২.০৩ ইরোকোয়া ভ্রাতৃত্ব

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ইরোকোয়া ভ্রাতৃত্ব

গণের একটি বিশেষ সংগঠন হল ভ্রাতৃত্ব (phratry, fraternity বা ভ্রাতৃত্ব)। ভ্রাতৃত্ব হল কোনো গোষ্ঠীর দুই বা ততোধিক গণের বিশেষ এক উদ্দেশ্যে জোট বাধা। একে গণের অংশ মিলে গণ গঠনের মতোই মনে করা যেতে পারে।

গ্রিক গোষ্ঠীগুলোতে ‘ভ্রাতৃত্ব’ সংগঠন গণের মতোই একটা উল্লেখযোগ্য সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। এথেন্সবাসী চারটি গোষ্ঠীর প্রতিটির তিনটি করে ‘ভ্রাতৃত্ব’ ছিল এবং এদের মধ্যে গণের সংখ্যা ছিল ত্রিশটি। ভ্রাতৃত্বের মোট সংখ্যা ছিল বারো এবং মোট গণ ছিল তিন শ ষাট। এই ধরনের সংখ্যা সাম্য দেখে একে গণের কোনো স্বাভাবিক পরিণতি বলে মনে হয় না। এই সম্বন্ধে গ্রোটের ধারণা, নিশ্চয় পরিষদের সমতা ও অন্যান্য গণের স্বার্থ বজায় রাখার জন্যে এই ব্যবস্থা গৃহীত হয়। কোনো গোষ্ঠীর সমস্ত গণ তাদের এক পূর্বপুরুষজাত গোষ্ঠী নাম বহন করে, তাই প্রতিটি ভ্রাতৃত্বে সমানসংখ্যক গণ থাকতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা থাকার কথা নয়। তেমনি প্রতিটি গোষ্ঠীতে সমানসংখ্যক ভ্রাতৃত্ব থাকতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে না। বরং ভ্রাতৃত্ব সংগঠনে নিকট গণের মধ্যে একটা সম্পর্ক দেখা যায়। সম্ভবত যারা কোনো এক আদি গণের বিভক্ত অংশ। গ্রিক ভ্রাতৃত্ব সংগঠনের এটাই ছিল মূল ভিত্তি। বহিরাগত গণদের যোগ দেওয়া বা তাদের পৃথকীকরণের ফলে এথেনীয় গোষ্ঠীগুলোর ভ্রাতৃত্ব সংগঠনে সংখ্যা সাম্য আসে।

রোমের কিউরিয়া ঠিক গ্রিক ভ্রাতৃত্বের সমতুল্য। ডায়োনিসিউস একে ভ্রাতৃত্ব বলে বারবার উল্লেখ করেছেন।[১] একটা কিউরিয়ায় ছিল দশটি গণ এবং একটা গোষ্ঠীতে দশটা কিউরিয়া। মোট তিনটি রোমান গোষ্ঠীতে ছিল ত্রিশটি কিউরিয়া ও তিন শ গণ। রোমান কিউরিয়া গ্রিক ভ্রাতৃত্ব সংগঠনের চেয়ে ছিল উচ্চ পর্যায়ের, কারণ কিউরিয়া সরকারের কাজে সরাসরি যোগ দিত। গণের পরিষদে (কমিটিয়া কিউরিয়াটা) কিউরিয়া যৌথভাবে ভোট দেয়, প্রতিটির একটি করে যৌথ ভোট। রোমান জনসাধারণ এর ওপর সার্বভৌমত্ব আরোপ করে, এটা চলে সার্ভিয়ুস টিউলিয়ুসের সময় পর্যন্ত।

গ্রিক ভ্রাতৃত্বের বিশেষ একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হল কোনো জ্ঞাতিভাইয়ের খুন মাফ করা বা তার প্রতিশোধ গ্রহণ করা এবং কোনো খুনিকে প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে আবার সমাজে গ্রহণ করা।[২] এথেনীয় ভ্রাতৃত্ব, ব্যক্তির নাগরিকত্বের তালিকাভুক্তির দেখাশোনা করত। বিয়ের পর স্ত্রী তার স্বামীর ভ্রাতৃত্বের সদস্যভুক্ত হত, তাদের ছেলেমেয়ে বাবার গণ ও ভ্রাতৃত্বভুক্ত হয়। এই ভ্রাতৃত্ব সংগঠনের আর একটা কাজ হল খুনিকে বিচার বিভাগের সামনে হাজির করা। এ সবই ছিল ভ্রাতৃসংঘের প্রধান কাজ। আরো কিছু কাজ ছিল, যেমন, কোনো মানী লোককে সম্মানের সাথে কবর দেওয়া, প্রাথমিক সামরিক সংগঠনের ভার, সম্প্রদায়গত খেলাধুলার ব্যবস্থা করা, পরিষদের নিয়মাদি তৈরি করা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির দেখাশোনা করা এবং সবার সামাজিক সুযোগ-সুবিধার প্রতি নজর রাখা।

আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যেও ভ্রাতৃত্ব সংগঠন বেশ স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টি হয়। এই সংগঠনের হাতে প্রাথমিক সরকারি কর্মের ভার মোটেই ছিল না, যেমনটা ছিল গণ, গোষ্ঠী ও মিত্রসংঘের হাতে। বিশেষ করে গোষ্ঠী যেখানে খুবই বড় সেখানে ভ্রাতৃত্বের কিছু কর্তব্য ভাগ করা ছিল। আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের ভ্রাতৃসংঘের গড়ন সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করলে গ্রিক ও রোমান ভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধে জানতে সুবিধা হবে।

সেনেকা-ইরোকোয়া গোষ্ঠীর মোট গণসংখ্যা আট। তারা দু ভাগে বিভক্ত ছিল:

প্রথম ভ্রাতৃত্ব

গণ : ১। ভালুক ২। নেকড়ে ৩। বীভার ৪। কচ্ছপ

দ্বিতীয় ভ্রাতৃত্ব

গণ : ৫। হরিণ ৬। কাদাখোঁচা ৭। সারস ৮। বাজপাখি

প্রতিটি গণ নিজ ভ্রাতৃত্ব সংঘের (ডে-আ-নন-ডা-ইয়োহ) অধীনে পরস্পর ভাই এবং অন্য ভ্রাতৃত্ব সংঘের জ্ঞাতিভাই। তাদের পদ ও সুযোগ-সুবিধা এক সমান। প্রথমে এক ভ্রাতৃত্বের অন্তর্গত গণের মধ্যে বিয়ে হত না, কিন্তু অপর ভ্রাতৃত্বের যে কোনো গণে বিয়ে সম্ভব। এক ভ্রাতৃত্বের গণের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ দেখে মনে হয় আসলে এই গণগুলো একই গণ থেকে উদ্ভূত, তাই এই বাধা। পরে এই বাধা উঠে যায়, শুধু বিশেষ কোনো গণে বিয়ে নিষিদ্ধ হয়। সেনেকাদের ঐতিহ্য থেকে জানা যায় ভালুক এবং হরিণ গণ হল মৌল গণ, বাকিগুলো এদেরই উপবিভাগ। এ থেকেই দেখা যাচ্ছে ভ্রাতৃত্ব আসলে গণের মতো জ্ঞাতি সম্পর্কের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। গণের সংখ্যা বাড়ার পর পুনর্মিলনের জন্যে তারা এই উচ্চ সংগঠনের আশ্রয় নিয়েছে। যখন দুই ভ্রাতৃত্বের মধ্যে সংখ্যাগত তারতম্য বেশি হয় তখন আর এক ভ্রাতৃত্ব থেকে গণের স্থানান্তরও ঘটে। কোনো গণে লোকসংখ্যা বেশ বেড়ে গেলে বা তারা ছড়িয়ে পড়লে বা পৃথক হয়ে গেলে পৃথক নামও গ্রহণ করে। কিন্তু ঐতিহ্যকে তারা ছিন্ন করে না এবং ভ্রাতৃত্ব সংগঠনের মাঝ দিয়ে এদের পুনর্মিলন ঘটে।

ঠিক এইভাবেই দেখা যায় ক্যাযুগা-ইরোকোয়ারা দুই ভ্রাতৃত্বে বিভক্ত ছিল। এদের মোট গণ ছিল আটটি। তারা সমান দুই ভাগে বিভক্ত ছিল না।

প্রথম ভ্রাতৃত্ব

গণ : ১। ভালুক ২। নেকড়ে ৩। কচ্ছপ ৪। কাদাখোঁচা ৫। বানমাছ

দ্বিতীয় ভ্রাতৃত্ব

গণ : ৬। হরিণ ৭। বীভার ৮। বাজপাখি

ঠিক সেনেকাদের মতো এখানে সাতটি গণ। সারস গণটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। এর জায়গায় এসেছে বানমাছ, দেখা যাচ্ছে বিপরীত ভ্রাতৃত্বে এর জায়গা।

ওনোনডাগা-ইরোকোয়াদের গণের সংখ্যা একই, শুধু সেনেকা গোষ্ঠী থেকে তাদের। দুটো গণের নাম আলাদা :

প্রথম ভ্রাতৃত্ব

গণ : ১। নেকড়ে ২। কচ্ছপ ৩। কাদাখোঁচা ৪। বীভার ৫। ঘুঁটি

দ্বিতীয় ভ্রাতৃত্ব

গণ : ৬। হরিণ ৭। বানমাছ ৮। ভালুক

এখানেও ভ্রাতৃত্বের গঠন সেনেকাদের থেকে ভিন্ন। প্রথম ভ্রাতৃত্বে তিনটি গণ একই, কিন্তু ভালুক গণ ভিন্ন ভ্রাতৃত্বে স্থানান্তরিত হয়েছে, গেছে হরিণদের দলে। এখানে গণের বিভাগও অসম। ক্যায়ুগাদের মতো। ওনোনাগাদের বাজপাখি গণ ও সেনেকাদের বানমাছ গণ নেই, তবু দুই ভ্রাতৃত্বের লোকেরা বলে তাদের মিল আছে।

মোহক্‌ ও ওনেইডাদের তিনটে করে গণ–ভালুক, নেকড়ে আর কচ্ছপ, তাদের কোনো ভ্রাতৃত্ব নেই। যখন মিত্রসংঘ গঠন করা হয়, সেনেকাদের আটটি গণের মধ্যে সাতটিই ছিল ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীতে, কিন্তু মোহক্‌ ও এনেইডাদের মাত্র তিনটি গুণ, যাদের নাম আগেই করা হয়েছে। এতেই দেখা যাচ্ছে তারা তখন একটা গোটা ভ্রাতৃত্ব হারিয়েছে এবং হারিয়েছে একটা গণ। এতে মনে হয় তারা একটা গণ থেকেই সৃষ্ট। যখন কোনো গোষ্ঠীতে গণ ও ভ্রাতৃত্ব সংগঠন থাকে, সেখানে ভ্রাতৃত্ব সংগঠন কেন্দ্র করেই বাকি সংগঠন কাজ করে। কোনো গোষ্ঠীতে বিয়ের দরুন গণেরা সব সময় মিশ্রিত হচ্ছে। ভ্রাতৃত্বের মাঝে প্রতিটি গণ তার স্ত্রীলোক ও তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভ্রাতৃত্বের অংশ হচ্ছে। তারা এক সাথে থাকার চেষ্টা করে–অবশ্য কোনো অংশ আলাদা হতেও পারে। এক গণের পুরুষ অন্য গণের মেয়েকে বিয়ে করে একসাথে থাকে, এতে কিন্তু কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, কারণ ছেলেমেয়ে পুরুষের গণের লোক নয়। আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের সামাজিক ইতিহাস নিখুঁতভাবে বের করা যায় কেবল গণ ও ভ্রাতৃত্বের সংগঠন ধরে। এ ব্যাপারে আমাদের দেখতে হবে গোষ্ঠী কেবল ভ্রাতৃত্ব সংগঠন নিয়ে পৃথক হয়েছে কি না। গণ সংগঠনকে বাদ দিয়ে তা ধারণা করা মনে হয় অসম্ভব।

টুস্কারোরা ইরোকোয়ারা প্রাচীনকালেই আসল দল থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল। প্রায় ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে আবার তারা বাধ্য হয় ইরোকোয়াদের অঞ্চলে আসতে এবং মিত্রসংঘের ষষ্ঠ সদস্য হিসেবে তারা স্থান করে নেয়। তাদের গণ ছিল আটটি এবং ভ্রাতৃত্ব ছিল দুটি :

প্রথম ভ্রাতৃত্ব। গণ : ১। ভালুক ২। বীভার ৩। বৃহৎ কচ্ছপ ৪। বানমাছ

দ্বিতীয় ভ্রাতৃত্ব। গণ : ৫। ধূসর নেকড়ে ৬। হলুদ নেকড়ে ৭। ক্ষুদ্র কচ্ছপ ৮। কাদাখোঁচা

তাদের দু’টা গণ ক্যায়ুগা ও ওনোনডাদের মতো এবং পাঁচটা গণ সেনেকাদের মতো এবং তিনটে গণ মোহক্‌ ও ওনাইডাদের সাথে মেলে। তাদের এক সময়ের ভালুক-গণ বর্তমানে একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। তা ছাড়া নেকড়ে ও কচ্ছপ গণ দু ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে : (ক) ধূসর নেকড়ে ও হলুদ নেকড়ে, (খ) বৃহৎ কচ্ছপ ও ক্ষুদ্র কচ্ছপ। প্রথম ভ্রাতৃত্বের তিনটি গণ সেনেকা এবং ক্যায়ুগা গণের প্রথম ভ্রাতৃত্বের মতোই। ব্যতিক্রম হল নেকড়ে গণ দুবার। এক ভ্রাতৃত্বের গণরা নিজেদের গণ ভাই বলে এবং যারা অন্য ভ্রাতৃত্বে তাদের বলে জ্ঞাতি গণ ভাই।

ভ্রাতৃত্বের গড়নের রদবদল দেখে মনে হয় বহু যুগ অন্তর অন্তর অবস্থার পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সমতা রক্ষার জন্যে হেরফের করতে হয়েছে। কোনো ভ্রাতৃত্ব বেশ উন্নতি করল, কারো হয়তো দুর্বিপাকে ভীষণ শোচনীয় অবস্থা, কোনো ভ্রাতৃত্ব হয়তো একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, তাই একটা সামগ্রিক সমতা রক্ষার জন্যে এক ভ্রাতৃত্ব থেকে অন্য ভ্রাতৃত্বে গণের স্থানান্তর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ইরোকেয়াদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সংগঠন অনাদিকাল থেকে চলে আসছে। মিত্রসংঘের চেয়ে ভ্রাতৃত্ব অনেক পুরোনো সংগঠন। কারণ, সংগঠন হিসেবে এটা অনেক ছোট। ইরোকোয়া গোষ্ঠীগুলোর মোট আটত্রিশটা গণ এবং চারটি গোষ্ঠীতে ভ্রাতৃত্বের সংখ্যা আটটি।

ইরোকোয়া ভ্রাতৃত্ব গ্রিক ভ্রাতৃত্ব থেকে নিম্ন ধরনের, যদিও গ্রিক ভ্রাতৃত্বের কাজকর্ম সম্বন্ধে আমরা খুব বেশি জানি না। গ্রিক ভ্রাতৃত্ব আবার রোমানদের চেয়ে নিম্নস্তরের। এই পার্থক্য দেখা দেবার কারণ দুই ভিন্ন পর্যায়ের সমাজ ব্যবস্থা ও দুই ভিন্ন যুগের তুলনা হচ্ছে। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে প্রগতির দুই বিশেষ পর্যায়ের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। আমরা জানি বিশেষ একটা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন একবার সৃষ্টি হয়ে তার পরবর্তী যুগেও আরো শক্তিশালী হয়ে চলে। সামাজিক কাঠামোয় এটা একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে চলতে থাকে। গ্রিক ও রোমান সমাজে রাজনৈতিক সমাজ আসার আগ পর্যন্ত গণ সমাজ বিশেষ প্রয়োজনীয় ছিল। আর ইরোকোয়া সমাজে এটা এখনো বর্তমান, কারণ তাদের অবস্থান সভ্যতার দু ধাপ নিচে। এই আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের প্রতিটি বিষয় সম্বন্ধে আমাদের খুঁটিয়ে দেখা উচিত। কারণ, তারা যে আদিম ও প্রাচীন অবস্থা তুলে ধরে তা আরো উন্নত সমাজকে কীভাবে প্রভাবিত করছে এটা বোঝা যাবে।

ইরোকোয়াদের ভ্রাতৃত্ব আসে দুটি কারণে। কারণ দুটি হল সামাজিক ও ধর্মীয়। বাস্তব উদাহরণ দিয়ে এর কাজ ও প্রয়োজনটা তুলে ধরা যাবে। প্রথমে খেলার কথা ধরা যাক। সেনেকাদের মধ্যে দেখা গেছে তারা ভ্রাতৃত্ব ধরে একে অপরের বিরুদ্ধে বল খেলে। খেলার ফলাফলের ওপর তারা বাজি ধরে। প্রতিটি ভ্রাতৃত্ব তাদের ছয় থেকে দশ জন করে বাছাই করা খেলোয়াড় নিয়ে মাঠে হাজির হত। খেলা শুরুর আগে বাজি হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তিগত সামগ্রী রাখা হত। খেলা ভীষণ উত্তেজনার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হত। দুপাশের লোকেরা তাদের খেলোয়াড়দের মুহুর্মুহুঃ উৎসাহ দিতে থাকে।[৩]

ভ্রাতৃত্ব সংগঠন নানাভাবে প্রকাশ পায়। গোষ্ঠী পরিষদে সাকেম এবং প্রধানরা ভ্রাতৃত্ব অনুযায়ী পরস্পর বিপরীত দিকে বসে। মধ্যখানে একটা কাল্পনিক পরিষদ-অগ্নি মনে করে ভ্রাতৃত্বের কর্তারা দুপাশে বসে। গোষ্ঠীপ্রধান এদের মাঝে থেকে বক্তৃতা দেয়। এমনি নানাভাবে ভ্রাতৃত্ব সংগঠন প্রকাশ পায়।

এর পর দেখা গেছে যখন কোনো খুনখারাবি ঘটে–যাদের লোক খুন হয় সেই গণের লোকেরা পরিষদে হাজির হয়ে সমস্ত তথ্য জানায় এবং তখন ঠিক হয় কীভাবে কী করা হবে। এদিকে যারা খুন করেছে তারাও পরিষদ ডেকে ঠিক করে কী করা হবে। অনেক সময় দেখা গেছে যারা খুন করেছে তারা তাদের ভ্রাতৃত্বের অন্যান্য গণকেও ডাক দেয়। আর যদি বিপরীত ভ্রাতৃত্বের গণের লোক খুন হয়ে থাকে তা হলে তাদের ভ্রাতৃত্ব পরিষদকে একটা মিটমাট করে ফেলার জন্যে ডাকে। তারা ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করে, চেষ্টা করে নিহতের পরিবার ও তার গণকে সন্তুষ্ট করতে। যতক্ষণ না কোনো চূড়ান্ত ফল লাভ ঘটে এই মিটমাটের প্রচেষ্টা চলতে থাকে। একটা গণের চেয়ে একটা ভ্রাতৃত্বের প্রভাব অনেক বেশি। এভাবে আমরা দেখি গ্রিক ভ্রাতৃত্ব, সভ্যতা আসার আগে কীভাবে খুনের মিটমাটের ব্যবস্থা করত। এই ব্যবস্থা পরে আদালত ও বিচার ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে।

গোষ্ঠীর কোনো মানী লোকের সৎকারের সময় ভ্রাতৃত্বই তার প্রধান ভূমিকা নেয়। যে ভ্রাতৃত্বের লোক তারা সবাই শোক প্রকাশ করে, বাকি ভ্রাতৃত্বের লোকেরা সৎকারের কাজকর্ম করে। যদি মৃত ব্যক্তি সাকেম হয়, তা হলে বিপরীত ভ্রাতৃত্বের লোকেরা সকার হয়ে গেলেই তার কোমরের তকমা পাঠিয়ে দেয়। ওনোনগাদের মধ্যে দেখা গেছে কেন্দ্রীয় পরিষদ-অগ্নির জন্যে এটা পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তার বিদায় ঘটে। কোমরবন্ধনী রেখে দেওয়া হয় যতদিন না নূতন সাকেম নির্ধারিত হয়। সেনেকাদের মধ্যে ব্যাপারটা একটু আলাদা। মৃত সাকেমকে কবর দেবার আগে অন্যান্য সাকেরা ভাষণ দেয়। তারপর সবাই কবরের চারপাশে দাঁড়িয়ে এক এক করে শাবলে করে মাটি দেয়। প্রথম মাটির অংশটা দেওয়া হয় বড় বড় সব ভৌতিক শক্তিদের উদ্দেশ্যে, দ্বিতীয় বার মাটি দেওয়া হয় সূর্যের নামে, তৃতীয়বার মা ধরিত্রীর নামে। পরে কবর মাটিতে ভরে গেলে কবরের ওপর তার শিং দুটো রেখে দেওয়া হয়। যতদিন না নূতন সাকেম নির্ধারিত হয় ওটা ওখানে থাকে। পরে নূতন সাকেমের মাথায় বসিয়ে অভিষেক সম্পন্ন হয়।[৪] এ থেকেই বোঝা যায় ভ্রাতৃত্ব সংগঠন আদিম সমাজে কেমন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে কাজ করত।

সাকেম এবং বিভিন্ন গণপ্রধান নির্বাচনে ভ্রাতৃত্বের একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। তাদের হ্যাঁ বা না বলার ক্ষমতা ছিল। আমরা আগেই বলেছি কোনো সাকেম বা গণপ্রধানের মৃত্যুর পর বা অন্য কোনো প্রধান মারা গেলে ভ্রাতৃত্বের অনুমতি ছাড়া নির্বাচন করা যেত না। ভ্রাতৃত্ব আশা করে কোনো ভ্রাতৃত্বের প্রতিটি গণই সেই ভ্রাতৃত্ব পরিষদের অনুমতি নেবে। অনেক সময় বিপরীত ভ্রাতৃত্বেরও মৌন সম্মতির প্রয়োজন হয়। দুই ভ্রাতৃত্বের পরিষদ একসাথে বসে মনোনয়ন ঘোষণা করে। যদি দুই পরিষদই মেনে নেয় তা হলে নির্বাচন সম্পূর্ণ হয়ে গেল, কিন্তু কোনো দিক থেকে প্রত্যাখ্যাত হলে গণ আবার নূতন লোককে মনোনয়ন করে। গণ ও ভ্রাতৃত্বের মনোনয়নের পর প্রয়োজন হয় পরবর্তী সংগঠন মিত্রসংঘের অনুমতি। বর্তমানে সেনেকাদের ঔষধি-ভবন নষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু একসময় এটা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রধান জায়গা ছিল। প্রতি ভ্রাতৃত্ব সংগঠনের একটি করে ঔষধি-ভবন ছিল, যার ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি ভ্রাতৃত্ব কীভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করত। এই ঔষধি-ভবন সম্বন্ধে এখন আর জানা যায় না।

ভ্রাতৃত্বের নির্দিষ্ট কোনো সরকারি কাজ ছিল না, তা ছিল গণ, গোষ্ঠী ও মিত্রসংঘের হাতে, কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে তার একটা বিশেষ প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল এবং ধর্মীয় ব্যাপারে এর একটা বিশেষ ভূমিকা দেখা দেয়। গ্রিক ভ্রাতৃত্ব বা রোমান কিউরিয়ার তো এদের কোনো প্রধান ছিল না। ভ্রাতৃত্বের কোনো প্রধান ছিল না এবং গণ ও গোষ্ঠীর ধর্মীয় আচরণের সাথে এর কোনো পার্থক্য ছিল না। ইরোকোয়াদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব তার আদিম পর্যায়ে ছিল এবং স্বাভাবিকভাবেই তা গড়ে ওঠে। গণ-গোষ্ঠী-মিত্রসংঘ থাকলে ধরে নেওয়া যায় তা ভ্রাতৃত্বেও আছে।

মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার গ্রামীণ ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব সংগঠন ছিল তা সাধারণ নীতি হিসেবেই ধরে নেওয়া যায় এবং ইরোকোয়াদের চেয়ে এদের মধ্যে তা পূর্ণরূপে বিকশিত হয়েছিল। স্পেনীয় লেখকদের লেখায় এদের সম্বন্ধে খুব অল্প তথ্যই পাওয়া যায়। টলাস্কালানরা পুয়েবলো টলাস্কালাদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ দখল করে ছিল, এ থেকে মনে হয় এরা কয়েকটি ভ্রাতৃত্ব সংগঠন। চারটে গোষ্ঠীতে তাদের সংখ্যা খুব একটা কম হবে না। তারা যখন একই অঞ্চল ও একই পুয়েবলো ভাষায় কথা বলে তাতে বোঝা যাচ্ছে ভ্রাতৃত্ব সংগঠন স্বাভাবিকভাবেই ছিল। প্রতিটি ভ্রাতৃত্বের একটি পৃথক সামরিক বিভাগ ছিল এবং ছিল এক ধরনের পোশাক ও পতাকা, আর ছিল সেনাপতি (টয়লি)। তারা যুদ্ধে যেত ভ্রাতৃত্বে সজ্জিত হয়ে। হোমারের যুগে গ্রিকদের মধ্যেও সামরিক ক্ষেত্রে এই ভ্রাতৃত্ব ও গোষ্ঠী সংগঠনের ব্যাপারটা অজানা ছিল না। দেখা গেছে নেস্টর এ্যাগামেননকে উপদেশ দেয় “সৈন্যদের ভ্রাতৃত্ব ও গোষ্ঠীতে আলাদা করতে, যাতে এক ভ্রাতৃত্ব তার ভ্রাতৃত্বকে এবং গোষ্ঠী তার গোষ্ঠীকে সাহায্য করতে পারে।”[৫] জ্ঞাতি ভিত্তি যুদ্ধক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। মেক্সিকোর আজটেকরা এমনি চার ভাগে বিভক্ত ছিল। টলাস্কালানদের মতো তাদেরও ভিন্ন বংশধারা ছিল এবং সম্ভবত এরা চারটে ভ্রাতৃত্ব সংগঠন। তাদের পোশাক ছিল আলাদা এবং যুদ্ধে যেত আলাদা দলে বিভক্ত হয়ে।

কিছু গোষ্ঠীতে আবার ভ্রাতৃত্ব তাদের সংগঠনে প্রধান হিসেবে দেখা দিয়েছে। যেমন, চোকটা গোষ্ঠীতে দুই ভ্রাতৃত্বের প্রথম ভ্রাতৃত্বে মোট চারটি গণ, যাদের বলা হয় “বিভক্ত লোকজন”, আর দ্বিতীয়টিতেও আছে চারটি গণ, যাদের বলে “প্রিয় লোকজন”। এইসব থেকে বোঝা যায় গণ সংগঠন বড় হয়ে বিভক্ত হয় এবং নূতন গণের জন্ম দেয়, এই গণগুলো ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে আসে গোষ্ঠীতে, আবার গোষ্ঠী বড় হয়ে ভেঙে যায় এবং পরে আবার মিলিত হয় মিত্রসংঘে। একই গোষ্ঠীর বিভিন্ন ভ্রাতৃত্ব একই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। এই মিত্রসংঘ আসলে দুটি গণের বিভিন্ন সাংগঠনিক পর্যায়ের ফল।

চিকাসা গোষ্ঠীর দুই ভ্রাতৃত্বের প্রথমটিতে চারটি ও দ্বিতীয়টিতে আটটি গণ :

ক। চিতাবাঘ ভ্রাতৃত্ব

গণ : ১। বনবিড়াল ২। পাখি ৩। মাছ ৪। হরিণ

খ। স্পেনীয় ভ্রাতৃত্ব

গণ : ৫। ভালুক ৬। স্পেনীয় ৭। রাজকীয় ৮। হুশকোনি ৯। কাঠবিড়াল ১০। কুমির ১১। নেকড়ে ১২। কালোপাখি

চোকটা ও চিকাসাদের ভ্রাতৃত্ব সগঠন সম্বন্ধে আমি খুব বেশি তথ্য দিতে পারব না। কারণ চৌদ্দ বছর আগে ড. বায়িংটন ও রেভারেণ্ড কপল্যাণ্ড তথ্য দিয়েছিল বটে, কিন্তু তাদের কার্যাবলি সম্বন্ধে আলোচনার সুযোগ মেলে নি।

কীভাবে গণ বিভক্ত হয়ে ভ্রাতৃত্ব গঠিত হয়েছে মোহেগণ গোষ্ঠী থেকে তার উদাহরণ পাওয়া যায়। এর মূল গণ ছিল তিনটি : নেকড়ে, কচ্ছপ ও টার্কি। এরা বিভক্ত হয়, কিন্তু প্রত্যেকে পূর্বের নাম গ্রহণ করে। এইভাবে তাদের ভাতৃত্ব-নামও এক থাকে। তাই প্রমাণিত হয় সময়ে কেমন করে একটা গণ বিভিন্ন গণে বিভক্ত হয়, আবার ভ্রাতৃত্বে পরিবর্তিত হয়ে এক হয়, কিন্তু নাম বদল করে না। যেমন :

ক। নেকড়ে ভ্রাতৃত্ব গণ :

১। নেকড়ে ২। ভালুক ৩। কুকুর ৪। ওপোসাম

খ। কচ্ছপ ভ্রাতৃত্ব

গণ : ৫। ছোট কচ্ছপ ৬। কাদা-কচ্ছপ ৭! বৃহৎ-কচ্ছপ ৮ হলুদ বানমাছ

গ। টার্কি ভ্রাতৃত্ব

গণ : ৯। টার্কি ১০। সারস ১১। মুরগিছানা।

এইভাবে দেখা যায় আসল নেকড়ে গণ চার ভাগে বিভক্ত হয়েছিল, কচ্ছপও চার ভাগে, আর টার্কি তিন ভাগে। প্রতিটি নূতন গণ নূতন নাম গ্রহণ করছে, শুধু আসল গণটা তার নাম ঠিকই রেখেছে–আর তাদের নামেই ভ্রাতৃত্বের নাম। এমন পরিষ্কার গণের বিভক্তি ও ভ্রাতৃত্বের উন্নয়ন অন্য কোনো আমেরিকান গোষ্ঠীতে দেখা যায় না। গণের জ্ঞাতি থেকেই ভ্রাতৃত্ব। মূল গণের নাম রাখতেই হবে এমন নিয়ম ছিল কি না জানি না, তবে ভ্রাতৃত্বে সেটা আসছে। সেই একই গণ ও গোষ্ঠী থাকে সরকারের কর্তব্য নিয়ে, কিন্তু এতৃত্ব তেমন নয়, বরং ধর্মীয় ও সামাজিক কাজে নিযুক্ত থাকে।

ডেলাওয়ার ও মুনসে গোষ্ঠীতেও সেই গণ তিনটে একই : নেকড়ে, কচ্ছপ ও টার্কি। ডেলাওয়ারদের মধ্যে বাবোটা গুণ আছে, কিন্তু তারা গণ-নাম নেয় নি, যদিও গতিটা সেই দিকেই।

উত্তর-পশ্চিম উপকূলে ব্লিঙ্কেট গোষ্ঠীতেও ভ্রাতৃত্বের দেখা মেলে। তাদের নিম্নলিখিত দুটি ভ্রাতৃত্ব দেখা যায় :

ক। নেকড়ে ভ্রাতৃত্ব

গণ : ১। ভালুক ২। ঈগল ৩। ডলফিন ৪। হাঙ্গর ৫। একা।

খ। দাঁড়কাক ভ্রাতৃত্ব

গণ : ৬। ব্যাঙ ৭। রাজহাঁস ৮। সিলমাছ ৯। পেঁচা ১০। স্যালমন মাছ।

কোনো ভ্রাতৃত্বের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ, কিন্তু বিপরীত ভ্রাতৃত্বের যে কোনো গণের সাথে বিয়ে হতে পারে। এতে বোঝা যায় এক ভ্রাতৃত্বের গণগুলো মৌল একটা গণ থেকেই জন্মলাভ করেছে। নেকড়ে ভ্রাতৃত্বের যে কোনো গণের কোনো সদস্য বিপরীত ভ্রাতৃত্বের যে কোনো সদস্যকে বিয়ে করতে পারে, তেমনি ওরাও পারে এদের কাউকে বিয়ে করতে।

ভ্রাতৃত্ব সংগঠন যে একটা প্রতিষ্ঠিত সংগঠন তার নমুনা পাওয়া গেল। গ্যানোয়া পরিবারেও তা ছিল। যেখানে গণসংখ্যা বেশি সেখানে এর থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। এই সংগঠনের জন্যে আরো অনুসন্ধান চালালে আমরা এমন আরো কিছু তথ্য পাব যার সাহায্যে আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের এই সংগঠনের এবং তাদের সরকারের অনেক কাজের ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।

১। “ডায়োনিসিউস”

২। এসকাইলাস জানিয়েছেন যে সেই প্রায়শ্চিত্ত করত ভ্রাতৃত্ব : “ইউমেনিডস”, ৬৫৬।

৩। “ইরোকেয়া সংঘ”, পৃঃ ২৯৪।

৪। ইরোকোয়ারা বিশ্বাস করত যে মৃত ব্যক্তির আত্মা দশ দিন ধরে মর্ত্য থেকে স্বর্গে যাত্রা করে। প্রতি রাতে সবাই মিলে দশ দিন ধরে শোক প্রকাশ করে। অন্ত্যেষ্টিকালের স্তোত্র বা বিলাপ করত সাধারণত মহিলারা। দশ রাত কবরের ওপর আগুন জ্বালানো হত। এটা ওদের একটা প্রাচীন রীতি। একাদশ দিবসে তারা একটা ভোজ দেয়। যেহেতু আত্মা ততদিনে স্বর্গে পৌঁছে গেছে এবং চিরবিশ্রাম লাভ করেছে, তাই আর দুঃখ করার কোনো মানে হয় না। ডোজের সাথেই এর সমাপ্তি ঘটে।

৫। “ইলিয়াড”। ২য় খণ্ড, পৃঃ ৩৬২।

৬। ব্যানক্রফটের “নেটিভ রেসেস অব দ্য প্যাসিফিক স্টেটস”, পৃঃ ১০৯।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *