকুরিকে একটি স্যাক্সোফোন ও বেহালা উপহার দেন নেতাজী। আবিদ আলি পান একটি সোনার কলম। ১৯৪৬ সালের ২০ জুন দিল্লিতে বিখ্যাত আই এন এ বন্দীদের ‘রেড ফোর্ট ট্রায়াল’-এর সময় গান্ধিজির উপস্থিতিতে নেতাজীর দেওয়া বেহালায় এই গান বাজিয়ে শোনান রাম সিং। স্বাধীনতা দিবসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর অনুরোধে তিনি ও তার অর্কেস্ট্রা দিল্লির লালকেল্লায় এই ‘কওমি তারানা’ পরিবেশন করেন। বাকিটা ইতিহাস। এরপরে কেটেছে কয়েক দশক। ‘নেতাজী’ জীবিত না মৃত তা নিয়ে আজও বিতর্কের শেষ নেই। বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছেন এই গানের অন্যতম তিন রূপকার-ক্যাপ্টেন আবিদ হাসান সাফরানী, মমতাজ হুসেন ও ক্যাপ্টেন রামসিং ঠাকুরি। রয়ে গেছে শুধু গানটি।
২ নভেম্বর পরাধীন ভারতের সেই প্রথম ‘অলিখিত’ জাতীয় সংগীতের জন্মদিন।
शुभ सुख चैन की बरखा बरसे, भारत भाग है जागा
पंजाब, सिन्ध, गुजरात, मराठा, द्राविड़ उत्कल बंगा
चंचल सागर, विन्ध्य, हिमालय, नीला जमुना गंगा
तेरे नित गुण गाएँ, तुझसे जीवन पाएँ
हर तन पाए आशा।
सूरज बन कर जग पर चमके, भारत नाम सुभागा,
जए हो! जए हो! जए हो! जए जए जए जए हो! ।।
सब के दिल में प्रीत बसाए, तेरी मीठी बाणी
हर सूबे के रहने वाले, हर मजहब के प्राणी
सब भेड और फर्क मिटा के, सब गोद में तेरी आके,
गूंथें प्रेम की माला।
सूरज बन कर जग पर चमके, भारत नाम सुभागा,
जए हो! जए हो! जए हो! जए जए जए जए हो! ।।
शुभ सवेरे पंख पखेरे, तेरे हि गुण गाएँ
बास भरी भरपूर हवाएँ, जीबन में रूत लाएँ,
सब मिल कर हिन्द पुकारे, जय आजाद हिन्द के नारे।
प्यारा देश हमारा।
सूरज बन कर जग पर चमके, भारत नाम सुभागा,
जए हो! जए हो! जए हो! जए जए जए जए हो!।।
।।অভয় পদ কমলে।।
সাল ১৮৮৫, ২২ ফেব্রুয়ারি। দক্ষিণেশ্বর। পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণ’র জন্মমহোৎসব। নরেন্দ্র রাখাল বাবুরাম ভবনাথ সুরেন্দ্র গিরীন্দ্র বিনোদ হাজরা রামলাল রাম নিত্যগোপাল মণি মল্লিক গিরিশ সিঁথির মহেন্দ্র কবিরাজসহ বহু ভক্তের সমাগম। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ঘরে চাঁদের হাট। চারদিন আগেই কেটেছে জন্মদিন। ঠাকুরের শরীর আগের চেয়ে ভালো। তাই ভক্তেরাও খুশি। কীর্তন শেষ হয়েছে খানিক আগেই। বেলা গড়াচ্ছে ধীরে, মন্থরে।
মাস্টার এসে প্রণাম করে দাঁড়ালেন। ঠাকুর তাকে ইঙ্গিতে কাছে এসে বসতে বলেন। এইবার গান গাইবেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ। ঠাকুর যে তার গানের বিশেষ ভক্ত। শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারকে তানুপরাটি পেড়ে দিতে বলেন। পরম যত্নে কোলের উপর নিয়ে নরেন্দ্র তানপুরাটি বাঁধছেন। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই চলছে তানপুরার কান মুলে মুলে শুদ্ধ স্বর বের করার কঠিন প্রক্রিয়া। বেশ অনেকটা সময় অতিক্রান্ত। এদিকে ঠাকুর ও অন্য সকলে ক্রমশ অধৈর্য। বিনোদ মুচকি হেসে বললেন, ”আজ শুধু বাঁধাই হবে, গান হবে আর একদিন।” ঘরভর্তি সকলে হো হো করে হেসে ওঠেন। নরেন্দ্রনাথ ভ্রূক্ষেপহীন। তিনি ধ্রুপদের তালিম পাওয়া ছাত্র। এসবে কান দেবেন কেন? শুদ্ধ স্বর চাই, শুদ্ধ স্বর। তা সে যতক্ষণ সময় লাগুক। শ্রীরামকৃষ্ণ হাসছেন আর বলছেন, ”এমনি ইচ্ছে হচ্ছে যে তানপুরাটা ভেঙে ফেলি। কী যে তখন থেকে শুধু টং টং টং—আবার তানা নানা নূম হবে।” এবার প্রিয় শিষ্যর কান ক্রমশ লাল হয়ে ওঠে। পালটা যোগ দিলেন ভবনাথ। আলতো কটাক্ষ, ”সব যাত্রার গোড়াতেই ওমন একটু হয়।” এবার ফোঁস করে ওঠে নরেন। বহু কষ্টে পাওয়া গেছে স্বর। শেষ পর্যায়ে তার বাঁধতে বাঁধতে রাগত স্বরে বললেন, ”সে না বুঝলেই হয়।” হেসে ওঠেন প্রেমের ঠাকুর। ”ওই দিলে দিলে…আমাদের সব উড়িয়ে দিলে।”
বাঁধভাঙা হাসি থামলে শুরু হল গান। অদ্ভুত তার সুর। কী অদ্ভুত চলন। নিবিষ্ট হয়ে গান গাইছেন নরেন্দ্রনাথ। ঠাকুর তার খাটে বসে শুনছেন। বাকিরা মাটিতে। প্রথম গান—’অন্তরে জাগিছ ও মা অন্তর যামিনী, কোলে করে আছ মোরে দিবস যামিনী’। ঠাকুর স্থির। ঘরভর্তি লোক বাকরুদ্ধ। সূচ পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে। এবার দ্বিতীয় গান—’গাও রে আনন্দময়ীর নাম। ওরে আমার একতন্ত্রী প্রাণের আরাম’। ঠাকুরের সারা শরীর কাঁপছে। গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। গান শেষ হতে তানপুরা নামিয়ে রাখতে যাচ্ছিলেন নরেন্দ্র। বারণ করলেন ঠাকুর। ”আহা, সেই গানটা ধর না…সেই গানটা।” যেন কোন ঘোরের মধ্যে থেকে ভেসে এল স্বর। আনত চোখ, দুটো হাত বুকের উপর। গায়কের হাতে ফিরে এল তানপুরা। চোখ বুজে আবার সুর মেলালেন নরেন্দ্র। তার অত্যন্ত প্রিয় গানগুলির একটি। ত্রৈলোক্যনাথ সান্যালের ধ্রুপদী রচনা। বাগেশ্রী রাগের অপার্থিব সুরলোকমণ্ডল। নিমেষের মধ্যে ঠাকুরের ভাবসমাধি। গঙ্গা থেকে যেন উড়ে আসছে চন্দনের গন্ধ। দূরে ভবতারিণী মন্দিরে একা হাসছেন ‘তিনি’। তাঁর চিন্ময়ী হাসিতে চরাচর জুড়ে আলোর সমুদ্র। ডুবতে ডুবতে, ভাসতে ভাসতে ভেসে চলছে জগত-সংসার।
নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে ও রূপরাশি।
তাই যোগী ধ্যান ধরে হয়ে গিরি-গুহাবাসী।
অনন্ত আঁধার কোলে মহানির্বাণ-হিল্লোলে,
চিরশান্তি-পরিমল অবিরল যায় ভাসি।।
মহাকাল রূপ ধরি, আঁধার বসন পরি,
সমাধি মন্দিরে ও মা কে গো তুমি একা বসি।
অভয় পদ কমলে প্রেমের বিজলী খেলে,
চিন্ময়-মুখ মণ্ডলে শোভে অট্ট অট্টহাসি
।। কালী, দ্য মাদার।।
সাল ১৮৯৮। শ্রীনগর, কাশ্মীর। ডাললেকের উপর একটি হাউসবোটে বসে এক সন্ন্যাসী। ঝিলমের উপর সূর্যাস্ত দেখছেন। সেই সন্ন্যাসী, যিনি পাঁচবছর আগেই ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগোর ধর্মমহাসভা আন্দোলিত করেছেন তাঁর ভাষনে। তাঁর উদাত্ত কন্ঠে ‘হে আমার আমেরিকার ভাইবোনেরা’—সেই সম্বোধনে মুগ্ধ তামাম মার্কিনবাসী। এরপর দীর্ঘ চারবছর যিনি ইউরোপ চষে বেড়িয়ে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরেছেন দেশে। দুর্বল হয়ে পড়েছেন। পরিভ্রমণ ও হাওয়াবদল করতেই তাঁর কাশ্মীরে আসা। কিন্তু সেদিন কী যেন হল, শতাব্দী-প্রাচীন ক্ষীর-ভবানী মাতার মন্দিরদর্শনে গিয়ে। মাতৃবিগ্রহ দর্শনের সেই ঘোর তার কিছুতেই কাটে না। ভিতরে ভিতরে বাড়ছে প্রচণ্ড অস্থিরতা। তাঁর সেই অস্থিরতা, ভাবোন্মাদতা এতই তীব্র যে হাউসবোটের মালিক, জনৈক মুসলিম ব্যবসায়ীর ছ’বছরের মেয়েকে মাতৃজ্ঞানে পুজোও করেছিলেন স্বামীজি। তবু যেন সেই ভাব কাটতে চায় না। তাঁর অস্থিরতা আঁচ করতে পেরেছেন তাঁর সহযাত্রী সিস্টার নিবেদিতা, জেসোফিন ম্যাকলয়েড ও শ্রীমতী ওলে বুলও। অবশেষে সেই প্রগাঢ় অস্থিরতা কলমের আঁচড়ে শান্ত করলেন তিনি। সৃষ্টি হল ‘কালী, দ্য মাদার’ নামে সেই অসাধারণ, কালোত্তীর্ণ কবিতাটি যাতে মুগ্ধ হয়েছিলেন দেশবাসী। মুগ্ধ হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র ও অরবিন্দের মতো মনীষীরা। মিস ওলে বুল পরবর্তীকালে জানিয়েছিলেন, রচনাটিতে সুর দেওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন বিবেকানন্দ। রোমান ওপেরার প্রভাব ছিল সেই সুরে। যদিও পরে সেই সুর আদৌ স্বরলিপিভুক্ত হয়েছিল কিনা তা জানা যায় না। শুধু রয়ে গেছে কিংবদন্তি এই রচনাটি। আজও কবিতার ছত্রে ছত্রে সেই ঘোর, সেই উন্মাদনা ও তিমিরনাশিনী অপার্থিব আলোর ছটা বিদ্যমান।
Kali, the Mother
The stars are blottted out,
The clouds are covering clouds,
It is darkness vibrant, sonant.
In the roaring, whirling wind
Are the souls of a million lunatics
Just loose from the prison-house,
Wrenching trees by the roots,
Sweeping all from the path.
The sea has joined the fray,
And swirls up mountain-waves,
To reach the pitchy sky.
The flash of lurid light
Reveals on every side
A thousand, thousand shades
Of Death begrimed and black–
Scattering plagues and sorrows,
Dancing mad with joy,
Come, Mother, come!
For Terror is Thy name,
Death is in Thy breath,
And every shaking step
Destroys a world for e’er.
Thou “Time”, the All-Destroyer!
Come, O Mother, come!
Who dares misery love,
And hug the form of Death
Dance in Destruction’s dance,
To him the Mother comes.
।। দেবীমাহাত্ম্য ও শাস্ত্রীয় রাগ-রাগিণীর আদিরূপ।।
ভারতীয় মার্গ সংগীত এক অপার সমুদ্র। প্রগাঢ় তার ব্যাপ্তি, তার গভীরতা, বৈচিত্র্য। শাস্ত্রীয় সংগীতের বিভিন্ন স্তর তাকে করে তুলেছে আরও সমৃদ্ধ, রত্নখচিত। সেখানে পরতে পরতে বিস্ময়। সংগীতের নিজস্ব নিয়মে সেখানে কখনও উঠে এসেছে প্রকৃতি, কখনও সময়, কখনও দেশকাল আবার কখনও গোটা ব্রহ্মাণ্ড।
মার্গ সংগীতের ভুবন বিস্তৃত জালে ধ্রুবতারার মতন জ্বলজ্বলে অবস্থান—বিভিন্ন রাগ-রাগিনীর। অদ্ভুত তাদের নাম, ততধিক অদ্ভুত তাদের চলন, সাঁঝ সরগম। প্রতিটি শাস্ত্রীয় রাগ-রাগিনীর সঙ্গে জুড়ে রয়েছে এক একটি অশ্রুত ইতিহাস, কিংবদন্তি। যুগ যুগ ধরে সেই সব রাগ-রাগিনী আমাদের কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে ও তারও ঊর্ধ্বে দিয়েছে রহস্যময়তা। অনাবিল সেই সব সুরের রৌদ্রজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় আমরা খুঁজে পাই ভগবত দর্শনের পরিপূর্ণতা। এ এক অবর্ণনীয় সুরেলা বর্ণমালা, যাকে সহজে কোনও চেনা সমীকরণের কাঠামোয় আটকানোর কল্পনা করা অসম্ভব।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে, যেখানে প্রেম-প্রকৃতি-ভক্তি-সমৃদ্ধির এত বিকাশ, সেখানে ভারতীয় লৌকিক দেব-দেবীদের প্রসঙ্গ থাকবে না, তা অকল্পনীয়। কথিত আছে, আদি সংগীতাচার্য হলেন স্বয়ং পিনাকপাণি মহাদেব। তার থেকেই উৎপত্তি শাস্ত্রীয় রাগরাগিনীর তত্ত্ব-কৌমুদীর। আর এখানেই তা স্বতন্ত্র, পথিকৃৎ। সময়ের সুদীর্ঘ ইতিহাস জুড়ে তাই বারবার উঠে এসেছে দেব-দেবী বন্দনা, দেবী-মাহাত্ম্য গাথা। কখনও সুরের অপার্থিব মূর্ছনায়, আবার কখনও রাগ-রাগিনীর নাম-পরিচয়ের মাধ্যমে দৈবশক্তির পরিচয় করিয়েছে এই সুরলোক। সেই ঐশ্বরিক ভক্তিবাদ ও দৈবস্তুতির কথা আজ কতটাই বা আমরা মনে রেখেছি, মর্মস্থ করেছি। আজ পারিপার্শ্বিকের নিরিখে ভারতীয় রাগ-রাগিণীতে দেব-দেবী মাহাত্ম্য নতুন করে খুঁজে দেখা প্রাসঙ্গিক, সমকালীন।
কিংবদন্তি অনুসারে ও সারঙ্গদেব রচিত আকর গ্রন্থ ‘সংগীতরত্নাকর’ জানাচ্ছে দেবাদিদেব শিব হলেন সংগীতশাস্ত্রের আদিগুরু। তাঁর ভয়ংকর প্রলয়নৃত্যের সূত্র ধরেই উঠে এসেছে তাল-লয়-ছন্দ ও মাত্রার প্রকাশ। একই সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে বহু রাগ-রাগিণীর। যেমন, শিবের পূর্বমুখ থেকে উঠে এসেছে রাগ ‘ভৈরব’, পশ্চিম মুখে নিঃসৃত রাগ ‘হিন্দোল’ বা ‘হিন্দোলম’, উত্তরমুখে প্রকাশ রাগ ‘মেঘ’-এর, দক্ষিণে ‘দীপক’ ও ঊর্ধ্বমুখ থেকে রাগ ‘শ্রী’। একইভাবে পুরাণ মতে দুর্গা বা পার্বতী থেকেও উৎপত্তি একাধিক রাগের, যার অন্যতম হল রাত্রি দ্বিপ্রহরের রাগ ‘মালকোষ’।
পুরান মতে, শিবের তাণ্ডবনৃত্য প্রশমিত করতেই এই রাগ সৃষ্টি করেন পার্বতী, যাতে ‘মাল’ ও ‘কৌশিকী’ দুটি রাগের রয়েছে অপূর্ব সংমিশ্রণ। এই সূত্র ধরে কোথাও যেন এক হয়ে যায় উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় বা কর্নাটকী মার্গ সংগীত ও তাদের সংস্কৃতির ইতিহাস। মহামতি মাতঙ্গ ও ত্যাগরাজের বর্ণনার সূত্র ধরে পাওয়া যায় শত শত বর্ষ পূর্বে বিভিন্ন দেব-দেবীদের উপর রচিত রাগ-রাগিনীর আখ্যান। সেই সব রাগ-রাগিনীর চলন, আরোহন-অবরোহনে ফুটে উঠেছে দৈবের প্রকাশ। শাস্ত্রমতে যা স্বয়ংসিদ্ধ। এর মধ্যে যেমন শিবমাহাত্ম্য নিয়ে পাওয়া যায়—’পান্থভারালী’ বা ‘পূর্বী’ ‘কেদারম’ বা ‘কেদার’ ‘হিন্দোলম’ বা ‘হিন্দোল’ ‘ভূপালাম’ বা ‘ভূপালী’ ‘কিরওয়ানী’ ‘শঙ্করা’ ‘ভৈরব’ ‘নট ভৈরব’ ‘খট’ ও ‘রেবতী’র মতো রাগের উল্লেখ।
বিষ্ণুকে নিয়ে রয়েছে—’বাওলী’ বা ‘ভূপাল টোরী’, ‘বৃন্দাবনী সারঙ্গ’ বা ‘সীমেন্দ্রমধ্যম’-এর মতো রাগ। কৃষ্ণবন্দনায় নিহিত রয়েছে—’কম্বোজি’, ‘কানাড়া’, ‘মোহনম’-এর মতো বিরল সব রাগ। শ্রীরাম-কে নিয়ে ‘নট্টকুরঞ্জিনী’, ‘সারং’, ‘খামাজ’, এমনকি ‘খরহরপ্রিয়া’ (মতান্তরে সীতা বা জানকীস্তুতি) বা ‘সম্মুখপ্রিয়া’-র মতো বিরল ও অপ্রচলিত রাগের হদিস পাওয়া যায়। এই তালিকার একটি বড়ো অংশ নিহিত রয়েছে দেবীমাহাত্ম্যের গভীর সংকলনে। দেবী যেখানে নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণা, রাগিনীসিদ্ধা, সুরসম্ভুতা। দেবীবন্দনা ও মাহাত্ম্যকীর্তনেও বারবার ঝলকে উঠেছে মার্গ সংগীতের বিদ্যুৎ। সৃষ্টি হয়েছে বহু রাগ-রাগিনীর কথা। শুধু দেবীবন্দনাই সেখানে উপলক্ষ নয়, দেবীর ভাব, মনন, বৈশিষ্ট্যাবলীর আত্মদর্শন রূপে ঘটেছে তাদের প্রকাশ। প্রতিটি রাগ-রাগিনীর চলনে প্রস্ফুটিত হয়েছে দেবীর প্রকৃতি, করুণা, বরাভয় ও সমৃদ্ধির অন্তর্লীন অনন্ত আখ্যান। কর্নাটকী সংগীতে রয়েছে এর একাধিক দৃষ্টান্ত। দেবী দুর্গার মহিমান্বেষণে পাওয়া যায়—অতি প্রাচীন রাগ ‘পুন্নাগাভরলি’ বা ‘পিলু’ ‘সাভেরী’ ‘নদানামাক্রিয়া’ ‘ধ্যানেশ্রী’ ‘আহিরী’ ‘ভৈরবী’ ‘দুর্গা’ ‘মুখরী’ ‘আরোহী’ ‘শিবরঞ্জনী’ ও ‘শ্যামা’-র উল্লেখ। দেবী দুর্গার মতোই তাঁর সন্তানদের নিয়ে রাগ-রাগিনীর ঐতিহ্যও বিপুল। সিদ্ধিদাতা গণেশের জন্য বন্দনাগীতিতে দেখা যায়—’বেহাগ’ ‘নট’ ‘কামোদ’ ও ‘হংসধ্বনি’র ব্যবহার। মহালক্ষ্মীর জন্য উঠে আসে—’শ্রীরাগ’ ‘মধ্যমাবর্তী’ ‘কলাবতী’ ‘বাহার’ অমৃতবর্ষীনী’ অথবা ‘নলিনীকন্ঠী’। বাগ্দেবী ও বিদ্যাধরী সরস্বতীর জন্য রয়েছে—’রাগ সরস্বতী’, ‘জ্ঞানরঞ্জনী’ ‘শ্রী’ ‘বাগেশ্রী’ ‘কল্যানী’ ‘কৌষিকী’, ও ‘হংসধ্বনি’র মতো একাধিক রাগ। দেব-সেনাপতি কার্তিকের মহিমা নিয়ে—’আদানা’ ‘আভোগী’ ‘সারঙ্গ’ অথবা ‘বাচস্পতি’র মতো বিভিন্ন রাগের কথা নারদমুনির ‘সংগীত মকরন্দ’-এ পাওয়া যায়। এমনকি, রাগ-মাহাত্ম্য থেকে বাদ পড়ে না মহিষাসুরও। দেবী দুর্গার সঙ্গে পুজো হয় তারও। ‘নারায়ণী’, ‘বিলহরী’ এবং ‘গোরখ কল্যাণ’ রাগে ধ্বনিত হয় মহিষাসুর-বন্দনা। এই তালিকা সুদীর্ঘায়িত ও মহা-বিস্ময়কর। এটাই ভারতীয় মার্গ সংগীতের অপার সৌন্দর্য, মাহাত্ম্য।
পরিশেষে, এই কথা বলাই যায় হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সুনিবীড় ও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে যে সাঙ্গীতিক বলয় তা আধ্যাত্মিকতা, ধর্ম, মিথ ও দৈব ভাবধারায় সম্পৃক্ত, সহজাত ও পরিপূরক। সময়ের নিবিড় কালখণ্ড ধরে শতাব্দীর পর শতাব্দী যা সঞ্চারিত হয়ে আসছে আমাদের মননে, শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে। সেই সাংগীতিক সমৃদ্ধিকে আজও সমাজ, দেশ ও কালের নিক্তিতে মাপা অসম্ভব। শারদ উৎসবে যখন ধর্মীয় লোকাচারের সংস্কৃতি অসুরদলনী, দশপ্রহরনধারিনী মাতৃবন্দনার বৃন্দগানে মিলিত হয়, তখনই হবে সেই আরাধ্য স্তুতিতে নির্মিত প্রাচীন রাগ-রাগিনীর অপার্থিব উদ্ভাস। নেপথ্যে থেকেও যা চির বাঙ্ময়। এখানেই শাস্ত্রীয়সংগীত ও প্রাচীন রাগ-রাগিনীর ঐতিহ্যের সম্পূরণ ও সার্থকতা। এই সেই প্রত্ন-সুর, দেবী আবাহনের…
ভবানী দয়ানী মহাবাকবাণী
সুর-নর-মুনি জনমানি, সকল বুধ জ্ঞানী
জগ জননী, জগ দানী, মহিষাসুরমর্দিনী
জ্বলামুখী চন্ডী অমর পদদানী।
(রাগ-ভৈরবী, তাল-ঝাঁপতাল,
কথা-প্রচলিত, সুরকার-ভাতখন্ডে)
।। বৈষ্ণব জন কো।।
এই তো সেদিনের কথা। হঠাৎই দেখা তাঁর সঙ্গে। দিল্লির চিত্তরঞ্জন ভবনে বইমেলার বাইরে। ভাঙা একটি বেঞ্চের উপর লাঠিতে ভর দিয়ে বসে তিনি। সেই গোল চশমা, শীর্ণ দেহ, হাঁটুর উপরে ওঠানো ধুতি আর বিবর্ণ সাদা চাদরে ঢেকে রাখা তাঁর রুগ্ন পাঁজর। শুকনো মুখ, অথচ উজ্জ্বল দুটি চোখে কী নিবিড় আকুতি। কেউ দেখেনি তাঁকে। দেখতে পায়নি। কিন্তু আমি দেখেছি। তিনি তখন মহাত্মা নন, বেয়াদপ উইয়ের বুভুক্ষু দাঁতে কাটা জরাজীর্ণ ‘সিলেক্টেড ওয়ার্কস অফ এম কে গান্ধি’।
বইমেলার উদ্যোগীরা বাইরে এনে ফেলে দিয়ে গেছে পুরোনো জঞ্জাল। প্রাচীন, অচল, জগদ্দল সে সব বইয়ের স্তুপ। ইচ্ছে হলেই নিতে পারেন। যত খুশি তত। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। অথচ কেউ সেদিকে ঘুরেও তাকাচ্ছে না। ধুলোভরা পাতা উলটে কারও সময় নেই সে সব রদ্দি বই পড়ার বা সংগ্রহ করার। তিনি করুণ অথচ শান্ত, ক্ষমাসুন্দর চোখে স্মিত হেসে আমাদের দিকে এগিয়ে দিচ্ছিলেন সে সব। আমরা তাকাইনি। পাত্তা দিইনি বিন্দুমাত্র সে সব মূল্যহীন, নোংরা কাগজের টুকরোকে। কারণ আমরা জানি, মহাত্মা কোনও বইয়ের পাতায় নয়, নোটের পাতায় সবচেয়ে আকর্ষণীয়। পড়ার টেবিলে নয়, নৃত্যরতা বিদেশিনীর সঙ্গে তাল মেলানো তার ‘জাল’ ছবি বেশি বিতর্কের বিষয়। তিনি ‘চোখের বদলে চোখ’-এর বিরোধীতা নিয়ে কী বলেছেন তার চাইতে তিনি কোন কোন মহিলাদের সঙ্গে কী কী যৌনাচার করেছেন, সে সব বেশি গুরুত্ব পায়। তার সত্যাগ্রহের চাইতে বেশি জরুরি তার ঘাতকের উগ্র জাতিয়তাবাদী আদর্শগাথা। যেন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বললেন, ”সঙ্গে নেবে?” ঘৃণা ও সমর্থনের ঊর্ধ্বে উঠে আমি মুখ ঘুরিয়ে নিই। কিন্তু ফেলতে পারি না। এতটাই প্রাসঙ্গিক তিনি? আজও?
জানিনা আজ কেন বিজয়ার সুর ও মহরমের মর্শিয়া ছাপিয়ে সেই সুর আচ্ছন্ন করছে আমায়! সেই রহস্যময় ধুন। পঞ্চদশ শতকের প্রাচীন গুজরাতি ভাষায় ভক্তিকবি নরসিংহ মেহতার মিশ্র খামাজ রাগের রচনা। যে সংগীতে, সাংগীতিক দর্শনে আচ্ছন্ন ছিলেন সেই ‘অর্ধমগ্ন ফকির’। আমি তাঁর নিরবিচ্ছিন্ন সুরালোকে ডুব দিই। কিন্তু তল খুঁজে পাই না। শুধু অনিবার্যভাবে গভীরতা বেড়ে চলে।
বৈষ্ণব জন তো তেনেরে কহিয়ে,
জে পীড় পরায়ি জানে রে
পর দুঃখে উপকার করে তোয়,
মন অভিমান না আনে রে…
।। সরদারী বেগম।।
রেওয়াজে বসেছেন বেগম। কন্ঠে ভৈরবী। টুকরো টুকরো সরগম, চিনির দানার মতো ছড়িয়ে পড়ছে তানপুরার তার ঘেঁসে, কোঠির আশপাশে। তার দু-চোখ বন্ধ, একটি হাতে যেন তানপুরায় অহল্যা-স্পর্শ, অন্যটি শূন্যে, ‘নাজুক’ হাওয়ার পাঁজর ছুঁয়ে মেপে নিচ্ছে ভাসিয়ে দেওয়া সুরগুলির অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। যেন এক অনন্ত ‘ইবাদত’।
কিন্তু সে ধ্যানও ভাঙে। কিসের যেন হইচই! আবার দাঙ্গা শুরু হল না কি! বাইরে এত হইহল্লা, চিৎকার কিসের? রেওয়াজের সময়ই যত রাজ্যের ‘না-মুরাদ’গুলো এসে জোটে? সুর কেটে যায় বাঈয়ের। সারা মুখ জুড়ে তার বিষাদ-বিরক্তির গন্ধ। সাধনায় বাধা পড়ে। তানুপরা গোঁসা করে গড়িয়ে পড়ে। কিসের এত ‘শোর-শারাবা’! দেখতে উঠে আসেন তিনি। এক চিলতে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। রাগে গজরাতে থাকেন। চিৎকার করে বলতে চান—”বন্দ করো ইয়ে সব”! তখনই আক্রমণাত্মক সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে উড়ে আসে একটা পাথর। সপাটে লাগে তার মাথায়। মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে আসে চারপাশ। ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠেন—”ইয়া আল্লাহ”! কালচে রক্ত গড়িয়ে পড়ে লখনৌয় চিকনে। সব রাগরাগিনী মুহূর্তে যমুনার কালো জলে তলিয়ে যায়। তাকিয়ার উপর গড়িয়ে পড়ে সরদারী বাঈ’-এর নিস্পন্দ দেহ।
মেয়ে সাকিনা যতক্ষণে এসে তার আম্মির রক্তে ভেসে যাওয়া দেহ কোলে তুলে নেয়, ততক্ষণে এই পৃথিবীর সব সুর হারিয়ে গেছে সরদারী মহলের ঘন, কালো বেবাক অন্ধকারে…
শ্যাম বেনেগলের ‘সরদারী বেগম’ (১৯৯৬) প্রথম দেখি দূরদর্শনে। বহু বছর আগে। আখতারি বাঈ ফৈজাবাদী বা আমরা যাকে বেগম আখতার নামে চিনি, তাঁর জন্মতিথি উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ টেলিকাষ্টে। এরপরেও বহুবার মুখোমুখি হয়েছি ‘সরদারী’র, কিন্তু সেই মৃত্যুদৃশ্যটি আজও ভুলতে পারিনি।
যতবার দেখেছি, ততবার প্রশ্ন করেছি নিজেকে ‘কে এই সরদারী’? এক সময় মনে হয়েছে ভারতীয় সংগীতের ‘বেগম’ বলতে যাকে বোঝায়, সেই আখতারী বাঈ ফৈজাবাদী বা বেগম আখতার নয় তো এর নেপথ্যচারিনী। কী অদ্ভুত মিল তাঁর জীবনের সঙ্গে। পরে অবশ্য সেই ভুল ভেঙেছে! সিনেমাটির চিত্রনাট্য ও কাহিনিকার খালিদ মহম্মদ পরবর্তীকালে তার এক বিশেষ সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, তারই দূর-সম্পর্কের দুই আত্মীয়াকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘মাম্মো’ ও ‘সরদারী বেগম’-এর গল্প। ভারতীয় আর্ট ফিল্মের ইতিহাসে দুটি সিনেমাই বহুচর্চ্চিত ও একইসঙ্গে দুটি চরিত্রের নামভূমিকায় অভিনয় করে নজর কেড়েছিলেন ফরিদা জালাল ও কিরণ খের। অর্থাৎ ‘সরদারী’ কোনও কাল্পনিক কথন নয়, সত্যি ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। কিরণ খের, রাজেশ্বরী সচদেব, অমরিশ পুরী, রজিত কপুর ও সুরেখা সিক্রি-র অভিনয়ের পাশাপাশি মাইলস্টোন গড়ে ছিল ‘সরদারী বেগম’ বনরাজ ভাটিয়া-র সংগীত ও জাভেদ আখতারের কলমে। জন্ম নিয়েছিল অবিস্মরণীয় কিছু গজল, ঠুংরি ও লঘু শাস্ত্রীয় সংগীতের বিদ্যুৎঝলক।
সিনেমাটিতে ব্যবহৃত হয়েছিল দশটি গান। দশটি অসামান্য কম্পোজিশন। অধিকাংশ গানই গেয়েছিলেন জয়পুর-আতরৌলি ঘরানার আরতী আংকলিকর-টিকেকর ও শুভা যোশী। ‘চাহে মার ডালো’ ও ‘মোরে কানহা’ দুটি গানে আশা ভোঁসলে ‘স্বর্গীয়’। প্রত্যেকটি গানই, বলা ভালো গজল ও ঠুমরি শ্রোতাদের ঋদ্ধ, সমৃদ্ধ করেছিল।
এর মধ্যে নন্দ রাগে ‘ঘর নাহী হমরে শ্যাম’, নট মলহারে ‘ঘির ঘির আই বদরিয়া’ ও বিশেষ করে ভৈরবীতে ‘চলি পি-কে নগর’ গান তিনটি আজও আমাদের মুগ্ধ করে। পরের বছর ‘সরদারী’ ৪৪তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মঞ্চে তিন তিনটি পুরস্কার জিতলেও অদ্ভুতভাবে সংগীতের জন্য কোনও পুরস্কার পাননি বনরাজ ভাটিয়া। আমার কাছে তা আজও বিস্ময়। সংখ্যায় অল্প হলেও, আজও কিন্তু সংগীত পিপাসু দর্শকেরা বিস্মিত ও আবেগমথিত হয়ে স্মরণ করেন ‘সরদারী বেগম’কে। কারণ, শুধু মাত্র অভিনয় বা সংগীত নয়, ‘সরদারী বেগম’ সেই সময়কার মহিলা সংগীতশিল্পীদের হারানো গৌরব ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে তাদের অস্তিত্বরক্ষার অবিস্মরণীয় লড়াইয়ের ইতিহাস তুলে ধরেছিল। তুলে ধরেছিল সেই সব ক্ষণজন্মা, সরস্বতীর মানসপুত্রীদের, সমাজ যাঁদের ‘বাঈ’ বা ‘তওয়াইফ’ বলে দূরে ঠেলে দিয়েছিল।
শেষ করি, সিনেমার শেষ দৃশ্যটি নিয়ে। দাঙ্গার আঘাতে সরদারী তখন অস্তাচলে। তাঁর ‘মকামে’র ভার নিয়েছেন তার একমাত্র মেয়ে সাকিনা, যে মায়ের গানের জগত থেকে একদিন সরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। হারিয়েছে তার নিজস্ব কিছু স্বপ্ন, ভালোবাসার মানুষ, নিজস্ব পৃথিবী, ঘর সংসার আর যা কিছু একটা সাধারণ মেয়ে তার জীবনের কাছে আশা করে থাকে। কিন্তু আজ সে একা। সম্বল বলতে শুধু মায়ের শেখানো সুরের বিদ্যা। তাই মাথায় নিয়ে সেও রেওয়াজে বসেছে। গাইছে ভৈরবীতে সেই করুণ সুর—’চলি পি-কে নগর’, যা মৃত্যুপথযাত্রী মা, সরদারী বেগমকে শুনিয়েছিল সে। সেই সুর চার দেয়ালের গণ্ডি ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ে রুক্ষ্ম, মাটির পৃথিবীতে। বাইরে পুরোনো দিল্লি, জামা মসজিদ এলাকা। সাইকেল চড়ে চলে যেতে যেতে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ায় একটা মানুষ, যে কিনা তার প্রাক্তন প্রেমিক। মুখ উঁচু করে সে শোনে গান, খানিকক্ষণ। তারপর প্যাডেল মেরে সাইকেল ঠেলে মিশে যায় ভিড়ে। স্বর্গভ্রষ্ট সেই সুর ভোরের প্রথম আলোর মতো হালকা ঢেউ তুলে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র…ঘুমের দরজা ঠেলে আজও আমি সেই সুর ও সাইকেলের চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাই…
কী আশ্চর্য! লেখা শেষ করতে গিয়ে মনে পড়ল আজ ৭ অক্টোবর। আখতারী বাঈ ফৈজাবাদীর ১০৪তম জন্মতিথি। পরোক্ষে আমি যে তাঁরই কথা লিখছি! এ কী অদ্ভুত, অলৌকিক সমাপতন!
শুধু বেগম আখতার নয়, এই অত্যাধুনিক মেকি, রংচড়ানো ও মুখোশ-মানুষদের দুনিয়ায় ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসা কলের গান ও লং প্লেয়িং রেকর্ডের বিস্মৃত, অবহেলিত শাস্ত্রীয় সংগীতের সেইসব অখ্যাতনামা সরদারী বেগমদের সশ্রদ্ধ প্রনাম জানাই এই লেখার মাধ্যমে…
।। অনল হক! অনল হক!।।
উঠেগা অনল হক কা নারা
যো ম্যায় ভি হুঁ, তুম ভি হো—
ঔউর রাজ করেগি খলক-এ-খুদা
যো ম্যায় ভি হুঁ, ঔউর তুম ভি হো…
আমি দেখতে পাচ্ছি তাকে… ঘুমের নিকষ কালো দরজা ঠেলে আমি দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি কুয়াশার সাদা ব্যারিকেড ঠেলে উপড়ে এসেছে ‘সরহদ’…মর্চে, জং ধরা কাঁটাতার।
ঘুমের মধ্যে একটু একটু করে ঢুকে পড়ছে লাহোর। সাল ১৯৮৫। ন্যাশনাল স্টেডিয়াম। হাজার হাজার মানুষের ‘জমাবরা’। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ—কে নেই সেখানে। কত হবে? ৩০…৪০…৫০ হাজার! মনে হয় তারও বেশি।
শত সহস্র কালো কালো মাথাগুলো দুলছে একটু একটু! ঠোঁট কাঁপছে তাদের। চোখ নিবিষ্ট সামনের দিকে। সেখানে মঞ্চ। মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে এক নারী। দূর থেকে যাকে ‘জোয়ান অফ আর্ক’ বলে বারবার ভুল হচ্ছে আমার। আহা! তার খোলা চুলে ঠিকরে পড়ছে আলো সর্বাঙ্গে জড়ানো মূলতানী জরির কাজ করা কালো রঙের শাড়িতে উঠেছে যেন আরব সাগরের ঢেউ। দৃঢ় একটা হাত ধরে আছে মাইক, অন্য হাত মেপে নিচ্ছে আকাশের ‘ওম’! চোখ কখনও বন্ধ, কখনও খোলা। যেন নিভন্ত কোনও আগ্নেয়গিরি জেগে উঠেছে। তিনি গাইছেন—
হাম দেখেঙ্গে!
লাজিম হ্যায় কে হাম ভি দেখেঙ্গে!
উও দিন কা জিসকা ওয়াদা থা…
আমি চিনি তাকে। তিনি ইকবাল বানু।
পাকিস্তানের কিংবদন্তি গজল ও ঠুমরি গায়িকা। কিন্তু এখানে তিনি কোনও মজলিশের ‘শান ও শৌকত’ হয়ে আসেননি। এসেছেন প্রতিবাদের লৌহ-সমান কন্ঠস্বর হয়ে। আমাদের ঘুমন্ত বিবেক জাগাতে।
এসেছেন বর্তমান শাসক দলীয় সরকারের তুঘলকি ফরমানের বিরুদ্ধে সরব হতে। সেই সরকার যা অত্যাচারী সেনানায়ক জেনারেল জিয়া উল হক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
সেই সরকার যা ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দখল করেছে ‘তখত-ই-পাকিস্তান’। বিতর্কিতভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত পাক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো-কে। জারি হয়েছে মার্শাল ল’ জেনারেল জিয়া-র নির্দেশে। এতেই অবশ্য খুশি নন তিনি। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে ঘোষণা হচ্ছে, ‘আজীব-ও-গরীব’ ফরমান। সরকারি মদতে ‘দহশদ-গর্দরা’ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। নিত্যনৈমিত্তিক আইনি বদল, কট্টরপন্থীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে জায়গা নিচ্ছে ‘শরিয়তি’ সিদ্ধান্ত। ইসলামকে হাতিয়ার করে মুক্তমনা, উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে শানানো হচ্ছে সাঁড়াশি আক্রমণ। সাধারণ মানুষের অধিকার নয়, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ তার ‘না-মুরাদ’ আশ্রয়। ধর্মের নামে যত্রতত্র আক্রান্ত হচ্ছেন সাহিত্য-সংস্কৃতিমনস্ক, শিক্ষিত মানুষ। মহিলাদের প্রতিমুহূর্তে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কঠোর নিয়মের অন্ধকূপে। সেখানে প্রশ্ন তোলা বা প্রতিবাদ করা আর ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়ানো সমার্থক। এমনই এক অস্থির, টালমাটাল, অগ্নিগর্ভ পরিবেশে, জিয়া-উল-হক সরকার ঘোষণা করল ‘শাড়ি’ পড়তে পারবেন না মহিলারা। পড়তে হবে সালোয়ার-কামিজ ও হতে হবে বোরখা-আবৃত। শাড়ি নাকি ইসলাম ও পাক-সংস্কৃতিবিরুদ্ধ।
সঙ্গে সঙ্গেই যেন বারুদে হল অগ্নিসংযোগ। প্রতিবাদ, বিক্ষোভের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। শুরু হল এক অলিখিত ‘জেহাদ’, স্বৈরতান্ত্রিক ‘না-পাক’ শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে! এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে লাহোরের জনতাকে আহ্বান করলেন বানু। তার কাছেই রয়েছে সবচেয়ে বড়ো ‘হাতিয়ার’। সেই অস্ত্রের নাম—ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ।
ফয়েজ পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী ও বিতর্কিত বামপন্থী কবি ও বুদ্ধিজীবী। ঠিক এক বছর আগেই যার ‘ইন্তেকাল’ হয়েছে। অথচ তিনি তখনও সমান আদৃত। ফয়েজের ‘নজম’কে অস্ত্র বানিয়েই সেদিন লাহোর স্টেডিয়ামে হাজার হাজার মানুষের সামনে এই গান গেয়েছিলেন বানু। তার সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়েছিলেন পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ। যার অধিকাংশই মহিলা। গানের শেষে লাহোর স্টেডিয়ামে উঠেছিল এক জোড়া শ্লোগান—’ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ আর ‘অনল হক’।
‘অন-অল হক’ অর্থাৎ ‘আমিই সত্য!’ ফয়েজ বলেছিলেন, ”মন্ত্র যেদিন ধ্বনিত হবে ‘আমিই সত্য’, যা আমিও, তুমিও জেনো তা”। কী অদ্ভুত সেই কথা। সত্যিই তো! শাশ্বত সত্যের কাছে সবাই সমান। তার কোনও মাপ-পরিমাপ নেই। কোথাও না কোথাও অলক্ষ্যে ধ্বনিত হয় বৃহদারণ্যক উপনিষদের পাতা থেকে উঠে আসা মহাবাক্য—’অহম ব্রহ্মাস্মি’ (আমিই ব্রহ্ম আমিই সত্য)-র কথা। বাইবেলের ‘রিভিলেশন’ (1:18. KJV) থেকে উঠে আসে “I am he that liveth, and was dead; the truth and the lie and, behold, I am alive for evermore, Amen; and have the keys of hell and of death, I am He.” শতসমুদ্র, সহস্র নদী যেন এক লহমায় এখানে এসে লীন হয়ে যায়। আমার ‘আমি’কে চেনার তাগিদে।
তাই যতবার ইকবাল বানু-র এই গান শুনেছি, যতবার পড়েছি ফয়েজ আহমেদ-এর এই কালজয়ী ‘নজম’ ঠিক ততবারই বিস্মিত হয়েছি, দর্শনের অন্ত্যমিল দেখে। অথচ ‘লাহোর অভিযান’-এর প্রায় ছ’বছর আগে ১৯৭৯ সালে ফয়েজ এই রচনাটি সম্পূর্ণ করেছিলেন। সুরও দিয়েছিলেন নিজেই। পরবর্তীকালে যা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের রণহুঙ্কারে পরিণত হয়। বানু-র উপর এরপরে জারি হয় নিষেধাজ্ঞা। দিল্লিতে জন্মেছিলেন বলে তাকে ‘ভারতের গুপ্তচর’ বলে দাগিয়েও দেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় তার গানের অনুষ্ঠান, রেডিওতে তার গান নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু তাতে থামেননি ইকবাল বানু। গেয়ে গেছেন এই গান সারাবিশ্ব জুড়ে। থামানো যায়নি সাধারণ মানুষকেও। সেই গান রেকর্ড করে লুকিয়ে চুরিয়ে, এমনকি তা ব্ল্যাকেও বিক্রি হয়েছে সারাদেশ জুড়ে। পরের ঘটনা ক্রমেই কালজয়ী ইতিহাস।
‘অনল হক’-এর ইতিহাস হাতড়াতে গিয়ে প্রথমেই যাকে দেখতে পাই, তিনি মালায়লি লেখক ভৈকম মুহম্মদ বশির। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত হওয়া তার গল্প-গ্রন্থ ‘অনর্ঘ নিমিশাম’-এ বর্ণিত একটি ছোটোগল্প ছিল ‘অনল হক’। অবশ্য সে ইতিহাস সংগৃহীত আরও একজনের অনবদ্য জীবনী থেকে। তিনি পারস্যের বিখ্যাত সুফি-সাধক আবু হুইসেন বিন মনসুর আল হালাজ। ৮৫৮ অব্দে পারস্যের ফারসা প্রদেশে তার জন্ম। ছিলেন চন্দ্রাহত, দিব্যোন্মাদ পুরুষ। বর্ণময় তার জীবন। ১২ বছর বয়সে কন্ঠস্থ করেছিলেন কোরান। করেছেন অতীন্দ্রিয় চর্চা। পাঠ নিয়েছেন সেই সময়কার বাগদাদের বিখ্যাত সুফি সাধক ও শিক্ষক জুনেইদ বাগদাদি-র কাছে। সাধনার তাগিদে দু’দুবার ছুটে গেছেন পবিত্র শহর মক্কায়। প্রথমবার, মক্কায় ‘ম্যভলভী’ সুফিদের সংস্পর্শে এসে করেছেন কঠোর সাধনা। ‘অনাদিঅন্ত’-কে জানার চেষ্টায় করেছেন কৃচ্ছসাধন। নিয়েছেন মৌনতা। উপবাস করেছেন টানা একবছর। হয়েছেন গিরিগুহাবাসী। ফিরে এসে প্রচার করেছেন ঐশ্বরিক জ্ঞানের বাণী। দ্বিতীয়বার, ৪০০ শাগরেদ নিয়ে পুনরায় ছুটে গেছেন ‘কাবা’ দর্শনে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ওঠে কালা জাদু, অতীন্দ্রিয়বাদ ও অতিমানবিক কর্মকাণ্ড পৃষ্ঠপোষকতার মিথ্যা অভিযোগ। নানাবিধ কালোবিদ্যায় তিনি নাকি পারদর্শীতা লাভ করেছিলেন। আসলে ঈশ্বরের দর্শন পেতে তিনি তখন ‘ভাবোন্মাদ’। তার জন্য নিজেকে ‘ফনাহ’ করতেও দ্বিধা নেই। ইরান, ইরাক, দামাস্কাস, সিরিয়া জুড়ে সেই কথা প্রচার করেন তিনি। পান প্রবল জনপ্রিয়তা ও সাধারণ মানুষের হৃদয়ের সান্নিধ্য। তার দিব্যোন্মাদতা তাকে ঈশ্বরীয় ক্ষমতার কাছে আনে। হয়েছিল মনোবিকারও। অদ্ভুত সেই ঘোর। একদিন যখন ‘শাগরিদ’-দের কাছে ঈশ্বরিক মাহাত্ম্যকথা বলছিলেন, তখনই তার ‘ভর’ হয়। বিকারগ্রস্তের মতো ”অনল হক! অনল হক” বলে চিৎকার করে উঠে ছোটাছুটি করতে থাকেন। কখনও কাঁদতে থাকেন, কখনও হাসতে থাকেন। আর মুখে তার একটাই কথা—”অনল হক!”
আল হালাজ-এর মুখে ”অনল হক” শুনে খেপে ওঠে সমাজের মাতব্বরেরা, যাদের অধিকাংশই কট্টরপন্থী মল্লাহ। তাদের দাবি, আল হালাজ এখন নিজেকেই ‘ঈশ্বর’ ভাবতে শুরু করেছে। এ তো ভয়াবহ অপরাধ! তাকে শাস্তি দিয়ে সমাজের কাছে কঠোর দৃষ্টান্ত রাখতে হবে, যাতে ‘আল্লাহ’র সমকক্ষ হওয়ার ধৃষ্টতা কেউ না করতে পারে। দুর্ভাগ্য, তাদের বোঝার ক্ষমতা নেই সাধনমার্গের কোন উচ্চাতিউচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে আল হালাজ নিজেকে সেই ‘অখন্ড সত্যে’র অংশ বলে মনে করেছেন। তাই রাতারাতি বসল সালিসি সভা। আটক করা হল আল হালাজ-কে। নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে। বহাল হল সর্বসমক্ষে মৃত্যুদণ্ডের বিধান। ইংরিজির ২৫ মার্চ ৯২২ অব্দে ঢ্যারা পিটিয়ে ঘোষণা করা হল তার ফাঁসির সাজা। পরদিন বাগদাদে টাইগ্রিস নদীর ধারে আল হালাজ-এর মৃত্যুদণ্ড দেখতে উপচে পড়ল হাজার হাজার মানুষ। নিয়ে আসা হল হালাজ-কে বধ্যভূমিতে। তার হাতে পায়ে শিকলের বেড়াজাল। প্রিয় সাধকের এই অবস্থা দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি তার ঘনিষ্ঠজন, শাগরেদ, গুণগ্রাহীরা। অথচ কোনও দুঃখ-শোক-ভয়-মনস্তাপের লেশ নেই হালাজ-এর মুখে। অপার্থিব এক হাসির রেখা ছুঁয়ে আছে তার ঠোঁট। এল সেই সময়। মাতব্বরেরা এগিয়ে এসে শোনায় তার ‘অধার্মিক’ কর্মকাণ্ডের দীর্ঘ অভিযোগের কিসসা। অথচ মুখে কোনও বিকার নেই আল হালাজ-এর। ভাষণের মাঝেই তিনি বলেন, ”তাড়াতাড়ি করো, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তিনি অপেক্ষায়।” এই কথা শুনে এগিয়ে আসে ঘাতক। ঘুষি মারে তার মুখে। উন্মাদের মতো চালাতে থাকে চাবুক, যতক্ষণ না অজ্ঞান হয়ে যান হালাজ। তারপর তাকে ঝোলানো হয় ফাঁসিকাঠে। এতেও রাগ মেটেনি তাদের। মৃত হালাজ-এর দেহে মাটির তেল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পরে তার ছাই ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল ট্রাইগ্রিসে। কথিত আছে, টাইগ্রিসের ধারে সে দিন হালাজ-এর ‘শাগরিদ’রা ধ্বনি তুলেছিলেন ”অনল হক! অনল হক!” হতভম্ব হয়ে সেই উন্মাদনা দেখেছিলেন মোল্লা সমাজের প্রতিনিধিরা। পরে বাগদাদ ছেড়ে হালাজ-এর বাণী প্রচারে তারা ছড়িয়ে পড়েন তুর্কিস্তান, ইরান, আফগান হয়ে ভারতে।
ঘুমের ঘন কুয়াশা আবারও ঢুকে পড়ছে ঘরে, মাথার ভিতর, মস্তিষ্কের কোষে কোষে। সেই অপার সমুদ্রে তলিয়ে যেতে যেতে দেখি মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন আল হালাজ। তার গলায় ফাঁসির দাগ, পোড়া শরীর, অথচ মুখে সেই স্মিত হাসি যা দেখেছি গতজন্মে টাইগ্রিসের ধারে। ক্রমেই সেই মুখ ধোঁয়ায় মিলিয়ে গিয়ে একে একে উঠে আসেন ভৈকম মুহম্মদ বশির, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, ইকবাল বানু। একবার তারা শূন্যে মেলান, পরক্ষণেই ফিরে আসেন।
ক্রমেই দেখতে পাচ্ছি সবার অলক্ষ্যে একে একে উঠে এসেছেন কালবুর্গী, পানসারে, গৌরী লঙ্কেশ। সারি বেধে উঠে দাঁড়িয়েছেন তারা আমার ঘুম আর জাগরণের মধ্যবর্তী অঞ্চলের শূন্যতায়।
ঘুমের আরব্য সাগরে তলিয়ে যেতে যেতে…শেষবারের মতো…আমি দেখতে পেলাম, তাদের প্রত্যেকের ঠোঁটের ভাঁজে রাখা সেই অমোঘ বীজমন্ত্র—
”অনল হক! অনল হক!”
।। কেসরিয়া বালমা।।
সে অনেকদিন আগেকার কথা। এক যে ছিল দেশ। থর মরুভূমির পাশে, রাজপুতানা। দেশের মধ্যে ছিল দেশ। সে দেশের নাম নারওয়ার। সেই দেশে বৃষ্টি হত না একদম। সারাদেশ এক্কেবারে শুকিয়ে চ্যালাকাঠ, ফুটিফাটা। চারদিকে ছিল শুধু ধু ধু মরুভূমি আর কাঁটাঝোপের জঙ্গল। খুব কষ্টে ছিল সেই দেশের লোকেরা। তবুও তারা হাসত, গাইত, রুখা-শুখা মরুভূমির বুকে চাষবাস করে দিন কাটতো। তারা ছিল বীর যোদ্ধাদের বংশজ। যতই কষ্টে থাকুক না কেন, হাতে তরবারি থাকলে তারা ভগবানের বিরুদ্ধে লড়তেও ভয় পায় না।
সেই দেশে ছিল এক রাজা। রাজার নাম নল। তার রানি দয়মন্তী। তাদের ছিল এক ছেলে, নাম ঢোলা। ভোলা নয়, ঢোলা। ঢোলক থেকে রাখা হয়েছিল কিনা কে জানে! রাজা-রানির চোখের মণি ছোট্ট রাজপুত্তুর ঢোলা। রাজার বন্ধু পুগলরাজ। তা সেই পুগলরাজের ছিল এক সুন্দরী রাজকন্যে, নাম মারু। ঢোলা আর মারু দু-জন হরিহর আত্মা। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারত না। দু-জনেই দুজনকে ছোটোবেলা থেকে ভীষণ ভালোবাসতো। যাকে বলে বেস্ট ফ্রেন্ড। তা ঢোলা-মারুর বাবা’রা, মানে দুই দেশের দুই রাজা ঠিক করলে, তাদের বিয়ে দেবে। ব্যাস! যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ওটুকুনি বয়সেই বিয়ে হল ঢোলা আর মারুর। তারা তো বেজায় খুশি। এবার থেকে সারাদিন পড়াশোনা শিকেয় তুলে একসঙ্গে খেলা করতে পারবে, উট ছোটাতে পারবে, মরুভূমির বুকে খুঁজতে যাবে পুরোনো কেল্লা। কিন্তু বাধ সাধলো মারুর বাবা পুগলের মহারাজা। বিয়ে না হয় হল, কিন্তু পড়াশোনা করে মানুষ হতে হবে তো, দেশের হাল সামলাতে হবে যে রাজা বুড়ো হলে। তাই মেয়েকে নিয়ে হিড়হিড় করে টানতে টানতে তিনি ফিরে এলেন নিজের রাজ্যে। ওদিকে প্রিয়বন্ধুকে হারিয়ে ঢোলার মনখারাপ। মারু তো কেঁদেকেটে ফুলিয়ে বসল চোখ। ঢোলাকে ছেড়ে আসার আগে বন্ধুত্বের, ভালোবাসার চিহ্ন রূপে মারু তাকে দিয়ে গেল গেরুয়া রংয়ের একটা কাপড়, ওদেশে তাকে বলা হয় ‘কেশরিয়া রং’। চোখের জল মুছে উটের পিঠে চড়ে বাবার কোলে বসে মারু ফিরে গেল নিজ রাজ্য পুগলে। দূর থেকে কেল্লার মাথায় চড়ে মারুর সেই চলে যাওয়া দেখল ঢোলা। কষ্ট হয়েছিল খুব, কিন্তু সে কাঁদেনি। রাজপুতদের চোখে কেউ জল দেখেনি কখনও।
এদিকে দিন যায় রাত যায়। সময় গড়ায়। ঢোলা-মারু দুজনই এখন যুবক যুবতী। মারু আজও ভুলতে পারেনি ঢোলাকে। কিন্তু ঢোলা ভুলে গেছিল মারুকে। ইতি মধ্যেই প্রয়াত হয়েছেন রাজা নল। দেশ চালানোর ভার এখন কুঁওর ঢোলা সিং-এর কাঁধে। সে অনেক ঝক্কি। রাজা মারা যেতেই ঘন ঘন বিদ্রোহ, অন্য রাজাদের আক্রমণ ঠেকানো, রাজপাট চালানো সব নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলার জো নেই রাজকুমার ঢোলার। এর মাঝে কোথায় যেন হারিয়ে গেল তার ছোটোবেলার ভালোবাসা—মারু। সে ভুলেই গেল তাকে। একদিন মায়ের নির্দেশে পাশের রাজ্যের রাজকন্যা মালওয়ানীকে বিয়েও করল ঢোলা। সেই খবর শুনে খুব কষ্ট পেল মারু। সেও তো তার স্ত্রী! আর সে বেঁচে থাকতে কীভাবে এই বিয়ে সম্ভব? ঢোলাকে সব পুরোনো কথা জানিয়ে চিঠি লিখতে শুরু করল মারু। কিন্তু সেই চিঠি কোনদিনও পৌঁছায়নি ঢোলার কাছে। রানি মালওয়ানী ঢোলা-মারুর এই প্রেমকাহিনি জানতেন। ঢোলা যাতে মারুকে ফিরে না পায় সেই জন্য সব চিঠি তিনি লুকিয়ে ফেলেন। অন্য দিকে, পুগলের সেনাপতির লম্পট ছেলে উমর সুমার মারুর প্রেমে পাগল। মারু তাকে পছন্দ করে না। তার জীবনে ঢোলা ছাড়া অন্য কেউ নেই। উমার সুমার সে সব বোঝে না। সে জোর করে মারুকে বিয়ে করতে চায়। মারু রেগে গিয়ে তাকে পুগল থেকে নির্বাসিত করে। মারুর উপর রাগে-দুঃখে ও অপমানের বদলা নিতে উমার সুমার হাত মেলায় রানি মালওয়ানীর সঙ্গে। দুজনের একটাই উদ্দেশ্য, ঢোলা আর মারুকে যেভাবেই হোক আলাদা করে রাখা।
এভাবেই কাটছিল দিন। কাটছিল মাস, বছর। ঢোলাকে না পেয়ে তখন মারু উন্মাদিনী। কিন্তু ঢোলাও তো মনে রাখেনি তাকে। তবু মারু আশা ছাড়েনি। সে বিশ্বাস করে একদিন ঢোলা ফিরে আসবে তার কাছে। একদিন মারু কেল্লার উপর ঘুরে ঘুরে ঢোলার কথা ভেবে মনের দুঃখে গান গাইছিল। ভারি করুণ তার সুর। সেই সুরের রেশ ছড়িয়ে পড়ল সারা পুগলে। এক সময় বানজারাদের একটা দল এল নারওয়ারে। রাজা ঢোলা সিংয়ের দরবারে গাইল তারা সেই গান। যে গানে মিশে আছে, ঢোলা-মারুর আখ্যান। সে গান শুনে মারু-র কথা মনে পড়ে যায় ঢোলার। এতদিন পর মারুর কথা মনে পড়ায় সে পাগল হয়ে ওঠে। ছুটে বেরিয়ে পড়ে পুগলের উদ্দেশ্যে। যেভাবেই হোক তাকে যে তার মারু-র কাছে পৌঁছাতে হবে। রানি মালওয়ানী তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে বিফল হয়। তার ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেয় বানজারারা। ঢোলা রানি মালওয়ানীকে তাড়িয়ে দেয়। এমনকি উমর সুমার দস্যু দিয়ে ঢোলা সিংকে প্রাণে মারার চেষ্টা করে। কিন্তু ঢোলা সিংয়ের বিক্রমের কাছে তারা হার মানে। অবশেষে অসংখ্য বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ঢোলা পৌঁছায় পুগলে। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর মিলন হয় ঢোলা-মারুর।
গল্প এখানেই শেষ নয়। মারুকে নিয়ে নিজের রাজ্য নারওয়ারে ফিরে চলে ঢোলা। দুজনেই খুব খুশি। কিন্তু বাধ সাধে বিশ্বাসঘাতক উমর সুমার। পথযাত্রায় ক্লান্ত ঢোলা-মারু যখন রাতে ঘুমিয়ে, সেখানে বিষাক্ত সাপ ছেড়ে দেয় সে। সেই সাপ কামড়ায় মারুকে। বিষের প্রভাবে ছটফট করতে করতে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ে মারু। ঘুম ভেঙে উঠে মৃত মারুকে দেখে শোকে দুঃখে পাগল হয়ে যায় ঢোলা। সে ঠিক করে মারুর সঙ্গে সেও সহমরণে যাব। হবে প্রথম ‘পুরুষ সতী’। চিতাকাঠ সাজিয়ে মৃত মারুর দেহ কোলে নিয়ে যেই মুহূর্তে আগুন ধরাতে যাবে ঢোলা, সেই মুহূর্তে উদয় হয় এক সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনী। তারা ঢোলাকে ‘সতী’ হতে নিষেধ করে ও বলে তারা মৃতের শরীরে প্রাণ ঢালার কৌশল জানে। তবে তার জন্য ঢোলাকে তার অর্ধেক প্রাণ মারুকে দিতে হবে। এককথায় রাজি হয়ে যায় ঢোলা। একথা শুনে তারা মৃত মারুর মাথার কাছে বসে একটি তারের যন্ত্র (রাবনহত্তা) বাজিয়ে গান ধরে। অদ্ভুত তার সুর। এ সেই সুর যা ঢোলার বিরহে কেল্লায় ঘুরে ঘুরে গাইত মারু। এ সেই সুর যা দরবারে গেয়ে ঢোলার স্মৃতি ফিরিয়ে আনে বানজারারা। সে সুরের এমন জাদু, চোখ মেলে মারু। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে জীবনে। অবশেষে ফিরে আসে তার চিরকালের ভালোবাসার মানুষ ঢোলার কাছে। তাদের ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী তাদের এক পক্ষীরাজ উট উপহার দেয়। তারা আশীর্বাদ করে বলে, আজ থেকে সারা দেশে ঢোলা-মারুর এই প্রেমাখ্যান অমর হয়ে থাকবে। এই উট তাদের সবসময় রক্ষা করবে বিপদ আপদ থেকে। আর সেই গান সেই সুর গোটা থর মরুভূমির বুকে নিয়ে আসবে ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের ধারাজল। যুগ যুগ ধরে সেই সুর বহন করবে রাজপুতদের শৌর্য, বীর্য, বলিদানের পাশাপাশি ভালোবাসা ও ত্যাগের অমর নিদর্শন। এই বলে সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী অন্তর্হিত হন। ‘উড়ন্ত’ সেই উটের পিঠে চেপে ঢোলা ও মারু উড়ে যায় তাদের চিরকালীন ভালোবাসার দেশে।
ছোটোবেলা থেকে দাদুর কাছে ঢোলা-মারুর এই কিংবদন্তি আখ্যান শুনে বড়ো হয়েছিল জিলাই। পুরো নাম আল্লাহ জিলাই বাঈ (১৯০২-১৯৯২)। শিখেছিলেন সেই অসাধারণ গান। তালিম নেন প্রখ্যাত খেয়াল গায়ক উস্তাদ হুসেইন বকশখ খান ও অচ্ছন মহারাজ-এর কাছে। মাত্র দশ বছর বয়সে বিকানীরের দরবারে তার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন রাজা গঙ্গা সিংজি মহারাজ। আর পিছনে ঘুরে দেখেননি জিলাই। সেই ‘কেসরিয়া বালাম’ গেয়েই হয়ে উঠেছিলেন ভারতবিখ্যাত। ১৯৭২ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হওয়ার পরেও অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে এই গানই পরিবেশন করেন তিনি। পরবর্তীকালে সেই গান, যা দেশ-কাল-সীমানার যাবতীয় গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে ওঠে রাজপুতানার রক্তের টান, বেঁচে থাকার আবেগ ও ভালোবাসার শাশ্বত সংলাপ। আজও যা অক্ষত, অজর, অমর!
।। বিলাসখানি টোড়ি।।
পিঠালা সো মজলিশ গয়ি, তানসেন সো রাগ
হাসিবো, রামিবো, বলিবো—গয়ো বীরবরা সাথ।
সাল ১৫৮৬। এপ্রিল ২৩। প্রয়াত হলেন মিঁয়া তানসেন। শেষ হল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ইতিহাসের এক স্বর্ণালী অধ্যায়। তাঁর প্রয়াণ-তিথির আজও সঠিক হদিস পাওয়া যায় না। যেমন জানা যায় না তাঁর সঠিক জন্মতিথিও। এমনকি, তানসেন কীভাবে প্রয়াত হলেন সে নিয়েও রয়েছে বহু মতভেদ।
কেউ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গাইতে গাইতে গলায় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ক্ষত বিষিয়ে গিয়েই। অনেকে বলেন, রাগ বাচস্পতি গাইতে গিয়ে শ্বাস আটকে মারা যান তিনি। আবার অনেকের মতে, তার মৃত্যুর কারণ স্বয়ং বাদশা আকবর। শেষোক্ত কারণটিই বহুল চর্চিত।
রাগ দীপক শোনার জন্য ছেলেমানুষি বায়না ধরে ছিলেন বাদশা। বড়ো ভয়ানক সে রাগ। সে রাগের সঠিক প্রয়োগে শুধু প্রদীপের জ্বলে ওঠা নয়, খোদ গায়কেরও অগ্নিদগ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে পুরোমাত্রায়। তাই প্রথমে অরাজি হলেও, পরে নিজের অন্নদাতা জালালুদ্দিনের আবদার রাখতে গিয়ে দীপক রাগের প্রভাবে অগ্নিদগ্ধ হন তানসেন। মেয়ে সরস্বতী (মতান্তরে সংগীতাচার্য স্বামী হরিদাসজীর ছাত্রী রূপা) বাপের নির্দেশে মেঘ মলহার গেয়ে বৃষ্টি নামিয়ে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছিল! আজ সে সব কিংবদন্তি।
কারণ যাই হোক, প্রায় আশি বছর বয়সে দেহ রাখলেন আকবরের নবরত্নসভার অন্যতম রত্ন মিঁয়া তানসেন। সেই শোকে পাথর হয়ে গেলেন আকবর। একমাস ধরে শোকপালনের ফরমান জারি হল তামাম মুঘল রিসায়তে। তানসেনের ‘জনাযা’য় গোটা আগ্রার পাশাপাশি সামিল হলেন শাহেনশাহও। কিন্তু এরপরেই শুরু হল সেই বিতর্কিত অধ্যায়।
তানসেনের শেষকৃত্য কিভাবে সম্পন্ন হবে তা নিয়ে শুরু হল ব্যাপক বিক্ষোভ। বেঁকে বসলেন হিন্দু সমাজের একশ্রেণির মাতব্বরেরা। তারা ঘোষণা করলেন, তানসেন হিঁদুর ঘরের ছেলে। নাম রামতনু মিশ্র, পিতা মুকুন্দ মিশ্র (মতান্তরে মকরন্দ পাণ্ডে) ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ও সুগায়ক। জনৈকা মুসলিম রমণী (তানসেনের স্ত্রী হুসেইনি বেগম)-র চক্করে পড়ে ধর্ম পরিবর্তন করলেও, তার শরীরে বইছে হিন্দুর রক্ত। তাই তাঁর শেষকৃত্য হিন্দুশাস্ত্র মতেই হওয়া উচিত।
কিন্তু এ তত্ত্ব মানতে নারাজ ইমাম-মৌলবীরা। তারা বললেন, আগে কী ছিলেন তা বড়ো কথা নয়, ধর্ম বদল করে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন তানসেন। ছিলেন পাঁচ রোজের ‘নামাজি’। তাই ইসলাম মতেই পালন করা হোক সুরসম্রাটের শেষ যাত্রা। তানসেনের শেষকৃত্য নিয়ে রীতিমতো শুরু হয়ে গেল দক্ষযজ্ঞ, প্রবল তর্কাতর্কি।
বলাবাহুল্য, বেকায়দায় পড়লেন আকবর। কোনও পক্ষকেই চটাতে চান না তিনি। একেই দীর্ঘদিনের সুহৃদ তানসেনের মৃত্যুতে তিনি শোকাহত, তার উপরে এমন জটিল পরিস্থিতি, এহেন অবস্থায় খোদ আকবরও বিপর্যস্ত। তানসেন-এর শেষকৃত্য নিয়ে দাঙ্গা বেঁধে যাওয়ার উপক্রম। এমন সময়ে আসরে নামলেন তানসেন-এর মেয়ে সরস্বতী। বলে রাখা ভালো, তানসেনের ছিল পাঁচ সন্তান—হামীরসেন, সুরটসেন, তানরস খান, সরস্বতী দেবী ও বিলাস খান। এরা প্রত্যেকেই উচ্চমানের গায়ক ও বীণাবাদক। পাঁচ সন্তানের মধ্যে মেয়ে সরস্বতীর উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতেন তানসেন। সেই সরস্বতী বললেন, তার মৃত্যুর পর যে এহেন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা ঠিকই আঁচ করেছিলেন তানসেন। তাই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা নিয়ে দিয়ে গেছেন বিস্ময়কর নির্দেশ। আর সেই নির্দেশ হল—গান। যে গায়ক তার গানের প্রভাবে তানসেন-এর মৃত শরীরে সামান্য হলেও প্রাণের সঞ্চার করতে পারবেন, তার ধর্মানুসারেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে আকবরের নবরত্নের অন্যতম এই রত্নটির। অর্থাৎ কিনা জীবনের শেষ অধ্যায়টির বিচার হবে সংগীত দিয়ে। একেই বলে ‘পোয়েটিক’ থুড়ি ‘মিউজিকাল জাস্টিস’।
অবাক হলেন আকবর। এ কী অসম্ভব কাজ! গান গেয়ে মৃতের শরীরে প্রাণের সঞ্চার কখনও সম্ভব নাকি? আশ্বস্ত করলেন তানসেন দুহিতা—হ্যাঁ সম্ভব! ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে রয়েছে সে গুণ। দরকার আধ্যাত্মিক সাধনা, সুরজ্ঞান ও আন্তরিক পরিবেশনের। বলাবাহুল্য, প্রস্তাবের সার্থকতা নিয়ে সন্দিহান হলেও অসম্ভব এই প্রস্তাবটি শেষপর্যন্ত মনে ধরে আকবরের। অবাক কাণ্ড, হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মাতব্বরেরাও একমত হলেন এই প্রস্তাবে। সংরক্ষণ করা হল তানসেন-এর মরদেহ। তারপর শুরু হল সেই রুদ্ধশ্বাস গানের লড়াই। মৃতসঞ্জীবনী সুরসুধার সন্ধানে, যা এক কথায় ছিল অসাধ্যসাধন। কারণ, তানসেনের পরবর্তী এমন কোনও গায়ক সে সময় ছিল না তামাম হিন্দুস্থানে যে কিনা এমনই ঐশ্বরিক ক্ষমতাধারী যার সুরের জাদুতে মৃতের শরীরেও প্রাণের সঞ্চার ঘটতে পারে। তবু সে সময় নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই শুরু হল গান।
তিনদিন, তিনরাত দেখতে দেখতে অতিক্রান্ত। সম্রাটের আমন্ত্রণে সারাদেশ থেকে আগত সেরা গায়করা ভিড় জমিয়েছেন আগ্রার দরবারে। দিনরাত ধরে পালা করে চলছে ওস্তাদি গান। ওদিকে ফুল, আতর, বরফ আর ঔষধি দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে তানসেন-এর মরদেহ। মনে হচ্ছে যেন পরম নিশ্চিন্তে তিনি ঘুমিয়ে রয়েছেন, এক্ষুনি জেগে উঠে তানপুরার তার বেঁধে রেওয়াজে বসবেন তার গুরু হরিদাস স্বামীর সৃষ্ট ‘বৃন্দাবনী সারঙ্গ’ রাগে। ওদিকে গান গেয়ে গেয়ে জেরবার দেশের তাবড় তাবড় গওয়াইয়ারা। তিনদিন ধরে সুরের বন্যা বয়ে গেল রাজ দরবারে, অথচ নিস্পন্দ তানসেন। তার মৃত শরীরে স্পন্দনের কোনও লক্ষণ নেই। এত কিছু করেও কি তবে সব আয়োজন ব্যর্থ হতে চলেছে? এমনকি কোনও গায়ক সত্যিই নেই ভূ-ভারতে, যে কিনা তানসেনের সমান ওজস্বী? নেই কি তানসেনের সমকক্ষ কোনও সুরসাধক যে কিনা এই অসাধ্যসাধন করতে পারে? বলাবাহুল্য হতাশ হয়ে পড়লেন আকবর।
এপ্রিল ২৬। সাল ১৮৫৬। ভোরের আলো ফুটতে তখনও দেরি। একটু একটু করে সরছে রাতের পরদা। ধীর পায়ে রাজদরবারে এসে দাঁড়ালেন এক দীন ফকির। বললেন, তিনি একবারটি চেষ্টা করতে চান। চালচুলোহীন সেই ফকিরের কথা শুনে তো হেসে কুটিপাটি সভাসদরা। তামাম হিন্দুস্তানের নামজাদা ওস্তাদেরা যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন এই ফকির সেখানে কী চমৎকার দেখাবেন? ফকির কিন্তু অনড়। শেষ চেষ্টা করে দেখতে তিনি যেন মরিয়া। তাঁর উজ্জ্বল দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে সায় দিলেন আকবর। তানসেন-এর পায়ের কাছে বসে ফকির শুরু করলেন গান। আর কী আশ্চর্য! মুহূর্তে যেন পালটে গেল গোটা পরিবেশ। অজানা সেই রাগের অপার্থিব সুরের অদ্ভুত মায়াজালে আচ্ছন্ন হলেন সকলে। ভোরবেলায় সেই রাগের এমনই মাধুর্য, যেন সকাল এর জন্যেই অপেক্ষা করে বসেছিল। সেই রাগ কেউ কখনও শোনেনি। কেউ কখনও ভাবেনি এমনও গান হয়। কী গায়কি, কী তালিম, কী সুর—প্রতিটি চলনে সবাই মুগ্ধ, বিস্মিত এমনকি যেন হারিয়ে ফেলেছেন মুখের ভাষা। এমন সময় দেখা গেল সেই অদ্ভুত দৃশ্য। অজ্ঞাত সেই ফকিরের গানে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে রাজসভায় শায়িত মিঁয়া তানসেন-এর নিস্পন্দ শরীরে। ফকির ভাবলেশহীন, তন্ময় হয়ে গেয়ে চলেছেন। যেন পরম করুণাময় ঈশ্বরের সাধনায় লীন হয়ে গেছে তাঁর সকল সত্ত্বা, বোধ, জাগরণ। এরপর অবলীলাক্রমে যখন একটি অসাধারণ গমক নিলেন সেই ফকির, সকলেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলেন মৃত তানসেন-এর ডান হাতটি কাঁপছে। দেখা গেল সেই অজ্ঞাত গায়কের দিকে তর্জনী নির্দেশ করছে তানসেন-এর ডানহাত। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন সময় থমকে গেল। তারপর সব শেষ।
ধন্য ধন্য পড়ে গেল রাজসভায়। সবাই আপ্লুত চোখে তখন সেই ফকিরের দিকে তাকিয়ে। গান শেষ করে মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়ালেন ফকির। অদ্ভুত প্রশান্তি তার মুখে। সকলের মুখে তখন একটাই প্রশ্ন—কে এই ফকির? ইনি তো কোনও সাধারণ মানুষ নন! খোদ বাদশাহ আকবর পর্যন্ত বিস্ময়ে হতবাক। কিন্তু নিজের পরিচয় প্রথমে দিতে চাননি সেই ফকির। পরে উপস্থিত সকলের একান্ত অনুরোধে নিজের পরিচয় দেন তিনি।
তিনি বিলাস খান। তানসেনের কনিষ্ঠতম সন্তান। অল্প বয়সে সুফিসাধনায় মজে ঘর ছেড়ে ছিলেন তিনি। সেদিন গাওয়া সেই রাগ তাঁর নিজস্ব রচনা। নাম ‘বিলাসখানি টোড়ি’।
দরবার ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সেই ফকিরকে নজরানা দিতে চেয়েছিলেন ‘দীন-ই-ইলাহী’। বিলাস খান জানিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর যেন তাঁকেও তাঁর পিতার পাশে স্থান দেওয়া হয়। কথা রেখেছিলেন আকবর। আজও গোয়ালিয়রে পাশাপাশি শুয়ে আছেন পিতা-পুত্র।
শাগরেদ’দের কাছে প্রায়ই এই গল্প শোনাতেন বড়ে গোলাম। শ্রীকৃষ্ণ রতনঝনকার জানিয়েছেন, এই গল্প শোনাতে শোনাতে নাকি আপ্লুত হয়ে পড়তেন বড়ো খান সাহেব। চোখে জল এনে কপাল চাপড়ে বলতেন, ”হায়! হায়! কোথায় হারিয়ে গেল সেইসব মানুষগুলো।” বলতেন, আর কি কখনও এমন গান হবে! আর কে স্পর্শ করবে সেই সাধনমার্গ? খুব আক্ষেপ করে বলতেন ”এমন মৃত্যুই বা নসিব হয় কতজনের।”
অদ্ভুত ব্যাপার, মিঁয়া তানসেনের মৃত্যুর ৩৮২ বছর পর ২৩ এপ্রিল ১৯৬৮ সালে হায়দরাবাদে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন পাতিয়ালা ঘরানার প্রবাদপ্রতিম শিল্পী উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান।
শেষ করার আগে যেটা না বললেই নয়, গত ২৩ এপ্রিল বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণদিবসের পাশাপাশি ছিল বড়ো খাঁ সাহেবের ৫১তম প্রয়াণতিথি।
আর আজকের দিনেই নিঃশব্দে, সকলের অগোচরে ৪৩৩ তম মৃত্যুবার্ষিকী পেরিয়ে এলেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের যুগপুরুষ, সংগীতসম্রাট মিঁয়া তানসেন।
।। দরবারীর দরবারে।।
सा रे ग_ म प ध_- नि_ सा,
सा, ध, नि, प, म प, ग, म रे सा
দরবারী। দরবারী কানাড়া। সারাজীবন যদি একটি মাত্র রাগ সঙ্গে নিয়েই নির্বাসন দেওয়া হয় আমায়, তবে আমি এই একটি রাগ নিয়েই দেশান্তরী হতে রাজি…
‘আশাবরী’ ঠাটের সেই রাগ যা অন্য কোনও রাগ না শিখেও শিখতে চেয়েছি, আত্মস্থ করতে চেয়েছি নিবিড় ভাবে। কতকটা বুঝে, কতকটা না বুঝে, সে রাগকে রাগের চাইতে বেশি মনে হয়েছে বিস্ময়। যা প্রাকৃত হয়েও অপ্রাকৃত। অদ্ভুত, ভৌতিক, অলৌকিক।
সেই রাগের সম্পর্কে বলতে গিয়ে পণ্ডিত শ্রীকৃষ্ণ রতনঝনকর বলেছিলেন, এ পৃথিবীর সুর নয়, বুঝি বা অন্য কোনও গ্রহের। শেষ সময়ে অজানা নির্জন স্টেশনে এই রাগের হাত ধরেই অনন্তের তানপুরায় সুর বেঁধেছিলেন উস্তাদ আব্দুল করিম খান…সে আরেক গল্প।
এই সেই রাগ যার সম্পর্কে নানা জ্ঞানীগুণীজনেরা উচ্চারণ করেছেন সাবধানবানী—প্রকৃত সুর লাগাতে পারলে নেমে আসতে পারে জিন-পরি, অতৃপ্ত আত্মারা। তানসেন সৃষ্ট এই রাগকে নিয়ে কাহিনির শেষ নেই, শেষ নেই কিংবদন্তির। ভারতীয় সিনেমা-সংগীতও বঞ্চিত হয়নি এর থেকে। ‘দরবারী’ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বহু কালজয়ী রচনা।
দীর্ঘাতিদীর্ঘ সেই তালিকা থেকে এ লেখায় তুলে নেওয়া হল একটি ‘মহারত্ন’। অসম্ভব স্বর্গীয় সেই মহার্ঘ রচনাংশ। অথচ কোথাও যেন নিঃশব্দে তার ‘স্তব্ধ’ হারিয়ে যাওয়া। আমরা তার খোঁজও রাখিনি।
১৯৫২ সাল। দেশ তখন নিতান্তই নাবালক। মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে মাত্র পাঁচ বছর আগে। এমনই সময় মুক্তি পেল ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র ঠাকুর-এর কাহিনি অবলম্বনে পরিচালক বিজয় ভাট-এর অমর সৃষ্টি ‘বৈজু বাওরা’। সে যুগে বা প্রথম সারির ‘মিউজিকাল ব্লকবাস্টার’।
কিংবদন্তি শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী বৈজনাথ মিশ্রা ওরফে বৈজু বাওয়ার জীবনী অবলম্বনে এই সিনেমায় বিখ্যাত গীতিকার শাকিল বদাউনির কথায় সুর দিয়েছিলেন আরেক প্রণম্য সুরকার নৌশাদ। দুই মহারথীর মিশেলে সৃষ্টি হয়েছিল বহু কালজয়ী গান, যা আজও আমাদের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। ভারতীয় মার্গ সংগীত যার ‘সাত মহলার স্বপ্নপুরী’র স্তম্ভ।
ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা বৈজু বাওয়ার মতো, সেলুলয়েডের ‘বৈজু বাওরা’ও তেমনই চর্চিত, মন্ত্রমুগ্ধতার আরেক নাম। একদিকে যেমন অভিনয়, অন্যদিকে এর সংগীত। বৈজুর ভূমিকায় ভারত ভূষণ ও তানসেনের ভূমিকায় রাজেন্দ্র-র অভিনয় আজও অবিস্মরণীয়। ঠিক তেমনই স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে এই সিনেমার কালজয়ী সংগীত। এই প্রথম কোনও সিনেমায় ‘মেইনস্ট্রিম’ আর্টিস্টও (লতা, রফি, শামসাদ বেগম)-দের পাশাপাশি ভারতীয় মার্গ সংগীতের দুই বিরল নক্ষত্রের সমাবেশ।
সেখানে সিংহভাগ দখল করে রেখেছেন উস্তাদ আমীর খান। বাকিটা ডি ভি পালুস্কর। রয়েছে অসাধারণ সব রাগের সমাহার। জনপ্রিয় গান যেমন—’তু গঙ্গা কী মৌজ’, বা ‘দুনিয়া কী রাখওয়ালে’ ইত্যাদির কথা বাদ দিলে ‘দেশী’ রাগে ‘আজ গাওত মন মেরা’, ‘মালকোষে’ নিবন্ধ ‘মন তড়পত হরি দর্শন’, পুরিয়া ধনশ্রী রাগে ‘তোরি জয় জয় করতার’ বা আমীর খানের কন্ঠে ‘মেঘ’ রাগে ‘ঘনন ঘনন ঘন’ ইত্যাদি আজও ভোলেনি সংগীতপ্রেমীরা। তবে এসব ছাপিয়েও কোথাও যেন স্বতন্ত্রতা পায় দরবারী কানাড়ায় আমীর খাঁ সাহেবের সেই অপার্থিব ‘সরগম’…
কথিত আছে (সিনেমাতেও চিত্রিত) বৈজুর বাবা গৌরীনাথ (নাম নিয়ে মতান্তর রয়েছে) ছিলেন পরম বৈষ্ণব। অনেকের মতে, তানসেনের সেই বিখ্যাত সৃষ্টি ‘মিঁয়া কী মলহার’-এর পালটা, নিজের বাবার নামে ‘গৌড় মলহার’ রাগটির রচনা করেছিলেন বৈজু। কৃষ্ণকীর্তন গেয়ে মাধুকরী ও সামান্য যজমানি করে দিন চালাতেন গৌরীনাথ। সুদূর চম্পানের (মতান্তরে চান্দেরী, গোয়ালিয়র, মধ্যপ্রদেশ) থেকে বৃন্দাবন হয়ে দিল্লি এসেছিলেন তিনি। দিল্লির রাস্তায় গান গেয়ে তিনি কৃষ্ণ নাম-মাহাত্ম্য প্রচার করতেন। সঙ্গে খঞ্জনি হাতে থাকত ছোট্ট বৈজু।
এভাবেই চলছিল। কিন্তু বাধ সাধলেন সম্রাট আকবর। ‘নবরত্নসভা’র অন্যতম কিংবদন্তি গায়ক তানসেনের খ্যাতি তখন মধ্যগগনে। সারাদেশে তার মতো ‘গাওয়াইয়া’ আর দ্বিতীয় কেউ নেই। আকবর আদেশ দিয়েছিলেন—তানসেন যখন রেওয়াজে বসবেন তখন গোটা অঞ্চলে নীরবতা ও শান্তি বজায় রাখতে হবে। কোনও শব্দ করা যাবে না। করলেই দেওয়া হবে কড়া শাস্তি। কিন্তু সম্রাটের ফরমান অগ্রাহ্য করে, সেই অঞ্চল দিয়েই কীর্তন গাইতে গেছিলেন গৌরীনাথ। রক্ষীরা ছুটে এসে তাকে বারণ করলেও, তা শোনেননি তিনি। ফলত বচসা শুরু হয় উভয়পক্ষে, সেখান থেকে হাতাহাতি। রক্ষীদের প্রহারে গুরুতর জখম হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন গৌরীনাথ। মারা যাওয়ার আগে ছেলে বৈজুকে বলেন তার হত্যার প্রতিশোধ নিতে।
পিতৃশোক ‘পাগল’ (বাওরা) হয়ে যান বৈজু। সব রাগ গিয়ে পড়ে তানসেনের ওপর। তানসেনের জন্যই সে বাবাকে হারিয়েছে। তানসেন একজন ‘হত্যাকারী’ তাই তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। এরপর যে ভাবেই হোক তানসেনকে হত্যা করার উপায় ভাবতে থাকে বৈজু। কিন্তু পেরে ওঠে না। সময় ঘুরতে থাকে।
ক্রমে বড়ো হয় বৈজু। কিন্তু প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভোলেনি সে। অবশেষে একদিন মেলে সুযোগ। তানসেন তখন রেওয়াজে বসেছেন। খোলা তরবারি হাতে সেখানে উপস্থিত হয় বৈজু। উদ্দেশ্য এক কোপে তানসেনকে দ্বিখণ্ডিত করা। কিন্তু ঠিক তখনই হয় এক ‘ম্যাজিক’। এক অদ্ভুত রাগ ধরেন তানসেন। সে রাগের এমন গভীরতা, যা আচ্ছন্ন করে বৈজুকে। সারা শরীরে তার রোমাঞ্চ হয়। যেন সারা শরীরের রক্ত জমাট বেঁধে আসে। এমনই ভয়ংকর সুন্দর সে রাগ। রাগ দরবারী কানাড়া। হাত থেকে তরবারি খসে পড়ে তার। তানসেন-বধ অধরাই রয়ে যায়। পরে তানসেন নিজেই বৈজুকে বলেছিলেন, তাকে মারতে হলে তরবারি নয়, সংগীত দিয়ে যেন মারা হয়। তার গোটা জীবন সংগীতের দান। একমাত্র সংগীতই পারে তা ছিনিয়ে নিতে। পরবর্তী ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা।
‘বৈজু বাওরা’তে তানসেনের কন্ঠে দরবারী কানাড়া রাগের সেই সরগম সার্থকতা পেয়েছিল আমীর খাঁ সাহেবের কন্ঠমাধুর্যে। আমরা কেউ তানসেনকে শুনিনি, কিন্তু আমীর খাঁ-কে শুনেছিলাম। দরবারীর সেই অসম্ভব ‘অপ্রাকৃতিক’, স্বর্গীয় সরগম অলক্ষ্যে কোথাও মিলিয়ে দিয়েছিল ভারতীয় মার্গ সংগীতের দুই পৃথক কালখণ্ডের প্রাতঃস্মরণীয় কিংবদন্তিকে। কিন্তু সেই সুর আমরা কতটাই বা আত্মস্থ, মর্মস্থ করতে পেরেছি! চুপিসারে, অনাদরে হারিয়েছে তা। কালের গর্ভে লীন হয়েছে নিঃশব্দে, সকলের অজ্ঞাতে।
।। পাগলা সানাই।।
সত্তর দশক। পুরানী দিল্লি। সদর বাজার অঞ্চলে একটু একটু করে নামছে ভোর। শীতের সময়, তাই কুয়াশার চাদর তখনও কাটেনি পুরোপুরি। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়তে একটু দেরি। ঈদগাহ রোডের চন্দ্র কুটিরের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে পথচলতি মানুষেরা। কিসের যে অপেক্ষা। এমন সময় ভেসে আসে সানাই। অপার্থিব সুরে। ভৈরবীর রেশ দমকে ওঠে দিল্লির বাতাসে। অঞ্চলবাসী জানে, রেওয়াজে বসেছেন জগদীশ। বিখ্যাত সানাই বাদক জগদীশপ্রসাদ কামার। বড়ো গুণী মানুষ। তার বাবা দীপচাঁদ ছিলেন সেই জমানার আরেক প্রখ্যাত সানাইবাদক ও শাস্ত্রীয় সংগীত বিশারদ। বাবার সেই ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলেছেন জগদীশ। তার সানাইয়ের মূর্চ্ছনা না শুনে ভোর শুরু হয় না এই পাড়ায়।
প্রতিদিন বাবার রেওয়াজ শুনে সেই ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস ছোট্ট মেয়েটির। চন্দ্র কুটিরের সবচেয়ে ছোটো সদস্য সে। রাতের বেলায় জন্মেছিল বলে, আদর করে জগদীশের প্রবাদপ্রতিম গুরুজি সানাই-সরতাজ উস্তাদ বিসমিল্লাহ খান সাহেব নাম রেখেছিলেন বাগেশ্বরী বা ‘বাগেশ্রী’। তার সেই নামে ছিল দেবী সরস্বতী ও ভারতীয় রাগ-রাগিনীর যৌথ সমন্বয়। বাগেশ্বরী কামার। খান সাহেবের সাকরেদ জগদীশ কামারের মেয়ে সে।
ছোটোবেলা থেকেই সানাইয়ের প্রতি ছিল বাগেশ্বরীর দুর্নিবার আকর্ষণ। তার অন্যান্য ভাইবোনেরা যখন খেলাধূলায় মত্ত, সে চুপটি করে ঘরের এক কোণে রাখা সানাইয়ে হাত বোলাতো। সানাই-ই ছিল তার একমাত্র বন্ধু। বাগেশ্বরীর খুব ইচ্ছা বাবার মতো সেও সানাইবাদক হবে একদিন। কিন্তু বাবাকে সে কথা বলার সাহস কোনদিন হয়নি ছোট্ট মেয়েটির। বলেছিল মা’কে। রক্ষণশীল পরিবার তার। বাড়িতে সংগীতের পরিবেশ থাকলেও ঘরের মেয়েরা সংগীতচর্চা করবে, সেই কথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না। ছোটো মেয়ের আর্জি তবু জগদীশ কামারের কানে পৌঁছে দেন তার স্ত্রী। জবাবও মেলে সঙ্গে সঙ্গেই—”লড়কিও কে লিয়ে নেহি হ্যায় ইমে কাম। পড়াই লিখাই করে, গুড্ডা-গুড্ডী লেকে খেলে ঔর শাদি, ঘরসংসার করে। মর্দোওয়ালা কাম কারনে কা কই জরুরাত নেহি।” রেগেমেগে উঠে যান বাবা। দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে সেই কথা শোনে ছোট্ট বাগেশ্বরী।
কিন্তু বাবা জগদীশ কামারের প্রত্যাখ্যানে দমে যায়নি বাগেশ্বরী। সানাই তার ধ্যান-জ্ঞান-ভালোবাসা। মায়ের সাহায্যে একটি পুরোনো সানাই জোগাড় করে সে। বাবার নজর এড়িয়ে মায়ের তত্ত্বাবধানে ঘরের এককোণে, গোপনে, নিভৃতে শুরু হয় তার সাধনা। বাবা জগদীশ কামার যা বাজান, মায়ের কাছে তা জেনে নতুন করে শেখে বাগেশ্বরী। এভাবেই গোপনে, সবার অলক্ষ্যে চলতে থাকে সানাইয়ের ক্লাস। কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একদিন হাতেনাতে ধরা পড়ে যায় সে। সুর-সাধনাতে এতটাই বিভোর যে, বাবা কখন এসে দাঁড়িয়েছেন পিছনে, তা বুঝতেই পারেননি বাগেশ্বরী। বাবাকে দেখে লজ্জায়, ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায় সে। কিন্তু বাবা জগদীশপ্রসাদ তাকে বকেননি। বিস্ময়ে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরেন মেয়েকে। অবাক হয়ে তিনি শুনেছিলেন ছোট্ট মেয়েটির সানাইয়ের ‘পুকারে’ কি ভাবে ওতপ্রোত হয়ে গেছে বেনারস ও দিল্লি ঘরানার ‘সাঁঝ’। তিনি এও বুঝতে পারেন, ‘মেয়ে’ বলে বাগেশ্বরীকে সানাই না শিখিয়ে কী ভুলটাই না করেছেন। এই প্রতিভাশালী মেয়েই তার সুযোগ্য উত্তরাধিকারিনী। মেয়েকে বুকে টেনে চোখের জল মুছে তাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করেন জগদীশপ্রসাদ। সেদিন থেকে শুরু হয় নতুন করে তালিম। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বাগেশ্বরী কামারকে।
বাবা জগদীশপ্রসাদের কাছে সানাইয়ের প্রাথমিক পাঠ শেষ হলে মেয়েকে তিনি নিয়ে আসেন বেনারসে। তার গুরু উস্তাদ বিসমিল্লাহ খান সাহেবের কাছে। স্বয়ং সানাইয়ের ঈশ্বরের কাছে তার মেয়ে তালিম নিক, এমনটাই ইচ্ছা জগদীশের। বিসমিল্লাহ তারও গুরু। তাই তিনি ছাড়া অন্য কেউ এর কদর বুঝবে না, এমনটাই ধারণা ছিল জগদীশের। প্রিয় শিষ্যের প্রস্তাব শুনে চমকে যান বিসমিল্লাহ। মেয়ে শিখবে সানাই? তা কি করে সম্ভব? এ যে চিরকাল পুরুষকেন্দ্রিক বাজনা! আজ পর্যন্ত কোনও মহিলার হাতে ওঠেনি সানাই। বিসমিল্লাহ কিছুতেই রাজি হননি। শেষে জগদীশের জেদাজেদিতে বাগেশ্বরীকে কিছু বাজিয়ে শোনানোর জন্য বলেন তিনি। কাঁপাকাঁপা হাতে বাগেশ্বরী নত মুখে সুর ধরেন। শুদ্ধ কেদার। এক মুহূর্তে ‘ম্যাজিক’। সুরের সে জাদুদে বিভোর বাগেশ্বরী খেয়ালও করেননি, তার বাবা ও গুরুজি দুজনেরই চোখে তখন জল। বাজনা শেষ হলে তাকে জড়িয়ে ধরেন বিসমিল্লাহ। আবেগরুদ্ধ কন্ঠে বলেন,—”বেটি, তুনে তো’ কামাল কর দিয়া। ইসি ঘর মে বৈঠ কর মেরা বিশ্বনাথ দর্শন হো গ্যয়া।” প্রিয়শিষ্য জগদীশকে বলেন—”মা সরস্বতী কা কৃপা হ্যায় ইস পে। বহুত দূর জায়েগী ইয়ে লড়কী।” সেদিন থেকে বাগেশ্বরী কামার হয়ে গেলেন উস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ সাহেবের একমাত্র ‘গাণ্ডাবন্ধ’ মহিলা সাকরেদ।
শুরু হল নতুন করে পথচলা। খাঁ সাহেবের তালিমে ক্রমেই অন্যান্য শিষ্যদের পিছনে ফেলে দেন এই অসামান্য প্রতিভাশালী মহিলা। বিসমিল্লাহ-ই তাকে সুযোগ করে দেন তার সাথে প্রথমবার স্টেজ পারফরম্যান্সের। বেনারসের সঙ্কটমোচন মন্দিরে গুরু-শিষ্যার সেই দ্বৈত সানাইবাদন আজও ভুলতে পারেননি মহল্লাবাসীরা। কিন্তু এতটাও সহজ হয়নি সেই ‘ডুয়েট’। বিসমিল্লাহ খাঁ-র নিজের ছাত্রদের একাংশ বেঁকে বসেছিল। তির্যক কটাক্ষ ছুঁড়ে দিয়েছিল রক্ষণশীল সমাজের মাতব্বরেরা। সঙ্কটমোচন মন্দিরে সানাই বাজাবে কিনা এক মহিলা? এ যে অভাবনীয়! কিন্তু কোনও কিছুতেই দমে যাননি বিসমিল্লাহ। বাগেশ্বরীকে নিয়েই তিনি বাজাবেন এবং বাজিয়েও ছিলেন। সেই বাজনা শুনে তারপর আর কেউ কোনদিন বলতে পারেননি যে সানাই শুধু, শুধুমাত্র পুরুষদের কুক্ষিগত বিদ্যা। কারণ, এক সাধারণ মহিলা তার অসাধারণ প্রতিভা, অধ্যাবসায় ও সাধনার জোরে সে ধারণা চিরকালের মতো বদলে দিয়েছেন। ততক্ষণে এটা প্রমাণিত হয়েছে শুধু সানাই কেন, যে কোনও শাস্ত্রীয় বাদ্যযন্ত্রই কোনও জাতিধর্ম ও লিঙ্গের কুক্ষিগত নয়, প্রকৃত সাধনা, ভালোবাসা ও অধ্যাবসায় থাকলে যে কেউ তার সুযোগ্য অধিকারী হতে পারে। গুরু-শিষ্যার সে দ্বৈত বাদনের শেষে ধন্য ধন্য পড়ে গেছিল মন্দির প্রাঙ্গণে। সেদিন দর্শকদের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসার প্রথম ‘নজরানা’ গুরুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বাগেশ্বরী। বিসমিল্লাহ গরিবগুর্বদের মধ্যে বিলিয়ে দেন সেই টাকা। হেসে বলেন—এই তার শিবপুজো।
দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সানাইয়ের জগত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন বাগেশ্বরী। খাঁ সাহেবের যতদিন পর্যন্ত বেঁচেছিলেন ততদিন পর্যন্ত তার কাছে নিয়েছেন তালিম। হয়ে উঠেছিলেন সে বাড়ির অন্যতম সদস্যা। দেশ জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় ধ্বনিত হয়েছে তার সানাই। দিল্লি ও বেনারস ঘরানার সার্থক সংমিশ্রণ উঠে আসতো তার বাজনায়। বাজিয়েছেন দেশবিদেশের নানান অনুষ্ঠানে। অথচ, দুর্ভাগ্যের বিষয় সংগীতের জগত কোনদিন তেমন স্বীকৃতি দেয়নি এই প্রচারবিমুখ গুণী শিল্পীটিকে। সাম্প্রতিক শাস্ত্রীয় সংগীতচর্চার আসরেও তিনি অদ্ভুতভাবে ‘ব্রাত্য’। তার নামও জানে না বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা। মহিলা হয়ে সানাইবাদনের মতন ব্যতিক্রমী শিল্পে পারঙ্গম হওয়াই কি এই অভাবনীয় উপেক্ষা ও অন্তরালের কারণ, এ নিয়ে বহু তর্কবিতর্ক আজও চলে শাস্ত্রীয় সংগীতমহলে। যদিও এসব বিষয় নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাতে রাজি নন বাগেশ্বরী। আজও দিল্লির সদর বাজার অঞ্চলে কান পাতলে শোনা যায় তার জাদু সানাইয়ের মাদকতা। আজও নিরলস প্রচেষ্টায় তার শিষ্য ও বিশেষ করে শিষ্যাদের মধ্যে বপন করে চলেছেন তার সারাজীবনের অর্জিত সাধনার ফসল। দুরদর্শনে দেওয়া তার সাক্ষাৎকারে বাগেশ্বরী জানিয়ে ছিলেন, তিনি এমনিতেও ‘নিভৃতচারিণী’। স্বামী, সন্তান, শিষ্য-শিষ্যাদের নিয়ে তার একফালি জগৎ। শুধু গুরুর দেওয়া শিক্ষা দেশের নব প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াই তার উদ্দেশ্য।
আজও পুরানী দিল্লির অলিগলিতে রাতে হাঁটলে পথচলতি মানুষ একবার ফিরে তাকান ঈদগাহ রোডের সেই চন্দ্র কুটিরের দিকে। গভীর রাতে সেই একচিলতে, বিবর্ণ বাড়ি থেকে ভেসে আসে সানাইয়ে করুণ সুর। বাগেশ্রী কানাড়া রাগে। সেই অপার্থিব সুর সানাইয়ের মোচড়ে বুকে ক্ষত রেখে দিয়ে যায়। নীরবে, নিভৃতে কোনও অজানা বেদনার অশ্রুত সুর কখন গুমরে ওঠে রাতের দিল্লির অন্ধকারে ঘেরা গুমোট আকাশে।
অঞ্চলের মানুষরা জানে রেওয়াজে বসেছেন সানাই সম্রাজ্ঞী, জগদীশ প্রসাদ ও বিসমিল্লাহ খাঁ সাহেবের স্নেহধন্যা, প্রিয়শিষ্যা বাগেশ্বরী কামার। এই ভারত উপমহাদেশের প্রথম ও সম্ভবতঃ একমাত্র মহিলা সানাইবাদক। যার কথা আজ আর কেউ মনে রাখে না।
।। ঘোষালবাড়ির গান।।
বেনারস মানেই শিল্প, কলা, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং সংগীতের পীঠস্থান। সেখানে অলিতে-গলিতে কান পাতলে শোনা যায় টপ্পা, ঠুংরি, দাদরা, কালোয়াতি খেয়াল। বাঙালিরা এমনিতেই সংস্কৃতি-সংগীতমনস্ক। বেনারসের বাঙালি হলে তো কথাই নেই। বেনারসের ঘোষাল বাড়ির পরতে পরতে তাই জড়িয়ে ছিল এই গান। তা যেমনি-তেমনি গান নয়, রীতিমত শাস্ত্রীয় সংগীত। পরিবারের মাথা অম্বিকা ঘোষাল-এর বাবা ছিলেন ক্লাসিকালের বড়ো সমঝদার। অন্তত ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ সিনেমায় তেমনটি দেখিয়ে গেছেন সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ দেখিয়ে ছিলেন, আমরা কিন্তু আত্মস্থ করে উঠতে পারিনি।
গল্প বলছে, বেনারসের বর্ধিষ্ণু ও বনেদি বাঙালি পরিবারের অন্যতম এই ঘোষালরা। বহুযুগ ধরে প্রবাসী। বাড়িতে নাটমন্দির আছে, দুর্গাপূজা হয়। বাড়ির বৃদ্ধ কর্তা, গোয়েন্দা কাহিনির দাপুটে ভক্ত অম্বিকা ঘোষাল। একমাত্র ছেলে উমানাথ, তার স্ত্রী ও ছোটো ছেলে রুকু ওরফে ‘ক্যাপ্টেন স্পার্ক’-কে নিয়ে কলকাতায় থাকেন। অবশ্য এই বেনারসেই পড়াশোনা উমানাথের, গল্পের ভিলেন ‘মগনলাল মেঘরাজ’ আবার তারই এক সময়কার সহপাঠী। পুজোর সময়ে সপরিবারে তারা বাড়িতে বেড়াতে আসেন। এই ঘোষাল বাড়িতেই ছিল একটি মহামূল্য সম্পদ। প্রাচীন এক সোনার গনেশ মূর্তি। নেপালের জিনিস। হিরে, চুনি, পান্নাখচিত। এই গনেশ মূর্তির রহস্যময় চুরির ঘটনা নিয়েই গোটা গল্পের জাফরি কাটা, উদ্ধারে নামে প্রদোষচন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদা। এর পরবর্তী ঘটনা অবশ্য সকলেরই জানা।
তবে যে জিনিসটি সত্যজিৎ দেখালেও, আমাদের কাছে উহ্য রয়ে গেছে তা হল ঘোষাল পরিবারে শুধু গনেশই ছিলেন না, ছিলেন সরস্বতীও। সারস্বত সাধনার ভিন্ন মার্গের নিদর্শন সেখানে দেখিয়েছেন সত্যজিৎ। ঘোষাল পরিবারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত মার্গ সংগীত। ছবির একটি দৃশ্যে ফেলুদা, তোপসে, জটায়ুকে অম্বিকাবাবুর সঙ্গে আলাপ করাতে নিয়ে যাচ্ছেন উমানাথ। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভেসে আসে ঠুংরি। কেসরবাঈ-এর কন্ঠে ‘কাহে কো দারি’। উমানাথ জানান, তার ঠাকুরদা শাস্ত্রীয় সংগীতের বড়ো ভক্ত। একসময় গানবাজনা নিয়ে প্রচুর মেতে থেকেছেন। এখন অবশ্য একজন চাকর রয়েছে শুধু গ্রামাফোনের রেকর্ড পালটাবার জন্য।
কেসরবাঈ। কেসরবাঈ কেরকর (১৮৯২-১৯৭৭)। জয়পুর-আতারৌলি ঘরানার প্রবাদপ্রতিম গায়িকা। গোয়ায় জন্ম হলেও যার সংগীতের হাতেখড়ি হয় মহারাষ্ট্রে, কোলহাপুরে। তালিম নিয়েছেন ভাস্কর বুয়া বাখলে, আল্লাদিয়া খান, আব্দুল করিম এবং রামকৃষ্ণ বুয়া ভাজ-এর মতো কিংবদন্তিদের কাছে। কলকাতাতেও গান গেয়েছেন তিনি। এই শহরই তাকে দিয়েছিল ‘সুরশ্রী’ উপাধি। শোনা যায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ। কেসরবাঈ কেরকর-এর ভৈরবীতে বিখ্যাত ঠুংরিটি সত্যজিৎ অসামান্য দক্ষতায় এই দৃশ্যে ব্যবহার করেন। এই ছবির শেষের দৃশ্যেও কেসরবাঈকে দ্বিতীয়বার শোনা যায়।
ঘোষাল বাড়িতে শোনা যায় ঊনবিংশ শতকের আরও এক অসামান্য কৃতি গায়িকা জোহরাবাঈ আগ্রাওয়ালীকেও। ছবির একটি দৃশ্যে দেখা যায় রাতের ঘোষাল বাড়িকে। সেখানে থমথমে এক পরিবেশ। অদ্ভুত শ্বাসরোধী সেই দৃশ্য। দেখা যায় গ্রামাফোনের পাশে ধ্যানস্থ অবস্থায় বসে আছেন উমানাথের ঠাকুরদা। অশীতিপর, মুণ্ডিতকেশ, ধ্যানমগ্ন এক বৃদ্ধ। টেবিলে পড়ে আছে জোনোফন রেকর্ডস। বাতাসে ভাসছে জোহরাবাঈ-এর বিখ্যাত গজল ‘পি কো হামতুম চলো’।
সেই জোহরাবাঈ (১৮৬৮-১৯১৩) যার অধিকাংশ রেকর্ডে দেখা যায় ছোটো ছেলেকে কোলে নিয়ে এক হাতে তানপুরা ছাড়ার সেই বিস্ময়কর ছবি। আগ্রা শহরে জন্ম ও মর্দানা কন্ঠের জন্য বিখ্যাত জোহরা তালিম নিয়েছিলেন আগ্রা ঘরানার প্রবাদপ্রতিম কল্লন খাঁ, মেহবুব খান (দরস পিয়া)-এর কাছে। তাঁর কন্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হয়েছিলেন ফৈয়াজ খান এবং বড়ে গেলাম-এর মতো কিংবদন্তিরা। জোহরাবাঈ-এর সেই গজল (পরবর্তীকালে যা গেয়েছেন মেহদি হাসানও) ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর ওই দৃশ্যটিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। আর এখানেই পরিচয় পাওয়া যায় সত্যজিতের শাস্ত্রীয় সংগীতে অসামান্য মুনশিয়ানার। আজও তা অজর, অক্ষয়, চিরকালীন।
বলে রাখা ভালো, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-র সংগীতের বিষয়ে আলোচনায় রেবা মুহুরি-র নাম না করলে তা অসম্পূর্ণ। ঘোষাল বাড়ির দৃশ্যে যেমন ওতোপ্রোত জড়িয়ে আছেন কেসরবাঈ, জোহরাবাঈরা; ঠিক তেমনই মছলিবাবার দৃশ্যে ‘মোহে লাগি লাগন গুরু’ বা ‘হে গোবিন্দ রাখো শরণ’ ও ‘পদঘুংরু বাধ মীরা নাচিরে’-র মতো ভজনগুলিকে বোধকরি বাঙালি দর্শকেরা কোনোদিন ভুলবে না। রেবা মুহুরি সেখানে অমরত্ব পেয়েছেন। সব মিলিয়ে ফেলুদার রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজের এই দ্বিতীয় ভাগটি যতটা গোয়েন্দা কাহিনি হিসেবে তা সার্থক, ঠিক ততটাই লঘুশাস্ত্রীয়, গজল ও ভজনের উৎকর্ষে নিদর্শন বহন করে। তাও রেবা মুহুরি এই ছবিতে তার অসামান্য গায়ন প্রতিভার পরিচয় নতুন করে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন, উক্ত দুই গায়িকা অসামান্য কিন্তু শেষমেশ বিস্মৃতির অতলেই তলিয়ে গেছেন। সত্যজিৎ নিজস্ব ভঙ্গিতে তাদের তুলে ধরেছিলেন রহস্য কাহিনির আবহসংগীতে নেপথ্য মোড়করূপে। দুর্ভাগ্য, আমরাই চিনতে পারিনি!
।। মাস্টার মদন।।
বিনতি শুনো মোরি কানহা রে
ডিসেম্বর ২৯, ১৯৪০। কলকাতা। সেবছর অল বেঙ্গল মিউজিকাল কনফারেন্সে একেবারে চাঁদের হাঁট বসেছে। চারদিনের সেই অনুষ্ঠানে ভারতীয় মার্গ সংগীতের হেন কোনও নক্ষত্র বাকি নেই, যারা কলকাতায় আসেননি। অমৃতবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে, সূচনাপর্বের ভার পেয়েছেন রামপুরের প্রবাদপ্রতিম উস্তাদ মুস্তাক হুসেইন খান ও অমৃতসরের উস্তাদ বিলাল মহম্মদ রবাবী-র মতো দুই বিখ্যাত খেয়াল গায়ক। গোটা অনুষ্ঠানের তদারকির ভার নিয়েছেন সরোদিয়া রাধিকামোহন মৈত্র। নক্ষত্র সমাগমের তালিকা যথেষ্ট দীর্ঘ। কে নেই সেখানে! লাহোরের উস্তাদ গুলাম আলী খান বম্বের হীরাবাঈ বর্দুকর পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর মানেকাবাঈ শিরোদকর উস্তাদ জিয়াউদ্দিন ও মইনুদ্দিন খান ও পণ্ডিত রমেশ ঠাকুর (তবলা)। রয়েছেন উস্তাদ আলী আকবর খান আনোখে লাল দক্ষিণী পণ্ডিত সুন্দরম আইয়ার আশফাক হুসেইন খান (খেয়াল) রামানুজ আয়েঙ্গার পণ্ডিত মগনলাল সরস্বতী বাঈ নাগেশরাও এবং সর্বোপরি উস্তাদ আমীর খান-এর মতো জলজ্যান্ত কিংবদন্তিরা। এতসব জ্ঞানী-গুণীজন অথচ গোটা কলকাতার নজর একজনের দিকে। শুধু একজনের দিকেই। সে মাত্র ১৩ বছর বয়সী একটা বাচ্চা ছেলে, যে কিনা তার গান শোনাতে এসেছে সুদূর শৈলশহর সিমলা থেকে। বেঙ্গল মিউজিকাল কনফারেন্সের ডাকে সেই প্রথম কোনও কিশোর গান গাইতে এল কলকাতায়। কিন্তু শুধুমাত্র দর্শকই না, সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী বিখ্যাত শিল্পীরাও সেই ‘কাল কা ছোকরা’র গান শোনার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে আছেন। যদিও এসবে ভ্রূক্ষেপ নেই ১৩ বছরের সেই পাঞ্জাবি ছেলেটির, লোকে তাকে চেনে ‘মাস্টার মদন’ নামে। এসবের থেকে অনেক দূরে, সে তখন ছোট্ট এক কামরার একটি ঘরে রেওয়াজ করতে ব্যস্ত। একদিন আগেই ছিল তার জন্মদিন।
সন্ধেবেলা ‘মাস্টার মদন’-এর অনুষ্ঠান। অথচ হাঁটুর বয়সী সেই বাচ্চা ছেলেটির গান শুনতে দুপুর থেকেই আছড়ে পড়ল ভিড়। তার গান শুনতে প্রথম সারিতে বসে আছেন মুস্তাক হুসেন ওঙ্কারনাথ আমীর খান দাবীর খান বীরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী কে এল সেহগল সহ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের তাবড় গুণীজনেরা। গ্রিনরুমে তখন প্রস্তুতি নিচ্ছে ছেলেটি। টেনশনে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে তার। নার্ভ ঠিক রাখতে এক গ্লাস গরম দুধ খেল সে। কেমন যেন তার স্বাদ! তবু সেসব ভাবার সময় নেই। একটু ধাতস্থ হয়েই ধীর পায়ে সে উঠে এল স্টেজে। সামনে হাজার মানুষের ভিড়, গুণিজনের সমাহার। মনে মনে মা সরস্বতী ও নানক দেব-এর নাম স্মরণ করে সে ধরল তার গান। দেশি টোড়িতে ঠুংরি—’বিনতি শুনো মেরি’। কী অদ্ভুত তার সুর। কী সাবলীল সেই বালকের গায়কি। সাক্ষাৎ সরস্বতী যেন ভর করেছেন তার কন্ঠে। প্রতিটি চলনে গোটা হল ফেটে পড়ছে সাধুবাদে। এমন অপার্থিব গান, এমন গায়কি খুব কম শোনা যায়। সেদিন যেন কলকাতাবাসীদের আরেক দেবদর্শন হল। সে সুরের জাদুতে সকলেই মন্ত্রমুগ্ধ। কিন্তু তখন অন্য, অন্য কিছু একটা হচ্ছিল বাচ্চা ছেলেটির শরীরে। এত ঘাম হচ্ছে কেন? কেন গলা জড়িয়ে আসছে তার? এ কী অদ্ভুত অস্বস্তি সারা শরীর জুড়ে। গলা যেন ছিঁড়ে পড়ছে। সারা শরীরে অদ্ভুত জ্বালা! কিন্তু আসর মাঝপথে শেষ করলে সংগীতের অপমান করা হয় যে। তাই সমস্ত কষ্ট সয়ে গান চালিয়ে গেল ছেলেটি। তার সেই শারীরিক কষ্টের কথা টেরও পেল না কেউ। একসময় শেষ হয় গান। উঠে দাঁড়িয়ে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম করে সে। গোটা হল ফেটে পড়ছে হাততালিতে। সংগীতের বোদ্ধারা হারিয়ে ফেলেছেন তাদের ভাষা। শুধু নিঃশব্দে তারা করে গেলেন আশীর্বাদ। আর সেই ছেলেটি? সে তখন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়েছে ব্যাকস্টেজে। বাথরুম পর্যন্ত যেতেও পারেনি, তার আগেই গ্রিনরুমের বাইরে দমকে দমকে বমি। যেন দেখা গেল দু-ফোঁটা রক্তের দাগও। কেন এমন হল? কেন? কেন? কেন? তবে কি আবারও সেই চক্রান্ত? আবারও সে ষড়যন্ত্রের শিকার? আবার? অচৈতন্য হওয়ার আগে ছেলেটি মনে করতে পেরেছিল—স্টেজে ওঠার আগে সেই দুধের গ্লাস, আর তার অদ্ভুত স্বাদ। তবে কি সেই দুধেই মেশানো ছিল কিছু? ঘন অন্ধকার নেমে আসে ছেলেটির চোখে। সেই অন্ধকার যা একটু একটু করে গ্রাস করছে তার বোধ, তালিম, সুর আর সত্তা। ঘন দুধের মতো জমাটবাঁধা সেই আঁধারে একটু একটু করে তলিয়ে যায় সে। গ্রিন রুমে তখন সবার অলক্ষ্যে পড়ে থাকে একটি গ্লাস। যার গায়ে তখনও লেগে দুধের গন্ধ।
ইয়ুন না রয়হ্ রয়হ্ কর হমে তরসাইয়ে
ডিসেম্বর ২৮ (মতান্তরে ২৬), ১৯২৭। পাঞ্জাবের জলন্ধর জেলার খানখানায় এক ধর্মপ্রাণ শিখ পরিবারে জন্ম মাস্টার মদনের। আকবরের নবরত্নসভার অন্যতম রত্ন, এবং একাধারে বিখ্যাত যোদ্ধা ও ইসলামী কবি-দার্শনিক আব্দুল রহিম খানখানান-এর তৈরি এই গ্রাম খানখানায় বাস করতেন সর্দার অমর সিং ও তার স্ত্রী পূরণ দেবী। তাদেরই কনিষ্ঠ সন্তান মদন সিং। মদনের থেকে ১৩ বছরের বড়ো ভাই মোহন নিজে বেহালা-বাদক ও সুদক্ষ গায়ক। দিদি শান্তিদেবীও ছিলেন সুগায়িকা। ছোটোবেলা থেকেই বাড়িতে গানের পরিবেশ। সর্দার অমর সিং সরকারি কর্মী হওয়ার সঙ্গে নিজেও ভালো গাইতেন। অঞ্চলের বিভিন্ন গুরুদ্বারা ও মন্দিরে তার ভজন ছিল বিখ্যাত। ছোটো ছেলেকে শিখিয়েছিলেন গুরু তেগবাহাদুর রচিত ‘শাহাবাদ’—’চেতনা হ্যায় তো চেত লে’। গানপাগলদের সংসারের হাল সামলাতেন পূরণদেবী। মদন এককথায় যাকে বলে চাইল্ড প্রডিজি। ছিলেন প্রবল শ্রুতিধর। যা কিছু শুনতেন তা মনে ধরে রাখার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। প্রথাগত সংগীতের তালিম মদন পেয়েছিলেন কিনা তা নিয়ে রয়েছে মতভেদ। তবে শোনা যায় তিন বছর বয়সে বিখ্যাত শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী পণ্ডিত অমরনাথের কাছে তালিম নিয়েছিলেন তিনি। পণ্ডিত অমরনাথ ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত সুরকার হুসনলাল-ভরতনাম-এর দাদা। পরে তিনি নিজে ‘মির্জা সাহিবা’ (১৯৪৭) সিনেমায় সুরারোপ করেন ও পাকিস্তানের বিখ্যাত শিল্পী নূরজাহান তাতে অসামান্য কিছু গান গেয়েছিলেন। গুরুর তালিমের পাশাপাশি মাস্টার মদন নিজেও যে অসম্ভব প্রতিভাবান ছিলেন সে নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। মদনের জন্মের অল্পকিছু কালের মধ্যেই সরকারি কাজে সিমলায় বদলি হয়ে যান সর্দার অমর সিং। সিমলাতে নতুন করে শুরু হয় মদনের সংগীতচর্চা। দাদা-দিদির অকুণ্ঠ উৎসাহ ও সাহচর্যে ক্রমেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ভজন, খেয়াল ও গজলে অসামান্য ‘পকড়’ তৈরি হয় তার। সে সময় সিমলাতে রেমিংটন র্যাণ্ড টাইপ রাইটার কোম্পানিতে কাজ করতেন বিখ্যাত গায়ক কে এল সেহগল। সর্দার অমর সিং-এর কোঠিতে ছিল তার নিত্য যাতায়াত। সিং পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে এলেই তিন ভাই বোনকে নিয়ে স্বরসাধনায় মাততেন সেহগল। ঘন্টার পর ঘন্টা চলত তাদের রেওয়াজ। তিন ভাই-বোনের মধ্যে অসামান্য গায়কি ও সুরের অধিকারী মদন ছিলেন সেহগলের বিশেষ প্রিয় পাত্র। তার তালিম এমনই তৈরি হয় যে মাত্র চার বছর বয়সে, ১৯৩০ সালের জুন মাসে ধরমপুর স্যানিটরিয়ামে হয় মদনের প্রথম পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্স। গেয়ে ছিলেন ভজন, মিশ্র কাফীতে ‘হে সারদা নমনঃ করু’। প্রবল জনপ্রিয়তা পান সেই আসর থেকেই। কৃতিত্বের সম্মানরূপে পেয়েছিলেন একটি ছোট্ট সোনার মেডেল। পেলেন নতুন পরিচয়। মদন সিং থেকে হলেন ‘মাস্টার মদন’। বলাবাহুল্য মদনের সুরের জাদুতে মাত হল সিমলা। সকলের মুখে তখন একটাই নাম। ঈশ্বরের অপার কৃপা ছিল মদনের গলায়। পাঁচ বছর বয়সেই অবলীলায় তিনি গেয়ে দিতেন শক্ত শক্ত রাগ-রাগিনী, খেয়াল, ধ্রুপদ, ভজন। ক্রমেই সিমলা ছাড়িয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল মদনের নাম। ডাক আসতে থাকে বিভিন্ন শহর, রাজ্য ও নেটিভ স্টেটের রাজা-রাজড়াদের দরবার থেকেও। প্রবল জনপ্রিয়তাই পরবর্তীকালে কাল হয়েছিল তার।
মদন যেখানেই গেছেন পেয়েছেন অসংখ্য সম্মান। তার একটি ‘পসন্দিদা’ কোট ছিল, যেটা প্রায় ঢেকেই গিয়েছিল মেডেলের বন্যায়। সেই ছোট্ট কোটটি পরেই সে ঘুরে বেড়াত সারাদেশ। মদন তখন সমস্ত দেশবাসীর কাছে এক অপার বিস্ময়। যেখানেই গেছে সেখানেই কুড়িয়েছে প্রশংসা। মদনের হাত ধরেই হাল ফিরেছিল অমর সিং’-এর সংসারে। এর মধ্যেই গানের পাশাপাশি সে চালিয়ে গেছে পড়াশোনা। সেহগলেরই উৎসাহে সিমলার সনাতন ধর্ম স্কুলের গণ্ডি টপকে দিল্লি পাড়ি দিয়েছে শিল্পী। প্রথমে রামজশ স্কুল ও পরে হিন্দু কলেজে ভরতি হয় সে। কিন্তু পড়াশোনা চালাতে পারেনি বেশিদিন। অধিকাংশ সময়ে হয় রেওয়াজ, না হয় অনুষ্ঠান করতে ভারতভ্রমণ চলছিল তার। বন্ধু-বান্ধবও জোটেনি তেমন এই মুখচোরা, লাজুক ছেলেটির। মাঝেমধ্যে কলেজ ক্যান্টিনে দেখা যেত তাকে। খাবার ফেলে মাটির দিকে তাকিয়ে গুনগুন করছে সে। সামনে দুধের গ্লাস। দুধ খেতে ভালোবাসতো খুব। ওর মধ্যেই চলছে সরগম আর পালটা সাধা। রেওয়াজের প্রতি এমনই ছিল তার ডেডিকেশন। ঘনিষ্ঠজনেরা বলেন, একবার চারদিনের ‘চিল্লা’ও করেছিলেন মদন। সে বড়ো ভয়ংকর জিনিস। ‘চিল্লা’ হচ্ছে একপ্রকার কঠোর রেওয়াজের মার্গ। সারাদিনে অল্পকিছু খাওয়া ও গোসল করাটুকু ছাড়া দিনের পুরো অংশ দিতে হত রেওয়াজে। ‘চিল্লা’র কুপ্রভাব পড়ে তার স্বাস্থ্যেও। সে সময় একটি দশ-এগারো বছর বয়সের ছেলে ‘চিল্লা’ করছে ভাবলে, আচ্ছা আচ্ছা ওস্তাদেরা চোখ কপালে তুলে ফেলবেন। এর ফলেই প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়েন মদন। কিন্তু গান বা রেওয়াজ—দুটির কোনওটি থেকেই তিনি সরে আসেননি। সরে আসছিল আসলে সময়। দ্রুত, খুব দ্রুত ফুরোচ্ছিল তা। মুছে যাচ্ছিল তা একটু একটু করে ‘চাইল্ড প্রডিজি অফ সিমলা’র জীবন থেকে। টের পাননি কেউ। কিন্তু তা ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন মদন নিজে।
হ্যয়রত সে তাক রাহা হ্যায় জানে-ওয়াফা মুঝে
তিন দশকের শেষভাগ। ততদিনে খ্যাতির মধ্যগগনে মাস্টার মদন। মাত্র আট বছর বয়সেই মুক্তি পেয়েছে তার প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড। বিখ্যাত শায়ের সাগর নিজামীর লেখা দুটি গজল—’ইয়ুন না রয়হ রয়হ কর হমে তরসাইয়ে’ ও ‘হ্যয়রত সে তাক রাহা হ্যায়’ গেয়েছিলেন মদন। রীতিমতন হইচই পড়ে গিয়েছিল সর্বত্র। ওটুকু বয়সেই মদন ছুঁয়ে ফেলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষ। কিন্তু বাধ সাধে তার ভগ্ন স্বাস্থ্য। দীর্ঘদিন হল একটুও বিশ্রাম পায়নি ছোটো ছেলেটি। সারাদেশ জুড়ে অবিশ্রান্ত ঘোরাঘুরি একটু একটু করে শেষ করে ফেলছিল তাকে। একটুতেই হাঁপিয়ে উঠতেন, তার সঙ্গে ছিল ঘুসঘুসে জ্বর আর কাশি। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তার খ্যাতির আলোয় অন্ধ হয়েছিল তার নিজের পরিবার। পাননি যত্ন, পরিচর্যা বা খাওয়া-দাওয়া। অনেকের মতে তাকে ঘিরে পরিবারের একাংশের উচ্চাকাঙ্খা ও স্বার্থপরতা ছিল তার ভগ্ন স্বাস্থ্যের অন্যতম কারণ। আর এর পাশাপাশি ছিল তার সেই সময়কার প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঈর্ষা ও চক্রান্ত। মদন-এর ঘনিষ্টজনেরা জানিয়েছেন, তার গায়কি ও অল্পবয়সে দেশজোড়া খ্যাতি সহ্য করতে পারেননি তারই সমকালীন শিল্পীগোষ্ঠীর একাংশ। ভাবতেও অবাক লাগে, তার গান চিরতরে থামিয়ে দিতে একাধিকবার হয়েছে ষড়যন্ত্র। একবার আম্বালায় গান গাইতে গিয়ে এক তবায়েফ মাস্টার মদনকে নিজের কোঠিতে ভজন গাওয়ার আমন্ত্রণ জানান এবং তাকে বিষাক্ত একটি পান খাইয়ে দেন। অনেকের মতে, মদনকে চিরতরে সরিয়ে দিতে দিল্লির রেডিও স্টেশনেও কেউ গোপনে তার দুধে মিশিয়ে দেয় পারা। এমনকি ১৯৪০ সালে কলকাতার অল বেঙ্গল মিউজিকাল কনফারেন্সের অনুষ্ঠানের সময়েও তাকে দুধে বিষ মিশিয়ে স্লো পয়েজনিং করে মেরে ফেলার চেষ্টাও চলেছিল। কারা করেছিল এসব? কারোর মতে পরিবারের লোকজন, কারোর মতে রাইভাল মিউজিশিয়ানদেরই কেউ কেউ। কলকাতার সেই অনুষ্ঠানের পর মদনের স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হয়। ধরা পড়ে দুরারোগ্য টিউবারকিউলোসিস। দিল্লিতে দিদির বাড়িতে থেকে তবুও তিনি নানা ঘরোয়া অনুষ্ঠান ও রেডিওতে গান গাওয়া জারি রেখেছিলেন। ১৯৪০ সালে সিমলায় তার অনুষ্ঠানে এমনই অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে, যে একই সময়ে সিমলায় আয়োজিত মহাত্মা গান্ধির একটি সভাতে দেখা যায় হাতেগোনা কিছু লোকের উপস্থিতি। এই ঘটনায় নাকি অবাক হয়ে গান্ধিজি নিজেই মাস্টার মদনের গান শোনার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। জানা নেই, সেই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ আদৌ বাস্তবে ঘটেছিল কিনা। কারণ, মদন নিজে তখন গুরুতর অসুস্থ, ক্ষয়রোগ ও ভেদবমির শিকার। অবশেষে দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪২ সালের ৫ জুন সিমলায় মায়ের কোলে মাথা রেখে চিরনিদ্রার দেশে পাড়ি দেয় ভারতীয় মার্গ সংগীতের বিস্ময় বালক মাস্টার মদন। পিছনে পড়ে থাকে শুধু আটটি গানের অপার ভাণ্ডার। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ১৪ বছর ৫ মাস। গোটা সিমলা জুড়ে বৃষ্টি হয়েছিল সেদিন। হাজার হাজার সিমলাবাসীদের চোখের জল মিশে গিয়েছিল তাতে। তাকে দাহ করার সময় তার মেডেল-খচিত কোর্টটিও তুলে দেওয়া হয় চিতায়। সেই বছরের শেষে পুত্রশোকে জর্জরিত মা পূরণদেবীও পাড়ি দেন অমৃতলোকে। মদনের বাবা সর্দার অমর সিং প্রায় ৪০ বছর পর দিল্লিতে দেহ রাখেন। ঘটনার প্রায় ৬০ বছর পর বিখ্যাত গজল গায়ক জগজিৎ সিং HMV থেকে ‘গজল কী সফর’ নামের একটি শতবার্ষিকী সংকলন সম্পাদনা করলে তাতে ঠাঁই পায় মাস্টার মদনের দুটি অবিস্মরণীয় গজল।
আজ এত বছর পর ভারতীয় মার্গ সংগীতের এই বিস্মৃত অধ্যায়টিকে স্মরণ করতে বসে বারবার অবাক হয়েছি এই ভেবে যে, মাস্টার মদনের মতো তরুণ প্রতিভাকেও কী রকম প্রতিকূলতা, হিংসা, স্বার্থপরতা ও পরিবারের উচ্চাকাঙ্খা তিলেতিলে শেষ করে দেয়। আজ থেকে এত বছর আগেও এ ধরনের ঘৃণ্য মানসিক অবক্ষয়ের পরিচয় যেন প্রতিমুহূর্তে চাবুক কষায় আমাদেরই। মাত্র ১৪ বছরেই নিভে গেল যে প্রতিভা, তার দায় শুধু পরিবারের উচ্চাকাঙ্খা বা হীন মনোবৃত্তির কিছু মানুষেরই নয়, দায় এই সমাজেরও যা মাস্টার মদন-এর মতো হাজার হাজার প্রতিভাকে সময়ের আগেই ঠেলে দেয় অপ্রত্যাশিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে। হয় জেত, না হয় হারিয়ে যাও—যার নীতি। যুগে যুগে এভাবেই সবার অলক্ষ্যে হারিয়ে যায় মাস্টার মদন-এর উত্তরসূরিরা। আমরাই পারি এইসব অকালে হারিয়ে যাওয়া আটকাতে, ফিরিয়ে আনতে সেইসব বিস্ময়কর প্রতিভাদের। তবেই অক্ষয়, শাশ্বত হবে ভারতীয় সংগীত, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের আগামী ভবিষ্যৎ।
।। শূন্য এ বুকে পাখি মোর।।
নজরুল জয়ন্তী এলেই এই গানটার কথা আজও ভীষণ মনে পড়ে। জানিনা কেন, শুধু এই গানটাই। অথচ নজরুল মানেই তো কত শত সহস্র অসাধারণ সব গান। জ্ঞান গোঁসাই, মানবেন্দ্র, ধীরেন বসু বা ফিরোজা বেগম-এর কন্ঠে অবিস্মরণীয় কত রচনা! কিন্তু না, অন্য কোনও গান নয়, শুধু এই গানটাই! হয়তো ‘ছায়ানট’ রাগটাই এমন, হয়তো এই গান ও তার কথাগুলো…জানিনা কেন মনে হয় কোনও ভাবেই তা এই পৃথিবীর নয়। অন্য কোনও নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে ভেসে আসা সেই সুর, সেই ‘সাঁঝ’ বা হৃদয় নিংড়ে উঠে আসা কিছু অপার্থিব শব্দযাপন!
তুই নাই বলে ওরে উন্মাদ/পাণ্ডুর হল আকাশের চাঁদ
এই গানকে নিয়েই একসময় কত তর্ক-বিতর্ক, অভিযোগ ও দোষারোপের পালা চলেছে। বিশারদরা মনে করেন এই গানের সূত্রপাতে রয়েছেন—রবীন্দ্রনাথ। ১৯০১ সালে তাঁর লেখা—’অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যাহা তাহা যায়।’ সেই অনন্য ‘ছায়ানট’। বহুজনের মতে, ভাইপো নীতীন্দ্রনাথের অকালমৃত্যু ব্যাথিত করেছিল রবীন্দ্রনাথকে। তারই উদ্দেশে লেখা হয় গানটি। অনেকে মনে করেন, প্রিয় পুত্র শমীন্দ্রের মৃত্যুতে লেখা এই গান। এ নিয়ে আগেও তর্ক-বিতর্ক ছিল, এখনও রয়েছে। কিন্তু সে সময় এই গানটি প্রবল আলোড়ন ফেলেছিল জনমানসে। গানটির সুরমাধুর্যে আলোড়িত হয়েছিলেন জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীও। তিনি শাস্ত্রীয় সংগীতের বিরাট পথিকৃৎ। গানটিকে আরও বেশি শাস্ত্রীয় অঙ্গে গাইবার জন্য—অর্থাৎ তানকারী, আলাপ-বিস্তার সহযোগে—মনস্থ করেন। ঠিক করেন, নিজস্ব স্টাইলে গাওয়া সেই গানটি স্বয়ং ‘গুরুদেব’-কে শুনিয়ে গানটি পরিবেশন করার অনুমতি চাইবেন। সেই মতো এক পরিচিতের মাধ্যমে এল সুযোগও। মন-প্রাণ ঢেলে গান গাইলেন জ্ঞান গোঁসাই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ-এর একটুও পছন্দ হয়নি। তাঁর মতে, গানটির অন্তর্নিহিত অসম্ভব যে বেদনা, হারানোকে ফিরে পাওয়ার আর্তি, জীবন দর্শন ও সর্বোপরি সুরের সেই স্থিতধী ভাব কোথাও যেন হারিয়ে গেছিল শাস্ত্রীয় রাগদারীতে। গানটির ভাব তথা সুর মাধুর্য বিঘ্নিত হয়েছে তাতে। ফলত এককথায় জ্ঞানবাবুর প্রস্তাব নাকচ করলেন তিনি।
তোর তরে বনে উঠিয়াছে ঝড়/লুটায় লতা ধূলায়
মনের দুঃখে নজরুল-এর কাছে এলেন গোঁসাই বাবু। রাখলেন আর্জি, ঠিক ওমনি একটা গান বানিয়ে দিতে হবে তাকে। কথায় ও সুরে যা রবি ঠাকুরের গানের চাইতে কোনও অংশে কম হবে না। সেই গান গেয়ে ‘গুরুদেব’-কে তাক লাগিয়ে দিতে চান জ্ঞানবাবু। হেসে ফেলেন নজরুল। বলেন, গুরুদেবের রচনার সমকক্ষ রচনা সৃষ্টির ক্ষমতা তাঁর কেন, এ দেশে কারোর নেই। তিনি চিরপ্রণম্য, অপার এক সমুদ্র যার তল মেলা ভার। কিন্তু জ্ঞান বাবু নাছোড়, ওমনিই একটা গান বেঁধে দিতে হবে তাকে, দিতেই হবে। অবশেষে রাজি হলেন নজরুল। চেয়ে নিলেন সময়। নজরুল শেষ পর্যন্ত গানটি লিখেছিলেন তাঁর পুত্র বুলবুলের অসময়ে মৃত্যুর পরে। একই ছায়ানট রাগ, অবিকল একই তার। আর কথায় যেন স্বয়ং ‘গুরুদেব’কেও ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। সৃষ্টি হল—’শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়, ফিরে আয়, ফিরে আয়’। জ্ঞানবাবু তা রেকর্ড করেন।
গোটা বাংলা উত্তাল হয়ে ওঠে সেই সুরে। বাংলা গানের জগতে আরও একটি ইতিহাস রচনা করলেন নজরুল। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির ঘনিষ্ঠ অনেকেই সে সময় এই রচনাটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এমনকি উঠে ছিল ‘সুর চুরি’র অভিযোগও। অথচ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং নজরুল-এর বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগকে কোনওদিনই আমল দেননি। সদগুণীই গুণের কদর বোঝেন। নিন্দুকেরা এরপর এসব নিয়ে কিছু বলার সাহস পাননি।
তুই ফিরে এলে ওরে চঞ্চল/আবার ফুটিবে বন ফুল দল
‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর’ আজও বাংলা গানের জগতে অবিসংবাদী প্রভাব রেখে চলেছে। দশকের পর দশক নজরুল-অনুরাগীরা নিজ নিজ সুরের তরণী ভাসিয়ে তাঁদের শ্রদ্ধা উজাড় করে দিয়েছেন এর প্রতিটি কথা ও সুরের চলনে। ‘ছায়ানট’ রাগের হাত ধরে বাংলা সংগীত জগতের দুই মহীরুহ, দুই ক্ষণজন্মা পুরুষ, দুই শোকার্ত পিতা—রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল কোথায় যেন সুরের পরতে মিলেমিশে এক হয়ে রইলেন। নিরাকার, অখণ্ড ব্রহ্মের মতো!
।। বনরাজ।।
১৯৭৬ সাল। গুজরাটের সেই প্রত্যন্ত প্রান্তর। দিকচক্রবালে মিশে যাওয়া রেললাইন। ছোট্ট জনপদ, প্ল্যাটফর্মবিহীন স্টেশন। আকাশ কালো করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ঢুকে পড়ছে রেলগাড়ি। গ্রামের নতুন পশু-ডাক্তার আসছেন। নেপথ্যে প্রীতি শর্মার কণ্ঠে—’মেরো গাঁও কথা পরে/যা দুধ কী নদিয়া বহে’…ঠিক এভাবেই শুরু হচ্ছে শ্যাম বেনেগলের বহুচর্চিত ‘মন্থন’। গুজরাট-রাজস্থান সীমান্ত ছুঁয়ে উঠে আসা সেই বিখ্যাত লোকগীতি। বহুজনের মতে, রাজস্থানী লোকগীতি ‘কেশরিয়া বালমে’র সমকক্ষ যদি কোনও গান থেকে থাকে তবে তা এটিই।
সাল ১৯৮১। উত্তর কলকাতা। সরু অলিগলি ধরে এগিয়ে আসছে হাতে টানা রিকশা। তাতে বসে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বৃদ্ধা, ভায়োলেট স্টোনহ্যাম ওরফে জেনিফার কেন্ডেল। রিকশা ছেড়ে নেমে এগিয়ে যান পুরোনো কলকাতার ব্রিটিশ জমানার বাড়ির দিকে। লিফট বন্ধ। ধীর, ক্লান্ত পায়ে অন্ধকার সিঁড়ি ভেঙে উঠতে থাকেন বৃদ্ধা। নেপথ্যে পিয়ানো কনচের্তোয় উঠে আসে তার অতীত। অদ্ভুত মন-কেমন করা সুর। অপর্ণা সেন-এর ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’-এর সুর সেই একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা ও প্রতারণার নির্মোক, উলঙ্গ চিত্রটি তুলে ধরে।
আশি দশকের মাঝামাঝি। টিভির পর্দায় আগুন ধরাচ্ছেন রঙিন ফুলছাপ শাড়ি পরিহীত লাস্যময়ী মধু সাপ্রে। ‘গার্ডেন ভরেলী’ শাড়ির বিখ্যাত সেই বিজ্ঞাপন আর ততধিক বিখ্যাত তার জিঙ্গল যা পরবর্তীকালে নতুন করে শোনা যাবে মণিরত্নমের ‘রোজা’ সিনেমায় সেই ‘রোজা জানেমন’ গানটির আবহে। এ আর রহমান নামের তরুণ এক দক্ষিণী সঙ্গীত পরিচালকের সুরে।
আশির দশকেরই শেষে ভীষ্ম সহানীর অমর রচনা অবলম্বনে গোবিন্দ নিহলানীর ‘তমস’ (১৯৮৮) মুক্তি পেল। পার্টিশান নিয়ে নির্মিত দেশের দীর্ঘতম টেলি-সিরিজ। আর সেখানেও উঠে আসছে পঞ্জাবের লোকগীতি আর স্বজনহারাদের বিষাদের মেলবন্ধনে রচিত অমোঘ সেই সুর।
এবার ১৯৯৬। দাঙ্গা কবলিত দিল্লি। বিক্ষোভকারী জনতার ছোঁড়া পাথরে রক্তাক্ত, আহত হয়ে লুটিয়ে পড়লেন ‘সরদারী বেগম’। তার শেষ সময় আগত। মেয়ে সাকিনার কাছে শুনতে চান গান। কান্নাভেজা গলায় সাকিনা গান ধরে ভৈরবীতে—’চলি পি কে নগর’…শ্যাম বেনেগালের ‘সরদারী বেগম’ যত না নির্দেশনা ও অভিনয়ের জোরে, তার চেয়ে অনেক বেশি আলোকিত হয়ে উঠলো তার সঙ্গীতের জাদু কাঠির ছোঁয়ায়।
সুদীর্ঘ চার দশক ধরে এভাবেই বলিউডে স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রমী স্থান ধরে রেখেছেন বনরাজ। বনরাজ ভাটিয়া। দেশের অন্যতম বিশিষ্ট ও প্রবীণ সুরকার তিনি। চার দশকে হাতেগোনা ২০-২৫টি সিনেমাতে তিনি সুর দিলেও, তার প্রগাঢ় সাঙ্গীতিক জ্ঞান, মেধা, দীক্ষা এবং যন্ত্রের উপর অসামান্য দক্ষতা, নজরকাড়া মুনশিয়ানায় বলিউডে আলাদা মান ও সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছিলেন বনরাজ। একসময়ে নির্দেশক শ্যাম বেনেগল-এর সার্থক এবং একমাত্র ‘জুড়িদার’ ছিলেন বনরাজ। বেনেগলের ছবি মানেই সঙ্গীতে তিনি। ‘অঙ্কুর’ (১৯৭৪), ‘জুনুন’ (১৯৭৮), ‘ভূমিকা’ (১৯৭৭), ‘মাণ্ডি’ (১৯৮৩) অথবা গোবিন্দ নিহাললীর ‘দ্রোহকাল’-এ (১৯৯৪) তাঁর সুরসংযোজন অসাধারণ। ‘সুরজ কা সাতওয়ান ঘোড়া’র ‘ইয়ে শামে’ গানটি আজও অন্যতম সেরা লাভ সং রূপে পরিচিত। এখানেই শেষ নয়। ক্লাসিক কমেডি ‘জানে ভি দো ইয়ারো’ (১৯৮৩), দেশভাগের উপাখ্যান ‘তমস’ বা বাঈজী সংস্কৃতির শেষ স্বাক্ষর ‘সরদারী বেগম’-এ (১৯৯৬) তাঁর সঙ্গীত অবিস্মরণীয়। ‘তমস’ বনরাজকে এনে দিয়েছিল জাতীয় পুরস্কারের স্বীকৃতি। এরপর একে একে তাঁর অসামান্য কীর্তির জন্য পেয়েছেন বি এফ জে অ্যাওয়ার্ড, সঙ্গীত নাটক আকাদেমী ও পদ্মশ্রীর মতো অনন্য সম্মান।
১৯২৭ সালের ৩১মে মুম্বইতে জন্মানো বনরাজ ভাটিয়া আজ ৯২ বর্ষীয় অশীতিপর বৃদ্ধ। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানতে পারলাম অসহায়, একাকী, নিঃস্ব অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন লন্ডনের রয়াল অ্যাকাডেমী অফ মিউজিকের এই গোল্ড মেডেলিস্ট। বলিউডে পা রাখার আগে বহু আগে ষাট দশকে যিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা পাঁচ বছর মিউজিক ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপনা করেছেন, আজ তিনি নিজেই প্রতিদিন একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছেন বিস্মৃতির অতল অন্তরালে। হাঁটুর ব্যথায় জর্জরিত, ধরেছে হৃদরোগ, আংশিক স্মৃতিভ্রংশ, চলা-ফেরায় সমস্যা সহ নানা শারীরিক জটিলতা। তার চেয়েও বড়ো সমস্যা ক্রমে নিঃস্ব, কপর্দকহীন হয়ে পড়েছেন বনরাজ। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ব্যাংকের খাতায় এক টাকাও জমা নেই তার। বহুদিন ধরে ভালো করে খাওয়া জোটে না আর। নিজের বলতে দীর্ঘদিনের এক বিশ্বস্ত পরিচারক। অতীতে ঠিক একই রকমভাবে তিলেতিলে সবার অলক্ষ্যে হারিয়ে গেছিলেন আরেক বিস্ময়কর সুরকার অজিত বর্মন। কেউ তার খোঁজও রাখেনি। বলিউডে এই ধরনের ঘটনা নতুন বা অস্বাভাবিক কিছু না। কথায় আছে না—”সেনোরিটা! বড়ে বড়ে দেশো মে অ্যায়সি ছোটি ছোটি বাত হোতি রহতি হ্যায়!”
তবু সৌভাগ্যের বিষয়, ‘মিড ডে’-র সেই প্রতিবেদন পড়ে এগিয়ে এসেছেন বহু মানুষ। এগিয়ে এসেছেন বলিউডের বহু নামজাদারা। দেশ-বিদেশ থেকে ক্রমেই সাড়া দিচ্ছেন, অকৃপণ নিঃস্বার্থ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন বনরাজ ভাটিয়ার অসংখ্য গুণগ্রাহীরা। তাঁকে নিয়ে একটি বিশেষ সাম্মানিক গ্রন্থপ্রকাশের পরিকল্পনাও নেওয়া হচ্ছে। গড়া হচ্ছে ‘ফাণ্ড’। সকলের একটাই উদ্দেশ্য—এইভাবে যেন সবার অলক্ষ্যে বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে না যান সুরকার বনরাজ ভাটিয়া। আবারও যেন তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। সঙ্গীতে ফিরে আসতে পারেন পুনরায়।
সেই একই প্রার্থনা কলমচিরও। এই লেখার মাধ্যমে সেই বিরল সঙ্গীতসাধকের প্রতি অফুরান শুভ কামনা, শ্রদ্ধার্ঘ্য ও তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। আবারও স্বমহিমায় ফিরুন বনরাজ। আবারও যেন শুনতে পারি আমরা পিয়ানোর সামনে বসে তিনি গাইছেন, শ্যাম বেনেগলের ‘সূরজ কা সাতওয়া ঘোড়া’ চলচ্চিত্রে তাঁরই দেওয়া সেই অপার্থিব সুর—
ইয়ে শামে সব কি সব শামে
ক্যয়া ইনকা কোই অর্থ নহি?
ঘবড়াকে তুমহে যব ইয়াদ কিয়া
ক্যয়া উন শামো কা অর্থ নহি?…
।। আমিনা পেরেরা।।
আমিনা আন্টিকে প্রথম দেখি হাওড়া স্টেশনে। আজ থেকে প্রায় সাত-আট বছর আগে। সেবার আমাদের প্রথম মাইহার যাত্রা। আমরা মানে আমি, উদয়, চন্দনাদি (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাটেক বিভাগের অধ্যাপিকা চন্দনা সেনগুপ্ত)। ছিল সিরাজ ও সায়কও। সেবার মাইহার মিউজিক কনফারেন্সে সিরাজ (ধ্যানেশ বাবুর সুযোগ্য পুত্র সিরাজ আলি খান) বাজিয়েছিল। এবং এককথায় তা অসাধারণ। তাদের সঙ্গেও তখনই আলাপ। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে মধ্যমণি ‘তিনি’। আমাদের মতো নেহাতই অনভিজ্ঞদের তিনিই মাতৃসম পথপ্রদর্শক। আমাদের সবার আমিনা আন্টি।
প্রথম আলাপেই তাকে ‘আন্টি’ বলে ডেকেছিলাম। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সেই প্রথম আলাপের ঘোর কাটতে চাইছিল না সহজে। ইনিই সেই আমিনা পেরেরা, যার কথা এত শুনেছি! কিংবদন্তি সরোদবাদক উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের মেয়ে, ‘বাবা’ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের নাতনি, অন্নপূর্ণা দেবী যার পিসি। মাইহার ঘরানার সঙ্গে যার সম্পর্ক পরতে পরতে। আমাদের মতো তুচ্ছ মানুষদের কাছে এই সান্নিধ্য পরম ভাগ্যের বিষয়।
কিন্তু যতই তাকে দেখেছি, অবাক হয়েছি আরও বেশি। বিশ্ববিখ্যাত শাস্ত্রীয় সংগীত ঘরানা ও পরিবারের সদস্যা, অথচ কী মাটির মানুষ। যেন কতদিনের চেনা। কী প্রশান্তি তার মুখে, কী ব্যাপ্তি তার কথায়, কী স্নেহ-মায়া-মমতায় গড়া সেই ব্যক্তিত্ব। সারা রাস্তা এক সঙ্গে গল্প করতে করতে আসা। কত কথা। কত অজানা ইতিহাস। ওনার ছোটোবেলা, দাদু (আলাউদ্দিন খাঁ)-র গল্প, দিদিমা (মদিনা বেগম)-এর গল্প, প্রবাদপ্রতিম পিসি-বাবা-দাদাদের কথা। এবং অবশ্যই মাইহারের গল্প। উনি বলছেন, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছি আমরা। চোখের সামনে যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল সমগ্র মাইহারের সাংগীতিক সাম্রাজ্য। সময় কেটেছিল অজান্তে।
মাইহারে নেমে আগে গেছিলাম ‘আশ্রমে’। বাবা উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের স্মৃতিবিজড়িত বাসস্থান-‘মদিনা ভবন’। সেই বাড়ি যেখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন রবিশংকর আলি আকবর নিখিল ব্যানার্জি যতীন ভট্টাচার্য পান্নালাল ঘোষ আশিস খাঁ ধ্যানেশ খাঁ-র মতো কিংবদন্তি শিল্পীরা। আজও যেখানে কান পাতলে সেতার-সরোদ-বাঁশির আওয়াজ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। আমিনা আন্টি নিজে সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে ছিলেন। এমনকি রাতে নিজের হাতে রেঁধে খাইয়েও ছিলেন পরম যত্নে। যত না আয়েশ, তার চেয়ে বেশি বিস্ময় জড়িয়ে প্রতিটি পদে। সেই স্বপ্নের পরিবেশ, সেই বাড়ি, সেই অজস্র স্মৃতি সব যেন মিলেমিশে একাকার। পরে, একে একে সারদা দেবীর আশ্রম, মাইহার কেল্লা, মিউজিক কনফারেন্স সব স্বপ্নের মতো কাটল। আলাপ হল বহু মানুষের সঙ্গে। প্রাণেশ কাকা (বিখ্যাত তবলিয়া প্রাণেশ খাঁ) তাদের অন্যতম। সিরাজের সঙ্গে তার সঙ্গত ভোলার নয়। এর মাঝেই বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের মাজারে ফুল চড়ানো, প্রার্থনা করা, মাইহার ঘুরে দেখা সব একে একে সুসম্পন্ন। এক সময় একসঙ্গে ফিরেও এলাম কলকাতায়।
এরপরে আমিনা আন্টির সেই রানিকুঠির বাড়ির দরজা অবারিত হয়ে যায় আমাদের কাছে। চন্দনাদি তাঁর বহুদিনের ছাত্রী। তার কাছে এসব পূর্ব-পরিচিত। কিন্তু আমার মতো নভিসের কাছে তা সরস্বতীর আপন দেশ। কতদিন হয়েছে রবিবার-রবিবার ছুটে গেছি সেখানে। আমি তার ছাত্র হতে পারিনি কখনও, কিন্তু তা বলে কখনও কোনও আড়াল টানেননি তিনি। বরং নিজের থেকে দেখিয়ে দিয়েছেন বহু রাগের চলন, সরগম, তান বা মীড়খণ্ডের আসল রূপ। সেতারকে তার হাতে কথা বলতে শুনেছি। বিস্ময়ে কেটে গেছে অগুনতি সময়। না চাইতেও দিয়ে গেছেন অনেক কিছু, অবারিত হাতে।
সম্প্রতি, প্রয়াত হয়েছেন আমিনা আন্টি। বন্ধু সিরাজের ফেসবুক পোস্ট থেকে জানতে পারি এই দুঃসংবাদের কথা। বহু কথা মনে পড়ে যাচ্ছেসেই সূত্রে। এইসব মানুষের কথা কতটাই বা জানি আমরা। প্রচারের আড়ালে থেকে যারা এগিয়ে দিয়েছেন তার ঘরানাকে। সিরাজ, সায়ক, দিশারী বা দেবাঞ্জন এই ঘরের ছেলে। আমার চাইতে অনেক বেশি সান্নিধ্য পেয়েছে তারা এই মহিয়সীর। তারা ভাগ্যবান। আমার সামান্য প্রাপ্তির ঝুলি ঘেঁটে আমিনা আন্টিকে এইটুকু শ্রদ্ধাঞ্জলি। আমিনা আন্টি, যেখানেই থাকুন আমার স্থির বিশ্বাস সেখানে আবার নতুন করে সেতার বেজে উঠবেই…নাম না জানা রাগে।
।। আমার গুরুমা।।
ইদ আসলে আমার চাচির কথা খুব মনে পড়ে।
আমার গুরুমাকে চিরকাল ‘চাচি’ বলে ডেকে এসেছি। জানি না কেন কখনও ‘মা’ বলে ডাকতে পারিনি। অথচ আমার গুরু উস্তাদ মতিউর ইসলম সাহেবকে প্রথম দিন থেকে ‘আব্বা’ বলেই ডেকেছি। ইদ আসলেই এখন খুব চাচির কথা মনে পড়ে। অত্যন্ত বিদূষী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলা। খুব গরিব ঘরের মেয়ে। ভালো ছাত্রী ছিলেন। সেই সময়কার বি এ, বি টি। বজবজের কাছে একটি স্কুলে পড়াতেন। মনে আছে, সকাল সকাল নামাজ, স্নান সেরে, রান্নাবান্না করে অপেক্ষা করতেন। সে যে কত রকমের পদ তা গুনে শেষ করা যেত না। আমিও সেই লোভে লাফাতে লাফাতে হাজির হতাম। কাবাব, বিরিয়ানি, সিমাইয়ের পায়েসের গন্ধে ম ম করত ঘর। কিন্তু তা হলে কী হবে, সামনে ঠিক মূর্তিমান বিভীষিকার মতো ‘আব্বা’ দাঁড়িয়ে। কড়া হুকুম হত—”বিরিয়ানি পরে হবে। আগে দেখি নতুন যে ‘পালটা’ শেখালাম সেটা উঠেছে কিনা। আগে রেওয়াজ, পরে কাবাব।” হা হতো’স্মি! ইদেও ছাড় নেই! অগত্যা আব্বার পিছন পিছন ব্যাজার মুখে সরোদ নিয়ে বসে পড়া ও ঝাড়া তিন ঘন্টার ভয়ংকর সিটিং। প্র্যাকটিস করব কী, খাবারের গন্ধে তখন মধ্যপ্রদেশে খণ্ডযুদ্ধ। যতবার পালটা সাধতে যাচ্ছি, তত হচ্ছে ভুল, ততই চড়ছে আব্বার মেজাজ—’শুধু বিরিয়ানি, মণ্ডা-মিঠাই খেলেই হবে। রেওয়াজ কে করবে শুনি। এসব কি বাজনা হচ্ছে? ভুতের কেত্তন?” যখন আর পারা যাচ্ছে না, খিদের চোটে প্রাণপাখী খাঁচাছাড়া হবার জোগাড় তখনই ত্রাতার ভূমিকায় আসরে নামতেন চাচি। খুব ঠান্ডা গলায় বলতেন ”ছেলেটা সকাল থেকে কিছু না খেয়ে বসে আছে। খেয়ে উঠেও তো বাজাতে পারে। মা সরস্বতী রাগ করবেন না। ইদের দিনে কি এতটুকু সহজ হওয়া যায় না?” সামান্য জিজ্ঞাসা আর তাতেই ‘ম্যাজিক’। আব্বা হুকুম করলেন ”যাও, খেয়ে উদ্ধার করো। তোমার চাচির কথার উপর তো কথা নেই।” শুধু বলারই অপেক্ষা। লাফিয়ে উঠে গপাগপ খেতে শুরু করে দিতাম। চাচি আদর করে পরম মাতৃস্নেহে এই পদ, সেই পদ তুলে দিতেন পাতে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন—”খা বেটা…ভালো করে খা। আর শোন, মন দিয়ে রেওয়াজ করিস বাবা। পালটা তুলতে পারলে কিমা রেঁধে খাওয়াব। রেওয়াজ করবি তো বল?”
আজ এত বছর হয়ে গেছে ওই স্পর্শ এখনও ভুলিনি। বয়স হয়েছে দুজনেরই, কিন্তু সেই ভালোবাসা আজও অমলিন। বিয়েতে এসেছিলেন। আমার স্ত্রী সুদেষ্ণাকে অনেক আদর, আশীর্বাদ করেছেন। শেষবার কলকাতা গিয়ে দেখা করে এসেছি। কিন্তু আজও ইদের সময় এই মানুষ দুটোর কথা খুব মনে পড়ে। ‘আম্মি’ বলে ডাকতে ইচ্ছা করে খুব সেই মানুষটাকে। ১৫০০ কিমি দূরে সুদূর দিল্লির এই ঘরের এককোণে রাখা সরোদটার দিকে তাকিয়ে খুব চাচির কথা মনে পড়ছে আজ। আমার চাচি, যাকে আমি কখনও ‘মা’ বলে ডাকতে পারিনি।
ইদ মুবারক আব্বা…ইদ মুবারক আম্মি!
।। অমল দত্তের তবলা।।
অমল ‘ডায়মন্ড’ দত্ত চলে গেছেন, বহুদিন হল। সঙ্গে নিয়ে একুশ তোপের সেলামী। ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটা যুগের অবসান। না, আমি তার কিংবদন্তি ফুটবল কোচিং বা ‘ম্যান মার্কিং’ নিয়ে বিশ্বমানের চিন্তা ভাবনা বিষয়ে কোনও ভাবগম্ভীর আলোচনা করতে বসিনি। সে দুঃসাহস বা যোগ্যতা আমার নেই। টিভিতে দত্তবাবুর শেষযাত্রা দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা কথা মনে পড়েছিল যা না বলে পারছি না। খুব কম লোকই জানেন যে অমল দত্ত ভালো ফুটবলার ও কোচের পাশাপাশি কিন্তু অসাধারণ ভালো তবলিয়া ছিলেন। সম্ভবত ওনার বাবার কাছে তালিম পেয়েছিলেন। বিদ্বজ্জনেরা ভালো বলতে পারবেন নিশ্চয় এ বিষয়ে।
বহুবছর আগে, খুব সম্ভব দূরদর্শনে একটা অসাধারণ অনুষ্ঠানের সাক্ষী হয়েছিলাম। যতদূর মনে পড়ে পয়লা বোশেখের একটা অসামান্য প্রোগ্রাম। তাতে বিখ্যাত ফুটবলারদের ত্রয়ী-বাদন। গানে সুকুমার সমাজপতি, তবলায় অমল দত্ত ও তানপুরায় পি কে ব্যানার্জি। সুকুমারবাবু নিজে অত্যন্ত সুগায়ক। তার ছেলে সন্দীপন সমাজপতিও গুণী শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী। সেদিন খুব সুন্দর কিছু বাংলা রাগাশ্রয়ী গান গেয়েছিলেন সুকুমারবাবু। পি কে-কে দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে উনি এসবে খুব একটা অভ্যস্ত নন। তবু যথাসাধ্য হাসি মুখে তানপুরা ছাড়ছিলেন। আর এক কথায় অনবদ্য ছিলেন অমলবাবু। আহা, এমন যোগ্য সঙ্গত খুব কম শুনেছি। আলতো ঠেকার মাঝে ফারুক্কাবাদ ঘরানার কী সুন্দর সব কাজ, পেশকার, বোলবাট। মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম সেদিন। সেই বাজনা শুনলে কে বলবে ইনি দেশীয় ফুটবলে বিশ্বমানের সেই ‘ডায়মন্ড’ চক্রব্যূহের স্রষ্টা। আজ সে কথা আরও একবার মনে পড়ে গেল। দুর্ভাগ্য, ‘ইউটিউব’ ও ‘গুগল’ ঘেটে অনেক চেষ্টা করেও সেই রেকর্ডিং উদ্ধার করতে পারলাম না।
‘গানের ওপারে’ আদৌ যদি কিছু থেকে থাকে, তবে এতক্ষণে ফুটবলের পাশাপাশি দেবাসুরগণকে তবলার তালে তাল মিলিয়ে ৪-১-২-১-২ ছন্দে গোল দেওয়া শেখাতে শুরু করেছেন অমল দত্ত। নতুন ‘হীরক’ জয়ন্তী শুরু হল বলে।
।। কৌতুক গীতি।।
ভারতীয় মেইনস্ট্রিম সিনেমায় ‘মুভি মিউজিক’-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অথচ ‘অবহেলিত’ পর্বটি হল ‘কৌতুক গীতি’ বা কমিক বা স্যাটায়ারিকাল কম্পোজিশন। জানি বিষয়টি নিয়ে বহু তর্ক-বিতর্ক উঠবে, তবু আলোচনার স্বার্থে বলা যেতেই পারে যে গল্পের খাতিরে যেমন রোম্যান্টিক, স্যাড সং বা দুঃখের গান, ভক্তিগীতি বা ডিভোশনাল সং, নেচার সং এমনকি ইরোটিক সং-ও বারবার উঠে এসেছে, তেমনই কিন্তু ভারতীয় সিনেমায় নিজের স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন সিনেমায় উঠে আসা ‘কমিক-কম্পোজিশন’ বা কৌতুক গীতির ব্যবহার। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই বিশেষ পর্যায়টির গান নিয়ে লোকজনের মধ্যে তেমন কোনও উৎসাহ বা হেলদোল আজকাল আর চোখে পড়ে না। এ বড়ো দুঃখের। হয়তো দৈনন্দিন জীবন থেকে নির্ভেজাল হাসি-ঠাট্টা-মশকরার রসদ ক্রমে নিম্নমুখী হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন থেকে…দ্রুত…খুব দ্রুত…
মনে করে দেখুন, কিশোর কুমার-এর ‘হাফ টিকিট’ (১৯৬২) সিনেমার সেই ‘চিল চিলচিল্লাকে কাজরে শুনায়ে’র মতো ‘ননসেন্স ভার্স’ বা ‘জিদ্দি’ (১৯৬৪) সিনেমায় মেহমুদ-এর লিপে মান্না দে-র কন্ঠে দরবারী কানাড়া রাগে ‘প্যার কি আগ মে তন বদন জ্বল গয়া’র কথা। মনে করুন, সুনীল দত্ত ও সায়রা বানুর ‘পড়োসন’ (১৯৬৮) সিনেমায় রাহুল ‘পঞ্চম’ দেব বর্মণ-এর সেই অসাধারণ ‘কাল্ট কম্পোজিশন’ —’এক চতুরনার বড়া হোশিয়ার’-র মতো গান, যাকে অমরত্ব দিয়েছিলেন মান্না দে ও কিশোর কুমার-এর মতো গায়কেরা। বেহাগ, বাগেশ্রী, দেশ ও ছায়ানটের মতো একাধিক রাগের মিশ্রণ (মিশ্ররাগ) ছিল তাতে। বাংলাতেও এমন দৃষ্টান্ত কম নেই। সত্যজিৎ রায়-এর ‘গুগাবাবা’ (১৯৬৯) থেকে ‘হল্লা চলেছে যুদ্ধে’ বা ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ (১৯৭২) সিনেমায় ‘কৃপা করে করো মোরে রায় বাহাদুর’ গানগুলো তালিকার শীর্ষে থাকবে। আজ হঠাৎই এই হাসির গানের প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল এই গানটি—’ম্যয় হু নম্বর এক গবাইয়া’-র মতো অসাধারণ মজাদার অথচ অখ্যাত গানটির কথা।
১৯৯৬ সালে রিলিজ হয় ডেভিড ধাওয়ান-গোবিন্দা জুটির আরও একটি ব্লকবাস্টার ছবি ‘সাজন চলে শ্বশুরাল’। একটা সময় ছিল যখন ডেভিড ধাওয়ান আর গোবিন্দা মানেই সিনেমা সুপারহিট। এ ছবিও তার ব্যতিক্রম নয়। গোবিন্দা একাই একশো, আর তার সাথে তুমুল পাল্লা দিয়ে সতীশ কৌশিক, কাদের খান, শক্তি কাপুর-এর অভিনয়। দর্শকেরা হাসতে হাসতে চেয়ার উলটে লুটোপুটি খেত। শুধু সিনেমাই নয়, ব্যাপক হিট হয়েছিল ‘সাজন চলে’ শ্বশুরাল-এর গানুগলিও। নাদিম-শ্রবনের সুরে, সমীরের লেখায় ছবির গানগুলি রীতিমত লোকেদের মুখে মুখে ফিরত। কিন্তু এত কিছু হওয়া সত্ত্বেও কোথাও যেন হারিয়ে গেছিল ‘ম্যায় হু নম্বর এক গবাইয়া’-র মতো অসম্ভব মজাদার, হাস্যকৌতুকে ভরপুর অথচ কঠিন রাগাশ্রয়ী গানটি। এও এক বিস্ময়!
সিনেমার গল্পে জানা যায়, অনেকটা ‘গুগাবাবা’র আদলে ‘শ্যামসুন্দর’ ওরফে ‘শ্যাম’ (গোবিন্দা)-র কথা, যে তার দক্ষিণী তবলাবাদক বন্ধু ‘মুত্তুস্বামী’ ওরফে ‘মুত্তু’ (সতীশ কৌশিক)-এর সঙ্গে বম্বে এসেছে গায়ক হবে বলে। ঘটনাচক্রে, একটি রেকর্ড কোম্পানির অনুষ্ঠানে তাদের ট্যালেন্টের পরিচয় দিতে গিয়ে মুখোমুখি সংঘাত—গানের লড়াইয়ে নামতে হয় এক জাঁদরেল শাস্ত্রীয় সংগীতের ওস্তাদের (শক্তি কাপুর) বিরুদ্ধে। সৃষ্টি হয় ‘ম্যায় হু নম্বর এক গাওয়াইয়া’। গানটি গেয়েছিলেন নব্বই দশকের অন্যতম বিখ্যাত গায়ক বিনোদ রাঠোর (যিনি ততদিনে ‘আশিকি’, ‘সাজন’ ও ‘দিওয়ানা’তে গেয়ে জনপ্রিয়), নবাগত কুনাল গাঞ্জাওয়ালা ও পণ্ডিত সত্যনারায়ণ মিশ্র। অদ্ভুত মুনশিয়ানায় গানের কথা সাজিয়ে ছিলেন সমীর।
এক কথায় গানটি ছিল সবদিক দিয়ে ব্যতিক্রমী। সেই সময় ওই ধারার সিনেমায় (পপুলার কমেডি) এই রকম কঠিন রাগাশ্রয়ী গানের ব্যবহারের কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। তাও এমনি সেমনি রাগ নয়, একেবারে দরবারী কানাড়ায় বানানো হয়েছিল গানটি। তেমনি মজাদার লিরিক। শুনতে মজার হলেও গানটি ছিল অত্যন্ত কঠিন। বিনোদ রাঠোর নিজে দীর্ঘদিন তাঁর বাবা পণ্ডিত চতুর্ভুজ রাঠোর-এর কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিলেও এ জাতীয় গান আগে কখনও গাননি। সদ্য সদ্য ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখা কুনাল গাঞ্জাওয়ালাকে রাখা হয় সাপোর্টিং ভোকাল হিসেবে। আসল দায়িত্বটি নিয়েছিলেন পণ্ডিত সত্যনারায়ণ মিশ্র। দরবারীর বক্রতান, সরগম বিন্যাস ও সর্বোপরি তারানার অংশটিতে জাঁদরেল ওস্তাদের লিপে অসাধারণ গায়কির পরিচয় রাখেন মিশ্র। অথচ লোকে তাঁকে কবেই ভুলে গেছে। ভুলে গেছে, অমিতাভ বচ্চনের ‘নমকহালাল’ (১৯৮২) সিনেমায় বাপি লাহিড়ির সুরে সেই বিখ্যাত ‘পগ ঘুংরু বাঁধ মীরা নাচিথি’ গানে কিশোর কুমার-এর পাশাপাশি তার গানের কথা। সেই গানে একটি বেশ শক্ত ‘তানকর্তব’ ছিল যা তিনিই গেয়েছিলেন। লোকে কিশোর কুমারকে মনে রাখলেও ভুলে গেছে সত্যনারায়ণ মিশ্র নামের এই অসম্ভব প্রতিভাবান শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পীটির কথা, যার কাজই ছিল শক্ত শক্ত রাগাশ্রয়ী গানে ‘সাপোর্টিং ভোকাল’ রূপে কাজ করা। বছর আট-নয় আগে নিতান্তই অবহেলায়, অনাদরে মারা যান সত্যনারায়ণ মিশ্র।
কিন্তু এত কিছু বাঁধা কাটিয়েও শেষপর্যন্ত সার্থকতা পায় ‘ম্যায় হুঁ নম্বর ওয়ান’ গানটি। সিনে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবল প্রশংসিত হন সেই সময় গানটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রত্যেক কলাকুশলী। সমস্ত কাগজে গানটি নিয়ে উঠে আসে একাধিক ‘পজেটিভ রিভিউ’। পায় সেরা গানের জন্য ফিল্মফেয়ার এওয়ার্ডের নমিনেশন। প্রশংসিত হন রাঠোর ও মিশ্র, দরবারী কানাড়ার এমন স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রমী গায়নের জন্য। তবে তা অল্প কিছুদিনের জন্যই। তারপরেই বিস্মৃতির আড়ালে কোথায় যেন হারিয়ে যায় গানটি। আরও হাজার হাজার গানের মতোই
সাধারণ দর্শককে হাসিতে ভরিয়ে তুললেও গানটি সে অর্থে কখনও যোগ্য স্বীকৃতি পায়নি। মানুষও একসময় ধীরে ধীরে ভুলে যায় বলিউডের অন্যতম সেরা এই ‘কমিক কম্পোজিশন’টিকে, যা আদতে হয় দরবারী কানাড়ার দুর্লঙ্ঘ, দুরুহ ভিতের উপর তৈরি। আজও যা বিস্ময়কর মুগ্ধতায় ভরপুর।
।। ইউফনি।।
কোনও একটি সিনেমা দেখার পর মোটামুটি দু’রকম প্রতিক্রিয়া উঠে আসে। এক, ভালো লাগা এবং অবশ্যই ভালো না লাগা। কিন্তু বহু ‘ভালো না লাগা’ সিনেমার মধ্যেও এমন কিছু বিশেষ পর্ব থাকে, যা আমাদের গভীরভাবে স্পর্শ করে। অমিতাভ বচ্চন-অনিল কাপুরের ‘আরমান’ (২০০৩) সেই রকমই একটি সিনেমা। ‘আরমান’ যখন রিলিজি করেছিল তখন আমার মাস্টার্স শেষ হওয়ার পথে। চিকিৎসক পিতা পুত্রের আদর্শ, তাদের স্বপ্ন, প্রতিকূলতা, ভালোবাসা ও উত্তীর্ণ হওয়ার গল্প শুনিয়েছিল ‘আরমান’। সেই অর্থে এর গল্প বা ‘সিনেম্যাটিক ট্রিটমেন্ট’ তেমন ভালো না লাগলেও পিতা-পুত্রের অদ্ভুত কেমিস্ট্রি কিন্তু মন্দ লাগেনি। আর অদ্ভুতভাবে টেনেছিল ‘ইউফনি’। সিনেমাটির মিউজিকের দায়িত্বে ছিলেন শঙ্কর-এহসান-লয়, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে রাজু সিং। জাভেদ আখতার-এর কথায় সিনেমার গানগুলি হিট হয়েছিল। তবে গভীরভাবে ছুঁয়ে গেছিল ‘ইউফনি’ অংশটি।
কাজ থেকে ফেরা ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ছেলেকে বাবা পরামর্শ দিচ্ছেন সংগীতের নিভৃত, শান্তির আশ্রয়ে বসতে। বলছেন, এই সেই আশ্রয় যা সারাদিনের সব ক্লেদ, দুঃখ, মনস্তাপ ভুলিয়ে দিতে সক্ষম। পথ দেখাতে সেই পিতা নিজের হাতে তুলে নেন বেহালা, ছেলের ঠোঁট স্যাক্সোফোন। তারপর উঠে আসে মিনিট তিনেকের এক অসাধারণ যুগলবন্দী। রাগ ইমনে কর্ণাটকী ভায়োলিন আর স্যাক্সোফোনে এমন অসাধারণ ও ব্যতিক্রমী দ্বৈত-বাদন খুব কম শোনা যায়। এর প্রত্যেকটি স্ট্রোক, নোট, মীড়খণ্ড ও পুকার এতটাই নিখুঁত যে বহুদিন তার রেশ রয়ে যায় মনে। যিনি ‘স্যাক্স’ বাজিয়েছেন তার তুলনা নেই। বেহালাবাদকের জন্য যে কোনও প্রশংসাই কম মনে হয়। বহুবার চেষ্টা করেছি, এই অনবদ্য বাদনের নেপথ্যে কারা রয়েছেন তা জানার…দুর্ভাগ্য, সমায়াভাবে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আজও, এতদিন পরেও এই অসাধারণ কম্পোজিশন মনে গেঁথে রয়েছে। দুই সেরা অভিনেতা তাদের মতো করে যথাসাধ্য ঢেলে দিয়েছেন দৃশ্যটিকে সার্থকতা দিতে।
‘ইউফনি’র অর্থ শ্রুতিমাধুর্য। কিন্তু আমার কাছে তা আরও বেশি কিছু। যতবার এই ছোট্ট পিসটি শুনি, আমার নিজের ছেলের কথা মনে পড়ে। জুনে সে দু’বছরে পা দেবে। আমার থেকে অনেকটা দূরে, তার মায়ের পাশে এখন সে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। আর আমি রাত জেগে জেগে সেই দিনটার জন্য অপেক্ষা করে থাকি, যেদিন দিনের শেষে ঘরে ফিরে বাপ-ব্যাটাতে একসাথে রেওয়াজে বসবো। যুগলবন্দীতে হবে সমানে সমানে লড়াই। তারপর, ইচ্ছে করে ভুল করব, সরগমে, বেসুরো হব আর হাসতে হাসতে আমার ছোটোখাটো ভুলচুকগুলো ধরিয়ে দেবে সে। ছেলের সেই হাসিতে আমিও মেলাবো তাল…সুর…লয়!
এর চেয়ে ভালো ‘ইউফনি’ আর কি হতে পারে…তাই না! সেই দিনটার অপেক্ষায় আমি রাত জেগে স্বপ্ন দেখতে থাকি। আজও…ভীষণভাবে!
।। দ্য ওয়াটার।।
১৯৫৫ সাল।
সত্যজিৎ রায়-এর কালজয়ী ‘পথের পাঁচালী’র পথচলা শুরু। সংগীত পরিচালনায় রবিশঙ্কর (১৯২০-২০১২)। তখনও তিনি ‘পণ্ডিত রবিশঙ্কর’ হয়ে উঠেছেন কিনা সন্দেহ। কারণ ওপেনিং ক্রেডিট ছিল ‘পণ্ডিত’ বর্জিত। কিন্তু রবিশংকর, রবিশংকরই। তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ‘মাইলস্টোন’ গড়েছিল ছবিটির সংগীতও। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে রচিত রবিশংকর-এর সুরে ‘পথের পাঁচালী’র কালজয়ী থিম মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল তামাম সিনেমা-প্রেমীদের। আজও সে মুগ্ধতা অটুট।
রবিশঙ্করের সেতার ও অলোকনাথ দে-এর বাঁশি—এই দুইয়ের সঙ্গমে, সুর-উচ্ছ্বাসে সেই অপার্থিব আবহের সৃষ্টি। যার সুরের মায়াজাল অমরত্ব দিয়েছিল বিভূতিভূষণের নিশ্চিন্দিপুরকে। সেই সুরবিন্যাসে প্রাণ পেয়েছিল ‘হরিহর’, ‘সর্বজয়া’, ‘অপু’, ‘দুর্গা’ ও ‘ইন্দিরা ঠাকরুন’-এর মতো চরিত্রগুলি।
বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ‘পথের পাঁচালী’র জন্য অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবহ সংগীতের শিরোপা আজও তাই রবিবাবুর দখলে।
১৯৯৭ সাল।
মুক্তি পেল ‘টাইটানিক’। জেমস ক্যামেরন-এর ম্যাগনাম ওপাস। ‘পথের পাঁচালী’র মুক্তির পাক্কা ৪২ বছর পরে। ডুবন্ত জাহাজে ভয়, আতঙ্ক, মৃত্যুমিছিল ছাপিয়ে উঠে এল ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও নির্ভরতার জয়গান। ‘রোজ বিউটেকার’ (কেট উইন্সলেট) আর ‘জ্যাক ডসন’ (লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও)-এর ভুবনজয়ী প্রেম-আখ্যানে আপ্লুত হয়েছিল গোটা পৃথিবী।
চিত্রনাট্য, অভিনয় ও পরিচালনার পাশাপাশি সংগীতেও চরম উৎকর্ষের নজির রেখেছিল ‘টাইটানিক’। ছবির সংগীত পরিচালনার জন্য প্রশংসা কুড়িয়ে ছিলেন জেমস ‘রয়’ হর্ণর (১৯৫৩-২০১৫)। তার সুরে বিখ্যাত গায়িকা স্যিলিন ডিওন-এর ‘মাই হার্ট উইল গো অন’ অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়।
গানের পাশাপাশি ‘টাইটানিক’-এর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে মোহিত হয়েছিলেন সংগীত প্রিয় মানুষেরা। ‘ওশন অফ মেমোরিজ’, ‘টেক আর টু দ্য সি, মি. মার্ডক’, ‘দ্য সিনকিং’, ‘ডেথ অফ টাইটানিক’, ‘হাইম অফ দ্য সি’র মতো ট্র্যাকগুলি আজও অবিস্মরণীয়।
সে বছর ১১টি অস্কার জিতে ইতিহাস গড়েছিল জেমস ক্যামেরন-এর ‘টাইটানিক’। তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালনা ও ‘অরিজিনাল সং’ ক্যাটাগরিতে দুটি অস্কার ছিনিয়ে নেন জেমস হর্ণর।
২০০৫ সাল।
মুক্তি পাওয়ার আগে থেকেই বিতর্ক উস্কে দিয়েছিল দীপা মেহতা-র ‘ওয়াটার’। দীপার ‘এলিমেন্টস ট্রিলজি’ (তার আগে তুমুল বিতর্কের ঢেউ তুলেছিল ‘ফায়ার’ ও ‘আর্থ’-র শেষ পর্ব।
ব্রিটিশ জমানায় ভারতে বিধবাদের করুণ অবস্থা, ব্রাহ্মণ্যবাদের আস্ফালন ও সমাজ থেকে একঘরে হওয়া অসহায় মহিলাদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের এক নয়া দিগদর্শন তুলে এনেছিলেন দীপা।
কিন্তু এত সহজসাধ্য ছিল না সেই কাজ। কট্টরপন্থী হিন্দুসমাজের রোষের আগুনে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শুটিং। দেশ ছেড়ে শ্রীলঙ্কা গিয়ে শুটিং শেষ করেন দীপা। পরবর্তীকালে ইতিহাস গড়েছিল লিজা রে, সীমা বিশ্বাস, জন আব্রাহাম অভিনীত ‘ওয়াটার’।
সিনেমার পাশাপাশি প্রবল সমাদৃত, প্রশংসিত হয় ‘ওয়াটার’-এর মিউজিক। এ আর রহমান ও মাইকেল ডানা-র যৌথ সংগীত পরিচালনায় অভূতপূর্ব সাড়া পায় ‘ওয়াটার’। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীতের সেই অপার্থিব মেলবন্ধনে যে সুরের জাদু দেখা দিয়েছিল ‘ওয়াটার’-এ, শ্রুতি মাধুর্যে আজও তা অনবদ্য, চিরকালীন।
‘পথের পাঁচালী’, ‘টাইটানিক’ ও ‘ওয়াটার’। মাঝে কেটে গেছে পাঁচটি দশক। কিন্তু ‘ওয়াটার’-এর সূত্র ধরে ৫০ বছরের ইতিহাস এক লহমায় এসে মিশে গেল সিনে-সংগীতের পরতে, পরতে।
‘ওয়াটার’-এর ব্যাকগ্রাউণ্ড স্কোরের দায়িত্ব সামলেছিলেন কানাডিয়ান সংগীত পরিচালক মাইকেল ডানা। পরে যিনি ‘লাইফ অফ পাই’-র সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে প্রভূত প্রশংসা কুড়িয়েছেন, এমনকি অস্কারও পেয়েছিলেন।
মজার বিষয়, ‘ওয়াটার’-এর থিম ও ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে ডানা অব্যর্থ দক্ষতায় মিশিয়ে দেন ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘টাইটানিক’-কে। বিশ্বের প্রথমসারির দুই কম্পোজারের দুটি ভিন্ন রচনাকে এভাবে মিশিয়ে দেওয়ার নজির খুব একটা চোখে পড়ে না। যার ফলে ‘ওয়াটার’-এর কম্পোজিশন শুনতে গিয়ে বারবার উঠে আসবে ‘পথের পাঁচালী’-র ধুন এবং ‘টাইটানিক’-এর কেল্টিক সিম্ফনি।
‘ওয়াটার’-এর মিউজিক নিয়ে তাই আজও রয়েছে বিতর্ক। ‘কম্পোজিশনগুলি কি নেহাতই অনুপ্রেরণা, নাকি সুর-চুরির দৃষ্টান্ত—এই নিয়ে আজও মতভেদ আছে। কিন্তু এ আর রহমান বা মাইকেল ডানা কেউই এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেননি। ‘হাউজ অফ উইডো’-এর মতো বিখ্যাত সেই কম্পোজিশনগুলি তাই আজও রহস্যাবৃত।
দিনের শেষে একটি পর্যায়ে পৌঁছাতেই হয়। তা অনুপ্রেরণা হোক বা ‘সুরচুরি’—’ওয়াটার’-এর থিম-সংগীত যে আসলে সর্বকালের দুই মহান শিল্পী—পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও জেমস রয় হর্ণর-এর প্রতি অলিখিত এক অবিসংবাদী সুরের শ্রদ্ধার্ঘ্য, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
।। বড়োদিনের গান।।
অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ ছিলেন জেমস। জেমস লর্ড পিয়েরপঁ। ছোটোবেলা থেকেই বাউণ্ডুলে, উড়নচন্ডী স্বভাবের মানুষ। জন্মেছিলেন ১৮২২ সালে ২৫ এপ্রিল বস্টন, ম্যাসাচুসেটস-এ। বাবা রেভারেন্ড জন পিয়েরপঁ ছিলেন ধার্মিক মানুষ, বস্টনের ইউনিটেরিয়ান চার্চের পাদরি।
দামাল জেমস-এর ছোটোবেলা থেকেই ছিল প্রবল লেখালেখির শখ। ভালোবাসতেন গান-বাজনাও। গান লেখা, সুর দেওয়া শখ ছিল তার। সুযোগ পেলেই স্টাডি রুমের এক কোণে মুখ গুঁজে তাকে লেখালেখি করতে দেখা যেত। মাত্র দশ বছর বয়সে তাকে পড়াশোনার জন্য নিউ হ্যাম্পশায়ারে বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয়। বোর্ডিং স্কুলে থাকার সময় শীতকালে ঘোড়ায় টানা স্লেজ গাড়ির রেস দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন জেমস। মা মেরি শেল্ডনকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন সেই কথা। কিন্তু রক্তে থাকা উদ্দামতা তাকে তিষ্ঠোতে দেয়নি বোর্ডিং স্কুলে। চার বছরের মাথায় সব শিকেয় তুলে ভেসে পড়েন প্রশান্ত মহাসাগরে, ‘দ্য শার্ক’ নামের একটি তিমি শিকারী জাহাজের নাবিক হয়ে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এরপর ২১ বছর পর্যন্ত ইউ এস নেভিতেও কাজ করেন জেমস। যেভাবে আচমকা সব কিছু ছেড়েছুড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিলেন, তেমনই একদিন ১৮৪৫ সালে তিনি ফিরেও আসেন তার পরিবারের কাছে। মা-বাবার চাপে পড়ে মিলিসেন্ট কউয়ি নামের এক সুন্দরী যুবতীকে বিয়ে করে তিন বাচ্চার বাপ হয়ে ঘোরতর সংসারীও হন।
জেমস পিয়েরপঁ-র গল্প কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ১৮শ শতকের মাঝমাঝি গোটা আমেরিকা জুড়ে ‘গোল্ড রাশে’র যে ধূম জাগে, তাতে শামিল হন জেমসও। সেই উন্মাদনা এমনই মাথায় চাগাড় দেয়, যে ১৮৪৯-এ বউ-বাচ্চা পরিবার সব ফেলে ব্যবসা করতে সানফ্রান্সিসকো পাড়ি দেন তিনি। ফটোগ্রাফার হিসেবে শুরু করেন কাজ। কিন্তু বিধি বাম! এক রাতে বিধ্বংসী অগ্নিকান্ডের জেরে দেউলিয়া হন জেমস। এত কিছু দুর্যোগের মধ্যেও লেখালেখি ছাড়েননি তিনি। ১৮৫০ সালে রচনা করেন ‘ওয়ান হর্স ওপেন স্লেজ’ ও ১৮৫২ সালে প্রকাশিত হয় ‘দ্য রিটার্ন্ড ক্যালিফোর্নিয়ান’। ১৮৫৬ সালে মারা যান তার স্ত্রী মিলিসেন্ট। জেমস তখন গরিব, কপর্দকশূন্য। পেট চালাতে ও বাচ্চাদের সামলাতে ইউনিটেরিয়ান চার্চের ক্যয়ারে সংগীত পরিচালক ও অর্গানবাদক রূপে যোগ দেন তিনি।
এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৮৫৭ সালে। একদিকে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে তখন ছড়িয়ে পড়েছে মহাবিদ্রোহের আগুন। ওই বছরই অগস্ট মাসে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন জেমস। এবার সাভানার মেয়র থমাস পার্স-এর মেয়ে এলিজা জেন পার্স হলেন পাত্রী। আর একমাসের মধ্যে সাত বছরের পুরোনো রচনা ‘ওয়ান হর্স ওপেন স্লেজ’ থেকে বেরিয়ে আসে একটি ছোট্ট গান যা একসময় ম্যাসাচুসেটসের মেডফোর্ডে ‘দ্য সিম্পসন ট্যাভার্ন’-এ বসে লিখেছিলেন জেমস, পরবর্তীকালে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্ব জুড়ে। হ্যাঁ, এই গানটিই হল ‘জিঙ্গল বেল!’ আজও ক্রিসমাস বা বড়োদিন এই গানটি ছাড়া সম্পূর্ণ নয়। অথচ একটা সময় ছিল যখন এই গানটির কথা ভুলেই গেছিলেন জেমস লর্ড পিয়েরপঁ। গানটি কিন্তু প্রথমে মোটেই সমাদর পায়নি। ১৯৮৩ সালে যখন ফ্লোরিডাতে দীর্ঘ রোগভোগের পর ৭১ বছর বয়সে মারা যান জেমস লর্ড পিয়েরপঁ, তখনও কেউ চেনে না এই গানটি। ক্রিসমাস পালনের জন্য লেখাও হয়নি গানটি। অথচ শেষ পর্যন্ত ক্রিসমাসের সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে যায় বিশ্ববন্দিত সেই গান। বাকিটা ইতিহাস।
বড়োদিন এলে অনিবার্যভাবে গাওয়া হয় ‘জিঙ্গল বেল’, অথচ এই কালজয়ী গানটির স্রষ্টা তথা সুরকারকে কেউ মনে রাখেনি। সময়ের স্রোতে মিলিয়ে গেছেন জেমস লর্ড পিয়েরপঁ।
।। দ্য ক্যাট কনসার্টো।।
‘টম এন্ড জেরি’-কে চেনে না বা ভালোবাসে না, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। ১৯৪০ সাল থেকে তারা দুজন আমাদের হাসিকান্না, ভালোবাসা-মনখারাপের সঙ্গী। ইঁদুর-বেড়ালের এমনই মজার কেমিস্ট্রি, যা কিনা সারাবিশ্বের আট থেকে আশি, আবালবৃদ্ধবনিতার মন জয় করেছিল। চল্লিশের দশক থেকে শুরু, উইলিয়াম হানা ও জোসেফ বারবারা-র সেই অমর সৃষ্টি আজও অদ্বিতীয়, অপ্রতিরোধ্য। এম জিএম (মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার)-এর ফ্রেড কুইম্বির ব্যানারে ১১৪টি ‘শটস’ (পরবর্তীকালে অন্যান্য নির্মাতাদের হাত ধরে প্রায় ১৬০টিরও বেশি)-এর দৌলতে ‘টম এন্ড জেরি’-র ঝুলিতে উঠে এসেছিল ৭টি অস্কার যা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল ডিজনিকেও।
১৯৪০-৫৮ সাল পর্যন্ত সয়মকালকে, নিঃসন্দেহে এই সিরিজটির ‘স্বর্ণযুগ’ বলা চলে। এই সময়ের মধ্যে নির্মিত ‘শর্টস’গুলি সবচেয়ে বেশি সাফল্য পায়, পায় জনপ্রিয়তা, কুড়োয় সমালোচনাও। তবু ‘টম এন্ড জেরি’ তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। এই সিরিজে এনিমেশনের পরেই যা সবচেয়ে বেশি শিরোনামে উঠে এসেছিল, তা হল সঙ্গীত পরিচালনা ও নেপথ্য সংগীত। গোটা সিরিজ-টি ‘নির্বাক’ হওয়ায় সংগীতই ছিল ‘টম’ আর ‘জেরি’র নিজস্ব ভাষা। চিন্তা করার বিষয়, এই সিরিজ’টির নির্মাতা, নির্দেশক, কলাকুশলীদের কথা সাধারণ মানুষ জানলেও, ‘টম এন্ড জেরি’র সুরকার স্কট ব্র্যাডলির কথা তারা কেউ জানে না। জানেন না, তার অসামান্য সুর-রচনার কথা, যা শুধু অস্কার জিতেই ক্ষান্ত হয়নি। ক্ষান্ত হয়েছে কালোত্তীর্ণ হয়ে।
সংগীত নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এই সিরিজে। ‘টম এণ্ড জেরি’র মিউজিক যেমন বহু প্রশংসা কুড়িয়েছে, তেমনি আছড়ে পড়েছে নানা বিতর্কেও। আর এসবের কৃতিত্ব মার্কিন কম্পোজার ওয়াল্টার স্কট ব্র্যাডলি (১৮৯১-১৯৭৭)-র। এ পর্যন্ত মোট ১১৩টি এপিসোড মিউজিক দিয়েছেন তিনি। পাশ্চাত্য সংগীতে সিদ্ধহস্ত ব্র্যাডলি প্রথম জীবনে থিয়েটার অর্কেস্ট্রায় পিয়ানো বাজাতেন। পরবর্তীকালে এম জি এম-এর সঙ্গে সংযুক্ত হন। কম্পোজ করেন ‘টম এণ্ড জেরি’র ‘সিগনেচার টিউন’ থেকে শুরু করে তার ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর। ইতিহাস সৃষ্টির পথে হেঁটে গেছিল ‘টম এন্ড জেরি’। রম্য-সংগীত বা ‘funny score’ তৈরিতে তার বিকল্প আর কেউই ছিল না সে সময়ে। বহু বিখ্যাত পাশ্চাত্য সংগীতকার যথা প্যাগানিনি, স্ত্রাভিন্সকি, হিন্ডেমিথ-এর রচনাকে হাস্যকৌতুক পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে এক অন্য ধারার সংগীত রচনা করেন তিনি। নিজেই হয়ে উঠেছিলেন স্বতন্ত্র ঘরানা। অবশ্য সুখের দিন বেশি ছিল না ব্র্যাডলির। ১৯৫৪ সালে এম জি এম-এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয় তার। ১৯৫৭ সালে এম জি এম-এর কার্টুন বিভাগটি বন্ধ হয়ে যায়। ‘টম এন্ড জেরি’ হস্তান্তরিত হয় অন্য একটি সংস্থা, ‘রেমব্রান্ট ফিল্মস-এর কাছে। সংশ্লিষ্ট সিরিজের হাল ধরেন স্টিফেন কনিচেক, ডেন এইচ ইলিয়ট, কার্ল ব্রান্ট বা এডওয়ার্ড প্লাম্ব-এর মতো স্কট ব্র্যাডলির উত্তরসুরীরা। যদিও ব্র্যাডলির মতো সেই প্রভাববিস্তার করতে পারেননি কেউই। এরপর আর বেশিদিন কাজ টানতে পারেননি ব্র্যাডলি। ২০ বছর পর ক্যালিফোর্নিয়ার চ্যাটাসওয়ার্থে ৮৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন তিনি।
‘টম এন্ড জেরি’র ১১৩টি ‘শর্টস-এ সংগীত দিলেও ওয়াল্টার স্কট ব্র্যাডলি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন ‘দ্য ক্যাট কনসার্টো’তে। ১৯৪৭ সালে ২৬ এপ্রিল মুক্তি পায় ‘ক্যাট কনসার্টো। সাড়ে সাত মিনিটের সেই ‘শর্টস’ আজও এনিমেশনের বিশ্বে এক উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপে পরিচিত। এই এনিমেশনে টম-কে দেখা যায় পিয়ানো বাজিয়ের চরিত্রে যার বাজনায় বাগড়া দেয় ছোট্ট ইঁদুর জেরি। পিয়ানো তথা বিখ্যাত ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকসের নোটেশনকে (এই ক্ষেত্রে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে রোম্যান্টিক যুগের বিখ্যাত পিয়ানিস্ট ফ্রাঞ্চ লিজ-এর বহুচর্চিত ‘হাঙ্গেরিয়ান রাপ্সডি নম্বর ২’) কীভাবে মজাদার করে তোলা যেতে পারে তা অদ্ভুত মুনশিয়ানায় দেখিয়েছিলেন ব্র্যাডলি। ‘কনসার্টো’ সে বছর সেরা এনিমেশনের অস্কার ছিনিয়ে নিয়েছিল।
তবে এই এপিসোড নিয়ে বিতর্কও ছড়িয়েছিল যথেষ্ট। গল্প চুরির অভিযোগ এনেছিল ‘দ্য ওয়ার্নার ব্রাদার্স’ কোম্পানি। কারণ ওই একই বছর ফ্রিজ ফ্রিল্যাং-এর পরিচালনায় তাদের একটি প্রোডাকশনস ‘বাগস বানি’ খরগোশকে নিয়ে ‘র্যাপ্সডি র্যাবিট’ মঞ্চস্থ হয়। আশ্চর্যের বিষয়, টমের মতো সেখানে ‘বাগস বানি’কেও দেখা যায় পিয়ানো বাজাতে ও আরও কাকতালীয় ভাবে তা ফ্রাঞ্জ লিজ-এর ‘হাঙ্গেরিয়ান রাপ্সডি নম্বর ২’। দুটি ভিন্ন সংস্থা এবং ভিন্ন কার্টুন হওয়া সত্ত্বেও কম্পোজিশন কি করে এতটা মিল? বলাবাহুল্য একে অন্যের বিরুদ্ধে সুর ও প্লট চুরির অভিযোগ এনেছিল দুটি সংস্থা। আকাদেমির টেবিলেও জমা পড়েছিল দুটি পৃথক আবেদন। যদিও শেষ পর্যন্ত বাজি মারে ‘ক্যাট কনসার্টো’, কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই রহস্য, রহস্যই থেকে গেছে।
আজ ‘দ্য ক্যাট কনসার্টো’র মুক্তির প্রায় ৭৩ বছর অতিক্রান্ত। এমনকি ৪২ বছর হল পরলোকে পাড়ি দিয়েছেন ‘টম এন্ড জেরি’র অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুরকার ওয়াল্টার স্কট ব্র্যাডলি। তবু আজও, ইতিহাসের পাতাটি সমানে সমানেই ভাগ করে নিয়েছে তারা। একে অন্যের ভাবনাচিন্তা বিকল্পধারার অপরিহার্য পরিপূরক হয়ে।
।। সত্যজিতের অজানা সুরে।।
সেই কবে দেখেছিলাম উৎপলেন্দুবাবুর এই ডকুমেন্টারিটা, ‘দ্য মিউজিক অফ সত্যজিৎ রায়’। আজও মন ছুঁয়ে যায়।
আজও ঘুমের গভীরে শুনতে পাই চেলো বাজছে, বাজছে সেতার, ভায়োলিন, ড্রামস। মোটা ফ্রেমের চশমা চোখে, দীর্ঘদেহী সেই মানুষটি—মুখে পাইপ, একহাতে নোটেশন শিট, অন্যহাত শূন্যে তুলে ‘ঘরেবাইরে’-র থিম রচনা করছেন। সুর করে গাইছেন—’ডা ডাডাডা ডাডা’। আর নেপথ্যে কোরাসে ‘বন্দেমাতরম! বন্দেমাতরম!’ গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আজও।
এরপরেই দ্রুত বদলে যাচ্ছে দৃশ্য। জ্বলন্ত মশাল ভেদ করে উঠে আসছে সেই পাহাড়ি রাস্তা, কুয়াশা ভেদ করে ঠিকরে পড়ছে নরম আলো, খাদের ধারে দাঁড়িয়ে একলা রায়বাহাদুর ও চকলেট লেগে থাকা মুখে সেই বাচ্চা গোর্খা ছেলেটি, যার অদ্ভুত পাহাড়ি সুরে কুয়াশার চাদর কেটে একটু একটু করে উঠে আসছে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। পিছুপিছু ‘গুগাবাবা’, ‘মহানগর’, ‘শাখাপ্রশাখা’, ‘আগন্তুক’—অজস্র সুরের মিছিল!
সত্যজিতের সিনেমা-সংগীতকে ব্যাখ্যা করা এক অসম্ভব স্বপ্নের মতো। কিছুটা হলেও উৎপলেন্দুবাবুর তথ্যচিত্রের পরতে পরতে রয়েছে তার স্বাক্ষর।
সিনেমার থেকে গান বা নেপথ্যে সংগীত বরাবরই বেশি টানে আমায়। সত্যজিতের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। ‘সোনার কেল্লা’-র প্রতি প্রেম ও আকর্ষণ আজ থেকে নয়, সেই ছোটোবেলা থেকে। ততধিক, আকর্ষণ সেই ছবির লোকসংগীত নিয়েও। ফেলুদার থিম ক্রমেই একটা মিথে পরিণত। কিন্তু ‘সোনার কেল্লা’য় ব্যবহৃত মীরার ‘মন মেরা রামরাম রচে’—এই ভজনটি আজও তাঁর স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। কী অসাধারণই না গানটি গেয়েছিলেন মোহিনী দেবী। কী অদ্ভুত সেই সুর।
আর ভিড় ঠেলে ছোট্ট মুকুলের একজোড়া সেই নিষ্পাপ চোখ, ঘুমোতে দেয়নি বহুদিন। মোহিনী দেবীকে এরপর আর তেমন কোনও সিনেমায় গাইতে শুনিনি। কিন্তু এই একটি গানেই তিনি অমর হয়ে রয়েছেন মানিকবাবুর সৃষ্টির পাশাপাশি।
ঠিক যেমনটি, লোকশিল্পী রামজন আম্মুর গাওয়া রাতের পোখরান স্টেশনের সেই ‘ঘুমারে ঘুমা’ রাজস্থানী ফোক বা ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ মালকোষ রাগে গাওয়া রেবা মুহুরির ‘মোহে লাগি লগন গুরু চরণন কী’ মীরা ভজনটি।
।। ‘সারাংশ’ ও অজিত বর্মণ।।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গানের প্রভাব যে কতটা, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতি মুহূর্তে, পল-অনুপলে মিশে আছে যে সুর, তা আমাদের চলার পথের সঙ্গী, পাথেয়। হাজার হাজার সুর, হাজার হাজার ধ্বনি-শব্দ-কথা ঘিরে আছে আমাদের। কিছু গান রয়ে যায় সঙ্গে, সারাজীবন। কিছু হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। সংগীতও সিনেমার তেমনই একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সিনেমা তার ১০০ বছরেরও বেশি সুদীর্ঘায়িত ইতিহাসে এমন অনেক গান-সুর-কথা উপহার দিয়েছে যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি। এর শুরু আছে, শেষ নেই কোনও। কিন্তু সময়ের এমনই অদ্ভুত এই চড়াই-উতরাই, যার অজানা-অচেনা বাঁকে হারিয়েছে বহু গান, ভেসে গেছে বহু সুর, কথা ও তাদের স্রষ্টারা। এমনই কিছু গান, কিছু অপ্রচলিত, অশ্রুত অধ্যায় নিয়েই পথ চলা। যেমন পরিচালক মহেশ ভাট-এর কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘সারাংশ’-এর সংগীত।
১৯৮৪ সালে মহেশ ভাট-এর এই সিনেমার মাধ্যমে যখন বলিউডে ডেবিউ করেন অনুপম খের, কেউ ভাবতেও পারেননি পরবর্তীকালে তা ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে মাইলফলকে পরিণত হবে। মৃত ছেলের অস্থিকলস নিয়ে এক রিটায়ার্ড স্কুল টিচার (অনুপম খের) ও তার শোকার্ত স্ত্রী (রোহিনী হাত্তাঙ্গদী)-র আপসহীন লড়াই, একাকিত্ব আর অসহায়তার ঘন অন্ধকারে একটু একটু করে তলিয়ে যাওয়ার আগে আবারও বেঁচে থাকার দাবিতে জীবনের পথে পথ-হাঁটার গল্প কেউই কখনও ভুলবে না। তিন তিনটি ফিল্মফেয়ার এওয়ার্ড ও ১৯৮৫ সালে একাডেমির মঞ্চে বিদেশি সিনেমার ক্যাটেগরিতে ভারতীয় সিনেমার একমাত্র ‘অফিসিয়াল এন্ট্রির’—’সারাংশ’কে সর্বকালের অন্যতম সেরার স্বীকৃতি দিলেও, আশ্চর্য হতে হয় এই সিনেমার গান নিয়ে বিদ্বজ্জনদের মধ্যে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য চর্চা বা আলোচনা না হওয়ায়।
এই সিনেমার সুরকার ছিলেন কলকাতার ছেলে অজিত বর্মণ, গীতিকার বসন্ত দেব। আশি দশকে বর্মণ-দেব জুটি বহু অবিস্মরণীয় গান উপহার দিয়েছেন বলিউডকে। যদিও পরবর্তীকালে খুব কম লোকই মনে রেখেছেন তাদের। ‘সারাংশ’-এ গানের সংখ্যা ছিল মাত্র দুটি। ভুপেন্দ্র সিং-এর কন্ঠে ‘আঁধিয়ারা গহরায়া’ ও অমিত কুমার-এর ‘হর ঘড়ি ঢল রহি হ্যায়’। দুটি গানই এককথায় অনবদ্য। সে বছর ‘সারাংশ’-এর জন্য সেরা গীতিকারের পুরস্কারও পান বসন্ত দেব। কিন্তু অজিত বর্মণ রয়ে যান বিস্মৃতির অন্ধকারে। ১৯৪৭ এর ২৬ মার্চ কলকাতায় জন্ম নেন প্রখ্যাত এই সুরকার। কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, পঙ্কজ মল্লিক, সলিল চৌধুরীদের মতো কিংবদন্তিদের সঙ্গে। ষাটের দশকের গোড়াতেই সুরকার হিসেবে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। শুধু বাংলা চলচ্চিত্রেই নয়, বলিউডে-এও তার অবদান অবিস্মরণীয়। গোবিন্দ নিহালিনী, মহেশ ভাট-এর মতো প্রথম সারির নির্মাতাদের ছবিতে সুর দিয়েছেন তিনি। ‘বিজেতা’, আক্রোশ’, ‘সারাংশ’-এর মতো জনপ্রিয় বেশ কয়েকটি ছবির সুরকার ছিলেন বর্মন সাহেব। সিনেমায় ক্ল্যাসিকাল এবং সেমি-ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের ‘ট্রিটমেন্ট’-এ ওই সময় তার মতো মুনশিয়ানা খুব কম সুরকারের ছিল। অথচ মানুষ তাকে মনে রাখেনি। মনে রাখেনি ‘বলিউড’ও। শেষ জীবনে পেয়েছিলেন ভয়াবহ একাকিত্ব ও অভাব। ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর যখন মুম্বইয়ের আন্ধেরি হাসপাতালে একপ্রকার নিঃশব্দে চলে গেলেন অজিত বর্মণ, সে খবরও পেল না কেউ। এমনই দুর্ভাগ্য, তার শেষকৃত্যে চলচ্চিত্র জগতের কেউ হাজিরও ছিলেন না।
জীবনে অনেক দুঃখ, শোকের গান শুনেছি আমি। কিন্তু ‘সারাংশ’-এর এই গান ‘আঁধিয়ার গহরায়া’র মতো এত ‘ডার্ক, ‘গ্লুমি’ রচনা খুব কম পেয়েছি। কী অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য, অপার্থিব গভীরতা এই সুরে। ভূপেন্দ্র সিং-এর কন্ঠ গানটিকে পূর্ণতা দিয়েছে। বসন্ত দেব-এর রচনায় উঠে এসেছে দর্শনের সেই অমোঘ মৃত্যুত্তীর্ণ আলো, যা জীবনের অন্ধকার পথে আলোর দিশারী।
।। মিলে সুর মেরা তুমহারা।।
ফ্ল্যাশব্যাক ১
মহাসমুদ্র। অপার অশান্ত তরঙ্গ হিল্লোলিত। আস্তে আস্তে তা মুছে দেখা যায় ঝরনাধারা। কল্লোলিত মূর্চ্ছনা যুগের ওপার হতে নেমে আসছে পৃথিবীর বুকে। ক্রমশ তাকে ছাপিয়ে উঠে আসছে এক প্রাজ্ঞের মুখ। পণ্ডিত ভীমসেন যোশী। সিন্ধুভৈরবী রাগে ঝলমল করছে চারপাশ। তিনি গাইছেন—’মিলে সুর মেরা তুমহারা’।
ফ্ল্যাশব্যাক ২
শীতকালের ভোর। কুয়াশা মাখা রাস্তা ধরে হেঁটে আসছেন এক বৃদ্ধ। হঠাৎই দেখেন পথের একধারে এক ছোট্ট ছেলে বসে পোস্টার লিখছে। বৃদ্ধের মনে পড়ে গেল, ছেলেটির নাম কিষান, একদা নিরক্ষর, বৃদ্ধের সাহচর্যেই তার অক্ষরজ্ঞান। আজ সে নিজে নিজেই শব্দের মালা বুনছে। পরম মমতায় সেই বৃদ্ধ আদর করে দেন ছেলেটিকে। ছেলেটি হাসে। নির্মল সেই আলোর সারল্য-রোশনাই ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। নেপথ্যে তখন কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, রাগ ভাটিয়ারে—’পূরব সে সুরজ উগা’।
ফ্ল্যাশব্যাক ৩
একঝাঁক ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ের দল। বিকেলের পড়ন্ত আলো পিছনে ফেলে ছুটে আসছে। মিলিয়ে যাচ্ছে নৈর্ঋতে। ভেসে আসছে সেতার, পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তারপর একে একে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা, উস্তাদ জাকির হুসেন উস্তাদ আল্লারাখা আমজাদ আলি খান-এর মতো প্রাতঃস্মরণীয়দের সমাহার। গায়নে বাদনে নৃত্যের তালে তালে উঠে আসছে দেশ রাগ। মন ছুঁয়ে যাওয়া সেই বন্দিশ—’বাজে সরগম হর তরফ সে…’
তখন আশি-নব্বই দশক। ৮৪’-র ভয়াবহতা কাটিয়ে দিল্লির মসনদে তখন রাজীব গান্ধির মৌরসীপাট্টা। টিভি সংস্কৃতি তখন সদ্য সদ্য ঢুকেছে বসার ঘরে। দূরদর্শন আর অল ইন রেডিও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পপুলার সার্কিটে। তখন ভারতীয় সোপ অপেরার স্বর্ণযুগ। আসমুদ্রহিমাচল মজে রয়েছে বি আর চোপড়ার ‘মহাভারত’ আর রামানন্দ সাগরের ‘রামায়ণ’-এ। উঠে আসছে ‘বুনিয়াদ’ (১৯৮৬-৮৭), ‘হামলোগ’ (১৯৮৪-৮৫), ‘সার্কাস’ (১৯৮৯-৯০), ‘নুক্কড়’ (১৯৮৬০৮৭), ‘গুল গুলশান গুলফাম’ (১৯৯১), ‘তমস’ (১৯৮৮), ফৌজি’ বা ‘মালগুড়ি ডেইজ’ (১৯৮৭)-এর মতো আরও বহু অবিস্মরণীয় সব টেলি-আখ্যান।
এহেন সময়ে ভারতীয় ঐক্য, সংহতি, সংস্কৃতি ও শিক্ষার প্রচারে নিয়োজিত কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সূত্র ধরে উঠে এল এই তিনটি ভিডিও, তিনটি সুর-রচনা। নয়া ইতিহাসের সৃষ্টি হল ভারতীয় টেলি জগতে। দূরদর্শন ও কেন্দ্রীয় তথ্যসম্প্রচার মন্ত্রকের উদ্যোগে ‘লোক সেবা সঞ্চার পরিষদ’ ও ‘জাতীয় সাক্ষরতা মিশন’-এর জনস্বার্থে প্রচারিত এই তিন সাংগীতিক কর্মশালা ‘মিলে সুরে মেরা তুমহারা’, ‘দেশ রাগ’ বা ‘পূরব সে সুরজ উগা’ আজও এমন মোহময়, মায়াবী এক সাংগীতিক কিংবদন্তি, যার জুড়ি মেলা ভার। ‘জন গণ মন’ ও ‘বন্দেমাতরম’-এর পর প্রায় ‘তৃতীয়’ জাতীয় সংগীতের সমান মর্যাদা পেয়েছিল ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’। পিছিয়ে ছিল না ‘দেশ রাগ’ বা ‘পূরব সে সুরজ উগা’ও। আজও এইসব শুনলে নস্ট্যালজিক হয়ে পড়েন না এমন মানুষ বিরল। কিন্তু মজার ব্যাপার, এই সুর রচনা তিনটি ক্রমেই কালোত্তীর্ণ হলেও এর রচনাকার বা সুরকাররা কিন্তু বিস্মৃতির আড়ালেই রয়ে গেছেন। অশোক পাটকি, লুই ব্যাংকস ও পীযুষ পাণ্ডেকে কতটাই বা মনে রেখেছি আমরা!
মহারাষ্ট্রের নাট্য, সিনেমা ও সংগীত জগতের দিকপাল ব্যক্তিত্ব অশোক পাটকি (জন্ম ২৫ আগষ্ট, ১৯৪১) প্রথম জীবনে হারমোনিয়ামবাদক হিসেবে খ্যাতিলাভ করলেও, নিজেও কখনও ভাবেননি কম্পোজার, অ্যারেঞ্জার হিসেবে বিখ্যাত হবেন। শৈশবে দিদি মীনা পাটকি (মারাঠি সিনেমার বিখ্যাত গায়িকা)-র অনুপ্রেরণায় প্রথম গান শিখতে বসা। হারমোনিয়াম বাদনে বিশেষ পারদর্শীতা লাভ করেন অশোক। নেন শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিমও। সুমন কল্যাণপুর, পণ্ডিত জিতেন্দ্র অভিষেকী, সুধীর ফাড়কে-র সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন বহু বছর। পরে শঙ্কর জয়কিষন, শচীন দেব বর্মণ ও রাহুল দেব বর্মণ-এর সহায়ক হিসেবেও বহু সিনেমায় মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টের কাজ করেছেন। একশোরও বেশি মারাঠি নাটকে সংগীত পরিচালনার পাশাপাশি বানিয়েছেন বহু জিঙ্গল, সুরারোপ করেছেন মারাঠি-হিন্দি-কোঙ্কনি সিনেমাতেও। কোঙ্কনি সিনেমা ‘অন্তর্নাদ’ (১৯৯১)-এর জন্য পেয়েছেন সেরা সংগীত পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার। আশি দশকের শেষভাগে ‘মিলে সুর মেলা তুমহারা’র সংগীত পরিচালকরূপে তিনি খ্যাতির শীর্ষে ওঠেন।
দার্জিলিং শহর থেকে পথ চলা শুরু ‘ভারতীয় জ্যাজ সংগীতের জনক’ লুই ব্যাংকস-এর। জন্ম ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১। গোর্খা পরিবারের ছেলে লুই ছোটোবেলা থেকেই ছিলেন ‘চাইল্ড প্রডিজি’। বাবা পুষ্কর বাহাদুরও ছিলেন একজন দক্ষ সংগীতজ্ঞ। তার কাছেই পিয়ানো, গিটার, ট্রাম্পেটের তালিম নেন লুই। যদিও তার আসল নাম দামবার বাহাদুর বুধাপ্রীতি, বিখ্যাত জ্যাজ শিল্পী ও ট্রাম্পেট-করোনেট বাদক লুই আমস্ট্রং-এর নামে রাখা হয় তার নাম। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকস, র্যেগে, জ্যাজ, ট্র্যান্স ও মেটালের পোকা লুই, বাবার পথ অনুসরণ করে আসেন কলকাতায়। বানান ‘লুই ব্যাংকস ব্রাদারহুড’ নামের ব্যান্ডটি। সেখান থেকেই রাহুল দেব বর্মণ-এর টিমে যুক্ত হয়ে ওয়ার্ল্ড ট্যুরের ডাক পান। বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ওতপ্রোতভাবে। বহু সিনেমা, জিঙ্গলে সংগীত পরিচালনা করলেও যন্ত্রানুসঙ্গ পরিচালনা মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে তার দক্ষতা ও মুনশিয়ানা ছিল প্রবাদপ্রতিম। আশি দশকের শেষে ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’, ‘দেশ রাগ’ ও ‘পূরব সে সুরজ উগা’-র সুর-সংযোজনা তাঁকে আলাদা করে প্রতিষ্ঠা দেয়।
‘অ্যাডম্যান’ পীযূষ পাণ্ডে-র কথা কে না জানে। ভারতীয় বিজ্ঞাপন ও বিপনন দুনিয়ার প্রাণপুরুষ পীযূষ পাণ্ডে-র জন্ম ১৯৫৫ সালে জয়পুরে। ছোটো থেকেই কবিতা, গল্প, সাহিত্যে ছিল তার প্রগাঢ় আকর্ষণ। নিজেও লিখতে পারতেন, আঁকতে পারতেন অসম্ভব ভালো। ছিলেন ভালো ক্রিকেটারও। জয়পুরের পাট চুকিয়ে দিল্লি এসে সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক ও পরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। দেশের প্রথমসারির বিজ্ঞাপন সংস্থা ‘ওগলভি’তে চাকরি নেন তিনি। এরপরের ঘটনা অবশ্য ইতিহাস। ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’, ‘দেশ রাগ’ বা ‘পূরব সে সুরজ উগা’র মতো গানগুলির রচনা তাঁর হাতেই।
আমার মতো অসংখ্য মানুষ যাদের আশি-নব্বই দশকে জন্ম বা বেড়ে ওঠা, তাদের এই তিনটি কালজয়ী সৃষ্টির জন্য এই মানুষগুলির কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। নতুন করে চেনা উচিত, সম্মান করা উচিত এদের সম্মিলিত সৃষ্টিকে। যদিও আমরা আত্মবিস্মৃতের জাত। খুব সহজেই ভুলতে ভালোবাসি। তবু যে নস্টালজিয়া এই গানগুলি ঘিরে আমাদের বাঁচতে শেখায়, ভাবতে শেখায়, অনুপ্রাণিত হতে শেখায় সেই স্তরে অশোক পাটকি, লুই ব্যাংকস বা পীযূষ পাণ্ডে-র মতো মানুষরা আমাদের নির্ভেজাল আবেগের পরতে পরতে বেঁচে থাকবেন চিরকাল!
।। সুর সঙ্গম।।
নাট্যকার, সাহিত্যিক, মুক্তমনা গিরিশ কারনাডকে চিনেছি অনেক পরে। তারও আগে পরিচয় পণ্ডিত শিবশঙ্কর শাস্ত্রী-র সঙ্গে। অনেক পরে জেনেছি ‘তুঘলক’, ‘হায়াবদানা’, ‘নাগমন্ডলা’ বা ‘ওয়েডিং এলবাম’-এর রচনাকার কারনাড-কে, কিন্তু তারও আগে শুনেছি প্রবীণ সেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতসাধকের কথা যিনি এক গণিকার মধ্যে খুঁজে ছিলেন রুদ্ধসংগীতের অশ্রুত আখ্যান।
১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তি পেয়েছিল হিন্দি ছায়াছবি ‘সুর সঙ্গম’। তার পরিচালক দক্ষিণী চলচ্চিত্র জগতের নক্ষত্র কে বিশ্বনাথ। ১৯৮০ সালে তারই সুযোগ্য পরিচালনায় কিংবদন্তি তেলেগু ছায়াছবি ‘শঙ্করভরনম’-এর হিন্দি রিমেক হয়েছিল ‘সুর সঙ্গম’ নামে। গিরিশ কারনাড ছিলেন ছবিটির মুখ্য চরিত্রে, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত শিবশঙ্কর শাস্ত্রীর ভূমিকায়। ছিলেন জয়াপ্রদা, শচীন পিলগাঁওকর, গুফি পেইন্টাল-এর মতো অন্যান্য প্রতিভাবান কলাকুশলীরাও। তবে এই সিনেমার সবচেয়ে বড়ো সম্পদ গিরিশ কারনাড-এর অভিনয়, জয়াপ্রদার নাচ এবং অসাধারণ কিছু রাগাশ্রয়ী গান।
ভারতীয় চলচ্চিত্রে অন্যতম কাল্ট মুভি রূপে পরিচিত ‘শঙ্করভরনম’-এর মতই ‘সুর সঙ্গম’-এও ছিল অসামান্য কিছু রাগাশ্রয়ী ভজন, খেয়াল ও তারানার সমাহার। ‘শঙ্করভরনম’-এর সংগীতের দায়িত্বে ছিলেন দক্ষিণের বিখ্যাত সঙ্গীতকার কে ভি মহাদেবন। গান রচনার হাল সামলান ভি এস মূর্তি, মাইসোর বাসুদেবাচার্য-এর মতো প্রথিতযশা লিরিসিস্টরা। আর গানের দায়িত্বে ছিলেন এস পি বালসুব্রহ্মনিয়ম এবং বাণী জয়রাম-এর মতো শিল্পী। কর্ণাটকী ক্ল্যাসিকালে সমৃদ্ধ ছবিটি সেই বছর একাধিক জাতীয় সম্মানের মধ্যে জিতে নিয়েছিল বেস্ট মিউজিক, বেস্ট প্লে-ব্যাক মেইল ও বেস্ট প্লে-ব্যাক ফিমেলের খেতাব। কিন্তু ‘শঙ্করভরনম’-এর রিমেকে উত্তর ভারতীয় হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রভাবকে বিস্তারিত করার সংকল্প নেন পরিচালক কে বিশ্বনাথ।
গিরিশ কারনাড অভিনীত ‘সুর সঙ্গম’-এর সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বলিউডের বিখ্যাত জুটি লক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারেলাল। গীতরচনায় বসন্ত দেব। প্লে-ব্যাকে ছিল রীতিমত অভিনবত্ব। গান গেয়েছিলেন পণ্ডিত রাজন-সাজন মিশ্র লতা মঙ্গেশকর কবিতা কৃষ্ণমূর্তি এস জানকী এবং সুরেশ ওয়াদেকর-এর মতো শিল্পীরা। পণ্ডিত শিবশঙ্কর শাস্ত্রীর চরিত্রে গিরিশ কারনাড-এর লিপে অধিকাংশ গানই গেয়েছিলেন রাজন ও সাজন মিশ্র। কর্ণাটকী ও হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় গায়নে বিশারদ গিরিশ তার যথাযথ উপস্থাপনে দৃশ্যগুলির মানবৃদ্ধি ঘটান। ভূপালি, ভাটিয়ার, খাম্বাজ, দেশী ও পুরিয়া ধনশ্রীর মতো রাগাশ্রিত অনন্যসাধারণ সেই সব গান আজ তিন দশক পার করেও শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ রাখে। সে বছর ‘সুর সঙ্গম’-এর জন্য সেরা সংগীত পরিচালনার জাতীয় পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেনলক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারেলাল।
মনে আছে, নব্বই দশকে দূরদর্শনে একাধিকবার প্রচারিত হয়েছিল গিরিশ অভিনীত ‘সুর সঙ্গম’। শুধুমাত্র সংগীতের জন্যই নয়, প্রবল প্রশংসিত হয়েছিল পণ্ডিত শিবশঙ্কর শাস্ত্রীর চরিত্রে গিরিশ কারনাড-এর অসামান্য অভিনয়। সংগীত সাধকের সেই চরিত্রে অসামান্য অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন কারনাড। তাঁর মৃত্যুতে এক মহীরুহ পতন হল ঠিকই, কিন্তু দুর্ভাগ্য যে আজও তাকে ‘এক থা টাইগার’-এর অন্যতম পার্শ্ব-চরিত্রাভিনেতা রূপে পরিচয় দেওয়া হয়। যারা এ তত্ত্বে বিশ্বাসী তাদের উচিত গিরিশ কারনাড অভিনীত ‘মন্থন’ (১৯৭৬), ‘স্বামী’ (১৯৮৭), ‘সংস্কার’ (১৯৮৭), ‘বংশ বৃক্ষ’ (১৯৭২), ‘নিশান্ত’ (১৯৭৫) বা ‘মালগুড়ি ডেইজ’ (১৯৮৭) দেখা। নিদেনপক্ষে দেখা উচিত কারনাড-এর অন্যতম মাস্টার পিস—’সুর সঙ্গম’ যা আমরা অনেকেই আজ ভুলে গেছি। যেখানে কারনাড ও পণ্ডিত শাস্ত্রীর চরিত্র যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এখানেই তার সার্থকতা।
।। আফতাব-এ-মৌসিকি।।
সে বছর বরোদাতে ভয়াবহ গরম পড়েছিল। বর্ষা আসতে তখনও বহু দেরি। গোটা বরোদরা জ্বলছে অস্বাভাবিক তাপদাহে। দিনের বেলা তো বটেই, রাতেও এমন অস্বাভাবিক গরম যে মানুষ তিষ্ঠোতে পারছে না। সর্বত্র ত্রাহি ত্রাহি রব।
কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী তখন বরোদা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি শাস্ত্রীয় সংগীতের বড়ো সমঝদারও বটে। তাঁরই বাড়িতে বসেছে মহ্যফিল। আসরের মধ্যমণি ‘আফতাব-এ-মৌসিকি’ উস্তাদ ফৈয়াজ খান সাহেব। তিনি তখন বরোদার মহারাজার সভাগায়ক। তামাম ভারতবর্ষ তাঁর সুরের জাদুতে মূহ্যমান। আলীসাহেবের সঙ্গে তার বিশেষ সখ্য। তাঁরই ডাকে সাড়া দিয়ে ফৈয়াজ খান এসেছেন গান শোনাতে।
আসরে উপবিষ্ট হয়ে শ্রোতাদের আদাব জানিয়ে খাঁ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আদেশ করুন কী শুনতে চান আপনারা। স্রোতাদের মধ্যে উঠল গুঞ্জন। কিছুক্ষণ পরে শলা পরামর্শ সেরে প্রায় সকলেই সমস্বরে আর্জি রাখলেন, গরমের এই প্রচণ্ড দাবদাহে সবাই কষ্ট পাচ্ছেন খুব। খাঁ সাহেব যদি মেহেরবানী করে কোনও বর্ষার গান শোনান তো ভালো হয়। এক মুহূর্ত চুপ করে ভাবলেন ফৈয়াজ খান। তারপর জলদ গম্ভীর কন্ঠে ধরলেন রাগ মেঘ মলহার।
খাঁ সাহেব সুর লাগাতেই গোটা সভা যেন মন্ত্রমুগ্ধ। ওদিকে খাঁ সাহেব তাঁর বিদ্যা, বোধ, রাগদারী, ভাব ও ঘরানার পেশকি উজাড় করে দিচ্ছেন। মনে হচ্ছে সভাগৃহে যেন সত্যি সত্যি একটু একটু করে ঘনিয়ে উঠেছে মেঘ, এমনই তাঁর কন্ঠের জাদু। প্রাচীন বন্দিশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেন বইতে শুরু করেছে বৃষ্টির ঠান্ডা বাতাস। পালটাতে শুরু করেছে পরিবেশ। খাঁ সাহেবের সেদিকে হুঁশ নেই। চোখ বন্ধ করে মলহারকে নিংড়ে নিচ্ছেন তাঁর সুরের পরশে।
ঠিক এমন সময় ঘটলো সেই ‘অলৌকিক’ ঘটনা। সত্যি সত্যি কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি নেমে এল বরোদা শহরে। শ্রোতারা আনন্দে উচ্ছ্বাসে আত্মহারা। কেউ কেউ সেই বৃষ্টির মধ্যে নাচতে শুরু করেছেন, কেউ কেউ অবাক চোখে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন খান সাহেবের দিকে, কেউ কেউ কেঁদে ফেলেছেন আবেগে। হাতজোড় করে খাঁ সাহেবকে বলছেন, আপনি মানুষ নন, সাক্ষাৎ ভগবান। সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে জানাচ্ছেন অন্তরের শ্রদ্ধা।
শুধু খাঁ সাহেব নির্বিকার। গান শেষ করে চুপ করে বসে রইলেন। মাথা নিচু, চোখ বন্ধ, গালে হাত, ধ্যানস্থ। কী যেন ভাবছেন। মুখে কোনও কথা নেই। সেদিন মহ্যফিল শেষে একে একে সব অতিথি-অভ্যাগতরা বিদায় নিলে মুজতবা আলীর সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি বিদায় নিতে।
”আপনাকে এমন বিষণ্ণ লাগছে কেন খাঁ সাহেব?” প্রশ্ন করেন মুজতবা।
”এরা কি সবাই আমাকে ভগবান ভাবছে?” অস্ফুটে বলেন ফৈয়াজ। ”আমি তো সামান্য মানুষ। কিছুই গাইতে পারি না। ওস্তাদের আশীর্বাদ ও আল্লার মর্জিতে অতি সামান্য যেটুকু পারি, গাই। আপনি বলুন, আমার কি সত্যি ক্ষমতা আছে গান গেয়ে বৃষ্টি নামানোর?” হেসে ফেলেন মুজতবা। বলেন, ”আপনি গেয়েছেন বলে বৃষ্টি হয়েছে কিনা জানি না, তবে এটা জানি আল্লাতালহা আজ শুধু আপনার সম্মান রাখতে চেয়েছিলেন।”
প্রতিবছর গরমের শুরুতে এই পুরোনো গল্পটি মনে পড়ে। পুরোনো হলেও চর্চিত। সৈয়দ মুজতবা আলী তার লেখা ‘পঞ্চতন্ত্র’-এ এই ঘটনার উল্লেখ করেন। ‘কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গি’তে এই অবিস্মরণীয় ঘটনাটির কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন পণ্ডিত কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এরপর বহু পত্রপত্রিকা, প্রবন্ধ, নিবন্ধেও স্থান পেয়েছে গল্পটি।
শুনলাম কলকাতায় বৃষ্টি হচ্ছে খুব। দিল্লিতে এখনও বৃষ্টি নেই। বাড়ছে গরম, ধুলোর ঝড়। শহর কলকাতা থেকে বহুদূরে এই রাজধানীতে অফিস ফেরতা মেট্রোতে শরীরের ক্লান্তি, ঘাম শুকোতে শুকোতে হঠাৎই মনে পড়ে গেল গল্পটি। গল্প হলেও সত্যি… চিরকালীন…শাশ্বত…
আমি জানি, আজ রাতে বৃষ্টি নামবে এই শহরেও। বর্ষা না হোক, ফৈয়াজি সুরের অবিশ্রান্ত বারিধারায় ভিজবে দিল্লি।
আমি সেই বৃষ্টিভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ পাচ্ছি…
।। জানকীনাথ সহায়।।
তখন ২০০৩। প্রকাশ ঝা-এর ‘গঙ্গাজল’ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারাদেশে। লোকের মুখে মুখে ঘুরছিল সেই ছবির ডায়লগ—’শালা, সব পবিত্র করে দেঙ্গে…’
সত্তর দশকের শেষের দিকে ঘটা কুখ্যাত ‘ভাগলপুর কাস্টডিয়াল ম্যাসাকার’ নিয়ে নির্মিত ‘গঙ্গাজল’ কুড়িয়েছিল সমালোচক ও দর্শকদের প্রশংসা। প্রকাশ ঝা-এর সিনেমা এমনিতেও ভালো লাগে। ‘দামুল’ (১৯৮৫), ‘মৃত্যুদণ্ড’ (১৯৯৭), ‘রাজনীতি’ (২০১০) বা নৃত্যশিল্পী সোনাল মানসিং-কে নিয়ে তার ডকুমেন্টারি ‘সোনাল’ (২০০১) গোগ্রাসে দেখেছি। ‘গঙ্গাজল’ও বেশ লেগেছিল। এস এস পি অমিত কুমারের চরিত্রে অজয় দেবগন এককথায় অসাধারণ। সিনেমাটি ছাড়াও আরও একজন আমায় প্রবল টেনেছিল, তিনি সারেঙ্গি বাদক উস্তাদ সুলতান খাঁ। সিনেমাটিতে তার গাওয়া দেড় মিনিটের একটি ছোট্ট পিস ছিল তুলসীদাসের ‘জব জানকীনাথ সহায় করে’। রাগ মিশ্র খাম্বাজ। বহু পরিচিত একটি ভজন। মনে আছে, সেই দেড় মিনিটের ধাক্কা সামলে উঠতে সময় লেগেছিল। এতদিন পণ্ডিত ডি ভি পালুস্কর আর শ্রীকৃষ্ণ রতনঝনকার ছিলেন এই ভজনটির ‘মিউচুয়াল শেয়ারহোল্ডার’। তাদের কন্ঠেই প্রথম শোনা। কিন্তু সেই প্রথম সুলতান খাঁ-র গলায় শুনি এই ‘রামধুন’। আর শুনেই এক ধাক্কায় সুরের ভাবসমাধি।
আর চার-পাঁচজনের মতো তার আগে থেকেই আমিও অবশ্য খান সাহেবের ভক্ত। উস্তাদ জাকির হুসেন-এর তবলার সঙ্গে তার স্বর্গীয় সারেঙ্গি বাদনের কথা না হয় বাদই দিলাম। ‘পিয়া বসন্তী রে’-গানটা আজও আমরা ভুলিনি। গানটিতে চিত্রা-র পাশাপাশি খাঁ সাহেবের সেই ‘ন্যাজাল ট্রিটমেন্ট’ আর কথায় কথায়, অনায়াসে তারসপ্তক ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসা, ভিডিওর নায়িকা নৌহিদ কুরেশীর মতনই অলৌকিক সুন্দর মনে হয়েছিল। আর তারপর এই ভজন। যেমন ‘সুলতানি’ গায়কি, তেমনই তার ‘সারেঙ্গি’—দুইয়ের অভূতপূর্ব মিশেলে, যেন সুরের রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ হল ‘গঙ্গাজল’ ছিটিয়ে।
তুলসীদাস ভজনে এমন অপার্থিব বিন্যাস আজও খুব কম চোখে পড়ে। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, আছে। উস্তাদ সুলতান খান নিঃসন্দেহে তার মধ্যে অন্যতম এবং অগ্রগণ্য। খাম্বাজ তার হারানো ‘বাজ’ খুঁজে পেল যেন সেই সুলতানি বিন্যাসে। আর আমাদের বুঁদ হয়ে থাকা ক্রমশই যেন অন্তহীন হয়ে ওঠে, আরও আরও…
।। অনিল সাগরে।।
মনে করুন সেই ষাট দশক। ঋত্বিক ঘটক-এর হাত ধরে ভেসে উঠছে ‘পার্টিশান ট্রিলজি’র কালজয়ী প্রথম অধ্যায় ‘মেঘে ঢাকা তারা’। ‘কোমল গান্ধার’ বা ‘সুবর্ণরেখা’ আসতে তখনও এক-দু’বছর দেরি।
কথা-সাহিত্যিক শক্তিপদ রাজগুরুর রচনা, সুপ্রিয়া দেবী-অনিল চ্যাটার্জি-বিজন ভট্টাচার্য-এর সেই অভিনয় আর অনিল সেনগুপ্ত-এর সংগীতে পণ্ডিত এ টি কানন-এর কন্ঠের সেই অপার্থিব মাদকতা। অনিল বাবুর উচ্ছ্বসিত ‘লিপে’ হংসধ্বনি রাগে কানন সাহেবের ‘লগি লগন পতি সখী সন’…
জলজ্যান্ত ইতিহাস রচনা হল বাংলা সিনেমা ও সিনে সংগীতের জগতে।
এরপর কেটেছে ২৫টি বছর।
আট দশকের মাঝামাঝি। নবীন মারাঠি চলচ্চিত্র পরিচালক অমল পলেকর-এর ‘অনকহী’র মুক্তি। মারাঠি নাট্যকার সি টি খানলকর-এর লেখা ‘কলই তস্মৈ নমহঃ’ অবলম্বনে হিন্দি ছায়াছবি। সঙ্গে যুক্ত হল পলেকর, শ্রীরাম লাগু, দীপ্তি নভল, বিনোদ মেহর-র অভিনয়ে সমৃদ্ধ সোশ্যাল থ্রিলার। এদের পাশাপাশি এক গানপাগল মানুষের চরিত্রে প্রৌঢ় অনিল চ্যাটার্জী-র নজরকাড়া অভিনয় রীতিমত ব্যাতিক্রমী। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ছিল প্রচলিত দোঁহা ও ভজনে সুরকার জয়দেব-এর অভূতপূর্ব কম্পোজিশন। ‘বসন্ত বাহার’ (১৯৫৬)-র দীর্ঘ বিরতির পর আবারও প্লে-ব্যাক করলেন পণ্ডিত ভীমসেন যোশী। মিশ্র খামাজে তুলসিদাসের রাম-ভজন—’রঘুবর তুম কো মেরী লাজ’ (মতান্তরে তুম হো এবং তুম তো)। অনেকের মতে, প্রায় একই রকম বন্দিশ পাওয়া যায় কৃষ্ণপ্রেমী সুফিসাধক গরীব নওয়াজের রচনাতেও। কিন্তু আগে সেই গান।
কালের অদৃশ্য নিয়মে এই গানেও লিপ দিলেন অনিলই। এ টি কানন-এর সুরের হাত ধরে যে পথচলা শুরু হয়েছিল, সেই বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ হল ভীমসেন যোশীতে।
দুটি পৃথক কালখণ্ডে দাঁড়িয়ে কানন-ভীমসেন। মধ্যে সূত্রধর সেই অনিল চ্যাটার্জী।
সে বছর সেরা সংগীত ও সেরা প্লে-ব্যাকের জন্য ৩২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিল অমল পলকের ‘অনকহী’।
সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালি এ টি কানন-কে মনে রাখলেও কোথাও না কোথাও ভুলেছে ভীমসেনজিকে। তাঁর সেই অসাধারণ, স্বর্গীয় ভজনটিকে। যা প্রারম্ভিক আলাপেই একটা নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।
আর তার সঙ্গে অনিলবাবুর তরঙ্গায়িত অভিনয়, অমল পলকের বিমুগ্ধ দৃষ্টি, শ্রীরাম লাগু-র মুগ্ধতা…সব মিলিয়ে এক অসামান্য জাদু-বাস্তবতা।
সিনেমাটিতে ব্যবহৃত অনিলবাবুর নিজের ভাষায়, এই গান ”মরুভূমিতে যেন বৃষ্টির ফোঁটা”…তার ছিটেফোঁটা আমাদেরও গায়ে এসে লাগুক…ভেজাক…
সুরের বৃষ্টিধারায় আমরাও ভিজতে থাকি…
।। কেদার ও ‘শাখা-প্রশাখা’।।
সাল ১৯৯২। সত্যজিৎ রায়ের ‘শাখা-প্রশাখা’। বিখ্যাত সেই শেষ দৃশ্য।
সুস্থ হয়ে উঠছেন আনন্দ মজুমদার। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের আঘাতকে পিছনে ফেলে। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো আঘাত খানিকক্ষণ আগেই পেয়েছেন তিনি। ছোট্ট নাতি ডিঙ্গো দাদুর সঙ্গে দেখা করতে এসে অকপট সারল্য ও সততায় জানিয়ে গেছে তার বাবা ও কাকার ‘এক নম্বরি’, ‘দু নম্বরি’ রোজগারের কথা। প্রশ্ন করেছে তার দাদুকে, সে কত নম্বরি? তিন নম্বরি? চার নম্বরি?
সৎ, আদর্শবান আনন্দের কাছে তার দুর্নীতিগ্রস্ত সন্তানদের আসল পরিচয় এভাবে উঠে আসায় তিনি বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত, বজ্রাহত। যেন সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়েছে তাঁর। এর চেয়ে যেন মৃত্যুও শ্রেয় তার কাছে। বাবার সঙ্গে দেখা করে একে একে ফিরে যাচ্ছে ছেলেরা, প্রবোধ-প্রবীর-প্রতাপ। তারা নিজেদের জগতে ব্যস্ত মানুষ। মিলিয়ে যাচ্ছে গাড়ির কর্কশ আওয়াজ।
ধীরে ধীরে বাবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় প্রশান্ত। তার কোথাও যাওয়ার নেই। সে মানসিক ভারসাম্যহীন। অথচ তার আদর্শ বিবেক, সততা চির অটুট। ছেলেকে দেখতে পেয়ে ঝকঝক করে ওঠে আনন্দ মজুমদারের চোখ। তাকে কাছে ডাকেন। বলে ওঠেন—”তুই-ই আমার সব রে প্রশান্ত, তুই আমার সব”! বাড়িয়ে দেন হাত। সন্তানের দিকে। পিতার হাত ধরে পুত্র। সেই হাত বুকে টেনে নেন পিতা। অস্ফুট কন্ঠে বলে ওঠেন, ”শান্তি শান্তি শান্তি!”
সত্যজিতের ‘শাখা-প্রশাখা’ সেই অর্থে কোনদিনই আমার পছন্দের তালিকায় ঠাঁই পায়নি। কিন্তু ছবিটা যতবার দেখতে বসেছি, এই শেষ দৃশ্যটি আমায় নাড়িয়ে দিয়ে যায়। শুধু গল্প বলার ধরন বা অভিনয় নয়, তার নেপথ্যে সংগীতের জন্য বারবার এই ছবিটির কাছে ঘুরে ফিরে আসা।
সিনেমাটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র প্রশান্ত (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও সে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকের অনুরক্ত। রাতে তার ঘর থেকে গ্রেগরিয়ান চ্যান্টস, বাখ বা বেঠোফেন ভেসে আসে। অসামান্য মুনশিয়ানায় প্রাশ্চাত্য সংগীতের ব্যবহার করেছেন সত্যজিৎ তার এই ছবিটিতে। ছিল শ্রমণা গুহঠাকুরতা-র কন্ঠে একটি রবীন্দ্রসংগীতও। সম্পূর্ণ নয়, খণ্ডাংশ—’মরি লো মরি, আমায় বাঁশীতে ডেকেছে কে’। কিন্তু সে সব ছাপিয়ে শেষ দৃশ্যে পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী-র কন্ঠে কেদারের আলাপ, অতুলনীয়, অপার্থিব, অদ্ভুত, অনন্যসাধারণ।
একে অন্যের হাত ধরে থাকা অসহায় পিতা-পুত্র, শান্তিধ্বনি ও এন্ড ক্রেডিটস-এ অজয়বাবুর কেদার রাগের সেই আলাপ আজও কোথাও আমাদের নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। অতনু চক্রবর্তী তার ‘সিনেমা সংগীত ও সত্যজিৎ’ বইতে রাগটির ব্যবহার, চলন ও গায়কি নিয়ে সত্যজিৎ-অজয়বাবুর অসামান্য কেমিস্ট্রির কথা তুলে ধরেছিলেন। পরবর্তীকালে টলিউড-বলিউড বিভিন্ন সিনেমায় অজয়বাবু কন্ঠ মাধুর্য রাখলেও ‘শাখা-প্রশাখা’য় তাঁর সেই ছোট্ট আলাপ পর্যায়টি আজও অবিস্মরণীয়।
।। আজ জানে কী জিদ না করো।।
তুম হী সোচো জারা কিউ না রোকে তুমহে…
আশি দশকের গোড়া। করাচি, পাকিস্তান। বহু ইতিহাসের সাক্ষী ব্রিস্টল হোটেলের ১১৩ নম্বর রুমে মুখোমুখি দুই অসমবয়সী বন্ধু। ‘ললিউড’ অর্থাৎ পাক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির দুই কিংবদন্তি। হাতে রঙিন পানিয়ের গ্লাস। নেপথ্যে লং-প্লেয়িং রেকর্ডে ফরিদা খানুম। ইমন কল্যাণে বিখ্যাত সেই গজল। যার সুর ছুঁয়ে সন্ধে নামছে করাচির জইনাব বাজারে। ঘরের ভিতর খেলা করছে পড়ন্ত বিকেলের কনে দেখা আলো।
—”শুভান আল্লাহ! আপনার কলমে জাদু আছে, হাশমী সাহেব! পাকিস্তান-হিন্দুস্তান সেই জাদুতে মশগুল, শুভান আল্লাহ!” —গান শেষ হতে বললেন এক বন্ধু। নাম আহমেদ রুশদী, কিংবদন্তি গায়ক, লোকে যাকে ‘সুরের জাদুকর’ নামে চেনে। ইদানিং খুব অসুস্থ। শরীর ভালো যাচ্ছে না তার।
—”না, রুশদী ভাই। লিখতে আর পারলাম কই! আল্লাহতালহ যতটা লেখালেন তাই দিয়ে সামান্য কিছু আঁচড় কাটলাম।”—আলতো হেসে বললেন কালো চশমা পরা, চাপ দাড়ির লোকটি। ইনি ফয়াজ হাশমী। বিখ্যাত শায়ের ও গীতিকার।
—”কী বলছেন আপনি! আপনি তো পাকিস্তানের ‘সরতাজ’। আল্লাহ মেহরবান, পাকিস্তানের মাটিতে আপনি এমন ফসল ফলিয়েছেন।”
—”হা হা হা!” হেসে উঠলেন ফয়াজ, ”পাকিস্তান আর আমাকে চিনল কই। আমিও তো এখানে শুধু ‘মুহাজির’ হয়েই রইলাম।” গম্ভীর গলায় গ্লাসে চুমুক দিয়ে—”তবে শুধু পাকিস্তান নয়, হিন্দুস্তানেরও ভাগ আছে এই ‘নজম’-এ। বিশেষ করে আমার ফেলে আসা ছোটোবেলার শহর কলকাতার”—বললেন হাশমী।
—”বলেন কী? কলকাত্তা? ইয়া আল্লাহ! এটা তো জানা ছিল না।”—বিস্ময়ে হতবাক রুশদী। আর মিটিমিটি হাসছেন ফয়াজ।
—”কলকাত্তা এক আজীব শহর, রুশদী ভাই। খোদ গালিব যে শহরে এসে আর ফিরে যেতে চাননি। যে শহরে রবীন্দ্রনাথ, ডি এল রায়, কাননদেবী, কে এল সহগল, পঙ্কজ মল্লিক আর গহরজান-এর মতো কত শত ফনকাররা সাধনা করেছেন, আমার মতো সামান্য মানুষের ‘ইবাদতে’ মিশে আছে সেই শহর। সেই শহরের মিট্টিতেই মিশে আছে এই নজম। সেই আমার প্রথম আশিকি”…
হেসে উঠলেন ফয়াজ হাশমী। উলটো দিকের চেয়ারে বসা আহমেদ রুশদী কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। আর সেই মওকায় করাচির শীত একটু একটু করে ঢুকে পড়ছে ঘরে। ঘন হচ্ছে কুয়াশা। স্মৃতির আঁকেবাঁকে দখল নিচ্ছে সেই অদ্ভুত নীল ধোঁয়া। ঘরের ভেতর ফায়ার প্লেসের আগুনটা উসকে দেওয়ার কথাও যেন মনে পড়ল না কারও। শুধু একটা সুর, দু’এক টুকরো কথা সেতারের মীড়খণ্ডের মতো মোচড় দিয়ে উঠছে দিকবিদিক জুড়ে—
ওয়াক্ত কে কয়েদ মে জিন্দেগী হ্যায় মগর
চন্দ লামহা ইয়ে হী হ্যায় জো আজাদ হ্যায়।
২
১৯২০ সাল। মধ্য কলকাতার শিয়ালদা অঞ্চলে হায়াত খান লেন (এখন যা বৈঠকখানা রোডের পাশে মনীন্দ্রনাথ মিত্র রোড)-এ জন্মেছিলেন ফয়াজ হাশমী। তার ওয়ালিদ মহম্মদ হুসেইন হাশমী নিজেও ছিলেন নামজাদা ‘শায়ের’ ও নাট্যকার। ‘দিলগীর’ ছদ্মনামে শায়েরী লেখার পাশাপাশি ‘ম্যাডান থিয়েটার’-এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই রক্তে সাহিত্যের টান নিয়েই জন্মেছিলেন ফয়াজ।
নয়-দশ বছর বয়স থেকে লেখালেখিতে হাতেখড়ি তার। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় লেখেন প্রথম নজম। তার সেই লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন সেই সময়কার কলকাতার উর্দু ও ইংরাজি সাহিত্যের মহাপণ্ডিত জনাব আগা হসর কাশ্মীরি। কাশ্মীরি ভবিষ্যদবানি করেছিলেন, বহুদূর যাবে ছোট্ট ফয়াজ। বাংলার পাশাপাশি ইংরাজি, উর্দু সাহিত্যের অনুরাগী ফয়াজ হাশমী এরপর কলেজের (খুব সম্ভবত বঙ্গবাসী কলেজ, ইংরাজি সাহিত্য) পাঠ চুকিয়ে মাত্র ২০ বছর বয়সে যশোর রোডে গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়ায় ‘রেসিডেন্ট লিরিসিস্ট’ হিসেবে কাজে যোগ দেন। এরমধ্যেই প্রায় ৩০০-এরও বেশি শায়েরী লেখেন ফয়াজ। অনেকের মতে, এই সময়ই লেখা হয়েছিল—’আজ জানে কী জিদ না করো’। পুরোটা নয়, শুধু প্রথম স্তবক।
সত্যি-মিথ্যে জানা নেই, ফয়াজ হাশমী-র ঘনিষ্টজনদের মতে, এর নেপথ্যেও রয়েছে একটি চমকে দেওয়া ঘটনা। কলেজে পড়াকালীন এক বঙ্গললনার প্রেমে পড়েছিলেন ফয়াজ। কিন্তু কোনওদিন তাকে প্রেমনিবেদনের সাহস দেখিয়ে উঠতে পারেননি। মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সিনে-গবেষক খালিদ হাসান জানিয়েছেন, সেই হারানো প্রেমের উদ্দেশেই লেখা হয়—’আজ জানে কী…’। যদিও তখন তা শেষ করতে পারেননি হাশমী। শোনা যায়, কোনওদিনই তিনি ভুলতে পারেননি তার সেই প্রথম প্রেমকে। প্রথম হৃদয় ভাঙার যন্ত্রণাকে তিনি সাজিয়ে ছিলেন কবিতার পাতায় পাতায়।
গ্রামোফোন কোম্পানির কাজের ফাঁকে ফাঁকে টলিপাড়ায় যাতায়াত ও পুরোদমে লেখালেখি চালিয়ে গেছেন তিনি। অভিন্নহৃদয় বন্ধু কমল দাশগুপ্ত-এর সুরে, তালাত মাহমুদ-এর কন্ঠে ও তার লেখায়—’তসবির তেরে দিল মেরা ব্যহলা না সকেগি’ তাকে রাতারাতি জনপ্রিয়তা এনে দেয়। অনিল বিশ্বাস-এর সুরে পঙ্কজ মল্লিক-এর কন্ঠে সেই বিখ্যাত গান ‘ইয়ে রাতে ইয়ে মৌসম’ জাত চিনিয়ে দেয় ফয়াজ হাশমীর। কিন্তু বেশিদিন কলকাতায় কাজ করতে পারেননি তিনি। ১৯৫১ সালে কোম্পানির নির্দেশে লাহোরে বদলি হয়ে যান হাশমী। কিন্তু লেখালেখি থামাননি। শিল্পসাহিত্য, সংগীত বা কবিতা কবে কোন কাঁটাতারের নিষেধ মেনেছে। তাই নতুন উদ্যমে শুরু হয় সিনেমার জন্য গান লেখা। ১৯৫৬ সালে প্রথম ব্রেক অসে ‘কুওয়ারি বেওয়া’ সিনেমায়। তার লেখনির জাদুতে মুগ্ধ হয় গোটা পাকিস্তান। এরপর একে একে ‘সবেরা’ (১৯৫৯) ও ‘দিয়া ওউর তুফান’ (১৯৬৯)-এর মতো একাধিক ব্লকবাস্টারের হিট গান বেরিয়েছে তার কলমেই। ২০০০-এরও বেশি গান, নজম এই সময়ে লিখেছেন ফয়াজ হাশমী। পেয়েছেন বহু প্রতিষ্ঠিত ‘নিগার সম্মান’ও।
অবশেষে ১৯৭৩। রিলিজ হল ‘বাদল ওউর বিজলি’। সিনেমাটি মাঝারি মানের চললেও হাশমীর গান জিতে নিল পাকিস্তানের ‘দিল-ও-দিমাগ’। পার্টিশানের সময় আগ্রা থেকে ছিন্নমূল হয়ে পাকিস্তানে উঠে আসা এক তরুণ সুরকার সোহেল রানা আবাদী-র সুরে বিহ্বল হল পেশোয়ার থেকে ইসলামাবাদ। হাবিব ওয়ালি মহম্মদ-এর কন্ঠে আর গীতিকার ফয়াজ হাশমী-র লেখার জাদুতে নতুন করে অমৃতের স্বাদ খুঁজে পেল পাকিস্তান। কালক্রমে সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে এদেশেও ঢুকে পড়ল রাগ ইমন কল্যাণের সুরে সেই কালজয়ী রচনা। আট দশকে সেই গানকেই নতুনভাবে গাইলেন ফরিদা খানুম। আবারও নতুন করে রচনা হল ইতিহাস। পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে তামাম দুনিয়ার লোকের মুখে তখন একটাই গান—’আজ জানে কী জিদ না করো…’
এই গানের সুর ধরে অমর হয়ে রইলেন খানুম। কিন্তু কখন অজান্তে, ইতিহাসের পাতা থেকে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন সোহেল রানা, ফয়াজ হাশমীরা। আগ্রা মনে রাখেনি সোহেল রানা-কে। একসময় যে গানের জন্ম এই শহর কলকাতায়, তার কাছেই বা কতটা সমাদর পেয়েছেন গানের গীতিকার, ‘কলকাতার ছেলে’ ফয়াজ হাশমী! ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর করাচিতে যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন হাশমী, তখনও শুধুই বঞ্চনা আর অভিমানের পাহাড় নিঃশব্দে জমা রয়ে গেল কোথাও। শুধু পিছনে পড়ে রইলো একটি কালজয়ী গান ও তাকে ঘিরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কিংবদন্তির ক্যারাভান।
দিল্লিতে এসে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক কালচারাল সেন্টারের কনফারেন্সে এক বৃদ্ধ গবেষকের কাছে এই দাস্তান শুনেছিলাম বহু বছর আগে। নাম না জানা সেই মানুষটি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, পাকিস্তান তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি বা সিনেমার জগতের বহু গুণীজনদের প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। যেমন কদর পাননি ‘ঠান্ডা গোশত’-এর লেখক সাদাত হাসান মান্টো, ‘প্রিন্স অফ মিনার্ভা মুভিটোন’-এর সাদিক আলি, মুমতাজ শান্তি, রেহানা মীনা সুরি বা ফয়াজ হাশমীর মতো ব্যক্তিত্বরা। কিন্তু এ দেশই বা তাদের কতটা মনে রেখেছে? কতটাই বা দিয়েছে প্রাপ্য সম্মানটুকু?
কলকাতার সেই অজ্ঞাত কবি ফয়াজ হাশমী দুই প্রাচীন শহর, কলকাতা ও করাচিকে বেঁধে দিয়ে গেছেন একটি নজমের সূত্রে। রাগ ইমন কল্যাণ তাকে দিয়েছে অক্ষয় চেতনার নিঃশব্দ উদ্ভাস। দুই দেশ, দুই কালখণ্ডের ঊর্ধ্বে উঠে শত সহস্র হৃদয়ে আজও ধ্বনিত হয়ে চলেছে প্রিয় মানুষকে কাছে পাওয়ার সেই চিরকালীন আকুল আর্তি। যার সামনে থমকে যায় সময়ের কাঁটা। ভালোবাসার স্তব্ধ জাগরণ মথিত হয় বিশ্বচরাচরে।
আজ জানে কী জিদ না করো
ইয়ু হী পহলু মে বৈঠে রহো
হায়, মর জায়েঙ্গে হম তো লুট জায়েঙ্গে
অ্যায়সি বাতে কিয়া না করো
তুম হী সোচো জরা কিঁউ না রোকে তুমহে
জান জাতী হ্যায় জব উঠকে জাতে হো তুম
তুমকো অপনী কসম, জান-এ-জাঁ
বাত ইতনী মেরী মান লো
ওয়ক্ত কী কয়েদ মে জিন্দেগী হ্যায় মগর
চন্দ ঘড়িয়াঁ হ্যায় ইয়েহী জো আওয়াজ হ্যায়
ইনকো খোকর মেরী জান-এ-জাঁ
উম্রভর না তরসতে রহো
কিতনা মাসুম রঙ্গীন হ্যায় সমা
হস্ন অউর ইশক কী আজ মেরাজ হ্যায়
কাল কী কিসকো খবর জানে-এ-জাঁ
রোক লোক আজকী রাত কো
যাওয়ার কথা নাই বা বললে আজ,
থাকলে না হয় এভাবেই পাশে বসে
যাওয়ার কথা নাই বা বললে আজ…
ছেড়ে চলে যাবে বলো না ও’কথা তুমি
মৃত্যুর চেয়েও নিঃস্ব হয়েছি আমি,
যাওয়ার কথা নাই বা বললে আজ…
ভেবে দেখো তুমি কেন আটকাই পথ
চলে যাও যদি, নিঃশ্বাস থেমে আসে
তোমাকে প্রেমের দিব্যি, হে প্রিয়তমা
এটুকু কথাই রাখো সেই আশ্বাসে
যাওয়ার কথা নাই বা বললে আজ…
জীবন বন্দি সময়ের কারাগারে
কিছু মুহূর্ত এখনো পড়েনি ধরা
অনুতাপ জেনো থেকে যাবে চিরকাল
যদি নাই পারো সে সময়ে বাস করা
রঙিন বাতাসে সারল্য মাখামাখি
শিখর ছুঁয়েছে মাধুর্য, ভালোবাসা
কে দেখেছে বলো আগামীর ইতিহাস
ধরে রাখো এই রাত্রিনিবিড় ভাষা
যাওয়ার কথা নাই বা বললে আজ
থাকলে না হয় এভাবেই পাশে বসে
যাওয়ার কথা নাই বা বললে আজ…
ভাবানুবাদ : লেখক
।। খ্যেরেয়াদে নাল ম্যায় নহী জানা।।
মেয়েটি উন্মাদের মতো ভালোবেসেছিল আরেক উন্মাদকে। উন্মাদ নয়, দিব্যোন্মাদ! সে রাখাল বালকের মতো সহজ, সরল, সুন্দর একটি ছেলে যে ভেড়া চড়ানো আর ‘ওয়াঞ্জলি’ (বাঁশি) বাজানো ছাড়া আর কিচ্ছুটি জানত না।
বহুদূর, সুন্দরী চিনাবের পাশে পাঞ্জাবের ছোটো জনপদ ‘খাজিয়ান ওয়ালা’ (বর্তমান তখত হাজারা, জিলা সরগোদা, পাকিস্তান) থেকে সে তশরিফ নিয়ে আসে এই জং প্রদেশে। ভারি দুঃখী সেই ছেলেটি। সম্পত্তির লোভে তার ভাইরা, ভাবীরা তাকে তাড়িয়ে দেয়। বাড়ি ছেড়ে এই দেশ, ওই দেশ ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছে ছিল ‘জং’-এ। সেই জং প্রদেশ, এক সময় যেখানে নিরলস সাধনা করেছেন সুলতান বাহুর মতো বিখ্যাত সুফিসাধক।
সেখানেই দেখা হয় দুজনের। সুন্দরী সেই মেয়েটির বাবা চুচাক মিঁয়া জং অঞ্চলের প্রভাবশালী, ধনী জমিদার। ঘরছাড়া ছেলেটির দুর্দশা দেখে (অনেকের মতে মেয়েটির অনুরোধে) চুচাক মিঁয়া তাকে আস্তাবল সামলানোর কাজ দেয়। তাই ভালোবেসে করে সেই ছেলেটি। ঘোড়া, বকরি আর ভ্যের চরানো ছাড়া অবসরে ‘ওয়াঞ্জলি’ বাজাতে ভারি ভালোবাসত সে।
মেয়েটি ভালোবেসে নাম দিয়েছিল ‘মুরলীওয়ালে’। কী অদ্ভুত জাদু সেই ছেলেটির বাঁশিতে। আহা, যেন শতসহস্র ঝরনার জল নেমে আসতো জং প্রদেশের উপত্যকায়। তার সেই বাঁশির প্রেমে পড়েছিল মেয়েটি। প্রেমে পড়েছিল চালচুলোহীন সেই ভাসা ভাসা চোখের ছেলেটির। সময় পেলেই চিনাবের পাশে দেখা যায় তাদের। ছেলেটি মনপ্রাণ উজাড় করে বাঁশি বাজাত আর সেই বাঁশির সুরে সাড়া দিয়ে সব কাজ ফেলে ছুটে আসত মেয়েটি। সে বুঝতেও পারেনি, কখন সেই সুরের পথ বেয়ে তারা স্পর্শ করেছিল একে অন্যের হৃদয়।
কিন্তু সুখ বেশিদিন কারুর কপালে সয়না। একদিন ধরা পড়ে যায় তারা। মেয়েটির কুচুটে, লোভি চাচা কৈয়দো দেখে ফেলে তাদের। ভীষণ মারধোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয় গরিব ছেলেটিকে। গ্রামের এক মৌলবির সঙ্গে শলাপরামর্শ করে মেয়েটির জোর করে বিয়ে ঠিক করে দেওয়া হয় সৈয়দা খ্যেরেয়া নামের অন্য একজনের সঙ্গে। এই খবর পেয়ে রাগে, দুঃখে, হতাশায় পাগল হয়ে যায় ছেলেটি। ভগ্নহৃদয় নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে অজানা পথে। অন্যদিকে মেয়েটিরও করুণ অবস্থা। সে তার ‘মুরলীওয়ালে’-কে ছাড়া আর কাউকে নিকাহ করতে চায় না। প্রেমিকের সঙ্গে বিচ্ছেদে মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে তার মাকে সে বলে—
খ্যেরেয়াদে নাল ম্যায় নহী জানা
দিল ভিচ রাঞ্জে দা খায়াল, নহী জানা…
‘হীর-রাঞ্জা’-র এরপরের গল্প সকলেরই জানা। কীভাবে বঙ্গের ‘কানফাটা’ সম্প্রদায়ের শৈব সন্ন্যাসী গোরক্ষনাথের সংস্পর্শে এসে যোগীতে পরিণত হয় রাঞ্জা, কীভাবে বাড়ির অমতে রুখে দাঁড়ায়ে হীর, বহুদিন বাদে আবারও মিলিত হবে তারা ও বিয়ের রাতে পারিবারিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিষ মাখানো লাড্ডু খেয়ে একসঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে প্রেমিক যুগল। পাকিস্তানের জং প্রদেশে পাশাপাশি মাটির গভীরে আজও শান্তিতে শুয়ে রয়েছে তারা।
অবিভক্ত পাঞ্জাবের লোকসংস্কৃতিতে মিশে রয়েছে ‘হীর-রাঞ্জা’-র সেই অমর বিষাদ-প্রেমাখ্যান (Romantic Tragedy) যা আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছরেরও আগে ১৭৬৬ সালে রচনা করেছিলেন মহান কবি ও সুফিসাধক ওয়ারিশ শাহ (১৭২২-১৭৯৮)। পাঞ্জাবের লোককথায় যে তিনটি অমর আখ্যানের কথা পাওয়া যায় ‘হীর-রাঞ্জা’ তার অন্যতম। বাকি দুটি হল ‘সোহনী-মহিওয়াল’ ও ‘মির্জা-সাহিবা’। এই অমর আখ্যান তিনটির সূত্র ধরে কাঁটাতারের দুই-পাশের মানুষের সুখ-দুঃখ ভালোবাসা-বিচ্ছেদের ‘দাস্তান’ শুধু পাঞ্জাব প্রদেশেই নয়, সারাদেশ জুড়ে আজও মথিত।
‘হীর-রাঞ্জা’-র অমর প্রেমকথার সাক্ষী হয়ে আজও এই আখ্যান ও বিশেষ করে এই প্রচলিত গানটি (অনেকের মতে ওয়ারিশ শাহ-ই এর রচয়িতা) দুই দেশের ভালোবাসার মানুষদের মোহাচ্ছন্ন করে। পপুলার কালচারেও এই পাঞ্জাবি লোকগীতি তার প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। ১৯২০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত দুই দেশেই ‘হীর-রাঞ্জা’-র কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয়েছে একাধিক চলচ্চিত্র। প্রতিটি সিনেমাতেই ঠাঁই পেয়েছে এই লোকগীতিটি। চল্লিশ দশকে পাকিস্তানি লোকশিল্পী তুফৈল নিয়াজী-র কন্ঠে এই গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরপর একে একে নূরজাহান শামসাদ বেগম নিয়াজি ব্রাদার্স মেহদী হাসান তালাত মেহমুদ, নুসরত ফতেহ আলী খান থেকে শুরু করে হালের শাফাকাত আমানত আলী ও রেখা ভরদ্বাজ-এর মতো শিল্পীরা এই গানটিকে অভাবনীয় উৎকর্ষতার উচ্চতায় নিয়ে যান।
মজার ব্যাপার, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বহুল পরিবর্তনও আসে গানটির কথা ও ভাষাতেও। প্রাচীন পাঞ্জাবি, গুরুমুখী বা শাহমুখী কখনও বিবর্তিত হয়েছে সিন্ধি, উর্দু আবার কখনও মিশেছে হিন্দী এমনকি খড়িবোলিতেও। কিন্তু তার ভাব বা সুরমাধুর্যে কোথাও ফাঁক পড়েনি। কী ভারত, কী পাকিস্তান আজও পাঞ্জাব প্রদেশের বহু পরিবারে বিয়ে-শাদির সময়ে এই গানটি গাওয়া হয়। গানের মাধ্যমে স্মরণ করা হয়, শ্রদ্ধা জানানো হয় সেইসব মানুষগুলিকে যাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও ত্যাগের কাহিনি যুগ যুগ ধরে মানুষকে ভালোবাসার আলোকিত পথে হাঁটতে শিখিয়েছে, দৃপ্তভাবে।
না মাঈ না ভেজ মুঝে,
ম্যায় নেহী জানা পরদেশ
জিস রাঞ্জে সঙ্গ শ্বাস জুড়ি,
উহ রাঞ্জা হ্যায় ইস দেশ রে…
খ্যেরেয়াদে নাল ম্যায় নহী জানা
দিল ভিচ রাঞ্জে দা খায়াল, নহী জানা।
লোগ কহে উসে রাঞ্জা যোগী,
মুঝ কো তো রব কা জামাল
জানে না জানে লোগ না জানে
উও জানে মেরা হাল, না মাঈ না ভেজ মুঝে…
খ্যেরেয়াদে নাল ম্যায় নহী জানা
দিল ভিচ রাঞ্জে দা খায়াল, নহী জানা।
বনধ আঁখো সে রাহ দিখে না
জো উহ জ্যোত জাগায়ী
রাঞ্জা মেরা দিন ধরম হ্যায়
রাঞ্জা হ্যায় কুল খুদাই, না মাঈ না ভেজ মুঝে…
খ্যেরেয়াদে নাল ম্যায় নহী জানা
দিল ভিচ রাঞ্জে দা খায়াল, নহী জানা।
(আধুনিক পাঠ)
।। যব ছোড় চলে…।।
‘যব ছোড় চলে লখনৌ নগরী/তব হাল-এ-আদাম পর কেয়া হ্যায় গুজরি’। —মাঝেমাঝেই গানটা খুব মনে পড়ে।
ওয়াজিদ আলি-র লেখা। লখনৌয়ের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। সিপাহী বিদ্রোহের সময় তুখোড় ষড়যন্ত্রে ওউধ থেকে সুদূর কলকাতার মেটিয়াব্রুজে তাকে হাউস এরেস্ট করে ব্রিটিশরাজ। এরপর কোনদিন আর তাঁর প্রিয় লক্ষণাবতীর মুখদর্শন করতে পারেননি তিনি। যার বিয়েতে সে সময় সত্তর লক্ষ দিনার খরচ হয়েছিল, আজও পার্ক সার্কার্সে কাছিয়াবাগান কবরখানায় সবার অজান্তেই মাত্র সাত টাকার কাফান-এ ঘুমোচ্ছেন তিনি। কোথায়, তা কেউ জানে না। সাধের লখনৌ ছেড়ে চলে আসার সময় এই গজলটি লিখেছিলেন ‘মেটিয়াবুরুজের নবাব’।
প্রিয় শহর, জন্মভূমি ছেড়ে আসার দুঃখ কষ্ট বেদনা এই অনবদ্য গজলটির পরতে পরতে গেঁথে রাখা। আজকাল কেন জানিনা এই গানটাই ঘুরে ফিরে আসছে মাথার মধ্যে। কাজে মন বসছে না। কেমন যেন প্রকাণ্ড, নিবিড় শূন্যতা মস্তিষ্কের অলিতে গলিতে। তবে কি কোথাও, আমাদের সবার মধ্যেই ওয়াজিদ আলি শাহ’-র প্রেতাত্মা কম বেশি লুকিয়ে? বিশেষ করে যারা আজও বিভিন্ন জীবিকার সূত্রে, অথবা গ্রাসাচ্ছাদনের লড়াইয়ে বহু বছর ঘরছাড়া।
মা দুর্গার পিছুপিছু যারা অল্পদিনের জন্য হলেও ফিরে আসতে চায় নিজের ঘরে, নিবিড় সংসারে। বাড়ি ছেড়ে, প্রিয় মানুষকে ছেড়ে, স্বজন-পরিজনকে দূরে ছেড়ে থাকার কষ্ট তারা ভালোই জানে। তবু এ কটা দিন দূরত্বের কথা নাই বা হল বলা। নাই বা হল বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখা একাকিত্বের দিবারাত্রির কাব্যচর্চা। একটা দিন শুধু উল্লাস, আনন্দ-মুখর মুর্হূত আর আপোষহীন ভালোবাসার কাছে সবটুকু জমা রাখা থাক। জানি, এই ‘মাহ ভাদর’ কাটবে একদিন। যথাসময়ে, অমোঘ অনিবার্যতায়। রুক্ষ প্রবাসী জীবন, বেঁচে থাকার লড়াই, কর্মব্যস্ততায় ‘ডুব দে রে মন কালী বলে’। আস্তে আস্তে আবার সঠিক অর্থতত্ত্বে নিমজ্জিত হবে এই প্রাণ। একেই তো বেঁচে থাকা বলে। এক পলকে মিলন, অন্য পলকে বিচ্ছেদ। আবারও কোনও নতুন শুরুর অপেক্ষায় এই শেষের কড়িকাঠ বেয়ে ঝুলতে থাকা। অনবরত, অবিচ্ছিন্নভাবে।
এবার তবে ফেরার পালা। নতুন করে ‘ফেরার’ জন্য এই ফেরা। লাইন দিয়ে কারাগৃহের দিকে এগিয়ে চলেছে ওয়াজিদ আলি-র প্রেতেরা। এই মন্দ্র স্বেচ্ছা নির্বাসনের পথে আমিও। ঘন্টা বাজছে দূরে। ঘুমের মধ্যে আমি তা শুনতে পাই। অন্ধ অনুসরণ করে এগোতেই থাকি। একের পর এক মিলিয়ে আসতে থাকে মুখ। পরিচিতের, স্বজনের, শত্রু-মিত্রভেদে মানুষের দল। সবার আগে দাঁড়িয়ে আছেন ‘তিনি’। ওয়াজিদ নন, সেপাই মিউটিনির পাক্কা চার বছর পর তাঁর জন্ম। মেটিয়াবুরুজ নয়, কলকাতার জোড়াসাঁকোয়।
এত রাতে কী করছেন কবি?
”বসন্ত কি এসে গেল?” তিনি শুধোন। ”কী কাণ্ড, শরৎকালই যে শেষ হল না এখনও! আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?” জিজ্ঞেস করি। ‘বহু যুগের ওপার হতে’ ভেসে আসে তার স্বর—”এ পরবাসে রবে কে…”
আমি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকি সে ঘর ও বাহিরের মধ্যবর্তী শূন্যতায়। ফেরা, না ফেরার অনাদি মাঝখানে। ‘ওয়াজিদি গজল’ একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে রবি ঘরানায়। আমি তা তন্ময় হয়ে শুনি। দূরে কেউ গাইছে। ”যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে/এই নিরালায় রব আপন কোণে/যাব না এই মাতাল সমীরণে…”
দূরে কোথাও বুক মোচড়ানো সুরে বেজে উঠছে এস্রাজ। আমি নয়, আমারই ছায়া ফিরে চলেছে ‘পরবাসে’।
Leave a Reply